দরজা ধরে কে যেন দাঁড়িয়েছে।
ফরহাদ উদ্দিন বসে আছেন খাটে। তাঁর পিঠ দরজার দিকে তবু তিনি স্পষ্ট বুঝলেন তার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তিনি খুবই অবাক হলেন চোখে না দেখেও কী করে বোঝা যাচ্ছে? এমন তো না, যে দাঁড়িয়ে আছে তার ছায়া এসে ঘরে ঢুকেছে। কিংবা সে শব্দ করছে, নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনছেন। তিনি কিছুই শুনছেন না। যে দাঁড়িয়ে আছে তার গায়ের গন্ধও পাচ্ছেন না। কারণ ফরহাদ উদ্দিন সাহেবের ঘ্রাণশক্তি নেই। গত পনেরো বছর ধরে তিনি কোনো কিছুর গন্ধ পান না। একবার কাগজি লেবু চিপে তার কিছু রস তিনি নাকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। নাক জ্বালা করেছে, তিনি কোনোই গন্ধ পান নি।
একজন কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকে দেখছেন না, তার গায়ের কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছেন না। সে কোনো শব্দও করছে না, অথচ ফরহাদ উদ্দিন সাহেব তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন।
তার কাছে এই ঘটনার জন্যে জগৎ খুব রহস্যময় মনে হলো। ফরহাদ উদ্দিনের কাছে মাঝে মাঝে অনেক তুচ্ছ কারণেও জগৎ রহস্যময় মনে হয়। আজকের কারণটা তেমন তুচ্ছ না।
ফরহাদ উদ্দিনের হাতে খবরের কাগজ। আজ ছুটির দিন। তিনটা বাজে। খবরের কাগজ সকালেই পড়া হয়েছে। এখন আবারো পড়ছেন, কারণ তিনি লক্ষ করেছেন খবরের কাগজ দ্বিতীয়বার পড়ার সময় অনেক ইন্টারেস্টিং খবর চোখে পড়ে যা প্রথমবারে চোখ মিস করে যায়। এই যেমন এখন তিনি দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা খবর পড়ছেন। সকালবেলা এই খবর চোখেই পড়ে নি—কাঁঠাল খেয়ে একই পরিবারের সাত জনের মৃত্যু। নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানিয়েছেন গাইবান্ধার রসুলপুরের জনৈক মজনু মিয়ার পরিবারে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মজনু মিয়া সকালে নিজের বাড়ির পেছনের কাঁঠাল গাছ থেকে একটা পাকা কাঁঠাল পেড়ে এনে সবাই মিলে আরাম করে খেয়েছে। খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তবমিএবং মৃত্যু।
আশ্চর্যজনক সংবাদ বটেই৷ বৃক্ষের ফল কি বিষাক্ত হতে শুরু করেছে? টিউবওয়েলের বিশুদ্ধ পানিতে এখন আর্সেনিক। গাছের ফলফলাদিতেও কি আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত কিছু জমতে শুরু করেছে? শেষ বিচারের দিন কি কাছে এসে গেছে? শেষ বিচারের দিনকাছাকাছি চলে এলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে। মাটির নিচ থেকে একটী বিকটাকার কুৎসিত প্রাণী বের হয়ে মানুষের ভাষায় কথা বলবে, গাছের ফলফলাদি বিষাক্ত হয়ে যাবে, পানির মধ্যে চলে আসবে তিক্ত স্বাদ…।
ব্যাপারগুলি নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে তার সঙ্গে আলাপ করা যায়। ফরহাদউদ্দিন এখন জানেন কে দাঁড়িয়ে আছে—কনক। মেয়েটার চুপি চুপি দরজা ধরে দাঁড়ানোর অভ্যাস আছে। পাখি স্বভাব মেয়ে। পাখি যেমন জানালায় বসে থাকে, কেউ তার দিকে তাকালেই উড়েযায়–কনক মেয়েটাও সেরকম। ঘাড় ঘুরিয়ে ফরহাদ উদ্দিন তার দিকে তাকালেই সে সরে যাবে। তবে একেবারে চলেও যাবে না। দরজার আশেপাশে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
কনক ফরহাদ উদ্দিনের বন্ধু বদরুল পাশার মেয়ে। এক মাস হলো মেয়েটা এই বাড়িতে আছো আঠারে উনিশ বছরের মেয়ে অথচ শিশুদের মতো ভাব ভঙ্গি। পাখি স্বভাবের মেয়ে এরকম হয়, কিছুতেই তাদের শৈশব কাটে না। মেয়েটার উপর ফরহাদ উদ্দিনের খুবই মায়া লেগে গেছে। আর মায়া এমন জিনিস একবার যদি লেগে যায় তাহলে সর্বনাশ, মায়া বাড়তেই থাকে।
কনক
জি।
সঞ্জু বাসায় আছে কিনা একটু দেখে আস। তাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। ঠিক সাড়ে তিনটার সময় বের হবো। তাকে মনে করিয়ে দিয়ে আস।
ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন মেয়েটা যাচ্ছে না। এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে। তিনি খবরের কাগজে মন দিলেন। এখন পড়ছেন কর্মখালি বিজ্ঞাপন। তার কর্মখালি বিজ্ঞাপন পড়ার কোনো কারণ নেই। তবু কেন জানি এই বিজ্ঞাপনগুলি পড়তে ভালো লাগে। তার প্রয়োজন না থাকলেও সঞ্জুর প্রয়োজন পড়বে। ছমাসের ঘধ্যে তার রেজাল্ট হয়ে যাবে। চাকরি খোঁজা শুরু। চাকরির বাজার কেমন–আগেভাগে দেখা থাকলে ভাল।
কনক
জ্বি।
দেখি মা আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও তো।
আচ্ছা।
চিনি দিও না কিন্তু। আমার ডায়াবেটিস মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। চিনি খাওয়া আর বিষ খাওয়া আমার জন্যে একই। এক চামচ চিনি মানে এক চামচ বিষ।
কনক এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হয় সে দরজার পাশ থেকে নড়বে। মেয়েটা মাঝে মাঝে এরকম করে কোনো কথাই শোনে না। চা বানিয়ে না আনলেই ভালো হয়। ফরহাদ উদ্দিনের চায়ের পিপাসা পায় নি। মেয়েটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার জন্যে কথা বলা। মায়া পড়ে গেলে যা হয়। যার উপর মায়া পড়েছে তার সঙ্গে শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করে। এই ইচ্ছাটিই বিপজ্জনক। কথা বলা মানেই মায়া বাড়ানো।
ফরহাদ উদ্দিন ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এই নিঃশ্বাস কনক মেয়েটার জন্যে। মেয়েটা পড়ে গেছে আউলা ঝাউলার মধ্যে। বদরুলের মেয়ে আউলা ঝাউলার মধ্যে পড়বে এটা জানা কথা কিন্তু এতটা যে পড়বে তা ফরহাদ উদ্দিন নিজেও ভাবেন নি। কনকের বয়স যখন সাত বছর—বদরুল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সেই নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনাও অদ্ভুত। বদরুল একদিন হঠাৎ অফিস কামাই দিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত। হাতে বিরাট সাইজের একটা ইলিশ মাছ। তার না-কি হঠাৎ সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছ করছে। ঘরে সর্ষে ছিল না। মাছ রেখে সে গেল সর্ষে কিনতে। এই যে গেল আর ফিরল না। তাকে খোজার চেষ্টা কম করা হয় নি। হাসপাতালে খোঁজ নেয়া হয়েছে! মর্গে খোঁজ নেয়া হয়েছে, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে খোঁজ নেয়া হয়েছে—কোনো লাভ হয় নি।
ফরহাদ উদ্দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বদরুলের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার সোহাগীতে গিয়েছেন। তার ক্ষীণ সন্দেহ ছিল—বদরুল হয়তো তার গ্রামের বাড়িতে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বদরুলের যে স্বভাব তার জন্যে এটা বিচিত্র কিছু না। গ্রামের বাড়িতে তাকে পাওয়া গেল না, তবে কিছুদিন পরপরই উড়ো খবর পাওয়া যেতে লাগল। একজন তাকে দেখেছে মুন্সিগঞ্জে এক চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। একজন তাকে দেখেছে অজিমীর শরীফে খাজা বাবার দরগায়।
কনকের মা সাবেরা বেগম মেয়েকে নিয়ে পড়ল মহা বিপদে। একজন মানুষ মরে যাওয়া এক কথা আর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অন্য কথা। মৃত মানুষের ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না। নিখোঁজ মানুষের সে সম্ভাবনা থাকে। সেই সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুতি থাকতে হয়।
সাবেরা বেগম ছয় মাসের মতো বদরুলের ভাড়া করা বাড়িতে থাকল। তারপর সংসার গুটিয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে গেল। ভাইয়ের বাসায় বেশি দিন থাকা গেল না। থাকার কথাও না। ঢাকা শহরে একটা পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো মানুষ বেশি নেই। শুরু হলো সাবেরা বেগমের যাযাবর জীবন। এর বাড়িতে কিছুদিন। চার মাস পর আরেক বাড়িতে কিছুদিন। মাঝে মাঝে ফরহাদ উদ্দিন তাদের দেখতে যান। সাবেরা বেগম কাঁদো কাদো গলায় বলে—-ভাই সাহেব, একটা কিছু বুদ্ধি দেন তো। আমি কী করব? পড়াশোনাও জানি না যে চাকরি বাকরি করব। আয়ার চাকরি করতে পারি কিন্তু মেয়েটাকে রাখব কোথায়? মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন। আগুনের মতো রূপ হয়েছে—তার বাপ আমাকে যে যন্ত্রণায় ফেলেছে এই মেয়ে তারচে দশগুণ যন্ত্রণায় আমাকে ফেলবে।
তারপর একদিন শুনলেন কনকের মা’র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ধর্মের দিক থেকে এই বিয়ে শুদ্ধ। যে সময় পর্যন্ত স্বামী নিখোঁজ থাকলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায় বদরুল তার চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। সাত বছর তিন মাস। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেই ছেলে কী একটা এনজিওতে কাজ করে। ভালো বেতন পায়। ফরহাদ উদ্দিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক সব রক্ষা হয়েছে। একদিন ওদের নতুন সংসার দেখতে গেলেন। দেখে মুগ্ধই হলেন। বেশ সুন্দর গোছানো ছিমছাম সংসার। ঘরে টিভি, ফ্রিজ আছে। নতুন সোফা সেট। কনকের সৎবাবী ঘরে ছিল না, তবে বসার ঘরে কনকের মা’র সঙ্গে তোলা দুজনের ছবি দেখলেন। ভদ্রলোকের কেমন যেন গুণ্ডা গুণ্ডা চেহারা। রাগী রাগী চোখ। বদরুল পাশার একেবার বিপরীত। বদরুলের ছিল ঠাণ্ডা চেহারা। যখন হাসত তখন মনে হতো সারা শরীর দিয়ে হাসছে। নিজে হাসত অন্যকে হাসাত। ছবির এই ভদ্রলোক সে-রকম হবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে একেকজন মানুষ একেক রকম। কেউ হাসবে, কেউ রাগী চোখে ঠোঁট মুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকবে।
সাবেরা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কোনো উপায় না দেখে বিয়েতে রাজি হয়েছি। ভাই, আপনি আমার উপর রাগ করবেন না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ছিঃ ছিঃ ভাবি। আমার রাগ করার কথা আসছে কেন? আপনি যা করেছেন ভালোই করেছেন।
আমার শুধু ভয় লাগছে এখন যদি কনকের বাবা ফিরে আসে তাহলে কী হবে?
আসুক ফিরে তারপর দেখা যাবে।
আমার মন বলছে ফিরে আসবে। যখনই এটা মনে হয় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ভাই, আপনি সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। আমি দুঃখী একটা মেয়ে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভাবি আমি অবশ্যই যোগাযোগ রাখব।
ফরহাদ উদ্দিন যোগাযোগ রেখেছেন।
গত মাসে হঠাৎ একদিন কনকের মা তার অফিসে টেলিফোন করলেন—খুবই প্রয়োজন, তিনি যেন পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও তাদের বাসায় আসেন। সম্ভব হলে আজই। তিনি সেদিনই অফিস শেষ করে গেলেন।
সাবেরা বেগম ফরহাদ উদ্দিনকে দেখে অকূলে কূল পেয়েছেন এরকম ভাব করলেন। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ভাবি কেমন আছেন? অনেক দিন পরে কথা হচ্ছে। নতুন টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন? তার আগে বলেন, আপনি আছেন কেমন?
সাবেরা বেগম বললেন, বেশি ভালো না। ভাই সাহেব, আপনি আমার ছোট্ট একটা উপকার করবেন? ছোট্ট উপকার না, আসলে বড় উপকার।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, অবশ্যই করব। কী করতে হবে বলুন।
ছয়-সাত দিনের জন্যে আমার মেয়েটাকে আপনার বাসায় রাখবেন। আমি ওর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। আমি কনককে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। বুঝতেই তো পারছেন—গ্রাম দেশ, নানান জনে নানান কথা বলবে।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, বদরুলের মেয়েকে এক সপ্তাহের জন্যে নিজের বাসায় নিয়ে রাখব এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি বলুন কবে এসে নিয়ে যেতে হবে। আমি সেদিনই আসব।
আবার কবে আসবেন, না আসবেন—আজই নিয়ে যান। ভাই সাহেব, আপনার পায়ে পড়ি। আমার এই উপকারটা আপনি করেন। আমি কনকের স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছি। সাতটা দিন একটু কষ্ট করেন।
ফরহাদ উদ্দিন অবাকই হলেন। এত তাড়াহুড়া কেন বুঝতে পারলেন না। তিনি কনককে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলেন। কথা নেই বার্তা নেই বন্ধুর মেয়ে নিয়ে উপস্থিত হওয়াটা রাহেলা কী চোখে নেবে কে জানে। মেয়েটা থাকবেই বা কোন ঘরে। বাড়তি ঘর তো নেই। কনক থাকবে কোথায়? ভালো সমস্যা হলো তো!
তিনি যে-রকম ভেবেছিলেন সে-রকম কিছু হলো না। রাহেলা অবাক হয়ে বললেন—এই মেয়েকে তো আমি ছোটবেলায় দেখেছি। সে তো তখন এত সুন্দর ছিল না। এখন এত সুন্দর হয়েছে কীভাবে। এই মেয়ে তুমি কী সাবান মাখ?।
কনক কোনো জবাব দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তবে তার মুখ দেখে মনে হলো—এতক্ষণ একটা ভয়ের মধ্যে সে ছিল, এখন এই ভয় তার কেটে গেছে।
রাহেলা বললেন, তুমি তাস খেলতে জানো?
কনক না-সূচক মাথা নাড়ল।
রাহেলা বললেন তাস খেলা শিখে নিও। আমি আমার মেয়েদের সঙ্গে মজা করে তাস খেলি। বড় মেয়েটা খেলতে চায় না। কিছুক্ষণ তাস খেললেই তার নাকি মাথা ধরে। তুমি তাস খেলা শিখে নিলে আমাদের প্লেয়ারের সর্ট হবে না।
কনক হেসে ফেলল। সেই হাসি দেখে ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো মেয়েটা অনেক দিন এরকম হাসার সুযোগ পায় নি। তার মনটা মায়ায় ভরে গেল।
রাহেলা বললেন—শোন মেয়ে, তুমি তোমার চাচার ঘরে ঘুমুবে। একা একা ঘুমুতে ভয় পাবে এই জন্যে নীতু ঘুমাবে তোমার সঙ্গে। আর তোমার চাচা যখন খবরাখবর না নিয়ে হুট করে তোমাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তার শাস্তি হিসেবে ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমুবে। আমি আমার ঘরে তাকে জায়গা দেব না। এমন নাক ডাকে আমি এক সেকেণ্ডের জন্যেও ঘুমুতে পারি না।
এক সপ্তাহ পর তিনি কনককে তার মা’র কাছে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কনকের মা, তার স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশন নিয়ে চলে গেছে। খবরটা তারা গোপন রেখেছে। কেউই কিছু জানে না।
ফরহাদ উদ্দিন কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, মা তুমি জানতে ওরা বিদেশে চলে যাবে?
কনক হা-সূচক মাথা নাড়ল।
তোমাকে কি আমার কাছে ফেলে গেছে?
কনক আবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
ফরহাদ উদ্দিন ভীত গলায় বললেন, এখন কী করা যায় বলো তো মা? রাহেলা এই খবর শুনলে কী করবে কে জানে। কেন জানি মনে হচ্ছে, সে খুবই রেগে যাবে। আমার তো খুবই ভয় লাগছে। তোমার ভয় লাগছে না?
কনক বলল, না।
ভয় লাগছে না কেন?
চাচিজি সব জানেন।
চাচিজি সব জানেন মানে কী? রাহেলা কী জানে? তোমার মা যে তোমাকে আমার ঘাড়ে ফেলে চলে গেছে এটা জানে?
হুঁ। তাকে বলেছি।
আমাকে বলো নি কেন?
কনক অন্যদিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসল। যেন মানুষটাকে বোকা বানিয়ে সে মজা পাচ্ছে। এই মেয়েও তার বাবার মতো অদ্ভুত হচ্ছে কিনা কে বলবে। মনে হয় হচ্ছে। পিতার স্বভাব কিছু না কিছু তো পাবেই।
ফরহাদ উদ্দিন খুবই অবাক হলেন।
কনক সহজ গলায় বলল, চাচাজি আমি একটা আইসক্রিম খাব।
তিনি আইসক্রিম কিনে আনলেন। তাঁর কাছে মনে হলো মেয়েটাকে তার মা ফেলে রেখে গিয়ে ভালোই করেছে।
.
চাচাজি আপনার চা।
কনক চা এনে রেখেছে। ফরহাদ উদ্দিন চায়ে চুমুক না দিয়েই বললেন, অসাধারণ চা হয়েছে মা। সাধারণের আগে একটা অ বসেছে। একটা অ না বসে দু’টা বসলে ভালো হতো—অঅসাধারণ চা। তুমি চলে যাচ্ছ কেন? বোস, গল্প করি। আমার হাতে এখনো বার তের মিনিট সময় আছে।
কনক বসল না, খাট ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রইল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমার চায়ের নেশা নেই। চায়ের নেশা ছিল তোমার বাবার। চায়ের দোকান দেখলেই চা খেতে দাঁড়িয়ে যাবে। সে কী ঠিক করেছিল জানো? সে ঠিক করেছিল ঢাকা শহরে যত চায়ের দোকান আছে সব দোকানে সে চা খাবে। তারপর যে দোকানের চা সবচে ভালো তাকে আধভরি ওজনের একটা গোল্ড মেডেল দেবে। মেডেলের নাম বদরুল পাশা টি মেডেল। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে কত দোকানের চা যে খেয়েছি।
মেডেল দেয়া হয়েছিল?
না দেয়া হয় নি। তোমার বাবার কোনো শখই বেশিদিন থাকে না। একটা জিনিস ধরে, কিছুদিন এটা নিয়ে কচলাকচলি করে তারপর ছেড়ে দেয়। একবার কী করল শোন, কোত্থেকে খবর নিয়ে এলো কুড়ি বছর যদি কেউ মিথ্যা না বলে তাহলে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়। তার মনের সকল ইচ্ছা তখন পূর্ণ হয়। তোমার বাবা মিথ্যা বলা ছেড়ে দিল। তোমার বাবার পাল্লায় পড়ে আমিও মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলাম। সে তার স্বভাব মতো তিন মাস পরে বলল—আরে দূর, মিথ্যা না বলে মানুষ থাকতে পারে। মানুষের জন্মই হয়েছে ফিফটি পার্সেন্ট সত্য বলার জন্যে আর ফিফটি পার্সেন্ট মিথ্যা বলার জন্যে।
আপনিও কি বাবার মতো ছেড়ে দিলেন?
না আমি ছাড়ি নি। বিশ বছর হতে আর বেশি বাকিও নেই। আগামী ডিসেম্বরে হবে। তখন একটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হবে।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কী?
মনের শক্তি। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হলে আমি যা ইচ্ছা করব তাই হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি—কথার কথা আর কী। মনে কর, আমার খুব ইচ্ছা সঞ্জুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়। কিন্তু সঞ্জু এটা চাচ্ছে না। যেহেতু আমি ইচ্ছা করেছি বিয়ে হবেই। সঞ্জু যদি নাও চায় তারপরেও হবে।
কনক ক্ষীণ গলায় বলল, সঞ্জু ভাইয়ার একজন পছন্দের মেয়ে আছে, তার নাম রিনি। সঞ্জু ভাইয়া উনাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, ডিসেম্বর মাস পার হবার পর আর পারবে না। তখন আমার ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। আমার যে ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে তা তো তুমি জানো। তখন যদি আমি ইচ্ছা করি তাহলে ঘ্রাণশক্তি ফিরে আসবে।
কনক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, এখন বসল। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে। সে খুবই মজা পাচ্ছে।
মেয়েটার সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভালোই লাগত। কিন্তু আর সময় নেই। সঞ্জুকে নিয়ে বের হতে হবে।
ফরহাদ উদ্দিনের খুব ইচ্ছা সঞ্জুর সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে তাকে এ বাড়িতেই রেখে দেন। এরকম ভালো একটা মেয়ে অথচ সঞ্জু তার দিকে ফিরেও কেন তাকাচ্ছে না সেটা একটা রহস্য। ঠিক মতো কয়েকবার তাকালেই মায়া লেগে যেত। একবার মায়া লেগে গেলে আর চিন্তা ছিল না। ফরহাদ উদ্দিন অবশ্য নিজের মতোই চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যখন তখন কনককে সঞ্জুর কাছে পাঠাচ্ছেন। টুকটাক কথা হতে হতে দেখা যাবে মায়া লেগে গেছে। মায়া লাগার জন্যে কথা চালাচালি করা খুবই জরুরি।
কনক!
জ্বি।
সঞ্জুর ঘরে একটু যাও তো। ওকে বলো কাপড় পরতে, আমরা এখন রওনা হব।
উনার ঘরে ঢুকলে উনি রাগ করবেন।
তাহলে দরজা থেকে বললো।
কনক উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ উদ্দিন আবারো একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। কী সুন্দর মেয়ে। সঞ্জুর আশেপাশে এরকম সুন্দর মেয়ে ছাড়া কি কাউকে মানায়? কাউকে মানায় না।
.
ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। ফরহাদ উদ্দিন দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলেন–শেষ কবে সঞ্জুকে নিয়ে রিকশায় উঠেছেন। মনে পড়ল না। শেষবার কবে সঞ্জুকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন সেটা মনে পড়ল। গত বৎসর মে জুন মাসের দিকে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে চিটাগাং গিয়েছিলেন। আন্তনগর ট্রেন। ফার্স্ট স্টপেজ ছিল ভৈরব। ভৈরবে দু টাকার কালোজাম কিনলেন। এত মিষ্টি কালোজাম তিনি জীবনে খান নি। পাঁচ টাকার এক ঠোঙা কেনা উচিত ছিল। বিরাট ভুল হয়েছে।
পুরনো ঘটনা আজকাল আর চট করে মনে পড়ে না। যেটা মনে করতে চান সেটা না পড়ে অন্য ঘটনা মনে পড়ে। ফরহাদ উদ্দিনের ধারণা ডায়াবেটিসের কারণে এটা হয়েছে। ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যে শরীরের সব কলকজায় জং ধরিয়ে দেয়, মরচে পড়ে যায়। সবার আগে মরচে ধরে মাথায়। কোনো কিছুই ঠিকঠাক মনে পড়ে না। তিনি শেষ কবে সঞ্জুকে নিয়ে রিকশায় উঠেছিলেন সেটা মনে পড়ল না—ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। যে লোক কালোজাম বিক্রি করছিল তার চেহারা পর্যন্ত মনে পড়ল। থুতনিতে দাড়ি, মাথায় বেতের টুপি। পান খাচ্ছিল। পানের রস গড়িয়ে দাড়িতে পড়েছে। ধবধবে সাদা দাড়ি বেয়ে পানের লাল পিক নামছে–এটাও মনে আছে।
সঞ্চুকে জিজ্ঞেস করলে হয়—সঞ্জু, শেষ কবে তোকে নিয়ে রিকশায় উঠেছি?
ফরহাদ উদ্দিনের সাহসে কুলাচ্ছে না। তাঁর মন বলছে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই সঞ্জু রেগে যাবে। কপালের রগ ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করবে, শেষ কবে তোমার সঙ্গে রিকশায় উঠেছিলাম তা দিয়ে দরকার কী?
রেগে গেলে সঞ্জুর কপালের রগ ফুলে যায় এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মানুষের কপালে যে রগ আছে এটাই তিনি জানতেন না। নিজের ছেলেকে রাগত অবস্থায় দেখার আগ পর্যন্ত তাঁর ধারণা ছিল মাথার খুলির ওপর সলিড চামড়ার একটা লেয়ার থাকে। এখন তিনি জানেন ঘটনা তা না। কপালের ঠিক মাঝখানে দু’টা রগ আছে। কোনো কোনো মানুষ রেগে গেলে এই রগ দু’টা ফুলে উঠে। ফরহাদ উদ্দিন আড় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের দিকে মানে ছেলের কপালের দিকে। রগ ফুলে আছে কি-না তার একটা গোপন পরীক্ষা। নাহ বগ ফুলে নেই। তবে সঞ্জুর মুখ থমথমে। তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, এ জার্নি বাই রিকশা—কেমন লাগছে রে সঞ্জু?
সঞ্জু জবাব দিল না। আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বসে রইল। ছেলের গম্ভীর মুখ দেখে ফরহাদ উদ্দিনের সামান্য ভয় ভয় করতে লাগল। এই তার আরেক সমস্যা হয়েছে—-অকারণ ভয়। অফিসে বড় সাহেব যখন ডাকেন বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠে। অথচ বুকে ধ্বক করার কোনো কারণ নেই। অফিসের বড় সাহেব আর্মির এক্স কর্নেল হাবীবুর রহমান অতি ভদ্রলোক। তিনি না হেসে কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। পাঞ্জাবিপরা হাবীবুর রহমান সাহেবকে দেখে মনেই হয় না তিনি আর্মির কর্নেল ছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হয় কোনো প্রাইভেট কলেজের মাই ডিয়ার টাইপ বাংলার প্রফেসর। অথচ এই ভদ্রলোকের চোখের দিকে পর্যন্ত তিনি তাকাতে পারেন না। তার বুক শিরশির করে। একবার বড় সাহেব কী একটা কাজে তাকে ডেকেছেন। তিনি ভয়ে আধমরা হয়ে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বড় সাহেব হাসি মুখে বললেন–কী ব্যাপার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। ফরহাদ উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লেন। চেয়ারটা যে দুই ফুটের মতো পেছন দিকে সরানো সেটা মনে থাকল না। তিনি ধপাস করে কার্পেটে পড়ে গেলেন। এটাও হয়তো ডায়াবেটিসের কারণে হচ্ছে। খুব সম্ভব অসুখটা সাহসও কমিয়ে দেয়। মানুষ ভীরু টাইপ হয়ে যায়।
নিজের বাড়ির লোকজন ছাড়া তিনি এখন সবাইকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে সঞ্জুকে। তার মানে কি এই যে সঞ্জু এখন বাইরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে? কয়েকদিন আগে বাসে উঠলেন, কন্ডাকটারের দিকে তাকিয়ে ভয়ে তার বুক কেঁপে গেল। এই বুঝি কন্ডাকটার কোনো তুচ্ছ কারণে তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবে, তারপর এক পর্যায়ে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেবে। এরকম ঘটনা যে ঘটছে না, তা-না। ঘটছে। গত মাসেই ইত্তেফাঁক পত্রিকায় উঠেছে—চলন্ত বাস হইতে বৃদ্ধ নিক্ষেপ। কন্ডাকটার পলাতক। পুরো খবরটা পড়তে পারেন নি। শেষ পৃষ্ঠায় নিউজটা ছিল। সেখানে কয়েক লাইন ছাপা হয়েছে, নিচে লেখা—পাঁচের পাতায় দেখুন। পাঁচের পাতায় কিছু নেই। অন্য কোনো পাতায় ছাপা হয়েছে ভেবে তিনি পুরো পত্রিকাটা পড়েছেন। কোথাও নেই।
ফরহাদ উদ্দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কলিং বেলে হাত রাখতে গিয়েও ভয়ে মিইয়ে যান। বুক সামান্য ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। মনে হয় বাড়ি এত চুপচাপ কেন? কোনো দুর্ঘটনা কি ঘটেছে! তার তিন মেয়ের কেউ কি বাথরুমে স্লীপ খেয়ে পড়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে? মাথায় আঘাত লাগা ভয়ংকর ব্যাপার। ব্রেইনে রক্তপাত হয়—বিরাট গণ্ডগোল হয়ে যায়। তার অফিসের এক কলিগের স্ত্রীর এরকম হয়েছে। সাবান পানিতে পিচ্ছিল হওয়া বাথরুমে উল্টে পড়ে মাথায় ব্যথা। সবাই ভাবল তেমন কিছু না। ভদ্রমহিলা রাতে দুবার বমি করে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমুতে গেলেন। ঘুম থেকে উঠে বললেন তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। এই সব ভেবে ঘরে ফেরার সময় ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। অথচ দরজা খুললে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় পরিস্থিতি খুবই ভালো। তাঁর তিন মেয়ে মায়ের সঙ্গে তাস খেলছে। টাকা দিয়ে খেলা হচ্ছে। সবার সামনেই দু টাকার চকচকে নোট। রাহেলা তাঁকে দেখে বলে—আজ খেলা বন্ধ। তোর বাবাকে চা দিতে হবে। তখন এক মেয়ে বলে—এইসব হবে না মা। আমি এখন পর্যন্ত একটা ডিলও পাই নি। বাবাকে বুয়া চা দেবে। তোমাকে আরো পাঁচ ডিল খেলতে হবে। খুবই আনন্দময় পরিবেশ।
এখনো ভয়ে তিনি কুঁকড়েই আছেন। আড় চোখে বারবার সঞ্জুর কপাল দেখতে চেষ্টা করছেন। কপাল দেখতে গিয়ে ছেলেকে দেখা হয়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর ছেলে! গায়ের রং সুন্দর। স্বাস্থ্য ভালো। মাথা ভরতি চুল। বাতাসে মাঝে মাঝে কিছু চুল কপালে এসে পড়ছে, সে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে। জরির পোশাক পরিয়ে মাথায় একটা মুকুট দিয়ে দিলেই রাজপুত্র। কিংবা একটা নীল রঙের স্যুট পরিয়ে গলায় টাই দিয়ে দিলে বিলেত ফেরত সাহেব পুত্র। এরকম ছেলেকে পাশে বসিয়ে রিকশায় ঘুরতেও আনন্দ। তিনি ছেলের হাত ধরলেন। সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, হাত ধরবে না তো বাবা।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
একটু সরে বোস না। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছ। এমনিতেই গরমে বাঁচি না।
ফরহাদ উদ্দিন সরে বসলেন।
হালকা গলায় বললেন, কনক মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে রে।
সঞ্জু বলল, কোনো রকম লাগে না।
খুবই দুঃখী মেয়ে। লাজুক, পাখি স্বভাব। অন্তরটা টলটলা পানির মতো। মাশাল্লাহ্। এরকম মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না।
সঞ্জু বলল, বাবা কথা বলতে বলতে তুমি আবারো আমার দিকে আসছ।
ফরহাদ উদ্দিন সরে বসলেন। রিকশা বেশ দ্রুত চলছে। চৈত্রমাস রাস্তা তেতে আছে। কানের পাশ দিয়ে গরম বাতাস বইছে। নাকের ভেতর সামান্য জ্বালা করছে। শুক্রবার ছুটির দিন, রাস্তায় যানজট নেই। ফরহাদ উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, চৈত্র মাসের গরমের একটা মজা আছে এটা কি তুই লক্ষ করেছিস?
সঞ্জু বলল, কী মজা?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, সব সিজনেরই আলাদা আলাদা মজা আছে। পৌষ মাসে যখন আঁকিয়ে শীত পড়ে সেই শীতের মজা আছে। আবার চৈত্র মাস যখন তালু ফাটা গরম পড়ে তারও মজা আছে।
সঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, মজা থাকলে তো ভালোই।
তোর কাছে কোন ঋতুটা ভালো লাগে? জানি না বাবা।
তোর ফেভারিট কোনো ঋতু নেই? বর্ষা? বর্ষা কেমন লাগে? স্কুলে রচনা লিখিস নি–আমার প্রিয় ঋতু?
বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সঞ্জু হঠাৎ থমথমে গলায় বলল, বাবা রিকশা থামতে বলো।
ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আমি অন্য রিকশায় যাব।
অন্য রিকশায় যাবি কেন? এখনো চাপাচাপি হচ্ছে? আচ্ছা আমি আরো সরে বসছি।
সরে বসতে হবে না। তুমি আরাম করে বোস। আমি অন্য রিকশায় যাব।
ফরহাদ উদ্দিন আহত গলায় বললেন, কেন? বেশ তো দুজনে গল্প করতে করতে যাচ্ছি।
সঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে বাবা।
ফরহাদ উদ্দিন ঢোক গিললেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুই সিগারট খাস না-কি?
সঞ্জু বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে থামাল। হুট করে রিকশা থেকে নেমে গেল। বাবাকে বলল, বাবা তুমি তোমার মতো চলে যাও। আমি আসছি।
রিকশা চলতে শুরু করেছে। ফরহাদ উদ্দিন পেছনে ফিরে ছেলেকে দেখার চেষ্টা করছেন। তাকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট ফাঁকা—এর মধ্যে সে কোথায় চলে গেল। শেষ পর্যন্ত যাবে তো?
তাঁর ইচ্ছা করছে রিকশা থামিয়ে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করতে–এটা ঠিক হবে না। সে সিগারেট খাবে। এতে তাঁর অস্বস্তি, ছেলেরও অস্বস্তি। তিনি ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি আবার বন্ধ হয়ে আছে। গত এক সপ্তাহে তিনবার ঘড়ি বন্ধ হলো। নতুন একটা ঘড়ি কেনা দরকার। আজকাল ঘড়ি সস্তা হয়ে গেছে। দেড়শ দুশ টাকায় ঘড়ি পাওয়া যায়। সমস্যা হলো ফরহাদ উদ্দিন পুরনো ঘড়ির মায়া ছাড়তে পারছেন না। এই ঘড়ির বয়স সঞ্জুর বয়সের কাছাকাছি। ইসলামপুর থেকে কিনেছিলেন তিনশ একুশ টাকা দিয়ে। ঘড়ি কেনার সময় তার সঙ্গে ছিল বদরুল পাশা। সে-ই পছন্দ করে ঘড়ি কিনেছে। ফেরার পথে বদরুল হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে নর্দমায় পড়ে গেল। তারপর আর উঠতে পারে না। ধরাধরি করে তোলা হলো। কত ঘটনা। বদরুল পাশা তার অতি প্রিয় বন্ধু ছিল। হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। আবার কোনো একদিন কি ফিরে আসবে? দুপুররাতে কলিং বেল টিপে আঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গম্ভীর গলায় বলবে—এই আমার মেয়ে কোথায়?
তিনি বলবেন, তুই এতদিন কোথায় ছিলি?
আমি এতদিন কোথায় ছিলাম তা দিয়ে তোর দরকার কী? আমার মেয়ে বের করে দে। প্যাচাল কথা এখন শুনব না।
রোদের তেজ কমে এসেছে। মনে হয় চারটা সাড়ে চারটা বাজে। তিনি যাচ্ছেন তাঁর প্রথম পক্ষের শ্বশুর বাড়িতে। সঞ্জুর নানার বাড়ি। সঞ্জুর মা’র মৃত্যুর পর এই বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ শেষ হয়ে গেছে। সাত বছর পর এই প্রথম যাচ্ছেন। তার শাশুড়ি খবর পাঠিয়েছেন—সঞ্জুকে নিয়ে তিনি যেন শুক্রবার বিকেলে অবশ্যই আসেন। জরুরি প্রয়োজন।
আজ কি বিশেষ কোনো দিন? সঞ্জুর মা পারুলের জন্মদিন, মৃত্যুদিন কিংবা বিয়ের দিন। পারুল সম্পর্কে সবকিছুই ফরহাদ উদ্দিন ভুলে গেছেন। মাথার চুল সঞ্জুর মতো কোঁকড়া ছিল এইটুকু শুধু মনে আছে। এটাও মনে থাকত না, মনে আছে কারণ কোঁকড়া চুল নিয়ে বিয়ের সময় খুব ঝামেলা হয়েছে। বিয়ে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবার পর ফরহাদ সাহেবের বড় মামা (সালু মামা) হঠাৎ ঘোষণা করলেন এই বিয়ে হবে না। মেয়ের মাথার চুল কোঁকড়ানো। কোঁকড়ানো চুলের মেয়ে অসতী হয়। লক্ষণ বিচার বইয়ে তিনি এই তথ্য পেয়েছেন। মেয়ের মাথার চুল শুধু যে কোঁকড়া তা-না। লালচে ভাবও আছে। অসতী নারীর চুল লালচে হয় এটিও না-কি শাস্ত্রে আছে। সালু মামা তার ভাগ্নেকে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কিরে বদু (বদু ফরহাদ উদ্দিনের ডাক নাম) তুই জেনেশুনে অসতী নারী বিবাহ করবি? ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় অস্পষ্ট শব্দ করলেন যা খানিকটা না-এর মতো শুনালো।
সালু মামা বললেন, লক্ষণ বিচার করে বিবাহ করতে হয়। বিয়ে তো তুই একবারই করবি। সেই বিয়েটা দেখে শুনে করা ভালো না?
ফরহাদ উদ্দিন আবারো ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।
তাহলে ওদের নো জানিয়ে দেই?
আচ্ছা।
বদরুল পাশা তখন খুবই অবাক হয়ে বলল, মামা এটা কেমন কথা! কোঁকড়া চুল থাকলে মেয়ে অসতী হয়—এটা বই-এ পড়ে বিয়ে বাতিল করে দেবেন? মেয়ের যে চুল কোঁকড়া এটা আগে দেখেন নি?
সালু মামা বললেন, তুমি এর মধ্যে কথা বলছ কেন? তুমি তো বিয়ে করছ না।
বদরুল পাশা বলল, আপনি তো মামা অন্যায় করতে পারেন না।
সালু মামা বললেন, পরিবারের স্বার্থে আমি অন্যায় করতে পারি। এখনই আমি কনে পক্ষকে না জানিয়ে দিচ্ছি।
ফরহাদ উদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে—-নো জানিয়ে দেবার পর হুলুস্থুল পড়ে গেল। মেয়ের বাড়িতে কান্নাকাটি। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবা আরো দশ হাজার টাকা বাড়তি দিয়ে পরিস্থিতি সামলালেন। নির্বিঘ্নে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ে বাড়ির খাওয়ার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। সালু মামা বললেন—-তিনি তাঁর জীবনে এত ভালো খাসির কালিয়া খান নি। যে বাবুর্চি এই কালিয়া রান্না করেছে। তার হাত রূপা দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়া দরকার। এই বলেই তিনি থেমে গেলেন না, বাবুর্চিকে পাশে দাঁড় করিয়ে হাসি হাসি মুখে ছবি তুললেন। বিয়ের আসরের ছবি তোলার জন্যে তিনি স্টুডিও থেকে ফটোগ্রাফার ভাড়া করে এনেছিলেন। খুবই দুঃখের কথা—দু’টা ছবি তোলার পরই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেল। বিয়ের একমাত্র ছবি যে দু’টা তোলা হলো তা হচ্ছে বাবুর্চির কাঁধে হাত রেখে সালু মামার হাসি হাসি মুখের ছবি।
বাসর ঘরে পারুলকে দেখে ফরহাদ উদ্দিন মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মাথা নিচু করে খাটের মাঝখানে রাজকন্যা বসে আছে। মানুষ এত সুন্দর হয়। পারুল নিঃশব্দে কাঁদছিল। নিতান্তই অপরিচিত, রূপবতী এক তরুণীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে আর তিনি বসে আছেন বোকার মতো। মেয়েটাকে কী বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। কেঁদো না বলবেন, না-কি কাঁদছ কেন? কী জিজ্ঞেস করবেন তা ঠিক করতে তার চল্লিশ মিনিটের মতো লাগল। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, কেঁদো না। বলেই খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন।
নববধূর কান্না তাতে থামল না, তবে কান্নার সঙ্গে শরীর দুলিয়ে হেঁচকি তোলা বন্ধ হয়ে গেল। বাসর ঘরে নববধূর সঙ্গে সুন্দর সুন্দর কথা বলার নিয়ম—-প্রেম ভালোবাসার কথা, ভাবের কথা, সুখ-দুঃখের কথা। তাঁর কোনো কথাই মনে পড়ল না। চুপচাপ বসে থেকে ক্লান্ত হতে হতে এক সময় বললেন, তোমাদের বাবুর্চির রান্না মাশাল্লাহ ভালো।
এই কথা শুনে পারুল চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে সামান্য বিস্ময়। তিনি তখন বললেন, বাবুর্চির নাম কী?
পারুল ক্ষীণ গলায় বলল, ফজলু মিয়া।
তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ফজলু মিয়ার দেশের বাড়ি কোথায়?
পারুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। তবে তার কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। গাল চোখের পানিতে ভেজা ছিল। শাড়ির আঁচল দিয়ে সে গাল মুছল। তার চোখের বিস্ময় আরো প্রবল হলো।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এক গ্লাস পানি খাব। বলেই দেখলেন খাটের সঙ্গে লাগানো টেবিলে পানির জগ, গ্লাস সাজানো। তিনি নিজেই উঠে পরপর দুগ্লাস পানি খেয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কারণ পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ছোট বাথরুম পায়। এখনো পাবে বলাই বাহুল্য। গ্রাম দেশের বাড়ি এটাচড বাথরুম থাকবে না। বাসর ঘর থেকে বের হয়ে দূরের কোনো বাথরুমে যেতে হবে। নতুন জামাই বাসর ঘর থেকে বের হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে। শালা শালীরা শুরু করবে নানান যন্ত্রণা। নতুন জামাইকে যন্ত্রণা দেয়া বিরাট আমাদের ব্যাপার। তিনি নিশ্চিত যে বাথরুমে ঢোকামাত্র তারা বাইরে থেকে বাথরুমের দরজায় তালা লাগিয়ে দেবে। গ্রাম দেশে এই রসিকতা খুবই কমন রসিকতা। তাকে অনেক রাত পর্যন্ত বাথরুমে বসে থাকতে হবে। শালা শালীদের হাসি এবং ঠাট্টা-তামাশা শুনতে হবে। দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে তিনি আরো আধাগ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রস্রাবের বেগ হলো। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, বাথরুমে যাব।
বাসর ঘর নিয়ে মানুষের কত সুখ-স্মৃতি থাকে। তার সবই দুঃখময় স্মৃতি। বাথরুমে ঢোকার পর তারা সত্যি সত্যিই বাইরে থেকে শিকল দিয়ে দিল। শালীর দল আজেবাজে কথা বলে হাসাহাসি করতে লাগল। দুলাভাই হাগে, দুলাভাই হাগে বলে চিকন গলায় বিকট চিৎকার। এদের সঙ্গে বয়স্কদের হাসিও যুক্ত হলো। বয়স্করা মাঝে মাঝে প্রশ্রয় সূচক ধমক দিচ্ছেন—-কী কর, ছেড়ে দাও না। আর কত!
কে কার কথা শুনে। তিনি দুই ঘণ্টার মতো সময় বাথরুমে বসে রইলেন। শেষ পর্যন্ত বাথরুম থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনে পারুল। নতুন বউ এই কাজটা করেছে বলে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে বেহায়া মেয়ে, বেলাজ মেয়ে।
বাসর রাতে পারুল তাকে বাথরুম থেকে নিজে শিকল খুলে বের করে আনিছে—এই দৃশ্য অনেকদিন পরে মনে করে তার কান্না পেয়ে গেল। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভালো মেয়ে ছিল। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দুই বছর এগারো মাস সুখে কেটেছে। তবে মেয়েটাকে বুঝতে বুঝতেই সময় কেটে গেল। চৈত্র মাসের এক দুপুরবেলা সব শেষ। তখন তিনি অফিস ক্যান্টিনে বসে হাফ বিরিয়ানির অর্ডার দিয়েছেন। বিরিয়ানি এরা ভালো বানায়। হাফ প্লেট বিরিয়ানির একটা কাবাব থাকে, অর্ধেকটা ভুনা ডিম থাকে। আলাদা করে প্লেটে তেতুলের ঝাল টক দেয়। হাফ প্লেটে পেট ভরে না, ক্ষিধে লেগে থাকে। ফুল প্লেটে আবার বেশি হয়ে যায়। তিনি ঠিক করে রেখেছেন হাফ প্লেটের পর অবস্থা বুঝে আরো হাফ প্লেটের অর্ডার দেবেন। সেদিন ক্ষিধেটা খুব মারাত্মক লেগেছিল। তিনি যখন খেতে বসেছেন তখন হন্তদন্ত হয়ে বদরুল পাশা উপস্থিত। সে মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছে কিন্তু দিতে পারছে না। খাওয়ার সময় দুঃসংবাদ দিতে নেই। তিনি আরাম করে হাফ প্লেট বিরিয়ানি খাবার পর আরেক হাফ প্লেটের অর্ডার দিলেন। বন্ধুকে খাওয়াবার জন্যে পিড়াপিড়ি করলেন। তিনি বুঝতেই পারেন নি কত ভয়ঙ্কর ঘটনা বাসায় ঘটে গেছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ঐ দিনের বিরিয়ানির স্বাদটা এখনো তার মুখে লেগে আছে।
আজ আরেক চৈত্র মাস। তাহলে কি আজ পারুলের মৃত্যুদিবস? সেই উপলক্ষে কোনো আয়োজন? বাদ আছর মিলাদ হবে? ফরহাদ উদ্দিন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন স্ত্রীর মৃত্যুর তারিখ তার মনে নেই। এটা লজ্জারই কথা। সঞ্জুর জন্মের তারিখ মনে আছে। সেখান থেকে হিসাব নিকাশ করে পারুলের মৃত্যুর তারিখ বের করা যাবে। একে বলে ব্যাক ক্যালকুলেশন চট করে করা যাবে না, কাগজ কলম লাগবে।
জ্যামে রিকশা গাড়ি সব আটকা পড়ে আছে। কখন জ্যাম ছুটবে কে জানে। চুপচাপ রিকশায় বসে থাকার চেয়ে মনে মনে অংকটা করার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। সঞ্জুর একবছর আঠারো দিন বয়সে তার মা মারা গেল। মূল ব্যাপার হলো আঠারো দিন। এইআঠারো দিন হয় যোগ করতে হবে কিংবা বাদ দিতে হবে। অংকের সুবিধার জন্য আঠারো দিনটী ধরা যাক পনেরো দিন। তিন হাতে থাকুক। পরে এই তিন হয়তোবা যোগ করতে হবে কিংবা বিয়োগ করতে হবে। ফরহাদ সাহেবের মাথা অল্প মায়ের মধ্যেই জট পাকিয়ে গেল। তিনি হতাশ চোখে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। তখনই সঞ্জুকে দেখলেন। সঞ্জুর রিকশাটা ঠিক তার রিকশার বাম পাশে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছা করলেই তিনি সঞ্জুর রিকশায় উঠে যেতে পারেন। সঞ্জু গম্ভীর চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, এই সঞ্জু!
সঞ্জু তাকাল। বিরক্তিতে তার ভুরু কুচকে গেল।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, তোর জন্ম তারিখ কবে?
মে মাসের ন’ তারিখ।
ন’ তারিখ থেকে পনরো বাদ দিলে কত হয়?
কী বলছ কিছু বুঝতে পারছি না।
ফরহাদ উদ্দিন হঠাৎ খুশি খুশি গলায় বললেন, এক কাজ কর, আমার রিকশায় চলে আয়।
কেন?
গল্প করতে করতে যাই। তোর সিগারেট খাওয়া তো হয়ে গেছে, নাকি আরেকটা খাবি?
সঞ্জু আবারো গম্ভীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেমেয়ে সব সময় বাবার মতো হয় এটাই নিয়ম। সঞ্জু কার মত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। তার মতো নিশ্চয়ই হয়নি। পারুল গম্ভীর ছিল না। কিংবা কে জানে হয়তো গম্ভীর ছিল। তিনি ভুলে গেছেন। পারুলের বিষয়ে তার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। কিছু কিছু স্মৃতি আবার খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে৷
যেমন পারুল সম্পর্কে তাঁর খুব স্পষ্ট একটা স্মৃতি হচ্ছে বিয়ের পর পর সে যখন ঢাকায় থাকতে এলো তখনকার ঘটনা। সকালবেলা নাশতা খেতে গিয়ে গলায় রুটি আটকে গেল। হাত-পা এলিয়ে চেয়ারে পড়ে গেল, সেখান থেকে মেঝেতে। বাড়িতে তখন তিনি আর একটা কাজের মেয়ে। বেবীট্যাক্সি এনে অতিদ্রুত পারুলকে কোন হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি ছুটে ঘর থেকে বের হতে গেলেন—দরজার কোণায় ধাক্কা লাগে তিনি নিজেই মেঝেতে উল্টে পড়ে অচেতন। যখন জ্ঞান হলো তিনি দেখেন তাকে খাটে শোয়ানো হয়েছে। তার মাথায় পানি ঢালছে পারুল নিজেই। জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্ত এবং জ্ঞান ফিরে পাবার পরের প্রতিটি ঘটনা তার মনে আছে। পারুল যে মুখ টিপে হাসতে হাসতে তার মাথায় পানি ঢালছে এটা তার মনে আছে। পারুলের গলায় সবুজ পাথর বসানো একটা রূপার মালা দুলছিল সেটি পর্যন্ত মনে আছে। এই ঘটনাটা নিয়ে তিনি কখনো কারো সঙ্গে আলাপ করেন নি।
পারুলের মৃত্যুর পর রাহেলাকে বিয়ে করলেন। রাহেলার সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর কোনো গল্প করার প্রশ্নই উঠে না। নাশতার টেবিলে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে পারুলের গলায় রুটি আটকে যাবার ঘটনাটা মনে পড়ে। ব্যস এই পর্যন্তই। গত মাসের প্রথম দিকে শুক্রবারে তিনি নাশতা খেতে বসেছেন। ডিমভাজা, রুটি আর সুজির হালুয়া। রাহেলা বসেছে তার বাদিকের চেয়ারটায়। রাহেলা বলল, আজকের রুটিটা যে অন্যরকম বুঝতে পারছ?
তিনি বললেন, না।
রাহেলা বলল, তোমাকে নতুন কিছু করে খাওয়ানো অর্থহীন। কিছুই বুঝতে পার না। আজকের রুটি তো আটার রুটি না। আলুর রুটি। আলু সিদ্ধ করে কাই বানিয়ে বেলে রুটি বানানো হয়েছে।
তিনি বললেন, ও।
রাহেলা তখন হঠাৎ তাঁকে চমকে দিয়ে বলল, রুটি গলায় আটকে আমি যে একবার মরতে বসেছিলাম তোমার মনে আছে?
ফরহাদ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলেন। রাহেলা কী বলছে? সে আবার কখন গলায় রুটি আটকে মরতে বসল!
এইভাবে তাকাচ্ছ কেন? সমস্যাটা কী?
কোনো সমস্যা না।
তোমার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয় কোনো সমস্যা যাচ্ছে। অফিসে কিছু হয় নি তো?
না।
রুটি গলায় আটকে যাবার কথা শুনে এমন চমকে গেলে কেন বলো তো?
চমকাই নি তো!
রাহেলা বলল, কতদিন আগের ঘটনা অথচ মনে হয় এই তো গত সপ্তাহে। তুমি ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেয়ে ধরাম করে পড়ে গেলে। তোমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়েই মনে হয় আমার গলা দিয়ে রুটি নেমে গেল। তোমাকে নিয়ে তখন দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি। মাথায় পানি ঢালাঢলি।… এরকম করে তাকাচ্ছ কেন? মনে নেই?
ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, মনে আছে।
আলু-রুটি খেতে কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
ভালো হয়েছে তাহলে মুখে রুটি নিয়ে বসে আছ কেন? খেতে ভালো না লাগলে বলো—নরম্যাল রুটি সেঁকে দেব।
আচ্ছা।
আলু-রুটি তোমার বড় মেয়ে বানিয়েছে। কোন বই-এ যেন রেসিপি পড়েছে। এই মেয়েটার রান্না-বান্নার দিকে ঝোঁক আছে। প্রায়ই এটা সেটা রাধে। ঐদিন করল চিনাবাদামের ভর্তা। চিনাবাদাম পিষে, সরিষার তেল, কাঁচামরিচ, আদা দিয়ে মেখে সামান্য তেলে ভেজে করেছে। খেতে অসাধারণ হয়েছে। তোমাকেও তো অফিসে পাঠিয়েছিলাম।
ফরহাদ সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, খেতে ভালো হয়েছিল। খুবই সুস্বাদু হয়েছিল।
রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কী উল্টাপাল্টা কথা বলছ? খেতে ভালো হয়েছে তুমি বুঝলে কীভাবে? তুমি তো মুখেও দাও নি। ভর্তা যেমন পাঠিয়েছিলাম সে-রকম ফেরত এসেছে। তোমার সমস্যাটা কি বলবে? তুমি কি আমাদের কোনো কথাই মন দিয়ে শোন না? সারাক্ষণ কপাল কুঁচকে কী চিন্তা কর?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দেন নি। খুব মন দিয়ে আলুর রুটি খেতে শুরু করেছিলেন। বড় রকমের কোনো ধাক্কা খেলে যে-কোনো একটা কাজ খুব মন দিয়ে করা শুরু করতে হয়। এতে ধাক্কাটা কম লাগে। স্মৃতি সংক্রান্ত জটিলতায় সেদিন তিনি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিলেন। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে তাঁর সবস্মৃতিই এলোমেলো হয়ে গেছে। সবুজ পাথর বসানো রূপার যে হারটা দুলতে দেখেছিলেন সেই হারটাও কি রাহেলার? রাহেলার গলায় এই হার তো কখনো দেখেন নি। রূপার গয়না রাহেলার পছন্দ না। সে বলে—রূপা পরবে ছেলেরা, তাদের হাতে থাকবে রূপার আংটি। সোনা পরবে মেয়েরা। এই কথাগুলি রাহেলার তো? না-কি পরে দেখা যাবে কথাগুলি আসলে বলেছিল পারুল।
খুবই জটিল সমস্যা। কারো সঙ্গে সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। কার সঙ্গে আলাপ করবেন? সবচে ভালো হতো নিজের ছেলের সাথে আলাপ করলে। ছেলের সঙ্গে আলাপ করার সুবিধা হচ্ছে ঘরের কথা ঘরে থাকবে। বাইরে বের হবে না। সঞ্জু খুবই চুপচাপ ধরনের ছেলে। তাকে দেখে মনে হয় সে সারাক্ষণই কিছু ভাবে। বড় হলে হয়তো কবি টবি হবে। তার আত্মীয়স্বজনের বিরাট গুষ্ঠির মধ্যে কোনো কবি সাহিত্যিক নেই। একজন থাকলে ভালোই হয়।
জ্যাম কেটেছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। দিনের আলো ফস করে নিভে গেছে। আকাশে ঘন কালো মেঘ। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। বৎসরের প্রথম বৃষ্টি ভিজতে পারলে ভালো হতো। গায়ের ঘামাচি মরে যেত। বৎসরের প্রথম বৃষ্টিতে থাকে ঘামাচির ওষুধ। বৎসরের শেষ বৃষ্টিতে থাকে চোখ ওঠা রোগের
আল্লাহপাক মানব জাতির জন্যে রোগ যেমন দিয়েছেন, রোগের ওষুধও দিয়েছেন। গাছপালায় ওষুধ দিয়ে পাঠিয়েছেন। বৃষ্টিতে ওষুধ দিয়ে পাঠিয়েছেন। অকাশের মেঘ কনট্রোল করার জন্যে তিনি আলাদা একজন ফেরেশতা রেখেছেন। ফেরেশতার নাম মীকাইল। হযরত মীকাইল আলায়হেস সালাম। তার দায়িত্ব হলো—মেঘ পরিচালনা করা আর মানুষের রুটি-রুজি বণ্টন করা।
টপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি ফরহাদ উদ্দিনের মাথায় পড়ল। তিনি চমকে আকাশের দিকে তাকালেন। বৎসরের প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা যার উপর পড়ে তার উপর আল্লাহপাকের অসীম রহমত। তার একটি ইচ্ছা তৎক্ষণাত পূরণ করা হয়। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যে তার উপরই পড়েছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে পড়তেও তো পারে। যদি পড়ে থাকে তাহলে তার একটি ইচ্ছা পূরণ হবে। দ্রুত কোনো কিছু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। কী চাওয়া যায়? কিছুই মাথায় আসছে না। ফরহাদ উদ্দিন অস্থির বোধ করছেন। নিঃশ্বাসেও খানিকটা কষ্ট হচ্ছে। কানের কাছে গরম লাগছে। শরীর ভারী হয়ে আসছে। খারাপ কিছু ঘটছে না তো। হার্ট এটাক? হার্ট এটাকের সময় বুকে ব্যথা হয়। তার বুকে অবশ্যি ব্যথা হচ্ছে না। তবে তার কেন জানি মনে হচ্ছে এক্ষুণি ব্যথা শুরু হবে। তিনি দুহাতে রিকশার হুড ধরলেন। সঞ্জু পাশে থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। সে শক্ত করে বাবাকে ধরে থাকত। আশেপাশের কোনো রিকশায় সঞ্জুকে দেখা যাচ্ছে না। খুব পানির পিপাসা হচ্ছে। রিকশাওয়ালাকে তিনি কি বলবেন রিকশা থামিয়ে তাঁর জন্যে পানির একটা বোতল নিয়ে আসতে? ঠাণ্ডা এক বোতল পানি। খানিকটা খাবেন, খানিকটা গায়ে মুখে মাখবেন।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। আরাম লাগছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো হঠাৎ তার শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
তিনি কি রিকশাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন? রিকশায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তাঁর আছে। একবার অফিস থেকে বাড়িতে ফেরার পথে তিনি রিকশায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখেন রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে চায়ের গ্লাসে পাউরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে। তাঁকে জেগে উঠতে দেখে কাছে এসে বলল স্যারের শইল খারাপ? ঘুমাইয়া পড়ছিলেন এই জন্যে রিকশা খাড়া করাইছি। গরম এক কাপ চা খাইবেন?
তিনি শুধু যে চা খেলেন তা না। তাঁর ক্ষিধে লেগেছিল, তিনি রিকশাওয়ালার মতো একটা পাউরুটি নিয়ে ঠিক তার মতোই চায়ে ডুবিয়ে আরাম করে খেলেন। চা-পাউরুটির দাম দিতে গেলেন—রিকশাওয়ালা তাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, দাম দেওন লাগব না। রিকশাওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে তার কিছু বলা উচিত ছিল। তিনি কিছুই বলেন নি। বরং এমন ভাব করেছেন যে প্যাসেঞ্জারের চা-নাশতার পয়সা রিকশাওয়ালা দেবে এটাই স্বাভাবিক। রিকশাওয়ালার সঙ্গে ছয় টাকা ভাড়া ঠিক হয়েছিল, তিনি তাকে ঠিক ছয় টাকাই দিলেন। একটা টাকা বেশি দিলেন না। তবে মনে মনে ঠিক করে রাখলেন—কোনো একদিন তাকে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবেন। ঢাকা শহর এমনই এক শহর যে ঘুরে ফিরে পরিচিত সবার সঙ্গেই কখনো না কখনো দেখা হবে। তখন দাওয়াতটা দিলেই হলো। রিকশাওয়ালার চেহারা তার মনে আছে। বিখ্যাত এক ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে তার চেহারার খুবই মিল আছে—আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। গালভাঙা মুখ, দাড়ি লম্বা। চোখ কোটরে ঢোকা। ঢাকা শহরে হরতালের দিন বোমাবাজিতে কিছু রিকশাওয়ালা মারা যায়। তাদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। ফরহাদ উদ্দিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখেন। আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে তাদের চেহারার কোনো মিল আছে কি-না। যখন দেখেন কোনো মিল নেই তখন স্বস্তি বোধ করেন।
ঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বরফের মতো ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোঁটা। ঠাণ্ডায় ফরহাদ সাহেবের শরীর জমে যাচ্ছে—কিন্তু তার পরেও কানের কাছে গরম লাগছে। সেই সঙ্গে এমন ঘুম লাগছে যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। যেভাবেই হোক কিছুক্ষণ জেগে থাকতেই হবে। পাঁচ ছয় মিনিট জেগে থাকতে পারলেই হবে। রিকশা গলির ভিতর ঢুকে পড়েছে। গলির মাঝামাঝি একটা নাপিতের দোকান—আশা হেয়ারকাটিং। নাপিতের দোকানের সামনে থেকে বাঁ দিকে আরেকটা গলি বের হয়েছে। সেই গলির শেষ মাথায় দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটা বড় কাঠগোলাপের গাছ আছে। বিশাল গাছ কিন্তু কোনো ফুল ফুটে না। বাড়ির একটা সুন্দর নাম আছে, নামটা মনে পড়ছে না। নামটা মনে পড়লে খুব লাভ হতো, রিকশাওয়ালাকে বাড়ির নাম বলে ঘুমিয়ে পড়তেন। ফরহাদ সাহেব বাড়ির নাম মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ফুলের নামে নাম। খুবই পরিচিত ফুল। নামের মধ্যেই জঙ্গল জঙ্গল ভাব আছে। নামটা মনে হলেই নাকে ফুলের গন্ধ লাগে এবং কেমন ছায়া ছায়া ভাব হয়। একটা গানেও নামটা আছে। গানটা মনে পড়লেই ফুলের নাম মনে পড়বে। সাত ভাই চম্পা জাগরে। বাড়ির নাম কি চম্পা হাউস? না চম্পা হাউস না, ইংরেজি নাম না, বাংলা নাম। পুরো গানটা যেন কী—
সাত ভাই চম্পা জাগরে
কেন বোন পারুল ডাকরে।
বাড়ির নাম মনে পড়েছে—পারুল কুটির। এই নামটা এতক্ষণ মনে পড়ল। অথচ তার স্ত্রীর নামে নাম। পারুল কুটির নামে জঙ্গল জঙ্গল কোনো ভাব তো নেই। তাহলে কেন মনে হলো জঙ্গল জঙ্গল ভাব? পারুলের ইংরেজি কী? সব ফুলেরই ইংরেজি নাম আছে। গোলাপ—রোজ, যুই—-জেসমিন, পারুলের কি কোনো ইংরেজি নেই? পারুলের ইংরেজি কী ভাবতে ভাবতে ফরহাদ উদ্দিন রিকশার ওপর ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলো। তার চেয়েও বিকট শব্দে ফাটল ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ট্রান্সফরমা’র। এতেও তার ঘুম ভাঙ্গল না।
.
ফরহাদ উদ্দিনের ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যায়। চোখ মেলেই তিনি খুব আরাম পেলেন। নরম ফোমের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। গায়ে ধোঁয়া চাদর। ধোয়াঁ চাদর থেকে আরামদায়ক গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার আঙুলগুলি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে সে হাত বুলাবার আগে তার আঙুল ডীপ ফ্রিজে কিছুক্ষণ রেখে ঠাণ্ডা করে আনছে। কনক না-কি? কনকের হাতের আংগুল এরকম ঠাণ্ডা। সে এ বাড়িতে আসবে কীভাবে। না-কি কেউ তাকে খবর দিয়ে এনেছে। ফরহাদ উদ্দিন পাশ ফিরলেন। আর তখনই কে একজন বলল, এখন কি একটু ভালো লাগছে?
তিনি ভালোমতো চোখ মেললেন। অপরিচিত একজন মহিলা বিছানার ডান পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। একজন চেনা মানুষের দেখা পেলে হতো। ভদ্রমহিলা একটু কাছে ঝুঁকে এসে নরম গলায় বললেন, উঠার দরকার নেই। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। এখন কি একটু ভালো লাগছে?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, জ্বি লাগছে।
আমরা তো খুবই ভয় পেয়েছিলাম। ডাক্তার এসে দেখে গেছে। ডাক্তার বলেছে সব ঠিক আছে। ব্লাড প্রেসার সামান্য কম, অতিরিক্ত দুর্বলতা থেকে এরকম হয়েছে। আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি এখন ঠিক আছি।
এরকম কি আগেও হয়েছে?
জ্বি না। সঞ্জু কোথায়?
দুধ নিয়ে আসি, এক গ্লাস দুধ এনে দেই?
জ্বি আচ্ছা।
ভদ্র মহিলা দুধ আনতে গেলেন। ফরহাদ উদ্দিন মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন এতক্ষণ কে কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আশ্চর্য, কেউ নেই। পুরো ব্যাপারটা মনে হয় স্বপ্নে ঘটেছে। স্বপ্নটা আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভালো হতো।
একটা গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে ভদ্রমহিলা আবার ঢুকলেন। তাকে আগে যতটা অচেনা লাগছিল এখন তারচেয়েও অচেনা লাগছে। এমন কি হতে পারে যে তিনি ভুল কোনো বাড়িতে ঢুকেছেন? তিনিও এদের চেনেন না, এরাও তাঁকে চেনে না। রিকশা হয়তো অন্য একটা বাড়ির সামনে থেমেছে। বাড়ির লোকজন দয়া করে তাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়েছে। সঞ্জু সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। সঞ্জুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। সে হয়তো শেষ পর্যন্ত আসে নি।
দুধটা খান।
একটু পরে খাই।
ঠিক আছে একটু পরেই খান। আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন।
ভদ্রমহিলা আবারো আগের চেয়ারটায় বসলেন। এবার তাকে একটু যেন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে একটা মানুষকে কিছুক্ষণ চেনা লাগছে আবার কিছুক্ষণ অচেনা লাগছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? ফরহাদ উদ্দিন হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
মিথ্যা সূচক হ্যাঁ মাথা নাড়া ঠিক হয় নি। মুখে মিথ্যা বলাও যা–মিথ্যা মাথা নাড়াও তা। না বলা উচিত ছিল। সেটা অবশ্যি ঠিক হতো না। আত্মীয়স্বজনকে চিনতে না পারা খুবই লজ্জার ব্যাপার। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেই পরিচয় বের হয়ে আসবে। ভদ্রমহিলা বললেন, অনেকদিন পরে দেখা তো এই জন্যে ভাবলাম চিনতে পারেন নি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আপনি ভালো আছেন?
আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?
ও আচ্ছা ঠিকই তো। আপনি করে কেন বলছি। বয়স হয়েছে তো—উল্টাপাল্টা কাজ করি। আপনি তুমি-তে জট পাকিয়ে ফেলি। তুমি ভালো আছ?
জ্বি ভালো।
ছেলেমেয়েরা ভালো?
প্রশ্নটা করেই ফরহাদ সাহেব শঙ্কিত বোধ করলেন। এটা একটা ভুল প্রশ্ন হয়েছে। হয়তো এই মহিলার ছেলেমেয়ে হয় নি। এরকম দম্পতি আছে যাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয় না। তাদের অফিসের বড় সাহেব কর্নেল হাবীবুর রহমান সাহেবেরই কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও স্ত্রীকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরে এলেন। যাদের বাচ্চা কাচ্চা হয় না তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় ছেলেমেয়েরা কেমন আছে তারা খুবই মনে কষ্ট পায়।
ভদ্রমহিলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ছেলেমেয়েরা ভালোই আছে। দুলাভাই, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
ফরহাদ উদ্দিন হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন। মহিলা হাসিমুখে বললেন—পারুল আপার মেজো ভাই ইস্তিয়াক। আমি তার স্ত্রী। আপনি এখন আবার বলে বসবেন না যে ইস্তিয়াককে চেনেন না।
কী যে তুমি বলো! কেন চিনব না।
ও কী করে বলুন তো?
ব্যবসা করে।
না, পুলিশ অফিসার। ডিবিতে আছে। এসপি। প্রমোশন হবার কথাবার্তা হচ্ছে। প্রমোশন হলেই ডিআইজি হবে।
বাহ্ ভালো তো।
আপনার সঙ্গে এখন আর এই পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই—আপনিও কিছু জানেন না। আমরাও আপনার ব্যাপারে কিছু জানি না।
ইস্তিয়াক কোথায়?
ও খুব জরুরি কাজে অফিসে আটকা পড়েছে। আপনি যে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন এই খবর সে জানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।
শাশুড়ি আম্মা, উনি কোথায়?
উনি তো এ বাড়িতে থাকেন না। ইস্তিয়াকের ছোট ভাই মনোয়ারের বাসায় থাকেন। মনোয়ার থাকে ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে। আপনি তো জানেন সে ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির টিচার।
ফরহাদ উদ্দিন কিছুই জানেন না তারপরেও বললেন, জানি। কিছু কিছু খবর রাখার চেষ্টা করি। কাজে কর্মে এত ব্যস্ত থাকি যোগাযোগটা রাখা সম্ভব হয় না। শাশুড়ি আম্মা চিঠি লিখেছিলেন এ বাড়িতে আসার জন্যে, তাই ভেবেছি উনি এ বাড়িতেই আছেন।
উনি আপনাকে কোনো চিঠি লিখেন নি। আমিই চিঠি লিখে আপনাকে আনিয়েছি। উনার হয়ে চিঠি লিখেছি যাতে আপনি আসেন।
ও।
মা’র শরীর খুবই খারাপ। প্যারালাইসিস হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকেন। কাউকে চিনতে পারেন না। কানে খুব ভালো শোনেন। কোনো মেয়ের গলা শুনলেই মনে করেন পারুল আপা এসেছেন। তার বড় মেয়ে যে মারা গেছে এই বোধ নেই।
কত দিন ধরে এই অবস্থা?
অনেক দিন, তবে মাঝে মাঝে সুস্থ থাকেন তখন সবাইকে চিনতে পারেন। সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন।
ও।
দুধটা খান।
আমি দুধ খাই না, ভালো লাগে না।
চা বানিয়ে আনব চা খাবেন?
আচ্ছা আন চা, এক কাপ খাই।
আমার নাম কি আপনার মনে আছে?
ফরহাদ উদ্দিন কিছুক্ষণ হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার নাম আমার মনে নাই।
এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ হয় না, নাম মনে না থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।
ফরহাদ উদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকে স্মৃতি শক্তি কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। শরীরটাও খারাপ।
শরীর যে খারাপ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন ভালো লাগছে না?
হুঁ এখন ভালো লাগছে।
গরম চা খেয়ে শুয়ে থাকুন। ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনাকে আর ডিসটার্ব করব। ইস্তিয়াক আসার পর ডেকে তুলব।
আচ্ছা।
আমার নাম তো আপনি আর জিজ্ঞেস করলেন না।
তোমার নাম কী?
দুলি। দুলালী থেকে দুলি।
এখন মনে পড়েছে।
দুলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিশ বছর কোনো মিথ্যা কথা বলবেন না। বিশ বছর মিথ্যা কথা না বললে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়। ঐ প্রতিজ্ঞা কি এখনো আছে? আপনার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়েছে?
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত মুখে হাসলেন।
দুলি বলল, প্রশ্নের জবাব তো দিলেন না।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, এই বৎসর ডিসেম্বরের দিকে কুড়ি বছর হবে।
এতদিন কোনো মিথ্যা বলেন নি?
টুকটাক বলেছি। যেমন তুমি যখন জিজ্ঞেস করলে তোমার নাম মনে আছে কিনা। তখন আমার নাম মনে ছিল না, তারপরেও চিনেছি এই ভাব করে মাথা নাড়লাম।
আপনার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হয়েছে?
এখনো তো কুড়ি বছর হয় নি।
দুলি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কুড়ি বছর পর সত্যি যদি আধ্যাত্মিক কোনো ক্ষমতা হয় আমাকে বলবেন। আমিও মিথ্যা বলা ছেড়ে দেব।
তুমি কি মিথ্যা বলো?
আমি বেশির ভাগ কথাই মিথ্যা বলি। প্রয়োজনে তো বলিই, অপ্রয়োজনেও বলি।
দুলি বলল, আপনি অসুস্থ মানুষ তারপরেও আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। দুলাভাই কিছু মনে করবেন না।
না কিছু মনে করি নি।
আপনি তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা মানুষ। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আপনি হয়তো জানেন না, এ বাড়ির সবাই আপনাকে খুব পছন্দ করে। প্রায়ই আপনার কথা হয়। আমার শাশুড়ি যখন সুস্থ থাকেন তখন তিনি বলেন বাজার থেকে বাইম মাছ কিনে আন। বাইম মাছের ঝোল রান্না করে পারুলের জামাইকে খেতে বলো। বাইম মাছ নাকি আপনার খুব পছন্দ।
হ্যাঁ আমার খুব পছন্দ। এখন অবশ্যি খাওয়া হয় না বাসায় কেউ বাইম মাছ পছন্দ করে না। দেখতে সাপের মতো তো এই জন্যে।
আমি নিজেও বাইম মাছ খাই না, তবে আপনাকে একদিন রান্না করে খাওয়াব।
আচ্ছা।
আমি আপনার চা নিয়ে আসছি। চায়ে তো চিনি দেব না তাই না?
এক চামচ চিনি দিও। বিনা চিনির চা খেতে পারি না।
দুলি চা আনতে গেল। ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসলেন। শরীরের ক্লান্ত ভাবটা পুরোপুরি চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে হেঁটে হেঁটে তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে ভালো লাগবে। ছাতায় বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগে। অনেক দিন ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে হাঁটা হয় না।
দুলি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ইস্তিয়াক টেলিফোন করেছে ও রাত বারোটার আগে ফিরতে পারবে না। তবে আপনার জন্যে গাড়ি পাঠিয়েছে। গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।
দরকার নেই। ছাতা থাকলে দাও। ছাতা নিয়ে চলে যাব।
অসম্ভব! আপনাকে গাড়ি ছাড়া পাঠাব না। ইস্তিয়াক বলেছে কাল সন্ধ্যার পর আপনাকে আসতে। আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। গাড়ি পাঠাবে।
গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। আমি চলে আসব।
আপনি সঙ্গে করে সঞ্জুকে আনবেন।
ও কোথাও যেতে চায় না।
নিজের মামার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। আপনি বলে টলে তাকে নিয়ে আসবেন।
আচ্ছা।
ও এবার এমএ পরীক্ষা দিয়েছে না?
হুঁ। ভাইভা বাকি আছে।
দুলি খানিকটা ইতস্তত করে বলল, তার মামা বোধহয় সঞ্জুর ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
সঞ্জুর কোন ব্যাপারে?
আমি ঠিক জানি না। তবে ব্যাপারটা জরুরি।
আমি তাকে নিয়ে আসব।
দুলাভাই আপনি কি একা একা যেতে পারবেন, না আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
আমি একাই যেতে পারব।
কাল রাতে আমাদের এখানে খাবেন। আমি আপনার জন্য বাইম মাছ রান্না করে রাখব।
আচ্ছা।
বাইম মাছ ছাড়া আপনার আর কী পছন্দ?
কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ। আমার মেয়েরা শুঁটকি মাছ খায় কিন্তু কাঁঠালের বিচি দিয়ে খায় না।
আমি কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ রান্না করে রাখব। আপনি কিন্তু কাল অবশ্যই সঞ্জুকে নিয়ে আসবেন।
আসতে না চাইলে জোর করে তো আনতে পারব না। ছেলে বড় হয়েছে, নিজের মতামত হয়েছে।
আসতে না চাইলে বলবেন হাসনাতের ব্যাপারে সঞ্জুর সঙ্গে তার মামা কথা বলবেন।
হাসনাত কে?
আপনি চিনবেন না। সঞ্জু চিনবে। হাসনাতের কথা বললেই সঞ্জু চিনবে।
আচ্ছা আমি হাসনাত সাহেবের কথা বলব। দুলি তুমি আমাকে একটা ছাতা জোগাড় করে দাও—ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যেতে ইচ্ছা করছে। গাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে না।
দেখি ঘরে ছাতা আছে কি-না। মেয়েদের রঙচঙা একটা ছাতা আছে, ঐ টা নিবেন?
আমার কোনো অসুবিধা নেই।
ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। মেয়েদের একটা ছাতা নিয়ে ফরহাদ উদ্দিন এগোচ্ছেন। তার খুবই ভালো লাগছে। রাস্তায় পানি জমে আছে। ফুটপাত পর্যন্ত এখনো পানি উঠে নি। তিনি ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে রাস্তার নোংরা পানিতে পা ফেলে ছপ ছপ শব্দ করতে করতে এগুচ্ছেন। হলুদ স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে। হলুদ আলো পানিতে নানা রকম নকশা তৈরি করছে। দেখতে এত ভালো লাগছে। ফরহাদ উদ্দিনের মনে হলো আরেকটু পানি হয়ে পুরো রাস্তাটা ডুবে গেলে ভালো হতো। রাস্তাটাকে মনে হতো নদী। একটা মানুষ নদীর ওপর হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কী মজার ব্যাপার।