ফরাসি প্রেমিক – উপন্যাস – তসলিমা নাসরিন
প্রতিটি মানুষের দুটো মাতৃভূমি, একটি তার নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।
–শ্রীবোকাচন্দ্র ঠাকুর
.
দমদম থেকে শার্ল দ্য গোল
মেয়েটি, পরনে লাল বেনারসি, নাকে কানে গলায় হাতে সোনার অলংকার, শুকিয়ে চড়চড় ঠোঁট, উড়োজাহাজ থেকে নেমে ডানে বামে সামনে পেছনে তাকাতে তাকাতে, চলন্ত সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে, রাশি রাশি সাদা মানুষ দেখতে দেখতে হাঁটছে যেদিকে লোক হাঁটছে বেশি, যেদিকে ঢল, কলকল, সেদিকে। ঢল থেমে যায় এক কোণে, একের পেছনে আরেক করে হয়ে যায় দীর্ঘ অজগর। অনেকটা রেশন দোকানে সস্তায় ডাল দিচ্ছে গো, দাঁড়িয়ে যাও-এর মতো। লেজ ডিঙিয়ে, মেয়েটি নিজেকে গলাতে চায় পেটে। পেটের লোকেরা বলে, ও মেয়ে, ও লাল শাড়ি, লেজে যাও, লেজে যাও। মেয়েটি জিভের জলে ঠোঁট ভেজাতে ভেজাতে লেজে ফেরে, সবার পিছে সবার নীচে সবহারাদের মাঝে।
অজগর সড় সড় করে ডিঙিয়ে যাচ্ছে ঝোপঝাড়।
কেবল লেজটিই ঝোপের কাঁটায় আটকে পড়ে।
মেয়েটি, কপালে থেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর, ভেজা ঠোঁট মুখোমুখি হয় দুজনের, কালোর আর সাদার। মেয়েটি কালো পেরিয়ে সাদার দিকে এগোয়, অমাবস্যা পায়ে দলে ধবল জ্যোৎস্নার দিকে। কালো ডাকে, ও মেয়ে, ও লাল শাড়ি, এদিকে। লাল শাড়ি কানে খাটো, হাঁক শুনেছে, ডাক বোঝেনি। সাদার সামনে ত্রিভঙ্গ দাঁড়ায় সুবিনীত সুস্মিতা। দেবী দুর্গার মতো লাগছে না কি, একবার চোখ তোলে। দেবীতে সাদার কিছু যায় আসে না, সাদা চোখ তোলে না, আঙুল তুলে কালোর দিকে ইঙ্গিত করে। লাল শাড়ি কানে খাটো হলেও চোখে খাটো নয়। দু পা বামে গেলেই কালো। বামে যেতে তার পা সরে না, মন সরে না।
কালো তো কালোই, আবার গজদন্ত। মেয়ে ফোঁসে।
পাসপোর্ট। গজদন্তের গভীর গুহা থেকে গমগম শব্দ বেরোয়।
গাঢ় নীল পাসপোর্টটি কালোর চোখের সামনে ধরে মেয়েটি, অজগরের মাথা বুক পেটের লোকেরা যেভাবে ধরে পার পেয়ে গেছে। গজদন্ত খপ করে ধরে গপ করে টোপটি গেলে। শেয়ালের কালো থাবায় ভারতীয় কুমিরের ছানা। যক্ষের ধন পেয়েছে গজদন্ত। টোপটির আগপাশতলা দেখতে দেখতে কালোর লাল টকটক জিভে, মেয়েটি দেখে, জল গড়াচ্ছে।
টিকিট। আবার গুহার গমগম।
এবার আর টোপ নয়। মেয়েটি কালো থাবায় পুরে দেয় দুপাতার টিকিট–দমদম শার্ল দ্য গোল দমদম—বাইশে ফেব্রুয়ারি, একুশে মার্চ নিরানব্বই।
কুমিরছানা চলে গেল মেশিনের তলায়, একবার দুবার তিনবার।
কী করতে এখানে এসেছ হে? গমগম।
সংসার করতে। শুকোতে থাকা ঠোঁট নড়ে।
কোন হোটেলে উঠবে, নাম কী? গমগম।
বাপের হোটেল থেকে স্বামীর হোটেলে উঠবে লাল শাড়ি। এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে জীবন পার।
ঠিকানা কী? গমগম।
টুকরো একটি কাগজ কালো থাবার ভেতর চালান করে, একশো বারো রু দু ফুবো সানদানি, প্যারিস সাত পাঁচ শূন্য এক শূন্য।
টাকা কত আছে? গমগম। দুশো ডলার থাবায় চলে যায়।
আর কত আছে? গমগম।
ঝোলার ভেতরে হাত আনাচ কানাচ খোঁজে, বাসি ফুল, ছেঁড়া চিঠি, দুটো বোতাম আর একটি চিনেবাদামের খোসা, আর আধখাওয়া কমলালেবুর সঙ্গে উঠে আসে বারোশো পঁচিশ টাকা।
গজদন্ত দু আঙুলে শুঁয়োপোকা ভুরু চুলকে চিকন গলায় জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী?
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এগুলো টাকা।
টাকা?
হ্যাঁ টাকা। ভারতের টাকা। মেয়েটির মাস্টারি গলা।
গজদন্ত টাকার এমন চেহারা আগে দেখেনি। সাদা লোকটির চোখ পড়ে টাকায়, নাক কুঁচকে ওঠে, যেন আবর্জনার স্তূপ থেকে এক মুঠো দুর্গন্ধ বিষ্ঠা এনে সামনে রেখেছে কেউ। মেয়েটির পেছনে নতুন অজগর, অজগর লম্বা হচ্ছে, হাঁসফাঁস করছে, বুকের পেটের লোকদের গা জ্বলছে। লাল আপদটি সামনে না থাকলে অনেককাল বেড়া ডিঙিয়ে যেত ওরা। ওদের মত নিজেকেও মেয়েটির বড় এক আপদ বলে মনে হয়।
সাদা তার সাদা চিবুক নেড়ে সাদা আঙুল তুলে বলে, এই লাল শাড়ি, তুমি ওই কোণে গিয়ে দাঁড়াও।
আপদ বিদেয় হয়। কোণে।
নতুন অজগর দ্রুত গড়িয়ে যায়। এই মাথা তো এই লেজ। কারও পাসপোর্ট মেশিনে ঢোকানো হয়নি। কারও ঝোলার ভেতর হাত ঢোকাতে হয়নি, টাকা খুঁজতে হয়নি। কাউকে কোনও কোণে পাঠানো হয়নি। মেয়েটিই একা। মেয়েটিই এক কোণে। কোণটি, মেয়েটির মনে হয়, চিড়িয়াখানার খাঁচা, যারাই পার হচ্ছে, অদৃশ্য খাঁচার ভেতর মেয়েটিকে দেখছে, কালো চোখের কালো চুলের কালচে রঙের আজব জীব দেখছে। মেয়েটি চোখ নামিয়ে রাখে মেঝেয়। অপরাধী চোখ।
অজগরের লেজের শেষ বিন্দুকে ছুটি দিয়ে গজদন্ত যখন সাদার দিকে ঝুঁকে হাসছে, মেয়েটি এক পা দু পা করে কোণের সীমানা ডিঙিয়ে সাদাকে মিনমিনে গলায়, সবাই যে চলে গেল, আমি যাব না? বলতেই সাদা ডানে বামে মাথা দোলায়। মাথা দুলতেই থাকে, এর অর্থ কি না তুমি যাবে না, না কি সাদার মনে কোনও গানের সুর জেগেছে হঠাৎ আর সে সুরে তাল না দিয়ে সে পারছে না।
সাদার মাথা দোলানো দেখে গজদন্ত বেরিয়ে আসে কাচের ঘর থেকে।
হাঁটো। গমগম।
গজদন্ত থামে। কাচের নয়, ইস্পাতের একটি ঘরে, পেছনে লাল শাড়ি। ঘরের ভেতরে দুটো চেয়ারে দুটো নীল পোশাকের সাদা লোক। একটির বেশি বয়স, আরেকটির কম। বেশি বয়সের হাতে যক্ষের ধনগুলো সঁপে দিয়ে গজদন্ত বেরিয়ে যায়। কমবয়সি হাসছিল, মেয়েটিকে দেখে হাসি গিলে ফেলে ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখে প্রসবযন্ত্রণা।
বেশিবয়সি আস্ত নপুংসক, প্রসবযন্ত্রণা নেই নাকে চোখে গালে। বদলে ইস্পাতের মুখ, টোকা দিলে হাড় তো ভাঙবেই, আঙুল খসে যাবে, এমন। বেশিবয়সি ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ফরাসি জানো?
না।
কী জানো?
ইংরেজি।
ইংরেজি চলবে না।
মেয়েটি ইস্পাতের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। বিস্ময় তাকে একবার ডানে কাত করে, একবার বামে।
পৃথিবীর কোথাও ইংরেজি ভাষাটি যে অচল হতে পারে, এ তার ধারণায় ছিল না। কলকাতায় জাতে উঠতে হলে বা সভ্য হতে হলে ইংরেজি জানতে হয়। তার বিশ্বাস ছিল, সভ্য লোকেরা, সে যে দেশেরই হোক না কেন, অনর্গল চোস্ত ইংরেজি বলে।
তোমার নিজের ভাষা কী? বেশিবয়সি ধমকে ওঠে।
বাংলা। ক্ষীণ স্বর মেয়েটির।
বাংলা চলবে না, বাক্যটি শোনার জন্য মেয়েটি প্রস্তুত ছিল, মেয়েটিকে হতাশ করে বেশিবয়সি বলে,
দোভাষীর ব্যবস্থা করা হবে।
দোভাষী এলে মেয়েটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হবে। উত্তর সন্তোষজনক হইলে বিচারকমণ্ডলি রায় ঘোষণা করিবে মুক্তির, আর না হলে অর্ধচন্দ্র, যেখানের মাল সেখানে ফেরত পাঠানো।
ইস্পাত আর প্রসবযন্ত্রণার দু জোড়া চোখ মেয়েটির চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি ঘুরে বেড়ায়। কপালের চোখটি সামান্য বুজে ইস্পাতি ইঙ্গিত করে কোণের চেয়ারে। বেনারসি শাড়ি, থেবড়ানো সিঁদুরের টিপ, শুকনো চড়চড়ে ঠোঁট কোণের চেয়ারে গিয়ে বসে। কোণে তিনটে চেয়ার পাতা। তিনটের একটিতে, দেয়ালের লাগোয়াটিতে, কচি কলাপাতা রঙের লম্বা আলখাল্লা পরা ঘোর কালো রঙের এক লোক বসা, লোকটির মাথা ভর্তি চুল নয়, চুলের জট। এক চেয়ারের ব্যবধান রেখে মেয়েটি বসে।
লোকটি জিরাফি গলা বাড়িয়ে খড়খড়ে গলায় বলে, আমি সেনেগালের, তুমি?
মেয়েটি কানে খাটো, কানে খাটো বলে চোখ ইস্পাতের দেয়ালে। দাঁড়কাকের কর্কশ কা কা রব থামার লক্ষণ নেই। তুমি কোন দেশের?
দেয়ালে চোখ স্থির, ঠাণ্ডা গলায় উত্তর ছুঁড়ে দেয় বাতাসে, আমি সেনেগালের নই।
সেনেগালের নয় বলে একটি অহংকারের চড়ুই চকিতে উড়ে এসে তার বাঁ কাঁধে বসে। বাঁ কাঁধটি মেয়েটি মোটে নড়াতে চায় না। কাঁধ না নড়িয়ে আড়চোখে দেখে দাঁড়কাকের কদাকার পায়ের কাছে ততোধিক কদাকার বেগুনি রঙের বস্তা। বস্তাটির গলা খুলে বুনো হস্তিথাবায় একটি নোংরা বোতল বের করে পিঠের দিকে মাথা ঝুলিয়ে হিপোপটেমাসের হাঁয়ের ওপর বোতল উপুড় করে। অর্ধেক বোতল জল ঢুকে যায় হাঁয়ে। জিরাফি গলা মেয়েটির দিকে এল আবার, জল খাবে?
না।
জিরাফি গলা আবার, তোমার পাসপোর্টও কি নকল?
না। এ স্বরটি ঝাঁঝালো।
তুমি কি চিন দেশের?
না।
বুঝেছি, পাকিস্তানি।
মেয়েটি উঠে যায়, কাঁধের চড়ুই কাঁধেই থাকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দেয়ালের দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ঘরে আরও এক সাদা লোক ঢুকতেই মেয়েটির চোখ উতলা হয়। সাদা লোকটি সেনেগালির পাশের চেয়ারটিতে বসে। মেয়েটি কাঁধের চড়ুইকে উড়িয়ে দিয়ে সাদার পাশে, জিরাফি নাগালের বাইরে নিশ্চিন্তে এসে বসে। সাদার তেল চিটচিটে কাপড় থেকে পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে।
সেই গন্ধে স্বচ্ছন্দে নাক ডুবিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোন দেশের?
রাশা।
আবার নাক, তোমাকে কী কারণে আটকেছে গো?
লোকটি ফ্যাক করে হলুদ দাঁতে হেসে উত্তর দেয়, মস্কো।
ও তুমি বুঝি মস্কোতে থাকো?
লোকটি মাথা নাড়ে।
জানো আমার এক কাকা মস্কোতে গিয়েছিলেন। খুব নাকি সুন্দর শহর। আমার দাদা তো সামনের বছরই সম্ভবত বেড়াতে যাবে মস্কো।
লোকটি হলুদ দাঁতে হাসে।
পেচ্ছাপের গন্ধে আবার নাক ডোবে মেয়েটির।
আমি ভারত থেকে এসেছি। তুমি গেছ কোনওদিন ভারতে?
লোকটি মাথা নাড়ে।
পেচ্ছাপের গন্ধের দিকে সরে এসে মেয়েটি বলে, বাহ! কোন শহরে গেছ বলো তো! কলকাতা গেছ?
লোকটি উত্তর দেয়, প্যারিস।
ও তুমি প্যারিসে এসেছ আগে? আমার কিন্তু এই প্রথম।
মেয়েটি কোনও উত্তর আশা করেনি, কিন্তু উত্তর উচ্চারিত হয়, মস্কো।
মেয়েটি এবার মুখ বোজে, নাক বোজে। তার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর কী হবে সে অনেকটা অনুমান করে।
প্রশ্ন কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কিছু জানো?
উত্তর ভ্লাদিমির আলেকজান্দ্রোভিচ স্তানিস্লাভস্কি।
এদিকে প্রসবযন্ত্রণা আর ইস্পাত মিলে খড়বড় ভড়বড় নড়বড় করে অনর্গল ফরাসি বলে যাচ্ছে। একটি শব্দ বোঝা মেয়েটির পক্ষে সম্ভব হয় না। এক ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হলে কমবয়সি নীল পোশাকের লোকটি তিন আসামির দিকে চেয়ার ঘোরায়। আঙুল তুলে লাল শাড়ির দিকে, স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে, তোমাকে ফিরে যেতে হবে, তোমার দেশে, বুঝলে? কমবয়সির মুখে প্রসবযন্ত্রণা নেই আর, কপালে একটি বাড়তি চোখ ছিল, সেটিও নিশ্চিহ্ন।
মেয়েটি ত্রস্ত উঠে দাঁড়ায়, দোভাষীর কথা বলছিলে, ওর কী হল?
দোভাষী পাওয়া যায়নি।
মেয়েটি যখন অপেক্ষা করছে তার পাসপোর্ট টিকিট ইত্যাদি যক্ষের ধন ফেরত পাবার, নীল পোশাকের বেশিবয়সি ইস্পাতমুখী আরেকটি বেশিবয়সি সাদা নিয়ে ঘরে ঢোকে, এটি চুইংগাম চিবোচ্ছে। এটি নীলার মাথা থেকে পা অব্দি নিরীক্ষণ করে, দুচোখে কুলোয় না, কপালে একটি বাড়তি চোখ ছিল, সেটি খোলা।
চুইংগাম চিবোত চিবোতে, মেয়েটিকে, কী নাম?
কার?
তোমার।
নীলাঞ্জনা মণ্ডল।
প্যারিসে কী কারণে এসেছ?
সংসার করতে।
কার সঙ্গে?
স্বামীর সঙ্গে।
স্বামীর নাম কী?
কিষানলাল?
বয়স কত?
ঠিক জানি না। আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে।
তোমার বয়স কত?
সাতাশ।
কতদিন আছে সে এখানে?
কে?
তোমার স্বামী।
নীলাঞ্জনা ঘাড় চুলকে বলে, সম্ভবত পনেরো বছর।
তুমি সঠিক জানো না?
না।
সে কি এদেশের নাগরিক?
তাই তো শুনেছি।
কী করে সে?
শুনেছি ব্যবসা করে।
শুনেছ? নিশ্চিত নও?
কে বলেছে সে তোমার স্বামী? চুইংগামের ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দেয় অবিশ্বাস।
নীলা ডানে বামে তাকিয়ে, বিব্রত বিনীত স্বরে বলে, আমি বলছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস হল।
পদবিই তো এক নয়। চুইংগামের ঠোঁট থেকে উড়ে অবিশ্বাস এসে বসে ডান চোখে।
তা এক নয়, কারণ…শুকনো ঢোক গেলে নীলা।
কী কারণ?
আমি ইচ্ছে করেই স্বামীর পদবি নিইনি।
নীলার বুক কাঁপে। তার স্বামীদেবতাটি কখনও বলেনি যে পদবি এক না হলে সর্বনাশ। বলেছে নাম ঠিকানা রেখো, বিয়ের কাগজ হাতে রেখো, দরকার নেই যদিও, সাবধানের মার নেই। বৈধ পাসপোর্ট, বৈধ ভিসা, আর কী!
কেউ না চাইতেই নীলা ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে লম্বা কাগজ বের করে বলে, এই দেখো, আমাদের বিয়ের দলিল।
কার বিয়ের দলিল? ইস্পাতমুখী জিজ্ঞেস করে।
কাগজটি ইস্পাতমুখীর দিকে বাড়িয়ে নীলা বলে, আমার আর কিষানলালের।
কাগজটির দিকে এক নজর তাকায়, হাতে নেয় না, বরং কমবয়সি নেয় ছোঁ মেরে। চুইংগাম লোকটি কমবয়সির সঙ্গে কিছুক্ষণ হড়বড় করে, নিতম্ব দুলোতে দুলোতে, বেরিয়ে যায়, নিতম্বের পেছন পেছন বেশিবয়সি ইস্পাতমুখী। আর কতক্ষণ এই কোনায় বসতে হবে, উত্তরের জন্য সে কমবয়সির দিকে তাকায়। কমবয়সির নিরিন্দ্রিয় ভঙ্গি নীলাকে কোনও আশা বা হতাশার কথা শোনায় না। অতঃপর আবার সেই কোণ, সেই অপেক্ষা, এবার ভ্লাদিমির আলেক্সান্দ্রোভিচের ঝুলে থাকা মাথার তলে। নীলার মনে হয়, এই ইস্পাতের ঘরে ঠায় বসে থেকেই বাকি জীবন কাটবে তার। নিজের অস্তিত্বটি ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, না পারছে ঘর থেকে বেরোতে, না পারছে ঠায় থাকতে। উঠে দাঁড়ায় সে, ঘরময় হাঁটে, দরজায় চোখ, নিস্তার দিতে কেউ আসছে আশায় কমবয়সি ইঙ্গিত করে স্থির হতে। স্থির হয় বটে সে, স্থিরের মধ্যে অস্থিরতা দ্বিগুণ লাফায়। আপাতত এই কোণ থেকে নীলা দূরে সরতে পারলে বাঁচে। সে কলকাতা হলে, কলকাতা।
পা পা করে এগিয়ে এসে, কমবয়সিকে জিজ্ঞেস করে, আমার সুটকেসগুলো কোত্থেকে নেব? কোন বিমানে ফিরতে হবে, এ সবের কি কিছু ঠিক করছেন?
কমবয়সি, কোনও উত্তর দেয় না। যেন এ কোনও প্রশ্ন নয়। অথবা কোনও প্রশ্ন করার অধিকার আর যে কেউ রাখুক, নীলা রাখে না।
আমার স্বামীর আমাকে নিতে আসার কথা। বাইরে অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই। তাকে কি ডাকা যাবে এখানে?
নীলা যার উদ্দেশ্যে বলে, সে একটি কৌটোর মুখ খুব যত্ন করে খুলে, চিমটি দিয়ে কালো তামাকগুঁড়ো তুলে, বাঁ হাতে ওপরের ঠোঁটটি টেনে চিমটির গুঁড়ো গুঁজে দেয় ভেতরে, তার নাকের নীচ থাকে ফুলে, নাকের পাটাও। কোনও শব্দ নেই, কেবল স্তানিস্লাভস্কির নাক ডাকার গড়গড়, আর সেনেগালি কালোর কোমরের মড়মড়। সেনেগালি কালো পিঠ টান করে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ, ক্ষণে ক্ষণে পিঠটিকে ডানে বামে মোচড় দিয়ে মড়মড় করে হাড় ফোঁটাচ্ছে। পিঠের সবগুলো হাড় ফুটিয়ে তবে সে পিঠকে নিস্তার দেয়, সেই সঙ্গে নীলাকেও। সেনেগালি উবু হয়ে আবার সেই নোংরা জলের বোতলে হাত দেয়, আবার হিপোপটেমাসের হাঁ, নিমেষে বোতল খালি।
জলতেষ্টা আর খিদে নীলাকে হাভাতের মতো গিলে খাচ্ছে। বন বন শন শন করে বাতাস নয়, ঘোরে মাথা।
কার কাঁধে মাথাটি রাখবে সে, স্তানিস্লাভস্কির কাঁধই তার কাঁধে এসে পিং পং বলের মতো পড়ছে বারবার, পেচ্ছাপের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে নাক বেয়ে মাথায় উঠছে, মাথাটি ঘাড় থেকে আলতো করে তুলে নিয়ে ইচ্ছে করে কোথাও ছুড়ে দিতে। ছুড়লে কোথায় আর, ইস্পাতের দেয়ালেই। কী দরকার ছিল, নীলা ভাবে, কোথাকার কোন কিষানলাল, জানা নেই শোনা নেই, হুট করে তাকে বিয়ে করার! কলকাতা খাঁ খাঁ করছিল, কলকাতা না ছাড়লে নীলা মারা পড়ত। কিন্তু বিয়ে না করেও সে ছাড়তে পারত শহর, দিল্লি বা বোম্বে কোথাও সে চলে যেতে পারত, কোথাও খুব দূরে, সুশান্তর গন্ধ বর্ণ থেকে যোজন যোজন দূরে।
আচ্ছা কেউ কি আমাকে অন্তত এক গেলাস জল দিতে পারো? নীলা নিজেকেই প্রশ্ন করে। নিজেকেই সে উত্তর দেয়, না কেউ আমরা তোমাকে এক গেলাস জল দিতে পারি না।
এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকার অভ্যেস নেই নীলার, বিশেষ করে এ যদি অপেক্ষা হয়। সুশান্তর জন্যও সে এতটা সময় কখনও অপেক্ষা করেনি, আসলে প্রয়োজনও হয়নি, যেখানেই দেখা করার, সুশান্তই গিয়েছে আগে। সুশান্তই। মাথা ঘোরাটা আরও বাড়ে, যেন কেবল মাথা নয়, ভারী একটা বোঝা মাথায় তার, গোটা সুশান্ত তার মাথার ওপর জেঁকে বসছে আবার।
ভারী বোঝার মাথা বেমক্কা চক্কর খেয়ে প্রায় ছিঁড়ে পড়ে, যখন চোখের সামনে সেনেগালিটিকে মুক্তি দেওয়া হয় আর বেগুনি বস্তা কাঁধে নিয়ে পেছনে একটি ঝলক দিয়ে হাসির এবং কাশির, সেনেগালি অদৃশ্য হয়। নীলার হাত নিশপিশ করে আলখাল্লার ঝুল ধরে লোকটিকে হিড়হিড় করে টেনে এনে এই ইস্পাতের ঘরে বসিয়ে দিতে, তারপর নিজে সে অদৃশ্য হতে, কাঁধের চড়ুইটিকে কাঁধে নিয়ে।
কালো লোকটি তো দিব্যি চলে গেল। আমার দোষটা কোথায় শুনি। নীলা জিজ্ঞেস করে।
আচ্ছা, কোণ থেকেই নীলা প্রশ্ন করল, গোলটা কোথায় হচ্ছে। আমার পাসপোর্টটা কি নকল?
কমবয়সি উত্তর দিল না।
আমার ভিসাটা কি নকল?
কোনও উত্তর নেই।
টাকাগুলো নকল?
কমবয়সি চেঁচিয়ে উঠল, এই লাল শাড়ি, বেশি বকবক কোরো না।
লাল শাড়ি মুখে কুলুপ আঁটে।
যক্ষের ধন যার হাতে, সেই বেশিবয়সি, ফিরে এল। সঙ্গে চুইংগাম চিবোনো আগের লোকাট, লোকটি এখন আর চুইংগাম চিবোচ্ছে না। লোকটির কপালের চোখটিও নিশ্চিহ্ন। নীলার হাতে ছুঁড়ে দেওয়া হল একটি একটি করে ধন, একটি বাড়তি কাগজও পড়ল। কাগজ মানে প্রশ্নপত্র, ইস্কুল কলেজে এমন প্রশ্নপত্র যথেষ্টই হাতে নিয়েছে সে, এ কিছু নতুন ঘটনা নয়। এবার তাকে পাচার হতে হয় কমবয়সি লোকের কাছে।
ভুরু নাচিয়ে কমবয়সি বলে, বেশ তো ছাড়া পেয়ে গেলে। ভাগ্য বলতে হবে। মসিয়ে বেস-এর করুণা না হলে বুঝতে।
কমবয়সির নাকের পাটা আর নাকের তলের মতো ঠোঁটজোড়াও ফোলে। ফোলা ঠোঁট তাকে ওই হোথা যাবার ইঙ্গিত করে। ওই হোথার হদিস পেতে পেতে হাওয়ায় উড়ে যায় আরও সময়। আবার সেই কাচের ঘর, আবার সেই গজদন্ত। গজদন্তের হাতে পূরণ করা বাড়তি কাগজটি বাড়িয়ে দেয় যেখানে অনেকটা মুচলেকা দেওয়া যাহা বলিতেছি সত্য বলিতেছি, মাস পার হইবার আগেই ভালয় ভালয় এই দেশ ত্যাগ করিব। এই দেশে বসত করিবার লোভে কোনও চাতুর্যের আশ্রয় লইব না, লইলে যে শাস্তিই দেওয়া হোক, গা পাতিয়া মন পাতিয়া বরণ করিয়া লইব ইত্যাদি।
গায়ের বাদামি রং, লাল বেনারসি, কপালের আর সিঁথির সিঁদুর, সোনার অলংকার, নীল পাসপোর্ট, খুচরো টাকা প্রাণপণ আড়াল করতে করতে বেড়া ডিঙোয় নীলা। ছাড়পত্র ভিক্ষে পেয়েছে সে, এ ভিক্ষে নাও জুটতে পারত তার। করুণা নাও হতে পারত মসিয়ে বেস-এর। সেই পুরনো কলকাতার পথে আবার একই আকাশ একই মেঘ দেখতে দেখতে ফিরতে হত তাকে একই বাড়িতে, যে বাড়ি থেকে একধরনের চিরবিদায় তাকে দেওয়া হয়েছে। ভিখিরি নীলা একলা পড়ে থাকা দুটো সুটকেস জোগাড় করে যখন বাইরে আসে, সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে, শেষ বিকেল।
কিষানলাল তখনও দাঁড়িয়ে, সুনীল আর চৈতালিও। নীলাকে দেখে তিনটি প্রায়-মৃত শরীর প্রায়-দৌড়ে প্রায় নীলার ওপর পড়ে। সুটকেসের ঠেলাগাড়িটি বেঁটে মোটা বুট পরা টাই পরা সুট পরা সুটের ওপরেও কোট পরা কিষানলাল প্রায় কেড়ে ঠেলতে ঠেলতে বলে, কী ব্যাপার, এত দেরি হল কেন? সেই ভোর থেকে বসে আছি!
সুনীল, লম্বা, ফর্সা পাতাকাঠি ঘটকমশাই একগাল হেসে বলে, আমরা প্রায় আশাই ছেড়ে দিচ্ছিলাম।
কপালের থেবড়ে থাকা সিঁদুরের টিপ দুহাতে ঘসে দিতে গিয়ে চৈতালি বলে, আহা কী ধকলটাই না গেছে।
কনকনে ঠাণ্ডার সূচ নীলার হাড়ে কেন মজ্জায় বেঁধে, বন্দর ছাড়তেই। চৈতালি তার গা থেকে বাড়তি গরম কোটটি দিয়ে নীলার গা ঢেকে দেয়। গা পোড়া গরম থেকে আসা নীলা, তীব্র এই সুচগুলোই নীলার প্রতি রোম ছুঁয়ে ছুঁয়ে অমল আনন্দের চাদর বুনে দেয়।
কলকাতায় এই তো আর দু মিনিট দেখেই ফোন করতে নিচ্ছিলাম, পরের ফ্লাইটে ফেরত পাঠাল কিনা জানতে। সুনীলের শুকনো ঠোঁটে ভেজা হাসির টুকরো।
স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর নামের পদবি মেলে না তাই ঝামেলা করেছে। মিললে আর সবার মতো সময়ে বেরোতে পারতাম। নীলা বলে।
পারতে না। পদবি মিললেও ওরা যা করেছে, তাই করত। সুনীল গাড়ির ভেতর গা গলিয়ে দিয়ে বলে।
নীলা গা ছেড়ে দিয়ে সামনের আসনে, বলে, ডলার আরও বেশি থাকলে পারতাম।
সুনীল গলা ছেড়ে প্রথম কেশে নিয়ে তারপর হেসে নিয়ে বলে, পারতে না। এই একই হাঙ্গামা করত ওরা।
হাজার প্রশ্নের চোখ নীলার, পাসপোর্ট ভিসা কিছু তো নকল নয়। কী কারণে করত?
সুনীল হাসে, কিষানও। প্রশ্নটির যেন একটিই মাত্র উত্তর, খ্যাক খ্যাক।
খ্যাক খ্যাকে মন ভরে না নীলার। তা হলে কারণ কী অমন হেনস্থা করার?
কারণ হল তোমার গায়ের রং। যথেষ্ট সাদা নয়। সুনীলের কথা শেষ হওয়ার আগে চৈতালি বলে, আর হল পাসপোর্ট, যথেষ্ট ধনী দেশের নয়।
নিজের গায়ের রং নীলার খুব মন্দ বলে মনে হয় না। সেনেগালির বিচ্ছিরি রঙের সঙ্গে মেলালে সে রীতিমতো সোনার বরণ কন্যা। সোনার বরণ চক্ষু কর্ণ নাসিকা কুঞ্চিত করে সেনেগালির কোমরের হাড় ফোটানো আর জল খাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা করে বলে, ও ব্যাটা সে দিব্যি পার পেয়ে গেল।
নীলার কণ্ঠে ক্ষোভের ফুলকি। ক্ষোভ সেনেগালির পার পাওয়ায়।
প্যারিসে নেমে কালো লোক দেখব আশা করিনি। নীলা গাড়ির কাছে নিজের মুখটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে।
কালো দেখলে গা জ্বলে কিযানেরও, সুনীল চৈতালিরও।
যত নষ্টের গোড়া ওই কালোগুলো। বসে বসে সরকারি সাহায্য খায়, সন্ত্রাস করে বেড়ায় আর এদের দোষের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের মতো প্রায়-সাদাদের।
সুনীলই প্রথম উত্তর দেয়, কালো লোকের জ্বালায় বাঁচার উপায় নেই।
কালোদের পিণ্ডি চটকানো চলে অনেকক্ষণ। শুদ্ধ বাংলায়।
.
বাঙালির ভিড়ে অবাঙালি কিষানলাল মাংসের বাটির ভেতর এক টুকরো আলুর মতো পড়ে থাকে।
আলু আড়চোখে মাংস দেখে, লাল টুকটুকে মাংস। নিরামিষাশীর মাংসে লোভ নেই, কে বলে! কিষানের আড়চোখ লক্ষ করে নীলার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় চকিতে সজাগ হয়, রাস্তার সিটি বাজানো যে কোনও কামুক পরপুরুষের সামনে যেমন হয়। খোলা বাহুটি মুহূর্তে আঁচলে ঢাকার পর তার চেতন ফেরে, লোকটি তার স্বামী, স্বামীর সামনে গুটোনোর কিছু নেই। যদিও বিয়ে হওয়ার পর সে দু সপ্তাহ মাত্র শুয়েছে স্বামীর সঙ্গে কলকাতার বাড়িতে, ও কেবল শোয়াই, রাতে সঙ্গম শেষে দুজনই দু দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়েছে। কিষানের সঙ্গে নীলার সম্পর্ক বলতে ওই শারীরিক সম্পর্কটুকুই। ভাঙা হিন্দি আর ভাঙা ইংরেজিতে দু-একটি কাজের কথা ছাড়া নীলার তেমন কোনও কথা হয়নি স্বামীর সঙ্গে। বিয়েতে নীলার মত দেওয়ার আগে মলিনা বলেছিলেন, অবাঙালি ছেলে, জানা নেই শোনা নেই, হুট করে বিয়ে করে ফেলবি, একটু দেখে শুনে কোনও বাঙালির ঘরে..।
বাদ দাও মা, বাঙালি তো যথেষ্ট দেখা হল। দেখা হল না? নীলা গলায় কান্না চেপে বলেছিল।
ওই দু সপ্তাহই। ওর মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা টিকিট এ সবের ব্যবস্থা করে, দিল্লি হয়ে প্যারিস চলে এল কিষান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতে কিছু বাকি ছিল নীলার, শেষ করে, সেও আকাশে উড়বে, এমনই কথা। স্বামীকে তুষ্ট করার জন্য নীলার বাবা অনির্বাণ তাগাদা দিয়েছেন বিয়ের শাড়ি অলংকার পরে উড়োজাহাজে উঠতে, সম্ভবত পুরুষই ভাল জানে, পুরুষেরা কীসে তুষ্ট হয়। কিষানই এই জগৎ সংসারে তার সবচেয়ে আপন, যেহেতু সে স্বামী, স্বামীর সঙ্গে বাকি জীবন যাপন করতে হবে তার, স্বামীকে তুষ্ট করতে হবে জীবনভর, তবু কী ব্যাপার রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছ ছাড়া আর কিছু প্রশ্নের হ্যাঁ না উত্তর ছাড়া স্বামীর সঙ্গে মধুর কোনও বাক্যালাপ তো নয়ই, কোনও মিষ্টি হাসি বা দৃষ্টি বিনিময়, তাও হয় না। কথার ফুলঝুরি যা কিছু সব বাংলায়, যা বলে পেছন ফিরে।
আচ্ছা, বিমানবন্দরের ফরাসি লোকগুলো ইংরেজি জানে না নাকি! ভাল ইংরেজি বলল না তো!
জানে জানে। ইচ্ছে করে বলে না। এই তো সবে এলে, থাকো, দেখবে এদের বর্ণবাদী চরিত্র। চৈতালির চিকন গলা ভারী শোনায়।
কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে। কিষানের মাথায় চাঁটি মেরে বলে সুনীল।
কিষান, মোটা কালো মোচ, আঙুলে পাকাতে পাকাতে মুখ খোলে, বাঙালি বেচারাকে একটু সুযোগ দিচ্ছি কিচিরমিচির করার।
হা হা।
.
নীলার ক্লান্তি জলতেষ্টা খিদে মাথাধরা উবে যায় যখন প্যারিস শহরের ভেতর ঢোকে গাড়ি। নীল পোশাকের কমবয়সি, বেশিবয়সি, চুইংগাম, গজদন্তের ওপর যে অভিমান ছিল, মুহূর্তে জল হয়ে গেল। গাড়ি হোটেল দ্য ভিল ছাড়িয়ে প্যালে রয়াল ছাড়িয়ে লুভর জাদুঘরের ভেতর দিয়ে পঁ নফের ওপর দিয়ে, সেইনের পাড় ধরে বুলোভার্ড শাঁ মিশেলের। দিকে যাচ্ছে যখন নীলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে, এর নাম কি স্বর্গ? নিজেকেই উত্তর দেয়, এর নামই।
.
অতিথি বধূ
কিষানলালের বাড়িতে পা দিয়ে নিজেকে অতিথি-মতো লাগে নীলার। বিশাল বাড়ি, দেয়ালের মাথা থেকে মেঝে অব্দি জানালা, জানালায় ভারী পর্দা, ওপারে ফুলে ছাওয়া ঝুল বারান্দা। আকাশ রঙের নীল গালিচায় ছাওয়া মেঝে, সোফায় বসতেই নরম গদিতে পা ডুবে যায় নীলার, সামনে মদের বোতলের তাক, পাথরের নারীমূর্তি, ছাদ থেকে পাখার বদলে ঝুলছে কাচের ঝালরবাতি, দেয়ালে সাঁটা ইস্পাতের পাত উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঘরময়। চৈতালির তাড়ায় নীলাকে বাড়ি দেখতে উঠতে হয়, এই হল বসার, এই শোবার, আর ওপাশের ঘরটি ঠিক কোনও কাজের নয়, বাড়তি মানুষ বা অকেজো জিনিসপত্র গোঁজার, আর এদিকে রান্নাঘর, ওদিকে স্নানঘর, কলঘর, মলঘর। সংসার নতুন করে সাজাবার কিছু নেই, চৈতালি বলে। এই দেখো ধুলো ঝাড়ার, কাপড় ধোবার, শুকোবার, বাসন ধোবার, এমনকী ডিম ফাটাবার, ফাটিয়ে একে নাড়বার, সেদ্ধ করবার, ফালি ফালি করে কাটবার যন্ত্র। সুশান্তর সঙ্গে টোনাটুনির সংসার করার স্বপ্ন দেখত নীলা, প্রথম গাছের তল, তারপর কুঁড়েঘর, সেই নুন আনতে পান্তা ফুরনো ঘরে কুপির আলোয় দুজনে দুজনকে ভালবাসবে, বাইরে বস্তুবাদী জগতের দিকে হো হো হাসি ছুড়ে দেবে আর যেদিন চেষ্টা চরিত্তির করে শহরতলির ইস্কুলে মাস্টারির কাজ জোটাতে পারবে সুশান্ত, যেদিন হ্যাজাকবাতি আসবে ঘরে, সারারাত ধরে উৎসব হবে গানের।
ধুত হ্যাজাকবাতি টাতি না, গানের উৎসব হবে পূর্ণিমায়। খোলা মাঠে।
ভালবাসিয়া গাছের তলে বাস করিব আবেগ নীলার কিছু কম ছিল না। বাঙালি জন্মই নেয় ওই আবেগ নিয়ে। আর সাতাশে পড়তেই কালবোশেখি ঝড়ে জীবন বদলে গেছে নীলার, গুঁড়িসুদ্ধ উড়ে গেছে শখের বটবৃক্ষ, হ্যাজাকবাতি নিবে গেছে, উৎসবে নেমে এসেছে ভুতুড়ে স্তব্ধতা, পূর্ণিমা ঢেকে গেছে এক আকাশ কালো মেঘে, আর নীলাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে অদ্ভুত বিনাশী হাওয়া সুদূরপারে এক ঝকঝকে ঘরে, সব আছের সংসারে।
কাজের লোক নেই? নীলা জিজ্ঞেস করে।
কিষান আর সুনীল বসে গেছে মদের বোতল খুলে। সে আসরে নিজেকে গলিয়ে দিয়ে চৈতালি বলে, কিষানের বউ কাজের লোকের কথা জিজ্ঞেস করছে গো!
সুনীল সশব্দে হাসে, কিষানের মোচের তলেও হাসি ঝিলিক দেয়।
যে উত্তরটি পায় নীলা, তা হল এই বিদেশে কারও ঘরে কাজের লোক থাকে না, এ দেশে কোনও গরিব নেই যে লোকের বাড়িতে কাজ করবে। আরও একটি ধারণা দেওয়া হয়, আজ যদি কাউকে ঘরদোর পরিষ্কার করার চাকরি দেওয়া হয়, ঘড়ি দেখে এক ঘণ্টায় কম পক্ষে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দিতে হবে।
নীলা আঙুলের কড়ায় হিসেব করে চোখ কপালে তোলে, তিনশো টাকা? পুরো মাস চবিবশ ঘণ্টা কাজ করেও তো কলকাতায় বাড়ির কাজের লোকদের তিনশো টাকা দেওয়া হয় না।
সুনীল এবং কিষান দুজনই নীলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এ প্যারিস, কলকাতা নয়।
লাখ টাকা বেতন দিয়ে কাজের লোক কে রাখে এখানে? মদে বরফ ঢালতে ঢালতে বলে সুনীল।
সব কি নিজের হাতে করতে হবে?
সোফার হাতলে বসে নীলা।
চৈতালির গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে কিষান বলে, ভয় পেলে না কি?
ভয়ের কী আছে। ঘরদোর তো সব গোছানোই দেখছি। ঘরে দৃষ্টি ছড়িয়ে বলে নীলা।
গোছানোর কিছু নেই, তোমার কাজ হল, কোনও কিছু অগোছালো না করা। কিষান জোরে হাসে।
.
খিদে সামাল দিতে দু চাক রুটি খেয়ে, জল খেয়ে দু গেলাস, চৈতালির তাড়ায় গরম জলে স্নান করে নেয় নীলা। স্নানের জলে ধুয়ে যায় সিঁথির সিঁদুর। ধুয়ে যায় চোখের কালো কালি। নিজেকে শুদ্ধ স্নিগ্ধ করে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে, যেই না জানালায় দাঁড়িয়েছে, আকাশ বা আকাশের নীচে যে স্বর্গ, দেখতে, হই হই করে ওঠে কিষান, বউ হয়ে এ কী পোশাক পরেছ? শাড়ি পরো, গয়না পরো, সন্ধেয় লোক আসবে বউ দেখতে।
কিষানের আবদার বা আদেশ মতো নীলা জিনস ছেড়ে লাল একখানা কাতান পরে সোনার অলংকারে গা মুড়োলো, হাত ভরে সোনার চুড়ি, কানে ভারী ঝুমকা, গলায় সোনার মালা। মুখে পাউডার মেখে কাজল পরে, সিঁদুরের টিপ পরে কপালে, সিঁথিতে সিঁদুরে আঙুল টেনে এয়োতির চিহ্ন এঁকে, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক লাগিয়ে তাকাল নিজের দিকে। এ সিঁদুর তো সুশান্তর পরিয়ে দেবার কথা ছিল। নীলার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো তেতো হাসি, কোথায় এখন সুশান্ত! দিব্যি আছে নিশ্চয়। বছর ধরে প্রেম করল নীলার সঙ্গে, আজ বিয়ে হয়, কাল বিয়ে হয় এমন, শেষ অব্দি জাতে মেলে না বলে কেটে পড়ল, কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে সুশান্ত চক্রবর্তী, নমশুদ্রের মেয়ে নীলাঞ্জনা মণ্ডলের সঙ্গে প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ। লেখাপড়া জানা ছেলেও যে এত জাতফাতের তোয়াক্কা করে! তোয়াক্কা সম্ভবত সুশান্ত করেনি, করেছে ওর বাবা মা, আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেই বা কী করে বাপ মায়ের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে সাত পাকে ঘোরে, নিজের পছন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে! নীলার কাছে ও সব কেবল অবাক করা ব্যাপার নয়। নিজের জীবনটিও তাকে অবাক করে, বিশেষ করে জেদ করে বিয়ে করার ব্যাপারটি। জীবনে আর যে দুর্ঘটনা ঘটুক এটি যে ঘটবে না, এ ব্যাপারে অনেকটাই সে নিশ্চিত ছিল। সুশান্তর বিয়ের পর, স্মৃতির ধার, দাঁতের কামড় নীলাকে রক্তাক্ত করছিল প্রতিদিন, এ ছাড়া, সে ভাবে, তার উপায়ই বা কী ছিল! নীলার হঠাৎ মনে হয়, বাঁচার জন্য কি তার কলকাতা ছাড়া, না কি এ অন্য রকম এক মৃত্যুকে বেছে নেওয়া, অথবা বিয়ে করতে হয় বলে করা, না করলে লোকে মন্দ বলে, ভুরু কুঁচকে তাকায়, তাই! নাকি কী ব্যাপার, বয়স এত হয়ে গেল, এখনও পাত্র জুটল না। এসব কূটকথা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সে যে কালা নয়, খোঁড়া নয়, তারও যে পাত্র জুটতে পারে, তা কিষানকে বিয়ে করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর পাড়াপড়শিকে দেখিয়ে এল। তাই কি?
.
সন্ধেয় বাড়িতে সাতজন অতিথি এল। সাতজনের মধ্যে দুজন অবাঙালি ভারতীয়, একজন ফরাসি। অডিল। গুজরাটি তারিক ইসমাইলের বউ। বউ নিয়ে এসেছে দুজন, বাবু গোগিনি আর রাজেশ শর্মা। বউ ছাড়া সানাল এডামারুকু। ওর বউ নেই। নীলা গ্রহণ করল যে যা দিল, মীনাক্ষীর সাতরঙের ফুলের তোড়া, সাহানা গোগিনির শাড়ি, আর সানালের একটি, একটিই টকটকে লাল গোলাপ আর দুগালে অডিলের চু চু করে দুটো চুমু। যে যার মতো চেয়ার টেনে বসে গেল। সবাই এ বাড়িতে আগে এসেছে। নীলাই নবাগত। অতিথিরও অতিথি।
মোয়েট অ্যান্ড শানডন শ্যাম্পেনের বোতলের গলা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কিষান বলল, আমার একটি নয়, দুটি নয়, একটি মাত্র বউ। আজ না হয় ভাসলামই শ্যাম্পেনের জলে। বলে যেই না বুড়োআঙুলে ছিপির গোড়ায় চাপ দিয়েছে, ছিপি বিষম শব্দে ছাদে লাফ দিল, আর শ্যাম্পেন ফুঁসে উঠে ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ল নীলার গায়ে। যেটুকু বোতলে ছিল। তাই ঢেলে গেলাসে গেলাসে ঢেলে দিল কিষান।
গেলাস উঠিয়ে ফ্রান্সে স্বাগতম বলল বাবু গোগিনি। বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে যার যার গেলাস উঠিয়ে পাশের গেলাসে টুং টাং শব্দ তুলে একই কথা বলল, স্বাগতম। মাতামাতি কিছুক্ষণ নীলাকে নিয়ে চলল, আহা সে কী ডাগর চোখ। চোখ তো দেখে না, যেন কথা বলে। সাহানা বাঁ কাতে নীলাকে দেখে বাবুকে খোঁচায়, দেখো দেখো ওকে একটু রেখা রেখা লাগে না? গোগিনি দম্পতির ধারালো চোখের সামনে তখন নীলা, জবুথবু নীলা, বাবু ঘাড় ডানে কাত করে ফিসফিস করে, আরে না, খানিকটা মীনাক্ষী শেষাদ্রির মতো বলতে পারো।
উঁহু, সানাল লাফিয়ে তিন চারটে হাঁটু ডিঙিয়ে নীলার সামনে লাল গালিচায় আসন করে বসে নাহ, কে বলে রেখার মতো, মীনাক্ষীর মতো, আমাদের বউদি দেখতে, যতটা গম্ভীর হওয়া সম্ভব, হয়ে, বলে একেবারে নীলাঞ্জনা মণ্ডলের মতো।
সারা ঘর হেসে ওঠে।
সানাল পদার্থবিদ। দশ বছর এ দেশে, বিয়ে থা করেনি। নোয়াজি-তে বাড়ি কিনেছে। একা থাকে। ছ ফুট মতো লম্বা। মেদহীন শরীর। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। মাথা নেড়ে যখন কথা বলে সানাল, সামনে পেছনে দোল খায় তার চুল। একবার সানালকে দেখে, আরেকবার কিষানকে, নীলা মেলায়। সানালকে দেয় একশোয় পঁচাশি, আর কিষানকে পনেরো। সানালের সঙ্গে, নীলা ভাবে, যে তার তো বিয়ে হতে পারত। কিন্তু হয়নি। জীবন যে কোথায় কার সঙ্গে বাঁধা থাকে! আসলেই কি বাঁধা থাকে? সুনীল যদি সানাল এডামারুকুকে কলকাতায় পাঠাত বিয়ে করতে, তবেই তো জীবন অন্যরকম হতে পারত তার। হতে পারত কিন্তু হয়নি।
ওই লোকটি, ওই ফরাসি মেয়েটির স্বামী? উনি কী করেন? নীলা চৈতালির কানে কানে জিজ্ঞেস করে।
লেখেন। থাকতেন লন্ডনে। ফরাসি মেয়ে বিয়ে করে এ দেশে চলে এসেছেন। বেশ ভাল একটা বই লিখেছেন জানো তো। কী নাম যেন বইটির…চৈতালি তার হাতের বুড়ো আর মধ্যমা ঘষে মনে করার চেষ্টা কার কী নাম, কী নাম…এই সুনীল তারিকের বইটির নাম যেন কী?
কেন আমি মুসলিম নই! সুনীলের ঝটপট জবাব।
হ্যাঁ, কেন আমি মুসলিম নই।
নীলা বলে, বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো! কেন আমি ক্রিশ্চান নই। আচ্ছা, কেউ কোনও বই লিখেছে, কেন আমি হিন্দু নই?
চৈতালি ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ে ধীরে। না তার জানা মতে নেই।
সুনীল মগ্ন ছিল হুইস্কির গুণাগুণ বর্ণনায়, মগ্নতা থেকে মুহূর্ত ব্যয় করে বলল, হ্যাঁ লিখেছে, শ্রীসুনীল চক্রবর্তী।
হা হা।
কিষান, কী খাওয়াচ্ছ এ সব! মল্ট বের করো। মল্ট।
কিষান সুনীলের আবদার পালন করে মদের তাক থেকে এক হাতে গ্ল্যানফিডিশ, আরেক হাতে লাফ্রোওইগ নিয়ে দুলতে দুলতে আসে।
আসরে তুমুল আনন্দধ্বনি।
শেষটা হবে স্প্রিংব্যাঙ্ক দিয়ে।
ওয়াও হো। সানাল সিটি বাজায়।
ইংরেজি ফরাসি হিন্দি মিশিয়ে আড্ডা জমে ওঠে। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ করে গলার স্বর সপ্তমে ওঠে সবার। সোফার এক কোণে চৈতালির গা ঘেঁষে বসে থাকে নীলা, বউ নীলা, মুখে রং মাখা নীলা, পুতুল নীলা, অতিথি নীলা। আড্ডার লোকেরা উঠে উঠে রান্নাঘর থেকে নিজেরাই জল বা বরফ বা কমলার রস নিয়ে আসে। কমলার রস নীলার আর সাহানার গেলাসে। বাকিরা হুইস্কির সঙ্গে কেউ নেয় জল, কেউ নেয় বরফ। তারিক জল বা বরফ না মিশিয়ে খায়। খেতে খেতে অন্তত দুবার বলে ফেলেছে, হুইস্কিতে জল মেশালে এর স্বাদই নষ্ট হয়ে যায়। এই মুশকিল ভারতীয়দের, মদ খেতে জানে না, তবু খাবে।
রাজেশ বলে, আমরা কি ভাই মদ খাওয়ার জন্য মদ খাই! খাই মাতাল হবার জন্য। তা যেভাবে মাতাল হওয়া যায়।
তা বলেছ বটে ভাই! বাবু গোগিনি গলা ফাটিয়ে হাসে।
সাহানা বাবুকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে, অমন দৈত্যের মতো হাসছ কেন? এর মধ্যে মাতাল হয়ে গেলে নাকি।
সানাল খপ করে ধরে সাহানাকে, আচ্ছা, এই যে বললেন দৈত্যের মতে, দৈত্যকে কখনও হাসতে দেখেছেন?
দেখেছি দেখেছি, অডিল মুখ খোলে, লা জকোন্দাকে হাসতে দেখেছি।
হাসির রোল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যে হাসিটি এঁকে লা জকোন্দাকে জগৎবিখ্যাত করেছেন, সেটিকে এক বাক্যে দানবীয় বলে রায় দেওয়ার পর, নীলার জানতে ইচ্ছে হয়, এ কি লোক হাসাতে, নাকি অডিল আসলেই মনে করছে হাসিটি অমন? জানার ইচ্ছেটি নীলা প্রকাশ করার সুযোগ পায় না কারণ সানাল আবার লাফিয়ে এসেছে নীলার দিকে। তিন চারটে হাঁটু ডিঙিয়ে।
গেলাসে, যেখানে কমলার রস ছিল, খানিকটা ভদকা ঢেলে দুটো ঝাঁকানি দিয়ে সানাল গম্ভীর মুখে বলল, এই স্ক্রু ড্রাইভারটা লক্ষ্মী মেয়ের মতো গিলে ফেলো তো নতুন বউ, তোমার মাথার যে সব স্ক্রু ঢিলে আছে, কাল সকালের মধ্যে সব টাইট হয়ে যাবে।
আরও এক দফা হাসি। হাসলে কিষানের কোদালি দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে। আর বাবু গোগিনির সোনা হাসি, ওপরের পাটির দুটো দাঁত সোনায় বাঁধানো, দুটো ঝলকায়। তারিক ইসমাইল ঠোঁট টিপে হাসে, হাসলে মাথা থেকে পা অব্দি কাঁপে। চৈতালি হাসি চাপলেই বাঁ হাতে মুখ ঢাকে। সানাল হাসে হা হা হো হো করে। আর অডিলের হাসিতে কেবল ওপরের গোলাপি মাড়ি বেরোয়, না দাঁত না শব্দ। রাজেশের মুখ ভর্তি দাড়ি, গোঁফ নেমে এসেছে ঠোঁটের ওপর, হাসলে গাল প্রসারিত হয়, এ পর্যন্তই, দাঁত ঢাকা পড়ে যায় গোঁফের আড়ালে। সুনীল হাসে দম টেনে, বাতাস বেরোয় না, ঢোকে।
ওই দমকের মধ্যে বাবু গোগিনির শখ হয় একটি প্রশ্ন করতে সবাইকে।
প্রশ্নটি হল, কেন ফরাসি পুরুষদের মুখ এত বড়, আর হাত এত ছোট?
কেউ জানে না এর উত্তর।
বাবু গোগিনি গম্ভীর মুখে উত্তর বলল, কারণ ফরাসি মেয়েদের স্তন খুব ছোট, আর স্তনবৃন্ত খুব বড়।
অডিল আর সানাল ছাড়া আর কেউ হাসল না।
মীনাক্ষী মুখ ঘোরাল।
সাহানা উঠে গেল।
প্রশ্নে প্রশ্ন বাড়ায়, সানাল বলে, আইন কী লিঙ্গ বলুন তো?
উত্তর নেই কারও মুখে।
উত্তর বলে দেয় সানাল, স্ত্রীলিঙ্গ।
উত্তর বলে দিব্যি মুখ বুজে বসে থাকে যতক্ষণ না এর কারণ জানার কৌতূহল কারও হয়। অডিলের হয়।
আইন স্ত্রীলিঙ্গ, কারণ আইনের ফাঁক আছে।
চৈতালি জিজ্ঞেস করে, কারও কি কমলার রস টস লাগবে?
প্রসঙ্গ দ্রুত ঘোরানো হচ্ছে।
আজ তোমার ছুটি, কাল থেকে সংসারধর্মে নেমে পড়তে হবে, বুঝলে। নীলার দিকে হাসিমাখা একখানা বাণী ছুঁড়ে দেয় কিষান।
সেই বাণীতে নীলা খুব বিদ্ধ বা রক্তিম হয় না।
চৈতালি নাক গলায়, সংসার কি আর একজনের, সংসারধর্মে নামতে হলে দুজনকেই নামতে হবে।
কিষান এক চুমুকে গেলাসের তলানিটুকু গিলে বলল, আমি অবিশ্বাসী লোক। আমার দ্বারা ধর্ম টর্ম পোষাবে না।
আর আমার বুঝি পোষাবে? নীলা প্রশ্ন করে।
তোমার পোষাতেই হবে। তুমি মেয়ে।
আসরের সবাই হেসে ওঠে, বড় জব্দ করা গেছে লেখাপড়া জানা মেয়েকে।
আরে কাছে এসে বসো না, বউ হয়ে এত দূরে দূরে থাকলে চলে! ঢুলু চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে কিষান বলে।
আসরের সবাই প্রায় ঠেলে পাঠায় নীলাকে কিষানের পাশে।
কিষান গেলাসে চামচের টোকা দিয়ে সবার চোখ ওর দিকে ফিরিয়ে বলে, ভদ্রমহাশয় ভদ্রমহিলাগণ, আমার বউখানা বেশ সুন্দরী! ঠিক কি না?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সমস্বরে রব ওঠে।
নীলার পিঠে বাহ বাহ বা জাতীয় চাপড় মেরে বলে কিষান, আরে দেখতে হবে তো কার বউ!
কিষানের এমন একটা বউয়ের দরকার ছিল বড়। তারিকের মত।
এমন কেমন?
এমন লক্ষ্মী, এমন সুন্দরী। আগাগোড়া ভারতীয়। ফিরিঙ্গিদের দিয়ে কি আর পোষায়! এদের সঙ্গে প্রেম করা যায়, বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করলে ভাই ভারতীয়। তারিক বিশুদ্ধ হিন্দিতে বলে।
চৈতালি চেঁচায়, তারিক যা বলেছে, তা কি কেউ অনুগ্রহ করে অনুবাদ করে দেবেন, অডিলের জন্য?
অডিল সাহানা আর বাবুর সঙ্গে ফিসফিসে ব্যস্ত ছিল। চকিতে মুখ তোলে, কেউ কি বদনাম করছ নাকি আমার!
আরে বলছেন কী, সানাল বলে, বদনাম হবে কেন! যা বলছে সত্য বলছে, তবে সত্যটা বানিয়ে বলছে।
তারিক হেসে বলে, জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি, কিন্তু আমার বউয়ের মতো সুন্দরী আর কাউকে দেখিনি।
অডিলের গোলাপি মাড়ি অনেকক্ষণ বেরিয়ে থাকে।
.
আড্ডা, হঠাৎ কেউ লক্ষ করে না, টুকরো হয়ে যায়, এক দলে রাজেশ বাবু আর তারিক।
বুঝলে হে ভারতের অর্থনীতি আগামী দশ বছরে বিষম পালটে যাচ্ছে….
ধুর, ও গরিব, গরিবই থাকবে, দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে…
পুরো সিলিকন ভিলি চলে গেছে ভারতীয়দের হাতে। ইয়োরোপও এখন কমপিউটারদক্ষ লোক আনতে ভারতে ধর্না দিচ্ছে।
আরে টাকা ওই হাতে গোনা কিছু লোকের হাতে, বেশির ভাগ লোকই তো না খেয়ে মরছে।
না খেয়ে মরতে আমি পুরো ভারতে একটি লোককেও দেখিনি। সব পশ্চিমি প্রচার।
জনসংখ্যাই দেশটিকে মারছে।
তা কেন, জনতা হল শক্তি, একে কাজে লাগাও। ইয়োরোপের কলকারখানা বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল, অন্য দেশ থেকে শ্রমিক না এনে এদের উপায় ছিল না।
আরেক দলে কিষান আর বাবু গোগিনি মুখে ফেনা তুলছে বলে যে
কংগ্রেস গেছে। একশো বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
বিজেপির ওপরও আর ভরসা করা যাচ্ছে না। বাজপেয়ী আছে বলে বাঁচোয়া।
ডানপন্থী বামপন্থী সব দলের গোমর ফাঁস। জ্যাক শিাখ মস্ত টাকা ঘুষ নিয়েছে দলের জন্য, সে জানো?
জসপার দলে যে চোর নেই তা না।
হোসে বোভে যে হারে জনপ্রিয় হচ্ছে, নির্বাচনে দাঁড়ালে ঠিকই পাশ করে যাবে।
আরে ধুর, এ সব হুজুগ। নিজের ব্যবসার সুবিধে হলে ম্যাগডোনাল্ডস অসুবিধে নয়। দিক না ওরকম সস্তায় খাবার, প্রতিযোগিতার নাম শুনলে বাবুদের মাথায় আকাশে ভেঙে পড়ে।
এক কোণে সানাল আর সুনীল। অনর্গল ফরাসি ভাষায় বকে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ ক্রিকেট।
অডিল আর মীনাক্ষী একদিকে। মুলত ওদের বাচ্চাদের গল্প।
নীলা আর চৈতালির সঙ্গে যোগ হল সাহানা।
প্রসঙ্গ সংসার। নতুন সংসার। বাজার সদাই। কোথায় কোন দোকানে পাঁচফোড়নের মশলা পাওয়া যায়, দেশি মাছ কোন দোকানে ভাল। তারপর কী রাঁধতে গিয়ে কী দিলে স্বাদ হয় ভাল।
কিষানের দলে রাজনীতি সরিয়ে ঢুকল ব্যবসাপাতি।
মুরগিতে সালমোনেলা, পাগল গোরু রোগ!
যত্তসব প্রচার।
মাছ মাংসের ঢালাও আমদানি হচ্ছে, দেশি মাংসের চড়া দাম।
ধুত, এদেশে ভারতীয় রেস্তোরাঁ করে লাভ নেই, রেস্তোরাঁর ব্যবসা চলে ইংলন্ডে। অবাধ অনুপ্রবেশকারীগুলো দল বেঁধে ইতালি চলে যাচ্ছে, কাজ করাব কাকে দিয়ে। কিষান বলে। তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে, এক চোখ ছোট করে, বউকেই নামিয়ে দেব ব্যবসায়, ও রাঁধবে, আমি বাড়ব।
কী কেমন রাঁধো তুমি? কিষান কনুই ঠেলে নীলার পেটে।
আমি রাঁধতে জানি না। নীলা নিজের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বলল।
কিষান জোরে হেসে উঠে। বলে কী মেয়ে, মেয়ে হয়েছ, রাঁধতে জানো না?
আমার রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখো, জীবনে যে ছেলেগুলো দেশের রান্নাঘরে উঁকি অব্দি দেয়নি, তারা কী দিব্যি রাঁধছে। তোমারও হয়ে যাবে।
সুনীল ক্রিকেট প্রসঙ্গ স্থগিত রেখে বলে, এই এই এই নতুন বউকে এক্ষুনি রান্নাবান্নার কথা বলছেন, আরে যাক না কটা দিন।
.
অনেক তো প্যাঁচাল হল, চৈতালি আপনি একটা গান করুন। চৈতালির হাতে চাপ দিয়ে বলে নীলা।
গান? ওরে বাপ। গান হল বাঙালির আড্ডায়। অবাঙালিরা গানের বোঝে কী! যত্তসব বেরসিক।
চৈতালি বাংলায় বলে। অবাঙালির দল থেকে কারও তেড়ে আসার তাই লক্ষণ নেই।
রাত আটটায় এক কালো সুট নেকটাই ঢুকল। হাতে খাবারের প্যাকেট। কিষানের রেস্তোরাঁর খাবার। রুটি সবজি। কিষানলাল নিরামিষাশী। এ বাড়িতে মাছ মাংস চলে না।
টেবিলে খাবার রেখে কালোসুট নেকটাই মোজাম্মেল বউ দেখতে এল কিষানের। মুখে এক গাল হাসি। চোখ এমন যে মনে হয় কাজল পরে আছে।
দিদি, আমি কিষানবাবুর দোকানে কাজ করি। বাংলাদেশের ছেলে।
বাঙালি!
নীলার দু চোখে দু ফোঁটা আনন্দ।
চৈতালি টেবিল সাজিয়ে দেয়, কেউ বসে টেবিলে, কেউ সোফায়।
সুনীল খেতে খেতে বলে, মাছ ভাত খেতে ইচ্ছে হলে আমাদের বাড়ি চলে এসো নীলা। চৈতালি চমৎকার রান্না করে।
নীলা বলে, আমার তো এক্ষুনি লোভ হচ্ছে খেতে। রুটি সবজি একদিন খাওয়া যায়, দুদিন না।
মোজাম্মেল তার হাসি মুখে নিয়ে বলে ওঠে, কোনও চিন্তা নেই দিদি, তাজমহলে চলে আসবেন। মাছ মাংস বেশ ভাল রাঁধে আমাদের বাবুর্চি।
খাবার পরও আড্ডা গড়ায় অনেকক্ষণ। কিষান নতুন বোতল খুলেছে। বাড়িতে সিজোফ্রেনিক ছেলে রেখে এসেছে বলে তারিকদম্পতি আগে ভাগে চলে যায়। রাজেশ দম্পতিও। সুনীলদম্পতি তাদের টুম্পামণিকে সানদানিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছে, ও বাড়িতে ঘুমোবে সে। ওদের তাই তাড়া নেই ওঠার। বোতল খালি হলে সানাল ওঠে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হুকে ঝুলিয়ে রাখা গরম জ্যাকেট পরতে পরতে সানাল সবাইকে শুনিয়ে বলে, নীলাবউদি, যাবার সময় দু গালে চুমু দিতে হয় এদেশে। আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে দিচ্ছি না। আজ যত ইচ্ছে চুমু খাবার দায়িত্ব কিষানকে দিয়ে গেলাম। ওর প্রাপ্য। কী বলো কিষান।
কিষান তখনও সোফায় বসা, শার্টের বোতাম ফেটে পেট বেরিয়ে আছে। পেট না তো পেটের তেল।
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে সে। মোচের তলে কোদালি দাঁত বেরিয়ে এসেছে, পেটের তেলও সে হাসিতে আরও বেরিয়ে আসে।
সানালের প্রস্থানের পর সুনীল আর চৈতালি যাবার উদ্যোগ করে।
কী ব্যাপার সবাই চলে যাচ্ছেন! বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। থেকেই যান না আজ রাতে। চৈতালির হাতখানা নীলা ধরে রাখে নিজের শক্ত হাতের মুঠোয়।
পাগল মেয়ে। সুনীল দম টেনে হাসে।
নীলার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে হুক থেকে নামিয়ে ওর গরম কোট পরে নেয় চৈতালি।
ওরা অদৃশ্য হতেই হঠাৎ এক স্তব্ধতা বন্ধ জানালা দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে। উৎসব শুরু হয় স্তব্ধতার মাতাল নৃত্যের।
নীলা একা বোধ করে, যদিও ঘরে সে একা নয়।
নীলা একা বোধ করে, যদিও জানে ঘরে যে মানুষটি বসে আছে, সে তার পরম আত্মীয়, তার স্বামী।
.
বিছানায় ওভাবেই ওরকম গা ভর্তি অলংকার আর কাতান পরেই (দ) হয়ে শুয়ে থাকে নীলা। আর কিষান সেই দ ভেঙে(1) করে বুকের আঁচল সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম পটাপট খুলে নেয়, কাঁচুলি ঠেলে সরাতেই নীলার স্তনজোড়া লাফিয়ে ওঠে। শক্ত আঙুলে সেদ্ধ আলু ডলার মতো দুরন্ত স্তনদুটোকে ডলে নিস্তেজ করে কিষান। ফোঁস ফোঁস শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই ঘরে। কিষানের লোমশ শরীরের তলে সে নিসাড় পড়ে থাকে। নিজেকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সুখ পাও এ সবে?
নিজেকেই উত্তর দেয়, না।