১. গীতার জনপ্রিয়তা

গীতার জনপ্রিয়তা

ঘটনাটির ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে নিশ্চয় করে কিছু বলার না থাকলেও ঘটনাটি বা রচনাটি এমনই যে, এটির উল্লেখ করার প্রলোভন সংবরণ করা কঠিন। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হো চি মিন ভারত সফরে এসে কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে নামলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। হো চি মিন ডাক্তার রায়কে নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি তো ডাক্তার, তা আপনি ভগবান মানেন? ডাক্তার রায় জবাবে নাকি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ এমন এক দেশ, এখানে জন্মালে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই মজ্জাগত হয়ে যায়। হো চি মিন নাকি বলেছিলেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আপনাদের একটি জিনিসকে আমি খুব কদর করি, সেটি হল গীতা। হো চি মিন কখনই ভক্ত ছিলেন না তবু তিনি যদি গীতাকে পছন্দ করে থাকেন তবে তা নিশ্চয়ই ভক্তির কারণে নয়, বলা যায় তা দার্শনিকতার কারণে। গীতায় যে তত্ত্ব, যে দর্শন প্রকাশিত, হো চি মিন সাহেবের তা মনে ধরে থাকবে। এত গেল হো চি মিনের ভাল লাগার কথা। আমরা একটু আলোচনা করে দেখব সাধারণ ভাবে এ দেশের মানুষের কাছে গীতার গুরুত্ব কতখানি এবং কেন? বিশেষত এ দেশীয় হিন্দুদের কাছে।

যদি প্রশ্ন করা হয় ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ কোনটি, তাহলে এককথায় তার জবাব মিলবে ভাগবত গীতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের বিরাট সংখ্যক নিরক্ষর কিংবা সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী না হয়েও গীতাকে যে সম্ভ্রমের চোখে দেখে থাকেন, তার মূলে রয়েছে ভক্তি ভাব। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথিত গীতা হিন্দুদের কাছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত ও মান্যতা লাভ করেছে। মহাভারতের দৌলতে কুরুক্ষেত্রে কৌরব ও পান্ডবদের যুদ্ধের কথা, সেই যুদ্ধে অর্জুনের সারথি রূপে কৃষ্ণের ভূমিকা, কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে যুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করায় অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখানো, অর্জুনের চেতনা ফেরাতে তাকে কৃষ্ণের উপদেশ দান বিরাট সংখ্যক মানুষ নিরক্ষর হয়েও অথবা সংস্কৃত না জেনেও জানেন। নানা শিল্পকলায় কৃষ্ণের অর্জুনের সারথি রূপে ভূমিকা পালন, কিংবা কৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শন রূপায়িত হতে দেখা যায় এমনকী বহু ক্যালেণ্ডারেরও এগুলি জনপ্রিয় ছবি। পরাধীনতার আমলে যাঁরা স্বদেশি করতেন, বিশেষত যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, তাঁরা গোপনীয়তা রক্ষার জন্য, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য গীতা স্পর্শ করে অঙ্গীকার করতেন। আদালতেও কাঠগড়ায় উঠে সাক্ষীকে সত্যকথনের সময় গীতা স্পর্শ করানো হয়। হরিসভায় যে সব ধর্মগ্রন্থ পঠিত ও আলোচিত হয় তন্মধ্যে গীতা যে অন্যতম, তা বলাই বাহুল্য। বয়স্ক মৃতদেহের সঙ্গে গীতা দেওয়ার রীতি শ্মশানযাত্রার সময়ে। অবশ্যই পুণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যেই কিংবা মৃত ব্যক্তির দোষ স্খালনের অভিপ্রায়ে।

গীতা নিয়ে নানাজনে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন সত্য সত্যই গীতা কি মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নাকি পরবর্তীকালের সংযোজন? কিংবা গীতা কি সত্যই শ্রীকৃষ্ণ কথিত, নাকি গীতা রচয়িতা কবি পাঠকের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গীতাকে ভগবানের কথিত বলে চালিয়ে দিয়েছেন? এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধাঙ্গনে কি সাত শতাধিক শ্লোক বিশিষ্ট গীতা রচনা বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব? বিভিন্ন উপনিষদ, মহাভারত প্রভৃতির নানা স্থানে গীতায় কথিত শ্লোকের গভীর সাযুজ্য লক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে কাকতালীয়ভাবেই কি এই সাযুজ্য ঘটেছে। Great men think alike বলেই কি এ সাযুজ্য পার পাবে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ বর্তমান?

এসব বিতর্কিত বিষয় সত্ত্বেও সত্য হল ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুজনগণের কাছে গীতার মূল্য এককথায় অপরিসীম। আমরা এর বিভিন্ন কারণানুসন্ধানে প্রয়াস পাব।

ক. গীতার গ্রহণযোগ্যতার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বলিষ্ঠ কারণ হল ধর্মপুস্তক রূপে এর পরিচিতি। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কথিত বাণীর সমষ্টি, অতএব হিন্দুমাত্রের কাছেই তার পবিত্রতা স্বীকৃত। বহু হিন্দুই প্রতিদিন নিয়ম করে গীতা পাঠ করেন। একদিনে সম্পূর্ণ গীতা পাঠ না করলেও প্রতিদিন একটি করে অধ্যায় পাঠ করেন এমন সংখ্যা নেহাৎ কম হবে না। এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য পুণ্যার্জন। গীতার শ্লোকগুলি সংস্কৃত বা দেবনাগরীতে রচিত। পাঠকের সুবিধার্থে নিজ নিজ মাতৃ-ভাষায় গীতার শ্লোকগুলিকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করা হয়েছে। মাতৃভাষায় গীতার শ্লোকগুলির ব্যাখ্যাও সম্পাদিত হয়েছে। সত্য কথা বলতে কী অধিকাংশ নব্যভারতীয় আর্য ভাষাতেই গীতা মূল ও ব্যাখ্যা সহ প্রকাশিত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠানে গীতা পাঠের আয়োজন করা হয়। তাছাড়া অধ্যাপক – ব্রাহ্মণদের যেসব সামগ্রী দান করা হয় যেমন বস্ত্র, ধাতু নির্মিত কোনো তৈজস, চিনি, ফল, মিষ্টান্ন তৎসহ থাকে একটি পকেট গীতাও।

খ. মননশীল, দার্শনিক, চিন্তানায়কদের কাছে গীতার গ্রহণযোগ্যতা তত্ত্বের কারণে। গীতায় যে নিষ্কাম ধর্মের কথা বর্ণিত হয়েছে সেজন্য ত বটেই, তৎসহ জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগে যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরাও তাঁদের মনের খোরাকের সন্ধান পান গীতাতে। গীতা নিয়ে তাই সারা পৃথিবী ব্যাপী তাত্ত্বিক মানুষদের অপরিসীম কৌতূহল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশীয় পন্ডিত, গবেষক, দার্শনিক চিন্তাবিদেরা নিজ নিজ মানসিকতা তথা বোধ অনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার গীতায় জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মযোগের সমন্বয়ের সন্ধান পেয়েছেন ও সেইমত ব্যাখ্যাও করেছেন।

গ. অপর এক শ্রেণীর মানুষ দেখা যায় যাঁদের কাছে গীতা হল মুশকিল আসান। জীবন পথ পরিক্রমায় নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়, মোকাবিলা করতে হয় নানা সমস্যার, মানুষ সহজেই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়ে, হয় কিংকর্তব্য বিমূঢ়। নিজের ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করে উঠতে পারে না। উচিত-অনুচিত বোধ তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে গীতা পালন করে মুশকিল আসানের ভূমিকা। যেমন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন তিনি যখনই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখনই শরণাপন্ন হয়েছেন গীতার, গীতায় পথ নির্দেশ লাভ করে তিনি সমস্যামুক্ত হয়েছেন, সার্থকভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছেন।

ঘ. অবিশ্বাস্য কবি কল্পনার উত্তুঙ্গ নিদর্শন রূপে অনেকে গীতাকে দেখে থাকেন। Cosmic Imagination- এর সাক্ষাৎ পান তাঁরা ‘বিশ্বরূপ দর্শনের’ বর্ণনায়।

ঙ. ভারতবর্ষের শাশ্বত ঐতিহ্য ও পরম্পরার অনবদ্য নিদর্শন রূপেও গীতাকে দেখা হয়। ভারতীয় ঐতিহ্যের সারাৎসার হল গীতা।

রবীন্দ্রনাথের গীতা অনুরক্তির পেছনে ছিল এটাই মূল কারণ।

জ্ঞান কর্ম ও ভক্তির যে সমন্বয়যোগ তাহাই সমস্ত ভারত ইতিহাসের চরমতত্ত্ব। . . . ভারতবর্ষ একদিন আপনার সমস্ত ইতিহাসের একটি চরমতত্ত্বকে দেখিয়াছিল। মানুষের ইতিহাসে জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম অনেক সময়ে স্বতন্ত্র ভাবে, এমন কি পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবে আপনার পথে চলে; সেই বিরোধের বিপ্লব ভারতবর্ষে খুব করিয়াই ঘটিয়াছে বলিয়াই এক জায়গায় তাহার সমন্বয়টিকে স্পষ্ট করিয়া সেদেখিতে পাইয়াছে। মানুষের সকল চেষ্টাই কোনখানে আসিয়া অবিরোধে মিলিতে পারে মহাভারত সকল পথের চৌমাথায় সেই চরম লক্ষ্যের আলোকটি জ্বালাইয়া ধরিয়াছে। তাহাই গীতা। . . . . মহাভারতের এই গীতার মধ্যে লজিকের ঐক্য তত্ত্ব সম্পূর্ণ না থাকিতে পারে কিন্তু তাহার মধ্যে বৃহৎ একটি জাতীয় জীবনের অনির্বচনীয় ঐক্যতত্ত্ব আছে।

(পরিচয়; ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা; ১৩শ খন্ড; রবীন্দ্ররচনাবলী; রচনাকাল ১৩২২, পৃ – ১৫৭)

চ. সমাজতাত্ত্বিকের কাছে আবার গীতার আবেদন ভিন্নতর। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা, বর্ণাশ্রম প্রথার নির্ভরযোগ্য উপাদান লাভ করা যায় গীতা থেকে।

ছ. গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, সর্ব ধর্মাণ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ— সব ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে শরণ কর। এই প্রেক্ষিতেই খৃষ্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে গীতার তুলনামূলক আলোচনা করেন একেশ্বরবাদীরা, বিশেষতঃ Comparative Religion নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা।

তুলনামূলক আলোচনার স্বার্থেও গীতার প্রসঙ্গ টেনেছেন অনেকে। কোরানের সঙ্গে, বাইবেলের সঙ্গে গীতার দৃষ্টিভঙ্গিগত সাযুজ্যের সন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন কেউ কেউ। যেমন বিবেকানন্দ অনুসন্ধান করেছেন যিশু ও কৃষ্ণের জীবনের সাদৃশ্যমূলক ঘটনাবলীর :

কোন চরিত্রটিকে অপরটি হইতে ধার করা হইয়াছে — এ সম্বন্ধে আলোচনা চলিতেছে। উভয় ক্ষেত্রেই একজন অত্যাচারী রাজা ছিল। উভয়েরই জন্ম হইয়াছিল অনেকটা এক অবস্থায়। দুইজনেরই মাতাপিতাকে বন্দী করিয়া রাখা হয়। দুইজনকেই দেবদূতেরা রক্ষা করিয়াছিলেন। উভয়ক্ষেত্রেই তাঁহাদের জন্ম বৎসরে যে শিশুগুলি ভূমিষ্ঠ হয়, তাহাদিগকে হত্যা করা হইয়াছিল। শৈশবাবস্থাও একই প্রকার। . . . . আবার পরিণামে উভয়েই নিহত হন। কৃষ্ণ নিহত হন একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায়; তিনি তাঁহার হত্যাকারীকে স্বর্গে লইয়া যান। খ্রীষ্টকে হত্যা করা হয়; তিনি দস্যুর মঙ্গল কামনা করেন এবং তাহাকে স্বর্গে লইয়া যান।

(কৃষ্ণ ও তাঁহার শিক্ষা; ৮ম খন্ড; স্বামীজীর বাণী ও রচনা)

কখনও আবার মন্তব্য করা হয়েছে— ‘নিউ টেস্টামেন্ট এবং গীতার উপদেশগুলিতে অনেক মিল আছে’(পৃ – ৩১৫)। এও বলেছেন স্বামীজী— ‘খ্রীষ্টের মতো কৃষ্ণও নিজেকেই ঈশ্বর বলিয়াছেন। নিজের মধ্যে তিনি দেবতাকে দর্শন করিয়াছিলেন’ (পৃ – ৩১১)।

বিদেশ পর্যটন কালে এমন কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন— আপনারা যীশুখ্রীষ্টকে যেমন শ্রদ্ধা ও পূজা করেন, শ্রীকৃষ্ণকেও তেমনি ভারতবর্ষের লোক শ্রদ্ধা ও পূজা করেন। শুধু যুগের ব্যবধান মাত্র। আপনাদের দেশের খ্রীসমাসের মতো হিন্দুরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি (জন্মাষ্টমী) পালন করেন। গীতার অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাইবেলে ধৃত সিদ্ধান্তে গভীরতর মিল দেখা যায়। কেউ কেউ এই কারণে মনে করে থাকেন যে খ্রীষ্টধর্ম থেকেই এইসব তত্ত্ব গীতায় গৃহীত হয়েছে। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ড. লরিনসর গীতার যে জার্মান অনুবাদ করেন সেখানে গীতা ও বাইবেলের মধ্যে প্রায় শতাধিক স্থলে শব্দসাদৃশ্য দেখিয়েছেন। যেমন, ‘সেইদিন তোমরা জানিতে পারিবে যে, আমি আমার পিতার মধ্যে, তোমরা আমার মধ্যে এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি (জন, ১৪, ২০), এর সঙ্গে গীতায় কথিত ‘যেন ভূতান্য শেষেণ দ্রক্ষস্যাত্মন্যথো ময়ি (গীতা, ৪, ৩৫), কিংবা ‘যো মাং পশ্যতি সর্বত্র চ ময়ি পশ্যতি (গীতা, ৬, ৩০) বাক্যগুলির গভীর মিল। জনের পরবর্তী ‘যে আমাকে প্রীতি করে আমিও তাহাকে প্রীতি করি’ (১৪, ২১) গীতায় কথিত ‘প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থম হং স চ মম প্রিয়ঃ’ (গীতা, ৭, ১৭) বাক্যের সাযুজ্য লক্ষণীয়। এইসবের প্রেক্ষিতে ড. লরিনসরের সিদ্ধান্ত— বাইবেল গীতা কারের জানা ছিল এবং গীতা খ্রীষ্টের প্রায় ৫০০ বছর পরে রচিত হয়ে থাকবে। কিন্তু ড. লরিনসরের এই অনুমান খন্ডিত হয়েছে কে. টি. তেলাং-এর দ্বারা। K.T. Telang ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ভাগবত গীতার অমিত্রাক্ষর ছন্দে (Blank verse) অনুবাদ করেছিলেন। শুধু তেলাং একাকী নন, মোক্ষমূলারের মত সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতও লরিনসরের অনুমান নাকচ করেছেন। পন্ডিতেরা গীতা রচনার কাল খ্রীষ্টপূর্ব বলে সিদ্ধান্তে এসেছেন। সেক্ষেত্রে লরিনসরের অনুমান যে টেঁকেনা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তিলক আবার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ‘খ্রীষ্ট ধর্ম হইতে কোন বিষয়ই গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব ছিল না, বরঞ্চ গীতার তত্ত্বসমূহের ন্যায় যে কিছু তত্ত্ব খ্রীষ্টীয় বাইবেলে পাওয়া যায়, সেগুলি বাইবেলেই, অন্তত বৌদ্ধধর্ম হইতে অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে গীতা বা বৈদিক ধর্ম হইতেই খ্রীষ্ট কিংবা তাঁহার শিষ্যদের কর্তৃক গৃহীত হওয়াই খুব সম্ভব . . . .।’

গীতা ও কোরাণের তুলনামূলক আলোচনাতেও কেউ কেউ প্রবৃত্ত হয়েছেন। যেমন আবদুল আজীজ আল আমান। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বলেছেন কর্মত্যাগ ও কর্মযোগ মোক্ষ প্রদান করলেও কর্মত্যাগের তুলনায় কর্মযোগ উৎকৃষ্টতর—

সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নি:শ্রেয়সকরাবুভৌ।
তয়োস্তু কর্মসনন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে।। ৫/২

অর্জুনকে উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ বলেছেন তাঁর কর্মেই অধিকার, ফলে নয়—

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।। ২/৪৭

কোরাণ শরীফেরও বহু স্থানে আল্লাহ মানুষকে কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেছেন, বলেছেন কর্মনিরত মানুষই শ্রেষ্ঠ।

গীতায় কথিত হয়েছে, ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি। শুভকর্মের যিনি অনুষ্ঠাতা তাঁর কখনই দুর্গতি হতে পারে না। কোরাণ শরীফে কথিত হয়েছে— লিল্লাজিনা আহসানো ফি হাজেহিদ দুনিয়া হাসানাতোন (৩৯ সুরা : ১০ আয়াত)। অর্থ হল, যারা পৃথিবীতে কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আরও বলা হয়েছে— অমাই ইয়ামাল ঝিমকালা যাররাতিন খাই রাঁই ইয়াস্ত অমাই ইয়ামাল মিসকালা যাররাতিন সার রাঁই ইয়ারা (৯৯ সুরা : ৭-৮ আয়াত)। অর্থ হল কেউ যদি অনুপরিমাণ সৎকাজ করে তা দেখবে ও কেউ অণুপরিমাণ অসৎকাজ করলে তাও দেখবে (সাজা লাভ করবে)।

গীতার দশম অধ্যায়ে বলা হয়েছে : দেবতা কিংবা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তির বিষয় জানেন না। আমিই সর্বপ্রকার দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ, আমিই তাদের স্রষ্টা। কোরান শরীফের নানা স্থানে আল্লাহ বলেছেন যে তিনি জ্বিন, মানুষ, ফেরেস্তা, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। গীতার দশম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—

যো মামজমনাদিঞ্চ, বেত্তি লোকমহেশ্বরম

অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্যেষু সর্বপাপৈ: প্রমুচ্যতে।। ১০/৩

মানুষের মধ্যে সেই মোহশূন্য ব্যক্তি সব পাপ থেকে মুক্ত, যিনি নাকি আমাকে জানেন অনাদি, জন্মরহিত, মহৈশ্বর্যসম্পন্ন এবং সর্ব লোক-প্রভু বলে।

এবারে দেখা যাক কোরান শরীফে কী বলা হয়েছে— কুল হো আল্লাহো আহাদ। আল্লাহুস সামাদ। লাস ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ। অলাম ইয়া কুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।

অর্থ হল— তিনি আল্লাহ অদ্বৈত আল্লাহ সর্ববিষয়ের নির্ভর, তিনি জনক নন, জাতকও নন। তাঁর সমতুল কেউ নেই।

গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে ভগবানের স্বরূপ দেখার বাসনা জানিয়েছেন। কোরান শরীফেও দেখি হজরত মুসা আল্লাহর কাছে অনুরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন— আমার প্রতিপালক, আমাকে দর্শন দাও। আমি তোমাকে দেখব। গীতার একাদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ লভ্য, অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনে বিস্ময়ান্বিত ও রোমাঞ্চিত হন।

ততঃ স বিস্ময়াবিষ্টো হৃষ্টরোমা ধনঞ্জয়ঃ।
প্রণম্য শিরসা দেবং কৃতাঞ্জলি র ভাষত।। ১১/১৪

কোরান শরীফের আয়াতে দেখি— ফালাম্মা তাজাল্লা রাব্বোহু লিল জাবালে জয়ালাহু দাক কাঁও অ খাররা মুসা সায়েকা (৭সুরা : ১৪৩ আয়াত)। অর্থ হল, যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে ‘জ্যোতিষ্মান হলেন তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করল, মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল . .। শুধু দুইয়ে মিলই নয়, গরমিলও রয়েছে। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ কম্বুকন্ঠে জানান সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশের জন্য, ধর্ম সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে তিনি আবির্ভূত হন—

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।। ৪/৮

গীতায় যেখানে ভগবানের নিজেরই আবির্ভূত হওয়ার কথা বর্ণিত, কিন্তু কোরাণ শরীফে আল্লাহ কোনো অবস্থাতেই স্বয়ং আবির্ভূত হন না বলা হয়েছে, বলা হয়েছে যুগে যুগে তিনি পয়গম্বরদের তাঁর বাণী ও নির্দেশ সহ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।

জ. শ্রীকৃষ্ণকে আদর্শ সর্বগুণান্বিত এবং সর্বপ্রকার ত্রুটি মুক্ত ব্যক্তি রূপে প্রতিপন্ন করতেও কেউ কেউ গীতার আলোচনায় প্রয়াস পান। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন :

আমি যত মানুষের কথা জানি, তাহাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর। তাঁহার মধ্যে মস্তিষ্কের উৎকর্ষ, হৃদয়বত্তা ও কর্মনৈপুণ্য সমভাবে বিকশিত হইয়াছিল। তাঁহার জীবনের প্রতি মুহূর্ত নাগরিক, যোদ্ধা, মন্ত্রী অথবা অন্য কোন দায়িত্বশীল পুরুষের কর্মপ্রবণতায় প্রাণবন্ত। বিদ্যাবত্তা, কবি-প্রতিভা, ভদ্র ব্যবহার— সব দিক দিয়াই তিনি ছিলেন মহান। গীতা ও অন্যান্য গ্রন্থে এই সর্বাঙ্গীণ ও বিস্ময়কর কর্মশীলতা এবং মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের অপূর্ব সমন্বয়ের কথা ব্যাখ্যাত হইয়াছে। . . . . এই মহান ব্যক্তির প্রচন্ড কর্মক্ষমতার পরিচয় এখনও দেখা যায়। পাঁচ হাজার বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে— আজও কোটি কোটি লোক তাঁহার বাণীতে অনুপ্রাণিত হইতেছে। . . . . সমগ্র জগতে তাঁহার চরিত্রের প্রভাব কত গভীর। তাঁহার পূর্ণাঙ্গ প্রজ্ঞাকে আমি পরম শ্রদ্ধা করি। কোন প্রকার কুটিলতা, কোন প্রকার কুসংস্কার সেই চরিত্রে দৃষ্ট হয় না।

স্বামীজী আরও বলেছেন :

আমাদের দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করিয়া ঊর্ধ্বে এবং সম্মুখে আগুয়ান মানবজাতিকে উদার দৃষ্টিতে দেখিতে শেখানোই, শ্রীকৃষ্ণের মহতী কীর্তি। তাঁহার বিশাল হৃদয়ই সর্বপ্রথম সকল মতের মধ্যে সত্যকে দেখিতে পাইয়াছিল, তাঁহার শ্রীমুখ হইতেই প্রত্যেক মানুষের জন্য সুন্দর সুন্দর কথা প্রথম নি:সৃত হইয়াছিল।

শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের বিশেষত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে স্বামীজী বললেন :

শ্রীকৃষ্ণের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হইল অনাসক্তি। তাঁহার কোন ব্যক্তিগত প্রয়োজন নাই, কোন অভাব তাঁহার নাই। কর্মের জন্যই তিনি কর্ম করেন। কর্মের জন্যই কর্ম। পূজার জন্য পূজা। পরোপকার কর— কারণ, পরোপকার মহৎ কাজ; আর কিছু চাহিও না। ইহাই শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র।

শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়বত্তার কথা বলতে গিয়ে স্বামীজী বললেন :

বুদ্ধদেবেরও পূর্ববর্তী শ্রীকৃষ্ণই সকল সম্প্রদায়ের নিকট ধর্মের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করিয়াছিলেন। মনঃশক্তি এবং প্রচন্ড কর্মপ্রাণতার কী অপূর্ব বিকাশ।’ স্বামীজীর দৃষ্টিতে, ‘কৃষ্ণ পরমাত্মা, স্বয়ং ভগবান।

স্বামীজীর কৃষ্ণ অনুরক্তির প্রকাশ বারংবার ঘটেছে। নানা উপলক্ষে তিনি তাঁকে নানাভাবে আবিষ্কার করেছেন। কৃষ্ণ চরিত্রের বহুমাত্রিকতায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন আর সেই মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছেন নানা সময়ে। স্বামী-শিষ্য-সংবাদে স্বামীজী শিষ্যকে বললেন :

অমন ভয়ানক যুদ্ধ কোলাহলেও কৃষ্ণ কেমন স্থির, গম্ভীর, শান্ত। যুদ্ধক্ষেত্রেই অর্জুনকে গীতা বলেছেন, ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম— যুদ্ধ করতে লাগিয়ে দিচ্ছেন। এই ভয়ানক যুদ্ধের প্রবর্তক হয়েও নিজে শ্রীকৃষ্ণ কেমন কর্মহীন— অস্ত্র ধরলেন না। যে দিকে চাইবি, দেখবি শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র Perfect— (সর্বাঙ্গ সুন্দর)। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, যোগ— তিনি যেন সকলেরই মূর্ত্তিমান বিগ্রহ! শ্রীকৃষ্ণের এই ভাবটিরই আজকাল বিশেষভাবে আলোচনা চাই। . . . . এখন চাই গীতারূপ সিংহনাদকারী শ্রীকৃষ্ণের পূজা;

স্বামীজীর কাছে মনে হয়েছে, ‘সমস্ত গীতাটি personified (মূর্তিমান)। যখন অর্জুনের মোহ আর কাপুরুষতা এসেছে, তিনি তাঁকে গীতা বলেছেন, তখন তাঁর Central idea (মুখ্য ভাব)টি তাঁর শরীর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে।

শ্রীকৃষ্ণের যে চিত্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত তাঁর সেই রথারূঢ় অর্জুনের সারথি রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বামীজী বললেন :

এমনি করে সজোরে ঘোড়া দুটোর রাশ টেনে ফেলেছেন যে, ঘোড়ার পিছনের পা-দুটো প্রায় হাঁটু গাড়া গোছ আর সামনের পাগুলো শূন্যে উঠে পড়েছে— ঘোড়াগুলো হাঁ করে ফেলেছে। এতে শ্রীকৃষ্ণের শরীরে একটা বেজায় action (ক্রিয়া) খেলছে। তাঁর সখা ত্রিভুবন বিখ্যাত বীর; দু-পক্ষ সেনাদলের মাঝখানে ধনুক-বাণ ফেলে দিয়ে কাপুরুষের মতো রথের ওপর বসে পড়েছেন। আর শ্রীকৃষ্ণ সেই রকম ঘোড়ার রাশ টেনে চাবুক হাতে সমস্ত শরীরটিকে বেঁকিয়ে তাঁর সেই অমানুষী প্রেমকরুণামাখা বালকের মতো মুখখানি অর্জুনের দিকে ফিরিয়ে স্থির, গম্ভীর দৃষ্টিতে চেয়ে তাঁর প্রাণের সখাকে গীতা বলছেন। . . . . সমস্ত শরীরে intense action (তীব্র ক্রিয়াশীলতা) আর মুখ যেন নীল আকাশের মতো ধীর গম্ভীর প্রশান্ত! এই গীতার Central idea।

গীতায় যথাক্রমে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিষোগ এই তিন যোগের কথাই আছে। তিনটি পথেরই প্রশংসা করা হয়েছে। তিনটি পথকেই পৃথক পৃথক ভাবে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষ অভীষ্ট লক্ষে উপনীত হতে যে কোনো একটি পথকেই অবলম্বন করতে পারে। বিশেষভাবে কোন একটি পথকে আশ্রয় করার পরামর্শ প্রদত্ত হয়নি। ফলত সূচনা হয়েছে বিতর্কের, শেষ পর্যন্ত গীতায় কোন একটি পথের কথাই কি সর্বাধিকগুরুত্ব পেয়েছে? যাঁরা বিতর্ক এড়াতে চান তাঁরা সুনিপুণভাবে গীতায় সমন্বয়বাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এঁদের মতে গীতায় বিশেষ কোনো একটি নির্দিষ্ট মতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

যাঁরা সমন্বয়বাদী তাঁদের একদিকে রাখলে অন্যদিকে রয়ে যান কর্মযোগের সমর্থকরা, জ্ঞানযোগের সমর্থকরা এবং ভক্তিষোগের সমর্থকরা। এঁরা নিজ নিজ বিশ্বাস, ষুক্তি ও ব্যাখ্যা অনুযায়ী যথাক্রমে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের প্রাধান্যের রমরমা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পাঠকসাধারণকেও নিজ নিজ মতে আস্থাশীল করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন—

যোগ

মজা হল পাঠক নিজ নিজ মানসিকতা অনুযায়ী গীতার মধ্যে কর্ম, জ্ঞান অথবা ভক্তিযোগের প্রাধান্য লক্ষ করেন। গীতার বৈশিষ্ট্য এখানে যে, তিনটি মতবাদকেই গীতা প্রশ্রয় দেয় একইভাবে। প্রশ্ন হল যাঁরা এইসব যোগের প্রাধান্যে বিশ্বাসী তাঁদের মানসিকতা কিরূপ? অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ কোন মানসিকতা বিশেষ বিশেষ যোগের সমর্থনের পরিপোষক? প্রথমেই ধরা যাক কর্মযোগের কথা। মূলতঃ প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে স্বাধীনতা-সংগ্রামে বিশ্বাসী, কিংবা দেশপ্রেমিক যাঁরা তাঁরাই কর্মবাদের জয়গানে মুখরিত হয়েছিলেন। গীতার কর্মবাদের বৈশিষ্ট্য আগে আলোচনা করে নেওয়া যাক। গীতায় কর্মযোগের দুটি বৈশিষ্ট্য। প্রথমতঃ মানুষকে যতই কেন আমরা নিষ্কর্মা দেখি বা বলি, আসলে কোনো জীবিত মানুষের পক্ষে নিষ্কর্মার জীবনযাপন সম্ভব নয়। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশের মত যতক্ষণ মানুষ জীবিত ততক্ষণই সেকর্মে সক্রিয়। এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নেই, ব্যাপার নেই সচেতন-অসচেতনের প্রসঙ্গ। নি:শ্বাস গ্রহণ এটিও একটি কাজ। আহার্য গ্রহণ এটিও কাজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কারো পক্ষে কর্মহীন থাকা সম্ভব নয়। যতক্ষণ মানুষ জীবিত থাকে, ততক্ষণই মানুষ কর্মঠ থাকে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ-কর্মেই আমাদের অধিকার কেবল, ফলে আমাদের কোনো অধিকার নেই। কী আশ্চর্য? মানুষ যে কর্মোদ্যোগী হয় সেত বিশেষ এক লক্ষ্যে উপনীত হতে। ফলের চিন্তা করেই ত মানুষ কর্মসাগরে ঝাঁপ দেয়। ছাত্র কঠিন পরিশ্রম করে পাঠ প্রস্তুত করে, বিনিদ্র রজনী যাপন করে। কেন করে না পরীক্ষা বৈতরণী অতিক্রমণের লক্ষ্যে তৎসহ বাঞ্ছিত সাফল্য করায়ত্ত করতে। অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসকের সাহায্য নেয় কেন, না রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে চিকিৎসক কেন রোগীর চিকিৎসা করেন, না অসুস্থকে সুস্থ করার অভিপ্রায়ে। বস্তুতঃ পরিণতির কথা ভেবেই ত মানুষের কাজে আত্মনিয়োগ। একটা লক্ষ্য না থাকলে মানুষ কাজ করবে কী করে? অথচ গীতায় বলা হল ফলের কথা চিন্তা না করেই কাজ করতে হবে। মানুষের অধিকার শুধু কর্ম করার, ফলের ব্যাপারে তার কোনো ভূমিকা নেই, চিন্তা করারও অবকাশ নেই। প্রশ্ন হল, সমাজসেবী, দেশপ্রেমী, স্বাধীনতাসংগ্রামীরা কেন ঝুঁকলেন এই কর্মযোগের প্রতি। Plurality of causes এখানে কাজ করেছে। দেখা যাক, সেগুলি কি কি—

ক. কর্মযোগে বিশ্বাসীরা মনে করেন জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগে বিশ্বাসী যাঁরা তাঁরা তুলনামূলকভাবে অলস জীবন যাপন করেন। জ্ঞান চর্চা কিংবা অধ্যাত্ম জগতে বিচরণ করলে সমাজের বা রাষ্ট্রের বৈষয়িক উন্নতি সম্ভব নয়।

খ. একমাত্র কর্মযোগের পথই মানুষকে অনেক বেশী নি:স্বার্থ করে, মানুষ যে কাজ করে তা কেবল নিজের জন্য নয়, নিজের স্বার্থে নয়, এমনকি নিজের স্বার্থোন্নতির জন্য করা কাজেও অন্যান্যরা উপকৃত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র তথা বৃহত্তর জনগণের উন্নতি একমাত্র কর্মযোগের উপরই নির্ভরশীল।

গ. জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগে যে ফললাভ ঘটে কর্মযোগেও সেই একই ফললাভ ঘটে, অতএব কর্মযোগ ত্যাগ করা যুক্তিযুক্ত নয়।

ঘ. স্বয়ং ঈশ্বরও কর্মযোগী, বিশ্ব-সংসার সৃষ্টিই তাঁর কর্মোদ্যোগের নিদর্শন। শুধু তাই নয়, বিশ্ব সংসার ও তাঁর সৃষ্ট জীবজগতের কল্যাণসাধনে সদাই কর্মতৎপর তিনি। রবীন্দ্রনাথ তাই ত বলেছেন :

মুক্তি? ওরে, মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে!

আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে।

রাখো রে ধ্যান থাকরে ফুলের ডালি,

ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি—

কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।।

সকলেই যদি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হয়, সকলেই যদি ভক্তিমার্গের পথিক হয়, তবে জগতের কর্মচঞ্চলতা তিরোহিত হবে। সংসার অচল হবে, জীবজগতের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

ঙ. সংসার অনিত্য, অকিঞ্চিৎকর। সংসার মায়াময়, প্রপঞ্চক, তা আমাদের মোহজালে আবদ্ধ করে রাখে। নিত্যের সন্ধানে তাই মোহপাশ থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। যে যত সেই মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারবে, ততই সেনিত্যের নিকটবর্তী হবে। স্পষ্টতই এখানে কর্মবিমুখতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এরূপ মানসিকতার পরিপুষ্টি সাধনে সংসারের অকল্যাণ, সমাজের অকল্যাণ, রাষ্ট্রের অকল্যাণ। পারিবারিক তথা সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রিক দায়িত্ব পালন যদি অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন হয়, মানুষ যদি পারিবারিক কিংবা সামাজিক দায়িত্ব পালনে মুখ ফেরায় তবে আখেরে ক্ষতি হবে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের, এক কথায় মানুষের। অতএব সামাজিক মানুষ কর্মযোগকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এইসব আশঙ্কার মূলচ্ছেদের অভিপ্রায়ে।

চ. সমাজসেবাও কাজ, দেশসেবাও কাজ এমনকি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম সেও কাজ। কোনোটিই অকাজ নয়, কোনটিই ভস্মে ঘি ঢালা নয়। ভক্তিমার্গের পথিক হয়ে যেমন অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব, ঈশ্বর-সন্নিধানে যাওয়া সম্ভব, সমাজসেবা কিংবা দেশসেবার মাধ্যমেও সেটা সম্ভব। তাই সমাজসেবী এবং দেশপ্রেমিকদের পছন্দের পথ কর্মযোগ, এ পথেও তো শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরলাভ সম্ভব।

ছ. স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের বিশেষ পছন্দের পথ ছিল কর্মযোগ। কেন? না প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতা আন্দোলন, সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় তার পরিণতি কী, ফলশ্রুতি কী? স্বাধীনতাসংগ্রামীদের কাছে এ ধরনের প্রশ্ন অনেকেই করেছেন, করতেন, হয়ত স্বাধীনতা- সংগ্রামীদের মনেও এমনতর সংশয় জন্মে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাঁরা কর্মযোগকেই আশ্রয় করে উত্তরের সন্ধান করতেন, উত্তর পেতেন। কি সেউত্তর? তাঁদের সীমাবদ্ধ প্রয়াস ফলবতী হবে কি নষ্ট হবে সেচিন্তা অর্থহীন, কর্মেই অধিকার মাত্র যখন তখন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের প্রয়াসটাই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ফললাভের কথা চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আন্দোলনের ফল যদি হয় স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, তবে সেক্ষেত্রে এঁরা বিশ্বাসী ছিলেন ‘মা ফলেষু কদাচনে’। সংগ্রামেই কেবল অধিকার, আন্দোলনেই তাঁদের অধিকার এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা কর্মযোগে তাই সামাজিক আন্দোলন কিংবা রাষ্ট্রিক আন্দোলনে পরম নির্ভরতার স্থান ছিল কর্মযোগ।

জ. অর্জুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিলেন। কেন? না তাঁর প্রিয়জন, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের নিহত হওয়ার সম্ভাবনার কারণে। কৃষ্ণ সুবাদে অর্জুনের, ক্ষাত্রবীর্ঘ বিসর্জন দেওয়া নয়, তাঁকে ক্ষত্রিয়ের কর্ম করতে হবে, সেই দায়িত্ব পালনে যদি আত্মীয় প্রিয়জনকে হত্যা করতে হয় তাও করতে হবে, তাতে কোনো পাপ হবে না। স্বাধীনতাসংগ্রামী বিশেষত বিপ্লবীরা এই সুবাদে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের সংগ্রামে বিদেশীয়দের হত্যা করলে কখনই তা পাপকাজ বলে পরিগণিত হবে না।

এবারে আসি জ্ঞানযোগের সমর্থকদের প্রসঙ্গে। গীতার ‘জ্ঞানযোগ’-এর ৪২ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে—

তসিদজ্ঞানসম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাস্মিনাত্মনঃ।

ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত।। ৪/৪২

আমাদের মনে যে অহরহ নানাবিষয়ে সংশয়ের উদ্ভব হয় তার কারণ অজ্ঞানতা। সেই অজ্ঞানতাপ্রসূত সংশয়ের অবসানে প্রয়োজন জ্ঞানের। জ্ঞানযোগের সমর্থক তাই একান্তভাবে জ্ঞানের পথকেই আশ্রয় করার কথা বলেন। যাঁরা তাত্ত্বিক, জ্ঞানসাধক, তাঁদের বক্তব্য হল বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা ব্যতিরেকে মানুষ সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে কিরূপে? আর সঠিক পথের সন্ধানলাভ ব্যতিরেকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া কি সম্ভব? মানুষকে পারমার্থিক জ্ঞানের অনুশীলন করতে হবে, অবহিত হতে হবে ভগবানের সঙ্গে তার নিত্য-সম্পর্ক বিষয়ে। আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত প্রকৃত তত্ত্ববিজ্ঞান জানা উচিত। জ্ঞানযোগে জানা সম্ভব ঈশ্বর তিনিই যিনি জন্মরহিত এবং তাঁর যে চিন্ময় দেহ তা অব্যয়। অন্তরঙ্গাসক্তিকে আশ্রয় করেই ঈশ্বর যুগে যুগে আদি চিন্ময় রূপে অবতীর্ণ হন। একমাত্র ভগবানই নিত্য, তিনি সচ্চিদানন্দ, জড় প্রকৃতি তাঁকে কলুষিত করতে অক্ষম। তিনিই একমাত্র যিনি কোনো কিছুর দ্বারা আবদ্ধ নন। তিনি স্বরাট। আমরা কেমন করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করতে পারি, করা কি সম্ভব—এর উত্তরও লভ্য জ্ঞানযোগে। দেবতাদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, কিন্তু অন্যান্য দেব-দেবীর সঙ্গে ভগবানের পার্থক্য কোথায়? এর উত্তর মিলবে জ্ঞানযোগেই। এমন কি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের পথনির্দেশের সন্ধানের জন্যও আমাদের জ্ঞানের আশ্রয়গ্রহণ ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জানা জরুরী কর্ম কী? অকর্মই বা কী, আবার বিকর্ম বলতেই বা কী বোঝায়? আত্ম-উপলব্ধি করতে গেলে কোন পথ অবলম্বন শ্রেয়ঃ? মানুষ স্বভাবতঃই সকাম, কিন্তু নিষ্কাম হওয়া কী সম্ভব? যজ্ঞ কী? দ্রব্যময় যজ্ঞ এবং জ্ঞানময় যজ্ঞের পার্থক্য কোথায়? পরমতত্ত্ব জ্ঞান লাভের জন্য কার শরণাগত হওয়া প্রয়োজন? পরমতত্ত্ব জ্ঞান কী? অপ্রাকৃত তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য কী? দুঃখ-সমুদ্র অতিক্রমণ কিরূপে সম্ভব?

অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।

সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।। ৪/৩৬

জ্ঞানরূপ তরণীর সাহায্যেই সেটা সম্ভব। বলা হয়েছে—

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।

জ্ঞানের তুল্য পবিত্র আর কিছু হয় না। কে জ্ঞানলাভের অধিকারী না যিনি শ্রদ্ধাবান, যিনি সংযতেন্দ্রিয়। মূলত যাঁরা তাত্ত্বিক, চিন্তাশীল, মননশীল, দর্শনবেত্তা অথবা শাস্ত্রজ্ঞ, জ্ঞানী, ধর্মবেত্তা তাঁরাই জ্ঞানযোগের সমর্থক। এঁদের কাজ তত্ত্বালোচনা, এতেই এঁদের আনন্দ। এঁরা সঠিক পথনির্দেশক হয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করেন। অধ্যাত্মবিদ্যার চুলচেরা বিচারে এঁদের আনন্দ। একটি ধারণার সঙ্গে অন্য ধারণার পার্থক্য কোথায় তার সন্ধান করেন, সর্ববিধ সংশয়ের অপনোদনে এঁরা সদাই সচেষ্ট। জ্ঞানমার্গের শ্রেষ্ঠত্বে এঁদের অগাধ আস্থা। তাই জ্ঞানমার্গের প্রচারে এঁরা অক্লান্ত। এঁদের শাস্ত্রজ্ঞান সীমাহীন। দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান এঁরা অন্যদের কাছে তুলে ধরতে আন্তরিক। সমাজ এঁদের সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। জ্ঞানী ব্যক্তি বলে এঁরা বিশেষ সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেন। শাণিত এঁদের বুদ্ধি, অতুলনীয় এঁদের নিষ্ঠা, বিচারশক্তি এঁদের তুলনাহীন। দৃষ্টিশক্তি এঁদের স্বচ্ছ। আপাদমস্তক এঁরা যুক্তিবাদী। তার্কিক বলে এঁদের সাধারণ পরিচিতি। শাস্ত্রব্যাখ্যাতা রূপে এঁদের কদর খুব। নিজেরাও এঁরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অবহিত।

সবশেষে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। গীতায় কথিত হয়েছে—

শ্রদ্ধা ধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেতীব যে প্রিয়া:।

শ্রদ্ধাবান যিনি, যিনি মৎপরায়ণ এবং ভক্ত তিনিই আমার প্রিয়। অতএব ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ, কেননা ভক্তিযোগের মাধ্যমেই পারমার্থিক উপলব্ধি সম্ভব। গীতার ভক্তিযোগে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বকলমে জানানো হয়েছে শ্রীভগবানের সান্নিধ্য লাভের জন্য শ্রেষ্ঠ পন্থা হল ভক্তিযোগ। শ্রীকৃষ্ণের স্বীকারোক্তি—

ময্যাবেশ্য মনো যে মাংনিত্যযুক্তা উপাসতে। শ্রদ্ধয়া পরমো পেতাস্তে যে যুক্ততমা মতা:।।

ঈশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত যিনি শ্রদ্ধাসহ তাঁর নিরন্তর উপাসনায় রত তিনিই যোগীশ্রেষ্ঠ। প্রকৃত ভক্ত সকল অবস্থাতেই সুখী। সকল অবস্থার মধ্যেই যে তিনি ভগবানের স্পর্শ লাভ করেন, প্রত্যক্ষ করেন ভগবানের ইচ্ছাকে। তাই ভক্তের কাছে শত্রুমিত্র, নিন্দা-প্রশংসা, দারিদ্র্য-প্রাচুর্য, শীত-গ্রীষ্ম, মান-অপমানে কোনো পার্থক্য নেই। ভক্ত আনন্দিত হন না, দুঃখিত হন না। তাঁর কাছে শুভ-অশুভ দুইই সমান—

ক. অনিকেতঃ স্থির মতির্ভক্তিমান প্রিয়ো নরঃ

খ. শ্রদ্দধানা মৎ পরমা ভক্তস্তেতী মে প্রিয়া:

গ. শুভাশুভ পরিত্যাগী ভক্তিমান যঃ স মে প্রিয়ঃ

ঘ. সর্বারম্ভ পরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ

ঙ. হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ

চ. ময্যর্পিত মনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ

এখানে জ্ঞানযোগীর সঙ্গে ভক্তিযোগীর পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। কী রকম? না, প্রথমটি অনেক বেশি ক্লেশসাপেক্ষ, দুরূহ, জটিল। তুলনামূলক ভাবে দ্বিতীয়টি সহজ ও জটিলতামুক্ত। প্রথমটিতে যুক্তিনির্ভরতা দেখি, পক্ষান্তরে দ্বিতীয়টিতে বিশ্বাসনির্ভরতার প্রাধান্য। ভক্তি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তাই দেখা যায় জ্ঞানের সাধকদের তুলনায় ভক্তিমার্গের পথিকদের সংখ্যা বেশি।

জ্ঞানযোগীরা ভগবানের অচিন্ত্য, অব্যক্ত এবং নির্বিশেষ তত্ত্ব জানতে প্রয়াস করেন। এঁদের প্রয়াস সময়- সাপেক্ষও বটে। অন্যদিকে ভক্তিযোগে ভক্ত ঈশ্বরভাবনায় ভাবিত মাত্র। তিনি ঈশ্বরের লীলামাহাত্ম্য শ্রবণ করেন, ঈশ্বরের বিগ্রহ দর্শন করেন, ঈশ্বরে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করে আপ্লুত হন, আনন্দাশ্রু নির্গত করেন, ঈশ্বরের আশ্রিত বলে নিজেকে উপলব্ধি করেন ভগবানের চরণে নি:শর্ত আত্মনিবেদনেই তাঁর পরমানন্দ। ভগবানের যে কোনো সেবায় আত্মনিয়োগেই তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন তা সেচন্দনবাটাই হোক কিংবা পূজার কুসুম চয়ন অথবা নৈবেদ্যর ফলমূলাদি কর্তন। ভক্তের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ভগবদসেবায় আত্মনিয়োগ। ভক্তিযোগই একমাত্র যোগ যাতে দান, ধ্যান, যজ্ঞ, তপশ্চর্যা, যোগাদির সমস্ত প্রকার ফলপ্রাপ্তি ঘটে। অপ্রাকৃতলোকে প্রবেশের জন্য ভক্তকে অষ্টাঙ্গযোগের অনুশীলনে ব্রতী হতে হয় না। ভক্তের ভক্তির কাছে ভগবান বাঁধা পড়ে আছেন। মূলত সাধকরা ভক্তিযোগের কথা বলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সরাসরি ভক্তিযোগের পক্ষে সওয়াল করেছেন, বলেছেন, ঈশ্বরের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি হল ভক্তি। ভক্ত যত সহজে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেন জ্ঞানী তা করেন না।

সবশেষে সমন্বয়বাদের প্রসঙ্গ। এই সমন্বয়বাদের সমর্থকদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয় এবং এই সমর্থকদের তালিকায় এমন সব গুরুত্বপূর্ণ মনীষীদের নাম রয়েছে যে তাঁদের অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। মূলতঃ কারা এই মতবাদের পৃষ্ঠপোষক সেই আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা স্মরণ করে নিই গীতার সেই অভয়বাণী যেখানে বলা হয়েছে—

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যা: পার্থ সর্বশঃ।। ৪/১১

অর্থাৎ যে কোনো পথেই ঈশ্বরসমীপে উপনীত হওয়া সম্ভব। মূলকথা হল ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ (প্রপদ্যন্তে)। কোনো পথই তুচ্ছ নয় অবহেলার নয়, সমন্বয়বাদের বড় সমর্থক ঋষি অরবিন্দ। স্পষ্টভাষায় তিনি জানিয়েছেন :

The Gita preserves a perfectly equal balance, emphasizing new knowledge, new works, new devotion, but for the purpose of the immediate trend of the thought, not with any absolute separate preferences of one over two others.

অরবিন্দের একটি মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল :

‘He is whom all three meet and become one’. এই ‘He’ হলেন supreme being

বা পুরুষোত্তম। দুটি বৈশিষ্ট্য এখানে লক্ষণীয়। এক, তিনটি পথই শেষ পর্যন্ত মিলেছে পুরুষোত্তমে, বলা বাহুল্য। তিনটি পথ হল যথাক্রমে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগ। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হল, কোনো বিশেষ পথের ওপর গুরুত্ব প্রদত্ত হয়নি। অতএব গীতায় কর্মযোগের প্রাধান্য কিংবা জ্ঞানযোগের প্রাধান্য নিয়ে সোচ্চার হওয়া অমূলক।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর ভাষায়:

গীতার জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মধ্যে যে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা দেখি তাহা বিশেষ রূপে ভারতবর্ষের।

ভারতের সমন্বয়ী আদর্শের নিরিখে গীতার এই সমন্বয়বাদের সাযুজ্য খুবই উপযুক্ত বলে কবি মনে করেছেন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মত ব্যক্তিত্বের সমর্থনও একই দিকে :

The Hindu tradition believes that the different views are complementary.

অর্থাৎ অবিমিশ্র কোনো মতাদর্শের রাজকীয় আধিপত্য নয়, বরং একাধিক মত পরস্পরের পরিপূরক রূপেই প্রকাশিত। স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে চালিকাশক্তি রূপে গণ্য করেছেন জ্ঞানকেই, তবে শেষ পর্যন্ত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির ঐক্যকেই তিনি মেনে নিয়েছেন :

Devotion are combined knowledge, action and meditation.

এই তিন ব্যতীত বীরেশ্বরানন্দজী ধ্যানকেও যুক্ত করে নিয়েছেন পূর্বোক্ত তিনটি যোগের সঙ্গে। বলেছেন :

Knowledge is the main note in this symphony.

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দার্শনিকপ্রবর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বোপরি ভক্তিযোগের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, বলেছেন:

ভক্তিযোগের সাহচর্য ব্যতিরেকে জ্ঞানযোগই বা কি, কর্মযোগই বা কি, দুই-ই নিষ্ফল হয়।

কেউ কেউ মনে করেন বৈষ্ণব দর্শনের পঞ্চরসের মত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির পথ। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের মধ্যে মধুর রসই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু মধুর রসেই রয়ে গেছে শান্ত, দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য চার চারটি রস। মধুর বিচ্ছিন্ন কোনো রস নয়। অনুরূপভাবে ভক্তিপথেই অন্তর্ভুক্ত কর্ম ও জ্ঞানের পথ। তাহলে প্রকারান্তরে সেই সমন্বয়বাদকেই স্বীকৃতি দেওয়া হল।

আর একটি মত এইরকম; সাধনার তিনটি স্তর তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে কর্মযোগ, দ্বিতীয় পর্যায়ে জ্ঞানযোগ। অন্তিম পর্যায়ে ভক্তিযোগ। একটি পর্যায় অতিক্রম করে তবেই দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে হয়। ভক্তিমার্গে উপনীত হতে কর্ম ও জ্ঞানলাভ অতিক্রান্ত করতে হবে। অস্যার্থ, ভক্তি মার্গে উপনীত হতে হলে কর্ম ও জ্ঞানযোগকে অতিক্রম করতে হবে। এক্ষেত্রেও প্রকারান্তরে সেই সমন্বয় বাদকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়।

সমন্বয়বাদের সমর্থন করলে সবথেকে যে সুবিধাটি মেলে তা হল বিতর্ক মুক্তি। সমন্বয়বাদে সকল পথকেই মেনে নেওয়া হয়েছে তাই বিশেষ কোনো একটি যোগের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা থাকে না। তাছাড়া সমন্বয়বাদে সকল মতের সকল পথের পথিকের আশ্রয় মেলে। সংশয় থেকে মুক্তিলাভ ঘটে। যিনি কর্মযোগের সমর্থক, অবচেতনভাবে হলেও একটা সংশয় থেকে যায়, জ্ঞানযোগ কি তাহলে অপ্রয়োজনীয়? ভক্তিযোগের কি সত্যসত্যই কোনো ভূমিকা নেই? সমন্বয়বাদে তিনেরই পরিপোষকতা মেনে নেওয়া হয়, বিতর্কের অবকাশ অন্যান্য যোগের মত আর থাকে না। সমন্বয়বাদের বৈচিত্র্যও অস্বীকারের নয়। কে না জানে Variety is the spice of life?

.

নান্দীমুখ :

১. গীতা রহস্য ; ১৯২৪; পৃ – ৫২৮

২. স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ৮ম খন্ড; পৃ – ৪২৮

৩. ঐ ৯ম খন্ড; পৃ – ১৬

৪. ঐ ঐ পৃ : ১৪ – ১৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *