১. তোরাহ
বিসিই ৫৯৭ সালে কানানের পাহাড়ী এলাকায় ক্ষুদে রাজ্য জুদাহ শক্তিশালী বাবিলোনিয় সাম্রাজ্যের শাসক নেবুচাঁদনেযারের সাথে আশ্রিত রাজ্যের চুক্তি ভঙ্গ করে। বিপর্যয়কর ভ্রান্তি ছিল এটা। তিন মাস পরে বাবিলোনিয় সেনাবাহিনী জুদাহর রাজধানী জেরুজালেম অবরোধ করে। সাথে সাথে আত্মসমর্পণ করেন তরুণ রাজা। রাষ্ট্রকে প্রাণবন্ত করে তোলা প্রায় দশ হাজার নাগিরকসহ বাবিলনে দেশান্তরে পাঠানো হয় তাঁকে। এরা ছিল পুরোহিত, সামরিক নেতা, কারিগর ও কামার। জেরুজালেম ছেড়ে যাবার সময় নির্বাসিতরা নিশ্চয়ই রাজা সলোমনের (c.৯৭০-৯৩০ বিসিই) আমলে যায়ন পর্বতে নির্মিত জাতীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের মূল কেন্দ্র মন্দিরের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে বিষণ্নতার সাথেই বুঝতে পেরেছিল জীবনে আর কোনও দিন এর দেখা মিলবে না। ৫৮৬ সালে তাদের এই ভীতি বাস্তব হয়ে ওঠে। জুদাহয় আরও এক দফা বিদ্রোহের পর নেবুচাঁদনেযার জেরুজালেম ধ্বংস করে দেন; সেই সাথে সলোমনের মন্দিরও পুড়িয়ে ভস্মে পরিণত করা হয়।
বাবিলনে নির্বাসিতদের সাথে রূঢ় আচরণ করা হয়নি। রাজাকে আরাম- দায়কভাবে সফরসঙ্গীসহ দক্ষিণের দুর্গে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, বাকিরা একসাথে খালের পাড়ে নতুন বসতিতে বাস করতে থাকে। অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হলেও স্বদেশ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ধর্ম হারিয়েছিল তারা। ওরা ছিল ইসরায়েল জাতির অংশ, ওরা বিশ্বাস করত ঈশ্বর ইয়াহওয়েহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চিরকালের মতো মাতৃভূমিতে বাস করতে পারবে। জেরুজালেম মন্দির, যেখানে ইয়াহওয়েহ তাঁর জাতির সাথে বাস করতেন, এই কাল্টের পক্ষে অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু এখানে ইয়াহওয়েহর উপস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন এক অজানা অচেনা দেশে এসে পড়েছিল ওরা। এটা নিশ্চয়ই স্বর্গীয় শাস্তি হয়ে থাকবে। সময়ে সময়ে ইসরায়েলিরা ইয়াহওয়েহ সাথে কোভেন্যান্ট চুক্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, অন্য দেবতাদের প্রতি প্রলুব্ধ হয়েছে। নির্বাসিতদের কেউ কেউ ধরে নিয়েছিল যে, ইসরায়েলের নেতা হিসাবে এমনি পরিস্থিতির সংশোধনের দায়িত্ব তাদেরই। কিন্তু কেমন করে মন্দির ছাড়া ইয়াহওয়েহর উপাসনা করবে, যেটা ছিল তাদের ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র উপায়?
বাবিলনে আসার পাঁচ বছর পরে চেবার খালের পাশে দাঁড়িয়ে ইযেকিয়েল নামে এক তরুণ পুরোহিত এক ভীতিকর দিব্যদর্শনের মুখোমুখি হলেন। কোনও কিছুই পরিষ্কারভাবে দেখা সম্ভব ছিল না, কারণ ওই আগুনের ঝড়ো ঘূর্ণী হাওয়া আর কান ফাটানো আওয়াজে কোনও কিছুই সাধারণ মানুষের পরিচিত পরিবেশের সাথে খাপ খাচ্ছিল না। কিন্তু ইযেকিয়েল জানতেন এটা ছিল ইয়াহওয়েহর প্রতাপ, কাভোদের উপস্থিতি, সাধারণত যেটা মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে আসীন ছিল।[১] ঈশ্বর জেরুজালেম ত্যাগ করেছেন, এখন এক বিশাল যুদ্ধ রথের মতো কিছু একটায় সওয়ার হয়ে বাবিলনে নির্বাসিতদের সাথে বাস করতে এসেছেন। স্ক্রোল ধরা একটা হাত এগিয়ে এলো ইযেকিয়েলের দিকে, ‘লেখা আর বিলাপ, খোদোক্তি ও সন্তাপের কথা’ তাতে লেখা ছিল। ‘এই পুস্তকখানি ভোজন করো,’ তাঁকে নির্দেশ দিলেন এক স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর। ‘আমি তোমাকে যে পুস্তক দিলাম উহা জঠরে গ্রহণ করিয়া উদর পরিপূর্ণ কর। তিনি যখন নির্বাসনের যন্ত্রণা ও ভোগান্তি মেনে নিয়ে সেটা অনেক কষ্টে গিললেন, ইযেকিয়েল লক্ষ করলেন, তা ‘মধুর ন্যায় মিষ্টি লাগিল।’[২]
এক ভবিষ্যৎদর্শন সুলভ মুহূর্ত ছিল এটা। নির্বাসিতরা হারানো মন্দিরের আকাঙ্ক্ষা করে যাবে, কারণ এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে মন্দির ছাড়া ধর্মের কল্পনা করা ছিল অসম্ভব।[৩] তবে এমন একটা সময় আসবে যখন ইসরায়েলিরা মন্দিরের বদলে বরং পবিত্র লিপি দিয়ে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। তাদের পবিত্রগ্রন্থ উপলব্ধি করা খুব একটা সহজ হবে না। ইযেকিয়েলের ক্রোলের মতো এর বাণী প্রায়শই হতাশাজনক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে। কিন্তু তবু তারা যখন এই বিভ্রান্তিকর টেক্সট উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছে, অন্তরের অন্তস্তলের অংশে পরিণত করতে চেয়েছে, তারা অনুভব করতে পেরেছে যে ঈশ্বরের সত্তার কাছে পৌঁছে গেছে-ঠিক জেরুজালেমের মন্দিরে গেলে যেমন মনে হতো।
তবে ইয়াহওয়েহবাদের ঐশীগ্রন্থের ধর্মে পরিণত হতে বহু বছর লাগবে। নির্বাসিতরা জেরুজালেমের আর্কাইভস থেকে বেশ কিছু স্ক্রোল বাবিলনে নিয়ে এসেছিল। এখানে তারা এইসব দলিল পাঠ করেছে, সম্পাদনা করেছে। ওদের দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হলে জনগণের ইতিহাস ও কাল্টের এইসব দলিল জাতীয় জীবন পুনঃস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু লিপিকারগণ এইসব রচনাকে খুব পবিত্র মনে করেননি। স্বাধীনভাবে নিত্য নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করে গেছেন তাঁরা, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তখনও পর্যন্ত তাদের পবিত্র টেক্সট সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। এটা ঠিক যে, মধ্যপ্রাচ্যে আকাশ থেকে নেমে আসা স্বর্গীয় পাথরের ফলকের অনেক গল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল যা অলৌকিকভাবে পৃথিবীতে গোপন স্বর্গীয় জ্ঞান নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলে মোজেসকে ইয়াহওয়েহর দেওয়া পাথরের ফলকের গল্পও চালু ছিল: মোজেসের সাথে মুখোমুখি কথা বলেছেন তিনি।[৪] কিন্তু জুদাহর আর্কাইভসের স্ক্রোলগুলো এই পর্যায়ের ছিল না। ইসরায়েলের কাল্টে তা কোনও ভূমিকা রাখেনি।
প্রাচীন বিশ্বের অধিকাংশ জাতির মতো ইসরায়েলিরা সব সময়ই মৌখিক ভাষ্যে তাদের ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে। তাদের জাতির প্রাথমিক কালে আনুমানিক ১২০০ বিসিই-তে কানানীয় পাহাড়ী এলাকার বারটি জাতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করত তারা, কিন্তু এও বিশ্বাস করত যে তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ ও একক ইতিহাস ছিল, এটা তারা গোত্রপিতা বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্দিরে পালন করত। স্বভাবকবিগণ পবিত্র অতীতের মহাকাব্যিক কাহিনী আবৃত্তি করত, আর সাধারণ জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অ্যাম ইয়াহওয়েহ বা ‘ইয়াহওয়েহর পরিবার’ হিসাবে একসূত্রে গ্রন্থিতকারী কোভেন্যান্ট চুক্তির নবায়ন করত। ঠিক এই পর্যায়ে, ইতিমধ্যে, ইসরায়েলের একটা স্পষ্ট ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই আদিম কালের দেবতাদের বিশ্বের সম্পর্কিত একটা মিথলজি ও লিটার্জি গড়ে তুলেছিল, কিন্তু ইসরায়েলিরা এই পৃথিবীতেই ইয়াহওয়েহর সাথে তাদের জীবনের প্রতি বেশি নজর দিয়েছিল। একেবারে শুরু থেকে কাজ ও কারণের ভাষায় ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা করত ওরা।
পরবর্তীকালের বাইবেলিয় বর্ণনায় প্রোথিত পূর্ববর্তীকালের বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অংশ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, ইসরায়েলিরা তাদের পূর্বপুরুষদের যাযাবর মনে করত। ইয়াহওয়েহ পথ দেখিয়ে তাদের কানানে নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, একদিন তাদের উত্তরাধিকারীরা এই ভুমির মালিকানা লাভ করবে। বহু বছর মিশরিয় শাসনের অধীনে দাস হিসাবে দিন কাটিয়েছে তারা, কিন্তু মহান নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনার ভেতর দিয়ে তাদের জয় করে নিয়েছেন ইয়াহওয়েহ, মোজেসের নেতৃত্বে তাদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে নিয়ে এসেছেন, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে পাহাড়ী এলাকা দখল করে নিতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত মূল কোনও বিবরণ ছিল নাঃ প্রতিটি গোষ্ঠীর কাহিনীর নিজস্ব ভাষ্য ছিল, প্রত্যেক অঞ্চলের ছিল নিজস্ব নায়ক। উদাহরণস্বরূপ, একেবারে উত্তরের দান রাজ্যের পুরোহিতগণ বিশ্বাস করতেন যে তারা মোজেসের উত্তরপুরুষ। গোটা জাতির পিতা আব্রাহাম হেবরনে বাস করতেন, দক্ষিণে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। গিলগালে স্থানীয় গোত্র প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইসরায়েলের অলৌকিক প্রবেশের ঘটনার উদযাপন করত; এই সময় জর্দান নদীর পানি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ওদের পথ করে দিয়েছিল। শেচেমের জনগণ বার্ষিক ভিত্তিতে কানানের বিজয়ের পর ইয়াহওয়ের সাথে জোশুয়ার সম্পাদিত কোভেন্যান্টের নবায়ন করত।[৬]
১,০০০ বিসিই সাল নাগাদ গোত্রীয় ব্যবস্থা আর কাজে আসছিল না, তো ইসরায়েলিরা কানানিয় পাহাড়ী এলাকায় দুটো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে: দক্ষিণে জুদাহ রাজ্য এবং উত্তরে অপেক্ষাকৃত বড় ও আরও সমৃদ্ধ ইসরায়েল রাজ্য। রাজার ব্যক্তিত্বের প্রতি কেন্দ্রিভূত জাতীয় মন্দিরে রাজকীয় বার্ষিক অনুষ্ঠানের কাছে ক্ৰমে কোভেন্যান্ট উৎসব হারিয়ে যায়। অভিষেকের এই দিনে রাজাকে দত্তক নিয়েছিলেন ইয়াহওয়েহ, তিনি ‘ঈশ্বর পুত্র’ ও ইয়াহওয়েহর স্বর্গীয় সত্তার পরিবারের স্বর্গীয় সভার সদস্যে পরিণত হন। উত্তরের রাজ্যের কাল্ট সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না, কারণ বাইবেলিয় রচয়িতাদের ভেতর জুদাহর প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছিল, তবে বাইবেলে ব্যবহৃত বহু শ্লোক জেরুজালেম লিটার্জিতে[৭] ব্যবহার করা হয়েছে, এগুলো দেখিয়েছে যে, জুদাহবাসীরা প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার বা’লের কাল্টে প্রভাবিত ছিল, একই ধরনের রাজকীয় মিথলজি ছিল এদের।[৮] ইয়াহওয়েহ জুদাহইয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার সাথে নিঃশর্ত চুক্তি করেছিলেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর উত্তরাধিকারীরা চিরকালের জন্যে জেরুজালেম শাসন করবে।
এখন সেইসব প্রাচীন কাহিনী কাল্ট থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এক স্বাধীন সাহিত্যিক জীবন অর্জন করেছিল সেগুলো। অষ্টম শতাব্দীতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার পুব প্রান্তে এক সাহিত্যিক বিপ্লবের সূচনা ঘটে।[৯] রাজাগণ তাঁদের শাসনকালকে মহিমান্বিত করে বিভিন্ন দলিল প্রকাশ করেন ও সেগুলোকে লাইব্রেরিতে রাখার ব্যবস্থা নেন। এই সময়ে গ্রিসে হোমারের মহাকাব্য লিপিবদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ইসরায়েল ও জুদাহয় ইতিহাসবিদগণ জাতীয় বীরগাথা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাচীন গল্পকাহিনীসমূহকে সংকলিত করা শুরু করেন। বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ পেন্টাটিউকের একেবারে আদি স্তবকে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে।[১০]
ইসরায়েল ও জুদাহর বহুমুখী ট্র্যাডিশন থেকে অষ্টম শতাব্দীর ইতিহাসবিদগণ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবরণ গড়ে তুলেছেন। পণ্ডিতগণ সাধারণত জুদাহর দক্ষিণী মহাকাব্যকে ‘J’ নামে অভিহিত করে থাকেন, কারণ রচয়িতাগণ সব সময়ই তাদের ঈশ্বরকে ‘ইয়াহওয়েহ’ আখ্যায়িত করেছেন; অন্যদিকে উত্তরের কাহিনী ‘E’ নামে পরিচিত, কারণ এই ইতিহাসবিদগণ অধিকতর আনুষ্ঠানিক পদবী ‘ইলোহিম’ বেশি পছন্দ করতেন। পরে একটি মাত্র কাহিনী নির্মাণের লক্ষ্যে এদুটি ভিন্ন বিবরণকে জনৈক সম্পাদক কর্তৃক সমন্বিত করা হয়েছিল। এটাই হিব্রু বাইবেলের মূল কাঠামো নির্মাণ করেছে। বিসিই অষ্টম শতাব্দীতে ইয়াহওয়েহ আব্রাহামকে মোসোপটেমিয়ার নিজ শহর উর ছেড়ে কানানিয় পাহাড়ী এলাকায় বসতি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; এখানে তিনি তাঁর সাথে এই কোভেন্যান্টে উপনীত হয়েছিলেন যে, তাঁর উত্তরপুরুষরা চিরকালের জন্যে গোটা দেশ লাভ করবে। আব্রাহাম হেবরনে বাস করতেন। তাঁর ছেলে ইসাক থাকতেন বীরশেবায় আর পৌত্র জ্যাকব (‘ইসরায়েল’ নামেও আখ্যায়িত) শেষ পর্যন্ত শেচেমের আশপাশের এলাকায় বসতি করেন।
দুর্ভিক্ষের সময় জ্যাকব ও বারটি ইসরায়েলি গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর ছেলেরা মিশরে পাড়ি জমান, এখানে প্রাথমিকভাবে বিকাশ লাভ করেন তারা, কিন্তু সংখ্যায় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে উঠলে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি ও নির্যাতিত হতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত বিসিই ১২৫০ সালের দিকে ইয়াহওয়েহ মোজেসের নেতৃত্বে তাদের মুক্ত করেন। ওরা পালানোর সময় ইয়াহওয়েহ সী অভ রীডসের পানি দ্বিখণ্ডিত করে, যাতে ইসরায়েলিরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হয়, কিন্তু ফারাও ও তাঁর বাহিনী ডুবে মারা যান। চল্লিশ বছর ধরে ইসরায়েলিরা কানানের দক্ষিণ অংশে সিনাইয়ের বুনো এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সিনাই পর্বতে ইয়াহওয়েহ ইসরায়েলের সাথে এক ভাবগম্ভীর কোভেন্যান্ট করেছিলেন এবং তাদের আইন দিয়েছিলেন, যেখানে ইয়াহওয়েহর নিজ হাতে খোদাই করা দশ নির্দেশনা সংকলিত পাথরের ফলকও ছিল। অবশেষে মোজেসের উত্তসুরি জোশুয়া গোত্রটিকে জর্দান নদী পার করে কানানে নিয়ে আসেন; এখানে সমস্ত কানানিয় শহর ও গ্রাম ধ্বংস করে, স্থানীয় জনগণকে হত্যা করে দেশটিকে আপন করে নেয় তারা।
অবশ্য ১৯৬৭ সাল থেকে এই অঞ্চলে খননকার্য পরিচালনারত ইসরায়েলি প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এই কাহিনীর সত্যতা প্রতিপাদন করার মতো কোনও প্রমাণ পাননি। বিদেশী আগ্রাসন বা গণহত্যার কোনও নজীর মেলেনি, জনসংখ্যার ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী কিছুও মেলেনি। পণ্ডিতমহল একমত যে, এক্সোডাসের কাহিনী ঐতিহাসিক নয়। অসংখ্য তত্ত্ব রয়েছে। বিসিই নবম শতাব্দী থেকে মিশরিয়রা কানানিয় শহর শাসন করেছে; সাবেক জনবসতিহীন পাহাড়ী এলাকায় প্রথম মানুষের বসতি গড়ে ওঠার সাথে সাথে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা প্রত্যাহার করে চলে যায়। ১২০০ বিসিইর দিকে আমরা প্রথম এই অঞ্চলে ‘ইসরায়েল” নামে এক জাতির অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। কোনও কোনও পণ্ডিত যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ইসরায়েলিরা আসলে উপকূলীয় এলাকার ব্যর্থ নগর-রাষ্ট্রসমূহের বাসিন্দা ছিল। সম্ভবত দক্ষিণের অন্যান্য জাতি এসে তাদের সাথে যোগ দিয়ে থাকতে পারে, তাদের ঈশ্বর ইয়াহওয়েহকে সাথে নিয়ে এসেছিল তারা, সিনাইয়ের আশপাশের দক্ষিণ এলাকায় যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মনে হয়।[১১] কানানীয় শহরে মিশরিয় শাসনাধীনে বাসকারীরা হয়তো মনে করে থাকবে যে তারা সত্যিই মিশর থকে মুক্তি পেয়েছিল-কিন্তু সেটা তাদের নিজেদের দেশেই।[১২]
‘J’ ও ‘E’ কোনও আধুনিক ঐতিহাসিক বিবরণ ছিল না। হোমার ও হেরোদোতাসের মতো লেখকগণ কী ঘটেছে তার অর্থ ব্যাখ্যা করার প্রয়াসে স্বর্গীয় চরিত্রদের সম্পর্কে কিংবদন্তী ও পৌরাণিক উপাদান যোগ করেছেন। প্রথম থেকেই বাইবেলে পরিণত হতে চলা বিবরণে কোনও একক কৃর্তত্বপূর্ণ বাণী ছিল না। ‘J’ ও ‘E’ রচয়িতাগণ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ইসরায়েলের কাহিনীর ব্যাখ্যা করেছেন; পরবর্তীকালের সম্পাদকগণ এইসব অসামঞ্জস্যতা ও পরস্পরবিরোধিতা দূর করার কোনও চেষ্টা করেননি। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসবিদগণ স্বাধীনভাবে ‘J’ ‘E’ বিবরণে নতুন বিষয় যোগ করবেন ও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করবেন।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘J’ ও ‘E’ উভয় বিবরণে ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। ‘J’ মানুষরূপী ইমেজারি ব্যবহার করেছেন, পরে যা ব্যাখ্যাকারীদের বিব্রত করবে। কোনও মধ্যপ্রাচ্যীয় ভূস্বামীর মতো স্বর্গউদ্যানে ঘুরে বেড়ান ইয়াহওয়েহ, নোয়াহর আর্কের দরজা বন্ধ করে দেন, ক্ষুব্ধ হন, বারবার মত পাল্টান। কিন্তু ‘E’ বিবরণে ইলোহিমের আরও গভীরতর দুর্ভেয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যিনি এমনকি তেমন ‘কথা’ই বলেন না, বরং বার্তাবাহক হিসাবে একজন দেবদূত পাঠাতেই বেশি পছন্দ করেন। পরে ইসরায়েলি ধর্ম ইয়াহিওয়েহকে একমাত্র ঈশ্বর ধরে নিয়ে প্রবলভাবে একেশ্বরবাদী হয়ে উঠবে কিন্তু’J’ বা ‘E’ এদের কেউই এটা বিশ্বাস করতেন না। আদিতে ইয়াহওয়েহ ‘পবিত্রজনদের’ স্বর্গীয় সভার একজন সদস্য ছিলেন, কানানের পরম ঈশ্বর এল সঙ্গী আশেরাহকে নিয়ে সেই সভার অধিপতি ছিলেন। এলাকার প্রতিটি জাতির পৃষ্ঠপোষক উপাস্য ছিলেন তিনি। ইয়াহওয়েহ ছিলেন ‘ইসরায়েলের পবিত্র জন’[১৩]। অষ্টম শতাব্দী নাগাদ ইয়াহওয়েহ এল ও স্বর্গীয় সভাকে[১৪] উৎখাত করেন” এবং ‘পবিত্রজনদের’ সমাবেশে শাসন পরিচালনা করেন। এরা ছিলেন তাঁর ‘স্বর্গীয় বাহিনীর যোদ্ধা।’[১৫] জাতির আনুগত্যের দিক থেকে অন্য কোনও দেবতাই আর ইয়াহওয়েহর সাথে তাল মেলাতে পারেননি। এখানে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, ছিল না কোনও প্রতিপক্ষ।[১৬] কিন্তু বাইলে দেখায় যে ৫৯৬ সালে নেবুচাঁদনেযারের হাতে মন্দির ধ্বংসের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসরায়েলিরা অন্য দেবতাদেরও এক সমাবেশের উপাসনা করত।[১৭]
মোজেস নন, দক্ষিণের মানুষ আব্রাহাম ছিলেন ‘J’র ইতিহাসের নায়ক। তাঁর জীবনকাল ও ঈশ্বর তাঁর সাথে যে কোভেন্যান্ট করেছিলেন তা রাজা ডেভিডের মুখাপেক্ষী।[১৮] কিন্তু ‘E’ আবার জ্যাকবের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, শেচেমে কবর দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ‘E’ আদিম ইতিহাসের কিছুই যোগ করেননি-বিশ্বসৃষ্টি, কেইন ও আবেল, প্লাবন ও টাওয়ার অভ বাবেলের বিদ্রোহ-’J’ র কাছে এসব দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘E’-র নায়ক ছিলেন মোজেস, দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে তাঁকে বেশি সম্মান করা হতো।[১৯] কিন্তু’J’ বা ‘E’ কেউই সিনাই পর্বতে মোজেসকে দেওয়া ইয়াহওয়েহর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেননি, পরে যা কিনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই সময় পর্যন্ত টেন কমান্ডমেন্টসের কোনও উল্লেখ ছিল না। প্রায় নিশ্চিতভাবেই অন্যান্য নিকটপ্রাচ্যের কিংবদন্তীর মতো মোজেসকে দেওয়া স্বর্গীয় ফলক আদিতে কিছু নিগূঢ় কাল্টিক উপকথা বহন করেছে।[২০] ’J’ ও ‘E’ র পক্ষে সিনাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ মোজেস 9 এল্ডাররা পাহাড়চূড়ায় ইয়াহওয়েহর দর্শন পেয়েছিলেন।[২১]
অষ্টম শতাব্দী নাগাদ পয়গম্বরদের একটা ছোট দল কেবল ইয়াহওয়েহরই উপাসনা করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পান। তবে এই পদক্ষেপ জনপ্রিয়তা পায়নি। যোদ্ধা হিসাবে ইয়াহওয়েহ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, তো ভালো ফসল চাইলেই ইসরায়েল ও জুদাহর জনগণের পক্ষে স্থানীয় উর্বরতার দেবতা বা’ল ও তাঁর বোন-স্ত্রী আনাতের শরণাপন্ন হওয়াই ছিল স্বাভাবিক, তারা জমিনকে উর্বর করে তোলার জন্যে স্বাভাবিক আচার পালন করত। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তরের রাজ্যের এক পয়গম্বর হোসিয়া এই রীতির বিরুদ্ধে তিক্ত ভাষায় প্রতিবাদ জানান। তাঁর স্ত্রী গোমার বা’লের পবিত্র বারবণিতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন, স্ত্রীর অবিশ্বস্ততার যে বেদনা তাকে তিনি ইয়াহওয়েহর জাতির তাঁকে ছেড়ে অন্য দেবতাদের বেশ্যাবৃত্তি করে বেড়ানোর সময় ইয়াহওয়েহ মনোভাবের মতো ভেবেছিলেন। ইসরায়েলিদের অবশ্যই ইয়াহওয়েহর কাছে ফিরে যেতে হবে, তিনিই তাদের সমস্ত চাহিদা মেটাতে পারেন। মন্দিরের আচার দিয়ে তাঁকে খুশি করার কোনও অর্থ নেই। ইয়াহওয়েহ চান কাল্টিক আনুগত্য (হেসেদ), পশু উৎসর্গ নয়।[২২] তারা ইয়াহওয়েহর প্রতি অবিশ্বস্ত থাকলে ইসরায়েল শক্তিশালী অসিরিয় সম্রাটের হাতে ধ্বংস হয়ে যাবে, ওদের শহরগুলোকে বিরান করে ফেলা হবে, নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে শিশুদের।[২৩]
মধ্যপ্রাচ্যে অসিরিয়রা নজীরবিহীন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বিদ্রোহী করদ রাজ্যগুলোয় ধ্বংসলীলা চালাত তারা, জনগণকে দেশান্তরী করত। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলে প্রচারণা চালানো পয়গম্বর আমোস যুক্তি দেখান যে, ইয়াহওয়েহ ইসরায়েলকে এর পদ্ধতিগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে পবিত্র যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন।[২৪] হোসিয়া ব্যাপক সম্মানিত বা’লের কাল্টের সমালোচনায় মুখর ছিলেন যেমন তেমনি আমোস ইয়াহওয়েহর প্রচলিত কাল্টকে উল্টে দিয়েছিলেন: তিনি আর আপনাআপনি ইসরায়েলের পক্ষে আসছেন না। আমোস উত্তরের রাজ্যের মন্দির আচারেরও ভর্ৎসনা করলেন। ইয়াহওয়েহ শোরগোলময় ভজন আর নিবেদনের বীণা বাদনে ক্লান্ত; এর বদলে তিনি চান “বিচার জলবৎ প্রবাহিত হউক, ধার্ম্মিকতা চিরপ্রবহমান স্রোতের ন্যায় বহুক।[২৫] এই প্রাথমিক যুগ থেকে বাইবেলিয় রচনাসমূহ চলমান অর্থডক্সিকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী ও প্রতিমাবিরোধী হয়ে ওঠে।
জেরুজালেমের ইসায়াহ ছিলেন আরও প্রচল ধারার, কিন্তু তাঁর অরাকলস ডেভিডের বংশের রাজকীয় আদর্শের সাথে মিলে যায়। ৭৪০ সালের দিকে মন্দিরে পয়গম্বরত্ব লাভ করেন তিনি। এখানে তিনি স্বর্গীয় সত্তার স্বর্গীয় সভা পরিবেষ্টিত অবস্থায় ইয়াহওয়েহকে দেখতে পান ও চেরুবিমদের কণ্ঠে ‘পবিত্র [কাদ্দোশ], পবিত্র, পবিত্র![২৬] চিৎকার শুনতে পান। ইয়াহওয়েহ ‘ভিন্ন’, ‘আলাদা’; এবং ভীষণভাবে দুর্ভেয়। ইয়াহওয়েহ ইসায়াহকে দুঃসংবাদ জানান: প্রত্যন্ত অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে, অধিবাসীরা যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে।[২৭] কিন্তু অসিরিয়াকে ভয় পাননি ইসায়াহ। তিনি পৃথিবীকে ইয়াহওয়েহর প্রতাপে ভরে উঠতে দেখেছেন[২৮], তিনি যতদিন যায়ন পর্বতে নিজ মন্দিরে আসীন আছেন ততদিন জুদাহ নিরাপদ, কারণ স্বর্গীয় যোদ্ধা ইয়াহওয়েহ ফের মাঠে নেমেছেন, তাঁর জনগণের পক্ষে যুদ্ধ করছেন।[২৯]
কিন্তু উত্তরের রাজ্যটি এমন কোনও সুবিধা লাভ করেনি। ৭৩২ সালে পশ্চিম থেকে অগ্রসরমান অসিরিয় বাহিনীকে ঠেকাতে ইসরায়েল স্থানীয় এক কনফেডারেটে যোগ দিলে অসিরিয় রাজা তৃতীয় তিলগেত পিলসার ইসরায়েলের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেন। দশ বছর পরে ৭২২ সালে আরেক দফা বিদ্রোহের পর অসিরিয় সেনাবাহিনী ইসরায়েলের অনন্য সাধারণ রাজধানী সুমেরিয়া ধ্বংস করে দেয়, শাসক শ্রেণীকে দেশান্তরে পাঠায়। অসিরিয় করদ রাজ্যে পরিণত হওয়া জুদাহ রাজ্য নিরাপদ থাকে, শরণার্থীরা উত্তর থেকে জেরুজালেমে আসতে থাকে, সম্ভবত সাথে করে নিয়ে আসছিল ‘E’ র কাহিনী ও হোসিয়া ও আমোসের নথিবদ্ধ অরাকলস, এই ট্র্যাজিডি আগেই দেখতে পেয়েছিলেন তাঁরা। জুদাহ রাজকীয় আর্কাইভসে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এসব, এখানে কিছু কাল পরে লিপিকারগণ ‘ইলোহিয়’ ট্র্যাডিশনকে ‘J’র দক্ষিণাঞ্চলীয় মহাকাব্যের সাথে সমন্বয় ঘটান।[৩০]
এই অন্ধকার বছরগুলোতে ইসায়াহ রাজকীয় সন্তানের আসন্ন জন্মের মুখোমুখি হয়েছিলেন– ঈশ্বর এখনও ডেভিডের বংশের সাথে থাকার নিদর্শন। ‘এক কন্যা (বা কুমারী) [আলমাহ] গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে এবং তাঁহার নাম ইম্যানুয়েল [আমাদের সহিত ঈশ্বর] রাখিবে।[৩১] তার জন্ম এমনকি এক নতুন আশার জন্ম বোঝাবে, উত্তরের হতচকিত জনগণের প্রতি ‘এক মহা আলোক’, যারা ‘মৃত্যুচ্ছায়ার দেশে বাস করিত,’ ও ‘অন্ধকারে ভ্রমণ করিত।’[৩২] শিশুটির জন্ম হওয়ার পর নাম আসলে রাখা হয়েছিল হেযেকিয়াহ। ইসায়াহ কল্পনা করলেন পুরো স্বর্গীয় সভাই এই রাজপুত্রের জন্ম উপলক্ষ্যে উৎসবে মেতে উঠেছে, অন্য ডেভিডিয় রাজার মতো এই শিশুটিও স্বর্গীয় চরিত্র ও অভিষেকের দিন স্বর্গীয় সভার সদস্যে পরিণত হবে, তখন তাঁকে ‘আশ্চৰ্য্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ’[৩৩] বলে ডাকা হবে।
বাইবেলিয় ইতিহাসবিদগণ বিদেশী দেবতাদের উপসনা নিষিদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন বলে হেযেকিয়াহকে ধর্মপ্রাণ রাজা হিসাবে শ্রদ্ধা করলেও তার বিদেশ নীতি ছিল বিপর্যয়কর। ৭০১ সালে ভ্রান্ত পরামর্শে চালিত হয়ে অসিরিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত এক বিদ্রোহের পর জেরুজালেম প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আশপাশের এলাকা নিষ্ঠুরভাবে বিরান করে ফেলা হয়; একটা ক্ষুদে অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয় জুদাহ। কিন্তু অসিরিয়ার প্রতিনিধিতে পরিণত হওয়া রাজা মানাশেহ (বিসিই ৬৮৭-৪২)-এর অধীনে জুদাহর ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটে। সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত হওয়ার প্রয়াসে তিনি তাঁর বাবার ধর্মীয় এখতিয়ারে বদল ঘটান, বা’লের উদ্দেশে বেদী স্থাপন করেন, জেরুজালেম মন্দিরে আশেরাহ ও সূর্যের স্বর্গীয় অশ্বের প্রতিমা স্থাপন করেন এবং শহরের বাইরে শিশু-বলীকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।[৩৪] জুদাহর সমৃদ্ধি সত্ত্বেও অসিরিয় আগ্রাসনের ধাক্কা অনুভবকারী গ্রামাঞ্চলে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। মানাশেহর পরলোকগমনের পর এক প্রাসাদ অভ্যুত্থানে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অসন্তোষ বিষ্ফেরিত হয়, ফলে মানাশেহর ছেলে আমোর উৎখাত হন ও তাঁর জায়গায় আট বছরের ছেলে জোসিয়াহকে সিংহাসনে বসানো হয়।
ততদিনে অসিরিয়া পতনের পথে পা বাড়িয়েছে। উত্থান ঘটছিল মিশরের। ৬৫৬ সালে ফারাও অসিরিয় বাহিনীকে লাভান্তে থেকে প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। জুদাহবাসীরা সবিস্ময়ে সাবেক ইসরায়েল রাজ্য থেকে অসিরিয়দের বিদায় প্রত্যক্ষ করে। পরাশক্তিসমূহ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে যুদ্ধ করার সময় জুদাহ পড়ে থাকে নিজ সম্পদে পরিচালিত হওয়ার জন্যে। জাতীয়তাবোধের এক জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ৬২২ সালে ইসায়াহ জুদাহর স্বর্ণযুগের প্রতীকী সৌধ সলোমনের মন্দিরের মেরামত কাজ শুরু করেন। এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন প্রধান পুরোহিত হিলকিয়াহ, রাজকীয় লিপিকার শাপানের কাছে দ্রুত ছুটে যান এখবর নিয়ে। সিনাই পর্বতে মোজসের হাতে তুলে দেওয়া ইয়াহওয়েহর ‘আইনের স্ক্রোল’ (সেফার তোরাহ) আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।[৩৬]
পুরোনো কাহিনীসমূহে ইয়াহওয়েহর শিক্ষার (তোরাহ) লিখিত রূপ দেওয়ার কোনও উল্লেখ ছিল না। ‘J’ ‘E’ বিবরণে মোজেস মুখে মুখে ইয়াহওয়েহর বাণী প্রচার করেছিলেন, সাধারণ মানুষও মৌখিকভাবেই সাড়া দিয়েছিল।[৩৭] সপ্তম শতাব্দীর সংস্কারকগণ অবশ্য ‘J’ ‘E’ গাথার সাথে নতুন পঙক্তি যোগ করেছিলেন, যা থেকে ব্যাখ্যা মেলে যে মোজেস ‘ইয়াহওয়েহর সমস্ত নির্দেশনার লিপিবদ্ধ রূপ দিয়েছেন’ ও মানুষের উদ্দেশে সেফার তোরাহ পাঠ করেছেন।[৩৮]
হিলকিয়াহ ও শাপান দাবি করেন, এই স্ক্রোল খোয়া গিয়েছিল; এর শিক্ষা কখনওই বাস্তবায়িত হয়নি; এর এমনি অলৌকিক আবিষ্কার বোঝায় যে জুদাহ নতুন করে আবার শুরু করতে পারে। হিলকিয়াহর দলিল সম্ভবত দ্বিতীয় বিবরণীর আদি ভাষ্য ধারণ করে থাকবে, যেখানে মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে মোজেসের ‘দ্বিতীয় বিবরণী’ (ডিউটেরোনমি; গ্রিক দিউতেরিয়ন) প্রদান করছেন বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু আসলে প্রাচীন লিপি হওয়ার বদলে ডিউটেরোনমি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ঐশীগ্রন্থ। অতীতের কোনও মহান ব্যক্তিত্বের উপর সম্পূর্ণ নতুন কোনও ধারণা চাপিয়ে দেওয়াটা সংস্কারকদের পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। ডিউটেরোনিমস্টরা বিশ্বাস করতেন, এক ক্রান্তিকালে মোজেসের হয়ে কথা বলছেন তাঁরা। অন্য কথায় এটা ছিল আজকের দিনে মোজেস ‘দ্বিতীয় ব্যবস্থা’ প্রচলন করলে জেসিয়াহকে তিনি কী বলতেন তারই বর্ণনা।
স্রেফ স্থিতাবস্থা লিপিবদ্ধ করার বদলে প্রথমবারের মতো কোনও ইসরায়েলি টেক্সট ব্যাপক পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছিল। উচ্চস্বরে স্ক্রোল পাঠ করার পর জেসিয়াহ হতাশায় পরনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন, সাথে সাথে এমন এক কর্মসূচি হাতে নেন যা ইয়াহওয়েহর নুতন তোরাহ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। তিনি মানাশেহর মন্দিরের যত অসম্মান ছিল সব পুড়িয়ে ফেলেন, জুদাহবাসীরা যেহেতু সব সময়ই উত্তরের রাজ্যের রাজকীয় মন্দিরকে অবৈধ ভেবে এসেছে, তিনি বেথেল ও সামারিয়ার মন্দির ধ্বংস করেন, সেগুলোর বেদীকে দূষিত করেন।[৩৯]
এটা দর্শনীয় যে ঐশীগ্রন্থের অর্থডক্সির ধারণার অগ্রদূত ডিউটেরোনো- মিস্টরাই বিস্ময়করভাবে নতুন বিধান যোগ করেছিলেন, যা- বাস্তবায়িত হলে-ইসরায়েলের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের খোলনলচে পাল্টে দিত।[৪০] উপাসনার পবিত্রতা নিশ্চিত করতে তাঁরা কাল্টের কেন্দ্রিভূতকরণ[৪১], মন্দির থেকে স্বাধীন সেক্যুলার বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও রাজাকে পবিত্র ক্ষমতা হতে উৎখাত করে বাকি সবার মতো তাঁকেও তোরাহর অধীন করতে চেয়েছিলেন। ডিউটেরোনোমিস্টরা আসলে আগের আইনি বিধানের শব্দ বিন্যাস, কাহিনী ও লিটার্জিকাল টেক্সট তাঁদের প্রস্তাবের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার লক্ষ্যে পাল্টে দিয়েছেন। কোনওভাবে সেক্যুলার বলয় নিয়ে ডিউটেরোনমি রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রকে কেন্দ্রিভূত করেছিল, পড়লে আধুনিক দলিলের মতো লাগে। এটা সামাজিক বিচারের ক্ষেত্রে আমোসের চেয়ে ঢের বেশি আবেগ প্রবণ, এর ধর্মতত্ত্ব জুদাহর প্রাচীন কাল্টিক পুরাণ থেকে অনেক বেশি যৌক্তিক:[৪২] আপনি ঈশ্বরকে দেখতে পান না এবং তিনিও মানুষের তৈরি কোনও ভবনে বাস করেন না।[৪৩] ইসরায়েলিদের ইয়াহওয়েহ যায়নে বাস করেন বলে তাদের দেশ লাভ করেনি, বরং লোকে তাঁর নির্দেশনা পালন করেছে বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।
সংস্কারকগণ ঐশীগ্রন্থসমূহকে ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজে লাগাননি, যেমনটা আজকাল প্রায়ই ঘটে থাকে, বরং তাকে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করার কাজে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা ইসায়েলের ইতিহাসও নতুন করে লিখেছেন, নতুন নতুন বিষয়বস্তু যোগ করেছেন যা J’ ‘E’ মহাকাব্যকে মোজেসের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সপ্তম শতাব্দীর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, যিনি এমন এক সময় ইসরায়েলিদের মুক্ত করেছেন যখন জেসিয়াহ ফারাওয়ের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশা করছিলেন। এক্সোডাসের কাহিনীর ক্লাইমেক্স সিনাইয়ের উপর কোনও থিওফ্যানি থাকেনি, বরং তা সেফার তোরাহর উপহার পরিণত হয়েছে এবং মোজেসের হাতে তুলে দেওয়া ইয়াহওয়েহর পাথরের ফলক এখন দশ নির্দেশনা খোদাই করা ফলকে পরিণত হয়েছে। ডিউটেরোনমিস্টরা জোশুয়ার উত্তরের পাহাড়ী এলাকা অধিকার করার ঘটনাকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে এক্সোডাসের কাহিনীকে বিস্তৃত করেছেন-জেসিয়াহ উত্তরের এলাকা পুনঃঅধিকারের এক নীল নকশা।[৪৪] তাঁরা বুক অভ সামুয়েল ও কিংস নামের দুটি পুস্তকে ইসরায়েল ও জুদাহ রাজ্যের ইতিহাসও রচনা করেছেন, যুক্তি তুলে ধরেছেন যে ডেভিডিয় রাজাগণই গোটা ইসরায়েলের একমাত্র বৈধ শাসক ছিলেন। কাহিনী শেষ হয়েছে এক নতুন মোজেস ও ডেভিডের চেয়েও মহান রাজা জোসিয়াহর আমলে।[৪৫]
তবে সবাই এই নতুন তোরাহয় বিমোহিত হয়নি। মোটামুটি এই সময় প্রচারণায় নামা পয়গম্বর জেরেমিয়াহ জোসিয়াহকে শ্রদ্ধা করতেন, তিনি সংস্কারকদের বহু লক্ষ্যের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু লিখিত ঐশীগ্রন্থের বেলায় তাঁর আপত্তি ছিল; ‘অধ্যাপকদের মিথ্যা লেখনী’ স্রেফ এক খোঁচায় ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করতে পারে ও লিখিত টেক্সট বাহ্যিক চিন্তাভাবনার ধরন তৈরি করতে পারে যা প্রজ্ঞার চেয়ে বরং তথ্যের উপরই বেশি জোর দেয়।[৪৬] আধুনিক ইহুদি আন্দোলনের এক গবেষণায় বিশিষ্ট পণ্ডিত হায়ান সোলোভেতচিক যুক্তি দেখিয়েছেন, মৌখিক ট্র্যাডিশন থেকে লিখিত টেক্সটে পরিবর্তন পাঠককে অনির্বচনীয় কোনও বিষয়ে অবাস্তব নিশ্চয়তা দিয়ে ধর্মীয় শোরগোলের কঠোরতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।[৪৭] ডিউটেরোনমিস্ট ধর্ম নিশ্চিতভাবেই শোরগোলময় ছিল। সংস্কারকগণ মোজেসকে স্থানীয় কানানবাসীদের সহিংস দমনের পক্ষে প্রচারকারী হিসাবে দেখিয়েছেন। ‘তোমরা যে যে জাতিকে অধিকার চ্যুত করিবে, তাহারা উচ্চ পর্বতের উপরে, পাহাড়ের উপরে এবং হরিৎপর্ণ প্রত্যেক বৃক্ষের তলে যে যে স্থানে আপন আপন দেবতাদের সেবা করিয়াছে, সেই সকল স্থান তোমরা একেবারে বিনষ্ট করিবে। তোমরা তাহাদের যজ্ঞবেদী সকল উৎপাটন করিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল ভগ্ন করিবে, তাহাদের আশেরা মূর্ত্তী সকল অগ্নিতে পোড়াইয়া দিবে তাহাদের খোদিত দেব প্রতিমা সকল ছেদন করিবে এবং সেই স্থান তাহাদের নাম লোপ করিবে।[৪৮] তাঁরা অনুমোদন দেওয়ার ঢঙে জোশুয়ার ভাইয়ের জনগণকে হত্যা করার বর্ণনা দিয়েছেন যেন তিনি কোনও অসিরিয় জেনারেল:
এইরূপে ইসরায়েল তাহাদের সকলকে ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যে প্রান্তরে অয়নিবাসীগণ তাহাদের পশ্চাতে ধাবিত হইয়াছিল, সেখানে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সংহার করিল; তাহারা সকলে নিঃশেষে খড়গধারে পতিত হইল, পরে সমস্ত ইসরায়েল ফিরিয়া অয়নে আসিয়া খড়গধারে তথাকার লোকদিগকেও আঘাত করিল। সেই দিবসে অয়নিবাসী সমস্ত লোক অর্থাৎ স্ত্রী, পুরুষ সর্ব্বশুদ্ধ বারো সহস্র লোক পতিত হইল।[৪৯]
ডিউটেরোনোমিস্টরা এমন এক অঞ্চলের সহিংস রীতিনীতিকে আত্মস্থ করেছিলেন যেখানে প্রায় দুই শো বছরের অসিরিয় নৃশংসতার অভিজ্ঞতা ছিল। এটা ঐশীগ্রন্থ যে একই সাথে ধর্মীয় অনুসন্ধানের ব্যর্থতা ও উত্থান তুলে ধরে তার প্রাথমিক ইঙ্গিত।
এইসব টেক্সটকে শ্রদ্ধা করা হলেও তখনও সেগুলো ‘ঐশীগ্রন্থে’ পরিণত হয়নি। লোকে পুরোনো রচনা বদলানোর বেলায় স্বাধীন ছিল। সুনির্দিষ্ট পবিত্র গ্রন্থের কোনও বিধান ছিল না। তবে সেগুলো সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। জোসিয়াহর সংস্কারকে উদযাপনকারী ডিউটেরোনমিস্টগণ বিশ্বাস করেছিলেন যে, ইসরায়েল এক নতুন যুগের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ৬২২ সালে মিশরিয় বাহিনীর সাথে এক সংঘর্ষে তিনি প্রাণ হারান। কয়েক বছরের মধ্যেই বাবিলোনিয়া অসিরিয় রাজধানী নিনেভেহ দখল করে নেয়, পরিণত হয় অঞ্চলের প্রধান শক্তিতে। জুদাহর স্বল্পায়ু স্বাধীনতার অবসান ঘটে। কয়েক দশকের জন্যে রাজাগণ মিশর ও বাবিলনের মধ্যে আনুগত্য নিয়ে দোলাচলে ছিলেন। অনেকেই তখনও বিশ্বাস করছিল যে ইয়াহওয়েহ যতদিন মন্দিরে অবস্থান করছেন ততদিন জুদাহ নিরাপদে থাকবে, যদিও জেরেমিয়াহ তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন যে, বাবিলনকে অস্বীকার করার মানে হবে আত্মঘাতী। অবশেষে দুটো ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ৫৮৬ সালে নেবুচাঁদনেযারের হাতে জেরুজালেম ও এর মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়।
নির্বাসনে রাজকীয় আর্কাইভসে লিপিকারগণ স্ক্রোল নিয়ে উঠে-পড়ে লাগেন। বিপর্যয়কে যুক্তিসঙ্গত করে তোলার লক্ষ্যে ডিউটেরোনমিস্টগণ ইতিহাসে মানাশেহর ধর্মীয় নীতিমালাকে দায়ী করেন নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করেন। কিন্তু মন্দির হারানোর সাথে সাথে গোটা জগৎ খোয়া গেছে যাদের সেইসব পুরোহিতগণ অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে আশার কারণ দেখতে পেয়েছিলেন। পণ্ডিতগণ পেন্টাটিউকের এই পুরোহিত গোষ্ঠীকে ‘P’ আখ্যায়িত করে থাকেন, যদিও আমরা জানি না ‘P” কোনও ব্যক্তিবিশেষ নাকি গোটা একটা মতবাদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ‘P’ প্রাচীন দলিলের উপর নির্ভর করে ‘J’ ‘E’ র বিবরণ নতুন করে লেখেন ও বুকস অভ নাম্বারস ও লেভিটিকাস যোগ করেন-কিছু কিছু লিখিত হয়েছিল বাকিগুলো মৌখিকভাবে প্রচারিত।[৫১] তাঁর উৎসের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘পবিত্রতার বিধান’[৫২] : (সপ্তম শতাব্দীর বিধানের একটি সংকলন) ও ‘দ্য টেবারন্যাকল ডক্যুমেন্ট,’ সিনাইয়ের বুনো প্রান্তরে ইসরায়েলিদের কাটানো বছরগুলোয় ইয়াহওয়েহর তাঁবুর বিবরণ, ‘P’র দর্শনে মূল বিষয় ছিল এটা।[৫৩] ‘P’র কিছু কিছু উপাদান প্রকৃতই ঢের প্রাচীন ছিল, কিন্তু তিনি নৈতিক মনোবল খোয়ানো জাতির সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষ্য তৈরি করেছেন।
‘P’ এক্সোডাসের কাহিনীকে ডিউটেরোনমিস্টদের চেয়ে খুবই ভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছেন। সেফার তোরাহ নয় বরং মরুপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় ঈশ্বরের অব্যাহত উপস্থিতির প্রতিশ্রুতিই ছিল এর ক্লাইমেক্স। ঈশ্বর ইসরায়েলকে মিশর থেকে উদ্ধার করে এনেছেন কেবল তাদের মাঝে বাস [সকন] করবেন বলে।[৫৪] ক্রিয়াপদ শাকানু এর অর্থ ‘তাঁবুবাসী যাযাবরের জীবন যাপন।’ স্থায়ী ভবনে বাস করার বদলে ঈশ্বর তাঁর ভবঘুরে জাতির সাথে ‘তাঁবু’ই পছন্দ করেন, কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দি নন তিনি, বরং ওরা যেখানে যাবে সেখানেই তাদের সাথে যেতে পারেন।[৫৫] ‘P’র পুনর্লিখনের পর বুক অভ এক্সোডাস শেষ হয়েছে ট্যাবারন্যাকলের সমাপ্তির ভেতর দিয়ে ইয়াহওয়েহর ‘প্রতাপ’ তাঁবুকে পরিপূর্ণ করে রেখেছে, তাঁর উপস্থিতির মেঘ তাঁকে ঢেকে রেখেছে।[৫৬] ‘P” বোঝাতে চেয়েছেন, ঈশ্বর তখনও বাবিলোনিয়ায় তাঁর জাতির নবতর ভবঘুরে সময়েও তাদের সাথে রয়েছেন। জোশুয়ার বিজয়ের ভেতর দিয়ে কাহিনী শেষ করার বদলে ‘P’ ইসরায়েলিদের প্রতিশ্রুত ভূমির সীমান্তে রেখে দিয়েছেন।[৫৭] একটি নির্দিষ্ট দেশে বাস করার জন্যেই নয়, বরং ঈশ্বরের উপস্থিতিতে বাস করাই ইসরায়েলের জাতি হওয়ার কারণ।
‘P’-র পুনর্লিখিত ইতিহাসে নির্বাসন ছিল অনেকগুলো অভিবাসনের সর্বশেষ। আদম ও ইভকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল; আবেলকে হত্যা করার পর কেইন গৃহহীন ভবঘুরের জীবন কাটিয়েছে; টাওয়ার অভ বাবেলে মানব জাতিকে বিক্ষিপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল; আব্রাহাম উর ত্যাগ করে গিয়েছিলেন; গোত্রসমূহ মিশরে অভিবাসী হয়েছিল; এবং শেষ পর্যন্ত মরুপ্রান্তরে যাযাবরের মতো জীবন কাটিয়েছে। নির্বাসিতদের এই সর্বশেষ পালায় তাদের অবশ্যই এমন একটা সম্প্রদায় গড়ে তুলতে হবে যেখানে সেই সত্তা ফিরে আসতে পারবেন। এক বিস্ময়কর উদ্ভাবনে ‘P’ বোঝাতে চেয়েছেন, যে, গোটা জাতিই মন্দিরের কর্মচারীদের মতো পবিত্রতার বিধি পালন করবে।[৫৮] সবাইকে এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যেন স্বর্গীয় সত্তার সেবা করছে। ইসরায়েলকে অবশ্যই ইয়াহওয়েহর মতোই ‘পবিত্র’ (কাদ্দোশ) ও ‘ভিন্ন’ হতে হবে।[৫৯] তো বিচ্ছিন্নতার নীতির উপর ভিত্তি করে ‘P” এক জীবনধারার নকশা করেন। নির্বাসিতদের অবশ্যই বাবিলোনিয় প্রতিবেশিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করতে হবে, খাবার ও পরিচ্ছন্নতার পৃথক নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তাহলেই–কেবল তাহলেই-ইয়াহওয়েহ তাদের মাঝে বাস করবেন। ‘আমি তোমাদের মধ্যে আমার আপন আবাস রাখিব,’ ওদের বলেছিলেন ঈশ্বর। ‘তোমাদের মধ্যে গমনাগমন করিব।[৬০] বাবিলোনিয়া আরেক ইডেনে পরিণত হতে পারে, যেখানে সন্ধ্যার শীতল হাওয়ায় ঈশ্বর আদমের সাথে হেঁটেছিলেন।
পবিত্রতারও এক জোরাল নৈতিক উপাদান ছিল। ইসরায়েলিদের অবশ্যই অন্য সমস্ত সৃষ্টপ্রাণীর ‘ভিন্নতা’-কে সম্মান করতে হবে। সুতরাং কোনও কিছুই এমনকি দেশ পর্যন্ত অধিকার করা যাবে না বা দাসে পরিণত করা চলবে না।[৬১] ইসরায়েলিরা অবশ্যই বিদেশীদের ঘৃণা করতে পারবে না। ‘আর কোন বিদেশী লোক যদি তোমাদের দেশে তোমাদের সহিত বাস করে, তোমরা তাহার প্রতি উপদ্রব করিও না। তোমাদের নিকটে তোমাদের স্বদেশী লোক যেমন, তোমাদের সহপ্রবাসী বিদেশী লোকও তেমনি হইবে; তুমি তাহাকে আপনার মতো প্রেম করিও; কেননা মিশর দেশে তোমরাও বিদেশী ছিলে।[৬২] ডিউটেরোনমিস্টদের বিপরীতে ‘P’র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। তাঁর বিচ্ছিন্নতা ও নির্বাসনের বিবরণ অবিরাম সাবেক শত্রুর সাথে সমন্বয়ের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে গেছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ের চেয়ে আর কোথাওই তা এতখানি স্পষ্ট নয়, এখানে ‘P’ ছয়দিনে ইলোহিম কর্তৃক স্বর্গমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির বর্ণনা দিচ্ছেন।
এটা সৃষ্টির কোনও ঐতিহাসিকভাবে সঠিক আক্ষরিক বিবরণ ছিল না। সর্বশেষ সম্পাদকগণ চলমান বাইবেলিয় টেক্সটসমূহকে একত্রিত করার সময় ‘P’-র কাহিনীকে ঠিক ‘J’র সৃষ্টি কাহিনীর পরেই স্থান দিয়েছিলেন, যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।৺৺ প্রাচীন বিশ্বে নক্ষত্রবিদ্যা বাস্তবভিত্তিক শাখার চেয়ে বরং থেরাপিউটিক বিষয় ছিল। লোকে মৃত্যুশয্যায়, নতুন কোনও প্রকল্পের সূচনায় বা কোনও নতুন বছরের শুরুতে যখনই তারা কোনওভাবে সমস্ত বস্তুকে সৃষ্টিকারী স্বর্গীয় শক্তির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন মনে করত- সৃষ্টিপুরাণ আবৃত্তি করত। যেসব নির্বাসিত ভাবত যে ইয়াহওয়েহ বাবিলনের মারদুক দেবতার কাছে অসম্মানজনকভাবে পরাজয় বরণ করেছিলেন তাদের কাছে ‘P’র কাহিনী সান্ত্বনাদায়ক হতে পারত। মারদুকের বিপরীতে-যার পৃথিবী সৃষ্টির কাহিনী প্রতি বছর নববর্ষে বার্ষিকভাবে ইসাগিলার যিগুরাতে দর্শনীয়ভাবে পুনরাবৃত্তি করতে হতো–ইয়াহওয়েহকে সুশৃঙ্খল নক্ষত্রমণ্ডলী সৃষ্টির জন্যে অন্য দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়নি; মহাসাগর মারদুকের সাথে যুদ্ধে করুণ পরিণতি লাভকারী তিয়ামাতের মতো কোনও ভীতিকর সাগর দেবতা ছিলেন না, বরং তা ছিল মহাবিশ্বের কাঁচামাল; সূর্য, চাঁদ ও তারামণ্ডলী দেবতা নয়, বরং তুচ্ছ সৃষ্টি ও নির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত। ইয়াহওয়েহর বিজয়কে পুনরাবৃত্ত করার প্রয়োজন ছিল না; তিনি ছয় দিনে কাজ শেষ করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন।[ ৬৪]
এটা অবশ্য এমন কোনও উচ্চমার্গীয় যুক্তি ছিল না; কোনও পরিহাস নেই, নেই কোনও আগ্রাসন। প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দেবতারা লাগাতার সহিংস ভীতিকর যুদ্ধের পর সাধারণত জগৎ সৃষ্টি করতেন। প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েলিরা সময়ের সূচনার ইয়াহওয়েহর সাগর দানোদের হত্যা করার কাহিনী ধারণ করে।[৬৫] কিন্তু ‘P’র সৃষ্টি পুরাণ অহিংস। ঈশ্বর কেবল নির্দেশ উচ্চারণ করেছেন আর আমাদের মহাবিশ্বের একের পর এক উপাদান অস্তিত্ব লাভ করেছে। প্রতিদিনের শেষে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট সমস্ত কিছুই তোভ, ভালো বলে আশীর্বাদ করেছেন। শেষ দিনে ইয়াহওয়েহ নিশ্চিত করলেন যে সমস্ত কিছুই ‘দারুণ ভালো,’ তিনি সমগ্র সৃষ্টিকে আশীর্বাদ করেন[৬৬]; ধরে নেওয়া যায় বাবিলোনিয়দেরও। সবারই ইয়াহওয়েহর মতো আচরণ করা উচিত: সাব্বাথে শান্তভাবে বিশ্রাম নিতে হবে, ঈশ্বরের জগতের সেবা করতে হবে ও তাঁর প্রতিটি তুচ্ছ সৃষ্টিকে আশীর্বাদ করতে হবে।
কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাবিলোনিয়ায় ধর্মপ্রচারকারী আরেক জন পয়গম্বর আরও আক্রমণাত্মক ধর্মতত্ত্বের প্রচার করেন; তিনি বিদেশী জাতি গোয়িমদের শেকলাবদ্ধ অবস্থায় ইসরায়েলের পেছনে কুচকাওয়াজ করে অগ্রসর হতে দেখার তর সইতে পারেননি। আমরা তাঁর নাম জানি না। কিন্তু তাঁর অরাকলস ইসায়াহর ক্রোলে সংরক্ষিত হয়েছে বলে তিনি সাধারণত দ্বিতীয় ইসায়াহ নামে পরিচিত। নির্বাসনের তখন অবসান হতে চলেছে। ৫৩৯ সালে পারসিয়ার রাজা সাইরাস বাবিলোনিয়দের পরাস্ত করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের অধিপতিতে পরিণত হন। সকল দেশান্তরীকে প্রত্যাবসনে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে দ্বিতীয় ইসায়াহ তাঁকে ইয়াহওয়েহর মেশায়াহ, তাঁর মনোনীত রাজা[৬৭] ডাকতেন। ইসরায়েলের স্বার্থে ইয়াহওয়েহ সাইরাসকে তাঁর উপায় হিসাবে তলব করেছেন এবং অঞ্চলের ক্ষমতায় বিপ্লব সাধন করেছেন। আর কোনও দেবতা কি তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন? না, গোয়িমদের দেবতাদের উদ্দেশে ভর্ৎসনার সাথে ঘোষণা করলেন ইয়াহওয়েহ, ‘দেখ, তোমরা অবস্তু ও তোমাদের কার্য্য অকিঞ্চন।’[৬৮] তিনি একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হলেন। ‘আমি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইয়াহওয়েহ,’ সগর্বে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ‘আমি ব্যতীত অন্য ঈশ্বর নাই।’[৬৯] এটাই হিব্রু বাইবেলে পরিণত হতে চলা গ্রন্থের প্রথম দ্ব্যর্থহীন একেশ্বরবাদী বিবৃতি। কিন্তু এর বিজয়বাদ ধর্মের অধিকতর মারমুখী বৈশিষ্ট্যে ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় ইসায়াহ এক পৌরাণিক ট্র্যাডিশনের উপর নির্ভর করেছেন, যার সাথে পেন্টাটিউকের সামান্যই সম্পর্ক ছিল। তিনি আদিম শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ইয়াহওয়েহর সাগর দানো হত্যার প্রাচীন কাহিনীকে নতুন করে জীবিত করে তোলেন, ঘোষণা করেন, ইয়াহওয়েহ ইসরায়েলের ঐতিহাসিক শত্রুদের পরাস্ত করে আবার সেই মহাজাগতিক বিজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছেন।[৭০] তিনি অবশ্য গোটা নির্বাসিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাননি। চারটি ‘দাসগীত’ ইসায়াহর অতিরঞ্জিত ভবিষ্যদ্বাণীকে বিরতি দিয়েছে। এই গানগুলোতে ইয়াহওয়েহর দাস বলে পরিচয় দানকারী এক রহস্যময় চরিত্র সারা বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব লাভ করেছেন–তবে সেটা হতে হবে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে। তিনি নিন্দিত ও নন্দিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভোগান্তি মানুষকে মুক্তি দেবে। গোয়িমদের অধীনে নিয়ে আসার কোনও ইচ্ছা এই দাসের ছিল না, বরং তিনি ‘জাতিসমূহের আলোকবর্তিকায়’ পরিণত হবেন ও পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ঈশ্বরের মুক্তিকে পৌঁছে যেতে সক্ষম করে তুলবেন।
সাইরাস তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন। ৫৩৯ সালের শেষের দিকে তাঁর অভিষেকের অল্প কয়েক মাস পরে, নির্বাসিতদের ছোট একটা দল জেরুজালেমের পথে নামে। বেশির ভাগ ইসরায়েলিই বাবিলনে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখানে তারা হিব্রু ঐশীগ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রত্যাবর্তনকারীরা সাথে করে নয়টি স্ক্রোল নিয়ে এসেছিল যাতে সৃষ্টির কাল থেকে দেশান্তরের মুহূর্ত পর্যন্ত ইতিহাসের বিবরণ ছিল: জেনেসিস, এক্সোডাস, নাম্বারস, ডিউটেরোনমি, জোশুয়া, জাজেস, সামুয়েল এবং কিংস; প্রফেটস-এর (নেভিইন) অরাকলসের সংকলন ও একটা হাইম পুস্তকও নিয়ে আসে তারা যেখানে বাবিলনে রচিত নতুন শ্লোক অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি এটা, কিন্তু নির্বাসিতরা হিব্রু বাইবেলের কঙ্কাল পেয়েছিল তাদের হাতে।
প্রত্যাবসিতদের গোষ্ঠী গোলাহ ধরে নিয়েছিল যে ওদের পরিমার্জিত ধর্ম ইয়াহওয়েহবাদের একমাত্র সত্যি রূপ। কিন্তু যেসব ইসরায়েলিকে বাবিলোনিয়ায় দেশান্তরী করা হয়নি, তাদের বেশিরভাগই সাবেক উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের এলাকায় বাস করছিল। এদের সাথে একমত হতে পারেনি তারা। তারা এই বর্জনবাদী প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করে। একটা নতুন মন্দির, বলা চলে মাঝারি মানের একটা উপাসনালয়ের নির্মাণ কাজ অবশেষে বিসিই ৫২০ সালে শেষ হয়, ইয়াহওয়েহবাদকে তা আরও একবার মন্দিরের ধর্মে পরিণত করে। কিন্তু আরেকটা আধ্যাত্মিকতার সূচনা হয় খুবই ধীরে ধীরে, এর পাশাপাশি বিকাশ লাভ করবে বলে। বাবিলোনিয়ায় রয়ে যাওয়া ইসরায়েলিদের সহযোগিতায় গোলাহরা বিভিন্ন উৎসের টেক্সটসমূহকে একক ঐশীগ্রন্থে রূপ দেওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছিল।