টিকিট কালেক্টরের হাতে টিকিট দিয়ে সুবোধবাবু এক পা এগুতে না এগুতেই প্রায় শতখানেক রিকশাওয়ালা ওঁকে ছেঁকে ধরল। কেউ কেউ হাত ধরে বলে, আইয়ে বাবুজি, চলিয়ে বাবুজি। কেউ কেউ আবার ওঁর হাতের ছোট সুটকেসটা নিয়ে টানাটানি করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কাঁহা যানা সাব?
শুধু ওঁকে না, সব প্যাসেঞ্জারকেই ওরা ঘিরে ধরছে। কী করবে ওরা? এ শহরে কোন রিকশাওয়ালাই দিন-রাত্তির খেটে দশ-বারো টাকার বেশি কামাই করতে পারে না। মালিকের পাওনা মিটিয়ে বিবি-বাচ্চার পেট চালানোই দায়। যা দিনকাল পড়েছে!
সারা দিনরাত্তিরে দশ-বারোটা ট্রেন আসে ঠিকই কিন্তু ভোরবেলার এই গাড়িতেই সব চাইতে বেশি প্যাসেঞ্জারের আসা-যাওয়া হয়। তাইতো এই গাড়ির প্যাসেঞ্জার ধরতে না পারলে রিকশাওয়ালাদের সারা সকালটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু এত রিকশার প্যাসেঞ্জার কি আছে?
সুবোধবাবু খানিকটা এগিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন বয়স্ক রিকশাওয়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। কী করবেন? কতজনের টানাটানি কতক্ষণ সহ্য করা যায়?
শিকার ধরার মহানন্দে রিকশা ওয়ালা এক লাফে সীটে উঠেই একটু পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, কাঁহা যানা সাব?
বাঙালীটোলা।
ডান পা দিয়ে প্যাডেলে জোরে একটা চাপ দিয়েই আবার প্রশ্ন করে, কিসকা ঘর যানা সাব?
রাজাবাবু কা কোঠি। সুবোধবাবু একটু থেমেই বললেন, উকিল মহেন্দ্রবাবুর বাড়ি। চেনো তো?
ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নিয়ে অনেকগুলো রিক্শা এক সঙ্গে বেরিয়েছে বলে রাস্তায় বেশ ভিড়। ক্রীং ক্রীং করে বেল বাজিয়ে, চিৎকার করে এরই মধ্যে সুবোধবাবুর রিকশাওয়ালা একটু এগিয়ে বলে, সব পুরানা বাঙালীবাবুদের কোঠি আমি চিনি। আর রাজাবাবুর ছোট ছেলের কোচোয়ান ছিল তো আমার বড় চাচা।
সুবোধবাবু সিগারেট ধরিয়েই বলেন, তাই নাকি?
আমি নিজেও তো ঝন্টুবাবুর কাছে কাজ করেছি।
আচ্ছা!
আচ্ছা বললেও সুবোধবাবু কিন্তু ঝন্টুবাবুকে চেনেন না। নামও শোনেননি কোনদিন। এই রাজাবাবুর পরিবারের বিষয়ে উনি কোন কিছুই জানেন না। ওঁদের কাউকে চেনেনও না। শুধু মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গেই মাত্র মাস কয়েক আগে মেজ মাসীমার ওখানে আলাপ হয়েছে। তাও নেহাতই হঠাৎ।
সুবোধবাবুকে ওঁর মা অনেকদিন ধরেই বলছিলেন, হ্যাঁরে আদু, তুই হরদম হিল্লী-দিল্লী ঘুরছিস আর যাতায়াতের পথে একবার রাচীতে নেমে মেজদিকে একটু দেখতে পারিস না? উনি একটু থেমে বললেন, এই মেজ মাসী কি তোদের জন্য কম করেছে?
সুবোধবাবু একজন প্রবীণ অধ্যাপক। ওঁর বহু ছাত্র নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছেন। তাদের অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ খ্যাতিমানও। তাইতো তাদের অনুরোধে বা চাপে সুবোধবাবুকে নানা কারণে ছুটতে হয় এখানে-ওখানে। প্রায় সারা দেশেই বলা যায় কিন্তু সত্যি রাঁচী যাবার অবকাশ বা সুযোগ হয় না। উনি ওঁর মাকে বললেন, দেখি, যদি সম্ভব হয় সামনের বার নাগপুর থেকে ফেরার সময় টাটায় নেমে রাঁচী ঘুরে আসিব।
ঐ মেজ মাসীর ওখানে গিয়েই হঠাৎ মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ। পরিচয় ও ঠিক নয়। একথা-সেকথার পর মেজ মাসী ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হারে আদু, ছেলের বিয়ে দিবি না?
সুবোধবাবু একটু হেসে বললেন, মা তো নাতির বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন কিন্তু কোন মেয়েকেই মা বা তার নাতির পছন্দ হচ্ছে না।
মেজ মাসী সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি হেসে বললেন, কি মহিম, ঘটকালী করব নাকি?
মহেন্দ্রবাবু একটু সকৃতজ্ঞ হাসি হেসে বললেন, যদি ওঁরা দয়া করে আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চান
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মেজ মাসী বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, তোদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক করা তো ভাগ্যের ব্যাপার। হাজার হোক তোরা রাজা অবলাকান্তের নাতি!
কথাটা শুনে অর্থনীতির যশস্বী অধ্যাপক সুবোধবাবু মুগ্ধ হতে পারেন না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত বাংলা-বিহার-উত্তরপ্রদেশে যেসব বাঙালী পরিবার খ্যাতি অর্জন করেছে, তাঁদের কজন উত্তরপুরুষ সেই খ্যাতি, গৌরব অম্লান রাখতে পেরেছেন? তবে উনি মুখে কিছু বললেন না। চুপ করে থাকেন।
পারিবারিক গৌরবের ইঙ্গিত পেয়েও সুবোধবাবুর মধ্যে বিন্দুমাত্র কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে মহেন্দ্রবাবু মনে মনে একটু ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু হাজার হোক উকিল তো! মনের ভাব মনের মধ্যেই লুকিয়ে একটু গদ্গদ হয়ে বললেন, আমার কন্যাটিকে যদি দয়া করে ওঁরা পছন্দ করেন…
এবার ও মেজ মাসী মাঝপথে কথা বলেন, তোদের বংশে কি কুচ্ছিত ছেলেমেয়ে জন্মেছে?
এবার সুবোধবাবু মনে মনে সত্যি একটু বিরক্ত হন।
মেজ মাসী বলে যান, তাছাড়া মহিম, তোর মেয়ে তো সাক্ষাৎ রাজকন্যা? ও ছুঁড়ীর মত রূপসী তো চোখে পড়ে না।
এত বাড়াবাড়িতে বোধ হয় মহেন্দ্রবাবুও একটু কুণ্ঠিত না হয়ে পারেন না। বলেন, না, না, পিসী, অত বলবেন না। তবে হ্যাঁ, আমার মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী। দেখলে হয়তো অপছন্দ হবে না।
এতক্ষণ পর বোধ হয় মেজ মাসীর হুঁশ হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দিকে একটু বেশী ঝোল টেনেছেন। তাই উনি এবার মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলি মহিম, আমার বাবা তো আমাদের কোন বোনকেই আজেবাজে পরিবারে বা পাত্রের হাতে দেননি।
সেকি আমি জানি না? মোসাহেবীর সুরে মহেন্দ্রবাবু মন্তব্য করেন।
এই আদুর বাবা কলকাতায় গবরমেন্টের কলেজে সব চাইতে বড় প্রফেসার ছিলেন। রিটায়ার করার দশ-বারো বছর আগে প্রিন্সিপ্যাল হন। এই আদু তো কত বছর বিলেতে থেকে পড়াশুনা করেছে!…
সুবোধবাবু একটু হেসে বলেন, মেজ মাসী, বাবার বা আমার কথা বলে কি হবে? আসলে পাত্রটিকে যদি ওঁদের পছন্দ হয়…
মহেন্দ্রবাবু গগদ হয়ে বললেন, কি যে বলেন আপনি?
মেজ মাসী একটু শাসন করার ভান করে বলেন, আঃ! আমাকে বলতে দে। এবার উনি রাজা অবলাকান্তর নাতির দিকে তাকিয়ে বলেন, শোন মহিম, আদুর ছেলেও বিলেত থেকে পাস করে এসেছে। হীরের টুকরো আমার নাতি! যেমন রূপ, তেমন গুণ!
বাপ-ঠাকুর্দার মতই..
ডাক্তার অঘোরনাথ চৌধুরীর দ্বিতীয়া কন্যা যোগমায়া দেবীর এই একটি রোগ! বড্ড কথা বলেন। শুধু তাই নয়। অন্য কাউকে কথা বলার সুযোগও দেন না। মহেন্দ্রবাবুকে আবার বাধা দিয়ে বললেন, ও ছেলে বাপ-ঠাকুর্দার চাইতে অনেক বেশী নাম করবে। বাপ-ঠাকুর্দা আর কখানা বই লিখেছে? ঐ কচি ছেলে এর মধ্যেই পাঁচ-সাতটা মোটা মোটা বই…
সুবোধবাবু একটু সংশোধন করে দেন, না মেজ মাসী, বাবুলের মাত্র দুটো বই বেরিয়েছে।
ঐ একই ব্যাপার! এই বয়সেই যদি মোটা মোটা দুটো বই লিখে থাকে, তাহলে…
যাই হোক ঐ রাঁচীতে মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সুবোধবাবুর আলাপ হয়। যোগমায়া দেবী পূজা করতে গেলে মহেন্দ্রবাবু সবিনয়ে নিবেদন করেন, পারিবারিক ব্যাপারে বেশী আর কি বলব? তবে আমার ঠাকুর্দা বিহার-উত্তরপ্রদেশের প্রবাসী বাঙালীসমাজে সত্যি গণ্যমান্য পুরুষ ছিলেন। আর আমি সামান্য উকিল..
সামান্য কেন হবেন? সুবোধবাবু একবার ওঁর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে একটু হেসে বলেন, আপনাকে দেখে তো স্যার আশুতোষের কথা মনে পড়ে যায়।
কি যে বলেন!
আপনার কটি সন্তান?
আমার তিনটি কন্যা। বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছি বছর দুয়েক আগে। আমার দ্বিতীয় কন্যাটি এই বছরই এম. এ. পাস করল।
বাঃ! শিক্ষাবিদ সুবোধবাবু শুনে খুশিই হন।
এবং শুনে খুশি হবেন, ফার্স্ট ক্লাসই পেয়েছে।
খুব ভাল।
মহেন্দ্রবাবু আরও অনেক কথা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সুবোধবাবু বললেন, অত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মোটামুটি শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়েই আমরা চাই।
উনি এবার নিজের পুত্রের বিষয়ে বলেন, হাজার হোক আপনি মেয়ের বিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই পাত্রকে ভাল করে দেখে-শুনে নেবেন।…
অত দেখাশুনার কি আছে? পিসীর কাছে যা শুনলাম…
উনি যাই বলুন, আপনি না দেখেশুনে একটি ছেলের হাতে অমন ভাল মেয়েকে তুলে দেবেন কেন। সুবোধবাবু একটু থেমে বলেন, আমার ছেলেটি স্বাস্থ্যবান এবং সুপুরুষও বলতে পারেন। ও প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে এল-এস-ই থেকে মাস্টার্স করেছে।
এল-এস-ই মানে?
প্রশ্ন শুনে সুবোধবাবু একটু দুঃখই পান। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স।
ও!
এখন জে-এন-ইউ তে পড়ায়। মাইনে—
জে-এন-ইউ তে কী?
ওঃ! সরি! জে-এন-ইউ মানে দিল্লীর জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি।
আচ্ছা! আচ্ছা!
এল-এস-ই এবং জে-এন-ইউ সম্পর্কে ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনেই সুবোধবাবু স্পষ্ট বুঝলেন, ওঁদের পারিবারিক ঐতিহ্যের গঙ্গা এখনও প্রবাহিত থাকলেও শিক্ষাদীক্ষারা ধারা ফল্গুর মতই বিলুপ্ত! বি. এ. এম. এ. পাস করলেই কি শিক্ষিত বা সংস্কৃতিবান হওয়া যায়?
যাই হোক রাঁচীতে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুবোধবাবু দিল্লী রওনা হবার আগে ওঁকে চিঠি দেন, আপনার পত্রের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমার মা ও তার নাতি যাকে পছন্দ করবেন, তাকেই পুত্রবধূ করে ঘরে আনব কিন্তু আপনারা দূরের বাসিন্দা বলে ওরা দুজনেই আমার উপর প্রাথমিক নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছেন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সেমিনারে যোগ দেবার জন্য আমি আগামী সোমবার দিল্লী যাচ্ছি। পনেরই পর্যন্ত সেমিনার চলবে। দিল্লীতে আমারও কিছু কাজ আছে। তাছাড়া পুত্রের আগামী বইটির পাণ্ডুলিপিও পড়তে হবে। যাইহোক মোটামুটি কুড়ি বাইশ তারিখ নাগাদ দিল্লী থেকে রওনা হয়ে আপনাদের ওখানে আসব বলে মনস্থির করেছি। ইচ্ছা আছে, একবেলা আপনাদের কাছে থেকেই কলকাতা রওনা হব। এখানে আমার অনেক কাজ।
সেই সুবাদেই সুবোধবাবু বহু প্রবাসী বাঙালীর উজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে এসেছেন।
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা রিকশার প্যাডেল ঘুরোতে ঘুরোতেই আপন মনে একটু হেসে বলে, ঝণ্টুবাবু বহুত মজাদার আদমী ছিলেন। ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে লাচ-গান শোনার জন্য উনি কত রুপেয় খরচা করতেন।
সুবোধবাবু একটু হাসেন।
ও একটু থেমেই বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, জানেন সাব, ঝন্টুবাবুর শরাব বিলাইত থেকে আসত।
উনি একটু উৎসাহ দেবার সুরেই বলেন, সত্যি?
আরে সাব, আমি কি আপনাকে ঝুট বলব? এ শহরের সবাই ওঁর কথা জানে।
এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে রিক্শা এগিয়ে চলে। রিকশাওয়ালা আপন মনেই বলে যায়, আরে সাব, রহিশ আদমীদের কারবারই আলাদা! ঝণ্টুবাবুর দুটো বিবি ছিল, দু-তিনটে আওরাতকেও উনি রেখেছিলেন। এছাড়া লক্ষ্ণৌ-কাশী থেকেও বাইজী এনে কয়েক মাস নিজের কাছে রাখতেন।
শুনেই সুবোধবাবুর সারা শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। রাগও হয়। একবার মনে মনে ভাবেন, যে পরিবারে ঝণ্টুবাবুর মত সুসন্তান জন্মেছেন, সেই পরিবারের মেয়েকে উনি পুত্রবধূ করে ঘরে আনতে পারেন না। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, যে কোন বড় পরিবারেই এ ধরনের দু-একটি রত্ন থাকতেই পারে কিন্তু তাদের জন্য নিরপরাধ বংশধররা শাস্তি পাবে কেন?
হঠাৎ উনি প্রশ্ন করেন, তুমি কি ঝণ্টুবাবুর কাজ ছেড়ে দিয়েছিলে?
ছেড়ে দেব না? বৃদ্ধ রিক্শাওয়ালার সুরই বদলে গেল। বলল, সাব, বলতে শরম হয়।
শরম লাগলেও ও থামে না। বলে, একদিন রাত্রে শরাব খেয়ে উনি আমার বিবির ইজ্জত নষ্ট করতে আসেন।
সুবোধবাবু মুখ বিকৃত করে অজান্তেই বলেন, ইস!
…সাব, তখন আমি জোয়ান বেটা! বিবিও জোয়ান লেড়কী। কোন বাল-বাচ্চাও হয়নি। ঝণ্টুবাবুর ঐ কাণ্ড দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। ভুলে গেলাম উনি আমার মালিক আছেন। হাতের কাছেই একটা বাঁশ পেয়ে আমি দমাদম ওঁকে পেটাতে শুরু করি।
ও একবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলে, তারপর ঝন্টুবাবুর হুকুমে দুটো দারোয়ান চাবুক দিয়ে মারতে মারতে আমাকে আধমরা করার পর…
বল কী?
রিকশা চালাতে চালাতেই ও মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে বলল, ভগবান কী কসম সাব! সব সাচ হ্যায়।
তুমি কিছু বললে না?
আমি গরীব অদমী। আমি কি বলব? ও বোধহয় একটু হাসে। বলে, সাব, ঝণ্টুবাবু সেদিন রাত্রে আমাকে আর আমার বিবিকে নাংগা করে বের করে দেন।
শুনে সুবোধবাবুর মত শান্ত মানুষেরও রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এ কতদিন আগেকার ঘটনা?
সাব, তখন আংরেজ জমানা। লড়াই ভী চলছিল!
উনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধের সময়ের কথা।
হঠাৎ রিক্শাটা মোড় ঘুরে ঢালু রাস্তায় এসে খুব জোরে ছুটতে শুরু করল কিন্তু বেশি দূর যাবার আগেই রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে একটা বিরাট দোতলা বাড়ির সামনের মাঠে ঢুকল।
এই কি রাজাবাবুর বাড়ি?
হাঁ সাব!
গাড়িবারান্দার নিচে রিকশা থামতে না থামতেই মহেন্দ্রবাবু প্রায় ছুটে এসে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন, আসুন।
ছোট্ট সুটকেসটা পাশে নামিয়ে রেখেই রিকশাওয়ালা দু হাত জোড় করে মহেন্দ্রবাবুকে বলল, প্রণাম সাহাব।
হাজার হোক রাজাবাবুর বংশধর! একজন তুচ্ছ রিকশাওয়ালার দিকে মুহূর্তের জন্য নজর দেওয়াও বোধহয় অমার্জনীয় অপরাধ। তাই মহেন্দ্রবাবু ওর কথায় কান দিলেন না।
সুবোধবাবু রিকশা থেকে নামার আগেই দুটো টাকা রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিতেই মহেন্দ্রবাবু হঠাৎ যেন ক্ষেপে উঠলেন, আহা হা! মোটে ষাট পয়সা ভাড়া।
সুবোধবাবু একটু হেসে বললেন, আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আমি জানি কতটুকু পরিশ্রম করলে কি পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত। এবার উনি রিকশাওয়ালার হাতে দু-টাকার নোটটি গুঁজে দিয়ে বললেন, আমি দিচ্ছি। তুমি রেখে দাও। সাহেব একটুও রাগ করবেন না।
কন্যার বিয়ের ব্যাপার না হলে মহেন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই এত বড় অন্যায় বরদাস্ত করতেন না। উনি বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন, আগে কোন গাড়ি-ঘোড়া এ বাড়িতে ঢুকলে ধন্য মনে করত। জোর করলেও কেউ ভাড়া নিত না।
একজন চাকর সুটকেসটি নিয়ে প্রায় দৌড়ে দোতলায় উঠল।
মহেন্দ্রবাবু সম্মানিত অতিথিকে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, এই রিকশাওয়ালা হারামজাদাই এক কালে আমার বাবাকে দুবেলা মালিশ করত।
আচ্ছা?
হ্যাঁ সুবোধবাবু!