চাষি ও চাষের জমি নিয়ে বাংলাদেশে বর্তমান আন্দোলনের উৎপত্তি হয়েছে মন্টেগু চেমস্ফোর্ড রিফর্মে, অর্থাৎ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৯১৯ সালের ভারত-শাসন আইনে। গত এক নম্বর মহাযুদ্ধের অবসানের পূর্বেই বেশ বোঝা গেল, মর্লি-মিন্টো নামাঙ্কিত যে শাসনপদ্ধতি ভারতবর্ষে চলছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষেরা তার বদল ঘটাবেন। ফলে কোনও কোনও বিষয়ে আইন করার সামান্য কিছু ক্ষমতা ভারতবাসীর হাতে আসবে। কিন্তু এই সামান্য উদ্দেশ্যের উপায়স্বরূপে আইনসভাগুলির সভ্যসংখ্যা বাড়বে একটু অসামান্য রকমে। এবং অনুপাকৃত তার চেয়েও অনেক বেশি বাড়ানো হবে ভোটদাতাদের সংখ্যা, যাদের ভোট কুড়িয়ে শাসনপরিষদে আসন পাওয়া যাবে। এদেশের বেশির ভাগ লোক চাষি। যে গুণে ভোটের অধিকার আসবে তাতে ভোটদাতাদের তালিকায় চাষির সংখ্যা হবে বেশ মোটা রকমের। তাঁরা যদি দল বাঁধতে পারে তবে তাদের ভোট উপেক্ষা করা বেশির ভাগ সভ্যপদপ্রার্থীর পক্ষেই সম্ভব হবে না। দেশময় সাড়া পড়ে গেল। বিশেষ করে বাংলাদেশের কথাই বলছি। জমিদারেরা বহু সভা করে প্রমাণ করলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সওয়াশো বছরের পুরাতন স্বীকৃতিতে তাঁরা যে শুধু চাষের জমির মালিক তা নন, তারাই হচ্ছেন চাষিদের স্বভাবসংগত নেতা, natural leaders of the people। কারণ, ও-কথাটা আইনে না। হোক তখনকার দলিল-দস্তাবেজে কোনও কোনও ইংরেজ রাজপুরুষ ব্যবহার করেছিলেন। জমিদারের স্বার্থ ও চাষির স্বাৰ্থ এক; অর্থাৎ জমিদারের স্বার্থই চাষির স্বাৰ্থ, চাষির হিতই জমিদারের হিত। যদস্তু হৃদয়ং মম তদন্তু হৃদয়ং তব। চাষিদের প্রকৃত স্বাৰ্থসিদ্ধি হবে তাঁরা যদি ভোট দিয়ে জমিদারদের বেশি সংখ্যায় আইনসভায় পাঠায়। ঘরভেদী দুষ্ট লোকের কথায় চাষিরা যেন কান না দেয়। দুষ্ট লোকের অভাব ছিল না। দেশময় রায়তদের সভায় তাঁরা প্রমাণ করতে লাগল যে, বাংলার চাষির যত দুঃখ তার মূলে বাংলার জমিদার। জমির সঙ্গে এরা কোনও সম্পর্ক রাখে না, সম্পর্ক শুধু জমির খাজনার সঙ্গে, অথচ এরাই জমির মালিক। সেই মালিকত্বের জোরে রায়তের খাজনা এরা ক্ৰমাগত বাড়িয়ে চলেছে, জমি যেন ইন্ডিয়া রবার। রায়ত ইচ্ছামতো তার জমি বিক্রি করতে পারে না, জমিদারকে দিতে হবে উচু নজর; নইলে জমি থেকে উচ্ছেদ। নিজের জমির গাছ রায়ত নিজে কেটে নিতে পারবে না, ঝড়ে-পড়া গাছও নিতে পারবে না; কারণ তারও মালিক জমিদার। নিজের জমিতে রায়ত ইচ্ছামতো পাকাবাড়ি করতে পারবে না, পুকুর কাটতে পারবে না, এ রকম আইনি অত্যাচার তো আছেই, তার উপর বে-আইনি অত্যাচারের শেষ নেই–জমিদারবাবুদের ও তাদের আমলাবাবুদের। এ সব বন্ধ করো। জমির খাজনার উচিত হার ঠিক করে খাজনা চিরকালের জন্য বেঁধে দাও, তার যেন আর বৃদ্ধি না হয়। জমিদারদের রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আছে। রায়তের খাজনারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হোক। জমির মালিকি স্বত্ব দেওয়া হোক রায়তকে, যাতে সে যদৃচ্ছা জমির ভোগ-ব্যবহার দান-বিক্রি করতে পারে। জমিদার থাকবে শুধু নির্দিষ্ট খাজনার মালিক, অর্থাৎ খাজনা আদায় করে রাজস্ব দেবার তহশীলদারির মুনাফার মালিক। তার অতিরিক্ত তাদের আর কিছু প্ৰাপ্য নয়। চাষের জমি তার সে-জমি যে চাষ করে শস্য ফলায়। ‘স্থাণুচ্ছেদস্য কেদারমাহুঃ শল্যবতো মৃগম’। বনের পশু বাণ দিয়ে যে মারে সে পশু তার, শস্যের খেত শস্যের জন্য যে তৈরি করে সে-খেতের জমিও তার। এইসব পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলার চাষিকে যদি চাষের জমির মালিক করা যায়, আর তার খাজনার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়, তবে তার কোনও দুঃখই থাকবে না। তার গোয়ালভরা গোরু আর গোলােভরা ধানে সোনার বাংলা প্রকৃতই সোনার বাংলা হয়ে উঠবে। এর উপায় হচ্ছে যে-সব রােয়ত-হিতৈষীরা সভা করে রায়তদের তাদের হিত বোঝাচ্ছেন ভোট দিয়ে বেশি সংখ্যায় তাদের আইনসভায় পাঠানো। যাতে রায়তদের সুবিধামতো আইন পরিবর্তন তাঁরা ঘটাতে পারে। যাদের আইনসভার সভ্য হবার, বা আত্মীয়বন্ধুদের সেখানে পাঠাবার কোনও অভিপ্ৰায় ছিল না, তাদেরও অনেকে এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই ভরসায় যে, রায়তেরা দল বাঁধলে নতুন আইনসভায় আইন মারফত রায়তের কিছু উপকার হতে পারে। আর, বাংলার রায়তের উপকার গোটা বাংলাদেশের উপকার। এই সাময়িক আন্দোলন বাংলা ভাষায় একটি স্থায়ী সাহিত্যিক ছাপ রেখে গেছে–শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ ও রবীন্দ্রনাথের লেখা তার ভূমিকা। এ আন্দোলন যে বাঙালির মনের অন্তস্তলে নাড়া দিয়েছিল এ তারই প্ৰমাণ।
মহাত্মার নন-কো-অপারেশন আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। ১৯১৯ সালের আইনে প্রতিষ্ঠিত আইনসভাগুলির সঙ্গে অসহযোগ উপলক্ষ করে। সুতরাং, কংগ্রেস প্রারম্ভে এ সভাগুলি বর্জন করল। তার ফলে অন্তত বাংলাদেশে যে স্বাদগন্ধহীন আইনসভার সৃষ্টি হল ভালমন্দ কোনও কাজ তার সাধ্য ও বুদ্ধির অতীত। চাষি ও চাষের জমি নিয়ে বিশেষ কোনও আলোচনা সে সভায় উঠল না। এবং, অসহযোগ আন্দোলনের বিজ্ঞাপিত ফল–‘ছ’মাসে স্বরাজ–যখন হাতে হাতে ফলিল না, যেমন প্ৰায় আন্দোলনের-ই ফলে না, তখন দেশব্যাপী দেখা দিল নিরাশা ও অবসাদের ভাব। তার প্রতিক্রিয়ায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও পণ্ডিত মতিলাল কংগ্রেসের মধ্যে স্বরাজ্যদল গড়ে তুললেন, তার মূল কর্মপদ্ধতি হল ১৯১৯ সালের আইনের আইনসভাগুলিকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দখল করে তাদের আচল করা, অর্থাৎ ওই আইনের শাসনপ্ৰথাকে ব্যৰ্থ করা। অসহযোগ বাইরে থেকে ভিতরে নেওয়া, বর্জনের নীতিকে বিনাশের রীতিতে রূপান্তরিত করা। এই প্ৰস্তাবের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কংগ্রেসে দু-দল দেখা দিল। প্র-গতি ও অ-গতি, প্রে-চেঞ্জার ও নো-চেঞ্জার, দলের অনেক ঝগড়াঝাঁটি ও গালমন্দের পর কংগ্রেসের অনুমতি পেয়ে পরবতী নির্বাচনে স্বরাজ্যদল আইনসভাগুলিতে ঢুকলেন, বাংলাদেশে মোটের উপর মোটা সংখ্যায়। প্রথমে কিছুকাল গেল ও সভাকে আঁচল করার চেষ্টায়। কতক সাফল্য ও মোটের উপর অসফলতার মধ্য দিয়ে শেষটা স্বরাজ্যদল হল আইনপরিষদে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধ দলের প্রধান দল–যে পরিণতি পূর্ব থেকে অনুমান করা কঠিন ছিল না। এমনধারা অবস্থায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর, ংলা পরিষদে বাংলার প্রজা ও জমিদার অর্থাৎ চাষি ও খাজনাগ্রাহীদের স্বত্বাব্স্বত্বের ১৮৮৫ সালের মূল আইনের কতকগুলি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ১৯২৮ সালে স্বরাজ্যদলের সহযোগিতা ও সহায়তায় এক আইন পাশ হল। নূতন আইনে চাষের জমির গাছে চাষি সম্পূর্ণ স্বত্ব পেল; সে জমির গাছ সে ইচ্ছামতো কেটে নিতে কি ঝড়ে বা অন্য রকমে পড়ে গেলে আত্মসাৎ করতে পারবে–জমিদারকে নজর না দিয়ে। চাষের জমিতে সে পাকা বাড়ি করতে পারবে নিজের ও পরিবারের লোকদের বসবাসের জন্য। পুকুর কাটতে পারবে নিজেদের পানীয় জলের জন্য। ইতিপূর্বে আইন ছিল চাষের বিঘ্ন ঘটালে চাষি প্রয়োজনমতো জমির গাছ কাটতে পারবে কিন্তু সে গাছ নিজে নিতে পারবে না, সে গাছ নেবে জমির জমিদার। পূর্বের আইনে চাষের জমিতে চাষি বাসের জন্য বাড়ি তৈরি করতে পারত, কিন্তু সে বাড়ি হওয়া চাই চাষির প্রয়োজনের উপযোগী, এবং সম্পূর্ণ পাকা বাড়ি চাষির প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সে আইনে চাষের জমিতে চাষি পুকুর কাটতে পারত চাষের কাজে প্রয়োজন হলে এবং চাষে নিযুক্ত মানুষ ও পশুর প্রয়োজনে, নিজের ও পরিবারের লোকদের পান-মানের প্রয়োজনে নয়। কেউ যদি মনে করেন যে, চাষিকে যাদৃচ্ছিা গাছ কাটতে দিলে জঙ্গল লোপাট হওয়ার ফলে চাষের অবনতি ঘটে, কি ক্ৰমাগত পুকুর কাটার ফলে চাষের জমির লাঘব হয়, এবং সাধ্যের অতিরিক্ত খরচে বাড়ি করে চাষি ঋণগ্রস্ত হতে পারেএসব অমঙ্গল থেকে দেশ ও চাষিকে রক্ষা করাই ছিল ও-রকম আইনের উদ্দেশ্য, তবে তিনি মস্ত ভুল করবেন। দেশের হিত কি চাষির অনিষ্টের সঙ্গে ও-সব বিধিনিষেধের কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ, জমিদারকে নজরের টাকা গুণে দিতে পারলেই ও-সব কোনও কাজেই চাষির আর বাধা থাকত না। এ সকল বিধিব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ছিল বিশুদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের উপর; ওগুলি laws of pure reason। জমিদার জমির মালিক। মালিকি স্বত্বের অর্থই হচ্ছে বস্তুকে যতরকমে সম্ভব ব্যবহার ও তা থেকে যত কিছু লাভের অধিকার। এ অধিকারের যতটুকু মালিক অন্যকে দেবে কেবল ততটুকু মাত্র তার অধিকার হবে, বাকি অধিকার মালিকের থেকে যাবে। জমিদার তার মালিকি স্বত্বের জমি চাষিকে দিয়েছে চাষের জন্য, খাজনার বিনিময়ে। সুতরাং চাষের জন্য যে ব্যবহার প্রয়োজন এবং চাষ করে যা লাভ সম্ভব, তাতেই মাত্ৰ চাষির অধিকার। এর বেশি অধিকার কি লাভ যদি সে চায়–যেমন গাছ কেটে নেবার, কি পাকা বাড়ি করবার, কি ইচ্ছামতো পুকুর কাটবার, তবে সে অধিকার জমির মালিকের কাছ থেকে খাজনার অতিরিক্ত আরও দাম দিয়ে কিনে নিতে হবে। এই দামের ভদ্রতা-সংগত নাম নজর বা সেলামি। ন্যায়ের নির্ভুল যুক্তি, এতে দেশের হিতাহিতের কোনও প্রশ্ন নেই। ১৯২৮ সালের নূতন আইনে জমিদারের খাজনা বাড়ীৰার ক্ষমতার কোনও লাঘব হল না, পূর্বের ক্ষমতাই বহাল থাকল। আন্দোলনটা খুব বেশি হয়েছিল চাষের জমি চাষির ইচ্ছামতো দান-বিক্রির দাবি নিয়ে। সুতরাং নুতন আইনে চাষিকে সে ক্ষমতা দেওয়া হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হল যে, সে-জন্য জমিদারকে জমির দামের শতকরা কুড়ি টাকা নজর দিতে হবে। পূর্বের আমলে যখন জমিদারের বিনা সম্মতিতে জমি বিক্রি করলে জমিদারের ইচ্ছা হলে ক্রেতাকে প্ৰজা স্বীকার না করে তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতেন তখনও শতকরা নিরানব্বইটি জায়গায় মোটের উপর ওই পরিমাণ নজর নিয়েই জমিদার ক্রেতাকে প্ৰজা স্বীকার করে নিতেন, যদি না কোনও কারণে জমিদার কি আমলাবাবুদের ক্রেতাকে কিঞ্চিৎ ‘শিক্ষা’ দেবার মতলব থাকত। কারণ, জমিদার জমি চায় না, চায় টাকা–আর চাষি চায় জমি। কিন্তু তখন এ টাকাটা আদায় হত কিছু দেরিতে, অল্পবিস্তর দর-কষাকষির পর। নুতন আইনে এই নজরের টাকা হাতে হাতে আদায়ে গভর্নমেন্ট হলেন জমিদারের তহশীলদার। নজরের টাকা রেজেষ্টি আপিসে জমা না দিলে বিক্রির দলিল রেজেষ্টি হবে না, এবং বিনা রেজেক্টিতে বিক্রি অসিদ্ধ। টাকাটা জমিদারের কাছে পৌঁছে দেবার ভার গভর্নমেন্ট নিজে নিলেন, অবশ্য চাষির কাছ থেকে খরচাটা নিয়ে। মোটের উপর নূতন আইনে জমিদারের আর্থিক ক্ষতি না হয়ে বরং লাভই হল। কিন্তু তবুও এটা তার মালিকি স্বত্বের উপর হস্তক্ষেপ, খেয়ালমাফিক ক্রেতাকে বহাল কি উচ্ছেদের অধিকারের সংকোচ। এর ক্ষতিপূরণ দরকার। সুতরাং বিধান হল জমিদার ইচ্ছা করলে নজরের টাকাটা না নিয়ে ক্রেতাকে জমির দাম ও তার উপর শতকরা দশ টাকা বেশি দিয়ে আদালতযোগে জমি খাস করে নিতে পারবেন। অর্থাৎ, কিছু টাকা খরচের বদলে প্রয়োজনমতো ক্রেতাকে ‘শিক্ষা’ দেবার পূর্ব ক্ষমতা জমিদারের বহাল থাকল, এবং অবস্থাবিশেষে খাস করার ভয় দেখিয়ে, মোচড় দিয়ে কিছু বেশি নজর আদায়ের পথটাও খোলা রইল। কারণ, পূর্বেই বলেছি, জমির প্রয়োজন জমিদারের কিছুমাত্র নেই, প্রয়োজন টাকার; আর চাষি জমি বেচে কিনে লাভ করতে চায় না, তার নিতান্ত প্রয়োজন জমির। ইংরেজি প্ৰবচনের কথায়, বাংলার চাষি চেয়েছিল রুটি, পেল পাথরের ঢেলা।
মহাত্মার প্রথম অসহযোগ-আন্দোলনে বাংলার চাষি, যাদের অধিকাংশ মুসলমান, কংগ্রেসের ডাকে প্রবল সাড়া দিয়েছিল, কংগ্রেসকে মনে করেছিল নিজের জিনিস। তেমন ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটেনি। এই অভূতপূর্ব অবস্থার সুযোগে বাংলার কংগ্রেসের নেতারা বাংলার রাষ্ট্ৰীয় বুদ্ধি ও আন্দোলনকে ধর্মভেদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি। নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের চিন্তা তাদের বুদ্ধিকে অন্ধ ও কর্মকে পঙ্গু করেছিল। বাংলার চাষির অনায়াসলভ্য নেতৃত্ব বাংলার কংগ্রেসের পক্ষে অসাধ্য হয়েছিল। ১৯২৮ সালের আইন-সংশোধন ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হল বাংলার আইনসভার কংগ্রেসী সভ্যদের কাছে চাষির স্বার্থের চেয়ে জমিদারের স্বাৰ্থ বড়। এই প্ৰস্তাবিত আইনের আলোচনায় স্বরাজ্যদলের এক বৈঠকে একজন বিখ্যাত নেতা বলেছিলেন যে, গাছ কেটে নেবার যে টোনা স্বত্ব চাষিকে দেওয়া হল it will strike their imagination, অর্থাৎ তাতেই বাংলার চাষিরা বাংলার কংগ্রেসের চাষি-হিতৈষণার মুগ্ধ থাকবে। বাংলার চাষি চাষা বটে, কিন্তু অতটা বোকা নয়। এর পর বাঙালি চাষির আনুগত্য বাংলার কংগ্রেস আর ফিরে পায়নি। কিন্তু জমিদারের স্বার্থরক্ষার এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত বিফল হল। ১৯২৮ সালের বিধান বেশিদিন টিকে থাকল না। অর্থাৎ বাংলার কংগ্রেসের পিয়াজ ও পয়জার দু-ই হল।
বিলাতের পার্লামেন্ট ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইন প্রণয়ন ও পাশ করলেন। এই আইনের কমু্যুনাল প্রতিনিধি ও কমু্যুনাল নির্বাচনের ব্যবস্থায় বাংলার আইনপরিষদে মুসলমান সভ্যেরা হলেন সবচেয়ে দলে ভারী। আর, এ সভ্যদের বেশির ভাগ নির্বাচিত হলেন মুসলমান চাষির ভোটের জোরে। সুতরাং, এবারকার আইনসভায় চাষির দাবি অগ্রাহ্য করে চলা আর সম্ভব হল না। ১৯৩৮ সালে ১৮৮৫ সালের টেনেসি আইন আবার সংশোধন হল। ১৯২৮ সালের আইনে চাষিরা গাছ কেটে নেবার, জমিতে ইচ্ছামতো পুকুর কাটবার ও পাকা বাড়ি তোলার যে সব স্বত্ব পেয়েছিল তা বহাল রইল। কিন্তু এবারের আইনে জমি বেচা-কেনার অধিকার হল নির্বাধি ও নিরুপদ্রব্য; ১৯২৮ সালের আইনে দেওয়া জমিদারের নজর পাওয়ার স্বত্ব ও ক্রেতার কাছ থেকে কিনে নেবার স্বত্ব দু-ই বাতিল হল। জমিদার যেমন তার জমিদারি বিক্রি করতে পারে, গভর্নমেন্টের কোনও দাবিদাওয়ার ভয় না রেখে, চাষিও তার জমি বিক্রির স্বত্ব পেল জমিদারের কোনও দাবি মেটাবার দায়ে না থেকে। চাষের জমির খাজনা বাড়াবার পূর্বের বিধি আইনের পৃষ্ঠায় বহাল থাকল বটে, কিন্তু বিধান হল ১৯৩৭ সাল থেকে দশ বছরের জন্য ও-সব বিধির প্রয়োগ বন্ধ থাকবে, অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যে জমির খাজনা আর বাড়ানো চলবে না। এই সাময়িক বাধা যে জমিদারের খাজনা বাড়াবার স্বত্বের লোপ বা বিশেষ সংকোচের সূচনা, তাতে কারও সন্দেহ নেই। এবং এই লোপ বা সংকোচের আইন বিধিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওই দশ বছরের মেয়াদ যে মাঝে মাঝে আইন করে বাড়ানো হবে, তাও নিঃসন্দেহ।
১৮৮৫ সালের টেনেন্সি আইন পাশের প্রাককালে কবি হেমচন্দ্ৰ লিখেছিলেন–
টেনেন্সি বিল নামে আইন হচ্ছে তৈয়ার করা,
গয়া গঙ্গা গদাধর ভূস্বামী প্রজারা।
অর্থাৎ, ও আইনে চাষের জমিতে জমিদারদের মালিকি স্বত্বের গয়াশ্রাদ্ধ হয়ে গেল। সে আইনে তেমন কিছুই হয়নি, মাসিক শ্ৰাদ্ধও নয়। কিন্তু ১৯৩৮ সালের আইনে গায়াশ্রাদ্ধ হয়ে জমিদারের মালিকি স্বত্বের প্ৰেতাত্মা দূর না হোক, সে স্বত্বের যে সপিণ্ডীকরণ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুকে ইচ্ছামতো অগুন্তি রকমে ব্যবহারে লাগাবার অধিকার যদি হয় মালিকি স্বত্ব তবে বাংলাদেশের চাষের জমিতে মালিকি স্বত্ব মোটামুটি এসেছে চাষির হাতে, নির্দিষ্ট খাজনা পাবার অধিকার ছাড়া আর বেশি কিছু অধিকার জমিদারের অবশিষ্ট নেই। ১৯১৯ সালের ভারতশাসন আইনের সমসাময়িক রােয়ত-আন্দোলনে চাষিদের পক্ষে যে সব দাবি উপস্থিত করা হয়েছিল, ১৯৩৮ সালে তার প্রায় সমস্তই পূরণ হয়েছে। কিন্তু বাংলার চাষির গোয়াল যদি গোরুতে ভরতি হয়ে থাকে, আর তার গোলা যদি ধানে বোঝাই হয়ে গিয়ে থাকে–তার একমাত্র কারণ, সে গোয়াল ও গোলা নিতান্তই ছোট; পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। চাষের জমির মালিকি স্বত্ব পেয়ে বাংলার চাষির আর্থিক দুৰ্দশা কিছুই ঘোচেনি। সোনার বাংলা কবিতা ও গানের ‘সোনার বাংলা’ রয়ে গেছে।