১. জিরেনিয়াম ফুলের চারা

ক্যাপ্টেন ব্লাড / রাফায়েল সাবাতিনি / রূপান্তর : কাজী শাহনূর হোসেন / প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৪

উইনডো বক্সের জিরেনিয়াম ফুলের চারাগুলোয় পানি দেয়ার সময় ডাক্তার পিটার ব্লাডের দৃষ্টি চলে গেল নিচের রাস্তায়। লোকজন জটলা করছে। ওদের হাটে কচি ডাল বাঁধা, হাতে অদ্ভুত সব অস্ত্র। কারও কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র বা তরোয়াল থাকলেও বেশিরভাগেরই মুগুর আর ফার্মিং নাইফ সম্বল। বিভিন্ন পেশার লোক এরা। কেউ তাঁতী, কেউ ছুতোর, কেউবা আবার মুচি, মিস্ত্রী।

পিটার ব্লাডের শহর, অর্থাৎ ব্রিজ ওয়াটারের জনতা টনটনের প্রতিবাদীদের মতই ডিউক অভ মনমাউথের সমর্থনে এক্যবদ্ধ। রাজা দ্বিতীয় জেমসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে ডিউক, দাবি তার ইংল্যান্ডের সিংহাসন।

সেনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পিটার ব্লড কিন্তু এক মনে নিজের কাজ করে চলেছে। জুলাইয়ের সন্ধেবেলায় রাজপথ যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সেদিকে নজর নেই। তার মতে বিদ্রোহী মাত্রই নির্বোধ। তা নইলে নিজের পায়ে কুড়াল মারে কেউ?

পিটার ব্লাড মনমাউথ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে জানে, সিংহাসন প্রাপ্তির ব্যাপারে কোনও আইনগত দাবি নেই ডিউকের। ফলে অনর্থক খুনোখুনি, রক্তপাতই সার হবে, কাজের কাজ হবে না কিছুই। ব্লাড দুঃখের হাসি হাসল। এই বোকালোর অনেকেই কাল আর সূর্যোদয় দেখতে পাবে না। ও জানে, আসলে সবাই জানে, সে রাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে মনমাউথ। সেজমুরের কাছে তাঁবু খাটানো রাজসৈন্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাবে। ব্লাডের ধারণা, রয়্যালিস্ট নেতা লর্ড ফেভারশ্যামও এ ব্যাপারে ভালই অবগত আছেন। ফলে যুদ্ধের পরিণতি হতে যাচ্ছে মনমাউথের অভ্যুত্থানের সমূল ধবংস।

জানালা বন্ধ করার সময় ওর মনে হলো ও ডাক্তার মানুষ, যোদ্ধা নয়। আহত যোদ্ধাদের বরং সারিয়ে তোলাই ওর দায়িত্ব। পর্দা টেনে দিয়েছে ও। ঘরে মোমবাতির মিষ্টি আলো। হাউজকীপার টেবিলে খাবার রেখে গেছে।

খাওয়া সেরে সকাল সকাল বিছানায় গেল ও. রাত এগারোটার দিকে মনমাউথ যুখন বিদ্রোহীদের নিয়ে আক্রমণ শানাতে যাচ্ছে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্লড। রাত দুটোয় মুখোমুখি হলো দুপক্ষ ঘন্টা খানেকের মধ্যেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো মনমাউথের বাহিনী। দূরাগত কামানের গর্জন ব্লাডের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। ভোর চারটেয় ঘুম ভাঙল ওর। সূর্য তখন রক্তাক্ত প্রান্তরের ওপর উঁকি দিচ্ছে। বিছানায় উঠে বসে চোখ ঘষছে ব্লাড এমন সময় শুনতে পেল দরজায় জোর ধাক্কার শব্দ। নাম ধরে ডাকছে কে যেন। ড্রেসিং গাউন পরে, পায়ে চটি গলিয়ে নিচে নেমে এল ও।

ভোরের আবছা সোনালী আলোয় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক লোক আর একটি ঘোড়া। ধুলো কাদা মাখা যুবকটির কোটের ডান হাতা ছিঁড়ে ঝুলছে। কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও দীর্ঘ এক মুহূর্ত নির্বাক রইল সে। ব্লাড ইতোমধ্যে চিনে ফেলেছে যুবককে। জেরেমি পিট। জাহাজের ক্যাপ্টেন। এর খালা এ পাড়ায় থাকে।

তাড়াহুড়ো কোরো না, বলল ব্লাড। যা বলার ধীরে সুস্থে বলল।

কথাটা যুবকের কানে ঢুকল বলে মনে হলো না। হাঁফাচ্ছে। লর্ড গিলয়, কোনমতে বলল। মারাত্মক আহত…ওগলথর্পের ফার্মে আছে। আমিই বয়ে নিয়ে গেছি…ও আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। প্লীজ, চলুন আমার সঙ্গে! জলদি!

নিশ্চয় যাব, বলল ব্লাড। বিষণ্ণ বোধ করছে। গিলডয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওকে সাহায্য করতে মনেপ্রাণে তৈরি সে। যদিও জানে তার বন্ধুটি ডিউক মনমাউথের সক্রিয় সমর্থক।

কমিনিট বাদে জেরেমি পিটের ক্লান্ত ঘোড়ায়,চেপে রওনা দিল ওরা। পিটার ব্লাডের জীবনে শুরু হলো এক স্মরণীয় পরিবর্তন। আপাত দৃষ্টিতে পিটকে সাধারণ একজন দূত মনে হলেও সে ঘুরিয়ে দিল এই ডাক্তারটির ভাগ্যের চাকা।

.

দুই

ব্রিজ ওয়াটারের মাইল খানেক পশ্চিমে, নদীর ডান তীরে ওগলুথর্পের ফার্মের অবস্থান। পথে ব্লাড আর পিট যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নরত অসংখ্য আহত, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ দেখতে পেল।

মাঠের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া শর্টকাট রাস্তাটা ধরল পিটু। এখানেও পরাজিত বাহিনীর সদস্যদের দেখা পেল ওরা। লোকগুলো বারবার পিছু ফিরে চাইছে। মনে আতঙ্ক, এই বুঝি লাল কোট পরা রাজসৈন্যরা ধরতে এল।

শেষ তক ফার্মে পৌঁছল ওরা। ফার্মের মালিকের নাম বেনস। সে ওদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানাল। হলরুমে জানালার নিচে একটি খাটিয়ায় শুয়ে রয়েছে লর্ড গিলড়য়। মিস্টার বেনসের স্ত্রী ও কন্যা তার শুশ্রূষা করছে। লোকটির গাল দুটো ফ্যাকাসে, প্রতি নিশ্বাসেই তার নীল ঠোঁট জোড়া থেকে মৃদু গোঙানির শব্দ আসছে।

ব্লাড দ্রুত কাজে লেগে পড়ল। আহত লোকটির কোট ছেঁড়ার পর পানি আর ব্যান্ডেজ চাইল, ড্রেস করবে। শরীরের ডান পাশে মারাত্মক ক্ষত। আধ ঘন্টা পরে রাজসৈন্যরা যখন ফার্মহাউজে প্রবেশ করল তখনও রোগীর সেবায় ব্যস্ত ডাক্তার ব্লাড। ঘোড়ার খুরের শব্দ বা সৈন্যদের চেঁচামেচি তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। লর্ড গিলয় এতক্ষণে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েছে। আতঙ্কিত সে। বেনস, তার স্ত্রী আর মেয়েও তটস্থ।

ভয়ের কিছু নেই, শান্ত স্বরে অভয় দিল ব্লাড। এটা খ্রীষ্টানদের দেশ। খ্রীষ্টানরা আহতদের সঙ্গে যুদ্ধ করে না। এমনকি আহতদের যারা সাহায্য করে তাদের সঙ্গেও নয়।

ডজন খানেক লাল কোট পরা সৈন্য হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল হলঘরটিতে। তাদের নেতৃত্বে ঘন জওয়ালা মোটা মত এক লোক। তার কোটের বুকের কাছে সোনালী ফিতে। চিৎকার করে নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে এল ও, হাত তরোয়ালে।

আমি ক্যাপ্টেন হোবার্ট- রাজসৈন্য, ফার্মের মালিকের উদ্দেশে বলল। এখানে বিপ্লবীদের লুকিয়ে রেখেছেন কেন?

কাঁপা গলায় জবাব দিল বেনস, আমি..আমি বিপ্লবীদের লুকিয়ে রাখিনি। এই ভদ্রলোক আহত অবস্থায়…।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি, সশব্দে এগিয়ে এল ক্যাপ্টেন আহত লোকটির শয্যাপাশে। কড়া চোখে চেয়ে রয়েছে। কিভাবে আহত হয়েছে বলে দিতে হবে না। ব্যাটা বিদ্রোহী কোথাকার। সৈন্যদের দিকে ফিরল ও। একে বার করে নিয়ে যাও!

ব্লাড সৈন্য ও আহত লোকটির মাঝখানে রুখে দাঁড়াল। এই লোকের অবস্থা খুবই করুণ। টানাহেঁচড়া করলে একে আর বাঁচানো সম্ভব নাও হতে পারে। মানবতার স্বার্থে এঁকে ছেড়ে দিন।

ক্যাপ্টেন হোর্ট যেন কথাটা শুনে আমোদ পেয়েছে। মানবতার নিকুচি করি! রাস্তার ফাঁসিকাঠে ঝোলাব এটাকে। সব শালাকে জন্মের মত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।

বিনা বিচারে ফাঁসি দেবেন? আপনারা খ্রীষ্টান না, আর কিছু? চেঁচাল পিটার ব্লাড।

কুদ্ধ ক্যাপ্টেন চরকির মত মুরল ওর দিকে।

তুমি কে হেঃ বড় বেশি ফটর ফটর করছ!

আমার নাম রাড, স্যার- পিটার ব্লাড।

কুৎসিত হাসল ক্যাপ্টেন। তুমি এখানে মরতে এসেছ কেন?

আমি একজন ডাক্তার। এই ভদ্রলোকের চিকিৎসা করতে এসেছি। থাকি ব্রিজওয়াটারে।

তুমিও নিশ্চয় ওই ডিউকটার দলে, অবজ্ঞার সঙ্গে বলল ক্যাপ্টেন। সৈন্যদের দিকে চাইল আবার। খাটিয়াটা তুলে নাও, নির্দেশ দিল। ব্রিজওয়াটারে নিয়ে যাও একে। আগে জেলে ঢোকানো হবে তারপর এর ব্যাপারে যা অর্ডার হবে মানব।

নেয়ার পথেই হয়তো মারা যেতে পারেন, ব্লাড আরেকবার বোঝাতে চেষ্টা করল।

আমার তাতে কি? নিঠুর হেসে বলল ক্যাপ্টেন। আমার কাজ হচ্ছে সব শালা বিপ্লবীকে পাকড়াও করা।

দুজন সৈন্য তুলে নিল খাটিয়া। গিলডয় ব্লাডের দিকে একটি হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করল। বন্ধু, বলল ও, আমি আপনার কাছে ঋণী। বেঁচে থাকলে ঋণ শোধ করতে…।

ব্লাড বাউ করুন। তারপর সৈন্যদের উদ্দেশে বলল, “সাবধানে নেবেন। ওঁর জীবন এখন আপনাদের হাতে। ক্যাপ্টেনের দিকে চাইল এৰার, আপনি অনুমতি দিলে আমি এখন যাব।

আপনি থাকবেন, কঠোর নির্দেশ এল! জেরেমি পিটকে দেখিয়ে ক্যাপ্টেন সৈন্যদের বলল, একেও ব্রিজওয়াটারে নিয়ে যাও। আর ওই লোকটাকেও, বেনসকে ইশারায় দেখাল। বিপ্লবীদের ধরে ঠাই দেয়ার মজা বোঝানো হবে।

ঘরে একটা শোরগোল শুরু হলো। বেনস সৈন্যদের খপ্পরে পড়ে ছটফট করছে। আতঙ্কিত মহিলারা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ওদের দিকে এগোল ক্যাপ্টেন।

বেনসের মেয়ের কাঁধ চেপে ধরেছে। মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল ক্যাপ্টেনের দিকে। লোকটি বাঁকা হেসে এক হাতে ওর চিবুক তুলে ধরে অন্যহাতে সজোরে চড় কষাল গালে।

এবার মুখে তালা পড়বে, গর্জাল ক্যাপ্টেম। মিসেস বেনস মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল। কাঁপছে তরুণী।

এদের নিয়ে যাও, বন্দী দুজনকে আঙুল দেখিয়ে সৈন্যদের আদেশ করল ক্যাপ্টেন। তারপর কি যেন ভেবে যোগ করল, একেও নাও ব্লডের প্রতি ইঙ্গিত।

এক জোড়া বজ্রমুষ্টি চেপে ধরল ব্লাডকে। সে শক্তিশালী পুরুষ, ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু তক্ষুণি আবার একাধিক সৈন্য ওকে ধরে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে দিল। ঠেলে ধাক্কিয়ে উঠনে নিয়ে আসা হলো ওকে। পিট আর বেনস অপেক্ষা করছে ওখানে।

জনৈক অশ্বারোহী সৈন্যের ঘোড়ার রেকাবের সঙ্গে বাঁধা হয়েছে প্রত্যেককে। ঘোড়া ছুটলে বন্দীদেরও বাধ্য হয়ে ছুটতে হবে। ক্যাপ্টেনের আদেশে ব্রিজওয়াটারের উদ্দেশে রওনা দিল সৈন্য দল।

.

তিন

তিন মাস পরে জেলখানার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে পিটার ব্লাড, জেরেমি পিট আর অ্যান্ড বেনস ওয়েস্ট ইন্ডিজে চিরতরে নির্বাসিত হলো; ক্রীতদাস হিসেবে। আখ খেতে শ্রম দিতে হবে ওদেরকে। ব্রিস্টলে নিয়ে যাওয়ার পর আরও পঞ্চাশ জন অপরাধীর সঙ্গে জাহাজে তুলে দেয়া হয়েছে এ তিনজনকে। জাহাজটির নাম জ্যামাইকা মার্চেন্ট। জাহাজের খোলে বন্দী হয়ে পাড়ি জমাল ওরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে টিকতে না পেরে এগারোজন মারা পড়ল। এদের মধ্যে ব্লাডদের সঙ্গী হতভাগ্য ফার্ম মালিক বেনসও রয়েছে। তবে পিটার ব্লাড না থাকলে মতের সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও অনেক বাড়ত। অসুস্থদেরকে দিনরাত শুশ্রূষা করে গেছে ও। ফলে রোগ বিশেষ ছড়াতে পারেনি, অন্যরা বেঁচে গেল।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি জ্যামাইকা মার্চেন্ট বার্বাডোজ দ্বীপের ব্রিজটাউনে নোঙর ফেলল। নামিয়ে দিয়েছে বিয়াল্লিশ জন বন্দীকে।

এক দল মিলিশিয়া এবং কজন সিভিলিয়ান ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মহিলা আর নিগ্রোও রয়েছে তাদের মাঝে। এই কলোনির গভর্নর স্টীড় ওদের দিকে এগিয়ে এল। মোটা সোটা, খাটো, লাল মুখো লোকটি সামান্য খুড়িয়ে হাঁটে, হাতে লাঠি। তার পেছন পেছন এল লম্বা, শক্তপোক্ত এক লোক, পরনে বার্বাডোজ মিলিশিয়ার কর্নেলের পোশাক। কুৎসিত, নিষ্ঠুর চেহারা। কর্নেলের পাশে রাইডিং ড্রেস পরিহিতা সুন্দরী এক তরুণী। কোঁকড়া চুলগুলো কাঁধের দুপাশে ছড়ানো, সূর্যের তাপ তার চামড়ার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। ধবধবে ফর্সা। দুর্দশাগ্রস্ত বন্দীদেরকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখছে মেয়েটি।

পিটার ব্লাড হাঁ করে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইল। নিজের অপরিচ্ছন্ন শরীর আর চেহারার কথা মনে পড়তেই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। এই সুরীর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত অবস্থায় নেই সে।

মেয়েটি তার সঙ্গীর কোটের হাতা ছোঁয়ার জন্যে হাত বাড়াল। মৃদু বিরক্তির শব্দ করে ওর দিকে ফিরল লোকটি। সঙ্গীর মুখের দিকে চেয়ে কি যেন বলছে মেয়েটি, তবে কর্নেল বিশেষ কান দিচ্ছে বলে মনে হলো না। গভর্নর ইতোমধ্যে ওদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়েছে। ব্লড মেয়েটির কথা শুনতে পাচ্ছে না, নিচু স্বরে কথা বলছে। কর্নেলের কথা কানে আসছে মাঝে মধ্যে; কিন্তু গভর্নরের চড়া সুরের কথাগুলো সবাই শুনছে।

ঠিক আছে, কর্নেল বিশপ, বলল গভর্নর, আপনিই আগে পছন্দ করুন। তারপর অন্যরা চাইলে এদের কিনে নিতে পারবে।

কর্নেল মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ জানাল। চাষের কাজে এদের দিয়ে খুব একটা সুবিধে হবে মনে হয় না, উঁচু স্বরে বলল সে। কুতকুতে চোখজোড়া বন্দীদের আবারও একবার পরখ করে নিল। কাছে এগিয়ে এসে জেরেমি পিটের সামনে দাঁড়াল ও। যুবকটির হাতের মাংসপেশীতে, হাত রাখল। তারপর মুখ হাঁ করে দাঁত দেখাতে বলল। মানুষ নয় যেন ভারবাহী কোন পশুকে যাচাই করছে।

শেষ পর্যন্ত জ্যামাইকা মার্চেন্টের কাপ্টেনের উদ্দেশে বলল, এটার জন্যে পনেরো পাউন্ড পারেন।

ত্রিশও এর জন্যে কম হয়ে যায়, স্যার! পাল্টা জানাল ক্যাপ্টেন।

এই টাকায় একটা নিগ্রো পাওয়া যায় সাদা কুত্তাগুলো বেশিদিন বঁচে না। কাজেও ফাঁকি দেয়। বড় জোর বিশ দিতে পারি। তার বেশি এক পেনিও নয়।

দরাদরির ধরন দেখে মাড় প্রমাদ গুণল। কর্নেল বিশপ তখন লাইন ধরে হাঁটা দিয়েছে। ব্লাডের প্রতি একবার দৃষ্টি দিয়ে পাশ কাটাল। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল রাডের পাশে দাঁড়ানো কানা দৈত্য উলভারস্টোনের শরীরে। সেজমুরে একটি চোখ হারিয়েছে, ও। কর্নেল আবার দর-দাম শুরু করল।

অন্যান্য ক্রেতারা ওদের দেখল, চলে গেল। হঠাৎ লাইনের শেষ প্রান্তে নড়াচড়া শুরু হলো। রাড় দেখতে পেল মেয়েটি বিশপের সঙ্গে কথা বলছে, রূপালী হাতলের চাবুকটা দিয়ে ইঙ্গিত করছে লাইনটির দিকে। মেয়েটি কাকে দেখাচ্ছে বোঝার জন্যে চোখের কাছে হাত তুলে আড়াল নিল বিশপ। তারপর ভারী, ধীর পদক্ষেপে লাইনের গোড়ার দিকে হেঁটে এল। গভর্নর আর মেয়েটিও আছে। ব্লাডের কাছে পৌঁছলে মেয়েটি চাবুক দিয়ে ওর বাহুতে আলতো টোকা দিল।

এর কথা বলছিলাম, বলল মেয়েটি।

এটা? কর্নেল তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানতে চাইল। ব্লড নিজেকে একজোড়া ছোট, বাদামী চোখের দৃষ্টিতে ভস্ম হতে দেখল।

হুঁহ! হাড্ডির থলে। এটাকে দিয়ে হবেটা কি ঘুরে চলে যাচ্ছিল এমন সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন বলে উঠল, “হ্যাংলা হলেও এর গুণ কম নয়। অসুস্থদের সবাইকে এ-ই সারিয়ে তুলেছে। পনেরো পাউন্ড অন্তত দিন, কর্নেল। দেখবেন এখানকার গরমের সঙ্গে, এ খাপ খাইয়ে নেবে।

গভর্নর স্টীড হেসে ফেলল। আপনার ভাতিজী মানুষ চিনতে ভুল করে না, কর্নেল। ওর পছন্দের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। নিজের কৌতুকে খুব একচোট হাসল সে। কর্নেলের ভাতিজী কিন্তু মোেটই মজা পায়নি, বিরক্তির দৃষ্টিতে চাইল।

দশ পাউন্ড দিতে পারি, শেষ পর্যন্ত জানাল কর্নেল।

পিটার ব্লাড মনেপ্রাণে কামনা করছে ক্যাপ্টেন যেন অফারটি প্রত্যাখ্যান করে। এই ভয়ঙ্কর, লোকটি এবং তার ভাতিজীর সম্পত্তি হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু ক্রীতদাস তো ক্রীতদাসই, নিজের ভাগ্য বদলের কোন ক্ষমতা কি তার থাকে? দশ পাউন্ডের বিনিময়ে কর্নেল বিশপের কাছে বিক্রি করা হলো পিটার ব্লাডকে।

.

চার

এক মাস পরের কথা। জানুয়ারির রোদ ঝলমলে এক সকাল। মিস অ্যারাবেলা বিশপ ঘোড়ায় চেপে চাচার পাহাড়ের ওপরকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল, শহরের উত্তর-পশ্চিমে যারে। তার সঙ্গে দুজন নিগ্রো। ওরা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে দৌড়চ্ছে পেছন পেছন। গভর্নমেন্ট হাউজে যাচ্ছে অ্যারাবেলা। গভর্নমেন্টের অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে। পথে লম্বা, পাতলা এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। উল্টো দিকে হেঁটে চলেছে। লোকটিকে আগে কোথাও দেখেছে মনে হলো

ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেছে অ্যারাবেলা। আগুয়ান লোকটিকে তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করল। উজ্জ্বল একজোড়া চোখের সঙ্গে মিলন হলো ওর দুচোখের। লোকটি চলে যাচ্ছিল, পাশ কাটিয়ে, থামাল অ্যারাবেলা।

আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে, বলল ও।

নিজের জিনিসকে চিনতে পারছেন না? জবাব এল।

নিজের জিনিস?

ওই একই হলো–আপনার চাচার। আমার নাম পিটার ব্লাড, দাম পাক্কা দশ পাউন্ড।

এবার আর চিনতে অসুবিধে হলো না। গত এক মাসে একবারও দেখা হয়নি বলে চেনেনি। অনেক বদলেছে লোকটি। এখন আর তাকে ক্রীতদাস মনে হচ্ছে না। অ্যারাবেলার মনে পড়ল লোকটি ডাক্তার। এর চিকিৎসায় গভর্নরের গেঁটেবাত সেরেছে। ফলে ব্রিজটাউনে রীতিমত বিখ্যাত হয়ে গেছে ব্লাড। তার সেবার বিনিময়ে মোটা ফি নিচ্ছে কর্নেল বিশপ। আখ চাষের চেয়ে ক্রীতদাসটিকে ডাক্তারি করতে দেয়াই লাভজনক তার জন্যে।

আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, ম্যাডাম, বলল ব্লাড। অন্য কেউ আমাকে কিনলে হয়তো খেতেই খেটে মরতাম, ডাক্তারি করার সুযোগ পেতাম না।

সেজন্যে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। চাচা আপনাকে কিনেছেন, আমি নই।

আপনি না বললে তো আর হত না।

আপনার জন্যে করুণা হয়েছিল, ঠাণ্ডা স্বরে বলল অ্যারাবেলা। চাচা খুবই কড়া ধাচের মানুষ। সব, আখ চাষীই তাই। তবে তার চেয়েও বাজে লোক আছে। মিস্টার ক্র্যাবস্টোন নামে এক লোককে সবাই ভয় পায়!

ব্লাডের বিস্ময় কাটেনি। কিন্তু আমি ছাড়া আরও অনেক লোকই তো ছিল।

তাদেরকে আপনার মত মনে হয়নি।

সেটা খুব স্বাভাবিক।

বাহ, নিজের প্রতি বেজায় উঁচু ধারণা দেখছি আপনার।

বলতে পারেন উল্টোটা।

কিরকম? ওরা আসলেই বিদ্রোহী, আমি নই। সেটাই পার্থক্য।

কিন্তু বিদ্রোহী না হলে এখানে এলেন কেন?

সংক্ষেপে সব জানাল ব্লাড।

মাই গড! কি অবিচার! না বলে পারল না অ্যারাবেলা।

রাজা জেমস ভালভাবেই ইংল্যান্ড শাসন করছেন, তিক্ততার সঙ্গে বলল ব্লাড। আমার কাছে বার্বাডোজই ভাল। এখানে অন্তত, ঈশ্বরে। বিশ্বাস রাখা যায়।

বাউ করল ও, আবার চলতে শুরু করল অ্যারাবেলার ঘোড়া। নিগ্রো দুটো লাফিয়ে উঠে ছুট লাগাল।

পিটার ব্লাড ঠায় দাঁড়িয়ে, ব্রিজটাউন উপসাগরের পানি ঝিকমিক করছে; সেদিকে চোখ তার। চমৎকার প্রকতি, তবুও তো জেলখান!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, নিজের পথ ধরল। সহবন্দীদের চেয়ে সে ভাগ্যবান। কিন্তু সেজন্যে আত্মতুষ্টির কোন কারণ নেই। বরঞ্চ ওদের দুর্দশার কথা ভেবে তার নিজের অশান্তি আরও বাড়ল। কর্নেল বিশপ বিয়াল্লিশজন বন্দীর পঁচিশ জুনকে কিনে নিয়েছে। বাকি স্বন্দীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকের খেতে। ব্লাড ওদের অবস্থা কেমন জানে না। কিন্তু বিশপের ক্রীতদাসদের প্রতি যে নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করা হয় তা তো তার নিজ চোখে দেখা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় ওদের। দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে দেখলে ওভারসিয়ার চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নেয়। অর্ধভুক্ত লোকগুলো। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে। সম্প্রতি দুজন শ্রমিক বিদ্রোহ করলে তাদের চরম ভাবে চাবুকপেটা করা হয়েছে।

পিটার ব্লাডকে এসব অবমাননা সইতে না হলেও ভেতর ভেতর সে মানবজাতির প্রতি গভীর বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণা অনুভব করে। এজায়গা থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণটা আকুলি বিকুলি করে তার। মিস বিশপের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হলে দুএক মিনিটের জন্যে কথাবার্তাও হয়। কিন্তু সুন্দরী তরুণীটির ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের প্রতি দুর্বল হওয়া থেকে অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রাখে ও। মেয়েটির চাচার মত জঘন্য অমানুষ জীবনে দেখেনি। অ্যারাবেলাকেও তাই লোকটির কাছ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারে না। নিষ্ঠুর লোকটির রক্ত বইছে ওই মেয়ের শরীরে। চাচার নির্মমতার কিছুমাত্র কি থাকবে না ওর. অন্তরে? মেয়েটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চায় ও, যখন পারে না তখন শীতল ভদ্রতা দেখায়।

.

পাঁচ

আখ শ্রমিকদের দুস্থা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পিটার ব্লাড সবাইকে উদ্ধার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সে উদ্দেশ্যেই একটি ছোটখাট জাহাজ হাতে পাওয়ার জন্যে গোপনে খোঁজ খবর করছে। জেরেমি পিট শিক্ষিত নৌ ক্যাপ্টেন। ক্রীতদাসদের মধ্যেও অনেক নাবিক রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাহাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয় কেউ।

একদিনের ঘটনা জেরেমি পিট চাবুকের বাড়ি খেয়ে মেজাজ হারাল। স্বয়ং বিশপকেই আক্রমণ করে বসল সে। বিশপের নিগ্রো পাহারাদাররা তক্ষুণি ঠেসে ধরল ওকে। মুহূর্তে চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে দেয়া হলো। বিশপ হাঁফাচ্ছে, কুৎসিত মুখটা তার রাগে থমথম করছে। জেরেমি পিটের দিকে এক ঝলক চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, নিয়ে আয় ওকে।

টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো পিটকে। মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া সহকর্মীদের অন্য কোন পথ নেই। ক্রীতদাসদের কোয়ার্টারের সামনে হেঁচড়ে আনার সময় পিটের চোখ চলে গেল বিস্তৃত উপসাগরের দিকে। জীবনে আজই কি শেষবারের মত নোঙর করা জাহাজ দেখছে ও? পোতাশ্রয়ের প্রবেশ পথের দিকে ধীরে এগোচ্ছে চমৎকার একটি জাহাজ, ইংল্যান্ডের পতাকা দুলিয়ে।

কর্নেল বিশপ থলথলে হাতের আড়ালে চোখ ঢেকে জাহাজটিকে দেখছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ওটা বন্দরে নোঙর করবে। তার আগেই পিটকে শাস্তি দেয়া হয়ে যাবে! ওকে তড়িঘড়ি ঠেলে স্টকে আটকে দেয়া হলো। বেআদব ক্রীতদাসদের এভাবেই স্টকের গর্তে হাত পা ঢুকিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। কর্নেল বিশপ জ্বর হেসে ধীর পায়ে এগোল।

বদমেজাজী কুত্তাকে শেখানো হবে কিভাবে মনিব মানতে হয়, বলল সে। নয় স্ট্র্যাপওয়ালা চাবুকটা তুলে নিল।

সপাসপ বাড়ি পড়ছে বন্দীর মাথায়-কাঁধে। পিট একবারের জন্যেও চেঁচাল না। ফলে বিশপের মেজাজ আরও চড়ে গেল। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সে নিজেই ক্ষান্ত দিল। অবশ্য ততক্ষণে পিট বেচারার ঘাড় থেকে কোমর অবধি কালসিটে পড়ে গেছে। কয়েক জায়গায় ফেটে গেছে চামড়া। পিট স্টকের গায়ে ঢলে পড়েছে, মাঝে মধ্যে কেবল মৃদু গোঙানির শব্দ করছে।

এবার হুঁশ হবে! গর্জাল বিশপ। নিগ্রো গার্ডদের নিয়ে চলে গেল।

দুঘণ্টা বাদে ব্লাড খুঁজে পেল পিটকে। কাঠফাটা রোদ আর মাছির ঝাঁক হামলে পড়েছে ওর পিঠের ওপর। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ও। ব্লাড প্রথমে পানি মুখে তুলে দিল ওর। তারপর ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে মলম লাগাল। এসময় ক্রুদ্ধ একটি কণ্ঠস্বর ধমকে উঠল হঠাৎ।

করছ কি? কর্নেল বিশপ ধেয়ে আসছে, সঙ্গে যথারীতি নিগ্রো গার্ডরা।

কর্নেলের দিকে ফিরে শান্ত স্বরে বলল রাত, কি করছি? দায়িত্ব পালন।

ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পিটের পিঠের ব্যান্ডেজ ছিঁড়ে দিল বিশপ। আর্তনাদ করে উঠল পিট, ককাচ্ছে।

একটু দয়া করুন। মানবতার খাতিরে… বলতে চেষ্টা করল ব্লাড।

তুমি ভাগে। এখ। থেকে। ঝট করে ঘুরে বলে উঠল বিশপ। আমার অনুমতি ছাড়া এর কাছেপিঠে যদি আসো, তো তোমারও একই হাল করে ছাড়ব।

ব্লাড এতটুকু নড়ল না।

আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দিন, শান্তস্বরে অনুরোধ করল। নইলে ডাক্তার হিসেবে আজই আমার শেষ দিন। এই দ্বীপের আর কারও অসুখ বিসুখে আমাকে পাবেন না- গভর্নরের জন্যেও নয়।

মুহূর্তের জন্যে কর্নেল হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে কথা সরল না। তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে চেঁচাল, আমাকে হুমকি দিস- তোর এতবড় সাহস!

হ্যাঁ, নির্লিপ্ত শোনাল ব্লাডের কণ্ঠ। তার চোখজোড়া বিশপের চোখে।

বিশপ দীর্ঘ একটি মুহূর্ত ওকে লক্ষ করল। তারপর বলল, তোমার সঙ্গে বেশি ভদ্রতা করে ফেলেছি। তবে নিজেকে শুধরাতে সময় লাগবে

আমার। ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। চাবকে তোমার পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে।

তাই? কিন্তু গভর্নর স্টীডের কথা একবারও ভাবছেন না?

তুমি ছাড়া এই দ্বীপে আর ডাক্তার নেই মনে করো?

ব্লাড হেসে ফেলল। সেকথা গভর্নরকেই বলে দেখুন না। অন্য কোন ডাক্তারকে তার মনে ধরলে তো!

ক্রুদ্ধ কর্নেল কর্ণপাত করল না। নিগ্রোদের উদ্দেশে হাঁক পাড়ল, কি যেন আদেশ করবে। কিন্তু হাঁক দেয়াই সার, সেই আদেশ আর তার দেয়া হলো না। কর্নেলের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে আচমকা প্রচণ্ড শব্দে গোলা বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে। কর্নেল বিশপ আঁতকে উঠে ঝেড়ে দিল দৌড়, তার নিগ্রোরাও বসে রইল না। এমনকি ব্লাডও ওদের পিছু নিল। উধ্বশ্বাসে ধাবমান লোকগুলোর দৃষ্টি চলে গেল সাগরের দিকে। দুর্গের কাছে বন্দরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই জাহাজটি। গোলা ঘোড়ায় ওটার কামানগুলো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে, তার ফলে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়েছে। মূল মাদ্ভুল থেকে ইংল্যান্ডের পতাকা ইতোমধ্যে নেমে গেছে। সে জায়গায় এখন পতপত করে উড়ছে স্পেনের লাল সোনালী নিশান।

এবার সবাই বুঝল। জলদস্যু! চেঁচাল বিশপ। জলদস্য!

তার কণ্ঠে একই সঙ্গে আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, তবে দুচোখ জ্বলছে ধকধক করে। নিগ্রো গার্ডরা মনিবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে, দাঁত বার করে নির্বোধের মত হাসছে।

.

ছয়

স্পেনগামী দুটো জাহাজে ইংরেজ বোম্বেটেরা আক্রমণ করে সমস্ত ধনরত্ন লুটে নিয়ে গেছে। ঘটনাটি সাম্প্রতিক। এ অঞ্চলে সোনা আর গুপ্তধনের অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে। ফলে প্রতিটি জাহাজই বিপুল সম্পত্তিতে ঠাসা থাকে। জলদস্যুদের উৎপাতও তাই স্বাভাবিক। স্পেন আর ইংল্যান্ডের মধ্যে স্প্যানিশ মেইন-এ ভয়াবহ যুদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু যে বোম্বেটে আর অপরাধীরা তাতে অংশ নিয়েছে তা নয়।

স্পেনের দুটি জাহাজের একটির নেতৃত্বে ছিল অ্যাডমিরাল ডন ডিয়েগো ডি এসপিনোসা। বদরাগী মানুষটি হেরে গিয়ে শপথ নিল ইংরেজদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবে। স্প্যানিশ মেইনের একটি ইংরেজ উপনিবেশে হামলা করবে ঠিক করল। বার্বাডোজ দ্বীপটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু স্থির হলো। এমন সময় আগ্রাসন চালানো হবে যখন ব্রিজটাউন উপকূলে কোন যুদ্ধ জাহাজ থাকবে না।

চমৎকারভাবে পরিকল্পনায় সফল হয়েছে সে। বিশটি কামান থেকে দুর্গে অবিরাম গোলাবর্ষণের আগ পর্যন্ত কাক পক্ষীটিও কিছু আঁচ করতে পারেনি। ব্লাডরা দেখতে পাচ্ছে বিশাল জাহাজটি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। কামানগুলো থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে।

দ্বিতীয় দফা গোলাগুলির পর চেতনা ফিরল বিশপের, কর্তব্যের কথা মনে পড়ে গেছে। বার্বাডোজ মিলিশিয়ার কমান্ডার হিসেবে তার জায়গা হচ্ছে ছোট্ট সেনাবাহিনীটির সঙ্গে, দুর্গের ভেতরে। ছুট লাগাল ও, নিগ্রোরাও।

ব্লাড ওদিকে ফিরে এসেছে পিটের কাছে। কি কপাল তোমার! বলল ও। কামানগুলো তৃতীয়বারের মত গর্জে উঠেছে। ব্লাড তার রোগীকে: স্টকমুক্ত করে পিঠে আবার ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

এসময় ওভারসিয়ার দৌড়ে এল ক্রীতদাস কোয়ার্টারে। তার পেছনে জনা বিশ ত্রিশ মজুর, সবাই সন্ত্রস্ত।

জঙ্গলে গিয়ে লুকাও! চেঁচাল ওভারসিয়ার। গা ঢাকা দিয়ে থাকো। আমরা স্প্যানিশ বদমাশগুলোকে মজা দেখাচ্ছি!

ক্রীতদাসরা ওর কথা অবশ্যই মানত যদি না ব্লাড বাধা দিত।

তাড়াহুড়োর কিছু নেই। জঙ্গলে পালানোর কোন কারণ দেখছি না। আর স্প্যানিশরা আগে শহরটা তো কজা করুক, তারপর না হয়। পালানোর কথা ভাবা যাবে।

ওরা কথানুযায়ী সকলে রয়ে গেল, নিচের ভয়াবহ যুদ্ধ দেখছে।

দুর্গ রক্ষার চেষ্টা করছে মিলিশিয়া এবং বন্দুক চালাতে সক্ষম প্রতিটি দ্বীপবাসী। ওরা জানে পরাজিত হলে রক্ষা নেই। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। গুলির শব্দ শহরের বুকের ভেতর ঢুকে আসছে। এর অর্থ দুর্গ রক্ষাকারীরা ক্রমশ পিছু হটছে। গোধূলি লগ্ন নাগাদ আড়াইশো। স্প্যানিশ ব্রিজটাউনের সর্বেসর্বা হয়ে গেল। দ্বীপবাসী আত্মসমর্পণ করেছে। গভর্নমেন্ট হাউজে গভর্নর স্টীড গেঁটে বাতের ব্যথা ভুলে কর্নেল বিশপ এবং অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করছে। ডন ডিয়েগো বলে পাঠিয়েছে শহরের মুক্তিপণ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। তারা যখন এসব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তখন স্প্যানিশরা শহরে তাণ্ডব চালাচ্ছে। লুটতরাজ, মদ্যপান, খুনোখুনি- কিছুই বাদ রাখছে না।

ব্লাড সাহসে ভর করে সন্ধ্যার পর শহরে নেমে এল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সব দেখেশুনে আত্মা শুকিয়ে গেছে ওর। ফলে কোয়ার্টারের দিকে ফিরে চলল। সরু একটা গলি ধরেছে ও। হঠাৎ এক তরুণীর সঙ্গে ধাক্কা খেল। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে মেয়েটি, বাতাসে উড়ছে অগোছাল চুল। ওকে ধাওয়া করছে এক ভারী বুট পরা স্প্যানিশ, হাসছে- গালি দিচ্ছে। প্রায় ধরেই ফেলেছিল মেয়েটিকে, বাধা, দিল ব্লাড। এক মৃত দ্বীপবাসীর কোমরের খাপ থেকে আগেই একটি তরোয়াল জোগাড় করেছে ও। স্প্যানিশ লোকটির পেট এফেঁড় ওফোঁড় করে দিল। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও। এবার মেয়েটির কব্জি চেপে ধরল ব্লাড।

এসো, বলল ও। অলিগলি পেরিয়ে মেয়েটিকে প্রায় উড়িয়ে কর্নেল বিশপের বাড়িতে নিয়ে এল। অন্ধকার বাড়ি। জোরে নক করল ও। ওপরতলার জানালা থেকে সাড়া এল।

কে ওখানে? অ্যারাবেলার কণ্ঠ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ব্লাড। যাক, মেয়েটি তবে রক্ষা পেল!

আমি- পিটার ব্লাড, কোনমতে জানাল।

এখানে কি চান?

অ্যারাবেলার গলা চিনতে পেরে এবার চিৎকার করে উঠল। মেয়েটি।

অ্যারাবেলা, আমি মেরি ট্রেইল।

মেরি! সামান্য পরেই দরজা খুলে গেল। মোমবাতি হাতে নিয়ে হলরূমে দাঁড়িয়ে অ্যারাবেলা।

ব্লাড ঢুকে পড়ল, মেয়েটিও; কাঁদছে। ব্লাড অযথা সময় নষ্ট করল না।

কাজের লোকজন কেউ আছে? জিজ্ঞেস করল ব্লাড।

নিগ্রো সহিস জেমস ছাড়া কেউ নেই।

ওকেই দরকার, বলল ব্লাড। ওকে ঘোড়া তৈরি করতে বলুন। তারপর যত জলদি সম্ভব স্পেইটসটাউন বা তারও উত্তরে চলে যান। এখানে আপনাদের মহাবিপদ!

কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ… বলতে চাইল অ্যারাবেলা।

তা শেষ। কিন্তু বদমাশি সবে শুরু। মিস ট্রেইলের মুখে সব শুনে নেবেন। এখন ঈশ্বরের দোহাই, যা বলছি করুন।

উনি…উনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, ফুঁপিয়ে চলেছে মেরি।

বাঁচিয়েছে মানে? মিস বিশপ বিস্মিত। কি হয়েছিল?

পরে শুনলেও চলবে, অসহিষ্ণু ব্লাড বলে উঠল। জেমসকে দয়া করে ডাকুন, যা বলছি করুন- এক্ষুণি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল মেরি। ওঁর কথা মত কাজ করো, প্লীজ।

মিস বিশপ এক্ষুণি জেমসের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘোড়া জুড়ে ফেলল অভিজ্ঞ সহিস। মেয়ে দুটি তারা জ্বলা রাতে বেরিয়ে পড়ল। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্লাড ও বাড়ির দরজার কাছে। মেরি ট্রেইলের শিশুসুলভ কণ্ঠটি শেষবারের মত কানে এল ওর: আপনি আমার জন্যে যা করলেন, মিস্টার ব্লাড, আমি কোনদিন ভুলব না- কোনদিন না।

কিন্তু ব্লাড তো ওর গলা শুনতে চায়নি। যারটা শুনতে চেয়েছিল সে নিশ্চুপ।

ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্ধকারে মিশে রইল ও। এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের চরকায় তেল দিতে চেষ্টা করল। অনেক কাজ বাকি। শহরে নিছক কৌতূহলের বশে যায়নি ও। অন্য উদ্দেশ্য ছিল। প্রয়োজনীয় খবরাখবর পাওয়া, হয়ে গেছে। আজ রাতটা অসম্ভব ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে যাচ্ছে ও। কাজেই সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।

কোয়ার্টারের উদ্দেশে পা বাড়াল ব্লাড। সহক্রীতদাসরা গভীর উদ্বেগ আর এক বুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

.

সাত

রাত ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছে। স্প্যানিশ যুদ্ধজাহাজটির পাহারায় এখন বড়জোর জনা দশেক লোক। আবার এদের বেশিরভাগই নিচের ডেকে বসে বিজয়ের অজুহাতে আমোদ ফুর্তি করছে। ওপরের ডেকে পাহারা দিচ্ছে যে দুজন নাবিক তারাও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করছে না। ফলে দুটো দাঁড়টানা নৌকা কখন যেন ওদের নজর এড়িয়ে, নিঃশব্দে জাহাজের এক পাশে চলে এল।

একজন পাহারাদার ডেকের কোণের দিকে এগোতেই এক ছায়ামূর্তির মুখোমুখি পড়ে গেল। জাহাজের পার্শ্ববর্তী মই বেয়ে উঠে এসেছে লোকটি।

কে তুমি? জানতে চাইলেও সতর্কতার ধার ধারল না। পাহারাদার। তার ধারণা, জাহাজের কোন নাবিক হবে হয়তো।

আমি, স্প্যানিশ ভাষায় মৃদু স্বরে জানাল ব্লাড।

পেড্রো? এক পা আগে বেড়েছে নাবিক।

আমার নাম পিটার, বলল ব্লাড। তারপর নাবিকটিকে জোরে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিল।

স্প্যানিশ লোকটি হতভম্ব, ছলাৎ করে একবার শব্দ উঠল কেবল। ভারী বর্ম সজ্জিত মানুষটি তখুনি ডুবে গেল।

এবার এসো, অপেক্ষমাণ সহযোগীদের উদ্দেশে বলল ব্লাড। কোন শব্দ করবে না।

মিনিট পাঁচেকের ভেতর জাহাজের ডেকে উঠে এল বিশজনের গোটা দলটি। নিচের ডেকে উৎসব চলছে, স্পষ্ট শোনা যায়। ভরাট গলায় একজন স্প্যানিশ গান গাইছে, অন্যরা কোরাসে তাল মেলাচ্ছে।

আমার সঙ্গে এসো, ফিসফিসিয়ে বলল ব্লাড।

ঝুঁকে ছায়ার মত নিঃশব্দে নিচের ডেকে নেমে এল। ওদের চোদ্দজনের হাতে হ্যান্ডগান। ওভারসিয়ারের বাড়ি তল্লাশি করে পেয়েছে। বাকিদের হাতে ধারাল ছোরা আর তরোয়াল।

স্প্যানিশ নাবিকরা ওদিকে পরম নিশ্চিন্তে হৈ হল্লায় মগ্ন। বার্বাডোজের গ্যারিসনকে নিরস্ত্র করা হয়েছে। তাদের সঙ্গীরা এখন এ শহরের সর্বময় কর্তা। তবে আর ভয়ের কি আছে? নিজেদেরকে ওরা বুনো চেহারার, অর্ধনগ্ন একদল লোকের দ্বারা ঘেরাও হতে দেখেও বিশ্বাস করতে পারল না।

কে ভেবেছিল একদল অপদার্থ ক্রীতদাস তাদের যুদ্ধজাহাজটি দখল করে নেবে?

মাতাল নাবিকদের হাসি তামাশা বন্ধ হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে লম্বা পাতলা এক লোকের দিকে দৃষ্টি তাদের। এগিয়ে এসে সাবলীল স্প্যানিশে কথা বলল সে।

ঝুটঝামেলা এড়াতে চাইলে ধরা দাও।

টু শব্দটি করতে পারল না মাতাল লোকগুলো। ওদেরকে জাহাজের খোলে পুরে দেয়া হলো।

স্প্যানিশদের খাদ্য-পানীয় দিয়ে উদরপূর্তি করল ক্রীতদাসরা। বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে।

সূর্যোদয়ের অল্প পরে একটি নৌকাকে দেখা গেল তীর ছেড়ে জাহাজের দিকে আসতে। ডন ডিয়েগো চারটি পেল্লায় সিন্দুকভর্তি ধনরত্ন আদায় করেছে গভর্নর স্টীডের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ। সে তার ছেলে ডন এস্তেবান আর ছজন নাবিকসহ জাহাজে ফিরছে।

স্প্যানিশ জাহাজটি গতকালকের মতই ঠায় দাঁড়ানো। কোথাও. কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না। তীরে দাঁড়ালে অবশ্য একপাশ থেকে ঝুলন্ত মইটি দেখা যায় না। মইয়ের নিচে ক্রীতদাস ওগলের নেতৃত্বে একদল বন্দুকধারী সৈন্য অপেক্ষারত। ওগল আগে রয়্যাল নেভিতে ছিল।

ডন ডিয়েগো মই বেয়ে উঠে ডেকে পা রাখল। একা। নিঃসন্দেহ। হঠাৎ মাথায় লোহার ডাণ্ডার বাড়ি খেয়ে মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল। ওকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ওরই কেবিনে। ইতোমধ্যে সিন্দুকগুলো ডেকে তোলা হয়েছে। ডন এস্তেবান আর নাবিক ছন একে একে মই বেয়ে উঠল এবং ডন ডিয়েগোর মতই কাটা কলাগাছ হলো। কেউ টা ফো করতে পারেনি।

তীরে দাঁড়িয়ে কর্নেল বিশপ আর গভর্নর স্টীড দেখতে পেল আটটি নৌকায় চেপে স্প্যানিশরা তাদের জাহাজের উদ্দেশে যাচ্ছে। দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে দুজনের। কি অপমান! কূল ও জাহাজের মাঝপথে যখন নৌকাগুলো তখন আচমকা গুলির শব্দে বাতাস কেঁপে উঠল।

প্রথম নৌকাটার ছফুটের মধ্যে গুলি পড়াতে পানির ফোয়ারা যাত্রীদের গা ভিজিয়ে দিল। সবাই হতবাক। হুঁশ ফিরে পেয়ে যাত্রীরা স্প্যানিশ বন্দুকধারীদের নির্বুদ্ধিতা ও অসতর্কতার জন্যে গালমন্দ শুরু করল। কামান থেকে কিভাবে গুলি ছুঁড়ে স্যালুট জানাতে হয় বোকাগুলো এখনও শিখল না। ওদের বকাবাজি ফুরানোর আগেই দ্বিতীয় গোলাটি আঘাত হানল। এবার নির্ভুল নিশানায়। একটি নৌকার আরোহীরা গুলির আঘাতে পানিতে ছিটকে পড়ল। বেশ কয়েকজন মারা পড়েছে, অন্যরা আহত।

বাকি সাতটি নৌকার যাত্রীরা লাফিয়ে উঠল। ক্রুদ্ধ। ভীত। কোন পাগলের হাতে কামানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তৃতীয় গোলাটি চুরমার করে দিয়েছে আরেকটি নৌকা। আর্তচিৎকার করে স্প্যানিশরা এবার যে যেদিকে পারে নৌকা বাইতে লাগল। কেউ কেউ তীরের দিকে ফিরতে চায়, আবার কেউ বা জাহাজে পৌঁছে আসল ঘটনা বুঝতে চায়। এরকম গোলমালের মধ্যে পর পর দুটো গোলা এসে তিন নম্বর নৌকাটিকে কাত করে দিল।

গোলন্দাজ হিসেবে ওগল তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। চতুর্থ গোলাটি দাগা হলে আর মতান্তর লক্ষ করা গেল না স্প্যানিশদের মধ্যে। প্রাণপণে পারের উদ্দেশে নৌকা বাইছে। দুটো নৌকা ইতোমধ্যে ডুবেছে। বাকি রয়েছে তিনটি। ওগলের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে শেষ নৌকাটি তীর ছুঁই ছুঁই অবস্থায় টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গেল।

স্প্যানিশ বোষেটেদের পুরো বাহিনী খতম হয়ে গেছে। মাত্র দশ মিনিট আগেও এরা মহা আনন্দে সিন্দুক ভর্তি ধনদৌলত নিয়ে জাহাজে ফেরার পথে নানারকম রঙীন স্বপ্ন দেখছিল।

.

আট

কূলে দাঁড়ানো দ্বীপবাসী এসব অদ্ভুত কাণ্ড দেখে স্প্যানিশদের চেয়ে কম অবাক হয়নি। স্পেনের পতাকা নামিয়ে মূল মালে ইংল্যান্ডের পতাকা তোলা হয়েছে। তারমানে স্প্যানিশ জাহাজটি এখন মিত্রদের হাতে। এ ব্যাপারে ব্রিজটাউনবাসী নিশ্চিত। কিন্তু কারা, দখল করেছে ওই জাহাজ? কিভাবেই বা? একমাত্র সম্ভাব্য জবাব হচ্ছে রাতের আঁধারে দ্বীপবাসীদের একটি দুঃসাহসী দল হয়তো কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কারা এই ত্রাণকর্তা জানা দরকার।

গভর্নর স্টীড কর্নেল বিশপকে দুজন অফিসার সহ নৌকায় তুলে দিল, খোঁজখবর জেনে আসতে।

মই বেয়ে ডেকে পা রাখতেই সিন্দুক চারটে দেখতে পেল বিশপ। চোখ চকচক করে উঠল ওর, অন্তরে প্রশান্তি। দুসারিতে স্প্যানিশ বর্ম পরিহিত বিশজন লোক দাঁড়িয়ে। কর্নেল বিশপ চিনতে পারল না এই সৈনিকের পোশাক পরা লোকগুলোর আড়ালে রয়েছে তারই অত্যাচারিত ক্রীতদাসের দল। পাতলা-সাতলা, লম্বা, সুদর্শন ভদ্রলোকটিকেও চেনেনি ও। স্বাগতম জানাল লোকটি; পরনে স্প্যানিশ বেশ; কোমরে গোঁজা সোনার হাতলওয়ালা তরবারি।

ওয়েলকাম, কর্নেল, একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর বলল। আপনার সম্মানে স্প্যানিশ কাপড়-চোপড় পরেছি আমরা। আমাদের চিনতে পারছেন না? আপনার পুরানো বন্ধু!

কর্নেলের চোখ বিস্ফারিত। এ কি সেই পিটার ব্লাড? শেভ করা * চেহারা আর পরিপাটি চুলের কারণে এর বয়স এখন তেত্রিশের চেয়ে একমাসও বেশি মনে করার উপায় নেই।

পিটার ব্লাড! বিশপের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। তাহলে তুমিই…?

হ্যাঁ! সঙ্গে এরাও ছিল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহযোগীদের উদ্দেশে হাত নাড়ল ব্লাড।

কর্নেল চোখ সরু করে চাইল।

হায় ঈশ্বর! এই কজন মাত্র লোক নিয়ে জাহাজ দখল করে নিলে? দারুণ ব্যাপার! চওড়া হ্যাটটি খুলে নিয়ে ভ্র মুছল। তোমাদের তো বকশিশ দিতেই হচেই হে! আমাকে তোমরা কৃতজ্ঞ করে ছাড়লে!

তাই হওয়াই তো.উচিত, বলল ব্লাড। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি ঠিক কতখানি কৃতজ্ঞ।

বিস্মিত বিশপ ব্লাডের দিকে চাইল। চেহারায় সন্দেহের ছায়া। এই প্রথমবারের মত মনে হচ্ছে, এদের কাছ থেকে যতখানি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার আশা করেছিল তা পাওয়া যাবে না।

আমার জন্যে তো চাবুকের বাড়ি অপেক্ষা করছে, বলছে ব্লাড। পিঠের চামড়া তুলে নেবেন বলেছিলেন না?

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল বিশপ। বোকার মত কথা! তোমার এই বীরত্বের পর তেমন কথা ভাবা যায়?

বাঁচালেন। তবে আমার ভাগ্য ভাল যে স্প্যানিশরা কাল এসেছিল। আজ এলে আমার দশাও হত বেচারা জেরেমি পিটের মত।

ওসব কথা ভুলে যাও না।

কিভাবে ভুলি, কর্নেল ডার্লিং? আপনি ক্রীতদাসদের ওপর কম অত্যাচার তো করেননি। তাই আমি ঠিক করেছি আপনাকে ছোট্ট একটা শাস্তি দেব। এমন শাস্তি যা বাপের জন্মে ভুলতে পারবেন না। পিট বেচারা এ জাহাজেই আছে, কেবিনে শুয়ে ব্যথায় ককাচ্ছে। ওর পিঠে রঙধনুর সাতটা রঙই ফুটিয়েছেন আপনি। একমাস লাগবে বেচারার সেরে উঠতে।

হ্যাগথর্প নামের ক্রীতদাসটি এবার আগে বাড়ল। লম্বা দশাসই চেহারার লোকটির মুখটি হাসি হাসি।

শুয়োরটার সঙ্গে অযথা সময় নষ্ট করছেন কেন? প্রশ্ন করল সে। পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

রাগে লাল হয়ে গেল বিশপের মুখ। কি-কি বলতে চাও তুমি? তোতলাচ্ছে।

এবার এক চোখা দৈত্য উলভারস্টোন নাক গলাল।

এটাকে মাস্তুলের সঙ্গে লটকে দিন, না, কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ও। ক্রীতদাসরা সমস্বরে সম্মতি জানাল।

কর্নেল বিশপের কাঁপাকাঁপি অবস্থা। ঘুরল ব্লাড। শান্ত, স্বাভাবিক। উত্তেজনার লেশমাত্র নেই তার মধ্যে। উলভারস্টোন, যা করার আমিই করব। আমি এখন এ জাহাজের ক্যাপ্টেন। কর্নেল বিশপকে আমার জিম্মি হিসেবে দরকার। কর্নেলের দিকে আবার ফিরল ও।

আপনি জানে বাঁচবেন কথা দিচ্ছি। কিন্তু আমরা জাহাজ ছাড়ার আগ পর্যন্ত আপ্লনাকে জিম্মি রাখব।

জাহাজ ছাড়ার আগ পর্যন্ত… ভীত বিশপ বাক্যটি শেষ করতে পারল না।

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, বলল ব্লাড। কর্নেলের সঙ্গী অফিসার দুজনের দিকে চাইল। নৌকা অপেক্ষা করছে। আমার কথা তো শুনলেন। গভর্নরকে দয়া করে জানিয়ে দেবেন।

কিন্তু, স্যার… বলতে চাইল একজন।

যা বলার বলে দিয়েছি, বাধা দিয়ে বলল ব্লাড। আমার নাম ব্লাড ক্যাপ্টেন ব্লাড। গভর্নর স্টীডকে বলুনগে আমরা এখন রওনা হচ্ছি। দুর্গ থেকে একটা গুলিও যদি ছোঁড়া হয় তো কর্নেল বিশপ মরবে। মই বেয়ে সোজা নেমে যান। নইলে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

সুড়সুড় করে পালাল লোক দুটো। কর্নেলের হম্বিতম্বি গায়ে মাখল না।

ক্রীতদাসদের জনা ছয়েকের জাহাজ সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান আছে। হ্যাঁগথর্পের নির্দেশে পাল তুলে ধীরে ধীরে বন্দর ত্যাগ করল ওরা। দুর্গের দিক থেকে কোন ঝামেলা করা হয়নি।

জাহাজ বন্দর থেকে বেরিয়ে এলে ব্লাড আবার বিশপের সঙ্গে কথা বলতে গেল।

সাঁতার জানেন, কর্নেল? আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করল।

ঝট করে চাইল কর্নেল। হলদেটে দেখাচ্ছে মস্ত চেহারাটা, চোখে আতঙ্ক। সে কিছু বলার আগে ব্লাড বলে চলল, আপনার কপাল ভাল আমি আমার বন্ধুদের মত রক্তলোভী নই। ওদেরকে বহু কষ্টে ঠেকাতে হয়েছে, নইলে আপনার এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকার কথা নয়। অবশ্য আপনার জন্যে অত ঝামেলা না করলেও চলত।

আসলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করছে ব্লাড। তার খুবই আনন্দ লাগত বিশপকে মাস্তুলের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিতে পারলে। কিন্তু একজনের কথা ভেবে ইচ্ছেটাকে ঝেটিয়ে বিদায় করল। হাজার হলেও কর্নেল বিশপ মিস অ্যারাবেলার চাচা।

সাঁতরে চলে যেতে পারবেন, বলল ব্লাড। মাত্র তো সিকি মাইল। আর তাছাড়া মোটা মানুষদের সাঁতরানোর সুবিধা অনেক, ভেসে থাকতে পারে।

কর্নেল বিশপ রাগ চেপে উঠে দাঁড়াল। ব্লাডের নির্দেশ মত জাহাজের রেলের সঙ্গে কাঠের তক্তা লাগানো হয়েছে।

নামতে হচ্ছে যে, কর্নেল, বলল ব্লাড।

তীব্র ঘৃণায় ব্লাডের দিকে চাইল কর্নেল। তারপর জুতো ছুঁড়ে ফেলে, কোট খুলে তক্তায় উঠে পড়ল। বিশ ফুট নিচের সবুজ পানির স্রোতের দিকে চেয়ে আত্মা শুকিয়ে এল ওর।

একটু হাঁটলেই চলবে, পেছন থেকে মৃদু হেসে বলল ব্লাড।

জাহাজের রেলের সঙ্গে ঝুলে চারদিকে এক ঝলক নজর বুলাল বিশপ। ডেকের সারিবদ্ধ লোকগুলো গতকালও ওর ভয়ে থরহরিকম্প ছিল। আর আজ দাঁত কেলিয়ে হাসছে, তামাশা দেখছে। হঠাৎ ভয়ের বদলে মেজাজ বিগড়ে গেল ওর। চিৎকার করে গালি দিল। তারপর তিন পা এগোতেই টাল হারিয়ে ঝপাত করে পানিতে গিয়ে পড়ল।

ভেসে উঠে বাতাস নেয়ার জন্যে আঁকুপাঁকু করতে লাগল। যুদ্ধজাহাজটি ততক্ষণে বেশ খানিকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু বিদ্রোহীদের সম্মিলিত কণ্ঠের গর্জন কানে এল স্পষ্ট; শেলের মত বিঁধছে ওর বুকে।

.

নয়

ডন ডিয়েগো ডি এসপিনোসার ঘুম ভেঙেছে, কেবিনের চারপাশে ক্লান্ত চোখ দুটো ঘুরাল। মাথায় ব্যথা। গুঙিয়ে উঠে আবার চোখ মুদল। ভাবতে চেষ্টা করছে। কাজটা সহজ হলো না, তবে এটুকু বুঝছে কোথাও কোন গণ্ডগোল হয়েছে। গতকালকের অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনে পড়ল। বার্বাডোজ দ্বীপ দখল করা থেকে শুরু করে জাহাজে পা রাখা পর্যন্ত সবই তো ঠিক ছিল। তারপর থেকে স্মৃতি আর ভাল কাজ করছে না।

এসময় দরজা খুলে গেল। ডন ডিয়েগো দেখতে পেল তার পোশাক পরা এক লোক কেবিনে ঢুকেছে। তাজ্জব বনল ডিয়েগো। লোকটি দরজা বন্ধ করে ডন ডিয়েগোর কাউচের কাছে এগিয়ে এল। লম্বায় ডনের চেয়ে কম হবে না সে।

ঘুম ভাঙল? স্প্যানিশে জিজ্ঞেস করল লোকটি। ডনের মাথায় হাত রেখেছে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল ও।

ব্যথা? জিজ্ঞেস করল আগন্তুক। ডনের কব্জিতে দুআঙুল রেখেছে।

আপনি ডাক্তার?

বলতে পারেন, রোগীর পালস দেখে বলল লোকটি। কব্জি ছেড়ে দিয়ে জানাল, ভয়ের কিছু নেই।

অতিকষ্টে উঠে বসল ডন ডিয়েগো।

আপনি কে? বেঁকিয়ে উঠল ও। আমার কাপড় পরে আমার জাহাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?

কালো ভ্রূ জোড়া সামান্য উঠে গেল, লোকটি ঠোঁটের কোণে হাসছে।

ভুল বললেন। এটা আপনার নয়, আমার জাহাজ। আর এ কাপড়ও আমার।

তোমার জাহাজ! চেঁচাল ডন। তোমার কাপড়! কিন্তু তাহলে… পরিচিত কেবিনটি আরেকবার জরিপ করল। আমি কি পাগল হয়ে গেছি? শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল। এটা আমাদের জাহাজটা নয়?

হ্যাঁ, আপনাদেরই।

তবে… স্প্যানিশ লোকটি ঘোর বিপাকে পড়েছে। তুমি আবার বলবে না তো তুমিই ডন ডিয়েগো?

না, না, আমার নাম ব্লাড-ক্যাপ্টেন পিটার ব্লাড। আর এই জাহাজ– কাপড় সবই জিতে নিয়েছি আমি। আপনি এখন আমার বন্দী!

ক্যাপ্টেন ব্লাড সব ব্যাখ্যা করল। স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল মাথার পেছনে হাত রাখল। কবুতরের ডিমের মত ফুলে রয়েছে জায়গাটা। এতে ব্লাডের কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। ব্লাডের হাসিমাখা মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল ও।

আমার ছেলে? ও কোথায়? ও-ও তো আমার সঙ্গে জাহাজে উঠেছে।

ও নিরাপদেই আছে। নৌকার ক্রু, গোলন্দাজ আর তার দলবলের মত সে-ও আমার বন্দী।

ডন ডিয়েগো গদিতে গা এলিয়ে দিল। দৃষ্টি তার ব্লাডের চেহারায়। ভাগ্য প্রবঞ্চমা করেছে, ফলে এবারের অ্যাডভেঞ্চার ব্যর্থ হয়ে গেল। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়া ছাড়া এখন উপায় নেই।

তো এখন কি হবে, সিনর ক্যাপ্টেন? শান্তস্বরে জানতে চাইল।

ডাণ্ডার বাড়িতে মারা পড়লেই বেঁচে যেতেন, বলল ব্লাড। এখন আপনাকে একরকম ধুকে ধুকেই মরতে হবে।

তাই? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করল ভন ডিয়েগো। ক্যাপ্টেন ব্লাড লম্বা টেবিলটির কোণের দিকে বসল।

আমি গাধা নই, বলল ও, আপনি এবং আপনার দশ জন জ্যান্ত নাবিক আমাদের জন্যে একটা হুমকি। আমি অবশ্য অযথা রক্তপাত চাই না। হাজার হলেও আপনারা বার্বাডোজ আক্রমণ না করলে আমাদের ভাগ্যে এমন সুযোগ জুটত না. সেজন্যে খানিকটা কৃতজ্ঞতাবোধ তো আছেই। কিন্তু, আমাদের হাতপা বাঁধা, বুঝতেই পারছেন।

কথাটা মানতে পারলাম না, বলল স্প্যানিশ।

আপনি কোন উপায় বাতলে দিতে পারলে আমি অবশ্যই ভেবে দেখব।

ডন ডিয়েগো তার চোখা গোফজোড়া একবার মুচড়ে নিল।

কটা ঘণ্টা সময় দিন। এ মুহূর্তে মাথায় অসম্ভব ব্যথা- সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

উঠে পড়ল ব্লাড। আধ ঘণ্টা সময় পাবেন, বলল সে। এর মধ্যে কিছু যদি ভেবে বার করতে না পারেন; তো জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। বাউ করে বেরিয়ে গেল ও। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ভাবতে বসল উন। প্রতিমুহূর্তে চেহারায় চিন্তার ছাপ গম্ভীর হচ্ছে। ঠিক আধ ঘণ্টা পরে দরজা আবার খুলে গেল। লম্বা শ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসল ডন।

একটা বিকল্প মাথায় এসেছে, বলল ও। তবে সেটা আপনার দয়ার ওপর নির্ভর করছে। আপনি আমাদেরকে কোন একটা দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে যান।

মাথা নাড়ল ব্লাড। সেটা সম্ভব নয়, ধীরে বলল ও।

তেমন ভয়ই করছিলাম, আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ডন। আমার আর কিছু বলার নেই।

ব্লাডের দৃষ্টিতে বন্দীর প্রতি শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে।

মরার ভয় নেই আপনার? জানতে চাইল।

অবান্তর প্রশ্ন- অপমানজনক, মাথা উঁচু করে বলল ডিয়েগো।

তবে প্রশ্নটা অন্যভাবে করি: বাঁচতে চান না?

চাই। আরও বেশি চাই আমার ছেলে বেঁচে থাকুক। কিন্তু সেজন্যে কারও হাতে পায়ে ধরব না।

টেবিলের কোণে আবার বসেছে ব্লাড। চাইলে সবার জীবন ভিক্ষে পেতে পারেন।

কি রকম?

জানালা দিয়ে চেয়ে দেখুন, দিগন্তে মেঘের মত একটা জিনিস দেখবেন। ওটাই বার্বাডোজ, বহু পেছনে ফেলে এসেছি। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ওই দ্বীপের সঙ্গে দূরত্ব যদূর সম্ভব বাড়ানো। এখন মুশকিল হচ্ছে নেভিগেশন সম্বন্ধে আমার দলে সবচেয়ে যে অভিজ্ঞ সে অসুস্থ। আমি জাহাজ চালাতে পারি, দলের আরও দুএকজনও পারে। কিন্তু সমুদ্রে পথ খুঁজতে হয় কিভাবে জানি না। ওলন্দাজ বসতি কুরাকাওতে সেজন্যেই যত জলদি সম্ভব পৌঁছতে চাই। আপনাদের গাইডেন্স দরকার। আমাদের ওখানে পৌঁছে দিলে আপনাদের সবাইকে ছেড়ে দেব। কথা দিচ্ছি।

ডন ডিয়েগো মাথা নিচু করে জানালার কাছে হেঁটে গেল। পানিতে রোদ খেলা করছে। এটা পর জাহাজ। ইংরেজ কুকুরগুলো কৌশলে তার কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছে। এতেই তো শেষ হচ্ছে না। ওলন্দাজ বসতিতে এদের পৌঁছে দেয়ার পর চিরতরে প্রিয় জাহাজটিকে হারাতে হবে। এ তো গেল এক দিক। অন্যদিকে নির্ভর করছে ষোলোজনের জীবন। চোদ্দজনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না

ও। কিন্তু বাকি দুজন তো সে নিজে আর তার প্রাণপ্রিয় সন্তান।

আমি রাজি, শেষ পর্যন্ত বলতে হলো ওকে।

.

দশ

ওলন্দাজ বসতিতে পৌঁছার পর একটি দাঁড়টানা নৌকায় তুলে দেয়া হলো স্প্যানিশদেরকে। যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারে। ইংরেজদেরকে ইচ্ছেমত গাল-মন্দ আর অভিশাপ দিয়ে বিদায় নিল ওরা। বলে গেল প্রতিশোধ নেবে।

জেরেমি পিট এখন জাহাজের হাল ধরেছে। ক্যাপ্টেন ব্লাড সিদ্ধান্ত নিল বোম্বেটেদের স্বর্গরাজ্য টরটুগাতে আশ্রয় নেবে। ওখানে ফরাসি সরকারের ছত্রছায়ায় জলদস্যরা নির্বিঘ্নে তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে।

ব্লাড প্রথমে চেয়েছিল ফ্রান্স বা হল্যান্ডে চলে যাবে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়তেও মন পুরোপুরি সায় দেয় না। অ্যারাবেলা বিশপের কথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। মেয়েটির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। কিন্তু এ-ও জানে, ওকে পাওয়া কপালে নেই। তাই বলে ওকে আর দেখতে পাবে না এ কথা ভাবতেও খারাপ লাগে। ইউরোপে পৌঁছেই বা করবে কি ও? ও একজন ক্রীতদাস, পলাতক আসামী বই তো নয়। তারচেয়ে বরং সমুদ্রেই জীবন কাটিয়ে দেয়া ভাল। যাদের কেউ নেই, কিছু নেই, তাদের সমুদ্রই আপন।

যাহোক, টরটুগার জলদস্যুদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যোগ দিল ব্লাড।

টরটুগার ফরাসি গভর্নর আঁসিয়ে ডি ওগেরন স্প্যানিশ যুদ্ধজাহাজটির জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে রাডকে টাকা ধার দিলেন। ব্লাড জাহাজটির নাম পাল্টে রাখল অ্যারাবেলা। বিশজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর সঙ্গে আরও পছন্দসই ষাটজনকে বাছাই করে দলভুক্ত করল। কঠোর আইন তার। দলভুক্ত সকলকে নেতার নির্দেশ একবাক্যে পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে যার আপত্তি আছে তার দলে যোগ দেয়ার কোন অধিকার নেই।

ডিসেম্বরের শেষাশেষি আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত জাহাজ নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়ল ব্লাড। ফিরল মে মাসে। ততদিনে ক্যাপ্টেন পিটার ব্লাডের নাম ছড়িয়ে পড়েছে ক্যারিবিয়ান সাগরে। এ কয়মাসে একটি স্প্যানিশ যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে লড়াই করে জিতেছে ওরা। আরেকটি স্প্যানিশ জাহাজে হামলা চালিয়ে জাহাজের সব মুক্তা লুটে নিয়েছে।

বর্তমান স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল ডন মিগুয়েল ও তার ভাতিজা ডন এস্তেবান ব্লাডকে পাকড়াও করতে বদ্ধপরিকর। ওদের জন্যে ব্যাপারটি পারিবারিক বিদ্বেষ। কারণ ডন ডিয়েগো কুরাকাও পৌঁছানোর আগেই মারা গেছে। তার ভাই আর ছেলে এজন্যে ব্লডের ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। প্রতিশোধ নেবে।

একদিন ব্লাড সমুদ্রতীরবর্তী একটি সরাইখানায় বসে রাম গিলছে, সঙ্গে হ্যাঁগথর্প আর উলভারস্টোন, এক লোক ওর দিকে এগিয়ে এল।

আপনি কি ক্যাপ্টেন ব্লাড?

জবাব দেয়ার আগে একবার চাইল ব্লাড। বোঝা যায় লম্বা লোকটি গায়ে শক্তি ধরে, নিষ্ঠুর মুখটা রোদে পোড়া। নোংরা আঙুলে বড়সড় একটা হিরের আঙটি, কানে সোনার দুল।

হ্যাঁ, আমিই ক্যাপ্টেন ব্লাড।

গুড, ইংরেজিতে বলল লোকটি। কারও তোয়াক্কা না করে টেবিলে বসে পড়ল। আমি লিভাসে, জানাল ও, আমার নাম শুনেছেন বোধহয়।

এ লোকের নাম তিনজনই শুনেছে। বিশটি কামানওয়ালা একটি জলদস্যু জাহাজের কমান্ডার। সপ্তাহ খানেক আগে বন্দরে নোঙর ফেলেছে এর জাহাজ। নর্দার্ন হিসপ্যানিওলার একদল ষাঁড় শিকারী জাহাজটির ক্রু। স্প্যানিশদেরকে ঘৃণা করে ওরা। লিভাসে জলদস্যু হিসেবে কুখ্যাত। তাছাড়া আরও একটি গুণ আছে তার। সে মেয়ে পটাতে ওস্তাদ। লোকে বলে গভর্নরের মেয়ে ম্যাডামজেল ডি ওগেরন ওর প্রেমে অন্ধ। লিভাসে মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। গভর্নর অবশ্য রাজি হননি, ওকে স্রেফ দরজা দেখিয়ে দিয়েছেন। ক্রুদ্ধ লিভাসে শপথ করে এসেছেগভর্নরের মেয়েকে বিয়ে করবেই; বলেছে গভর্নরকে পরে পস্তাতে হবে।

তো সেই লিভাসে এখন ব্লাডের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে। ব্লাডকে সে তার তরোয়াল, জাহাজ ও সঙ্গী নাবিকদের পর্যন্ত সাধছে। ব্লাডও মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেলিভাসের সাহায্য সহযোগিতা পেলে উপকার হবে। কিন্তু লোকটিকে পছন্দ নয় তার, ফলে চটজলদি কিছু জানাল না।

সে বলল, প্রস্তাবটি ভেবে দেখবে। হ্যাঁগথর্প.ও উলভারস্টোনের কিন্তু ফরাসি লোকটাকে অতখানি অসহ্য মনে হয়নি। ওরা দুজন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ব্লাডকে রাজি করাল। এক সপ্তাহ পরে চুক্তিপত্রে সই করল লিভাসে আর ব্লাড। সিদ্ধান্ত হলো, দুটো জাহাজ লুণ্ঠিত সমস্ত মালামাল সমান দুভাগে ভাগ করে নেবে। দুটো জাহাজ সর্বক্ষণ এক সঙ্গে কাজ না করলেও এই শর্তের খেলাপ হবে না। কেউ যদি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল করে তো তাকে ফাঁসিতে লটকানো হবে।

যাহোক; অভিযানে বেরোনোর দিন সন্ধেয় অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে গেল লিভাসে। ম্যাডামজেল ডি ওগেরনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্যে পাঁচিল টপকে গভর্নরের বাগানে ঢোকার চেষ্টা করেছিল সে। গার্ড দুবার গুলি করায় জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তবে চিৎকার করে জানিয়ে এসেছে ফিরেই প্রেমিকাকে ঘরে তুলে নেবে।

সে রাতে নিজের জাহাজ লা ফোদরে-তে সে যখন ঘুমিয়ে কাদা তখন এল ক্যাপ্টেনব্লাড। কটা বিষয়ে চূড়ান্ত আলাপ সেরে নেবে। কথাবার্তা শেষে জাহাজে ফেরার পথে মন ভারী হয়ে গেল ব্লাডের। লিভাসে লোকটি পিছল ধরনের।

সন্দেহ দানা বাঁধছে ওর মনে। কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। জাহাজে ফিরতেই উলভারস্টোনের সঙ্গে দেখা হলো।

তোমাদের কথায় ওই লোকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছি। আমার নিজের কোন ইচ্ছে ছিল না। মনে হচ্ছে আমাদের ক্ষতিই হবে।

একচোখা দৈত্য তার চোখ ঘুরিয়ে দাঁত বিকশিত করল। বেঈমানী করলে কুত্তাটার ঘাড় ভেঙে দেব না!

বেঁচে থাকলে তবে তো, বলল ক্যাপ্টেন। যাকগে, কাল সকালে রওনা দেব, এই বলে নিজের কেবিনে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *