প্রথম অধ্যায় – নেকড়েদের গ্র্যান্ড মাস্টার
ভেযের ব্যারন সিনর জাঁ, শিকারে অত্যুৎসাহী একজন মানুষ।
বেভাল আর লোগোর মাঝে একটা উপত্যকার অবস্থান। সেখানে একটা উঁচু টাওয়ার আছে। এককালে এটা ভেযের প্রাসাদোপম বাসস্থানের অংশ ছিল। এখন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও, যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ ১৭৮০ সালের দিকে তা ছিল না। দুৰ্গটা নির্মিত হয়েছিল বারো কি তেরো শতকের দিকে।
এখন পথচারীরা বা পশুপাখি ঝড় বৃষ্টির সময় অনায়াসে এখানে আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু তখন সাধারণ মানুষ এটাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখতে পারত না। অতীতের সেই জাকজমক, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত আর নেই। নেই বিপদের ছায়া দেখলেই ঝুল সেতু উঠিয়ে নেয়া বা পোর্টকুলিস নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও এর বিশালতা মানুষকে বিস্মিত করে।
এই দুর্গের লর্ডকে বাইরে থেকে খুব জাদরেল মনে হত। কিন্তু যারা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত তারা জানত-সে যত গর্জে তত বর্ষে না। তবে বনের পশুপাখির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ছিল ওদের আজন্ম শত্রু।
ভেযের লর্ড ছিল নেকড়ে শিকারিদের নেতা। এই পদমর্যাদার কারণে নেকড়ে শিকারের ভূত মাথায় চাপলে তাকে থামানো যেত না।
উপরন্তু তার স্ত্রীর ব্যাপারে রটনা ছিল যে সে নাকি প্রিন্সের মেয়ে-যদিও অবৈধ! নিজের পদমর্যাদার এবং ক্ষমতাবান শ্বশুরের বদৌলতে, কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহসও পেত না।
লর্ড প্রায় প্রতিদিনই শিকারে বেরোত লোকলস্কর নিয়ে। শিকারের সময় তার সাথে থাকত গোটা বারো ঘোড়া আর চল্লিশটা কুকুর। শিকার হিসাবে লোকটার প্রথম পছন্দ ছিল নেকড়ে, তারপর বুনো শুয়োর এবং সবশেষে হরিণ।
তবে যত ঘোড়া আর কুকুরই থাকুক না কেন, প্রতিবারই তো আর ভাল শিকার জোটে না।
এমনই একদিন, শিকারি কুকুরগুলোর প্রধান রক্ষণাবেক্ষণকারী ম্যাকোট, গম্ভীর মুখে অপেক্ষারত ব্যারনের সাথে দেখা করতে এল।
ভুরু কুঁচকে গেল ব্যারনের, কী ব্যাপার ম্যাকোট, তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে শিকারের জন্য আজকের দিনটা ঠিক সুবিধার হবে না।
মাথা নাড়ল ম্যাকোট।
খুলে বলল।
কালো নেকড়েটাকে দেখা গেছে, মাই লর্ড।
ওহ! তাই নাকি? বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যারন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও এই পশুটার নাগাল পায়নি।
জি, ম্যাকোট বলতে লাগল। জানোয়ারটা ভীষণ চালাক, এমনভাবে দৌড়াদৌড়ি করে পায়ের ছাপ ফেলেছে, যে আমি অনুসরণ করতে করতে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে এসেছি।
তাহলে তুমি বলতে চাইছ, ওটাকে বাগে পাবার সম্ভাবনা নেই।
মনে হচ্ছে না।
খিস্তি করে উঠল লর্ড। মহান নমরুদের পর খিস্তি ঝাড়ায় তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। আমার শরীরটাও বেশি ভাল লাগছে না। ওই কালো নেকড়েটার বদলে আর কী শিকার করা যেতে পারে?
নেকড়েটার পিছু নেয়ায় আর কোন পশুকে খেয়াল করতে পারিনি। লর্ড কি বেরিয়ে পড়বেন? সামনে প্রথম যেটা পাবেন, ওটাই শিকার করে নেবেন?
সম্মতি দেয়ার আগেই এনগুভাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল।
ওই যে এনগুভা আসছে। দেখা যাক, ও কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারে কি না।
বিনয়ের পরাকাষ্ঠা সাজল এনগুভা। আপনার মতো মহান লর্ডকে দেয়ার মতো কোন পরামর্শ আমার ঝুলিতে নেই। তবে এটা জানানো আমার দায়িত্ব যে, কাছেই একটা চমৎকার হরিণ দেখে এলাম।
চলো তোমার হরিণ দেখে আসি। ভুল খবর না হলে পুরস্কার পাবে।
তা কোথায় তোমার এই হরিণ? জিজ্ঞেস করল ম্যাকোট। সাবধান, অহেতুক আমাদের দৌড় করিও না।
ম্যাটাডো আর জুপিটাকে আমার সাথে দিন, তারপর দেখুন। ম্যাটাডো আর জুপিটা লর্ডের সেরা দুই শিকারি কুকুর। সত্যি সত্যিই এনগুভা ওদের নিয়ে শ খানেক গজ এগোতে না এগোতেই বিশাল একটা পুরুষ হরিণ চোখে পড়ল। ম্যাকোট শিঙায় ফুঁ দিল। যদিও কালো নেকড়েটা পেলে ভাল হত, তারপরও যা পাওয়া গেছে তাতেই সম্ভষ্ট লর্ড ভেয। শুরু হলো ধাওয়া-দুঘণ্টা ধরে অক্লান্ত ভাবে ছুটল হরিণটা।
নিচু জমিতে ছোট নদীর কাছে পৌঁছে গতি একটু কমলো ওটার। কিন্তু পানি পেরিয়ে তীরে উঠেই আবার ছুটতে লাগল। শিকারি কুকুরগুলোও নাছোড়বান্দা। ছড়িয়ে পড়ে হরিণটার গন্ধ খুঁজে বের করল ওগুলো। ব্যারন আর তার শিকারিরা সেইন্ট আঁতোয়ার পুকুরে পৌঁছল। এদিকেই বাস করে স্যাবট-কারিগর, থিবল্ট।
বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে ওর, লম্বা, সুঠামদেহী। বিষণ্ণতায় ভোগে থিবল্ট। প্রতিবেশী যারাই ওর চেয়ে ভাল আছে, তাদের প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা নিয়ে বেঁচে আছে ও। ওই সময়ে, এখনকার মতো নিজের জন্মগত সামাজিক অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় ছিল না। অক্ষরজ্ঞান ছিল থিবল্টের। কিছুটা ল্যাটিন ভাষাও জানত। প্রচুর বই পড়ত ও। তবে এত পড়াশোনার পরও, ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ওর দুর্বলতা ছিল।
বিশ বছর বয়সে জুতো-প্রস্তুতকারীর পেশা বাদ দিয়ে, অন্যকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখত থিবল্ট। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওর। কিন্তু পরিচিতরা সবাই পাঁচ-ছয় বছর গাধার খাটুনি খেটেও কোন পদোন্নতি পায়নি-কেউ এমনকি সামান্য কর্পোরালও হতে পারেনি।
নৌ-বাহিনীতেও একই অবস্থা। কোন জুতো-প্রস্তুতকারীর ছেলে পদোন্নতি পেয়েছে এমনটা কখনও শোনেনি ও।
নোটারি হিসেবে কলম পিষে বড় হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিল। কিন্তু শুরু করতে যে ত্রিশ হাজার ফ্লা দরকার, সেটা আর যোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
এর মাঝে থিবল্টের বাবা মারা গেল। তাকে কবর দেয়ার পর ওর হাতে তেমন কোন টাকা পয়সা ছিল না। বছর তিনেক ফ্রান্সের নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াল ও। তখন অনেক কিছুই শিখেছে। ভালো নাচতে শিখেছে, চমঙ্কার লাঠি খেলতে শিখেছে, শিখেছে বর্শা দিয়ে শিকার করতে। আর একটা জিনিস শিখেছে-একজন ব্যবসায়ীর কথার যে দাম আছে, প্রেমাস্পদের কথার সে দাম নেই। অনেক অভিজাতের চেয়েই থিবল্ট সুদর্শন, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান। কিন্তু তারপরও ওর সামাজিক অবস্থানের কোন উন্নতি হলো না। কেন ও গরীব ঘরে জন্মেছে, কোন অভিজাত ঘরে নয়, সে-ই আফসোস ওকে কুরে কুরে খায়।
থিবল্ট আবিষ্কার করল, এইসব নাচ, খেলাধুলায় অহেতুক পরিশ্রম ছাড়া কিছু হয় না। ওর বাবা যদি জুতো তৈরি করে জীবন ধারণ করতে পেরে থাকে, সে-ও পারবে। আর তাই অরলিয়ন্সের রাজকীয় পদমর্যাদাধারী লুই ফিলিপের স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বনে একটা কুঁড়েঘর তৈরি করে জুতো তৈরির ব্যবসা শুরু করল।
নিজের হাতেই ঘর আর আসবাবপত্র তৈরি করল থিবল্ট।
তিন বছর হয়ে গেল ও ফিরে এসে সব গুছিয়ে বসেছে। ওর ত্রুটি বলতে অন্যের প্রতি ঈর্ষাবোধটাই যা। কিন্তু তাতে করে কারো কোন ক্ষতি অন্তত হচ্ছিল না।
দ্বিতীয় অধ্যায় – সিনর জাঁ এবং স্যাবট-কারিগর
শরতের মাঝামাঝি। থিবল্ট খোলা জায়গায় কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ মুখ তুলে কয়েক পা দূরে কম্পমান পশুটাকে দেখতে পেল ও। হরিণটার ভীত চাহনির আড়ালে বুদ্ধির ছটা লক্ষ করা যায়। থিবল্ট অনেকক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছিল যে ওটা ওর কুঁড়ের পাশ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। শিকারিদের এড়ানোর চেষ্টায় কখনও গ্রামের দিকে যাচ্ছে আবার ফিরেও আসছে।
থিবল্টের জন্য এতে বিস্ময়ের কিছু না থাকলেও ও হাতের কাজ থামিয়ে দিল।
বাহ্! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ও, কী চমৎকার প্রাণীটা। মাংসের স্বাদও খুব ভাল হবে। বছর চারেক আগে ভোফিনে জুতো কারিগরদের একটা ভোজ হয়েছিল। সেখানে খেয়েছিলাম এমন হরিণের মাংস। ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে। যারা রোজ এমন মাংস খেতে পায় তারা আসলেই ভাগ্যবান। এই লর্ডেরা প্রতি বেলায় মাংস আর ওয়াইন দিয়ে খুঁড়িভোজ করে। আর এদিকে আমি হতভাগা শুধু আলু আর পানি খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এমনকি রবিবারেও সবসময় ভাল এক টুকরো বেকন আর সজী জোটে না।
থিবল্ট নিজের সাথে কথা শুরু করতেই হরিণটা হাপিশ! হাতের কাজটা গুছিয়ে উঠতেই কর্কশ একটা কণ্ঠ ওকে উদ্দেশ করে হেঁকে উঠল, এই যে বেওকুফ! শোন এদিকে।
কুকুরগুলোকে অস্থির দেখে ব্যারন নিশ্চিত হতে চাইছিল ভুল দিকে যাচ্ছে না তারা।
এই গাধা! জানোয়ারটাকে দেখেছিস?
ব্যারনের কথার ধরণ আমাদের দার্শনিক জুতোর কারিগরের ঠিক পছন্দ হলো না। তাই জেনেও না জানার ভান করল ও, কোন্ জানোয়ার?
আরে মুখপোড়া! যে হরিণটা আমরা তাড়া করছি। এদিক দিয়েই তো যাওয়ার কথা ওটার। এত সুন্দর একটা হরিণ দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ নেই। জলদি বল্ কোনদিকে গেছে, নয়তো মার খাবি।
বিড়বিড় করে থিবল্ট নিজেকে বলল, প্লেগ হোক তোর নেকড়ের বাচ্চা। তারপর মুখে গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে জোরে বলল, ও হরিণ! হ্যাঁ দেখেছি তো।
বিশাল শিংওয়ালা একটা সুন্দর হরিণ, তাই না?
হ্যাঁ, হরিণই বটে। বড় শিং-নাকি বড় খুর ছিল? আপনাকে এখন যেমন পরিষ্কার দেখছি, তেমনি পরিষ্কার দেখেছি। তবে পায়ের দিকে খেয়াল করিনি, তাই খুরগুলো বড় ছিল কি না বলতে পারছি না। তবে ওটার দৌড়তে যে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না এটুকু বলতে পারি।
অন্য সময় হলে বোকার মতো কথা শুনে হয়তো হেসে ফেলত ব্যারন। কিন্তু এতক্ষণে হরিণটার কাছে বার বার নাকানি-চুবানি খেয়ে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে।
যথেষ্ট হয়েছে। আমি মজা করার মানসিকতায় নেই।
মাই লর্ড আমাকে যে মানসিকতায় চাইবেন, আমি তাতেই থাকব।
তাহলে প্রশ্নের জবাব দে।
কিছু তো জিজ্ঞেসই করেননি।
হরিণটাকে কি ক্লান্ত মনে হয়েছে?
খুব একটা না।
কোন্ পথে এসেছিল?
আসেনি তো, দাঁড়িয়ে ছিল।
কোন না কোন পথে তো নিশ্চয়ই এসেছিল।
তা তো বটেই, তবে আমি দেখিনি।
কোন্ পথে গেছে?
মাই লর্ড, আপনাকে অবশ্যই বলতাম, কিন্তু ওকে যেতেও দেখিনি।
লর্ড ভে থিবল্টের দিকে রাগী চোখে তাকালেন।
তো জনাব গোবেচারা, হরিণটা কি অনেকক্ষণ হলো এদিক দিয়ে গেছে?
খুব বেশিক্ষণ নয়।
কতক্ষণ?
থিবল্ট মনে করার ভান করল, বোধহয় পরশুদিন, বলার সময় মুখের হাসিটা লুকাতে পারল না ও। ব্যারনও হাসিটা দেখে চাবুক উঁচিয়ে থিবল্টের দিকে এগিয়ে গেল।
একছুটে গিয়ে ঘরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট।
তুই প্রলাপ বকছিস মিথ্যেবাদী! বিশ গজও হবে না, মাক্যাসিনো, মানে আমার সেরা হাউন্ডটা ডাকাডাকি করছে। ওদিকে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে হরিণটা এদিক দিয়েই গেছে। আর এদিক দিয়ে গেলে তুই দেখিসনি এটা হতেই পারে না।
ক্ষমা করবেন মাই লর্ড। আমাদের ভালমানুষ পাদ্রীর কথা অনুযায়ী পোপ ছাড়া আর সবারই ভুল হতে পারে। মঁসিয়ে মাক্যাসিনোও সম্ভবত ভুল করেছেন।
কান খুলে শুনে রাখ বদমাশ, মাক্যাসিনো কখনও ভুল করে না। আর প্রমাণ হিসেবে মাটির ওপর আমি হরিণটার পায়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।
ব্যারনকে ভুরু কোঁচকাতে দেখে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল থিবল্ট, যা-ই হোক, মাই লর্ড আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি…
চুপ, এদিকে আয় বদমাশ।
ব্যারনকে আর রাগানোটা ঠিক হবে না, হয়তো আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবে একটু ইতস্তত করে হলেও বেরিয়ে এল বিবল্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্য থিবল্টের, যতটুকু রাগার এরইমধ্যে রেগে গেছে লর্ড ভেয। আড়াল ছেড়ে বেরোনো মাত্র
ওর দিকে তেড়ে গেল সে। চাবুকের বাট দিয়ে বাড়ি মারল ওর মাথায়!
আঘাতের আকস্মিকতায় সামনের দিকে ঝুঁকে গেল থিবল্ট। ঠিক তখনই ব্যারন ওর বুকে গায়ের জোরে একটা লাথি কষাল। লাথির ধাক্কায় থিবল্ট পেছন দিকে উড়ে গিয়ে কুঁড়ের দরজার উপর আছড়ে পড়ল।
চাবুক চালিয়ে ব্যারন বলল, নে, এটা মিথ্যে বলার জন্য! আর পা চালানোর পর বলল, আর এটা অনর্থক বাজে বকার জন্য!
পড়ে থাকা মানুষটার দিকে ফিরেও তাকাল না সে। এদিকে মাক্যাসিনোর ডাক শুনে বাকি হাউডগুলোও এসে হাজির হয়েছে। শিঙা ফুঁকে ওদের উৎসাহ দিতে দিতে ছুটে চলে গেল ব্যারন।
উঠে দাঁড়াল থিবল্ট। ভাল করে দেখে নিল কোন হাড় ভেঙেছে কি না।
নাহ, হাড়গোড় কোনটা ভাঙেনি, সব ঠিকই আছে। তো ব্যারন সাহেব, প্রিন্সের বেজন্মা মেয়েকে বিয়ে করেছ বলে মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করছ। একটা কথা বলে রাখি, ওই হরিণ আর তোমার কপালে নেই! এই গোবেচারা, বেওকুফ, বদমাশের ভাগ্যেই হরিণটা জুটবে। এটা আমার প্রতিজ্ঞা! চিৎকার করে বলল থিবল্ট। আর প্রতিজ্ঞা করে যে রাখতে পারে না, সে তো পুরুষই নয়!
