ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো / অনুবাদ : প্রিন্স আশরাফ
উৎসর্গ: এনডিএলের জন্য… যে এই মিরাকল ঘটিয়েছে… ক্রিস্টিনার জন্য… যে এই মিরাকলের একজন আর ব্রাইডাকে…
অনুবাদকের উৎসর্গ: প্রিয় মানুষ কাজল ঘোষ
.
দশটি রূপার মুদ্রা রয়েছে নারীর,
যদি সে তাদের একটি হারায়,
প্রদীপ জ্বালিয়ে, বাড়ি ঝেড়ে-মুছে,
খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত যত্নসহকারে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় না কি? মুদ্রাটি খুঁজে পেলে, বন্ধুদের ডাকে
প্রতিবেশীদের খবর দেয়
বলে আনন্দ করো
আমি মুদ্রাটি খুঁজে পেয়েছি
যেটি হারিয়ে গিয়েছিল।
লুক: ১৫ ৮-৯
.
সতর্কতা
আমার বই পিলগ্রিমে আমি দুই ধরনের অনুশীলনের কথা বলেছি। নাটকের কাজ করার সময় আমি তা শিখেছিলাম। যদিও ফলাফল ছিল একই। সত্যিই বলছি, আমি আমার শিক্ষকের কাছ থেকে মারাত্মক তিরষ্কৃত হয়েছিলাম। সহজতর অথবা দ্রুততর পদ্ধতি থাকতে পারে, তা কোনো ব্যাপার নয়। যাই হোক না কেন, রাতিনীতি কখনো বদলে যায় না। শিক্ষক বলেছিলেন।
এ কারণে, ব্রাইডায় বর্ণিত কয়েকটি চান্দ্র সম্পর্কিত উপাসনা শতকের ওপর চাঁদের রীতিনীতিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ জাতীয় রীতিনীতি অভিজ্ঞতা আর অনুশীলনের দরকার হয়। এসব উপাসনা নির্দিষ্ট তত্ত্বাবধানের অধীনে ছাড়া বিপজ্জনক হতে পারে, যা অভিজ্ঞতা আর অনুশীলনের প্রয়োজন হতে পারে।
—পাওলো কোয়েলহো
এ বইয়ে বর্ণিত কালো শক্তির আহ্বান করার কেউ চেষ্টা করবেন না। মানব মস্তিষ্ক অতি বিচিত্র কারণে সাজেশনের বশীভূত হতে পারে। ট্রেন্স অবস্থায় মস্তিষ্ক বিচিত্র কার্যকলাপ করতে পারে। –অনুবাদক
.
পূর্বকথা
আমরা লোড্রেসের একটা ক্যাফেতে শেষ রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। রোমের পবিত্র রাস্তায় একদল তীর্থযাত্রীর সাথে ছিলাম আমি। আমরা ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তি অনুসন্ধানের জন্য অনেক দিন ধরেই ভ্রমণরত ছিলাম। মেয়েটির নাম ছিল ব্রাইডা অফার্ন। সেও এমনই এক দলের সাথে ছিল।
এ রকম এক রাতে, আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারকা আকৃতির পথ ধরে পাইরিনিসের সেই মঠে গিয়েছিল কি না।
আমি কখনো ওখানে ছিলাম না। সে উত্তর দিয়েছিল।
আমি চমকে উঠেছিলাম। মেয়েটি গিয়েছিলো। কারণ তার ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তি রয়েছে।
সব পথ রোমের দিকেই যায়, এই পুরনো প্রবাদটি দিয়ে ব্রাইডা বলতে শুরু করল।
ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি যেকোনো জায়গায় জেগে উঠতে পারে। আমি আয়ারল্যান্ড থেকে রোমে এসেছি।
আমাদের পরপর কয়েকবারের মিটিংয়ে সে আমাকে তার অনুসন্ধানের গল্প বলেছিল। তার গল্প বলা শেষ হলে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোনো দিন এটা নিয়ে লিখতে পারি কি না।
সে প্রথমে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু যখনই আমরা পরেরবার দেখা করেছিলাম, সে বাধ সেধেছিল। ব্রাইডা এ গল্পের সাথে জড়িতের নামগুলো পরিবর্তন করতে আমাকে অনুরোধ করেছিল। জনগণ কোন ধরনের বই পড়ে এবং কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, তা জানতে চেয়েছিল।
আমার কোনো ধারণা নেই। আমি বলেছিলাম। কিন্তু আমি মনে করি, শুধুমাত্র এ কারণেই তোমার এমন বাধা দেয়াটা ঠিক হবে না।
তোমার কথাই ঠিক। ব্রাইডা বলেছিল। কারণ আমার কাছে ব্যক্তিগত গল্প মনে হলেও, এ কথা নিশ্চিত যে, অন্য কেউ এর চেয়ে আরো বেশি কিছু জানতে পারে।
সেই ঝুঁকিটা আমাদের একসাথে নিতে হবে, ব্রাইডা। রীতিনীতি থেকে অজ্ঞাতনামা লেখা বলে, প্রত্যেক ব্যক্তি জীবনে দুই মনোভাবের একটি গ্রহণ করতে পারে: গাছপালা রোপণ করতে পারে অথবা নির্মাণ করতে পারে। নির্মাতারা তাদের কাজের জন্য বছরের পর বছর লাগাতে পারে। কিন্তু একদিন, তারা তাদের কাজ শেষ করে। তারপর তারা নিজের দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে। ভবন নির্মাণ শেষ হলে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে।
যারা গাছ রোপণ করে তাদের কথায় আসা যাক। ঝড় বর্ষা আর ঋতুর পরিবর্তনে তারা কখনো বিশ্রাম নেয় না। কিন্তু ভবনের মতো গাছপালা কখনো বাড়তে থাকা থামিয়ে দেয় না। বাগানকারীদের নিয়মিত পরিচর্যার বদলে বেড়ে ওঠা গাছপালাই বাগানকারীদের মহৎ অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ করে দেয়।
বাগানকারীরা একে অন্যকে চিনতে পারে। কারণ তারা জানে, প্রতিটি চারার বেড়ে ওঠার ইতিহাস গোটা জগতের মাঝে সুপ্ত।
—-লেখক
.
ব্রাইডা
আয়ারল্যান্ড
আগস্ট ১৯৮৩-মার্চ ১৯৮৪
সামার অ্যান্ড অটম
আমি জাদুবিদ্যা শিখতে চাই তরুণী মেয়েটা বলল। ম্যাগাস (প্রাচীনকালে জাদুকর বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের ম্যাজাই বলা হতো। তারা একবচনে ম্যাগাস। এখানে ম্যাগাসকে প্রজ্ঞাবান পুরুষ হিসেবে দেখালেও জাদুকর বা ব্যক্তিবিশেষের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হবে– অনুবাদক।) বা জাদুকর তরুণী মেয়েটিকে দেখছিলেন। রংচটা জিনস, টি-শার্ট পরনে। লাজুক মেয়েরা যেভাবে লজ্জা ভুলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে তাকায়, সেভাবে তাকিয়ে ছিল। আমার বয়স অবশ্যই ওর দ্বিগুণ হবে; ম্যাগাস বা জাদুকর ভাবলেন। কিন্তু এও জেনে গেলেন, তিনি তার আত্মার সাথীটির দেখা পেয়েছেন।
আমার নাম ব্রাইডা, তরুণী মেয়েটি বলল। আগেই নিজের পরিচয় না দেবার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। এই মুহূর্তটির জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি। আমি যে রকম ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি নার্ভাস হয়ে গেছি।
তুমি কেন ম্যাজিক শিখতে চাও? জাদুকর জিজ্ঞাসা করলেন।
যাতে আমি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। জীবনের রহস্য বুঝতে পারি। অকাল্ট পাওয়ার বা গূঢ় গুপ্ত শক্তি সম্বন্ধে শিখতে পারি। কীভাবে অতীত আর ভবিষ্যতে ভ্রমণ করতে হয় তা জানতে পারি।
এই প্রথম কেউ এমন এক অনুবোধ নিয়ে তার কাছে এসেছে তা নয়। একটা সময় ছিল যখন তিনি রীতিনীতির শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন, কয়েকজন ছাত্রকে শিক্ষা দিতেন। বিশ্বাস করতেন তার আশপাশে যারা থাকে তাদের বদলে দিলে তারা বিশ্বকে বদলে দিতে পারবে। কিন্তু তিনি ভুল করেছিলেন। রীতিনীতি কখনো কোনো ভুল করতে পারে না।
তুমি কি মনে করো না, এসবের জন্য তুমি অনেক বেশি তরুণ?
আমার বয়স একুশ বছর। ব্রাইডা বলল। আমি যদি ব্যালে ড্যান্স শুরু করতে চাইতাম, আমাকে বেশি বয়স্কই বিবেচনা করত।
জাদুকর মেয়েটিকে তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিলেন। তারা নীরবে বনের মধ্য দিয়ে যেতে লাগল। মেয়েটি সুন্দরী, জাদুকর ভাবলেন। গাছের ছায়া দীর্ঘতর। দিগন্তে সূর্য অস্তগামী। কিন্তু আমি ওর চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী। আর এ কারণে আমাকে দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে।
ব্রাইডা পাশে চলা মানুষটার নীরবতায় বিরক্ত। এমনকি মানুষটি তার শেষ মন্তব্যে কোনো রকম সাড়া দেয়নি। বনের পথ বেশ ভেজা ভেজা। ঝরাপাতায় ঢাকা। খুব দ্রুতই ছায়ার আকৃতি বদলে যাচ্ছে। রাত নেমে আসছে। চারদিকে শীঘ্রই অন্ধকার নেমে আসবে। তাদের সঙ্গে কোনো ফ্লাশলাইট নেই।
ওকে আমার বিশ্বাস করতে হবে, ব্রাইডা মনে মনে বলল। যদি বিশ্বাস করি, উনি আমাকে জাদুবিদ্যা শেখাতে পারেন, তাহলে আমাকে এও বিশ্বাস করতে হবে, উনি বনের মধ্য দিয়ে আমাকে গাইড করে নিয়ে যেতে পারবেন।
তারা হেঁটে চলল। জাদুকর উদ্দেশ্যহীনভাবে একপাশ থেকে আরেক পাশে জায়গা বদল করছিলেন। এমনকি পথের মাঝে কোনো বাধা না থাকলেও দিক বদলে ফেলছিলেন। তারা একই স্থান দিয়ে একটি বৃত্তাকার পথে তিন-চারবার হেঁটে গেল।
সম্ভবত উনি আমাকে পরীক্ষা করছেন। ব্রাইডা এর শেষ পরিণতি দেখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমনকি নিজেকে বলার চেষ্টা করল, কিছু ঘটছে, এমনকি এই চক্রাকারে ঘোরা–সব কিছুই পুরোপুরি স্বাভাবিক নিয়মে চলছে।
ব্রাইডা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছে। সে এর চেয়ে আরো বেশি কিছু আশা করেছিল। ডাবলিন এখান থেকে নব্বই মাইল দূরে। গ্রামের বাস খুব অস্বস্তিকর। অসময়ে ছেড়ে চলে যায়। সে খুব সকাল সকাল উঠে পড়েছিল। তিন ঘণ্টা ধরে ভ্রমণ করে এসেছে। গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসা করেছে কোথায় জাদুকরকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। জাদুকরের মতো একজন অদ্ভুত মানুষের কাছ থেকে সে কী পেতে যাচ্ছে, এর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। অবশেষে, কেউ একজন তাকে বলেছিল বনের যে কোনদিকে দিনের সময় সাধারণত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি যে এর মধ্যে গ্রামের একজন মেয়েকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, সে সম্বন্ধে কেউ কোনো সতর্ক করেনি।
তিনি বেশ মজার মানুষ। ব্রাইডা ভাবল। তারা এখন ওপরের দিকে উঠছে। আশা করছিল সূর্য আকাশে আরো কিছুক্ষণ থাকবে। ভেজা পাতায় পা পিছলে পড়ার ভয়ে ভীত।
তুমি সত্যিই কেন জাদুবিদ্যা শিখতে চাও?
ব্রাইডা খুশি, নীরবতা ভঙ্গ হয়েছে। সে আগের মতো একই উত্তর দিল।
কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হননি।
সম্ভবত তুমি জাদু শিখতে চাও কারণ ব্যাপারটা রহস্যময় এবং গোপন। এর দ্বারা যেসব উত্তর পাওয়া যায় তা কয়েকজন মানুষের পুরো জীবনকাল ধরে খুঁজে মরতে হয়। তা না হলে জাদুবিদ্যার রোমান্টিক অতীত থাকার কারণেও হতে পারে।
ব্রাইডা কিছুই বলল না। জানে না কী বলতে হবে। এ রকম কোনো উত্তর দিয়ে বসতে পারে, যা জাদুকর পছন্দ নাও করতে পারেন। এর চেয়ে আগের মতো চুপচাপ পথ চলাই তার কাছে শ্রেয় মনে হলো।
শেষ পর্যন্ত তারা একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছাল। গোটা বন অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। ওখানকার মাঠ পাথুরে, সবুজের সমারোহ নেই। কিন্তু অন্ততপক্ষে পথটা অনেক কম পিচ্ছিল। ব্রাইডা কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই জাদুকরকে অনুসরণ করতে পারছে।
জাদুকর সুউচ্চ চূড়ায় গিয়ে বসলেন। ব্রাইডাকেও বসতে বললেন।
অন্যরাও আগে এখানে এসেছে। জাদুকর বললেন। তারাও আমার কাছ থেকে জাদুবিদ্যা শিখতে এসেছিল। যা তাদের শেখানো দরকার আমি তার সব শিখিয়েছি। সে জন্য মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল। এখন আমি একা থাকতে চাই, পর্বত আরোহণ করতে চাই, বাগান করতে চাই আর ঈশ্বরের কাছাকাছি থাকতে চাই।
তা সত্যি নয়। ব্রাইডা উত্তর দিল।
কী সত্যি নয়? তিনি বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনি হয়তো ঈশ্বরের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে থাকতে চান কিন্তু আপনি একা হতে চান, তা সত্যি নয়।
ব্রাইডা নিজের কথায় অনুতপ্ত হলো। হঠাৎ করে আবেগের বশে বলে ফেলেছে। এখন তা শুধরে নেয়ার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। সম্ভবত অনেকেই একা হতে চায়। সম্ভবত নারীদের পুরুষের দরকার, পুরুষের যতটা নারীর দরকার।
জাদুকরের বিরক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি শান্তভাবেই আবার কথা শুরু করলেন।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি। তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার উত্তরের ব্যাপারে সৎ থাকবে। যদি আমাকে সত্যটা বলল, তুমি যা শিখতে চাও, আমি তোমাকে তা শিখিয়ে দেব। আর মিথ্যা বললে, তুমি আর কখনো এই বনে ফিরে আসবে না।
ব্রাইডা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তিনি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছেন। তাকে সাদাসিধেভাবে সত্যিটা বলতে হবে, এটাই সব।
ব্রাইডার চিরন্তন ধারণা, একজন শিক্ষক একজনকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে কোনো কঠিন জিনিস দাবি করবে।
ধরো, আমি যা শিখেছি তা তোমাকে শেখাতে শুরু করলাম। তিনি ব্রাইডার দিকে তাকিয়ে বললেন, ধরো, আমি তোমাকে প্যারালাল ইউনিভার্স, যা আমাদের ঘিরে আছে তা দেখাতে শুরু করলাম। দেব-দেবী, প্রকৃতির জ্ঞান, সূর্যের রীতিনীতির রহস্য, চাঁদের রীতিনীতি সব শেখালাম। তারপর একদিন, তুমি কিছু খাবার কিনতে শহরে গেলে এবং পথিমধ্যে তোমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে তোমার দেখা হলো।
আমি জানি না কীভাবে তাকে চিনতে পারব। ব্রাইডা ভাবল। কিন্তু কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিল। এর চেয়ে আরো কঠিন কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে সে কল্পনা করছিল।
তোমার প্রেমিকও তোমার মতো একই রকম অনুভব করছিল। তোমার কাছে এলো। তোমরা একে অপরের প্রেমে পড়লে। তুমি আমার সঙ্গে তোমার অধ্যয়ন চালিয়ে যাও। দিনের বেলায়, আমি তোমাকে সৌরজগতের জ্ঞান শিক্ষা দেব, আর রাত্রিতে সে তোমাকে ভালোবাসার জ্ঞান শিক্ষা দেবে। কিন্তু এমন এক মুহূর্ত আসবে, যখন এ দুটি ব্যাপারের সহাবস্থান আর সম্ভব হবে না। তখন তোমাকে একটিকে বেছে নিতে হবে।
জাদুকর মুহূর্তের জন্য থামেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি মূল প্রশ্নটা করার আগে, তরুণীর উত্তর কী হতে পারে ভেবে ভীত হয়ে পড়লেন। সেই সন্ধ্যায় তরুণীর আগমণ তাদের দুজনের জীবনের অন্য মুহূর্তের সূচনা করেছিল। তিনি তা জেনেছিলেন, কারণ তিনি রীতিনীতি এবং শিক্ষকের অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছিলেন। তরুণীটির যে রকম তাকে প্রয়োজন, তেমনি তারও মেয়েটিকে প্রয়োজন। কিন্তু তাকে প্রশ্নের যথাযথ সত্য উত্তর দিতে হবে। এটাই একমাত্র শর্ত।
এখন পুরোপুরি সতোর সাথে এ প্রশ্নের উত্তর দাও। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন। তুমি কি তাহলে যা কিছু শিখেছ সব ছেড়ে দেবে? তোমার ভালোবাসার মানুষটির জন্য সমস্ত সম্ভাবনা এবং জাদূর জগতের রহস্যময়তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে?
ব্রাইডা অন্যদিকে তাকালো। পর্বত আর জঙ্গল চারপাশে। নিচের গ্রামের দিক থেকে আলো আসতে শুরু করেছে। শীঘ্রই, পরিবারগুলো রাতের খাবার খেতে টেবিলের ধারে একসাথে বসবে। তারা সতোর সাথে কঠোর পরিশ্রম করে। তারা ঈশ্বরকে ভয় করে এবং তাদের সহযোগী মানুষদের সাহায্য করার চেষ্টা করে। তারা এই সমস্ত জিনিস করে, কারণ ভালোবাসা কী তারা জেনে গেছে। তাদের বসবাস করার একটি কারণ, তারা সব কিছু বুঝতে পারে, সূর্য এবং চাঁদের রীতিনীতিও তারা বুঝে ফেলছে।
আমার অনুসন্ধান এবং ব্যক্তিগত আনন্দের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য দেখি না আমি। সে বলল।
আমার প্রশের জবাব দাও। তিনি ব্রাইডার দিকে তাকিয়ে আছেন। তুমি কি ওই মানুষটার জন্য সব কিছু ছেড়ে দিতে পারবে?
ব্রাইডার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। এটা কোনো প্রশ্ন নয়, পছন্দের জিনিস বেছে নেয়ার ব্যাপার। মানুষ তার সারা জীবনে এর চেয়ে কঠিন পছন্দের মুখোমুখি কখনো হয় না। এ ব্যাপারে আগেও সে অনেক চিন্তাভাবনা করেছে। এক সময় এ পৃথিবীতে তার নিজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ছিল না। তার কয়েকজন ছেলেবন্ধু ছিল। সব সময় বিশ্বাস করত সে সবাইকে ভালোবেসে। এক মুহূর্ত পরেই প্রেম উবে যাওয়ার ব্যাপারটা বিস্ময়কর। সে যাবৎ আহরিত সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে যখন বুঝে পেল প্রেমের মতো জটিল আর কিছু নেই, ঠিক তারপর পর…নিজের চেয়ে সামান্য বেশি বয়সের একজনের প্রেমে পড়ে গেল। তার এই নতুন প্রেমিক পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়ন করছিল। তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। পুনরায় সে প্রেমে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। আবেগের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। কিন্তু আবারও হতাশ হয়ে পড়ল সে। কোনো কিছুর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। তারপরও, এটাই তার জীবনের মহত্তম জুয়াখেলা।
ব্রাইডা জাদুকরের দষ্টিসীমা এড়িয়ে যাচ্ছিল। জাদুকরের চোখ গ্রামের দিক থেকে ভেসে আসা মিটিমিটি আলোর দিকে। মানুষ শুরু থেকেই প্রেমের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব বুঝতে চেষ্টা করে।
আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। ব্রাইডা শেষ পর্যন্ত বলল।
সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, তিনি কখনো মানুষের হৃদয়ের কথা বুঝতে পারবেন না, ব্রাইডা ভাবল। তিনি শক্তি আর জাদুবিদ্যার রহস্য জানেন, কিন্তু মানুষকে জানেন না। জাদুকরের এলোমেলো চুল, সূর্যের রশ্মিতে পোড়া তৃক এবং পর্বতে আরোহণের মতো শারীরিক সক্ষমতা আছে। তিনি খুবই আকর্ষণীয়, তার চোখের ভেতর দিয়ে আত্মা পূর্ণ প্রকাশ পায় এবং তাকে সাধারণ মানবিক হওয়ার আবেগের দ্বারা পুনরায় হতাশ হতে হবে। ব্রাইডা নিজেও হতাশ, কিন্তু মিথ্যা বলেনি।
আমার দিকে তাকাও। জাদুকর বললেন।
ব্রাইডা লজ্জা পেলেও কথামতো কাজ করল।
তুমি সত্যিটা স্বীকার করেছ। আমি তোমার শিক্ষক হব।
আঁধার ঘনীভূত হয়ে এলো। চাঁদহীন আকাশে তারকারাজি উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল। একজন অপরিচিত মানুষকে নিজ জীবনের গল্প বলতে ব্রাইডার দুই ঘণ্টা সময় লেগে গেল। জাদুবিদ্যার ওপর তার আগ্রহের ঘটনাগুলোই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল সে। তার শৈশব দিব্যদৃষ্টি, সতর্কবার্তা, ভবিষ্যদ্বাণী, অভ্যন্তরীণ ডাক, কিন্তু কিছুই খুঁজে পেল না। সে শুধু ভেতরে ভেতরে সহজাতভাবেই এগুলো অনুভব করত, এটাই সব। আর এ কারণেই জ্যোতিষবিদ্যার কোর্স নিয়েছিল। ট্যারট আর সংখ্যাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেছিল।
ওগুলো নিছক ভাষাই। জাদুকর বললেন, আর ওগুলোই সব নয়। জাদুবিদ্যা মানুষের হৃদয়ের সব ভাষায় কথা বলতে পারে।
তাহলে জাদুবিদ্যা কী? ব্রাইডা জিজ্ঞাসা করল।
অন্ধকারের মধ্যেও ব্রাইডা বুঝতে পারল জাদুকর তার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিজের চিন্তায় মশগুল। সম্ভবত উত্তর খুঁজছেন।
জাদুবিদ্যা এক ধরনের সেতু, তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, এমন এক সেতু, যাতে দৃশ্যমান জগৎ থেকে অদৃশ্যমান জগতে বিচরণ করা যায়। আর দুই জগৎ থেকেই অনেক কিছু শেখা যায়।
আর কীভাবে এই সেতু পার হতে শিখব?
এই সেতু পার হতে তোমার নিজেকেই পথ আবিষ্কার করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব পথ রয়েছে।
এর দুটি রূপ আছে। ম্যাগাস উত্তর দিলেন। সূর্যের রীতিনীতি, যা আমাদের চারপাশের স্থান এবং বিশ্বের মধ্য দিয়ে গোপন শিক্ষা প্রদান করে। চাঁদের রীতিনীতি, যা সময় এবং বস্তুর মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রদান করে।
ব্রাইডা বুঝতে পারল। সূর্যের রীতিনীতিতে রাত্রি, আকাশে তারা, গাছগুলো, শীতল হাওয়া। চাঁদের রীতিনীতিতে তার সামনের এই মানুষটি, তার চোখে পূর্বসূরির জ্বলজ্বলে জ্ঞান।
আমি চাঁদের রীতিনীতি থেকে শিখেছি। জাদুকর এমনভাবে বললেন যেন তিনি ব্রাইডার চিন্তাভাবনা বুঝতে পারছেন। কিন্তু সেই রীতিনীতির শিক্ষক কখনো না ছিলাম না আমি। আমি সূর্যের রীতিনীতির শিক্ষক।
তাহলে আমাকে সূর্যের রীতিনীতি শেখান। ব্রাইডা বলল। জাদুকরের কণ্ঠস্বরের চঞ্চলতা তাকে ছুঁয়ে গেল।
আমি যা শিখেছি তাই তোমাকে শেখাব। কিন্তু সূর্যের রীতিনীতির অনেক। পথ আছে। প্রত্যেকের তার সামর্থ্যে বিশ্বাস করা উচিত।
ব্রাইডার ধারণা ঠিক। জাদুকরের কণ্ঠস্বরে চঞ্চলতা ঝরে পড়ছে। তাকে নিশ্চয়তা দেয়ার চেয়ে বেশি ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
আমি জানি, আমি সূর্যের রীতিনীতি বুঝতে পারব। ব্রাইডা বলল।
জাদুকর তারার দিকে তাকানো বাদ দিয়ে তরুণীর দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি জানেন সূর্যের রীতিনীতি শিখতে মেয়েটি এখনো সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়নি। এখনো তাকে এই শিক্ষা প্রদান করা উচিত নয়। কিছু ছাত্র তাদের শিক্ষকদের বেছে নেয়।
প্রথম পাঠ শুরুর আগে, তোমাকে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমি। তিনি বললেন। যখন রাস্তা খুঁজে পাবে, ভীত হবে না। ভুল করার জন্য যথেষ্ট সাহস রাখতে হবে। হতাশা, পরাজয় এবং নৈরাশ্য এসব সরঞ্জাম ঈশ্বর আমাদের শিক্ষা দিতে ব্যবহার করেন।
অদ্ভুত সরঞ্জাম। ব্রাইডা বলল। এগুলো বহন করার শক্তি মানুষ প্রায়ই হারিয়ে ফেলে।
জাদুকর এসব সরঞ্জামের কারণ জানতেন। তিনি এরই মধ্যে নিজের শরীর ও আত্মায় এসবের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।
আমাকে সূর্যের রীতিনীতি শেখান। ব্রাইডা জোর দিয়ে বলল।
জাদুকর ব্রাইডাকে পাথরের ওপর হেলান দিয়ে শিথিল হয়ে বসতে বললেন।
তোমার চোখ বন্ধ করার কোনো দরকার নেই। তোমার চারপাশের জগষ্টাকে দেখ। যতটুকু বুঝতে পারো বোঝার চেষ্টা করো। ঐতিহ্যবাহী সূর্য নিয়মিতভাবে সবার মধ্যে স্বর্গীয় জ্ঞান ছড়িয়ে চলেছে।
জাদুকর যেভাবে বলছিলেন ব্রাইডা তাই করছিল। কিন্তু বুঝতে পারল অনেক তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে সে।
এটাই প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। তিনি বললেন, একজন স্প্যানিশ এটা সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি বিশ্বাসের অর্থ বুঝতেন। তার নাম সেইন্ট জন অব দ্য ক্রস।
জাদুকর মেয়েটার আগ্রহী বিশ্বাসী মুখের দিকে তাকালেন। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তিনি প্রার্থনা করছিলেন, তিনি যা শিক্ষা দিচ্ছেন তা যেন মেয়েটা বুঝতে পারে। মেয়েটি তার আত্মার সহচরী, যদিও এখনও সে তা জানে না, যদিও এখনও তার বয়স ভারি কম এবং হৃদয় জাগতিক প্রাচুর্যের প্রতি অনুরক্ত।
.
০২.
ব্রাইডা দেখতে পেল জাদুকর অন্ধকার বনের ভেতর হেঁটে যেতে যেতে এক সময় গাছের আড়ালে হারিয়ে গেলেন। সে যদিও তাকে একা ফেলে যাওয়ার ভয়ে ভীত ছিল, কিন্তু এ মুহূর্তে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করল। এটাই তার প্রথম পাঠ। তার দেখানো উচিত নয় সে নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
তিনি ছাত্রী হিসেবে আমাকে গ্রহণ করেছেন। আমি তাকে নিরাশ করতে পারি না।
ব্রাইডা নিজের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। একইসাথে, কত দ্রুত এসব ঘটে যাচ্ছে। দেখে বিস্মিত। নিজের যোগ্যতা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই এখানে এসেছে। সে নিশ্চিত জাদুকর আশপাশে কোথাও আছেন। তার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছেন। দেখছেন জাদূর প্রথম পাঠটুকু নিতে সক্ষম কি না। তিনি সাহসিকতার কথা বলেছিলেন। এমনকি যদি সে সাপ-বিচ্ছুর কথা কল্পনা করে ভীত হয়ে ওঠে–তাকে অবশ্যই সাহসী হতে হবে। তারপর তিনি তাকে প্রথম পাঠ দিতে ফিরে আসবেন।
আমি একজন বলিষ্ঠ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নারী। ব্রাইডা শ্বাস নিতে নিতে ভাবল। সে সেই মানুষটির সঙ্গে আছে যাকে অন্যরা হয় ভালোবেসেছিল, নয় ভয় করেছিল। সেই সন্ধ্যা তারা একসাথে দেখেছে। জাদুকরের কণ্ঠস্বরে তারুণ্য ঝরে পড়ছিল। তিনি আমাকে বেশ উৎসাহী হিসেবে পেয়েছেন। সম্ভবত তিনি, এমনকি, আমার সঙ্গে প্রেমও করতে চেয়েছেন। খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা নয়। যাহোক, জাদুকরের দৃষ্টিতে অদ্ভুত কিছু ছিল।
বোকার মতো কী সব ভাবছি আমি। ব্রাইডা বাস্তবে ফিরে এলো। হঠাৎ করে বুঝতে পারল একজন সাধারণ নারী সে। সে আর জাদুকরের কথা। ভাবতে চাইছিল না। বুঝতে পারল জাদুকর তাকে একা রেখে যাওয়ার পরে অনেক সময় পার হয়ে গেছে।
ব্রাইডা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে এই মানুষটির সম্বন্ধে বিপরীতধর্মী কিছু কথাবার্তা শুনেছিল। কিছু লোক বলেছিল তাদের দেখা মতে, তিনি সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী শিক্ষক। বাতাসের দিকনির্দেশনা পরিবর্তন করতে সক্ষম, মেঘভেদী বর্ষণ করতে পারেন, চিন্তার শুদ্ধতার দ্বারা অঘটন ঘটাতে পারেন। ব্রাইডা এসব কথায় অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল।
অন্য ছাত্ররা, যারা জাদুবিষয়ক একই পাঠ নিতে এসেছিলো, তারা নিশ্চিত করেছিল, তিনি একজন কাল জাদুকর, ক্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান। একবার এক সাধারণ মানুষকে ধ্বংস করতে তিনি তার শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, কারণ তিনি সেই মানুষটির স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিলেন। এ কারণে শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তাকে বনে একাকী নির্বাসিত হতে হয়েছিল।
সম্ভবত নিঃসঙ্গতা তার পাগলামিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে, ব্রাইডা ভাবল। সে আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তার বয়স কম কিন্তু জানে, নিঃসঙ্গতা মানুষকে অন্য রকম করে দেয়, বিশেষত যারা বয়স্ক হয়ে উঠছে। তার এমন সব লোকজনের সাথে দেখা হয়েছে, যারা নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গতায় আসক্ত হয়ে পড়েছে, তারা বিশ্বাস করে পৃথিবী খুব খারাপ জায়গা। সন্ধ্যা থেকে রাত তার ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। নিঃসঙ্গতা দিয়েই তারা জগতের সব কিছুকে বিচার করে। চারদিকের সব কিছুকে তারা তাদের একাকীত্বের সাথে গুলিয়ে ফেলে। সম্ভবত জাদুকরও নিঃসঙ্গতায় উন্মত্ত হয়ে গেছেন।
হঠাৎ করে কাছাকাছি শব্দ শুনে ব্রাইডা লাফ দিয়ে উঠল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। গোড়ার দিকের আত্মবিশ্বাস উবে গেল। সে চারদিকে তাকালো কিছুই দেখতে পেল না। আতঙ্কের একটি ঢেউ পেটের দিক থেকে পাক খেয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
আমার অবশ্যই নিজেকে সংযত করা উচিত। ব্রাইডা ভাবল। কিন্তু তা অসম্ভব। সাপ-বিচ্ছুর কল্পনা আর শৈশবের ভূতের ছবি তার সামনে আসতে শুরু করেছে। ব্রাইডা আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ল। অন্য একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠল, একজন ক্ষমতাশালী জাদুকর, শয়তানের সাথে সমঝোতা করে তাকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছেন।
আপনি কোথায়? ব্রাইডা কেঁদে ফেলল। কে কী মনে করল তা নিয়ে সে কোনো রকম মাথা ঘামাল না। সে শুধু এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চায়।
কেউ কোনো উত্তর দিল না।
আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন!
বনের নিস্তব্ধতার অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছিল। ব্রাইডার মাথা ঘুরতে লাগল। মনে হলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু তার জ্ঞান হারালে চলবে না। সে নিশ্চিত জাদুকর এখন ধারে-কাছে কোথাও আছেন। অজ্ঞান হয়ে। পড়লে কোনো লাভ হবে না। তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।
এ চিন্তা তাকে সচেতন করে তুলল। নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করতে লাগল। আমার তাকে ডাকা উচিত নয়। নিজেকে বলল সে। আমার চিৎকার জঙ্গলে বাস করা অন্য মানুষকে আকৃষ্ট করবে। জঙ্গলে বাস করা মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হতে পারে।
আমার বিশ্বাস আছে, ব্রাইডা নরম স্বরে বলতে শুরু করল। আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস রয়েছে, বিশ্বাস আছে দেবদূতে। যিনি আমাকে এখানে এনেছেন এবং আমার সঙ্গে এখানে আছেন। তিনি কেমন তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু আমি জানি তিনি কাছেই আছেন। উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারি না আমি।
শেষের কথাটা ব্রাইডা সেই সুদূর শৈশবে স্তোস্ত্র থেকে শিখেছিল, বিগত বছরগুলোতে আর ভাবেনি। দাদিমা তাকে স্তোস্ত্র শিখিয়েছিলেন, কিছুদিন আগে তিনি মারা গেছেন। এখানে তিনি তার সাথে আছেন ভাবতেই ভয় কেটে যেতে লাগল। অল্প কিছুদিন আগে মারা যাওয়ার কারণে তার উপস্থিতি যেন বেশ তীব্রভাবেই অনুভূত হচ্ছিলো।
ব্রাইডা বুঝতে পেরেছে বিপদ এবং ভয়ের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য আছে।
সর্বাপেক্ষা উঁচু স্থানের গোপন জায়গায়… এভাবেই স্তোস্ত্র শুরু হয়েছিল। ব্রাইডা বুঝতে পারছিল এ কথার সাথে সাথে আরো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। স্তোস্ত্র আবৃত্তি করতে থাকলেও তার ভয়ের ব্যাপারটা দূর হচ্ছিল না। সে কিছু সময় জন্য আবৃত্তি শুরু করেছিল, তারপর ভয় সত্ত্বেও সে বেশ শান্ত হয়ে উঠলো। তার কোনো উপায় ছিল নাঃ হয় তাকে অভিভাবক দেবদূতে ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে নতুবা আত্মসমর্পণ করতে হবে।
ব্রাইডা অদৃশ্য কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভব করছিল। এই উপস্থিতিতে আমার বিশ্বাস করতে হবে। আমি জানি না কীভাবে তা ব্যাখ্যা করব, কিন্তু এর অস্তিত্ব আছে এবং তা সমস্ত রাত্রি আমার সঙ্গে থাকবে, কারণ আমি জানি না কীভাবে এখান থেকে একা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাব।
শৈশবে ব্রাইডা মাঝরাতে কখনো কখনো বিছানায় উঠে বসত, ভয়ে কাঁপত। বাবা তাকে কোলে করে জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে শহর দেখাতেন। এই শহরে তারা বসবাস করত। তিনি রাত্রির পাহারাদারের কথা বলতেন, দুধওয়ালার কথা বলতেন যে দুধ দিতে বেরিয়ে পড়েছিল। বেকারের পাউরুটি তৈরির কথা বলতেন। রাতের কল্পনায় সে যেসব দৈত্যদানবের কথা ভাবত সেগুলোকে বাবা মন থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। তার বদলে রাতে যেসব মানুষ কাজে থাকে তাদের কথা বলতেন, বলতেন রাত দিনেরই অন্য আরেকটা অংশ।
অন্ধকার শুধু আলোরই একটা অংশ। সে আলোর মধ্যে যে রকম নিরাপদ অনুভব করত অন্ধকারেও তেমনি। অন্ধকার আলোর উপস্থিতিতে বিশ্বাস বাড়ায়। তার অবশ্যই আস্থা রাখা উচিত। এ আস্থাকেই বিশ্বাস বলা হয়। কেউ কখনো বিশ্বাসকে বুঝতে পারে না, কিন্তু সে এখন রাতের গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে বিশ্বাসের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। এর অস্তিত্ব রয়েছে কারণ সে এতে বিশ্বাস করে। অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু যারা বিশ্বাস করে তাদের জন্য অলৌকিকের অস্তিত্ব রয়েছে।
তিনি প্রথম পাঠে আমাকে এ সমন্ধে কিছু বলেছিলেন, ব্রাইডা ভাবল। তারপর কী ঘটে চলেছে তা হঠাৎ করে বুঝে ফেললো। হঠাৎ করেই টেনশনের কারণে প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করতে লাগল। চাপা উত্তেজনার কারণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে, টের পায়নি, আবার হাঁটতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তে পাশে কেউ আছে মনে হচ্ছিল।
ব্রাইডার নিজের ওপর বিশ্বাস আছে। আর বিশ্বাস কখনো জঙ্গলের মধ্যে সাপ-বিচ্ছুর সাথে থাকে না। বিশ্বাস তার অভিভাবক দেবদূতকে জাগিয়ে রেখে পাহারা দেবে।
ব্রাইডা আবার পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
০৩.
ব্রাইডা উজ্জ্বল আলোর মধ্যে জেগে উঠল। সূর্যের অপূর্ব কিরণ চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে। তার শীত শীত লাগছিল। জামাকাপড়গুলো নোংরা হয়ে গেছে। কিন্তু সে আনন্দিত। গোটা রাত সে একা এই জঙ্গলে কাটিয়েছে।
ব্রাইডা জাদুকরের আশায় চারদিকে তাকালো। জানে তাকে খুঁজে পাবে না। তিনি অবশ্যই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে এ রকম জায়গায় গেছেন, যেখান থেকে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করা যায়। সম্ভবত বিস্ময়ের সাথে ভাবছেন গত রাতে আসা মেয়েটি সূর্যের রীতিনীতির পাঠ শেখার মতো যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করেছে কি না।
আমি অন্ধকার রাতের ব্যাপারে শিখেছি। ব্রাইডা নিঃশব্দ বনভূমিকে বলল। আমি শিখেছি ঈশ্বরের খোঁজ করা অন্ধকার রাতের মতো। ঈশ্বরের অনুসন্ধান একটি আঁধার রাত্রি, বিশ্বাস একটি আধার রাত্রি। ব্যাপারটা বিস্ময়করভাবে সত্যি, কারণ আমাদের প্রত্যেক দিনই একটি অন্ধকার রাত্রি। আমরা কেউ জানি না পরবর্তী মিনিটে এমন কী ঘটতে পারে। আমরা এখনো সম্মুখপানে এগিয়ে যাই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।
অথবা, কে জানে, পরবর্তী মুহূর্তে কী রহস্যময়তা লুকিয়ে আছে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কী গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্রাইডা বুঝতে পারছিল।
জীবনের প্রতি মুহূর্ত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হয়।
তুমি জীবনের জন্যে সাপ-বিচ্ছুতে পরিপূর্ণ পথ বেছে নিতে পারে অথবা শক্তিশালী প্রতিরক্ষায় বিলিয়ে দিতে পারো।
বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিশ্বাস আঁধার রাত্রির মতো। তা সে মেনে নিতে পারুক বা না-ই পারুক।
ব্রাইডা ঘড়ি দেখল। দেরি হয়ে গেছে। তাকে বাস ধরতে হবে। তিন ঘণ্টার জার্নি করতে হবে। বয়ফ্রেন্ডের কাছে কীভাবে বোঝাবে তা নিয়ে। ভাবতে হবে, সে পুরো একটা রাত জঙ্গলে একা কাটিয়েছে, ও কখনো বিশ্বাস করবে না।
সূর্যের রীতিনীতি খুব কঠিন! ব্রাইডা জোরে চিৎকার করে বনভূমিকে জানিয়ে দিল। আমাকে নিজের শিক্ষক হতে হবে। আমি যে রকমটি আশা করেছিলাম তা নয়!
ব্রাইডা নিচে গ্রামের দিকে তাকালো। মনে মনে পথের হদিস বের করছিল। কীভাবে ফিরে যাবে তাই ভাবছিল। সে আবার পাথরের দিকে ঘুরে তাকালো। আনন্দে কেঁদে উঠল। তার কণ্ঠস্বরে আনন্দ ঝরে পড়ছিল।
অন্য আরেকটি জিনিস বুঝতে পেরেছি। আপনি খুব অদ্ভুত একজন মানুষ।
একটা পুরনো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে জাদুকর মেয়েটিকে লক্ষ করছিলেন। তিনি মেয়েটার আর্তনাদ শুনেছেন, ঘন আঁধার রাতে মেয়েটির কান্না শুনেছেন। এক সময় তার লোভ হয়েছিল যে মেয়েটার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে তাকে ভয় আর আতঙ্কের হাত থেকে বর্মের মতো রক্ষা করেন। বলেন, তাকে এমন চ্যালেঞ্চ মোকাবিলা করতে হবে না।
ও রকমটি করতে হয়নি বলে তিনি এখন খুশি। তিনি গর্ববোধ করতে থাকেন, মেয়েটা তরুণী হলেও তার আত্মার সাথী হওয়ার উপযুক্ত।
.
০৪.
ডাবলিনের প্রাণকেন্দ্রে বইয়ের দোকানটি অবস্থিত। অকাল্ট বা গুপ্তজ্ঞানের আধিভৌতিক বিষয়ের বইয়ের সমারোহ সেখানে। সংবাদপত্র অথবা সাময়িক পত্রিকাতে কখনো এ বিজ্ঞাপন যায় না, লোকজনকে সেখানে গিয়ে অন্যদের জন্য সুপারিশও করতে হয় না। মালিক এতেই খুশি যে তার বিশেষ কিছু কাস্টমার আছে।
বইয়ের দোকান পূর্ণ থাকে। ব্রাইডা এ বইয়ের দোকান সম্বন্ধে শুনেছিল। শেষ পর্যন্ত তার এক শিক্ষকের কাছ থেকে বইয়ের দোকানের ঠিকানা পেয়েছে। এই শিক্ষক তাকে কিছুদিন নভঃভ্রমণ বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। ব্রাইডা একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে সেখানে গিয়েছিল।
এর পর থেকে, যখনই সে সুযোগ পেত, বইয়ের দোকানে বইয়ের খোঁজে যেত। কিন্তু সে কখনো কোনো বই কিনত না, কারণ সবগুলো বই দেশের বাহির থেকে আনিয়ে নেয়া, তাই দামটাও ছিল খুব বেশি। সে বইগুলো ঘাটাঘাটি করত। বইয়ের মধ্যকার ডিজাইন আর প্রতীক নিয়ে পড়াশোনা করত। জ্ঞানের দুয়ার তার জন্য সব সময় ভোলা ছিল। জাদুকরের সাথে তার অভিজ্ঞতার পরে সে আরো বেশি সতর্ক হয়েছিল। মাঝেমধ্যে সে শুধু যেসব জিনিস বুঝতে পারত তার প্রতিই উৎসাহ দেখাত। বুঝতে পারছিল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার হারিয়ে ফেলেছে। এখনকার মতো থাকলে একই রকম অভিজ্ঞতার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকবে। এখনো নিজেকে বদলানোর মতো সৎসাহস গড়ে ওঠেনি। এজন্যে তাকে অনবরত সংগ্রাম করে যেতে হবে। সে গাঢ় অন্ধকার রাত্রির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। জানত এই পথে নিজেকে খুঁজে পাবে না। যদিও নিজের ব্যাপারে মাঝেমধ্যে অসন্তুষ্ট হতো। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে বাইরে যাওয়া অসম্ভব মনে হত তার কাছে।
বই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। শত বছর আগের গবেষণাধর্মী গ্রন্থে বুকশেলফ ভরে আছে। শুধু বইয়ের পাতাতেই খুব কমসংখ্যক লেখক নতুন কিছু বলতে ভয় পেয়েছিল। বইয়ের পাতার জ্ঞান, আধিভৌতিক জ্ঞান, দুর এবং নিকটবর্তী প্রত্যেক যুগের জন্য উনাোচিত হয়েছিল।
বইয়ের সম্বন্ধে জানা ছাড়াও ব্রাইডার বইয়ের দোকানে যাওয়ার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল–ক্রেতাদের লক্ষ্য করা। সে কখনো কখনো রসায়নের গবেষণাধর্মী বই পড়ার ভান করত, সে সময় মূলত অন্য আগত নারী পুরুষদের খুটিয়ে খুটিয়ে দেখত, বিশেষত তার চেয়ে বেশি বয়স্ক লোকজনদের ওপর নজর রাখত। এসব পাঠক সাধারণত স্বচ্ছন্দে বইয়ের দোকানে ঘুরাঘুরি করত, তারা জানত তারা কি চায় এবং সব সময় ঠিক শেলফটিতেই যেত। সে কল্পনা করার চেষ্টা করত লোকজনের পছন্দসই বইগুলো খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার হবে। কাউকে কাউকে খুব জ্ঞানী মনে হতো। ভেতরের শক্তি জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে এমন মনে হতো। অন্যরা বেপরোয়াভাবে বহু আগের ভুলে যাওয়ার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করত। দেখে মনে হতো খুঁজে না পেলে তাদের জীবনের কোনো অর্থ থাকবে না।
ব্রাইডা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারছিল, সর্বাপেক্ষা নিয়মিত খদ্দেররা দোকান মালিকের সঙ্গে দু-একটা কথা বলে। তারা অদ্ভুত জিনিসের সম্বন্ধে কথা বলছিল, যেমন চাঁদের কলা, পাথরের বৈশিষ্ট্যাবলি এবং ধর্মীয় রীতিনীতির শব্দের সঠিক উচ্চারণ।
একদিন বিকালে ব্রাইডাও ওই রকম করতে যথেষ্ট সাহসিকতা দেখিয়েছিল। সে কাজ থেকে ফিরে এসেছিল। দিনটা খুব ভালোভাবেই কেটেছে। আজকের দিনটা ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত।
আমি জানি এখানে গোপন সমাজ আছে। ব্রাইডা বলল। কথাবার্তা শুরু করার জন্য খুব ভালো একটা লাইন, ভাবল সে। সে কিছু জানত।
দোকান মালিক তার অ্যাকাউন্ট থেকে চোখ তুলে তাকে বিস্ময়ের সাথে দেখল।
আমি জাদুকরের সাথে ছিলাম। ব্রাইডা কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলল। সে যে কিছু জানে, এটা বোঝাতে চাইল। তিনি আমাকে গাঢ় অন্ধকারতম রাত্রি সমন্ধে বুঝিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, জ্ঞানের পথ মানে এই নয় যে ভুল করতে ভয় পাওয়া যাবে না।
ব্রাইডা খেয়াল করল দোকান মালিক এখন তার কথা আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনছে। জাদুকর যদি তাকে কিছু শিক্ষা দিয়ে বিরক্ত বোধ করত তাহলে হয়তো সে অবশ্যই বিশেষ কেউ হতো।
আপনি যদি গাঢ়তম অন্ধকার রাত্রির পথ জানেন তাহলে আপনার বইয়ের কী প্রয়োজন? বই বিক্রেতা শেষ পর্যন্ত বলল।
ব্রাইডা জানত জাদুকরের নাম উল্লেখ করা কোনো কাজের কথা নয়।
বলল আমি ওই পদ্ধতিতে শিখতে চাই না।
দোকান মালিক আরো কাছ থেকে এই সুন্দরী তরুণীকে দেখতে লাগল। মেয়েটা যেন স্বর্গীয় উপাদান, তার পরও জাদুকর তাকে অনেক বেশি অধিকার করে রেখেছে। হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু আছে। মেয়েটি সম্ভবত মিথ্যা বলছে, কিন্তু মেয়েটি অন্ধকার রাত্রির কথাও বলছে।
আপনি প্রায়ই এখানে আসেন দোকান মালিক বলল, আপনি আসেন, কয়েকটা বই পড়েন কিন্তু কখনো কিছু কেনেন না।
এখানকার বই অনেক বেশি দামি। ব্রাইডা বলল। সে লোকটার সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমি আরো অন্যান্য বই পড়েছি। কোর্সে অংশ নিয়েছি।
ব্রাইডা তার কোর্সের শিক্ষকদের নাম বলল, আশা করছে লোকটাকে প্রভাবিত করতে পারবে।
সব কিছু যে রকম আশা করেছিল সে রকম হলো না। দোকান মালিক তাকে বাদ দিয়ে অন্য আরেকজন কাস্টমারের সাথে কথা বলতে গেল।
একজন ক্রেতা জানতে চাইছিল, তিনি যে বই অর্ডার দিয়েছিলেন তা এসেছে কি না। পরবর্তী একশ বছরের গ্রহের অবস্থান সম্পর্কিত বই ছিল সেটি।
দোকান মালিক কাউন্টারের নিচে রাখা কয়েকটা প্যাকেজ পরীক্ষা করে দেখল। ব্রাইডা দেখল প্যাকেজগুলোতে সারা দেশের বিভিন্ন রকমের স্ট্যাম্প লাগানো আছে।
ব্রাইডা আগের চেয়ে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ল। তার প্রাথমিক সাহস পুরোপুরি উবে গেছে। কিন্তু সে অনন্যপায়। অন্য কাস্টমারকে মিটিয়ে না আসা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে।
আমি জানি না কীভাবে শুরু করব। ব্রাইডা বলল। তার চোখ জলে ভরে গেল।
আপনি কোন বিষয়ে জানতে চান? মালিক জিজ্ঞাসা করল।
আমি যা বিশ্বাস করি সে ব্যাপারে। তার কাছ থেকে একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর। সে সারা জীবন যা বিশ্বাস করে তার খোঁজে কাটিয়েছে। একমাত্র সমস্যা হলো প্রতিদিনই সে ভিন্ন ভিন্ন কিছু বিশ্বাস করে এসেছে।
বই বিক্রেতা এক টুকরো কাগজে একটা নাম লিখল। অ্যাকাউন্টের কাগজে লিখছিল। সেখানে থেকে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ল। কিছুক্ষণের জন্য হাতে ধরে রাখল।
আমি আপনাকে একটা ঠিকানা দিচ্ছি। বই বিক্রেতা বলল, একটা সময় ছিল যখন লোকজন জাদুকরী অভিজ্ঞতাকে প্রাকৃতিক ব্যাপার বলে গ্রহণ করত। সে সময় কোনো পুরোহিত ছিল না। কেউ অতিপ্রাকৃত ব্যাপারের পেছনে গোপনীয়তা খুঁজে বেড়াত না।
ব্রাইডা বুঝতে পারছিল না লোকটা তাকে কোনো কিছু রেফার করছে কিনা।
আপনি কি জানেন ম্যাজিক কী? লোকটা জিজ্ঞাসা করল।
দৃশ্যমান জগৎ এবং অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতুবন্ধ।
দোকান মালিক তাকে হাতে ধরা কাগজের টুকরোটা দিল।
একটা ফোন নাম্বার আর নাম লেখা: উইক্কা। (ডাকিনীবিদ্যায় একজন ঈশ্বর থাকেন। তিনি অন্ধকারের ঈশ্বর। তার একজন স্ত্রী। থাকেন। তিনি অন্ধকারের ঈশ্বরী। ডাইনিরা যে ধর্ম পালন করে তার নাম উইক্কা। উইক্কা শব্দের অর্থ উইজার্ড বা জাদুকর। তবে এখানে ডাইনি সম্রাজ্ঞীকে উইক্কা নামে ডাকা হচ্ছে–অনুবাদক।)
ব্রাইডা লোকটার হাত থেকে কাগজটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিল। মালিককে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো। সে দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি জানি ম্যাজিক অনেক ভাষায় কথা বলে, এমনকি একজন বই বিক্রেতার ভাষাও যে অসহযোগীর ভান করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খুব বিনয়ী, ভদ্র আর উপকারী।
ব্রাইডা লোকটার দিকে চুমু ছুঁড়ে চলে গেল। বই বিক্রেতা থমকে দাঁড়িয়ে রইল। জাদুকর তার ছাত্রীকে এই জিনিস শিখিয়েছে। সে ভাবল। একটা উপহার, তা যতই ভালো হোক, জাদুকরের এতটা আগ্রহ দেখানোর কোনো কারণ থাকতে পারে না। আরো কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। উইক্কা তা বের করতে পারবে।
দোকান বন্ধ করার সময় বই বিক্রেতা সম্প্রতি লক্ষ করেছে তার খরিদ্দার পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক তরুণ আসছে। পুরনো বইগুলো আবার শেলফে ফিরে আসছে। শেষ পর্যন্ত জিনিসগুলো যেখান থেকে গিয়েছিল সেখানেই ফিরে আসছে।
.
০৫.
পুরাতন ভবনটি শহরের কেন্দ্রে। জায়গাটা উনিশ শতকের রোমান্টিসিজমের নিদর্শন হিসেবে টুরিস্টদের দর্শনীয় স্থান। উইক্কা দেখা করতে রাজি হওয়ার আগে ব্রাইডাকে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আর এখন ব্রাইডা রহস্যময় ধূসর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের উত্তেজনাকে চেপে রাখতে চাইছে। ভবনটি সে যে রকম কল্পনা করেছিল ঠিক তেমনই। যারা বইয়ের দোকানে ঘোরাঘুরি করতে পারে তাদের জন্য কাক্ষিত জায়গা।
কোনো এলিভেটর নেই। ব্রাইডা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কাক্ষিত তলায় পৌঁছে দরজার বেল বাজাল।
ভেতরে কুকুর ডেকে উঠল। তার একটু পরে, ছিমছাম, অভিজাত, গম্ভীর দর্শনীয় একজন মহিলা দরজা খুলে দিল।
আমি ফোন করেছিলাম। ব্রাইডা বলল।
উইক্কা ভেতরে আসার ইঙ্গিত দিল। ব্রাইডা ভেতরে লিভিংরুমে ঢুকল। সাদা দেয়ালে আধুনিক চিত্রকলার সমারোহ। দেয়ালে পেইন্টিং, ঘরে ভাস্কর্য এবং টেবিলের ওপর চিত্রায়িত তৈজসপত্র। ঘরটা খুব চতুরতার সাথে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। এর ভেতরে সোফা, একটা ডাইনিং টেবিল এবং লাইব্রেরিও আছে। প্রতিটি জিনিসই বেশ উঁচুমানের এবং এ রকম জিনিস শুধু নিউজস্টান্টের স্থাপত্য আর ডিজাইন ম্যাগাজিনগুলোতে দেখেছে।
অবশ্যই সৌভাগ্যের প্রতীক। ব্রাইডা ভাবল।
উইক্কা ব্রাইডাকে পথ দেখিয়ে বিশালাকার লিভিংরুমে নিয়ে গেল। দুটো ইটালিয়ান চামড়ায় মোড়া চেয়ার আর একটি ইস্পাতের আর্মচেয়ার দ্বারা সজ্জিত…দুই চেয়ারের মাঝখানে নিচু কাঁচের টেবিল।
তুমি বেশ ছোট। উইক্কা শেষ পর্যন্ত বলল।
ব্যালেরিনাতে তার স্বাভাবিক মন্তব্য এ ধরনের ছিল। ব্রাইডা কিছুই বলল না। মহিলার কাছ থেকে আরো কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। এই ফাঁকে পুরাতন ভবনে আধুনিক ডিজাইনের সমারোহে বিস্মিত হচ্ছিল। জ্ঞান আহরণের ব্যাপারে তার রোমান্টিক ধারণা আরেকবার ধাক্কা খেল।
তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। উইক্কা বলল। ব্রাইডা বুঝতে পারল তিনি বলতে বই বিক্রেতার কথা বলা হচ্ছে।
আমি একজন শিক্ষকের খোঁজে এসেছি। আমি জাদুবিদ্যার পথ অনুসরণ করতে চাই।
উইক্কা ব্রাইডার দিকে তাকালো। মেয়েটা সত্যিই একটা উপহার কিন্তু তাকে জানতে হবে ম্যাগাস কেন এই তরুণীর ব্যাপারে এত আগ্রহী। মেয়েটার নিজের ব্যাপারটাই যথেষ্ট নয়। ম্যাগাস যদি জাদুবিদ্যার ব্যাপারে নতুন হতো, তাহলে হয়তো এ রকম একজন তরুণীর দ্বারা প্রভাবিত হতো। কিন্তু তিনি খুব ভালো করেই জানেন প্রত্যেকের মধ্যে ঐশ্বরিক দান আছে। তিনি এ জাতীয় ফাঁদে পড়ার ব্যাপারে অভিজ্ঞ।
উইক্কা উঠে দাঁড়াল। বুকশেলফের কাছে গিয়ে তার প্রিয় তাসের বাক্স তুলে নিল।
তুমি কি জানো কীভাবে তাসের জাদু দেখাতে হয়? উইক্কা জিজ্ঞাসা করল।
ব্রাইডা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে এ ব্যাপারে কয়েকটা কোর্স করেছে। জানে ওই মহিলার হাতে যে তাসটা রয়েছে তা ভাগ্যের ট্যারট কার্ড। (ট্যারটকার্ড-ভবিষ্যৎ বলার জন্য ফারচুন টেলায়রা ছবিওয়ালা এই কার্ডগুলো ব্যবহার করে থাকে। আটাওরটা ছবিওয়ালা তাসের বক্স থাকে–অনুবাদক।) ওখানে আটাত্তরটা কার্ড রয়েছে। সে কয়েক পদ্ধতিতে এই কার্ডের খেলা শিখেছে। আর এখন সেই জ্ঞান প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়ে উঠল।
উইক্কা কার্ডগুলো নিজের কাছে রাখল, শ্যাফল করল। তারপর কাঁচের টেবিলের ওপর এলোমেলোভাবেই কার্ডগুলো উল্টো করে রাখল। ব্রাইডা কোর্সের সময় এ পদ্ধতিটা খুব একটা পছন্দ করত না। মহিলাটা সেগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অদ্ভুত ভাষায় কিছু বুলি আওড়ে গেল। তারপর একটা কার্ডের পিঠ সোজা করে রাখল।
তেইশ নাম্বার কার্ড।
ক্লাবের কিং।
খুব ভালো প্রতিরক্ষা। উইক্কা বলল, কালো চুলের একজন শক্তিশালী, অদম্য মানুষ।
তার বয়ফ্রেন্ড শক্তিশালীও নয়, অদম্যও নয়। আর জাদুকরের চুলের রং ধূসর।
শারীরিক অভিব্যক্তি নিয়ে ভাববে না। উইক্কা এমনভাবে বলল, যেন সে তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। তোমার আত্মার সঙ্গী সম্বন্ধে ভাব।
আপনি আত্মার সঙ্গী বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন? ব্রাইডা বিস্মিত। এই ভদ্রমহিলা তার মধ্যে অন্য রকম শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছে, যা জাদুকর অথবা বই বিক্রেতার চেয়ে ভিন্ন রকম।
উইক্কা এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। আবার কার্ডগুলো শফল করে আগের মতোই এলোমেলোভাবে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখল। শুধু এবার কার্ডগুলো সোজা করে ছড়ানো। একেবারে মধ্যের কার্ডটার নাম্বার এগারো। একজন মহিলা জোর করে সিংহের মুখ হা করছে।
উইক্কা কার্ডটা তুলে ব্রাইডাকে ধরে রাখতে বলল। ব্রাইডা তাই করল।
এর আগের ভবিষ্যদ্ববাণীতে, তোমার শক্তি সব সময়ই একজন মহিলা। উইক্কা বলল।
আত্মার সঙ্গী বলতে আপনি কে বোঝাতে চান? ব্রাইডা আবার জিজ্ঞাসা করল। প্রথমবারের মতো সেই মহিলাটির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, কিন্তু খুব দুর্বল চ্যালেঞ্চ তা।
উইক্কা মুহূর্তের জন্য নীরব রইল। মনের মধ্যে সন্দেহ ডেকে গেল কোনো একটা নির্দিষ্ট কারণে ম্যাগাস এই মেয়েকে আত্মার সঙ্গী সম্বন্ধে শেখায়নি। ননসেন্স, সে নিজে নিজে বলল। তারপর ভাবনাটাকে ঝেড়ে ফেলল।
আত্মার সঙ্গীই হচ্ছে প্রথম জিনিস, যা যারা চাঁদের রীতিনীতি অনুসরণ করতে চায়, তারা শেখে। উইক্কা বলল, শুধু আত্মার সঙ্গীকে বুঝতে পার ওপর ভিত্তি করে…আমরা বুঝতে পারি কতটুকু জ্ঞান আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হলো।
উইক্কা ব্যাখ্যা বলে চলল। ব্রাইডা চুপ করে শুনে যেতে লাগল।
আমরা স্বর্গীয়, কারণ আমরা সবাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। উইক্কা বলল, যে কারণে আমরা অনেক জীবন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে চলি। আমরা অচেনা জগৎ থেকে এসে আবার অচেনা জগতে চলে যাই। জাদুবিদ্যার জগতে এসে তুমি বুঝতে পারবে, ম্যাজিকে এ রকম অনেক জিনিস আছে যা কখনো ব্যাখ্যা করা যায় না। ঈশ্বর নির্দিষ্ট জিনিস নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি কেন এমনটি করেন তার গোপনীয়তা শুধু নিজের কাছেই রাখেন।
বিশ্বাসের আঁধার রাত্রি। ব্রাইডা ভাবল। তো তার অস্তিত্ব চাঁদের রীতিনীতিতে রয়েছে।
ঘটনা হলো এসব ঘটে। উইক্কা বলে চলল, যখন লোকে পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণের কথা ভাবে, তারা সব সময় খুব কঠিন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। শুরুতে পৃথিবীতে মাত্র কতিপয় লোক এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতো। কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, এই সমস্ত নতুন আত্মা কোথা থেকে আসে?
ব্রাইডা দমবন্ধ করে বসে রইল। এ রকম প্রশ্ন নিজেকে বহুবার করেছে।
উত্তরটা সহজ। উইক্কা তরুণীটির নীরবতাকে উপভোগ করে বলল। এ রকম পুনর্জন্মে, আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই। আমাদের আত্মা যেভাবে স্ফটিক আর তারকা, কোষ আর উদ্ভিদে ভাগ হয়।
আমাদের আত্মা দুই ভাগে ভাগ হয়। এই নতুন আত্মা আবার পরবর্তীতে দুই ভাগে ভাগ হয়। কয়েক পুরুষ ধরে, আমরা এই পৃথিবীতে বৃহত্তর অংশ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ি।
শুধু এর একটা অংশই জানে সে কে? ব্রাইডা জিজ্ঞাসা করল। তার অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে। কিন্তু সে ওগুলোকে একসাথে জিজ্ঞাসা করতে চায়। আর সেগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সেই অংশ থেকে হই যাকে অ্যালকেমিস্টরা অ্যানিমা মান্ডি, পৃথিবীর আত্মা বলে থাকে। উইক্কা বলল। সত্যাটা হলো যদি অ্যানিমা মান্ডি এভাবে বিভক্ত হতে থাকে, তাহলে তা বড় হতে থাকবে কিন্তু এটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। সে কারণে যখনই দুই ভাগে বিভক্ত হয়, তখনই আমরা নিজেদের খুঁজে পাই। যে পদ্ধতিতে তা খুঁজে পাই তাকেই আমরা প্রেম বলি। কারণ যখন একটা আত্মা বিভক্ত হয়, তা সব সময় পুরুষ অংশ এবং নারী অংশে ভাগ হয়।
এ কারণে বুক অব জেনেসিসে ওভাবেই ব্যাখ্যা দেয়া আছে। আদমের আত্মা দুই ভাবে বিভক্ত হলো, হাওয়া তার থেকে জন্ম নিল।
উইক্কা হঠাৎ থেমে গিয়ে টেবিলের ওপর ছড়ানো-ছিটানো কার্ডগুলোর দিকে তাকালো।
অনেক রকম তাস রয়েছে। উইক্কা বলল, কিন্তু সেগুলো সবই একই বক্সের বিভিন্ন অংশ। ওদের ম্যাসেজ বুঝতে হলে আমাদের ওগুলোর সব দরকার। সবগুলোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তো আত্মার ক্ষেত্রেই একই কথা খাটে। মানুষেরা সবাই বক্সের তাসের মতো পরস্পর সাযুজ্যপূর্ণ।
প্রত্যেকের জীবনে, একজন আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেতে রহস্যময় বাধা আসে। যত মহত্তর ভালোবাসা তাদের পৃথক করে, ততই অনুভূতি তাদের আবার একত্রে করে দেয়।
কিন্তু আমার আত্মার সঙ্গী কে তা আমি কীভাবে জানতে পারব? ব্রাইডা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করল।
উইক্কা হেসে ফেলল। তার বিপরীতে বসা মেয়েটি ভীষণ আগ্রহ আর উদ্যোগের সাথে প্রশ্নটি করেছে। তাদের চোখের আলো দেখেই তুমি তোমার আত্মার সঙ্গীকে বলে দিতে পারবে। সময়ের সাথে সাথে লোকজন তাদের সত্যিকারের ভালোবাসাকে এভাবেই খুঁজে পায়। চাঁদের রীতিনীতির ভিন্নতর পদ্ধতি রয়েছে। এক ধরনের ভিন্ন জোতিদৃষ্টি, যা দ্বারা আত্মার সঙ্গীর বাম কাঁধের ওপর আলোকিত বিন্দু দেখা যায়। কিন্তু সে এই মেয়েটিকে তা বলতে পারে না। মেয়েটি হয়তো একদিন ওই আলো দেখা শিখে যাবে। বা নাও শিখতে পারে। মেয়েটি খুব তাড়াতাড়িই তা বুঝতে পারবে।
ঝুঁকি নিয়ে উইক্কা ব্রাইডাকে বলল। ব্যর্থতার ঝুঁকি, হতাশা, কুহক সবই পথে বাধা হিসেবে আসতে পারে। কিন্তু কখনো তোমার ভালোবাসার খোঁজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে না। তুমি খুঁজে যাবে, শেষ পর্যন্ত তুমি বিজয়ী হবে।
ব্রাইডার মনে পড়ে গেল জাদুবিদ্যার পথের কথা বলতে গিয়ে জাদুকরও একই রকম কথা বলেছিল। সম্ভবত সব কিছুই একই জিনিস। ব্রাইডা ভাবল।
উইক্কা টেবিলের থেকে কার্ডগুলো তুলতে লাগল। ব্রাইডা বুঝতে পারল তার সময় শেষ হয়ে আসছে। যদিও তার আরো একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ছিল।
প্রত্যেকের জীবনে কি একজনের বেশি আত্মার সঙ্গীর সাথে সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব?
হ্যাঁ। উইক্কা তিক্তস্বরে বলল। তা যখন ঘটে হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। পরিণতিতে যন্ত্রণা আর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। হ্যাঁ। একজন তিন অথবা চারজন আত্মার সঙ্গীর সাথে মিলিত হতে পারে। কারণ আমরা সংখ্যায় বহুধাভক্ত এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। তরুণী মেয়েটি ঠিক প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু এর উত্তর এড়িয়ে যেতে হবে।
সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা একাকী এবং একমাত্র। উইক্কা বলল, আর এই প্রয়োজনীয়তাকেই ভালোবাসা বলে। ভালোবাসা এ রকম শক্তি, যা আমাদের একত্রে ফিরিয়ে আনে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভালোবাসাকে এক জায়গায় করে।
আমরা গোটা পৃথিবীর জন্য দায়ী, কারণ আমরা জানি না তারা কোথায় থাকতে পারে। এসব আত্মার সঙ্গীরা শুরু থেকেই একসঙ্গে ছিল। যদি তারা ভালো থাকে, তাহলে আমরাও ভালো থাকি। তারা সুখী থাকলে আমরাও সুখী থাকি। তারা ভালো না থাকলে, আমরাও দুঃখ ভোগ করি। যদিও তা অবচেতনভাবে ঘটে থাকে। সর্বোপরি, আমরা পুনর্জন্মের জন্য দায়ী, অন্ততপক্ষে একবার, আত্মার সে সঙ্গী একবার হলেও আমাদের পথ অতিক্রম করে। এমনকি যদি তা মাত্র এক মুহূর্তের জন্যও ঘটে থাকে, কারণ সেই মুহূর্ত তাদের মধ্যে এতটাই ভালোবাসা নিয়ে আসে, তা আমাদের বাকি দিনগুলোকে বিবেচ্য করে।
রান্নাঘরে কুকুর ডাকছিল। উইক্কা কার্ড তোলা শেষ করে আবার ব্রাইডার দিকে তাকালো।
আমরা আমাদের আত্মার সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে যেতে দিই। তাদের গ্রহণ করি না, এমনকি লক্ষ্যও করি না। আমাদের পরবর্তী আত্মার সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। আমাদের স্বার্থপরতার কারণেও এমন ঘটে। তারপর আমরা আমাদের নিজেদের ওপর অত্যাচার করে নিঃসঙ্গতাকে বরণ করে নিই।
উইক্কা উঠে দাঁড়িয়ে ব্রাইডাকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল।
তুমি এখানে তোমার আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেতে আসোনি। বিদায় জানানোর আগে উইক্কা বলল, তোমার একটা ঐশ্বরিক শক্তি আছে, আর যখন আমি সেই ঐশ্বরিক শক্তিটা কী জানতে পারব, তখন তোমাকে চাঁদের রীতিনীতি শেখাতে পারব।
ব্রাইডার নিজেকে বিশেষ কেউ বলে মনে হচ্ছিল। নিজের মধ্যে এই বোধটুকু অনুভব করা দরকার। এই মহিলা তাকে বেশ উৎসাহিত করেছে, সে যে অনেকের মধ্যে একজন, এই সম্মানটুকু দিয়েছে।
আমি আমার সর্বোত্তম চেষ্টা করব। আমি চাঁদের রীতিনীতি শিখতে চাই। ব্রাইডা ভাবল, কারণ চাঁদের রীতিনীতিতে গভীর জঙ্গলে একাকী রাত কাটানোর দরকার নেই।
এখন আমার কথা শোনো, উইক্কা শান্ত স্বরে বলল, আজ থেকে প্রতিদিন, তোমার পছন্দমতো এক ঘণ্টা সময়, টেবিলে একাকী বসবে। আর আমি যেভাবে ট্যারট ডেক সাজিয়েছিলাম, ওভাবে সাজাবে। পুরোপুরি এলোমেলোভাবে। কোনো কিছু বোঝার চেষ্টা করবে না। সাধারণভাবে কার্ডগুলো স্টাডি করবে। ওই মুহূর্তে তোমার যা জানা দরকার তা ওগুলো তোমাকে শিক্ষা দেবে।
সূর্যের রীতিনীতির মতো, আমাকে নিজে নিজে শিখে নিতে হবে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ব্রাইডা ভাবল। বাসে বসে বুঝতে পারল ওই মহিলা তাকে তার ঐশ্বরিক শক্তির কথা বলেছে। পরবর্তী সাক্ষাতে হয়ত এ ব্যাপারে বলতে পারে সে।
.
০৬.
গোটা সপ্তাহজুড়ে, লিভিংরুমের টেবিলের ওপর ট্যারট কার্ড বিছিয়ে ব্রাইডা তাতেই মনোযোগী হয়ে রইল। রাত দশটায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভোরে ওঠার জন্য অ্যালার্ম সেট করে রাখত। খুব ভোরে উঠে এক কাপ কফি বানিয়ে নিত। ছড়ানো-ছিটানো কার্ডগুলোর সামনে বসে ওদের ভেতরের লুকানো ভাষা পড়ার চেষ্টা করত।
প্রথম রাতে ব্রাইডা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ব্রাইডা অভিভূত যে উইক্কা। তাকে এক ধরনের গোপন রীতিনীতি শিখিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই ঠিক একইভাবে কার্ডগুলোকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করত। আশা করত কোনো না কোনো অলৌকিক ম্যাসেজ উন্মোচিত হবে। আধা ঘণ্টা পর, কয়েকটা ছোট ছোট দৃশ্য দেখার পর, যেটাকে সে তার কল্পনার ফল হিসেবেই ধরে নিয়েছে, বুঝতে পারল বড় ধরনের কোনো কিছু ঘটেনি।
পরের রাতেও সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। উইক্কা বলেছিল, কার্ডগুলো তাদের নিজেদের গল্প বলবে। কোর্সে শেখা জ্ঞানের দ্বারা ব্রাইডা বুঝতে পারল, কার্ডে খুব প্রাচীন আমলের গল্প বলা আছে। হাজার বছর আগের গল্প। সে সময় মানবতা তার আদিম জ্ঞানের খুব কাছাকাছি ছিল।
ছবিগুলো এতই সাধারণ, ব্রাইডা ভাবল। একজন মহিলা জোর করে সিংহের মুখ হা করে ধরেছে, দুটো রহস্যময় প্রাণী একটা ঠেলাগাড়ি টানছে, একজন মানুষ টেবিলের ওপর ঢাকা জিনিসপত্রের সামনে বসে আছে। তাকে শেখানো হয়েছিল কার্ডের ডেকটা একটা বইয়ের মতো। যে বইয়ের মধ্যে জীবনের চলার জন্য স্বর্গীয় জ্ঞান লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু বইয়ের লেখক, জানতেন যে মানবতা ধর্মীয় জ্ঞানের চেয়ে অনেক সহজে শেখা হয়ে যাবে। ডেকের ভেতরে দেব-দেবীরা রয়েছে।
খুব সহজ কিছু হতে পারে না। প্রতিবার কার্ডগুলো টেবিলে ছড়ানোর পর ব্রাইডা ভাবল। তাকে অনেক জটিল মেথড শেখানো হয়েছিল, বিস্তৃত পদ্ধতি। আর এই কার্ডগুলো কোনো রকম নিয়ম-কানুন ছাড়াই ছড়ানোর কারণে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সমস্যা হচ্ছিল। তৃতীয় রাতে, রেগেমেগে কার্ডগুলো মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিল, তার এই রাগ প্রতিক্রিয়ার কারণে, এর পেছনে হয়তো কোনো ম্যাজিক্যাল প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে। কিন্তু এবারও ফলাফল অসন্তোষজনক। শুধু কয়েকটা কল্পনা, যা সে আবার আগের কল্পনার মতোই বাতিল করে দিল।
সেই সাথে, মুহূর্তের জন্যও আত্মার সঙ্গীর ধারণাটা তার মন থেকে মুছে যায়নি। প্রথমে, তার মনে হলো, সে যেন তার কৈশোরে ফিরে গেছে। কৈশোরের স্বপ্ন এক রাজপুত্র পাহাড়, পর্বত, উপত্যাকা পেরিয়ে একপাটি কাঁচের জুতোর মেয়েটির খোঁজে আসবে অথবা ঘুমন্ত রাজকুমারীকে চুম্বনে জাগিয়ে তুলবে।
আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পাওয়া কেবল রূপকথার গল্পেই ঘটতে পারে। ব্রাইডা মজা করে নিজেকে বলল। রূপকথার জগৎই তার কাছে প্রথমে জাদুকরী জগৎ হিসেবে ধরা দেয়, যে জগতে প্রবেশের জন্য এখনো সে সমানভাবে উদ্গ্রীব। বিস্ময়ের সাথে ভাবে, কেন লোকজন সেই জগতের চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে, যা শৈশবে তাদের অসম্ভব আনন্দের মধ্যে রাখত।
সম্ভবত তারা আনন্দের উপকরণ পুরোপুরি উপভোগ করত না। তার কাছে ব্যাপারটা একটু এলোমেলো মনে হলো, কিন্তু ডায়রিতে ব্যাপারটাকে সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা হিসেবে লিখে রাখল।
এক সপ্তাহ নিজেকে আত্মার সঙ্গীর ধারণার মধ্যে আবেশিত রেখে ব্রাইডার অদ্ভুত অনুভূতি হলো: কী হবে যদি সে ভুল মানুষটাকে বেছে নেয়? অষ্টম রাতে, সে আবার ট্যারট কার্ডে মনোনিবেশ করতে করতে সিদ্ধান্ত নিল তার বয়ফ্রেন্ডকে পরের রাতে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাবে।
.
০৭.
ব্রাইডা বেশ অভিজাত রেস্টুরেন্ট বেছে নিল। কারণ তার বয়ফ্রেন্ড সব সময় নিজেই বিল দেয়ার জন্য জোরাজুরি করে, যদিও একজন পদার্থবিদ্যার প্রফেসরের রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে তার আয় খুব বেশি নয়। সেক্রেটারি হিসেবে ব্রাইডার আয় তার চেয়ে বেশি। এখনো সামার চলছে। তারা নদীর পাশে পেভমেন্টের একটা টেবিলে বসল।
আমি জানতে চাই, আত্মারা কখন আবার তোমার সাথে আমাকে ঘুমাতে দেবে। লরেন্স বেশ রসিকতার সাথে বলল।
ব্রাইডা কড়া নজরে তার দিকে তাকালো। সে লরেন্সকে তার অ্যাপার্টমেন্টে দুই সপ্তাহের জন্য আসতে নিষেধ করেছে। লরেন্স সম্মত হলেও বেশ জোরের সাথে জানিয়েছে সে তাকে কতটা ভালোবাসে। লরেন্সও তার পদ্ধতিতে জগতের রহস্য বোঝার চেষ্টা করে। এমনকি যদি একদিন লরেন্সও তাকে সপ্তাহ দুয়ের জন্য দূরে থাকতে বলে তাহলে তাকেও তাতে সম্মতি দিতে হবে।
তারা ধীরে-সুস্থে খেতে লাগল। দুজন বেশির ভাগ সময় চুপচাপ রইল। নদীতে নৌকা দেখে ভেসে যাওয়া, পথের পাশে হেঁটে যাওয়া মানুষের সারি দেখে সময় কাটাল। টেবিলের ওপরের হোয়াইট ওয়াইনের বোতল ধীরে ধীরে খালি হয়ে গেল। আরেকটা বোতল দিয়ে গেল। আধা ঘণ্টা পর, তারা দুটো চেয়ার পাশাপাশি এনে একত্র করে একে অন্যের কাঁধে হাত দিয়ে বসে গ্রীষ্মের তারাখচিত আকাশ দেখতে লাগল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, লরেন্স ব্রাইডার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তুমি এখন যা দেখছ হাজার বছর আগেও আকাশটা এ রকম ছিল।
লরেন্স এ কথা তাদের প্রথম সাক্ষাতের পরদিনই বলেছিল। কিন্তু ব্রাইডা তাতে বাধা দেয়নি। এভাবেই লরেন্স তার জগক্টাকে ব্রাইডার সাথে ভাগ করে নেয়।
অনেক তারারা এরই মধ্যে ধংস হয়ে গেছে। যদিও তাদের আলো এখনো জগতে বিরাজ করছে। অন্য তারারা অনেক অনেক দূরে জন্ম নিচ্ছে। তাদের আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি।
কেউ কি কখনো জানে না–আসলে আকাশটা দেখতে কেমন? এই প্রশ্নটা তাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়ও করেছিল। আনন্দঘন মুহূর্তে এ কথার পুনরাবৃত্তি উপভোগ্য।
আমরা জানি না। যা আমরা দেখতে পাই তাই নিয়ে স্টাডি করি। কিন্তু যা আমরা দেখি তাই সব সময় সেখানে থাকে না।
আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমরা কী দিয়ে তৈরি? আমাদের শরীরের অণু-পরমাণু- এগুলো কোথা থেকে আসে?
লরেন্স আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, এগুলো ওই আকাশের তারাতে তৈরি, তৈরি এই নদীতেও। এগুলো সেই আদিম দুনিয়ার অস্তিত্ব।
তো সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত পরে, আর কোনো কিছু যোগ হয়নি?
না। কিছুই না। সব কিছুই চলমান এবং তা চলছে। সব কিছুই রূপান্তর হয়ে এসেছে এবং রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু এই জগতে যা কিছুর এখন অস্তিত্ব আছে, তা বিলিয়ন বছর আগের সেই একই পদার্থ। এর মধ্যে সামান্যতম পরমাণু কণাও যোগ হয়নি।
ব্রাইডা বসে বসে আকাশের তারা আর প্রবাহমান নদীর গতিময়তা দেখতে লাগল। নদীর প্রবাহমানতা দেখা অনেক সহজ কিন্তু আকাশের তারার গতিময়তা দেখা কঠিন। যদিও উভয়ই প্রবাহমান।
লরেন্স। ব্রাইডা শেষ পর্যন্ত বলল। তারা দুজনই দীর্ঘসময় ধরে নৌকার চলাচল দেখছে। আমাকে এবারে একটা অন্য রকম প্রশ্ন করতে দাও। আমার শরীরের যেসব পরমাণু আমার শরীর গঠন করেছে, সেই একই পরমাণু দ্বারা কি এর আগে কারোর শরীর গঠিত হওয়া কি সম্ভব?
লরেন্স তার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ?
আমি যা বলেছি, এ রকম কোনো কিছু কি সম্ভব?
সেগুলো উদ্ভিদ অথবা পোকামাকড় অথবা তা এমনকি হিলিয়াম অণুতেও রূপান্তরিত হতে পারে। আর তা পৃথিবী থেকে মিলিয়ন মাইল দূরে কোথাও হতে পারে।
কিন্তু তা কি সম্ভব যে আজ যা দিয়ে আমার শরীর তৈরি তা অন্য কারো শরীর হতে পারে যে মারা গিয়েছে অন্য কারো শরীরে এমন কেউ।
লরেন্স মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। তারপর বলল, হ্যাঁ, তা হতে পারে।
দূর থেকে সংগীতের ধ্বনি ভেসে আসছিল। নদীর অন্য পাশ থেকে আসছিল। এমনকি তার থেকেও দূরে হতে পারে। ব্রাইডা নদীর বুকে শিলিউয়েটে একজন নাবিককে দেখতে পেল। তার কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল স্কুল ড্যান্সের কথা। তার ছোট্ট বেডরুম, পনিটেইল চুল বাধার গোলাপি ফিতে। ব্রাইডা বুঝতে পারল লরেন্স এর আগে কখনো এই জাতীয় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। সম্ভবত এখন সে বিস্ময়ের সাথে ভাবছে, যদি তার নিজের শরীর অন্য কোনো ভাইকিং যোদ্ধার শরীর হয়ে থাকে অথবা কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে অথবা প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনো রহস্যময় বিলুপ্ত প্রাণীর হয়ে থাকে।
কিন্তু ব্রাইডার চিন্তাভাবনা অন্যদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে শুধু জানতে চাইছিল, এই যে মানুষটা তাকে আবেগের সাথে আলিঙ্গন করে, সে কি কখনও তার নিজের অংশ ছিল।
বার্জ নৌকা কাছাকাছি চলে এসেছে। সংগীতের মূর্ঘনা জোরালো হয়েছে। অন্য টেবিলের কথোপকথন শেষ হয়ে গেছে। সবাই উত্তীর্ণ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এই শব্দ কোথা থেকে আসছে। কারণ সবাই একসময় কিশোর ছিল। স্কুল ড্যান্সে অংশ নিয়েছিল। তাদের স্বপ্নে যোদ্ধা আর পরীর গল্প জায়গা করে নিয়েছিল।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, লরেন্স।
ব্রাইডা আশা করে এই সুদর্শন তরুণ, যে আকাশের তারার আলো সমন্ধে এত বেশি জানে, সে তার অংশ হবে।
.
০৮.
ব্যাপারটা ভালো নয়। আমি তা করতে পারি না।
ব্রাইডা বিছানায় উঠে বসে বেডসাইডে টেবিলে সিগারেটের জন্য হাতড়াতে লাগল। তার সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে, ব্রেকফাস্টের আগে সিগারেট ধরানোর সিদ্ধান্ত নিল।
উইক্কার সাথে দেখা করার পর দুই দিন পার হয়ে গেছে। সে জানত, গত দুই সপ্তাহ সে তার সর্বোত্তম চেষ্টা করেছে। অনেক আশা করে কার্ডগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে, যেভাবে উইক্কা তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, খুব চেষ্টা করেছে যাতে ভদ্রমহিলাকে আশাহত করতে না হয়। কিন্তু কার্ডগুলো তাদের গোপনীয়তা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে।
গত তিন রাত ধরে প্রত্যেকবার যখন কার্ডের কাজ শেষ করেছে, তার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল খুব বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আবারও মনে হলো, অন্যদের জীবন যেমন যায় তার তেমন যাচ্ছে না। জীবন কোনো কিছু অর্জন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। যখন সে লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি, মাটি ফাঁক হয়ে তাকে যেন গিলে নিচ্ছে। তার জ্ঞান অর্জন, তার ভালোবাসার মানুষ, নির্দিষ্ট স্বপ্ন সে কখনো কারো সাথে শেয়ার করেনি।
ব্রাইডা জাদুকরের কথা ভাবল। সম্ভবত তিনি তাকে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে শুধু তখনই জাদুকরের কাছে ফিরে যাবে, যখন তার মুখোমুখি হওয়ার মতো যথেষ্ট জাদুবিদ্যা তার আয়ত্তে আসবে।
আর এখন সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে তা কখনো ঘটবে না।
ব্রাইডা অনেক সময় বিছানায় শুয়ে রইল। উঠে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ইচ্ছা করছিল না। শেষ পর্যন্ত, দৈনন্দিন কাজের জন্য তাকে উঠতেই হলো।
প্রতিদিনের অন্ধকার রাত মোকাবিলা করতে হবে। জঙ্গল থেকে আসার পর থেকে রাতগুলোকে সে এ নামেই ডাকে। কফি বানাল। ঘড়ি দেখল। এখনো হাতে অনেক সময় আছে।
ব্রাইডা বইয়ের তাকের কাছে গেল। সেই বইটা খুঁজতে লাগল যাতে বই বিক্রেতার দেয়া কাগজের টুকরোটা রেখেছিল। নিজের সাথে কথা বলে সে ভাবল, আরেকটা পথ খোলা আছে। সে জাদুকরের সাথে দেখা করেছে। তার উইক্কার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত, সেই মানুষটার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়, যে তাকে এমনভাবে শিক্ষা দেবে, যা সে বুঝতে পারে।
কিন্তু ব্রাইডা জানে এটা একটা খোঁড়া অজুহাত।
আমি সব সময় কোনো কিছু শুরু করি, তারপর হাল ছেড়ে দিই। ব্রাইডা তিক্তভাবে ভাবল। সম্ভবত জীবন খুব তাড়াতাড়িই তা বুঝতে পারবে এবং একই রকম সুযোগ বারবার তার সামনে দেয়া বন্ধ করে দেবে। অথবা, সম্ভবত যখনই ব্রাইডা শুরু করবে তখনই হাল ছেড়ে দেবে। কোনো রকম পদক্ষেপ ছাড়াই, সাম্ভাব্য পথের কথা ভেবে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ব্রাইডা এ রকমই। দিন দিন নিজেকে আরো দুর্বল, আরো শক্তিহীন অপরিবর্তনীয় মনে হতে থাকে। কয়েক বছর আগে, সে তার নিজের ব্যবহারের কারণে হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্ততপক্ষে এখনো মাঝে মাঝে তার বীরোচিত আচরণের কারণ খুঁজে পায়। যদিও এখন নিজের ভুলগুলো শুধরে নেয়া শুরু করতে চায়। সে জানে, অনারাও একই রকম ভুল করে। তারা তাদের ভুলে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও অনেক দেরি হয়ে যায়।
উইক্কাকে ফোন করবে না ঠিক করল। কিন্তু বুকশপের ব্যাপারে কী হবে? তাহলে তার ওখানে আবার যাওয়ার মতো হিম্মত থাকবে না। যদি সে কোনো সাড়া না দেয়, বই বিক্রেতা পরবর্তী সময়ে তার প্রতি আর সদয় হবে না। আগেও এমনটি ঘটেছে। একজন মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে গিয়ে অন্যদের সাথেও সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাদের আমি সত্যিই পছন্দ করতাম। একই জিনিস এখন আবার করতে পারে না। সে এ রকম একটা পথে আছে যেখানে মূল্যবান যোগাযোগগুলো খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
ব্রাইডা নাম্বারটা খুঁজে নিয়ে ডায়াল করল।
আমি আগামীকাল আসতে পারব না। ব্রাইডা বলল।
না, প্লামারও তা করতে পারবে না? উইক্কা উত্তর দিল। মুহূর্তের জন্য ব্রাইডা বুঝতে পারল মহিলা কোন বিষয়ে কথা বলছে।
উইক্কা একই রকম সমস্যার অভিযোগ তুলতে লাগল। তার কিচেন সিঙ্কের সমস্যায় কতবার পানি মিস্ত্রিকে ডেকেছে ঠিক করে দেয়ার জন্য, মিস্ত্রি কখনো আসেনি। উইক্কা পুরনো বিল্ডিংয়ের ব্যাপারে এক দীর্ঘ গল্প ফেঁদে বসল। দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু যার অনেক রকম সমস্যা রয়েছে। পানি মিস্ত্রির গল্পের মাঝামাঝি হঠাৎ করে উইক্কা প্রশ্ন করল:
তুমি কি তোমার ট্যারট কার্ড খুঁজে পেয়েছ?
ব্রাইডা বিস্মিত। জানালো, পেয়েছিল। উইক্কা কার্ডগুলো টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিতে বলল। কারণ সে তাকে এ রকম একটা পদ্ধতি শিখিয়ে দিতে চায়, যাতে খুঁজে পাওয়া যাবে পানির মিস্ত্রি আজ আসবে কি আসবে না।
আগের চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়ে উইক্কা যেমনটি বলল, ব্রাইডা তা-ই করল। সে কার্ডগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে শ্যেনদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে নির্দেশনা শোনার অপেক্ষায় রইল। ফোন কল করার উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে ধোয়াটে হয়ে যাচ্ছিল।
উইক্কা তখনো কথা বলে চলছিল। ব্রাইডা ধৈর্য্য ধরে শোনার সিদ্ধান্ত নিল। সম্ভবত উইক্কা তার বন্ধু হতে পারে। তাহলে সে আরো বেশি সহ্য শক্তির অধিকারী হতে পারবে। তখন চাঁদের রীতিনীতি বোঝা সহজ হবে।
উইক্কা এই ফাঁকে কথোপকথনের মধ্যে এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে চলে যাচ্ছিল। পানির কলের মিস্ত্রির কথা বলে চলছিল। ভবনের ম্যানেজারের সাথে কেয়ারটেকারের বেতন নিয়ে তার যে তর্কাতর্কি হয়েছে, তা বলল। তারপর চলে গেল তার বৃদ্ধ বয়সের পেনশনের প্রসঙ্গে।
ব্রাইডা সব কিছু কয়েকটা হা, হু দিয়ে চালিয়ে গেল। উইক্কা যা বলছিল তাতেই একমত হলো। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছিল না। এক ধরনের ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরল। একজন মহিলার সাথে পানির কলের মিস্ত্রি, কেয়ারটেকার আর পেনশন নিয়ে এই সাতসকালে আলাপ চালিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিরক্তকর কাজের একটি। সে টেবিলে কার্ডের দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করল এবং এর আগে যা কখনো লক্ষ করেনি সে রকমই একটা কিছু লক্ষ করল।
উইক্কা তাকে জিজ্ঞাসা করল সে শুনছে কি না। ব্রাইডা বিড়বিড় করে সায় জানালো। কিন্তু তার মন এখন শত মাইল দূরে, এমন এক জায়গায় ঘুরছে যেখানে সে কখনো যায়নি। এই কার্ডের প্রতিটি ডিটেলস তাকে সেই ভ্রমণের দিকে ঠেলে পাঠাচ্ছে।
হঠাৎ করে কারো স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ার মতো ব্রাইডা বুঝতে পারল সে আর উইক্কার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। তার ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। কিন্তু তা বাইরে থেকে আসছে। সে নিজে নিজে ফিসফিস করে নিজেকে বলল, তুমি কি বুঝতে পারছ? ব্রাইডা তার কথাটারই পুনরাবৃত্তি করল, তুমি কি বুঝতে পারছ? সেই রহস্যময় কণ্ঠস্বর আবার জিজ্ঞাসা করল।
ব্যাপারটার তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। তার সামনে ট্যারট কার্ড অদ্ভুত জিনিস দেখাতে শুরু করল: ব্রোঞ্জের মতো তৈলাক্ত শরীরের একজন পুরুষ মানুষ, শুধু একটা নেংটি পরে আছে, মুখে বিশাল কোনো মাছের মাথার আকৃতির মুখোশ। আকাশ জুড়ে মেঘ। দেখে মনে হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা তড়িঘড়ি করে একটা চৌকো আকারে রূপ নিলো। একটা প্রাচীন আমলের সুবৃহৎ প্রাসাদ, সেখানে কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষ একদল তরুণ বালককে গুরুত্বপূর্ণভাবে কোনো গোপন তথ্য জানাচ্ছে।
সাত আর আট যোগ করো, তোমরা আমার নাম্বার পেয়ে যাবে। আমিই শয়তান। আমিই এই বইয়ে স্বাক্ষর করেছি। মধ্যযুগীয় উৎসবের পোশাক পরিহিত বালক বলল। মাতাল নারী পুরুষেরা তার দিকে তাকালো। দৃশ্যটা পরবর্তিত হয়ে সাগরে রূপ নিল। পাথরের পাশে মন্দির। তারপর আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বিদ্যুৎ চমক দেখা দিল।
একটা দরজা দেখা গেল। খুব ভারী, যেন পুরনো কোনো দুর্গের। একটা দরজা ব্রাইডার খুব কাছে এলো। মনে হলো খুব শিগগিরই সে তা খুলতে পারবে।
ফিরে এসো। কণ্ঠস্বরটি বলল।
ফিরে এসো। ফোনের অন্য প্রান্তের কণ্ঠস্বরও বলল। উইক্কার কণ্ঠস্বর। ব্রাইডা এই সময়ে বাধা দেয়ায় বিরক্ত হলো। কেয়ারটেকার আর পানির মিস্ত্রি নিয়ে বিরক্তিকর কথা বলার চেয়ে অনেক উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে ছিল সে।
আর একটু। ব্রাইডা উত্তর দিল। সে দরজাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করছিল। কিন্তু সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আমি জানি কী ঘটেছে। উইক্কা তাকে বলল।
ব্রাইডা হতভম্ব। শক পেল। সে বুঝতে পারছে না কী ঘটে চলেছে।
আমি জানি কী ঘটেছে। উইক্কা আবার বলল। ব্রাইডার নীরবতা বুঝতে পারল।
আমি পানির কলের মিস্ত্রি সমন্ধে আর কিছু বলতে চাই না। মিস্ত্রি গত সপ্তাহে এখানে এসে সব কিছু ঠিকঠাক করে দিয়েছে।
ফোন রেখে দেয়ার আগে উইক্কা জানালো, সময়মতো সে ব্রাইডাকে আশা করে।
ব্রাইডা বিদায় না জানিয়েই ফোন রেখে দিল। রান্নাঘরের দেয়ালের দিকে দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
.
০৯.
এটা একটা কৌশল। উইক্কা বলল। ব্রাইডা ভীতভাবে আবার সেই ইটালিয়ান আর্মচেয়ারে বসল।
আমি জানতাম তুমি কেমন বোধ করবে। উইক্কা বলে চলল, মাঝে মাঝে আমরা খুব সহজভাবে একটা পথ তৈরি করি, কারণ আমরা তাতে বিশ্বাস করি না। ব্যাপারটা খুব সহজ। যাই হোক, যখন ঘটনা ঘটতে থাকে, পথ নিজেই আমাদের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়, আমরা তাতে চলতে ভয় পাই।
উইক্কা বলেছিল সে বুঝতে পারে না কেন এত মানুষ তাদের সারাটা জীবন এমন পথে ধ্বংস করে চলে, যে পথ তারা অনুসরণ করতে চায় না। পরিবর্তে একটা মাত্র পথ অনুসরণ করে তারা কোথাও না কোথাও যেতে পারে।
আমার বিশ্বাস এটা একটা কৌশল। ব্রাইডা প্রতিবাদ করল। আগের মতো ঔদ্ধত্য তার মধ্যে নেই। উইক্কার ওপর তার শ্রদ্ধা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
না, না, দৃশ্যটা কোনো কৌশল ছিল না। আমি ফোনে তোমাকে যা বলছিলাম তা ছিল কৌশল। হাজার হাজার বছর ধরে, আমরা শুধু যাদের দেখতে পেতাম তাদের সাথেই কথা বলতাম। তারপর, শত বছর আগে, দেখা আর শোনা আলাদা হয়ে গেল। আমরা এখন মনে করি ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক। আমাদের প্রতিক্রিয়ার ধরনটা বুঝতে পারি না। আমাদের শরীর এখনো এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
বাস্তব ফলাফল হলো, যখন আমরা ফোনে কথা বলি, আমরা প্রায়ই এ রকম একটা অবস্থায় পৌঁছে যাই, যাকে জাদুকরী আবেশ বলা যায়। আমাদের মন আরেকটা ফ্রিকোয়েন্সিতে চলে যায়। আর অদৃশ্য জগতের কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠি। আমি জানি কোনো কোনো ডাইনি অন্যের সাথে কথা বলার সময় সব সময় ফোনের পাশে কাগজ-কলম রাখে। তারা ফোনে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা চালিয়ে যায়। ফোন রেখে দেয়ার পরে তাদের কাছে চাঁদের রীতিনীতির প্রতীক এসে ধরা দেয়।
কিন্তু ট্যারট কার্ড নিজেই আমার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিল কেন?
যারা জাদুবিদ্যা অধ্যয়ন করতে চায় তাদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। উইক্কা উত্তর দিল। যখন আমরা পথ সেট করি, আমরা সব সময় কী আশা করি তার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করে নিই। মহিলারা তাদের আত্মার সঙ্গীর খোঁজে থাকে। পুরুষরা শক্তির খোঁজ করে। কেউই শিখতে ততটা আগ্রহী নয়। তারা শুধু তাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে চায়।
কিন্তু জাদুবিদ্যার পথ–জীবনের পথের মতো–সব সময় রহস্যময়তায় ঘেরা। কিছু শেখা মানে হচ্ছে, যে জগৎ সমন্ধে তুমি কিছুই জানো না তার সান্নিধ্যে আসা। শিখতে হলে তোমাকে অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে।
যেমনটি অন্ধকার রাতে হয়েছিল। ব্রাইডা বলল।
বাধা দিয়ো না। উইক্কার গলা বেশ তিক্ত শোনাল। ব্রাইডা বুঝতে পারল সে যা বলেছে তার জন্য নয়। হতে পারে উইক্কা জাদুকরের উপর রেগে আছে। ব্রাইডা ভাবল। সম্ভবত উইক্কা একদিন জাদুকরের প্রেমে পড়েছিল। তারা দুজনে প্রায় সমবয়সী।
আমি দুঃখিত। ব্রাইডা বলল।
ঠিক আছে। উইক্কা নিজের প্রতিক্রিয়ায় অবাক হয়েছে।
আপনি আমাকে ট্যারট কার্ড সম্বন্ধে বলুন।
যখন তুমি কার্ড ছড়িয়ে দাও, কী ঘটবে সে সম্পর্কে তোমার সব সময় পূর্ব ধারণা থাকে। তুমি কখনো কার্ডগুলোকে তাদের নিজেদের গল্প শোনাতে দাও না। তুমি নিশ্চিত করে দিতে চাও কী তুমি তাদের কাছ থেকে দেখতে চাও।
তোমার সাথে ফোনে কথা বলা শুরু করে আমি তা বুঝতে পারি। আমি বুঝতে পারি এটা একটা লক্ষণ, আর ফোনই আমার সহযোগী হতে পারে। আমি খুবই বিরক্তিকর আটপৌরে কথোপকথন শুরু করে তোমাকে কার্ডের দিকে নজর রাখতে বলি। তুমি ফোনের কারণে এক ধরনের আবেশের মধ্যে ছিলে। আর কার্ডগুলো তোমাকে জাদুকরী জগতে নিয়ে গিয়েছিল।
উইক্কা সাজেশন দিল এর পরেরবার কেউ যখন কারোর সাথে ফোনে কথা বলতে থাকবে, তখন ব্রাইডা তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যা দেখতে পাবে তাতে সে বিস্মিত হবে।
আমি আপনাকে আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। ব্রাইডা চা নিতে নিতে বলল।
আমি জানতে চাই, কেন আপনি আমাকে অন্য পথের কথা বলছেন না। ব্রাইডা বলল।
কারণ উইক্কা কিছুক্ষণ ভাবল কারণ, ম্যাগাস তোমার মধ্যে কী দেখেছে আমি খুঁজে বের করতে চাই। আমি তোমার ঐশ্বরিক শক্তির ব্যাপারটা বুঝতে চাই কিন্তু সে মুখে বলল, কারণ তোমার মধ্যে শক্তি আছে।
আপনি কীভাবে জানেন?
খুব সহজ। তোমার কানের মধ্য দিয়ে।
আমার কানের মধ্য দিয়ে! অদ্ভুত কথা! ব্রাইডা ভাবল। সে কি আমার জ্যোতি দেখতে পাওয়ার কথা ভাবছে?
প্রত্যেকের মাঝে শক্তি রয়েছে। কিন্তু অনেকেই অন্যদের তুলনায় উন্নত ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে জন্মে। যেমন, আমাকে ঐশ্বরিক শক্তি উন্নত করতে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যেসব মানুষ ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে জন্মে, তাদের খুব ছোট সংযুক্ত এয়ারলোব থাকে।
সাথে সাথেই ব্রাইডা তার কানের পাতায় হাত দিল। ব্যাপারটা সত্য।
তোমার কি গাড়ি আছে?
না, ব্রাইডা বলল। তার গাড়ি নেই।
তাহলে ট্যাক্সি ভাড়া করার মতো সৌভাগ্য তৈরি করো। উইক্কা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমাদের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার সময় হয়েছে।
হঠাৎ সব কিছু বেশ দ্রুতগতিতে চলছে। ব্রাইডা ভাবল। সে উঠে দাঁড়াল। আবেশী অবস্থায় যে মেঘ সে দেখেছিল, জীবন তা সরিয়ে দিতে শুরু করেছে।
.
১০.
মধ্যদুপুর। তারা ডাবলিনের দক্ষিণে পনেরো মাইল দূরে পাহাড়ের কাছে পৌঁছাল। আমরা এই ট্রিপ বাসে করে আসতে পারতাম। ব্রাইডা ট্যাক্সি ভাড়া দিতে দিতে নিজের মনে গজগজ করল। উইক্কা সাথে একটা ব্যাগে করে কিছু কাপড়চোপড় এনেছে।
আপনারা চাইলে আমি অপেক্ষা করতে পারি। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, এই এলাকায় আরেকটা ট্যাক্সি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। ফাঁকা জায়গা।
চিন্তা করো না। উইক্কা ব্রাইডাকে স্বস্তি দেয়ার জন্য বলল, আমরা যা চাই তা সব সময় পেয়ে যাই।
ড্রাইভার তাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। তারা পাহাড়ের কাছে, গাছের নিচে দাঁড়াল।
ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাও। উইক্কা বলল। জঙ্গলের আত্মারা সব সময় ভালো আচরণ আশা করে।
ব্রাইডা অনুমতি চাইল। যে জঙ্গলটা খুব সাধারণ জঙ্গল বলে মনে হচ্ছিল তাতে যেন হঠাৎ প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো।
দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের সেতুবন্ধনের মাঝে থাকো। গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উইক্কা বলল। জগতের সব কিছুরই প্রাণ আছে। তোমাকে সব সময় জীবনের সংস্পর্শে থাকার চেষ্টা করতে হবে। তারা তোমার ভাষা বুঝতে পারবে। তাহলে গোটা জগন্টাই তোমার কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করবে।
ব্রাইডা উইক্কার হাঁটাচলায় বিস্মিত হলো। উইক্কার পা এ রকমভাবে ভূমিতে পড়ছিল যে তাতে কোনো শব্দ হচ্ছিল না।
তারা বিশাল আকৃতির একটা পাথরের ধারের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ব্রাইডা যখন ভাবছিল কীভাবে এত বড় পাথরটা এখানে এলো, তখনই সে ফাঁকা জায়গার ঠিক মাঝখানে আগুন পোড়া ছাই দেখতে পেল।
খুব সুন্দর জায়গা। সন্ধ্যা হওয়ার খানিক আগে, সূর্যের আলো গ্রীষ্মের অপরাহ্নে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। পাখিরা কলরব করছে, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। তারা দুজন বেশ কিছুটা ওপরের দিকে আছে। ব্রাইডা চতুর্দিকে এবং নিচে দিগন্তের দিকে তাকালো।
উইক্কা ব্যাগের মধ্য থেকে আলখাল্লার মতো একটা জিনিস বের করে গায়ে চাপিয়ে নিল। তারপর গাছের আড়ালে ব্যাগটা রাখল, যাতে কেউ ফাঁকা জায়গা থেকে দেখতে না পায়।
বসে পড়ো। উইক্কা বলল।
উইক্কাকে অন্য রকম দেখাচ্ছিল। ব্রাইডা বুঝতে পারল না, আলখাল্লার কারণে তাকে এমন লাগছে, নাকি এ জায়গাটাই মনে অন্য রকম অনুভূতি এনে দিয়েছে।
প্রথমত আমি কী করতে যাচ্ছি তা ব্যাখ্যা করছি। আমি খুঁজে বের করতে চাই, কীভাবে ঈশ্বরের শক্তি তোমার ওপর কাজ করে। আমি শুধু তোমাকে সেই শিক্ষা দিতে শুরু করব, যা তোমার ঐশ্বরিক শক্তি আমাকে বলে দেবে।
উইক্কা ব্রাইডাকে রিলাক্স হতে বলল। নিজেকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের কোলে সঁপে দিতে বলল, যেমনটি সে ট্যারট কার্ডের ক্ষেত্রে করেছিল।
তোমার অতীত জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে, তুমি জাদুবিদ্যার রাস্তা তৈরি করে নিয়েছ। আমি তোমার ট্যারট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জেনেছি।
ব্রাইডা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। কিন্তু উইক্কা চোখ খোলা রাখতে বলল।
জাদুকরী জায়গা সব সময় সুন্দর, যেমনটা সে সর্বদা থাকতে চায়। জলপ্রপাত, পাহাড়, আর জঙ্গলের এসব জায়গায় পৃথিবীর আত্মারা খেলা করে, হাসে আর আমাদের সাথে কথা বলে। তুমি এখন পবিত্র জায়গায় আছো। পাখি আর বাতাসের দোলা তাই জানিয়ে দিচ্ছে। ঈশ্বরকে এ জন্য ধন্যবাদ। এই পাখি, এই হাওয়া আর জঙ্গলের বাসিন্দা আআরা, সব সময় দশ্যমান আর অদৃশ্যমানতার মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে থাকে।
উইক্কার কণ্ঠস্বর ব্রাইডাকে বেশ স্বস্তি দিল। এই মুহূর্তে ধর্মীয় অনুভূতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
অন্য আরেক দিন আমি তোমাকে জাদুবিদ্যার জটিল গোপনীয়তা সমন্ধে বলব, আত্মার সঙ্গী সমন্ধে বলব। একজন মানুষের সারা জীবন তার আত্মার সঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে কেটে যায়। সে হয়তো জ্ঞান, অর্থসম্পদ অথবা ক্ষমতার জন্য ছুটে চলার ভান করতে থাকে কিন্তু তা কোনো ব্যাপার নয়। যা কিছুই সে অর্জন করুক না কেন, আত্মার সঙ্গী খুঁজে না পেলে সব কিছুই ব্যর্থ হয়ে যায়।
ব্রাইডা বাতাসে অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি অনুভব করল। কয়েক মুহূর্তের জন্য, এটা এমন এক অনুভূতি যা সে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। তার চোখ জলে ভরে উঠল।
রাতের বেলা, আমরা যখন আলাদা হয়ে যাই, আমাদের একটা অংশ নিজেকে প্রস্তুত করে, জ্ঞান অর্জন করে। পুরুষের অংশ। পুরুষ মানুষেরা কৃষি, প্রকৃতি আর আকাশের তারাদের চলন বোঝার চেষ্টা করে। জ্ঞান এ রকম ক্ষমতা, যা পৃথিবীকে আপন কক্ষে রাখে, আর তারারা তাদের কক্ষপথে ভ্রমণ করে। মানুষের বিজয় ওখানেই জ্ঞানকে বজায় রেখে প্রতিপালন করা। আর এ কারণেই গোটা মানব জগৎ টিকে আছে।
নারীরা এমন কিছু দেয়, যা অনেক বেশি রহস্যময় আর নাজুক, কিন্তু তা ছাড়া জ্ঞানের কোনো অর্থ নেই। তা রূপান্তরযোগ্য। পুরুষরা ভূমি কর্ষিত করে উর্বর করে, আমরা তাতে বীজ বপন করি। মাটি গাছপালায় রূপান্তরিত হয়।
মাটির বীজ দরকার। বীজের মাটি দরকার। একটার অর্থ শুধু অন্যে বোঝে। মানুষের ক্ষেত্রেও একই জিনিস। যখন পুরুষের জ্ঞান নারীর শক্তির সাথে মিলিত হয়, তখন মহৎ জাদুকরী শক্তি তৈরি হয়। তার নাম প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা অর্থ হচ্ছে জানা এবং রূপান্তরিত করা।
আমি যাদু বিদ্যা শিখকে চাই