বাসর উপহার (উপন্যাস)
লুৎফর রহমান
১. দুই বন্ধু
যশোহর জেলায় মহম্মদপুরের অদূরবর্তী মধুমতী তীরের জ্যোৎস্নাসুন্দর নৈশ আকাশতলে বসিযা দুইটি যুবক। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুর কোলে মাথা রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–”ভাই, তুমি কি জীবনে বিবাহ করবে না”?
২য় বন্ধু কহিলেন–না এই মুক্ত জীবন–এই উদার–গম্ভীর, শান্তমধুর, অশ্রু-শীতল, করুণা-বিহ্বল প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য নূতন পরিচয়ে জীবন শেষ করতে চাই। আর বেশি কী দরকার?
১ম বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন–তবে কেন চাকরি কর?
“চাকরি করি কেন? অনেক লোককে আমার দেবার আছে–নিজের স্ত্রী-পুত্র ছাড়া কি জগতে আর কাউকে ভালোবাসতে নেই? নিজকে ত্যাগ করে পরের কথা ভাবতে কত আনন্দ, কত রস, তা তুমি বুঝবে না!”
১ম–আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও।
২য়–আমি তা পারব না। প্রেম করাতেই আমার আনন্দ।-এই মাত্র আমি বলতে পারি। এর মাঝে আমার কোনো কৃতিত্ব বা গৌরব নেই। আমি তোমাদেরকে সুখী দেখতে চাই–সমস্ত দুঃখী নর-নারী সুখী হোক-এই আমি চাই।
১ম–আমাকে তুমি সুখী দেখতে পাবে না। এ জীবনে নয়–কিছুতে নয়।
২য়–কী বলছো! তোমার কথা আমায় খুলে বল দেখি। জীবন যদি ২/১ দিনের হতো, তা হলে দুঃখ সহ্য করা কঠিন হতো না। জীবন দীর্ঘ, এ জীবন সরস মধুর না হলে কী করে বাঁচা যায়? মনুষ্য-জীবনকে সুখময় করে তোলবার জন্য পৃথিবীর মোল আনা কাজ।
১ম–তা ঠিক। কিন্তু আমার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ নিরর্থক। তুমি জান না, আমার পিতা অতি উগ্র প্রকৃতির লোক ছিলেন। মা ছোট বেলাতেই মারা যান। বাড়িতে টিকতে না পেরে আমি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নেই, তার কন্যাকে বিবাহ করি। দুঃখের বিষয়–কোনো শান্তিই জীবনে লাভ হয় নাই। যেন আগুনের ভিতর থেকে অগ্নি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমার পত্নী অতিশয় বিদ্রোহিণী এবং বদ। আমি যা বলি, তার বিপরীত চলাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। শ্বশুর বাড়িতে আমাকে অতিশয় সঙ্কোচে এবং ভয়ে কাল কাটাতে হতো। আমার মানসিক যন্ত্রণার অবধি ছিল না। বাপের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেও সে রাজি নয়।–এই আমার দুঃখের কারণ। আমি তাকে ত্যাগ করতে চাই।
২য়–কাজটা কি ভালো হবে? ধৈর্য ধারণ কর, দুর্বল নারীজাতির প্রতি ক্ষমাশীল হওয়াই জ্ঞানীর কাজ।
১ম–তোমার ভিতর নারী চিত্তের দুর্বলতা আছে। পুরুষের ও কথা নয়। ভাবপ্রবণতায় জগৎ চলে না। একটা অশিক্ষিতা মূর্খ নারীর জন্যে একটা পুরুষ মানুষ তার জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে, বিলম্ব করে কাজ খুব খারাপ করেছি। পরীর এই দুর্ব্যবহার ও ধৃষ্টতায় আমি মরে আছি। আমি যা সিদ্ধান্ত করেছি, তার এদিক-ওদিক হবে না। বৃথা আলেয়ার পেছনে পেছনে ছুটে আমার জীবন দুঃখময় হয়ে উঠেছে। এই সঙ্কল্পের পরই যেন জীবনটা অনেক হালকা মনে হচ্ছে। আমার ঘাড় থেকে আজ এ বড় দৈত্য নেমে যাবে।
২য়–তোমাদের বিয়ে পূর্বেই বাতিল হয়েছে, বিবাহ জবরদস্তির বাধন নয়। বিবাহে আত্মার সম্মতি থাকা চাই। যেখানে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি হয়, মিলনের পরিবর্তে কলহের সূচনা হয়? বুঝতে হবে, সেখানে কেউ কাউকেও চায় না সুতরাং বিবাহও বাতিল হয়ে যায়।
১ম–আরও দুঃখের বিষয় এই যে, একটি ছয় বৎসরের ছেলে আছে।
২য়–পত্নী ত্যাগ করা কোনোমতে ভালো কাজ নয়। অপেক্ষা কর, নিজের কাছে এনে। নিজের রুচিমত গড়ে নিতে চেষ্টা কর। ভবিষ্যৎ জীবনে এই পুত্রের মুখ কি কণ্টকের মতো তোমাকে ব্যথা দেবে না?
১ম–ছেলের জন্য তার মায়ের উচিত ছেলের জন্মদাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। নারী ছেলেকে সোহাগ করে, কিন্তু তার কি ভাবা উচিত নয় এ ছেলে সে কোথা থেকে পেয়েছে? নারী বড় অবোধ। ছেলের পিতাকে ভুলে গিয়ে, ছেলেকে বুকে চেপে ধরতে নারীর লজ্জা করে না। ইসলাম ধর্মে অবাধ্য, কলহপ্রিয়, ভক্তিহীনা নারীকে শিক্ষা দেবার জন্যেই তালাকের ব্যবস্থা আছে। তালাক জিনিসটার আদৌ আবশ্যকতা না থাকলে ইসলাম ‘তালাক’কে সমর্থন করতো না।
২য়–অবাধ্য ও ব্যভিচারী–এই দুই অপরাধী নারীকে ত্যাগ করা যায়।
১ম–আমার পত্নী ব্যভিচারিণী নয়, কিন্তু সে আমাকে চায় না। আমারও উচিত নয় তাকে কষ্ট দেওয়া-ছাড়াছাড়ি হওয়াই ভালো।
২য়–যেখানে রুচি ও সভ্যতার বিভিন্নতা সেইখানেই প্রণয়ের অভাব। মাংসের ক্ষুধা চিরদিন থাকে না। একজন কৃপণের কন্যার সঙ্গে একজন দানশীল দেশসেবকের পুত্রের। বিবাহ ঠিক নয়। কোনো মনে জুড়ে-গেঁথে দিলেই বিপদ শেষ হয় না। বেমানান বন্ধুত্ব। টেকসই হয় না। যে দুই পরিবার একই রকম মানসিকতা পোষণ করে, তাদের মাঝে বিবাহ ও আত্মীয়তা হলে ভালো হয়।
১ম–বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু দেখাশুনা হওয়া কেমন?
২য়–কন্যা দেখানো সুন্নত। এতে অনেক বিপদের হাত থেকে বাঁচা যায়। তবে সমাজের অনেকে কন্যা দেখানো পছন্দ করেন না। তারা ভাবেন, এতে তাদের অপমান হবে। সমাজ যা ভালো বোঝে, তার উপর কোনো কথা বলতে চাই নে।
১ম–প্রাচীন কালে মুসলমান জাতির মধ্যে কেমন প্রথা ছিল? ইতিহাস কি কিছু বলে না।
২য়–এর অর্থ ভালো। স্বামী বা কন্যাকে সঙ্গী গ্রহণ করবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ভালো-মন্দ বিচারের অধিকার নর-নারীকে দেওয়া হয়েছে। আত্মার অসম্মতিতে বিবাহ ইসলাম অনুমোদন করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েকে জবরদস্তি করে ‘কবুল’ বলানো হয়।–তা বড়ই অন্যায়।
১ম–এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
২য়–সমাজ নিজের গতিতে চলে। কোনো কথা সে গ্রাহ্য করে না। সমাজের চাপে। বহু মানুষের জীবন চূর্ণ হয়ে যায়।
১ম্যাক, ওসব কথার মীমাংসা পরে হবে। আমার সম্বেন্ধে কী বলছো?
২য়–তাঁকে এখানে নিয়ে এস। সর্বপ্রকারে তাকে ভালো করতে চেষ্টা কর। যদি সর্বপ্রকার মঙ্গল চেষ্টা করেও কোনো ফল না হয়, তার পর যা জান, তাই করো।
১ম–খরচপত্র সম্বন্ধে কী হবে?
২য়–আমি যে একশত টাকা বেতন পাচ্ছি, তাই থেকে তুমি ৫০ টাকা নেবে। বাকি টাকাতেই আমার খরচ চলবে।
মহম্মদপুরের জমিদার নীলকান্ত রায়বাহাদুর বর্তমানে যে ভদ্রলোকটি ২য় বন্ধু নামে পরিচিত হইতেছেন, তাঁহাকে নিজ জমিদারির ম্যানেজাররূপে রাখিয়াছেন। বেতন মাসিক ১০০ টাকা। ২য় বন্ধু এক সময়ে কলিকাতায় নীলকান্তের সহিত কলিকাতা সিটি কলেজে একই শ্রেণীতে পাঠ করিয়াছিলেন। ২য় বন্ধুর চরিত্রগুণে মুগ্ধ হইয়া নীলকান্ত নিজ জমিদারির সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁহাকে দিয়াছেন। পূর্ববর্তী ম্যানেজার মহাশয়গণ প্রজার উপর অত্যাচার করতেন। বর্তমান ম্যানেজার অতি মহৎ প্রকৃতির লোক। বি. এ. পাস করিয়া ঘরে বসিয়াছিলেন। বন্ধু নীলকান্ত তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়া নিজ জমিদারির ভার দিয়াছেন। বন্ধু নীলকান্ত বাবু জমিদার হলেও তাহার জীবন খুব উন্নত। প্রজাদের উপর কোনো প্রকার অন্যায় প্রাধান্য তাহার নাই। মানবসেবা এবং পৃথিবীর মঙ্গল করাই তাহার জীবনের উদ্দেশ্য।
১ম বন্ধু উত্তরে কহিলেন–তোমার এই অনুগ্রহের ভার আমার পক্ষে বহন করা কি খুব কঠিন হবে না?
২য়–আমি যদি সংসারী হতাম, তা হলে তুমি একথা বলতে পারতে। আমি সন্ন্যাসী ফকিরের দান গ্রহণ করাতে তোমার কি আপত্তি? যে আমার সেবা গ্রহণ করে, সে আমায় ধন্য করে।
১ম–শ্বশুর বাড়ি থেকে কী করে স্ত্রীকে বের করি?
২য়–বল, পশ্চিমে বেড়াতে যাই। দেশ ভ্রমণের নামে মেয়ে মানুষ খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বাড়ি নেবার কথা বলো না।
২য় বন্ধুর পরামর্শ মতো ১ম বন্ধু স্ত্রীকে যথাসময়ে কৌশল করিয়া শ্বশুর বাড়ি হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। কয়েকদিন এখানে-ওখানে ঘুরিয়া তিনি মহম্মদপুরে আসিয়াছেন।
স্ত্রী বাসায় আসিয়া বিশেষ অসন্তোষ প্রকাশ করেন নাই। কেন যে তাঁহাকে এমনভাবে এখানে আনা হয়, তাহাও তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।
ম্যানেজার সহেব বন্ধুর বাসাতেই খাইবেন।
.
নারী-চিত্ত
২য় বন্ধু কহিলেন–বিপুল ধৈর্য চাই। অসহিষ্ণু হয়েছে কি, সমস্ত পণ্ড হয়েছে।
১ম–বড় কঠিন।
২য়–হাঁ কঠিন বৈ কি।-এর মতো কঠিন কাজ আর নেই। মানুষকে মহৎ ও মঙ্গলের পথে। আনতে হলে, এই হচ্ছে তার পথ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসফল হলেও মানব-হৃদয়ের মঙ্গলের জন্যে আর দ্বিতীয় পথ নেই। ক্রোধ, ঘৃণা, নির্যাতন–এগুলি মানুষকে কখনও বড় করে না। সাময়িক উপকার হলেও এর ফল কখনও ভালো নয়।
১ম–তোমার উপদেশ আমি মাথা পেতে নিলুম। আমি এখনও ক্রোধ দমন করতে শিখি নি।
২য়–এত ক্রোধ হয় কেন?
১ম–যা আমার রুচিকে আঘাত করে, তা আমি সহ্য করতে পারি নে। বিভিন্ন রুচির মানুষ একসঙ্গে বাস করলেই কলহ হয়।
২য়–তা ঠিক।-একটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
১ম–কী বিষয়?
২য়–আমাদের দেশের নারী মা-বাপ হারা পথের শিশু।–কেউ তাদেরকে শিক্ষা দেবার নেই–উন্নত সমাজের সংস্রব তারা পায় না। তাদের রুচি মার্জিত হবে কেমন। করে?
১ম–কিন্তু আমার দাবিকে কিছুতে ছাড়তে চাই নে।-এ আমার কাছে একেবারে অসহ্য।
২য়–সমাজ যখন নারীকে এমন করেই গড়ে তুলছে, তখন তুমি অসন্তুষ্ট হলে চলবে না। যে স্বামী পত্নীর উপর অসন্তুষ্ট, সে-ই কার্যক্ষেত্রে আপন ভগিনী ও কন্যার শিক্ষার ব্যবস্থা করে না। তুমি পিতা বা ভাই হয়ে যে অবহেলা কর, তার ফল স্বামীরূপে গ্রহণ করতেই হবে।
১ম–তুমি ভারি মোক্তারি করছ?
২য়–তোমার বেদনা আমি বুঝতে পাচ্ছি। অন্তত নারীর বাবা-মা যদি মেয়েদের একটিমাত্র শিক্ষা দেন, তা হলেই যথেষ্ট হয়।
১ম–সেটি কী?
২য়–সেটি বিনয় এবং বাধ্যতা। বিভিন্ন মানব-চরিত্র এবং জীবনের কর্মবৈচিত্র্য মনুষ্যকে জ্ঞানী এবং লোক-চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞ করে তোলে। মেয়েরা বাল্যকাল হতে মৃত্যু পর্যন্ত একই ধরনের ২/৪টা মানুষ, যেমন, মা, বোন, চাচি-এদের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। কলেজ বা স্কুলে অনেক মেয়ের সঙ্গে মেশবারও তার সুবিধে নেই, জীবনে তার ঘাত প্রতিঘাত নেই।–বৈচিত্র্য নেই। এই বৈচিত্র্যে মানবাত্মার রূপ ও সৌন্দর্য ফোটে। যেখানে ভাব ও বৈচিত্র্য নেই, সেখানে মানুষ আনন্দ পায় না। তাই বিবাহের কয়েক বৎসর পরেই। স্বামীরা বলে ওঠেন–কিছু ভালো লাগে না।
১ম–ঠিক কথা।
২য়–সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধা মেয়েরা সঙ্কীর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই বাড়তে থাকে। তাদের জীবনে বৃহত্তর অনুভূতি নেই। গল্পের মধ্যে তাদের এই সব কথা হয়। যেমন, কী রান্না হয়েছে, স্বামী বা শ্বশুর কী গয়না দিয়েছেন। আমার ছোট খোকার বয়স ৭/৮ হবে। তোমার শাড়িখানির দাম কিছুই নয়। ওর চাইতে আমার ঢের ভালো শাড়ি আছে।-এই। সব রাবি কথা যা শুনলে যুবকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠে।
১ম–তাই।-তুমি যে উপদেশ দিচ্ছ, তা যেন সাগর সেচে মানিক বের করার মতো কথা।
২য়–দেখই না চেষ্টা করে। কিছু কিছু পড়াতে থাক।
১ম–কোন সময়?
২য়–রাত্রিতে।
১ম–সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি শুতে যান।
২য়–তুমি সন্ধ্যার আগেই কাছারী ছেড়ে গৃহে ফিরবে।
এখানে বলা দরকার ১ম বন্ধু জমিদার মহাশয়ের কাছারীতে ২৫ টাকা বেতনে একটা সামান্য চাকরি পাইয়াছেন।
১ম–পল্লীগ্রামে বৌ পড়ানো কেউ পছন্দ করে না। সবাই আমায় ঠাট্টা করবে।
২য়–এ তো তোমার বাড়ি নয় যে, কাউকে ভয় করতে হবে। চেঁচামেচি না করে ভদ্রভাবে দুই এক লাইন পড়ানো–এ তো ভালো কথা। এতে কার কী বলবার আছে? তবে নারীর শিক্ষা স্বামীর দ্বারা হওয়া ঠিক নয়। স্বামীর কাজ গুরুগিরি নয়। এ কাজ অন্যের দ্বারা হওয়াই ভালো, তবে এখন অন্য উপায় নাই বলে, নিজেই চেষ্টা কর।
ব১ম–যে কাজ বাপ-মায়ের করা দরকার, তা স্বামীর সাজে না।
২য়–আচ্ছা একটু পড়িয়ে নাও, তারপরে সুশিক্ষার জন্য ঢাকা বা কলিকাতার কোনো মিশনরী স্কুলে রেখে এলে খুব ভালো হবে। মুসলমান সমাজে সুশিক্ষিতা নারীর বিশেষ দরকার আছে। তোমার স্ত্রী যদি ভালো শিক্ষা লাভ করতে পারেন, তা হলে তার দ্বারা দেশের অনেক মহৎ কাজ হবে।
.
পাঠ-দান
কার্যত স্ত্রীকে পড়াইতে গিয়া ১ম বন্ধু নিতান্তই অপ্রস্তুত হইলেন। বাতি ধরাইয়া দুই ঘণ্টা ধরিয়া টেবিলের পার্শ্বে বসিয়া অনেক চেষ্টা করিয়াও যখন পত্নীকে কথা বলাইতে পারিলেন না, তখন তিনি হতাশ হইলেন। পত্নী খোকাকে কোলে লইয়া ঐ যে চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিলেন, আর কোনো কথা কহিলেন না।
ঠিক এইভাবে সাতদিন চলিল। স্বামী একটিমাত্র ক্রোধের কথাও বলিলেন না। শুধু বলিলেন–লেখা-পড়া শেখাতে তোমার আপত্তি কী? কেন তুমি এতে এত কষ্টবোধ কর?
কোনো লাভ হইল না। খোকার মা কোনো কথা বলিলেন না।
শেষে ১ম বন্ধু কহিলেন–মেয়েরা লেখা-পড়া শিখলে তাদের ছেলেরা বড় ও সম্মানিত হয়। কথাগুলি শুনিয়া খোকার মা উৎসাহিত হইয়া বিছানায় উঠিয়া বসিলেন–কহিলেন ‘তাই নাকি?’ একটা ছবির দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–এ ছবিটি কার?
স্বামী আনাতিশয্যে কহিলেন–ইনি মিসেস সরোজিনী। ভারতের শ্রেষ্ঠতম বিদুষী মহিলা। সেদিন স্ত্রী স্বামীর কাছে সাতটি অক্ষর শিখিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইল।
দ্বিতীয় ভাগ পড়িতে পড়িতে খোকার মা পড়িলেন–”পর নিন্দা মহাপাপ, কুটিল লোক। ভালো নয়। সত্য ছাড়া ধর্ম নাই।”
তিনি এই সব নতুন কথা জীবনে এই প্রথম শুনিলেন। তাঁহার খুর আশ্চর্য ঠেকিল। কিন্তু সে ভাব স্থায়ী হইল না। তিনি খোকাকে বুকে লইয়া ভাত না খাওয়াই ঘুমাইয়া পড়িলেন।
.
স্বামীর দুঃখ
কতকগুলি দুঃস্বভাবে স্বামী মনে মনে তিক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু সে সম্বন্ধে স্বামী কোনো উচ্চবাচ্য করিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে কিছুক্ষণ ধরিয়া পত্নীকে পড়াইতে থাকেন।
পত্নী কহিলেন-তুমি এত দরিদ্র, তোমার লজ্জা করে না?-স্ত্রীকে পালন করবার যোগ্যতা তোমার কই? আমাকে শীঘ্রই বাপের বাড়ি রেখে এস।
কথা কয়টি তীরের মতো স্বামীর বুকে বিধিল। স্ত্রী যে স্বামীকে এমন করিয়া অপমান করিতে পারে, ইহা তাঁহার স্বপ্নেরও অগোচর। এ বিষ কী প্রকারে হজম করা যায়? যে বিবাহের ভিত্তি বয়সের ক্ষুধা, প্রেম নহে–ধিক সেই বিবাহে! ইচ্ছা হইল নিজের গলায় নিজে ছুরি বসাইয়া দেন। বন্ধুটা নিশ্চয়ই পাগল, নতুবা তাহাকে কে এই বিধির বিড়ম্বনা
সহ্য করিবার জন্য এত উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। পুত্রটির কথা মনে করিয়া তাহার গা। ঘামিয়া উঠিল। বিধাতা কেন এই কণ্টক দিয়া তাহার জীবনকে মরুময় করিয়া দিলেন। খোদার কোনো বিচার নাই।–ইত্যাকার চিন্তা তাহার মনকে বিষাদিত করিয়া তুলিল।
অতি কষ্টে কথা চাপিয়া রাখিয়া পত্নীকে মৃদু স্বরে কহিলেন–”পিতার বাড়ির সুখের চাইতে স্বামীর বাড়ির দুঃখ ভালো।”–এই কথা কয়টি বলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।
২য় বন্ধু আপন ঘরে একাকী বসিয়াছিলেন। তিনি একাই থাকেন। তাঁহার শূন্য গৃহে কতকগুলি ইংরেজি-বাংলা বই, কতকগুলি মাসিক, একখানা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এবং একটি ভূত্য ছাড়া আর কেউ থাকে না।
১ম বন্ধু বিনা ভূমিকায় সকল কথা যাইয়া বলিলেন।
২য় বন্ধু উদ্বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–তুমি কি গায়ে হাত তুলেছ?
‘না’।
‘বেশ করেছে’।
‘কী বললে? বেশ করেছি! এমন বৌকে মেরে হাত-পা ভেঙে গঙ্গার পানিতে ডুবিয়ে দিতে হয়।’
‘এ ছাড়া নারীর স্বভাবে সহস্র দোষ দেখতে পাবে, কিছুই তুমি বলতে পারবে না। ধর্মপত্নীকে ভৎর্সনা করা ভালো নয়। দোষ-ত্রুটি নিয়েই নারী বিবাহিতা হয়। তুমি স্কুল করবে, এবং সেই স্কুলের ছাত্রী হবে সে-বিবাহের শর্ত তা নয়। স্বামীর কাজ ভালবাসা, প্রেম করা, গুরুগিরি করা নয়।
‘এখন কী করতে হবে?’
‘অন্ধ এবং বধির হবে।‘
‘কী সর্বনাশ।‘
‘কোনো কথা বলো না, কোনো সমালোচনাও করো না। যদি কঠোর নীতি অবলম্বন কর, তার মন তোমার হাতছাড়া হবে। সবই কলের মতো সে করে যাবে, বৎসরে বৎসরে সন্তান প্রসব করে যাবে। যার সবই হবে প্রাণহীন মেশিনের কাজ। সে অন্তরে অন্তরে তোমাকে ঘৃণা করবে।
‘নারী এত বড় প্রতারক!‘
‘সমাজ নারীর জন্য কী করেছে? সে অন্ধকারে থাকে, তার মন অন্ধকারে বাড়ে আলোর পরিচয় অধঃপতিত হবে না?’
২য় বন্ধু আবার কহিলেন–ছেলেদিগকে, ছাত্র-ছাত্রীদিগকে শাসন করতে পার, পত্নীকে নয়। সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতা ছাড়া তাকে শিক্ষিত করবার আর কোনো পন্থা নাই তাতে ফল কিছু হোক আর না হোক।
‘কোনো ফল হবে না, বৃথা চেষ্টা।‘
১ম বন্ধু একটু থেমে জিজ্ঞাসা করিলেন–প্রতিদিনকার জীবনে নারীর কী কী দুঃস্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়?
২য়–নারীর কতকগুলি সাধারণ দোষ আছে। সেগুলি শুধু একজনের দোষ নয়–এ হচ্ছে শিক্ষার অভাবের দরুন। আমি বলে যাচ্ছি। তুমি শোন
বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা। সকাল বেলাতেই বিষ-মুখ করে বের হওয়া অর্থাৎ ঝগড়া মুখে করে বের হওয়া। যার সামনেই বসা তার কাছেই অপরের নিন্দা করা। জিনিসপত্র অগোছালো করে রাখা। ইচ্ছা করে কানে না শোনা। প্রাণহীন জিনিসের উপর রাগ করা। ক্রোধে দরজায় ধাক্কা মারা। ৰাক্সের উপর জিনিসপত্র রাখা। ছেলেমেয়েদের কাছে স্বামীকে খেলো করা-এটি গুরুতর অপরাধ। ছেলেকে তিরস্কার করলে ছেলের শিক্ষকের উপর রাগা। নিজের ছেলেমেয়ের দোষ না দেখা। জোরে হি হি করে হাসা। বেশি চিৎকার করে গৃহের শান্তি নষ্ট করা। বিচার না করে কথা বলা পর মুহূর্তে আবার আর এক কথা বলা। জিনিসপত্র আলগা রাখা। ঘরে গরমের সময় ঠাণ্ডা পানির বন্দোবস্ত রাখা। পড়াশুনায় বিরক্ত হওয়া সকল লোককে খেলো মনে করা। স্বামীর কাছে বাড়ির আর সকলের নিন্দা করা। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীত চলা। তাকে বুঝতে চেষ্টা না করা। নোংরা থাকা। স্বামীর খাবার এবং তার সুখ-সুবিধার কোনো খোঁজ না রাখা–তার সঙ্গে আলাপ না করা। স্বামীকে অগ্রাহ্য করা। ছেলেমেয়েদের যখন তখন খেতে দেওয়া। যখন তখন বাজে লোকের সামনে নববধূদের স্বামীর সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়।
২য়–নারী যতই রূপসী, বিদুষী এবং বংশে শ্ৰেষ্ঠা হউক না কেন স্বামীকে মুরুব্বী বলে মেনে চলা উচিত।
১ম–আমি একটি ঘটনা জানি ভারী মর্মস্পর্শী।
২য়–কী রকম?
১ম–একটা ভালো বংশের মেয়ে দেখতে ভারি সুন্দর। কি যে সুন্দরী তা আর কি বলবো। তার একটা যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। যুবকটি লেখাপড়া না জানলেও তার স্বভাবটি বড় ভালো। মেয়েটি এর এই নিরীহ প্রকৃতিতে কিছুতেই তৃপ্তি লাভ করতে পারল না। স্বামীকে অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করতে লাগল। যুবকটি কত করে তাকে ভালোবাসতে চায়, মেয়েটি ঘৃণায় তার দিকে ফিরে তাকায় না।
২য়–নারী জীবনের এই অহঙ্কার তাদের সর্বনাশের কারণ, তবে একটি কথা বিবেচনা করতে হবে। পিতামাতার কর্তব্য কোনো বিরুদ্ধ রুচির লোকের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে না দেন-তাতে মেয়েদের অবোধ মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে–তারা কোনোকালে স্বামীকে ভালোবাসতে পারে না। আপন ভাগ্যে তুষ্ট থাকাই ভালো কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেরূপ হয় না।
১ম–বিরুদ্ধ রুচির অর্থ কী?
২য়–একটি সুন্দর ফুটফুটে চঞ্চল হাস্যরসিক মেয়ের সঙ্গে একটা ধাঙ্গড় অভ্যাস ছেলের বিয়ে না হওয়াই ভালো।
১ম–শুধু সৎস্বভাব হলেই চলবে না।
২য়–শুধু সৎ মানে একটা নিরীহ বোকা মানুষও হতে পারে। তাকে লোকে প্রশংসা করতে পারে। কিন্তু তাকে নিয়ে মনুষ্য তৃপ্তি লাভ করতে পারে না। বিবাহিতদের একজন আর একজনকে ভোগ করতে চায়। স্বামী স্ত্রীর একজন আর একজনের নিকট উপাদেয়, মধুর, স্নিগ্ধ, সুন্দর, মোহন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবেন। একজনের আর একজনের রুচি অনুযায়ী হতে হবে। নইলে প্রণয় সম্ভব নয়। একজন সাহিত্যিক হয়তো তার পত্নীকে পছন্দ করে না। পত্নীর অপবিত্র মনে পিপাসা হয়তো একটা পাষণ্ড লোককে আকাক্ষা করে। দম্পতির যা ধর্ম–তা স্বামী-স্ত্রীকে পালন করতেই হবে। নইলে বিরোধ হবেই। কোনো যুবকের বউ যদি যোগিনীর মতো ব্রত পালন আরম্ভ করেন, দিবারাত্র তপজপ, মোরাকাবা মোশাহেদায় ডুবে থাকেন, বৃথা জিন্দেগি বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে থাকেন, হাসি তপজপ মোরাকাবার ধ্যান যে দোষের–তা বলছি না, দাম্পত্য ধর্ম পালন করাও স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম! এরূপ না করলে হয় স্বামী, না হয় পরী একজন আর একজনের মনের উপর অত্যাচার করবেন। মোটা বুদ্ধির লোকেরা এসব বুঝতে পারে না। শরীরের মতো মনুষের মনও খোরাক চায়–মনের খোরাক আনন্দ, প্রীতিরস, বাধ্যতা, সহৃদয়তা, সহানুভূতি, আলাপ গল্প। এক কথায় দম্পতির ধর্ম একজন আর একজনকে তৃপ্তি দেওয়া। দম্পতির একজনের আর একজনের প্রতি দ্বিতীয় কোনো ধর্ম নাই। বিবেকের কথা, ধর্ম এসব অন্যের কাছে প্রচার করে-স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের কাছে এসবই যথেষ্ট নয়।
১ম–একটি মেয়ের কথা জানি, সে বেশ বই পড়তো–তা দেখে তাঁর স্বামী বিরক্ত হতো। বলতো-বই-টই পড়লে চলবে না।
২য়–তাই তো বলছিলাম। দু’জনই এক ভাবের লোক হওয়া চাই। ঐ মেয়েটির যদি একটি শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তাহলে তার কত কদরই না হতো। অসভ্য যুবকটি লেখাপড়ার মর্যাদা বোঝে না, সে তো রাগবেই। তার চিন্তা, রুচি-কদর্য, সে উচ্চ জীবনের আশীর্বাদ ভোগ করতে পারে না। ভালো মেয়ের ভাগ্যে যদি একটা ধাঙ্গড় স্বামী জোটে, তার মতো দুঃখের বিষয় আর নেই। এসব বিষয় পূর্ব হতে বাপ-মায়ের বিবেচনা করা উচিত। কোনো কোনো পিতামাতা এতই দুর্বুদ্ধি ও প্রাণহীন যে, ওরা ছেলেমেয়েদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিছুই বোঝেন না, জবরদস্তি করে যা হয় একটা করেন।
১ম–এরূপ বিয়ে কি সিদ্ধ হয়?
২য়–কখনই না। অন্তর কেউ কাকে স্বীকার না করলে বিয়ে ঠিক হয় না, এরূপ বিয়ে জবরদস্তি ও ব্যভিচার ছাড়া কিছু নয়।
১ম–এরূপ বিয়ে কি ভেঙ্গে দেওয়া উচিত?
২য়–যাকে একবার হৃদয় দেওয়া হয়েছে, তাকে আর কোনো মতে ত্যাগ করা চলে। এরূপ করলে নারীর ভাগ্য আরও দুঃখময় হয়ে ওঠে।
১ম–নারী স্বভাবের যেসব দোষ-ত্রুটির কথা বললে, ওগুলো অনবরত ধরতে থাকলে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি দিনরাত্রি সমালোচনা করতে থাকলে তাদের জীবন কি বিষময় হয়ে ওঠে না।
২য়–স্বামীর পক্ষে নিরন্তর পত্নীর দোষ-ত্রুটি ধরা পড়াই অভদ্রতা। অনবরত সমালোচনা করলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়। জীবন গঠনে পত্নীকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। বই-পুস্তকের উন্নত চরিত্রের আদর্শ সম্মুখে ধরে তার আত্মান্নতির সুবিধা করে দেওয়া, ছাড়া, মুখের উপর দিবারাত্রি ভুল ধরলে পারিবারিক জীবন নীরস, প্রাণহীন ও প্রেমহীন হয়ে পড়ে। ছেলেবেলায় মা-বাপের কিংবা স্কুলে শিক্ষক বা শিক্ষয়িত্রীর ভর্ৎসনায় উপকার হয়–কিন্তু বিবাহিতা হওয়া মাত্র নারীকে আর ভর্ৎসনা করা চলে না। নিজের চিন্তা করে নিজেকে গঠন করে তোলবার অবসর মানুষকে দিতে হবে।
১ম–ভর্ৎসনায় কি কোনোই কাজ হয় না?
২য়–অতি সামান্য ইশারা-ইঙ্গিত একেবারে ব্যর্থ হয় না। কঠিন রূঢ় ভর্ৎসনায় কিছু। ফল হলেও সে ফলের কোনো মূল্য নেই, সে ফল অন্তঃসারশূন্য।
১ম–এমন মেয়ে কি নেই, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী-কোনো মতে নিজদিগকে দোষী মনে করেন না? নিজের স্বভাব গঠনের কোনো চেষ্টাই করেন না?
২য়–যারা নিতান্তই অশিক্ষিতা, তারা কিছুই ভাবে না। একইভাবে জীবন কাটায়। সেজন্য কোনো অশিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করা খুবই বিপদের কথা। জীবনের দুঃখ এতে বেড়েই ওঠে, বংশেরও কোনো উন্নতি হয় না। দীন মানসিকতা, মন্দ রুচির মেয়েদের পেটের ছেলেপেলেও মন্দ রুচির হয়। বই পড়তে পারে, মামুলি লেখা সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, এরূপ বিদ্যাবুদ্ধি মেয়েদের থাকা চাই-ই-চাই। মেয়েরা কতকটা মাঠের জমির মতো। যেমন জমি তৈরি হবে, ফসলও ঠিক তেমনি হবে। এ সত্য কথা দেশের লোক চিন্তা করে না। মেয়েদের শিক্ষা, তাদের মনরূপ ক্ষেত্রের উৎকর্ষ সাধনের কোনো চেষ্টা নাই, অথচ লোকে ইচ্ছা করে বংশের ছেলেরা জজ, ব্যারিস্টার দেশপূজ্য হোক; কবি, সাহিত্যিক, ধনী, ব্যবসায়ী হোক–এরূপ আশা করা বাতুলতামাত্র। মেয়েদের মনের উন্নতি, তাদের বই-পুস্তক পড়বার অবসর করে দেওয়া–সকলেই একটা বাজে কাজ মনে করেন। এ যে কত বড় বোকামি, তা আর বলে কি হবে। ক্ষেত্র সব সময় সতেজ, রসালো, শক্তিপূর্ণ ও পবিত্র থাকা চাই, নইলে বংশ বা জাতির কোনো মতেই মঙ্গল নাই।
১ম–অনেক লেখাপড়া জানা মেয়ে অসভ্য হয়ে থাকে, অনেক মূর্খ মেয়েকে খুব সভ্য, বিনয়ী, স্বামীর অনুগত এবং ভদ্র হতে দেখেছি–এ মানে কী?
২য়–যে সমস্ত মূৰ্থ মেয়েকে সভ্য দেখেছ–তারা তাদের মাতার বা বংশের চরিত্র প্রভাব লাভ করে থাকেন। লেখা পড়া বা বিদ্যার শক্তি কোনো সময় বংশের প্রভাবকে অতিক্রম করে উঠতে পারে না–সেজন্য অনেক গোলমাল হয়। তাছাড়া অল্প বিদ্যা অনেক সময় কোনো কাজে আসে না।
১ম–এই যে ‘বংশ প্রভাব’ কথাটি বললে, এটি শুনতে বড় কানে বাজে।
২য়–তা ঠিক। কথাটি সত্য, কিন্তু তাই বলে কথায় কথায় বংশ প্রভাব উল্লেখ করা অভদ্রতা নয়। বরং ‘বংশের দোষ’ এই কথাটি কখনও মুখে প্রকাশ করা ঠিক নয়।
১ম–বধুদের মনের উন্নতির জন্যে কী কী উপায় অবলম্বন করতে হবে?
২য়–প্রত্যেক পরিবারে মেয়েদের মনের উন্নতির জন্য একটা বিশেষ বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। বিশেষ সময়ের জন্য তাদের মনের সঙ্গে একটা স্বতন্ত্র স্ত্রী-পাঠ্য সাহিত্যের যোগ হওয়া চাই-ই-চাই।
১ম–নিরন্তর মেয়েরা বাজে কাজে ব্যস্ত থাকে–এর সুবিধা হবে কী?
২য়–হ্যাঁ, মানুষ এতই কাজে ব্যস্ত যে, তাদের নামাজ পড়বারও অবসর নেই! কী পরিতাপ! জাতির অধঃপতন কেন হবে না? আমি বেশ বুঝতে পাচ্ছি, মানুষ নামাজ পড়ে শাসন আর বেত্রাঘাতের ভয়ে-নইলে তাও পড়তো না। নামাজের সঙ্গে আত্মোন্নতির যে এতখানি যোগ আছে, তা যদি সবাই বুঝতো, তা হলে আর আত্মোন্নতির ব্যাপারে সময় ব্যয় করাকে কেউ সময় নষ্ট বল মনে করতো না। মনের উন্নতির চেষ্টা, স্বভাব গঠনের সাধনা–এবাদত ছাড়া আর কিছু নয়। মুসলমান মেয়েরা কি কোরান পাঠ করে না? এও কি সময় নষ্ট?-কোরান জিনিসটা কী?–একি সাহিত্য নয়-আত্মোন্নতির প্রকৃষ্ট পথ নয়?-কোরআন লোকে বোঝো না বলে খোদার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়-আত্মোন্নতির তিলার্ধ পরিমাণ সাহায্য হয় না। মুসলমান মেয়েরা যদি কোরান বুঝে পাঠ করতো, তা হলে কী যে সুন্দর হতো, তা আর বলবার নয়।
১ম–শুধু কোরান পড়লেই তো হয়, আর অন্য কিছু পড়বার দরকার কী?
২য়–মানুষ শুধু খোদার কালাম হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না, স্বভাবের অন্তর্গত করতে। সক্ষম হয় না। যখন পৃথিবীর সাহিত্যটা খোদার কালামের ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি–সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান কবিতা, কাব্য উপন্যাসের মঙ্গলময় মূর্তিতে মানব-চিত্তকে নাড়া দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকেরা গানে-গল্পে, রূপে-রসে এলাহীর কালাম অভিনব ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছন–বিভিন্ন রুচির লোকের উপযোগী করে। সেইজন্য সাহিত্যকে সব দিক দিয়ে গ্রহণ করতে চেষ্টা করতে হবে। এইভাবেই মানবাত্মার মঙ্গল ভালোভাবে হয়।
১ম–আমি অনেক লোককে দেখেছি, যারা বেশ বই পড়ে, কিন্তু তাদের স্বভাবের কোনো উন্নতি হয় না।
২য়–ও কথা বলো না, কিছু না কিছু হবেই। অবশ্য স্বভাব গঠনের একটা আন্তরিক ইচ্ছা থাকা চাই। নিজের ভালো হতে চেষ্টা না করলে, কে কাকে ঠেলে বড় করতে পারে। মনের উন্নতির ব্যবস্থা করে দিয়েও যদি কোনো ফল না হয়, তাহলে আর দুঃখ করবার কারণ নেই।
১ম–মেয়েরা অনেক সময় মনে করে, বিয়ের জন্যই একটু লেখাপড়া শেখা দরকার। বিয়েটা যখন হয়ে গেছে, তখন ঐসব কাগজ-বই নেড়ে দরকার কী?
২য়–এরূপ চিন্তা অনেক মেয়ে পোষণ করেন বটে।
১ম–কী বয়সের ছেলের সঙ্গে কী বয়সের মেয়ের বিয়ে ভালো?
২য়–মেয়ের বয়স ছেলের অর্ধেক বা ২/১ বৎসরের বেশি হওয়া ভালো।
১ম–এর মানে কী?
২য়–নারীর শরীর পুরুষ অপেক্ষা দৃঢ় এবং বলবান। বর কন্যা এক বয়সের হলে বা। মেয়ের শরীর পুরুষ অপেক্ষা অধিকতর সুগঠিত হলে ছেলের শরীর অল্প সময়ে ভেঙে পড়ে, এতে ছেলে স্বাস্থ্যহীন হয়ে অসময়ে মারা পড়ে। ছেলেরা নিজ নিজ শরীর সম্বন্ধে যদি সতর্ক না হয়, তবে খুবই বিপদের কথা। ঔষধাদি এবং প্রচুর পুষ্টিকর আহার ব্যতীত দাম্পত্য জীবনের মর্যাদা কিছুতেই রক্ষা করা যায় না।
১ম–কোনো কোনো মেয়ে অত্যন্ত কামুকা।
২য়–এ কথা ঠিক নয় ছেলেরাই অধিক অসহিষ্ণু তবে মেয়েদের যদি এরূপ কোনো দুর্বলতা থাকে, তবে সেটা বড়ই দোষের কথা। নারীকে স্বামীর শরীর সম্বন্ধে সর্বদাই সতর্কে চলতে হবে-নইলে সর্বনাশ হবেই। জবরদস্তি, রাগারাগি, মারামারি করে বাধা দেওয়াও ভদ্রতা নয়। কোনো কোনো মেয়ে স্বামীর শরীর সম্বন্ধে একেবারেই উদাসীন।
১ম–কোনো কোনো মেয়ে স্বামীর মুখ ভার দেখলেই অসহ্য বোধ করেন, জিজ্ঞাসা করেন–কী হয়েছে। হাসি-মুখ না করে ছাড়েন না। স্বামীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও খুব কড়াকড়ি।
২য়–এ গুণ প্রত্যেক মেয়েরই থাকা উচিত। এরূপ না করলে স্বামীর শরীর ঠিক থাকে। অল্প সময়েই ভেঙে পড়ে। অনেকে আলস্য করে ঔষধ-পত্র ব্যবহার করে না। পত্নীর কর্তব্য এ বিষয়ে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করা এবং নিজ হস্তে স্বামীকে ঔষধ খেতে বাধ্য করা।, স্বামীর জীবনটি নারীর জন্য অনেকটা নৌকার মতো-ডুবলে নিজেকেও ডুবতে হবে।
১ম–বাঁদী বৌ গ্রহণ প্রথা কেমন?
২য়–ইহা জঘন্য, ঘৃণিত। ইহাতে পরিবারে বড় অকল্যাণ হয়। বংশের সর্বনাশ হয়, নিজের শরীর-মন অপবিত্র হয়। এরূপ করা কখনও ঠিক না।
কদাচিৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই বিবাহ সমর্থন করা যায়, কিন্তু বাদী বৌ গ্রহণ করা বড়ই আপত্তিজনক। কোনো ভদ্রলোকেরই এরূপ কাজ করা উচিত নয়।
১ম–বাদী বৌ গ্রহণ করবার কারণ কী?
২য়–কারণ দুইটি। একটি গৃহের কাজ, অন্যটা কোনো ইতর ঘরের মেয়ের রূপে মুগ্ধ হওয়া।
১ম–গৃহের কী কাজ?
২য়–ধান ভানা, বিবিদের জন্যে পানি আনা, গো-সেবা এবং জ্বাল দেবার জন্য ঘুঁটে তৈরি করা।
১ম–পরিবার প্রতিপালনের জন্য এগুলি তো বিশেষ দরকার।
২য়–পানির জন্যে নিজের মর্যাদা নষ্ট করে একটা বাঁদী বৌ আমদানি করা এবং তাঁর দেওয়া পানি দিয়ে গোসল করা বধূদের পক্ষে বড় অপমানজনক। এর চাইতে মরণ ভালো কোনো কারণে সমান ঘরের সতীন হলে মান-ইজ্জত নষ্ট হয় না। কোনো কোনো ঘরে এমন আছে। কিন্তু একটা ইতর মেয়ে যদি স্বামীর বিছানার অংশীদার হয়, তবে তা সহ্য করা কোনো ভদ্র কন্যার পক্ষে সম্ভব নয়। ধান ভানা, গোবরের ঘুঁটে তৈরি–এ সব নিজে করলেই-বা কি ক্ষতি? অবশ্য যদি সামর্থ্যে এবং সময়ে কুলায়-নইলে অবস্থানুযায়ী গাছ ফেড়ে জ্বালানি কাষ্ঠ সংগ্রহ করে বা ধান বিক্রি করে চাল কেনাই ভালো। নিজে হাতে চাষ করলে বা নারী ধান ভানলে কেউ অভদ্রলোক হয় না ভদ্রলোক হয় মনুষ্যত্ব, চরিত্র বলে এবং জ্ঞানে। তবে যাদের অবস্থায় কুলায় তাদের পক্ষে বধূদের এরূপ কষ্টসাধ্য কাজে যেতে বাধ্য না করা উচিত। যারা নিজেরা ইচ্ছা করে করেন বা যাদের অবস্থায় কুলায় না, তাদের কথা স্বতন্ত্র। সাংসারিক কার্যে পুরুষদের কর্তব্য বধূদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করা। নিজেরা বাবুর মতো বসে থেকে বধূদিগকে বলদের মতো খাটান বড়ই অন্যায়।
১ম–তুমি কি একাধিক বিবাহ সমর্থন কর?
২য়–কখনও নয়, কখনও নয়। বিশেষ যুগে বা বিশেষ কারণে একাধিক বিবাহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ে থাকবে, কিন্তু কখনও আদর্শ নয়। তবে বিবাহে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের স্মৃতি থাকা নিতান্ত বাঞ্ছনীয়। এ কাজ অন্যের দ্বারা বা জবরদস্তিতে হওয়া খোদার ইচ্ছা নয়। এরূপ ভাবে পরের ইচ্ছায় বিয়ে হলে চরিত্র বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের মনের কোণে একটু পাপের দুর্বলতা উঁকিঝুঁকি মারেই। যে জিনিসটা প্রেম, তা মানুষকে অতিশয় পবিত্র করে লোকচক্ষুর অগোচরে। জগতে বাধ্য হয়ে সৎ থাকা বড় কঠিন, অন্তত বাহিরে না হোক, অন্তরে সে ব্যভিচার করবেনই।
১ম–মনের কোণের এই পাপ, দুর্বলতা কি ভালো?
২য়–কখনও নয়, কখনও নয়। যে চক্ষু স্বামী বা পত্নী ছাড়া অন্যের দিকে পাপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তা বরং তুলে ফেলা ভালো। আত্মা অপবিত্র হওয়া অপেক্ষা একটা চক্ষু নষ্ট হওয়া বরং ভালো।
.
আপন-পর, পারিবারিক গ্রাসাচ্ছাদন
১ম–জগতে কে আপন, কে পর, তা বুঝতে পারি নে।
২য়–পত্নী স্বামীকে এবং স্বামী পত্নীকে নিকটতম আত্মীয় মনে করবে। মনুষ্য আপন পিতামাতাকে ত্যাগ করে সাদীর জন্য অস্থির হয়। এ আল্লাহর ব্যবস্থা এর উপর কথা চলে না। ছেলে বড় হলে, পিতা তাকে ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর চরম বিপদেও কেউ কাউকে ত্যাগ করতে পারেন না। সুখের সময় অনেকেই বন্ধু হয়, দুঃখের সময় সবাই পালায়। পত্নী সকল অবসস্থয়, নিকটে আছেন। ধর্মপুস্তকে যাই লেখা থাক, জগতের কর্মক্ষেত্রে আমরা কোনো দয়া-ধর্ম দেখতে পাই না। যার যার মতো সেই, কেউ যেন কারো। নয়। টাকাটা দিতে একদিন বিলম্ব হলেই মহাজন কটু কথা বলে, ঘরে অন্ন না থাকলে কে তা জিজ্ঞাসা করে? কিছুই নয়, সবই পুস্তকের কথা। মানুষের জীবনের ধর্মের কোনো রঙ নাই।
১ম–তাহলে কি ধর্ম নাই?
২য়–রসুলুল্লাহ্ যদি এসে বলেন–আমি ক্ষুধার্ত, আমি পীড়িত-তাহলে অনেকেই সম্ভব দরুদ পড়তে পড়তে পালিয়ে যাবে। বক্তৃতা ক্ষেত্রে অনেকেই ভাই ভাই বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে একটু ত্যাগ স্বীকার করতে তাঁরা চান না।
১ম–তা হলে কে আপন, কে পর?
২য়–নিজের বাহুবলই বড় বল। বিপদে মাতা এবং পত্নী পার্শ্বে থাকেন। যারা জগতে বন্ধু হয়ে আসন উজ্জ্বল করে বসে থাকেন, তাদের উপর কোনো ভরসা করো না। সর্বদাই নিজের কাছা ও কোচা ঠিক রাখা উচিত। দুঃখ ও সত্যকে অতি অল্প মা ই শ্রদ্ধা করে। চোর, বদমাইশ ও দুষ্টের জন্য মানুষ কাঁদে, দীন-দুঃখীকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না।
১ম–যা বল্লে, তা অতি কঠিন কথা।
২য়–জগতের এই অবস্থা বুঝেও নিজের অবস্থা ঠিক রেখে যতটা সম্ভব মানুষকে বিপদে আপদে সাহয্য করা উচিত, সেইটেই ধর্ম। টাকা তোমার কাছে আছে, সে টাকা যে শুধু তোমারই এ কথা মনে না করা উচিত।
মানুষকে, পরকে অন্তরে ভালোবেসো, মানুষের দুর্বলতা ও দারিদ্রকে উপহাস করো না। মানুষ অনেক সময় সাধু ও দানশীল প্রেমিক জনকে মিথ্যা কথা বলে, সে কথাও জেনে রাখা উচিত। জগতে বোকা হওয়াও ঠিক নয়। জগতে থাকতে হলে জগতের জ্ঞান থাকা। চাই। অপরিমিত এবং অন্যায় দানও ভালো নয়, তাতে আলস্যপরায়ণ ও কর্মবিমুখ লোকের। প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
১ম–অনেক সময় সংসারে পিতা-পুত্রে কলহ হয়।
২য়–এর কারণ, পরস্পরে সহানুভূতির অভাব। পরিবারে জ্ঞান, বিবেচনা ও ধর্মভাবের অভাব। নিজে উপায় করতে না পারলে, পিতাও ভালোবাসে না। তাতে তাকে দোষ দেওয়া চলে না। পুত্র সেয়ানা হলে, তারও বিবেচনা করা উচিত, আপন স্ত্রী-পুত্রের ভার বৃদ্ধ পিতার স্কন্ধে চাপিয়ে দিলে তার বিলক্ষণ কষ্ট হয়। বুড়াকালে মানুষ বিশ্রাম করতে চায়, তখন তাকে উপার্জনের জন্য সংসারে ভাবনা ভাবতে বাধ্য করা ঠিক নয়। সংসারে সকলেরই সহিষ্ণু হয়ে, মিলেমিশে যাতে ভালো হয়–তাই করা উচিত। ঝগড়া-কলহ করা, পেছনে পেছনে কথা বলা এসব পরিবারে অবনতির কারণ।
১ম–বিয়ে কোন্ সময় করা উচিত?
২য়–নিজে যোগ্য হয়ে তারপর বিয়ে করা উচতি। না হলে অর্থাভাব, মনোমালিন্য, আহার ও চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হয়। মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ, ভ্রাতা ও বোনের সঙ্গে মমতার বন্ধন–এ সব চিরদিন থাকে না। নিজকে জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, কারো সঙ্গে মমতার বন্ধন থাকে না। পিতামাতা চিরদিনই তোমাকে খাওয়াতে পরাতে পারেন না। তাঁরাও কিন্তু আশা করেন।-এ কথা অপ্রীতিকর হলেও, সংসারে সময় হলে চিন্তা করা দরকার।
১ম–কীভাবে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়? মানব-জীবনে অর্থাগমের পথ কী?
২য়–শুধু শুধু ঘুরে বেড়ান বড়ই অন্যায়। তাকে লোকে লক্ষীছাড়া ও পাগল বলে। অপরের এমন কি নিকট আত্মীয়ের আশ্রিত হয়ে, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলে ইজ্জত নষ্ট হয়। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হয়ে অর্থাগমের পথ দেখা উচিত। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থেকো না। চিরদিন নিজেকে নির্ভরশীল শিশু মনে করো না। পিতার কর্তব্য শেষ হলেই আর তার কাছে কিছু আশা করো না।
১ম–বর্তমানে অর্থাগমের পথ কী?
২য়–প্রথম দিনেই যে মানুষ লক্ষপতি হয়, তা নয়। বর্তমানে অনেকেই চাকরির আশা করে, কিন্তু সকল মানুষই যে চাকরির যোগ্য তা নয়। ঘুষ খেয়ে, চুরি করে, অনেকে ভুড়ি মোটা করে সত্য, কিন্তু অবৈধ পথে, নৃশংস কার্যের দ্বারা জীবনকে উন্নত করবার চেষ্টা বড়ই ঘৃণিত। অনেক কাজ আছে দেশে, তার কোনো একটাকে অবলম্ব করলেই পয়সা হবে। নিজের রুচি অনুযায়ী কোনো ব্যবসা অবলম্বন কর। কাজ যতই ছোট হোক, তাতে জাত যায় না। সাধুতার সঙ্গে কোনো স্বাধীন ব্যবসা করলেই জীবনের অভাব-অভিযোগের মীমাংসা হবে। এটা থুয়ে ওটা, ওটা ধুয়ে এটা-এরূপ করলে জীবনে উন্নতি করা যায় না। কৃষি, বস্ত্রবয়ন, সেকরার কাজ, মিস্ত্রীর কাজ, স্বদেশজাত শিল্প-বাণিজ্য চালানী কারবার,–যার যেমন রুচি ও বুদ্ধি সে তাই করবে।
১ম–দ্রলোকের ছেলে এ সব কাজ করলে লোকে কি বলবে?–এতে কী সম্মান বাড়ে?
২য়–ঐ তো আমাদের ভুল ধারণা। চাঁদের আলো সব জায়গাতেই পড়ে তাতে চন্দ্রালোকের গৌরব নষ্ট হয় না। ভদ্র সন্তান, যোগ শিক্ষিত ব্যক্তি যে কাজই করুক–তাতে তার সম্মান নষ্ট হয় না। সম্মান নিজের মনের ভিতর। দুর্বল-হৃদয় ব্যক্তিরাই বিবেক ও .আপন বিচার-বুদ্ধি অপেক্ষা মানুষকে বেশি ভয় করে। এতকাল এসব কাজ অশিক্ষিত লোকেরা করেছে বলে, এসব কাজকে লোকে ছোট মনে করে দ্ৰ শিক্ষিত লোক এসব কাজে ঢুকলেই কাজের গৌরব বেড়ে যবে। ল্যাঙ্কাশায়ারের তাঁতীরাই বিলেতের রাজা। ব্যবসা-বুদ্ধি সহজ বিষয় নয়। যে জাতির ব্যবসা-বুদ্ধি বেশি, তারাই জাতিসমূহের উপর কর্তৃত্ব করে। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশ, আধুনিক উন্নত প্রণালীতে কৃষিতে মন দেওয়াও আমাদের উচিত। নূতন লোকের পক্ষে প্রথমে অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়, কিন্তু না ঠতে শিখলে জেতা যায় না। অনেক কিছু প্রাথমিক অসুবিধা দেখেই পালিয়ে যান, হতাশ হন-এসব অপরিপক্ক লোকের প্রকৃতি। উন্নতি ও মঙ্গলের পথ বাধা নই, প্রস্তুত নাই–পথ বেঁধে নিতে হবে, প্রস্তুত করে নিতে হবে। এতদিন দেশের কোনো কোনো চাকরীতে মোটা ঘুষ পাবার ও এক রাত্রিতে বড় হবার সুবিধা ছিল, এ সুবিধা এখন আর নাই। এই দুইটি সুবিধাকে গ্রামের লোকেরা বহু জন্মের ভাগ্যফল মনে করত, এখন আর চাকরীতে মায়া নাই। ধর্ম ও বিবেকবান লোক এহেন ইতর-বৃত্তির সাহায্যে পরিবার প্রতিপালন করতে ঘৃণা বোধ করেন।
১ম–চাকরি কি ভালো কাজ নয়?
২য়–কোনো জিনিসের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। সকলের পক্ষেও চাকরী খারাপ নয় যেখানে আত্মসম্মান বজায় থাকে না, চরিত্র ঠিক থাকে না, আপনা-আপনি পাপ ও মন্দজীবনের সংস্পর্শ ঘটে ওঠে, যেখানে সর্বদাই দূর দূর, ছেই ছেই ভাব, সেখানে চাকরী না করাই ভালো। চাকরী গ্রহণ করে প্রবুর সঙ্গে ঝগড়া-কলহ, তার মঙ্গল চেষ্টা না করা, প্রভুর অভদ্র ব্যবহার–এসবও ভদ্রলোকের কাজ নয়। চাকরিতে আয়-উন্নতি কম; ব্যবসা করতে পারলে তাতেই সুবিধা।
১ম–যারা চাকরি করে, তাদের কি সম্মান বেশি
২য়–দাস ও গোলাম জাতি আমরা। যে ঘাড় ধরতে পারে, দুকথা চড়া বলতে পারে, তারই সম্মান বেশি। স্বাধীন জীবন, ব্যবসায়ীর জীবুন এ যেন তুচ্ছ, না পাবার যোগ্য নয়–এমন ধারাই ভাব। তা বলে আর কি হবে, যা ভালো তাই করা উচিত। কালে কালে দেশে লোকের মন উন্নত হলে লোকে স্বাধীনতাকেই বেশি ভালো তাই করা উচিত। কালে কালে দেশের লোকের মন উন্নত হলে লোকে স্বাধীনতাকেই বেশি ভালোবাসবে। ইউরোপেও সাধারণ লোকদের মাঝে চাকুরের সম্মান কম নয়, কিন্তু দেশের সাধারণ স্বাধীন অধিবাসী অবহেলা ও লাঞ্ছনার পাত্র নয়। চকুরেরা ও দেশের শাসন-যন্ত্র দেশবাসীর টাকাতেই বাঁচে। চাকুরেরা এদেরই চাকর।
.
পরিবার
২য়–যে পরিবারে সহানুভূতি নেই–সে পরিবার মর্যাদা দাবি করতে পারে না–সে পরিবারই নয়।
১ম–এরূপ কি সম্ভব?
২য়–এরূপ পরিবার অনেক আছে। হয়ত বড়ির একটি লোক রোগ যন্ত্রণায় চীৎকার করছেন, অবহেলায় তার কষ্টের সীমা নাই। তাকে কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না। তিনি যখন সুস্থ হবে, তখন সকলেরই পরম আত্মীয়। মা পীড়িতা, রোগশয্যায় নিঃসহায় হয়ে পড়ে আছেন, বাড়ির সবাই হাসি-খেলায় ব্যস্ত। ছেলেদের আনন্দ উৎসব সমানভবেই চলছে। পত্নী পীড়িতা-স্বামী তাকে একবারও ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন না-এ আদর্শ পরিবারের ভালো নয়।
১ম–বাস্তবিক এ বড়ই অন্যায়।
২য়–সহানুভূতি ব্যতীত আত্মীয়তার কোনো মূল্য নেই। যে মাতা সমস্ত রাত্রি জেগে সন্তানকে মানুষ করেছেন, তার সামান্য অসুখে অস্থির ও ব্যাকুল হয়েছেন, রোগপীড়িতা হলে তাকে কেউ দেখার নাই। কি অবিচারের কথা। বস্তুত মনুষ্য পশুর চেয়েও অধম এবং অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মনুষ্য রোজা-নামাজ করে, কিন্তু তার জীবনের কাজ পশুর মতো। এক ব্যক্তি সম্বন্ধে জানি, সে শুক্রবারে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিল। এদিকে তার মা ঘরে কলেরায় মরে আছেন। তাঁর যে কোনো অসুখ হয়েছে এ খবর কেউ রাখে না। বাড়িতে বধূরাও ছিলেন। যেসব সন্তানকে প্রাণ দিয়ে এই মা মানুষ করেছিলেন, এরা তাদেরই বউ। কিন্তু তাদের ব্যবহারটা দেখ। মায়ের এই অবস্থায় পুত্রেরা নামাজ পড়তে গিয়ে যদি মায়ের সেবা করতেন, তাহলে খোদা বেশি.সন্তুষ্ট হতেন।
১ম–সত্য
২য়–এক বাড়ির একটি অন্তঃসত্ত্বা বালিকা ১৮ দিন বেদনায় কাতর থেকে অবশেষে প্রাণত্যাগ করে। এরাও আবার মানুষ,-এক পরিবারের মানুষ।
১ম–মেয়েটির কি কেউ ছিল না?
২য়–ছিল বই কি? বাপ, ভাই, স্বামী সবই ছিল। লোকে বলে আপন হতে পর ভালো, ঘর হতে জঙ্গল ভালো। মানুষ আত্মীয় হয়ে যে অবিচার করে, অন্যে তা করতে ভয় পায়। পরিবারের সবাই ১৮ দিন ধরে বালিকাটির আর্তনাদ শুনলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই করলো না। এই তো আমাদের আত্মীয়তা ও পরিবারের বন্ধন। পিতা ছিলেন, স্বামী ছিল। মুসলমান পরিবারের নিরীহ নির্ভরশীলদের উপর যত অবিচার হয়–এমন আর কোথাও হয় না। সমস্ত জাতিটা যেন প্রেমহীন মনুষ্যত্ব-বর্জিত হয়ে পড়েছে। বাড়ির বুড়ো পিতা পীড়িত হলে অনেক সময় তাকে অবহেলায় মারা যেতে হয়। এমন ঘটনাও আমি জানি। বস্তুত পরিবারের প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে-নইলে পরিবারের লোকদিগকে পশু বল্লে অন্যায় বলা হবে না। পীড়িতের খবর নেওয়া, সর্বপ্রকারের তার ব্যথাকে লাঘব করতে চেষ্টা করা প্রত্যেক ভদ্র পরিবারের কর্তব্য। বাড়ির মুরুব্বী যিনি, তার নির্ভরশীলদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে কৃপণতা করা উচিত নয়। কর্তার অসুখে ডাক্তার, কবিরাজ হাঁটাহাটি করছে, কিন্তু পরী বা নির্ভরশীলদের বেলায় জিজ্ঞাসা করবার লোক নাই।-এ বড়ই অন্যায়।
১ম–বাড়িতে বিধবা মেয়েদের অনেক সময় অবহেলা হয়।
২য়–তা হয় বই কি! একবার বিয়ে দিয়েছ, যেন সমস্ত কর্তব্য শেষ হয়েছে, এইরূপ মনে করা হয়। বিধবা সুখ-দুঃখের প্রতি কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয় না। –১ম–বাড়ির কর্তার বুড়ো বয়সে পত্নী মায়া যাবার ১ মাসের মধ্যে বিয়ে হয়। বিধবা মেয়েদের ৫ বৎসরের মধ্যে জুটে উঠে না–এর মানে কী?
২য়–দুঃখের কথাই বললে। বিধবা মেয়েরা আবর্জনা বিশেষ। জাতির সর্বত্র যেন গলিত পচা ঘায়ে পরিপূর্ণ। অন্যায়ে যেন এদের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। মানুষের মনুষত্য সর্বত্রই লাঞ্ছিত হচ্ছে। বিধবা মেয়েদের যত শীঘ্র সম্ভব বিয়ে দিয়ে ফেলা উচিত।
১ম–এ কাজে কি জবরদস্তি ভালো?
২য়–এমন কোনো পুরুষ মানুষ এ পর্যন্ত আমার নজরে পড়ে নাই, যিনি পত্নী বিয়োগে চিরদিন মৃত পত্নীর কথা স্মরণ করে দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করেন নাই। মেয়েরা আপত্তি তুলতে পারেন, কতকটা লজ্জার খাতিরে। দরিদ্রা, পরাধীনা, নির্ভরশীল যারা, তাদের লজ্জা বেশি। এই লজ্জার বেদনা হতে নারীকে রক্ষা করতে হবে। বিয়েটা আর কিছু নয়, এই দুঃখপূর্ণ সংসারে একটা সুখ-দুঃখের সাথী খুঁজে নেওয়া। নারীর দুঃসহ জীবনের ভার একা বহন করতে পারা যায় না। এতে লজ্জার কিছু নাই। নারীর এই লজ্জার আর এক নাম ব্যথা। তারা যদি অশিক্ষিতা, পরমুখাপেক্ষী না হন তা হলে আর তাদের লজ্জা হয় না। কোনো ইংরাজ রমণী লজ্জার খাতিরে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে ইতস্তত করেন না। আমরা সর্বহারা নিঃসহয়া বলেই একটু বেশি সাধু, লাজুক এবং ভদ্র।
১ম–বাড়ির কথা যিনি তিনি অনেক সময় ভারী অত্যাচারী হন।
২য়–হাঁ হন বই কি! বস্তুত কর্তা যদি বাড়ির সকলের প্রতি অত্যাচারী হন, তবে তা বড়ই অন্যায়। দিবারাত্র কচকচি, কর্তার জ্বালায় বাড়ির সবাই তটস্থ। এরূপ অত্যাচারীর মৃত্যু বাইরে না হোক মনে মনে সবাই ইচ্ছা করেন। পত্নীর সঙ্গে, সেয়ানা-পুত্র-কন্যা ও পুত্রবধূদের সঙ্গে সব সময় ভদ্র ব্যবহার করা উচিত। অশ্লীল বাক্য, গালাগালি ভদ্র পরিবারের লক্ষণ নহে।
১ম–কিন্তু কর্তার ভুল কে সংশোধন করবে?
২য়–এর কোনো প্রতিকার নাই। এরূপ পরিবার অতি শীঘ্র ধ্বংস হবে। পুত্রের বিদ্রোহী হয়–তাদের জীবন শান্তিহীন ও দুঃখময় হয়–সকল দিক অন্ধকার হয়ে ওঠে।
১ম–পরিবারে অশান্তির কারণ অনেকটা অভাব নয় কি?
২য়–জগতে আজ মানুষের নুতন অভাব হচ্ছে না। চিরদিন মনুষ্য সমাজে এইটি হয়ে এসেছে-তার মীমাংসাও হয়েছে। মোটের উপর অশান্তি, মারামারি দ্বারা কোনোই ফল হয় না। ভদ্রতা ও সহানুভূতির দ্বারা সর্বত্রই সুফল হয়।
১ম–পরিবারের মধ্যে ধর্মচর্চার অভাব আমি অনুভব করেছি।
২য়–হা, আমাদের পরিবারের এ একটা মস্ত অভাব। সকল বাক্যের মধ্যে খোদার বাক্য শ্রেষ্ঠ। সকল বাক্য অপেক্ষা খোদার বাক্য অধিক সারময়। খোদার কালামে মানুষের জন্য যে কল্যাণ নিহিত আছে–তা বুঝবার কোনো চেষ্টা বা সুবিধা নাই-ফলে মুসলমান পরিবার দিন দিন পুণ্য ব শূন্য, সত্য-বর্জিত হয়ে পড়ছে।
এটা সমাজের পক্ষে বড়ই ভয়ানক কথা। ফলে সমাজস্থ লোকগুলি দিন দিন অন্ধ, দুঃখী এবং শান্তি-সুখ শূন্য হচ্ছে। মানুষের মন দিন দিন মঙ্গলের পথে অগ্রসর হতে না পেরে, দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। নামাজ-রোজার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সন্ধ্যায় বা প্রত্যহ কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের সকলে একস্থানে সমবেত হবে, মাতৃভাষায় কোরান, হাদীস, মহাপুরুষদের জীবনী আলোচনা করেন, তাহলে বড়ই ভালো হয়।
১ম–এতে সংসারের কাজের ক্ষতি হয় নাকি?
২য়–অক্ষয়, অনন্ত জীবনের পারের যোগা না করে, জাগতিক দুদিনের শান্তি লাভের জন্য মনুষ্য কত লালায়িত। ধিক মনুষ্যকে! আত্মার মঙ্গলের জন্যে, খোদার জন্যে পরিবারে লোকদের মনুষ্যত্ব জাগাবার জন্যে, তাদের আত্মাকে সুন্দর, সুরভিত করে তোলবার জন্যে চেষ্টা করতেই হবে, একটি বাদ দিয়ে মনুষ্যত্ব জাগাবার জন্যে, তাদের আত্মাকে সুরভিত করে তোলবার জন্যে চেষ্টা করতেই হবে, একটি বাদ দিয়ে মনুষ্যত্ব জাগাবার জন্যে, তাদের আত্মাকে সুন্দর, সুরভিত করে তোলবার জন্যে চেষ্টা করতেই হবে, একটি বাদ দিয়ে মনুষ্য সহস্র সহস্র টাকা উপায় করলেও তার কোনো গৌরব নাই। মুসলমান সমাজের উন্নতি পথের একটা বাধা হচ্ছে এই যে, আমাদের পরিবারের লোকদের আত্মোন্নতি বা চরিত্র গঠনের কোনো বন্দোবস্ত নেই। বাড়িতে একটা ‘Holy and Virtuou’s Atmosphere build’ (হোলী অ্যান্ড ভারচুয়াস এ্যাটোমোসেফেয়ার বিড়) করতে হবে।
১ম–পরিবারে একজনে অনেক সময় আর একজনের কথা শোনেন না–এর মানে কী?
২য়–এর মানে কর্তার চরিত্রশক্তির অভাব; গৃহিণী এজন্য দায়ী। যে জাতি আপন আপন পরিবার শৃঙ্খলার সঙ্গে চালাতে পারে। কর্তা ও গৃহিণী উভয়েরই চরিত্রবল ও জ্ঞানের অভাববশত পরিবারে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। ছেলেরা কথা শোনে না, দাসদাসীরা বিদ্রোহী হয়। এক ভাই আর এক ভাই-এর কথা শোনে না।
১ম–এর প্রতিকার সম্বন্ধে কিছু বল।
২য়–সংক্ষেপে কিছু বলছি। মোটামুটি এইগুলি মনে রাখলেই কাজ হবে। ছোটদের সঙ্গে অধিক চেঁচামেচি করা ঠিক নয়। একজন একটি হুকুম দিলে, দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার প্রতিবাদ করা ঠিক নয়, কিংবা তখন আর একটা হুকুম দিতে নাই। ছেলেদের সামনে স্বামী-স্ত্রীতে প্রতিবাদ করা ঠিক নয়, কিংবা তখন আর একটা হুকম দিতে নাই। ছেলেদের সামনে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া নিষেধ। পত্নী নিজের ছেলে-মেয়েদের মঙ্গলের জন্য স্বামীর কোনো কথার প্রতিবাদ করবেন না। স্বামীর ইচ্ছা অবিলম্বে পালন করবেন, ছেলমেয়েরা যা দেখবে তাই শিখবে। উপদেশ অপেক্ষা উদাহরণ তাদের শিক্ষার জন্য ভারি উপকারী। মাকে সর্ব প্রকারে পিতার বাধ্য দেখলে, অবাধ্যকতা কী জিনিস তা তারা মোটেই টের পাবে না। একটা হুকুম একবার, বড় জোর দুবার বলবে, কখনও ৫/৭ বার বলবে না। যেমন ”বাজারে যাও” এই কথাটি কখনও দু’বারের অধিক বলবে না। কখনও অসহিষ্ণু হয়ো না। যদি অবাধ্য হয়, তবে অনেকক্ষণ পর শাস্তি দেবে। কিন্তু-দুবারের অধিক কোনো হুকুমই দেবে না। অনেক সময় অবাধ্য হলে, কথা না শুনলে বা প্রতিবাদ করলে কিছুই বলবে না–আন্তরিক অনিচ্ছার উপর জবরদস্তি ভালো নয়। হুকুম না শুনলেও চলবে–ছোটদের এরূপ কল্পনা করবার সুযোগ দিও না। ছোট যে, সে বড়কে সম্মান করবে-এই সম্মান। করবার শিক্ষা মধুর করে দিতে হবে। সৎশিক্ষা ক্রোধের সঙ্গে দেবে না।
ছেলে যা শোনে, যা দেখে তাই করে। উপদেশ অপেক্ষা উদাহরণ উত্তম। আপনি করে কথা বল”–এই কথা না বলে নিজেরা ছেলেদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বললেই কাজ অধিক হয়। শিশুদিগকে প্রাতে নিজেরাই ছালাম করবে, তাহলে তারা উপদেশ দেবার পূর্বেই ছালাম করা শিক্ষা করবে।
ঘোটর কাছে কখনও বড়র নিন্দা করো না–এটা যার পর নাই বোকামি। ছোট যে সে বড়কে খুব ভদ্রতার সঙ্গে সম্বোধন করবে। ছোটর সম্মুখে কখনও বড়োর অপমান বা অসম্মান করবে না। বাল্যকাল হতে পরিবার এইভাবে গঠিত হয়ে উঠলে শেষকালে পরিবারে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অশান্তি উপস্থিত হয় না। স্মরণ রেখো, অবাধ্যতাই পরিবারের অশান্তির একমাত্র কারণ।
.
বিরোধ
পত্নীকে আনবার কয়েক দিন পর হইতেই স্বামী-স্ত্রীতে বিরোধ বাধিয়া উঠিল। বেলা পর্যন্ত থাকা, সকল কাজেই অবাধ্যতা, নিজের ইচ্ছামত চলা, সর্বদা রাগে কথা বলা–প্রভৃতি স্বভাবে ১ম বন্ধু মনে মনে দুঃখিত হইলেও, বন্ধুর উপদেশে তাহা মোটেই গ্রাহ্য করিলেন না। শিক্ষার অভাবই যে ইহার একমাত্র কারণ, তাহা তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না। তিনি প্রাণপণে পত্নীকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। প্রথম কয়েক দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগখানা শেষ হইল বটে, কিন্তু এখন দুই-একদিন পরই পড়িবার সময় হইলে ছেলেটি কাঁদিয়া ওঠে, না হয় পত্নীর মাথা ধরে!
পড়ার সুবিধা হইবে ভাবিয়া রাত্রি আটটার সময় দুই বন্ধু বাসায় ঢুকিয়া নিজেরাই রান্নার বন্দোবস্ত করেন।
দুই বন্ধুর এই আশ্চর্য কাণ্ড দেখিয়া থোকার মা মনে মনে হাসিত। এমনটি যে সে কোনো দিন দেখে নাই, শোনে নাই। স্বামীটাকে একটা মাথা পাগল, বন্ধুটাকেও অন্তত ততটা না ভাবিয়া খোকার মা বিছানার উপর আরামে ছেলেটাকে বুকের মধ্যে লইয়া থাকিবেন। পড়াশুনা খুব অল্পই হইত। নিতান্ত অনিচ্ছায় দুই-একবার পুস্তকের দিকে চোখ দিয়া অক্ষরগুলি দেখিত। ওসব তাহার মোটেই ভালো লাগে না। চিরকাল বাল্যকাল হইতে যে মেয়েদের ছেলেপেলে, রান্নাবান্না লইয়া নিতান্ত হালকাভাবে গল্প করিতে শুনিয়াছে, নিজেই তাহা করিয়াছে এবং তাহাতে তাহার অপরিসীম আনন্দ বোধ হইয়াছে। স্বামীকে সে কি মনে করে-কাপড়-চোপড়ের মতো একটা আবশ্যক দ্রব্য মাত্র, তাহার সংস্পর্শে একটা অপরিসীম আনন্দ অনুভূতির কল্পনাও সে করিতে পারে না স্বামীর সহিত সে কথা বলিতে চায় না–নূতন ঝিটির কাছে তাহার কোনো সঙ্কোচ নাই, সহজভাবে আনন্দে সারাদিন ধরিয়া গল্প করে, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না–লজ্জাও হয় না।
স্বামী তাহাকে সমস্ত প্রাণ দিয়া ভালবাসিতে চায়। তাহার সহজ আলাপ, প্রেমহাস্য প্রতিনিয়ত কী একটা নিদারুণ অশোভন অসহজভাবে বিঘ্ন পায়। ব্যাপারটি স্বামীর কাছে নিতান্তই অস্বাভাবিক ঠেকে। মাঝে মাঝে দুঃখের আঘাত তাহার বুকের ভিতর জ্বলন্ত লৌহ-শলাকার মতো জ্বালা দিয়া যায়, কিন্তু পরক্ষণেই সে মনকে সান্ত্বনা দিয়া ভাবে, গ্রামে থাকার দরুন পত্নী স্বামীর সহিত কীরূপ উঠিতে বসিতে হয়, তাহা জানে না। কিছুদিন তালিম পাইলেই দুরস্ত হইয়া যাইবে। সে আনন্দে-উৎসাহে পরীকে জড়াইয়া ধরে মুখে। আদরের চুম্বন মুদ্রিত করিতে যায়। পরী বিরক্তিতে মুখ টান দেয় আহা ছাড় বলিয়া সরিয়া যায়। স্বামী প্রেমের আবেগে তাহা গ্রাহ্য করেন না।
এইভাবে ছয়মাস কাটিয়া গেল। অনেক কষ্ট করিয়া চারুশিক্ষার খানিকটা পড়া হইল। ইংরেজি ফার্স্ট বুকের অর্ধেকটা শেষ হইল, কিন্তু বহু কষ্ট করিয়াও শতকিয়া মুখস্ত হইল না
স্বামী ভাবিলেন–প্রথম প্রথম এরূপ হইয়াই থাকে। কুচ পরোয়া নাই।
.
স্বামী ও স্ত্রী
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, কখনও দুঃখের কথা বলো না, নিরাশার কথা বলো না। যে ভুল হয়েছে, তবে আলোচনা করে শিরে করাঘাত করো না-এ সব মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না। ভাঙ্গা তরীর উপর দাঁড়িয়ে হাসতে হবে, বেলাভূমির দিকে তাকিয়ে তরীকে ঠেলতে হবে। ডোবে ডুবুক, তবুও আনন্দ কর, হাস্য কর, সম্মুখে চল–হায় হায় করো না। দুঃখ, বিপদ, মৃত্যুর মাঝে পড়ো না–কখনও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলো না, উহা পাপী মনুষ্যের কাজ। কখনও অভিযোগ করো না, কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করেন না।
১ম–বন্ধু জীবনে তাই করবো।
২য়–কতকগুলি পরিবার আছে, যেখানে সবাই অনবরত হায় হায় করতে থাকে। দুঃখ না থাকলেও দুঃখ টেনে এনে গৃহকে অশান্তিপূর্ণ করে তোলে। এগুলি নিতান্তাই বোকামি। তাদের নিজের বুকে বিষ-গৃহের আলো-বাতাসকে বিষিয়ে তোলে, যারা তাদের স্পর্শে আসে তাদের জীবনকে পর্যন্ত তারা আনন্দহীন এবং তিক্ত করে তোলে।
১ম–বাস্তবিক এরা অভিশপ্ত, এদের মুখ দেখলে অযাত্রা।
২য়–যা বলেছ, তাই ঠিক। নারীদের পক্ষে এরূপ স্বভাব একেবারে অমার্জনীয় অপরাধ। নারীর জন্য দুঃখ, নিরানন্দ, নিরাশা, দীর্ঘনিঃশ্বাস, আক্ষেপ একেবারে হারাম নারী বৈশাখের ঝড়ের মতো আনন্দের প্রবাহ হবে–তার সামনে যে থাকে, তাকে একেবারে আনন্দের বারিধারা। কল্যাণ ঘোতে ডুবিয়ে নিয়ে যাবে। নারীর মুখে একমাত্র স্বামীর মৃত্যুতেই দুঃখ দেখা দেবে, আর কোনো অবস্থাতেই না। আলো যেমন অন্ধকারের শত্রু, নারী তেমনি দুঃখের বিপরীত অবস্থা-কোনো অবস্থাতেই সে দলিতা হবে না, কোনো অবস্থাতেই ক্রুদ্ধ। হবে না, দুঃখে-বিষাদে, দৈন্য-সম্পদে সর্বত্রই সে আলো, রস উৎস, শক্তি ও আশা।
১ম–বড় সুন্দর কথা।
২য়–দাম্পত্য জীবনে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।
১ম–কী বিষয়?
২য়–সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্য।
১ম–কী রকম?
২য়–বলছি। আমি অবিবাহিত মানুষ। লোকে মনে করবে আমি অনর্থক মোড়লী করছি, কিন্তু ঠিক তা নয়। আমি যা বলছি, তা সত্য।
১ম–আমি তা মনে করবো না।
২য়–মানুষের শত্রুই হচ্ছে জীবন। মূর্খেরা অপরিমিত শুক্র ব্যয় করে। কিন্তু খায় ছাই-ভস্ম। সকল মানুষকে রাতারাতি ব্রহ্মচারী হবার উপদেশ আমি দেই না, কিন্তু একপাল বিবাহিত সন্ন্যাসী হবার উপদেশও আমি দিই না। কথা কি–বিবাহিতাকে প্রচুর পুষ্টিকর খাদ্য আহার করতে হবেই শাক-কচু খেয়ে সংসার করলে অকালে বিবিধ ব্যাধি-পীড়িত হয়ে মারা যেতে হবে। দুঃখের বিষয় আমাদের কারো স্বাস্থ্যের প্রতি মোটেই দৃষ্টি নাই। লোকগুলি যে কত ভুল করে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যাই। শরীর তো আর লোহা নয়–একে অনবরত পুষ্টির খাদ্য যোগাতে হবে নইলে মরণ, অকাল বার্ধক্য, প্রাণঘাতী ব্যাধি অপরিহার্য। ডিম, মুরগী, রোহিৎ মৎস্য ঘৃত, দুগ্ধ এসব প্রয়োজন। কেউ হয়তো বলবেন, দরিদ্রেরা এসব জোটাবে কী করে? সেটা হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রশ্ন। শরীর রক্ষা না করলে শরীর ভেঙে পড়বে; স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের এই সত্য দরিদ্রকে খাতির করে চলবে না। অনেক সময় আমরা স্বাস্থ্যরক্ষার গুরুত্ব অনুভব করি নে, ইচ্ছে করে কৃপণতা করে অপুষ্টিকর খাদ্য খাই, বিলাসিতা করে পয়সা উড়িয়ে দেই-না খেয়ে আত্মহত্যা করি। শরীরটা মাংসের ইঞ্জিন বই তো নয়–কয়লা ও জল অভাবে ট্রেনখানি টেনে নেওয়া দূরের কথা, নিজেই নিজের ভারে অচল হয়ে পড়তে হবে। ভালো পুষ্টিকর আহার চাই, বাসের জন্য ভালো ঘর চাই, আলো চাই, বাতাস চাই, তবেই জীবনের কল্যাণ ও প্রসন্নতা লাভ হবে। দুঃখ জিনিসটা পাপ, মৃত্যু এবং অন্ধকার। ওর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আমরা চাই স্বাস্থ্য, আলো, জীবন, আনন্দ ও রস।
১ম–আমরা সবাই দরিদ্র।
২য়–দরিদ্র তা ঠিক। কিন্তু দারিদ্রের বেদনা এ জাতির নাই। দুই পয়সার শাক খেয়ে সারারাত্রি শোকর করি, খোদা এ চান না। যেখানে অভাবের তীব্র অনুভূতি, সেইখানে মীমাংসার চেষ্টা। যে জাতির অভাবের বেদনা নাই–সে তা পূরণ করার জন্য ব্যস্ত হয় না। প্রভু ইচ্ছা করেন না, তার পুত্রেরা দুইখানি ফেলে দেওয়া হাড় খেয়ে লেজ দুলায়! জাতির পক্ষে কী লজ্জার কথা!
১ম বন্ধু–ঠিক কথা।
২য়–সমস্ত বিলাসিতা বর্জন করতে হবে। নিজে চাকর হও, নিজে রান্না কর। অনাবশ্যক বিলাদ্রব্য ত্যাগ কর-মজুর হও, তথাপি ভালো খাও, ভালো থাক।
১ম–বিলাসিতার খরচ কমিয়ে গাভী, মুরগী পেলে পুকুর-খাদকে মাছ দিয়ে ভরে খাবার বন্দোবস্তটা করা গেল; ভালো থাকি কী করে? খড়ের ঘরে নিজে সঁতসেঁতে মেঝের উপর শুয়ে ম্যালেরিয়ায় মরি, এর উপায় কী?
২য়–প্রত্যেক ভদ্রলোক, তুমি যেমন বল্লে একটু চেষ্টা করে খাবার সুবন্দোবস্ত করতে পারে–কিন্তু কয়জন তা করে? কে গাভীর যত্ন করে? কে মুরগীর চাষ করে? দেশে পুকুর আছে ঢের, কিন্তু কয়জন মাছের চাষ করতে আগ্রহী হন? ১০ পয়সার চিংড়ি এবং এক পয়সার সজিনার ডাটায় যখন আমাদের খাওয়া হয়, তখন আর অত চেষ্টা-চরিত্র করবার কী দরকার?–এই হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। বলেছি–অভাব বেদনার অনুভূতি আমাদের নাই–অল্পেই আমরা কুকুরের মতো তুষ্ট হয়ে যাই–আমাদের মঙ্গল কোথা থেকে হবে? আমরা চিরদিন দাস হয়ে তো থাকবই। হ্যাঁ, তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে ভালো। থাকি কী করে?
১ম–তাই জিজ্ঞাসা করছি?
২য়–যাদের ক্ষমতা আছে, তারাও ভালো ঘর এবং আলোবাতাসের ব্যবস্থা করে না। স্যাঁতসেঁতে ঘর এবং আলোহীন বায়ুহীন অন্ধকার ঘরে তাদের বাস করতে কোনো আপত্তি নেই।
১ম–বাসের জন্যে কীরূপ ঘর ভালো?
২য়–সকলের সাধ্যমত চেষ্টা করা কর্তব্য, বাসের জন্য পাকা ইটের ঘর তৈরি করা। এতে এমন কি টাকা লাগে?-অথচ এতে কত সুবিধা! খড়ের ও টিনের ঘরেই বেশি খরচ ক্ষতি; স্বাস্থ্য নষ্ট হয়।সর্প ও চোর-দস্যুর ভয়ও বিলক্ষণ আছে। লোকের ধারণা ইটের ঘরে খরচ বেশি–কিন্তু সে ধারণা একেবারে ভুল। অমিতব্যয়ী মানুষ অন্যায় বেহিসেবী এবং পান-তামাকের খরচে যে টাকা ব্যয় করে-তা একসঙ্গে করলে সংসারের শ্রেষ্ঠ দরকারি জিনিস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটু বাসস্থান তৈরি হয়। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটু বাসস্থান প্রস্তুত করা-ভিক্ষুকেরও কর্তব্য ভিক্ষা করে স্থায়ী স্বাস্থ্যকর বাসস্থান নির্মাণ করা। নোংরা, অপরিষ্কার, অপবিত্র, সাপ-পোকার সঙ্গে বন্ধ ঘরে বাস করার অর্থ-এই সোনার মানব জীবনটাকে পশুর জীবনের মতো অবহেলা করা।
১ম–এইবারে যা বলবো, তা খোকার মার কাছ থেকে গোপন রেখো, নইলে আর আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।
প্রথম বন্ধু হাসিয়া বলিলেন–আমি বলবো, তোমার একটা সতীন আছেন, তিনি ঈর্ষা করে আমার মন বিষ করে দিচ্ছেন, তোমাকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছা হয় না। দ্বিতীয় বন্ধু হাসিয়া উত্তর দিলেন–না, না, তা বলো না, তা হলে আমার দুর্গতির সীমা থাকবে না।
একটু থামিয়া বলিলেন-বন্ধু, ক্ষুধা ব্যতীত যেমন খাওয়া দাওয়া নিষেধ তীব্র ইচ্ছা ছাড়া কখনও পত্নীকে চাবে না। তাতে স্বাস্থ্যের বিলক্ষণ ক্ষতি হয়। পরীর সঙ্গে একই বিছানায় শোয়া নিষেধ। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই স্বতন্ত্র শয্যা থাকা চাই। যদি পাশাপাশি দুইটি প্রকোষ্ঠ হয়, তবে তাই খুব ভালো। স্বতন্ত্র প্রকোষ্ঠে নিজের নিজের মতো থাকবার, যাবার আসবার জন্যে মাঝের দেয়ালে একটা দরজা থাকবে। দরজার আবরণ থাকা চাই, অনবরত এক জনের উপর আর একজনের দৃষ্টি না পড়া চাই। প্রত্যেক মানুষের স্বভাবে একটা স্বাতন্ত্র এবং বিশিষ্টতা আছে–সেটাকে বজায় রেখেই স্বামী-স্ত্রীতে বাস করবে।
স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে একই বিছানায় শোয়া ঠিক নয়–এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, দেখতে অশোভন এবং সুরুচির পথে বিঘ্নজনক। এক ঘরে অর্থাৎ একই প্রকোষ্ঠে থাকাও ঠিক নয়–অধিক স্পর্শে শরীরের ক্ষতি হয়, পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা হয়। ফলে মনোমালিন্য হওয়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।
১ম–স্বামী-স্ত্রীতে এক ঘরে থাকা কি রকম কথা?
২য়–খড়ের ঘর হলে এক ঘরেই থাকতে হবে। তাছাড়া আর উপায় নাই। আমি বলছি একই প্রকোষ্ঠে অর্থাৎ এক কামরায় না থাকবার কথা। পাশাপাশি দুইটি কামড়ায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে বাস করবে। প্রত্যেকের জিনিসপত্র, বই-পুস্তক, বসবার আসন নিজের মতো থাকবে।
স্বামী-স্ত্রীর ঘরে অন্য কোনো লোকও থাকবে না। অনুমতি ছাড়া কেউ ঘরে প্রবেশ করবে না–ছেলেরাও না-৪ বৎসর হলেই ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র থাকবার ব্যবস্থা হবে। কখনও নিজের ঘরে রাখবে না। এতে ছেলেরা বাল্যকাল হতেই আত্মনির্ভরশীল হবে। মায়ের আঁচল ধরে পেছনে পেছনে থাকবার স্বভাব ছেলেদের দিনদিনই থাকে। এটা বড়ই দোষের। একটু সেয়ানা হলেই ছেলেদেরকে আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগ করে দাও। সেটা কোনো নিষ্ঠুরতা নয়। নিতান্ত শিশুকে মা নিজের ঘরে রাখবে। কিন্তু নিজের কাছে শোয়াবে না একটা রোলিং ঘেরা ছোট চৌকিতে স্বতন্ত্র করে শুইয়ে রাখবে; নিজের কাছে কখনও শোয়বে না–এতে শিশুর স্বাস্থ্যনাশে এবং মায়ের বিরক্তি ও স্বাস্থ্যনাশ হয়।
১ম–রাত্রের শিশুকে স্বতন্ত্র শোয়ালে কি সে বাঁচে, মা কি করে কাঁদা মাত্র ঘুমের মধ্যে শিশুর কাছে একশ’বার যেয়ে উপস্থিত হবে?
২য়–না, তা যাবার মোটেই দরকার নেই। খোদা তার সৃষ্টিতে কোনো অবিবেচনার পরিচয় দেন নাই। মূর্খ মেয়েরা শিশুকে যতবার ইচ্ছা, ততবারই দুধ দেয়-বেদনা পেলে, পেটে ব্যথা হলে, জ্বরে, অশান্তিতে, গরমে বা যে কোনো অসুবিধাতে কাদামাত্র মুখে মাইটি ভরে দেবে, এটি যারপরনাই মূর্খতা। শিশুদের রাত্রিতে দুইবারের অধিক দুধ খাওয়ানো নিষেধ। সারা রাত্রি তার মুখে মাই দিয়ে বুকের কাছে রাখবার কোনো দরকার নেই। শিশুদের দুধ দেবার মোটামুটি একটা নিয়ম বলে দিচ্ছি। ২১ দিন পর্যন্ত শিশুদেরকে প্রতি দু’ঘণ্টায়, দিনে-রাত্রে ১৩ বার দুধ দেবে–রাত্রিতে মাত্র দু’বার। ১ মাস হতে ২মাস পর্যন্ত দিনে রাত্রে ৭/৮ বার খাওয়াবে-রাত্রে মাত্র ১বার দেবে। তার পর এক বৎসর পর্যন্ত দিনে রাত্রে ৬/৭ বার, রাত্রে মোটে কিছু খাওয়ানোর দরকার নেই।
১ম–বটে, এতো কিছু জানতাম না। আচ্ছা মাতৃদুগ্ধ ভালো, না গো-দুগ্ধ ভালো।
২য়–মাতৃদুগ্ধই ভালো, যাদের তাতে আপত্তি আছে, তারা গোদুগ্ধ হাল্কা করে খাওয়াবেন, তবে শিশুর জন্মের ৫/৭ দিন পর্যন্ত মায়ের দুগ্ধই দিতে হবে।
১ম–স্বামী-স্ত্রীর ব্যবহার সম্বন্ধে আরও কিছু বল।
২য়–পত্নী স্বামীর বিশেষ অসন্তোষ উৎপাদন করে সাধুতা বা সংযম সম্বন্ধে কোনো পক্ষের বেশি বাড়াবাড়ি বা গোড়ামি ভালো নয়। একটু বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলেই দাম্পত্য জীবনে কোনো বিঘ্ন আসে না। উভয়ের জীবন সরস এবং মধুময় হয়। পত্নীতে যথাসম্ভব কম যাবে। যত সংযম অভ্যাস করতে পার, ততই উভয় পক্ষে ভালো। শরীরটা একবার বাঁধা হয়ে গেলে আর বিশেষ ভয় থাকে না।
১ম–লোকে ছোট ঘরের মেয়ে আর বড় ঘরের মেয়ে বলে এর মানে কী? সবারই তো একই জিনিস? রাজরানীরও যা আছে, একজন কুলী রমণীরও তাই আছে।
২য়–না তা ঠিক নয়। নারীর রূপ বা আকর্ষণ শুধু তার আছে নয়। সবারই এক জিনিস আছে সত্য, কিন্তু তাই ধরেই নারীত্বকে পরিমাণ করলে চলবে না। নূরজাহান, মমতাজ, মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা। এঁদের মত শত শত সুন্দরী জগতে আছে–কিন্তু খোদা তাদের মনের বিশিষ্ট সৌন্দর্য, তাদের ব্যক্তিত্বের বিশিষ্ট গৌরব, তাদের রূপের মহিমা দিয়েছেন রুচি, বাক্য, ভাব, বংশমর্যাদা, স্বভাব, ব্যক্তি, বিশেষ ক্ষমতা এবং মানসিক সৌন্দর্য নারীকে শ্রেষ্ঠ, রূপময়ী এবং গরীয়সী করে। নারী অঙ্গের নিজস্ব মূল্য খুব অল্প।
১ম–এই জন্যেই স্ত্রী-শিক্ষা প্রয়োজন–তার রুচি, বাক্য, ভাব, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতা এবং মনকে মার্জিত এবং বিকশিত করে তুলতে হবে–এগুলি বাদ দিয়ে নারী কিছু নয়।
২য়–তাই ঠিক।
১ম–শুনেছি ছেলেমেয়েদের চেহারা অনেকটাই মাতার মানসিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভর করেন।
২য়–হ্যাঁ তাই। তবে বাহিরের চেহারায় কিছু আসে যায় না। অনেক সুদৃশ্য নর-নারী আছে, যাদের মন খুব অপবিত্র। তাদের সৌন্দর্য্যে মানবসমাজের কি কল্যাণ হয়–বরং মনুষ্যসমাজকে তারা তিক্ত করে তোলে। সৌন্দর্য বিধাতার দান-এ একেবারে অশ্রদ্ধার জিনিসও নয়। নারীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। শয্যাগৃহে উত্তম উত্তম ছবি ঝুলিয়ে দেব। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনো অশ্লীল এবং ক্রোধপূর্ণ বাক্য শোনাবে না। এ অবস্থায় পবিত্র খোদার ভাবপূর্ণ সঙ্গীত, গজল শোনাবেফলে সন্তান রূপবান, সাধু-চরিত্র হবে। শুভ্র সুন্দর ফুল, নবীন তৃণ ও লতাপত্র আচ্ছাদিত সবুজ ক্ষেত্র, ঘরের জানালা দিয়ে সর্বদা নারীর নয়নসমক্ষে পড়া চাই।
নারী একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পবিত্র ভূমিতে মনুষ্যরূপ অমৃত বৃক্ষের উদ্ভব হয়। এই পবিত্র ভূমির জন্য যত্ন আবশ্যক–এই মহীতল হতে মনুষ্যরূপী মহাযোগীবর জাগ্রত হন। নারী ধন্য!
.
নারীর প্রেম
২য়–পত্নীকে কাজেও বলিও না, হুকুমও করিও না-যেহেতু নারী অতিথি এবং তাকে প্রেম করেছ। নারীর কর্তব্য সে আপন স্বামীকে নির্লজ্জের ন্যায় প্রেম করে–যেন মনুষ্য তাকে বেহায়া বলে গালি দেয়–যেন তাকে সকলে বলে এই মেয়েটি স্বামীহাজতে। বস্তুত স্বামীহাজতে হওয়াই হচ্ছে সতী নারীর লক্ষণ।
১ম–কিন্তু সমাজের যা অবস্থা, তাতে দাম্পত্য প্রেম হওয়া একপ্রকার অসম্ভব। কন্যা। যদি স্বামীর নিন্দা করে, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তা হলে মা-বাপ ভাবে আমার। মেয়ে আমাদেরই আছে। যদি স্বামীকে প্রেম করে, তাকে মুখে এবং কার্যে প্রেম করে, তা হলে সবাই বলবে–মেয়েটা ধেড়ে। ঠিক তেমনি ছেলে যদি বিয়ের পর পত্নীকে ভালোবাসতে চায়, তা হলে পিতা মাতা, ভগ্নী সবাই ভাবেন আমাদের ছেলে পর হয়ে। গেছে, কোথা থেকে একটা আপদ এসে আমাদের ভাই অথবা ছেলেটাকে পর করে নিয়ে গেল। কেউ কেউ মনে মনে দারুন ঈর্ষা পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই বউকে বিধতে। চেষ্টা করেন। ছেলে যদি বউকে নিন্দা করে, তাকে পদে পদে অপ্রস্তুত করে, তা হলে সে। ছেলের প্রশংসার সীমা থাকে না।
২য়–তুমি বড় গুরুতর কথা বলেছ। বাস্তবিকই সমাজে এরূপ হয়ে থাকে, কিন্তু যে পরিবারে এমনটি হয়, সে পরিবার অভিশপ্ত। প্রেম অপার্থিব পদার্থযুবক-যুবতীতে যথার্থ প্রেমের সঞ্চার দেখলে তাতে আনন্দিত হওয়া উচিত। যে তা দেখে ঈর্ষা পোষণ করে, সে নীচাশয় ছাড়া কিছু নয়। বলতে কি, আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রীতে যথার্থ প্রেম নাই–যদি তা থাকতো, তা হলে অতি অল্প সময়ে জাতির মঙ্গল হতো। প্রেম নাই বলেই এত অশান্তি, দুঃখ অভাব, চরিত্রহীনতা। পুত্র এবং পুত্রবধূতে যাতে গভীর প্রেম সঞ্চিত হয়ে ওঠে বরং তার চেষ্টা করা উচিত। কালক্রমে তাদের পরস্পরকে ভালোবাসার পথে বিঘ্ন জন্মাতে নাই–সেটা ছেলমেয়েদের প্রতি এক প্রকার নির্মম অত্যাচার, মুরুব্বী হয়েছ বলে যে কিছু বিবেচনা করবার নেই, কোনো কাজে কোনো ভুল নেই–এমনটি মনে করা ঠিক নয়। ছোটর প্রতি ব্যবহারে মুরুব্বীদের সতর্ক হওয়া উচিত, যেন ছোটদের উপর কোনো অত্যাচার না হয়। এর ফলে ছেলেদের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। আর একটা কথা–যুবকদের প্রাণে স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ নিয়ে একটা নুতন চিন্তা এসেছে। তারা বৌকে আর কামের সামগ্রী মনে করেন না। তারা বধূকে একজন বন্ধুরূপে সর্বদা চান। তাকে সমানভাবে আপনার সুখ-দুঃখে, আপনার জীবনের নিগূঢ় সত্যে, অন্তরের সমস্ত বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা হাসি কান্না আলাপ-রহস্য সমস্ত অনুভূতিতে সর্বদা পেতে চান–তাকে রাত্রিকালে শুধু কামের সামগ্রীরূপে পেতে চান না–যুবক চিত্তের নারী সম্বন্ধে এই অনুভূতি যুগের প্রভাব হলেও এ প্রভাব বড় সুন্দর। পুরুষ নারীকে যে এইভাবে পেতে চায়–এ পাওয়া সত্যিকারের পাওয়া। নারীকে এইভাবেই পেতে হবে। নারী এইভাবে স্বামীর জীবনে নিজেকে ধ্বনিত করে। তুলবে, নইলে তার জীবন বৃথা। দু’জনার মধ্যে আকাশের মতো উঁচু ভেদ রয়েছে, শুধু কাম তাদের মিলনের ভিত্তি-এটি ভারী দোষের ধারণা। জাগ্রত মানুষের আত্মা নারীকে কখনও পশু ভাবে পেয়ে তৃপ্ত হতে পারে না। অথচ পুরানো লোকগুলি যারা যুবকদের শ্রদ্ধার পাত্র, তারা নারীকে এইভাবে পাওয়ার ঘোর বিরোধী। নারী সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুব খারাপ। তারা পত্নীর সঙ্গে কথা বলতে দেখলে হাসতে দেখলে ভারী বিরক্ত হন–বেহায়া নির্লজ্জ শয়তান বলে গালি দেন। মেয়ে মানুষের গান গাওয়া তো তারা বেশ্যার কীর্তি মনে করেন। ছেলেরা বলে থিয়েটারে মেয়েদের গান শুনলে দোষ হয় না, গ্রামোফোনে নারীর গান ভাই বোন সবাই একসঙ্গে শোনে–সতী স্বামীগতপ্রাণা পত্নীর গান শুনলে কী ক্ষতি? ও আমরা শুনবই–আমাদের পরী সর্বপ্রকার পন্থায় আমাদের মন আকর্ষণ করবেন, আমদের চিত্তকে বেঁধে রাখবে, নইলে আমাদের মন অপবিত্র হয়, কুচিন্তায় পূর্ণ হয়। চরিত্রহীনা নারীর হাবভাব আমাদের কল্পনার বিষয় হয়ে পড়ে। ছেলেরা বিদ্রোহী হয়। গৃহে তাদের পিপাসা মেটে না–গ্রাম সমাজ ছেড়ে দূরে বিদেশে, যেখানে কেউ বলবার নাই, সেখানে পালায়। অনেকের সে সুবিধা নাই। কোনো কোনো সময় বধূরা বিদ্রোহিণী হন; ফলে ভারি একটা বিশ্রী অবস্থার সূচনা হয়।
১ম–তা হলে এর উপায় কী?
২য়–যুগের প্রভাবকে মেনে চলতে হবে। আর বাস্তবিক ভেবে দেখতে গেলে ছেলেদের মনে নারী সম্বন্ধে এই নবীন অনুভূতিকে উপেক্ষা এবং অশ্রদ্ধা করা চলে না।
১ম–মেয়েরা যেখানে বিদ্রোহিণী হন, সেখানে কী ব্যবস্থা?
২য়–মেয়েরা বিদ্রোহিনী হলে আর উপায় নেই। কিযে করতে হবে, তা তো জানি নে। পত্নী হবার দায়িত্ব ঘাড়ে নেবার আগে মেয়েদের বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষিতা হলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের কর্তব্য বধূরা বুঝতে পারবেন। অবোধের কোনো চিন্তা নেই, কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই। সে যা ইচ্ছে তাই করে। তার কাছে ভালো-মন্দ কোনো কথার মূল্য নেই। নিজের লোকসান কিছু বোঝে না। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষিতা মেয়েদের কাছে যা আশা করা যায়, তা পাওয়া যায় না–তা বলে শিক্ষার দোষ দেওয়া চলে না। নারী জীবনের জন্য বিশেষ কতগুলি শিক্ষা দরকার-পুরুষের শিক্ষা তার জন্যে যথেষ্ট নয়। নারীর প্রধান শিক্ষার বিষয় হচ্ছে যে প্রেম ও ত্যাগে মহিমান্বিতা হবে-এইটেই হচ্ছে নারী জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা। নারী সর্বপ্রকারে স্বামীর অনুগত্য হবে, এমন ভাব দেখাবে যেন স্বামী ছাড়া সে আর কিছু জানে না। নারীর ইহাই ধর্ম। যে নারী বিদ্রোহিণী, স্বামীর অবাধ্য, স্বামীকে প্রেম করে না, স্বামীকে বাক্যে এবং ব্যবহারে তুষ্ট করে না, সে নারী ধর্মকে অবমাননা করে, সে নারী যে সংসারে থাকে, সে সংসারের অকল্যাণ হয়, তার নিজেরও মঙ্গল হয় না।
নারীর পক্ষে ক্রোধ অমার্জনীয় অপরাধ। আঁখিজলই নারী মুখের শোভা। ক্রোধ নারীর পক্ষে হারাম।
নারী কখনও বাপের বাড়ি থাকবে না। স্বামী নিতান্ত দরিদ্র হলেও স্বামীকে বুকে করে বৃক্ষতলে কাল কাটাবে, তথাপি পিতৃগৃহে যাবে না। নারীর জন্য পিতৃগৃহ অমঙ্গল স্থান। স্বামীর ভিটাই নারীর শোভা ও মর্যাদা বর্ধন করে।
১ম–আচ্ছা স্বামী যদি পত্নীকে ভালো না বাসে?
২য়–তবু নারী স্বামীকে প্রেম করবে। প্রেম করতে যেয়ে যদি নারীর প্রাণ যায়, সেও ভালো। পিশাচ ব্যতীত সাত্যিকারের প্রেমকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। স্বামী যদি আঘাত করে, সে আঘাত মাথা পেতে নেবে। প্রেম করতে ক্রটি করবে না প্রেম বুকের মধ্যে থাকলে চলবে না, বাক্যে এবং ব্যবহারে তার পরিচয় চাই। নারী নিজেকে কখনও হীন মনে করবে না, প্রেমের দ্বারা সে দুর্দান্ত স্বামী-শিশুকে নিজের করে নেবে। যদি সে স্বামীকে ত্যাগ করবার সুবিধা না পায়, তবু তাকে নিজের আত্মার তৃপ্তির জন্যে আন্তরিক প্রেম করবে এবং তার কোনো প্রতিদান চাইবে না। এইখানে নারী কত বড়, তা তার স্বামী। অনুভব না করুক, খোদা দেখেবেন। নারী কখনও স্বামীকে অভিশাপ দেবে না স্বামীর নিন্দা করবে না–নারীর পক্ষে তা মহাপাপ।
১ম–স্বামী যদি পত্নীকে তাড়িয়ে দেন?
২য়–সে কিছুতেই যাবে না। আপন সন্তানকে যেমন নারী কিছুতেই ত্যাগ করে না, পত্নীও স্বামীকে ত্যাগ করবে না। স্বামী পিশাচ হতে পারে, কিন্তু সে কথা পূর্বে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। একবার স্বামী হলে আর তাকে কোনো মতে অগ্রাহ্য করা যাবে না। সে গুণে পত্নী ভক্তি বা শ্রদ্ধার পাত্র নয়। পিতার দোষ যেমন পুত্রের দেখবার দরকার নেই, স্বামীর দোষ-ত্রুটি সমালোচনা করবার অধিকারও নারীর নেই। সম্বন্ধেই সে নারীর পূজনীয়।
১ম–এর কোনো যুক্তি-তর্ক হতে জানবে তার স্বামী কেমন হবে?
২য়–নারীকে এ সুযোগ দিতে হবে, জবরদস্তি করে তাকে কবুল বলানো অধর্ম।
১ম–নারীর উপর যদি অপরিসীম অত্যাচার-অবিচার হতে থাকে, তার কি কোনো প্রতিকার নেই-তার জীবন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?
২য়–নারীর পবিত্র দেহ স্বামীর, বর্তমানে স্বামী ছাড়া অন্য কারোর দ্বারা কলঙ্কিত হবে। নারী কোনো রকমে স্বামীকে ত্যাগ করবে না। বিবাহ বন্ধন কোনোরূপেই ছিন্ন হবে না।
১ম–পত্নীকে স্বামী ত্যাগ করতে পারে কেন?
২য়–নারী ব্যভিচারিণী হলে স্বামী তাকে ত্যাগ করবে। যার সঙ্গে সে ব্যভিচার করে, তার সঙ্গেই তার বিবাহ হওয়া উচিত।
১ম–পত্নী স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে না?
২য়–স্বামীর যদি কোনো সংবাদ না পাওয়া যায়, একেবারে যদি নিরুদ্দেশ হয়, দিনান্তে তাকে চোখের দেখা না পাওয়া যায়, স্বামী পত্নীর সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রাখে, স্বামীর যদি কোনো সন্ধান না পাওয়া যায়, তবে ত্যাগ করা যায়। তাকে অপরিচিত এবং নিষ্ঠুর মনে করে পত্নী তাকে ত্যাগ করবে।
১ম–বিধবা নারী কী করবে?
২য়–তিনি ইচ্ছে করলে পুনরায় বিয়ে করতে পারেন, তাতে কোনো দোষ নেই। সন্তানবতী হলে স্বামীর গৃহে থাকতে পারেন,–যেমন খুশি।
১ম–তুমি যে বললে স্বামীর অবহেলা নারী সহ্য করবে। স্বামীর কী কোনো দায়িত্ব নেই?
২য়–আমি তো পূর্বেই বলেছি–পত্নীর সঙ্গে স্বামী কীরূপ ব্যবহার করবে। নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্যে এর চাইতে বড় কথা আরকে বলেছে? বস্তুতঃ পূর্ব হইতে ভেবে-চিন্তে বিয়ে করা উচিত। বিয়ে করে আর ক্রোধ বা দুঃখ প্রকাশ করা ঠিক নয়। নারীকে কোনো রকমে অমর্যাদা করা ঠিক নয়। যেহেতু নারী আশ্রিতা, নির্ভরশীল এবং অতিথি।
১ম–শাশুড়ী ও বধূতে অনেক সময় ঝগড়া-বিবাদ হয়, তার কি করা যায়?
২য়–কোনো কোনো শাশুড়ীর মত এই যে, বৌকে শিক্ষা না দিলে সে সংসার চালাবে কী করে? সে পরিপক্ব হবে কীভাবে? এ যুক্তি ঠিক নয়। মেয়েকে সর্বপ্রকারের শিক্ষা দেবার ভার তার বাপ-মায়ের উপর। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা সবাইকে ভালোবাসবে এবং ভালোবাসা পাবে। শ্বশুরবাড়ি যদি তার পক্ষে একটা তাড়নার ক্ষেত্র এবং স্কুল ঘর হয়ে ওঠে, তবে বড় দুঃখের কথা। বিয়ের পূর্বেই মেয়েদেরকে সর্বপ্রকার শিক্ষা দিতে হবে, নইলে তার নিজের জীবন দুঃখময় হবে। যাদের স্পর্শে সে যাবে তাদের জীবনও দুঃখময় করে তুলবে। নিতান্ত শিশু বয়সের মেয়েকে বিয়ে না দেওয়াই ঠিক। মেয়ে শ্বশুর বাড়ির উপযুক্ত হয়েছে কি না, এজন্য রীতিমত একটা পরীক্ষা হওয়া উচিত। মেয়েদের জীবনের জন্য বাপ-মায়ের কিছুমাত্র দায়িত্বজ্ঞান নেই, এ বড়ই অন্যায় কথা। তার আদব-কায়দা, গৃহস্থালী জ্ঞান, শ্বশুর-শাশুড়ী, স্বামী, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার, বাক্যালাপ জ্ঞান, জিনিসপত্র শৃঙ্খলার সঙ্গে রক্ষা, সন্তান পালন, অল্প অল্প সেলাই কার্য–এ সব বিষয়ে তার অল্প-বিস্তর জ্ঞান থাকা চাই। তা ছাড়া তার বুদ্ধির উন্মেষ, এটু চিন্তাশক্তি, ভালোমন্দ জ্ঞান। এ সবও থাকা চাই।
স্বামী যেমন পত্নীকে যত্ন করবেন, আদর করবেন, সম্মান করবেন, পত্নীরও কর্তব্য স্বামীকে সর্বপ্রকারে প্রেম করেন, স্বামীতে বাধ্য থাকেন, তার অন্তরের ভিতর প্রবেশ করেন। তার কীসে সুখ হয়, সে কথা বলবার পূর্বেই অনুভব করে কাজ করেন। স্বামী যদি নিতান্তই ইতর, দুর্বৃত্ত, নরপিশাচ এবং শয়তান হয়, তবে তাকে নারী যদি ত্যাগ করেন, দোষ দেওয়া যায় না।
.
আদর্শ পরিবার
২য় বন্ধু কহিলেন বন্ধু! যে পরিবার সত্যবর্জিত, সে পরিবার অশান্তির কেন্দ্র। পরিবারের লোকেরা যদি সব সময় সত্যভাবে চলবার আকাঙ্ক্ষা না রাখে, পরস্পরে মিথ্যা ব্যবহার করে, একজন আর এক জনের সঙ্গে নিষ্ঠুরাচরণ করে, কারো সঙ্গে কারো প্রেম নেই, কারো প্রতি কারোর সহানুভূতি নেই, সে পরিবার অশান্তির আকর। একজন আর একজনকে ক্ষমা করতে হবে, পরস্পরে একটা সুগভীর প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ থাকবে, যে কর্তা হবে সে পরিবারের সবাইকে ভালোবাসবে। প্রেমের যে শাসন, সেইটিই উত্তম। অহরহ কলহ বিবাদ, নিষ্ঠুর ব্যবহার এসব সত্যবর্জিত পরিবারের লক্ষণ।
১ম–সত্যবর্জিত অর্থ কী?
২য়–মানুষের জীবন যান সত্যকে লক্ষ্য করে চলে না তখন তার লক্ষ্য সত্য জীবন নয়, তখন কোনো ধর্ম-কর্ম তাকে ইহজীবন এবং পরজগতের দুঃখ হতে রক্ষা করতে পারে না। তাদের জীবন কেবল বিড়ম্বনাময়, দুঃখ ও অশান্তিতে পূর্ণ। পরিবারে অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হওয়া বড়ই অন্যায় এবং আপত্তিজনক। কোনো পরিবারে অভাবের দরুন অশান্তি হয়, পরস্পরে ভাইতে ভাইতে, পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য উপস্থিত হয়। অভাবের জন্য একে অন্যের পেছনে কথা না বলে সকলে মিলে একসঙ্গে কী করা কর্তব্য এ বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করাই ভালো। পরিবারে Despotic Rule মোটেই ভালো নয়। Tyrant Father of Tyrant eldest brother যারা পরিবারে কনিষ্ঠদেরকে একেবারে নির্মলভাবে চেপে রাখতে চান, কারো ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করতে চান না, পুত্রের সঙ্গেও সন্ধি করে চলতে হবে। এটিই খোদার অভিপ্রেত এবং ভদ্রতা। যে পরিবারে সগ্রন্থ পাঠ, মহাপুরুষদের জীবনী, কোরান-হাদীসের আলোচনা হয় না, সে পরিবারের মঙ্গল এবং উন্নতি হয় না, চিত্ত তাদের মার্জিত হয় না, শুধু নামাজে না বুঝে খোদার কালাম আবৃত্তি করলে আধ্যাত্মিক কোনো মঙ্গল হয় না, মনের কপাট খোলে না, আল্লাহর বাক্যের কোনো সার্থকতা হয় না। তারা যেমন আছে চিরকালই তেমন থাকে। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য তারা বুঝে হাদীস শরীফ পাঠ করে, নইলে মুসলমান পরিবারের বিনাশ অনিবার্য। পবিত্র হাদীস শরীফে মানুষের সর্বপ্রকার মঙ্গলের কথা লেখা আছে। মানবাত্মার উন্নতিতেই মনুষ্য শক্তি, শান্তি, ধন, কল্যাণ লাভ করে। তা অর্জন করবার কোনো কঠিন আদেশ কেন দেওয়া হয় না, তা জনি নে। না বুঝে চিরকাল নামাজ পড়লে মানুষের আত্মোন্নতি কী করে হবে? আত্মা নিত্য নূতন বল সংগ্রহ করবে, এজন্য পরিবারে হাদীস কোরানের আলোচনা হওয়া নিতান্ত দরকার। এটা ফরজ করতে হবে। এ না করলে মুসলমান পরিবারের কোনো কল্যাণ নাই নাই নাই। দেখ মোনাজাতটা পর্যন্ত না বুঝে সম্পন্ন হয়। পাপী আল্লাহর কাছে ক্রন্দন নিবেদন (মোনাজাতটা) পর্যন্ত না বুঝে করা হয়। কী ভয়ানক কথা! মুসলমান সমাজে কোনো সত্যনিষ্ঠ সাধক, মহাপ্রেমিক, মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করবার কোনো পথ নেই, যেহেতু আল্লাহ্ সমস্ত বাক্য-তার রসূলের লোহার সিন্দুকে আঁটা। তা পড়বার (বুঝে পড়বার), ভাববার, নিজস্ব করবার, চিন্তা করবার কোনো দরকার নইে। কী ভয়ানক, কী সর্বনাশের কথা! যে পবিত্র জ্ঞানভাণ্ডার আমাদেরকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে জীবনশক্তি, রস, চিন্তা, চরিত্রবল দেবে তারই কোনো আলোচনা নাই–কেবল আবৃত্তি, কেবল প্রাণহীন আবৃত্তি। আমাদের বিনাশের জন্য চরম দুঃখ অপেক্ষা করছে।
এই সময় মগরেবের নামাজ পড়িবার সময় হইল, দুই বন্ধু ওজু করিয়া নামাজ পড়িতে গেলেন। ১ম বন্ধু এমামতি করিলেন। ফরজ তিন রাকাত পর দ্বিতীয় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু যদি; আমরা আন্তরিকতার সহিত বুঝে শুধু ফরজ নামাজ পড়ি, তাই যথেষ্ট হয়। নামাজের সংখাধিক্যে খোদাকে পাওয়া যাবে না, অনুভূতি এবং প্রভুকে চিত্তে ধারণ করাই পরম কথা। প্রেম ও সত্যই তার প্রকাশ। তার বন্দনার অর্থ সত্যময় হওয়া–প্রেমিক হওয়া।
১ম–বন্ধু সুন্নত শেষ করিয়া কহিলেন–ভাই, বন্ধু হলেও তোমার কাছে আমি মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়। এক্ষণে আমি ইচ্ছা করি তুমি মাতৃভাষায় মোনাজাত কর, যাতে আমার মনে ধর্মভাব জাগে। মোনাজাত শেষ হলে আমার আত্মা যেন আল্লাহর পথে একটু অগ্রসর হয়, যেন একটু উন্নত হয়।
২য়–বন্ধু হাত উঠাইয়া প্রার্থনা করিলেন–”প্রভু! তুমি ইহজগৎ এবং পরজগতে আমার মঙ্গল বিধান কর। তোমার শাস্তি হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর। আমাদের পাপ তুমি ক্ষমা কর। মিথ্যার উপর আমাদিগকে জয়যুক্ত কর। হে প্রভু, তাহাতেই যেন আমরা গৌরব করি। পার্থিব প্রভাব, বল, সম্পদ এবং অর্থে আমরা গৌরব না করি। হে প্রভু আমাদিগকে কাফের করিও না-যেহেতু তাহারা মিথ্যা ও পার্থিব বিষয়ে গৌরব করে। হে নাথ, আমাদের পাপ তুমি হরণ কর, যেন আমাদের রসনা অপবিত্র না হয়। যেন আবৃত্তি করিয়া আমাদের কর্তব্য শেষ না করি, যেন তোমাতে আমরা পরিপূর্ণ হই। আমাদিগকে সর্বপ্রকারে নির্মল এবং শুদ্ধ কর, যেহেতু অপবিত্র আত্মায় তোমার আসন হইবে না। দয়াময়, আমাদিগকে শয়তান হইতে রক্ষা কর–তাহা মিথ্যা, ক্রোধ এবং অবিনয়। আমাদিগকে মানুষ কর, তুমি আপন হাতে আমাদিগকে জাগাও। যেন সর্বত্র তোমাকে প্রচার করি। সমস্ত মনুষ্য হৃদয়ে তুমি তোমার রাজ্য বিস্তার কর। সমস্ত মানবচিত্তে তোমার আসন প্রতিষ্ঠিত হউক, যেন তোমারই জন্যে বাচিয়া থাকি, যেন সর্বত্র তোমাকে প্রচার। করি। মনুষ্যের সহিত ব্যবহারে আমরা যেন কাহাকেও বিঘ্ন না দেই, যেন সকলকে প্রেম করি, যেন প্রতিশোধ না লই। যেন শত্রুকেও প্রেম করি, আঘাত যদি করি, যেন তোমারই জন্যে করি। হে প্রভু, আমাদের জিহ্বা তুমি সংযত কর যেন মিথ্যা কথা আমরা না বলি। যেন সমস্ত কার্যেই, সমস্ত বাক্যেই তুমি থাক। আমাদিগকে দিন দিন মহৎ হইতে মহত্তর কর। যেন কাহারও উপর অত্যাচার না করি, যেন মনুষ্য দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অভিশাপ না দেয়। হে প্রভু অন্নহীনকে অন্ন দাও, শয়তানপ্রাপ্তকে উদ্ধার কর। যেন মর্ত্যে তোমার দূত হইতে পারি এবং স্বর্গে তোমার সহিত বাস করি।–হে নাথ, যেন জগতের জন্য আত্মা বিক্রয় না করি। আত্মাকে হারাইয়া জগৎ লাভ করিয়া কী লাভ? আমাদিগকে পশু পরিও না। আমরা যেন কখনও ধার্মিকতার বড়াই না করি, যেন পুবৃত্ত ও নরপিশাচের মঙ্গল কামনা করি। যাহারা আমাদিগকে আঘাত করে, তাহাদিগকে যেন ভালোবাসি। আমাদিগকে সহিষ্ণুতা দান কর। যেন আত্মা হইতে প্রার্থনা করি, যেন প্রতিবেশীকে ভালোবাসি যেন কাহারও প্রতি রূঢ় বাক্য প্রয়োগ না করি, পাপের উপর আমাদিগকে জয়যুক্ত কর।
হে প্রভু, সমস্ত মুসলমান জাতিকে তুমি আশীর্বাদ কর–যেন সত্য করিয়া তাহারা তোমার পরিচয় লাভ করে, দয়াময়, মুসলমান জাতিকে তুমি উদ্ধার কর, তোমার শুভ ইচ্ছা ব্যতীত কখনও তাহারা উদ্ধার লাভ করিবে না। তাহাদিগকে অধর্মাচরণ হইতে রক্ষা কর। প্রভু, মনুষ্য সমাজ হইতে প্রেম কি তুমি তুলিয়া লইয়াছ? যেন বিনয়ে, জ্ঞানে, মনুষ্যত্বে আমরা পরস্পরে প্রতিযোগিতা করি। যেন দীন-দুঃখীদিগকে ভালবাসি। যেন ধন, ক্ষমতা ও শক্তির গর্বে অন্ধ না হই। আমীন”–
অতঃপর দোয়া কুনুত পাঠ করিলেন–”হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি ও তোমারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমাকেই বিশ্বাস করি ও তোমারই ভরসা করি এবং তোমারই নিকট মঙ্গল চাই। আমরা তোমারই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা অকৃতজ্ঞ নহি, যাহারা তোমার অবাধ্য তাহাদের সঙ্গ ত্যাগ করি ও তাহাদের নিকট হইতে দূরে থাকি। হে আল্লাহ, আমরা তোমারই বন্দেগী করি ও তোমারই উপাসনা করি এবং তোমাকেই সেজদা করি। তোমারই আরাধনার জন্য একান্ত চেষ্টা করি এবং তোমারই দয়ার। প্রার্থী হই। তোমার শাস্তিকে ভয় করি; নিশ্চয় তোমার শাস্তি কাফেরদের জন্য নির্দিষ্ট আছে।”
অতঃপর আয়তুল কুরসি পাঠ করিলেন,–”আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য নাই। তিনি নিত্য ও জীবন্ত, তাঁহাকে তন্দ্রা বা নিদ্রায় আকর্ষণ করে না। ভূলোক এবং দ্যুলোকে যাহা কিছু আছে, তাহা তাঁহার জন্য। কোনো ব্যক্তি তদীয় বিনানুমতিতে তাহার মুক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করিতে পারে? তাহার ইচ্ছা ব্যতীত মানব তদীয় অনন্ত জ্ঞানের কণামাত্র বুঝিতে পারে না। তাহার সিংহাসন আকাশ হইতে পৃথিবী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে, সুতরাং উহার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত হইতে হয় না, কারণ তিনি মহান ও উচ্চ।”
১ম বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন-দোয়া কুনুতে পাপীদেরকে পরিহার করে চলবার জন্য খোদা তাঁর ভক্তগণকে শিক্ষা দিচ্ছেন।
২য়–খোদার যদি তা-ই উদ্দেশ্য হবে, তা হলে পৃথিবীতে তাঁর পবিত্র বাক্যসমূহ এবং এত পয়গম্বর পাঠাতেন না। কাফের দুরাত্মাদেরকে ভাগ করলে আল্লাহর ধর্ম প্রচার হবে কীরূপে? তাদের কুকার্যের সহায়তা করা, তাদের সঙ্গ উপভোগ করা সাধুদের কার্য নয়। উপাসনাকালে বাড়ির ছেলেরা যদি নিকটে আসে, তবে দাঁত সিটকে তাড়িয়ে দিতে নেই। মনুষ্য জানে না উপাসনা কাকে বলে।
১ম–শুক্রবারের দিন উপাসনাকালে গরীব লোকের ছেলেরা মসজিদের সমানে এসে। খাড়া হয়। তারা একটু টু-শব্দ করলে, নামাজীরা ”শুয়রের বাচ্চা–দূর হও” বলে গালি দেয়।
২য় বন্ধু আবার কহিলেন–মনুষ্য জানে না উপাসনা কাকে বলে–আল্লাহ্ কী চান? তিনি উপাসনা অপেক্ষা প্রেম অধিক ভালোবাসেন।
১ম–হাঁ, তাই।
২য়–পরিবারের কোনো কোনো লোক অনুযোগ করে বলে থাকেন—”অমুক আমাকে একখণ্ড কাপড় কোনোদিন কিনে দেয় নাই, একটু মিছরী কোনোদিন খেতে দেয় নাই, আমি ব্যধিতে পড়লে কেউ জিজ্ঞাসা করল না” কখনও অভিযোগ করবে না। প্রেম চিরকালই মৌন এবং ত্যাগই তার স্বভাব। যে তোমাকে প্রেম করছে, সেও ভালো, যে করে নাই সেও ভালো।
বুড়ারা অনেক সময় তাদের যৌবনকালের কথা ভুলে গিয়ে যুবকদের জীবনের প্রতি কিছুমাত্র সহানুভূতি পোষণ করেন না। যুবকের চালচলন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাব-ভাব তারা দুই চোখে দেখতে পারেন না-এটা বড়ই অন্যায়।
বংশের কোনো কোনো লোক আপনজনকে ত্যাগ করে, অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে–এটা বড়ই ভুল আপনজন যতই দুর্বৃত্ত হোক, আসন্ন বিপদে বেদনার চীৎকারে আপনজন ছাড়া কেউ অগ্রসর হতে পারে না। এ কথা সকলেরই মনে রাখা উচিত। মানব সমাজের চির-চলিত বিধান এই। আপনজন যদি আপনজনের প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ করে, তা বড়ই অধর্ম।
১ম–আপনজন যদি অত্যাচারী, নিষ্ঠুর ও কটুভাষী হয়–তা হলে তার উপর কি মন বিরূপ হয় না?
২য়–তা হয়। কাউকে ভালোবাসি বলে যে তাকে নিরন্তর আঘাত করা হবে, তাও ঠিক নয়। বস্তুত নিষ্ঠুরাচরণ, কটু কথা, এসব বড়ই আপত্তিজনক। এরূপ হলে ভালোবাসার ভার কেউ বহন করতে চায় না।
১ম–তুমি কি বলছিলে–”প্রেম চিরকালই মৌন, ত্যাগই তার স্বভাব”। কতকগুলি হৃদয়হীন মানুষ যদি একজন ত্যাগী ও প্রেমিক বলে তার উপর অত্যাচার করে, তা হলে কেমন হবে। একটা লোক ভালো বলে তাকে চিরদিনই মাংসের পরিবর্তে অস্থি দেওয়া; আর বলা–”তুমি বড় ভালো লোক-অস্থি খেতে তোমার আপত্তি নেই, আমরা মাংস খাই”–কী রকম ব্যাপার হয়?
২য়–সংসারে যে এমনটি হয় না, তা নয়। একজনকে চূর্ণ করে নিজে সুবিধে করে নেওয়া অবোধের কাজ। কিন্তু বাস্তবিক প্রেমিক যিনি, তিনি এমনিভাবে চূর্ণ হবেন। মহত্ত্বের এই-ই ভাব। তবে তার প্রতি সবার কর্তব্য কী তাও বলা দরকার। কারো প্রতি নিষ্ঠুর হওয়া ঠিক নয়। যে ত্যাগ স্বীকার করে, তার প্রতি একেবারে মমতাশূন্য হওয়া মানুষের কাজ। নয়। পরস্পরকে অনুভব করা, একজন আর একজনের কষ্ট বোঝাই মনুষ্যত্ব। কার্যে বাক্যে, ব্যবহারে একজন আর একজনের প্রতি মমতা দেখানো আবশ্যক। ছেলে বন্ধু মায়ের সুখ দুঃখের প্রতি নজর রাখবেন, পত্নী স্বামীকে সুখী করতে চেষ্টা করবেন। একজন আর একজনের দোষ-ক্রটি যথাসাধ্য ক্ষমা করবেন। স্বামী পত্নীকে শুধু নারীজীবনের কর্তব্য দেখিয়েই তার প্রেমের পরিচয় দেবেন না–তাকে আপন শক্তিমতো ভালোবাসার উপহার দেবেন। আশ্রিত ছোট প্রিয়জনদেরকে কাপড়-চোপড় কিনে দেবেন, যদি শক্তিতে না কুলায় দেবেন না বা অল্পসল্প দেবেন–তাতে কেউ কিছু মনে করবে না। স্বামীর উপহার পেয়ে। পত্নী কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করবেন না বরং খুবই আনন্দ প্রকাশ করবেন। অনবরত নিজের এবং ছেলেদের অভিযোগ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করবেন না।
১ম–কোনো কোনো পরিবারে বৌকে কোনো উপহার দিলে রাগ করে।
২য়–আমি তো পূর্বে বলেছি বধূর সুখ-সুবিধা আনন্দ-স্বচ্ছন্দ্যের প্রতি হিংসা পোষণ করা কোনো কোনো পরিবারে স্বভাব। বিয়ের পরই ছেলেদেরকে বাজে লোক মনে করা অন্যায়, এ ভদ্রলোকদের কাজ নয়। পরিবারের প্রত্যেকে যদি নিজের স্বার্থটা বেশি বোঝেন, সে পরিবারে কখনও শান্তি হয় না। একজনের জামা ছিঁড়ে গিয়েছে, যার আছে সেটাই আপাতত নিয়ে কাজ চালান যেতে পারে, কাপড় নষ্ট হবে বলে স্বার্থপরের মতো বাক্সবন্দী করে রাখা ঠিক নয়। একজনের ধুতিটা ময়লা হয়েছে, কোথাও যেতে হবে, যার ধোয়া ধুতি আছে, বের করে দাও–কোনো নীচতার পরিচয় দিও না। ছাতা সেরে রাখা ভালো নয়। বাড়ির কোনো বৌ কোথাও যাবে, অন্য বৌয়ের গহনা সে পরে যাক, তাতে সকলেরই আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। উদারতা, সহানুভূতি, পরকে সুখী করবার ইচ্ছা এগুলো পরিবারকে স্বর্গীয়ভাবে পুষ্ট করে তোলে। কারো দ্বারা যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তা নিয়ে কচকচি করা বা অসন্তোষ প্রকাশ করাও ঠিক নয়।
বিশ্বাসে বিশ্বাস বাড়ে, প্রেমে প্রেম বাড়ে। তুমি যদি আমাকে বিশ্বস না কর আমিও তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই নে। তুমি যদি আমাকে একটুখানি প্রেম কর, আমি তার পরিবর্তে দ্বিগুণ প্রেম করি, পরিবারে একজন আর একজনকে বিশ্বাস এবং প্রেম করবে।
পত্নীকে স্বামী কোনো সময়ে মুখোমুখি হয়ে বলবে না–তুমি সত্য হও, স্বামীভক্ত হও, আমাকে প্রেম কর। পরী যেন কখনও বুঝতে না পারে স্বামী তার স্বভাব-চরিত্র লক্ষ করেছেন, স্বামী তাকে ঘৃণা করেন। প্রেম প্রদর্শনের ব্যাপারে মানুষ কখনও ইচ্ছা করে না, কেউ তার উপর গুরুগিরি করে, কেউ তাকে প্রেম করতে শিক্ষা দেয়। মানুষকে সোজা কিছু বলে প্রকারান্তরে শিক্ষা দেওয়া ভালো। শিশুর জন্য সোজা উপদেশ ভালো। একটু বয়স বেশি হলে তাকে প্রকারান্তরে শিক্ষা দেওয়া ঠিক। এমনকি নারীচরিত্র গঠনের বই সম্ভব হলে নিজে না কিনে অপরের হস্ত দিয়ে উপহার দেওয়াই ভালো। কোনো উপদেশ দিতে যেও না, বরং ভালোবাস।
১ম–যে নারীর মোটেই ভালো হবার ইচ্ছে নেই, মন যার পাষাণ অথবা ভাবহীন। জড়পদার্থ, তাকে কী করে নিজের মতো করে নেওয়া যায়?
২য়তা করা যায় না। নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম কী? তা আমি পূর্বেই বলেছি, সে কথা সকল নারীরই মনে রাখা উচিত।
১ম–দোষ ধরা প্রবৃত্তিটি কেমন?
২য়–এটি বড়ই খারাপ। অনবরত দোষ ধরলে, কাজের সমালোচনা করলে, মানুষের বুদ্ধি থাকলেও তার লোপ হয়। কোনো কোনো পরিবারে এরূপ লোকের অভাব নেই। ছেলেদের সামান্য ত্রুটিতে গালি দেওয়া, মারতে ওঠা, বৌকে উঠতে বসতে কথার খোঁচা মারা বড়ই খারাপ।
বউয়ের কর্তব্য তারা যেন সর্বদা লক্ষ রাখেন, যে ভুল একবার হয়েছে তা যেন পুনরায়
হয়। মানুষ যদি আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের দোষ-ত্রুটি, ভুল সংশোধন করতে চেষ্টা করে, তা হলে নিশ্চয় তাতে সফল হওয়া যায়। যে সমস্ত নারী আত্মমর্যাদাজ্ঞাসম্পন্ন, তারা। নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে সতর্ক হন। কেউ মুখে বলুক আর নাই বলুক, কোনরকমে নিজের বুঝতে পারলেই সতর্ক হতে হবে। অনবরত একটি ভুল করতে থাকলে পরিবারস্থ সকলে যারপরনাই দুঃখিত ও বিরক্ত হন।
১ম–যদি কেউ এমন হয়, কিছুতেই নিজের দোষ-ত্রুটি বুঝতে পারে না, পুনঃপুনঃ একটি ভুল করে?
২য়–তা হলে তাকে ক্ষমা করতে হবে। ভুল মানুষ করতে পারে। কিন্তু তার জন্যে অনুতাপ প্রকাশ করলে আর কোনো দোষ থাকে না। বিনয়ী হবার এবং দুঃখ প্রকাশ করবার অধিকার মূখেরও আছে। বস্তুত মানব চরিত্রের এই দুইটিই শ্রেষ্ঠ ভূষণ। খোদা দাম্ভিক সাধুকে ক্ষমা করবেন না, কিন্তু বিনয়ী পাপীকে ক্ষমা করবেন। নারী বিদূষীশ্রেষ্ঠা এবং শক্তিবতী হলেও প্রেম আকর্ষণের এই দুইটিই উত্তম অস্ত্র। মনুষ্য বিনয়কে প্রেম করে চুম্বন। করে, মাথায় এবং হৃদয়ে রাখে–ক্রোধ এবং হঠকারিতা দেখলে ভয়ে পালিয়ে যায়। প্রেম। জিনিসটা আত্মা হতে আসে, এর উপর জবরদস্তি চলে না।
.
গৃহস্থালী
২য় বন্ধু বলিলেন–বন্ধু, মেয়েদের হাতে সুচ সূতা থাকবেই। যে জামাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাতে সুঁই দিয়ে মেরামত করলে, আরও ছয় মাস চলবে। মাসে মাসে নূতন জামা, কাপড়, জুতো পরলেই যে পরিবারে মর্যদা দ্রুতবেগে বাড়তে থাকে এরূপ মনে করা বড়ই ভুল। বাড়িতে রিপু করা ছেঁড়া জামা পরলে, তাতে কোনো দোষ হয় না। লোকে যদি গরিব মনে করে করুক। কোন পরিবার মর্যাদাসম্পন্ন তা লোকের বুঝতে বাকি থাকে না। নিত্য জামা কাপড় পরলেই কি, না পরলেই কি! যে বিছানার চাঁদরটি এক জায়গায় একটুখানি ছেঁড়া মতো হয়েছে, বিলম্ব না করে তখনই তাকে সেলাই করে ফেলা উচিত। বধূর একটুখানি মনোযোগ, একটুখানি সতর্কতায় পরিবারের বহু কল্যাণ হয়। স্বামীর অল্পেই স্বচ্ছলতা আসে। বধূ যদি অমনোযোগী হন, স্বামী বা পরিবারের সুখ-দুঃখে অভাব-অনটনে কিছুমাত্র সহানুভূতি না থাকে, তবে তা বড়ই দোষের কথা। অতিথির মতো পরের বাড়িতে আসা, নিজের সুখ ও ভোগটুকু নিয়ে ব্যস্ত থাকা, এরূপ ব্যবহার ভালো নয়।
পরিবারে যদি অনেক মানুষ থাকে, তবে কাজ নিয়ে কখনও ঠেলাঠেলি করা ভালো নয়। যার শরীরে শক্তি আসে, সে কাজ করুক, যে শুয়ে থাকে, সে থাকুক। কখনও ঝগড়া ঝটি ভালো নয়।
১ম–গৃহস্থালীর মূল উদ্দেশ্য কী? গৃহস্থালী শব্দটির অর্থ কী? আমায় বুঝিয়ে বল।
২য়–গৃহস্থালীর অর্থ এমন কতকগুলি আয়োজন যার ফলে কতকগুলি লোক এক জায়গায় বাস করে জাগতিক এবং শরীরের সমস্ত অভাব পূরণ করতে পারে। পার্থিব অভাব সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তারা খোদার কাজ করতে পারে–মানব সমাজের মঙ্গল চেষ্টা করতে সমর্থ হয়।
১ম–এই অভাব পূরণের কাজ কী? কী উপায়ে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে? আমার মনে হয় উচ্চ কোনো মানুষ গৃহস্থালী করে না।
২য়–মানুষের মন এত অবনত হয়ে পড়েছে–তাহাদের চিন্তা এত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, মানুষ খাবার জন্যেই বেঁচে থাকে, চিন্তা করে, চেষ্টা করে, লেখাপড়া শেখে, সংগ্রাম করে। মানুষের সমস্ত শক্তি শুধু পেটের জন্যে ব্যয়িত হচ্ছে। মানুষের জীবনের যে একটা বড় উদ্দেশ্য আছে, তা কেউ কল্পনা করে না। মানুষ যে উপাসনা করে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে, তছবীহ্ টেপে কেবল অন্ন ও অর্থের মৃদু মধুর ঝুনু ঝুনু শব্দ শোনবার জন্যে। কোনো জাতি বিনষ্ট হবার পূর্ব লক্ষণ হচ্ছে এই। পেটের জন্যে মানুষ যে কেন এত ভাবিত ও আকুল হয়, তা বোঝা যায় না। যে পরিবার শুধু পেটের জন্য ব্যস্ত, মানুষ্যত্ব ও সত্যার্জিত, জাগতিক গৌরবের জন্য লালায়িত, জীবনের উচ্চতর সার্থকতার কোনো ধার ধারে না, সে নিকৃষ্ট পরিবার। সে পরিবারকে কতকগুলি পশুর আড্ডা বললে কোনোই দোষ হয় না।
১ম–জীবন সংগ্রাম কি খুব কঠিন হয়ে ওঠে নি?
২য়–এক রত্তি নয়। মনুষ্য যখন ধর্মহীন হয়, পতিত হয়, তখনই সে চতুর্দিক অন্ধকার দেখে, রাতদিন পেটের কথাই চিন্তা করে। সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে বহু মানুষ ইচ্ছা। করে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করে। সম্মান জিনিসটা কী? যে সম্মান মনুষ্যত্ব ও সত্যবর্জিত সে সম্মান সম্মান নয়। মানুষ জানে না, সম্মান কী? পেটের জন্যে যদি মানুষকে এত চিন্তা করতে হয়, তা হলে খোদা মিথ্যা, তার ধর্ম মিথ্যা। মানুষ ইচ্ছা করে নিজেদের দুঃখ বাড়ায়। খোদাকে ভুলেই মানুষের এই দুর্দশা। কী হবে রেশমী কাপড়ে, সাততলা দালানে, গহনায়, দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদায়, মেয়ের ভালো বিয়েতে-যদি মিথ্যা, হীনতা, নীচতা, চৌর্যবৃত্তি আশ্রয় করে এইসব দূর করতে হয়। কতকগুলি লোকের একটা সর্বনাশা ধারণা হয়েছে–”আমলের দরকার নেই, শুধু নামাজ-রোজার কেতা বজায় রাখলেই খোদার পাওনাটুকু শোধ দেওয়া গেল, ধর্মজীবনের কর্তব্যগুলি পরিসমাপ্ত হল। এই অতি ভয়ানক ভুল চিন্তাধারায় সমাজের প্রভূত অনিষ্ট হবে। মানুষ ধর্ম, সত্য ও মনুষ্যত্ব বিসর্জিত হয়ে অতি শোচনীয় দুর্গতির ভারে বিনষ্ট হবেই।
২য়–আমাদের তথাকথিত ভদ্রলোক হবার দরকার নেই। বাবু হবার কোনো দরকার নেই। আজ সবার লক্ষ্য চাকরি। একটা intellect-এর prostitution ছাড়া আর কিছু নয়। জ্ঞান লাভ করতেই হবে সেটা কি চাকরির জন্যে? মানুষের কী হীন চিন্তা, সমস্ত সমাজটার কী শোচনীয় angle মতো vision। মর্যাদাজ্ঞান এদের একটুও নেই। লেখাপড়া শিখে কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, ব্যবসায় এসব করলে কী ক্ষতি? না, না, সবাইকে ‘বাবু’ হতে হবে! আর ব্যবসায় করলেও বাবুদের পাঁচ হাজার টাকা মূলধন চাই!-নইলে ব্যবসা কী করে করা যায়! ছোট লোকের মতো কেন চাউলের বস্তা পিঠে করে এক জায়গায় নিলে কী ক্ষতি? চৌর্যবৃত্তি অপেক্ষা সেটা সম্মানজনক। সাদা কাপড়পরা চোর নামাজী অপেক্ষা একজন মজুর, মিস্ত্রী, কর্মকার, দরজি, তেলি বা জোলা ভালো। ভদ্রলোক হবার যে উৎকট নেশা দেশের লোকের মনের মাঝে চেগিয়ে উঠেছে, সেই জন্যেই জীবনসংগ্রাম এত কঠিন হয়ে পড়েছে। উকিল বাবুর তোষামোদকারী মিথ্যাবাদী মহুরী হওয়ার চাইতে, একটা জুয়াচোর জমিদারি সেরেস্তায় নায়েব হওয়ার চাইতে, একটা দুর্বৃত্ত রাজকর্মচারি হওয়ার চাইতে, একটা সুদখোর চেয়ারে বসা বাবু হওয়ার চাইতে, বাজারে দাড়ি পাল্লা ধরে চাউল বিক্রয় করতে বসা ভালো, জুতা মেরামত করা ভালো, নাপিত হওয়া ভালো, দপ্তরী, কুমোর, কামার, দরজী হওয়া ভালো। যারা তথাকথিত ছোট কাজ করে তাদের পয়সার অভাব নেই। পয়সার অভাব হয় চোর ভদ্রলোক বাবুদের। তাদের ধর্মজীবন একটা ভণ্ডামি পোশাক-পরিচ্ছদে বেশ্যাদের আড়ম্বরের মতো। লেখাপড়া শিখে মানুষ অপবিত্র মিথ্যা জীবন যাপন করবার জন্যে যে এত লালায়িত কেমন করে হয়, তা বুঝি নে!
১ম–যারা এই সমস্ত ছোট কাজ করে, তারা বড় নীচ।
২য়–সে দোষ কাজের নয়, সে দোষ শিক্ষার। শিক্ষা নাই বলেই তারা মিথ্যাবাদী। এবং নীচ। কাজের কোনো দোষ নেই।
১ম–চাকরি জিনিসটা কি একেবারেই খারাপ?
২য়–জীবিকার জন্য চাকরি না করাই ভালো।
১ম–কী করতে হবে?
২য়–কৃষক হও, মজুর হও।
১ম–ভদ্রলোকেরা কি তা পারে?
২য়–মানুষের আদি পিতার জীবন মজুরের। তার ছিল দুখানি হাত, এই মাটি, আর একটি সুখ-দুঃখের বন্ধু। মানুষের জন্য এই-ই যথেষ্ট মূলধন। হালকর্ষণ এবং মজুরের জীবন মানুষের প্রথম ও সত্যরূপ। এ দুটিকে কখনও অশ্রদ্ধা করতে নেই। অন্য কাজ করা যে দোষের তা বলছি তা বলছি নে। আমি বলি, এ দুটি মানুষের নিজস্ব ব্যবসায়কে অস্বীকার করে কেন সে দুঃখ ডেকে আনে? তুমি বলছ, ভদ্রলোকে এসব কঠিন কাজ পারে না। ঠিক বলেছ। ভদ্রলোক যে, তাকে কানমলা খেয়ে বিনয়ের নামে চুপ করে থাকতে হয়। তার ভাগ্নিকে মানুষ যখন গলা ধাক্কা দেয়, তখন তাকে মৌন হয়ে থাকতে হয়। তাকে যখন মানুষে লাথি মারে, তখন তাকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানুষ মাংস খেয়ে যখন অস্থি ফেলে দেয় তাতেই তৃপ্ত থাকা ভদ্রলোকের কাজ। তিনি ননীর পুতুল, এমন কি আত্মরক্ষার ক্ষমতা নেই, গায়ে মাংস নেই, অর্ধ মণ জিনিস হাতে করলে হাঁপিয়ে পড়েন। একটু রৌদ্রে বেরোলে মোমের মতো গলে যান। মাটিতে পা লাগলে পা ফেটে রক্ত বের হয়! তিনি চাকর-নফর দিয়ে পা, গা টেপান, মিনিটে মিনিটে পান খান, সাত হাত হুঁকাতে তামাক সেবন করেন, খেলে কিছু হজম হয় না তবুও খান, কেউ ধাক্কা মারলে চিৎ হয়ে পড়েন, তার কাজ তোষামোদ, শঠতা, ধৈর্য এবং ফাঁকি-ভদ্রলোকের অনেক গুণ আছে! এই সব নবাবী ভদ্রতা ছেড়ে দিতে হবে। আজকালকার এই সব অনুভূতির যুগে ভদ্রলোক মানে কুকুর, ভীরু, কাপুরুষ, দুর্বল, শঠ, মিথ্যাবাদী, ভণ্ড ননীর পুতুল নয়–সে কর্মী, তেজস্বী, কখনও মজুর, কখনও মালিক, সে সত্যপ্রিয়, সাহসী, কৃষক, শিল্পী, মিস্ত্রী, সৈনিক, সেনাপতি। প্রত্যেক মানুষকে–সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নরপতি হয়, তাকে প্রথমে মজুর, হতে হবে, তাকে কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। কঠিন পরিশ্রম এবং Discipline তার মাংসপেশীকে সরল ও সুদৃঢ় করে তুলবে। পাশ্চাত্য জাতিরা আজ এই কথা বুঝেছে বলে তারা পৃথিবীকে শাসন করছে। মানুষ যেদিন মজুরকে ঘৃণা করবে, সেদিন সে জগতের গোলাম হবে, যেমন আমরা হয়েছি।
১ম বন্ধু–বুঝেছি। আমার মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েদেরকে বাল্যকাল হতেই এইভাবে শিক্ষা দিতে হবে।
২য়–হ্যাঁ, সমস্ত সাংসারিক কার্যে যত বড় লোকই তুমি হও না, ছেলে-মেয়েদিগকে লাগিয়ে দাও। খবরদার, একটু সঙ্কোচ করো না। পরিশ্রম ও কাজের ভার দিয়ে তাদেরকে লোহার মতো শক্ত করে তোল। বিশ বৎসরের পূর্বে কখনও ছেলেমেয়েদেরকে বিলাসজীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে দিও না। একবারে মোটা বস্ত্র, মোটা চাল, কঠিন শয্যা, সাংসারিক সমস্ত কার্যে তাদেরকে অভ্যস্ত করাও। কোনো লজ্জা করো না। যাদেরকে তোমরা লজ্জা করে থাক, তারা কাপুরুষ, দুর্বলহৃদয়; পরমুখাপেক্ষী, তাদের কোনো সম্মানজ্ঞান নাই, তাদের মনের স্বাধীনতা নাই।
এই সমস্ত কাজে ছেলেদেরকে কখনও নিষ্ঠুরের মতো অভ্যস্ত করাবে না। প্রেমে এবং নিজে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের মনুষ্যত্ব গঠন করে তুলবে। সংযম অভ্যাসে বেশী জবরদস্তি ভালো নয়, তাতে তাদের মনুষ্যত্ব অর্জনে অশ্রদ্ধাও হতে পারে রূঢ় আজ্ঞা, ভর্ৎসনা, Despotism যতটা কম হয়, ততই ভালো।
১ম–কি কি ধরনের কাজ ছেলেমেয়েদেরকে অভ্যস্ত করাতে হবে?
২য়–গো-সেবা, গাভী-দোহন, ঘর-দ্বার ঝট দেওয়া, রান্না, পানি তোলা, ধান বের করা, চাল প্রস্তুত করা, রৌদ্রে দেওয়া, উঠান নিকান, বাগানের কাজ, কাপড় ধোয়া, কাঠ চেলা করা, বাঁশ ফাড়া, বেড়া বাঁধা, গাছ লাগান, গৃহস্থালীর দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা, রোগীর সেবা ইত্যাদি।
১ম–সংসার চালানো সম্বন্ধে কিছু বল।
২য়–চাকুরের জীবন আদর্শ নয়। দেশের সকল মানুষই যে চাকরি করবে, তা হতে পারে না। যারা চাকুরী করে না তারা যে সম্মানের যোগ্য নয় এরূপ মনে করা বাতুলের। কাজ। কে একজন ডেপুটি বা দারোগা হলে যে স্বর্গে উঠেছেন, এরূপ মনে করাও বোকামি। একখানি ঘরের জন্য যেমন অনেকগুলি স্তম্ভ দরকার, তাদের কাজ বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আপন আপন কর্তব্য সম্পাদন করা–জাতির মানুষগুলিও তেমনি বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করবে। প্রত্যেক মানুষের, প্রত্যেক কাজের মূল্য এবং মর্যাদা আছে।
আমরা এখনও পতিত জাতি বলে চাকরির এত লোভ করি। এটা জাতি হিসাবে বিনষ্ট হবার কল্পনা। মানুষের মর্যাদা হয়-জ্ঞান, আত্মশক্তি এবং মানুষ্যত্বে। আর কিছুতেই নয়।
১ম–তা ঠিক।
২য়–জ্ঞান, আত্মার স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্বকে লক্ষ্য রেখে আমি বলি কৃষক হও, পল্লীর সামান্য দর্জি হও, জমি চাষ কর, বাগান তৈরি কর, তরকারির ক্ষেত কর। আমি বলি এই ই মানুষের আদর্শ এবং স্বাভাবিক জীবন। চাকরি জীবনের একটা অস্বাভাবিক অবস্থা।
১ম–তা ঠিক, কিন্তু পল্লীর যারা নিরীহ প্রকৃতির লোক তাদেরকে জব্দ করবার জন্যে সকল মানুষই প্রস্তুত। জমিদার, রাজকর্মচারী, গ্রামের মণ্ডল সবাই তাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে চায়। কেমন করে পল্লীর দরিদ্র গৃহস্থ হয়ে শান্তি লাভ করা যায়? ক্ষমতা চাই, দশজনকে বাধ্য রাখা চাই, টাকা চাই, মর্যাদা চাই, তা না হলে বাস করা যায় কী ভাবে? চাকুরেকে লোকে সম্মান করে, ভয় করে।
২য়–এই ভাবের মানসিকতা অনেকে পোষণ করেন। ফলে লোকে চাকুরী করে, অতি হীন পন্থায়, ঘুষ খেয়ে, চুরি করে বহু অর্থ সঞ্চয় করে। জমিদারি করে, ধরে, মেরে মানুষকে অপদস্থ করে প্রতাপ জাহির করে। জাতির জীবনে বহু পাপ রয়েছে, তাই সত্য জীবনের আদর্শ মানুষের প্রকাশ হচ্ছে না।
১ম–তা হলে কী করা যায়?
২য়–মিথ্যাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যেখানে সত্য, সেইখানে শক্তি। বড় মানুষ হবার দুরাশা, জীবনের পক্ষে দুঃখজনক। যারা সত্যের সেবক, ধর্ম জিনিসটাকে যারা সত্য করে অনুভব করতে শিখেছে–তারা মিলিত হও, পাপ ও মিথ্যার হুমকিতে ভয় পেলে চলবে না। খোদা আছেন, তার পতাকা যারা ধরেছে, তারা লাঞ্ছিত হবে না। অত্যাচারী বড় লোক তার সমস্ত প্রতাপ নিয়ে দুমড়ে পড়বে, মানুষের জুলুম আর চলবে না। সহজ সত্য জীবনের জয় হবেই।
১ম–যা বলছিলে তাই বলো কীভাবে সংসারে আয় হতে পারে? পরিবারে শান্তি সুখ বাড়ে।
২য়–সংসারে যা নিত্য প্রয়োজন, তার প্রায় সবগুলিই একটু কষ্ট স্বীকার করলে বাড়িতে তৈরী করে নেওয়া যায়। কেবল আলস্যবশত মানুষ নানাবিধ অভাবে জর্জারিত হয়। মাঠে যদি ধান হয়। তবে বাড়িতে তরকারি হবে না কেন? এ জিনিসটা কেনবার দরকার? দুটো বেগুনের গাছ লাগিয়ে রাখলে সারা বছর বেগুন ধরে, অথচ কুঁড়েমি করে প্রত্যেক হাটেই পয়সা নিয়ে তরকারিওয়ালার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে হয়। বেশ করে বেড়া দিয়ে নানাবিধ তরকারী গাছ, লঙ্কা, হলুদ, আদা, পেঁয়াজ এই সব লাগিয়ে দাও। বাড়ির চারধার দিয়ে মানকচু, ওল, কাঁচাকলা লাগাও। বাবু হয়ো না; নিজের যদি দরকার না হয়, তবে কাউকে দিলে তো তার উপকার হয়–খোদার দেওয়া হাত-পা; এবং গায়ের বলকে নিরর্থক করে দেওয়া বড়ই অন্যায়। বাড়ির চারধারে জায়গা থাকলে অসংখ্য গুবাক ও নারিকেল গাছ লাগিয়ে দেবে।
১ম–বাঁশের ঝাড়ে তো বেশ দুপয়সা আয় হয়?
২য়–হ্যাঁ, তবে বাড়ির কাছ বাঁশের ঝাড় ভালো নয়। যেখানে বেশী বাঁশের ঝাড়, সেখানে মানুষ বাঁচে না। দূরে কোনো স্থানে ২/১ ঝাড় বাঁশ থাকলে সংসারে অনেক সাহায্য হয়।
১ম–আর কী কী জিনিস তৈরি করা যায়?
২য়–আলু জিনিসটা বেশ ফলে। এর বীজ ২/১ সের লাগিয়ে দিলে ২০-২৫ গুণ ফলে। কফি তৈরি করলেও খাবার কাজ চলে এবং বিক্রি করে দুপয়সা লাভ হয়। এক একটা কফির দাম চার আনা-পাঁচ আনা। আষাঢ় মাসে গৃহস্থের বাড়ি গোয়াল ঘরের গোবরে অতিশয় বিশ্রী দৃশ্য হয়। এতে যেমন স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, মনেরও তেমনি অবনতি ঘটে। একটু দূরে কোনো স্থানে বৃত্তাকার গর্ত করে যদি গোবর, গো-মূত্রগুলি সেখানে জমা করে ঢেকে রাখা হয়, তা হলে সেগুলি ফসলের উৎকৃষ্ট সার হয়, বাড়ির সৌন্দর্যও নষ্ট হয় না। গরুগুলির স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
১ম–বাস্তবিক গরুর প্রতি বড়ই অন্যায় ব্যবহার করা হয়। তারা আষাঢ় মাসে বড়ই কষ্টে থাকে।
২য়–অনেক লোক এমন নিষ্ঠুর আছে, যারা গুরুর কল্যাণে বেঁচে থাকে, কিন্তু তাদেরকে পেট ভরে খেতে দেয় না। থাকবার জায়গা দেয় না, থাকবার জায়গা অতিশয় নোংরা করে রাখে। প্রত্যেক ভদ্রলোকের কর্তব্য গরুকে ভালো খেতে দেওয়া এবং ভালো জায়গায় তাদেরকে রাখা।
১ম–গরুর জন্য কী খাদ্য ভালো?
২য়–খড় এবং খইল গরুর জন্য উৎকৃষ্ট খাদ্য। অনেকে গরুর খাদ্যের জন্য যা দুটি পয়সা খরচ করেন, তা বাজে এবং অতিরিক্ত খরচ মনে করেন। এটা বড়ই ভুল। যে পরিবারে গরুগুলি দেখতে সুশ্রী এবং তাজা-মোটা তাদের অবস্থাও ভালো হয়। যারা দুর্বল শক্তিহীন রোগজীর্ণ গরু দিয়ে কাজ করে, তাদের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মানুষের জন্য যেমন পুষ্টিকর খাদ্য আবশ্যক গরুর জন্যে ঠিক তেমনি ভালো খাবার দরকার। গরুর অযত্ন বড়ই খারাপ, এতে পরিবারে বিলক্ষণ অকল্যাণ হয়।
আর একটি কথা বলে আজকার মতো কথা শেষ করবো, তার পর চলো নামাজ পড়তে যাই।
অনেক পরিবারে বাড়ির কর্তা মারা গেলে মেয়েদের দুঃখের অবধি থাকে না। পুরুষ মানুষ বিহনেও মেয়েরা অন্তঃপুরে থেকেই নাবালক ছেলেরা বড় হওয়া পর্যন্ত কায়ক্লেশে চালিয়ে নিতে পারেন-এমন কতকগুলি বন্দোবস্ত করে যাওয়া চাই। মেয়েরা দশদিক অন্ধকার দেখেন–ভয় পেয়ে পরের বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি, বাপের বাড়ি চলে যান। নিজের স্বামীর ভিটায় স্বাধীনতা রক্ষা করে অপরিসীম কষ্ট সহ্য করা বরং ভালো তবু কারোর মুখাপেক্ষী হওয়া ঠিক নয়। আপন মাতা এবং স্বামী ছাড়া কারোর উপর জোর চলে না–উপদেষ্টা, আত্মীয়, মুরুব্বী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীর নামে মানুষ আপন অন্তরস্থ পাশবিকতার তাড়নায় কেবল আঘাতই করতে থাকে–প্রেম করতে মানুষ অল্পই জানে। আমাদের দেশে অনেক পিতা আছেন যারা দায়ে ঠেকে পিতা হয়ে পড়েছেন, পিতার মর্যাদা রক্ষা করতে চান না–পারেনও না; পিতা বলে বিশেষ আশা ও দাবী করলেও ঠকতে হবে। ভাইও বিয়ের পর যে পরম আত্মীয় থাকেন, এ তো মনে হয় না। পিতা, ভাই বা কোনো নিকট আত্মীয়কে অবলম্বন করাও ঠিক নয়, সবিনয়ে তাদের অনুগ্রহ অস্বীকার করাই ঠিক।
বাড়িতে যদি একটা পানের বরোজ থাকে, তবে বিলক্ষণ লাভ হয়। অসংখ্য গুবাক ও নারিকেল গাছেও লাভ আছে। বেনার ঝাড়ের কাঠি দিয়ে সের, ফুল রাখবার পাত্র, আরও অনেক জিনিস তৈরি হয়। খেজুরের পাতা দিয়ে আসন, শয্যা প্রস্তুত করা যায়–বাঁশের শলা দিয়ে অনেক দ্রব্য প্রস্তুত হয়। কোনো কাজকে অবহেলা বা ঘৃণা করতে নাই। একমাত্র সত্য জীবন গৌরব-কাজে, শিল্পে, কোনো অগৌরব নেই। অধর্মাচরণেই অগৌরব হয়। এই কথাটি প্রত্যেক পরিবারের নারী-পুরুষকে অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করতে হবে। তা হলে জীবনের পনেরো আনা দুঃখ কমে যাবে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের নানাবিধ শিল্প কাজ শিখে রাখাও উত্তম। আমাদের দেশে অগণিত নারীর লক্ষ লক্ষ হাত একেবারে নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে। কত কাজে কত পয়সা যে এরা উপায় করতে পারে, তার ইয়ত্তা নাই।
সেলাই-রিপুর কাজও খুব ভালো। বাড়িতে একটা হ্যাঁন্ড মেশিন থাকলে বিপদের দিনে বিলক্ষণ উপকার হয়। জামা, কোট, কামিজ, ছেলেদের পেনী সেলাই করে দুপয়সা লাভ হয়। কোনো কোনো মেয়ে সামান্য দুঃখে অতিশয় ভয় পান। সাহস ও স্বাধীনতার সম্মুখে সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যায়। যেখানে ভীতি, নৈরাশ্য এবং পরনির্ভরশীলতা, সেইখানেই অপরিমিত লাঞ্ছনা, অপমান ও দুঃখ সইতে হয়। প্রত্যেক মেয়েরই কিছু কিছু প্রাথমিক শিক্ষা থাকা নিতান্ত দরকার। হাতের লেখাটা পুরুষের লেখার মতো সুন্দর হওয়া চাই–স্বামীর কাছে চিঠি লিখিবার মতো জ্ঞান বা হস্তাক্ষরে কোনো লাভ নেই বরং লোকসান। মেয়েদের একটু প্রাথমিক শিক্ষা থাকলে তাদের বিলক্ষণ উপকার হয়, তাদের মনের বল বাড়ে-দুঃখ দেখে ভয় পান না, সংসারের অনেক সমস্যার মীমাংসা করতে পারেন, মানুষের ধোকায় পড়ে সম্মান সঙ্গতি হারিয়ে বসেন না।
অনেক লোক আছে যারা নিয়ত মানুষের কুৎসা রটনা করে, দুঃখী সংসারের প্রতি কোনো সহানুভূতি তাদের নেই। উপহাস, গ্লানি ও ঠাট্টাই তাদের ব্যবসা-এরা জগতের পশু জাতীয় লোক, এদের কথা গ্রাহ্য করতে নেই।
–অধর্মাচারণ, মিথ্যা, শয়তানী, প্রবঞ্চনার দ্বারা যে পরিবার প্রতিষ্ঠিত ঐ পরিবার ঘৃণিত। তাদের মান-সম্মানের কোনো মূল্যই নেই। স্বার্থান্বেষীরা তাদেরকে সালাম করতে পারে। কিন্তু একমাত্র সত্যাশিত পরিবারই, তারা যতই দুঃখী হোক, মানুষের সম্মান ও মর্যাদার পাত্র।
.
মর্মাহত স্বামী
কয়েকদিন হইল ২য় বন্ধু একটা বিশেষ মোকদ্দমায় ১ম বন্ধুর উপর কাছারীর ভার দিয়া কলিকাতা গিয়াছেন।
সেদিন কাজ করিতে করিতে অনেক বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল। বাসায় ফিরিয়া প্রথম বন্ধু দেখিলেন সমস্ত উঠানখানি অন্ধকার। দরজা দিয়া ঢুকিতেই হারিকেন আলোটি একটা দমকা বাতাসে নিবিয়া গেল। খোকাকে ডাকিলেন-না খোকা উত্তর দিল, খোকার মা উত্তর দিলেন।
বারান্দায় উঠিতে একটা বদনা পায়ের আঘাতে ছুটিয়া পড়িল।
শব্দ শুনিয়া পত্নী উঠিলেন। তিনি সন্ধ্যাকালেই খোকাকে লইয়া শুইয়া ছিলেন, এই উঠিলেন। ঝি কখন যে চলিয়া গিয়াছে, তাহা জানেন না।
১ম বন্ধু কহিলেন–বাতিটা লাগাও। পত্নী অতিকষ্টে জড়িত স্বরে উত্তর দিলেন–ম্যাচ বাক্সটি যে কোথায় আছে, তার ঠিক নেই।
“তাইতো এই ঝড় বাতাসের” … বলিয়া প্রথম বন্ধু সেই অন্ধকারের মধ্যে ফিরিলেন। কাছারীতে ফিরিয়া বিহারী সিংহকে ডাকিয়া বলিলেন–”তোমাকে একটু বাজারে যেতে হবে।”
বিহারী। কেন বাবু?
১ম–একটা ম্যাচ বাক্স আনতে।
বিহারী মনে মনে একটু হাসিল-তার মানে, “সে-কথা দিন থাকতে মনে ছিল না বাবু!”
বিহারী কহিল–”তা আমার ম্যাচবাক্সটাই নিয়ে যান। কাল দিনে কিনলেই হবে?”
প্রথম বন্ধু বিহারীর ম্যাচ বাক্সটি লইয়া বাসায় ফিরিলেন।
পত্নী আবার ঘুমাইয়াছিলেন। তাহাকে উঠাইয়া কহিলেন–এই ম্যাচ বাক্স এনেছি, বাতি ধরাও। কেন ঘুমিয়ে ছিলে? বসে বসে পড়তে থাকলেই হতো। বেশি ঘুমোলে শরীর খারাপ হয়। পড়া তো খুব ভালো। তুমি বসে বসে পড়তে–আর আমি যখন আসছি, আমার সাড়া পেলেই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বলতে-’এসেছ, এস’! বলিয়া একটু প্রীতির হাসি হাসলেন।
পত্নী সে হাসির অর্থ বুঝিলেন না। কহিলেন–”আমার ওসব ভালো লাগে না।”
“কী ভালো লাগে না?-পড়তে?-না, আমায় দেখে আনন্দে অভ্যর্থনা জানাতে?”
“পড়তেও চাইনে–ও ‘ঠাট’ করতেও চাইনে–আমাদের মধ্যে ওসব কিছু নেই”
“পড়া খুব ভালো-নইলে তোমার জন্য এত কষ্ট কচ্ছি!”
“তোমার কষ্ট করা বৃথা–আমার মাথায় ওসব যায় না–তোমার ওসব কীর্তি কোনো মেয়েই জানে না।”
“পড়লে তোমার জ্ঞান হবে।”
“জ্ঞান দিয়ে আমার কী হবে?”
১ম–জ্ঞান হলে ভালো মন্দ বুঝতে পারবে, আমার সঙ্গে, লোকের সঙ্গে, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, সংসারের উন্নতি কিসে হবে, দাম্পত্যজীবন কীভাবে চললে সুখময় হয়, ধর্মাধর্ম, নারী-জীবনের বিশেষত্ব, নারীধর্ম, স্বামীর সহিত নারীর সম্বন্ধ এসব বুঝতে পারবে। মানুষ কিসে বিগ্ন পায়, ছেলেমেয়ের কিসে মঙ্গল হয় এসব বই পড়লে বুঝতে পারা যায়।
পত্নী। তুমি যে এত কথা ভাব, তা তো একটুও ভাবি নি। তোমার মনে যে এত কেন ‘মগজ’ তা তো একটুও জানি নে। আমি কি তোমার সংসার ছারেখারে দিচ্ছি? না, কারো ঘরে সিঁদ দিচ্ছি? কার কাছে অধর্ম করলাম? ইস, আমার মত মেয়ে আর একটা পেতে হয় না, আমার মত ‘মা’ একটা খুঁজে কেউ বের করুক দিখি? আমি যেমন মানুষের মন যুগিয়ে চলি, এমন আর কেউ চলবে না।
১ম–তুমি আমার কথাটা মন্দভাবে নিচ্ছ কেন? যাক, এখন খেতে দাও। ঘরগুলি অন্ধকার কেন? বাতি লাগাও। এই নাও ম্যাচ বাক্স।
ম্যাচবাক্স লইয়া চৌকির তলা হইতে হারিকেন বাহির করিয়া চিমনী খুলিয়া বাতি ধরানো হইল। চিমনীটা কালী ময়লায় ভরা।
রান্নাঘরে যাইতে পাতিলাটি পুড়িয়া বাতিটি নিবিয়া গেল। বাতিতে তেল ছিল না।
একটা মেটে ঘড়ায় অন্ধকারে খোকার মায়ের ধাক্কা লাগিল। ক্রোধে ‘দূর ছাই-মরে না‘ ইত্যাদি বলিয়া পত্নী হারিকেন হাত হইতে ফেলিয়া দিলেন।
সে রাত্র আর কাহারও খাওয়া হইল না। প্রথম বন্ধু কোনোমতে অন্ধকারে বিছানা হাতড়াইয়া শুইয়া পড়িলেন। এ যেন প্রতিদিন তীব্র হলাহল পান করিবার মতো অবস্থা হইয়া উঠিয়াছে। বন্ধু তাহাকে সহ্য করিয়াই যাইতে বলিয়াছে, হয়তো তাহার চিন্তাধারায় কিছু ভুল আছে। হয়ত তিনি তাহার জীবনের গভীর অবস্থা ঠিক বুঝিতে পারিতেছেন না। তাহাকে যদি এমনই অবস্থায় পড়িতে হইত, তিনি কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিতেন না। প্রতি মুহূর্তে সর্পের বিষ দংশনে জর্জরিত হওয়া অপেক্ষা মরণই ভালো। এ যেন সর্পদংশন। অপেক্ষা অধিক জ্বালাময়। হয়ত অদৃষ্টে সুখ না থাকিলে, শত চেষ্টাতেও তাহা লাভ হইবে না। সুখময় দাম্পত্য জীবন তাহার ভাগ্যে নাই।
সংসারে সকল ক্ষেত্রেই কি সরল ব্যবহার ফলবান হয়? কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেত্রাঘাত প্রয়োজন। প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা প্রহারের দ্বারাও এই শার্দুল-ভার্ব নারীর মতি স্থির হইতে পারে! নিজ সমাজ ব্যবস্থার উপর ধিক্কার জন্মিল। এই নারী যদি তাহাকে ভালো না বাসিতেই পারে, তবে তাহাকে জোর করিয়া তাহার সহিত কেন বিবাহ দেওয়া হইল? এত গর্হিত কাজ সমাজ কেন করিতে সাহস পায়! সে কি জীবন ভরিয়া একটা অনিচ্ছুক নারীর প্রতি বল প্রয়োগ করিয়া যাইবে–এতো বিবাহের নামে সত্য ব্যভিচার।
সেও কি ভালবাসিয়া এই নারীকে বিবাহ করিয়াছে? না–কখনও নয়। তবুও সে তো তাহাকে অশ্রদ্ধা করিতে চায় না। তাহাদের উভয়ের জীবনই হয়তো ব্যর্থ হইয়াছে। তা বলিয়া কি আবার নূতন করিয়া জীবনের অভিনয় হওয়া সম্ভব। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, ভাগ্যে সন্তুষ্ট থাকিয়া জীবনকে যথাসম্ভব সরল করিয়া লওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
হঠাৎ তিনি উঠানে নারীর ক্রন্দন-শব্দ শুনিলেন। প্রথমে শব্দ মৃদু শোনা গেল, তার পর স্বর ক্রমশ উচ্চ হইতে লাগিল। সেই গভীর রাত্রে নারীর বিলাপ শুনিয়া তিনি দুঃখিত হইবেন কি লজ্জায় এতটুকু হইয়া গেলেন। লোকে শুনিলে কী বলিবে? ”তাহাকে কেন বাপ মার কোল হইতে ছিনাইয়া আনা হইয়াছে, এত দুঃখ, এত অত্যাচার তাহার কপালে ছিল? দিবারাত্র তাহাকে জ্বালা দেওয়া হয়: একটা মানুষকে গোটা সংসারের কাজ তাহাকে করিতে হইতেছে। কোনো দিন সে কাজ করে না, দিবারাত্র হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাঁটিয়াও মন পাওয়া যায় না”–ইত্যাদি।
ভাগ্যে খোকা উঠিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। নইলে তিনি কত রাত্রি পর্যন্ত চীৎকার করিতেন এবং হৃদয়ের গভীর দুঃখ প্রকাশ করিতেন তাহা যায় না।
শেষ রাত্রে প্রথম বন্ধু কি একটা স্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া উঠিলেন। তাঁহার হৃদয় মমতায় ভরিয়া উঠিল। তাঁহার পত্নী খোকাকে লইয়া এক মরুভূমির কোলে মিশাইয়া গেলেন, কিছুতেই তাঁহাদের খুঁজিয়া বাহির করা গেল না।
.
এক বিধবা নারী
পরের দিন সকাল বেলা দেখা গেল এক নারী পাল্কিতে এসে কাছারীর সম্মুখে অপেক্ষা কচ্ছেন। ম্যানেজার তাকে সাদরে এক প্রকোষ্ঠে আসন দিলেন এবং অন্য লোককে সরিয়ে দিয়ে তাঁর কথা শুনতে লাগলেন। নারী বললেন তার বাড়ি তিন ক্রোশ দূরে। ভ্রাতার বাড়িতে সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একটা বিধবা মেয়ে সঙ্গে ছিল। ভ্রাতা টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন, মেয়েটিকে ২০০ টাকা পণ নিয়ে তার অনিচ্ছায় বিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনিও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে আর ভ্রাতার বাড়িতে থাকতে পারেন না।
ম্যানেজার ভদ্রমহিলাকে প্রথম বন্ধুর বাড়িতে বিশ্রামের জন্য যেতে বলে দিয়ে বললেন–আপনার কোনো চিন্তা নাই। জমিদার বাবু কোন্ শ্রেণীর লোক তা আপনি জানেন। তিনি নারী জাতির রক্ষক। আপনার এই অন্যায়ের যাতে সুবিচার হয়, তা নিশ্চয়ই করবেন।
১ম বন্ধু–নারী যখন দুঃখে পড়ে, অত্যাচারিতা হয়, অন্তত তখন তার বাইরে বের হওয়া দরকার, স্বাধীনতা দরকার।
২য়–নিশ্চয়ই, তবে যারা চিরদিন অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়েছে, তারা মরলেও কাউকে দুঃখ জানাতে ভয় পায়–পা তাদের চলে না–মুখে কথা আস না। মেয়েদেরকে অতিশয় লজ্জাশীলা, অতিশয় মৌনী করে রাখা ঠিক নয়।
১ম–মেয়েদের মুখে ভাষা দিতে চাও, পায়ে বল দিতে চাও, বাহিরের আলো বাতাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাও। এক কথায় তাদেরকে স্বাধীনতা দিতে চাও।
২য়–স্বাধীনতা মানে, হো হো করে হেসে, সাজসজ্জা করে পাউডার পমেটম মেখে গলিতে গলিতে নেচে বেড়ান নয়। স্বাস্থ্যের জন্য আলো-বাতাসের আবশ্যকতা আছে। কিন্তু দুঃখের বিরুদ্ধে কথা বলা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা দরকার, নারীর কর্মশক্তির স্ফুরণের নামই স্বাধীনতা!
১ম–মেয়েদের বাইরে খুব সাবধানতার সঙ্গেই বের হতে হবে।
২য়–মেয়েরা কখনও কোনো অজানা অপরিচিত স্থানে বাইরে বের হবে না, যাবে না; এতে বিপদ আছে। কোনো দূর স্থানে, অজানা দেশে মেয়েদের বিয়ে হওয়াও ঠিক নয়। এই দুর্ভাগা দেশে মেয়েদের এতে বহু বিড়ম্বনা হওয়া সম্ভব। আপন গ্রাম, কদাচিৎ পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়া মেয়েরা কখনও দূরবর্তী গ্রামে বিবাহিতা হবে না। এতে বহু লাভ আছে। অহঙ্কার ও দাম্ভিকতার বশবর্তী হয়ে মেয়েদেরকে দিল্লী, লক্ষ্ণৌ অজানা দেশে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। নিজের প্রতিবেশীকে সম্মান করা, তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করা খুবই ভালো, এইটেই স্বাস্থ্যবান জাতির লক্ষণ।
১ম–এ কথা এখানে কেন বলা হয়?
২য়–কথাটি ঠিক প্রাসঙ্গিক না হলেও, খুব দরকারি কথা বলে না বলে পারলাম না।
১ম–এই মহিলাটি সম্বন্ধে কী করবে?
২য়–মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন আর উপায় কী? পরের বাড়ির ভাত খাবে, কিন্তু পরের ঘরে বাস করবে না। স্বামীর ভিটাটুকু বিক্রি করেই ভদ্র মহিলার এই দুর্দশা হয়েছে। নারী যতই দুর্গম্মিস্তা হোক না–কখনও আপন প্রতিবেশী গ্রাম এবং আশ্রয়স্থান, আপন ভিটা ত্যাগ করবে না। ভিটা যদি না থাকে, তবে কোনো গাছের তলাতে কুড়ে বেঁধে আশ্রয়স্থান নির্মাণ করবে, তবু পরের ঘরে মাথা দিবে না। নারী পরমুখাপেক্ষী, পরপ্রত্যাশী হবে না। স্বাধীনতাই মানুষের বল, সমস্ত গোপন শক্তি প্রকাশের পথ। সে ডাল ভেঙ্গে, সুপারী কেটে, হলুদ গুঁড়ো করে, কাঁথা সেলাই করে, আর না হোক পেঁকিতে ধান ভেনে খাবে, তবু পরের ঘরে মাথা দেবে না। তবু পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী হবে না।
১ম–যা জিজ্ঞাসা করলাম, সে কথার উত্তর কই?
২য়–এঁকে বিনা নজরে, একখানা বাড়ি দেবো, টাকাটা আদায়ের বন্দোবস্ত করবো।
১ম–এর ভাইকে ধরে এনে জব্দ করে দাও।
২য়–মনুষ্যত্ব ও বিচারের নামে অভদ্রতার পরিচয় দেওয়া উচিত নয়। বিবাহ যখন হয়ে গেছে, তখন আর কি করা যায়, বিবাহিত নারীকে নিয়ে টানাটানি করলে তার ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না।
.
মেয়ে দেখা
২য় বন্ধু–একটা বিষয় আমাকে বড় বিব্রত করে।
১য়–কী বিষয়?
২য়–কোনো সওদা করতে হলে, মানুষ জিনিসটি ভালো কি মন্দ বেশ করে নেড়ে-চেড়ে দেখে। পত্নী ক্রয় করতে হলে, ভালো কি মন্দ তা দেখবার কোনো উপায় নাই। যেমন, চোখ বেঁধে বাজারের জিনিসপত্র কেনা-বাসায় এসে যেটা পচা বা টক, সেটিকে ফেলে দাও। বিয়ে করতেও দেরি নেই–পছন্দ হল না, তালাক দিতেও দেরি নেই। অথবা কিনে যখন ফেলেছ, তখন পচা হলেও খেয়ে ফেল, পেটে বেদনা গোলযোগ আরম্ভ হলে চুপচাপ থাক–উঃ শব্দটি পর্যন্ত বলো না। আমি বলি, যাকে বিয়ে করবে তাকে বেশ করে দেখেশুনে নাও-যাতে বাড়ি এসে পচা বলে ফেলে দেবার প্রয়োজন না হয়।
১ম–পচা মেয়েদের কি বিয়ে হবে না?
২য়–হ্যাঁ, হবে বইকি! কাক, কুকুর এরা পচা জিনিসগুলো মহা উপাদেয় বলে গ্রহণ করে। যার যেমন রুচি, সে তেমন পরী গ্রহণ করবে। যার শুঁটকি খাবার অভ্যাস নাই তার। সামনে শুঁটকির ডিস্ রাখলে তাকে জীবন্ত মেরে ফেলা হবে অথচ যা কোনো গৃহিণী কতকষ্টে বেঁধেছেন তার কেন সমাদর হবে না।
১ম–দেখেশুনে বিয়ে করবার উপায় কী?
২য়–আপন মাতা বা কোনো নিকট আত্মীয়ার সঙ্গে মেয়েকে কিছুদিন ভাবি শ্বশুরবাড়ি বাস করতে হবে। নইলে মেয়ের স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে কোনো কিছু জানা যাবে না।
১ম–তাতে সবাই আপত্তি তুলবে।
২য়–এতে কী আপত্তি তা বুঝি না। নিজের কোনো আত্মীয়ের ভাবি শ্বশুর বাড়িতে –যেয়ে যদি ২/১০ দিন অতিথি হয়ে থাকেন, তাতে বিশেষ আপত্তির কী আছে, জানি নে।
১ম–ছেলে যদি বিয়ের আগে মেয়েকে দেখে, তা কী দোষের?
২য়–এটি ছুন্নত, তবে আমাদের দেশে চলন নেই। আপন আত্মীয়দের মাঝে বিয়ে হলে, মেয়ে দেখাতে বিশেষ বাধা হয় না। এমন কি পূর্ব হতেই অনেক সময় দেখাশুনা পরিচয় হয়েই থাকে।
১ম–তুমি যে ২/১ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের অনুরাগের কথা বলেছ, তার অর্থ কী?
২য়–হ্যাঁ বলছি অনুরাগের অভাবে রূপবতী সর্বগুণালঙ্কৃত নারী চোখে কুৎসিত দেখায়। অনুরাগের ফলে খুব মন্দ মেয়েও কারো কারো চোখে অতি সুন্দর বলে মনে হয়। কোনো কোনো ভদ্রলোক মেয়ে দেখানো খুব অপমানের কথা মনে করেন; কিন্তু তাদের এতে অপমান বোধ করা ঠিক নয়। বিয়ে দেবার পর যদি মেয়েকে চিরদিন অবহেলিত হয়ে থাকতে হয়, তবে সে বেদনা মেয়ের বাপ-মাকে বেশি ভোগ করতে হয়। এমন শোকাবহ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। বিয়ের পরই অনেক জামাতা পত্নী ত্যাগ করে; বেশ্যাগত হয়, যুবতী পীর প্রতি ফিরেও তাকায় না–এই মর্মান্তিক দৃশ্য কে সহ্য করতে পারে? এমনও দেখা যায়, অনেক স্বামী তার সুন্দরী পত্নীর দিকে ফিরেও তাকায় না–কোনো কু-চেহারার নারীর প্রতি আসক্ত। এর শেষ ফল অতি ভয়ানক। স্বাস্থ্যনাশ, আয়ুক্ষয়, অকাল মৃত্যু। এই মহাপাপের প্রশ্রয় কেন যে দেশের পিতামাতা দেন তা বুঝি না। অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে, জামাতাকে গালি দিয়ে তারা মনকে সান্ত্বনা দেন। ভদ্রভাবে নিজেদের দৃষ্টির সম্মুখে রেখে ছেলেমেয়ে পরস্পরের সম্মতি গ্রহণ করলে যে কী অপমান, কী ক্ষতি হয়-তা বুঝি না। যারা এরূপ গোড়ামির পরিচয় দেন তাঁরা অতিশয় মূর্খ, আপন পুত্র কন্যার প্রতি নিষ্ঠুর। একাধিক বিবাহের কারণ কী জান! পরস্পর পরিচয় ও অনুরাগের অভাবে পুরুষদের মন সর্বদাই অতৃপ্ত থাকে। ফলে পুরুষেরা একাধিক পত্নী গ্রহণ করে, ভাবে এতেই তৃপ্তি পাওয়া যাবে, কিন্তু অনুরাগের অভাব সহস্র রমণীকে ভোগ করলেও কামনার তৃপ্তি হয় না বরং এ অগ্নি উত্তরোত্তর আরও বেড়ে চলে। যে নারীর স্বামীর প্রতি অনুরাগ জন্মে না, তার মনও অপবিত্র থাকে, পর্দা প্রথার কল্যাণে তাদের পক্ষে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই, কিন্তু কিছুমাত্র সুযোগ হয়ে উঠলে অতি অল্প লোকেই আপন জীবনের কোনো না কোনো সময় পরনারীতে রত হন–এর একমাত্র কারণ পত্নীর প্রতি গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধার অভাব। অনুরাগ ব্যতীত সেটি সম্ভব নয়। বিবাহের পূর্বে অনুরাগ যেমন জন্মে, বিবাহের পর সেরূপ জন্মে না, যে জিনিস আমার প্রত্যাখ্যান করবার স্বাধীনতা নাই যাকে হারাবার কোনো উপায় নাই তার প্রতি সুগভীর প্রেম এবং শ্রদ্ধা জাগে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক জায়গায় বাস করার দরুণ বহু বৎসরে নারী পুরুষে একটা আকর্ষণ ও মমতা জমে ওঠে বটে, কিন্তু তার নাম প্রণয়।ওরূপ হওয়া মনের চিত্তের মামুলী স্বভাব। স্বামীস্ত্রীতে মামুলী স্বভাবকে অতিক্রম করে। কল্পনা ও স্বপ্নরাজ্যের একটা অতি নিবিড়, প্রীতি, অতি প্রাণারাম, মাদকতাপূর্ণ স্নিগ্ধ ভাব জমে ওঠে, সেইটেই চাই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে ভালোবাসার কোনো সুযোগ বা অধিকার দেওয়া হয়। পত্নী নির্বাচনের ভার শুধু ব্যাটাছেলেদেরই আছে, স্বামী নির্বাচনের ক্ষমতা মেয়েদের নাই। তারা বলে, পুরুষছেলের আবার কী দেখবে! পুরুষছেলে আর সোনার দলা!-তার নাক থাক আর না থাক! সে চোর, অসভ্য, গালকাটা হোক!
যে স্বামী পত্নীর আন্তরিক অনুরাগ লাভ করে না–তার অনুদিন আয়ুক্ষয় হতে থাকে, –স্বামীর প্রতি অনুরাগহীন মেয়েদের সহিত সহবাসে পুরুষের বিলক্ষণ ক্ষতির কারণ হয়।
দাম্পত্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান অনুরাগ। এছাড়া দাম্পত্য-জীবন একটা মূল্যহীন কথা ছাড়া আর কিছু নয়।
.
নারীর গান
১ম বন্ধু–বন্ধু, গান গাওয়া কেমন?
২য়–খুব ভালো।
১ম–নারী যদি গান গায়?
২য় –তাতে তো দোষ নেই।
১ম –লাভ কী?
২য় –এই তাপদগ্ধ, দুঃখময় শোক-জ্বালাময় সংসার যদি একটুখানি শান্তি সম্ভব, তবে তা গানেই লাভ হয়। এই মরুময় সংসারে বাঁচবার একুটখানি আকর্ষণ নাই। যারা পশু জীবন যাপন করে, তাদের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু যারা একটুখানি ঊর্ধ্বে ওঠেন তারা জগতের উলঙ্গ শ্রীহীন মূর্তি দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন। এ লক্ষ্মীছাড়া সংসারে একমাত্র আকর্ষণ খোদার কাজ করা, দরিদ্রের সেবা, খোদার রাজ্য বিস্তার করা, জগতের দুঃখের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং পত্নীর প্রেম। পত্নী যদি সঙ্গীতের সুমধুর ধ্বনিতে স্বামীর প্রাণে শান্তি, আশা, উৎসাহ, শক্তি, বিশ্বাস আনতে পারেন, তবে তা কখনও দোষের নয়। বরং খুব ভালো! বস্তুত পত্নী সর্বপ্রকারে স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করবেন, তার মনুষ্যত্ব এবং জীবনকে সার্থক এবং সফল করবেন। স্বামী সংগ্রাম করবেন-পত্নী তার হাতে অস্ত্র যোগাবেন, তাকে অন্ন দেবেন, তার ক্লান্ত ওষ্ঠে সুশীতল বারি দেবেন–আপন অঞ্চল দিয়ে বাতাস করবেন। নারী জীবনের এইই মহা সার্থকতা। এই জগৎ একটা সংগ্রামের ক্ষেত্র বৈ তো নয়–পাপে এবং পুণ্যে, আনন্দে-দুঃখে, দুর্বলে এবং সবলে। শয়তানে এবং দেবতায়! জীবনের সমস্ত ধারাটা একটা নারী। নারী-জীবন কী সুন্দর! কী মহাজীবন তার, তার সেবা কী মহিমাময়!
সঙ্গীত কী?-এই কি আশা-বিশ্বাস শক্তির বাণী নয়?–উহা কি চিরউদাসী চিরবিবাগী পরম দুঃখের সার্থক, প্রেমযোগী শ্বাশত সত্যপুরুষের স্বভাব নয়! উহা কি চিরনির্মলের সুরভি নিশ্বাসের মতো নয়।
আপন স্বামীর চিত্তবিনোদনের জন্য বিবাহিতা নারী গান গাইতে পারে, যেখানে সেখানে দেখিয়ে মজলিশ গুলজার করে বেয়াদবের মতো গান করা ঠিক নয়। অবিবাহিতা কুমারীরা বিশেষ ভদ্র সমাজে, বিশেষ কোনো পবিত্র মাহফিলে গজল বা উত্তম আধ্যাত্মিক ভাবপূর্ণ গান গাইতে পারে–তাতে দোষ নেই।-আনমনে মানুষ নীরস কঠিন অপ্রেমিক শান্তিদাতা এবং ভীষণ মনে করে। খোদা সম্বন্ধে মনে এরূপ চিন্তা পোষণ করা মহাপাপ এবং কুফরীখোদা চিরসুন্দর, মধুর, স্নিগ্ধ, টোরলের মতো পেলব, তিনি রূপ, রস, ফুলের মতো নির্মল, শুদ্ধ গন্ধময়। সঙ্গীতের ধারায় তার গন্ধ ভেসে আসে। যে সমস্ত গান, শয়তানী ভাবপূর্ণ, অপবিত্র, উজ্জ্বলতা ও সংযমহীনতার প্রকাশ পায় তা শয়তান সমাজের জন্য; এবং তা সর্বদা বর্জন করতে হবে।
অতঃপর দুই বন্ধু রাস্তায় বেড়াইতে বাহির হইলেন, বেড়াইতে বেড়াইতে কহিলেন–বন্ধু সময়ের পূর্বে কখনও কথা বলতে নেই।
১ম –কী রকম?
২য় –ওষ্ঠ কথা বলে। যে কথার সঙ্গে অন্তরের যোগ নেই, মন যে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করে।
আবার কহিলেন–কতকগুলি লোক সময় কাটে না, তাই কথা বলে–মিথ্যা কথা বলে।
১ম–কী রকম?
২য়–যেমন একজন জিজ্ঞাসা করলেন–গরুটা কি বিক্রয় করবে?-হ্যাঁ করবো। প্রশ্ন কত টাকা?
উত্তর–দশ টাকা।
প্রশ্নকর্তা–তাহলে আমাকেই দিন।
উত্তরদাতা–বেশ, তুমি লও।
প্র. ক–হা এস।
সময় কালে মাথা চুলকিয়ে বলা, আমার কোনো অমত নেই, তবে কি না আমি ভেবেছিলাম, তুমি গল্প কর।-ইত্যাদি।
যারা পরের নিন্দা তোমার কাছে করে, তারা নিশ্চয়ই তোমার নিন্দা অপরের কাছে করবে।
১ম–জগতের বন্ধুত্ব স্বার্থের খাতিরে।
২য়–ঠিক কথা। সর্বদা সত্যকে লক্ষ্য রেখে চলাই ঠিক, তাতে কেউ শত্রু হোক, কেউ মিত্র হোক–গ্রাহ্য করা উচিত নয়। সর্বদাই নিঃস্বার্থভাবে মানুষের বন্ধু হবে।
১ম–সত্যকে সমর্থন করাই পরম লাভ। আর বেশি দরকার কী?
২য়–বিচারপ্রার্থীকে কখনও অসম্মান করো না–তাকে সমাদর কর, তার কথা শোন এবং তার জন্যে সংগ্রাম কর।
১ম–ন্যায়কে সমর্থন করতে পারাই পরম লাভ।
২য়–কখনও রূঢ় কথা বলো না। যে রূঢ় কথা বলে তাকে মানুষ ঘৃণা করে, খোদাও তাকে ঘৃণা করেন। তার অর্থ ও ক্ষমতা বৃথা।
১ম–তাই।
২য়–নামাজের সময় শিশুদেরকে গালি দিয়ে তাড়িয়ে দিও না। মানুষের উপর ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গি করো না–তাতে নামাজ নষ্ট হয়।
১ম–হ্যাঁ, ঠিক।
২য়–ধর্মের নামে মানুষকে ঠকিও না, ইহা মূঢ়ের কাজ।
১ম–হ্যাঁ, তাই।
২য়–মানব-সেবার উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু জীবিকার জন্যে চাকরি করো না। এরূপ চাকরি অবৈধ এবং অপবিত্র।
১ম–হ্যাঁ, তাই।
২য়–বিবাহ কার্যে তাড়াহুড়ো করো না। অবৈধ অর্থে ধর্মকার্য করো না। যার কিছু অর্থ অপবিত্র, তার সকল অর্থই অপবিত্র। প্রতিবেশীকে প্রেম কর। অধর্মকে আশ্রয় করে কখনও জাগতিক উন্নতির আশঙ্কা করো না। শেষ জীবনে সাধু হবার আকাঙ্ক্ষা পাপ করো না। পাপ সংসারের মর্যাদা ঘৃণিত।
.
কনিষ্ঠদের সঙ্গে বিরোধ
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, কনিষ্ঠদের সঙ্গে বিরোধ অনেক পরিবারেই হয়ে থাকে। পরিবারের এ একটা অতি শোচনীয় কাহিনী। পিতা-দিবা রাত্র বলে, “এই হতভাগার কাছে ছেলেটা যাবে না।” জ্যেষ্ঠ ভাই ছোট ভাই সম্বন্ধে পত্নীকে বলছেন–”এই নরাধম পাষণ্ড মরে না।”
১ম–বাস্তবিক পরিবারের একটা অতি শোচনীয় দিকই বটে। এর যে মীমাংসা তা জানা যায় না।
২য়–মানুষ জীবন সম্বন্ধে কখন নিরাশা পোষণ করতে নেই। পাজি, শুয়োর বলা, গালাগালি দেওয়া, জাহান্নামি বলা খুব সহজ। মুরুব্বী সাজতে এক পয়সা ব্যয় হয় না। এতুটুকু সাধনা প্রয়োজন না। দুর্বৃত্ত, দুরাচারকে সহানুভূতি না করা, তাকে মঙ্গল ও মহত্ত্বের পথে আকর্ষণ করা। তাকে প্রেম করা অতিশয় কঠিন। মনুষ্য নিজে যে কতখানি ধড়িবাজ অপদার্থ, তা চিন্তা করে না। অন্যকে সে উচ্চ গলায় ধড়িবাজ বলতে নিপুণ। মানুষকে দিও, তাকে বড় করতে চেষ্টা করো প্রেমে তাকে আকর্ষণ কর; যদি যোগ্যতা না থাকে তবে সে দোষ তোমার।
জগতে এমন কি জিনিস আছে যা নিরর্থক। মনুষ্য জীবন কি নিরর্থক হতে পারে?
যে নিম্নস্তরের লোক সে মানুষ্যের ভুল ধরে তত বেশি। বাহাদুরি দেখাতে সিদ্ধহস্ত। ব্যাপারটি সমাজের মনুষ্য চরিত্রকে লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে। যোগ্য পরিচালনের অভাবে কত জীবনই না ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত মিস্ত্রীর হাতে পড়লে, একই কাঠ যেমন সুন্দর জিনিসে পরিণত হয়, ঠিক সেই কাঠখানি মন্দ মিস্ত্রীর হাতে একটা কদর্য জিনিসে পরিণত হবে। অনেক সময় কাঠখানিই খারাপ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের উপর তম্বী করবার আগে নিজেদের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করো, তোমরা নিজে তাই তো পাও। তোমাদের নিজেদেরই তো যথেষ্ট শেখবার আছে। তোমরা নিজেরাই দরিদ্র-মনুষ্য জীবনের দায়িত্ব তোমরা গ্রহণ করতে জান না।
১ম–পরিবারের মধ্যে যদি কারো স্বভাব বদ হয়ে ওঠে, তখন কী করা যায়?
২য়–মানুষ যতই কোনো দুরাচার নীচাশয় হোক না–ক্রুদ্ধ হয়ো না–সেটাকে একটা সত্য এটর্ড বলেই ধরে নিতে হবে। কী করে তার মঙ্গল করা যায় সেই চেষ্টা কর।
কেউ যদি বদ হয়ে ওঠে-তবে সে তো বদ আছে এবং সে যে ভদ্রতা সে জানে না, অনবরত সে কথা তাকে বলে কী লাভ হবে? বরং তা বলে তাকে আরও ক্ষতি করা হয়। উত্তম আদর্শ-চরিত্রের বই তাকে ২/৩ খানা করে পড়তে দাও–তার প্রতি সহানুভূতি পোষণ কর–এমন কি তাকে জানতেও দিও না, তার মঙ্গলের চেষ্টা তুমি করছ। শুধু আরাম, আয়েশের জন্যেই তাকে বই পড়তে দাও। সভাসমিতি, উমভথর, উমভতণরণভডণ এ তাকে নিয়ে যাও। ভালো ভালো লোকের কাছে তাকে নিয়ে যাও। তার স্বভাবের হীনতার বিরুদ্ধে একটা মস্ত ষড়যন্ত্র চলছে–তা তাকে জানতে দিও না।
১ম–যদি বই না পড়ে?
২য়–তাহলে খুব ভালো চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠছে, এই ধরনের উপন্যাস পড়তে দাও। কোনো ভালো ইংরেজি গ্রন্থ বা বিদেশী উচ্চাঙ্গের সাহিত্য কোনো বাহানা ধরে তাকে প্রত্যহ একটু একটু পড়াও। যা কিছুতেই কিছু হয় না, দুঃখ করো না, যেহেতু কর্তব্য তোমার শেষ হয়েছে। তোমার যেটুকু করবার দরকার সেটুকু করেছ, বাকিটুকুর জন্যে তুমি দায়ী নও। –অপরাধীকে উপহাস করো না, তার নিন্দাও কারো কাছে করে না,আজ হোক, কাল হোক-একদিন সে তোমার কথা মনে করবেই। অন্তত মরণকালে তোমার কথা মনে করে। একটু চোখের পানি ফেলবেই। তাও কম লাভ নয়।
১ম–যদি কোনো ছেলে অসময়ে পড়া ছেড়ে দেয় কোনো রকমেই তার মাথায় কোনো জ্ঞান প্রবেশ না করে?
২য়–তাকে Common easy Literature পড়তে দাও। আর সে কি কাজের উপযোগী তা লক্ষ্য কর-সেই কাজেই তাকে লাগিয়ে দাও। যে ছেলে স্কুলে ভালো পড়া পারে না সে যে একজন জাতির রক্ষাকর্তা সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি হবে না, তা কে জানে। সে যে একজন ভালো। Watch maker হবে। তাই বা তুমি যেন করে বুঝতে পারবে। কেন নিরন্তর তাকে অপদার্থ বলে গালি দাও, যে যে জায়গায় কাজ করতে খোদা কর্তৃক তৈরি হয়েছে, সেইখানে তাকে দাও, ঠিক মুখে মুখে লেগে যাবে, কোনো গোলমাল থাকবে না। ভবিষ্যৎ জীবনে যার একজন সুদক্ষ কারিগর হবার কথা, দর্শন, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ তার মাথায় প্রবেশ নাও করতে পারে সে জন্য কেন তাকে একেবারেই আবর্জনা ভেবে তাড়িয়ে দাও?
১ম–যদি কেউ মাতাল ও লম্পট হয়?
২য়–জবরদস্তি, মারামারি, ভৎর্সনা দ্বারা লম্পট ও বদমাইশকে পথে আনা যায় না। এই পথের ভীষণ পরিণাম। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকারের কথাই তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে। এই অবস্থায় তাকে কখনও স্নেহ বঞ্চিত করো না। নিজে তাকে মুখোমুখি হয়ে কোনো উপদেশ দিও না। তার বন্ধু-বান্ধব দিয়ে তাকে পথে আনতে চেষ্টা করবে, যদি একান্তই অধঃপাতে যায়, তবে কোনো উপায় নাই। সমস্ত সম্পত্তি হেবা করে তার খোরপোষের বন্দোবস্ত শুধু করবে। সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারে, কখনও এ অধিকার তাকে দিও না।
মানুষ অনেক সময় পাপ করে ভারি অনিচ্ছায়। গাছের পাতা যেমন সর্বদা আলোক চায়, পতিত মনুষ্য-আত্মাও তেমনি মুক্তি চায়, আলো চায়, পথ চায়। একটা মহাশক্তি তার দরিদ্র আত্মাকে চেপে ধরে। পতিত ভারি নিঃসহায়, ভারি দরিদ্র, তাকে ভর্ৎসনা না করে, তার অন্তর্নিহিত দীন মনুষ্য আত্মাটিকে প্রেম ও সহানুভূতিতে সাহায্য কর। ডাকাত, তস্কর, পাজী, বদমাইশ সবাই আপন আপন পাপে লজ্জিত থাকে, শয়তানের কবল হতে তার মুক্তির জন্যে তাকে সাহায্য কর।
থামিয়া কহিলেন–দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পাবে অনেক মানুষের অনেক ছোট ছোট দোষ ত্রুটি। সেজন্য তাকে ত্যাগ করো না, মানুষ একদিক দিয়ে মন্দ পতিত, অন্যদিকে দিয়ে ভালো উন্নত। কেবলই গুণ মানুষে সম্ভব নয়। মানুষের গুণের দিক দেখ, দোষ দেখ না। আর একটি কথা তর্ক করে কাউকে হারানো যায় না যতক্ষণ না সে নিজে হারে।
.
বিনষ্ট মানুষ
২য় বন্ধু –অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোক, ছেলেবুদ্ধি কন্যার মুখের উপর কখনও বলবে না, “তুমি কী সুন্দর, তোমায় আমি কত ভালবাসি!”
আজ যে নারীকে প্রেমের চোখে স্বর্গের বিদ্যাধরী দল মনে হচ্ছে কাল তার প্রতি আর সে মাদকতা থাকবে না, হয়তো তখন দ্বিতীয় কোনো নারীর রূপ চোখে সুন্দর দেখাবে। মানুষের চোখের নেশা, রূপের মাদকতা রূপের মাদকতা এবং প্রেম বা ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। যে রীকে একবার ভালোবেসেছ, একবার প্রেম করেছ, তাকে আর কখনও ত্যাগ করতে পার না। অন্তরে এবং প্রকাশ্যে তাকে প্রেম কর। তার প্রতি বিশ্বস্ত থাক, নইলে ব্যভিচার করা হবে। চোখকে যে সংযত না করতে পারে, মনকে যে শাসন না করতে পারে–তার প্রেমের তার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। সে কাপুরুষ। তার বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। বন্ধু যে নারী উচ্চবংশোদ্ভূতা, যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভক্তি না থাকে, তাকে বিয়ে করো না। চক্ষু এবং প্রেম মানুষকে অনেক সময় প্রতারণা করে। মোহের বশবর্তী হয়ে আজ যাকে বিয়ে করেছ, কালই তার প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অবজ্ঞা আসবে। পত্নীর প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা খুবই বিপজ্জনক। এতে পরী অপেক্ষা নিজের চরিত্রের অধিক ক্ষতি হয়।
১ম–তুমি যে বললে, বিনষ্ট হবার খুব সম্ভাবনা তার মানে কী?
২য়–মানুষ যখনই আপন পত্নীর প্রতি প্রেম হারায় তার অসংযত পাপদৃষ্টি এদিক ওদিক পড়ে, তার ক্ষুধিত মন নূতন নূতন নারীর প্রতি ধাবিত হয়। সে সাবধান। লজ্জিত হয়ে নিজের কান নিজে না মলে আপন পত্রীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা না করে, তার পাপ স্বীকার না করে তখনই তার মরণ উপস্থিত। বন্ধু নারীর মুখ বিষের মতো মনুষ্যত্বের অন্তর বাহির বিষাক্ত করে। উহা অগ্নির জ্বালায় মনুষ্যকে তাপদগ্ধ করে। উহা অভিশপ্ত নিশ্বাসের ন্যায় সুপবিত্র মানবচিত্তকে বিভ্রান্ত করে। উহা জগতের অভিশাপ। সমস্ত বিশ্বের বাতাসকে নারীর মুখ কলঙ্কিত করেছে, ঠিক, নারীর মুখে তা জীবনবিলাসী গোলাপ পুষ্প। তাকে ঘৃণা কর, ওর স্পর্শ হতে, ওর কটাক্ষ হতে সরে পড়। নারীর পাপ মুখ! নারীর অপবিত্র সুন্দর মুখ মনুষ্যকে সর্বস্বান্ত করে, তাকে পথের ফকির করে পথেই ফেলে যায়। স্বার্থময়, কুহকময়ী নারীর যাদু দৃষ্টি হতে সাবধান।
যে পাপিনী নারীর কটাক্ষে পাগল হয়েছে; দিগহারা হয়েছে, তার রক্ষা নাই, নরক হতে নরকে যে ছুটে বেড়াবে, তার শান্তি নেই। তার সুখ নেই, পাপিনী সুন্দরীর দেহ সর্বদাই বিয়ের উৎস–তাহা দগ্ধ করে কেবল পিপাসা বাড়ায়। মৃত্যুর বিভীষিকায় পথিককে উদ্ভ্রান্ত করে, মাতাল করে, পাগল করে। সর্বদাই সাধ্বী নারীতে ডুবে থাকে, তাকেই ভালবাস-নির্লজ্জের ন্যায় ভালবাস, সাধ্বী নারীর মুখে জগতের আশীর্বাদ, মানুষের আয়ু-স্বাস্থ্য শান্তি, শক্তি, জীবন ও আনন্দের কারণ। যে পরম নিত্য সত্যের পরিচয় পেতে চায়–তাকে প্রথমে নারীকেই দেখতে হবে। নারীকে ত্যাগ করে, নারীকে উপহাস, অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা করে কেউ খোদাকে পাবে না। খোদার স্বরূপ পরিপূর্ণভাবে নারীতে ফুটে উঠেছে। মন যদি পত্নীতে ক্লান্ত হয়ে থাকে, চক্ষু যদি পাপ পথে হাঁটে, তবে সে চোখ তুলে ফেলে দাও। হৃদয় যদি অন্য নারীর প্রতি পাপভরে আনত হয়, তবে সে হৃদয়ে শলাকা বিদ্ধ কর। আপন আপন পত্নীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, পাপ স্বীকার কর এবং শান্তি গ্রহণ কর।
পতিতা কুহকিনী নারীর সংখ্যাধিক্যে পৃথিবী ছেয়ে গেছে। এদের পাপ পদভাবে ধরণী ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর মানব-সমাজের পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহ, নারীভয়, দুর্ভিক্ষ অপেক্ষা এদের অস্তিত্বই সমূহ বিপদের কারণ হয়ে পড়েছে। এদের অগ্নিনিশ্বাস হতে মনুষ্য। সমাজকে রক্ষা করতে হলে সাধ্বী নারী-সমাজকেই ব্যস্ত হতে হবে চিন্তিত হতে হবে। ধরণীর সমস্ত পথ অলিগলি, আলো-বাতাস বিঘ্নসঙ্কুল হয়ে পড়েছে। অতএব নারীকে বলি–হে নারী! তোমরা আপন স্বামীকে অতিশয় সন্তর্পণে রক্ষা কর। স্বামী হারার মতো মহাবিপদ নারী জীবনে আর নাই। জগতের সমস্ত ধন-সম্পদ হারিয়ে যাক, একটা মনুষ্য আত্মা যেন না হারায়-আপন আপন স্বামীকে তোমরা কখনও হারিও না।
নারী আপন বিপদের কথা মোটেই জানে না। তার কোন সময় যে কী সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে সে সম্বন্ধে সে মোটেই সজাগ ও সতর্ক নয়। তার ঘরে সিঁদ দেবার জন্যে কুহকিনী নারী, চারদিকে জাল বুনে রেখেছে, যে-কোনো মুহূর্তে সে জালে কোনো দুর্বলচিত্ত এমন কি সবলচিত্ত পুরুষও আটকা পড়ে জীবন, যৌবন, ধর্ম, মনুষ্যত্ব, স্বাস্থ্য, অর্থ, চরিত্র, স্ত্রী-পুত্র সব হারাতে পারে।
তারপর বললেন–সমস্ত সতী সাধ্বী নারীকে আজ বেশ্যা (?) হতে হবে।
১ম–কী বলছো? কী কথা বলছো, কী কথা বল যে, কী ভয়ানক কথা বল হে?
২য়–হা, ঠিক কথাই বলছি। নইলে রক্ষা নেই। সমস্ত মানুষই বিনষ্ট হবে?
১ম–কী রকম?
২য়–তুমি জান না এক সময়ে এক সাধ্বী নারী ক্রন্দন করতে করতে এক বুজুর্গ, মস্তান ফকিরের কাছে যেয়ে বললেন—”মহারাজ, আমার স্বামী বেশ্যাসক্ত হয়েছে, কুহকময়ী নারীর পাপমুখ তাঁকে হরণ করেছে; আমার প্রতি দয়া করুন।“ বুজর্গ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—”তোর স্বামী বেশ্যাসক্ত হয়েছে, তুইও যেয়ে খানকী হ।”
পীরের কথা শুনে সাধ্বী অবাক হলেন, এত বড় অসম্ভব কথা পীরের মুখে। প্রতিবাদ করার তো উপায় নাই। নারী বাড়ি এসে কেবলই ভাবতে লাগলেন। পীরের হুকুম না মানলে চলবে না। বাস্তবিকই একদিন তিনি কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরসহ ছদ্মবেশে যে শহরে তার স্বামী নেশায় মেতেছিলেন সেই শহরে যেয়ে উপস্থিত হলেন, তরপর সেখানে এক বাড়ি ভাড়া করে চতুর্দিকে প্রচার করে দিলেন-এক মহাসুন্দরী নাচওয়ালী এখানে এসেছে যার ইচ্ছে তিনি উপযুক্ত মূল্য দিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। সদাগরের ছদ্মবেশিনী পত্নী দরজায় বাদী-দাসী রেখে দিলেন। কত লম্পট, কত বড় লোক আমীর এসে বিবির দরাজায় হানা দিলেন। দাসী গিয়ে বিবির কাছে চিঠি পাঠালেন। বিবি সবাইকে ফিরিয়ে দিলেন। সবাই ম্লানমুখে নাচওয়ালীর দরজা হতে ফিরে গেলেন।
একদিন এক সদাগর এসে দরজায় তার নিবেদন জানালেন। বিবি চিঠি পেয়ে বুঝতে পারলে–এইবার তার ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে। ইনিই তার স্বামী, এইবার তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। বিবি বলে পাঠালেন-যদি বহু হাজার টাকা দিতে পার তবে বিবির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বদমাইশ সদাগরের আর তো কোনো কাজ ছিল না, কোথায় কোন সুন্দরী আছে, তার সন্ধান নেওয়াই ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এক মহাসুন্দরী নাচওয়ালীর সংবাদ পেয়ে তার মাথা ঘুরে গেল। সমস্ত কাজ ত্যাগ করে তিনি এই নূতন বিবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন; কিন্তু শুনলেন বিবির সঙ্গে দেখা করতে হলে লাগবে বেসুমার টাকা। কিন্তু তা বলে। কি হবে। এই সুন্দরীর প্রেম লাভ করতেই হবে নইলে জীবন তার ব্যর্থ! সদাগরের যা কিছু ছিল, সব বিক্রি করে-মাল, জাহাজ যা কিছু সব বিক্রি করে-পঞ্চাশটি হাজার টাকা নজর দিয়ে বিবির সঙ্গে দেখা করলেন। এদিকে বেশ্যারূপী সদাগরপত্নী দিনরাত্র আল্লা আল্লা করছেন। এবাদত করছেন তার খোদার কাছে কাঁদাকাটা করে বলছেন খোদা আমার স্বামীকে মিলিয়ে দাও।
সদাগর ছদ্মবেশী বিবির সঙ্গে দেখা করলেন। কাতর ভাবে তার প্রণয় প্রার্থনা করলেন, ছদ্মবেশী নারী জাঁকালো পোশাক রং বেরং এর ঢং করে নিজের স্বামীকে মুগ্ধ করে বললেন–আচ্ছা, আমরা যখন উভয়ে উভয়ের প্রেম মজেছি তখন আর এখানে থাকা কেন, চল আমার তোমার বাড়িতে যাই, সারা দিনটা প্রেমে আনন্দে এক সঙ্গে কাটিয়ে দেব–জীবন আমাদের কী সুখেরই হবে। সদাগরকে আর পায় কে? জীবনে কী মহাসৌভাগ্য লাভ। যার প্রণয় লাভ করতে শত শত লোক ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে–সেই নারী তার প্রেমপ্রার্থী!
এরপর সদাগরের বৌ সদাগরকে নিয়ে দেশে এলেন। ফকিরের দোয়াতে স্বামীকে পাপ ও উদ্ধৃঙ্খলতার কবল হতে রক্ষা করে নারী দেশে এলেন এবং মহাসুখে কালযাপন করতে লাগলেন। সদাগরের চরিত্রের সংশোধন হল।
বিভিন্ন সমাজের মেয়েরা যেরূপভাবে গঠিত হয়ে উঠেছে, আমাদের মেয়েদেরও সেইভাবে গঠিত হয়ে উঠতে হবে। ছেলেদের রুচি অনুযায়ী মেয়েদেরও হাব-ভাব গঠন করে তুলতে হবে-নইলে গোটা সমাজটাই চরিত্রহীন হয়ে উঠবে, স্বামী-স্ত্রীতে প্রণয় হবে না, ছেলেরা জীবনে কেবলই উঁকিঝুঁকি মারতে থাকবে, মেয়েদের কপাল পুড়বে। তারা কেবলই মেয়েদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকবে, কখনও তাদেরকে প্রাণভরে ভালোবাসবে না।
১ম–ঠিক কথা, ছেলেদেরকে নির্লজ্জ বলে লাভ নেই। কালের ধর্ম যা।
২য়–হা, কালের ধর্ম যা। (Conservative) হলে চলবে না, একটু (Liberal)ই হতে হবে। সেই সাবেক মান্ধাতা আমলের মতো চললে-মেয়েদের উপর ছেলেরা তো রাগবেই। যুবক হৃদয়ের রুদ্ধ বেদনা তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার অশ্রু তার কবিতা নারীর বোঝা চাই-নইলে যুবকেরা জীবনে শান্তি পাবে না, পৃথিবী ও জীবনকে যে উপভোগ করতে পারবে না–জীবনটি তার নিতান্তই ব্যর্থ, অর্থশূন্য ও উদ্যমহীন হয়ে উঠবে।
এমন সময় কাঁচারী ঘরে আসিয়া চাপরাশী মফিজউদ্দিন খবর দিল-ছোট সাহেবের (১ম বন্ধু) শ্বশুর বাড়ি থেকে কুটুম্ব এসেছেন।
তাড়াতাড়ি প্রথম বন্ধু বাসায় গেলেন। দেখিলেন তার শ্যালক-রত্ন, এসে এক পালঙ্কে মাথা খুঁজিয়া বসিয়া আছেন। প্রথম বন্ধুকে দেখিয়া তিনি মাথা তুলিলেন না, উঠিলেনও না, কোনো কথাও বলিলেন না। প্রথম বন্ধু খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া পত্নীকে কহিলেন–খাবার বন্দোবস্ত করে দাও, কিছু নাস্তার যোগাড় কর; ঝিকে পানি দিতে কহিয়া তিনি বাসা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া পুনরায় কাঁচারী ঘরে আসিলেন।
তখন লোকজন কেহ ছিল না। বরকন্দাজেরা রান্নার যোগাড়ে গিয়াছে, কেহ কেহ মফস্বলে খাজনার তাগাদা করিতে গিয়াছেন। দ্বিতীয় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, সাংসারিক কাজকর্ম সম্বন্ধে সর্বদা লেখাপড়া করে নেওয়া উচিত। মুখের কথার কোনো মূল্য নাই। দুজনা দুপক্ষের মধ্যে যে বন্দোবস্ত বা কথাবার্তা হল। তা কলম-কালিতে লিখিত হওয়া আবশ্যক। বিনা দলিলে কোনো কাজ অতি আপনার জনের সঙ্গেও আরম্ভ করো না, এর শেষ ফল মনোমালিন্য, কার্যের বিফলতা।
১ম–যেখানে ধর্ম ও ন্যায়, সেখানে লেখাপড়ার কী প্রয়োজন? ধর্ম ঠিক থাকলে সবই ঠিক থাকে।
২য়–হ্যাঁ। যেখানে ধর্ম ও ন্যায় রক্ষা করতে হবে, সেখানেই লেখাপড়া সাক্ষী আবশ্যক। এতে কোনো দোষ নেই।
১ম–আপন লোকের সঙ্গে এরূপ করলে, নিশ্চয়ই তারা বলবে আমাকে অবিশ্বাস করছে।
২য়–পর আপন, বিশ্বাস অবিশ্বাস বলে কোনো কথা নেই। একটা কাজের নিয়ম। মুখের কথার উপর নির্ভর করে কোনো কাজ আপন-পর কারো সঙ্গে হওয়া ঠিক নয়। এতে মনোমালিন্য, ক্ষতি, রাগারাগি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি দলিল রেজিষ্ট্রি হলে দোষ না হয়, তবে অন্যের সঙ্গে হওয়া কি দোষের? প্রথম প্রথম বন্ধুত্বের খাতিরে কথা না বলে মন কষাকষি ভালো নয়। লেখাপড়া না করে কোনো কাজে অগ্রসর হলেই পরস্পরে অবিশ্বাস উপস্থিত হয়-আগ্রহের অভাব, কাজের সফলতার অমনোযোগ, অনেক সময় অপর পক্ষকে ফাঁকি দেবার পাপ মনে জাগে।
১ম–খুব ভালো লোকের মনেও কি এরূপ হয়?
২য়–হ্যাঁ, হয়, মানুষ যতই বড় হোক, রক্ত মাংসের শরীরে লোভ ও দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতি ভালো লোকও পয়শ্চর সংস্রবে ভিতরে ভিতরে দুর্বল, নীচ ক্রুর হয়ে উঠেন। এই কারণেই ভালো লোকেরাও নিজেদেরকে আইনের কবলে বেঁধে নিজেদের মান রক্ষা করেন। মানুষের ভিতর একটা পশু সর্বদাই আপন স্বভাবের পরিচয় দেবার জন্যে ওঁত পেতে বসে আছে। তাকে বাধন দিয়ে চেপে না রাখলে সে জ্ঞানত বিবেককে অতিক্রম করে, নিজের দুঃস্বভাবের পরিচয় দেয়।
১ম–জগতে স্বার্থ ও অর্থ বড়ই খারাপ জিনিস।
২য়–মানুষ খোদাকে ভুলে জাগতিকভাবে অর্থ ও স্বার্থের গোলামি করে, তাছাড়াও এ দুটি এমনই জিনিস যে এর বশে এলেই মানুষ ইতর হয়ে ওঠে, এজন্য মহাজনেরা অনেক সময় পথের ধুলা মেখে ফকির হন, তত্রাচ এ দুটির সংস্রবে যান না। বলতে কি, এই দুটি জিনিস মানুষকে দোজখে টেনে নেয়। ”অর্থশালী মানুষের স্বর্গে যাওয়া সম্ভব নয়।” এ কথাটি মিথ্যা নয়।
১ম–তবে এদুটি জিনিসকে প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই ত্যাগ করা উচিত।
২য়–কথা এই, এ দুটি জিনিস ছাড়া জগৎ চলে না–জগতের কোনো কল্যাণ সম্ভব নয়। দীন-দুঃখীর মঙ্গল, দেহ রক্ষা, মানব মঙ্গল, বহুবিধ সকাৰ্য, খোদার রাজ্যবিস্তার, এক কথায় অর্থ ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে না।
১ম–তবে উপায়?
২য়, অর্থ ও স্বার্থ অন্বেষী হও–মানুষের মতো খোদার ওয়াস্তে, কখনও দুরাচার, নীচ, শয়তান নরপিশাচের মতো নয়। অর্থের সদ্ব্যবহার কর-অর্থ তোমাকে ব্যবহার না করুক।
১ম–অনেক লোক কেবল অর্থ করে, কার কত টাকা আছে, কে কতখানি শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন সেই গল্প করে।
২য় –হ্যাঁ, এরূপ নীচ লোক জগতে ঢের আছে। আমার অনেক টাকা আছে, আমার এক টাকা আয় হয়েছে, আমার অমুক আত্মীয় সম্পত্তিশালী লোক–এই সমস্ত কথা বলে গৌরব করা মূখের কাজ। একমাত্র সত্য ও মনুষ্যত্বের গৌরব করা। অর্থ যদি কারো থাকে, কেউ যদি অনেক টাকা মাইনে পায়, সে তাই দিয়ে আল্লাহর কাজ করুক–এতে গৌরব ও বড়াই করা নিছক শয়তানী।
১ম–ঐ লোকটি বেশ উন্নতি করেছে এরূপ গল্পও করে।
২য়–সমস্ত জগৎ লাভ করে যদি আত্মা ও ধর্ম হারাতে হয় তবে সে লাভে লাভ নাই। বরং সমস্ত জগৎ ত্যাগ করে, যদি আত্মাকে রক্ষা করা যায় তাই ভালো।
১ম–কেন, ধর্ম কি বাহিরের ক্রিয়া নহে? আমি যদি বাহিরের ক্রিয়াকলাপ ঠিক রাখি, তাহলে অন্যায়, মিথ্যা দাম্ভিকতা, গর্ব, মিথ্যাচার ও সবে কী ক্ষতি?
২য়–অন্যায়, মিথ্যা প্রতারণা, গর্ব ও সব ত্যাগ করাই ধর্ম। আত্মশুদ্ধি ব্যতীত নাজাত অসম্ভব। বাহিরের ক্রিয়া-কলাপের আবশ্যকতা থাকলেও ঐ গুলির দ্বারা কেউ বেহেস্তে দাখেল হবে না–এরূপ বিশ্বাস করা বেশক হারাম।
প্রথম বন্ধু এই সময়ে বাসায় গেলেন। তখন আহারের সময় হইয়াছে। দেখিলেন আহারের কোনোই বন্দোবস্ত হয় নাই। কী যেন একটা আয়োজন চলিতেছে। তিনি বারান্দায় একখানি চৌকির উপর বসিলেন। এমন সময় একখানি পাল্কী আসিয়া দরজায় নামিল।
অতঃপর তাহার পরী একখানি সাদা শাড়ি ঘোমটায় মাথা ঢাকিয়া, খোকার হাত বাম হস্তে ধরিয়া যাত্রার বেশে স্বামীর পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়া মাটির দিকে মুখ করিয়া কহিলেন–বাড়ি যাইতে চাই। খোকার মাতা গমনোদ্যত অবস্থায় উঠানে যাইয়া দাঁড়াইল।
প্রথম বন্ধু মাটির দিকে মুখ করিয়া কহিলেন–আচ্ছা!
ভালোই হইয়াছে। খোলাঘরে দুই বন্ধুর রাজত্ব। বেশ সুখেই দিন কাটিতে লাগিল। বয়স্কা ঝিকে ১০টি টাকা দিয়া বিদায় করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
দ্বিতীয় বন্ধু ভাতের হাঁড়িতে জ্বাল দিতে দিতে কহিলেন-বন্ধু, মানুষের কঠিন কথা বলবার প্রবৃত্তি বড়ই খারাপ। কোনো অবস্থায় তা ঠিক নয়। কি লেখায়, কি বাক্যে, কঠিন রূঢ় বাক্য ব্যবহার করলেও, তার ফল খারাপই হয়। খোদার কাছে মানুষ কত অপরাধ করে, তিনি চির মৌন।
মানুষ যা বোঝে তা বোঝেই। নিষ্ঠুর কথার দ্বারা তাকে নিজের মতে দীক্ষিত করবার চেষ্টা সব সময়ই ব্যর্থ হয়। যখন দেখতে পাচ্ছ, মানুষ বুঝতে পাচ্ছে, না চুপ করে থাকাই শ্রেয়, অনর্থক শক্তি ক্ষয় করে কোনো লাভ নেই। মানুষ যতক্ষণ না নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারে, ততক্ষণ তাকে বাহির থেকে কঠিন কথায় বোঝান যায় না।
কোনো কোনো পরিবারে দেখা যায় প্রবীণ কর্তা বা স্ত্রী ছোটদেরকে অনবরত উপদেশ দিচ্ছেন। তাদের কথার অন্ত নাই। সমালোচনার শেষ নাই, ভর্ৎসনার অবধি নাই। তাঁরা ভাবেন পারিবারিক মঙ্গল সাধনের পথ এই। এর ফলে সংসারে অশান্তি হয়, ভেতরে ভেতরে সবাই বিদ্রোহী ও অসন্তুষ্টিই হতে থাকে, যাদের জন্য তাদের প্রাণ দেওয়া উচিত, তাদেরকে তারা অতিশয় অশ্রদ্ধা করে।
শুধু পরিবার বলে নয, সমাজে নিয়তই মানুষের সঙ্গে মতামত নিয়ে ঝগড়া করবার প্রবৃত্তি অনেকেরই আছে। সবিনয় ভদ্র মিষ্ট-মধুর আলোচনা বা সমালোচনা মন্দ নয়, কিন্তু যেখানেই দেখা যাচ্ছে তোমার কথা গৃহীত হচ্ছে না সেখানেই কথা বলো না, মৌন থাক।
অনেক মানুষ এমনও আছে যারা মুখে মিষ্ট কথা বলে, অন্তরে তাদের গরল অথবা তাদের কথার সঙ্গে অন্তরের কোনো যোগ নেই। এরা যে নীচ ও ইতর প্রকৃতির লোক, তা যে জাতির মানুষই হোক, ধর্মের ভঙ্গি যতই তারা ধরুক না, এই শ্রেণীর লোককে মোনাফেক বলে। মোনাফেক বড়ই নিকৃষ্ট জীব।
আর একটি কথা-অত্যাচারিত হয়ে কখনও অভিযোগ করতে ভয় করো না। অত্যাচারের সমালোচনা ছাড়া জগতের কখনও কল্যাণ হয় না। তাই বলে মিথ্যা বা নিরন্তর খুঁটিনাটির অভিযোগ ভালো নয়। তাতে চিত্তের শান্তি নষ্ট হয়। যেখানে অভিযোগের ফলে ব্যক্তি-বিশেষের শান্তি হয় এবং তাতে অনেক মানুষের উপকার হয়, সেক্ষেত্রে চুপ করে না থাকা ভালো। পুরাকালে গ্রিক দেশের এক রাক্ষস প্রত্যেক দিন এক একটা জান্তা মানুষ। ধরে ধরে খেত। একদিন এক বীর প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাক্ষসেরও হাড় খেয়ে রাক্ষসটিকে হত্যা করলেন। ক্ষমা করা ভালো কিন্তু সব সময় অত্যাচারীর অত্যাচারকে ক্ষমা করা ঠিক নয় বরং তা কাপুরুষতা।
সংসারে কতগুলি লোক আছে, যারা স্বার্থ ও সুখের গন্ধে এসে জোটে। এই শ্রেণীর বন্ধুর অভাব নেই। যেখানেই মধু দেখে, সেখানেই ভ্রমরের মতো উড়ে এসে বসে, তারপর মধু ফুরোলে তারা চম্পট দেয়। যেখানে দুঃখ ও বেদনা সেদিকে তারা ফিরে তাকায় না। এই ভ্রমর দলকে কখনও বন্ধু মনে করো না–এদের বন্ধুত্বের কখনও বিশ্বাস করো না। তবে এদেরকে কখনও ঘৃণা করো নাপ্রয়োজন হলে উপকারও করো। কারণ সর্বশ্রেণীর মানুষই প্রীতিপাত্র। তাদের মুখে কিছু বলো না।
.
ভালোবাসার শক্তি
২য় বন্ধু কহিলেন–পুরুষের জীবন গঠনে মেয়েদের প্রভাব অনেক সময়ে আশ্চর্য রকমে দেখা যায়।
১ম–কী রকম?
২য়–বিলেতের একটা লম্পট, মিথ্যাবাদী, ভীষণ প্রকৃতির যুবক একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। একদিন মেয়েটি বললে–আমি শুনেছি, তোমার প্রকৃতি বড় উগ্র-তোমার ব্যবহার হিংস্র পশুর মতো। আমাকে যদি পেতে চাও তাহলে ভদ্রপ্রকৃতির এবং বিনয়ী হও। তা ছাড়া তুমি একটা পথের Vagabond আমাকে বিয়ে করলে, খাবে কি? যদি অবস্থা ভালো করতে পার, যদি স্বভাব ভালো করতে পার, তবেই আমার সঙ্গে দেখা করো-নইলে নয়। যদি মানুষ হতে পার, তাহলে আমাকে পাবে আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো।
যুবকটি তার প্রেমিকার এই কথাগুলি কোরানের বাক্যের মতো গ্রহণ করলো। সে মেয়েটির কর চুম্বন করে বললে-তুমি যেমনটি ইচ্ছা করেছ, ঠিক তেমনই হবে।
বাস্তবিক এরপর যুবকটির স্বভাবে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। তার স্বভাবের সমস্ত হিংস্রভাব দূর হয়ে গেল। সে নিজের সমস্ত দোষ-ত্রুটি একে একে বর্জন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে তার প্রশংসা চতুর্দিকে হতে লাগল। সে অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্থ উপার্জনে মন দিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সে একজন অর্থশালী লোক হয়ে পড়ল। তারপর সেই বালিকা তাকে খুব আনন্দের সঙ্গে বিয়ে করলো।
পুরুষের চরিত্রে মেয়েদের শক্তি অসাধারণ। এই গুপ্ত রহস্য যেদিন আমাদের দেশের মেয়েরা বুঝবে, সেইদিন জাতির যথার্থ কল্যাণ হবে। মেয়েদের প্রভাবে পুরুষ পিশাচ হয়, তাদেরই প্রভাবে পুরুষ কর্মশীল, চরিত্রবান এবং সর্ব প্রকার কল্যাণ লাভ করে।
১ম–আমাদের দেশের মেয়েরা পুরুষের পায়ের বেড়ী।
২য় বন্ধু–নারী পুরুষের জীবনের ভার না হয়ে বরং আশীর্বাদ হবে, এইটেই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। শুধু কামুকতার জন্য নারী ব্যবহৃত হবে, এই মানসিকতা যারা পোষণ করে তারা নিতান্তই ভুল করে। কামুকতার বর্তিকা যেমন, পুরুষের জীবনে নারীও তেমন। নারীও মানব জীবনের আশীর্বাদ। এই নারী জীবনকে যারা সার্থক ও সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করে না তারা পাগল। নারীর কী কর্তব্য, জাতি গঠনে, যাদের স্পর্শে সে থাকে তাদের সম্বন্ধে আপন প্রিয়তম স্বামী সম্বন্ধে সে তার জীবনকে কতখানি সার্থক করতে পারে–এ জ্ঞান তার নেই।
১ম–নারী তো দাসী–সে কেবল কাজ করবে, সেবা করবে, হুকুম পালন করবে–তার কি আর কোনো কাজ আছে? তার জীবনের আর কি কোনো বিশেষত্ব আছে?
২য়–হ্যাঁ, নারীজীবন এদেশের যেমন বিশেষত্বহীন, এমনটি আর কোথাও নয়। পুরুষের-চাইতে নারী জীবনের মূল্য বেশি। নারীর চরিত্র-প্রভাব সমস্ত জাতির জীবনে পড়ে। নারী যদি জ্ঞানবতী হতো, তাহলে বুঝতে পারত তার জীবনের মূল্য কত বেশি, তার কর্তব্য কী-তার জীবনের বিশেষত্ব কী? শুধু সন্তান প্রসব করা, শুধু কামনার বস্তু হওয়া নারীর কাজ নয়,অথচ নারীকে শুধু ধারণাই দেওয়া হয়।
.
পিতামাতার দাবি পরচর্চা
১ম–বন্ধু। আমি একটা ছেলেকে জানি, সে তার বুড়ো বাপকে টাকা দেয় না, বলে বাপ বড় গরিব।
২য়–কেন, এরূপ হবার মানে কী? বাপের কোনো খবর নেয় না? সে কি নিজের ছেলেকে ভালোবাসে না।
১ম–হ্যাঁ, বাসে বইকি, কোলে করে, চুমো খায়।
২য়–বটে! তুমি কিছু শুনেছ না কি?
১ম–হ্যাঁ, বাপ আবার বিয়ে করেছে এই তার অপরাধ।
২য়–সে কি? বড় অন্যায় কথা। বাপ যদি বিপত্নীক হয়ে আবার বিয়ে করতে চান, তাতে কারো বাধা দেওয়া উচিত নয়। এমন কি মাকেও বাধা দেওয়া উচিত নয়, সেটা নিছক কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছু নয়।
১ম–মাতাপিতার সহিত পুত্রের সম্বন্ধ কী?
২য়–মাতাপিতা পুত্রকন্যাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন। তারপর আর কোনো কর্তব্য নাই।
১ম–পুত্রের কর্তব্য কী?
২য় –বিত্তশালী পুত্র মাতাপিতাকে প্রতিপালন করবে। এটা করা ফরজ। মাতপিতা যদি অবস্থাপন্ন হন, তবু নিজের আয়ের কিছু কিছু মাতা এবং পিতাকে পৃথক করে বা অবস্থা বুঝে একসঙ্গে দিতে হবে। পুত্রের অবস্থা যদি খারাপ হয়, তাহলে ধনী পিতামাতাকে কিছু না দিলেও দোষ নাই।
১ম–দরিদ্র পিতামাতাকে ত্যাগ করা কীরূপ?
২য়–এ মহাপাপ। কাপুরুষতা মনুষ্যত্বের পক্ষে লজ্জাজনক।
১ম–পিতামাতা যদি দুষ্ট ও বদমাইশ হন, তাহলে কি তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে না?
২য়–না, কখনও নহে। তাঁদের সঙ্গে সম্বন্ধ না রাখতে পার, কথা না বলেতে পার, কিন্তু তাঁদের খরচপত্র যোগাতে হবে। পিতা মন্দ হতে পারেন, কিন্তু মাতা পিশাচী হলেও তার প্রেমে কখনও সন্দেহ করো না।
১ম–পিতার খামখেয়ালীর জন্য অর্থ যোগান কীরূপ?
২য়–পিতার মোকদ্দমার খরচ, মারামারির খরচ, কিংবা কোনো খেয়ালী বাহুল্য খরচ পুত্র বহন করতে বাধ্য নয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগতভাবে সমাজ, মানুষ ও দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। একজন আর একজনের খেয়াল মেনে চলতে পারে না। তবে মোটের উপর বিরোধ জিনিসটা ভালো নয়। মুরুব্বীদের কর্তব্য সেয়ানা স্বাধীন পুত্র-কন্যাদের উপর অত্যধিক প্রাধান্য না দেখানো। ছোটদের কর্তব্য মুরুব্বীদেরকে যথাসম্ভব সম্রম করে চলা।
১ম–বাল্যকালের শিক্ষার দোষেই ছেলেমেয়েদের স্বভাব গঠিত হয়। ছেলেমেয়েদের স্বভাব মন্দ হয়। তবে সে কথা না বলাই ভালো। সমস্ত পুত্রকন্যাই জগতে নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
১ম–এই জন্যই উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে ছেলেমেয়েদের চরিত্র-গঠনের ভার দেওয়া উচিত।
২য়–দেশের পিতামাতা ছেলেদের মনের মনুষ্যত্ব জাগাবার কোনো বন্দোবস্ত করেন। তার ফলে ছেলেরা লেখাপড়া শেখে; কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, অনুদার, আত্মসুখানুসন্ধানেৎসু, মিথ্যাবাদী, প্রগলভ, অপবিত্রচিত্ত, অর্থলোভী এবং দাম্ভিক হয়ে ওঠে। ধিক এরূপ পিতামাতা।
১ম–আচ্ছা কোনো কোনো লোক মনে আঘাত পেয়ে সামনা সামনি উত্তর দিতে না পেরে অপরের কাছে যেয়ে মনের গরম প্রকাশ করে এবং তার সঙ্গে পরম বন্ধুত্বের ভাব দেখায়।
২য়–পরনিন্দা, পরচর্চা, ক্রোধ পোষণ-এসব ভালো নয়। যা হয় সবিনয়ে সামনা সামনি বলাই ভালো। তবে মূর্খ ও সত্যবর্জিত ব্যক্তিদের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলবে
–নিন্দাকার্যটি জীবনের ব্যবসা করে নেওয়া ঠিক নয়। যথাসাধ্য মানুষের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর। দোষ-গুণে মনুষ্য-স্বভাব গঠিত। সমস্ত মানুষকে যথাসম্ভব উত্তম মনে করতে চেষ্টা কর।
.
স্ত্রীলোকদের সাংসারিক আহার
১ম বন্ধু–কোনো কোনো পরিবার স্ত্রীলোকের আহার সম্বন্ধে বড়ই অমনোযোগী।
২য়–এরূপ পরিবার ধ্বংস হউক। যে পরিবারে নারীর অসম্মান হয়, সে স্থান হইতে আল্লাহর রহমত দূর হয়।
১ম–এরূপ কেন হয়?
২য়–অনেক সময় মেয়েরা নিজে কিছু না খেয়ে স্বামী ও পুত্রদেরকে সবকিছু দিয়ে ফেলেন। এমন কি বাড়ির মেয়ে যারা, দাসী যারা, তাদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না–এটা হৃদয়হীনতার পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
১ম–কিন্তু মেয়েরা যদি নিজ হস্তে নিজের অংশ জোর করে আদায় করেন, তাহলে তাদের নিন্দা চতুর্দিকে প্রচারিত হয়।
২য়–কোনো কাজেরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। একেবারে না খাওয়া কিংবা বাড়ির কর্তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী না হওয়া দুটিই দোষের। বাড়ির কর্তার শরীরটি ঠিক না থাকলে সমস্ত সংসারটাই অচল হয়ে পড়ে, সুতরাং তার সম্বন্ধে বিশেষ যত্ন নেওয়া চাই। আবার মেয়েরা যদি কিছু না খায়; অত্যধিক পরিশ্রমে, এর উপর ব্যাধি ও সন্তান প্রসবের আঘাতে তাদের শরীর অল্প সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে। বাড়ির কর্তার কর্তব্য মেয়েদের খাদ্যাদি সম্বন্ধে বিশেষ নজর রাখা।
১ম–টানাটানির সংসারে এবং একান্নভুক্ত পরিবারে কতগুলি লোকের এরূপ কষ্টই হয়ে থাকে যেখানে সকলের একজনের উপর নির্ভর করে, সেখানে একান্নভুক্ত পরিবারে কোনো অসুবিধা হয় না। তাতে প্রত্যেকেরই মনুষ্যত্ব ও কর্মশক্তি জাগ্রত হয়, পরিবারে কারো উপর অযথা অত্যাচার হয় না।
১ম–পরিবারের খরচপত্র সম্বন্ধে হিসাব রাখা কেমন?
২য়–এইটি দরকার। হিসাব না রাখা মুসলমান সমাজের একটি মস্ত বড় দোষ। সংসারের আয়-ব্যয়ের সহিত রীতিমতো হিসাব রাখা চাই। আয়-ব্যয় এর বিল কত এসব ঠিক রাখতে হবে। এর প্রভাবে পরিবারে, নানা প্রকার বিশৃঙ্খলা, মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়–অনেক অবিচারও হয়। প্রত্যেক পরিবারের কর্তব্য নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা। সব সময় পরিবারের Financial অবস্থা চোখের সামনে রাখেন।
১ম–পরিবারের কেউ যদি পীড়িত, দরিদ্র হয়ে পড়েন, তার সম্বন্ধে কী করতে হবে?
২য়–তার সম্বন্ধে প্রত্যেকেরই বিবেচনা করা কর্তব্য। তার অভাব-অভিযোগ পূরণ করতে হবে। কর্মহীন থাকলে সৎ পরামর্শ দিয়ে বা অর্থ সাহায্য করে তার জীবনের একটি গতি করে দিতে হবে। বস্তুত নিষ্ঠুরের ন্যায় চোখ-কান বুজে বসে থাকা উচিত নয়। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও প্রেম, এরই নাম ইসলাম। একটু থামিয়া কহিলেন–বন্ধু জীবন সম্বন্ধে এটু সূক্ষ্ম কথা বলে দিচ্ছি, মনে করে রেখ। কখনও সময়ের পূর্বে পর্যন্ত বিচলিত হয়ো নানা মরে ভূত হয়ো না;-পূর্ব হতেই ভীত হয়ো না-শেষ পর্যন্ত দেখো! ভবিষ্যৎ কী হয় বলা যায় না!–ছোট বড় সকল কাজেই এই নিয়ম।
১ম–কোনো কোনো পরিবার মেয়েদের কাপড়চোপড় সম্বন্ধে বড়ই টানাটানি করে।
২য়–নিজেদের পোশক-পরিচ্ছেদ যথেষ্ট আর মেয়েদের বেলায় যত অভাবের উল্লেখ এ অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। বুদ্ধিমান বিবেচনাশীল কর্তা যিনি তাঁরই এ সম্বন্ধে বিবেচনা চাই।
.
অবস্থার উন্নতি
২য় বন্ধু–কোনো পরিবার যদি বাড়িতে দালান-কোঠা দেয়, টাকা উপায় করে-তাকে অযথা বিশেষ প্রশংসা করতে পারি না। নিম্নস্তরের লোকদের কাজে পার্থিব উন্নতি খুব প্রশংসার বিষয় এর উল্লেখযোগ্য ঘটনা সন্দেহ নাই। কিন্তু তুমি কখনও কোনো জাগতিক ভাবে অর্থশালী লোক সম্বন্ধে বলো না–অমুক তোক বেশ উন্নতি করেছে।
১ম–তা আমি কখনও বলি না।
২য়–অসত্য, অন্যায়, মিথ্যাকে আশ্রয় করে যারা বড় লোক হয়–তারা কখনও ভদ্রলোক নয়, তাদের বাড়ির মেয়েরা সোনার গহনা পরুক। জাগতিক প্রাধান্যের জন্য কখনও অপবিত্র পথ অবলম্বন করে বড়লোক হতে নাই–কারণ জীবন ক্ষণস্থায়ী। আত্মাকে বিনষ্ট করে ২/৪ লোকের প্রশংসিত দৃষ্টি লাভ করে কী লাভ? ধর্ম প্রচারের জন্যে মানবসেবার জন্যে, আল্লাহকে প্রচার করবার জন্যে অর্থশালী হওয়া যায়–তাছাড়া লোককে জব্দ করব, জমিদারি করব এইসব উদ্দেশ্যে বড়লোক হতে ইচ্ছা করা হারাম। সত্যের পূজারী জ্ঞানের সাধক হয়ে দরিদ্র জীবন-যাপন করা বরং উত্তম।
১ম–অর্থ সঞ্চয় করা কেমন, বিপন্ন মানুষের কাছে ঋণ করা কেমন?
২য়–খোদার কার্য কর। তিনি তোমার যা কিছু জগতে প্রয়োজন তা দেবেন, দিবারাত্রি যদি টাকার ভাবনা ভাবলে, উপসনায় বসতে যদি জাগতিক অর্থ সম্পদের চিন্তা করলে, তাহলে তোমার খোদার চিন্তা কীভাবে হবে? বস্তুত দিবারাত্রি ‘হায় অন্ন’ ‘হায় অন্ন’ করতে থাকে।-এটা ধার্মিক জনের কাজ নয়। জীবনের কর্তব্য পালন কর। জাগতিক আকারে মীমাংসা হবে। নিশ্চয়ই হবে। খোদা মানুষের কার্যে কখনও মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেন নাই। আর যদি নাই হয়–তাতেও দুঃখ নাই।
১ম–তাহলে অর্থচিন্তা মোটেই করতে নেই?
২য়–আমি কি তাই বলছি? কতকগুলি লোক আছে যারা দিবারাত্রি অর্থের চিন্তায় থাকে, সেইটে দোষের। নীরবে মুখ বুজে কাজ করে যাও, অর্থ উপায়ের পথ দেখ। মহাপুরুষেরা বলেছেন অদ্য অদ্যকার জন্য, কল্যকার জন্য কল্যকার চিন্তাই যথেষ্ট। কল্যকার কথা ভাবতে নেই। কার্যক্ষেত্রে ঠিক এরূপভাবে মানুষ চলতে পারে না। ধর্মহীন লোকদের কাছে যাতে হাত পাততে না হয়, এজন্য কিছু কিছু সঞ্চয় করে রাখতে হবে। অভাবে মনুষ্যত্ব থাকে না–মনের উদারতা নষ্ট হয়, নিঃসম্বল কদৰ্পর্কহীন হয়ে পরের কাছে হাত পাতা গৃহস্থের পক্ষে বড়ই লজ্জা ও অপমানের কথা। অর্থশালী লোকেরা অনেক সময় হৃদয়হীন ও কটুভাষী হয়, কিন্তু এ সব দোষ যদি বড়লোকদের নাও থাকে, তবে তারা জগতের মহা-উপকারী ও সম্মানিত বান্দা। মহাপুরুষেরা বড়লোকদের কুস্বভাব ও হীনতা দেখে অর্থকে ঘৃণা করেছেন; কিন্তু সচ্ছল জিনিসটা নিন্দনীয় নয়, বরং এটি প্রত্যেক পরিবারের জন্য নিতান্ত প্রয়োজন। এটির অভাব বড়ই দোষের। জমিদারি, গাড়ি, ঘোড়া, রৌশন চৌকি, পাল্কি, চেয়ার এসব প্রয়োজন নাই। বেহুদা বে-আন্দাজি খরচ এবং অতিশয় কৃপণতা উভয়ই দোষের।
১ম–মুসলমান সমাজের দান বলে একটি কথা আছে। এর মহিমা সকলেই প্রচার করে থাকে। পতিতদের উদ্ধারের জন্যও দান আবশ্যক। এসব ক্ষেত্রে কৃপণতা করা উচিত নয়। তবে হরদম যাকে তাকে দান করায় কোনো লাভ নেই–দানের মহিমা সর্বত্র প্রচার করার চাইতে মানুষকে আল্লাহর ওয়াস্তে অর্থশালী, ব্যবসায়ী, সঞ্চয়ী হতে বলাই ঠিক। ভিক্ষুক মোল্লাদের পকেটে টাকা দেওয়ার চাইতে দেশের মঙ্গল হয় এরূপ বড় অনুষ্ঠানে দান করা উত্তম। দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর জন্য ছোট ছোট দানের আবশ্যকতা আছে। প্রত্যেক পরিবারে অন্তত একশ টাকা হরদম মজুদ থাকা চাই।
১ম–সংসারে খরচপত্র কি কর্তার হাতে হওয়াই ভালো?
২য়–বাজারের হিসাব পত্নী বা পরিবারের অন্য কোনো লোকের হাতে দেওয়াই ভালো।
সুন্দর লেখা