ভুল সত্য – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
দিগিন বসে আছেন ইজিচেয়ারে। সামনে উঁচু টুলের ওপর পা দু’খানা ভোলা। দু’পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে শরৎকালীন পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে একটু মেঘ। দিগিন দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে একটু বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। তার বাঁ হাতের কাছে ছোট টেবিলের ওপর একটা দামি ট্রানজিস্টার রেডিয়ো। রেডিয়োর সামনে চায়ের খালি কাপ, কাপের পাশে মাদ্রাজি চুরুটের বাক্স, দেশলাই। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে রোদের ঠিকরে আসা আলো চোখে কট কট করে লাগে। পায়ের পাতা জড়ো করে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে দেন তিনি।
একটু আগে খবর হচ্ছিল রেডিয়োতে। তিনি খবরটায় মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। সংবাদ-পাঠক বলে যাচ্ছিল, গতকাল ভারত ও সোভিয়েট রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, উভয়পক্ষই একটি করে গোল দেওয়ায় খেলাটি অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। আজ আবার বৈঠক বসবে। ইত্যাদি। দিগিন তখন থেকেই নিজের ওপর এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর একটু বিরক্ত হয়ে আছেন। রেডিয়োটা বন্ধ করে দিলেন। অমনি নীচের তলা থেকে সরোজিনীর গান ভেসে আসে–এ প্রকাণ্ড জগতের মাঝে যত মিষ্টি যেথা আছে, সব দিলাম মা তোমার ভোগে, রোগ সারা মা, রোগ সারা…।
সরোজিনী, দিগিনের বোন। এ সব গান সরোজিনী নিজেই বানায়, সুব দেয় আর গায়। সরোজিনীর স্বামী আজ বছর দুই বিছানায় শোয়া। তার রাজ্যের অসুখ, মাঝে মাঝে ওঠা-হাঁটা করে, আবার বিছানা নেয় দু’দিন পর। সরোজিনী একটু পাগলি আছে। রামপ্রসাদি সুরে সারা দিনই গান গায়। ওর স্বামী হরিপদ মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে ধমকায়, চড়-চাপড়ও দেয়। কিন্তু তাতে সরোজিনীর কিছু পরিবর্তন হয় না।
দিগিন উভয়পক্ষের একটি করে গোল দেওয়ার রহস্যটা চোখ বুজে মনে মনে ভেদ করার চেষ্টা করছিলেন। কাল রাতে ভালই ঘুম হয়েছে তার। মাঝরাতে এক বার ঘুম ভেঙেছিল কুকুরের কান্না শুনে। মোদকের নেশায় ঘুম, সহজে ভাঙার নয়, তবু ভেঙেছিল। উঠে বাথরুম সেরে আবার শুতে যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কাঠের খুঁটির ওপর টংগি ঘর। বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়। খুব বেশি গাছপালা থাকায় কুকুরটাকে দেখা গেল না। আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে কৃষ্ণপক্ষের। মাঝরাতে এইসব চাদ-ফাদ দেখলে কুকুর-বিড়াল কাঁদবেই। এই সময়টায় ওদের বোধহয় পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। আবার শুলে শেষ রাতে তেমন ভাল ঘুম হবে না মনে করে দিগিন একটা ঘুমের বড়ি খানিকটা বিয়ার দিয়ে গিলে ফেলেন। বিয়ারের বোতলটা খুলে ফেলেছেন, তাই কী আর করেন, পুরো বোতলটাই সাফ করে শুয়ে পড়েন আবার। ঘুমের বড়িটা বেশ কড়া ধাতের, তার ওপর বিয়ার থাকায় কী একটা গোলমাল হয়ে গেল শরীরের মধ্যে। আজ সকাল পর্যন্ত মাঝে মধ্যে এই গোলমালটা টের পাচ্ছেন, কান’ শুনতে ‘ধান’ শুনছেন। ভারত আর সোভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে তো ফুটবল খেলা হয়নি যে গোল হবে।
কাঠের সিড়িতে ঝোড়ো বেগে পায়ের শব্দ তুলে কে উঠে আসছে। শানু। শানু ছাড়া কারও এত তাড়া থাকে না। দিগিন ভারী বিরক্ত বোধ করে চোখ বুজে ঘুমের ভান করলেন। চুরুটটা জ্বলে জ্বলে ছোট হয়ে এসেছে, আঙুলে তাপ লাগছে।
শানু ঘরে ঢুকেই ডাকে, ছোটকাকা।
দিগিন উত্তর দেন না।
শানু কাছে আসে, ইজিচেয়ারের ওপর ঝুঁকে বলে, ও কাকা।
দিগিন চুরুটটা মুখে তুলে চোখ না খুলেই বলেন, হু।
ঘুমোচ্ছ?
শরীরটা ভাল নেই। কেন?
সোপাস্টোনের সেই ডিপোজিটটা ভুটান গভর্নমেন্ট আমাদের ইজারা দিতে রাজি হয়েছে, কিন্তু অনেক টাকা চাইছে।
কত?
পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। শান্তি আজ আবার যাবে কথাবার্তা বলতে।
দিগিন চোখ খোলেন না। বলেন, খামোখা।
এত খরচা করলাম, এখন পিছিয়ে যাব?
গেলেই ভাল। নইলে আরও টাকা ক্ষতি হবে। মোট কত খরচ হয়েছে?
হিসেব তো এখনও শেষ করিনি। খরচ তো এখনও হচ্ছে। তবে হাজার ত্রিশেক বেরিয়ে গেছে।
আরও যাবে।
লস হবে বলছ?
হবে।
কেন?
ডিপোজিট কতটা আছে পরীক্ষা করিয়েছ?
করিয়েছি।
কী বলে সার্ভেয়াররা?
কিছু বলতে পারছে না, ওপরের দিকের পাথরের কোয়ালিটি ভাল নয়। নীচের দিকে ভাল জিনিস থাকতে পারে। ঠিক কতটা ডিপোজিট আছে বলতে পারল না, বলা নাকি সম্ভব নয়।
হু।–দিগিন বলেন।
কী করব?
যা বলবার তা তো বহুকাল আগেই বলে দিয়েছি। এখনও অল্প ক্ষতির ওপর ছেড়ে দাও।
কিন্তু কলকাতায় যেনমুনা পাঠিয়েছিলাম তাতে অনেক ভাল খদ্দের ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। দরও ভালই পাব।
দিগিন চোখ খুললেন। পায়ের পাতা সরে গেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার গা থেকে ঠিকরে আসা রোদ আবার চোখে কটাশ করে লাগে। চোখটা বুজে ফেলে বলেন, যা ভাল বোঝো করো।
শানু অধৈর্য হয়ে কাঠের পাটাতনে জুতো ঠুকে বলে, তুমি একদম অ্যাডভাইস দিচ্ছ না। গত দু’ বছর চারটে লোককে দৈনিক চুক্তিতে লাগিয়ে রেখেছি। তারা দিনরাত খুঁজে খুঁজে বহু কষ্টে শেষ পর্যন্ত যাও বা ডিপোজিটটা খুঁজে পেল তাও এখন যদি কাজে লাগাতে না পারি তা হলে আমার। মনের তাবস্থাটা কী হয় এক বার ভেবে দেখেছ? কত টাকা জলে যাবে।
সোপস্টোন তো আর হিরে-জহরত নয়। ওর পিছনে দু’বছর অত টাকা ঢালা বোকামি হয়েছে। আগেই তোমার ভেবে দেখা উচিত ছিল।
শানু রেগে গিয়ে বলে, কিন্তু ভুটান গভর্নমেন্ট অত টাকা চাইবে কেন? ডিপোজিটটার খোঁজও ততা ওরা রাখে না, আমরা খুঁজে পেয়েছি। সুতরাং রাইট তো আমাদের। ওদের উচিত নমিনাল একটা টাকা নিয়ে খনিটা ছেড়ে দেওয়া।
দিগিন হাসলেন। বললেন, তা তো দেবেই না, বরং ওরা তোমাদের হটিয়ে নিজেরাই সোপস্টোনটা তুলে ব্যাবসা করবে।
কিন্তু আমরা যে ওটা খুঁজতে বিস্তর টাকা ঢাললাম, সেটা কে দেবে? ওরা দেবে?
খোঁজার সময়ে তো ওদের পরামর্শ নাওনি। ঘরের টাকা ঢেলে বরং ওদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছ। ওরা দেবে কেন?
কিন্তু দেওয়া তো উচিত।
ওদের সেটা বোঝাও গিয়ে।
শানু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলে, আমি লাভ চাইছি না। খরচটাও যদি উঠে আসত।
উঠবে না। বরং আরও টাকা বেরিয়ে যাবে। কোথায় কোন জয়ন্তীয়ায় নদীর ধারে একটা সোপস্টোনের টুকরো খুঁজে পেয়ে কে একজন এসে তোমাকে খবর দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে গুপ্তধন পাওয়ার মতো নেচে উঠলে। দুনিয়ায় যদি এত সহজেই সব পাওয়া যেত।
কাঠের মেঝেয় শানু পায়চারি করতে থাকে। দিগিন চোখ দুটো অল্প একটু খুলে ভাইপোকে দেখেন। বংশটাতেই পাগলের বীজ আছে। জয়ন্তীয়ায় নদীর ধারে সোপস্টোনটা খুঁজে পেয়েছিল শান্তি পাল নামে একজন ভবঘুরে। সে কেমন করে শানুকে বশ করে বুঝিয়েছিল, কাছেপিঠেই সোপস্টোনের মস্ত কোনও খনি আছে। শানুও নিশ্চিত হয়ে লোকটাকে খোঁজার কাজে লাগায়। লোকটা দিনে বারো টাকা নিত, সঙ্গে আরও তিন জন হা-ঘরেকে জুটিয়ে নিল, তারা পেত দিনে আট টাকা। এ ছাড়া ছিল আনুষঙ্গিক খরচ-খরচা, ত্রিশ হাজারের বেশিই বেরিয়ে গেছে। পায়ের পাতায় আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢাকা দেন দিগিন। চোখ বোজেন এবং উভয়পক্ষের একটি করে গোল দেওয়ার বিষয়টা ভাবতে থাকেন।
শানু আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধৈর্যহীন, চঞ্চল, ক্ষুব্ধ।
ছোটকাকা।
হু।
অনেক লস হয়ে গেল।
বুঝতে তো পারছি।
বুঝতে পেরে চুপচাপ বসে আছ কী করে?
কী করব?
কিছু একটা করা তো দরকার।
দু’বছর ধরে চারটে লোকের কর্মসংস্থান করেছ, এ তো ভালই। তোমার লাভ যদি লবডঙ্কাও হয়, তবু ওই চারটি লোকের অনেক আশীর্বাদ তোমার পক্ষে জমা হয়েছে। সেইটাই স্যাটিসফ্যাকশন।
শানু কোমরে হাত দিয়ে ঋজু দাঁড়িয়ে তার অকৃতদার, বিচক্ষণ এবং দার্শনিক কাকাটিকে ভ্রূ কুঁচকে দেখে বলে, তুমি একদম ফিলজফার হয়ে যাচ্ছ।
যাচ্ছি না। গেছি। –বলে আর-একটা সরু মাদ্রাজি চুরুট সযত্নে ধরিয়ে নেন দিগিন। সোয়া আটটা বাজে, এক্ষুনি তার তৃতীয় কাপ চা আসবে। ত্রিশ টাকা কিলোর চা, গন্ধে ঘর মাত হয়ে যায়। সম্ভাব্য চায়ের কথা ভাবতে তিনি স্ফুর্তিযুক্ত হয়ে বলেন, যা গেছে। ছেড়ে দাও। ওইটাই শেষ পর্যন্ত টিকবে।
যে টাকাটা লস হল তাতে তোমারও শেয়ার আছে, ভুলে যেয়ো না।
ভুলিনি বলেই তো বলছি। আরও যা লস হবে তাতেও আমার শেয়ার থাকবে। বিপদে পণ্ডিতরা অর্ধেক ত্যাগ করেন।
শানু একটা বড় শ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সে যেতে-না-যেতেই পুন্নি চা নিয়ে আসে।
ছোটমামা।
হু।
চা।
হু।
ঠক করে চা টেবিলে রেখে পুন্নি বলে, কারা যেন আসছে আজকে আবার।
দিগিন অবাক হয়ে বলেন, কারা?
কী জানি!– পুন্নি ঠোঁট উলটে বলে, শুনছি কারা যেন আসবে।
কত কে আসে।–দিগিন দার্শনিকের মতো বলেন, কার কথা বলছিস?
তুমি বুঝি জানো না? কে এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাবা আসবে, সবাই বলছে।
ও– বলে দিগিন সুগন্ধী চায়ে চুমুক দেন। আগুন-গরম চা। গরম ছাড়া খেতে পারেন না দিগিন। দোতলায় উঠতে উঠতে ঠান্ডা মেরে যায় বলে দোতলায় পাশের ঘরেই চায়ের সরঞ্জাম রাখেন দিগিন। পুন্নি ঠিক সময়ে আসে, নিঃশব্দে চা করে দিয়ে যায়। ওর হাতে চামচ নাড়ার বা কেটলির হাতলের কোনও শব্দ হয় না। ভারী লক্ষ্মী মেয়ে।
তা কী করবে?— পুন্নি জিজ্ঞেস করে।
কী করব? এলে আসবে।
আমি সামনে যাব না।
সামনে যাওয়ার জন্য যাবি কেন? চা-টা দিয়ে আসবি। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাবটা দিবি। তার বেশি কিছু করতে হবে না।
আমি সামনেই যাব না।
কেন?
আমার ভাল লাগে না।
ও।–বলে দিগিন হাত বাড়িয়ে রেডিয়োটা চালিয়ে দেন। লোকগীতি হচ্ছে। লোকগীতি মানেই দমের খেলা। দিগিন রেডিয়ো বন্ধ করে দেন। পায়ের পাতার ও পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢাকা পড়েছে।
ছোটমামা।
হু।
আমি যা বলেছি শুনেছ তো?
শুনলাম।
আমি সামনে যাব না।
আচ্ছা।
আচ্ছা বললে হবে না। তখন মা চেঁচাবে, বাবা বকবে, বড়মামা আর মেজমামা তম্বি করবে, তা হবে না। আমি তোমাকে বলে রাখলাম, তোমাকে সামলাতে হবে সব দিক।
দিগিন ‘হু’ দেন।
ঠিক তো?– পুন্নি সন্দেহে জিজ্ঞেস করে।
হু।
কী করবে?
তোর বদলে দকলীকে দেখিয়ে দেব।
টের পাবে না?
টের পাবে কেন? এত বড় সংসারে কত মেয়ে, কারটা দেখে যাচ্ছে তার ঠিক কী? দলীও তো আমাদের ভাগনিই। তোর চিন্তা নেই।
পুন্নি মুখ বেঁকায়। বলে, আহা।
দিগিন বলেন, কী হল?
পুন্নি শ্বাস ফেলে বলে, দকলী ঠিক ধরা পড়ে যাবে।
ধরা পড়ার কী? চুরি করছে নাকি? তুই বিকেলের দিকটায় বরং বাড়িতে থাকিস না।
পুন্নি উত্তর না দিয়ে জোরে পা ফেলে হেঁটে যায়।
বহুকাল আগে দিগিন এক বার একটা কাণ্ড করেছিলেন। কয়েকজন ডাকসাইটে মাতালকে নেমন্তন্ন করেছিলেন সে বার। তার আগের দিন একটা প্রকাণ্ড তরমুজ কিনে এনে তার এক দিকে ফুটো করে সব শাঁস বের করে ফেলেন, তারপর সেটাতে ধেননা, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, রাম, জিন ইত্যাদি ভরে ফুটোটা বন্ধ করে দেন। একটা ছোট ভাইপোকে ডেকে এনে ঘরের এক ধারে তাকে বসিয়ে অন্য ধারে নিজে বসেন। তরমুজটাকে এক বার ভাইপোর দিকে গড়িয়ে দেন, ভাইপো আবার তার দিকে গড়িয়ে দেয়। এইভাবে ঘণ্টাখানেক গড়াগড়ি খেয়ে তরমুজটা কী মারাত্মক অ্যাটম বোম তৈরি করে রেখেছিল পেটের মধ্যে, তার কোনও ধারণা ছিল না দিগিনের। পরের দিন বন্ধুরা এসে পৌছুনোর আগেই তিনি জিনিসটা একটু গেলাসে ঢেলে চাখতে গিয়ে সেই যে দুনিয়ার বার হয়ে। গেলেন, ফিরে আসতে পরদিন সকাল। বন্ধুরা যথাসময়ে এসেছিল। কিন্তু মাতাল হলেও তারা মৃত্যুশীল এবং সকলেরই কিছু প্রাণের মায়া কম নয়। দিগিনের অবস্থা দেখে ওই তরমুজের ধারেকাছেও তারা ঘেঁষেনি। দিগিনের আজও মনে পড়ে সেই মারাত্মক নেশার পর শরীরের মধ্যে যে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, কাল রাতে বিয়ার দিয়ে ঘুমের বড়ি খাওয়াতেও তেমনি কিছু গোলমাল হয়ে গেছে। তবে জীবনটাকে নানা এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আদতে জীবন। আলো যেমন প্রতিহত না হলে আলো বলে মনে হয় না, জীবনটাও কি তাই নয়?
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে দিগিন যখন ভাগ্যান্বেষণে এই শিলিগুড়িতে আসেন তখন শিলিগুড়ি ছিল ছোট গঞ্জ শহর। একমাত্র স্টেশনটাই ছিল রমরমা। দার্জিলিঙের যাত্রীরা ব্রডগেজ থেকে নেমে ন্যারোগেজের খেলনা গাড়িতে ওঠার আগে এখানে ব্রেকফাস্ট সারত। যাত্রীদের মধ্যে তখন অধিকাংশ দাপুটে লালমুখো সাহেব। এ ছাড়া শহরটা ছিল ঘুমও, জনবিরল। তখনই এখানে কিছু ঠিকাদারির কাজ পেলেন দিগিন, কাঠের কারবারে নামলেন, কমলালেবু আর চায়ের ব্যাবসাতেও হাত দিয়েছিলেন। সেই সময়ে কাঠের টংগি ঘর সমেত হাকিমপাড়ার এই জমিটা তার হাতে আসে। একা থাকতেন, রান্নাবান্নার একটা লোক ছিল। দিব্যি জমে গেলেন এইখানে। তখন থেকেই বারান্দায় বা ঘরে বসে টেবিলে ঠ্যাং তুলে মেঘহীন দিনে নিজের পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা তার অভ্যাস। আর একা-বোকা থেকে থেকেই তার নানা নেশার পত্তন হয়। পচাই দিয়ে শুরু, গাঁজা, গুলি, মোক কিছুই বাদ রাখেননি। এখনও তার নেশার কিছু ঠিক নেই। যখন যেটা ইচ্ছে হয় খান। বাঁধাধরা জীবন ভাল লাগে না।
দেশভাগের পর হুড়মুড় করে বড় দুই ভাই, তাদের বউ, দুই বোন, স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিশাল এক দঙ্গল এসে পড়ল। একাকিত্বটা চলে গেল দেশছাড়া হয়ে। টংগি ঘরটার আশেপাশে আরও দু’খানা বাড়ি উঠল। অবশ্য একান্নবর্তিতা তাদের ভাঙেনি। বড় পাকশালে সকলের রান্না হয়। বড়দা উকিল, মেজোজনের ওষুধের স্টেশনারি, বড় ভগ্নিপতি কয়লার ব্যাবসা করে, ছোট ভগ্নিপতি অসুখে ভোগে বলে শালাদের ঘাড়ে পড়ে আছে। চাকরি তাকে করতেও দেওয়া হয় না।
.
সকালে সেবক রোডের মোড়ে কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা। কাঞ্চনকুমার লালোয়ানি। মোটর-সাইকেলটা থামিয়ে দিগিন ডাকলেন, কাঞ্চন।
কাঞ্চন তার ভোকসওয়াগন থামিয়ে পান খেতে নেমেছিল মোড়ের দোকানটায়। পরনে খুব দামি একটা বিলিতি সিন্থেটিক ফেব্রিকের লাল গেঞ্জি, সাদা প্যারালেল ঘঁটের প্যান্ট, পায়ে চপ্পল, চোখে বড় মাপের রোদ-চশমা। জুলপি চুল সব হালফ্যাশনের। পিছু ফিরে দিগিনকে দেখেই দু খিলি পান তাড়াহুড়ো করে মুখে পুরে এগিয়ে আসে।
আরে দিগিনদাদা।
যাচ্ছিস কোথায়?
কাল রাতে জোর ধস নেমেছে তিনধারিয়ার কাছে। বাবাজি তো খার্সাঙে আটকা পড়ে আছে। আজ সুবায় ফিরবার কথা। যাচ্ছি ধসের সাইটে, যদি পায়দল এ পারে আসতে পারে তো নিয়ে আসব।
দিগিন বলল, ধস? কই আমি তো শুনিনি।
শুনবেন কী করে? আজকাল তো ঘরের বাইরে আসেনই না। দুনিয়ায় কত কিছু হয়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়ে গেলেন নাকি?
সাজগোজ যাই করুক কাঞ্চনের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। হিলকার্ট রোডে একটা প্রকাণ্ড কাপড়ের দোকান দিয়েছে সম্প্রতি। আর আছে মদের দোকান, মোটর পার্টসের বিশাল প্রতিষ্ঠান। একসময়ে ওর মোটর পার্টসের কারবারে কিছু টাকা লগ্নি করেছিলেন দিগিন। কিন্তু সংসারের চাপে, দুঃসময়ে টাকাটা তুলে নিতে হয়েছিল। রাখতে পারলে আজ ভাল আয় হত।
দিগিন বলেন, বের হয়ে হবে কী? কাজকারবার কিছু নেই।
কাজ নেই কে বলে? অনেক কাজ পড়ে আছে। আসেন না একদিন গরিবের বাড়িতে। ডিসকাস করা যাবে।
দিগিন লক্ষ করেন, কাঞ্চনের জুলপির চুলে কলপ দেওয়া। কয়েকটা সাদা দেখা যেত আগে, এখন নেই। দিগিন বলেন, আসবখন। শানুটার জন্য বড় চিন্তা হয়। সোপস্টোনের পিছনে বহুত গচ্চা দিয়েছে।
কাঞ্চন হাসে, বলে, শানুর মাথায় পোকা। সোপস্টোনের কারবার কিছু প্রফিটেবল হলে শিলিগুড়ির মার্চেন্ট আর ঠিকাদাররা বসে আছে কেন? আমি তো আগেই জানি, টাকা জলে যাচ্ছে। দেখা হলে আমি তো বলি শানুকে। শানু রেগে যায়।
ঝকঝকে সবুজ ভোসওয়াগনটার দিকে চেয়ে দিগিন বলেন, বেশ আছিস কাঞ্চন।
হাঁ দাদা, ভাল আছি। তবে ভাল আর থাকা যাবে না।
ও কথা সবাই বলে।
জোর কম্পিটিশন। এখন সকলের হাতে টাকা। বাজার স্যাচুরেটেড।
গিমিক। দিগিন জানেন। গত সাতাশ বছরে শিলিগুড়ির বাতাসে টাকা কম ওড়েনি। তার চোখের সামনেই শিলিগুড়ি উত্তরবাংলার সবচেয়ে বড় ব্যাবসাকেন্দ্র হয়ে উঠা, কিন্তু তাঁদের পরিবার পুরনো ঠিকাদারির ব্যাবসা ছাড়া আর কিছু ধরতে পারল না। বড়দা অবশ্য ব্যাবসাতে নেই, ওকালতি করে তার একরকম চলে যায়। মেজোজন পুরনো বাজারে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে বসে আছে বহুকাল। তেমন কিছু লাভ হয় না। শানু আর দুজন ভাইপোকে নিজের ঠিকাদারিতে নামাতে পেরেছেন দিগিন। ওরা যত লোভী তত চালাক নয়। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় ওরা বিচিত্র সব কারবারে নাক গলাতে যায়। চোট হয়ে অবশ্য ফিরে আসে। দিগিনের অবশ্য এখন আর তাতে কিছু যায় আসে না। আটান্ন বছর বয়স, কিছু টাকা আছে, চলে যাবে। কিন্তু ভাইপোদের জন্য একরকম দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। কাঞ্চনকে তাই একটু ভাল করে দেখে নেন দিগিন। ছোকরা বেশ দাঁড়িয়েছে।
দিগিন বলেন, শানুটাকে ব্যাবসাতে নামিয়ে নিবি কাঞ্চন?
কাঞ্চন জর্দা-পানের পিক ফেলে বলে, শানু নামবে না।
দিগিন সেটা জানেন। একটু শ্বাস ফেলে মোটরসাইকেলের স্টার্টারে একটা লাথি মেরে বলেন, ততার সঙ্গে একদিন বসব।
আচ্ছা।
কাঞ্চন তার তোকসওয়াগনে উঠল। দিগিন হিলকার্ট রোড ধরে ব্যাঙ্কে এলেন।
সোমবার। বড্ড ভিড়। চেকটা জমা দিয়ে এজেন্টের ঘরে ঢুকে গেলেন। এজেন্ট ভটচায় বুড়ো হয়ে এসেছেন। মাস দুয়ের মধ্যেই রিটায়ার করে চলে যাবেন। ভটচাযের বুড়োটে ভাবটা অবশ্য বয়সের জন্য নয়। দিগিনেরও ওইরকমই বয়স। ভটচায় বুড়িয়ে গেছেন পেটের অসুখে আর হাঁপানিতে। শিলিগুড়ির ওয়েদারকে গালাগাল দেওয়া হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।
কী খবর দিগিনবাবু?
কাঞ্চনের সাফল্যের ছবিটা চোখের সামনে জ্বলছে, দিগিন তাই বিষয় গলায় বলেন, এই তো।
ভটচায দিগিনের অন্যমনস্কতা লক্ষ করলেন। কিন্তু বেশি কথার মধ্যে গেলেন না। তিন জন লোক ঘরে বসে আছে, কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে আসছে কাগজপত্র সই করাতে। ব্যস্ত ভটচায় বললেন, এবার পুজোয় চলে যাচ্ছি, বুঝলেন?
হু।
আপনাদের শিলিগুড়ি ছাড়ছি শেষ পর্যন্ত।
বলে ভটচায ব্যস্ত রইলেন কিছুক্ষণ। মিনিট কুড়ি পর একটু ফাঁক পেলেন। সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, একটা খান। চুরুট খেয়ে বুক তো পুড়িয়ে ফেলেছেন।
দিগিন মাথা নাড়লেন। নিজের সরু মাদ্রাজি চুরুট ছাড়া অন্য কিছু তেমন ভাল লাগে না। ফসফসে ধোঁয়ায় ভারী বিরক্তি আসে।
ভটচার্য বলেন, নেশাটেশা করেন বটে, কিন্তু চেহারাটা এখনও ঠিক রেখেছেন। এখানকার জল-হাওয়ায় কী করে ফিট থাকেন মশাই?
ফিট থাকি নেশা করি বলেই।
সব নেশাখোরই ও কথা বলে।
মাইরি। মদ শরীরের সব জীবাণু নষ্ট করে দেয়।
কিন্তু মদটা তো থাকে পেটে।
হ্যাঁ। লিভারের বারোটা বাজায় আস্তে আস্তে। তবে মদ খেলে মদের এফেক্ট ছাড়া অন্য কোনও রোগ বড় একটা হয় না।
ভটচায় একটু আগ্রহ দেখিয়ে বলেন, সত্যি?
দিগিন চুরুটটা আরামে টেনে হেসে বলেন, কোনও মাতালের ছোটখাটো অসুখ দেখেছেন কখনও? জেনুইন মাতালের ও সব হয় না। মদ খুব বড় জীবাণুনাশক।
দুর।
মদে ভিজিয়ে রাখলে কোনও জিনিস সহজে নষ্ট হয় না জানেন? তাই ওষুধে অ্যালকোহল থাকে প্রিজারভার হিসেবে।
ভটচায় চিন্তিত মুখে বলেন, তা বটে।
তবেই দেখুন। স্টমাকটাকে মদে ড়ুবিয়ে রাখলে তার প্রিজারভেশনের ক্ষমতা বাড়ে কি না।
আফিং খেলে পেটের রোগ সারে শুনেছি।
তাও খেতে পারেন। তবে ও হচ্ছে ঝিমুনি নেশা।
না না, নেশার জন্য নয়। ওষুধ হিসেবে।
দিগিন মৃদু হেসে বলে, অ্যালকোহল আরও ভাল। আজ রাতে আসুন আমার ওখানে, একটা মজার জিনিস খাওয়াব। দেশি জিনিস, সঙ্গে একটা পাতার রস মিশিয়ে দেব। দেখবেন, কাল সকালে কেমন ফাইন হাগা হয়।
দিগিনকে সঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না ভটচায়। সন্দেহের চোখে চেয়ে থাকেন। বলেন, আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে কোনও এক্সপেরিমেন্ট করবেন না তো?
গিনিপিগ। বলে হা হা করে হাসেন দিগিন। মাথা নেড়ে বলেন, আরে না না।
ঘরে আবার লোকজন ঢুকে পড়ে। ভটচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দিগিন আপনমনে হাত দু’খানা টিপেটুপে পরীক্ষা করে দেখেন। হাওয়াই শার্টের হাতা গুটিয়ে বাইসেপটা টেপেন একটু। না, আটান্নতেও তার মাংসপেশি বেশ শক্ত আছে। ঝুলে যায়নি। বুড়ো বয়সটা একটা ধারণা মাত্র। অত্যাচার এই বয়সেও তিনি কিছু কম করেন না। তবু শরীরটা টান-টান, হাটা-চলা-পরিশ্রম কোনও যুবকের চেয়ে কিছু কম পারেন না।
ভটচায এবার একটু ফাঁক পেয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত আমাকে বুড়ো বয়সে নেশাভাং ধরাবেন না তো মশাই।
দিগিন ভটচাযের সন্দেহকুটিল মুখখানা একটুক্ষণ দেখে নিয়ে বলেন, জীবনের একটা দিক একেবারে না-জানা থাকা কি ভাল? নেশার চোখে দুনিয়াটা কেমন দেখায় তা দেখে রাখা ভাল। নইলে যখন ওপরে যাবেন, যখন যম জিজ্ঞেস করবে, বাপু হে, দুনিয়াটায় কী কী রকম সব অভিজ্ঞতা হল, তখন তো ব্যাঙ্কিং ছাড়া আর কিছু বলার থাকবে না।
ভটচায মুখখানা স্মিতহাসিতে ভরিয়ে তুলে বলেন, বয়সকালে রোজগারপাতির সময়টায় নেশাভঙের পয়সা একরকম জোটানো যায়। আমার তো তা নয়। এই তো পারমানেন্টলি বসে যাচ্ছি, রিটায়ারের পর নেশার পয়সা জোগাবে কে?
ভূতে, নেশা লোকের ও ঠিক জুটে যায়।
না মশাই, আমার ও-সব দরকার নেই।
আচ্ছা, না হয় নেশা নাই করলেন, এক দিন একটু চাখলেই কি আর নেশা হয়ে যায়? নেশা করারও একটা প্রসেস আছে। চলে আসবেন আজকে, অন্তত এক দিনের জন্য আপনার পেটের গোলমাল মেরামত করে দেব। ওই সঙ্গে রাতের খাওয়াটাও সেরে যাবেন, নেমন্তন্ন রইল।
বলে দিগিন ওঠেন।
আচ্ছা যাব!–ভটচায হাসলেন।
ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে দিগিন আবার মোটরসাইকেলে ওঠেন। আজকাল আর তার অ্যাকাউন্টে টাকা বড় একটা জমা পড়ে না। বরং প্রতি মাসেই চার-পাঁচটা উইথড্রয়াল হয় কমপক্ষে। তাঁর নিজস্ব সংসার নয়, দাদারাও রোজগেরে, তবু কী কারণে যেন সংসারের খরচের সিংহভাগ তাকেই দিয়ে আসতে হচ্ছে বরাবর।
মোটরসাইকেলটা নিয়ে ইতস্তত একটু ঘুরে বেড়ান তিনি, এম-ই-এস-এর একটা কনস্ট্রাকশন চলছে বাগডোগরায়, ভাবলেন, সাইটটা দেখে আসবেন। কিন্তু মহানন্দা ব্রিজ পেরিয়েই তাঁর দীর্ঘ রাস্তাটা ভেবে ক্লান্তি লাগল। থাক গে, ঠিকাদারিটা যখন শানুই দেখছে তখন আর তার মাথা ঘামানোর কী আছে। সারাটা জীবন তো এই কর্মই করলেন।
বাইকটা ঘুরিয়ে নিলেন, শিলিগুড়ি যদিও তাঁর হাতের তেলোটার মতোই চেনা, তবু মাঝে তিনি কোথাও যাওয়ার জায়গা খুঁজে পান না। ভালও লাগে না। তাই খানিকক্ষণ এলোমেলো বাইকটা চালান দিগিন, শিলিগুড়ির শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লোকই তার চেনা। বাইক থামিয়ে দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলেন, কয়েকটা চেনা জায়গায় উঁকি দিয়ে ফেরেন, কয়েকটা দোকান থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে নিলেন। তবু সময় ফুরোল না। বেলা এগারোটাই পেরোতে চায় না সহজে। শরৎকালটা তার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। সেবক রোড ধরে একটু এগোলে মহানন্দার অববাহিকায় উপত্যকার মতো বিশাল নিচু মাঠ আর বালিয়াড়ি দেখা যায়। বাইক থামিয়ে চেয়ে রইলেন সেই দিকে। মুঠোভর একটা মেঘ সকাল থেকে চেষ্টা করে এতক্ষণে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে ফেলেছে। উজ্জ্বল রোদে তিনধারিয়ার বিন্দু বিন্দু বাড়িঘর নজরে আসে।
বহুকাল শালুগাড়ার বাকসিদ্ধাইয়ের কাছে যাওয়া হয় না। রেডিয়ো স্টেশন পেরিয়ে খানিক দূর এগিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে ঢালুতে নামিয়ে বাইকটা রাখেন দিগিন। তারপর সরু পথ ধরে বা ধারে নেমে যান। বড় রাস্তায় এক-আধটা মিলিটারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে বাকসিদ্ধাইয়ের কাছে মিলিটারির লোক এসেছে। ভিড় অবশ্য সারা দিনই থাকে।
আধমাইলটাক হেঁটে গাছপালায় আচ্ছন্ন শান্ত জায়গায় পৌঁছে যান তিনি। অনেককাল আসা হয়নি। অবাক হয়ে দেখেন, এদের বাড়িঘরের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সচ্ছলতার চিহ্নগুলি দেখলেই বোঝা যায়। কেবলমাত্র লোকের ভবিষ্যৎ বলে দিয়ে উইদাউট ক্যাপিট্যালে বেশ দাঁড়িয়েছে এরা।
বাইরে খোলা একটা ঘর। আনাড়ি মিস্ত্রির তৈরি দু-চারখানা বেঞ্চি পাতা। মিলিটারি, মেয়েছেলে, বুড়ো, বাচ্চা, জনা পঁচিশ লোক বসে আছে। অল্পবয়সি বাকসিদ্ধাই মেয়েটি হাতে সেই পুরনো একটা শিবলিঙ্গের মতো পাথরের দিকে চেয়ে কথা বলছে। দিগিনের কানে এ রকম একটু সংলাপ ভেসে আসে
মহিলাকণ্ঠ-সে কেমন দেখতে?
বাকসিদ্ধাই-রোগা, ফরসা, চোখে চশমা।
মহিলাকণ্ঠ-আমার ছেলের সঙ্গে মানায়?
বাকসিদ্ধাই—মানায়।
জাত?
স্বঘর।
মহিলাকণ্ঠ সনিশ্বাসে বলে, বিয়েটা হবে?
হবে।
দিগিন ঘরটায় না ঢুকে এগিয়ে যান। উত্তর দিকে বাঁশঝাড়ে আচ্ছন্ন ছায়ায় ঢাকা পথে কতকগুলো বাচ্চা ছেলে খেলছে। উত্তর প্রান্তে খেত। উদাস মাঠ, তার ও পাশে কালো মেঘের মতো হিমালয় ঘনিয়ে উঠেছে উত্তরের আকাশে। গত সাতাশ বছর ধরে দেখছেন দিগিন। দাঁড়িয়ে একটা মাদ্রাজি চুরুট শেষ করেন তিনি।
আবার যখন এসে খোলা ঘরখানায় উকি দিলেন তখন ভিড় অনেক পাতলা হয়েছে। অবাঙালি কাঠখোট্টা এক মিলিটারি সওয়াল-জবাব করছে। তার ঘর থেকে চিঠি এসেছে, ছেলের অসুখ। সিদ্ধাই মাথা নেড়ে জানায়, সেরে যাবে। চনিপড়া নিয়ে যায় যেন।
পিছনের একটা বেঞ্চে একা বসে দিগিন চুরুট টানেন! সিদ্ধাই তাকে চেনে। এক বার মুখ তুলে দেখে হাসল।
ভিড় পাতলা হলে সিদ্ধাই মুখ তুলে বলে, ভাল তো?
দিগিন মাথা নেড়ে জানালেন, না।
কী হয়েছে?
আমার ভাইপো
বলতে গিয়ে ক্লান্তি বোধ করে থেমে যান দিগিন। এ সব প্রশ্নের কোনও মানে নেই। সোপস্টোন চুলোয় যাক, পুন্নির বিয়ে নিয়েও প্রশ্ন করার প্রবৃত্তি হয় না তার।
চুরুটটা মুখ থেকে নামিয়ে দিগিন চোখ বুজে বলেন, মা, আমার মরণ কবে?
সিদ্ধাই হাতের পাথরটার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর বলে, সে দেরি আছে।
কত দেরি?
অনেক দেরি, তবে একটা ডাঙর মেয়েছেলে ক্ষতি করবে।
ডাঙর মেয়েছেলে? সে কে?
ফরসা, লম্বা মেয়েছেলে একজন, পাহাড়ি মেয়েছেলে।
দিগিন হাসেন, ময়নার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে। ময়না একসময়ে বিখ্যাত ছিল। সবাই তার চেহারাটা জানে। দিগিন একটু শ্বাস ফেলে বলেন, কীরকম ক্ষতি?
পয়সাকড়ি আর নাম-যশের ক্ষতি।
বিষ-টিষ খাওয়াবে না তো?
সিদ্ধাই ইতস্তত করে বলে, সাবধানে থাকবেন, তবে আপনার এখনও অনেক আয়ু আছে।
দিগিনের ক্লান্তি লাগে। একটা পাঁচ টাকার নোেট এগিয়ে দেন। সিদ্ধাইয়ের বুড়ো বাপ বসে আছে পিছনে, টাকাটা সে নেয়। বলে, আর কিছু জানবেন না?
না। আটান্ন বছর বয়সে আর কী জানবার আছে, আমার তো কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
বুড়ো মাথা নাড়ে।
সিদ্ধাই মেয়েটি তার কমনীয় মুখশ্রী তুলে বলে, শরীরে একরকম জ্বালা রোগ হবে। জল পড়ে দেব, নিয়ে যাবেন।
দিগিন অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়েন। জ্বালা রোগ হওয়ার বাধা কী? যত অ্যালকোহল রক্তে জমা হয়েছে তাতে অনেক কিছু হতে পারে।
দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পুন্নি এসে যখন ডেকে তুলল তখন সাড়ে তিনটে। চারটের আগে তিনি ওঠেন না বড় একটা, ঘড়িটা দেখে বিরক্ত হলেন। বললেন, কী রে?
ওঠো, তোমার চা হয়ে গেছে।
চা, তার এত তাড়া কী?
বাঃ, আজ কে সব আসবে বিকেলে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে চলবে কী করে?
দিগিন হাসলেন। ত্রিশ টাকা কিলোর চায়ের গন্ধে ঘর ম ম করে। বলেন, যার আসবার আসবে। তোর অত মাথাব্যথার কী? আমি তো দকলীকে বলে রেখেছি, সে রাজিও হয়েছে।
পুন্নি বলে, ঠিক আছে।
কিন্তু পুন্নির মুখে রাগ।
দিগিন কিছু বলেন না, পুন্নিই গজগজ করে, রোজ সং সেজে অচেনা মানুষের সামনে গিয়ে বসা কার ভাল লাগে।
তোকে বসতে কেউ বলেছে?
না বসলে তোমাদের প্রেস্টিজ থাকবে নাকি?
ও। তা সেই কথা ভেবেই বুঝি হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছিস?
হুড়োহুড়ি আবার কী! পুন্নি ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বলে, চা-টা খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পুন্নি চলে গেলে উত্তরমুখো ইজিচেয়ারটায় আবার বসেন দিগিন। টুলের ওপর পা তুলে দেন। হিমালয় সারা দিন লুকোচুরি খেলে এই শরৎকালে। বরফে ঢাকা দূরের পাহাড়গুলি ঢেকে গেছে। কুয়াশার মতো ভাপে। দেখা যায় শুধু নীল পাহাড়ের সারি। দিগিন দেখেন, দেখতে কখনও ক্লান্তি লাগে না। অবসরপ্রাপ্তের মতো বসে থেকে সময় বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সময় ঠিক হিমালয়ের মতো পাথর হয়ে জমে আছে। এভাবে কর্মহীন এবং অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার কথা তার নয়। বয়স মাত্র আটান্ন, শরীরটাও যথেষ্ট মজবুত, তবু মনে মনে একরকম কর্মত্যাগ এবং বৈরাগ্য এসে গেছে।
শিলিগুড়িতে যখন তিনি প্রথম এসেছিলেন তখন এটা ছিল গঞ্জ মতো জায়গা। বাগরাকোটে কয়লাখনির সন্ধান, সিকিমের কমলালেবুর চালান, কাঠের ব্যাবসা, চা বাগানের মালিকানা কোনও চেষ্টাই তার কম ছিল না। অবশেষে বংশগত পাগলামির খেয়ালবশে এক বার মধ্যপ্রদেশও চলে যান হিরের সন্ধান পেয়ে। সে ভীষণ কষ্ট গেছে। তাঁবুতে থাকতেন, খাদ্যাখাদ্যের বিচার ছিল না, হাতখানেক দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেল, তবু হিরের নেশায় পাগল ছিলেন কিছুকাল। হিরে পাননি তা নয়। ছোট ছোট কম দামি কয়েকটা পেয়েছিলেন, তাতে খরচটা কোনওক্রমে উঠেছিল হয়তো। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল শরীরের। জন্ডিস ধরল। মাস ছয়েক সেই রোগে শয্যাশায়ি রইলেন প্রায়। লিভারটা সেই থেকে খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তাররা তার নেশাভাং একদম বারণ করে দিলেন। কিছুকাল সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর এক দিন মনে হল, একা মানুষ, শরীর বাঁচিয়ে রেখে কী হবে! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গভীর একাকিত্ব একটা কালো কম্বলের মতো যেন চেপে ধরে। লিভারটা জখম আছে আজও, তবু দিগিন কিছু মানেন না।
ঘুম স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন হরেন বোসসে লোকটা বড় ভালবাসতেন দিগিনকে। প্রায়ই বলতেন, বিয়ে না করে এক রকম ভালই আছ হে দিগিন, কিন্তু চল্লিশের পর ভুগবে। সাহেবরা চল্লিশ পর্যন্ত একা থাকে, ফুর্তি ললাটে, ফুর্তির অভাবও ওদেশে নেই, কিন্তু চল্লিশের পব ঠিক টুক করে বিয়েটি করে ফেলে। কারণ মানুষ ওই বয়স থেকে লোনলি হতে শুরু করে।
অক্টোবর না নভেম্বরের শীতে ঘুম একটা সৃষ্টিছাড়া জায়গা। দিগিন কার্যব্যাপদেশে পাহাড় লাইনে গিয়ে ঘুমে একটা-দুটো দিন কাটাতেন। চার ধারে জন-মনিষ্যি নেই, পাতলা বরফের আস্তরণ পড়ত কোনও কোনও বছর শীতকালে। ওয়েটিংরুমে আগুন জ্বেলে বোতল নিয়ে বসতেন দুজনে। কথা হত।
হরেন বোস এক দিন তার শালির সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুশকিল হল হরেন বোসের বউ ছিল নেপালি। যখন প্রথম ব্যাচেলার হরেন বোস ঘুমে আসেন তখন বয়স-টয়স কম। নেপালি ঝি ঘরের কাজকর্ম করত। দীর্ঘ শীতকালে, একাকিত্বে যখন মানুষকে কর্মনাশা ভূতে পায়, তেমনি একটা দুর্বল সময়ে তিনি সেই মেয়েটিকে উপভোগ করেন। মেয়েটা অরাজি ছিল না। কিন্তু তারপর তার বাড়ির লোকজন এসে হরেনকে ধরে, বিয়ে করতে হবে! করতে হল। গোটা দুই ছেলেমেয়েও হল তাদের। সেই বউয়ের একটা বোন ছিল। মনাস্টারিতে যাওয়ার রাস্তাটা হিলকার্ট রোডের যে জায়গা থেকে শুরু হয়েছে সেই মোডে একটা খুপরিতে পারিবারিক সবজির দোকানে বসত মেয়েটি। পনেরো-ষোলোর বেশি বয়স নয়, দীনদরিদ্র পোশাক পরে দু’গালে রক্তিমাভা আর সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে বসে থাকত। সামনে সবুজ স্কোয়াশ, বাঁধাকপি, বিন, শুটি, ফুলকপি সাজাননা। তার মাঝখানে তাকে বেশ দেখাত। সেই দোকানের সামনে ছোকরা নেপালি কয়েকজন গাদা ফুল পায়ের আঘাতে শূন্যে তুলে তুলে চুঙ্গি খেলত খুব। মেয়েটি সব বুঝে হাসত। হরেন বোস প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আত্মীয় যখন হয়ে গেছে তখন ফেলতে পারি না। ওদের সম্প্রদায়ে উপযুক্ত ছেলে বড় কম, বিয়ে যদি করেও তার রোজগার করাবে। বিয়ে না দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। পয়সার লালচ তো বড় কম নয়। দোকানে বসে থাকে বলে লোকে নিচু নজরে দেখে, কু-প্রস্তাব দেয়, পয়সা দেখায়। তোমারও উদ্যোগ করে বিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। মেয়েটা কচি আছে, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে।
দিগিন রাজি হলেন।
সেই মেয়েটিই ময়না।
দিগিন সেবার পুজোর পর এক ভোররাতে টাইগার হিলে গেলেন সুর্যোদয় দেখতে। বহু বার দেখেছেন, তবু গেলেন। সঙ্গে ময়না ছিল। টাইগার হিলে ওঠবার একটা খাড়া এবং শর্টকাট রাস্তা আছে। সেটা দিগিন চিনতেন না ময়না চিনত। সেই রাস্তা ধরে উঠতে দিগিনের হাঁপ ধরে যায়। মাঝে মাঝে বসেন, ময়নার সঙ্গে কথা বলেন, মাতৃভাষার মতো নেপালি ভাষা বলতে পারেন দিগিন, ময়না জানে ভাল বাংলা কথা। কথাবার্তার কোনও অসুবিধে হয়নি। আকাশে তখন ময়ূরকণ্ঠী রং ধরেছে। পালটে যাচ্ছে রং। শেষরাতে সূর্য ওঠার অনেক আগেই আকাশের ওই বর্ণালী দেখা যায়। কিন্তু সে সৌন্দর্য বড় একটা খেয়াল না করে দিগিন বলেন, থাকতে পারবে তো আমার সঙ্গে?
দিগিনের বয়স তখন বত্রিশ, ময়নার মেরেকেটে ষোলো, রাজি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ঘুমের। শীতের দেশে নিরন্তর দারিদ্র্য আর স্থবিরতা ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছে তখন মেয়েটির। সে বলল, যদি আমাকে কলকাতা শহর দেখাবে বলল, তা হলে থাকব।
থাকা মানে কী জানো তো?
মেয়েটি চেয়ে থাকল।
দিগিন অবশ্য ব্যাখ্যা করলেন না। তিনি জানতেন, বিয়ে করার কোনও পদ্ধতি না মানলে ক্ষতি নেই। যে-কোনও রকম একটু অনুষ্ঠান করলেই চলবে। এবং সেটাই নিরাপদ। তার সন্দেহ ছিল, এই নিতান্ত অশিক্ষিত অভিজ্ঞতাহীন মেয়েটির সঙ্গে তাদের বংশগত যেটুকু আভিজাত্য আছে তা শেষ পর্যন্ত মিলবে কি না। দিগিনের একটা সুবিধে, তিনিও লেখাপড়া বিশেষ করেননি। ক্লাস এইট পর্যন্ত উঠে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। পড়াশুনো সেইখানেই শেষ হয়। অতঃপর ব্যাপক জীবনযাপন থেকেই তিনি তার স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ভেবে দেখেছিলেন, মেয়েটির কাছ থেকে একমাত্র শরীর আর কিছু সেবা তিনি পেতে পারেন। তার বেশি কিছু দেওয়ার সাধ্য মেয়েটির নেই।
দিগিন টাইগার হিলে ওঠার মাঝপথে মেয়েটিকে সেই গভীর শীতার্ত পরিবেশে একটি চুমু খান। বলেন, তোমাকে কলকাতা দেখাব।
সেই যে টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে গেলেন, সেখান থেকে আর ঘুমে ফিরে এলেন না দিগিন। এক ছোকরার জিপে ফিরলেন দার্জিলিং। সেখান থেকে আবার জিপ ভাড়া করে ময়নাকে নিয়ে টানা নেমে এলেন শিলিগুড়িতে। বত্রিশ বছর বয়সে বিয়ের ঝামেলায় যেতে তার ভরসা হল না। ময়নার বয়স তখন নিতান্ত কম। তাকে যা-তা বুঝিয়েছিলেন। ময়না তখন ঘুম ছাড়ার জন্য ব্যগ্র। তা ছাড়া সে জানত যে এই লোকটাই তার হবু স্বামী, তাই আপত্তি করেনি।
টংগি ঘরটায় ময়নাকে নিয়ে থাকার বিপদ ছিল। আস্তানাটা সবাই চেনে, হরেন বোস, মেয়েটির আত্মীয়স্বজন সেখানে যে-কোনও সময়ে হাজির হতে পারে। পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারে। তবু দিগিন ময়নাকে নিয়ে উঠলেন সেখানেই।
তিন দিন পর হরেন বোস হাজির হলেন এসে।
কী খবর ভায়া?
ভালই।
ময়না?
আছে।
হরেন বোস মাথা নেড়ে বললেন, জানতাম।:–বলে একটু শাস ছাড়লেন।
ময়নাকে অবশ্য তখন চেনার উপায় নেই। নেপালি পপাশাক ছেড়ে সে তখন চমৎকার সব ছাপা শাড়ি পরে। সাবান দিয়ে স্নানের পর গা ঝকঝকে পরিষ্কার। সিথেয় সিদুর, এক বেণিতে বাঁধা চুল, খুশিতে ফেটে পড়ছে। হরেন বোস দেখে খুশি হলেন। বললেন, ভয় নেই, ওর পরিবার থেকে ঝামেলা হবে না, তবে কাজটা পাকা করলেই পারতে।
দিগিন বত্রিশ বছরে মাথা তখন কম পাকাননি। বলেন, তা হয় না। আপনার মতো বাঁধা পড়ে যেতে আমি রাজি নই।
কিন্তু বদনাম? সিকিউরিটি?
ও সব ছাড়ুন! ওর পরিবারকে আমি হাজার টাকা দিচ্ছি কন্যাপণ হিসেবে।
ময়না এ রকম সম্পর্ক মানবে?
মানবে আবার কী? মেনে তো নিয়েছে।
না, মানেনি। বয়স কম বলে বুঝতে পারছে না যে তুমি ওকে রেখেছ মাত্র, বিয়ে করেনি। বয়স হলে বুঝবে।
ও এক রকম বিয়েই, কালীবাড়িতে নিয়ে গিয়ে মায়ের পায়ের সিদুর ছুঁইয়ে দিয়েছি!
বিচক্ষণ হরেন বোস গম্ভীরভাবে বললেন, ঠিক আছে। বিয়ে তো আসলে পরস্পরকে স্বামী বা স্ত্রী বলে স্বীকার করা। ও হলেই হল। টাকাটা দিয়ে এসো।
দিয়ে দিচ্ছি।
বলে দিগিন নগদ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন।
হরেন বোস মুখটা গম্ভীর করে রাখলেও মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন দিগিনের বিচক্ষণতায়, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে দিগিনের সিকিমি ‘রাম’-এর বোতল খালি করলেন। বললেন, তা হলে টাইগার হিল থেকেই তোমার অধঃপতন শুরু হল?
দিগিন হাসলেন, উত্তর দিলেন না।
হরেন বোস বললেন, হঠাৎ এ রকম ধারা করতে গেলে কেন?
দিগিন একটু ভেবে বলেন, আসলে কী জানেন দাদা, যখন টাইগার হিলে উঠছিলাম তখনও ঠিক করিনি যে, মেয়েটাকে নিয়ে পালাব। ভেবেছিলাম আমার বাউন্ডুলে জীবন, দায়দায়িত্ব নেই, মেয়েটাকে পাকাপাকি বিয়েই করে ফেলি। কিন্তু টাইগার হিলেই গোলমালটা হয়ে গেল, একদম শেষ চড়াইটা বেয়ে যখন পাহাড়ের ছাদে চড়েছি, তখন দেখি সামনে অন্ধকারের এক মহাসমুদ্র। নীচে গভীর উপত্যকায় যেন কত হাজার বছরের অন্ধকার জমেছে। বাঁ দিকে উত্তরে ব্রোঞ্জের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার আবছা চেহারা, পাশে পাশে সব ব্রোঞ্জের পাহাড়। এ তো কত বার দেখেছি, নতুন কিছু নয়। সূর্য উঠবার আগেই প্রথম সূর্যের আলো এভারেস্টের ডগা ছুঁতেই যেন আগুন জ্বলে গেল বরফে, আশপাশে আবছায়ায় বিস্তর লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। ওই রকম ভোলা জায়গায়, ওই গভীর বিশাল অন্ধকারের সমুদ্র আর পাহাড়-টাহাড় দেখে মনে হল, জগতে বাঁধা পড়ার মতো বোকামি আর নেই। যার একটা শেকড় গজায় সে বাকি দুনিয়া থেকে উৎখাত হয়ে যায়। টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে দেখতেই ঠিক করলাম যে হাওয়া বাতাসের মতো একটা সম্পর্ক থাকাই ভাল।
হরেন বোস মাথা নেড়ে বললেন, বুঝেছি।
তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ নেশা করে বললেন, আমি তোমার চেয়ে অনেক বোকা।
দিগিন উত্তর দিলেন না।
হরেন বোস ময়নার ভেজে আনা ফুলুরিতে কামড় বসিয়ে বললেন, তুমি সুখী হবে।
ময়না ঘরে আসতে জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে রে? রামরও?
ময়না লজ্জার হাসি হাসে। মাথা নামায়।
হরেন বোস সস্নেহে একটু চেয়ে থেকে বলেন, মেয়েটা ভাল, দেখো দিগিন।
চিন্তা করবেন না, সব ঠিক আছে।
কিন্তু তবু সব ঠিক থাকেনি।
বছর দুই বাদে সমস্যা দেখা দিতে থাকে। বুদ্ধিমান দিগিন তার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না। তবে দু-চারখানা চিঠিপত্র বছরে দিতে হত, দায়ে দফায় টাকা-পয়সা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ময়নার খবর তিনি কখনও দেননি। তখন প্রাচীনপন্থী মা বাপ বেঁচে, পুরনো প্রথাও মরে যায়নি পরিবারে। ভেবেছিলেন ব্যাপারটা চেপে রাখতে পারবেন।
কিন্তু দেশভাগের পর পরই চিঠি এল, বাড়ির সবাই চলে আসছে। তাদের থাকার বন্দোবস্ত যেন করা হয়। দিগিন মুশকিলে পড়লেন। ময়না খুব বোকা ছিল না, দু’বছরে তার বয়স আর অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। দিগিনের সঙ্গে তার সম্পর্কটাও ছিল অদ্ভুত। দিগিন ময়নাকে বিয়ে করা বউ বলে কখনও মনে করেননি। তাই মনে মনে নিজেকে ব্যাচেলার ভেবে যেমন খুশি নিজস্ব জীবনযাপন করতেন। পাহাড়ে ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন ব্যাবসার ধান্দায়। ঘরে একটা মেয়েছেলে আছে, সে ঝি বা রক্ষিতা, এর বেশি কিছু ভাবতেন না, ময়না সেটা বুঝতে পারত। উপায় নেই বলে মেনে নিত দিগিনকে। ঝগড়াঝাটি কিছু করত না তা নয়, তবে করেও লাভ ছিল না।
বাড়ির লোক আসছে, বহুকাল বাদে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। মা বাপ তখনও বেঁচে আছেন। দিগিন তাই গুরুং বস্তিতে ময়নার জন্য ভাল ঘর ভাড়া করলেন। খুব বেশি বোঝাতে হল না ময়নাকে। দু’-এক কথাতে সে রাজি হয়ে গেল। ময়নাকে গুরুংদের বস্তিতে পাঠিয়ে ঘরদোর সাফ করলেন দিগিন। তার কিছু মনে হল না। কোনও অভাব টের পেলেন না।
অবশ্য সম্পর্কটা ছিড়ে ফেললেন না। বাড়ির লোকজনকে এড়িয়ে রোজই যেতেন ময়নার কাছে। মাসোহারা তো দিতেনই, সব খরচ বহন করতেন ময়নার। ময়নাও অখুশি ছিল না। বাড়ির লোক ব্যাপারটা টের পেলেও কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। বয়সের ছেলের রোজগার যদি ভাল হয় তো তার দু-একটা স্বভাবদোষ মানতে কারও আপত্তি হয় না। ছেলে হল সোনার আংটি, বাঁকা হলেও দাম কমে না।
সেই ময়না এখনও দিগিনেরই আছে, তবে পুরোটা নয়। দিগিনের আটান্ন হলে ময়নার না হোক বিয়াল্লিশ বছর বয়স তো হলই। গুরুং বস্তি ছেড়ে বর্ধমান রোডে ঘোট একটা বাড়িতে উঠে গেছে। ময়না। বাড়ি করে দিয়েছেন নিজেই। ময়না যৌবনকালটা বড় চঞ্চলতা করেছে। গুরুং বস্তিতে উঠে যাওয়ার পর থেকেই সে দিগিনকে পছন্দ করতে পারত না। বার দুই পালিয়ে গেছে একটা অপদার্থ জাত-ভাইয়ের সঙ্গে। পোযায়নি বলে ফিরে এসেছে। লটঘট করেছিল নির্মল সিঙের ছোটছেলে অবতার সিঙের সঙ্গে। দিগিন শাসন করেছেন, বিয়ে করা বউ নয় বলে ক্ষমাও করে দিয়েছেন।
ছেলেমেয়ে হয়নি, বাঁজা ময়না এখনও নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে ছোট বাড়িটায়। ঘুম থেকে তার এক ভাইঝি আসে, কিছু দিন থেকে যায়। হরেন বোস রিটায়ার করে বাড়ি করেছিলেন দার্জিলিঙে। কিছু দিন আগে মারা গেছেন। তার বউ বা ছেলেপুলেরাও আসে মাঝে মাঝে, ময়নাও যায়। কিন্তু ময়না একা। বড় একা।
.