দ্য টাইগার’স প্রে – উইলবার স্মিথ / টম হারপার
অনুবাদ: অসীম পিয়াস
উৎসর্গ : বইটি উৎসর্গ করছি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী নিসো-কে, দিন রাত্রির প্রতিটি ক্ষণ যে আমার পৃথিবী আলোকিত করে রেখেছে।
ভাষায় যতোটা প্রকাশ করা সম্ভব, তার চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়।
.
.
ডাওজার নামের জাহাজটায় বিশাল বিশাল অনেকগুলো পাল। সেই সাথে মালপত্রে বোঝাই। উষ্ণ মৌসুমি বায়ু চাবুকের মতো বাড়ি দিয়ে সমুদ্রের নীল বুকে সফেদ রেখা একে দিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই, ঝকঝকে। ফলে সূর্য কিরণ পড়ে দাগগুলো ঝিকমিক করে উঠছে। বাতাসে জাহাজের পালগুলো ফুলে আছে, মাস্তুলের সাথের বাঁধনগুলো এতো টানটান হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে এখুনি ছিঁড়ে যাবে। ভারী জাহাজটা ভারত মহাসাগরের ঢেউয়ের তালে একবার উপরে উঠছে আর নামছে। আসলে জাহাজটা প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে।
ডাওজারের মাস্টার জোশিয়াহ ইঞ্চবার্ড জাহাজের পিছনে দাঁড়িয়ে পিছু ধাওয়াকারী জাহাজটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের আলো ফোঁটার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে ওটাকে। লম্বা, সরু জাহাজটা একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতোই ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওটার কালো গায়ে লাল রঙ করা কামানের চারকোণা খোপ চিহ্নিত করা। ধীরে ধীরে কমছে জাহাজ দুটোর
ইঞ্চবার্ড মাথার উপরের পালগুলোর দিকে তাকালো। বাতাস একধারে বয়েই চলেছে, পালগুলোও তাই এখনো টানটান হয়ে আছে। এভাবে যদি চলতেই থাকে তাহলে ছিঁড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে না, কিন্তু আবার এই ঝুঁকিটা না নিলেও সর্বনাশ হওয়াটা নিশ্চিত।
“মি. ইভান্স,” ফাস্ট মেট-এর দিকে হাক ছাড়লো জোশিয়াহ। “সবাইকে দ্রুত স্টেসেইল (জাহাজের আগা থেকে মাথা পর্যন্ত যে পাল খাটানো হয়) টাঙ্গাতে বলো।”
মিস্টার ইভান্সের বাড়ি ওয়েলশ। বয়শ তিরিশের শেষ দিকে। সে উপরের পালগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। “এই বাতাসের ভিতর স্যার? আর বেশি হলে মাস্তুল ভেঙে যাবে।”
“ঠিক বলেছো মি. ইভান্স, কিন্তু তোমার কাজ আমার কথার উপর কথা বলা না, তোমার কাজ আমার কথা শোনা। গতি আর আধা নট বাড়াতে পারলেও বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে।”
ইঞ্চবার্ড প্রায় বিশ বছর যাবত এই সাগরে জাহাজ চালাচ্ছে। প্রতি পদে পদে মামা চাচার জোরওয়ালা লোকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজের যোগ্যতায় আজ ও এই অবস্থানে এসেছে। ভারত আর স্পাইস দ্বীপের জঘন্য সব বন্দরের এমন সব অভিযান থেকে ও বেঁচে ফিরে এসেছে যেসব অভিযানে অর্ধেক ক্রু তাদের বিছানাতেই সমাহিত হয়ে আছে। আর এখন, এই মুহূর্তে ও নিজের জাহাজকে বিপদে ফেলতে পারবে না।
“করছেন কি?”
কথাটা বললো একজন মহিলা। স্বরটা শান্ত কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ। পিছন থেকে এসেছে কথাটা। কয়েকজন ক্রু দড়ি বেয়ে মাস্তুলে ওঠা থামিয়ে থমকে গেলো। সাগরের অথৈ জলের মাঝে তিন সপ্তাহ কাটানোর পর একজন মহিলার মুখ দর্শন সত্যিকার অর্থেই বড় মনোরম।
ইঞ্চবার্ড দ্রুত ঠোঁটের আগায় চলে আসা গালিটা আটকালো। “সেনোরা দুয়ার্তে। এসব আপনার ভাবার বিষয় না। আপনি বরং নিচের ডেকে থাকলেই ভালো করবেন।”
দুয়ার্তে উপরের দিকে তাকালো। বাতাসে ওর লম্বা কালো চুল উড়ছে। তার মাঝখানে ওর জলপাই রঙের সুন্দর মুখটা দেখা যাচ্ছে। ও এতোটাই হ্যাংলা যে দেখে মনে হচ্ছে আর একটু জোরে বাতাস দিলেই উড়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়বে। কিন্তু নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ইঞ্চবার্ড জানে যে মেয়েটা মোটেও ততোটা দুর্বল নয়।
“অবশ্যই এটা আমার ভাববার বিষয়,” দুয়ার্তে বললো। “জাহাজের কিছু হলে আমরা সবাই-ই মারা পড়বো।”
লোকগুলো তখনও ঝুলতে ঝুলতে ওকে দেখেই চলেছে। ফার্স্ট মেট ইভান্স তা দেখে চেঁচিয়ে উঠলো, “কাজে মন দে সবাই। নইলে হাতের রশি দিয়ে পিটাবো কিন্তু।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার উঠতে শুরু করলো সবাই। ইঞ্চবার্ড টের পেলো, এই মহিলার উপস্থিতি ওর খবরদারি ফলানোতে সমস্যা করছে।
“নিচে যান,” আদেশ দিলো ও। “জলদস্যুরা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে কি করবে সেটা কি আমাকে বলে দিতে হবে?”
“সর্বনাশ,” মাস্তুলের মাথায় দাঁড়ানো লোকটা চেঁচিয়ে বললো। “ওরা পতাকা তুলে দিয়েছে। তারপর এতো জোরে যীশুর নাম ধরে ডাক দিলো যে নিচের সবাই শুনতে পেলো।
অবশ্য লোকটা না বললেও চলতো। সবাই দেখতে পেয়েছে ততোক্ষণে ওদের শত্রু জাহাজের মূল মাস্তুল থেকে একটা কালো পতাকা উড়ছে, তার নিচেই উড়ছে আর একটা লাল পতাকা।
এর মানে হচ্ছে, কাউকেই জ্যান্ত ছাড়া হবে না!
*
পতপত করে উড়তে থাকা পতাকা দুটো দেখতে পেয়ে ফাইটিং কক-এর ক্যাপ্টেন জ্যাক লেগ্রাঞ্জের মুখে ক্ষুধার্ত একটা হাসি ফুটে উঠলো। মাদাগাস্কারের উপকূলে প্রথমবার চোখে পড়ার পর থেকেই, গত তিন দিন ধরে ওরা সামনের মার্চেন্টম্যানটা (ব্যবসার উদ্দেশ্যে মালবাহী জাহাজ) ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে। জাহাজটা বন্দর ছাড়তে দেরি করে ফেলেছে, এ কারণে ভারত মহাসাগরের জলদস্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে যে পাহারাদার জাহাজের দলটা আছে সেটার সাথে আসতে পারেনি। রাতে প্রচুর বাতাস হয়েছে, সে কারণে লেগ্রাঞ্জ জাহাজের সবগুলো পালই তুলে দিয়েছে, আশা করছে ওর জাহাজটা সামনের পেটমোটা জাহাজটাকে সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। জুয়াটা কাজে লেগেছে বলা যায়, ওরা আর এক কি দেড় লীগ পিছিয়ে আছে মাত্র। আর কিছু পরেই ধরে ফেলবে।
লেগ্রাঞ্জ নিজের জাহাজের দিকে তাকালো এবার। জাহাজটা শুরুতে ব্রিস্টল থেকে দাস আনা নেওয়ার কাজ করতো। পূর্ব আফ্রিকা থেকে আমেরিকার উপনিবেশ আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সব জায়গাতেই চলাচল ছিলো ওটার। লেগ্রাঞ্জ ছিলো এটার ফাস্ট মেট। কিন্তু একদিন চুরি করতে গিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে ধরা পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন ওকে পিটিয়ে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়। পরদিন রাতে, ক্ষতের ব্যান্ডেজের রক্ত শুকানোর আগেই ও ওর পক্ষের নাবিকদের নিয়ে জাহাজ আক্রমণ করে, আর জাহাজ দখল করে ক্যাপ্টেনকে মাস্তুল-এর কাঠে ঝুলিয়ে দেয়। ওরা জাহাজটাকে একটা জনশূন্য খাড়িতে নিয়ে যায়, তারপর জাহাজটার নাবিকদের থাকার জায়গাটা পুরো ভেঙ্গে ফেলে খোলের দুপাশে এক ডজন বন্দুকের খোপ তৈরি করে নেয়। নিজেদের বিনোদনের জন্যে সুন্দর কয়েকটাকে রেখে স্বাস্থ্যবান দাসগুলোকে বেঁচে দেয় ওরা। দুর্বল আর রোগাগুলোকে হাত পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। জাহাজের যেসব ক্রু ওদের দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় ওদেরও একই পরিণতি হয়। জাহাজটা আগে শুধু নামেই যোদ্ধা ছিলো, এখন কাজেও হয়েছে। এখন ওটা এমন এক শিকারি যেটা সাগরের বুকের বড় বড় জাহাজগুলো বাদে আর সবকিছুকেই শিকার করতে পারে।
“বো চেজারটা (জাহাজের সামনে বসানো কামান) থেকে গোলা ছোড়ো,” আদেশ দিলো ও। “পাছায় বাড়ি খেয়ে ওটা আর কদ্দূর যেতে পারে দেখা যাক।”
“আর একটা পালও যদি ভোলা হয়, তাহলে ওদের বড় মাস্তুলটা ভেঙ্গে পড়বে,” পাশ থেকে মেট বললো।
লেগ্রাঞ্জ হাসলো। “একদম ঠিক!”
ওর লোকেরা বো চেজারটায় গোলা ভরতে লাগলো। জাহাজের সামনে পিছনে দুই দিকেই আছে কামান। জাহাজের পাটাতন কিছুটা বাড়িয়ে ওগুলো বসানোর জায়গা করা হয়েছে। বত্রিশ পাউন্ডের গোলা ছুঁড়তে পারে কামানগুলো। গোলন্দাজ লোকটা নিচ থেকে একটা ব্রেজিয়ারে (লোহার পাত্র) কয়লা এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ওরা জাহাজ আর জাহাজের মালপত্র দুটোই চায় কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত হাত ফসকে যায়, তাহলে লেগ্রাঞ্জ দরকার হলে জাহাজটা পুড়িয়ে দেবে তবুও পালাতে দেবে না।
“ওটার কি হবে ক্যাপ্টেন?” মেট জিজ্ঞেস করলো।
জাহাজের পিছন দিকে বহুদূরে দিগন্তের কাছে আরো একটা জাহাজকে : ঢেউয়ের তালে দুলতে দেখা যাচ্ছে। লেগ্রাঞ্জ নিজের পাই গ্লাসটা সেদিকে তাক করলো। জাহাজটা ছোট, এক মাস্তুলের। রোদে পোড়া খোল। বাতাসের তোড়ে প্রায় উড়ে আসছে, মনে হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়তে পড়তেও পড়ছে না। ওটার লোকজন সব জাহাজের ডেক-এ জড়ো হয়ে ওদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। একজনের হাতে একটা টেলিস্কোপ দেখা গেলো, ফাইটিং কক-এর দিকে তাক করাপতাকা দেখে সম্ভবত ব্যাটা এতোক্ষণে নিজের পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছে, আর মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছে যে জলদস্যুরা ওদেরকে রেখে আরো দামী একটা জাহাজের পিছু নিয়েছে।
লেগ্রাঞ্জ মুখ টিপে হেসে হাতের টেলিস্কোপটা নামিয়ে রাখলো। “আগে এদের সাথে বোঝাঁপড়াটা করে নেই। তারপর ওটার দিকে নজর দেওয়া যাবে। আপাতত ওটা আমাদের কোনো ঝামেলা করতে পারবে না।”
*
টম কোর্টনী নিজের টেলিস্কোপ নামালো। লাল আর কালো পতাকাওয়ালা জলদস্যুর জাহাজটা দিগন্ত রেখার কাছে ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায়।
“মার্চেন্টম্যানটা আরো একটা পাল খাটাচ্ছে,” মন্তব্য করলো ও। “এবার সম্ভবত ওরা ওদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।”
জলদস্যুর জাহাজ থেকে আলো ঝলসে উঠলো। এক সেকেন্ড পরেই ওরা কামানের গোলার পানির উপর আছড়ে পড়ার মৃদু শব্দ শুনতে পেলো।
“এখনো সীমার বাইরে,” টমের পাশের লোকটা বললো। কামানের গোলার আঘাতে মার্চেন্টম্যানটার পিছনের কয়েক ক্যাবল দূরের পানি ছিটকে উঠেছে শুধু। লোকটা টমের চাইতে লম্বা, গা ভর্তি মাংস, নড়লেই কিলবিল করে। তার কালো মুখ ভরা অনেকগুলো কাটা দাগ, উঁচু নিচু হয়ে আছে। আফ্রিকার যে উপজাতিতে ওর জন্য সেটার শাস্ত্রীয় আচারের চিহ্ন ওগুলো। সেই ছোট থেকে লোকটা টমের সাথে আছে-এর আগে ছিলো টমের বাবা হাল-এর সাথে। অথচ ওর কালো শরীরটায় এখনো একটা ভাজ-ও পড়েনি কিংবা একটা চুলেও সামান্য পাক ধরেনি। যদিও মাথা সবসময়েই কামিয়ে রাখে।
“বেশিক্ষণের জন্যে না, আবোলি। এই মোটা শরীর নিয়ে জাহাজটা আর বড়জোর কয়েক নট পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে।”
“ওরা আত্মসমর্পণ করলেই বুদ্ধির কাজ করবে। যারা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাদেরকে জলদস্যুরা কি করে সেটা তো জানাই আছে।”
টম ওর পিছনদিকে তাকালো। সামনের দিকে টাঙ্গানো শামিয়ানার নিচে দুজন মহিলা বসে আছে। দুজনেই ওদের কথা কান পেতে শুনছে, আর সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না।
“তার মানে আমাদের আসলে মার্চেন্টম্যানটাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,” অনিশ্চিত স্বরে বললো টম।
আবোলি জানে টমের মাথার ভিতর কি চিন্তা চলছে। “ওদের চল্লিশটা কামান আছে, আর আমাদের বারোটা,” সতর্ক করলো ও। “আর ওদের লোকও কমপক্ষে আমাদের দ্বিগুণ।”
“ওদের সাথে লাগতে যাওয়া চরম বোকামি হবে।”
মহিলাদের দুজনের একজন উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। তার নীল চোখ ঝকঝক করছে। মহিলাকে ঠিক প্রচলিত অর্থে সুন্দরি বলা যাবে : মুখের কাটা বেশি বড়, চোয়াল শক্ত, আর রোদে থাকতে থাকতে মসৃণ চামড়া তামাটে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দেখে ভীষণ রকম প্রাণবন্ত মনে হয়, জীবনে ভরপুর। আশপাশের সবাইও সেই শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। চেহারাটাও দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। ফলে প্রথম দেখাতেই টম ওর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো বলা যায়।
“উজবুকের মতো কথা বোলো না টম কোর্টনী,” ঘোষণা দিলো সে। “তুমি আসলেই ঐ বেচারাদেরকে এই জলদস্যুদের হাতে মরতে ছেড়ে দেবে?” টমের হাত থেকে পাই গ্লাসটা ছিনিয়ে নিতে নিতে বললো ও। তারপর নিজের চোখে দিয়ে বললো, “যদূর জানি ঐ জাহাজে একজন মহিলাও আছে। দস্যুরা জাহাজটা দখল করে ফেললে তার কি অবস্থা হবে জানো না?”
যে লোকটা হাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে টম তার সাথে চোখাচোখি করলো। “তোমার কি মনে হয় ডোরি?”
ডোরিয়ান কোর্টনী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ওরা দুজন ভাই। যদিও খুব কম মানুষই সেটা ধরতে পারে। আরবের মরুভূমিতে থাকতে থাকতে ডোরিয়ানের গায়ের রঙ গাড় বাদামী হয়ে গিয়েছে। মাথায় একটা সবুজ পট্টি বাঁধা। ওর লাল চুলের পুরোটাই তাতে ঢাকা পড়েছে প্রায়। ঢিলেঢালা নাবিকদের পায়জামা পরনে ওর। কোমরে একটা বাকানো ছুরি ঝোলানো।
“আমিও ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছি না।” হালকা চালেই বললো ডোরি। কিন্তু সবাই জানে ওর কথার পিছনে আসলে কতোটা তিক্ততা লুকিয়ে আছে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ওকে দস্যুরা ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। প্রায় দশ বছর খোঁজার পর টম আবার ওকে খুঁজে পায়। সবাই ভেবেছিলো মারা গিয়েছে ও। ডোরিয়ানকে কিনেছিলো মাস্কটের এক হিতৈষী রাজকুমার। ও তার বাড়ির একজন প্রহরী হিসেবে কাজ শুরু করে। পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমিতে আবার যখন ওদের দেখা হয় তখন টম ওকে চিনতেই পারেনি। বলা যায়, মাত্র এক চুলের জন্যে ওরা একজন আর একজনকে খুন করে ফেলেনি সেবার।
“ব্যাপারটা মোটেও সহজ হবে না ক্লিবি,” আবোলি সতর্ক করলো। টমকে ও ক্লিবি নামে ডাকে; ওর মাতৃভাষায় এর মানে হচ্ছে বাজপাখি। দাস ব্যবসায়ীদেরকে আবোলি ভয়াবহ মাত্রায় ঘৃণা করে। ও আফ্রিকার লোজি উপজাতিদের একজন। ওর দুজন স্ত্রী-জিতি আর ফাল্লা। তাদের গর্ভে ওর ছয়টা বাচ্চা জন্ম নেয়। একবার ব্যবসার কাজে আবোলি অনেক দূরে গিয়েছিলো। সেই ফাঁকে আরব দাস ব্যবসায়ীরা গ্রামে আক্রমণ করে ওখানকার লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তার মাঝে জিতি, ফাল্লা আর আবোলির বড় দুই ছেলে-ও ছিলো। বাকি বাচ্চাদেরকে মেরে রেখে যায়। আবোলির ছোট ছোট চারটা ছেলেমেয়েকে গাছের গুঁড়ির সাথে আছাড় মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কারণ ওরা এতো ছোট ছিলো যে ওদেরকে পূর্ব তীরের দাস বাণিজ্যের এলাকায় জোর করে নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ হতো না।
টম আর আবোলি পুরো আফ্রিকা জুড়ে দস্যুগুলোকে খুঁজে খুঁজে মেরেছে। ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছেও হাল ছাড়েনি। এর মধ্যেই জিতি, ফাল্লা আর ওদের জীবিত দুই ছেলেকে মুক্ত করে ওরা। আর দাস ব্যবসায়ীদের উপর চরম প্রতিশোধ নেয়। ছেলে দুটো, মানে যামা আর তুলা এখন প্রায় তরুণ। আবোলি ইদানীং ওদের মুখেও ঐ শাস্ত্রীয় চিহ্ন দেওয়ার কথা ভাবছে। টম জানে ওরাও চিহ্নটা অর্জন করার জন্যে অধীর হয়ে আছে।
“জাহাজটা তো পুরো বোঝাই হয়ে আছে, ডোরিয়ান বললো। মনে হলো যেনো এইমাত্র ব্যাপারটা টের পেয়েছে ও। “মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে একেবারে মোক্ষম জিনিস।”
আবোলি এর মধ্যেই ওর পিস্তল প্রস্তুত করা শুরু করেছে। “তোমার বাবা কি বলতেন জানো নিশ্চয়ই।”
“সবারই উপকার করো, কিন্তু করা শেষে নিজের ফী-টা নিতে ভুলো না।” টম হেসে বললো। “সে যা-ই হোক, কিন্তু মেয়েমানুষ সাথে থাকলে কোনো ঝামেলায় জড়ানো আমার ঠিক পছন্দ না।”
সারাহ ডেকের নিচে গায়েব হয়ে গেলো। একটু পরেই ফিরে এলো একটা সোনালি হাতলওয়ালা তরবারি হাতে করে। হাতলের মাথায় একটা নীলকান্ত মণি ঝিকমিক করছে।
“তুমি কি যাবে টম কোর্টনী? নাকি আমাকেই করতে হবে কাজটা?” জানতে চাইলো ও।
সাগর জুড়ে আরো একটা গোলার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো। এবার অবশ্য মার্চেন্টম্যানটা থেকে কয়েক টুকরো কাঠ উড়ে যেতে দেখা গেলো।
‘হায় খোদা, মিসেস কোর্টনী, আমারতো মনে হয় এমনকি দস্যুরাও তোমার কথা অমান্য করার চাইতে বরং মুঘল সাম্রাজ্যের গুপ্তধনে ভরা ঐ জাহাজটাকে ছেড়ে দেওয়াই বেশি পছন্দ করবে। তুমি কি বলল, ইয়াসমিনি?” শেষের কথাটা ও বললো সারাহের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরি আরব মেয়েটাকে। ও হচ্ছে ডোরিয়ানের স্ত্রী, পরনে একদম ছিমছাম একটা পোশাক, মাথায় একটা সাদা ওড়না।
“একজন ভালো স্ত্রী সর্বাবস্থায় তার স্বামীকে মান্য করে,” বিনয়ী কণ্ঠে বললো ও। “আমি আমার ওষুধের বাক্সটা গুছিয়ে নিচ্ছি। সন্দেহ নেই আপনাদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমার কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
টম নীল তরবারিটা কোমরে গুঁজে নিলো। ওটার নাম নেপচুন। একসময় তরবারিটা ছিলো ওর বাবার, তার আগে ওর দাদার। তবে এটার প্রথম মালিক ছিলো ওর পরদাদা চার্লস কোর্টনি। স্পেনের র্যাঞ্চেরিয়া জয়ের পর স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক তাকে এটা উপহার দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তরবারিটা পাওয়ার কারণে টম এখন টেম্পল অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য হলি গ্রেইল-এর একজন নাইট নটোনিয়ার। ওর উত্তরসূরিদের মতোই ও এটা দিয়ে অসংখ্য লোককে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সেসব মৃত্যু ওদের পাওনা ছিলো। তরবারিটা একেবারে খাঁটি টোলেডো ইস্পাতের তৈরি, আর হাতলের নীলাটার জন্যে ফলার ওজনটাও চমৎকারভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
টম খাপ থেকে তরবারিটা বের করলো, সূর্যের আলো ওটায় প্রতিফলিত হতে ওর চেহারাও আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
“কামানগুলো রেডি করে ফেলো আবোলি। দুটো করে তিতির পাখি মারো ওদের দিকে।” তিতির পাখি হলো ছোট ছোট সীসার বল ভরা গোলা। মেঘের মতো ওগুলো ভেসে যায়, আর সামনে যেটা-ই পড়ে সেটা ধ্বংস করে ছাড়ে। “মি. উইলসন, বাতাসের দিকে আরো তিন পয়েন্ট ঘুরিয়ে দিন জাহাজের মুখ।”
*
দস্যুদের বো চেজার আবারও গর্জে উঠলো। একটা গোলা অনেক দূরে গিয়ে পড়লো, আর একটা পিছনদিকের একটা তক্তা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলো, টুকরো কাঠের গুঁড়োয় ভরে গেলো আশপাশ। ইঞ্চবার্ডের গালেও একটা টুকরো এসে লাগলো, উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো সেখান দিয়ে।
দস্যুরা ওদের জাহাজের দিকে পরিবর্তন করে এমনভাবে বাকিয়ে নিলো যাতে ডাজারের সবগুলো মাস্তুল এক সারিতে চলে আসে। ঠিক নাইনপিন খেলার মতো।
“অতো দূর থেকে লাগানো সহজ হবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো মেট।
ওদের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে ঠিক সাথে সাথেই উপর থেকে মড়াত করে একটা শব্দ ভেসে এলো। সবার চোখ ঘুরে গেলো উপর দিকে-দেখতে পেলো একগাদা কাঠ আর ক্যানভাসের কাপড় ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। সবাই লাফিয়ে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলোর কয়েকজন নড়তে দেরি করে ফেললো। হাল ধরে ছিলো যে লোকটা তার ঠিক চাদি বরাবর পড়লো মাস্তুল, মুহূর্তে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেলো মাথাটা। বাতাসের উল্টো দিকে ঘুরে গেলো জাহাজ। আর পালটা মৃত লোকটার উপর কাফনের কাপড়ের মতো করে ঢেকে গেলো।
“কেটে দাও ওটা,” চেঁচিয়ে বললো ইঞ্চবার্ড। “হুইলটাকে মুক্ত রাখতে হবে।” লোকজন কুড়াল হাতে ছুটে গিয়ে মাস্তুলের গোড়াটা কাটা শুরু করলো।
আর একটা গোলা ছোঁড়ার শব্দে ওর কথা চাপা পড়ে গেলো। ওর মুখের মাত্র এক ফুট দূর দিয়ে উড়ে গেলো কামানের গোলাটা। ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পাটাতনের উপর পড়ে গেলো ইঞ্চবার্ড। জাহাজটা এখন একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। জাহাজের খোলটা কেঁপে উঠলো আবার। আরও একটা মাস্তুল ফাটার আওয়াজ পাওয়া গেলো। জুরা পাল-টাকে সরিয়ে ফেলেছে ততোক্ষণে। সদ্য মৃত লোকটার রক্তে লাল হয়ে আছে ওটা। নিচেই দেখা গুলো হুইলটাও টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে, মাস্তুলটা ঠিক ওটার উপরেই পড়েছিলো। আবার একটা বসাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। আর ওদের হাতে মোটেও অতোটা সময় নেই।
এদিকে দস্যুদের জাহাজটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে, আর কিছুক্ষণের মাঝেই পাশাপাশি চলে আসবে। ইঞ্চবার্ড ওটার ডেক-এর লোকজনগুলোকেও দেখতে পাচ্ছে এখন। কয়েকজন তাদের হাতের তরবারি নেড়ে উল্লাস করছে, বাকিদের হাতেও ভয়ালদর্শন লম্বা তরবারি।
ইঞ্চবার্ড দাঁতে দাঁত পিষলো। “জাহাজে কাউকে উঠতে দেবে না।”
*
ফাইটিং ককের হালী ওটাকে ডাওজারের পাশাপাশি নিয়ে এলো। তারপর মাস্তুলের উপরের লোকেরা পাল গুটিয়ে নিলো, আর বাকি দস্যুরা জাহাজের কিনারের কাঠের উপর উঠে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। ওদের লাফঝাপের চোটে জাহাজ দুটো একটা আর একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে দুলতে লাগলো। এখন ওদের মাঝে ব্যবধান মাত্র কয়েক ফুট পানি।
লেগ্রাঞ্জ লাফ দিয়ে রেইলের উপর উঠে দাঁড়ালো। পানির মতোই সহজে হয়ে গেলো কাজটা, সন্তুষ্টচিত্তে ভাবলো ও। মার্চেন্টম্যানের ডেক-এ তাকিয়ে দেখে ওখানে কেউ নেই। কু-রা নিশ্চয়ই ডেক-এর নিচে, পাগলের মতো নিজেদের মূল্যবান সম্পদ লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। খামাখা কষ্ট করছে : কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা কান্নাকাটি করতে করতে জীবন ভিক্ষা দেওয়ার জন্যে অনুনয় করতে থাকবে, আর কোথায় কি রেখেছে সেসবও সুড়সুড় করে বলে দেবে।
ও কথা বলার জন্যে মুখের সামনে চোঙ্গাটা তুললো। “পতাকা নামিয়ে নাও আর অতিথিদের বরণ করার জন্যে প্রস্তুত হও।”
ওর লোকেরা উল্লাস করে উঠলো। লেগ্রাঞ্জ জাহাজের কামানগুলোর দিকে তাকালো। ওগুলোর একটাতেও কোনো গোলন্দাজ নেই। কক-এর কামানের বহরে এগুলো সংযুক্ত হবে এখন। অথবা ও ডাওজারকেই কিছুটা সংস্কার করে নিজের জাহাজের বহরে যোগ করে নিতে পারবে। দুটো জাহাজ পেলে পুরো সমুদ্রটাই ওর হয়ে যাবে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই নেকড়ের মতো ধূর্ত একটা হাসি ফুটলো ওর মুখে।
চোখের কোণে রঙিন কিছু একটা ধরা পড়লো ওর : একটা কমলা আভা, যেন একটা কামানের গোড়ার কাছে কোনো ধাতুর উপর সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ও গলা বাড়িয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করলো। ওটা সূর্যের আলো না। ওটা আসলে কামানের সলতেতে লাগানো আগুন, ধীরে ধীরে সেটা গোলার দিকে এগিয়ে চলেছে। দ্রুত বাকি কামানগুলোকে পরীক্ষা করতেই ওর রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। প্রতিটা কামানেই গোলা ভরা, আর সলতেতে আগুন লাগিয়ে ঠিক ওদের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে।
“মাথা নামাও সবাই,” চিৎকার করে উঠলো ও। গোলন্দাজবিহীন কামানগুলো থেকে একেবারে পয়েন্ট ব্লাংক থেকে কয়েকটা গোলা ছুটে গেলো। গোলার সাথে পেরেক ভরে দেওয়া হয়েছে। গোলাটা সোজা জাহাজের একটা পাশকে পুরো চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো। একদম সামনে যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো তারা একেবারে কিমা কিমা হয়ে গেলো বলা যায়, রক্তের হোলি খেলা হলো যেন ওখানে। তাদের পিছনে যারা ছিলো তারাও প্লিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হলো। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃসীম নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলো, কিন্তু তারপরেই ডাওজারের লোকেরা হারে রে রে করতে করতে মাস্কেট আর পিস্তল হাতে দৌড়ে আসতেই আবার আকাশ বাতাস চিৎকার আর গুলির আওয়াজে ভরে উঠলো। ওরা লাফিয়ে কক-এর ডেক-এ উঠে এসে যারা তখনও বেঁচে ছিলো তাদেরকে গুলি করে মারতে লাগলো। কম আহতেরা পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার গুলি খেয়ে শুয়ে গেলো। জাহাজ দুটো দূরে সরে যেতে শুরু করতেই ডাওজারের লোকজন উল্লাস করে উঠলো।
লেগ্রাঞ্জের শিকার হাত ফসকে যাচ্ছে। কিন্তু ফাইটিং কক-এ প্রায় দুইশ লোক আছে; আর ডাওজারে সর্বোচ্চ হলে একশোর কাছাকাছি লোক হবে। ফলে এতো ক্ষয় ক্ষতির পরেও দস্যুরা এখনো সংখ্যায় বেশি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে ওদের দরকার শুধু সাহস।
প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠে লেগ্রাঞ্জ একটা দুলতে থাকা রশি পাকড়ে নিজের কোমরে বেঁধে নিলো, তারপর মুক্ত হাতটায় একটা পিস্তল তুলে নিয়ে আবার রেইলের উপর উঠে দাঁড়ালো।
“কাউকে জ্যান্ত ছাড়বো না,” গর্জে উঠলো ও। তারপর দড়িতে ঝুলে ধোঁয়ার ভিতর দিয়েই ডাওজারের ডেক-এ গিয়ে নামলো। একজন নাবিক ওকে দেখতে পেলো, কিন্তু হাতের মাস্কেটের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় সে একটা তরবারি তুলে নিতে গেলো। লেগ্রাঞ্জ একেবারে মুখে গুলি করে শুইয়ে দিলো তাকে। তারপর পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে কোমর থেকে আর একটা তুলে নিলো। আর একটা নাবিক ওর সামনে পড়ে গেলো, লেগ্রাঞ্জ ওকেও গুলি করলো, তারপর নিজের তরবারি বের করলো।
একটু পরেই ডাওজারের ডেক জুড়ে লোহার ঝনঝনানি আর খালি পায়ের ধুপধাপ শব্দ শোনা যেতে লাগলো, কারণ লেগ্রাঞ্জের সাঙাতেরাও ওকে অনুসরণ করে এটায় এসে নামতে শুরু করেছে। প্রায় প্রত্যেকের গায়েই মৃত সঙ্গীদের রক্ত আর মাংস মেখে আছে, প্রথমেই ওরা হাত দিয়ে নাড়িয়ে ধোয়াটা পরিষ্কার করে নিলো। ডাওজারের লোকজন মুহূর্তের মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়লো। এতো কিছুর পরেও দস্যুরা ওদের চাইতে সংখ্যায় এখনো অনেক বেশি। আর এই মুহূর্তে দস্যুরা সবাই একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যে মারাত্মক ক্ষেপে আছে। একে একে ডাওজারের প্রায় সবগুলো ক্রু-কে হত্যা করা হলো। শুধু কয়েকজনকে জাহাজের লেজের কাছের হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো।
লড়াই শেষ হয়েছে বোঝমাত্র কয়েকজন দস্যু ছুটে গেলো লুট শুরু করতে। বাকিরা ডাওজারের যে কয়জন জীবিত আছে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের তরবারি দিয়ে মাঝে মাঝে খোঁচা দিতে লাগলো, কিন্তু মেরে ফেলার কোনো চেষ্টা করলো না। কারণ ওরা জানে যে ওদের ক্যাপ্টেন এতে তাড়াতাড়ি সব শেষ করতে চাইবে না। ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে এরা যা করেছে সেটার প্রতিশোধ নিতে হবে ধীরে ধীরে।
লেগ্রাঞ্জ ধীর পায়ে লাশগুলোর ফাঁক দিয়ে, রক্তে ভেজা ডেক ধরে এগিয়ে এলো। “তোদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কে?” জানতে চাইলো ও।
ইঞ্চবার্ড লেংচে লেংচে সামনে এগিয়ে এলো। হাতের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরে ওর জামা লাল হয়ে আছে। “জোসিয়াহ ইঞ্চবার্ড, আমিই মাস্টার।”
লেগ্রাঞ্জ ওর ঘাড় ধরে সামনে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে ডেক-এ ফেলে দিলো। “আত্মসমর্পণ করলি না কেননা?” হিসহিসিয়ে উঠলো ও। “আমাদের সাথে লড়াই করিস, কতো বড় সাহস তোর!”
লেগ্রাঞ্জ কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে ইঞ্চবার্ডের গালে চেপে ধরলো। আমি তোর জ্যান্ত চামড়া ছাড়িয়ে নেবো, তারপর তোর সামনে তোর নাড়িভুড়ি কেটে হাঙ্গরকে খেতে দেবো।”
পাশের লোকগুলো সব হেসে উঠলো। ইঞ্চবার্ড কাঁপতে কাঁপতে অনুনয় করতে লাগলো।
“আমরা মাদ্রাজ থেকে মশলা আর সুতি কাপড় নিয়ে এসেছি, সব জাহাজের খোলে আছে। আর বাইরে আছে মরিচ। সব নিয়ে নিন।”
লেগ্রাঞ্জ ওর দিকে মুখ এগিয়ে নিলো। “তাতো নেবোই। আমি তোর জাহাজের প্রতিটা তক্তা, প্রতিটা পেরেক খুলে ফেলবো। তারপর প্রতিটা লুকানো পয়সা পর্যন্ত খুঁজে বের করবো। কিন্তু সেজন্যে আমি তোকে কিছু করবো না, তুই শাস্তি পাবি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্যে, আমার লোকেদের যা করেছিস সেটার জন্যে।”
নিচে নামার সিঁড়ির মুখে একটা ধ্বস্তাধস্তির আওয়াজ হলো। লেগ্রাঞ্জ ঘুরে সেদিকে তাকাতেই দেখে ওর দুজন লোক এক বন্দিকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে। আসছে। বন্দিটা একজন মহিলা, সেটা চোখে পড়তেই সবাই শিষ দিয়ে উঠলো। মহিলার শরীরের উর্ধাংশের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, হাত দিয়ে নিজের গলা আর বুক ঢেকে রেখেছে সে। লোক দুটো মহিলাটাকে ধাক্কা দিয়ে লেগ্রাঞ্জের সামনে ফেলে দিলো।
“ক্যাপ্টেনের কেবিনে পেয়েছি একে। এগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলো।” একজন দস্যু নিজের মুঠি খুলতেই একগাদা সোনার মুদ্রা গড়িয়ে পড়লো। বাকিরা তা দেকেহ আবারও শিষ দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করলো।
লেগ্রাঞ্জ মেয়েটার থুতনির নিচে হাত দিয়ে জোর করে ওর মুখটা নিজের দিকে ফেরালো। মেয়েটা কালো নিষ্কল্প চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে, চোখের মণিতে অপরিসীম ঘৃণা, অনুগ্রহ ভিক্ষার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই।
“ব্রেজিয়ারটা নিয়ে এসো,” আদেশ দিলো লেগ্রাঞ্জ। তারপর চুল ধরে টেনে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে আচমকা প্রচণ্ড জোরে দিলো একটা ধাক্কা। মেয়েটা পিছন দিকে সরে গিয়ে একটা রশিতে বেঁধে উল্টে পড়ে গেলো। পড়ে গিয়ে নড়ার আগেই চারজন দস্যু এগিয়ে গেলো ওর দিকে, তারপর ওর চার হাত পা চারদিকে টেনে ডেক-এর সাথে চেপে ধরে রাখলো।
লেগ্রাঞ্জ এগিয়ে গেলো ওর দিকে। তারপর হাতের ছুরি দিয়ে মেয়েটার স্কার্টের খানিকটা কেটে দিতেই ওর লোকেরা মেয়েটার দুই পা দুদিকে টেনে ধরলো। মেয়েটা মোচড়া মুচড়ি করতে লাগলো কিন্তু লোকগুলো শক্ত হাতে ওকে ধরে রাখলো। লেগ্রাঞ্জ স্কার্টের আরো খানিকটা উপরে তুললো, মেয়েটার মসৃণ উরু বের হয়ে গেলো তাতে। লোকজন অশ্লীল শব্দ করতে লাগলো।
লেগ্রাঞ্জ ইঞ্চবার্ডের দিকে তাকালো। “এ কি তোর বৌ? নাকি বেশ্যা?”
“একজন যাত্রী,” দাঁতে দাঁত চেপে বললো ইঞ্চবার্ড। ওনাকে ছেড়ে দিন হুজুর।”
“সেটা নির্ভর করবে ও আমাকে কেমন মজা দেয় তার উপর।”
দুজন লোক একটা লোহার তেপায়ার উপর একটা ব্রেজিয়ার নিয়ে এলো। ভিতরে কয়লা সামান্য আভায় জ্বলছে। লেগ্রাঞ্জ ওগুলোকে নিজের তরবারি দিয়ে নাড়তে লাগলো। একটু পরেই তরবারির ডগাটা গনগনে লাল হয়ে গেলো। তারপর ধোঁয়া ওঠা তরবারিটা তুলে এনে মেয়েটার উপর ধরে রাখলো। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালো আবার। এখন আর সেখানে কোনো প্রতিরোধ নেই, আছে নিখাদ আতংক।
লেগ্রাঞ্জের ঠোঁটে একটা চিকন হাসি দেখা গেলো। ও তরবারিটা ঠিক মেয়েটার উরুর সংযোগস্থলের কাছাকাছি নামিয়ে আনলো। শরীরের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উপরে হবে। মেয়েটা এক ফোঁটা নাড়াচাড়া করছে না। তরবারির ছোঁয়া লাগার ভয়ে মোচড়ামুচড়ি দূরে থাক যেনো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। তরবারিটা থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে।
লেগ্রাঞ্জ তরবারিটা আরো খানিকটা নামানো শুরু করতেই মেয়েটা আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ছিলো ধোঁকাবাজি। এখন তরবারিটা মাত্র এক চুল উপরে বলা যায়। লেগ্রাঞ্জ হেসে উঠলো। ওর অত্যাচারে দাসী মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক দিন ও এরকম মজা করার সুযোগ পায় না।
“সব নিয়ে নিন,” অনুনয় করলো মেয়েটা। “জাহাজ, স্বর্ণ, যা ইচ্ছা নিয়ে নিন।”
“নেবো,” লেগ্রাঞ্জ কথা দিলো। “কিন্তু তার আগে একটু মজা না করলে হয়!” তরবারির মাথাটা ততোক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ও আবার সেটাকে ব্রেজিয়ারে ঠেসে দিলো। এবার আগের চাইতেও গরম হলে তারপর বের করে মেয়েটার চোখের সামনে ধরে রাখলো। মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। “দেখতে পাচ্ছিস এটা? এটায় তুই মরবি না। কিন্তু আমি তোকে এমন শিক্ষা দেবো যা তুই কোনোদিন কল্পনাও করিসনি।”
“নরকের কীট, তুই নরকেই যা,” হিসিয়ে উঠলো মেয়েটা।
ওর কথা লেগ্রাঞ্জকে বরং আরো বেশি উসকে দিলো। ওর এরকম তেজী মেয়েই পছন্দ-যখন শেষ পর্যন্ত ও হাল ছেড়ে দেবে তখনকার তৃপ্তির সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। ও নিজের ঠোঁট চাটতেই রক্তের স্বাদ পেলো। নিচের তলা থেকে চিৎকার আর হাতাহাতির আওয়াজ শোনা গেলো, কিন্তু লেগ্রাঞ্জ তখন এই খেলায় এতো বেশি মজে ছিলো যে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত ছিলো না। ভাবলো ওর লোকেরা হয়তো লুটের মাল নিয়ে ঝগড়া করছে। ওদেরকে পরে সামলানো যাবে।
ও নিজের খালি হাতটা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে নরম সুরে বললো, “তোকে আমি একটু একটু করে পোড়াবো, বুঝলি মাগী? পুরো শরীরে হ্যাঁকা দেবো। তারপর তোকে ভোগ করে আমার লোকেদের মাঝে ছেড়ে দেবো। ওরা তোকে নিয়ে তখন যা ইচ্ছে করবে।”
*
“দাঁড় ওঠাও,” শান্ত স্বরে আদেশ দিলো টম। সেন্টারাসের ডিঙ্গি নৌকাটা দস্যুদের জাহাজের কালো শরীরের নিচে আসতেই আটটা দাঁড়ের সবগুলো উঠে গেলো নৌকার ভিতরে। টম আস্তে নৌকার হাল ঘুরিয়ে দিলো। ও একবারের জন্যেও উপরে তাকালো না। সমস্ত মনোযোগ নিপে নৌকাটা জাহাজের সমান্তরালে নিয়ে আসা। নৌকার সামনে বসে আবোলি আর ডোরিয়ান ফাইটিং কক-এর ডেক-এর দিকে নিজেদের মাস্কেট তাক করে রেখেছে। কিনার থেকে দেখা গেলো একটা কামান বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাক করে আছে। যদি দস্যুদের জাহাজে একজন দস্যুও থেকে থাকে, তাহলে সে এটা দিয়ে নৌকার সবাইকে ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারবে।
টম ঘাড় ঘুরিয়ে সেন্টারাস-এর দিকে তাকালো। এখান থেকে আধা মাইলটাক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দস্যুরা ওটাকে খেয়াল করেনি করলেও এখন লুটতরাজ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে ওটার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সারাহ আর ইয়াসমিনির সাথে মাত্র দুজন লোককে রেখে এসেছে ও। ওরা যদি এখানে ব্যর্থ হয়, তাহলে মেয়ে দুটোর কপালে শনি আছে। ও জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলো।
ডিঙ্গি নৌকাটার গলুই দস্যুদের জাহাজের গায়ে ঘষা খেলো। হালকা খসখস শব্দ হলো শুধু। আবোলি জাহাজে ওঠার সিঁড়িটা আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে ইশারা করলো। টম মাথা নেড়ে জানালো যে কেউ নেই। পানির কাছাকাছি জাহজের খোলে একসারি খুপরি দেখা গেল। কামানের খোপ হিসেবে খুব নিচু ওগুলো। টম বুঝলো ওগুলো সম্ভবত বাতাস চলাচলের জন্যে বানানো হয়েছে। জাহজটা যখন দাস আনা নেওয়া করতো তখন কাজে লাগতো।
টম বেল্ট থেকে নিজের ছুরিটা খুলে নিয়ে হাতের কাছের খুপরিটার জোড়া লাগানো জায়গাটায় ঢুকিয়ে চাড় দিলো। যখন দাসেরা এখানে থাকতো তখন এটাকে ভিতর থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ করে দেয়া হতো। কিন্তু দস্যুদের এসব ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওর ছুরির ফলা ভিতরের হুড়কোয় স্পর্শ করলো। ও ছুরিটা উপর দিকে চাড় দিলো।
হুড়কো খুলে পড়ে গেলো। খুপরিটা খুলে ভিতরের আলো আধারিতে উঁকি দিলো টম। কেউ ওর দিকে তেড়ে এলো না। আবোলি নৌকাটা স্থির করে ধরে রাখলো, আর ও দেহটা বাকিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। বাকিরাও অস্ত্র হাতে ওর পিছু নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। আবোলির অবশ্য ওর দশাসই শরীরটা নিয়ে ঐ ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকতে কষ্ট হলো।
খোলটা একেবারে জিনিসপত্রে ঠাসা আর বদ্ধ। টম প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আগালো, কিন্তু তবুও মাথা উপরের কাঠে ঠুকে গেলো। দস্যুদের লুট করা মালামালের ভিতর দিয়ে আগাতে লাগলো ও। আলো বলতে উপরের কাঠের ফাঁক গলে যেটুকু আসছে সেটুকুই। সেন্টারাসের বাকি লোকজন আর আবালি আর ডোরিও আছে পিছনেই। বাকিদের মধ্যে আছে আলফ উইলসন, টমের বাবার সাথেও জাহাজ চালিয়েছে সে; আবোলির দুই ছেলে, যামা আর তুলা। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলজ্বল করছে, জাহাজটার দাস ব্যবসা সংক্রান্ত অতীত বুঝতে পেরে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। ওরা প্রত্যেকেই জানে যে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে এখানে আসলে হয়তো ওরা কাঠের ভিতর থেকে মুখব্যাদান করে থাকা এই লোহার কড়াগুলোর সাথে বাধা থাকতো, তারপর সমুদ্রের ওপারে আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ানে পশুর মতো বিক্রি হয়ে যেতো; তবে সেটাও নির্ভর করছে যদি শেষ পর্যন্ত ওরা এই খুপরির ভিতর বেঁচে থাকতে পারে, তবেই। ওদের মনে হতে লাগলো এই তক্তাগুলো থেকে যেনো বাতাসে সেই অভাগা লোকগুলোর দুর্দশা আর কষ্টের কান্না আর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।
টম মই বেয়ে উঠে সাবধানে মাথা তুললো উপরে। ও যেখানে মাথা তুলেছে সেটা জাহাজের কোয়ার্টারডেক, একেবারে পিছনের মাস্তুলের কাছেই। সামনে গনগনে সূর্যের নিচে শুধু মানুষের লাশ ইতস্তত পড়ে আছে। জ্যান্ত সবাই ডাওজারে গিয়েছে, সেটা লুট করতে। টম পিছনের সবাইকে হাতের ইশারা করলো উপরে উঠে আসতে। ও লম্বা একটা কামানের দিকে ইঙ্গিত করলো। ওটার নল সোজা ডাওজারের খোলের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
ও দ্রুত আদেশ দিলো, “ওটা টেনে আনো ভিতরে।”
যামা আর তুলা ঝটপট কামানটা যে দড়ি দিয়ে জাহাজের সাথে বাঁধা সেটা টেনে ধরলো। আলফ উইলসন আর অন্য লোকটাও যোগ দিলো ওদের সাথে। সবাই একসাথে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো ওটা। ঘড় ঘড় করতে করতে কামানটা নিজের জায়গায় ফিরে আসতেই খোপটা দিয়ে আলো প্রবেশ করতে লাগলো। সেদিকে দিয়ে নিজের মাথা বের করে দিলো টম। দুটো জাহাজই একসাথে চলছে এখন। কিছুক্ষণ পরপর দুটোর খোল বাড়ি খাচ্ছে পরম্পর। আর দুটোর ফাঁকে এক চিলতে পানি ঝিকমিক করছে।
ও নিজের বেল্ট খুলে ফেললো। “আমাকে ধরো, আবোলি।”
আবোলি ওর পা ধরে রাখলো, আর ও কামানের খোপটা দিয়ে শরীর বাকিয়ে মুচড়িয়ে ডাওজারের গা স্পর্শ করলো। কিন্তু ডাওজারের গায়ে কোনো কামানের খোপ নেই। তবে টম জাহাজের লেজের দিকের জানালাগুলো হাতে পেলো, ঠিক ক্যাপ্টেনের কেবিনের জানালা ছিল ওটা। জানালার কাঁচের ওপাশে কয়েকটা অবয়ব নাড়াচাড়া করতে দেখা গেলো, বোঝা যাচ্ছে যে ভিতরে কোনো দামী জিনিস লুকানো আছে কিনা সেটা খুঁজতে পুরো কেবিনটায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। টম সাথে সাথে জমে গেল জায়গায়, কিন্তু ওরা নিজেদের কাজে এতো বেশি মগ্ন হয়ে ছিলো যে, দুই জাহাজের মাঝখানের এই গাঢ় অন্ধকারে ওর উপস্থিতি টের পেলো না।
“ধরো দেখি এটা,” একজন ডাক দিলো। “খুব বেশি ভারি!”
ভাঙা জানালা দিয়ে স্পষ্ট লোকটার গলা শোনা যাচ্ছিলো। টম দেখলো আর একজন লোক এসে তার সাথে হাত লাগালো। দুজন মিলে একটা শক্ত বক্স ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো।
কেবিনে আর কেউ নেই। টম আরো খানিকটা মুচড়ে এগিয়ে গেলো, ভাগ্যিস আবোলি শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছিলো। জানালার ভাঙা কাঁচের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো ও, সাবধান থাকছে যাতে কবজি না কাটে। তারপর জানালার হুড়কো খুলে জানালাটা খুলে ফেললো।
“ছেড়ে দাও,” ফিসফিসিয়ে বললো টম। আবোলি ছেড়ে দিতেই ও জানালার গোবরাট ধরে নিজেকে ভিতরে টেনে তুললো। ওর পতনের ধাক্কায় কয়েকটা কুশন ছড়িয়ে পড়লো নিচে। ওগুলো ছিঁড়ে তুলা বের করে ফেলা হয়েছে। ভিতরে যদি দামি কিছু থেকে থাকে তাহলে তা আর নেই।
আবোলি টমের নীল তরবারিটা জানালা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। টম ওটা নিজের কোমরে বেঁধে নিয়ে পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিলো। বাকিরাও তততক্ষণে চলে এলো এই জাহাজে। সবাই ভিতরে ঢোকার পর দেখা গেলো নাড়াচাড়ার আর জায়গা নেই।
কেবিনের উপরের ডেক থেকে একটা হাসির হল্লা ভেসে এলো। কি হচ্ছে ভেবে পেলো না টম।
আচমকা খুলে গেলো দরজা। এক দস্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো সামনে। সে এতোক্ষণ রান্নাঘরটা লুট করছিলো সম্ভবত, কারণ তার এক হাতে দেখা গেলো এক গাদা রূপার চামচ আর এক হাতে একটা মোমদানি।
“কি করছো তোমরা? এসব আমার।” কিন্তু এরপরেই ওর খেয়াল হলো যে এরা ওর দলের কেউ না। “তোরা আবার কোন শালা?”
কিন্তু কেউ যে তরবারি চালাবে সেই জায়গা ঘরের ভিতরে ছিলো না। আবোলি হাতের ছুরিটাই চালালো শেষ পর্যন্ত। দস্যুর গলা এফোঁড় ওফোড় হয়ে গেলো। গলা চেপে ধরে মেঝেতে পড়ে গেলো সে। গলগল করে হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। হাতের চামচ আর মোমদানি ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।
“আমার পিছনে আসো সবাই!” টম মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। পুরো জায়গাটা কুরুক্ষেত্র হয়ে আছে : লোকজন কাপড়চোপড়ের গাটরি নিয়ে টানাটানি করছে, আলমারি ভেঙ্গে ভিতরের জিনিস ছড়িয়ে ফেলেছে, দামি দামি সব মশলা পুরো মেঝেতে সয়লাব হয়ে আছে। কয়েকজনকে দেখা গেলো রাম-এর একটা পিপা ভেঙ্গে সেটা থেকে খাওয়া। শুরু করেছে।
কারো হাতেই অস্ত্র নেই। বেশিরভাগই ওদেরকে ঘরটা থেকে বের হতে দেখেনি, বা দেখলেও বোঝেনি যে ওরা আসলে কারা।
সেন্টারাসের দলটা দেরি না করে আক্রমণ করে বসলো। ডোরি আর আবোলি অভিজ্ঞ যোদ্ধা। অসংখ্য যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে। যামা আর তুলা ওদের বাবার লড়াইয়ের কাহিনি শুনে শুনে বড় হয়েছে। ওরাও আজ জীবনে প্রথম লড়াইয়ের স্বাদ নিলো। আলফ উইলসন আর বাকিরা এর আগে এভোবার কোর্টনীদের সাথে নানান অভিযানে গিয়েছে যে ওরা একেবারে নিখুঁতভাবে জানে যে কি করতে হবে।
দস্যুরা বলা যায় টেরও পেলো না যে ওদের সাথে কি হচ্ছে। বেশিরভাগই কিছু বুঝে ওঠার আগেই অক্কা পেলো। কয়েকজন হাতের কাছে যা পেলো তা দিয়েই আত্মরক্ষার চেষ্টা করলো-নেভিগেশনের বই, থালা বাটি, কাপড়ের গাটরি-কিন্তু তাদেরকেও অনায়াসে পেড়ে ফেলা হলো। চোখের কোনা দিয়ে টম দেখতে পেলো যে ডোরিয়ান মাপা পদক্ষেপে সামনে আগাচ্ছে। ওর সামনের দস্যুর হাতে ছুরি। ডোরিয়ান তরবারি দিয়ে ঝটকা মেরে ছুরিটা ফেলে দিলো, সাথে সাথেই সেটা ঘুরিয়ে দস্যুর হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিলো। তারপর কবজির মোচড়ে তরবারিটা বের করে হাতল দিয়ে পিছনে আক্রমণোদ্যত একজনের মুখে আঘাত করলো। লোকটা মুখ চেপে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা, ডোরিয়ান সামনে এগিয়ে তাকেও এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।
কিন্তু গুটিকয়েক দস্যু ঠিকই সিডি পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। “সবাই ডেক-এ যাও জলদি,” আদেশ দিলো টম। এতোক্ষণে উপরের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই নিচে কি হচ্ছে সেটা টের পেয়ে গিয়েছে, ওদের কেউ যদি উপরে ওঠার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয় তাহলে টম আর ওর দল নিচেই আটকা পড়ে যাবে।
টম গুলির বেগে সিঁড়ির দিকে ছুটলো। সিঁড়িটা রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে, তবুও ও তিনটা করে ধাপ একবারে পার হতে লাগলো। সিঁড়ির মাথায় একজন লোককে দেখা গেলো; টম একটা পিস্তল বের করে বাম হাত দিয়ে গুলি করলো তাকে। এতো কাছে থেকে গুলি না লাগার প্রশ্নই আসে না। লোকটা ওর উপর মুখ থুবড়ে পড়লো। টম একদিকে সরে গিয়ে সংঘর্ষ এড়ালো, তারপর এক লাফে বাকি সিঁড়িটা টপকে উপরের ডেক-এ এসে উঠলো।
যুদ্ধের উত্তেজনায় ওর সবগুলো স্নায়ু টানটান হয়ে আছে। এক নজরেই সব চোখে পড়লো ওর পিছন দিকে বন্দীদেরকে জড়ো করে রাখা হয়েছে অস্ত্রধারী দস্যুরা ঘিরে রেখেছে তাদেরকে; জাহাজের ক্যাপ্টেন হাঁটু মুড়ে বসে আছে, সারা শরীর রক্তাক্ত; একটা মহিলাকে মেঝেতে চেপে রাখা হয়েছে, বিবস্ত্র, এক দাড়িওয়ালা দস্যু তার উরুর ফাঁকে একটা তরবারি ধরে আছে।
টম ওর দ্বিতীয় পিস্তলটা বের করে গুলি করলো। কিন্তু একটু বেশি তাড়াহুড়া করায় গুলি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পিছনের আর একটা লোকের গায়ে লাগলো। দস্যুদের ক্যাপ্টেন লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো। অন্ধ আক্রোশে সে হাতের তরবারিটা দিয়ে শোয়ানো মেয়েমানুষটাকে বিদ্ধ করতে গেলো।
আর একটা গুলির শব্দ পাওয়া গেলো। ডোরিয়ান টমের পাশে উঠে এসেছে। ওর হাতের দুটো পিস্তল থেকেই ধোঁয়া উড়ছে; দস্যুদের ক্যাপ্টেন তরবারি ফেলে কবজি চেপে টলতে টলতে পিছনে সরে গেলো। রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।
টম ভাইয়ের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসলো। “গুড় শট, ডোরি।”
“আমিতো ব্যাটার হৃদপিণ্ডের দিকে তাক করেছিলাম,” ডরিয়ান গুলিহীন পিস্তলটা কোমরে গুজতে গুজতে বললো। তারপর আবার তরবারিটা তুলে নিলো ডান হাতে। এক দস্যু বর্শা হাতে ওর দিকে এগিয়ে এলো। ডোরিয়ান একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়ালো, ফলে লোকটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ডোরিয়ান সেই সুযোগে নিজের তরবারি গেঁথে দিলো। একেবারে বুকের মাঝ বরাবর ঢুকলো তরবারিটা, ফলে শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে প্রায় এক বিঘত পরিমাণ লম্বা একটা ক্ষত সৃষ্টি হলো।
আবোলি ততোক্ষণে আবার নিচে নেমে গিয়েছে। টমও ওর পিছু পিছু নিচে নেমে গেলো। আবারও জাহাজের পিছনে আর একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠে ডাওজারের লোকজন এবার ওদের বন্দীকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদের কাছে অস্ত্র ছিলো না কিন্তু দস্যুরা ছিলো একদম অপ্রস্তুত। কয়েকজন লুটতরাজে চলে গিয়েছিলো; আর বাকিরা ছিলো লেগ্রাঞ্জের সাথে মহিলাটার কান্ড কীর্তি দেখায় ব্যস্ত। কয়েকজন নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে রেখেছিলো, ফলে এখন ওরা দুই দিক থেকেই আক্রমণের শিকার হলো। নাবিকেরা দস্যুদের অস্ত্র জোর করে কেড়ে নিলো, নাহয় এমনভাবে চেপে রাখলো যাতে ওরা ওগুলো আর ব্যবহার করতে না পারে। টম এর ভিতর দিয়েই এগিয়ে দস্যুদের সর্দারকে খুঁজতে লাগলো।
ওর পা কিছু একটায় আটকে গেলো। চোখ নামিয়ে সেদিকে তাকালো ও। একটু আগে দেখা মহিলাটা, শরীর বাকিয়ে একটা বল-এর মতো হয়ে আছে, ছেঁড়া জামা দিয়েই আব্রু রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাছেই একটা গনগনে ব্রেজিয়ার জ্বলছে। আশেপাশের হট্টগোলে সবাই ভুলে গিয়েছে সেটার কথা।
এই যুদ্ধের উত্তেজনার মাঝেও, টম সতর্ক হয়ে গেলো। আগুন হচ্ছে সকল নাবিকের নিকৃষ্টতম ভীতি–যা কিনা একটা জাহাজকে মুহূর্তেই কালো ছাইতে রূপান্তরিত করতে পারে।
আবোলিও দেখেছে সেটা। ও একটা পা দিয়ে ব্রেজিয়ারটা তুলে নিয়ে পাশের দস্যুদের জাহাজে ছুঁড়ে দিলো। গরম কয়লা ছড়িয়ে পড়লো ডেক জুড়ে। একটা গিয়ে পড়লো এক গাদা রশির উপর, কিন্তু ডাওজারের এই হট্টগোলের মাঝে কেউ সেটা খেয়াল করলো না।
টম মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কেউ কাছে আসতে চাইলেই ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিলো দূরে, আর ফাঁকে ফাঁকে শত্ৰুদলের ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে লাগলো। সেন্টারাসের লোকজন, ডাওজারের ক্রু আর দস্যুদল ততোক্ষণে মরণপণ লড়াইতে লেগে গিয়েছে। নিচের ডেক থেকে ইঁদুরের মতো আরো অনেকগুলো দস্যু দৌড়ে এলো। এসেই এমন এক আক্রোশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো যা সচরাচর টমের চোখে পড়েনি আগে। এর কারণ অবশ্য জানা, ওদের আর হারাবার কিছু নেই।
তারপর আচমকাই, ঠিক বাতাসের গতি পরিবর্তনের মতো দস্যুরা রণে ভঙ্গ দিয়ে দিলো। টমের সামনের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো। এটাই সুযোগ ওর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করার। ও সামনে এগিয়ে পলায়নরত কয়েকজনকে পেড়ে ফেললো। প্রথমে ও বুঝতে পারলো না ওরা এভাবে পালাচ্ছে কেননা। একটু পরেই গন্ধটা পেলো টম। চারপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ানো গান পাউডারের ঝাঝালো গন্ধটা না। এটা হচ্ছে কাঠ আর আলকাতরা পোড়ার শক্তিশালী দম আটকানো গন্ধ।
উদ্দত শত্রু আর জ্বলন্ত জাহাজের মাঝে দস্যুরা শেষমেশ জাহাজটাকেই বাঁচাবে বলে ঠিক করেছে, আর সেজন্যেই সেদিকে দৌড়ে যাচ্ছে যদি জাহাজটা কোনোমতে বাঁচাতে পারে। একজনকে দেখা গেলো ডাওজারের কিনারা দিয়ে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টম তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। লোকটা দুই জাহাজের মাঝখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে খোলে বাড়ি খেয়ে পানিতে আছড়ে পড়লো। টম আশেপাশে তাকালো। কালো ধোঁয়া ফাইটিং কককে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে; জাহাজের কিনারা ছাড়িয়ে আগুন থাকার জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এখন।
“এটাকে ঐ জাহাজ থেকে দূরে সরাতে হবে,” চিৎকার করে বললো টম। আগুন যদি কোনোভাবে ডাওজারে লেগে যায় তাহলে ওরা সবাই পুড়ে মরবে। যামা ওর বিশাল কুঠারটা দিয়ে ঝুলতে থাকা সব রশি কেটে দিতে লাগলো। ডাওজারের দুজন ক্রু-ও দুটো তরবারি তুলে নিয়ে ওর সাথে যোগ দিলো।
আগুনের শিখা লকলক করে উপরে উঠতেই লাগলো। কিন্তু তখনো জাহাজ দুটো জোড়া লেগেই আছে। উপরে তাকিয়ে টম দেখলো ডাওজারের মাস্তুলের একটা আড়কাঠ দস্যুদের জাহাজটার রশিতে বেঁধে গিয়েছে। ফলে দুটো জাহাজই খুব শক্তভাবে আটকে আছে।
“কুড়ালটা দাও আমাকে।” বলে ও যামার হাত থেকে সেটা নিয়ে মাস্তুলের সাথে বাধা জালটা বেয়ে উঠতে লাগলো উপরে। ডোরিয়ানও উঠলো পিছু পিছু।
জালের ফাঁকগুলোয় পা বাঁধিয়ে টম মাস্তুলের মাথার কাছে উঠে এলো। নিজের জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়ায় এর আগে কখনোই ওকে এতো উপরে উঠতে হয়নি, কিন্তু তবুও দেখা গেলো কাজটায় ভালোই দক্ষ ও।
মাথায় পৌঁছেই আড়কাঠ আর রশিগুলোর স্তূপে কোপ দিতে লাগলো টম। ওর ঠিক নিচেই দেখা গেলো আগুন জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে আগুনের শিখা ওর জুতোর তলা চাটছে। ধোয়ায় চোখে পানি চলে এলো। ডোরিয়ানও পৌঁছে একই কাজ করতে লাগলো। ও আড়কাঠের উপর চড়ে বসে যে পাশটায় রশিগুলো আটকে আছে সে পাশটা কোপাতে লাগলো।
কিন্তু এরপরেও দেখা গেলো জাহাজ দুটো কেউ কারো বন্ধন ছাড়ছেই না।
“ছুটছে না কেন?”
ডোরিয়ান একটা পেরেকের দিকে দেখালো। ওটার সাথে রশিগুলো আটকে আছে। ও টমের হাত থেকে কুড়ালটা নিয়ে ওটার দিকে এগিয়ে গেলো।
কিন্তু কিছু একটা এসে আড়কাঠটায় আঘাত করলো। টমও টের পেলো কনটা, তারপরেই মাস্তুলের গায়ে হওয়া ছিদ্রটা দেখতে পেলো। ঠিক ডোরিয়ানের পায়ের কাছে। ধোয়ার ভিতর দিয়েই টম দেখতে পেলো দস্যুদলের সর্দার হাতের মাস্কেটটা নামাচ্ছে। সে-ই করেছে গুলিটা।
ও আমাদের দুজনকেই একসাথে মারতে চাচ্ছে, মনে মনে ভাবলো টম। এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে ও আড়কাঠের শেষ মাথায় এগিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে ফাইটিং কক-এর পাল ধরে ঝুলে পড়লো। তারপর একটা পাক খেয়ে কিছু একটা ধরে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। এতো জোরে নিচে পড়তে লাগলো যে ঘষায় ওর হাত পা ছিলে গেলো, তারপর প্রচণ্ড জোরে শক্ত ডেক-এ আছড়ে পড়লো। ধোঁয়া আর হট্টগোলের মাঝে কেউ ওকে খেয়াল করলো না। সবাই পানি ভরা বালতি হাতে ছোটাছুটি করছে, চেষ্টা করছে আগুনের তেজ কিছুটা কমাতে। বাকিরা চেষ্টা করছে সাথের নৌকাটা নামাতে। ওটা নোঙ্গরে আটকে বেখাপ্লাভাবে ঝুলছে।
লেগ্রাঞ্জ মাস্কেটটায় গুলি ভরছে আবার। টম নিজেকে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো। দুজনেই ছিটোকে পড়লো মাটিতে। মাস্কেটটা লেগ্রাঞ্জের শরীরের নিচে পড়লো। লেগ্রাঞ্জ শরীরকে ঝাড়া দিয়ে টমকে ফেলে দিতে চাইলো কিন্তু টমের শরীরে ওজনের জন্যে পারলো না। টম নিজের মোজার ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে আনলো।
লেগ্রাঞ্জ কিছু করার না পেয়ে অন্ধের মতো ডেক-এর উপর একটা অস্ত্রের জন্যে হাতড়াতে লাগলো। একটা কামানের নিচে একটা কাঠের মুগুর পড়ে ছিলো, সেটায় হাত লাগলো ওর। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ও সেটা দিয়ে টমের মাথায় বাড়ি দিলো। সময়মতো টমের চোখে পড়লো ব্যাপারটা। ও মাথা সরিয়ে ফেললো, ফলে বাড়িটা লাগলো ওর কাঁধে। কিন্তু টমের বন্ধনুক্ত হতে লেগ্রাঞ্জের ওটুকুই যথেষ্ট ছিলো। ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা মাস্কেটটা তুলে নিয়ে টমের দিকে তাক করে ধরেই ট্রিগার টিপে দিলো।
চকমকি পাথরটায় ইস্পাতের ঘষায় ফুলকি ছুটলো। টম চমকে উঠে পিছু হটার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাস্কেটটায় মিসফায়ার হলো। ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে লেগ্রাঞ্জ অস্ত্রটা উল্টো করে ব্যারেল চেপে ধরে টমের দিকে এগিয়ে গেলো।
বাতাসে ধোয়া কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। লেগ্রাঞ্জের পিছনে তাকিয়ে টম দেখলো যে জাহাজ দুটো সরে যাচ্ছে দূরে। ডোরিয়ান ডাওজারকে মুক্ত করে ফেলেছে। ওকে এখনি সাঁতরে ওটায় গিয়ে উঠতে হবে-কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে লেগ্রাঞ্জ, গদার মতো করে ধরে আছে নিজের মাস্কেটটা। টম পিছিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দস্যুর ভয়ানক বাড়িগুলো এড়িয়ে যেতে লাগলো। ততোক্ষণে পূর্ণোদ্যমে জ্বলতে শুরু করেছে আগুন; আর সবাই আগুন নেভানোয় ক্ষান্ত দিয়ে নিজের জান বাঁচানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু লেগ্রাঞ্জ। তবুও টমকে আক্রমণ করতেই থাকলো, এতো দ্রুত ও হাতের অস্ত্রটা ঘোরাতে লাগলো যে টম যে কিছু একটা হাতে তুলে নেবে সে সুযোগই পাচ্ছিলো না।
টম আর এক ধাপ পিছিয়ে গেলো আর একটু পরেই জাহাজের কিনার। বহু কষ্টে মাস্কেটের আরো একটা আঘাত এড়িয়ে ও রেইলের উপর শরীরটা টেনে তুললো।
সরু ধারটার উপর ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ও নিচের পানির দিকে তাকালো একবার। জাহাজটা বাতাসের ধাক্কায় আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ও যদি লাফ দেয় তাহলে বাতাস ওকে জাহাজের নিচে ঠেলে দেবে। সেক্ষেত্রে জাহাজের খোলে লেগে থাকা শামুকে কেটে মোরব্বা হতে সময় লাগবে না। তবে যদি এর আগেই হাঙ্গর ওকে ধরে ফেলে তাহলে ভিন্ন কথা।
লেগ্রাঞ্জও ব্যাপারটা জানে। ও তাই আক্রমণে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করলো। ও জানে না যে টম কে, কোথা থেকে এসেছে বা কিভাবে জাহাজে উঠেছে, শুধু জানে যে টম ওর হাত থেকে ওর শিকার কেড়ে নিয়েছে। আর টমের জন্যেই ওর জাহাজটাও এখন হারাতে হচ্ছে। আবারও একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ও টমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য টমকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে।
টম আঘাতটাকে এড়িয়ে পিছন দিকে ঝাঁপ দিলো। অবাক চোখে লেগ্রাঞ্জ দেখলো, টম নিচের পানিতে আছড়ে না পড়ে শূন্যে ভাসছে। তারপর জাহাজের পাশ থেকে এমনভাবে উড়ে গেলো যেনো ওর পাখা গজিয়েছে।
লেগ্রাঞ্জ খেয়াল করেনি যে জাহাজের মাস্তুলের আড়কাঠের সাথে পাল খাটানোর যে দড়িটা বাধা সেটা টম আগেই ধরে ফেলেছিলো। টম ঝুলতে ঝুলিতে যতোদূর সম্ভব দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো, আসার সময় গতি আরো বেশি বেড়ে গেলো কারণ জাহাজ ঘুরে গিয়ে ওর ভরবেগ আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। ও পা দুটো ভাজ করে বুকের কাছে তুলে আনলো, তারপর লেগ্রাঞ্জের কাছে আসতেই সপাটে পা চালালো। বুটশুদ্ধ পা জোড়া লেগ্রাঞ্জের কপালে আঘাত হানলো। এতো জোরে লেগ্রাঞ্জের শরীরটা বেঁকে গেলো যে টম স্পষ্ট ওর মেরুদণ্ড ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো। লেগ্রাঞ্জ পা ভাঁজ হয়ে পিছনে উল্টে পড়ে গেলো। সাথে সাথে আগুন এসে গ্রাস করালো ওকে। এক মুহূর্তের জন্যে টম লেগ্রাঞ্জের ভয়ার্ত মুখটা দেখতে পেলো। ওর দাড়ি, চুল আর কাপড়ে আগুন ধরে গিয়েছে ততোক্ষণে, চেহারায় ফোস্কা পড়ে কাঁপছে।
টম দড়িটাতে ঝুলে উল্টো পাশের পানির উপর পৌঁছে গেলো। তারপর বিপরীত দিকে ফিরতে শুরু করতেই ছেড়ে দিলো দড়িটা। ঝুপ করে পড়লো গিয়ে পানিতে। হাঙ্গরেরা ওর রক্তের গন্ধ পাওয়ার আগেই শক্ত হাতে সাঁতার কেটে সহজেই ডাওজারের কাছে পৌঁছে গেলো ও। ডোরিয়ান মইয়ের শেষ ধাপে অপেক্ষা করছিলো ওকে ধরে টেনে তোলার জন্যে।
“সারাহ আর ইয়াসমিনি কোথায়?” হাফাতে হাফাতে বললো টম। তখনো শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। ও পাগলের মতো ডাওাজারের চারপাশের পানিতে খুঁজতে লাগলো, তারপর ফাইটিং কক-এর জ্বলন্ত শরীরের ফাঁক দিয়ে ওদের দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
টম এরপর নিজের মনোযোগ ফেরালো দস্যুদের জাহাজের প্রতি। অগ্নিকুণ্ড ওটার প্রতিটা মাস্তুল আর কিনার ধরে জ্বলছে, পালগুলোতেও একই অবস্থা। কয়েকজনের গায়েও লেগে গিয়েছে আগুন। লোকজন থাকতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যেসব দস্যু ডাওজারে আটকা পড়েছে তারা যে খুব আরামে আছে তা কিন্তু না। জাহাজের ক্রুরা সবাই ভয়ানক হিংস্র হয়ে আছে। কাউকেই ছাড়া হচ্ছে না। ঠিক দস্যুরা যেরকম বলেছিলো।
“একটা নৌকা নামিয়ে দেওয়া উচিত, সমুদ্রে হাবুডুবুর দস্যুদের দেখিয়ে বললো ডোরিয়ান। হাঙরের ডানা দেখা যেতেই চিৎকার শুরু হয়ে গেলো সবার মাঝে।
“এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে লাভ কি বলো, কেপ টাউনে গিয়ে সেই ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে,” টম মনে করিয়ে দিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় ওদের ফুসফুসের সব বাতাস বেরিয়ে গেলো, হল্কা এসে লাগলো সবার গায়ে। একটা বিশাল ঢেউ এসে জাহাজকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। যারা দাঁড়িয়ে ছিলো সবাই-ই ডেক-এ ছিটকে পড়লো। জ্বলন্ত ছাই আর ধ্বংসাবশেষ ঝরতে লাগলো উপর থেকে। সামনে তাকিয়ে দেখা গেলো ফাইটিং কক বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। শুধু কিছু পোড়া কাঠ ভাসতে দেখা যাচ্ছে পানিতে।
টম কষ্টে সৃষ্টে উঠে দাঁড়ালো। এখন আর কাউকে উদ্ধারের চিন্তা করে লাভ নেই। পানিতে থাকা প্রত্যেকটা লোকই নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে বিস্ফোরণের ধাক্কায় তলিয়ে গিয়েছে।
“ওটার পাউডার ম্যাগাজিনে লেগেছিলো মনে হয়।” জাহাজের পাশ থেকে এক পোড়খাওয়া চেহারার লোক বলে উঠলো। গায়ের কোট হারিয়ে ফেলেছে। সে; আর তার বাহু আর গালের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরছে। এরপরেও তার চেহারায় কর্তৃত্বের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলো টম।
“আপনিই কি ডাওজারের মাস্টার?”
“জোসিয়াহ ইঞ্চবার্ড।” লোকটা ফাইটিং ককের ধ্বংসাবশেষের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, টুকরো গুলো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। “জাহাজটা আর ওটার ডাকাতগুলো দুটোর জন্যেই পরিণতিটা ভালোই হয়েছে বলবো।”
টম লড়াই সম্পর্কে লোকটার মন্তব্য শোনার অপেক্ষায় চুপ করে থাকলো, আশা করলো, ওরা যে সাহায্য করেছে সে জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু ইঞ্চবার্ড আর কিছুই বললো না।
“ভাগ্য ভালো যে দস্যুরা যখন আক্রমণ করেছিলো তখন আমরা কাছেই ছিলাম,” টম মনে করিয়ে দিলো। “আমরা আপনার জাহাজটাকে বাঁচিয়েছি।”
ইঞ্চবার্ড ওর কথার অর্থ সাথে সাথেই ধরতে পারলো। “দুঃখিত, আপনারা এজন্যে কিছু পাবেন না। কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলো ইঞ্চবার্ড।
“আপনার জাহাজটা দস্যুরা দখল করে নিয়েছিলো। আপনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন,” জানালো ডোরিয়ান।
“আমি আত্মসমর্পণ করিনি।”
“কিন্তু সব দেখে কিন্তু সেটাই মনে হয়েছে।”
“আপনাদের যদি সেরকম মনে হয় তাহলে লন্ডনের নৌ আদালতে অভিযোগ করতে পারেন।”
টম আর কিছু বললো না। পনের বছর আগে একজন ফেরারি হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছিলো ও। ওর বড় ভাই বিলিকে হত্যার অভিযোগ আছে ওর বিরুদ্ধে। বিলি ছিলো একজন আপাদমস্তক শয়তান লোক। প্রচণ্ড রগচটা। টেমস নদীর ঘাটে, এক মধ্যরাতে ও টমকে আক্রমণ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। অন্ধকারে চিনতে না পেরে টম নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে খুন করে বসে। কিন্তু একথা বলে আদালতে পার পাওয়া যাবে না। ও যদি আবার ফিরে যায়, তাহলে নিশ্চিত ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে।
ইঞ্চবার্ডের সেটা জানার কথা না। তবে ও টমের দুর্বলতাটা ধরতে পারলো। “আপনি যদি মামলা করতে চান তো কোনো সমস্যা নেই। আমি সানন্দে আমার জাহাজে করেই আপনাকে লন্ডনে নিয়ে যাবো।”
“আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনার জাহাজটা রক্ষা করেছি।” ডেক-এর লোকদের মাঝে উত্তেজিত কোলাহল শোনা গেলো। সেন্টারাস পাশাপাশি চলে এসেছে। আবোলি, সারাহ আর ইয়াসমিনিকে ধরে ডাওজারে চড়তে সাহায্য করলো। আমি আমার লোকজন, এমনকি আমার পরিবারের জীবনের ঝুঁকিও নিয়েছি,” টম আবার বললো।
ইঞ্চবার্ডের কণ্ঠ নরম হলো কিছুটা। “আমার হাত-পা বাঁধা, স্যার। ব্যাপারটা একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। আমি যদি আমার মালিকদের না জানিয়ে কিছু করি তাহলে আর কোনোদিন সমুদ্রের মুখ দেখা হবে না। আপনারা যা করেছেন, সেটার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে যা চান তা-ই দিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেজন্যে আপনাকে আগে কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে।”
টম মাথা ঝাঁকালো। মাস্টার এই জাহাজের দায়িত্বে আছে, কিন্তু এতে যা আছে সেসবের মালিক অন্য কেউ। “তাহলে আমি বরং তার সাথেই কথা বলি।”
সারাহ আর ইয়াসমিনি মই বেয়ে উপরে উঠে এলো। সারাহ নিজের পিছনে হাত বেঁধে ডেক জুড়ে ধ্বংসস্তূপ দেখতে লাগলো।
“পরুষ মানুষ মিয়ে আর পারা যায় না,” ইয়াসমিনিকে বললো ও। “কখনো কিছু এলোমেলো ছাড়া গুছিয়ে রাখতে জানে না।” তারপর ইঞ্চবার্ডের দিকে ফিরে বললো। “আমার স্বামী আপনার জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করে থাকলে দুঃখিত।”
ইঞ্চবাৰ্ড অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। “আমরাও ঠিক সেটা নিয়েই আলাপ করছিলাম।”
“আপনার স্বামী আমাদের সবাইকে রক্ষা করেছেন, আর একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। লেগ্রাঞ্জের হাত থেকে যে মহিলাটাকে টম বাঁচিয়েছিলো সে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। কণ্ঠ নিচু আর কেমন ফ্যাসফেসে হয়ে আছে। এমন এক টানে কথা কথা বলছে যেটা টম ধরতে পারলো না। ছেঁড়া কাপড়টা পাল্টে সে নতুন একটা পোশাক পরেছে। একটা নীল রঙ্গা সূতি কাপড়, ঠিক তার বুকের উপর এসে শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে গোটা সমুদ্রই বুঝি মেয়েটার গায়ে এসে জুটেছে। চুল একটা ফিতেয় বাঁধা, তবে কয়েকটা ঠিকই ছুটে এসে ওর খোলা গলায় খেলা করছে। বয়স মোটেও বিশের বেশি না, কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যায় সেই তুলনায় সাহস আর শক্তিতে অনেক বেশি পরিপক্ক মেয়েটা। ডেক এর প্রতিটা লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঘণ্টা আগেও এরা সবাই মেয়েটার সবচে গোপনীয় অঙ্গটাও দেখেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কারো মনে মোটেও কামভাব জাগছে না।
“ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড, আশা করি আপনি ভদ্রতা ভুলে যাননি,” মহিলা বললো। “এই লোকগুলো আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে আর আমি এমনকি এদের নামটা পর্যন্ত জানি না।”
টম সামান্য মাথা ঝাঁকালো। “আমার নাম টম,” বললো ও। “আমার ভাই, ডোরিয়ান; ওর স্ত্রী, ইয়াসমিন; আর আমার স্ত্রী, সারাহ। আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা খুব খুশি।”
“আমি অ্যানা দুয়ার্তে। ঐ দস্যুগুলো আমাদের সব লুট করে নিতে চেয়েছিলো।” অ্যানার শরীরে মৃদু কাঁপুনি বয়ে গেলো। “আমি জানি ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড কেননা তার জাহাজ রক্ষা করার জন্যে বিনিময়ে কিছু দিতে পারছেন না। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে অকৃতজ্ঞ ভাববেন না। দস্যুরা আমাদের মালপত্রের যেটুকু রেখে গিয়েছে তার থেকে যতো ইচ্ছে নিয়ে নিন।”
টম আশা করলো ইঞ্চবার্ড প্রতিবাদ করবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন একটা কথা-ও বললো না।
“আপনি আমাদের দিকটা ভাবছেন বলে খুশি হলাম ম্যাম, কিন্তু আমার মনে হয় এভাবে আমাদেরকে ইচ্ছে মতো সব দিয়ে দিলে কর্তৃপক্ষ বেজার হতে পারে। বিশেষ করে উনিও যদি ইঞ্চবার্ডের মতো হন, তাহলেতো কথাই নেই।”
অ্যানা নিজের মাথা নাড়লো।
“এগুলো আমার মালপত্র।”
“আপনার?”
“আমিই কর্তৃপক্ষ।”
“আপনি?” টম ওর আশ্চর্য ভাবটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।
সারাহ কনুই দিয়ে ওকে গুতো দিলো। “টম কোর্টনী। তুমি একটা আস্ত গবেট। তুমি পুরো আফ্রিকা জুড়ে মহিলা সেনানায়ক, মহিলা ডাকাত, মহিলা মানুষখেকোদের দেখেছো আর জিনিসপত্র বিক্রি করেছো আর এখন কিনা মহিলা ব্যবসায়ী দেখেই তব্দা খেয়ে গেলে?”
অ্যানা আর সারাহ দৃষ্টি বিনিময় করলো-ওদের চোখাচোখির কিছুই বুঝলো না টম। তবে নিজেকে আসলেই বেকুব আর বুদ্ধ মনে হতে লাগলো ওর। এদিকে সারাহের মুখে ওর নাম শুনে ইঞ্চবার্ডের মুখভঙ্গির আশ্চর্য পরিবর্তন ওর চোখে পড়লো না।
সারাহ ওর হাতের ভিতর নিজের বাহু ঢুকিয়ে একদিকে টেনে নিয়ে গেলো। “চলোতো, মিষ্টি করে বললো ও। “মিস দুয়ার্তের উপর যথেষ্ট ধকল গিয়েছে, এখন এভাবে ওনাকে হা করে গিলতে হবে না। চলো কয়টা কাপড়ের গাটরি পছন্দ করি, যা দিয়ে আমাদের বন্দুকের গুলি আর পাউডারের দাম উঠে যাবে। তারপর এদেরকে শান্তিমতো নিজেদের পথে চলে যেতে দেই।”
*
সেদিন পুরোটা, এরপর আরো গোটা একটা দিন লেগে গেলো ওদের আলাদা হতে। সারাহ আর ইয়াসমিনি আহতদের সেবা করলো। টম, ডোরিয়ান আর আবোলি ইঞ্চবার্ডের লোকদেরকে জাহাজ মেরামতে সাহায্য করলো। ওরা মিলে আবার একটা মাস্তুল খাড়া করে দিলো। জাহাজের প্রায় অর্ধেক ক্রু মারা পড়েছে, ফলে সেন্টারাসের লোকেরা রশি পাকিয়ে আর মাস্তুলে চটা মেরে আবার খাড়া না করে দিলে আবার জাহাজটার পক্ষে একা চলা সম্ভব হতো না।
“আবহাওয়া ঠিক থাকলে এটা দিয়েই কেপ টাউনে পৌঁছে যাবো,” ইঞ্চবার্ড বললো। “ওখান থেকে নতুন লোক ভাড়া করে লন্ডনের দিকে যাত্রা করবো।”
কাজটা খুব একটা সহজ না। কিন্তু টম টের পেলো যে ইঞ্চবার্ড চাচ্ছে ওরা জাহাজ থেকে চলে যাক। ব্যপারটা ওর কাছে ভালোই লাগলো। ওরাও তাই দেরি না করে বিদায় নিয়ে ফিরে চললো।
বাতাস পরিষ্কার। রাত নামতেই সারাহ আর টম জাহাজের পিছনের গলইতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত অবলোকন করলো। সূর্যটা পশ্চিম আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত দেশগুলোর ওপাশে টুপ করে ডুবে গেলো।
“তুমি ঐ দুয়ার্তে মেয়েটার কথা ভাবছো, তাই না?” সারাহ বললো।
“আরে না, না,” টম বলতে গেলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিলো সারাহ।
“আমাদের যদি একটা ছেলে থাকতো তাহলে ঠিক ওর মতোই একটা বৌ চাইতাম আমি।”
টম সারাহকে আরো কাছে টেনে নিলো। বিয়ের পর থেকেই ওরা বাচ্চা নেওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। কয়েক বছর আগে সারাহ গর্ভবতীও হয়েছিলো, তখন ওরা লুঙ্গা নদীতে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছিলো; টম ভেবেছিলো ওদের জীবন এবার পূর্ণতা পাবে। কিন্তু সারাহের গর্ভপাত হয়ে যায়, আর তার পর থেকেই ওদের শত চেষ্টার পরেও আর সারাহের গর্ভ সঞ্চার সম্ভব হয়নি।
“তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে তুমি ইংল্যান্ডে থেকে গেলেই ভালো করতে?” সারাহ জানতে চাইলো। “ডেভনের (একটা শহর) কোনো সুন্দরি মেয়েকে বিয়ে করে হাই উইল্ড-এ (টমদের বাড়ির নাম) বাড়ি বানিয়ে থাকলেই ভালো হতো। ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চা হতো।”
টম সারাহের গালে আলতো একটা চাপড় দিলো। “কখনোই না। আর হাই উইল্ড এর মালিক হচ্ছে ব্ল্যাক বিলি।” টমদের বংশের নিয়ম অনুযায়ী সব সম্পত্তির মালিক হয় বড় ছেলে। বিলি ডেভনের সবচেয়ে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। তবুও সম্পত্তির লোভে বিলি ওদের বাবাকে সময়ের আগেই কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু সেই সম্পত্তি ভোগ করার জন্যে বেঁচে থাকতে পারে নি সে।
“সম্পত্তির মালিক এখন হবে বিলির ছেলে ফ্রান্সিস।” টম বলে থামলো একটু। মায়ের কোলে শোয়া একটা লালমুখো ছেলের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। “এতদিনে তাগড়া জোয়ান হয়ে যাওয়ার কথা ওর। হাই উইল্ডের জমিদার-ও হয়ে গিয়েছে।”
সারাহ বাতাসের তোড়ে উড়তে থাকা কাপড় সোজা করলো আবার। “সময় আমাদের সবার সাথেই বড় নির্দয় আচরণ করে, টম কোর্টনী।”
টম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, সূর্যের শেষ কিরণটা সেখানে সমুদ্রকে লেহন করছে। ঢেউ এসে সেন্টারাসের খোলে বাড়ি খেয়ে গর্জন করছে, জাহাজটা এখন যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমে, আফ্রিকার সর্ব দক্ষিণে কেপ টাউনে। হাই উইল্ড থেকে পালিয়ে আসার পর এই শহরটাকেই টম বাড়ি হিসেবে পরিচয় দেয় এখন। কেপ টাউনে ওরা জাহাজটার টুকটাক মেরামত করবে, কিনে আনা মালপত্র বিক্রি করবে, নতুন মালামাল কিনবে, তারপর কয়েক মাস পর আবার হয়তো নতুন কোনো অভিযানে বের হবে।
টম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনে কোনো কিছু নিয়ে ওর দুঃখ নেই, কিন্তু বড় হওয়ার পথে ওকে কতোটা কষ্ট করতে হয়েছে সেসব ও ভুলে যায়নি। সেই বিশাল পুরনো বাড়িটা, সেই গির্জাটা যেটার প্রাঙ্গণে অসংখ্য কোর্টনী কবরে শুয়ে আছে। ওর দাদার সেবা করা চাকরেরা, যাদের সন্তানেরা অনাগত কোর্টনীদের সন্তানদের সেবা করবে, সবই ছিলো একটা বিশাল কিছুর অংশ হিসেবে থাকার অনুভূতি। এখন ও যেখানেই থাকুক না কেননা, ওর শিকড় ওখানেই প্রোথিত, অনেক গভীরে। ও নিজেকে ওখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, কিন্তু এখনো নতুন কোনো জমিনের সন্ধান পায়নি যেখানে নতুন করে শিকড় গাড়তে পারে।
টম সারাহকে দুই হাতে ধরে কপালে চুমু খেলো।
“আমি ভাবছি ফ্রান্সিস এখন কেমন হয়েছে,” কৌতূহলী কণ্ঠে বললো ও।
*
বিশাল বাড়িটা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। বাতাস এসে ওটার কিনারে বা গম্বুজে ধাক্কা খেয়ে বিচিত্র শব্দ করছে আর ধুপধাপ করে ঢিলে হয়ে যাওয়া খিড়কিগুলোকে আটকে দিচ্ছে। শুধুমাত্র সবার উপরের তলার শেষ ঘরটা বাদে বাকি সবগুলো জানালা অন্ধকার হয়ে আছে।
ওটা হচ্ছে মাস্টার বেডরুম। একটা মাত্র মোমবাতি মোমদানির উপরে টিমটিম করে জ্বলছে সেখানে। সেই আলোয় ঘরের চারপাশে বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে, যেনো ওগুলো সব দৈত্য দানো৷ চিমনি বেয়ে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ফায়ারপ্লেসের নিভে যাওয়া কয়লাগুলো তাতে কেঁপে কেঁপে উঠে ঝাঁঝরির উপর নাড়াচাড়া করছে। কয়লা শেষ হয়ে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টা আগেই নিভে গিয়েছে আগুন, কিন্তু তবুও ওটার পাশে দুটো অবয়ব বসে পড়ে নকশা তুলছে, আর একজন কমবয়সী। ছেলে এই মৃদু আলোতেও বই পড়ার ভান করে যাচ্ছে। বিগত পনেরো মিনিট যাবত একটা পৃষ্ঠায়ই আটকে আছে সে।
মহিলাটা হঠাৎ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন। তার ছেলে দৌড়ে এলো কাছে।
“কি হলো আম্মু?”
মহিলা নিজের আঙুল মুখে পুরে খানিকটা রক্ত চুষে নিলেন। “এই আলোয় চোখে দেখা যায় না, ফ্রান্সিস।”
মহিলা হচ্ছে এলিস লেইটন-আগে নাম ছিলো এলিস গ্রেনভিল, এরপর এলিস কোর্টনী। ছেলের দিকে তাকালেন উনি, ছেলের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছোঁয়া দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছেন। ছেলের বয়স পুরো আঠারো হয়নি, কিন্তু এখনই তাগড়া জোয়ান হয়ে গিয়েছে বলা যায়। তবে ছেলেটার মন বড় নরম। মহিলার চিন্তার কারণ সেটাই। বাইরের শয়তানিতে ভরা দুনিয়াতে ছেলেটা কিভাবে কি করবে কে জানে। খাড়া খাড়া কালো চুল, সেই সাথে বাদামী গায়ের রঙ আর মায়াবী কালো চোখে ছেলেটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে। চোখের পাতার ঠিক উপরে কপালেও এক গোছা কালো চুল আছে ওর। মহিলা খেয়াল করে দেখেছেন যে গায়ের মেয়েরা ওর দিকে কিভাবে তাকায়। কোনো একসময়, ঠিক একই দৃষ্টিতে উনিও ওর বাবার দিকে তাকাতেন।
জানালার কপাট দড়াম করে বাড়ি খেলো আবার। যেনো শয়তান নিজে এসে দরজায় করাঘাত করছে। ফ্রান্সিস হাতের বইটা বন্ধ করে একটা লোহার শলা দিয়ে ফায়ারপ্লেসের ভিতর খোঁচাখুঁচি করতে লাগলো। কিন্তু ছাই বাদে আর কিছু বের হলো না।
“বাবা কোথায় গিয়েছে জানো?”
ওর বাবা-মানে আসলে সৎ বাবা। তবে এনাকেই ও বাবা হিসেবে জানে। গত এক সপ্তাহ যাবত বলা যায় লাইব্রেরিতেই নিজেকে বন্দী করে রেখেছেন উনি। কি সব কাগজপত্র নিয়ে পড়ে আছেন, যেসব ওদেরকে দেখতে দিচ্ছেন না। একবার ফ্রান্সিস দেখে করতে গিয়েছিলো, স্যার ওয়াল্টার ওকে বকাঝকা করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এলিস হাতের কাপড়টা নামিয়ে রাখলেন। ওনার কালো চুলে বয়সের আগেই পাক ধরেছে, চোখে কোটরের ভিতরে প্রায়, ধূসর চামড়া গালের কাছটায় কুঁচকে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের এখনো ওর মায়ের সুন্দর আর হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা মনে আছে। সেই ছোটবেলায় মা যখন কোনো পার্টি বা নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফিরতো, তখন ফিরেই আগে ওর ঘরে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে শুভরাত্রি জানাতে। তার চামড়া থেকে তখন আভা বের হতো, চোখ জোড়া ঝলমল করতো। মা যখন ওর দিকে ঝুঁকে আসতো তখন ও মায়ের গায়ের সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেতো, তার নরম তুলতুলে হাত ওর গালে স্পর্শ করতো। মায়ের গলার হীরার হারটা মোমের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠতে। সেই হীরাগুলোই সবার আগে হাতছাড়া হয়েছে।
খালি বাড়িটায় আবার একটা প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে গেলো। মেঝে শুষ্টু কেঁপে উঠলো তাতে। ফায়ারপ্লেসের কয়লা, সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লো। ফ্রান্সিস লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো।
“বজ্রপাত নাকি?” অনিশ্চিত স্বরে বললেন এলিস।
ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। “জানালাও না। নিচ থেকে এসেছে শব্দটা।”
বলে ও লম্বা বারান্দাটা ধরে হেঁটে গিয়ে বিশাল সিঁড়িটা ধরে নেমে এলো। মোমবাতি থেকে মোম গড়িয়ে পড়ে ওর হাতে ছ্যাকা দিতে লাগলো। কিন্তু হাই উইন্ডে আর কোনো রূপার মোমবাতিদান অবশিষ্ট নেই। ফ্রান্সিস সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাতাসে গন্ধ শুকলো। শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে ও গান পাউডারের ঘ্রাণ ভালোই চেনে। স্থানীয় সেনাবাহিনির মহড়ার সময়েও দেখেছে। কিন্তু এ বাড়িতে কখনো এই জিনিসের ঘ্রাণ পায়নি।
বুকের ভিতর একটা শঙ্কা দলা পাকিয়ে উঠলো ওর, হৃৎপিণ্ড বাড়ি খেতে লাগলো বুকের খাঁচার সাথে। ও দৌড়ে লাইব্রেরির দরজার কাছে পৌঁছালো। “বাবা?” ডাক দিলো ও। “বাবা ঠিক আছেন আপনি?”
উত্তরে শুধু জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পতনের শব্দ বাদে আর কিছুই পাওয়া গেলো না। ও দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা আটকানো। হাঁটু মুড়ে বসে ও চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরে তাকালো। কিন্তু ফুটোয় চাবি ভরা থাকায় ওপাশের কিছুই দেখা গেলো না।
“বাবা?” আরো একবার চেষ্টা করলো ও। এবার আগের চাইতে জোরে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ওর বাবা প্রায় কোনো বিরতি ছাড়াই মদ খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।
মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে ও পকেটা হাত ঢুকিয়ে একটা ছুরি বের করে আনলো। তারপর আস্তে সেটাকে চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে ওপাশের মেঝেতে চাবিটা ফেলে দিলো। পুরনো দরজাটার নিচে প্রায় এক ইঞ্চি মতো ফাঁকা আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ও ঘরের শেষ মাথায় টুপি ঝোলানোর জায়গাটায় একটা খড়ের টুপি দেখতে পেলো। টুপিটা নিয়ে এসে সেটার সাহায্যে দরজার নিচ থেকে চাবিটা টেনে নিয়ে এলো।
দ্রুত হাতে তালা খুলে দরজাটা খুলে ফেললো ফ্রান্সিস। রুমের ভিতর আগাতেই মোমের আলোয় ছায়াগুলো বিচিত্র নকশা করে সরে যেতে লাগলো। ছোট বেলায় ও এখানকার মসৃণ মেঝেয় পিছলা খেতো। কিন্তু এখন মেঝেটা অমসৃণ আর জায়গায় জায়গায় চলটা উঠে গিয়েছে; বহু বছর হয় পালিশ করা হয় না। দেয়াল জুড়ে সারি সারি খালি বইয়ের তাক; বাকি সব কিছুর মতো বইগুলোও বেঁচে দেওয়া হয়েছে। একসময় যেখানে তরবারি আর ঢাল ঝোলানো থাকতো সেখানের প্লাস্টারে দাগ হয়ে আছে। কোর্টনীদের শৌর্য বীর্যের প্রতীক ছিলো সেগুলো। রূপা আর কাঁচের তৈজসপত্রের মতো ওগুলোও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
ঘরের একদম শেষ মাথায় একটা বিশাল ওকে কাঠের টেবিল। একগাদা কাগজ আর খালি ওয়াইনের বোতল দেখা যাচ্ছে ওটার উপর। কোনো গ্লাস বা আর কোনো পাত্র নেই। ওর বাবা আলুথালুভাবে ওটার পেছনে চেয়ারে বসে আছেন। যেনো ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাগজপত্রের উপরে লাল রঙের একটা তরলে ভরে আছে।
ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা দৌড় মেরে অবয়বটার কাছে। পৌঁছে সেটাকে টেনে সোজা করলো। কিন্তু ছেড়ে দিতেই দেহটা টেবিলের উপর পড়ে টেবিল শুদ্ধ উলটে পড়ে গেলো। ওর বাবা মেঝের উপর আছড়ে পড়ে একদিকে কাত হয়ে গেলেন। একটা হাত থেকে পিস্তল খসে পড়লো।
সারা শরীর কাঁপিয়ে বমি পেলো ফ্রান্সিসের। বহু কষ্টে সামলালো ও সেটা। “বাবা?”
স্যার ওয়াল্টার লেইটন একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু মাদকের নেশা তার সব শেষ করে দিয়েছে। এমনকি মারা যাওয়ার পরেও তার চেহারায় এক অদম্য শক্তিমত্তার ভাব ফুটে আছে। ছোট বেলার কথা মনে পড়লো ফ্রান্সিসের। বাবা ওকে বাতাসে ছুঁড়ে মেরে আবার ধরে ফেলতেন, ঘোড়ায় চড়ে বেড়া ডিঙ্গাতে পারলে একটা স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ দিতেন, বলা নেই কওয়া নেই লন্ডনে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। এখন তার নিষ্প্রাণ নীল চোখ জোড়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ওর কাছে ক্ষমা চাইছে। সামনের দিক থেকে তাকালে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভালো করে খেয়াল করলেই কপালের উপরের দিকের ক্ষতটা চোখে পড়ে, যেখান দিয়ে পিস্তলের গুলি তার ঘিলুকে পিছন দিয়ে বের করে দিয়েছে।
পিছনে একটা খনখনে চিৎকারে সম্বিত ফিরলো ফ্রান্সিসের। ও ঘুরে তাকালো সেদিকে। এলিস দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। মুখে হাত চাপা দেওয়া। মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন।
“তোমাকে বলেছিলাম উপরেই থাকতে,” ফ্রান্সিস বললো। ওনাকে এই দৃশ্য দেখতে দিতে চায়নি মোটেও। ও দ্রুত এগিয়ে এলিসকে জড়িয়ে ধরলো। মুখটা নিজের কাঁধে চেপে ধরলো যাতে ভয়াবহ দৃশটা তাকে দেখতে না হয়।
এলিস ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম কেনো করলেন উনি?”
ফ্রান্সিস এলিসকে একটা চামড়ার চেয়ারের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বসিয়ে দিলো। ওখান থেকে লাশটা দেখা যাবে না। তারপর গায়ের শালটা আরো ভালোভাবে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আবার টেবিলটার কাছে। ফিরে গেলো। এলিস আর ওঠার চেষ্টা করলেন না।
ফ্রান্সিস কাগজের গাদা থেকে সবার উপরের কাগজটা তুলে নিয়ে আলোর বিপরীতে ধরলো। লন্ডনের একটা ফার্মের একজন উকিলের চিঠি ওটা। ও জীবনেও নাম শোনেনি আগে। আইনের নানান গালভরা ধারা আর শব্দে ভরা চিঠিটা। ফলে বুঝলো না কিছুই। একটা প্যারার কিছুটা বুঝলো শুধু।
যদি আপনি উনিশে অক্টোবর মাঝরাতের আগে এই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে দেওয়ান পাঠিয়ে উল্লেখিত সম্পত্তি আর তাতে অবস্থিত যা কিছু আছে সব দখল করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
“এখানে আসলে হাই উইল্ড এর কথা বলা হয়েছে,” ফ্রান্সিস বুঝতে পারলো। “আর দিনটাও আজ রাতেই।” ও ঘড়ির দিকে তাকালো। যতোটা ভেবেছিলো, তার চাইতে বেশি রাত এখন। পাহাড়ের উপরের গির্জায় এগারোটার ঘণ্টা বাজানো হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু ও সেটা খেয়াল করেনি। হঠাৎ প্রচণ্ড আতংক গ্রাস করলো ওকে। “ওদের আসতে আর এক ঘণ্টাও নেই।”
ফ্রান্সিস আবার ওর বাবার লাশটার দিকে তাকালো। ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো ও, এতোক্ষণের দুঃখিত ভাবটা কেটে যাচ্ছে সেটার কারণে! ওর ঠিক মনে নেই কতোদিন আগে ও টের পেয়েছিলো যে ওর বাবা আসলে একজন জাত জুয়াড়ি। প্রায়ই দেখা যেতো ওদের বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে রৌপ্যমুদ্রা উধাও হয়ে যাচ্ছে, আবার কয়েক মাস পর দেখা যেতো সেসব আবার ফিরে আসছে। মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাসের আসর বসতো। অনেক রাত পর্যন্ত চলতো সেগুলো, ফ্রান্সিসের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলেও দেখতে সেগুলো চলছে। ওর বাবার মেজাজও একেক সময় একেক রকম থাকতো। কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যেতো চুপচাপ, বেজার হয়ে আবার কখনো খুশিতে ঝলমল করতেন। ফ্রান্সিস আর এলিসের জন্যে গাদা গাদা উপহার নিয়ে আসতেন তখন। প্রায়ই দেখা যেতো অপরিচিত লোকজন আসছে বাড়িতে। সিঁড়ির রেলিং-এর আড়াল থেকে তাদেরকে দেখতে ফ্রান্সিস। কিন্তু ধরা পড়লেই এলিস ওকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আচ্ছাসে বকতেন।
কিন্তু ও কখনো কল্পনাও করেনি যে অবস্থা এতটা খারাপ। বাইরে থেকে তীব্র একটা শব্দ কাঁপিয়ে দিলো আবার বাড়িটাকে। ফ্রান্সিসের মনে হলো দেওয়ানেরা বোধহয় এসেই পড়েছে। আসলে ওগুলো জানালার কপাট বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ঘড়ির দিকে আর এক নজর তাকিয়ে বুঝলো আর মাত্র পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে।
“আমাদেরকে যেতে হবে,” করুণ সুরে বললো ফ্রান্সিস। ও আবার ওর মাকে টেনে দাঁড় করিয়ে উপরের তলায় নিয়ে গেলো। যাওয়ার পথে সদর দরজা বন্ধ করে দিতে ভুললো না। এলিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, হাত পা ঠাণ্ডা। “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, যা যা নেওয়া সম্ভব সব নাও।”
অবসন্ন ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে দেরাজ খুলে কয়েকটা পোশাক বের করলেন এলিস। ফ্রান্সিস নিজের ঘরে গিয়ে নিজের যৎসামান্য যা আছে তা একটা ব্যাগে ভরে নিলো। প্রতিটা সেকেন্ড পার হওয়াটা অনুভব করতে পারছে ও।
আবার মায়ের ঘরে ফিরে এসে দেখে বিছানা জুড়ে কাপড় ছড়িয়ে উনি চুপচাপ বসে আছেন।
“কি ব্যাপার?” রেগে গেলো ফ্রান্সিস। “ওরা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে এখানে।” বলতে বলতে নিজেই মায়ের কাপড় একটা ব্যাগে ভরতে শুরু করলো। “যদি আজ আমার বাবা
“ওনাকে ওই নামে ডাকবে না,” ফিসফিস করে বললেন এলিস। “স্যার ওয়াল্টার তোমার বাবা নন।”
“আমি জানি। কিন্তু তুমিই বলেছো যে আমার তাকে-”
“ভুল করেছি আমি। আমি ওনাকে বিয়ে করেছিলাম কারণ আমি ছিলাম এক বিধাব আর তোমার একজন বাবার দরকার ছিলো। উইলিয়াম মারা যাওয়ার পরে আমার পরিবার আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়; ওরা এমনকি ওর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও আসেনি। অভিজাত পরিবারগুলোর বাইরের একজন সাধারণ লোককে বিয়ে করার জন্যে বাবা আমাকে খুবই অপছন্দ করতেন। অথচ কোর্টনীদের আমাদের চাইতেও বেশি টাকা পয়সা ছিলো। এরপর উইলিয়াম মারা গেলো, আর মারা যাওয়া নিয়ে যেসব গুজব শোনা যেতে লাগলো… বাবা আমাকে কখনোই ক্ষমা করেননি।”
“এসব তো আগে বলোনি।”
“তুমিতো ছিলে একটা দুধের বাচ্চা। এমনিতেই কতো কষ্ট পেয়েছো তুমি। স্যার ওয়াল্টার লেইটন ছিলেন দারুণ একজন মানুষ। খুব মজা করতে পারতেন। কিন্তু আমি ওনার আসল রূপটা ধরতে পারিনি। ঠিক যেমন আমি তোমার বাবাকেও চিনতে ভুল করেছিলাম। যখন বুঝেছি ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”
“কিন্তু তুমি সবসময় বলেছো যে আমার বাবা, মানে আমার আসল বাবা, উইলিয়াম কোর্টনী ছিলেন ভালো মানুষ। একজন দয়ালু মহৎ লোক।”
এলিসের চেহারায় ভাঁজ পড়লো। “ওহ ফ্রান্সিস, সবই ছিলো মিথ্যে। উইলিয়াম কোর্টনী কেমন মানুষ ছিলো সেটা জানলে তুমি কতটা কষ্ট পাবে সেই ভয়েই আমি কিছু বলতে সাহস করিনি। ও ছিলো একটা কুৎসিত মনের নরপশু। নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো; আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে, বেঁচে থাকলে তোমার উপরেও করতো। ও নিজের আপন ভাই টমাসকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো।”
ফ্রান্সিসের মনে হলো পায়ে কোনো বল পাচ্ছে না। ও ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো। রাগের চোটে চোখে পানি এসে গেলো ওর। “না। আমিতো জানি টমাস ওনাকে খুন করেছেন। তুমিই বলেছো মা। তুমি নিজে বলেছো।”
“সেটা সত্যি। টম উইলিয়ামকে মেরেছে,” স্বীকার করলো এলিস। “কিন্তু সেটা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে।”
“তুমি সেখানে ছিলে?” টম জোর দিয়ে বললো। “নিজের চোখে দেখেছো?”
“উইলিয়াম লন্ডনে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। টম ওকে খুন করেছে এমন খবর চাউর হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি টম যদি ওকে আসলেই খুন করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আগে উসকে দেওয়া হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিজের আপন ভাইকে খুন করার লোক টম না।”
ফ্রান্সিসের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। কিন্তু আসলে উনি সেটাই।”
আচমকা নিচে করাঘাত শোনা গেলো। মাপা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। শব্দটা কিসের সেটা ধরতে এবার আর কোনো কষ্ট হলো না। ভারী দরজায় শক্তিশালী একটা হাতের আঘাত। ফ্রান্সিস চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ একজন দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
এলিস ফ্রান্সিসকে আঁকড়ে ধরলেন। “তুমি এখন বড় হয়েছে। সত্যিটা এখন তোমার জানা দরকার।”
“মিথ্যা বলছো তুমি।” ও ঝাড়ি মেরে এলিসের হাত ছুটিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ তুলে নিলো। আবারও দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমি আজ রাতে একটা বাবাকে হারিয়েছি। আর এখন তুমি বাকিজনেরও স্মৃতি নষ্ট করে দিচ্ছো।”
“দরজা খুলুন,” একটা ভারি গলা শোনা গেলো। এই ঝড়ের মাঝেও স্পষ্ট। “আমরা আইনের লোক।”
ফ্রান্সিস দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। “আমাদের যেতে হবে। ওরা আমাদেরকে এখানে পেলে সব কিছু নিয়ে নেবে।”
“আমি যাবো না,” গায়ের শালটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন এলিস। “ওরা নিশ্চয়ই একজন গরীব বিধবাকে এভাবে বাড়িছাড়া করবে না। আর ওয়াল্টার যেহেতু মারা গিয়েছে, তার মানে এতো সহজে ওড়া ওর ঋণের শোধ পাবে না। যদি ওরা বাড়িটা নিতে চায় তো নিক। এই বাড়িটায় আমার একমাত্র আনন্দ হচ্ছে তোমার জন্ম। এটা বাদে বাড়িটায় শুধু দুঃখই পেয়েছি।”
ফ্রান্সিস এলিসের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবেগা দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর; অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।
“দরজা খুলুন,” নিচ থেকে হাক শোনা গেলো আবার।
ফ্রান্সিস দৌড় দিলো। পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনে চলে এলো ও। আস্তাবলের সব কর্মচারীকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; ও যেসব ঘোড়ার শাবকে চড়ে বড় হয়েছে সেসবকেও বহু আগেই নয়ন মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। শুধু একটা ঘোড়াই বাকি আছে-নাম হাইপেরিয়ন। তেরোতম জন্মদিনে ওর সৎ বাবা ওকে এই উজ্জ্বল বাদামী ঘোড়াটা উপহার দিয়েছিলো। ফ্রান্সিসের পদধ্বনি শুনে ঘোড়াটা মৃদু হ্রেষা ধ্বনি করে উঠলো।
ফ্রান্সিস একটা বাতি জ্বালিয়ে দ্রুত হাতে ঘোড়ার পিঠে কম্বল চাপালো। দেওয়ানের লোকজন কিছুক্ষণ পরেই পিছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢোকা যায় কিনা সেটা খুঁজতে চলে আসবে। ও দেয়ালে ঝোলানো একটা পানিরোধী কাপড় কাঁধে চাপিয়ে হাইপেরিয়নকে উঠোনে নিয়ে এলো।
একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে।
“মা?” এলিসকে দেখা মাত্র ফ্রান্সিসের রাগ পানি হয়ে গেলো, আস্তাবলের ছায়ায় ওনাকে ভূতের মতো লাগছে। ওনার শুকিয়ে যাওয়া শরীরে ঝুলতে থাকা কাপড় বেয়ে পানি ঝরছে, যেনো একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ওনার হাতে একটা ছোট ভেলভেটের ব্যাগ।
“বিদায় না বলেই তোমাকে ছাড়ি কিভাবে বলো?”
ফ্রান্সিস–কে জড়িয়ে ধরলো। “গুডবাই মা।”
“কোথায় যাবে তুমি?” ঝড়ের কারণে ফ্রান্সিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাতে হচ্ছে এলিসের।
ফ্রান্সিসের মাথায় চিন্তাটা আগে আসেনি। কিন্ত আসামত্র ও উত্তরটা পেয়ে গেলো।
“দুনিয়াতে পরিবার বলতে আমার আর আছে গাই চাচা। উনিতো এখন আছে বোম্বেতে। আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন অফিসে যাবো। গিয়ে একটা চাকরি আর ওদের জাহাজে করে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলবো।” ফ্রান্সিস বিশাল বাড়িটার দিকে তাকালো। কতো শত স্মৃতিতে ভরপুর। “একদিন অনেক টাকা কামিয়ে আবার ফিরে আসবো। আবার হাই উইল্ডকে ফিরিয়ে নেবো।”
এলিস হাতের আঙুলে ঝোলানো ভেলভেটের ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরলেন। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজের একমাত্র ছেলেকে বিদায় দেওয়ার ব্যথাকে চাপতে।
“ভালোই বলেছো। গাই চাচার সাথে সাবধানে থাকবে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে ওদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরেরা বাদে তুমি হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার। মাত্র দুই বছর বয়সেই তুমি এটার মালিক হয়েছিলে। তোমার দাদা হাল বিশ হাজারেরও বেশি শেয়ার কিনেছিলেন। আর উইলিয়াম এতো কম বয়সে মারা যাওয়ার পরে তুমিই ছিলে ওগুলোর মালিক। ওগুলোকে একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে রেখে দেওয়া যেতো। কিন্তু গাই বলেছিলো ওগুলো বিক্রি করে দিতে। আমি ওর কথাই শুনি। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ যে আসলেই আমাদেরকে আমাদের ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়েছিলো কিনা। আমরা যদি শেয়ারগুলো ট্রাস্টে রাখতাম তাহলে ওয়াল্টার কখনোই ওগুলোর নাগাল পেতো না। ওগুলোকে নগদ টাকায় ভাঙ্গানোর পরেই…”
এলিস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উইলিয়াম যেমন মানুষই হোক না কেনো, ও। মারা যাওয়ার পর এলিস ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী বিধাব। কিন্তু বিগত পনেরো বছর ধরে সেই সম্পত্তিকে তার সদ্য প্রয়াত স্বামী ঋণ আর কর্জের বোঝা বানিয়ে ফেলেছে। কোন মুখে উনি ফ্রান্সিসকে থেকে যেতে বলবেন? ওর জন্যে এখানে কিছুই নেই। স্যার ওয়াল্টার সব খেয়ে দিয়েছেন।
“এটা নাও।” বলে উনি ভেলভেটের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন। বৃষ্টিতে কাপড়টা ভিজে গিয়েছে কিন্তু ফ্রান্সিস হাতে নিয়েই বুঝলো যে ভিতরে শক্ত কিছু একটা আছে। ও ব্যাগটা খুললো।
বিগত কয়েক মাসের দারিদ্রের পরে ভিতরের দৃশ্যটা একেবারে স্বর্গীয় বলা চলে। আস্তাবলের মশালের আলোয় ও দেখতে পেলো জিনিসটা একটা সোনার পদক। ঝকড়া কেশরওয়ালা একটা সিংহ খোদাই করা আছে তাতে। সিংহটা নিজের পায়ের থাবায় পুরো পৃথিবীকে ধরে রেখেছে। আর উপরের মীনা করা নীল আকাশ থেকে হীরার তারা আলো ছড়াচ্ছে।
“কি এটা?”
“দ্য অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জ অ্যান্ড হলি গ্রেইল। কোর্টনীরা বংশ পরম্পরায় এটা গলায় পরে। এটার মালিক এখন তুমি।”
“কিন্তু…” ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো। যেনো একজন ক্ষুধার্ত লোককে একগাদা খাবারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। “এরতে বিশাল দাম। শুধুমাত্র হীরাগুলোইতো… এটা বেঁচেই তো আমরা হাই উইল্ড রেখে দিতে পারি।”
“না।” ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন এলিস। “এটা কোর্টনীদের ইজ্জতের ব্যাপার। যেখানেই যাও, যা-ই করো, এটা কখনো যেনো হাতছাড়া না হয়।”
কাছেই চিৎকার শোনা গেলো। বাড়ির পাশ থেকেই। এলিস ফ্রান্সিসের হাত ধরে কপালে চুমু খেলেন।
“যাও। লন্ডনে গিয়ে স্যার নিকোলাস চিন্ডস এর সাথে দেখা করবে। উনি তোমার দাদার বন্ধু ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ওনার প্রভাব এখনো অনেক। যদি কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারেন তো উনিই পারবেন।”
*
ছোট থাকতে ফ্রান্সিস অনেকবার লন্ডন এসেছে। কিন্তু সবসময়েই সাথে ওর বাবা মা ছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরতো ওরা। কোচোয়ান চাবুক দিয়ে বাতাসে সপাং করে বাড়ি দিয়ে সামনের লোকদের সরিয়ে দিতে। সাথে একটা চাকরও থাকতো যে প্রতিটা থামার জায়গায় কিছু লাগলে এনে দিতো। আর এবার লন্ডন যেতে লাগলো প্রায় এক সপ্তাহ। ভাঙাচোরা রাস্তা আর শরতের ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস উঠে গেলো ওর। রাত কাটালো কোনো খানা খন্দের ভিতরে। হাইপেরিয়নকে বেঁধে রাখতো ঝোঁপের আড়ালে যাতে কারো চোখে না পড়ে। কারণ সবসময় দুশ্চিন্তা হতো যে কোনো শয়তানের কবলে পড়ে ও জামার নিচে লুকানো লাল ভেলভেটের ব্যাগটা হারিয়ে ফেলবে। স্যালিসবুরি পৌঁছার পর এক সকালে ওর ঘুম ভাঙলো শেরিফের লোকজনের ডাকে। ওরা ওকে ঘোড়া চোর মনে করে ধাওয়া দিলো। বেশ কয়েকটা মাঠ পেরিয়ে এসে তারপর পালাতে সক্ষম হলো ফ্রান্সিস। রিচমন্ড পৌঁছে, সাথে থাকা শেষ কয়েকটা মুদ্রা দিয়ে ও হাইপেরিয়নের জন্যে এক ব্যাগ ওট আর নিজের জন্যে এক মগ বিয়ার কিনলো। লন্ডন পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘোড়াটা প্রায় পঙ্গু হওয়ার জোগাড় হলো। আর ফ্রান্সিসও দেখা গেলো ময়লা-কাদা মেখে ভূত হয়ে গিয়েছে।
শহরের কোলাহলে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে গেলো। লোকজনের হট্টগোল, পাথরের রাস্তায় গাড়ির ক্যাচকোচ শব্দ-নীরবতা নেই এক ফোঁটা। ফ্রান্সিস হাইপেরিয়নের উপর থেকে নেমে লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো। সাথে কানে কানে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ব্যস্ত রাস্তায় বেশিরভাগ লোকই ওকে কোনো পাত্তা দিলো না, কিন্তু ওদের চোখের দৃষ্টি ফ্রান্সিসের নজর এড়ালো না। এক ভবঘুরে ছেলের সাথে এরকম সুন্দর একটা ঘোড়া-ব্যাপারটা সবার কাছেই সন্দেহজনক। সেটা বুঝতে পেরে ফ্রান্সিসের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো; এর আগে কখনো ওর এতোটা একাকী লাগেনি।
অবশেষে একটা আস্তাবল খুঁজে পেলো ফ্রান্সিস। কিন্তু ওখানকার লোকটা ফ্রান্সিসকে এক নজর দেখেই ঘোষণা দিলো যে ওকে আগাম টাকা দিতে হবে। ভাড়া হচ্ছে পাঁচ শিলিং।
ফ্রান্সিস নিজের পকেট চাপড়ে বললো, “আমার কাছে কিছু নেই।”
“তাহলে আমারও কিছুই করার নেই।”
“প্লীজ।” রাত নেমে আসছে। এই ভয়ানক শহরে এভাবে চলার কথা মাথায় আসতেই ভয় লাগছে ফ্রান্সিসের। “আমি কালই আপনার টাকা দিয়ে দেবো।”
ধূর্ত চোখে ফ্রান্সিসকে আপাদমস্তক মাপলো লোকটা। ওর মরিয়া ভাবটা ভালোই টের পেয়েছে। “ঘোড়াটাকে বেচে দাও তাহলে।”
আতংকিত চোখে চেয়ে রইলো ফ্রান্সিস। প্রস্তাবটা বাতিল করতে মুখ খুললো, কিন্তু কথা বের হলো না। কারণ হঠাৎ খেয়াল হলো যে, ও যদি ভারতে নতুন জীবন শুরু করতে যায় তাহলে হাইপেরিয়নকে সাথে নিতে পারবে না।
চোখে পানি জমলো ফ্রান্সিসের কিন্তু সেটা পড়তে দিলো না।
“কতো দেবেন?”
“আমার জন্যে না। আমি দেখি কেনার মতো কাউকে পাই কিনা। ততোক্ষণ ও এখানেই থাক।”
ফ্রান্সিস ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরে কেশরে মুখ গুঁজে দিলো। হাইপেরিয়ন গরগর করে উঠলো। আস্তাবলের পরিচিত শব্দ আর গন্ধে আবার ভালো লাগছে ওর।
“রাতে থাকার জন্যে একটু জায়গা পাওয়া যাবে?”
লোকটা আবার ওর আপাদমস্তক তাকালো একবার। “চাইলে আস্তাবলে ঘুমাতে পারো।”
*
রাতে ফ্রান্সিসের ভালো ঘুম হলো না। ভোরেই উঠে পড়লো তাই। একটা পাত্র থেকে পানি নিয়ে যতোটা সম্ভব নিজেকে পরিষ্কার করে নিলো। ঘোড়ার গা পরিষ্কার করার ব্রাশ দিয়ে কাপড়ের কাদা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না বেশি একটা। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দোকানের কাছে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে শুকনো হাসি ফুটলো ওর মুখে। চুলগুলো কাকের বাসার মতো.হয়ে আছে। চোখের চারপাশে বেগুনি দাগ, যেনো কেউ ঘুষি মেরেছে। গাল জুড়ে সদ্য গজানো দাড়ি। কাপড় ছিঁড়ে আছে এখানে সেখানে। আর কাদা না থাকলেও দাগ ঠিকই লেগে আছে সবখানে। ডান পায়ের জুতোর ছেঁড়া দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আঙুল।
ফ্রান্সিস লন্ডনের অন্যতম সেরা ধনীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। স্যার নিকোলাস চিল্ডস-ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটা ছোট সওদাগরী কোম্পানি থেকে অর্ধেক দুনিয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী এক মহীরুহে রূপান্তরিত করেছেন। ফ্রান্সিস অনেক ছোট থাকতেই ওনার নাম শুনেছিলো। কিন্তু ওর সৎ বাবা যখনই ওনার প্রসঙ্গ তুলতেন ওর মা তখন অন্য ব্যাপারে কথা বলতেন।
ফ্রান্সিসের মনে হলো লন্ডনের প্রায় সবাই-ই লেডেনহল স্ট্রীট-এর বাড়িটাকে চেনে, তাই কোনদিকে যাবে সেটা বের করতে ওর কোনোরকম বেগই পেতে হলো না। প্রথম দর্শনে বাড়িটার খুব আলাদা কিছুই চোখে পড়বে না। কাঠের জানালা আর একজোড়া ভারী দরজা কৌতূহলী পথিকের দৃষ্টি থেকে বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে; অলঙ্করণ বলতে আছে শুধু দরজার দুপাশে বিশাল দুটো থাম। তার পাশে একজন পোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়ানো। কিন্তু যদি চোখ তুলে দেখা হয়, তাহলে অনেক বিস্তারিত ধরা পড়বে। তখন বোঝা যাবে যে আসলে ভবনটা কতোটা বিশাল। দোতলায় একটা কাঠের ব্যালকনি রাস্তা পর্যন্ত এসে পড়েছে। পিছনে কাঁচ ঘেরা বারান্দা। তার ঠিক উপরে, তিনতলায় একটা রাজকীয় প্রতীক সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরে কার্ণিসে যতোদূর চোখ যায় ততোদূর একটা সমুদ্রে ভাসমান পালতোলা জাহাজের মুরাল আঁকা। জাহাজের পাশে ডলফিনেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। ওটার মাঝে আছে রানি এলিজাবেথের একজন নাবিকের ভাস্কর্য। নাবিকটা লন্ডনের বাড়িগুলোর চুড়া আর চিমনীগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
জানা না থাকলে, প্রথম দর্শনে কারো মনে হতে পারে যে এটা বোধহয় জাহাজের জিনিসপত্রের দোকান। ভুল করে শহরের মাঝখানে দোকানটা দিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আসলে জায়গাটা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান কয়েকজন লোকের সদরদপ্তর।
ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো, সাহসে কুলাচ্ছে না। শেষমেশ দারোয়ানের দিকে আগালো ও।
“কষ্ট করে স্যার নিকোলাস চিল্ডসকে গিয়ে একটু বলবেন যে, ফ্রান্সিস কোর্টনী ওনার সাথে জরুরি কাজে দেখা করতে চায়।” উৎকণ্ঠায় স্বাভাবিকের চাইতে বেশি জোরে বলে ফেললো কথাগুলো। মনে মনে এরকম বাচ্চামির জন্যে মরমে মরে গেলো ফ্রান্সিস।
দারোয়ান ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “স্যার নিকোলাস চিল্ডস আজ খুব ব্যস্ত। আর স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী তো সেই রাজা চার্লসের আমলেই মারা গিয়েছেন।”
“আমি ওনার নাতীর নাতী। একটু দয়া করুন, আমার স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করাটা জরুরি।” বলে ও ভারি দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলো। একটা শক্ত হাত ওর পথ আটকে দাঁড়ালো, তারপর ধাক্কা দিয়ে আবার পিছনে ঠেলে দিলো।
“স্যার নিকোলাস কারো সাথে দেখা করছেন না।” জোর দেওয়ার জন্যে দারোয়ান প্রতিটা শব্দ বলার সময় আঙুল দিয়ে ফ্রান্সিসের বুকে খোঁচা দিলো। “আর যদি আপনি এরকম দরজা ধাক্কা দিতে আসেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনবো।”
ফ্রান্সিস রাস্তার উল্টোপাশে একটা কফির দোকানের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলো লোকজন টেবিল ঘিরে বসে নানা আলাপ আলোচনা করছে, পত্রিকা পড়ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওর আর ওদের মাঝে বাধা শুধু একটা কাঁচ, অথচ মনে হচ্ছে ওটা সম্পূর্ণ অন্য একটা দুনিয়া।
একটা অক্ষম ক্রোধ বয়ে গেলো ফ্রান্সিসের ভিতর দিয়ে। একেবারে ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলো সেটা। বিগত কয়েক বছরে ওর মাঝে মাঝে মনে হতো যে ওর আসলে কিছুই নেই। আসলে ফ্রান্সিস কখনো বোঝেইনি যে ওর কতোটা ছিলো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে টাকা পয়সা না থাকার হতাশায় আসলে ও কতোটা কাবু হয়ে পড়েছে। টাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব না। এটার কমতি থাকাতেই ওর সৎ বাবা মারা পড়লো, ওকে ওর মায়ের কাছে থেকে আলাদা হয়ে যেতে হলো, ওর বাড়ি, ওর ঘোড়া সব ছাড়তে হলো। পরনের কাপড় আর গলায় ঝোলানো পদকটা ছাড়া ওর আর এখন কিছুই নেই।
ফ্রান্সিস আবারও কফির দোকানটার ভিতরে তাকিয়ে নিজেকে সেখানে কল্পনা করতে লাগলো। মনে মনে দেখতে পেলো ওর সাথের ব্যবসায়ীদের সাথে বসে ও ভারত থেকে সদ্য সেরে আসা ব্যবসা আর সেটা থেকে পাওয়া বিশাল মুনাফার কথা আলোচনা করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিতে যা করা দরকার ও সেটা করতে প্রস্তুত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যেতে প্রস্তুত, যে কোনো কষ্ট সইতে রাজি, যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না। সফল হওয়ার জন্যে এমনকি মানুষও খুন করতে পারবে। যদিও চিন্তাটা মাথায় আসতেই ওর কাপুনি ধরে গেলো। ফ্রান্সিস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে ও ওর ভাগ্যকে জয় করবেই নয়তো চেষ্টা করে জান দিতে হলেও দেবে।
অপেক্ষা করবে বলেই ঠিক করলো ফ্রান্সিস। প্রতিবার যখন দোকানটার দরজা খুলছিলো তখন ভিতরের খাবারের সুগন্ধে ওর জিভে জল চলে আসছিলো। সকালটা পড়ে আসতেই দেখা গেলো লোকজন মাংসের পাই বা গরম পেস্ট্রি হাতে গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছে। ওর গলায় ঝুলানো ব্যাগটার ওজন ওর কাছে ক্রমশ আরো ভারি লাগতে লাগলো; জিনিসটা এতো বেশি দামি, অথচ এটা বিক্রির কথা ভাবতেও পারে না। ও একবার ভাবলো আস্তাবলে ফিরে গিয়ে দেখে যে লোকটা হাইপেরিয়নকে বেচতে পেরেছে কিনা, কিন্তু স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়ে যায় সেজন্যে যেতেও পারছে না।
ফ্রান্সিস জানে না যে কিভাবে স্যার নিকোলাসকে চিনবে। মা বলেছে যে চিল্ডস ওর দাদা হাল এর বন্ধু ছিলেন, তার মানে ওনার বয়স নিশ্চয়ই এখন অনেক বেশি। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটার ভিতরে লোকজুনের আসা যাওয়া দেখতে লাগলো। পরিপাটি পরচুলা পরা বৃদ্ধ লোকেরা যেমন আসছে, তেমনি বই আর কাগজপত্রের বোঝা নিয়ে যুবকদেরকেও দেখা গেলো ভিতরে যেতে। প্রতিবার যখনই দরজা খোলা হচ্ছিলো দারোয়ানটা ওর দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে থাকছিলো, কিন্তু ফ্রান্সিস একবারও রাস্তা পার হলো না। একবার ওর মনে হলো যে কেউ একজন দোতলার ব্যালকনির ছায়া থেকে ওর দিকে। খেয়াল রাখছে। কিন্তু ও ভালো করে দেখার আগেই লোকটা ভিতরে চলে গেলো।
অক্টোবরের দিনটা বয়ে চললো। ছায়াগুলো লম্বা হলো আরো; খালি হয়ে গেলো কফির দোকানটা। গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ধ্যার প্রার্থনার সংকেত দেওয়া শুরু হলো। ফ্রান্সিস ভেবে পেলো না এখন ও কোথায় যাবে বা কি খাবে। দুপুরে দেখা সব দিবাস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়েছে ততোক্ষণে। এখন ওর মাথায় ঘুরছে শুধু খাওয়ার কথা। ও ভেলভেটের ব্যাগটা স্পর্শ করে নাড়াচাড়া করলো কিছুক্ষণ। আস্তাবলের কাছেই ও একটা মহাজনের দোকান দেখেছিলো; ওখানে বন্ধক রেখে নিশ্চয়ই ভালো টাকা পাওয়া যাবে। কয়েকদিনই তো, হাইপেরিয়নের টাকাটা পেলাই শোধ করে দেবে। কিন্তু চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে লজ্জা হতে লাগলো ওর।
চিন্তায় ডুবে থাকায় ফ্রান্সিস খেয়াল করলো না যে চাপরাসটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে টের পেলো। লোকটার হাতে একটা কাগজে মোড়ানো গরম কেক।
“সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে আছো দেখলাম। কিছু তো খাও নি।”
ফ্রান্সিস লোকটার হাত থেকে কেকটা প্রায় কেড়ে নিয়ে গপাগপ খেতে আরম্ভ করে দিলো। কেকটার মিষ্টি স্বাদ আর আলমন্ডের সুঘ্রাণ আস্বাদনের অবস্থায় নেই ও আর এখন।
ফ্রান্সিস খাওয়ায় এতোই ব্যস্ত ছিলো যে দারোয়ানের সাথে আরো দুজন লোক এসেছে সেটা ও খেয়াল করার ফুরসত পায়নি। আচমকা এক জোড়া শক্ত হাত ওর হাত জোড়া চেপে ধরলো, আর একটা হাত চেপে ধরলো ওর মুখ। আর দারোয়ানটা হাতের লাঠি চেপে ধরলো ওর গলায়। দম বন্ধ হয়ে এলো ফ্রান্সিসের। অর্ধেক খাওয়া কেকটা মাটিতে পড়ে গেলো, আর একটু পরেই বুটের তলায় চাপা পড়ে মিশে গেলো রাস্তায়।
ফ্রান্সিস নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। দারোয়ান আর তার লোকেরা ওকে চ্যাং দোলা করে রাস্তা পেরিয়ে দালানের ভিতরে নিয়ে গেলো। ও এমনকি একটা চিৎকারও দিতে পারলো না। রাস্তার কেউ যদি ঘটনাটা দেখেও থাকে, তারা ভালোই জানে যে এসব ক্ষেত্রে না দেখার ভান করাটাই মঙ্গল।
*
বাইরের থেকে দেখে যা মনে হয়, ভিতরে আসলে বাড়িটা আরো বেশি বড়। লোকগুলো ফ্রান্সিসকে ধরে একটা লম্বা করিডোরে নিয়ে এলো। লবঙ্গ আর মরিচের গন্ধে ভারি হয়ে আছে জায়গাটা। ওখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ওরা। ফ্রান্সিস হাসি ঠাট্টা আর আলাপের শব্দ শুনতে পেলো, কিন্তু আশেপাশের সব দরজাই বন্ধ, তাই ওদের শব্দ কেউ শুনতে পেলো না।
লোকগুলো ওকে সবার উপরের তলার একটা বিশাল দরজার সামনে নিয়ে এলো। দরজার হাতলটা পিতলের। দেখতে ঠিক শিকার ধরতে উদ্যত একটা সিংহের মতো। দারোয়ান সম্ভ্রমের সাথে টোকা দিলো। এমনকি দরজা খোলার আগেও কিছুটা ইতস্তত করলো, যেনো কোনো ভয়ঙ্কর জানোয়ারের খাঁচায় ঢুকতে যাচ্ছে।
ভিতরটা অন্ধকার। বাতাসও গরম আর ভ্যাপসা। যেনো একটা কাঁচের ঘর। ফায়ারপ্লেসে ছোট একটু আগুন জ্বলছে। পিছনের দেয়ালের সাথে একটা বিশাল ডেস্ক, তার উপরেও একটা মোমবাতি জ্বলছে, কিন্তু দুটোর আলোয় পর্দায় ঘেরা ঘরটা আলোকিত হচ্ছে না মোটেও। দেয়ালগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেনো হেলে পড়ছে। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল বিশাল সব জাহাজ আর যুদ্ধের ছবি ঝুলানো। গিলটি করা ফ্রেমে বাধাই করা ওগুলোর। বাতাসে কটু গন্ধ, যেন এক টুকরো কাঁচা মাংস বহুদিন ধরে এখানে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কাউকে চোখে পড়লো না। শুধু ডেস্কের পিছনে একটা টিপির মতো দেখা যাচ্ছে, যেনো গাদা করা ময়লা কাপড়ের ভূপ।
ওকে ধরে আনা লোকগুলো ওকে ছেড়ে দিয়ে টুপি খুলে দাঁড়ালো। আচমকা বাধন আলগা হওয়ায় ফ্রান্সিস ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে প্রায় উল্টে পড়ে যেতে যেতে সামলালো। তারপর গলায় হাত ডলতে লাগলো।
ডেস্কের পিছনে ভেজা, খড়খড়ে কাশির শব্দ পাওয়া গেলো। তারপরেই টিপিটা নড়তে শুরু করলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই ফ্রান্সিস বুঝলো ওটা একটা মানুষ। ঠিকভাবে বললে, বিশাল ভুড়িওয়ালা একটা মানুষ। পরনে রেশমের ড্রেসিং গাউন, আর হাঁটুর উপর একটা কম্বল রাখা। থলথলে থুতনির পিছনে ঘাড় দেখাই যাচ্ছে না। লোকটার মাথা কামানো, কিন্তু ঠিকভাবে না, তাই ইতস্তত সাদা চুলগুলো তুলা গাছের কাটার মতো বের হয়ে আছে। গাল জুড়ে নীল হয়ে ফুটে আছে শিরা-উপশিরা। শুধু তার কোটরে বসে যাওয়া, মাংসের আড়ালে লুকানো চোখগুলোতেই একটু যা জীবনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
“কে তুই?” মাথা না তুলেই জানতে চাইলো লোকটা। ফ্রান্সিস ধারণা। করলো লোকটার সম্ভবত মাথা তোলার শক্তি-ই নেই। অনেক পরে ও জেনেছিলো যে ওর ধারণা অর্ধেক সত্যি। যদি কোনো বিরল উপলক্ষে উনি এই ঘর ছেড়ে বের হতে চাইতেন, তাহলে ওনার চেয়ারের সাথে লাগানো লোহার আংটাগুলো ধরে চেয়ারসমেত তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হতো। যখন প্রাকৃতিক কর্ম সারার দরকার হতো তখন নাকি তিনজন লোক তাকে বয়ে নিয়ে যেতো, তারপর কাজ শেষ হলে তারাই শৌচকার্য সেরে দিতো।
একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পেটে ঘুষি বসিয়ে দিলো। “স্যার নিকোলাস যখন কিছু জিজ্ঞে করবে তখন চুপ না থেকে কথা বলবি।”
ফ্রান্সিস কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুষি খেয়ে ওর দম বেরিয়ে গিয়েছে পুরোটা, ফলে কোনো কথাই বেরুলো না।
“কে পাঠিয়েছে তোকে? নরিস আর ওর ডোগেটের লোকজন?”
“কে?” হাফাতে হাফাতে বললো ফ্রান্সিস। এই নামের কাউকে চিনি না। আমি।”
“আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করিস না ছোঁড়া।” স্যার নিকোলাস মাথাটা সামান্য নাড়তেই আরো একটা ঘুষি পড়লো পেটে। তবে ফ্রান্সিস এবার পেট শক্ত করে রেখেছিলো, তাই আগেরবারের মতো অতোটা জোরে লাগলো না। “সারাদিন আমার বাড়ির উপর নজর রেখেছিস। কার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিস?”
“মোটেও না”।
“তোকে কি ঐ ইন্টারলোপারগুলো পাঠিয়েছে নাকি? ওরা কি জানে না আমার ব্যবসা চুরির চেষ্টা করার পরিণাম কি হতে পারে? যদি একবার ধরতে পারি তাহলে সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে ভারতের জেলে পচিয়ে মারবো।”
“প্লীজ,” বলতে গেলে ফ্রান্সিস, কিন্তু কিডনী বরাবর আর একটা ঘুষি পড়ায় থেমে যেতে হলো। “আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী। আমার মা আমাকে পাঠিয়েছেন।”
স্যার নিকোলাসের চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। “ফাজলামি করিস আমার সাথে? স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর আগে মারা গিয়েছেন।”
“উনি আমার পরদাদা।” ফ্রান্সিস হন্তদন্ত হয়ে জামার ভিতর থেকে ভেলভেটের ব্যাগটা বের করার চেষ্টা করলো। প্রহরী দেখে ভাবলো ও বোধহয় কোনো অস্ত্র বের করছে। সে ফ্রান্সিসের পায়ে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো, সাথে সাথে আবার পা তুললো ওর বুকে লাথি মারার জন্যে।
ফ্রান্সিস ব্যাগটা বের করে আনলো। প্রহরী ওর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে, মুখটা খুলে ঝাঁকি দিতেই ভিতর থেকে সিংহখচিত পদকটা মেঝেতে গিয়ে পড়লো।
প্রহরী মারার জন্যে আবার হাত তুললো।
“থামো,” স্যার নিকোলাস বললেন। “দেখি আমি ওটা।”
লোক দুজন ফ্রান্সিসকে টেনে তুললো, আর একজন খানসামা সোনার সিংহটা তুলে নিয়ে ডেস্কের উপর রাখলো। স্যার নিকোলাস ওটা তুলে ধরলেন, মোমের আলোয় ওটায় খোদাই করা চুনি আর হীরাগুলো ঝিকিয়ে উঠলো।
“কোথায় পেয়েছিস এটা?” ফ্রান্সিসকে ধমক দিয়ে জানতে চাইলেন উনি।
“এটা আমাদের পরিবারের। আমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছেন।”
স্যার নিকোলাস পদকটাকে উলটে পালটে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর লোকদেরকে হাতের ইশারায় ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিতে বললেন।
“কে তুমি?” স্যার নিকোলাস আবার জিজ্ঞেস করলেন কথাটা। তবে এবার আর তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই।
ফ্রান্সিস সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নড়তেই সারা শরীরে অবর্ণনীয় ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে অগ্রাহ্য করলো সেটাকে। এই প্রশ্নটা শুনলে কি বলবে সেই কথাগুলো সারাদিন বার বার আওড়েছে ও। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে কথাগুলো বলতে হতে পারে সেটা কল্পনাও করেনি।
“আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী, বাবা উইলিয়াম কোর্টনী। আর দাদা হচ্ছেন হাল কোর্টনী। ডার্টমাউথ এর ব্যারন আর অর্ডার অফ সেন্ট জর্জ অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল এর নৌবাহিনির নাইট। বিশ বছর আগে আমার দাদা আপনার কোম্পানির জাহাজ রক্ষা করতে ফিয়ে জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এখন আমি শুধু একটু সহায়তা চাচ্ছি। আমি কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ চাই।”
চিল্ডস এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন যেনো ও একটা প্রেতাত্মা।
“তোমরা যাও,” নিজের লোকদের আদেশ দিলেন উনি।
ওরা চলে গেলো। চিল্ডস আপাদমস্তক ফ্রান্সিসকে জরিপ করলেন। কয়েক যুগ ধরে উনি নিজের সম্পত্তির মতো করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেখাশোনা করছেন। এই লেডেনহলের অফিস থেকে শুরু করে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিজের হাতকে প্রসারিত করেছেন উনি। কতো রাজা, মন্ত্রী আসলো গেলো। কেউ কেউ দাবি করেছিলো কোম্পানি খুব বেশি ক্ষমতাধর হয়ে যাচ্ছে, এর ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু উনি তাদের প্রত্যেককে দেখে নিয়েছেন। একে একে তার প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে দিয়ে আজও টিকে আছেন, আর তাদের চাইতে বেশিদিন বেঁচেও আছেন।
কোর্টনীরাও অনেকেই এসেছে গিয়েছে। পরিবারটা একসময় খুবই ভালো কাজের লোক হিসেবে তাকে সেবা দিয়েছে এবং এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আর কাজ শেষ হওয়ার পর উনি ওনার শত্রুদের মতোই ওদেরকেও সহজেই সরিয়ে দিয়েছেন। এসব করতে ওনার এক ফোঁটা বিবেকে বাঁধেনি। বোম্বেতে ওনার নিজের বাড়িতে বসে উনি টম কোর্টনীকে ওর ভাই উইলিয়ামের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার ফাঁদ পাতেন। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে টম সেই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে উল্টো উইলিয়ামকেই মেরে বসে। তবে তাতে চিল্ডসের কোনো সমস্যা হয়নি। টম ফেরারি হয়ে পালিয়ে যায় আর উইলিয়ামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাত শতাংশ ভাগ চলে যায় ওর শিশুপুত্রের উত্তরাধিকারে। আর এক বিধবাকে ফুসলিয়ে সেই ভাগটা তার কাছে বিক্রি করানোর জন্যে মোটেও কোনো কষ্ট হয়নি। ফলে কোম্পানির উপর তার প্রভাব এখন একচেটিয়া করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উনি এই ফ্রান্সিস কোর্টনীর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলেন।
ছেলেটা এখন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় যুবক হওয়ার দশা। লোকগুলো ওর গলার যেখানে চেপে ধরেছিলো সেখানে একটা নীলচে দাগ হয়ে আছে। চেহারা ফ্যাকাশে কিন্তু তাতেও একটা চাপা আভিজাত্য ঠিকই প্রকাশ পাচ্ছে, যা চিল্ডস বিশ বছর আগে ওর দাদা হাল-এর মাঝে দেখেছিলেন। এই ছেলেটা তার খুব কাজেও লাগতে পারে, আবার তার জন্যে বিপজ্জনকও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
“শোন বাছা,” উনি আগের চাইতে অনেক নরম আর স্নেহময় কণ্ঠে বললেন। “কাছে এসো যাতে তোমাকে আরো ভালো দেখতে পারি।”
উনি ইচ্ছে করে এমনটা করতে বললেন। ওনার শরীর নষ্ট হয়ে গেলেও নীল চোখজোড়া এখনো ওনার মস্তিষ্কের মতোই ক্ষুরধার আছে।
ফ্রান্সিস টলোমলো পায়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো।
“তোমার সাথে এরকম বাজে আচরণ করার জন্যে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি,” চিল্ডস বললেন। “আমার শত্রুদের গুপ্তচরের অভাব নেই। আরা আমাকে আর আমার কোম্পানির ক্ষতি করতে ওরা কিছুতেই থামবে না। খুব বেশি ব্যথা পাওনি তো, না?”
ফ্রান্সিস ওর হাতের পাশটা একটু ঘষলো। না দেখেও টের পাচ্ছে যে ওসব জায়গায় রক্ত জমাটবেঁধে গিয়েছে।
“আমি খুব ক্ষুধার্ত, মহামান্য।”
“আরে তাইতো।” চিল্ডস ওনার ডেস্কের কোনায় বসানো একটা বেল বাজালেন। তারপর ধমক দিয়ে একজন চাকরকে খাবার আনতে আদেশ দিলেন। “এখন বসো দেখি। আর আমাকে সব খুলে বলো। এখানে এলে কিভাবে? চিঠি লিখে যদি আসতে তাহলেতো তোমাকে এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না।”
ফ্রান্সিস ব্যথা সামলে চেয়ারে বসলো। “আমার সৎ বাবা গত সপ্তাহে মারা গিয়েছেন। এই সোনার পদকটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি উনি।”
চিল্ডস একটা রুমাল দিয়ে নিজের প্রু মুছলেন। “শুনে খারাপ লাগলো। তোমার মা হয়তো কখনো বলেনি তোমাকে, কিন্তু আমি সবসময়েই তোমার বড় হওয়ার খোঁজখবর রেখেছি। আর তোমার বাবা যেভাবে মারা, গেলেন-আমার নিজেকেও ব্যাপারটার জন্যে দোষী মনে হয়। কারণ তোমার টম চাচা ঐ জঘন্য কাজটা করতে যাওয়ার আগে আমিই ছিলাম শেষ লোক যে তাকে দেখেছিলো। আমার সবসময়েই মনে হয়েছে যে আমি কি কিছু বলে বা করে ওর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারতাম? আমি কি একটু খেয়াল করলে ওর অভিসন্ধি ধরতে পারতাম আর ওকে আটকাতে পারতাম?”
বলতে বলতে কাশির দমকে বাকা হয়ে গেলেন উনি। রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন সাথে সাথে। রুমালটা সরাতেই দেখা গেলো ওটায় টকটকে তাজা রক্ত লেগে আছে।
“আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে আপনার কিছুই করার ছিলো না, স্যার, “ ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করলো।
তবে ওর মায়ের বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই ওর মনে একটা অসুস্থ চিন্তা আবার নাড়া দিয়ে গেলো।
“আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলতে পারি?”
“অবশ্যই। নিজের বাবা মতো ভাবতে পারো আমাকে।”
“বাড়ি ছেড়ে আসার আগে আমার মা খুব আজব একটা কথা বলেছিলেন। উনি বলেছিলেন যে উনি বিশ্বাস করেন টম চাচা নাকি আসলে নির্দোষ। উনি নাকি বাবাকে মেরেছিলেন নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে।”
চিল্ডস এতো জোরে মাথা নাড়লেন যে ওনার থলথলে থুতনী দুলতে লাগলো। “উনি ভুল ভেবেছেন। আসলে অধিক শোকে ওনার বুদ্ধি ঠিকমতো কাজ করছে না। বেচারী! উইলিয়াম কোর্টনী যেদিন মারা যায় আমি সেদিন তাকে হাউস অফ লর্ডসে দেখেছিলাম। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে যে দুশ্চিন্তার কথা সেদিন ও বলেছিলো বা তার জন্যে যে ভালোবাসা আর স্নেহের ভাব আমি দেখেছিলাম সেটা ছিলো সম্পূর্ণ খাঁটি। সেদিনই উইলিয়াম আমাকে বলেছিলো যে ও টমকে দশ হাজার পাউন্ড দেবে, যাতে টম একটা জাহাজ নিয়ে ওদের ভাই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করে আনতে পারে। ডোরিয়ানকে দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো-পরে জানা যায় যে ছেলেটা মারা গিয়েছে। তবে সেটায় টম কোর্টনীর লোভ মিটলো না। ও টেমসের ধারে উইলিয়ামকে পিছন থেকে আক্রমণ করে ওর বাবার সম্পত্তির আরো বেশি ভাগ দাবি করে। উইলিয়াম রাজি না হতেই ও নির্দয়ের মতো ওর গলা কেটে মেরে ফেলে।”
দৃশ্যটা কল্পনা করে ফ্রান্সিস শিউরে উঠলো। “আপনি নিশ্চিত?”
“এক মাঝি পুরো ঘটনাটা দেখেছিলো। ও আমাকে সব বলেছে। এমনকি এতোদিন পরেও আমার সব মনে আছে।”
একজন চাকর দরজায় আঘাত করে একটা রূপার ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো। তারপর খাবারের পাত্রগুলো চিল্ডসের ডেস্কে নামিয়ে রাখলো। ঝলসানো মাংস দেখা গেলো ওগুলোয়। দুই গ্লাস ক্লারেট মদ ঢেলে দিয়ে সে বিদায় নিলো। ফ্রান্সিস আর দেরি না করে বলা চলে ঝাঁপিয়ে পড়লো খাবারের উপর।
চিল্ডসও প্রায় ফ্রান্সিসের মতোই বুভুক্ষের মতোই খেতে লাগলেন। ওনার গাল বেয়ে ঝোল পড়ে জামার সামনের দিকটা ভরে গেলো।
“তুমি কি বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে চাও?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে চিল্ডসের মুখ থেকে খাবারের কণা ছুটে বেরিয়ে এলো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলা শুরু করলেন, “অবশ্যই তুমি চাও। তুমি একজন কোর্টনী। আর তোমার শরীরে কেমন রক্ত বইছে সেটা আমার ভালোই জানা আছে।”
ফ্রান্সিস ঢাকাঢক করে খানিকটা ওয়াইন গিললো। “জ্বী স্যার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।”
“আজ এখানে তোমার উপস্থিতি আমি ভাগ্যের খেল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না; যেনো তোমাকে তোমার কপালই এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এক সপ্তাহ আগে একটা জাহাজ ভারত থেকে ডেপ্টফোর্ডে নোঙ্গর করে। নাম ডাওজার। ক্যাপ্টেনের নাম হচ্ছে ইঞ্চবার্ড। ওর কাছে থেকে সেই একটা ঘটনা শুনলাম আমি। বোম্বে থেকে রওনা দেওয়ার বাইশ দিন পরে, মাদাগাস্কারের কাছাকাছি ওদের জাহাজকে দস্যুরা আক্রমণ করে বসে। ওরা প্রায় দখল করেই ফেলেছিল জাহাজটা। প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় সেদিন। কিন্তু ওরা যখন প্রাণপণ লড়াই করছিলো তখন একটা ছোট জাহাজ ওদের সাথে যোগ দেয়। আর ওটার ক্যাপ্টেন ছিলো আমাদের টম কোর্টনী।”
ফ্রান্সিসের মনে হলো ঘরটা ওর চারপাশে দুলছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো যেনো ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ওয়াইন ওর মাথায় চড়ে বসছে। “এ কিভাবে সম্ভব? টম কোর্টনীতে অনেক আগেই আফ্রিকায় মারা গিয়েছেন। আমার গাই চাচা বলেছেন সেটা।”
“তোমার চাচা ভুল জেনেছিলেন। টম কোর্টনী বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। আফ্রিকার উপকূলে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে। ইঞ্চবার্ডের ধারণা সমুদ্রে না বের হলে সে কেপ টাউনে থাকে।”
চিল্ডস তার কাটা চামচ আর ছুরি নামিয়ে রাখলেন। “তুমি কোম্পানিতে একটা চাকরি চেয়েছিলে। তোমার দাদার জন্যে যে ভালোবাসা আমার আছে, বা তোমার পরিবারের সাথে আমাদের যে দীর্ঘ সম্পর্ক সেটার জন্যে আমি তোমাকে খুশি মনে তোমার গাই চাচার সাথে একটা কেরানির চাকরি দিয়ে দিতে পারি। আমাদের একটা জাহাজে করে তুমি ফ্রি-তেই যেতে পারবে ভারত। কিন্তু আমি তোমাকে এর চাইতে ভালো কিছু দিতে পারি। জাহাজকে বলবো কেপ টাউন হয়ে বোম্বে যেতে। ছোটখাটো মেরামত আর রসদ সংগ্রহ করতে ওখানে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। যদি তুমি চাও তো জাহাজ থেকে নেমে তোমার চাচাকে খুঁজে বের করতে পারো।”
ফ্রান্সিস আরো এক টুকরো মাংস গিলে নিলো। এতোগুলো খবরের ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। চিল্ডস সামনে ঝুঁকে এলেন। ওয়াইনের কারণে তার ঠোঁট রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।
“টম কোর্টনী যখন ইংল্যান্ড ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন আমরা ওকে ধরার জন্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই পুরস্কারের জিম্মা নিচ্ছি। এখনো সেটা বলবত আছে। পাঁচ হাজার পাউন্ড।” আবার বললেন চিল্ডস। “যে কোনো মানুষের জন্যে বিশাল একটা টাকা, আর তোমার মতো বয়সীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। আর টাকাটা যদি তুমি বোম্বেতে ঠিকমতো খাটাতে পারো তাহলে ফিরতে ফিরতে তুমি এটা দ্বিগুণ কি তিনগুণ-ও করে ফেলতে পারবে।”
ফ্রান্সিস টাকার অঙ্কটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করলো। বিশাল একটা গাড়িতে করে হাই উইল্ডে ফিরে আবার বাড়িটা দখল নেওয়ার কথা ভাবলো। ওর মাকে আবার ওখানকার কত্রী হিসেবে দেখার কথা ভাবলো। জায়গাটাকে আবার সেই ছোট বেলার মতো আনন্দ আর খুশিতে ভরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলো।
ওয়াইন খাওয়ার কারণে ওর গরম লাগতে লাগলো। ও জানে যে এরকম অনেকক্ষণ উপোস থাকার পর এভাবে দ্রুত পান করা ঠিক না, কিন্তু ও থামাতে পারছিলো না। ও বুঝতে পারছিলো যে ওর আরো কিছু প্রশ্ন করা দরকার, গাই টম আর ওর উত্তরাধিকারের ব্যাপারে। কিন্তু চিল্ডসের স্বর শুনে বোঝা গেলো এ ব্যাপারে উনি আলাপ করতে আগ্রহী না। উনি যখন আরো ওয়াইন ঢেলে দিলেন ফ্রান্সিস কৃতজ্ঞচিত্তেই সেটা খেয়ে নিলো।
“এই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই তুমি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছো,” চিল্ডস বললেন। “আমাদের দুজনেরই পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় হবে এবার।”
সেন্ট জর্জের পদকটা তখনো টেবিলেই পড়ে আছে, অর্ধেকটা এক তাড়া কাগজের নিচে ঢাকা। ফ্রান্সিস ওটা তুলে নিতেই চিল্ডসের চেহারা বেজার হয়ে গেলো, কিন্তু ফ্রান্সিস সেটা খেয়াল করলো না। এতোটা মদ খেয়ে ও এখন ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না।
“আমার বাবার ইজ্জতের কসম, স্যার নিকোলাস। আমি টম কোর্টনীকে খুঁজে বের করে তাকে তার উপযুক্ত শাস্তিই দেবো।”
*
টম আর ডোরিয়ান পানশালার বাইরে বসে আছে। মাঝে মাঝে পানপাত্রে চুমুক দিচ্ছে আর টেবিল উপসাগরে নোঙ্গর করে থাকা জাহাজগুলোর দিকে নজর বুলাচ্ছে। টম খাচ্ছে মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ওয়াইন, তবে ডোরিয়ান ওর নতুন গ্রহণ করা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের মদ জাতীয় পানীয় পরিহার করে চলে। তাই ও খাচ্ছে কমলার রস। ওদের পিছনে টেবিল পর্বত আকাশ জুড়ে আঁকারাকা রেখা টেনে ফুটে আছে। ডেভিলস পিক আর লাতনক পিক এর ছোট চূড়াগুলো উপসাগরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, মনে হচ্ছে কোনো প্রাকৃতিক গ্যালারি। পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলের নিচে প্রায় শ-খানেক সাদা রঙ করা পাথুরে বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উত্তর প্রান্তে একটা দুর্গ, নেদারল্যান্ডের তিনরঙ্গা পতাকা উড়ছে সেখানে। দুর্গে পাঁচটা গম্বুজ। দেখেই বোঝা যায় এই উপনিবেশে কারা ক্ষমতাবান।
একটা ইন্ডিয়াম্যান (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ) হেলে দুলে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ের রঙ আর দড়াদড়ির অবস্থা দেখে টম বুঝলো ওটা ইংল্যান্ড থেকে এবারই প্রথম সমুদ্র নামানো হয়েছে। জাহাজটার আগমনের ফলে কি কি হতে পারে সে ব্যাপারে দ্রুত হিসাব করে নিলো টম। আইভরির দাম বেড়ে যাবে, কারণ এই ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারত পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে রসদপত্র কিনবে; বিনিময়ে ওরা দেবে ইংল্যান্ড থেকে আনা ছুরি আর ইস্পাতের পাত্র। জাহাজটা দেরি করে এসেছে, বেশিরভাগ আইভরিই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তবে টম গতবারের অভিযান থেকে আনা কয়েকটা হাতীর দাঁত কি মনে করে যেনো রেখে দিয়েছিলো। এখন এদের কাছে কতোটা লাভ করতে পারবে সেই চিন্তা মাথায় আসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ওর।
একটু পরেই টম আর ডোরিয়ান, ওরা যে বোর্ডিং হাউসটায় উঠেছে সেটায় ফিরে যাবে। কেপ টাউনে ওরা সবসময় ওখানেই থাকে। আমস্টারডাম ব্যাঙ্কের একটা অফিস আছে এখানে। সেটায় দশ হাজার পাউন্ড জমা আছে টমের, কিন্তু ও সেটা দিয়ে নিজের বাড়ি বানানোর চেষ্টা করেনি কখনো। ডাচ কর্তৃপক্ষ ভিনদেশী কাউকে এই উপনিবেশে বাড়ি বানানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তবে জায়গা মতো কিছু রিক্স-ডলার (সাউথ আফ্রিকার তৎকালীন মুদ্রা) ছাড়লেই নিষেধের বেড়াজাল আলগা হয়ে যায়। টম অবশ্য কখনো চেষ্টা করেনি। বছরের পর বছর ধরে ও মৌসুমের শেষ সময়টা এই বোর্ডিং হাউসেই কাটিয়ে দেয় আর ধৈর্য ধরে পরের মৌসুম শুরুর অপেক্ষা করে।
“বিরক্ত হয়ে গিয়েছে নাকি টম?” ডোরিয়ান জিজ্ঞেস করলো। জবাবে টম ওর হাত সামনে বাড়িয়ে পাহাড়, সমুদ্র, আর তার উপরের তুলোর পেজার মতো মেঘ আর দিগন্তে ডুবতে বসা সুর্যের দিকে দেখালো। “এতো কিছু থাকার পরেও বিরক্ত কিভাবে হই বলো তো?”
“আমি তোমাকে খুব ভালোই চিনি, ভাইয়া,” মৃদু হেসে বললো ডোরিয়ান “ঐ দস্যু লেগ্রাঞ্জের হাত থেকে ডাওজারকে উদ্ধার করে আনার পর থেকে তুমি একটা বারও বন্দুকের গুলি ছোড়োনি। আর সেটাও ঘটেছিলো প্রায় এক বছর আগে।”
এবার আফ্রিকায় হাতীর দাঁত সংগ্রহের অভিযানটা ছিলো একেবারেই সাদামাটা। টম আর ডোরিয়ান জাম্বেসি নদীর প্রায় দুইশো লীগ পর্যন্ত ভিতরে অভিযান চালায়, কিন্তু এর আগে যেসব দাস ব্যবসায়ীদের সাথে ঝামেলা বেধেছিলো তাদের কারো সাথেই এবার আর দেখা হয়নি। এমনকি শিকারও বিগত বছরগুলোর মতো হয়নি। সেন্টারাস এবার মাত্র অর্ধেক খোল ভরে আইভরি নিয়ে ফিরে এসেছে।
“ঝামেলায় জড়ানো ব্যবসার জন্যে ক্ষতিকর,” দৃঢ় বিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বললো টম।
তারপর দিগন্তে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলো ও। চোখ পিট পিট করে দেখলো কয়েকবার। যেখানে সূর্যের শেষ কিরণটাও মিলিয়ে যাচ্ছিলো সেখানে এমন সবুজ একটা রঙ দেখা গেলো যা টম এর আগে কখনোই দেখেনি। একেবারে চমকে গেলো ও; যদিও এরকম ঘটনার কথা আগেও শুনেছে, কিন্তু এবারই প্রথম চাক্ষুষ দেখার ভাগ্য হলো।
“ব্যাপারটা দেখেছো?” টম জিজ্ঞেস করলো। দুজনেই উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তে।
“তা আর বলতে!” ডোরিয়ানও সমান উত্তেজিত হয়ে আছে। “এটাকে বলে নেপচুন-এর চোখ টিপ।” এটাও একটা রহস্য-ঠিক সেন্ট এলমোর আগুন-এর মতো। পৃথিবীর দুর্গম সমুদ্রগুলোয় যাত্রা করলে নাকি মাঝে মাঝে দেখা যায় সেটা।
“আমি শুনেছি যারা এটা দেখে তারা নাকি বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, আবার চেয়ারে বসতে বসতে আগ্রহের সাথে বললো টম।
“তোমার জন্যে তাহলে ভালোই হবে,” ডোরিয়ান ফোড়ন কাটলো। “এখন যা আছে সেটা তো বহু আগেই ব্যবহার করে শেষ করে ফেলেছে।”
প্রত্যুত্তরে টম হেসে ওর গ্লাসের তলানিটুকু ডোরিয়ানের মাথায় ঢেলে দিলো। “বড় ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির শাস্তি স্বরূপ এখন আর এক গ্লাস ওয়াইন কিনে নিয়ে আসো।”
ডোরিয়ান বার থেকে টমের জন্যে আর এক গ্লাস পানীয় এনে টেবিলের উপর রাখলো, তারপর আবার চুপচাপ দুজন তারিয়ে তারিয়ে নৈঃশব্দটা উপভোগ করতে লাগলো। একটু পরেই দেখা গেলো ইন্ডিয়াম্যানটা ঘাটে এসে নোঙ্গর ফেললো।
অন্ধকার পানিতে নোঙ্গর ফেলার ঝপাস শব্দ হতেই তীর থেকে ঝাক বেঁধে নৌকা ছুটে গেলো জাহাজটার দিকে। ঠিক মায়ের দুধ খেতে ছাগলের বাচ্চা যেভাবে ছুটে যায়।
“এরা সকালের আগে মালপত্র ডাঙ্গায় আনবে না,” টম বললো। “এদের কাছে কি কি বেঁচা যায় সেটা আগে পরখ করে নিলেই ভালো হবে।”
টম পানীয়ের দাম হিসেবে একটা কয়েন টেবিলের উপর রাখলো, তারপর দুজন মিলে আবার পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললো। রাস্তাটার নাম হচ্ছে ডাই হেরেংগ্ৰাচ (Die Heerengracht), অর্থ ভদ্রলোকের রাস্তা। কোম্পানির বাগান থেকে প্যারেড গ্রাউন্ড পর্যন্ত লম্বা রাস্তাটা। দুজনে কথায় মশগুল থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা মহিলাটাকে খেয়াল করলো না কেউই। একেবারে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হতে টের পেলো দুজন।
“টম কোর্টনী?” মেয়েটা বললো। চেহারায় নিখাদ বিস্ময়।
“অ্যানা দুয়ার্তে?” টম জবাব দিলো। ওর চেহারাও খুশিতে ভরে গিয়েছে।
“আমাকে মনে আছে আপনার?”
“আপনাকে কিভাবে ভুলি বলেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি আর আমার ভাই, মাত্রই আপনার সাথে যেদিন দেখা হয়েছিলো সেদিনের কথা আলাপ করছিলাম। কিন্তু আপনি যে কেপ টাউনে সেটা জানা ছিলো না।”
“আমার জাহাজ দুই দিন আগে মাদ্রাজ থেকে এসেছে।”
“এবার নিশ্চয়ই গতবারের মতো কিছু হয়নি?”
মেয়েটা নিজের গলায় ঝুলানো একটা রুপালি ক্রুশ চেপে ধরে বললো, “না, ভাগ্যটা এবার ভালো ছিলো।”
আচমকা টমের ঐ সবুজ দ্যুতিটার কথা মাথায় এলো। যদিও ও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, কিন্তু কেনো যেনো মনে হলো ওটা এই অপ্রত্যাশিত মোলাকাতটাকেই ইঙ্গিত করেছিলো বোধহয়।
“আজ রাতে আমাদের সাথে খেতে হবে,” ডোরিয়ান বলে উঠলো। “সারাহ আর ইয়াসমিনি আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে।”
“তাহলেতো খুবই ভালো হয়,” অ্যানা হাসলো। “সত্যি কথা হচ্ছে আমি নিজেই চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথে বসতে। আমার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব আছে আপনাদের জন্যে।”
*