১. ছোঁচা শব্দটা

০১.

ছোঁচা শব্দটা কোথেকে এল মশাই? ছুঁচো থেকে নাকি? হাতটান শব্দটারই বা ইতিহাস কী? কিংবা দু’ কান-কাটা কথাটাই বা অমন অপমানজক কেন?

অবশ্য অপমান কথাটারও কোনও মানে হয় না। অপমান মনে করলেই অপমান। আমার যা অবস্থা তাতে অপমান গায়ে মাখতে যাওয়াটাও এক লাটসাহেবি শৌখিনতা।

সুবিনয়দের পিছনের বারান্দায় আমি শুই। বারান্দাটা খারাপ নয়। বুক-সমান দেয়ালের গাঁথুনি, তার ওপরটা গ্রিল দেওয়া। বারান্দার অর্ধেকটা প্লাইউড দিয়ে ঘিরে খাওয়ার ঘর হয়েছে, বাকি অর্ধেকটায় এঁটো বাসনপত্র ডাই করা থাকে, মুখ ধোওয়ার বেসিন রয়েছে, কয়েকটা প্যাকিং বাক্স পড়ে আছে খালি। এইসব বাক্সে বিদেশ থেকে কেমিকালস আসে। বিদেশের জিনিস বলে বাক্সগুলো বেশ মজবুত। দিনের বেলা প্যাকিং বাক্সগুলো, মোট তিনটে, একটার ওপর আর-একটা দাড় করানো থাকে। রাত্রিবেলা ওগুলো নামিয়ে আমি পাশাপাশি সাজিয়ে নিই। বাক্সগুলো সমান নয়, যার ফলে একটু উঁচু-নিচু হয়। তা হোক, তা হোক। আমার কিছু অসুবিধা হয় না। একেবারে মেঝেয় শোওয়ার চেয়ে এটুকু উচ্চতা মন্দ কী?

বারান্দার লাগোয়া পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘরে সুবিনয়ের বিধবা মা শোন খাটে, মেঝেয় শোয় ষোলোসতেরো বছর বয়সের ঝি কুসুম। অন্য ঘরে সুবিনয় এক খাটে শোয়, অন্য খাটে দুই বাচ্চা নিয়ে সুবিনয়ের বউ ক্ষণা। সামনের দিকে আরও দুটো ঘর আছে। তার একটা সুবিনয়ের ল্যাবরেটরি, অন্যটা বসবার ঘর। কিন্তু সেইসব ঘরে আমাকে থাকতে দেওয়ার কথা ওদের মনে হয়নি। সুবিনয়ের এক বোন ছিল এই সেদিন পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছিল না কিছুতেই। যতই তার বিয়ের দেরি হচ্ছিল ততই সে দিনরাত মুখ আর হাত-পায়ের পরিচর্যা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। ছেলে-ছোকরা দেখলে কেমন হন্যের মতো হয়ে যেত, এবং শেষমেষ আমার মতো অপদার্থের দিকেও তার কিছুটা ঝুঁকে পড়ার লক্ষণ দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। একদিন তো সে পরিষ্কার তার বউদিকে বলে দিল, এই শীতে উপলদা একদম খোলা বারান্দায় শোয়, তার চেয়ে খাওয়ার ঘরটায় শুতে দাও না কেন? এ কথা যখন হচ্ছিল তখন আমি চার-পাঁচ হাত দূরে বসে সুবিনয়ের মুখোমুখি খাওয়ার টেবিলে চা খাচ্ছি। চোর-চোখে তাকিয়ে দেখি, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো সুবিনয়ের বোন অচলার দিকে চেয়ে রান্নাঘরের ভিতরে টুলে-বসা ক্ষণা একটু চোখের ইঙ্গিত করে চাপা স্বরে বলল, উঃ হু!

আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। ঠিকই তো! খাওয়ার ঘরে দেয়ালের র‍্যাকে দামি স্টিলের বাসনপত্র, চামচ থেকে শুরু করে কত কী থাকে সরানোর মতো। এখানে আমাকে শোওয়ানো বোকামি। তা সে যাক গে। অচলার যখন ওইরকম হন্যে দশা, তখন আমার এ বাড়িতে বাস সে এক রাতে প্রায় উঠিয়ে দিয়েছিল আর কী। কোথাও কিছু না, মাঝরাতে একদিন দুম করে চলে এসেছিল বারান্দায়। বাথরুমে যাওয়ার প্যাসেজের ধারেই আমি শুই, মাঝরাতে বারান্দা দিয়ে বাথরুমে আনাগোনা করতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু অচলা বাথরুমে যায়নি, সটান এসে আমার প্যাকিং বাক্সের বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। সেটা নিতান্ত মানবিক করুণাবশতও হতে পারে। কিন্তু তাইতেই আমার পাতলা ঘুম ভেঙে যেতে আমি ‘বাবা গো’ বলে চেচিয়ে উঠেছিলাম ভূত ভেবে। অচলা সময় মতো পালিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে বিকট শব্দ করেছিল। গোলমাল শুনে তার মা উঠে এসে বারান্দায় তদন্ত করেন, আমি তাকে বলি যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছি। তিনি তা বিশ্বাস করেননি এবং আমার উদ্দেশেই বোধহয় বলেন, এ সব একদম ভাল কথা নয়। কালই সুবিনয়কে বলছি।

সুবিনয়কে তিনি কী বলেছিলেন কে জানে, কিন্তু সুবিনয় ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি। ঘামালে বিপদ ছিল। কারণ, সুবিনয়ের চেহারা দানবের মতো বিশাল এবং রাগলে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কোনও ব্যাপার নিয়েই সে বড় একটা মাথা ঘামায় না। সর্বদাই সে এক ভাবনার ঘোরে বাস করে। জাগতিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে তাকে কেউ কোনও কথা বললে সে ভারী বিরক্ত হয়। এই যে আমি তার বাড়িতে আছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, এটাও যে খুব বাঞ্ছিত ব্যাপার নয় কোনও গৃহস্থের কাছে তাও সে বোঝে না। সে সর্বদাই তার কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে আছে। মস্ত এক কোম্পানির চিফ কেমিস্ট, কিছু পেপার লিখে বৈজ্ঞানিক জগতেও নাম-টাম করেছে। প্রায়ই বিদেশে যায়। সুবিনয় বাংলাদেশের সেই লুপ্তপ্রায় স্বামীদের একজন যাদের বউ খানিকটা সমীহ করে চলে। স্ত্রী স্বামীকে সমীহ করে, এ ব্যাপারটা আমি আর কোথাও দেখিনি এ জীবনে। সুবিনয়ের এই কর্তৃত্বময় অস্তিত্বের দরুনই আমি এ বাড়িতে বেশ কিছুকাল টিকে আছি। সুবিনয় যে আমাকে তাড়ায় না তার একটা গূঢ় কারণও আছে।

তা বলে যেন কেউ মনে না করেন যে, আমার প্রতি সুবিনয় স্নেহশীল। সত্য বটে, স্কুলজীবনে আমরা সহপাঠী ছিলাম মিত্র ইনস্টিটিউশনে। গলায় গলায় ভাব ছিল তখন। কলেজে ও সায়েন্স নিল, আমি কমার্স। কোনওক্রমে বি কম পাশ করে আমি লেখাপড়া ছাড়ি, সুবিনয় সোনার মেডেল পেয়ে এগিয়ে গেল। আমরা ভিন্ন হয়ে গেলাম। দুই বন্ধুর একজন খুব কৃতী হয়ে উঠলে আর বন্ধুত্ব থাকে না, কমপ্লেকস এসে যায়।

এখন আমাকে সবাই অপদার্থ বলে জানে। কেবল দীর্ঘকাল আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, আমার প্রতিভা একদিন বিকশিত হবেই। আমি মোটামুটি ভাল গান গাইতে পারতাম, চমৎকার থিয়েটার করতাম, নাটক-ফাটকও লিখেছি এককালে উদ্বাস্তুদের দুঃখ নিয়ে, অল্পস্বল্প ছবি আঁকতে পারতাম, সবচেয়ে ভাল পারতাম কাদামাটি দিয়ে নানা রকম মূর্তি তৈরি করতে। এত বহুমুখী প্রতিভা নিজের ভিতরে দেখে আমার ধারণা ছিল, একটা না একটা লাইন ধরে আমি ঠিক উন্নতি করব, আর সবক’টা লাইনেই যদি উন্নতি করি তা হলে তো কথাই নেই। আরও অনেকেরই এককালে ধারণা ছিল। আমার বিচক্ষণ বাবা কিন্তু বরাবর বলে এসেছেন, এ ছেলের কিছু হবে না। এত দিকে মাথা দিলে কি কারও কিছু হয়?

আমার পারিবারিক ইতিহাসটি খুবই সংক্ষিপ্ত। আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমার পাঁচ বছর বয়সে মা মারা গেলে বাবা আমার এক মাসিকে বিয়ে করেন। মায়ের পিসতুতো বোন। মাসির এক চোখ কানা আর দাত উঁচু বলে তাঁর বিয়ে হচ্ছিল না। আমি সেই মাসির কাছে মানুষ। বি কম পরীক্ষার কিছু আগে বাবা অপ্রকট হলেন। দুনিয়ায় তখন আমার মাসি, আর মাসির আমি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু কেউ কারও ভরসা নই। মাসি বলত, তুই যদি চুরি ছ্যাঁচড়ামি গুন্ডামি বা ডাকাতি করেও দুটো পয়সা আনতে পারতিস!

বাস্তবিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যে-সব উন্নতি হয় বলে শুনেছি তার কিছুই আমার হল না। হ্যাঁ, গান আমি এখনও আগের মতোই গাই, সুযোগ পেলে অভিনয়ও খারাপ করব না, আগের মতো নাটকও লিখতে পারি। ছবি কিংবা মাটির পুতুলও আঁকতে বা বানাতে পারি। কিন্তু সে সবও যেন কোথায় আটকে আছে, উন্নতি হয়নি। সিনেমায় নামতে গিয়েছিলাম। দু-চারটে সিনেমায় চান্স পেলাম বটে ছোট ছোট ভূমিকায় কিন্তু তাকে সিনেমায় নামা বলে না ঠিক। দুটো-একটা চাকরিও পেয়েছিলাম, একটার কোম্পানি ক্লোজার হল, অন্যটায় অস্থায়ি চাকরি টিকল না। মাসির লেখাপড়া ছিল না তেমন। বাবা লোকান্তরিত হওয়ার পর মাসি বিস্তর সেলাই-ফোড়াই করে সংসার চালাতে গিয়ে একটা ভাল চোখকেও প্রায় খারাপ করে ফেলল। মাসি যখন কাঁদত তখন কিন্তু তার অন্ধ চোখেও জল পড়ত।

বিনা কাজে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম। বেশ লাগত। কাজকর্ম না করতে করতে এক ধরনের কাজের আলসেমি পেয়ে বসেছিল। আড্ডার অভাব ছিল না। সংসারের ভাবনা একা মাসিকে ভাবতে দিয়ে আমি চৌপর দিন বাইরে কাটাতাম। নিছক সঙ্গী না জুটলে ময়দানের ম্যাজিক, খোলামাঠের ফুটবল বা ক্রিকেট, ইউসিস লাইব্রেরিতে ঢুকে ছবির ম্যাগাজিন দেখে সময় কাটাতাম। বাবা বাড়ি করে যাননি, ভাড়া বাকি পড়ায় একবার বাড়িওলা হুড়ো দিয়ে তুলে দিল। বুড়ো বাড়িওলা মারা গেছে, ছেলেরা লায়েক হয়েছে। তাদের অত মায়া-দয়া নেই। মহা আতান্তরে পড়ে মাসি তার লতায়-পাতায় সম্পর্কের এক বড়লোক ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠল। ভাই মাসিকে তাড়াল না, গরিব আত্মীয়দের আশ্রয় দিলে বিস্তর কাজ আদায় করা যায়। কিন্তু সেখানে আমার ঠাঁই হল না। তারা পরিষ্কারই বলে দিলেন, তোমার বোনপোকে রাখতে পারব না বাপু, বড়সড় ছেলে, নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেবে। এ কথা শুনে মাসি বলে, ওমা, বোনপো কী? ও আমার ছেলে, নিজের হাতে মানুষ করেছি যে! কিন্তু তারা কিছুতেই মত দিল না যখন মাসির তখন হাউহাউ করে কান্না। আমি মাসিকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়ে তখনকার মতো ঠান্ডা করে কেটে পড়লাম। আমার যা হোক, কানা মাসিটা আমার তো না খেয়ে মরবে না। তবে সে বাড়িতে আমার যাতায়াত আছে, কয়েক বার নেমন্তন্নও খেয়েছি।

তখন হাওড়া-কদমতলা রুটের একটা প্রাইভেট বাসে কন্ডাক্টরি করি। সারাদিন পয়সার ঝনঝন, লোকের ঘেমো গা, গাড়ির চলা, তার মধ্যে কখনও ঘুণাক্ষরেও মনে পড়ত না যে, আমি বি কম পাশ বা এ কাজের চেয়ে একটা কেরানিগিরি পেলে অনেক ভাল হত। সে যা হোক, কন্ডাক্টরি কিছু খারাপ লাগত না। তবে প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়ার সময়ে আমি বেশি সুবিধা করতে পারতাম না। আর একটা লাভও হত বেশ, প্যাসেঞ্জারদের মুখে নানা খবর শুনে শুনে দুনিয়া সম্পর্কে বিনা মাগনা অনেক জ্ঞানলাভও হয়ে যেত। কয়েক দিনের মধ্যেই এলাকার হেক্কোড়দের চিনে ফেললাম, তাদের কাছে টিকিট বেচার প্রশ্ন উঠত না, উলটে খাতির দিতে হত। মনাই ঘোষ ছিলেন এলাকার মাথা। মনে আছে একবার তিনি পঞ্চাননতলার মোড়ে বাস থামিয়ে নেমে গিয়ে লন্ড্রির জামা কাপড় আনলেন, বাস ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চোর, ছিনতাইবাজ, পকেটমার বিস্তর চেনা-জানা হয়ে। গেল, আজও ও-সব জায়গায় গেলে দু’-চার কাপ চা বিনা পয়সায় লোকে ডেকে খাওয়ায়। আনাড়ি ছিলাম বলে প্রথম দিকে আমার ব্যাগ থেকে বার দুই খুচরো হাপিশ হয়েছে। পরের দিকে কাকের মতো চালাক হয়ে উঠি। বাস চালাত ধন সিং নামে একটা রাজপুত। জলের ট্যাঙ্কের কাছে একবার সে একটা ছোকরাকে চাপা দিলে রাস্তার লোক রে রে করে তাড়া করল। ভয়ে ধন সিংয়ের আর হিতাহিত জ্ঞান রইল না। পঞ্চাননতলার সরু রাস্তায় যে আপ-ডাউন বাস কী করে চলে সেইটাই লোকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, আর সেই মারাত্মক ভিড়ের সরু রাস্তায় ধন সিং বাসের গতি বোধকরি ত্রিশ-চল্লিশ মাইল তুলে দিল। কোনও স্টপে গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না। প্যাসেঞ্জাররা প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে, বাঁচাও। এই স্টুপিড! এই উল্লুকের বাচ্চা! এই শুয়োরের বাচ্চা! কে শোনে কার কথা! আমরা দুই কন্ডাক্টর, আমি আর গোবিন্দ, দুই দরজায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বিপদ দেখলেই লাফাব। ধন সিং কদমতলা পর্যন্ত উড়িয়ে নিল বাস। তারপর যেই থামল, অমনি কোত্থেকে যে শয়ে শয়ে লোক জুটে গেল চারধারে কে জানে! পালানোর পথ ছিল না। ধন সিং প্রচণ্ড মার খেয়ে আধমরা হয়ে হাসপাতালে গেল, আমি আর গোবিন্দ ঠ্যাঙানি খেয়ে কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে পড়ে রইলাম রাস্তায়। মুখ-টুখ ফুলে, গায়ে গতরে একশো ফোড়ার ব্যথা হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা।

অনেক পরে চেনা একটা হোটেলের বাচ্চা বয়গুলো এসে আমাদের জলটল দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। দু’জনে কষ্টেসৃষ্টে চেনা দোকানে গিয়ে কোকাতে কোকাতে বসলাম। ব্যাগ দু’জনেরই হাপিশ হয়ে গেছে, জামা-টামা ছিড়ে একাকার, গোবিন্দর চটিজোড়াও হাওয়া। পাবলিক প্যাদালে তো কিছু করার নেই। রাগও করা যায় না, কার মুখ মনে করে রাগ করব? গোটা জীবন আর তাবৎ দুনিয়ার ওপর রাগে চোখে জল আসে শুধু। গোবিন্দ আর আমি একটা করে কোয়ার্টার রুটি আর ছোট সানকির মতো কলাই করা প্লেটে হাফ প্লেট করে মাংস নিয়ে বসলাম। মাংস মুখে দিয়েই গোবিন্দ উহু উহু করে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, জিভটা কেটে এই ফুলেছে মাইরি, নুন ঝাল পড়তেই যা চিড়িক দিয়েছে না! খাই কী করে বল তো!

এ সব কথা যখন হচ্ছে তখনই ছোকরা বয়টা এসে বলল, গোবিন্দদা, আপনার দেশ থেকে আপনার খোঁজে একটা লোক অনেক বার এসে ঘুরে গেছে। ওই আবার এসেছে, দেখুন।

গোবিন্দ মুখ তুলল, আমিও দেখলাম, বুড়ো মতো একটা লোক খুব বিষন্ন মুখের ভাব করে এসে বেঞ্চে বসে মুখের ঘাম মুছল সাদা একটা ন্যাকড়া পকেট থেকে বের করে।

গোবিন্দ বলল, তারক জ্যাঠা, খবরটবর কী? খারাপ নাকি?

 হ্যাঁ বাবা। তোমার পিতৃদেব—

গোবিন্দ আঁতকে উঠে বলল, আর বলবেন না, আর বলবেন না।

লোকটা ভড়কে থেমে গেল। আর দেখলাম, গোবিন্দ গোগ্রাসে মাংস-রুটি খাচ্ছে জিভের মায়া ত্যাগ করে। খেতে খেতেই বলল, ও শুনলেই খাওয়া নষ্ট। এখন পেটে দশটা বাঘের খিদে। একটু বসুন, ও খবর পাঁচ মিনিট পরে শুনলেও চলবে। শত হোক, হিন্দুর ছেলে তো! ও খবর শুনলে খাই কী করে!

খাওয়ার শেষে গোবিন্দ উঠে দাম-টাম দিয়ে এল, বলল, চলুন, দেশে যেতে হবে তো?

তারক জ্যাঠা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা তো হবেই। পরশুদিনের ঘটনা বাবা, মাঠ থেকে ফিরে তোমার বাবামশাই হঠাৎ উঠোনে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কত জল, পাখা, ওঝা, বদ্যি, হাঃ—

 গোবিন্দ আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, উপল, খবরটা ভাল। তারপর গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, হক্কের মরা মরেছে, জ্যাঠা। আর বেঁচে থেকে হতটা কী? দুনিয়া তো ছিবড়ে হয়ে গিয়েছিল। এই বলে সে আমার দিকে চেয়ে বলল, উপল, তুইও চল। গায়ের ব্যথাটা ঝেড়ে আসবি। দেশে আমাদের ধানজমি আছে। বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল বদমাইশির জন্য, তাই ফিরতে পারছিলাম না। নইলে কোন শালা মরতে কন্ডাক্টরি করে।

বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে দু’জনে সেই রাতে কেটে পড়লাম হাওড়া জেলার শিবগঞ্জে।

আমার স্বভাব বসতে পেলেই ঠেলেঠুলে শুয়ে পড়া। গোবিন্দর দেশটা বেশ ভালই। বাগনান থেকে বাসে ঘণ্টা কয়েকের রাস্তা। পৌঁছে গেলে মনে হয়, ঠিক এ রকমধারা জায়গাই তো এতকাল খুঁজছিলাম। গোবিন্দদের ধানজমি বেশি না হোক, ওদের দু’বেলা ভাতের অভাব নেই। বিরাট একটা নারকোল বাগান আছে। মেটে দোতলা বাড়িতে বেশ মাঝারি বড় সংসার।

দু’বেলা খাওয়ার-শোওয়ার ভাবনা নেই, আমি তাই নিশ্চিন্তে সেখানে শেকড় চালিয়ে দিলাম। ভরসা হল, বাকি জীবনটা এখানেই কেটে যাবে বুঝি! গোবিন্দ তখন প্রায়ই বলত, দাঁড়া তোকে এ দিকেই সেট করিয়ে দেব। কিন্তু মাস তিনেক যেতে না যেতেই গোবিন্দ বিয়ে করে বসল, আর তার দুমাস বাদেই গোবিন্দর মুখ হাঁড়ি। আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কয় না। বুঝলাম, ওর বউ বুদ্ধি দিয়েছে। তবু গায়ে না-মেখে আমি আরও এক মাস কাটিয়ে দিলাম। মোট ছ’ মাস পর। গোবিন্দর বড় ভাই একদিন খাড়ুবেড়েতে যাত্রা দেখে ফেরার পথে গহিন রাতে রাস্তায় টর্চ ফেলে ফেলে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে নরমে গরমে বলেই ফেলল, এ বয়সটা তো বসে খাওয়ার বয়স নয় গো বাপু। গাঁ-ঘরে কাজকর্মই বা কোথায় পাবে। বরং কলকাতার বাজারটাই ঘুরে দেখোগে।

গোবিন্দর বড় ভাই নন্দদুলালের খুব ইচ্ছে ছিল তার মেয়ে কমলিনীকে আমি বিয়ে করি। কিন্তু কমলিনীর বয়স মোটে বারো, সুশ্রীও নয়, তা ছাড়া আমারও বিয়ের ব্যাপারটা বড় ঝামেলা বলে মনে হয়, তাই রাজি হইনি, ঘরজামাই রাখলেও না হয় ভেবে দেখতাম। তা সে প্রস্তাবও নয়, বরং কমলিনীর মা আমাকে প্রায়ই কাজ খোঁজার জন্য হুড়ো দিত, চাষবাস দেখতে পাঠাত। বেলপুকুর বাজারে গিয়ে শুকনো নারকোল বেচে এসেছি কতবার। আখের চাষ হবে বলে গোটা একটা খেত নাড়া জ্বেলে আগুনে পোড়াতে হয়েছিল। এত সব কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না। বউ হলে সে আরও তাড়া দেবে সারা জন্ম।

এক বর্ষার রাতে গোবিন্দদের গোলাঘরে চোরে সিঁধ দিল। বিস্তর ধান লোপাট। সকালবেলা খুব চেঁচামেচি হল, তারপর থিতু হয়ে সবাই বসে এক মাথা হয়ে ঠিক করল যে, এবার থেকে আমাকে সারা রাত বাড়ি চৌকি দিতে হবে। একটা নিষ্কর্মা লোক সারা দিন বসে খাবে, কোনও কাজে লাগবে না, এ কি হয়?

দিন পনেরো পাহারা দিতেও হল। এক রাতে ফের চোর এল। আমার চোখের সামনে পরিষ্কার পাঁচ-ছ’জন কালো কালোলোক। তাদের দু’-একজন আমার মুখ চেনা। দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় বসে লণ্ঠন পাশে নিয়ে একটা লম্বা লাঠি উঠোনে মাঝে মাঝে ঠুকছিলাম, দুটো দিশি কুকুর সামনে ঝিমোচ্ছে। এ সময়ে এই কাণ্ড। চোর দেখে ভিরমি খাই আর কী। লাঠি যে মানুষের কোন কাজে লাগে তা তখনও মাথায় সেঁধোচ্ছে না। চোর ক’জন এসে সোজা আমার চারধারে দাঁড়িয়ে গেল, একজন বলল, উপল শালা, মেরে মাঠে পুঁতে দিয়ে আসব, মনে থাকে যেন। কুকুর দুটো দু’বার ভুক ভুক করে হঠাৎ ল্যাজ নাড়তে লাগল চোরদের খাতির দেখানোর জন্য। দিশি কুকুরদের বীরত্ব জানা আছে। আমিও তাদের দেখে কায়দাটা শিখে গেলাম, এক গাল হেসে বললাম, আরে তোমরা ভাবো কী বলো তো, অ্যাঁ? পাহারা কি আসলে দিই? গুঁতোর চোটে পাহারা দেওয়ায়। যা করার চটপট সেরে নাও ভাই সকল, আমি চার দিকে চোখ রাখছি।

চোরেরা যখন মহা ব্যস্ত ঠিক তখনই আখের বুঝে আমি লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে লম্বা দিলাম। নইলে পরদিন আমার ওপর দিয়ে বিস্তর ঝামেলা যেত।

তা সেই লাঠি আর লণ্ঠন ছাড়া তখন আর আমার কোনও মূলধন ছিল না। আফসোস হল, চোরদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে যদি কিছু নগদ বা ঘটিবাটি গোবিন্দদের বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনতে পারতাম তো বেশ হত।

আমার বাবা সারা জীবনটাই ছিলেন ডাকঘরের পিয়োন, শেষ জীবনে সর্টার, আর এক থাক উচুতে উঠতে পারলে তাকে ভদ্রলোক বলা চলত, তা তিনি উঠতে পারেননি। বিস্তর ধারকর্জ করে খাওয়া-দাওয়া ভাল করতেন। ওই এক শখ ছিল। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড-এর অর্ধেকই প্রায় ফৌত হয়ে গিয়েছিল ওই কর্মে। সারাটা জীবন তাকে কেবল টাকা খুঁজতে দেখেছি। অন্য সব টাকার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাড়ির আনাচে কানাচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুলিশের মতো সার্চ চালাতেন। বিছানার তোশক উলটে, জাজিম উঁচু করে চাটাইয়ের তলা পর্যন্ত, ওদিকে কাঠের আলমারির মাথা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের কৌটো বাউটো, পুরনো চিঠিপত্রের বান্ডিলের মধ্যে পরম উৎসাহে তিনি টাকা বা পয়সা খুঁজতেন। কদাচিং এক আধটা দশ বা পাঁচ পয়সা পেয়ে আনন্দে ‘অ্যাই যে, অ্যাই যে, বলেছিলুম না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। ঘরের গোছগাছ হাঁটকানোর জন্য মাসি খুব রাগ করতেন বাবার ওপর। বাবা সে-সব গায়ে মাখতেন না, বরং সুর করে মাসিকে খ্যাপাতেন, কানামাছি ভোঁ ভোঁ..। কানা মাসির নামই হয়ে গিয়েছিল কানামাছি।

বাবার কাছ থেকে ওই একটা স্বভাব আমি পেয়েছি। আমারও স্বভাব যখন তখন যেখানে সেখানে অবসর পেলেই পয়সা খোঁজা, হাটে-বাজারে, রাস্তায়-ঘাটে ঘর-দোরে প্রায় সময়েই আমি হাট পাট করে পয়সা খুঁজি। সিকিটা আধুলিটা পেয়েও গেছি কখনও সখনও। না পেলেও ক্ষতি নেই, খোঁজাটার মধ্যেই একটা আনন্দ আছে, যেমন লোকে খামোকা ঘুড়ি উড়িয়ে বা মাছ ধরতে বসে আনন্দ পায় এ অনেকটা সে রকমই আনন্দ।

একবার হরতালের আগের দিন বিকেলে বাবা পবদিনের বাজার করতে গেছেন। তখনও বুড়ো বাড়িওলা বেঁচে। বাজারে বাবার সঙ্গে দেখা হতেই বুড়ো বাড়িওলা আঁতকে উঠে বললেন, এ কী বাপ, তোমাকে না আজ সকালেই বাজার করে ফিরতে দেখলুম! আবার এ বেলা বাজারে কেন বাবা? বাবা মাথা চুলকে বললেন, কাল হরতাল কিনা, তাই কালকের বাজারটা সেরে রাখছি। শুনে বুড়ো রেগেমেগে খেকিয়ে উঠলেন, হরতাল ছিল তো হরতালই হত, শাকভাত নুনভাত কি মুড়ি-টুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতে না। অ্যা? এ কী ধরনের অমিতব্যয় তোমাদের, দিনে দু-দুবার বাজার। এ বয়সেই যদি দুটো পয়সা রাখতে না পারো তো কি গুচ্ছের ছেলেপুলে হয়ে গেলে তখন পারবে? দুটো পয়সার মর্ম যে কবে বুঝবে তোমরা! বয়স হয়ে গেলে কপাল চাপড়াবে।

সেই থেকে বাবা একটা ঠাট্টার কথা পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সময়েই খুক খুক করে হাসতে হাসতে বললেন, দুটো পয়সা রাখতে না পারলে…!

কিন্তু ঠাট্টার কথা হলেও, ওই দুটো পয়সা রাখতে না পারায় কানা মাসিকে ভাইয়ের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হচ্ছে। আর আমার হাতে হারিকেন।

বাস্তবিকই হারিকেন আর লাঠি সম্বল করে গোবিন্দর বাড়ি থেকে যেদিন পালাই সেই দিন রাতে ভারী একটা দুঃখ হচ্ছিল আমার। বলতে কী গোবিন্দর বাড়িতে থাকতে আমি দুটো পয়সা করেছিলাম। প্রায় দিনই এটা-সেটা নিয়ে গোপনে বেচে দিতাম, ঘরের মেঝেয় একটা সোনার মাকড়ি কুড়িয়ে পেয়ে রেখে দিয়েছিলাম, দু-চারটে পয়সা কুড়িয়ে-টুড়িয়ে একটা বাঁশের চোঙায় জমিয়ে রেখেছিলাম। সেই গুপ্ত সম্পদ গোবিন্দদের পশ্চিমের বাতায় গোঁজা আছে। আনতে পারিনি।

১. ছোঁচা শব্দটা

১. ছোঁচা শব্দটা

কাগজের বউ – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

০১.

ছোঁচা শব্দটা কোথেকে এল মশাই? ছুঁচো থেকে নাকি? হাতটান শব্দটারই বা ইতিহাস কী? কিংবা দু’ কান-কাটা কথাটাই বা অমন অপমানজক কেন?

অবশ্য অপমান কথাটারও কোনও মানে হয় না। অপমান মনে করলেই অপমান। আমার যা অবস্থা তাতে অপমান গায়ে মাখতে যাওয়াটাও এক লাটসাহেবি শৌখিনতা।

সুবিনয়দের পিছনের বারান্দায় আমি শুই। বারান্দাটা খারাপ নয়। বুক-সমান দেয়ালের গাঁথুনি, তার ওপরটা গ্রিল দেওয়া। বারান্দার অর্ধেকটা প্লাইউড দিয়ে ঘিরে খাওয়ার ঘর হয়েছে, বাকি অর্ধেকটায় এঁটো বাসনপত্র ডাই করা থাকে, মুখ ধোওয়ার বেসিন রয়েছে, কয়েকটা প্যাকিং বাক্স পড়ে আছে খালি। এইসব বাক্সে বিদেশ থেকে কেমিকালস আসে। বিদেশের জিনিস বলে বাক্সগুলো বেশ মজবুত। দিনের বেলা প্যাকিং বাক্সগুলো, মোট তিনটে, একটার ওপর আর-একটা দাড় করানো থাকে। রাত্রিবেলা ওগুলো নামিয়ে আমি পাশাপাশি সাজিয়ে নিই। বাক্সগুলো সমান নয়, যার ফলে একটু উঁচু-নিচু হয়। তা হোক, তা হোক। আমার কিছু অসুবিধা হয় না। একেবারে মেঝেয় শোওয়ার চেয়ে এটুকু উচ্চতা মন্দ কী?

বারান্দার লাগোয়া পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘরে সুবিনয়ের বিধবা মা শোন খাটে, মেঝেয় শোয় ষোলোসতেরো বছর বয়সের ঝি কুসুম। অন্য ঘরে সুবিনয় এক খাটে শোয়, অন্য খাটে দুই বাচ্চা নিয়ে সুবিনয়ের বউ ক্ষণা। সামনের দিকে আরও দুটো ঘর আছে। তার একটা সুবিনয়ের ল্যাবরেটরি, অন্যটা বসবার ঘর। কিন্তু সেইসব ঘরে আমাকে থাকতে দেওয়ার কথা ওদের মনে হয়নি। সুবিনয়ের এক বোন ছিল এই সেদিন পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছিল না কিছুতেই। যতই তার বিয়ের দেরি হচ্ছিল ততই সে দিনরাত মুখ আর হাত-পায়ের পরিচর্যা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। ছেলে-ছোকরা দেখলে কেমন হন্যের মতো হয়ে যেত, এবং শেষমেষ আমার মতো অপদার্থের দিকেও তার কিছুটা ঝুঁকে পড়ার লক্ষণ দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। একদিন তো সে পরিষ্কার তার বউদিকে বলে দিল, এই শীতে উপলদা একদম খোলা বারান্দায় শোয়, তার চেয়ে খাওয়ার ঘরটায় শুতে দাও না কেন? এ কথা যখন হচ্ছিল তখন আমি চার-পাঁচ হাত দূরে বসে সুবিনয়ের মুখোমুখি খাওয়ার টেবিলে চা খাচ্ছি। চোর-চোখে তাকিয়ে দেখি, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো সুবিনয়ের বোন অচলার দিকে চেয়ে রান্নাঘরের ভিতরে টুলে-বসা ক্ষণা একটু চোখের ইঙ্গিত করে চাপা স্বরে বলল, উঃ হু!

আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। ঠিকই তো! খাওয়ার ঘরে দেয়ালের র‍্যাকে দামি স্টিলের বাসনপত্র, চামচ থেকে শুরু করে কত কী থাকে সরানোর মতো। এখানে আমাকে শোওয়ানো বোকামি। তা সে যাক গে। অচলার যখন ওইরকম হন্যে দশা, তখন আমার এ বাড়িতে বাস সে এক রাতে প্রায় উঠিয়ে দিয়েছিল আর কী। কোথাও কিছু না, মাঝরাতে একদিন দুম করে চলে এসেছিল বারান্দায়। বাথরুমে যাওয়ার প্যাসেজের ধারেই আমি শুই, মাঝরাতে বারান্দা দিয়ে বাথরুমে আনাগোনা করতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু অচলা বাথরুমে যায়নি, সটান এসে আমার প্যাকিং বাক্সের বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। সেটা নিতান্ত মানবিক করুণাবশতও হতে পারে। কিন্তু তাইতেই আমার পাতলা ঘুম ভেঙে যেতে আমি ‘বাবা গো’ বলে চেচিয়ে উঠেছিলাম ভূত ভেবে। অচলা সময় মতো পালিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে বিকট শব্দ করেছিল। গোলমাল শুনে তার মা উঠে এসে বারান্দায় তদন্ত করেন, আমি তাকে বলি যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছি। তিনি তা বিশ্বাস করেননি এবং আমার উদ্দেশেই বোধহয় বলেন, এ সব একদম ভাল কথা নয়। কালই সুবিনয়কে বলছি।

সুবিনয়কে তিনি কী বলেছিলেন কে জানে, কিন্তু সুবিনয় ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি। ঘামালে বিপদ ছিল। কারণ, সুবিনয়ের চেহারা দানবের মতো বিশাল এবং রাগলে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কোনও ব্যাপার নিয়েই সে বড় একটা মাথা ঘামায় না। সর্বদাই সে এক ভাবনার ঘোরে বাস করে। জাগতিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে তাকে কেউ কোনও কথা বললে সে ভারী বিরক্ত হয়। এই যে আমি তার বাড়িতে আছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, এটাও যে খুব বাঞ্ছিত ব্যাপার নয় কোনও গৃহস্থের কাছে তাও সে বোঝে না। সে সর্বদাই তার কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে আছে। মস্ত এক কোম্পানির চিফ কেমিস্ট, কিছু পেপার লিখে বৈজ্ঞানিক জগতেও নাম-টাম করেছে। প্রায়ই বিদেশে যায়। সুবিনয় বাংলাদেশের সেই লুপ্তপ্রায় স্বামীদের একজন যাদের বউ খানিকটা সমীহ করে চলে। স্ত্রী স্বামীকে সমীহ করে, এ ব্যাপারটা আমি আর কোথাও দেখিনি এ জীবনে। সুবিনয়ের এই কর্তৃত্বময় অস্তিত্বের দরুনই আমি এ বাড়িতে বেশ কিছুকাল টিকে আছি। সুবিনয় যে আমাকে তাড়ায় না তার একটা গূঢ় কারণও আছে।

তা বলে যেন কেউ মনে না করেন যে, আমার প্রতি সুবিনয় স্নেহশীল। সত্য বটে, স্কুলজীবনে আমরা সহপাঠী ছিলাম মিত্র ইনস্টিটিউশনে। গলায় গলায় ভাব ছিল তখন। কলেজে ও সায়েন্স নিল, আমি কমার্স। কোনওক্রমে বি কম পাশ করে আমি লেখাপড়া ছাড়ি, সুবিনয় সোনার মেডেল পেয়ে এগিয়ে গেল। আমরা ভিন্ন হয়ে গেলাম। দুই বন্ধুর একজন খুব কৃতী হয়ে উঠলে আর বন্ধুত্ব থাকে না, কমপ্লেকস এসে যায়।

এখন আমাকে সবাই অপদার্থ বলে জানে। কেবল দীর্ঘকাল আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, আমার প্রতিভা একদিন বিকশিত হবেই। আমি মোটামুটি ভাল গান গাইতে পারতাম, চমৎকার থিয়েটার করতাম, নাটক-ফাটকও লিখেছি এককালে উদ্বাস্তুদের দুঃখ নিয়ে, অল্পস্বল্প ছবি আঁকতে পারতাম, সবচেয়ে ভাল পারতাম কাদামাটি দিয়ে নানা রকম মূর্তি তৈরি করতে। এত বহুমুখী প্রতিভা নিজের ভিতরে দেখে আমার ধারণা ছিল, একটা না একটা লাইন ধরে আমি ঠিক উন্নতি করব, আর সবক’টা লাইনেই যদি উন্নতি করি তা হলে তো কথাই নেই। আরও অনেকেরই এককালে ধারণা ছিল। আমার বিচক্ষণ বাবা কিন্তু বরাবর বলে এসেছেন, এ ছেলের কিছু হবে না। এত দিকে মাথা দিলে কি কারও কিছু হয়?

আমার পারিবারিক ইতিহাসটি খুবই সংক্ষিপ্ত। আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমার পাঁচ বছর বয়সে মা মারা গেলে বাবা আমার এক মাসিকে বিয়ে করেন। মায়ের পিসতুতো বোন। মাসির এক চোখ কানা আর দাত উঁচু বলে তাঁর বিয়ে হচ্ছিল না। আমি সেই মাসির কাছে মানুষ। বি কম পরীক্ষার কিছু আগে বাবা অপ্রকট হলেন। দুনিয়ায় তখন আমার মাসি, আর মাসির আমি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু কেউ কারও ভরসা নই। মাসি বলত, তুই যদি চুরি ছ্যাঁচড়ামি গুন্ডামি বা ডাকাতি করেও দুটো পয়সা আনতে পারতিস!

বাস্তবিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যে-সব উন্নতি হয় বলে শুনেছি তার কিছুই আমার হল না। হ্যাঁ, গান আমি এখনও আগের মতোই গাই, সুযোগ পেলে অভিনয়ও খারাপ করব না, আগের মতো নাটকও লিখতে পারি। ছবি কিংবা মাটির পুতুলও আঁকতে বা বানাতে পারি। কিন্তু সে সবও যেন কোথায় আটকে আছে, উন্নতি হয়নি। সিনেমায় নামতে গিয়েছিলাম। দু-চারটে সিনেমায় চান্স পেলাম বটে ছোট ছোট ভূমিকায় কিন্তু তাকে সিনেমায় নামা বলে না ঠিক। দুটো-একটা চাকরিও পেয়েছিলাম, একটার কোম্পানি ক্লোজার হল, অন্যটায় অস্থায়ি চাকরি টিকল না। মাসির লেখাপড়া ছিল না তেমন। বাবা লোকান্তরিত হওয়ার পর মাসি বিস্তর সেলাই-ফোড়াই করে সংসার চালাতে গিয়ে একটা ভাল চোখকেও প্রায় খারাপ করে ফেলল। মাসি যখন কাঁদত তখন কিন্তু তার অন্ধ চোখেও জল পড়ত।

বিনা কাজে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম। বেশ লাগত। কাজকর্ম না করতে করতে এক ধরনের কাজের আলসেমি পেয়ে বসেছিল। আড্ডার অভাব ছিল না। সংসারের ভাবনা একা মাসিকে ভাবতে দিয়ে আমি চৌপর দিন বাইরে কাটাতাম। নিছক সঙ্গী না জুটলে ময়দানের ম্যাজিক, খোলামাঠের ফুটবল বা ক্রিকেট, ইউসিস লাইব্রেরিতে ঢুকে ছবির ম্যাগাজিন দেখে সময় কাটাতাম। বাবা বাড়ি করে যাননি, ভাড়া বাকি পড়ায় একবার বাড়িওলা হুড়ো দিয়ে তুলে দিল। বুড়ো বাড়িওলা মারা গেছে, ছেলেরা লায়েক হয়েছে। তাদের অত মায়া-দয়া নেই। মহা আতান্তরে পড়ে মাসি তার লতায়-পাতায় সম্পর্কের এক বড়লোক ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠল। ভাই মাসিকে তাড়াল না, গরিব আত্মীয়দের আশ্রয় দিলে বিস্তর কাজ আদায় করা যায়। কিন্তু সেখানে আমার ঠাঁই হল না। তারা পরিষ্কারই বলে দিলেন, তোমার বোনপোকে রাখতে পারব না বাপু, বড়সড় ছেলে, নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেবে। এ কথা শুনে মাসি বলে, ওমা, বোনপো কী? ও আমার ছেলে, নিজের হাতে মানুষ করেছি যে! কিন্তু তারা কিছুতেই মত দিল না যখন মাসির তখন হাউহাউ করে কান্না। আমি মাসিকে অনেক স্তোকবাক্য দিয়ে তখনকার মতো ঠান্ডা করে কেটে পড়লাম। আমার যা হোক, কানা মাসিটা আমার তো না খেয়ে মরবে না। তবে সে বাড়িতে আমার যাতায়াত আছে, কয়েক বার নেমন্তন্নও খেয়েছি।

তখন হাওড়া-কদমতলা রুটের একটা প্রাইভেট বাসে কন্ডাক্টরি করি। সারাদিন পয়সার ঝনঝন, লোকের ঘেমো গা, গাড়ির চলা, তার মধ্যে কখনও ঘুণাক্ষরেও মনে পড়ত না যে, আমি বি কম পাশ বা এ কাজের চেয়ে একটা কেরানিগিরি পেলে অনেক ভাল হত। সে যা হোক, কন্ডাক্টরি কিছু খারাপ লাগত না। তবে প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়ার সময়ে আমি বেশি সুবিধা করতে পারতাম না। আর একটা লাভও হত বেশ, প্যাসেঞ্জারদের মুখে নানা খবর শুনে শুনে দুনিয়া সম্পর্কে বিনা মাগনা অনেক জ্ঞানলাভও হয়ে যেত। কয়েক দিনের মধ্যেই এলাকার হেক্কোড়দের চিনে ফেললাম, তাদের কাছে টিকিট বেচার প্রশ্ন উঠত না, উলটে খাতির দিতে হত। মনাই ঘোষ ছিলেন এলাকার মাথা। মনে আছে একবার তিনি পঞ্চাননতলার মোড়ে বাস থামিয়ে নেমে গিয়ে লন্ড্রির জামা কাপড় আনলেন, বাস ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চোর, ছিনতাইবাজ, পকেটমার বিস্তর চেনা-জানা হয়ে। গেল, আজও ও-সব জায়গায় গেলে দু’-চার কাপ চা বিনা পয়সায় লোকে ডেকে খাওয়ায়। আনাড়ি ছিলাম বলে প্রথম দিকে আমার ব্যাগ থেকে বার দুই খুচরো হাপিশ হয়েছে। পরের দিকে কাকের মতো চালাক হয়ে উঠি। বাস চালাত ধন সিং নামে একটা রাজপুত। জলের ট্যাঙ্কের কাছে একবার সে একটা ছোকরাকে চাপা দিলে রাস্তার লোক রে রে করে তাড়া করল। ভয়ে ধন সিংয়ের আর হিতাহিত জ্ঞান রইল না। পঞ্চাননতলার সরু রাস্তায় যে আপ-ডাউন বাস কী করে চলে সেইটাই লোকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, আর সেই মারাত্মক ভিড়ের সরু রাস্তায় ধন সিং বাসের গতি বোধকরি ত্রিশ-চল্লিশ মাইল তুলে দিল। কোনও স্টপে গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না। প্যাসেঞ্জাররা প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে, বাঁচাও। এই স্টুপিড! এই উল্লুকের বাচ্চা! এই শুয়োরের বাচ্চা! কে শোনে কার কথা! আমরা দুই কন্ডাক্টর, আমি আর গোবিন্দ, দুই দরজায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বিপদ দেখলেই লাফাব। ধন সিং কদমতলা পর্যন্ত উড়িয়ে নিল বাস। তারপর যেই থামল, অমনি কোত্থেকে যে শয়ে শয়ে লোক জুটে গেল চারধারে কে জানে! পালানোর পথ ছিল না। ধন সিং প্রচণ্ড মার খেয়ে আধমরা হয়ে হাসপাতালে গেল, আমি আর গোবিন্দ ঠ্যাঙানি খেয়ে কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে পড়ে রইলাম রাস্তায়। মুখ-টুখ ফুলে, গায়ে গতরে একশো ফোড়ার ব্যথা হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা।

অনেক পরে চেনা একটা হোটেলের বাচ্চা বয়গুলো এসে আমাদের জলটল দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। দু’জনে কষ্টেসৃষ্টে চেনা দোকানে গিয়ে কোকাতে কোকাতে বসলাম। ব্যাগ দু’জনেরই হাপিশ হয়ে গেছে, জামা-টামা ছিড়ে একাকার, গোবিন্দর চটিজোড়াও হাওয়া। পাবলিক প্যাদালে তো কিছু করার নেই। রাগও করা যায় না, কার মুখ মনে করে রাগ করব? গোটা জীবন আর তাবৎ দুনিয়ার ওপর রাগে চোখে জল আসে শুধু। গোবিন্দ আর আমি একটা করে কোয়ার্টার রুটি আর ছোট সানকির মতো কলাই করা প্লেটে হাফ প্লেট করে মাংস নিয়ে বসলাম। মাংস মুখে দিয়েই গোবিন্দ উহু উহু করে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, জিভটা কেটে এই ফুলেছে মাইরি, নুন ঝাল পড়তেই যা চিড়িক দিয়েছে না! খাই কী করে বল তো!

এ সব কথা যখন হচ্ছে তখনই ছোকরা বয়টা এসে বলল, গোবিন্দদা, আপনার দেশ থেকে আপনার খোঁজে একটা লোক অনেক বার এসে ঘুরে গেছে। ওই আবার এসেছে, দেখুন।

গোবিন্দ মুখ তুলল, আমিও দেখলাম, বুড়ো মতো একটা লোক খুব বিষন্ন মুখের ভাব করে এসে বেঞ্চে বসে মুখের ঘাম মুছল সাদা একটা ন্যাকড়া পকেট থেকে বের করে।

গোবিন্দ বলল, তারক জ্যাঠা, খবরটবর কী? খারাপ নাকি?

 হ্যাঁ বাবা। তোমার পিতৃদেব—

গোবিন্দ আঁতকে উঠে বলল, আর বলবেন না, আর বলবেন না।

লোকটা ভড়কে থেমে গেল। আর দেখলাম, গোবিন্দ গোগ্রাসে মাংস-রুটি খাচ্ছে জিভের মায়া ত্যাগ করে। খেতে খেতেই বলল, ও শুনলেই খাওয়া নষ্ট। এখন পেটে দশটা বাঘের খিদে। একটু বসুন, ও খবর পাঁচ মিনিট পরে শুনলেও চলবে। শত হোক, হিন্দুর ছেলে তো! ও খবর শুনলে খাই কী করে!

খাওয়ার শেষে গোবিন্দ উঠে দাম-টাম দিয়ে এল, বলল, চলুন, দেশে যেতে হবে তো?

তারক জ্যাঠা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা তো হবেই। পরশুদিনের ঘটনা বাবা, মাঠ থেকে ফিরে তোমার বাবামশাই হঠাৎ উঠোনে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কত জল, পাখা, ওঝা, বদ্যি, হাঃ—

 গোবিন্দ আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, উপল, খবরটা ভাল। তারপর গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, হক্কের মরা মরেছে, জ্যাঠা। আর বেঁচে থেকে হতটা কী? দুনিয়া তো ছিবড়ে হয়ে গিয়েছিল। এই বলে সে আমার দিকে চেয়ে বলল, উপল, তুইও চল। গায়ের ব্যথাটা ঝেড়ে আসবি। দেশে আমাদের ধানজমি আছে। বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল বদমাইশির জন্য, তাই ফিরতে পারছিলাম না। নইলে কোন শালা মরতে কন্ডাক্টরি করে।

বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে দু’জনে সেই রাতে কেটে পড়লাম হাওড়া জেলার শিবগঞ্জে।

আমার স্বভাব বসতে পেলেই ঠেলেঠুলে শুয়ে পড়া। গোবিন্দর দেশটা বেশ ভালই। বাগনান থেকে বাসে ঘণ্টা কয়েকের রাস্তা। পৌঁছে গেলে মনে হয়, ঠিক এ রকমধারা জায়গাই তো এতকাল খুঁজছিলাম। গোবিন্দদের ধানজমি বেশি না হোক, ওদের দু’বেলা ভাতের অভাব নেই। বিরাট একটা নারকোল বাগান আছে। মেটে দোতলা বাড়িতে বেশ মাঝারি বড় সংসার।

দু’বেলা খাওয়ার-শোওয়ার ভাবনা নেই, আমি তাই নিশ্চিন্তে সেখানে শেকড় চালিয়ে দিলাম। ভরসা হল, বাকি জীবনটা এখানেই কেটে যাবে বুঝি! গোবিন্দ তখন প্রায়ই বলত, দাঁড়া তোকে এ দিকেই সেট করিয়ে দেব। কিন্তু মাস তিনেক যেতে না যেতেই গোবিন্দ বিয়ে করে বসল, আর তার দুমাস বাদেই গোবিন্দর মুখ হাঁড়ি। আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কয় না। বুঝলাম, ওর বউ বুদ্ধি দিয়েছে। তবু গায়ে না-মেখে আমি আরও এক মাস কাটিয়ে দিলাম। মোট ছ’ মাস পর। গোবিন্দর বড় ভাই একদিন খাড়ুবেড়েতে যাত্রা দেখে ফেরার পথে গহিন রাতে রাস্তায় টর্চ ফেলে ফেলে আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে নরমে গরমে বলেই ফেলল, এ বয়সটা তো বসে খাওয়ার বয়স নয় গো বাপু। গাঁ-ঘরে কাজকর্মই বা কোথায় পাবে। বরং কলকাতার বাজারটাই ঘুরে দেখোগে।

গোবিন্দর বড় ভাই নন্দদুলালের খুব ইচ্ছে ছিল তার মেয়ে কমলিনীকে আমি বিয়ে করি। কিন্তু কমলিনীর বয়স মোটে বারো, সুশ্রীও নয়, তা ছাড়া আমারও বিয়ের ব্যাপারটা বড় ঝামেলা বলে মনে হয়, তাই রাজি হইনি, ঘরজামাই রাখলেও না হয় ভেবে দেখতাম। তা সে প্রস্তাবও নয়, বরং কমলিনীর মা আমাকে প্রায়ই কাজ খোঁজার জন্য হুড়ো দিত, চাষবাস দেখতে পাঠাত। বেলপুকুর বাজারে গিয়ে শুকনো নারকোল বেচে এসেছি কতবার। আখের চাষ হবে বলে গোটা একটা খেত নাড়া জ্বেলে আগুনে পোড়াতে হয়েছিল। এত সব কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না। বউ হলে সে আরও তাড়া দেবে সারা জন্ম।

এক বর্ষার রাতে গোবিন্দদের গোলাঘরে চোরে সিঁধ দিল। বিস্তর ধান লোপাট। সকালবেলা খুব চেঁচামেচি হল, তারপর থিতু হয়ে সবাই বসে এক মাথা হয়ে ঠিক করল যে, এবার থেকে আমাকে সারা রাত বাড়ি চৌকি দিতে হবে। একটা নিষ্কর্মা লোক সারা দিন বসে খাবে, কোনও কাজে লাগবে না, এ কি হয়?

দিন পনেরো পাহারা দিতেও হল। এক রাতে ফের চোর এল। আমার চোখের সামনে পরিষ্কার পাঁচ-ছ’জন কালো কালোলোক। তাদের দু’-একজন আমার মুখ চেনা। দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় বসে লণ্ঠন পাশে নিয়ে একটা লম্বা লাঠি উঠোনে মাঝে মাঝে ঠুকছিলাম, দুটো দিশি কুকুর সামনে ঝিমোচ্ছে। এ সময়ে এই কাণ্ড। চোর দেখে ভিরমি খাই আর কী। লাঠি যে মানুষের কোন কাজে লাগে তা তখনও মাথায় সেঁধোচ্ছে না। চোর ক’জন এসে সোজা আমার চারধারে দাঁড়িয়ে গেল, একজন বলল, উপল শালা, মেরে মাঠে পুঁতে দিয়ে আসব, মনে থাকে যেন। কুকুর দুটো দু’বার ভুক ভুক করে হঠাৎ ল্যাজ নাড়তে লাগল চোরদের খাতির দেখানোর জন্য। দিশি কুকুরদের বীরত্ব জানা আছে। আমিও তাদের দেখে কায়দাটা শিখে গেলাম, এক গাল হেসে বললাম, আরে তোমরা ভাবো কী বলো তো, অ্যাঁ? পাহারা কি আসলে দিই? গুঁতোর চোটে পাহারা দেওয়ায়। যা করার চটপট সেরে নাও ভাই সকল, আমি চার দিকে চোখ রাখছি।

চোরেরা যখন মহা ব্যস্ত ঠিক তখনই আখের বুঝে আমি লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে লম্বা দিলাম। নইলে পরদিন আমার ওপর দিয়ে বিস্তর ঝামেলা যেত।

তা সেই লাঠি আর লণ্ঠন ছাড়া তখন আর আমার কোনও মূলধন ছিল না। আফসোস হল, চোরদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে যদি কিছু নগদ বা ঘটিবাটি গোবিন্দদের বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনতে পারতাম তো বেশ হত।

আমার বাবা সারা জীবনটাই ছিলেন ডাকঘরের পিয়োন, শেষ জীবনে সর্টার, আর এক থাক উচুতে উঠতে পারলে তাকে ভদ্রলোক বলা চলত, তা তিনি উঠতে পারেননি। বিস্তর ধারকর্জ করে খাওয়া-দাওয়া ভাল করতেন। ওই এক শখ ছিল। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড-এর অর্ধেকই প্রায় ফৌত হয়ে গিয়েছিল ওই কর্মে। সারাটা জীবন তাকে কেবল টাকা খুঁজতে দেখেছি। অন্য সব টাকার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাড়ির আনাচে কানাচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুলিশের মতো সার্চ চালাতেন। বিছানার তোশক উলটে, জাজিম উঁচু করে চাটাইয়ের তলা পর্যন্ত, ওদিকে কাঠের আলমারির মাথা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের কৌটো বাউটো, পুরনো চিঠিপত্রের বান্ডিলের মধ্যে পরম উৎসাহে তিনি টাকা বা পয়সা খুঁজতেন। কদাচিং এক আধটা দশ বা পাঁচ পয়সা পেয়ে আনন্দে ‘অ্যাই যে, অ্যাই যে, বলেছিলুম না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। ঘরের গোছগাছ হাঁটকানোর জন্য মাসি খুব রাগ করতেন বাবার ওপর। বাবা সে-সব গায়ে মাখতেন না, বরং সুর করে মাসিকে খ্যাপাতেন, কানামাছি ভোঁ ভোঁ..। কানা মাসির নামই হয়ে গিয়েছিল কানামাছি।

বাবার কাছ থেকে ওই একটা স্বভাব আমি পেয়েছি। আমারও স্বভাব যখন তখন যেখানে সেখানে অবসর পেলেই পয়সা খোঁজা, হাটে-বাজারে, রাস্তায়-ঘাটে ঘর-দোরে প্রায় সময়েই আমি হাট পাট করে পয়সা খুঁজি। সিকিটা আধুলিটা পেয়েও গেছি কখনও সখনও। না পেলেও ক্ষতি নেই, খোঁজাটার মধ্যেই একটা আনন্দ আছে, যেমন লোকে খামোকা ঘুড়ি উড়িয়ে বা মাছ ধরতে বসে আনন্দ পায় এ অনেকটা সে রকমই আনন্দ।

একবার হরতালের আগের দিন বিকেলে বাবা পবদিনের বাজার করতে গেছেন। তখনও বুড়ো বাড়িওলা বেঁচে। বাজারে বাবার সঙ্গে দেখা হতেই বুড়ো বাড়িওলা আঁতকে উঠে বললেন, এ কী বাপ, তোমাকে না আজ সকালেই বাজার করে ফিরতে দেখলুম! আবার এ বেলা বাজারে কেন বাবা? বাবা মাথা চুলকে বললেন, কাল হরতাল কিনা, তাই কালকের বাজারটা সেরে রাখছি। শুনে বুড়ো রেগেমেগে খেকিয়ে উঠলেন, হরতাল ছিল তো হরতালই হত, শাকভাত নুনভাত কি মুড়ি-টুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতে না। অ্যা? এ কী ধরনের অমিতব্যয় তোমাদের, দিনে দু-দুবার বাজার। এ বয়সেই যদি দুটো পয়সা রাখতে না পারো তো কি গুচ্ছের ছেলেপুলে হয়ে গেলে তখন পারবে? দুটো পয়সার মর্ম যে কবে বুঝবে তোমরা! বয়স হয়ে গেলে কপাল চাপড়াবে।

সেই থেকে বাবা একটা ঠাট্টার কথা পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সময়েই খুক খুক করে হাসতে হাসতে বললেন, দুটো পয়সা রাখতে না পারলে…!

কিন্তু ঠাট্টার কথা হলেও, ওই দুটো পয়সা রাখতে না পারায় কানা মাসিকে ভাইয়ের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হচ্ছে। আর আমার হাতে হারিকেন।

বাস্তবিকই হারিকেন আর লাঠি সম্বল করে গোবিন্দর বাড়ি থেকে যেদিন পালাই সেই দিন রাতে ভারী একটা দুঃখ হচ্ছিল আমার। বলতে কী গোবিন্দর বাড়িতে থাকতে আমি দুটো পয়সা করেছিলাম। প্রায় দিনই এটা-সেটা নিয়ে গোপনে বেচে দিতাম, ঘরের মেঝেয় একটা সোনার মাকড়ি কুড়িয়ে পেয়ে রেখে দিয়েছিলাম, দু-চারটে পয়সা কুড়িয়ে-টুড়িয়ে একটা বাঁশের চোঙায় জমিয়ে রেখেছিলাম। সেই গুপ্ত সম্পদ গোবিন্দদের পশ্চিমের বাতায় গোঁজা আছে। আনতে পারিনি।

.

০২.

কাল রাতে সুবিনয় আর ক্ষণা অনেকক্ষণ আমাকে নিয়ে কথা বলাবলি করছিল। ক্ষণা চায় না যে আমি আর এক দিনও এ বাড়িতে থাকি। কথায় কথায় সে তার বরকে বলল, বাজার-ফেরত পঁয়ত্রিশটা পয়সা তুমি খাওয়ার টেবিলে রাখলে আজ সকালে, নিজের চোখে দেখা আমার! পনেরো মিনিট বাদে গিয়ে দেখি পয়সা হাওয়া। তোমার ওই দু’ কানকাটা ছোঁচা বন্ধুটির কিন্তু বেশ ভালরকম হাতটান আছে।

সুবিনয় ঘুমগলায় বলল, পয়সাকড়ি সরিয়ে রাখলেই হয় সাবধান মতো।

আহা, কী কথার ছিরি? সারাক্ষণ ঘরে একটা চোর ছোঁচা বসবাস করলে কাহাতক সাবধান হবে মানুষ? তার চেয়ে ওকে এবার সরে পড়তে বলো, অনেক দিন হয়ে গেছে। আজ তুমি বাজার করলে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তো তোমার ওই প্রাণের বন্ধুই বাজার করে, বাজারে কত পয়সা হাতায় তার হিসেব কে করছে?

এই রকম সব কথা হচ্ছিল, আমি প্যাকিং বাক্সের বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজায় কান পেতে সব শুনছি। খুবই অপমানজনক কথা। কিন্তু কতটা অপমানজনক তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া, আমাকে শুনিয়েও তো বলেনি যে খামোকা অপমান বোধ করতে যাব।

নিশুত রাতে আমার বিছানায় শুয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এক ভাঙা চাঁদ দেখতে দেখতে ঘুম ছুটে গেল। কী করে বোঝাই এদের যে, আমারও দু-চারটে পয়সাকড়ির দরকার হয়। আমার সবচেয়ে অসুবিধা এই যে, আমার আজকাল বড় খিদের ভয়। সারা দিন আমার পেটে একটা খিদের ভাব চুপ করে বসে আছে। ভরা পেটেও সেই খিদের স্মৃতি। কেবল ভয় করে, আবার যখন খিদে পাবে তখন খেতে পাব তো!

