১. নর্সমেন, নর্সভাষা এবং নর্সমিথ

প্রথম অধ্যায় —নর্সমেন, নর্সভাষা এবং নর্সমিথ

নর্স শব্দটির উৎপত্তি নর্থ থেকে, অর্থাৎ উত্তরদিক। নর্সমেন বলা হত সেসব মানুষকে যাঁরা মূলতঃ স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় থাকতেন এবং ‘পুরাতন নর্স ভাষা’-য় কথা বলতেন। সময়টা ছিল সম্ভবত ৮00 থেকে ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দ। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে যে ভাষাতে উত্তর-জার্মানিক প্রজাতি কথা বলতেন, সেই ভাষাই ছিল নর্স ভাষা। অষ্টম শতকের শেষের দিকে এই ভাষাগোষ্ঠী প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপেই। এঁদেরই আমরা ভাইকিং নামে জানি। অষ্টম শতাব্দী এবং তার আশেপাশে ভাইকিং যুগ শুরু হয়।

ভাইকিং যুগে নর্সমেনরা ছড়িয়ে পড়েন বহু জায়গায়। তাঁরা ছিলেন সামুদ্রিক বণিক, যোদ্ধা এবং তাঁরা বহু জায়গায় বসতি স্থাপন করেছেন। তাঁরা দরকারে রাজনীতি করেছেন, রাজত্ব স্থাপন করেছেন, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ওয়েলস, ফারো দ্বীপপুঞ্জ, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, বেলারুস, গ্রীনল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, অ্যাস্টোনিয়া, লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, জার্মানী, পোলান্ড এমনকি দক্ষিণ ইটালিতেও।

নরম্যান বা নর্মান্ডি শব্দটাও এই নর্সম্যান শব্দ থেকেই এসেছে। উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্স এঁরাই দখল করেছিলেন, সেইজন্যেই সেখানকার এক বিরাট অংশকে নর্মান্ডি বলা হয়। এঁরাই পরবর্তীকালে গলজাতি নামে পরিচিত। আবার পরে এঁরা পূর্ব—জার্মানিতে অস্ট্রোগথ হিসেবেও পরিচিত হন। ডেনমার্ক, সুইডেন বা নরওয়েতে এঁদের রাজত্ব অনেকদিন অবধি চলেছে।

নর্সমেন বা নর্থ-জার্মানিক গোষ্ঠীর মানুষরা এক আলাদা ধর্মে বিশ্বাস করতেন। প্রচুর দেব-দেবীবিশিষ্ট এই ধর্মের নাম ছিল পুরাতন নর্স ধর্ম। খ্রীষ্টধর্ম শক্তিশালী হলেও তেরোশ’ শতকের আগে এই ধর্মের উপর নিজের জয়যাত্রা সংঘটিত করতে পারেনি।

বেশিরভাগ পুরোনো নর্স গাথা আইসল্যান্ডেই সৃষ্টি হয়েছে। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে এইসমস্ত গাথাগুলিকে সংগ্রহ এবং লিপিবদ্ধ করা হয়। সংগ্রহের একটিকে বলা হয় ‘প্রোজ এডা’—যেটা স্নরি স্টারলুসন সংগ্রহ করে নিজের মত ভাষায় লিখেছেন। এই বইতে গদ্যে বিভিন্ন গাথা রয়েছে। এছাড়াও গান এবং কবিতাগুলি ‘পোয়েটিক এডা’ নামক একটি বইতে সংগৃহীত আছে, যার লেখকের নাম পাওয়া যায় না, এবং মনে করা হয় প্রোজ এডার থেকে বেশি পুরোনো।

এই নর্সমেনদের মিথ এবং ধর্মবিশ্বাস একেবারেই অন্যরকম ছিল। খ্রীষ্টানরা এই ধর্মকে নর্স প্যাগান ধর্ম বলতেন। নর্সদের একটি শক্তিশালী মিথোলজি ছিল। এই মিথে প্রচুর দেবদেবী, বস্তু, এবং বিভিন্ন রকম জীবের বর্ণনা এবং গল্প রয়েছে। প্রচুর রীতিনীতিতে ভরা এই ধর্মের কাহিনীতে সমস্ত ঘটনারই একটি ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই ধর্ম অনুসারে দেবতাদেরও দুটি শাখা আছে। নর্স মিথোলজি একটি আখ্যানের আকারে সাজানো। যে আখ্যানের একটি অন্তিমক্ষণ রয়েছে— র‍্যাগনারক, যখন দেবতা, মানুষ, সমস্ত জীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই দেবতাদের জগত-সৃষ্টির আদিকাল থেকে র‍্যাগনারকের সময় যেটা ভবিষ্যতে ঘটবে, সেই পুরো যাত্রাটা খুব সুন্দরভাবে কিছু মিথগল্পের শিকল দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত।

লক্ষণীয় বিষয় হল, নর্স মিথোলজিতে কোনো দেবতাই একেবারে নিখুঁত নন। সকলেরই দোষত্রুটি আছে, এবং যেহেতু ভাইকিংরা যোদ্ধার জাত, তাই একটু নজর করলেই দেখা যাবে যে অনেক দেবতাই নানাভাবে নিজেদের অঙ্গ খুইয়েছেন। যেমন ওডিনের একটি চোখ নেই, টিউয়ের ডান হাত কবজি থেকে নেই, হোড জন্মান্ধ। যুদ্ধকে এই ধর্মে অনেক মহিমান্বিত করা হয়েছে। বিশ্বাস করা হত, বীরের মত যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যু হলে মৃত্যুর পরে তাঁর জন্য অপার আনন্দ ও শৌর্য অপেক্ষা করে আছে। এছাড়াও মৃত্যু কখনোই মানুষের অন্ত নয়। মৃত্যুর পরেও প্রত্যেক মানুষের এক আশ্রয় রয়েছে—সেখানে কোনো মানুষ ভালো থাকবেন না খারাপ সেটা তাঁর জাগতিক কাজের উপর নির্ভর করবে। শুধু মানব নয়— দেবতারাও কিন্তু তাঁদের কর্মফল ভোগ করবেন র‍্যাগনারকে। তাঁরা যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই সিদ্ধান্তগুলিই র‍্যাগনারকে তাঁর অসুবিধা বা সুবিধার কারণ হিসাবে প্রকট হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *