প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড - প্রথম ভাগ
দ্বিতীয় খণ্ড - দ্বিতীয় ভাগ

১. নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক গঠন থেকে মানুষরূপে ক্রমবিবর্তনের প্রমাণসমূহ

প্রথম পরিচ্ছেদ – নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক গঠন থেকে মানুষরূপে ক্রমবিবর্তনের প্রমাণসমূহ

মানুষের উদ্ভব বিষয়ক প্রমাণসমূহের প্রকৃতি—মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে সমরূপ অঙ্গ—সংস্থান—পারস্পরিক সাদৃশ্যের বিবিধ বিষয়—ক্রমোন্নতি—আদিম বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গের সংস্থান, মাংসপেশি, জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, চুল, অস্থি, জননেন্দ্ৰিয় ইত্যাদি—মানুষের উদ্ভব বিষয়ক এই তিনটি মূল শ্রেণিবিভাগ সম্বন্ধে তথ্যের বিন্যাস।

.

মানুষ কোনো পূর্বোদ্ভূত নিম্নশ্রেণির প্রজাতিরই বিবর্তিত উন্নততর রূপ কি না জানতে চাইলে প্রথমেই জানতে হবে শারীরিক গঠন ও মানসিক গুণের বিচারে মানুষ তাদের থেকে কোনোভাবে ভিন্ন কি না—তা সে ভিন্নতা যতই সামান্য হোক না কেন, আর যদি তাই হয়, তাহলে নিম্নশ্রেণির জীবদের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের মতো মানুষের বেলাতেও সেটা বংশগতভাবে বর্তায় কি না। আবার, এই ভিন্নতা কি অন্য প্রাণীদের মতো একই সাধারণ কারণজনিত কোনো ফল এবং সেগুলো কি তাদের মতো একই নিয়মের বশবর্তী, যেমন, শরীরের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কোনো অঙ্গের ব্যবহার বা অব্যবহারের ফলস্বরূপ, বংশগতভাবে তার প্রভাব ইত্যাদি? মানুষও কি একইভাবে অঙ্গের অসঙ্গতিতে, ক্রমবিকাশের সীমাবদ্ধতায় তার পূর্বতন বা আদিম অবস্থার দৈহিক গঠনের কোনো নিয়মে পুনরায় ফিরে যেতে পারে? খুব স্বাভাবিকভাইে এটাও নিশ্চয় জিজ্ঞাসা হতে পারে যে অন্যান্য বহু প্রাণীর মতো মানুষও কি বিভিন্ন প্রকারের ও উপজাতির মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, যাদের মধ্যে তফাত অতি সামান্য, কিংবা কখনো কখনো এত বেশি যে তাদের সন্দেহজনক প্রজাতি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে? কীভাবে এই জাতিগুলো পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে? যৌন মিলনের পরে কীভাবে তারা প্রথম এবং পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে? এইভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন আমাদের সামনে ক্রমশ উপস্থিত হয়।

প্রশ্নকর্তা এরপর আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চলে আসবেন—মানুষের মধ্যে কি এত দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধির প্রবণতা আছে যে টিকে থাকবার জন্য তাকে প্রায়শই কঠিন জীবনসংগ্রাম করতে হবে? এবং তার ফলস্বরূপই কি শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে সুবিধাজনক বৈচিত্র্যগুলো রক্ষা পায় আর ক্ষতিকর বৈচিত্র্যগুলো নির্মূল হয়ে যায়? তবে কি মানুষের সব জাতি অথবা প্রজাতি, যে অভিধা-ই ব্যবহার করা হোক না কেন, জোর করে একে অন্যকে সরিয়ে দিচ্ছে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ? আমরা দেখব এই সমস্ত প্রশ্নেরই, যা বাস্তবিকপক্ষে তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, উত্তর হবে হ্যাঁ-বাচক, ঠিক নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের নিয়মপদ্ধতির মতোই। এখানে উল্লিখিত কিছু প্রশ্নের আলোচনা আপাতত স্থগিত রাখব এবং প্রথমে আমরা দেখব যে মানুষের শারীরিক গঠনে কম-বেশি এমন কোনো চিহ্ন আছে কি না যার সাহায্যে প্রমাণ করা যায় মানুষের উদ্ভব হয়েছে নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক রূপ থেকে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে মানুষের মানসিক শক্তির সঙ্গে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মানসিক শক্তির তুলনামূলক আলোচনা করা হবে।

মানুষের শারীরিক গঠন

এটা শুনতে বেশ খারাপ লাগারই কথা যে মানুষের শারীরিক গঠন ঠিক অন্যান্য স্তন্যপায়ী জন্তুর আকার বা গড়নের মতোই। তার কাঠামোর সমস্ত হাড়কেই বানর, বাদুড় বা সীলমাছের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তার পেশি, স্নায়ু, রক্তবাহী নালি বা শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মস্তিষ্কও যে এই একই নিয়ম মেনে চলে সেটাও অধ্যাপক হাক্সলি ও অন্যান্য শরীরতত্ত্ববিদ্রা দেখিয়েছেন। বিশোফ-এর মতো একজন বিরোধী সমালোচকও স্বীকার করেছেন যে মানুষের মস্তিষ্কের প্রতিটি প্রধান অংশ ও ভাঁজের সঙ্গে ওরাং-ওটাং-এর মস্তিষ্কের সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন মস্তিষ্কের বিকাশের কোনো পর্যায়েই উভয়ের মস্তিষ্কের মধ্যে সম্পূর্ণ মিল ছিল না এবং তা থাকতেও পারে না, কারণ তাহলে তো তাদের মানসিক শক্তিও একই রকমের হতো। ভালপিয়ান বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে বনমানুষের মস্তিষ্কের সত্যিকারের তফাত খুব কম। এই ব্যাপারে যেন কেউ ভুল না করেন যে মস্তিষ্কের চরিত্র, করোটির গঠন ও আকারে মানুষের অবস্থান একেবারে বনমানুষের কাছাকাছি। তাছাড়া বেবুন ও সাধারণ জাতের বানরদের সঙ্গেও করোটির গঠনের ব্যাপারে মানুষের যথেষ্ট মিল আছে।’ কিন্তু মস্তিষ্কের গঠন বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিষয়ে মানুষ ও উচ্চশ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে পারস্পরিক সাদৃশ্যের বর্ণনা এখানে নিতান্তই অর্থহীন।

তবে শারীরিক গঠনের সঙ্গে সরাসরি বা সুস্পষ্ট কোনো সম্বন্ধ না থাকলে ও দু’-একটি বিষয়ের উল্লেখ এখানে করা প্রয়োজন, যেগুলোর সাহায্যে এই সাদৃশ্য বা সম্পর্ককে ভালোভাবে দেখানো যেতে পারে।

নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের থেকে কিছু রোগ যেমন মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়, তেমনি মানুষও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের কিছু কিছু রোগের কারণ, যেমন গ্লান্ডার্স, জলাতঙ্ক, বসন্ত, সিফিলিস, কলেরা, হার্পিস ইত্যাদি। এই তথ্য উভয়ের মধ্যেকার স্নায়ুকলা এবং রক্তের মুখ্য গঠন ও উপাদানের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যকে যতটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করে, ততটা স্পষ্ট প্রমাণ সবচেয়ে সংবেদনশীল অণুবীক্ষণ বা সবচেয়ে ভালো রাসায়নিক বিশ্লেষণের সাহায্যেও পাওয়া যায় না। আমাদের মতোই বানরদেরও কিছু রোগ হয় যেগুলো আদৌ সংক্রামক নয়। অধ্যাপক রেঙ্গার, সেবুস আজারে নামে একশ্রেণির বানরকে তাদের নিজস্ব বাসভূমিতে দীর্ঘদিন পরীক্ষা করে দেখেছেন যে তারা সর্দিতে ভোগে এবং তার সাধারণ লক্ষণগুলো মানুষের ক্ষেত্রেও একই। ঘন ঘন সর্দি হলে তারা ক্ষয়রোগেও আক্রান্ত হয়। তাছাড়া এই ধরনের বানররা সন্ন্যাস রোগ, পেট ফুলে যাওয়া এবং চোখে ছানি প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয়। শৈশবে দুধে-দাঁত পড়ার সময় প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তারা। এদের ওপর ওষুধের ক্রিয়াও ঠিক আমাদেরই মতো। কোনো কোনো জাতের বানরদের আবার চা, কফি এবং উৎকৃষ্ট মদের উপর দারুণ লোভ থাকে। আমি নিজের চোখে দেখেছি যে তারা খোশমজাজে ধূমপানও করে।[১] ব্রেহম একে সমর্থন করে বলেছেন যে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসীরা বুনো বেবুনদের ধরার জন্য কড়া দেশজ মদ ভর্তি পাত্র টোপ হিসেবে ব্যবহার করে, কারণ তা খেয়ে তারা সহজেই মাতাল হয়ে পড়ে। তিনি এই ধরনের কিছু মাতাল বেবুনকে আটক রেখে পরীক্ষা করে তাদের ব্যবহার ও আশ্চর্য মুখভঙ্গি সম্পর্কে নানা মজাদার তথ্য পেশ করেছেন। পরের দিন সকালে তারা অত্যন্ত হতাশ ও খিটখিটে হয়ে পড়ে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে করুণভাবে তাকিয়ে থাকে। তখন বিয়ার বা মদ দিলে তারা বিরক্তি প্রকাশ করে কিন্তু লেবুর জল পেলে তারিয়ে তারিয়ে পান করে। এটেলেস জাতীয় আমেরিকান বানররা একবার ব্র্যান্ডি খেয়ে মাতাল হওয়ার পর আর কখনো স্পর্শ পর্যন্ত করে না। দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো তারা মানুষের চেয়েও সুবিবেচক। এইসমস্ত সামান্য ঘটনা প্রমাণ করে মানুষ ও বানরের স্বাদগ্রহণের স্নায়ুগুলো কত কাছাকাছি এবং উভয়ের স্নায়ুতন্ত্র কীরকম একইভাবে কাজ করে থাকে।

[১. জীবজগতের খুব নিচু স্তরের কিছু কিছু প্রাণীর মধ্যে ওইসব বস্তুর প্রতি একইরকম আসক্তি লক্ষ করা যায়। মি. এ. নিকেলস আমাকে জানিয়েছেন তিনি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে ফ্যাসিওলারটাস সিনেরাস নামক তিনটি নিম্নশ্রেণির বানর জাতীয় প্রাণীর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন যে কোনোরকম অনুশীলন ছাড়াই তারা মদ ও ধূমপানের প্রতি তীব্র আসক্তি প্রকাশ করেছে।]

মানুষের দেহে অভ্যন্তরস্থ পরজীবী জীবাণুর আক্রমণ কখনো কখনো তার মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া বহিঃস্থ পরজীবীরাও নানাভাবে আক্রমণ করে। এই একই জাতি বা বংশের অন্তর্ভুক্ত পরজীবীরা অন্যান্য স্তন্য পায়ী প্রাণীদেরও আক্রমণ করে এবং খোসপাঁচড়ার ক্ষেত্রেও আক্রমণকারী পরজীবীগুলো হয়ে থাকে একই প্রজাতির। অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীব, পাখি, এমনকী পোকামাকড়দের মতোই মানুষও গর্ভধারণ, রোগের আক্রমণ ও তার স্থায়িত্ব ইত্যাদি প্রায় সব বিষয়েই একই রহস্যময় নিয়মের অনুবর্তী এবং চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মানুষের যেকোনো ক্ষতও আরোগ্যলাভের পথে তাদের মতো প্রায় একই উপায়ে সেরে ওঠে এবং অঙ্গচ্ছেদনের পর কোনো ক্ষত সৃষ্টি হলে, বিশেষ করে ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায়, ক্ষতস্থান কিছুটা পুনর্গঠিত হয়, ঠিক যেমনটি নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের বেলাতেও ঘটে থাকে।

জীবের জন্ম সংক্রান্ত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি, পুরুষের প্রণয়- নিবেদন থেকে শুরু করে সন্তানের জন্মাদান ও লালন-পালন পর্যন্ত, আশ্চর্যজনকভাবে সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে একইরকম। মানুষের বাচ্চার মতো বানররাও প্রায় একইরকম অসহায় অবস্থার মধ্যে জন্মায়। কোনো কোনো জাতের বানররা আবার মানুষের মতোই শৈশবে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক বাপ-মায়ের মতো দেখতে হয় না। কেউ কেউ বেশ জোর দিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভেদ দেখান এই বলে যে অন্যান্য জীবের তুলনায় মানবশিশুর পরিণত হয়ে উঠতে কিছু বেশি সময় লাগে। কিন্তু যদি আমরা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষদের লক্ষ করি তাহলে দেখব এই প্রভেদ এমন কিছু বেশি নয়। কারণ একটি ওরাং শিশুর দশ থেকে পনেরো বছরের আগে যৌবন লাভ করে না। অধিকাংশ স্তন্যপায়ী জীবের পুরুষদের মতোই মানবজাতির পুরুষেরাও দেহের আকার, শারীরিক শক্তি, চুলের পরিমাণ ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের জাতের মেয়েদের থেকে আলাদা, উভয়ের মানসিক গঠনেও প্রচুর প্রভেদ থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে উচ্চশ্রেণির জীব, বিশেষত বনমানুষেরা, দৈহিক গঠন, পেশিতন্তুর গঠন, জীব রাসায়নিক গঠন, মানসিক গঠন প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের খুবই কাছাকাছি জায়গায় রয়েছে।

ভ্রূণের ক্রমবিকাশ

মানুষের ভ্রূণ, যা এক ইঞ্চির প্রায় একশো পঁচিশ ভাগ ব্যাসবিশিষ্ট একটি ডিম্বাণু থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়, তা কোনো অর্থেই অন্য প্রাণীদের ডিম্বাণুর থেকে আলাদা নয়। মানুষের ভ্রূণকেও প্রাথমিক অবস্থায় অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ভ্রূণের থেকে আলাদা করে চেনা প্রায় অসম্ভব। এই সময় শরীরের রক্তবাহী ধমনীগুলো ধনুকের মতো বাঁকানো অবস্থায় থাকে, যেন ব্রঙ্কিয়া – তে রক্ত পাঠাবার জন্যই এমন ব্যবস্থাপনা। কিন্তু উচ্চশ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এ-রকম কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও দেখা যায় তাদের গলার কাছে (১ নং ছবি f ও g ) পূর্বাবস্থার নিদর্শন হিসেবে চেরা দাগ রয়ে গেছে। পরবর্তী পর্যায়ে হাত-পায়ের ক্রমোন্নতি ঘটে। সুবিখ্যাত ফন্ বেয়ার লিখেছেন, ‘সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ীদের পা, পাখির ডানা ও পা এবং মানুষের হাত-পা—সবই সেই একই প্রাথমিক গঠন থেকে সৃষ্ট।’ অধ্যাপক হাক্সলি বলেছেন, “বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে বানরের কিছু কিছু প্রভেদ চোখে পড়ে। আবার বানরদের সঙ্গে কুকুরের বিকাশে যতটা তফাত, প্ৰায় ততটাই তফাত চোখে পড়ে কুকুরের সঙ্গে মানুষের বিকাশের বেলাতেও। শেষোক্ত সিদ্ধান্তটি আশ্চর্য মনে হলেও এটি পরীক্ষিত সত্য।’

যেহেতু এই বইয়ের অনেক পাঠকের ভ্রূণের গঠন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই, তাই মানুষ ও কুকুরের ভ্রূণের দুটি ছবি এখানে দেয়া হলো। দুটিই বিকাশলাভের প্রাথমিক পর্যায়ের চিত্র, খুব সাবধানে ও যতদূর সম্ভব নির্ভূলভাবে অনুকৃত।[২]

[২. মানুষের ভ্রুণের ছবিটির জন্য অধ্যাপক একারের ‘আইকন ফিজিক্স’, ১৮৫১-১৮৫৯, সারণী ছবি ২ দ্রষ্টব্য। ভ্রূণটি প্রকৃত মাপের চেয়ে দশগুণ বড় করে দেখানো হয়েছে। কুকুরের ভ্রূণটির জন্য অধ্যাপক বিশোফের ‘Entwicklungsgeschichte des Hunde – Eies’, ১৮৪৫, সারণি ১১, ছবি ৪২ বি দ্রষ্টব্য। ছবিটি একটি পঁচিশ দিন বয়সের ভ্রুণের প্রকৃত মাপের চেয়ে পাঁচগুণ বড়। দুটি চিত্রেই অন্তর্বর্তী নাড়ি-ভুঁড়ি ও গর্ভাশয়ের উপাদানসমূহকে বাদ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক হাক্সলির ‘ Man’s place in Nature’ নামক বই থেকে প্রাপ্ত ধারণা অনুযায়ী ছবি দু’টি ব্যবহার করা হয়েছে। অধ্যাপক হ্যাকেলও তাঁর ‘Schopfungsgeschichte’ নামক গ্রন্থে একইরকম ছবি ব্যবহার করেছেন।]

উচ্চ পর্যায়ের ওইসব বিশেষজ্ঞদের মতামত উদ্ধৃত করার পর, একগাদা ধার করা তথ্যের সাহায্যে আমার পক্ষে এটা দেখানো নিতান্তই অর্থহীন যে মানুষের ভ্রূণ অবিকল অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরই মতো। তবে এটুকু বলা যায় যে মানুষের ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের ভ্রূণবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে গঠনগত সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন, ভ্রূণের প্রথম অবস্থায় হৃদপিণ্ড বলতে শুধুমাত্র একটি ধুক্‌ধুক্ করা নালীকেই বোঝায়; দেহের যাবতীয় বর্জ্যপদার্থ একটি সরু পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে; এবং অনুত্রিকাস্থি (os coccyx) সত্যিকারের লেজের মতো বেরিয়ে থাকে, ‘প্রাথমিক অবস্থায় পায়ের পেছন থেকে লম্বা হয়।[৩]

[৩। অধ্যাপক উইম্যান, ‘প্রোক্লেম অফ আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’, চতুর্থ খণ্ড]

১নং ছবি—উপরে মানুষের ভ্রূণের ছবিটি একার-এর গ্রন্থ থেকে নেওয়া। নিচে কুকুরের ভ্রূণের ছবিটি বিশোফের গ্রন্থ থেকে পাওয়া।

a. সম্মুখ-মস্তিষ্ক, সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ারস

b. মধ্য-মস্তিষ্ক, কর্পোরা কোরাড্রিজেমিনা

c. পশ্চাৎ-মস্তিষ্ক, সেরিবেলাম, মেডুলা অবলংগাটা

d. চোখ

e. কান

f. প্রথম ভিসেরাল আর্চ

g. দ্বিতীয় ভিসেরাল আর্চ

h. ক্রমোন্নতির প্রক্রিয়ায় মেরুদণ্ডী স্তম্ভ ও মাংসপেশি

i. সম্মুখবর্তী (হাত-পা)

k. পশ্চাদ্বর্তী (হাত-পা)

l. লেজ বা অনুত্রিকাস্থি

শ্বাসযন্ত্র সম্বলিত সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর ভ্রূণে করপোরা উলফিয়ানা নামে একটি গ্রন্থি থাকে যা দেখতে ও কাজে পরিণত মাছের বৃক্কের মতো।[৪] এমনকী ভ্রূণের বিকাশের শেষ পর্যায়েও মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে কিছু আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক বিশোফের মতে, মানুষের ভ্রূণের সাত মাস বয়সের সময় তার মস্তিষ্কের ভাঁজ একটি পূর্ণবয়স্ক বেবুনের মতো বিকাশের একই পর্যায়ে পৌঁছায়। অধ্যাপক ওয়েন বলেছেন, পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ‘যা দাঁড়াতে বা হাঁটতে আলম্ব হিসেবে কাজ করে, সেটিই সম্ভবত মানুষের গঠনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।’ কিন্তু অধ্যাপক উইম্যান প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা একটি ভ্রূণকে পরীক্ষা করে দেখেছেন, ‘পায়ের বুড়ো আঙ্গুল অন্যান্য আঙ্গুলের চাইতে ছোট এবং তাদের সঙ্গে সমান্তরাল না থেকে একপাশে বাঁকানো অবস্থায় থাকে, যা এ-বিষয়ে অন্যান্য চতুষ্পদ প্রাণীদের স্বাভাবিক অবস্থার মতোই।’ অধ্যাপক হাক্সলির লেখা থেকে আর-একটি উদ্ধৃতি দিয়ে ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনার ছেদ টানব আমি। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—মানুষ কি কুকর, ব্যাঙ, পাখি বা মাছের থেকে স্বতন্ত্র কোনো উপায়ে সৃষ্টি হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ প্রশ্নের নিঃসংশয়ে উত্তর একটাই—মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের ধারা তার ঠিক পরের স্তরের প্রাণীদের সঙ্গে নিকট সাদৃশ্যযুক্ত। এ-বিষয়ে কুকুর ও বানরের মধ্যে যতটা মিল, তার চেয়ে অনেক বেশি মিল দেখা যায় বানর ও মানুষের মধ্যে।’

[৪। অধ্যাপক ওয়েন, ‘অ্যানাটমি অফ ভার্টিব্রেটস’, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৫৩।]

মৌলিক বা প্রাথমিক অঙ্গ

এ-বিষয়টি যদিও আগের দু’টি বিষয়ের মতো অতটা গুরত্বপূর্ণ নয়, তবুও অন্য কারণে এখানে আলোচনা করা প্রয়োজন। উচ্চশ্রেণির এমন কোনো একটি প্রাণীরও নাম করা যাবে না, যারা আদিম অবস্থার কোনো অঙ্গ এখনও শরীরে বহন করে না—এমনকী মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাথমিক বা মৌলিক অঙ্গগুলোকে পরবর্তীকালে সৃষ্ট অঙ্গগুলোর থেকে আলাদা করতে হবে, যদিও সবসময় কাজটি খুব সহজ নয়। হয় প্রাথমিক অঙ্গগুলো সম্পূর্ণ অজেকো হয়ে পড়েছে। [ যেমন পুরুষ-চতুষ্পদদের দুগ্ধগ্রন্থি বা জাবরকাটা প্রাণীদের

কৃন্তক দন্ত (incisor), যা কখনোই মাড়ি কেটে বেরোতে পারে না], অথবা বর্তমান প্রজন্মে সেগুলো এত সামান্য কাজে লাগে যে আজকের মতো অবস্থাতেই সেগুলো কোনোদিন সৃষ্ট হয়েছিল বলে মনেই হয় না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের অঙ্গগুলোকে অবশ্য সরাসরি প্রাথমিক বা মৌলিক অঙ্গ বলা যায় না, কিন্তু তারা ক্রমশ সেদিকেই এগোচ্ছে। অন্যদিকে, পরবর্তীকালে সৃষ্ট বা বর্ধিষ্ণু (Nascent) অঙ্গগুলো সম্পূর্ণ বিকশিত না হলেও খুবই প্রয়োজনীয় এবং প্রয়োজনে সেগুলো আরও বিকশিত হতে পারে। প্রাথমিক বা মৌলিক অঙ্গগুলো বস্তুত পরিবর্তনশীল। এর কারণটাও সহজবোধ্য। আসলে এগুলো এখন অকেজো বা প্রায়-অকেজো, ফলে তারা আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের অধীন নয়। কখনো কখনো এগুলো একেবারে লুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেও অনেক সময় উল্টো পথে তাদের পূর্বাবস্থায় আবার ফিরে যেতে পারে, যে কারণে বিষয়টি অনুধাবনযোগ্য।

যে যে কারণে বিভিন্ন অঙ্গ প্রাথমিক অবস্থায় থেকে গেছে তার মুখ্য কারণ হলো বয়ঃপ্রাপ্তির কালে অঙ্গগুলোর অব্যবহার, যে-সময়ে এদের ব্যবহৃত হওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বংশগতির প্রভাবজনিত কারণও আছে। ‘অব্যবহার’ মানে কিন্তু শুধু পেশিসমূহের ক্রিয়ার হ্রাস নয়, শরীরের কোনো অংশে বা অঙ্গে রক্তচাপের অদলবদলে রক্তপ্রবাহের স্বল্পতা অথবা কোনো অঙ্গের অভ্যাসজনিত নিষ্ক্রিয়তার কথাও মনে রাখতে হবে। তবে প্রাথমিক অঙ্গগুলো অনেক সময় কোনো প্রজাতির স্ত্রী বা পুরুষদের মধ্যে অকেজো অবস্থা দেখা যেতে পারে, যা কিনা ওই একই প্রজাতির বিপরীত লিঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত থাকতে পারে। এই আদিম বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গগুলো, আমরা পরে দেখব, প্রায়শই সৃষ্টি হয়েছে এখানে উল্লিখিত অঙ্গগুলোর থেকে স্বতন্ত্র উপায়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অঙ্গগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলেও অবলুপ্ত হয়েছে, কারণ প্রজাতির জীবনে পরিবর্তিত অভ্যাসের পক্ষে সেটা হয়তো ক্ষতিকর ছিল। হ্রাস বা অবলুপ্তির এই প্রক্রিয়া সম্ভবত ক্ষতিপূরণ ও বুদ্ধির মিতাচার (economy of growth)—এই দুটি মৌলিক নীতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অঙ্গের ক্রমহ্রাসমানতার শেষ পর্যায়ে যখন অব্যহারজনিত কারণে অঙ্গহ্রাস সম্পূর্ণ হয়েছে এবং বুদ্ধির মিতাচারজনিত কারণ ও আর তেমন সক্রিয় নয়, সেই পর্যায়টিকে বুঝে ওঠা খুবই দুরূহ। কোনো অঙ্গ যা ইতিমধ্যেই অকেজো ও ক্ষুদ্রকার হয়ে পড়েছে, তার চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ বিলুপ্তিকে, যেক্ষেত্রে উপরিউক্ত নীতিদ্বয়ের কোনো ভূমিকা নেই, সম্ভবত প্যানজেনেসিসের প্রকল্প (hypothesis of pangenesis) দিয়ে বোঝা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু প্রাথমিক বা মৌলিক অঙ্গের সম্পূর্ণ বিষয়টি আমার আগের একটি লেখায় ব্যাখ্যা সহকারে আলোচিত হয়েছে, তাই এ ব্যাপারে এখানে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।

মানবশরীরের বিভিন্ন অংশে প্রাথমিক অবস্থার কিছু পেশি লক্ষ করা যায়।[৫]

[৫. উদাহরণস্বরূপ, মি. রিচার্ড (Annales des sciences Nat. – তৃতীয় শ্রেণি প্ৰাণীতত্ত্ব; ১৮৫২, খণ্ড ১৮, পৃষ্ঠা ১৩) সেইসমস্ত প্রাথমিক বা আদিম শরীর-অংশের বর্ণনা ও ছবি দিয়েছেন, যাদের তিনি বলেছেন ‘হাতের বংশানুক্রমিক (pedieux delamain) পেশি, যেগুলো কখনো কখনো খুবই ছোট আকারের হয়। অপর একটি পশ্চাদ্বর্তী টিবিয়াল (be tibial) পেশি, যা সাধারণত বর্তমানে হাতে অনুপস্থিত থাকে কিন্তু মাঝে মাঝে পেশিটিকে কম-বেশি আদিম বা প্রাথমিক অবস্থায় পুনারাবির্ভূত হতে দেখা যায়।]

নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের শরীরের বেশ কিছু পেশিকেও অনেক সময় খুবই হ্রাসপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের শরীরে দেখা যায়। প্রত্যেকেই লক্ষ করে থাকবেন যে বহু প্রাণী, বিশেষত ঘোড়া, তার শরীরের চিকন চামড়াকে সর্বত্র আশ্চর্যভাবে নাড়াতে বা কাঁপাতে পারে, এবং তা সম্ভব হয় প্যানিকিউলাস কারনোসস্ নামক পেশির জন্য। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশেও এই পেশিটির কার্যকারিতা দেখা যায়। যেমন কপালে, যার সাহায্য আমরা ভ্রূ তুলতে পারি। ঘাড়ের কাছের সুবিকশিত প্ল্যাটিমা মাইওডিস এইরকম পেশি। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টার্নার জানিয়েছেন, শরীরের পাঁচটি ভিন্ন জায়গায় অবস্থিত পেশিতন্তু, যেমন বগল, স্কন্ধাস্থির নিকটে ইত্যাদি জায়গায় সমস্ত পেশিগুলোই প্যানিকিউলাস পেশিব্যবস্থার অন্তর্গত। প্রায় ছ’শো মানবশরীর পরীক্ষা করে শতকরা তিনভাগ শরীরে তিনি দেখেছেন যে, বুকের খাঁচার উপরের পেশিতন্তুগুলো, যেমন মাস্কুলাস স্টারনালিস অথবা স্টারনালিস ব্রুটোরাম, যেগুলো পেটের পেশি রেকটাস অ্যাবডোমিনালিসের বর্ধিত অংশ নয়, কিন্তু প্যানিকিউলাস পেশির সঙ্গে নিকট সাদৃশ্যযুক্ত। তিনি বলেছেন, ‘আদিম অঙ্গসংস্থান যে বিশেষ অবস্থানগত পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল—এই বক্তব্যের স্বপক্ষে একটি চমৎকার প্রমাণ হাজির করে এই পেশিটি।’

কোনো কোনো ব্যক্তির করোটির উপরিভাগের পেশি-সংকোচনের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা থাকে এবং এই পেশিগুলো এখনও পরিবর্তশীল হলেও অংশত প্রাথমিক বা আদিম অবস্থায় রয়ে গেছে। এম. এ দ্য ক্যাদল আমাকে একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা জানিয়েছেন যা এই ক্ষমতার দীর্ঘদিন ধরে বা বংশপরস্পরায় চালু থাকার এবং এর অস্বাভাবিক বিকাশের এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত। তিনি এমন একটি পরিবারকে জানেন, যে-পরিবারের বর্তমান কর্তা যৌবনে করোটির চামড়া নাচিয়ে (পেশি সম্প্রসারণের সাহায্যে) কয়েকটি ভারী বই মাথার উপর থেকে দূরে নিক্ষেপ করতে পারতেন এবং এভাবে তিনি বহু বাজি জিতেছেন। তাঁর বাবা, কাকা, ঠাকুরদা এবং তিন ছেলে সকলেই এই অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। প্রায় আটপুরুষ আগে এই পরিবারটি দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ পূর্বোক্ত এই শাখাটির কর্তা অপর শাখাটির পারিবারিক কর্তার সাত পুরুষের সম্পর্কিত জ্ঞাতিভাই। দ্বিতীয় শাখাটির বর্তমান কর্তা ফ্রান্সের অন্য একটি অঞ্চলে বসবাস করেন। তাঁকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর ওই বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় দেন। বর্তমানকালে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি পেশি যে কত দীর্ঘদিন ধরে তার ক্ষমতাকে বংশপরম্পরায় ধরে রাখতে পারে, এটা তারই এক চমৎকার দৃষ্টান্ত। সম্ভবত সুদূর অতীতের মানবাকৃতির পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই পাওয়া এই ক্ষমতা, কারণ দেখা যায় বানরদেরও এই ক্ষমতা আছে এবং তারা অনবরত এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে মাথার উপরকার চামড়াকে উঁচু-নিচু করতে পারে।

বহির্ভাগের পেশি যা কানের বাইরের দিককে এবং অন্তর্ভাগের পেশি যা কানের ভেতরের দিকের বিভিন্ন অংশকে নাড়াতে সাহায্য করে, তা এখনও মানুষের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বা আদিম অবস্থায় রয়ে গেছে এবং এ-সমস্তই প্যানিকিউলাস পেশিব্যবস্থার অন্তর্গত। এগুলোর বিকাশ, কিংবা অন্তত এগুলোর কার্যকলাপ, পরিবর্তনশীল প্রকৃতির। আমি এমন একজন মানুষকে দেখেছি যে তার সম্পূর্ণ বহিঃকর্ণ সামনের দিকে নিয়ে আসতে পারে। কেউ কেউ ওপরের দিকে এবং পিছনের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। এদের মধ্যে একজন আমাকে বলেছিল যে যদি আমরা মাঝে মাঝে কানে হাত দিই এবং সেইদিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি, তাহলে আমাদের অধিকাংশের পক্ষেই পুন পুন প্রচেষ্টার দ্বারা কান নাড়ানোর বিশেষ ক্ষমতা ফিরে পাওয়া সম্ভব। কান খাড়া করা এবং বিভিন্ন দিকে ফেরানোর ক্ষমতা নিঃসন্দেহে পশুদের একটি বড় গুণ যার দ্বারা তারা বুঝতে পারে কোন দিক থেকে বিপদ আসছে। কিন্তু আমি কখনো এমন কোনো মানুষের কথা শুনিনি যার মধ্যে এই ক্ষমতা বর্তমান এবং যা কিনা তার কাজে লাগে। সমস্ত বহিঃকর্ণকে তার বিভিন্ন ভাঁজ ও সুস্পষ্ট চিহ্ন (হেলিক্স ও অ্যান্টিহলিক্স, ট্রাগাস ও অ্যান্টিট্রাগাস ইত্যাদি) সমেত একটি প্রাথমিক বা মৌলিক অঙ্গ বলা যেতে পারে, যা নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের ক্ষেত্রে কান খাড়া করার সময় কোনোরকম বোঝা না হয়ে কানকে রক্ষা এবং শক্তিশালী করে। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা যে এই অংশের কোমলাস্থি (cartilage) কম্পনকে পৌঁছে দেয় শ্রবণ-স্নায়ুতে। কিন্তু মি. টয়নবি[৬] এ-বিষয়ে পরীক্ষিত তথ্যাদি পেশ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বহিঃকর্ণের স্বতন্ত্র কোনো কাজ নেই। শিম্পাঞ্জি ও ওরাং-ওটাংয়ের কান দেখতে অনেকটা মানুষের কানের মতোই এবং প্রধান পেশিগুলোও একইরকম, যদিও তা খুবই কম বিকশিত। চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা আমাকে জানিয়েছেন যে শিম্পাঞ্জি বা ওরাং-ওটাং কখনো তাদের কান নাড়াতে বা খাড়া করতে পারে না। এ থেকে বোঝা যায় অন্তত কাজের ক্ষেত্রে মানুষের মতোই এদের বহিঃকর্ণও একইরকম প্রাথমিক বা আদিম অবস্থায় রয়েছে। এইসমস্ত প্রাণীদের এবং মানুষের পূর্বপুরুষদের কান খাড়া করার ক্ষমতা কেন লোপ পেল, তা আমরা জানি না। যদিও আমি এ-বিষয়ে নিশ্চিত নই, তবু এমনটা হতে পারে যে তারা বৃক্ষবাসী ও দারুণ শক্তিশালী হওয়ার দরুণ খুব কম সময়েই বিপদের মধ্যে পড়ত, ফলে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাদের কান নাড়ানোর খুব একটা প্রয়োজন হতো না এবং সম্ভবত এইভাবেই ধীরে ধীরে তাদের এ-ক্ষমতাটি লোপ পেয়েছে। আকারে বড় আর শক্তিশালী পাখিদের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সুদূর সামুদ্রিক দ্বীপের অধিবাসী হওয়ার দরুন শিকারি জন্তুর আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গেছে তারা এবং তার ফলে ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলেছে ডানা মেলে ওড়বার ক্ষমতা। অবশ্য মানুষ ও কিছু কিছু জাতের বানরের কান নাড়ানোর অক্ষমতা অংশত পূরণ হয় কোনো দিকের শব্দ শোনার জন্য তাদের মাথা ঘোরাতে পারার ক্ষমতার সাহায্যে। এটা বেশ জোর দিয়েই বলা হয় যে, একমাত্র মানুষের কানের লতি (lobule) আছে। কিন্তু ‘এর প্রাথমিক অবস্থা গরিলাদের মধ্যেও দেখা যায়।’ এবং অধ্যাপক প্রেয়ার-এর কাছে আমি শুনেছি যে, নিগ্রোদের মধ্যে অনেক সময় এর অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রসিদ্ধ ভাস্কর মি. উনার বহিঃকর্ণের একটি ছোট্ট বৈশিষ্ট্যের কথা আমাকে জানান, যা তিনি স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই লক্ষ করেছেন এবং তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করেছেন। বিষয়টি প্রথম তাঁর নজরে আসে পাক-এর (পরীবিশেষ) মূর্তি গড়ার সময়, যেখানে তিনি সরু ছুঁচলো কান তৈরি করেছিলেন। সেইসময় তাঁকে বিভিন্ন বানরের এবং আরও সযত্নে মানুষের কান নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যটি হলো ভিতরের দিকে ভাঁজ করা সীমা বা হেলিক্স থেকে বেরিয়ে আসা একটি ছোট ভোঁতা অংশের অদ্ভুত উপস্থিতি। এটা যাদের থাকে, জন্মের সময় থেকেই থাকে, এবং অধ্যাপক লুভিগ মেয়ার-এর মতে মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যেই এই এটা বেশি দেখা যায়। মি উনার হুবহু এ-রকম একটি মডেল তৈরি করেছেন এবং আমাকে তার একটি ছবি পাঠিয়েছেন (২নং ছবি)।

২নং ছবি—মানুষের কান; ছাচ এবং অঙ্কন মি. উনারের; a—প্রশিক্ষণ বা উদ্‌গত বিন্দু

ভোঁতা অংশটি যে শুধু ভিতরের দিকের কানের কেন্দ্রাভিমুখে বেরিয়ে থাকে তাই নয়, প্রায়ই বাইরের দিকে ঈষৎ উঁচু হয়ে থাকে, ফলে সামনাসামনি বা পেছন থেকে লক্ষ করলে সহজেই চোখে পড়ে। এর কোনো সুনির্দিষ্ট আকার নেই, অবস্থানও খুব নির্দিষ্ট নয়, কখনো থাকে একটু উঁচুতে, কখনো-বা একটু নিচুতে, এমনকী এক কানে এর দেখা মিললেও অন্য কানে তা না-ও থাকতে পারে। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের চিড়িয়াখানায় একটি স্পাইডার-মাংকির (Ateles beelzebuth) কানেও এই একই ব্যাপার লক্ষ করেছি আমি। ড. ই. রে ল্যাংকেস্টার হামবুর্গের চিড়িয়াখানায় একটি শিম্পাঞ্জির কানেও এই একই জিনিস দেখেছেন। হেলিক্স স্পষ্টতই কানের ভিতরের দিকের ভাঁজ করা অংশের চূড়ান্ত সীমা এবং ভাঁজ করা অংশটি কোনো-না-কোনোভাবে সম্পূর্ণ বহিঃকর্ণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যার ফলে বহিঃকর্ণ বরাবরের জন্য একটু পিছনে হেলে একই অবস্থানে থাকে। বেশ কিছু বানর, যারা উন্নতির উচ্চতর পর্যায়ে, পৌঁছয়নি, যেমন বেবুন ও ম্যাকাকাস-এর কয়েকটি প্রজাতির কানের উপরিভাগ সামান্য ছুঁচলো এবং কানের প্রান্তসীমা মোটেই ভিতরের দিকে ভাঁজ করা নয়। কিন্তু বহিঃকর্ণের প্রান্তসীমা যদি এভাবে ভাঁজ করা থাকত, তাহলে একটি বিন্দু ভিতরের দিকে কেন্দ্রাভিমুখী এবং সম্ভবত বাইরের দিকেও কিছুটা উঁচু হয়ে থাকত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই এই অংশের উৎপত্তির কারণ বলেও আমি বিশ্বাস করি। অন্যদিকে, অধ্যাপক এল. মেয়ার তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন যে সম্পূর্ণ বিষয়টিই হচ্ছে নিছক পরিবর্তনশীলতার ব্যাপার এবং এই বেরিয়ে থাকা অংশগুলো মোটেই বাস্তব নয়, আসলে এগুলো তাদের দুপাশে অবস্থিত অন্ত বর্তী কোমলাস্থির পুরোপুরি গড়ে না-ওঠার কারণেই সৃষ্ট। আমি স্বীকার করতে সম্পূর্ণ রাজি আছি যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যা হতে পারে, যেমন অধ্যাপক মেয়ারের উল্লিখিত উদাহরণগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে ওগুলোর মধ্যে প্রচুর ছোট ছোট ছুঁচলো অংশ আছে অথবা যার সমস্ত প্রান্তসীমাই সৰ্পিল। ড. এল. ডাউনের সহায়তায় আমি নিজেই মাইক্রোসেফ্যালাস জাতীয় একটি জড়বুদ্ধির কান পর্যবেক্ষণ করেছি যার প্রক্ষিপ্ত অংশটি ছিল হেলিক্সের বাইরের দিকে, অন্তবর্তী ভাঁজ করা প্রান্তসীমায় নয়, ফলে কানের পূর্ববর্তী কোনো চূড়ার সঙ্গে এই অংশটির সম্পর্ক থাকতে পারে না। তথাপি কোনো কোনো ক্ষেত্রে, আমার মতে, বহিঃকর্ণে এই ধরনের ছোট ভোঁতা বিন্দু আসলে আমাদের মানবাকৃতি পূর্বসূরিদের ছুঁচলো খাড়া কানেরই অবশেষ মাত্র। এ ঘটনার পৌনঃপুনিকতা ও ছুঁচলো কানের ওই অংশের সঙ্গে এর অবস্থানগত সাদৃশ্যই আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছে। আমাকে পাঠানো একটি ফোটোতে কানের এই অংশটি এত বড় যে অনুমান করে নিতে হয়, অধ্যাপক মেয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, প্রান্তসীমা বরাবর কোমলাস্থির সমবিকাশের ফলেই বহিঃকর্ণের আকার সুষম হয়ে থাকে এবং এখানে প্রক্ষিপ্ত অংশটি সমস্ত কানের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে। উত্তর আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের অধিবাসী দুজন লোকের কানের ঊর্ধ্বতম প্রান্তসীমা মোটেই ভিতরের দিকে ভাঁজ করা নয়, ছুঁচলো এবং সাধারণ চতুষ্পদ জন্তুর কানের সঙ্গে তাদের নিকট সাদৃশ্য লক্ষণীয়। এ-রকম একটি ক্ষেত্রে সাইনোপিথেবাস নিগার জাতীয় একটি বানরের কানের সঙ্গে একটি মানবশিশুর কানের তুলনা করে শিশুটির পিতা দেখছেন যে আকৃতিগতভাবে উভয়ে নিকট সম্বন্ধযুক্ত। যদি এই দু’টি ক্ষেত্রে বহিঃকর্ণসীমা স্বাভাবিক নিয়মে ভিতরের দিকে ভাঁজ করা থাকত, তাহলে একটি অন্তবর্তী প্রক্ষিপ্ত অংশ অবশ্যই গঠিত হতো। আরও অন্তত দু’টি ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে বাইরের আকৃতি এখনও খানিকটা ছুঁচলোই রয়ে গেছে, যদিও কানের ঊর্ধ্বাংশের প্রান্তসীমা স্বাভাবিকভাবেই ভিতরের দিকে ভাঁজ করা, তবে দুটির মধ্যে একটি ক্ষেত্রে বেশ সঙ্কীর্ণ অবস্থাতে। এই পাতার উডকাটটি (৩ নং ছবি) ভ্রূণাবস্থায় একটি ওরাং-ওটাং এর ফোটোর বিশ্বস্ত নকল (ড. নিটশের পাঠানো) লক্ষণীয় যে এই সময়ে ভ্রূণের কানের ছুঁচলো বহিঃরেখা প্ৰাপ্ত বয়স্ক একটি ওরাং-ওটাং-এর কানের থেকে (যার সঙ্গে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কানের নিকট সাদৃশ্য থাকে) কত আলাদা। এটা স্পষ্ট যে এ-রকম একটি কানের প্রান্তবর্তী ক্ষুদ্র অংশের ভাঁজ, যদি বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত না হয়, ভিতরের দিকে একটি প্রক্ষিপ্ত অংশ সৃষ্টি করবে। মোটের ওপর এটা এখনও পর্যন্ত আমার কাছে সম্ভবপর বলেই মনে হয় যে, মানুষ ও বানর উভয়ের ব্যাপারেই এই অংশগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী অবস্থারই নিদর্শনস্বরূপ।

[৬. ‘দ্য ডিজিজেস অফ দ্য ইয়ার’, লেখক জে. টয়নবি. এফ. আর এস, ১৮৬০ পৃ. ১২। প্রখ্যাত শারীরতত্ত্ববিদ অধ্যাপক প্রেয়ার আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি পরবর্তীকালে কানের কাঠামোর কাজ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং এই পুস্তকের মতো প্রায় একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।]

৩নং ছবি—ওরাং-ওটাং-এর একটি পরিণত ভ্রূণ। একটি ফোটোর হুবহু নকল, যেখানে জীবনের এই প্রারম্ভিক সময়ে কানের গঠন দেখানো হয়েছে।

অতিরিক্ত পেশিতত্ত্ব ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য গঠনকাঠামোসহ নিক্‌টিটেটিং মেমব্রেন বা তৃতীয় চক্ষপল্লবটি বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে পাখিদের ক্ষেত্রে এবং তাদের কাছে এর বিশেষ কার্যকরী গুরুত্ব রয়েছে, কারণ এর সাহায্য খুব দ্রুত সমস্ত চক্ষুগোলককে ঢেকে নেওয়া যায়। কিন্তু সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী এবং কোনো কোনো মাছের (যেমন হাউর) মধ্যে এই একই জিনিস লক্ষ করা যায়। স্তন্যপায়ী গোত্রের অন্তর্গত কিছু নিম্নশ্রেণির প্রাণী, যেমন হংসচঞ্চু বা ক্যাঙারু, এবং সিন্ধুঘোটকের মতো কিছু উচ্চ শ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেও এটি যথেষ্টই বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু সমস্ত শারীরতত্ত্ববিদই স্বীকার করেছেন যে মানুষ, চতুষ্পদী জন্তু এবং অবশিষ্ট অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এর অবস্থান নিতান্তই একটি প্রাথমিক বা আদিম অংশ হিসেবে, যাকে উপপল্লব (Semilunar fold) বলা হয়।[৭]

[৭. অধ্যাপক মুলারের ‘এলিমেন্টস অফ ফিজিওলজি’, ইংরেজি ভাষান্তর, ১৮৪২, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৭। অধ্যাপক ওয়েন, ‘অ্যানাটমি অফ ভার্টিব্রেটস’, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৬০; ওই একই বইতে সিন্ধুঘোটকের ওপর প্রবন্ধ, ‘প্রোক্রিয়েশন ইন জুলজিক্যাল সোসাইটি’, ৮ নভেম্বর, ১৮৫৪। আরও দেখুন, আর. নক্সের, ‘গ্রেট আর্টিস্টস অ্যান্ড অ্যানাটমিস্টস’, পৃ. ১০৬। আদিম বা লুপ্তপ্রায় এই অংশটি দৃশ্যত উইরোপের অধিবাসীদের তুলনায় নিগ্রো এবং অস্ট্রেলিয়ানদের ক্ষেত্রে কিছুটা বড়। দ্রষ্টব্য, কার্ল ফখৎ, ‘লেকচারস অন ম্যান’, ইংরেজি ভাষান্তর, পৃ. ১২৯।]

বেশির ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কাছেই ঘ্রাণশক্তি একটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয়। রোমন্থক প্রাণীদের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি বিপদসংকেত হিসেবে কাজ করে, মাংসাশী প্রাণীদের ক্ষেত্রে শিকার ধরতে সাহায্য করে, আবার বুনো শুয়োরের মতো জন্তুদের ক্ষেত্রে এই দুটি উদ্দেশ্যই সাধিত হয়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি খুব সামান্যই প্রয়োজনে লাগে, এমনকী কালো মানুষদের ক্ষেত্রেও, যদিও তাদের মধ্যে এর বিকাশ সভ্য ও সাদা মানুষদের তুলনায় অকেটাই বেশি।[৮] তথাপি, এটি তাদের বিপদ-বার্তা জানায় না, আবার কিছু খুঁজতেও সাহায্যও করে না; তীব্র দুর্গন্ধময় পরিবেশ এক্সিমোদের ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না বা বর্বরদের ক্ষেত্রে অর্ধগলিত মাংস আহার থেকে নিবৃত্ত করে না। ইউরোপীয়দের মধ্যে ঘ্রাণের অনুভূতি একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম এ ব্যাপারে আমি আরও নিশ্চিত হয়েছি জনৈক বিখ্যাত প্রকৃতিতত্ত্ববিদকে পরীক্ষা করে, যাঁর মধ্যে এই অনুভূতি অত্যন্ত বেশি এবং তিনি তা প্রমাণ করেছেন। ক্রমবিবর্তনের নীতিতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা এ-কথা সহজে স্বীকার করতে চাইবেন না যে মানুষের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি এখন যে অবস্থায় আছে, তা মানুষের স্বোপার্জিত। উত্তরাধিকারসূত্রে এই বিশেষ ক্ষমতা সে খুবই দুর্বল ও প্রাথমিক অবস্থায় লাভ করেছে। সেইসব আদিম পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, যাদের কাছে ঘ্রাণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কার্যকরী ক্ষমতাবিশিষ্ট এবং নিয়মিত ব্যবহারযোগ্য। যে-সমস্ত প্রাণীদের এই অনুভূতি যথেষ্ট বিকশিত, যেমন কুকুর বা ঘোড়া তাদের ক্ষেত্রে কোনো প্রাণী বা স্থানের স্মৃতি গন্ধের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সম্ভবত এবার আমরা বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কী এবং এ বিষয়ে ড. মডস্লে ঠিকই বলেছেন, যে মানুষের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি ‘শুধুমাত্র বিস্মৃত দৃশ্য এবং স্থানের স্পষ্ট ছবি ও অনুভূতি মনে করার ব্যাপারেই কার্যকরী।’

[৮. দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীদের প্রখর ঘ্রাণশক্তি সম্পর্কে অধ্যাপক হামবোল্ডের বক্তব্য যথেষ্টই পরিচিত, অন্যরাও তা সমর্থন করেন। মি. হুজো ‘Etudes sur les Fuculte’s Mentales’ ইত্যাদি, খণ্ড, ১, ১৮৭২, পৃ. ৯১-তে জোর দিয়ে বলেছেন যে তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন নিগ্রো এবং রেড ইন্ডিয়ানরা তাদের ঘ্রাণাভূতি দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেও যে- কোনো ব্যক্তিকে চিনতে পারে। ড. ডব্লু. ওগল ঘ্রাণশক্তি ও শরীরের তৈলাক্ত অঞ্চলের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির বর্ণগত উপাদান এবং তৎসহ শরীরের চামড়ার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার লক্ষ করেন। সেইজন্যই আমি পরবর্তী সময়ে বলেছি সাদা বর্ণের জাতিগুলোর তুলনায় কালো বর্ণের জাতিগুলোর ঘ্রাণানুভূতি প্রখর ও সূক্ষ্ম হয়। দ্রষ্টব্য, তাঁর গবেষণাপত্রগুলো, ‘মেডিকো-চিররেজিক্যাল ট্রানজাকশন’, লন্ডন, খণ্ড, ৩,পৃ. ২৭৬।]

অন্যান্য দ্বিপদী বানর জাতীয় প্রাণীদের থেকে একটা ব্যাপারে মানুষ স্পষ্টতই আলাদা—তার শরীর প্রায় রোমহীন। পুরুষদের দেহে বেশির ভাগ জায়গায় তবু ইতস্তত ছড়ানো সামান্য কিছু রোম বা চুল দেখা যায়, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে তা প্রায় থাকে না বললেই চলে। রোমশতার ব্যাপারে বিভিন্ন জাতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, আবার একই জাতির সকলের রোম শুধুমাত্র পরিমাণেই নয়, অবস্থানেও আলাদা হতে পারে। কোনো কোনো ইউরোপবাসীর কাঁধ একেবারে রোমশূন্য, আবার কারুর হয়তো ঘন। রোমে আচ্ছাদিত। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের শরীরে ছড়িয়ে থাকা রোম আসলে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের শরীর জুড়ে সুষম রোমাচ্ছাদনেরই লুপ্তপ্রায় চিহ্নবিশেষ। এ-কথা আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যখন হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশের পুরনো প্রদাহিত স্থানে ওষুধপত্র বা মালিশ লাগালে সেখানকার ধূসর রঙের পাতলা ছোট ছোট রোম কখনো কখনো ‘ঘন, লম্বা ও গাঢ় কালো রঙের চুলে’ পরিণত হয়।

স্যার জেম্স প্যাগেট আমাকে জানিয়েছেন যে একই পরিবারভুক্ত কয়েকজনের ভ্রূপল্লবে প্রায়ই এমন দু-একটি চুল দেখা যায় যেগুলো অন্যদের তুলনায় অনেক দীর্ঘ। এই সামান্য বৈশিষ্ট্যটিও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বলেই আমার ধারণা। এই দীর্ঘ কেশগুচ্ছও তাদের সুদূর পূর্বপুরুষদেরই প্রতিনিধিস্বরূপ, কারণ শিম্পাঞ্জি ও ম্যাকাকাস জাতীয় বানরদের কোনো কোনো প্রজাতির মধ্যে চোখের উপরে রোমহীন চামড়া থেকে উৎপন্ন বিক্ষিপ্ত কিন্তু রীতিমতো দীর্ঘ চুল দেখা যায়, যা আমাদের ভ্রূর সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। কোনো কোনো বেবুনের রোমশ ভ্রূপ্রদেশ থেকেও একইরকম লম্বা চুল বেরিয়ে থাকতে দেখা যায়।

এখানে একটি কৌতূলোদ্দীপক বিষয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। ছ-মাস বয়সের মানুষের ভ্রূণ পাতলা পশমের মতো রোম বা লানুগো-য় আবৃত থাকে। মাস পাঁচেকের সময় এগুলো প্রথম উদগত হয় এবং ভ্রূ ও মুখমণ্ডলে, বিশেষত মুখগহ্বরের চারপাশে, মাথার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে এ-রকম চুল দেখা যায়। এটি একটি মেয়ে-ভ্রূণে এমনকী গোঁফের আভাস পর্যন্ত দেখেছেন। কিন্তু এ ঘটনা খুব-একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কেননা বিকাশের প্রথমাবস্থার বাহ্যচরিত্রলক্ষণে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে সাধারণত আরও অনেক ধরনের মিলই বর্তমান থাকে। ভ্রূণের শরীরে রোমের অভিমুখ ও বিন্যাস একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতোই, যদিও নানারকম পরিবর্তনের সম্ভাবনা থেকেই যায়। কপাল ও কানদুটি সমেত সমস্ত শরীর জুড়েই বিস্তৃত থাকে ঘন রোমরাজি, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো হাতের তালু ও পায়ের পাতা দুটি থাকে মসৃণ, রোমহীন, ঠিক যেমনটি দেখা যায় নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের চার হাত-পায়ের নিচে। এটাকে নিছকই একটা সমাপতন বলে মেনে নেওয়া যায় না। বরং মনে করা যেতে পারে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে যারা রোমশ অবস্থায় জন্মায়, সম্ভবত তাদের শরীরের রোমের আচ্ছাদনই ভ্রূণের অবয়বের এই রোমশতার প্রথম পূর্বসূরি। জন্ম থেকেই যারা শরীর ও মুখ ঘন রোমে আবৃত, এ-রকম তিন-চার জনের কথা নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই অদ্ভুত অবস্থা উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত ও দাঁতের অস্বাভাবিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[৯]

[৯. অধ্যাপক অ্যালেক্স ব্রান্ড সম্প্রতি এই বৈশিষ্ট্যগুলো সমন্বিত এক রাশিয়ান পিতাপুত্রের খবর জানিয়েছেন। দুজনের ছবিই আমি প্যারিস থেকে পেয়েছি।]

অধ্যাপক অ্যালেক্স ব্র্যান্ড আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির মুখের চুল একটি ভ্রূণের রোমের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন, তাদের গঠনরীতি প্রায় এক। তাই তিনি বলেছেন, উপরিউক্ত বিষয়টিকে চুলের বিকাশের গতিরোধের এবং ক্রমবৃদ্ধির ফল হিসেবে দেখানো যেতে পারে। অনেক দুর্বল শিশুর পিঠে লম্বা রেশমের মতো রোম দেখা যায় যা আমি শিশু-হাসপাতালের জনৈক শল্য-চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনেছি। তার কারণও সম্ভবত এই একই।

উন্নত সভ্য জাতের মানুষদের ক্ষেত্রে পেছনের পেষক-দাঁত (posterior moalr) বা আক্কেল-দাঁত ক্রমশ অবলুপ্তির দিকেই এগোচ্ছে। অন্যান্য পেষক- দাঁতের তুলনায় আক্কেল-দাঁত আকারে অনেক ছোট, যেমনটি দেখা যায় শিম্পাঞ্জি ও ওরাং-ওটাংদের ক্ষেত্রে, এবং এদের মাত্র দুটি করে আলাদা ছেদক-দাঁত থাকে। কম-বেশি সতেরো বছরের আগে আক্কেল-দাঁত মাড়ি কেটে বেরোয় না এবং আমি নিশ্চিত যে অন্যান্য দাঁতের চেয়ে অনেক আগেই তা ক্ষয় হয়ে যায় বা পড়ে যায়। কোনো কোনো দন্ত-বিশারদ অবশ্য তা স্বীকার করেন না। আবার অন্যান্য দাঁতের তুলনায় এই দাঁতটি গঠন ও বিকাশকালের ক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে, মেলানিয়ান জাতির মধ্যে আক্কেল- দাঁত তিনটি আলাদা ছেদক-দাঁতের সঙ্গে একত্রে থাকে এবং সাধারণত সুস্থ অবস্থাতেই থাকে। অন্যান্য দাঁতের তুলনায় এগুলো পৃথক আকারের হলেও ককেশিয়ান জাতির ক্ষেত্রে এই পার্থক্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অধ্যাপক শ্যাফহউসেন জাতিগুলোর মধ্যেকার এই পার্থক্যকে সূচিত করেছেন এইভাবে : সভ্য জাতিগুলোর ক্ষেত্রে ‘চোয়ালের পশ্চাদংশের আকার সর্বদাই ছোট।’ তার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, নিয়মিত নরম এবং সিদ্ধ খাদ্য খাওয়ার যে- অভ্যাস সভ্যজাতিগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার ফলে তাদেরকে চোয়ালের কসরত খুবই কম করতে হয়। মি. ব্রেস আমাকে জানিয়েছেন, আমেরিকায় এখন বাচ্চাদের মাড়ির কিছু দাঁত তুলে ফেলা প্রায় একটা সাবর্জনীন ঘটনা এসে দাঁড়িয়েছে, কারণ স্বাভাবিক দাঁতের পূর্ণ বিকাশের জন্য যতটা দরকার চোয়ালের হাড় ঠিক ততটা বাড়তে পারে না।[১০]

[১০. অধ্যাপক মতেগাজা ফ্লোরেন্স থেকে আমাকে লিখেছেন যে তিনি সাম্প্রতিককালে মানুষের বিভিন্ন জাতির শেষ বা তৃতীয় মোলার-দাঁত (আকারে বড়, পেষক-দাঁত) বিষয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছেন এবং তিনিও এই একই সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন, অর্থাৎ উচ্চতর বা সুসভ্য জাতিগুলোর মধ্যে তৃতীয় পেষক-দাঁত অপুষ্টিজনিত কারণে হয় ক্ষয়ে যাচ্ছে, নতুবা ক্রমবিলুপ্তির পথে।]

পৌষ্টিক নালীতে আমি একটিমাত্র লুপ্তপ্রায় অঙ্গের কথা জানি, যাকে সিকাম-এর ভারনিফর্ম অ্যাপেনডেজ (Vermiform appendage of the caecum) বলা হয়। সিকাম হলো অন্ত্রের একটি শাখা বা বর্ধিত অংশবিশেষ, যা ক্যুল দ্য সাক-এ গিয়ে শেষ হয়েছে। নিম্নশ্রেণির অনেক তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট দীর্ঘ। কোয়ালা জাতীয় ক্যাঙারুর ক্ষেত্রে এটি তার পুরো শরীরের তিন গুণেরও বেশি লম্বা। কখনো কখনো দেখা যায় এটি নিচের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে কিংবা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। খাদ্যভ্যাস বা খাদ্যের পরিবর্তনের ফলে দেখা যায় কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে সিকাম খুব ছোট হয়ে এসেছে এবং ভারমিফর্ম অ্যাপেনডেজ সেক্ষেত্রে এই হ্রাসপ্রাপ্ত অঙ্গের লুপ্তপ্রায় একটি অংশ হিসেবে পড়ে রয়েছে। অধ্যাপক কানেসত্রিনি মানুষের ক্ষেত্রে এর বিভিন্ন আকারের নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। অ্যাপেনডিক্সের ক্ষুদ্র আকার এবং কানেসত্রিনির সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে আসলে এটি একটি লুপ্তপ্রায় প্রাথমিক অঙ্গবিশেষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি যেমন আদৌ না থাকতে পারে, তেমনি আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দারুণভাবে বিকশিত অবস্থাতেও দেখা যেতে পারে। এর অবস্থানের অর্ধেক বা তিন ভাগের দু-ভাগ জায়গাই কখনো কখনো এর আয়তনে ভরে যায়, আর শেষাংশ চওড়া ও শক্ত হয়ে বেড়ে ওঠে। ওরাংওটাং-এর অ্যাপেনজে বেশ লম্বা এবং কুণ্ডলীকৃত। মানুষের ক্ষেত্রে এটি হ্রাসপ্রাপ্ত সিকামের শেষপ্রান্তে দেখা যায় এবং সাধারণত চ র থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়, যার ব্যাস মাত্র এক ইঞ্চির এক-তৃতীয়াংশ। এটি শুধু যে অপ্রয়োজনীয় তাই নয়, কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে সম্প্রতি দু’টি ঘটনার কথা শুনেছি আমি। ঘটনার কারণ কোনো শক্ত ক্ষুদ্র বস্তু, যেমন দানা খাদ্য, এর মধ্যে কোনোক্রমে প্রবেশ করলে প্রচণ্ড প্রদাহ ও যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়।[১১]

[১১. এম. সি. মার্তাস (Revue des deux modes) এবং হ্যাকেল (Geneneue Morphologic) উভয়েই উল্লেখ করেছেন যে এই লুপ্তপ্রায় অঙ্গটি কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।]

নিম্নশ্রেণির কিছু বানর (quadrumana), লেমুর ও মাংসাশী প্রাণী এবং অধিকাংশ ক্যাঙারুর মধ্যে হাতের ঊধ্বাংশের হাড়ের (humerus) শেষাংশে সুপ্রা-কন্ডিলয়েড ফোরামেন (Supra-condiloid foramen) নামে একটি ছিদ্র থাকে, যার মধ্যে দিয়ে সম্মুখ-হাতের প্রধান স্নায়ু এবং প্রায়শই প্রধান ধমনী অতিক্রম করে। মানুষের বাহুতেও সাধারণত এই একই ধরনের ছিদ্রের চিহ্ন দেখা যায়, কখনো কখনো সেটা বেশ স্পষ্টভাবেই থাকে। হাড়ের একটা হুকের মতো বাঁকের ফলেই এটা সৃষ্টি হয় এবং সম্পূর্ণ হয় একপ্রস্থ অস্থিবন্ধনী পেশির সাহায্যে। ড. স্ট্রুথার্স[১২] যিনি এই বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছেন, লক্ষ করেছেন যে এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি কখনো কখনো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়। একজন লোকের কথা তিনি বলেছেন যার সন্তানদের মধ্যে চারজনের শরীরে তাদের পিতার মতো বৈশিষ্ট্যটি বিদ্যমান। ছিদ্রটি যদি থাকে, তাহলে প্রধান স্নায়ু অবশ্যই তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, এবং এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে এটি হচ্ছে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের সুপ্রা-কন্ডিলয়েড ফোরামেন এর লুপ্তপ্রায় অংশেরই অনুরূপ। অধ্যাপক টার্নার হিসাব করে দেখিয়েছেন, বর্তমানে মানুষের শতকরা একভাগের মধ্যে এটি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে যদি মানুষের মধ্যে পুনরায় এর বিকাশ ঘটে (আর তা ঘটা একেবারে অসম্ভবও নয়), তাহলে তা হবে পুনরায় সেই অতি প্রাচীন অবস্থায় ফিরে যাওয়া, কারণ উচ্চশ্রেণির বানরদের মধ্যেও বর্তমানে এটি অনুপস্থিত।

[১২. বংশানুক্রম প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য ড. ট্রুথার্সের প্রবন্ধ, ‘লানসেট্’, ১৫ ফেব্রুয়ারি,পৃ. ৮৭৩ এবং ওই একই পত্রিকায় অপর এক গবেষণাপত্র যার প্রকাশকাল ২৪ জানুয়ারি, ১৮৬৩, পৃ. ৮৩। আমার জানা খবর অনুযায়ী ড. নক্সই সম্ভবত প্রথম শারীরবিদ্ যিনি মানুষের দেহের এই অদ্ভুত বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দ্রষ্টব্য, তাঁর ‘গ্রেট অ্যার্টিস্টস অ্যান্ড অ্যানাটমিস্টস’, পৃ. ৬৩। আর ও দ্রষ্টব্য, ড. গ্রবার-এর গুরত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা,—Bulletin de I’ Aead. Imp de st, petersbourg’, খণ্ড ১২, পৃ. ৪৪৮।]

মানুষের বাহুর হাড়ে কখনো-সখনও আর একটি ফোরামেন বা ছিদ্রও দেখা যায়, যাকে ইন্টার-কন্ডিলয়েড বলে। সবসময় না হলেও বিভিন্ন জাতের বনমানুষ, গরিলা, বানর এবং এই জাতীয় অনেক নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের দেহে মাঝে মধ্যে এর দেখা মেলে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপর হলো, এই ছিদ্রটি মানুষের মধ্যে এখনকার তুলনায় অনেক বেশি দেখা যেত প্রাচীনকালে। মি. বাসকে[১৩] এ-বিষয়ে নিম্নলিখিত তথ্যসমূহ জোগাড় করেছেন : অধ্যাপক ব্রকা প্যারিসের দক্ষিণ প্রান্তের কবরখানা থেকে সংগৃহীত বাহুর হাড়ের শতকরা সাড়ে চার ভাগ ক্ষেত্রে ছিদ্রটি লক্ষ করেছিলেন এবং ওরোনি-তে ব্রোঞ্জ যুগের মাটির গহ্বর থেকে পাওয়া বত্রিশটি প্রগণ্ডাস্থির (humeri) মধ্যে আটটিতে এই ছিদ্র দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করেন এই অস্বাভাবিক অনুপাত সম্ভবত পারিবারিক কবরখানার কারণেই। মঁসিয়ে দুপো আবার লেসি-উপত্যকার গুহায় রেইনডিয়ার যুগের ছিদ্রযুক্ত হাড় দেখেছিলেন শতকরা ত্রিশ ভাগ। মঁসিয়ে লুগয়ে আঁজাতুঁলের ডলমেন* এ রক্ষিত শতকরা পঁচিশ ভাগ দেহে এই ছিদ্র লক্ষ করেছিলেন এবং মঁসিয়ে প্রুনার বে একই অবস্থায় ভরিল থেকে পাওয়া হাড়ে এর সংখ্যা দেখেছিলেন শতকরা ছাব্বিশ ভাগ। মঁসিয়ে প্রুনার বে বলেছেন, ‘গুয়াস (guanche) অস্থিকাঠামোর ক্ষেত্রে এটি একটি খুবই সাধারণত ঘটনা।’ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো—এ বিষয়ে আরও অনেক বিষয়ে প্রাচীন জাতিগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিকালের জাতিদের তুলনায় অনেক বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের। এর প্রধান কারণ সম্ভবত প্রাচীন জাতিগুলো তাদের সুদূর পশুসদৃশ পূর্বপুরুষদের দীর্ঘ বংশধারার অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী।

[১৩. ‘অন দ্য কেভস অফ জিব্রালটার’, ট্রানজাকশন ইন ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ প্রিহিস্টোরিক্যাল আর্কিওলজি’, তৃতীয় অধিবেশন, ১৮৬, পৃ. অধ্যাপক ওয়াইম্যান সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে (৪র্থ বার্ষিক রিপোর্ট, পিয়াবডি মিউজিয়াম, ১৮৭১, পৃ. ২০), পশ্চিম আমেরিকা ও ফ্লোরিডা অঞ্চলের প্রাচীন ঢিপিগুলোর মধ্যে কবরস্থ মানুষদের শতকরা একত্রিশ ভাগের হাড়ে এই ছিদ্র আছে। একই ব্যাপর নিগ্রোদের মধ্যেও খুবই বেশি দেখা যায়। ডলমেন-দুটি খাড়া প্রস্তরখণ্ডের উপর রাখা প্রস্তরখণ্ড বিশেষ।]

মানুষের ক্ষেত্রে অন্যান্য কশেরুকা বা মেরুদণ্ডের অংশসহ অনুত্রিকাস্থিটি লেজের মতোই অকেজো হলেও আসলে তা কিন্তু অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ওই অংশেরই সমতুল। মানুষের ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় এই অংশটি যে বেশ প্রত্যক্ষ ও শেষপ্রান্ত থেকে কিছুটা বর্ধিত, তা যে-কোনো ভ্রূণের ছবিতেই দেখা যেতে পারে (ছবি ১)। এমনকী জন্মের পরেও কোনো দুলর্ভ ক্ষেত্রে অংশটি লেজের একটি ছোট্ট প্রাথমিক অংশের পরিচয়সহ বাইরে বেরিয়ে থাকে।[১৪] সাধারণত মাত্র চারটি কশেরুকা নিয়ে গঠিত এই অনুত্রিকাস্থিটি আকারে বেশ ছোট এবং দৃঢ়সম্বন্ধ। এগুলো যে গঠনের প্রাথমিক বা আদিম রূপের অবশেষে হিসাবেই রয়েছে তা স্পষ্টই বোঝা যায়, কেননা মেরুদণ্ডের তলস্থিত অংশটি ছাড়া বাকিগুলো শুধুমাত্র মধ্য-অংশকেই (centrum) ধারণ করে থাকে। কতকগুলি ছোট পেশিতন্ত্রর আবরণে ঢাকা থাকে এগুলি। অধ্যাপক টার্নার আমাকে জানিয়েছেন যে এগুলির মধ্যে একটিকে থেইল্ চিহ্নিত করেছিলেন লেজেরই প্রাথমিক পুনরাবৃত্তি হিসেবে- এটি এমন একটি পেশি যা বহু স্তন্য পায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে দারুণভাবে বিকশিত হয়েছে।

[১৪. অধ্যাপক কাত্রেফাজ সাম্প্রতিককালে এই বিষয়ে কিছু তথ্য যোগাড় করেছেন, Revue des cours scientifiques’, ১৯৬৭-৬৮ পৃ. ৬২৫। ১৮৪০ সালে ফ্লিথমান এমন একটি লেজযুক্ত মানুষের ভ্রূণ প্রদর্শন করেছিলেন যা সচরাচর দেখা যায় না-এটা মেরুদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। লেজটিকে বহু শারীরবিদ আরল্যানজেন-এর প্রাণিতত্ত্ববিদদের আলোচনা-সভায় উপস্থিত থেকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। {দ্রষ্টব্য, মার্শালের ‘ Nied erlandi-schen Archiv fir zoologie’ ১৮৭১]।]

মানুষের সষম্নাকাণ্ড পৃষ্ঠদেশের শেষপ্রান্ত বা প্রথম ‘লাম্বার’ কশেরুকা পর্যন্ত গেছে। কিন্তু সরু সুতোর মতো একটি তন্তু (filum terminale) মেরুনালীর সেক্রাল অংশের অক্ষ বরাবর নেমে গেছে, এমনকী সেটাকে অনুত্রিকাস্থির পিছন পর্যন্ত ও দেখা যায়। অধ্যাপক টার্নারের মতে এই তন্তুর ঊধ্বংশটি নিঃসন্দেহে সুষুম্নাকাণ্ডের অনুরূপ, কিন্তু নিম্নাংশটি শুধুমাত্র পায়ামেটার (piamater) বা স্নায়ুতন্ত্রের ঝিল্লি দিয়েই তৈরি। এক্ষেত্রেও অনুত্রিকাস্থিটি মেরুদণ্ডের মতো একটি গুরত্বপূর্ণ অঙ্গের অবশেষে বলেই বিবেচিত হয়, যদিও তার সঙ্গে মেরুনালির কোনো যোগ নেই। অধ্যাপক টার্নারের কাছে আমি

কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি দেখিয়েছেন নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের লেজের সঙ্গে অনুত্রিকাস্থি কতটা সাদৃশ্যযুক্ত। অধ্যাপক লুস্কা কিছুদিন আগে অনুত্রিকাস্থির শেষ প্রান্তে খুবই অদ্ভুত কুণ্ডলীকৃত একটি অংশ আবিষ্কার করেছেন যা মধ্য-সেক্রাল ধমনীর সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই আবিষ্কার অধ্যাপক ক্রাউস ও অধ্যাপক মেয়ারকে একটি বানর ও একটি বিড়ালের লেজ নিয়ে পরীক্ষায় উৎসাহিত করেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা একইরকম কুণ্ডলীকৃত অংশের সন্ধান পেয়েছেন, যদিও তা ঠিক, শেষপ্রান্তে নয়।

জননপ্রক্রিয়া এমন কিছু কিছু অঙ্গের ব্যবহার আছে যা এখন প্রায় প্রাথমিক বা লুপ্ত অঙ্গের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তবে এগুলো আগের ব্যাপারগুলো থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাদা—এখানে এমন কোনো অঙ্গ বা অঙ্গের অংশ আমাদের আলোচ্য নয় যা প্রজাতিগুলোর মধ্যে আর কার্যকরী অবস্থায় নেই, বরং প্রজাতির দুটি বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে একটিতে কার্যকরী এবং অন্যটিতে নিতান্ত প্রাথমিক কার্যকরী অবস্থায় রয়েছে। তথাপি আগের উদাহরণগুলোর মতো এক্ষেত্রেও প্রজাতিগুলো আলাদা আলাদা ভাবে সৃষ্ট হয়েছে এই ধারণা থেকে এই প্রাথমিত অঙ্গের উৎপত্তির ব্যাখ্যা করা কঠিন এসব প্রাথমিক অঙ্গের ব্যাপারে আমি পরে দেখাব যে নিতান্ত উত্তরাধিকারপ্রথাই এক্ষেত্রে কাজ করে, অর্থাৎ একটি লিঙ্গ যে-অঙ্গটি প্রাপ্ত হয়, তা অন্য লিঙ্গে অংশত সঞ্চারিত হয়। এখানে আমি এই ধরনের কয়েকটি লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদাহরণ দেব। আমরা সকলেই জানি যে মানুষ সমেত সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রজাতির পুরুষদেরই প্রাথমিক দুগ্ধ-গ্রন্থি আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট বিকশিত হয়ে ওঠে এবং প্রচুর দুধ উৎপাদন করতে পারে। উভয় লিঙ্গের মধ্যে এই দুগ্ধগ্রন্থির কিছু সাদৃশ্যও চোখে পড়ে, যেমন হামে আক্রান্ত হওয়ার সময় উভয়েই স্ফীত হয়ে ওঠে। ভেসিকিউলা প্রোসটাটিকা, যা অনেক পুরুষ-স্তন্যপায়ীর শরীরে থাকে, তা যে সংযুক্ত-নালিসহ নারীর জরায়ুরেই অনুরূপ—এ- কথা এখন সর্বস্বীকৃত। এই দেহাংশটি সম্বন্ধে অধ্যাপক লিউকার্ট-এর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা স্বীকার না করে উপায় নেই। বিশেষত সেইসমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এ-কথা আরও স্পষ্ট যাদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে জরায়ু দুটি ভাগে বিভক্ত থাকে[১৫], কেননা তাদের পুরুষদের ভেসিকিউলাও অনুরূপভাবে বিভক্ত। জননতন্ত্রের অন্তগর্ত আরও কিছু লুপ্তপ্রায় অঙ্গের কথা এখানে আর উল্লেখ করা হলো না।

[১৫. লিউকাট, টডের ‘সাইক্লোপিডিয়া অফ অ্যানাটমি’, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪১৫। মানুষের এই অঙ্গটির দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক, কিন্তু অন্যান্য অনেক লুপ্তপ্রায় অঙ্গের মতো এটিও বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসহ পরিবর্তনশীল।]

এখানে যে তিন শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কথা উল্লেখ করা হলো, তা অভ্রান্ত। তবে ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’-এ যেভাবে বিশদে বলেছি, এখানে তার পুনরাবৃত্তি অর্থহীন। একই শ্রেণির অন্তর্গত সমস্ত প্রাণীদের শারীরিক কাঠামোর সাদৃশ্য বেশ বোঝা যায় যদি আমরা তাদের একজন সাধারণ পূর্বপুরুষের কথা স্বীকার করে নিই এবং বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত অবস্থায় নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার যোগ্যতার কারণে তাদের পার্থক্যের কথা মনে রাখি। অন্য কোনো মতবাদের দ্বারা মানুষ বা বানরের হাত, ঘোড়ার পা, সীলমাছের পাখনা, বাদুড়ের ডানা ইত্যাদির মধ্যে গঠনগত সাদৃশ্যের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।[১৬] একই আদর্শ ছক অনুযায়ী তারা গঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়াটা নিশ্চয়ই কোনো বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রসূত ব্যাখ্যা নয়। বিকাশের ক্ষেত্রে ভ্রূণের শেষ দশায় পরিবর্তনের মূল নীতি কীভাবে হঠাৎ কার্যকরী হয় এবং অনুরূপ সময়ে বংশানুসরণ করে কেমন আশ্চর্যজনকভাবে ভ্রূণগুলো কাঠামো ও গঠনে বিভিন্নতা প্রাপ্ত হয়, সেটা আমরা বুঝতে পারি এবং আরও বুঝতে পারি এই বিভিন্নতার মধ্যেও কীভাবে তারা তাদের একই পূর্বপুরুষের কাঠামোকে কম- বেশি ধরে রাখে নিজেদের অবয়বে। মানুষ, কুকুর, সীল, বাদুড়, সরীসৃপ ইত্যাদির ভ্রূণকে যে প্রথম অবস্থায় আলাদা করা কঠিন—এই চমকপ্রদ বিষয়টির অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেয়া আজও সম্ভব হয়নি। আদিম বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে আমরা বড়জোর অনুমান করেছি যে আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে একসময় এসব অঙ্গ যথাযথভাবেই বিদ্যমান ছিল এবং কালক্রমে জীবনযাপনের অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে এই অঙ্গগুলোর ব্যবহার কমে যাওয়ায় এগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে গেছে বা কোথাও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অথবা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

[১৬. অধ্যাপক বিয়ানকনি সম্প্রতি প্রকাশিত ছবিসহ একটি চমৎকার বইতে (La Thioric dar wirienne et la dite independlente, ১৮৭৪) দেখাতে চেয়েছেন যে উপরোল্লিখিত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুরূপ গঠন-কাঠামোকে তাদের ব্যবহারিক অনুযায়ী যান্ত্রিক নীতিতেই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আর কেউই বোধহয় এত ভালোভাবে দেখাতে পারেননি যে এই ধরনের গঠন-আকৃতি কী আশ্চর্যভাবে এদের মুখ্য উদ্দেশ্যের পক্ষে উপযোগী হয় ওঠে, এবং আমি মনে করি এই উপযোগীকরণকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতবাদ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বাদুড়ের ডানা পরীক্ষা করে তিনি (বিয়ানকনি) যা উপস্থিত করেন, অগুস্ত কোঁৎ’-এর কথা ধার করে বলা যায়—’আমার কাছে তা শুধুমাত্র একটি অধিতাত্ত্বিক নীতি বলে মনে হয়’, অর্থাৎ সংরক্ষণ হলো—’প্রাণীর স্তন্যপায়ী প্রকৃতির অখণ্ডতা’। মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি আদিম বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গের আলোচনা করেছেন এবং তা-ও আবার সেইসমস্ত অঙ্গ যা এখনও আংশিকভাবে আদিম বা প্রাথমিক, যেমন গরু বা শুয়োরের এমন খুর যা মাটি স্পর্শ করে না। তিনি সুস্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন, ওটা তাদের এখনও কাজে লাগে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে তিনি এক্ষেত্রে গরুর চোয়াল কেটে উঠতে পারা কৃদন্ত বা চতুষ্পদ পুরুষ-পশুদের দুগ্ধগ্রন্থি বা গুবরে পোকার ডানা বা কাঁধের ডানা-আচ্ছাদনের মধ্যে থাকে কিংবা ফুলের গর্ভকেশরের চিহ্ন অথবা বিভিন্ন ফুলের পুংকেশর এবং আরও অনেক বিষয়ে আদৌ আলোচনা করেননি। যদিও আমি দারুণভাবে অধ্যাপক বিয়ানকনির কাজের প্রশংসা করি, তবু আমার মনে হয় অধিকাংশ প্রাণীতত্ত্ববিদের মধ্যে এই ধারণা এখনও অক্ষত যে অনুরূপ গঠন- আকৃতিকে নিছক অভিযোজনের নীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।]

সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি কীভাবে মানুষ এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী একই সাধারণ কাঠামোয় তৈরি হয়েছে, কীভাবে তাদের সকলকে বিকাশের একই প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে এবং কেনই বা তাদের কয়েকটি লুপ্তপ্রায় আদিম অঙ্গও এক। ফলে তাদের বংশধারার সাদৃশ্যও আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। এ ব্যাপারে অন্য কোনো মত গ্রহণ করার অর্থ হলো এটাই স্বীকার করে নেওয়া যে আমাদের নিজেদের শারীরিক কাঠামো এবং চারপাশের অন্যান্য জীবজন্তুদের শারীরিক কাঠামোগুলো স্রেফ আমাদের ধোঁকা দেয়ার উপকরণ মাত্র। এই সিদ্ধান্ত আরও জোরদার হবে যদি আমরা সেটা প্রাণীজগতের দিকে তাকাই এবং তাদের সাদৃশ্য ও শ্রেণিবিভাজন থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ, ভৌগোলিক বিভাজন ও ভূতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের (জীবাশ্মঘটিত) প্রমাণসমূহ বিচার করে দেখি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে-রকম স্পর্ধার সঙ্গে বলতেন যে তাঁরা দেবতাদের অংশ, তা যদি আমাদের সিদ্ধান্তকে কখনো প্রভাবিত করে তাহলে সেটাকে স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কিন্তু শীঘ্রই এমন এক দিন আসবে, যখন লোকে শুনলে আশ্চর্য হবে যে, একসময় প্রকৃতিতত্ত্ববিদরা (যাঁরা কিনা মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনামূলক শারীরিক গঠনতত্ত্ব ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেছেন) বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকটি প্রাণীর ক্ষেত্রেই নাকি সৃজনের নিয়ম আলাদা আলাদাভাবে কাজ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *