দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব – জাহিদ হোসেন
উৎসর্গ :
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড
২০১০-এ বিবিএ শেষ করার পর মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। চাকরি-বাকরি পাচ্ছিলাম না। তখন ন্যাশনাল ব্যাংকের চাকরিটা পাই।
থ্যাংক ইউ ফর অল দ্য মেমোরিজ, এনবিএল
ভূমিকা
ভূমিকায় খুব বেশি কথা বলবো না। জানি না বইটা কী রকম হলো, এর বিচারের ভার আপনাদের। আমি আমার পছন্দের জায়গা থেকে একটা বই লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্যাটার্নের দিক দিয়ে এই বই গাই রিচি’র একটা ফিল্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত-স্ন্যাচ। আবার স্পাই থৃলার জনরা দ্বারাও মারাত্মক অনুপ্রাণিত ছিলাম আমি। স্পাই থৃলার আমার খুব পছন্দের একটা জনরা। আমার সবচেয়ে প্রিয় দুই থৃলার লেখক স্পাই থৃলারেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন-জন লে ক্যারে ও রবার্ট লুডলাম।
বইটাতে অনেককে ট্রিবিউট দেয়া হয়েছে। লেখক, ফিকশন্যাল চরিত্র মিলিয়ে লিস্টটা কম বড় হবে না। কাকে কাকে ট্রিবিউট দেয়া হয়েছে। আপনারাই না হয় খুঁজে বের করুন।
বরাবরের মত বাতিঘরের প্রকাশক নাজিম ভাই’কে আলাদাভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বইয়ের নাম উদ্ভট হওয়া সত্ত্বেও একটিবারের জন্যও নাম বদলাবার অনুরোধ না করার জন্য এবং আমার ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য। বিশেষ ধন্যবাদ রাজীব দত্তকে–তার গ্র্যাফিত্তিকে কেন্দ্র করে বইটি লেখার সুযোগ করে দেবার জন্য।
ধন্যবাদ জানাই আমার বৌ জেসমিন রহমানকেও। তুমি না থাকলে বইটা আরো দ্রুত শেষ হতো। হে হে হে!
বইটা লিখে আমি যে রকম আনন্দ পেয়েছি, আপনারা যদি তার ছিটেফোঁটাও পান, তাহলেই আমি নিজেকে সার্থক মনে করবো। এবং একটা সর্নিবন্ধ অনুরোধ : এটা একটা ফিকশন। দয়া করে, একে ফিকশন হিসেবেই দেখুন। বেশি কথা বলবো না বলে, শেষমেষ অনেক কিছুই বলে ফেললাম। অভ্যাস খারাপ!
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। আপনাদের মঙ্গলময় জীবন কামনা করছি।
জাহিদ হোসেন
ঢাকাদক্ষিণ, সিলেট
ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৯
.
And Jehovah God commanded the man, saying, Of every tree of the garden thou mayest freely eat: but of the tree of the knowledge of good and evil, thou shalt not eat of it: for in the day that thou eatest thereof thou shalt surely die.
— Genesis 2:16-17
.
মান্নান মিয়ার রেসিপি:
দুধ চা যেভাবে বানাবেন।
যা যা লাগবে :
১. দেড় কাপ দুধ
২. চা-পাতা : এক চা চামচ
৩. চিনিঃ দুই চা চামচ
জ্বাল দেয়া দুধ থেকে দেড় কাপ নিয়ে চা পাতা দিয়ে ফুটাতে হবে। কাপে দুই চামচ চিনি দিতে হবে। অথবা, চিনি স্বাদমতো দিতে পারেন। কাপের উপর ছাকনি রেখে চা ঢালুন। তারপর চামচ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে পরিবেশন করুন গরম গরম চা!
বিঃদ্রঃ উঁচু থেকে কাপে চা ঢাললে কাপে ফেনা হয়। ফেনা চাইলে এই পদ্ধতি বাঞ্ছনীয়।
.
পূর্বাভাস
সবাই বলে মান্নান মিয়ার হাতে জাদু আছে। তার দোকানের এক কাপ চা স্রেফ চা-পাতা, পানি আর চিনি সহযোগে প্রস্তুতকৃত কাপ ভর্তি এক ধরণের বিশেষ তরল নয়। এ যেন অমৃত, এক কাপ খেলেই শরীর-মন নিমেষে চাঙ্গা হয়ে যায়।
যে জন্য স্রেফ এক কাপ খেয়ে কারো পেট ভরে না। তাকে দ্বিতীয় কাপের অর্ডার করতেই হয়। মান্নান মিয়াও তাই কেটলি গরম করতে লেগে যায়। লিকার মেশায়, দুধ-চিনি দেয়, কখনো দেয় আদা কিংবা মশলা। তারপর গরম গরম পরিবেশন করে।
মান্নান মিয়ার চার দোকান তাই সবসময় জমজমাট থাকে। সাকুল্যে দুটা বেঞ্চ দোকানে। দুটোই খদ্দেরে ভর্তি থাকে। চা খোররা ভিড় জমায়। চা খায়, বিস্কুট খায়, সিগারেট ফুকে, আলাপ জমায়।
এমন না যে মান্নান মিয়া খুব খদ্দের অন্তঃপ্রাণ। মুখে সবসময় অমায়িক হাসি ঝুলে থাকে। কাস্টমার যাই বলে তা-ই মাথা পেতে মেনে নেয়।
না, মোটেও না। মান্নান মিয়া ঠিক তার উল্টা। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি
লোকটার চেহারায় হালকা মঙ্গোলিয়ান ধাঁচ আছে। কেউ কেউ বলে জাপানিজ ধাঁচ, কেউবা চাইনিজ। মানে, দেখে ঠিক বাংলাদেশি বলে মনে হয় না আর কি। মাথায় পাতলা চুল, গায়ের রং ফ্যাকাশে। মাথায় চুল কম থাকলেও তার দেহের অন্যান্য জায়গায় কিন্তু চুলের কমতি নেই। তার শার্টের ফোকর দিয়ে বের হয়ে এসেছে বুকের কালো লোম। শুধু বুকে না। তার হাতে লোম, পায়ে লোম, গলার অর্ধেকও লোমে ঢাকা।
ছেলে-ছোকরারা ফাজলামি করে তাকে গরিলা বলে ডাকে। যদিও গরিলার মত ভুসভুসে কালো না সে। রং পরিস্কার।
সমস্যা অবশ্য তার নোম কিংবা দেহের রংয়ে না। সমস্যা তার মেজাজে। মান্নান মিয়ার মেজাজ অত্যাধিক চড়া। কাস্টোমার যে ব্যবসায়ের লক্ষী, এ কথাটা প্রায়ই ভুলে যায় সে। সামান্য এদিক-সেদিক হলে চালু হয়ে যায় মুখ।
অনেকেই সিগারেট খেয়ে সিগারেটের বাঁট চা’র কাপেই গুঁজে দেয়। এটা দুচোখে দেখতে পারে না সে। একবার করে দেখেন, রীতিমত কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠবে মান্নান মিয়া।
চাউলের গলির মাথায় চারটা ফ্লোর নিয়ে একটা প্রাইভেট ভার্সিটি-বেস্ট ইউনিভার্সিটি। সংক্ষেপে বিইউ। বিইউ’র ছেলেপিলেরা সকাল নেই রাত নেই মান্নান মিয়ার চার দোকানে পড়ে থাকে। বিবিএ ফার্স্ট ইয়ারের এক ছাত্র, নাম পঞ্চম, কদিন আগে এরকম কাপে সিগারেট গুঁজে দিয়েছিল। বেঞ্চে বসে বসে চারটা বেনসন স্যুইচ খতম করেছিল সে। খাওয়া শেষে চারটাই গুঁজে দিয়েছিল চা’র কাপে।
মান্নান মিয়া তো ফায়ার! দুদিনের পোলা, নয়া সিগারেট খাওয়া শিখছে। দুনিয়াডারে এখন অ্যাশট্রে ভাবে! যেখান ইচ্ছা সিগারেটের পুটকি ফালায়া দেয়।
পঞ্চমেরও বয়স কম, রক্ত গরম। চেতে গিয়ে সেও দু’কথা শুনিয়ে দেয়। চার ব্যবসা মান্নান মিয়ার পেছন দিয়ে ভরে দেবে বলে।
ক্ষুদ্ধ মান্নান মিয়া রেগেমেগে পঞ্চমের কলার চেপে ধরে।
অবস্থা খারাপ দিকে মোড় নেয়। মান্নান মিয়াকে সাইজ করার জন্য বন্ধু-বান্ধব জড়ো করে পঞ্চম। তর্কাতর্কি বাড়ে, হাতাহাতি হয়। শেষমেষ এলাকার কিছু মুরুব্বীদের হস্তক্ষেপে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। দু’জনের মধ্যে মিটমাট হয়ে যায়। হাত মিলায় দু’জন, উপস্থিত জনতার চাপাচাপিতে বুকও মিলায়।
এরপর থেকে দুজনের মধ্যে দারুণ ভাব। পঞ্চম এখন মান্নান মিয়ার চা’র দোকানেই পড়ে থাকে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, চা খায়, সিগারেট কুঁকে। মুড ভালো থাকলে গান ধরে। পঞ্চমের গানের গলা ভালো। মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে এসে চা খোরদের গান শোনায় ও।
রাস্তা থামায় দিলো
কাফেলা এলো
দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া এলো
দিল্লীতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া এলো।
মান্নান মিয়া আপাতদৃষ্টিতে একটু রগচটা হলেও আদতে সে মানুষ খারাপ না। ওর ব্যক্তিগত জীবন এক রহস্যের নাম। খুব কম লোকই ওর ব্যাপারে জানে। যা জানে তাও খুব সীমিত। পানির ট্যাংকির পেছনে একটা কলোনি আছে। ঐ কলোনিতে থাকে ও। দোকান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। সকালে দোকানে আসে, মাঝরাতে ফিরে। এর বাইরে ওর কোন জীবন আছে কিনা, তা কেউ জানে না। মান্নান মিয়া বিবাহিত না অবিবাহিত, এ সম্বন্ধেও কারো কিছু জানা নেই। বিবাহিত যদি হয়েও থাকে, তবে বৌ এখানে থাকে না। অন্য কোথাও থাকে।
এমনিতে মেপে মেপে কথা বলে সে। কিন্তু মনমেজাজ ভালো থাকলে ফুরফুরিয়ে কথা বলে, খদ্দেরদের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। অদ্ভুত সব গল্প। হাঁ হয়ে মানুষ শোনে। ওর গল্প শুনলে মনেই হয় না মান্নান মিয়া সামান্য এক চা-দোকানি। চা-সিগারেট বিক্রি করে পেট চালায়। তখন মনে হয় মান্নান মিয়া অসামান্য এক গল্পকার, ভাগ্যের ফেরে চা ব্যবসায়ে নেমেছে।
এমনিতে পেটে বোমা ফেললেও ওর মুখ থেকে কথা বের করা যায় না। মান্নান মিয়া যদি গল্প বলতে চায় নিজের ইচ্ছাতেই বলবে। কোনকিছুর লোভ দেখিয়ে ওর পেট থেকে গল্প বের করা অসম্ভব।
বৃষ্টি-বাদলার দিনে মান্নান মিয়ার মেজাজ অত্যাধিক ভালো থাকে। সে তখন গুনগুনিয়ে গান গায়। রাজ কাপুর অভিনীত সিনেমার গান–
ঘারবার নেহি
সানসার নেহি
মুঝসে কিসিকো পেয়ার নেহি
মুঝসে কিসিকো পেয়ার নেহি…
গুনগুন গান শুরু হলেই ওর নিয়মিত খদ্দেররা বুঝতে পারে মান্নান মিয়ার মেজাজ আজ ভালো। ওরা নড়েচড়ে বসে। এক কাপ চা’র জায়গায় দু’কাপ চা অর্ডার দেয় তখন। সময় নিয়ে চা খায়। কারণ ওরা জানে মান্নান মিয়া আজ গল্প বলবে। দারুণ কোন গল্প।
আজ সারাদিন ধরেই টিপটিপ বৃষ্টি দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। আবহাওয়াও বেশ ঠান্ডা। ভার্সিটির কিছু পোলাপান ছিল বিকাল পর্যন্ত। তারপর থেকে খদ্দেররা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। কিছু রিকশাওয়ালা ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে চা খেতে আসে। গরম গরম চা আর টোস্ট বিস্কুট। অথবা চা পাউরুটি-কলা। কিন্তু নিয়মিত কোন কাস্টমারকে দেখা যায় না। এক ভ্যানওয়ালা থামলো। সিগারেট নিলো। গোল্ড লিফ। আর পান-সুপারি। খানিকপর আরেকজন আসলো। কাকভেজা অবস্থা। গরম চা গালে ঠেকিয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ। ওর সাদা শার্ট ভিজে গেছে, প্যান্টের অবস্থাও সুবিধার না। হাঁটুর নিচ থেকে কাদায় মাখামাখি।
রগচটা মান্নান মিয়া চেষ্টা করে খেজুরে আলাপ শুরু করার। “কী যে বালের বৃষ্টি শুরু হইলো কন দেহি ভাই। ব্যবসার অবস্থাও খুব খারাপ।”
সাদা শার্ট কিছুই বলে না। একবার বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে সায় জানায়। তারপর আবার গরম চা গালে চেপে ধরে।
মান্নান মিয়া হাল ছাড়ে না। “ঢাকার কিছু জায়গা ডুইব্যা গেছে মনে অয়। ঢাকায় একটু বৃষ্টি দিলেই অইলো…”।
চাটা এক ঢোকে শেষ করে দেয় লোকটা। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে-”আরেক কাপ দেন।”
“মশলা চা খাইবেন? খায়া দেখেন, আরাম পাইবেন।”
“মশলা চা?” লোকটা যেন নিক্তিতে ওজন করে নেয়-মশলা চা না দুধ চা? শেষ পর্যন্ত মশলা চার পাল্লাই ভারি হয়। “দেন, মশলা চাই দেন।”
হুড়মুড় করে বিইউ’র কিছু পোলাপান এসে ঢুকে। মান্নান মিয়ার রেগুলার কাস্টমার। তিতাস, রবিন, জাকি, অর্ণব। এসেই হড়বড়িয়ে বলে–”মামা চারটা বেনসন, চারটা মালাই চা। কড়া করে। খুব কড়া করে।”
পরিচিত মুখ দেখে মান্নান মিয়া বেজায় খুশি হয়। কেতলি বসায়। গুনগুনিয়ে গান ধরে।
পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া হ্যায়…
“মামা মনে হয় খুব মুডে আছো…” জাকি বলে।
“আমগো আর মুড কিসের? পেট লইয়া কুল পাই না, আবার মুড।” প্রসন্ন মুখে জবাব দেয় মান্নান মিয়া। বেনসনের প্যাকেট খুলে চারটা শলাকা বের করে ওদের হাতে ধরিয়ে দেয়।
জাকিরা তক্কে তক্কে থাকে। ওরা জানে মান্নান মিয়া এখন গল্প বলার মুডে চলে গেছে। আলতু-ফালতু কথা বলে এখন ওর মেজাজ খিঁচড়ে দেয়ার কোন মানে নাই।
পাঁচজনের হাতে চার কাপ তুলে দেয় মান্নান মিয়া। চারটা মালাই চা, একটা মশলা।
জাকিরা চায়ে চুমুক দেয়, সিগারেট ফুঁকে। বাইরের টিপ টিপ বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয় অ্যাশফল্ট রাজপথ। এলাকার পুরনো পাগল বস্তা বসির মাথায় বস্তা পেঁচিয়ে দৌড়াচ্ছে গলিময়।
“বৃষ্টির মায়েরে চুদি, বৃষ্টির মায়েরে চুদি।”
জনশ্রুতি আছে বস্তা বসিরের এক বৌ ছিল। বৃষ্টি নাম। বিয়ের বছর খানেক পর বৌ এক দোকানদারের হাত ধরে ভেগে যায়, আর ফিরে নি। তারপর থেকেই বস্তা বসিরের মাথা খারাপ। সারা শরীরে বস্তা পেঁচিয়ে ঘুরে। তবে ওর হৃদয়বিদারক কাহিনী নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করে। কারণ ওর বৌয়ের নাম প্রায়ই পাল্টে যায়। আজ এটা, তো কাল আরেকটা। গত দুই মাস ধরে ওর বৌয়ের নাম বৃষ্টি। এর আগে ছিল মালতী, এরও আগে সন্ধ্যা।
বস্তা বসির দৌড়াতে দৌড়াতে গলির শেষ মাথায় গিয়ে হারায়। মৃদু হেসে গল্প শুরু করে মান্নান মিয়া। পাঠকের সুবিধার্থে গল্পটা প্রমিত ভাষায় দেয়া হলো–
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখনো বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয় নাই। দুনিয়া ছিল অন্ধকারে ঢাকা। মানুষজন কম ছিল। খুনাখুনি-রাহাজানি হিংসা এগুলো কম ছিল। মানুষের মধ্যে শান্তি ছিল, মিল-মহব্বত ছিল।
সেই যুগে এক সন্ত বাস করতেন। একেকজন তাকে একেক নামে ডাকে, তার আসল নাম এখন আর কেউ জানে না। ওটা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। সে কালে গহীন এক জঙ্গল ছিল। খুব দুর্গম, হিংস্র জন্তু জানোয়ারে ভর্তি। ওই জঙ্গলের মাঝে ছিল এক কুঁড়েঘর, ওখানে থাকতেন তিনি। সন্ত নিরামিষাশী ছিলেন, জঙ্গলে যে ফলমূল মিলতো তাই পেড়ে খেতেন। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা হ্রদ বয়ে গেছে। হৃদের পানি সুমিষ্ট। ওখান থেকেই পানি সংগ্রহ করে খেতেন তিনি। সন্ত কারো সাতে পাঁচে থাকেন না। দিনের বেশির ভাগ সময় ধ্যানে কাটে তার।
সন্ত খুবই দয়ালু ছিলেন। মানুষ, হিংস্র জীব-জন্তু-সবার জন্যই ছিল তার অসীম দয়া। একবার তীরবিদ্ধ এক বাঘকে সেবা-শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেন তিনি, আরেকবার সারালেন হিংস্র এক নেকড়েকে। শিকারীদের হাতে জখমিকৃত পশুপাখিরা তার পরিচর্যায় নতুন জীবন ফিরে পেত। তিনি লতাপাতা দিয়ে, ভেষজ উপাদান দিয়ে যে মেডিসিন তৈরি করতেন তা ছিল ধন্বন্তরি। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজন দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে আসা শুরু করে। তিনি প্রায় সব রোগই সারাতে পারতেন। খেয়াল রেখো, আমি বলেছি প্রায়। কারণ একটা জিনিস উনি সারাতে পারতেন না। সেটা হলো, মৃত্যু।
অনেক মানুষ তার মৃত্যুপথযাত্রি আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে হাজির হতো, বুকে আশা সন্ত তার প্রিয়জনকে সারিয়ে তুলবেন। কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরতে হতো তাকে। মুত্যুকে হারানোর কোন তরিকা সন্তের জানা ছিল না।
সন্ত বিষণ্ণ হয়ে উঠতেন। মানুষের মরণশীলতা তাকে পীড়িত করতো। তিনি এর প্রতিকার খুঁজতেন। জড়িবুটি নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন। যদি কোন উপায় মিলে।
কিন্তু না।
মৃত্যু অনিবার্য। এর থেকে কারো মুক্তি নাই।
একদিন সন্ত জঙ্গলের গভীরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। জঙ্গলী অনেক বিষাক্ত লতা-পাতা আছে, যা খেলে মানুষ মারা যায়। ওরকমই কিছু একটা মুখে দিয়ে থাকবেন তিনি। নিমিষে তার সারা শরীর নীল হয়ে যায়, মুখ দিয়ে গঁাজলা বের হতে থাকে। সন্ত বুঝতে পারেন তার অন্তিম সময় সমাগত, মৃত্যু দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে।
এমন সময় কোথা থেকে একটা গাছের পাতা তার সামনে এসে পড়ে। উৎসুক সন্ত পাতাটি হাতে নেন, মুখে পুরে চিবান। অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে খানিকটা ভালো বোধ করছেন। দূরে একমই আরো কিছু পাতা পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। ওগুলোও মুখে পুরে চিবাতে থাকেন সন্ত। ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। এভাবেই স্রেফ পাতা চিবিয়ে খেয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন এ পূণ্যাত্না।
কৌতূহল হয় তার। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো এ কোন গাছের পাতা?
অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হন তিনি। খুঁজে বের করেন রহস্যময় ঐ গাছ। গাছগুলো জঙ্গলের গহীনতম কোণে এক উঁচু টিলায় অবস্থিত, টিলার অপর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক সুদৃশ্য ঝর্ণা।
ঝর্ণায় অবগাহন করেন সন্ত। তিনি বুঝতে পারেন সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি এ দিকে কোন জনমানুষের পা পড়েনি।
উঁচু গাছগুলো পরীক্ষা করে দেখেন তিনি। আকাশপানে ছড়িয়েছে এর মাথা। উচ্চতায় কমপক্ষে একো-দুশো ফুট তো হবেই। আর এর ঘ্রাণ তীব্র, নেশাধরানো।
হঠাৎ প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করেন সন্ত। পুরো দেহজুড়ে আরামদায়ক আলস্য এসে ভরে করে, শরীর যেন নড়ছেই না। বাধ্য হয়ে সুউচ্চ গাছগুলোর ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
স্বপ্নে এক মুন্ডিতমস্তক শিশুকে দেখতে পান সন্ত। আনমনে খেলছে। ধীরে ধীরে তার মতো আরো কিছু শিশু এসে উপস্থিত হয় ওখানে। তাদের সকলের মাঝে শান্ত-স্নিগ্ধ ভাবভঙ্গি, পরনে শ্বেতশুভ্র বসন। তারা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে-’আপনি অমরত্বের চাবি খুঁজে পেয়েছেন মহাত্মা। আপনাকে অভিবাদন।’
তারা তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়, মাথায় পরায় রাজমুকুট। পুষ্পবৃষ্টি শুরু হয়, মৃদু বাজনা বাজে। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। মিষ্টি চেহারার এক পিচ্চি এসে তার হাতে কিছু একটা ধরিয়ে দেয়। হাত খুলে সন্ত দেখেন রহস্যময় ঐ গাছের পাতা।
পিচ্চিটা তখন মিটিমিটি হাসছে। “নিন, মহাত্মা । অমরত্ব!”
সন্ত বুঝতে পারেন মৃত্যুরোগ সারানোর তরিকা পেয়ে গেছেন তিনি। ঘুম ভাঙ্গলে নিজের ভেতরে অন্য ধরণের এক সজীবতা খুঁজে পান সন্ত। স্বপ্নের মাহাত্ন্য তিনি অনুধাবন করতে পারেন।
টিলার গোড়ায় কুঁড়েঘর বানিয়ে ওখানেই বাস করতে শুরু করেন তিনি। এখন মৃত্যুপথযাত্রি কোন মানুষ কিংবা পশু তার কাছে এলে খালি হাতে আর ফিরে যায় না। তিনি রহস্যময় ঐ পাতার সাহায্যে তাদেরকে সারিয়ে তুলেন।
তারপর কেটে গেছে কত সহস্র বছর। কত মানুষ এলো, গেল। নতুন নতুন আবিষ্কারে উন্নতির শিখরে পৌঁছাল মানুষ। কিন্তু পাদপ্রদীপের আড়ালেই রয়ে গেলেন ঐ সন্ত। বিস্মৃতির অতলে হারাল তার আবিষ্কার, হারিয়ে গেল ঐ রহস্যময় পাতা ও গাছ।
কেউ কেউ বলে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ঝর্ণার ধারে আজো তার কুঁড়েঘর বহাল তবিয়তে আছে। মানবজাতির কল্যাণ কামনায় আজো তিনি ধ্যানমগ্ন।
গল্প শেষ হলেও রেশটুকু রয়ে যায়। চার বন্ধুই আনমনা। গালে গরম চার কাপ লাগিয়ে বসে থাকা লোকটাও নিশ্চপ, কী জানি ভাবছে। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে অবিরত।
“ঐ গাছের পাতাটা কী মান্নান ভাই?” জাকি প্রশ্ন করে। গল্পের প্রভাবেই হয়তোবা খানিক আগের সম্বোধন করা মামা এখন পরিণত হয়েছে ভাইয়ে।
মান্নান মিয়া মুচকি হাসে। উনুনে আবারো কেতলি চাপিয়েছে সে। আরো এক কাপ চা খাবে সবাই। চারটা মালাই, আর একটা মশলা।
“পাতাটার ব্যাপারে অনেকেই অনেক কথা বলে, বুঝলেন নি। কেউ কেউ বলে এরকম কোন গাছ দুনিয়ায় নাই। কেউ কেউ বলে ঐ গাছটা আসলে জ্ঞানবৃক্ষ-যে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খায় সেই অমর হয়। শারীরিকভাবে অমর না, তয় তার নাম যুগ যুগ ধইরা মানুষ মনে রাখে। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খায়া সে অনেক জ্ঞানী হয়, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের বেবাক রহস্য তার জানা হইয়া যায়। এটা হইলো একটা মত। আবার আরেকটা মতও প্রচলিত আছে, যেখানে এই গল্পটার ধারণা মাইনা নেয়া হয়। যেখানে বলা হয় যে আসলেই এরকম গাছ আছে, ঐ গাছের পাতা ও পাতার রস মানুষদের জ্যান্ত কইরা তুলে। ঐ পাতাটা হইলো গিয়া…”
থেমে কাপে চা ঢালে মান্নান মিয়া। দুধ-চিনি মেশায়, চামচ দিয়ে নাড়ে। পাঁচজনই ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে নাম শোনার জন্য।
“পাতাটা কী?” গালে চার কাপ ধরে থাকা লোকটাই ধৈৰ্য্য হারিয়ে প্রশ্ন করে বসে।
মান্নান মিয়া পাঁচজনের হাতেই গরম গরম চার কাপ ধরিয়ে দেয়। তারপর রহস্যময় গলায় বলে :
“চা-পাতা।”
.
অধ্যায় ১
দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব!
গ্র্যাফিতির পাশে দাঁড়িয়ে তীব্র চা’র পিপাসা পেল পুলিশের সিনিয়র গোয়েন্দা রফিকুল ইসলামের। টং দোকান বন্ধ, পাশে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চা-ওয়ালা কিসমত। কিসমতের কিসমত বেশ খারাপ। কিসমত ভালো থাকলে কী আর ভোররাতের কাঁচা ঘুম এভাবে নষ্ট হয়? কী সুন্দর বৌকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল সে। টং দোকান বন্ধ করতে করতে বারোটা-সাড়ে বারোটা বেজে যায়। তারপর বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে একটা-দেড়টা। পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুম সবচেয়ে গাঢ় থাকার কথা। ওর খুপড়ি ঘরের সামনে এসে পুলিশের টিম যখন ধাক্কাধাক্কি করে বাইরে থেকে তখন তার নাক ডাকার তীব্র আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো।
এখন বাজে চারটা ঊনষাট। খানিক আগে ফজরের আযান পড়েছে। পুবাকাশে রক্তিমাভা। সূর্য উঠি উঠি করছে, হয়তোবা আড়মোড়া ভাঙ্গছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে একদমই ইচ্ছা করছে না তার। হয়তোবা কিসমত আলীর মতো সেও দেরিতে ঘুমাতে গিয়েছিল, সকাল সকাল চোখ দুটো আর খুলতে পারছে না।
চারদিকে অপার্থিব এক আভা। সাদামাটা ঢাকা শহরটিকে সকালবেলা একদমই অচেনা মনে হয়। মনে হয় মহান সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টার সালভাদর দালি’র কোন পরাবাস্তব পেইন্টিং। কিসমত আলীর মার্কামারা চা’র দোকানটিকেও ভ্রম হয় ফ্রেমে বাঁধানো ফটোগ্রাফ হিসেবে।
আচ্ছা, কিসমতকে ধমক দিলে কী ও ঝটপট এককাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে না? দুধ চা না, কড়া লিকারের রং চা?
পরক্ষণেই নিজেকে চোখ রাঙ্গান রফিকুল ইসলাম। দেয়ালের গ্রাফিতির দিকে আরেকবার চোখ পড়ে তার। একজন পিস্তলধারী কাউকে ধাওয়া করছে। পিস্তলের নল দিয়ে হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে যা সদ্য গুলি ছোঁড়ার প্রমাণ। যাকে ধাওয়া করা হচ্ছে তার গা রক্তাক্ত, দেহ থেকে ছোপ ছোপ রক্ত বের হচ্ছে। আঁকিয়ে নিখুঁত দক্ষতায় লাল লাল তিনটি ফোঁটা এঁকে রেখেছেন। রক্ত ছিলকে পড়ার দৃশ্য। বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না, গুলিটা অব্যর্থ নিশানায় লক্ষ্যভেদ করেছে। গ্রাফিতির নিচে আঁকাবাঁকা অক্ষরে অতি পরিচিত কিছু শব্দ লেখা :
দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব!
তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জিনিসটা এখনো উহ্যই রয়ে গেছে। দেয়াল চিত্রের ওই লাল লাল তিনটি ফোঁটা মোটেও কৃত্রিম লাল রং না, রং-তুলি দিয়ে যা শিল্পী এঁকে রেখেছেন।
লাল লাল ওই ফোঁটাগুলো হলো রক্ত! মানব-রক্ত!
রক্তের রং শুকিয়ে গেছে যদিও। এখন লাল রং পরিণত হয়েছে খয়েরি’তে। হঠাৎ দেখলে রক্ত না মনে হয়ে খয়ের দেয়া পানের পিকও মনে হতে পারে।
রক্ত পরীক্ষা না করেই রফিকুল ইসলাম বলতে পারেন কিসমত আলীর চা’র দোকানের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশের শরীর থেকেই রক্তগুলো এসেছে।
রফিকুল ইসলামের আত্মবিশ্বাসের কারণ আছে। কারণ এ নিয়ে চতুর্থবার এভাবে কাউকে খুন করা হলো। প্রতিটা খুনের দৃশ্যপট একই রকম-একটা চা’র দোকান, দোকানের পাশের দেয়াল জুড়ে গ্রাফিতি, এ্যাফিতিতে পিস্তল নিয়ে ধাওয়া করার দৃশ্য ও অদ্ভুতুড়ে লেখা এবং দোকানের ঠিক সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একটি লাশ।
দেড়মাসের ব্যবধানে চার চারটা খুন। তাও একই পদ্ধতিতে। রফিকুল ইসলাম জানেন গুলিবিদ্ধ লোকটির শরীরে ময়নাতদন্ত চালালে একটা মাত্র গুলির হদিস পাওয়া যাবে। অবশ্য ঠিক গুলির হদিস না, কারণ গুলি ভিকটিমের শরীরে পাওয়া যায় নি। অন্তত এ চারটি খুনে না। চারবারই গুলি মৃতদেহের পাশে পাওয়া গেছে। সুন্দর করে প্যাকেটে মোড়ানো অবস্থায়।
শরীরে মিলেছে দুটি ক্ষতস্থান। একটা এন্ট্রি ওন্ড, একটা এক্সিট ওন্ড । গুলি ঢোকার ও বের হবার নিশানা। গুলি চামড়া ভেদ করে ঢুকেছে হৃৎপিন্ডে। তারপর হৃৎপিন্ড ফুটো করে বের হয়ে গেছে পিঠ দিয়ে।
লাশের পাশে একটা ট্রে রাখা। ট্রে’তে এককাপ লিকার চা, ছোট্ট একটা বাটিতে তিনটা বিস্কুট। একটা বিস্কুটের একপাশ ভাঙা, যেন এইমাত্র কেউ খেয়ে গেছে। চাও আধা কাপ। মনে হয় কেউ বাকিটুকু গলধঃকরণ করেছে। প্রথম প্রথশ এ দৃশ্য দেখে রফিকুল ইসলাম আশান্বিত হয়ে উঠতেন। নিশ্চয় কাপের হাতলে হাতের ছাপ পাওয়া যাবে! কিংবা বিস্কুটে। ভাগ্য ভালো থাকলে স্যালাইভা মিলবে।
কিন্তু না! জিনিসগুলোকে ল্যাবে পাঠিয়ে কোন লাভ হয়নি। বিস্কুট, চার কাপ কিংবা বাটি-কোথাও কোন ধরণের প্রিন্টস পাওয়া যায়নি। স্যালাইভাও না।
ব্যবহৃত গুলিটিও আছে ট্রে’র একপাশে। গুলি দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না রফিকুল ইসলামের। অসুবিধা হওয়ার কথাও না। বন্দুক-গুলি এগুলো খুবই প্রিয় টপিক চিরকুমার রফিকুল ইসলামের। বাইরের দেশে গেলে আর কিছু না আনলেও অ্যান্টিক বন্দুক সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, কোল্ট, ওয়ালথার, রুগার। বাসায় একটা রুম বরাদ্দ শুধুমাত্র এই সৌখিন বন্দুকগুলোর জন্য। দেয়ালে ঝুলছে রাইফেল, কাঁচের আলমারিতে পিস্তল। ঘরটাতে কাউকে ঢুকতে দেন না রফিকুল ইসলাম, কাজের বুয়াকেও না। একবার ছুটা বুয়া কালামের মা ভুল করে ঢুকতে যাচ্ছিল, হা হা করে তেড়ে এসেছিলেন তিনি। ঘরে ঢোকা নিয়ে এর আগের জনের চাকরি নট হয়ে গিয়েছিল। তলাবদ্ধ রুমের ভেতর কী তা বের করার জন্য চাবি চুরি করতে গিয়ে ধরা খায় মহিলা। তারপর পত্রপাঠ বিদায়।
গুলিটা কাছ থেকে আরেকবার দেখে নেন রফিকুল ইসলাম। ব্যবহৃত গুলিটি .৫০০ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ম্যাগনামের। মারাত্মক শক্তিশালী অস্ত্র। এক গুলিতে বুনো হাতিকেও শুইয়ে দিতে পারে এতটাই শক্তিশালী। কিন্তু এরকম একটা সফিস্টিকেটেড অস্ত্র এখানে কী করছে?
ছিঁচকে মারামারিতে এ ধরণের কিছু ব্যবহার করার কথা না, লোকটাও বুনো হাতি গোছের কেউ না যে তাকে খতম করার জন্য ৫০০ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ম্যাগনাম ব্যবহার করা লাগবে। লোকটার ওজন ষাট থেকে পয়ষট্টির মধ্যে হবে, উচ্চতা আন্দাজ সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো। ওকে মারার জন্য একটা অতি সাধারণ রিভলবারই যথেষ্ট।
তবে কী এই কেস বিশেষ কিছু?
রফিকুল ইসলাম অবশ্য খুব একটা বিস্মিত হন না। ঘাতকের শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝোঁক আছে। বাকি তিন খুনে এর নজির মিলে।
ভিকটিমের পকেট ছুঁড়ে কিছু পাওয়া যায়নি। অবশ্য পাওয়ার আশাও করেননি রফিকুল ইসলাম। প্যান্টের দুই পকেটই খালি। পেছনের পকেটটাও গড়ের মাঠ। শার্টের বুক পকেট অবশ্য একদম খালি ছিল না। একটা পাতা পাওয়া গেছে।
চা-পাতা। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে কুঁড়ি।
চা-পাতায় আড়াআড়ি ভাবে কেউ লাল মার্কারে ক্রস চিহ্ন এঁকে রেখেছে। বাকি তিনটা লাশের বুক পকেটেও চা-পাতা পাওয়া গেছে। তাই পাতা দেখে আর সাত-পাঁচ চিন্তা করা লাগে না রফিকুল ইসলামের।
“এইগুলার মানে কী?” বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে গিয়াস উদ্দিন।
গিয়াস উদ্দিন ওর সেকেন্ড ইন কমান্ড। বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের। ষাট ছুঁই ছুঁই। চাকরির বয়সও কম না। কিন্তু প্রমোশন ভাগ্য অনুকূলে না থাকায় বেশিদূর ডিঙ্গাতে পারেনি, হাঁটুর বয়সী রফিকুল ইসলামের পেছনেই পড়ে আছে। স্যার স্যার ডাকা লাগে।
আনমনে মাথা নাড়েন রফিকুল ইসলাম। এইগুলার মানে জানা নেই তারও।
ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে নিচ্ছে ফরেনসিক টিমের একজন। ফ্ল্যাশের মুহুর্মুহু আওয়াজ। দূরবর্তী মেঘের ডাক শোনা যায়।
“বৃষ্টি আইবো মনে অয়।”
সেপাই রমজান আলীর আবহাওয়ার পূর্বাভাসে কাউকে খুব একটা উৎসাহী মনে হয় না। যে যার নিজের চিন্তায় মশগুল।
খুনের পদ্ধতি একই রকম হলেও শিকার স্বতন্ত্র। প্রথমজন বৃদ্ধ, বয়স ৬৯, পেশায় রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার। দ্বিতীয়জন তরুণ, বয়স ১৯, বিবিএ করছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। তৃতীয়জন মধ্যবয়স্ক, বয়স ৩১, পেশায় ব্যাংকার। চতুর্থজনের পরিচয় এখনো বের হয়নি। হুমড়ি খেয়ে চোখের সামনেই পড়ে আছে। পড়ে আছে আবার পড়ে নেইও।
কবিতা মনে পড়ে রফিকুল ইসলামের। জীবনানন্দের কবিতা।
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে-জানি না সে
এইখানে শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া;-তারপর একদিন চলে গেছে
কোন দূর মেঘে।
মেঘের গর্জনে জীবনানন্দ ছেড়ে আবার ধরাধামে ফিরে আসেন রফিকুল ইসলাম। সেপাই রমজান আলীর আবহাওয়া পূর্বাভাস সত্যি হয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হয়।
ক্রাইম সিন নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।
রফিকুল ইসলাম অধস্তনদের নির্দেশ দেন। জোগাড় করে ফেলা হয় কিছু তেরপলিন আর কাপড়। তারপর ওগুলো দিয়ে ত্বরিত গতিতে ক্রাইম সিনকে ঢেকে দেয়া হয়।
কিন্তু বৃষ্টির বেগ আর বাড়ে না। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঢাকার কংক্রিটের উপরিভাগ সামান্য ভিজিয়েই যায়, আর কিছু না।
রমজান আলী আফসোসে মাথা নাড়ে, “পিঁপড়ার বৃষ্টি!”
রফিকুল ইসলামের চোখ আরো একবার দেয়ালচিত্রের দিকে যায়। নিজের এন্ড্রয়েডে এ্যাফিতিটির ছবি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তোলা হয়ে গেছে, আরো কয়েকটা তুলে নেন তিনি। মেঘের আনাগোনা বেড়েছে, আলোও অপেক্ষাকৃত কম। ছবি ভালো আসে না।
নিচের লেখার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হেসে উঠেন রফিকুল ইসলাম।
মিডিয়া এই কেসকে এখন দুধ চা বলে ডাকে। আর খুনির নাম দুধ চা কিলার। প্রথম আলো পন্ডিতি করে বাংলা নাম দিয়েছে-দুধ চা ঘাতক। কালকে হয়তোবা প্রথম আলো হেডলাইন করবে :
দুধ চা বধিলো আরেকজন!
কিন্তু দুধ চা খেয়ে কেন কেউ গুলি করবে? দুধ চা খেলে কী হননেচ্ছা জাগে? দুধ চা কী তবে মানুষকে নিমিষে ঘাতক বানিয়ে ফেলে?
কোন জবাব মিলে না। আকাশ পাতাল ভাবতে থাকেন পুলিশের সিনিয়র গোয়েন্দা রফিকুল ইসলাম। আর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে ঢাকা শহর।
*
অধ্যায় ২
“ডক্টর মেহবুব আরেফিন চৌধুরী। এমএসি। সংক্ষেপে ম্যাক। বিশাল দেহের জন্য অনেকে তাকে মজা করে বিগ ম্যাক বলেও ডাকে। অ্যাভারেজ বাঙ্গালিরা হাইটে বেঁটেখাটো হলেও ডক্টর মেহবুব ইজ ডিফারেন্ট। উচ্চতায় পাক্কা ছয় ফুট দুই। ওজনও বেশ ভালো। ৭৯ কিলো। বাবা অ্যাম্বাসেডর ছিলেন, মা গৃহিণী। বাবা-মা’র একমাত্র ছেলে। আদরে-সোহাগে বড় হয়েছেন। বাবার চাকরির সুবাদে হিল্লি-দিল্লী ঘুরে বেড়িয়েছেন। পড়াশোনাও মোস্টলি বিদেশে। ডক্টরেট করেছেন অক্সফোর্ড থেকে ওরিয়েন্টাল ফিলোসফি’তে।”
সিআইএ সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের চিফ অভ অপারেশন্স ডেভিড কনওয়েল খুকখুক করে খানিকটা কাশেন। গ্লাস থেকে দুই ঢোক পানি খান। নিঃশব্দ রুমে কনওয়েলের পানি গেলার শব্দটা বোমার মত শোনায়। টিস্যু দিয়ে আলতো করে মুখ মুছে টিস্যুটা ছুঁড়ে ফেলা হয় মিটার বিশেক দূরের
ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। বাস্কেট কর্নেলের পেছনে, ঘরের এক কোণায় রাখা। আন্দাজেই ছুঁড়েছিলেন কনওয়েল। টিস্যুটা দেয়ালে লেগে বাস্কেটের কয়েক মিটার দূরে গিয়ে পড়ে।
ভ্রু কুঁচকে ফেলেন কর্নওয়েল, তার অস্পষ্ট বিড়বিড়ানি শোনা যায়-হাউ ডিড আই মিস দ্যাট।
রাইলি কোনমতে হাসি আটকায়। মিটিংয়ে প্রতিবারই কনওয়েল এ কাজটা করেন। এবং প্রতিবারই তার টিস্যু ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট মিস করে। টিস্যু মিসের পর অবিশ্বাসে কর্নওয়েলের কোঁচকানো, এবং অতি পরিচিত বিড়বিড়ানি-হাউ ডিড আই মিস দ্যাট!
কর্নওয়েলের পিএ জোয়ানা মানিপেনি তড়াক মেরে উঠে গিয়ে টিস্যুটা জায়গামতো বাস্কেটে চালান করে দেয়। রাইলি কান পেতে রাখে। তাকে নিরাশ করে না জোয়ানা। চশমাটা চোখে এঁটে কর্নওয়েলকে উৎসাহ যোগায় সে-ইট ওয়াজ প্রিটি ক্লোজ, স্যার!
কর্নওয়েলের কোঁচকানো সমান হয়, চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়। চকচকে টাকে একবার হাত বুলান তিনি। উপস্থিত সবার দিকেও একবার চোখ বুলিয়ে নেন। তারপর আবার শুরু করেন। তার গলা শান্ত, সংযত, স্থির। মখমলসদৃশ। যেন কেউ মাখনে আলতো করে ছুরি চালাচ্ছে। “বেশ কিছু টপ নচ ভার্সিটি থেকে ডক্টর মেহবুবের জন্য অফার ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেন। একসময় ওই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হন। ভদ্রলোক বেশ এনলাইটেন্ড। বোদ্ধা, বিদগ্ধ পন্ডিত। বা আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে-আঁতেল। ফিলসফি রিলেটেড তার বেশ কিছু আর্টিকেল দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয় রেগুলারলি। তার নামের একটা ভ্যালু আছে। শুধু বাংলাদেশে না, বাইরের দেশেও। এ পর্যন্ত কাহিনীটা সাদামাটা, সিম্পল। কিন্তু প্রবলেমটা হয় বছরখানেক আগে যখন ডক্টর চায়না ট্রিপে যান। চায়না থেকে ফেরার পর ভদ্রলোক ইকোনমিস্টের এশিয়া এডিশনে একটা আর্টিকেল লেখেন। আর্টিকেলটা অভিনব। অভিনব এ জন্য যে ডক্টর তার সাবজেক্টের বাইরে গিয়ে এই প্রথমবারের মত কিছু লিখেন। আর্টিকেলের বিষয়বস্তু-চা। আর্টিকেলটা আপনাদের সবার ডোশিয়ারেই থাকার কথা…” কর্নওয়েল সবার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেন।
সবাই হালকা মাথা নাড়ে। মানে সবার ডোশিয়ারেই ওটা আছে।
“গুড।” আবারো মখমলীয় ভাষণ শুরু হয়। প্রশ্ন জাগতেই পারে, ফিলসফি’র পন্ডিতের সাথে চা’র কী সম্পর্ক? হোয়াই টি? আবার অন্যভাবেও কিন্তু প্রশ্নটা করা যায়-চা নিয়ে কেউ কিছু লিখলোই বা, তাতে কার কী? হোয়াটস দ্য বিগ ফাজ? ফাজ আছে কী?…রাইলি?”
ম্যাথু রাইলি চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, মাঝপথেই থামে। তার সবুজ চোখজোড়া কাপ ছেড়ে টেকো মাথার কনওয়েলের ওপর নিবদ্ধ হয়।
লোমে কনওয়েলের অ্যালার্জি আছে। তার দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে ছাঁটা। এমনকি ভুরু পর্যন্ত চেঁছে তুলে ফেলা হয়েছে। শার্টের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে বুকের যে অংশটা দেখা যায়, সেটাও টেকো মাথার মতই মসৃণ কর্নওয়েলের। ক্লাব পুলে একবার শর্টস পরিহিত অবস্থায় তাকে দেখেছিল রাইলি। লোমহীন ডেভিড কর্নওয়েলকে অদ্ভুত লাগছিল সেদিন। ডিপার্টমেন্টে কানাঘুষা আছে, কনওয়েল নিয়মিত ওয়াক্সিং করেন। ওয়াক্স করে দেহের সব লোম ফেলে দেন।
কিন্তু এ মুহূর্তে লোম নিয়ে চিন্তা করছিল না রাইলি। কনওয়েল লোম চেঁছে ফেলে দেন অথবা লোম রেখে বনমানুষ হয়ে যান তাতে তার কোন মাথাব্যথা নাই। তার মাথাব্যথার কারণ ভিন্ন। সাউথইস্ট এশিয়ার বাংলাদেশ ও ভারত ডেস্ক সে-ই সামলায়। কাজেই ডক্টর মেহবুব আরেফিন চৌধুরী সংক্রান্ত ইন্টেলটা তারই দেয়ার কথা। কিন্তু ইন্টেলটা এসেছে অন্য সোর্স থেকে। সোর্সটা বন্ধুপ্রতিম কোন দেশ থেকে আসেনি। এসেছে যাদের সাথে প্রায়ই টক্কর লেগে যায় তাদের। চাইনিজদের থেকে।
আর এটা নিয়ে চিফ অভ অপারেশন্স ডেভিড কর্নওয়েল বেশ মনঃক্ষুণ্ণ। ইতিমধ্যে গায়ে হুল ফোঁটানো কিছু কথাবার্তা বলেও ফেলেছেন তিনি। ডেস্কে বসে সারাদিন ঘোড়ার ঘাস কাটো নাকি?-এ জাতীয় ইঙ্গিতপূর্ণ, দ্ব্যর্থক কথাবার্তাও একদফা বলা হয়ে গেছে। কথাটা দ্ব্যর্থক এ জন্য যে রাইলিদের পারিবারিক ব্যবসা হলো ঘাস জন্মানো। স্পোটর্স স্টেডিয়ামে যে সবুজ, সুন্দর ঘাস দেখা যায় ওগুলো আসলে প্রাকৃতিক না, কৃত্রিমভাবে বানানো। রাইলিদের পরিবার এ ব্যবসার সাথেই জড়িত। তার দাদার আস্তাবল ছিল। সেখানে পথক্লান্ত ঘোড়া দু’দন্ড বিশ্রাম নিত, পানি খেত, ঘাস খেত। তার দাদা আক্ষরিক অর্থেই ঘোড়ার ঘাস কাটতেন। আর বাবা ব্যবসাটাকে একটু ভদ্রস্থ করেন। আস্তাবল হটিয়ে ছোটখাট একটা কোম্পানিই খুলে বসেন। ঘাসের কোম্পানি। রাইলি গ্রাস।
ঘাস নিয়ে প্রতিদিনই তাই তাকে দু’চারটা খোঁচা খাওয়া লাগে। খেতে খেতে এটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে তার, অত প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তবে তার মনে ক্ষীণ ভয়, সবার সামনেই না তার কাছা খুলে দেন বস। তাহলে মহা কেলেঙ্কারি হবে। তার ঠিক সামনের চেয়ারেই বসা ডিপার্টমেন্টে সদ্য যোগদান করা এজেন্ট শ্যানন স্কালি। ফর্সা, লম্বা, স্বাস্থ্যবান। খাড়া নাক চেহারায় এক ধরণের ধারালো ভাব নিয়ে এসেছে তার। পরনে খয়েরি রংয়ের লো-কাট ব্লাউজ ও কালো স্কার্ট। ব্লাউজটা এতটাই লো যে একটু ঝুঁকলেই দুই পাহাড়ের কিয়দাংশ ও মধ্যবর্তী উপত্যকা বেশ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।
শ্যানন মাঝে মাঝেই ঝুঁকছে। কলম ঠিক করার ছুতোয়, ডোশিয়ার দেখার ছুতোয় কিংবা স্রেফ তাদেরকে টিজ করার ছুতোয়। আর একটা করে হার্টবিট মিস হচ্ছে রাইলি’র। রাইলি এ-ও জানে তার ডানদিকের চেয়ারে বসা জোনাথন কিংয়েরও একই অবস্থা। কিং এর মাঝেই শ্যাননকে এক দফা ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছে। শ্যাননও পাকা ঘুঘু। কিংয়ের আমন্ত্রণে সাড়া দেয় নাই। এই ঐতিহাসিক প্রত্যাখান নিয়ে ডিপার্টমেন্টে কদিন খুব হাসিঠাট্টা হলো। কিং বেশ সুদর্শন, সুপুরুষ। হাত বাড়ালে যে কাউকে পেয়ে অভ্যস্থ। সচরাচর তাকে পাওয়ার জন্য লাইন লাগায় মেয়েরা, কিন্তু শ্যানন কিনা এই হটশট জোনাথন কিংকে পাত্তাই দিলো না? এক কথায় ডিনারের আমন্ত্রণ পায়ে ঠেলে দিলো?
আজব!
তবে কিং দমে যায়নি। হাজারো ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা তাকে ধৈর্যশীল করে তুলেছে। ঘুঘুকে সে বন্দী করবেই করবে।
“রাইলি?” গলা খাঁকারি দেন কর্নওয়েল, কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিরক্তির ছোঁয়া।
রাইলি এতক্ষণ যেন এক বুদবুদে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ডেভিড কর্নওয়েলের গলা খাঁকারি শুনে ঘাসের ব্যবসা, শ্যানন স্কালি ও জোনাথন কিংয়ের স্বপ্নীল বুদবুদ ছেড়ে ধরায় নেমে আসে সে।
“চায়ের আড়ালে ডক্টর আসলে অন্যকিছু বলতে চেয়েছেন…” কথাটুকু শেষ না করে মাঝপথেই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখে রাইলি।
“সেই অন্যকিছুটা কী, রাইলি?”
সেই অন্যকিছুটা কী সেটা জানলে তো হয়েই যেত রে চোদনা!
মনের কথা আর মুখে আনে না রাইলি। চেষ্টা করে বুদ্ধিদীপ্ত কোন উত্তর দিতে-”সামথিং ইনভ্যালুয়েবল, স্যার। পিপল উইল ডাই টু গেট ইট।”
“মানুষের কাছে সবচেয়ে ইনভ্যালুয়েবল জিনিস কী?”
আচমকা প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে যায় ঘাস ব্যবসায়ী রাইলি। “…ইনভ্যালুয়েবল জিনিস…ইনভ্যালুয়েবল…”
শ্যানন স্কালিই বাঁচিয়ে দেয় তাকে। নিজের জীবন, স্যার। মানুষের কাছে সবচেয়ে ইনভ্যালুয়েবল জিনিস হলো নিজের জীবন।”
“এগজ্যাক্টলি, স্কালি! এগজ্যাক্টলি! নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর নেই।” কর্নওয়েল থামেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তারপর কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা ওষুধের শিশি বের করেন। শিশি ভর্তি সাদা সাদা বড়ি। টেবিলে গ্লাস রাখা আছে। পানি দিয়ে সাদা বড়ি পেটে চালান করে দেন কর্নওয়েল। ভরা মিটিংয়ে আগেও কর্নওয়েলকে ওষুধ খেতে দেখেছে রাইলি। এবং প্রতিবারের মতো এবারও তার মনে হয়-এ ওষুধটা বোধহয় কনওয়েলকে নির্লোম রাখতে সাহায্য করে!
“ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান।” মখমলীয় ভাষণ শুরু হয় আবার। “চায়ের আড়ালে ডক্টর কী ইনভ্যালুয়েবল জিনিস বলতে চেয়েছেন তা বলার আগে চাইনিজ এক সন্তের ব্যাপারে একটু আলোকপাত করা যাক।”
কথাটা যদিওবা আলোকপাত, কিন্তু কর্নওয়েলের কথা শেষ হওয়ামাত্র মিটিং রুমের বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হলো। একটা বাতিই জ্বলছে-সেটা প্রজেক্টরের। মিটিংরুমের সাদা বোর্ড তখন রুপান্তরিত হয়েছে টিভি স্ক্রিনে।
চেয়ার ঠেলে ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন কর্নওয়েল, হাতে হাজির হয়েছে পয়েন্টার। স্ক্রিনে তখন গাট্টাগোট্টা বৃদ্ধ এক লোককে দেখা যাচ্ছে, মাথায় অল্প চুল। তার হাতে পাতার মত কিছু ধরে রাখা। আর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পাতা চিবুচ্ছে সে।
কর্নওয়েল পয়েন্টারটা বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাক করেন। “শ্যানং…”
ডোশিয়ারে রাখা আর্টিকেলের দিকে রাইলি’র দৃষ্টি চলে যায়। খানিকটা চাইনিজ ক্যালিগ্রাফির আদলে আর্টিকেলের হেডলাইন লেখা-দ্য টি অভ শ্যানং…
*
অধ্যায় ৩
গেইটে পরপর তিনটা টোকা দেয় সে। তারপর খানিকক্ষণের বিরতি। আবার দুইটা টোকা। লম্বা, উঁচু গেট। দু’পাশে দুটা সিসিটিভি ক্যামেরা তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে।
কারো পদশব্দ শোনা যায়। থপথপথপ। গেটে একটা পিপহোল আছে। হোঁৎকামুখো একজনকে দেখা যায়। চর্বিবহুল মুখ, নাক যেন কেউ ঘুষি মেরে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে। পিপহোলের হোল দিয়ে তাকায় হোঁৎকামুখো।
তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে লোকটা, গমগম গলায় জিজ্ঞেস করে-”দস্তভয়স্কি টলস্টয়ের চেয়ে ভালো লেখক কে?”
“নিকোলাই গোগল।”
তাদের পাসওয়ার্ড বিনিময় শেষ হয়। গেইট খুলে যায়। সেফ হাউজে পা রাখে সে। হোঁকামুখো ভাবলেশহীন গলায় সম্ভাষণ জানায়, “ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ, বুলশিট!”
প্রসন্ন মুখে তাকায় সে, যদিও ভেতরে ভেতরে রাগ চিড়বিড়িয়ে উঠছে। “থ্যাঙ্ক ইউ! তুমি কিন্তু একটুও চেঞ্জ হয় নাই মারিয়ার বাপ।”
হোঁৎকামুখোর ভাবলেশহীন মুখে তখন রক্তিমাভা। সে জানে বুলশিট বলে সম্বোধন করার জবাব এর চেয়ে ভালোভাবে হতে পারতো না।
মারিয়া হোকামুখোর প্রাক্তন স্ত্রী। ক’মাস আগে মারিয়ার আঠারো মিনিটের একটা ভিডিও ক্লিপে ছেয়ে যায় ইন্টারনেট। বসের সাথে প্রণয়লীলায় মত্ত মারিয়া উত্তেজনার তুঙ্গে উঠে বারবার বুড়ো লোকটাকে একটা নামেই সম্বোধন করছিল-ড্যাডি! তারপর থেকেই হোঁৎকামুখোর নাম হয়ে গেছে মারিয়ার বাপ। যদিওবা মারিয়ার বাপ নামকরণের আগে তার আরেকটা নাম ছিল। ওই নামটাও যথেষ্ট অদ্ভুত ও অশ্লীল-গরুর পাছা! হোঁৎকামুখোর ভয়ানক এক দুর্বলতা আছে, আর সেটা হলো গরুর পাছা। তার মতে রাশিয়ার গরুগুলো ম্যাদামারা, পা নাই, পাছাটাছা নাই। কিন্তু বাংলাদেশি গরুগুলোর পাছা দশাসই, দেখলেই চাটি মারার জন্য হাত নিশপিশ করে ।
বাড়ির একপাশে একটা গোয়াল করে রেখেছে সে। গোয়ালে দুইটা তাগড়া গরু। প্রতিদিন সকাল বেলা নিয়ম করে দশ মিনিট গরুর পাছা ধরে বসে থাকে হোকামুখো। তার অদ্ভুত আনন্দ হয়। আর কোরবানির সময় তো হোঁৎকামুখোর ক্রিসমাস লেগে যায়। সে হাটে হাটে ঘুরে, গরুর পাছায় হাত বুলিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে-”কত?” এলাকার গরুর বেপারিরাও তাকে চিনে ফেলেছে। বড় গরু কিনলে তাকে এনে দেখায়। গাজীপুরের সবচেয়ে বড় ডেইরি ফার্মের মালিক আব্দুর রহিম। সময় পেলে প্রায়ই ওখানে ঢু মারে হোল্কামুখো, সারি সারি গরুর মাংসল পাছায় চাটি মেরে আসে। আব্দুর রহিমও তাকে খুব খাতির করে। হাতে ধরে দেখায় কোনটা স্থানীয় গরু, কোনটা ইন্ডিয়ান গরু, কোনটা নেপালি গরু। মনোযোগী ছাত্রের মত শোনে হোল্কামুখো।
রাশিয়ার স্পাই কমিউনিটিতে কানাঘুষা বাংলাদেশে এতদিন ধরে হোকামুখোর থেকে যাওয়ার একটাই কারণ; আর তা হলো গরুর পাছা। মারিয়ার বাপ ও গরুর পাছার ডামাডোলে তার আসল নাম ডেনিস চেরিশেভ এখন অনেকটাই যেন মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।
সেফ হাউজ গাজিপুরের দোতলা এক দালান। নিচের তালায় ছোট্ট লন, বাগান। ফুলের গাছ আছে; গোলাপ, ডালিয়া, সূর্যমুখী। আছে শাকসবজির গাছ। পেঁপে, টমেটো, লেবু। বাগানের একপাশে চেয়ার-টেবিল, কোণায় দোলনা। প্রথম দেখায় মনে হবে কোন সুখী দম্পতির আবাস। পুরুষটি হয়তোবা চাকরি করে, মহিলাটি গৃহিণী। ছেলেমেয়ে আছে, অথবা নেই। বৃদ্ধ মা-বাপ আছে। বাপটি সারাদিন পেপার পড়ে, আর বাগানে গাছের যত্ন-আত্তি করে।
কাভার হিসেবে কিন্তু আসলেই এখানে দুজন মেকি জামাই-বৌ আছে। ডেনিস চেরিশেভ ও তাতিয়ানা রোমানোভা। ডেনিস-তাতিয়ানা দুজনেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, চেহারা দেখে অবশ্য ভিনদেশি বোঝার যো নেই। চেরিশেভের চুল সোনালী ছিল, সে কালো করে ফেলেছে। আর চোখের কটাভাব দূর করেছে কন্ট্রাক্ট লেন্স লাগিয়ে। তাতিয়ানারও একই অবস্থা।
নিচতলায় বসার ঘর, ডাইনিং রুম, সার্ভেইল্যান্স রুম, রান্নাঘর। উপরতলায় পাঁচটা শোবারঘর। এরই একটাতে জায়গা হয় তার। রুমটা পরিস্কার-পরিছন্ন, ছিমছাম। বিছানা, ওয়াল ক্যাবিনেট, ডেস্ক। সাথে অ্যাটাচড বাথ। গোসল সেরে বাইরে বের হতেই ডেস্কে একটা ফাইল আবিষ্কার করে সে। ফাইলের প্রথমেই ইকোনমিস্টের আর্টিকেল-দ্য টি অভ শ্যানং, লেখক ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী। নিচে ডক্টরের ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ড, পেপার ক্লিপিং।
পড়তে শুরু করে সে।
*
অধ্যায় ৪
ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী
ফ্যাক্ট ফাইল
জন্ম : ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯
বাবা : আরেফিন চৌধুরী
মা : শামসাদ চৌধুরী
বৈবাহিক অবস্থা : অকৃতদার
উচ্চতা : ৬’২”
ওজন : ৭৯ কেজি
গায়ের রং : ফর্সা
জন্মদাগ : নাভির সামান্য উপরে জোড়া জড়ুল
শিক্ষাগত যোগ্যতা : ফিলোসফি’তে মাস্টার্স, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়। ওরিয়েন্টাল ফিলোসফি’তে পিএইচডি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
ঠিকানা : বিগ ম্যাক ভিলা, বাসা নং-১৯, রোড নং-১, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
শখ : মাছ ধরা, লেখালেখি করা, বই পড়া।
প্রিয় বই : এ হিস্ট্রি অভ ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি//বাট্রান্ড রাসেল
স্বপ্ন : ইয়টে চড়ে সমুদ্র দর্শন, হাঙ্গর মাছ পোষা, রবিনসন ক্রুসোর মত নির্জন দ্বীপে বসবাস।
*
অধ্যায় ৫
কথা ছিল রহস্যময় ঐ বাণী সংবলিত টয়লেটের পেছনের গলিতে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই দেখা মিলবে আগন্তুকের।
কদমের অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না। প্রথম দিনও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পরের দিনও। লোকটার সাথে পনেরো মিনিটের কোন যোগসূত্র আছে। মজিদ ভাই বলছিলেন লোকটা পাক্কা পনেরো মিনিট সময় নেয় মাল আউট করতে। সেজন্য জীবনটাকে সে পনেরো মিনিটের সমষ্টি হিসেবে ধরে নিয়েছে। কথাটা শুনে কান-টান লাল হয়ে গিয়েছিল কদমের।
গন্ধ কথা শুনলেই কদমের এরকম হয়। কান লাল হয়ে যায়, পেটের মধ্যে গুঁড়গুঁড় করে, বুকের মধ্যে ধড়ফড়। মজিদ ভাই অবশ্য কদমের কান লাল হয়ে যাওয়া দু’চোখে দেখতে পারেন না।
“হালা, হাফ-লেডিজ!” কদমকে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে দেখলে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকান মজিদ ভাই।
কিন্তু কদম কী করবে?
সে ভালো ছেলে। লক্ষী ছেলে। গুড বয়। মোটেও হাফ-লেডিজ না। টুকটাক হাত সাফাই করে, ঠিক আছে। কলাটা, মূলোটা পড়ে থাকলে দেখলে নিজের অজান্তেই পকেটে পুরে ফেলে। কিন্তু একেবারে পুকুর চুরি করে না। গন্ধ কথা বলে না। বাপ-মা মরা ছেলে ওরকম কত উচ্ছন্নে যায়, কদম কিন্তু যায়নি। সে মামা-মামির খেদমত করে, বাজারের টাকা দেয়, এটা সেটা কিনে, ওষুধ-পথ্যি করে। এই তো কদিন আগে মামার সিরিয়াস লেভেলের ডিসেন্ট্রি হলো। রীতিমত অটোসিস্টেমে হাগা-মুতা। কদম কিন্তু নাক সিটকায়নি। মামাকে হসপিটালে ভর্তি করা, তার বিছানা বালিশ পরিস্কার সব এক হাতেই করেছে কদম। মামি তো বুড়ো হয়ে গেছেন, কিছু করতে পারেন না। তাই সব দিক কদমকেই সামলাতে হয়।
কদম সবদিক সামলাতে পারে। সে বাজার করতে পারে, মাছের দরদাম করতে পারে। রুই মাছ ছয়শো টাকা দাম হাঁকলে সে সুট করে এক ধাক্কায় দাম দুশো টাকায় নিয়ে আসতে পারে। এই তো গত মাসে মামার বাই চাপলো ইলিশ মাছ খাবেন। ইলিশ মাছ মামার খুব পছন্দ, কদিন পরপরই কিনে দেওয়া লাগে। ইলিশ মাছের আলাদা একটা গন্ধ আছে। গন্ধটা খুব প্রিয় মামার। তার খুব ইচ্ছা গন্ধটা সেন্টের শিশিতে ভরে রাখবেন! যেবারই তিনি ইলিশ মাছ খান, একটা মুহূর্ত বরাদ্দ থাকে হা হুতাশের জন্য। হা-হুঁতাশ ইলিশ মাছের গন্ধ কেন সেন্টের শিশিতে ভরে রাখা যায় না সেজন্য। তিনি কদমের কাছে নিজের যুগান্তকারী আইডিয়াও শোনান-একটি সেন্টের কোম্পানি গড়ে তুলবেন। ইলিশ মাছের গন্ধওয়ালা সেন্ট। কোম্পানির এমডি হবে কদম, তিনি নিজে থাকবেন চেয়ারম্যান হিসেবে। বাকি জীবন সেন্ট বেঁচে কাটিয়ে দেবেন, পেনশনের টাকায় আর দিনাতিপাত করতে হবে না।
“মামা, এত টাকা কইখন পাইবেন?”
“ক্যান, উজ্জ্বল পাঠাবে!”
উজ্জ্বল মামা-মামির একমাত্র সন্তান। বছর পনেরো হলো আমেরিকায় সেটলড। বাপ-মা’কে পুঁছেও না। ওখানেই বিয়ে-থা করেছে, গাড়ি-বাড়ি করেছে। প্রথম প্রথম ফোন ধরতো, এখন ফোনও ধরে না। বাপ-মা বেঁচে আছে না মরে গেছে জানার আগ্রহও নেই তার। তবে বাপ-মা নিজের ছেলের ব্যাপারে একদম অন্ধ।
ছেলে খুব ব্যস্ত থাকে, সময় পায় না! আর বৌটাও খুব দজ্জাল!
এই তো সামনের ঈদেই বৌমা’কে নিয়ে আসবে উজ্জ্বল, বৌমা’র বাংলাদেশ দেখার খুব শখ।
ঈদ আসে, ঈদ যায়। কিন্তু উজ্জ্বল আর আসে না। উজ্জ্বলের অনুপস্থিতিতে মামা’র দুই বেডরুমের আধা-পাকা দালানটিকে অনুজ্জ্বল দেখায়।
তো গতমাসে মামা’র যখন বাই চাপলো ইলিশ মাছ খাবেন, মাছওয়ালাও মওকা বুঝে দাম হাঁকলো আড়াই হাজার। অন্য কেউ হলে অ্যাবাউট টার্ন নিতো। কিন্তু কদম অন্য কেউ না। সে শেষমেষ ওই মাছটা এক হাজার দুইশত টাকায় কিনে নিয়ে এসেছিলো। কদম এমনই।
আগেই বলেছি, ডিসেন্ট্রি হলে অনায়াসে হাগা-মুতা পরিস্কার করা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। ওতে মোটেও ঘেন্না লাগে না তার। কদমের চাকরি হসপিটালে ওয়ার্ডবয়ের চাকরি। দিনে শ’খানেক বেডপ্যান পাল্টাতে হয় তাকে। তাই মলমূত্র তার কাছে ডাল-ভাত!
তবে মাঝে মাঝে ওর চাকরি চলে যায়। আচমকাই চলে যায়। ও একদমই বুঝতে পারে না। তখন বিপদে পড়ে যায় বেচারা।
কদম এমনিতে খুবই সতর্ক। ওর হবি যে উদ্ভট, তা সে ভালোভাবেই জানে। মানুষজন বিভিন্ন দেশের স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে, বই সংগ্রহ করে, পেইন্টিংও সংগ্রহ করে। কিন্তু তাই বলে রক্ত, বীর্য কিংবা মূত্র?
মামার আধা-পাকা দালানের নিচে একটা বেসমেন্ট মতো আছে। নানা বানিয়ে গিয়েছিলেন। নানা পূর্ব-পাকিস্তান আমলের পেইন্টার ছিলেন, বেসমেন্টটা ছিল উনার স্টুডিয়ে । একসময় বেশ নাম-ডাক ছিল তার। করাচি, লাহোর, পিন্ডিতে গিয়ে একক শো করে এসেছেন এককালে। বইয়ের প্রচ্ছদ-অলংকরণও করতেন। হয়তোবা আরো নামডাক হতো তার। এস এম সুলতান কিংবা কামরুল হাসানের পর্যায়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এত খ্যাতি তার ভাগ্যে ছিল না।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ ছোট ভাইয়ের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি নানা। ছোটভাই পুলিশে চাকরি করতো। ২৫ শে মার্চের ভয়ালরাতে প্রথম তান্ডবটা রাজারবাগ পুলিশলাইনের ওপর দিয়েই গিয়েছিল। নানা তাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে। সকাল হতেই ভাইয়ের খোঁজে হন্য হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই নিখোঁজ।
তখন থেকেই বেসমেন্টটা একপ্রকার খালিই পড়ে আছে। এখন অবশ্য আর খালি নেই। এখন বেসমেন্ট ভর্তি বিভিন্ন উচ্চতার কাঁচের জার ও শিশিতে। জার ও শিশি ভর্তি হয়ে আছে রক্ত, বীর্য ও মূত্রে!
কিছু হসপিটাল থেকে হস্তগত, কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সংগৃহীত। সামান্য যা টাকা-পয়সা আছে কদমের, তা এই অদ্ভুত শখপূরণের জন্যই ব্যয় করে সে। হাত সাফাই করেও টাকা আসে। একবার ছয় নাম্বার বাসে এক বুড়া চাচা ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল। চাচার বাম পকেটে ছিল পাঁচটা এক হাজার টাকার কড়কড়ে নোট। আলগোছে নিয়ে নেয় কদম। চাচা তখন ঘুমে কাতর, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। লালা পড়ে শার্টের খানিকটা ভিজে গেছে। রাগ লাগে না তার, মায়া হয়।
আহা, বুড়া মানুষ!
একটা নোট ভাঁজ করে সে রেখে দেয়। তারপর পরের স্টপেজে সুট করে নেমে যায়। চাচা তখন জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
এরই মধ্যে তিন-তিনটা হসপিটালের চৌকাঠ মাড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে কদমের এবং দুইটা থেকেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে তাকে।
ঘাড়ধাক্কার ব্যথা যতোটা না শারীরিক তারচেয়ে মানসিক হওয়ার কথা। কিন্তু কদমের মান-সম্মান বোধ একটু কম। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গুলবাজ ঘনাদা যেরকম মারামারি করার পর শরীর থেকে ধূলো ঝাড়তেন, কদমও তেমনি মান-সম্মান বোধ শরীর থেকে অনেক আগেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।
হসপিটাল থেকে ঘাড়ধাক্কা খাওয়ার পর ক’দিন এখানে সেখানে ফুট ফরমাস খেটেছে সে। তারপর আবার কাজ জুটেছে। সরকারি হসপিটালে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে ওখানকার দালালচক্রের সাথে ওর বেশ খাতির জমে গিয়েছিল। তাদের হয়ে নানা সময়ে কাজ-টাজ করে দিতো।
দালাল চক্রের প্রধান মজিদ ভাই। উনিই মিস্টার ফিফটিন মিনিটস এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। “ওর লগে কাম কর। ফায়দা অইবো।”
“কী ফায়দা, মজিদ ভাই?”
“স্কয়ারে সাড়ে বারো হাজার টাকা বেতনের চাকরি। ওই হালায় সিস্টেম কইরা দিবো।” মজিদ ভাইয়ের ব্রণের দাগওয়ালা কুৎসিত মুখটাকে হঠাৎ করেই প্রচন্ড মায়াবী মনে হয় কদমের।
তার মনে সাড়ে বারো হাজার টাকার লাড়ু ফুটিয়ে দিয়ে যান তিনি। সেই লাড়ু খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে কদম।
দুই মাস হলো নতুন হসপিটালে ঢুকেছে কদম। গত চাকরির চেয়েও এটার বেতন কম। মোটে সাড়ে ছয় হাজার। টুকটাক হাত সাফাই করে আরো কিছু মিলে। কিন্তু সেটা আহামরি কিছু না। স্কয়ারের সাড়ে বারো হাজার টাকা তাই ক্ষণে ক্ষণে চোখ রাঙ্গায়।
পুরো ডাবল!
ওইদিন এরকমই এক গলিতে আসতে বলেছিলেন মজিদ ভাই। কদম সময়মত এসে হাজির। ঠিক পনেরো মিনিট পর ফ্ল্যাক্স হাতে এক চা-ওয়ালা এসে উদয় হয়। তার পরনে ময়লা শার্ট আর লুঙ্গি। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। হলুদ দাঁত বের করে চা-ওয়ালা তাকে জিজ্ঞেস করে
“ভাইসাব, এক কাপ দুধ চা খান।”
মাথা নাড়ে কদম।
“তাইলে রং চা নেন? রং চা অইলো গিয়া আসল চা, বুঝলেন ভাইসাব? দুধ চা তো ফালতু, এর চেয়ে শরবত খাওয়া ভালো।”
কদমের সেদিন মনে হয়েছিল আরো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। পনেরো মিনিটের কথা যদিও বলা হয়েছে, কিন্তু কে আর ঘড়ির কাঁটা ধরে মানুষের সাথে দেখা করতে আসে। বাংলাদেশি কেতা হলো সময়ের আধা ঘন্টা-এক ঘন্টা পরে আসা। তাহলে নিজের গুরুত্ব বোঝানো যাবে। যাদের কোন কাজ-কাম থাকে না ওরাই সময়মত এসে উপস্থিত হয়।
কদম তাই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। সময় কাটানোর জন্য বরং এক কাপ চা খাওয়া যায়। হাত বাড়িয়ে এক কাপ রং চা তুলে নেয় কদম। গরম গরম চা, ধোঁয়া উড়ছে। চায়ে চুমুক দিতেই একটা ঝটকার মতো খায় কদম।
এটা কী ছিল! চা খেয়ে এরকম ইলেকট্রিক শকওয়ালা ঝটকা তো কখনো খায়নি কদম। চায়ে কী তবে কোন ধরণের কেমিক্যাল মেশানো?
মুখের কাছে কাপ আনতেই লেখাটা চোখে পড়ে কদমের। সবুজ মার্কার পেনে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা।
সিএনজিটাতে উঠে পড়ো।
কাপ নামাতেই দুটা জিনিস নজরে পড়ে কদমের। ১. চা ওয়ালা হাওয়া ২. গলির মাথায় একটা সবুজ সিএনজি দাঁড়ানো।
পায়ে পায়ে সিএনজি’র কাছে এসে পৌঁছে কদম। সিএনজি’র দরজা খোলা, ভেতর থেকে টাটকা চা-পাতার সুবাস নাকে এসে ধাক্কা মারে। ফাসফেঁসে গলায় কারো কণ্ঠস্বর শোনা যায়-”উঠে পড়ো, কদম।”
উঁকি মারতেই মাঝারি গড়নের একজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। বেঁটেখাটো, পেটমোটা। পরনে এক সাইজ বড়ো চেক শার্ট ও ঢোলা প্যান্ট। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ভারি ফ্রেমের চশমার আড়ালে চোখদুটো বড় বড় দেখায়। প্রথম দর্শনে স্কুল-কলেজের টিচার বলে মনে হয় লোকটাকে কিংবা সরকারি অফিসের আমলা। এই হয়তোবা টিফিন ক্যারিয়ার বের করে বৌয়ের রান্না করা ভাত আর ছোট মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার সারবেন। পাশের জন হয়তোবা মাংস নিয়ে এসেছে। মাংসের এক টুকরা তাকে দেবে, তিনি বিনিময়ে ছোট মাছের ঝোল ঢেলে দিবেন। খাওয়া দাওয়া শেষে আয়েশ করে এক খিলি পান মুখে দিবেন। গুটুর গুটুর করে পান খাবেন আর এই দেশে আর থাকা যাবে না’ টাইপ কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করবেন।
লোকটাকে দেখে কদমের কেন জানি প্রামাণিক স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। এরকমই দেখতে ছিলেন স্যার। বেঁটেখাটো, পেটমোটা। ওদের স্কুলে অংক পড়াতেন। অংক না পারলে কান মলে বলতেন-পারবা ক্যামনে? মাথায় তো ব্রেন নাই, খালি গোবর!
কদম অংকে একবার একশো’তে চার পেয়েছিল। প্রামাণিক স্যার ওর দু’কান মলে বলেছিলেন-তোর তো শুধু মাথায় না, গা ভর্তি গোবর রে কদম!
কদম চায়ের কাপ হাতে নিয়েই প্রামাণিক স্যারের মতো দেখতে লোকটার পাশে বসে পড়ে। এই লোকটাই কী তবে মজিদ ভাইয়ের বর্ণিত লোক? ভেবে খানিকটা মুষড়ে পড়ে কদম। প্রামাণিক স্যার লোকটাকে ওর কোন কালেই খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি। তার মতো কারো সাথে কাম করা লাগবো ভাবতে বিষিয়ে উঠে মন।
সিএনজি মহাখালী কাঁচা বাজারের পেছনের গলিতে এসে থামে। পেছনের গলিতে একটা স্কুল, মহাখালী মডেল স্কুল। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। বাইরে প্যান্ডেল টাঙ্গানো, সারি সারি চেয়ার রাখা। স্টেজে এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে গান ধরেছে
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান
প্রামানিক স্যারের মতো দেখতে লোকটা স্কুলের ভেতরে ঢোকে পড়ে। পেছনের সারিতে এক ধুমসো মহিলা বসে আছে। দরদর করে ঘামছে আর হাত দিয়ে বাতাস করছে। তার কাছে গিয়ে কী জানি বলে লোকটা। তারপর ঘুরে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে।
কদম ফাঁপরে পড়ে যায়। মজিদ ভাই তাকে এক লোকের সাথে দেখা করার কথা বলেছিল, মহিলার সাথে না। তাহলে এ কোথা থেকে আসলো?
পায়ে পায়ে এগোয় কদম। মহিলা মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে হাত দিয়ে বাতাস করেই যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। অন্য কোনদিকে তার আর কোন খেয়াল নেই। আশেপাশের সিট জনশূন্য। সামনের সারি অবশ্য লোকে ঠাসা। তাদের সবার নজর স্টেজে।
স্টেজে তখনো গান চলছে। এবার একক। কাঠফাটা গরমে এক পিচ্চি মেয়ে গান ধরেছে–
বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
“মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক এখানে আমি কী করতেছি, তাই না কদম?” এক ঘন্টার ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো ইলেকট্রিক শকওয়ালা ঝটকা খায় সে। আওয়াজটা তার পাশে বসা মহিলার। মহিলার আওয়াজ…
“আওয়াজ শুনে চমকায়া গেলে কদম? এখনই এইরকম চমকায়া গেলে হবে বলো? চমকানোর আরো কত কী বাকি!” মহিলার গলায় মৃদু পরিহাসের সুর।
কদম আরো চমকে উঠে। সমস্যা আসলে মহিলার আওয়াজে না। মহিলা তো আওয়াজ করতেই পারে। সমস্যা আসলে মহিলার পুরুষালি গলায়! মহিলা কী তবে তৃতীয় লি….
“না আমি হিজড়া না। আমার পরিচয় ধীরে ধীরে জানতে পারবা। দ্য থিং ইজ, আই এ্যাম নট দ্যাট ইম্পরট্যান্ট। ইউ আর মোর ইম্পরট্যান্ট। আপাতত আমাকে গিল্টি মিয়া ডাকলেই হবে। মাসুদ রানার গিল্টি মিয়া, দ্য ম্যান হু ইজ অলওয়েজ গিল্টি। আমার সাথে পরিচিত হয়ে আখেরে তোমার লাভই হবে, বুঝলা। আশা করি, মজিদ তোমারে বুঝাইছে জিনিসটা।”
মজিদ ভাইয়ের ব্রণওয়ালা মুখ খানিকক্ষণের জন্য চোখে ভাসে কদমের। সাড়ে বারো হাজারের লোভনীয় লাডুকে মুখের চারপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। মুখ এগিয়ে নেয় কদম। লাড়ু ঢুকলো বলে, আর একটু। আর একটু….
কিন্তু কী চায় এই মহিলারুপী পুরুষ? কী করলে সাড়ে বারো হাজারের লাড়ু গিলতে পারবে ও?
চিন্তার সূত্র ছিন্ন হয় বিচ্ছিন্ন করতালিতে। পিচ্চি মেয়ের একক গান পরিবেশন শেষ। নাভি দেখানো শাড়িতে সুন্দরী উপস্থাপিকা এসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরবর্তী আকর্ষণের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এবার নাচ। ভারতনট্যম। ঘোষণা শেষে শাড়িতে কামনার ঝড় তুলে মেয়েটা প্রস্থান নেয়।
“কী, মেয়েটারে দেইখা লোভ হইতেছে?” বিস্ময়ে চোখ ফেরাতেই মহিলা চোখ টিপে। “হয়। এরকম সবারই হয়। আমারও হইতেছে। নাভির কত নিচে শাড়ি পড়ছে দেখছো? আর একটু হইলেই তো পুরা আস্তাগফিরুল্লাহ অবস্থা হইতো। হিহিহিহি।”
দেহ দুলিয়ে বিশ্রিভাবে হাসে মহিলা।
তারপর পাশের চেয়ারে রাখা ফ্লাক্স থেকে চা ঢালে কাপে। চুক চুক করে খায়। হাতের চেঁটো দিয়ে মুখ মুছে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। “বোধিধার্মা রে চিনো?”
বোধিধার্মা!
বেকুবের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কদম।
“বুঝছি, চিনো না। বোধিধার্মা হইলেন জেন বৌদ্ধদের ফাউন্ডার ও নেতা। লিজেন্ড আছে যে উনি একবার মেডিটেশনে বসছেন। মেডিটেশনে বইসা আঁতকা ঘুমাইয়া পড়ছেন। তো ঘুম থাইকা উইঠ্যা তার খুব রাগ হইলো। ধ্যানে অবহেলা তার মোটেও পছন্দ না। সো হি বিকেম ফিউরিয়াস। তিনি রাইগা মাইগা অস্থির হইয়া চোখের পাতা কাইটা ফেললেন, যাতে আর ঘুমাইতে না পারেন। সেই চোখের পাতা যেখানে পড়ে, ওইখান থিকা একটা চা গাছ জন্ম নেয়। আর এইভাবেই চার উৎপত্তি। চা’র উৎপত্তি নিয়ে আরেকটা ভার্সন আছে। সেইটা হইলো শ্যানংয়ের ভার্সন। দেবতা শ্যানং একবার গাছ-গাছড়া, শেকড়-বাকড় খাইয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেছিলেন। একদিন এইরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যায়া বিষাক্ত কোন লতা-পাতা বা ভেষজ কিছু খাইয়া ফেলেন তিনি। সাথে সাথে শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রীতিমত মৃত্যুর মুখামুখি চইলা যান শ্যানং। তখন লাকিলি বাতাসের ঝাঁপটায় একটা পাতা আইসা ডেকচিতে পড়ে। শ্যানংয়ের ক্যান জানি খুব আগ্রহ জন্মে। আগ্রহের বশবর্তী হইয়া পাতাটা চিবায়া খান তিনি। আর তখনই মিরাকলটা ঘইট্টা যায়। আস্তে আস্তে পুরাপুরি সুস্থ হইয়া যান শ্যানং। পরবর্তীতে ঐ পাতা সবসময় নিজের লগে রাখতেন তিনি। উল্টাপাল্টা কুনু লতা-পাতা খাইলে সাথে সাথে ঐ পাতাট খাইতেন। সবকিছু ঠিক হয়া যাইতো। কও তো পাতাটার নাম কী?”
কদম কইতে পারে না।
“চা-পাতা।”
নীরবে চার ইতিহাস শুনে যায় কদম। কোন মন্তব্য করে না। তার হঠাৎ খেয়াল হয় চা’র কাপটা সে সিএনজি’তে ফেলে এসেছে। পকেটে ঢুকিয়ে নিলেও পারতো। সেদিন মামির হাত থেকে পড়ে চার কাপ ভেঙে গেল। মামি বলছিলেন কাপ আর বেশি নাই, কিনতে হবে। কাপটা দেখতেও সুন্দর ছিল, শুধু মার্কার পেন দিয়ে লেখাটা কাপড় দিয়ে মুছলেই হতো…
“চা নিয়া তো অনেক কথা হইলো। এইবার আসল কথায় আসি। ডক্টর মেহবুব আরেফিন চৌধুরী। নামটা পরিচিত লাগতেছে?”
হকচকিয়ে যায় কদম। হ্যাঁ অবশ্যই নামটা পরিচিত লাগতেছে।
“আই বিলিভ হি কেম টু ইওর হসপিটাল। তাই না?”
মাথা নাড়ে কদম, থুড়া থুড়া ইংরেজি সেও জানে। ম্যাট্রিকটা পাশ করতে পেরেছিল কোনমতে। ইন্টারেও ভর্তি হয়েছিল। তারপর স্যারের মানিব্যাগ সাফাই করতে গিয়ে ধরা খেল এবং সুন্দর করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হলো তাকে। মানিব্যাগে টাকা খুব বেশি ছিল না। একশো সতুর টাকা। সারা রাস্তা মামা গজগজ করতে করতে বাসায় ফিরলেন-তুই আমার মাথাটা হেঁট কইরা দিলি…
“কদম?” মহিলা তাকিয়ে আছে।
“হ্যাঁ। উনি এসেছিলেন।”
“গ্রেট।”
“কিছু টেস্টও করাইতে হইছে। ঠিক কিনা?”
“হ্যাঁ, ঠিক।”
“আর কিছু করো নাই?” কেমন জানি লোলুপ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় মহিলা, ভেতরটা একেবারে শুকিয়ে যায় কদমের।
আর কিছু বলতে ঠিক কী বুঝাচ্ছে মহিলা?
অশ্লীল হাসিতে ভরে আছে মহিলার মুখ। উঁচু-নিচু দাঁত সব দেখা যাচ্ছে। কদম অবশ্য বুঝতে পারে না বিষয়টা কী। এমনিতেই বুদ্ধিতে খাটো ও। সবকিছু অনেক দেরিতে বুঝে। মামা বলতেন-কদমের বুদ্ধি হাঁটুতে। কদমও মনে মনে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। আগে পায়ে ব্যথা ট্যথা পেলে সবার আগে হাঁটু চেক করে নিত, বুদ্ধি নিরাপদ আছে কিনা দেখতো। একবার হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। ওর সেকী কান্না!
আমার বুদ্ধি ব্যথা পাইছে! আমার বুদ্ধি ব্যথা পাইছে!
বোধিধার্মা, শ্যানং, চা কিংবা মেহবুব আরেফিন চৌধুরী-এদের সাথে এই মহিলার কী সম্পর্ক থাকতে পারে বা থাকা উচিত তা চিন্তা করে চাইলে মাথা গরম করে দিতে পারে সে। কিন্তু কদম অহেতুক কারণে মাথা গরম করা মোটেও পছন্দ করে না।
স্টেজে তখন এক কিশোরী মেয়ে উঠে কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করেছে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা। আমি হবো সকালবেলার পাখি…
মহিলা তন্ময় হয়ে কবিতা পাঠ শুনে। পাঠ শেষ হয় একসময়। হাততালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। মহিলাও হাততালি দেয়, সমঝদারের মতো মাথাও নাড়ে। আর এরই এক ফাঁকে ছোট্ট একটা ঘটনাও ঘটিয়ে বসে সে।
হালকা গলায় অদ্ভুত এক আবদার করে বসে মহিলা। আবদার এতই অদ্ভুত যে শুনে খানিকক্ষণ তবদা হয়ে বসে থাকে কদম।
আর তারপর থেকেই লক্ষী ছেলে, গুড বয় কদমের জীবনটা আমূল পাল্টে যায়।
*
অধ্যায় ৬
চতুর্থ ভিকটিমের পরিচয় বের করা গেছে। নাম মঞ্জুর আহমেদ, বয়স ৪২। পেশায় ডাক্তার। বিবাহিত, দুই কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রীও ডাক্তার। ভদ্রলোক মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রোগী দেখে তারপর বাসায় ফিরেন। প্রাইভেট কার এসে তাকে নিয়ে যায়।
ঘটনার দিন মঞ্জুর আহমেদের শ্যালিকার বাসায় একটা প্রোগ্রাম ছিল। পুরো পরিবার ছিল ওই প্রোগ্রামে। গাড়িও ছিল ওদের সাথে। কথা ছিল রোগী দেখা শেষে শ্যালিকার বাসার প্রোগ্রামে যোগ দিবেন মঞ্জুর আহমেদ।
ওইদিন খুব ভিড় ছিল। রোগী দেখা শেষে বের হতে হতে সাড়ে দশটা বেজে যায় মঞ্জুর আহমেদের। উনি উনার সহকারীকে বলেন, ট্যাক্সি, সিএনজি, বাস যা-ই পাবেন, উঠে পড়বেন। গেটের দারোয়ান জানায় স্যারকে একটা রিকশায় উঠতে দেখছে ও। রিকশা করে তিনি সম্ভবত র ওয়াটার শপিং মলের ওদিকটায় যেতে চাচ্ছিলেন। ওখানে প্রচুর সিএনজি মিলে। স্যারের সাথে গাড়ি যখন থাকে না তখন উনি এভাবে রিকশায় করে ব্ল ওয়াটারের দিকে যান। ওদিকে অনেক রাত অবধি সিএনজি পাওয়া যায়।
তারপর থেকে তার আর কোন ট্রেস নেই। তার সিমের কললিস্ট চেক করা হয়েছে। ওইদিন স্ত্রীর সাথে আলাপই ছিল ডাক্তারের সর্বশেষ ফোনালাপ। ব্লু ওয়াটার শপিং মলের আশেপাশে খোঁজখবর নেয়াও শেষ। কেউই তেমন কোন তথ্য দিতে পারলো না।
ডাক্তার সর্বশেষ কল করেছিলেন ১০৪৪৬ মিনিটে। তখন তিনি রিকশায়। স্ত্রীকে জানান, এখনো সিএনজি পাননি। সিএনজি পেলে সময় বেশি লাগবে না। রাতের এই সময়টায় ঢাকা শহর প্রায় ফাঁকা থাকে। জ্যাম বলতে গেলে থাকেই না। স্ত্রী তাকে তাড়া দেন, জলদি আসো। খাবার দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ডাঃ মঞ্জুর আহমেদের জলদি আসা আর হয় না।
তাকে পাওয়া যায় মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে, মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায়।
তবে কী রিকশা থেকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে যায় তাকে? নাকি রিকশা চলাকালীন সময়ে কোন সিএনজি পেয়ে যান, তারপর দরদাম করে ওটাতেই উঠে পড়েন? ব্লু ওয়াটারের ওদিকে আর যাওয়া লাগলো না তখন।
চারজনকে নিয়ে গবেষণা করা হয়ে গেছে তার। কিন্তু তাদের মাঝে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য তিনটা কমন যোগসূত্র আছে
যোগসূত্র নাম্বার এক, তারা চারজনই পুরুষ
যোগসূত্র নাম্বার দুই, তারা চারজনই ঢাকা নিবাসী
যোগসূত্র নাম্বার তিন, তাদের খুন করার প্যাটার্ন একই রকমের
কিন্তু অমিলও কম নয়। তাদের পেশা ভিন্ন, বয়স ভিন্ন, ব্যাকগ্রাউন্ড ভিন্ন। তারা থাকেনও ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। কিন্তু এক জায়গায় এসে চারজনই মিলে গেল।
কিংবা কোন এক মনোবিকারগ্রস্ত খুনি মিলিয়ে দিলো।
দুধ চা কিলার কী তবে কোন ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার? সপ্তাহ কিংবা মাসের কোন এক বিশেষ দিনে/মুহূর্তে তার হননেচ্ছা জেগে উঠে?
হতে পারে।
তবে সিরিয়াল কিলার কনসেপ্টটা এখনো বিদেশি। তার মানে এই না যে দেশি কোন সিরিয়াল কিলার হতে পারে না।
আলবাত পারে। বিকারগ্রস্ত মানুষ শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকে না, দুনিয়ার সব জায়গাতেই থাকে।
আজ মাউন্ট এডোরার আশেপাশে আছে পুলিশের দুই টিম। ওই এলাকায় যত রিকশাওয়ালা আছে সবাইকে ডাক্তারের ছবি দেখানো হচ্ছে। গতকালও একই কাজ করে এসেছে ওরা, কাজ হয়নি। আজ আবার ওদেরকে পাঠিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। যদি কোন কাজ হয়।
দুপুর তিনটার দিকে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড গিয়াস উদ্দিন ফোন দেয়। একজন রিকশাওয়ালা চিনতে পেরেছে ডাক্তারকে। ওইদিন ও-ই ডাক্তারকে রিকশায় উঠিয়েছিল। ডাক্তারকে আগেও সে রিকশায় তুলেছে, এটাই প্রথম নয়। এডোরার আশেপাশের গলিতে সে নিয়মিত রিকশা চালায়। এখানকার খদ্দের সে মোটামুটি চিনে।
তবে পরের তথ্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওইদিন মাঝরাস্তায় খালি সিএনজি দেখে ওটা থামান ডাক্তার। তারপর দরদাম করে ওটাতেই উঠে পড়েন।
“সিএনজি ওয়ালার চেহারা মনে আছে?”
“জি না, স্যার। রাইতের আন্ধারে মুখ ভালো মতো দেখা যায় নাই।”
“বা ঐ সিএনজি’র কোন কিছু…”
লোকটা খানিকক্ষণ ভাবে। ভেবে জবাব দেয়-‘সিএনজি’র পিছে ছায়াছবির পোস্টার আছিল। রাজ্জাকের ছবি। বাবা কেন চাকর।”
জবাবটা শুনে মুখ কুঁচকে কী জানি চিন্তা করার চেষ্টা করেন রফিকুল ইসলাম। তারপর দুদ্দাড় করে প্রথম ভিকটিম ৬৯ বছর বয়সী রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার সুলতান মাহমুদের ফাইল বের করে। মাহমুদ ওইদিন বেরিয়েছিলেন বন্ধুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণে। অনুষ্ঠান ছিল অফিসার্স ক্লাবে। ওখান থেকে বেরোতে বেরোতে রাত হয়ে গিয়েছিল। এগারটার মতো। ওইদিন সুলতান মাহমুদকে সিএনজি’তে তুলে দিয়েছিলেন তারই অন্তরঙ্গ বন্ধু শ্যামল দত্ত। শ্যামল থাকেন বেইলি রোডেই, অফিসার্স ক্লাবের দুই গলি পরেই। উনি হেঁটেই বাসায় ফিরেন।
যা খুঁজছিলেন পেয়ে যান রফিকুল ইসলাম। সিএনজি’র কথা আলাদাভাবে শ্যামল দত্তের মনে আছে দুটা কারণে
কারণ ১. সিএনজি খুব কম ভাড়া চাচ্ছিল। বেইলি রোড থেকে নিকুঞ্জ মাত্র একশো বিশ টাকা!
কারণ ২. সিএনজি’র পেছনে একটা সিনেমার পোস্টার লাগানো। বাবা কেন চাকর।
ভ্রু কুঁচকে ফাইল দেখতে থাকেন রফিকুল ইসলাম। তার ভুটা কুঁচকেই থাকে, সমান হয় না।
*
অধ্যায় ৭
রেস্টুরেন্টের নাম গরম লাগছে।
অবশ্য কদম ভেতরে ঢোকার পর থেকে গরম লাগার মত কিছু পায়নি। রেস্টুরেন্ট আগা গোড়া এসিতে মোড়া। এমনকি বাথরুমও হিমশীতল, পানি বরফ ঠান্ডা। গরম লাগবে কী শীতে সে রীতিমত কাঁপছে।
বাথরুম খারাপ না, বেশ বড়। ঢুকতেই ডানদিকে সারি সারি বেসিন, লম্বা কাঁচের আয়না। মোটমাট তিনটা ইউরিনাল, চারটা ল্যাট্রিন। দুইটা ল্যাট্রিনে ইংলিশ স্টাইলের কমোড, আর দুইটা বাংলা।
কদম ভেতরে ঢুকে এক চক্কর টু মেরে নেয়। ইউরিনালে কেউ নেই। ওপর নিচ দেখে নেয় সে।
না, কোন ধরণের ম্যাসেজ লেখা নেই।
চারটা ল্যাট্রিনের তিনটা ফাঁকা। একটা ইংলিশ কমোডে গু ভাসছে। ফ্লাশ করতে গিয়ে কদম লক্ষ্য করে ফ্লাশ নষ্ট। কমোডের ডালা নামিয়ে দেয়
সে, ভাসন্ত গু-ও ডালার নিচে হারায়।
অন্য টয়লেটটা বন্ধ। ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। কারো গলার আওয়াজ। কেউ একজন ফোনে কথা বলছে। বাইরে থেকে শুনতে পায় কদম।
কদম অযথাই হাত-মুখ ধোয়। টিস্যুর রোল থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মোছে। ফ্রি’ তে মিলছে দেখে কয়েক তাড়া টিস্যু পকেটেও ভরে নেয়। বাসায় টিস্যু ব্যবহার করা হয় না। একটা টয়লেট টিস্যুর দাম পনেরো টাকা। আর এক কেজি বাঁধা কপির দাম পনেরো টাকা। টিস্যুর চেয়ে বাঁধা কপি উত্তম। টিস্যু কিনে ফুটানি না করলেও চলবে। শৌচকার্যের পর পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই তো হলো।
মোবাইল বের করে কদম সাপের গেম খেলে খানিকক্ষণ। এরই মধ্যে বাথরুমে আরেকজন ঢুকে। স্যুটেড-বুটেড লোক, চোখে চশমা, গা থেকে ভুর ভুর করে ভেসে আসছে পারফিউমের গন্ধ। একবার তার দিকে চোখ বুলিয়ে লোকটা হাত ধুতে শুরু করে। কদমও নির্বিকার মুখে সাপের গেম খেলতে থাকে। হাত ধোয়া শেষে লোকটা চলেও যায়।
সাপ গিয়ে উঁস খায় দেয়ালে। গেম ওভার। মোবাইল স্ক্রিনে মেসেজ ভাসে। কদম হতাশ হয়। এবারো জয়নালের সর্বোচ্চ স্কোর টপকানো গেল না। জয়নালের স্কোর ৩৮,৬০০। কদম সাকুল্যে ১৮,৯০০ তুলতে পেরেছে। এর উপরে কখনো যায় নাই।
ব্যাকে চাপলে মোবাইল ফিরে আসে হোমপেজে। ওয়ালপেপারে একটা সবুজ উপত্যকার ছবি। মাঝখানে একটা পাথরের কুঁড়েঘর, চিমনি দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই, কোন মানুষজন নেই। অনতিদূরে একটা স্বচ্ছ লেক, লেকের দূরবর্তী প্রান্ত যেন আকাশে গিয়ে মিশেছে। আকাশে রংধনুর সাত রং।
কদম স্বপ্ন দেখে ওই লেক বেয়ে একদিন রংধনু ছুঁয়ে আসবে ও। তারপর রংধনুর সাত রং শরীরে মেখে ফিরে আসবে কুঁড়েঘরে। বারান্দায় বসে চা খাবে। সাথে থাকবে….
ফ্ল্যাশের শব্দ। তারপর খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ। কাঁধ আর কানের মাঝখানে মোবাইল ব্যালেন্স করে এক মধ্য বয়স্ক লোক বেরিয়ে আসে, হাত পোয়। আড়চোখে লোকটার আপাদমস্তক দেখে কদম।
লোকটা বেঁটেখাটো, মাথায় চুল হালকা, মুখটা গোলগাল। থুতনিতে স্টাইলিশ ছাগলী দাড়ি। দাড়িটা আবার ঝুটি করে বাঁধা। দ্রু’তে সোনালি রিং, বাম কানেও একটা রিং শোভা পাচ্ছে। আলো লেগে ঝিলিক দিয়ে উঠে রিং।
ছাগলী দাঁড়ি তাকে পাত্তাই দেয় না, মোবাইলে কথা বলে যেতে থাকে অবিরাম।
শিস বাজাতে বাজাতে চতুর্থ ল্যাট্রিনে একবার ঢু মারে কদম, যেটা। থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে ছাগলী দাঁড়ি। এবং ঢুকতেই পরিচিত গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে। মুহূর্তে দার্শনিক ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কদম। ছাগলী দাড়ি, চৌকো দাড়ি, লম্বা দাড়ি কিংবা দাঁড়িহীন-সবার মলমূত্রের গন্ধ কিন্তু একই! ধনী-গরীব, উজির-নাজির সবাই কিন্তু এইক্ষেত্রে একই কাতারে অবস্থান করছে। এ এক অদ্ভুত সাম্যাবস্থা!
ভাবালুতা শেষে টয়লেটের ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয় কদম। স্পর্শকাতর অঙ্গের ছবি আছে বেশ কয়েকটা, স্তন ও লিঙ্গ। স্তন-লিঙ্গ দেখে কদম লজ্জায় রাঙ্গা হয়, মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছু ফোন নাম্বার দেয়ালে লেখা। কিন্তু যা খুঁজছিল তা নেই।
লোকটা বলেছিল লালমাটিয়া ব্লক-ই’র তের নাম্বার রোডের কোন এক রেস্টুরেন্টে ম্যাসেজটা থাকবে। বাথরুমের দেয়ালে সবুজ কালিতে একটি কাপের ছবি আঁকা থাকবে। নিচে লেখা থাকবে-রং চা, আসল চা। এত কিছু থাকতে ম্যাসেজটা বাথরুমের দেয়ালে কেন লেখা থাকবে এটা আর পরিস্কার করেনি লোকটা, কদমও গরজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেনি।
লালমাটিয়া ব্লক-ই’তে চারটা রেস্টুরেন্ট। কোপা সামছু, চরম চাপ, ডিপ থ্রোট ও গরম লাগছে।
কোপা সামছু, চরম চাপ ও ডিপ থ্রোট দেখা শেষ। না, কোন ধরণের কোন ম্যাসেজ পায় নি সে।
কোপা সামছু পিচ্চি একটা রেস্টুরেন্ট। সাকুল্যে দুইটা বেসিন, আর একটা বাথরুম। চরম চাপেরও একই অবস্থা। ডিপ থ্রোটের ওয়াশ রুম ফ্যাসিলিটি খানিকটা ভালো। বাথরুমের সংখ্যা দুই, বেসিনও দুইটা। চারটার মাঝে গরম লাগছে’ই খুব সম্ভবত সবচেয়ে পশ। সুযোগ-সুবিধা অপেক্ষাকৃত ভালো। খাওয়ার ও ত্যাগ করার।
কিন্তু চারটা রেস্টুরেন্টই অন্তত এক জায়গায় অভিন্ন। কোনটাতেই কোন কাপের ছবি পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায়নি রহস্যময় বাণী-রং চা, আসল চা।
কী হলো লোকটার? যোগাযোগ যে করবে তারও কোন উপায় নেই। লোকটা হুট করে উদয় হয়, হুট করে হাপিশও হয়ে যায়। কোন ফোন নাম্বার নেই, ঠিকানা নেই। নাম্বার চাইতে কী জানি বলছিল লোকটা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
দরকার হইলে আমিই তোমারে খুঁইজ্যা বাইর করবো। টেনশন নিয়ে না।
হতাশ হয় কদম। গরম লাগছে থেকে ঠাঠা রোদে বাইরে বেরিয়ে এসে সত্যি সত্যিই গরম লাগা শুরু করে তার। মুহূর্তে চটচটে ঘামে ভিজে যায় শরীর। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠতে খেয়াল হয় সকাল থেকে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। এক কাপ চা আর রুটি মুখে পুরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সে আর এখন প্রায় সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।
গরম লাগছে’র ঠিক উল্টাদিকে একটা ভাতের হোটেল। কোন নাম নেই হোটেলটির, টিয়া রংয়ের নামফলকটি শূন্য। একদম শূন্য না অবশ্য। জায়গায় জায়গায় পাখির সাদা বিষ্ঠা শোভা পাচ্ছে। গাঢ় টিয়ার সাথে সাদা সাদা লেপটানো ছোপ, যেনবা উত্তর-আধুনিক কোন শিল্পীর ক্যানভাস। কে জানে, নামফলকটি নিলামে তোলা হলে হয়তোবা মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হবে।
হোটেলটির গা ঘেঁষে একটা ঝাকড়া শ্যাওড়া গাছ। গাছের ডালে ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কাকের দঙ্গল। বিষ্ঠা ওদের পশ্চাৎদেশ থেকেই নির্গত হয়। নির্গত বিষ্ঠা তারপর মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ নিয়মে এসে পতিত হয় টিয়া রংয়ের নামফলকে কিংবা এর আশেপাশে।
বেঞ্চিতে বসে চায়ে ডুবিয়ে রুটি খেতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজনকে, কয়েকজন খাচ্ছে ভাত। কেউ কেউ চায়ে চুমুক দিয়ে অলস ভঙ্গিতে টিভি দেখছে। টিভিতে ওমর সানি আর মৌসুমীর পুরনো একটা ছবি দেখাচ্ছে। ওমর সানি বাঁশি বাজাচ্ছে, মৌসুমী তার ধুমসো কোমর দুলিয়ে নাচছে। মৌসুমীর পরনে লেহেঙ্গা ও স্কার্টের মাঝামাঝি একটা পোশাক। পোশাকের দায়িত্বে যে ছিল সে হয়তোবা বিভ্রান্তিতে ভুগছিল। মৌসুমী স্কার্ট পরবে না লেহেঙ্গা? শেষমেষ ‘না স্কার্ট, না লেহেঙ্গা পরেই হাজির হন নায়িকা।
হাঁটুর সামান্য নিচে এসে ফুরিয়ে গেছে পোশাকটি। ক্যামেরা মৌসুমীর কোমর ও মাংসল পা’র ওপর স্থির।
লোকজন চা খায়, চায়ে ডুবিয়ে রুটি খায়, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ মাখিয়ে ভাত খায় আর মৌসুমীর কোমর ও মাংসল পা দেখে।
চেয়ার টেনে বসে পড়ে কদম। তার উল্টা দিকে এক বুড়ো লোক ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছে। হাড়জিরজিরে শরীর, তোবড়ানো গাল। পরনে ময়লা
শার্ট আর লুঙ্গি। তার প্লাস্টিকের প্লেটের একপাশে মরিচ আর পেঁয়াজ রাখা। মাঝে মাঝে সে কামড় দিচ্ছে লম্বা মরিচে, মাঝে মাঝে গোলাকার পেঁয়াজে। তার মাথার উপর শব্দ করে ঘুরে যাচ্ছে গোলাপি সিলিং ফ্যান, আর টেবিল ঘিরে ভনভন করে ঘুরছে কয়েকটা মাছি। লোকটা মাছির উপস্থিতি গ্রাহ্যই করছে না। সে ধ্যানস্থ ঋষির মতো তার সমস্ত মনোযোগ ভাত, ডাল, মরিচ আর পেঁয়াজের ওপর রাখে। ওদিকে টিভিতে তখনো মৌসুমী কোমর দুলিয়ে যাচ্ছেন, আর ওমর সানি বাজাচ্ছেন বাঁশি।
দেয়ালে সাঁটা খাবারের মূল্যতালিকা। রং চা পাঁচ, আদা চা ছয়, দুধ চা। আট। সাদা ভাত দশ, ডাল পনেরো, ভাজি পনেরো, সবজি পনেরো। মাংসের আলাদা মূল্যতালিকা, মাছের আলাদা।
ভাত, আলু ভাজি আর ডালের অর্ডার দেয় কদম। পিচ্চি ছেলেটা অর্ডার নিয়ে চলে যায় পেছনের দিকে। পেছনেই খুব সম্ভবত হেঁসেল।
“বেসিন কোন দিকে রে?”
পিচ্চি হাঁটতে হাঁটতেই হাত দিয়ে ইঙ্গিত দেয়। ডানে।
কদম উঠে দাঁড়িয়ে বেসিন পানে এগোয়। জায়গাটাকে ঠিক বেসিন বলা যায় কিনা জানে না কদম। পানির ট্যাপ আছে, পরপর তিনটা। নিচটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। ওখানে ময়লা পানি জমে আছে। পানি বের হওয়ার জায়গা আছে হয়তোবা, ময়লা জমে জমে বন্ধ হয়ে গেছে।
ট্যাপের পাশে সাবানদানিতে কসকো সাবান রাখা। স্বচ্ছ কসকো সাবানে হাত ঘষে ঘষে ধুয়ে নেয় কদম। ট্যাপের পতিত জলধারা যুক্ত হয় ময়লার স্রোতধারার সাথে।
“চা খাইবেন?” পিচ্চিটা আবার উদয় হয়।
“না। তোদের টয়লেটটা কোনদিকে?” হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ পেয়ে বসে কদমের।
পিচ্চি এবার পেছন দিকটা ইঙ্গিতে দেখায়।
হেঁসেলের পাশে টয়লেট?
পেছনে গিয়ে ভুল ভাঙে কদমের। টয়লেট আসলেই পেছনে, হেঁসেলেরও পেছনে। দরজা খুলতেই দুর্গন্ধ দু’হাত মেলে স্বাগত জানায় তাকে। কদম গড়পড়তা সাধারণ মানুষ হলে এতক্ষণে তার নাড়িভূঁড়ি উল্টে আসার কথা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে এরচেয়ে ভয়ানক দুর্গন্ধ আর দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত সে। তাই নাড়িভূড়ি জায়গামত থাকে, উল্টে আসে না।
ভেতরটা প্রায়ান্ধকার। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে তেরছা ভাবে আলো এসে পড়েছে। ওতেই যা করার করতে হবে।
আর তখনই লেখাটা চোখে পড়ে কদমের। আলোটা তেরছাভাবে যেখানে পড়েছে, তার ঠিক নিচে। সবুজ কালিতে ধূমায়িত এক কাপের ছবি আঁকা। নিচে লেখা : রং চা, আসল চা!
*
হেঁসেলের পাশে পিচ্চি একটা দরজা আছে। পাঁচক ময়লা-টয়লা ওদিক দিয়েই ফেলে। পেছনে একটা ময়লা উপচানো নীল ড্রামের দেখা মিলে। ড্রাম পেরুলে একটা কানা গলি। গলি শেষ হয়েছে একটা দেয়ালে। হোটেল আর অফিস কমপ্লেক্সের পশ্চাৎদ্দেশ মুখোমুখি দাঁড়ানো। দুই পাছার মাঝখানের খাজ এই কানা গলি।
কেউ ব্যবহার করে না এই গলি। গলির একমাত্র উপযোগিতা ময়লা ফেলা। এই কানা গলি একটি জ্বলজ্যান্ত ডাস্টবিন ছাড়া আর কিছুই না। গন্ধে টেকা দায়। ঠিক পাছার খাঁজের মতোই দুর্গন্ধ।
দুর্গন্ধে অভ্যাস আছে কদমের। ওটা নিয়েই তার কাজ-কারবার। দুর্গন্ধকে তাই প্রচন্ড আপন মনে হয়। মনে হয় ঘরে ফিরে এসেছি। সুগন্ধে বরং ক্রু কুঁচকায় কদমের। বমি বমি লাগে। মনে হয় বানোয়াট কোন জিনিস। মেকি, কৃত্রিম।
এখন স্রেফ পনেরো মিনিটের অপেক্ষা। কদম পকেট থেকে মোবাইল বের করে। সাপের গেম খেলা যাক।
আচ্ছা এই পনেরো মিনিটের কাউন্ট ডাউন কখন থেকে শুরু? সে যখন বাথরুমে মেসেজটা দেখেছে তখন থেকে না যখন হোটেলে ঢুকেছে তখন থেকে? নাকি কাউন্ট ডাউন শুরু গলিতে ঢোকার পর থেকে?
অস্থির লাগে কদমের। এখন ৩ঃ১১ বাজে। তাহলে কী ৩ঃ২৬-এ আসবে লোকটা?
সাপ গিয়ে দেয়ালে ট্রুস খায়। মোবাইল স্ক্রিনে মেসেজ ভাসে, ‘গেম ওভার।
ঠিক ৩৪২৪ এ অফিস কমপ্লেক্সের পেছনের দরজা সটান খুলে যায়। ধড়াম করে একটা আওয়াজ হয়। হকচকিয়ে গিয়ে হাত থেকে মোবাইলটাই ফেলে দেয় কদম।
লোকটা বেরিয়ে আসে। আজ তার বেশভূষা ভিন্ন। গায়ে নীল রংয়ের ইউনিফর্ম, হাতে লাল লাঠি। বুকে লেবেল সাঁটা। সিকিউরিটি গার্ড।
“আমার দিকে তাকাইয়ো না। যা করতাছো, করতে থাকো।” বিড়বিড়িয়ে বলে যায় লোকটা।
তারপর কদমের উল্টাদিকে প্রস্রাব করার ভঙ্গিমায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ও। ফুসসসস করে একটা আওয়াজ শুরু হয়।
সত্যিই কী প্রস্রাব করতেছে নাকি লোকটা?
আড়চোখে ওর দিকে তাকায় কদম।
“বলছি আমার দিকে না তাকাইতে। কুনুদিন কাউরে মুততে দেখো নাই?” খেঁকিয়ে উঠে নকল সিকিউরিটি গার্ড।
কদম মোবাইলটা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে তুলে। ভাগ্য ভালো, পলিথিনের একটা প্যাকেট ছিল নিচে রাখা। মোবাইল ওখানে গিয়ে পড়েছে, তাই তেমন কিছু হয়নি। আর কোথাও তাকাতে না পেরে বেকুবের মতো কিছুক্ষণ নিজের মোবাইল স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকে ও। স্ক্রিনে পরিচিত দৃশ্য। সবুজ উপত্যকা, কুঁড়েঘর আর রংধনুর সাত রং।
কোন একদিন…
জিপার লাগানোর শব্দ। প্রস্রাব শেষ তাহলে। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসেই থাকে লোকটা। “কালকের প্ল্যান বুঝবার পারছো তো? ক্লিয়ার?”
না, কদম ক্লিয়ার না। তাই ও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বারবার।
কীভাবে? কীভাবে হবে সবকিছু?
লোকটা ব্যাখ্যা করে বুঝায়।
এভাবে। এভাবেই হবে সবকিছু।
অপারেশনের একটা গালভরা নাম দেয় লোকটা। অপারেশন ইন অ্যান্ড আউট। বাম হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল এক করে একটা বৃত্ত আঁকে ও, তারপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বৃত্ত ভেদ করে ভেতরে ঢুকে বারবার।
যৌনসঙ্গমের চিরায়ত ইঙ্গিত।
লোকটার মুখও অশ্লীল হাসিতে ভরপুর। যেন প্রজননের মতো নেক কাজে অবদান রাখছে, ভাবতেই বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি বেড়ে যাচ্ছে। তার।
“ঢুকবে দুইজন, বের হবে একজন।”
প্ল্যানটা একদমই পছন্দ হয়নি কদমের। হসপিটালের ভেতরটা না হয় কোনভাবে ম্যানেজ করা গেল, কিন্তু পুরো প্ল্যানটা কীভাবে ম্যানেজ করবে ও? তার ওপর লোকটা জানিয়েই দিয়েছে হসপিটালের ভেতরের দায়িত্ব সম্পূর্ণ ওর।
কিছু কখনো করে নাই ও। আর তার মতো হাই-প্রোফাইল লোককে চেতনানাশক কিছু দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখাটা খুবই রিস্কি।
জেগে উঠে উনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? উনি নিশ্চয়ই কদমের গর্দান চাইবেন? বেঁকে বসে কদম। “কিন্তু উনি যখন জেগে উঠবেন, তখন কী জবাব দেব আমি?”
“আরে উনি তোমারে খুব লাইক করেন, তুমি ঠিকই উল্টাপাল্টা কিছু একটা কইয়া ম্যানেজ করতে পারবা। আর আমার লোকও থাকবো। অবস্থা খারাপ হইলে, ও-ই সামাল দিবো। সো, নো চিন্তা। ডু…”
স্ফূর্তি করার কথাটা আর মুখ ফুটে বলতে পারে না লোকটা। তার আগেই দুদিকে মাথা নাড়তে শুরু করেছে কদম। “আমি পারবো না।”
“পারবা, পারবা।”
“না।” একটু কাঠিন্যও কী মিশে যায় কদমের দুর্বল কণ্ঠে?
লোকটার চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করে। “বাহু, কদমের চ্যাত আছে দেখি! ইম্প্রেসিভ। আচ্ছা, কাজটা না করলে কী কী হইবো বা হইতে পারে বইলা দেই–
এক. তুমি যে হসপিটাল থাইক্কা ব্লাড, ইউরিনের স্যাম্পল এইগুলান সরাও আমি হসপিটাল অথরিটিরে কইয়া দিমু। তোমার চাকরি তৃতীয় বারের মত নট অইয়া যাইবো। সাড়ে ছয় হাজার পাইতা, এখন পাইবা জিরো।
দুই…”
দুই নাম্বার পয়েন্টে আসার আগেই হাহাকার করে উঠে কদম। দুইটা চাকরি গেছে, তিন নাম্বারটাও খোয়াতে চায় না ও। এরপর আর কেউ চাকরি দিবে না ওকে।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। করবো।”
“এইতো, গুড। কদম ইজ এ গুড বয়। কদম হয় একটি ভালো পোলা।” পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে রাস্তায় রেখে দেয় লোকটা। “এইটা রাখো। এখানে একটা অ্যাপ আছে। ট্যাঙ্গো। কল-ভিডিও কল দুইটাই করা যায়। ট্যাঙ্গোতে আমার লগে কানেক্টেড আছো তুমি। আমি কল করমু তোমারে, তুমি না। বুঝবার পারছো?”
“পারছি।”
“গুড।” উঠে দাঁড়ায় লোকটা। কদমের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি দেয়। লোকটা লম্বা আছে বেশ। তবে পেটটা পুরো শরীরের তুলনায় ভালোই মোটা। স্ফীত উদর ইউনিফর্ম ভেদ করে বাইরে বের হয় হয় অবস্থা। শার্টের ফাঁক দিয়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি দেখা যায়।
গোঁফ লাগিয়েছে। ভুরুটা ঘন। গতবার ফর্সা দেখাচ্ছিল, এবার রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। আর প্রথমবার তো লিঙ্গই বদলে ফেলেছিল লোকটা, হাজির হয়েছিল এক ধুমসো মহিলার চেহারা সুরত নিয়ে।
আচ্ছা, লোকটার আসল রুপ কী?
গদাই লসকরি চালে চলেই যাচ্ছিল লোকটা। পেছন থেকে আস্তে করে ডাক দেয় কদম।
“আপনার নাম কী নামে সেভ করা?”
না থেমেই লোকটা জবাব দেয়। প্রথম দেখাতেই কইছিলাম নামটা। গিল্টি। জি-ইউ-আই-এল-টি-আই।”
“কিন্তু গিল্টি নামের শেষে তো ওয়াই, আই না।” মেট্রিক পাস কদমের খানিকটা গর্বই হয় গিল্টি নামের সঠিক বানান জানে বলে।
বিরক্ত চোখে তাকায় লোকটা। “হইছে, বানান ঠিক করা লাগতো না। যা করতে বলতেছি ওইটা ঠিকমতো করো। যত্তসব।”
খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে সেঁধোয় লোকটা। দড়াম করে লেগে যায় দরজা।
*
অধ্যায় ৮
পেছন নকিব মগে করে চা দিয়ে গেছে। চা মুখে দিতেই রফিকুল ইসলামের মুখটা তেতো হয়ে যায়। নির্ঘাৎ অন্য দোকান থেকে এনেছে, মকবুল মিয়া এই রকম চা বানাতেই পারে না। নকিবকে ডেকে নিশ্চিত হওয়া গেল। মকবুলের দোকান বন্ধ। বাধ্য হয়ে পাশের একটা চার দোকান থেকে চা নিয়ে এসেছে সে।
“দোকান বন্ধ?”
“জে, স্যার। তালা লাগান দেয়া। বাড়িত গেছে মনে অয়।”
অদ্ভুত লাগে রফিকুল ইসলামের। মকবুলের দোকান সচরাচর বন্ধ দেখেননি তিনি। দুই ঈদে বাড়িতে বেড়াতে যায় সে। প্রায় সপ্তাহখানেক থেকে ফিরে আসে। না হয় ওর দোকান সবসময় ভোলা থাকে। ভোরবেলায় দোকান খুলে ও আর বন্ধ করতে করতে রাত বারোটা-একটা। দুপুরের দিকে বাসায় গিয়ে ছোটখাট একটা ভাতঘুম দিয়ে নেয় মকবুল। তারপর দোকানে ফিরে আবার কাজে লেগে যায়। ভাতঘুমের সময়টায় ওর এক শ্যালক দোকান সামলায়।
মোটামুটি এই-ই হলো মকবুলের দৈনন্দিন রুটিন। এর ব্যত্যয় ঘটে খুব কম। বিকালের দিকে অফিস থেকে চা খেতে বের হন রফিকুল ইসলাম। মিনিট পনেরো বাইরে থাকেন। মকবুলের দোকানে বসে টুকটাক কথাবার্তা হয় তখন। মকবুলের আগ্রহের বিষয় প্রধানত ক্রিকেট। বাংলাদেশের কোন খেলাই মিস দেয় না ও। খেলা দেখার জন্য পকেটবুক আকৃতির একটা টিভিও কিনে রেখেছে। বাংলাদেশ জিতলে খুশির চোটে ফ্রি চা-ও খাওয়ায়। তবে রাজনীতির আলাপ মোটেও পছন্দ করে না মকবুল। কেউ শুরু করতে চাইলে তার আগ্রহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে বলে-”ভাই, আমগো হইলো পেটনীতি। পেট ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা।”
এমনিতে বেশ মজলিশি মানুষ মকবুল। রঙ্গ-রসিকতা পছন্দ করে খুব, পছন্দ করে নিজের কাজও। পড়ালেখা শিখে নাই এ নিয়ে তেমন কোন আফসোস নাই। রফিকুল ইসলামদের মত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফাইল ঠেলে জীবন পার করে দিতে পারে নাই বলে কোন মনস্তাপও নেই তার মাঝে। বরং চা খাইয়ে সে যে অসাধারণ তৃপ্তি পায় এটা বারবার তার কথায় ফুটে উঠে ।
“মানুষগো খাওয়ানো একটা ইবাদত, বুঝলেন নি ভাইসাব…”
নিজের কাজ এত পছন্দ করে বলেই কী তার চা এত অসাধারণ হয়? রফিকুল ইসলাম একদিন জিজ্ঞেস করেন মকবুল মিয়াকে।
মকবুল মিয়া তখন পাউরুটি ছিঁড়ে একটি কুকুরকে খেতে দিচ্ছে। কুকুরটি এই গলিতেই ঘুরে-ফিরে। লাথি-গুঁতো খায়, ময়লা-আবর্জনা ঘটে, মাঝে মাঝে মানুষজন ভালোবেসে খাবারও দেয় তাকে।
প্রশ্ন শুনে মকবুল মিয়া হাসে। “আমি আর কী চা বানাই, ভাইসাব? মোহাম্মদপুরে একজন চা বানায়, মান্নান মিয়া নাম। এক কাপ খাইলে সেকেন্ড কাপ আপনেরে খাইতেই হইবো, এত টেস্ট উনার চায়ের। আমি কয়েকবার গেছিলাম, কী রহম চা বানায় দেখতে। মান্নান ভাই কথা এটু কম কয়, তয় উনার মন ভালো থাকলে সুন্দর সুন্দর গফ করে। মানুষ লইয়া গফ, চা লইয়া গফ। পারলে একদিন যাইয়েন আপনে, মোহাম্মদপুরে উনার দোকান।”
চা-টা বেসিনে ফেলে দেন রফিকুল ইসলাম। এরকম জানলে বাসা থেকে ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসা যেত। ভাত খেয়ে এক কাপ চা না মিললে ঠিক জুত লাগে না রফিকুল ইসলামের। মুখের ভিতরটা আমসা আমসা লাগে।
আপাতত আমসা আমসা ভাবকে ব্যাকসিটে পাঠান তিনি। সামনে মেলে রাখা স্মার্ট ফোনে মনোযোগ দেন। ডাটা অন করতেই জলতরঙ্গের মত কিছু শব্দ। মেসেঞ্জারে ইনকামিং মেসেজের আওয়াজ। মেসেঞ্জারে ঢুকেন তিনি। বন্ধু জহিরুল আলম একটা মেসেজ পাঠিয়েছে। একটা ছবি। বর্তমানে চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে আছে ও। গত এক দশক ধরে ওখানেই পড়াচ্ছে, বিয়ে-থা করে সেটলও হয়েছে ওখানেই। মাঝে মাঝে কথা হয় ফেসবুকে। কেমন আছিস ‘ভালো’ টাইপ কথাবার্তা। কয়েকবার চট্টগ্রাম যাওয়ার নেমন্তন্নও দিয়েছে জহির। যাচ্ছি যাবো বলে পার করে দিয়েছেন তিনি। মাঝখানে বহুদিন আর নক দেয়া হয় নি।
ছবিটা একটা দেয়ালের। সাদা দেয়াল না, দেয়াল কিছু আঁকিবুকি আছে। দেয়ালচিত্র। ইংরেজিতে এ্যাফিতি। একজন লোক পিস্তল হাতে আরেকজনকে ধাওয়া করছে। সামনের জন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখছে। ছবির উপরে লেখা–দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব।
ছবি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক চট্টগ্রামেও দুধ-চা কিলার তান্ডব চালিয়েছে। অন্তত রফিকুল ইসলামের প্রথম প্রথম তা-ই মনে হয়েছিল।
কিন্তু না।
এই এ্যাফিতি বছর দুয়েক আগের। আর দুধ-চা হত্যাকান্ড শুরুই হয়েছে দেড় মাস আগে। দেয়ালটা চিটাগাং ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের।
মেসেঞ্জারে শুধু ওয়ালের ছবিই দেয়নি জহির, এর সামান্য ইতিহাসও তুলে ধরেছে। একটা পেপারের ওয়েব লিংক আছে। ক্যাম্পাস বার্তা নামে পত্রিকার। এটা চিটাগাং ভার্সিটির মাসিক পত্রিকা। মাসে মাসে বেরোয়। ওখানে একটা আর্টিকেল বের হয়েছিল এই অদ্ভুত দেয়াল চিত্র নিয়ে। দেয়ালচিত্রের পেছনের ইতিহাস ওখানে তুলে ধরা।
চিটাগাং ভার্সিটির কলা ভবনের পেছনে কয়েকটা ভাসমান টি-স্টল আছে। টি-স্টলের উল্টাদিকের দেয়ালে এই এ্যাফিতি আঁকা। কোন এক প্রত্যুষে কলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রিরা এ্যাফিতিটি আবিষ্কার করে। কে এঁকেছে, কেনইবা এঁকেছে এর কিছুই জানে না তারা। তবে এ্যাফিতি দারুণ হিট হয়ে যায়। এই দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষজন ছবি তোলে, ভিডিও বানায়, আড্ডা দেয়। ছাত্র-ছাত্রিরা এই এ্যাফিতির স্রষ্টাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু স্রষ্টার পরিচয় রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা।
আর্ট বিভাগের এক ছন্নছাড়া প্রফেসর আছেন, নাম লালন বৈরাগী। আসল নাম না, ছদ্মনাম। ভয়ানক চা-খোর ভদ্রলোক। চা-চক্র নামে উনার একটা আর্ট সিরিজ আছে। আর্ট সমাজে ভালোই সমাদৃত। এই সিরিজে এখনো পর্যন্ত চারটা পেইন্টিং আছে। সব কয়টা পেইন্টিংয়েরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো চা। ধারণা করা হয় প্রফেসর লালনই এই এ্যাফিতি এঁকেছেন। তাকে কয়েকবার প্রশ্ন করা হয়েছিল এ বিষয়ে, কিন্তু তার জবাব ছিল অদ্ভুত হেঁয়ালিমাখা।
“যে আঁকার সে-ই এঁকেছে।”
আর্টিকেলটা শেষ করে প্রচন্ড কৌতূহল বোধ করেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু হারামজাদা জহিরুল এ্যাফিতির ছবি মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে বিলকুল লাপাত্তা। তার টিকিটিও পাওয়া যাচ্ছে না আর।
রফিকুল ইসলাম ফোন করেন। ফোন বন্ধ। মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠান। কিন্তু কোন রিপ্লাই আসে না। সারাদিন প্রচন্ড অস্থিরতার মাঝে কাটান তিনি। দুধ-চা কিলার এর কেস ফাইল বের করে বারবার পড়েন। এ যাবত কেসে যা যা অগ্রগতি হয়েছে সবকিছুর ওপর একবার চোখ বুলান। সিএনজি’র পেছনে যে সিনেমার পোস্টার আঁকা ছিল-বাবা কেন চাকর, তা নিয়ে খুব বেশি দূর এগুতে পারেননি তারা। এরকম সিনেমার পোস্টার ওয়ালা সিএনজি ১০০ টা থাকতে পারে। তাতে কী কিছু প্রমাণিত হয়? তবুও সেকেন্ডে ইন কমান্ড গিয়াস উদ্দিনকে এর পেছনে লাগিয়ে রাখেন।
ফাইলে বেশ কিছু পেপার ক্লিপিংস রাখা। অনেক পত্রিকাই খুব গুরুত্ব নিয়ে কেসটা কাভার করেছে। কিন্তু কেউই চিটাগাং ভার্সিটির ওই গ্রাফিতির কথা উল্লেখ করে নাই।
রাতের খাবার শেষে ফোন আসে। জহির। সারাদিন ফোন স্যুইচড অভ ছিল, চার্জ ছিল না। তাই কল করতে পারে নাই। এ্যাফিতি নিয়ে কথা হয়। “চিটাগাংয়ে কী ওই সময় এই টাইপ কিলিংস হয়েছে?”
ফোনের ওপাশে খানিকক্ষণ চুপ থাকে জহির। “জানি না রে। তবে মনে হয় না। এরকম সেনসেশন্যাল কিছু হলে তো মিডিয়ায় আসতো।”
ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপে ট্রান্সফার করে নিয়ে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। কথা বলতে বলতে জুম করে দেখছিলেন তিনি। “আচ্ছা, এতদিন ধরে এই গ্রাফিতি তোদের ক্যাম্পাসে আছে, কিন্তু তোরা কেউই টু শব্দটা পর্যন্ত করলি না। কেন?”
“আসলে এই এ্যাফিতির বয়স তো কম না। দুই বছরেরও বেশি। প্রথম প্রথম খুব মাতামাতি হতো, এখন আর কেউ খেয়ালও করে না। আমিও কিন্তু খেয়াল করি নাই। ফেসবুকে আমার এক ফ্রেন্ড আছে, সোবাহান আকবর নাম। চট্টগ্রাম নিবাসী, চিটাগাং ভার্সিটিতে নাকি পড়ছে। ও-ই কথায় কথায় জানালো। তারপর মাথায় হিট করলো-আরে এই গ্রাফিতি তো আমাদের ক্যাম্পাসেও আছে!”
“তোর কী ধারণা লালন বৈরাগীই এই এ্যাফিতির আর্টিস্ট?”
“ক্যাম্পাসে সবাই এটা মনে করে। লোকটা একটু আউলা টাইপের, আর্টিস্টরা যেরকম হয় আর কী।”
“কই থাকে লোকটা?”
“উনি তো মাস দুয়েক হলো চাকরি ছেড়ে দিছে। ড্রিঙ্কিং প্রবলেম ছিল, নেশা-ফেশাও করতো। অ্যাফেয়ার ছিল অনেক, স্ক্যান্ডাল ছিল। বৌ ছেড়ে গেছে বহুত দিন হলো, ছেলে মেয়ে নাই। ডিপার্টমেন্টে উনার অ্যাগেইনস্টে প্রচুর কমপ্লেইন। পরে একসময় নিজে নিজেই রিজাইন দিছে…এখন কই থাকে জানি না, তবে যটুক জানি চিটাগাংয়েই বাড়ি।”
আরো খানিকক্ষণ কথা হয় জহিরের সাথে। জহির তাকে আবারো আমন্ত্রণ জানায়। চিটাগাং ভার্সিটি খুব সুন্দর, বিশাল ক্যাম্পাস। তোর খুব ভালো লাগবে।
তবে ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। আগামীকালকেই চিটাগাং যাচ্ছেন তিনি। এই এ্যাফিতি কাকতালীয় কিছু হতে পারে না।
*
অধ্যায় ৯
কাসেমের কসাইখানা আজ লোকে লোকারণ্য। রীতিমত তিল ধারণের ঠাঁই নেই” টাইপ অবস্থা। কসাইখানার সামনে মানুষের সাথে সাথে র্যাব পুলিশের একটা দলকেও দেখা যাচ্ছে। এত এত মানুষকে সামাল দিতে যেয়ে তারা ঘেমে নেয়ে একাকার। তারা কখনো ধমকাধমকি করছেন, চোখ রাঙ্গাছেন, কখনোবা করছেন মৃদু খিস্তিখেউর-”ঐ হালার পুতেরা জিন্দেগিতে তোরা লাশ দেখস নাই?”
কিংবা আরেকটু কড়া খিস্তিখেউর-”নাটকির পো, লাশ পেছন দিয়া ভইরা দিমু।”
কিন্তু তাতে ভিড় কমে না, বরং বাড়তেই থাকে। লাশ পেছন দিয়ে ভরে দেয়ার সম্ভাবনায় তারা একটুও ভয় পায় না। তারা জানে ওটা কথার কথা। তারা উঁকি দেয়, স্মার্টফোনে ছবি তুলে। কারণ এরকম লাশ তো সবসময় দেখা যায় না। মাথায় এরকম দা’র কোপ খেয়ে কয়জন পটল তুলে? আর সে লাশ যদি ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর মত কোন বিখ্যাত লোকের লাশ হয় তাহলে তো কথাই নেই।
পুলিশকে তাই বাধ্য হয়ে লাঠিচার্জ করা লাগে। কিন্তু মানুষের উৎসাহ তাতে বিন্দুমাত্র কমছে না। বরঞ্চ বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
যেদিকে তাকাও শুধু মানুষ আর মানুষ! রাস্তায় মানুষ, ব্যালকনিতে মানুষ, বিল্ডিংয়ের ছাদে মানুষ এমনকি কসাইখানার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছের ডালেও কিছু অত্যুৎসাহী মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু বেচারাদের ভাগ্য খারাপ। ডালটা ছিল বেশ নড়বড়ে। তাই এতজনের ভার আর সহ্য করতে পারেনি। মট করে হঠাৎই ভেঙে যায় তা। ডালে উপবিষ্ট পঁচজনসহ ডালটি সশব্দে নিচে পড়ে, মারাত্মকভাবে আহত করে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আরো সাতজনকে। পতিত পাঁচজন ও নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাতজনের হাহাকারে ভেসে যায় চারপাশ।
“ও আল্লারে। মাইরা লাইছেরে…”
হাহাকার একসময় মারামারি ও হাতাহাতিতে রুপান্তরিত হয়। যদিওবা পতিত পাঁচজনের সাথেই মারামারিটা হওয়া উচিত কিন্তু কোন এক রহস্যময় কারণে ঐ পাঁচজনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মারামারি তো আর থেমে থাকতে পারে না? রক্ত তো এমনিতেই অনেক গরম হয়ে আছে। তাই নিজেদের মধ্যে নিজেরাই মারামারি বাঁধিয়ে দেয় ভিড়ের লোকজন। একসময় পুলিশ এসে মারামারি থামায়।
একটু দূরে তামান্না কনফেকশনারীর সামনে তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে ঐ পতিত পাঁচজন। এর মধ্যে সর্ব ডানের জনের কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। সাদা রুমাল দিয়ে সে তার ক্ষতস্থান চেপে রেখেছে। তার পাশেই দাঁড়ানো লম্বা চুল ওয়ালা এক লোক, কাঁধে ঝুলানো ক্যামেরা। তার ক্যামেরার লেন্স ফেটে গেছে, তার নিজেরও সামনের পাটির একটা দাঁত উধাও। কপাল ফাটা জিজ্ঞেস করে লেন্স ফাটাকে, “কীরে মোশতাক, ক্যামেরা জুম কইরা কী প্যাকেজের কোন সন্ধান করতে পারছিলি?”
লেন্স ফাটা মানে মোশতাকের কণ্ঠে আগুন ঝরে। “আরে আপনে আছেন আপনার প্যাকেজ লইয়া। এদিকে যে আমার ক্যামেরার লেন্স ফাইট্টা গেছে সেদিকে আর আপনার খেয়াল নাই।”
কপাল ফাটা তাতে মোটেও দমে না। “আরে একটা ক্যামেরা গেলে আরেকটা ক্যামেরা আসবো। কিন্তু প্যাকেজ গেলে তো আর প্যাকেজ আসবো না…কী, বের করতে পারছিলি?”
“নাহ্, পারি নাই। এখন খুশি?” মুখ ঝামটা দেয় মোশতাক, ফাটা লেন্স কোনমতে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে।
মোশতাকের পাশেই ফাটা নাক চেপে কঁকাচ্ছে একজন, সাদা টিস্যু পেপার রক্তে লাল। তার গলায় ঝুলছে একটা বাইনোকুলার। এই লোকটাই কয়েকদিন আগে অমরত্বের সন্ধানে নামে একটা আর্টিকেল লিখেছিল দৈনিক তাজা খবর-এ। তার আর্টিকেল অনুযায়ী, ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী চায়নায় গিয়ে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। মাসদুয়েক ওখানে ছিলেন ডাক্তার। ঘুরে বেড়িয়েছেন চায়নার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত। কীসের খোঁজে? অমরত্বের খোঁজে। সেই অমরত্ব এখন ডক্টরের জিম্মায়। এই জন্যই চাইনিজ অথরিটি ডক্টরের দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তারা চাচ্ছিল না দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হোক। পরে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে দেশে ফেরার পথ সুগম হয় ডক্টরের। নাহলে তিনি চায়নাতেই পচে মরতেন। তার অমরত্বের কাহিনী বিলীন হয়ে যেত কালের গর্ভে।
ফাটা নাকওয়ালা ঐ সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে সে এতকিছু জানলো কেমন করে। জবাবে ফাটা নাকওয়ালা ফো হাসি হেসে বলেছিল-”আমার স্পেশাল সোর্স আছে!”
এই মুহূর্তে ফাটা নাকের পাশে তার স্পেশাল সোর্স দাঁড়িয়ে আছে। সোর্সের বয়স নেয়াহেতই অল্প। পনেরো-ষোল হবে বড়জোর। গাছ থেকে পড়ে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে সে, বুড়ো আঙুল বলতে গেলে থেঁতলেই গেছে। এখন সেই থেঁতলানো বুড়ো আঙুল ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
“কান্দিস নারে আকবর। দেখিস তোর আঙুল ঠিক হয়া যাইবো,” পাশ থেকে তাকে সান্তনা দেয় ফাটা নাক।
“হ্, বাল ঠিক হইবো। আপনের লাইগ্যা আইজ আমার এই দশা,” ফোঁপানি ছেড়ে হঠাৎই রণমূর্তি ধারণ করে আকবর।
আকবরের অভিযোগটা একদম মিথ্যে নয়। সে তো সামান্য এক চাকর মাত্র, এই তো কয়েক ঘন্টা আগেও যে কিনা ডক্টরের বাসায় চাকরি করতো। ডক্টর মানুষ বড় ভালো ছিল। ভালো খাওয়াতো, পরাতো, মাসশেষে টাকাও পেত। রীতিমত সুখের জীবন ছিল তার। কিন্তু ঐ যে বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। ভূতেই কিলিয়েছিল আকবরকে।
নাহলে কেউ সুখের মুখে লাথি মেরে কেউ স্পাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়? তাও আবার ড্যান্ডির লোভে?
খেপা আকবরকে আর না ঘাঁটিয়ে ফাটা নাক এবার দৃষ্টি দেয় তার ফটোগ্রাফারের দিকে। ফটোগ্রাফার কেন জানি খুব বিস্মিত। চোখ বড় বড় করে এই মুহূর্তে সে ক্যামেরা উল্টে পাল্টে দেখছে। তার বিস্ময়ের কারণ একটু পর বুঝা গেল। ডালসহ নিচে পড়ার সময় তার সাধের ক্যামেরার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি।
জিনিসটা ফাটা নাকের দৃষ্টি এড়ায় না। তাই সে ফাঁকেতালে জিজ্ঞেস করে বসে-”ছবি তুলতে পারছিলা?”
উৎসাহী মাথা নাড়ে ফটোগ্রাফার। ক্যামেরা টিপে কয়েকটা ছবি দেখায়ও সে। আগ্রহ নিয়ে ছবিগুলো একে একে দেখে ফাটা নাক। “কোপ মারলো কাসেম, কাম সারলো চাকমা! এই চাকমা কইখন আসলো?”
ফটোগ্রাফার যখন ছবি দেখে বিস্ময়ে মাথা চুলকাচ্ছে তখন আরেকজন ঠান্ডা রাগে কাঁপছে রীতিমত। তিনি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের কনিষ্টতম মালিক আলফনসো কুয়ারোন। এই মুহূর্তে তিনি তার কালো কাঁচে ঘেরা মাজদার ভেতর থেকে কসাইখানার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টিপথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা টিভি চ্যানেলের ক্রু ও ক্যামেরাম্যান। উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছেন এক তরুণ টিভি সাংবাদিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে ঐ টিভি চ্যানেলই তার গাড়ির টিভিতে চলছে। সাংবাদিকের কথা কানে আসে তারঃ
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে কাসেম মিয়া যিনি কসাই কাসেম নামে ব্যাপক পরিচিত এই জঘন্য হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছেন। ঘটনার পর থেকে কসাই কাসেম পলাতক। আমরা এই জঘন্য হত্যাকান্ডটি যিনি সরাসরি দেখেছেন এরকম একজনের সাথে এখন কথা বলবো।
টিভি সাংবাদিক টাক মাথার এক লোকের দিকে ফিরে।
বিরক্ত লাগে আলফনসো কুয়ারোনের। তাই তিনি টিভির ভলিউম কমিয়ে দিয়ে দৃষ্টি ফেরান তার সামনে বসে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক যুবকটির দিকে। যুবকটি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চুইংগাম চিবাচ্ছে, চোখে-মুখে উদাসীন ভাব। মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্ণধারের বিরক্তি চরমে উঠে। দায়িত্ব দেয়ার আগে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন লোকটা যে কোন উপায়ে কাজ আদায় করে নিতে জানে। তিনি ভেবেছিলেন রাফসার রশিদ আরো চটপটে হবে, অন্তত পশ্চিমা গোয়েন্দাদের দেখে এরকমটাই ধারণা হয়েছে তার।
“তুমি কসাই কাসেমের পিছু নিলে না কেন?” প্রশ্নটা ইতিমধ্যে অনেকবার করা হয়েছে তবুও আবার জিজ্ঞেস করেন তিনি।
“উত্তরটা তো অনেকবার দিলাম, স্যার।” কণ্ঠ থেকে বিরক্তি লুকাতে পারে না গোয়েন্দা।
আবার মুখে মুখে তর্ক করে। শালা! “আবার দাও।”
“কাসেমের কসাইখানায় পেছনের দিকে একটা দরজা আছে। ঘটানাটা ঘটানোর পর কাসেম ওইটা দিয়ে পালায়। তাই পিছু নেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠে নাই।”
“পেছনে কাউকে রাখোনি কেন?” খেঁকিয়ে উঠেন কুয়ারোন।
“স্যার আমি তো জানতাম না কসাইখানায় এরকম কিছু ঘটবে। তাই আর অত গুরুত্ব দেই নাই।”
“যত্তসব আবালদের নিয়ে কাজ করা লাগে!” গজগজ করতে থাকেন কুয়ারোন। “কসাই কাসেম কই কই যাইতে পারে খোঁজ নিছো?”
“স্যার, একটু আগে আমার এক সোর্সকে ফোন দিছি। সে বলছে জেনে আমাকে ফোন দিবে।”
“আবার ফোন দাও। দেখো কিছু বের করতে পারছে কিনা।”
নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে গোয়েন্দা আর মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্ণধার খর চোখে তাকিয়ে থাকেন কসাইখানার দিকে। কেউ হঠাৎ দেখলে তার চোখের একটা বৈশিষ্ট্য নজর কাড়তো তাদের।
হেটেরোক্রমিয়া। দুই চোখ দুই ধরণের। একটা সবুজ, একটা নীল। সাধারণত কুয়ারোন রোদ চশমার আড়ালেই তার চোখ দুটো ঢেকে রাখেন, আজ টেনশনের ঠেলায় চশমা কপালে গিয়ে ঠেকেছে।
তাদের থেকে আরো কিছুটা দূরে, কাঁচাবাজারের সামনের গলিতে একটা মাইক্রোবাস দাঁড় করিয়ে রাখা। মাইক্রোবাসের ভেতরে কয়েকজন মানুষ ঝিম মেরে বসে আছে, তাদের মুখেচোখে থমথমে ভাব। এদের মধ্যে বয়স্কজন কিছুক্ষণ আগে এসে মাইক্রোবাসে উঠেছেন। তার পরনে সাদা স্পোটর্স টি-শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট। পায়ে রানিং শু। সারা শরীর ঘামে জবজব করছে তার। অবশ্য করারই কথা। কারণ মাইক্রোবাসের এয়ারকুলারটা কাজ করছে না। যার জন্য ঘেমে নেয়ে একসা হচ্ছেন তারা।
বয়স্কজন একটু পর পর রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছেন আর বিষদৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন তার পাশে বসে থাকা মানুষটির দিকে। গাড়ির পেছনের সিট থেকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। শব্দ শুনে পেছন দিকে পাখির খাঁচার দিকে তাকাতে মনটা আরো বিষিয়ে উঠে তার। “শালা, বলদ কোনহানকার!” বিড়বিড়িয়ে বলে উঠেন তিনি। তবে পেছন থেকে দষ্টি দ্রুতই সরিয়ে নেন তিনি, মনোযোগ দেন পাশে বসে থাকা মানুষটির দিকে। সেই কখন থেকে লোকটা মাথা নিচু করে মাইক্রোবাসের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঝেটা অত ভালো করে পরিস্কার করা যায় নি, এখনো বমির কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। লোকটার মাথায় গামছা প্যাচানো। আসলে বলা উচিত তার মাথায় গামছা প্যাচানো ছিল। হড়হড় করে বমি করার পর ঐ গামছা দিয়ে মুখ পরিস্কার করে সে। এখন গামছাটা সিটের ওপর রাখা। তার পরনে সাদা শার্ট ও একটা পুরনো লুঙ্গি। লুঙ্গি আর শার্টে ময়লা লেপ্টে আছে।
সে যেখানে বসেছে তারই এক কোণায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ঘুঘুর পরিপূর্ণ ইউনিফর্ম, ঘুঘু সদৃশ একটা ক্যাপসহ। ক্যাপটা ইউনিফর্মেরই অংশ। ক্যাপের লোগোতে ছোট্ট হরফে গোয়েন্দা সংস্থার ট্যাগ লাইন-ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি।
“তোমাকে বলেছিলাম নর্মাল থাকতে। তা না করে পাখিওয়ালার ছদ্মবেশ নিতে গেলা কেন?” হিসহিসিয়ে বলে উঠেন বয়স্ক মানুষটি।
উত্তরটা দিতে কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করে মাথা নিচু করে রাখা লোকটি। “স্যার, যাতে কেউ সন্দেহ না করে সেজন্যই ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলাম।”
“পাখি বেচতে বেচতে তুমি ড্রেইনে কী করতেছিলা?”
মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে লোকটা, যেনবা কথা বলতে ভুলে গেছে।
“কী হলো, বলো কী করতেছিলা?” বাঘের মত গর্জে উঠেন বয়স্ক মানুষটি।
এবার আর দেরি করে না সে, হড়বড় করে বলে উঠে। “জলবিয়োগ করছিলাম, স্যার!”
কথাটা হজম করতে কষ্ট হয় বয়স্ক মানুষটার। “জলবিয়োগ?”
“জি, স্যার। কথ্য বাংলায়, প্রস্রাব।”
বয়স্ক মানুষটিকে দেখে মনে হলো চিরতার পানি গিলছেন। “আমরা কথ্য বাংলা বলি, তুমি কী অকথ্য বাংলায় কথা বলো?
“জি না স্যার।” মাথা নিচু করে জবাব দেয় সে।
“এখন বলো ড্রেনে পড়লা কিভাবে?”
“উঁকি দিতে গেছিলাম, স্যার…”
তার কথার মাঝখানেই বাঁধ সাধেন বয়স্ক মানুষটি। “কেন? উঁকি দিতে গেলা কেন?”
“ডক্টর কাসেমের সাথে করমর্দন করছিলেন, ভাবলাম কোন সংকেত বিনিময় হলো কিনা। সেজন্য গলা বাড়িয়েছিলাম…”
“গলাই তো বাড়াইছিলা, আর কিছু তো বাড়াও নাই। তাহলে তুমি ড্রেনে কীভাবে?” বয়স্কজনের অধৈর্য কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
“গলার সাথে সাথে পা টাও বাড়িয়েছিলাম, স্যার। নালার ওদিকটা পিচ্ছিল। নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি নাই। আর ডক্টরের সাথে করমর্দনের…”
“করমর্দনটা আবার কী জিনিস, আলমগীর?”
“হ্যান্ডশেক, স্যার।”
“যাই হোক, স্যারের বাংলা জনাব বলো নাই। আমার সাতপুরুষের ভাগ্য।” বিড়বিড় করে কলেন তিনি।
“জি, স্যার?”
“কিছু না…তারপর কী হলো?”
“ডক্টরের সাথে করমর্দনের সময় ব্যথা পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় কাসেম। তারপর অবস্থা খারাপ দিকে মোড় নেয়। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ডক্টরের মাথায় কোপ দিয়ে বসে কাসেম…”
“আর তুমিও পা পিছলে ড্রেনে বসে পড়ো।”
অপরাধীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ঘাড় চুলকায় আলমগীর। “স্যার, ইচ্ছা করে পড়িনি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বয়স্ক মানুষটি। তার ত্রিশ বছরের পেশাগত জীবনে এরকম বেকুব আর দেখেছেন কিনা মনে করার চেষ্টা করেন, কিন্তু মনে করতে পারেন না। মাথা ব্যথা করছে তার। টি-শার্টের বুক পকেটে রাখা আইডি কার্ড চুপসে গেছে ঘামে। বের করে সিটে রাখেন তিনি। আইডি কার্ডে তার নাম পড়া যায় সহজেই-লতিফুর রহমান। নামের নিচে তার পদবী। ইউনিট হেড, ঘুঘু।
“ড্রেন থেকে উঠার পর কী দেখলা?” লতিফুর রহমান জিজ্ঞেস করেন।
“উঠার পর দেখলাম ডক্টর মাটিতে পড়ে আছেন। তার মাথা দুফাঁক হয়ে গেছে, ফাঁকের মাঝখানে একটা দা। আর কসাই কাসেম উধাও।”
“আর প্যাকেজ?” উৎসাহে সামনে ঝুঁকে পড়েন তিনি।
“প্যাকেজটা তো স্যার ডক্টরের হাতে ছিল। কিন্তু মাটিতে পড়ার পর ঐটা আর দেখিনি। বোধহয় কসাই কাসেম নিয়ে গেছে।”
“তুমি আর খোঁজনি?”
“আমি তো তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, স্যার। নালা থেকে দৌড়ে ওখানে গিয়ে সব জায়গা খুঁজেছি। এমনকি ডক্টরের মৃতদেহও খুঁজেছি। কিন্তু ওর দু’ফাঁক হওয়া মাথার দিকে একবার ভালো করে তাকাতেই আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে…”।
“তারপর মাইক্রোবাসে এসে বমি করে সবকিছু পুরো ভাসাইয়া দাও, তাই তো?” আলমগীরের কথাটা শেষ করে দেন তিনি।
“জি, স্যার.” মিনমিনিয়ে বলে উঠে আলমগীর। : কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন লতিফুর রহমান, মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। একটু পর মুখ ফিরিয়ে বলেন, “তো এখন কী করা যায়? এখানে বসে থেকে তো কোন লাভ নেই।”
কথাটা অবশ্য আলমগীরকে নয়, বরঞ্চ সামনের সিটের আরোহীকে করা। আরোহী মধ্যবয়স্ক, বেশ ভারিক্কি চেহারা, চোখে সানগ্লাস। এতক্ষণ কানে মোবাইল ঠেকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছিল সে। প্রশ্ন শুনে পেছনে তাকায়।
“মহাখালীতেই কসাই কাসেমের পরিচিত একজন থাকে। বটি সুমন নাম। ওর কাছে যাওয়া যায়। ওকে ধরে ধাতানি দিলেই সব বের হয়ে যাবে।”
“বটি সুমন?” নাম শুনে যেন একটু বিস্মিত হন বয়স্ক মানুষটি, তবে দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠেন তিনি। “বটি আবার কাসেমের পরিচিত হলো কবে
থেকে?”
“পরিচিত স্যার। টিবি গেইট এলাকায় ওর আস্তানা। যাবেন?” সামনে থেকে সানগ্লাসের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
মাথা নেড়ে সায় জানান তিনি।
অতঃপর, ঘুঘু বাহিনী টিবি গেইটের দিকে চললো।
ঘুঘু বাহিনী যখন টিবি গেইটের দিকে যাচ্ছে তখন হঠাৎ কাসেমের কসাইখানায় এক ধরণের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। এক ফ্যাকাশে চেহারার এশিয়ান যুবক কসাইখানা থেকে বুলেটগতিতে দৌড়ে বের হয়, তার পিছু পিছু কয়েকজন পুলিশ ও উৎসাহী জনতা। যুবকটি মাঝারি উচ্চতার। চেহারা চাইনিজদের মতো। কিংবা জাপানিজ অথবা থাই কিংবা মঙ্গোলিয়ান। নাক বোঁচা। অ্যাথলেটদের মত ছিপছিপে শরীর, দেহ অনেকটা স্পিংয়ের মত পাকানো। গায়ে এক রত্তি মেদ নেই।
প্রিন্টারদের মত দৌড়াচ্ছে সে। তার গজ বিশেক সামনে তিনজন পুলিশ দাঁড়ানো, ভিড় সামাল দিচ্ছে। কসাইখানার গোলমালের শব্দ হয়তোবা তাদেরও কানে গিয়ে থাকবে। আর তালগাছকে এভাবে প্রাণপণ দৌড়াতে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হয় তাদের। পথরোধ করে দাঁড়ায় তারা।
সেইসাথে ভুলটাও করে বসে। কারণ যুবকটি মার্শাল আর্টে ট্রেনিং প্রাপ্ত। তার সাঁই সাঁই করে হাত-পা চালানো দেখলে একজনের ছবিই চোখে ভাসে-ব্রুস লি। কাজেই পুলিশ তিনজনের ভাগ্যে যে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তা বলাই বাহুল্য।
বাস্তবে হলোও তাই। তিনজনের সামনে পড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় বোঁচা নাকের শরীরে। আর বোঁচা নাকের শরীরে যখন বিদ্যুৎ খেলে তখন যা হওয়ার তাই হয়। আর যা সাধারণত হয় তা হচ্ছে-মার খেয়ে এদিক সেদিক ছিটকে পড়তে থাতে তার সব প্রতিদ্ধন্ধী।
প্রথমেই সে শুরু করে ডান দিকের বেঁটেখাটো, মোটাসোটা পুলিশ কনস্টেবলকে দিয়ে। চিল চিৎকার দিয়ে তালগাছ আক্রমণ করে বসে কনস্টেবলটির কাঁধের মাঝ বরাবর নার্ভ সেন্টারে। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন প্যারালাইজড হয়ে যায় ঐ কনস্টেবল, হাতের ডান্ডা যায় খসে।
কিন্তু ডান্ডা মাটিতে পড়তে দেয় না ঐ চাইনিজ/জাপানিজ/থাই/মঙ্গোলিয়ান। ডান্ডা হাতে নিয়ে হাঁটু দিয়ে মট করে ভেঙে ফেলে তা। এত ভিড়বাট্টার মাঝেও ডান্ডা ভাঙার শব্দটা বড়ই বিকট শোনায়। তবে বিকট এই শব্দও কিন্তু ছাপিয়ে যায় বোঁচা নাক। কেন জানি ডান্ডা ভাঙার সময় পশুর মত এক ধরণের জান্তব আওয়াজ তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল যা শুধু উকট ছিল না, ছিল কিছুটা অশরীরীও।
পরবর্তীতে পুলিশগুলো রিপোর্টে বলে ডান্ডা ভাঙার সময় লোকটা মুখ দিয়ে আ আ করছিল, তবে তারা পুরো নিশ্চিত না। আওয়াজটা অ, অও হতে পারে। কিংবা অ্যা অ্যা। সেইসাথে তারা এও যোগ করে, আওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো গিয়ে ভাঙা ডান্ডা। হাঁটু দিয়ে মট করে মোটা দশাসই ডান্ডা ভাঙা তো আর চাট্টিখানি কথা না।
আওয়াজ যাই হোক, ভাবগতিক দেখে ভড়কে যায় বাকি দুজন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা, মাথায় চিন্তার ঝড়।
ঝেড়ে দৌড় দেবে নাকি শহীদ হবে?
বোঁচা নাক অবশ্য চিন্তার ধারও ধারে না। বামের জনের পাঁজরে পড়ে তার দ্বিতীয় কারাতের কোপ আর তৃতীয়টা পড়ে মাঝখানের পুলিশের গলায়-ঠিক কণ্ঠনালীর নিচে।
তিনজন ছিটকে পড়ে তিনদিকে।
হতভম্ব মানুষজনকে পাশ কাটিয়ে বাম দিকের চিপা গলিতে ঢুকে পড়ে বোঁচা নাক, পেছন থেকে শোনা যায় পুলিশের দিশাহারা বাঁশির শব্দ। দৌড়াতে দৌড়াতেই একবার পেছন ফিরে তাকায় সে।
নাহ্, একদম বিপদমুক্ত হওয়া যায়নি। আরো জনা পাঁচেক পুলিশ ফেউয়ের মত তার পিছু পিছু আসছে, সাথে অত্যুৎসাহী কিছু মানুষ। সমস্যা হচ্ছে গলিটা একটু বেশিই চিপা। খুব দ্রুত দৌড়ানো যাচ্ছে না। তাছাড়া উল্টা দিক থেকে সমানে মানুষজন আসছে। হাজার চেষ্টার পরও তাই পুলিশদের সাথে নিজের দূরত্ব বাড়ানো যাচ্ছে না।
হঠাৎ করেই সামনে এক বরই বিক্রেতার দিকে নজর গেল তার। লোকটার সামনে গামলাভর্তি বড় বড় বরই। গোলাকার বরই দেখেই আইডিয়াটা মাথায় আসে তার।
আচমকা গতি কমায় সে। বরই বিক্রেতার ঠিক সামনে এসে হার্ড ব্রেক কষে। মুখ তুলে তাকায় বরই বিক্রেতা। বরই কেনার জন্য বিদেশি আগন্তুককে দন্ডায়মান দেখে উৎফুল্ল বোধ করে সে। সেইসাথে কিভাবে আলাপ শুরু করা যায়, সেটা নিয়েও আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। বরই বিক্রেতা বিদেশি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। দুটা ভাষা জানে সে-হিন্দি ও ইংরেজি। ইংরেজি ভাষার সমৃদ্ধ শব্দ ভান্ডারে সাকুল্যে চারটা শব্দ তার অবলম্বন। ইয়েস, নো, ভেরি গুড এবং থ্যাংক ইউ। হিন্দিতে সে আরো খানিকটা দক্ষ। কয়েকটা গালি পারে-কামিনে, হারামজাদে, শুয়ার কে আওলাদ। কষ্টমষ্ট করে কোনমতে একটা বাক্যও দাঁড় করাতে পারে। তুম ক্যায়সে হো ইয়ার?
কিন্তু এ লোকটা তো দেখতে চাকমা-চাকমা! এ কী ইংরেজি বুঝবে? আলাপচারিতা করা বা বরই কেনা তো আর চাইনিজ/ জাপানিজ/ থাই/ মঙ্গোলিয়ান/চাকমা চাকমা’র উদ্দেশ্য না। সে এক হ্যাঁচকা টানে গামলা ছিনিয়ে নিয়ে সব বরই রাস্তায় ফেলে দেয়। পেছনে আরেকটা গামলায় পেয়ারা রাখা ছিল। ঐ গামলাটাও একই পরিণতি ভোগ করে। চিপা গলি ভরে যায় বরই আর পেয়ারায়। আর একে একে মানুষজন বরই ও পেয়ারায় পা ফেলে ধুপধাপ করে পড়তে থাকে। বরই, পেয়ারা ও মানুষের সম্মিলিত পতন এক অসাধারণ সুরলহরী সৃষ্টি করে।
দৌড়বিদ কিন্তু ততক্ষণে হাওয়া। সে কাট মেরে বাম দিকের আরেকটা গলিতে ঢুকে পড়ে। পকেট থেকে একবার মোবাইল বের করে জিপিএসে গাড়িটার অবস্থান দেখে নেয় সে, সেইসাথে নিজের অবস্থানও।
অভীষ্ট লক্ষ্য খুব বেশি দূরে নেই। এই তো আর কয়েক কদম।
পা বাড়ায় দৌড়বিদ।
*
অধ্যায় ১০
মটকা মেরে তন্দ্রা ছুটে রাইলি’র। বাইরে খটখটে রোদ। ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে এক পিচ্চি দৌড়াদৌড়ি করছে। বোতলের লেবেল ইংরেজিতে দেয়া, পড়তে পারে রাইলি। ফ্রেশ। পানি ফ্রেশ হলেও পিচ্চিটাকে অত ফ্রেশ লাগছে না। তার ঠোঁটের ডগায় জ্বরঠসা, নখের নিচে কয়েকমণ ময়লা আর পা দুটো ধূলায় মাখামাখি। মানুষজন আগ্রহ নিয়ে ওর পানি কিনছে। মধ্যবয়স্ক এক লোক রাস্তায় থুথু ফেলছে, তার ঠিক পাশে টুকরি নিয়ে আপেল বিক্রি করছে এক বুড়ো। মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে দলবেঁধে ভিক্ষা করছে কিছু পঙ্গু। তাদের গানের সুর বদ্ধ কাঁচের আড়ালে থেকেও বুঝতে পারে রাইলি। ঢাকার ভিক্ষুকরা অনেক সুরেলা। খালি গলায় বেশ ভালোই গাইতে পারে।
ফুটপাথের কোণায় এক লোক গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়, চুলে জটা, গা ভর্তি রাজ্যের ধূলা। মাছি ভনভন করে উড়ছে তাকে ঘিরে।
মরে গেল নাকি, শালা? জটাওয়ালাকে দেখে দুশ্চিন্তাই হয় রাইলি’র।
গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা। তার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে আছেন ডেভিড কর্নওয়েল। তার চোখমুখ কোঁচকানো, দৃষ্টি জোয়ানা মানিপেনি’র কোলের ওপর মেলে রাখা ল্যাপটপের ওপর নিবদ্ধ। ল্যাপটপে একটা ভিডিও চলছে, কেউ একজন দৌড়াচ্ছে ছোট্ট গলি দিয়ে। ক্যামেরা খুব সম্ভবত লোকটার কলারের খাঁজে লুকানো। দৌড়ানোর তালে তালে কাঁপছে ক্যামেরা। কাঁপছে ভিডিও। ধাবমান ব্যক্তিটির দেহের ধাক্কায় ছিটকে পড়ছে পথচারী। বরইয়ের থালা উপুড় হয়ে পড়ে গেছে। গলিময় ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ ও হালকা লাল বরই। পা পিছলে মানুষের পতন দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে রাইলির।
বুদ্ধি আছে চাকমাটার।
“গুড জব, ঈথা, সার্ভেইল্যান্স টিমের প্রধান অ্যালিস্টার ম্যাকলিন উৎসাহ জোগান চাকমাটাকে। ম্যাকলিনরা এই মুহূর্তে ঘাঁটি গেড়েছেন ১৭ তলা উঁচু ব্র্যাক বিল্ডিংয়ের ছাদে, ওখান থেকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন।
চাকমা দৌড়ায়। আরেকটা গলিতে ঢুকে। গলিটা একটা মেইন রোডে এসে মিলিত হয়েছে। ভিডিওতে পরিচিত রাস্তা দেখে এদিক-সেদিক তাকায় রাইলি।
ওই তো রাস্তার উল্টাপাশে চাকমা।
আর কয়েক কদম, তারপরই ওদের জিপ। এঁকেবেকে দৌড়াচ্ছে চাকমা।
হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে কাটা কলাগাছের মতো রাস্তার মাঝখানে পড়ে যায় সে।
হতভম্ব অবস্থা হয় জিপের সবার। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলান কর্নওয়েল। ড্রাইভিং সিটে বসা জোনাথন কিংয়ের উদ্দেশ্যে নির্দেশ ছুঁড়ে দেন-”কিং, কুইক।”
কিং এমনিতেই যথেষ্ট কুইক। তার ওপর বসের নির্দেশ। অতিরিক্ত কুইক হতে গিয়ে জিপ ঠুকে দেয় এক টয়োটা প্রেমিওয়ের চকচকে পাছায়।
আর পাছাও গেল বেঁকে!
রেগেমেগে নেমে আসে ড্রাইভার। ড্রাইভার অল্প বয়স্ক, বছর পঁচিশের এক চ্যাংড়া যুবক। চুল জেল খেয়ে আকাশপানে ঊর্ধ্বমান, গালভর্তি ব্রণ, ভ্র’তে রিং আটকানো। রোদ লেগে ঝলসে উঠে রিং। শুকনো খ্যাংরা কাঠির মতো শরীর ছেলেটার, একটু জোরে ফুঁ দিলে উড়ে যাবার কথা। কিন্তু হলে কী হবে, তেজ আছে ষোল আনা। চোখদুটো রাগে জ্বলছে খ্যাংরা কাঠির, চোখের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে সব। যেনবা টয়োটা প্রেমিও না, ওর নিজেরই পাছায় ঠুকে দেয়া হয়েছে জিপটি!
আর পাছার হাড়ও গেছে বেঁকে!
“অই খানকির পোলা, মাদারচোত…” ছোটখাট অভিধানই খুলে বসে খ্যাংরা কাঠি।
“খসাও!” কনওয়েলের ছোট্ট নির্দেশ।
জোনাথন কিংয়ের মনে হলো বস খসাও বলছেন না, বলছেন টুসাও। প্যাডালে চেপে বসে তার পা। গোত্তা খেয়ে সামনে বাড়ে জিপ। জিপের দিকে এগোতে থাকা খ্যাংরা কাঠির রাগে জ্বলতে থাকা চোখে তখন উপস্থিত হয়েছে বিস্ময়। তার বিস্ময় দ্রুতই রুপান্তরিত হয় ভীতিতে। ততক্ষণে জিপ ঠুকে দিয়েছে তার ডান পায়ে। পাখা গজায় খ্যাংরা কাঠির। পাখির মত একপাক উড়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ে জিপার খুলে মুত্র বিসর্জনরত এক পথচারীর ওপর। পথচারীটির মূত্র বিসর্জন তখনো শেষ হয়নি। তার শেষ কয়েক ফোঁটা মূত্রধারা ভিজিয়ে দেয় খ্যাংরা কাঠির জেলে ডুবে থাকা ঊর্ধ্বমুখী চুল। দেয়াল থেকে মুখ ভেংচিয়ে হাসে ছোট্ট শ্লোগান-এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ। করিলে দশ টাকা জরিমানা।
ততক্ষণে টয়োটা প্রেমিওকে সামান্য ঘষা দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে বিপরীত রাস্তায় এসে উপস্থিত হয়েছে রাইলিদের জিপ।
“ইনকামিং মোটরবাইক, ইনকামিং মোটরবাইক,” সার্ভেইল্যান্স টিমের সদস্য রবি কীন তাদের সতর্ক করে দেয়।
আর তখনই দ্রুত ধাবমান মোটরসাইকেলটা সবার নজরে আসে। হিরো হোন্ডা। জিপকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় হিরো হোন্ডা। চাকমাকে ঘিরে রাস্তার মাঝখানে তখন ছোটখাট জটলা বেঁধে গেছে। একটা প্রাইভেট কার, কয়েকটা রিকশা, সিএনজি, একটা ওষুধ কোম্পানির ভ্যান আর কিছু উৎসুক মানুষের জটলা।
বাইকটা সোজা জটলার দিকে ছুটে। সামনে রিকশা পড়ে। তোয়াক্কা করে না হোন্ডা। সটান গিয়ে ঠুকে দেয় রিকশার পাছায়।
আর পাছাও যায় বেঁকে!
ধাক্কা খেয়ে ফজল আলীর রিকশা ছিটকে পড়ে দূরে। ফজল আলী উড়ে, সাথে তার রিকশায়ও উড়ে উড়ে তার পুরনো লুঙ্গিটাও। উড়তে উড়তে লুঙ্গির গিঁট আলগা হয়। মাথা ছাড়িয়ে, পতাকার মত পত পত করে বাতাসে দোলতে থাকে তা। ঝকঝকে রোদে ফজল আলীর কালো কুঁচকে যাওয়া পশ্চাৎদ্দেশ দেখে হুল্লোড় উঠে একটা, এক টোকাই আরেক টোকাইকে রসিয়ে রসিয়ে জানায়-দ্যাখ দ্যাখ, হালার কালা পুটকি দেখা যায়!
বাইকের জন্য সরে গিয়ে দ্রুত জায়গা করে দেয় সবাই। সিএনজি সরে, রিকশা সরে। ফজল আলীর মতো ইজ্জত খোয়ানোর ইচ্ছা কারোরই নাই।
তারপর খুব দ্রুত সবকিছু ঘটে যায়। বাইকধারী হালকা থেমে রাস্তায় পড়ে থাকা চাকমার পকেট হাতড়ায়। একটা মাঝারি আকৃতির সুদৃশ্য প্যাকেজ বের হয়ে আসে পকেট থেকে। প্যাকেজ পকেটস্থ করে আবার বাইক দাবড়ায় সে।
ততক্ষণে সংবিৎ ফিরে এসেছে রাইলি ও গংদের। আগে বাড়তে যায় কিং। কিন্তু বেরসিকের মত ওষুধ কোম্পানির ভ্যান এসে আচমকা পথরোধ করে দাঁড়ায়। ভ্যানের ইঞ্জিন কয়েকবার যক্ষা রোগীর মতো কাশে। খুক খুক খুক। তারপর আচমকা ব্রেক কষে থেমেই যায়।
পেটমোটা কিসিমের এক লোক বের হয়, হেলতে দুলতে। পেট গর্ভবতী গাভীর মতো উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে তার। অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙে সে, পাছা চুলকে দেখে দূরবর্তী মেঘ। তারপর হঠাৎ খেয়াল হয় তার। পাছা চুলকানোর জন্য কিংবা মেঘের গতিপ্রকৃতি বুঝার জন্য তো আর সে গাড়ি থেকে বের হয়নি।
ভ্যানের বনেট খুলে দাঁড়ায় সে।
জিপের ড্রাইভিং সিটে তখন দাঁত কিড়মিড় করে শাপশাপান্ত করছে। জোনাথন কিং।
কনওয়েলের মাথা কিন্তু ঠান্ডা। আবারো ছোট্ট একটা নির্দেশ দেন তিনি। এবারেরটা ম্যাথু রাইলি’র উদ্দেশ্যে।
“গো, ফলো দ্য বাইক।”
নির্দেশটা হৃদয়ঙ্গম করতে খানিকটা সময় লেগে যায় রাইলি’র। তার চোখে হয়তোবা তখনো ফজল আলীর কুঁচকে যাওয়া কালা পুটকি ভাসছে, কিংবা মুত্র বিসর্জনরত পথচারীর ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাওয়া মুখ। তাই ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় লেগেই যায় তার।
খানিকটা সময় মানে বড়জোর সাত থেকে আট সেকেন্ড। এর বেশি না। কিন্তু তাদের জগতে সাত-আট সেকেন্ড মানে সাত-আট দিন।
তাই সামনের রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে সে দেখে তার দিকে কর্নওয়েল ও মানিপেনি শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।
জিপের দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে পা হড়কায় রাইলি। উষ্টা খেতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সামলে নেয় নিজেকে। জিপ থেকে নেমে চিলচোখে দ্রুত চারপাশটা দেখে নেয় সে। বাইকের পিছু নিতে হলে আরেকটা বাইকই দরকার। কিন্তু সামনে পিছে শুধু রিকশা, সিএনজি, প্রাইভেট কার আর ভ্যান। আর তাদের ঘিরে তামাশা দেখতে থাকা জনস্রোত। ভিড় ঠেলে ইউনিফর্ম পরা কাউকে আসতে দেখা যায়।
ট্রাফিক পুলিশ!
দ্রুত পা চালানো দরকার।
তারপর হঠাৎই চোখে পড়ে তার। তাদের থেকে খানিকটা পেছনে একটা পিকআপ ট্রাক দাঁড়ানো। ট্রাকের সামনে একটা মোটরবাইক রাখা। সওয়ারী বাইক থেকে নেমে মোবাইলে কার সাথে জানি কথা বলছে। বাইকের চাবি ইগনিশন কী’তে লটকানো!
বিস্মিত বাইকচালকের বিচিতে মোক্ষম একটা লাথি বসিয়ে বাইকটা স্টার্ট করে রাইলি। রাস্তায় ততক্ষণে গিটু লেগে গেছে। গাড়ি সব স্থির দাঁড়ানো। এখানে মোটরসাইকেল চালানো সম্ভব না।
রাইলি মোটরসাইকেল ফুটপাথে উঠিয়ে দেয়। এঁকেবেঁকে মোটরসাইকেল চলতে থাকে। ফুটপাথে মহাশোরগোল বেঁধে যায়। ভ্যান উল্টে পড়ে, টুকরির ফলমূল ছিটকে পড়ে, ছিটকে পড়ে মানুষজন। স্কার্ট পরিহিতা একজনের খয়েরি স্কার্ট বাতাসের চোটে ঊর্ধ্বগগনে উড়তে থাকে, বেরিয়ে পড়ে অপ্রস্তুত তরুণীর গোলাপী রংয়ের অন্তর্বাস। সাথে সাথে কিছু ঘটনা দ্রুত ঘটে যায়।
শিস দিয়ে উঠে কিছু টোকাই, রাস্তার ধারে দাঁড়ি কামাতে থাকা নাপিত ভুল করে ভুরু করে কামিয়ে দেয়, জুতা পালিশ করতে থাকা মুচি কালি দিয়ে পালিশ করে দেয় সাড় চার হাজার টাকা দামের ডলসে অ্যান্ড গাবানার প্যান্ট, বনফুল ব্রেডস-এর ভ্যানচালক অল্পবয়স্ক ছোকরা ছয়ফুল তার পাউরুটিভর্তি ভ্যান নিয়ে উঠে যায় রাস্তার ধারের ফটোকপির দোকানে। ধাবড়া ফটোকপি মেশিন ভরে যায় বনফুলের পাউরুটিতে। পরবর্তী বেশ কিছুদিন ফটোকপি দোকানদার মঞ্জুকে নিয়মিত এই অভিযোগ শুনতে হবে যে তার ফটোকপি করা কাগজে কেমন পাউরুটি-পাউরুটি গন্ধ!
স্কার্ট উপরে উঠার নিট যোগফল এই সবকিছু।
তরুণীর লোমহীন উরু দেখে হার্টবিট মিস হয় রাইলিরও। এমন না যে উন্মুক্ত পা দেখে অভ্যস্ত না রাইলি। ক্যালিফোর্নিয়ার বিচ সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিনের বসবাস রাইলির। শোবার ঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্রসৈকত দেখা যায়। সৈকতে বিকিনি পরিহিত সুন্দরী ললনারা গায়ে-মাথায় লোশন মেখে রৌদ্রস্নান করে, হেঁটে বেড়ায়, পানিতে নেমে গোসল করে। তাই উদাম শরীর রাইলি’র গা-সওয়া।
কিন্তু উপমহাদেশের মেয়েরা শ্বেতাঙ্গদের মতো ধবধবে সাদা না, তাদের গাত্রবর্ণ শ্যামলা। আর এই জিনিসটাই ওদেরকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে রাইলির চোখে। ভার্সিটি জীবনে ওর দুই গার্লফ্রেন্ডের দুইজনই ছিল ইন্ডিয়ান। একজন প্রিয়া আগরওয়াল, অন্যজন প্রীতি সাক্সেনা। দুইজনেরই গায়ের রং ছিল শ্যামলা। প্রিয়ার রং ছিল শ্যামলার এক ডিগ্রি নিচে, কালোর দিকে। আর প্রীতির রং শ্যামলার এক ডিগ্রি উপরে, উজ্জ্বল শ্যামলা। শ্যামলার প্রতি তাই রীতিমত আসক্তি জন্মে গিয়েছিল রাইলির।
তরুণীর লোমহীন শ্যামলা উরু প্রীতি সাক্সেনার কথা মনে করিয়ে দেয় রাইলিকে। প্রীতি মেয়েটার প্রতি একসময় ভালোই অনুরক্ত ছিল ও। কিন্তু উপমহাদেশের মেয়েদের একটাই দোষ। ওরা বড় বেশি বিয়ে বিয়ে করে।
বিয়ে করো, বিয়ে করো!
আর এটাতেই আপত্তি রাইলির। প্রীতির বাপ গুজরাটের এমপি। তার বড় সাধ মেয়েকে সংসারী জীবনে দেখার। প্রীতির ইচ্ছাও ছিল অনেকটা তাই। শেষমেষ বাপের ইচ্ছা অনুযায়ী মোম্বাইয়ের এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে প্রীতি ইন্ডিয়াতেই সেটল করে। প্রীতির টাকা পয়সা নিয়ে কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। স্বামী অঢেল কামায়। গাড়ি-বাড়ি সব আছে। আমেরিকা থেকে এমবিএ করা প্রীতি এখন তাই হাউজওয়াইফ, গৃহ পালিত স্ত্রী। মাস কয়েক আগে ওদের এক মিউঁচুয়াল ফ্রেন্ড বরুনের সাথে দেখা রাইলির। ও ই জানায় সব। সেদিন রাতে তিন শট টাকিলায় প্রীতিকে না পাওয়ার দুঃখ গিলে খায় ও।
স্কার্টওয়ালীকে দেখে সেই দুঃখবোধ আবার চাগিয়ে উঠে তার। মনঃসংযোগে চিড় ধরে। ফুটপাথের সাথে লাগোয়া ফাস্ট ফুডের দোকানের দরজা খুলে কেউ একজন যে বেরিয়ে আসছে, তা আর খেয়াল করে না সে।
ধাম!
কাঁচের দরজা ভেঙে বাইক ছিটকে পড়ে দূরে। শেষ মুহূর্তে লাফ মেরে সরে যাওয়ায় ফাস্ট ফুডের খদ্দের বেঁচে যায়। কিন্তু মোটরসাইকেল আরোহী রাইলির ভাগ্য অত সুপ্রসন্ন ছিল না। দরজার হাতলে ধাক্কা খেয়ে জায়গাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে ও।
মারাত্মক আহত রাইলি’কে ঘিরে মানুষজন জড়ো হতে শুরু করে। ওদিকে জিপ ছেড়ে ততক্ষণে দুই গলি পেছনে একটা আনমার্কড মাইক্রোবাসে জায়গা করে নিয়েছেন কর্নওয়েল ও তার দলবল। আর সবার মতো রাইলি’র জামার কলারেও ভিডিও চিপ সংযুক্ত। লাইভ ভিডিও ফিড বসে বসে দেখছিল সবাই।
রাইলি’র অন্তিম পরিণতিতে হতাশায় গুঙ্গিয়ে উঠে সব। মেজাজ হারিয়ে হাতে ধরা পেন্সিলটা গলির ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেন কনওয়েল। কিন্তু পেন্সিল ডাস্টবিনে না পড়ে ফুটপাথে গিয়ে পড়ে।
রেগেমেগে সামনের সিটে সজোরে লাথিই কষিয়ে দেন কনওয়েল।
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় জোয়ানা মানিপেনি। মাইক্রোবাস থেকে নেমে ফুটপাথে পড়ে থাকা পেন্সিল ছুঁড়ে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। চশমাটা ভালোমতো চোখে এটে কনওয়েলকে উৎসাহ যোগায় সে
“ইট ওয়াজ প্রিটি ক্লোজ, স্যার!”