দর্জি হাফিজ মিঞা
ঢাকা শহরে আমাদের বাড়ি ছিল মুসলমান-প্রধান পাড়ায়। তাদের সঙ্গে আমাদের রেশিও ছিল প্রায় থ্রি-ইজ-টু-ওয়ান। দু-চার ঘর পেশাদারী মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবার ছাড়া, এ সম্প্রদায়ের বাকি সবাই-ই নানারকম স্বল্প আয়ের ছোটোখাটো দোকানদার ছিল। প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলল তাদের দেখিনি। তবুও তাদের কথা বাদ দিয়ে আজও কেন জানি, ঢাকার কথা ভাবতে পারি না। শৈশব এবং কৈশোরের স্মৃতিপটের অর্ধেকের বেশিরভাগটাই জুড়ে আছে এরা। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এবং বৈচিত্র্যে এরা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। চেহারাও ছিল তেমনি মজাদার- একেবারে সুকুমার রায়ের ছড়া এবং গল্পের উপযুক্ত সব নায়ক।
খিটখিটে মেজাজের দর্জি হাফিজ মিঞা। নিশুতি রাতের ডাকাতের মত দেখতে, পনির-আখরোট-বাদাম- পেস্তার দোকানদার জব্বার মিঞা। দিবারাত্র মদের নেশায় মশগুল, ঘোড়াগাড়ির আস্তাবলের মালিক মির্জা সাহেব। কুকুচে কালো, বিশালাকার এবং লোমশ হাতুড়ে ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা। বিরাট পাকা তরমুজের মতো ভুঁড়িওয়ালা ফল বিক্রেতা আর মিঞা। সদ্য-মাজা, রোদে-রাখা, পেতলের ডেচির মতো চকচকে টাকওয়ালা তামাকবিক্রেতা কালু মিঞা। সরু গোঁফওয়ালা রেস্টুরেন্ট-মালিক করিম খানসামা। আর ছিল ওস্তাদ বাজিকর ঝুলুর মিঞা। কচ্ছপের মতো তাকে আস্তে আস্তে, পা একগজ ফাঁক ক’রে হাঁটতে দেখে মনে হ’ত যে সে যেন নিজেকে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে, দশ হাতের মধ্যেই, হাফিজ মিঞার দর্জির দোকান। আসন ক’রে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মিঞা কাঁচি হাতে যখন কোটের ছাঁট দিতে বসত তখন দেখে মনে হ’ত ঠিক যেন দীর্ঘদিন অনশনরত, ধ্যানমগ্ন, অস্থিচর্মসার, স্লেটপাথরে খোদিত, গান্ধার শৈলীর অবিকল বুদ্ধমূর্তি। বুকের পাঁজরের খাঁচাটা যেন তার তিন জ’ পেরেকের মতো সরু শরীরটা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। খাঁচার তলায় পেটের গর্তটি যেন অবিকল একটি আড়াই-সেরি দই-এর খালি ভাঁড়। শুধু উষ্ণীষের পরিবর্তে পঁচা পাটের রঙের কদমছাঁট চুল। আর ঐ রঙের আবছা যে গোঁফজোড়া ছিল, পরিচিত নানারকম মুসলমানী গোঁফের আকারের সঙ্গে তার কোনরকম মিলই ছিল না। বলা বাহুল্য, ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে তার মিল এইখানেই শেষ। পেটের যাবতীয় রোগে ভুগে ভুগে তার এমনই দশা হয়েছিল যে যা-ই খায়-না কেন তার লিভার ঘোরতর বিদ্রোহ ঘোষনা করত। তবুও পিচগোলা জলের মতো দেখতে ভীষণ কড়া চা, আর আবির জলের মতো লাল, তেল-লঙ্কার রগরগে ঝোলওয়ালা, ‘কালেজা-কা সালন্’, ঘি-চকচকে পরোটার সঙ্গে না খেতে পেলে তার মেজাজ তক্ষুনি সপ্তমে চ’ড়ে যেত। এ-রকম সময়ে আমরা অনেক দূর থেকে তার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারতাম এই গোলমাল কিসের। পেটের রোগের সঙ্গে ক্রনিক সর্দি-কাশি থাকার দরুন তার গলা দিয়ে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ রেরুত। সকালবেলার গুরুগম্ভির খরজের ভাঙা স্বর, রোদের উত্তাপ বাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। দিনের আলোর সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক না-থাকলেও সন্ধের দিকে সে-স্বর যদিও-বা কিঞ্চিৎ নামত, মাঝে-মাঝে কারণ- বিশেষে বেশ তীব্র হয়ে উঠতে এতটুকুও দেরি হ’ত না। আর রেগে গেলে তো কথাই নেই। স্বরগ্রামের প্রত্যেকটি স্বরই তার গলা দিয়ে এমন জোরালো হয়ে বেরুত, হঠাৎ শুনলে মনে হয় যেন তখনকার দিনের চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির কিক্কর সিং, আর ততই বিখ্যাত বাঘ-লড়াকু শ্যামাকান্ত ঝগড়া করছে। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম, ‘পাঁপড়-তোড়-পালোয়ান’। অর্থাৎ তার গায়ে এত তাগত্ যে অনায়াসেই সে একটি পাঁপড় ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে।
মিঞার খাবার আসত ইসলামপুর কিংবা বাবুরবাজারের একেক দিন একেক দোকান থেকে। বারো-তেরো বছরের অত্যন্ত গরিব একটি ছেলে, যেমনই নিকষ কালো তার গায়ের রঙ তেমনই মানানসই ছিল তার নাম। মাথায় তেল-মালিশ, গা- টেপা থেকে পানবিড়ি আনা, এমন-কি প্রাতঃকৃত্যাদি সারবার সময় জল ভ’রে বদ্না এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি যাবতীয় ফাইফরমাশ খাটত এই কালুই। একধরনের বিহারী উর্দু এবং কুট্টি ভাষার এক আজব সংমিশ্রণে এদের মধ্যে কথাবার্তা চলত। হুকুম দেওয়া এবং সে-হুঁকুম যথার্থ তামিল হওয়ার ব্যাপারে মিঞার ভাবখানা ছিল দিল্লীর বাদশাহের মতো। হাজার হোক ঢাকার নবাববাড়ি তো কয়েক গজের মধ্যেই ছিল তাছাড়া খোদ নবাবসাহেবের না হলেও ‘ডজন-ডজন ভাঞ্জা-ভাতিজার জামাকাপড় তো সে-ই তৈরি ক’রে দিত। তাই একটু-আধটু নবাবী চাল হ’লই-বা, তাতে দোষের কী! যেদিন কালু এসে খবর দিত যে ‘আজ কালাজা-কা সালন্ খতম হো গাইস’, সেদিন মিঞার মেজাজের কোনো ঠিকঠিকানা থাকত না। যেন পৃথিবীর সব খাবারের ভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। মিঞা তা হলে খাবে কী? কালু তাকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করে ‘সালন্ নাহি হ্যায় তো কেয়া হুইস্? বিরিয়ানি হাইস্, শিক আউর শামী কাবাব্ হাইস্, চাপ হাইস্, মাটান চপ্ আউর কালিস হাইস্, মাটান কারি আউর কিমা হাইস্’- কে শোনে! এ-সব মিঞার একটাও পছন্দ নয়। তার ‘কালেজা-কা সালন্’ চাই-ই; কালুকে হাতপাখার ডাঁট্ দেখিয়ে বলে ‘নাহিতো তেরা পিকা চামড়া উত্থার দেগা।’ ভয়ে কালু ক্যারার মতো কুঁকড়ে যায়। উপায় নেই। ঐ সালন্ যে তাকে যেমন ক’রে হোক যোগাড় করতেই হবে। প্রয়োজন হলে রাত- বেরাতে বাড়ি গিয়ে তার মাকে দিয়েই বানিয়ে আনতে হবে। তা না হলে তার আর রক্ষে নেই। যাই হোক, বেশিরভাগ দিনই কালু তার মনিবের এই প্রিয় খাদ্যটি এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে, কোথাও-না-কোথাও থেকে ঠিক এনে হাজির করত। এ-রকম সময়ে মিঞার ঠোঁটের কোণে একটি অস্পষ্ট হাসির রেখা মুহূর্তের জন্যে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যায়; যাতে কালুর চোখে তা ধরা না পড়ে, পাছে যদি কালুর সেবায় কোনোরকম ঘাটতি দেখা দেয়। ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেদিন সে এই বিশেষ খাবারটি হাজির করতে পারত না, সেদিন সত্যি-সত্যিই তার পিঠের চামড়ার দফারফা হত। ঐ দৃশ্য দেখে মিঞার ওপর আমার রাগের সীমা থাকত না। মানুষ কি এমন জানোয়ার হতে পারে যে তার বুদ্ধি-বিবেচনা সব লোপ পায়? এই বুড়ো বয়সেও লোকটার সংযমের কোনো বালাই নেই কেন!
মিঞার দপ্ ক’রে জ্বলে-ওঠা আগুনের মতো এই মেজাজ এবং নবাবী চালের পেছনে ছিল একদিকে তার অসুস্থতা আর স্ত্রী-বিয়োগ এবং নিঃসঙ্গতা বোধ, অন্য দিকে ছিল তার কারিগরিতে অসাধারণ মুন্সিয়ানা, আর তেমনই গর্ব। অতি উঁচুদরের কারিগরি শুধু দর্জিগিরিতেই সীমবদ্ধ ছিল না। পায়রা-ওড়ানো এবং বিভিন্ন জাতের গেরোবাজের বীজ মিশিয়ে উঁচু জাতের পায়রার বংশ তৈরি করাতে সে ছিল ততোধিক পারদর্শী। সে-কথায় পরে আসছি। নবাবী আমলে ‘ওস্তাদ’ খেতাবটি হয়তো এমন লোকের জন্যেই রাখা থাকত।
একদিন বিকেলে দোতলার রাস্তার ধারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ত্রিপলের হুড়-দেওয়া একটি ফোর্ড গাড়ি এসে হাফিজ মিঞার দোকানের সামনে দাঁড়াল। সেকালে সারাদিনে বড়জোর একখানা কি দু’খানা মোটরগাড়ি আমাদের জিন্দাবাহার গলি দিয়ে যাতায়াত করত। হুডের তলায় সওয়ারকে দেখবার জন্যে আমি বিশেষ কৌতূহলী। হাফিজ মিঞা শুয়ে ছিল। ‘আস্-সেলাম্ ওয়ালেকুম্’ ব’লে ধড়ফড় ক’রে উঠে বসল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টকটকে লাল তুর্কি টুপি মাথায়, বিশুদ্ধ গাওয়া-ঘি রঙের রেশমী আচকান পরা, গৌরকান্তি একটি যুবক এক টুকরো পশমী কাপড় হাতে, গাড়িটা থেকে নামলেন। হাল্কা বাদামী রঙের দাঁড়ি-গোঁফ থাকা সত্ত্বেও যুবকের মুখাবয়ব কিঞ্চিৎ মেয়েলি। দর্জিকে কাপড়টা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “হামারা কোট্ বনা দিজিয়েগা’। পৈটিক গোল-যোগের সঙ্গে বুকে শ্লেষ্মার আধিক্য মিঞাকে মাঝে-মাঝে ভীষণ কাবু ক’রে ফেলত। গভীর রাত্রিতে খ্যাকর-খ্যাকর কাশির আওয়াজে প্রায়ই আমার ঘুম ভেঙে যেত। এদিনও তার তবিয়ৎ এবং মেজাজ যে তেমন ভালো ছিল না, সকালবেলা থেকে কালুর ওপর তার জুলুমের রকম দেখেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। মিঞা খুব সরু গলায় এবং তমিজের সঙ্গে উত্তর দিয়ে বলল, ‘মেহেরবানি করকে কাপড়া ছোড় যাইয়ে, আউর তিনরোজ বাদ আকে ট্রায়েল দে যাইয়েগা!’ শুনে নবাবজাদার মাথার লাল তুর্কি টুপিটা প’ড়ে যায় আর কি! বললেন, ‘লেকিন’ লেকিন, আপতো হমারা নাহি নহি লিয়া, ট্রায়েল ক্যায়সে হোগা!’ মিঞা আগের মতোই চাপা সুরে যা বলল তার অর্থ, আপনি তিনদিন পরে আসুন তো তার পর দেখা যাবে। নবাবজাদা, কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধি হয়ে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো ভাবছিলেন মিঞা কি নিছক ইয়ার্কি করছে। তার পর, কিছু না বলেই গাড়িতে ঢুকে পড়লেন। দর্জির আওয়াজ ক্ষীণ হলেও প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়, দীর্ঘজীবনের কারিগরির অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের যোগফল যেন। তবু মিঞার কথা বলার ঢং-ঢাং দেখে মনে হ’ল ওর তবিয়ৎ তেমন বহাল নেই ব’লে নবাবজাদাকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে চাইছে।
পরের দিন ভোরে উঠেই দেখি হাফিজ মিঞা কোটের কাপড় মেজেতে পেতে ওস্তাদ চিত্রকরের মতো, চ্যাপটা নীল চক দিয়ে, কোথাও সরল, কোথাও বক্র, অতি মার্জিত সব রেখা টানছে। মাঝে-মাঝে চোখ বুজে গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করছে। নবাবজাদার শরীরের গঠন এবং আকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করেছিল কি? তপসে মাছের মতো সরু, লম্বা আঙুলগুলো এবং নীল চক ধরবার এবং তা দিয়ে টান-টুন দেবার কায়দা দেখে আমার মতো অপরিণত বয়সের বালকের চোখেও তাক লেগে যাচ্ছিল। আবার কয়েক মিনিট পর-পরই উঠে দাঁড়িয়ে এক চোখ বুঝে দেখছিল চকের দাগগুলো ঠিক-ঠিক জায়গায় ঠিক-ঠিক আয়তনে পড়ছে কি না! আমি অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি মিঞা দর্জি না আর্টিস্ট! তার পর অতি সন্তর্পণে নীল দাগগুলোর উপর দিয়ে কাঁচি চালাল। আমি তার দুঃসাহস দেখে হতভম্ব। যদি ভুলচুক্ করে বসে? যদি আস্তিন ছোটো হয়ে যায়? যদি পিঠের উপর খোঁচ পড়ে? এবং এর ফলাফল কি হতে পারে এ-কথা ভেবে আমার মনে নানারকম আশঙ্কা ঘোরাফেরা করতে আরম্ভ করল। বিলকুল কোনো মাপ না নিয়ে লোকটা কোট বানিয়ে দেবে এবং সেটা নবাবজাদার মতো বিশিষ্ট একজন গ্রাহক বিনা প্রতিবাদে মজুরি দিয়ে গ্রহণ করবে? প্রত্যেক জুম্মাবারে মোল্লা ডেকে দোকানে ‘মিলাদ-শরীফ’ ক’রে মিঞা কি কোনো তুক্তা হাসিল হাসিল করেছে না কি! না নেহাৎ পাগলামি করছে!
তিনদিন পরে মিঞার কাণ্ড দেখার কৌতূহলে আমি দুপুরবেলা থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার বুকের ভেতরটায় অহেতুক এক দুশ্চিন্তা আনাগোনা করছে। যেন আমারই আজ অগ্নিপরীক্ষা হবে। যদি কোটটা সত্যিসত্যিই নবাবজাদার গায়ে ফিট না করে! কিন্তু মিঞা নীল আর খয়েরি রঙের লুঙ্গি আর একটা ময়লা গোলাপী রঙের গেঞ্জি পরে নিশ্চিন্ত মনে দরজায় হেলান দিয়ে ব’সে একটি লোকের সঙ্গে পায়রার জাত নিয়ে অবোধ্য খুঁটিনাটির আলোচনায় মশগুল। এ-রকম সময় নবাবজাদা কেন, দুনিয়ার অন্য সব-কিছুর কথাই সে ভুলে যায়।
নির্দিষ্ট সময়ে ফোর্ড গাড়ি এসে হাজির। আমার উত্তেজনার সীমা নেই। মিঞা নবাবজাদাকে সম্ভাষণ জানিয়ে আলমারি থেকে হ্যাঁঙারে ঝোলানো কোটটি আনবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। বিশেষ কোনো ব্যস্ততা নেই। নবাবজাদার ভ্রু ঈষৎ কুঁচকোনো। চোখে-মুখে সন্দেহের ছাপ সুস্পষ্ট। আয়নার মুখোমুখি তাঁকে দাঁড় করিয়ে আলতো ক’রে কোটটি পরিয়ে দিল। এক অলৌকিক ব্যাপার। প্রায়, প্রায় নিখুঁত কাটিং অ্যাণ্ড ফিটিং! কাঁধের পুট, আস্তিন, বগল সব ঠিক। শুধু পিঠে একটু ভাঁজ পড়েছে। দেখে নবাবজাদার চোখ ছানাবড়া। মুখ হাঁ ক’রে নির্বাক হয়ে আয়নার সামনে জ’মে গেলেন। আমিও যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছি। ওস্তাদ হাফিজ মিঞা নীল চকটা দিয়ে কোটের ওপর বীজগণিতের সংকেতের মতো দু-চারটি ছোট-ছোট হাল্কা দাগ বসিয়ে সে-সব জায়গায় আলপিন গেঁথে দিল। ছেলেকে আদেশ করল কী করতে হবে। নবাবজাদার মুখে যেন কে কুলুপ আটকে দিয়েছে। গাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে যাবেন আর কি, ঠিক সেইসময়ে একটু থেমে ওস্তাদ দর্জির দিকে মুখ ঘোরালেন। ঠোঁটের ডান কোণে কয়েক সেকেণ্ড ছোট্র একটি হাসি ধরে রেখে বললেন, “কামাল কামাল! গজব্, গজর্!
ঘণ্টা দুয়েক পরে সুন্দর ভাঁজে কোটটি ভালো ক’রে ইস্ত্রি ক’রে সেটিকে হ্যাঁঙারে ঝুলিয়ে রেখে ছেলের মারফত নবাববাড়ি পাঠিয়ে দিল। কী অসাধারণ কারিগর। এই নিরক্ষর লোকটির বিশেষজ্ঞসুলভ বিদ্যা এবং দক্ষতা দেখে আমিও নবাবজাদার মতো বিস্ময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
যদিও দর্জিগিরিই হাফিজ মিঞার মুখ্য পেশা ছিল, আসলে তার প্রাণ-মন প’ড়ে থাকত তার দোকানের ছাদে রাখা গেরোবাজ পায়রাগুলোর ওপর। আফিমের নেশার মতোই পায়রা-ওড়ানোর নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। ভোরে কাক ডাকার সঙ্গে- সঙ্গেই মিঞা ছাদে উঠে আসে। এইসময় তার সমস্ত অসুস্থতা, অবসাদ, জড়তা, তার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে অনেক দূরে চ’লে যায়। আগের দিন সন্ধেবেলার চাটাইয়ের ওপর শোয়া নিস্তেজ বিশীর্ণ লোকটির সঙ্গে সকাল-বেলার এ-লোকটির কোনোই মিল নেই। উত্তেজনা-মিশ্রিত এক প্রবল কর্ম-চাঞ্চল্য ভূতের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে। তাকে দেখা মাত্রই পায়রাগুলো যেন খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। সেকি আনন্দ! সেকি ঠেলাঠেলি! যেন অনেকদিন পরে সন্তানেরা তাদের বাপ- মাকে ফিরে পেয়েছে। মুঠো-মুঠো ধান ছড়িয়ে দিয়ে যেই-না খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া, বাঁধভাঙা নদীর জলের মতো পায়রার দল দানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ ক’টি দানা তার হাতে চড়ে না খেতে পেলে যেন তাদের খাওয়াই শেষ হ’ত না। মনিব যেমন তার পোষা কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, মিঞাও ঠিক তেমনি ক’রে তাদের আদর করে। আঃ কী মর্মস্পর্শী সে-দৃশ্য। এই পাখিগুলোর প্রতি তার মমতার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না।
দানা খাওয়া সারা হলেই নিশানের মতো লাল এক টুকরো কাপড় ডগায় বাঁধা একটি মুলি বাঁশের সাহায্যে পায়রাগুলোকে তাড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়। পক্ষিজগতে এমন-কিছু কি আর আছে যার ডানাতে বে-লাগাম ঘোড়ার মতো প্রাণের উদ্দাম উচ্ছলতার এমন আশ্চর্য বিকাশ দেখা যায়। যে-ডানার প্রত্যেকটি পালক বিদ্যুতে ভরপুর এবং বিদ্যুতের মতোই ত্বরিত যার গতি। যার প্রত্যেকটি রোম চাঞ্চল্য আর উত্তেজনায় ভরা! এই পাখিগুলো প্রথমে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে, সোজা লাইন কেটে হাউইবাজির মতো শূন্যে ওঠে। পরমুহূর্তে তেমনি সোজা লাইনে নিচের দিকে গোত্তা মারে। শাঁই-শাঁই ক’রে দিক্-বিদিক্ ছুটে যায়। আবার ফিরে আসে। মিঞা একহাতে মুলি বাঁশটি উঁচিয়ে ঘোরাতে থাকে, অন্য হাতে সাঁড়াশির মতো নিচের ঠোঁট চেপে ধরে, সরু মোটা ছোটো-বড়ো শিস্ দিতে থাকে। আকাশে-বাতাসে এক সাংঘাতিক উত্তেজনা, এক সাংঘাতিক কর্মচাঞ্চল্য। তার পরই, অপরূপ, মনোরম এক দৃশ্য। চল্লিশ-পঞ্চাশটি খানদানি গেরোবাজ পায়রা যখন একই সঙ্গে, একই ছন্দে, চক্রাকারে ডিগবাজির পর ডিগবাজি খেতে থাকে তখন মনে হয় যেন আকাশে পাখিদের ব্যালে-নৃত্য দেখছি। তাদের ডানায় আর বুকে উষার গোলাপী আলোর ছোঁয়ায় মনে হ’ত যেন হাউইবাজি থেকে সারি-সারি গোলাপ ফুটে বেরুচ্ছে। আঃ! সে-কী বাহার! কী অপূর্ব! এ দৃশ্য দেখে আমার মনটাও উড়ি-উড়ি করে। এক অদমনীয় চঞ্চলতা আমাকে অস্তির ক’রে তোলে। ক্রমাগত ডানা ঝাঁপটা দিয়ে উঠে মহাকাশে মিলিয়ে যায়। নিছক উড়ে বেড়াবার একরকম নির্ভেজাল আনন্দ পাওয়ায় পক্ষিজগতে পায়রার জুড়ি বোধ হয় আর তেমন নেই। ডানায় ভর ক’রে প্রহরের পর প্রহর শূন্যে ভেসে বেড়াতে চিল-শকুনদেরও তুলনা নেই। কিন্তু সেই ডানায় না আছে ঝাঁপটা, না আছে উচ্ছলতা। তবুও ঝোড়ো হাওয়ার ডগায় ঘন কালো মেঘের বাহনে গা এলিয়ে দিয়ে দূর থেকে বৃত্তাকারে যখন এই পাখিরা ঘুরে-ঘুরে ভেসে আসে, সে- দৃশ্য সে-আনন্দই বা কম কিসের! দেখতে যেমনই চমৎকার, চোখেও তেমনি আরামদায়ক। শরীরের আঁটো মাংসপেশীগুলো শিথিল হয়ে আসে। মন আপনাআপনিই এলিয়ে পড়ে। নাগরিক জীবনের নানা চাপে প্রসারিত মন সাময়িক মুক্তি পায়। গগন ঠাকুর তো তাই চীনে কালিতে ঐ-দৃশ্যের খাসা কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন।
অন্যান্য পায়রা-পাগল লোকদের মতো পায়রা নিয়ে বাজি খেলায় হাফিজ মিঞার বিন্দুমাত্রও উৎসাহ ছিল না। এ-বিষয়ে তার বেশ-একটু নাক-উঁচু ভাব ছিল। তার কাছে এটি অতি নিকৃষ্ট ধরনের খেলা। এই পাখিদের প্রথমে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে উড়তে শেখানো এবং পরে তাদের বিশেষ ধরনের ট্রেনিং দেওয়ায় মিঞার পদ্ধতি ছিল পুরোপুরি সামরিক। মিঞাও ঠিক যেন আনকোরা জোয়ানদের ট্রেনার। এককথায় সার্জেন্ট মেজর। তা সত্ত্বেও পায়রা ওড়ানোকে সে যে একটি চারুকলার স্তরে তুলে ধরেছিল, এ-সত্যটি ঢাকা শহরে তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীরা, হিংসাবশত সামনাসামনি প্রকাশ না-করলেও মনে-মনে একবাক্যে স্বীকার ক’রে নিয়েছিল। মিঞার পায়রাদের মধ্যে মনুষ্যজগতের ক্যাসানোভার মতো অনেকগুলো মরদ ‘লুটেরা’ পায়রা ছিল। অন্য পায়রার দলে ঢুকে তার থেকে বাছাইকরা মাদী পায়রাগুলোকে ভাগিয়ে আনাতে তাদের কেরামতি দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। এ বিশেষ পায়রাগুলোকে মিঞা তৈরি করত নানাজাতের খানদানি পায়রার সংমিশ্রণে–যেমন ‘বেনারসী কাজি’র সঙ্গে ‘বাংলার কাজি’, ‘সারডুম’-এর সঙ্গে ‘নাস্রা’, ‘প্লেন’-এর সঙ্গে ‘অপরাজিতা প্লেন’, ‘সব্চিনিয়া’র সঙ্গে ‘কাজি’ ইত্যাদি। মিঞার মতে ‘নাম্রা’র নজর নাকি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এবং ‘বাজি’ দেখাতে এর নাকি জুড়ি নেই। একনাগাড়ে দীর্ঘ-কালব্যাপি আকাশে উড়ে বেড়াতে ‘প্লেন’ পায়রা নাকি তুলনাহীন। এ-বিষয়ে নানা পরিক্ষানীরিক্ষায় প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞানের ছিটেফোঁটা পাবার লোভে অনেকেই তার কাছে আনাগোনা করত। নির্ভেজাল খোশামোদ থেকে তার পা-ছোঁয়া পর্যন্ত কিছুই বাদ যেত না। কিন্তু এই জ্ঞানের এবং দক্ষতার মালিকানা যে শুধু তারই। ‘আচ্ছা, দেখা যাবেখন, আজ শরীরটা তেমন জুত-সই মনে হচ্ছে না, আরেকদিন হবে’, এইভাবে টালবাহানা করে তাদের বিদায় দিত। এ-ব্যাপারে তার ভাবখানা ছিল বাঘা-বাঘা মুসলমান গাইয়ে-বাজিয়েদের মতো। শুনেছি ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব এভাবে তাঁর গুণমুগ্ধদের অনুরোধ খারিজ ক’রে দিতেন।
নেশা–তা আফিম-গাঁজা-ভাঙেরই হোক, আর পায়রা ওড়ানোরই হোক, সঙ্গী না জোটাতে পারলে তা তেমন জমে না। সারা সকাল পায়রা ওড়ানো আর বাকি দিন পেশাদারী কর্মব্যস্ততার আড়ালে তার জীবন ছিল নিতান্তই নিঃসঙ্গ। কিছুকাল আগেই তার স্ত্রীবিয়োগ হয়েছিল। পরিবার বলতে শুধু একটিমাত্র ছেলে। এই ছেলে দর্জিগিরিতে তার সঙ্গে সামিল থাকলেও পায়রার ব্যাপারে তার বিশেষ উৎসাহ ছিল না। তাছাড়া সন্ধে হলেই তার সমবয়সীদের আড্ডায় সে চ’লে যেত। এ-সময় থেকে সারারাত মিঞার কাছে এক অনন্তকাল। শরীরের যাবতীয় অভিযোগও তখনই মাথা চাড়া দিয়ে উঠত, এবং এ-সময় থেকেই কালুর অবিরাম সেবা তার পক্ষে অত্যান্ত জরুরি হয়ে উঠত। পাঁজর বের-করা কঠিন আস্তরণের তলায়, অন্যান্য পাঁচটি স্বাভাবিক লোকের মতো তার মনেও নানা কথা নানাভাবে জমে ওঠে। নিকট কাউকে সে-কথা বলতে পেরে হাল্কা বোধ করা খাওয়া-পরার মতোই এটাও তো প্রত্যেক মানুষের নিতান্তই প্রাথমিক প্রয়োজন। যাই হোক, নেশাখোরের সঙ্গী যদি তার বিশ্বস্ত আর গুণ-মুগ্ধ হয়, তা হলে তো আর কথাই নেই। আমার অগ্রজের মধ্যে এ-দুয়ের সংমিশ্রণ পেয়ে মিঞা, জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তাকে সানন্দে দলে টেনে নিল। নিজের ছেলের মতো আমার ভাইকেও একই স্নেহের চোখে দেখতো। স্বভাবতই মিঞার সুখদুঃখের কাহিনীর–তা নিজেরই হোক আর তার পোষা পায়রাদেরই হোক– একমাত্র অংশীদার সেই হ’ল। একেক দিন রাত এগারোটা পর্যন্ত এই আদানপ্রদান চলত। এই নেশা যে কী সাংঘাতিক রকম ছোঁয়াচে হতে পারে, তার প্রমাণ পেতে বেশি দেরি হ’ল না। অল্পদিনের মধ্যে আমিও যে কখন বেমালুম এদের দলে ঢুকে পড়েছিলাম টেরও পাইনি।
ঠাকুরদার আমল থেকেই আমাদের বাড়িতে কিছু সাধারণ গোলা পায়রা ছিল। মিঞার পরিচালনায়, পায়রা ওড়ানোয়, পায়রার অভিজাত বংশ তৈরি করার অসাধারণ উত্তেজনায় আমরা দু-ভাই মেতে উঠলাম। আমাদের খাওয়া-দাওয়া খেলাধুলো শিকেয় উঠল। এই নেশা যে মানুষকে কীভাবে অভিভূত ক’রে ফেলে, যাঁরা একবার এর খপ্পরে পড়েছেন, শুধু তাঁরাই জানেন। যাই হোক, আমার ক্ষেত্রে এই নেশার মেয়াদ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি; কারণ আমি তার পরিবর্তে আরো ভয়ানক আরেক নেশার কবলে পড়লাম। সে-কথা অন্যত্র বলব।
একদিন বিকেলে আমরা দু-ভাই স্কুল থেকে ফেরবার সঙ্গে-সঙ্গেই মিঞা আমাদের জানাল যে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা শহরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পায়রার এক রেস হবে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ ঝাঁক পায়রা এই প্রতিযোগিতায় নামানো হবে এবং এই রেসের কক্ষপথ নাকি আমাদের পাড়ার ওপর দিয়েই। মিঞার প্ল্যান হচ্ছে যে যেমন ক’রেই হোক এই-সব দল থেকে বাছাইকরা পায়রাদের ভাগিয়ে আনতে হবে। এই ফন্দিতে মিঞা যেমনই উত্তেজিত, তেমনই দৃঢ়-সংকল্প। আমরা দু-ভাই যেন তাকে যোগান দিতে প্রস্তুত থাকি। এই উত্তেজনার জ্বর আমাদেরও এমনভাবে স্পর্শ করল যে সারারাত প্রায় ঘুমই এল না।
পরদিন সকালে কাক ডাকার আগেই ছাদে উঠে এলাম। মিঞা অবিশ্যি তার আগেই উঠে এসে দানা জল ইত্যাদির সব ব্যবস্থায় ব্যস্ত। ছেলেকে মোতায়েন করেছে সংলগ্ন বাড়ির তেতলার ছাদে। আর কালুকে পাঠিয়েছে আমাদের পাড়ার মসজিদের আজান দেবার গম্বুজে। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হ’ল পুবের আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখতে, কারণ পায়রার দল পুব থেকে পশ্চিমের দিকেই যাবে।
আমাদের জোড়া-জোড়া চোখ দূরবীনের মতো সেই আকাশকে তন্ন তন্ন ক’রে যেন ঈদের চাঁদ খুঁজছে। ফিনফিনে মসলিনের চাদরের মতো হাল্কা কুয়াশায় গোটা শহর ঢাকা। ওপরে শীতের প্রভাতের মোলায়েম সোনালী আলোয় সারা আসমান সদ্য তৈরি পেতলের চাদরের মতোই ঝকঝক করছে। দু-চারটে কাক আর শালিকের ছোট্ট-ছোট্ট কালো বিন্দু ছাড়া এই আসমান যেন ছবি আঁকার আগে চিত্রকরের নিঙ্কলঙ্ক ক্যানভাস ।
হঠাৎ মসজিদের মিনারের দিক থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসায় আমাদের কান তৎক্ষণাৎ খাড়া হয়ে উঠল। কালু চিৎকার ক’রে বলছে, ‘আ রহিস, আ রহিস।’ আমাদের চোখ বিস্ফারিত। নবাববাড়ির সদর প্রবেশ-পথের গম্বুজ, বাড়িঘর, জগন্নাথ কলেজ ইত্যাদির ওপর দিয়ে আমাদের দৃষ্টি ছোটে পুবের দিগন্তে। পায়রা তো দূরের কথা, একটা চড়ুই-ফিঙেও চোখে পড়ছে না। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই দেখি একটা আবছা ধোঁয়া আকাশের দিকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হয়তো নারায়ণগঞ্জের পাটকলের ধোঁয়া হবে, কে জানে? তাছাড়া, এই সাতসকালে কত উনুনের ধোঁয়াই তো এইরকম আকাশে উঠে মিলিয়ে যায়। যাই হোক, মৃত বিশীর্ণের ওপর শকুনের চোখের মতোই আমাদের জোড়া-জোড়া চোখও সেই ধোঁয়ার ওপর দৃঢ়সংবদ্ধ। কিন্তু এ-ধোঁয়া যে ক্রমশই গাঢ় হয়ে ভাদ্রের এক টুকরো কালো মেঘের মতোই এগিয়ে আসছে। হঠাৎ দেখি মিঞা ভীষণ তৎপর হয়ে উঠল। পায়রার খাঁচার দরজাগুলো পর-পর খুলে দিল। বের হবার সঙ্গে-সঙ্গেই লাল নিশানাওয়ালা সেই মুলি বাঁশটি দিয়ে পায়রাদের তাড়িয়ে আকাশে উড়িয়ে দিল। সুঁই, সুঁই…. সুঁই-ই আওয়াজে শিস্ দিতে আরম্ভ করল। আমরাও শিস্ত্রে ঐকতান জুড়ে দিলাম। নিস্তব্ধ, নিশ্চল, ভোরের আকাশ-বাতাস হঠাৎ প্রবল উত্তেজনায়, কর্মচাঞ্চল্য আর উৎকণ্ঠায় ভ’রে উঠল। সেই কালো মেঘটি দেখতে-না-দেখতেই খণ্ড খণ্ড হয়ে, সারা পুবের দিগন্ত ছেয়ে শাঁই-শাঁই ক’রে এগিয়ে আসছে। আমরা পরিষ্কার তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মিঞার পায়রার দল ইতিমধ্যে সম্ভাব্য কক্ষপথে চক্কর কাটতে আরম্ভ করছে। ঝড়ের সুপুরি গাছের মতো মুলি বাঁশটি কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে দ্রুত বেগে সে দোলাতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রের ফৌজি লোকদের মতোই নিশানের নানারকম সংকেত করতে থাকে। ইতিমধ্যেই প্রতিযোগী পায়রার দল তড়িৎ বেগে এগুচ্ছে শৃঙ্খলিত গঠনে, যেন শত্রুপক্ষের এরোপ্লেনের দল আসছে। এই দল যেই-না আমাদের পাড়ার ওপরে আসা, মিঞার পায়রারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে, প্যারাট্রুপার্সদের মতো, ভিন্ন-ভিন্ন প্রতিযোগী দলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাদের লক্ষ্য হ’ল সবচেয়ে এগিয়ে-যাওয়া দলের থেকে পায়রা ভাগিয়ে আনা। মিঞাও ক্ষিপ্ত হয়ে, তাদের শিস্ত্রের মাধ্যমে, তার নানারকম অদৃশ্য সংকেতলিপি পাঠায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পায়রার দল অপরিচিত দলের থেকে বেশ কয়েকটি পায়রা সঙ্গে ক’রে শাঁই- শাঁই-শাঁই ক’রে আকাশের ওপরের দিকে উঠে গেল। আর উঠতে-উঠতে অনন্ত নীলিমায় মিশে গেল। আমরা দু-ভাই সাংঘাতিক উদ্ববিগ্ন। দেখি মিঞা নিশ্চিন্তমনে ছাদের নীচু পাঁচিলে ব’সে একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। যেন সব-কিছু ঠিক আছে। তার এই প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় দেখে আমরা দু-ভাই হতভম্ব। বিড়িটা শেষ না হতেই তার থেকে আরেকটা বিড়ি ধরাল। সেটি শেষ হবার আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অস্বাভাবিকরকম তৎপরতার সঙ্গে গোটা ছাদটাকে ঝাঁট দিল। তার পর মুঠো মুঠো ধান ছড়াল। মাটির গামলাগুলোকে ফাঁক-ফাঁক ক’রে রেখে জলে টইটুম্বর ক’রে দিল। থেকে-থেকেই আকাশের দিকে চায়, আবার চোখ নামিয়ে আনে। এ-রকম কয়েকবার করার পরই মিঞা আমাদের ইশারা করল ছাদ থেকে নেমে যেতে। হঠাৎ বেতারে কোন বার্তা পেয়েছে যেন। তার ছেলেও সংলগ্ন বাড়ির ছাদ থেকে নেমে গেল। আমরা দৌড়ে দোতলার বারান্দায় এসে হাজির হলাম। দেখি মিঞা তার ছাদের দরজার আড়ালে আত্মগোপন ক’রে আছে। পায়রার দল যে এখন আকাশ থেকে নামছে তা বুঝতে আমাদের কোনোই অসুবিধে হ’ল না।
এইখানেই মিঞার ট্রেনিং-এর বৈশিষ্ট্যের কথা ব’লে রাখি। মহাকাশে উড়ে দলচ্যুত পায়রাগুলো যখন ক্লান্তি, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় ছটফট করে, তখনই তার মরদ পায়রাগুলো তাদের সঙ্গে ক’রে ছাদে নেমে আসে। অপরিচিত পরিবেশ দেখে নতুন পায়রাগুলো অস্বস্তি বোধ করে। বিপদের আশঙ্কায় পালাবার চেষ্টা করে। সঙ্গে-সঙ্গে মরদ পায়রাগুলো উড়ে গিয়ে তক্ষুনি তাদের ঘিরে ফেলে, ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বলা বাহুল্য যে এ-ধরনের ‘ডাকাতি’র জন্যে মিঞার শত্রুসংখ্যা,স্বভাবতই, দিন-দিন বেড়ে উঠছিল। যাই হোক, তার ‘ডাকাত’ পায়রাদের কার্যক্রমের অবিশ্যি এইখানেই ইতি। বাকি ক্রিয়াকলাপের ভার এইবার মিঞা সম্পূর্ণ নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। এদিকে ক্ষুধার্ত পাখিগুলো হাপুস-হুঁপুস ক’রে দানা গিলছে; পরমুহূর্তেই ঠোঁট দিয়ে চোঁ ক’রে জল শুষে নিচ্ছে। তাদের এই মগ্নতার সুযোগ নিয়ে হুলো বেড়ালের মতো নিঃশব্দপদক্ষেপে মিঞা খাঁচাগুলোর দরজা, বেশি নয়, মাত্র তিন-চার ইঞ্চি নাগাদ ফাঁক ক’রে দেয়। তার ভেতরেও প্রচুর ধান আর জল আগে থেকেই রাখা ছিল। ছাদের ধান নিঃশেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গে ভাগিয়ে-আনা পাখি ক’টিকে দলের মাঝখানে রেখে মিঞার পায়রারা রীতিমতো তাদের ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যায় খাঁচার ধানের দিকে। কী আশ্চর্য ট্রেনিং! কী তার সুক্ষ্ম কারিগরি! এদিকে খাঁচার ভেতর অসম্ভব ভিড়ে সব-কিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে। এই তো তাদের বন্দী করবার সুবর্ণ সুযোগ। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে ওত-পাতা বাঘ যেমন শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে মিঞা ক্ষিপ্রহাতে খাঁচার দরজাগুলো নামিয়ে দিল।
নাটকীয় ঢঙে নবাবজাদারই মতো আমিও মনে-মনে বললাম, “কামাল, কামাল! গজব্, গজব!