তাড়াতাড়ি শিকারের অস্ত্র নিয়ে তৈরি হলো থিবল্ট। যেদিক থেকে হাউন্ডগুলোর চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, সেদিকেই ছুটল ও। একজন মানুষের পক্ষে যত জোরে ছোটা সম্ভব। হরিণ আর তার পিছু ধাওয়াকারীদের বাঁকানো পথের দিক আন্দাজ করে নিল। তারপর কোনাকুনি সেদিকে ছুটল, যাতে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।
দৌড়াতে দৌড়াতেই হরিণটাকে কীভাবে শিকার করবে, একমাস ধরে কীভাবে খাবে সেই পরিকল্পনা করতে লাগল থিবল্ট। ফলশ্রুতিতে ব্যারন আর তার লোকদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হবে। এটাই হবে লোকটার অহেতুক নিষ্ঠুরতার জবাব। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হেসে উঠল ও।
থিবল্টের হিসাব অনুযায়ী হরিণটা নিকটবর্তী একটা কাঠের সেতুর দিকে যাবে। তাই সেতুটার কাছেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ও।
অল্পক্ষণ পরেই হরিণটার দেখা পাওয়া গেল। বাতাসে কান খাড়া করে শত্রুর আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত হয়ে উঠল থিবল্ট। আড়াল থেকে উঠে জন্তুটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল হাতের বর্শাটা।
হরিণটা প্রথম লাফে সেতুর অর্ধেক, দ্বিতীয় লাফে বাকি সেতু আর তৃতীয় লাফে পগার পার!
এক ফুটের জন্য হরিণকে মিস করে ঘাসে নাক খুঁজল বর্শাটা। থিবল্টের জানা ছিল না এত বাজে ভাবে বর্শা ছোঁড়াও ওর পক্ষে সম্ভব। যাদের সাথে পুরো ফ্রান্স চক্কর দিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে ওর নিশানাই ছিল সবচাইতে নিপুণ। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো থিবল্টের। বর্শাটা তুলে নিয়ে হরিণটার প্রায় সমান ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওটার পিছু নিল আবার।
এলাকাটা হরিণটার চেয়ে কম চেনে না ও। আবারও আগেভাগে অনুমান করে পথের পাশে লুকিয়ে পড়ল। এবার প্রাণীটা অনেক কাছ দিয়ে গেল। কিন্তু বিধিবাম! বর্শা দিয়ে বাড়ি মারবে, না ওটা ছুঁড়ে-মারবে ভাবতে ভাবতে হরিণটা ওকে পার হয়ে গেল। অবশেষে ওটা যখন প্রায় বিশ কদম দূরে সরে গেছে, তখন বর্শা ছুঁড়ল থিবল্ট। কিন্তু এবারও পরিণতি আগের মতোই হলো-লক্ষ্যভেদ করতে পারল না ও।
হাউন্ডগুলোর ডাক ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। আর কিছু সময় পরে পরিকল্পনা সফল করার সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যত কঠিন হচ্ছে, হরিণটাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হয়ে উঠছে থিবল্টের মনে।
হরিণটা আমার চাই-ই চাই। ব্যারন ব্যাটা তো আমাকে মানুষই মনে করে! গরীবের যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে তো তাকে বলছি। প্রমাণ করতে চাই যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, আমিও মানুষ! আবার বর্শাটা তুলে দৌড় শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু গরীবের ঈশ্বর হয় ওর কথা কানে তোলেননি আর নয়তো ওর পরীক্ষা আরও কঠিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তৃতীয় চেষ্টাটাও বিফলে গেল বেচারার।
ঈশ্বর! অধৈর্য হয়ে উঠেছে থিবল্ট, মনে হচ্ছে ঈশ্বর কানে শুনতে পায় না! তাহলে শয়তানকেই বলি! ঈশ্বর নয় শয়তান, যে-ই শুনুক, হরিণের বাচ্চা হরিণ, তোকে আমি ধরবই!
এই দ্বিমুখী নীতিসূচক কথা শেষ করতে করতেই হরিণটা চতুর্থবারের মতো ওকে ফাঁকি দিয়ে ঝোঁপের আড়ালে হারিয়ে গেল। হাউন্ডগুলোর ডাক এত কাছে শোনা যেতে লাগল যে এই মুহূর্তে হরিণটার পিছু ধাওয়া করার চিন্তা আপাতত বাদ দিতে হলো ওকে। ঝোঁপের আড়ালে বর্শাটা লুকিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ল ও। কুকুরগুলো এখনও গন্ধ খুঁজে যাচ্ছে। আর ওগুলোর পেছন পেছনই এসে হাজির হলো ব্যারন। লর্ড ভেযের মেজাজ যারপরনাই খারাপ হয়ে আছে। রাগের চোটে এমন হন্তদন্ত হয়ে চলাফেরা করছে সে, যে পঞ্চান্ন বছর বয়স হলেও হাবভাব দেখে বিশ বছরের যুবক বলে মনে হচ্ছে তাকে।
সামান্য একটা হরিণের পেছনে চার-চারটা ঘণ্টা খরচ করেও ধরা যাচ্ছে না। এমনটা আগে কখনও হয়নি।
লোকদের তাড়া দিচ্ছে ব্যারন, কুকুরদের ওপর চালাচ্ছে চাবুক; স্পরের নির্মম খোঁচায় আগেই ঘোড়াগুলোকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। সেতু পেরোতেই কুকুরগুলো আবার হরিণটার গায়ের গন্ধ খুঁজে পেল।
খুশিতে শিঙায় ফুঁ দিল ব্যারন।
কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ টিকল না।
কারণ থিবল্টের গাছের নিচে এসেই যাদুমন্ত্রের মতো থেমে গেল কুকুরগুলো। কর্তার হুকুমে ঘোড়া থেকে নেমে হরিণটার পায়ের ছাপ খুঁজতে শুরু করল ম্যাকোট, এনগুভা এবং অন্যরা। ওদিকে কুকুরগুলোও গাছে কাছ থেকে সরতে নারাজ। অনেক খুঁজেও কোন ছাপ বের করতে পারল না কেউ। কুকুরগুলোকে নড়ানোর চেষ্টা করেও বিফল হলো ওরা। সবাইকে ছাপিয়ে শোনা গেল ব্যারনের রাগান্বিত কণ্ঠ।
বজ্জাত কুকুরগুলো কি গর্তে গিয়ে পড়ল না কি, ম্যাকোট?
না, মাই লর্ড। এখানেই আছে। কিন্তু নড়াচড়া করছে না।
কী বলছ! নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন শুধু শুধু?
কী করব, মাই লর্ড? ঘটনা যে কী ঘটছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
দাঁড়িয়ে পড়েছে। এগোচ্ছে না! তা-ও এই বনের মধ্যে! যেখানে গন্ধ হারানোর জন্য না আছে নদী না আছে পাহাড়তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ম্যাকোট!
আমার মাথা খারাপ হয়েছে, মাই লর্ড?
হ্যাঁ, তুমি একটা গর্দভ আর তোমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল।
নিজের ওপর সব অপমান নীরবে হজম করতে অভ্যস্ত ম্যাকোট, কিন্তু প্রাণ প্রিয় কুকুরের ওপর আক্রমণটা আর সহ্য হলো না ওর। মুখের ওপর প্রশ্ন করে বসল, জঞ্জাল, মাই লর্ড? আমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল! আপনার আস্তাবলের সেরা ঘোড়াটাকে নেকড়ে মেরে ফেলল। সেই নেকড়েটাকে তাড়িয়ে এনেছিল যারা, তারা জঞ্জাল!
হ্যাঁ, আবারও বলছি, বেহুদা জঞ্জাল! একটা হরিণের পিছনে এত ঘণ্টা তাড়া করে এসে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল, জঞ্জালই তো!
ম্যাকোট পরিষ্কার কিন্তু কিছুটা দুঃখ মেশানো স্বরে বলল, মাই লর্ড, আমাকে বোকা, গাধা, মাথামোটা, অপোগন্ড যা খুশি বলুন; এমনকি আমার বউ, বাচ্চাদেরকেও যত খুশি অপমানসূচক কথা বলুন, কিছু মনে করব না আমি; কিন্তু এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে আপনার চাকরি করছি, তার খাতিরে হলেও দয়া করে আমার কাজকে, আপনার কুকুরগুলোকে অপমান করবেন না।
তাহলে ওদের এই হঠাৎ থেমে যাওয়ার ব্যাখ্যাটা কী? বলল কী ব্যাখ্যা, আমি শুনতে রাজি আছি।
আপনার মতোই আমারও কোন ধারণা নেই, মাই লর্ড। হরিণটা হয় আকাশে, নয় পাতালে মিলিয়ে গেছে।
কী আজেবাজে বকছ? হরিণটার কি পাখা গজিয়েছে যে উড়ে যাবে, না কি খরগোশের মতো গর্তে লুকাবে?
ওটা তো কথার কথা বললাম, মাই লর্ড। আসল কথা হচ্ছে, এর পেছনে কোন জাদুর কারসাজি আছে। কথা নেই বার্তা নেই সবগুলো কুকুর একসাথে গন্ধ শোঁকা বাদ দিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনার কাছে এটাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
চাবকে ওগুলোর পিঠের চামড়া তুলে ফেলল তাহলে! ভূত তাড়ানোর এর চেয়ে ভাল রাস্তা আর নেই।
আদেশ দিয়ে নিজেও এগিয়ে গেল ব্যারন। ম্যাকোট আদেশ পালন শুরু করল। এনগুভা হ্যাটটা হাতে নিয়ে ব্যারনের কাছে এগিয়ে এল। ঘোড়ার লাগামে হাত রেখে বলল, মাই লর্ড, এইমাত্র গাছের পাতার আড়ালে একটা কোকিল দেখলাম। মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
কোকিল, কী আবোল তাবোল বকছিস, বানর কোথাকার? দাঁড়া, অনর্থক আমাকে বিরক্ত করতে আসার মজা তোকে টের পাওয়াচ্ছি। চাবুক তুলল ব্যারন। এনগুভা মাথার ওপর হাত তুলে নিজেকে আড়াল করে বলল, মারতে চাইলে মারবেন, মাই লর্ড। কিন্তু একবারটি উপর দিকে তাকান। গাছের ডালে বসা পাখিটাকে দেখলে চাবুকের বাড়ি নয়, আমাকে পুরস্কার দিতে চাইবেন।
থিবল্ট ওক গাছের মগডালে বসে ছিল। সেদিকেই নির্দেশ করল এনগুভা।
কপালে হাত দিয়ে সরাসরি সূর্যের আলো আড়াল করে উপরে গাছের দিকে তাকাল ব্যারন-এবং দেখতে পেল থিবন্টকে।
এনগুভা বলল, মাই লর্ড, যদি চান তো আমি গিয়ে… বলে গাছে চড়ার ইঙ্গিত করল সে।
হাত তুলে নিষেধ করল ব্যারন।
এই যে, উপরে যে আছ, থিবকে তখনও চিনতে পারেনি ব্যারন, আমার একটা কথা জানার ছিল। জবাব দেবে?
উত্তরের অপেক্ষায় একটুক্ষণ চুপ করে থাকল ব্যারন।
তাহলে জবাব দেবে না! তুমি বোধহয় কানে কম শোনো। অসুবিধা নেই, কথা বলানোর ট্রাম্পেট আছে আমার, বলে ম্যাকোটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে আর ম্যাকোট সেই হাতে ধরিয়ে দিল বন্দুক।
এদিকে থিবল্ট একমনে গাছের ডাল কাটার ভান করতে লাগল। ব্যারন কী করছে সেটা যেন ও দেখেইনি। বা দেখলেও গুরুত্ব দেয়নি।
উত্তরের জন্য একটু অপেক্ষা করে গুলি ছুঁড়ে দিল ব্যারন। করাৎ করে আওয়াজ হলো ডাল ভাঙ্গার।
ব্যারনের নিশানা খুবই ভাল। থিবল্টের ডালের গোড়াতেই গিয়ে লেগেছে গুলিটা। আশেপাশে আরও ডাল থাকলেও পতন ঠেকাতে পারল না ও। তবে গাছটায় ডালপালা অনেক আর খুব ঘন। তাই পতনটা থেমে থেমে হলো। অবশেষে ও মাটিতে এসে পড়ল।
আরে! নিজের নিশানার সাফল্যে নিজেই মুগ্ধ ব্যারন। এ তো সকালের সেই জোকারটা। তো, আমার চাবুকের সাথে কাটানো সময়টা খুব কম মনে হয়েছিল তোর, তাই না? আবার চলে এসেছিস দেখা করতে?
নিখাদ আন্তরিকতার সুরে থিবল্ট বলল, একদমই না, মাই লর্ড।
তাহলে সেটা তোর চামড়ার জন্যই ভাল, এখানে গাছের মগডালে বসে কী করছিস?
মাই লর্ড নিজেই দেখতে পাচ্ছেন, আশপাশে ছড়ানো ছিটানো শুকনো কাঠের দিকে নির্দেশ করল থিবল্ট। জ্বালানীর জন্য কাঠ সংগ্রহ করছিলাম।
এবার আর ফালতু কথা না বলে সরাসরি বল, হরিণটার কী হয়েছে?
শয়তানের দিব্যি, ও যেখানে বসেছিল, ওখান থেকে সব পরিষ্কার দেখা যাওয়ার কথা, ম্যাকোট যোগ করল।
বিশ্বাস করুন, মাই লর্ড। হরিণটার ব্যাপারে আপনি কী জানতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমিও সেরকমই ধারণা করেছিলাম, ব্যঙ্গের সুরে বলল ম্যাকোট। ও হরিণটাকে দেখেনি। হরিণটার ব্যাপারে কী জানতে চাইছি তা-ও বুঝতে পারছে না। কুকুরগুলো যেখানে থেমে গেছে, ওখান পর্যন্ত হরিণটার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অথচ মাটির ওপর যেখানে আরও চিহ্ন থাকার কথা, সেখানে কোন দাগই নেই।
শুনেছিস? ব্যারনও যোগ করল। তুই উপরে ছিলি আর হরিণটা নিচে। ইঁদুরের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা নিশ্চয়ই করেনি। আর তুই বলছিস বটে যে কিছু দেখিসনি তুই, শুনিসওনি। কিন্তু আমি বলছি তুই অবশ্যই দেখেছিস, নয়তো শুনেছিস!
ম্যাকোট বলল, এটা পরিষ্কার যে ও হরিণটাকে মেরে কোন একটা ঝোপে লুকিয়ে রেখেছে।
মাই লর্ড, থিবল্ট খুব ভাল করেই জানে ম্যাকোটের ধারণা কতটা ভুল। স্বর্গের সব সাধু-সন্তদের দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি হরিণটাকে মারিনি। আমি যদি হরিণটার গায়ে একটা আঁচড়ও কেটে থাকি, তাহলে জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছি, আমার আত্মা কোনদিন মুক্তি পাবে না। তাছাড়া আঘাত না করে কীভাবে হরিণটাকে মারতাম। আর আঘাত করলে তো রক্তের দাগ থাকত। খুঁজে দেখুন, মাই লর্ড। ম্যাকোটের দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বর জানেন, কোথাও কোন রক্তের দাগ আপনি পাবেন না। তাছাড়া নিরীহ জটাকে আমি মারব কী দিয়ে? অস্ত্র কোথায় আমার? আপনিই দেখুন মাই লর্ড, এই কাটারিটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।
কিন্তু থিবল্টের কপাল খারাপ। এনভা আশেপাশের ঝোঁপঝাড়ে চুঁ মেরে বেড়াচ্ছিল। একটা ঝোঁপ থেকে থিবল্টের বর্শাটা কুড়িয়ে এনে ব্যারনের হাতে দিল সে।
কোন সন্দেহ নেই-এনগুভা হচ্ছে থিবল্টের শনি!
তৃতীয় অধ্যায় – অ্যানটে
ব্যারন নীরবে এনগুভার বাড়িয়ে দেয়া বর্শাটা নিল, উল্টেপাল্টে দেখল। ফ্রান্স ঘোরার সময়, নিজের অস্ত্র চেনার জন্য হাতলে একটা জুতো খোদাই করে রেখেছিল থিবল্ট। চিহ্নটা দেখিয়ে ব্যারন বলল, আহহা, মঁসিয়ে গোবেচারা! এই জিনিসটা তো আপনার বিপক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে! যাই-হোক, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, তুই চোরাশিকার করেছিস, এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার উপর সত্য গোপন করেছিস, যেটা কিনা মহাপাপ। যে আত্মার নামে প্রতিজ্ঞা করেছিস, সেই আত্মার মুক্তির জন্য তোর মুখ থেকে সত্যটা আমি বের করব।
তারপর ম্যাকোটকে আদেশ করল, বদমাশটার জামা খুলে ওকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর ওর পিঠে ছত্রিশবার চাবুক চালাও-সত্য গোপন করার জন্য বারোটা আর চোরা শিকারের জন্য চব্বিশটা। না, বরং বারোটা চোরা শিকারের জন্য আর চব্বিশটা সত্য গোপনের জন্য হোক। ঈশ্বরের ভাগটা বেশি থাকা উচিত।
দলের লোকেরা খুশি হয়ে উঠল। যাক, ভালই হলো, সারাদিনের দুর্ভোগের ঝাল একজনের ওপর মেটানোর সুযোগ পাওয়া গেছে।
থিবল্ট বারবার বলার চেষ্টা করল হরিণ তো দূরের কথা, ও একটা ছাগলও শিকার করেনি। তা সত্ত্বেও ওর জামা খুলে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে ব্যারনের দেয়া আদেশ কার্যকর করা শুরু হলো।
থিবল্ট চিৎকার না করার চেষ্টায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। কিন্তু আঘাতগুলোতে এত জোর ছিল, যে তিন নম্বর বাড়ির পর আর চুপ থাকতে পারল না ও।
ব্যারন খুব রূঢ় স্বভাবের মানুষ হলেও থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর আর্ত-চিৎকার সহ্য করতে এমনকি তারও অসুবিধা হচ্ছিল। নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছে। শাস্তি কার্যকর হতে দিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ব্যারন।
ঠিক এই সময় একটা মেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল বনের ভেতর থেকে। ঘোড়ার পাশে অশ্রুভেজা সুন্দর চোখজোড়া তুলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। ব্যারনকে অনুনয়ের সুরে বলল, ঈশ্বরের দোহাই মাই লর্ড, মানুষটাকে দয়া করুন।
নিচের দিকে তাকাল ব্যারন। বেশি হলে ষোলো বছর হবে ওর বয়স। চমৎকার হালকা-পাতলা শরীর। দুধে আলতা গায়ের রঙ। বড় বড় নীল চোখ। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল কাঁধ ছাড়িয়েছে। কমনীয় মুখভঙ্গিতে মেয়েটাকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় লাগছে।
এতসব কিছু লক্ষ করতে ব্যারনের মাত্র একটা মুহূর্ত লাগল। সাধারণ অনাড়ম্বর পোষাকে ঢাকা থাকলেও সুন্দরকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি তার। কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ব্যারন।
চাবুকের বাড়ি বন্ধ হচ্ছে না দেখে আবার কেঁদে উঠল মেয়েটা।
মাই লর্ড, ঈশ্বরের দোহাই, দয়া করুন! আপনার লোকদের থামতে বলুন। মানুষটার চিৎকার আর সহ্য করতে পারছি না।
বিরক্তি প্রকাশ করে লর্ড ভেস বলল, এই বদমাশটার জন্য কাঁদছ? কে হয় ও তোমার, ভাই?
না, মাই লর্ড।
তোমার কাজিন? না, মাই লর্ড।
তোমার প্রেমিক?
প্রেমিক! মাই লর্ড, মজা করছেন আমাকে নিয়ে।
কেন, হতে পারে না? সত্যি হলে স্বীকার করছি, মেয়ে, ওকে আমার অনেক হিংসা হবে।
চোখ নিচু করল মেয়েটা।
ওকে আমি চিনি না, মাই লর্ড আজকের আগে কখনও দেখিনি।
এনগুভা একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না। উল্টো দিক থেকে দেখছে তাই বোধহয় চিনতে পারছে না।
চুপ! কড়া সুরে বলল ব্যারন। তারপর আবার হাসিমুখে মেয়েটার দিকে ফিরল।
আচ্ছা! তাহলে স্বজন নয়, বন্ধু নয়, এমন কারো জন্য কতদূর ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছ, দেখা যাক।
কীভাবে মাই লর্ড?
ওই বদমাশটার জন্য দয়ার বিনিময়ে একটা চুমু চাই!
একটা চুমুর বিনিময়ে একটা মানুষের জীবন বাঁচবে। আমি নিশ্চিত এতে কেউ কোন পাপ ধরবে না।
ব্যারনের অনুমতির অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। কাঠের জুতো জোড়া খুলে ফেলল। নেকড়ে শিকারির বুটের ওপর পা রেখে ঘোড়ার কেশর ধরে নিজেকে উঁচু করল ও। পরিষ্কার, নরম চিবুকটা এগিয়ে দিল ব্যারনের দিকে।
একটা চুমুর কথা থাকলেও ব্যারন দুটো চুমু খেল। তবে কথা রাখল সে। ম্যাকোটকে ইঙ্গিত করল শাস্তি বন্ধ করতে।
ম্যাকোট ওদিকে নিষ্ঠার সাথে গুণে গুণে চাবুকের বাড়ি মারছিল। বাবো নম্বরটা যখন নামতে শুরু করেছে, তখন মার বন্ধ করার আদেশ পেল সে। চাবুকের এই শেষ বাড়িটা না থামিয়ে দ্বিগুণ জোরে চালাল-যেন বারোর সঙ্গে তেরো নম্বরটাও মিশিয়ে দিতে চাইছে! এটার দাগ থিবল্টের কাঁধে আগেরগুলোর চাইতেও গভীরভাবে বসে গেল। তবে তার পরপরই খুলে দেয়া হলো ওর বাঁধন।
ব্যারন তখন মেয়েটার সাথে কথা বলছে।
নাম কী তোমার?
জর্জিনা অ্যানলেট, আমার মায়ের নামে নাম। অবশ্য গাঁয়ের লোক আমাকে শুধু অ্যানলেট বলেই ডাকে।
নামটা শুভ নয়।
কোন্ দিক থেকে, মাই লর্ড?
যে কোন সময় নেকড়ের শিকার হয়ে যেতে পারো! তুমি থাকো কোথায়, অ্যানলেট?
পোসিয়ামন-এ, মাই লর্ড।
ওখান থেকে একা একা এই বনে চলে এসেছ? তোমার সাহস আছে।
বাধ্য হয়েই আসতে হয়, মাই লর্ড। আমার আর দাদীমায়ের তিনটা ছাগল পালতে হয়।
আচ্ছা, ছাগলের ঘাস নিতে আসো?
জি, মাই লর্ড।
একে তোমার বয়স কম, তায় সুন্দরী আবার সাহসীও?
মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠি মাই লর্ড।
কীসের ভয়ে?
শীতের সন্ধ্যায় নেকড়ে-মানবদের অনেক গল্প শুনেছি, মাই লর্ড। যখন একা থাকি, বাতাসের ধাক্কায় গাছের শাখা থেকে শব্দ ওঠে, তখন আমার শরীরে ভয়ের শিহরণ বয়ে যায়, গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু যখন শিকারি কুকুরগুলোর চিৎকার আর আপনার শিঙার শব্দ ভেসে আসে, তখন আবার নিজেকে নিরাপদ মনে হয়।
মেয়েটার জবাবে খুশি হয়ে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ব্যারন বলল, তা বটে, নেকড়েদের আমরা দৌড়ের ওপর রাখি। তবে মেয়ে, একটা রাস্তা আছে তোমার এই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার।
কীভাবে, মাই লর্ড?
ভেযের দুর্গ-প্রাসাদে চলে এসো। নেকড়ে-মানব তো দূরের কথা, কোন ধরনের কোন হিংস্র পশুই ওর সীমানায় ঢুকতে পারে না। অন্তত জীবিত অবস্থায় তো নয়ই।
অ্যানলেট না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল।
কেন, আসবে না কেন?
নেকড়ের চাইতেও খারাপ কিছু থাকতে পারে ওখানে।
শুনে হাসতে শুরু করল ভেযের লর্ড। মনিবকে হাসতে দেখে দলের অন্যরাও অনুকরণ করল। আনলেটের দর্শনে আবার খোশমেজাজে ফিরে গেছে ব্যারন। আরও অনেকক্ষণ হেসেই যেত সে, কিন্তু মাঝখান থেকে বাগড়া দিল ম্যাকোট। কুকুরগুলোকে জড়ো করে এনে মনে করিয়ে দিল, দুর্গে ফিরতে হলে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সবাইকে। ব্যারন উৎফুল্ল মনে মেয়েটার দিকে আঙুল নাচিয়ে দলের সাথে ফিরতি পথ ধরল।
থিবল্টের সাথে একা হয়ে গেল অ্যানলেট। সুন্দরী ও, তাছাড়া থিবল্টের জীবনও বাঁচিয়েছে। এমন মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে নিজেকে একা আবিষ্কার করার পরও, থিবল্টের চিন্তা জুড়ে তখনও শুধুই প্রতিশোধ আর ঘৃণা। সকাল থেকেই অন্ধকারের পথে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছে ও। শয়তান যদি আমার আর্জিটা এই বেলা শুনত, অপস্রিয়মাণ শিকারি দলের দিকে হাত নেড়ে বলল ও। যদি শুধু একবার শুনত, আমাকে যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছ, তার উচিত জবাব তোমরা পেতে
এভাবে বলছ কেন? কাছে এসে বলল অ্যানলেট, ব্যারন খুবই দয়ালু লোক। গরিবদের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেন। মেয়েদের সঙ্গেও খুবই ভদ্র ব্যবহার করেন তিনি।
তা তো বটেই, যে মারগুলো আমাকে মেরেছে, তার প্রতিটার জবাব কী দেই দেখো।
এটা তো স্বীকার করবে যে মার খাবার মতো কাজ তুমি করেছ।
আচ্ছা! ব্যারনের চুমু খেয়ে সুন্দরী অ্যানলেটের মাথা ঘুরে গেছে নাকি?
মঁসিয়ে বিবল্ট, অন্তত তোমার কাছ থেকে এই চুমু নিয়ে কোন কথা আমি। আশা করিনি। তারপরও বলব, ব্যারন তার অধিকারের মধ্যে থেকেই কাজটা করেছেন।
আমাকে এভাবে মেরে!
তুমি কেন লর্ডদের এলাকায় শিকার করতে গেছ?
কৃষক কি ধনী, শিকারের অধিকার সবার আছে।
অবশ্যই না। জম্ভগুলো ঘুরে বেড়ায় ওদের এলাকায়, ওখানকার ঘাস খায়। অরলিয়ন্সের ডিউকের এলাকার হরিণকে লক্ষ্য করে বর্শা ছোঁড়ার অধিকার তোমার নেই।
তোমাকে কে বলেছে আমি বর্শা ছুঁড়েছি? আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অ্যানলেটের দিকে একটু এগোল থিবল্ট।
কে বলবে? আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাকে মিথ্যে বলল না। গাছের আড়াল থেকে তুমি যখন বর্শাটা ছুঁড়লে, তখনই দেখেছি আমি তোমাকে।
মেয়েটার সরল সত্যবাদিতার সামনে মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাওয়ায় থিবল্টের রাগ মিইয়ে গেল।
যা-ই হোক, গরীবদেরও কখনও না কখনও লর্ডদের মতো ভালমন্দ খেতে ইচ্ছা করতেই পারে। মাদমোয়াজেল অ্যানলেট, তুমি হলে কী করতে, খরগোশ মারার জন্য কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাতে? আর তাছাড়া, ঈশ্বর কি শুধু ব্যারনদের জন্যই হরিণ সৃষ্টি করেছেন?
মঁসিয়ে থিবল্ট, ঈশ্বর অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করতে বলেছেন। ঈশ্বরের আইন মেনে চলল, ভাল থাকবে।
তুমি আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছ, তারমানে কি আমাকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। উৎসবের দিন বুসোনে তোমাকে দেখেছি। ওরা তোমাকে সুন্দর নাচিয়ে বলছিল। যারা চারপাশে দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম।
প্রশংসা শুনে থিবল্ট একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
আচ্ছা, আচ্ছা, তোমাকে দেখেছি মনে হচ্ছে। একসাথে বোধহয় আমরা নেচেওছিলাম। তখন এত লম্বা ছিলে না, তাই চিনতে পারিনি। কিন্তু এখন একটু একটু মনে পড়ছে। তুমি গোলাপি আর সাদা রঙের জামা পরেছিলে। আমরা একটা খামারে নেচেছিলাম। আমি তোমাকে চুমু খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি রাজি হওনি।
তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভাল, মঁসিয়ে থিবল্ট।
তোমাকে দেখেছিলাম তা প্রায় একবছর হবে। কী জানো অ্যানলেট, এই একবছরে তুমি শুধু লম্বাই হওনি, অনেক সুন্দরও হয়েছ। একসাথে এই দুটো কাজ যে সাফল্যের সাথে করতে পারো, এটা স্বীকার করতেই হবে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটার গাল। চোখ নামিয়ে নিল ও। লজ্জা পাওয়ায় ওকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে।
থিবল্ট আরও ভাল করে অ্যানলেটকে লক্ষ করতে লাগল। পরের প্রশ্নটা করার সময় ওর গলায় উদ্বেগ প্রকাশ পেল।
তোমার প্রেমিক আছে, অ্যানলেট?
না, কখনও ছিল না। আর আশা করি হবেও না।
কেন? প্রেমের দেবতা কি এতই খারাপ যে তুমি তাকে ভয় পাও?
তা নয়, আমি আসলে প্রেমিক চাই না।
কী চাও তাহলে?
স্বামী।
থিবরে নড়ে ওঠাটা অ্যানলেট হয় দেখেনি, আর নয়তো দেখেও না দেখার ভান করল।
ও আবারও বলল, দাদীমা অসুস্থ। তার দেখাশোনা আমাকেই করতে হয়। প্রেমিক থাকলে দাদীমার দেখাশোনা ঠিক মতো করতে পারব না। কিন্তু ভাল একজন স্বামী হলে, সে আমাকে দাদীমার দেখাশোনা ছাড়াও অন্যান্য কাজে সাহায্য করতে পারবে।
কিন্তু স্বামী কি চাইবে, তুমি দাদীকে তার চেয়ে বেশি ভালবাসো? যদি ঈর্ষাবোধ করে?
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অ্যানলেট উত্তর দিল, সেটা নিয়ে কোন ভয় নেই। আমি আমার স্বামীকেও এতটা ভালবাসব যাতে সে অভিযোগ করার কোন সুযোগ না পায়। সে যত ধৈর্য আর নম্রতা দেখাবে দাদীমার প্রতি, আমি তত তার প্রতি মনোযোগ দেব। আরও পরিশ্রম করব যাতে সংসারে কোন কিছুর কমতি না থাকে। আমাকে দেখে ছোটখাটো মনে হতে পারে, কিন্তু পরিশ্রম করার মানসিকতা আমার আছে। মনের জোর থাকলে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করা যায়। আমি, আমার স্বামী এবং দাদীমা, আমরা ঠিক সুখী হব।
বলতে চাইছ, তিনজন একসাথে খুব গরীব থাকবে।
তোমার কি ধারণা গরীবদের ভালবাসা ধনীদের চাইতে একটা মুদ্রাও কম? যখন দাদীমা আমাকে দুর্বল হাতে জড়িয়ে ধরে, বয়স্ক, কোঁচকানো মুখটা আমার মুখের সাথে চেপে ধরে, তার ভালবাসার অশ্রুতে আমার গাল ভিজে যায়, আমিও কাঁদতে শুরু করি, মঁসিয়ে থিবল্ট। আমাদের দুজনের মতো অভাবী হয়তো এ দেশে আর কেউ নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ওই মুহূর্তে আমি যতটা সুখ অনুভব করি, রাণী বা রাজকুমারীরা তাদের সর্বোচ্চ সুখের দিনেও ততটা সুখ অনুভব করে না।
মেয়েটার কথা শুনতে শুনতে নানান কথা ভাবছিল থিবল্ট; যে কিনা লর্ড, ডিউক এদের দুর্গ-প্রাসাদে কত উৎসব অনুষ্ঠান হতে দেখেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে অভিজাত কোন নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাবার। সে-ই এখন ভাবছে, অ্যানলেট নামের এই সুন্দর, নম্র স্বভাবের মেয়েটিকে যদি নিজের করে পায়, তাহলে ব্যারনদেরও ঈর্ষার পাত্র হতে পারবে ও।
আচ্ছা, অ্যানলেট। যদি আমার মত কেউ তোমার স্বামী হতে চায়, তুমি তাকে গ্রহণ করবে?
সবাই বলে থিব সুদর্শন। তাছাড়া সারা ফ্রান্স ভ্রমণের সুবাদে নিজ কাজে দক্ষতা ছাড়াও আরও অনেক কিছুই জানে ও। তার ওপর বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে, একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েই যায়। অ্যানলেট থিবল্টের জীবন বাঁচানোয় এক্ষেত্রে যেমন হয়েছে। ম্যাকোট যেভাবে মারছিল, তাতে ছত্রিশ ঘা খেলে থিবলের আর বাঁচার আশা ছিল না।
হ্যাঁ, যদি তাতে আমার দাদীমার ভাল হয়।
থিবল্ট অ্যানলেটের হাত ধরল।
ঠিক আছে অ্যানলেট, খুব শীঘ্রই আমরা আবার কথা বলব।
যখন তুমি চাও, থিবল্ট।
অ্যানলেট, আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি, তুমি কথা দিচ্ছ তুমি আমাকে ভালবাসবে?
স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে কি আমার ভালবাসার কথা?
শুধু একটা প্রতিজ্ঞা করো। বল, মঁসিয়ে থিবল্ট, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি ভালবাসব না।
প্রতিজ্ঞার কী দরকার? একজন সৎ লোকের জন্য এক সত্যবাদী মেয়ের মুখের কথাই কি যথেষ্ট নয়?
আমরা কবে বিয়ে করব, অ্যানলেট? বলতে বলতে অ্যানলেটের কোমরে . হাত রাখল থিবল্ট।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অ্যানলেট।
দাদীমার সাথে দেখা করো। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন আমাকে বোক নিয়ে বাড়ি যেতে সাহায্য করো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অ্যানলেটকে গ্রামের কাছে পৌঁছে দিল থিবল্ট। বিদায় নেয়ার আগে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে একটা চুমু আদায় করল ও। ব্যারনকে চুমু খাওয়ার সময় কোন অস্বস্তিবোধ হয়নি। কিন্তু এই চুমুতে লজ্জাবোধ করল অ্যানলেট। মাথার ভারি বোঝাটা নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেল ও। নীল আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতো অপস্রিয়মাণ মেয়েটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল থিবল্ট। অ্যানলেট দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। এই চমৎকার তরুণীটি ওর হবে, এটা ওর চিন্তার কারণ নয়। অন্যের জিনিস পাওয়ার একটা দুর্ভাগ্যজনক আকাঙ্ক্ষা ওর ভেতর আছে। অ্যানলেট সুন্দরী এক তরুণী। অন্য কেউ আগেই যাতে অ্যানলেটকে পেতে না পারে, তাই ও অ্যানলেটকে চেয়েছে। যে সরলতা নিয়ে অ্যানলেট ওর সাথে কথা বলেছে, তাতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে এটা ক্ষণিকের আবেগ, গভীর কোন অনুভূতি নয়। এখানে হৃদয়ের চেয়ে হিসেবের জায়গা বেশি। থিবল্টের পক্ষে প্রেমিকের মতো ভালবাসা সম্ভব নয়। নিজে দরিদ্র হয়েও আরেকটা দরিদ্র মেয়েকে ভালবাসা পাওয়ার জন্য ভালবাসার চিন্তা করা ওর পক্ষে অসম্ভব। তাই অ্যানলেট যত দূরে সরে যেতে লাগল, ততই নিজের ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থিবকে অধিকার করতে লাগল। ও যখন বাড়ি পৌঁছল, ততক্ষণে পুরো অন্ধকার নেমে গেছে।
চতুর্থ অধ্যায় – কালো নেকড়ে
সারা দিনের ধকলে প্রচণ্ড ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত থিবল্ট। হরিণটাও মারতে পারেনি। তাই খাওয়াটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হলো না ওর। কিন্তু ভয়ংকর ক্ষুধার কারণে শুকনো রুটির স্বাদও হরিণের মাংসের চেয়ে খারাপ লাগল না।
হঠাৎ করেই ওর পোষা ছাগলটা ডাকতে শুরু করল। ওটারও মনে হয় খিদে পেয়েছে। এক বোঝা ঘাস নিয়ে ছাউনির দরজা খুলল থিবল্ট। দরজা খোলার সাথে সাথে ছাগলটা ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। ঘাসের বোঝা ফেলে ওটাকে ধরতে গেল থিবল্ট। শিং ধরে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর অবশেষে আবার ছাগলটাকে ছাউনিতে নিতে পারল ও। তারপর ফিরল খাওয়া শেষ করতে। কিন্তু ঘাস খাবার বদলে করুণ স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল ছাগলটা। অগত্যা আবার খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়তে হলো থিবল্টকে। সাবধানে দরজা খুলে ছাউনিতে ঢুকে অন্ধকার কোনাগুলো হাতড়ে দেখতে লাগল ও। যথেষ্ট সাহসী থিবল্ট। কিন্তু ঈষদুষ্ণ, মোটা চামড়ার ভিন্ন একটা প্রাণীর স্পর্শ পাওয়া মাত্র চমকে উঠে হাত টেনে নিল ও। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বাতি এনে আলো ফেলল ছাউনিতে। ছাগলটা যে প্রাণীটাকে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করছিল, সেটাকে চিনতে পেরে ওর হাত থেকে বাতিটা পড়ে যাবার উপক্রম হলো। সেই হরিণটা, যার পিছনে ব্যারন আর তার হাউন্ডগুলো সারাদিন ঘুরেছে। যেটাকে ঈশ্বরের নামে মারতে না পেরে থিবল্ট এমনকি শয়তানের কাছে পর্যন্ত আর্জি জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওকে চাবুকের বাড়িও খেতে হয়েছে এটারই কারণে। দরজাটা বন্ধ আছে কি না ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল ও। তারপর হরিণটার দিকে এগিয়ে গেল। হয় খুব ক্লান্ত, নয়তো প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ওটা। ওকে এগোতে দেখেও কিছুই করল না। শুধু কালো বড় মসৃণ চোখজোড়া তুলে তাকিয়ে রইল।
নিজেকেই বলল থিবল্ট, নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। কোথায় লুকাবে বুঝতে না পেরে হরিণটা শেষমেশ এখানে এসে ঢুকেছে। কিন্তু তারপরই মনে পড়ল ওর, হুড়কোটা এত শক্ত ভাবে এটে গিয়েছিল যে একটু আগেই হাতুড়ি এনে খুলতে হয়েছে ওটা। তাছাড়া দরজা খোলা থাকলে তো ছাগলটা আরও আগেই বেরিয়ে যেত। আরেকটু ভাল করে খেয়াল করে দেখল, হরিণটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
ভীতু নয় থিবল্ট, কিন্তু এখন ওর কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ছাউনি থেকে বের হয়ে দরজা আটকে দিল ও। ছাগলটা এই সুযোগে আবার বেরিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে আগুনের পাশে বসে পড়েছে। ওখান থেকে নড়ার বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ নেই ওটার।
ও শয়তানের কাছে আর্জি জানিয়েছিল সত্যি, কিন্তু এভাবে সেটা সত্যি হয়ে যাবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে থিবল্টের। অন্ধকারের শক্তির ছত্রছায়ায় থাকার ব্যাপারটা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে গিয়ে বাণী মনে করতে পারল না। বুকের কাছে ক্রুশ আঁকতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাত উঠল না।
থিবল্টের মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে ওর ফিসফিস করছে অশুভ আত্মারা।
ওর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাল, ঈশ্বর বা শয়তান যে-ই দিয়ে থাকুক, হরিণটাকে কাজে না লাগানো বোকামি হয়ে যাবে। অন্ধকারের জগৎ থেকে পাঠানো হলেও, আমি তো আর খেতে বাধ্য নই। তাছাড়া একা এটা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও না। অন্য কাউকে সাথে নিতে হলেও তো ঠকা হয়ে গেল। তার চেয়ে মঠের নানদের কাছে বিক্রি করে দিলে ভাল দাম পাব। আর অন্ধকারের ছোঁয়া থাকলেও, ওখানকার পবিত্র পরিবেশে তা দূর হয়ে যাবে, আমিও বেঁচে যাব। হরিণটাকে বিক্রি করে যা পাব, সারাদিন খাটনি করে তার এক-চতুর্থাংশও পাই না। মুখ ঘুরিয়ে থাকা ঈশ্বরের চেয়ে সাহায্যকারী শয়তান অনেক ভাল। শয়তান আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু আমিও তো বোকা নই। আমার যা খুশি, তাই করতে পারি।
অনেক যুক্তি বের করে ফেলল থিবল্ট। অথচ মিনিট পাঁচেক আগেও কপাল পর্যন্ত হাত তুলতে পারছিল না। হরিণটা রেখেই দেবে ও। সুযোগমতো বিক্রি করে দেবে। এমনকি এ-ও চিন্তা করল-ওই টাকায় ওর হবু বৌয়ের জন্য বিয়ের কাপড় কিনবে। অ্যানলেটের মতো এক দেবদূত বাড়িতে থাকলে, কোন শয়তানই বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর সাহস পাবে না।
শয়তান যদি বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়, আমি অ্যানলেটের দাদীর কাছে গিয়ে ওকে চাইব। শয়তানের ধোকায় প্রার্থনা ভুলে গেলেও কোন সমস্যা নেই, লক্ষ্মীমন্ত একটা বউ থাকবে, যার সাথে শয়তানের কোন দেনা পাওনা থাকবে না, সে-ই আমার হয়ে প্রার্থনা করবে।
এভাবে নিজেকে আশ্বস্ত করে হরিণটাকে খাবার দিয়ে এল থিবল্ট। ওটার ঘুমানোর জায়গাটা আরামদায়ক আছে কি না তাও দেখল। ভাল দাম পেতে হলে একটু যত্ন-আত্তি তো করতে হবে।
ওদিকে পরদিন সকালে আবার শিকারে বেরোল ব্যারন। তবে এবার কোন দুর্বল হরিণ নয়-আগেরদিন যার পিছু নিয়েছিল ম্যাকোট, সেই নেকড়েটাই ওদের লক্ষ্য।
নেকড়েটা যে আসলেই ঘাগু নেকড়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বহুবছরের অভিজ্ঞতা ওর সম্বল এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। গায়ের রঙ পুরোটাই কালো। অনেক ঘোরাল ওটা শিকারি-দলকে। পিছু ধাওয়া করে আগেরদিনের এলাকায় চলে এল ব্যারন। এগিয়ে চলল জুতো-কারিগরের কুঁড়ের দিকে।
সন্ধ্যায় অ্যানলেটের সাথে দেখা করতে যাবে, তাই সকাল সকাল কাজ শুরু করেছে থিবল্ট। দিনের বেলা হরিণটাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি হবে। বনরক্ষকের সামনে পড়লে কোন সদুত্তর দিতে পারবে না। কোন এক সন্ধ্যায় বেরিয়ে চুপি চুপি কনভেন্টে চলে যাবে।
শিঙার আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই ছাউনির দরজার সামনে একগাদা লতাপাতা এনে স্তূপ করল। যাতে দরজাটা কারও চোখে না পড়ে। তারপর এসে এত গভীর মনোযোগে কাজ শুরু করল, যেন চোখ পর্যন্ত তোলার ফুরসত নেই। ওর।
হঠাৎ দরজায় খামচাননার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়াল ও। কিন্তু যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেল। থিবকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে একটা কালো নেকড়ে এসে ঢুকল ভেতরে! তবে ঘরের মাঝখানে এসে নেকড়েদের মতো করেই বসে পড়ল ওটা। জুলজুল করে তাকাল জুতোর কারিগরের দিকে।
নেকড়েটাকে তাড়ানোর জন্য একটা কুঠার মাথার ওপর তুলে নিল থিবল্ট।
হেসে উঠল নেকড়েটা! কেমন একটা কৌতুকের আভাস খেলে গেল ওটার মুখে। থিবল্ট এর আগে কখনও কোন নেকড়েকে হাসতে শোনেনি। কুকুরের মতো ডাকতে শুনেছে, কিন্তু ওরা মানুষের মতো হাসে তা জানত না। আর সে কী হাসি! কোন মানুষও যদি এভাবে হাসত, তবুও পিলে চমকে যেত থিবল্টের। কুঠার ধরা হাতটা নামিয়ে নিল ও।
তুমি একটা মানুষ বটে! ওর বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ভরাট এবং গম্ভীর গলায় বলে উঠল নেকড়েটা। তোমার অনুরোধ রাখতে রাজার বন থেকে সবচেয়ে চমৎকার হরিণটাকে পাঠালাম। আর তুমি কিনা আমারই মাথা দুভাগ করে দিতে চাইছ! মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ দেখি নেকড়েদের মতোই! একটা পশুর গলা দিয়ে ওর মত কথা বেরোচ্ছে দেখে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল থিবল্টের। হাত থেকে খসে?
নেকড়েটা আবার বলতে লাগল, এসো, অবুঝ না হয়ে বন্ধুর মতো বসে কথা বলি। গতকাল তুমি ব্যারনের হরিণটা চেয়েছিলে। আমি ওটাকে ধরে তোমার ছাউনিতে নিয়ে এলাম। যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তাই দড়ি দিয়ে বেঁধেও রাখলাম। তার বিনিময়ে তুমি আমাকে কুঠার দেখাচ্ছ?
আমি কীভাবে জানব তুমি কে?
আচ্ছা, আমাকে চিনতে পারোনি! ভাল কারণ বের করেছ।
আমার কোন বন্ধুর কি এমন বিদঘুঁটে কোট পরে আসার কথা?
বিদঘুঁটে কোট? তা বটে! রক্তের মতো লাল জিভ বের করে নিজের পশম চেটে দিল নেকড়ে। আচ্ছা লোক বটে তুমি! তোমাকে খুশি করা তত বেশ কঠিন দেখা যাচ্ছে। যা-ই হোক, আমি তোমার কাজটা যে করে দিলাম, তার বিনিময়ে কিছু দিতে রাজি আছ তো?
অবশ্যই, বললেও, অস্বস্তিবোধটা এড়াতে পারল না। তবে আগে জানা দরকার তুমি কী চাও? বলো! কী চাও?
প্রথমেই এক গ্লাস পানি। কুকুরগুলোর ধাওয়া খেয়ে আমার দম শেষ।
এখনই দিচ্ছি।
ঘরের কাছেই একটা পানির উৎস আছে। সেখান থেকে পরিষ্কার পানি এনে দিল থিবল্ট। এবং এত অল্পে পার পেয়ে যাওয়ার স্বস্তিটা ও লুকাতে পারল না।
পানির পাত্রটা রেখে একটু কুর্ণিশ করল ও। নেকড়েটাও তৃপ্তির সাথে পানি খেয়ে মেঝেতে লম্বা হলো।
আচ্ছা, এখন শোনো।
আমার কাছ থেকে আরও কিছু চাও? কেঁপে উঠল থিবল্ট।
হ্যাঁ, খুবই জরুরি জিনিস। কুকুরগুলোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি। ক্রমেই কাছে আসছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এখানে চলে আসবে।
ওদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করো।
উদ্ধার করব, কীভাবে? আঁতকে উঠল থিবল্ট। এর আগে ব্যারনের শিকারে বাগড়া বাধানোয় কী ফল হয়েছিল খুব ভাল মনে আছে ওর।
ভাবো, একটা কিছু বুদ্ধি বের করো আমাকে বাঁচানোর।
কুকরগুলোর হাত থেকে এখন তোমাকে বাঁচানো মানেই তোমার জীবন বাঁচানো। ওরা যদি একবার তোমার নাগাল পায়, তাহলে তোমাকে টুকরো টুকরো করতে বেশি সময় লাগবে না ওদের। থিবল্ট বুঝতে পারছে, ও এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। যদি তোমাকে এখন উদ্ধার করি, বিনিময়ে আমি কী পাব?
বিনিময়ে? কেন, হরিণটা?
তাহলে পানির হিসেবটা?
আমরা বরং নতুন করে আবার আলোচনা শুরু করি। তুমি যদি সমঝোতায় আসতে চাও, আমার আপত্তি নেই। তাড়াতাড়ি বলল, কী চাও আমার কাছে?
তোমাকে এমন বেকায়দায় পেলে অধিকাংশই সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান এসব বাহ্যিক জিনিসই চাইত, কিন্তু আমি তা করব না। গতকাল আমি হরিণটা চেয়েছিলাম, তুমি দিয়েছ। কাল আবার আরেকটা জিনিস চাইতে পারি। আমার এই সমস্যাটা আছে। কখন কী চাই তার ঠিক নেই। সবসময় তো আর তোমার কাছে চাইতে পারব না। শয়তান বা আর যা-ই হও, তোমার কাছে আমার চাওয়া এটাই যে, এখন থেকে আমার সব ইচ্ছা পূরণ হোক।
নেকড়েটার মুখে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি ফুটে উঠল। এ-ই? তোমার কথার শুরু আর শেষের সুরটা মিলল না।
একজন দরিদ্র মানুষ হিসেবে আমার চাওয়াগুলোও খুব সাধারণ আর ঘোট ছোটই হবে। একটুকরো জমি, ঘর, দুবেলা অন্নসংস্থান, এর বেশি আমার মতো মানুষ আর কী চাইতে পারে।
আমি পারলে খুশি মনে তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দিতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব
সেক্ষেত্রে কুকুরগুলো তোমার কী হাল করতে পারে সে ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করো।
তাহলে তোমার ধারণা যেহেতু সাহায্য চেয়েছি, তুমি যা খুশি তাই চাইতে পারো?
ধারণা না, আমি নিশ্চিত।
তাই! তাহলে তাকাও।
কোনদিকে?
আমি যেখানে ছিলাম। আতঙ্কে পিছিয়ে গেল থিবল্ট। নেকড়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কীভাবে, বলার কোন উপায় নেই।
এখনও মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য ছাড়া আমি নিরুপায়?
ওহ! শয়তান, তুমি আছ কোথায় এখন?
নাম ধরে ডেকে প্রশ্ন করলে আমাকে উত্তর দিতেই হবে। ঘোত করে জবাব দিল নেকড়েটা। আগের জায়গাতেই আছি।
কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না তো।
কারণ অদৃশ্য হয়ে আছি।
কিন্তু কুকুর, শিকারি, ব্যারন সবাই এখনই চলে আসবে তোমার খোঁজে।
তা আসবে, তবে আমাকে খুঁজে পাবে না।
তোমাকে না পেলে তখন আমার ওপর চড়াও হবে ওরা।
গতকালের মতোই। গতকাল হরিণটাকে ধরার জন্য ছত্রিশ ঘা চাবুকের শাস্তি দিয়েছিল। আজ দেবে বাহাত্তর ঘা। তার উপর আজ আর চুমুর বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য অ্যানলেটও আসবে না।
তাহলে এখন কী করব?
হরিণটাকে ছেড়ে দাও। কুকুরগুলো ভুল করে হরিণটাকে ধাওয়া করবে। তোমার বদলে ওরা মার খাবে।
এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, নেকড়ের গন্ধ বলে ভুল করে হরিণকে ধাওয়া করবে, এটা কী সম্ভব?
অদৃশ্য কণ্ঠ উত্তর দিল, সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন তাড়াতাড়ি করো, কুকুরগুলোর আগেই যদি ছাউনিতে পৌঁছাতে না পারো, ব্যাপারটা সুখকর হবে না। আমার জন্য নয় অবশ্য, আমাকে তো ওরা খুঁজে পাবে নাকিন্তু যাকে পাবে, তার জন্য।
থিবল্ট আর অপেক্ষা করল না। একছুটে গিয়ে ছাউনির দরজা খুলে দিল। সাথেসাথেই লাফিয়ে বেরিয়ে এল হরিণটা। নেকড়েটার পায়ের ছাপের উপর দিয়ে ছুটে বনে হারিয়ে গেল। ওদিকে ঘরের একশো গজের মধ্যে চলে এসেছে কুকুরগুলো। পুরো দলটাই দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। তারপর ডাক ছেড়ে একযোগে হরিণটা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করল। ভুল গন্ধের পিছনে ছুটছে ওরা। নেকড়েটাকে ছেড়ে হরিণটার পিছু ধাওয়া করেছে।
স্বস্তির একটা শ্বাস ছাড়ল থিবল্ট। তারপর ব্যারনের শিঙার আওয়াজ শুনতে শুনতে ফিরে এল ঘরে। নেকড়েটা সেই আগের জায়গায় শুয়ে আছে। কীভাবে। আবার হাজির হলো কে জানে!
পঞ্চম অধ্যায় – অশুভ চুক্তি
চৌকাঠে জমে গিয়েছিল থিবল্ট। নেকড়েটা এমনভাবে আবার কথা বলতে শুরু করল যেন মাঝখানে কোন বাধা পড়েনি, আমি বলেছি যে তোমার ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। আসলে তোমার নিজের সুবিধা এবং আরামের জন্য ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
তারমানে তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই আশা করতে পারি না?
ঠিক তা নয়, অন্যদের ক্ষতি চাওয়ার ইচ্ছাপূরণে আমি সাহায্য করতে পারি।
তাতে আমার কী লাভ হবে?
আরে বোকা! কে যেন বলেছিল না, অন্যের দুর্ভাগ্যে-সেটা যদি খুব কাছের বন্ধুরও হয়, তাতেও কিছু না কিছু লাভ থাকেই।
কে বলেছিল, কোন নেকড়ে? নেকড়েরাও যে নিজেদের মধ্যে এমন দর্শন চালাচালি করে তা জানা ছিল না।
না, মানুষই বলেছিল।
পরে কি তার ফাঁসি হয়েছিল?
উল্টো, সে পরে গভর্নর হয়েছিল। ওখানে অবশ্য নেকড়ের সংখ্যাও কম ছিল না। কাছের বন্ধুর দুর্ভাগ্যেও যদি সুখ থেকে থাকে, শক্রর দুর্ভাগ্যে কতটা আনন্দ হবে চিন্তা করো।
কথাটা একেবারে ভুল বলোনি।
প্রতিবেশী, সে তোমার বন্ধু হোক বা শত্রু, তার ক্ষতিতে লাভবান হবার সুযোগ তো থাকেই।
উত্তর দেয়ার আগে একটু ভেবে নিল থিবল্ট, খুব একটা ভুল বলোনি তুমি। ঠিক আছে, আমি রাজি। কিন্তু এর বিনিময়ে আবার নিশ্চয়ই কিছু চাইবে। কী চাও?
অবশ্যই। প্রতিবার তোমার কোন এমন একটা ইচ্ছা, যাতে তোমার তাৎক্ষণিক কোন উপকার হচ্ছে না, তাহলে সেটা পূরণ করার বিনিময়ে তোমার শরীরের কিছু একটা আমি নেব।
আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠল থিবল্টের চেহারায়।
ভয় পেও না। আমার চেনা জানা এক বিশেষ ইহুদীর মতো ঋণগ্রহীতার শরীরের মাংস চাইব না।
তাহলে কী চাও?
তোমার প্রথম ইচ্ছাপূরণের জন্য একটা চুল, দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের জন্য দুটো, তৃতীয়টার জন্য চারটা। এভাবে প্রতিবার আগেরবারের দ্বিগুণ হবে।
থিবল্ট হেসে ফেলল, ওহ, এইই। তাহলে আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে মেনে নিলাম। আমি প্রথমদিকেই এমন কিছু চেয়ে নেব যাতে পরে আমাকে আর পরচুলা পরতে না হয়। তাহলে চুক্তি হয়ে যাক! থিবল্ট হাত বাড়িয়ে দিল। নেকড়েটা থাবা উঁচু করেও থেমে গেল।
কী হলো?
ভাবছিলাম, আমার বাবার নখগুলো খুবই ধারালো। তোমার আহত হবার সম্ভাবনা আছে। এরচেয়ে বরং আমরা আরেকটা বিনিময় করি। আমার একটা সোনার আংটি আছে, ওটার সাথে তোমার রূপার আংটি। এতেও অবশ্য তুমিই লাভবান হচ্ছ। থাবা মেলে ধরতেই তাতে নিখুঁত একটা সোনার আংটি দেখতে পেল থিবল্ট। কোনরকম দ্বিধা না করে চুক্তিটা মেনে নিল ও। আংটিবদল করল। দুজন।
তাহলে! এখন আমরা এক হয়ে গেলাম। বলল নেকড়ে।
মানে বলতে চাইছ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। একটু বেশি তাড়াতাড়ি এগোচ্ছ তুমি।
দেখা যাক। এখন তাহলে যে যার কাজে যাই।
বিদায়, মহামান্য নেকড়ে।
আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত, মঁসিয়ে থিবল্ট।
বলার সাথে সাথেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নেকড়েটা। পেছনে রেখে গেল ঝাঁঝালো কটু গন্ধ।
বিস্মিত ভাবে চারপাশে নেকড়েটাকে খুঁজল থিবল্ট। এখনও এমন হুট করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ব্যাপারটার সাথে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি ও।
একবার মনে হলো পুরোটাই স্বপ্ন ছিল কি না। কিন্তু অনামিকার সোনার আংটিটা দেখে বুঝতে পারল ঘটনাটা সত্যি ঘটেছে। আংটিটা খুলে ভাল করে দেখল। আংটিটাতে থ আর শ অক্ষর-দুটো খোদাই করা।
শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর। থিবল্ট আর শয়তান, চুক্তিবদ্ধ দুইজনের নামের আদ্যক্ষর। শয়তানের সাথে চুক্তি করতে গেলে কিছু ছাড় তো দিতেই হবে।
একটা গানের সুর ভঁজার চেষ্টা করল ও। কিন্তু ভয় ওর কণ্ঠ বিকৃত করে দিয়েছে, তাই সে বিরক্ত হয়ে বাদ দিল। নিজের কাজে মন দিল এবার।
শুরু করেও আবার ব্যারনের কুকুর আর শিঙার আওয়াজ শুনে কাজ থামিয়ে দিল থিবল্ট।
ফুলবাবু, যত ইচ্ছা নেকড়ের পিছু ধাওয়া করো। তোমার প্রাসাদে ওর একটা থাবাও নিতে পারবে না। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াও বা আর যা-ই করো, একটা অভিশাপেই তোমার চাবুকের শোধ তুলে নিতে পারব আমি। ভাবতে ভাবতেই থেমে গেল ও।
নেব না-ই বা কেনই? ব্যারন আর ম্যাকোটের ওপর শোধ তো নিতেই পারি। একটা চুলেরই তো ব্যাপার। মাথা ভরা সিংহের কেশরের মতো চুলে আঙুল চালাল থিবল্ট।
একটা গেলেও আরও অনেক চুল থাকবে। তাছাড়া শয়তান আমাকে ধোকা দিল কি না, সেটাও প্রমাণ হয়ে যাবে। ঠিক আছে, ব্যারনের কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটুক, আর অপদার্থ ম্যাকোটেরও, আমার সাথে যেমন করেছিল, তেমন খারাপ কিছুই ঘটুক।
অভিশাপ দেয়ার সময় বেশ উদ্বিগ্ন বোধ করছিল ও। শয়তানের ব্যাপার, কিছুই বলা যায় না। আবার কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করল থিবল্ট। অমনোযোগের ফলে হাত কেটে রক্ত বেরোল ওর। দামী একজোড়া জুতোও নষ্ট হলো। তারপর হঠাৎ দূরে জোরালো চেঁচামেচি শুনে কী ব্যাপার দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এল ও। অদূরে কিছু লোকজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। বেশ ধীরে আসছে তারা। কাছে পৌঁছানোর পর বোঝা গেল ওরা ব্যারনের লোক। কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসছে। অনেকটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো। আরও কাছে আসার পর দেখা গেল ওরা ব্যারন আর ম্যাকোটকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্টের কপালে ঘাম জমল। কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ও।
হরিণটাকে দৌড়ে যেতে দেখে ব্যারন ভেবেছিল হাউন্ডগুলোর ডাক শুনে ভয় পেয়ে লুকোবার চেষ্টা করছে ওটা। পরে কুকুরগুলোর আচরণ দেখে বুঝল, ওরা হরিণটাকেই তাড়া করছে। তখন প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় ব্যারন। শাপশাপান্ত আর মারামারিতেই ক্ষান্ত হয়নি। ঘোড়া নিয়ে কুকুরের পালে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কুকুরদের এই ভুলের জন্য ম্যাকোটকেই দায়ী করে ব্যারন।
ম্যাকোটও কোন প্রতিবাদ করল না। ও নিজেও কুকুরগুলোর ওপর চড়াও হয়। কুকুরগুলোকে ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।
ওদিকে কুকুরগুলো হরিণটাকে তাড়া করে নদীর দিকে এগোচ্ছিল। ম্যাকোট এগিয়ে গিয়ে ওগুলোকে থামানোর চেষ্টা করল। ঘোড়াটাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন স্রোতের বেগ খুবই বেশি ছিল। ম্যাকোটের ঘোড়াটা তাল সামলাতে পারল না। প্রথমে ডুবল ঘোড়াটা, তারপর ম্যাকোট নিজে।
ম্যাকোটকে ডুবে যেতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল লর্ড ভে। নিজের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের প্রতি একটা মায়া আছে তার। যে করেই হোক, ম্যাকোটকে উদ্ধার করো। যে ওকে উদ্ধার করতে পারবে তাকে পঁচিশ, না পঞ্চাশ, না একশো লুই পুরস্কার দেব! বলে নিজেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল ব্যারন। কিন্তু দলের অন্যরা তাকে বাধা দিল। আর তাতে করে যে সময়টা নষ্ট হলো, সেটাই নিশ্চিত করল ম্যাকোটের মৃত্যু! শেষবারের মতো যখন ম্যাকোটের মাথা জেগে উঠল পানির উপর, সে তখনও কুকুরগুলোকে ফিরে যেতে বলছিল। সোয়া এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেল মৃতদেহটা। এদিকে ম্যাকোট মারা গেছে বোঝার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ব্যারন।
থিবল্ট উপলব্ধি করল, কালো নেকড়ে ওর ইচ্ছাটা ঠিক কীভাবে পূরণ করেছে। বিনিময়টা কখন নেবে সেটা অবশ্য বুঝতে পারছে না ও। ইচ্ছাটা পূরণ হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চুলের গোড়ায় কোন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে না। কয়েকটা চুলেই কালো নেকড়ে থেমে যাবে কি না তা-ও বুঝতে পারছে না। ম্যাকোটকে ও দেখতে পারত না বটে। কিন্তু মৃতদেহ দেখে কোনরকম আনন্দও অনুভব করছে না। পছন্দ করার কোন কারণ না থাকলেও, লোকটার মৃত্যু কামনা করেনি ও। আবার এ-ও ঠিক, থিবল্ট পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ভবিষ্যতে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে ওকে।
ব্যারনও মৃতবৎ পড়ে আছে। ম্যাকোটের মৃতদেহ দেখার পর থেকে আর তার জ্ঞান ফেরেনি। ঘাসের স্তূপে এনে ব্যারনকে শোয়াল ওরা। জ্ঞান ফেরানোর মতো কিছু পাওয়া যায় কি না খুঁজতে লাগল সবাই। কেউ ভিনেগারের কথা বলল, কেউ বলল অম্নের কথা। এরমধ্যে এনগুভার গলা শোনা গেল, এসব কিছুই না, একটা ছাগল দরকার। যদি একটা ছাগল পাওয়া যেত।
ছাগল? ব্যারনের জ্ঞান ফিরলে নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত মনে করতে পারত থিবল্ট। আমার একটা ছাগল আছে!
সত্যি! আছে? যাক, মাই লর্ডকে এখন বাঁচানো যাবে। খুশিতে থিবকে। জড়িয়ে ধরল এনগুভা। নিয়ে এসো তোমার ছাগল, বন্ধু!
থিবল্ট ছাউনি থেকে ছাগলটাকে নিয়ে এল।
ওটার শিংগুলো শক্ত করে ধরো, আর সামনের একটা পা ভোলো। আরেক শিকারি একটা ছুরি বের করে ধার দেয়া শুরু করল।
তোমরা কী করবে? প্রস্তুতি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল থিবল্ট।
কেন? তুমি জানো না! ছাগলের হৃদপিণ্ডের কাছে ক্রুশের আকৃতির একটা হাড় আছে। ওটাকে গুড়ো করতে পারলে, তার মতো দাওয়াই আর হয় না।
ছাগলটার শিং আর পা ছেড়ে দিয়ে থিবল্ট জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমার ছাগলটাকে মেরে ফেলতে চাইছ?
ছি, ছি! মঁসিয়ে থিবল্ট, এটা কোন কথা হলো। আমাদের ব্যারনের জীবনের চাইতে এই ছাগলটার জীবনের দাম তোমার কাছে বেশি হলো? খুবই লজ্জার ব্যাপার।
তোমার জন্য বলা খুব সহজ। আমার নিজের বলতে এই ছাগলটাই আছে। ওর উপর আমি নির্ভর করি। আমাকে নিয়মিত দুধ দেয় ও। তাছাড়া একটা মায়াও পড়ে গেছে।
মঁসিয়ে থিবল্ট, এভাবে তোমার চিন্তা করা উচিত হচ্ছে না। ব্যারন যদি শুনতে পেতেন ওনার জীবন নিয়ে এভাবে দর কষাকষি হচ্ছে, উনার হৃদয় ভেঙে যেত।
আরেকজন বাঁকা হাসি হেসে বলল, ওর যদি মনে হয় ছাগলের দাম শুধু ব্যারনই মেটাতে পারবেন, তাহলে ও দুর্গে আসুক। গতকাল যে হিসাবটা বাকি ছিল, ওটা দিয়ে না হয় দাম মেটানো যাবে।
এদের সাথে এখন শক্তিতে পারবে না, তাছাড়া এখন শয়তানকেও ডাকতে চায় না ও। এটা বুঝে গেছে, ওর সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ নেই। এখানে যারা আছে, তাদের কারো আর কোন ক্ষতি চায় না গিবল্ট।
একজন মারা গেছে, আরেকজন মৃতপ্রায়-যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে ওর। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুখ ঘুরিয়ে রাখল ও। অসহায়ভাবে ডাকতে থাকা ছাগলটার গলা কেটে হৃদপিণ্ড উন্মুক্ত করে হাড়টা খুঁজে বের করল ব্যারনের লোকেরা। হাড়টা গুড়ো করে ভিনেগার আর অন্য দুয়েকটা জিনিস দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করা হলো। তারপর ছুরি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে ওটা খাইয়ে দেয়া হলো ব্যারনকে।
জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। নাক ঝেড়ে উঠে বসল ব্যারন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় পানীয় চাইল।
এনভা একটা কাঠের কাপে পানি এনে দিল। কাপটা থিবল্টের পারিবারিক সম্পত্তি। ঠোঁটে লাগানো মাত্র ব্যারন টের পেল কী পানীয় তাকে দেয়া হয়েছে। রাগে কাপটা ছুঁড়ে ফেলল সে। বাড়ি লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ওটা। ওয়াইন চাইল ব্যারন। একজন ঘোড়ায় চড়ে দুর্গে গিয়ে দুটো বোতল নিয়ে এল। আর কোন কাপ না পাওয়ায় বোতল দুটোই পালা করে গলায় ঢালল ব্যারন।
তারপর বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
ষষ্ঠ অধ্যায় – অভিশপ্ত চুল
ব্যারনের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটার পর, তার লোকেরা হাউন্ডগুলোর খোঁজে গেল। ওগুলোকে পাওয়া গেল ঘুমন্ত অবস্থায়। চারপাশে রক্তের দাগ। বোঝ গেল-ওরা হরিণটাকে ধরতে পেরেছিল। হরিণটার শরীরের দুয়েকটা অবশিষ্টাংশও আশেপাশে পাওয়া গেল। কুকুরগুলোকে ছাউনিতে আটকে রাখা হলো। তখনও ব্যারনের ঘুম ভাঙেনি দেখে, লোকগুলো থিবল্টের ঘরে খাওয়ার মতো যা ছিল, জড়ো করল সব। ছাগলটাকেও রান্না করে ডাকল থিবল্টকে। কিন্তু থিবল্ট জানাল ব্যারন আর ম্যাকোটের অবস্থা দেখে ওর খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।
ভেঙে যাওয়া কাপটা তুলল ও। ওটাকে জোড়া লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। গত দুদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওর অবস্থা বেশ নাজুক। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা ওর পক্ষে সম্ভব ভাবতে লাগল। তখন আনলেটের মুখটাই প্রথম ওর মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোট বাচ্চারা স্বপ্নে যে রূপে দেবদূতদের দেখে, অনেকটা সে রূপে। অ্যানলেটের গায়ে সাদা রঙের পোশাক, পিঠে সাদা রঙের বিশাল ডানা, নীল আকাশের বুকে ভেসে যাচ্ছে। ওকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। পিছু নিতে ইশারা করছে ও, বলছে, যারা আমার সাথে আসবে, তারা সুখী হবে। কিন্তু থিবল্ট যে উত্তরটা খুঁজে পেল তা হলো ভিন্ন, হ্যাঁ অ্যানলেট, গতকাল পর্যন্ত তোমাকে অনুসরণ করলে ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আমি রাজার মতো জীবন-মৃত্যুর অধিকারী। মাত্র একদিন বয়সী ভালবাসার পেছনে ছোটার মতো বোকা আমি নই। তোমাকে বিয়ে করার মানে জীবনের অভাব অভিযোগকে দ্বিগুণ-তিনগুণ করা। না অ্যানলেট, তুমি প্রেমিকা হতে পারো; কিন্তু স্ত্রী হবে এমন কেউ-যে অর্থ নিয়ে আসবে। আর আমার তো ক্ষমতা রইলই।
অ্যানলেট ওর বাগদত্তা, কিন্তু এই সম্পর্ক ভাঙলে বরং মেয়েটারই ভাল।
আমার মতো সৎ মানুষের উচিত নিজের আনন্দের চেয়ে অন্যের ভালটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। অ্যানলেট অল্পবয়সী, মিষ্টি একটা মেয়ে। একজন কাঠ জুতো কারিগরের স্ত্রী হওয়ার চেয়ে অনেক ভাল একজন সঙ্গী ওর প্রাপ্য। আগের দিনের আবেগের বশে করা প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই উচিত ওর। তারপরই ক্ৰয়োলের বিধবা মিল মালকিনের কথা ওর মনে পড়ল। তার বয়স ছাব্বিশ থেকে আটাশের মধ্যে হবে-সুন্দরী। আর তার মিলটাও কখনও বন্ধ থাকে না, সুতরাং যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ আছে বলা যায়। ঠিক এমন একজনকেই দরকার থিবল্টের।
আগে যতবারই মাদাম পুলের কথা ভেবেছে, তখন কোন আশা দেখেনি। কিন্তু নেকড়ের কারণে এখন অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা পেয়েছে ও, সুতরাং এখনকার কথা আলাদা। মাদাম পুলেকে পাওয়ার জন্য ওর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে কোন বেগ পেতে হবে না ওকে। যদিও সবাই বলে মহিলা বদমেজাজি আর হৃদয়হীন। কিন্তু ওইসব ছোটখাটো দোষ সামলানো ওর জন্য এখন কোন বিষয়ই না। সকাল হতেই সিদ্ধান্ত নিল ও, ক্ৰয়োল যাবে।
****
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল ব্যারনের। বাতাসে চাবুক হাঁকিয়ে বাকিদের জাগাল সে। ম্যাকোটের মৃতদেহটা পাঠিয়ে দিল প্রাসাদে। অন্তত একটা বুনন শুয়োর শিকার করে তারপর নিজে ফিরবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। আতিথেয়তার জন্য থিবল্টের সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দিল সে।
ব্যারন তার কুকুর আর লোকজন নিয়ে বিদায় নিল। শূন্য ছাউনি, আলমিরা, ভাঙা আসবাব আর ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র দেখে দুঃখ হলো থিবল্টের। অভিজাতদের চলার পর পথের অবস্থা এমনই হয়! তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, ওর বর্তমানের দুঃখকে হালকা করে দিল। খুঁজে পেতে শেষ রুটিটা দিয়ে ছাগলের মাংসের শেষ টুকরোটা গলাধঃকরণ করল ও। তারপর ঝর্ণা থেকে পানি খেয়ে তৈরি হয়ে ক্রয়োলের পথ ধরল। নটার সময় বেরিয়ে পড়ল যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতেই মাদামের সাথে দেখা করতে পারে।
ক্ৰয়োল যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তা ছেড়ে দীর্ঘ পথ বেছে নিল থিবল্ট। এ পথেই অ্যানলেটের সাথে ওর দেখা হয়েছিল। অবচেতন মন ওকে এদিকেই টেনে এনেছে। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ থিবল্ট দেখতে পেল, পেছন ফিরে ছাগলের জন্য ঘাস কাটছে অ্যানলেট। চাইলে মেয়েটার অলক্ষ্যে চলে যেতেই পারত বটে, কিন্তু ওর ভেতরের শয়তানটা ওকে অ্যানলেটের দিকেই টেনে নিয়ে গেল। টের পেয়ে মুখ তুলে থিবকে দেখতে পেল অ্যানলেট। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল ও, হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল।
ও তুমি। কাল রাতে আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, আর তোমার জন্য প্রার্থনা করেছি।
অ্যানলেটের দেবদূতের মতো আকাশে ভেসে যেতে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ল থিবল্টের। আমাকে স্বপ্নে দেখেছ, আমার জন্য প্রার্থনা করেছ, কেন? প্রশ্নে আন্তরিকতার ছোঁয়া কিছুটা কমই ছিল।
মেয়েটা ওর বড় নীল চোখজোড়া তুলল। স্বপ্ন দেখেছি, কারণ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আর প্রার্থনা করেছি কারণ, আমি দেখেছি ব্যারন আর তার শিকারিরা কী দুর্ঘটনায় পড়েছিল। তার ফলে তোমাকে কী ভোগান্তিটা পোহাতে হয়েছে, সেটাও আমি জানি। আমার মনের কথা যদি শুনতাম, তাহলে এক ছুটে চলে যেতাম তোমাকে সাহায্য করতে।
হুম, আসলে মন্দ হত না, আমার সঙ্গ পেতে।
এমন সঙ্গ পাওয়ার চেয়ে ব্যারন আর তার লোকদের সামলানোর কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে বেশি ভাল লাগত। বাহ! তোমার আংটিটা তো সুন্দর। কোথায় পেলে?
নেকড়ের দেয়া আংটিটা চোখে পড়েছে মেয়েটার। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল থিবল্টের। এই আংটিটা?
হ্যাঁ, এই আংটিটা, বিবল্ট উত্তর দিতে চাচ্ছে না বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল অ্যানলেট। নিচু স্বরে বলল, নিশ্চয়ই কোন মেয়ে তোমাকে দিয়েছে?
পাকা মিথ্যেবাদীর মতো জবাব দিল ও, ভুল করছ অ্যানলেট, এটা বিয়ের দিন তোমাকে পরাব বলে কিনেছি।
কেন সত্যিটা আমাকে বলছ না?
সত্যি বলছি, অ্যানলেট।
না, মুখ ভার করে মাথা নাড়ল অ্যানলেট।
তোমার কেন মনে হলো আমি মিথ্যে বলছি?
কারণ আংটির ভেতর আমার অন্তত দুটো আঙুল ঢুকবে। থিবল্টের একটা আঙুল আসলেই অ্যানলেটের দুআঙুলের সমান।
একটু বড় হয়তো, কিন্তু ছোট করা যাবে।
বিদায়, মঁসিয়ে থিবল্ট।
কী! বিদায়?
হ্যাঁ।
তুমি চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ, যাচ্ছি।
আপনার মা
কেন, অ্যানলেট?
আমি কোন মিথ্যেবাদীকে ভালবাসি না।
অ্যানলেটকে আশ্বস্ত করার মতো কোন কথাই ওর মাথায় আসল না।
শোনো, চোখে জল অ্যানলেটের। ওরও চলে যেতে কষ্ট হচ্ছে। যদি সত্যিই তুমি এটা আমার জন্য এনে থাকো…
বিশ্বাস করো এটা তোমার জন্য, অ্যানলেট।
তাহলে এটা আমাকে রাখতে দাও। বিয়ের দিন এটা আশীর্বাদের জন্য ফেরত দেব।
আমি এটা তোমার সুন্দর হাতে দেখতে চাই। কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ, এটা আসলেই তোমার হাতের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি আজই মঁসিয়ে দুর্জোর কাছে যাচ্ছি। তোমার হাতের মাপ নিয়ে আংটিটা ঠিক করব।
অ্যানলেটের চোখের জল শুকিয়ে গেল, ফিরে এল মুখের হাসি। নিজের হাত বাড়িয়ে দিল ও। থিবল্ট মেয়েটার হাতটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল। তারপর চুমু খেল হাতে।
চুমু খাওয়া তোমার ঠিক হয়নি, মঁসিয়ে থিবল্ট, আমার হাত নোংরা হয়ে আছে।
তাহলে চুমু খাওয়ার জন্য অন্য কিছু দাও। অ্যানলেট ওর কপাল এগিয়ে দিল।
বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বাস আর খুশি নিয়ে অ্যানলেট বলল, এখন তাহলে আমাকে আংটিটা দেখতে দাও।
থিবল্ট আংটিটা খুলে মেয়েটার হাতে পরিয়ে দিতে গেল। ও খুবই অবাক হলো যখন আঙুল আঙটিতে ঢুকল না। এমনটা হতে পারে কে জানত?
অ্যানলেট হাসতে হাসতে বলল, মজার ব্যাপার তো!
একের পর এক আঙুলে চেষ্টা করতে থাকল থিবল্ট। আংটিটা যেন ক্রমেই ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে, কোন আঙুলেই পরানো যাচ্ছে না। যেন আংটিটা এই নিষ্পাপ হাতটাকে। ট করতে চায় না। থিবল্ট ঘামতে শুরু করল। ওর হাতের ভেতর অ্যানলেটের হাতও কাঁপতে শুরু করল। কোন আঙুলেই যখন ঢুকল না, তখন মেয়েটা কেঁদে ফেলল। এসবের মানে কী?
হতচ্ছাড়া আংটি, দূর হ পাথরের গায়ে সজোরে ওটা ছুঁড়ে-মারল থিবল্ট। কিন্তু বাড়ি খেতেই একটা স্ফুলিঙ্গ উঠল। ভাঙার বদলে ফিরে এসে থিবল্টের আঙুলে ঢুকে গেল আংটিটা! অ্যানলেট বিস্মিত চোখে ঘটনাটা দেখে থিবল্টের দিকে তাকাল। থিবল্ট স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, কী দেখছ?
নিরুত্তর মেয়েটার চোখে ক্রমেই ভয়ের চিহ্ন বাড়তে লাগল। থিবল্ট বুঝে পাচ্ছে না মেয়েটা কী দেখছে। অবশেষে মেয়েটা ওর মাথার দিকে আঙুল তুলে বলল, মঁসিয়ে থিবল্ট, মঁসিয়ে থিবল্ট, ওখানে কী হয়েছে?
কোথায়?
ওখানে! ওখানে! মেয়েটার চেহারা ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
মাটিতে পা ঠুকে প্রশ্ন করল থিবল্ট, ওখানেটা কোথায়? কী দেখছ তুমি?
মেয়েটা ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। দুহাতে মুখ ঢেকে একটা চিৎকার দিল। তারপর ঘুরে যত জোরে পারে দৌড়াতে শুরু করল।
হতভম্ব হয়ে জায়গায় জমে গেল থিবল্ট, পিছু ধাওয়া করার কথা ওর মাথাতেই এল না।
কী দেখে এত ভয় পেল অ্যানলেট? আঙুল দিয়ে কী দেখাচ্ছিল? প্রথম খুনির মতো ঈশ্বর কী ওকেও চিহ্নিত করে দিয়েছেন? আর করবেন না-ই বা কেন? ও ও তো কেইনের মতো একটা মানুষকেই খুন করেছে। পাদ্রী তো বলেছেন, প্রতিটি মানুষই পরস্পরের ভাই। থিবল্টের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ওর জানতেই হবে কী দেখে অ্যানলেট এত ভয় পেল। শহরে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আসতে পারে। কিন্তু অ্যানলেট যা দেখেছে, আরও মানুষ তা দেখে ফেলবে। কয়েক পা দূরেই একটা স্বচ্ছ পানির ঝরনা আছে। ওখানে গেলেই নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। ঝরনার পাশে গিয়ে হাটু গেড়ে বসল ও সেই একই মুখ, নাক, অন্যরকম কিছু নেই। কিন্তু কিছু তো একটা অবশ্যই আছে। কপালের ওপর উজ্জ্বল কিছু একটা চোখে পড়ল। আরেকটু ঝুঁকে দেখল লাল রঙের চুল। লাল, তবে সাধারণ কোন লাল নয়। রক্তের মতো, আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল! কীভাবে চুলটা ওখানে এল চিন্তা করার আগেই ওটা তুলে ফেলার চেষ্টা করল থিবল্ট। কিন্তু অনেকরকম ভাবে চেষ্টা করেও চুলটা ওঠাতে পারল না। শেষে ক্ষান্ত দিল। বরং ক্ৰয়োলেই যাওয়া যাক। একটা লাল চুলের কারণে বিয়েতে সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু খুঁতখুতানি রয়েই গেল ওর মনে চুলটার চিন্তা মাথা থেকে তাড়াতে পারল না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে বাড়ির পথ ধরল থিবল্ট। ঘরে ফিরে একটা ধারাল যন্ত্র হাতে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করল চুলটা কাটার। কিন্তু কোন লাভ হলো না! পরীক্ষা করে দেখল যন্ত্রের ধার ঠিক আছে, কিন্তু চুলটা কিছুতেই কাটা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে হতাশ হয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিল। বুঝতে পারছে, চুক্তি অনুযায়ী এই চুলটা এখন কালো নেকড়ের।
সপ্তম অধ্যায় – মিলের ছেলেটা
কাটতে ব্যর্থ হয়ে আশপাশের চুল দিয়ে লাল চুলটাকে ঢাকার চেষ্টা করল থিবল্ট। আশা করা যায় সবার দৃষ্টি অ্যানলেটের মতো তীক্ষ্ণ হবে না। চুলটা অন্যরা লক্ষ করবে না। অভিজাতদের দেখেছে চুলের রঙ টাকার জন্য পরচুলা ব্যবহার করতে। কিন্তু আইন ওকে সে অনুমতি দেয়নি। তাই চিরুনি দিয়ে সাবধানে আঁচড়ে চুলটা ঢাকার প্রয়াস পেল। তারপর আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী মিল মালকিনের সাথে দেখা করতে বেরোল। এবার অবশ্য আর ভুল করল না। সংক্ষিপ্ত রাস্তাটাই ধরল, যাতে অ্যানলেটের সাথে দেখা না হয়।
ক্রয়োলে যাওয়ার রাস্তায় উঠে থিবল্ট দেখল, একটা লম্বা ছেলে দুটো গাধা নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে চিনতে পারল, ওর কাজিন ল্যান্ড্রি। মিল মালকিনের ওখানেই কাজ করে। আশা করা যায় ল্যান্ড্রি ওর সাথে মিল মালকিনের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে। ভালই হলো ছেলেটাকে পেয়ে। থিবল্ট এগিয়ে গেল ল্যান্ড্রির দিকে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেল ল্যান্ড্রি। ফিরে তাকিয়ে থিবকে চিনতে পারল। ল্যান্ড্রি বরাবরই আমুদে একজন সঙ্গী। কিন্তু এখন ল্যাড্রিকে মনমরা দেখে বেশ অবাক হলো। ল্যান্ড্রি গাধা দুটোকে এগোতে দিয়ে থিবল্টের জন্য দাঁড়াল।
কী ব্যাপার, ল্যাড্রি, ছয় সপ্তাহ পর, কাজ রেখে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, আর তুমি এমন মুখ ভার করে রেখেছ?
মুখ দেখে মন খারাপ মনে হতে পারে; কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে দেখে খুবই খুশি হয়েছি।
বলছ বটে, কিন্তু মনে তো হচ্ছে না।
মানে?
তোমার গলার স্বরটাও বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। তুমি তো সবসময় হাসিখুশি থাকতে, গান গাইতে। আজ মনে হচ্ছে তুমি শবযাত্রায় অংশ নিয়েছ। পানির অভাবে মিল বন্ধ হয়ে গেছে?
না না, তেমন কিছু হয়নি। বরং উল্টো, পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। ভুট্টার দানার বদলে আমার হৃদয় মিলের চাকার নিচে পড়েছে। এখন শুধু কিছু ঔড়ো অবশিষ্ট আছে।
আচ্ছা! মিলে তাহলে তুমি খুশি নও?
প্রথম যেদিন মিলে পা রেখেছি, সেদিন থেকেই আমি চাকার নিচে চাপা পড়েছি।
ল্যাড্রি, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ। সমস্যাটা কী খুলে বলল তো!
ল্যান্ড্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
দেখো ভাই, টাকা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করার সঙ্গতি হয়তো আমার নেই। কিন্তু দুটো ভাল কথা বলে তোমার দুঃখ ভোলানোর চেষ্টা তো করতে পারি।
অনেক ধন্যবাদ, থিবল্ট। কিন্তু অর্থ বা উপদেশ-কোনটাই আমার কোন কাজে আসবে না।
যা-ই হোক, আমাকে বলো। বললে নিজেকে হালকা লাগবে।
আমি কিছু বলব না। বলে কোন লাভ নেই।
থিবল্ট হাসতে শুরু করল।
তুমি হাসছ? ল্যান্ড্রি কে বিস্মিত এবং রাগান্বিত মনে হলো। আমার বিপদ দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে?
তোমার বিপদ দেখে হাসছি না, ল্যান্ড্রি। হাসছি কারণ তোমার ধারণা তুমি আমার কাছ থেকে সমস্যাটা লুকিয়ে রাখতে পারবে। কী সমস্যা হতে পারে সেটা তো আন্দাজ করাই যায়।
আন্দাজ করো তাহলে।
বাজি ধরতে পারি তুমি প্রেমে পড়েছ।
আমি, প্রেমে! কে তোমাকে এসব বাজে কথা বলেছে?
বাজে নয়, সত্যি কথা।
আগেরবারের চাইতেও দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ল ল্যাড্রি।
বেশ। ঠিকই ধরেছ, আমি প্রেমে পড়েছি!
যাক! অবশেষে স্বীকার করলে! ওর হৃৎস্পন্দন একটু বেড়ে গেল কাজিনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর ছায়া দেখে। তো, কার প্রেমে পড়েছ?
কার?
হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করেছি কার প্রেমে পড়েছ?
তুমি যদি আমার বুক থেকে হৃদপিণ্ডটাও বের করে ফেলো তা-ও আমি বলব না।
এরইমধ্যে বলে দিয়েছ।
কী? বলে দিয়েছি? বিস্মিত চোখে থিবল্টের দিকে তাকাল ল্যান্ড্রি।
অবশ্যই।
তুমি বানিয়ে বলছ!
প্রথম যেদিন মাদাম পুলের মিলে পা রেখেছ, সেদিন থেকেই মিলের চাকায় তুমি আটকা পড়ে গেছ। তারপর তার ডান হাত হয়েছ। মিলে তুমি অসুখী কারণ তুমি প্রেমে পড়েছ। সুতরাং, মিল মালকিনের প্রেমে পড়েছ, তাই তুমি অসুখী।
থিবল্ট, চুপ! যদি ও শুনে ফেলে।
কীভাবে শুনবে? নাকি তোমার ধারণা সে অদৃশ্য হতে পারে, অথবা প্রজাপতি বা ফুলের রূপ ধরতে পারে।
যা-ই হোক, থিবল্ট, চুপ থাকো।
মিল মালকিন তাহলে কঠিন হৃদয়ের মহিলা? তোমার দুর্দশা দেখেও কোন দয়া দেখান না? যদিও সান্ত্বনাসূচক কথা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিল্ট খুশি।
কঠিন হৃদয়! তা বলা যায়। প্রথমদিকে বোকার মতো ভাবতাম আমার ভালবাসাটাকে খারাপ চোখে দেখবে না। সারাদিন কাজ করতাম আর ওকে দেখতাম। ও-ও মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাত। তারপর হাসত। সেই দৃষ্টি আর হাসিতে যে কী সুখ ছিল, থিবল্ট। তাতেই কেন যে সন্তুষ্ট থাকতে পারলাম ্না?
থিবল্ট দার্শনিক উত্তর দিল, কিছুই করার নেই, পুরুষেরা এমনই।
আমার মনের কথা বলার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম আমার অবস্থানের উপরের কারও সাথে কথা বলছি। মাদাম পুলে ভয়ংকর ক্ষেপে গেল। আমাকে ভিক্ষুক বলে গাল দিল। হুমকি দিল পরের সপ্তাহেই আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে।
হুম, কদিন আগের ঘটনা এটা?
প্রায় তিন সপ্তাহ।
সেই পরের সপ্তাহ আসতে এখনও বাকি আছে? প্রশ্নটা করার পর থেকেই একটা অস্বস্তি হতে থাকল থিবল্টের। ল্যান্ড্রির চেয়ে মেয়েদের ও ভাল বোঝে। একমিনিট চুপ থেকে বলল, দেখে যতটা মনে হয়েছিল, ততটা অসুখী তুমি আসলে নও।
ততটা অসুখী নই?
না।
যদি দেখতে কীভাবে দিন কাটাচ্ছি। তাকায় না, হাসে না। আমাকে দেখলেই উল্টো ঘুরে যায়। কাজের কথা বলতে গেলেও এত অবহেলার ভাব দেখায়, আমি সব ভুলে কাঁদতে শুরু করি। তখন আমাকে সামলে নিতে বলে। আমি দৌড়ে পালিয়ে আসি।
তোমার মালকিনের পেছনেই পড়ে থাকতে হবে কেন? আরও তো অনেক মেয়ে আছে, যারা তোমার মতো ছেলে পেলে বর্তে যাবে।
ওকে আমি ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
আমি হলে ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করতাম না। অন্য কাউ নাও।
আমি পারব না।
অন্তত চেষ্টা তো করো। যদি সে দেখে তুমি অন্য কারও প্রতি ঝুঁকেছ, ঈর্ষাবোধ করতে পারে। এখন যেমন তুমি তার পেছনে ছুটছ, তখন হয়তো সে তোমার পেছনে ছুটবে। মেয়েরা খুব অদ্ভুত।
যদি জানতাম তাতে কাজ হবে, তাহলে চেষ্টা অবশ্যই করতাম। কিন্তু এখন…
এখন কী?
যা কিছু ঘটেছে তারপর এসব করে আর কোন লাভ নেই।
কী ঘটেছে? সব তথ্য জানার তাগিদ বোধ করল থিবল্ট।
সে কথা আমার বলার সাহস নেই।
কেন?
ওই যে একটা কথা আছে না, ঘুমন্ত কুকুরকে জাগিও না।
ওরা মিলের কাছে চলে এসেছে, কথা শুরু হলেও শেষ করা যেত না, তাই আর ল্যান্দ্রিকে জোরাজুরি করল না থিবল্ট। ল্যান্ড্রি ভালবাসলেও ওই মহিলা ওকে ভালবাসে না। অল্প বয়সী, সাধারণ চেহারার ল্যান্ড্রি ওর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাত্তাই পাবে না। সামান্যতম রুচিবোধ থাকলেও মহিলা ওকেই পছন্দ করবে। নিজের সাফল্যের ব্যাপারে তাই মোটামুটি নিশ্চয়তা বোধ করতে লাগল ও। সবুজ উপত্যকার একেবারে গোড়ায় মিলটার অবস্থান। ঝরনার স্রোত এখানে একটা পুকুর তৈরি করেছে। তার আশেপাশে রয়েছে বিশাল সব গাছের সারি। মিলের বিশাল চাকা ছোট ছোট শাখা নদী তৈরি করেছে। নুড়ি ছড়ানো পথে মিষ্টি শব্দ তুলে শাখাগুলো ছুটে যাচ্ছে অনবরত।
দূর থেকে তাকালে মিলের চিমনিটাই আগে চোখে পড়ে। কাছে না আসলে এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় না। জায়গাটা থিবল্টের চেনা। তবে এবার অন্য দৃষ্টিতে দেখছে থিবল্ট। মালকিন যে দৃষ্টিতে তার সম্পত্তির দিকে তাকায়, অনেকটা সে দৃষ্টিতে।
খামারে ঢুকতেই চোখে পড়ল কবুতর, হাঁস আর মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানারঙের দুধেল গরু দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে মালপত্র নামছে। ঘোড়াগুলোও দেখতে চমৎকার। একটা ছেলে গুদাম থেকে বস্তা টেনে আনছে। একটা মেয়েকেও দেখা গেল মাল বইতে। একটা শুয়োর ঘুমোচ্ছে। সবমিলে নানান ধরনের পশুপাখির বাস এখানে।
মুগ্ধ এবং তৃপ্ত ভঙ্গিতে দেখছে থিবল্ট। ল্যান্ড্রি যদি নিজের চিন্তায় বুঁদ না হয়ে থাকত, তাহলে বিষয়টা লক্ষ করত। বিধবা ডাইনিং রুমে ছিল। থিবকে দেখে পরিচয় জানতে চাইল।
নিজের পরিচয় দিল থিবল্ট। জানাল, ওর কাজিনের সাথে দেখা করতে এসেছে।
বিধবা হাসিমুখে ওকে অভ্যর্থনা জানাল। সেই সাথে দিনটা খামারে কাটাবার আমন্ত্রণও জানিয়ে দিল! মহিলার হাসিকে শুভলক্ষণ বলেই ধরল থিবল্ট।
বন থেকে কিছু জাম নিয়ে এসেছে ও উপহার হিসেবে। মহিলা সেগুলো সাজিয়ে আনতে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। থিবল্ট লক্ষ করল, বিধবা ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে কিছু একটা দেখছে। পেছনে তাকিয়ে দেখল ল্যান্ড্রি মাল নামাচ্ছে। মহিলা ওকেই দেখছিল। থিবল্ট এটা টের পেয়েছে বুঝে তার গাল লাল হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল মাদাম, আপনার ভাইকে যদি একটু সাহায্য করেন, দেখতেই পারছেন কাজটা ওর একার পক্ষে কঠিন হয়ে গেছে বলে ঘরে ঢুকে গেল সে।
কপাল। প্রথমে মাদাম পলে, পরে ল্যাভিকে দেখে মন্তব্য করল থিবস্ট। ও তো মনে হচ্ছে ওর ধারণার চাইতেও ভাগ্যবান। আবার কি কালো নেকড়েকে ডাকতে হবে?
মালকিনের অনুরোধ অনুযায়ী ভাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল থিবল্ট। মাদাম ভেতর থেকে দেখছে এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত। তাই কাজে সাহায্যের বেলায় নিজের শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে কসুর করল না। কাজ শেষ হলে খাবার ঘরে গিয়ে বসল ওরা। কাজের মেয়েরা টেবিল সাজিয়ে দিল। মাদাম টেবিলের মাথায় বসেছে, আর থিবল্ট বসেছে তার ডানে। থিবল্টের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিল মাদাম পুলে। আশান্বিত হয়ে উঠল ও। তবে ভুল ভাঙতে দেরি হলো না! ওর রসিকতায় হাসতে হাসতেই ল্যাড্রির দিকে চোরা চোখে তাকাতে লাগল মাদাম পুলে। এদিকে ও বেচারা মাদামের বেড়ে দেয়া কোন খাবারই স্পর্শ করেনি। ছেলেটার দুগাল বেয়ে পানি পড়ছে। ছেলেটার দুঃখ মহিলার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। মাদাম নরম দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে ল্যাভ্রিকে খেতে অনুরোধ করল।
.
এই ছোট্ট ইঙ্গিতের ভেতর না বলা অনেক প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে ছিল। সাথে সাথে মালকিনের অনুরোধে খেতে শুরু করল ল্যান্ড্রি।
এসবের কছুই থিবল্টের নজর এড়াল না।
এখন যেহেতু শয়তান ওর পাশে আছে, সিনর জঁ-এর মতো করে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল থিবল্ট, মহিলা এই বাচ্চা ছেলেটাকে ভালবাসে, এ-ও কি সম্ভব? স্বীকার করতেই হবে মহিলার রুচি খুব একটা উন্নত নয়। আমারও তাতে কোন উপকার হচ্ছে না। না, না সুন্দরী, তোমার দরকার আমার মতো একজন পুরুষ, যে এই মিলের দেখাশোনা করতে পারবে।
থিবল্ট লক্ষ করল, বিধবা ল্যান্ড্রির প্রতি তার প্রথম দিককার দৃষ্টি আর হাসিতে ফিরে গেছে। ব্যবস্থা একটা তাহলে নিতেই হচ্ছে। আমার জন্য এরচেয়ে ভাল জুড়ি আশেপাশে আর কোথাও নেই। কিন্তু ল্যান্ড্রির কী করব? ওর ভালবাসা তো আমার পরিকল্পনা কেঁচে দিচ্ছে। আমি কখনও-ই চাই না ল্যান্ড্রির পরিণতি ম্যাকোটের মতো হোক। এটা নিয়ে আমি ভাবছি কেন? এটা তো কালো নেকড়ের মাথাব্যথা। তারপর নিচু স্বরে বলল, কালো নেকড়ে, এমন ব্যবস্থা করো যাতে ল্যান্ড্রির কোন দুর্ঘটনা না ঘটে, কিন্তু আমার পরিকল্পনায়ও ও কোন বাগড়া বাধাতে না পারে। প্রার্থনা শেষ হয়েছে কি হয়নি, মিলিটারি উর্দি পরা জনা চার-পাঁচজন লোককে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মিলের দিকে আসতে দেখা গেল। ল্যান্ড্রি ওদের দেখে চিৎকার দিয়ে পালাতে গিয়েও আবার বসে পড়ল।
অষ্টম অধ্যায় – থিবটের ইছা
সৈনিকদের আসতে দেখল সবাই। ল্যাস্ট্রির প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় পেয়ে গেল বিধবা।
ঈশ্বর। কী হয়েছে ল্যাড্রি?
থিবল্টও জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, ল্যান্ড্রি, কী ব্যাপার?
গত বৃহস্পতিবার দো-ফা ইনে রিক্রুটিং-সার্জেন্টের সাথে দেখা হয়েছিল। তখন মুহূর্তের হতাশাবোধের কারণে আমি আমার নাম তালিকাভুক্ত করেছিলাম।
মুহূর্তের হতাশাবোধ! কেন জানতে পারি? প্রশ্ন করল মাদাম।
সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেলল ল্যান্ড্রি, হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। কারণ আমি আপনাকে ভালবাসি!
বোকা ছেলে! আমাকে ভালবাসো, তাই তুমি সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছ?
আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে মিল থেকে তাড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু তাড়িয়ে কি দিয়েছি? মাদাম পুলের মুখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তাতে ভুল বুঝবার কোন অবকাশ নেই।
ঈশ্বর! আপনি আমাকে সত্যিই তাড়িয়ে দিতেন না?
বোকা ছেলে! মিল মালকিনের হাসি আর অভিব্যক্তি দেখে অন্য সময় হলে খুশিতে পাগল হয়ে যেত ল্যান্ড্রি, কিন্তু এখন ওর দুঃখ আরও বেড়ে গেল। চেষ্টা করলে হয়তো এখনও লুকাতে পারব আমি।
লুকাবে! থিবল্ট বলল, মনে হয় না তাতে কোন লাভ হবে।
কেন হবে না? বলল মাদাম।চেষ্টা করে দেখা যাক। এসো ল্যান্ড্রি।
থিবল্টের চোখ ওদের অনুসরণ করল, ঘটনা তোমার অনুকূলে যাচ্ছে না, বন্ধু! নিজেকেই শোনাল ও, তবে আশার কথা, সৈন্যরা বোকা নয় মোটেও, যেখানেই লুকাক, ঠিক খুঁজে বের করবে। এই কথা বলে নিজের অজান্তেই আরেকটা ইচ্ছা প্রকাশ করে ফেলল থিবল্ট।
কাছেই কোথাও ল্যাভ্রিকে লুকিয়ে ফিরে এল মহিলা। আর তখনই এসে ঢুকল রিক্রুটিং সার্জেন্ট আর তার লোকেরা। দুজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল যাতে ল্যান্ড্রি পালাতে না পারে। ঘরের চারপাশে নজর বুলাল সার্জেন্ট। মাদাম হাসিমুখে সার্জেন্টকে কিছু খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। খাবার ফাঁকে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল। সার্জেন্ট জবাব দিল, তারা একটা ছেলেকে খুঁজতে এসেছে। ছেলেটা নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেছে কিন্তু তারপর আর হাজিরা দেয়নি-জানা গেছে ওর নাম ল্যান্ডি। ক্ৰয়োলের মিল মালকিন বিধবা মাদাম পুলের কাছে থাকে ও। সে কারণেই সার্জেন্টকে এখানে আসতে হয়েছে।
মহিলা জবাব দিল ল্যান্ড্রির ব্যাপারে সে কিছু জানে না। এই নামের কেউ কখনও মিলে কাজও করেনি।
সার্জেন্ট মাদামের চোখ এবং মুখের প্রশংসা করল। তারপর বলল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই চোখের দৃষ্টি এবং মুখের কথা তার বিশ্বাস করতে হবে। মিলটা খুঁজে দেখতে সে বাধ্য।
মিনিট পাঁচেক পরে সার্জেন্ট এসে মাদামের কাছে তার রুমের চাবি চাইল। বিধবা বিস্মিত হলেও শেষ পর্যন্ত চাবি দিতে বাধ্য হলো। তারও এক-দুমিনিট পর সার্জেন্ট ল্যাভ্রিকে টেনে নিয়ে আসল। এই দৃশ্য দেখে মহিলার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। থিবল্টের হৃদপিণ্ড এত জোরে চলছে যে ভয় হলো ওটা ফেটে না যায়। কালো নেকড়ে পেছনে না থাকলে, বিবল্ট নিশ্চিত সার্জেন্ট ল্যাড্রিকে ওখানে খুঁজতে যেত না।
ব্যঙ্গের সুরে সার্জেন্ট বলল, তো রাজার বদলে সুন্দরীর সেবা করতে চাইছ? বুঝতে পারছি। কিন্তু এটাও তো ঠিক, যে রাজার রাজ্যে জন্ম নিয়েছ। তার স্বাস্থ্য পান করেছ। সময় এলে তার সেবাও করতে হবে। কয়েকবছর রাজার সেবা করে তারপর না হয় আবার এখানে ফিরে এসো। চলল।
বিধবা প্রতিবাদ করল, কিন্তু ওর বয়স এখনও বিশ হয়নি। তোমরা ওকে নিতে পারো না।
উনি ঠিকই বলেছেন, আমার এখনও বিশ হয়নি। কবে হবে?
আগামীকালের আগে নয়।
বেশ, আজ রাতটা তাহলে খড়ের বিছানায় কাটাও, সকালেই তুমি প্রস্তুত হয়ে যাবে।
কাঁদতে শুরু করল ল্যান্ড্রি। বিধবা অনেক অনুনয় বিনয় করল। সৈনিকদের চুমু খাবার অনুমতি দিল। টাকাও সাধল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ল্যাড্রিকে হাত বেঁধে নিয়ে গেল সৈনিকরা। যাওয়ার আগে ল্যান্ড্রি জানিয়ে গেল, কাছে থাকুক বা দূরে, সবসময় ও মাদামকে ভালবাসবে। মৃত্যুর সময়ও মুখে তার নাম নিয়েই মরবে। এই বিপর্যয়ের মুখে, দুনিয়া কী ভাববে তার পরোয়া করল না সুন্দরী বিধবা। ল্যাড্রিকে নিয়ে যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরল। ওরা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার পর বিধবাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হলো। উপরে উপরে অনেক আন্তরিকতা দেখাল থিবল্ট। ল্যান্ড্রির প্রতি মহিলার আবেগের প্রকাশ দেখে ও একটু দমে গিয়েছিল। তবে এখন আবার আশা ফিরে পাচ্ছে। মূলসহ আগাছাটা তো উপড়ে ফেলা গেছে। ল্যান্ড্রির নাম নিয়ে কাঁদতে শুরু করল বিধবা। বেচারা! ওর মতো দুর্বল আর নরম ছেলের কী হবে এখন? বন্দুক আর বোঝার ভারেই তো মারা যাবে ও। তারপর অতিথির দিকে ফিরে বলল, এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা বিপর্যয়, মঁসিয়ে থিবল্ট। বুঝতেই পারছেন, আমি ওকে ভালবাসি। ভদ্র, দয়ালু একটা ছেলে। জুয়া, মদ বা কোনরকম বদ-অভ্যাস ছিল না। ও কখনও আমার ইচ্ছার বিরোধিতা করত না। দেখে বোঝা যায় ওর স্ত্রী কখনও আতংকে থাকবে না। দুটো কঠিন বছর মঁসিয়ে পুলের সাথে কাটানোর পর, ও ছিল আমার জন্য সুবাতাস। মঁসিয়ে থিবল্ট, আমার মতো দুঃখী মহিলার জন্য ভবিষ্যৎ সুখ আর শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট হতে দেখাটা যে কতটা কষ্টের!
থিবল্ট ভাবল এটাই নিজের কথা বলার আদর্শ সময়। ও যখনই কোন মহিলাকে কাঁদতে দেখে, ওর মনে হয় মহিলা সান্ত্বনার বাণী শুনতে চায়। অধিকাংশ সময়ই যে এটা ভুল, সেটা অবশ্য ও বুঝতে পারেনি।
আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। আমিও আপনার সাথে সমব্যথী। ও তো আমারও ভাই। ল্যারি প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আপনার উচিত ওর মতো অন্য কাউকে খুঁজে নেয়া।
ওর মতো! এমন ভাল আর সুন্দর ছেলে আমি আর কোথায় পাব? ওর তরুণ মুখটা দেখতে পাওয়াই আমার সুখের জন্য যথেষ্ট ছিল। দিনরাত কাজ করতে পারত ও। কিন্তু আমি ওর দিকে তাকালেই কুঁকড়ে যেত। ওর স্মৃতিই আমাকে আর কারও দিকে তাকাতে দেবে না। বাকি জীবন আমাকে বিধবা হিসেবেই কাটাতে হবে।
যাহ্! কিন্তু ল্যান্ড্রির বয়স তো খুবই কম ছিল।
সেটা কোন দোষ নয়।
ও যে সবসময় এমনই থাকত সেটা কেউ বলতে পারে না। আমার কথা শুনুন, মাদাম, এমন কাউকে খুঁজে বের করুন যে আপনাকে ওর কথা ভুলিয়ে দেবে। বাচ্চা বাচ্চা মুখ নয়, আপনার দরকার একজন শক্তসমর্থ পুরুষ। ল্যান্ড্রির যে গুণগুলো আছে বা নেই, সব তার ভেতর থাকবে। সে হবে সুবিবেচক, যাতে হঠাৎ করে আবিষ্কার করতে না হয় যে, আপনি ভুল করে একজন খারাপ লোককে বিয়ে করে বসেছেন।
মিল মালকিন মাথা নাড়তে লাগল। ওদিকে থিবল্ট বলে চলেছে, সংক্ষেপে, আপনার এমন কাউকে খুঁজে নেয়া উচিত যাকে আপনি সম্মান করতে পারবেন। যে মিলটাকে এখনকার চেয়েও লাভজনক ভাবে চালাতে পারবে, আপনার দেখাশোনা করতে পারবে।
এমন একটা লোক আমি কোথায় পাব? মহিলা উঠে দাঁড়াল। যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল থিবল্টের দিকে। মহিলার কথার সুরটা ধরতে না পেরে থিবল্ট ভাবল, এটাই হচ্ছে ওর ইচ্ছার কথা জানানোর সুযোগ।
এখন আমাকে বলতেই হচ্ছে। আপনার মতো সুন্দরীকে স্বামী খুঁজতে বেশিদূর যেতে হবে না। আমি যখন আপনার জন্য যোগ্য লোকের বর্ণনা দিচ্ছিলাম, তখন আসলে আমার কথাই বলছিলাম। আপনার স্বামী হতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবব আমি।
মহিলা চোখে বিবমিষা নিয়ে থাকল থিবল্টের দিকে। কিন্তু ওর সে খেয়াল নেই, বলে চলেছে, আমি কখনও আপনার ইচ্ছার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। আমার একটাই নীতি এবং ইচ্ছা আছে। নীতি আপনার কথা অনুসারে চলা, আর ইচ্ছা আপনাকে সুখী করা। আপনার সম্পদ বাড়ানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে, সে ব্যাপারে আপনাকে পরে বলব… আর…
বক্তব্যটা শেষ করতে পারল না থিবল্ট।
কী! এতক্ষণ চেপে রাখায় রাগটা অনেক বেশি তীব্রভাবে প্রকাশ পেল মাদাম পুলের কণ্ঠে। তুই! যাকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম, আমার হৃদয় দখল করতে চাইছিস! তোর ভাইয়ের চিন্তা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিস! বেরিয়ে যা, বদমাশ! বেরিয়ে যা এখান থেকে! না গেলে লোক দিয়ে তোকে মিলের চাকার নিচে ফেলব!
হিবল্ট কোন জবাব দেয়ার সুযোগ পেল না। হতভম্ব হয়ে গেছে। নিজের পক্ষে বলার মতো কিছু মাথায়ই আসল না ওর। ওদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মিলের কর্মচারীরা এসে হাজির। দেখল তাদের মালকিন হাতের কাছে যা পাচ্ছে-জগ, চেয়ার, ইত্যাদি, তা-ই ছুঁড়ে-মারছে থিবল্টের দিকে। আর থিবল্ট কোনমতে সেগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। মালকিন চেঁচাচ্ছে, মেরে ফেলল ওকে! বদমাশ! শয়তান!
বিধবার দল ভারি হতে দেখে ভোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ও। ঠিক এমন সময় ঘুমিয়ে থাকা বড়-সড় শুয়োরটা জেগে উঠল। চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে দৌড় দিল ওটা। এসে পড়ল থিবল্টের পায়ের ওপর। ডিগবাজি খেয়ে কাদায় গড়িয়ে পড়ল থিবল্ট। রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, নরকে যা হারামজাদা!
.
বলতে যা দেরি, শুয়োরটা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সব ভেঙে-চুরে দৌড় শুরু করল। কর্মচারীরা ওটাকে ধরার জন্য পেছন পেছন ছুটল। কিন্তু সবাইকে ফেলে দিয়ে শুয়োরটা দৌড়ে গেল। তারপর মিলের চাকার নিচে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে গেল ওটা। মিল মালকিন পুরো দৃশ্যটা অবিশ্বাস নিয়ে দেখল। থিবল্টের অভিশাপ দেয়া এবং তারপরের সব ঘটনা। চেঁচিয়ে বলল সে, থিবল্টকে ধরো! পালাতে দিও না! ও একটা জাদুকর। একটা নেকড়ে-মানব! এই বন-জঙ্গলে এটা একটা ভয়ঙ্কর অভিযোগ। মিলের লোকেরা মালকিনের কথা শুনে থমকে গিয়েছিল। যতক্ষণে ওরা হাতে লাঠিসোটা তুলেছে, ততক্ষণে থিবল্ট খামার থেকে বেরিয়ে গেছে। পাহাড়টা সরাসরি পার হয়ে গেল ও। এত দ্রুত পার হলো যে মিল মালকিনের অভিযোগটাই যেন তাতে সত্য প্রমাণিত হলো।
কী হলো! থেমে গেলে কেন? ওর পিছু নাও, ধরো ওকে! তাগাদা দিল মাদাম পুলে।
কর্মচারীরা কিন্তু নড়তে নারাজ, কী লাভ মাদাম। নেকড়ে-মানবের বিরুদ্ধে আমরা কী-ই বা করতে পারি?
নবম অধ্যায় – নেকড়ে-অধিনায়ক
পালিয়ে সোজা বনের দিকে গেল থিবল্ট। ওখানে কেউ পিছু নিতে আসবে না। আসলেও কালো নেকড়ের কল্যাণে ও যে ক্ষমতা পেয়েছে, তাতে শক্রর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কোন ব্যাপারই না। সমস্যা হচ্ছে, একটা শুয়োরকে যেভাবে শয়তানের ভোগ পাঠানো যায়, মানুষকে সেভাবে পাঠানোটা ঠিক হবে না। ম্যাকোটের মৃত্যুটা এখনও ওর হৃদয়কে ভারি করে রেখেছে। মাঝেমাঝেই পেছন ফিরে দেখছে ও-কেউ পিছু নিয়েছে কি না। শরতের অন্ধকার রাত। বাতাসের ধাক্কায় শুকনো পাতা খসে পড়ছে গাছ থেকে। হাওয়া এ গাছে ও গাছে ধাক্কা খেয়ে বিষণ্ণ সুর তুলছে।
থেকে থেকে পাচার ডাক শুনে মনে হচ্ছে পথ হারানো মানুষের আওয়াজ। এগুলো ওর খুবই পরিচিত শব্দ। এসবে কান না দিয়ে বনে ঢুকেই ডাল কেটে চার ফুট লম্বা একটা লাঠি বানিয়ে নিল ও। এখন শত্রুর মোকাবেলা করতে তৈরি থিবল্ট। মেয়েদের শাপশাপান্ত করতে লাগল ও। কোন যুক্তি ছাড়াই জলজ্যান্ত একটা পুরুষ মানুষকে ছেড়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে পছন্দ করা-কোন মানে হয় না! হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ পেল ও। ঘুরে দেখল অন্ধকারে একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখল একটা নেকড়ে ওর পিছু নিয়েছে। কিন্তু এটা সেই কালো নেকড়েটা নয়। এর রঙ লালচে বাদামি। আকারেও মিল নেই। সব নেকড়েই তো আর প্রথম নেকড়ের মতো ওর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে না। হাতের লাঠিটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে নিল বিল্ট, যাতে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, নেকড়েটার মধ্যে আক্রমণের কোন লক্ষণ নেই। ওর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ছে ওটা, ও এগোলে এগোচ্ছে। মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ছে দল ভারি করার জন্য। এই ডাকগুলো থিবল্টকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। একটু পর সামনেও একজোড়া উজ্জ্বল বিন্দু চোখে পড়ল। লাঠি উঁচিয়ে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেল থিবল্ট। নিচে একটা নেকড়ে শুয়ে ছিল। কোন চিন্তা ভাবনা না করেই নেকড়েটার মাথায় একটা বাড়ি মেরে বসল ও। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে গেল জটা। তারপর মনিবের হাতে মার খাওয়া কুকুরের মতো কান নাড়তে নাড়তে ওর আগে আগে হাঁটা শুরু করল। থিবস্ট ঘুরে দেখতে পেল যে প্রথম নেকড়েটা এখনও ওর পেছন পেছন আসছে। ডানে বামে আরও দুটো নেকড়ে এসে হাজির হলো-আরও আসছে। মাইলখানেক যাওয়ার আগেই সংখ্যাটা এক ডজনে পৌঁছে গেল। থিবল্ট টের পাচ্ছে, পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে পড়ছে। গান গাওয়ার চেষ্টা করল ও; আশা, মানুষের গলার আওয়াজ শুনে হয়ত নেকড়েগুলো ভয় পেতে পারে। কিন্তু কাজ হলো না। সবগুলো নেকড়ে কম্পাসের কাটার মতো ওর সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। মোটা ডাল দেখে কোন গাছে উঠে দিনের আলোর অপেক্ষা করার চিন্তা মাথায় এলেও পরে ওটা বাতিল করে দিল থিবল্ট। সিদ্ধান্ত নিল বাড়ির দিকেই এগোবে। এখন পর্যন্ত নেকড়েগুলোর হাবভাব শত্রুভাবাপন্ন নয়। যদি বেগতিক দেখে, তখন গাছে উঠে গেলেই হবে। ও এতটাই অন্যমনস্ক ছিল, কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি। প্রথমটা চিনতেই পারেনি নিজের বাড়ি। ওকে বিস্মিত করে দিয়ে সামনের নেকড়েগুলো সম্মানের সাথে দুভাগ হয়ে দুলাইনে বসে পড়ল। যেন রাস্তা করে দিল ওর জন্য। তবে সেজন্য আর নেকড়েগুলোকে ধন্যবাদ জানাতে গেল না থিবল্ট। বরং সোজা ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। শুধু খিল লাগিয়েই ক্ষান্ত দিল না, একটা ভারি আসবাবও এনে রাখল দরজার সামনে। রাতে যদি আক্রমণ আসে, কিছুক্ষণ অন্তত ঠেকাতে পারবে। অবশেষে চেয়ারে বসে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল ও।
একটু দম নেয়ার পর উঠে গিয়ে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে সামনের বনের দিকে তাকাল থিবল্ট।
চলে যাওয়ার বদলে নেকড়েরা সব ওর বাড়ির সামনে বসে আছে।
অন্য কেউ হলে পশুগুলোকে দেখে ভয় পেত। কিন্তু থিবল্ট একটু আগেই ওগুলোর পাহারায় বাড়ি ফিরেছে। এখন ওগুলোর আর ওর মাঝে, যতই পাতলা হোক, একটা দেয়াল অন্তত আছে।
টেবিলে একটা লোহার বাতি রাখল থিবল্ট, তারপর আগুন জ্বালাল। কিন্তু এই নেকড়েগুলো অন্য জাতের। আগুন দেখেও নিজেদের জায়গা ছেড়ে নড়ল না ওরা। অস্বস্তি নিয়ে থিবল্টের আর ঘুমানো হলো না। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। আকাশের তারাগুলো নিভতে শুরু করল। নেকড়েগুলো তখনও কীসের যেন অপেক্ষায় শুয়ে-বসে আছে। শেষ তারাটা নিভে যাওয়ার পর প্রথম সূর্যকিরণ এসে পড়ল। তখন সবগুলো নেকড়ে একসাথে উঠে দাঁড়াল। করুণ সুরে একসাথে ডাক ছেড়ে একেকটা একেক দিকে চলে গেল। এতক্ষণে বসে একটু চিন্তা করার সুযোগ পেল থিবল্ট। আচ্ছা, মিল মালকিন কেন ল্যান্ড্রির বদলে ওকে পছন্দ করল না? ও কি আর সুদর্শন থিবল্ট নেই? নাকি ওর চেহারায় কোন পরিবর্তন এসেছে? পরীক্ষা করে দেখার জন্য আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথম দর্শনেই মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল ওর। এখনও সেই সুদর্শন থিবল্টই আছে বটে, কিন্তু গতদিনের হুট করে বেরিয়ে যাওয়া ইচ্ছাগুলোর কল্যাণে মাথার একটা লাল চুল বেড়ে এক গোছ লাল চুলে পরিণত হয়েছে।
চুলগুলো কাটার বা তোলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, জানে থিবল্ট। সাবধান থাকতে হবে যাতে আর কোন ইচ্ছে এভাবে বেরিয়ে না যায়। সবচেয়ে ভাল হয়, মন থেকে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঝেড়ে ফেলে নিজের আদি জীবিকায় ফিরে গেলে। নিজের কাজে লেগে যাবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু কিছুতেই মন বসল না। আগে সুন্দর দিনগুলোতে মনের আনন্দে গান গাইত। কিন্তু কোন গানই মনে করতে পারল না। নিজের অভাবের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাওয়াটা কি ভাল, যখন চাইলেই ইচ্ছাপূরণ করে সুখী হওয়ার সুযোগ আছে? আগে রান্নার সখ ছিল ওর, কিন্তু এখন সেটাও ভাল লাগছে না। অবশেষে ক্ষুধার তাড়নায় কালো রুটি খেতে বাধ্য হলো থিবল্ট। মানুষের ওপর ওর রাগ আরও বেড়ে গেল। দিনটা এত লম্বা যেন কাটতেই চাইছে না। দরজার বাইরে নিজের বানানো বেঞ্চিটায় গিয়ে বসল ও। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, এমনি সময় একটা দুটো করে নেকড়ে এসে হাজির হতে শুরু করল। নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে পড়ল ওগুলো। কয়েকটা নেকড়ে চলে আসতেই আবার ঘরে গিয়ে দরজা দিল থিবল্ট। বেশ ক্লান্ত লাগছে, রাত জাগার শক্তি নেই। তাই সারারাতের জন্য আগুন জ্বেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ও। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ঘুম যখন ভাঙল তখন দিন হয়ে গেছে। সূর্য উঠে গেছে অনেক আগেই।
জানালার কাছে গিয়ে দেখল নেকড়েগুলো মাটিতে ওদের রাত্রিযাপনের চিহ্ন রেখে গেছে।
পরের সন্ধ্যায় আবার নেকড়েরা এসে হাজির। ইতিমধ্যে ওদের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে থিবল্ট। সম্ভবত কালো নেকড়ের সাথে ওর সম্পর্কের কারণেই ওগুলো ওর প্রতি সহমর্মিতা বোধ করছে। ওর প্রতি জম্ভগুলোর এই মনোভাব কতদূর গভীর জানার সিদ্ধান্ত নিল থিবল্ট। দা-বর্শা সঙ্গে নিয়ে, আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। নেকড়েগুলো তেড়ে না এসে বরং প্রভুভক্ত কুকুরের মতো লেজ নাড়তে লাগল। তখন কাছে গিয়ে দুয়েকটার পিঠ চুলকে দিল ও। এতে আরও খুশি হয়ে উঠল ওগুলো।
বাহ! একটু সুবিধা পেলেই কল্পনার ঘোড়ার লাগাম ছুটিয়ে দেয় থিবল্ট। এমন বাধ্য এবং দ্ৰ শিকারি দল কোন লর্ড ব্যারনেরও নেই। চাইলেই এখন আমি হরিণ শাবক দিয়ে রাতের খাবার সারতে পারি।
বলতে যা দেরি, দল থেকে চারটা বড়সড় নেকড়ে ছিটকে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর নেকড়ের ডাকাডাকি শোনা গেল। আধঘণ্টা পর একটা হরিণ শাবক নিয়ে ফিরে এল নেকড়েগুলো। শিকারটাকে থিবল্টের পায়ের কাছে ফেলল। খুশি হয়ে নিজের জন্য মাংস রেখে বাকিটুকু ভাগ করে দিল থিবল্ট। ওদের কাছে নিজের অবস্থান মেনে নিল। সম্রাটের মতো ওদের ইশারা করল চলে যেতে। পরের দিন যাতে আবার ফিরে আসে।
পরের দিন সরাইখানায় বেঁচে যাওয়া মাংসটুকু বিক্রি করে দিয়ে এল ও। তারপরের দিন বুনো শুয়োরের মাংস। অল্পদিনেই সরাইখানার সবচেয়ে বড় জোগানদারে পরিণত হলো থিবল্ট। জুতো তৈরির কাজ ছেড়ে ভাটিখানায় ঘুরে বেড়াতে লাগল ও। কেউ কেউ ওর লাল চুল নিয়ে ঠাট্টা করার চেষ্টা করত। কিন্তু ও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিত-এই ব্যাপারে কোন রকম মশকরা ও বরদাশত করবে না।
এমন সময় ডিউক আর তার স্ত্রী লর্ড ব্যারনের বাড়িতে বেড়াতে এল। আশপাশের এলাকা থেকে অনেক অভিজাত লর্ড এবং লেডিরাও যোগ দিল। থিবল্টের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পালেও হাওয়া লাগল। ব্যারনের শিকারের শিঙা আরও জোরে বাজতে শুরু করল। বিশাল দল নিয়ে সে প্রতি রাতে শিকারে বেরোত।
প্রায় রাতেই ভোজ আর নাচ-গান হত। কখনও কখনও দলবেঁধে ঘুরতে বেরোত সবাই। সাধারণ মানুষেরা তাকিয়ে দেখত এইসব জৌলুস। থিবল্ট আফসোস করত, কেন ও লর্ড হয়ে জন্ম নেয়নি। কেন সঙ্গী হিসেবে কোন লেডিকে ও পাবে না। অ্যানলেট তো হতদরিদ্র আর মাদাম পুলে একটা জরাজীর্ণ মিলের মালিক।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিল। থিবল্ট এরই মধ্যে অনেকটাই শয়তানের কজায় চলে গেছে। অল্প যা একটু ভাল অবশিষ্ট ছিল, তা-ও ফিকে হতে বসেছে। সরাইখানা থেকে কত আর পায়। ওর মন যা চায়, একবছর ধরে টাকা জমালেও তা হবে না। বিবল্ট, শুরু করেছিল ব্যারনের হরিণ দিয়ে; তারপর অ্যানলেটকে চেয়েছিল। এরপর মাদাম পুলের মিলের আশা করেছিল। এখন কোন প্রাসাদ দুর্গ পেলেও কি ওর মন ভরবে? সুন্দর পা, নিখুঁত গোড়ালি, অভূতপূর্ব সৌরভ, দামী পোশাক, এসব বিলাসিতাও তো চাই ওর।
অবশেষে একদিন ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল। হাতে এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গরীব থাকাটা অন্যায়। ওর সব চুল যদি লাল হয়েও যায়, তবু পরোয়া করে না! ক্ষমতা ব্যবহার করে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওকে পূরণ করতেই হবে।