কাউরীবুড়ির মন্দির
নিবিড় ও গহিন অরণ্যের মধ্যে এক গাঢ় নিস্তব্ধ রাত৷ চারিদিক ছেয়ে আছে আদিম বনজ নৈঃশব্দ্যে৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই, প্রাণের কোনো সাড়া নেই, সময় এখানে মৃত, জীবন এখানে স্তব্ধ৷
অরণ্যের মধ্যে একটি অতি প্রাচীন মন্দির৷ তার আদিম পাথুরে গায়ে খোদাই করা আছে শতাব্দীপ্রাচীন অজানা ইতিহাসের প্রলেপ৷ সেই পাথরের গায়ে এই প্রাগৈতিহাসিক আদিম বনভূমির ছায়া এসে পড়ে, এসে পড়ে চাঁদের অপার্থিব জ্যোৎস্না৷ তারা ফিসফিস করে বলে যায় কত অজানা গল্প, কত গোপন দীর্ঘশ্বাসের কাহিনি৷
সেই মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ রয়েছে একটি অদ্ভুত মূর্তি, আমাদের চেনা মূর্তির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ মূর্তির সামনে জ্বলছে দুটি বড় বড় প্রদীপ৷ প্রদীপ দুটির মধ্যস্থলে বজ্রাসনে বসে আছেন একজন নারী৷ নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো অচঞ্চল তিনি৷ তাঁর শুষ্ক শানিত মুখে ক্লান্ত আনন্দশৈথিল্য৷ অনেক দুঃসাধ্য উপাসনার শেষে আজ তিনি জয়ী, আজ তিনি সিদ্ধ৷
‘‘মাই…তুই এসেছিস মাই?’’ নিজের মাতৃভাষায় ধীর ও শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন তিনি, জনহীন অরণ্যের বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ খেলে গেল অক্ষরমালাগুলি৷
কিছুক্ষণের স্থির স্তব্ধতার পর অন্ধকার রাত্রির বুক চিরে, পাতালের গহিন থেকে, অজানা নক্ষত্রলোক থেকে উঠে এল এক অলৌকিক অপার্থিব খনখনে স্বর—
‘‘আমাকে কে জাগালি রে মেয়ে? কে তুই?’’
‘‘আমি তোর দেওরি রে মাই৷ তোর মেয়ে৷’’
‘‘কী চাস মেয়ে? কেন জাগালি আমাকে?’’
‘‘আশীর্বাদ চাই মাই, নাগযক্ষিণীর আশীর্বাদ৷’’
‘‘কেন রে মেয়ে? এমন ভয়ানক দৈবী শক্তি নিয়ে কী করবি তুই?’’
‘‘আমার সবকিছু যে হারিয়ে যাচ্ছে মাই…ওই…ওই ডাইনি যে ছিনিয়ে নিতে এসেছে আমার সবকিছু৷ আমি তা হতে দেব না মাই, আমার সবকিছু হারিয়ে আমি পথের ভিখিরি হতে পারব না৷’’
‘‘শোন রে মেয়ে, নাগযক্ষিণীর জাদু বড় কঠিন জাদু, বড় দুরূহ বিদ্যা৷ শুধুমাত্র মন্ত্রসাধনায় তাকে আয়ত্ত করা যায় না৷ হৃদয় শুদ্ধ না হলে, চিত্ত পবিত্র না হলে, বুদ্ধি প্রসন্ন না হলে তাকে অধিকার করা বড় কঠিন৷ বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিতে সে বিদ্যা মুহূর্তে মহাবিষধর নাগ হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিশোধস্পৃহায় নিজের প্রয়োগকারীকেই দংশন করে বসে…’’
‘‘জানি রে মাই…’’ নারীটির স্বর অটল, অচঞ্চল, ‘‘তোর মেয়েরা এ সবই জানে৷ এইসব জেনেই আজ আমি জাগিয়েছি তোকে৷’’
‘‘আরেকবার ভেবে নে মেয়ে, যা চাইছিস তার কিন্তু মূল্য বড় সাংঘাতিক৷’’
‘‘বল রে মাই, কী চাস তুই৷’’
‘‘দেওয়ার মতো কী মূল্য তোর কাছে আছে রে মেয়ে?’’
‘‘ধন, সম্পদ, যৌবন, জীবন, সব আছে রে মাই৷ বল মাই, একবার মুখ ফুটে বল, কী বলি চাস তুই৷’’
সময়ের গহ্বর থেকে, মৃত নক্ষত্রের আলো বেয়ে সেই গহিন অরণ্যের বাতাসে ভেসে এল কার অশরীরী উত্তর—
‘‘ভালোবাসা৷’’
* * * *
ঝামেলাটা শুরু করেছিল বিশু-ই, মানে হরেন সাঁপুই-এর বড় ছেলে বিশ্বনাথ৷ কিন্তু সেই মওকায় মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় যে অমন একটা হাতে গরম গল্প জুটে যাবে…
সেটা ছিল এক বর্ষার সন্ধে৷ সারাদিন ধরে কখনও মুষলধারে, কখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে৷ একে পনেরোই অগস্ট হওয়ার দরুন আফিস-কাছারি সব বন্ধ, তার ওপর ট্রেনের লাইনে জল জমে ট্রেনও চলছে না৷ পথঘাট জলে ডুবে একশা, এমনকি এ এলাকার অমন জমজমাট সাহাগঞ্জের বাজারেরও ঝাঁপ বন্ধ বলে খবর৷ চারিদিকে জলে থইথই, কবির ভাষায় চারিদিকে জল শুধু জল৷ দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল৷
মোটমাট এই ঘরবন্দি অবস্থায় তিতিবিরক্ত হতে হতে শেষমেশ পাড়ার কয়েকজন ক্লাবঘরে এসে জমায়েত হয়েছে৷ আড্ডার অনুপান বলতে অবশ্য হরির দোকানের চা আর মুড়ির সঙ্গে গরমাগরম চপ-ফুলুরি৷ তাই নিয়ে গুলতানি চলছে সবার মধ্যে৷
ক্লাবঘরের এককোণে বসে ন’পাড়ার ভজা আর রঘু খুব মন দিয়ে ক্যারম পিটোচ্ছিল৷ বাকিদের আবার ক্যারমে তেমন মন নেই, তারা কয়েকজন মিলে ব্রিজ খেলছিল৷ বাকিরা বলতে বিশু, বংশী, শিবু আর গদাই৷ মধ্যমণি হয়ে অবশ্য বসেছিলেন একজনই, ভবতারণ চট্টোপাধ্যায়, ওরফে চাটুজ্জেমশাই৷
চাটুজ্জেমশাই আমাদের পাড়ায় এসেছেন বেশিদিন নয়৷ চাকরি করতেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে৷ ছেলেমেয়ে নেই, স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুয়েক হল৷ তারপরেই ভিআরএস নিয়ে নেন ভদ্রলোক৷ সেই টাকায় মাস ছয়েক আগে তিনি এ পাড়ার মুখুজ্জেদের একতলা পোড়ো বাড়িটা সস্তায় কিনে ফেলেন৷ সেটাকে সংস্কার করে বসবাস করছেন তাও নয় নয় করে তিন-চার মাস হয়ে গেল৷
ভদ্রলোককে দেখলে প্রথম দর্শনে কাশীর ডাঁসা পেয়ারার কথা মনে পড়ে৷ ছোটখাটো রোগাসোগা চেহারা, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, আর মাথাজোড়া চকচকে টাক৷ মুখে সবসময়ই একটা শান্ত সৌম্য হাসি লেগেই আছে৷ ভদ্রলোকের বহু গুণের মধ্যে একটা হল আয়ুর্বেদ৷ তা ছাড়া জ্যোতিষচর্চার ওপর দখলও অসামান্য৷ নিরহংকারী সদাশয় মানুষ, কারও সাতেপাঁচে নেই৷ নেশা বলতে শুধু গোল্ড ফ্লেক সিগারেট, দুধ-চিনি ছাড়া কড়া চা আর বই৷
তবে ভদ্রলোকের সবচেয়ে বড় যে গুণটির জন্য তাঁকে ছাড়া এদের আড্ডাটা জমে না, সেটা হচ্ছে গল্পের অফুরন্ত ভাঁড়ার৷ আর সেসব গল্পই রীতিমতো যাকে বলে শিরশিরানি জাগানো ভয়াল ভয়ংকর অলৌকিক গল্প৷
কথা হচ্ছিল অবৈধ প্রেম নিয়ে৷ ব্রিজ খেলতে খেলতেই বিশু আর বংশীর মধ্যে একটা ঝামেলা পাকিয়ে উঠছিল ক্রমেই৷ বিশুর মতে ভালোবাসা ইজ ভালোবাসা, তার আবার বৈধ-অবৈধ কী? ওদিকে বংশীর বক্তব্য, সবাই যদি তাই-ই ভাবে তাহলে তো সমাজ-টমাজ এসব রাখার কোনো মানেই হয় না, অসভ্য জংলিদের মতো বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকলেই হয়! বিশু পালটা দিল, মানবমন অনেক জটিল জিনিস, তাকে নিয়মকানুনের নিগড়ে বেঁধে রাখা অসম্ভব ইত্যাদি৷
বিশুর কথাবার্তা ক্রমেই ক্ষুরধার হয়ে উঠছিল৷ হাজার হোক পড়াশোনা করা বলিয়ে কইয়ে ছেলে৷ ওর সঙ্গে যুক্তিতর্কে বংশী পারবে কেন? শেষমেশ গদাই একটা বিলো দ্য বেল্ট হিট করতে বাধ্য হল, ‘‘হ্যাঁ রে বিশু, তোর লেটেস্ট চিড়িয়ার খবর কী? সে আছে না গেছে?’’
একটু রাগত চোখে এদিকে তাকাল বিশু, তারপর বলল, ‘‘কেন, জেনে কী করবি?’’
‘‘আহা বলই না’’, ফুট কাটল শিবু৷
‘‘নেই৷’’ সংক্ষিপ্ত উত্তর৷
হুল ফুটোল বংশী, ‘‘তা তিনি এবার কার সঙ্গে গেলেন রে বিশু? তোর বন্ধু, নাকি তার বান্ধবীর হাজব্যান্ড?’’
উঠে বসল বিশু, তারপর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ‘‘তাতে তোদের কী বে?’’
‘‘তুই তো আবার হাত দেখতে এক্সপার্ট শুনেছি৷ তা বাপু, মেয়েদের হাত-টাত ধরার আগে একটু বিচ্ছেদ, বিরহ এসব রেখা-টেখাগুলো দেখে নিলে পারিস তো৷’’ এবার গদাই৷
এখানে বলে রাখা ভালো, বিশু হাত দেখতে জানে৷ সেজন্য মেয়েমহলে ওর একটা বাড়তি খাতিরও আছে৷ লোকে অবশ্য বলে ওর হস্তরেখা শিক্ষা নাকি ওই উদ্দেশ্যেই৷ তবে ছোকরা আপাতত চাটুজ্জেমশাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আরও কিছু শেখার ধান্দায়৷
বিশু গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ বোঝা গেল যে ছোকরা বিলক্ষণ চটেছে৷ তাই শান্তির জল ছেটাবার প্রচেষ্টায় এবার নামতে হল সর্বজনপ্রিয় রঘুকে, ঠান্ডা মাথার ছেলে বলে বাজারে যার বেশ সুনাম আছে৷ স্ট্রাইকার দিয়ে একটা ঘুঁটি তাক করতে করতেই বলল, ‘‘আহা বলই না বাবা৷ আমাদের কি আর তোর মতো কপাল? নাকি তোর মতো ক্যালি আছে? আমাদের ওই শুনেই একটু শান্তি৷’’
একটু ঠান্ডা হল ছোঁড়া, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘‘অন্য কারও সঙ্গে নয়৷ নিজের বরের সঙ্গেই চলে গেছে!’’
শুনে সবাই তো যাকে বলে স্তম্ভিত! প্রথমে আর্তনাদ করে উঠল শিবুই, ‘‘নিজের বরের সঙ্গে চলে গেছে মানে? এবার তুই একজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে প্রেম করছিলিস?’’
ছোকরা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ল৷ বাকিরা তো বিস্ময়ে একেবারে থ!
ইত্যবসরে খুক খুক করে কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন চাটুজ্জেমশাই৷ তারপর বললেন, ‘‘আমাদের বিশুবাবু এবার বেশ জটিল প্রেমজালে জড়িয়েছিলেন মনে হচ্ছে? তা ভালো, চলতি কথায় বলে যার সঙ্গে মজে মন, কী বা হাড়ি কী বা ডোম!
তবে একটা কথা বলি বাবা৷ নিষিদ্ধ প্রেম হল নিষিদ্ধ নেশার মতো, বুঝলে তো৷ নেশা করার থেকে নেশা লুকোবার ব্যাপারটাতেই লোকে মজে বেশি৷ তাতে অবশ্য ঝুঁকি কম নয়৷ ধরা পড়লে হেনস্থা, পাড়ায় ছিছিক্কার, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছে মাথা নীচু হওয়া তো আছেই৷ সেরকম হলে প্রাণের ঝুঁকিও বড় কম থাকে না৷ প্রায়শই খবরের কাগজে এই নিয়ে খুনখারাপির খবর লেগেই থাকে, দেখেছ নিশ্চয়ই৷ যৌন ঈর্ষা বড় আদিম মনোবৃত্তি, মুহূর্তেই তা মানুষকে অন্ধ দানব বানিয়ে দিতে পারে৷ এই ফাঁদে একবার যে পা দিয়েছে তার সঙ্গে উন্মত্ত খ্যাপা ষাঁড়ের কোনো তফাত নেই হে, তখন সে যা খুশি তাই করতে পারে৷’’
ধরতাইটা ধরে নিল গদাই, ‘‘এই নিয়ে আপনার ঝুলিতে কোনো অভিজ্ঞতা আছে নাকি দাদা? থাকলে ঝেড়ে ফেলুন না৷ বর্ষার রাতে এসব চাদরচাপা গল্প জমবে ভালো৷’’
চাটুজ্জেমশাই জানালার বাইরের দিকে চেয়েছিলেন৷ হ্যারিকেনের আলোয় তাঁর লম্বা ছায়া দেওয়ালের ওপর জোলো বাতাসে অল্প অল্প কাঁপছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা গোল্ড ফ্লেক ধরালেন তিনি৷ তারপর দেশলাইয়ের কাঠিটা নিভিয়ে জঙ্গলে আমার সঙ্গে যা যা হয়েছিল, সেসব মনে পড়লে এখনও ভয়ে কেঁপে উঠি৷ মানুষ যৌন ঈর্ষায় একবার হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে কী যে করতে পারে তার ইয়ত্তা নেই!’’
বলা বাহুল্য বাকিরা আরও ঘন হয়ে এল চাটুজ্জেমশাইয়ের কাছে৷ এই বৃষ্টির সন্ধেবেলায় এরকম একটা জমাটি গল্পের থেকে ভালো আর কী হতে পারে? চাটুজ্জেমশাইও গোল্ড ফ্লেকে একটা লম্বা টান দিয়ে শুরু করলেন৷
‘‘তখন আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে উত্তর আসামের বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি…’’ হরির চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে শুরু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘সদানন্দকাকু জানেন যে আমি ছুটি কাটাতে এসেছি৷ কিন্তু আমার লক্ষ্য একটাই, গোলকপুষ্প৷’’
‘‘কী বললেন? কীসের পুষ্প?’’ কথাটা শুধু রঘু নয়, আরও অনেকেই শুনতে পায়নি মনে হল৷
‘‘গোলকপুষ্প৷ ইয়ারসাগুম্বার একটা ভ্যারিয়েন্ট৷’’
‘‘কীসের ভ্যারিয়েন্ট খুঁজছেন বললেন? কীসের গুম্ফা?’’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করল গদাই৷ আমরাও হতভম্ব!
‘‘গুম্ফা নয়, গুম্বা৷ ইয়ারসাগুম্বা৷’’ কঠোর চোখে গদাইয়ের দিকে তাকালেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘এই ইয়ারসাগুম্বা বা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস হচ্ছে প্রকৃতির এক আশ্চর্য আবিষ্কার, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ঔষধিও বটে৷ শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে কিডনি আর লিভারের বিভিন্ন রোগ সারাতে এর জুড়ি নেই৷ তবে যে বিশেষ গুণটির জন্য পৃথিবীজোড়া আয়ুর্বেদিক মেডিসিনের বাজারে এর বিপুল খ্যাতি’’, গলাটা একটু নীচু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘সেটা হচ্ছে যৌন সক্ষমতা৷ পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মানুষের যৌন তাড়না এবং যৌন সক্ষমতা বাড়াতে এই ভেষজ অ্যাফ্রোডিজিয়াকটির জুড়ি নেই৷ এর ইংরেজি নামই হচ্ছে হিমালয়ান ভায়াগ্রা৷’’
‘‘কোথায় পাওয়া যায় এ জিনিস?’’ প্রশ্ন করল ভজা৷
‘‘এ কি আর বাজারে পাওয়ার জিনিস হে? অতি দুষ্প্রাপ্য, অতি দুর্মূল্য বস্তু৷ পাওয়া যায় একমাত্র তিব্বতের দিকেই, সি-লেভেল থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিট উচ্চতার ওপরে৷ একটু নেমে এলে অবশ্য নেপালেও পাওয়া যায়৷ স্থানীয়রা বলে কীড়াজড়ি৷’’
‘‘জিনিসটা দেখতে কীরকম?’’ গল্পের গন্ধে গন্ধে ক্যারম পেটানো থামিয়ে রঘুও এগিয়ে এসেছে এদিকে৷
‘‘জিনিসটা দেখতে অবশ্য একটু অদ্ভুত, বুঝলে৷ দৈর্ঘ্যে আর আকারে বেশি বড় না, ধরো এই দেশলাই কাঠির সাইজের হবে৷’’
‘‘তা মহার্ঘ বললেন কেন?’’ কৌতূহলী হল বংশী৷ ওর ওষুধ ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসা৷
‘‘মহার্ঘ কেন?’’ অল্প হাসলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘ও বস্তুটির এক কিলোর দাম, তা ধরো এখনকার বাজারে ষাট থেকে পঁয়ষট্টি মতো হবে৷’’
‘‘ষাট থেকে পঁয়ষট্টি বলতে?’’
‘‘লাখ৷’’
‘‘লাখ? ষাট-পঁয়ষট্টি লাখ?’’ শুনে আমরা তো হাঁ! ‘‘মানে এক গ্রামের দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা? এ-এ-এ তো…’’ বলতে গিয়ে তুতলে যায় শিবু৷
‘‘সোনার থেকেও দামি’’, মৃদু হাসলেন চাটুজ্জেমশাই৷
‘‘তা এই কীড়াজড়ি ওরফে ইয়ারাসাগুম্বার ব্যাপারে আমরা আয়ুর্বেদিক লাইনের লোকজনেরা সবাই মোটামুটিরকম জানি৷ আমি যে সময়ের কথা বলছি সে ধরো তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা৷ তখনও এইসব ভায়াগ্রা-টায়াগ্রা আবিষ্কার হয়নি৷
আমি তখন নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড৷ চাকরিবাকরি করি, খাইদাই আর অবসর সময়ে বিভিন্ন অজানা পাহাড়ি ভেষজের খোঁজ করি৷ সেই করতে গিয়ে ওখানকার কিছু এজেন্টের সঙ্গে আমার বেশ সখ্য হয়ে গেছিল৷ তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ছুটকোছাটকা খবর পেতাম ঠিকই, তবে তাতে মন ভরত না৷
সেইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল৷ কেটে যেতও, যদি না উনিশশো নব্বই সালের আশ্বিন মাসের এক সন্ধেয় দৈবাৎ আমার হাতে একটা প্রাচীন পুথি এসে পড়ত৷
পুথিটা নিয়ে এসেছিল ওসমান, আমার শিলিগুড়ির চেনা এজেন্ট৷ নর্থ বেঙ্গল আর নর্থ-ইস্ট জুড়ে পুরোনো পুথিপত্র জোগাড় করার লাইনে ও ছিল বেতাজ বাদশা৷ আমাকে ওসমান একটা আলাদা খাতির করত৷ কারণ সেরকম সেরকম ভালো পুথি পেলে আমি উচিত দাম দিতে কোনোদিনই কসুর করিনি৷
পুথিটা একটা পুরোনো আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পুথি৷ রচয়িতা ‘কামরূপ-দেশাগত’ জনৈক ব্রাহ্মণ, নাম রুচিনাথ বড়গোঁহাই৷ পুথিটার বয়েস কিন্তু খুব বেশি না, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক নাগাদ লেখা, কারণ তাতে ‘বৃটিস সৈন্যপুঞ্জ’ এবং ‘লংডং যবননগরী’-র উল্লেখ আছে৷ অর্থাৎ লেখক ইংরেজ রাজত্বের ব্যাপারে সম্যক ওয়াকি-বহাল৷ সময়কালটা বুঝতে অবশ্য আরও সুবিধা হল, কারণ ভদ্রলোক তাঁর রাজ্যের রাজা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘স্বর্গদেউ চন্দ্রকান্ত সিংহ’-র কথা৷ এই অহোমরাজের রাজত্বকাল আঠেরোশো এগারো থেকে আঠেরোশো আঠেরোর মধ্যে৷
পুথিটায় প্রথম দিকে তেমন কিছু ইন্টারেস্টিং পাইনি৷ সাধারণ আয়ুর্বেদিক গাছগাছালির বিবরণ, তার প্রায় সবই আমার চেনা, নতুন কিছু নেই৷ পাতা ওলটাতে ওলটাতে ভাবছিলাম ওটা ওসমানকে ফিরিয়েই দেব কি না৷
থমকে গেলাম মাঝামাঝি এসে৷ কয়েকটা পাতা পড়ে নিজের চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ আরিব্বাস, এ তো পুরো স্বর্ণখনি!
ওসমান খুব সম্ভবত আমার চোখমুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করেছিল নিশ্চয়ই, নইলে হঠাৎ করে অমন একটা সাধারণ পুথির দাম হাজার টাকা হেঁকে বসবে কেন? তখনকার দিনে হাজার টাকার দাম অনেক৷ তবুও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে টাকাটা ওসমানের হাতে তুলে দিলাম৷’’
‘‘কেন? তাতে কী ছিল চাটুজ্জেমশাই?’’ প্রশ্নটা বংশীই করল বটে৷ তবে আমাদের সবার মনেও তখন ওই একই জিজ্ঞাসা৷
সামনে রাখা চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে ফের শুরু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘যা ছিল আমার কাছে তখনই তার দাম লাখ টাকার সমান৷ সেটি হচ্ছে গোলকপুষ্প নামে একটি অতি দুষ্প্রাপ্য ভেষজলতার উল্লেখ৷
এই গোলকপুষ্পের উল্লেখ এর আগেও এক-দু’ জায়গায় পেয়েছি, তবে তা সবই ভাসা ভাসা৷ শুধু জানতে পেরেছিলাম যে গোলকপুষ্প পাওয়া যায় উত্তর আসামের জঙ্গলে৷ ডিব্রুগড় থেকে শুরু করে ধুবড়ির মাঝামাঝি কোনো এক জঙ্গলের মধ্যে৷ তার নাকি অনেক গুণাগুণ, বিশেষ করে এর রস নাকি যাবতীয় যৌন রোগের অব্যর্থ দাওয়াই৷
ওসমান চলে যেতেই চট করে রাতের খাওয়াটা সেরে পুথিটা নিয়ে চৌকিতে লম্বা হলাম৷
আগাগোড়া সংস্কৃতে লেখা পুথি, বেশি বড় নয়৷ পুরোটা পড়ে ফেলতে সময় লাগল ঘণ্টা দুয়েকের সামান্য বেশি৷
পড়তে পড়তে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম৷ পুথিতে এই ভেষজের গুণাবলির ব্যাপারে যা যা পড়লাম সেসব যেমনই আশ্চর্যের তেমনই অদ্ভুত৷ এমনকি এর এমন কিছু কিছু প্রয়োগের কথা আছে যেগুলো বিশ্বাস করা একটু কঠিন, মানে আয়ুর্বেদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই৷ প্রধান যে গুণ, সেটা তো ইয়ারসাগুম্বার সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলে যায়ই৷ এ ছাড়াও এর দ্বারা বেশ কিছু জটিল স্নায়ুরোগের চিকিৎসা, বিভিন্ন মেয়েলি অসুখের প্রতিবিধানও নাকি সম্ভব৷
শুধু শেষের শ্লোকটার অর্থ তখন বুঝতে পারিনি৷ যখন বুঝতে পারলাম, তখন ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেছে৷’’
‘‘কী সেটা?’’ প্রশ্নটা কে করল ঠিক বোঝা গেল না৷
একটু থামলেন চাটুজ্জেমশাই, তারপর একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, ‘‘‘গোলকপুষ্পাৎ মহাভয়ং সঞ্জাতং যদ্ভবিষ্যতে৷ তদ্ভয়ং নিবারণার্থং গোলকপুষ্পং বিধীয়তে৷’ অর্থাৎ গোলকপুষ্প থেকে যদি মহাভয় উৎপন্ন হয়, তাহলে গোলকপুষ্পেরই সাহায্য লইবে৷
তবে যেটা দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, সেটা হচ্ছে যে এই ভেষজটির প্রাপ্তিস্থান একেবারে নির্দিষ্ট করে লিখে দেওয়া হয়েছে৷ আর সেই শ্লোকটা এতবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে গেছিল৷ বেংমোরা গ্রামস্য উত্তরম্ মাগুরি ইতি নামঃ সরঃ৷ তত্র দেবীস্থানে জাতি ইয়ম্ গুল্মম্ বিচিত্রম্ চ৷ অর্থাৎ কিনা, বেংমোরা গাঁওয়ের উত্তরে যে মাগুরি বিল, তার কাছে আছে দেবীস্থান৷ সেই মন্দিরের গর্ভগৃহেই ফোটে এই আশ্চর্য গুল্মলতাটি৷
বেংমোরা যে উত্তর আসামের প্রধানতম শহর তিনসুকিয়ার আদি নাম, সে আমি জানতামই৷ ম্যাপ দেখে-টেখে মাগুরি বিলও খুঁজে পাওয়া গেল৷ বলা বাহুল্য এরপর যদি এর খোঁজে তিনসুকিয়ার জঙ্গলে না যাই, তবে আমার আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এতদিনের আগ্রহ সবই বৃথা৷ টাকার কথাটাও ভুললে চলবে না৷ একবার যদি খুঁজেপেতে এই জিনিস আমার হাতে আসে, আর তারপর যদি এর সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারি, তাহলে আমার অন্নবস্ত্রের সংস্থানের কথা ছেড়েই দিলাম, আমার পরের কয়েকপুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে হেসে খেলে চালিয়ে দিতে পারবে৷ তার ওপর খ্যাতির লোভটাও কম নয়, চাই কি হয়তো ভেষজটার বৈজ্ঞানিক নামকরণই হয়ে গেল অফিওকর্ডিসেপ্স ভবতারণেসিয়া!
উঠেছিলাম লখিমপুর ডিস্ট্রিক্টে সদানন্দ চৌধুরীর বাড়িতে, টাউনের নাম তিনসুকিয়া৷ এখন তো তিনসুকিয়া বড় শহর, উজনি বা আপার আসামের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র৷ তখন তিনসুকিয়া বড়সড় গঞ্জ ছিল বললেই চলে৷
সদানন্দকাকু ছিলেন আমার বাবার গ্রামতুতো ভাই৷ খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা লোক৷ কাকুর বিধবা মা আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঘর মোছার কাজ করতেন৷ কাকুর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে ঠাকুর্দা ওঁর পড়াশোনার ভার নেন ও তাঁরই চেষ্টায় সদানন্দকাকু গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন৷ তারপর বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিতে দিতে আসাম সরকারের অধীনে একটি সরকারি চাকরি জোটান৷ তখন থেকেই অবশ্য আমাদের সঙ্গে কাকুর যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে৷ শুধু মাঝে মাঝে খবর পেতাম যে কাকু নিজ অধ্যবসায়ে চাকরির জায়গায় প্রভূত উন্নতি করেছেন৷
যদিও অনেকদিন ধরেই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না, তবুও একটা চিঠি ছেড়ে দিয়েছিলাম ওঁর ডিপার্টমেন্টের ঠিকানায়৷ তবে তার ফলাফল যে অমন হবে সে অবশ্য আমি ভাবিনি৷
ট্রেন থেকে নেমে দেখি সদানন্দকাকু স্বয়ং এসে উপস্থিত৷ আমি ওঁকে অবশ্য দেখেই চিনেছি, সামান্য মোটা হওয়া আর চুলে পাক ধরা ছাড়া আর কোনো বদল নেই৷ তবে আমাকে যে উনি কী করে চিনলেন সেটা একটা প্রশ্ন বটে৷ কারণ উনি আমাকে শেষ দেখেছেন আমার বয়েস যখন আট৷ আর আমি যখনকার কথা বলছি তখন আমার বয়েস আঠাশ, প্রায় কুড়ি বছরের ব্যবধান৷ তবে সে রহস্য কেটে গেল যখন উনি বললেন যে ‘তোমাকে দেখলেই চণ্ডীদার ছেলে বলে চেনা যায় বাবা, একেবারে সেই মুখ কেটে বসানো৷’ আমার বাবার নাম ছিল চণ্ডীচরণ৷
তিনসুকিয়াতে আমাদের অফিসের ইনস্পেকশন বাংলোতে আমার বুকিং করা ছিল৷ কিন্তু কাকু আমার কোনো কথাই শুনলেন না, স্টেশন থেকে একপ্রকার জোর করেই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে তুললেন তাঁদের বাড়িতে৷ বাড়ি বললে অবশ্য কমই বলা হয়, সে এক বিশাল প্রশস্ত বাংলো৷ বোঝা যায় যে কাকু এই ক’বছরের মধ্যে কম উন্নতি করেননি! তবে অত বড় বাংলোয় থাকার মধ্যে ওই তিনজনই৷ সদানন্দকাকু, তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণা কাকিমা আর তাঁদের মেয়ে মাধুরী৷
আর আমার গল্প এই মাধুরীকে নিয়েই৷ গোলকপুষ্প নিয়ে তো বটেই!
আসার পর থেকেই কাকিমা আর মাধুরীর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল৷ কাকিমার বোধহয় ছেলের শখ ছিল, আমাকে পেয়ে সেই অতৃপ্ত মাতৃস্নেহ প্রায় দুর্নিবার হয়ে উঠল৷ কাকুও নিশ্চয়ই ওঁকে সবিস্তারে আমার ঠাকুর্দা আর বাবার সাহায্য করার কথা বলেছিলেন৷ ফলে দুর্বার মাতৃস্নেহ আর কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে যে জিনিস দাঁড়াল সে আর কহতব্য নয় ভাই, ভালোবাসার অত্যাচার বললেই চলে৷ তার ওপর কাকিমার রান্নার হাতটি ছিল সোনায় মোড়া৷ তোমরা তো জানোই, ব্রহ্মপুত্রের মাছের স্বাদই আলাদা৷ আহা, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল, সেই রান্না এখনও মুখে লেগে আছে ভাই৷
মাধুরীকে দেখে প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল ভারী ভালো এবং ঠান্ডা মেয়ে৷ ততদিনে আমি জ্যোতিষচর্চায় মোটামুটি নাম করে ফেলেছি৷ মাধুরীকে দেখেই বুঝলাম যে মেয়ে তুলারাশির জাতক, যেমন ঠান্ডা শান্ত স্বভাব, তেমনই বুদ্ধিমতী৷ খুব সম্ভবত বৃহস্পতির স্থান উচ্চ, সামগ্রিক আচার-আচরণের মধ্যে একটা ধীর এবং প্রাজ্ঞ ব্যাপার আছে৷ সব মিলিয়ে যাকে বলে বেশ প্লেজেন্ট পার্সোনালিটি৷
তবে প্রথম দিন থেকেই একটা ব্যাপার কিন্তু আমার নজর এড়ায়নি৷ মেয়েটাকে দেখে মনে হত সবসময়ই যেন একটা আলগা বিষাদের চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে৷ ম্রিয়মাণ মুখ, মরা চাউনি৷ যেন বুকের মধ্যে কোথাও একটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে৷
এদিকে আমার কাজ এগোচ্ছিল খারাপ না৷ সদানন্দকাকুর বাড়ি তিনসুকিয়া টাউনের একটু বাইরের দিকে৷ জায়গাটার নাম গেলাপুখুরি৷ জায়গাটা একদম জঙ্গলের গা ঘেঁষে৷ পশ্চিম দিকে দু-পা হাঁটলেই সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ আর তার পরেই এথেলবাড়ি শিবমন্দির৷ মন্দির বাঁয়ে ফেলে লিম্বুগুড়ি চার্চ ছাড়ালেই মাগুরি বিল শুরু৷
বলা বাহুল্য, সদানন্দকাকুকে আমি এখানে আসার আসল কারণটা জানাইনি৷ শুধু বলেছিলাম যে নেচার ফটোগ্রাফি আমার জীবনের একমাত্র শখ৷ এইদিকে কোনোদিন আসা হয়নি বলে আমি জঙ্গল ঘুরতে এসেছি৷
সঙ্গে চিরসাথি আসাহি ক্যামেরাটা ছিলই, ফলে ওঁদের কনভিন্স করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি৷ আমার প্ল্যান ছিল মাসখানেকের মধ্যে কোনো একটা পাত্তা লাগিয়ে কেটে পড়া৷ পরে চুপিচুপি ফিরে এলেই হল৷ ব্যাপারটা নিয়ে হইচই হোক সে আমি একদমই চাইনি৷
সে যাই হোক৷ কাজকম্ম খারাপ না এগোবার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে৷ কাকু আমার সঙ্গে একটি স্থানীয় লোককে পার্মানেন্টলি জুটিয়ে দিয়েছিলেন, নাম ছিল মংকু৷ ছোকরাকে প্রথম দিনেই আমার বেশ পছন্দ হয়ে যায়৷ সহজ-সরল লোক, তার ওপর গত বেশ কয়েকপুরুষ ধরেই ওর পরিবার এই অঞ্চলের বাসিন্দা৷ বাপঠাকুর্দার হাত ধরে ব্রহ্মপুত্রের প্রতিটি ঢেউ থেকে শুরু করে তিনসুকিয়ার জঙ্গলের প্রতিটি গাছ চিনেছে ও৷ এই জঙ্গলে ওর থেকে ভালো গাইড আর হয় না৷
প্রথম দিন আমাকে দেখেই একটা আভূমি প্রণাম ঠুকল মংকু৷ তারপর বাঙালিঘেঁষা আসামিজ উচ্চারণে আমাকে জানাল যে এই অঞ্চলের যাবতীয় বনজঙ্গল তার নখদর্পণে৷ সে আশা করছে যে মালিকের খাস আদমির পছন্দমতো বেশ কিছু ছবি সে তুলিয়ে দিতে পারবেই পারবে৷
পরের দিন থেকেই আমার কাজ শুরু হয়ে গেল৷ রোজ সাতসকালে উঠে খেয়েদেয়ে কাঁধে ক্যামেরাটা ঝুলিয়ে জঙ্গলে বেরিয়ে যাই, ফিরি দুপুর নাগাদ৷ দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে ফের জঙ্গল অনুসন্ধান৷ ফিরে আসতে হয় সন্ধ্যা হওয়ার আগেই৷
তারপর সদানন্দকাকুদের সঙ্গে চা-তেলেভাজা সহযোগে বিপুল আড্ডা৷ রাতের এলাহি ডিনারের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷
এই করে করে যখন দিন পাঁচ-ছয় কেটেছে, তখনই ঘটল ঘটনাটা৷
এই ক’দিনে আমি প্রায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি সারা জঙ্গলটা৷ মাগুরি বিল বেশ বড় বিল, চারিপাশে ঘন জঙ্গল৷ তার আশপাশে প্রায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাইনি৷ শুধু বাদ রয়ে গেছিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকটা৷
টাউন থেকে জঙ্গলে ঢোকার যে প্রধান রাস্তাটা, সেটা পশ্চিম দিকে৷ সেখান থেকে বিলের দক্ষিণ-পূর্বে যাওয়ার কোনো চলাচলের রাস্তা তো নেই-ই, তার ওপর মাঝে একটা বড় শুকনো নালা আছে৷ প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিলাম যে ওদিকে যেতে মংকুর তীব্র অনীহা৷ ওদিকে যাওয়ার নাম শুনলেই ছোকরার চোখে-মুখে চকিতের জন্য একটা অস্বাভাবিক ছায়া খেলে যায়৷
ওই রাস্তাটার কথা ভুলেই গেছিলাম৷ সাতদিনের শেষে নিষ্ফলা অভিযানের শেষে ফিরে আসছি, মনটা ব্যর্থতার বিষাদে তিক্ত হয়ে আছে, এমন সময় হঠাৎ করে আমার সেই শুকনো নালাটার কথা মনে পড়ে গেল৷ আরে যাহ, ওদিকে যাওয়া হল না তো!
কথাটা মংকুকে বলতেই দেখি সে ছোঁড়া অবাধ্য ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল, ‘‘মাফ করো দাদা, ওইদিকে যাব না৷’’
‘‘সে কী? কেন?’’ আশ্চর্য হলাম, ‘‘এই যে সেদিন বললি মালিকের খাস আদমির পছন্দমতো সব ছবি তুলিয়ে দিবি আমায়?’’
ঘাড় ত্যাড়া করে খানিকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ছোকরা, তারপর ভয়ার্ত স্বরে ইতিউতি তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘‘ওদিকে যেতে পারব না গো দাদা, ওদিকে যাওয়া আমাদের বারণ আছে৷’’
‘‘আমাদের মানে কাদের?’’
‘‘আমাদের সব্বার৷ দিবংগোঁয়্যা, বড়গোঁয়্যা, তেঙাপোনিয়া, সব্বার মানা ওদিকে যাওয়ার৷’’
এরা কারা সেসব বুঝলাম না৷ ‘‘কে মানা করেছে রে?’’ পালটা প্রশ্ন করলাম আমি৷
‘‘বড়দেওরি’’, মংকুর ফিসফিস করে বলা কথাগুলো সন্ধের অন্ধকারে বড় অদ্ভুত শোনাল৷
আমি একবার তাকালাম সেই জঙ্গলের দিকে৷ আশ্বিনের আকাশ থেকে সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত৷ সারা আকাশ জুড়ে ঘরফেরত পাখিদের ডানা ঝাপটানো আর কলরবের আওয়াজে কান পাতা দায়৷ ছোটবেলা থেকেই আমার বিশেষ কিছু সেন্স বড় প্রবল, কোথাও কোনো অশরীরী বা অলৌকিক কিছু ঘটলে আগে থেকেই কিছু একটা আঁচ করতে পারতাম৷ সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হঠাৎই মনে হল, ওদিকে যেন কিছু একটা আছে৷ সেটা কী বুঝতে পারছি না, তবে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি৷ যেন একটা একটা দুর্ষ্ণেয় শক্তি আমাকে চুম্বকের মতো ওদিকে টানছে৷ তার কোনো শুভাশুভ নেই, পাপ-পুণ্য নেই, উল্লাস বা হাহাকার নেই, শুধু এক উদাস রিক্ততা আছে, তাকে ভাষায় বর্ণনা করা খুব কঠিন৷
আচ্ছন্ন স্বরে প্রশ্ন করলাম, ‘‘ওদিকে কী আছে মংকু?’’
গলাটা একদম নামিয়ে ফিসফিস করে বলল মংকু, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির৷’’
* * * *
সেদিন রাত্তিরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে নিজের ঘরে এসেছি, এমন সময় দরজায় ঠকঠক৷ দরজা খুলতেই দেখি সদানন্দকাকু দাঁড়িয়ে, সঙ্গে কাকিমা৷
তাড়াতাড়ি দুজনকে ঘরে এনে বসালাম৷ কাকু প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী ব্যাপার ভব, আজ তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে? তোমার শরীর ভালো তো?’’
আমি বললাম, ‘‘না না কাকু, আমার শরীর একদম ঠিক আছে৷ ও নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না৷ আসলে যাওয়ার সময় চলে আসছে তো, তাই মনটা খারাপ হয়ে আছে৷’’
কাকিমা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘‘ও মা, এ কী কথা? এই তো সেদিন এলে, এখনই এত যাই যাই কীসের? ভালো করে তো খাতিরযত্ন করাই হল না৷’’
হাত জোড় করে বললাম, ‘‘কাকিমা, এই ক’দিনে যা খাতিরযত্ন করেছেন, তাতে এই ক’দিনে নির্ঘাত আমার ওজন কম সে কম দশ কিলো বেড়ে গেছে৷ মা মারা গেছেন ছোটবেলাতেই, তারপর থেকে আজ অবধি এত আদরযত্ন কারও কাছ থেকেই পাইনি৷’’
কাকিমার চোখটা ছলছল করে এল, একটু ঝুঁকে এসে আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন৷
কাকু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘‘তাহলে আর যাই যাই করছ কেন? অন্তত মাসখানেক থেকে যাও৷’’
হেসে ফেললাম, ‘‘কাকু, আপনি তো নিজেও সরকারি অফিসার৷ জানেনই তো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে এখন লোকের কীরকম অভাব৷ বড়সাহেব তো ছুটি দিতেই চাইছিলেন না৷ বহুকষ্টে তাঁকে রাজি করিয়ে তবেই এখানে আসতে পেরেছি৷ এখন যদি আর ছুটি বাড়াই, তাহলে আমার ওপরওয়ালা বোধহয় রামদা হাতে আমার খোঁজে এখানেই হানা দেবেন৷’’
‘‘হুম’’, এই বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন দুজনে, তারপর কাকু একটু ইতস্ততভাবে বললেন, ‘‘আচ্ছা বাবা, তুমি তো আয়ুর্বেদচর্চা করো বললে৷ তোমাদের শাস্ত্রে ডিপ্রেশন বা মনখারাপ সারাবার ওষুধ নেই?’’
ডিপ্রেশন মানে ঠিক মনখারাপ নয়, ওটা একটা মেডিক্যাল কন্ডিশন৷ তবে সে ভুলটা আর কাকুকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না৷ প্রশ্ন করলাম, ‘‘কিছু কিছু আছে কাকু, কিন্তু কেন? আপনার আবার ডিপ্রেশনের ওষুধের দরকার পড়ল কেন?’’
‘‘আমার না বাবা, মাধুরীর৷’’
‘‘কেন কাকু? কী হয়েছে?’’
অল্প কথায় কাকু যা বললেন তা এইরকম—
মাধুরীর বিয়ে হয়েছিল প্রায় মাস সাত-আটেক আগে৷ লেখাপড়ায় মাধুরীর কোনোদিনই তেমন উৎসাহ ছিল না৷ গ্র্যাজুয়েশনের পর সে নিজেই আর পড়তে চায়নি৷ কাকুরা জোরজবরদস্তি করেননি, পালটি ঘরের সৎপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেন৷
পাত্রের খোঁজ মাধুরীই দিয়েছিল৷ অনির্বাণের সঙ্গে ওর আলাপ কোনো এক বান্ধবীর বাড়িতে৷ তিনসুকিয়া থেকে আরেকটু উত্তরে গেলে সদিয়া বলে একটি জেলা আছে, সেখানেই ওদের তিনপুরুষের বাস৷ বাঙালি হলেও ওরা বহুদিন আসাম প্রবাসী৷ ছেলের চেহারাতেও একটু উত্তর-পূর্বের ছাপ আছে৷ তার অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে৷ অনির্বাণের মা এখানকারই মহিলা৷
অনির্বাণ ছেলে হিসেবে দেখতে শুনতে ভালো৷ চাকরি করে ডিব্রুগড়ে, কোনো এক চা-বাগানের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে৷ মাইনে খারাপ না৷ মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই৷ থাকার মধ্যে এক বিধবা দিদি, অনির্বাণের থেকে বছর পাঁচেকের বড়৷ তিনি ওর সঙ্গেই থাকেন৷ এ ছাড়া কাছের লোক বলতে এক মামা৷ এক কথায় নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার৷
কাকু ডিব্রুগড়ে লোক পাঠিয়ে গোপনে তত্ত্বতালাশ নিলেন৷ জানা গেল ছেলের স্বভাব-চরিত্র চমৎকার, নেশাভাং করে না, মেয়েঘটিত কোনো কেচ্ছাও নেই৷ ছেলের দাবিদাওয়াও বিশেষ কিছু নেই, শাঁখা-সিঁদুরেই খুশি৷
কাকুরা শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন৷
বিয়েটা হয়েছিল গত বছর ফাল্গুনে৷ কাকুরা যথাসাধ্য ভালোভাবে বিয়ের আয়োজন করলেন৷ কলকাতা থেকে অনির্বাণের কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা এলেন৷ ওর কলেজের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবও এল৷ বেশ হইহই হল কয়েকদিন৷
বিয়ের পরপরই ওরা চলে গেল ভুটানে, হানিমুন করতে৷ ফিরে এল হপ্তাখানেক বাদে৷ তারিখটা এখনও মনে আছে কাকুর, বিশে ফেব্রুয়ারি৷ শিবরাত্রির ঠিক দু’দিন আগে৷
ফিরে আসার পরদিনই মাধুরী বাপের বাড়ি চলে আসে৷ কথা ছিল শিবরাত্রির পরের দিন মাধুরী সদিয়া চলে যাবে৷ তারপর কয়েকদিন ওখানে কাটিয়ে ডিব্রুগড়, অনির্বাণের কর্মস্থলে৷
এই ক’দিন অনির্বাণের দিদি বাড়ি ছিলেন না, মৃত স্বামীর কিছু পেনশন সংক্রান্ত কাজে গুয়াহাটি গেছিলেন৷ তবে যেদিন অনির্বাণরা ফিরে আসে, তার আগের দিনই কাজকর্ম মিটিয়ে সদিয়া চলে আসেন তিনি৷ কামাখ্যা থেকে আনা একটি পবিত্র সিঁদুরের কৌটো উপহার দেন মাধুরীকে৷
আসল কাহিনি শুরু ঠিক শিবরাত্রির পরের দিন থেকে৷
তেইশে ফেব্রুয়ারি, মানে যেদিন মাধুরীর বেরোনোর কথা, সেইদিন দুপুর থেকে হঠাৎ করেই মাধুরীর প্রচণ্ড শরীর খারাপ৷ স্নান করে, দুপুরের খাওয়া সেরে সবে বিছানায় শুয়েছে সে৷ হঠাৎ করে ধুম জ্বর, সেই সঙ্গে ঠকঠক করে কাঁপুনি৷ দেখতে দেখতে থার্মোমিটারের পারদ পৌঁছে গেল একশো তিন ডিগ্রিতে! গা যেন পুড়ে যাচ্ছে মেয়ের, আর তার সঙ্গে সমানে চলছে প্রলাপ বকা৷
অবস্থা আরও খারাপ হল সন্ধের দিকে৷ সারা শরীর অবশ হয়ে এল মাধুরীর৷ বিছানা থেকে মাথা তোলা তো দূরস্থান, মুখ দিয়ে কোনো কথাই ফুটছে না৷ দেখে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সারা শরীর যেন প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছে৷ সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ৷ দুটো চোখই জবাফুলের মতো লাল৷ জলপট্টি দিতে দিতে ক্রমাগত কেঁদে চলেছেন কাকিমা, আর মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করছেন৷ স্থানীয় ডাক্তারবাবুকে এত্তেলা দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি এসে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে গেছেন এতে যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে রাত পোহালেই গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷
সে রাতটা বাড়ির প্রতিটি মানুষ সাংঘাতিক উদ্বেগে ছিলেন৷ কেউ দাঁতে কুটোটি কাটেননি৷ পাড়াপ্রতিবেশীরা পালা করে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন৷ প্রায় অচৈতন্য মাধুরীর মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কেঁদে ভাসাচ্ছেন কাকিমা৷ ওদিকে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করা যাচ্ছে না, লাইনে গণ্ডগোল৷ অত রাতে সদিয়াতে কাউকে পাঠানোও সম্ভব নয়৷ একে রাস্তাঘাট ভালো না, তার ওপর সন্ত্রাসবাদীদের উৎপাত তো আছেই৷ মোটমাট সব মিলিয়ে সে এক ক্যাডাভ্যারাস অবস্থা৷
কিন্তু পরের দিন আরেক চমক!
পরের দিন ভোরবেলা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরে কলিং বেলের সুইচ টিপেছেন সদানন্দকাকু, দরজা খুলে দিল মাধুরী স্বয়ং! কাকু তো একেবারে হতভম্ব! কাকিমা জলপট্টি দিতে দিতে শেষরাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ তিনিও দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এসে এই দৃশ্য দেখে অবাক! মাধুরীর যাবতীয় রোগবালাই ম্যাজিকের মতোই একেবারে ভ্যানিশ! একদম ঝরঝরে তকতকে মেয়ে৷ হাসিমুখে বলল, ‘‘যাদবকাকুকে গাড়ি বার করে রাখতে বলো বাবা৷ দুপুরের খাওয়াটা সেরেই ও বাড়ি চলে যাই৷’’
কাকিমা ঠাকুর ঠাকুর করে মাথায় হাত ঠেকালেন৷ এতদিন ধরে বাড়িতে গোবিন্দের নিত্যসেবা করছেন সে কি এমনি এমনি? ভক্তির একটা জোর নেই?
তারপর ঠিক এক সপ্তাহ৷ ঠিক এক সপ্তাহ বাদে মেয়ে তার যাবতীয় জিনিসপত্র দু-দুটো ঢাউস স্যুটকেসে বোঝাই করে ফিরে এল এ বাড়িতে৷ বাড়ির দরজায় সে দুটো নামিয়ে দিয়ে থমথমে মুখে সদানন্দকাকুকে বলল, ‘‘আমি ফিরে এলাম বাবা৷ আমাকে রাখতে হয় রাখো, ফেলতে হয় ফেলো, কিন্তু আমি কিছুতেই আর ও বাড়ি ফিরে যাব না৷’’
এই পর্যন্ত বলে আঁচলে মুখ ঢাকলেন কাকিমা, ‘‘ওই এক কথা বলে সেই যে ঘরে ঢুকল, তারপর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে৷ যতই জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে মা, কেন এখানে চলে এলি সে নিয়ে কিছু বল আমাদের! বনিবনা হচ্ছে না? অনির্বাণের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের সম্পর্ক আছে? টাকাপয়সা বা অন্য কোনো কিছু চাইছে? অথবা অন্য কোনো অত্যাচার যা আমাদের মুখ ফুটে বলতে পারছিস না? কিন্তু মেয়ে কিছুই বলছে না বাবা৷’’
কাকুদের উদ্বেগের কারণটা বুঝলাম৷ হওয়ারই কথা, হাজার হোক একমাত্র মেয়ে, ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন৷ তার মাসখানেকের মধ্যেই যদি তাকে তার নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে ফিরে আসতে হয় তাহলে চিন্তার কারণ থাকে বই কি!
‘‘আপনারা অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি?’’ আমি প্রশ্ন করেছিলাম৷
‘‘করেছিলাম বই কি! তাকে ফোন করে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু অর্ধেক সময় হয় তার অফিস বা বাড়ির ল্যান্ডলাইন কাজ করে না, বা করলেও কেউ ফোন তোলে না৷’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর’’, এই বলে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে চুপ রইলেন কাকিমা৷ তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘‘আমরা গেছিলাম ডিব্রুগড়ে৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অনির্বাণের দেখা পাইনি৷’’
‘‘আর ওদের বাড়ি? সদিয়াতে যাননি?’’
‘‘গেছিলাম বই কি!’’
‘‘তাহলে?’’
‘‘দরজা বন্ধ ছিল৷ আমাদের অনেক কড়া নাড়াতেও কেউ দরজা খোলেনি৷’’
শুনে পুরো ব্যাপারটাই বেশ আশ্চর্যজনক লাগল৷ তখনও অবধি অবিবাহিত থাকলেও চেনাপরিচিতদের মধ্যে বেশ কিছু সাংসারিক অশান্তি, পারস্পরিক মনোমালিন্য, এমনকি ডিভোর্স হতেও দেখেছি৷ সব জায়গায় দেখেছি যে ঘুরেফিরে সেই কয়েকটা চেনা ইস্যুই বারবার ফিরে আসে৷ কিন্তু এখানে কেসটা বেশ আশ্চর্যের৷ এমন কী ঘটেছে যে মাধুরী কাউকে, এমনকি তার মা-বাবাকেও জানাতে পারছে না?
‘‘সেই থেকে মেয়েটা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায় বাবা৷ চোখের সামনে দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে৷ ভালো করে খায় না, গান শোনে না, হাসি-ঠাট্টা নেই৷ মা হয়ে কী করে সহ্য করি বলো’’, চোখে আঁচল চাপা দিলেন কাকিমা৷
কাকুও দেখি মাথা নীচু করে বসে আছেন৷ তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘‘আমরা বেশ কিছু সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলাম, বুঝলে৷ কিন্তু কেউই বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি৷ অন্তত যদি ওর এই ডিপ্রেশনটা কাটে, মুখ ফুটে আমাদের জানায় যে কী হয়েছে, তাহলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারি৷ চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে না৷ এদিকে আত্মীয়স্বজন আছে, পাড়াপড়শি আছে, তাদেরকে আর কতদিনই বা মিথ্যে বলে ঠেকিয়ে রাখি বলো? ইতিমধ্যেই এদিক-ওদিক কানাকানি শুরু হয়েছে৷ আমাদের মান-সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে৷’’
তখন আমার অল্প বয়েস৷ তা ছাড়া রহস্যজনক ব্যাপারের দিকে চিরকালই আমার একটা আলাদা আগ্রহ ছিল৷ মনস্থির করে নিলাম, এই রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না৷ তা ছাড়া কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে৷
কথাটা কাকুকে জানিয়ে দিলাম৷ এও বললাম যে কাল বিকেলে আমি একবার মাধুরীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চাই৷
* * * *
পরের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ যখন আমি বাড়ি থেকে বেরোলাম তখনই মাথার ওপর রোদ্দুর বেশ চড়া৷ পিঠে একটা ছোট রুকস্যাক, তাতে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর৷ কোমরে একটা জাঙ্গল নাইফ, একটা পয়েন্ট টু টু বোরের রিভলভার আর পাউচ ব্যাগে আসাহি ক্যামেরাটা৷ এদিকে আবার বিকেলের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে৷ তাই রুকস্যাকে একটা সোয়েটারও আছে৷ পরনে জংলা ছাপের টাইট টিশার্ট আর কর্ডরয়ের ট্রাউজার, পায়ে মোটা হিলের হান্টিং বুট৷
মংকুকে ইচ্ছে করেই সঙ্গে নিইনি৷ জানতাম যে যদি ওকে জানাই কোথায় যাচ্ছি, তাহলে আমার যাওয়াটা ভেস্তে যাওয়া অবধারিত৷ আমার মন বলছিল ওই কাউরীবুড়ির মন্দিরই আমার অভীষ্ট লক্ষ্য৷ ওখানেই গোলকপুষ্পর খোঁজ পাব৷
তবে কাজটা যে প্রভূত ঝুঁকির সে নিয়ে সন্দেহ নেই৷ আসামের জঙ্গলের মতো বিপদসংকুল জায়গা কমই আছে৷ লেপার্ড বা পাইথনের কথা ছেড়েই দিলাম, কখন যে ঘাসের জঙ্গল থেকে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসবে হিংস্রে বুনো মোষ, বা হিলহিলে মাথা তুলে দাঁড়াবে ব্যান্ডেড ক্রেইট, সেসব সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে৷ এতদিন এসব মংকুই সামলাত৷ কোন রাস্তা নিরাপদ, কোন পথে গেলে বুনো হাতির দলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা কম, কোথায় গেলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দুটো আঠেরো ফুট লম্বা কিং কোবরার সংসারযাপনের ছবি তুলতে পারব, সেসব ওর একেবারে নখদর্পণে ছিল৷
কিন্তু আজ আমি একা৷
রাস্তা এই ক’দিনে বেশ ভালোমতোই চেনা হয়ে গেছিল৷ ঘণ্টাখানেক বাদে যখন সেই শুকনো নালার কাছে এসে দাঁড়ালাম তখন সূর্য ঠিক মধ্যগগনে৷ মাথার ওপর আশ্বিনের পরিষ্কার আকাশ৷ বেশ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে৷ পাখপাখালির ডাক ছাড়া দূর দূর অবধি আর কোনো প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই৷
বলতে দ্বিধা নেই, শুকনো নালাটার সামনে বুনো ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গা-টা একটু শিরশির করে উঠল৷ তার একটা কারণ যদি হয় মংকুর কালকের কথাগুলো, আরেকটা হচ্ছে যতই এগোচ্ছিলাম নালাটার দিকে, মনে হচ্ছিল জঙ্গল জুড়ে যেন একটা চাপা নৈঃশব্দ্য নেমে আসছে৷ মানে ধীরে ধীরে আমার আর জঙ্গলটার মধ্যে একটা পর্দা গজিয়ে উঠছে, সেটা পেরিয়ে ওদিককার আওয়াজ আর আমার কানে পৌঁছোচ্ছেই না৷
নালাটার কাছে পৌঁছে একবার পেছনে তাকালাম৷ আমার আসার সুঁড়িপথটা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ বুনো ঘাসের ডগাগুলো ফণা তোলা সাপের মতো দুলছিল৷ কাউকে ছোবল মারবে নাকি?
মাথাটা সবে ঘুরিয়েছি, এমন সময় শাল, সেগুন আর গামার গাছের দুর্ভেদ্য পাঁচিলের মধ্য দিয়ে হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল৷ আমার মনে হল কেউ যেন কান্নার সুরে ফিসফিস করে বলে উঠল, ফিরে আয়, ফিরে আয়…এখনও সময় আছে…ফিরে আয়…
চোখটা একবার বন্ধ করেই ফের খুললাম আমি৷ কী সব আজেবাজে ভাবছি! গোলকপুষ্প খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনায় মাথাটা আমার খারাপ হয়ে গেল নাকি?
জাঙ্গল নাইফটা হাতে নিয়ে নালাটায় নামলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম যে শুকনো নালার ঘাসে বাতাসের একটা দমকা দীর্ঘশ্বাস খেলে গেল৷
আর তারপরেই সব চুপ!
চুপ মানে একদম চুপ৷ হঠাৎ করেই কে যেন বাতাসের টুঁটি টিপে ধরেছে, আশ্বিনের ঝিরিঝিরি বাতাস একেবারেই উধাও৷ জঙ্গলের আওয়াজটা কমে আসতে আসতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল৷
বুকসমান উঁচু ঘাস ঠেলে নালাটা পেরোতে সময় লাগল মিনিট তিনেক৷ হাঁচোড়পাঁচোড় করে ওপরে উঠে একবার ঘুরে দাঁড়ালাম৷ ব্যাপারটা কী? সব কিছু এরকম ঠান্ডা মেরে গেল কেন?
কই কোথাও কিছু নেই তো! সব স্বাভাবিক৷ শুধু ওই একটাই ব্যাপার, জঙ্গলের পাখির ডাক বা অন্য কোনো আওয়াজ নেই, আর বাতাসে একটা বিষণ্ণ গম্ভীর ভাব ছেয়ে আছে৷
ব্যাপারটা কী? এদিকটায় পাখি-টাখি বা অন্যান্য জন্তুজানোয়ার নেই নাকি? এরকম তো হওয়ার কথা নয়!
আমার ভাবনাটা যে ভুল সেটা টের পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই৷
আমার ঠিক সামনে ছিল একটা পুরোনো শ্যাওলা ধরা অগুরু গাছ৷ সেদিকে এক পা এগোতেই দেখি কোথা থেকে একটা কাক উড়ে এসে বসল তার ডালে৷
শুধু বসল৷
ডাকল না৷
তার দৃষ্টি সোজা আমার দিকেই৷
লক্ষ করলাম কাকটার চোখদুটো কালো নয়৷ লাল, হলদেটে লাল৷
কাকটাকে উপেক্ষা করেই পরের পা ফেললাম৷ এবার ডানদিকের গামার গাছের ডালে উড়ে এসে বসল আরেকটা কাক৷ ঠিক আগেরটার মতোই৷ এও ডাকল না৷ হলদেটে লাল চোখ মেলে তাকিয়ে রইল আমার দিকে৷ একটু আশ্চর্য হলাম৷ এ আবার কীরকমের কাক?
পরের পা ফেললাম৷ এবার বাঁদিকের শিশুগাছের ডালে উড়ে এসে বসল আরেকটা কাক৷ সেও আগের দুটোর মতোই হলদেটে লাল চোখ মেলে চেয়ে রইল আমার দিকে৷
এবার একটা অদ্ভুত জিনিস শুরু হল৷ এক পা এক পা করে এগোচ্ছি, আর দেখছি আশেপাশের প্রতিটা গাছের ডালে এক একটা করে কাক উড়ে এসে বসছে৷ তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি আমার দিকে, তাদের প্রত্যেকের চোখের রং এক৷
রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা পথের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না? মনে হল সেটা এই সাম্প্রতিক কালেই তৈরি হয়েছে৷ তার মানে কি অলরেডি অন্য কেউ কাউরীবুড়ির মন্দিরের খোঁজ পেয়ে গেছে? অর্থাৎ আমার একজন কম্পিটিটর ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছে বাজারে? এত দূর এসে তরী ডুববে নাকি?
ব্যাপারটা মাথায় আসতেই মনে একটা মরিয়া সাহস ফিরে পেলাম৷ জাঙ্গল নাইফটা বাগিয়ে এগিয়ে পড়লাম সেই রাস্তা ধরে৷
আজ এতদিন বাদেও সেই দুপুরটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা একটা জঙ্গল৷ একটা ঝিমধরা নিঝুম নিস্তব্ধতা চারিদিকে ছেয়ে আছে৷ তার মধ্য দিয়ে আমি একা একটা জাঙ্গল নাইফ হাতে ডালপালা ছাঁটতে ছাঁটতে এগোচ্ছি৷
একটা কথা অবশ্য ভুল হল৷ আমি একা নই৷ ওরাও আছে৷
আমি খেয়াল করছিলাম যে আমার এগোবার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাকেদের ঝাঁকও আমার সঙ্গে সঙ্গে এই ডাল, ওই ডাল করে এগোচ্ছিল৷ তাদের কেউ একবারও ডাকছে না৷ শুধু আমার পথের আশেপাশের কোনো গাছের ডালে একটু একটু করে উড়ে গিয়ে বসছে আর আমার দিকে ফিরে সেই ঠান্ডা হলদেটে লাল চোখে তাকিয়ে আছে৷
এইভাবে মিনিট দশ-পনেরো এগোনোর পর হঠাৎ করেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছোলাম৷ জায়গাটা একটা চাতাল মতো৷ খানিকটা গোলমতো ফাঁকা জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক উলটো দিকে বেশ কয়েকটা নিমগাছ একসঙ্গে জড়ো হয়ে একটা বিশাল চাঁদোয়া মতো বানিয়েছে৷ আর তার ঠিক নীচে পাথরের তৈরি পুরোনো একটা মন্দির৷
কাউরীবুড়ির মন্দির!!
এতক্ষণের পরিশ্রমে আর উত্তেজনায় দরদর করে ঘামছিলাম৷ ওখানেই ধুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম৷ মাথাটা নীচু করতেই বুকের ধড়াস ধড়াস আওয়াজটা নিজের কানেই দ্রিমিদ্রিমি হয়ে বেজে উঠল৷ আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র৷ তার পরেই হয়তো সাত রাজার ধন এক মানিক আমার হাতে!
মিনিটখানেক ওইভাবে বসে থাকার পর মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালাম৷ বেল্টটা টাইট করে বেঁধে আর জাঙ্গল নাইফটা খাপে ঢুকিয়ে নেমে পড়লাম চাতালে৷ তারপর লম্বা লম্বা পায়ে জায়গাটা অতিক্রম করে মন্দিরটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম৷
পাথরের মন্দির, আকারে বেশ বড়৷ আমাদের পরিচিত ভারতীয় একচালা বা দোচালা মন্দির থেকে বেশ আলাদা৷ আদল অনেকটা তিব্বতি বা চিনা মন্দিরের মতো৷ মন্দিরের সারা গায়ে দক্ষ হাতে পাথর কুঁদে অপূর্ব অলংকরণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ মন্দিরের ঠিক সামনে একটা হাড়িকাঠও নজরে এল৷ মানে এককালে বলিদানের ব্যবস্থাও ছিল নিশ্চয়ই৷ নরবলিও হত কি?
ধীর পায়ে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে উঠলাম৷ ওঠার আগে হান্টিং বুটটা খুলে রাখতে ভুললাম না যদিও৷ হাজার হোক এত বছরের সংস্কার৷ তা ছাড়া আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে এই মন্দির এখনও জাগ্রত, এখানে শ্রদ্ধাবনত ভাবে, মাথা নীচু করেই ঢুকতে হবে৷
ঢোকার আগে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে নিলাম৷ গোটা চত্বরটা ঘিরে থাকা প্রতিটি গাছের ডালে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক কাক বসে৷ কেউ ডাকছে না৷ এবং প্রত্যেকে তীক্ষ্ণ ঠোঁট উঁচিয়ে, হলদেটে লাল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷
কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে, যা হয় হবে৷ যার জন্য এত কষ্ট করে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছি, সেই গোলকপুষ্প আছে কি নেই, এই মুহূর্তে সেটাই একমাত্র বিচার্য৷ বাকিটা পরে দেখা যাবে না হয়৷
আলো থেকে অন্ধকারে ঢোকার ফলেই হয়তো প্রথমে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ চোখটা সয়ে আসতে খানিকটা সময় নিল৷
প্রথমেই লক্ষ করলাম যে মন্দিরের মধ্যে মূর্তি বলতে কিছু নেই৷ দরজার উলটোদিকের দেওয়ালে একটা দেবীমূর্তির রিলিফ, পাথরে কুঁদে ফুটিয়ে তোলা৷ আর ঠিক তার সামনে মেঝেতে গাঁথা আছে একটা পাথরের হাড়িকাঠ৷ হাড়িকাঠের ঠিক সামনে একটা গর্ত৷ সেই গর্ত দিয়ে কী যেন একটা উঁকি দিচ্ছে৷
রুকস্যাক থেকে টর্চটা বার করে উলটোদিকের দেওয়ালে ফেললাম৷ এই কি কাউরীবুড়ির মূর্তি?
মূর্তিটা একটু অদ্ভুত৷ দেবীর কোনো বাহন নেই, পদ্মাসনে বসে আছেন৷ দেহের তুলনায় মুখটা একটু বড়, চোখদুটো আরও অস্বাভাবিক রকমের বড়৷ পাথর কুঁদে কুঁদে উড়ন্ত চুল বোঝানো হয়েছে৷ মাতৃমূর্তির মুখে সচরাচর একটা স্নিগ্ধ স্নেহচ্ছায়া লেগে থাকে৷ কিন্তু এঁর মুখে একটা তিক্ত, নিস্পৃহ, উদাসীন ভাব ফুটে আছে৷ সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই, প্রেম নেই, মোহ নেই৷ কিচ্ছু নেই৷
এবার টর্চটা ঘোরালাম মেঝের দিকে৷ রিসেন্টলি কিছু পুজো-আচ্চা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কারণ হাড়িকাঠের সামনে পড়ে আছে জবাফুল, আতপ চাল আর সিঁদুরলেপা অশ্বত্থের পাতা৷ আর তার সামনের গর্ত থেকে উঁকি মারছে ওটা কী?
ওদিকে আলো ফেলতেই হৃৎপিণ্ডটা একলাফে গলার কাছে উঠে এল৷ একটা লতানে গাছ বেরিয়ে আছে গর্তটা থেকে৷ পানপাতার মতো বড় বড় পাতা৷ আর তার ডগায় ফুটে আছে একটি কুঁড়ি৷ কুঁড়ির ঠিক মাথার ওপর একটি বড় পাতা সাপের ফণার মতো উঁচিয়ে আছে৷
হাতটা থরথর করে কাঁপছিল৷ এটাই যে সেই গোলকপুষ্প তাতে কোনো ভুল নেই৷ মনে মনে বর্ণনাটা একবার আউড়ে নিলাম৷ একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে৷ পুথিতে এও বলা আছে যে ওই কুঁড়ি ফুটতে এখনও অনেক দেরি, ফুটবে আষাঢ় মাসে, অম্বুবাচীর দিন৷ সেদিন পাতাগুলো শুকনো হয়ে ঝরে যাবে, আর ডগায় দুলবে ছাই ছাই রঙের এই আশ্চর্য ফুল৷ তার সৌরভে নাকি সমস্ত বনভূমি আমোদিত হয়ে ওঠে৷ মানুষের মনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে কামনার সহস্রশীর্ষ কালসর্প৷ সেই রাতে নাকি স্বয়ং কামদেব আর ধন্বন্তরি এই মর্তভূমিতে নেমে আসেন এই দেবভোগ্য ফুল সংগ্রহ করতে৷ তার অর্ধেক দিয়ে তৈরি হয় জীবনদায়ী ঔষধি, বাকি অর্ধেক দিয়ে উদ্দীপক কামরস!
আমি অবশ্য এতশত ভাবছিলাম না৷ আমি জানি যে সমস্ত পৌরাণিক কাহিনির পেছনে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক বা জাগতিক সত্য৷ এইসব গল্পকথার মানে একটাই, এই ফুলের রসের কেমিক্যাল কম্পোনেন্টের দুটি বিশেষ ধর্ম আছে৷ একটি মেডিসিনাল, আরেকটি অ্যাফ্রোডিজিয়াক৷
ইতিমধ্যেই আমি আমার কর্তব্য স্থির করে নিয়েছি৷ লতাকে এখান থেকে তুলে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে পরিচর্যা করে বাঁচিয়ে রাখার প্ল্যান-প্রোগ্রাম ইত্যাদি করাই আছে৷ ইতিমধ্যেই এখানকার মাটির কম্পোজিশন জোগাড় করে রেখেছি৷ এর পরে এখন একটাই কাজ বাকি, যত্ন সহকারে একে এখান থেকে তুলে একবার কালিম্পং-এ নিয়ে যাওয়ার ওয়াস্তা, ব্যস৷ আমার এক চেনা ভদ্রলোকের গ্রিন হাউস আছে কালিম্পং-এ৷ যে-কোনো লতা বা গুল্মকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করায় সেই ভদ্রলোক প্রায় ধন্বন্তরি৷ আমার আয়ুর্বেদিক গবেষণায় উনি যথেষ্ট সাহায্য করেন৷
ধীরে ধীরে রুকস্যাকটা পিঠ থেকে নামিয়ে আমার আসাহি ক্যামেরাটা বার করলাম৷ এখান থেকে লতাটাকে যথাবিহিত যত্নসহকারে উপড়ে নেওয়ার আগে তার কয়েকটা ফোটো তুলে নেওয়া আবশ্যক৷
ক্যামেরার অ্যাপার্চার ইত্যাদি ঠিক করছি, ঠিক এমন সময়ে আমার পিছন থেকে একটি তীক্ষ্ণ মহিলা কণ্ঠের চিৎকার ভেসে এল, ‘‘কে, কে ওখানে?’’
* * * *
আমি এমন চমকে উঠেছিলাম যে হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়৷ কোনোমতে সামলেসুমলে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি একজন মহিলা, ঠিক দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে৷ হাতে একটা বেতের চুপড়ি, দু’চোখে বিপুল বিস্ময় আর ক্রোধ৷
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘‘এ কী! আপনি কে? কোথা থেকে এলেন?’’
মহিলা দ্রুতপায়ে এসে বেতের চুপড়িটা নামিয়ে রাখলেন৷ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ সর্পিণীর মতো হিসহিস করে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কে আপনি? এখানে এলেন কী করে? কে রাস্তা দেখাল আপনাকে?’’
ভদ্রমহিলার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট মতো৷ কটা চোখ, চওড়া চোয়াল, আর ভাঙা গাল৷ উপরের পাটির দাঁতগুলো একটু বড়৷ পরনে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ৷ বয়েস বেশি না, পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যেই হবে৷ কিন্তু ইতিমধ্যেই মহিলার মাথার চুল সাদা হতে শুরু করেছে৷ হিসেব মতো মহিলার এখনও যথেষ্ট যৌবনবতী থাকার কথা৷ কিন্তু তার বদলে ছড়ানো শুকনো আঙুল, কাঠ কাঠ হাত-পা এবং সারা মুখ জুড়ে রুক্ষ, শুষ্ক, বিরক্ত একটা ভাব৷ সব মিলিয়ে মহিলার উপস্থিতিটাই খুব কর্কশ ও অস্বস্তিকর৷
নমস্কার করে বললাম, ‘‘আমার নাম ভবতারণ চট্টোপাধ্যায়, বাড়ি কলকাতা৷ এখন অবশ্য শিলিগুড়িতে থাকি৷ এখানে এসে উঠেছি…’’
‘‘আপনার ঠিকুজি জানতে চাইনি’’, ধমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা, ‘‘আপনি এতদূর এলেন কী করে? আর এ জায়গার খোঁজই বা পেলেন কী করে?’’
‘‘হেঁটেই এলাম৷ উড়ে আসার তো কোনো রাস্তা নেই বলেই দেখছি৷’’ অল্প হাসার চেষ্টা করলাম৷
‘‘আপনি ঠাট্টা করছেন? আপনার স্পর্ধা তো কম নয়৷’’ দু’চোখ ধক করে জ্বলে উঠল মহিলার৷ ‘‘কে আসতে বলেছে আপনাকে? জানেন কোথায় এসেছেন আপনি?’’
‘‘জানি বই কি৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷ না জেনে আর আসব কেন বলুন?’’
মুহূর্তের মধ্যে মহিলার মুখের মধ্যে পরপর বিস্ময়, ভয় আর ক্রোধের ছায়া খেলে গেল৷ তারপর বললেন, ‘‘কেন এসেছেন আপনি? কী চাই এখানে?’’
আসার কারণটা বলেই ফেললাম৷ আর লুকিয়ে লাভ নেই৷
আমার কথা শুনে মহিলার কটা চোখদুটো ফের জ্বলে উঠল, দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, ‘‘আপনার সাহস তো কম নয়! আপনি কাউরীবুড়ির ফুল তুলে নিয়ে যেতে এসেছেন? আপনি জানেন কত পবিত্র এই ফুল? সেই ফুল নিয়ে ব্যবসা করবেন? আপনার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত৷’’
ভাবলাম উলটে কটা কড়া জবাব দিই৷ তারপর ভাবলাম, থাক, এরকম পরিস্থিতে আগেও বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে৷ অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে এসব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ রাস্তা যখন চিনে গেছি তখন এখানে বারবার আসা যাবে৷
চুপ করে থাকায় ফল হল৷ হিসহিসানি কমল খানিকটা, ‘‘কে রাস্তা দেখাল আপনাকে?’’
মংকুর কথাটা স্বীকার করলাম৷ এমনকি সে যে বারণ করেছিল বারবার সেটাও জানালাম৷
মহিলা খরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে৷ তারপর বললেন, ‘‘গত আড়াইশো বছর ধরে একমাত্র আমাদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া এই মন্দিরে আর কেউ জীবন্ত পা রাখেনি৷ রাখলেও বেঁচে ফিরে যায়নি৷ আপনি এলেন কী করে এখানে?’’
মহিলা মনে হয় উন্মাদ৷ আড়াইশো বছর ধরে ওঁদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ মন্দিরে পা রাখেনি? এটা বিশ্বাসযোগ্য?
এখন কথা হচ্ছে যে উন্মাদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে নেই৷ আমি চট করে মন্দিরের গায়ে আঁকা কাউরীবুড়ির রিলিফটার দিকে একটা প্রণাম ঠুকে দিলাম, ‘‘সে একমাত্র মা কাউরীবুড়িই জানেন৷ তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া কি এখানে আসতে পারি বলুন? মা নিজেই পথ দেখিয়ে এনেছেন আমাকে৷’’
দেখানে ভক্তিটায় বোধহয় কাজ হল৷ মহিলা সাপের চাউনিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘‘আপনার কোনো ক্ষতি করছি না আপাতত, নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলেছেন ভেবে ছেড়ে দিচ্ছি৷ এখন এই কোণে চুপচাপ ভদ্রভাবে বসে থাকুন৷ আমার পুজো শেষ হলে আপনাকে জঙ্গলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসব৷ আর হ্যাঁ, এই যে আপনি এখানে এসেছেন, এসব কথা যেন বাইরে প্রচার না হয়৷ কালই ফিরতি ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি ফিরে যাবেন৷ তবে কোনো প্যাঁচ কষার চেষ্টা করবেন না কিন্তু, ফের যদি দেখেছি এদিকে আসতে তাহলে কিন্তু এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন না, এই বলে দিলাম৷’’
হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম৷ পকেটে একটা রিভলবার, কোমরে একটা জাঙ্গল নাইফ নিয়ে ঘুরছি৷ মার্শাল আর্টও জানা আছে অল্পবিস্তর৷ তার পরেও যদি এই নিরস্ত্র মহিলা আমার প্রাণনাশের ধমকি দেন তাহলে তো…
‘‘কথাটা বিশ্বাস হল না, তাই না?’’ ভদ্রমহিলা দেখি আমার মনের কথাটা পড়ে ফেলেছেন৷ ঠোঁটের কোণ অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে বললেন, ‘‘দেখবেন আমি কী করতে পারি?’’ তারপর বাইরের দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন, ‘‘তাকিয়ে দেখুন৷’’
জঙ্গলের দিকে তাকাতেই এক ধাক্কায় আমার হৃৎপিণ্ডটা প্রায় কণ্ঠার কাছে এসে থমকে গেল৷
তাকিয়ে দেখি জঙ্গলের প্রতিটি গাছের মাথায় আর ডালে শুধু কাক আর কাক৷ এই কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন রাজ্যের কাক হাজারে হাজারে এসে চারিদিকের সবকটা গাছের ডাল দখল করে ফেলেছে৷ এবং দখল করেছে এত নিঃশব্দে যে আমি তার আঁচ অবধি পাইনি৷ কোনো ডানা ঝাপটানোর শব্দ নেই, কোনো ডাকাডাকির শব্দ নেই৷ যেন কয়েকটা পাথরে কোঁদা মূর্তি চেয়ে আছে এদিকেই৷
না, এদিকে না৷ শুধু আমার দিকে৷ তাদের হলদেটে লাল চোখগুলো সব আমার মুখের ওপরেই স্থির হয়ে আছে হাজার জোড়া সার্চলাইটের মতো৷ সেদিকে তাকিয়ে এই প্রথম একটা জিনিস অনুভব করলাম৷ সেই নিষ্পলক জ্বলন্ত চোখগুলোতে যেটা মিশে আছে সেটাকে বলে রাগ৷ প্রবল ঘেন্না মেশানো রাগ৷ আমার মনে হল যেন প্রতিটা কাকের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে আমাকে খুবলে খাওয়ার প্রবল বাসনা৷ কেবলমাত্র অনুমতি নেই বলে ওরা চুপচাপ বসে আসে গাছের ডালে৷ নইলে এতক্ষণে…
বলতে নেই, ওই দৃশ্য দেখে দিনের বেলাতেও বুকটা ঠান্ডা হয়ে এল৷ এসব হচ্ছেটা কী?
পেছন থেকে সেই চাপা হিসহিস শব্দটা ভেসে এল ফের, ‘‘কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবেন না৷ তাহলে কিন্তু আপনার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ চুপচাপ ওখানে দাঁড়ান৷ আমি বার করে নিয়ে না গেলে আপনি এই জঙ্গল থেকে জ্যান্ত বেরোতে পারবেন না৷’’
‘‘কি…কি…কিন্তু আপনি কে?’’
খানিকক্ষণ চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন মহিলা৷ মনে হল বোধহয় ভাবছেন আমাকে উত্তর দেওয়াটা ঠিক হবে কি না৷ তারপর ধীরস্বরে বললেন, ‘‘আমি এই মন্দিরের সেবায়েত, এখানকার বড়দেওরি৷’’
বড়দেওরি কথাটা কোথায় যেন শুনেছি মনে হল৷ কিন্তু তখন উত্তেজনায় মাথাটা এমন ঘেঁটে ছিল যে সেটা মাথায় এল না৷ প্রশ্ন করলাম, ‘‘সেবায়েত? মাফ করবেন, কিন্তু আজ অবধি কোনো মহিলাকে মন্দিরের সেবায়েত হতে দেখিনি৷’’
মহিলা ততক্ষণে আমার দিকে পিছন ফিরে বেতের চুপড়ি থেকে পুজোর সরঞ্জাম নামিয়ে রাখতে শুরু করেছেন৷ সেখান থেকেই বললেন, ‘‘শুনে না থাকলে শুনুন৷ সব কিছুরই তো প্রথমবার বলে কিছু হয়৷’’
পেটের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্নের বুজকুড়ি উঠছিল৷ একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করলাম, ‘‘কিন্তু আমাকে যে বলা হল এই মন্দিরে আসা নাকি লোকের বারণ৷ মানে এখানে কেউ আসে না…’’
‘‘লোকেদের বারণ করা হয়েছে বলেই তারা আসে না৷ কারণ বুড়িমা পছন্দ করেন না যে কেউ তাঁকে বিরক্ত করুক৷’’
বারণ করলেই লোকে শুনছে, শুনে ভারী আশ্চর্য লাগল৷ এখানকার লোক এত বাধ্য নাকি? ভাবতে ভাবতেই মংকুর কথা মনে পড়ে গেল৷ ও-ই বলেছিল না যে বড়দেওরির বারণ আছে এদিকে আসার?
কথাটা বলতে মহিলার ঠোঁটে একটা আলগা হাসি খেলে গেল৷ তারপর ধীর স্বরে বললেন, ‘‘ও ঠিকই বলেছে৷ ওদের বারণ আছে৷ শুধু ওরা কেন, বললাম যে, একমাত্র আমাদের পরিবারের মেয়েদের ছাড়া বাকি সবার জন্য এখানে আসা বারণ৷’’ বলে থামলেন তিনি, তারপর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ‘‘সরুন, সরুন৷ আমাকে পুজোটা শেষ করতে দিন’’, বলেই ব্যস্তসমস্ত পায়ে সেই দেওয়ালে গাঁথা অদ্ভুত মূর্তির সামনে গিয়ে বসলেন তিনি৷
একমাত্র এঁদের ফ্যামিলির মহিলা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এখানে আসা কেন বারণ সেটা আমার মাথায় ঢুকল না৷ তবে এ নিয়ে আর বেশি জানার চেষ্টা করাটা উচিত হবে বলে মনে হল না৷ চুপচাপ মাটিতে বসে ভদ্রমহিলার পুজো করা দেখতে লাগলাম৷
পুজোর পদ্ধতি বড় অদ্ভুত৷ প্রথমেই একটা বাটি থেকে রক্তচন্দন নিয়ে নিজের কপালে একটা অদ্ভুত সিম্বল আঁকলেন৷ তারপর ছোট মাটির প্রদীপে সর্ষের তেল ঢেলে তাতে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালালেন৷ একগোছা ধূপ ধরিয়ে বাঁশের তৈরি একটা ধূপদানিতে গাঁথলেন৷ সেসব সারা হলে কয়েকটা জবাফুল, পান-সুপারি, ভেজা চাল, শুকনো লংকা এসব বার করে মাটিতে রেখে পুজো শুরু করলেন৷
পুজো করতে সময় লাগল আধঘণ্টাটাক৷ অর্ঘ্যদান শেষ হতেই মন্দিরের বাইরে বেরোলেন ভদ্রমহিলা৷ অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য না, অল্প সময় পরেই বাঁ হাতে একটা দু-পা বাঁধা পায়রা ঝুলিয়ে নিয়ে এলেন৷ ডান হাতে একটা বড়ো হাত-দা৷
এরপর ভদ্রমহিলা যেটা করলেন সেটা দেখে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেলাম আমি!
বাঁ হাতে পায়রাটাকে ধরে মাটিতে গাঁথা পাথরের হাড়িকাঠটার মধ্যে রাখলেন৷ তারপর সম্পূর্ণ অজানা একটা ভাষায় উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র বলতে বলতে হাতের দা-টা দিয়ে এককোপে পায়রাটার মুন্ডুটা কেটে ফেললেন৷ ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তে ভিজে গেল মহিলার শুকনো ফ্যাকাশে হাত দুটো৷ সাদা কাপড়ে ছিটকে এল রক্তের ফোঁটা৷
মুন্ডুহীন পায়রাটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর আর নিস্তেজ হয়ে গেল৷ আর পায়রাটার রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল গর্তটার দিকে, যেখান থেকে উঁকি মারছে গোলকপুষ্পের লতা!
দৃশ্যটা দেখে আমার হাত-পা এমনই জমে গেছিল যে নড়তে বা কিছু বলতে পারছিলাম না৷ ইতিমধ্যেই কখন যে মহিলা হাত-টাত ধুয়ে পুজোর উপচার গুছিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা খেয়াল করিনি৷ সংবিৎ ফিরল যখন উনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘‘চলুন, আপনাকে জঙ্গলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসি৷ আর হ্যাঁ, যা বললাম, কালই শিলিগুড়ি ফিরে যান, এদিকে আসার আর চেষ্টাও করবেন না যেন৷ কাউরীবুড়ির অনুচরেরা কিন্তু আপনাকে চিনে নিয়েছে৷ এখানে ফিরে আসার বা অন্য কোনো বদমাইশি করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে তার ফল যে ভালো হবে না, সেটা আগেই বলেই দিলাম৷’’
যে রাস্তা ধরে এসেছিলাম সেই রাস্তা ধরেই ফিরতে হল৷ এবার কোনো কাকের দেখা পেলাম না৷ ততক্ষণে বিকেল পড়ে আসছিল৷
মিনিট পনেরো হাঁটার পর ফের সেই নালার কাছে এসে পৌঁছোলাম৷ আগের বার যেখান থেকে নালাটা পেরিয়েছিলাম, ভদ্রমহিলা তার থেকে একটু দূরে হেঁটে গেলেন৷ দেখি কয়েকটা পুরোনো গাছ এপার-ওপার ফেলা আছে ব্রিজের মতো করে৷ তার মানে মহিলা এই পথেই যাতায়াত করেন৷ এদিক-ওদিক তাকাতে একটু দূরে প্রাচীন একটা ভাঙা কাঠের দেউড়িরও আভাস পেলাম৷
নালাটা পেরোতেই আস্তে আস্তে পাখিদের ঘরে ফেরার শব্দ কানে আসতে লাগল৷ হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম, এতক্ষণ এসব শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না কেন?
ভদ্রমহিলা আমার আগে আগে যাচ্ছিলেন৷ আমি থামতেই উনিও থেমে গেলেন৷ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘‘কী হল, থামলেন কেন? চলুন৷ সন্ধে নামার আগে আপনাকে এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে৷ নইলে আমারও সাধ্য থাকবে না আপনাকে রক্ষা করার৷’’
‘‘শব্দ…শব্দ…’’ অস্ফুটে বললাম, ‘‘এতক্ষণ আপনার কথা ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না কেন?’’
সন্ধে নেমে আসা আধো আঁধারের মধ্যে ভদ্রমহিলার চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠল, ‘‘কারণ কাউরীবুড়ি কোনো আনন্দ বা উল্লাসের শব্দ সহ্য করতে পারেন না৷ তাই তাঁর এলাকায় সমস্ত অবাঞ্ছিত শব্দের প্রবেশ নিষেধ, কোনো অবাঞ্ছিত অতিথির প্রবেশও নিষেধ৷’’
অস্ফুটে বলে ফেললাম, ‘‘সেইজন্যই ওই গোলকপুষ্পের কথা কেউ জানে না…!’’
পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর ডান হাতের তর্জনী তুলে শাসাবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘এই শেষবারের মতো আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি ওই ফুলের কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না৷ ও ফুল মহা পবিত্র ফুল, অম্বুবাচীর দিন কাউরীবুড়ির কাছে ওকে অর্ঘ্য দেওয়া হয়৷ ওকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না৷ আপনার মহাসর্বনাশ হবে৷’’
বলে থামলেন একটু৷ তারপর বললেন, ‘‘অবশ্য তুলে নিয়ে গিয়েও লাভও নেই৷ ওই মন্দির ছাড়া এই লতা আর অন্য কোথাও বাঁচবেও না৷’’
বেকুবের মতো প্রশ্ন করলাম, ‘‘কেন?’’
ভদ্রমহিলা ঘুরে দাঁড়ালেন৷
রাস্তা শেষ হয়ে আসছিল৷ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে একটু বাঁদিকে জঙ্গলের বড় রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিল, যেটা ধরে আমি এসেছিলাম৷ সেদিকে তর্জনী তুলে আমাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ভদ্রমহিলা৷ নিজে ডানদিকের একটা সুঁড়িপথ ধরে চলে যাচ্ছিলেন৷ কী একটা ভেবে থমকালেন, তারপর ঘনিয়ে আসা অন্ধকার আরও গাঢ় করে দিয়ে বললেন, ‘‘কারণ কাউরীবুড়ির কাছে দেওয়া বলির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচে না৷’’
* * * *
সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা বেজে গেছিল৷ তখন ওদিককার শহরগুলোতে ছটা বাজলেই রাত৷ তার ওপর ছিঁচকে চোর বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎপাত তো আছেই৷ একে অচেনা জঙ্গল, তার ওপর সন্ধের অন্ধকার৷ স্রেফ একটা টর্চের ভরসায় সাপখোপের কামড় এড়িয়ে সেদিন যে কী করে ফিরেছি সে গল্প না হয় আরেকদিন বলব৷
বাড়িতে ঢোকার আগে একটু দূর থেকেই দেখতে পেলাম সদর দরজায় আলো জ্বলছে, সেখানে বেশ কয়েকজন জটলা করে৷ কাকু-কাকিমা তো আছেনই, এমনকি কাকুদের প্রতিবেশী দু-তিনজনকেও চিনতে পারলাম৷ একটু এগোতে দেখি মংকুও সেখানে উপস্থিত৷ প্রমাদ গণলাম, ব্যাটা কী বলতে কী বলেছে কে জানে?
বাড়িতে ঢুকতেই কাকু দৌড়ে এলেন, ‘‘এ কী ভবতারণ, এত রাত অবধি ছিলে কোথায়? আমি আর তোমার কাকিমা তো ভেবে ভেবে সারা৷ তার ওপর মংকু বলল আজ নাকি ওকে আসতে বারণ করে দিয়েছ? কোনো আপদ-বিপদ হয়নি তো? আমি তো আরেকটু হলেই থানায় যাচ্ছিলাম৷’’
কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, ‘‘আরে না না কাকু, চিন্তা করার মতো তেমন কিছুই হয়নি৷ ঘুরতে ঘুরতে একটু শহরের বাইরে চলে গেসলাম৷ তারপর গাড়ি-ঘোড়া না পেয়ে হেঁটে আসতে একটু দেরি হল, এই যা!’’
কাকিমা ছলছল চোখে বললেন, ‘‘অমন করতে আছে বাছা? পরের ছেলে বলে কি আমাদের চিন্তা হয় না? ভালোমন্দ কিছু যদি একটা ঘটে যেত?’’
আমি আমার মাকে হারিয়েছি সেই কোন ছোটবেলায়, তাঁর কথা ভালো করে মনেও পড়ে না৷ স্মৃতি বলতে একটা পুরোনো হাতে বোনা সোয়েটার আর কিছু রংচটা ফটোগ্রাফ৷ কাকিমার ছলছল চোখদুটি দেখে আমার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ আজ যদি আমার নিজের মা বেঁচে থাকতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনিও এইভাবেই আমার চিন্তায় কাতর হতেন, এইভাবেই আমার পথ চেয়ে থাকতেন?
মনস্থির গতকালই করে নিয়েছিলাম, আজ আরও দৃঢ়সংকল্প হলাম৷ এই মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তবেই আমি ফিরব৷
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে হাত-পা ধুয়ে নিতে নিতে মংকুকে চাপা গলায় বললাম, ‘‘খুলে বল তো, কী বলেছিস কাকুকে?’’
জল ঢালতে ঢালতে মংকু একবার ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে নিল৷ তারপর বলল, ‘‘বাবুকে তেমন কিছুই বলিনি৷ শুধু বলেছি দাদা আজকে আমাকে আসতে বারণ করে দিয়েছে, বলেছে শহরটা একা একা ঘুরে দেখতে চায়৷’’
‘‘সাবাস!’’ বলে গামছাটা হাতে টেনে নিলাম, ‘‘কাল সকালে তোর সঙ্গে আমার আলাদা করে কথা আছে৷’’
‘‘কী নিয়ে?’’
‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির নিয়ে৷’’
‘‘কেন?’’ কুয়োর বালতিটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল মংকু৷ ওর স্বরে ফের সেই ভয়ের ছায়া৷
‘‘আজ আমি কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলাম৷’’
মংকুর হাত থেকে বালতিটা সশব্দে পড়ে গিয়ে বিশ্রী একটা খ্যানখ্যানে আওয়াজ তুলল৷ আমি ধরে না ফেললে ছোকরা পড়েই যেত হয়তো৷ অতি কষ্টে ওর মুখটা চেপে ধরে আস্তে করে শুইয়ে দিলাম কুয়োতলায়৷ বাড়ির ভেতর থেকে কাকু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল রে মংকু, আওয়াজ কীসের?’’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘ও কিছু না কাকু, বালতিটা হাত থেকে পড়ে গেসল৷’’
মুখে কিছুক্ষণ জলের ঝাপটা দিতেই পিটপিট করে চাইল ছোকরা, তারপর আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসল৷ দাঁড় করাতে গিয়ে দেখি পা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটার৷
থিতু হতে একটু সময় নিল মংকু৷ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি ফের মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম, ‘‘আস্তে, এখন না৷ কাল সকাল দশটা নাগাদ করোনেশনের সামনে৷ সেখানেই কথা বলব৷ এখন বাড়ি যা৷’’
* * * *
‘‘আপনি ডেকেছিলেন?’’
ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম মাধুরী৷ পরনে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি৷ সম্পূর্ণ নিরাভরণ বেশ, হাতে শাঁখা-নোয়া কিছুই নেই, গলাও খালি৷ সদ্যবিবাহিত কোনো মেয়ের পক্ষে যেটা একটু অস্বাভাবিক৷ অলংকার বলতে শুধু ডান হাতের আঙুলে দুটো আংটি৷ তবে হ্যাঁ, সিঁথিতে ডগডগ করছে লাল টকটকে সিঁদুর৷ সধবার চিহ্ন বলতে ওইটুকুই৷
সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলাম৷ বললাম, ‘‘বোসো৷’’
ধীর পায়ে এসে চেয়ারে বসল মাধুরী৷ তারপর শান্তস্বরে বলল, ‘‘বলুন৷ ডেকেছেন কেন?’’
কিছু বলার আগে একটা হালকা গন্ধ আমার নাকে এল, কিছু একটা পোড়ার গন্ধ৷ ভিজে কাঠ জ্বলতে থাকলে যেমন একটা ভ্যাপসা ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে, সেরকম৷ গন্ধটা একটু অস্বস্তিকর৷ কিন্তু সেসবে আমল দিলাম না৷
বাজে কথায় সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রসঙ্গে এলাম, ‘‘তোমার ব্যাপারে শুনলাম৷ কাকু-কাকিমা কাল সবই বলেছেন আমাকে৷ আমি কি এ ব্যাপারে কোনোভাবে তোমাকে হেল্প করতে পারি?’’
‘‘না৷’’ সংক্ষিপ্ত এবং দৃঢ় উত্তর৷ বুঝলাম এভাবে হবে না৷ অন্য রাস্তা ধরতে হবে৷
‘‘তুমি জানো বোধহয়, আমি বহুদিন যাবৎ আয়ুর্বেদ নিয়ে চর্চা করি৷ সেই সূত্রে নানাধরনের ভেষজ ওষুধ জানা আছে আমার৷ যদি তোমার বা অনির্বাণের কোনো ইয়ে, মানে শারীরিক সমস্যা থাকে তো আমাকে সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারো৷ আমি এরকম অনেক কেস সলভ করেছি৷’’
‘‘না, তার দরকার নেই৷’’ মনে হল একটু বিরক্ত হয়েছে মেয়েটা৷
প্রমাদ গুনলাম৷ মনে হচ্ছে ভুল লাইনে খেলে চটিয়ে দিয়েছি মেয়েটাকে৷ পেশেন্ট যদি একবার বিগড়ে যায় তো মুশকিল৷ তাকে দিয়ে তখন আর কিছুই বলানো যাবে না৷
‘‘হুম৷ আচ্ছা, অন্য কথা বলা যাক৷ অবসর সময়ে তুমি কী করো মাধুরী?’’
‘‘গান শুনি৷ সিনেমা দেখি৷ বই পড়ি৷’’
‘‘গাইতে পারো?’’
‘‘পারি৷’’
‘‘একটা গেয়ে শোনাবে?’’
‘‘না৷’’ আবার সেই পাথুরে দেওয়াল৷
এবার সত্যিই মাথা চুলকোতে লাগলাম৷ আমি মনস্তত্ত্ববিদ নই৷ এসব ক্ষেত্রে কী করে মনের দরজা খুলে রোগীর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হয় সে আমার অজানা৷ এখন কী উপায়?
‘‘আপনি আয়ুর্বেদচর্চা করেন বললেন তো৷ আর কিছু পারেন?’’ আমার চিন্তাজালকে ছিন্ন করে বলে উঠল মাধুরী৷
‘‘আর কিছু বলতে?’’
‘‘হাত দেখতে বা কোষ্ঠীবিচার করতে পারেন?’’
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন৷ মাধুরী নিজে থেকেই আমার কোর্টে একটা সহজ বল ঠেলে দিয়েছে৷
‘‘পারি বই কি!’’ আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলাম, ‘‘প্রায় দশ বছর হল এই নিয়ে চর্চা করছি, পারব না মানে? খুব ভালোভাবেই পারি৷’’
‘‘ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?’’
‘‘আলবাত৷ কী জানতে চাও বলো?’’
মাধুরী ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে৷ তারপর প্রাণহীন শুকনো স্বরে বলল, ‘‘দেখুন তো, আমি মরে যাব কবে৷’’
এইবার সোজা হয়ে বসে মেয়েটার দিকে চাইলাম৷ একটা দিশা দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে!
আমি হাত দেখতে পারি জেনে অনেক বয়স্ক বা প্রৌঢ় লোককে দেখেছি আমার হাতে তাঁদের হাত তুলে দিতে৷ তাঁরা খেলাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ভালো করে দেখে বলো তো বাছা, এই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব কবে?’’ বোঝাই যায় তাঁরা মরতে চাওয়ার মুহূর্তটির খোঁজ নয়, বরঞ্চ আর ক’দিন বেঁচে থাকতে পারবেন তার হিসেব চান৷ আমিও তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসিমুখে বলি, ‘‘আরে আপনি এখনও অনেকদিন বাঁচবেন মাসিমা৷ আগে নাতির ঘরে পুতির মুখ দেখুন৷ তারপর নাহয় পরপারে যাওয়ার কথা ভাববেন৷ এখনই তাড়া কীসের?’’ তাঁরাও মনোমতো উত্তর পেয়ে হাসিমুখে আশীর্বাদ করে চলে গেছেন৷
কিন্তু মাধুরীর বলার মধ্যে একটা রিক্ত আকুতি ছিল, একটা নিঃশেষ ফুরিয়ে যাওয়া ছিল, মৃত্যুর দিকে অলস বয়ে যাওয়া ছিল৷ ওর প্রতিটি স্বরে ফুটে উঠছিল এক নির্মম অমোঘ সত্য, ওপারের চিঠির খোঁজে উদগ্রীব এই মেয়ে৷ আর সেই তিক্ত উদাসীন শূন্য আকুতির সঙ্গে একটা জায়গারই তুলনা চলে৷
শ্মশান৷
কথাটা ভাবতে ভাবতেই ফের সেই গন্ধটা আমার নাকে এল৷ ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷
হাতটা তুলে আমার দু’হাতের মধ্যে নিলাম৷ আগেই বলেছি, এই শাস্ত্রে আমার কিছু ব্যুৎপত্তি আছে৷ হাওড়া শালকিয়ার বিখ্যাত জ্যোতিষাচার্য আশুতোষ ন্যায়রত্ন নিজের হাতে আমাকে এই শাস্ত্রে দীক্ষা দিয়েছেন৷ তাঁর শিক্ষা ব্যর্থ হতে পারে না৷
নরম হাত, আঙুলগুলি চাঁপাকলির মতো৷ নখগুলি সুন্দর ও গোলাকার আকারের৷ এ মেয়ে স্পষ্টতই বৃহস্পতির জাতিকা৷ কিন্তু সেই সঙ্গে এও লক্ষ করলাম যে সমস্ত হাত জুড়ে একটা কালো ছোপ পড়েছে৷ চামড়াগুলো শুকনো, খসখসে৷ নখের ডগাগুলো নিষ্প্রাণ এবং ফ্যাকাশে৷ দেখে মনে হল চাঁদের গায়ে যক্ষ্মার গ্রহণ লেগেছে৷
হাতের তেলোটা দেখেই চমকে উঠলাম৷ এ যে অতি উঁচু দরের আধ্যাত্মিক হাত! লাখে একটা মেলে! বৃহস্পতির স্থান অতি উচ্চ, সেখানে একটি রিং চিহ্ন বর্তমান৷ সেইসঙ্গে শনির স্থানও উচ্চ এবং সেখানে একটি ত্রিশূলচিহ্ন স্পষ্ট৷ তার ওপর কেতুর স্থান থেকে বৃহস্পতি অবধি একটি রেখা প্রসারিত৷ অত্যন্ত উচ্চকোটির ঐশী অনুগ্রহপ্রাপ্ত মানুষ না হলে এই তিনটি চিহ্ন থাকে না৷ এও বুঝতে পারছিলাম যে জাতিকার জীবনে অন্তত এমন একটি ঘটনা ঘটবে যার দ্বারা তিনি ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছোবেন! কিন্তু সেটা যে কী তা হাত দেখে বোঝা দুষ্কর৷
কিন্তু আমার চোখে ধরা পড়ে গেছিল একটা খুব অদ্ভুত জিনিস৷ জাতিকার বাইশ বছর বয়সে একটা প্রায় একইসঙ্গে মৃত্যুযোগ এবং বৈধব্যযোগ আছে৷ যদি উনি এই ফাঁড়াটা কাটিয়ে ওঠেন, তাহলে আমার গণনা আরও বলছে যে উনি কম করে আরও তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর অবধি সুখে বাঁচবেন৷ কিন্তু যে ফাঁড়া আছে তার থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব!
দুটো কথাই বললাম ওকে৷ শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল মাধুরী৷ তারপর মুখ তুলে বলল, ‘‘আমার ভগবান চাই না দাদা, ভগবানের আশীর্বাদও চাই না৷ এই জীবনে আমি শুধু একটা জিনিসই চাই, অনির্বাণ চৌধুরীকে ফিরে পেতে৷ ওকে ছাড়া আমার এই জীবনে আর কিছুই চাইবার নেই৷ আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি করে বলুন তো, আমি কি ওকে আর কোনোদিনই ফিরে পাব না?’’
তাকিয়ে দেখি মাধুরীর পদ্মদিঘি চোখে টলটল করছে মুক্তোর মতো দু’ফোঁটা জল৷ চেপে রাখা কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে ওর শরীর৷ একটু আগের সেই নিস্পৃহ উদাসীনতা, শুষ্ক কাঠিন্য আর নেই, তার জায়গা নিয়েছে এক প্রবল, অব্যক্ত আকুতি৷ যেন গাঢ় অভিমানের সুউচ্চ বাঁধ ভেঙে উছলে উঠেছে আবেগের প্রবল বর্ষণধারা, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওর হৃদয়ের তপ্ত এবং আকুল জনপদ৷
আমি চুপ করে রইলাম৷ কিছুক্ষণ পর মাধুরী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘‘আমি আজ আর কিছু বলার অবস্থায় নেই দাদা৷ নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে দিন প্লিজ৷ আমি কথা দিচ্ছি, কাল আমি আপনাকে সব বলব৷ এবার আমিও একটা এসপার বা ওসপার চাইছি৷’’
পরের দিন মুখ খুলেছিল মাধুরী৷ আমাকে জানিয়েছিল কী ঘটেছে ওর সঙ্গে৷ তারপর সেখান থেকে যেটা শুরু হল সেটা আটকাবার ক্ষমতা আমার নিজেরও ছিল না৷
* * * *