১. চাঁদপাল ঘাট

মরণের ডঙ্কা বাজে – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

চাঁদপাল ঘাট থেকে রেঙ্গুনগামী মেল স্টিমার ছাড়ছে। বহু লোকজনের ভিড়। পুজোর ছুটির ঠিক পরেই। বর্মা প্রবাসী দু-চারজন বাঙালি পরিবার রেঙ্গুনে ফিরচে। কুলিরা মালপত্র তুলচে। দড়াদড়ি ছোঁড়াছুড়ি, হইহই। ডেকযাত্রীদের গোলমালের মধ্যে জাহাজ ছেড়ে গেল। যারা আত্মীয়স্বজনকে তুলে দিতে এসেছিল, তারা তীরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়তে লাগল।

সুরেশ্বরকে কেউ তুলে দিতে আসেনি। কারণ কলকাতায় তার জানাশোনা বিশেষ কেউ নেই! সবে চাকরিটা পেয়েছে, একটা বড়ো ঔষধ-ব্যবসায়ী ফার্মের ক্যানভাসার হয়ে সে যাচ্ছে রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর।

সুরেশ্বরের বাড়ি হুগলি জেলার একটা গ্রামে। বেজায় ম্যালেরিয়ায় দেশটা উচ্ছন্ন গিয়েছে, গ্রামের মধ্যে অত্যন্ত বনজঙ্গল, পোড়ো বাড়ির ইট পাকার হয়ে পথে যাতায়াত বন্ধ করেছে, সন্ধ্যার পর সুরেশ্বরদের পাড়ায় আলো জ্বলে না।

ওদের পাড়ায় চারিদিকে বনজঙ্গল ও ভাঙা পোডড়াবাড়ির মধ্যে একমাত্র অধিবাসী সুরেশ্বররা। কোনো উপায় নেই বলেই এখানে পড়ে থাকা–নইলে কোন কালে উঠে গিয়ে শহর-বাজারের দিকে বাস করত ওরা।

সুরেশ্বর বি. এস-সি. পাস করে এতদিন বাড়িতে বসে ছিল। চাকরি মেলা দুর্ঘট আর কে-ই বা করে দেবে–এই সবের জন্যেই সে চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। তার বাবা সম্প্রতি পেনসন নিয়ে বাড়ি এসে বসেছেন, খুব সামান্যই পেনসন–সে আয়ে সংসার চালানো কায়ক্লেশে হয়; কিন্তু তাও পাড়াগাঁয়ে। শহরে সে আয়ে চলে না। বছর খানেক বাড়ি বসে থাকবার পরে সুরেশ্বর গ্রামে আর থাকতে পারলে না। গ্রামে নেই লোকজন। তার সমবয়সি এমন কোনো ভদ্রলোকের ছেলে নেই যার সঙ্গে দু-দন্ড কথাবার্তা বলা যায়। সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়াই গ্রামের নিয়ম। তারপর কোনোদিকে সাড়াশব্দ নেই।

ক্রমশ এ জীবন সুরেশ্বরের অসহ্য হয়ে উঠল। সে ঠিক করলে কলকাতায় এসে টিউশনি করেও যদি চালায়, তবুও তো শহরে থাকতে পারবে এখন।

আজ মাস পাঁচ-ছয় আগে সুরেশ্বর কলকাতায় আসে এবং দেশের একজন পরিচিত লোকের মেসে ওঠে। এতদিন এক-আধটা টিউশনি করেই চালাচ্ছিল, সম্প্রতি এই চাকরিটা পেয়েছে, তারই এক ছাত্রের পিতার সাহায্যে ও সুপারিশে। সঙ্গে তিন বাক্স ঔষধ-পত্রের নমুনা আছে বলে তাদের ফার্মের মোটরগাড়ি ওকে চাঁদপাল ঘাটে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল।

এই প্রথম চাকরি এবং এই প্রথম দূর বিদেশে যাওয়া–সুরেশ্বরের মনে খানিকটা আনন্দ ও খানিকটা বিষাদ মেশানো এক অদ্ভুত ভাব। একদল মানুষ আছে, যারা অজানা দূর বিদেশে নতুন নতুন বিপদের সামনে পড়বার সুযোগ পেলে নেচে ওঠে–সুরেশ্বর ঠিক সে দলের নয়। সে নিতান্তই ঘরকুনো ও নিরীহ ধরনের মানুষ–তার মতো লোক নিরাপদে চাকরি করে আর দশজন বাঙালি ভদ্রলোকের মতো নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম পালন করতে পারলে সুখী হয়।

তাকে যে বিদেশে যেতে হচ্ছে–তাও যে-সে বিদেশ নয়, সমুদ্র পারের দেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে–সে নিতান্তই দায়ে পড়ে। নইলে চাকরি থাকে না! সে চায়নি এবং ভেবেও রেখেছে এইবার নিরাপদে ফিরে আসতে পারলে অন্য চাকরির চেষ্টা করবে।

কিন্তু জাহাজ ছাড়বার পরে সুরেশ্বরের মন্দ লাগছিল না। ধীরে ধীরে বোটানিক্যাল গার্ডেন, দুই তীর-ব্যাপী কলকারখানা পেছনে ফেলে রেখে প্রকান্ড জাহাজখানা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভোর ছটায় জাহাজ ছেড়েছিল, এখন বেশ রৌদ্র উঠেছে, ডেকের একদিকে অনেকখানি জায়গায় যাত্রীরা ডেক-চেয়ার পেতে গল্পগুজব জুড়ে দিয়েছে, স্টিমারের একজন কর্মচারী সবাইকে বলে গেল পাইলট নেমে যাওয়ার আগে যদি ডাঙায় কোনো চিঠি পাঠানো দরকার হয় তা যেন লিখে রাখা হয়।

বয় এসে বললে–আপনাকে চায়ের বদলে আর কিছু দেব?

সুরেশ্বর সেকেণ্ড ক্লাসের যাত্রী, সে চা খায় না, এখবর আগেই জানিয়েছিল এবং কিছু আগে সকলকে চা দেওয়ার সময়ে চায়ের পেয়ালা সে ফেরত দিয়েছে।

সুরেশ্বর বললে–না, কিছু দরকার নেই।

বয় চলে গেল।

এমন সময় কে একজন বেশ মার্জিত ও ভদ্র সুরে পেছনের দিক থেকে জিজ্ঞেস করলে– মাপ করবেন, মশায় কি বাঙালি।

সুরেশ্বর পেছনে ফিরে বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখলে এইমাত্র একজন নব আগন্তুক যাত্রী তার ডেক-চেয়ার পাতবার মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়েছে ও তাকে প্রশ্ন করছে। তার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়, একহারা, দীর্ঘ সুঠাম চেহারা। সুন্দর মুখশ্রী, চোখ দুটি বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল–সবসুদ্ধ মিলিয়ে বেশ সুপুরুষ।

সুরেশ্বর উত্তর দেওয়ার আগেই সে লোকটি হাসিমুখে বললে–কিছু মনে করবেন না, একসঙ্গেই ক-দিন থাকতে হবে আপনার সঙ্গে, একটু আলাপ করে নিতে চাই। প্রথমটা বুঝতে পারিনি আপনি বাঙালি কিনা।

সুরেশ্বর হেসে বললে–এর আর মনে করবার কী? ভালোই তো হল আমার পক্ষেও। সেকেণ্ড ক্লাসে আর কি বাঙালি নেই?

না, আর যাঁরা যাচ্ছেন–সবাই ডেকে। একজন কেবল ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। আপনি কতদূর যাবেন–রেঙ্গুনে?

আপাতত তাই বটে–সেখান থেকে যাব সিঙ্গাপুর।

বেশ, বেশ খুব ভালো হল। আমিও তাই। সরে এসে বসুন এদিকে, আপনার সঙ্গে একটু ভালো করে আলাপ জমিয়ে নিই। বাঁচলুম আপনাকে পেয়ে।

সুরেশ্বর শীঘ্রই তার সঙ্গীটির বিষয়ে তার নিজের মুখেই অনেক কথা শুনলে। ওর নাম বিমলচন্দ্র বসু, সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে ডাক্তারি করবার চেষ্টায় সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। বিমলের বাড়ি কলকাতায়, ওদের অবস্থা বেশ ভালোই। ওদের পাড়ার এক ভদ্রলোকের বন্ধু সিঙ্গাপুরে ব্যাবসা করেন, তাঁর নামে বিমল চিঠি নিয়ে যাচ্ছে।

কথাবার্তা শুনে সুরেশ্বরের মনে হল বিমল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সাহসী। নতুন দেশে নতুন জীবনের মধ্যে যাবার আনন্দেই সে মশগুল। সে বেশ সবল যুবকও বটে। অবশ্য সুরেশ্বর নিজেও গায়ে ভালোই শক্তি ধরে, এক সময়ে রীতিমতো ব্যায়াম ও কুস্তি করত, তারপর গ্রামে অনেকদিন থাকার সময়ে সে মাটি-কোপানো, কাঠ-কাটা প্রভৃতি সংসারের কাজ নিজের হাতে করত বলে হাত-পা যথেষ্ট শক্ত ও কর্মক্ষম।

ক্রমে বেলা বেশ পড়ে এল। সুরেশ্বর ও বিমল ডেকে বসে নানারকম গল্প করছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে হঠাৎ বিমল বললে–আমি একবার কেবিন থেকে আসি, আপনি বসুন। ডায়মণ্ডহারবার ছাড়িয়েছে, এখুনি পাইলট নেমে যাবে। আমার চিঠিপত্র দিতে হবে ওর সঙ্গে। আপনি যদি চিঠিপত্র দেন তবে এই বেলা লিখে রাখুন।

সাগর-পয়েন্টের বাতিঘর দূর থেকে দেখা যাওয়ার কিছু আগেই কলকাতা বন্দরের পাইলট জাহাজ থেকে নেমে একখানা স্টিমলঞ্চে কলকাতার দিকে চলে গেল।

সাগর-পয়েন্ট ছাড়িয়ে কিছু পরেই সমুদ্র–কোনো দিকে ডাঙা দেখা যায় না–ঈষৎ ঘোলা ও পাটকিলে রঙের জলরাশি চারিধারে। সন্ধ্যা হয়েছে, সাগর-পয়েন্টের বাতিঘরে আলো ঘুরে ঘুরে জ্বলছে, কতকগুলি সাদা গাংচিল জাহাজের বেতারের মাস্তুলের ওপর উড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত করছে বলে বিমল কেবিন থেকে ওভার-কোটটা আনতে গেল, সুরেশ্বর ডেকে বসে রইল।

জ্যোৎস্না রাত। ডেকের রেলিং-এর ধারে চাঁদের আলো এসে পড়েছে, সুরেশ্বরের মন এই সন্ধ্যায় খুবই খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ বাড়ির কথা ভেবে, বৃদ্ধ বাপ-মায়ের কথা ভেবে, আসবার সময়ে বোন প্রভার অশ্রুসজল করুণ মুখখানির কথা ভেবে।

পূর্বেই বলেছি সুরেশ্বর নিরীহ প্রকৃতির ঘরোয়া ধরনের লোক। বিদেশে যাচ্ছে তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, চাকরির খাতিরে। বিমল যদিও সুরেশ্বরের মতো ঘরকুনো নয়, তবুও তার সিঙ্গাপুরে যাবার মধ্যে কোনো দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা ছিল না। সে চিঠি নিয়ে যাচ্ছে পরিচিত বন্ধুর নিকট থেকে সেখানকার লোকের নামে, তারা ওকে সন্ধান বলে দেবে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে; তারপর বিমল সেখানে একখানা বাড়ি ভাড়া নিয়ে গেটের গায়ে নাম-খোদাই পেতলের পাত বসিয়ে শান্ত ও সুবোধ বালকের মতো ডাক্তারি আরম্ভ করে দেবে–এই ছিল তার মতলব। যেমন পাঁজজনে দেশে বসে করছে, সে না হয় গিয়ে করবে সিঙ্গাপুরে।

কিন্তু দু-জনেই জানত না একটা কথা।

তারা জানত না যে নিরুপদ্রব, শান্তভাবে ডাক্তারি ও ওষুধের ক্যানভাসারি করতে তারা যাচ্ছে না–তাদের অদৃষ্ট তাদের দুজনকে একসঙ্গে গেঁথে নিয়ে চলেছে এক বিপদসংকুল পথযাত্রা এবং তাদের দুজনের জীবনের এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার দিকে।

.

জাহাজ সমুদ্রে পড়েছে। বিস্তীর্ণ জলরাশি ও অনন্ত নীল আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।

একদিন দুপুরে বিমল সুরেশ্বরকে উত্তেজিত সুরে ডাক দিয়ে বললে–চট করে চলে আসুন, দেখুন, কী একটা জন্তু!

জন্তুটা আর কিছু নয়, উড্ডীয়মান মৎস্য। জাহাজের শব্দে জল থেকে উঠে খানিকটা উড়ে আবার জলে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। জীবনে এই প্রথম সুরেশ্বর উড্ডীন মৎস্য দেখলে; ছেলেবেলায় চারুপাঠে ছবি দেখেছিল বটে।

মাঝে মাঝে অন্য অন্য জাহাজের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রায়ই কলিকাতাগামী জাহাজ।

ওরা জাহাজের নাম পড়ছে–ওরা কেন, সবাই। এ অকূল জলরাশির দেশে অন্য একখানা জাহাজ ও অন্য লোকজন দেখতে পাওয়া যেন কত অভিনব দৃশ্য! শত শত যাত্রী ঝুঁকে পড়েছে সাগ্রহে রেলিংয়ের ওপর, নাম পড়ছে, কত কী মন্তব্য করছে। ওরাও নাম পড়লে– একখানার নাম ড্যাবহাউসি, একখানার নাম ইরাবতী, একখানার নামের কোনো মানে হয় না–কিলাওয়াজা–অন্তত ওরা তো কোনো মানে খুঁজে পেলে না। একখানা জাপানি এন. ওয়াই.কে. লাইনের জাহাজ হিদজুমারু, উদীয়মান সূর্য আঁকা পতাকা ওড়ানো।

দু-দিনের দিন রাত্রে বেসিন লাইট হাউসের আলো ঘুরে ঘরে জ্বলতে দেখা গেল।

সুরেশ্বর সমুদ্র-পীড়ায় কাতর হয়ে পড়েছে, কিন্তু বিমল ঠিক খাড়া আছে, যদিও তার খাওয়ার ইচ্ছা প্রায় লোপ পেয়েচে। সুরেশ্বর তো কিছুই খেতে পারে না, যা খায় পেটে তলায় না, দিনরাত কেবিনে শুয়ে আছে, মাথা তুলবার ক্ষমতা নেই।

জাহাজের স্টুয়ার্ড এসে দেখে গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে চলে যায়।

কী বিশ্রী জিনিস এই পরের চাকরি! এত হাঙ্গামা পোয়ানো কি ওর পোয়? দিব্যি ছিল, বাড়িতে খাচ্ছিল-দাচ্ছিল। চাকরির খাতিরে বিদেশে বেরিয়ে কী ঝকমারি দেখো তো!

বিমল আপন মনে ডেকে বসে বই পড়ে, ঘূর্তিতে শিস দেয়, গান করে। সুরেশ্বরকে ঠাট্টা করে বলে–হোয়াট এ গুড সেলার ইউ আর!

তিন দিন দুই রাত্রি ক্রমাগত জাহাজে চলবার পরে তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় এলিফ্যান্ট পয়েন্টের লাইট হাউস দেখা গেল।

বেলাভূমি যদিও দেখা যায় না, তবুও সমুদ্রের জলের ঘোর নীল রং ক্রমশ সবুজ হয়ে ওঠাতে বোঝা গেল যে ডাঙা বেশি দূরে নেই। ডাঙার গাছপালা মাঝে মাঝে জলে ভাসতে দেখা যাচ্ছে।

সন্ধ্যার অল্প পরেই জাহাজ ইরাবতীর মোহনায় প্রবেশ করলে। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের সাইরেন বেজে উঠল, রয়েল মেলের নিশান উঠিয়ে দেওয়া হল মাস্তুলে। সন্ধ্যাকাশ তখনও যেন লাল। সন্ধ্যাতারার সঙ্গে চাঁদ উঠেছে পশ্চিমাকাশে–ইরাবতীবক্ষে চাঁদের ছায়া পড়েছে।

জাহাজ কিছুদূর গিয়ে নোঙর ফেললে। রাত্রে ইরাবতী নদীতে বড়ো জাহাজ চালানোর নিয়ম নেই। রেঙ্গুনের পাইলট রাত্রে জাহাজে থাকবে সকালে ইরাবতী বক্ষে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে।

ভোরবেলায় কেবিন থেকে ঘুম চোখে বেরিয়ে এসে সুরেশ্বর দেখলে জাহাজ চলছে ইরাবতীর দুই তীরের সমতলভূমি ও ধানখেতের মধ্যে দিয়ে। যতদূর চোখ যায় নিম্ন বঙ্গের মতো শস্যশ্যামলা ঘন সবুজ ভূমি, কাঠের ঘরবাড়ি। তারপরেই রেঙ্গুনে পৌঁছে গেল জাহাজ।

সুরেশ্বর বা বিমল কেউ রেঙ্গুনে নামবে না। সুরেশ্বরের রেঙ্গুনে কাজ আছে বটে কিন্তু সে ফিরবার মুখে। ওরা দুজনেই এ জাহাজ থেকে সিঙ্গাপুরগামী জাহাজে ওদের জিনিসপত্র রেখে শহর বেড়াতে বেরোলো।

বেশি কিছু দেখবার সময় নেই। দুপুরের পরেই সিঙ্গাপুরের জাহাজ ছাড়বে, জাহাজের পার্সার বলে দিলে বেলা সাড়ে বারোটার আগেই ফিরে আসতে।

নতুন দেশ, নতুন মানুষের ভিড়। ওরা যা কিছু দেখছে, বেশ লাগছে ওদের চোখে। লেক, পার্ক ও সোয়েডাগোং প্যাগোডা দেখে ওরা জাহাজে ফিরবার কিছু পরেই জাহাজ ছেড়ে দিলে।

আবার অকূল সমুদ্রে অনন্ত জলরাশি।

একদিন সুরেশ্বর বিমলকে বললে–দেখো বিমল, কাল রাত্রে বড়ো একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি–এ কয়দিনের মেলামেশায় তাদের পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা তুমি-তে পৌঁচেছে।

কী স্বপ্ন?

তুমি আর আমি ছোটো একটা অদ্ভুত গড়নের বজরা নৌকা করে সমুদ্রে কোথায় যাচ্ছি। সে ধরনের বজরা আমি ছবিতে দেখেছি, ঠিক বোঝাতে পারছি নে এখন। তারপর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল, খালি ধোঁয়া–বিশ্রী কালো ধোঁয়া–

আমরা বাঁচলাম তো! না খসলাম?

কথা শেষ করে বিমল হো হো করে হেসে উঠল। সুরেশ্বর চুপ করে রইল।

বিমল বললে–আমি একটা প্রস্তাব করি শোনো। চলো দু-জনে সিঙ্গাপুর গিয়ে একটা জায়গা বেছে নিয়ে ডাক্তারখানা খুলি। তুমি তোমার কোম্পানিকে বলে ওষুধ আনাবে। বেশ ভালো হবে। আমি ডাক্তারি করব।

রেঙ্গুন থেকে জাহাজ ছেড়ে দুইদিন দুই রাত অনবরত যাওয়ার পরে চতুর্থ দিন ভোরে জমি দেখা গেল! রেঙ্গুনের মতো সমতলভূমি নয়, উঁচু-নীচু, যেদিকে চাও সেদিকে পাহাড়। উপকূলের চতুর্দিকেই মাছ ধরবার বিপুল আয়োজন, বড়ো বড়ো কালো রঙের খুঁটি দিয়ে ঘেরা, জাল ফেলা। জেলেদের থাকবার টিনের ঘর। পালতোলা জেলে-ডিঙিতে অহরহ তীর আচ্ছন্ন।

পিনাং বন্দরে জাহাজ ঢুকবামাত্রই অসংখ্য সামপান এসে জাহাজের চারিধারে ঘিরলে। মাঝিরা সকলেই চীনেম্যান।

ওরা সামপানে করে বন্দরে নেমে শহর দেখতে বার হল। ঘণ্টা হিসেবে দু-জনে একখানা রিকশা করলে–ঘণ্টা-পিছু কুড়ি সেন্ট ভাড়া।

পিনাঙে ঠিক সমুদ্রতীরে একটু সমতলভূমি, চারিদিকেই পাহাড়, অনেকগুলো ছোটো নদী এই সব পাহাড় থেকে বার হয়ে শহরের মধ্যে দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে।

ওরা একটা পাহাড়ের ওপর চীনা মঠ দেখতে গেল। পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি, বাগান, পুরোহিতের ঘর, দেবমন্দির স্তরে স্তরে উঠেছে। বাগানের চারিদিকে নালার ঝরনার স্রোতে কত পদ্মগাছ। মন্দিরের মধ্যে টেস্ট ধর্মজ দেবমূর্তি।

এদের মধ্যে একটি মূর্তি দেখে সুরেশ্বর চমকে দাঁড়িয়ে গেল।

কোন চীনা দেবতার মূর্তি, কুটি-কুটিল, কঠিন রুক্ষ মুখ। হাতে অস্ত্র, দাঁড়াবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত আক্রোশপূর্ণ। সমস্ত পৃথিবী যেন ধ্বংস করতে উদ্যত।

বিমল বললে–কী, দাঁড়ালে যে?

দেখছ মূর্তিটা? মুখ-চোখের কী ভয়ানক নিষ্ঠুর ভাব দেখেছ?

মন্দিরের পুরোহিতদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল ওটি টেস্ট রণ দেবতার মূর্তি।

হঠাৎ সুরেশ্বর বললে–চলো, এখান থেকে চলে যাই।

বিস্মিত বিমল বললেও কী। পাহাড়ের উপরে যাবে না?

সুরেশ্বর আর উঠতে অনিচ্ছুক দেখে বিমল ওকে নিয়ে জাহাজে ফিরল।

পথে বললে–তোমার কী হল হে সুরেশ্বর? ওরকম মুখ গম্ভীর করে মনমরা হয়ে পড়লে কেন?

সুরেশ্বর বললে–কই না, ও কিছু নয়, চলো।

জাহাজে ফিরে এসেও কিন্তু সুরেশ্বরের সে ভাব দূর হল না। ভালো করে কথা কয় না, কী যেন ভাবছে। নৈশভোজের টেবিলে ও ভালো করে খেতেও পারলে না।

রাত ন-টার পরে পিনাং থেকে জাহাজ ছাড়লে সুরেশ্বর যেন কিছু স্বস্তি অনুভব করলে। পিনাং বন্দরের জেটির আলোকমালা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওরা ডেকে এসে বসেছে নৈশভোজের পরে।

হঠাৎ সুরেশ্বর বলে উঠল–উঃ কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম ওই চীনাদেবতার মূর্তিটা দেখে!

বিমল হেসে বললে–আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু, সত্যি তুমি এত ভীতু তা তো জানি নে! স্বীকার করি মূর্তিটা অবিশ্য কমনীয় নয়, তবুও

সুরেশ্বর গম্ভীর মুখে বললে–আমার মনে হচ্ছে কী জান বিমল? আমরা যেন এই দেবতার কোপদৃষ্টিতে পড়ে গিয়েছি। সবসময় সব জায়গায় যেতে নেই। আমরা সন্ধ্যাবেলা ওই চীনে মন্দিরে গিয়ে ভালো কাজ করিনি।

পিনাং থেকে ছাড়বার তিন দিন পরে জাহাজ সিঙ্গাপুর পৌঁছোলো।

দূর থেকে সিঙ্গাপুরের দৃশ্য দেখে বিমল ও সুরেশ্বর খুব খুশি হয়ে উঠল। শুধু মালয় উপদ্বীপ কেন সমগ্র এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর একটি প্রধান বন্দর, বন্দরে ঢুকবার সময়েই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল!

অসংখ্য ছোটো ছোটো পাহাড় জলের মধ্য থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, তাদের ওপর সুদৃশ্য ঘরবাড়ি–চারিদিকে পিনাং-এর মতো মাছ ধরবার প্রকান্ড আড্ডা! নীল রং-এ চিত্রিত চক্ষু ড্রাগন, ঝোলানো পালতোলা সেই চীনা জাঙ্ক ও সামপানে সমুদ্রবক্ষ আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

বন্দরে ঢোকবার মুখেই একখানা ব্রিটিশ যুদ্ধ-জাহাজ প্রায় মাঝ-দরিয়ায় নোঙর করে আছে। কয়লা নেবার জন্যে। তার প্রকান্ড ফোকরওয়ালা দুই কামান ওদের দিকে মুখ হাঁ করে আছে। যেন ওদের গিলবার লোভে। আরও নানা ধরনের জাহাজ, স্টিমলঞ্চ, সামপানে, মালয় নৌকার ভিড়ে বন্দরের জল দেখা যায় না। যেদিকে চোখ পড়ে শুধু নৌকো আর জাহাজ, বিমলের মনে হল কলকাতা এর কাছে কোথায় লাগে? তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বড়ো বন্দর।

চারিধারেই বারসমুদ্র, বন্দরের মুখে ছোটো-বড়ো জাহাজ দাঁড়িয়ে, তাদের মধ্যে আর দু খানা বড়ো যুদ্ধ-জাহাজ ওদের চোখে পড়ল। বন্দরে উত্তর-পূর্ব কোণে তিন মাইলের পরে বিখ্যাত নৌবহরের আড্ডা। দূর থেকে দেখা যায়, বড়ো বড়ো ইস্পাতের খুঁটি, বেতারের মাস্তুলে সে-দিকটা অরণ্যের সৃষ্টি করেছে।

জাহাজের কয়লা নেবার একটা প্রধান আড্ডা সিঙ্গাপুর। পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে পূর্বগামী সব রকম জাহাজকেই এখানে দাঁড়াতে হবে কয়লার জন্যে। এর বিপুল ব্যবস্থা আছে, বহুদূর ধরে পর্বতাকারে কয়লা রক্ষিত হয়েছে, যেন সমুদ্রের ধারে ধারে অনেক দূর পর্যন্ত একটা অবিচ্ছিন্ন কয়লার পাহাড়ের সারি চলে গিয়েছে।

বন্দরে জাহাজ এসে থামলে সুরেশ্বর ও বিমল চীনে কুলি দিয়ে মালপত্র এনে দু-খানা রিকশা ভাড়া করলে। ওরা দুজনেই একটা ভারতীয় হোটেল দেখে নিয়ে সেখানে উঠল। বিকালের দিকে সুরেশ্বর তার ওষুধের ফার্মের কাজে কয়েক জায়গায় ঘুরে এল, বিমল যে ভদ্রলোকের নামে চিঠি এনেছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেল।

সন্ধ্যার পূর্বে সুরেশ্বর জিজ্ঞেস করলে, কী হয়েছে? অমনভাবে বসে কেন?

বিমল বললে–ভাই এতদূরে পয়সা খরচ করে আসাই মিথ্যে হল। আমি যা ভেবে এখানে এলুম তা হবার কোনো আশা নেই। যে ভদ্রলোকের নামে চিঠি এনেছিলাম, তাঁর নিজের ভাগনে ডাক্তার হয়ে এসে বসেছে। আমার কোনো আশাই নেই।

সুরেশ্বর বললে–তাতে কী হয়েছে? এত বড় সিঙ্গাপুর শহরে দু-জন বাঙালি ডাক্তারের স্থান হবে না? ক্ষেপেছ তুমি? আমি ওষুধের দোকান খুলছি, তুমি সেখানে ডাক্তার হয়ে বোসো! দেখো কী হয় না হয়।

হঠাৎ সুরেশ্বরের মনে হল তাদের ঘরের বাইরে জানালার কাছে কে যেন একজন ওদের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে।

বিমল বললে–ও কে?

সুরেশ্বর তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলে। তার মনে হল একজন যেন বারান্দার মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সে ফিরে এসে বললে–ও কিছু না, কে একজন গেল।

তারপর ওরা দু-জনে অনেক রাত পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের ভারতীয় পাড়ায় একখানা ওষুধের দোকান খুলবার সম্বন্ধে জল্পনা করলে। বিমল হাজার খানেক টাকা এখন ঢালতে প্রস্তুত আছে, সুরেশ্বর নিজেদের ফার্মকে বলে ওষুধের জোগাড় করবে।

বড়ো ডাকঘরের ক্লক টাওয়ারে ঢং ঢং করে রাত এগারোটা বাজল। হোটেলের চাকর এসে দু-জনের খাবার দিয়ে গেল। শিখের হোটেল, মোটা মোটা সুস্বাদু রুটি ও মাংস, আস্ত মাসকলায়ের ডাল ও আলুর তরকারি–এই আহার্য। সারাদিনের ক্লান্তির পরে তা অমৃতের মতো লাগল ওদের।

আহারাদি সেরে সুরেশ্বর শোবার জোগাড় করতে যাচ্ছে এমন সময় বিমল হঠাৎ দরজার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে।

সুরেশ্বর বললে–কী?

বিমল ফিরে এসে বিছানায় বসল। বললে–আমার ঠিক মনে হল কে একজন জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কাউকে দেখলুম না কিন্তু–

সুরেশ্বরের কীরকম সন্দেহ হল। বিদেশ-বিভুই জায়গা, নানারকম বিপদের আশঙ্কা এখানে পদে পদে। সে বললে–সাবধান থাকাই ভালো। দরজা বেশ বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ো। রাতও হয়েছে অনেক।

সুরেশ্বরের ঘুম ছিল সজাগ। তা অনেক রাত্রে একটা কীসের শব্দে ও ঘুম ভেঙে বিছানার ওপর উঠে বসল সন্দিগ্ধ মন নিয়ে।

বিছানার শিয়রের দিকে জানলাটা খোলা ছিল। বিছানা ও জানলার মধ্যে একটা ছোটো টেবিলের দিকে নজর পড়াতে সুরেশ্বর দেখলে টেবিলটার ওপর ঢিল জড়ানো একটুকরো কাগজ। এটাই বোধ হয় একটু আগে জানলা দিয়ে এসে পড়েছে, তার শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ঘরে আলো জ্বালাই ছিল। কাগজের টুকরোটা ও পড়লে, তাতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে–

আপনারা ভারতীয়! যতদূর জানতে পেরেছি সিঙ্গাপুরে আপনারা নবাগত ও চিকিৎসা ব্যবসায়ী। কাল দুপুর বেলা বোটানিক্যাল গার্ডেনে অর্কিডের ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে যে বড়ো ডুরিয়ান ফলের গাছ আছে, তার নীচে অপেক্ষা করবেন দু-জনেই। আপনাদের দু জনের পক্ষেই লাভজনক কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হবে। আসতে ইতস্তত করবেন না।

লেখার নীচে নাম-সই নেই।

বিমলও কাগজখানা পড়লে।

ব্যাপার কী? এ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ দু-জনেই নীরব।

সুরেশ্বর প্রথমে কথা বললে। বললে–কেউ তামাশা করেছে বলে মনে হচ্ছে, কী বলো? কিন্তু তাই বা করবে কে, আমাদের চেনেই-বা কে?

বিমল চিন্তিত মুখে বললে–কিছু বুঝতে পারছি নে। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না কি?

কী খারাপ উদ্দেশ্য আমরা যে খুব বড়োলোক নই, তার প্রমাণ ভিক্টোরিয়া হোটেল বা এম্পায়ার হোটেলে না উঠে এখানে উঠেছি। টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়েও যাচ্ছিনে। সুতরাং কী করতে পারে আমাদের?

সে রাত্রের মতো দু-জনে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে উঠে বিমল বললে–চলে যাওয়াই যাক। এত ভয় কীসের? বোটানিক্যাল গার্ডেন তো আর নির্জন মরুভূমি নয়, সেখানে কত লোক বেড়ায় নিশ্চয়ই। দু-জনকে খুন করে দিনের আলোয় টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যাবে, এত ভরসা কারোর হবে না।

দুপুরের পরে হোটেল থেকে বেরিয়ে কুয়ালা জোহোর স্ট্রিটের মোড় থেকে একখানা রিকশা ভাড়া করলে। ম্যাসিডন কোম্পানির সোডাওয়াটারের দোকানের সামনে একজন চীনা ভদ্রলোক ওদের রিকশা থামিয়ে চীনে রিকশাওয়ালাকে কী জিজ্ঞেস করলে। তারপর উত্তর পেয়ে লোকটি চলে গেল। বিমল রিকশাওয়ালাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলে–কী বললে তোমাকে হে?

রিকশাওয়ালা বললে–জিজ্ঞেস করলে সওদাগরি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

তুমি কী বললে?

অমি কিছু বলিনি। বলবার নিয়ম নেই আমাদের। সিঙ্গাপুর খারাপ জায়গা, মিস্টার। বোটানিক্যাল গার্ডেন শহর ছাড়িয়ে প্রায় দু-মাইল দূরে। শহর ছাড়িয়েই প্রকান্ড একটা কীসের কারখানা। তারপর পথের দু-ধারে ধনী মালয়, ইউরোপীয় ও চীনাদের বাগানবাড়ি। এমন ঘন সবুজ গাছপালার সমাবেশ ও শোভা, বিমল ও সুরেশ্বর বাংলা দেশের ছেলে হয়েও দেখেনি –কারণ বিষুব রেখার নিকটবর্তী এইসব স্থানের মতো উদ্ভিদ সংস্থান ও প্রাচুর্য পৃথিবীর অন্য কোথাও হওয়া সম্ভব নয়।

মাঝে মাঝে রবারের বাগান।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে পৌঁছে ওরা রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদেয় করলে। প্রকান্ড বড়ো বাগান। কত ধরনের গাছপালা, বেশিরভাগই মালয় উপদ্বীপজাত। বড়ো বড়ো রুটিফলের গাছ, ডুরিয়ান পাকবার সময় বলে ডুরিয়ান ফলের গাছের নীচে দিয়ে যেতে। পাকা ডুরিয়ান ফলের দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের নারিকেলকুঞ্জ একটি অদ্ভুত সৌন্দর্যময় স্থান। এত উঁচু উঁচু নারিকেল গাছের এমন ঘন সন্নিবেশ ওরা কোথাও দেখেনি। নিস্তব্ধ দুপুরে নারিকেল বৃক্ষশ্রেণীর মাথায় কী পাখি ডাকছে সুস্বরে, আকাশ সুনীল, জায়গাটা বড়ো ভালো লাগল ওদের। অর্কিডহাউস খুঁজে বার করে তার উত্তর-পূর্ব কোণে সত্যই খুব বড়ো একটা ডুরিয়ান ফলের গাছ দেখা গেল। সে ঘাছেরও ফল পেকে যথারীতি দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

বিমল বললে–একটু সতর্ক থাকো। দেখা যাক না কী হয়!

সবুজ টিয়ার ঝাঁক গাছের ডালে ডালে উড়ে বসছে। একটা অপূর্ব শান্তি চারিদিকে ওরা দু-জনে ডুরিয়ান গাছের ছায়ায় শুকনো তালপাতা পেতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

মিনিট তিনও হয়নি, এমন সময় কিছুদূরে এক মাদ্রাজি ও একজন চীনা ভদ্রলোককে ওদের দিকে আসতে দেখা গেল।

সুরেশ্বর ও বিমল দু-জনেই উঠে দাঁড়াল।

ওরা কাছে এসে অভিবাদন করলে। মাদ্রাজি ভদ্রলোকটি অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুবেশ, তিনি বেশ পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন–আপনারা ঠিক এসেছেন তাহলে। তিনি মি. আ-চীন, স্থানীয় কনসুলেট অফিসের মিলিটারি অ্যাটাসে। আমার নাম সুব্বা রাও।

পরস্পরের অভিবাদন-বিনিময় শেষ হবার পর চারজনই সেই ডুরিয়ান গাছের তলায় বসল। সমগ্র বোটানিক্যাল গার্ডেনে এর চেয়ে নির্জন স্থান আছে কিনা সন্দেহ।

সুব্বা রাও বললেন–প্রথমেই একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনারা দুজনেই উপাধিকারী ডাক্তার তো? সুরেশ্বর বললে, সে ডাক্তার নয়, ঔষধ-ব্যবসায়ী। বিমল পাস করা ডাক্তার।

একথার উত্তরে আ-চীন বললে–দু-জনকেই আমাদের দরকার। একটা কথা প্রথমেই বলি, আমাদের দেশ ঘোর বিপন্ন। আমরা ভারতের সাহায্য চাই। জাপান অন্যায়ভাবে আমাদের আক্রমণ করছে, দেশে খাদ্য নেই, ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই। আমরা গোপনে ডাক্তারি ইউনিটি গঠন করে দেশে পাঠাচ্ছি। কারণ আইনত বিদেশ থেকে আমরা তা সংগ্রহ করতে পারি না। আপনারা বুদ্ধের দেশের লোক, আমরা আপনাদের মন্ত্রশিষ্য। আমাদের সাহায্য করুন। এর বদলে আমাদের দরিদ্র দেশ দু-শো ডলার মাসিক বেতন ও অন্যান্য খরচ দেবে। এখন আপনারা বিবেচনা করে বলুন আপনাদের কী মত?

সুরেশ্বর বললে–যদি রাজি হই, কবে যেতে হবে।

এক সপ্তাহের মধ্যে। লুকিয়ে যেতে হবে, কারণ এখন হংকং যাবার পাসপোর্ট আপনারা পাবেন না। আমার গভর্নমেন্ট সে-ব্যবস্থা করবেন ও আপনাদের এখানে এই এক সপ্তাহ থাকার খরচ বহন করবেন। আপনারা যদি রাজি হন, আমার গভর্নমেন্ট আপনাদের কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবেন।

সুব্বা রাও বললেন–জবাব এখুনি দিতে হবে না। ভেবে দেখুন আপনারা। আজ সন্ধ্যাবেলা জোহোর স্ট্রিটের বড়ো পার্কের ব্যাণ্ড-স্ট্যাণ্ডের কাছে আমি ও আ-চীন থাকব। কিন্তু দয়া করে কাউকে জানাবেন না।

ওরা চলে গেলে বিমল বললে–কী বল সুরেশ্বর, শুনলে তো সব ব্যাপার?

সুরেশ্বর বললে–চলো যাই। এখন আমাদের বয়স কম, দেশ-বিদেশে যাবার তো এই সময়। একটা বড়ো যুদ্ধের সময় মেডিক্যাল ইউনিটে থাকলে ডাক্তার হিসেবে তোমারও অনেক জ্ঞান হবে। চীনদেশটাও দেখা হয়ে যাবে পরের পয়সায়।

বিমল বললে–আমার তো খুবই ইচ্ছে, শুধু তুমি কী বল তাই ভাবছিলুম।

সন্ধ্যাবেলায় ওরা এসে জোহোর স্ট্রিটের পার্কের ব্যাণ্ড-স্ট্যাণ্ডের কোণে আ-চীন ও সুব্বা রাওয়ের সাক্ষাৎ পেলে। ওদের সব কথাবার্তা শুনে আ-চীন বললে–তাহলে আপনাদের রওনা হতে হবে কাল রাত্রে। ক-দিনে আপনাদের হোটেলের বিল যা হয়েছে তা কাল বিকালেই চুকিয়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আপনারা এইখানে অপেক্ষা করবেন। বাকি ব্যবস্থা আমি করব। আর এই নিন–

কথা শেষ করে বিমলের হাতে একখানা কাগজ গুঁজে দিয়ে আ-চীন ও সুব্বা রাও চলে গেলেন।

বিমল খুলে দেখলে কাগজখানা এক-শো ডলারের নোট।

পরদিন সকাল থেকে ওরা বাড়িতে চিঠিপত্র লেখা, কিছু কিছু জিনিসপত্র কেনা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত রইল। বৈকালে নির্দেশমতো আবার ব্যাণ্ড-স্ট্যাণ্ডের কোণে এসে দাঁড়াল।

একটু পরেই আ-চীন এলেন। বিমলকে জিজ্ঞেস করলেন—

আপনাদের জিনিসপত্র?

হোটেলেই আছে।

হোটেলে রেখে ভালো করেননি। একখানা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে জিনিসপত্র তুলে এখানে নিয়ে আসুন। আমি এখানেই থাকি। পার্কের কোণে ছোটো রাস্তাটার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে হর্ন দিতে বলবেন। আপনাদের আর কিছু লাগবে?

না, ধন্যবাদ। যা দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট।

আধঘণ্টার মধ্যেই বিমল ও সুরেশ্বর ট্যাক্সিতে ফিরে পার্কের কোণে দাঁড়িয়ে হর্ন দিতে লাগল।

আ-চীন এসে ওদের গাড়িতে উঠে মালয় ভাষায় ড্রাইভারকে কী বললেন। সে ট্যাক্সি বড়ো পোস্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড় করালো।

বিমল বললে–এখানে কী হবে?

বিমলের কথা শেষ হতে-না-হতে ওদের ট্যাক্সির পাশে একখানা নীল রংয়ের হুইপেট গাড়ি এসে দাঁড়াল। স্টিয়ারিং ধরে আছে একজন চীনা ড্রাইভার।

আ-চীন বললেন–উঠুন পাশের গাড়িতে।

পরে তাঁর ইঙ্গিত মতো দু-জন ড্রাইভার মিলে জিনিসপত্র সব নতুন গাড়িখানায় তুলে দিলে। গাড়ি যখন তিরবেগে সিঙ্গাপুরের অজানা বড়ো রাস্তা বেয়ে চলেছে, তখন বিমল বললে–অত সদরে দাঁড়িয়ে ও ব্যবস্থা করলেন কেন? কেউ যদি টের পেয়ে থাকে?

আ-চীন বললেন–কেউ করবে না জানি বলেই ওই ব্যবস্থা। এ সময়ে চীনা ডাক নিতে রোজ কনসুলেট অফিসের লোক ওখানে আসবে সকলেই জানে। আমার পরনে কনসুলেট ইউনিফর্ম, আমি লুকিয়ে কোনো কাজ করতে গেলেই সন্দেহের চোখে লোকে দেখবে। সদরে কেউ কিছু হঠাৎ মনে করবে না।

একটু পরেই সমুদ্র চোখে পড়ল–নারিকেল শ্রেণির আড়ালে। শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে একটা নিভৃত স্থানে এসে গাড়ি একটা বাংলোর কম্পাউণ্ডের মধ্যে ঢুকল। পাশেই নীল সমুদ্র।

আ-চীন বললেন–এখানে নামতে হবে। বাংলোর একটা ঘরে ওদের বসিয়ে আ-চীন বললেন–আমি যাই। এখানে নিশ্চিন্ত মনে থাকুন। কোনো ভয় নেই। যথাসময়ে আপনাদের খাবার দেওয়া হবে। বাকি ব্যবস্থা সব রাত্রে।

তিনি চলে গেলেন। একটু পরে জনৈক চীনা ভৃত্য ছোটো ছোটো পেয়ালায় সবুজ চা ও কুমড়োর বিচির কেক নিয়ে ওদের সামনে রাখলে।

বিমল বললে–এ আবার কী চিজ বাবা? ইঁদুর ভাজা-টাজা নয় তো?

সুরেশ্বর বললে–ইঁদুর নয়, কুমড়োর বিচি, তা স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে ইঁদুর খাওয়া অভ্যেস করতে হবে, নইলে হরিমটর খেয়ে থাকতে হবে চীন দেশে।

কিন্তু কেকগুলি ওদের মন্দ লাগল না। চা পানের পরে ওরা বাংলোর চারিধারে একটু ঘুরে বেড়ালে। সিঙ্গাপুরের উপকণ্ঠে নির্জন স্থানে সমুদ্রতীরে বাংলোটি অবস্থিত। সমুদ্রের দিকে এক সারি ঝাউ অপরাহ্রে বাতাসে সোঁ সোঁ করছিল। দূরে সমুদ্র বক্ষে অস্তসূর্যের আভা পড়ে কী সুন্দর দেখাচ্ছে।

সুরেশ্বর ভাবছিল হুগলি জেলার তাদের সেই গ্রাম, তাদের পুরোনো বাড়ি–বাপ-মায়ের কথা। জীর্ণ, সান-বাঁধানো পুকুরের ঘাটের পৈঠা বেয়ে মা পুকুরে গা ধুতে নামছেন এতক্ষণ।

জীবনের কীসব অদ্ভুত পরিবর্তনও ঘটে! তিন মাস মাত্র আগে সেও এমনি সন্ধ্যায় ওই গ্রামের খালের ধারটিতে একা পায়চারি করে বেড়াত ও কীভাবে কোথায় গেলে চাকরি

পাওয়া যায় সেই ভাবনাতে ব্যস্ত থাকত। আর আজ কোথায় কতদূরে এসে পড়েছে।

বিমল মুগ্ধ হয়েছিল এই সুদূরপ্রসারী শ্যামল সমুদ্র-বেলার সান্ধ্যশোভার দৃশ্যে। সে ভাবছিল কবি ও ঔপন্যাসিকদের পক্ষে এমন বাংলো তো স্বর্গ–মাথার ওপরকার নীল আকাশ–এই সবুজ ঝাউয়ের সারি–ওই সমুদ্রবক্ষের ছোটো ছোটো পাহাড়–সত্যিই স্বর্গ–

গভীর রাত্রে আ-চীন এসে ওদের ওঠালেন। একখানা মোটরে আধ মাইল আন্দাজ গিয়ে সমুদ্রতীরের একটা নির্জন স্থানে ওরা জিনিসপত্র সমেত ছোটো একটা জালি বোটে উঠল। দূরে বন্দরের আলোর সারি দেখা যাচ্ছে–অন্ধকার রাত্রি, নির্জন সমুদ্র বক্ষ। কিছুদূরে একটা চীনা জাঙ্ক অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল–জালিবোট গিয়ে জাঙ্কের গায়ে লাগল।

দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওরা জাঙ্কে উঠল।

পাটাতনের নীচে একটা ছোটো কামরা ওদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। কামরাতে একটা চীনা মাদুর বিছানো, বেতের বালিশ, চীনা লণ্ঠন, রঙিন গালার পুতুল, কাঁচকড়ার ফুলের টবে নার্সিসাস ফুল গাছ–এমনকী ছোটো খাঁচাসমেত একটি ক্যানারি পাখি।

আ-চীন বললেন–কামরা আপনাদের পছন্দ হয়েছে তো?

সুরেশ্বর বললে–সুন্দর সাজানো কামরা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আ-চীন গম্ভীরভাবে বললেন–ধন্যবাদ আপনাদের। আমাদের বিপন্ন দেশকে দয়া করে আপনারা সাহায্য করবার জন্যে এত কষ্ট স্বীকার করে অজানা ভবিষ্যতের দিকে চলেছেন। ভগবান যুদ্ধের দেশের লোক আপনারা–সবসময়েই আপনারা আমাদের নমস্য। ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদ আপনাদের ওপর বর্ষিত হোক।

সুরেশ্বর বললে–আপনি তো সঙ্গে যাবেন না।–এ নৌকো ঠিক জায়গায় আমাদের নিয়ে যাবে তো?

সে বিষয় ভাববেন না। এ চীন গভর্নমেন্টের বেতনভোগী জাঙ্ক। তিন দিন পরে একখানা চীনা জাহাজ আপনাদের তুলে নেবে। কারণ সামনে দুস্তর চীন সমুদ্র। জাঙ্কে সে-সমুদ্র পার হওয়া তো যাবে না।

আ-চীন বিদায় নেবার পরে নৌকা নোঙর ওঠালে। জাঙ্কের সুসজ্জিত কামরায় মোমবাতির আলো জ্বলছে। অনুকূল বায়ুভরে চীন সমুদ্র বেয়ে নৌকো চলেছে–ঘন অন্ধকার, কেবল আলোকোৎক্ষেপক ঢেউগুলি যেন জোনাকির ঝাঁকের মতো জ্বলছে।

বিমল বললে–এখান থেকে হংকং সতেরো-শো আঠেরো-শো মাইল দূর। এক ভীষণ চীনসমুদ্র–আর এই জাঙ্ক তো এখানে মোচার খোলা। প্রাণ নিয়ে এখন ডাঙায় পা দিতে পারলে তো হয়।

সুরেশ্বর বললে–এসে ভালো করোনি বিমল। ঝোঁকের মাথায় তখন দু-জনেই আ-চীনের কথায় ভুলে গেলুম কেমন–দেখলে? এই জাঙ্কে যদি তোমায় আমায় খুন করে এরা জলে ভাসিয়ে দেয়, এদের কে কী করবে? কেউ জানে না আমরা কোথায় আছি। কেউ একটা খোঁজ পর্যন্ত করবে না।

বিমল বললে–ও সব কথা ভেবে কেন মন খারাপ কর? বাইরে যেয়ে সমুদ্রের দৃশ্যটা একবার দেখো। ফসফোরেসেন্ট ঢেউগুলি কী চমৎকার দেখাচ্চে? মাঝে মাঝে কেমন একপ্রকার শব্দ হচ্ছে সমুদ্রের মধ্যে। ওগুলো কী? ওরা কাউকে কিছু বলতে পারে না, ইংরেজি ভাষা কে জানে নৌকোয়, তা ওদের জানা নেই। রাত্রে ওদের ঘুম হল না। ক্রমে পুব দিক ফর্সা হয়ে এল, রাত ভোর হয়ে গেল। একটু পরে সূর্য উঠল।

সকাল থেকে নৌকা ভয়ানক নাচুনি ও দুলুনি শুরু করে দিল। চীন সমুদ্র অত্যন্ত বিপজ্জনক, সর্বদা চঞ্চল, ঝড় তুফান লেগেই আছে। ওরা সমুদ্রপীড়ায় কাতর হয়ে কামরার মধ্যে ঢুকে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আহার বিহারে রুচি রইল না।

সেদিন বিকেলে এক মস্ত ঢেউয়ের মাথায় একটি কাটল ফিস এসে পড়লে জাঙ্কের পাটাতনে। সেটা তখনও জ্যান্ত, পালাবার আগেই চীনা মাঝিরা ধরে ফেললে।

জাঙ্কে যা খাবার দেয়, সে ওদের মুখে ভালো লাগে না। ভাত ও সুটকি মাছের তরকারি। সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত দু-টি বাঙালি যাত্রীর পক্ষে চীনা ভাত-তরকারি খাওয়া প্রায় অসম্ভব।

সুরেশ্বর বললে-ঝকমারি করেছি এসে ভাই। না খেয়ে তো দেখছি আপাতত মরতে হবে।

তৃতীয় দিন দুপুরে দূরে দিগবলয়ে একখানা বড়ো স্টিমারের ধোঁয়া দেখা গেল। ওরা দেখলে জাঙ্কের সারেং দূরবিন দিয়ে সেদিকে চেয়ে উদবিগ্ন মুখে কী আদেশ দিলে, মাঝিমাল্লারা পাল নামিয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। আবার উলটো দিকে যাবে নাকি? ব্যাপার কী?

সুরেশ্বর সারেঙকে জিজ্ঞেস করলে– নৌকো ঘোরাচ্ছে কেন?

সারেং দূরের অস্পষ্ট জাহাজটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে উদবিগ্ন মুখে বললে–ইংলিশ ক্রুজার, মিস্টার, ভেরি বিগক্রুজার–বিগগান–

সুরেশ্বর বললে–তাতে তোমাদের ভয় কী? ওরা তোমাদের কিছু বলতে যাবে কেন?

কিন্তু সুরেশ্বর জানত না সারেং-এর আসল ভয়ের কারণ কোনখানে। চীনা সমুদ্রে চীনা বোম্বেটের উপদ্রব নিবারণের জন্যে ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ সর্বপ্রকার চীনা নৌকো, জাহাজ ও জাঙ্কের ওপর–বিশেষ করে বন্দর থেকে দূরে বার সমুদ্র দিয়ে যেসব যায়–তাদের ওপর খরদৃষ্টি রাখে। ওদের জাঙ্ককে দেখে সন্দেহ হলেই থামিয়ে থানাতল্লাসী করবেই। তাহলে এ জাঙ্কে যে বেআইনি আফিম রয়েছে পাটাতনের নীচে লুকোনো–তা ধরা পড়ে যাবে।

চীনা মাঝিগুলি অতিশয় ধূর্ত। যুদ্ধ জাহাজ দূর থেকে যেমনি দেখা অমনি জাঙ্ক মাঝ সমুদ্রে ঝুপ করে নোঙর নামিয়ে দিলে ও পাটাতনের নীচে থেকে মাছ ধরার জাল বার করে সমুদ্রে ফেলতে লাগল–দেখতে দেখতে জাঙ্কখানা একখানি চীনা জেলে-ডিঙিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল।

বিমল বললে–উঃ কী চালাক দেখেছ!

সুরেশ্বর বললে–চালাক তাই রক্ষে–নইলে ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ এসে যদি আমাদের ধরত –বিনা পাসপোর্টে ভ্রমণ করার অপরাধে তোমায় আমায় জেল খাটতে হবে, সে হুঁশ আছে?

ধূসরবর্ণের বিরাটকায় ব্রিটিশ ক্রুজারখানা ক্রমেই নিকটে এসে পড়ছে। এখন তার বড়ো ফোকরওয়ালা কামানগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের বুকে একটা ধূসরবর্ণের পর্বত যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।

যদি কোনো সন্দেহ করে একটি বড়ো কামান তাদের দিকে দাগে–আর ওদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে?

চীনা মাঝিমাল্লাগুলি মহাউৎসাহে ততক্ষণ জাল ফেলে মাছ ধরছে। সুরেশ্বর ও বিমলের বুক ঢিপঢিপ করছে উদবেগে ও উত্তেজনায়। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় যুদ্ধজাহাজখানা ওদের দিকে লক্ষই করলে না। ওদের প্রায় একমাইল দূরে দিয়ে সোজা পূর্ণবেগে সিঙ্গাপুরের দিকে চলে গেল।

জাঙ্কসুদ্ধ লোক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

দুপুরের পরে দূরে একটি ছোটো দ্বীপ দেখা গেল।

জাঙ্ক গিয়ে ক্রমে দ্বীপের পাশে নোঙর করলে। বিমল ও সুরেশ্বর শুনলে নৌকোর জল ফুরিয়ে গেছে–এবং এখানে মিষ্ট জল পাওয়া যায়।

ওরা সেখানে থাকতে থাকতে আর একখানা বড়ো জাঙ্ক বিপরীত দিক থেকে এসে ওদের কাছেই নোঙর করলে।

বিমলদের জাঙ্কের মাঝিরা বেশ একটু ভীত হয়ে পড়ল নবাগত নৌকাখানা দেখে। সকলেই ঘন ঘন চকিত দৃষ্টিতে সে-দিকে চায়–যদিও ভয়ের কারণ যে কী তা সুরেশ্বর বা বিমল কেউ বুঝতে পারলে না।

কিন্তু একটু পরে সেটা খুব ভালো করেই বোঝা গেল।

ও নৌকা থেকে দশ-বারোজন গুন্ডা ও বর্বর আকৃতির চীনেম্যান এসে ওদের জাঙ্ক ঘিরে ফেললে। সকলের হাতেই বন্দুক, কারো হাতে ছোরা।

ওদের জাঙ্কের কেউ কোনোরকম বাধা দিলে না–দেওয়া সম্ভবও ছিল না। দস্যুরা দলে ভারি, তা ছাড়া অত বন্দুক এ নৌকোয় ছিল না। সকলের মুখ বেঁধে ওরা নৌকোয় যা কিছু ছিল, সব কেড়ে নিয়ে নিজেদের জাঙ্কে ওঠালে। বিমল ও সুরেশ্বরের কাছে যা ছিল, সব গেল। আ-চীন প্রদত্ত এক-শো ডলারের নোটখানা পর্যন্ত–কারণ সেখানা ভাঙাবার দরকার না হওয়ায় ওদের বাক্সেই ছিল।

চীন সমুদ্রের বোম্বেটের উপদ্রব সম্বন্ধে বিমল ও সুরেশ্বর অনেক কথা শুনেছিল। সিঙ্গাপুরে আরও শুনেছিল যে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন হওয়ায় সমস্ত হংকং-এর নিকটবর্তী সমুদ্রে জড়ো হচ্ছে–এদিকে সুতরাং বোম্বেটেদের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।

চীন ও মালয় জলদস্যুরা শুধু লুঠপাট করেই ছেড়ে দেয় না–যাত্রীদের প্রাণনষ্টও করে। কারণ এরা বেঁচে ফিরে গিয়ে অত্যাচারের সংবাদ সিঙ্গাপুর বা হংকং-এ প্রচার করলেই চীন ও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কড়াকড়ি পাহারা বসাবে সমুদ্রে। মরা মানুষ কোনো কথা বলে না–এ প্রাচীন নীতি অনেক ক্ষেত্রেই বড়ো কাজ দেয়।

দেখা গেল বর্তমান দস্যুরা এ নীতি ভালোভাবেই জানে। কারণ জিনিসপত্র ওদের জাঙ্কে রেখে এসে ওরা আবার ফিরে এল বিমলদের নৌকোয়–যেখানে পাটাতনের ওপর মাঝিমল্লার দল সারি সারি মুখ ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।

বিমল ছিল নিজের কামরায়। সুরেশ্বর কোথায় বিমল তা জানে না। একজন বদমাইশকে ছোরা হাতে ওর কামরায় ঢুকতে দেখে বিমল চমকে উঠল।

লোকটা সম্ভবত চীনাম্যান। বয়স আন্দাজ ত্রিশ, সার্কাসের পালোয়ানের মতো জোয়ান নীল ইজের আর একটি বুক কাটা কোর্তা গায়ে। মুখখানা দেখতে খুব কুশ্রী নয়, কিন্তু কঠিন ও নিষ্ঠুর। ওর হাতে অস্ত্রখানা বিমল লক্ষ করে দেখলে ঠিক ছোরা নয়, মালয় উপদ্বীপে যাকে ক্রিস বলে তাই। যেমনি চকচকে তেমনি সেখানা ক্ষুরধার বলে মনে হল!

সে ক্রিসখানা বিমলের সামনে উঁচু করে তুলে ধরে দেখিয়ে বললে–আমি তোমাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি, কিছু মনে কোরো না।

বিমলের মুখ বাঁধা, সে কী কথা বলবে?

লোকটা পকেট থেকে একটা চামড়ার থলি বার করে সেটার মুখ খুলে বিমলের চোখের সামনে মেলে ধরলে। শুকনো আমচুরের মতো কতকগুলি কী জিনিস তার মধ্যে রয়েছে! বিমল অবাক হয়ে ভাবছে এ জিনিসগুলি কী, বা তাকে এগুলি দেখানোর সার্থকতাই বা কী–এমন সময় লোকটা একটা শুকনো আমচুর বার করে ওর নাকের সামনে ধরে বলে– চিনতে পারলে না কী জিনিস?

বিমল এতক্ষণে জিনিসটা চিনতে পারলে এবং চিনে ভয়ে ও বিস্ময়ে শিউরে উঠল। সেটা একটা কাটা শুকনো কান, মানুষের কান! লোকটা হা হা করে নিষ্ঠুর বিদ্রুপের হাসি হেসে বললে-বুঝেছ এবার? হাঁ, ওটা আমার একটা বাতিক–মানুষের কান সংগ্রহ করা। তোমাকেও তোমার কান দুটির জন্যে একটুখানি কষ্ট দেব। আশা করি মনে কিছু করবে না। এসো, একটু এগিয়ে এসো দেখি।

বিমল নিরুপায়, মুখ দিয়ে একটা কথা বার করবার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই তার। এক মুহূর্তে তার মনে হল হয়তো সুরেশ্বরের সমানই অবস্থা ঘটেছে, এতক্ষণে তারও অশেষ দুর্দশা হচ্ছে এই পীতবর্ণ বর্বরদের হাতে।

বুদ্ধদেবের ধর্মকে এরা বেশ আয়ত্ত করেছে বটে!

লোকটা সময়ের মূল্য বোঝে, কারণ কথা শেষ করেই বুদ্ধশিষ্যের এই বিচিত্র নমুনাটি চকচকে ক্রিসখানা হাতে করে এগিয়ে এল–বিমলের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল–মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ বার হতে চেয়েও হল না, সে প্রাণপণে দুই চোখ বুজলে।

তীক্ষ্ণ ক্রিসের স্পর্শ খুব ঠাণ্ডা–কতটা ঠাণ্ডা, খু-উব ঠাণ্ডা কি? ক্রিসের স্পর্শ এল না, এল তার পরিবর্তে দূর থেকে একটা অস্পষ্ট গম্ভীর আওয়াজ–প্রস্তরময় কূলে সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রবল বেগে আছড়ে পড়ার শব্দের মতো গম্ভীর।

কতকগুলি ব্যস্ত মানুষের সম্মিলিত দ্রুত পদশব্দ বিমলের কানে গেল–বিস্মিত বিমল চোখ খুলে চেয়ে দেখলে লোকটা ছুটে কামরার বাইরে চলে গেল–চারিদিকে একটি সাড়া শোরগোল, কাঠের পাটাতনের ওপর অনেকগুলি পলায়নপর মানুষের দ্রুত পায়ের শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে।

কী ব্যাপার? এ আবার কী নতুন কান্ড?

পরক্ষণেই বিমলের মনে হল তাদের জাঙ্কখানা একটা প্রকান্ড দুলুনি খেয়ে একেবারে কাত হয়ে পড়বার উপক্রম করেই পরমুহূর্তে ঢেউয়ের তালে যেন আকাশে ঠেলে উঠল–নোঙরের শিকলে কড় কড় শব্দে টান ধরল–মজবুত শিকল না হলে সেই হেঁচকাটানে ছিঁড়ে যেত নিশ্চয়ই। একটু পরে বিমলদের নৌকোর একজন জোয়ান মাঝি ওর কামরায় ঢুকে হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলে।

তখনও পাশে কোথায় খুব হইচই হচ্ছে।

বিমল বললে–ব্যাপার কী বলো তো?আমার বন্ধুটি কোথায়?

মাঝি বললে–সে ভালোই আছে।

বলেই সে বাইরে চলে গেল। বেশি কথা বলে না এদেশের লোক।

বিমল তাড়াতাড়ি কামরার বাইরে এসে দেখলে সামনে এক অদ্ভুত ব্যাপার। নবাগত বোম্বেটে জাঙ্কখানা কঠিন প্রস্তরময় ডাঙায় ধাক্কা খেয়ে জখম হয়েছে। আর অল্প দূরেই সমুদ্রবক্ষে এমন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলে যা জীবনে কখনো দেখেনি।

আকাশ থেকে কালো মোটা থামের মতো একটা জিনিস নেমে সমুদ্রের জলে মিশে গিয়েছে –সে জিনিসটা আবার চলনশীল–হ্যাঁলকা রবারের বেলুন বা ফানুসের মতো অত বড়ো কালো মোটা থামটা বায়ুর গতির সঙ্গে ধীরে উত্তর থেকে দক্ষিণে ভেসে চলেছে।

এই সময় সুরেশ্বর ও জাঙ্কের সারেং এসে ওদের পাশে দাঁড়ালো।

সারেং বললে–উঃ কত বড়ো জোড়া জলস্তম্ভ, মিস্টার! চীন সমুদ্রে প্রায়ই জলস্তম্ভ হয় বটে কিন্তু এমন জোড়া জলস্তম্ভ আমি কখনো দেখিনি! ওই জলস্তম্ভটা আজ আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।

ওই কালো মোটা থামের মতো ব্যাপারটা তাহলে জলস্তম্ভ। ছবিতে দেখেছে বটে। কিন্তু বিমল বা সুরেশ্বর জীবনে এই প্রথম জিনিসটা দেখলে।

কিন্তু ব্যাপারটা ওরা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। জলস্তম্ভ ওদের জীবন বাঁচাল কী করে?

বেশি দেরি হল না ব্যাপারটা বুঝতে। যখন ওরা দেখলে এই অল্প সময়ের মধ্যেই সুদক্ষ সারেং নোঙর উঠিয়ে জাঙ্কখানা ডাঙা থেকে প্রায় এক-শো গজ এনে ফেলেছে এবং প্রতিমুহূর্তেই তীর ও সমুদ্র উভয়ের ব্যবধান বাড়ছে। সারেং ও মাঝিদের মুখে শোনা গেল এই জলস্তম্ভের জোড়াটি দ্বীপের অদূরে ভেঙে গিয়ে বিপুল জলোচ্ছাসের সৃষ্টি করে–তাতে বোম্বেটেদের জাঙ্কখানাকে ঊর্ধ্বে উঠিয়ে সবেগে আছাড় মেরেছে ডাঙার গায়ে। জাঙ্কখানা জখম তো হয়েছেই এবং বোধ হচ্ছে ওদের কতকগুলি লোককেও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মেরেছে।

সারেং বললে–জলস্তম্ভ ভয়ানক জিনিস, মিস্টার। অনেক সময় জাহাজ পর্যন্ত বিপদে পড়ে যায়–বড়ো বড়ো জাহাজ দূর থেকে কামান দেগে জলস্তম্ভ ভেঙে দেয়। আর বিশেষ করে এই চীন সমুদ্রে সপ্তাহে দু-একটা বালাই লেগেই আছে।

দ্বীপ ছেড়ে জাঙ্কটা বহুদূর চলে এসেছে।

আবার অকূল সমুদ্র!

বোম্বেটে জাহাজ ও জলস্তম্ভ স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গিয়েছে দিগন্তবিস্তৃত নীলিমার মধ্যে। সুরেশ্বর ও বিমল চুপ করে সমুদ্রের অপরূপ রঙের দিকে চেয়ে বসে আছে।

সারেং এসে বললে,–মিস্টার, আমরা হংকং থেকে আর বেশি দূরে নেই। কিন্তু হংকং যাব না।

সুরেশ্বর বললে- কোথায় যাব তবে?

হংকং থেকে পঞ্চাশ মাইল আন্দাজ দূরে ইয়ান-চাউ বলে একটা ছোটো দ্বীপ আছে। সেখানে আপনাদের নামিয়ে দেবার আদেশ আছে আমার ওপর। হংকং-এর কাছে গেলে ব্রিটিশ মানোয়ারী জাহাজ আমাদের নৌকো তল্লাসী করবে। তোমরা ধরা পড়ে যাবে মিস্টার!

পরদিন দুপুরের পরে ইয়ান-চাউ পৌঁছে গেল ওদের নৌকো। ক্ষুদ্র দ্বীপ। আগোগোড়া দ্বীপটি যেন একটা ছোটো পাহাড়, সমুদ্রের জল থেকে মাথা তুলে জেগে রয়েছে। এখানে চীন গভর্নমেন্টের একটা বেতারের স্টেশন আছে।

সমস্ত দ্বীপে আর কোনো অধিবাসী নেই। ওই বেতারের স্টেশনের জনকয়েক চীনা কর্মচারী ছাড়া।

দু-দিন ওরা সেখানে বেতারের আড্ডায় কর্মচারীদের অতিথি হয়ে রইল। তৃতীয় দিন খুব সকালে ক্ষুদ্র একখানা জাঙ্কে ওদের দশ মাইল দূরবর্তী উপকূলে নিয়ে যাওয়া হল।

বেতারে এইরকম আদেশই নাকি এসেছে।

এই চীন দেশ! যদি ঢেউ-খেলানো ছাদ-আঁটা চীনা বাড়ি না থাকত, তবে চীন দেশের প্রথম দৃশ্যটা বাংলা দেশের সাধারণ দৃশ্য থেকে পৃথক করে নেওয়া হঠাৎ যেত না।

উপকূল থেকে পাঁচমাইল দূরে রেলওয়ে স্টেশন। অতি প্রচন্ড কড়া রৌদ্রে পদ-ব্ৰজেই ওদের স্টেশনে আসতে হল। এদেশে ওদের জামাই-আদরে কেউ রাখবে না, কঠিন সামরিক জীবন যে এখন থেকেই শুরু হল ওদের–এ কথাটা সুরেশ্বর ও বিমল হাড়ে হাড়ে বুঝলে সেই ভীষণ রোদে বিশ্রী ধুলোভরা রাস্তা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে।

তার ওপর বেতারের কর্মচারীটি ওদের সঙ্গে ছিল, তার মুখেই শোনা গেল এসব অঞ্চল আদৌ নিরাপদ নয়।

দেশের রাজনৈতিক অবস্থার গন্ডগোলের সুযোগ নিয়ে চোর-ডাকাত ও গুন্ডার দল যা খুশি শুরু করেছে। তারা দিনদুপুরও মানে না। স্বদেশি-বিদেশিও মানে না। কারো ধন-প্রাণ নিরাপদ নয় আজকাল। দেশ এক প্রকার অরাজক।

শীঘ্রই এর একটা প্রমাণ পাওয়া গেল পথের মধ্যেই। ওরা একদলে আছে মাত্র চারজন। রৌদ্রে সুরেশ্বরের জল তেষ্টা পেয়েছিল–চীনা কর্মচারীটিকে ও ইংরেজিতে বললে–জল কোথাও পাওয়া যাবে?

রাস্তা থেকে কিছু দূরে একটা ক্ষুদ্র গ্রাম বা বস্তি। খানকতক খড়ের ঘর একজায়গায় জড়ো করা মাত্র। চীনা কর্মচারীর পিছু পিছু ওরা সেই বস্তির দিকে গেল। বিমলের মনে হল একবার বৈদ্যবাটির গঙ্গার চরে সে তরমুজ কিনতে গিয়েছিল–এ ঠিক যেন বৈদ্যবাটীর চড়ার চাষি কৈবর্তদের গাঁ-খানা। একখানা গোরুরগাড়ি সামনেই ছিল–তফাতের মধ্যে চোখে পড়ল সেটার গড়ন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। গোরুরগাড়ির অত মোটা চাকা বাংলা দেশে হয় না।

ওদের আসতে দেখেই কিন্তু বস্তির মধ্যে একটা ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হল। মেয়ে-পুরুষ যে যার ঘর ছেড়ে ছুটে বেরোলো–এদিক-ওদিক দৌড় দিল। চীনা কর্মচারীও তৎপর কম নয়–সেও ছুটে গিয়ে একটি ধাবমানা স্ত্রীলোকের পথ আগলে দাঁড়াল।

স্ত্রীলোকটি দু-হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে জড়সড় হয়ে আর্তনাদ করে উঠল। ব্যাপারটা কী? সুরেশ্বর ও বিমল অবাক হয়ে গিয়েছে।

স্ত্রীলোকের বিপন্ন কণ্ঠের আর্তনাদ বিমল সহ্য করতে পারলে না। ও চেঁচিয়ে বললে– ওকে কিছু বোলো না, মি. চংপে–

ততক্ষণ ওদের সঙ্গী চীনা ভাষায় কী একটা বললে স্ত্রীলোকটিকে। কথাটা এইরকম শোনাল ওদের অনভ্যস্ত কানে।

হি চীন-কিচীন–চীন-চীন–

স্ত্রীলোকটি মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওর দিকে ভয়ে ভয়ে চেয়ে বললে-ই-চীন, কি চীন, সি চীন–

–কী চীন, ফি চীন?

–সি চীন, লি চীন।

সুরেশ্বর ও বিমল ওদের কথা শুনে হেসেই খুন। কথাবার্তাগুলো যেন ওই রকমই শোনাচ্ছিল।

তারপর ওরা স্ত্রীলোকটির কাছে পায়ে পায়ে গেল। আহা, যেন মূর্তিমতী দারিদ্র্যের ছবি। ভারতবর্ষীয় লোকে তবুও স্নান করে, গায়-মাথায় তেল দেয়, ওরা তাও করে না–গায়ে খড়ি উঠছে, মাথা রক্ষ, শরীর অন্নাভাবে শীর্ণ ও জ্যোতিহীন। হতভাগ্য মহাচীন, হতভাগ্য ভারতবর্ষ! দু-জনেই দরিদ্র, কেউ খেতে পায় না,–শুরু-শিষ্য দু-জনের অবস্থাই সমান।

বিমলের মনে মনে এই দরিদ্রা নারী, এই দরিদ্র, হতভাগ্য, উৎপীড়িত মহাচিনের এই ভয়ার্ত, অসহায় কুঁড়েঘরবাসী চাষিমজুর–এদের প্রতি একটা গভীর অনুকম্পা ও সহানুভূতি জাগল। মানুষ যখন দুঃখকষ্ট পায়, সবদেশে সর্বকালে তারা এক। চীন, ভারতবর্ষ, রাশিয়া, আবিসিনিয়া, স্পেন, মেক্সিকো, এদের মধ্যে দেশের সীমা এখানে মুছে গিয়েছে।

এই অভাগিনী ভয়ব্যাকুলা দরিদ্র নারী সমগ্র চীনদেশের প্রতীক।

বিমল এসেছে এক হতভাগ্য দেশ থেকে–এই হতভাগ্য দেশকে সাহায্য করতে। সে তা যথাসাধ্য করবে। দরকার হলে বুকের রক্ত দিয়েও করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *