প্রথম পরিচ্ছেদ – চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
১. মোগল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
মোগল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ব ভোগীর কোন স্থান ছিলো না। কারণ সে ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকার প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে মাতব্বরের সহায়তায় কৃষকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতো। এজন্য মোঘল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কোন বংশানুক্রমিক জমিদারী স্বত্বের জন্ম দেয়নি এবং জমির ওপর দখলী স্বত্বের ভিত্তিতে মোগল আমলে কোন অভিজাত শ্রেণী গড়ে ওঠারও কোন ব্যবস্থা ছিলো না।
তবে মোগল ভূমি রাজস্ব নীতির এই কাঠামো সত্ত্বেও তার মধ্যে কিছু কিছু ব্যতিক্রমও থাকতো। প্রথমত অনেক হিন্দু রাজারা নিজেদের এলাকাকে এমন স্বাধীনভাবে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করতেন যে তাঁদের থেকে একটা বাৎসরিক কর আদায় ব্যতীত কেন্দ্রীয় মোগল সরকারের আর করার কিছু থাকতো না। কাজেই এই রাজারা কৃষকদের থেকে নিজেদের এজেন্টদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতেন এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ কর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় মোগল সরকার নিজেদের কর্মচারীদেরকে মাসিক অথবা বাৎসরিক মাইনে নগদ টাকায় না দিয়ে তাদেরকে এক একটি এলাকার রাজস্ব আদায়ের অধিকার দান করতো। এইভাবেই এই মোগল কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারী তত্ত্বাবধান সত্ত্বেও স্বাধীনভাবে নিজ নিজ নির্দিষ্ট এলাকায় রাজস্ব আদায় করে যেতো। তৃতীয়ত, কোন কোন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রাম্য মাতব্বরদের ওপর নির্ভর না করেই সরাসরিভাবে নিজেদের কর্মচারীদের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের হিসাব দেখাশোনা করতো এবং তাদের থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতো।
উপরোক্ত তিন ধরনের ব্যবস্থার ফলে ভূমি ব্যবস্থার সাধারণ কাঠামোর মধ্যে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দেখা দিলেও আইনত এবং কার্যত জমির ওপর রাষ্ট্র অথবা জমিদার জাতীয় কোন শ্রেণীর দখলী স্বত্ব মোগল আমলে ছিলো না। জমির সত্যিকার মালিক তখন ছিলো তারাই যারা নিজেরা গ্রামে কৃষিকার্যের দ্বারা জমিতে ফসল উৎপাদন করতো। কাজেই সে সময় যাদেরকে জমিদার বলা হতো তারা ছিল সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট মাত্র, ভূস্বামী অথবা জমির মালিক নয়।
অবশ্য মোগল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এই ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অনেকাংশে শিথিল হয়ে পড়ে এবং তার ফলে অরাজকতা দেখা দেয়। ওপরে বর্ণিত তিন শ্রেণীর কর আদায়কারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা এবং অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ইচ্ছামতোভাবে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। এর ফলে কৃষকদের ওপর চারিদিক থেকে নানা ধরনের কর্মচারীদের যে ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয় সেই প্রসঙ্গে ফরাসী পরিব্রাজক বার্ণিয়ের ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লেখেন যে, এই সব কর্মচারীরা কৃষকদের ওপর নিরংকুশ আধিপত্য করে। কিন্তু শুধু কৃষকদের ওপর নয়, নিজেদের এলাকার অন্তর্গত নগর এবং গ্রামের কারিগর ও ব্যবসায়ীদের ওপরও তারা অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার সাথে এই আধিপত্যকে জারী রাখে।
২. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী প্রাপ্তি
১৭৬৫ খৃস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মোগল সম্রাটের থেকে দেওয়ানী লাভ করে বাঙলাদেশে রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত হয়। রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের প্রতি এক নির্দেশনামায় তাদেরকে বলে যে, রায়তদেরকে তাদের বোঝানো দরকার যে, কর বৃদ্ধি করা কোম্পানীর উদ্দেশ্য নয়। তাদের আসল উদ্দেশ্য নির্যাতনকারী ও কৃষকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে নির্যাতনের হাত থেকে কৃষকদেরকে রক্ষা করা। কিন্তু এই রক্ষাকার্য কোম্পানীর দ্বারা তো সম্ভব হয়ইনি উপরন্তু কৃষকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা তাদের দেওয়ানী প্রাপ্তির পর থেকে বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এটাই স্বাভাবিক। কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিলো একটি বিদেশী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এদেশে মুনাফা লুণ্ঠন করাই ছিলো তার একমাত্র উদ্দেশ্য। এছাড়া কোম্পানীর ব্যবস্থাপনার মধ্যে এই সময় নানা ধরনের সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং কোম্পানীর কর্মচারীরা যথেচ্ছভাবে চারিদিকে ব্যক্তিগত মুনাফা এবং লুটতরাজ শুরু করে। এর ফলে কৃষকদের অবস্থা অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যেই অদৃষ্টপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হয় এবং তাদের জীবনে নেমে আসে বাঙলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ – ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।*
[*বাংলা ১১৭৬ সালে এই দুর্ভিক্ষ হয় বলে একে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়।]
তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা এই মহাদুর্ভিক্ষের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দায়ী করলেও প্রকৃতপক্ষে তার সাথে অনাবৃষ্টি অথবা ঐ ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিলো না। ইয়ং হাসব্যান্ড নামে এই দুর্ভিক্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ ঐতিহাসিক ১৭৮৬ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত একটি পুস্তকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইংরেজ বণিকদের ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন:
তাহাদের মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হইল চাউল কিনিয়া গুদামজাত করিয়া রাখা। তাহারা নিশ্চিত ছিলো যে, জীবন ধারণের পক্ষে অপরিহার্য এই দ্রব্যটির জন্য তাহারা যে মূল্যই চাইবে তাহাই পাইবে।… চাষীরা তাহাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফসল অপরের গুদামে মজুদ হইতে দেখিয়া চাষাবাস সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া পড়িল। ইহার ফলে দেখা দিল খাদ্যাভাব। দেশে যাহা কিছু খাদ্য ছিল তাহা (ইংরেজ বণিকদের) একচেটিয়া দখলে চলিয়া গেল।… খাদ্যের পরিমাণ যত কমিতে লাগিল ততই দাম বাড়িতে লাগিল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুখঃময় জীবনের উপর পতিত হইল এক পুঞ্জীভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু ইহা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।
এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোন অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নহে। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিল, তাহা এমনকি ভারতবাসীরাও আর কখনও চোখে দেখে নাই বা শোনে নাই।
চরম খাদ্যাভাবের এক বিভীষিকাময় ইঙ্গিত লইয়া দেখা দিল ১৭৬৯ খৃস্টাব্দ, সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাহাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিলো সেইখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান-চাউল ক্রয় করিতে লাগিল। এই জঘন্যতম ব্যবসায় মুনাফা হইল এত শীঘ্র ও এরূপ বিপুল পরিমাণে যে মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এই ব্যবসা করিয়া দুর্ভিক্ষ শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) ইউরোপে পাঠাইয়াছিলেন।[১]
মহাদুর্ভিক্ষের মাত্র তিন বৎসর পর ১৭৭২ খৃস্টাব্দে গভর্ণর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ইংল্যান্ডে কোম্পানী ডাইরেক্টরদের কাছে লিখিত এক পত্রে তাঁদেরকে জানান:
প্রদেশের (বাংলার) সমগ্র লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু এবং তাহার ফলস্বরূপ চাষের চরম অবনতি সত্ত্বেও ১৭৭১ খৃস্টাব্দে নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ খৃস্টাব্দের রাজস্ব অপেক্ষাও অধিক হইয়াছে। যে কোন লোকের পক্ষে ইহা মনে করা স্বাভাবিক যে, এইরূপ একটা ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে রাজস্ব অপেক্ষকৃত অল্প হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তাহা না হইবার কারণ এই যে, সকল শক্তি দিয়া রাজস্ব আদায় করা হইয়াছে।[২]
দুর্ভিক্ষের পূর্বে বাঙলাদেশের রাজস্ব ১৭৬৮ খৃস্টাব্দে ছিলো ১,৫২,০৪,৮৫৬ টাকা, কিন্তু দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ খৃস্টাব্দে প্রদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১,৫৭,২৬,৫৭৬ টাকায়।[৩] ইংরেজ বণিকদের ভূমি রাজস্ব নীতি কোন্ উদ্দেশ্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিলো এবং কতোখানি নির্মমভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অর্ধমৃত কৃষকদের থেকে বর্ধিতহারে রাজস্ব আদায় করে তা উপরোল্লিখিত রাজস্বের অংক থেকেই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে।
কিন্তু বর্ধিতহারে রাজস্ব আদায় সত্ত্বেও কোম্পানীর কর্মচারীদের ব্যক্তিগত আদায় এবং নানা নির্যাতনের ফলে রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভবপর হয়নি। প্রথমদিকের একশালা বন্দোবস্ত ব্যর্থ হওয়ার পর ১৭৭২ খৃস্টাব্দে তারা পাঁচশালা বন্দোবস্ত করে।[৪] কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ধাক্কায় সেই বন্দোবস্তও ব্যর্থ হয়। এইভাবে একশালা পাঁচশালা এবং পরে দশশালা বন্দোবস্ত কোম্পানীর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা নিশ্চিত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে ব্যর্থ হওয়ার পর গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস নোতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। নানা আলোচনা-পর্যালোচনার পর তিনি ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত এক নোতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে পেশ করেন এবং কোম্পানী কর্তৃক ১৭৯৩ খৃস্টাব্দে তা অনুমোদিত হয়। এই ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
পূর্ববর্তী ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদাররা ছিলো সরকারের এবং কোম্পানীর রাজস্ব আদায়কারী এজেন্ট। জমিতে তাদের কোন দখলীস্বত্ব ছিলো না। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদেরকে জমির মালিক ও স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এজেন্ট হিসেবে পূর্বে তারা স্বাধীন কৃষকদের থেকে রাজস্ব আদায় করতো। কিন্তু এরপর তারা অধীনস্থ প্রজাদের থেকে কর আদায়ের অধিকারী হলো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী স্থির হয় যে, জমিদাররা আদায়কৃত রাজস্বের নয়-দশমাংশ কোম্পানীর কাছে হস্তান্তরিত করবে। এই হিসাব মতো একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক জমিদারদের দেয় রূপে নির্দিষ্ট রাজস্ব কোম্পানীর ঘরে জমা দিলে বংশানুক্রমে জমিদাররা জমির স্বত্বাধিকারী থাকবেন এবং ভবিষ্যতে জমির মূল্য যাই হোক তাতে তাঁদের সাথে কোম্পানীর বন্দোবস্তের কোন পরিবর্তন হবে না। সে বন্দোবস্ত অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী।
এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের ভূমি ব্যবস্থার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন সূচিত হলো। পূর্বে যে জমির মালিক ছিলো কৃষি-কার্যরত খোদ কৃষক, সেই জমির মালিক এবার হলো পূর্ববর্তীকালের রাজস্ব আদায়কারী সরকারী এজেন্ট-জমিদার। এই মালিকানার ফলে জমিদাররা ইচ্ছেমতোভাবে জমি ক্রয়-বিক্রয়, বিলি-ব্যবস্থা সবকিছু করারই অধিকার লাভ করলো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে কোম্পানী দেশে কোন জরিপ করেনি। কাজেই যে সমস্ত জমি তখনো পর্যন্ত অনাবাদী ছিলো সেগুলো পর্যন্ত জমিদারদের দখলীভুক্ত হলো এবং এর ফলে তারা ভালো আবাদযোগ্য জমি থেকে শুরু করে অনেক সমৃদ্ধ বন অঞ্চলেরও মালিক হয়ে বসলো।
এই বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানী জমির ওপর তাদের দাবী চিরকালের মতো ছেড়ে দিলেও এরপর জমি থেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের মুনাফা তাদের নিশ্চিত হলো। একদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অংশীদারদের ক্রমবর্ধমান লভ্যাংশের দাবী এবং অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কৃষক বিদ্রোহ দমন এবং অন্যান্য যুদ্ধবিগ্রহের ব্যয় নির্বাহের জন্য কোম্পানীর প্রয়োজন, এ দুই মেটানোর ক্ষেত্রে কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেকাংশে কার্যকরী হয়। এই নোতুন রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে বাঙলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রাপ্য ভূমি-রাজস্ব নির্ধারিত হয় দুই কোটি আটষট্টি লক্ষ টাকা, অর্থাৎ চৌত্রিশ লক্ষ পাউন্ড। আর্থিক প্রয়োজনে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা নিশ্চিত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও এই বন্দোবস্তের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্রষ্টা লর্ড কর্ণওয়ালিস এবং অন্যান্য অনেক ইংরেজ শাসকরাও নিজেদের রিপোর্ট ও চিঠিপত্রে স্বীকার করেছেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু সৃষ্ট জমিদারদের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে লর্ড কর্ণওয়ালিস বলেন :
আমাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই (এদেশের) ভূস্বামীগণকে আমাদের সহযোগী করিয়া লইতে হইবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্ত মনে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করিতে পারে, তাহার কোনরূপ পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগিতেই পারে না।[৫]
গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে জমিদারদের ভূমিকা সম্পর্কে গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৯ খৃস্টাব্দে ঘোষণা করেন:
আমি এটা বলতে বাধ্য যে, ব্যাপক গণ-বিক্ষোভ অথবা গণ-বিপ্লব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে। অন্যান্য অনেক দিক দিয়ে, এমনকি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যর্থ হলেও, এর ফলে এমন এক বিপুলসংখ্যক ধনী ভূস্বামী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে যারা বৃটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে আগ্রহশীল এবং জনগণের ওপর যাদের অখণ্ড প্রভুত্ব বজায় আছে।[৬]
ভূস্বামীদের ব্যাপক গণ-বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে ইংরেজ শাসকদের এই দৃষ্টিভঙ্গী ভারতের ইংরেজ শাসনের কোন পর্যায়েই বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। সিপাহী বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহের সময় বাঙলাদেশের জমিদারদের ভূমিকা লক্ষ্য করে ১৮৬২ খৃস্টাব্দে বৃটেনের ভারত-সচিব ভারতবর্ষে তাঁদের প্রতিনিধিদের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু হইতে যে বহু প্রকারের রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায় সেই সম্বন্ধে মহারাণীর সরকার কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করে না। ভূসম্পত্তির উপর সুরক্ষিত ও একচ্ছত্র ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে ভূস্বামীগণের উপর রাষ্ট্রের দাবী চিরকালের জন্য সীমাবদ্ধ হয় বটে, কিন্তু ইহার ফলে যে শাসন-ব্যবস্থা ভূস্বামীদের এইরূপ বিরাট সুযোগ স্বেচ্ছায় দান করিয়াছে এবং যে শাসন-ব্যবস্থা স্থায়িত্বের উপর ঐ ভূস্বামীদের অস্তিত্ব নির্ভর করে, সেই শাসন-ব্যবস্থার প্রতি ভূস্বামীগণের অনুরক্তি ও আনুগত্যের মনোভাব জাগ্রত না হইয়া পারে না।[৭]
এ ঊনিশ শতকে ভারতীয় প্রতিক্রিয়ার অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকদের নিদারুণ বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করে মাঝে মাঝে কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করলেও ইংরেজসৃষ্ট সামন্ত স্বার্থের ধারক, বাহক ও সেবক হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বপক্ষে নিম্নলিখিত বক্তব্য হাজির করেন:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গ সমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ ইংরেজদিগকে দিই না। যেদিন ইংরেজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেই দিন সে পরামর্শ দিব।[৮]
ইংরেজের মঙ্গল এবং সমাজের মঙ্গলকে একই সূত্রে গেঁথে “ঋষি’ বঙ্কিমচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের পরিবর্তে জমিদারদেরকে লঘুভাবে শাসন করার জন্য বৃটিশ ভারতীয় সরকারকে পরামর্শ দিতে গিয়ে আরও বলেন:
যদি তাঁহারা কু-চরিত্র জমিদারগণকে শাসিত করিতে পারেন তবে দেশের যে মঙ্গল সিদ্ধ হইবে তজ্জন্য তাহাদিগের মাহাত্ম্য অনন্তকাল পর্যন্ত ইতিহাসে কীর্তিত হইবে এবং তাহাদিগের দেশ উচ্চতর সভ্যতার পদবীতে আরোহণ করিবে।[৯]
ভারতের গভর্ণর জেনারেল থাকাকালে লর্ড আরউইন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতির উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন যে, “জমির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইহার (অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত – ব.উ.) অর্থ রাষ্ট্রের পক্ষে একটা ত্যাগ।’[১০] এই ত্যাগ রাষ্ট্র কেন স্বীকার করতে বাধ্য ছিলো তার কারণ কর্ণওয়ালিস বেন্টিংক এবং ভারতে ইংরেজ শাসনের অন্যান্য কর্ণধারদের বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়। এদেশের গণতান্ত্রিক কর্মী এবং বিপ্লবীদের কাছেও এই কারণ সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিলো না। ইংরেজ শাসকরা এদেশে নিজেদের মিত্রশক্তি গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলো এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল তা বিফল হয়নি। ভারতে প্রত্যক্ষ ইংরেজ শাসন ও আধিপত্যের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদাররা বিশ্বস্ততার সাথে প্রভু সেবা করেছিলো। এই প্রভু সেবার উদাহরণ দিতে গিয়ে বাঙলাদেশের প্রখ্যাত সন্ত্রাসবাদী নেতা হেমচন্দ্ৰ কানুনগো বলেন:
এ কাজে (সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে) সরকারী ছোট-বড় কর্মচারীদের মধ্যে, এমনকি পুলিশের কাছেও বরং সাড়া পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু জমিদার শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে কম সাড়া পেয়েছি।[১১]
১৯২৫ খৃস্টাব্দে সারা ভারতব্যাপী গণ-আন্দোলনের মুখে বৃটিশ ভারত সরকারকে আশ্বাস দেওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গীয় জমিদার সঙ্ঘের সভাপতি গভর্ণর জেনারেলকে বলেন:
মহামান্য বড়লাট বাহাদুর! আপনি জমিদারগণের পূর্ণ সমর্থন ও বিশ্বস্ত সাহায্যের উপর নির্ভর করতে পারেন।[১২]
এরপর ১৯৩৫ খৃস্টাব্দের শাসনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব লাভের পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য জমিদার সঙ্ঘের তৎকালীন সভাপতি ময়মনসিংহের মহারাজা ঘোষণা করেন:
শ্রেণী হিসাবে আমাদের (ভূস্বামী শ্রেণীর) অস্তিত্ব বজায় রাখিতে হইলে ইংরেজ শাসনকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী করিয়া তোলা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।[১৩]
কাজেই ইংরেজ শাষক, জমিদার শ্রেণী এবং বিপ্লবের প্রতিনিধিরা সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, জমিদার শ্রেণী বিশ্বস্ততার সাথে ইংরেজ রাজত্বকে এদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের সমগ্র প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলো এবং ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণীটি শেষ দিন পর্যন্ত সেই ঔপনিবেশিক শাসকদের পদসেবা থেকে বিরত থাকেনি। কাজেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত হিসেবে ব্যর্থ হলেও সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে তার পূর্ণ সাফল্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
৪. বন্দোবস্তের পরবর্তী পর্যায়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অব্যবহিত পরেই দেখা গেল যে, জমিদারদের অধিকাংশই অপদার্থ। তারা নিজেদের এলাকায় কোন খোঁজ-খবর রাখতো না এবং অনেক সময় শহরে বসে নায়েব গোমস্তাদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে তা দু’হাতে খরচ করতো। এই খরচের এক কানাকড়িও জমির উন্নতি অথবা কৃষকদের জন্য ব্যয় হতো না। কাজেই জমির পরিচর্যার দায়িত্ব বন্দোবস্তের পরেও বস্তুতপক্ষে কৃষকদের হাতে পরিপূর্ণভাবে ন্যাস্ত ছিলো।
জমিদাররা কিন্তু আইনসঙ্গতভাবে নির্দিষ্ট কর কৃষকদের থেকে আদায় করেই ক্ষান্ত হতো না। তারা তাদের ওপর নিত্যনোতুন কর ধার্য করে যেতো এবং পাওনার দাবী উপস্থিত করতো। এই সব সম্পূর্ণভাবে বেআইনী পাওনা মেটাতে গিয়ে কৃষকরা উত্তরোত্তরভাবে গরীব ও নিঃস্ব হতো এবং সরকার তাদের এই দুরবস্তার হাত থেকে রক্ষা করার কোন ব্যবস্থাই করতো না। উপরন্তু সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তার জোরেই জমিদাররা কৃষকদের ওপর এইসব নির্যাতন চালিয়ে যেতো।
কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের মাত্রা মাঝে মাঝে এতো বেশী অতিক্রম করে যেতো যে, তার ফলে কৃষকরা স্থানে স্থানে বিদ্রোহ ঘোষণা করতো এবং স্থানীয় জমিদার ও সরকারের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। জমিদারদের নির্যাতনের ফলে কৃষক-শক্তির এই অভ্যুত্থান ইংরেজ সরকারকে বিপ্লবের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেকখানি সজাগ করে তুলতো এবং ব্যাপক ও বৃহত্তর কৃষক অভ্যুত্থান রোধ করার উদ্দেশ্যে তারা মাঝে মাঝে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দোষ-ত্রুটি নিয়ে নানা পর্যালোচনা এবং তার ভিত্তিতে সংস্কারের উদ্যোগও গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের হাতে যে ক্ষমতা ন্যাস্ত করেছিল তাকে কোন প্রকার সংস্কারের মাধ্যমেই খর্ব করা বৃটিশ-ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জমিদারদের স্বার্থের প্রতি মৌলিক পক্ষপাতিত্বই এই ব্যর্থতার কারণ।
একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমি বন্দোবস্ত হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একদিকে কৃষকদের পঙ্গু করে দিয়েছিল এবং অন্যদিকে ভূমি রাজস্ব খাতে রাষ্ট্রের আয়কে চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট করেছিল। এর ফলে ঊনিশ শতকে ও বিশ শতকে মূল্য বৃদ্ধির ফলে জমি থেকে অতিরিক্ত মুনাফার সমগ্র অংশই জমিদারদের পকেটস্থ হয়, তার দ্বারা কৃষক সমাজ অথবা রাষ্ট্র কেউই উপকৃত হয় না। ১৮৮০ খৃস্টাব্দের দিকে হিসেব করে দেখা গিয়েছিল যে, ভূমি রাজস্ব থেকে বাঙলাদেশের জমিদাররা লাভ করেছিলো দুই কোটি পাউন্ড কিন্তু সরকারের ঘরে জমা হচ্ছিল মাত্র চল্লিশ লক্ষ পাউন্ড। অর্থাৎ বস্তুতপক্ষে এই চল্লিশ লক্ষ পাউন্ড রাজস্ব আদায় করার জন্য সরকার সামগ্রিক ভূমি রাজস্ব থেকে ব্যয় করছিলো দুই কোটি পাউন্ড। [১৪]
এই অবস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং বৃটিশ-ভারতীয় সরকারেরই সৃষ্টি। কারণ ১৭৯৩ খৃস্টাব্দে জমিদারদের ভূম্যাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। এর পরবর্তী পর্যায়ে ইচ্ছামতোভাবে নানান কর ধার্যের অধিকারও তারা জমিদারদেরকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে করে দিয়েছিলো। অধ্যাপক রাধাকমল মুখার্জী ভারতের ভূমি সমস্যার ওপর লেখা একটি পুস্তকে এ সম্পর্কে বলেছেন যে, আধুনিক জমিদারী প্রথা গ্রাম্য সমাজের অধিকার এবং কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাকে ব্যবহার করেছিলো কৃষকদেরকে দমন করার কাজে।[১৫] এর একটা উদাহরণ হিসেবে তিনি বিক্রয় আইনের উল্লেখ করেছেন। এই আইন অনুযায়ী নিলামকৃত জমিতে নোতুন জমিদারদেরকে ইচ্ছামতোভাবে অতিরিক্ত কর বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। প্রথমদিকে এর আওতা কেবলমাত্র নিলামকৃত জমির ওপর সীমাবদ্ধ থাকলেও অতি সত্ত্বর সমস্ত জমিদাররাই তার সুযোগ নিয়ে এবং সরকারের থেকে এ ব্যাপারে কোন বাধা না পেয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে নিজেরাই জমির ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করে যেতে থাকে। রাষ্ট্রের আয় এবং জমিদারদের আয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান তারতম্যের এটাই হলো সর্বপ্রধান কারণ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী পর্যায়ের একটি প্রধান উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো বন্দোবস্তুসৃষ্ট জমিদার শ্রেণী ছাড়াও ধাপে ধাপে আরও অনেক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর জন্ম। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা মূল জমিদারের পক্ষ থেকে জমিদারী দেখা-শোনার ভারপ্রাপ্ত হতো এবং জমিদারদেরকে দেয় রাজস্ব এবং জমিদারদের থেকে তাদের পাওনা বাদ দিয়েও অতিরিক্ত আদায় দ্বারা নিজেদের উদরপূর্তি করতো। অপদার্থ জমিদাররা নিজেদের জমিদারীর কাজকর্ম তত্ত্বাবধানে অক্ষম হওয়ার জন্যই প্রধানত, এই শ্রেণীর নোতুন মধ্যস্বত্বভোগীরাই প্রায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ নির্দিষ্ট এলাকায় খাজনা আদায়ের নামে প্রজাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন জারী রাখতো। সমগ্র উনিশ শতক এবং বিশ শতকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাসে এই অতিরিক্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা উত্তরোত্তরভাবে বৃদ্ধি লাভ করে এদেশে নিয়মিতভাবে খাদ্যসংকট, দুর্ভিক্ষ, মহামারী সৃষ্টি করেছে এবং কৃষকদের জমি থেকে উত্তরোত্তর বর্ধিত হারে উচ্ছেদ করে তাদেরকে পরিণত করেছে ভূমিহীন কৃষক ও গ্রাম্য দিনমজুর শ্রেণীতে।
এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী সৃষ্টির একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ১৭৯৩ খৃস্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর অসংখ্য জমিদারীর হাত বদল। পরবর্তীকালে জমিদারীর মুনাফা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও প্রথমদিকে অর্থাৎ লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের ওপর দেয় রাজস্বের যে ভার চাপানো হয়েছিলো তৎকালীন অবস্থায় তা ছিলো অতিরিক্ত। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর অনেকদিন পর্যন্ত কৃষকদের খাজনা দেওয়ার ক্ষমতা পূর্বের থেকে কমে আসে। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় সরকার সেদিকে বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না রেখে জমিদারদের ওপর দেয় রাজস্বের এক গুরুভার চাপিয়ে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও এই রাজস্ব আদায় করা অনেক ক্ষেত্রে জমিদারদের পক্ষে সম্ভব হতো না এবং তার ফলে বন্দোবস্তের শর্ত অনুসারে সরকারের হাতে দেয় রাজস্ব পৌঁছে দিতে না পারার জন্য তাদের জমিদারী আংশিক অথবা পুরোপুরিভাবে নিলাম হয়ে যেতো। এই অবস্থায় অনেক জমিদার জমিদারী রক্ষার জন্য মহাজন ও বেনিয়াদের শরণাপন্ন হতো, কিন্তু এসব করেও শেষ পর্যন্ত জমিদারী রক্ষা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এই সমস্ত জমিদারী যারা পুরাতন জমিদারদের থেকে ক্রয় করতো তারা ছিলো মুৎসুদ্দী বেনিয়া, মহাজন এবং ব্যবসায়ী শ্রেণী। কাজেই ১৭৯৩ খৃস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় যে সমস্ত জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক নিজেদের জমিদারী রক্ষা করতে অক্ষম হওয়ার ফলে যে নোতুন জমিদাররা জমিদারী বন্দোবস্ত নেয় তারা ছিলো নোতুন শ্রেণীর মানুষ এবং তাদের মেজাজ এবং চরিত্রও ছিলো পূর্বের জমিদারদের থেকে স্বতন্ত্র। জমিদারী সংক্রান্ত কোন কিছুই এই নোতুন জমিদাররা বুঝতো না এবং নিজেদের জমিদারী দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাদেরকে অন্য শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করতে হতো। এই নির্ভরশীলতার ফলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাঠামোর মধ্যে পত্তনি নামে এক ধরনের নোতুন ভূমিস্বত্বের সৃষ্টি হয় এবং পত্তনিদার নামে এক নোতুন বংশানুক্রমিক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী জন্মলাভ করে।
এ সম্বন্ধে কার্ল মার্কস মন্তব্য করেন:
বংশপরম্পরায় ভোগদখল করা জমিজমা থেকে বঞ্চিত কৃষকদের ওপর অবাধ এবং অনিয়ন্ত্রিত শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েও মূল জমিদার শ্রেণী কোম্পানীর চাপে উৎখাত হয়ে গেল এবং তাদের স্থান দখল করলো শহরের চতুর ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। সরকারী ব্যবস্থায় ফিরে আসা জমিদারগুলি (অর্থাৎ সরকারী খাসমহলের জমিদারী – ব.উ.) ছাড়া বাঙলাদেশের প্রায় সমস্ত জমি এখন এই ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের আয়ত্তের মধ্যে আছে। এই ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা আবার পত্তনি নামে নোতুন এক ধরনের ভূমিস্বত্ব সৃষ্টি করেছে।[১৬]
৫. তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বাঙলার কৃষক সমাজের চিত্র
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৮৫০ খৃস্টাব্দে পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থার ওপর কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধগুলির ভাষা তৎকালীন হলেও ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে কৃষক জীবনের যে চিত্র সেগুলিতে পাওয়া যায় তার সাথে আমাদের সমসাময়িক কৃষক জীবনের চিত্রের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী পর্যায় বাঙলাদেশের কৃষকদের অবস্থা জমিদার, পত্তনিদার, সরকারী কর্মচারী প্রভৃতি উৎপীড়কদের নির্যাতনের ফলে কোন্ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল এই উদ্ধৃতিগুলি থেকেই তার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে।
বাঙলাদেশের ভূস্বামীরা ১৮৫০ খৃস্টাব্দে কিভাবে প্রজাপালন করতো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বলা হয় :
‘যে রক্ষক সেই ভক্ষক’ এ প্রবাদ বুঝি বাঙলার ভূস্বামীদিগের ব্যবস্থার দৃষ্টেই সূচিত হইয়া থাকিবে। ভূস্বামী স্বাধিকারে অধিষ্ঠান করিলে প্রজারা একদিনের নিমিত্তে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না; কি জানি কখন কি উৎপাত ঘটে ইহা ভাবিয়াই তাহারা সর্বদাই শংকিত। তিনি কি কেবল নির্দিষ্ট রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া পরিতৃপ্ত হয়েন? তিনি ছলে-বলে-কৌশলে তাহাদিগের যথাসর্বস্ব হরণে একাগ্রচিত্তে প্রতিজ্ঞারূঢ় থাকেন। তাহাদিগের দারিদ্র্যদশা, শীর্ণ-শরীর, ম্লান বদন, অতি মলিন চীর বসন, কিছুতেই তাঁহার পাষাণময় হৃদয় আর্দ্র করিতে পারে না, কিছুতেই তাঁহার কঠোর নেত্রের বারিবিন্দু বিনির্গত করিতে সমর্থ হয় না। তিনি ন্যায্য রাজস্ব ভিন্ন বাটা, যথাকালে অনাদায়ী রাজস্বে নিয়মাতিরিক্ত বৃদ্ধি, বাটার বৃদ্ধি, বৃদ্ধির বৃদ্ধি, আগমনি, পার্বনি, হিসাবানা প্রভৃতি অশেষ প্রকার উপলক্ষ্য করিয়া ক্রমাগতই প্রজা নিষ্পীড়ন করিতে থাকেন। অনেকানেক ভূস্বামী আনদায়ী ধনের চতুর্থাংশ বৃদ্ধি স্বরূপ গ্রহণ করেন। প্রতি শতে পঁচিশ টাকা করিয়া বৃদ্ধি। ইহার অপেক্ষা অনর্থমূলক ব্যাপার আর কি আছ? ইহাতে তাহাদের সর্বনাশের সূত্র সঞ্চার হয়,- তাহাদিগকে যাতনাযন্ত্রে পেষণ করা হয়। ভূস্বামীর ভবনে বিবাহ, আদ্যকৃত, দেবোত্সব বা প্রকারান্তর পূণ্য-ক্রিয়া ও উৎসব ব্যাপার উপস্থিত হইলে প্রজাদের অনর্থপাত উপস্থিত; তাহাদিগকেই ইহার সমুদয় বা অধিকাংশ ব্যয় সম্পন্ন করিতে হয়। ইহা মাঙ্গন বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে। তিনি মাঙ্গন অর্থাৎ ভিক্ষা উপলক্ষ্য করিয়া বলপূর্বক অপহরণ করেন, ভিক্ষুক নাম গ্রহণ করিয়া দস্যুবৃত্তি সাধন করেন। যে বৎসর দুই-তিনবার এইরূপ ভিক্ষা না হয়, সে বৎসরই নয়। রাজস্ব সংকলনের ন্যায় ইহাও নির্দিষ্ট প্রণালীক্রমে সংগৃহীত হয় এবং তৎপরিশোধে কিঞ্চিন্মাত্র ত্রুটি জন্মিলেও প্রজাদিগকে অতিশয় অনুচিত শাস্তি ভোগ করিতে হয়।[১৭]
অন্য একটি প্রবন্ধে পত্রিকাটি প্রজাপীড়নের আরও কয়েকটি দিক উল্লেখ করে:
বাঙলাদেশের অনেক ভূস্বামীরই এই প্রকার উপদ্রব এবং অনেক প্রজারই এই প্রকার যাতনা। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর জেলার কোন ভূস্বামী ও তাঁহাদের কর্মচারীদিগের চরিত্র শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হওয়া গেল। তাঁহারা প্রজাদের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি দূরে থাকুক, তাহাদিগের শরীরও আপনার অধিকারভুক্ত জ্ঞান করেন, এবং তদনুসারে তাহাদিগের কায়িক পরিশ্রমও আপনার ক্রীত বস্তু বোধ করিয়া তাহার উপর দাওয়া করেন। তাঁহাদের এই প্রকার অখণ্ড অনুমতি আছে, যে কোন মূল্যে বিনা বেতনে তাঁহারদিগকে গোপেরা দুগ্ধ দান করিবেক, মৎস্যোপজীবীরা মৎস্য প্রদান করিবেক, নাপিতে ক্ষৌর করিবেক, যান- বাহনে বহন করিবেক, চর্মকার চর্মপাদুকা প্রদান করিবেক, ইত্যাদি সকলেই স্ব স্ব উপজীব্যোচিত অনুষ্ঠান দ্বারা তাঁহারদিগের সেবা করিবেক। ক্রীতদাসকেও এরূপ দাসত্ব করিতে হয় না। সেও স্বীয় কার্যের বেতন স্বরূপ অন্নবস্ত্র প্রাপ্ত হয়। আর ইঁহারা স্বীয় অধিকারস্থ ব্যবসায়ীদিগের নিকট যাবতীয় বস্তু ক্রয় করেন, তাহারও উচিত মূল্য দান করেন না। ইঁহারা যে পণে দ্রব্য গ্রহণ করেন, তাহার নাম ‘সরকারী মূল্য’ – সে মূল্য সাধারণরূপে প্রচলিত হইলে বাণিজ্য ব্যবসায় উচ্ছিন্ন হইত।[১৮]
অনুপস্থিত জমিদারদের নায়েব গোমস্তাদের নির্যাতন সম্পর্কে পত্রিকাটিতে বলা হয়:
যে সকল ভূস্বামী আপনার অধিকারে অবস্থিতি করেন না, তাঁহারদের প্রজাদিগকেও কেহ যেন সুখীবোধ না করেন। তাহারদিগকে ভূস্বামীর ভয়ংকর ভ্রভঙ্গ ও রক্তাক্ত লোচন দৃষ্টি করিতে না হউক, কিন্তু তাঁহার নিয়োজিত ব্যাঘ্র-সম নিষ্ঠুর স্বভাব কর্মচারীদিগের কঠোর হস্তে সর্বদাই পতিত হইতে হয়। তাহাদের কর্ণকুহরে গোমস্তা ও নায়েব শব্দ বজ্র নির্ঘোষের ন্যায় ভয়ানক বোধ হয়।[১৯]
পুরাতন জমিদারদের পরিবর্তে যারা নোতুন জমিদার হলো তার অধিকাংশই ছিলো শহরবাসী বেনিয়া, দালাল, ব্যবসায়ী প্রভৃতি। শহরে বসবাস করার ফলে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে নিয়মিতভাবে তারা রাজস্ব আদায় করতে পারতো না। এই খাজনা আদায়ের প্রয়োজনেই তারা সৃষ্টি করে আর এক নোতুন মধ্যস্বত্বভোগী। এই নোতুন মধ্যস্বত্বভোগীকে সরকারও আইনসঙ্গত বলে স্বীকার করে নিলো এবং তারা জমিদারের মোট প্রাপ্যের ওপর নিজেদের অতিরিক্ত প্রাপ্য কৃষকদের থেকে আদায় করতে গিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে দিলো। এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্রের ভূমিকায় লিখেছেন:
জমিদারদের পরবর্তী স্তরে পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার, গাঁতিদার ইত্যাদি মধ্যস্বত্বভোগীরা ক্ষুদে জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হলেন। হেস্টিংসের আমলে ১৭৭২ সালে বড় বড় জমিদার ও জমিদারীর সংখ্যা একশতের খুব বেশী ছিল না। কিন্তু তারপর চিরস্থায়ীত্ব ও মধ্যস্বত্বের ফলে ১৮৭২ সালের মধ্যে জমিদারীর সংখ্যা বেড়ে দেড় লক্ষের বেশী হলো। এর মধ্যে ৫৩৩টি হলো বড় জমিদারী, ২০০০০ একরের উপরে, ১৫৭৪৭টি জমিদারী হলো ৫০০- ২০০০০ একরের মধ্যে এবং ৫০০ একর ও তার কম জমিদারীর সংখ্যা হল ১৩৭৯২০টি। এই ক্ষুদে জমিদারীর সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপাতের আধিক্য অনুমান করা যায়।[২০]
১৭৯৩ সালের অনেক আগে থেকেই বাঙলাদেশে ইজারাদারী ব্যবস্থা শুরু করে। কলকাতা গোবিন্দপুর সুতানুটির জমিদারী পাওয়ার পর কলকাতার মাঠ ঘাট খাল বিল পর্যন্ত তারা ইজারা দিতো। কাজেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু পূর্ব থেকেই ইংরেজরা ইজারাদারী ব্যবস্থাকে তাদের এক বছর পাঁচ বছর ইত্যাদি বিভিন্ন মেয়াদী ইজারারই পরিণতি বলা চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমলে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের সম্পর্কে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাতে বলা হয়:
তাহার (অর্থাৎ ইজরাদারের – ব.উ.) অতি প্রভূত লোভরূপ হুতাশন শিখা ভূস্বামীর অপেক্ষায় দীর্ঘ হওয়াই সম্ভাবিত। তিনি সেই লোভাগ্নির উপভোগ আহরণার্থে ভূস্বামী সংস্থাপিত নানা প্রকার নিষ্পীড়ন প্রণালীর কোনভাগই পরিত্যাগ করেন না, বরঞ্চ সর্ব্বপ্রযত্নে তাহার বৃদ্ধিরই চেষ্টা পায়েন। বিশেষতঃ প্রজারা ভূস্বামীর চিরন্তন ধন, তাহারা এককালে উচ্ছিন্ন না যায় ও অধিকার পরিত্যাগ না করে, তাহার এমত বাসনা অবশ্যই থাকিতে পারে। কিন্তু ইজারার নিরূপিত সময় অতীত হইলেই ইজারাদারের স্বত্ব লোপ হয়, সুতরাং প্রজাদের প্রতি তাঁহার স্নেহ সঞ্চারের সম্ভাবনা কি? নিঃশেষে ধন শোষণ করিতে পারিলেই তাঁহার মঙ্গল। বিশেষতঃ ভূস্বামী তাঁহার নিকট যাদৃশ নিষ্কর্ষণ করিয়া কর গ্রহণ করেন, তাহাতে তাঁহার লাভভাবের তাদৃশ সম্ভাবনা থাকে না। অতএব তিনি স্বীয় লাভ প্রত্যাশায় উপায়ান্তর চেষ্টা করেন, বিবিধপ্রকার কুটিল কৌশল কল্পনা করিতে থাকেন। প্রজার সর্বনাশই সেই সকল বিষম যন্ত্রণার একমাত্র তাৎপর্য! তাহারা ভূস্বামীকে যত রাজস্ব প্রদান করিত, ইজারাদারকে তদপেক্ষায় চতুর্থাংশ অধিক দিতে হইবেক। কল্য যে ভূম্যাধিকারের লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব ছিল, অদ্য তাহাতে আর পঞ্চবিংশতি সহস্র যুক্ত হইল! অতএব ইজারার নাম শুনিলে প্রজাদের হৃৎকম্প না হইবে কেন?
এক্ষণে যাহারদিগকে উপর্যুপরি জমিদার, পত্তনীদার, ইজারাদার, ও দরইজারাদার এই চারিপ্রভুর লোভনলে আহুতি দান করিতে হয়, তাহারা যে কি প্রকারে প্রাণ ধারণ করে, তাহা ভাবিয়া স্থির করা যায় না। তাহাদের দারুণ দুর্দ্দশা বাক্যপথের অতীত।[২১]
কিন্তু কৃষক ও প্রজাসাধারণের ওপর নির্যাতন শুধুমাত্র জমিদারী এবং ইজারাদারী প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। গ্রামাঞ্চলে প্রায় নৈরাজ্যিক অবস্থার মধ্যে সরকারী কর্মচারীরা সাধারণ কৃষক ও বিভিন্ন ধরনের গ্রাম্য কারিগরদের ওপর যে উৎপীড়ন ও শোষণ করতো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার চিত্রও অতি নিদারুণ:
দুঃখের আর অন্ত নাই, প্রজাপীড়নের প্রধান প্রধান অঙ্গের বিবরণ এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে। তাহার এক অঙ্গের নাম ফৌজদারী উপদ্রব।- এ নাম শ্রবণ মাত্র কোন্ ব্যক্তি না কম্পিত কলেবর হয়? পঞ্চম বর্ষীয় বালকও থানা ও দারোগার প্রসঙ্গ শুনিয়া সভয়ে মাতৃক্রোড়ে গিয়া নিলীন হয়! তদবধি কেমন প্রগাঢ় সংস্কার জমিয়া যায়, যে চিরজীবনই তাহারদিগকে ভূত প্রেত শ্মশানাদির ন্যায় ভয়ংকর বোধ হয়। পথিমধ্যে কোন প্রচণ্ডমূর্তী ফৌজদারী লোকের সহিত সহসা সাক্ষাৎ হওয়া কত ভয়ের বিষয়। ফলতঃ পল্লীগ্রামস্থ ইতর লোকদিগের পক্ষে এ সংস্কার অমূলক নহে, দারোগা ও তৎসংক্রান্ত কর্মচারীদের প্রসিদ্ধ দুর্ব্যবহার স্মরণ করিলে হৃদয়ের শোণিত শুষ্ক হইতে থাকে। চৌর্য, দস্যুবৃত্তি, তদনুরূপ কোন ব্যাপারের অনুসন্ধান পাইলে তিনি স্বসম্প্রদায় সমভিব্যাহারে গ্রাম মধ্যে সমাগমপূর্বক অশেষ প্রকার অত্যাচার আরম্ভ করেন। … দারোগার দীর্ঘোদর পূরণার্থে কিছু কিছু অন্নদান না করিলে তাহারদিগের কোনক্রমেই নিষ্কৃতি নাই। তিনি এইরূপ যত পারেন, সংগ্রহ করিয়া পরিশেষে দস্যু বা সন্ধিচোর যে গৃহস্থের সর্বনাশ করিয়াছে, তাহার উপর সর্বপ্রযত্নে আক্রমণ করেন এবং তাহার যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহারও কিঞ্চিৎ ভাগ গ্রহণপূর্বক প্রীতমনে প্রস্থান করেন। তাঁহার অধিকারে নরহত্যা হইলে তাঁহার পরাক্রম চতুর্গুণ বৃদ্ধি হয়। গ্রামস্থ লোকে ফৌজদারীর প্রকাণ্ড কান্তভয়ে যে বিষয়ে জাপ্য রাখিবার যত যত্ন করে, তাঁহার লোভ রিপু তত প্রবল হইয়া তাহার চরিতার্থতা সাধনের চেষ্টাও তদনুরূপ বৃদ্ধি হয়। এই তাঁহার উদ্দেশ্য এবং ইহাই তাঁহার কার্য্য।[২২]
ওপরে যে বিভিন্ন প্রকার কৃষক নির্যাতনের চিত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে দেওয়া গেলো তার থেকে একথা অনেকের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তৎকালীন শাসনযন্ত্রের সর্বত্রই নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা বিরাজ করতো এবং ইংরেজ শাসকরা কোন রাজকার্যই সুশৃঙ্খলভাবে সমাধা করতে সক্ষম হতো না। কিন্তু এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল তা তত্ত্ববোধিনীর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হবে:
যে দেশে রাজা ও রাজ-নিয়ম আছে এবং যে স্থানের প্রজারা বহু বেতন-ভুক্ উত্তমোত্তম রাজ-কর্মচারী নিয়োগের উপযোগী যথেষ্ট কর প্রদান করে, সে দেশ যে এমত অশাসিত থাকে এবং তত্রত্য লোকের ধন, মান, প্রাণাদি কিছুই যে স্বায়ত্ত নহে, ইহাতে তথাকার রাজ-কার্য্যেরই ত্রুটি স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু পাঠকবর্গ যেন এমন মনে না করেন, যে আমাদের রাজপুরুষদিগের সমুদয় কার্যই এইরূপ বিশৃঙ্খল। যে বিষয়ে তাঁহারদিগের স্বার্থ আছে, তাহাতে যত্ন, পরিশ্রম ও উৎসাহের কিছুমাত্র অল্পতা দেখা যায় না, – বোধহয় তাঁহারা আত্মলাভার্থে প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া অতি দুষ্কর কর্ম্মও সম্পন্ন করিতে পারেন। স্বার্থ সাধনে প্রবৃত্ত হইলে তাঁহারদের মনের প্রভাব বৃদ্ধি হয় এবং অঙ্গসকল দ্বিগুণ বল ধারণ করে। রাজস্ব সংগ্রহার্থে কি অপূর্ব কৌশল, কি পরিপাটী নিয়ম, কি অদ্ভুত নৈপুণ্যই প্ৰকাশ করিয়াছেন।[২৩]
জমিদার, ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি রংবেরং এর মধ্যস্বত্বভোগী শোষকরা কৃষকদের ওপর যত প্রকার নির্যাতন চালাতো তার নিম্নলিখিত তালিকা তত্ত্ববোধিনীতে সংযোজিত হয়েছে:
১। দণ্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত ২। চর্মপাদুকা প্রহার ৩। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বক্ষস্থল দলন ৪। খাপড়া দিয়ে নাসিকা-কৰ্ণ মর্দন ৫। মাটিতে নাসিকা ঘর্ষণ ৬। পিঠে হাত বেঁকিয়ে বেঁধে বংশদণ্ড দিয়ে মোড়া দেওয়া ৭। গায়ে বিছুটি দেওয়া ৮। হাত-পা নিগড়বদ্ধ করা ৯। কান ধরে দৌড় করানো ১০। ফাটা দু’খানা বাঁধা বাখারি দিয়ে হাত দলন করা ১১। গ্রীষ্মকালে ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে পা ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে, পিঠ বেঁকিয়ে পিঠের ওপর ও হাতের উপর ইট চাপিয়ে রাখা ১২। প্রচণ্ড শীতে জলমগ্ন করা ও গায়ে জল নিক্ষেপ করা ১৩। গোণীবদ্ধ করে জলমগ্ন করা ১৪। বৃক্ষে বা অন্যত্র বেঁধে লম্বা করা ১৫। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা।[১৬। চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা ১৭। কারারুদ্ধ করে উপোস রাখা ১৮। গৃহবন্দী করে লংকামরীচের ধোঁয়া দেওয়া! ২৪
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে ১৮৫০ সালের বাঙলাদেশের কৃষক সমাজের অবস্থার বর্ণনাকে উদ্ধৃতিসহকারে দেওয়ার উদ্দেশ্য তৎকালীন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ঊনিশ শতকীয় কৃষকজীবনের যে চিত্র পত্রিকাটিতে অংকিত হয়েছে তা সরাসরিভাবে তুলে ধরা। কৃষকদের অবস্থার সম্পর্কে কোন বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এই পত্রিকাতে না থাকলেও গ্রাম্য সমাজের চিত্রকে সততার সাথে বর্ণনার ক্ষেত্রে এই পত্রিকার স্থান ঊনিশ শতকে অদ্বিতীয়। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বিনয় ঘোষ মন্তব্য করেছেন:
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা শহরের পত্রিকা এবং শহুরে মধ্যবিত্তরাই পত্রিকার পরিচালক। কিন্তু তৎসত্ত্বেও অর্থনীতিক ও সামাজিক সমস্যা-বিচারে তত্ত্ববোধিনীর দৃষ্টি গ্রামাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরের প্রতি কখনও নিবদ্ধ হয়নি। যখনই অর্থনীতিক সুখ-সমৃদ্ধি ও অভাব- অনটনের কথা পত্রিকায় আলোচিত হয়েছে, তখনই জৌলুস অথবা শহর-নগরের দৃশ্যমান সমৃদ্ধিকে কখনও সে সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতি বলে ভুল করেনি।[২৫]
এই বিশেষ বক্তব্যের স্বপক্ষে নীচে তত্ত্ববোধিনী থেকে আর একটি অংশ উদ্ধৃত করা হলো: যাহারা কেবল কলিকাতাস্থ ও কতিপয় অন্য নগরস্থ কতকগুলি বিশেষ বিশেষ লোকের সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করিয়া বঙ্গদেশের শুভাশুভের বিষয়ে আলোচনা করে, যাহারা কেবল নগর মধ্যে সর্ব্বদা কতিপয় সধন-লোকের সহিত একত্রিত হইয়া কথোপকথন করে এবং যে সমস্ত লোক আধুনিক নব্যসম্প্রদায়ীদিগকে ইংরেজদিগের বেশভূষা ও আচার ব্যবহারের অনুকরণ করিতে দেখিয়া মহানন্দে আনন্দিত হয়, তাহারাই বলে যে অধুনা বঙ্গদেশের বিশেষ উন্নতি হইয়াছে, কিন্তু যে সমস্ত লোক বঙ্গদেশের অন্তর্বর্ত্তী সমস্ত পল্লীগ্রামস্থ মনুষ্যের অবস্থা অনুসন্ধান করিয়া দেখে এবং যাহারা মধ্যে মধ্যে তাহাদিগের সহিত কথোপকথন করিয়া নানা প্রকার দুঃখের বার্তা শ্রবণ করে, তাহারা আর কখনই বলিতে পারে না যে এক্ষণে বঙ্গরাজ্যের বিশেষ দুর্দ্দশা ভিন্ন কোন অংশে ইহার উন্নতি হইয়াছে। যদি চিরাধীনত্বকে সম্পদ বলিয়া গণনা করা সঙ্গত হয়, যদি অনশনাবস্থায় দিনযাপন করাকে উন্নতির লক্ষণ বলিয়া গ্রহণ করা উচিত হয় এবং যদি মুমূর্ষু অবস্থাকে সম্পদের সময় বলিয়া মনে করা বিধেয় হয়, তাহা হইলে বর্তমান বঙ্গবাসী লোককেও সুখী ও সম্পদশালী বলিয়া মনে করিতে পারা যায়।
অধুনা কলিকাতা প্রভৃতি কোন কোন প্রকাশ্য স্থানস্থ কতিপয় ব্যক্তি যেমন উৎকৃষ্ট অট্টালিকায় বাস করিয়া উত্তমোত্তম উপাদেয় দ্রব্য ভক্ষণ করিয়া এবং সুচারু পরিচ্ছদ ধারণ ও সুন্দর যানবাহনে আরোহণ করিয়া কিঞ্চিৎ সুখী হইয়াছে, সেইরূপ পল্লী গ্রামের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি অন্নাচ্ছাদনাভাবে বিজাতীয় যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে। কোন সামান্য জলাশয়ের মধ্যে কুম্ভীরাদি ভীষণ জলজন্তু প্রবিষ্ট হইলে তত্রস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীবর্গের যেমন অবস্থা হইয়া থাকে বঙ্গদেশবাসী দুৰ্ব্বল মনুষ্যদিগেরও এক্ষণে তদ্রূপ দশা উপস্থিত হইয়াছে।[২৬]
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙলাদেশের যে চিত্র ফুটে ওঠে তার সাথে ১৯৭০ সালের পূর্ব বাঙলার বর্তমান অবস্থার কি আশ্চর্য সাদৃশ্য! আজও ঢাকা এবং অন্যান্য শহরবাসী কতিপয় ব্যক্তি ‘উৎকৃষ্ট অট্টালিকায় বাস করিয়া উত্তমোত্তম উপাদেয় দ্রব্য ভক্ষণ করিয়া এবং সুচারু পরিচ্ছদ ধারণ ও সুন্দর যানবাহনে আরোহণ করিয়া কিঞ্চিৎ সুখী হইয়াছে’ এবং ‘পল্লী গ্রামের মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি উপযুক্ত অনুচ্ছাদনাভাবে বিজাতীয় যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে।’ ‘কোন সামান্য জলাশয়ের মধ্যে কুম্ভীরাদি ভীষণ জলজন্তু প্রবিষ্ট হইলে তত্রস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীবর্গের যেমন অবস্থা হইয়া থাকে বঙ্গদেশবাসী দুৰ্ব্বল মনুষ্যদিগেরও এক্ষণে তদ্রূপ দশা উপস্থিত হইয়াছে’ –এই বক্তব্য ১৮৫০ এর বাঙলাদেশের মতো ১৯৭০ এর পূর্ব বাঙলার ক্ষেত্রেও আজ সমানভাবেই প্রযোজ্য।
৬. বৃটিশ-ভারতীয় সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা
বৃটিশ-ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ অন্যান্য ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কার্ল মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটালের’ তৃতীয় খণ্ডে বলেন:
অন্যান্য যে কোন জাতির ইতিহাসের মধ্যে একমাত্র ভারতের বৃটিশ শাসনের ইতিহাসই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ক্রমাগত নিষ্ফল ও গাঁজাখোরী (এবং কার্যক্ষেত্রে শয়তানী) পরীক্ষা নিরীক্ষার ইতিহাস। বাঙলাদেশে তাঁরা ব্যাপকভাবে ইংল্যান্ডের ভূমিব্যবস্থার এক প্রহসন সৃষ্টি করেন; দক্ষিণ ভারতে ক্ষুদ্রাকার ভূমির বণ্টননীতির হাস্যকর বিকৃতি ঘটান; এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জমির ওপর যৌথ-অধিকারমূলক গ্রামসমাজকে রূপান্তরিত করেন তার নিজেরই এক ব্যঙ্গ চিত্রে।[২৭]
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যর্থতা বৃটিশ-ভারতীয় সরকারের দ্বারাও ঊনিশ ও বিশ শতকের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বীকৃত হয়। ১৮১৯ খৃস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টররা’ বলেন:
এ বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ না করে আমরা পারছি না যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যাদের সাথে হয় তাদেরকে সত্যিকার ভূস্বামী হিসেবে ধরে নেওয়ার ফলেই অন্যান্যদের অধিকার ও স্বার্থ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ভুল (যা এখন সেই হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে), এবং তার থেকে উদ্ভূত অভ্যাসের বলে রায়তদের দেওয়া রাজস্বকে হিসাবের মধ্যে বিবেচনা না করে তাকে খাজনা হিসেবে বিবেচনা করার ফলেই তার থেকে অন্যান্য যে সমস্ত কুফল প্রত্যাশা করা যেতে পারতো তার উৎপত্তি হয়েছে … এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে শব্দের ভুল প্রয়োগ এবং রায়তদের থেকে পাওনার দাবীকে সঠিকভাবে ‘রাজস্ব’ শব্দ দ্বারা বর্ণনা না করে তার পরিবর্তে ‘খাজনা’ শব্দ ব্যবহারই ভূমিব্যবস্থার সমগ্র বিষয়টির মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং তার ফলে রায়তদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত ও বিনষ্ট হয়েছে।[২৮]
১৮৩১-৩২ খৃস্টাব্দে ‘সিলেক্ট কমিটি’ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:
বাঙলাদেশে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্তকৃত জেলাগুলিতে কোন বন্দোবস্তই নেই এবং সরাসরিভাবে নির্ধারিত রাজস্বের পরিমাণ ব্যতীত সেখানকার সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় ভুলবশতঃ ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের অধিকার ব্যবহারিক নিয়মকানুনের দ্বারা এমন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো যে তার ওপর ভিত্তি করেই আদালতের পক্ষে ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণ সম্ভব হতো। এটাকেই উপরোক্ত ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। এছাড়া আরও একটা বড়ো কারণ হলো জমিদারদের বংশানুক্রমিক ভূস্বামী হিসেবে ঘোষণার ব্যবস্থা।[২৯]
১৮৭২ খৃস্টাব্দে বৃটিশ-ভারতীয় সরকারের একটি রিপোর্টে বলা হয়:
আধুনিক একজন জমিদার পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের প্রত্যেকটি বেহিসেবী খরচ অথবা প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে তার রায়তদের ওপর খাজনা ধার্য করে।[৩০]
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়ত ও জমিদারদের সম্পর্ক উত্তরোত্তরভাবে তিক্ত হয়ে ওঠে এবং জমিদারদের উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে রায়তরা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আঠারো শতকের শেষভাগ এবং সারা ঊনিশ শতক ব্যাপী ভারতের ইতিহাসে এই ধরনের অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের স্থান উল্লেখযোগ্য। বস্তুতপক্ষে এই দীর্ঘকালব্যাপী বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মর্মবস্তুই হলো কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ এবং জমির ওপর তাদের স্বত্ব পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।
এই কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সুপ্রকাশ রায় তাঁর ‘ভারতের কৃষক- বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ নামক পুস্তকে বলেছেন:
বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের কৃষক বিদ্রোহগুলি প্রথমে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে আরম্ভ হইলেও তাহা ক্রমশঃ সংগঠিত ও সঙ্ঘবদ্ধরূপ গ্রহণ করিয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, কোন কোনটি এমনকি সমগ্র দেশময় বিস্তারলাভ করিয়াছিল।[৩১]
ইংরেজশাসন প্রাচীন ভারতের গ্রাম-সমাজের অচলায়তন ভাঙিয়া কৃষকদিগকে বাহিরে আনিয়া তাহাদিগকে অভূতপূর্ব শোষণ উৎপীড়নের শিকারে পরিণত করিলে তাহারা প্রথমে দিশেহারা হইয়া ইস্তস্তত বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছিল। ইহার পর অল্পকালের মধ্যেই আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসেবে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ও সংগঠিতভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করে।[৩১]
একদিকে জমিদারদের অকর্মণ্যতা এবং মাত্রাতিরিক্ত শোষণ (যে শোষণের কোন লভ্যাংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী বৃটিশ-ভারতীয় সরকারের প্রাপ্য ছিলো না।) এবং অন্যদিকে ক্রমাগত সঙ্ঘবদ্ধ ও সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ এই দুইয়ের হাত থেকে রক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বৃটিশ-ভারতীয় সরকার ১৮৫৯ এবং ১৮৮৫ খৃস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার সাধনের চেষ্টা করে।
এই দুই সংস্কারমূলক আইন অনুযায়ী দখলীস্বত্ব এবং অ-দখলী স্বত্বের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। দখলীস্বত্ব পাওয়ার জন্যে একটা জমি ক্রমাগত বারো বৎসর দখলের মধ্যে রাখতে হবে এবং বারো বৎসর পর এই দখলী স্বত্বের ফলে কোন জমিদার ইচ্ছেমতোভাবে খাজনাবৃদ্ধি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে খাজনা বৃদ্ধি করতে হলে নির্ধারিত নিয়ম ও রীতি অনুযায়ীই করতে হবে। এছাড়া খাজনা সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসার একটা ব্যবস্থাও তাতে থাকে। পাট্টা এবং রশিদ প্রদানের কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে তা পুরোপুরিভাবে নিষ্ফল হয়।
এই দুই প্রজাস্বত্ব আইন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৯০২ খৃস্টাব্দে বৃটিশ ভারতীয় সকারের গভর্ণর জেনারেল কাউন্সিল এক প্রস্তাবে বললেন:
পূর্ববর্তী শতকে বৃটিশ সরকার যে ভূস্বামীদেরকে একটা শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের প্রজাবর্গ বাঙলাদেশের কৃষকদের সম্পর্কে একথা বলার যুক্তি আরও কম যে তাদের অবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবন্তের ফলে ভয়ানক আরামদায়ক ও সমৃদ্ধ হয়েছে। বরং আসল ব্যাপার অন্যরকম ছিলো বলে এবং জমিদারদের থেকে ভাল ব্যবহারের পরিবর্তে জমিদারদের দ্বারা তারা খাজনা জর্জরিত, দারিদ্রক্লিষ্ট এবং নির্যাতিত হওয়ার ফলেই ভারত সরকার বাধ্য হয়ে তাদের পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন এবং ১৮৫৯ খৃস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে ১৮৮৫ খৃস্টাব্দের আইন পর্যন্ত একের পর এক আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে তার জীবনে এনেছিলেন অধিকতর নিরাপত্তা যা সে এখনো ভোগ করছে।[৩২]
উপরোক্ত প্রস্তাবে আরো বলা হয়:
মোটকথা রায়তরা বাঙলাদেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করেনি; সেটা তারা লাভ করেছে এর অবাধ স্বাধীনতা ও অপব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সর্ব্বোচ্চ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে।[৩৩]
কিন্তু ১৯০২ সালের গভর্ণর জেনারেলের কাউন্সিলের এই সীমাবদ্ধ দাবী সত্ত্বেও একথা সত্য যে ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইন কৃষকদের দুই প্রধান সমস্যা জমিদার কর্তৃক ইচ্ছেমতো খাজনা বৃদ্ধি এবং জমি থেকে উচ্ছেদের হাত থেকে তাদেরকে বিন্দুমাত্র রক্ষা করতে সমর্থ হয়নি।
১৯২১ | ১৯৩১ | |
জমিদার এবং খাজনাভোগী | ৩৯০,৫৬২ | ৬৩৩,৮৩৪ |
কৃষিকর্মরত ভূমি মালিক এবং প্রজা | ৯,২৭৪,৯২৪ | ৬,০৭৯,৭১৭ |
কৃষি শ্রমিক | ১,৮০৫,৫০২ | ২,৭১৮,৯৩৯ |
৭. বিশ শতকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
সেন্সাস কমিশনার স্যার টমাস মনরোর মতে ১৮৪২ সালে ভারতে কোন ভূমিহীন কৃষক ছিলো না। ১৮৭২ সালে অর্থাৎ এর মাত্র তিরিশ বছর পর ভারতে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫ লক্ষ। এদের সংখ্যা এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে এবং ১৯৩১ সালের সেন্সাস অনুসারে দেখা যায় যে বাঙলাদেশের কৃষিকার্যরত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা তিরিশ ভাগই ভূমিহীন।[৩৪] জমিদার, কৃষিকার্যরত ভূমিমালিক ও কৃষি শ্রমিকদের নিম্নলিখিত একটা হিসাবে ১৯৩১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে[৩৫] পাওয়া যায় :
উপরের এই সংখ্যাগুলি থেকে স্পষ্টই দেখা যায় যে, ১৯২১ থেকে ১৯৩১ এই দশ বৎসরের মধ্যে জমিদার এবং খাজনাভোগী শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২৪৩, ২৭২ অর্থাৎ প্রায় ৬২% গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অনুপাতে কৃষিকার্যরত ভূমিমালিক ও প্রজাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে এবং কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা অনেকখানি বৃদ্ধি লাভ করেছে।
১৯২১ এবং ১৯৩১ সালের সেন্সাসের মধ্যে বিভক্তিকরণের কতকগুলি তারতম্যের ফলে ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা কিছু কম করে দেখানো হলেও বস্তুতঃপক্ষে তৎকালীন বাঙলাদেশের ভূমিহীনদের সংখ্যা ৩০%-এর বেশীই ছিলো। এ সম্পর্কে বাঙলা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ভূমিরাজস্ব কমিশনের (ফ্লাউড কমিশন) কাছে প্রদত্ত একটি স্মারকলিপিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার পক্ষ থেকে বলা হয়:
সেন্সাসে (অর্থাৎ ১৯৩১ সালের সেন্সাসে – ব. উ.) অনুসৃত কৃত্রিম সংজ্ঞাটি (অর্থাৎ কৃষকদের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করার সংজ্ঞা – ব. উ.) খুবই দুঃখজনক কারণ কৃষকরা কি পরিমাণে জমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে এর ফলে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। যে বর্গাদার জমির ওপর কোন অধিকার ব্যতীত কেবলমাত্র মৌখিক ও বাৎসরিক ইজারার ভিত্তিতে জমিতে চাষ আবাদ করে তাকে জমি থেকে বিতাড়িত বলেই ধরে নিতে হবে। বাঙলাদেশে কি অনুপাত জমি এখন বর্গাদারদের মাধ্যমে চাষ আবাদ করা হয় সেটা বলা অসম্ভব কিন্তু গ্রামবাঙলা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান আছে এ রকম যে কোন লোকের কাছে একথা স্পষ্ট যে, এ ধরনের তথাকথিত ‘জমি বন্দোবস্তের’ সংখ্যা অদ্ভুত দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমানে, অন্ততঃপক্ষে কোন কোন জায়গায়, এক-তৃতীয়াংশ জমি পর্যন্ত এইভাবেই আবাদ হচ্ছে।[৩৬]
১৮৮৪ সাল থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত জমি হস্তান্তর দলিলের সংখ্যা এবং তার পরিণতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক রাধাকমল মুখার্জী লিখেছেন :
রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে দখলী জমি হস্তান্তরের সংখ্যা ১৮৮৪ সালের ৪৩,০০০ থেকে ১৯১৩ সালে দাঁড়ায় ১৫ লক্ষে (এবং তার পর থেকে নিঃসন্দেহে উত্তরোত্তরভাবে আরও বেড়ে চলেছে)। এর অর্থ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক শ্রেণীর চাষীরা বিক্রীত হয়ে জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে এবং ভূমিহীন সর্বহারার দলকেই নিশ্চিতভাবে স্ফীত করছে। এই শ্রমিকেরা অবশ্য কল, কারখানা এবং বাঙলাদেশের বাগানগুলিতে যায় না, সেগুলি প্রধানতঃ উত্তর প্রদেশীয় শ্রমিকদের দ্বারাই ভর্তি থাকে। তারা হয় অধস্তন-রায়ত অথবা ভাড়াটে কৃষিমজুর ও ভাগচাষী হিসেবে কাজ করে। প্রথম শ্রেণীভুক্তরা (অর্থাৎ অধস্তন রায়তরা ব. উ.) মহাজনদের হাতে চলে যাওয়া তাদের নিজেদের জমির ওপরই উচ্চহারে খাজনা দিয়ে চাষাবাদ করে এবং এই কারণেই ক্রমবর্ধমানভাবে দেখা দেয় অনুপযুক্ত আবাদ ও দারিদ্র্য।[৩৭]
বর্ধিতহারে যে সমস্ত কৃষকেরা ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছিলো তারা যদি কলকারখানায় কাজ পেতো তাহলে তাদের অবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক জীবন তেমন ঘোরতর আকার ধারণ করতো না। এ ধরনের কাজের অভাব যে উত্তর প্রদেশীয় শ্রমিকদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিলো তা নয়। এর আসল কারণ বাঙলাদেশে এবং সারা ভারতে ইংরেজ রাজত্বকালে শিল্পোন্নয়নের অভাব। শিল্প যদি ঊনিশ এবং বিশেষতঃ বিশশতকে উপযুক্তভাবে অগ্রগতি লাভ করতো তাহলে অবস্থা এতো শোচনীয় না হয়ে ভূমিহীন কৃষকদের শ্রম শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়োজিত হতো এবং তার ফলে একদিকে তাদের জীবিকার সংস্থান এবং অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা উন্নত হতো। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সে সম্ভাবনাকেও ভয়ানকভাবে রোধ করে। এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলিত হয় তাতে একদিকে জমিদারদেরকে সর্বপ্রকার নোতুন কর থেকে চিরতরে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং অন্যদিকে তাদেরকে অবাধ সুযোগ সুবিধা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অধিকার পর্যন্ত দেওয়া হয় ইচ্ছেমতো কৃষকদের ওপর কর বৃদ্ধি করার। এই অপদার্থ বেকার- জমিদাররা ভূমি থেকে উদ্বৃত্ত যাবতীয় মুনাফা নিজেদের প্রয়োজন ও ভোগবিলাস মেটানোর জন্যে খরচা করে যায় এবং তার ফলে সেই উদ্বৃত্ত জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক ও বিস্তৃত বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতেই সহায়তা করে।
শুধু এইভাবেই নয়, শিল্পক্ষেত্রে নোতুন উদ্যমকে ব্যাহত করে সেখানেও বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ ভারতীয় সরকার শিল্পকার্য থেকে প্রাপ্য মুনাফার ওপর আয়কর ধার্য করলেও কৃষি এবং জমিদারী থেকে প্রাপ্য মুনাফার ওপর তারা সে ধরনের কোন আয়কর নির্ধারণ করে না। এর ফলে বাঙলাদেশের ধনীদের হাতে যে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ ছিলো সেটা তারা জমিদারী ক্রয় এবং ভূমিস্বত্বের মালিক হওয়ার জন্যেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যয় করে। কারণ এই ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করলে নিশ্চিতভাবে এবং নিরুপদ্রবে মুনাফা ভোগ করা যেতো এবং সে মুনাফার অংকও শিল্প মুনাফার তুলনায় হয়তো অনেক বেশী। এই কারণে যাদের হাতে কিছু পরিমাণ বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি জমা হতো তাদের মধ্যে বিপুল অধিকাংশই সেটা জমিজমা এবং জমিদারী স্বত্ব ক্রয়ের জন্যে নিয়োগ করতো। শিল্পক্ষেত্রে বাঙালী মধ্যবিত্তের উৎসাহের অভাব সম্পর্কে বিনয় ঘোষ তাঁর সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র পুস্তকে লিখেছেন :
এই নুতন ধনিক শ্রেণীর (অর্থাৎ মার্কস বর্ণিত ‘শহুরে পুঁজিপতি’ বেনিয়ান মুৎসুদ্দী দালাল ব্যবসায়ী প্রভৃতি – ব.উ.) কাছে জমিদারী ও বাণিজ্যপণ্যের মতো লেনদেনের স্পেকুলেশনের ও মুনাফার বস্তু হয়ে উঠল। বস্তুতঃ কর্ণওয়ালিসেরও উদ্দেশ্য ছিল তাই। এদেশের নূতন ধনিক শ্রেণীর সঞ্চিত ধনের একটা গতি করা প্রয়োজন। জমিদারীতে নিরাপদ আয় এবং অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করে কর্ণওয়ালিস এদেশের নূতন বাণিজ্যলব্ধ মূলধনকে স্বাধীন শিল্পায়নের ক্ষেত্র থেকে সনাতন ভূসম্পত্তির দিকে পরিচালিত করেছিলেন।[৩৮]
এই উদ্দেশ্যে ৬ই মার্চ ১৭৯৩ তারিখে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ডিরেক্টরদের কাছে প্রেরিত একটি পত্রে কর্ণওয়ালিস তাঁদেরকে জানান:
ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণা করার সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে সেটাকে তারা অন্য কোনভাবে নিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে।[৩৯] কর্ণওয়ালিসের এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি।
বাঙলাদেশে প্রতি একরে জমিদাররা সরকারকে খাজনা দিতো দশ আনা আট পয়সা, কিন্তু জকিদাররা বেআইনী আদায় বাদ দিয়ে আইনমতো কৃষকদের থেকে আদায় করতো একর প্রতি তিন টাকা অর্থাৎ সরকারকে যা দিতো তার পাঁচ গুণ।[৪০]
এ সম্পর্কে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার স্মারকলিপিতে বলা হয়:
বাঙলাদেশের জমিদাররা কৃষিজাত আয়ের ওপর আয়কর থেকে মুক্ত। বাঙলাদেশের রাজস্ব জমিদার ছাড়া অন্য শ্রেণীদের থেকে আয়করের মাধ্যমে সংগৃহীত রাজস্বের অর্ধেক। অথচ বোম্বাই প্রদেশে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ আয়কর থেকে প্রাপ্ত অংকের দ্বিগুণ। এর অর্থ শিল্প, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাপ্ত আয়ের ওপর কর জমি থেকে আয়ের ওপর করের অপেক্ষা অন্যায়ভাবে বেশী ধার্য করা হচ্ছে। করভারের এই অসম বিতরণ দেশের শিল্পায়নের বাধা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিতে পুঁজি নিয়োগ করে মোটামুটি করমুক্ত একটা আয় নিশ্চিত হবে একথা যদি কেউ জানে তাহলে সে শিল্প প্রচেষ্টার মতো আপেক্ষিকভাবে বিপদসংকুল একটা এলাকায় সাধারণতঃ তার জমা টাকা নিয়োগ করতে চায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শিল্পক্ষেত্রে প্রদেশের পশ্চাৎপদত্ব এবং কৃষি জমির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হয়ে চলার ভয়ানক প্রক্রিয়ার জন্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তুই প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।[৪১]
৮. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু-বিরোধী আন্দোলন ও কৃষক সংগঠন
বাঙলাদেশে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস কেবলমাত্র ইংরেজ শাসন অথবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরবর্তী যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস আরও অনেক সুদূরপ্রসারী। তবে একথা সত্য যে, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে বাঙলাদেশের কৃষক এক নোতুন পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং এই সমস্ত খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহ ক্রমশঃ অধিকতর সংগঠিত রূপ ধারণ করে।
ইংরেজদের আমলে সর্বপ্রথম কৃষক-বিদ্রোহ হলো ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’।[১৭৬৩ সালের এই বিদ্রোহের পর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমস্ত কৃষক-বিদ্রোহ ঘটে তাদেরকে আপাতঃদৃষ্টিতে নিতান্ত বিচ্ছিন্ন মনে হলেও তাদের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত যোগসূত্র ছিলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং সেই বন্দোবস্তজাত শোষণব্যবস্থাই এই যোগসূত্রের মূল স্রষ্টা।
খণ্ড খণ্ড কৃষক-বিদ্রোহকে একটা আন্দোলনের রূপ দেওয়ার জন্য সাংগঠনিক প্রচেষ্টার প্রথম উদাহরণ পাওয়া যায় ১৮৭২-৭৩ সালে ‘সিরাজগঞ্জ কৃষক-বিদ্রোহের’ সময়। ভারতের কৃষক-বিদ্রোহের ইতিহাস রচয়িতা সুপ্রকাশ রায় এই বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন:
১৮৭২-৭৩ খৃস্টাব্দে ‘সিরাজগঞ্জ-বিদ্রোহ-এর সময় পাবনা জেলার সর্বত্র যে কৃষক সমিতি গঠিত হইয়াছিল তাহা কোনক্রমেই আকস্মিক ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর কৃষক-বিদ্রোহ হইতে সংগ্রামী কৃষক যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিল তাহারই ফলস্বরূপ দেখা দিয়াছিল কৃষকের এই নিজস্ব সংগঠন। বৃটিশ শাসন ও জমিদার এবং মহাজন শ্রেণীর সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিই সংগ্রামী কৃষককে তাহাদের নিজস্ব সংগঠন সম্বন্ধে সচেতন করিয়া তুলিয়াছিল ও নিজস্ব সংগঠন সম্বন্ধীয় এই চেতনাই বিংশ শতাব্দীতে কৃষকের সংগ্রাম-শক্তি বহুগুণে বর্ধিত করিয়াছিল। ‘সিরাজগঞ্জ-বিদ্রোহ-এর সময় গঠিত এই কৃষক সমিতিকে ১৯৩৬ সালে গঠিত সর্বভারতীয় কৃষকসভার অগ্রদূত বলা চলে।[৪২]
আঠারো এবং উনিশ শতকের বিদ্রোহগুলির মধ্যে সিরাজগঞ্জ কৃষক-বিদ্রোহের একটা বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এই বিদ্রোহ সরাসরিভাবে বৃটিশ ভারতীয় সরকারকে প্রজাস্বত্ব সম্পর্কিত একটি আইনে প্রণয়ন করতে বাধ্য করে।[১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং ১৮৫৯ সালের আইনর বলে জমিদাররা আদালতের অনুমোদনক্রমে ইচ্ছেমতো খাজনা বৃদ্ধি এবং কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতো।[১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন অনুসারে জমিদারদের এই ক্ষমতাকে অনেকাংশে খর্ব করা হয়। এরপর থেকে যে কোন কৃষক একটানাভাবে বারো বৎসর কোন জমিতে চাষাবাদ করে এলে সেই জমির ওপর তার দখলীস্বত্ব সৃষ্টি হবে এবং তাকে সেই জমি থেকে উৎখাত করা চলবে না বলে স্থির হয়। কাজেই প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা ও গলদ থাকার জন্যে চাষীরা এই আইনের ফলে খুব একটা লাভবান না হলেও ১৭৯৩ এর পর এই সর্বপ্রথম আইনগতভাবে ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমির ওপর কৃষকদের আংশিক স্বত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।
পূর্ব বাঙলা ও আসামের ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ারে এ সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্য করা হয়:
পাবনা জেলার ১৮৭২-৭৩ খৃস্টাব্দের কৃষক-বিদ্রোহ (‘Riots’) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, ইহারই পরিণতিস্বরূপ কৃষিভূমির উপর প্রজার অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে পূর্ণ আলোচনা আরম্ভ হইয়াছিল এবং সেই আলোচনারই চূড়ান্ত ফল হিসাবে বিধিবদ্ধ হইয়াছিল ‘প্রজাবৃন্দের সনদ’ বলিয়া কথিত ১৮৮৫ খৃস্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন।[৪৩]
বাঙলাদেশের সরকারী ইতিহাস-প্রণেতা বাকল্যাণ্ড সিরাজগঞ্জ-বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছেন :
১৮৭২-৭৩ খৃস্টাব্দের পাবনায় কৃষক-বিদ্রোহেই ১৮৮৫ খৃস্টাব্দের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের আলোচনা ও উহা চূড়ান্ত রূপ গ্রহণের মূল কারণ উপরোক্ত মন্তব্যসমূহ থেকে সিরাজগঞ্জ কৃষক-বিদ্রোহের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সহজেই বোঝা যায়। ভারতের বিশেষতঃ বাঙলাদেশের বুকে অসংখ্য ছোট-বড়ো কৃষক-বিদ্রোহের মধ্যে সাফল্যের দিক থেকে এই বিদ্রোহ অনেক বেশী সার্থক এবং এই সার্থকতার কারণ তার সাংগঠনিক চরিত্র। কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি এই সর্বপ্রথম একটি কৃষক সমিতির মধ্যে সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। কৃষকদের সংগঠিত শক্তিই সিরাজগঞ্জ কৃষক-বিদ্রোহের সাফল্যের প্রধান কারণ।
১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু বিশ শতকের গোড়া থেকেই হিন্দু-মুসলামানের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে অনেক রকম জটিলতা সৃষ্টি করে। কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক ঘোষণা সত্ত্বেও তার মধ্যে একই সাথে সাম্প্রদায়িক প্রভাব এবং কৃষক-শ্রমিকদের শ্রেণীশত্রুদের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। এর ফলে প্রথমে মুসলমান সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের জন্ম হয় ১৯০৬ সালে এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেসের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের একাংশের নেতৃত্বে ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি। এই সমিতি প্রতিষ্ঠার পূর্বে কংগ্রেসের আহ্বানে বাঙলাদেশের কৃষকেরা উৎসাহের সাথেই প্রত্যেকবার সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯২০-২২ সালে খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সময়েও হিন্দু-মুসলমান কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যাপক গণ-আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। এই সময়েই বাঙলাদেশের নদীয়া, ত্রিপুরা, নোয়াখালী ইত্যাদি জেলায় ১৯২০ সালের পরই স্থানীয়ভাবে কৃষক সমিতি গঠিত হয়।[৪৫] এবং বিচ্ছিন্নভাবে হলেও কৃষক আন্দোলন শ্রেণী আন্দোলন হিসেবে কিছুটা দানা বাঁধতে থাকে। এর কয়েক বৎসর পর ১৯২৬-২৭ সালে পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশের মতো বাঙলাদেশেও ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি নামে একটি কৃষক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।[৪৬]
কৃষকদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ এ সময় ছিলো প্রধানত, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শরিক হওয়ার ফলে কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয়ত, ঊনিশশো বিশের দিক থেকে কৃষকদের অবস্থার ক্রমশঃ দ্রুত অবনতি। ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনের সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তাতে অনেক বক্তা বলেন যে, তৎকালে কৃষিনির্ভর জনসমষ্টির অন্ততঃ শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভূমিহীন। বাঙলাদেশে দখলী স্বত্বভোগী শ্রেণীর সংখ্যার দ্রুত অবনতির প্রক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই সব বক্তারা বলেন যে, কোন প্রতিকার ব্যবস্থা না হলে অচিরেই এই শ্রেণীটি সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হয়ে যাবে।[৪৭]
১৯২৮ সালে প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের ফলে কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।[৪৮] অন্যদিকে এই সংশোধনী বিতর্কের সময় প্রজাস্বত্ব আইনের প্রশ্নে আইনসভা মোটামুটিভাবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হয় এবং অধিকাংশ হিন্দু সদস্যরা জমিদার পক্ষে এবং মুসলমানরা প্রজার পক্ষে ভোট দেন।[৪৯]
প্রজাস্বত্বের প্রশ্নের সাথে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন এইভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণ বাঙলাদেশে শ্রেণী- বিরোধের প্রধান ক্ষেত্র জমিদার ও কৃষক, মহাজন ও খাতক। জমিদাররা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই মহাজনের ভূমিকা পালন করার জন্যে বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী-বিরোধ সরাসরি জমিদার-মহাজন এবং কৃষক-খাতক এই দুই শ্রেণীর বিরোধে পরিণত হয়। এই জমিদার-মহাজনদের মধ্যে বৃহত্তম অংশ ছিলো হিন্দু এবং কৃষক-খাতকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো মুসলমান। এই জন্য জমিদার-মহাজন ও কৃষক–খাতকের শ্রেণী-বিরোধ বাহ্যতঃ একটা সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রজা সমিতির বিঘোষিত অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সত্ত্বেও এজন্যেই তার সত্যিকার চরিত্র ছিলো বহুলাংশে সাম্প্রদায়িক।
প্রজা-আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবুল মনসুর আহমদ ১৯৪৫ সালে নভেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘বাংলা মুসলিম রাজনীতির পটভূমি ও পরিচয়’ নামে একটি প্রবন্ধে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:
এই সময়ে সাধারণ নির্বাচন এলো। লীগ নেতৃত্বে ও প্রজা নেতৃত্বে একযোগে কাজ করবার চেষ্টা হলো। লীগ শুধু মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান এবং কৃষক-প্রজা সমিতি হিন্দু-মুসলমান মিলিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ প্রতিষ্ঠান, এসব কথা কারো মনেই লাগলো না। লীগ-প্রজা পার্টির মধ্যে একত্রে কাজ করার পক্ষে কোন টেকনিক্যাল অসুবিধা আছে বলেও কারো মনে হলো না। কারণ একটার ‘সাম্প্রদায়িক’ রূপ ও আরেকটার ‘অসাম্প্রদায়িক’ রূপ সত্ত্বেও সবাই যেন জানতেন যে, ও-দুটোই মুসলিম প্রতিষ্ঠান। আসলে ছিলও তাই। আজকাল যেমন হিন্দুসভা ও কংগ্রেসে একযোগে কাজ করবার আয়োজন চলছে, কংগ্রেসী ও হিন্দু সভাওয়ালাদের কারো মনেই তেমন কোন টেকনিক্যাল আপত্তির কথাই উঠছে না, সবাই যেমন ধরে নিচ্ছে ও আসলে হিন্দুদেরই প্রতিষ্ঠান তেমনি লীগ ও কৃষক-প্রজার সহযোগিতা স্বাভাবিক বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল।[৫০]
ঊনিশশো তিরিশের দিকে এ জাতীয় সাম্প্রদায়িক প্রভাব এবং প্রজা-আন্দোলনে কংগ্রেসের উৎসাহের অভাব প্রসঙ্গে ঐ একই প্রবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ বলেন:
প্রজা-আন্দোলন মুসলিম আন্দোলন। প্রমাণের যা কিছু বাকী ছিল, তাও প্রমাণিত হয়ে গেল আগামী দুচার বছরে। প্রজাস্বত্ব আইন, মহাজন আইন, প্রাথমিক শিক্ষা স্কীম, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল প্রভৃতি যতগুলি গণকল্যাণের কাজ আইনসভায় হলো, তার প্রায় সবগুলিকেই সমস্ত হিন্দু মেম্বর একযোগে বাধা দিলেন। প্রজা-আন্দোলনের মতো এতবড় একটা গণআন্দোলনে হিন্দুরা কেন যোগ দিলেন না, জমিদারী উচ্ছেদের দাবীর মত এতবড় একটা বিপ্লবী দাবীতে কংগ্রেসের মত প্রগ্রেসিভ একটা দলও কেন উৎসাহের সঙ্গে সহযোগিতা করলেন না, তার কারণ পাওয়া গেল ফ্লাউড কমিশনের তদন্তের সময়। এই কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বড় বড় হিন্দুনেতা বললেন: জমিদারী প্রথার উপর বাঙলার কৃষি, বাঙলার সাহিত্য এবং বাঙলার অর্থনৈতিক জীবনের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত। এ প্রথা উঠিয়ে দিলে সে কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামাজিক জীবন বিপন্ন হবে।
এইবার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো কেন প্রজা আন্দোলনে হিন্দু রাজনৈতিক নেতাদের সহানুভূতি ছিল না, কেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণ-প্রতিষ্ঠান কৃষক-প্রজা সমিতিতে হিন্দুরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যোগ দিলেন না, এইবার সেটা বোঝা গেল। জমিদারী প্রথা উঠলে মুসলিম জনসাধারণের সঙ্গে হিন্দু চাষীকুলেরও অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, এটা ঠিক I কিন্তু হিন্দু সমাজের যে স্তর রাজনীতিতে নেতৃত্ব করেন, তারা চাষী হিন্দুদের কেউ নন। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বর্ণহিন্দু মাত্র। জমিদারী প্রথা থেকে যে আট কোটির মত টাকা বছরে প্রজাদের কাছ থেকে আদায় হয় তার দশ ভাগের নয় ভাগই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে বণ্টন হয়। কাজেই জমিদারী প্রথা উঠে গেলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক জীবনে বিষম ঝুঁকি লাগবে। কাজেই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে অর্থনৈতিক আত্মহত্যা করতে পারে না। আর এরাই হলেন হিন্দুদের রাষ্ট্রনেতা। কাজেই তাঁরা প্রজা- আন্দোলন ও প্রজা সমিতি থেকে দূরে থাকলেন।[৫১]
হিন্দু ‘রাষ্ট্রনেতাদের’ সম্পর্কে এককালীন কৃষক-প্রজা নেতা আবুল মনসুর আহমদের এই বক্তব্য খুব যথার্থ হলেও এর থেকে অবশ্য মনে হতে পারে যে, মুসলমান ‘রাষ্ট্রনেতারা’ কৃ ষক-প্রজাদের দুরবস্থা লাঘব করার মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফ্লাউড কমিশনের সামনে হিন্দু নেতাদের সাক্ষ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য থেকে একথাও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ফজলুল হক মন্ত্রীসভা কৃষক-প্রজাদের উন্নতি বিধানের জন্যেই সেই কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। এ বিষয়ে অন্য আলোচনার পূর্বে আবুল মনসুর আহমদের নিজেরই পরবর্তীকালীন লেখা আত্মজীবনী থেকে দুটি অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
সমিতির সেক্রেটারী শামসুদ্দিন সাহেবকে মন্ত্রী না করা। নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর (কৃষক-প্রজা নেতা ফজলুল হক বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক শামসুদ্দিন আহমদকে মন্ত্রী না করে তাঁর পরিবর্তে নবাব মোশাররফ হোসেনকে কৃষক-প্রজা পর্টির সদস্য হিসেবে মন্ত্রীত্বের পদ দেন এবং বলেন যে, নবাব সাহেব কৃষক-প্রজা পার্টির কার্যক্রম পুরোপুরি গ্রহণ করিয়াছেন ব. উ.)[৫২] হইতে কৃষক-প্রজা কর্মীদের মধ্যে যে অসন্তোষ ধূমায়িত হইতেছিল, মন্ত্রী বেতন আড়াই হাজার ও মেম্বার বেতন আড়াইশ’ করায় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়িয়া গেল। শেষ পর্যন্ত জমিদারী উচ্ছেদের প্রশ্নটাকে শিকায় তুলিয়া যখন ফ্লাউড কমিশন নিয়োগ করা হইল তখন কর্মীদের অসন্তোষ প্রকাশ্য ক্রোধে পরিণত হইল।[৫৩]
ফজলুল হকের উপর্যুপরি বিশ্বাসঘাতকতা এবং কার্যক্ষেত্রে অন্যান্য প্রজা নেতাদের কৃষক- প্রজা স্বার্থের বিরোধিতা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর কৃষক-প্রজা আন্দোলনের ভূমিকা প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর উপরোক্ত আত্মজীবনীতে লেখন:
কংগ্রেস এবং কিষাণসভার বন্ধুরা বাঙলার প্রজা-আন্দোলনকে মুসলমান জোতদারদের আন্দোলন বলিতেন। তাঁদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল না। কৃষক-প্রজা আন্দোলন যে সময়ে খুবই জনপ্রিয় আন্দোলন, কৃষক-প্রজা সমিতি যখন খুবই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, সেদিনও বর্গাদারদের দখলীস্বত্ব দেওয়ার প্রশ্নে অনেক অনেক প্রজা-নেতাই ছ্যাত করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেন। স্যার আবদুর রহিম, মৌলবী আবদুল করিম, খান বাহাদুর আবদুল মোমিন প্রভৃতি বড় বড় মুসলিম নেতারা প্রজা সমিতির কর্মকর্তা থাকা হইতেও প্রজা সমিতির মধ্যকার রূপ বোঝা যায়। এই আন্দোলনে সমাজবাদী ও সাম্যবাদী বামপন্থী একদল কর্মী ছিলেন বটে এবং তাঁদের চেষ্টায় প্রজা আন্দোলন বাধ্য হইয়া কৃষক- আন্দোলনের আকৃতি-প্রকৃতিও কিছুটা পাইয়াছে বটে, কিন্তু স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক কারণেই তাঁরা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব পান নাই।[৫৪]
১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে যথাক্রমে স্যার আবদুর রহিম ও মৌলানা আকরম খাঁ নির্বাচিত হন। সমিতির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন মুজিবুর রহমান, আবদুল করিম, ফজলুল হক, আবদুল্লাহ সুহরাওয়ার্দী এবং খান বাহাদুর মোমিন সিআইই। শামসুদ্দীন আহমদ এবং তমিজউদ্দিন আহমদ উভয়ে নির্বাচিত হন যুগ্ম সম্পাদক।[৫৫] কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রজা সমিতির মাধ্যমে বাঙলাদেশের প্রজা- আন্দোলনের জন্মলগ্ন থেকেই এই আন্দোলন যে সমস্ত নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল তাঁদের সাথে কৃষক-প্রজা স্বার্থের কোন যোগ ছিল না। কৃষকদেরকে তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবহার করে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যেই প্রথমে প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠা এবং পরে নির্বাচনের মুখে তার নাম পরিবর্তন করে কৃষক-প্রজা সমিতির নামে তাকে নোতুনভাবে গঠন করতে উদ্যোগী হন।
মুসলমান জোতদার-জমিদারদের নেতৃত্বে গঠিত ও তাঁদের দ্বারা পরিচালিত কৃষক-প্রজা সমিতি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে নিজেদের ম্যানিফেস্টোতে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ, খাজনা হ্রাস, নজর-সেলামী রহিতকরণ, খাজনা-ঋণ মওকুফ, মহাজনী আইন প্রণয়ন, সালিসি বোর্ড গঠন, হাজা-মজা নদী সংস্কার, প্রতি থানায় হাসপাতাল স্থাপন, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক বাধ্যতামূলককরণ, বাঙলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, শাসন-ব্যয় হ্রাসকরণ, মন্ত্রী বেতন এক হাজার টাকা নির্ধারণ ও রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন দাবী লিপিবদ্ধ করে।[৫৬]
কিন্তু এসব সত্ত্বেও ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রীত্ব গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম দিকে কোন নির্বাচনী ওয়াদাকেই পূরণ না করে মন্ত্রীত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে অবস্থাবিশেষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তবে তাঁর এই বহুপ্রকার বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপের পর যখন কৃষক-প্রজা সমিতির কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী সদস্যের মধ্যে দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তখন মন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেই তিনি শেষ পর্যন্ত ঋণ সালিসি বোর্ড (১৯৩৮) গঠন এবং প্রজাস্বত্ব আইন (১৯৩৯), মহাজনী আইন (১৯৪০) প্রভৃতি কয়েকটি আইন পাশ করতে বাধ্য হন এবং ফলে সাময়িকভাবে কৃষকদের একাংশ কিছুটা উপকৃত হয়। কিন্তু এই সমস্ত ছোটখাটো সংস্কারের প্রচেষ্টা হলেও বাঙলাদেশের কৃষকদের দুর্দশার মূল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথা বিলোপের প্রশ্নটিকে ফজলুল হক মন্ত্রীসভা ভালোভাবে ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং চতুরতার সাথে সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নিয়োগ করে ফ্লাউড কমিশন। বাঙলাদেশে প্রজা আন্দোলন যাঁরা গঠন করেছিলেন এবং যাঁরা তার নেতৃত্ব দিতেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন কৃষকদের শ্রেণীশত্রু। তাঁদের মধ্যে অনেকে জাতীয়তাবাদী মুসলমান হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যে থাকেন কিন্তু সেখানে সাম্প্রদায়িক প্রভাববৃদ্ধির ফলে তা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নোতুনভাবে নিজেদের রাজনীতিকে গঠন করতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা রাতারাতি মুসলিম লীগের মতো একটা বিঘোষিত সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি যোগ না দিয়ে কংগ্রেসের মতোই একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের দিকে নজর দেন। ১৯৩৫ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের পর তাঁদের এই উদ্দেশ্য কৃষক-প্রজা সমিতির মাধ্যমে সিদ্ধ হওয়ার পথে কোন বাধা থাকে না। উপরন্তু রোয়েদাদের পর ছয় আনা খাজনা দানকারী কৃষকরা ভোটের অধিকারী হওয়ায় প্রজা আন্দোলনের নামে তাদের ভোট পাওয়ার পথই এর দ্বারা প্রশস্ত হয় এবং এই ভোট লাভের পর একে একে কৃষক-প্রজা সমিতির সমস্ত কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদী নেতারাই সমিতির ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির সেতু অতিক্রম করে মুসলিম লীগের রাজনীতি ক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন।
ঊনিশশো তিরিশের গোড়ার থেকেই আন্তর্জাতিক সংকটের ফলে বাঙলাদেশের কৃষকদের অবস্থার খুব দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং তাদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতাও অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। কৃষক-প্রজা নেতারা কৃষক-প্রজা সমিতির মাধ্যমে মুসলমান কৃষকদের এক বিরাট অংশকে নিজেদের আওতায় কিছুদিনের জন্য আটকে রাখলেও বাঙলাদেশের সমগ্র কৃষক সমাজ সেই আওতাভুক্ত ছিলো না। তাদের মধ্যে সত্যিকার শ্রেণী-সংগঠনের যে চেতনা দেখা দেয় তা মোটামুটিভাবে রূপ লাভ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার মাধ্যমে।
নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার শ্রেণী পার্থক্য নির্দেশ এবং কৃষকসভার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুজফ্ফর আহমদ ১৯৩৭ সালের ২৭-২৮ শে মার্চ বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়ের গ্রামে অনুষ্ঠিত প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে সভাপতি পরিষদের পক্ষ থেকে পঠিত দলিলে বলেন:
অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতি বর্তমান থাকিতে পৃথকভাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা গড়িয়া তুলিবার আবার কি প্রয়োজন রহিয়াছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি সংক্ষেপে প্রদান করিব। সকলেই জানেন, কৃষক-প্রজা সমিতির নাম প্রথমে শুধু “নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ ছিল। প্রকৃত কৃষকগণের সহিত উহার যোগাযোগ ছিল না বলিলেও চলে। অনেক প্রজাই কৃষক বটে, কিন্তু কৃষক মাত্রই প্রজা নহে। যে সকল বড় বড় মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকগণ শোষণের সহিত লিপ্ত রহিয়াছে তাহারাও প্ৰজা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কাজেই প্রজা ও কৃষকের স্বার্থ সব সময়ে এক হইতে পারে না। নূতন আইনে কৃষকদের ভোটের অধিকার কিছু বাড়িয়াছে। তাই নির্বাচনের অল্প দিন পূর্ব্বে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি উহার নামের সহিত ‘কৃষক’ শব্দটিও জুড়িয়া দিয়াছে। কৃষকদের ভোট না পাইলে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভবপর ছিল না। নির্বাচনের পূর্ব্বে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি অতিশয় কৰ্ম্মঠ হইয়া উঠিয়াছিল। উহার প্রচারের দ্বারা বাংলার গ্রামাঞ্চলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হইয়াছিল, কিন্তু সবই কিছু হইয়াছিল ভোট সংগ্রহের জন্য। কৃষকদের সংগঠিত করিয়া তোলার, কিংবা তাহাদের সংগ্রামের নেতৃত্ব করিবার কোনো উদ্দেশ্য যে নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতির ছিল এমন কোন পরিচয় উহার কাজ হইতে পাওয়া যায় নাই। নির্বাচন শেষ হইয়া যাওয়া মাত্রই কৃষক-প্রজা সমিতি জমিদারগণের সহিত সোলেনামা করিয়া লইয়াছে। নির্বাচনের সময়ে সকল বিবাদ-বিসংবাদ ভুলিয়া যাইয়া লিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি এখন জমিদার শ্রেণীর সহিত প্রগাঢ় বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছে। উক্ত সমিতির প্রধান নেতা মিস্টার একে ফজলুল হক জমিদারদের সম্বন্ধে ও মিনিস্টারদের পদ সম্বন্ধে পূর্বে যত তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলেন সেই সবই তিনি এখন ভুলিয়া গিয়াছেন। কৃষকদের স্বার্থকে পদদলিত করিয়া তিনি এখন জমিদারগণের সহযোগিতায় বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করিয়াছেন। নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতিকে তিনি জমিদারগণের নিকট বিক্রয় করিয়া দিয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। মোট এগারোজন মন্ত্রীর মধ্যে তাঁহাকে লইয়া মাত্র দুইজন মন্ত্ৰী নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতির সভ্যদের মধ্য হইতে গ্রহণ করা হইয়াছে।
কৃষকদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া তুলিয়া তাঁহাদিগকে তাঁহার দাবী-দাওয়া পূরণের জন্য সংগ্রামের পথে পরিচালনা করিবার উদ্দেশ্যে যে নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতি ছিল না তাহা এখন বেশ ভালোরূপেই বুঝিতে পারা যাইতেছে। কৃষকদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙিয়া উক্ত সমিতি যাহা পাইতে চাহিয়াছিল তাহার সবটা না হইলেও খানিকটা উহা পাইয়া গিয়াছে। কৃষকদের নিকট যত বড় বড় ওয়াদা নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতি করিয়াছিল সে সবের মধ্যে যে এতটুকুও অকপট সরলতা ছিল না তাহা এখন বেশ ভালোরূপেই বুঝিতে পারা যাইতেছে। কাজেই, পৃথক বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা সংগঠনের যে অত্যাধিক প্রয়োজন আছে সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।[৫৭]
৯. কৃষক সভার উত্থান
কৃষকদের জন্য একটা পৃথক শ্রেণী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ঊনিশশো তিরিশের গোড়া থেকেই অনেকে বোধ করছিলেন।[৫৮ ১৯৩২ সালে কংগ্রেস কর্তৃক সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কৃষক সংগঠন সম্পর্কে এই চিন্তা আরও জোরদার হয় এবং ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে কংগ্রেসের লাখনৌ অধিবেশনের সময় নিখিল ভারত কৃষক সভা নামে একটি সংগঠন জন্মলাভ করে।[৫৯]
বাঙলাদেশের যে সমস্ত কর্মী লাখনৌ কংগ্রেসের সময় নিখিল ভারত কৃষক সভা প্রতিষ্ঠার সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে ১৯৩৬ সালের অগাস্ট মাসে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে একটি সভা হয় এবং সেই সভায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার জন্ম হয়।[৬০] কংগ্রেসের অন্তর্গত একটি শ্রেণী সংগঠন হিসেবেই নিখিলভারত কৃষক সভা এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাঙলাদেশে কৃষকসভার ওপর কংগ্রেসের প্রভাব অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কম ছিলো। এর প্রধান কারণ বাঙলাদেশে কংগ্রেসের মধ্যে জমিদার শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত বেশী আধিপত্য। এর ফলে এখানে কৃষক সভার ওপর বামপন্থীদের প্রভাব বরাবরই বেশী থাকে এবং ১৯৪০ এর দিকে বাস্তবতঃ তা কংগ্রেসের পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির একটি শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোটামুটিভাবে সংগঠিত হয়।
১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত একটি পুস্তিকাতে এ সম্পর্কে বলা হয়:
বাংলার মুসলমান কৃষকদের অবস্থার সঙ্গে নিচু বর্ণের বা অস্পৃশ্য হিন্দু কৃষকদের মধ্যে কিছু মিল আছে। রাজনীতিক চেতনার দিক দিয়ে তারা প্রায় সমান অনগ্রসর। বর্ণ হিন্দুরা এই দুইয়ের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন ও অগ্রসর। হিন্দু কৃষকদের তুলনায় হিন্দু মধ্য শ্রেণীর সংখ্যার অনুপাত মুসলমান কৃষকদের তুলনায় মধ্য শ্রেণীর অনুপাতের চেয়ে বেশি। এই সামাজিক অবস্থার মধ্যে বাংলায় কৃষক সভার জন্ম হয়। তার নেতৃত্ব ঠিক কংগ্রেস থেকেও আসেনি, এসেছে সরাসরি লাল পতাকা থেকে। তাই কৃষক আন্দোলনের মধ্যে প্রথম থেকেই বুর্জোয়া সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে পলিটাটেরিয়ান (সর্বহারার) শ্রেণী চেতনা জাগাবার চেষ্টা হয়েছে।[৬১]
জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন, জমিদার-মহাজন বিরোধী শ্রেণী আন্দোলন গঠন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও কৃষি বিপ্লব নিখিল ভারত কৃষক সভায় নীতি এবং উদ্দেশ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়।[৬২]
১৯৩৬ সালের অগাস্টে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার এবং সেই বৎসরই ডিসেম্বর মাসে তাদের ফয়েজপুর প্রস্তাবে কংগ্রেসের বাইরে কৃষকদের নিজেদের শ্রেণী সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেও কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেসের সাথে কৃষকসভার নানা রকম বিরোধ দেখা দেয়।
কৃষক সভা শ্রেণী সংঘর্ষের দিকে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার ফলেই তার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের জমিদার-জোতদার শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা কৃষকসভার তীব্র বিরোধিতা শুরু করে এবং তাদের প্রভাবে হরিপুরা কংগ্রেসে কৃষক সভা বিরোধী একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়। গান্ধীও এই সময় জমিদার জোতদারদের স্বপক্ষে কৃষক সভার বিরোধিতা করে তার প্রতি অনেক দোষারোপ করেন।[৬৩ কংগ্রেসের ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে সমর্থন করে যাওয়ার নীতি সত্ত্বেও নিখিল ভারত কৃষক সভা ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ এ তাদের হরিপুরা অধিবেশনে এবং মে ১৯৩৮ এ কুমিল্লা অধিবেশনে কংগ্রেসের কৃষক সভা বিরোধী প্রস্তাব ও তাদের প্রতি দোষারোপের প্রতিবাদ করে।[৬৪] এইভাবে কংগ্রেসের কৃষক সভার দ্বন্দ্ব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বৎসরের মধ্যেই খোলাখুলিভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
বাঙলাদেশে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ এই সাত বৎসরে, কৃষক সভার সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১,২৪,৮৭২। এই সংখ্যা ডিসেম্বর ১৯৩৭-এ ছিলো ১০,০৮০; এপ্রিল ১৯৩৮-এ ছিলো ৩৫,৫০০ এবং মে ১৯৩৯-এ ছিলো ৫০,০০০। এরপর দুই বৎসর কৃষক সমিতির সংখ্যা হঠাৎ কমে এসে জুন ১৯৪০-এ ৩৪,০০০ এবং জুন ১৯৪২-এ ৩৫,০০০-এ এসে দাঁড়ায়, কিন্তু এর পর বৎসর অর্থাৎ মে ১৯৪৩-এ এই সংখ্যা আবার হঠাৎ বেড়ে গিয়ে হয় ১,২৪,৮৭২। [৬৫]
চিরস্থায়ী প্রথা ও জমিদারী উচ্ছেদ কৃষকসভার সর্বপ্রধান কর্মসূচী হওয়া সত্ত্বেও তার ভিত্তিতে তারা কোন ব্যাপক ও শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গঠন করতে সক্ষম হয়নি। স্থানীয় ভিত্তিতে তারা যে সমস্ত সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলো তার মধ্যে ২৪ পরগণার খাস জমি আন্দোলন এবং বর্ধমান জেলার ক্যানাল কর আন্দোলন অন্যতম। খাস জমি আন্দোলনে চাষীরা জমিদারের কাছ থেকে খাস জমি ফেরৎ চায় এবং ক্যানাল কর আন্দোলনের মাধ্যমে কর একর প্রতি ৫॥০ থেকে অনেকখানি কমিয়ে আনতে চায়। খাস জমি আন্দোলন সফল না হলেও ক্যানাল কর আন্দোলনের ফলে একর প্রতি ৫০ থেকে ৩॥০ ও পরে ॥/০ তে নামিয়ে আনা হয়।[৬৬]
১৯৩৯-৪০ এর দিকে উত্তর বাঙলার রংপুর, জলপাইগুড়ি ও দিনাজপুর জেলায় আধিয়ার আন্দোলন চলে এবং জলপাইগুড়ি ও দিনাজপুরে তা অনেকখানি দানা বাঁধে। কিন্তু পুলিশের হামলা ও নির্যাতনে দুই জেলাতেই এই আন্দোলন পরের দিকে ভেঙে যায়।[৬৭] ঐ একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৩৯-৪০ এ ময়মনসিংহ জেলার হাজং এলাকায় টং আন্দোলন অনেক বেশী সাফল্য লাভ করে। সেখানে জমিতে কৃষকদের স্বত্ব, টাকায় খাজনা দেবার অধিকার ইত্যাদি দাবী আংশিকভাবে স্বীকৃত হয়।[৬৮]
১৯৩৭-এ ফজলুল হক মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর তারা পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো চিরস্থায়ী প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে নীরব থাকলেও এর জন্য কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এর ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে তদন্তের জন্যে তারা একটি ভূমিরাজস্ব কমিশন (ফ্লাউড কমিশন) নিয়োগ করে। এই কমিশনের কাছে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা একটি মেমোরেন্ডাম পেশ করে এবং তাতে অন্যান্য দাবীর সাথে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ এবং জমির পরিমাণের পরিবর্তে আয়ের ওপর ভিত্তি করে ধার্যের দাবী পেশ করা হয়।[৬৯] ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কংগ্রেস ও কৃষকসভার মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে এবং ১৯৪১ এর জুন মাসে হিটলার সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণ করার পর এই সংঘর্ষ তীব্রতর হয়।
প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে কৃষকসভা চায় বিপ্লবী ও যুদ্ধবিরোধী জাতীয় সংগ্রাম। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব সে সময়ে কোন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিতে অস্বীকার করে। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কৃষক সভার ওপরও সরকারী হামলা শুরু হয়। কৃষক সভার নির্বাচিত সভাপতি রাহুল সাংস্কৃত্যায়নসহ অনেকে গ্রেফতার হন এবং অনেকে আত্মগোপন করেন।[৭০] এই সময় কৃষক সভা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার সদস্য সংখ্যাও অনেক কমে আসে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে জুন ১৯৪১-এ হিটলার সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণ করার পর যুদ্ধের গতি পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষকসভার যুদ্ধনীতি আমূলভাবে পরিবর্তিত হয়। কৃষকসভা সংগ্রামের শ্লোগান ছেড়ে দেশরক্ষার শ্লোগান তোলে এবং সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করে।[৭১]
কিন্তু এর ফলে কৃষকসভা ও কংগ্রেসের সম্পর্কের কোন উন্নতি হলো না। কারণ তাদের পারস্পরিক বিরোধ অন্য রূপ ধারণ করলো। কংগ্রেস এই দেশরক্ষার শ্লোগান না দিয়ে শ্লোগান দিলো জাতীয় সংগ্রামের। এর ফলে দুই প্রতিষ্ঠানের নীতিগত বিরোধ খুব তীব্র হয়ে উঠলো এবং অগাস্ট ১৯৪২-এ এই বিরোধ জাতীয় রাজনীতি এবং কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে রীতিমতো এক সংকট সৃষ্টি করলো।
যুদ্ধকালীন অবস্থার মধ্যে ১৯৪২-৪৩ সালে বাঙলাদেশে যে ভয়ানক খাদ্য সংকট ও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় সেই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকসভার নীতির মধ্যে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জাপানের মিত্র পঞ্চম বাহিনীর (সুভাষ বোস প্রভৃতির দল) বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে এই পর্যায়ে কৃষক সভা যে নীতি নির্ধারণ করে তার সারমর্ম হলো:
অতীতে কৃষকের সংগ্রাম ছিল প্রত্যক্ষভাবে কৃষক শ্রেণীর স্বার্থে জমিদার-বিরোধী ফের্কদার (Sectarian) সংগ্রাম। তাও ছিল জাতীয় সংগ্রামের অংশ, কিন্তু পরোক্ষভাবে। এখন সারা জাতির স্বার্থে কৃষক শ্রেণীর স্বার্থের প্রধান শত্রু পঞ্চমবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় সংগ্রামের অংশ। এই সংগ্রামের লক্ষ্য, কৃষক শ্রেণী ও সমগ্র জাতিকে আহার দিয়ে বাঁচানো ও দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐক্য গড়তে সাহায্য করা। খাবার ফসল বাড়ালে তার ফলে শ্রেণী হিসাবে কৃষকের বিরুদ্ধে জমিদার শ্রেণীর লাভ বা শোষণ বাড়বে না, লাভ হবে দেশের-জাতির। কিন্তু ফসল না বাড়ালে সুবিধা হবে পঞ্চমবাহিনীর এবং বিপদ বাড়বে কৃষক শ্রেণীর ও জাতির। এই অবস্থায় কৃষক শ্রেণীর শত্রু জমিদার শ্রেণীর শত্রু নয়। পঞ্চমবাহিনীই কৃষক শ্রেণীর শত্রু, জাতিরও শত্রু। জাতির সাধারণ শত্রু জাপানী ফ্যাসিস্ট কৃষক ও জমিদার দুই শ্রেণীরই সমান শত্ৰু। কিন্তু পঞ্চমবাহিনী জাপানের শত্রু নয়, বন্ধু।
পঞ্চমবাহিনীর শত্রু হিসাবে দেশপ্রেমিক জমিদারদের সংগঠিত করলে তাতে কৃষকদেরও সুবিধা। জমিদারদের সংগঠনে কৃষকদের সাহায্য করা দরকার। তাতে দেশপ্রেমিকদের একতা বাড়বে, পঞ্চমবাহিনীকে আরো কোণঠাসা করা হবে, আমলাতন্ত্রকে নত করার জন্যে দেশপ্রেমিকদের সংঘবদ্ধ শক্তি এগিয়ে যাবে।[৭২]
ওপরের এই উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে এই পর্যায়ে কৃষকসভা তার মৌলিক কর্মসূচী জমিদারীপ্রথা উচ্ছেদকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেশরক্ষার নামে নিজেকে সরকারের অধিক ফসল ফলাও আন্দোলনের একটা অঙ্গে পরিণত করে। এর ফলে অনেকখানি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জমিদারদের বিরোধিতার অভাবে কৃষক সভার সদস্য সংখ্যা ১৯৪৩ এর দিকে বৃদ্ধি পেলেও শ্রেণী সংগঠন হিসেবে তার গুরুত্ব বহুলাংশে কমে আসে।
বাঙলাদেশে কৃষক সভার সাংগঠনিক দুর্বলতা সম্পর্কে ১৯৪৩ সালে তাঁরা নিজেদের কর্মীদের কাছে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেন:
১ . কৃষক আন্দোলন সারা দেশ জুড়ে হয়নি, মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো কোনো কোনো এলাকায় মাত্র হয়েছে।
২. সমস্ত কৃষকদের ওপরে এখনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
৩. যে সকল এলাকায় আন্দোলন আছে সেখানেও সকল স্তরের কৃষকদের মধ্যে এবং বিশেষ করে আধিয়ার ও খেতমুজরদের মধ্যে কাজ করে না।
৪. কৃষকদের ভিতর থেকে আন্দোলনের জন্যে যথেষ্ট নেতা তৈরী করা হয়নি এবং এ বিষয়ে অতি অল্পই চেষ্টা হয়েছে। কর্মীরা বিষয়টির গুরুত্ব ঠিক বোঝেননি।
৫. কৃষকসভা কৃষকদের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কাজের মধ্যে নিয়ম শৃঙ্খলার অভাব। গণসংগঠন হিসাবে সভাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। মার্ক্সবাদী গণআন্দোলন হিসাবে কৃষক আন্দোলনকে তৈরী করবার জন্যে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে উপযুক্ত রাজনীতিক ও সাংগঠনিক চেতনা জাগানো হয়নি। কর্মীরা ঠিক বোঝেননি যে, কৃষক আন্দোলনকে সত্যিকার মার্ক্সবাদী গণআন্দোলনে পরিণত করবার একমাত্র উপায় সাধারণ কৃষকদের মধ্যে সক্রিয় রাজনীতিক চেতনা জাগিয়ে তোলা।
৬. কৃষক সভার সমস্ত কাজের মধ্যে নিয়মিত সংযোগ না রাখা এবং তার ফলে অনেক দরকারী কাজ উপেক্ষা করা।
৭. কর্মীরা সাধারণ কৃষকদের জীবনযাত্রা ও সামাজিক চালচলন সম্বন্ধে খুঁটিনাটি খবর রাখেন না ও তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে পারেন না। চাষের কাজ সম্বন্ধেও খবর রাখেন না। কৃষক জীবনে দরকারী আইনের খোঁজ-খবর রাখেন না। [৭৩]
১০. বাঙলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণ DONE page 366
বৃটিশ আমলের পূর্বে ভারতে দুর্ভিক্ষ মাঝে মাঝে দেখা দিতো কিন্তু সেই সব দুর্ভিক্ষ কখনো তেমন ব্যাপক আকার ধারণ করতো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় এই দুর্ভিক্ষ সীমাবদ্ধ থাকতো এবং সেগুলিতে ব্যাপক হারে কোন প্রাণহানিও ঘটতো না। প্রাচীন গ্রাম্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রত্যেক গ্রামে ‘ধর্মগোলা’ নামে এক একটা শস্যভাণ্ডার থাকতো এবং সেই শস্যভাণ্ডারের সঞ্চিত খাদ্যশস্য দ্বারা দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করা হতো।[৭৪]
কিন্তু বৃটিশের কাছে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বস্তুতঃপক্ষে ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই সারা ভারতবর্ষ এবং বিশেষতঃ বাঙলাদেশ পরিণত হয় একটা চিরদুর্ভিক্ষের দেশে। এ সময় থেকেই আমাদের দেশে শুরু হয় ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ। ব্যাপকতা, স্থায়িত্ব ও প্রাণহানির দিক থেকে এই দুর্ভিক্ষসমূহ ভারতের ইতিহাসে এক নোতুন রেকর্ড স্থাপন করে।[৭৫]
বৃটিশ আমলে ভারতবর্ষ দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হওয়ার দুটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: রেলপথ নির্মাণ ও সেচ-ব্যবস্থার ধ্বংস। রেলপথ নির্মাণকে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে কৃষক সমিতির মেমোরেন্ডামেও উল্লেখ করা হয়। এ প্রসঙ্গে সুপ্রকাশ রায় বলেন:
ইহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের ফলে শাসকগণ বৃটেনের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর প্রায় ছয় মাসের খাদ্য এবং সকল বৃটিশ শিল্পের কাঁচা মালের চাহিদা পূরণের জন্য ভারতের শস্য বৃটেনে প্রেরণ করিবার বিশেষ সুবিধা লাভ করে। রেলপথের দ্বারা ভারতের বন্দরগুলির সহিত গ্রাম ও শহর কেন্দ্রসমূহ সংযুক্ত হওয়ায় ভারতের শস্য ক্রমশ অধিক পরিমাণে জাহাজযোগে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দরে প্রেরিত হইতে থাকে। চরম বিপর্যয় সত্ত্বেও ভারতে কৃষি হইতে যে খাদ্য পাওয়া যাইত তাহারও অধিকাংশ এইভাবে ভারতের বাহিরে প্রেরিত হওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং তাহার ফলে নিঃস্ব কৃষক জনসাধাণের পক্ষে তাহা ক্রয় করা অসম্ভব হইয়া পড়ে। অথচ কৃষকগণ এই খাদ্যশস্যই নামমাত্র মূল্যে মহাজনের নিকট বিক্রয় করিতে বাধ্য হয়।[৭৬]
ভারতবর্ষে রেলপথ স্থাপনের পূর্বে ও পরে দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ও প্রাণহানির তুলনা করলে এ বিষয়ে ধারণা অনেকখানি স্পষ্ট হয়। ১৮০২ থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত ৫৩ বৎসরে মোট দুর্ভিক্ষের সংখ্যা ছিলো ১৩ এবং সেই সব দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০ লক্ষ। কিন্তু রেলপথ স্থাপিত হতে শুরু হওয়ার পর ১৮৬০ থেকে ১৮৭৯ এই ২০ বৎসরে দুর্ভিক্ষের সংখ্যা হলো ১৬ এবং মৃত্যুর সংখ্যা হলো ১ কোটি ২০ লক্ষ।[৭৭]
দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে অবশ্য সেচব্যবস্থার ধ্বংস রেলপথ নির্মাণের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা আসার পূর্বে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সেচব্যবস্থা অন্যান্য দেশের অনুরূপ ব্যবস্থার থেকে ছিলো অনেকাংশে উন্নত, সুপরিকল্পিত ও সুরক্ষিত। সেজন্যে সময়ে ভারতীয় কৃষিও ছিলো পরবর্তী যুগের থেকে অনেক বেশী উন্নত। মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতার যুগে সারা ভারতবর্ষব্যাপী সেচব্যবস্থা ব্যাপক অরাজকতার ফলে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ইংরেজদের শাসনামলে জমিদাররা ভূসম্পত্তির মালিক হওয়ার পর থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সেচব্যবস্থা ক্রমশঃ ধ্বংস হয়ে চলে। জমিদাররা নিজেরা জমি ও কৃষিব্যবস্থার উন্নতির প্রতি বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে কেবলমাত্র কৃষক শোষণের দ্বারা রাজস্ব বৃদ্ধি করার চেষ্টায় সমস্ত চিন্তা এবং শক্তিকে নিয়োগ নিয়োগ করার ফলে সেচব্যবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। কৃষকদের নিজেদের আর্থিক অবস্থা উত্তরোত্তরভাবে ভেঙে পড়ার ফলে তাদের পক্ষেও সেচব্যবস্থার কোন উন্নতি সাধন এককভাবে সম্ভব হয় না। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ার পরিবর্তে একর প্রতি উৎপন্ন শস্যের পরিমাণ ক্রমশঃ কমে আসে। এর পরিণামে খাদ্য সংকট এবং দুর্ভিক্ষ ভারতীয় কৃষক জীবনে একটা চিরস্থায়ী স্থান দখল করে এদেশকে পরিণত করে চিরদুর্ভিক্ষের দেশে।
‘ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসন’ নামে একটি প্রবন্ধে কার্ল মার্কস এ সম্পর্কে বলেছেন:
স্মরণাতীতকাল থেকে এশিয়ার শাসনব্যবস্থা তিনভাগে বিভক্ত ছিলো। যথা: রাজস্ব বিভাগ অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ লুণ্ঠন বিভাগ; সমর বিভাগ অর্থাৎ বৈদেশিক লুণ্ঠন বিভাগ এবং সর্বশেষে দেশের পূর্তবিভাগ। … (বাঙলাদেশে) বৃটিশ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের পূর্ববর্তী শাসকদের থেকে রাজস্ব ও যুদ্ধবিভাগের ভার গ্রহণ করেছে কিন্তু পূর্তবিভাগকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছে। সুতরাং এর পরিণতি হিসেবে দেখা দিয়েছে বর্তমান কৃষিব্যবস্থার মধ্যে চরম বিপর্যয়। এই কৃষিব্যবস্থা এমনই যে, তা বৃটিশ বণিকের অবাধ প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারে না।
মোগল সম্রাটেরা সারা বাঙলাদেশে বিস্তৃত জলপথ ও সেচব্যবস্থা নির্মাণ করেছিলেন। এই ক্যানেলগুলি দেখে সতেরো শতকের ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ের মন্তব্য করেছিলেন যে, এই ব্যবস্থার ফলেই ‘বাংলাদেশ মিশরের থেকেও অধিক সম্পদশালী।’ এ সম্পর্কে বিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়াম উইলকক বলেন:
ব-দ্বীপ অঞ্চলের যে অসংখ্য নদনদী নিরবিচ্ছিন্নভাবে উহাদের গতি পরিবর্তন করিতেছে, উহারা প্রথমে ছিল কাটাখাল। ইংরেজ শাসনকালে ইহাদিগকে আপন খাত হইতে এবং আপন খেয়ালে প্রবাহিত হইতে দেওয়া হইয়াছে। পূর্বে এই খালগুলি গঙ্গানদীর বন্যার জলরাশিকে বিভিন্ন খাতে ছাড়াইয়া দিতে এবং এইভাবে প্রদেশের জলনিঃসরণ ব্যবস্থা হিসেবে কার্য করিত। নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বঙ্গদেশের যে সমৃদ্ধি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে লুণ্ঠনকারী ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে’ প্রলুব্ধ করিয়া বঙ্গদেশে টানিয়া আনিয়াছিল, সেই সমৃদ্ধি এই খালসমূহের দান। এই মূল খালব্যবস্থার ব্যবহার ও উহার উন্নতি সাধনের জন্য এই পর্যন্ত কিছুই করা হয় নাই, বরং পরবর্তীকালে রেলপথ নির্মিত হইলে তাহা দ্বারা খালগুলি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। ইহার ফলে কয়েকটি অঞ্চল পলিমিশ্রিত গঙ্গাজলের সরবরাহ হইতে বঞ্চিত হইয়া ক্ৰমশঃ অনুর্বর ও উৎপাদন-ক্ষমতাহীন হইয়া পড়িয়াছে। অন্যান্য অঞ্চলগুলিও উপযুক্ত জল নিঃসরণ-ব্যবস্থার অভাবে বৎসরের অধিকাংশ সময় জলপ্লাবিত থাকায় অনিবার্যরূপেই জনক্ষয়কারী ম্যালেরিয়ার আবাসভূমিতে পরিণত হইয়াছে। ইহা ব্যতীত, যে ভূমিক্ষয়ের ফলে প্রতি বৎসর বহু গ্রাম এবং বন ও কৃষিভূমি নদীগর্ভে বিলীন হইয়া যাইতেছে, তাহা নিবারণ করিবার জন্য গঙ্গানদীর নিম্নভাগে বাঁধ নির্মাণের কোন চেষ্টাই করা হয় নাই।[৭৮]
১৯৩০ সালে বাঙলা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সেচ বিভাগীয় কমিটি তাঁদের রিপোর্টে বলেন যে, বাঙলাদেশের প্রত্যেক জেলাতে যে সমস্ত খালে নৌকা চলাচল আছে সেগুলি প্রায়ই পলিমাটি দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। এই খালগুলিই হলো বাঙলার রাস্তাঘাট ও রাজপথ এবং সেগুলিকে যথাযথভাবে রক্ষা করার গুরুত্বকে কোন অংশেই খর্ব করা চলে না।[৭৯]
ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার থেকে শুরু করে ভারতের কৃষিব্যবস্থাকে সর্বতোভাবে বৃটেনের আর্থিক ব্যবস্থার অধীনে করার চেষ্টাই যে ভারতবর্ষ চিরদুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হওয়ার কারণ সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সুপ্রকাশ রায় বলেন:
বিদেশী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের আত্ম-সম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজের সর্বাত্মক ধ্বংস, কৃষিভূমির উপর ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুদ্রা-অর্থনীতির প্রচলন, মহাজনী প্রথার আবির্ভাব এবং ভারতের কৃষিকে আধুনিক শিল্পে উন্নত গ্রেট বৃটেনের আর্থিক ব্যবস্থার একান্ত অধীন করিবার অনিবার্য পরিণতি হইল আধুনিক ভারতের ক্রমবর্ধমান দুর্ভিক্ষ। ভারতের দুর্ভিক্ষ বৃটিশ শাসনেরই দান এই মহাসত্যটি গোপন রাখিবার উদ্দেশ্যেই বৃটেনের অর্থনীতি ও ইতিহাসের পণ্ডিতগণ বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা মতবাদের ধূম্রজাল সৃষ্টি করিয়াছেন, যেমন ভারতবর্ষ হইল ‘চিরদুর্ভিক্ষের দেশ’, ‘চিরদারিদ্র্যের দেশ’, ‘ভারতের কৃষকগণ অমিতব্যয়ী’, ‘ভারতের দুর্ভিক্ষ অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির ফল’ ইত্যাদি সর্বোপরি তাঁহারা অষ্টাদশ শতাব্দীর বৃটিশ মূল ধনী শ্রেণীর আজ্ঞাবহ ধর্মযাজক ম্যালথাসের জনসংখ্যা-সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ও যুক্তিহীন মতবাদটি ‘বৃটেনের মিথ্যার যাদুঘর’ হইতে বাহির করিয়া এবং তাহাই ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়া প্রচার করিয়াছেন যে, ভারতের খাদ্যোৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধিই দুর্ভিক্ষের কারণ।[৮০]
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার মেমোরেন্ডামটিতে খাদ্য ঘাটতি সম্পর্কে বলা হয় যে, তৎকালীন অবস্থায় জরুরী পরিস্থিতির জন্যে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করে রাখা তো দূরের কথা কৃষিব্যবস্থার অবনতির ফলে জনসংখ্যাকে মোটামুটিভাবে খাইয়ে রাখার মতো উপযুক্ত খাদ্যশস্য উৎপন্ন করাও বাঙলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না।[৮১]
এই নিদারুণ ও চিরস্থায়ী খাদ্য সংকটের সাথে চিরস্থায়ী ভূমিব্যবস্থার সম্পর্কের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে মেমোরেণ্ডামটিতে বলা হয়:
কেউ হয়তো একথা জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাথে এর সম্পর্ক কি? আমরা আবার বলছি যে, ভারতবর্ষ, বিশেষতঃ বাঙলাদেশ, নিজের সম্পদকে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারে যাতে করে তাঁর পক্ষে বর্তমান জনসংখ্যার থেকে বেশী সংখ্যককে মোটামুটিভাবে খাইয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব। শুধু যে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রদেশের কৃষিব্যবস্থা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, শুধু যে জমির কোন উন্নতি অথবা কৃষিকার্যে পদ্ধতির কোন উন্নতি সাধন করা হয়নি তাই নয়, উপরন্তু আমরা বাস্তবতঃ দেখছি যে, জমি খণ্ড খণ্ড অংশে বহুধাবিভক্ত হওয়ার ফলে একর প্রতি জমির উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বাঙলাদেশে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জমি আবাদের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তা অনাবাদী জমি হিসেবে পড়ে আছে। এই সমস্ত অনাবাদী জমিতে আবাদকার্য পুঁজি ব্যতীত কখনই হাতে নেওয়া যায় না। অন্য অসুবিধা বাদ দিলে সেচ এবং জল নিংকাশনের ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। আমরা দেখেছি যে, জমিদাররা এ কাজ হাতে নিতে অনিচ্ছুক এবং অপারগ প্রমাণিত হয়েছে, তারা শুধু নিজেদের খাজনা আদায় করেই সন্তুষ্ট। সরকারের পক্ষেও রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা ব্যতীত এ ধরনের কাজে হাত দেওয়া সম্ভবপর বিবেচিত হবে না বলেই মনে হয়। সুতরাং ভবিষ্যতে প্রদেশের পক্ষে নিজের খাদ্য সংস্থান ব্যবস্থা নির্ভর করবে ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং কৃষিব্যবস্থার পুনর্বাসনের সমস্যা সমাধান কতখানি দৃঢ়তার সাথে করা হবে তার ওপর।[৮২]
ফ্লাউড কমিশনের কাছে প্রদত্ত মেমোরেণ্ডামের উপরোক্ত বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেই ১৯৪৩ সালে ভবানী সেন জমিদারী প্রথার পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
মন্বন্তরের (অর্থাৎ ১৯৪৩ সালের বা পঞ্চাশের মন্বন্তরের – ব. উ.) বছর পর্যন্ত ২০ বছরের গড়পড়তা হিসাব লইয়া দেখা গিয়াছে যে, বাংলায় ধানের জমির পরিমাণ ২ কোটি একরের সামান্য কিছু বেশি – এবং তাহাতে যে চাউল উৎপন্ন হয় তাহার পরিমাণ প্রায় ২৩ কোটি মণ। বাংলার ৬ কোটি লোকের জন্য বছরে চাউল লাগে ৩০ কোটি মণ, কোনো কোনো মতে ২৭ কোটি মণ। বছর বছর খাদ্যের এত ঘাটতি অথচ বাংলায় জমি আছে যথেষ্ট। ফ্লাউড কমিশনের তদন্তেই প্রকাশ পায় যে, এখনও বাংলায় ৩৭ লক্ষ একর চাষের যোগ্য জমি পতিত রহিয়াছে। সরকারী হিসাব অনুসারে প্রতি একরে ১২.৪ মণ করিয়া চাউল হয়। ৩৭ লক্ষ একর জমিতে যদি চাষীরা চাষ করিতে পারে, তাহা হইলে আরও প্রায় ৫ কোটি মণ চাউল পাওয়া যায়। অথচ এত জমি পড়িয়া রহিয়াছে শুধু এই জন্য যে, জমির মালিক জমিদার, সে চাষের জন্য জমির পিছনে এক পয়সাও খরচ করিবে না। সে চায় যে, কৃষক সেলামী দিক, খাজনা দিক, জমি বন্দোবস্ত করিয়া নিজে টাকা খরচ করিয়া জমির আগাছা দূর করুক, জলসেচনের ব্যবস্থা করুক এবং সার দিক। কিন্তু বাংলার চাষীর অত সামর্থ্য নাই; যে জমিতে নদীনালা প্রভৃতি স্বাভাবিক সেচের ব্যবস্তা আছে সেই জমিতেই চাষ হয় যে জমিতে পয়সা খরচ করিয়া সেচের ব্যবস্থা করিতে হয় সেই জমিতে আর চান হয় না। বাংলার সমস্ত আবাদী জমির শতকরা মাত্র ৬.২ ভাগ জমিতে সরকারী সেচের ব্যবস্থা আছে, এই ভারতবর্ষেরই অন্যান্য জায়গায় সরকারী টাকায় ঢের বেশী জমিতে সেচের ব্যবস্থা হইয়াছে।
পাঞ্জাবে সমস্ত আবাদী জমির শতকরা ৫৫ ভাগ এবং মাদ্রাজে শতকরা ৩৩ ভাগে সেচের ব্যবস্থা আছে। বাংলার অফুরন্ত খালবিল সেচের খরচ স্বভাবতঃই কমাইয়া দিয়াছে; তবু ৩৭ লক্ষ একর জমি সেচ ও সারের অভাবে পতিত আছে, কারণ সরকার ও জমিদারের প্রধান স্বার্থ কৃষকের নিকট হইতে কর আদায় করা, জমির জন্য অর্থ ব্যয় কেহ করে না।[৮৩]
১১. পঞ্চাশের মন্বন্তর *
[* বাঙলা ১৩৫০ সালে এই দুর্ভিক্ষ হয় বলে একে বলা হয় পঞ্চাশের মন্বন্তর।]
১৯১৮-২১ সালের দুর্ভিক্ষের পর ১৯৩৪ সালে বাঙলাদেশের অঞ্চলবিশেষে আবার খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময় ময়মনসিংহ জেলার কোন কোন অংশে ফসল নষ্ট হয় এবং তার ফলে সেখানে খাদ্যশস্যের মূল্য খুব বৃদ্ধি পায়। মজুতদার এবং আড়ৎদাররা আরও মূল্য বৃদ্ধির আশায় খাদ্যশস্য গুদামজাত করে রাখে এবং সরকারীভাবে এলাকাটিকে দুর্ভিক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষণা না করার ফলে সরকারী কর্মচারীরা এ ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন। এই সবের ফলে দুর্ভিক্ষের অবস্থা এত নিদারুণ হয় যে, কৃষকেরা অনেকেই গাছের পাতা খেয়ে কোন রকমে জীবন ধারণ করেন।[৮৪]
এরপর ১৯৩৬ সালে দুর্ভিক্ষ আরও অনেকখানি বিস্তার লাভ করে এবং পশ্চিম ও মধ্য বাঙলা তার দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই এলাকায় মোট ৭০ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারা পীড়িত হলেও সরকার মাত্র ১১.৫ লক্ষ টাকা সাহায্য এবং ৩৬ লক্ষ টাকা ঋণ দান করেই নিশ্চিন্ত হন। তৎকালীন খাদ্য সংকটের তদন্তের জন্যে তাঁরা একজন অফিসার নিয়োগ করলেও সরকারীভাবে তাঁকে ‘দুর্ভিক্ষ অফিসার’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় না। কারণ তীব্র খাদ্য সংকট সত্ত্বেও সরকার বাঙলাদেশের পশ্চিম ও মধ্য অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন।[৮৫]
১৯৩৪ সালের দুর্ভিক্ষের ঠিক পূর্বে খাদ্য পরিস্থিতির তদন্তের জন্যে একটা সরকারী কমিটি স্থাপিত হয়। সেই কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, সে বছর ঢাকা জেলায় উৎপন্ন হয়েছিলো প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের শতকরা ৩০ ভাগ। সিরাজগঞ্জে কৃষকদের ঘরে ৬ মাসের খাদ্য ছিলো। কিশোরগঞ্জে ৭০ জন কৃষক ভীষণভাবে ঋণগ্রন্থ। শতকরা ২০ জনের ঘরে সারা বৎসরের ধান ছিলো এবং শতকরা ৫ জনের কাছে ছিলো বিক্রয় করার মতো উদ্বৃত্তশস্য। অন্য সকলকে ধান কিনে ঘাটতি পূরণ করতে হতো। নদীয়া জেলায় শতকরা ৫০ জনের ঘরে ৬ মাসের খাদ্য খাটতি। বাঁকুড়া জেলায় শতকরা ৬০ জনের ঘরে খাদ্য ছিলো ছয় মাসের।[৮৬ মোটামুটিভাবে বলা চলে যে, ১৯৪৩ সালে সারা বাঙলায় ছয় সপ্তাহের খাদ্য ঘাটতি ছিলো।[৮৭]
সরকারী তথ্য এবং তদন্ত রিপোর্ট থেকেই এই ঘাটতির খবর পাওয়া যায় অথচ ঘাটতি পূরণ করার জন্যে সরকার কোন চেষ্টা তো করেইনি উপরন্তু সমুদ্রতীরের অঞ্চলসমূহ থেকে প্রায় এক লক্ষ মণ চাল তারা সরিয়ে অন্যত্র চালান দিয়ে সেখানকার খাদ্য সংকটকে তীব্রতর করে।[৮৮]
বাঙলাদেশে প্রতি বছরই খাদ্যশস্য প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপাদন হয়। কাজেই খাদ্য আমদানী এখানকার একটা নিয়মিত ব্যাপার। ১৯৪৩ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ কোটি মণ। এই ঘাটতি অন্যান্য বৎসরের তুলনায় কিছু বেশী হলেও তার দ্বারা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা ছিলো না।
প্রতি বছর ঘাটতি সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না দুই কারণে। প্রথমত, সরকার বিদেশ থেকে পুরো ঘাটতি পরিমাণ শস্য আমদানী না করলেও কিছু খাদ্য প্রতি বৎসরই আমদানী করতো। এই আমদানীর সম্ভাবনার জন্যে জোতদার ও ব্যাপারীরা বেশীদিন ধান- চাল গুদামে আটকে রাখতো না। এর ফলে বাজারে খাদ্যশস্যের সরবরাহ অনেকটা নিয়মিত হতো। দ্বিতীয়ত, বাঙলাদেশের বহু লোক অর্থাভাবে বরাবরই একবেলা, আধবেলা না খেয়ে থাকার ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনার জন্যে তারা বাজারে চাপ সৃষ্টি করতো। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষও খাদ্য ঘাটতি থেকে তত প্রকট আকার ধারণ করেনি যতখানি করেছিলো মজুতদারদের সৃষ্ট কৃত্রিম খাদ্য ঘাটতির ফলে। যুদ্ধকালীন অবস্থার দোহাই দিয়ে সরকার বাঙলার প্রয়োজনীয় খাদ্য ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে খাদ্য আমদানী করতে পূর্বের মতো তৎপর না হওয়ার ফলে মজুতদাররা আসন্ন দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফল চিন্তা করে খাদ্যশস্য, প্রধানতঃ চাল গুদামজাত করতে লাগলো। অধিকতর লাভের আশায় কিছু দিন তারা চাল বিক্রী প্রায় একেবারে বন্ধ করে দিলো। কাজেই সাধারণ মানুষ চালের অভাবে তিলে তিলে মরতে শুরু করলো।
১৯৪৩ সালের মে মাসের দিকেই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটলো। কলকাতা এবং অন্যান্য শহরগুলিতে নিরন্ন, নিঃসম্বল কৃষকেরা দু’মুঠো ভাতের জন্যে ঘর থেকে ঘরে ভিক্ষা করলো এবং সেই ভিক্ষাও অনেকের ভাগ্যে না জোটার ফলে তারা বিপুল সংখ্যায় মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকলো। এই সময় গ্রাম-বাঙলার শতকরা ৭৫ জন কৃষকের ঘরে চাল ছিল না। সব চাল জমা হয়েছিলো জোতদার, আড়ৎদার, চোরাকারবারী, সরকারী এজেন্ট ও মিল মালিকদের হাতে। এই দস্যুদের মুনাফা সম্পর্কে সরকারী দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশনের রিপোর্টেই বলা হয় যে, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষকালীন অবস্থাতেই চাল বিক্রী করে চোরাকারবারী, ব্যাপারীরা অতিরিক্ত লাভ করেছে ১৫০ কোটি টাকা।[৮৯]
সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১৫ লক্ষ হলেও অন্যান্য বেসরকারী সূত্রের হিসেবমতো দুর্ভিক্ষের বছরে অনাহারে ৩৫ লক্ষ নর-নারী মারা যায় এবং ১২ হইতে ১৫ লক্ষ নর-নারী ও শিশু পথের ভিখারী হয়। অন্নের জন্য লোকে স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় করে এবং নর্দমার ভিতর কুকুরের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট লইয়া কাড়াকাড়ি করে।[৯০]
দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিটির সরকারী বিবরণ অনুসারে বাঙলাদেশের ছয় কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি মানুষের জীবন দুর্ভিক্ষের দ্বারা সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বাঙলার ৯০টি মহকুমার মধ্যে ২৯টি মহকুমায় দুর্ভিক্ষ ভীষণভাবে বিস্তার লাভ করে। বাঙলাদেশের মোট ৮২৯৫৫ বর্গমাইলের মধ্যে প্রায় ২১৬৬৫ বর্গমাইলের মানুষ তীব্রভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়।[৯১]
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় বাঙলাদেশে খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে লীগ মন্ত্রীসভা গদিনশিন ছিলো। প্রদেশে মুসলিম লীগ মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে ১৯৪৩-এর ২৫শে এপ্রিল এবং ঠিক সেই সময় থেকেই দুর্ভিক্ষ ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। এর ফলে চারিদিকে লীগ মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয় এবং মুসলিম লীগের বিরোধী দলসমূহ, বিশেষতঃ কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা, তাদেরকে এই দুর্ভিক্ষের জন্যে দায়ী করে। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে একটি পুস্তিকায় বিস্তৃতভাবে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আলোচনা করে মুসলিম লীগ সরকার এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীত্বাধীন সরবরাহ বিভাগকেই দুর্ভিক্ষের জন্যে দায়ী করেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সময় পঞ্চাশের মন্বন্তরে মুসলিম লীগ সরকারের ভূমিকার কথা জোরেশোরে প্রচার শুরু হয় এবং সেই বিরুদ্ধ প্রচারণার মুখে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক ‘মিল্লাতে’ মোহম্মদ হাবিবুল্লাহ একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষের প্রকৃত দায়িত্ব পূর্ববর্তী শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার ওপর ন্যাস্ত করেন। প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন:
দুর্ভিক্ষ সাধারণতঃ একদিনে আসে না। কিছু দিন আগেই এর লক্ষণসমূহ প্ৰকাশ পাইতে থাকে। এই সব লক্ষণ প্রকাশ পাইলেই গভর্ণমেন্ট দুর্ভিক্ষের কারণসমূহ দূর করিবার চেষ্টা করেন। সভ্য জগতের ইহাই নীতি। বাঙলাদেশে দুর্ভিক্ষের লক্ষণ যখন প্ৰকাশ পাইয়াছিল সেই সময় বাঙলার শাসনের দায়িত্ব ছিল কুখ্যাত শ্যামা-হক মন্ত্রীমণ্ডলীর উপর। দেশের দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে, আসন্ন দুর্ভিক্ষকে গোড়াতেই রোধ করিবার কোন চেষ্টাই এই গভর্ণমেন্ট করেন নাই। আসন্ন মন্বন্তরকে রুখিবার জন্য সরকার পক্ষ হইতে প্রয়োজন ছিল যে প্রস্তুতির – যে সংগঠনের, সে সম্পর্কে কোন মাথা ঘামানোই ছিল না শ্যামা-হক মন্ত্রীদের। জনসাধারণকে সজাগ ও সংঘবদ্ধ করার যে দায়িত্ব ছিল গভর্ণমেন্টের, তাহাও করা হয় নাই মোটেই।
রোম যখন আগুনে পুড়িতেছিল নীরো তখন বাজাইতেছিল বাঁশী। বাঙলাকে যখন দুর্ভিক্ষের রাক্ষস গ্রাস করিতে উদ্যত, বাঙলার শ্যামা-হক মন্ত্রীরা তখন আত্মীয়-বাৎসল্যের উৎসবে মত্ত। ফলে দেখিতে পাই – দেশে খাদ্যশস্যের অভাব হইবে এই সহজ কথাটাও তারা অনুভব করেন নাই – করিয়া থাকিলেও ভারত সরকারের গোচরীভূত করার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। বরং প্রধানমন্ত্রী মিঃ ফজলুল হক ভারত সরকারকে এ কথাটি জানাইয়াছিলেন: বাঙলা তার নিজের ব্যবস্থা নিজেই করিতে পারিবে। খাদ্য আমদানীর কোনই প্রয়োজন নাই।[৯২]
মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্যে কি কি করেছেন তার এক লম্বা ফিরিস্তি দেওয়ার পর সরবরাহ মন্ত্রী শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে সরবরাহের ব্যাপারে যে সমস্ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো সে সম্পর্কে হাবিবুল্লাহ আরও বলেন:
দিল্লী হইতে শুরুতে খাদ্যশস্য পাওয়া যায় না। হু লড়ায়ের পর যখন খাদ্যশস্য আসিল তখন একসঙ্গে এত বেশী পরিমাণ আসিল যে, যানবাহনের অভাবে খাদ্য চলাচলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হইল না। সামরিক বিভাগের সঙ্গে দস্তুরমতো লড়াই করিয়া তবে খাদ্য চলাচল ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব হইয়াছিল।
তাছাড়া যুদ্ধের জন্য সরকারী কর্মচারীরা নানা কাজে ব্যস্ত ছিল। নবগঠিত খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগের জন্য ছিল না উপযুক্ত লোক। সরবরাহ সম্পর্কে কাহারও ছিল না অভিজ্ঞতা। খাদ্যশস্য গুদামজাত করার জন্য গুদাম ছিল না। এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় লইয়া যাইবার জন্য ছিল না গাড়ী, ঘোড়া, মোটর, নৌকা বা অন্য যানবাহন। বাঙলার বাহির হইতে শস্য আসিয়া কলিকাতায় পড়িয়া আছে – দুর্ভিক্ষ পীড়িত স্থানে পাঠাইবার ব্যবস্থা নাই। স্টেশন হইতে গ্রামে পাঠাইবার উপায় নাই। সর্বত্র সামরিক কর্তৃত্ব। এক এক স্থানে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরিয়া রেলগাড়ী মিলিটারী কাজের জন্য আটক। অসামরিক ব্যাপারের দিকে সামরিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেবার অবসর নাই। এর উপর চারিদিকে বোমার রাজত্ব – উচ্ছৃঙ্খল ভাব।[৯৩]
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে উত্তরোত্তরভাবে ফজলুল হক এবং অন্যেরা ব্যবহার করছিলেন। এজন্যে ঐ বৎসর মার্চ মাসে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ একটি দীর্ঘ প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে হাবিবুল্লাহর উপরোক্ত বক্তব্যকেই আবার নোতুনভাবে উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন:
১৯৪২ সালে শ্যামা-হক মন্ত্রীত্বের আমলে বাঙলাদেশ হইতে চাউল রফতানি করা হয়। সে বছর আউশ ধানের ফসল ভালো হয় নাই। কংগ্রেস অগাস্ট-আন্দোলন আরম্ভ করিয়া দেখে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়াছিল। ভারত সরকারের ‘ডিনায়েল পলিসি’ অনুসারে ধান-চাউল ও নৌকা জনসাধারণের নিকট হইতে সরাইয়া লওয়া হইল। মেদিনীপুরে তুফান হওয়ায় সেখানকার অধিবাসীদের নিদারুণ ক্ষতি হইল।
এই সমস্ত দুর্বিপাকের মধ্যে বাঙলাদেশে চাউলের ঘাটতি দেখা দিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘোষণা করিলেন যে, বাঙলাদেশে বাহির হইতে চাউল আনার প্রয়োজন নাই। অথচ তখন বর্মা হইতে চাউল আসা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কোচিন ও ত্রিবাংকুরে তখন খাদ্যাভাব দেখা দিয়াছে। বাঙলাদেশে তখন ২৫ লক্ষ টন চাউলের ঘাটতি অথচ প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ঘোষণা করিলেন যে, বাঙলায় চাউলের কোন অভাব নাই। পক্ষান্তরে শ্যামা-হক সরকার বাঙলা হইতে ভারত সরকারের পক্ষে চাউল কিনিবার দায়িত্ব লইলেন এবং শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার মুখপত্র ‘নবযুগের’ তৎকালীন পরিচালক এইচ দত্ত এ্যান্ড সন্সকে চাউলের কন্ট্রাক্ট দিলেন। তারপর বাহির হইতে খাদ্য আমদানী বন্ধ হইল। ১৩৫০ সালের আমন ফসল ভালো হইল না। যুদ্ধের জন্য এ দেশে বিস্তর সৈন্য আনা হইল। মিলিটারী হইতে তাহাদের জন্য মুরগী, হাঁস, গরু, ছাগল, গোত্, আণ্ডা ও শাকসব্জী কেনা শুরু হইল। গভর্ণমেন্ট তাহাদের পুলিশ ও হাসপাতাল প্রভৃতির জন্য চাউল কেনা আরম্ভ করিলেন। ট্রাম কোম্পানী, রেল কোম্পানী প্রভৃতি বড় বড় বিলাতী ও দেশী কোম্পানী কর্পোরেশন ও মিউনি সপ্যালিটি নিজেদের কর্মচারীদের জন্য বহু চাউল কিনিয়া গুদামজাত করেন। ফলে চাউলের দাম বাড়িতে লাগিল। বড়লাট লর্ড লিনলিথগো খাদ্য ও দেশরক্ষার ভার নিজ হাতে লইলেন। জেনারেল উড তাঁহার ‘বেসিক প্ল্যান অনুসারে সমস্ত প্রদেশগুলিকে বাড়তি ও ঘাটতি এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিলেন। বাড়তি প্রদেশ হইতে ঘাটতি প্রদেশে খাদ্য রফতানি করিতে আদেশ দিলেন। বিহার বাঙলাকে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার টন চাউল দিবে উড সাহেব এইরূপ আদেশ দিলেন। কিন্তু বিহার সরকার কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের সহিত লড়াই শুরু করিলেন। জনসাধারণকে খাদ্য দেওয়ার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের, না কেন্দ্রীয় সরকারের, দুই সরকারের মধ্যে তাহা লইয়া বাদানুবাদ হইল। এই বাদানুবাদ প্রায় তিন মাস স্থায়ী হইল। এ দিকে বাঙলায় দুর্ভিক্ষ ভীষণ আকার ধারণ করিয়াছে। তবুও বিহার সরকার কোন চাউলই পাঠাইলেন না। আসাম সরকার সামান্য পাঠাইলেন। উড়িষ্যা মাত্র ২১ হাজার টন পাঠাইল; তাহা মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া অঞ্চলেই শেষ হইয়া গেল। দেশের মধ্যে যে পরিমাণ চাউল ছিল তাহা মজুতদার ও মুনাফাখোরদের গুদামে লুকাইল। চাউলের ব্যবসা সবচেয়ে লাভজনক হইয়া উঠিল এবং যেখানে যত পুঁজিপতি ও মুনাফালোভী ছিল সকলেই চাউলের ফটকা খেলিতে লাগিল। রাতারাতি লোকে লক্ষপতি হইতে লাগিল, আর রাস্তায় হাজার হাজার দুর্গত লোকের আবির্ভাব হইল। শ্যামা-হক মন্ত্রীত্ব এই সময় পদত্যাগ করিলেন।[৯৪]
পুঁজিপতি ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ফটকা খেলতে শুরু করার ফলে তারা দুর্ভিক্ষের বাজারে রাতারাতি লক্ষপতি হতে লাগলো এই বক্তব্যের পরই মুসলিম লীগ মন্ত্রীত্বের সময় শহীদ সুহরাওয়ার্দীর সরবরাহ বিভাগ কর্তৃক ইস্পাহানী কোম্পানীর ওপর চাউল সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পণ করার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলছেন:
বাঙলা সরকারের তরফ হইতে বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম হইতে চাউল ক্রয় করিবার জন্য ব্যবসায়ীদিগকে কন্ট্রাক্ট লইতে অনুরোধ করা হইল। কিন্তু হিন্দু ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে লীগ মন্ত্রীসভার সহিত অসহযোগিতা করিল।
সা ওয়ালেস নামক বিলাতী ফার্মের ঐ সমস্ত প্রদেশে ব্যবসা ছিল কিন্তু তাহারাও রাজী হইল না। বাঙ্গালায় পাকিস্তান হইতে পারে না, ইহা প্রমাণের জন্য হিন্দু প্রধান প্রদেশসমূহ বাঙ্গালায় চাউল পাঠানো বন্ধ করিয়া দিল। ফলে বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের চাউলের দরজা বাঙলার মুখের উপর বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। মতলব, লীগ মন্ত্রীসভাকে শাস্তি দেওয়া। শেষে ইস্পাহানী কোম্পানী নামক মুসলমান ফার্মকে ধরা হইল। তাঁরা চাউল সংগ্রহ করিতে রাজী হইলেন। কিন্তু ইহার জন্য তাঁহাদের অন্যান্য ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বন্ধ হইল।[৯৫]
মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ইস্পাহানী কোম্পানীকে চাউল সংগ্রহ করার ঠিকাদারী দেওয়ার ব্যাপারটিকে মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক এমনভাবে উপস্থিত করেছেন যার থেকে মনে হয় যেন মুসলমান ইস্পাহানী কোম্পানী বাঙলাদেশের কৃষক-শ্রমিক জনগণকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েই অন্যান্য সমস্ত ব্যবসা বন্ধ রেখে চাউল সংগ্রহের ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। চাউল সংগ্রহ এবং চাউলের ব্যবসা যে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সব থেকে লাভজনক ব্যাপার ছিলো এবং সেজন্যই যে ইস্পাহানী কোম্পানী তাদের অন্য ব্যবসা স্থগিত রেখে মুসলিম লীগ সরকারের বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে মুনাফা লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলো সেকথা আবুল মনসুর আহমদের বিবৃতির মধ্যে কোথাও নেই।
কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজসেবীদের নিয়ে গঠিত খাদ্য কমিটিগুলির মাধ্যমে মুসলিম লীগ সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্যে কিছুটা প্রচেষ্টা চালালেও চোরাকারবারী, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কোন সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই তারা সক্ষম হয়নি। উপরন্তু তাদের আমলে ইস্পাহানী কোম্পানীর মতো মুসলমান কোম্পানী চাউল সংগ্রহের প্রায় একচেটিয়া অনুমতি লাভের পর সর্বশক্তি নিয়োগ করে নিজেদের পুঁজি ও মূলধনকে রাতারাতি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো। বাঙ্গালা ১৩৫০ সালে বাঙলাদেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিলো তা পূর্ববর্তী ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতোই ছিলো পুরোপুরি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, সাম্রাজ্যবাদের সামরিক স্বার্থ, প্রশাসনিক অচলাবস্থা ইত্যাদি সব কিছু একযোগেই ছিলো পঞ্চাশের মন্বন্তরের স্রষ্টা। বড়লাট লর্ড লিনলিথগো নিজের হাতে খাদ্য বিভাগের ভার নিলেও খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারটিকে জরুরী ভিত্তিতে সংগঠিত করার কোন ব্যবস্থাই তারা করেনি। রেলগাড়ী, নৌকা এবং ট্রাকযোগে বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ এলাকায় খাদ্য পৌঁছানোর কোন রকম ব্যবস্থাই জরুরী ভিত্তিতে হয়নি। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে খাদ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত সরবরাহের অভাবে তা সময়মতো কোন কাজে লাগনি। এছাড়া গুদামের সংখ্যা কম হওয়ার জন্যে খাদ্য বেশী দিন ভালোভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিলো না। এর ফলে নিদারুণ দুর্ভিক্ষের মুখেও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়।
‘ভাঙনের মুখে বাঙলা’ নামে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ওপর লিখিত একটি পুস্তিকাতে ভবানী সেন দুর্ভিক্ষের ধ্বংসলীলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:
দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছে মোট ৩৫ লক্ষ লোক। যাহারা বাঁচিয়া আছে তাহারাই আজিকার দিনের সমস্যা। বিধ্বস্ত এলাকার শতকরা ১০ জন লোক আজও দুস্থ, ইহাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বিশিষ্ট সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা হিসাব করিয়া বলিয়াছন যে, প্রায় ১২ লক্ষ লোক এখনও দুস্থ ভিখারী। একেবারে ভিখারী না হইলেও রিক্ত হইয়া পড়িয়াছে এমন লোকের সংখ্যা ৬০ লক্ষ। তাহাদের ২৭ লক্ষ ক্ষেতমজুর, ১৫ লক্ষ গরীব কৃষক, ১৫ লক্ষ গ্রাম্য শিল্পজীবী এবং ২৫০০০ স্কুলের শিক্ষক। ইহা ছাড়া আরও অন্যান্য শ্রেণীর লোকও আছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক বাঙলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে।[৯৬]
শুধু কৃষকরাই নয়, গ্রাম্য কামার-কুমোর, জেলে এবং অন্যান্য শিল্পজীবীরাও দুর্ভিক্ষের ফলে দারুণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো এবং শ্রেণী হিসেবে তাদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিলো। এ সম্পর্কে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের একটি গ্রামের ওপর সুভাষ মুখ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনযুদ্ধে’ নিম্নলিখিত বিবরণ দেন:
রাত্রে আর ঋষিপাড়া ঢাকের শব্দে মুখর হয় না। আগে চাটগাঁ, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জায়গা হইতে ঢাকের বায়না আসিত; আজকাল পূজা-পার্বণ প্রায় উঠিয়া গিয়াছে। গ্রামে বিবাহাদি সিকিভাগও হয় কিনা সন্দেহ। চামড়ার কাজ প্রায় বন্ধ। পাট ও পাল্লা তৈয়ারের কাজ ও আজ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বেতের পণ ৩ ও সাড়ে ৩ টাকা। বাজারে ক্রেতা নাই। তাহা ছাড়া যানবাহনের অভাবে আসাম হইতে বেতের চালানও আসে না, ফরিদপুরের যে অঞ্চলে বেত পাওয়া যায় সেখানে ম্যালেরিয়া এত বেশী যে, লোক সেখানে যাইতে ভরসা পায় না। টঙ্গিবাড়ী গ্রামের ঋষিপাড়া প্রায় সাফ হইয়া গিয়াছে।[৯৭]
বগুড়া জেলার একটি গ্রামে তাঁতীদের সম্পর্কে ‘জনযুদ্ধের আর একটি রিপোর্টে বলা হয় : দশটিকা গ্রামে ২ শত ঘর তাঁতীর বাস। মোট তাঁদের সংখ্যা ১৭৩ এবং ২৫ জনের ৪-৫ বিঘা করিয়া আবাদী জমি। দুর্ভিক্ষের সময় ৫০ জন লোককে শহরের লঙ্গরখানায় খাইয়া প্রাণ বাঁচাইতে হইয়াছে, অসুখ-বিসুখে মরিয়াছে ৬০ জন। ২৫ জনের মধ্যে ১৩ জনই তাহাদের মোট ৫২ বিঘা জমি বেচিয়া দিয়া দিনমজুর হইয়াছে। প্রায় ১০০ জন তাহাদের তাঁত ২-১ জন বর্ধিষ্ণু তাঁতীর কাছে বন্ধক রাখিয়া সংসার চালাইয়াছে। শুধু দশটিকা নয়, জেলার সমস্ত গ্রামেই তাঁতীদের আজ এমন অবস্থা।[৯৮]
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলে বাঙলাদেশের গরীব কৃষকদের জমি যে হারে জোতদার মহাজনদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে আমাদের দেশের ইতিহাসে ইতিপূর্বে তার কোন তুলনা ছিলো না। সরকারী সাব-রেজিস্ট্রারদের অফিসের হিসাব অনুসারে ২৫০ টাকা বা তার থেকেও অল্প মূল্যের যে সমস্ত জমি বিক্রি হয়েছে তার মোট বিক্রয় মূল্য ১০ কোটি টাকা।[৯৯]
এই জমি হস্তান্তর সম্পর্কে মন্তব্য করতে ভবানী সেন উল্লেখ করেছেন:
যে কৃষকেরা এইভাবে জমি হারাইয়াছে তাহাদের শতকরা একজনের বেশী দুর্ভিক্ষের পর জমি ফিরিয়া পায় নাই, এমনকি জমি ফেরত সম্পর্কে সরকারী আইনের সাহায্যেও না। মাত্র ১৫টি এলাকায় এক বছরের ভিতর ৫ লাখ কৃষক প্রায় ১০ কোটি টাকার জমি বেচিয়া ফেলিয়াছে। এই অঞ্চলে দখলীস্বত্ববিশিষ্ট জোত বিক্রয় হইয়াছে ৪,২৬,৬৮৩টি, তাহাও শুধু সেই সমস্ত জমি যাহার দাম ২৫০ টাকার বেশী নয়। বাংলার সবচেয়ে বেশী জমি হস্তান্তরিত হইয়াছিল ১৯২৩ সালে। এই সময় সমগ্র বাঙলায় যত জায়গা জমি বিক্রয় হইয়াছিল (কেবল ২৫০ টাকার কম নয়) তাহার সংখ্যা ৩,১৪,০০০; ১৯২৯ সালের পর অর্থনৈতিক সংকটের কয়েকটা বছরও এই সংখ্যা ২ লক্ষের কম ছিল।
১৯৪৩ সালে জমি হইতে কৃষক উৎখাতের পরিমাণ এত বেশী হইয়াছে যে, অতীতে আর কখনো এইরূপ হয় নাই।
বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করিয়া বলিয়াছেন যে, শতকরা ৫ জন চাষী তাহাদের সমস্ত জমিজমা বিক্রয় করিয়া দিয়াছে। শতকরা আরও ১১ জন কিছু না কিছু জমি বেচিয়াছে। এই জমি কিনিয়াছে জমিদার, জোতদার এবং কন্ট্রাক্টররা। যুদ্ধের বাজারে ইহারাই টাকায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। যেসব চাষী জমি বেচিয়াছে তাহাদের অনেকেই চাষ ছাড়িয়া পরের জমিতে মজুরি করা শুরু করিয়াছে আর সবাই হইয়াছে ভিখারী। একই কৃষির ভেতর ঐশ্বর্যের পাশাপাশি দুস্থতা গ্রাম্য জীবনের সরল সম্বন্ধ ভাঙিয়া দিয়াছে। যাহারা ছিল ভাই-ভাই তাহারা হইয়াছে মনিব-চাকর।[১০০]
এইভাবে পঞ্চাশের মন্বন্তর বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষককে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে, লক্ষ লক্ষ কৃষককে ভিক্ষুকে পরিণত করেই তার ধ্বংসলীলাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বহু লক্ষ কৃষকের জমি জমিদার, জোতদার, মহাজন, চোরাকারবারী ও কন্ট্রাক্টদেরকে কাছে হস্তান্তরিত করে তাদেরকে পরিণত করেছিলো গ্রাম্য দিনমজুর অথবা ভাগচাষীতে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভার নেতা ভবানী সেন উপরি উদ্ধৃত মন্তব্য করলেও কৃষকসভা কর্তৃক ১৯৪৩ সালের প্রকাশিত একটি দলিলে কৃষকদের শ্রেণীশত্রু সম্পর্কে তাঁরা নিম্নলিখিত বক্তব্য হাজির করেন:
খাবার ফসল বাড়ালে তার ফলে শ্রেণী হিসেবে কৃষকের বিরুদ্ধে জমিদার শ্রেণীর লাভ বা শোষণ বাড়বে না, লাভ হবে দেশের – জাতির। কিন্তু ফসল না বাড়ালে সুবিধা হবে পঞ্চম বাহিনীর এবং বিপদ বাড়বে কৃষক শ্রেণীর ও জাতির। এই অবস্থায় কৃষক শ্রেণীর শত্রু জমিদার শ্রেণী নয়, পঞ্চম বাহিনীই কৃষক শ্রেণীর শত্রু, জাতিরও শত্রু।
জাতির সাধারণ শত্রু জাপানী ফ্যাসিস্ট কৃষক ও জমিদার দুই শ্রেণীরই সমান শত্রু। কিন্তু পঞ্চম বাহিনী জাপানের শত্রু নয়, বন্ধু।
পঞ্চম বাহিনীর শত্রু হিসেবে দেশপ্রেমিক জমিদারদের সংগঠিত করলে তাতে কৃষকদের সুবিধা। জমিদারদের সংগঠনে কৃষকদের সাহায্য করা দরকার। তাতে দেশপ্রেমিকদের একতা বাড়বে, পঞ্চম বাহিনীকে আরো কোণঠাসা করা হবে, আমলাতন্ত্রকে নত করার জন্যে দেশপ্রেমিকদের সংঘবদ্ধ শক্তি এগিয়ে যাবে।[১০১]
যে জোতদার, জমিদাররা গ্রামাঞ্চলে নিজেরাই খাদ্যশস্য মজুত করে চোরাকারবারী ও বেপারীদের সাথে একত্রে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুট করেছিলো এই শোষকদেরকেই কৃষকসভার এই দলিলে বর্ণনা করা হচ্ছে ‘দেশ প্রেমিক’ হিসেবে! শুধু তাই নয়, জমিদারদেরকে সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে কৃষকদেরকে পরামর্শ এবং উপদেশ দেওয়া হচ্ছে সাহায্য করার জন্যে! এর কারণ যুদ্ধকালীন অবস্থায় পঞ্চম বাহিনীই কৃষকসহ জনগণের সমগ্র অংশের সর্বপ্রধান শত্রু এবং কৃষকদের চিরশত্রু জমিদার শ্রেণী, আর তাদের শত্রু নয়, পরম মিত্র!
জাপানী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে দেশীয় পরিস্থিতির বিচার ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষকসভায় ব্যর্থতাই তাঁদের উপরোক্ত মতামত ও বক্তব্যের জন্য দায়ী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দেশ বাঙলায় ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ আন্দোলনকে জোরদার করার মাধ্যমে বাঙলাদেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানের ধ্বনি তুলে তাঁরা অন্য সমস্ত মৌলিক ধ্বনিকে জলাঞ্জলি দেন এবং এই সব কারণেই ভারতীয় এবং সেই সাথে বাঙলাদেশের কৃষকসভা যুদ্ধকালীন অবস্থায় পঞ্চম বাহিনীর শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে দেখার ফলে কৃষকদেরকে সরাসরিভাবে শ্রেণী-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে কৃষি বিপ্লবের রাজনীতির দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী কয়েক বৎসরে কৃষকসভার নেতৃত্বে পরিচালিত তেভাগা আন্দোলনের মধ্যেও এই সমস্ত দুর্বলতা আন্দোলনের চরিত্র এবং গতিকে অনেকাংশে নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে।
তথ্যসূত্র
১. Quoted in Memoramdum on the Permanent Settlement Presented by The Bengal Provincial Kisan Sava to the Land Revenue Commission.
Published by Smritish Banerjee, Publicity Secretary, Bengal Provincial Kisan Sava, ২7 B, Gangadhar Babu Lane, Calcutta, P 17.
২. Younghusband: Transactions in India. (17৪6 ) P 123-124.
দ্রষ্টব্য: সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (প্রথম খণ্ড), জুলাই ১৯৬৬, পৃ ১৩-১৪।
৩. Hunter’s ‘Annals etc. ‘ Apopendix: Records etc.
দ্রষ্টব্য: সুপ্রাকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (প্রথম খণ্ড) পৃ ১৫।
৪. Quoted in Memorandum on the Permanent Settlement, P 1৪.
৫. Radha Kamal Mukherjee, Land Problems in India, P 35.
দ্রষ্টব্য: সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৪।
৬. Lord William Bentinck, Speech, Quoted from Rajani Palme Dutt, India Today, P 21৪.
৭. Despatch from the Secretary of State for India to the Govt. of India dated 9th July, 1৪6২.
দ্রষ্টব্য: সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৫।
৮. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
৯. পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৮।
১০. Memorandum of the Permanent Settlement, P 39.
১১ হেমচন্দ্ৰ কানুনগো, বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, কমলা বুক ডিপো লিমিটেড, ১৯২৮, পৃ ২৭।
১২ সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত ১৩৫।
১৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৬।
১৪ Memorandum, P3২.
১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৫।
১৬ Karl Marx, An Article on India’ (Marx – Engels on India, Moscow) P 73.
১৭ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদিগের দুরবস্থা বর্ণনা’, বৈশাখ, ১৭৭২ সাল, ৮১ সংখ্যা, বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১০৯-১০।
১৮ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, শ্রাবণ, ১৭৭২ সাল, ৮৪ সংখ্যা। বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১৯।
১৯ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ৮১ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১২।[২০ বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৭ বিনয় ঘোষের এই তথ্য Bengal Administration Report, 1৪7২-73, P 73 থেকে নেওয়া।
২১ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ৮১ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১৩।
২২ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ৮১ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১৪-
২৩ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ৮৪ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১৭ ২৪ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ৮৪ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৯, ১২৩।
২৫ সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৪৩।
২৬ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, শ্রাবণ, ১৭৭২ সাল, ৮৪ সংখ্যা, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১৮১-৮২।
২৭ Karl Marx, Capital, Vol. III, P 39২-93.
২৮ Memorandum, P ২9.
২৯ পূর্বোক্ত, P 30-31.
৩০ পূর্বোক্ত, P 35.
৩১ সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ ১০।
৩২ Land Revenue Policy of the India Government, Published by order of the Governor General of India in Council, 190২, P 7-৪.
৩৩ পূর্বোক্ত, P ৪-9.
৩৪ Memorandum on the Permanent Sttlement, P 40.
৩৫ পূর্বোক্ত।
৩৬ পূর্বোক্ত, P 4২-3.
৩৭ Rada Kamal Mukherjee, Land Problems in India, P 157, Quoted in Memorandum, P 44.
৩৮ বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৬।
৩৯ পূর্বোক্ত।
৪০ Memorandum, P51.
৪১ পূর্বোক্ত, P ৫২.
৪২ সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ ১১।
৪৩ Imperial Gazetteer, E Bengal and Assam, P. ২৪5; উদ্ধৃত সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ, পৃ ৪১৬।
৪৪ CE Buckland, Bengal under the Lieutenant Governors, Vol I, P 545. দ্রষ্টব্যঃ সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত পৃ ৪১৬।
৪৫ কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, রাজনীতি সংগঠন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষ হইতে আবদুল্লা রসুল কর্তৃক ২৪৯, বহুবাজার স্ট্রীট, কলিকাতা হইতে প্রকাশিত ও পপুলার প্রিন্টিং ওয়ার্কস্, ৪৭, মধু রায় লেন হইতে মুদ্রিত, পৃ ৮।
৪৬ পূর্বোক্ত।
৪৭ Memorandum, P 43-44.
৪৮ কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, পৃ ৯।
৪৯. কৃষক সমস্যা, মুজফ্ফর আহমদ, পৃ ৩৯ ন্যাশনানল বুক এজেন্সী, কলকাতা, ৩য় সংস্করণ, অক্টোবর, ১৯৫৪; ১৯৩৭ সালের ৩৭-২৮শে মার্চ বাঁকুড়া জেলার পাত্র-সায়ের নামক গ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ। (খ) আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, প্রথম সংস্করণ, পৃ ৫৩।
৫০ মিল্লাত, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মুখপত্র, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২৩শে নভেম্বর, ১৯৪৫, পৃ ৩।
৫১ পূর্বোক্ত।
৫২ আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, প্রথম সংস্করণ, পৃ ১৩৩।
৫৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৮-৩৯।
৫৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৫-৬৬।
৫৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৩।
৫৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৯।
৫৭ মুজফ্ফর আহমদ, পৃ ৪৪-৪৬।
৫৮ Memorandum of the Bengal Provincial Kisan Sava To the Land Revenue Commission (Preface).
৫৯ পূর্বোক্ত এবং কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস রাজনীতি সংগঠন, পৃ ১১।
৬০ পূর্বোক্ত।
৬১ কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস রাজনীতি সংগঠন, পৃ ১২।
৬২ পূর্বোক্ত, পৃ ১২-১৩।
৬৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩।
৬৪ পূর্বোক্ত।
৬৫ পূর্বোক্ত, পৃ, ১৫-১৬।
৬৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬।
৬৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৭।
৬৮ পূর্বোক্ত।
৬৯ Memorandum, P ৪4.
৭০ কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস রাজনীতি সংগঠন, পৃ ২০-২১।
৭১ পূর্বোক্ত, পৃ ২২।
৭২ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯-৩০।
৭৩ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৯-৬০।
৭৪ সুপ্রকাশ রায়, পৃ ১৭৬।
৭৫ Memorandum, P 60.
৭৬ সুপ্রকাশ রায়, পৃ ১৭৯।
৭৭ দ্রষ্টব্য : সুপ্রকাশ রায়, পৃ ১৭৯।
৭৮ দ্রষ্টব্য : সুপ্রকাশ রায়, পৃ ১৮১।
৭৯ Memorandum, P 6২ এবং সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত পৃ ১৮০।
৮০ সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৮২।
৮১ Memorandum, P61.
৮২ পূর্বোক্ত।
৮৩ ভবানী সেন, ভাঙনের মুখে বাংলা, দ্বিতীয় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৪৫, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী লিমিটেড, ১২, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা, পৃ ২-৩।
৮৪ Memorandum, P59.
৮৫ পূর্বোক্ত, P 59-60.
৮৬ ভবানী সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ৬-৭।
৮৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৩।
৮৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৭।
৮৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১।
৯০ পূর্বোক্ত।
৯১ পূর্বোক্ত, পৃ ১০।
৯২ সাপ্তাহিক মিল্লাত, ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৪৫।
৯৩ পূর্বোক্ত।
৯৪ মিল্লাত, ১ম বর্ষ, ১৪শ সংখ্যা, ৮ই মার্চ, ১৯৪৬।
৯৫ পূর্বোক্ত।
৯৬ ভবানী সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ১০।
৯৭ জনযুদ্ধ, ৩য় বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, উদ্ধৃত : ভাঙনের মুখে বাংলা, পৃ ১৫।
৯৮ জনযুদ্ধ, ১৫-৩-১৯৪৫, উদ্ধৃত : ভাঙনের মুখে বাংলা, পৃ ১৫-১৬।[৯৯ ভাঙনের মুখে বাংলা, পৃ ৮।
১০০ পূর্বোক্ত।
১০১ কৃষক কর্মীদের শিক্ষা কোর্স, পূর্বোক্ত, পৃ ২৯-৩০।