১. ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশ

প্রথম অধ্যায় – ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশ (The Origin and Evolution of Human Race in Religious Views)

সৃষ্টির আদিতে (In the Beginning)

‘মানুষের ইতিহাস হল প্রকৃতপক্ষে ধর্মের ইতিহাস’—মানব সভ্যতার মূলের দিক থেকে বিচার করলে ম্যাক্সমূলারের (Maxmuller) এই উক্তি খুব একটা অতিশয়োক্তিপূর্ণ নয়। কারণ এমন কোন আদিম মানব গোষ্ঠী বা সমাজ ছিল না যেখানে অজ্ঞতা থেকে ধর্মের ধারণা প্রথম সৃষ্টি লাভ করেনি। অবশ্য আজকের সুসংগঠিত, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের সঙ্গে আদিম ধর্মমতের পার্থক্য ছিল অনেক। ধর্মের প্রথম উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের প্রশ্নটি ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। আর তারপরই ধর্মের স্বরূপ ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কেননা ধর্ম একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। একে কোন একটিমাত্র সামাজিক রীতির বৃদ্ধি বা বিস্তৃতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না। যতই আদিম রূপের হোক না কেন উপাসনাকে কোন একটিমাত্র চিন্তার বা একটিমাত্র আবেগের প্রকাশ বলা যায় না। বরং ধর্ম হল (মানব সভ্যতার ক্রম বিবর্তনশীল ধারার বহু বহু পূর্বের) অনেকগুলো জটিল ও শক্তিশালী চিন্তার সৃষ্টি।

কোন কোন গবেষক মনে করেন, ‘ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন’—এই তত্ত্বটির মধ্যেই রয়েছে ধর্মের সবচেয়ে বড় ফাঁকি। আদমের উৎপত্তিকাল থেকে বাইবেলের হিসেব অনুযায়ী আব্রাহাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন আদমের ১৯৪৮ বছর পর। এবং আব্রাহামের জন্ম থেকে যিশুর আবির্ভাব ঘটেছিল ১৮৫২ বছর পরে। অর্থাৎ আদম থেকে যিশুর সময়ের ব্যবধান ৩৮০০ বছর। বাইবেলে বিশ্বসৃষ্টির আবির্ভাব হয়েছিল তাও নির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। আজকের ২০২১ খ্রিষ্টাব্দকে ভিত্তি হিসেবে (যিশুর জন্মের ৩/৪ বছর পর থেকে খ্রিষ্টীয় সন গণনা শুরু হয়, সেই হিসেবে) বিশ্বসৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল। আর মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল, অর্থাৎ প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে–এর মাত্র দিন কয়েক পরেই। বাইবেলের এই সৃষ্টিতত্ত্বকে ইসলাম সমর্থন করে। কিন্তু এই সৃষ্টিতত্ত্ব আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।

পুরানো বাইবেল-এ আছে হিব্রুসৃষ্টিতত্ত্ব। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম বিশ্বাস করে এ-সৃষ্টিতত্ত্বে, অর্থাৎ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মানে এবং বিভ্রান্ত হয় এটি দিয়ে। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব মৌলিক নয়, এর অনেকখানি ধার করা হয়েছে ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে; এবং এর নানা মিল রয়েছে হিন্দুসৃষ্টিতত্ত্বের সাথেও। বেদের ‘নাসাদীয় সূক্ত’ এবং ‘হিরণ্যগর্ভ সূক্ত’— দুটিই হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বের সপক্ষে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

নাসাদীয় সূক্তে বলা হয়েছে, ‘নাসাদাসিস নঃ সদাসিত্ তদানীম নাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রো যৎ…। (ঋগ্বেদ, ১০/১২৯/১)। অর্থাৎ সেকালে যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবী ছিল না, অতি দূরবিস্তৃত আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কি ছিল? কোথায় কার স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল?

আরেকটি সূক্তে আছে, ‘তম অসিৎ তমস…তপসস্তন্মাহিনাজায়াতৈকম’ (ঋগ্বেদ, ১০/১২৯/৩)। অর্থাৎ চারদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সমস্ত জিনিস একত্রে পুঞ্জীভূত ছিল। সেখান থেকে প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হল।

হিরণ্যগর্ভ সূক্তে বলা হয়েছে, ‘আপন হ য়দ বৃহাতিবিশ্বমা য়ান গর্ভম…’। (ঋগ্বেদ, ১০/১২১/৭)। অর্থাৎ সর্বপ্রথম হিরণ্যগর্ভই সৃষ্টি হল অর্থাৎ সর্বপ্রথম জলময় প্রাণের উৎপত্তি হয়। এখানে প্রথম প্রাণকে প্রজাপতি (ব্রহ্ম) বলা হয়েছে।

আরেকটি সূক্তে আছে, ‘হিরণ্যগর্ভানি অপঃ তে সলিলা…। ঋগ্বেদ, (1০/22/2) অর্থাৎ প্রথমে হিরণ্যগর্ভ সৃষ্ট হল। সেখানে ছিল উত্তপ্ত গলিত তরল। এটি ছিল মহাশূন্যে ভাসমান। বছরের পর বছর এই অবস্থা অতিক্রান্ত হয়। তারপর সেখানে বিস্ফোরণ ঘটল গলিত পদার্থ থেকে, বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল।… সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র তৈরি হল। (ঋগ্বেদ, ১০/৭২/৩)।

‘তার এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হল।’ (ঋগ্বেদ, ১০/৭২/৪)। ‘তারপর সৃষ্ট ক্ষেত্রে সাত ধাপে সংকোচন-প্রসারণ সম্পন্ন হল। তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।’ (ঋগ্বেদ, ১০/৭২৮-৯)। একই কথা আরেকটি সূক্তে বলা হয়েছে, ভুরি পরিমাণ জল সমস্ত বিশ্বভূবন আচ্ছন্ন করে ছিল, সেখানে অগ্নির উৎপত্তি হয়। এভাবে গলিত উত্তপ্ত তরল থেকে প্রাণরূপ দেবতার উদ্ভব হয়। (ঋগ্বেদ, ১০/১২১/৭)।

আর বাইবেলে বলা হয়েছে ‘ঈশ্বর মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং তার নাক দিয়ে জীবনের নিঃশ্বাস ফুঁকে দিলেন, আর মানুষ জীবন্ত হল’ (জেনেসিস ২ : ৭)। আদিপুস্তক-এর ‘জগৎ-সৃষ্টির বিবরণ’-এ বলা হয়েছে : ‘পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিত ছিল।… পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক, ও জলকে দুই ভাগে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইভাবে বিতান করিয়া বিতানের ঊর্ধ্বস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন; তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন।’ পবিত্র কোরআনেও বলা হয়েছে ছয় দিনে বা ছয় ধাপে আসমান এবং জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে- ইন্না রাব্বাকুমুল্লাহুল্লাযী খালাক্বাছ ছামাওয়াতি অলআরদ্বা ফী ছিত্তাতি আইয়্যামিন ছুম্মাছ্‌তাওয়া আলাল আরশি, ইয়ুগশিল লাইলান নাহারা ইয়াতলুবুহু হাছীছাওঁ আশ্শামছা আলক্বামারা আননুজুমা মুছাখারাতিম বিআমরিহ; আলা লাহুল খালকু আলআমর; তাবারাকাল্লাহু রাব্বুল আ’লামীন। (কোরআন ৭:৫৪ )

অর্থাৎ— নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ, যিনি আসমান ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের উপর সমাসীন হন। তিনিই আবৃত করেন রাত্রি দ্বারা দিনকে যাতে তাদের একে অন্যকে দ্রুত গতিতে অনুসরণ করে, তিনিই সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি, যা তাঁরই আদেশের অনুবর্তী। জেনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ প্রদান করা। আল্লাহ্ বরকতময়, সারা জাহানের প্রতিপালক (ইফা)। দেখা যাচ্ছে সৃষ্টি তত্ত্বে বাইবেল বর্ণিত পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টির প্রদেয় তথ্যের সাথে কোরআনে কোন পার্থক্য করা হয়নি।

তবে বাইবেলের ঈশ্বর আদিম জলরাশিকে মঞ্চের সাহায্যে দু-ভাগ করে, যার ওপর স্থাপন করেন গগনমণ্ডল। ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বের তিয়াওয়াথের লাশ দু-ভাগ করার সাথে এর মিল আছে। বাইবেলে আছে, ‘পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল।’ ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বে নেই এ-আলোবিকাশের কথা, তবে ব্যাবিলনি ঈশ্বর মেরোডাক নিজেই আলোর দেবতা।

.

ইরানি বা জরথুষ্টি সৃষ্টিতত্ত্বে আহুর মাজদা বা ওরমুজদ স্রষ্টা ও শুভশক্তি। সে সৃষ্টি করেছে সব কিছু। সে অবশ্য বিশ্বের জন্যে বেশি দিন আয়ু ধার্য করে নি, করেছে বারো হাজার বছর। এটা আজকাল আর মানা সম্ভব নয়, কেননা আজ আমরা অনন্ত মহাকালের ধারণা করতে পারি; আদিম মানুষের কোন অসীম অনন্ততার বোধ ছিল না; তখন বারো হাজার ছিল মহাকাল, আর হয়ত পাঁচশো মাইলই ছিল অনন্ত অসীম। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে ছিল একটি শয়তানও, যার নাম আহরিমান। আহরিমান আগে ওরমুজদের কথা জানত না, একদিন ওরমুজদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতি দেখে সে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তিন হাজার বছরে ওরমুজদ সৃষ্টি করে বিশ্ব, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ। তবে আহরিমান ওরমুজদের সৃষ্টি করে বিশ্ব, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ। তবে আহরিমান ওরমুজদের প্রতিটি শুভ সৃষ্টির বিরুদ্ধে অশুভ সৃষ্টির অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে; সে হয় অশুভর ঈশ্বর। তিন হাজার বছর ধরে চলে শুভ- অশুভর যুদ্ধ; তবে জরথুষ্টের জন্মের সাথে জয়ী হয় শুভশক্তি। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে শুভ-অশুভর বিরোধ খুব বড় ব্যাপার, যা নেই হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে; কিন্তু প্রবলভাবে রয়েছে হিব্রু আর আরব সৃষ্টিতত্ত্বে। তাদের গোপন চিন্তায় ঈশ্বর একটি নয়, দুটি; একটি শুভর, আরেকটি অশুভর।

শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে আদি পিতা হজরত আদমের কাল নির্ণীত হয়েছে মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ বছর থেকে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বছর। তাই আদম (আ.) থেকে মানবজাতির ক্রম দাঁড়ায়—

১. হজরত আদম আ. (Adam) খ্রি. পূ. ৪৯৪২-৫৮৭২

২. হজরত ইদ্রিছ আ. (Enoch) খ্রি. পূ. ৪১৮৮-৪৫৩৩

৩. হজরত নূহ আ. (Noah) খ্রি. পূ. ৩০৪৩-৩৯৯৩

৪. হজরত হুদ আ. (Haber) খ্রি. পূ. ২৩২০-২৪৫০

৫. হজরত সালেহ আ. (Methusela) খ্রি. পূ. ২০৮০ – ২১৫০

৬. হজরত ইব্রাহীম আ. (Abraham) খ্রি. পূ. ১৮২২–১৯৯৮

৭. হজরত লুত আ. (Lot) খ্রি. পূ. ১৮৭০-১৯৫০

৮. হজরত ইসমাইল আ. (Ismacl) খ্রি. পূ. ১৭৭৪-১৯১১

৯. হজরত ইসহাক আ. (Isaac ) খ্রি. পূ. ১৭১৭–১৮৯৭

১০. হজরত ইয়াকু আ. ( Jacob) খ্রি. পূ. ১৬৯০-১৮৩৭

১১. হজরত ইউসুফ আ. (Joseph) খ্রি. পূ. ১৬৩৫–১৭৪৫

১২. হজরত শোয়াইব আ. (Jethro) খ্রি. পূ. ১৪৯০-১৬০০

১৩. হজরত আইয়ুব আ. (Job) খ্রি. পূ. ১৪২০ – ১৫৪০

১৪. হজরত মুসা আ. ( Moses) খ্রি. পূ. ১৪০৭–১৫২৭

১৫. হজরত হারুন আ. (Aaron) খ্রি. পূ. ১৪০৮–১৫৩১

১৬. হজরত যুলকিফিল আ. (Ezekiel) খ্রি. পূ. ১৪২৫-১৫০০

১৭. হজরত দাউদ আ. (David) খ্রি. পূ. ৯৭১-১০৪৪

১৮. হজরত সোলায়মান আ. (Solomon) খ্রি. পূ. ৯৩১–৯৮৪

১৯. হজরত ইলিয়াস আ. (Elisha) খ্রি. পূ. ৮৫০–৯১০

২০. হজরত আল ইয়াসায়া আ. (Elijah) খ্রি. পূ. ৭৯৫–৮৮৫

২১. হজরত ইউনুছ আ. (Jonah) খ্রি. পূ. ৭৫০-৮২০

২২. হজরত যাকারিয়া আ. (Zechariah) খ্রি. পূ. ৩১-৯১

২৩. হজরত ইয়াহইয়া আ. (John) খ্রি. পূ. ৩১

২৪. হজরত ঈসা আ. (Jesus) খ্রি. পূ. ৩২

২৫. হজরত মুহম্মদ সা. (Mohamed) খ্রি, ৫৭০-৬৩২। [১]

হিন্দু মতে, হজরত নূহকে মনু (আদি পিতা) বলা হয়েছে। মনু থেকে মানব জাতির উদ্ভবও বলা হয়েছে (মনু > মানব)। এই মানব শব্দেরই বিবর্তিত আধুনিক রূপ মানুষ। মুসলিম মতে, আদমই[২] আদিপিতা। আর আদম থেকেই আদমি (মানে মানুষ) কথাটির উৎপত্তি। ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলমান মতেও নূহকে ‘দ্বিতীয় আদম’ বলা হয়েছে। মানে, তাঁর কালে যে মহাপ্লাবন হয়, অনুমিত হয়, তাতে পৃথিবীর জীবজন্তু ইত্যাদি এমনভাবে বিপর্যস্ত হয় যে, তার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকে না। তবে হজরত নূহ আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক জাহাজ তৈরি করে সৃষ্টি জগতের যে সামান্য নমুনা উদ্ধার করতে সমর্থ হন, তা থেকে নতুন সৃষ্টিজগতের পত্তন হয়। এই হিসেবে তাঁকে মানব জাতির আদি পিতা বলা হয়। হিন্দু পুরাণেও মনুরকালে মহাপ্লাবনের উল্লেখ আছে। বাইবেল-কুরআনে তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। এই মহাপ্লাবনকে বাইবেলে বলা হয়েছে তুফান (deluge)। সাম্প্রতিককালে কুরআন-বাইবেল বর্ণিত তথ্যের আলোকে দুজীপর্বত/আরারাত পর্বতমালার শীর্ষ থেকে এই কথিত নূহের জাহাজের ধ্বংশাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানটি বর্তমানে আর্মেনিয়া দেশের অন্তর্গত। কোন কোন নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, হজরত নূহের বংশধর ও উত্তর পুরুষগণ এই এলাকা থেকেই পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে এই নূহের বংশধরগণই বসবাস করছে। বর্তমান ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিসমূহ ও ভাষাগোষ্ঠীসমূহ এই নূহের উত্তরাধিকারী। যেমন : হাম, সাম, ইয়াপেচ/যেফত। এঁরা হজরত নূহের তিন পুত্র। এঁদেরই নামান্তর আর্যজাতি। বর্তমান ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশ হল— হিন্দুস্তানী আর্য; ইরান (পারস্য) ইরানীয় আর্য; মঙ্গোলিয়া (চিন) মঙ্গোলীয় আর্য; হাবসী—আফ্রিকীয় জাতি ইত্যাদি। সংক্ষেপে এদের ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি বলা হয় (Indo-European Race )। এদের ভাষাকেও বলা হয়— ইন্দো-ইউরোপীয়

ভাষাগোষ্ঠী। (Indo-European Language)। কাসাসুল আম্বিয়া (নবী কাহিনী) তে মঙ্গোলীয়দের বলা হয়েছে ‘ইয়াজুজ মাজুজ’। কোরআনে এদেরই আদি পিতা হজরত ইব্রাহীম নামে পরিচিত (আবীকুম ইব্রাহীম)। হজরত ইব্রাহীমের পুত্র ইসমাইল ও ইসহাকের বংশধর বনু ইসমাইল ও ইসরাইল গোষ্ঠীর উত্তর পুরুষরা বর্তমান বিশ্বে সংখ্যায় সর্বাধিক। উল্লেখ্য, জ্যেষ্ঠপুত্র ইসমাইলের বংশ হজরত মুহম্মদ (স.) (৫৭০-৬৩২ খ্রি.) আরব দেশে মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং বনু ইসরাইল বংশ মধ্যপ্রাচ্যে বায়তুল মুকাদ্দিসকে কেন্দ্র করে ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। এঁদেরই আদি পিতা হজরত মুসা। মুসার পরে দাউদ-সুলায়মান প্রভৃতি। আর কুরআনে ইব্রাহীম ও মুসার প্রতি সহীফা (কিতাব) নাজিল করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [‘ফী সুহূফে ইব্রাহীম ওয়া মুসা’]। মুসার পরে তাঁরই বংশে দাউদকে সাম কিতাব দেওয়া হয়েছে [Psalms of David]। নামান্তর যবুর কিতাব। উল্লেখ্য, ভারতীয় দ্বিতীয় বেদের নামও সাম অর্থ একই-গান (Psalms)। [সূত্র মুসলিম সুফিতত্ত্বে ‘সমাধান’]। উল্লেখ্য, দাউদের কিতাব যর মূল খ্রিষ্টীয় বাইবেল কিতাবের অন্তর্ভুক্ত (তৌরাত, যবুর ও ইঞ্জিল)। এগুলি একত্রে বাইবেল নামেই কথিত (Old and New Testament)। শুধু মুসার কিতাব তৌরাত : দাউদের কিতাব যবুর ও ঈসার কিতাব ইঞ্জিল নামে কথিত। ইব্রাহীমের কিতাবই মূলগ্রন্থ বেদ (ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব) নামে কথিত। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে সনাতন যুগে ব্রহ্মা, ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে এবং কলিতে বুদ্ধ ও কল্কীর আবির্ভাব ঘটে। এই চার যুগে দশজন অবতারের আগমন হয়। যথা—

‘মৎস কুর্মো বরাহশ্চ নরসিংহোহত বামনাঃ।
রামো রামশ্চ রামশ্চ বুদ্ধঃ কল্কি চ’।।

সামবেদের বীজমন্ত্ররূপে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর— সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তার নামের আদ্যাক্ষর যুক্তমন্ত্র সন্নিবেশিত হয়েছে— ‘ওঁ’ / ওম্ (womb)।

কে বলা হয়ে থাকে অক্ষরব্রহ্ম। সনাতন ধর্মানুসারিরা মঙ্গলকার্যে মন্ত্ৰ উচ্চারণ করতে এর ব্যবহার করে থাকেন। শুধু সনাতন ধর্মেই না, শিখ ধর্ম ও প্রতিষ্ঠিত ‘ইক ওমকার’ বা এক ওম (ওঁ)-এর ভিত্তিতে। বাহাই ধর্মেও রয়েছে আত্ম উদ্‌গত মনুষ্য মহিমাদীপ্তির অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা। ইংরেজিতে ‘omni’ শব্দটা কোন কিছুর বিশালতা, অসীমতা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়, সেটা ওই ওঁ থেকেই আগত। যেমন- omnipresent, omnipotent ইত্যাদি। ওঁ-এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বেদে এবং পরবর্তীকালে উপনিষদেও এর কথা বলা হয়েছে। যর্জুবেদের ২:১৩, ৪০:১৫, ৪০:১৭ এবং ঋগবেদ : ১:৩:৭ এ ওঁ-এর উল্লেখ আছে। মাণ্ডুক্য উপনিষদ কেবল ওঁ এর মাহত্ম্য বর্ণনাতে উৎসর্গ। (যোগ দর্শন ১:২৭-১:২৮) উচ্চারণের সময় এর তিনটি অংশ পাওয়া যায়—অ, উ, ম। যেখানে অ-বিরাট, অগ্নি এবং বিশ্ব; উ-হিরণ্যগর্ভ, বায়ু এবং তৈজস; ম-ঈশ্বর, আদিত্য এবং প্রাজ্ঞ বুঝায়। (দ্র. Mohammad Abdul Hye, Crescent and Lotus : The Sacred Meaning of Religious Symbols) ।

ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যা একাধারে ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযোজ্য। এই ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ওঁ-কার এমন এক শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, ভক্তবাঞ্ছাপূর্ণকারী, অজ্ঞাননাশক ও জ্ঞানপ্রদাতা। সর্বোপরি এটি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সংঘটনকারী ঈশ্বরের প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, তিনি সকল শব্দ মধ্যে ওঁ। Big Bang Theory অনুসারে মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে মহাবিস্ফোরণ হয়েছিল, String Theory অনুসারে এক ধরনের মৃদু শব্দ তথা নিম্ন কম্পাংকের অণুনাদের ফলে মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, আর বেদ অনুসারে ওঁ শব্দের প্রভাবে সাতটি মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।

সনাতন ধর্মের সূত্র অনুসারে বিশ্বের প্রত্যেক রাত্রি শেষে যখন দিনের সূচনা হয় তখন আংশিক সৃষ্টি শুরু হয়। বিশ্বের জীবনীতে মোট দিনের সংখ্যা ৩৬,০০০। মহাবিশ্বের একদিন = ৪,৩২,০০০০০০০ বছর। বিশ্বের দিন শেষে যখন রাত শুরু হয় তখন খণ্ড প্রলয় বা আংশিক ধ্বংস শুরু হয়। বিশ্ব সারা রাত ধ্বংস অবস্থায় থাকে খণ্ড প্রলয়ের সময় সম্পূর্ণ বিশ্ব ধ্বংস হয় না। বিশ্বের উপরের চারটি স্তর যেমন- সত্যঃলোক, তপঃলোক, জনঃলোক, মহঃলোক ধ্বংস হয় না, কিন্তু নিচের দশটি স্তরের গ্রহমণ্ডলী ধ্বংস হয়। সকল প্রাণির আত্মা ভগবান বিষ্ণুর কাছে ফিরে যায় এবং সমস্ত রাত সেখানে অবস্থান করে। বিশ্বের রাত (যা ৪৩২০ ০০০০০০ বছরের সমান) শেষ হলে পুনরায় বিশ্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহমণ্ডলীর সৃষ্টি শুরু হয় যাকে আংশিক পুনঃসৃষ্টি বলে।

বিশ্ব যখন সর্বোতভাবে ধ্বংস হয় অর্থাৎ বিশ্বের ১৪টি স্তর ধ্বংস হওয়ার পর সম্পূর্ণ পুনঃসৃষ্টি শুরু হয় অর্থাৎ মহাপ্রলয়ের পর। মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ জীবন ৩১,১০৪০০০০০০০০০০০ বছরের সমান। এই সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর মহাবিশ্ব সর্বোতভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যাকে মহাপ্রলয় বলে। এই সময় সকল প্রাণির আত্মা কৃষ্ণের ছায়ারূপ মহাবিষ্ণুর শরীরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তারা মহাবিশ্বের পুনঃসৃষ্টি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। ইসলামি পরিভাষায় এই সময়কালকে বলা হয়েছে ‘বরজখ’। যে সকল মানুষ ধর্মীয় জীবনযাপনের মাধ্যমে চিন্ময় জগতে যাওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছে তাদের আত্মা মহাবিষ্ণুর শরীর থেকে কৃষ্ণের শাশ্বত ধাম চিন্ময় জগতে প্রবেশ করে নিত্য জীবন লাভ করে আর যাদের জড় .জগত ভোগের বাসনা থাকে অর্থাৎ সঠিকভাবে ধর্মীয় জীবনযাপন করেননি- তাদের পরবর্তী সৃষ্টি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, যা ৩১,১০৪০০০০০০০০০০০ বছর পর আবার আরম্ভ হয়। আধুনিক মহাবিশ্ব (Cosmology) গবেষণাবিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তাঁরা এর নাম দিয়েছেন অসিলেটিং মহাবিশ্ব মডেল (Oscillating Universe Model)

সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ভূ-তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিবিদ রেভারেন্ড থমাস বারণে। ১৬৯১ খ্রি. প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Sacred Theory of Earth (পৃথিবীর পবিত্র তত্ত্ব) বইয়ে তিনি লেখেন পৃথিবীর ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও এর পরিবর্তনসমূহ ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ। ওপরদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানী ভূ-তত্ত্বের জনক চার্লস লায়েল তাঁর Principles of Geology গ্রন্থে ভূ-তত্ত্বের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণানির্ভর তথ্য ও বিশ্লেষণের প্রবর্তন করেন। ইতিপূর্বে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবের কারণে অধিকাংশ ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল পৃথিবী (বাইবেলে তথ্যানুযায়ী) মাত্র ৬০০০ বছর পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে। লায়েল তাঁর গ্রন্থে ভূ-স্তরের ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রমাণ করেন পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে আরও অনেক বছর আগে।

হিন্দুশাস্ত্রে সতী অঙ্গ থেকে একান্ন পীঠ[৩] উদ্ভবের ব্যাখ্যা আছে। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই তত্ত্ব সৃষ্টির পিছনে কাজ করে দুটি ক্ষেত্র— শিব ও শক্তি। শিব ও শক্তির একত্র প্রয়াসে সৃষ্ট হয় অনাহত নাদ। এই নাদ থেকে ধীরে ধীরে একান্নটি বর্ণের উদ্ভব হয়। হিন্দুশাস্ত্রে যাকে শব্দব্রহ্ম বলে চিহ্নিত করা হয়। সতীর একান্নটি পীঠ হল একান্নটি শব্দ ব্রহ্মের প্রতীক। (দ্র. Numeral Theology/সংখ্যাতাত্ত্বিক ধর্মতত্ত্ব)।

মানুষ যেন সমস্ত সৃষ্টিজগতের নির্যাস, মানুষের মাঝে তিনি মাধুর্যভজন করেন। তিনি প্রেমে উত্তাল হয়ে উঠেন এই মানবহৃদয়ে, আর কোথাও নয়। বিমূর্ত অনস্তিত্বতা থেকে তিনি ছন্দময় অবয়বে আসেন এই আদমসুরতেই। ছন্দের গীতাঞ্জলি হয়ে গলে পড়েন মানুষেরই হাতে। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর হৃদয় দিয়ে তিনি অন্যায় দণ্ডের যন্ত্রণা ভোগ করেন, সক্রেটিসের হাত দিয়ে হেমলক পান করে বেদনায় নীলকণ্ঠ হন, কুষ্ঠরোগীর হৃদয়পদ্মাসনে বসে বেদনার্ত ছন্দে বিগলিত হন তিনিই। লালন ফকিরের ভাষায়—

‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি এই মানুষের উত্তম কিছুই নাই
দেবদেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে।
এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন, তাইতে মানুষরূপ গড়লেন নিরঞ্জন’।

ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (Advent and spreading of Religions )

জগৎ ও জীবন কী, সৃষ্টি কী, মানুষ কোথা থেকে এল, কাল কী, সৃষ্টির পরিণতি কোথায় ইত্যাদি সব প্রশ্ন মানব মনের চিরন্তন জিজ্ঞাসা। যুগ যুগ ধরে মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছে কখনও কর্মকামী হয়ে কখনও দার্শনিক হয়ে, কখনও বা বিজ্ঞানী হয়ে। তবে বিজ্ঞানীর সত্যাসুন্ধান পদ্ধতি, আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক কিংবা ধর্মকামীর সন্ধান পদ্ধতি আলাদা। ধর্ম এক ধরনের দর্শন, তবে বিশ্বাসনির্ভর। ধর্মকামীরা মনে করেন, মানুষের পক্ষে পরম সত্যকে জানা কখনই সম্ভবপর নয়। তাঁদের বিশ্বাস, পৃথিবীতে যুগে যুগে পরম সত্যের বার্তাবাহী পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের বাণীই চিরন্তন, এবং চরম ও পরম সত্য। তাঁদের প্রদর্শিত পথই সত্যের পথ। দার্শনিকের সত্যসন্ধান যুক্তিনির্ভর। দার্শনিকরা মনে করেন, বিশুদ্ধ মননচর্চা এবং যুক্তিবাদের মাধ্যমেই প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া যায়।

ধর্মের সমাজবিজ্ঞানের সবচেয়ে চিন্তাশীল এবং চমৎপ্রদ বিষয়-ধর্মের উৎস। এর অর্থ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নয়, ‘ধর্ম কোথা থেকে এল’ বরং প্রশ্নটা হবে মানুষ কেন ধর্মপ্রবণ? যে কোন বিষয়ে তার উৎপত্তি ও উৎস নিয়ে প্রশ্ন করাটা আদি প্রবণতা। দার্শনিক এবং সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীদের এটাই প্রধান প্রথা। আইনস্টাইনের মতে, ‘জীবনের সর্বাপেক্ষা সুন্দর অভিজ্ঞতা হল রহস্যময়তা। এই রহস্যসময়তাই সত্যিকার চারুশিল্প এবং বিজ্ঞানের মূল আবেগ হিসেবে কাজ করে। যিনি এ সম্বন্ধে জানেন না, বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন না, আশ্চর্যান্বিত হন না, তিনি মৃতের সমান এবং তার চোখ দু’টি হয়ে যায় নিষ্প্রভ’।… আইনস্টাইনের মতে, ‘ভয়মিশ্রিত রহস্যময়তার অভিজ্ঞতা থেকেই ধর্মের সৃষ্টি। এ হল এমন কিছুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা যার অভ্যন্তরে আমরা প্রবেশ করতে পারি না। এক সুগভীর হেতু (reason) এবং প্রভাময় সৌন্দর্য সম্বন্ধে আমাদের উপলব্ধি যা কেবল তাদের প্রাথমিক অবস্থায় বোধগম্য নয়। এই জ্ঞান এবং অনুভূতিই প্রকৃত ধর্মের জন্ম দেয়’। (অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ধারণা ও মতামত)।

‘ধর্ম” শব্দটি সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ ‘ধারণ করা’। যার দ্বারা নিজের এবং অপরের জীবন ও সমৃদ্ধি বিধৃত হয়, তা-ই ধর্ম। ইংরেজি religion শব্দটি লাতিন ‘religare’ থেকে উদ্ভূত। যার প্রচলিত অর্থ সমাজের বন্ধনী। কিন্তু রোমক পণ্ডিত সিসিরো বলেন, ‘religare’ থেকে ‘religion’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। এই অর্থ ধর্ম মানে পুনরাহরণ, সংগ্রহ, চিন্তা ইত্যাদি। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতদের অনেকেই ধর্মের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তাঁদের ধর্মের অর্থ আরও ব্যাপক এবং গভীর। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক দার্শনিক পণ্ডিতেরা বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে ধর্মতত্ত্বকে অত্যন্ত জটিল এবং গভীর করে তুলেছেন। যেমন কান্ট বলেছেন, ‘religion is morality’; কিন্তু ফিক্তের মতে ‘Religion is Knowledge’, মাক্সমূলারের মতে ‘Religion is subjective faculty for the apprehension of mankind’। জন স্টুয়ার্ট মিলের ধর্ম সম্পর্কীয় ব্যাখ্যা আরও কটু ও ব্যাপক। তিনি বলেন, ‘The essence of religion is the strong and earnest direction of the emotions and desires. towards ideal object recognized as of the highest excellence and is regulfully paramount over all selfist objects of desires’ মার্কস আরও তিক্ত করে বলেছেন, ‘Religion is the sigh of the oppressed creature, the feelings of heartless world, just as it is the spirit of the unspiritual conditons. It is the opium of the people. ‘ (Deutsch- Franz. P. 57। আবার সীলির মতানুসারে ‘Religion is what may be described as habitual and permanent admiration’। অগুস্ত কোঁতে এর মতে, ‘Religion consists in regulations one’s individual nature and from the rallying point for all the separate individuals’। পাশ্চাত্ত্যের পণ্ডিতদের এভাবে ধর্ম সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। ভারতীয় পণ্ডিতেরা ধর্মকে একটি সামগ্রিক জীবনদর্শন বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রকারদের মতে মানুষের জীবনে যা কিছু আছে তা মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত : জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ। এই বিভাগ পাশ্চাত্ত্যের পণ্ডিতদের Thought Action এবং Feelingএর অনুরূপ। সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্ৰ (১৮৮৮- ১৯৬৯) তাঁর সত্যানুসরণ গ্রন্থে ধর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন এরকম : ‘যার ওপর যা কিছু সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধর্ম।’ আলোচনা প্রসঙ্গে অনুসারিদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন : ‘বাঁচা বাড়ার মর্ম যা, ধর্ম বলে জানিস তা।’ ধর্মদেশনায় তিনি being and becoming এর সপক্ষে। তাঁর মতে অপরের বাঁচা-বাড়ায় সহায়তা প্রদান করাই ধার্মিকের কাজ।

ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতেরা যে নানান মত প্রকাশ করেছেন তাকে মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা যায়:

১. টাইলর (E.B. Tylor) স্পেন্সার (Spencer) প্রমুখ গবেষকদের মতে সর্বপ্রাণবাদ থেকেই ধর্মের উদ্ভব। আদিম মানুষ বিশ্বের সবকিছুকেই নিজের মত জীবন্ত ও চেতনা-সম্পন্ন (animatism) বলে ভাবত। এরপর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে গড়ে ওঠে সবকিছুর মধ্যেই আত্মার অস্তিত্ব (animism) আবিষ্কার। এভাবে সর্বপ্রাণবাদের ফলে ধর্মের তিনটি অঙ্গ গড়ে ওঠে—ক. জীবন্ত ও মৃত প্রাণীর আত্মায় বিশ্বাস এবং মৃত ও পূর্বপুরুষদের পুজো; খ. দেহাতিরিক্ত আত্মায় বিশ্বাস; এবং গ. বস্তুর মধ্যে নিহিত আত্মায় বিশ্বাস ও তার পুজো। ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা আরম্ভ হয় মাত্র গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে টাইলর-এর ‘আদিম সংস্কৃতি’ (Primitive Culture) নামক গ্রন্থের মাধ্যমে। ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত এই গ্রন্থের দুটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য মতবাদ হয়— ১. ঈশ্বর প্রত্যাদেশবাদ (Theory of Revelation) এবং ২. অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ (deism)।

২. গোষ্ঠী বা দলে যেমন একজন প্রধান ব্যক্তি থাকে, আদিম মানুষও তেমনি বিশ্বের এক প্রধান ব্যক্তির কল্পনা করে নিত এবং এই ধারণা থেকেই ঈশ্বর ভাবনা আসে। স্মিডটের মতে, এই একেশ্বরবাদ গড়ে উঠেছিল culture complex থেকে; ফ্রেজার মনে করেন রাজার ধারণা থেকেই এর উৎপত্তি। কিন্তু মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে পরিবারপ্রধান পিতাই এই ধারণার উৎস। বাবা তার সন্তানকে ভাল কাজের জন্য পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য দণ্ড দেন; এই ধারণাই পুরস্কার শাস্তিদাতা ঈশ্বরকে কল্পনা করে।

৩. সমাজবিজ্ঞানী স্পেন্সারের মতে, পুর্বপুরুষদের মধ্যে যারা বীর ছিলেন, তারাই উত্তরসূরিদের কাছে দেবতা হিসেবে কল্পিত হন। এভাবে বিভিন্ন দেব-দেবী ও তাদের পুজোর প্রচলন হয়। অবশ্য এই সাথে ভূতের ভয়ও মিশ্রিত ছিল। এর নাম ম্যানিজম (manism)। অনেকটা এ- ধরনের মত fetishism যা চাঁদ-সূর্য-দিন-রাত-মানুষ সব কিছুকে আত্মা-সম্পন্ন বলে মনে করত এবং এদের কল্পনায় জীবত্ব আরোপ করা হয়। অবশ্য এই জীবত্ব আরোপের দুটি স্তর ছিল— প্রথম স্তরে দেব- দেবীর মূর্তিতে জন্তু-জানোয়ারের মুখ কল্পনা করা হত, পরবর্তী স্তরে কল্পিত হত মানুষের মুখ।

৪. স্যার জেমস ফ্রেজার (Sir James Frazer) তাঁর The Golden Bough (189০) বইতে লিখেছেন, আদিম মানুষ যখন জাদুবিদ্যা দিয়ে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, তখন সে ভাবল এমন এক শক্তি নিশ্চয়ই রয়েছে যাকে জাদু নয়, বরং প্রার্থনার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে হয়; এবং এভাবেই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে।

৫. স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক কারণেই মানুষের মধ্যেই ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে, এমন কথাও বহু পণ্ডিত বলেছেন। এই কারণটিকে কেউ বলেছেন ভয়, কেউবা ভূত-বিশ্বাস, কেউ মরমিয়া (mystic) অনুভূতি। মরমী দৃষ্টিতে ‘মানুষ’ শব্দের অর্থ মননশীল জীব। মানুষ যেদিন থেকে ‘মানুষ’ হয়েছে, চিন্তা করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই তার মনে প্রশ্ন জেগেছে;

৬. ‘আমি কে?’ ‘আমি কী?’ ‘আমি কেন?’ এই তিনটি প্রশ্নের মধ্য দিয়েই আবর্তিত হয়েছে মরমী জিজ্ঞাসার স্বরূপ। আবার প্রুস্ মনে করেন, আদিম মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভুল করে ভেবে বসে যে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরেও বিরাট এক শক্তি রয়েছে। ম্যাক্সমূলারের মতে, ভাষার ভুল প্রয়োগের (disease of language) ফলে জন্তু-মাটি-নদী ইত্যাদি জীবনলাভ করে, যেমন ‘নদী তীব্রবেগে বয়ে যাচ্ছে’ কিংবা ‘চাঁদ হাসছে’। এই ভাষাগত ভুলের ফলেই দেব-দেবীর উৎপত্তি হয়েছে মানুষের মনে।

৬. সমাজবিজ্ঞানী ডার্কহাইম (Emile Durkheim) মনে করেন যে আদিম মানুষ স্বগোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে একটিমাত্র টোটেম (totem) গ্রহণ করত গোষ্ঠীর সংহতি অটুট রাখতে। এই টোটেমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা থেকেই ক্রমশ ধর্মচিন্তা গড়ে ওঠে।

ধর্মের উৎপত্তির কারণ হিসেবে পণ্ডিতেরা সর্বপ্রাণবাদ, স্বাভাবিক মানসিকতা, এবং সামাজিক সংহতির কথা তুলে ধরেছেন আলাদা-আলাদাভাবে। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ফেটিশিজম্ মতটিই প্রবল ছিল, কিন্তু পরে এ-বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়ায় বর্তমানে সর্বপ্রাণবাদই সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি পেয়েছে। মাক্সমূলার, ফ্রয়েড, স্মিড্‌ট প্রমুখের মতবাদ পণ্ডিতমহলে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। অ- পণ্ডিত মহলের একাংশে যে চলতি ধারণা ছিল সেটি হল ভয় থেকে ধর্মের উৎপত্তি। কিন্তু এই ধারণাও পণ্ডিতদের কাছে স্বীকৃতি পায়নি।

টাইলরের সর্বপ্রাণবাদকে শেষ কথা বলে মেনে না নিয়ে বর্তমান শতাব্দীতেও বিভিন্ন গবেষক এগিয়ে আসেন। টাইলর-মর্গ্যান-ফ্রেজারের অনুমানভিত্তিক গবেষণার বদলে আদিম উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করে তথ্যসংগ্রহের ওপর জোর দিলেন মেলিনোওস্কি, র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন, রেমন্ড ফার্থ, লোয়ী প্রমুখ গবেষক। প্রথম তিনজন পণ্ডিত ধর্মের উৎপত্তির চেয়ে ধর্ম সমাজে কী ভূমিকা পালন করে সে-বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন; এবং লোয়ী তাঁর Primitive Religion বইয়ে বললেন যে অ্যানিমেটিজম্ ও অ্যানিমিজমের মধ্যে কোনটি আগে দেখা দিয়েছিল সে-কথা জোর করে বলা যায় না। তাঁর মতে, মানুষ যখন অজানা রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছে তখনই তার মনে অতীন্দ্রিয় শক্তির ধারণা জন্মেছে। সমাজে ধর্মচেতনা কীভাবে পরিবর্তিত হয় বা ধর্ম আজ ও কেন টিকে আছে, এ সম্বন্ধে বহু গবেষণা হলেও ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে ধর্মের উৎপত্তি তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। মেলিনোওস্কি, র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন, বেনেডিক্‌ট্ প্রমুখ পণ্ডিত ধর্মের কার্যকর ভূমিকা (function) এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ তত্ত্বের (disfusion theory) প্রয়োগে নতুন আলোক দিলেও টাইলরের মত বাতিল হয়ে যায়নি, বরং পরবর্তী গবেষণা ভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েও তাঁর মতকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছে।

ভারতীয় ঋষিরা মনে করেন মনুষ্য সমাজ ত্রিতাপ জ্বালা থেকে মুক্ত নয়। আধিভৌতিক, আধিদৈবিক এবং আধি আধ্যাত্মিক—এ ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধ মানুষ পরিত্রাণ প্রাপ্তির লক্ষ্যেই ধর্মের আশ্রয় নেয়। এখানেই সে প্রশান্তি লাভ করে।

তবে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান সাধারণভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে পার্থিব জীবনের অসম্পূর্ণতা এবং অসংখ্য দুর্বলতা, নিশ্চিত মৃত্যু ছাড়া জীবনের আর সব বিষয়েই অনিশ্চয়তা, এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে নিরাপত্তার অভাববোধ থেকেই মানুষের ধর্মচেতনার উদ্ভব হয়।

.

‘ধর্ম’ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘যা ধারণ করে,’ অর্থাৎ যা সমাজকে ধরে রাখে। নানা ধর্মীয় অনুশাসন, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও বিধিনিষেধগুলি সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানুষে মানুষে সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে সংবিধানের ভূমিকা ও আধুনিক রাষ্ট্রের আইনের ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি Religion কথাটি এর প্রায় সমার্থক হিসেবেই প্রচলিত হয়ে গেছে। এর অর্থ পুনরায় যুক্ত করা। লাতিন ‘religion’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ও religion এক নয়। ‘ধর্ম’ কথাটির মূল তাৎপর্য অনেক বেশি।

ধর্ম কী এবং ধর্ম কেন? এ সম্পর্কে জানার মানুষের কৌতূহল ছিল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। আদিম মানুষেরাও ধর্ম নিয়ে ভাবতেন। ধর্মের উৎপত্তির এক ক্রম-ইতিহাস রয়েছে। এ ক্রম-ইতিহাস নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্ব থেকে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্যার এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর (Tylor) তাঁর Primitive Culture নামক গ্রন্থে বলেছেন সর্বপ্রাণবাদই (animism) ধর্মের সবচেয়ে আদিম রূপ। এমিল ডার্কহাইম দেখিয়েছেন, টোটেমবাদ (totemism) থেকে পরে সৃষ্টি হয়েছে সর্বপ্রাণবাদ চিন্তাধারা।

ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশ্ন এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন ঈশ্বর ও আল্লাহ অথবা God এর প্রত্যাদেশ (Devine Revulation) থেকে ধর্মের উৎপত্তি। আবার কেউ বলছেন বিচারবুদ্ধি তথা প্রজ্ঞা থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। মায়েল এডওয়ার্ডস Miall Edwards), লর্ড হার্বাট (Lord Herbert), জন টলেন্ড (John Toland), লা ম্যাতারি (La Mettrie), ডি এলমবার্ট (D Alembert), ভলটেয়ার (Voltair) প্রমুখ ফরাসি এবং ইংরেজ দার্শনিক মানবীয় বিচার বুদ্ধি তথা প্রজ্ঞা থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে বলে মতপ্রকাশ করেন। ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ হল এ শ্রেণির ধর্ম। টাইলর (Tylor) বলেছেন : সর্বপ্রাণবাদ থেকে ধর্মের উৎপত্তি। হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer) বলেছেন : প্রেতবাদ (Ghost Theory) থেকে ধর্মের উৎপত্তি।

নৃতত্ত্ববিচারে ‘টোটেম’ প্রথাই (Totemism) পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। উত্তর আমেরিকার লোহিত ভারতীয়রা (Red Indian) এ প্রথাকে মান্য করতেন। কোন কোন লোকবিজ্ঞানীর মতে ‘ট্যাবু’ (Taboo) পদবাচ্য থেকে ধর্মের উৎপত্তি। টোটেম’ এবং ‘ট্যাবু’-এ দুটিরই মধ্যে শুচি, অশুচি এবং বিধি-নিষেধের বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়। অতএব নৃতত্ত্ববিদেরা আদি এ দুটি প্রথাকে ধর্ম-উৎপত্তির ক্ষেত্রে খুবই গ্রহণযোগ্য মতবাদ বলে মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন ‘ইন্দ্রজাল’ অথবা জাদু এ সকল ক্রিয়াকর্ম থেকে ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে।

আমরা জানি কালের চাহিদায় বেশ কয়েকজন ধর্ম প্রবর্তক পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। যেমন : গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিষ্ট/হজরত ঈসা (সা.), হজরত মুসা (স.), হজরত মুহম্মদ (স.) মানব কল্যাণে যে যতটুকু অর্জন করেছেন সেটা প্রচার করেছেন। ধর্ম মূলত একটি সার্বভৌম বিষয়। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, ধর্ম হল : এক. আত্মবিশ্বাস এবং কল্যাণ লাভের আগ্রহ : দুই. বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সত্যকে জানার পথ; তিন. মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহকে সংশ্লেষণাত্মক করা; চার. সকল উপাত্তগুলিকে (Data) পরমনীতির মাধ্যমে মূল্যায়ন; পাঁচ, পরম তত্ত্ব বা পরম সত্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভ করা।

মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এ পর্যন্ত যে সকল পয়গম্বরের নাম জানা যায়, বিস্ময়করভাবে তাদের সকলেরই জন্ম দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বাঙালি মুসলিম রমণী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩০)। নারীমুক্তি আন্দোলনের এ পথিকৃৎ প্ৰশ্ন রেখেছেন :

‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। কোন বিশেষ ধর্মের নিগূঢ় মর্ম বা আধ্যাত্মিক বিষয় আমার আলোচ্য নহে। ধর্মে যে সামাজিক আইন-কানুন বিধিবদ্ধ আছে, আমি কেবল তাহারই আলোচনা করিব, সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিত থাকুন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশ জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিম্বা ঈশ্বর-প্রেরিত দূত বলিয়া প্ৰকাশ করিয়াছেন। এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে, সেইরূপ পয়গম্বরদিগকে (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও এই বুদ্ধিমত্তায় দেখা যায়।’….

তবেই দেখিতে পাইতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রীলোকের সেরূপ যোগ্যতা কই যে, মুণি ঋষি হইতে পারিতেন? যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী-শাসনের নিমিত্তে প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া রমণী জাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে? ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকায় তাঁহার রাজত্ব ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু ত সকল দেশেই আছে, কেবল দূতগণ সর্বদেশময় ব্যাপ্ত হন নাই কেন?’ (‘স্ত্রী-জাতির অবনতি, ‘ রোকেয়া রচনাবলী, বাংলা একাডেমী)।

বলা হয়ে থাকে, নবীদের মাধ্যমে একশত চারখানা পবিত্র গ্রন্থ মানুষের জন্য সংবিধান করে পাঠানো হয়েছে; তার মধ্যে প্রধান গ্রন্থ চারখানা; তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল এবং কোরআন। যদিও এই মাত্র চারখানা ব্যতিত অন্য একশত পবিত্ৰ গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় নাই। এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয় প্রধান চারখানা পবিত্র গ্রন্থও প্রেরিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। দুটি মাত্র ভাষায়, ইবরানি ও আরবিতে— বলা হয়ে থাকে, আরবি আল্লাহর ভাষা—তাহলে দুনিয়া বলতে কি শুধু মধ্যপ্রাচ্যকে বোঝায়? মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীরাই কি কেবলমাত্র মানুষ জাতি? অন্যদিকে আরবি ব্যতিত মানবজাতির অপরাপর ভাষার স্রষ্টা কে? ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় নবী নেই কেন? এমনকি এশিয়াতেও মধ্যপ্রাচ্য ব্যতিত অন্য কোথাও নবীর জন্ম হয়নি কেন? আবার আমরা দেখি, যদি মুসলমানরা পথপ্রদর্শক হয়ে থাকেন তাহলে ভারতবর্ষেও অসংখ্য পথ প্রদর্শকের সন্ধান মেলে; আর পথপ্রদর্শক প্রণীত পথই যদি ধর্ম হয়ে থাকে তাহলে ভারতবর্ষেও ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে অনেক, রয়েছে পবিত্র গ্রন্থও। কিন্তু কেন? ভারতবর্ষে এ-সবের প্রয়োজন হয়েছে অথচ অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাতে কেন প্রয়োজন হয়নি? আমরা যদি মোটা দাগে পথ প্রদর্শক, তাদের ধর্ম ও পবিত্র গ্রন্থসমূহের সন্ধান করি তাহলে দেখতে পাব—

মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নিয়েছেন— মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী হজরত আদম, শিস, নূহ, ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, জরথ্রস্ত্র, মুসা, দাউদ, সোলাইমান, ঈসা, মহম্মদ, এবং বাহাউল্লাহ প্রমুখ। তাদের ধর্ম-হানিফ, পার্শি, ইহুদি, খ্রিষ্টান, সাবেইন, ইসলাম, বাহাই প্রভৃতি। ধর্মগ্রন্থ— তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল, কোরআন, কিতাবে আকদাস ইত্যাদি।

অপরদিকে ভারতবর্ষে আমরা দেখব জন্মগ্রহণ করেছেন— ভরত, শম্বর, কৃষ্ণ, রাম (হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী), মহাবীর, গৌতম, চৈতন্য, নানক, আউল চাঁদ, আকবর, রামমোহন, লালন প্রমুখ। তাদের ধর্ম-চক্র, হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শিখ, কর্তাভজা, দীন-ই-ইলাহী, ব্রাহ্ম প্রভৃতি এবং ধর্মগ্রন্থ—গীতা, বেদ, ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব ইত্যাদি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতীয় বৌদ্ধমতই বিস্তার লাভ করেছে মায়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মঙ্গোলিয়া হয়ে সুদূর জাপান পর্যন্ত; আর এরই মধ্যে বিলীন হয়েছে চীনের আদি চিন্তাধারা। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েতনামে উদ্ভূত হয়েছে কাও দাই (মহা শক্তির পথ) নামে একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। সম্প্রতি চীনে উদ্ভব ঘটেছে পালন কৃং ধর্ম। যদিও জাপানে জন্মলাভকারী গুরু শিনতোর দর্শন অবলম্বনকারীরা শিনতো ধর্মানুসারী হিসেবে সেখানে পরিগণিত হয়ে থাকেন।

ধর্ম কোন আপেক্ষিক বস্তু নয়। ধর্ম হচ্ছে বিশেষ কিছু সনাতনিক নিয়ম-যা স্বাভাবিক, যা সহজ-সরল যা মানবিক বৃত্তিকে গঠন করে। ধর্মের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে অধ্যাপক রাইট (Write) বলেছেন : Religion is the endevour to secure the conservation of socially reorganized values through specific action that are believed or from other merely human beings and that imply a feeling of dependence upon this agency। অর্থাৎ বিশেষ ধরনের ক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজ স্বীকৃত মূল্যের নিত্যতাকে লাভ করার প্রচেষ্টা হল ধর্ম, যে ক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির সাধারণ আত্মা এবং অন্যান্য নিছক মনুষ্যজাতীয় জীব থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তাকে আহ্বান করা হয় এবং যে ক্রিয়া ঐ সত্তার উপর নির্ভরতাবোধ সূচিত করে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে বিশ্বে প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম, জৈন, শিখ ও পারসিক ধর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মের অনুগামী সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বেও এসব ধর্মের অনুসারীরা যথেষ্ট পরিমাণে বসবাস করছে। এজন্য এ সকল ধর্মগুলিকে বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

অধ্যাপক টাইল (Tyle) ধর্মকে মূলত দুভাগে ভাগ করেছেন; এক. প্রাকৃত ধর্ম দুই. নৈতিক ধর্ম। অধ্যাপক গ্যালওয়ে আবার ধর্মকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দেখিয়েছেন : এক. উপজাতীয়, দুই জাতীয়, তিন. বিশ্বজনীন।

ধর্মের ঐতিহাসিক অধ্যয়নের বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। টাইলর, ফ্রেজার, ম্যাক্স ওয়েবার, ম্যাক্সমূলার, মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রমুখ ধর্মের সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ধর্মের যিনি প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত করেন তিনি গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রি. পূ. ৪৮৪-৪২৪)। এরপর ইউহেমেরাস (খ্রি. পূ. ৩৩০-২৬০), বেবিলনীয় ধর্মযাজক বেরোসাস (খ্রি. পূর্ব ২৮০), রোমান পণ্ডিত মরকাস টেরেনটিয়াস ভারো (খ্রি. পূর্ব. ১১৬-২৭), মারকাস টিলিয়াস সিসেরো (খ্রি. পূর্ব. ১০৬-৪৩), সম্রাট জুলিয়াস সিজার (খ্রি. ১০০-৪৪), মার্কো পোলো (১২৫৪-১৩২৩), রোজার বেকন (১২১৪-১২৯৪) প্রমুখ ধর্মের ইতিহাস নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তৎকালীন এশিয় পণ্ডিতেরাও তাদের ধর্ম নিয়ে অনেকে গবেষণা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। একজন বৌদ্ধ হিসেবে চীনা পরিব্রাজকরা ভারতীয় ধর্মসমূহের বর্ণনা দেন। এঁদের মধ্যে পঞ্চম শতাব্দীর ফা হিয়েন এবং সপ্তম শতাব্দীর হিউয়েন সাঙ্ স্মরণীয় হয়ে আছেন। এর কিছুকাল পর ঐতিহাসিক এবং ভূগোলবিদগণ জাতিগত বিবরণ সংগ্রহের জন্য এশিয় মহাদেশ পরিভ্রমণ করেন। বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি তারা প্রসিদ্ধ উপজাতিগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেন। তাবারী (৮২৮-৯২৩ খ্রি.) মাসুদী (মৃ. ৯৫৬ খ্রি.) এবং আল বেরুনী (৯৭৩-১০৫০), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.) তাঁদের অন্যতম।

ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ধারণায় নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত ব্যতীত ইতিহাসবিদ ও ধর্মীয় প্রবক্তাদের জীবনভিত্তিক চরিতগ্রন্থাবলির প্রভাবও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি নাম হজরত মহম্মদ (স.) এর প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাক (৭০৪-৭৬৮ খ্রি.)। আরবীয় ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক রচিত গ্রন্থটির আরবি নাম সিরাহ। এর প্রথম ইংরেজি সংস্করণের নাম Sirah or The Biography of the Prophet। ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম (মৃ. ৮৩৪ খ্রি.) The Biography of Muhammad নামে ইবনে ইসহাকের গ্রন্থটির সংশোধিত সংস্করণ বের করেন। বর্তমান বিশ্বে এটি সিরাত-এ ইবনে হিশাম নামে ব্যাপক পরিচিত। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এ. গুইল্লাউম ( A. Guillaume) The Life of Muhammad নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড রেহাটসেক (Edward Rehatsek ) The Life of Muhammad Apostle of Allah নামে বইটির আংশিক অনুবাদ করেন এবং মাইকেল এডওয়ার্ডসের (Michael Edwards) সম্পাদনায় তা মুদ্রিত হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাঁকে সৃষ্টি করা না হলে এই বিশ্ব প্রকৃতির কোন কিছুই সৃষ্টি করা হত না।’ তবে এই হাদিসের সত্যতা নিরঙ্কুশ নয়। ড. মাইকেল এইচ. হার্ট তাঁর The Hundred : A Ranking of the Most Influential Person in History গ্রন্থে হজরত মহম্মদ (স)কে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাবিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

.

বর্তমান অধ্যায়ে মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে যে সংক্ষিপ্ত উপাত্ত উপস্থাপিত হল তাতে একজন সন্ধিৎসু মনের চূড়ান্ত পরিতৃপ্তি প্রাপ্তি সম্ভব নয়। কেননা ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কিত ধারণা যেহেতু এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্বাসনির্ভর— প্রমাণপ্রতিষ্ঠিত নয়। তাই সন্ধিৎসু মানুষকে তাঁর সন্ধিৎসার অনুকূলে উত্তর পেতে হলে তাকে ততক্ষণ বিশ্বাসের কাছেই সমর্পিত থাকতে হবে। তাই এই সমর্পণ ও সন্ধিৎসু জিজ্ঞাসার সীমাবদ্ধতা যেদিন মানব-অন্তরে উত্তরণ ঘটবে— সেদিন হয়ত তার কাছে স্রষ্টা ও সৃষ্টি রহস্য আরো বেশি উন্মোচিত হবে। সেই উন্মোচনের আলোয় আগামী বিশ্বে ধর্ম কী রূপ নেবে এবং মানব-সমাজ কতটা মানবিক হবে— না সীমালঙ্ঘন করে বিলুপ্ত মানবতা ফিরে পেতে আবার নিঃশর্ত সমর্পণে ধর্মচেতনায়ই ফিরে যেতে বাধ্য হবে— তারই দশ দিগন্ত অনুসন্ধান করা হবে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে।

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

E. G. White, In the Beginning : Patriarch and Prophets, World’s Last Chance Prepare to Meet your God; United States of America, 2০০8

Charles Darwin, The Origin of Species by Means of Natural Selection, Murray, 1859.

John R. Hinnells (edited); The Penguin Hand Book of Living Religions, Penguin Books, London.

John R. Hinnells (edited); Penguin Dictionary of Religions; Penguin Books, London.

Karen Armstrong, A History of God; Ballantine Books, New York. পবিত্র বাইবেল (পুরাতন ও নুতন নিয়ম); বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা মোহাম্মদ সফিউল আলম, কোরানের আলোকে স্রষ্টা ও সৃষ্টি; ইসলামিক পাবলিকেশন্স লিঃ; চট্টগ্রাম, ১৯৭৭

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ধারণা ও মতামত (ভাষান্তর : অনিল দাস), নয়া প্রকাশ, কলকাতা ১৯৯৯।

এফ, এঙ্গেলস : এ্যান্টি ডুরিং (অনুবাদ : সরদার ফজলুল করিম), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫।

ফিওদর করোভনিক, পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচীন যুগ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো-১৯৮৬। মোঃ জাকারিয়া কামাল, কোরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে মানুষ ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, প্র. প্র. ১৯৯২

ড. সুকোমল বড়ুয়া ও সুমন কান্তি বড়ুয়া, ত্রিপিটক পরিচিতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০০

জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া, বৌদ্ধ ধর্মের কর্মবাদ বনাম সৃষ্টিরহস্য; কৃষ্টি সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, ২০০০

ভবানীপ্রসাদ সাহু, ধর্মের উৎস সন্ধানে; উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, ২০০১

ড. সৈয়দ কামাল আহমেদ, সৃষ্টির রহস্যে মানব; ফ্রেন্ডস বুক কর্নার, ঢাকা, ২০১৯

১. পবিত্র কোরআনেও পঁচিশজন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের উল্লেখ ধারা অনুযায়ী তাঁদের নামসমূহ নিম্নরূপ :

হজরত আদম (আ.), ২. হজরত ইদ্রিছ (আ.), ৩. হজরত নূহ (আ.) ৪. হজরত দাউদ (আ.), ৫. হজরত সুলাইমান (আ.), ৬. হজরত ইব্রাহীম (আ.), ৭. হজরত হুদ (আ.), ৮. হজরত ছালেহ (আ.) ৯. হজরত লুত (আ.) ১০. হজরত ইছহাক (আ.) ১১. হজরত ইয়াকুব (আ.), ১২. হজরত শোয়াইব, ১৩. হজরত ইউসুফ (আ.), ১৪. হজরত ইউনুছ (আ.) ১৫. হজরত আইয়ুব (আ.), ১৬. হজরত ইয়াহহিয়া (আ.), ১৭. হজরত জাকারিয়া (আ.), ১৮. হজরত ইলিয়াছ (আ.), ১৯. হজরত মুসা (আ.), ২০. হজরত হারুন (আ.), ২১. হজরত ইসমাঈল (আ.), ২২. হজরত সালেহ (আ.), ২৩. হজরত ঈসা (আ.), ২৪. হজরত জুলকি ফিল (আ.), এবং ২৫. হজরত মুহম্মদ (স.)। কোরআন-এ উল্লিখিত ১১৪টি সুরার মধ্যে মাত্র ৪টি সুরায় যথাক্রমে বাক্বারা, আনআম, শুয়ারা ও আ’রাফ উপরোক্ত নবীদের নাম উল্লিখিত হয়েছে।

২. ‘আদম’ শব্দটির উৎস হচ্ছে হিব্রু শব্দ ‘আদামা’, ‘আদামা’ অর্থ মৃত্তিকা। আদম শব্দটি ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলিম পরিশেষে মানব জাতির আদি পিতা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সে মতে শব্দটি নামবাচক। কিন্তু শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে নানা কথা চালু রয়েছে। তখন তা আর শুধু নামবাচক মনে হয় না। কারো মতে শব্দটি আরব, কারো মতে অনারব তথা হিব্রু। আদম শব্দের আভিধানিক অর্থ সভ্যতা। আরবি ছাড়াও হিব্রু, সুরিয়ানি প্রভৃতি ভাষায় আদম শব্দটি রয়েছে এবং এর অর্থ সভ্যতা।

৩. ভারত এবং বহির্ভারত মিলে দেবী পীঠের সংখ্যা ৫১টি। তন্মধ্যে বাংলাদেশে ৮টি, শ্রীলঙ্কায় ১টি, পাকিস্তানে ২টি, নেপালে ৩টি, তিব্বতে ১টি এবং এবং ভারতে ৩৬টি সর্বমোট একান্নটি। (বিস্তারিত পাঠের জন্য সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *