মোহিনী – উপন্যাস – সমরেশ মজুমদার
তাঁর দিন শুরু হয় রাতের সেই প্রহরে, যখন পৃথিবীতে যোগীরাই জেগে থাকেন। দীর্ঘদিন ওই একই সময়ে নিদ্রাদেবী তাঁকে মুক্তি দিয়ে যান। কোনো জানান দেওয়া ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। বিছানায় উঠে বসে তিনি বিশাল কাচের জানলার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে পর্দা এমন ভাবে ওখানে টেনে দেওয়া হয় যাতে তিনি একফালি আকাশ দেখতে পান। এ আকাশে কখনও হলুদ তারা জ্বলে কখনও মেঘ ময়লাটে। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে ওদিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকাটাও আজ তার অভ্যাসে মিশে গেছে।
সূর্য উঠতে এখনও অনেক দেরি। আর কে না জানে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই সময়টাই পৃথিবী পবিত্র থাকে! বিছানা থেকে মাটিতে দুটো পায়ের পাতায় সমানভাবে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই এখনও তাঁর সমস্ত শরীরে শিহরন ছড়ায়। এই শরীর, যার প্রতিটি শিরাকোষ বহু বহু ব্যবহৃত, যার প্রতিটির অস্তিত্ব তিনি যেন আলাদা করেই জানেন, এখন, এই মুহূর্তে, তারা ক্লান্তির কথা জানান দেয়। এবং তখনই সচল হন তিনি। সংলগ্ন টয়লেট থেকে যখন বেরিয়ে আসেন তখন জলের ফোঁটায় মুখ শীতল। এই সময় তিনি কখনোই আলো জ্বালেন না। এই আবছা অন্ধকার তাঁকে অনেক বেশি স্বস্তি দেয়। জানলার পাশে শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর শীতলপাটি বিছানো থাকেই। তিনি এবার শরীরের সমস্ত কোষ এবং শিরায় উদ্যম ছড়িয়ে দেন। সমস্ত ক্লান্তি সযত্নে মুছে নিয়ে ওদের সতেজ করে তোলেন। মাত্র দশ মিনিটের এই শরীরচর্চা, যা কিনা কয়েকটি আসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাঁর আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পুজোয় বসার আগে শুদ্ধি দরকার। এই দশ মিনিট তারই প্রস্তুতি।
পৃথিবীর যে-কোনো দেশ এবং আবহাওয়া তাঁকে আসনের পর স্নান থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। স্নানের সময় ঘর আবছা বা কখনও গাঢ় অন্ধকারে জড়ানো থাকে। চব্বিশ ঘণ্টার এই সময়টাই তাঁর শরীর নিরাবরণ, জলের ধারা নামে চুলের গোড়া ছুঁয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত। এখন আর শরীরের দিকে তাকান না তিনি। আর এই অন্ধকার সেই না-দেখার ইচ্ছেটাকে সাহায্য করে বিনীতভাবে। চোখ বন্ধ, কিন্তু মন আপাদমস্তক জরিপ করে নেয়। সবই ঠিক আছে। পায়ের প্রতিটি শিরা থেকে হাতের প্রতি রোমকুপ। কোথাও কোনো বিদ্রোহ অথবা নিস্পৃহতা নেই জানার পর তাঁর মুখে সেই অন্ধকারেই স্বস্তি ফুটে ওঠে।
নির্মল শরীর পরিষ্কার কাপড়ে জড়িয়ে তিনি তাঁর ঈশ্বরের উপাসনায় নিমগ্ন হন স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে। নটরাজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওই আবছা অন্ধকার শরীরে বিদ্যুতের জন্ম হয়। একটি চরণের ওপর শরীর রেখে, অন্যটি ঈষৎ ওপরে তুলে চার হাতে চার রকম মুদ্রায় যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর সামনে বসে তিনি প্রতি দিনের জীবন সংগ্রহ করেন। নটরাজ অমঙ্গলের সংহারক, সুন্দরের জন্মদাতা। নটরাজ, নৃত্যের যিনি সম্রাট, যাঁর নাচ আনন্দ এবং দুঃখের দ্বিবিধ অনুভূতিতে, কখনও একা, কখনও সদলে, প্রতি মুহূর্তে ছন্দের জন্মদাতা, সত্য ও শক্তির স্রষ্টা। সেই ঈশ্বরের সামনে বসে থাকতে তাঁর শরীরে-মনে কম্পন জাগ্রত হয়। যেন একটি প্রদীপ থেকে আর একটি প্রদীপের সলতে ধরিয়ে নেওয়া। আপ্লুত তিনি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানান সেই মুহূর্তে, যখন পূর্ব দিগন্তে সূর্যদেব দেখা দিতে প্রস্তুত।
উপাসনার পর তিনি এসে দাঁড়ান, ঘরের দরজা খুলে শ্বেতপাথরের বারান্দায়। যদিও বারান্দা শব্দটা সঠিক প্রয়োগ নয়। আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন আঠারো নম্বর ইন্দিরা মার্গের এই বাড়িটি। কেউ কেউ একে রানির প্রাসাদ বলে থাকে। প্রায় বাইশটি সাদা সিঁড়ি ভেঙে এ বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছাতে হয়। নির্জন ইন্দিরা মার্গে এমন সাদা বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। বাড়িটির ডান পাশ দিয়ে গাঁথুনি ওপরে উঠে বিস্তৃত হয়ে গেছে তার শোওয়ার ঘরের সামনে। একে বারান্দা বলা চলে কি না তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু তিনি দুটো হাত বুকের ওপর যুক্ত করে সেখানেই দাঁড়িয়ে সূর্যদেবকে আঁধার সরিয়ে উঠে আসতে দ্যাখেন।
যখন তিনি আলোকিত, তখন পেছনে শব্দ হয়। তিনি মুখ ফিরিয়ে কমলাকে দেখতে পান। স্নান সেরে কমলা এসেছে তার ইচ্ছে জানতে। তিনি প্রাতরাশে আজ কী পছন্দ করবেন, দুপুরে কী খাবেন! এই প্রশ্ন করতে আসাটা এখন নিয়মের পর্যায়ে এসে গেছে। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি যে খাবারের কথা বলবেন তাই প্রতি সকালে খেয়ে চলেছেন দীর্ঘকাল। কিন্তু তার এই সময় নানা রকম খাদ্যদ্রব্যের কথা ভাবতে ভাল লাগে। কমলাও অনভ্যস্ত রান্নার কথা বলে সুখ পায়। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে একটি কিশোরীকে সে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে দেখল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই সময়টুকু ছাড়া যার সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ কমলা পায় না।
ঠিক সাতটা বাজতেই সদর দরজার বেলের বোতামে চাপ পড়বে। দরজা খুলে দেবে শ্রীনিবাস। কমলার মতো পঁয়ত্রিশ বছর নয়, কিন্তু ওই প্রৌঢ়েরও দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর হয়ে গেল এই সংসারে। সংসার শব্দটা নিয়ে শ্রীনিবাসের খুব আপত্তি ছিল। কিন্তু কমলা তাকে বলেছে আপত্তি করার কিছু নেই। সঙ্গীতের সংসার। দরজা খুলে নমস্কার জানাবে শ্রীনিবাস। দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া প্রায় একই সঙ্গে প্রত্যহ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। মৃদঙ্গ বাদক শাস্ত্রীজী এবং শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী, যাঁর গলায় সুর স্বচ্ছন্দে খেলা করে। তারপরেই এই রানির প্রাসাদে মৃদঙ্গের বোল ওঠে। দুই প্রবীণ প্রবীণা একটি দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের প্রস্তুতিতে মগ্ন। আর সেই সময়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে তিনি নমস্কার জানাবেন সহশিল্পীদের, প্রণাম করবেন বাদ্যযন্ত্রগুলোকে। সহশিল্পীদের কাজ আরম্ভ এবং তার আগমন প্রায় ঘড়ি ধরে ঘটে যায় প্রতিদিন। এ ব্যাপারে তাকে নিয়ে বিরূপ গল্প প্রচলিত আছে। তার উগ্র মেজাজ, আপোসহীন কথাবার্তা নাকি কখনও কখনও ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মীর আগে যিনি তাকে কিছুদিন কণ্ঠসঙ্গীতে সাহায্য করতেন তিনি কিছুতেই সময়ে আসতে পারতেন না। কোনো কোনো মানুষের স্বভাবে সময় রাখতে পারাটা আসে না। তাঁকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে দুজনের বাদানুবাদও হয়েছিল। সে সময়ে ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু রূঢ় বাক্য ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটা সাংবাদিকরা জানতে পেরে তাঁকে প্রশ্ন করেন। তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, সময় আমার কাছে ঈশ্বরের মতো। যে মানুষ সময়ের অমর্যাদা করতে পারেন তিনি আমার ক্ষমা পাবেন না। আমি শুধু ঈশ্বরের জন্যেই অপেক্ষা করতে পারি কিন্তু কোনো মানুষের জন্য নয়।
সহশিল্পীদের সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময়ের পর রিহার্সাল শুরু হয়। ছয় ঘণ্টা ধরে পঞ্চাশ বছরের শরীর প্রতিটি পদক্ষেপ, মুদ্রার অঙ্গ সঞ্চালনে নিজেকে নিয়োগ করে নিঃশর্তে। ছয় ঘণ্টার এই অনুশীলন তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রতিটি পর্বের স্টাইল আলাদা। দ্বিতীয় বিরতির সময় কমলা সকালের খাবার নিয়ে আসে। তিনজনে বসে ইদলি, সম্বর আর দক্ষিণ ভারতীয় কফি পান করেন। দুপুর গড়িয়ে গেলে সহশিল্পীরা বিদায় নেন। ওঁদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেন তিনি। তারপর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার স্নানের ঘরে। এবং তার পরে পূজা। এই মুহূর্তে তিনি ব্রাহ্মণকন্যা। যে ব্রাহ্মণ মনে করেন, ব্রহ্মা বিষ্ণু এবং শিব জগতের নিয়ামক। ব্রহ্মা হলেন জ্ঞানের দেবতা। বেদ তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত। শিব সুন্দর, শক্তি এবং নৃত্যের দেবতা। আর বিষ্ণু, যাঁকে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি বরণ করে নিয়েছে, তিনি নানা অবতাররূপ ধারণ করে দুর্জনকে ধ্বংস করতে পৃথিবীতে যুগে যুগে ফিরে আসেন।
তাঁর পূজায় এই তিন দেবতা কোনো প্রাপ্তির কারণে নয়, স্বীকৃতির শ্রদ্ধায় নিবেদিত। যখন পৃথিবীর মানুষেরা নিজেদের মধ্যে স্থূল মারামারিতে ব্যাপৃত ছিল এবং বেদ শুধু ব্রাহ্মণদের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে কুক্ষিগত, তখন দেবরাজ ইন্দ্র ব্রহ্মাকে অনুরোধ করলেন এমন কিছু উদ্ভাবন করতে, যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণীয় হবে। চার বেদের মূলতত্ত্ব গ্রহণ করে ব্রহ্মা তখন শব্দ, সঙ্গীত, মূকাভিনয় এবং আবেগের মিশ্রণে পঞ্চম বেদ সৃষ্টি করলেন। তারপর ভরতমুনিকে ডেকে তাঁকে এই বেদে অভিজ্ঞ করে তুললেন। প্রাপ্ত জ্ঞান নিজের একশ সন্তানের মধ্যে বিতরণ করে ভরতমুনি তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন। কিন্তু এই পঞ্চম বেদে নৃত্যের কোনো স্থান ছিল না। দেবাদিদেব শিব ভরতমুনিকে পরামর্শ দেন নৃত্যকেও গ্রহণ করতে। কিন্তু নৃত্য সম্পর্কে ভরতমুনির কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় শিব তার প্রধান অনুচর নন্দীকেশ্বরকে নিয়োগ করেন সাহায্য করতে। সেই শুদ্ধ নৃত্যের বিস্তৃত বিবরণ অভিনয় দর্পণ এবং ভারতার্ণব। শিব, যিনি নটরাজ, তিনি নৃত্যের স্রষ্টা। নৃত্যকে পাঁচটি অধ্যায়ে তিনি বিভক্ত করেছেন। সৃষ্টি, রক্ষা, ধ্বংস, প্রত্যাখ্যান এবং আশীর্বাদ। আর এই পাঁচটি নিয়ে যে নৃত্যের যাত্রা শুরু, তার নাম ভরতনাট্যম। পূজার আসনে যতক্ষণ তিনি বসে থাকেন ততক্ষণ তার শরীরে যেন শিবের সেই ডম্বরু বাজতে থাকে মাতালের মতো।
পূজার পর মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশন করে কমলা। যদিও তখন প্রায় অপরাহ্ন। গত তিরিশ বছরে খাদ্যাভাস একটুও পাল্টায়নি যাঁর তাঁর কিন্তু কখনই খাদ্যগ্রহণে বিরক্তি আসে না। তিনি ঘরের আসবাবপত্রের স্থান প্রায়ই পরিবর্তন করেন, এমন কী দেওয়ালের রঙও। কিন্তু কৈশোরের অভ্যস্ত খাবার পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করননি। তাঁর পূজার ঘরে ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের ছবি, তিরুপতি মন্দিরের আলোকচিত্রর যেমন দেখা পাওয়া যায় তেমনি প্রায় প্রতিটি ঘরেই শিব রয়েছেন বিভিন্ন চেহারায়। বাদ্যযন্ত্র, বিশেষ করে মৃদঙ্গ, বাঁশি এবং বীণার দেখা পাওয়া যাবে ঘরে ঘরে। অবশ্য কমলা প্রায়ই এদের জায়গা বদল করে দেয়। কিন্তু কোনো দেওয়ালেই বাঁধানো মানপত্র অথবা প্রশংসাপত্র ঝোলে না, কোথাও পদকের চিহ্ন দেখা যায় না। যদিও গত তিরিশ বছর ধরে তিনি নিয়মিত ওসব পেয়ে গেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। কিন্তু কখনই চোখের সামনে রাখতে চান না।
খাওয়া শেষ হলে তিনি ফিরে আসেন টেবিলে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়মিত বন্ধুবান্ধবরা চিঠি লেখেন। সপ্তাহে দুদিন এই সব চিঠি পড়ে জবাব দেওয়া হয়। এই ব্যাপারে অনুষ্ঠান না থাকলে সেক্রেটারি তাকে সাহায্য করেন। মিস্টার আয়ার বস্তুত তার সমস্ত ব্যবসায়িক দিকটাই দেখে থাকেন। ভগবান ভেঙ্কটেশ্বরের ইচ্ছায় তিনি সৎ কর্মচারি পেয়েছেন।
মাতৃভাষায় লেখা চিঠিপত্র সহজেই পড়তে পারেন তিনি। তেমন একটি চিঠির কয়েক লাইন পড়তে পড়তে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। চিঠিটা শুরু হয়েছে এইভাবে, জানি না এই চিঠি আপনার হাতে পড়বে কিনা। আপনার মতো পৃথিবীবিখ্যাত ভরতনাট্যমের শিল্পীর কাছে যদি এই চিঠির সারমর্ম পৌঁছায় সেই আশায় লিখছি। আমার গ্রামের নাম পাণ্ডানুল্লুর। এই গ্রামে আপনি এককালে এসেছিলেন। পিতৃদেবের কাছে শুনেছি সেই সময় আপনি কথাকলি নৃত্যের ছাত্রী ছিলেন। দীর্ঘসময় আপনি আমার পিতামহের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। সেসব অনেক কাল আগের কথা। আপনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, আমার পিতামহকে ভরতনাট্যম নৃত্যের একজন শ্রদ্ধেয় সেবক বলা হয়ে থাকে। তিনি এই গ্রামেই সব রকম বৈভব থেকে দূরে থেকে সাধারণ জীবন যাপন করে পরিণত বয়সে দেহ রেখেছিলেন। সেই মানুষটির শততম জন্মজয়ন্তী এই মাসের বাইশ তারিখে। আমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া কি আপনার পক্ষে সম্ভব হবে? আমার আর্থিক সঙ্গতি নেই। এই অনুষ্ঠান গ্রামের দরিদ্র মানুষ, যাঁরা ভরতনাট্যম নাচকে এখনও ভালবাসেন, বোঝেন, তাঁদের জন্যেই। বিনীত আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, নানা পিল্লাই।
ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটে। সেটা ছড়িয়ে পড়ল দু-প্রান্তে। নানা কে? সেই রোগা কালো কিশোর, যাকে তার পিতামহ কখনই অনুশীলনের সময় ঘরে ঢুকতে দিতেন না? এত বছর পরে তার নাম মনে নেই। যদি সেই কিশোরই হয় তাহলে তারা সমবয়সী। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। এই একই ভুল মানুষেরা বারংবার করে যায়। পরিচিতির গণ্ডিটা অনেক বড় করে ফেললে অতীতের পরিচিত দূরের মানুষ হয়ে যায়। শুধু নানা পিল্লাই নয়, অতীতের অনেককেই মনে করে আজ আর তাদের কাছে পৌঁছানো যাবে না। এটা অবশ্য সব সময় খারাপ কাজ করে না। কিন্তু গুরুদেবের জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি নিস্পৃহ থাকবেন তা এরা ভাবল কী করে! মিস্টার আয়ারের জন্যে অপেক্ষা করলেন না তিনি। সুন্দর চিঠি লেখার প্যাডটা টেনে নিয়ে কলম খুললেন, ভাই নানা, আপনার চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সত্যি কথা বলছি আমি আপনাকে স্পষ্ট স্মরণ করতে পারছি না। তার কারণ পাণ্ডানুল্লুরে আমি যখন ছিলাম তখন গুরুদেব আমাকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, অন্য সব স্মৃতি গৌণ হয়ে গিয়েছে। আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি এখন খুবই ব্যস্ত। দেশ এবং বিদেশের নানান জায়গায় আমাকে আগামী মাসগুলোতে অনুষ্ঠান করতে যেতে হবে। সেকারণে অনুশীলনের প্রয়োজন। কিন্তু একটি জায়গায় আপনি ভুল করেছেন। আমাকে গঠন করেছেন তাঁকে অস্বীকার করা মানে আমার জীবনকে অস্বীকার করা। কারণ নৃত্যই আমার জীবন। বাইশ তারিখে আমার জন্যে সময় রাখবেন। বিনীত, আপনাদের আশা রাও।
একটু আগে আয়ার সাহেব বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। চিঠিপত্রের উত্তর কী হবে জেনে নিয়ে সেগুলো পরিচ্ছন্ন টাইপে রূপান্তরিত করে সই করিয়ে নিয়েছেন। আগামী তিন মাসে তার যে অনুষ্ঠান স্থির ছিল আজকের চিঠির জন্যে পরিবর্তন করতে হওয়ায় আয়ার সাহেব বেশ বিরক্ত হয়েছেন। গৌহাটি থেকে পাণ্ডানুল্লুর, ফিরে এসে আবার তাঁকে কলকাতায় যেতে হবে। মাঝখানে শিলঙ-এর উদ্যোক্তাদের হতাশ করতে হবে। কিন্তু যতই বিরক্ত হন আয়ার সাহেব কখনই প্রকাশ করেন না সরাসরি। তিনি বুঝে নেন। আজ মনটা ভাল লাগছে। নানার চিঠি তো বটেই, নিউইয়র্ক থেকে পুরনো বন্ধু হেনরি টার্নার চিঠি লিখেছে। হেনরি তাঁর প্রথম আমেরিকান ট্যুর স্পনসর করেছিল। হেনরি লিখেছে, সবই তো জানি, তবু মানতে পারি না তোমার এই একাকিত্ব। বিশদ জানতে চাই। আয়ার সাহেব মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। কী উত্তর হবে তা জানতে তিনিও উন্মুখ। আশা চোখ বন্ধ করেছিলেন ক্ষণিক। তারপর জবাব দিয়েছিলেন প্রশ্নটির, আমার একটা গোপন আকাশ আছে যেখানে আমি ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। আর একটা কথায় এর জবাব দেওয়া যায়, এখনও অনেকটা পথ সামনে পড়ে রয়েছে।
আয়ার সাহেব চলে যাওয়ার পর আশা বাইরের বারান্দা অথবা চাতালে চলে এলেন। নীচে ইন্দিরা মার্গ আলোয় আলোকিত। সমস্ত শহরে হিরে জ্বলছে। কিন্তু মুখ তুললেই নীল আকাশ। কী শান্ত। লম্বা ডেকচেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে থাকতে আশার খুব ভাল লাগে। চেয়ারটা এমন, শরীর এলিয়ে দিলেই আকাশ আর তারারা সরাসরি চোখের ওপর উপুড় হয়ে আসে। এই সময় কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। কোনো অতিথিকে কমলা আপ্যায়ন করবে না। এমনকী রাতের খাবারের জন্যে দরজায় এসে দাঁড়াবে না। তার জানা আছে তিনি অপরাহ্নের পর রাত্রে আর কিছু গ্রহণ করেন না। ফ্লাস্কে খুব ঠাণ্ডা দুধ রেখে দিয়ে যাবে কমলা। যদি ইচ্ছে হয় শোওয়ার আগে তাই খেয়ে নেবেন।
আশা রাও। আজ এই শব্দ দুটো সমস্ত ভারতবর্ষের মানুষের চেনা। কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি দান করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এর আগে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির সম্মান তিনি পেয়েছেন। পদ্মভূষণ পেতে কার না ভাল লাগে। কিন্তু সেখানেই একটা গোলমাল হয়ে রয়েছে। পদ্মভূষণ দেওয়া হয়েছে তাঁকে তাঁর নাচের জন্যে। রাষ্ট্রপতি ভবনে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে একমাত্র তাঁকেই। কিন্তু এ কেমন কথা! ভরতনাট্যমের শিল্পী হিসেবে তিনি কী করে তাঁর সহশিল্পীদের অস্বীকার করেন? তাঁর নাচের প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্দর হতো না, যদি এঁরা না থাকতেন। তাই এঁদের ফেলে তিনি একা ওই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন না। আয়ার সাহেবকে এই চিঠি লিখতে বলেছিলেন তিনি। সই করাবার আগে আয়ার মৃদুস্বরে বলেছিলেন, সরকারি অফিসার এই চিঠি পেয়ে বিরক্ত হতে পারেন।
উষ্ণ হয়েছিলেন আশা, কে কী হল তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না আমি। যা অন্যায় তার সঙ্গে আপস করা মানে ঈশ্বরের আরাধনার অধিকার হারানো। সেই চিঠির উত্তর এখনও আসেনি। আশা চোখ বন্ধ করলেন। কখনও কখনও তারারা চোখের মণিতে অস্বস্তি তৈরি করে। ছুঁচলো শলাকার মতো বিদ্ধ করে।
ম্যাঙ্গালোরের সেই গ্রামে কতকাল যাওয়া হয়নি। যার একদিকে সমুদ্র আর কাজুবাদামের জঙ্গল, যে গ্রামের মেয়েদের সুন্দরী হিসেবে খ্যাতি ছিল সেই গ্রাম তাঁর জন্মভূমি। পিতামাতার একমাত্র সন্তান যদি কন্যা হয় তাহলে পৈতৃক বাড়ির স্থায়িত্ব বেশিদিন হয় না। আত্মীয়-স্বজনের পরিমণ্ডল ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। ম্যাঙ্গালোরের সেই গ্রামের মাটির সঙ্গে আজ তাঁর কাছে ভারতবর্ষের যে-কোনো জায়গার মাটির কোনো প্রভেদ নেই। একটিও মানুষ সেখানে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে নেই, যার কাছে যাওয়ার জন্যে হৃদয় উন্মুখ হয়।
পিতা বলতেন তাদের শরীরে কাশ্মীরের শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের রক্ত আছে। কয়েকশো বছর আগে তারা একটি পবিত্র নদীর সন্ধানে কাশ্মীর ছেড়ে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন।
পঞ্চাশ বছর আগে যে মেয়ে রাও পরিবারে জন্মেছিল, বিধাতা তার শরীরে অসুখের পাকা বন্দোবস্ত করে দিতে চেয়েছিলেন। কারণে অকারণে ভুগত সে। শরীর হাড়সর্বস্ব, মুখে লাবণ্যের চিহ্ন নেই। গরম অথবা ঠাণ্ডা মানেই বিছানায় শুয়ে থাকা। এ মেয়ের ঘরের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। বাড়ির লোকেরা তাকে কখনই গেট পর্যন্ত যেতে দেয়নি। একটু বড় হওয়ার পর যখন স্কুলে যাওয়ার সময় হল, তখন অসুস্থতা প্রায়ই বাধা হয়ে উঠত। আশার পিতৃদেব দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারতেন না। মোটামুটি সফল ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। আশার আরোগ্যের জন্যে সবরকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কোনো চিকিৎসকের ঔষধ কাজ করছিল না। কোনো সমবয়সী বন্ধু আশার কাছে আসতে আনন্দ পেত না। বালিকার সর্বসময়ের সঙ্গী বাড়ির প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা। এই সময় আচমকা তাঁর পিতৃদেব পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। মুহূর্তেই বালিকার জীবন থেকে স্নেহ ভালবাসার বাড়ানো হাত সরে গেল। এবং তখনই সেই বালিকা আবিষ্কার করল শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে স্নেহ ভালবাসার বঞ্চিত বেদনা অনেক বেশি কষ্টকর। আর এই বোধ তার মনে জেদের জন্ম দিল। তাকে বাঁচতে হবে। তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবেই, কোনো আপস নেই। কারণ কেউ তার হাতে প্রিয় জিনিস তুলে দেবে না। কিন্তু লক্ষ্যটা কী তাই তো ছিল অজানা। এই সময় সে নটরাজের মূর্তি দেখতে পেল। নৃত্যের স্থির প্রতিকৃতি। রোগজীর্ণ-দুর্বল শরীর নিয়ে সেই নৃত্যরত ভঙ্গির অনুকরণ করতে চেষ্টা করত সে। দুটো হাতে চার হাতের মুদ্রা ফোটাতে চাইত আর এই করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল আশা। মা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন নাচ শিখতে চায় কি না। গৃহ চিকিৎসক উপদেশ দিল নাচ এক ধরনের ব্যায়াম যার ধকল সহ্য করতে পারলে শরীরের উন্নতি হবে। বালিকা এসব গ্রাহ্য করত না। সে শুধু অনুভব করত নটরাজের অনুকরণ করলেই শরীরে রোমাঞ্চ জাগে। শেষ পর্যন্ত মা তাঁকে নিয়ে গেলেন গ্রামের একজন নৃত্য শিক্ষকের কাছে। ভদ্রলোক খুব গরিব। একটু পাগলাটে স্বভাবের। নাচ নিয়েই থাকেন সারাদিন। ফলে অভাব হাঁ করে বসে থাকে তাঁকে ঘিরে। আশার দিকে একপলক তাকিয়ে তিনি মাকে বলেছিলেন, মেয়েকে খুন করতে চান করুন কিন্তু আমাকে জড়াবেন না। ওই হাড়ে নাচ হয় না।
কথাটা শুনে আশা কেঁদে ফেলেছিল। হকচকিয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তারপর সামলে নিয়ে কিছুটা রসিকতার ছলে জিজ্ঞাসা করেছিলেন শরীরটাকে দোলাও তো। মানে যেকোনো নাচের একটা ভঙ্গি করো তো দেখি। হাঁটু ঢাকা ফ্রক সামলে আশা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর নটরাজের চেনা ভঙ্গিটির অনুকরণ করল সে। কিন্তু আজ তার পা কাঁপতে লাগল। হাত ভারী হয়ে উঠল। নৃত্যশিক্ষকের চোখে সামান্য বিস্ময়। দুটো হাত বুকে জড়ো করে বলেছিলেন, যা করলে তার মানে জানো? জানো না। ডম্বরু হল সৃষ্টির উৎস। হাতের মুদ্রায় যে আশা তা রক্ষা করবে জগতকে, রোষাগ্নি ধ্বংস করবে অমঙ্গলকে আর পদক্ষেপ মুক্তি দেবে যন্ত্রণা থেকে। বসো।
এই সব কথাবার্তার একটা অর্থও তার বোধগম্য হল না। কিন্তু যখন লোকটি তাকে এই কথাগুলো বলেছিলেন তখন সে যে একটি বালিকা তা যেন ভাবছিলেন না। মুখ চোখে যে আন্তরিকতা তা আশাকে নিজের সম্বন্ধে নতুন করে ভাবাল। কেউ তাকে বড়দের মতো সম্মান দিচ্ছে এ অভিজ্ঞতা তার প্রথম। অতএব মানুষটির কথাবার্তা সে না বুঝলেও ভাল লাগল। শিক্ষক তাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সে বসেছিল বাবু হয়ে। মাথা নিচু করে। হঠাৎ এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শিক্ষক বললেন, মুখ তুলে তাকাও। হ্যাঁ। কী নাচ শিখতে চাও তুমি? কথাকলি না ভরতনাট্যম?
মা বললেন, ভরতনাট্যম।
হঠাৎ ওকে নাচ শেখাতে এনেছেন কেন?
আসলে ও খুব অসুখে ভোগে। ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাকে বলল নাচ শিখলে–
কি? শিক্ষক চেঁচিয়ে উঠলেন, আমি ব্যায়াম করিয়ে আপনার মেয়ের শরীর সারাব? মোটেই নয়। নিয়ে যান ওকে কোনো ব্যায়ামাগারে। এটা নাচ শেখার জায়গা।
মা খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। কথাটা ঠিকঠাক বলা হয়নি বুঝতে পেরে অনুনয় করতে লাগলেন। শিক্ষকের মত পরিবর্তনের জন্যে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষক রাজি হলেন। কিন্তু তারপর থেকে যে শিক্ষা শুরু হল তার বিবরণ বাড়িতে দিতে অসুবিধে হত। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আর শিক্ষক তাকে ভরতনাট্যমের ইতিহাস বলতেন। আগে মনের মধ্যে নাচটাকে নিতে হবে তারপর শরীরে ফোটাতে হবে অভিব্যক্তি। কী করতে যাচ্ছ সেটাই যদি না জানো তাহলে করাটা অন্ধ অনুকরণের বাইরে যাবে না কোনদিন। মা জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন নাচ শিখছিস একটু দেখা! কিন্তু সেটাই হতো না। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগত। কিন্তু এক সময় জড়িয়ে গেল সে।
ভরতনাট্যম হল একমাত্র ভারতীয় নৃত্য, যা বহুযুগ ধরে অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে। নাট্য শাস্ত্রানুযায়ী এই শিল্পের তিনটি ভাগ, নৃত্ত, নৃত্য এবং নাট্য। নৃত্ত যে অংশে অঙ্গবিক্ষেপ তা পরিমণ্ডল সাজানোর কাজেই লাগে, কোনো মানে তৈরি করে না। কিন্তু নৃত্ত হল শুদ্ধ নাচের মূলস্তম্ভ। আর নৃত্য হল অর্থবহ। হাতের বিভিন্ন মুদ্রায়, মুখের অভিব্যক্তি, মূকাভিনয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন শিল্পী। নাট্যে, কখনও চলতি কথার সাহায্যে, অভিব্যক্তি ও অভিনয়ের মাধ্যমে, শরীর সঞ্চালনে একটি নাটকীয় জগত সৃষ্টি করেন শিল্পী। কিন্তু সরলীকরণের সূত্রে ভরতনাট্যমের প্রকাশ এখন দুটো খাতে। নৃত্য আর অভিনয়। ভারতীয় নৃত্যকলায় মানুষের শরীর নিয়ে নানান পরীক্ষা হয়েছে। শরীরের ওজন এবং তার ব্যালেন্স স্থির রাখার চিন্তা মাথায় রেখেই নৃত্যের উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যাকর্ষণ থিওরির যথার্থ প্রয়োগ নাচের বিভিন্ন ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায়। কখনও কখনও অঙ্কের হিসেবে নাচের কম্পোজিশন তৈরি বলে মনে হবে।
নাচ শুরু হবে সমাপদ অবস্থা থেকে। নাচের এটাই প্রথম অবস্থা যেখানে পা সামনের দিকে থাকবে। নাচিয়ের শরীর সহজ ভঙ্গিতে থাকবে। খুব সচকিত অথবা অলস নয়। এরপর দুটো পা দুপাশে নিয়ে যাওয়ার অবস্থাকে বলে কলাই তিরুপুডাল। অর্ধমণ্ডলী আসছে এর পরে। এখানে শুধু পা-ই নয়, হাঁটুও দুপাশে নামিয়ে আনতে হবে।
শিক্ষক প্রথম অনুশীলন শুরু করালেন এই অবস্থায়, সমাপদ থেকে অর্ধমণ্ডলী। পায়ে জড়তা এবং কোমরে অস্বস্তি। বারংবার সে বিফল হচ্ছিল। শিক্ষক মাথা নাড়লেন, না, যতক্ষণ তুমি অর্ধমণ্ডলীতে পৌঁছাতে না পারছ, ততক্ষণ আমি আর একটা কথাও বলছি না, পুরো ব্যাপারটা আবার দেখে নাও। প্রথমে পা দুপাশে নিয়ে যাবে, হাঁটু বেঁকিয়ে আনবে এবং হাত হয় দুপাশে ছড়িয়ে দেবে। অথবা কোমরে শক্ত করে রাখবে। জ্যমিতি বোঝো? একদম জ্যামিতিক নিয়মে এই ভঙ্গি অনেকটা ত্রিকোণ সৃষ্টি করবে। তোমার কাঁধের রেখা একটা ত্রিকোণের জন্ম দেবে, আবার কোমর থেকে পায়ের বিস্তার থাই এবং পায়ের গুলির মাধ্যমে ত্রিকোণকে দৃশ্যমান করবে। মাটিতে পায়ের অবস্থান সঠিক রাখা খুব জরুরি। দুটো পা এমনভাবে জমি স্পর্শ করবে যাতে শরীরের ওজন ঠিকঠাক বিভক্ত হয়। পায়ের পাতা মাটিতে সমানভাবে রাখার নাম টাট্টু। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুধু পায়ের আঙুলের ওপর শরীরের ওজন রেখে গোড়ালি উঁচু করতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ে শরীরের ভার থাকবে গোড়ালির ওপর আর আঙুল উঠে আসবে ওপরে। অর্ধমণ্ডলী অবস্থায় এই তিন পর্যায়ে পায়ের সঞ্চালন। এর পরে দুটো পায়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে একই ভঙ্গির বিনিময় ঘটবে।
এখন ভাবতে অবাক লাগে অর্ধমণ্ডলী অবস্থায় স্বচ্ছন্দ হতে সেই রুগণা বালিকার তিন সপ্তাহ লেগেছিল। নাচের প্রথম নিবেদনের নাম যে আলারিপ্পু তাই জানতে কতদিন লেগে গিয়েছিল। ঈশ্বরকে অভিজ্ঞান এবং দর্শকদের অভিনন্দন জানানোর জন্যেই আলারিপ্পু চিহ্নিত। এটি ভরতনাট্যম নাচের স্বল্পমেয়াদী পর্যায়। নৃত্য শিল্পীর কাছে এই পর্যায় শরীর গরম করে নেওয়ার সুযোগ এবং দর্শকরা সুযোগ পান শিল্পীর কলাকৌশলের একটা প্রাথমিক আন্দাজ তৈরি করার। আলারিপ্পুর অর্থ হল কুঁড়ির প্রস্ফুটন। হাত, চোখ, ঘাড় এবং শরীরের পাঁজরার সঞ্চালনে ভূমিতে নামার আগে ভূমিকার কাজ করে।
আশার দিনগুলো খুব আনন্দে কাটত যদি শিক্ষকটি সুস্থির হতেন। মানুষটি সব সময় একই মেজাজে থাকতেন না। একদিন তিনি ডুবে যেতেন শিক্ষকতায় অন্যদিন বিনা কারণে আশাকে ফিরিয়ে দিতেন। ফলে শিক্ষার ধরাবাহিকতায় প্রায়ই বিঘ্ন ঘটত। মন ভাল থাকলে তিনি বলতেন, নাচ হল ঈশ্বরের আরাধনায় মানুষের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এই পূজার জন্যে আগে নিজেকে তৈরি করতে হয়। সাধারণ মানুষ যা পারে না তা অর্জন করতে একজন শিল্পীকে দীর্ঘদিন অনুশীলন করতে হয়। কিন্তু এই জ্ঞান অন্য কোনো উদ্দেশ্যের জন্যে আহরণ করা পাপ। তুমি যা শিখবে তা কখনই বসন্তের কোকিল যারা, তাদের শেখাবে না। এই কথাগুলো আশা কোনোদিন ভুলতে পারেননি।
ভরতনাট্যম নাচের ইতিহাস এবং তার গঠন নিয়ে মোটামুটি খবর জানা এবং শরীরের প্রাথমিক চর্চা আশাকে আরও বেশি উৎসাহী করে তুলল। যিনি মনে করেছিলেন যে আশা নাচ শিখলে তার শরীরে পরিবর্তন হবে তিনি খুশি হলেন। কিন্তু আশা বুঝতে পারছিল না যে তার সামনে আর কিছু নেই। তার পাগল শিক্ষককে সব সময় পাওয়া যায় না। গেলেও যে মানুষ তিন-চার রকম নাচের জগতে এক সঙ্গে প্রবেশ করেন তার দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত থাকে। এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই আশা বাইরের বারান্দায় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সে কৌতূহলী হয়ে বাইরের ঘরে ছুটে গিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল শিক্ষক এবং তার কাকা মুখোমুখি বসে আছেন চেয়ারে। মা দাঁড়িয়ে আছেন সামান্য দুরে। বাইরে তখন সূর্যদেব উঠেছেন কী ওঠেননি। কিন্তু পৃথিবীতে একটা হালকা আলো নেমেছে।
শিক্ষক বললেন, আমার মনে হচ্ছে এই কথাগুলো আপনাদের বলা উচিত। এখানে এসে মনে হল আসবার সময়টা ঠিক নির্বাচন করিনি। মুশকিল হল আমি নিজের জীবনের ক্ষেত্রে বারংবার একই ভুল করে গেছি বলেই তার দাম মিটিয়ে যাচ্ছি।
কাকা গম্ভীর গলায় বললেন, আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। ভোরবেলায় ওঠায় আমরা অভ্যস্ত। শিক্ষক মাথা নাড়লেন খুশিতে, বাঃ। মন ভাল হল। আপনাদের মেয়েকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল নাচের পরিশ্রম সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু এমন জেদী এবং আগ্রহী মেয়ে এর আগে আমি দেখিনি। ওর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে। আমার চিনতে ভুল হয়নি। এই মেয়ে যদি নাচ শেখার সুযোগ পায় তাহলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমার পক্ষে হয়তো আরও কিছুদিন ওকে শেখানো সম্ভব। কিন্তু আমি চাই ও এই নরম অবস্থাতেই সঠিক গুরুর সঙ্গ লাভ করুক। এই অনুরোধ জানাতেই এখানে আমার আসা।
কাকা মায়ের দিকে তাকালো। মা নিচু স্বরে বললেন, কিন্তু গাঁয়ে সেই রকম মানুষ–।
আহা! আমাদের গ্রামটাই কি পৃথিবী! দক্ষিণ ভারতে অনেক গুণী সাধক আছেন। শিক্ষক বললেন, আপনারা রাজি থাকলে তাঁদের কারো সঙ্গে আমি যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।
কাকা মাথা নাড়লেন, আপনি একটা কথা বুঝতে ভুল করছেন। ছোট মেয়ে গ্রামের শিক্ষকের কাছে নাচ শিখল, সেটা এক ব্যাপার। আর কিছু দিন পরে ভাল পাত্র খুঁজে ওকে বিয়ে দিতে হবে। ওর বাবা নেই, কর্তব্য আমারই। এই অবস্থায় গ্রামের বাইরে গিয়ে নাচ শিখে কী লাভ হবে!
শিক্ষক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। সেই দৃষ্টির সামনে কাকাও যেন সংকুচিত হলেন। শিক্ষক বললেন, এসব কথা তো আমাকে আগে বলেননি। আর যে পাঁচটা মেয়ে বিয়ের জন্যে আমার কাছে নাচ শিখতে আসে আশা যদি তাদের দলে বলে জানতাম তাহলে এই ভোরে আপনাদের বিরক্ত করতাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে তিনি। মা তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, আপনি কি আর ওকে নাচ শেখাবেন না?
না। যে মেয়েকে নিয়ে আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন তার চেহারা কীরকম ছিল? ওষুধ খাইয়ে যাকে সুস্থ করতে পারেননি তার বিয়ে কী করে দিতেন আপনারা? বাড়িতে রুগণা অসুস্থ হয়ে যদি বাকি জীবন পড়ে থাকত তাহলে খুশি হতেন? না, আর আমার প্রয়োজন নেই। শিক্ষক আর দাঁড়াননি। হনহনিয়ে গেট খুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আর দরজার আড়ালে আশার ছোট্ট শরীরটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। পায়ের তলায় ভূমিকম্প শুরু হল যেন। এবং তার পরেই আশার শরীরটা মাটিতে পড়ল সম্বিত হারিয়ে। শব্দটা শুনে ছুটে এলেন আশার মা, কাকা।
দুদিন ধরে অঝোরে চোখের জল পড়া আর বুকের খাঁচায় যন্ত্রণা দেখার পর কাকা যে কখন গেছেন শিক্ষকের কাছে তা তার জানা নেই। হঠাৎ ঘরে সেই মানুষটার আবির্ভাব হল। তাদের মতো ব্রাহ্মণ পরিবারে বাইরের লোককে সচরাচর অন্তঃপুরে আনা হত না। বিছানার পাশে এসে তিনি দুই হাতে আশার ছোট্ট গাল স্পর্শ করলেন। তারপর বললেন, তুমি এত বোকা মেয়ে কেন? আমি তো ভাবতেই পারছি না। সব সময় বলেছি বুকের ভেতরে যে মন আছে তাকে শক্ত করবে। ওঠো, উঠে বসো। একজন শিল্পী কখনও চোখের জল ফেলে না। সে রক্ত দিয়ে জল পড়ার কারণটাকে জয় করে। কী হল, উঠে বোসো! সেই ধমক খেয়ে উঠে বসল আশা কাঁপতে কাঁপতে। তার শরীর পারছিল না। কিন্তু ওই স্পর্শ, ওই শব্দগুলো যেন শারীরিক দৌর্বল্যকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করল। শিক্ষক বললেন, তৈরি হও, তোমাকে কেরালায় যেতে হবে।
তখনও শরীরে যৌবন আসেনি। নারীত্বের কোনো চিহ্ন ফুটে ওঠেনি আশার শরীরে। কৈশোরের ক্রমাগত অসুস্থতা তার শরীরকে এমন কাহিল করে তুলেছিল যে বয়সের তুলনায় তাকে বেশ ছোটই দেখাত। সেই মেয়ে মায়ের স্পর্শ ছাড়া অন্য কিছুর অভাব বোধ করেনি যখন কাকার সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে রওনা হল। শিক্ষক কারো অনুরোধ ছাড়াই তাদের সঙ্গী হলেন। মহাকবি ভি এম মেনন শোরানপুরে কথাকলি নৃত্যনাট্যের যে কলামণ্ডলম তৈরি করেছিলেন শিক্ষক সেখানেই আশাকে প্রথমে নিয়ে গেলেন। প্রথমবার বাড়ির বাইরে পা দিয়ে, অচেনা মানুষের মধ্যে এসে আশা নিজের মতো করে কিছুই ভাবতে পারছিল না। সব কিছুই তার কাছে এমন নতুন ও চমক নিয়ে উপস্থিত হচ্ছিল যে সে তাতেই বুঁদ হয়ে ছিল। প্রচুর মন্দিরের শহর। চারপাশ ছোট পাহাড়ে ঘেরা।
কলামণ্ডলমের প্রধানাধ্যক্ষ তাকে দেখলেন। একটি শীর্ণা মেয়ে, যার শরীরে কোনো পরিশ্রম সহ্য করার শক্তি আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে বললেন, তোমাকে এখানে আনা হয়েছে কেন? তুমি কি নাচ জানো?
আশা অসহায় চোখে শিক্ষকের দিকে তাকাল। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁকে নীরব থাকতে অনুরোধ করলেন প্রধানাধ্যক্ষ। দ্বিতীয়বার প্রশ্নের পর আশা মাথা নাড়ল, না। প্রধানাধ্যক্ষের মুখে হাসি ফুটল, তাহলে? কিছুই কি জানো না?
আমি ইতিহাস জানি আর জানি কীভাবে শুরু করতে হয়!
কীসের ইতিহাস? কীসের শুরু?
ভরতনাট্যমের। আশা ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল।
দেখা যাক। যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই দেখাও কী জানো।
আশা স্থির মনে আলারিপ্পু পরিবেশন করল। প্রধানাধ্যক্ষের মুখে হাসি ফুটে উঠল আবার, যে শুরুটা জানে তার শেষ জানতে চাওয়ার নিশ্চয়ই অধিকার আছে। তবে সব সময় মনে রেখো শিল্পের কোনো শেষ নেই। কোথাও শিল্প থেমে থাকে না।
কিন্তু কলামণ্ডলম অথবা অ্যাকাডেমি অফ আর্টসের অধ্যাপক মেনন প্রচণ্ড আপত্তি জানালেন আশার ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে। কলামণ্ডলমে কোনো ছাত্রী নেই। আসলে মেয়েদের পক্ষে এত পরিশ্রম সহ্য করা সম্ভব নয় জেনেই কখনই তাদের ভর্তি করা হয় না। যদিও কোনো লিখিত আইন নেই কিন্তু প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে যাওয়া মেননসাহেবের অভিপ্রেত নয়। তাছাড়া তার ধারণায় কথাকলি নাচ পুরুষশিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। প্রতিদিন রাত আড়াইটের সময় শিল্পীরা অনুশীলন শুরু করেন। চোখের বিভিন্ন ভঙ্গির অনুশীলন দিয়ে যার শুরু, তার শেষ বারো ঘন্টা পরে। এই কঠোর শ্রম পুরুষেরাই শুধু সহ্য করতে পারে বলে মেয়েদের ভর্তি করা হয় না।
প্রধানাধ্যক্ষ মেননের সঙ্গে একমত হলেন, হ্যাঁ, ওই পরিশ্রম এইটুকু মেয়ে সহ্য করতে পারবে না। হঠাৎ আশা বলে উঠল, পারব। আমি পারব।
অনেক আলোচনার পর স্থির হল আশাকে সুযোগ দেওয়া হবে। যদি সে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে যে সব ছাত্রী এখানে ভর্তি হতে চাইবে তাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে রাখার সুবিধে হবে। অধ্যাপক মেনন বললেন, তুমি ভেব না মেয়ে বলে তোমাকে বিশেষ সুবিধে দেওয়া হবে। এতগুলো শাসানি মাথায় নিয়ে আশা কলামণ্ডলমের ছাত্রী হল।
কথাকলি ভরতনাট্যমের মতো একক নৃত্য নয়। কত্থকের মতো রাজ দরবারের নৃত্য নয় অথবা মণিপুরী নৃত্যের কাব্যধর্মিতা এতে নেই। কথাকলির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার নাট্যধর্মিতা। রূপকথা বা উপকথার জগত থেকে দেবতা, দৈত্য বা আত্মারা জমজমাট পোশাকে নেমে এসে কথাকলি নাচে, একটি নাটকীয় পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে। কথাকলি নৃত্যে নাচিয়ের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অংশগ্রহণ করে। অন্য কোনো ভারতীয় নৃত্যে হাড় এবং পেশীর এমন ব্যবহার হয় না। পেশী, বিশেষ করে মুখের পেশীর সঞ্চালন অনুশীলন পর্বে প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে। আশার ছোট্ট শরীরের পক্ষে এই পরিশ্রম খুব কষ্টকর। কিন্তু তবু সে মুখ বুজে সহ্য করছিল। প্রায় দুবছর ধরে সে প্রতিটি অনুশাসন মেনেছে। এমনকী মেনন সাহেবের মতো কড়া অধ্যাপকও স্বীকার করেছেন যে এই মেয়েটি ব্যতিক্রম।
কিন্তু কথাকলির মধ্যে ডুবে গিয়ে আশা আবিষ্কার করল তার মন ভরছে না। এই সময়ের মধ্যে সেই কিশোরীর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিশ্রম করার ক্ষমতা, জেদ এবং নিজেকে যাচাই করে বোঝার শক্তি তাকে ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। এই সময় কাকা এলেন তাকে দেখতে। এবং তখনই সে মনের কথা জানাল। এখানে তার মন ভরছে না, কলামণ্ডলম বা কথাকলির জগৎ তার জন্যে নয় বলে বিশ্বাস হচ্ছে। একজন গুরু চাই যিনি তাকে সঠিক পথে পৌঁছে দিতে পারবেন। কাকা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন যে এইখানেই তার থাকা উচিত। কী অসুবিধে হচ্ছে জানালে তিনি তার প্রতিবিধান করতে পারেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার কী মনে হচ্ছে এত পরিশ্রম সহ্য করতে পারছ না?
সে উত্তর দিয়েছিল, না। তার উল্টো। আমার মনের পরিশ্রম হচ্ছে না।
এইরকম ভাষায় কথা বলতে পারে আশা তা ধারণাতেই ছিল না। কাকা বুঝলেন ব্যাপারটা আর সাধারণ পর্যায়ে নেই। এতদিন যে ছিল পাহাড়ের ঘেরের মধ্যে আটকে থাকা ছোট্ট পুকুর, সেই এখন মুখ খুঁজে নিয়ে ঝরনায় রূপান্তরিত হয়ে নদী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এখন আর অন্য কোনো পথ নেই। অনিচ্ছা থাকলেও তার কর্তব্য হচ্ছে একে সঠিক পথে চালিত করা।
প্রধানাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। পরিষ্কার বললেন তার নিজের তেমন কোনো ধারণা নেই। কিন্তু মেয়ে কথাকলি নাচের গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাইছে না। সে আরও বড় জায়গায় পৌঁছাতে চাইছে। এক্ষেত্রে তাঁর কী করা উচিত। প্রধানাধ্যক্ষ প্রথমে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। কথাকলি নৃত্যনাট্যের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তিনি কখনই বরদাস্ত করতে পারেন না সেই ছাত্রীকে, যে এতে সন্তুষ্ট নয়। পরিচিত পৌরাণিক গল্প, অভ্যস্ত সঙ্গীত, প্রতীকধর্মী মেকআপ, স্টাইলাইজড পোশাক কথাকলি নৃত্যনাট্যের দর্শককে একটা আকাঙ্ক্ষিত জগতে সহজেই নিয়ে যেতে পারে। একমাত্র কথাকলি নৃত্যনাট্যেই সেই প্রাচীন ঐতিহ্য এখনও রয়েছে, যেখানে নাট্যগুণ রসসৃষ্টিতে সক্ষম। এই নৈপুণ্য অন্য ভারতীয় নাট্যশালায় প্রায় লোপ পেতে বসেছে। প্রধানাধ্যক্ষ আশাকে ডেকে পাঠালেন।
ঘরে ঢুকে আশা গুরুজনদের প্রণাম সেরে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। প্রধানাধ্যক্ষ মেয়েটিকে ভাল করে লক্ষ্য করলেন। তার হঠাৎ খেয়াল হল কোনো শিক্ষকই আশা সম্পর্কে কখনও অভিযোগ করেনি বরং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং গ্রহণ করার জন্যে উৎসাহ দেখে সবাই প্রশংসাই করেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
তোমার এখানে ভাল লাগছে না?
মাথা নিচু করেই আশা জবাব দিল, ভাল লাগছে।
তাহলে এখান থেকে চলে যেতে চাইছ কেন?
আমার তো মায়ের কাছে থাকতে খুব ভাল লাগত। তবু তো এত দূরে এসেছিলাম।
প্রধানাধ্যক্ষ কথাগুলো শুনে অবাক হলেন। এমন ইঙ্গিতে রূঢ় কথা সরল গলায় যে জানিয়ে দিতে পারে সে সহজ মেয়ে নয়। তিনি আর শাসনের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবু খানিকটা পরীক্ষা করার গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কথাকলির প্রাথমিক পাঠ তোমার নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে এখানে আর কিছু শেখার নেই?
আমার একথা বলার মতো স্পর্ধা যেন কখনও না হয়। কিন্তু আমি একক নৃত্যের মাধ্যমে নিজের কথা বলতে চাই।
কেন? পৌরাণিক চরিত্ররা কী আমাদের কথাই বলে না? দলগত অভিনয়ের মাধ্যমে সেই জীবন কী স্পষ্ট হয় না?
আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ, বলে। কিন্তু তাদের দশটা কথার একটা কথা আমার। যে পাখি খোলা আকাশে উড়তে চায় তার কী বড় খাঁচায় ডানা মেলতে ভাল লাগে? আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দলগত অভিনয় দর্শকের কাছে অর্থবহ এবং দৃষ্টিনন্দন। তাতে নাট্যরস বেড়ে যায়। কিন্তু আমি একজন অভিনেত্রী হিসেবে অন্যের জীবন পরিস্ফুট করে যাচ্ছি। কিন্তু সেই সুখটা তো নকল সুখ।
প্রধানাধ্যক্ষ আচমকা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি ভরতনাট্যম শিখতে চাও?
এবার চোখ তুলল আশা, আপনারা যদি সুযোগ করে দেন।
প্রধানাধ্যক্ষ হাসলেন, বেশ। তোমার ইচ্ছেই পূর্ণ হোক। যে অধ্যবসায় এবং মানসিকতা তোমার লক্ষ্য করছি তাতে এইটুকু বলতে পারি সাধনা থেকে যদি তুমি ভ্রষ্ট না হও তাহলে একদিন তুমি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীর স্বীকৃতি পাবে। এখন তুমি যাও, আমি তোমার অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করব।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেল আশা কথাকলি নৃত্যনাট্যে আর আগ্রহী নয়। কারণ সে মনে করে কথাকলি তাকে তেমন কিছু দিতে পারছে না। ফলে এই নিয়ে রসিকতা যা রীতিমতো আক্রমণের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হল। ছাত্ররা তাদের একমাত্র সহ-শিক্ষার্থিনীকে হারাবার আশঙ্কায় বিমর্ষ এবং ক্রুদ্ধ হল। শেষের দলটিকে ইন্ধন জোগালেন সেই সব শিক্ষক, যাঁরা কথাকলিকেই শ্রেষ্ঠ নৃত্য মনে করেন। এখনও এই বয়সে পৌঁছে কোনো কোনো সাংবাদিক অতীতের সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলেন। কথাকলিকে তুচ্ছ করার মতো দুঃসাহস এবং হীনমানসিকতা তার কোনোকালেই ছিল না একথা আর কতবার বলবেন তিনি। সবাই সব কিছুর জন্যে তৈরি হয় না। নদীর মতো তাকে নিজের খাত খুঁজে নিতে হয়। সেই খোঁজার চেষ্টাই সেই সময় বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন সবাই। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আবার তালিম নিয়ে তিনি কথাকলি নৃত্যনাট্যে অংশ নেবেন। অন্তত ওই নাচের প্রতি তিনি যে অশ্রদ্ধা পোষণ করেন না, এতে প্রমাণিত হবে। কিন্তু এখন যেভাবে সময় নিয়ন্ত্রিত, তাতে বাড়তি সময় বের করা সম্ভব নয়।
প্রধানাধ্যক্ষের পরামর্শে কাকা দুদিন পরে তাকে নিয়ে যাত্রা করলেন। যাত্রা করার সময় কয়েকজন বন্ধু তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তাদের মধ্যে একজন, শ্রীনিবাসন, কেঁদেই ফেলেছিল সবার সামনে। তখন তাদের বয়স পনেরো ছোঁয়নি। কিন্তু শ্রীনিবাসন যে অমন করবে সে ভাবেনি। কিন্তু আশার চোখে জল আসেনি। এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছে। যখনই কোনো নতুন সাধনার উদ্দেশ্যে আগের মাটি থেকে শেকড় তুলতে হয়েছে তখন কোনো পিছুটান অনুভব করেনি সে। সব সময় তার আগামীদিনের আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রধানাধ্যক্ষের সঙ্গে কাকার কী কথা হয়েছিল আশা জানে না কিন্তু যেতে যেতে তিনি তাকে। বলেছিলেন, মনে রাখবে তুমি একটি তীর্থক্ষেত্রে যাচ্ছ। একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তোমার কোনো পার্থক্য নেই। তীর্থযাত্রী যেমন তীর্থক্ষেত্রে পৌঁছে জাগতিক সুখের সন্ধান করে না, তার লক্ষ্য থাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধন্য হওয়া তেমনি তুমিও সেইমত আচরণ করবে। হয়তো প্রধানাধ্যক্ষ কাকাকে বলেছিলেন তার মন প্রস্তুত করে দিতে। এসব বলার পরেও কাকা নিচু স্বরে বলেছিলেন, তবে আমার মনে হয় এত কষ্টের মধ্যে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল। তোমার মায়ের তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। ঈশ্বরের আশীর্বাদে যখন এই দুই বছরে অসুখবিসুখ আর ফিরে আসেনি তখন সংসারধর্ম করার ব্যাপারে অসুবিধে হবেনা। আশা অন্যদিকে তাকিয়েছিল, কথা শেষ হতে সে নিজের অজান্তেই এমনভাবে কাকার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল যে তিনি আর প্রসঙ্গ টানতে চাননি। এই মানুষটিকে তার এক সময় খুব কড়া প্রকৃতির বলে মনে হত। কিন্তু যত তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে লাগল তত মনে হচ্ছিল মানুষটির চারপাশের দেওয়ালগুলো একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে।
সারারাত জেগে ওরা যখন পাণ্ডানুল্লুর গ্রামে পৌঁছেছিল তখন সবে ভোর হয়েছে। তবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় আশার শরীরে এক ফোঁটা ক্লান্তি নেই। তখনও গ্রামের মানুষের ঘুম ভাল করে ভাঙেনি। শক্ত মাটির পথ দিয়ে ওর হেঁটে আসছিল আধফোঁটা রোদ্দুরে। সেই সাতসকালে এক প্রৌঢ় তার কাজে যাচ্ছিলেন, কাকা নাম বলতেই তিনি নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে ওদের পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে এলেন একটি ছোট্ট ঘরের সামনে। দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ঘরটিকে কুঁড়েঘর বললে ঠিক বলা হবে। দরজা বন্ধ।
ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে দরজার গায়ে। কাকা তাকেই ইশারা করলেন দরজায় আঘাত করতে। সেই বন্ধ দরজায় শীর্ণা মেয়েটি মৃদু আঘাত করল। কোনো শব্দ এল না ভেতর থেকে। আশা কী করবে বুঝতে না পেরে কাকার দিকে তাকাল। কাকা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন উদ্বিগ্ন মুখে। আশা আবার দরজার দিকে ফিরল। এমন কিছু মজবুত নয়। সে এবার শব্দ করল বেশ জোরে। এই ঘরের ভেতরে যিনি আছেন তিনি ভরতনাট্যম নাচকে নিজের মধ্যে যেভাবে সঞ্চয় করেছেন সেভাবে আর কেউ এই মুহূর্তে পারেননি। সেই তাঞ্জোর রাজাদের সময় থেকে এই শাস্ত্রে যেসব পণ্ডিত পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন ইনি তাদের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। এসব কাকা তাকে বলেছেন আসবার সময়।
দরজা খুলল। ঘরের অন্ধকারে বাইরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই বৃদ্ধ দেখা দিলেন। প্রথমে বিস্ময়, তারপর শীর্ণ মেয়েটিকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আশা দেখল তার সামনে যে কালো জীর্ণ শরীর এসে দাঁড়িয়েছে তার লজ্জা নিবারণ হয়েছে একটি লেংটির মাধ্যমে, মুখে অজস্র বলিরেখা এবং একটি চোখ অন্ধ। কোনো পরিচয় জিজ্ঞাসা না করে বৃদ্ধ বললেন, এসো, ভেতরে এসে বসো তোমরা। কথাগুলো বলেই তিনি চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
দৃশ্যটি আশাকে বাকরহিত করে তুলেছিল। তার সমস্ত চেতনা এক সঙ্গে জানান দিয়েছিল যে সে প্রকৃত গুরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল। এই সময় কাকা পেছন থেকে এগিয়ে বসে তার পিঠে হাত রাখলেন, চলো। আমরা তাঁর দেখা পেয়েছি।
ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা চওড়া মাদুর দেখতে পেল ওরা। প্রায় সমস্ত ঘর জুড়ে সেটি পাতা। পাশেই আর একটা দরজা। বোধহয় সেখানেই তিনি শুয়েছিলেন। কাকা বসলেন মাদুরের ওপর। সে দাঁড়িয়ে দেখল ঘরের এক পাশে মৃদঙ্গ রয়েছে। আর কোনো আসবাব নেই এখানে। খানিকবাদে তিনি আবার বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে। এবার তাঁর কোমর থেকে সাদা কাপড় জড়ানো। খানিকটা ভদ্র হবার চেষ্টা আর কী। তিনি এসে দাঁড়ানো মাত্র আশা এগিয়ে গিয়ে তার দুই পা স্পর্শ করে বসে পড়ল। এক মুহূর্ত পরে মাথার ঠিক মাঝখানে হাতের স্পর্শ পেল সে। এটা সেই ধরনের স্পর্শ যার মাধ্যমে আশীর্বাদ অনুভব করা যায়। তারপর প্রশ্ন করলেন, ইনি আপনার মেয়ে?
কাকা নমস্কার করলেন অর্ধনত হয়ে, আজ্ঞে না, আমার দাদার মেয়ে। দাদা নেই।
ওহো। একটা বিষাদের স্বর ফুটে উঠল গলায়। একটু সময় নিলেন এবং সেই সময় বোঝা গেল তার কথা বলার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোত্থেকে আসছেন আপনারা?
কাকা তাঁকে সব কথা খুলে বললেন। তিনি তার ভাল চোখটি বন্ধ করে সব শুনলেন। তারপর আশার দিকে তাকালেন, দু’বছর শিক্ষা নেওয়ার পর তোমার মতি পাল্টালো। কিন্তু তুমি কী শিখেছ তা তো আমাকে দেখাতে হবে মা।
প্রায় এক ঘন্টা পরে তিনি ইঙ্গিত করলেন আশাকে মাদুরের ওপর বসতে। কোনো যন্ত্র নেই, সঙ্গীতের সহযোগিতা নেই, নিজের মুখে শব্দ উচ্চারণ করে শরীর সঞ্চালন করতে করতে আশার মনে আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হচ্ছিল, সে কিছুতেই ফিরে যাবে না। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, এবার তুমি বলো ঠিক কী চাও তুমি? কত কষ্ট সহ্য করতে পারবে?
আপনি যা আদেশ করবেন, সে তড়িঘড়ি বলে উঠল, আমি আজ থেকে আপনার কাছে শিখতে চাই।
তিনি হেসে মাথা নাড়লেন, তা সম্ভব নয়।
কেন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল আশা।
নিজের জীর্ণ বুকের খাঁচার ওপর হাত রাখলেন তিনি, এই শরীর বাদ সেধেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। বিশেষ করে বছরের এই সময়। শরীরও আর আগের মতো মনের কথা শোনে না। সেই কারণেই নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের আমি শিক্ষা দিতে পারি না।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল আশা, কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাব না।
সেই এক চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তুমি খুব জেদী, না?
আশা মাথা নিচু করল। এর জবাবে কী বলতে পারে সে। হঠাৎ তার কানে গেল, তেই ইয়া তেই ইয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আশা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’বার ডান পা মাটিতে ঠুকল। ডান, ডান, বাঁ, বাঁ বা ডান।
এই প্রথম পর্যায়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ ছেলেমানুষের খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। ইশারায় তিনি কাছে ডাকলেন। আশা কম্পিত পায়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখ দুলিয়ে বসতে বললেন। আশা পা মুড়ে বসতেই তার এক চোখ দীর্ঘক্ষণ তার চোখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎই প্রশ্নটা ছিটকে এল, তুই পারবি? সমস্ত শরীর নড়ে উঠল আশার, চোখের পলক না ফেলে বলল, পারব।
পাণ্ডানুল্লুর গ্রামটি খুব বড় নয়। কিন্তু এ গ্রামের মানুষেরা তাদের জীবনযাত্রার মধ্যে সঙ্গীত এবং নৃত্যকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছেন যে আশার দিনগুলো চমৎকার কেটে যাচ্ছিল। যতক্ষণ আবহাওয়ার পরিবর্তন না ঘটছে ততক্ষণ গুরুদেব সক্রিয়ভাবে তাকে শিক্ষা দেবেন না। তার শরীর সেটা দিতে তাকে সাহায্য করবে না। প্রথমে কথাটা শোনার পর মন ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অপেক্ষা করার ধৈর্য তার ছিল না। প্রতিদিন গুরুদেবের সামনে বসে কথা শুনতে হবে অথচ নাচ শিখতে পারবে না এ কেমন কথা।
কিন্তু দিন গড়াতে আশা ধৈর্য ধরতে শিখল। কাকা চলে গেছেন সেইদিনই। যাওয়ার আগে তার এখানে থাকার ব্যবস্থা করে গেছেন গুরুদেবের ছেলের সঙ্গে কথা বলে। গুরুদেব এই বাড়িতে থাকেন একা। কিন্তু পাশেই তাঁর পরিবারের লোকজনেরা থাকেন। গুরুদেবের তিন ছেলে এবং অনেক নাতি নাতনি। ছেলেরাও ভাল নাচেন কিন্তু নাচ নিয়ে সর্বক্ষণ থাকেন না। পিতার প্রতিভা তাঁরা পাননি কিন্তু পিতার প্রতি শ্রদ্ধায় সব সময় নিবেদিত প্রাণ। গুরুদেবের নাতি নানা পিল্লাই কিন্তু নাচ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। ওই ঘরে ঢুকে শরীর সঞ্চালনের বদলে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, টিলায় ওঠা, নদীর জলে ডুব দিতে তার বেশি ভাল লাগত। আর এই কারণে নাচের ঘরে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতে তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। সে থাকত নিজের মনে। আশা তারই সমবয়সী। ফলে আশার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করত। সেটা এমন একটা সময় যে সমবয়সী ছেলের সম্পর্কে মেয়েদের কৌতূহল জাগবেই। কিন্তু সেই কালো দামাল ছেলেটা তাকে খুব একটা টানত না। বরং একা একা টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়াবার সময় নাচের মুদ্রায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি আরাম লাগত। কীভাবে মেঘেরা শরীর ভাসায় দেখার পর সে ভাসতে চেষ্টা করত, গাছেরা হাওয়ার দোলায় যেভাবে ডাল দোলায় তার অনুকরণ করার চেষ্টা করত। একদিন একটি বিরাট পাথর দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। পাথরটি কুঁজো হয়ে যেন সমস্ত ছন্দ বন্ধ করে মহাকালের মতো স্থির হয়ে বসে রয়েছে। সারাটা দুপুর কেটে গিয়েছিল সেই পাথরের মতো স্থির হয়ে শরীরটাকে অর্থবহ করতে। এবং এই একাকী ঘুরে বেড়ানো তাকে একটি আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গেল। প্রকৃতির বাইরের চেহারাটা চোখের আরাম দেয় কিন্তু তাকে ঘিরে মনের আবর্ত তৈরি হলে নতুন অর্থ তৈরি হয়ে আসে। আর সেই বেরিয়ে আসা অর্থটি সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
আশার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল নানা পিল্লাইদের বাড়িতে। কিন্তু সেখানে সে থাকত হাতে গোনা সময়ে। ভোর হলেই সে চলে যেত তাতার কাছে। গ্রামের সমস্ত মানুষ গুরুদেবকে ওই নামেই ডাকত। বৃদ্ধ ঘুম থেকে উঠে তাকে বসতে বলতেন হাসিমুখে। যেদিন তার নিঃশ্বাসের কষ্ট হত সেদিন কথা বলতে পারতেন না। যেদিন শরীর একটু ভাল থাকত সেদিন গল্প করতেন।
তেই ইয়াম দাত তা তেই ইয়াম তা হা। পায়ের গোড়ালির ওপর শরীরের ভর রেখে পাতা ওপরে রাখতে হবে। তারপর এক পা সামনের দিকে প্রসারিত করতে হবে ডান বা বাঁদিকে। তারপর সেই পা ফিরিয়ে আনতে হবে, পেছনের পায়ের পাশে।
তৃতীয় পর্যায়ে আসছে তাত্ তেই তাম্। সমান পাতায় শরীরের ভর রেখে আঙুলের ওপর সামান্য এগোনো। পায়ের আঙুল থেকে গোড়ালির মধ্যে সঞ্চালন শুরু হল।
একটু একটু করে নবম পর্যায়ের বিশদ বিবরণ তাতার মুখে শুনতে পেল আশা। সে মনে মনে গেঁথে নিল বোলগুলো, তেই ইয়াম্ দাত, তা তেই ইয়াম্ তা হা, তাত্ তেই তা তেই হাত তেই হি, তাত তেই তা হা, তেই তেই তা, ডি ডি তাই। অষ্টম পর্যায়ে নিঃশব্দে শরীরের ভঙ্গি পরিবর্তন এবং নবম পর্যায়ে তা ডিট ডিট তাই। এসবের শুরুতে প্রথম বোল তেই ইয়া তেই ইয়ে তো রয়েছেই। কিন্তু ভরতনাট্যমের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নবম পর্যায়ের বিস্তারে পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল অংশটি নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। সাহিত্য ও স্থাপত্য বলছে ভরতনাট্যম পরিবেশিত হত একক এবং দলগতভাবে। উনিশ শতকে তাঞ্জোরের চার ভাই, চিন্নার্য, পন্না, ভাদিভেলু এবং শিবানন্দন দলগত নৃত্যের বদলে একক নৃত্যে পুরোপুরি ভরতনাট্যমকে নিয়ে আসেন। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, ভরতনাট্যম নাচ সাধারণত মন্দিরে ঈশ্বরের সামনে পরিবেশিত হত কিন্তু রাজদরবারের নৃত্যের সঙ্গে এর পার্থক্য প্রমাণ করে দুটো নাচের শুধু অভিব্যক্তিতে।
দুমাস কাটানোর পর আশার মনে হল তাদের গ্রামের শিক্ষক যে কথা গল্প করে বলতেন সেই সব কথার সঙ্গে তার কথার কোনো পার্থক্য নেই। শুধু সেই মানুষটি কখনই এক বিষয়ে স্থির। থাকতেন না। কিন্তু তাতা সেই বিষয়ের গভীরে তাকে নিয়ে যেতেন। সক্রিয় শিক্ষা শুরু হবার আগে তাতা তাকে নির্দেশ দিলেন মাকে দর্শন করে আসতে, কারণ তিনি মনে করেন মায়ের আশীর্বাদ না পেলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তাতার এক ছেলে আশাকে পৌঁছে দিয়ে এল বাড়িতে।
সেই প্রথমবার আশার মনে হল সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না পরিচিত পরিবেশে। যেখানে সে জন্মেছে, যে চৌহদ্দিতে তার শৈশব কেটেছে সেখানে কোনো কিছু নতুন করে পাওয়ার নেই। এমন কী খুড়তুতো ভাই বোনেদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শুধু মায়ের পাশে শোওয়ার পর তিনি যখন তার গায়ে হাত রাখেন তখন সমস্ত শরীর-মনে একটা শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে ফিরে আশা যে দুঃসংবাদটি পেয়েছিল তা সে বাকি জীবনে ভুলতে পারেনি। তার সেই শিক্ষক, যিনি নাচ ভালবেসেছিলেন নিজের মতো করে, একটি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। মাঝ রাতে একটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি এমন আশঙ্কা করা হয়েছে। হঠাৎ পরিচিত পৃথিবী থেকে একটি বিশেষ মানুষ উধাও হয়ে গেছে, সমস্ত চেষ্টাতেও যার হদিস পাওয়া সম্ভব নয়, আশাকে নাড়িয়ে দিল। নিজের পিতৃদেবের মৃত্যু তাকে এই বোধ দেয়নি। কারণ তখন তার নিজস্ব অনুভূতির জন্ম হয়নি। সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় সেই খেয়ালি মানুষটিকে যিনি বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন না। তাকে তো অনেকেই আধ পাগল বলত। সাংসারিক নিয়মের বাঁধাপথে মানুষটি কখনও চলেননি। কিন্তু আশাকে নৃত্য সম্পর্কে প্রথম অবহিত করেছিলেন এই মানুষটি। নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বপ্নের দরজায়। এখনও মাঝে মাঝে আশার গোলমাল হয়ে যায় ঠিক কাকে তার গুরুদেব বলা উচিত? তাতা না সেই শিক্ষককে।
তাতার কাছে ফেরার তাগিদ আশাকে বেশিদিন শোকভিভূত রাখতে পারেনি। কিন্তু ফেরার সময় এবার একটা কাণ্ড হল। কাকার শরীর খারাপ তাই কাকার এক ছেলে তাকে পৌঁছে দিতে চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ মা ঘোষণা করলেন তিনি সঙ্গে যাবেন। তিনি নিজের চোখে দেখে আসতে চান তাঁর মেয়ে কীরকম পরিবেশে থাকছে। দূরত্বটা অনেক কিন্তু প্রৌঢ়া কিছুতেই নিরস্ত হলেন না। শেষ পর্যন্ত কাকাও বললেন, তোমার মায়ের যাওয়া দরকার। কারণ আমি তো পিল্লাই পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি; তিনি গেলে সেটা সম্ভব হবে এবং আমরাও নিশ্চিন্ত হব। অতএব মা চললেন সঙ্গে। বাড়ি থেকে বের হবার পর কিন্তু আশার খুব ভাল লাগল মায়ের সঙ্গ। পথের সব কিছুতেই মায়ের কৌতূহল, আশারও।
মায়ের জন্যেই স্টেশনে নেমে গরুর গাড়ি নেওয়া হল। অবশ্য দূরত্বটা কম নয়। এখানে পাঁচ সাত ক্রোশ মানুষ অক্লেশে হেঁটে যায়। পাণ্ডানুল্লুরের কাছ দিয়ে অবশ্য রাস্তা গিয়েছে বাসের, হাঁটতেও হয় না বেশি, কিন্তু গরুর গাড়িতে চেপে আশারও ভাল লাগল। বেশ হেলতে দুলতে প্রকৃতিকে একটু একটু করে আবিষ্কার করা যাচ্ছিল।
গ্রামে যখন পৌঁছাল ওরা, তখন সূর্য মাথার ওপরে। আশার বার তর সইছিল না। ওকে দেখে যারা এগিয়ে এসেছিল তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা দুলিয়ে সে মায়ের হাত ধরে চলল তার কাছে। তার ঘরের দরজা খোলা। তিনি বসেছিলেন দেওয়ালের সামনে। কয়েকজন শিল্পী তাঁর কাছে সম্ভবত তালিম নিচ্ছিল। মৃদঙ্গে বোল উঠছিল। দরজায় তাদের দেখে তাতা মুখ তুলে চাইলেন। এবং তারপরই ওঁর মুখ হাসিতে ভরে উঠল। দ্রুত ব্যবধান ঘুচিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকাল আশা। বৃদ্ধের শীর্ণ আঙুল তার মাথায়, তিনি বললেন, বাঃ তুমি এসে গেছ! যেন তার আসার পথ চেয়েছিলেন তাতা। খুশিতে মন ভরে গেল আশার। সে মুখ তুলে বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন আমার মা।
তাই? কোথায় তিনি? সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকালেন তাতা। তারপরেই দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করে বললেন, আসুন। আমি ভাল দেখতে পাই না। মা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তারপর নতজানু হয়ে তার পা স্পর্শ করতে করতে সবাইকে অবাক করে সশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটল যে আশা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেল। হাত বাড়াতে গিয়েও তাতা থেমে গেলেন। ঘরের অন্য মানুষেরা চুপচাপ দৃশ্যটি দেখছেন। শেষ পর্যন্ত তাতা বললেন, মা আপনি শান্ত হন।
আমি পারছি না, আমি আর সইতে পারছি না। মা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।
আমাকে যদি একটু খুলে বলেন–। তার গলায় মমতা।
ওকে ছেড়ে আমি আর থাকতে পারছি না। পৃথিবীতে ওই মেয়ে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আপনি ওকে বুঝিয়ে বলুন। মায়ের কান্না জড়ানো শব্দগুলো কানে আসামাত্র আশা কাঠ হয়ে দাঁড়াল। এ কী বলছেন মা? এতটা পথ আসবার সময় সে বুঝতেই পারেনি এখানে মায়ের আসার উদ্দেশ্য কী! সে তীব্র গলায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। মা তখন বলেই চলেছেন আশা তার জীবনের কতখানি। অল্প-স্বল্প নাচ শেখাতে তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু গ্রামের যে শিক্ষক প্রথম আশাকে নাচ শিখিয়েছিলেন তিনি মারা যাওয়ার আগে একদিন তাকে বলেছিলেন, আশা যদি সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠে তবে তার জগৎ হবে আলাদা, সেখানে মা দাদা বোনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই কথা শোনার পর তিনি আর চান না মেয়ে পর হয়ে যাক।
ততক্ষণে শক্তি ফিরে পেয়েছে আশা। এগিয়ে এসে মায়ের বাজু ধরে বলল, তুমি ওঠো।
মা সেই কথায় কান দিলেন না, আমার বুকে জমে থাকা কষ্ট আমি কাউকে বলিনি। এমনকী ওই মেয়েকেও নয়। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হল আপনি আমাকে বুঝতে পারবেন।
আশা কেঁপে উঠল। তার ভবিষ্যতের ওপর একটা কালো পর্দা নেমে আসছে। মায়ের কথা শুনে তাতা তাকে এইবার বলবেন চলে যেতে। এবং তা যদি হয় তাহলে সে গ্রামে ফিরে গিয়েই কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখন যদি কোনোমতে মাকে তাতার সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া যেত! চুপচাপ শুনছিলেন তাতা, এবার কথা বললেন, মা, আমি আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি বলুন তো, আপনার সন্তান যখন বিবাহের পর স্বামীর ঘরে চলে যাবে তখন আপনি কী করবেন? সেই একাকিত্ব সহ্য করবেন কী করে?
মা একটু থমকে গেলেন। তারপর দৃঢ় গলায় বললেন, তখন আমার সান্ত্বনা থাকবে এই ভেবে যে আমার মেয়েকে যত্ন করার মানুষ এসেছে। তার ভবিষ্যৎ আর অনিশ্চিত নয়।
ও, তাহলে আপনার মেয়ের মঙ্গল হলে আপনি এই একাকিত্ব সহ্য করতে পারবেন?
মা মুখে কিছু না বলে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে স্বীকৃতি জানালেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বেশ। আমি আপনার মেয়ের বিবাহের আয়োজন করছি।
শুধু মা নন, আশাও চমকে উঠল। এ কী কথা বলছেন তাতা।
মা মুখ ফিরিয়ে তার মুখ একবার দেখে নিয়ে বললেন, আমি, আমি ঠিক প্রস্তুত নই।
এই বিবাহে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না মা!
পাত্র কে?
জগদীশ্বর। শিব। নটরাজ। সুরের দেবতা। শিল্পের জনক। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হলে যে যত্ন এবং নিরাপত্তা আপনার মেয়ে পাবে তা পৃথিবীর কোনো মানুষ ওকে দিতে পারবে?
হঠাৎ মা দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়ালেন, না।
না মানে? তাতার গলার স্বর চড়া।
দরকার নেই। ও এখানে থাকুক, ওর যেমন ইচ্ছে তেমন শিখুক। আমি চেষ্টা করব আমার কষ্ট অতিক্রম করতে। না, আমি আর ওর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেব না।