স্বর্গখেলনা –- উপন্যাস — বিমল কর
০১.
বাসটা ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে বেলা নটা নাগাদ এখানে হাজির হয়, আসার কথা আটটায়, আসতে আসতে ওই সময়টুকু যায়। পথ মাইল পাঁচেক অবশ্য, কিন্তু পথের হিসেবে কিছু আসে যায় না। ছেলেমেয়েগুলোকে শুধু কুড়িয়ে আনা তো নয়, গুছিয়ে আনাও। ঘুরে-ফিরে এর-ওর দরজায় দাঁড়াও, প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন দাও, সজোরে কড়া নাড়ো, কোনও ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে ইজের পরাও, কোনও মেয়ের বাসি-চুলে একটু আলগা চিরুনি বুলিয়ে নাও, তারপর বাচ্চাগুলোকে গাড়িতে তোলো। এই রকম করে আসা। রোজ, নিত্য। সময় বয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য কী! পাঁচ মাইলের পথ যদি আট-দশ মাইলের পেট্রল খায়, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। তবু তো বাসটা নিয়মিত আসে।
কী করে আসে সেটাই এক আশ্চর্য। আসার কথা নয়, যে কোনওদিন যে কোনও জায়গায় ওটা দমবন্ধ নিশ্চল-অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে পারে। বিন্দুমাত্র ভরসা নেই, মাঝেই-মধ্যেই নাড়ি হারায়, তবুও ওই গাড়িকেই ভরসা। নুটু মিস্ত্রি, যে এই অদ্ভুত মজার গাড়ি তৈরি করেছিল, তার হাতে গড়াপেটা বলেই নয় শুধু, তারই হাতে লালিত-পালিত হচ্ছে বলেই সবাইয়ের যেটুকু ভর ভরসা।
নুটু মিস্ত্রির এই গাড়ির গায়ে মিস্ত্রি নিজেই সাদা রং আর ব্রাশ দিয়ে নাম লিখেছে ইংরেজিতে। মিস্ত্রির যে ইংরেজি বর্ণ-জ্ঞান আছে তা মনে করার হেতু নেই। গত বছর বাঘা দাদাকে দিয়ে খড়িতে করে বাসের গায়ে হরফগুলো লিখিয়েছিল, তারপর নিজে সাদা রং দাগে দাগে বুলিয়ে গেছে। ফলে ইংরেজিতে এই বাসের নাম মেজর গাড়ি–অর্থাৎ বাংলায় যা হবে মজার গাড়ি। নামটা বাচ্চাগুলোই দিয়েছিল, লিখেছিল অবশ্য বাঘা। লেখার দোষ বাঘার নয়। তার বয়স ছিল মাত্র দশ, মিস্ত্রির কাঁধে বসে ঘাড়ের পাশ দিয়ে পা দুটো গলিয়ে তাকে লিখতে হয়েছিল। একটা করে অক্ষর শেষ হয় আর মিস্ত্রি এক পা করে সরে যায় পাশে।
বাঘা আর নেই, গত শীতে তার বাবা বদলি হয়ে গেলে বাঘা চলে গেছে, তার লেখাটা থেকে গেছে। নুটু মিস্ত্রির খুবই ইচ্ছে ছিল বাসের অন্য পাশে সে বাংলাতেও নামটা লিখে নেবে। বাঘাদাদা চলে যাওয়ায় হয়নি, না কি অপেক্ষা করছে জ্যোতিবাবু কবে নিজে থেকেই গোটা গোটা করে নামটা লিখে দেন। জ্যোতিবাবু ছবি আঁকান ছেলেমেয়েদের, পড়ান, তাঁর হাতে লেখা খাসা হবে।
নুটুর কথা, নুটুর গাড়ির কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সাত কাহন বলবে। কবে কোথায় কোন উইলিসাহেবের সোফার হয়ে দশ বছর কাটিয়েছে, কেমন করে সেই বিশ্বকর্মা সাহেবের হাতে তার গাড়ির কাজের যাবতীয় যা কিছু শিক্ষা, তারপর উইলিসাহেব মরে গেলে পাটনায় আগরওয়ালার মোটর কারখানায় টানা কবছর হরেক রকম গাড়ির মেরামতি করেছে, কোন বিশারদ নুটুকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল এই বলে যে, নুটু নেভার সেজ নো–এসব কথা প্রত্যেকটি মনে আছে নুটুর। বলতে পারলে নুটু খুশি হয়। কিন্তু সব গল্পের পর নুটুর শেষ গল্পটা বড় কষ্টের। সেটা সে বলতে চায় না।
সেই গল্পেরই পরিণতি এই মজার গাড়ি, নুটু যার জন্মদাতা। একটা ফোর্ড গাড়ির ইঞ্জিনই শুধু সে পেয়েছিল। পুরনো বনেদি বংশ বলে জঞ্জালের মধ্যেও নুটু ইঞ্জিনটার চরিত্র বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল। লোহার দরেই ওটা সে কেনাল সাহেবদাদুকে দিয়ে। তারপর দিনের পর দিন মাসের পর মাস সে মেতে থাকল। শহরের সারাইখানা, কামারবাড়ি আর কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে সমানে গতর দিয়ে লড়ে এই গাড়ি সে তৈরি করেছে। নুটুই গাড়ির সব, ড্রাইভার ক্লিনার মেকানিক সব কিছু।
এই গাড়ি না হওয়া পর্যন্ত শহর থেকে বাচ্চাদের আনা যেত না। মধুবাবুর ঘোড়ার গাড়ি চেপে পাঁচ-সাত জন যা আসত, বাকিরা এখানে থাকত। বাকি বলতে জনা তিরিশ ছাত্র। এখন আরও বিশ-পঁচিশ বেড়েছে, দু-দশ জন মাইল দেড়-দুই দূর থেকে হেঁটেও আসে।
মজার গাড়ির সবটাই মজা। তার হাত-পা গুটোনো, কচ্ছপের মতন একটা খোলা আছে পিঠে, ভেতরে তিনটে সরু লং বেঞ্চ, জানলার ফুটোয় ক্যাম্বিসের পরদা গুটোনো থাকে। গাড়িটা ফট ফট শব্দ করে, ধোঁয়া ছাড়ে চিমনির মতন, তার সারা গা নড়ে, বিচিত্র স্বর আওড়ায় সর্বদা, চলতে গেলেই বাঁয়ে হেলে পড়ে, ডাইনে দোল খায়–তবু গাড়িটা চলে।
এই গাড়ি নিয়ে নুটু ভোরের কাক ডাকতেই ছেলেমেয়ে আনতে যাত্রা করে দেয়। পনেরো মিনিটের পথ, হাতে আরও বাড়তি একঘণ্টা সময় নিয়ে বেরোয়। বাধা-বিপত্তি তো থাকবেই। যত রকম কলকবজা যন্ত্রপাতি যাবতীয় গাড়ির মধ্যে সিটের নীচে মজুত নুটুর।
শহরে ঢুকে–ঢাকার ঠিক মুখেই শান্তি কুটিরের সামনে গিয়ে গাড়িটাকে প্রথমে দাঁড় করিয়ে দেয় নুটু।
জানলা দিয়ে গলা বাড়ায় তুষার দিদিমণি। কোনওদিন সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে, ফোলা-ফোলা চোখ, এলোমেলো চুল। মুখ বাড়িয়ে সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু হেসে হাত নেড়ে বারান্দায় এসে বসতে বলেছে তুষার দিদিমণি, তারপরই জানলা ফাঁকা।
নুটু গাড়ি থেকে নেমে শান্তি কুটিরের কাঠের ফটক খুলে বাগানে ঢুকেছে। বাগানে কয়েকটি গাছ, কিছু দেশি ফুল, যখন যা ফোটে। নুটু জানে বলেই বেছে বেছে কয়েকটি ফুল তুলে নেয়। তারপর বারান্দার ছোট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সূর্য-ওঠা-সকাল দেখে। একটু পরেই একগ্লাস চা আসে ভেতর থেকে, কামিনীঝি দিয়ে যায়। নুটুর এটা বাঁধা।
যেদিন তুষার দিদিমণি তৈরি থাকেন, সে দিনও নুটুকে নীচে নেমে এসে প্রাপ্য চা-টুকু এবং দিদিমণির সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু সূর্য-ওঠা-আলোর মতন সকৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করতে হয়।
তুষার দিদিমণি একটা হালকা বেতের টুকরি নিয়ে গাড়িতে নুটুর পাশে এসে বসলেন। নুটুর গাড়ি ছাড়ল।
আজ কেমন একটু শীত, নুটু। তুষারদিদি বললেন হয়তো।
বাদলার ঠাণ্ডা দিদি?
না। এমনি; শিশির বা হিমের হবে।
বাদলার বড় ভয় নুটুর। বাদলার রাস্তা গাড়িটাকে বড় ভোগায়। শিশির কি হিমের ঠাণ্ডা শুনে নুটু নিশ্চিন্ত হয়। অল্প এগিয়ে বলে, বুলুটার গায়ে তবে একটা মোটা কিছু পরিয়ে নেবেন দিদি।
বুলু পাঁচ বছরের মেয়ে, রোগা-রোগা দেখতে, হয়তো কদিন সর্দিকাশিতে ভুগেছে।
তুষারদিদি এক পাশে ঘাড় হেলিয়ে হাসি-স্বচ্ছ চোখে নুটুকে দেখেন, যেন ঠাট্টা করে বলেন, তাই নাকি।
গাড়িটা শহরের চারপাশে টহল মারে তারপর। তুষারদিদিকে প্রায় সব বাড়িতে নামতে হয়, ঢুকতে হয়।
কাঞ্চন মুখ ধুচ্ছে সবে। চটপট তাকে তুষারদিদি নিজেই তৈরি করে নেন। কাঞ্চনের মা রাগ করে বলেন, এই ছেলেকে তুই বাপু নিয়ে গিয়ে রাখ তুষার, আমি আর পারি না। কখন থেকে ঠেলছি, বিছানা ছেড়ে কিছুতেই উঠবে না। ওইটুকু একফোঁটা ছেলের কী আয়েস।
রায়বাহাদুরের নাতি তো। তুষার হেসে বলে, একটু হবে। বলতে বলতে শার্টের সামনেটা কাঞ্চনের প্যান্টে গুঁজে দিয়ে আস্তে করে ঠেলে দেয় তুষার কাঞ্চনকে, চল চল…ছুট দে। কাঞ্চনের বই-খাতার ব্যাগটা নিজেই অনিলার হাত থেকে নিয়ে সদরের দিকে এগোয়।
আর এক বাড়িতে মন্টুকে হয়তো ঘুম থেকেই টেনে তুলতে হয়। মন্টুর মাথার পাশে বসে তুষার ডাকে, এই মন্টু, ওঠ। উঠবি না? আজ লেবুপাতার গল্পটা হবে তোদের।
বিনুর আর সব তৈরি–শুধু চুল আঁচড়ানো হয়নি। রিবনটা বিনুর হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে তুষার তাকে টেনে এনে গাড়িতে তোলে।
পুটুর দুধদাঁত পড়েছে, পুটু ঘুম থেকে উঠে সেই দাঁত পেয়েছে বিছানায়। ইঁদুরের গর্ত খুঁজছে, গর্তে দাঁত না দিয়ে সে যাবে না স্কুলে। তুষার হয় গর্ত খুঁজতে বসল, না হয় পুটুকে বলল, পাগলা ছেলে, এখানে ইঁদুর কই, মাঠে কত ইঁদুরের গর্ত, বড় ইঁদুরচল সেই গর্তে দিয়ে দেব। পুটু সানন্দে মাথা নাড়ল মাঠের ইঁদুর তার যেন বেশি পছন্দ।
এমনি করেই ছেলেমেয়েগুলোকে টেনে-টুনে তুলে আনতে হয়। পথের মধ্যেও তুষারের শত কাজ। নিজের জায়গা ছেড়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বসে কারও মুখ মুছিয়ে দেয়, কোনও মেয়ের চুল আঁচড়ে রিবন বাঁধে, কারও বা জামায় বোতাম বসায়।
তুষারের বেতের টুকরিতে সব থাকে। নিজের একটা শাড়ি, জামা, চিরুনি, ছোট্ট পাউডারের কৌটো, চুঁচ-সূতোটুকটাক আরও অনেক কিছু।
গাড়িটা শহরের এলাকা পেরিয়ে একটা বাঁক নেয় ডান দিকে থাকে রেল লাইন বাঁ দিকে ক্ষেত আর মাঠ। রেল লাইনের পাশে পাশে খানিকটা ছুটে এসে হঠাৎ পথ গোলমাল হয়ে যায়, টিলার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে লাইন পুবের জঙ্গলে অদৃশ্য, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাথর কাঁকর আর মোরম রঙের মাটি মেশানো সড়ক ধরে নুটুর বাস তেঁতুল-ঝোঁপের মধ্যে এসে দাঁড়ায়, ঝোঁপ পেরোলেই দূরে চাঁদমাড়ি পাহাড়। রাস্তাটা এখানে ঢালু। দুপাশে ফাঁকা মাঠ, অল্প-স্বল্প গাছ, টেলিগ্রাফের একটা লাইন রাস্তার গায়ে গায়ে চলে গেছে।
রেলগাড়ির সঙ্গে মজার গাড়ির কোনও কোনওদিন দেখা হয়ে যায়। সাড়ে সাতটার প্যাসেঞ্জার গাড়ি। যতক্ষণ একসঙ্গে ছুটছে ছেলেমেয়েগুলো ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। রেলগাড়িকে হারাবার জন্যে বাচ্চাগুলো একসঙ্গে চেঁচায়: নুটুদা, হারিয়ে দাও, রেলকে হারিয়ে দাও। নুটুও গিয়ার বদলায়, যেন দেখাতে চায় তার গাড়ির শক্তিও কিছু কম নয়। হ্যাঁন্ডিকাপ পেলে নুটু রেলকে হারায়, অবশ্য দেড়শো গজ দৌড়ে নুটু যদি পঞ্চাশ গজ হ্যাঁন্ডিকাপ পায়। রেল হারলে ছেলেগুলোর খুব ফুর্তি। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একসঙ্গে সব কজন কলা দেখাবে আর দুয়ো দেবে রেলকে। রেলের ইঞ্জিনের কাটা-দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় পট্টি বাঁধা ফায়ারম্যান দুয়ো পেয়ে হাত তুলে নাড়ে যতক্ষণ দেখা যায় গাড়িটাকে।
পথটা কিন্তু ভাল। ফাঁকা, শান্ত, স্তব্ধ। রোদ উথলে পড়ছে চারপাশে, মাঠগুলো বেশির ভাগই পতিত, কোনও কোনওটায় ডাল বোনা হয়েছে বা সরষে, মাঠের কোথাও কোথাও কুল অর্জুন আর অশ্বত্থ গাছ। পাখি উড়ে যায়, বাতাসে সরু শিসের ডাক ভাসে একটুক্ষণ, কোথাও বা রাখাল গোরু-মোষ চরাচ্ছে। পথে বয়েল গাড়ির সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে, সকাল বেলা জঙ্গলে চলেছে কাঠ কাটতে, বয়েলের গলায় বাঁধা ঘণ্টা বাজছে, ফাঁকা জায়গায় ঘণ্টার সেই শব্দ চমৎকার শোনায়।
মাইল আড়াই এই ভাবে এগিয়ে আসার পর চোখে পড়বে ছোট্ট একটি গ্রাম। গাড়িটা এখানে থামে অল্প সময়। কুচকুচে কালো চেহারা, ছোট ছোট চুল, বড় বড় চোখ, নাক একটু খাঁদা একটি ছেলে, তারই হাত ধরে গোলগাল মোটা নাদুসনুদুস একটি বাচ্চা মেয়ে এসে উঠবে গাড়িতে। ছেলেটার নাম টুসু, মেয়েটির নাম বেলা।
টুসু একটা ফুল পায় তুষারের কাছ থেকে। কোনওদিন বা বেলাও। তুষারের নিয়ম, ডাকাডাকি না করতেই যে তৈরি হয়ে থাকবে গাড়ির জন্যে, সে একটা ফুল পাবে। অবশ্য তুষারের এই ফুল শেষাবধি আর থাকে নাকাড়াকাড়ি করে ওরা নিয়ে নেয়।
টুসুদের তুলে নিয়ে মজার গাড়ি যখন নিস্তব্ধ ফাঁকা রোদভেজা মাঠ-ঘাট দুপাশে রেখে বিচিত্র দেহভঙ্গি ও শব্দ করতে করতে চলেছে, তখন সমস্বরে ছেলেমেয়েগুলো মজার গাড়ির ছড়া গায়। ছড়াটাও মজার। তুষারকেও মাঝে মাঝে গাইতে হয়। সেই কলকণ্ঠের গীত ছড়ায় অলস মাঠ ঘাট যেন প্রফুল মুখে হেসে ওঠে।
.
০২.
পাহাড়ের মাটি আর কাঁকর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে গাড়িটা শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে থামে সেখানে ছোট বড় কয়েকটা কটেজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আদিগন্ত ফাঁকা মাঠের মধ্যে পাহাড়তলিতে কয়েকটা ছোট ছোট কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে এটাই সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ।
অনেকটা দূরে পাহাড়ের তরঙ্গ, আকাশ এবং মেঘের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কালচে-সবুজ একটি রেখা উত্তর পশ্চিম দিকটা ঢেকে রেখেছে। দিনের আলোয় সবুজ বনানী কার্পেটে তোলা সুতোর কাজের মতন দেখায়, বৃক্ষলতায় ঘন, অস্পষ্ট অবয়ব। বনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঢালু জমি, যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঢেউ ভেঙে পড়েছিল-তার ভাঙন বন এবং বনের পর ঢালু মাটিতে গড়াতে গড়াতে এখানে এসে থেমে গেছে। এখানটা মোটামুটি সমতল। কিছু বৃক্ষ, কিছু পাথর! সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ এই সমতলে পাহাড়তলির নির্জন লোকালয়ের ছবির মতন দাঁড়িয়ে।
ছ-সাতটি কুটির, কটেজের মতন চেহারা; কোনওটা ইটের, পাথর মাটি মিশিয়ে তৈরি; কারও মাথায় খাপরা, কারও মাথায় খড়ের ছাড়ি। ঘন মেটুলি রঙের গা। শালের চারা কেটে কেটে এলাকাটার বেড়া দেওয়া হয়েছে। সামনের দিকের বেড়া বোধ হয় সামান্য বেশি মজবুত, কারুকর্ম কিছু কিছু চোখে পড়বে। শিশুতীর্থরৈ এটা সামনের দিক বলেই হয়তো বেড়ার পাশে পাশে কোথাও জাফরি, কোথাও আকাশ-জালি, ফুল লতা-পাতার বাগান। জাফরি বেয়ে বুনো লতা উঠেছে, আকাশ-জালিতে ছিটফুলের চুমকি, চন্দনের ফোঁটার মতন এক রকমের লতানো ফুল। মাটিতে বিবিধ পাতা গাছ, কোথাও গাঁদা কোথাও কলাফুল কোথাও বা মোরগঝুঁটি–ঋতুর পথ চেয়ে ফোটে, পালা ফুরালে মরে যায়।
শিশুতীর্থর সদর ফটক আছে একটা। কাঠের ফটক। ফটকের মাথায় মালতী লতার টোপর, দুপাশে ঝাউ ঝাউয়ের কুঞ্জ। গায়ে গায়ে জবা গাছ, অপরাজিতার ঝোঁপ। ফটকের মাথায় কাঠের তক্তায় শিশুতীর্থ নামটা ঝুলছে।
কাঁকরে মাটির রাস্তা ফটকের কাছ থেকে আদরে যেন ডেকে নিয়ে এই তীর্থের খানিকটা পৌঁছে দেবে, তারপর আর বাঁধাধরা রাস্তা কোথাও চোখে পড়বে না। হয় মাটি, না হয় ঘাসভরা মাঠ, গাছের ছায়া, এদিক ওদিক মুখ করে আলো-ছায়ায় কুটিরগুলো দাঁড়িয়ে আছে তফাত-তফাত।
এই এই রকম চার পাঁচটি কটেজ এ পাশে, সামনের দিকটায়। পিছনে অনেকটা সবুজ মাঠের ওধারে আরও তিনটি বাড়ি, একই ধরনের অনেকটা, দুটো খুব গায় গায়–অন্যটা গজ পঞ্চাশ তফাতে। সাহেবদাদুর বাড়ি ওরই কাছাকাছি। পুবমুখো টালি ছাওয়া বাড়িটাই সাহেবদাদুর। ছোটখাটো বাসা, সামনে পিছনে বাগান।
ঘরগুলোর পরিচয় দেওয়া দরকার। সামনে দিকের বাড়িগুলো ক্লাসরুম। লম্বা লম্বা চেহারা, উঁচু উঁচু মাথা, দেওয়ালের গায়ে বড় বড় জানলা। জানলায় খড়খড়ি। রোদ বাতাস খেলা করে ঘরে, জানলা দিয়ে গাছের ডাল-পালা দেখা যায়, আকাশ চোখে পড়ে।
এক মাঠ তফাতে পিছন দিকের তিনটে বাড়ির দুটোতে থাকে কিছু ছেলে, দুজন শিক্ষক। সাহেবদাদুর বাড়ির কাছাকাছি লম্বা বাড়িটায় আশাদি আর রেবা। ঝি-চাকররা ওই বাড়িরই একপাশে ঘর পেয়েছে, রান্নাঘরটাও বাড়ির গা লাগানো, ছেলেদের খাবার ঘর ওখানে।
সাহেবদাদুর কথা সামান্য বলতে হয়। গায়ের রং এবং মুখের গড়ন অনেকটা সাহেবদের মতন বলে ছেলেমেয়েরা এই ডাক শুরু করে দিয়েছিল কবে সেই থেকে উনি সাহেবদাদু। সাহেবদাদুর বয়স হয়েছে, এখন বোধ করি প্রায় সত্তর। বার্ধক্য-হেতু চলাফেরা করেন খুব কম। চাকা গাড়িতে বসে মাঝেমাঝে তাঁর শিশুতীর্থের চারপাশ দেখে বেড়ান। অসুস্থ থাকলে বাড়ির বারান্দায় শুয়ে থাকেন, শুয়ে শুয়ে শিশুতীর্থের মেলা দেখেন।
সাহেবদাদুর পূর্ব পরিচয় ছিল, সে-পরিচয় তিনি কাউকে জানানো প্রয়োজন মনে করেন না। একদা কেমন করে যেন এসে পড়েছিলেন এদিকে। জায়গাটা ভাল লেগে গিয়েছিল। বছর কয়েক পরে আবার এলেন, সঙ্গে মাত্র একটি ভৃত্য। ছোটখাটো একটি মাথা গোঁজার জায়গা করে ঈশ্বর উপাসনায় মন দিতে চেয়েছিলেন; মন বসেনি। হঠাৎ কিছুদিনের জন্যে কোথায় চলে গেলেন, ফিরে এলেন মাসান্তে। সঙ্গে একটি শিশু। এই শিশুই তাঁর শেষ জীবনের মায়া মোহের শিকড় হয়ে তাঁকে এখানে বেঁধে রাখল, শান্তির স্বাদ জাগাল।
কোনও কোনও মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে শিউলি ফুলের তুলনা করা চলে। এরা অবেলায় ফোটে, যখন আর দিনালোক নেই, সন্ধ্যা নেমেছে তখন ফুটে ওঠে, অন্ধকারে সৌরভ বিলোয়, তারপর সকালে ঝরে যায়। সাহেবদাদুর জীবনের দিকে তাকালে মনে হবে, দিনান্তে তিনি যেন তাঁর হৃদয়ের আকুলতা অনুভব করে এই শিশুতীর্থ গড়তে চেয়েছেন, এখন সেই পুষ্প বিকশিত। উষাকালের মুখ চেয়ে বসে আছেন এবার তিনি। এই তীর্থের মাটিতে ঝরে যাবেন।
আমি ছিলাম ভবঘুরে সাহেবদাদু একদিন আশালতাকে বলেছিলেন মৃদু আচ্ছন্ন গলায়, কে জানত বল, তোদের এই পাথুরে মাটিতে আমার পা এমনি করে গেঁথে যাবে! ১৬
আশালতা পাথুরে মাটি শব্দটার অর্থ বুঝেছিল। তার মনে হয়েছিল, সাহেবদাদু সংসার থেকে পালাতে গিয়েও ফিরে এসেছেন বলে মাঝে মাঝে যেন স্নেহবশে এই সংসারকে তিরস্কার করেন।
আশালতা কোনও জবাব দিতে পারে না। ইচ্ছেও করে না কিছু বলতে। মন কেমন বিষণ্ণ অথচ গভীর মমতায় সিক্ত হয়ে আসে। নীরবে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
সাহেবদাদু যে শিশুটিকে এনেছিলেন, একদিন সে সাহেবদাদুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে:
তখন চৈত্র মাস। চাকরটার তাপ-জ্বর; সে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। রোদের তাত সামান্য পড়ে আসতেই সাহেবদাদু তাঁর টমটম হাঁকিয়ে শহরে ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন। শেষ বেলায় আচমকা ঝড় উঠল। ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী। আকাশ কালো করা সেই দৈত্যকায় ঝড় এত ভীষণ চেহারা নিয়ে দেখা দিল যে, শিশুটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে সঙ্গী খুঁজছিল। তার কোনও সঙ্গী ছিল না, বুড়ো চাকরটা জ্বরে বেঘোর। এই জনহীন প্রান্তর ঝড়ের গর্জনে ভরে গেছে, চারপাশ নিকষ কালো, গাছপালা গা মাথা লুটিয়ে মাটিতে আঁচড়াচ্ছিল, বাতাসের বেগ শাখা-প্রশাখা ভাঙছিল। ভীত শিশু তার একমাত্র সঙ্গী চাকরটার কাছে গিয়ে গা আঁকড়ে বসেছিল। কিন্তু জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ মানুষটা কোনও কথা বলতে পারেনি, কোনও সাহস সান্ত্বনা দিতে পারেনি, এমনকী চোখের পাতা খুলে তাকিয়ে থাকাও তার সাধ্যাতীত ছিল।
সাহেবদাদু যখন ফিরে এলেন তখন ঝড় থেমেছে, চাকরের ঘরে শিশুটি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে বিছানার পাশে। ওকে মৃত দেখাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল বীভৎস এবং ভয়ংকর কিছুর সংস্পর্শে এসে সে অসহায়ের মতন কোনও অবলম্বন খুঁজেছিল, পায়নি; না পেয়ে শেষাবধি এই ভাবে কোণঠাসা হয়ে মরেছে।
ওর নাম ইতি। ওর আট বছরের জীবনে সেদিন ছেদ পড়তে পারত। পড়েনি। সাহেবদাদু ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন বলেই সঙ্গে তাঁর প্রয়োজনীয় মানুষটি ছিল। ইতি সে-যাত্রা বেঁচে গেল। কিন্তু মেয়েটার মনে সেদিনের আচমকা ভয় কোথায় যেন একটা অসাড়ত্ব এনে দিল। সে একা থাকতে চাইত না, একা শুতে পারত না, ফাঁকায় তার গা ছমছম করত।
সাহেবদাদু বুঝেছিলেন, মেয়েটার সঙ্গী দরকার। তাঁর বা বিষ্ণুর সঙ্গ যথেষ্ট নয়।
তোর মাসির কাছে যাবি? সাহেবদাদু ইতির মনের ভাব বোঝবার চেষ্টা করলেন।
না।
মাসিকে তোর মনে আছে?
নেই।
তবে?
কিচ্ছু না।
ইতির কথা–ইতির সঙ্গীর কথা চিন্তা করতে করতেই একদিন সাহেবদাদুর খেয়াল হল, কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা জুটিয়ে এনে এখানে একটা পাঠশালার মতন খুললে কেমন হয়। সাহেবদাদুর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু মানুষ নতুন কোনও খেলা শিখলে যেমন নেশায় জড়িয়ে যায়, উনি অনেকটা সেই ভাবে জড়ালেন।
ছ বছর আগে একটি মাটির ঘরে শিশুতীর্থের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পাঁচ-ছটি ছাত্র। চারটি ছাত্র তিনি জোগাড় করেছিলেন মাইল দেড়েক দূরের গ্রাম থেকে, তারা আদিবাসী, ক্রিশ্চান। আর দুটি আসত শহরের কাঠ কারখানার মালিকের বাড়ি থেকে, মটর বাইকের সাইডকারে। কাঠ কারখানার মালিক সাহেবদাদুর প্রতি শ্রদ্ধাবান এবং অনুরক্ত ছিলেন বলেই যেন সাহায্য করেছিলেন নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে শিশুতীর্থে পাঠিয়ে।
একথা বোঝাই যায়, অজায়গায় এমনি একটি কোমল লতা রোপণ করেছিলেন সাহেবদাদু যা রক্ষা করা ও বর্ধিত করা খুবই কষ্টকর। যে কোনও সময় শুকিয়ে যেতে পারত সে সম্ভাবনা সর্বদাই ছিল। কিন্তু সাহেবদাদুর প্রাণান্ত চেষ্টায় কয়েকজনের সাহায্যে লতাটি শুকোয়নি, বেঁচে গেছে। ছ বছরে তার যেটুকু বৃদ্ধি ও বিস্তার তা নিতান্ত কম নয়।
সামান্য আর কয়েকটি কথাও বলতে হয়। যে বয়সে সাহেবদাদু তাঁর জীবন এই দুরূহ কর্মে উৎসর্গ করেছিলেন, সে বয়স উদ্যমের নয়। অবশিষ্ট শক্তিটুকু ছিল আয়ুকে কোনও রকমে রক্ষা করার জন্যে। উনি সেই শক্তিকে কর্মের জন্যে ব্যয় করে খুব দ্রুত আয়ুকে ফুরিয়ে আনলেন। এখন এই মানুষটির কাছে সেসব কল্পনা, যে কল্পনা জাফরি কাটা জানলার রৌদ্র ছায়ার মতন অস্পষ্ট ও মেদুর, তেমন কল্পনা অবলম্বন করে পড়ে আছেন। হয়তো তিনি দেখতে পান, শিশুতীর্থে খুব বড় একটা মেলা বসেছে, মুখর হয়ে উঠেছে সর্বত্র, কলরবে এ নির্জনতা পূর্ণ, শত শিশুর চরণের ধুলোয় ধুলোয় গাছের পাতা ধূসর হয়ে গেছে, ঘাসের ডগাগুলো দলিত, দূর থেকে একজোড়া ছেলে-মেয়ে ছুটে আসছে, রোদের খর আলোয় মুখগুলো দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো, ছুটতে ছুটতে তারা পলাশ গাছটার তলা দিয়ে সামনে চলে এল, সাহেবদাদুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ওদের হাতে মুঠো ভরা ফুল…
দৃশ্যটা হঠাৎ যেন রোদের ছটায় ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়। সাহেবদাদু চোখের পাতা বুজে বসে থাকেন।
.
০৩.
আজ সকালেও কালকের রাত্রের প্রকাণ্ড মেঘটার কিছু অবশেষ ছিল। যেমন ঘুম ভাঙার পরও ঘুমের রেশ, তেমনি রেশ ছিল বাদলার। অল্প পরেই টুটে গেল। ঝকঝকে রোদ ছড়াল মাটিতে। আকাশ বোয়া মোছা উঠোনের মতন নিকানো।
মাসটা আশ্বিন। এই সবে আশ্বিন পড়েছে। বৃষ্টি-বাদলের পালা ফুরোচ্ছে। একটু-আধটু শরতের বর্ষণ থাকবে কিছুদিন। নুটুর মনে তেমন আর উদ্বিগ্নতা নেই। এইমাত্র তার গাড়ি এসে থামল শিশুতীর্থর ফটকে।
তুষার নীচে নেমে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েগুলো নামছিল হুড়োহুড়ি করে, কাউকে কাউকে হাত ধরে নামিয়ে দিচ্ছিল তুষার। কলকণ্ঠে ভরে উঠল জায়গাটা। যেন এক ঝাঁক পাখি হঠাৎ উড়ে এসে এখানের মাঠে নেমেছে।
ওরা নেমে গেলে বাস ফাঁকা। এই ফাঁকার দিকে তাকালে তুষারের একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ছেলেবেলায় সে দেখত, একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ির কামরা তাদের স্টেশনে কেটে রেখে বাকি গাড়িটা চলে যেত। বাবার অফিসে গিয়ে তুষার কিছুক্ষণ জ্বালাতন করত বাবাকে, তারপর প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে অনেকটা চলে আসত শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। কামরাটা দাঁড়িয়ে আছে লাইনে, কোনও কোনও দরজা খোলা, ভেতরটা একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই, কিছু নেই। মাঝে মাঝে এই ফাঁকা কামরার মধ্যে উঠে পড়ত তুষার। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কেমন যেন লাগত তার। ভাল লাগত না।
ফাঁকা বাসটার মধ্যে তাকিয়ে কয়েক পলক যেন তুষার ছেলেবেলার সেই দৃশ্য মনে করে নেয়। তারপর মাথা নিচু করে কোমর নুইয়ে তাকে আবার উঠতে হয় বাসে। তিনটে সরু সরু লম্বা বেঞ্চির কোথাও না কোথাও, বেঞ্চের নীচে কিছু কিছু জিনিস রোজই পড়ে থাকে, ওরা ফেলে যায়।
তুষার চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল। কে তার বই ফেলে গেছে একটা, এক কোণে ধ্রুবর নতুন লাট্ট পড়ে আছে, তপুর পিসি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব দেখে ভাইপোর গায়ে কোট পরিয়ে দিয়েছিল–তপু সেটা খুলে ফেলে কুঁকড়ে-মুকড়ে একপাশে ফেলে রেখেছে, বিনুর বা চন্দ্রার কানের দুল, বেঞ্চির তলায় এক পাটি জুতো। জুতোটা অশোকের। এক পাটি এখানে ফেলেছে, আর-একপাটি এতক্ষণে মাঠের কোথাও ফেলে রেখে পালিয়েছে।
একে একে তুষার সব কুড়িয়ে নিল। কুড়িয়ে বুকের কাছে জড়ো করে নীচে নামল। নুটু ততক্ষণে নীচে নেমে তার গাড়ির মুখের ঢাকা খুলে দিয়ে হাওয়া খাওয়াচ্ছে। তুষারকে নামতে দেখে নুটু নিজের জায়গায় ফিরে এসে তুষারের বেতের টুকরিটা তুলে নিয়ে এগিয়ে দিল তুষারকে। এক হাত বুকের কাছে আড় করে, বাচ্চাগুলোর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র আগলে, অন্য হাতে নিজের বেতের টুকরিটা ঝুলিয়ে তুষার ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।
ছেলেমেয়েগুলো কেউ আর এখানে নেই। নামা মাত্রই সব কটা দৌড় দেয়। ১৮
তুষার ফটক পেরিয়ে রাস্তা ধরল।
আশাদির ঘরে গান হচ্ছে। একেবারে কচিগুলো গান গাইছে। আশাদি নিজেও ভাল গাইতে পারে। সামান্য দূরে ডান দিকের ঘর থেকে আষো আধো কচি কচি গলার গান ভেসে আসছিল। তুষার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকাল একবার। চমৎকার রোদ হয়েছে আজ, সোনার মতো চকচক করছে। তুষার একটু মুখ উঁচু করে আকাশ দেখে নিল, নীলের রং লেগেছে, আশে পাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ।
গাছে গাছে পাখি ডাকছিল। কোথায় যেন অনেকগুলো চড়ুই ঝগড়া বাধিয়েছে। একটা কাককে তাড়া করে লোমের ঝালর ঝোলানো ক্ষুদে কুকুরটা ছুটতে ছুটতে তুষারের পায়ের কাছে পড়ল।
অভ্যর্থনা। ওর নাম তুলল। সাদা লোমের পুঁটলি বলে কুকুরটার ওই নাম হয়েছে। তুলো তুষারের পায়ের ওপর লাফিয়ে, শাড়ির প্রান্ত কয়েকবার দাঁত দিয়ে টেনে, লাফাতে লাফাতে আবার ছুটল।
তুষারের ঘর ও-দিকটায়; ওই যে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে! তুষার তার ঘর দেখতে পেল। খোলা জানলা; পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে ছায়ার চওড়া পাড় বসানো যেন। দোপাটির বাগান শুকিয়ে গেছে, কয়েকটা কলাফুলের গাছ ঘরের সিঁড়ির পাশে রোদে স্নান করছে। করবীর ঝোঁপ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
সামান্য এগিয়ে আসতেই আড়াল পড়া দূরের ঘরটাও চোখে পড়ল। ওটা জ্যোতিবাবুর ঘর। জ্যোতিবাবুর ঘরের সামনে আমতলায় তাঁর ছেলেমেয়েরা শুয়ে বসে কী যেন শুনছে, আর জ্যোতিবাবু একটা বেতের মোড়ায় বসে কী বলছেন।
মাঠের ঘাস মাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে আরও অল্প এগিয়ে আসতেই তুষারের চোখে পড়ল শিরিষ গাছের ডালে বাঁধা দোলনার ওপর আদিত্যবাবু বসে আছেন। তুষার যেতে যেতে মুহূর্তের জন্যে থামল, দেখল। কেমন অস্বস্তি বোধ করল।
আশাদির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে ভেসে আসছে, জ্যোতিবাবুর ছেলেমেয়েরা একসাথে কী যেন একটা বলছে, সেই সমবেত স্বর কানে বাতাসের স্রোতের মতন এসে লাগল, তুষার সামান্য দ্রুত পায়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শিরিষ গাছের কাছে আসতেই আদিত্য দোলনার পিড়ি একটু দুলিয়ে সামান্য যেন ঝুঁকে এল।
মুখ তুলল তুষার। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে যেমন মিষ্টি হাসি আসে মুখে তেমন হাসিমুখ করল।
আদিত্য শিষ্টাচার প্রকাশ করল না, যেন ওসবের কোনও প্রয়োজন নেই। চোখের তারা স্থির, কয়েক মুহূর্ত দেখল তুষারকে, তারপর ঘরের দিকটায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করে দেখাল।
তুষার বুঝল। কিছু বলল না। ও চলে যাচ্ছিল, আদিত্য কথা বলল। আপনার ভেড়ার পালকে কী রকম ঠাণ্ডা করে রেখেছি দেখেছেন। গলার স্বরে, বলার ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ ছিল স্পষ্ট। আদিত্যর ঠোঁটের কোণায়, গালে বিদ্রুপের হাসিও দেখতে পেল তুষার।
পা বাড়াতে গিয়েও তুষার একটু দাঁড়াল। তাকাল, তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। আসার পথেই বুঝতে পেরেছিলাম।
আদিত্য দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমায় দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন?
বোঝা যায়।
কী বোঝা যায়, আমি রয়েছি।
হ্যাঁ। তুষার মাথা নাড়ল। নয়তো আমার ঘরে এত শান্তশিষ্ট হয়ে সব থাকবে কেন।
আদিত্যর হাতে একটা ঢিল ছিল, ঢিলটা সে দূরে একটা ময়নার দিকে ছুঁড়ে মারল। তুষার দেখল।
আপনাদের এই..কী যেন শিশুতীর্থ না বোগাস কী যেন এই আখড়া–এই আখড়ার নিয়মকানুন কে তৈরি করেছে? আদিত্য বিরক্ত মুখে বলল।
তুষার চোখে চোখে তাকাল আদিত্যর। কেন?
অল স্টুপিড।
তুষার বিরক্ত বোধ করল, প্রকাশ করল না। এখানের কোনও নিয়ম নেই।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি, যার যা মরজি চালিয়ে যাচ্ছে।
দায়িত্ব আছে।
কী? …কী বললেন কথাটা? আদিত্য সমস্ত মুখ বিরূপ করে যেন ধমকে উঠল।
বললাম দায়িত্ব আছে। তুষার শান্ত গলায় জবাব দিল।
খবরদার–আদিত্য মাথা নেড়ে নেড়ে ব্যঙ্গ এবং রঙ্গের ভঙ্গিতে বলল, কাউকে যেন ভুল করেও কথাটা বলবেন না। বলে আদিত্য হেসে উঠল, নিয়ম নেই, দায়িত্ব আছে। হাউ স্টুপিড।
তুষার ভেবেছিল জবাব দেবে না। সে শান্ত থাকতে চেয়েছিল, পারল না। বলল, নিয়ম মানুষ তৈরি করে, দায়িত্ব অনুভব করতে হয়।
আদিত্য কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশের মতন চোখ বড় এবং স্থির করল। মানে কী কথাটার?
তুষার মানে বলল না। ঠোঁটের আগায় হাসল একটু। বলল, আপনার জন্যে এখানকার নিয়ম দায়িত্ব কোনওটাই নেই, ওকথা তুলে কী লাভ।
লাভ। আদিত্য অপ্রসন্ন উত্তেজিত স্বরে বলল, মুখে তো বললেন দিব্যি আমার জন্যে কিছু নেই, কিন্তু কাল কী হয়েছিল জানেন?
তুষার তাকাল।
কাল সন্ধেবেলায় আমি ওই কুয়াতলার দিকে–আদিত্য হাত বাড়িয়ে দূরে একটা জায়গা দেখাল, একটা বুনো বক মারার চেষ্টা করছিলাম।
বুনো বক?
খোঁড়া বক। কী ভাবে চলে এসেছিল যেন। ভাল মাংস হত। ওই মেয়েটা কী যেন নাম ইতি না কি, আপনাদের খোদ কর্তার বাড়ির মেয়েটা, সে এসে আমাকে ধমকে দিল।
তুষার ভেতরে ভেতরে অশান্তি বোধ করছিল, ওপরে কিছু প্রকাশ করল না, বরং কত যেন অন্যায় কাজ করা হয়ে গেছে এমন গলা করে বলল, না কি? আমাদের ইতি–
আকাশ থেকে পড়বেন না। আপনাদের ইতি-ফিতি আমি বুঝি না, বুঝতে চাই না। গাছের পাখি, বনের বক মারব তার আবার এখান-ওখান কী আছে! মেয়েটা এসে আমার মুখের ওপর শাসিয়ে বলে গেল, মারবেন না, দাদুর বারণ, রাগ করবেন।
আদিত্য যেন কালকের অপমান এবং আক্রোশ নতুন করে অনুভব করছিল, আমি একটা বক মারব তাতে তার দাদু রাগ করবে কেন? কী আমার এল গেল তার দাদুর রাগে। আরও একদিন ও আমায় দাদুর কথা বলে শাসিয়েছিল, আমি এখানে বেড়াতে বেড়াতে সিগারেট খাচ্ছিলাম।
তুষার বিব্রত বোধ করছিল। চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। বলল, এখানে এই চৌহদ্দির মধ্যে কতক জিনিস আছে যা করা অনুচিত।
যেমন–?
নিষ্ঠুর কিছু কাজ, অভব্য কোনও আচরণ।
মাংস খাওয়াটা নিষ্ঠুরতা, সিগারেট খাওয়া অভব্যতা–এসব আমায় শিখতে হবে?
সব জায়গায় সবকিছু করা যায় না।
না করার জন্যে আপনাদের নিয়ম আছে দেখছি। আদিত্য উপহাস করে বলল, ফন্দি-ফিকিরগুলো ভাল। সোজাসুজি বললেই পারেন, পয়সা নেই মাছ-মাংস খাওয়াবার তাই কাঁচকলার ঝাল খাওয়াই, ওসব বাজে কথা বলার কী দরকার।
তুষার কোনও জবাব দিল না। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আদিত্য পিছন থেকে জোরে জোরে বলল, মানুষ ছাগল নয়। আপনারা একটা খোঁয়াড় তৈরি করে রেখেছেন। অল স্টুপিড।
তুষার পিছন ফিরে তাকাল না, সিঁড়ির অল্প কয়েকটি ধাপ ভেঙে বারান্দায় উঠল।
আদিত্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। তুষারের হাঁটা দেখতে তার ভাল লাগে। স্কুল, মাংস, সিগারেট–কোনও কিছু আর মনে পড়ছিল না আদিত্যর। তুষারের শরীর তার ইন্দ্রিয়কে কেমন কাতর করছে। তুষার সুন্দর। তুষার…
তুষারের নীরব ঘর থেকে আচমকা একটা কলরব ভেসে এল, যেন জানলা খোলা পেয়ে একঝাঁক পায়রা বদ্ধ ঘর থেকে একসঙ্গে ডানা ঝাঁপটে বাইরে বেরিয়ে এল। আদিত্যের অন্যমনস্কতা নষ্ট হল শব্দে, ঘরটার দিকে ঘৃণা এবং বিরক্তির চোখে তাকিয়ে আদিত্য দাঁতে দাঁত ঘষে অস্পষ্ট গলায় কী যেন বলল একটা। তারপর মাঠ দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।
.
নিজের ঘরে ঢুকে তুষার একটা হাস্যকর অবস্থা দেখল। তার ঘরের ছেলেমেয়েরা আসন হয়ে বসে, মুখের কাছে খোলা বই নিয়ে চুপ করে বসে আছে। বীরুর চোখ বন্ধ, সে সমানে বই হাতে করে দুলছে, কানু দু-হাতে দুকান ধরে বসে আছে। মালা বইয়ের আড়াল দিয়ে আমসত্ত্বের টুকরো চুষছে।
তুষার নিজের জায়গায় গিয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে রাখল। রোদের তাতে তার কপালে গলায় সামান্য ঘাম হয়েছে। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে তুষার আবার একবার ওদের দেখল।
ততক্ষণে ছেলেমেয়েরা সব যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। পিছু ফিরে একবার দেখে নিল নতুন লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কি না! নেই, কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে বীরুর দুলুনি থেমে গেল, চোখের পাতা স্প্রিঙের মতন খুলে গেল, এক লাফে বীরু দাঁড়িয়ে উঠল। কানু কান ছেড়ে মালার হাত থেকে আমসত্ত্ব কেড়ে মুখে পুরে দিল টপ করে। মালা কানুর জামা খামচে ধরল।
তোরা সকলে এত লক্ষ্মী হয়ে বসে! তুষার বলল, বলে এক পা এগিয়ে এল।
লক্ষ্মীরা নিমেষে যে কতবড় লক্ষ্মীছাড়া হতে পারে তার প্রমাণ দিতেই একজন কোথা থেকে একটা এয়ারগান বের করে ফট করে শব্দ করল, একটা ছেলে প্যান্টের পকেট থেকে বেলুন বাঁশি বের করে ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দিল, বাঁশি বাজতে লাগল, অন্যগুলো কোলাহল করে উঠল, কেউ তুষারের কাছে ছুটে গেল, কেউ বা বসে বসেই অন্যের সঙ্গে খুনসুটি শুরু করল।
যে-ঘর এতক্ষণ ফাঁকা নির্জীব নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল–তুষার আসার পর সেই ঘর যেন জীবন্ত মুখর হয়ে উঠল। এই ঘরের এটাই রীতি, এ-রকমই স্বাভাবিক।
তুষারের ঘরের একটু বর্ণনা দিতে হয়। ঘরটা খুব বড় নয়, লম্বা ছাঁদের দেখতে। মাথার ওপর খাপরার ছাউনি, চটের সিলিং দেওয়া। সিলিঙের ওপর ঘন চুনকাম। দেওয়ালগুলোতে প্লাস্টার নেই, ইটের গাঁথনির গায়েই চুনকাম পড়ে পড়ে সাদা হয়ে আছে। দুপাশেই বড় বড় জানলা গোটা চারেক।
ঘরের মেঝে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। প্রায় সমস্ত ঘর জুড়ে পাতলা চট ছড়ানো, তার ওপর বড় বড় শতরঞ্জি পাতা। বাচ্চাগুলো মাটিতে বসে, ছোট ছোট ডেস্ক পড়ে আছে–একটা বেঞ্চিও। ঘরের দেওয়ালে কাগজের ফুল সাজানো, দুচারখানা ছবিও। তুষারের বসবার দিকটা বারো রকম জিনিসে ভরা, কিছু ছবির বই-পত্ৰ, গ্লোব, ব্ল্যাকবোর্ড, ন্যাকড়ার খেলনা, মাটির মূর্তি, আরও কিছু কিছু জিনিস এই রকমের।
তুষারের বসবার একটা চেয়ার আছে অবশ্য কিন্তু সেটা একপাশে সরিয়ে রাখা, টেবিলটাও। বেতের মোড়াটা টেনে নিয়েই বেশির ভাগ সময় বসে তুষার, কখনও কখনও সরাসরি শতরঞ্জির ওপর আসন হয়ে, কিংবা হাঁটু ভেঙে।
তুষারের বসবার দিকটার এক কোণে ছোট একটা দরজা খুললে কুঠরি মতন এক ফালি ঘর চোখে পড়বে। ঘরটা নানা কাজ অকাজের খুচরো জিনিসে ভরা, তবু, ওই ঘরেই নিচু ছোট জানলার পাশে একটা ক্যাম্বিসের হেলানো চেয়ার দেখলেই বোঝা যায় এটা তার বিশ্রামের নিভৃত স্থান।
তুষারের ঘরে এই রকম একটা কুঠরি থাকলেও সকলের ঘরে নেই। আশাদির ঘরে নেই, মলিনার ঘরেও নয়। জ্যোতিবাবুর ঘরে আছে, যদিও জ্যোতিবাবু সেটা ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না।
তুষারকে যারা ঘিরে ধরেছিল তাদের একজনের গালে কালির দাগ। তুষার বুঝতে পারল না, এতখানি কালি কী করে ও মুখে মাখল।
ইস! তুষার ছেলেমানুষের মতন গলা করে বলল, বলে জিভ বের করল, যেন কত বড় একটা অঘটন ঘটিয়েছে ছেলেটা। মুখে কালি মাখালি কী করে রে, শানু?
কালি মেখে শানুর কোনও অনুশোচনা হয়েছে বলে মনে হল না। বরং সে গাল দুটো আরও ফোলাল, ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করল।
ও বহুরূপী সাজছিল দিদি…অশোক বলল।
বহুরূপী? তুষার অবাক!
আমি কাল একটা বহুরূপী দেখেছি। শানু চোখ ঘুরিয়ে বলল। শানুর ওপর পাটির তিনটে দাঁতই পড়ে গেছে, নতুন দাঁত এখনও ওঠেনি। মাথার চুল খোঁচা খোঁচা।
ততক্ষণে যমুনা তুষারের বই খাতা কাগজপত্র এটা সেটা রাখার টেবিল থেকে কালির শিশিটা এনে দিয়েছে তুষারের হাতে। তুষার শিশি দেখেই বুঝতে পারল। কাল একটা লেখার কাজ করছিল তুষার, কালির শিশি বাইরে বের করেছিল, তুলে রাখতে ভুলে গেছে।
শানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তুষার কোলের কাছে টেনে নিল; হাসল, কেমন বহুরূপী দেখেছিস রে, শানু?
শানু সঙ্গে সঙ্গে তুষারের কোলের কাছ থেকে ছিটকে দুহাত সরে এল। সরে এসেই দু হাত তুলে চোখ জ্বলজ্বল করে বহুরূপীর বিবরণ দিতে লাগল। এত্ত বড়! …রাজা হয়েছিল। লাল জামা গায়ে, হাতে ধনুক ছিল। সেই বহুরূপীটাকে ছোট মামা একটা টাকা দিল।
রাজা বহুরূপী? তুষার ছেলেমানুষ হয়ে শানুর গল্প শুনতে লাগল।
হ্যাঁ-শানু মাথা নাড়ল। তারপরেই হেসে ফেলল কেমন, বলল, রাজাটার না দিদি, রাজাটার তরোয়ালই নেই। শানুর হাসি এবং কথা থেকে মনে হবে যে-রাজার তরোয়াল নেই সে আবার কেমন রাজা!
তুষার তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। ঘরের অন্যদিকে রুনু আর নন্তুতে ডিগবাজি খাওয়া, খেলা খেলছে; হাবুল মাটিতে মাথা আর দেওয়ালে পা তুলে দিয়ে ক্রমশ ঠেলে ওঠার চেষ্টার করছে কতদূর পা তুলতে পারে তারই পরীক্ষা, পড়ে যাচ্ছে পা, আবার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে অনর্গল কথা, চিৎকার, হাসি।
তুষার মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে বলল, রাজাটা বোধ হয় ভুল করে তরোয়াল বাড়িতে রেখে গিয়েছিল, শানু।
শানু তাকাল। কথাটা তার মনে লাগল। হতেও পারে, হয়তো সত্যি সত্যি তরোয়াল তার ছিল, বাড়িতে ফেলে গিয়েছে। শানুর চোখ-মুখ দেখে মনে হল, সে ভাবছে। তার দুঃখই হচ্ছে, আহা তরোয়ালটা থাকলে কেমন ভাল দেখাত রাজাকে।
যমুনা হাঁটু ভেঙে তুষারের পিঠের কাছে বসে। তুষারের খোঁপার ওপর একটা কুটো পড়েছিল কীসের। যমুনা কুটোটা তুলে নিয়ে ফেলে দিল। বলল, বহুরূপীরা আগের জন্মে গিরগিটি ছিল।
তুষার হাসল না। তাকে নিত্য এরকম অদ্ভুত মজার মজার কথা শুনতে হয়। যমুনার দিকে মুখ ফিরিয়ে তুষার বলল, কে বলল রে?
পিসিমা।
ও! …তুই বহুরূপী দেখেছিস?
হু, ক–ত দেখেছি।
কী কী সাজতে দেখেছিস?
অনেক, হনুমান, রাক্ষস..যমুনা ভেবে ভেবে বলল, ধোপা, শিব, দুর্গা, অর্জুন..
অর্জুন সাজতেও দেখেছিস?
যমুনা মাথা কাত করে হেলাল।
তুষার একটু কী যেন ভেবে নিল। অর্জুনের গল্প জানিস তোরা?
একটু আধটু জানত সবাই; কিন্তু কেউ আর কিছু বলল না। ওরা জানে, তুষারদিদি অর্জুনের গল্পটা নিজেই বলবে। সবাই একটু ঘেঁষে গুছিয়ে বসল।
তুষার হাতে তালি দিয়ে সকলকে চুপ করতে বলল। এত সহজে সবাই শান্ত হবে এমন কথা ভাবা ভুল। রুনু, নন্তু কিংবা হাবুলের কানে তুষারের তালির শব্দ পৌঁছেছে বলেও মনে হল না। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে হাতে তালি দিয়ে বিকুইক খেলছে।
তুষার এবার নাম ধরে ধরে ডাকল প্রত্যেককে। যমুনা ঘোষণা করে দিল, দিদি অর্জুনের গল্প বলবেন। দেখা গেল, গল্পের নামে সবাই কাছ ঘেঁষল পলকে। তুষারকে ঘিরে বসল ওরা।
গল্প শুরু করার আগে তুষার তার বেতের টুকরিটা আনিয়ে নিল। তারপর গল্প শুরু করল।
গল্পের মধ্যে তুষার কোনও ছেলের জামায় সেফটিপিন আটকে দিল, কারও চুল আঁচড়ে দিল, মেয়েদের বিনুনি বেঁধে দিল। পরিবেশটা স্কুলের নয়, ঘরের; মনে হবে বাড়িতে দালানে বসে যেন কোনও দিদি মাসি পিসি তার স্নেহের পাত্রদের সাজিয়ে-গুছিয়ে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।
অর্জুনের গল্প শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কেউ জানে না। কিন্তু আর একটু বেলায় এদের সকলের খাওয়ার ছুটি। তুষার ওদের নিয়ে খাওয়ার ঘরে চলে যাবে। হাত-মুখ ধুইয়ে খাওয়াবে সকলকে। তারপর বিশ্রাম। ওরা এই ঘরে এসে শুয়ে পড়বে। অবশ্য কেউ বড় একটা শোয় না। খেলা করে, দুরন্তপনা করে।
তুষার গল্প বলতে বলতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। রোদ গাঢ় হয়ে উঠেছে। পাখিদের কিচকিচ শব্দ ভেসে আসছে। হাত-ঘড়ি দেখল তুষার, দশটা বেজে গেছে।
গল্প মাঝপথে, শিশুতীর্থর পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজল। দূর থেকে শব্দটা কেঁপে-কেঁপে ভেসে এল। খাওয়ার ছুটি।
গল্পের আকর্ষণে কেউ উঠল না। তুষার হাসল। বলল, চল। বাকিটা পরে হবে।
দুপুরে? শানু শুধোল।
কাল।
না, না, আজ। তুষারকে কয়েকজনে মিলে জাপটে ধরল।
আজ দুপুরে ওই গানটা হবে যে, পুশি ক্যাট পুশি ক্যাট হোয়ার হ্যাড ইউ বিন..
ওটা গান নয়, ইংরেজি ছড়া। সবাই জানত কথাটা। এ-ঘরেও গান হয়, তুষারদির সঙ্গে তারা সবাই গায়। সেগুলো বাংলা গান। ইংরেজি ছড়ায় গানের মজা নেই, কিন্তু তুষারদি ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলা খেলান। খেলাটা খুব মজার।
আমি আজ ক্যাট হব। টুটুল বলল।
শানু টুটুলকে কাঁচকলা দেখাল। ফলে টুটুল শানুর ওপর লাফিয়ে পড়বে এটা স্বাভাবিক। শানু দু-হাত মুঠো করে পাকিয়ে শুন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছিল, আমি টাইগার। ক্যাটকে খেয়ে ফেলব।
তুষার উঠল। বেতের টুকরি হাতে করেই উঠে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েরাও তৈরি। বলল, চল তোরা।
হুড়মুড় করে ছেলেমেয়েগুলো ঘর থেকে দৌড় দিল।
তুষার চলে যাচ্ছিল। যেতে গিয়ে তার জুতোর কথা মনে পড়ল, অন্যান্য জিনিসগুলোও নিল তুষার। জামাটা নিল না। জামাটা যার তাকে নিজের ঘরেই পাওয়া যাবে। অন্য বাচ্চাদের জিনিস এবার দিয়ে দেবে তুষার।
বাইরে এসে তুষার দেখল, তার ঘরের ছেলেমেয়েরা ছুটে অনেকটা দূরে চলে গেছে।
.
০৪.
শিশুতীর্থর সব ব্যবস্থাই একটু অন্য রকম। এখানে স্কুলের মতন করে ক্লাস হয় না, পড়াশোনা করানোর রীতি নেই। সাহেব দাদু যখন শিক্ষা নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাতে বসলেন তখন তাঁর মনে হয়েছিল, কচি বয়সের এই ছেলেমেয়েগুলোকে ক্লাসরুমে পুরে খোঁয়াড়ের মতন আটকে রেখে কোনও লাভ নেই। পড়াশোনাকে জীবনের আর সমস্ত থেকে আলাদা করে দেখা আমাদের স্বভাব। এটা ভাল না।
সাহেবদাদু এমন একটা ব্যবস্থা খুঁজছিলেন যাতে এই কচি বয়সের ছেলেমেয়েগুলোর জীবনযাপন এবং শিক্ষাকে অঙ্গীভুত করা যায়, যেন, স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই এরা যেটুকু শেখবার শেখে, বাকিটুকু ফেলে দেয়।
কিছু কিছু বিদেশি বই আনিয়ে বিভিন্ন শিক্ষার ধারা বোঝবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কোনও কোনওটা মনঃপূত হলেও তাঁর সামর্থ্য যা তাতে বড় কিছু একটা করার উপায় ছিল না। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সে-সব বৃহত্তর ব্যাপারে তিনি যাননি। এমন সময় হল্যান্ড না কোন দেশের গ্রাম্য বিদ্যালয়ের একটা পদ্ধতির বিবরণ তাঁর চোখে পড়ে। ব্যবস্থাটা তাঁর ভাল লাগে, ভরসা হয় এখানে এই রীতি তিনি চালু করতে পারবেন।
অন্যের পরিকল্পনা নিজের মনের মতন করে, সম্ভব-অসম্ভব খতিয়ে দেখে তাঁকে সেই ব্যবস্থাটা এখানের মতন করে গড়ে নিতে হয়েছে। সেই নিয়মেই শিশুতীর্থ চালানো হয়।
এখানে গুটি পাঁচেক শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী। ছাত্র সংখ্যা ষাট-পঁয়ষট্টি। ছাত্রদের ভাগ করা হয়েছে বয়স দেখে, কখনও কখনও তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি দেখে। এদের এক একটি দলকে এক একজন শিক্ষকের হাতে সম্পূর্ণ ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন তুষারের হাতে যারা আছে তারা একান্ত ভাবেই তুষারের হাতে মানুষ হচ্ছে। তুষারের ঘর কথাটার অর্থ তুষারের ক্লাস। তুষারের ছাত্রদের যাবতীয় যা কিছু তুষারই শেখাবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মাস্টার বদলাবে, একজন এসে ইংরেজি শেখাবে, অন্যজনে অঙ্ক–এসব ব্যবস্থা এখানে নেই। সাহেবদাদুর ধারণা ভাগের মা গঙ্গা পায় না যেমন, তেমনি পাঁচ হাতে শিক্ষা হয় না। শিক্ষা এক হাতে একের অধীনে হওয়া দরকার। তাতে মানুষের মনে যে পারিবারিক বোধ আছে তার বিকাশ হয়, যারা শেখে তারা শিক্ষকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে, আত্মীয়তা বোধ করে, আর যে শেখায় তার সুখ এই, সে নিজের মনের মতন করে, নিজের কল্পনা মতন ছাত্রদের শেখাতে পারে। এই স্বাধীনতা না থাকলে, সাহেবদাদু বলেন, টিচার আর কী শেখাতে পারে! আমরা মাস্টার ভাড়া করি, তাঁদের হাতে ভার তুলে দিই না। পিতা-মাতার যেমন সন্তান ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্কটা সেই রকম পারবারিক ও অন্তরঙ্গ করতে হবে, দায়-দায়িত্ব সব থাকবে তাঁরই ওপর, যেমন ছেলেমেয়ের দায় শিক্ষা সবই তার বাবা-মার।
সাহেবদাদুর এই নীতি যে কার্যক্ষেত্রে সফল হয়েছে, শিশুতীর্থ দেখলে সেটা বোঝা যায়। বোঝা যায়–তুষার, আশাদি, জ্যোতিবাবুকে দেখলে। আর দুজন আছে এখানে, প্রফুল্লবাবু আর মলিনা, এরা দুজনেই নতুন। প্রফুল্ল কেন যেন এখনও ঠিক তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। মলিনা তৈরি হয়ে উঠতে পারবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
খাবার ঘরে ছেলেমেয়েগুলোর খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। তুষারের ঘর আর মলিনার ঘরের বাচ্চাগুলোর পর বাকি তিন ঘরের ছেলেমেয়েরা এসে খাবে। জ্যোতিবাবু আর খাবার ঘরে আসেন না, প্রফুল্লবাবুও নন। আশাদি একাই সব কজনকে সামলে খাইয়ে দেয়। ঠাকুর আছে, ঝি আছে। অসুবিধে বড় একটা হয় না।
খাওয়ার ব্যাপারটা এখানে খুবই সাধারণ। ভাত, ডাল, তরিতরকারি, মাছের টুকরো পাতে থাকে কোনওদিন, কোনওদিন থাকে না। বাচ্চাদের দুধ দেবার খুবই সাধ ছিল সাহেবদাদুর–সংগ্রহ করা মুশকিল বলে পেরে ওঠেন না। বেলা দুটো নাগাদ এদের জলখাবার দেওয়া হয়। কোনদিন রুটি-তরকারি, কোনওদিন ফলমূল, কোনওদিন বা আর কিছু।
তিনটেয় ছুটি। নুটুর বাস শহরের ছেলেমেয়ে নিয়ে ফিরে যায়। এখানে যারা থাকে তারা ছোটে সাহেবদাদুর বাড়িতে।
.
বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হলে তুষার কারও কারও হাত-মুখ ধুয়ে দিল, মুছিয়ে দিল। ছেলেমেয়েগুলো ছুটতে ছুটতে খেলতে খেলতে চলে গেল মাঠের দিকে।
মলিনা বাইরে জলের ড্রামটার কাছে দাঁড়িয়েছিল। পাশে দুটো কলাগাছ, একটা পেঁপে গাছ; হাত পনেরো দুরে রান্নাঘর। এঁটো পাতায় ডাঁই এনে মতি-ঝি আঁস্তাকুড় রাখা চৌবাচ্চাটায় ফেলল।
এখানে শরৎ আর হেমন্তর তফাতটা যেন ভাল করে বোঝা যায় না। আজ বোঝা যাচ্ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদ লক্ষ করে। সারা আকাশ খুব হালকা নীল, যেন সেই নীল থেকে কুলোয় করে কেউ ঝকঝকে রোদ ঝেড়ে ঝেড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফড়িংয়ের মতন কয়েকটা সবুজ পোকা উড়ছিল। পেঁপেগাছের চিকরিকাটা পাতার ডগা দুলছে থেকে থেকে, কলাগাছের তলায় দুটো বেড়াল বাচ্চা খেলা করছে।
মলিনা রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, তুমি আমাদের পাড়ায় গিয়েছিলে তুষারদি?
তুষার হাত ধুয়ে ড্রামের কাছ থেকে সরে এল। না, যাইনি!
তুমি ওদিকে যাও না?
খুব কম। আমি বাড়ি থেকে বড় একটা বেরোতে পারি না।
মলিনা শাড়ির আঁচলের পাক গলায় জড়াল একবার, আবার খুলল। মুখচোখ খুব বিরস। তুষারের দিকে তাকাল না, অনেকটা আপন মনে কথা বলার মতন করে বলল, বাড়িতে থেকেও তুমি বেরুতে পার না, আর আমরা–? কথাটা মলিনা শেষ করল না।
তুষার লক্ষ করল মলিনাকে। মলিনা এই রকম। তার কথা কখনও পুরোপুরি বোঝা যায় না।
তোমাদের কী হয়েছে? তুষার শুধোল।
মলিনা জবাব দিল না। তার মুখের হতাশ বিরক্ত অসুখী ভাব থেকে যা বোঝার বুঝতে হবে। মলিনার মুখে কখনও হাসি থাকে না। ও কখনও খুশি নয়। মলিনার মনে যে সুখ নেই, সর্বক্ষণ যেন সে সেটা প্রকাশ করতে চায়!
তুষারের হাতে বেশি সময় নেই। আশাদির কোয়ার্টারে গিয়ে তাকে স্নান করে নিতে হবে। সকালে তুষার স্নান করে আসতে পারে না। এখানে এসে এই খাওয়ার ছুটিতে সে স্নান করে নেয়। স্নান করে, খাওয়া-দাওয়া সারে। ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় সে নেয় না। কেই বা নেয় এখানে! আশাদি অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, দেখ তুষার, আমার বড় আলসেমি বাড়ছে, খাওয়ার পর একটু শুয়ে আসতে ইচ্ছে করে। কেন বল তো?
সকাল থেকেই যে তোমার খাটুনি।
সে তো তোরও।
তোমার মতন নয়।
কথাটা অবশ্য ঠিক। এই এতগুলো ছেলেমেয়ে তারা পাঁচ-সাত জন–সকলের রান্না বান্না খাওয়া-দাওয়ার ভার আশাদির ঘাড়ে। জ্যোতিবাবু বাজার আর ভাঁড়ারের দায় মাথায় নিয়েছেন, বাকি সব দায় আশাদির। খুব সকালে উঠে আশাদি ঠাকুর-চাকরদের এদিকের ব্যবস্থা বুঝিয়ে এবং গুছিয়ে দিয়ে তবে অন্য কাজে হাত দিতে পারে।
তুষার সময় নষ্ট করতে পারছিল না। খাবার ঘর পরিষ্কার করে অন্য দলের পাতা পড়ছে। মলিনার কোনও তাড়া নেই। তুষার বলল, তোমার কোনও দরকার আছে? কাজ থাকে তো বলো, আমি বরং সময় করে একবার তোমাদের ওদিকে যাব।
দরকার। …মলিনা তুষারকে অন্যমনস্ক চোখে দেখল। না, দরকার নেই কিছু৷দু মুহূর্ত থেমে চাপা গলায়, যেন অনুচিত কোনও অনুরোধ করেছে এমন সুরে বলল, আমি পাঁচটা টাকা দেব তোমার হাতে। বাড়িতে যদি পৌঁছে দাও। বাবা একটা ধুতি কিনতে টাকা চেয়েছিল। মলিনার মুখ অপ্রসন্ন, তিক্ত।
তুষারের ভাল লাগছিল না। মলিনার বাড়ির কথা উঠলে তার অস্বস্তি হয়, ভাল লাগে না। তুষার বলল, বেশ তত দিয়ো। আমি পাঠিয়ে দেব।
তুষার আর অপেক্ষা করল না। আশাদির ছেলেমেয়েগুলো আসছে, তাদের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তুষার বারান্দার মতন ঢাকা জায়গায় উঠে দেওয়ালের পেরেকে ঝুলোনো বেতের টুকরিটা নিয়ে চলে গেল।
সামনেই আশাদির কোয়ার্টার, গা লাগানো। এই কোয়ার্টারে আশাদি আর মলিনা থাকে। দুজনের দুটো ছোট ছোট ঘর, এক ফালি বারান্দা। কাঠের জাফরি দিয়ে বারান্দাটাও অনেকখানি ঘেরা। কোয়ার্টারের পেছন দিকে উঠোন, কলঘর।
আশাদির ঘর খোলাই থাকে। তুষার ঘরে এসে বেতের টুকরিটা রাখল।
ঘরের জানলাগুলো খোলা। রোদ এসে বিছানায় পড়েছে আশাদির। ঘরটা ছোট, খুব সাধারণ ভাবে সাজানো, বিছানার তক্তপোশ ছাড়া আসবাবের মধ্যে একটা ছোট টেবিল-খান দুয়েক বেতের মোড়া; এক কোণে আশাদির সেলাই কল, বাক্স, স্যুটকেস। জানলায় পরদা নেই। দেওয়ালে আশাদির মার ফটো। এক ক্যালেন্ডার ঝুলছে পশ্চিমের দেওয়ালে। ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
একটা মোড়া টেনে তুষার একটু বসল। এলো খোঁপাটা খুলে নিল। কাল মাথায় জল দিতে পারেনি; আজ জল না দিলে বিকেলে আর মাথা তোলা যাবে না। বেতের টুকরি থেকে শাড়ি জামা বের করে পাশে রাখল তুষার–বিছানার ওপর, চিরুনি বের করে চুলের গোড়ার জট ছাড়িয়ে নিল। তুষার তেল আনতে ভুলে গেছে আজ। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কলঘরে আশাদির মাথায় মাখা তেল আছে– নারকেল তেল। তুষার কোনওদিনই মাথায় একরাশ তেল মাখতে পারে না, অথচ একটু তেল জল না পড়লে তার বড় মাথা ধরে।
রান্নাঘর থেকে বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়ার শব্দ প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ভেসে আসছে। ওরা এই রকম, খেতে বসেও শান্ত নয়। জ্যোতিবাবু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তদারক করেন, আশাদি ভেতরে পাতের কাছে ঘুরে ঘুরে দেখছেন, তবু যেন মনে হবে একটা ছোট হাট বসে গেছে।
চুল ছাড়িয়ে শাড়ি জামা হাতে নিয়ে তুষার উঠে পড়ল। পিছনের দরজার ছিটকিনি খুললেই উঠোন, উঠোনের একপাশে কলঘর। উঠোনের দুধারে দুই খুঁটি, তার বাঁধা। আশাদি আর মলিনার সকালের শাড়ি জামা শুকোচ্ছে। রোদ উঠোন মাড়িয়ে ডালিম গাছটার দিকে সরে গেছে অল্প। কয়েকটা চড়ুই ফর ফর করে উড়ছিল।
তুষার তাড়াতাড়ি স্নান করতে কলঘরে ঢুকে গেল। ড্রামে আজ জল কম। আশাদি বোধহয় সকালে স্নান সেরে রেখেছে। জল সাবান গোলা। তুষার তার গা-মোছা গামছাটা খুঁজে পেল না। কলঘরের একপাশে দড়িতে তার গামছা থাকে। কোথায় গেল গামছাটা? আবার কলঘর থেকে বাইরে আসতে হল তুষারকে। বাইরে কোথাও তার গামছা নেই। তুষার মনে মনে ঈষৎ বিরক্ত হল।
সাবান গোলা জলে স্নান করতে করতে তুষার মলিনার কথা ভাবল। মলিনা এই রকম। তার সব কাজই অপরিষ্কার। এই জলে সে সাবান দিয়ে ঘোলা করেছে, ওই যে কয়েকটা নোংরা পড়ে আছে এক পাশে–ভেতর-জামা, সায়া, ওগুলোও মলিনার। নিজের হাতে তোলার অবসর পায়নি, ফেলে রেখেছে, ঝিকে দিয়ে কাচিয়ে নেবে। তুষারের মনে হল, গামছাটাও বোধহয় মলিনা ব্যবহার করে ঘরে নিয়ে গিয়ে কোথাও ফেলে রেখেছে।
স্নান সেরে ধোওয়া কাপড় জামা গায়ে জড়িয়ে তুষার বেরিয়ে এল। তার ধোওয়া শাড়ি জামা নিংড়ে রোদে মেলে দিতে দিতে আকাশের তলায় দুটো চিলকে সাঁতার কাটতে দেখে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল তুষার। তার ভাল লাগছিল।
রোদে মেলা ভিজে শাড়িতে একবার করে মাথা মোছে তুষার আবার একবার করে চুল ঝাড়ে। খাবার ঘর শান্ত। কতক কাক কা কা করছে।
আশাদির পায়ের শব্দ শুনতে পেল তুষার। আশাদি ঘরে এসেছে।
অগোছালো শাড়ি পরে তুষার ঘরে এল।
আশাদি বিছানায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।
চান হল?
হল। …আমার গামছাটা পেলাম না। তুষার তার চিরুনি তুলে আগে চুল আঁচড়ে নিতে লাগল।
পেলি না?
না।
সে কী? আশাদি অবাক। কোথায় গেল?
আমি কী করে জানব। তুষার বলল, বলেই ছেলেমানুষের মতন গলা করে বলল, মাথা মুছতে পেলাম না ভাল করে, দেখো তো কি জল থেকে গেল। সারাদিন ভিজে থাকলে এমন গন্ধ হয় মাথায়।
আমার গামছাটা নিলে পারতিস।
না, তুমি যা ফিটফাট, তোমার গামছায় মাথা মুছে রাখলে গালাগাল খাবে কে!
আশাদি নিজেই উঠল। বাইরে রোদ থেকে গামছা এনে তুষারের মাথা মুছিয়ে দিল। বলল, তোর চুল যেন আরও বাড়ছে, তুষার।
আরও খুকি হচ্ছি যে। তুষার শব্দ করে হেসে উঠল। হেসে মুখ ফিরিয়ে আশাদিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।
ছাড়। আশাদি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। নিজের তো সব হয়ে গেল, আমার আজ চান হয়নি।
তুষার আশাদির মাথার দিকে লক্ষ করল। তুমি চান করোনি?
না। সময় করে উঠতে পারলাম না।
কিন্তু জল কই, যেটুকু ছিল আমি শেষ করে এলাম। তাও আবার সাবান গোলা জল।
আশাদি গায়ের আঁচল আলগা করল। মুখে কপালে ঘাম। গালে কীসের একটা আঁচড় লেগে লাল হয়ে আছে। তুষার দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গায়ে জড়ানো শাড়িটা ভাল করে পরতে লাগল।
আশাদি বলল, সকালে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। শরীর খারাপ। দেরি হয়ে গেল।
কী হয়েছে ওঁর? তুষার বাড়তি আঁচল হাতে গুটিয়ে নিয়ে নিমেষে আশাদির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখে উৎকণ্ঠা।
একটু জ্বর জ্বর মতন হয়েছে।
সাহেবদাদুর শরীর ইদানীং আর ভাল যাচ্ছে না। প্রায় কোনও না কোনও উপসর্গ লেগে থাকে। ওঁর জ্বর হয়েছে শুনে তুষার উদ্বিগ্ন হল।
বলল, ঠাণ্ডা–?
হতে পারে। জানি না ঠিক।
ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছ?
উনি দিতে বারণ করলেন। গাড়িটাও তখন তোদের আনতে বেরিয়ে গেছে।
তুষার আঁচল গায়ে তুলল। জ্যোতিবাবুকে বললে না কেন, সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন?
আশাদি কোনও জবাব দিল না। মনে হল ভাবছে যেন কিছু।
তুষার বলল, আমি বিকেলে দেখা করে যাব।
আশাদি স্নানের জন্যে ঘর ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলল, যাস। …ও শোনদরজার কাছেই আশাদি ঘুরে দাঁড়াল, আমায় উনি ওই আদিত্যবাবুর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওই ভদ্রলোকও কেমন। আমার ভাল লাগে না।
আশাদি চলে গেল, তুষার দাঁড়িয়ে থাকল।
.
০৫.
এখন দুপুর। বাইরে রোদ প্রখর। ভাদ্রের শেষ বলে রোদে হলকা আছে। গাছ এবং গাছের পাতায় অনেকটা তাপ শুষে যাচ্ছিল বলে গরমের আঁচ গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছিল না। তা ছাড়া বর্ষা হয়ে গেছে, কালও দু-চার পশলা ছিল, কাজেই বাতাস তেমন গরম নয়। তবু ঘাম হচ্ছিল। তুষার তার বেতের মোড়ায় চুপ করে বসে। তার ঘরের ছেলেমেয়েগুলো এখন খুব শান্ত। ওরা হাতের লেখা করছে। হাতের লেখা শেষ হলে, তুষার ভেবে রেখেছে আজ স্বাস্থ্য পড়াবে। স্বাস্থ্য পড়ানোর একটা মোটামুটি ছক সে ঠিক করে রেখেছে।
হাতের লেখা লেখবার সময় বাচ্চারা যেমন এক শব্দ বা কথা উচ্চারণ করে টেনে টেনে-সেই রকম শব্দ হচ্ছিল। বিভিন্ন ছেলে মেয়ের গলায় বিভিন্ন শব্দে সেই ধ্বনি অদ্ভুত শোনাচ্ছিল।
বাইরে ঘুঘু ডাকছে। গাছের ছায়ায় বসে রোজ দুপুরবেলা এমনি করে ঘুঘু ডাকে এখানে। মাঝে মাঝে কোকিলও। আজ কোকিলটা আশে পাশে কোথাও নেই, কোন ঘরের সামনে গিয়ে বসেছে জানে।
তুষার কপাল মুছে নিল। একটা হাতপাখা অবশ্য আছে ওদিকে। কোনও দরকার নেই পাখার। এখুনি জানলা দিয়ে দমকা হাওয়া বয়ে গেলে ঘর আবার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগবে। আজকের বাতাস তেমন গরম নয়। বরং দুরে কোথাও বৃষ্টির জলে ভিজে ঠাণ্ডা হয়ে মাঝে মাঝে এপাশে এসে লুটিয়ে পড়ছে।
বসে থাকতে থাকতে তুষার সাহেবদাদুর কথা ভাবছিল। আজ যাবার আগে নিশ্চয় একবার দেখা করে যেতে হবে। গত দুদিন তুষার তাঁর কাছে যেতে পারেনি। সাহেবদাদুর শরীরটা এই একবছরে যেন বড় তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ল। সেই যে টমটম করে কোথায় যেতে গিয়ে গাড়ি উলটে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটালেন, তারপর থেকেই ওঁর শরীর ভাঙার দিকে। অবশ্য বয়স হয়েছে, শরীর ভাঙবে, অথর্ব হয়ে পড়বেন ক্রমশই–এটা কিছু আশ্চর্যের নয়। কিন্তু বছরখানেক আগেকার সাহেবদাদুর সঙ্গে আজকের সাহেবদাদুর তুলনা করলে মনে হবে, এক বছরে এত স্বাভাবিক নয়।
উনি নানা দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় আছেন। একটা দুটো দুর্ভাবনার কথা তুষার জানে, আশাদিও জানে। জ্যোতিবাবুও যে না জানেন এমন মনে হয় না।
সেই সব দুর্ভাবনার একটা হল, অর্থচিন্তা। এই শিশুতীর্থের জন্যে উনি ওঁর যথাসর্বস্ব দিয়েছেন। মোটামুটি ধনী লোক না হলে বা অর্থের ব্যবস্থা না থাকলে এই প্রতিষ্ঠান এতকাল কষ্টেসৃষ্টে চালানোও সম্ভব ছিল না। এত কিছুঘরবাড়ি জিনিস-পত্র–যত দীন ভাবেই হোক উনি একার সামর্থেই করেছেন। এখন ভাণ্ডার বোধ হয় প্রায় শূন্য। সর্বক্ষণই দুশ্চিন্তা, কেমন করে শিশুতীর্থ চলবে।
সাহেবদাদুর এক বন্ধু কোনও মিশনারি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের যেন হর্তাকর্তা ব্যক্তি। তুষার আশাদির কাছে শুনেছিল সাহেবদাদু সেই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাৎসরিক কিছু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। তুষার ঠিক জানে না সাহায্যটা এত দিনে পাওয়া গেছে কি না। এ ছাড়া সামান্য আর যা সাহায্য অন্যান্য সূত্র থেকে আসে–সাহেবদাদুর অবর্তমানে তা পাওয়া যাবে কি না কে জানে!
সাহেবদাদুর অন্য দুর্ভাবনা ইতি। দেখতে রোগা মতন মেয়েটা তার অবোধ মুখ নিয়ে কেমন বড় হয়ে উঠল। তুষার নিজের চোখেই গত দুবছর ধরে ওকে দেখছে। কেমন শীর্ণ শ্যামলা ছিল, সেই মেয়ে যেন বাড়ন্ত হবার সময়ে এসে হু হু করে বেড়ে উঠল। মেয়েদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। ঝড় এলে যেন বানের মতন আসে। পনেরো বছরের ইতিকে চট করে দেখলে কে আজ বলবে যে বছরখানেক আগেও অমন রোগা ছিপছিপে চঞ্চল মেয়ে ছিল। আজ ইতি রীতিমতো তুষারের মাথায় মাথায় হয়ে উঠেছে। শরীর বড় সুন্দর হয়ে বেড়েছে, নতুন ফোঁটা ফুলের মতন দেখায়। গায়ের সেই শ্যামলা রং যে কী উজ্জ্বল মিষ্টি হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
ইতির সবই ভাল। মন্দ এই যে, মেয়েটা কেমন করে যেন এই বয়সেই অনেকখানি গম্ভীর, চুপচাপ। এত শান্তশিষ্ট হওয়া ওকে–ওই বয়সের মেয়ের পক্ষে-মানায় না। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে, তুষার লক্ষ করে দেখেছে, বড় একা নিঃসম্পর্ক নিষ্প্রাণ দেখায়। যেন একটা বৈরাগ্যের ছবি।
সাহেবদাদু ইতির সম্পর্কে সব সময় দুশ্চিন্তা করেন। তাঁর অবর্তমানে মেয়েটার কী হবে, এই শিশু-তীর্থ সম্বল করে সে কি জীবন কাটাতে পারবে? শিশুতীর্থের ভবিষ্যতই যেখানে স্পষ্ট করে দেখা যায় না, সেখানে ইতিকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে নিশ্চিন্ত হওয়া কিংবা ভরসা পাওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া ইতির কাছে, কে বলতে পারে, এই শিশুতীর্থের মূল্য সত্যি সত্যি কতটা!
ঘুঘুর ডাকে তুষারের মনোযোগ ছিল না। জানলার বাইরে থেকে একটা হলুদ ছিটঅলা পাখি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ফর ফর করে উড়ে আবার অন্য জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুষারের অন্যমনস্কতা ফিকে হয়ে এল, ঘুঘুর ডাক আবার শুনতে পেল তুষার। দু-এক দমক হাওয়া এসেছে। বাইরের রোদ এত ঘন যেন আলোর সর পড়ে জমে আছে।
ছেলে-মেয়েদের দিকে চোখ বুলিয়ে তুষার জানলার বাইরে তাকাল। মনে পড়ল, সাহেবদাদুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি আদিত্যবাবুর কথা জিজ্ঞেস করবেন। আশাদি বলেছে। সাহেবদাদু জিজ্ঞেস করলে তুষার যে কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না।
এত লোক থাকতে তুষারকেই বা কেন যে আদিত্যবাবুর সম্পর্কে প্রশ্ন করার যোগ্য পাত্র মনে হল এও এক অদ্ভুত ব্যাপার। খুব সম্ভব আশাদি বিদঘুঁটে ব্যাপারটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিস্তার পেয়েছে।
তুষার কিছু জানে না। সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে বিরক্ত হয়েই তুষার মনে মনে বলল, আমি কিছু জানি না। আদিত্যবাবু এখানে কী করছেন, কেমন দেখছেন শিশুতীর্থ, কী বলছেন–আমি জানতে চাই না, জানি না।
ব্যাপারটা অস্বস্তিকর বলেই তুষার তার দায় এড়াতে আদিত্য সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকতে চাইল। কিন্তু পারল না। কারণ এখানে–এই শিশুতীর্থে তুষার ছাড়া অন্য কেউ আদিত্যর ওপর প্রসন্ন নয়। আশাদি খুবই বিরক্ত, মুখে কিছু বলেন না। জ্যোতিবাবু হয়তো বিরক্ত নন, কিন্তু আদিত্য তাঁকে এড়িয়ে চলে। মলিনা আর প্রফুল্লবাবুকে আদিত্য গ্রাহ্য করে না।
ভদ্রলোক এখানে কেন এসেছেন তুষার বুঝতে পারে না। অযথা সময় নষ্ট করছেন এখানে বসে। শিশুতীর্থ তাঁকে কিছু শেখাচ্ছে না, বা তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর খোরাক কিছুই জোগাড় করতে পারছেন না। তবু বসে আছেন। বসে বসে নিজের এবং অন্যদের সহিষ্ণুতার মাত্রা নষ্ট করছেন।
সংসারে কত রকমের অদ্ভুত মানুষই না থাকে, আদিত্য সেই রকম। সত্যিই মানুষটা বিচিত্র, তুষার এই রকম লোক দেখেনি। যার উচিত ছিল পুলিশের কোনও চাকরি নেওয়া সে এসেছে শিশুশিক্ষার তদারকি করতে। স্বভাবে চরিত্রে মনে এই মানুষ শিশুরাজ্যে, শিক্ষার রাজ্যে একেবারে বেমানান। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ বলে কথা আছে একটা–যদি প্রহ্লাদকুলে দৈত্য বলে কিছু থাকত তবে আদিত্যকে সেখানে বসানো চলত। ফুলের বনে মত্তহস্তী। ও কেন এল? সংসারে ওর কি অন্য জায়গা ছিল না?
আদিত্য নিজেই বলে, আমি মিসফিট। এসব শিশুশিক্ষা-টিক্ষায় আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
নেই?
একেবারেই না। আদিত্য বিতৃষ্ণার সঙ্গে মাথা নেড়েছিল।
আশ্চর্য! তুষার বলেছিল।
আশ্চর্যের কিছু না। এই রকমই হয়ে থাকে।
যে যা পছন্দ করে না তাকে তাই হতে হয়?
হ্যাঁ। আজকাল জগৎ অন্য রকম হয়ে গেছে। যার পাকা চোর হওয়া উচিত সে সাধু হয়।
কথা শুনে তুষার হেসে ফেলেছিল। এই রকমই কথা বলে লোকটা। কী বলছে ভেবে দেখে না।
আপনি তো শিশুশিক্ষার বিষয় নিয়ে চর্চা করেছেন শুনেছি। তুষার বোঝাবার মতন গলা করে বলেছিল একদিন।
না, মোটেই না।
সে কি! আমরা যে শুনেছিলাম–
শোনানোর মতন পরিচয় আমার ছিল বলে শুনেছেন। তবে সেটা মিথ্যে পরিচয়। পেটের জন্যে রাখতে হয়েছে।
মানে?
জীবিকা। আমায় মাস গেলে চাইল্ড এডুকেশন সোসাইটি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার থেকে তিনশো টাকা মাইনে দেয়।
তুষার বিন্দুমাত্র খুশি হয়নি কথা শুনে। একটু রূঢ় ভাবেই বলেছিল, তা হলে আপনি ওদের ঠকাচ্ছেন?
একরকম তাই। ঠকানো ছাড়া উপায় কী। আমরা সব সময় হয় নিজেকে না হয় অন্যকে ঠকাই।
হ্যাঁ, যদি ঠগ হই। তুষার ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছিল।
আদিত্য গ্রাহ্য করেনি; হেসেছিল।
এই পরিচয় ওর। শিশুশিক্ষা, শিশুর মন, শিক্ষার তত্ত্ব কোনও কিছুর প্রতিই আদিত্যর আকর্ষণ নেই, অথচ এই লোক, তুষার জেনেছে, এই লোকই মনস্তত্ত্বের ডিগ্রি নিয়েছে, শিশুশিক্ষার ডিপ্লোমা পেয়েছে, সরকারি পয়সায় দেড় দুবছর বিদেশ ঘুরে এসেছে শিশুশিক্ষা পদ্ধতির নতুন রীতি-নীতিতে শিক্ষিত হয়ে আসতে। এখানে এসে বাঁধা চাকরি পেয়েছে, চাকরির শর্ত অনুযায়ী নানা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা ও গবেষণা করছে।
তুষারের ঘৃণা হয়েছিল। আদিত্যকে সে ঘৃণাই করেছিল তখন। লোকটা শুধু অযোগ্য নয়, প্রবঞ্চকও।
তবু এই মানুষই তুষারকে কেমন একটা সৌজন্যমূলক দুর্বলতার মধ্যে ফেলেছে। যদি সাহেবদাদু ওর কথা জিজ্ঞেস করেন তুষার কি বলতে পারবে, এখানে ওঁকে থাকতে দেওয়া নিরর্থক। শিশুতীর্থের আদর্শ ও শান্তির পক্ষে ভদ্রলোক বিঘ্ন।
তুষার ভেবে দেখল, সে কিছু বলবে না। আদিত্যবাবুর বিপক্ষে নয়, স্বপক্ষেও নয়। বিপক্ষে বলা ভাল দেখায় না, কারণ মানুষটা এখানের অতিথি, মাসখানেকের বেশি হল এসেছে, আরও হয়তো মাসখানেক থেকে চলে যাবে। ওর সঙ্গে শিশুতীর্থের যখন কোনও যোগাযোগ নেই, তখন কেন অনর্থক একজনের অপযশ গাওয়া।
আদিত্যর প্রতি তুষার করুণাই অনুভব করল। নিতান্ত চাকরির জন্যে যে লোক শিশু কল্যাণের ব্রত নিয়েছে তার সম্পর্কে তুষারের কিছু বলার নেই। আদিত্যকে অত্যন্ত দীন এবং হীন বলে মনে হচ্ছিল তুষারের।
শানুর অঙ্ক হয়ে গেছে। শানু তুষারকে ডাকল দিদি।
তুষারের চমক ভাঙল। চমক ভাঙার পরই তুষার অনুভব করতে পারল তার কপাল গলা ঘাড় ঘামে ভিজে উঠেছে।