আমার আর-একটা সমস্যা হল, পয়সা। পয়সা খুঁজতে খুঁজতে আমার জীবনটা গেল। সেই যে লণ্ঠন আর লাঠি হাতে গোবিন্দদের বাড়ি থেকে নিশুত রাতে বেরিয়ে পড়লাম, সেই থেকে পয়সা খোঁজার বিরাম নেই। পয়সাও যে কত কায়দায় আমাকে ফাঁকি দিচ্ছে, জীবনভোর লুকোচুরি খেলছে আমার সঙ্গে তা বলে শেষ হয় না।

লাঠি-লণ্ঠন নিয়ে সেই পালানোর পর দু’দিন বাদে বাগনানের বাসের আড্ডায় তিনটে ছ্যাঁচোড়ের সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় অনেক কথা বেরিয়ে পড়ল। তাদের ব্যাবসাপত্র খারাপ নয়, চুরি, ছিনতাই আর ছোটখাটো ডাকাতি করে তাদের ভালই চলে। অনেক বলে কয়ে ভিড়ে পড়লাম তাদের সঙ্গে। তারা আমাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে, বিস্তর শাসিয়ে সাবধান করে দিল, বেগরবাঁই করলে জান যাবে।

বাগনান বাজারে এক দুপুরে বসে আছি, ছোট্ট একটা খুকি তার বাচ্চা ঝিয়ের সঙ্গে দোকানের সওদা করতে এসেছে। ছ্যাঁচোড়দের একজন কদম বলল, ওই খুকিটা হল হোমিয়ো ডাক্তার কালীপদ ঘোষের ছোট মেয়ে, কানে একজোড়া সোনার বেলফুল দেখা যাচ্ছে। দেখবে নাকি হে উপল ভদ্র?

ওরা কেন যে আমার নামের সঙ্গে ভদ্র কথাটা জুড়ে নিয়েছে তা ওরাই জানে। প্রস্তাব শুনে আমার হাত-পা ঝিমঝিম করছিল। আসলে আমার সব কাজে বাগড়া দেওয়ার জন্য একজন সং আছে। সে আমার বিবেকবুড়ো। যখন-তখন এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করে রাজ্যের হিতকথা ফেঁদে বসে। তাকে না পারি তাড়াতে, না পারি এড়াতে।

ছ্যাঁচোড়দের অন্য একজন হাজু আমাকে জোর একটা চিমটি দিয়ে বলল, দু’দিন ধরে খাওয়াচ্ছি তোমাকে, সে কি এমনি? যাও কাজে লেগে পড়ো। ধরা পড়ে মার খাও তো সেও এ লাইনের একটা শিক্ষা। মারধর বিস্তর খেতে হবে। বাবুয়ানি কীসের?

সত্যিই তো। আমার যে মাঝে মাঝে এক পাগলাটে খিদে পায়। সেই সব খিদের কথা ভেবে বড় ভয় পাই। কাজে না নামলে কেউ খেতে দেবে কেন? উঠে পড়লাম।

জানা আছে, কালীপদ ঘোষের মেয়ে, কাজেই একটা সুবিধে। অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটিতে খানিকটা বনস্পতি কিনে মেয়েটা রাস্তায় পা দিতেই গিয়ে বললাম, ও খুকি, কালীপদদার কাণ্ডখানা কী বলো তো! পেট ব্যথার একটা ওষুধ কবে থেকে করে দিতে বলছি।

খুকি কিছু অবাক হয়ে বলল, বাবা তো খড়গপুরে গেছে।

খুশি হয়ে বলি, আমাকে চিনতে পারছ তো? আমি রামকাকা, লেভেল ক্রসিং-এর ধারে রঘুদের বাড়ি থাকি। চেনো?

খুকি মাথা নাড়ল দ্বিধাভরে। চেনে।

 আমি বললাম, তোমার বাবা কয়েকটা জিনিস চেয়ে রেখেছিল আমার কাছে, দেব দিচ্ছি করে আর দেওয়া হয়নি। মহীনের দোকানে রেখে দিয়েছি, নিয়ে যাবে এসো।

বলে বাজারের ভিতর দিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে যাই। ঝি মেয়েটা দুনিয়া কিছু বেশি চেনে, সে হঠাৎ বলে উঠল, ও বিন্তি যাসনে, এ লোকটা ভাল না।

ভীষণ রেগে গিয়ে তাকে এক ধমক মারলাম, মারব এক থাপ্পড় বদমাশ ছোটলোক কোথাকার! এই সেদিনও কালীপদদা বলছিল বটে, বাচ্চা একটা ঝি রেখেছে সেটা চোর। তোর কথাই বলছিল তবে।

ঝি মেয়েটা ভয় খেয়ে চুপ করে গেল। মাথাটা আমার বরাবরই পরিষ্কার। মতলব ভালই খেলে। খানিকটা ভয়ে, খানিকটা বিশ্বাসে খুকিটা এল আমার সঙ্গে, ঝি মেয়েটাও। বাজারের দোকানঘরের পিছু দিকটায় একটা গলি মতন। মুদির দোকান থেকে একটা ঠোঙায় কিছু ত্রিফলা কিনে এনে খুকির হাতে দিয়ে বললাম, এইটে বাবাকে দিয়ে আমার কথা বোলো, তা হলেই হবে। সবই বলা আছে।

মেয়েটা ঘাড় নাড়ল, ঠোঙা হাতে আমাকে অবাক হয়ে দেখছিল। পিছু ফিরতেই আমি ফের ডেকে বললাম, ও বিন্তি, তোমার বাপ-মায়ের কি আক্কেল নেই! ওইটুকু মেয়ের কানে সোনার দুল পরিয়ে বাড়ির বার করেছে! এসো, এসো, ওটা খুলে ঠোঙায় ভরে নাও। কে কোথায় গুন্ডা বদমাশ দেখবে, দু’ থাপ্পড় দিয়ে কেড়ে নেবে। কালও ছিনতাই হয়েছে এখানে।

মেয়েটা কাঠ হয়ে আছে। ঝি মেয়েটা ঝেঁঝে উঠল, কেন খুলবে, অ্যাঁ? চালাকির আর জায়গা পাওনি?

তাকে ফের একটা ধমক মারলাম। কিন্তু বিন্তিও দুল খুলতে রাজি নয়। মাথা নেড়ে বলল, না, খুলব না। সদ্য কান বিঁধিয়েছি, দুল খুললে ছ্যাঁদা বুজে যাবে।

কথাটা আমারও যুক্তিযুক্ত মনে হল। এ অবস্থায় ওর কান থেকে দুল খুলি কী করে?

ছ্যাঁচোড়দের তিন নম্বর হল পৈলেন। সে কম কথা আর বেশি কাজের মানুষ। আমি যখন খুকিটিকে তার ঝি সমেত চলে যেতে অনুমতি দিয়ে দিয়েছি, ওরাও চলে যাচ্ছে, ঠিক সে সময়ে। পৈলেন এসে গলির মুখটা আটকে দাঁড়াল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, রোগা কিন্তু পাকানো শক্ত চেহারা। কলাকৌশলের ধার দিয়েও গেল না। ঝি মেয়েটাকে একখানা পেল্লায় ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, চেঁচালে গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলব।

সেই দৃশ্য দেখে বিন্তি থর থর করে কাঁপে, কথা সরে না। এক-একটা প্যাঁচ ঘুরিয়ে পৈলেন পুট পুট করে দুটো বেলকুঁড়ি তার কান থেকে খুলে বলল, বাড়ি যাও, কাউকে কিছু বললে কিন্তু মেরে ফেলব।

রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পৈলেন আমাকে বলল, সব জায়গায় কি আর কৌশল করতে আছে রে আহাম্মক? গায়ের জোর ফলালে যেখানে বেশি কাজ হয়, সেখানে অত পেঁচিয়ে কাজ করবি কেন?

হক কথা।

বেলকুঁড়ি দুটো বেচে যে পয়সা পাওয়া গেল তার হিস্যা ওরা আমাকে দিল না, আমার আহাম্মকিতেই তো ব্যাপারটা নষ্ট হচ্ছিল প্রায়।

এক দিন পাঁশকুড়া-হাওড়া ডাউন লোকালে তক্তে তক্কে চারমূর্তি উঠেছি। শনিবার সন্ধে, ভিড় বেশি নেই। এক কামরায় একজোড়া বুড়োবুড়ি উঠেছে। বুড়ির গায়ে গয়নার বন্যা। ইদানীং কারও হাতে মোটা বালা সমেত ছ’গাছা করে বারোগাছা চুড়ি, গলায় মটরদানা হার বা কানে ঝাপটা দেখিনি। আঙুলে অন্তত পাঁচ আনি সোনার দুটো আংটি। বুড়োর হাতে ঘড়ি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, হাতে রুপো-বানো লাঠি। এ যেন চোর-ছ্যাচোড়দের কাছে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়ে বেরোনো।

ফাঁকা ফাঁকা কামরায় বুড়ো উসখুস করছে। মুখোমুখি আমরা বসে ঘুমের ভান করে চোখ মিটমিট করে সব দেখছি। বুড়ো চাপা গলায় বলল, এত সব গয়না-টয়না পরে বেরিয়ে ভাল কাজ করোনি। ভয়-ভয় করছে।

বুড়ি ধমক দিয়ে বলল, রাখো তো ভয়! গা থেকে গয়না খুলে রেখে আমি কোনও দিন বেরিয়েছি নাকি? ও সব আমার ধাতে সইবে না।

বুড়ি ঝাঁপি থেকে স্টিলের তৈরি ঝকঝকে পানের বাটা বের করে বসল। বাটাখানা চমৎকার। বারোটা খোপে বারো রকমের মশলা, মাঝখানে পরিষ্কার ন্যাতায় জড়ানো পানপাতা। দামি জিনিস।

পৈলেন আর হাজু গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, আমি আর কদম কামরার দু’ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পৈলেনের পিস্তল আছে, হাজুর ছুরি। কদম নলবন্দুক হাতে ওধার সামলাচ্ছে। কী জানি কেন, আমার হাতে ওরা অস্ত্রশস্ত্র কিছু দেয়নি। কেবল ধারালো দুটো ব্লেড আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরতে শিখিয়ে দিয়েছে হাজু, বলেছে, যখন কাউকে ব্লেড ধরা হাতে আলতো করে গালে-মুখে বুলিয়ে দিবি, তখন দেখবি কাণ্ডখানা। রক্তের স্রোত বইবে।

পৈলেন পিস্তল ধরতেই বুড়ো বলে উঠল, ওই যে দেখো গো, বলেছিলুম না! ওই দেখো, হয়ে গেল।

বুড়ি পানটা মুখে দিয়ে পৈলেনের দিকে তাকিয়ে বলল, এ মিনসেটাই ডাকাত নাকি! ওমা, এ যে একটু আগেও সামনে বসে ঝিমোচ্ছিল গো!

বুড়ো আস্তে করে বলল, এখন ঝিমুনি কেটে গেছে। সামলাও ঠ্যালা।

বুড়ি ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, আমি সামলাব কেন তুমি পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকতে? এককালে তো খুব ঠ্যাঙা-লাঠি নিয়ে আবগারির দারোগাগিরি করতে। এখন অমন মেনিমুখো হলে চলবে কেন?

পৈলেন ধৈর্য হারিয়ে বলল, অত কথার সময় নেই, চটপট করুন। আমাদের তাড়া আছে।

বুড়ি ঝংকার দিল, তাড়া আছে সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু গয়না আমি খুলছি না। তাড়া থাকলে চলে যাও।

হাজু ‘চপ’ বলে একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে হাতের আধ-হাত দোধার ছোরাটা বুড়োর গলায় ঠেকিয়ে বলল, পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি গয়না খুলতে। যদি দেরি হয় তো এই বুড়োমানুষটার হয়ে যাবে দিদিমা। বিধবা হবেন।

বুড়ি জর্দা আটকে দু’বার হেঁচকি তুলে হঠাৎ হাউড়ে মাউড়ে করে কেঁদে উঠে চেঁচাতে লাগল, ওমা গো, ওগো তোমরা সব দেখো, কী কাণ্ড। বুড়োটাকে মেরে ফেলল যে!

কামরায় মোট জনা কুড়ি লোকও হবে না। এধার-ওধার ছিটিয়ে বসে ছিল। কেউ নড়ল না। সবাই অন্যমনস্ক হয়ে কিংবা ভয়ে পাথর হয়ে রইল। কেবল দুটো ছোকরা টিটকিরি দিল কোথা থেকে, দাদাদের কমিশন কত? একজন বলল, ও দাদা, অথরিটি কত করে নেয়? সব বন্দোবস্ত করা আছে, না?

গলায় ছোরা-ঠেকানো অবস্থায় বুড়ো তখন তম্বি করছে, কী ব্যাপার বলো তো তোমার! গা করছ না যে? পাঁচ মিনিটের আর কত বাকি আছে শুনি! শিগগির গয়না খোলো।

বুড়ি তখনও জর্দার ধক সামলাতে পারেনি। তিন-তিনটে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খুলতে বললেই খুলব, না? এ সব গয়না ফের আমাকে কে তৈরি করে দেবে আগে বলো! তুমি দেবে?

দেব, দেব শিগগির খোলো। বুড়ো তাড়া দেয়।

কিন্তু বুড়ি তবু গা করে না। কষ্টেসৃষ্টে একগাছা চুড়ি ডান হাত থেকে আঙুলের গাঁট পর্যন্ত এনে বলে, সেই কবে পরেছিলুম, এখন তো মোটা হয়ে গেছি, এ কি আর খোলা সহজ?

হাজু তার ছোরাটা এগিয়ে দিয়ে পিস্তলটা পৈলেনের হাত থেকে নেয়। পৈলেন ছোরাটা চুড়ির ফাঁকে ঢুকিয়ে এক টানে কেটে নেয়। দিদিমা চেঁচাতে থাকেন ভয়ে, কিন্তু পৈলেনের হাত পাকা, কোথাও একটুও ছড়ে যায়নি। পৈলেন পটাপট চুড়িগুলো কাটতে থাকে।

দিদিমা দাদুর দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, কথা দিলে কিন্তু! সব গয়না ঠিক এ রকম তৈরি করে দিতে হবে। তখন নাকিসুরে বলতে পারবে না, এখন রিটায়ার করেছি, কোত্থেকে দেব!

দেব, দেব।

 দিদিমা তখন চার দিকে তাকিয়ে লোকজনের মুখ চেয়ে বলে, শুনে রেখো তোমরা সব, সাক্ষী রইলে কিন্তু। উনি বলেছেন সব ফের গড়িয়ে দেবেন।

পৈলেন গোটা চারেক চুড়ি ততক্ষণে খুলে ফেলেছে কেটে, চমৎকার কাজ হচ্ছে। হাজু বাঁ হাত বাড়িয়ে বুড়ো লোকটার হাতঘড়ি খুলে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিল, এবার গলার কাছে পাঞ্জাবির সোনার বোতামের প্রথমটা খুলে ফেলেছে। আমার কিছু করার নেই, দাঁড়িয়ে দেখছি। বলতে কী ট্রেনের কামরায় ডাকাতির কথা বিস্তর শুনলেও চোখে কখনও দেখিনি সে দৃশ্য। তাই প্রাণভরে দেখে নিচ্ছিলাম।

বুড়ি ফের দুটো হেঁচকি তুলে বুড়োর দিকে চেয়ে বলল, পিস্তলের নল মাথায় ঠেকিয়ে বোকার মতো বসে আছ কী? বোতামটা নিজেই খুলে দাও, নইলে ও মিনসে যেভাবে বোতাম খুলছে পুরনো পাঞ্জাবিটা না ফেঁসে যায়। আর প্রেশারের বড়ি থাকলে দাও তো, খেয়ে ফেলি। মাথাটা কেমন করছে। দুটো বড়ি দিয়ো।

এ সব কথাবার্তার মাঝখানেই হঠাৎ একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল কী করে। মাঝখানের ফাঁকা বেঞ্চিতে অনেকক্ষণ যাবৎ একটা লোক হাকুচ ময়লা একটা চাদরে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। এই সব গণ্ডগোলে বোধহয় এতক্ষণে কী করে তার ঘুম ভেঙেছে। চাদরটা সরিয়ে মস্ত একটা গোলপানা মুখ তুলে লোকটা তাকাল। চোখদুটো টকটকে লাল, নাকের নীচে মস্ত ভূঁড়ো গোঁফ, গালে বিজবিজে কালো দাড়ি। লাল চোখে কয়েক পলক দৃশ্যটা দেখেই লোকটা হঠাৎ ঘুমের ধন্দভাব ঝেড়ে ফেলে তড়াক করে উঠে বসে বিকট গলায় বলে উঠল, মানকে বলে সাবাস!

কথাটার অর্থ কী তা আমি আজও জানি না। কিন্তু ওই দুর্বোধ্য বিকট চিৎকারে হাজুর নার্ভ নষ্ট হয়ে গেল বুঝি। পৈলেনের পিস্তলটাও বোধহয় সে আগে বড় একটা হাতে পায়নি। পিস্তল হাতে থাকলে আনাড়িদের যেমন হয় হাজুরও তেমন হঠাৎ ফালতু বীরত্ব চাগিয়ে উঠল। বুড়োকে ছেড়ে ঘুরে হুড়ম করে আচমকা একটা গুলি ছুড়ল সে। গুলিটা গাড়ির ছাদে একটা ঘুরন্ত পাখায় পটাং করে লাগল শুনলাম। যে লোকটা চেঁচিয়েছিল সে লোকটা হঠাৎ দ্বিগুণ চেঁচাতে চেঁচাতে উঠে চার দিকে দাপাতে লাগল, মেরে ফেলেছে রে, মেরে ফেলেছে রে! তখন দেখি, লোকটার পরনে একটা খাকি হাফ প্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পুটলির মতো একটা ভুড়ি সামনের দিকে দাপানোর তালে তালে নড়ছে। পৈলেন ছোরা হাতে বাঁই করে ঘুরে দৃশ্যটা দেখল। আমার আজও সন্দেহ হয়, পৈলেন লোকটাকে নির্ঘাৎ পুলিশ বলে ভেবেছিল। নইলে এমন কিছু ঘটেনি যে পৈলেন মাথা গুলিয়ে ফেলে হঠাৎ দৌড় লাগাবে। আমি আজও বুঝি না, পৈলেনের সেই দৌড়টার কী মানে হয়। দৌড়ে সে যেতে চেয়েছিল কোথায়? চলন্ত গাড়ি থেকে তো আর দৌড়ে পালানো সম্ভব নয়।

তবু ছোরাটা উঁচিয়ে ধরে পৈলেনও এক সাংঘাতিক আতঙ্কের স্বরে ‘যে ধরবি মেরে ফেলব, জান লিয়ে লেবো শশালা…জান লিয়ে লেবো-রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে বলে দিচ্ছি…’ এই বলতে বলতে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খ্যাপার মতো এ দরজা থেকে ও দরজা পর্যন্ত কেন যে খামোকা ছোটাছুটি করল তা ওই জানে। কেউ ওকে ধরতেও যায়নি, মারতেও যায়নি। কিন্তু ও তখন আতঙ্কে, মাথার গণ্ডগোলে কেমনধারা হয়ে মস্ত খোলা দরজার দিকে পিছন করে কামরার ভিতরবাগে ছোরা উঁচিয়ে নাহক লোকেদের বাপ-মা তুলে গালাগাল করছিল। দরজার কাছেই সেই দুটো টিটকিরিবাজ ছেলে দাঁড়িয়ে হাওয়া খেয়েছে এতক্ষণ। তাদেরই একজন, স্পষ্ট দেখলাম, আস্তে করে পা বাড়িয়ে টুক করে একটা টোকা মারল পৈলেনের হাঁটুতে। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন একটু কেতরে জোর একটা লাথি কষাল পৈলেনের পেটে। প্রথম টোকাটায় পৈলেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পরের লাথিটা সামলাতে পারল না। বাইরের চলন্ত অন্ধকারে বোঁ করে বেরিয়ে গেল, যেমন গুবরে পোকারা ঘর থেকে বাইরে উড়ে যায়।

হাজুর আনাড়ি হাতে ধরা পিস্তলটা তখন ঠকঠক কাঁপছে। পুরনো পিস্তল, আর কলকবজা কিছু নড়বড়ে হবে হয়তো। একটা ঢিলে নাটবল্টুর শব্দ হচ্ছিল যেন। অকারণে সে আর-এক বার গুলি ছুড়ল। মোটা কালো লোকটা তিড়িং করে লাফিয়ে একটা বেঞ্চে উঠে চেঁচাচ্ছে সমানে, গুলি, গুল্লি! শ্যাষ হয়ে গেলাম। প্যাটটা গেল। বুকটা গেল!

কিন্তু আমি দেখেছি, গুলিটা একটা জোনাকি পোকার মতো নির্দোষভাবে জানালা দিয়ে উড়ে বাইরে গেছে। কিন্তু হাফ প্যান্ট পরা লোকটাকে সে কথা তখন বোঝায় কে? লোকটা এখন নিজের উরুতে থাবড়া মেরে কেবল বলছে, মানকে বলে সাবাস! আবার গুল্লি?

হাজু তখন বুড়োকে ছেড়ে হঠাৎ দুটো বেঞ্চের মাঝখানে বসে পড়ল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে পিস্তলটা মাঝে মাঝে নাড়ে আর বলে, চেন টানবে না কোনও শুয়োরের বাচ্চা। খবরদার, এখনও চারটে গুলি আছে, চারটে লাশ ফেলে দেব।

এ সব সময়ে হামাগুড়ি দেওয়াটা যে কত বড় ভুল তা বুঝলাম যখন দেখি হাজুর মাথায় কে যেন একটা পাঁচ-সাত কেজি ওজনের চাল বা গমের বস্তা গদাম করে ফেলে দিল। বস্তার তলায় চেপটা লেগে হাজু দম সামলাতে না সামলাতেই দরজার ছেলে দুটো পাকা ফুটবল খেলাড়ির মতো দু’ধার থেকে তার মাথায় লম্বা লম্বা কয়েকটা গোল কিক-এর শট জমিয়ে দিল। কামরার অন্য ধার থেকে কদম তখন চেঁচাচ্ছে, আমাকে ধরেছে। এই শালার গুষ্টির শ্রাদ্ধ করি। এই রাঁড়ের ছেলে হাজু, পিস্তল চালা শালা, লাশ ফেলে দে…।

কিন্তু তখন হাজুর জ্ঞান নেই, পিস্তল ছিটকে গেছে বেঞ্চের তলায়। দু’ সেকেন্ডের মধ্যে ওধার থেকে হাটুরে মারের শব্দ আসতে লাগল। লোকজন সব সাহস পেয়ে গেছে। সোনার বোতামওলা বুড়োটাও তখন রুপো বাঁধানো লাঠি হাতে উঠে গেল ওধারে। তাকে বলতে শুনলাম, আহা হা, সবাইকেই চান্স দিতে হবে তো। অমন ঘিরে থাকলে চলে! একটু সরে দিকি বাবারা এধার থেকে, সরো, সরো…

বলতে না বলতেই কদমের মাথায় লাঠিবাজির শব্দ আসে ফটাস করে। কামরাসুদ্ধু লোক ওদিকে ধেয়ে যাচ্ছে। এধারে হাজুর মাথায় সমানে ফুটবলের লাথি, কয়েকটা গাইয়া লোক উঠে এসে উবু হয়ে বসে বেধড়ক থাপড়াচ্ছে, একজন বুকে হাঁটু দিয়ে চেপে হাজুর নাকে আঙুল ঢুকিয়ে চড়চড়িয়ে নাকটা ছিঁড়ছে।

আমি বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বুঝতে পারি, আরে! আমিও যে এদের দলে ছিলাম! বুঝেই হঠাৎ চারধারে চনমনে হয়ে তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজি।

ঠিক এ সময়ে সেই মোটা কালোলোকটা বেঞ্চের ওপর থেকে নেমে এসে দু’হাতে আমাকে সাপটে ধরে ফেলল। বিকট স্বরে বলল, মানকে বলে সাবাস! দেখেন তো মশয়, আমার কোথায় কোথায় গুল্লি দুটো ঢুকল। দেখেন, ভাল করে দেখেন। রক্ত দেখা যায়?

আমি খুব অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, আরে না, আপনার গুলি লাগেনি।

 বলেন কী?— লোকটা অবাক হয়ে বলল, মানকে বলে সাবাস! লাগে নাই? অ্যাঁ। দুই দুইটা গুল্লি।

লাগেনি। আমি দেখেছি।

ওধার থেকে কদম আমার নাম ধরে বারকয়েক ডাক দিয়েই থেমে গেল। পাইকারি মারের চোটে তার মুখ থেকে কয়েকটা কোঁক কোঁক আওয়াজ বেরোল মাত্র। এধারে হাজুর আধমরা শরীরটার তখনও ডলাইমলাই চলছে।

মোটা কালো লোকটা ভাল করে নিজের গা দেখে-টেখে গুলি লাগেনি বুঝে নিশ্চিত হয়ে চারধারে তাকিয়ে অবস্থাটা দেখল। বোধহয় পৌরুষ জেগে উঠল তার। হাজুকে দেখে সে পছন্দ করল না। বলেই ফেলল, এইটারে আর মেরে হবেটা কী? টেরই পাবে না। চলেন, ওই ধারের হারামজাদারে দুইটা দেই।

এই বলে আমাকে টানতে টানতে ওধারে নিয়ে গেল। রুপোবাঁধানো লাঠি হাতে বুড়ো লোকটা ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কত আর পারা যায়। হাতে আবার আর্থারাইটিস।

যারা মার দিচ্ছিল তারা কিছু ক্লান্ত। দু’একজন সরে গিয়ে আমাদের জায়গা করে দিয়ে খাতির করে বলল, ভালমতো দেবেন। এদের গায়ে মারধর তেমন লাগে না।

কালো মোটা লোকটা অসুরের মতো লাফিয়ে পড়ল কদমের ওপর। মুহূর্তে কদমের মাথার একমুঠো চুল উপড়ে এনে আলোতে দেখে বলল, হেই শালা, পরচুলা নাকি?

না, পরচুলা নয়। আমি জানি। কিন্তু সে কথা বলাটা ঠিক হবে না বলে বললাম না। কালো লোকটা আমাকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে তাড়া দিল, মারেন, মারেন! দেখেন কী?

মারতেই হল। চক্ষুলজ্জা আছে, নিজের প্রাণের ভয় আছে। একটু আস্তের ওপর দুটো লাথি কষালাম। গালে একটা চাপড়। কদমের জ্ঞান ছিল। একবার চোখ তুলে দেখল। কিন্তু কথা বলার অবস্থা নয়। গাড়ির দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে উবু হয়ে মার খেতে লাগল নাগাড়ে। তারপর শুয়ে পড়ল।

পরের স্টেশনে গাড়ি থামতেই হই রই কাণ্ড। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সেই ফাঁকে পালিয়ে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠলাম গিয়ে। হঠাৎ দেখি, আমার সঙ্গে সেই কালো মোটা লোকটাও উঠেছে এসে। আমাকে একটা বিড়ি দিয়ে বলল, পালিয়ে এসে ভাল কাজ করেছেন। আপনি বুদ্ধিমান। নইলে থানা-পুলিশের ঝামেলায় পড়ে যেতে হত।

আমি একটা হুঁ দিলাম। বাস্তবিকই বোধহয় আমি বুদ্ধিমান। ডাকাতের দলে আমিও যে ছিলাম সেটা কেউ ধরতেই পারল না।

কথায় কথায় লোকটার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। বেশ লোক। ক্যানিংয়ের বাজারে তার আটাকল আছে, তিনটে নৌকোর মালিক। আমাকেও লোকটা পছন্দ করে ফেলল। শেষমেশ বলেই ফেলল, তোমারে তো বিশ্বাসী মানুষ বলেই মনে হয়। আমার তিনটে মালের নৌকো লাট এলাকায় খেপ দেয়। চাও তো তোমারে তদারকির কাজে লাগিয়ে দিই। মানকে বলে সাবাস! বলে খুব হাসল। গলা নামিয়ে বলে, আমার নামই মানিক। মানিকচন্দ্র সাহা, বৈশ্য। আবার বৈষ্ণবও বটে হে। বাঙাল দেশে বাড়ি। কিন্তু এতদঞ্চলে থাইকতে থাইকতে দেশি ভাষা প্রায় ভুলে গেছি। যাবা নাকি আমার সঙ্গে? আমি লোক ভাল৷

রাজি হয়ে ক্যানিং চললাম। বরাবর দেখেছি, উড়নচণ্ডীদের ঠিক সহায়-সম্বল জুটে যায় কী করে যেন। ঘর ছেড়ে এক বার বেরিয়ে পড়লে আর বড় একটা ঘরের অভাব হয় না।

.

০৩.

ক্যানিং জায়গা ভাল। ঘিঞ্জি বাজারটার ভিতরে মানিক সাহাব আটাকল। আটাকলের পিছনেই দমবন্ধ তিনটে ঘরে তার তিন-তিনটে জলজ্যান্ত বউ থাকে। ছেলেপুলে কত তা গুনে শেষ করতে পারিনি। যে ক দিন ছিলাম সেখানে প্রায় দিনই ছেলেপুলেদের মধ্যে দু-একটা নতুন মুখ দেখতাম। তার ক’টা ছেলেমেয়ে তা জিজ্ঞেস করলে মানিক নিজেও প্রায়ই গুলিয়ে ফেলত। এক দিন আমার চোখের সামনেই রাস্তায় ঘুগনিওলার ছেলে কাদা মাখছিল, মানিক সাহা তাকে নিজের ছেলে মনে করে নড়া ধরে তুলে এনে আচ্ছাসে পিটুনি দিয়ে দিল। ভুল ধরা পড়তেই জিভ কেটে বলল, মানকে বলে সাবাস।

বড় ভাল লোক মানিক সাহা। সে নিজেও সে কথা প্রায়ই বলত, বুঝলে হে উপল, আমি লোকটা বড় ভাল। লোকে আমারে ভয় দেখায়, বলে, একের অধিক বিবাহ বে-আইনি। একদিন নাকি আমারে জেল খাটতে হবে। কিন্তু আমি কই, জেল খাটাবা খাটাও, কিন্তু আমারে মন্দ কোয়ো না কেউ। আমি তো কোনও মেয়ের সঙ্গে নষ্টামি করি নাই। বদমাইশ লোক ঘরে বউ থুয়ে অন্যের সঙ্গে নষ্টামি করে। আমি বদমাইশ না। মেয়েছেলে দেখে মাথা খারাপ হলে আমি তারে বিয়ে করে ফেলি। এইটে সাহসের কাজ, না কি ড়ুব দিয়ে জল খাওয়াটা সাহসের?

ঘিঞ্জি বাজারটা পার হলেই বিপুল নদী, আকাশ, ব্রিটিশ আমলের কুঠিবাড়ি। হাজার রকমের মাল বোঝাই হয়ে নৌকো যায় বাসন্তী হয়ে গোসাবা। আরও ভিতরবাগে নানা নদীনালা ধরে ধরে গহিন সুন্দরবন পর্যন্ত। নৌকোয় থেকে থেকে জোয়ার-ভাটা, গাঙের চরিত্র, মেঘ, বর্ষা, শীত সবই চিনে গেলাম। নদীর জীবনে না থাকলে পৃথিবীর কত রূপ অদেখা থেকে যেত। লাট অঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, মোটরগাড়ি নেই, রিকশা নেই, এমনকী সাইকেল বা গো-গাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় না। মাইল মাইল চষা খেতের তফাতে এক-এক খানা গ্রাম। নৌকো ভিড়িয়ে প্রায়দিনই গাঁ দেখতে চলে গেছি গভীর দেশের মধ্যে। সেখানে নিঝুম এক আশ্চর্য জগৎ। ফিরে আসতে মন চাইত না।

আমার সে-জীবনটা ভণ্ডুল করে দিল মানিক সাহা নিজেই। বাসন্তী ছেড়ে ক্যানিংমুখো নৌকো। বড় গাঙে পড়তেই ঝড়। মাল গস্ত করতে সেবার মানিক সাহা নিজেই গিয়েছিল। খড় কিনে ফিরছে। পাহাড়-প্রমাণ বোঝাই নৌকো। মানিক হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় খালি গায়ে হালের কাছে বসে গুন গুন করে ঢপের গান গাইছে। সুরের জ্ঞান ছিল। একটু আগেই একটা পচা কাঠ কুমিরের মতো আধো ড়ুবন্ত ভেসে যাচ্ছিল দেখে কামঠ! কামঠ! বলে চেঁচিয়ে আমাদের সঙ্গে রঙ্গ করছিল। জোর বাতাস ছাড়তেই কিছু আলগা খড় উড়ে গেল ডাইনির চুলের মতো। আকাশে গুমগুম শব্দ। নৌকোর জোড় আর বাঁধনে একটা ক্যাচকোচ শব্দ উঠল বিপদের। জল ঘোর কালো। আকাশে ঘূর্ণি মেঘ উড়ে আসছে!

কেমনধারা অন্য রকম চোখে মানিক সাহা এক বার পিছু ফিরে দেখল। তার দু’হাত পিছনে আমি দাঁড়িয়ে, আমার পিছনে খড়ের গাদা। কিন্তু আমাকে বা খড়ের গাদাকে দেখল না মানিক সাহা। এমনকী গোঙানো জলে গহিন ছায়া ফেলে যে প্রকাণ্ড ঝড় আসছে তার দিকেও ভ্রুক্ষেপ করল না সে। তবু কী যেন দেখল। মাঝিরা চেঁচামেচি করছিল নৌকো সামলাতে।

মোজাম্মেল খড়ের গাদার ওপর থেকে একটা দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে নেমে এসে মানিক সাহাকে বলল, সাহাবাবু, খোলের মধ্যে ঢুকে পড়ুন। ইদিক-সিদিক কিছু হলে তিন-তিনটে ঠাকরোন বিধবা হবেন।

খাকি হাফপ্যান্ট পরা মানিক সাহা উবু হয়ে যেমন বসে ছিল তেমনি রইল। পুরনো পালের কাপড় হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে ফেড়ে গিয়ে নিশেনের মতো উড়ছে। নৌকো কিছু বেসামাল। মাঝিরা ডাঙার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু একটা ঘোলায় পড়ে নৌকোটা এগোতে চাইছে না। ওদিকে দিকবিদিক একটা ধোঁয়াটে চাদরের মতো আড়াল করে বড় গাঙ ধরে উড়োজাহাজের শব্দ তুলে ঝড় আসছে। আলগা খড় মুঠো মুঠো উড়ে যায় বাতাসে, এদিক-সেদিক পাক খেয়ে জলে পড়ে। মানিক সাহা যেভাবে উবু হয়ে বসে আছে ধারে তাতে বাতাসের তেমন চোট এলে না উলটে জলে গিয়ে পড়ে।

ভাল ভেবে আমি গিয়ে পিছন থেকে মানিক সাহার বা কনুইয়ের ওপরটা চেপে ধরে বললাম, মানিকদা, চলো খোলে বসে কেত্তন গাই।

মানিক সাহা মুখ তুলে, ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখল। তার বাঁ হাতে রুপোর চেনে বাঁধা পীত পোখরাজ, গোমেদ, বৈদূর্যমণি, সিংহলের মুক্তো, চুনি নিয়ে পাঁচটা পাথর, তা ছাড়া তাগায় বাঁধা দুটি মাদুলি। আমি যেখানটায় ধরেছি তার হাত, সেখানে তাবিজ আর পাথর খজবজ করে উঠল। দেখি, মানিক সাহার দু চোখে টলমল করছে জল।

হাত বাড়িয়ে আমার গলা ধরে মাথাটা তার মুখের কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, কাজগুলো সব খারাপ হয়ে গেছে। না?

কী কাজ খারাপ হয়েছে, কেনই বা হল, তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু বুঝতে পারছি, মানিক সাহার হঠাৎ কোনও কারণে বড় অনুতাপ এসে গেছে।

আন্দাজে বললাম, কেন, কাজ খারাপ হবে কেন? আমি তো কিছু খারাপ দেখি না।

মানিক সাহা কথা বলল না। সেই ঝড় বাতাসে খাকি হাফপ্যান্ট পরে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে উবু হয়ে বসে চোখের জলে গঙ্গার জল বাড়াতে থাকে, আর কেবল কী মনে করে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে।

ও সব কথার তখন সময় নেই। ঘুণে ধরা মাস্তুল পালের নিশেন সমেত মড়াৎ করে ভেঙে জলে ভেসে গেল। নন্দর মাথায় চোট হয়ে রক্ত গড়াচ্ছে গাল ভাসিয়ে। এই তক্কে নৌকো ঘোলা পেরিয়ে একখানা চক্কর মারল। ধড়াস ধড়াস করে তিন-চারজন আমরা কুমড়ো গড়াগড়ি দিয়ে উঠে দেখি, দুনিয়া মুছে গেছে। চার দিকে বাতাসের হাহাকার শব্দ। তাল-বেতাল জল ফুলে উঠছে গহিন আঁধার গাঙে। নৌকো আকাশে উঠে পাতালে পড়ছে।

এই সব গোলমালে যে যার সামলাতে যখন ব্যস্ত তখন মানিক সাহার হাফপ্যান্ট পরা শরীর পাটাতনে চিত হয়ে পড়ে আছে। মাল্লারা নৌকো একটা ঘাটের মাটির বাঁধে প্রচণ্ড ঘষটানি লাগিয়ে ভিড়িয়ে দিল। লাফিয়ে নেমে সব দড়িদড়া আর খোটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মানিক সাহা তখনও চিত হয়ে পড়ে আছে। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির ধারালো বর্শা ফুড়ছে চার দিক। আগুনের হলকা ছড়িয়ে দড়াম দড়াম করে বাজ পড়ে কাছেপিঠে। মানিক সাহা চোখ বুজে পড়ে আছে। তাগা ছিড়ে কয়েকটা তাবিজ আর কবচ ছিটকে পড়েছে চারধারে।

আমি তাকে নাড়া দিতেই সে সেই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই, যেন বিছানায় শুয়ে আছে, এমন আরামে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, কাজগুলো সব খারাপ হয়ে গেছে।

এ অঞ্চলের ঝড় হঠাৎ এসে হঠাৎ যায়। ঝড় থেমে গেলে দেখা গেল, খড় ভিজে নৌকো তিন গুণ ভারী হয়ে জলের নীচে মাটিতে বসে গেছে। তার ওপর ভঁটিতে এখন উলটো স্রোত। মাল্লারা ওপরে উঠে খড়ের চাপান কমানোর জন্য ভেজা খড়ের আঁটি হাতে হাতে চালান করছিল ডাঙায়। ভিজে সবাই চুস। খড়গুলো পড়ে থাকবে এখানে, কাল অন্য নৌকো নিয়ে যাবে এসে।

খোলের ভিতর আমার একটা টিনের সুটকেস আছে। তার ভিতর থেকে সস্তার সিগারেট আর দেশলাই এনে পাটাতনে মানিক সাহার পাশে বসলাম। দিব্যি ঠান্ডা হাওয়া। পরিষ্কার আকাশে ফুটফুট করছে তারা। ভেজা গায়ে উঠে বসে মানিক সাহা একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে বলল, উপলভাই, বড় অপরাধ করে ফেলেছি হে। মানকে বলে সাবাস।

কিছুই বুঝতে পারছি না। ধমক দিয়ে বললাম, ব্যাপারটা কী?

সে গম্ভীর হয়ে বলে, তখন তুমি ফচ করে এসে যদি হাতটা না-ধরতে তা হলে এতক্ষণে আমার লাশ গাঙে ভাসত। যেই না মনের জ্বালায় লাফিয়ে পড়ব বলে মন করেছি অমনি তুমি এসে

শুনে ভয় খেয়ে যাই। মানিক সাহা লাফিয়ে পড়লে আগামী কাল থেকে আমার গতি হত কী? বললাম, লাফাবে কেন?

ঝড়জলের ওই বিকট চেহারা দেখে হঠাৎ নিজের সব পাপের কথা মনে পড়ে গেল কিনা। কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

সারাক্ষণ মানিক সাহার সেই এক কথা। কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে। কী খারাপ হল, কেন খারাপ হল এ সব জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। সে রাতে লঞ্চ ধরে ক্যানিং ফিরে এসে অবধি তার মাথার জট ছাড়ল না। তারপর তিন দিন, চার দিন করে সময় যেতে লাগল। মানিক সাহা খায় দায়, হাসে, গল্প করে, কিন্তু হঠাৎ সব কিছুর মাঝখানে একটা বড় শ্বাস বুক থেকে ছেড়ে বলে, কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

মাসখানেকের মধ্যে তিনটে নৌকো বেচে দিল সে জলের দরে। আটাকল আর দোকানঘর বউদের নামে লিখে দিল। বউরা কেউ মরাকান্না কাঁদে, কেউ বিকট চেঁচিয়ে গালমন্দ করে মানিক সাহাকে। কিন্তু লোকটা নির্বিকার, কেবল বলে, কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

আরও ক’দিন বাদে আমার কাছে গোপনে সে ঝেড়ে কাশল। বললে, তিন বিয়ে ভাল নয়, বুঝলে? অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে এক বিয়ে ভাল। আর এই ব্যাবসা-ট্যাবসার কোনও মানে হয় না, আসল জিনিস হল চাষবাস।

আমি ঢাকের বাঁয়া হয়ে মাথা নাড়ি।

 কিছুদিন বাদে একদিন সকালে মানিক সাহা আমাকে নিয়ে দাঁতন করতে করতে বাঁধে হাঁটতে লাগল। সেদিনও তার পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, গা আদুড়। খানিক দূর গিয়ে দাঁতন জলে ফেলে দিয়ে পিছু ফিরে আমাকে বলল, দৌড়োও!

বলে সে নিজে হাঁসফাস করে ছুটতে থাকে। আমার জাগতিক অবলম্বনকে ছুটতে দেখে আমিও দৌড়োই। লঞ্চ তখন ছাড়ে-ছাড়ে অবস্থা। মানিক সাহা এক লম্ফে চড়ে গেল, পিছনে আমি।

একগাল হেসে সে বলল, খুব জোর পালিয়েছি হে। তিন-তিনটে বউ যার, জীবনে কি তার শান্তি আছে? বউগুলো চারটে শালাকে আমদানি করেছে আমাকে নজরে রাখার জন্য। মানকে বলে সাবাস।

আমি বেজার মুখে বললাম, কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?

মানিক সাহা সংক্ষেপে বলল, এক বিয়ে, আর চাষবাস। আর কোনও ফাঁদে পা দিচ্ছি না।

গোসাবায় নেমে মাইল পাঁচেক মাঠ বরাবর হেঁটে পাখিরালয় গাঁ। সেখান থেকে নদী পেরিয়ে দয়াপুর। সেখানে পৌছতে বেলা কাবার হয়ে গেল। গিয়ে দেখি, মানিক সাহা সেখানে আগেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে কবে থেকে। জমিজোত কেনা হয়ে গেছে, দিব্যি মাটির বাড়ি আর ঘেরা বাগান। লোকজন কাজকর্ম করছে। এমনকী সেখানে ডজন খানেক খাকি হাফপ্যান্টও মজুত রয়েছে।

পরদিনই মানিক সাহা বিয়ে বসল। বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে ছিল আগে থেকেই। গরিবের ঘরের শ্রীময়ি একটা কালো, অল্পবয়সি মেয়ে লাজুক হেসে মানিকের বউ হয়ে গেল। নাম ঝুমুর। মানিক আমাকে চুপি চুপি বলল, এক বিয়ে, বুঝলে? এখন থেকে আর বহু বিবাহ নয়।

আমি বুঝদারের মতো মাথা নাড়ি। তখন মানিক হঠাৎ ধর্মভয়ে কাতর হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে বলো তো, ধৰ্মত আমি কাউকে ঠকাইনি তো, জোচ্চুরি করিনি তো কারও সঙ্গে? সকলের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি তো? তারপর নিজেই কর গুনে হিসেব করে বলে, বউদের ছেলেপুলে, টাকা-পয়সার অভাব রাখিনি, এক, মহাজনের কাছেও বাকি বলে কিছু পড়ে নেই, দুই, কর্মচারীদের কারও এক পয়সা মারিনি, তিন…

দয়াপুরে দিব্যি আমার থাকা চলছিল। কাজকর্ম নেই, বসে খাও, আর চাষবাস একটু দেখাশোনা করো, কাজের লোকদের কিছু হাঁকডাক করো, বাস হয়ে গেল। সেই খিদের চিন্তাটা তেমন মাথা চাড়া দেয় না। ভাবলাম, আমার সেই খিদের ভূত বোধহয় রোজার হাতে পড়েছে।

কিন্তু মানিক সাহার নতুন বউ জ্বালালে। এক মাসের মাথায় সে আমার সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি শুরু করে। সেটা মন্দ লাগত না। মেয়েছেলের সঙ্গ তো খারাপ না, সময়টা কাটেও ভাল। কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই সে নানা রকম ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল। রাত-বিরেতে উঠে আসত আমার বিছানায়।

আমি তাকে বলতাম, দেখো, মেয়েমানুষের চেয়ে আমার ঢের বেশি দরকার একটা আশ্রয়। তুমি অমন করলে একদিন ধরা পড়ব ঠিক, তখন মানকে আমাকে তাড়াবে।

ইস, তাড়ালেই হল?— বলে খুব দেমাক দেখাত। আবার কখনও বলত, চলো পালিয়ে যাই।

অত বোকা আমি নই। পালানোর কথায় পাশ কাটাতাম।

শেষতক ঝুমুরের মধ্যে একটা হন্যে ভাব দেখা দিল। কাঁচা অল্পবয়সি পুরুষমানুষের গন্ধে তার আর রাখ-ঢাক রইল না। মানিক সাহা খেত থেকে ফিরে এসে যখন জিরেন নিচ্ছে তখন আমি কত বার বলেছি, যাও বউঠান, একটু হাওয়া-টাওয়া করো, দুটো ডাব কেটে দাও?

সে তখন আমার সঙ্গে প্রায় মানকের চোখের সামনে ঢলাচ্ছে। বলত, ডাব ও নিজে কেটে নিতে পারবে না?

রাত-বিরেতে মানকে ভাল করে ঘুমোবার আগেই উঠে আসত। চোখের সামনেই দিন দুপুরে আমাকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যেত বাগানের দিকে।

টের না-পাওয়ার কথা নয় মানকের। ভাল করে দেখেশুনে সে অবশেষে একদিন গর্জন করে উঠে বলল, অসতী! অসতী।

যাদের স্বভাব খারাপ তারা টপ করে পায়ে ধরতে পারে। ঝুমুরও পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল। প্রথম বলল, ভুল দেখেছ। পরে স্বীকার হয়ে বলল, আর হবে না এ রকম।

কিন্তু তাই কি হয়! যা হওয়ার তাই হচ্ছিল ফের।

এবার মানিক সাহা কেঁদে উঠল এক রাতে। বউয়ের হাত-পায়ে ধরে বিস্তর বোঝাল। ঝুমুরও কাঁদল, আদর করে বলল, তোমায় ছুঁয়ে বলছি, আর হবে না।

আবার হল।

তৃতীয় দফায় মানিক সাহা একদিন বউকে ধরে বেধড়ক ঠেঙাল, তারপর দেড় বেলা বেঁধে রাখল ঘরে।

কী জানি কেন এ ব্যাপারে আমাকে তেমন কিছু বলত না মানিক। মাঝে মাঝে কেবল ছানি পড়া চোখের মতো যেন ভাল ঠাহর করতে পারছে না, এমনভাবে তাকাত। এক-আধবার করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করেছে, উপলভাই, এর চেয়ে কি তিন বিয়েই ভাল ছিল?

আমি তার কী জানি। চুপ করে থাকতাম।

সে নিজেই ভেবেচিন্তে বলত, তিনটে বউ থাকলে সুবিধে এই যে, তারা পরপুরুষের কথা ভাববার সময় পায় না, একটাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করে। হিংসুক জাত তো! এক বিয়ের দেখছি বিস্তর ঝামেলা।

ইদানীং খুব তাড়ি খাওয়া ধরেছিল মানকে। ঝুমুর কাঁকড়ার ঝাল, মাছের চচ্চড়ি করে দিত। আমি আর মানকে সেই চাট দিয়ে জ্যোৎস্নার উঠোনে বসে সন্ধের পর খেতাম।

ঝুমুর একদিন আধ টিন পোকামারার সাংঘাতিক বিষ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আজ রাতেই নিকেশ করবে।

বোকা মেয়েমানুষ। ডাক্তার, থানা-পুলিশ, আদালত এ সব খেয়াল নেই। কিন্তু ঝুমুরের চোখ-মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, রাজি না হলে এ বিষ একদিন আমার ভিতরে কোনও কৌশলে চালান করে দেবে। একটা চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে ও।

টিন নিয়ে গ্যাঁজানো তাড়িতে মেশাতে হল।

কী বুদ্ধি!–ঝুমুর দেখে বলল, প্রথমটায় খেলেই তো গন্ধে টের পাবে। আগে ভাল তাড়ি দিয়ে নেশা করিয়ে নেবে তারপর এটা দিয়ো। নেশার ঝোঁকে কী খাচ্ছে টের পাবে না।

ঝুমুরের বুদ্ধি দেখে আমি তখন অবাক। মেয়েমানুষ একই সঙ্গে কত বোকা আর চালাক হতে পারে!

সন্ধেবেলা ঝুমুর বাপের বাড়ি গেল। কাল সকালে ফিরে এসে কান্নাকাটি করবে। বিধবা হবে তো!

আমি আর মানকে তাড়িতে বসলাম।

আকাশে চাঁদ ছিল না, উঠোনে একটা হারিকেন ছিল শুধু। চাঁদের অভাবে মানকে উদাস চোখে হারিকেনটার দিকে চেয়ে ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছে। আমি তাকে পা দিয়ে ছোট একটা আদুরে লাথি মেরে মুখটা কাছে আনতে ইশারা করলাম। সে হামাগুড়ি দিয়ে কাছে আসতেই বললাম, বোঝো কেমন?

কী বুঝব ভাই?

শোন মানিকদা, যখন-তখন না দেখেশুনে যা-তা খেয়ে বোস না এ বাড়িতে।

কেন বলো তো?

দু’ নম্বর হাঁড়িতে বিষ মেশানো আছে।

বিষ?

বলে হঠাৎ হাফপ্যান্ট পরা মানিক লাফিয়ে উঠে হাতের ভাঁড় ছুড়ে ফেলে পেল্লায় চেঁচাতে থাকল, বিষ দিছে! বিষ দিছে! মরে গেলাম, ও বাবা রে, মরে গেলাম। আমার বুকটা কেমন করে। আমার প্যাটটা কেমন করে।

এই বলে আর সারা উঠোন জুড়ে লাফিয়ে নৃত্য করে।

হুবহু সেই ট্রেনের কামরার দৃশ্য।

হাতের ভাঁড়টা শেষ করে আমি হারিকেনটা তুলে নিয়ে রওনা দিলাম। পুঁটুলি একটা বাঁধাই ছিল।

মাঠ পেরিয়ে যখন ঘাটের কাছে পৌঁছেছি তখন পিছন থেকে মানিকও হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। কোনও কথা হল না দু’জনে। জোয়ারের জল এখন বেশ ফেঁপে আছে। পাড়ে তোলা নৌকোটা এঁটেল কাদায় ঠেলে নিয়ে জলে ফেলে দু’জনে উঠে বসলাম।

মানিক সাহা পাখিরালয়ে নেমে গেল অন্ধকারে। আমি তাকে হারিকেনটা ধরিয়ে দিলাম হাতে। সেই আলোতে দেখা গেল, তার মুখ-চোখ কেমন ভোম্বলপানা হয়ে আছে। পিছনে দিগন্তজোড়া অন্ধকার পৃথিবী, অচেনা। সেদিকে চাইল। তারপর আমাকে বলল, না ভাই, এবার পুরো ব্যাচেলার। চিরকুমার থাকব এখন থেকে।

এই বলে খাড়াই ভেঙে উঠে গেল। কোথায় গেল তা আমি আজও জানি না। আমি নৌকো বেঁধে রেখে গোসাবামুখো হাঁটা ধরলাম।

.

০৪.

বারান্দাটায় থাকতে আমার কিছু খারাপ লাগে না। শীত বা বর্ষায় একটু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু ও সব গায়ে মাখা আমার অভ্যাস নয়।

বারান্দার বাতি নিভলেই রোজ এক অতিথি আসে। কেঁদো একটা ছুঁচো। এত স্বাস্থ্যবান ছুঁচো কদাচিৎ দেখা যায়। হুলো বেড়ালের মতো বড় চেহারার এক মিস্টার ইউনিভার্স, বেসিনের তলায় এঁটো বাসন-কোসন ডাঁই করা থাকে, সে এসেই বাসনপত্রে হুটোপাটি শুরু করে দেয়। বাতি জ্বাললেই গ্রিলের দরজার বাইরে বা জালের ফুটোর ভিতরে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। তার লোমহীন মোটা লেজটা দেখা যায়। ভারী চালাক ছুঁচো। রান্নাঘরে এক রাতে চারখানা পরোটা নিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে রেখে গেল। গোটা তিনেক নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ক্ষণা বারবারই সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, এ কি আর ছুঁচোর কাজ! বাটির ঢাকনায় নোড়া চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। অত ভারী জিনিস সরাতে পারে নাকি ছুঁচোরা? এ অন্য ছুঁচোর কাজ। যাদের লোকে ছোঁচা বলে।

শুনে আমার একটু লজ্জা করল। ছুঁচোটার ওপর রাগও হল খুব।

এ বাড়িতে আর একটা উৎপাত আছে চড়াই পাখির। গ্রিলের ফুটো দিয়ে রাজ্যের চড়াই এসে লোহার বিমের খাঁজে রাত কাটায়। রাতে বিমের গায়ে ডিম ডিম সব চড়াই বসে নানা রকমের শব্দ করে। অসুবিধে হল তাদের পুরীষ নিয়ে। যখন-তখন লাজলজ্জার বালাই নেই, হড়াক করে খানিকটা সাদায় কালোয় ক্বাথ ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। আমার বালিশ বিছানা বলতে যা একটু কিছু আছে সব দাগ-ধরা হয়ে গেল। এখন কাচলেও ওঠে না। মাঝেমধ্যে প্রথম রাতে দুটো-তিনটে চড়াইয়ের মধ্যে মাথা গরম করা ঝগড়া লেগে পড়ে। একটা আর-একটাকে খোঁচাতে খোঁচাতে দুটো-তিনটে মিলে জড়াজড়ি করে পড়ে যায় নীচে।

এ দুই উৎপাত ছাড়া এখন আর কোনও অসুবিধে নেই।

 ছুঁচোটার সাহস ক্রমেই বাড়ছে। পরোটা চুরির পরদিন যেই এসেছে অমনি উঠে বাতি জ্বাললাম। একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। রোজ যেমন সুট করে পালায় সেদিন মোটেই তেমন কিছু করল না। একটু লজ্জার ভান করে কয়েক পা দৌড়ে গ্রিলের দরজার কাছে গিয়ে সামনের পায়ের মধ্যে মুখ ঘষে প্রসাধন করতে লাগল নিশ্চিন্তে।

কিছু করার নেই। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অল্প একটু অভিমান হয়েছিল বটে ছুঁচোটার ওপর, কিন্তু সেটা বোঝার মতো হৃদয় ওর নেই।

কয়েকটা বাজারের থলি খামকা দাঁতে কেটে রেখে গেল কয়েক বার। একটা বাসি চাদর বারান্দায় পড়ে ছিল, পরদিন ঝি কাচবে, সেটা সাত জায়গায় ছ্যাঁদা হল একদিন। তা ছাড়া নাদি মেখে রেখে যায় বারান্দায় রোজ। পরিষ্কার করতে ঝি চেঁচামেচি করে। আজকাল আবার রাতে এত বেশি সাড়াশব্দ শুরু করে যে আমার ঘুম চটে যায়। বাতি জ্বেলে তাড়া দিলে চলে যায় ঠিকই। বাতি নেভালেই আসে।

ক্ষণা একটা লাঠি আমার বিছানার পাশে রেখে দিয়ে এক রাতে বলল, শুধু চেয়ে চেয়ে ছুঁচোর কাণ্ড দেখলেই তো হবে না। এটা দিয়ে আজ ওটাকে পিটিয়ে মারা চাই।

আমার কমলাকান্তের মতো অবস্থা। সে রাতে ছুঁচো মহারাজ এলে আমি নানা শব্দ সাড়া করে উঠে বাতি জ্বাললাম। ছুঁচোটার ভয় ভেঙে গেছে একেবারেই। আজকাল আমাকে দেখলে নড়েও না। কষে এক বার লাঠিটা চালালাম, সে অলিম্পিকের চালে দৌড়ে পালিয়ে গেল। ক্ষণাকে শোনানোর জন্য কয়েক বার প্রবল লাঠির শব্দ আর গালাগাল করে আমিও শুয়ে পড়ি।

কয়েক রাত এইভাবে কাটলে একদিন ক্ষণা বলল, অসহ্য করে তুলল তো ছুঁচোটা। আজ বাজার থেকে ইঁদুর মারা বিষ আনবেন তো। অন্য কিছুতে হবে না।

শুনে আমার ঘাম দিল।

শেষবার বিষ দিয়েছিলাম মানিক সাহার বাড়িতে। আর বিষ-টিষ বড় একটা দেওয়া হয়নি। দুনিয়ায় ফালতু লোক বা অপ্রয়োজনীয় জীবজন্তু কীটপতঙ্গের অভাব নেই ঠিকই, তবু এই জনে জনে বিষ দিয়ে বেড়ানোর কাজটা আমার তেমন পছন্দ নয়।

দু-চারদিন গড়িমসি করে কাটিয়ে দিই। রাতে ছুঁচোটা এসে ফের হুটোপাটা শুরু করলে অন্ধকারে মাথা-তোলা দিয়ে আধশোয়া হয়ে তাকে ডাকি, এই মোটা, শুনছিস? পালা, পালিয়ে যা মানিক সাহা মতো।

ছুঁচোটা চিড়িক মিড়িক করে কী জবাবও দেয় যেন। কিন্তু ঠিক ভাবের আদানপ্রদান হয় না। নির্বোধটাকে কী করে বোঝাই যে, মানুষকে অত বিশ্বাস করা ঠিক নয়?

মশা বা ছারপোকাও আমি পারতপক্ষে মারতে পারি না। আমার বাবারও এই স্বভাব ছিল। প্রায়ই বলতেন, লেট দি লিটল ক্রিচারস এনজয় দেয়ার লিটল লাইভস। একজন মহাপুরুষের বাণী থেকে কোটেশনটা মুখস্থ করেছিলেন। আমাদের একটা পোষা বেড়ালকে মাঝে মাঝে খড়ম দিয়ে এক ঘা দু’ ঘা দিয়েছেন বড় জোর, তার নিষ্ঠুরতা এর বেশি যেতে পারত না! বেড়ালটা খড়মের ঘা খেয়ে লাফিয়ে গিয়ে জানালায় উঠে বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। তার চোখে অবিশ্বাসভরে যেন বলে উঠত, ইউ টু ব্রুটাস? বাবাও তার দিকে চেয়ে খুব সবজান্তার মতো বলতেন, কেমন লাগল বল? মনে করছিস তেমন কিছু লাগেনি? সে এখন টের পাবিনা। রাত হোক, হাড়ের জোড়ে জোড়ে টের পাবি।

বেড়ালটা টের পেত কি না জানি না, তবে বাবাকে দেখেছি, রাতের বেলা চুপি চুপি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট জলে গুলে বেড়ালকে জোর করে খাইয়ে দিতেন।

আমার কানা মাসিরও প্রাণটা ভাল ছিল। রাজ্যের কাক, কুকুর, বেড়াল, পায়রাকে ডেকে ডেকে এঁটো-কাঁটা খাওয়াতেন। এই করে করে কুকুর বেড়াল তো পোষ মেনে গিয়েছিলই, কয়েকটা কাক শালিকও তার ভক্ত হয়ে পড়ে। মাসি কোথাও বেরোলে রাস্তা থেকে গুনে গুনে এগারোটা কুকুর তার পিছু নিত। বড় রাস্তা পর্যন্ত সঙ্গে গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসত। কানা মাসি যখন রান্নাঘরে বসে ছ্যাঁক ছোঁক করছে তখন চৌকাঠে এসে নির্ভয়ে কাক তাকে ডেকে কত রকম কথা বলত ক্যাও ম্যাও করে। সেসব কথার জবাবও কানা মাসিকে দিতে শুনেছি, রোসো বাছা, খিদেয় তোমাদের সব সময়ে পেটের ছেলে পড়ে গেলে তো চলবে না। বসে থাকো, ভাতের দলা মেখে দিচ্ছি একটু বাদে…

ছেলেবেলা থেকে এই সব দেখেশুনে আমার প্রাণেও একটা ভেজা-ভাব এসে গেছে।

কিন্তু সকলের প্রাণ তো আমারটার মতো পান্তা ভাত নয়। ক্ষণার ও সব দুর্বলতা নেই। তিন দিন বাদে সে আমাকে বাজারের টাকা দেওয়ার সময়ে সকালবেলাটাতেই বলে ফেলল, ফর্দ দেখে জিনিস আনেন, তবু ভুল হয় কেন বলুন তো! আজ যদি বিষ আনতে ভুল হয় তবে কিন্তু…।

বাকিটা প্রকাশ করল না ক্ষণা। কিন্তু তাতেই নানা রকম অজানা ভয় ভীতিতে আমার ভিতরটা ভরে গেল। ক্ষণার মুখে একপলকের জন্য ঝুমুরের সেই মুখের ছায়া দেখতে পেলাম বুঝি।

ক্ষণার চেহারা খারাপ নয়, আবার ভালও নয়। ওই একরকমের চেহারা থাকে, না লম্বা না বেঁটে, ফরসা না কালো। ক্ষণার মুখ নাক চোখ কান সব ঠিকঠাক। গালের মাংস বেশি নয়, কমও নয়। দাঁত উঁচুও নয়, আবার ভিতরে ঢোকানোও নয়। অর্থাৎ, ক্ষণাকে যদি কেউ সুন্দর দেখে তো বলার কিছু নেই, আবার খারাপ দেখলেও প্রতিবাদের মানে হয় না।

হাত পেতে বাজারের টাকা নেওয়ার সময়ে আজ আমি ক্ষণাকে একটু আড় চোখে দেখে নিলাম। ক্ষণাকে এক-এক সময়ে এক-এক রকম দেখায়। আজ খুব রগচটা, রসকষহীন দেখাচ্ছিল।

সুবিনয় পারতপক্ষে বাজারহাট করতে চায় না, ওসব তার অভ্যাস নেই। খুবই চিন্তাশীল, ব্যস্ত মানুষ। নিজের ঘর-সংসার বা আত্মজনদের সে চোখে দেখেও দেখতে পায় না। তার এই দেখা-টেখাগুলো অনেকটা ফিল্মহীন ক্যামেরায় ছবি তোলার মতো। শাটার টিপে যাও, ছবি উঠবে না। সুবিনয়ের ভিতরেও সেই ফিল্মের অভাব আমি টের পাই। নিজের মনোমতো কাজ ছাড়া দুনিয়ার কোনও কিছুই সে লক্ষ করে না।

বাজারের থলি হাতে যাচ্ছি, রাস্তায় সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা। সুবিনয় মস্ত লম্বা লোক, ছ’ ফুট দু’তিন ইঞ্চি হবে। গায়ের রং কালচে। স্বাস্থ্য খারাপ নয় বলে দানবের মতো দেখায়। ওর গায়ে যে অসুরের মতো শক্তি আছে সেটাও ও জানে না ভাল করে। নিজে সুন্দর কি কুচ্ছিত তাও ও খেয়াল করে কি?

এই লম্বা-চওড়া হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। যেমন কাজের নয় খুব সুন্দর বা বিখ্যাত হওয়া। যারা খুব লম্বা-চওড়া, কিংবা খুব সুন্দর দেখতে, কিংবা বিখ্যাত ফিল্মস্টার, নেতা বা খেলোয়াড় তাদের একটা অসুবিধে তারা দরকার মতো চট করে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে না, অচেনা জায়গায় পালিয়ে যেতে পারে না। তারা কী করছে না করছে তা সব সময়েই চারপাশের লোক লক্ষ করে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত গুন্ডা হল নব। সেই নব যখন রাস্তাঘাটে বেরোয় বা দোকানপাটে যায় তখন তাকে পর্যন্ত লোক ফিরে ফিরে দেখে। ভারী অস্বস্তি তাতে। এই যে রাস্তা উপচে শয়ে শয়ে লোকের যাতায়াত, এই ভিড়ে এমনিতে কেউ কাউকে লক্ষ না করুক, ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে তালগাছের মতো উচু মাথার সুবিনয়কে সবাই দু’পলক দেখে যাচ্ছে। সুবিনয় যদি এখন থুতু ফেলে, কি ডাবের খোলায় লাথি মারে, বা একটা আধুলি কুড়িয়ে পায় তো সবাই সেটা নজর করবে।

ঠিক এই কারণেই আমার কখনও গড়পড়তা মানুষের ওপরে উঠতে ইচ্ছে হয় না। কখনও কখনও লুকিয়ে পড়া বা পালিয়ে যাওয়ার বড় দরকার হয় মানুষের। বড় মানুষ হলে পালানোর বা লুকোনোর বড় অসুবিধে।

সুবিনয়ের ডান হাতের আঙুলে লম্বা একটা ফিলটার সিগারেট, বাঁ হাতে মাথার চুল পিছন দিকে সটাসট সরিয়ে দিচ্ছে বারবার। এটাই ওর সব সময়ের অভ্যাস।

আমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল, ফিল্মহীন ক্যামেরার চোখে এক বার তাকালও আমার দিকে। কিন্তু চিনতে পারল না একদম।

আমি ওকে ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে গেছি, তখন হঠাৎ পিছন থেকে ডাক দিল, উপল!

দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাই।

ও খুব বিরক্ত মুখে চেয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিস?

বাজারে।

বাজারে!

বলে সুবিনয় যেন খানিকক্ষণ বাজার শব্দটা নিয়ে ভাবল। শব্দটা কোথায় যেন শুনেছি বলে মনে হল ওর, একটু ভ্রু কুঁচকে চেনা শব্দটা একটু বাজিয়ে নিল বোধহয় মনে মনে। তারপর বলল, কিন্তু তোকে যে আমার খুব দরকার! একটা জায়গায় যেতে হবে।

বলতে কী অন্য কারও চেয়ে সুবিনয়ের ফাইফরমাশ খাটতেই আমার অনিচ্ছা কম হয়। বললাম, বাজারটা সেরে যাচ্ছি।

সুবিনয় হাতঘড়ি দেখে বলল, না, দেরি হয়ে যাবে।

 তা হলে?

সুবিনয় জটিল সমস্যাটা মুহূর্তে জল করে দিয়ে বলল, আমি বরং বাজার করছি। তুই এক বার প্রীতির কাছে যা।

এই বলে সুবিনয় পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা দিস।

খামে প্রীতির ঠিকানা লেখা, ডাকটিকিট লাগানো। সুবিনয় নিজেই বলল, ডাকে দিতে গিয়ে ভাবলাম দেরি হয়ে যাবে পেতে। হাতে হাতে দেওয়াই ভাল। মুখেও বলে দিস।

কী বলব?

বলিস রবিবার।– সুবিনয়ের মুখটা খুবই থমথমে দেখাচ্ছিল।

এ সব সংকেত বুঝতে আমার আজকাল আর অসুবিধে হয় না। গত বছরখানেক এই কর্ম করছি। বাজারের ফর্দ, থলি আর টাকা ওর হাতে দিয়ে বললাম, ক্ষণা বলেছিল, ইঁদুরের বিষ আনতে।

‘বিষ’ কথাটায় বুঝি অন্যমনস্ক সুবিনয় শিউরে উঠল। বলল, কীসের বিষ?

ইঁদুরের। একটা ছুঁচো খুব উৎপাত করে।

সুবিনয় আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল বাজারমুখো। ভ্রু কোঁচকাল, মুখ গম্ভীর। হঠাৎ বলল, আমার কোম্পানিও প্রোডাকশনে নামছে।

কীসের?

পেস্টিসাইড, ইনসেকটিসাইড আর র‍্যাটকিলার। তার মধ্যে র‍্যাটকিলারটাই ইম্পর্ট্যান্ট। কত লক্ষ টন ক্রপ যেন রোজ ইঁদুরেরা খেয়ে ফেলছে, তুই কিছু জানিস?

অনেক খাচ্ছে শুনেছি।

হুঁ, অনেক। কোম্পানি বলছে এমন একটা পয়জন তৈরি করবে যা ইনস্ট্যান্ট, চিপ, ইজিলি অ্যাভেইলেবেল হবে। এখনকার র‍্যাটকিলার যেমন আটার গুলি-ফুলির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় সে রকম হবে না। বিষটা ইটসেলফ ইঁদুরদের কাছে খুব প্যালেটেবল হওয়া চাই। নইলে কোটি কোটি ইঁদুর মারতে হাজার হাজার মন গম খরচ করতে হয়।

কোটি কোটি ইঁদুর নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার পরিচিত মোটা ছুঁচোটাকে নিয়েই আমার একটুখানি উদ্বেগ রয়েছে মাত্র। বললাম, বিষটা তৈরি করে ফেল তাড়াতাড়ি। অত খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়া ঠিক নয়।

কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট জব। ও রকম পয়জন বের করতে পারলে রিভোলিউশনারি ব্যাপার হবে। প্রীতিকে বলিস কিন্তু মনে করে। রবিবার।

এই বলে সুবিনয় রাহাখরচ বাবদ পাঁচটা টাকা আমার দিকে বাতাসে ছুড়ে দিল।

লুফে নিয়ে বলি, হ্যাঁ রবিবার। মনে আছে।

খানিক এসে সুবিনয় বাজারের রাস্তা ধরল। আমি সোজা গিয়ে বাসরাস্তায় উঠে পড়ি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সুবিনয় ইঁদুর মারা বিষ কিনতে ভুলে যাবে। ফর্দের প্রথমেই লেখা আছে, ইঁদুরের বিষ। কিন্তু ফর্দটা তেমন লক্ষ করবে কি সুবিনয়? ভুল হবেই।

সুবিনয়ের বেহিসেবি বুদ্ধি। যে চিঠি হাতে হাতে দেওয়া হবে তাতে পঁচিশ পয়সার ডাকটিকিটটা একদম ফালতু খরচ। আমি পানের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনতে পাঁচ টাকার নোট ভাঙিয়ে নিই। আর পানের জলে আঙুল ভিজিয়ে সাবধানে খাম থেকে ডাক টিকিটটা তুলে নিয়ে পকেটে রাখি। যদিও আমি জন্মে কাউকে চিঠি লিখি না, তবু কখন কী কাজে লেগে যায় কে বলবে!

.

০৫.

গোলপার্কের কাছে একটা দারুণ ফ্ল্যাটে এক বান্ধবীর সঙ্গে প্রীতি থাকে। সুবিনয়ের একটু দূর সম্পর্কের শালি। এখন অবশ্য প্রীতিকে আর সুবিনয়ের শালী বলা যায় না। এইসব প্রাথমিক স্তর ওরা অনেককাল অতিক্রম করে এসেছে।

কী করে ব্যাপারটা হয়েছিল তা আমি সঠিক জানি না। তবে এটা ঠিকই যে, প্রীতি দেখতে চমৎকার। ছোটখাটো, রোগা, আর খুব ফরসা চেহারা প্রীতির। এমন একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব ওকে ঘিরে থাকে যে, রক্তমাংসের মানুষ বলে মনেই হয় না। ঘাড় পর্যন্ত বব করা হলেও ওর মাথার চুল অসম্ভব ঘন। তেলহীন, একটু রুক্ষ চুলের মাঝখানে মুখখানি টুলটুল করে। বড় দু’খানা চোখ, পাতলা নাক, পুরন্ত ঠোঁট, থুতনির গভীর খাঁজ। অর্থাৎ, সুন্দর হওয়ার জন্য যা যা লাগে সবই স্টকে আছে। বাঁ গালে এক ইঞ্চি লম্বা একটা জড়ুল আছে। অন্য কারও হলে জড়ুলটাই সৌন্দর্যহানি ঘটাত, কিন্তু প্রীতির সৌন্দর্য এমনই যে জড়ুলটাকে পর্যন্ত সৌন্দর্যের খনি করে তুলেছে।

প্রীতি কেমিস্ট্রির এম এসসি। ডক্টরেট করতে আমেরিকা গিয়েছিল চার বছরের জন্য।

যত দূর জানি, আমেরিকায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রীতি সুবিনয়ের শালিই ছিল। এমনকী মাঝে মাঝে প্রীতি তার জামাইবাবুর কাছে পড়াশুনো করতেও আসত। আমেরিকায় যাওয়ার আগে সে নাকি সুবিনয়কে বলেছিল, একা একা সাত হাজার মাইল দূরের দেশে যেতে যা ভয় করছে না জামাইবাবু! আপনি যদি সঙ্গে যেতেন তো বেশ হত।

সুবিনয় ফি বছরই এক-আধবার ইউরোপ, আমেরিকায় যায়। দু-চার-ছ’ মাস থেকে আসে। যেবার প্রতি গেল তার ছ’ মাসের মধ্যে সুবিনয়ও গেল আমেরিকায়। ওদের সম্পর্কটা হয়তো সেখানেই পালটে যায়। শুনেছি, সেটা বেশ খোলামেলা ফুর্তির দেশ, অত ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। ফিল্মহীন সুবিনয় এমনিতে মেয়েদের খুব একটা লক্ষ করে না, কিন্তু বিদেশে গিয়ে সুন্দরী শালিটির সৌন্দর্য বোধহয় সে প্রথম লক্ষ করল। যখন ফিরে এল তখন সে অসম্ভব অন্যমনস্ক আর নার্ভাস। ডক্টরেটের জন্য প্রীতি আমেরিকায় রয়ে গেছে, আর এদিকে আমেরিকা শব্দটা শুনলেই সুবিনয় চমকে ওঠে। ক’মাস চিঠি আর টেলিগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তব্যপরায়ণ ডাকবিভাগকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল সে। আমার ধারণা, ম্যাসাচুসেটসের যে-কোনও ডাকপিয়নই প্রীতি রায় নামটা শুনলেই আজও আঁতকে উঠে বলবে, প্রীতি এগেইন। ওঃ মাই গড!

সুন্দরবন থেকে ফিরে তখন কলকাতায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে ঘুরতে টাকা ধার করার চেষ্টা করি। সুবিনয়কেও বার কয়েক ট্যাপ করলাম। ও কয়েক বারই বিনা প্রশ্নে এবং মুখ বেজার না করে ধার দিয়ে গেল। শোধ হবে না জেনেও। তারপর একদিন বলল, তুই আমার বাড়িতে এসে কয়েক দিন থাক। তোর সঙ্গে আমার দরকার আছে।

আমার মনটা জ্যোৎস্নায় ভরে গেল। ঠিক এইরকমই আমি চাই। অন্যের সাজানো সুখের সংসারের এককোণে বেশ নিরিবিলিতে থেকে যাব। পোষা বেড়াল কুকুরের মতো। ঝামেলা নেই, ঝঞ্জাট নেই।

আমি তো জেনে গেছি, দুনিয়াতে আমার আর বেশি কিছু করার নেই, হওয়ার নেই।

আমি যখন সুবিনয়ের বাড়ি প্রথম আসি তখন এই চিঠির যুগ চলছে। সেইসব চিঠির অধিকাংশই আমার নিজের হাতে ডাকবাক্সে ফেলা। এর কিছুকাল বাদে প্রীতি ফিরে এসে কলেজে চাকরি নিল।

যাতায়াতের জন্য সুবিনয় যে রাহাখরচ দিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এখন মনে হতে পারে যে, সুবিনয়ের কাছে ভাঙানি ছিল না বলেই, গোটা পাঁচ টাকার নোটটাই দিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সুখের ব্যাপার হল, যেদিনই প্রীতির কাছে আমাকে কোনও চিঠি বা খবর নিয়ে যেতে হয় সেদিনই সুবিনয়ের কাছে ভাঙানি থাকে না, পাঁচ বা দশ টাকার নোট দিতে হয়। আর কোনও দিনই সে ফেরত পয়সা চায় না।

আমার মনে হয়, এই রাহাখরচের বহুগুণ বেশি টাকা দেওয়ার মধ্যে একটা নিঃশব্দ কাকুতি-মিনতি আছে। টাকাটা প্রায় সময়েই আমার পকেটের মধ্যে খচমচ শব্দ করে দুর্বোধ্য ভাষায় আমাকে অনুরোধ করে, বোলো না, কাউকে বোলো না।

আমি বলতে যাব কোন দুঃখে! বলার কোনও মানেও হয় না। আমার সন্দেহ হয়, যদি আমি বলেও দিই তা হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। ভাববে, উপলটা তো গাড়ল, কত আগড়ম-বাগড়ম বলে।

বহু কষ্টে এই গাড়লত্ব আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। ভেবে দেখেছি, চূড়ান্ত গাড়ল না হলে দুনিয়াতে টিকে থাকা মুশকিল। দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই হাফ বুদ্ধিমান হয়ে জন্মায়, তারপর কেউ কেউ পুরো বুদ্ধিমান হওয়ার বৃথা চেষ্টায় আয়ুক্ষয় করে, কেউ কেউ বিনা চেষ্টায় গাড়ল হতে থাকে। আমি বরাবর এই দু’নম্বরি দলের।

গাড়লদের সবচেয়ে বড় গুণ হল, তারা ওপর-ওপরসা দুনিয়াটাকে দেখে, আর ভাবে, দুনিয়াটা খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে। দিন হচ্ছে, বাতাস বইছে, কীটপতঙ্গ পশু-পাখি মানুষ সব বিষয়কর্মে ব্যস্ত রয়েছে, গাছে ফুল ফুটছে, আকাশে চাঁদ উঠছে, রোজ খবরের কাগজ বেরোচ্ছে বা রেডিয়োতে গান হচ্ছে, মেয়ে-পুরুষরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘর করছে। ন্যায্য জীবন যে রকম হয় আর কী! বেশ চলছে সব কিছু। গাড়লরা কখনও দুনিয়ার গায়ের এই স্বাভাবিকতার জামাটা তুলে ভিতরের খোস-পাঁচড়া, দাদ-চুলকুনি দেখার চেষ্টা করে না।

আমিও করি না। সুবিনয়ের প্রীতিকে দেওয়া এইসব চিঠি বা কথার সংকেতের মধ্যে কী জিনিস লুকিয়ে আছে তা যেমন গাড়ল পাবলিকের জানার কথা নয়, তেমনি আমিও না-জানার চেষ্টা করি।

রবিবার। রবিবার। আমার অবশ্য পুরো জীবনটাই রবিবার। স্কুল কলেজে এক হপ্তায় আরও ছটা দিন ছিল, বাস-কন্ডাক্টরি করার সময়ে হপ্তায় রবিবারটাও ঘুচে পুরো সাতটা কাজের দিন হল। তারপর সাত-সাতটা কাজের দিন জীবনের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেলে এক অচেনা মাস্টারমশাই চকখড়ি দিয়ে কেবল রবিবার কথাটা লিখে দিলেন। রোজ সেই কথাটা আমি ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুখস্থ করি।

রবিবার নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু ভাবতে চাই না। সুবিনয় বা প্রীতির রবিবার কেমন সে সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ গাড়ল থাকতে চাই।

যে বন্ধুর সঙ্গে প্রীতি বসবাস করে তার নাম রুমা মজুমদার। হাওড়া জেলা মহিলা ভলিবল টিমের প্রাক্তন খেলোয়াড় রুমা বিদ্যুতের গতি আর বজ্রের মতো জোরালো স্ম্যাশ করে বিস্তর পয়েন্ট করেছিল এককালে। তার নামই ছিল স্ম্যাশিং রুমা। এক বার বাংলা দলেও খেলেছিল। হাওড়ায় বাস কন্ডাক্টরি করার সময়ে একবার গাড়ি ব্রেকডাউন হয়ে দু’ দিন জিরেন নিচ্ছি, সে সময়ে ডালমিয়া পার্কে মেয়েদের ম্যাচ প্র্যাকটিস হচ্ছে। আমরা কয়েকজন চ্যাংড়া-প্যাংড়া মেয়েদের উরু দেখব বলে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। লাল রঙের খাটো প্যান্ট আর সাদা জামা পরা মস্ত চেহারার রুমাকে তখনই দেখি, উড়ন্ত বলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখ আটকে আছে, চিতাবাঘের মতো লাফানোর আগে একটু কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, তারপর হঠাৎ পাকানো শরীরটাকে হাউইয়ের মতো শূন্যে তুলে ডান বা বাঁ হাতে হাতুড়ির মতো বসিয়ে দিচ্ছে বলে, সেই বসান খেয়ে তোড়ে চোটে বলটা যেন ধোঁয়াটে মতো হয়ে যেত, চোখে ভাল করে ঠাহর হওয়ার আগেই মাটিতে মাথা ঠকে রুমাকে পয়েন্ট এনে দিত। লম্বা, কালো জোরালো চেহারা। ভাল দৌড়ত, হাইজাম্প দিত, ডিসকাস ছুড়তে পারত, গঙ্গার সাঁতারে কয়েকবার জিতেছে। এখন সরকারি দফতরের ছোট অফিসার। খেলাধুলো ছেড়ে দিয়েছে। মাঝেসাঝে একটু-আধটু সাঁতরায় বা টেবিল টেনিস খেলে। অফিসে তার অধস্তনরা তাকে যমের মতো ভয় খায়।

রুমার চেহারাটা একটু বন্য প্রকৃতির হলেও আর মুখে একটু মেদহীন চোয়াড়ে ভাব থাকলেও ভয়াবহ কিছু নেই। বরং আর পাঁচটা লাফঝাঁপ করা মেয়ের তুলনায় সে দেখতে ভাল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে এমন এক তাচ্ছিল্য আর ঠোঁটে এমন এক বক্র হাসি যে মুখোমুখি হলেই কেমন এক অস্বস্তি হতে থাকে। আর মুশকিল এই যে, পুরুষদের সে দু’চোখে দেখতে পারে না। উইমেনস লিব-এর সে একজন গোঁড়া সমর্থক। ছেলে-মেয়েদের প্রেম ভালবাসাকে সে পশুর মতো আচরণ বলে মনে করে। অসম্ভব সিগারেট খায় রুমা। দিনে তিন প্যাকেট। ধোঁয়া দিয়ে নিখুঁত রিং ছাড়তে পারে।

পাড়ার বখাটেরা পর্যন্ত রুমাকে আওয়াজ দেয় না। এক বার একটি ফাজিল ছোড়া তাকে ‘ক্লিওপেট্রা’ বলে ডেকেছিল, রুমা তাক রামকৃষ্ণ মিশনের কাছ থেকে ধাওয়া করে রেল লাইন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। অল্পের জন্য ছেলেটা ডাউন ট্রেনে কাটা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়।

রুমা মজুমদারের জন্যই প্রীতির দোতলার এই ফ্ল্যাটে আসতে আমার কিছু ভয় ভয় করে। প্রথম দিন আমাকে দেখেই রুমা খুব রক্ত-জল করা ঠান্ডা গলায় বলেছিল, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো! মুখটা চেনা-চেনা লাগছে!

সেই শুনে ভয়ে আমি সিঁটিয়ে যাই।

হয়েছিল কী, সেই ডালমিয়া পার্কে দু’দলের ম্যাচ প্র্যাকটিসের সময় দু-চারজন সুযোগ সন্ধানী মতলববাজ দর্শক উপস্থিত ছিল। প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্রলোক সব। ময়দানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েদের হকি খেলা দেখতে যারা ভিড় করে তাদেরই সমগোত্রের লোক। খুব বাহবা বা হায় হায়। দিচ্ছিল খেলা দেখে, যেন ও খেলার ওপর দেশের সম্মান নির্ভর করছে। যেই রুমার দল শেষ সেট জিতে ম্যাচ নিল অমনি সেই ভদ্রবাবুরা দৌড়ে গিয়ে কোর্টে ঢুকে যে যাকে পারে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানানোর চেষ্টা করেছিল। একজন লোক মেয়েদের চুমু খাওয়ারও চেষ্টা করে। মেয়েরা অতিষ্ঠ হয়ে রাঙামুখে পালানোর চেষ্টা করছে। সেই দেখে হঠাৎ হরির লুটের গন্ধ পেয়ে আমি বিনি মাগনা একটা মেয়েছেলের গা ছোঁব বলে নেমে পড়েছিলাম। কপাল মন্দ। আমি হাতের সামনে এই রুমাকেই পেয়ে গিয়েছিলাম, যে কিনা এক নম্বরের ম্যানহেটার। সাবাস বলে চেঁচিয়ে যেই তাকে ধরতে গেছি অমনি কসরত করা মেয়েটা এক পা পিছিয়ে চটাং করে একটা চড় মেরেছিল বাঁ গালে। আমার মাথাটা ভলিবলের মতোই সেই স্ম্যাশে জমি পর্যন্ত নেমে গেল, সেইসঙ্গে আমার গোটা শরীরটাও।

কাজেই আমি রুমাকে কখনও দেখেছি বলে স্বীকার করিনি। বলেছি, কোথায় আর দেখবেন। আমি তো হাওড়ার লোক নই।

সেই রুমাই আজ দরজা খুলল। পরনে গোলাপের ছাপওলা হাউসকোট, বুকের দিকটায় তিনটে বোতাম লাগানো নেই বলে হাউসকোটের তলায় স্পোর্টস গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। গেঞ্জির সহনশীলতাকে চরম পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে ওর বুকের দুর্দান্ত মেয়েমানুষি।

ভয় খেয়ে চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকাই।

নিরুত্তাপ গলায় রুমা বলে, কী খবর?

রুমা সুবিনয়ের চিঠির খবর জানে না। সে জানে, আমি প্রীতির দিদির বাড়ি থেকে খোঁজ নিতে আসি। কিন্তু এই ঘন ঘন আসাটাকে সে বড় ভাল চোখে দেখে না।

আমি নিচু স্বরে বলি, ক্ষণা পাঠাল।

 রুমা তেমনি উদাস স্বরে বলল, প্রায়ই পাঠাচ্ছে। আসুন ভিতরে, প্রীতি আছে।

বলে রুমা সামনের ঘর দিয়ে ভিতরের ঘরের দিকে চলে গেল। একটু বাদেই ও-ঘর থেকে স্টিরিওতে ট্যাংগো নাচের বিকট জোর বাজনা শুনতে পেলাম। ট্যাংগো কি না তা আমি সঠিক জানি না, জোরালো বিদেশি বাজনা মাত্রই আমার কাছে ট্যাংগো।

সামনের ঘরটায় প্রীতি থাকে। ঘরের দুটি দিক বুক-শেলফ বোঝাই। এক ধারে সিঙ্গল খাট, সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ঘোরানো যায় এমন চেয়ার। মস্ত আলমারির একটা আধ-খোলা পাল্লা দিয়ে ভিতরে শাড়ির বন্যা দেখা যাচ্ছে। মেঝেয় একটা টমেটো রঙের নরম উলের কার্পেট, সেখানেও বই-খাতা পড়ে আছে।

প্রীতি টেবিলে ঝুঁকে কিছু লিখছিল। সম্প্রতি এক কলেজের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট হয়েছে সে। বড়লোকের মেয়ে হওয়ায় দেদার টাকা ওড়াতে পারে।

আমি ঢুকতেই দেখি প্রতি তার স্বপ্নঘেরা মুখখানা ফিরিয়ে দরজার দিকেই চেয়ে আছে। হাতের কলমটা নিক্ষেপে উদ্যত ছুরির মতো ধরা। প্রীতি দেখতে যতই সুন্দর হোক, রাগলে ওর কালো জড়ুলটা লালচে হয়ে যায়, এটা ক’দিন লক্ষ করেছি। আজও জড়ুলটা লালচে দেখাচ্ছিল।

আমি খুব বেশি সাহস পেলাম না কাছে যাওয়ার। ঘরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুখে একটু বিনীত হাসি নিয়ে এগিয়ে ব্রেক কষলাম।

প্রীতি খুব বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু আমার কাজ তো আমাকে করতেই হবে। চিঠিটা বের করে দূর থেকে একটু আলগা হাতে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, রবিবার।

রবিবার কী?— প্রীতি দাঁতে কলমটা কামড়ে ঠান্ডা চোখে চেয়ে বলল।

আমি আর জানি না। বললাম।

প্রীতি চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, আপনারা দু’জনেই পাগল। জামাইবাবুকে বলবেন, রবিবার নয়, কোনও বারই না। আমি আর এ সব প্রশ্রয় দেব না।

আমি ফের বললাম, রবিবারটা মনে রাখবেন।

বলেই পিছু হটে দরজার নাগালে পৌঁছে যাই প্রায়। প্রীতি চিঠিটা নেড়ে আমাকে ডেকে বলল, উপলবাবু, একটু শুনুন।

আমি দাঁড়াই। প্রীতি উঠে কয়েক পা কাছে আসে, তারও পরনে হালকা গোলাপি রঙের হাউসকোট। বোতাম সব লাগানো। পিছনে হাত রেখে সে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, আপনি তো জানেন, জামাইবাবু এ সব চিঠিতে আবোল-তাবোল সব কথা লেখেন। জানেন তো।

না। আমি কখনও খুলে পড়িনি। ভয়ে ভয়ে বলি।

 পড়েননি!-বলে প্রীতি যেন একটু চিন্তিত হয়, বলে, পড়েননি কেন?

যাঃ, পরের চিঠি পড়ে না, কেন খুব যা-তা লেখে নাকি?

প্রীতি চিঠিটা আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, আমি এটা এখনও পড়িনি। পড়বার ইচ্ছেও নেই। আপনি বরং পড়ে দেখুন। উনি একদম পাগল হয়ে গেছেন। এরপর আমি ক্ষণাদিকে জানাব।

একটু ভড়কে যাই। গলা খাঁকারি দিয়ে বলি, এ চিঠিটা হয়তো অনুতাপের। পড়ে দেখুন না!

প্রীতি খুব করুণ হেসে বলল, বেচারা!

কে?

 আপনি।

প্রীতি চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। মাথার খাটো চুল দু’হাতে পেছনের দিকে সরিয়ে চুলের গোড়া মুঠো করে ধরে রইল খানিকক্ষণ। খুবই মনোরম ভঙ্গি। নানা উদবেগ সত্ত্বেও আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। প্রীতি আমার মুখের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, অনুতাপের চিঠি হলে রবিবার কথাটা মুখে বলে পাঠাত না। উপলবাবু, আপনি কি রবিবার কথাটারও অর্থ জানেন না?

আমি যথেষ্ট গাড়ল হওয়ার চেষ্টা করে বলি, সপ্তাহের সপ্তম দিন।

প্রীতি গভীর শ্বাস ফেলে বলে, বেচারা!

কে?

আপনি?

কেন?

রবিবার কথাটার অর্থ অত সহজ নয়। জামাইবাবু চান, রবিবারে আমি একটা বিশেষ জায়গায় ওঁর সঙ্গে দেখা করি। আপনাকে দিয়ে ও অনেক বারই অনেক কথা বলে পাঠিয়েছে। যেমন কার্জন পার্ক কিংবা বিজলি সিনেমায় ছ’টার শো কিংবা স্যাটারডে ক্লাব। আপনি কি কখনও এ-সব কথা ডিসাইফার করার চেষ্টা করেননি?

না। তবে খানিকটা আন্দাজ করেছিলাম।

বসুন। আপনাকে কয়েকটা কথা বলব।

বলে প্রীতি তার নিজের ঘুরন্ত চেয়ারে ফিরে গেল। আমি একটা টুল গোছের গদি-আঁটা নিচু জিনিসের ওপর বসলাম। কত রকম আসবাবপত্র আছে দুনিয়ায়, সবগুলোর নাম কি আর জানি! যেটার ওপর বসেছি সেটা কী বস্তু তা আজও জানা নেই।

প্রীতি চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে বলল, কোম্পানি থেকে জামাইবাবুকে সাউথ এন্ড পার্কে একটা দারুণ ফ্ল্যাট দিয়েছে, আপনি জানেন?

আমি মাথা নিচু করে রাখি। দুর্ভাগ্যবশত ফ্ল্যাটের কথা আমি জানি এবং এমনকী সুবিনয়ের নির্দেশমতো সেই ফ্ল্যাটটা নানা আসবাবপত্র দিয়ে আমাকেই সাজাতে হয়েছে। প্রায়ই সেখানে সুবিনয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়।

প্রীতি আমার অপরাধবোধের ভাবটা লক্ষ না করেই বলল, ফ্ল্যাটটা এখান থেকে খুব দূর নয়, পাঁচ মিনিটের রাস্তা। ফ্ল্যাট পেয়েও জামাইবাবু সেখানে তার ফ্যামিলি শিফট করেনি। কেন জানেন?

আমি গলা খাঁকারি দিই। পাশের ঘরে ট্যাংগো থেমে গেছে। পরদা সরিয়ে এক বার দরজার ফ্রেমে রুমা এসে দাঁড়াল, বলল, এনি ট্রাবল প্রীতি?

প্রীতি ঘাড় নেড়ে বলল, না।

তা হলে আমি বাথরুমে যাচ্ছি। বলে চলে যাওয়ার আগে খুব কুট সন্দেহের চোখে রুমা আমাকে এক বার দেখে নিল। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। বাঙালি মেয়েরা ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

প্রীতি একটু দুষ্টু হেসে বলল, আপনি এলেই রুমা ও ঘরে স্টিরিয়োতে লাউড মিউজিক বাজায় কেন জানেন?

না তো! তবে বাজায় লক্ষ করেছি।

ওর ধারণা, আপনি আমার সঙ্গে প্রেম করতে আসেন।

বুকটা কেঁপে গেল। আমি এবার সত্যিকারের গাড়লের মতো বলে ফেললাম, মাইরি না।

 বেচারা! প্রীতি বলল।

কে?

আপনি।

এই নিয়ে এ ডায়লগ তিন বার হল। আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম।

প্রীতি বলল, রুমা প্রেম-ট্রেম দুচোখে দেখতে পারে না। তাই পাছে আপনার আর আমার প্রেমের কথাবার্তা ওর কানে যায় সেই ঘেন্নায় আপনি এলেই ও স্টিরিয়ো চালায়। বেচারা!

কে?

রুমা।

আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি।

প্রীতি গভীর অন্যমনস্কতার সঙ্গে বলল, তবু তো রুমা আসল ব্যাপারটা জানে না। যদি জানত, একজন লোক যার স্ত্রী এবং সন্তান আছে, সে সব ভুলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে তা হলে বোধহয় সুইসাইড করে বসত।

আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আর কী করব? প্রীতি এই কদিন আগেও এত ভাল মেয়ে ছিল না। সুবিনয়কে লেখা ওর বেশ কিছু চিঠি আমি হাতসাফাই করেছি। গত সপ্তাহেও সুবিনয়ের ফ্ল্যাটের ঠিকানায় প্রীতির চিঠি গেছে। সুবিনয়টা নিতান্ত গাড়ল, প্রীতির চিঠিপত্র সে যেখানে-সেখানে বেখেয়ালে ফেলে রাখে। ক্ষণা কখনও খুলে পড়লে সর্বনাশ। কিন্তু অসময়ে কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি কয়েকখানা চিঠি সরিয়ে রেখেছি। সেগুলো আমার কানা মাসির কাছে জমা আছে।

প্রীতি বলে, হ্যাঁ, সেই ফ্ল্যাটটার কথা। জামাইবাবুর খুব ইচ্ছে আমাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে সংসার পাতে। তার জন্য ক্ষণাদিকে ডিভোর্স করবে বলেও ঠিক করেছে। যত দিন ডিভোর্স না হয় তত দিন আমার সঙ্গে এ রকম রবিবারে রবিবারে ওই ফ্ল্যাটে কাটানোর খুব শখ জামাইবাবুর।

আমি যথেষ্ট লজ্জিত হওয়ার ভান করি।

প্রীতি বলল, বেচারা!

কে?

জামাইবাবু! ম্যাসাচুসেটসেও আমাকে ভয়ংকর জ্বালাতন করতে শুরু করেছিল। তারপর ফিরে এসে এত চিঠি লিখেছিল যে সে চিঠি সব পড়তে গেলে রিসার্চ বন্ধ করতে হয়।

আমি মুখভাবে সমবেদনা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি। যদিও জানি, এটা প্রীতির আসল কথা নয়। অন্য একটা কিছু আছে এর মধ্যে।

প্রীতির ঘোরানো চেয়ারটা খুব ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। ভ্রু কুঁচকে কী একটু ভাবতে ভাবতে প্রীতি আস্তে করে বলল, ওকে বুঝিয়ে বলবেন, এ হয় না। আমি অবশ্য এ সব নোংরামি থেকে পালানোর জন্য আবার আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। মিনেসোটার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও হাতে এসেছে।

বলে টেবিলের বইপত্রের দিকে ঝুঁকে পড়বার আগে প্রীতি একটু হেসে বলল, আপনি অত বোকা সেজে থাকেন কেন বলুন তো! এ সব কি আপনি টের পেতেন না। আপনিই জামাইবাবুর মিডলম্যান, আপনার জানা উচিত ছিল।

আমি দাঁড়িয়ে পড়ে বলি, আজ তা হলে আসি।

প্রীতি বলল, আসি-টাসি নয়। বলুন যাই। আর আসার কোনও প্রভিশন না-রাখাই ভাল। আপনিও খুব ভাল লোক নন উপলবাবু।

আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম।

 প্রীতি বলল, বেচারা!

কে?

আমি নিজেই।

আমি সকালে তেমন কিছু খাইনি, ক্ষণা দুটো বিস্কুট দিয়ে চা দিয়েছিল। সুবিনয় আজকাল ফ্যাট হওয়ার ভয়ে আর কর্মক্ষমতা এবং যৌবনরক্ষার জন্য খাওয়া-দাওয়ার খুব কাটছাট করেছে। সেই মাপে আমারও খোরাক কমাচ্ছে ক্ষণা। কিন্তু আমার ফ্যাটের বা কর্মক্ষমতার বা যৌবনহানির কোনও ভয়ডর নেই, আমার বাস্তবিক খিদে পায়। এখনও পেয়েছে। প্রীতিদের ফ্ল্যাটের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে নিজের ভিতরে মাঠের মতো মস্ত ধু ধু খিদেটাকে টের পেয়ে অসম্ভব খেতে ইচ্ছে করছিল। অনেকক্ষণ ধরে গোগ্রাসে খেলে তবে যেন খিদেটা যাবে। মুখ রসস্থ, শরীরটা চনমনে।

পকেটে পাঁচ টাকার কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। রেস্টুরেন্টে বসে খেলে এক লহমায় ফুরিয়ে যাবে, পেটও ভরবে না। এ সব ভাবতে ভাবতে আধাআধি সিঁড়ি নেমেছি, এ সময়ে তলার দিক থেকে আর-একটা লোক সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। অল্প বয়সের যুবক, ভীষণ অভিজাত আর সুন্দর চেহারা। খুব লম্বা-চওড়া নয়, কিন্তু ভারী ছমছমে শরীর তার। পরনে হাঁটুর কাছে পকেটওলা নীলরঙের জিনস, গায়ে ক্রিমরঙা দুটো বুক পকেটওলা একটা জামা, পায়ে সম্বরের গোড়ালি-ঢাকা বুট, চোখে একটা বড় চশমা, হাতে মস্ত একটা ঘড়ি, ঘাড় থেকে স্ট্র্যাপে একটা ব্যাগ ঝুলছে। এক পলকেই বোঝা যায়, এ লোকটা বিদেশে থাকে, বা সদ্য বিদেশ থেকে এসেছে। শিস দিতে দিতে তরতর করে উঠে আসছিল, আমার মুখোমুখি পড়ে এক্সকিউজ মি বলে দেয়ালের দিকে সরে গেল। তার মুখে একটু মেয়েলি কমনীয়তা আছে, খুব ফরসা রং, চোখের দৃষ্টির মধ্যে যে সুদূরতা মিশে আছে তা দেখলে বোঝা যায়, এ খুব পড়াশুনা করেছে বা করে। ব্যাগের গায়ে লেখা প্যান-অ্যাম। আমাকে পেরিয়ে ওপরে উঠে গেল যুবকটি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, প্রীতিদের আধ-খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যুবকটি ভালবাসার গলায় ডাক দিল, প্রীতি!

আমি তাড়াতাড়ি নেমে আসতে থাকি। আমি চাই না, প্রীতি এই অবস্থায় আমাকে দেখে ফেলুক। নামবার সময়ে ভাবতে থাকি, যদি কখনও এই যুবকটির সঙ্গে সুবিনয়ের মারপিট লাগে তবে কে জিতবে! সুবিনয়েরই জেতবার কথা, যদি এ ছোকরার কোনও মার্কিন প্যাঁচ ফ্যাঁচ জানা না থাকে।

কিন্তু পৃথিবীর সুখী মানুষদের এ সব প্রেম-ভালবাসার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা আমার এখন নয়। খিদেটা অসম্ভব চাগিয়ে উঠেছে। খিদের মুখে সবসময়ে খাবার জুটবে এমন বাবুগিরির অবস্থা আমার নয়। খিদে পেলেও তা চেপে রাখার অভ্যাস আমার দীর্ঘকালের। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয়, খাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠি। তখন সব রকম রীতিনীতি ভুলে কেবল একনাগাড়ে গবগব করে খেতে ইচ্ছে করে।

খিদের মুখে মাসির কথা আমার মনে পড়বেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *