উত্তরণ – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
ওদের দোতলা আর তিনতলার সব আলো নিভে গিয়েছিল তখন। ঘরের দালানের সিঁড়ির। বেশ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছিল। এমন কি কৌশিকের দাদা কৌস্তুভের বেশী রাতে পড়াশোনার ভারী শেড দেওয়া টেবল ল্যাম্পের আলোর রেশটাও দেখা যাচ্ছিল না আর গ্যারেজের মাথার নীচু ঘরটার জানলা দিয়ে।
শুধু নীচের তলায় রান্নাঘরের আলোটা তখন জ্বলছিল তার স্বল্পশক্তি নিয়ে।
সব দিকের সব কাজ মিটিয়ে বংশী রান্নাঘর ধাওয়া মোছা করে রাখছিল আগামী সকালের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে। মাঝরাত পর্যন্ত না খেটে এখন উপায় নেই বংশীর। রান্নার লোকটা চলে গেছে কৌশিকদের, প্রায় মাসখানেক হতে চলল। বেচারা বংশীই এখন একমেবাদ্বিতীয়।
বাড়িতে আর কাজ করবার মত আছে কে?
সুলক্ষণা-কৌশিক কৌস্তুভ আর সুদক্ষিণার মা সুলক্ষণা, বিধবা হয়ে অবধি মাছ-মাংস ছোঁয়া ত্যাগ করেছেন, নিজের সামান্যতম রান্নাটুকু করে নেওয়া ছাড়া রান্নার দিকে আর কিছু হয় না তার দ্বারা।
সুদক্ষিণা তো আছে নিজেকে নিয়ে।
কলেজ, কোচিং ক্লাস, গানের স্কুল সব কিছু সামলে মরবার সময় নেই তার।
বাকী ওর বৌদি।
কৌস্তুভের স্ত্রী অপর্ণা।
ঘর-সংসারের বেশীটা দায়িত্ব যার নেবার কথা। তা যার যা দায়িত্ব নেবার কথা, সে যদি তা নিতে পারে, সংসারে তো সমস্যা বলে কিছুই থাকে না। কিন্তু সংসারে সমস্যা আছে, থাকে। এদের সংসারে আসল জায়গাতেই শূন্যতা।
অপর্ণা কোনদিন সুলক্ষণার ডান হাত হয়ে উঠতে পারল না। পারল না সংসারের কোন দায় ঘাড়ে নিতে। অপর্ণা চিররুগ্ন। বিছানায় পড়ে না থেকে অপর্ণা যেকদিন এঘর-ওঘর করে বেড়াতে পারে, শোবার ঘরে না খেয়ে খাবার ঘরে এসে খায় সে-কদিন এদের উৎসবের দিন।
অপর্ণা যদি কোনদিন কৌস্তুভের জামায় একটা বোম বসিয়ে দেয়, কৃতার্থ হয়ে যায় সংসার। অপর্ণা যদি একদিন চাদানী থেকে চা ঢালতে যায়, বাড়িসুষ্ঠু সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে তুমি কেন, তুমি কেন বলে। অপর্ণা যে বেঁচে আছে, এটাই যেন সংসার পাওনার অতিরিক্ত পাচ্ছে।
অতএব পুরনো চাকর বুড়ো বংশী ছাড়া আর কে? তাই সবাই যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি দেখি করছিল, বংশী তখন সকালের রসদ জোগাচ্ছিল।
রোজই তাই করে।
কিন্তু কই, কোনদিন তো আচমকা এমন আর্তনাদ করে ওঠে না বংশী! আর্তনাদটা যে অস্বাভাবিক, আর মাত্রা ছাড়ানোতাতে যে সন্দেহ নেই, তার প্রমাণ কৌশিকের ছুটে আসা। ঘুম সম্পর্কে কৌশিকের একটা বিশেষ সুনাম আছে, তা ছাড়া সে তিনতলায় শোয়। চিৎকারটা অতএব সেখানেও গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে।
দোতলার প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন।
ঘুমছোটা চোখ নিয়ে ওরা ছুটে এল দোতলা থেকে, তিনতলা থেকে অপর্ণাও ডাক্তারের নিষেধ ভুলে সিঁড়ি নামল। না নেমে থাকতে পারবে কেন?
কে বলতে পারে বংশীকে সাপে কামড়েছে, না ডাকাতে ছোরা মেরেছে!
কি!
কি!
কি হয়েছে!
একযোগে সকলের মুখ থেকে উচ্চারিত হল প্রশ্নটা। কিন্তু উত্তর শোনবার আর প্রয়োজন হল না। উত্তর ওরা দেখতে পেল সবাই।
সাপ নয়! ডাকাত নয়! চোর।
চোর পড়েছে বাড়িতে, এই নিশুতি রাতের সুযোগে। তবে ধরাও পড়েছে বংশীর কাছে।
.
বাড়িতে চোর পড়া এমন কিছু নতুন কথা নয়, চোর ধরা পড়াও খুব একটা অসম্ভব নয়। কিন্তু মেয়ে চোর ধরা পড়ার মত ঘটনা সচরাচর ঘটে না!
সেই অঘটন ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্য বরফ হয়ে গেল সকলেই। অবশ্য মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে উঠলেন, এই বংশী, ছিঃ!
সুলক্ষণার এই ধিক্কারে বোধকরি বংশীর চেতনা এল, নিজের প্রতি লক্ষ্য পড়ল, আর হুঁশ হল ওই কমবয়সী মেয়েটাকে সে একেবারে বাহুবন্ধনে বন্দী করে বুকে সাপটে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটার ক্রুদ্ধ ঝটপটানিতেও বন্ধন শিথিল করছে না।
বন্ধনটা শিথিল করে দিল বংশী।
এখন পৃষ্ঠবল আছে।
এখন ওই চোর মেয়েটার পালাবার পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে দুদুটো পুরুষ। অতএব এখন বংশী দায়িত্বমুক্ত। এখন মুখটাকে যতটা সম্ভব করুণ আর গলাটাকে যতটা সম্ভব বাষ্পচ্ছন্ন করা চলে। বংশীর পক্ষে ওই যতটা সম্ভব দুটো করে বংশী হাতের ওপর হাত বুলোত বুলোতে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, বংশীর তো সবই ছিঃ! আর হারামজাদা মেয়েটা যে আমার হাতখানা কামড়ে নিল কুকুরের মতন, তা তো কেউ
কামড়ে!
কামড়ে নিয়েছে।
বংশীর সেই বিকট আর্তনাদের রহস্য ভেদ হল।
সুলক্ষণা মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করলেন, সুদক্ষিণা প্রায় ধমকে উঠল, অসভ্যর মত খারাপ কথা বলিস না বংশী! আর কৌশিক ছাড়া পাওয়া প্রাণীটার দিকে একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে নিয়ে বলে উঠল, মানুষের দাঁতের বিষও বাঘ ভালুকের থেকে কিছু কম বিষাক্ত নয়রে বংশী। শীগগির চলে আয় আমার সঙ্গে, ডেটল লাগিয়ে নিবি।
.
ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা একবার চারিদিকে তাকিয়েছিল ছুটে পালাবার জন্যে, দেখেছে পথ বন্ধ। যেখান দিয়ে ঢুকেছিল, উঠোনের সেই ছোট দরজাটা, যেটা জঞ্জাল ফেলে এসে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে বংশী ওর খুবই সুবিধে করে দিয়েছিল, ঠিক তার সামনাসামনি দালানের দরজায় বংশীর বিশাল বপুখানি দেদীপ্যমান।
কাজেই চেষ্টা করা পাগলামি বুঝেই মেয়েটা ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌশিকের এই মন্তব্যে একবার চোখ তুলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিল।
কৌশিক মনে মনে বলল, ওঃ খুব যে তেজ। ভস্ম করে ফেলবে যেন। তবু যদি না ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে পরের বাড়িতে চুরি করতে আসতিস।
মনে মনে তুই বলতে দোষ নেই। ভাবল কৌশিক, সবাইকেই বলা চলে। আর এ তো চোর। না, বাংলায় এম. এ. হলেও চট করে চোরের স্ত্রীলিঙ্গ খুঁজে পেল না কৌশিক।
কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়ে ধরে নিল কেন তাকে এরা? একা কৌশিক নয়, সবাই। পুরোপুরি পাকা চোরের মত রাতের অন্ধকারে যে বাসন কাপড় চুরি করতে আসে, তাকে ভদ্রঘরের মেয়ে ভাবার হেতুটা কি? ওর মুখ চোখ ভঙ্গী?
তা ও-রকম মুখ চোখ কি এতই দুর্লভ? রঙ তো বেশ ময়লাই। একটু টিকলো নাক, একটু সুগঠিত ঠোঁট এ তো কত শাকওলি মাছওলিদেরও থাকে।
থাকে।
কিন্তু ওই বিশেষ ভঙ্গীটা তাদের থাকে না বোধ করি। তাই সকলেই মনে মনে ভাবল, ছি ছি, ভদ্রঘরের মেয়ে, এই বয়সের মেয়ে হয়ে কিনা এতটা অধঃপাতের পথে নেমেছে?
অধঃপাতের একটা পথ মেয়েমানুষের জন্যে চিরনির্দিষ্ট আছে, সভ্যতার আদিযুগ থেকে আছে। সে পথে রাজা মন্ত্রীর ঘরের মেয়েকে দেখলেও কেউ অবাক হয় না, ভট্টচার্যির ঘরের মেয়েকে দেখলেও বিচলিত হয় না। জানে, এমন হয়েই থাকে।
কিন্তু এ যে অধঃপাতের অন্য আর একটা শাখা-পথ। এটা তো পুরুষের জন্যেই একচেটিয়া ছিল। তাই এ পথে ওকে দেখে সকলেই অবাক হচ্ছে, বিচলিত হচ্ছে।
.
কৌশিক ডেকেছিল, কিন্তু বংশী নড়ার নাম করেনি। কৌশিক আবার একটা কড়া কটাক্ষ করে তাড়া দেয় বংশীকে, এই বংশী, মরতে না চাস তো চটপট আয়। বিষ শরীরে চারিয়ে গেলে–
শরীরে বিষ চারিয়ে যাবার ভয়ঙ্কর ভয় সত্ত্বেও বংশী নির্বিকার কণ্ঠে বলে, সে যাক! এই সর্বনাশী মেয়েটা যাতে না হাওয়া হয়, সেটা দেখতে হবে তো?
হাওয়া হবে? সুলক্ষণা এবার কথা কন, আমার চোখের সামনে থেকে যদি হাওয়া হতে পারে তো সেই বাহাদুরির জন্যেই সাত খুন মাপ হওয়া উচিত ওর। দেখছি আমি ওকে। যা, তোরা শুতে যা।
শুতে যাব? আমরা শুতে যাব? সুদক্ষিণা ঠিকরে ওঠে, পুলিসে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না ওকে?
পুলিসে? সুলক্ষণা হাসেন, তবে তাই কর তোরা, আমিই নিশ্চিন্দি হয়ে শুতে যাই।
পুলিসে দেওয়া হবে না? বংশী ক্ষেপে.ওঠে, পুলিস এসে ওর ওই দাঁতের পাটি যদি না ভাঙল তো হলটা কি?
হল আর কি-কৌশিক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে বলে, তোমার রক্ত বিষিয়ে মৃত্যু, আর মার অপাত্রে দয়া প্রদর্শন। থানা পুলিসের কথা চিন্তা না করে তোর এখন হাসপাতালের কথা চিন্তা করা উচিত বংশী, কিন্তু নইলে বলা যায় না, হয়তো অদৃষ্টে তোর মৃত্যু আছে।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।
হ্যাঁ, তা কাণ্ডই বৈকি। এমন অপ্রত্যাশিত ব্যাপার কে আশা করেছিল? ঘাড়গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা আসামী হঠাৎ মুখ তুলে বলে ওঠে, মানুষের দাঁতেই যে শুধু বিষ থাকে তা নয়, দেখছি। জিভেও কম বিষ থাকে না!
এ কী দুঃসাহস!
যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর প্রত্যেকেই কী যেন একটা বলতে গেল, আর কাউকেই কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে সুলক্ষণা ঈষৎ কঠিন সুরে বলে উঠলেন, বৃথা কথা বাড়াচ্ছিস কেন তোরা? তুচ্ছ একটা কারণে বাড়িসুষ্ঠু সবাই রাত জেগে রথ দোলের ভিড় করবি নাকি? বৌমা, তুমি আবার নেমে এসেছ কেন বাছা? এক্ষুনি হয়তো বুকের কষ্ট হবে। যাও যাও, শুয়ে পড়গে! খোকা, যা বৌমাকে ধরে ধরে নিয়ে যা সাবধানে।
কৌস্তুভকে সুলক্ষণা খোকাই বলেন চিরকাল। যদিও তিনি মুখে বলেন, খোকা না বলে ওকে আমার জ্যেঠামশাই বললেই ভাল মানায়।
বাস্তবিক ভারী ধীর স্থির গম্ভীর আর বিজ্ঞ সুলক্ষণার এই বড়ছেলে।
তবে– আড়ালে সুদক্ষিণা বলে, একটু যা স্ত্রৈণ।
সুলক্ষণা মেয়ের এই বাঁচালতায় তাড়া দেন। বলেন, ফাজলামির মাত্রা রাখতে হয় ক্ষে। স্ত্রৈণই যদি হয় তো, সে তোদের দাদা সাধে হয়নি। ওই বৌকে রাতদিন আঙুরের বাক্সয় তুলো পেতে না রাখলে? খোকার অতটা যত্ন আছে বলেই না বৌমা তবু একটু হেঁটে নড়ে বেড়ায়। তা নইলে বিছানায় পিঠে এক হয়ে ছাতা ধরত।
সুলক্ষণার এ মন্তব্য বাহুল্য আদৌ নয়। সত্যিই এতটা যত্ন চিকিৎসা না পেলে, অপর্ণার শরীরের অবস্থা কী হত বলা শক্ত। কিন্তু অপর্ণা প্রয়োজনের দশগুণ বেশী যত্ন আদর পায়, সেবা চিকিৎসা পায়। একা স্বামীর কাছেই নয়, সবাইয়ের কাছেই পায়। ছেলের মধ্যে ঔদাসীন্যের নামমাত্র নেই, তবু সুলক্ষণা বলেন, অ খোকা, বৌমা ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি তো? ঘুম ভেঙে একলা রয়েছে হয়তো বলেন, অ খোকা, ডাক্তারবাবু যেন কদিন আসেননি মনে হচ্ছে? খবর দিল একবার।
কৌশিক শুনতে পেলে হাতজোড় করে বলে, মাগো দোহাই তোমার, সেই যে কি বলে, মা মনসায় ধুনোর গন্ধ না কি, সেটা আর অত দিও না তুমি! ভদ্রমহিলাকে দুএকটা দিনও একটু সুস্থ থাকতে দাও।
সুলক্ষণা মৃদু হেসে বলেন, কিসে সুস্থ থাকে, আর কিসে সুস্থ থাকে না, তুই জানিস ভূতটা?
কিন্তু সুলক্ষণাই কি সবটা জানেন?
কই, উনি তো বুঝতে পারলেন না, এখন অপর্ণার আদৌ এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না। খুব ইচ্ছে করছিল ওই চোর মেয়েটাকে কী প্রকার শাসন করা হয়, তাই দেখতে!
বুঝতে পারলেন না, তাই বললেন, খোকা, ওকে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে যা।
চোখের কোণায় এক ঝলক জল এসে পড়ল অপর্ণার, অভিমানে না অপমানে কে জানে, তবু নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি উঠতে লাগল এক পা এক পা করে।
কৌস্তুভও সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল তার পিঠে হাতটা ঠেকিয়ে। শুধু যাবার সময় মাকে উদ্দেশ করে বলল, তুমিও বেশী কষ্ট পেও না মা, যা পারে বংশী করুক।
যা পারে বংশী করুক।
তার মানে? মেয়েটাকে ধরে মারুক বংশী, না কি? বংশী ওর বেশী আর কি, ও ছাড়া আর কি পারবে? দু ঘা মেরে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া?
সুদক্ষিণা কুদ্ধস্বরে বলে ওঠে, হয়ে গেল বাড়ির কর্তার রায় দেওয়া! এবার কর্তার মা কি বলেন দেখি! চোর ধরা পড়লে পুলিস ডাকে না, এমন বাড়িও যে থাকে তা এই আজ দেখছি!
তোরা যাবি?
সুলক্ষণা প্রায় ধমকে ওঠেন, মশা মারতে কামান দাগার প্রবাদটা যে তোরা সত্যি করে তুললি দেখছি!
মশা! সুদক্ষিণা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, এই সব মশামারি পিছনে কত কত বাঘ সিংহীর গ্যাং থাকে জানো তুমি?
সুলক্ষণা যেন মেয়ের এই রাগের বহরে কৌতুক অনুভব করেন। সেই কৌতুকের স্বরেই বলেন, কি করে জানব বল, তোদের মতন তো রাতদিন ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ছি না। আমার বুদ্ধিতে যা কুলোয় তাই করব।
চলে আয় ক্ষেণু, কৌশিক বড় একটা মোচড় দিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে, পরিণতি বুঝতেই পারছি। স্রেফ সদর দরজাটি খুলে সসম্মানে বিদায় দেওয়া। আহা উঠোনের ওই শ্যাওলার ওপর দিয়ে কত শ্রম স্বীকার করে এসেছেন মহিলাটি, তা তার আগে বোধ হয় অতিথি সৎকার পর্বটাও ভালই হয়ে যাবে। চল, চল! মা আমাদের উপস্থিতিতে মিটসেটা খুলতে পারছেন না। সকালের জন্যে তোমার কি মজুত আছে মা? রাজভোগ? চমচম্? কেক? ডালমুট?
সুলক্ষণা হেসে ফেলে বলেন, তুই যাবি?
এই তো চলে গেছি।
সুদক্ষিণাও যায়, কিন্তু ওদের মত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে না। সিঁড়ির ওপরকার ল্যান্ডিঙে বসে থাকে কোণ ঘেঁষে। যাতে নীচের তলার কথাবার্তা শোনা যায়।
কিন্তু সুলক্ষণা হচ্ছেন সুদক্ষিণার মা। বুদ্ধিতে ওর চেয়ে তিনি কাঁচা হবেন এমন আশা নিশ্চয়ই করা যায় না। তাই মেয়েটার হাত চেপে ধরে সরে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দৃঢ়স্বরে উনি বলেন, নাম কি তোর?
.
নাম কি তোর!
পাকা বুদ্ধি সুলক্ষণা কি আশা করছেন জিগ্যেসমাত্র উত্তর দেবে সে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, বাপ কি করে, বংশপরিচয় কি রকম!
না, তা হয়তো আশা করেননি, তবু কথার মাত্রা হিসেবেই প্রশ্ন করেন, নাম কি তোর?
মেয়েটা জ্বালাভরা চোখ দুটো তুলে, রূঢ় গলায় উত্তর দেয়, নামের কি দরকার আপনার? পুলিসে দেবেন তো দিন, চাকর দিয়ে মার খাওয়াতে হয় তো তাই মারুন।
এতক্ষণে সুলক্ষণার মুখে রাগের ছাপ পড়ে।
গলায় বিরক্তির সুর ফোটে।
বলেন, দেখে তো অন্তত একটু ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল, কথাবার্তা তো তেমন নয়? শুধু চোরই নয়, ভারী অসভ্যও দেখছি।
মেয়েটা কিন্তু এ ধিক্কারেও বিশেষ দমে না, তেমনি গলাতেই বলে, চুরি করতে এসেছি, তবু ভদ্রঘরের মেয়েই বা আমায় ভাবছেন কেন?
ভাবছিলাম তোর চেহারা দেখে। চুরি অমন অনেকেই করে অভাবে পড়ে। ভিক্ষে করতে বাধলে চুরি করে বসে। কিন্তু কথাবার্তায় কিছুটা সভ্যতা রাখ। নাম কি বল্? চুরি করবার মতন এমন কি তোর অভাব পড়ল ব? পেছনে বাঘ সিংহীর দল আছে কিনা তাও বল্।
মেয়েটা এবার রূঢ়তা ছেড়ে বিদ্রূপ ধরে।
অতবড় মানুষটা বলে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না, বলে ওঠে, কেন, ভুলিয়ে-ভালিয়ে দলের নাম বার করে নিয়ে তবে আমায় পুলিসে দেবেন?
সুলক্ষণা নির্নিমেষনেত্রে ওর মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে বলেন, আমার বড় বড় ছেলেরা পর্যন্ত আমায় কত ভয় করে, জানিস?
জানতাম না। দেখলাম।
তবে? তুই আমার বাড়িতে চুরি করতে এসে আমায় অগ্রাহ্য করবি? বাড়ির নিয়ম উলটে দিবি? আমায় ওদের কাছে খেলো করবি? নাম বল্।
মেয়েটা এবার হঠাৎ মাথাটা হেঁট করে।
তারপর ঈষৎ ভাঙা গলায় বলে, চৈতালী!
চৈতালী? ও বাবা, এ যে একেবারে কবিতার পাতা থেকে ঝরে পড়ল! এবার বিদ্রুপের পালা সুলক্ষণার, এত বাহারি নামটি কে রেখেছিল? নাম যে রেখেছিল, সে বুঝি নামকরণ করেই মরে গিয়েছিল? তাই তারপর নামের আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারেনি?
মেয়েটা ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, ঠিকই বলেছেন। শুনতে পাই জন্মাবার আগেই মা নামকরণটা করে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, চৈত্র মাসে জন্মাবে, ছেলে হলে নাম রাখবো চৈৎ সিং, মেয়ে হলে চৈতালী! তা মেয়ে কি ছেলে, সে আর নাকি বুঝেও যাননি। অজ্ঞানের মধ্যেই
সুলক্ষণা একটু থতমত খান।
নেহাতই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যে প্রশ্নটা করেছিলেন, তার এমন একটা উত্তর পাবেন ভাবেননি। এবার একটু শান্ত কোমল স্বরে বলেন, তোর সব পরিচয় আমায় খুলে বল্ দিকি? শুনি কার প্ররোচনায় পড়ে এই বয়সে
বংশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হতাশ-চোখে দুই হাতের তেলো উলটে পরমহংসের ভঙ্গী করে বোধ করি বাকী কাজ সারতেই চলে যায়।
অপর্ণা শোবার ঘরে গিয়ে খাট পর্যন্ত না এগিয়ে দরজার সামনে রাখা সরু ডিভ্যানটায় বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আশ্চর্য, সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে চলে এলে তোমরা!
কৌস্তুভ ব্যস্ত হয়ে পাখার রেগুলেটারটা ঠেলে দিয়ে, আর স্ত্রীর হাতের কাছে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলে, পরে কথা বোলো, আগে একটু সুস্থ হয়ে নাও।
অগত্যা জল খেয়ে আর পাখা খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে অপর্ণা বলে, কি করে যে ওকে একা মার কাছে রেখে চলে এলে
বংশী তো রয়েছে।
বংশী তো ভারী! বুড়ো একটা! আর একটু হাঁপিয়ে নিয়ে অপর্ণা বলে, যদি কোথাও ছোরা লুকনো থাকে? যদি বাইরে ওর দল থাকে? ভেবে ভয়ে আমার বুকের মধ্যে কি রকম যেন করছে।
কৌস্তুভ ওর ভয় নিরাকরণের জন্যে নীচে নেমে যায় না, বুকে হাত বুলিয়ে বুকেরই চিকিৎসা করতে থাকে।
.
সুদক্ষিণা বসে থেকে থেকে খানিক পরে বিরক্ত হয়ে উঠে এসে তিনতলায় গিয়ে বলে, ছোড়দা ঘুমোলি?
নাক ডাকাচ্ছি।
মার এই অসমসাহসিকতার অর্থ কি বলতে পারিস?
কে জানে বাবা! পূর্বকালের কোন সইয়ের কি গঙ্গাজলের মেয়ে কিনা তাই বা কে জানে? দেখে মনে হল অনেক দিনের অদেখা বোনঝি পেলেন বুঝি একটি!
থাম! ঘটনাস্থলে যাই চল্। …
পাগল হয়েছিস? এই তিনতলায় উঠে এসে আরামে শুয়ে পড়ে, আবার?
তা তো বলবিই তুই, কুম্ভকর্ণের অবতার! যদি ওর সঙ্গে ছোরা-টোরা কিছু থাকে?
থাকে শ্রীমতী সুলক্ষণা দেবীর বুকে বিদ্ধ করে পালিয়ে যাবে। আমরা তিনটি অনাথ শিশু মাতৃহীন হব, কাগজে এই লোমহর্ষক হত্যাকাহিনী ছাপা হবে
আঃ ছোড়দা! ন্যাকামি করিস না, চল বলছি।
ইচ্ছে হয় তুই যা না! আমি গিয়ে শেষে বংশীর মতন কামড় খাই আর কি!
আর আমি মার বারণ না শুনে আবার নীচে নামলে ওই বিচ্ছিরীটার সামনে মার কাছে ধমক খাই যদি? তুই সঙ্গে থাকলে তবু একটু বুকের বল–
কৌশিক বালিশটা উলটে-পালটে ঘাড়ের তলায় জুত করে গুঁজে দিয়ে বলে, কেন ফ্যাচফ্যাচ করছিস? দেখলি না একটা ভদ্রলোকের ঘরের সাধারণ মেয়ে। ডাকাতও নয়, গুণ্ডাও নয়। হয়তো নেহাতই অভাবের জ্বালায়, না হয় তো কারুর প্ররোচনার ঠেলায় মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
উঃ! একেবারে গণকার!
আচ্ছা দেখিস, শেষ পর্যন্ত আমার গণনা সত্যি হয় কি না।
তা কৌশিকের গণনা অনেকটাই সত্যি।
সুলক্ষণারও।
যতই জীর্ণ বিবর্ণ শাড়ী হোক, তবু চৈতালীর সে শাড়ী স্কুল কলেজের মেয়েদের মত ঘুরিয়ে পরা, যতই রুক্ষ জট-পাকানো চুল হোক তবু সে চুল দুটো বেণী করে দু কাঁধে ফেলা, আর যতই শীর্ণ হোক, তবু মুখে একটা বুদ্ধিমার্জিত লাবণ্য। এ মেয়ে অনেক দিনের পাকা অপরাধী নয়, এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন সুলক্ষণা। কেন কে জানে, যে মেয়েটা রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল, আর তার নিজেরই ব্যবহারের রুপোর গ্লাসটা আর বাটি দুটো নিয়ে পালাচ্ছিল, তার ওপর কেমন একটা মমতা অনুভব করছিলেন সুলক্ষণা। তাই ওর কথার মাঝখানে সত্যিই মিষ্টি খেতে দিয়ে জল দিলেন ওকে। ঈষৎ হেসে বললেন, ভয় নেই, বিষের নাড় নয়। খা, খেয়ে বাকী কথা বল্।…মাসীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসে তোর উচ্ছন্ন-যাওয়া বাপটা যখন তোকে তার আড্ডায় এনে ফেলল, তখন কত বয়েস তোর?
আট!
তা বলি উচ্ছন্ন তো গেছল সে, সুলক্ষণা সহসা স্বর কঠোর করে বলেন, চোর-ছ্যাচোড়দের দলে এনে ফেলে সবদিকে নষ্ট করেনি তো তোকে? মেয়ে বেচে খায়, এমন লোকেরও তো অভাব নেই জগতে? সেইটাই জিজ্ঞেস করছি।
চৈতালী মুখ তুলে পরিষ্কার চোখে স্থির গলায় বলে, না, বরং বাঘের মত আগলে রাখে।
আর এই যে রাতদুপুরে ছেড়ে দিয়েছে?
চৈতালীর এতক্ষণকার শুকনো চোখ দুটো এই তুচ্ছ কথায় সহসা জলে ভরে যায়। মাথা নীচু করে আস্তে বলে, বাড়িতে নেই, হাসপাতালে আছে।
হাসপাতালে!
হ্যাঁ, খুব অসুখ। দলের একজনের সঙ্গে ঝগড়া করে মাথা ফাটিয়েছিল, ধরা পড়বার ভয়ে ডাক্তার দেখায়নি, তারপর বিষিয়ে গিয়ে
সুলক্ষণা একটু চুপ করে থেকে বলেন, নাম কি বাপের?
তা বলতে পারবো না।
বলতে পারবি না? ধরা পড়ার ভয়? আর ওই যে হাসপাতালে গেছে?
অন্য নামে। দলের লোকেরা অন্য নাম দিয়ে ভর্তি করে দিয়ে এসেছে। এখন বলছে ইজেকশন দিতে হলে বাড়ি থেকে খরচা দিতে হবে!
সুলক্ষণা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, তাই বুঝি খরচ জোগাড় করতে বেরিয়েছিলি?
চৈতালী চুপ করে থাকে!
তা আসল নাম না হয় না বললি, কোন্ নামে কোন্ হাসপাতালে আছে তা বলবি তো?
না, না! চৈতালীর মুখে ফুটে ওঠে একটা অসহায় আতঙ্ক, ওরা যদি দেখে আর কেউ খোঁজ করছে, মেরে ফেলবে আমাকে।
হু! সুলক্ষণা আর একবার একটু চুপ করে থেকে বলেন, কিন্তু এখন আছিস কোথায়? বাপ তত বাঘের মত আগলে রাখত–
চৈতালী মাথা নীচু করে বলে, সেই তো কষ্ট!
আমার কাছে থাকবি?
চৈতালী চমকে চেয়ে বলে, কি?
বলছি আমার কাছে থাকবি?
কী বলছেন? আপনি কি পাগল?
কেন রে, পাগলের কি দেখলি? চুরি করে খাওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া কিছু খারাপ? অমনি তো খেতে দেব না তোকে, কাজ করিয়ে নেব। রান্নাবান্না জানিস নিশ্চয়ই!
একটা চোরকে বাড়িতে পুষতে সাহস হবে আপনার? আমি যা কিছু বলেছি, সে সব যে বানানো গল্প নয়, তাই বা কি করে বুঝছেন আপনি?
সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, সে আর বুঝবো কি করে ব! সংসারে অসুবিধেয় পড়লে যে রাস্তা থেকে লোক ধরে রাখতে হয়, কে তাদের গ্যারান্টি হচ্ছে? আর গল্প বানানোর কথা বলছিস? তা আমার নিজের ছেলেই যদি বাইরে থেকে ঘুরে এসে গল্প বানিয়ে বলে, ধরতে পারব? তবে? তা হলে তো পৃথিবীতে সদা সশঙ্কিত হয়েই বাস করতে হয়। তার চেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেললেই ল্যাঠা চুকে গেল।
চৈতালীর জীবনে চৈতালী এমন কথা কখনো শুনেছে? মানুষকে অবিশ্বাস করতে হয় তাই জানে সে।
চৈতালী হঠাৎ সুলক্ষণার পায়ের কাছে নীচু হয়ে প্রণাম করে গাঢ় স্বরে বলে, মা!
মা নয়, মা নয়, সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, মাসীমা। আমার ওই ছোট ছেলেমেয়ে দুটো বেজায় হিংসুটে, মা বলতে শুনলে হিংসেয় সারা হবে।
তারপর তিনিও ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলেন, দেখ, আমি শুধু ভগবানের নাম স্মরণ করেই এই দুঃসাহস করতে চাইছি। হয়তো এর জন্যে সংসারে আমায় কিছু লড়তে হবে। দেখি কি হয়? তবে মনে রাখিস, তোর ভগবানও তাকে সুযোগ দিচ্ছেন। খারাপ হতে এক মিনিটও লাগে না, ভাল হতে অনেক সময় দরকার। সে সময় আমি তোকে দেব। দেখব আমার অঙ্ককষা ভুল হল, না ঠিক হল। আজ তোকে আটকাব না, যদি ইচ্ছে হয়, যদি ভয়ঙ্কর কোন কুগ্রহ তোর বাধা না হয়, আসবি আমার কাছে
চৈতালী ব্যাকুল স্বরে বলে, আমি আজ থেকেই থাকব। যাব না।
থাকবি? তা থাক তবে!
.
হ্যাঁ, থেকেই যায় চৈতালী।
দেখবে ভগবান তাকে সুযোগ দিলেন, না দুর্যোগ দিলেন। বাপ তো হাসপাতালে, নিতাই নামক সেই লোকটা, যাকে চৈতালী বাবার বন্ধু হিসাবে নিতাই কাকা বলে এবং মনে মনে জানে সে তার বাবার পরম শত্রু–সেই তার বাবাকে উচ্ছন্নে দেবার গুরু–সেই নোকটা কাল এসে বলেছে, ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা সংকটজনক, তবে খরচা দিলে ইনজেকশন আর রক্ত দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারে।
চৈতালী ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, তা কর সে সব?
নিতাই পরম অবহেলায় বলেছিল, কোথা থেকে? হাসপাতালে যাবার সময় কি তোর বাবা আমার হাতে একমোট টাকা দিয়ে গেছে?
চৈতালীও অবশ্য এমন কিছু নরম শান্ত মেয়ে নয়।
সেই আট-দশ বছর বয়েস থেকে বাবার ব্যবসার মাল এহাত-ওহাত চালান করে করে পোক্ত হয়েছে, আর রাতদিন বাড়িতে যে নানাবিধ লোকের আমদানী হয়েছে, তাদের আড্ডা শুনে, তর্কাতর্কি শুনে, আর তাদের জন্যে চা বানিয়ে হাতে কড়া পড়িয়েছে।
কাজে কাজেই কথাও তার কড়া কড়া।
সেই কড়া সুর আর কড়া ভাষায় প্রশ্ন করেছিল সে এযাবৎ যে চৈতালীর বাবা ব্যবসা করছিল নিতাইয়ের সঙ্গে একযোগে, সে ব্যবসার কি হল? বাবা হাসপাতালে যাবার সময় টাকার মোট না হয় না দিয়ে গেছে, ব্যবসাটাও তো তেমনি নিয়ে যায়নি। তার আয়?
তার উত্তরে নিতাই চৈতালীকে যথেচ্ছ গালাগাল দিয়ে বলেছে, সেই আয়ের উপসত্ব যদি আদায় করতে চায় চৈতালী তো আদালতের সাহায্য নিক গিয়ে। আর বাপকে যদি বাঁচাতে চায় তো, যেখান থেকে হোক টাকা জোগাড় করে এনে দিক!
প্রথমটার থেকে শেষেরটাই আগে দরকার ভেবে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল চৈতালী। খুব একটা নতুন কিছু নয়, ছেলেবেলায় এ ধরনের কাজ অনেক করেছে। ট্রামে বাসে ট্রেনে রেস্তোরাঁয় পাড়ার লোকের বাড়িতে, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াত বাবা, আর বলত, ওর বুকপকেট থেকে কলমটা তুলে নিতে পারিস? প্যান্টের পকেট থেকে মনি-ব্যাগটা? পারিস কাছ ঘেঁষে বসে টুক করে ঘড়িটা কেটে নিতে? দেখি তো কেমন বাহাদুর মেয়ে?
চৈতালী বলত, এ তো চুরি! বাবা, তুমি আমায় চুরি করা শেখাচ্ছ?
বাবা অনেক লম্বা লেকচার দিত। মেয়েকে বোঝাত এই দুনিয়ায় সবাই চোর। রাজা মন্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল কাটাল কেউ বাদ নেই, একধার থেকে সবাই চুরি করে চলেছে, শুধু চুরির রকমফের মাত্র। এ তো তবু সামান্য চুরি, সাধারণ চুরি। বড় বড় জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত বিদ্বান তারা যে তলে তলে মানুষের প্রাণ মান ধর্ম বিবেক বিশ্বাস আত্মা সব চুরি করে চলেছে।
ওষুধে ভেজালের কাহিনী শোনাত বাবা ওইটুকু মেয়েটাকে, শোনাত খাদ্যে বিষাক্ত বস্তু মিশেল দেওয়ার। যেদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে সব কিছুর কথা তুলে বিশদ ব্যাখ্যা করত, ধর্মাধর্ম পাপপুণ্য ও সব বাজে ফকিকারি। বেঁচে থাকতে হলে টাকা চাই। আর সে টাকা ছলে বলে কৌশলে যে করে হোক–
বাবার বাক্যচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে যেত চৈতালী। ক্রমশ ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে গেল, এমন কি . জিনিস দেখলে নিজেরই হাত নিসপিস করত চৈতালীর। পাড়ার লোকের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে টুক করে তুলে আনত এটা-ওটা।
স্কুলেও ভরতি করে দিয়েছিল বাবা একবার, পড়েও ছিল কিছুকাল। সেখানে সহপাঠিনীদের জিনিসপত্র চুরি করে করে পয়লট্ট করতে করতে ধরা পড়ল একদিন, স্কুল থেকে দূর করে দিল।
তদবধি বাড়িতেই।
মাঝে মাঝে বাবার সব বন্ধুদের বাড়িতে চোরাই মাল পাচার করতে পাঠানো ছাড়া আর খুব কিছু করতে বেরোতে হত না।
কিন্তু বিপদ হল বাপের মাথা ফাটায়।
নাম ভাড়িয়ে ভাঁড়িয়ে আর বাসা বদলে বদলে চালাত লোকটা। প্রথমদিকে তাই ডাক্তার হাসপাতাল এসবগুলো এড়াবার চেষ্টা করেছে। তারপর এই অবস্থা।
.
সুলক্ষণাদের এই শহরতলির বাড়িটার পেছনে দিব্যি একটা পুকুর আছে, ছাত থেকে জানালা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। আর তার সঙ্গেই দেখতে পাওয়া যায় পুকুরের ওপারে বস্তির গা ছাড়িয়ে একটা মাঠ-কোঠা। সেখানেই সম্প্রতি বাস করছিল চৈতালীর বাবা। ওখান থেকে আসতে বড় রাস্তার প্রথম বাড়িটাই সুলক্ষণার। আসতে যেতে ওদের বাড়ির নীচের ঘরের ভেতরগুলো দেখে দেখে চৈতালীর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
চৈতালী জানত দালানের শেফে ওই যে ঝকমকে বাসনগুলো সাজানো থাকে, তার মধ্যেকার রুপোর বাসনগুলোয় গিন্নী খাওয়া-দাওয়া করেন। জানতো বৌ একটা আছে, সে দৈবাৎ নীচে নামে। জানতো দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে আছে গিন্নীর। আর জানত চাকরটা কখন কি কাজ করে।
শুধু ওদের বাড়িতে যে একদিন তাকে চুরি করতে ঢুকতে হবে, সেটাই জানত না। রুপোর বাসনগুলো শুধু লক্ষ্য করেই এসেছিল। কারণ বোঝা যেত জিনিসগুলো ভারী ভারী বনেদী। আর দামও আছে এখন ওর।
তা কথাটা সত্যিই।
বিধবা হবার পর কাসা আর কাঁচের বাসন ত্যাগ করে পাথর ধরবেন ভেবেছিলেন সুলক্ষণা, পাথর ধোপে টিকল না। বিয়ের সময় দানে পাওয়া সেই ভাল ভাল রুলোর বাসনের সে বার করে নিলেন। বললেন, এই পর্যন্ত সিন্দুকের জায়গা জোড়া করে তুলেই রেখে এসেছি, যাঁর জিনিস তিনি তো কোনদিন ভোগ করতে পারেননি। আমিই করে যাই শেষবেলায়।
জানলা দিয়ে দেখা যেত সেই বাসনের শেল্টা। চৈতালীর বাবা মেয়েকে বলত, কী রকম বাহার দিয়ে রাখে দেখেছিস? যাব একদিন। কে যাওয়াবে তা অবশ্য বলত না। একথাও বলেনি যাওয়াবার ভারটা তুই নে না।
বলেনি, তবু সে ভার নিতে এসেছিল চৈতালী।
কিন্তু স্বপ্নেও ভেবেছিল কি এ রকম একটা পরিণতি হবে?
অথচ হয়েও গেল।
বইয়ে পড়া গল্পের মতই ঘটে গেল ব্যাপারটা।
.
আচ্ছা, সুলক্ষণাও কি পরীক্ষা করতে নামলেন, বইয়ে পড়া মনস্তত্ত্ব সত্যিকার মানুষের ব্যাপারে ঘটানো যায় কি না? পরীক্ষা করতে নামলেন, মানুষ সত্যিই অমৃতের সন্তান কি না?
নাকি কারণটা একেবারেই স্থূল?
শহরতলির এই পাড়াটায় এসে পর্যন্ত লোক জোটানো যে কী বিড়ম্বনা সেটা অনুভব করে করে এবং বুড়ো বংশীটার কষ্ট দেখে, এই ঝুঁকিটা কি নিয়ে ফেললেন?
সুলক্ষণার কথা সুলক্ষণাই জানেন। ওঁর খোলা মেলা আবরণের অন্তরালে যে চাপা একটি সত্তা আছে, সে নিতান্তই কঠিন প্রকৃতির। তাই সুলক্ষণার মনের কথা সঠিক বোঝা শক্ত।
তবে সকালবেলা চায়ের টেবিলে ছেলেমেয়ের কাছে শেষোক্ত কারণটাই পেশ করলেন তিনি। বললেন, দেখিই না। সত্যিই তো তেমন কারে পড়লে রাস্তা থেকে একটা অজানা অচেনা জোয়ান লোককেও ডেকে কাজ করাতে হয়, বাড়িতে জায়গা দিতে হয়। এ তো কম বয়সী একটা মেয়ে মাত্র। সুদক্ষিণার চাইতে দুতিন বছরের বড় হয়তো ঢের।
কিন্তু শুনে প্রথমটা ওরা—
আচ্ছা একেবারে প্রথম থেকেই তবে বলা যাক।
.
একেবারে সকালবেলা সুলক্ষণাকে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ সেটা তাঁর পুজো করার সময়। প্রথম দেখা মেলে চায়ের টেবিলে। টেবিলে আজ সবাই। অপর্ণাও!
এসে বসতেই কৌশিক বলে ওঠে, তারপর মা, তোমার কালকের অ্যাডভেঞ্চার কতদূর গড়াল? অপরাধীর জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করে নিলে নাকি? যেভাবে নির্জনে ওকে নিয়ে গিয়ে গুছিয়ে বসলে।
সুলক্ষণা পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে হেসে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। খাতাকলম যদি দিয়ে যেতিস একটা।
সত্যি মা, তুমি অপূর্ব।
শুধু অপূর্ব সুদক্ষিণা বলে ওঠে, একেবারে অভূতপূর্ব। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম সকালবেলা তোমাকে রক্তাক্তকলেবরে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাব।
সুলক্ষণা হঠাৎ হেসে উঠলেন, ওই ধারণাটুকু মনে গেঁথে নাকডাকিয়ে ঘুমোলি তো সারারাত্তির?
তা কি করব? তুমি যেভাবে আমাদের বিতাড়িত করলে। সে যাহোক, তারপর মহিলাটি বিদায় গ্রহণ করলেন কখন? মানে, কতক্ষণ তুমি
কথার মাঝখানেই বলেন সুলক্ষণা, গেল কই? যায় নি তো! রয়েছে!
যায় নি তো!
রয়েছে!
রয়েছে মানে কি?
চার-চারটে মানুষই একযোগে চমকে উঠল। আর অপর্ণা কাদো কাদো গলায় বলে উঠল, এখনো আছে? দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছেন তো?
অবিরত ভুগে ভুগে অপর্ণার স্নায়ুগুলো এমন শিথিল হয়ে গেছে যে, এতটুকু ভাবের বেগও বইবার ক্ষমতা নেই তাদের! ভয় বিস্ময় ব্যাকুলতা উৎকণ্ঠা উদ্বেগ কোন কিছুর ছোঁয়া লাগলেই চোখে জল এসে যায়।
তাই রাত্রের সেই চোরাঙ্গনাকে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে কি না প্রশ্ন করতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে সে।
সুলক্ষণা যেন দেখেননি সেই অশ্রুবাষ্প, তাই নেহাৎ সহজ ভাবে বলেন, ওমা, তালা লাগিয়ে রাখব কি! তাকে যে আমি কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।
কাজে লাগিয়ে!
ছেলেমেয়ের সঙ্গে একটা পরিহাস করছেন সুলক্ষণা?
বিশ্বাসযোগ্য?
তাই আবার ওরা একযোগে একই কথা বলে ওঠে, কাজে লাগিয়েছ?
হ্যাঁ রে। যে কষ্ট যাচ্ছে বংশীটার। লোক তো এ পাড়ায় দুর্লভ রত্ন! তাই ওটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিলাম কাজে লাগিয়ে। সেই তো আজ রাঁধছে। বংশী তো বাজারে গেছে!
মা!
কৌশিক বলে ওঠে, ভাবছি তুমি পাগল হয়ে গেছ, না আমরা পাগল হয়ে গেছি?
সুলক্ষণা কিছু বলার আগে সুদক্ষিণা বলে, না তার চেয়েও বেশী কিছু ঘটেছে। পাগলামিরও একটা সীমা থাকে, ও নিশ্চয় কিছু তুকতাক করেছে।
হ্যাঁ, মায়ের সঙ্গে এ ধরনের কথা চালায় ওরা। সে প্রশ্রয় আছে।
সুলক্ষণা এসব বিষয় গায়ে মাখেন না। বলেন, তিলকে তাল করছিস তোরা। কারে পড়লে তো রাস্তা থেকে একটা
এতক্ষণ পরে গম্ভীরপ্রকৃতি বড়ছেলে একটা কথা বলল। বলল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না মা, হঠাৎ এরকম একটা ডিসিশান নিলে কেন তুমি?
নিলাম কেন?
কৌস্তুভের প্রশ্নে একটু যেন সিরিয়াস হলেন সুলক্ষণা। বললেন, ভাবলাম দেখি না রিস্ক নিয়ে। অভাবে পড়ে কুসঙ্গে পড়ে কত হাজার হাজার মানুষই তো নষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি, একটা মানুষকেও বাঁচানো যায় কিনা, বদ-অভ্যাস তাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে কিনা।
আলোচনায় হঠাৎ ছেদ পড়ল।
সিঁড়ির সামনে একটা সাদা শাড়ীর কোণ দুলে উঠল, একটু বাসন-পত্রের শব্দ হল।
ও, এনেছিস?
সুলক্ষণা বলেন, চিড়ে ভাজতে দিয়ে এসেছিলাম চায়ের সঙ্গে খাবি বলে তোরা। কই আয় না এদিকে, দিয়ে যা!
সামান্য বোধহয় ইতস্ততের ভূমিকা অভিনয় করল মেয়েটা, তারপরই বেশ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে পাত্রটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল।
এরা সবিস্ময় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ওর পরনের শাড়ীটি বড় বেশী চেনা।
সুলক্ষণার শাড়ী। চওড়া বেগুনী চুড়িপাড়।
যে সব এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে আলমারির নীচের তাকে, তারই একখানা। ওই সব অপয়া শাড়ী বৌকে মেয়েকে তিনি কোনদিন পরতে দেননি। ওরাও কোনদিন ভাবেনি, মা যেগুলো আর পরতে পাবেন না সেগুলো ওরা পরবে।
কিন্তু ওই সুন্দর পাড়ের শাড়ীটার এই গতি দেখে মেয়ের গায়ে জ্বালা ধরল, বৌয়ের চোখে জল এল। ছেলেরা অবশ্য ঠিক ধরতে পারল না, শাড়ীটা কার। তবে অনুমান করল মা ফর্সা শাড়ী সাপ্লাই করে ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে জাতে তুলেছেন।
মেয়েটা যে দেখতে একেবারে ভদ্রলোকের বাড়ির ভালো মেয়ের মত সেটা আজও আবার নতুন করে অনুভব করল এরা।
সুলক্ষণা বললেন, ওরে, ওইখানে মরিচের গুঁড়োর শিশিটা আছে, দিয়ে যা তো!
ভাতটা খাওয়া হয় নীচের দালানে, চা-টা দোতলায়। তাই চায়ের ব্যাপারে একটু আসা যাওয়া করতেই হয়।
সুদক্ষিণা বিরক্ত হয়ে বলে, ওই দৃষ্টিসুখকর জীবটিকে বারবার আর নাই বা সামনে আনলে মা।
সুলক্ষণা মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, ছি ক্ষেণু, ছোট হসনে। মনে রাখিস ও তোদের আশ্রিত-র পর্যায়ে পড়ল। তবে টিকে যদি থাকে, মাইনেও দেব। ওর একটা দাবি জন্মাবার জন্যেই দেব।
অর্থাৎ একখানি সুসভ্যা রাঁধুনী লাভ করছ তুমি– কৌশিক বলে, রাঁধুক তাতে ক্ষতি নেই, কাউকে কামড়ে-টামড়ে দিতে না এলেই হল।
সুলক্ষণার চোখের ইশারা, কৌস্তুভের অস্বস্তি প্রকাশ, সব ব্যর্থ করে দিয়ে কথাটা সম্পূর্ণ করল কৌশিক, চৈতালীর উপস্থিতিতেই। কারণ মরিচের গুড়োর শিশি নিয়ে সে তখন ঠিক কৌশিকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
না শোনার ভান করা যায় না।
সুলক্ষণা বলে উঠলেন, তুই যদি সব সময় ওকে ওরকম ক্ষ্যাপাস তবে তো ওর আমার কাছে থাকাই চলে না রে।
এ সুরে কাজ হল।
কৌশিক অপ্রতিভ হল। রীতিমতই হল। পেছনে ওর উপস্থিতিই একটু বিচলিত করেছিল। যতই নিন্দনীয় ইতিহাস থাক, সভ্য-ভব্য দেখতে আস্ত একটা তরুণী মেয়েকে সমীহ একটু না করে পারা যায় না। তাছাড়া, আড়ালে কথা বলারও একটা লজ্জা আছে।
কৌশিক মেয়েটার আপাদমস্তক দেখে নেয়। দেখে, সেখানে কি প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু কই?
কিছুই তো না।
একেবারে ভাবশূন্য মুখ। গতরাত্রে চোর অবস্থায় ধরা পড়েও যে মেয়ে ফোঁস করে উঠেছিল, তার পক্ষে এটা আশ্চর্য!
কী এ?
সর্বংসহার সাধনা? সুলক্ষণা তাহলে এইটিই বুঝিয়েছেন পড়িয়েছেন ওকে, আমার ছোট ছেলেটা অতি অসভ্য, তার কথাবার্তায় কিছু মনে কোরো না তুমি।
ধ্যেৎ, বড় বিশ্রী হয়ে গেল।
তবে কি না লজ্জায় পড়ে গেছি, এটা প্রকাশ করাও আবার বেশী লজ্জা। তাই কৌশিক সেটা অপ্রকাশিত রেখে মার কথার উত্তর দেয়, নতুন করে আর ক্ষ্যাপাবার কি আছে? আমার তো ধারণা ছিল ওই কামড়-টামড়গুলো, ইয়ে, মানে–ওই আর কি ইয়েরই লক্ষণ কিন্তু তুমি যখন বারণ করছ, এ প্রসঙ্গে ইতি। বাড়িতে ডেটল কিছু বেশী করে মজুত রাখা ছাড়া
এমন ভাবে মাথা চুলকোয় কৌশিক যে মনে হয় সত্যিই বিশেষ চিন্তায় পড়েছে।
.
এই ছেলেটার জন্যেই সুলক্ষণার মন আর সংসার এত দুঃখেও সর্বদা আনন্দোজ্জ্বল। কথা দিয়েই ভরিয়ে রাখে ও চারপাশের সমস্ত শূন্যতা।
নইলে দুঃখ কম সুলক্ষণার?
নতুন বাড়িটি তৈরি করে পুরো একটা বছরও ভোগ করতে পারেননি স্বামী। নতুন পাড়ায় এসে পড়শিনীদের সঙ্গে সবেমাত্র পরিচয় হতে না হতে সুলক্ষণার বৈধব্যের লজ্জা। হ্যাঁ, লজ্জা বৈকি। শোকের চেয়ে লজ্জাই বেশী। আর লজ্জার দাঁত যে শাকের চেয়ে অনেক বেশী ধারালো।
তা ছাড়া বড়ছেলেটার ওই বরবাদ-যাওয়া জীবন। বৌয়ের সেবা করা, বৌয়ের তাওত করা ছাড়া আর কোন কিছুই রইল না কৌস্তুভের। ডাক্তার বলেছে, এ এক বিশেষ রোগ, রক্ত তৈরী হয় না ভেতরে।
অতএব, চিরদিনই রক্তশূন্যতায় ভুগবে অপর্ণা।
এর থেকে মুক্তি মানে মৃত্যু।
সে তো আরও ভয়াবহ। সে দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখাই মানবিকতা।
সুদক্ষিণার জন্যেও কত চিন্তা।
ওর বাপ থাকলে দায়িত্ব অর্ধেক হত সুলক্ষণার।
কিন্তু মায়ের মনের এই ভারগ্রস্ত অবস্থাকে কৌশিক যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে না পারুক, ও যে চেষ্টা করছে, তাতেই অনেকটা ভার লাঘব হয়।
সুলক্ষণা জানেন চৈতালীকে যতই ঠাট্টা-উপহাস করুক কৌশিক, ঘৃণা করবে না। মানুষকে ঘৃণা করার কথা ভাবতেই পারে না ও! সেই তো ভরসা সুলক্ষণার, সেই তো বুকের বল। মনের একেবারে ভেতরের ঘরের খবর নিলে দেখা যেত, কৌশিকের দরদের ভরসাতেই ওই চোর মেয়েটাকে এত সহজে বাড়িতে জায়গা দিতে সাহস করলেন সুলক্ষণা।
সুলক্ষণা দেখলেন, চৈতালী কৌশিকের মাথা চুলকোনোয় হাসি চেপে সরে গেল। সুলক্ষণাও হাসি চাপলেন।
সুদক্ষিণা মায়ের সেই ছোট হওয়ার কথায় অভিমানক্ষুব্ধ হলেও একটা কথা ভেবে হঠাৎ একটু সহৃদয়তা বোধ করল। এরকম একটা মেয়ে বাড়িতে থাকা মন্দ নয়। নেহাত ঝিও নয়, অথচ ঝিয়ের চেয়ে বেশী সম্মান দিতে হবে না, এটা বেশ। মায়ের কিছুটা ভার লাঘব হবে। কাজ কমলে মাকে বেশীক্ষণ পাওয়া যাবে।
আত্মীয়-টাত্মীয় থাকা সুবিধের নয় বাবা।
দেখেছে ওর বাবার অসুখের সময় পিসিমাকে আসতে। সুলক্ষণা একা পেরে উঠবেন না। বলেও নয়, সম্পর্কের দাবিতেই এসেছিলেন। কিন্তু তিনি আর তার দুই মেয়ের প্রয়োজনের দাবি মেটাতে মেটাতেই সুদক্ষিণার প্রাণান্ত হয়েছিল।
পিসিমা রাত জাগবেন, সুদক্ষিণার কর্তব্য প্রহরে প্রহরে হিটার জ্বেলে চা বানিয়ে খাওয়ানো। কেননা পিসিমা অবিরত তার শ্বশুরবাড়ির মেয়েদের শিক্ষা সহবৎ আর কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনী শোনাচ্ছেন। পিসিমার মেয়েরা দয়া করে রোগীর বাড়ি এসেছে, এই দাবিতে তাদের চারবেলার খাওয়ার সমস্ত তদারক করতে হত রোগীর মেয়েকে।
সুদক্ষিণার ইচ্ছে হত বলে, পিসিমা, তোমার মেয়ে দুটিও তো তোমার শ্বশুরবাড়ির।
সে যাক, বাবার মারা যাওয়া কালীন স্মৃতি থেকেই সুদক্ষিণার আত্মীয়ভীতি। অথচ দ্বিতীয় কেউ একটা না থাকার অসুবিধেও অনুভব করে। বৌদি তো ওই, নিজেও সে একেবারে কিছু না, তা ভাল করেই জানে। কিন্তু মাকে যে একটু দেখা দরকার, তাও তত বোঝে।
এই তো কতদিন এমন হয়েছে, সুদক্ষিণা সবিস্ময়ে বলেছে, মা, তুমি ভাত খেলে না?
সুলক্ষণা হেসে বলেছেন, নাঃ, খেলাম না। আড়ি করে দিয়েছি আজ ভাতের সঙ্গে।
সদক্ষিণা মরমে মরে গেছে।
সুদক্ষিণা চুপি চুপি বংশীকে জিগ্যেস করেছে, হারে বংশী, আজ একাদশী?
মার একেবারে হাতের কাছে একজন কেউ থাকলে যে ভাল হয় সে কথা বুঝে ফেলেই আরও অস্বস্তি সুদক্ষিণার।
তাই চৈতালী যখন মরিচের গুড়োর শিশি রেখে চলে গেল, সুদক্ষিণা ভাবল, হিস্ট্রিটায় একেবারে যে চোর। নইলে এমন কিছু মন্দ নয়। কিন্তু আশ্চয্যি, দেখে কিছুতেই মনে হচ্ছে না ওই মেয়েটা কাল রাত্রের সেই বিটকেল ঘটনার নায়িকা!
.
তা নিজের শাড়ীটাড়ী পরিয়ে বেশ তো মানুষ করে তুলেছ দেখছি এখন, কৌশিক বলে, ওর পেছনের ব্যক্তিরা যদি হঠাৎ বাড়ি-চড়াও হয়ে তোমাকে মেয়ে আটকানোর দায়ে ফেলে?
ও নাবালিকা নয়।
বেগতিক দেখলে ও উলটো স্টেটমেন্ট দেবে।
সুলক্ষণা সামান্য হেসে বলেন, বেগতিক দেখে কে কি না করতে পারে! নিতান্ত নিরীহ একটা লোক খুন করেও বসতে পারে।
কৌস্তুভ মার মুখের দিকে তাকায়, উঠে পড়ে।
বৌকে বলে, আটটার সময় ডাক্তারবাবু আসবেন মনে আছে তো? হাঁ ভাল কথা মা, মেয়েটা সম্বন্ধে একেবারে বিশ্বাসের নিশ্চিন্ত রাখা ঠিক নয়। মানুষ চেনা শক্ত।
সুলক্ষণা মৃদু হাসেন, তা শক্ত বৈকি বাবা!
এই মজলিশের মধ্যে আরও একবার এসে পড়ে চৈতালী, খালি পেয়ালাগুলো গুছিয়ে নিয়ে যেতে।
সুলক্ষণা বললেন, এত সব তুই করিস না চৈতালী, বংশী তাহলে বেকার হয়ে যাবে। তুই রান্নাটা কর পরিপাটি করে। যেমন বলে দিয়েছি আঁশ নিরামিষ করে–
সুদক্ষিণা মার কথায় চমকে উঠে বসেছিল।
ও চলে যেতেই বলে, নামটা কি বললে?
চৈতালী।
চৈতালী! চৈতালী নিজের নাম ওর? নাকি শাড়ীর মত এই নামটিও তোমার দান মা?
না রে বাপু। সুলক্ষণা জোরে হেসে ওঠেন, ওর নিজেরই। আমিও প্রথমটা নামের বাহার দেখে চমকে গিয়েছিলাম। তা দেখলাম, আসলে ভাল ঘরেই উদ্ভব। তারপর এই ভবের খেলায় পড়ে।
কৌশিক না-পড়া খবরের কাগজখানা হাতে পাকাতে পাকাতে বলে, তা যাক, আপাতত ভবার্ণব পার হবার তরণীটি ওর ভালই জুটল দেখা যাচ্ছে। বেশ সুলক্ষণাক্রান্ত। এখন সুবাতাসের দাক্ষিণ্য পেলেই– বলে সুদক্ষিণার দিকে একটি নিরীহ কটাক্ষপাত করে।
সুদক্ষিণা গম্ভীর ভাবে বলে, আমি তোমাদের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই।
তা নেই বটে। তুই শুধু প্যাঁচে আছিস। বলে হাসতে হাসতে উঠে যায় কৌশিক।
আর এই সব ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহানুভূতি সমালোচনা সব কিছুর মধ্যে এক অলিখিত দলিলে স্থিরীকৃত হয়ে যায় চৈতালীর এখানের বাসটা পাকাই হল।
না হবেই বা কি করে।
একবেলাতেই যে কাজে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সে। তা ছাড়া একটানা বংশীর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ আর জঠর যে কতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সকলের, তা যেন বংশীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্পষ্ট ধরা পড়ল।
বংশী তুই একটু চোখে চোখে রাখিস…
দুপুরের দিকে বাইরের দরজাটা চাবি দিলে ভাল হয়, রুপোর বাসনগুলো কিছুদিন তুলে ফেললে হত না? এই ধরনের ক্ষীণ দুএকটা মন্তব্য দুএকবার উচ্চারিত হল।….
অথচ সকলেই মনে মনে ধরে নিল, ওগুলো প্রতিপালিত হবে না। মনে হল, এগুলো যেন। বাহুল্যই বলা হচ্ছে।
আশ্চর্য!
এই মেয়েটা মাঝরাত্তিরে চুরি করতে বেরিয়েছিল!
.
ইনজেকশনের পর কিছুক্ষণ অপর্ণার কাছে থেকে সুস্থ করে না গেলে বেরোবার উপায় নেই কৌস্তুভের। পাখার রেগুলেটারকে শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলেও বইখাতা নেড়ে বাতাস করতে হয়, বার বার নাড়ি দেখতে হয়। শাকবর্ণ মুখের স্বাভাবিক ফ্যাকাশে রঙটা ফিরতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে।
সাত রাজ্য খুঁজে সুন্দরী বৌ এনেছিলেন সুলক্ষণা। সে সৌন্দর্যের অবশিষ্টাংশ আজ শুধু করুণাই জাগায়।
সাদা ফরসা রঙটা এখন ফ্যাকাশে বিবর্ণ খড়ির মত। কপালের মাপ অনেকখানি বেড়ে গেছে, সামনের চুল উঠে গিয়ে আর পাতলা হয়ে গিয়ে। গালের হাড় উঁচু, চোয়ালের হাড় কোণাচে, চোখের দৃষ্টিতে শুধু এক অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ।
পানের মত নিটোল মুখে গভীর কালো দুটি চোখ আঁকা সরস্বতী প্রতিমার মত বৌটি সুলক্ষণার এখন শুধু স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দেয়ালে ঝুলছে। বিয়ের সময় অনেক আহ্লাদ করে বরকনের। রঙিন ফটো তুলিয়েছিলেন সুলক্ষণার স্বামী।
এই সব কথা মনে পড়লে সদা আনন্দময়ী সুলক্ষণার মনও বুঝি বেদনায় ভরে ওঠে।
.
অপর্ণার চোখে অসীম ক্লান্তি।
ক্লান্তি নেই কৌস্তুভের।
বিধাতার নিষ্ঠুরতা থেকে ও যেন ছিনিয়ে রাখবেই অপর্ণাকে। টিকিয়ে রাখবে এই পৃথিবীতে।
সুলক্ষণা ইনজেকশনের সময় ছিলেন, তারপর নেমে গিয়েছিলেন ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে।
আবার এলেন।
বললেন, তোর তো বেলা হয়ে যাচ্ছে খোকা, চান করবি, খাবি। আমি একটু না হয় বসছি বৌমার কাছে, তুই যা।
অপর্ণা ক্ষীণ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলে, না না, আমি একাই থাকতে পারব।
কৌস্তুভও বলে, তুমি এখন আবার! কেন, ক্ষেণু নেই?
না, ওর তো আজ গানের ক্লাস। ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, যা তুই।
ব্যস্ত কৌস্তুভ হচ্ছিল এতক্ষণ মনে মনে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ব্যস্ততা দেখানো চলে না, তাহলে অপর্ণা আহত হবে। অভিমানের জোর নেই, শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ে।
মার বিবেচনায় স্বস্তি পেয়ে নেমে গেল সে। এবং যথারীতি চান করে এসে টেবিলের ধারে বসে শান্ত গম্ভীর গলায় ডাক দিল, বংশী!
কিন্তু বংশী এল না।
এল চৈতালী।
.
কোস্তুভ কৌশিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত।
মেয়ে দেখলেই অস্বস্তি অনুভব করে ও। সকালবেলা কৌশিক যখন চৈতালীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছিল, কৌস্তুভ অস্বস্তিতে ঘেমে উঠছিল।
তাই চৈতালীকে ভাত দিতে আসতে দেখে ওর ক্ষিদেই উপে গেল। চৈতালী কিন্তু নির্বিকার। এল, কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে টেবিলে রাখল, ভাত বেড়ে আনল, পরিপাটি করে পাশে বাটি সাজিয়ে দিল, নুন লেবু সব দিয়ে আস্তে সরে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়াল।
অস্বস্তির মাঝখানেও অবাক হয়ে গেল কৌস্তুভ!
সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, আনকোরা নতুন হাতে এত সুন্দরভাবে কাজ হওয়া সম্ভব? আর এতগুলো রান্না হয়ে ওঠা?
শুধু বংশী কেন, বামুনঠাকুরদের আমলেও দেখেছে কৌস্তুভ। রান্না হয়ে না ওঠার জন্যে সুলক্ষণা অনুযোগ করতেন, গরম ডাল ভাত ঠাণ্ডা করবার জন্যে হানটান করছেন, এইটাই কৌস্তুভ বহুদিন থেকে দেখতে অভ্যস্ত। সুলক্ষণার স্বামীর আমল থেকেই। ভদ্রলোক স্ত্রীকে রান্না ভঁড়ার ঘরে বেশীক্ষণ থাকতে দিতে আদৌ ভালবাসতেন না। কাজেই সারা সকাল সুলক্ষণাকে তার কাছেই ঘুরতে হত, এদিকটা দেখা হত না।
আজও তো কই দেখেননি মা, ভাবল কৌস্তুভ। আর সঙ্গে সঙ্গেই ভাবল, অথচ এ এত সুন্দর করে।
আচ্ছা কাল তো মেয়েটাকে এত পরিষ্কার দেখতে লাগছিল না। কাজকর্ম করলে মেয়েদের চেহারা বদলে যায় নাকি?
আর কিছু লাগবে?
না না। আবার কি।
কৌস্তুভ ব্যস্ত হয়ে জলের গ্লাসে হাত ডুবিয়ে উঠে পড়ল।
চৈতালী হঠাৎ খুব স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ভাত তো সবই দেখছি পড়ে রইল। আমার হাতের রান্না বলে ঘেন্নায় খেতে পারলেন না বুঝি!
না না, ইস সে কি! আমি কোনদিনই এত–জিগ্যেস কোরো মাকে পালিয়ে গেল কৌস্তুভ।
আর চৈতালী নিষ্পলকে তাকিয়ে রইল সেই ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া ভাতের থালাটার দিকে। এদের কাছে ভাতের কোন দাম নেই।
অবশ্য চৈতালীরাও চিরদিনের দুঃখী নয়! কৈশোরটা মাসীর বাড়িতে কষ্টে কাটলেও, বাপের কাছে নানারকম দেখেছে।
তার ছিল দশ দশা।
কখনো হাতী, কখনো মশা।
কিন্তু এখন?
দীনহীন একটা দাঁতব্য হাসপাতালে পড়ে আছে বাবা, ইনজেকশনের ওষুধ জুটছে না। অথচ এদের যে বৌ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, তার জন্যে বড় ডাক্তার এল, ইনজেকশন পড়ল।
নিজের মনে ভয়ানক একটা দুঃখ অনুভব করল চৈতালী।
সকাল থেকে কাজ দেখিয়ে দেবার উৎসাহে এবং মনের মত মাছ তরকারির উপচার নিয়ে রাঁধতে বসতে পাওয়ার আনন্দে যেন স্থান কাল পাত্র বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল চৈতালী। হঠাৎ এখন বাবার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সমস্ত শরীরের মধ্যে মস্ত একটা আলোড়ন উঠে চোখে জল এল।
.
সুদক্ষিণা কলেজ থেকে ফেরার পর সুলক্ষণা একটা ঠিকানা লেখা কাগজ এনে ওর সামনে ধরে বললেন, জায়গাটা জানিস ক্ষে?
সুদক্ষিণা তাতে চোখটা বুলিয়ে নিয়ে বলে, বাঃ এ তো দেখছি একটা হাসপাতাল! আমি কি করে জানব?
কী মুশকিল, তুই জানবিই এমন কথা তো বলিনি রে বাপু। জানিস কি না তাই বলছি। জায়গাটার আন্দাজ হচ্ছে?
মনে হচ্ছে তো বড়বাজারের দিকে কেন কি হবে সেখানে?
না, হবে না কিছু সুলক্ষণা বলেন, তুই যখন পারবিই না। ভাবছিলাম মেয়েটাকে একটু সঙ্গে করে নিয়ে যেতিস–
সুদক্ষিণা চমকে ওঠে, বলে, কেন, কি হল ওর? হাসপাতালে কেন?
ভাবনা ধরে যায় তার।
একদিনেই আস্বাদ পেয়েছে সংসারের শৃঙ্খলার, কাজের কর্মের, ভাল রান্নার। তাই একেবারে ঘৃণিত অসহ্যকেই দামী মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন আবার কি হল তার?
সুলক্ষণা খুলে বলেন।
ওর কিছু না, ওর বাবার।
হাসপাতালে আছে ওর বাপ, ও শুধু ঠিকানাটা জানে, যায়নি একদিনের জন্যে। নিয়ে যায়নি কেউ। নিয়ে যাবার লোকই ছিল না
সুদক্ষিণা নাক কুঁচকে হেসে বলে, এখন বুঝি হয়েছে ভাবছে?
ও হয়তো কিছুই ভাবেনি, আমি ওর প্রাণটার দিকে তাকিয়ে দেখছি–
তা আমি তো ওদিকে জীবনেও একা যাইনি। তা ছাড়া আবার হাসপাতাল-ফাসপাতাল!
থাক তবে।
বলে চলে গেলেন সুলক্ষণা।
.
কিন্তু ছেড়ে দিলেন কি?
না। গৃহীত সংকল্প ত্যাগ করা সুলক্ষণার প্রকৃতি নয়।
কৌশিকের কাছে গেলেন।
কৌশিক দুহাত জোড় করে হাসে, মা, তুমি কি মহিমাময়ী মা! নিত্য তোমার পদধূলি সেবন করলে যদি কিছু হয় আমাদের। সেই অজ্ঞাত অপরিচিত মহাচোর ভদ্রলোকটির জন্যে তুমি তোমার ছেলেকে দিয়ে কমলা আপেল বিস্কুট মিছরি পাঠাবে? পাঠাবে ওষুধের টাকা? তদুপরি তোমার এই নিরীহ বালকের মাথায় চাপাবে সেই মহান ব্যক্তির কন্যাটিকে?
সুলক্ষণা বলেন, বুঝলাম তোর অসুবিধে হবে। কিন্তু দেখ, মেয়েটার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। সারাদিন কাঁদছে।
আহা তা অত কৈফিয়তের কি আছে? আমি বলছি অসুবিধে হবে? হুকুম করবে চলে যাব, ব্যস! তবে
কি তবে?
মহিলাটিকে একটু বারণ করে দিয়ে, আমার সঙ্গে যেতে যেতে পথে যেন ফাঁস ফাস না করেন।
.
সুলক্ষণা ছেলের এই অনুরোধের কোন জবাব দেননি, হেসে সরে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।
সুলক্ষণা ছেলেকে বলেছিলেন পথ থেকে ফল কিনে দিতে।
ফলের বহর দেখে লজ্জায় কুণ্ঠায় এতটুকু হয়ে গেল চৈতালী। এ কি! চৈতালীর বাপের জন্য এত!
এরা সত্যিই এমন মহানুভব, না পুরো পরিবারটাই পাগল?
এত কি হবে?
না বলে পারল না চৈতালী।
কৌশিক গম্ভীর মুখ করে বলে, কখন কত লাগে ধারণা আছে আপনার?
আপনি!
চৈতালীকে ওই সুকান্তি ভদ্রছেলেটি আপনি বলছে! মরমে মরে গিয়েও কি এদের ভদ্রতার ঋণ পরিশোধ হবে?
হবে না।
তবু চৈতালী নম্র গলায় বলে, আমাকে আপনি বলবেন না! মাসীমা আমায় দয়া করে
দেখ আপনি না বললাম না বললাম, ওই দয়া-টয়া বললেই ট্যাক্সি থেকে নেমে সটান বাসে চড়ে বাড়ি ফিরে যাব।
ওর কথার ধরনে হেসে ফেলে চৈতালী। তারপর আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বড় হয়ে পর্যন্ত খালি বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি জানোয়ারই দেখেছি, পৃথিবীতে যে দেবতাও আছে, তা দেখিনি কোনদিন।
সুলক্ষণা ওদের পাঠিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে ভাবছিলেন, আমার পরীক্ষাটা কি বড্ড বেশী দুঃসাহসিক হচ্ছে? আমি কি বিপদ ডেকে আনব? কৌশিককে অসংগত অনুরোধের চাপ দিয়ে বিব্রত করলাম? আমি কি
বংশী এসে দাঁড়াল।
বলল, মা, আমি তো বুন্ধু, চাকর নফর, কিন্তু একটা কথা না বলে তো পারছি না।
সুলক্ষণা হেসে ফেলে বললেন, না বলে যখন পারছিসই না, তখন বলেই ফেল?
চোট্টা মেয়েটাকে তো মাথার মণি করলে, কিন্তু ওর মতিগতি সুবিধের নয়।
সুলক্ষণা ভুরু কোঁচকালেন।
এটাই প্রশ্ন।
বংশী বেশ জোরালো স্বরে বলে, তোমার ওই রুপোর গেলাসটা, যেটা নিয়ে কাল হাতেনাতে ধরা পড়েছিল, সেটার ওপর ওর ছোঁকছোঁকানি যায়নি। তখন দেখি মাজা গেলাসটা হাতে নিয়ে একেবারে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন জগতের সকল চিন্তা ওই গেলাসটায়। নেহাত আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি রেখে দিল। তা কি আর বলে, জিগ্যেস করতে বলল, গেলাসে কার নাম লেখা?
সুলক্ষণা শান্ত গলায় বলেন, এতে হলটা কি? হয়তো নামটাই পড়ছিল।
তোমার যেমন সারল্য মন, তেমনিই তো বলবে। জানি, দোষ ধরবে না। আমার রাগ ধরে গেল। বললাম, কার নাম কি বিত্তান্ত, অত কথায় তোর দরকার কি? মা দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে–
বংশী!
সুলক্ষণার তীব্র স্বরে বংশী থমকে থেমে যায়।
সুলক্ষণা দাঁড়িয়ে উঠে সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, আর কোনদিন যেন এ ধরনের কথা না শুনি। আর ওভাবে তুই টুই করে খারাপ ভাবে কথা বলবি না ওর সঙ্গে। ক্ষেণুকে যেভাবে মেনে চলিস, সেই ভাবেই মেনে চলবি ওকে।
রায় দিয়ে চলে যান সুলক্ষণা।
আর রোষে ক্ষোভে ধিক্কারে বংশী সংকল্প করে কালই দেশে চলে যাব। ওই চোর মেয়েটা একবেলা একটু ভাল রান্না বেঁধেছে, তাই এত আদর তার? আর বংশী যে- ঠিক আছে যাব যাব। এই তিন সত্যি।
.
কিন্তু তিন সত্যি কি রক্ষা হল বংশীর?
বসে তো ছিল অনেকক্ষণ গুম হয়ে, তার পর?
চৈতালী আর কৌশিকের ফিরতে দেরি দেখে সুলক্ষণা যখন বংশীকেই ডেকে বললেন, কই ওরা তো এখনো এল না দেখছি, ওদিকে বৌমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুধটা ততক্ষণ জ্বাল দেবার ব্যবস্থা কর বংশী।
তখন বংশী ছিটকে এসে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, মা হয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে বসে আছ কী করে মা? একবার খেয়াল করছ না–ব্যাপারটা কি ঘটেছে?
সুলক্ষণাও চিন্তান্বিত ছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশ না করে বলেন, কেন বল্ তো? কী হল?
কী হল? ছেলেটাকে ইচ্ছে করে ডাকিনীর খপরে ধরে দিয়ে কোন্ বদমাইশ গুণ্ডার আড্ডায় পাঠিয়ে দিলে কে জানে, কী তার কপালে ঘটছে কে জানে! আর বলছ যে, কী? আজন্ম কলকাতায় আছ, জানো না কতরকমের বদমাইশি আছে সংসারে। বুঝতে পারলে না সব বানানো গপো। ওই হাসপাতালের ছুতো করে কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলল কে জানে। হাসপাতালে গেল কি না বড়বাজারে! যেখানে যত রাজ্যের গুণ্ডাপট্টি। অতবড় মেডিকেল কলেজ গেল, তাতে কুলোল না ওর বাপের? ছলনা, ছলনা, আমি বলছি সব ছলনা।
.
সুলক্ষণা ভেতরে ভাঙলেও বাইরে মচকান না, বলেন, থাম বংশী, পাগলের মত বকিসনি। এ স। গাড়ি পাওয়া অত সোজা নাকি?
কিন্তু ভেতরে কি সত্যি ভাঙলেন?
তার বিধাতার কাছে কি দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন না, ঠাকুর মুখ রেখো!
আর ঠিক সেই সময়
সুদক্ষিণ, ছুটে এল, মা, বৌদি ভয় পেয়ে কীরকম করছে!
ভয় পেয়ে কী রকম করাটা বৌদির নিত্য-নৈমিত্তিক। এবং ভয়টার কারণ প্রায়শই এত তুচ্ছ যে, রাগ করতেও বেন্না করে। তবু কৌস্তুভ বাড়িতে না থাকলে যেতেই হয়, ছুটে গেলেন।
দেখলেন অপর্ণা ঘামছে চোখ বুজে শুয়ে।
কী হয়েছে?
জানি না, সুদক্ষিণা বলে, কে ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ছোড়দাকে গুণ্ডারা খুন করেছে
আঃ, কী আশ্চর্য! এ ওই নির্বুদ্ধির ঢেঁকি বংশীটার কাজ। সুলক্ষণা ব্যস্ত হলেন, বৌমা! বৌমা!
অপর্ণা চোখ খুলে কান্নাভরা গলায় বলে ঠাকুরপোকে কেন যেতে দিলেন মা?
সুলক্ষণা তাঁর ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে বলেন, দিয়েছি তার কি?
মনে হচ্ছে কোন বিপদ হয়েছে!
সুলক্ষণা দৃঢ় স্বরে বলেন, আমি না পাঠালেই কি ও বাড়ি বসে থাকতে বৌমা? নাকি ও নিজে বেরোলে বিপদ আসতে পারত না?
এবার সুদক্ষিণা বলে, বিপদ আসা আর বিপদের মুখে পাঠানো তফাত নয় কি মা?
তা আমার হাত থেকে বিপদ আসাই যদি ওর ভাগ্যে থাকে, সেও তো আমি রদ করতে পারব না ক্ষে।
ওই! হল! সেই তোমার ভাগ্য। তা হলে তো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বলে কিছু থাকা উচিত নয়। কিন্তু যাই বল মা, ভাগ্য-টাগ্য যদি মানো তত তোমার তুকতাকও মানা উচিত! মেয়েটা নির্ঘাত তোমায় তুক করেছে। নইলে ভাল করে ভেবে দেখ, কি অন্ধ তুমি হয়ে গেছ? খুব দি ভাল মেয়ে হয়, চোর-ডাকাত কিছু যদি নাও হয়, বাড়ির রাঁধুনীর বাবা-মা হাসপাতালে থাকলে কে কবে বাড়ির ছেলেকে পাঠায় দেখতে
সুলক্ষণা স্থির স্বরে বলেন, আসল জায়গাটায় ভুল করেই সব গুলিয়ে ফেলছিস ক্ষে। বাড়ির রাঁধুনী না ভেবে বাড়ির মেয়ে ভাবলেই আমার অঙ্কটা বুঝতে পারবি।
বাড়ির মেয়ে!
সুদক্ষিণা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তাই বল। বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলে মনে বড় অহংকার ছিল, সেটা গেল। এবার বোধ করি ওঁকে দিদি বলে ডাকবার হুকুম আসবে?
সুলক্ষণা ঈষৎ হেসে বলেন, সে হুকুম আমার কাছ থেকে না এসে, তোর নিজের ভেতর থেকেও আসতে পারে ক্ষে।
আমি তোমাদের মতন অত মহৎ নয়।…এই যে দাদা এসে গেছ। মার কাণ্ড জানো? ছোড়দাকে পাঠিয়েছেন চৈতালীর সঙ্গে, তার বাবা না কাকা কে হাসপাতালে আছে তাকে। দেখাতে। এখনো ফেরেনি তারা।
কৌস্তুভ একবারমাত্র মা বোন দুজনের মুখভাব অবলোকন করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তাই নাকি? আর পরক্ষণে তার থেকে চতুগুণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠে, কিন্তু অপর্ণার কি হল? আবার হঠাৎ
সুলক্ষণা ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
.
আচ্ছা, মেয়েটা কোথায় গেল বল্ দেখি?
নিতাই তার প্রিয় সাগরেদ বরেনকে জিগ্যেস করে, একেবারে হাওয়া হয়ে গেল কি করে?
বরেন নাক কুঁচকে বলে, বুঝতে পারছ না দাদা? তলে তলে প্রণয়ী জুটিয়ে রেখেছিল, যেই বাপ চোখের আড়াল হয়েছে, সেই
না না, নিতাই প্রতিবাদ করে ওঠে, সে প্যাটার্নের মেয়ে নয়। দেখতিস না মেজাজ? যেন রায়বাঘিনী। ওসব মেয়ে–
বরেনের বোধ করি কোনখানে একটু জ্বালা আছে, তাই তিক্তস্বরে বলে, বাঘিনী বলে কি আর প্রেমে কসুর হয়? গরু গাধাদের দিকে হেনস্থার দৃষ্টিতে তাকাতে পারে, কিন্তু জগতে বাঘও তো আছে।
.
নিতাইয়ের চৈতালী সম্পর্কে ঠিক এ রায়টা মনঃপূত হয় না। মেয়েটাকে তো দেখছে সেই ছোটবেলা থেকে। তা ছাড়া সেদিনই শচীনের হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ নিয়ে যে কোদল হয়ে গেছে নিতাইয়ের সঙ্গে চৈতালীর, এই হারিয়ে যাওয়াটা তারই প্রতিক্রিয়া কিনা ভেবে খুব একটা স্বস্তি নেই তার। কে জানে বাবা, গঙ্গায় ডুবেটুবে মরতে গেল না কি? যা তেজী মেয়ে! সেদিন তো মনে হচ্ছিল ভস্ম করে ফেলে বুঝি নিতাইকে।
কিন্তু নিতাই তো তা বলে ওই একফোঁটা মেয়েটার কাছে বেকুব বনে গিয়ে টাকার বাক্স খুলতে বসবে না। চোরাই আফিঙের যে ব্যবসাটি ছিল তাদের, তার সব কিছু ঝামেলা নিতাই নিজে পোয়াত না? শচীনটা কতটুকু কী করেছে? সব কি নিতাই শচীনকেই জানাত? যতটুকু ওকে দিয়ে করানো যায় তাই করিয়েছে। এসব কাজে দুচারজনকে না নামালেও তো সুবিধে হয় না। মনের মতন বৌটা দুম করে মরে যাওয়ায় লোকটা তো জীবনে হতাশ হয়ে নেলাক্ষ্যাপা হতে বসেছিল; সেই স্কুলের সহপাঠিত্বের পরিচয় ঝালিয়ে নিতাই ওকে আয়ত্তে এনে মানুষ করে তুলেছিল।
তখন তো জানতই না নিতাই, ওর বৌটা একটা মেয়ের জন্ম দিয়ে তবে নিজে মরেছে। শুনলো অনেক দিন পরে, শচীন বলল ওর একটা মেয়ে আছে, সে মাসীর কাছে মানুষ হচ্ছে।
তা সে মেয়েকে কি শচীন নিজের কাছে আনতে চেয়েছিল কোনদিন? না চায়নি। নিতাই-ই প্ররোচনা দিয়ে দিয়ে তাকে এখানে আনিয়েছে।
মেয়ে শুনে উল্লসিত হয়েছিল নিতাই।
এ সব ব্যবসায় একটা এক্সপার্ট মেয়ে ভয়ানক কাজে লাগে। কালে ভবিষ্যতে সেই মেয়েই দলনেত্রী হয়ে উঠে একশো পুরুষের কান কাটে।
নিতাই আশা করেছিল শচীনের মেয়েটাকে তেমনি এক্সপার্ট করে তুলবে। তাই ছোট থেকেই আনতে বলেছিল ওকে। বলেছিল, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে টাশ টাশ কিন্তু সেই মাসী মাগী না কে, সে মেয়েটাকে দশ বারো বছরেরটি না করে ছাড়ল না। আদৌ ছাড়ত না, যদি না নিজে বিধবা হয়ে অথই জলে পড়ত।
তা সেই, যা বলেছিল নিতাই, তাই হল। এক্সপার্ট যে হল না ছুঁড়ি তা নয়, কিন্তু ওই। টাশ টাশ!
নিতাইকে তো দুচক্ষের বিষ দেখেছে বরাবর। আর শচীনও ওদিকে খুব হুঁশিয়ার ছিল। মেয়েকে আগলে আগলে ফিরত।
কিন্তু এখন?
এখন কোত্থান থেকে আগলাবি আগলা? সময়ে যদি একটা বেথা দিতিস তাও বা হত। এই তত বরেন, মেয়েটার ওপর ওর যথেষ্ট লোভ ছিল, জাতে ও বামুন, দিতে পারত অনায়াসে। তা নয়। মেয়ে ওঁর দামী।
এখন? দামী মেয়ে এই তো ভেসে গেল।
বরেনের কথায় নিতাই গা ঝাড়া দিয়ে বলে, ওসব কথা যাক, এখন করা যাবে কি তাই ব? এদিকে তো এই বিপদ ঘটে গেল, ওদিকে মেয়ে হাওয়া
বরেন বিরক্ত স্বরে বলে, হাওয়া হোক, ঝড় হোক, আমাদের কি নিতাইদা? যার সঙ্গে চক্ষুলজ্জা সেই যখন
কিন্তু আমাদের, ইয়ে আমাদের আর একবার হাসপাতালে না যাওয়া কি ঠিক হল? লাশটা–
বরেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে, ক্ষেপেছ দাদা! খাল কেটে কুমির আনতে চাও? লাশ নিতে গেলে, জেরার চোটে তোমাকে একেবারে ফাঁস করে ছাড়বে না? এ বাবা যাদের মড়া তারা বুঝবে। অজ্ঞাত পরিচয় লিখে গাদায় জ্বালিয়ে দেবে। চুকে যাবে ল্যাঠা।
চুকে তো যাবে নিতাই চিন্তিত স্বরে বলে, যদি রায়বাঘিনী হঠাৎ এসে পড়ে বাপের খোঁজ চায়?
চাইবে, পাবে না। বরেন মুখ বাঁকিয়ে বলে, যে যা চায়, সে তা পেলে তো জগতে কোনও সমস্যাই থাকত না।
তাহলে বলছিস, চেপে বসে থাকব নিশ্চিন্দি হয়ে?
নিশ্চয়।
.
ঠিক সেই সময় কৌশিকদের বাড়িতেও এই রকম আলোচনাই চলছে।
সুদক্ষিণা প্রশ্ন করেছে তাহলে দাদা চুপ করে বসে থাকবে?
কৌস্তুভ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিছু করে উঠতে পারেনি।
পারবে কি করে, অপর্ণার সামনে বেশী উদ্বেগ প্রকাশও বারণ। ছুটোছুটি করতে উঠলে, বিপদ আবার কোন্ দিক থেকে আসবে কে বলতে পারে?
সুলক্ষণা নিজের ঘরে বসে আছেন।
সুদক্ষিণা পাশের কাদের বাড়ি থেকে কোথায় যেন ফোন করে এসেছে।
এমনি একটা সময়ে ঘড়ির কাঁটাটা বোধ করি সাড়ে নটার ঘর ছাড়িয়ে দশটার দিকে এগোতে সুরু করেছে, হঠাৎ বংশী ছুটে এসে খবর দিল এসেছে!
.
এসেছে?
অপর্ণা একবার উঠে বসেই শুয়ে পড়ে বলল, পাখাটা একটু জোরে– তারপর বলল, একা? না দুজন?
সুদক্ষিণা দ্রুত নীচে নেমে যাচ্ছিল, সুলক্ষণা ডেকে থামালেন। বললেন, বেশী কিছু বকাবকি করতে যাসনে।
বকাবকি করতে যাব না? সুদক্ষিণা ফিরে দাঁড়াল, এক প্লেট সন্দেশ নিয়ে সামনে ধরব তাহলে? এই বলছ?
হ্যাঁ তাই বলছি হাসলেন একটু সুলক্ষণা।
সুলক্ষণা বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কোন দিক থেকে আর কি কারণে এই মূর্তি নিয়েছে। মূল কারণ তো আবার তিনি নিজেই। চট করে কিছু বলে বসা ঠিক নয় এ বোধ রয়েছে। তাই সুদক্ষিণাকে বিশ্বাস করলেন না। নিজেই হাল ধরতে গেলেন।
আর নীচে নেমেই প্রথমে চোখে পড়ল চৈতালীর বিগত কালকের মতই বিবর্ণ নিষ্প্রভ অবনতমস্তক মূর্তিটা।
বিচলিত হয়ে গেলেন সুলক্ষণা, কিছু একটা বলতে গেলেন, এগিয়ে এল কৌশিক। খুব নীচু গলায় বলল, ওর বাবা কেমন আছেন জিগ্যেস কোর না মা।
জিগ্যেস করব না!
না। কারণ জিগ্যেস করবার কিছু নেই।
জিগ্যেস করবার কিছু নেই?
মানে বুঝতে দেরি হল না সুলক্ষণার। আস্তে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
নানা ঝামেলায়! জীবনে জানি না এসব জায়গায় কি করতে হয়, না হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করে–
সুলক্ষণা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, নে কাপড়-চোপড় একটু ছেড়ে নে তোরা, হাতমুখ ধো। রাত হয়েছে, খেতে বোস।
সুলক্ষণা ভাবলেন, খুব সহজ কথার মধ্য দিয়ে, আর অন্যমনস্কতার ভানের মধ্য দিয়ে, ব্যাপারটাকে হালকা করে নেবেন। গুরুত্ব কমিয়ে দেবেন।
কিন্তু চৈতালী?
চৈতালী কি তাই করবে?
চৈতালী কি অন্যমনস্ক হবে? হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসবে?
কৃচ্ছ্র সাধনের পদ্ধতি সে জানে না, কিন্তু মা-বাপ মারা গেলে যে অশৌচ পালনের কৃচ্ছু সাধন করতে হয়, তা সে জানে। আর করতেই যদি হয় তো, আঠারো আনাই হোক না? সেই পদ্ধতিই ধরে সে। কিছু না খাওয়ার পদ্ধতি।
.
বাতাসের মোড় ঘুড়ে গেল।
চৈতালীর পিতৃবিয়োগ, সমস্ত সংসারের কাছ থেকে একটু বিশেষ স্নেহ এনে দিল চৈতালীর জন্যে! তার অশৌচ পালনের কৃচ্ছসাধন সমস্ত সংসারের থেকে একটা যেন শ্রদ্ধা এনে দিল!
আর এই স্নেহ আর শ্রদ্ধার পরিপ্রেক্ষিতে চৈতালী যেন মূল্যবান হয়ে উঠল।
সুদক্ষিণা বললে, এই বংশী, খবরদার ওকে কিছু বলবি না।
বংশী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, আমি আবার কবে কি বললাম কাকে? বংশী যে চাকর, সেই চাকর।
ওসব কথা কেন? কিছু বলবি না, তাই বলে রাখছি। আর
কৌশিক বলে, মা, ও বেচারীকে এখন আর কিছুদিন কাজটাজ নাই করতে দিলে?
সুলক্ষণা ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলেন, বাপমরা অশৌচ ওর এখন, করবেই বা কি? করছেই বা কি?
না, তাই বলছি।
কৌস্তুভ এসে বলে, অপর্ণা বলছিল এ সময় ওকে
সুলক্ষণা ভুরু কুঁচকে বলেন, কাকে?
মানে তোমাদের এই মেয়েটার কথা হচ্ছিল। বলছিল, এ সময় ওর আত্মীয়-টাত্মীয়দের কাছে গেলেই ভাল হত।
তাহলে কোথায় ওর আত্মীয়রা আছে খুঁজে বার করো।
বলে চলে গেলেন সুলক্ষণা।
.
হ্যাঁ, বাতাসের মোড় ঘুরে গেছে বাড়ির। কাদাবালি মাখা যে পাথরকুচিটুকু সুলক্ষণা নিজে কাদা থেকে তুলে ধুলো-বালি ধুয়ে আঁচলে মুছে লোকচক্ষে ধরে আত্মসন্তোষ লাভ করেছিলেন, লোকে যদি সে বস্তুকে মূল্যবান বলে বুঝে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, সোনা বাঁধিয়ে আঙটি বানাতে চায়, সুলক্ষণার ভাল লাগবে কেন?
সুলক্ষণার আর ওকে ঘষে-মেজে উজ্জ্বল করে তোেলবার অবকাশ থাকল কই? কোথায় থাকল বড়মুখ করে বলতে পারার অবকাশ, দেখলি তো আমার হিসেব ঠিক কি না? বুঝলি তো আমি কাঁচ কি হীরে চিনতে পারি কি না।
তাই চৈতালীর ওপর একান্ত স্নেহ থাকলেও ওদেরটা বাড়াবাড়ি ঠেকছে। সেদিন ওরা সুলক্ষণার বুদ্ধিকে বিদ্রূপ করেছিল, আজ সুলক্ষণা ওদের সুবুদ্ধিতে বিরক্ত হচ্ছেন!
কিন্তু সে কথা ওদের বোঝার ক্ষমতা নেই।
তাই সুদক্ষিণা চৈতালীকে দোতলায় নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লেগেছে, কতদূর লেখাপড়া করেছে চৈতালী, গল্পের বই পড়তে পারে কিনা। যদি পারে তো পড়ক না বসে বসে, কত তো গল্পের বই রয়েছে সুদক্ষিণার ঘরে। ওর ছেলেবেলার বইগুলোও আছে। বড়দের বেশী শক্ত বই না পড়তে পারে তো ওইগুলোই পড়ক। কত মজার মজার গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প
চৈতালীর বাবা মারা গেছে!
এই খবরটাই সুদক্ষিণাকে দ্রব করে দিয়েছে। আহা, হোক চোর-ঘঁচোড় বিচ্ছিরি বাবা, তবু বাবা তো! সুদক্ষিণা তো জানে, বাবা মারা গেলে কী কষ্ট হয়।
সুদক্ষিণার তো তবু মা আছেন।
মায়ের মত মা!
আর ও বেচারী জীবনে কখনো মাকে চোখেই দেখেনি।
তবে?
সহানুভূতি না এসে পারা যায়?
ভাল না বেসে পারা যায়?
এ সহানুভূতি, এ ভালবাসা চৈতালীর ওপরও কাজ করছে বৈকি। দূরীভূত করছে তার নিজেকে সরিয়ে রাখবার প্রচেষ্টাকে আর কাঠিণ্যকে।
সুলক্ষণার স্নেহ তাকে আশ্রয় দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু অনেকখানিটা জায়গা দিতে পারেনি, দিতে পারেনি নিজেকে নিশ্চিন্তে মেলে ধরবার মত অনেকটা পরিসর। যেন সুলক্ষণার একান্ত নিজস্ব বস্তু ছিল ও সুলক্ষণার হাতের খুঁটি। এই খুঁটিটি নিয়ে সুলক্ষণা ওঁর ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলার ছক্ পেতে বসেছেন।
সুলক্ষণার ইচ্ছা আর নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চৈতালী নামক খুঁটিটি সুলক্ষণাকে জয়ের গৌরব এনে দেবে।
তাই সুলক্ষণার স্নেহগণ্ডির পরিসরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সেই দায়ের ভার বহন করছিল চৈতালী, সুদক্ষিণা আর কৌশিক সেই স্বল্পপরিসর ঠাই থেকে টেনে বার করে আনছে দায়হীন খোলা হাওয়ার দেশে।
তবু ভেসে যায় না চৈতালী।
সুলক্ষণাকেই আঁকড়ে থাকে।
শুধু মনের মধ্যে এক বিচিত্র আলোর খেলা চলে।
সুদক্ষিণা বলে, দেখ, বয়েস হিসেবে তোমাকে দিদি টিদি গোছের কিছু একটা বললে ভাল দেখাত, কিন্তু সে সব আমার কেমন আসে না। তাই নাম ধরেই ডাকি। কিছু মনে কর না তো?
চৈতালী কৃতার্থতায় রঙিন হয়ে ওঠে।
বলে, কী যে বলেন।
কৌশিক বলে, দেখ ক্ষে, অত ঘটা করে ক্ষমা চাওয়ার ফার্সটা না করে ওর এই সব আপনি আজ্ঞে গুলো বন্ধ করলে পারতিস। অন্তত সেটাই ভাল দেখাত। বয়সে খুব মারাত্মক একটা ডিফারেন্স আছে বলে তো মনে হয় না।
সুদক্ষিণা একটু লাল হয়ে উঠে বলে, জানি না তো বাপু। দেখে একটু বড় মনে হয়, তাই বলছি। তোমার বয়েস কত গো চৈতালী?
চৈতালী আস্তে বলে, একুশ।
তবে? সুদক্ষিণা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আমার তো সবে কুড়ি সুরু হয়েছে।
মেয়েরা তো কখনো ঠিক বয়েস বলে না– কৌশিক মন্তব্য করে।
মেয়েদের সম্পর্কে এত জ্ঞান সঞ্চয় করলি কী করে ছোড়দা? সুদক্ষিণা বলে, তবে এখনো একটু কাঁচা আছিস। এ জ্ঞানটুকু জন্মায়নি ঠিক বলে না বলে, বয়েস বাড়িয়ে বলে। চৈতালী–
আহা ওর কথা কে বলছে? আমি বলছি তোর কথা–
আমার কথা? বড্ড তোর সাহস বেড়েছে দেখছি ছোড়দা, আমায় রাগাতে আসছিস। আমি বয়েস কমাচ্ছি?
অসম্ভব কি?
ওঃ তাই তো! আমার বয়েস জানিস না তুই?
দেবতা জানে না, তো আমি কোন্ ছার!
বেশ, বেশ, আমি বলছি আমার বয়েস দশ! হল তো?
ভাইবোনের এই কৌতুক কলহে হেসে ফেলে চৈতালী আর বোধ-করি স্থানকাল-পাত্র বিস্মৃত হয়েই বলে ওঠে, মেয়েদের বয়েস লুকোনো নিয়ে আমার মেসোমশাই যা মজার একটা গল্প বলতেন। বিলেতের গল্প অবিশ্যি। ওখানের একজন ধনীলোক কাজে অবসর নেবার পর গ্রামে বাস করতে গেলেন। থাকতে থাকতে তার ইচ্ছে হল, গ্রামে বিখ্যাত হবার জন্যে কিছু একটা করবেন। ভেবে চিন্তে তাই ঘোষণা করলেন, গ্রামে যদি কোন একশো বছরের বুড়ি থাকে, তাকে তিনি তাঁর বাকী জীবন মাসে পঁচিশ পাউন্ড করে পেনসন দেবেন।
দেখা গেল, ঘোষণা শুনে সেই পেনসনের দাবীদার হয়ে কেউ এল না।
তিনি ধরে নিলেন গ্রামে একশো বছরের বুড়ি নেই। তখন আবার ঘোষণা করলেন গ্রামের আশী বছরের বুড়িরা ওই পেনসন পাবে।
দেখা গেল তাতেও একজনও সাড়া দিল না। ধনী ভদ্রলোক ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবলেন, গ্রামের মহিলারা সকলেই কি অল্পজীবী?
অতঃপর তিনি বললেন, ষাট বছর বয়সের মহিলা মাত্রেই তার ওই পেনসনটা পেতে পারবেন। এমন আশ্চর্য তাতেও গ্রাম নীরব। উনি চটে মটে বললেন, ব্যাপার কি? এখানে কি পাইকারি হারে বয়স্থা মহিলারা খুন হন? নচেৎ এ রকমটা হবে কেন?
রেগে গিয়ে ভদ্রলোক চল্লিশ বছরের মহিলাদের ওপর পেন ধার্য করলেন, এবং তাতেও সেই পুরনো ফলই পেলেন। এবারে ভদ্রলোক আর রাগও করলেন না। আর হতাশও হলেন না। খুব কৌতুক অনুভব করলেন। সেই কৌতুকের বশবর্তী হয়ে বললেন, পঁচিশ বছরের মেয়েদের এই পেনটা দেবেন তিনি।
এইটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দলে দলে মহিলা আসতে সুরু করলেন তাঁর বাড়িতে। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচানব্বই পর্যন্ত। ভদ্রলোক তো দিশেহারা।
ঝোঁকের মাথায় গল্পটা বলে ফেলে ভারী কুণ্ঠিত হয়ে পড়লো চৈতালী। এসে পর্যন্ত একসঙ্গে এর সিকি কথাও কোনদিন বলেনি। তা ছাড়া তার কি এখন মজার গল্প বলার সময়? কী না জানি ভাবল এরা।
এরা কিন্তু কিছুই ভাবল না। বরং হেসে উঠল এবং কৌশিক সপ্রশংস হাসি-হাসি মুখে প্রশ্ন করল, কার কাছে শুনেছিলে এ গল্প?
আমার মেসোমশাই।
বলে আরও জড়সড় হয়ে পড়ে চৈতালী। তার যে একটা অতীত ছিল, এবং সেখানে তার আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি ছিল, একথা কি প্রকাশ করবার? অন্তত এদের কাছে প্রকাশ করবার? সেই অতীতকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলবার সংকল্পই তো করেছে সে, বাপের মৃতদেহের সামনে।
কিন্তু এরা এতসব বোঝে না।
বরং এরা অবাকই হয়, আর বোধকরি কিছুটা লজ্জিতও।
ইস্, সুদক্ষিণা আবার জিগ্যেস করেছিল বাংলা বই পড়তে পারে কি না, অন্তত ছোটদের বই-টই।
কৌশিকও আগে ভাবেনি, এমন গুছিয়ে সুন্দরভাবে গল্প বলার মত বুদ্ধি ওর থাকতে পারে। এমন এক উৎকট পরিবেশের মধ্যে দেখা গিয়েছিল মেয়েটাকে!
সন্দেহ নেই, সত্যিই ভাল ভদ্রঘরের মেয়ে, কোন একটা দৈব-দুর্বিপাকে পড়েই
কী সেই দুর্বিপাক?
প্রলোভনে ভুলে কুলত্যাগ?
গুণ্ডার অত্যাচার?
দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় গৃহচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে
কিন্তু তাই বা কেমন করে হবে? বাপ ছিল তো! বাপের কাছেই ছিল এযাবৎ। বাপের পদবী বলেছিল মজুমদার। অর্থাৎ জাত ভালই। কী তবে ওর ইতিহাস?
যে ইতিহাস এমন একটা মার্জিত বুদ্ধি সভ্য মেয়েকে ছিঁচকে চুরিতে নামায়!
কেমন করে উদ্ধার করা যায় সে-ইতিহাস।
ওর পক্ষে কি বলা সম্ভব?
আর ওকে জিগ্যেস করাই কি কৌশিকের পক্ষে সঙ্গত?
তবে যেটা জিগ্যেস করা সম্ভব, সেটা করে।
তোমার সেই মেসোমশাই বুঝি মারা গেছেন?
হ্যাঁ। আমার যখন এগারো বছর বয়েস।
ও! তোমায় বুঝি খুব ভালবাসতেন তিনি?
খুব! কত যে গল্প বলতেন! আর কত বিষয় যে শিক্ষা দিতেন সেই সব গল্পের মধ্যে দিয়ে।
বলেই পাংশুবর্ণ হয়ে ওঠে চৈতালী।
শিক্ষা!
শিক্ষা কথাটা মুখে আনছে সে!
যদি কৌশিক হেসে ওঠে?
যদি বলে ওঠে, তা বটে। খুব ভাল শিক্ষাই তিনি দিয়েছিলেন।
কিন্তু এরা তা করবে না।
এরা ইতর নয়।
তাই সুদক্ষিণা বলে ওঠে, যাই বল মেসোমশাই পিসেমশাই থাকা খুব ভালো। বেশ আদর হয়, তাই না?
আর কৌশিক বলে, উনিই বোধ হয় পড়াতেন?
চৈতালী মাথা নীচু করে বলে, যতদিন ওঁর কাছে থেকেছি। অবিশ্যি স্কুলের পড়া পড়াতে বিশেষ ইয়ে করতেন না, গল্প কবিতা এই সবের মধ্যে দিয়ে
গল্প কবিতা!
ও বাবা! আবার স্কুলেও পড়েছে!
কর্পোরেশান স্কুলেই খুব সম্ভব। সুদক্ষিণা সেটা জেনে নেবার কৌতূহল সংবরণ করতে পারে না, বলে, কোন্ স্কুলে পড়তে?
ভিক্টোরিয়া। ওটাই তবু বাড়ির কাছে ছিল—
ভিক্টোরিয়া! সেরেছে। তাহলে তো5, সুদক্ষিণা যেন বিচলিত হয়ে ওঠে।
কোন্ ক্লাস পর্যন্ত এটা জিগ্যেস করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই উত্তরটা পেয়ে যায়। চৈতালী নিজেই বলে। স্বগতোক্তির মতই বলে ওঠে, কদিনই বা পড়তে পেলাম। ক্লাস সিক্সে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তো
আহা, সুদক্ষিণা আপন মনে বলে, আর পড়া হল না? কেউ পড়তে পেল না– ভাবতে এত খারাপ লাগে।
চৈতালী মৃদু স্বরে বলে, না, তারপরও পড়েছিলাম দুতিন বছর, বাবার কাছে আসার পর, সে একটা বাজে স্কুল
সেই বাজে স্কুলের সামান্য মাইনেও যে বাবা ঠিকমত দেয়নি বলে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দিয়েছিল, সে কথা আর বলে না চৈতালী। তা ছাড়া নিজের সেই বদভ্যাস! স্কুলের অন্য মেয়েদের জিনিস বাড়িতে আনা। ছি ছি!
বাবার কাছে আসার পরের ইতিহাস তো সবই বাজে বিশ্রী। চোর হয়ে উঠেছিল চৈতালী তখন।
ভাবলে অবাক লাগে, কী মুখরা, কী রণচণ্ডী ছিল সে! নিজের সেই মূর্তিটাকে বুঝি এখন আর চৈতালী চিনতে পারছে না।
তার বাবার বন্ধুদের আড্ডার সেই রসদ যোগানদার মেয়েটা কি সত্যিই চৈতালী?