১. টুকুনের কথা

একি কাণ্ড! – হুমায়ূন আহমেদ

০১.

টুকুনের কথা কেউ বিশ্বাস করে না।

টুকুন কিছু বলতে গেলেই তাঁর মা চোখ বড় বড় করে বলেন, আবার? আবার? চুপ কর বললাম। কিছু শুনতে চাচ্ছি না।

টুকুন করুণ গলায় বলে, শুনতে চাচ্ছনা কেন মা?

টুকুনের মা বিরক্ত গলায় বলেন, তোমার বানানো গল্প শুনে কান ঝালাপালা হয়েছে। এই জন্যেই শুনতে চাচ্ছি না।

টুকুনের বাবা এতটা নির্দয় নন। তিনি গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ ছেলের কথা শুনে দুঃখিত গলায় বলেন, কেন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছ?

টুকুন যদি বলে, বানিয়ে বলছি না তো বাবা। যা বলছি সবই সত্যি।

তখন তার বাবা আরো গম্ভীর হয়ে যান। থেমে থেমে বলেন, তুমি বলতে চাচ্ছ একটা কাক এসে তোমার সঙ্গে গল্প করে?

হুঁ। জানালার রেলিং-এ এসে বসে, তারপর গল্প করে।

কি গল্প?

নানান ধরনের গল্প।

আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত তোমার সেই কাককে দেখিনি।

তোমরা যখন আশে পাশে থাক তখন তো সে আসে না।

সে কখন আসে?

আমি যখন পড়তে বসি তখন আসে। খুব ডিসটার্ব করে।

কিভাবে ডিসটার্ব করে? পড়া জিজ্ঞেস করে?

মাঝে মাঝে করে। মাঝে মাঝে আমার পড়া নিয়ে হাসাহাসি করে।

পড়া নিয়ে হাসাহাসিও করে?

 হ্যাঁ করে। ঐদিন বলল, টুকুন ভুটানের রাজধানী যেন কি বললে?

আমি বললাম, থিম্পু। কাকটা বলল, লজ্জাকর একটা নাম। শুরু হয়েছে থ দিয়ে। থ দিয়ে কি হয়– থু থু। ভুটানের রাজধানীর নাম হওয়া উচিত কি। কি শুরু হয় ক দিয়ে। ক হচ্ছে সবচে ভাল অক্ষর কারণ কাক শুরু ক দিয়ে।

তোমাকে সে বলল?

 জি বাবা।

আচ্ছা, এখন চুপ করে আমার সামনে বস। আমি তোমাকে দুএকটা কথা বলব। শান্ত হয়ে বস। নড়াচড়া করবে না। পেনসিলটা নিয়ে এরকম করছ কেন? খোঁচা খাবে। পেন্সিল টেবিলের উপর রাখ। পা এমনভাবে নাড়াচ্ছ কেন? তুমি তো ফুটবল খেলছ না, বসে আছ। ভদ্র হয়ে বস।

টুকুন ভদ্র হয়ে বসল। তার বাবা রশিদ সাহেব, টুকুনের মা এবং টুকুনের ছোট বোনকে ডাকতে গেলেন। টুকুনের ছোটবোনের নাম মৃদুলা। তার বয়স দেড় বছর। দাঁড়াতে পারে। একটু একটু হাঁটতে পারে তবে এখনো কথা বলতে পারে না। টুকুন কে সে ডাকে–কুন। মৃদুলা হচ্ছে সবদিক দিয়ে লক্ষ্মী মেয়ে। দুধ খাওয়া নিয়ে হৈ চৈ করে না। খাব না, খাব না বলে টুকুনের মত সারা বাড়ি ছোটাছুটি করে না। মিষ্টি মুখ করে খেয়ে ফেলে, তারপর অবশ্যি ওয়াক করে বমি করে ফেলে। মৃদুলার স্কুলে যাবার দরকার নেই কিন্তু সে খুব স্কুলে যেতে চায়। টুকুনের মত স্কুলে যাবার সময় হঠাৎ মুখ কালো করে বলে না –মা, আমার হাঁটুতে ব্যথা। স্কুলে যাব কি করে?

টুকুনের মা মুনা তখন বলেন, তুমি তো আর হেঁটে যাবে না। তোমার বাবা রিক্সা করে তোমাকে দিয়ে আসবেন।

হেঁটে হেঁটে রিক্সায় উঠতে হবে তো মা।

না, তাও হবে না। তোমার বাবা তোমাকে কোলে করে রিক্সায় তুলবেন।

মুনা ছেলের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছেন। সবচে যন্ত্রণা হচ্ছে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার ব্যাপারটা। ক্লাস থ্রতে পড়ে একটা ছেলে, সাত বৎসর মাত্র বয়স। সে কেন এত বানিয়ে কথা বলবে? আর বলার সময় এমনভাবে বলে যে, অনেকেই মনে করে সত্যিই বোধহয় কাক এসে কথা বলে। কিছুদিন আগে দেশের বাড়ি থেকে মুনার শশুর এসেছেন। তার শরীর খারাপ, ডাক্তার দেখাবেন। ডাক্তার দেখালেন। এক সপ্তাহ থাকলেন। যাবার সময় মুনাকে আড়ালে ডেকে নিচু গলায় বললেন, বৌমা, টুকুন এসব কি বলে?

কাকের সঙ্গে কথা বলার কথা বলছেন?

হ্যাঁ মা।

এইসব ও বানিয়ে বানিয়ে বলে, বাবা। ভীষণ দুষ্ট হয়েছে। ওর যন্ত্রণায় আমরা অস্থির হয়েছি।

না, মানে বলছিলাম কি মা –মানে –যেভাবে বলছিল আমার আবার কিছুটা বিশ্বাস হয়ে গেল। হতেও তো পারে।

কি যে বলেন বাবা! কাক কথা বলবে নাকি? আর বললেও টুকুন বুঝবে কিভাবে? মানুষ কি কাকের কথা বুঝতে পারে?

কেউ কেউ কিন্তু পারে, মা। আমাদের এক নবী ছিলেন হযরত সোলায়মান– উনি পশুপাখির কথা বুঝতে পারতেন।

মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, বাবা, টুকুন কোন নবী না। ও হল মহাদুষ্ট এক ছেলে। আপনি ওর কথায় কান দেবেন না। এই সব কথা যখন বলতে আসবে তখন ধমক দেবেন।

না না, ধমকাধমকির কি আছে? বাচ্চা ছেলে।

বমকাধমকি করতে হবে, বাবা। এইসব প্রশ্রয় দেয়ার কোন মানে হয় না। গালে চড় দিলে ঠিক হত। চড় দেয়া যাবে না। তার বাবা শাসন ছাড়া আধুনিক কায়দায় ছেলে মানুষ করবে। আধুনিক কায়দায় ছেলে মানুষ করার এই হল ফল।

.

টুকুন খাটে পা দুলিয়ে বসে আছে।

রশিদ সাহেব একটা চেয়ার টেনে বসেছেন টুকুনের সামনে। মুনা মৃদুলাকে কোলে নিয়ে খাটের শেষ মাথায় বসেছেন। এখান থেকে টুকুনের মুখ ভাল করে দেখা যায় না। মাঝে মাঝে টুকুন যখন তার দিকে তাকাচ্ছে তখনই তিনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন। মুনার এখন ছেলের জন্য খানিকটা মায়া লাগছে। বাচ্চা একটা ছেলের জন্যে– বিচারসভা। কোন দরকার ছিল না। বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে বলুক না। এমন কিছু ক্ষতিতো হচ্ছে না। টুকুনকে অবশ্যি খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে তার বাবার দিকেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

রশিদ সাহেব বললেন, টুকুন!

 জ্বি বাবা।

 যে কাকটা তোমার সঙ্গে কথা বলে তার নাম কি?

ওর কোন নাম নেই, বাবা। পাখিদের নাম থাকে না। মানুষদের নাম থাকে।

 তোমাকে সে কি ডাকে?

নাম ধরে ডাকে। টুকুন বলে।

সে শুধু তোমার সঙ্গে কথা বলে, আমাদের সঙ্গে বলে না –এর কারণ কি?

ও ছোটদের পছন্দ করে। বড়দের পছন্দ করে না।

 মৃদুলা তো ছোট। ওকে পছন্দ করে না কেন?

মৃদুলাকে সে দুচোখে দেখতে পারে না, বাবা। ঐ দিন আমাকে বলল, তোমার ছোট বোনটার এমন বিশ্রী নাম কে রেখেছে? তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম রাখা উচিত ছিল উকুন। তাহলে কত ভাল হত। টুকুনের বোন উকুন।

এইসব কথা কাকটা তোমাকে বলল?

জ্বি বাবা।

আর কি বলে?

মাঝে মাঝে ইংরেজী জিজ্ঞেস করে? ঐদিন বলল টুকুন আকাশ ইংরেজী কি?

 তুমি আকাশ ইংরেজী বলতে পারলে?

 টুকুন খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, পেরেছি বাবা। বানান ও বলেছি– sky।

আচ্ছা বেশ। এখন আমার কথা মন দিয়ে শোন।

আমি খুব মন দিয়ে শুনছি, বাবা।

তুমি মোটেই মন দিয়ে কথা শুনছ না। পা নাচাচ্ছ।

কাকটা আমাকে বলেছে, টুকুন শোন, কখনো চুপচাপ বসে থাকবে না। যদি কখনো বসে থাকতে হয় তাহলে পা নাচাবে। পা নাচালে পায়ের একসারসাইজ হয়। রক্ত চলাচল ভাল হয়। পা দুটা ভাল থাকে। আমাদের যেমন পাখা, তোমাদের তেমনি পা।

রশিদ সাহেব হতাশ চোখে মুনার দিকে তাকালেন। মুনা হেসে ফেললেন। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করলেন। টুকুন যেন তাঁর হাসিমুখ দেখতে না পায়। আজ হাসাহাসি না। আজ টুকুনকে গম্ভীর মুখে কিছু কথা বুঝিয়ে দেয়া হবে।

রশিদ সাহেব বললেন, টুকুন, তাকাও আমার দিকে। শোন কি বলছি। ছোটরা প্রায়ই বানিয়ে বানিয়ে নানান কথা বলে। এটা তেমন দোষের না। তবে তাকে স্বীকার করতে হবে — সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কেউ যদি বানিয়ে কথা বলে তারপর সবাইকে বুঝাতে চায় কথাটা সত্যি তাহলে খুব সমস্যা। এটা তার অভ্যাস হয়ে যাবে। তুমিই বল, অভ্যাস হবে না?

টুকুন খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, অভ্যাস তো হবেই। বড় হয়েও তখন মিথ্যা কথা বলবে।

এই তো তুমি বুঝতে পারছ। কাজেই এখন থেকে তুমি আর কাক নিয়ে কিছু বলবে না। বললে তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।

আমার অভ্যাস হবে না, বাবা। আমি তো আর বানিয়ে বানিয়ে বলি না।

তুমি বানিয়ে বল না?

 না। যা সত্যি আমি তাই বলি।

রশিদ সাহেব হতাশ গলায় বললেন, আচ্ছা, তুমি যাও। মুনা ভাত দাও, ভাত খেয়ে নি।

খাবার টেবিলে টুকুন কি একটা বলতে যাচ্ছিল, রশিদ সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কাক ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে তুমি কথা বলতে পার।

কাক নিয়ে কথা বলতে পারব না?

 না।

টুকুন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা। রশিদ সাহেব চিন্তিত মুখে ভাত খাচ্ছেন। মুনা মৃদুলাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। সে আটটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। প্রতি রাতেই তাকে খাওয়াতে হয় ঘুমের মধ্যে।

টুকুন মার দিকে ঝুঁকে এসে ফিস ফিস করে বলল, মা একটা মজার জিনিস জান? তুমি যেমন মৃদুলাকে খাইয়ে দিচ্ছ, কাকও ঠিক তেমনি তার ছোট বাচ্চাদের খাইয়ে দেয়। ওদের তো হাত নেই। ওরা ঠোঁট দিয়ে খাওয়ায়।

মা বললেন, একটু আগে কি বলা হয়েছে? কাক নিয়ে আর কোন কথা না। চুপ।

টুকুন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *