১. নামের শেষে অক্ষর

পোকা – উপন্যাস – হুমায়ূন আহমেদ

আলতাফ হোসেনের নামের শেষে অনেকগুলি অক্ষর।

আলতাফ হোসেন বি. এ. (অনার্স), এম, এ, বি, টি, এল, এল, বি.।

প্রতিটি অক্ষরের পেছনে কিছু ইতিহাস আছে। যেহেতু পোকার নায়ক আলতাফ হোসেন সেহেতু তার ইতিহাস জানা থাকলে পোকার বিষয়বস্তু বুঝতে সুবিধা হবে। অনার্স থেকে শুরু করা যাক। আলতাফের ইচ্ছা ছিল পাস কোর্সে পড়া। তার দূর সম্পর্কের মামা এ.জি, অফিসের সিনিয়র এসিসটেন্ট বজলুর রহমান বললেন, অনার্স পড়। শুনতে ভাল লাগে। আলতাফ হোসেন ক্ষীণ গলায় বলল, ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট খারাপ, অনার্সে ভর্তি হতে পারব না, মামা। বজলুর রহমান বললেন, চেষ্টা করে দেখ। কত আজে-বাজে সাবজেক্ট আছে–পল সায়েন্স, ফল সায়েন্স। আলতাফ অনেক খুঁজে পেতে জগন্নাথ কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল। বজলুর রহমান বললেন, খাটাখাটনি করে পড়। খাটাখাটনি কখনো বৃথা যায় না। কথায় আছে–খাটে মানুষ টে না।

আলতাফ প্রচণ্ড খাটাখাটনি করল। অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর সে তার মামার পা ছুঁয়ে সালাম করল। ক্ষীণ গলায় বলল, রেজাল্ট হয়েছে মামা। বজলুর রহমান বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসলেন। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রেজাল্ট?

থার্ড ক্লাস পেয়েছি, মামা।

বলজুর রহমান সাহেবের উৎসাহ মরে গেল। তিনি হতাশ গলায় বললেন, এত পড়াশোনা করে শেষে থার্ড ক্লাস?

জি মামা।

 থার্ড ক্লাস ডিগ্রী নিয়ে চাকরি-বাকরি তো কিছুই পাবি না। এখন করবি কি?

 আপনি বলে দিন, মামা।

 এম, এ, দিয়ে দে। এম, এ, পাশ থাকলে থার্ড ক্লাসের দোষ কাটা যায়। ভালমত পড়াশুনা করে এম. এ. দে। খাটাখাটনি কর। কথায় আছে–খাটে মানুষ ঘাঁটে না।

আলতাফ হোসেন খুব ভালমত পড়াশুনা করে এম, এ, দিল। রেজাল্ট বের হবার পর যথারীতি পা ছুঁয়ে মামাকে সালাম করল। বজলুর রহমান শংকিত গলায় বললেন, কি রে, এবারো থার্ড ক্লাস?

জ্বি মামা।

থার্ড ক্লাসের তুই তো দোকান দিয়ে ফেলেছিস রে গাধা।

আলতাফ হোসেন ক্ষীণ স্বরে কি যেন বলল, পরিষ্কার বোঝা গেল না। তার বেশিরভাগ কথাই পরিষ্কার বোঝা যায় না। তবে আর চোখ ভিজে উঠল। বজলুর রহমান বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। এখন চাকরি-বাকরি খোঁজ। রোজগারপাতির চেষ্টা তো দেখা দরকার। আমার ঘাড়ে বসে কতদিন খাবি? আর থার্ড ক্লাস নিয়ে মন খারাপ করিস না। ডিগ্রীটাই সবাই দেখবে, ক্লাস কে দেখবে? এত সময় কার আছে? তাছাড়া থার্ড ক্লাস পাওয়াও সহজ না। এক চান্সে পেয়েছিস, এটা কম কথা না।

মামার উপদেশমত আলতাফ হোসেন চাকরির খোঁজে লেগে গেল। দু’বছর অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি খুঁজল। কিছু হল না। বলজুর রহমান বললেন, বি, টি, দিয়ে ফেল। বি, টি, থাকলে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবি। স্কুলের চাকরিতেই আজকাল মজা। প্রাইভেট টিউশানি করবি, দুই হাতে টাকা কামাবি। স্কুল মাস্টারি আজকাল কেউ করতে চায় না, ঐ লাইনে চাকরি খালি আছে।

আলতাফ হোসেন বি. টি, পাশ করল। স্কুলের কোন চাকরি জোগাড় করা গেল না। স্কুলে সায়েন্স গ্রেজুয়েট চায়, এম, এ, বি, টি, চায় না। আরো দু বছর গেল। বজলুর রহমান বললেন, এল. এল. বি.টা দিয়ে দিবি নাকি? আইনের একটা ডিগ্রী থাকলে সুবিধা হবে। আলতাফ হোসেন এল, এল, বি, ডিগ্রী নিয়ে নিল। চাকরির কোন সুবিধা হল না।

বজলুর রহমান হতাশ হয়ে একদিন বললেন, বিয়ে করবি? অনেক সময় বিয়ে করলে ভাগ্য ফেরে। কথায় আছে–স্ত্রী ভাগ্যে ধন। দেখবি বিয়ে করে?

আলতাফ হোসেন অস্পষ্ট গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।

চাকরি পাওয়া না গেলেও বিয়ের মেয়ে পেতে অসুবিধা হল না। আট-দশটি মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেল। এই মেয়েগুলির অভিভাবকদের কথা শুনলে মনে হতে পারে এরা বেকার ছেলেই খুঁজছিল। একজন তো বলেই ফেলল, পাত্র হিসেবে বেকার ছেলের তুলনা নেই। এরা খুব স্ত্রীভক্ত হয়ে থাকে। চাকরি বাকরি নেই তো, তাই স্ত্রীকে খুব মানে। আরে ভাই, চাকরি তো একসময় হবেই। রিজিক আল্লার হাতে। মানুষের হাতে থাকলে চিন্তার বিষয় ছিল।

বজলুর রহমান মেয়ে দেখে বেড়াতে লাগলেন। আষাঢ় মাসের ন’ অরিখে বিয়ের কথা পাকা করে এক কেজি বাসি সন্দেশহাতে বাসায় ফিরলেন। মেয়ের নাম হোসনে আরা। লালমাটিয়া কলেজে বি, এ, পড়ে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও মাথাভর্তি চুল।

বজলুর রহমান রাতে খেতে বসে খুব আগ্রহের সাথে হোসনে আরার লম্বা চুলের গল্প করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, তার স্ত্রী মনোয়ারা কোন রকম আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধু তার মেয়ে দুলারী চোখ বড় বড় করে শুনছে। বজলুর রহমান তৃপ্ত গলায় বললেন, মেয়ের চুল ১.২২ মিটার লম্বা।

কেউ তেমন বিস্মিত হল না, শুধু দুলারী বলল, তুমি কি গজফিতা দিয়ে মেপেছ?

আমি মাপব কেন? ওরা নিয়মিত মাপে।

তাহলে তো আমাদেরও মাপতে হবে। তুমি একটা গজফিতা কিনে এনো তো বাবা।

তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তুই এমন বাঁকা কথা বলছিস কেন? কি হলো?

দুলারী বলল, এক মিটার সমান কত ফুট তুমি কি জান, বাবা?

না, জানি না।

তোমার উচিত ছিল ওদের জিজ্ঞেস করা। মিটারের হিসাব তো সবাই জানে না, গজ-ফুটের হিসাব জানে।

বজলুর রহমান চিন্তিতমুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা কেন যেন কাটা কাটা কথা বলছে। ধমক দেবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। দুলারী তাঁর বড়ই আদরের মেয়ে। তাকে ধমক দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া দুদিন পর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাপের বাড়িতে যে কটা দিন থাকবে আদরে থাকুক।

দুলারী বড়ই খেয়ালি ধরনের মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিল। বই নিয়ে বসলেই তার নাকি মাথা ধরে। বজলুর রহমান মেয়ের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। সে বিয়েও করবে না।

মূর্খ অবস্থায় বিয়ে করব না-কি? শ্বশুরবাড়িতে রোজ কথা শুনতে হবে। আগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি, তারপর বিয়ে।

বজলুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই তো পড়াশোনাই ছেড়ে দিয়েছিস, পাশ করবি কি ভাবে?

মাথাধরা রোগটা কমলেই পড়াশোনা শুরু করব।

চার বছর ঘরে বসে থাকার পর দুলারী আবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত কলেজে যাচ্ছে। রাত জেগে পড়াশোনা করছে। এমন খেয়ালি মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা মুশকিল। বজলুর রহমান তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা বাদ দিয়েছেন। মেয়ের সঙ্গে কথা যা বলার তা তিনি মেয়ের মার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন। এই যে মেয়ে এখন ক্যাট ক্যাট করে কথা বলছে, তাকে একটা ধমক দেয়া উচিত, তা দিতে পারছেন না। দুলারীকে ধমক দেয়ার সমস্যা আছে। ধমক দিলে সে কিছুই বলবে না, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে। তার দরজা বন্ধ মানে ভয়াবহ ব্যাপার। একবার কাঠমিস্ত্রী এনে দরজা কাটাতে হয়েছিল। করাত ফরাত এনে কেলেঙ্কারি কাণ্ড।

দুলারী বলল, বাবা, তুমি কি হোসনে আরা বেগমের লম্বা চুলের কোন সেম্পল এনেছ?

না।

ভুল করেছ। সেম্পল আনা দরকার ছিল।

বজলুর রহমান নিজেকে সামলাতে পারলেন না। স্ত্রীকে বললেন, তোমার মেয়েকে এখান থেকে যেতে বল তো।

দুলারী উঠে চলে গেল। বজলুর রহমান বললেন, ওর কি হয়েছে?

মনোয়ারা চাপা গলায় বললেন, সর্বনাশ হয়েছে।

সর্বনাশ হয়েছে মানে?

খাওয়া শেষ করো, অরপর বলব।

বজলুর রহমান তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে গিয়ে গলায় কৈ মাছের কাঁটা লাগিয়ে ফেললেন। কৈ মাছের কাঁটা কৈ মাছের মতই জীবন্ত হয়ে থাকে, যতই সময় যায় কাঁটা ততই ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকে। বজলুর রহমান ব্যথায় অস্থির হলেন। একটু পর পর বলেন, এর চেয়ে মরণ ভাল ছিল। এই সময়ে স্বামীকে দুঃসংবাদ দেয়া ঠিক হবে কিনা মনোয়ারা বুঝতে পারেন না। বজুলুর রহমান যখন বললেন, কি ঘটনা বল। তখন তাঁকে ঘটনা বলতে হল। ঘটনা শুনে বজলুর রহমানের চোখ কপালে উঠে গেল, তিনি কৈ মাছের কাঁটার ব্যথা ভুলে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, হারামজাদা আলতাফ কোথায়? হারামজাদার চামড়া ছিলে লবণ মাখিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেব। ডাক হারামজাদাকে।

মনোয়ারী বললেন, ও বাসায় নেই।

দুলারীকে ডাক।

 ওকে ডাকা যাবে না।

ঘটনা আসলেই ভয়াবহ। দুলারী আজ সকাল দশটায় কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে মার কাছে রিকশা ভাড়া চাইতে এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছে, মা, আমি এখন একটা কথা বলব, শুনেই হৈ-চৈ শুরু করবে না। কথাটা হল, আমি আলতাফ ভাইকে বিয়ে করব। হোসনে আরা ফোসনে আরার কথা ভুলে যাও।

মনোয়ারা হতভম্ব গলায় বললেন, কি বললি?

দুলারী বলল, কি বলেছি তা তো শুনেছ। ভাল করেই শুনেছ। আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? রিকশা ভাড়া দাও, মা। দশ টাকা দেবে। ছেঁড়া নোট দিও না আবার। একদিন ছেঁড়া নোট নিয়ে যা যন্ত্রণায় পড়েছিলাম।

মনোয়ারা রিকশা ভাড়া এনে দিলেন এবং ভাবলেন দুলারী ঠাট্টা করছে। ঠাট্টা তো বটেই। ঠাট্টা ছাড়া আর কি?

তিনি রোজ দুপুরে শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের শেষ দশ পাতা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমুতে যান। আজ ঘুমুতে পারলেন না। জোহরের নামাজ পড়লেন এবং মেয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুলারী কলেজ থেকে ফিরে সহজ গলায় বলল, পানি দাও তো মা, পিপাসা হয়েছে।

মনোয়ারার বুক থেকে পাষাণ নেমে গেল। যাক, কোন সমস্যা তাহলে নেই। তিনি পানি এনে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, আজ কলেজে কি হল রে? দুলারী বলল, কিছু হয়নি। তুমি কি বাবাকে বলেছ?

কি বলব?

কলেজে যাবার আগে তোমাকে যে বলে গেলাম?

কি বলে গেলি?

তুমি ভালই জান কি বলে গেছি। তুমি বাবাকে বলে রাজি করাবে। না হলে…

না হলে কি?

 তোমরা রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকব। দরজা খুলব না, ভাত খাব না।

তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?

হ্যাঁ।

তোর বাবা তোকে খুন করে ফেলবে।

খুন করলে খুন করবে।

দুলারী সত্যি সত্যি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলল। অবশ্যি মনোয়ারা দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। তবে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাদের চব্বিশ ঘন্টা সময় দিলাম, মা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিছু না করলে আমি র‍্যাটম খাব। এই হল ঘটনা।

বজলুর রহমান বললেন, র‍্যাটম কি?

র‍্যাটম হল ইঁদুর-মারা বিষ। ধরে এক ফাইল ছিল, সেটা এখন দুলারীর কাছে।

বজলুর রহমান দীর্ঘ সময় ঝিম ধরে বসে রইলেন। গলায় বিঁধে থাকা মাছের কাঁটার কথা তাঁর মনে রইল না। মনোয়ারা বললেন, এখন কি করবে?

বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, হারামজাদাকে আমি খুন করব। হারামজাদা কোথায়?

রোজ তো এই সময় বাসাতেই থাকে, আজ কোথায় যেন গেছে।

 মাছ কাটার বটিটা আমার কাছে দাও, তারপর দেখ কি করি। শুওর কা কাচ্চা।

আমার মনে হয় আলতাফ কিছু জানে না। তোমার মেয়েটা শয়তানের ঘোড়া, হাড়-বজ্জাত। বটি দিয়ে কাটতে হয় ওকে কাট।

পালের গোদা আগে শেষ করি। তারপর তোমার মেয়েকে ধরব। আমি এখন কবি নজরুল। আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই। বটি কই? বটি আন।

বটি আনার আগেই আলতাফ হোসেন উপস্থিত হল। বজলুর রহমান বললেন, কোথায় গিয়েছিলি?

রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিলাম, মামা। মাথা জাম হয়েছিল, ভাবলাম একটু হাঁটি।

মাথা জাম হয়েছিল?’

জি মামা।

এখন জাম দূর হয়েছে?

 জি না। এখনো আছে।

সারা জীবনের জন্যে জাম দূর করার ব্যবস্থা করছি। এই জীবনে আর জাম লাগবে না।

জ্বি আচ্ছা।

আলতাফ ভেতরের দিকে রওনা হল। বজলুর রহমান হুংকার দিলেন, যাস কোথায়?

ভাত খেতে যাই, মামা।

ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে রাগারাগি করা যায় না। বজলুর রহমান অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন, গম্ভীর গলায় বললেন, যা, ভাত খা! ভাত খেয়ে বিছানা বালিশ নিয়ে বিদায় হয়ে যাবি। এই জীবনে তোর মুখদর্শন করতে চাই না।

আলতাফ অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?

কোথায় যাবি আমি কি জানি? যেখানে ইচ্ছা যা। মনোয়ারা, হারামজাদাটাকে ভাত দাও।

আলতাফ ভয়ে ভয়ে বলল, কি হয়েছে মামা?

ভাত খেয়ে আয়, তারপর বুঝবি কত ধানে কত চাল।

আলতাফ বলল, ভাত দিন মামী।

 মনোয়ারা বললেন, ভাত টেবিলে বাড়া আছে, নিজে নিয়ে খাও।

আলতাফ ভাত খেল। মামার কথামত সুটকেস গুছাল। মামা তাকে যেতে বলেছেন, কাজেই যেতে হবে। মামার সঙ্গে তর্ক করা বা তার অবাধ্য হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। বজলুর রহমান বললেন, কোথায় যাবি কিছু ভেবেছিস?

জি না, মামা।

 রেল স্টেশনে চলে যা। খবরের কাগজ বিছিয়ে প্লাটফরমে শুয়ে থাকবি?

জ্বি আচ্ছা।

আলতাফ নিচু হয়ে মামাকে সালাম করল। বজলুর রহমানের ইচ্ছা করছিল লাথি দিয়ে শুয়রের বাচ্চাকে চিৎ করে ফেলে দেন, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। আলতাফ চলে গেল। সারা রাত বজলুর রহমানের ঘুম হল না। কৈ মাছের কাঁটার যন্ত্রণাতেই ঘুম হল না। ভোররাতে ঠিক করলেন, মেডিকেল কলেজে যাবেন। এই যন্ত্রণা পোষার কোন মানে হয় না। মেডিকেল কলেজে একা যাওয়া যায় না, কাউকে সঙ্গে নিতে হয়। তিনি আলতাফের খোঁজে কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলেন। সে সত্যি সত্যি একটা ইত্তেফাক বিছিয়ে তার উপর গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মামাকে দেখেই সে বলল, কাঁটা এখনো আছে মামা?

হ্যাঁ। কাঁটা তুলতে যাচ্ছি। তুই চল আমার সঙ্গে।

সুটকেস নিয়ে যাব?

নিয়ে যাবি না তো কার কাছে রেখে যাবি?

বজলুর রহমান কাঁটা তুললেন। আলতাফকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আলতাফের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে কাগজে মোড়া মাছের কাঁটা। মামার গলার কাঁটা সে ফেলে আসতে রাজি হয়নি। কাগজে মুড়ে নিয়ে এসেছে। বাসায় ফিরে বজলুর রহমান স্ত্রীকে ডেকে বললেন, গাধাটার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি আছে? আপত্তি না থাকলে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। মনোয়ারা বললেন, দেখ, তুমি যা ভাল বোঝ। তবে বিয়ে দেয়াই ভাল। তোমার মেয়ে হয়েছে কচ্ছপের মত। কামড় দিয়ে যেটা ধরবে সেটা আর ছাড়বে না। বিয়ে না দিলে শেষমেষ কি করে বসে কে জানে। র‍্যাটম নিয়ে বসে আছে।

ওর কপালে আছে র‍্যাটম। জীবন্ত র‍্যাটম। তোমার মেয়েকে বল, র‍্যাটমের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে একটা কথা শুনে রাখ–এই মেয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শেষ। বিয়ের পর এদের আমি ঘাড় ধরে বের করে দেব। এই বাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ।

ওরা যাবে কোথায়? খাবে কি?

 সেটা ওদের ব্যাপার।

বিয়ে কবে দিচ্ছ?

গাধাটাকে জিজ্ঞেস করে একটা তারিখ ঠিক কর।

আলতাফকে জিজ্ঞেস করা হল, সে মাথা নিচু করে বলল, বিয়ে করব না।

বজলুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, ফাজলামির জায়গা পাস না! বিয়ে করবি না মানে? তোর ঘাড় বিয়ে করবে।

চাকরিবাকরি নাই।

কোন অজুহাত শুনতে চাই না আগামী রোববার তোর বিয়ে।

জ্বি আচ্ছা, মামা।

হাতে মাছের কাঁটা নিয়ে ঘুছিস কেন? ফেল মাছের কাঁটা।

আলতাফ মাছের কাঁটা ফেলে দিল।

 ঘরের ভেতর ফেললি কি মনে করে? যা, রাস্তায় ফেলে দিয়ে আয়।

আলতাফ কাঁটা হাতে বের হয়ে গেল। বজলুর রহমান মনোয়ারাকে বললেন, দুলারীকে গিয়ে বল, রোববারে বিয়ের তারিখ হয়েছে।

মনোয়ারা বললেন, আর একটু চিন্তা-ভাবনা করলে হত না?

একবার যখন বলেছি রোববার, তখন রোববারই হবে। মানুষের জবানের দাম আছে।

কিছু সময় তো লাগবেই। বিয়ের কেনাকাটা করব না?

গাধার সঙ্গে বিয়ের আবার কেনাকাটা কি? কেনাকাটার নামও মুখে আনবে না।

আমাদের একটাই মেয়ে।

একটাই হোক আর দশটাই হোক কেনাকাটা হবে না। এটা আমার ফাইন্যাল কখা। তোমার পছন্দ হলে ভাল, পছন্দ না হলেও ভাল।

আলতাফ ফিরে এসেছে। ভীত চোখে তাকাচ্ছে মামার দিকে। বজলুর রহমান বললেন, কিছু বলবি?

কাঁটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছি, মামা।

আহ! বিরটি কাজ করেছিস। আয় কোলে এসে বোস, আদর করি।

বলেই তার মনে হল, আলতাফ সত্যি সত্যি তার কোলে বসার জন্যে এগিয়ে আসতে পারে। প্রথম শ্রেণীর গাধারা করতে পারে না হেন কাজ নেই।

আলতাফ অবশ্যি মামার কোলে বসার চেষ্টা করল মা। ঘরের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে মাথা চুলকাতে লাগল। তাকে দেখে মনে হতে পারে, ফ্যান কেন ঘুরে এই রহস্য নিয়ে সে এখন চিন্তিত।

বজলুর রহমান হুংকার দিয়ে বললেন, ঐ গাধা, ফ্যানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? সিলিং ফ্যান আগে কখনো দেখিসনি? চোখ নামা।

আলতাফ চোখ নামাল।

যা আমার সামনে থেকে।

আলতাফ ঘর থেকে বের হয়ে এল। আসন্ন বিয়ের আনন্দে তাকে খুব উল্লসিত বলে মনে হল না। বজলুর রহমান শুকনো মুখে বসে রইলেন। তাঁর মনোকক্টের যথেষ্ট কারণ আছে। দুলারীর বিয়ে বলতে গেলে ঠিকই হয়ে আছে। ছেলের ফুপা ফুপু এসে মেয়ে দেখে হাতে আঙটি পরিয়ে গেছেন। অতি সস্তা ধরনের আঙটি। রঙ দেখে মনে হয় পেতলের। আঙটি সাইজেও ছোট। যাতায়াতি করে ঢুকাতে গিয়ে দুলারীর আঙুলের চামড়া উঠে গেল। হুলস্থূল ধরনের বড়লোকরা উপহারের ব্যাপারে হাড়-কেপ্পন হয়। ওরা হুলস্থূল ধরনের বড়লোক। ছেলের চেহারা ভাল। মাথায় অবশ্যি চুল নেই। এই বয়সে টাক পড়ে গেছে। এটা তেমন গুরুতর কোন সমস্যা না। ছেলেরা মাথার চুল দিয়ে কি করবে? এদের তো আর মাখায় বেণী করতে হবে না? তাছাড়া পয়সাওয়ালা লোকদেরই মাথায় টাক পড়ে। আজ পর্যন্ত তিনি মাথায় টাকওয়ালা কোন ভিক্ষুক দেখেননি। যারা ভিক্ষা করে বেড়ায় তাদের মাথাভর্তি ঘন চুল থাকে।

আলতাফ হারামজাদাটারও মাথাভর্তি ঘন চুল। একসময় সেও ভিক্ষুক-টিক্ষুক কিছু হবে। একে দয়া দেখানো ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল হয়েছে। মিসটেক অব দি সেঞ্চুরি।

বজলুর রহমানের ধারণা তিনি ভুল করেন না! এই ভুল এখন ভেঙে গেছে। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন। কালসাপকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দেয়া উচিত ছিল না। তিনি শুধু যে আসতে দিয়েছেন তাই না, বলতে গেলে আদর করে ঘরে স্থান দিয়েছেন। তাও দিতেন না। গ্রহের ফেরে এই কাজটা করতে হয়েছে। ঘটনাটা এ রকম–বজলুর রহমানের ছোটবোন মিনুর ছেলে হল আলতাফ।

বজলুর রহমান মিনুকে পছন্দ করেন না। মিনুর স্বামী মোবারক হোসেনকে দু চোখে দেখতে পারেন না। মোবারক হোসেনের একটা ডিসপেনসারি আছে। সেই ডিসপেনসারিতে আয়-উন্নতি বলে কিছু নেই। কারণ ডিসপেনসারি খোলা এবং বন্ধ করার কোন নিয়ম-কানুন নেই। যখন ইচ্ছা হল মোবারক ডিসপেনসারি খুলে বসে আছে। যখন ইচ্ছা ডিসপেনসারি বন্ধ করে বাসায় চলে আসছে। ডিসপেনসারির বেশির ভাগ অষুধ নিজেই খেয়ে ফেলছে। এই হল অবস্থা। মিনু যখন অসুস্থ হল সে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল না। নিজেই চিকিৎসা করে। অষুধ যে বেচে সে নাকি ভাক্তারের বাবা।

ডাবল এ্যাকশান এন্টিবায়োটিক প্লাস উপবাস চিকিৎসাপদ্ধতি নামে তার নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি চলল। এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে নিরম্বু উপবাসে থেকে এন্টিবায়োটিক খেতে হয়। এতে অষুধের অ্যাকশান না-কি ডাবল হয়ে যায়। শরীরে পুষ্টি না থাকলে–শরীরের জীবাণুদেরও পুষ্টি থাকে না। এরা আধমরা অবস্থায় থাকে–তখন কড়া এন্টিবায়োটিক পড়লে আর দেখতে হবে না।

মোবারক হোসেনের চিকিৎসাপদ্ধতির কারণেই মিনু আঠারোদিন জ্বরভোগের পর মারা গেল। মোবারক হোসেন আলতাফকে কোলে নিয়ে মৃত্যুসংবাদ দিতে এল।

বজলুর রহমান গম্ভীর মুখে মৃত্যুসংবাদ শুনলেন। দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বললেন, ডাক্তার শেষ পর্যন্ত দেখাওনি?

মোবারক হোসেন বললেন, ডাক্তার আর কি দেখব? ডাক্তাররা কি জানে?

ডাক্তাররা কিছু জানে না। তুমি সব জান?

 আপনাদের দোয়ায় অষুধ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে যা শিখেছি, ভালই শিখেছি।

এখন এই দুধের শিশু কে পালবে?

আলতাফের কথা বলছেন? তাকে নিয়ে মোটেই চিন্তা করবেন না। আমিই পালব। তা ছাড়া তাকে দুধের শিশু বলা ঠিক না। দুবছর হয়ে গেছে। কথা প্রায় সবই বুঝে। বলতে পারে না। পিরিচে ভাত মাছ দিলে কপ কপ করে খায়।

ও আচ্ছা।

মোবারক হোসেন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, আলতাফ, ইনি তোমার মামা হন। বড় মামা। বল তো–মামা।

আলতাফ বলল, উ ঊ।

মোবারক হৃষ্টচিত্তে বলল, ও এইভাবেই কথা বলে। মামা বলতে বলেছি তো, কাজেই সে দুবার বলেছে উ-উ। কারণ মামা শব্দটায় দুটা অক্ষর। মা বলতে বললে একবার উ বলবে। কারণ মা হল এক অক্ষরের শব্দ।

বাবু বল তো মা।

আলতাফ বলল, ঊ।

 মোবারক হোসেন আনন্দিত স্বরে বলল, দেখলেন ছেলের বুদ্ধি।

বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, গতকাল তোমার স্ত্রী মারা গেছে। আজ তুমি দাঁত বের করে হাসছ!

অন্য প্রসঙ্গে হাসছি। ছেলের বুদ্ধি দেখে হাসছি। সব বাবারাই ছেলেমেয়ের বুদ্ধির পৱিচয় পেলে খুশি হয়ে হাসে।

তোমার বুদ্ধিমান ছেলেকে নিয়ে তুমি বিদায় হয়ে যাও। আর কোনদিন যেন তোমাকে এ বাড়িতে না দেখি।

জ্বি আচ্ছা। কিছু খরচ-বরচ কি দিবেন?

কি খরচ?

হাত একেবারে খালি। গোর দিতে অনেক খরচপাতি–কাফনের কাপড়ই আপনার দশ গজ। মার্কিন লংক্লথ সস্তাটা হল নিন আপনের পঁচিশ, ..

দূর হও বললাম। দূর হও। ভকভক করে মুখ থেকে কিসের গন্ধ বেরুচ্ছে। মদ্য পান করেছ?

জ্বি না। মদ খাই না। একটু কাশির মত হয়েছিল দুবোতল কফ সিরাপ এক সাথে খেয়ে ফেলেছি। কফ সিরাপে কিছু এলকোহল থাকে। তবে খুব সামান্য।

বজলুর রহমান কঠিন গলায় বললেন, বিদায় হও। বিদায়।

 মোবারক হোসেন বিদেয় হল।

বজুর রহমানের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মনে হল কাজটা ঠিক হয় নি কিছু পয়সা দিয়ে দেয়া উচিত ছিল। বড় ভাই হিসেবে তারও একটা দায়িত্ব আছে। অপ্রিয় হলেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হল–এ জাতীয় লোকদের কোন সাহায্য করতে নেই। এদের সাহায্য করার অর্থই হচ্ছে এদের প্রশ্রয় দেয়া। টাকার অভাবে একজন মৃত মানুষের কবর হবে না এটাও বিশ্বাস্য নয়।

বজলুর রহমান রাত এগারোটার দিকে ঠিক করলেন–খোঁজ নিতে যাবেন। যাওয়া হল না। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। বাসার সামনে একহাঁটু পানি জমে গেল। তিনি গেলেন পরদিন।

মোবারকের বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর মোবারক দরজা খুলল। পুরোপুরি খুলল না, সামান্য ফাঁক করে ভীত গলায় বলল, কে?

বজলুর রহমান বললেন, আমি। দরজা খোল।

মোবারক দরজা খুলল। তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোন কারণে ভয় পেয়েছে। চোখ রক্তবর্ণ। ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়াচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা হাত পা কাঁপছে। মৃত বাড়িতে অনেক লোকজন থাকার কথা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। একটা মানুষ নেই। তবে ভেতর থেকে বিজ-বিজ শব্দ আসছে।

বজলুর রহমান বললেন, শব্দ কিসের?

মোবারক হোসেন নিচু গলায় কি বলল এক বিন্দু বোঝা গেল না।

বজলুর রহমান বললেন, এ রকম করছ কেন?

ভেতরে এসে দেখেন।

কি দেখব?

 বিরাট বিপদে পড়েছি।

বজলুর রহমান মোবারকের সঙ্গেই তার শোবার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ঘরভর্তি তেলাপোকা। হাজার হাজার বললেও কম বলা হবে–লক্ষ লক্ষ পোকা। তাদের হাঁটা, পাখায়-পাখায় ঘসাঘসি থেকেই বিজবিজ শব্দ আসছে। পোকাদের মাঝখানে শান্তমুখে বসে আছে আলতাফ। তার চোখে ভয় বা বিস্ময় কিছুই নেই। সে বজলুর রহমানকে দেখে দুবার বলল, উ উ।

বজলুর রহমান বললেন, ব্যাপারটা কি?

মোবারক ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, তেলাপোকা।

 তেলাপোকা সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কোত্থেকে এল এত তেলাপোকা?

 জানি না।

অন্য ঘরেও আছে, না শুধু এই ঘরে?

এই ঘরে। মিনুর ডেডবডি এই ঘরে ছিল। তেলাপোকায় খেয়ে ফেলেছে।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

জ্বি না মাথা খারাপ হয় নাই। সত্যি কথা বলতেছি। আপনার কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। না পেয়ে মনটা খুব খারাপ হল।

বাবুকে ঘরে রেখে আবার বের হলাম টাকার সন্ধানে।

 তাকে তুমি খালি বাড়িতে রেখে গেলে?

জ্বি। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ঝড়-বৃষ্টিতে আটকা পড়ে গেলাম। ফিরে দেখি এই অবস্থা।

তুমি একটা দুধের শিশুকে খালি বাড়িতে একটা ডেডবডির পাশে বসিয়ে চলে গেলে!

জি। না গিয়ে তো উপায় ছিল না। হাতে নাই একটা পয়সা।

একটা মানুষ মারা গেছে–কোন লোকজন নাই। এইটাই বা কেমন কথা?

কাউকে বলি নাই তো।

বল নাই কেন?

কি দরকার। বললেই লোকজন এসে গিজগিজ করবে। হেন কথা তেন কথা বলবে। দরকার কি?

তোমার মাথা পুরোপুরি খারাপ।

জি না ভাই সাহেব। মাথা ঠিক আছে।

আমি এই ছেলেকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন থাক আমার এখানে। তুমি অবস্থা ঠিকঠাক করে তারপর নিয়ে যাবে।

জ্বি আচ্ছা।

আর এই নাও এক হাজার টাকা।

আপনাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরত দিয়ে দিব।

ফিরত দিতে হবে না।

আমি ফিরত দিয়ে দিব। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরত দিব।

মোবারক হোসেন এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফিরত দিতে এল না। বরং আরো টাকা ধার করতে এল। সে ন-কি ভয়াবহ ঝামেলায় পড়েছে। পুলিশের ধারণা, সে তার স্ত্রীকে খুন করেছে। তারপর রটিয়েছে তেলাপোকা খেয়ে ফেলেছে।

মোবারক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, পুলিশ বড় যন্ত্রণা করতেছে ভাইসব। শুধু টাকা চায়।

খুন করেন না কি?

 জ্বি না, আমি খুন করব কেন?

তোমার চোখ-মুখ দেখে তো মনে হয় করেছ?

জ্বি-না। তবে পুলিশের ধারণা, করেছি। ৩০২ ধারায় কেইস দিবে বলে মনে হয়। আপনি একটু আমার হয়ে সাক্ষ্য দিবেন।

বজলুর রহমান আঁৎকে উঠে বললেন, আমি আবার কি সাক্ষ্য দিব?

তেলাপোকা যে খেয়ে ফেলেছে এইটা একটু বলবেন। আপনি তো নিজের চোখে তেলাপোকা দেখেছেন।

আমি কিছুই দেখি নাই। টাকা দিতেছি, টাকা নিয়ে যাও। আমি যেন কোন ঝামেলায় না পড়ি।

জ্বি আচ্ছা।

আর শোন, তোমার ছেলে নিয়ে যাও।

জি, নিয়ে যাব। আজকেই নিয়ে যেতাম, আজ আবার এখান থেকে রমনা থানায় যাব। টাকা আপনার কাছ থেকে যা পাব সবটা পুলিশকে দিয়ে দিব। কাল পরশু এসে নিয়ে যাব।

মোবারক আর ফিরে আসেনি। পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। মামলা চলাকালিন সময়ে সে মারা গেছে জেল হাজতে। আলতাফ থেকে গেছে এই বাড়িতে। তার আত্মীয়স্বজন কেউ তাকে নিতে আসেনি। মনে হয় সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

.

০২.

বারই চৈত্র রোববার আজিমপুর কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে হয়ে গেল।

আলতাফ আগে থাকতো রান্নাঘরের পাশে খুপড়ি মত জানালাবিহীন একটা ঘরে। বিয়ের পর সে উঠে গেল দোতলায় দুলারীর ঘরে! তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন বলতে এইটুকুই। তবে স্ত্রীর ভাগ্যের কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক সে একটি চাকরি পেয়ে গেল। ভাল চাকরি, সিটি ব্যাঙ্কের অ্যাসিসটেন্ট কেশিয়ার। বেতন তিন হাজার টাকা, মেডিকেল আছে, যাতায়াতের এলাউন্স আছে।

বজলুর রহমান বললেন, এই গাধাকে যে চাকরি দিয়েছে সে আরো বড় গাধা, রামগাধা। তাকে ঘাড় ধরে দেশ থেকে বের করে দেয়া উচিত।

মনোয়ারা বললেন, এত ঘন ঘন গাধা বলো না তো। দুলারী মনে কষ্ট পাবে!

কষ্ট পেলে পাবে, গাধাকে গাধা বলব না তো কি বলব? ক্যাঙ্গারু বলব?

কিছুই বলতে হবে না, মেয়ের জামাই চাকরি পেয়েছে–এ তো ভাল কথা। বেচারা নিজের চেষ্টায় জোগাড় করেছে। মন্ত্রী-মিনিস্টার ধরাধরি করতে হয়নি। কত আনন্দের ব্যাপার।

আনন্দ দুদিন পর টের পাবে। টাকাপয়সার গণ্ডগোলের জন্যে বাবাজীকে যখন জেলে নিয়ে ঢুকাবে তখন বুঝবে আনন্দ কাহাকে বলে। কয়েকটা দিন সবুর কর, এক সপ্তাহ, এর মধ্যেই রেজাল্ট আউট হয়ে যাবে। এক সপ্তার বেশি যদি গাধাটাকে কেউ চাকরিতে রাখে, আমি নিজের কান কেটে কুত্তার লেজে সূতা দিয়ে বেঁধে দেব।

মাসখানিক কেটে গেল, চাকরি যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সকাল আটটায় টিফিন বক্সে টিফিন নিয়ে আলতাফ রওনা হয়। আলতাফের সঙ্গে যায় দূলারী। সে তাকে বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। দুলারীর হাতে থাকে একটা চটের ব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকে একটা পানির বোতল, ছোট্ট ফ্লাস্কে এক কাপ গরম দূধ এবং এক কৌটা পানের মশলা।

দুলারীর কাণ্ড কারখানায় বজলুর রহমান বড়ই বিরক্ত। মনোয়ারাকে একদিন ডেকে বলে দিলেন, দুলারী সঙ্গে যায় কেন? গাধাটা কি বাসস্টপ চেনে না? দুলারীকে নিষেধ করে দেবে। বাড়াবাড়ি আমি পছন্দ করি না। ঢং বেশি হয়ে যাচ্ছে।

মনোয়ার নিষেধ করেছেন। আদুরে গলায় বললেন, কি দরকার রোজ রোজ সাথে যাওয়ার? তোর বাবা রাগ করে।

দুলারী হাই তুলতে তুলতে বলেছে, করুক রাগ।

বাড়াবাড়ি বেশি হচ্ছে।

 মোটেই বেশি হচ্ছে না। তুমি তা ভাল করেই জান।

বাড়াবাড়ি বেশি হচ্ছে না এটা অবশ্যি সত্যি। স্বামীকে নিয়ে ঢলাঢলি, ছাদে হাঁটাহাটি, অকারণ হাসাহাসি এইসব কিছুই হচ্ছে না। সন্ধ্যা না হতেই দরজা বন্ধ করে এরা গুজগুজ করে গল্পও করে না। খুব অন্যায় জেনেও তিনি কয়েকবার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছেন। আলতাফ চেয়ারে ঝিম ধরে বসে থাকে। দুলারী নিজের কাজ করে। যেন কেউ কাউকে চেনে না। বজলুর রহমান সব শুনে বলেছেন, ঝিম ধরে বসে থাকে না, ঘুমায়। চতুষ্পদ জন্তুরা ঘুমায় দাঁড়িয়ে। ও ঘুমায় বসে। এইটুকুই যা তফাৎ। আর কোন তফাৎ নেই। মনোয়ারা একদিন কথায় কথায় দুলারীকে জিজ্ঞেসও করে ফেললেন, আলতাফ কি চেয়ারে বসে বসে ঘুমায় নাকি রে?

দুলারী বিরক্ত হয়ে বলেছে, চেয়ারে বসে ঘুমুবে কেন? এইসব কি আজেবাজে কথা বল?

প্রায়ই দেখি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকে।

তাতে অসুবিধা কি?

 না, অসুবিধা আর কি। দেখতে খারাপ লাগে।

তোমাকে দেখতে বলেছে কে?

 তুই এমন ক্যাট ক্যাট করছিস কেন? আমি একটা কথার কথা বললাম।

ওকে নিয়ে তোমরা সারাক্ষণ সমালোচনা কর আমার ভাল লাগে না। বেচারা কারো সাতে নেই পাঁচে নেই, চুপচাপ থাকে, আর তোমরা …

কি যন্ত্রণা! কেঁদে ফেলছিস কেন? আমরা কি এমন বললাম?

বাবা তো তাকে সারাক্ষণই গাধা বলছে। চুপচাপ থাকলেই মানুষ গাধা হয়ে যায়? চুপচাপ থাকাটা কি অপরাধ?

অপরাধ হবে কেন? একেবারে ঝিম ধরে থাকে তো, তাই…

মোটেই ঝিম ধরে থাকে না, বসে বসে ভাবে।

কি ভাবে?

নানান কিছু নিয়ে ভাবে, তোমরা বুঝবে না। ও পোকাদের নিয়ে ভাবে।

 পোকাদের নিয়ে ভাবে!

 হ্যাঁ। পোকা-মাকড় এইসব নিয়ে ভাবে।

মনোয়ারা শুকনো গলায় বললেন, পোকা-মাকড়দের নিয়ে ভাবা তো ভাল কথা। শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে।

তুমি আবার বাবাকে এসব বলতে যেও না। বাবা কি বুঝতে কি বুঝবে। বাবা তো আবার সবকিছু বেশি বুঝে।

আরে না, তোর বাবাকে সব কথা বলার দরকার কি? পুরুষ মানুষকে সব কথা বলতে নেই, এতে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়। তা ইয়ে, আলতাফ কি দিনরাত পোকাদের নিয়েই ভাবে?

দুলারী বিরক্ত গলায় বলল, দিনরাত পোকাদের নিয়ে ভাববে কেন? ওর কি আর কাজকর্ম নেই? মাঝেমধ্যে ভাবে। তুমি আবার বাবাকে কিছু বলতে যেও না।

পাগল হয়েছিস, তাঁকে বলার দরকার কি?

মনোয়ারা সেই রাতেই স্বামীকে ফিসফিস করে পোকার ব্যাপারটা বললেন।

বজলুর রহমান বললেন, আরে, গাধাটার তো ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। পোকা নিয়ে ভাবে মানে? পোকা নিয়ে ভাবার কি আছে? গাধাটাকে ডাক।

থাক, ভাকতে হবে না।

অবশ্যই ডাকতে হবে। অবহেলা করার ব্যাপার এটা না।

 পরে একসময় ওকে আলাদা করে ডেকে … মানে দুলারী যাতে কিছু বুঝতে পারে।

বজলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কোন রকম আর্গুমেন্টে যাবে না। আই হেট আর্গুমেন্ট। তুমি গাধাটাকে ডেকে আন। আজই এর ফয়সালা হওয়া উচিত। পোকাদের নিয়ে ভাবে, পোকাদের রবীন্দ্রনাথ হয়েছে। হারামজাদা!

মনোয়ারা ডাকতে গেলেন। দুলারী বলল, এই রাতদুপুরে বাবা ডাকছে কেন?

মনোয়ারা ক্ষীণ গলায় বললেন, ঐ অফিসে কাজকর্ম কেমন হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করবে।

তুমি পোকার ব্যাপার বাবাকে কিছু বলনি তো?

না।

আলতাফ মামার ঘরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে বলল, মামা ডেকেছেন?

বজলুর রহমান বললেন, বোস। মামা ভাকবি না, খবর্দার।

 কি ডাকব?

কিছুই ডাকতে হবে না। ডাকাডাকির পালা শেষ।

আলতাফ বসল। বজলুর রহমান গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুই নাকি পোকাদের নিয়ে ভাবিস?

জ্বি মামা?

কি ভাবিস?

তেমন কিছু না, মামা। ওদের সঙ্গে কথা টথা বলি, ওরা যখন চুপ করে থাকে তখন ভাবি।

বজলুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, ওদের সঙ্গে কথা বলিস?

জ্বি মামা।

কবে থেকে কথা বলাবলি শুরু হয়েছে?

যখন আপনার এখানে আসলাম তখন থেকে।

আমার এখানে এসেছিস দুবছর বয়সে, তখন থেকে পোকাদের সঙ্গে তোর দোস্তি?

দোস্তি না মামা। ওরা যে আমাকে ঠিক পছন্দ করে তা না। সবাই আমাকে ভয় পায়। ভয়ের কারণে কিছু কিছু কথা শুনে।

পোকারা তাহলে তোর ভয়ে কম্পমান?

আলতাফ হা-সূচক মাথা নাড়ল। বজলুর রহমান মনে মনে বললেন, গাধাটার তো আসলেই ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। ব্রেইনে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘটনা শুনছ তো? পোকারা আমাদের আলতাফকে হেড মাস্টার সাহেবের মত ভয় পায়। আলতাফের ভয়ে তারা থরথরি কম্পমান।

আপনি যত বলছেন ওরা তত ভয় পায় না মামা। কিছুটা ভয় পায়।

 ভয়ের চোটে ওরা কি করে? তোকে দেখলেই স্লামালিকুম দেয়?

 তা না, তবে ডাকলে আসে।

বজলুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনলে তো, আলতাফ ডাকলেই পোকারা যে যেখানে থাকে ছুটে আসে। মনোয়ারা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আরেকদিন এইসব নিয়ে কথা হবে। আজ রাত অনেক হয়েছে। তিনি হাই তোলার ভঙ্গি করলেন।

বজলুর রহমান বললেন, রাত যতই হোক ব্যাপারটার ফয়সালা হওয়া দরকার। আলতাফ, দেখি তুই তোর এক পোকা ডেকে আন।

একটা তেলাপোকা ডেকে আনব মামা?

 ডাক, তেলাপোকাই ডাক। তেলাপোকাই বা খারাপ কি?

আলতাফ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উড়তে উড়তে ঘরে একটা তেলাপোকা ঢুকল। বসল সিলিং ফ্যানের পাখায়।

আলতাফ বলল, এই, নিচে নাম।

 পোকা নিচে নামল। বসল মেঝেতে। আলতাফ বলল, শুঁড় দুটা নাড় তো।

তেলাপোকা শুঁড় নাড়াতে লাগল। বজলুর রহমান নিজের অজান্তেই আয়াতুল কুরসি সুরাটা মনে মনে পড়ে ফেললেন।

আলতাফ বলল, মামা, একে কি চলে যেতে বলব?

বল।

আলতাফ বলল, চলে যা।

পোকা গেল না। শুঁড় নাড়তে লাগল। একবার পাখা তুলে উড়ার ভঙ্গি করল। আবার পাখা নামিয়ে ফেলল।

মনোয়ারা বললেন, কই, যাচ্ছে না তো।

যেতে চাচ্ছে না মামী। এরা সবসময় কথা শুনে না।

তেলাপোকা চক্রাকারে ঘুরছে। আলতাফ বলল, এই, ঘোরা বন্ধ কর।

ঘোরা থেমে গেল।

 যা, চলে যা।

পোকা নড়ল না। স্থির হয়ে গেল।

বজলুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, যেতে না চাইলে কি আর করা! আলতাফ বলল, মামা, আমি যাই? ঘুম পাচ্ছে।

বজলুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, যা।

আলতাফ উঠে চলে গেল। বজলুর রহমান এবং মনোয়ারা দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। মনোয়ারা প্রথম নীরবতা ভংগ করলেন। ফিসফিস করে বললেন, এটা কি হল?

বজলুর রহমান রাগী গলায় বললেন, কিসের কথা বলছ?

 পোকা তো সত্যি সত্যি ওর কথা শুনে।

কোন কথাটা শুনেছে?

ওর কথা শুনে পোকা ঘরে এসেছে।

তোমারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পোকা কথা শুনবে মানে? কাকতালীয়ভাবে একটা তেলাপোকা ঘরে এসেছে। এই হল ব্যাপার। ঝড়ে বক মরে গেছে, আর ফকির সাহেব বললেন, দেখলি, দোয়া কুনুত পড়ে ফুঁ দিলাম আর বক মরে পড়ে গেল। ব্যাপার এর বেশি কিছু না।

শুঁড় মাড়িতে বলল, শুঁড় নাড়ল।

কি যন্ত্রণা! পোকা শুঁড় নাড়ে না? কুকুর যেমন লেজ নাড়ে পোকা নাড়ে শুঁড়। ওদের কাজই হল শুঁড় নাড়া।

আমার ভয়-ভয় লাগছে।

ফালতু কথা বলবে না। ভয়ের এর মধ্যে কি আছে?

বজলুর রহমান ঘুমুতে গেলেন। তাঁর ভাল ঘুম হল না। রাতে কয়েকবার উঠলেন। পানি খেলেন, বাথরুমে গেলেন। যতবারই বাথরুমে গেলেন ততবারই লক্ষ্য করলেন–তেলাপোকাটা যায়নি। মেঝেতে ঘুরঘুর করছে। অবশ্যি এটা আগের পোকা নাও হতে পারে। হয়তো অন্য একটা। চায়নিজদের মত সব তেলাপোকাও দেখতে একরকম। একটার সঙ্গে অন্য একটা আলাদা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাঁর মনে হল পোকাটী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু যে তাকিয়ে আছে তাই না, ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করছে। তিনি পোকাটার গায়ে থু করে থুথু ছিটিয়ে দিলেন, তারপরেও সেটা নড়ল না বরং তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে এল। এ কি যন্ত্রণা! তিনি বললেন, যা হারামজাদা।

পোকাটা থমকে গেল। এখন আবার শুড় নাড়ছে।

 শুঁড় নাড়া বন্ধ কর হারামীর বাচ্চা।

পোকাটা শুঁড় নাড়া বন্ধ করল। বজলুর রহমান এক দৃষ্টিতে পোকাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

০৩.

আজ অসহ্য গরম। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, এতে গরম আরো বেড়েছে। এই গরমেও আলতাফের ঘরের দুটি জানালাই বন্ধ। শুধু যে বন্ধ তাই না, পর্দাও টেনে দেয়া। জানালা খোলা রেখে আলতাফ ঘুমুতে পারে না। ঘরে আলো থাকলেও সে ঘুমুতে পারে না। আলতাফের অভ্যাসে দুলারী অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে, এখন আর তার খারাপ লাগে না। এই ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমও অন্ধকার। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাস্তু ছিল, আলতাফ সেই বাল্ব খুলে রেখেছে। অন্ধকারে আলতাফের অসুবিধা হয় না, তবে দূলারীর হয়। সে একটা টর্চলাইট নিয়ে বাথরুমে মায়।

আজকের অন্ধকার অন্য রাতের চেয়েও বেশি, কারণ বাসার সামনে স্ট্রীট ল্যাম্পের বাল্ব আবার চুরি হয়েছে। অন্ধকার বাথরুমে আলতাফ হাত-মুখ ধুচ্ছে। দূলারী খাটের উপর মশারি খাটাচ্ছে। আন্দাজের উপর খাটাচ্ছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুলারী বলল, আজ খুব গরম।

আলতাফ বলল, হুঁ।

একটা জানালা খুলে দেই?

না।

 মশারীর ভেতর ফ্যানের বাতাস ঢুকে না। গরম লাগে।

মশারি খাটিও না।

 মশারি না খাটালে উপায় আছে? মশা খেয়ে ফেলবে না?

মশা খাবে না, ওদের না করে দেব।

আলতাফের কথায় অন্য কেউ চমকে উঠতো, দুলারী চমকাল না, এরকম কথা সে প্রায়ই শুনে। দুলারী মশারি খুলে ফেলল। আলতাফ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরুল। দুলারী বলল, বাবা তোমাকে কেন ডেকেছিলেন?

পোকাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন।

 তুমি বলেছ?

হুঁ।

কেন বলেছ?

মামা জানতে চাইলেন তাই বললাম। না বলার কি আছে?

বাবা কি তোমার কথা বিশ্বাস করেছেন?

 বিশ্বাস করবেন না কেন?

আমার মনে হয় না বাবা তোমার কথা বিশ্বাস করেছেন। তোমাকে নিয়ে এখন নিশ্চয়ই মার সঙ্গে হাসাহাসি করছেন। সাধারণ কিছু বললেই বাবা হাসাহাসি করেন, আর এখন বলছ অদ্ভুত কথা।

মামা আমাকে স্নেহ করেন। তা ছাড়া অদ্ভুত কথা তো কিছু বলি নাই।

বাবা তোমাকে মোটেই স্নেহ করেন না। সারাক্ষণ গাধা ডাকেন।

আলতাফ হাই তুলতে তুলতে বলল, ঘুম পাচ্ছে, চল শুয়ে পড়ি।

 দুলারী বলল, তুমি আমার একটা কথা শোন। এইসব কথা তুমি কাউকে বলবে না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

আলতাফ বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, আমি নিজ থেকে বলি না, মামা জিজ্ঞেস করলেন,..

জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবে না। তোমাকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করলে আমার ভাল লাগে না। রাগ লাগে, কান্না পায়।

আলতাফ পাশ ফিরতে ফিরতে সহজ গলায় বলল, পোকাগুলি তো সারাক্ষণ হাসাহাসি করে।

করুক। ওদের হাসি তো আর কেউ বুঝতে পারছে না।

আলতাফ কিছু বলল না। ঘর নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দুলারী বলল, ঘুমিয়ে পড়েছ?

আলতাফ জবাব দিল না। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। হাত-পা লম্বালম্বি ছড়ানো। মনে হচ্ছে তালগাছের একটা লম্বা গুঁড়ি। এই এক ঘুমেই সে রাত কাবার করে দেবে। সকালে দূলারী জেগে ওঠে দেখবে–আলতাফ একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। দুলারী ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার আরো কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল।

মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু গরম কমছে না, গরমে মাথা ধরে যাচ্ছে। মশা কামড়াচ্ছে। মশারা এখন আর আলতাফের কথা শুনছে না। দুলারী মনে মনে হাসল। মানুষটা কি অদ্ভুত বিশ্বাস নিয়েই-না আছে–পোকারা তার কথা শুনে। অবশ্যি এরকম বিশ্বাস থাকা দোষের কিছু না। তার এই বিশ্বাসে তো কারো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। আলতাফের চেয়েও কত ভয়ংকর সব বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীতে লোকজন বাস করে। নিজের প্রস্রাব নিজেই গ্লাসে করে খেলে ফেলছে–এতে নাকি শরীর রোগহীন হয়। আরেকবার দুলারী পত্রিকায় পড়েছে, শিকাগোতে এক লোক আট বছর বয়েসী একটা মেয়েকে খুন করে তার জরায়ু বের করে খেয়ে ফেলেছে। এতে নাকি যৌবন অক্ষয় হয়। এদের তুলনায় আলতাফের বিশ্বাস তো খুব সাধারণ। তাছাড়া কে জানে আলতাফ হয়তো পোকাদের কথা বুঝতেও পারে। অসম্ভব কিছু না। সোলায়মান পয়গম্বর পৃথিবীর সব পশু-পাখিদের কথা বুঝতেন।

দুলারী পাশ ফিরলো। মশা খুব কামড়াচ্ছে। টেবিলের উপর একটিন মর্টিন আছে। স্প্রে করে ঘরে ছড়িয়ে না দিলে মশারা তাকে ঘুমুতে দেবে না। দুলারী সাবধানে বিছানা থেকে নামল। টেবিলটা কোন দিকে দুলারী বুঝতে পারছে না। অন্ধকার হলেই মানুষ দিকহারা হয়ে পড়ে। পশ্চিমকে মনে হয় উত্তর, উত্তরকে মনে হয় দক্ষিণ।

দুলারী অষুধ স্প্রে করে দিল। ঘরে এখন হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ। নাক জ্বালা করছে। মশার কামড়ের চেয়ে নাক জ্বালা বরং ভাল। দুলারী বিছানায় ফিরে এলো। আলতাফ অস্ফুট শব্দ করল। বিড়বিড় বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছে। দুলারী বলল, কি বলছ? আলতাফ লল, হুঁ।

ঘুমুচ্ছ?

হুঁ।

মশার অষুধ দিয়েছি। তোমার খারাপ লাগছে না তো?

হুঁ।

আজ একেবারে গায়ে ফোসকা পড়ে যাবার মত গরম পড়েছে।

হুঁ।

ইচ্ছে করছে গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলতে।

হুঁ।

দুলারী জানে এই হুঁ অর্থহীন। যাই জিজ্ঞেস করা হোক আলতাফ বলবে–হুঁ। ঘুমের মধ্যেই বলে যাবে। দুলারীর ঘুম আসছে না। একা জেগে থাকা বেশ কষ্টের। জেগে থাকলেই কথা বলতে ইচ্ছা করে। ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয় না, তবে আলতাফ ঘুমের মধ্যেই হুঁ হুঁ করে, এও মন্দ না।

এই শোন।

হুঁ।

অফিসে তোমার কাজকর্ম কেমন হচ্ছে?

হুঁ।

কেউ আবার ভাবছে না তো তুমি পাগল কিংবা বোকা?

হুঁ।

আমি একদিন তোমাদের অফিসে যাব। তোমাকে জানিয়ে যাব না, না জানিয়ে যাব। চুপি চুপি যাব। বোরকা পরে যাব যাতে তুমি চিনতে না পার। নিজের চোখে দেখে আসব তুমি কি কর।

হুঁ।

তোমাদের অফিসে ক্যানটিন আছে? থাকলে ক্যানটিনে চা খাব।

গরম যেন আরো বাড়ছে। গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। দুলারীর মনে হল, গায়ের কাপড় খুলে ফেললে কেমন হয়? অন্ধকারে কে আর দেখতে আসছে? আলতাফ যে জেগে উঠবে তাও না। আর জাগলেও বাতি জ্বালবে না। দূলারী তার গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলল। এখন একটু আরাম লাগছে। গায়ে বাতাস লাগছে। আবার নিজেকে কেমন জানি পোকাপোকা লাগছে। পোকাদের গায়ে কোন কাপড় থাকে না। আলতাফ বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। কি বলছে সে? দুলারী শোনার চেষ্টা করছে। অর্থহীন সব শব্দ–কিছু খিচ ঝিঝ ঝিঝ। পোকারা কি এমন শব্দ করে? দুলারী আলতাফের গায়ে হাত রাখল। কি ঠাণ্ডা শরীর।

এই শুনছ? শুনছ?

হুঁ।

পানি খাবে?

খাব।

তোমার ঘুম ভেঙেছে?

ভেঙেছে।

আলতাফ উঠে বসল। বিস্মিত গলায় বলল, তুমি নেংটো হয়ে শুয়ে আছ

ঘর অন্ধকার, আলোর সামান্যতম ইশারাও নেই। এর মধ্যে মানুষটা বুঝলো কি করে তার গায়ে কাপড় নেই? দুলারী অস্বস্তির সঙ্গে বলল, বড় গরম!

আলতাফ বলল, ও আচ্ছা। দুলারী অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে পানির বোতল এবং গ্লাস নিয়ে এল। আলতাফ এক চুমুকে পানি শেষ করেই আবার শুয়ে পড়ল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। সে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

দুলারীর শরীর জ্বালা করছে। বুক ধক ধ্বক করছে। সে আবারো ডাকল, এই, এই। আলতাফ বলল, কি?

ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?

হুঁ।

এখনো কি ঘুমুচ্ছ? তুমি তো আবার ঘুমের মধ্যেও হুঁ হুঁ কর।

 না ঘুমাচ্ছি না।

 দুলারী ক্ষীণ স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে।

গল্প কর।

 তুমি একটা গল্প বল। আমি শুনি।

আলতাফ বলল, আমি তো গল্প জানি না।

সত্যি জান না?

না।

তাহলে কথা বল। যা ইচ্ছা বল। তোমার কথা শুনতে ভাল লাগে।

আলতাফ পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, আমার কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি বল আমি শুনি।

দূলারী আলতাফের গায়ে হাত রাখতে রাখতে বলল, আমাকে বিয়ে করে তুমি কি খুশি হয়েছ?

খুশি-অখুশির কি আছে?

তুমি আমাকে ভালবাস না?

আলতাফ ক্লান্ত গলায় বলল, ভালবাসাবাসির এখানে কি আছে? পোকারা ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে তুমি আমাকে বিয়ে করেছ।

পোকারা ব্যবস্থা করে দিয়েছে?

হ্যাঁ। ওরা তোমার মাথাটা গণ্ডগোল করে রেখেছে বলেই তুমি সারাক্ষণ আমার জন্য পাগল হয়ে থাক।

এইসব তুমি কি বলছ?

আলতাফ হাই তুলতে তুলতে বলল, এতদিন আমি তোমাদের এখানে আছি, কখনো তো আমার জন্য তোমার টান ছিল না। হঠাৎ বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে গেলে। পোকারা তোমাকে পাগল বানিয়ে দিল। এরা এইসব পারে।

দুলারী রাগী গলায় বলল, পোকারা এটা করল কেন?

পোকারা করল কারণ ওরা আমাকে খুব পছন্দ করে। ওরা বোধহয় ভেবে বের করেছে–তোমাকে বিয়ে করলেই আমার ভাল হবে। ওরা আমার ভাল দেখেছে।

তোমার পোকা মাকড়ের ব্যাপার আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।

আচ্ছা।

এ ধরনের গাঁজাখুরি গল্প আমার সঙ্গে কখনো করবে না।

আচ্ছা।

 তুমি ঘুমাতে চাইলে ঘুমাও, আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

আচ্ছা।

আলতাফ পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। বাকি রাতটা দুলারী কাটালো নির্ঘুম। নানান অদ্ভুত চিন্তাভাবনা তার মাথায় আসতে লাগল। যেন সে একটা পোকা হয়ে গেছে। খুব সুন্দর একটা পোকা। অনেকেই তাকে দেখতে আসছে। আলতাফও এল! সে মুগ্ধ গলায় কলল, বাহ কি সুন্দর! কি সুন্দর! এই, তোমরা একটা ক্যামেরা নিয়ে আস। আমি দুলারীর একটা ছবি তুলে রাখি।

আলতাফ ছবি তুলছে। কি অদ্ভুত কাণ্ড–আলতাফও একটা পোকা হয়ে গেছে! দুলারী বলল, এই, শোন শোন। আলতাফ পোকাদের ভাষায় বলল, খিছ খিছ খিছ। দুলারী এর মানে বুঝতে পারল। এর মানে হল–দুলারী, হাসিমুখে তাকাও। আমি ছবি তুলছি। ছবি তোলার সময় কেউ এমন গম্ভীর হয়ে থাকে?

পোকাদের ভাষার এই হল মজা। মাত্র তিনটা শব্দ—খিছ খিছ খিছ। অথচ কত কিছু বোঝা যাচ্ছে।

.

০৪.

বজলুর রহমান সাধারণত ফজর ওয়াক্তে জেগে উঠেন। নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াকে যান। ঘণ্টাখানিক হাঁটাহাটি করে নাশতা খান। এই রুটিনের নড়চড় খুব একটা হয় না। আজ হল। গত রাতে বলতে গেলে ঘুম একেবারেই হয়নি। শেষ রাতের দিকে চোখ একটু ধরে এসেছিল, ওম্নি বিশ্রী বিশ্রী স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। স্বপ্নে একটা ধবধবে সাদা রঙের তেলাপোকা এসে তাঁকে ইংরেজিতে বলল, How are you Mr, B, Rahumari? তিনি বাংলায় বললেন, যা, ভাগ। তেলাপোকা বিস্মিত হয়ে বলল (এবার হিন্দীতে), কিয়া তুম আংরেজি নেহি জানতে?

আতঙ্কেই বজলুর রহমানের ঘুম ভেঙে গেল। রাতটা বিছানায় বসে বসেই কাটিয়ে দিলেন।

এখন সকাল ন’টা। তিনি নাশতা খেতে খাবার ঘরে এসেছেন। তাঁর মাথা ভার ভার হয়ে আছে। চোখ জ্বালা করছে। তিনি লক্ষ করলেন, রুটি গলা দিয়ে নামছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক টুকরা রুটি মুখে নিয়ে অনেকক্ষণ চিবানোর পর পানি দিয়ে গিলে ফেলতে হচ্ছে। একরাত ঘুম না হওয়ার এত সমস্যা? তিনি বিরক্তমুখে ডাকলেন, মনোয়ারা।

কি?

যদি খুব কষ্ট না হয় তাহলে কাছে এসে একটু শুনে যাও?

মনোয়ারা দ্রুত উঠে এলেন। কুণ্ঠিত গলায় বললেন, কাঁচা আমের আচার বানাচ্ছি। দুলারী কদিন থেকে বলছে। কি জন্যে ডেকেছ?

বজলুর রহমান স্ত্রীকে কি জন্যে ডেকেছেন মনে করতে পারলেন না, তবে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলেন। কারণ তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তার রাতের ঘুমের কোন অসুবিধা হয়নি। গত রাতে কি ঘটেছে না ঘটেছে তাও বোধহয় মনে নেই।

রাতে ঘুম হয়েছিল?

 যা গরম! ঘুম কি আসে?

দেখে তো মনে হয় মরার মত ঘুমিয়েছ।

 মনোয়ারা হকচকিয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে মরার মত ঘুমিয়ে তিনি অপরাধ করেছেন। বজলুর রহমান বললেন, আলতাফকে ডাক, ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

ও তো অফিসে চলে গেছে।

অফিস দশটায়, এখন বাজে ন’টা।

 বাস পায় না, ভিড় হয়, এইজন্যে আগে আগে যায়।

 দুলারীকে ডাক।

ও তো আলতাফের সঙ্গে গেছে। আলতাফকে বাসে উঠিয়ে কলেজে চলে যাবে।

তিনি থমথমে গলায় বললেন, আলতাফকে কি কোলে করে বাসে তুলে দিতে হয়? মনোয়ারা বললেন, তুমি চট করে রেগে যাচ্ছ। তোমার শরীর মনে হয় খারাপ। দেখি, জ্বর আছে কি-না। ও আল্লা, জ্বর আছে তো। বেশ জ্বর। যাও, বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাক। বজলুর রহমান শোবার ঘরে চলে গেলেন। ঘরে ঢুকেই তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হল। তেলাপোকাটা এখনো ঘুরঘুর করছে। বজলুর রহমানকে দেখে পরিচিত ভঙ্গিতে কাছে এগিয়ে এল। এটা কাল রাতের তেলাপোকা কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। অন্য একটাও হতে পারে। ঘরে তেলাপোকার উপদ্রব হয়েছে পোকা মারার অষুধ কিনতে হবে। আজই কিনতে হবে। এখন কিনে আনলেই হয়। পরে মনে থাকবে না।

বজলুর রহমান জ্বর নিয়েই পোকা মারার অষুধ কিনতে বের হলেন। বাজারে অনেক ধরনের অষুধ আছে–Kill Them, Finish, Rouche Killer, vanish. তিনি কিনলেন দুফাইল কিল দেম। নামটা সুন্দর! কিল দেম। তাদের মার, শুধু মার, মেরে শেষ করে দাও। শুওরের বাচ্চা। এদের শুওরের বাচ্চা কলা ঠিক না। এরা তারচেয়েও খারাপ। কিল দেম বোতলের গায়ে লেখা–এটি বিষাক্ত অষুধ। স্প্রে করার সময় হাতে গ্লাভস পরে নেবেন। রাতের বেলায় ঘরের কোণায়, কমোডে, বেসিনে, ভাড়ার ঘরে ছড়িয়ে দেবেন। পরপর তিনবাত অষুধ দেবেন। পনেরো দিন বিরতির পর আবার অষুধ দেবেন।

অষুধের তেজ কেমন পরীক্ষা করার জন্যে বজলুর রহমান দিনের বেলাতেই অষুধ স্প্রে করলেন। গ্লাভস ছাড়াই করলেন, তিনি গ্লাভ কিনতে ভুলে গিয়েছিলেন।

Kili Them অষুধ হিসেবে মন্দ না। পোকাটার গায়ে স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে কাজ হল। পোকাটা একবার উড়ার চেষ্টা করেই চিৎ হয়ে পড়ে গেল। কয়েকবার শুড় নেড়েই স্থির হয়ে গেল। বজলুর রহমান হৃষ্টচিত্তে বললেন, শুয়র কা বাচ্চা। বলেই মরা পোকটির গায়ে আরো কয়েকবার কিল দেম স্প্রে করে দিলেন। তার মনে হিংস্র এক ধরনের আনন্দ হল। অনেক দিন এধরনের আনন্দ পাননি। প্রচণ্ড আনন্দের জন্যেই ঘাম দিয়ে তার জ্বর চলে গেল। ক্ষুধা বোধ হল।

.

দুলারী কলেজ থেকে ফিরতেই মনোয়ারা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবার সঙ্গে কিন্তু খুব সাবধানে কথা বলবি। খুব সাবধান!

দুলারী ভীত গলায় বলল, বাবার কি হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। মনে হয় রাতে গরমের জন্যে ভাল ঘুম হয়নি। সকাল থেকে ছটফট করছে। কি যেন দোকান থেকে কিনে এনেছে। ঘরে ঘরে দিচ্ছে। বোটকা গন্ধ।

জিনিসটা কি?

জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। যা মেজাজ করে রেখেছে জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগে। তুই তোর বাবার সঙ্গে সাবধানে কথা বলিস। না ডাকলে কাছে যাবি না।

আচ্ছা।

বজলুর রহমান মেয়েকে ডাকলেন না। দুলারী নিজ থেকেই কৌতূহলী হয়ে বাবার ঘরে ঢুকল। ক্ষীণ গলায় বলল, কেমন আছ বাবা?

বজলুর রহমান জবাব দিলেন মা। মেয়ের দিকে তাকালেনও না। দুলারী বলল, তোমার কি শরীর খারাপ?

না। জ্বর ছিল, এখন নেই।

 দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। মা বলছিল তোমার রাতে ঘুম হয়নি। ঘুম না হওয়ারই কথা। যা গরম! আমারও রাতে ঘুম হয়নি।

আলতাফ! আলতাফের ঘুম হয়েছে?

ঘুম নিয়ে তো ওর কোন সমস্যা নেই বাবা। ভরদুপুরে ওকে যদি একটা কম্বল দিয়ে ছেড়ে দাও ও আরাম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে।

বজলুর রহমান মেয়ের কথায় তেমন মজা পেলেন না। তাঁর মুখ আরো কঠিন হয়ে গেল। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ওর মাথাটা কি খারাপ?

 দুলারী হকচকিয়ে গিয়ে বলল, মাথা খারাপ হবে কেন?

কাল রাতে আমাকে বলল, ও পোকাদের কথা শুনতে পায়। পোকারাও ওর কথা শুনে। এইসব হাবিজাবি।

বাবা, এটা হল ওর একটা খেয়াল।

খেয়াল?

হ্যাঁ, খেয়াল। ও অবশ্যি বিশ্বাস করে।

তুই বিশ্বাস করিস?

ফিফটি ফিফটি করি বাবা।

ফিফটি ফিফটি মানে?

কিছুটা করি কিছুটা করি না। মানুষ পোকার কথা কি করে শুনবে এটা যখন মনে হয় তখন বিশ্বাস করি না। আবার যখন দেখি ও মশাদের কামড়াতে নিষেধ করল, ওমনি মশার কামড়ানো বন্ধ করল, তখন কিছুটা বিশ্বাস হয়।

বজলুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, মশারা ওর কথায় কামড়ানো বন্ধ করে দেয়? সব গান্ধিবাদী মশা?

দুলারী বলল, সবসময় যে কামড়ানো বন্ধ করে তা না, মাঝে মাঝে করে।

বজলুর রহমান বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আলতাফের স্থান হওয়া উচিত পাগলাগারদে। শুধু ওর একার না–তোরও। মিয়া বিবি দুজনেরই। কোন মানুষ যদি একনাগাড়ে অনেক দিন পাঁঠার সঙ্গে থাকে তাহলে তার গা থেকে পাঁঠার মত গন্ধ বের হয়। এই-ই নিয়ম। তোর গা থেকেও পাঁঠার মত গন্ধ বেরুচ্ছে।

এরকম করে কথা বলছ কেন বাবা?

তোদের চাবকানো উচিত। তা না করে ভদ্র ভাষায় কথা বলছি। যা আমার সামনে থেকে।

দুলারী কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমি জানি তুমি ওকে দেখতে পার না। আমাকেও না। আমরা তোমার সঙ্গে থাকব না। আলাদা বাসা নেব।

যা ইচ্ছা কর। এখন আমার সামনে থেকে যা।

দুলারী প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল।

.

০৫.

আলতাফ মাথা নিচু করে লেজার বই-এ লিখে যাচ্ছে। একটা দশ বাজে, টিফিন টাইম। অফিসের মূল হলঘর প্রায় ফাঁকা। সবাই ভিড় করেছে ক্যানটিনে।

গনি সাহেব আলতাফের পাশের টেবিলে বসেন। তিনি পান মুখে দিতে দিতে বললেন, করছেন কি আলতাফ সাহেব?

আলতাফ হাসল। গনি সাহেব বললেন, একটা থেকে দুটা হচ্ছে রেস্ট পেরিয়ড। রেস্ট পেরিয়ডে কাজ করলে আয়ু কমে যায়। রেস্ট পেরিয়ডে অফিসের কোন কাজ করবেন না। যত জরুরি কাজই থাকুক হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন। পান খাবেন। সিগারেট খাবেন। পা নাড়বেন। খবরের কাগজ পড়বেন। কিন্তু ভুলেও কাজ করবেন না।

জ্বি আচ্ছা।

 খাওয়া-দাওয়া করেছেন?

জ্বি।

চা খাবেন না কি? চলুন চা খেয়ে আসি।

 আমি দুপুরে চা খাই না।

চায়ের কোন সকাল দুপুর নেই। আসুন তো আমার সঙ্গে।

আলতাফ মাথা নিচু করে বলল, এখন কোথাও যাব না।

গনি সাহেব বিস্মিত হলেন। তাঁর মুখের উপর কেউ কখনো না বলে না। এই অফিসে তিনি অতি জনপ্রিয় একজন মানুষ। পরপর কয়েক বছর ধরেই অফিসার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তিনি যে নিজ থেকে চায়ের দাওয়াত দিলেন, এটা কম কথা না। কিন্তু মানুষটা বোধহয় এর গুরুত্ব ধরতে পারছে না। মনে হচ্ছে নির্বোধ ধরনের মানুষ। কেউ না বললে তা হজম করা গনি সাহেবের স্বভাব নয়। তিনি আলতাফের সামনের চেয়ার টেনে বসলেন। হাসিমুখে বললেন, অফিসের কাজকর্ম কেমন হচ্ছে?

জ্বি, ভাল হচ্ছে।

অসুবিধা হলে বলবেন।

জ্বি আচ্ছা।

বড় কর্তাদের সাথে ঝামেলা হলেও বলবেন। আগের দিন এখন নেই, বুঝতে পারছেন?

আলতাফ চুপ করে রইল। গনি সাহেবের যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। একটা বোকা বোকা ধরনের লোককে কাছে টানা যাচ্ছে না, এ কেমন কথা? লোকটা কি তার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না? বিপদে না পড়লে বুঝতে পারবে না। বিপদে শিগগিরই পড়বে। তখন ছুটে আসতে হবে তাঁর কাছেই। দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বুঝে না, এ তো অতি পুরাতন কথা।

যাই আলতাফ সাহেব।

আচ্ছা।

আলতাফ পাঁচটা পর্যন্ত চেয়ারে বসে রইল। পাঁচটার ঘণ্টা পড়ার পর ফাইল গুছাতে শুরু করল, ঠিক তখন বড় সাহেবের পিয়ন এসে বলল, স্যার আফনেরে বুলায়। যে কোন বুদ্ধিমান মানুষ পিয়নের ডাকের ধরণ থেকে বুঝে ফেলবে বড় সাহেবের মেজাজ ঠিক না। আলতাফ কিছু বুঝতে পারল না।

বড় সাহেবের নাম মনসুর আলী। ছোটখাট ধরনের মানুষ। তিনি প্রচণ্ড গরমেও স্যুট পরে থাকেন। তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি কারোর সাতে পাঁচে থাকেন না। কিন্তু তারপরও তার ছায়া দেখলেই অফিসের সবাই চমকে উঠে। তিনি সচরাচর নিচের স্তরের কর্মচারিদের ডাকেন না। তাঁর নীতি হল–দূরত্ব বজায় রেখে চলার নীতি। আলতাফের মত একজন জুনিয়র কর্মচারি যে মাত্র সেদিন কাজে যোগ দিয়েছে তাকে খাস কামরায় ডাকার কারণ কি? গনি সাহেব চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঘটনা না জেনে যাওয়া যায় না।

.

বড় সাহেবের ঘরটা প্রকাণ্ড। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। এয়ারকুলারের কাঁটা এত নিচে নামানো যে ঘরে ঢুকলেই শীতের কারণে শরীরে কাঁপন ধরে যায়। ঘরের আলোও কম। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায় না। এত কম আলোতেও বড় সাহেব চোখে সানগ্লাস পরে থাকেন। এই অফিসের অতি পুরাতন কর্মচারি সগীর মিয়াও কোনদিন সানগ্লাস ছাড়া বড় সাহেবকে দেখেনি। অফিসের সবার ধারণা, বড় সাহেবের একটা চোখ নষ্ট বলেই তিনি কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখেন।

আলতাফ ঘরে ঢুকে ক্ষীণ গলায় কলল, স্যার ডেকেছেন?

বড় সাহেব বললেন, আপনার নাম আলতাফ হোসেন?

 জি স্যার।

কাজে যোগ দিয়েছেন কবে?

 দুমাস হয়েছে স্যার।

বসুন।

আলতাফ বসল। বড় সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, এই ফাইলটা আপনার তৈরি করা না? জুন মাসের এক্সপেনডিচার ফাইল।

ছি স্যার, আমার করা।

ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে একটা কাগজ পেলাম, মনে হচ্ছে আপনারই হাতের লেখা। দেখুন তো এটা আপনার হাতের লেখা কি-না।

বড় সাহেব পুরো ফাইলটাই এগিয়ে দিলেন। আলতাফ কাগজটার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, এটা আমারই লেখা।

কি লিখেছেন এখানে?

আলতাফ চুপ করে রইল। বড় সাহেব বললেন, আমি এই লেখার পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

আলতাফ বলল, এই পাতাটা স্যার ভুল করে ফাইলে দিয়ে দিয়েছি।

আমারো তাই ধারণা।

বড় সাহেব ফাইলটা আবার নিজের কাছে নিলেন। ভ্রু কুঁচকে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গুটি গুটি করে বিচিত্র কিছু জিনিস লেখা–

[III({||||||UILT}}}fb/T||||J0-1[ [TVIE DDDDDIDDDDD DDDDDD DDD DD][][[[ ]। JILIULUILO TUDIJU I MITJO. I MNO OLJO ||||||||||au[0]]]]] ]]]] [] [B]][][][000000 Tit]| || ||| |||}{VT|||]Jn-1 [ TV||||||g||||||L [ If [[[[[0000000[] [][0 D] [[ ৯][][] D IIUI|||||1|||||14pUTIIIU-IIIJITIJJ-IIITIVIL ||||ELF [1] DDDDDDDDDDD DDDD6D[D DDDDDDDD

TUITIEUTU||||IU-TIfITTRI)-| |||[[] [[ [ ] [][]]]]]]]]]]] [[[[n][D DDDDDDDDJT IUID] [EUTIIIU-IIf If}}TIOJn-[ IT}|||||| nakfTn BDn[[ [[[[ [[[[[[[[[]] [[]BD

বড় সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, জিনিসটা কি?

কিছু না স্যার।

যা লিখেছেন তা কি অর্থহীন, না কোন অর্থ আছে?

 অর্থ আছে স্যার। পোকাদের নিয়ে একটা লেখা লিখেছি স্যার।

 কাদের নিয়ে লিখেছেন?

 পোকাদের নিয়ে। যেমন তেলাপোকা, মাকড়সা, শুয়োপোকা, ..

সাংকেতিক ভাষায় লিখেছেন?

জি স্যার।

সাংকেতিক ভাষা আপনি জানেন, না নিজে তৈরি করেছেন?

আলতাফ হোসেন ইতস্ততঃ করে বলল, আমি তৈরি করেছি স্যার। তবে পোকারা আমাকে সাহায্য করেছে।

পোকারা আপনাকে সাহায্য করেছে?

জ্বি স্যার। এখানে দুধরনের সাংকেতিক ভাষা আছে। প্রথমটা তেলাপোকাদের কাছ থেকে নেয়া। দ্বিতীয়টা পেয়েছি ঘুনপোকাদের কাছ থেকে।

ঘুনপোকা?

জি স্যার, ঘুনপোকা। আমি যে টেবিলে কাজ করি সেই টেবিলে অনেক ঘুনপোকা থাকে। ওরা আমাকে লিখতে সাহায্য করেছে। স্যার, আমি এখন উঠি?

বসুন, আরো কিছুক্ষণ বসুন। তাড়া আছে?

জি না স্যার, তাড়া নেই।

 আসুন, চা খাওয়া যাক। আপনি চা খান তো?

দিনে দুকাপ চা খাই স্যার। সকালে এক কাপ আর বিকালে এক কাপ।

এখন তে বিকাল, এখন খাওয়া যেতে পারে।

বড় সাহেব বেল টিপলেন। বেয়ারাকে চা দিতে বললেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, এখানে কি লিখেছেন একটু পড়ুন তো শুনি।

পোকাদের সাহায্য ছাড়া তো স্যার পড়া যাবে না।

তার মানে কি এই যে এ লেখা আপনি কখনো পড়তে পারবেন না?

পড়তে পারব। পোকা থাকলেই পড়তে পারব। আপনার ঘরে কোন তেলাপোকা বা ঘুনপোকা নেই। আমি কি স্যার আমার টেবিলে গিয়ে পড়ে নিয়ে আসব?

থাক, আরেক দিন দেখা যাবে।

বড় সাহেব উঠে দাঁড়াতে দীড়াতে বললেন, আপনি কি এইসব ব্যাপার নিয়ে অফিসের কারো সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন?

না স্যার।

না করাই ভাল। অফিস হল অফিসের কাজকর্মের জন্যে, পোকাদের সাংকেতিক ভাষা লেখার জন্যে না। ঠিক বলেছি না?

জ্বি স্যার।

আলতাফ বড় সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে দেখল, গনি সাহেব অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন।

আলতাফ সাহেব, ব্যাপারটা কি?

কিছু না।

বড় সাহেবের ঘরে এতক্ষণ কী করলেন?

চা খেয়েছি।

গনি সাহেবের মুখ কঠিন হয়ে গেল। তিনি এই অফিসের যথেষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তি। অফিসার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, অথচ তাঁকে এখনো বড় সাহেব তাঁর অফিসে চা খেতে বলেননি। চা খাওয়া দূরে থাক, রুমে কখনো ডাকেননি। এর মানেটা কি?

শুধু চা-ই খেলেন, না আরো কিছু আলাপ-টালাপ হল?

পোকাদের নিয়ে কথা বলেছি।

বুঝতে পারলাম না, কাদের নিয়ে কথা বলেছেন?

 তেলাপোকা, ঘুনপোকা, মাকড়সা–এদের নিয়ে।

গনি সাহেব হাসিমুখে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা। মনে মনে বললেন, গভীর জলের মাছ, Deep water fish. পোকাদের নিয়ে কথা বলা হচ্ছিল। আমার সঙ্গে মামদোবাজি, পোকার চাটনি বানিয়ে খাইয়ে দেব। তখন বুঝবে পোকা কি জিনিস।

আলতাফ সাহেব!

জ্বি।

চলুন আপনাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি।

আমি বাসে করে যাই।

 চলুন তাহলে বাসস্টপ পর্যন্ত যাই।

গনি সাহেব ভেবেছিলেন, যেতে যেতে আরো কিছু কথা বের করা যাবে। লাভ হল না। আলতাফ হ্যাঁ হুঁ ছাড়া কিছুই বলল না। ব্যাটা আসলেই গভীর জলের মাছ। তার আগেই টের পাওয়া উচিত ছিল। টের পাননি। এখন থেকে ব্যাটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে। খাতির জমাতে হবে। সবচে ভাল হয় বাসা চিনে এলে। ছুটির দিনে বাসায় চলে যেতে হবে।

আলতাফ সাহেব।

জ্বি।

আপনার বাসা কোথায়?

মগবাজারে।

মগবাজারে কোথায়?

রেল ক্রসিং-এর কাছে।

বলেন কি! আমার এক রিলেটিভ থাকে, আমি আসি প্রায়ই। দেখি একবার যাব আপনার বাসায়। ঠিকানাটা কি?

আলতাফ ঠিকানা বলল। গনি সাহেব নোটবই বের করে ঠিকানা লিখে রাখলেন। মনে মনে ভাবলেন, কাল ছুটির দিন আছে, সন্ধ্যাবেলার দিকে চলে যাবেন। ব্যাটা ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিনা কে জানে। গভীর জলের মাছ! ভুল ঠিকানা দিতেও পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *