১. তুমি আর কখনো এস না

মধুময় – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তুমি আর কখনো এস না!

মধুময় টেবিলে কনুইয়ের ওপর থুতনি রেখে যেমনভাবে বসেছিল, সেইরকমই রইল, একটুও চমকে উঠল না, একটাও কথা বলল না। আসলে সে মনে মনে ব্যাকুলভাবে বলতে চাইল, আমি পারব না! স্বপ্না, কেন আমায় ফিরিয়ে দিচ্ছ?

সে, নিঃশব্দে স্বপ্নার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

স্বপ্না বলল, তুমি কি চাও আমি আত্মহত্যা করি?

মধুময় এখনও চুপ।

কেন দিনের পর দিন, আমাকে এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলছ? যে সম্পর্ক একবার ভেঙে যায়, তাকে আর জোর করে জোড়া লাগানো যায় না। আমি ওপরে গেলেই মা আমাকে বকুনি দিয়ে একেবারে ভাজা-ভাজা করবে। আমার দাদা-টাদারা শেষকালে যদি তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়, সেটা কি ভালো হবে?

মধুময় একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ঠিক আছে, আমি এখানে আর আসব না, কিন্তু বাইরে কোথাও

না, তাও সম্ভব নয়। আমি ওরকমভাবে কিছু চাই না, বাড়ির লোককে কিছু না জানিয়ে, লুকিয়ে, গোপনে-ওটা আমার স্বভাব নয়।

মাসে অন্তত একবার?

কেন তুমি অবুঝের মতন কথা বলছ? আমি যা পারব না, সে-সম্পর্কে জোর করে কোনো লাভ আছে?

তুমি এক সময় বলেছিলে…

তারপর কত কী বদলে গেছে।

আবার সব কিছু বদলে নেওয়া যায় না, আমি যদি সেই আগের মতন

তা হয় না। তুমিও জান, তা হয় না। সাড়ে চারটে বাজল, আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।

মধুময় উঠে দাঁড়াল। তার লম্বা শরীরটার জন্য সে বিব্রত, এইরকম মুখের ভাব। কাঁধ দুটো উঁচু হয়ে আছে। মাটির দিকে চোখ রেখে সে জিজ্ঞেস করল, তাহলে আর আমি কোনোদিন

আসব না?

স্বপ্না বলল, তোমারও তো একটা আত্মসম্মান আছে, যেখানে কেউ তোমাকে চায় না, সেখানে কেন তুমি আসবে?

তুমিও চাও না?

স্বপ্না মধুময়ের ডান বাহুতে বাঁ-হাতটা ছোঁয়াল। এর আগে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে মধুময় যে কবার স্বপ্নকে ছুঁতে গেছে, সেই ক-বারই স্বপ্ন এমনভাবে ছটফটিয়ে দূরে সরে গেছে যেন মধুময় একজন মেথর, এক্ষুনি কমোড পরিষ্কার করে এল।

আজ স্বপ্না নিজেই ছুঁয়ে দিল মধুময়কে। যেখানে সে হাত রেখেছে সেই জায়গাটা যেন জ্বলছে।

তোমাকে তো বুঝিয়ে বললাম, আমাদের পুরোনো সম্পর্ক আর নেই!

আচ্ছা, আমি আর আসব না।

স্বপ্না মধুময়ের বাহুতে আর একটু চাপ দিল, গলার আওয়াজ আরও নরম করে বলল, লক্ষ্মীটি, শুধু শুধু মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখো না, আমাকে ছাড়াও তুমি জীবনে অনেক কিছু করতে পার–

মধুময় স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল স্বপ্নার দিকে। এক সময় কোনো কথা না বলে শুধু চোখে চোখেই অনেক কথা হয়ে যেত। কিন্তু স্বপ্না চোখ ফিরিয়ে নিল। মধুময় জানে, স্বপ্নার মনটা ফুলের মতন কোমল। ফুলও এক সময় কঠিন হতে পারে।

মধুময় আর কিছু না বলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এই বৈঠকখানা ঘরের সামনেই একটা লম্বা বারান্দা। তার শেষপ্রান্তে, কয়েকটা সিঁড়ির পর বাইরের গেট। বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে সে মনে মনে বলতে লাগল, আমি আর এখানে আসব না, আমি আর এখানে আসব না।

তার পিঠে যেন একটা গরম হাওয়া লাগছে। যেন কার নিশ্বাস। মধুময় তবু তাকাল না পেছন ফিরে। একথা ঠিক, স্বপ্না তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য গেট পর্যন্ত আসবে না। সে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে আছে বসবার ঘরের দরজার সামনে। অতদূর থেকে স্বপ্নার স্বস্তির নিশ্বাস কি তার পিঠে লাগতে পারে?

গেট থেকে বেরিয়ে মধুময় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। সামনেই ট্রামস্টপ। মধুময়ের এখান থেকেই ওঠবার কথা। কিন্তু উঠল না, হাঁটতেই লাগল। দুটো হাতই কোটের পকেটে গোঁজা, মাটির দিকে মুখ, সে রাস্তার কিছুই দেখছে না।

বেশ খানিকটা গিয়ে মধুময় থমকে দাঁড়াল। মনে মনে বেশ পরিষ্কার উচ্চারণে সে বলল, আমি স্বপ্নার মাকে খুন করব। ওই ভদ্রমহিলা অনেকের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছেন। আমি স্বপ্নার দাদাকেও খুন করব, কারণ সে আমাকে অপমান করার স্পর্ধা দেখিয়েছে। এমনকী, স্বপ্নার মেজোকাকা যদি উলটোপালটা কথা বলতে আসেন, তাহলে তাকেও খুন করা যেতে পারে।

তারপর মধুময় আবার স্বপ্নার বাড়িতে গিয়ে বলবে, আমি আবার এসেছি। এখন তো আর বারণ করার কেউ নেই!

কোটের পকেট থেকে মধুময় হাত দুটো বের করল। সে পারে, সে অনায়াসেই এই তিনজনকে খুন করে ফেলতে পারে।

তারপর মধুময় হাসল। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? মাকে, দাদাকে, ছোটোকাকাকে খুন করলেই বা স্বপ্না তার কাছে আসবে কেন? একজন খুনিকে কেনই-বা সে ভালোবাসবে? ওইসব প্রিয়জনের চেয়ে কি তার আকর্ষণ বেশি?

তা ছাড়া, স্বপ্নার প্রতিটি ব্যবহারেই আজ ফুটে উঠেছিল যে, সে নিজেই আর মধুময়কে চায় না। বিশেষত ওই যে গায়ে হাত ছোঁয়ালে। চরম ন্যাকামি নয়! বাড়ির কুকুরকে বাইরে পাঠাবার সময় গায়ে হাত বুলিয়ে যেমন লোকে বলে, –যা যা– সেরকমভাবেই স্বপ্না তাকে চলে যেতে বলেছে।

মধুময় আর কোনোদিন আসবে না স্বপ্নার বাড়িতে। রাসবিহারী মোড় থেকে লেক মার্কেট পর্যন্ত ট্রামরাস্তা, এই রাস্তাটুকুতে সে আর পায়ে হেঁটে যাবে না কোনোদিন। ট্রাম, বাস বা ট্যাক্সিতে যেতে হলে, সে এইটুকু পথ চোখ বুজে থাকবে। সারাজীবনের মতো এটা ঠিক হয়ে গেল।

–এইজন্যই স্বপ্না ক-দিন ধরে তার লেখা চিঠিগুলো ফেরত চাইছিল। আজ আর চায়নি। মধুময়কে তাড়াবার ব্যস্ততায় ভুলে গেছে বোধ হয়। স্বপ্ন কি ভেবেছিল যে, সে অন্য কাউকে বিয়ে করলে মধুময় ওই চিঠিগুলো দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে পারে? স্বপ্ন এ-রকমও ভাবতে পারে তার সম্পর্কে?

হ্যাঁ, ভাবতে তো পারেই। মানুষ একবার খারাপ কাজ করলে দ্বিতীয়, তৃতীয়বার করাও তো তার পক্ষে স্বাভাবিক।

দেশপ্রিয় পার্কের রেলিং-এ হেলান দিয়ে মধুময় একটা সিগারেট ধরালো। এবার সে কী করবে? এখন মানে এই মুহূর্তে নয়–বাকি জীবনটা?

তাঁর চোখের সামনে যেন চলচ্ছবির মতন ফুটে উঠল তার গতকয়েক বছরের জীবনের ঘটনা। এই ঘটনাগুলো সে ভুলতে চায়, কিন্তু কেউ তাকে ভুলতে দেবে না। সে আশা করেছিল স্বপ্না অন্তত তাকে সব কিছু ভুলিয়ে দেবে। দু-জনে মিলে আবার একটা নতুন জীবন শুরু করবে।

পার্কের রেলিং-এর পাশে দাঁড়ানো মধুময় যেন একটা পাথরের মূর্তি।

গত দু-বছর মধুময় একটা দারুণ ভুলের মধ্যে ডুবেছিল। এরমধ্যে জেল খাটতে হয়েছে ছ-মাস। তাও কোনো রাজনৈতিক কারণে নয় যে গর্ব করে বলা যাবে।

সি.আই.টি. রোডে এক সময় স্বপ্নাদের বাড়ি আর তাদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। স্বপ্নার বাবা সরকারি চাকুরি ছেড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঢুকেই উন্নতি করতে লাগলেন হু-হু করে। তারপর ঝাঁ করে একটা গোটাবাড়ি কিনে উঠে গেলেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে। মধুময় ধরেই নিয়েছিল, স্বপ্নার সঙ্গে তার চিরকালের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। এই ধরে নেওয়াটাই তার প্রথম ভুল। সচরাচর এ-রকম হয় না।

বি এসসি পাশ করে মধুময় এম এসসি-তে ভরতি হওয়ার সুযোগ পেল না কলকাতায়। একটা সিট পাওয়া গিয়েছিল পাটনা ইউনিভার্সিটিতে। তার বাবা সেখানেই ভরতি করে দিয়ে এলেন মধুময়কে।

কোনোক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে দু-বছর কাটিয়ে দিয়ে এম এসসি পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল মধুময়ের। কিন্তু পাটনায় কিছুতেই মন টিকল না তার, ছ-মাসের মাথায় পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে ফিরে এল কলকাতায়। সেটা মধুময়ের দ্বিতীয় ভুল।

সে ভেবেছিল, শুধু শুধু এম এসসি-র জন্য দুটো বছর নষ্ট করে কী লাভ। আসল উদ্দেশ্য তো চাকরি! চাকরির জন্য বি এসসি-ও যা, এম এসসি-ও তাই। কলকাতায় ফিরে সে চাকরির জন্য উঠে পড়ে লাগল। অর্থাৎ এই শহরের আট-দশ লাখ বেকারদের মধ্যে ডুবে গেল সে।

বাড়ি বদল করলেও স্বপ্নার সঙ্গে তার দেখা হত প্রায় রোজই। গোড়ার দিকে পাটনা যাওয়ার পর স্বপ্না তাকে চিঠি লিখত নিয়মিত। মধুময়ের চিঠি লেখার ব্যাপারে বড়ো আলস্য। স্বপ্নার তিনখানা চিঠির উত্তরে সে লিখত একটা। স্বপ্নার চিঠি পাঁচ পাতা, তো মধুময়ের দেড় পাতা। কিংবা, চিঠিতে কিছু লেখার বদলে মধুময় একটা-দুটো ছবি এঁকে পাঠাত।

মধুময় ভেবেছিল, এক বছরের মধ্যে সে নিশ্চয়ই একটা চাকরি পেয়ে যাবে, তারপর আর এক বছর সময় লাগবে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিতে। তখন সে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বিয়ে করবে স্বপ্নাকে।

কিন্তু চাকরি পাবে কি, কখনো কখনো ইন্টারভিউ পেলেও মধুময়ের যেতে ইচ্ছে করত না। বাবা-কাকা, মেসো-পিসের চেনাশুনো বা ধরাধরির সূত্রে কয়েকবার এরকম ইন্টারভিউ পেয়েছে মধুময়। কিন্তু সে বিরক্তিতে ঠোঁট উলটেছে। সাড়ে তিন-শো, চার-শো টাকা মাইনে–এই সামান্য টাকার চাকরি পেয়েই বা কী লাভ? এই টাকায় আজকাল দু-খানা ঘরের বাড়িও ভাড়া পাওয়া যায় না।

স্বপ্না বলেছে, প্রথমেই বুঝি কেউ বেশি মাইনে দেয়? চাকরিতে ঢুকলে দু-এক বছর পর নতুন গ্রেড, নতুন স্কেল দেবে।

স্বপ্নাদের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুর বেলা শুয়ে থেকেছে মধুময়, তার পকেটে ইন্টারভিউয়ের চিঠি। সে হাসতে হাসতে বলেছে, জান ইন্টারভিউয়ের জন্য সকাল সাড়ে ন টায় যেতে বলে, তারপর বসিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হয়তো ডাক পড়ে সেই চারটে সাড়ে চারটের সময়… আমার খুব খিদে পেয়ে যায়।

স্বপ্না হেসে বলেছে, ঠিক আছে, আমি দুপুর বেলা টিফিন কৌটোয় করে তোমার জন্য খাবার নিয়ে যাব।

মধুময় বলেছিল, অন্য ক্যাণ্ডিডেটরা তোমাকে দেখে সিটি দেবে।

 তাহলে–কথাটা শেষ না করে স্বপ্না তার ছোট্ট হাতব্যাগটা খুলে দুটো দশ টাকার নোট বের করে বলেছে, তোমার কাছে রাখো।

ওপাড়ার একটি বাচ্চাদের স্কুলে স্বপ্না তখন সকাল বেলা পড়াতে শুরু করেছে। তার নিজস্ব রোজগার আছে। স্বপ্নার কাছ থেকে ওই টাকা নেওয়াটা হয়েছিল তার তৃতীয় ভুল। স্বপ্না বলেছিল, তোমার উচিত ছিল আর্টিস্ট হওয়া। কেন তুমি সায়েন্স পড়তে গেলে?

এই কথাটা শুনলেই মধুময় লজ্জা পায়। মধুময়ের ছবি আঁকার হাত আছে। সে কোথাও শেখেনি। ছোটোবেলা থেকেই তার ছবি আঁকার শখ। আত্মীয়স্বজনরা সবাই প্রশংসা করেছে তার ছবি দেখে। স্বপ্নার ছবি সে এঁকেছে অনেকগুলো, কিন্তু মধুময় জানে, আত্মীয়স্বজনের বা বান্ধবীর প্রশংসা পেলেই কেউ আর্টিস্ট হয় না। এরজন্য প্রচুর পরিশ্রম করা দরকার। ছবি আঁকা সারাদিনের কাজ। খরচও অনেক। সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে শিল্পী হওয়ার ঝুঁকি সে নিতে পারেনি। তাকে শখের শিল্পী হয়েই থাকতে হবে।

বেকার অবস্থায় বেশ বড়ো কয়েকটি প্রলোভনের মধ্যে পড়তে হয়। তারমধ্যে একটি হচ্ছে বখাটে হয়ে যাওয়া। মধুময় হঠাৎ পাড়ার বেকার বখাটেদের দলে ভিড়ে গেল। বখামির একটা দারুণ নেশা আছে তো। সবসময়ই কিছু-না-কিছু উত্তেজনা। এপাড়া, ওপাড়ায় ঝগড়া, মারামারি, রবারের কারখানার পেছনের মাঠে সন্ধ্যের পর লুকিয়ে লুকিয়ে মদ্যপান, নারীদের বিষয়ে জমকালো আলোচনা। প্রত্যেকটিই ধাপে ধাপে এগোয়।

আর্টস্কুলে ভরতি না হয়ে সায়েন্স পড়তে যাওয়া যেমন মধুময়ের চরিত্রবিরোধী কাজ হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি চরিত্রবিরোধী কাজ সে করতে লাগল এই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশে। যে মধুময় ছিল লাজুক, নম্র একটি ছেলে, সে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ার ছোটোখাটো গুণ্ডাদের মধ্যে বেশ নাম করে ফেলল। তার লম্বা চেহারা, চুল বড়ো বড়ো, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করলে এবং গলায় একটা রুমাল বাঁধলে তাকে গুণ্ডার ভূমিকায় বেশ মানিয়েও যায়।

স্বপ্নার সঙ্গে এই সময়টায় কম দেখা হতে লাগল। দেখা হলেও স্বপ্না তার এই পরিবর্তিত ভূমিকা কিছু বুঝতে পারে না। স্বপ্না অভিমান করে। মধুময় তখন চমৎকার মিথ্যে বলতে শিখেছে, সেইসব মিথ্যে দিয়ে সে স্বপ্নকে ভোলায়।

স্বপ্নার সঙ্গে তখন দেখা হত সকালে বা দুপুরে। সন্ধ্যের পর একদিনও নয়। সন্ধ্যের পর মধুময় অন্য মানুষ।

মধুময়ের সেই বখাটে দলের আর একজনেরও কোনো মেয়েবন্ধু ছিল না। কেউ ভালোবাসা পায়নি। তাই তারা সর্বক্ষণ মেয়ের শরীর নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকত। মধুময়ের তো সেরকম কোনো অভাব ছিল না। তবু কেন সে ওই আলোচনায় বেশি মজা পেতে লাগল, সেটা একটা রহস্য। মেয়েদের বিষয়ে আলোচনা করার বদলে সে তো স্বপ্নার সঙ্গেই সময় কাটাতে পারত খুব সুন্দরভাবে। অথচ সে স্বপ্নার কাছে না গিয়ে বসে থাকত ওই বন্ধুদের সঙ্গে। হয়তো যেকোনো সুন্দর জিনিস সম্পর্কেই তার আক্রোশ জন্মে গিয়েছিল। ছবি আঁকা একদম ভুলে গিয়ে সে উপভোগ করত বন্ধুদের অশ্লীল রসিকতা।

মধুময় তখন ঠিক যেন, একটা দ্বিতীয় গুপ্ত জীবন কাটাচ্ছিল। সে সম্পর্কে স্বপ্না কিছু জানে না। তার বাড়ির কেউই কোনো সন্দেহ করেনি। মধুময়ের বাবা বাড়িতে থাকেন খুবই কম সময়, ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে তিনি মনোযোগ দিতে পারেন না। শুধু মাঝে মাঝে রাত্তির বেলা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার একটু আগে স্ত্রীকে বকাবকি করেন খানিকটা।

ছেলেটা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এ-রকম বেকার হয়েই থাকবে–সারাদিন কী করে সে?

মধুময়ের মা তাড়াতাড়ি ছেলের দোষ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন নানা কথা বলে চাকরির জন্যে তো হন্যে হয়ে ঘুরছে সারাদিন। চাকরি কি আজকাল গাছে ফলে?

এতগুলো জায়গায় আমি নিজে গিয়ে চেষ্টা করলাম ওর জন্য, কোথাও তো ইন্টারভিউয়ে ভালো করতে পারে না। এবার না হয় আমাদের অফিসেই বড়ো সাহেবকে বলে দেখব… মধুময়ের বাবা কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নিজের অফিসে বড়ো সাহেবকে বলে একটা ছোটোখাটো চাকরির ব্যবস্থা করে ফেললেন। কিন্তু সে চাকরিও প্রত্যাখ্যান করল মধুময়।

সরাসরি বাবার সঙ্গে কথা না বলে, মাকে সে জানিয়ে দিল, বাবার সঙ্গে সে এক অফিসে চাকরি করবে না। তাতে বাবারও অসুবিধে হবে, তার নিজেরও অসুবিধে হবে। অফিসের লোকেরাও এব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না।

মধুময়ের বাবা একথা শুনে আরও রাগ করলেন। স্ত্রীকে তিনি জানিয়ে দিলেন, ছেলে যা খুশি করে করুক। দু-দিন বাদে আমি যখন চোখ বুজব আর সংসারটা ওর ঘাড়ে পড়বে, তখন বুঝবে ঠেলা।

মধুময় তার মাকে জানিয়ে দিল, তিন মাসের মধ্যেই যেকোনোভাবেই হোক, একটা উপার্জনের পথ সে খুঁজে নেবে। এজন্য বাবাকে চেষ্টা করতে হবে না। সে নিজেই পারবে।

বেকারেরও হাত-খরচ লাগে, আড্ডার সময় বেকারদেরও পয়সা খরচ হয়। মধুময় তখন যাদের সঙ্গে মিশছিল, তারা অনেকেই তার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়ো, এবং পাঁচ-ছ-বছর ধরে বেকার। তবু কোন অত্যাশ্চর্য উপায়ে তারা পয়সা জোগাড় করত তা মধুময় জানে না। কিন্তু তার নিজের বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। মায়ের কাছ থেকে আর প্রত্যেক দিন পয়সা চাওয়া যায় না। স্বপ্নার সঙ্গে দেখা হলে মধুময় বলত, দেখি তুমি কত পয়সা জমালে–তারপর স্বপ্নার হাতব্যাগটা খুলে বলত, তোমার কাছ থেকে আবার পনেরো টাকা ধার নিলাম। সব শোধ করে দেব একসঙ্গে।

মধুময়ের ছোটোবোন রুমি শুধু একদিন তাকে বলেছিল, হ্যাঁ রে দাদা, তুই আজকাল রতনদের দলের সঙ্গে মিশছিস? আমাদের কলেজের সামনে দেখলাম তোরা একটা ট্যাক্সি করে যাচ্ছিস…

রুমি পড়ে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। গতকাল সত্যিই ওইখান দিয়ে মধুময়রা গিয়েছিল একটা ট্যাক্সিতে। মধুময় অস্বীকার করতে পারল না।

কেন, ওদের সঙ্গে মিশলে কী হয়েছে?

 ওরা তো সব কটা বাজে ছেলে! তোর সঙ্গে রুচিতে মেলে?

কে বলেছে বাজে ছেলে?

ওরা সবসময় খারাপ খারাপ কথা বলে, মেয়েদের দেখলে সিটি দেয়…

তোকে দেখে কোনোদিন খারাপ কথা বলেছে কিছু?

বখাটে ছেলেদের মধ্যে এ-ব্যাপারে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। তারা কখনো সেমসাইড করে না। নিজেদের দলের কারুর আত্মীয় বা চেনা মেয়েদের ওরা বলে সেমসাইড।

মধুময় বলল, লোকের সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না, তারা ভালো কী খারাপ। ওরা মোটেই খারাপ ছেলে নয়, বেকার বলে সবাই ওদের অবজ্ঞা করে, ওরা কি ইচ্ছে করে বেকার হয়ে আছে?

বেকার হলেই বুঝি বখাটে হতে হবে? তুই ওদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে স্বপ্নাদিকে বলে দেব।

স্বপ্না সম্পর্কে সবাই একটা কথা জানে। স্বপ্না একদম মিথ্যেকথা বা কোনোরকম খারাপ কথা সহ্য করতে পারে না। ছেলেরা দূরে থাক, কোনো মেয়েও স্বপ্নার সামনে কোনো অসভ্য কথা বললে, স্বপ্না সেখান থেকে রাগ করে উঠে যায়। মধুময়ের সঙ্গে স্বপ্নার এত দিনের পরিচয়, কিন্তু মধুময় এখন পর্যন্ত একবারও স্বপ্নাকে চুমু খায়নি। বিয়ের আগে স্বপ্ন ওসব ব্যাপার কল্পনাই করতে পারে না।

মধুময় এমনভাবে রুমির দিকে তাকিয়েছিল যেন, রুমি যদি সত্যিই স্বপ্নার কাছে এ ব্যাপারে কোনো নালিশ করে, তাহলে সে রুমিকে ভস্ম করে ফেলবে।

লম্বা চওড়া চেহারার জন্য মধুময়কে খুব পছন্দ করে রতন। প্রায়ই সে মধুময়ের পিঠ চাপড়ে বলে এ ছেলেটাকে দিয়ে অনেক কাজ হবে। এ-রকম একটা এক নম্বরি ছেলে কেরানিগিরির জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল, একথা ভাবা যায় মাইরি! এ ছেলের তো রাজা হওয়ার কথা!

মধুময়ের সাহস পরীক্ষা করবার জন্য একদিন সন্ধ্যে বেলা কার্জন পার্কের কোণে দাঁড়িয়ে রতন বলল, ওই যে মোটা মতন লোকটা যাচ্ছে, তুই ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারিস মধুময়?

মধুময় অবাক হয়ে বলেছিল, কেন? ওকে ফেলে দেব কেন?

 রতন বলেছিল, সে-কথা জানবার তোর দরকার নেই। লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েই ইডেন গার্ডেনের দিকে ছুটে পালাবি। যদি ধরা না পড়িস, তাহলে বুঝব তুই বাহাদুর।

আর যদি ধরা পড়ি?

তখন উপস্থিত বুদ্ধি খাটাবি। এমনিতে লোকের সঙ্গে রাস্তাঘাটে ধাক্কা লেগে তো যায়ই। আর যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়–

পুলিশে ধরবে কেন?

ধরবে না, কথার কথা বলছি। তবু যদি ধরে তুই তখন কিন্তু আমাদের কারুর নাম বলবি না। তাহলে বুঝব তোর হিম্মত।

লোকটির মুখভরতি পান, বাতাবি লেবুর মতন গোল মুখের মধ্যে চোখদুটো অতিলোভীর মতন। দেখলেই মনে হয়, লোকটা সারাদিন স্বার্থ চিন্তা করে। মানুষ ঠকানোই ওর পেশা। লোকটার হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ।

উলটো দিক দিয়ে হেঁটে গিয়ে মধুময় লোকটির সামনে থমকে দাঁড়াল। অনেক সময় এ রকম হয়, দু-জন লোক মুখোমুখি পড়ে যায়, একজন ডান দিকে সরলে অন্যজনও ডান দিকে সরে, আবার দু-জনই বাঁ দিকে। সেইরকম অবস্থায় মধুময় লোকটিকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল। লোকটিকে দেখেই সে খুব অপছন্দ করেছিল বলে ল্যাংটা বেশ জোরেই কষালো।

লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। হাতের ব্যাগটা ছিটকে গেল। মধুময় যেন দেখতেই পায়নি, এইভাবে এগিয়ে গেল। তারপর রাজভবনের পাশ দিয়ে অন্ধকার রাস্তা ধরে সে ছুটে গেল ইডেন গার্ডেনের দিকে।

পরের দিন রতন বলল, লোকটার ব্যাগে দেড় হাজার টাকা ছিল মাত্তর। এই নে তোর শেয়ার, চার-শো টাকা।

মধুময়ের হাত কাঁপছিল।

রতন বলেছিল, কী রে ভয় পাচ্ছিস? লোকটা বড়োবাজারে ব্যবসা করে। এই দেড় হাজার টাকা তো ওর কাছে হাতের ময়লা। সরষের তেলের দাম কেজিতে আট আনা বাড়িয়ে দিলেই ওদের দিনে দশ হাজার টাকা রোজগার! জানিস!

অপরাধবোধকেও অতিক্রম করে গেল নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ। একটা বদমাশ লোককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এই হিসেবে ব্যাপারটাকে নিল মধুময়। যেন সে একটা ছোটোখাটো রবিনহুড। গভর্নমেন্ট তো এইসব ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেবে না। আমরাই দেব।

স্কুল-কলেজে পড়ার সময়েও মধুময় কখনো গুণ্ডামি মারামারি করেনি। তার স্বভাবটাই ছিল নরম। বলশালী চেহারা হলেও অনেকে তাই তাকে বলত মেয়েলি ছেলে। এখন মধুময় প্রমাণ করে দিল, সে মোটেই মেয়েলি নয়। এই নতুন ভূমিকায় সে বেশ উত্তেজনা বোধ করল।

টাকাটা পাওয়ার পর সে স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, তোমার কাছ থেকে সবসুদ্ধু কত টাকা ধার নিয়েছিলাম যেন? পঁচাত্তর টাকা, না? এই নাও!

স্বপ্না অবাক হয়ে বলেছিল, তুমি চাকরি পেয়ে গেছ? কই, আমাকে বলনি তো!

মধুময় বলেছিল, না, চাকরি পাইনি এখনও। তবে শিগগিরই কিছু করব।

 তাহলে কোথায় পেলে টাকা?

মধুময় চটেছিল। সে পুরুষমানুষ, সে কেন একটি মেয়ের কাছে কৈফিয়ত দেবে টাকা কোথা থেকে পেল? স্বপ্না রোজগার করতে পারে, আর সে পারে না? বেকার বলে কি স্বপ্নাও তাকে অবজ্ঞা দেখাতে শুরু করেছে?

সে জোর করে স্বপ্নার ব্যাগে গুঁজে দিল পঁচাত্তর টাকা। গঙ্গার ধারে রেস্তোরাঁয় গিয়ে আরও খরচ করে ফেলল কুড়ি টাকা, স্বপ্না খেতে চায় না, তবু সে জোর করে খাওয়াবেই।

স্বপ্না তবু বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল টাকাটার কথা। সে জানতে চায় মধুময় হঠাৎ এমন বড়োলোক হয়ে উঠল কী করে? তার কাছে মধুময় কোনো কিছুই গোপন করে না, স্বপ্নার এ-রকম ধারণা, সুতরাং টাকা পাওয়ার ব্যাপারটাই-বা বলবে না কেন? কিন্তু টাকার প্রসঙ্গ উঠলেই চটে যাচ্ছিল মধুময়।

দ্বিতীয় কাজটিও মধুময় বেশ সার্থকভাবেই করল। কাজ বেশ সোজা, কোনো একটি লোককে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া। মধুময় নিজের হাতে টাকা পয়সা লুঠ করে না। সে ভার রতন আর দু-জন সঙ্গীর। সে শুধু একটি লোককে রাস্তায় ফেলে দেয় এবং দ্বিতীয়বারেও লোকটিকে দেখিয়ে দিয়েছিল রতন, তারও চেহারার মধ্যে একটা দারুণ নিষ্ঠুরতার ছাপ। মানুষের রক্ত নিংড়ে নেওয়াই যেন ওর কাজ। এইসব লোকের নিশ্চয়ই শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই রীতিমতন ঘৃণার সঙ্গেই লোকটিকে ফেলে দিয়েছিল মধুময়।

দ্বিতীয়বার পেল সে মাত্র সাতাশ টাকা! রতন খুব আপশোসের সঙ্গে বলেছিল, ও শালা মহা কঞ্জুস। অত বড়ো পেটমোটা ব্যাগের মধ্যে রেখেছিল মাত্র একশো তিরিশ টাকা! শালা!

ব্যাগে সত্যিই কত টাকা ছিল, সেটা জানবার উপায় নেই মধুময়ের। সেটা রতন যা বলবে, তা-ই বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু মধুময় জানে, দলপতিকে অবিশ্বাস করতে নেই। তা ছাড়া, কাজটাই তার খুব ভালো লাগছে, সে কিছু খারাপ লোককে শাস্তি দিচ্ছে! টাকাটাই তো প্রধান উদ্দেশ্য নয়!

কিন্তু এই টাকাটা পকেটে রাখলেই যেন মধুময়ের পকেট জ্বলতে থাকে। তক্ষুনি ইচ্ছে করে খরচ করে ফেলতে। মধুময়ের অন্তত দুটো গেঞ্জি কেনার দরকার, সে-কথা মাকে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। কিন্তু নিজের রোজগার করা টাকা দিয়েও সে গেঞ্জি কিনল না। ছুটে চলে গেল স্বপ্নার কাছে। যাওয়ার পথে একটা দোকান থেকে কিনে নিয়ে গেল রাজশেখর বসুর রচনাবলির একটি খন্ড। স্বপ্না একদিন বলেছিল, রাজশেখর বসুর বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। খুব পড়তে ইচ্ছে করে।

উপহারটা পেয়ে খুশি হয়েছিল স্বপ্না। কিন্তু সেইসঙ্গে বলেছিল, তোমার কী যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে আজকাল!

মধুময় চমকে উঠে বলেছিল, কই না তো! তুমি কী পরিবর্তন দেখলে?

 কীরকম যেন একটা ছটফটে ভাব! এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পার না! আগে তো এ-রকম ছিলে না।

মধুময় হেসে বলেছিল, বেকাররা একটু ছটফটেই হয়।

 নিজেকে সবসময় বেকার বোলো না তো! আমার শুনতে ভালো লাগে না।

আমি আর বেশিদিন বেকার থাকব না অবশ্য।

কোথাও চাকরি পাচ্ছ বুঝি?

চাকরি ছাড়া বুঝি পুরুষমানুষ আর অন্য কোনো কাজ করতে পারে না?

খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল।

মধুময় আজকাল অধিকাংশ সময়েই বাড়িতে থাকে। আগে থাকত না। বেকার ছেলেদের পক্ষে বাড়িতে বসে থাকা একটা লজ্জার ব্যাপার। খেয়েদেয়ে রোজ দুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মোটা হওয়া বেকার ছেলেদের পক্ষে বড়োই বেমানান। লোকে তাতে আরও বেশি উপহাস করে। বেকাররা রোগা হবে, তাদের চোখের কোণে কালি থাকবে, মেজাজ হবে খিটখিটে, এটাই যেন স্বাভাবিক। যেন দেখলেই বেকার বলে চিনতে পারা যায়। পরিচ্ছন্ন পোশাক, পরিপাটিভাবে চুল আঁচড়ানো, সুন্দর চেহারার বেকার দেখলে বাকি সব লোকেদের কেমন যেন অস্বস্তি হয়।

মধুময়ও আগে বোতাম খোলা শার্ট আর রবারের চটি পরে, চুল না আঁচড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। দুপুর বেলা নাকেমুখে কোনোরকমে খানিকটা ভাত গুঁজে খুব ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কোনো পার্কে গিয়ে শুয়ে থাকত গাছের ছায়ায়।

চাকরি পাওয়াটাই বড়োকথা নয়, সবসময় এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যেন চাকরির জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা হচ্ছে। আর চাকরির চেষ্টা মানে তো শুধু দরখাস্ত লেখা নয়, গুরুত্বপূর্ণ লোকদের ধরাধরি কর।

কিন্তু মধুময় আর দুপুর রোদ্দুরে ঘোরাঘুরি করা ছেড়ে দিয়েছে। সে দুপুরে ঘুমোয় না অবশ্য, বই পড়ে কিংবা ছবি আঁকে।

মা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, কিছু সুবিধে হল রে, খোকা? তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলেন।

মধুময় করুণ মুখ করে বলে, দেখো মা, চাকরি নেই বলে রোজ লোকের কাছে অপমান সইতে পারব না। হাজার হোক ভদ্রলোকের ছেলে। চাকরি যেদিন হওয়ার সেদিন হবেই। তার আগে রোজ রোজ লোকের কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করা–

মা চুপ করে যান। এটা যে, মধুময়ের একটা নতুন কায়দা সেটা তিনি বুঝতে পারেন না। এমনকী ওই করুণ মুখভঙ্গিটাও অভিনয়। মধুময়ের নতুন খেলার পক্ষে এটা খুব দরকারি।

শতকরা নিরানব্বইজন প্রৌঢ়ার মতন মধুময়ের মা-ও নিয়তিতে বিশ্বাস করেন। সুতরাং, চাকরি যেদিন হওয়ার সেদিন হবেই, এইকথা তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। মধুময়ের বাবা এখনও ভালো চাকরি করছেন, সংসারে খুব একটা অনটন নেই। তবে ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বেকার বসে আছে, এটাই যা লজ্জার ব্যাপার। তিন বছর হয়ে গেল।

বেকার ছেলেদের প্রেম করতে নেই। অন্তত প্রকাশ্যে। আগে মধুময় স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করতে যেত গোপনে গোপনে। কিন্তু এখন সে ইচ্ছে করেই সবাইকে জানিয়ে দেয় স্বপ্নার কথা। এটাও তার নতুন কৌশল।

সকাল বেলা সে তার বোন রুমিকে বলে, তোর কাছে মেঘদূতের কোনো অনুবাদ বই আছে? একবার দিস তো, স্বপ্না চাইছিল। অর্থাৎ সে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিতে চায় যে, আজ সে স্বপ্নার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

সপ্তাহে তিনদিন স্বপ্না গানের ক্লাসে যায়। ওর ক্লাস শেষ হয় আটটার সময়। সেই তিন দিন ঠিক আটটা দশে হাজরা মোড়ে দাঁড়ালে দেখা হয় স্বপ্নার সঙ্গে।

কিন্তু মধুময় বাড়ি থেকে বেরোয় দুটোর সময়। মাঝখানে ঘণ্টাপাঁচেক তার অন্য কাজ থাকে। মধুময়ের বাড়ির কেউ তো জানতে পারছে না যে, স্বপ্নার সঙ্গে ঠিক ক-টার সময় দেখা করতে যাবে। রাস্তায় কিংবা বাড়িতে।

সন্ধ্যে বেলা বেরিয়ে সে চলে আসে শিয়ালদা স্টেশনে। তার নতুন বন্ধুরা কাছাকাছি কোনো চায়ের দোকানে অপেক্ষা করে আগে থেকে। এক-একদিন এক-এক জায়গায়।

এই সময়টায় শিয়ালদা স্টেশনে সাংঘাতিক ভিড়। সবাই দারুণ ব্যস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করে। কারুর কোনো দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে মধুময় তার বন্ধুদের সঙ্গে ভেতরে গিয়ে অলসভাবে ঘুরে বেড়ায়। আসলে তীক্ষ্ণচোখে নজর রাখে যাত্রীদের ওপর। তারপর বেছে বেছে একজনকে ঠিক করে। সেই লোকটির চেহারায় কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। তাকে শুধু সচ্ছল হলেই চলবে না, তাকে নিষ্ঠুরও হতে হবে। দেখলেই যাতে বোঝা যায়, এই লোক অন্য অনেককে ঠকায়। অপরের রক্তশোষণ করেই সে বেঁচে আছে। কিংবা, এই লোক খাবারে ভেজাল মেশায়, কিংবা বেবিফুড ব্ল্যাক করে। শুধু চেহারা দেখেই এতখানি বুঝে নিতে হয়।

কোনো একটা ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়, সেইসময় কাজ শুরু করে মধুময়। এই সময় একটা দারুণ হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মধুময়ের অন্য বন্ধুরা তখন আলাদা হয়ে গেছে, কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না। মধুময় দৌড়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে সেই বেছে রাখা লোকটিকে খুবজোরে ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটা এমনভাবে দিতে হয়, যাতে সে ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে।

প্রথম প্রথম মধুময় ধাক্কা মেরে নিজেও দৌড়ে পালাত। এখন আর তা করে না, সে নিজেই লোকটিকে টেনে তোলে। অন্য লোকেরাও সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। দু-এক মিনিট সময় লাগে। তারমধ্যেই লোকটির ব্যাগ হাওয়া। রতন কিংবা ধনা ব্যাগটা নিয়ে মিশে যায় ভিড়ের মধ্যে।

মধুময় লোকটিকে সমবেদনা জানায়। অন্যদের সঙ্গে মিলে সেও ব্যাগটা খোঁজবার ভান করে। তার আগে সে নিজেই লোকটিকে ধমক দেয়–আপনার চোখ নেই মশাই, ট্রেন এসেছে বলে এমন অন্ধের মতন ছুটতে হবে!

মধুময়কে সন্দেহ করার উপায় নেই। তার দুর্দান্ত সুন্দর চেহারা, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার মতন সাজপোশাক। তার ব্যবহার কত ভদ্র।

স্টেশন থেকে ব্যাগ-ট্যাগ ছিনতাই করে ছিঁচকে চোরেরা। সকলেরই ধারণা, সেইসব ছিঁচকে চোরদের একটা টিপিক্যাল চেহারা আছে। তাদের মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, ইঁদুরের মতন লম্বাটে মুখ আর চঞ্চল চোখ। লোকেরা সেইরকম চেহারায় কারুকেই ভিড়ের মধ্যে খোঁজে।

ট্রেন ছাড়ার সময় হলে মধুময় ট্রেনে উঠে পড়ে। উলটোডাঙা বা দমদম পর্যন্ত চলে যায়। তারপর সেখানে নেমে আবার উলটো দিকের ট্রেন ধরে শিয়ালদা ফিরে আসে। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টার বেশি লাগে না।

মৌলালির মোড় থেকে একটু বাঁ-দিকে বেঁকলে যে-পার্কটা, সেখানে অপেক্ষা করে রতনরা। টাকাপয়সা তক্ষুনি ভাগ হয়ে যায়। লোক চিনতে খুব ভুল না হলে, রোজগার হয় বেশ ভালোই। এক-এক দিন চার-পাঁচ হাজার টাকাও থাকে ব্যাগে। দু-শো-আড়াই-শোর কমে কোনোদিন না।

সপ্তাহে একদিন শিয়ালদায়, পরের সপ্তাহে হাওড়ায়, তার পরের সপ্তাহে ডালহৌসিতে এবং তারপর একদিন চৌরঙ্গিতে সিনেমাপাড়ায়। মাসে মোট চার দিন কাজ। হাজার বারো শো টাকা হেসে-খেলে পাওয়া যায়।

টাকা ভাগাভাগির পর রতন আর ধনারা যায় ফুর্তি করতে। মধুময় কিন্তু আর ওদের সঙ্গে থাকে না। তার অন্য কাজ আছে।

ঠিক আটটা দশে সে পৌঁছে যায় হাজরা মোড়ে। তার মুখে বিন্দুমাত্র উত্তেজনার চিহ্ন নেই।

 স্বপ্না এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ?

মধুময় হাসিমুখে বলে, অন্তত আধঘণ্টা।

স্বপ্না বলে, তুমি আচ্ছা পাগল! এরকমভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কী দরকার? বাড়িতে আসতে পার-না? আমি তো রোজ গানের স্কুলে আসি না।

মধুময় বলে, আমার এ-রকম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেই ভালো লাগে, ঠিক নতুন প্রেমিকদের মতন মনে হয়।

সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়েস থেকে স্বপ্না মধুময়ের বান্ধবী। সবাই জানে, মধুময় একদিন স্বপ্নাকে বিয়ে করবে। একটা ঠিকমতন চাকরি পেলেই হয়।

টাকাগুলো খরচ করাই এক ঝামেলা। স্বপ্না বেশ সচ্ছল পরিবারের মেয়ে হলেও শখ করে পাড়ার একটা মর্নিং স্কুলে পড়ায়। অর্থাৎ তার একটা বৈধ রোজগারের পথ আছে। নিজের খরচ সে নিজেই চালায় এবং যেহেতু তার প্রেমিক বেকার, তাই সে ধরেই নিয়েছে যে, দু জনে কোনো রেস্তোরাঁয় যেতে গেলে স্বপ্নাই ব্যাগ থেকে টাকা বার করে দেবে।

মধুময় তাতে আপত্তি করে নিজে টাকা দিতে গেলেই স্বপ্না জিজ্ঞেস করে, তুমি টাকা কোথায় পেলে?

মধুময় নিজেই একসময় স্বপ্নার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। সুতরাং হঠাৎ তার পকেটে অনেক টাকা থাকার ব্যাখ্যা দেওয়া তার পক্ষে সত্যিই শক্ত। তাই সে একগাল হেসে বলল, আমার রিস্টওয়াচটা আজ বিক্রি করে দিলাম।

কেন?

বেকারের হাতে ঘড়ি মানায় না।

যাঃ, বাজে কথা বলো না। আমাকে জিজ্ঞেস না করে কেন বিক্রি করলে?

জিজ্ঞেস করলে তুমি আপত্তি করতে, সেইজন্য।

আমি তোমাকে আর একটা ঘড়ি কিনে দেব।

অথচ মধুময়ের পকেটে তখন অনেক টাকা। একজন বেকারের তুলনায় তো বটেই, তার বয়েসি অনেক ছেলের তুলনাতেই সে বেশ সচ্ছল। পকেটে হাজার খানেকের বেশি টাকা রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছেমতন খরচ করার উপায় নেই। একজন বেকার দু-হাতে টাকা ওড়াচ্ছে– এ কি কেউ কখনো দেখেছে?

স্বপ্না এত বেড়াতে ভালোবাসে, মধুময় ইচ্ছে করলেই ট্যাক্সি ভাড়া করে তাকে নিয়ে চলে যেতে পারে ব্যারাকপুরে বা ডায়মণ্ড হারবারে। কিংবা আরও দূরে। অবশ্য খুব বেশি দূরে নয়, কারণ সে-দিনের মধ্যেই ফিরতে হবে। কোথাও তার সঙ্গে স্বপ্না রাত্রে থাকবে, একথা কল্পনাই করা যায় না।

স্বপ্না এখনও ভাবে, বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েদের সাধারণ আলিঙ্গন চুম্বনও পাপ। স্বপ্নার অসাধারণ সারল্য ও সততার জন্য তার কলেজের বান্ধবীরাও কখনো তাকে তাদের গোপন কথা বলেনি।

এত সরল বলেই স্বপ্নাকে কক্ষনো ঠকাতে ইচ্ছে করেনি মধুময়ের। কিন্তু সে যে কিছুদিন ধরে দু-রকম জীবনযাপন করছে, সে-কথা স্বপ্নাকে কিছুতেই জানাতে পারে না।

যদিও মধুময়ের মনে মনে যুক্তির অভাব নেই। সে তো কোনো অন্যায় করছে না। তার স্বাস্থ্য ভালো, পড়াশুনোয় মাঝারি, সে তো সৎভাবে থেকে এই দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বেকার আখ্যা দিয়ে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর।

বাড়ির লোকের অনুরোধে মধুময় ডব্লু বি সি এস পরীক্ষা দিয়েছিল। পাশও করেছে। প্যানেলে নাম আছে তার। কিন্তু কবে চাকরি হবে কোনো ঠিক নেই। তার দু-বছর আগে যাদের প্যানেলে নাম উঠেছিল, তারাও অনেকে চাকরি পায়নি এখনও। এ কীরকম ব্যবস্থা, যেখানে পনেরো হাজার ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর চাকরি পায় মাত্র বাইশজন? বছরের পর বছর এই অদ্ভুত কান্ড চলছে। এরই ওপর দেশ টিকে আছে।

মধুময় কেন নিজেকে বঞ্চিত করবে? কেন চব্বিশ বছর বয়সেও তাকে বাবা-মায়ের কাছে হাত পেতে ট্রাম-বাস-ভাড়া কিংবা সিগারেটের খরচ চাইতে হবে? তাই সে কেড়ে নিচ্ছে। যাদের বেশি আছে, কেড়ে নিচ্ছে তাদের কাছ থেকে। চোরের ওপর বাটপাড়ি করাটা কি একটা অপরাধ? মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন, সেই সময়টা তারা বঞ্চিত নিঃস্ব হয়ে থাকবে কেন?

মধুময়ের এক কাকা বাড়িতে এসে একদিন বললেন, শোন, তোর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি আমি। শুধু শুধু বাড়িতে বসে আছিস

মধুময় অমনি একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। তার চাকরির জন্য আত্মীয়স্বজনেরা সবাই যেন খুব চিন্তিত। এই জিনিসটাই তার ভালো লাগে না। সে কি সবার করুণার পাত্র? তার জন্য অন্যরা ব্যবস্থা করে দেবে কেন? তার নিজের কি যোগ্যতা নেই?

কাকা বললেন, আমাদের পাড়ার স্কুলের আমি কমিটি-মেম্বার। তুই এ-স্কুলে ঢুকে পড়।

 মধুময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, স্কুলে?

হ্যাঁ, বেশি খাটুনি নেই। স্কুলে তো প্রায়ই ছুটিছাটা থাকে। তার ওপর গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটি–

স্কুলে পড়ানো আমার পোষাবে না।

কেন–পোষাবে না কেন? তোকে তো আর বরাবর স্কুলের মাস্টারি করতে বলছি না। যত দিন তুই ভালো চাকরি না পাস… শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে এ অনেক ভালো… তারপর মাস গেলে শ-আড়াই টাকা, মন্দ কী।

আড়াইশো টাকা?

মনে কর ওটা তোর হাত-খরচ।

আড়াইশো টাকার জন্য রোজ সকালে স্নান করে ভাত খেয়ে বেরোতে হবে– থাকতে হবে দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত। অথচ আমারই মতন বি এসসি পাশ করে যারা ব্যাঙ্কে বা এল আইসি-তে কিংবা কোনো কমার্শিয়াল ফার্মে ঢোকে, তারা দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করার জন্য অন্তত সাত-আট-শো টাকা পায়।

সেরকম চাকরি যতদিন না পাচ্ছিস.. স্কুলে থাকতে থাকতেই অন্য জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে পারিস… আজকাল তো অনেক ভালো ছেলেই বসে না থেকে স্কুলের চাকরিতে ঢুকে পড়ে। তারপর নানা জায়গায় দরখাস্ত পাঠায়, কিংবা পরীক্ষা দেয়। দু-এক বছরের মধ্যে কিছু একটা পেয়েও যায়।

মেজোকাকা, আমার স্কুলে পড়াবার যোগ্যতা নেই।

 বি এসসি পাশ করেছিস, আর স্কুলের ছেলেদের তুই পড়াতে পারবি না?

সবাই কি পড়াতে পারে?

 কেন পারবে না?

সেইজন্যই তো আজকাল স্কুলগুলোর এই অবস্থা!

মধুময়ের মাকে মেজোকাকা বললেন, ও বউদি, শুনুন, আপনার ছেলের কথা। ওর জন্য একটা স্কুলের কাজ জোগাড় করে আনলাম, ও তাতে রাজি নয়। শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে আড়াইশো টাকা পেত।

মধুময়ের মা চট করে কোনো মন্তব্য করলেন না। ছেলের মেজাজ তিনি জানেন। একবার কোনো ব্যাপারে না বললে সহজে আর হ্যাঁ করানো যায় না।

মেজোকাকা বললেন, স্কুলে তো আজকাল পড়াশুনো প্রায় হয়ই না। প্রায়ই স্ট্রাইক-ফাইক লেগেই থাকে। সেইজন্যই বলছিলাম, একবার ঢুকে পড়তে পারলে ঠায় বসে বসেই মাইনে পেত।

মা আস্তে আস্তে বললেন, ও বোধ হয় স্কুলের কাজ পারবে না। একসঙ্গে অতগুলো ছেলেকে সামলানো…

মধুময় বলল, তুমি ঠিকই ধরেছ মা। সবাই কি সব জিনিস পারে? আমার দ্বারা মাস্টারি করা হবে না।

বাড়িতে থাকলে মেজোকাকার সঙ্গে আরও তর্কবিতর্ক করতে হবে বলে মধুময় একটা ছুতো দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

ভেতরে ভেতরে রাগে সে ফুঁসছে।

কোনো চাকরি পাচ্ছে না বলেই সে স্কুলে পড়াবে? স্কুলে পড়ানোটা এতই সহজ কাজ? অযোগ্যতা নিয়ে কিংবা অযত্নের সঙ্গে স্কুলের ছেলেদের পড়ানোটা অন্যায় নয়? অন্য চাকরির চেষ্টা করতে করতে স্কুলে দু-এক বছর কাটিয়ে মাইনে নেওয়ার চেয়ে, একজন চোরাকারবারির টাকা ছিনিয়ে নেওয়া কি বেশি অন্যায়?

মঙ্গলবার রাত পৌনে এগারোটার সময় একটা ঘটনা ঘটল।

সন্ধ্যে থেকে একটা লোককে অনুসরণ করছিল মধুময় ও তার বন্ধুরা। লোকটা মেট্রো সিনেমা থেকে বেরিয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির সঙ্গে লোকটার চেহারায় বা ব্যবহারে কোনো মিল নেই। লোকটার মুখখানা হিংস্র ধরনের, একটা দামি প্যান্ট ও সিল্কের হাওয়াই শার্ট পরা, হাতে সোনার ব্যাণ্ডের ঘড়ি। মেয়েটি পরে আছে সাধারণ একটা তাঁতের শাড়ি, মুখখানা লাজুক লাজুক। এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে ওই ধরনের পুরুষদের যোগাযোগ হয় একটিমাত্র উপায়েই। টাকার জোরে।

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে লোকটি ওই মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকল একটি বারে। এখানে পর্দাঘেরা কেবিন আছে। সেখানে ওরা বসে রইল দু-ঘণ্টা। মধুময়ের বন্ধু রতন আর ধনাও বারের মধ্যে গিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। মধুময় বাইরে ঘোরাঘুরি করতে লাগল।

সেই বার থেকে বেরিয়ে লোকটি আর মেয়েটি হাঁটতে লাগল। লোকটির চোখ লালচে হয়ে এসেছে, মুখের চামড়া চকচক করছে। মেয়েটি কিছু পান করেছে কি না বোঝা যায় না।

চৌরঙ্গি তখন আলোকোজ্জ্বল। প্রচুর লোকজন, এখানে কিছু করার উপায় নেই। ওরা যদি হাঁটতে হাঁটতে জাদুঘরের দিকে যায়, তাহলেই মধুময়ের সুবিধে। ওদিকটায় অন্ধকার থাকে।

কিন্তু ওরা গ্র্যাণ্ড হোটেল পেরিয়ে এসেও আবার ফিরল। গ্র্যাণ্ড হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসে ওরা দাঁড়াল। লোকটি মেয়েটিকে হোটেলের মধ্যে নিয়ে যেতে চায়, অথচ মেয়েটি যাবে না। এত বড়ো হোটেলে ঢুকতে মেয়েটি বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছে। লোকটি একটুক্ষণ হাত-পা নেড়ে মেয়েটিকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল। মেয়েটি তবু যাবে না। তখন ওরা ঢুকল গ্র্যাণ্ড হোটেলের নীচেই আর একটা বারে। ওরা আরও খাবে। এবার বেরোল সাড়ে দশটার সময়। বেশি চেষ্টা করতে হল না, সহজেই পেয়ে গেল একটা ট্যাক্সি। দরজা খুলে মেয়েটি আগে উঠল, লোকটি কিন্তু উঠল না। জানলা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে বলতে লাগল কী যেন সব। তারপর হাতের ঝোলানো ব্যাগ খুলে কিছু টাকা তুলে দিল মেয়েটির হাতে।

ট্যাক্সি চলে যাওয়ার পর লোকটি দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। ওকে যে কেউ লক্ষ করছে, ও তা জানে না।

লোকটা রাস্তা পেরিয়ে চলে এল গ্র্যাণ্ড হোটেলের উলটো দিকে। যেখানে প্রাইভেট গাড়িগুলো পার্ক করা থাকে। লোকটা কি নিজের গাড়ি এখানে রেখে এতক্ষণ পায়ে হেঁটে ঘুরছিল? নিজের গাড়ি থাকতেও সে মেয়েটিকে ট্যাক্সিতে করে পাঠিয়ে দিল? মানুষ কেন এমন করে কে জানে!

এদিকটায় বেশ অন্ধকার।

হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে লোকটির সামনে এসে দাঁড়াল মধুময়। খুব ব্যস্তভাবে দৌড়োবার ভঙ্গি করে খুব জোরে ধাক্কা দিল লোকটাকে। কতটা জোরে ধাক্কা দিতে হবে, তা মধুময়ের এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। লোকটা মাটিতে পড়ে যেতেই রতন আর ধনা এগিয়ে এসে নিপুণ হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।

কিন্তু মধুময় চলে যাওয়ার আগেই লোকটি তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাতে চেপে ধরল মধুময়কে। লোকটার গায়ে বেশ জোর।

চেঁচিয়ে উঠল, শালা, তুম ধাক্কা মারা! কাহে মারা!

মধুময় নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। কিন্তু একটুও দেরি করবার উপায় নেই। লোকটার চিৎকার শুনে এক্ষুনি লোক জড়ো হয়ে যাবে।

মধুময় প্রচন্ড জোরে দু-খানা ঘুসি মারল লোকটার থুতনিতে।

লোকটা মার ডালা, মার ডালা বলে চেঁচিয়ে উঠল। ততক্ষণে কিছু লোক পৌঁছে গেছে সেখানে।

মধুময়ের বুক কাঁপছে, কিন্তু মুখখানা শান্ত। সে আদৌ পালাবার চেষ্টা করল না।

লোকটা হাউ মাউ করে বলতে লাগল, হামারা ব্যাগ-বহুত রুপিয়া থা–ইতনা বড়া হ্যাণ্ড- ব্যাগ!

মধুময় বিরক্তির সঙ্গে বলল, আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো? যতসব পেঁচি মাতাল?

অন্য লোকেরা এসে প্রশ্ন করতে লাগল, কী হয়েছে দাদা–কী হয়েছে?

লোকটি বলল তার ব্যাগ হারাবার কথা।

মধুময় চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল, কত বড়ো ব্যাগ?

লোকটা দু-হাত তুলে ব্যাগের মাপ দেখাল। লোকটার ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

মধুময় হেসে অন্যদের বলল, দেখুন তো কী ঝামেলা! এসব লোকদের পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত!

লোকটা মাতাল। কথা বলছে জড়িয়ে জড়িয়ে। সবাই মাতালের বিপক্ষে যায়। তা ছাড়া অত বড়ো একটা হ্যাণ্ডব্যাগ যে মধুময় নেয়নি তা তো দেখাই যাচ্ছে। তা ছাড়া মধুময়কে কে সন্দেহ করবে? তার সুন্দর চেহারা, মাথার চুল নিপাটভাবে আঁচড়ানো, কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্ব আছে।

কাছাকাছি কোথাও ব্যাগটা নেই। সুতরাং পুরো ব্যাপারটাই মাতালের প্রলাপ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। লোকটার জড়ানো কথার মধ্যে এইটুকু শুধু বোঝা গেল, এদিকে তার গাড়ি নেই, সে এদিকে এসেছিল হিসি করবার জন্য।

লোকটিকে ভিড়ের হাতে সঁপে দিয়ে মধুময় ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল।

এই তার প্রথম বাধা। যদি পুলিশ আসত, পুলিশ অবশ্য কিছুই প্রমাণ করতে পারত না। কলকাতা শহরে চলতে চলতে তো মানুষের সঙ্গে মানুষের ধাক্কা লাগেই। আর মধুময় নিজে কোনোদিন ব্যাগ কেড়ে নেয় না।

পুলিশকে মধুময় ভয় পায় না। ভয়টা শুধু জানাজানি হয়ে যাওয়ার–যদি চেনাশোনা কোনো লোক হঠাৎ দেখে ফেলে? যদি ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ কোনোদিন বেরিয়ে আসে স্বপ্নার দাদা? যদি সেই সময়েই রতনরা ব্যাগটা নিয়ে পালাতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়?

কিন্তু এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। ঝুঁকি না নিলে, জীবনে কোনো কাজই করা যায় না।

লোকটাকে ঘুসি মারার জন্য মধুময়ের একটুও অনুতাপ হয়নি। লোকটা যে একটা জাত শয়তান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লোকটা নিরীহ মেয়েদের সর্বনাশ করে টাকার জোরে। এসব টাকা ওরা পায় কোথায়? লোকটা ওই মেয়েটিকে গ্র্যাণ্ড হোটেলে নিয়ে যেতে চাইছিল। এক সন্ধ্যেতে গ্র্যাণ্ড হোটেলে কত টাকা খরচ হয়? অনেক কেরানির এক মাসের মাইনের চেয়েও বেশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *