১. গণিতবিদ

প্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন সয়েন্স ফিকশন
মূল : আইজাক আসিমভ
অনুবাদ : নাজমুছ ছাকিব

গণিতবিদ

ক্লীয়ন প্রথম… ফাস্ট গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের সম্রাট প্রথম ক্লীয়ন ছিলেন এ্যান্টান রাজবংশের শেষ বংশধর। জন্ম গ্যালাক্টিক ইরার ১১, ৯৮৮ সালে (হ্যারি সেলডনের জন্ম ঠিক একই বছরে, অনেকেই মনে করেন যে ক্লীয়নের সাথে সেলডনের জন্ম সালটাকে ইচ্ছে করেই মেলানো হয়েছে, যেহেতু ট্র্যান্টরে আগমনের কিছুদিন পরেই ক্লীয়নের সাথে সেলডন দেখা করেছিলেন)। মাত্র বাইশ বছর বয়সে সম্রাট প্রথম ক্লীয়ন ক্ষমতাসীন হন। সেই সময় গ্যালাক্সির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বিরাজ করছিল সীমাহীন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা। কিন্তু ইতিহাসে ক্লীয়নের সুদীর্ঘ শাসনকালকে চিহ্নিত করা হয় নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ হিসেবে। ধারণা করা হয়ে থাকে যে এই শান্তি ও সমৃদ্ধির পিছনে মূল অবদান ছিল ক্লীয়নের চীফ-অব-স্টাফ ইটো ডেমারজেলের। অথচ ইতিহাসবিদরা এই ইটো ডেমারজেলের ব্যাপারে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি, কারণ সে সর্বদাই নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখত।
ক্লীয়ন নিজে…
—-এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

০১.

ছোটখাটো একটা হাই তুলতে গিয়েও তুললেন না ক্লীয়ন। বললেন, হ্যারি সেলডন এই নামের কোনো লোককে তুমি চেন, ডেমারজেল, বা নামটা কখনো শুনেছ?

দশ বছরের কিছু বেশি হয়েছে ক্লীয়ন সিংহাসনে বসেছেন। এই সময়ের মাঝে তিনি হাতে গোনা কয়েকবার জমকালো রাজকীয় পোশাক, আলখাল্লা–যে পোশাকগুলো পরিধান করলে তাকে মহান সম্রাটের মতোই মনে হয় সেগুলো পরিধান করে জনসমক্ষে হাজির হয়েছেন। পিছনের দেয়ালের কুলুঙ্গিগুলোতে পূর্বপুরুষদের হলোগ্রাফের সাথে তার নিজের হলোগ্রাফও আছে একটা, এমনভাবে রাখা যেন এক নজর তাকিয়েই সবাই বুঝতে পারে যে তিনি পূর্বপুরুষদের চেয়েও অনেক মহিমান্বিত।

এই হলোগ্রাফ তৈরির সময় ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। হলোগ্রাফ এবং বাস্তব ক্লীয়নের সাথে যথেষ্ট অমিল। যেমন বাস্তবে ক্লীয়নের চুলের রং হালকা বাদামী, হলোগ্রাফে চুলের রং ঠিকই আছে কিন্তু যথেষ্ট পাতলা। বাস্তবে ক্লীয়নের মুখে একটা অসঙ্গতি চোখে পড়ে। তার উপরের ঠোঁটের ডান কোণা বাদিকের চেয়ে খানিকটা বাকা হয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় উপরের দিকে উঠে থাকে সবসময়ই। হলোগ্রাফে এই অসঙ্গতিটুকু ফুটিয়ে তোলা হয়নি। এছাড়াও হলোগ্রাফে তার উচ্চতা যা দেখানো হয়েছে বাস্তবে তার উচ্চতা আরো কমপক্ষে ২ সে. মি. কম। তিনি উঠে গিয়ে যদি হলোগ্রাফের পাশে দাঁড়ান তাহলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে।

এটাই ক্লীয়নের ক্ষমতায় অভিষেকের হলোগ্রাফ। তখন তিনি ছিলেন তরুণ এবং সুদর্শন। অবশ্য এখনো তিনি সুদর্শন এবং গুরুগম্ভীর আর জটিল রাজকীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে যখন মুক্ত থাকেন, তার মুখে ভালোমানুষী স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে।

দীর্ঘদিনের পরিচর্যিত এবং পরিশিলীত সুরে জবাব দিল ডেমারজেল, হ্যারি সেলডন? নামটা অপরিচিত, সায়ার। আমি কী জানার চেষ্টা করব?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী গতরাতে এই লোকটার কথা আমাকে বলেছে। ভেবেছিলাম তুমি জানো।

ভুরু কুঁচকালো ডেমারজেল। তবে খুবই সামান্য, এতই সামান্য যে চোখে না পড়ার মতোই, কারণ সম্রাটের সামনে কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ করার নিয়ম নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর উচিত ছিল কথাটা প্রথমে আমাকে জানানো যেহেতু আমি চীফ-অব-স্টাফ। সবাই যদি ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েও আপনাকে বিরক্ত করা শুরু করে।

হাত তুললেন ক্লীয়ন, সাথে সাথে থেমে গেল ডেমারজেল। আহ্ ডেমারজেল, সবসময় নিয়ম কানুন মেনে চলা যায় না। গতরাতের অভ্যর্থনার সময় আমি কুশলাদি জানার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর সামনে একটু দাঁড়িয়েছিলাম। ওই সময়েই সে কথাগুলো আমাকে বলে আর আমিও না শুনে পারিনি। কারণ বিষয়টা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে।

আকৃষ্ট করেছে? কেন, সায়ার?

দেখো, পুরনো দিনের মতো গণিত আর বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে মানুষের মাঝে এখন কোনো ধরনের উন্মাদনা নেই। এইসব বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বোধহয় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেছে। হয়তো সবাই ধরে নিয়েছে যে মানুষের সুখ ও কল্যাণের জন্য যা যা আবিষ্কার করা প্রয়োজন বিজ্ঞান তার সবই আবিষ্কার করে ফেলেছে, তোমার কী মনে হয়? তারপরেও অসম্ভব এবং অকল্পনীয় অনেক কিছু এখনো ঘটতে পারে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী আপনাকে এগুলো জানিয়েছে, সায়ার?

হ্যাঁ, হ্যারি সেলডন একটা গণিত সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ট্র্যান্টরে এসেছে। কী কারণে জানি না সম্মেলনটা প্রতি দশ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী আমাকে জানায় যে এই হ্যারি সেলডন প্রমাণ করে দেখিয়েছে। যে গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আগাম বলে দেওয়া সম্ভব।

মুখে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে তুলল ডেমারজেল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ। কিন্তু তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে হয় তিনি বুঝতে ভুল করেছেন অথবা এই গণিতবিদ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা, এগুলো তো শিশুদের রূপকথা।

তাই কী, ডেমারজেল? মানুষ কিন্তু এগুলো বিশ্বাস করে।

মানুষ অনেক কিছুই বিশ্বাস করে, সায়ার।

কিন্তু এই ধরনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো একটু বেশিই বিশ্বাস করে। যাইহোক ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সত্য হোক বা না হোক, কোনো ব্যাপার না। যদি একজন গণিতজ্ঞ আমার জন্য জনগণের কাছে প্রচার করে যে অনাগত দিনগুলোতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সুখ-সমৃদ্ধি-শান্তি, ভবিষ্যতে এম্পায়ার হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধিশালী–সেটা ভালো হবে না?

শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু তাতে কী লাভ হবে, সায়ার?

জনগণ যদি বিশ্বাস করে, তাহলে তারা সেই অনুযায়ী আচরণ করবে। অনেক মতবাদই শুধু মানুষের গভীর বিশ্বাসের কারণে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই মতবাদগুলো আসলে মানুষের ভয়, শঙ্কা দূর করে তাদেরকে প্রশমিত করে তোলে। এই জাতীয় কথা তুমিই আমাকে বুঝিয়েছিলে।

বলেছিলাম, সায়ার। সতর্ক পর্যবেক্ষণে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে আছে ডেমারজেল, বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে বললে সীমা লঙ্ঘন করা হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে তো যেকোনো ব্যক্তিই মতবাদগুলো প্রচার করতে পারে।

যেকোনো ব্যক্তিকে জনগণ সমানভাবে বিশ্বাস করবে না, ডেমারজেল। অন্যদিকে একজন গণিতজ্ঞ তার মতবাদ প্রচার করবে গাণিতিক সূত্র এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে–যা সাধারণ মানুষ বুঝবে না অথচ বিশ্বাস করবে ঠিকই।

বরাবরের মতোই আপনি অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, সায়ার। সত্যি কথা, আমরা এখন সমস্যাসঙ্কুল কঠিন সময়ের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই সময় জনগণকে শান্ত রাখা প্রয়োজন। তার জন্য এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যাতে করে অর্থ ব্যয় বা সামরিক শক্তি কোনোটাই প্রয়োগ করতে না হয়। যেহেতু সমসাময়িক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই দুটো পদ্ধতিতেই লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।

ঠিক, ডেমারজেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন সম্রাট। হ্যারি সেলডনকে খুঁজে বের করো। আমি জানি তোমার হাত এই বিশাল গ্রহের সব জায়গাতেই ছড়ানো, এমনকি সেইসব স্থানেও যেখানে আমার সৈনিকরা পর্যন্ত যেতে ভয় পায়। হ্যারি সেলডনকে আমার সামনে নিয়ে এসো। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।

তাই হবে, সায়ার। বলল ডেমারজেল। সম্রাট অবশ্য জানেন না যে তার চীফ অব স্টাফ এরই মাঝে হ্যারি সেলডনকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। একটা কথা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল ডেমারজেল–এই চমৎকার কাজের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীকে একটা প্রশংসাসূচক ধন্যবাদ জানাতে হবে।

.

০২.

বর্তমান কাহিনী যে সময়ের, সেই সময় হ্যারি সেলডন ছিলেন নিতান্তই অখ্যাত তরুণ এক গণিতবিদ। সম্রাট প্রথম ক্লীয়নের মতো তার বয়সও বত্রিশ বছর, তবে তার উচ্চতা মাত্র ১.৭৩ মিটার। মসৃণ নিভাজ মুখমণ্ডলে সর্বদাই একটা সতেজ হাসি খুশি ভাব, ঘন বাদামী চুল, প্রায় কালোই বলা যায় এবং পোশাকে-আশাকে তখনো একটা গ্রাম্য প্রাদেশিকতার ছোঁয়া রয়ে গিয়েছিল।

পরবর্তী যুগে যে মানুষগুলোর কাছে তিনি আধা ঈশ্বরে পরিণত হন, সেই মানুষগুলোর কাছে তার এই তরুণ বয়সের চেহারা কল্পনা করাও ধর্মদ্রোহিতার সামিল। ভবিষ্যতের বংশধরদের সামনে তিনি ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা পক্ককেশ অশীতিপর বৃদ্ধ। বলিরেখাপূর্ণ মুখ, উজ্জ্বল দীপ্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আর তার পিতৃসুলভ স্নেহময় মুখমণ্ডল থেকে ফুটে বেরুচ্ছে নির্ভেজাল জ্ঞানের উজ্জ্বল প্রভা। তবে সেই বৃদ্ধ বয়সেও তার মুখে সতেজ হাসি-খুশি ভাবটা বজায় ছিল।

এই মুহূর্তেও তার চোখ দিয়ে খুশির ঝিলিক বেরুচ্ছে। গণিত সম্মেলনে তিনি তার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। বাঘা-বাঘা গণিতবিদরা কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয়েছে। বৃদ্ধ অস্টারফি মাথা নেড়ে বলেছেন, চমৎকার, ইয়ং ম্যান। চমৎকার। অস্টারফির প্রশংসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

বর্তমান ঘটনায় অবশ্য হ্যারি সেলডন খানিকটা বিমূঢ়। খুশি হবেন না শঙ্কিত হবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।

লেফটেন্যান্ট আলবান ওয়েলিস, পরিচয়পত্র দেখালো সামনে দাঁড়ানো সম্রাটের গার্ড রেজিমেন্টের অফিসার। আপনি কী আমার সাথে একটু আসবেন, স্যার?

ওয়েলিস সশস্ত্র নিঃসন্দেহে। সেলডন জানেন এদের সাথে তাকে যেতেই হবে। তবে দু-একটা প্রশ্ন করে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে তো কোনো দোষ নেই। তাই তিনি বললেন, কোথায়, সম্রাটের সাথে দেখা করার জন্য?

প্রাসাদে নিয়ে যাব, স্যার। আমাকে শুধু এতটুকুই বলা হয়েছে।

কিন্তু কেন?

কারণটা আমাকে জানানো হয়নি। শুধু কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে। আপনাকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে হবে, যেভাবেই হোক।

দেখে তো মনে হয় গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তেমন কোনো অপরাধ। করেছি বলে তো মনে পড়ে না।

বরং বলুন যে আপনাকে সসম্মানে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দয়া করে আর দেরী করবেন না।

দেরী করলেন না সেলডন। ঠোঁট দুটো জোরে চেপে রাখলেন। ভাবখানা এমন, মুখ ফসকে যেন আর কোনো প্রশ্ন বেরিয়ে না পড়ে। মাথা নেড়ে পা বাড়ালেন সামনে। সম্রাটের সাথে দেখা হলে বা একটা রাজকীয় সংবর্ধনা পেলেও তিনি খুশী হবেন না। তার আসল উদ্দেশ্য এম্পায়ার অর্থাৎ মানবজাতির কল্যাণ এবং সুখ শান্তির জন্য আজীবন সাধনা করা–কোনো সম্রাটের ব্যক্তিগত তল্পিবাহক হতে পারবেন না তিনি।

অফিসার সামনে, আর সৈনিক দুজন পিছনে। মাঝখানে সেলডন। হোটেলের বাইরে একটা গ্রাউন্ড কার অপেক্ষা করছিল। এমন সুসজ্জিত এবং জাঁকজমকপূর্ণ গাড়ি তিনি আগে দেখেন নি।

এলাকাটা ট্রান্টরের সবচেয়ে অভিজাত বসতিগুলোর একটা। গম্বুজের ছাদ এত উঁচু যে নবাগত কারো কাছে মনে হতে পারে, সে খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কী সেলডন–যিনি উন্মুক্ত গ্রহের খোলা আকাশের নিচে বেড়ে উঠেছেন–তিনিও প্রায় ভুল ভেবে বসেছিলেন যে আসলে দাঁড়িয়ে আছেন অকৃত্রিম সূর্যের আলোর মাঝে। অথচ উপরে তাকালে আলো প্রদানকারী কোনো নক্ষত্র বা মেঘ চোখে পড়বে না। তবে বাতাস বেশ আরামদায়ক এবং সুবাসিত।

জায়গাটা তারা পার হয়ে গেলেন। এর পরেই দেখা গেল গম্বুজের ছাদ ঢালু হয়ে নিচে নেমে এসেছে, চারপাশের দেয়ালগুলো সরে এসেছে অনেকটা কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরেই সেলডন দেখলেন যে তারা একটা আবদ্ধ টানেলের ভিতর দিয়ে চলছেন। খানিকদূর পরপরই চোখে পড়ছে মহাকাশযান এবং নক্ষত্র চিহ্ন। অর্থাৎ এই টানেলগুলো সরকারি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট।

টানেলের শেষ মাথায় একটা দরজা খুলে গেল। দ্রুত বেগে গ্রাউন্ড কার বেরিয়ে এল খোলা জায়গায় সত্যিকারের উন্মুক্ত প্রান্তর। ট্র্যান্টরের বুকে ২৫০ বর্গ কিলোমিটার স্থান রয়েছে যা একেবারেই প্রাকৃতিক, গ্রহের বাকি অংশের মতো ধাতব গম্বুজ দ্বারা আবৃত করে ফেলা হয়নি, যেখানে মাথার উপরে অকৃত্রিম আকাশ এবং মেঘ চোখে পড়ে। এটাই সম্রাটদের বাসস্থান, এখানেই রয়েছে সম্রাটের প্রাসাদ। সুযোগ পেলে এখানে একটু ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা আছে সেলডনের। প্রাসাদ দেখার জন্য নয়–গ্যালাক্টিক ইউনিভার্সিটিও এখানেই এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এখানেই আছে গ্যালাকিক গ্রন্থাগার।

যাইহোক ট্র্যান্টরের আবদ্ধ পরিমণ্ডলের বাইরে এখানে এই খোলা জায়গায় আকাশ নিষ্প্রভ ধূসর। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা লাগল মুখে। জানালা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

একটা ঝড়ো দিন শুরু হতে যাচ্ছে।

.

০৩.

আসলেই কী সম্রাট তার সাথে দেখা করবেন, এই ব্যাপারে সেলডন নিশ্চিত নন। বড়ো জোর চতুর্থ বা পঞ্চম মাত্রার কোনো কর্মকর্তা এসে দাবী করবে যে সে সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলছে।

কতজন মানুষ সম্রাটকে দেখেছে? হলোভিশনে নয়, সরাসরি, সামনাসামনি। কতজন মানুষ সম্রাটের সত্যিকার নশ্বর দেহটা দেখেছে–যে সম্রাট কখনো এই ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ড ছেড়ে বাইরে যান নি।

সংখ্যাটা নেহায়েতই অপ্রতুল। পঁচিশ মিলিয়ন বাসযোগ্য গ্রহ, প্রতিটি গ্রহেই বিলিয়ন বিলিয়ন মানব সন্তান এবং এই কোয়াড্রিলিয়ন মানব সন্তানদের মাঝে কয়জন রক্ত-মাংসের সম্রাটের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পেরেছে? কয়েক হাজার।

এবং এই বিষয়ে আসলেই কী কেউ মাথা ঘামায়? সম্রাট এম্পায়ার-এর প্রতীক ছাড়া কিছুই না, মহাকাশযান এবং নক্ষত্র চিহ্নের মতোই, তবে অনেক বেশি অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য। আসলে এখন এম্পায়ার বলতে সম্রাটকে বোঝায় না, বোঝায় তার সুবিশাল সেনাবাহিনী এবং নীতিহীন কর্মকর্তাদের যারা এম্পায়ারের জনগণের উপর যন্ত্রণাদায়ক বোঝার মতো চেপে বসেছে।

কাজেই তিনি যখন ছোট এক কামরায় এক সুদর্শন তরুণের মুখোমুখি হলেন, ভেবেই পেলেন না সম্রাটের অফিসারদের ভেতর এইরকম একজন লোক কোত্থেকে এলো যে কি না তার দিকে দাম্ভিকভাবে না তাকিয়ে ভদ্র সৌজন্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কামরাটা একেবারেই সাধাসিধে। আসবাবপত্র তেমন কিছুই নেই। মাঝখানে একটা টেবিল, যার কিনারায় তরুণ বসে আছে। এক পা মাটিতে আরেক পা ঝোলানো। সেলডনের অভিজ্ঞতায় বলে যে, সম্রাটের অফিসাররা সবসময়ই গম্ভীর আর রাগী–ভাবখানা যেন পুরো গ্যালাক্সির বোঝা তারা কাঁধে নিয়ে রেখেছে। অফিসারদের পদমর্যাদা যত কম তারা তত বেশি গম্ভীর আর রাগী।

এই তরুণ তাহলে খুবই উঁচু পর্যায়ের কেউ হবে। তার ক্ষমতা নিশ্চয়ই এত বেশি যে সেটা প্রকাশ করার জন্য ভুরু কুঁচকে রাখতে হয় না।

সেলডন বুঝতে পারছেন না কেমন আচরণ করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় বোধহয় চুপ করে থাকলেই, লোকটাই প্রথম কথা বলুক।

তুমি হ্যারি সেলডন, গণিতবিদ। তরুণ অফিসার বললেন।

জ্বি স্যার। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সেলডন।

মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়লেন তরুণ। বলা উচিত সায়ার, তবে আমি আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করিনা। সারাদিন এইসবের মাঝেই থাকতে হয়, এগুলো আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। এখানে শুধু আমি আর তুমি, কাজেই আনুষ্ঠানিকতা বাদ। বসো, প্রফেসর।

পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো সেলডনের। কারণ অর্ধেক বক্তব্য শুনেই বুঝে ফেলেছেন যে এই তরুণ আর কেউ নন, সম্রাট প্রথম ক্লীয়ন স্বয়ং। এবার ছবিতে, হলোভিশনে দেখা সম্রাটের ছবির সাথে তরুণের চেহারার কিছুটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। ছবিতে অবশ্য দেখা যায় তার পরনে চোখ ধাঁধানো রাজকীয় পোশাক, চেহারায় সীমাহীন মাহাত্ম এবং গাম্ভীর্য।

অথচ সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে একেবারেই সাধারণ।

একটুও নড়লেন না সেলডন।

সামান্য ভুরু কুঁচকালেন সম্রাট, তিনি সর্বদা নির্দেশ দিয়ে তা পালন হতে দেখেই অভ্যস্ত। কাজেই না চাইতেই গলা দিয়ে স্বভাবসুলভ নির্দেশের সুর বেরিয়ে এল, আমি তোমাকে বসতে বলেছি। ওই চেয়ারে, জলদি।

বাধ্য ছেলের মতো টুপ করে বসে পড়লেন সেলডন। এমনকি জ্বি, সায়ার, বলার সাহসটুকু পর্যন্ত দেখালেন না।

সম্রাট হাসলেন। বেশ ভালো। এবার আমরা দুজন সাধারণ মানুষের মতো কথা বলতে পারি তাই না। সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিলে আমি তো সাধারণ। মানুষই। তুমি কী বলো?

ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির মন্তব্য নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। সতর্ক সুরে বললেন সেলডন।

ওহ, এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তোমার সাথে একজন সমমর্যাদার মানুষের মতো কথা বলতে চাই। সেটা করতে পারলে খুশি হব। আমাকে সাহায্য করো।

জ্বি, সায়ার।

শুধু জ্বি বললেই চলবে। তোমার আমার মাঝখানের দূরত্ব কমানোর কোনো উপায় নেই?

সেলডনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন ক্লীয়ন, আর সেলডনের কাছে মনে হলো কী প্রাণবন্ত দৃষ্টি।

তোমার চেহারা গণিতবিদদের মতো নয়। সম্রাট বললেন।

শেষ পর্যন্ত একটু সাহস করে হাসলেন সেলডন। আমি সঠিক জানি না গণিতবিদের চেহারা কেমন হওয়া উচিত, ইওর ইম্প- ক্লীয়ন সতর্ক করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলতেই বাকি কথাগুলো পেটের ভিতর চালান করে দিলেন সেলডন।

সাদা চুল, বললেন ক্লীয়ন। দাড়ি থাকতেও পারে, আর অবশ্যই বৃদ্ধ।

নিশ্চয়ই এই গণিতবিদরাও একসময় তরুণ ছিলেন।

কিন্তু তখন তাদের তেমন একটা নাম যশ থাকে না। গ্যালাক্সির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে করতে তাদের চেহারা আমি যেমন বললাম সেইরকমই হয়ে যায়।

আমার তাহলে তেমন নাম যশ নেই।

অথচ এখানে যে সম্মেলন হয়েছে সেখানে তুমি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছ। সুযোগ অনেকেই পেয়েছে। তাদের অনেকেরই বয়স আমার চেয়েও কম। খুব অল্প কয়েকজনই আসলে মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে।

নিঃসন্দেহে তোমার তত্ত্ব আমার কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারাই আমাকে বুঝিয়েছে যে তোমার বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা আগাম বলে দেওয়া সম্ভব।

হঠাৎ করেই ভীষণ ক্লান্ত বোধ করলেন সেলডন। মনে হচ্ছে তার তত্ত্বের ভুল ব্যাখ্যা চলতেই থাকবে। আসলে এই সম্মেলনে আসাই উচিত হয়নি।

ঠিক সেইরকম কিছু না, তিনি বললেন। আমি যা করেছি তা অনেক বেশি সীমিত। প্রতিটি সিস্টেমেই বিভিন্ন কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা বলা অসম্ভব। কম জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। প্রচলিত ধারণা হলো এই যে মানব সমাজের মতো একটা অতি জটিল সিস্টেমে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় খুব দ্রুত এবং সেখানে ভবিষ্যতে কী হবে না হবে সেটা বলা পুরোপুরি অসম্ভব। আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে মানব সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা অন্তত একটা স্টার্টিং পয়েন্ট নির্বাচন করতে পারব, তারপর নিখুঁত অনুমানের ভিত্তিতে এই বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারপরে হয়তোবা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। কিন্তু তা বিস্তারিত কিছু হবে না হবে অনেকগুলো বিকল্প পথ; সুনিশ্চিত কিছু নয় বরং গাণিতিক সম্ভাবনা।

অসীম ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনলেন সম্রাট। বললেন, কিন্তু তোমার মূল বক্তব্য তো এটাই যে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব।

আবারো বলছি আমি সেই ধরনের কিছু প্রমাণ করতে পারিনি। শুধু বলেছি যে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব এর বেশি কিছু না। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আমাদেরকে প্রথমেই সঠিক স্টার্টিং পয়েন্ট নির্ধারণ করতে হবে। তারপরে রয়েছে শতকরা একশ ভাগ নিখুঁত অনুমান এবং নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে গাণিতিক বিশ্লেষণ সম্পন্ন করার কাজ। আমার গণিতের সাহায্যে এই সমস্যাগুলোর কোনোটারই জবাব মিলবে না। আর মিললেও তা হবে শুধুই সম্ভাবনা, কোনো অবস্থাতেই ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে না; এটা শুধুই কী হতে পারে তার অনুমান। প্রতিটি সফল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এই কাজটা আরো নিখুঁতভাবে করে, নইলে তারা জীবনে সফল হতে পারত না।

কিন্তু তারা সেটা গণিতের সাহায্যে করে না।

সত্যি কথা। তারা সেটা করে অন্তর্জানের সাহায্যে।

গণিতের সাহায্যে যে কেউ নিখুঁতভাবে সম্ভাবনা যাচাই করতে পারবে, তখন। আর অন্তর্জানের উপর নির্ভর না করলেও চলবে।

এটাও সত্যি কথা, কিন্তু আমি শুধু বলেছি যে গাণিতিক বিশ্লেষণ সম্ভব। সেটা যে বাস্তব হবে তা কিন্তু বলিনি।

কোনো বিষয় সম্ভব কিন্তু অবাস্তব হয় কী করে?

মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহে গিয়ে প্রতিটি মানুষের সাথে দেখা করা তাত্ত্বিকভাবে কাজটা আমার পক্ষে সম্ভব। সে জন্য সময় লাগবে আমি যতদিন বাঁচব তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। আবার অমর হলেও লাভ নেই। যে হারে পূর্বে জন্মানো। মানুষগুলোর সাথে দেখা করব তার চেয়েও বেশি হারে নতুন মানুষ জন্ম নেবে প্রতিদিন। তারচেয়েও বড়ো কথা আমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই বা আমি তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বহু মানুষ জীবনকাল শেষ করে মারা যাবে।

এই ধরনের ব্যাখ্যা কী তোমার ভবিষ্যৎ গণিতের বেলায়ও প্রযোজ্য?

খানিকটা ইতস্তত করে আবার শুরু করলেন সেলডন। হয়তো বা গাণিতিক সমাধান পেতে হলে আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। মহাবিশ্বের যাবতীয় তথ্য ধারণ করতে সক্ষম এবং হাইপারস্পেসাল গতিতে কাজ করতে পারে এমন একটা কম্পিউটার থাকলেও লাভ হবে না। ফলাফল কাজে লাগানোর আগেই বহুবছর পার হয়ে যাবে, পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো সুযোগ থাকবে না। তখন প্রাপ্ত ফলাফল হয়ে পড়বে অর্থহীন।

প্রক্রিয়াটাকে আরো সহজ করা যায় না? ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলেন ক্লীয়ন।

ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি–সেলডন বুঝতে পারছেন উত্তরগুলো যেহেতু পছন্দ হচ্ছে না তাই সম্রাট রেগে উঠছেন। তিনিও সতর্কভাবে জবাব দিতে লাগলেন ভেবে দেখুন, বিজ্ঞানীরা কীভাবে বস্তুর পরমাণু নিয়ে কাজ করে। একটা বস্তুতে রয়েছে অগণিত পরমাণু। সেগুলো অবিরাম দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। যা অনুমান। করা সত্যিই কঠিন। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মাঝেও একটা লুকানো নিয়ম আছে। আর তাইতো আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক প্রশ্নেরই জবাব পেয়েছি। আমরা সমাজবিজ্ঞানীরা পরমাণুর স্থানে মানুষকে নিয়ে ঠিক একই উপায়ে কাজ করার চেষ্টা করি, তবে সেই ক্ষেত্রে নতুন একটা বিষয় যোগ করতে হবে আর তা হচ্ছে মানুষের আবেগ। পরমাণু নিরাবেগ; কিন্তু মানুষ সর্বদাই আবেগ দ্বারা পরিচালিত। মনের বিভিন্ন অবস্থা এবং আবেগ বিবেচনা করতে হলে এত বেশি জটিলতা তৈরি হয় যা সামলনো পুরোপুরি অসম্ভব।

নিরাবেগ পরমাণুর মতো মানুষের মন বা আবেগেরও একটা লুকানো নিয়ম থাকতে পারে?

হয়তোবা। যদি থাকেও তা এত বেশি সূক্ষ্ম, এত বেশি এলোমেলো যে এক্ষেত্রে আমার গাণিতিক বিশ্লেষণ কোনো সাহায্য করতে পারবে না। ভেবে দেখুন গ্যালাক্সিতে বর্তমানে পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহে মানুষ বাস করছে। প্রতিটি গ্রহের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং সংস্কৃতি। একটা গ্রহের সাথে আরেকটা গ্রহের কোনো মিল নেই। প্রতিটি গ্রহে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন মানবসন্তান। প্রত্যেকটি মানুষের রয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক মন এবং আবেগ। প্রতিটি গ্রহ, প্রতিটি মানুষ অগণিত উপায়ে, কল্পনাতীত সমন্বয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে চলেছে। সেইজন্যই তো বারবার বলছি কাগজে কলমে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ সম্ভব হলেও বাস্তবে তা মোটেই সম্ভব নয়।

সাইকোহিস্টোরিক্যাল মানে?

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নাম দিয়েছি আমি সাইকোহিস্টোরি।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন সম্রাট, হেঁটে কামরার অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। ফিরে এসে আবার দাঁড়ালেন সেলডনের সামনে।

উঠে দাঁড়াও! আদেশ করলেন তিনি।

দাঁড়িয়ে তার চেয়ে খানিকটা লম্বা সম্রাটের দিকে তাকালেন সেলডন। দৃষ্টিতে একটা দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।

তোমার এই সাইকোহিস্টোরী… বললেন ক্লীয়ন, যদি এটাকে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগানো যায়, তাহলে এর উপকারিতা হবে অসীম, তাই নয় কী?

নিঃসন্দেহে এর উপকারিতা হবে কল্পনাতীত। অনাগত ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা জানতে পারলে তোক অতি সাধারণ সম্ভাবনা–তাই হবে। মানবজাতির এগিয়ে চলার চমৎকার দিকনির্দেশনা–যা আগে কখনো তৈরি হয়নি। কিন্তু… থেমে গেলেন সেলডন।

বেশ? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন সম্রাট।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণের ফলাফল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখতে হবে। তাদেরকে জানানো যাবে না।

জানানো যাবে না! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন সম্রাট।

সহজ ব্যাপার। একটু বুঝিয়ে বলতে দিন। সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ তৈরি করে যদি তার ফলাফল জনসমক্ষে প্রচার করা হয় তাহলে মানবজাতির আচরণ এবং আবেগের ভেতর একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। অন্যদিকে ভবিষ্যত না জেনে শুধু মানবিক আবেগ ও আচরণের উপর নির্ভর করে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ যে বিশ্লেষণের ফলাফল মানুষের কাছে গোপন থাকে সেটা হয়ে পড়ে অর্থহীন। বুঝতে পেরেছেন?

সম্রাটের চোখগুলো আলোকিত হয়ে উঠল। হেসে উঠলেন গলা ছেড়ে।

সেলডনের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, তার ভারী হাতের ওজনে সেলডন খানিকটা ঝুঁকে পড়লেন।

তুমি বুঝতে পারছ না? বললেন ক্লীয়ন, বুঝতে পারছ না তোমার গুরুত্বটা কোথায়। তোমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে না। শুধু একটা ভবিষ্যত বেছে নাও চমৎকার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত, তারপর এমনভাবে ভবিষ্যদ্বাণী কর যা মানুষের আবেগ এবং আচরণকে এমনভাবে পাল্টে দেবে যেন তুমি যে ভবিষ্যত বেছে নিয়েছ সেটা অর্জিত হয়। খারাপ ভবিষ্যদ্বাণী না করে একটা সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যত বেছে নেওয়াই ভালো।

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, সায়ার। কিন্তু সেটাও অসম্ভব।

অসম্ভব?

সত্যি কথা বলতে কী আরো বেশি অবাস্তব। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি যদি মানুষের আবেগ এবং আচরণ থেকে অনুমান করতে না পারেন যে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, তাহলে আপনি বিপরীত কাজটাও করতে পারবেন না। অর্থাৎ ভবিষ্যত অনুমান করে আপনি বলতে পারবেন না মানুষের আবেগ এবং আচরণ কেমন হবে।

ক্লীয়নকে হতাশ দেখালো। আর তোমার গবেষণাপত্রগুলো?… ওগুলো কী কাজে লাগবে?

ওগুলো শুধুই গাণিতিক উপস্থাপনা, গুটিকয়েক পণ্ডিত কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটাকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।

জঘন্য। রাগের সাথে বললেন ক্লীয়ন।

হালকা একটু কাঁধ ঝাঁকালেন সেলডন। এখন আরো বেশি করে অনুভব করছেন যে এখানে আসা তার ঠিক হয়নি। যদি সম্রাটের মনে হয় যে তিনি তাকে বোকা বানিয়েছেন, তখন কী হবে?

আর ক্লীয়নের চেহারা দেখে তো মনে হয় তিনি সেইরকমই ভাবছেন।

যাইহোক, বললেন সম্রাট। যদি তোমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হোক বা না হোক। আমার অফিসাররা বেশ দক্ষ, ভালোভাবেই জানে কোন কথা বললে জনগণ কোন পথে চলবে। তোমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো থেকে তারা ভালোগুলো বেছে নেবে যেন আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়।

এই কাজের জন্য আমাকে প্রয়োজন কেন? আপনার অফিসাররাই কাজটা আরো ভালোভাবে করতে পারবে।

সরকারি অফিসাররা কাজটা ফলপ্রসূভাবে করতে পারবে না। এছাড়াও অফিসারদেরকে যখন তখন বক্তৃতা বিবৃতি দিতে হয়, জনগণ তাদেরকে বিশ্বাস করে না।

আমাকে কেন বিশ্বাস করবে?

তুমি একজন গণিতবিদ। তুমি ভবিষ্যত নির্ণয় করবে গণিত দিয়ে। অন্যদের মতো অন্তর্জানের সাহায্যে না।

কিন্তু আমি সেরকম কিছুই করব না।

কে বলতে পারে? সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন ক্লীয়ন।

দুজনেই নীরব। সেলডনের মনে হলো তিনি একটা ফাঁদে পড়েছেন। সম্রাট যখন সরাসরি আদেশ দেবেন তখন প্রত্যাখ্যান করা কী ঠিক। প্রত্যাখ্যান কলে হয় বন্দীত্ব অথবা মৃত্যুদণ্ড। বিচার অবশ্য একটা হবে। তবে সেটা হবে লোক দেখানো। সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারো হবে না।

কাজ হবে না এভাবে। শেষ পর্যন্ত বললেন তিনি।

কেন?

যদি আমি এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করি যা অর্জন করতে হলে এই প্রজন্ম এমনকি হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত শেষ হয়ে যাবে; তাতে কোনো লাভ হবে না। এক শতাব্দী পরে সুখ সমৃদ্ধি আসতে পারে এই ধরনের আশ্বাসে মানুষের কী আসে যায়।

সঠিক ফলাফল পেতে হলে আমাকে আরো তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করতে হবে। সেলডন বলে চলেছেন। খুব কাছাকাছি সময়ের সম্ভাব্য পরিণাম নির্ণয় করতে হবে। শুধু যেগুলো জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করবে। আজ হোক, কাল হোক–তবে খুব শিঘ্রই কোনো একটা সম্ভাব্য পরিণাম আর বাস্তবে পরিণত হবে না। সাথে সাথেই আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে, সেই সাথে আপনার জনপ্রিয়তাও হ্রাস পাবে পুরোপুরি। শুধু তাই নয়, তখন আর সাইকোহিস্টোরী সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়া যাবে না, আমি সেটাকে যতই নিখুঁতভাবে বাস্তবে পরিণত করিনা কেন, লাভ হবে না কোনো।

বস্তার মতো নিজেকে একটা চেয়ারে ছুঁড়ে ফেললেন ক্লীয়ন, ভুরু কুঁচকে তাকালেন সেলডনের দিকে। তোমরা গণিতবিদরা তাহলে শুধু এইই করতে পারো। শুধু অসম্ভব আশা জাগাতে পারো যা কখনো সত্যি হবে না।

আসলে সায়ার, আপনি নিজেই অসম্ভব আশার কথা বলছেন। প্রচণ্ড সাহস নিয়ে কথাটা বলেই ফেললেন সেলডন।

তোমার পরীক্ষা নেওয়া যাক। ধরো তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তোমার গণিতের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে বলো আমি গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হবো কিনা। কী জবাব দেবে?

সাইকোহিস্টোরী যদি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করেও তবু আমার গাণিতিক বিশ্লেষণ এই ধরনের নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর সবগুলো সূত্র মিলিয়েও মাত্র একটা ইলেকট্রনের আচরণ কেমন হবে সেটা বের করা যায়নি, যা বের করা গেছে সেটা হলো অনেকগুলো ইলেকট্রনের একটা গড় আচরণ।

তোমার গণিত তুমিই ভালো বুঝবে আমার চেয়ে। তার সাহায্যে একটা চমৎকার উত্তর দাও দেখি। আমি কী গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হব?।

আপনি আমার জন্য একটা ফাঁদ তৈরি করেছেন, সায়ার। মৃদু গলায় জবাব দিলেন সেলডন। হয় আমাকে বলে দিন কী ধরনের জবাব আপনার পছন্দ, আমি সেইভাবেই বলব অথবা নির্ভয়ে আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ দিন।

তুমি নির্ভয়ে বলো।

আপনি কথা দিচ্ছেন?

তুমি কী লিখিত চাও? ব্যঙ্গ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন ক্লীয়ন।

 আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। যদিও সেলডনের ঠিক বিশ্বাস হলো না।

কথা দিলাম তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। নির্ভয়ে বলো।

গত চার শতাব্দীর সম্রাটদের অর্ধেকই নিহত হয়েছেন গুপ্তঘাতকের হাতে, কাজেই আমার সিদ্ধান্ত গুপ্তঘাতকের হাতে আপনার নিহত হওয়ার সম্ভাবনা আধাআধি।

একটা গাধাও এইরকম জবাব দিতে পারবে। রাগের সাথে বললেন ক্লীয়ন। এখানে গণিতের কোনো মারপ্যাঁচ নেই।

আমি আপনাকে অনেকবার বলেছি যে এইধরনের বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারে না আমার গণিত।

তোমার কী মনে হয় না যে আমার হতভাগ্য পূর্বপুরুষদের ঘটনাবলী থেকে ভালো শিক্ষা পেয়েছি?

লম্বা দম নিলেন সেলডন। না, সায়ার। ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হচ্ছে যে আমরা ইতিহাস থেকে কিছুই শিখিনি, শিখতে পারি না। এই যেমন আপনি আমাকে এইভাবে দেখা করতে দিয়েছেন। যদি আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা থাকত আমার যদিও আসলে নেই। শেষের কথাগুলো দ্রুত যোগ করলেন তিনি।

নির্দয় ভঙ্গিতে হাসলেন ক্লীয়ন। আসলে আমাদের কাজের ধারা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। প্রযুক্তি আজকে কোথায় এসে পৌঁছেছে সেটাও জান না বোধহয়। তোমার অতীত বর্তমান সবকিছুই আমাদের নখদর্পণে। এখানে পৌঁছার সাথে সাথে স্ক্যান করা হয়েছে তোমাকে। তোমার অভিব্যক্তি এবং কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তোমার মন-মানসিকতা আমরা পড়ে ফেলেছি খোলা বইয়ের মতো। অর্থাৎ তোমার মাথার ভেতরে কী চিন্তা ভাবনা আছে সবই আমরা জানি। যদি ক্ষতিকর কিছু থাকত তাহলে তোমাকে আমার কাছে আসতেই দেওয়া হতো না। সত্যি কথা বলতে কী হয়তো জীবিত থাকতে না।

একটা অদ্ভুত গন্ধ পেলেন সেলডন, তবে জবাব দিতে দেরী করলেন না। বহিরাগতদের পক্ষে সম্রাটের কাছে পৌঁছানো সবসময়ই কঠিন, এমনকি প্রযুক্তি যখন এত উন্নত ছিল না তখনো। যাইহোক, সম্রাটদের হত্যার ঘটনাগুলো সবই ঘটেছে প্রাসাদ বিদ্রোহের মাধ্যমে। সম্রাটের খুব কাছাকাছি যারা অবস্থান করে তারাই হচ্ছে মূলত তার জন্য আসল বিপদ। এইরকম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে জটিল সব সতর্কতা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। আর আমার সাথে যেরকম আচরণ করছেন সেইরকম আচরণ নিশ্চয়ই আপনার অফিসার, দেহরক্ষী বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সাথে করেন না।

জানি। তবে উত্তর হচ্ছে আমি তাদের সাথে সদয় আচরণ করি এবং আমাকে অপছন্দ করার কোনো সুযোগ তাদের দেই না।

বোকার মতো- কথা শেষ না করেই দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে থেমে গেলেন সেলডন।

বলে যাও। ক্লীয়নের কণ্ঠে পূর্বের মতোই রাগের আভাস। আমি তোমাকে নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি। বলো, আমার বোকামীটা কোথায়?

মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। আসলে বলতে চেয়েছি অপ্রাসঙ্গিক। ঘনিষ্ঠজনদের সাথে আপনার ব্যবহার কখনোই একরকম হতে পারে না। কোনো না কোনো সময় আপনার মনে কারো না কারো বিরুদ্ধে সন্দেহের উদয় হয়েছে। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। অসতর্ক কোনো মন্তব্য–একটু আগে আমি যেমন করেছি। অসতর্ক কোনো অঙ্গভঙ্গি, একটু সরু চোখে তাকানো। আপনি যাকে সন্দেহ করছেন সেই ব্যক্তি ব্যাপারটা অনুভব করতে পারবে। তখন সে চেষ্টা করবে আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার। তাতে আপনার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হবে। শেষ পর্যন্ত হয় আপনি তাকে। দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবেন অথবা নিজে তার হাতে খুন হবেন। এটা এমন একটা চক্র যা গত চার শতাব্দীর সম্রাটদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তাহলে আমি কোনো গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হওয়াটা এড়াতে পারব না?

না, সায়ার। তবে আপনি ভাগ্যবানও হতে পারেন।

চেয়ারের হাতলে আঙ্গুল দিয়ে মৃদুলয়ে তবলা বাজাতে লাগলেন সম্রাট। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, তুমি আর তোমার সাইকোহিস্টোরী সব ফালতু, একেবারে অকাজের। চলে যাও তুমি। কথাগুলো বলেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন সম্রাট। হঠাৎ করে তাকে বয়সের তুলনায় অনেক বৃদ্ধ মনে হতে লাগল।

আমি তো বলেছিই আমার গণিত আপনার কোনো কাজে আসবে না, সায়ার। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কুর্নিশ করার চেষ্টা করলেন সেলডন, কিন্তু যেন অদৃশ্য থেকে নির্দেশ পেয়ে দুজন গার্ড এসে তাকে বের করে নিয়ে গেল। পিছন থেকে সম্রাটের ভারী কণ্ঠস্বর গম-গম করে উঠল রাজকীয় কামরার ভেতর। লোকটাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছ সেখানেই নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে এসো।

.

০৪.

আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো ইটো ডেমারজেল। দৃষ্টি খানিকটা অন্যরকম। সায়ার, আপনি বেশ রেগে গিয়েছিলেন। বলল সে।

চোখ তুলে তাকালেন ক্লীয়ন। জোর করে মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। লোকটা আমাকে হতাশ করেছে।

সে কিন্তু আপনাকে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি যা সে করতে পারবেনা।

সে কিছুই করতে পারবে না।

এবং আপনাকে কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।

সেইজন্যই তো আমি হতাশ।

হতাশা না বলে দুঃশ্চিন্তা বলাই ভালো হবে বোধহয়। হ্যারি সেলডন হলো গিয়ে একটা নষ্ট কামান।

নষ্ট… কী? ডেমারজেল, তুমি মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করো, কোথায় পাও এগুলো, বলতো।

গম্ভীর ভঙ্গিতে জবাব দিল ডেমারজেল। তরুণ বয়সে শব্দটা আমি শুনেছিলাম, এম্পায়ার-এর আনাচেকানাচে এইরকম অসংখ্য শব্দ ছড়িয়ে আছে যার অধিকাংশই ট্র্যান্টরের অজানা, একইভাবে ট্র্যান্টরে প্রচলিত অনেক শব্দই বাকি গ্যালাক্সিতে অপরিচিত।

তুমি কী আমাকে বলতে এসেছ যে এম্পায়ার কল্পনাতীত বিশাল? হ্যারি সেলডন একটা নষ্ট কামান বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?

শুধু বলতে চাই যে এই লোক নিজের অজান্তেই আমাদের অনেক ক্ষতি করে ফেলতে পারে। নিজের গুরুত্ব বা ক্ষমতা সম্পর্কে তার কেনো ধারণাই নেই।

তুমি এটা বের করেছ, তাইনা, ডেমারজেল?

জ্বি, সায়ার, সে অনগ্রসর গ্রহের অধিবাসী। ট্র্যান্টরের জীবনযাত্রার ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞ। আগে কখনো এই গ্রহে আসেনি। জানে না কীভাবে অভিজাত পরিবারের সন্তানদের মতো বা রাজদরবারে পদস্থ ব্যক্তিদের মতো আচরণ করতে হয়। অথচ আপনার সামনে সে নির্ভয়ে কথা বলেছে।

হ্যাঁ, না পারার কী আছে। আমিই তাকে সেই অনুমতি দিয়েছি। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে তাকে সমমর্যাদার মানুষ হিসেবে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি।

পুরোপুরি সঠিক বলেননি, সায়ার। সাধারণ কাউকে নিজের সমমর্যাদার মানুষের মতো ভাবার মানসিকতা আপনার ভেতরে নেই। আদেশ দেওয়ার অভ্যাস আপনার জন্মগত। তারপরেও আপনি যদি কোনো ব্যক্তিকে সেরকম সুযোগ দেন খুব অল্প কয়েকজনই সেটা নিখুঁতভাবে সামলাতে পারবে। বেশিরভাগই হয়ে যাবে বাকরুদ্ধ, পাগলও হয়ে যেতে পারে কেউ কেউ। অথচ এই লোক কিন্তু ঠিকই সামলে নিয়েছে।

যাইহোক, তুমি যতই প্রশংসা করো, ডেমারজেল, আমার কিন্তু লোকটাকে মোটেই পছন্দ হয়নি। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ক্লীয়ন। লক্ষ্য করেছ, সে কিন্তু আমার কাছে তার গণিতের ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি। যেন জানতই আমি কিছু বুঝব না।

আসলেই বুঝতে পারতেন না, সায়ার। আপনি গণিতবিদ নন, বিজ্ঞানী নন, শিল্পী নন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনেক লোক আছে যারা আপনার চেয়ে বেশি জানে, তাদের কাজই হচ্ছে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে আপনার সেবা করা। আপনি সম্রাট, আর তারা তাদের সমন্বিত জ্ঞান আপনার পায়ে নিবেদন করতে বাধ্য।

তাই? সে বৃদ্ধ হলে–যার রয়েছে বহু বছরের অর্জিত জ্ঞান, তাহলে আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু এই সেলডন, আমার সমবয়সী, কেন সে আমার চেয়ে বেশি জানবে।

সে জানে না কীভাবে আদেশ দিতে হয়, কীভাবে লক্ষ কোটি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণকারী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ডেমারজেল, তুমি বোধহয় আমার সাথে মশকরা করো।

সায়ার, আত্মরক্ষার সুরে বলল ডেমারজেল।

বাদ দাও। তোমার এই নষ্ট কামানের বিষয়ে ফিরে আসা যাক। কোনদিক দিয়ে সে বিপজ্জনক? গ্রাম্য লোক ছাড়াতো তাকে অন্য কিছু মনে হয় না।

ঠিক, কিন্তু তার রয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব এক গণিত।

সেটা কোনো কাজেই আসবে না, সেলডন নিজেই বলেছে।

আপনার কাছে মনে হয়েছে এই গণিত কাজে লাগবে। আপনি ব্যাখ্যা করে বোঝানোর পর আমারও তাই মনে হয়েছে। অন্যদের কাছেও এটা কাজের জিনিস মনে হতে পারে। সেলডন নিজেও এখন এই লাইনে চিন্তা করবে, যেহেতু আমরাই তাকে এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছি। কে জানে এই মুহূর্তেই হয়তো সে এটাকে কার্যকরী করে তোলার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। যদি তাই হয়, যদি গণিতের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, সেটা যত হালকাই হোক না কেন, নিমেষেই প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে যে কেউ। একটা বিষয় খুব অবাক লেগেছে আমার। সেলডন নিজের জন্য ক্ষমতা চায় না। কিন্তু অন্যেরা তাকে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

আমি চেষ্টা করেছি। কোনো লাভ হয়নি।

আপনার সাথে দেখা করার আগে বিষয়টা সে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। এখন নেবে। হয়তো আপনাকে সাহায্য করার ইচ্ছা তার নেই, কিন্তু কেউ–যেমন ওয়ি প্রদেশের মেয়র–তাকে বাধ্য করতে পারে।

কেন সে ওয়ি প্রদেশকে সাহায্য করবে, আমাকে করবে না?

সে নিজেই বলেছে যে একজন মানুষের মন এবং আচরণ ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

ভুরু কুঁচকে চিন্তা করছেন ক্লীয়ন। তুমি কী আসলেই মনে করো যে এই সাইকোহিস্টোরী কার্যকরী করে গড়ে তোলা সম্ভব। সেলডন কিন্তু নিশ্চিন্ত যে একেবারেই অসম্ভব।

হয়তো কিছুদিন পরেই সে উপলব্ধি করতে পারবে যে আসলে তার ধারণা ভুল। ছিল।

তবে তো ওকে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।

না, ছেড়ে দিয়ে ঠিক কাজ করেছেন, সায়ার। বন্দী করে রাখলে হয়তো সাইকোহিস্টোরীর অগ্রগতি করার কোনো চেষ্টাই সে করত না। ছেড়ে দেওয়াই ভালো হয়েছে। তবে পুরোপুরি চোখের আড়াল হতে দেওয়া যাবে না। পিছনে সব সময় লোক লাগিয়ে রাখতে হবে। যেন আমাদের শত্রুরা তাকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে না পারে। আর যখন সে তার বিজ্ঞান চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে তখনই তাকে আমাদের কজায় নিয়ে আসব। তখন হয়তো জোর খাঁটিয়ে লাভ হবে।

কিন্তু যদি আমাদের কোনো শত্রু তাকে তুলে নিয়ে যায়, বলা ভালো এম্পায়ারের শত্রু, যেহেতু আমিই এম্পায়ার, অথবা যদি সে স্বেচ্ছায় শত্রু পক্ষকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়–এগুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

অবশ্যই, সায়ার। আমি চেষ্টা করব যেন এইধরনের কিছু না ঘটে। যদি ঘটেই যায় তখন ব্যবস্থা আছে। আমরা যদি তাকে ব্যবহার করতে না পারি তাহলে অন্য কেউই পারবে না।

অস্বস্তি বোধ করছেন ক্লীয়ন। পুরো ব্যাপারটা আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি ডেমারজেল। তবে এমন যেন না হয় যে আমরা শুধু একটা বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। হয়তো দেখা যাবে যে তার ধারণা শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব কিন্তু বাস্তবে একেবারেই অকেজো।

হতে পারে, সায়ার। কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে ধরে নিতে হবে যে সেলডন ভবিষ্যতে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হবে। পরে যদি আমাদের ধারণা ভুল হয় তাহলে কিছু সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া তেমন বড়ো কোনো ক্ষতি হবে না। অন্যদিকে আমরা গুরুত্ব দিলাম না কিন্তু এই লোক বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফেলল, তখন আমাদের সব হারাতে হবে।

বেশ। তবে আমার বোধহয় বিস্তারিত সবকিছু জানার প্রয়োজন নেই। যদি সেটা অপ্রীতিকর কিছু হয়।

আমরা শুধু আশা করতে পারি যে সেরকম কিছু ঘটবে না।

.

০৫.

সম্রাটের সাথে দেখা করার পর পেরিয়ে গেল একটা সন্ধ্যা, পুরো একরাত এবং পরবর্তী ভোরের কিছু অংশ। অন্তত ইম্পেরিয়াল সেক্টরের ফুটপাত, চলমান করিডোর, খোলা চত্বর এবং পার্কের আলোর পরিবর্তন দেখে সেলডনের কাছে সেরকমই মনে হলো।

এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন একটা ছোট পার্কের প্রাস্টিকের ছোট আসনে। বসার সাথে সাথেই আসনটা তার দেহ কাঠামোর সাথে মিলিয়ে আকৃতি পরিবর্তন করে মিশে গেল শরীরের সাথে। বেশ আরামদায়ক। আলো দেখে মনে হচ্ছে এখন মধ্য সকাল। তরতাজা বাতাস যথেষ্ট ঠাণ্ডা হলেও গায়ে হুল ফোঁটানোর মতো নয়।

ট্র্যান্টরের প্রকৃতি কী সবসময় এইরকম আরামদায়ক থাকে? প্রাসাদ এলাকার অকৃত্রিম মেঘলা দিনের কথা মনে পড়ল তার। একই সাথে মনে পড়ল হেলিকন তার নিজ গ্রহের মেঘ, বৃষ্টি, উষ্ণতা, তুষারপাতের দিনগুলোর কথা। অবাক হয়ে ভাবলেন প্রকৃতির এইরকম বৈচিত্র্যের জন্য কি কারো মনে হাহাকার তৈরি হয় না। ট্র্যান্টরের পরিবেশ একঘেয়ে রকমের আরামদায়ক। মনে হয় যেন চারপাশে কিছুই নেই। দিনের পর দিন এখানে বাস করে কেউ হাহুতাশ করবে এও কী সম্ভব?

হয়তো সম্ভব। তবে একদিন, দুইদিন বা সাতদিনে সেটা হবে না। আরো বেশিদিন লাগবে। তিনি আছেন মাত্র একদিন। আগামীকাল ফিরে যাচ্ছেন নিজ গ্রহে। কাজেই সময়টা উপভোগ করা যাক। কে জানে জীবনে আর কখনো ট্র্যান্টরে আসা হবে কি না।

তবে একটা অস্বস্তি রয়েই গেল। সম্রাটের সাথে তিনি যেভাবে কথা বলেছেন সেটা বোধহয় ঠিক হলো না। হাজার হোক এই লোকটাই গ্যালাক্সির হর্তাকর্তা। ইচ্ছে হলেই তাকে বন্দী বা হত্যা করতে পারে। অথবা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এমন পর্যদস্ত করবেন যার চেয়ে মৃত্যুই অধিক শ্রেয় মনে হবে।

তার হোটেলের রুমে একটা কম্পিউটার আছে। রাতে ঘুমানোর আগে সেই কম্পিউটারের এনসাইক্লোপেডিক অংশে প্রথম ক্লীয়নের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য একবার ঢু মেরেছিলেন। সেখানে সম্রাটের অতি উচ্চমাত্রার প্রশংসা করা হয়েছে। সন্দেহ নেই পূর্ববর্তী সম্রাটরা ভালো মন্দ যাই করুক না কেন জীবিতকালে তারাও একইরকম প্রশংসা পেয়েছেন। এটা নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি। তাকে সবচেয়ে যা অবাক করেছে সেটা হলো সম্রাট ক্লীয়নের জন্ম রাজপ্রাসাদে এবং তিনি আজ পর্যন্ত এক সেকেন্ডের জন্যও প্রাসাদ এলাকা ছেড়ে বেরোন নি। হয়তো নিরাপত্তার কারণে। সেলডনের মনে হয়েছে সম্রাট আসলে বন্দী, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। হয়তো এটা গ্যালাক্সির সবচেয়ে বিলাসবহুল আরামদায়ক কয়েদখানা, কিন্তু আসলে তিনি বন্দী।

যদিও সম্রাটের আচার-ব্যবহার যথেষ্ট ভালো এবং পূর্বপুরুষদের মতো রক্তলোলুপ এইকথা তার শত্রুও বলবে না। তবু তাকে খেপিয়ে তোলাটা অনুচিত। আগামীকাল হেলিকনে ফিরে যাচ্ছেন এই ভাবনাটাই তার দেহ মনে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিল। যদিও তার নিজ গ্রহে এখন শীতকাল এবং এই সময়টাতেই সেখানকার প্রকৃতি সবচেয়ে জঘন্য রূপ ধারণ করে।

উজ্জ্বল আলোর দিকে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। যদিও এখানে কখনো বৃষ্টি হয় না, তথাপি বাতাসে জলীয় উপাদান যথেষ্ট। সামান্য দূরে একটা ফোয়ারা; গাছ পালাগুলো সবুজ এবং সেগুলো সম্ভবত কখনো শুষ্কতার মুখোমুখি হয়নি। হঠাৎ ঝোঁপঝাড়গুলো এমনভাবে নড়ে উঠছে যেন ওগুলোর ভেতর দিয়ে কোনো প্রাণী ছুটে যাচ্ছে। এমনকি তিনি মৌমাছির গুঞ্জনও শুনতে পেলেন।

পুরো গ্যালাক্সিতে ট্র্যান্টরকে মনে করা হয় ধাতু এবং সিরামিকের কৃত্রিম বিশ্ব, আর এই ছোট জায়গাটা সত্যিকার অর্থেই আকর্ষণীয়।

আরো গুটিকয়েক মানুষ পার্কে আছে। সকলের মাথাতেই হালকা রঙের টুপি, কয়েকটা আবার ভীষণ ঘোট। সামান্য দূরেই অতিশয় সুন্দরী এক তরুণী বসে আছে, যদিও ভিউয়ারের উপর ঝুঁকে থাকার কারণে সেলডন তার মুখ দেখতে পেলেন না। মন্থর পায়ে এক লোক পেরিয়ে গেল তাকে, যাবার সময় কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। গিয়ে বসল একেবারে মুখোমুখি চেয়ারটায়। পায়ের উপর পা তুলে মুখ ঢাকল একগাদা টেলিপ্রিন্টারে। পরনে গোলাপি রঙের আঁটোসাঁটো ট্রাউজার।

অদ্ভুত ব্যাপার, ট্র্যান্টরের পুরুষ অধিবাসীদের ভেতর রঙচঙে পোশাক পরার প্রবণতা আছে, অথচ মেয়েরা পরিধান করে আটপৌরে সাদা পোশাক। এমন পরিচ্ছন্ন আবহাওয়াতে হালকা পোশাক পরিধান করাই যুক্তিযুক্ত। খানিকটা আমুদে ভঙ্গিতে নিজের হেলিকনিয়ান পরিচ্ছদের দিকে তাকালেন। বহুব্যবহারে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে সেগুলো। ট্র্যান্টরে তো তিনি আর থাকছেন না কিন্তু যদি থাকতেন তাহলে সবার আগে কিনতে হতো নতুন পোশাক। অন্যথায় সকলের কৌতুক আর হাসির খোরাক হয়ে পড়তেন তিনি। এই যেমন সামনের টেলিপ্রিন্টারওয়ালা তার দিকে এখন আরো বেশি কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে। আউটওয়ার্ল্ডের পোশাক তাকে আগ্রহী করে তুলেছে নিঃসন্দেহে।

মানুষকে হাসিয়ে ভিতরে ভিতরে তিনি হয়তো দার্শনিক হয়ে উঠতে পারতেন, কিন্তু ব্যাপারটা তিনি উপভোগ করতেন না।

সেলডনও এবার কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। লোকটা বোধহয় নিজের সাথেই তর্ক করছে। একবার মনে হলো তার সাথে কথা বলবে, পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদলে পিছিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে হলো কথা বলবে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে সেলডন ভেবে পাচ্ছেন না।

লোকটা লম্বা, চওড়া কাধ, মেদহীন কাঠামো। গাঢ় রংয়ের চুলের মাঝে ছিটেফোঁটা সোনালি রংয়ের আভা। মসৃণভাবে কামানো গাল, গম্ভীর অভিব্যক্তি, দেখেই বোঝা যায় প্রচণ্ড শক্তিশালী অথচ শরীরের কোথাও মাংসপেশীর বাহুল্য নেই। রূঢ় মুখমণ্ডলে আমুদে ভাব কিন্তু সেখানে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নেই।

নিজের মনের সাথে তর্কযুদ্ধে লোকটা বোধহয় হেরে গেল (অথবা জিতল), কারণ কথা শুরু করার জন্য সে খানিকটা সামনে ঝুঁকে এসেছে। সেলডন বুঝতে পারছেন লোকটাকে তার পছন্দ হবে।

মাফ করবেন, আপনি কী সেই গণিত সম্মেলনে ছিলেন, প্রতি দশ বছরে যেটা অনুষ্ঠিত হয়? প্রথম কৌতূহলী প্রশ্ন।

হ্যাঁ, ছিলাম। জবাব দিলেন সেলডন।

আহ্, মনে হয়েছিল আমি আপনাকে ওখানে দেখেছি। কিছুটা পরিচিত মনে হলো বলেই আপনার কাছাকাছি বসেছি। মাফ করবেন, বোধহয় আপনাকে বিরক্ত-

মোটেই না, আমি এখন অলস সময় কাটাচ্ছি।

ঠিক আছে দেখা যাক আমি যা জানি সেটা কতখানি সঠিক। আপনি প্রফেসর সেলডন।

সেলডন। হ্যারি সেলডন। প্রায় সঠিক বলেছেন। আপনি?

চ্যাটার হামিন। লোকটাকে খানিকটা বিব্রত দেখালো। বেশ সাদামাটা নাম।

চ্যাটার বা হামিন নামটা কখনো শুনিনি। তবে এভাবে বলা যায় যে হ্যারিস বা সেলডনের মতো প্রচলিত নামগুলোর ভিড়ে আপনার নামের একটা নতুনত্ব আছে নিঃসন্দেহে।

চেয়ার ঘষটে ঘষটে সেলডন আরো কাছাকাছি গিয়ে বসলেন। খানিকটা স্থিতিস্থাপক সিরাময়েড টাইলস-এর মেঝেতে ঘ্যাষ করে একটা শব্দ হলো।

আমার পোশাকগুলোও একেবারে সাদামাটা। ট্র্যান্টরিয়ান পোশাক পরার কথা মাথাতেই আসেনি।

আপনি যেকোনো মুহূর্তে কিনে নিতে পারবেন।

আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি। তাছাড়া ওগুলো কেনার সামর্থ্য আমার নেই। গণিতবিদরা বড়ো বড়ো সংখ্যা নিয়ে কাজ করলেও সংখ্যার মতো তাদের আয় হয় না। আমার ধারণা আপনিও একজন গণিতবিদ–হামিন।

না। ওই বিষয়ে আমি অ-আ কিছুই জানি না।

ও। সেলডন হতাশ। এই যে বললেন আমাকে গণিত সম্মেলনে দেখেছেন।

দর্শক হিসেবে ছিলাম। আমি একজন সাংবাদিক। হাতের টেলিপ্রিন্টারগুলো জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল হামিন। নিউজ হলোকাস্টে সংবাদ সরবরাহ করি। এই কাজ করে করে আমি ক্লান্ত।

এই কাজ আর ভালো লাগে না?

মাথা নাড়ল হামিন। এই গ্রহ সেই গ্রহ ঘুরে ঘুরে আবোল-তাবোল সংবাদ সংগ্রহ করে করে বিরক্তি ধরে গেছে।

কিছুটা হিসেবী দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকালো সে। তবে মজার মজার ঘটনাও ঘটে। আমি শুনেছি যে আপনাকে কয়েকজন ইম্পেরিয়াল গার্ড-এর সাথে প্রাসাদে দেখা গেছে। আপনি নিশ্চয়ই সম্রাটের সাথে দেখা করতে যাননি?

সেলডনের মুখের হাসি মুছে গেল। ধীরে ধীরে বললেন, দেখা হলেও সংবাদে প্রচার করার জন্য সেই কথা আপনাকে বলব না।

না, না, সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য নয়। আপনি হয়তো জানেন না, তাই আমার কাছ থেকে জেনে নিন–সাংবাদিকতা পেশার প্রথম নিয়ম হলো সম্রাটের কোনো খবরই প্রচার করা যাবে না যদি না সেই খবর প্রচার করার জন্য অফিসিয়ালি আমাদের হাতে দেওয়া হয়। পদ্ধতিটা ভুল। কারণ গুজব তো এমনিতেই ছড়ায়, এতে করে আরো বেশি ছড়ায়।

কিন্তু বন্ধু, আপনি যদি সেটা প্রচার নাই করেন তাহলে জানতে চাইছেন কেন?

ব্যক্তিগত কৌতূহল। বিশ্বাস করুন আমার যে পেশা তাতে অনেক অনেক বেশি জানতে হয়। যাইহোক, আপনার বক্তৃতা পুরোটা না শুনলেও এটুকু বুঝতে পেরেছি। যে আপনার গবেষণার মূল বক্তব্য হচ্ছে ভবিষ্যতের পূর্বানুমান বা ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব।

মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন সেলডন, ভুল।

মাফ করবেন?

কিছু না।

বেশ, ভবিষ্যদ্বাণী–নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী–সম্রাট বা যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে আকৃষ্ট করবে। তাই ধরে নিচ্ছি সম্রাট প্রথম ক্লীয়নকে খুশী করার জন্য তাকে কিছু। ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে এসেছেন।

এ ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে চাই না। কঠিন গলায় বললেন সেলডন।

সামান্য একটু কাঁধ ঝাঁকালো হামিন। বোধহয় ইটো ডেমারজেলও সেখানে ছিল।

কে?

ইটো ডেমারজেলের নাম শুনেননি আপনি?

কখনোই না।

ক্লীয়নের প্রতিচ্ছবি–ক্লীয়নের অপচ্ছায়া–ক্লীয়নের কুমন্ত্রণাদাতা–ক্লীয়নের হিংসাত্মক পরিকল্পনার রূপদানকারী। ডেমারজেলকে এইসব নামেই অভিহিত করা হয়।

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন সেলডন। হামিন বলে যাচ্ছে, হয়তো আপনি তাকে দেখেননি, কিন্তু সে ওখানে ছিল। আর যদি সে মনে করে আপনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন।

আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে সেলডন বললেন। আমার বক্তৃতা শুনলেই আপনি বুঝতেন যে আমি শুধু তাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা বলেছি।

কোনো ব্যাপার না। যদি সে মনে করে আপনি পারবেন, তাহলে আপনাকে ছাড়বে না।

ছেড়েই তো দিয়েছে। এখন আপনার সাথে কথা বলছি।

এটাকে ছেড়ে দেওয়া বলে না। সে জানে আপনি কোথায়। কোথায় যাবেন, কী করবেন সবই সে জানবে। যখন প্রয়োজন হবে ঠিকই আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে। যদি মনে করে আপনাকে দিয়ে উপকার হবে তখন আপনাকে নিংড়ে কাজ আদায় করবে। যদি মনে করে কোনো কাজ হবে না তখন আপনাকে নিংড়ে জীবন বের করে নেবে।

আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?

না শুধু সতর্ক করে দিচ্ছি।

আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।

তাই? একটু আগেই তো বললেন একটা ভুল হয়েছে। সেই ভুলটা কী আপনার গবেষণার ফলাফল সম্মেলনে উপস্থাপন করা যার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে?

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন সেলডন। হামিনের অনুমান সঠিক–ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি বিপদের গন্ধ পেলেন।

আগন্তুকদের কোনো ছায়া মাটিতে পড়েনি কারণ আলো অনেক বেশি মৃদু এবং ছড়ানো। শুধু চোখের কোণে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল।

.

পলায়ন

ট্র্যান্টর… প্রথম গ্যালাক্টিক এম্পায়ার-এর রাজধানী… সম্রাট প্রথম ক্লীয়নের আমলে ট্র্যান্টরের জৌলুস এবং সুখ্যাতি আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায় সেই সময় এই গ্রহ সকল ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়। দুইশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের পুরো গ্রহটা ছিল অগণিত গম্বুজওয়ালা ধাতব ছাদ দিয়ে আচ্ছাদিত, সুবিশাল নগরীগুলোর বিস্তৃতি ছিল ভূ-স্তরের অনেক গভীরে একেবারে কন্টিনেন্টাল শেলফ পর্যন্ত। জনসংখ্যা ছিল চল্লিশ বিলিয়ন।

… যদিও ট্র্যান্টরের ভাগ্যাকাশে ধ্বংসের লক্ষণগুলো পরিস্কার ফুটে উঠেছিল (এবং সবাই সেটা অন্তরের অন্তঃস্থলে উপলব্ধিও করেছিল) তথাপি অধিবাসীরা মনে করত এই গ্রহ সুখ, সমৃদ্ধি এবং প্রাচুর্যে ভরপুর এক জাগতিক স্বর্গ এবং বিশ্বাসই করতে পারেনি যে…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

০৬.

চোখ তুলে তাকালেন সেলডন। সামনে এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টিতে একই সাথে প্রকাশ পাচ্ছে রাগ এবং তিরস্কার। পাশে আরো এক তরুণ–প্রথম জনের চেয়ে দ্বিতীয়জনের বয়স বোধহয় কিছুটা কমই হবে। দুজনেই লম্বা চওড়া শক্তিশালী।

পোশাক পরিচ্ছদ পুরোপুরি ট্র্যান্টরিয়ান। চোখ ধাঁধানো রং, কোমরে চওড়া বেল্ট, বিশাল বারান্দাওয়ালা গোলাকার টুপি। বারান্দার দুপ্রান্ত থেকে দুটো উজ্জ্বল গোলাপী রংয়ের রিবন চলে গেছে ঘাড়ের পিছনে।

সবকিছু মিলিয়ে কৌতুক বোধ করলেন। হেসে উঠলেন তিনি।

 সামনে দাঁড়ানো তরুণ কড়া ধাতানি দিল, হাসছিস কেন, ব্যাটা গাইয়া ভূত?

সম্বোধনটা এড়িয়ে গেলেন সেলডন। ভদ্রভাবে বললেন, হাসির জন্য দুঃখিত। আসলে তোমার পোশাক দেখে বেশ মজা লাগছে।

আমার পোশাক? তাই? আর তুই কী পড়েছিস? এগুলো কোনো জামা কাপড় হলো? সেলডনের জ্যাকেটের ল্যাপেল ধরে হালকা একটা টান দিল তরুণ। নিঃসন্দেহে তরুণের পোশাক পরিচ্ছদের তুলনায় তারটা অনেক বেশি পুরনো আর নিষ্প্রভ মনে মনে ভাবলেন সেলডন।

আসলে এগুলো আউটওয়ার্ল্ডের পোশাক। আর এগুলো ছাড়া পড়ার মতো অন্য কিছু আমার নেই।

বেড়াতে আসা লোকজন এখন পার্ক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপদের গন্ধ পেয়েছে সবাই এবং তখন আশেপাশে থাকার কোনো আগ্রহ নেই। তার নতুন বন্ধু হামিন চলে গেলেও অবাক হবেন না সেলডন। কিন্তু সেটা দেখার জন্য বেয়াড়া কিসিমের তরুণের উপর থেকে চোখ সরানো নিরাপদ মনে হলো না তার কাছে।

তুই আউটওয়ার্ল্ডার? জিজ্ঞেস করল তরুণ।

হ্যাঁ, সেইহেতু আমার পোশাকগুলোও তাই।

সেইহেতু? এটা আবার কোন ধরনের শব্দ? তোর নিজ গ্রহের?

আমি আসলে বলতে চাচ্ছি যে সেই কারণেই আমার পোশাকগুলো তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। আমি বেড়াতে এসেছি।

কোন গ্রহ থেকে?

হ্যালিকন।

তরুণের ভুরু জোড়া এক হয়ে গেল। কখনো নাম শুনিনি।

খুব একটা বড়ো গ্রহ না।

সেখানে ফিরে যাচ্ছিস না কেন?

যাব। আগামীকাল।

না, এখুনি যাবি।

তরুণ তার সঙ্গীর দিকে তাকালো। সেলডনও তাকালেন। তখনই চোখের কোণা দিয়ে হামিনকে দেখতে পেলেন তিনি। নতুন বন্ধু তাকে ফেলে চলে যায়নি। পার্কে শুধু তিনি হামিন আর দুই তরুণ।

আমি আজকের দিনটা ঘুরে বেড়াব। আগামীকাল ফিরে যাব।

না, সেটা করা যাবে না এক্ষুনি ফিরে যাবি।

হাসলেন সেলডন। না, যাব না।

সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল তরুণ, মারভী, এই পোশাকগুলো তোর ভালো লেগেছে?

প্রথমবারের মতো কথা বলল মারভী। মোটেই না। জঘন্য। বমি আসতে চায়।

ওকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেওয়া যায় না। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

অবশ্যই না, এলেম।

 এলেম হাসল, বেশ, মারভী কী বলেছে, তুই শুনেছিস।

এবার হামিন কথা বলল, তোমরা দুজনেই শোনো, এলেম এবং মারভী। যথেষ্ট মজা হয়েছে। এখন চলে যাচ্ছ না কেন?

এলেম সেলডনের উপর খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। সোজা হয়ে ঘুরল। তুমি কে?

সেটা তোমার জানার কোনো দরকার নেই। কড়া গলায় জবাব দিল হামিন।

তুমি ট্র্যান্টরিয়ান? জিজ্ঞেস করল এলেম।

এটাও জানার দরকার নেই।

পোশাক পরিচ্ছদ ট্র্যান্টরিয়ানদের মতো। সেই কারণেই তোমাকে কিছু বলব না আমরা। খামোখা বিপদ ডেকে এনোনা নিজের জন্য।

আমি থাকছি। অর্থাৎ তোমাদের দুজনের বিরুদ্ধে আমরা দুজন। লড়াইটা ঠিক তোমাদের মনের মতো হবে না। এক কাজ করো, আমাদের দুজনকে সামলানোর জন্য তোমরা বরং আরো সঙ্গী সাথী ডেকে নিয়ে আসো, যাও।

আমারও মনে হয় আপনার চলে যাওয়া উচিত, হামিন। সেলডন বললেন। ভালো মানুষ বলেই বিপদে সাহায্য করতে চাইছেন, কিন্তু আমার জন্য আপনি কেন আহত হবেন।

এরা আবার কী বিপদ ঘটাবে, সেলডন। দুই পয়সার চামচা সব।

চামচা! রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল এলেম। সেলডনের মনে হলো হ্যালিকনের চেয়ে ট্র্যান্টরে চামচা শব্দটার অর্থ বোধহয় অনেক বেশি অপমানজনক।

শোন, মারভী, চিৎকার করে বলল এলেম, তুই এই ব্যাটাকে সামলা, আমি সেলডনের বারোটা বাজাচ্ছি। ওকেই আমাদের দরকার। এখুনি-

জ্যাকেটের ল্যাপেল ধরে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালো সে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হবে আত্মরক্ষার জন্য হাত বাড়িয়েছেন সেলডন, তার চেয়ার খানিকটা পিছনে সরে গেল। বাড়ানো হাত দুটো ধরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চেয়ারটা মাটিতে পড়ে গেল।

চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাগুলো। দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল এলেম।

সেলডন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন এলেমের দিকে। তারপর পাশে তাকালেন মারভীর জন্য।

এলেম নিথর পড়ে আছে, মুখ বিকৃত হয়ে গেছে ব্যথায়। বুড়ো আঙ্গুল দুটো ভেঙেছে, ব্যথা পেয়েছে কুচকীতে, মেরুদণ্ডের দুচারটা হাড়ও বোধহয় নড়ে গেছে।

হামিন পিছন দিক থেকে মারভীর গলা পেচিয়ে রেখেছে আরেক হাত দিয়ে মুচড়ে ধরেছে তার ডান হাত। আরেকটু উপর দিকে তুললেই হাতটা ভেঙ্গে যাবে। মারভীর মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। হাসফাস করছে নিঃশ্বাস নেবার জন্য। চকচকে ধারালো ছোট একটা ছুরি পড়ে আছে মাটিতে।

বজ্ৰ-আটুনি কিছুটা ঢিলা করল হামিন। নিখাদ বিস্ময়ের সাথে বলল, আপনি ব্যাটাকে জঘন্যভাবে আহত করেছেন।

তাইতো মনে হয়। বললেন সেলডন।

আরেকটু বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়লে ঘাড় ভাঙত।

কী ধরনের গণিতবিদ আপনি?

হ্যালিকনিয়ান গণিতবিদ। এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ছুরিটা তুললেন সেলডন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, জঘন্য এবং বিপজ্জনক।

আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে এগুলো আরো নিখুঁতভাবে কাজ করে। যাইহোক, এই দুটোকে ছেড়ে দেই। মারামারি করার খায়েশ বোধহয় আর নেই।

মারভীকে ছেড়ে দিল হামিন। মারভী প্রথমে তার কাধ ডলল, শ্বাস টানল শব্দ করে। তারপর ঘুরে তাকালো প্রতিপক্ষ দুজনের দিকে প্রচণ্ড বিদ্বেষ নিয়ে।

ভাগো এখান থেকে। কড়া গলায় বলল হামিন। অন্যথায় হামলা এবং খুনের চেষ্টার দায়ে জেলে যেতে হবে। এই ছুরি সব প্রমাণ করবে।

সেলডন এবং হামিন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলেন। এলেম এখনো ব্যথায় কাতরাচ্ছে। মারভী তাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দু-একবার পিছন ফিরে তাকালো। কিন্তু তারা দুজন তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।

এক হাত বাড়িয়ে সেলডন বললেন, আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো। অপরিচিত একজনের বিপদে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। আমি একা বোধহয় দুজনকে সামলাতে পারতাম না।

তেমন কিছু না ভঙ্গিতে হাত নাড়ল হামিন। আমি মোটেই ভয় পাইনি। ওরা রাস্তার দুই পয়সার মাস্তান। জানতাম কায়দামতো ধরতে পারলেই সোজা হয়ে যাবে।

যেভাবে ধরেছিলেন তাতেই তো ছোকরার কলিজা শুকিয়ে গেছে। কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন সেলডন।

শ্রাগ করল হামিন। আপনিও কম যান না। তারপর গলার স্বর পরিবর্তন না। করেই বলল, চলুন, সরে পড়ি। এখানে সময় নষ্ট করলে বিপদ আরো বাড়বে।

কেন? আপনি ভাবছেন ওরা আবার ফিরে আসবে।

জীবনেও আর এই মুখো হবে না। তবে পার্কে অনেক দুঃসাহসী মানুষ ছিল। দেখেননি গা বাঁচানোর জন্য কেমন দ্রুত কেটে পড়েছে। ওরাই আবার ভালোমানুষী দেখিয়ে পুলিশে খবর দেবে।

চমৎকার। গুণ্ডা দুটোর নাম আমরা জানি। চেহারার বর্ণনা দিতে পারব পুলিশের কাছে।

চেহারার বর্ণনা দেবেন? পুলিশ কী করবে?

ওরা অপরাধ করেছে

বোকার মতো কথা বলবেন না। আমাদের শরীরে আচড়টি পর্যন্ত নেই। আর ওদের দুজনকে হাসপাতালে যেতে হবে। এলেমের অবস্থাতো খুবই খারাপ। আমরাই বরং ফেসে যাব।

অসম্ভব। পার্কে যারা ছিল তারা দেখেছে-

সাক্ষী দেওয়ার জন্য কাউকে ডাকা হলে তো।–সেলডন, একটা ব্যাপার মাথাতে ঢুকিয়ে নিন। ওই দুজন এসেছিল আপনার জন্য শুধু আপনার জন্য। ওদেরকে বলে দেওয়া হয়েছে আপনার পরনে হ্যাঁলিকনিয়ান পোশাক এবং চেহারার বর্ণনাও পরিস্কার দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত আপনার একটা হলোগ্রাফও দেখানো হয়েছে। আমার ধারণা ওদেরকে এমন কেউ পাঠিয়েছে যারা পুলিশকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চলুন আর অপেক্ষা করা যাবে না।

দ্রুত পা চালালো হামিন, এক হাত দিয়ে সেলডনের ঊর্ধ্বাঙ্গ ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। জোর খাঁটিয়েও সেই হাত ছোটাতে পারলেন না সেলডন। নিজেকে তার সেই শিশুর মতো মনে হলো।

পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা খিলানওয়ালা ফুটপাথে উঠলেন তারা। স্বল্প আলোতে চোখ পিট পিট করতে লাগলেন সেলডন। এমন সময় কাছেই কোথাও একটা গ্রাউন্ড কার-এর ব্রেক কষার শব্দ হলো।

এসে পড়েছে। বিড়বিড় করল হামিন। জলদি, সেলডন। দ্রুত পা চালিয়ে একটা চলমান ফুটপাথে উঠে ভিড়ের সাথে মিশে গেলেন দুজন।

.

০৭.

সেলডন বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে তিনি হোটেল রুমে ফিরতে চান। কিন্তু হামিনের এক কথা, হোটেলে ফেরা যাবে না।

আপনি পাগল হলেন নাকি? প্রায় ফিসফিস করে বলল সে, ওখানেও আপনাকে ধরার জন্য কেউ না কেউ অপেক্ষা করছে।

কিন্তু আমার মাল-সামান তো সব ওখানেই।

থাকুক। কিছু হবে না।

এই মুহূর্তে তারা রয়েছেন এক কামরাবিশিষ্ট ছোট এক এ্যাপার্টমেন্টের ভিতর। জায়গাটা ট্র্যান্টরের ঠিক কোন অংশে তিনি বলতে পারবেন না। কামরার পুরোটাই দখল করে রেখেছে একটা ডেস্ক এবং চেয়ার একটা বিছানা এবং একটা কম্পিউটার আউটলেট। ওয়াশরুম ডাইনিংরুম বলে কিছু নেই। তবে সকলের ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে একটা ওয়াশরুম আছে। হামিন তাকে সেখানে নিয়ে গেল। ভিতরে। কেউ একজন ছিল আগে থেকেই। বেরিয়ে এসে সেলডনের চাইতে তার পোশাকের দিকেই মনোযোগ দিল বেশি।

সেলডন বলে দেওয়ার পর হামিনও সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। আপনার এই পোশাক ছাড়তে হবে। মান্ধাতা আমলের হ্যাঁলিকনিয়ান পোশাক-

এর কতটুকু আপনার কল্পনা, হামিন? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। প্রথমে আপনার কথা আমি অর্ধেক বিশ্বাস করেছি আর এখন মনে হচ্ছে এটা শুধু… শুধু

আপনি বোধহয় বলতে চাইছেন, ভয় দেখানো।

ঠিকই বলেছেন। আপনি বোধহয় অদ্ভুত কোনো কারণে আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন।

মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখুন। আমি গাণিতিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারব না। যাইহোক, আপনি সম্রাটের সাথে দেখা করেছেন। অস্বীকার করবেন না। তিনি। আপনার কাছে কিছু চেয়েছিলেন, আপনি তা দেন নি। এটাও অস্বীকার করবেন না। আমার ধারণা সম্রাট আপনার কাছে চেয়েছিল ভবিষ্যতের বিস্তারিত বর্ণনা, আপনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সম্ভবত ডেমারজেল মনে করে আপনি আরো চড়া দাম দিয়ে অন্য কারো কাছে আপনার আবিষ্কার বিক্রি করবেন। আমি তো বলেছি যদি ডেমারজেল আপনাকে চায়, তাহলে কোথাও গিয়ে মুখ লুকাতে পারবেন না। আপনাকে সে ঠিকই খুঁজে বের করবে। বদমাশ দুটো ঝামেলা বাধানোর আগেই এই কথাটা আমি। আপনাকে বলেছি। আমি একজন সাংবাদিক এবং একজন ট্র্যান্টরিয়ান। ভালোভাবেই জানি কোন ঘটনা কীভাবে সাজানো হয়। মনে আছে, একপর্যায়ে এলেম বলেছিল ওরা আপনাকেই চায়?

হ্যাঁ, মনে আছে।

আমাকে নিয়ে সে মোটেই মাথা ঘামায়নি। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে অপমান করা।

নিজে চেয়ারে বসে সেলডনকে বিছানার দিকে ইশারা করল হামিন। শুয়ে পরুন, সেলডন। বিশ্রাম নিন। আমার মতে গুণ্ডা দুটোকে ডেমারজেল ছাড়া অন্য কেউ পাঠায়নি এবং সে আরো অনেককেই পাঠাতে পারে। কাজেই আপনার এই বেশভূষার হাত থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। অবশ্য এই সেক্টরে যদি আপনার কোনো দেশী ভাই হ্যাঁলিকনিয়ান জোব্বা পরা অবস্থায় ধরা পড়ে, তখন সে যে আপনি নন তা বোঝানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। বোঝাতে না পারলে বিপদ।

কী বলছেন?

সত্যি বলছি। আপনাকে এই বেশ ছাড়তে হবে। আমরা এগুলোকে এটমাইজ করে ফেলব–অবশ্য কারো চোখে ধরা না পড়ে যদি কোনো ডিজপোজাল ইউনিটের কাছে পৌঁছানো যায়, তবেই। তার আগে ট্র্যান্টরিয়ান পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার আকৃতি আমার চেয়ে খানিকটা কম, ব্যাপারটা আমার মাথায় আছে। অবশ্য জামা-কাপড়গুলো গায়ে একদম ফিট না হলেও ক্ষতি নেই।

হাত নাড়লেন সেলডন। দাম দেওয়ার মতো কোনো ক্রেডিট আমার কাছে। নেই। যা ছিল সব রয়ে গেছে হোটেলের সেফে।

এই বিষয়ে পরে কোনো এক সময় চিন্তা করব। দরকারী পোশাক জোগাড় করতে আমার এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। সেই সময়টা আপনি এখানে থাকবেন।

হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন সেলডন। বেশ, এতই যখন জরুরি, থাকছি আমি।

হোটেলে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। কথা দিন।

দিলাম। কিন্তু আমি বেশ বিব্রত বোধ করছি। আপনি আমার জন্য অনেক ঝামেলা করছেন। এখন আবার খরচও করবেন। ডেমারজেলের কথা যতই বলুন না কেন, নিশ্চয়ই আমাকে ধরে নিয়ে যেত না। শুধু পোশাকগুলো নিয়েই ওরা ভয় দেখাচ্ছিল।

মোটেই না। ওরা আপনাকে ধরে কোনো স্পেসপোর্টে নিয়ে যেত, তারপর হ্যালিকনের পথে কোনো হাইপারশিপে উঠিয়ে দিত।

এটাতো কথার কথা সত্যি সত্যি নিশ্চয়ই এমন করত না।

কেন?

আমি তো হ্যালিকনে ফিরেই যাচ্ছি–আগামীকাল।

এখনো আগামীকাল ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন?

অবশ্যই। যাব না কেন?

না যাওয়ার পিছনে হাজারো কারণ আছে।

হঠাৎ করেই ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেন সেলডন। শুনুন, হামিন, এই খেলা আর চালিয়ে যেতে পারব না। এখানে কাজ শেষ, এখন আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। টিকেটগুলো হোটেলে রয়ে গেছে। নয়তো সেগুলো পাল্টে নিয়ে আজকেই ফিরে যেতাম। সত্যি বলছি।

আপনি হ্যালিকনে ফিরে যেতে পারবেন না।

এবার আর রাগ প্রকাশ না করে পারলেন না সেলডন। ওখানেও আমাকে ধরার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকবে?

মাথা নাড়ল হামিন। রাগ করবেন না, সেলডন। ওখানেও কেউ না কেউ থাকবে। আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। হ্যালিকনে ফিরে গেলে আপনি সহজেই। ডেমারজেলের হাতে ধরা পড়বেন। হ্যালিকন নিরাপদ এবং চমৎকার ইম্পেরিয়াল টেরিটোরি। হ্যালিকন কখনো বিদ্রোহ করেছে, কখনো সম্রাটের বিরোধীপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে?

না, কখনোই না–এবং তার পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের গ্রহটাকে ঘিরে রেখেছে অনেকগুলো বড়ো বড়ো গ্রহ। নিজের নিরাপত্তার জন্যই তাকে এম্পায়ারের শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে হয়।

ঠিক। আর তাই ইম্পেরিয়াল ফোর্স হ্যালিকনের স্থায়ী প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতা পাবে। প্রতিটা মুহূর্ত আপনাকে তারা চোখে চোখে রাখতে পারবে। ডেমারজেল যখনই মনে করবে আপনাকে তার প্রয়োজন, তখনই আপনাকে সে হাতের মুঠোয় পাবে। আমি আপনাকে সতর্ক করে দিতে পারছি, নয়তো ঠিকই একটা মিথ্যে নিরাপত্তার ধারণা নিয়ে হাঁটে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন।

হাস্যকর। যদি সে চায় আমি হ্যালিকনে ফিরে যাই, তাহলে এত ঝামেলা পাকাচ্ছে কেন? কেন দুটো গুণ্ডা পাঠিয়ে আমাকে সতর্ক করে তুলছে?

আপনাকে সে সতর্ক করবে কেন? সে কী আর জানত যে গুণ্ডাগুলোর সাথে মারামারি করার সময় আমি আপনার পাশে থাকব।

যাইহোক। ধরুন আপনি আমাকে সতর্ক করতে পারলেন না। আর গুণ্ডাদুটো তখন সফল হলে হয়তো দুচার ঘণ্টা আগে ফিরে যেতাম। তাতে কী লাভটা হতো?

হয়তো আপনি মত পাল্টাবেন মনে করে সে ভয় পাচ্ছে।

বাড়ি না ফিরলে, কোথায় যাব? হ্যালিকনে ধরতে পারলে যেকোনোখানেই ধরতে পারবে, হয়তো পালিয়ে এ্যানাক্রনে চলে গেলাম–এখান থেকে প্রায় দশ হাজার পারসেক দূরে। কিন্তু সেখানেও ধরে ফেলবে। হাইপারস্পেশাল শিপ-এর কারণে দূরত্ব আজকাল কোনো ব্যাপারই না। যত বিদ্রোহই করুক না কেন, কোন গ্রহ সম্রাটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে বা আমার জন্য দাঁড়াবে? সবচেয়ে বড়ো কথা আমি হ্যালিকনের নাগরিক, অন্য কোথাও আমি এই সুবিধাটুকু পাব না।

ধৈর্য ধরে কথাগুলো শুনল হামিন, মাথা নাড়ল কয়েকবার, কিন্তু চেহারা ছিল বরাবরের মতোই গম্ভীর এবং ভাবলেশহীন। ঠিকই বলেছেন, বলল সে, কিন্তু একটা গ্রহ আছে যেখানে সম্রাট নিজেও তার পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সাহস করেন না। আর আমার ধারণা এই ব্যাপারটাই ডেমারজেলকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

চিন্তা করছেন সেলডন, স্মৃতির পাতা হাতড়াচ্ছেন। কিন্তু এমন কোনো গ্রহ খুঁজে পেলেন না যেখানে ইম্পেরিয়াল ফোর্সও অসহায়। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন গ্রহ?

আপনি এখন সেই গ্রহের বুকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার ধারণা এই কারণেই ভয় পাচ্ছে ডেমারজেল। আপনাকে হ্যালিকনে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সে যতটা উদ্বিগ্ন তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন আপনি না আবার এখানে থেকে যান। যদি হঠাৎ আপনার মনে হয়–নাহ, আরো কটা দিন থেকেই যাই।

দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। তারপর সেলডনই কথা বললেন। কণ্ঠে সুস্পষ্ট কৌতুক। ট্র্যান্টর! এম্পায়ার-এর রাজধানী। যার কক্ষপথে রয়েছে ইম্পেরিয়াল ফোর্স-এর হোম বেজ। যে গ্রহের সেনাবাহিনী গ্যালাক্সির মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ দুর্ধর্ষ এবং প্রশিক্ষিত। যদি বোঝাতে চান যে ট্র্যান্টরে থাকলেই আমি ডেমারজেল-এর হাত থেকে বাঁচতে পারব তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার কল্পনা আসলে সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

না! আপনি একজন আউটওয়ার্ল্ডার, সেলডন। জানেন না ট্র্যান্টর আসলে কী। এই গ্রহের জনসংখ্যা চারশ কোটি। গ্যালাক্সিতে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা গ্রহ আছে যেগুলোর জনসংখ্যা ট্র্যান্টরের জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ। বাকিগুলোর তারচেয়েও কম। এই গ্রহের প্রযুক্তি এবং সমাজব্যবস্থা অসম্ভব উন্নত এবং অবিশ্বাস্য রকমের জটিল। আমরা এখন আছি ইম্পেরিয়াল সেক্টরে। এই সেক্টরের জনসংখ্যা এবং জীবনযাত্রার মান শুধু গ্যালাক্সিই নয় ট্র্যান্টরের অন্যান্য সেক্টরের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। কমবেশি আটশ সেক্টর আছে ট্র্যান্টরে। এর মাঝে এমন কিছু সেক্টর আছে যেগুলোর সমাজ ব্যবস্থা, আইন কানুন অন্যান্য সেক্টর থেকে একেবারেই আলাদা, কোনো মিল নেই। এবং এই সেক্টরগুলোর কোনোটাকেই সম্রাট তেমন একটা ঘাটান না। ওসব জায়গায় ইম্পেরিয়াল ফোর্সও যেতে ভয় পায়।

কেন?

এম্পায়ার কখনোই ট্র্যান্টরের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করতে পারবে না। যদি তা করে তাহলে যে টেকনোলজীর উপর ভিত্তি করে এই গ্রহ পরিচালিত হচ্ছে সেই টেকনোলজীর মূলে আঘাত লাগবে। এখানকার টেকনোলজীগুলো এত নিবিড়ভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত যেকোনো একটাকে সামান্য টোকা দিলে পুরো কাঠামোটাই ভেঙে চূড়মার হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন সেলডন, আমরা ট্র্যান্টরবাসীরা খুব ভালো করেই জানি যে একটা ভূমিকম্প হবে সেটা আগে থেকে ধরতে না পারলে অথবা আমাদেরই কোনো ভুল দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় এবং সেটা সামলানোর জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়।

এমন অদ্ভুত কথাতো কখনো শুনিনি।

হামিনের মুখে একটা মুচকী হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। শোনার কথাও না। এম্পায়ার নিশ্চয়ই তার নিজের দুর্বলতার কথা সবার কাছে বলে বেড়াবে না। কিন্তু

আমি একজন সাংবাদিক। ট্র্যান্টরিয়ানদের চেয়েও আমি অনেক বেশি জানি। আপনি না জানলেও–সম্রাট জানেন–ইটো ডেমারজেল জানে যে ট্র্যান্টরে টোকা দিলেও এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাবে।

আপনার মতে এই সকল কারণেই আমার ট্র্যান্টরে থাকা উচিত?

হ্যাঁ। আমি আপনাকে ট্র্যান্টরের এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারব যেখানে ডেমারজেলের হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকতে পারবেন। লুকিয়ে থাকতে হবে না, নাম বদলাতে হবে না, বরং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। আপনাকে ছুঁয়ে দেখার সাহসও হবে না। এগুলো জানে বলেই তো সে তাড়াহুড়া করে আপনাকে ট্র্যান্টর থেকে সরিয়ে দিতে চায়। আমি না থাকলে এবং নিজেকে রক্ষা করার বিস্ময়কর ক্ষমতা আপনার না থাকলে এতক্ষণে সে সফল হতো নিঃসন্দেহে।

কিন্তু আমাকে কতদিন ট্র্যান্টরে থাকতে হবে?

আপনার নিরাপত্তার জন্য যত দিন প্রয়োজন, সেলডন। হয়তো সারাজীবন।

.

০৮.

নিজের প্রজেক্টরে সেলডনের একটা হলোগ্রাফ তৈরি করেছে হামিন। সেটাই খুঁটিয়ে দেখছেন সেলডন। আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন দেখায় হলোগ্রাফ তার চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত, মনে হলো যেন কামরার ভেতর একইরকম দুজন ব্যক্তি রয়েছে।

নতুন টিউনিকের হাতাগুলো দেখছেন সেলডন। হ্যাঁলিকনিয়ান মনোভাবের কারণে মনে হলো রংটা আরো হালকা হলে ভালো হতো, যদিও হামিন বেছে বেছে সবচেয়ে হালকা রংয়ের পোশাক নিয়ে এসেছে, সেজন্য কৃতজ্ঞ বোধ করলেন (পার্কে হামলা করতে আসা দুই তরুণের রংচঙে পোশাকের কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন তিনি)।

এই টুপিটা বোধহয় মাথায় পরা উচিত। তিনি বললেন।

ইম্পেরিয়াল সেক্টরে অবশ্যই টুপি পরবেন। নয়তো সবাই মনে করবে আপনার জন্ম হয়েছে নীচু বংশে। অন্যান্য সেক্টরের নিয়ম আবার আলাদা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। টুপিটা তৈরি হয়েছে নরম কোনো বস্তু দিয়ে। মাথায় দেওয়ার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিনিসটা চমৎকারভাবে মাথায় বসে গেল। চারপাশে সমানভাবে ছড়ানো গোলাকার ব্রীম, তবে আক্রমণকারী দুই তরুণের টুপির চেয়ে ছোট এবং বেশি সুন্দর।

বেঁধে রাখার জন্য কোনো স্ট্র্যাপ নেই।

না। এটা আজকালকার ছোঁকড়াদের নতুন ফ্যাশন।

কীহ?

হ্যাঁ। নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই এগুলো পরে। আপনাদের ওখানেও নিশ্চয়ই এইরকম ছেলে ছোঁকড়া আছে।

আছে না আবার। স্টাইল করার জন্য মাথার অর্ধেক কামিয়ে ফেলে বাকি অর্ধেকে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল রাখে।

হামিনের মুখ খানিকটা বাঁকা হয়ে গেল। নিশ্চয়ই খুব খারাপ দেখায়?

একেবারে জঘন্য। এদের আবার দুটো ভাগ আছে। একদল চুল লম্বা রাখে বা দিকে আরেক দল ডান দিকে। দুদলই মনে করে তাদের স্টাইলই সবার সেরা এবং এটা নিয়ে প্রায়শই রাস্তায় মারামারি শুরু করে দেয়।

তাহলে স্ট্রাপ ছাড়া এই টুপি আপনি মাথায় রাখতে পারবেন।

আশা করি অভ্যাস হয়ে যাবে।

ব্যাপারটা অবশ্য অনেকের চোখে পড়বে, কারণ এই টুপি দেখে সবাই মনে করবে আপনি শোক পালন করছেন। তাছাড়া এটা পরে আপনার অস্বস্তি লুকাতে পারবেন না। যাইহোক, ইম্পেরিয়াল সেক্টরে আর বেশিক্ষণ থাকছি না। অনেক দেখা হয়েছে। প্রজেক্টর বন্ধ করে দিল হামিন।

আপনার কত খরচ হয়েছে? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।

জেনে কী করবেন?

আপনার কাছে ঋণী থাকতে হবে–এটা ভেবেই খারাপ লাগছে।

বেশি ভাববেন না। সব নিজের ইচ্ছেতেই করছি। কিন্তু এখানে আর থাকা উচিত নয়। আমার চেহারার বর্ণনা নিশ্চয়ই জায়গামতো পৌঁছে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে এখানে পুলিশ বা অন্য কেউ চলে আসতে পারে।

সেক্ষেত্রে টাকা পয়সা বড়ো ব্যাপার নয়, বড়ো ব্যাপার হচ্ছে আপনি আমার জন্য নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন।

জানি। কিন্তু বললাম তো, আমি নিজের ইচ্ছাতেই সব করেছি। নিজেকে রক্ষা করতে পারি আমি।

কিন্তু কেন-

পরে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। ভালো কথা, আপনার পুরনো কাপড়গুলো আমি এটমাইজ করে ফেলেছি, বোধহয় কারো চোখে ধরা না পরেই। এনার্জি লেভেলে একটু উঠানামা হবে। জায়গামতো সেটা রেকর্ডও করা হবে। আসল কারণটা কী সেটা কেউ না কেউ ঠিকই ধরে ফেলবে–এখন সময়টা আসলে খুবই কঠিন। তবে আশা করি দুই আর দুই-এ চার বানানোর আগেই আমরা সরে যেতে পারব।

.

০৯.

হলদেটে মোলায়েম আলো। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে দুজন। হামিনের দৃষ্টি কোথাও স্থির হয়ে থাকছে না, চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাঁটার গতিও কমাচ্ছে না। একইসাথে সে সমান তালে কথাও বলে চলেছে।

তাল মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন সেলডন। এখানে বোধহয় অনেক হাঁটতে হয়। কথাটা বলতে হলো, কারণ অনেকগুলো দ্বিমুখী ফুটপাথ আর ক্রসওভার রয়েছে এখানে।

অসুবিধা কী? বলল হামিন। কাছাকাছি দূরত্বে হন্টনই এখনো সবচেয়ে ভালো পরিবহন। সবচেয়ে সুবিধাজনক, সবচেয়ে সস্তা, সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। অগণিত বছর ধরে জ্ঞান বিজ্ঞানে বিস্ময়কর অগ্রগতিও এটা পাল্টাতে পারেনি। আপনার কী উচ্চতা ভীতি আছে, সেলডন?

ডানপাশে রেলিং-এর পরে একটা গভীর খাদ। সেদিকে তাকালেন তিনি। এই খাদটাই পাশাপাশি দুটো ওয়ার্কিং লেনকে আলাদা করেছে। একটা লেন আরেকটা লেন-এর বিপরীত। দুটোর মাঝখানে সংযোগ হিসেবে সমান দূরত্ব পরপর অনেকগুলো ক্রস ওভার রয়েছে। অর্থাৎ উঁচু জায়গায় উঠতে ভয় পাই কীনা, সেরকম পাই না। তবে খুব বেশি উঁচু থেকে নিচে তাকানো সবসময় অস্বস্তিকর। এটা কত নিচে নেমেছে?

এখানে বোধহয় চল্লিশ বা পঞ্চাশ লেভেল। ইম্পেরিয়াল সেক্টর এবং অল্প কয়েকটা অতি উন্নত অংশে এটাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ অংশেই এক লেভেল নিচেই গ্রাউন্ড লেভেল।

আমার ধারণা এটা আত্মহত্যার প্রবণতা উৎসাহিত করে।

খুব একটা না। সহজ পদ্ধতি আরো অনেকগুলো আছে। তাছাড়া ট্র্যান্টরে আত্মহত্যা ব্যাপারটাকে খারাপ নজরে দেখা হয় না। আত্মহত্যার জন্য এখানে অনেকগুলো সেন্টার আছে। সেখানে গিয়ে যে কেউ পছন্দ মতো পদ্ধতিতে নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দিতে পারে। তবে শর্ত একটাই। আত্মহননকারীকে বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপীর জন্য গিনিপিগ হতে হবে। অবশ্য এই কারণে জিজ্ঞেস করছি না যে আপনার উচ্চতা ভীতি আছে কি না। আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া নেব। যেখানে ট্যাক্সি ভাড়া পাওয়া যায় সেখানের লোকগুলো আমাকে সাংবাদিক হিসেবে চেনে। আমি ওদের কিছু উপকার করেছি, বিনিময়ে ওরাও মাঝে মাঝে আমার উপকার করে দেয়। আমার নাম ওরা রেকর্ড করতে ভুলে যাবে এবং খেয়ালই করবে না যে আমার সাথে আরেকজন ছিল। অবশ্য সেজন্য বেশ মোটা অঙ্কের ক্রেডিট খরচ করতে হবে। কারণ ডেমারজেলের গুণ্ডাগুলো চেপে ধরলে সত্যি কথা বলতে বাধ্য হবে ওরা, তখন আমার দেওয়া ক্রেডিট ওদেরকে নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু সেজন্য হয়তো অনেক সময় লাগবে।

এর সাথে উচ্চতাভীতির সম্পর্ক কী?

আমরা ট্যাক্সি রেন্টালে দ্রুত পৌঁছাব যদি গ্র্যাভিটিক লিফট ব্যবহার করি। সবাই অবশ্য খুব বেশি প্রয়োজন দেখা না দিলে এটা ব্যবহার করে না এবং সত্যি কথা বলতে কী আমার নিজেরও খুব একটা ইচ্ছা নেই। তবে এই মুহূর্তে, যদি মনে করেন যে আপনি সামলাতে পারবেন, তাহলে সময় বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করলে ভালো হবে।

গ্র্যাভিটিক লিফট জিনিসটা কী?

এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। যদি সাইকোলজিক্যালি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় তাহলে হয়তো এক সময় পুরো ট্র্যান্টরে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে, তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য গ্রহে। মূলত গ্র্যাভিটিক লিফট হচ্ছে এমন এক এ্যালিভেটর শ্যাফট যার ভেতরে কোনো এ্যালিভেটর ক্যাব থাকে না। আমরা শূন্যে দাঁড়িয়ে উপরে উঠব বা নিচে নামব। আর এই উপরে উঠানো বা নিচে নামানোর কাজটা করবে এ্যান্টি গ্র্যাভিটি। এখন পর্যন্ত শুধু এই একটা ক্ষেত্রেই এ্যান্টি গ্র্যাভিটির ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে, সবচেয়ে বড়ো কারণ এই যে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে সহজ ব্যবহার।

যদি উঠা নামার মাঝখানে পাওয়ার চলে যায় তখন কী হবে?

যা ভাবছেন তাই হবে। পড়ে যাব, মারা যাব। এখন পর্যন্ত এই ধরনের দুর্ঘটনার কোনো খবর শুনিনি, হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আমি অবশ্যই জানতাম। হয়তো খবরটা প্রকাশ করতে পারতাম না নিরাপত্তার খাতিরে সবসময় এই কারণ দেখিয়েই খারাপ খবরগুলো প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু আমি জানতে পারতাম। ঠিকই। আপনি ভয় পেলে অবশ্য পরিকল্পনাটা বাদ। কিন্তু কড়িডোর ধরে যেতে বেশি সময় লাগবে, এগুলো কেমন আবদ্ধ, কিছুক্ষণ চলার পর অনেকেরই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

একটা বাঁক ঘুরল হামিন। সামনেই টিকেট কাউন্টারের মতো একটা কোটর, তার সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো নারীপুরুষ। কয়েকজনের সাথে। আবার বাচ্চাও আছে।

নিজের গ্রহে থাকতে এধরনের আবিষ্কারের কোনো খবর পাইনি। নিচু গলায় বললেন সেলডন। অবশ্য আমাদের নিউজ মিডিয়া অধিকাংশই স্থানীয় সংবাদ প্রচার করে, তারপরেও এইরকম একটা খবর নিশ্চয়ই চাপা থাকত না।

পুরো ব্যাপারটাই পরীক্ষামূলক এবং শুধু ইম্পেরিয়াল সেক্টরেই সীমাবদ্ধ। প্রচুর জ্বালানী খরচ হয়। সেজন্যই প্রশাসন এখনই ব্যাপকভাবে প্রচার করছে না। ক্লীয়নের আগে যে সম্রাট ছিলেন–ষষ্ঠ স্ট্যালিন নিজের বিছানায় ঘুমের মধ্যে মরে গিয়ে যিনি সবাইকে বিস্মিত করেছিলেন, তার নির্দেশেই অল্প কয়েকটি স্থানে গ্র্যাভিটিক লিফট বসানো হয়। সবাই বলে, স্ট্যালিন আসলে এ্যান্টি গ্র্যাভিটির সাথে নিজের নাম জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন ইতিহাসে তার নাম অমর করে রাখার জন্য। হয়তো এটার ব্যবহার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে অন্যদিকে এটা দিয়ে গ্র্যাভিটিক লিফট ছাড়া অন্য কোনো আবিষ্কার সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

আর কী আবিষ্কারের চিন্তা ভাবনা ছিল? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

এ্যান্টি গ্র্যাভ স্পেসফ্লাইট। তার জন্য অবশ্য ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন যে এটা কোনোদিনও সম্ভব হবে না। কিন্তু গ্র্যাভিটিক লিফট তৈরি করার আগে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করত যে এটাও ম্ভব হবে না।

লাইনটা ক্রমেই ছোট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই সেলডন নিজেকে আবিষ্কার করলেন একেবারে কিনারায়। সামনে একটা গহ্বর। বাতাসে কেমন এক ধরনের চকমকে ভাব। সেলডন হাত বাড়ালেন ছোঁয়ার জন্য। সাথে সাথে হালকা ইলেকট্রিক শক খেলেন। ব্যথা লাগেনি, কিন্তু ঝট করে হাত পিছিয়ে এনে ঝাড়তে লাগলেন।

মাথা নাড়ল হামিন। সতর্কতা, যেন কন্ট্রোল চালু করার আগেই কেউ ভিতরে ঢুকে না পড়ে। কন্ট্রোলে কয়েকটা নাম্বার চাপল সে। বাতাসের চকচকে ভাব চলে গেল।

উঁকি দিয়ে শ্যাফটের ভিতরে তাকালেন সেলডন।

কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। বলল হামিন। আমার হাত ধরে রাখবেন আর চোখ বন্ধ করে রাখুন। তাহলেই হবে।

সেলডন আসলে কোনো সুযোগই পেলেন না। কিছু বলার আগেই হামিন শক্ত করে তার হাত ধরে পা রাখল শূন্যের মাঝে। ভয়ে কেঁপে উঠলেন সেলডন এবং নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙানী বেরিয়ে এল।

উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছেন, সেইরকম কোনো অনুভূতি হলো না। জোরালো বাতাসের ঝাঁপটাও টের পেলেন না তিনি। কয়েক সেকেন্ড পরেই পিঠে হালকা ধাক্কা খেয়ে সামনে বাড়লেন। হোঁচট খেলেন। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে টের পেলেন পায়ের নিচে নিরেট জমিন।

চোখ খুললেন তিনি। আমরা পৌঁছে গেছি?

মরি নি। শুকনো গলায় বলল হামিন। তারপর হাঁটতে শুরু করল। হাত ধরে রেখেছে, কাজেই সেলডনও সামনে বাড়তে বাধ্য হলেন।

আমি জানতে চাইছি আমরা কী সঠিক লেভেলে পৌঁছেছি?

অবশ্যই।

আমরা যখন নিচে নামছিলাম তখন যদি নিচ থেকে কেউ উপরে উঠত কী হত?

দুটো আলাদা লেন আছে। এক লেন দিয়ে যে গতিতে নিচে নামা হয় অন্য লেন। দিয়ে সমান গতিতে উপরে উঠা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে দুর্ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আমি কিচ্ছু টের পাইনি।

পাওয়ার কথাও না। কোনো এক্সেলারেশন নেই। এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ের ভিতরেই আপনার পতনের গতিতে একটা সামঞ্জস্য তৈরি হয়ে যায় সেই সাথে আপনার চারপাশের বায়ুপ্রবাহের গতিও ছিল সমান।

চমৎকার।

ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ব্যয়বহুল। আর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটাকে আরো উন্নত, কার্যকরী এবং ব্যবহারোপযোগী করে তোলার কোনো আগ্রহ কারো নেই। সব জায়গাতেই একই কথা। আমরা এটা করতে পারব না। এটা করা যাবে না। প্রচণ্ড রাগে কাঁধ ঝাড়ল হামিন। যাইহোক ট্যাক্সি রেন্টালে পৌঁছে গেছি। দেখা যাক কী হয়।

.

১০.

সেলডন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যেন তাকে দেখে কারো মনে সন্দেহ না জাগে। কিন্তু ব্যাপারটা কঠিন। এয়ার ট্যাক্সি টার্মিনালের ভেতর অনেক মানুষ আসা যাওয়া করছে, প্রচুর ট্যাক্সিও আছে। যেভাবে মানুষজন এবং চারপাশে তাকাচ্ছেন, তাতে নিঃসন্দেহে সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। স্বাভাবিক থাকতেই পারছেন না।

কীভাবেই বা পারবেন? গায়ের নতুন পোশাকে অস্বস্তি বোধ করছেন। কোনো। পকেট নেই যে হাতগুলো তার ভেতর ঢুকিয়ে রাখবেন। বেল্টের দুপাশে দুটো পাউচ। একটু নড়লেই সেগুলো শরীরের সাথে অনবরত বাড়ি খাচ্ছে। যার ফলে তার মনে হচ্ছে কেউ যেন শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েদের দিকে মনোযোগ দিলেন তিনি। তাদের কোমরে কোনো পাউচ চোখে পড়ল না। তবে বাক্সের মতো ছোট একটা জিনিস বহন করছে তারা। মাঝে মাঝে সেটা আটকে রাখছে কোমরের সাথে। কৌশলটা ধরতে না পেরে শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন বোধহয় লুকানো চুম্বক আছে। হয় বাক্সের সাথে নয়তো বেল্টের সাথে। বিতৃষ্ণার সাথে লক্ষ্য করলেন মেয়েদের পোশাকে ততটা জাঁকজমক নেই, অন্তত আকৃষ্ট করার মতো করে শরীরের বিশেষ অংশগুলো উন্মুক্ত করে রাখেনি কেউই। তবে দুএকটা পোশাকের ডিজাইন দেখে মনে হলো যে সেই মেয়েগুলো চাইছে। তাদের গুরু নিতম্বের দিকে পুরুষদের চোখ যাক।

এদিকে হামিন দক্ষতার সাথে কাজ করছে। যথেষ্ট পরিমাণ ক্রেডিট জমা দিয়ে হাতে একটা সুপারকন্ডাকটিভ সিরাময়েড টাইল নিয়ে ফিরে এল। এই টাইল দিয়েই তাদের ভাড়া করা এয়ার ট্যাক্সি চালু করতে হবে।

চলুন, সেলডন। দুই আসনের একটা ছোট বাহনের দিকে ইশারা করে বলল হামিন।

আপনার নাম সই করতে হয়েছে, হামিন?

না, এখানে সবাই আমাকে ভালো করেই চেনে। তাই নিয়ম মেনে সবকিছু করার গরজ দেখায়নি কেউ।

আপনি কী করছেন ওরা জানে?

কেউ জিজ্ঞেস করে নি, আমিও নিজে থেকে কিছু বলিনি। হাতের টাইল একটা ফুটো দিয়ে ঢোকালো হামিন। এয়ার ট্যাক্সি চালু হলো। হালকা কম্পন অনুভব করলেন সেলডন।

আমরা ডি-সেভেন এ যাব।

ডি-সেভেন জিনিসটা কী সেলডন জানেন না তবে অনুমান করলেন এটা বোধহয় কোনো রাস্তার নাম।

অন্যান্য গ্রাউন্ড কারের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে এয়ার ট্যাক্সি চলা শুরু করল। কিছুক্ষণ চলার পর খানিকটা তীর্যকভাবে উপরের দিকে উঠতে লাগল। গতি বাড়ছে। ধীরে ধীরে। তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেল।

ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই একটা সিট বেল্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলডনকে আসনের সাথে আটকে নিয়েছে। অনুভব করলেন তিনি পিছনে সিটের আরামদায়ক ফোমের একেবারে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন তারপরে যেন প্রিং-এ ধাক্কা খেয়ে আবার ছিটকে বেরিয়ে এলেন।

এটাতো এ্যান্টিগ্র্যাভিটিক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বললেন।

না, জবাব দিল হামিন। এই ঝাঁকুনিটা হচ্ছে ছোট একটা জেট রি অ্যাকশনের কারণে। তবে আমাদের উপরে টিউবের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যথেষ্ট।

সামনে ধীরে ধীরে যা উন্মোচিত হচ্ছে, সেলডনের কাছে মনে হলো যেন অসংখ্য এবং অগণিত গুহা, দূর থেকে মনে হয় চেকারবোর্ডের মতো। অন্যান্য এয়ার। ট্যাক্সিগুলোকে এড়িয়ে হামিন ডি-সেভেন টানেলের খোলামুখের দিকে এগিয়ে চলেছে।

যেকোনো মুহূর্তে আপনি অন্য ট্যাক্সির সাথে ধাক্কা লাগাবেন। গলা পরিস্কার করে বললেন সেলডন।

সেই সম্ভাবনা শতকরা একশ ভাগ ছিল যদি এটা চালানোর জন্য আমাকে নির্ভর করতে হতো নিজের বোধ বুদ্ধি এবং দক্ষতার উপর। কিন্তু এই ট্যাক্সি কম্পিউটার চালিত।–এই যে চলে এসেছি।

ডি-সেভেন টানেলে ঢুকল তারা; মনে হলো যেন টানেলটা তাদের গিলে ফেলল। বাইরের প্লাজার উজ্জ্বল ঝলমলে আলো মুছে গেল, টানেলের ভিতরের আলো নিষ্প্রভ হলুদ।

কন্ট্রোল ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে বসল হামিন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক, ঝামেলা ছাড়াই একটা ধাপ পেরনো গেল। স্টেশনে ধরা পড়ার ভয় ছিল। কিন্তু এখানে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ।।

মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে এয়ার ট্যাক্সি। কোনো শব্দ নেই, শুধু একটা মোলায়েম গুঞ্জন। টানেলের দুপাশের দেয়াল সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে পিছনে।

কী রকম গতিতে এগোচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

দ্রুত কন্ট্রোলের উপর চোখ বুলালো হামিন। ঘণ্টায় প্রায় তিনশ পঞ্চাশ কিলোমিটার।

ম্যাগনেটিক প্রপালশন?

 হ্যাঁ। আমার ধারণা হ্যালিকনেও এই জিনিস আছে।

আছে। মাত্র একটা লাইন। ইচ্ছে থাকলেও কখনো চড়ার সৌভাগ্য হয়নি। কোনো ধারণাই ছিল না যে জিনিসটা এমন হবে।

ট্র্যান্টরের ল্যান্ড সারফেসের উপর থেকে শুরু করে গভীর তলদেশ পর্যন্ত মহাসাগরগুলোর দুর্গম তলদেশ পর্যন্ত এইরকম অসংখ্য টানেল মৌমাছির চাকের মতো ছড়িয়ে আছে। দূরের যাত্রার জন্য এটাই ট্র্যান্টরে একমাত্র এবং প্রধান মাধ্যম।

কতক্ষণ লাগবে?

প্রথম গন্তব্যে পৌঁছতে পাঁচ ঘণ্টার কিছু বেশি লাগবে।

পাঁচ ঘণ্টা! মুখ বাঁকালেন সেলডন।

চিন্তা করবেন না। প্রতি বিশ মিনিট পর পর রেস্ট এরিয়া আছে। ইচ্ছে হলেই সেখানে থেমে টানেল থেকে বেরনো যাবে, হাঁটাহাঁটি করে নিতে পারব। খাবারসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে।

তারপর দুজনেই নিশ্চুপ। আবার আলোচনা শুরু হলো যখন সেলডন হঠাৎ একটা আলোর চমক দেখে সোজা হয়ে বসলেন। তার কাছে মনে হলো তিনি বোধহয় আরো দুটো এয়ার-ট্যাক্সি দেখেছেন।

ওটা একটা রেস্ট এরিয়া। অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দিল হামিন।

আপনি আমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেই জায়গাটা কী আসলেই নিরাপদ?

অন্য অনেক জায়গার চেয়ে নিরাপদ। অন্তত ইম্পেরিয়াল ফোর্স সরাসরি আপনার গায়ে হাত দিতে পারবে না। তবে ভাড়াটে খুনী বা অপহরণকারী পাঠিয়ে আপনার ক্ষতি করতে পারে সেজন্য তো কিছুটা সতর্ক থাকতেই হবে। আমি আপনার জন্য দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করে দেব।

ভাড়াটে খুনী? অস্বস্তির সাথে বললেন সেলডন। ওরা কী আসলেই আমাকে খুন করতে চায়?

আমি নিশ্চিত যে ডেমারজেল আপনাকে খুন করতে চায় না। সে আপনাকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু শত্রুতো আরো অনেকেই আছে। তারা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে, অথবা কোনো ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।

মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সেলডন। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই তিনি ছিলেন অনুন্নত এক গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত এক গণিতজ্ঞ। চমৎকার সব দৃশ্য দেখে সময় কাটাচ্ছিলেন। চেয়েছিলেন নিজ গ্রহে ফিরে যাওয়ার আগে অনভ্যস্ত গ্রাম্য চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে দেখবেন এই সুবিশাল গ্রহের অতি উন্নত জৌলুশ এবং চাকচিক্য। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, পিছনে ছুটে আসছে ইম্পেরিয়াল ফোর্স। ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁপে উঠলেন তিনি।

আপনার কী হবে আর এখন কী করতে চাইছেন?

চিন্তিত গলায় জবাব দিল হামিন। আমাকে ওরা ছেড়ে দেবে না। দেখা যাবে কোনো একদিন কোনো গুপ্তঘাতক আড়াল থেকে আমাকে মেরে পালিয়ে গেল।

কথাগুলো বলার সময় হামিনের বলার ভঙ্গি বা কণ্ঠস্বর পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকল কিন্তু সেলডন কুঁকড়ে গেলেন।

আপনাকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না আপনি… আপনি… একটুও ভয় পেয়েছেন।

আমি ঘাগু ট্র্যান্টরিয়ান। এই গ্রহটাকে অন্য অনেকের চেয়ে ভালোভাবে জানি। আমি অনেক মানুষকে চিনি, জানি যাদের বেশিরভাগই আমার কাছে কোনো না কোনো কারণে ঋণী। আমি অত্যন্ত সাবধানী লোক এবং নিজেকে রক্ষা করতে পারব এই বিশ্বাস আমার আছে।

শুনে খুশী হলাম এবং আশা করি আপনি আসলেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন, হামিন, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, কেন আপনি এই ঝুঁকি নিচ্ছেন। আমি আপনার কে? কেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনছেন?

কন্ট্রোল নিয়ে খেলা করতে লাগল হামিন, জবাব দেওয়ার আগে সময় নিচ্ছে। তারপর সরাসরি তাকালো সেলডনের দিকে।

আমি আপনাকে রক্ষা করতে চাইছি ঠিক একই কারণে যে কারণে সম্রাট আপনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল–আপনার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা।

প্রচণ্ড হতাশ হলেন সেলডন। তাকে রক্ষা করার পেছনে বন্ধুত্ব বা মানবিক কোনো কারণ নেই। পুরোটাই স্বার্থ। আসলে তিনি শিকার, শুধু এক শিকারীর খপ্পর থেকে আরেক শিকারীর হাতে পড়েছেন। ক্রোধের সাথে জবাব দিলেন, এই সম্মেলনে আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন করাটাই চরম ভুল। এটা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে।

না, এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। সম্রাট এবং তার অফিসাররা আপনাকে চায় এক কারণে, তারা চায় আপনাকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে, নিজেদের বংশধরদের জন্য সুখ, সমৃদ্ধি এবং আরামআয়েশের ব্যবস্থা বজায় রাখতে। যেন সম্রাটের শাসন বজায় থাকে এবং পরবর্তীকালে তার ছেলেও একইভাবে শাসন করতে পারে। কিন্তু আমি চাই আপনার এই ক্ষমতা দিয়ে যেন গ্যালাক্সির মঙ্গল করা যায়।

পার্থক্যটা কোথায়? তিক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

এবার হামিনও রেগে উঠল। পার্থক্যটা কোথায় সেটা যদি বুঝতে না পারেন তাহলে আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। যে সম্রাট এখন আমাদের শাসন করছেন তার জনের আগে, তিনি যে রাজবংশের প্রতিনিধি সেই বংশের সূত্রপাতের অনেক অনেক আগে মানব সভ্যতার জন্ম। হয়তোবা গ্যালাক্সির পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের বয়সের চেয়েও প্রাচীন মানব সভ্যতা। কিংবদন্তী আছে যে এক সময় মানব জাতি শুধু একটা গ্রহেই বাস করত।

কিংবদন্তী!

হ্যাঁ, কিংবদন্তী। কিন্তু সেটা সত্যি না হওয়ার পেছনে তো আমি কোনো কারণ দেখিনা। হয়তো বিশ হাজার বা তারও বেশি বছর আগে ঘটনা এমনই ছিল। নিশ্চয়ই হাইপারস্পেশাল যোগাযোগের জ্ঞান-বুদ্ধি মাথায় নিয়েই মানব জাতির জন্ম হয়নি। শুরুতে নিশ্চয়ই আলোর গতির চেয়ে হাজার গুণ বেশি দ্রুত যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা ছিল না এবং তারা নিঃসন্দেহে একটা মাত্র প্ল্যানেটরি সিস্টেমে বন্দী হয়ে ছিল। আর গ্যালাক্সির গ্রহগুলোতে যে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে তা আমি, আপনি বা সম্রাট এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদের মৃত্যুর পরেও বহু বহু বছর টিকে থাকবে। এমনকি হয়তোবা এই এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু মানবজাতি ঠিক তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখবে। সেই ক্ষেত্রে, কেন একজনের কথা ভাবব, কেন সম্রাট এবং তরুণ যুবরাজ-এর জন্য চিন্তিত হব? এম্পায়ার কীভাবে চলছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। গ্যালাক্সির কোয়াড্রিলিয়ন মানবসন্তানের কী হবে? কী হবে তাদের?

মানব জাতি তার পথ চলা চালিয়ে যাবে।

আপনি কী কোনো তাগিদ অনুভব করছেন না যে তাদের একটা দিকনির্দেশনা দরকার নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

যে কেউ মনে করতে পারে এখন যেভাবে চলছে সেইভাবেই নিজেদের অস্তিত্ব ভালোভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে।

মনে করতে পারে। সে কী আপনি যে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলছেন তার কৌশলটা বলতে পারবে?

আমি এই কৌশলটাকে বলি সাইকোহিস্টোরী। তাত্ত্বিকভাবে পারবে।

আর আপনি এই তত্ত্বকে বাস্তবে পরিণত করার কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না।

আমি চাই, হামিন। কিন্তু ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের মাঝে অনেক ফারাক। সম্রাটকে আমি বলেছি যে সাইকোহিস্টোরীকে বাস্তব কৌশলে পরিণত করা যাবে না, আপনাকেও একই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।

আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন?

না, আমি তা চাই না, বরং ট্র্যান্টরের সমান শিলাখণ্ড হাতে নিয়ে সেগুলো ওজন অনুযায়ী সাজানোর চেষ্টা করাও অনেক ভালো। আমি জানি সাইকোহিস্টোরী এমন একটা কাজ যা আমি সাত-জনমেও শেষ করতে পারব না।

মানব জাতির সত্যিকার অবস্থা জানতে পারলে আপনি চেষ্টা করবেন?

অবান্তর প্রশ্ন। মানবজাতির সত্যিকার অবস্থা আবার কী? আপনি কী দাবী করছেন যে আপনি সেটা জানেন?

হ্যাঁ, জানি। এবং মাত্র পাঁচ শব্দেই আপনাকে পুরোটা বলে দিতে পারি। আবার সামনে তাকালো হামিন। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল টানেলের দেয়ালের পরিবর্তনহীনতা, কীভাবে সেগুলো চোখের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। পরক্ষণেই পিছিয়ে যাচ্ছে সাঁ করে। তারপর হাসি মুখে শব্দ পাঁচটা বলল।

গ্যালাক্টিক এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

.

ইউনিভার্সিটি

স্ট্রিলিং ইউনিভার্সিটি… প্রাচীন ট্র্যান্টরের স্ট্রিলিং সেক্টরে অবস্থিত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান… সমাজবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় সুখ্যাতি থাকলেও বর্তমানে কিন্তু ঐ সকল কারণে এই প্রতিষ্ঠানের কথা মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করে না। ইউনিভার্সিটির জ্ঞানী-গুণীদের প্রজন্ম এটা ভেবে আশ্চর্য হতে পারেন যে পরবর্তী যুগে এই প্রতিষ্ঠান কোনো এক হ্যারি সেলডনের কারণেই পুরো মহাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে, কারণ তথাকথিত পালিয়ে বেড়ানোর সময় তিনি এখানে অল্প কিছুদিনের জন্য বাস করেছিলেন।
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা।

.

১১.

স্তম্ভিত হয়ে বসে আছেন সেলডন। অস্বস্তি বোধ করছেন নিজের ক্ষুদ্রতা আর স্বল্পতার কথা ভেবে।

নতুন এক বিজ্ঞান তৈরি করেছেন তিনিঃ সাইকোহিস্টোরী। সম্ভাবনার নিয়মগুলোকে বর্ধিত করে তাতে এনে দিয়েছেন নতুন এক মাত্রা, যোগ করেছেন নতুন জটিলতা এবং অনিশ্চয়তা, তৈরি করেছেন বিশাল বিশাল গাণিতিক সমীকরণ যার ফলাফল হতে পারে অসংখ্য।–বোধহয় অসীম। বলতে পারবেন না।

তার কাছে আছে সাইকোহিস্টোরী বা বলা যায় যে সাইকোহিস্টোরীর মূল নীতিগুলো। কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে তার কী বিস্তারিত ধারণা আছে যার সাহায্যে সমীকরণগুলোর একটা বোধগম্য অর্থ দাঁড় করানো যায়।

নেই। ইতিহাসে কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। হ্যাঁলিকনিয়ান ইতিহাসের একটা প্রাথমিক ধারণা আছে কারণ বিদ্যালয়ে সেটা অধ্যয়ন করা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই জানাই কী সব? কোনো সন্দেহ নেই তিনি যা জানেন সেটা হলো গিয়ে সম্পূর্ণ ইতিহাসের একটা নগ্ন কঙ্কাল। অর্ধেক কল্পনা, অর্ধেক সময়ের করাল গ্রাসে বিকৃত।

হামিন কীভাবে বলল গ্যালাক্টিক এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? দশহাজার বছর ধরে যা এম্পায়ার হিসেবে স্বীকৃত, তারও আগের দুহাজার বছর ট্র্যান্টর প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি কিংডমের রাজধানী হিসেবে যে ক্ষমতার অধিকারী ছিল তাও একটা এম্পায়ারের সমকক্ষ। প্রথম দিকে কোনো গ্রহই নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চায়নি। ফলে প্রথম কয়েক শতাব্দী বিপুল পরিমাণে বিদ্রোহ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সিংহাসন নিয়ে হানাহানি সামলাতে হয়েছে ট্র্যান্টরকে। ধীরে ধীরে নিজেকে সে গড়ে তুলেছে রূপকথার এক বিশ্বে যাকে এখন বলা হয় অবিনশ্বর বিশ্ব ইটারনাল ওয়ার্ল্ড।

এ কথা সত্য যে গত চার শতাব্দীতে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিগত সম্রাটদের অধিকাংশই নিহত হয়েছেন আততায়ীর হাতে, বারবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই ছিল সীমাহীন অস্থিরতা। তবে সেই পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটছে। গ্যালাক্সিতে এখন যে শান্তি বিরাজ করছে তা আগে কখনো ছিল না। পূর্ববর্তী সম্রাট ষষ্ঠ স্ট্যালিন-এর শাসনকাল এবং বর্তমানে তার পুত্র প্রথম ক্লীয়নের আমলে প্রতিটি গ্রহ ক্রমেই উন্নতি লাভ করছে এবং ক্লীয়নকে কোনো অবস্থাতেই রক্তলোলুপ স্বৈরাচার বলা যাবে না। এমনকি যারা ইমপেরিয়ামকে ঘৃণা করে তারাও ক্লীয়নের কোনো বদনাম বা দোষ দিতে পারবে না। তাদের বেশি। অভিযোগ বরং ইটো ডেমারজেলের বিরুদ্ধে।

তাহলে হামিন এই কথা বলল কেন–এবং এইরকম আত্মবিশ্বাসের সাথে।

হামিন পেশায় একজন সাংবাদিক। গ্যালাক্সির ইতিহাস এবং সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ তার নখদর্পণে। তাই কী সে এমন একটা কথা বলতে পেরেছে? হয়তো এই বক্তব্যের পেছনে তার জোরালো প্রমাণ আছে। যদি থাকেই, কী সেই প্রমাণ?

বেশ কয়েকবারই সেলডন জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলেন। একটা উত্তর তার পাওনা হয়েছে। কিন্তু হামিনের গম্ভীর মুখে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য ঠিক সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না। তাছাড়া নিজের ভেতর থেকেও কী যেন একটা বাধা দিল। যত যাইহোক, গ্যালাক্টিক এম্পায়ার হচ্ছে মূল ভিত্তি যার উপর নির্ভর করে তার সকল বিশ্লেষণ, যুক্তি প্রমাণ গড়ে উঠেছে। যদি কোথাও ভুল করে থাকেন, তিনি সেটা জানতে চান না।

ভুল হয়েছে, এটা তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন না। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটলেই গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের স্থায়িত্ব শেষ হবে। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন শুধু তখনই গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের মৃত্যু হবে।

চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, লাভ হলো না। সাইকোহিস্টোরী বিজ্ঞানকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার কী মহাবিশ্বের ইতিহাস পুরোটা জেনে নেওয়া উচিত?

সেটা কী সম্ভব? পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ, প্রতিটিরই রয়েছে সীমাহীন জটিল নিজস্ব ইতিহাস। তার সবগুলো তিনি কীভাবে জানবেন? তিনি জানেন গ্যালাক্টিক ইতিহাসের উপর অসংখ্য বুক-ফিল্ম রয়েছে। কী যেন একটা দরকারে অনেকদিন আগে সেইরকম একটা বুক-ফিল্ম দেখেছিলেন তিনি এবং মাত্র অর্ধেক দেখেই বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

বুক-ফিল্মগুলোতে কেবল গুরুত্বপূর্ণ গ্রহগুলোরই ইতিহাস থাকে। বেশিরভাগেই থাকে নিজেদের ইতিহাস। দুএকটিতে অন্যান্য গ্রহেরও বর্ণনা থাকে সেই সময় পর্যন্ত, যতদিন ঐ গ্রহগুলো নিজেদের প্রথম সারিতে রাখতে পেরেছিল। যখন থেকে সেগুলোর গুরুত্ব হ্রাস পায় তার পরবর্তী সময়ের কোনো বর্ণনা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেলডনের মনে আছে ঐ বুক ফিল্মে হ্যালিকন সম্বন্ধে দুটো লাইন পেয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল যে এক সময় হ্যালিকন ইম্পেরিয়াল সিংহাসনের দাবীদার কোনো এক ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়েছিল, যদিও সেই ব্যক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। হ্যাঁলিককে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, সম্ভবত এই কারণে যে গ্রহটাকে শাস্তি দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে গণ্য করা হয়নি।

এইরকম ইতিহাস জেনে কী লাভ হবে? প্রতিটি গ্রহ–একটাও বাদ দেওয়া যাবে না–প্রতিটি গ্রহের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, আন্তঃক্রিয়া সাইকোহিস্টোরীর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একজন মানুষ কীভাবে পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের পূর্ণ ইতিহাস পর্যালোচনা করে সম্ভ্যাব্য আন্তঃক্রিয়া নির্ধারণ করবে? অসম্ভব। এবং তিনি আরো একবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন যে সাইকোহিস্টোরী পুরোপুরি তাত্ত্বিক, বাস্তবে পরিণত করা যাবে না।

মৃদু একটা ঝাঁকুনির ফলে সেলডন ধারণা করলেন বোধহয় এয়ার ট্যাক্সির গতি কমছে।

কী হলো? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

আমার ধারণা যথেষ্ট দূরে আসা গেছে, হামিন বলল, এবার পানাহার এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য খানিকটা বিরতির ঝুঁকি নেওয়া যায়।

পরবর্তী পনেরো মিনিট এয়ার ট্যাক্সির গতি ধীরে ধীরে কমল। সামনে একটা আলোকিত চতুর। আরো অনেকগুলো ট্যাক্সির মাঝে খালি জায়গা দেখে সেখানে ল্যান্ড করল হামিন।

.

১২.

মনে হলো হামিন তার অভিজ্ঞ চোখে এক পলকে পুরো এলাকা, অন্যান্য ট্যাক্সি, ডিনার করতে আসা নারী পুরুষ সকলের উপর নজর বুলালো। সেলডন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন যদিও জানেন না কীভাবে তা সম্ভব। তিনি হামিনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করলেন।

ছোট একটা টেবিলে বসে বোতাম টিপে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর প্রশ্ন করলেন সেলডন, সব ঠিক আছে? কণ্ঠস্বর অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টাও করলেন।

মনে হয়। বলল হামিন।

 কীভাবে বুঝলেন?

হামিনের গভীর চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য সেলডনের উপর স্থির হলো। অভিজ্ঞতা, বলল সে। আমার মতো দীর্ঘদিন সংবাদের পেছনে ছুটে বেড়ালে আপনিও এক পলক তাকিয়েই বলে দিতে পারবেন, এখানে কোনো খবর নেই।

মাথা নাড়লেন সেলডন। স্বস্তি বোধ করছেন। হয়তো কথাগুলো হামিন বলেছে ঠাট্টার ভঙ্গিতে তারপরেও তাতে যথেষ্ট পরিমাণ সত্য আছে।

কিন্তু স্যান্ডউইচে প্রথম কামড় দিয়েই তার স্বস্তি পুরোপুরি উবে গেল। মুখ ভর্তি খাবার আর চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে হামিনের দিকে তাকালেন তিনি।

মাই ফ্রেন্ড, এটা রাস্তার ধারের সস্তা হোটেল। বলল হামিন। সস্তা, দ্রুত পাওয়া যায় এবং জঘন্য স্বাদ। এই খাবারগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন এবং অত্যন্ত কড়া ছত্রাকের নির্যাস মেশানো। ট্রান্টরিয়ান জিহ্বা এই স্বাদে অভ্যস্ত।

বেশ পরিশ্রম করে মুখের খাবারটুকু পেটে চালান করলেন সেলডন। কিন্তু হোটেলে-।

আপনি তখন ছিলেন ইম্পেরিয়াল সেক্টরে, সেলডন। সেখানে খাবার আমদানী করা হয় এবং সবচেয়ে উন্নতমানের মাইক্রোফুড ব্যবহার করা হয়। দামও অত্যন্ত বেশি।

স্যান্ডউইচ আবার মুখে তুলবেন কিনা ভাবছেন সেলডন। তার মানে যতদিন ট্র্যান্টরে থাকব…

ঠোঁট দিয়ে শ… শ… শ শব্দ করার মতো একটা ভঙ্গি করল হামিন। কাউকে বুঝতে দেবেন না যে আপনি আরো ভালো স্বাদে অভ্যস্ত। ট্র্যান্টরে কিছু কিছু স্থানে বেশি আভিজাত্য দেখানো একজন আউটওয়ার্ল্ডার হওয়ার চেয়েও বিপজ্জনক। নিশ্চিত থাকুন, সব জায়গার খাবারই এমন বিস্বাদ না। রাস্তার ধারের এই হোটেলগুলোর নিচু মানের খাবার সরবরাহ করার একটা অখ্যাতি আছে। আপনি যদি এই স্যান্ডউইচটা হজম করতে পারেন, তাহলে ট্র্যান্টরে অন্য কোথাও গিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আর খাবারে আপনার কোনো ক্ষতিও হবে না। পচে যায়নি, দুদিন আগের বাসী খাবারও না, শুধু স্বাদটা একটু কড়া। বিশ্বাস করুন কিছুদিন পর আপনি এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। অনেক ট্র্যান্টরিয়ানকেই আমি চিনি যারা মূল্যবান সুস্বাদু খাবার মুখে নিয়েই থুঃ করে ফেলে দেয় কারণ তাতে এইরকম কড়া স্বাদ গন্ধ থাকে না।

এখানে কী প্রচুর খাদ্য উৎপাদন করা হয়? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। তার আগে অবশ্য দেখে নিলেন কথা শুনে ফেলার মতো কাছাকাছি কেউ আছে কিনা। আমি শুনেছি যে আশেপাশের বিশটা গ্রহ থেকে শয়ে শয়ে ফ্রেইট শিপ ট্র্যান্টরের প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করে।

আমিও জানি। এবং শত শত ফ্রেইট শিপ ট্র্যান্টরের বর্জ্য নিয়ে যায়। গল্পটা আরো মুখরোচক হবে যদি আপনি বলেন যে সেই একই শিপগুলো বর্জ্য বহন করে নিয়ে যায় যেগুলো খাবার বহন করে নিয়ে আসে। এটা সত্যি যে আমরা বিপুল পরিমাণে খাদ্য আমদানী করি, কিন্তু তার অধিকাংশই বিলাসী এবং মূল্যবান। এবং আমরা বিপুল পরিমাণে বর্জ্য রপ্তানী করি, অত্যন্ত যত্নের সাথে সেগুলোর ক্ষতিকারক প্রভাব দূর করে কার্যকরী উপাদানে পরিণত করা হয়–যেমন জৈব সার যার প্রতিটা কণা অনেক গ্রহের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান আমাদের কাছে যেমন। মূল্যবান খাদ্য। কিন্তু আমি যা বললাম তা হলো মূল ছবির একটা অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।

তাই?

সাগরের মাছ ছাড়াও এখানে আছে ফল এবং টাটকা শাকসজীর বাগান, পোলট্রি, খরগোস এবং বিশাল বিশাল মাইক্রো অর্গানিজমের ফার্ম–সাধারণত বলা হয় ছত্রাকের খামার, যদিও উৎপাদন অত্যন্ত কম। এবং আমাদের বর্জ্যগুলো অধিকাংশই এই উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এখানেই ব্যবহার করা হয়। আসলে অনেক দিক দিয়েই ট্র্যান্টর সুবিশাল এবং অতিরিক্ত বেড়ে উঠা একটা স্পেস সেটলম্যান্টের মতো। আপনি কখনো ওগুলোতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

স্পেস সেটলম্যান্টগুলো হচ্ছে আবদ্ধ শহরের মতো যার ভেতরে সবকিছুই কৃত্রিম উপায়ে রিসাইকল করা হয়। কৃত্রিম ভেন্টিলেশন, কৃত্রিম দিনরাত ইত্যাদি ইত্যাদি। পার্থক্য শুধু এক জায়গাতে। সেটা হলো সবচেয়ে বড়ো সেটলম্যান্টের জনসংখ্যা দশ মিলিয়নের কাছাকাছি আর ট্র্যান্টরের জনসংখ্যা তার দশহাজার গুণ বেশি। অবশ্য আমাদের সত্যিকার মধ্যাকর্ষণ আছে। আর কোনো স্পেস সেটলম্যান্টই আমাদের মাইক্রোফুডের মতো উন্নত মাইক্রোফুড তৈরি করতে পারবে না। আমাদের এখানে। যে ঈষ্ট ভেট, ফাঙ্গাল ম্যাট, এলগি পন্ড আছে সেগুলো আয়তনে এত বিশাল যে বাইরের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আর আমরা কৃত্রিম উপায়ে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ।

সেলডন তার স্যান্ডউইচের প্রায় পুরোটাই শেষ করে ফেলেছেন। এখন আর ততটা খারাপ মনে হচ্ছে না। এটা আমার কোনো ক্ষতি করবে না?

পেট খানিকটা সমস্যা তো করবেই, কপাল খারাপ হলে ডায়রিয়া হয়ে যেতে পারে। তবে সেরকম ঘটনা খুবই কম। এটাতে ডায়রিয়ার প্রতিশেধক মেশানো আছে, ভয় থাকবে না আর। আপনি যেহেতু এই ব্যাপারে বেশ স্পর্শকাতর।

এটা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না, হামিন। ঝগড়া বাধানোর সুরে সেলডন বললেন। প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।

.

১৩.

আবার পথ চলা শুরু হলো। টানেলের ভিতর দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে তাদের এয়ার ট্যাক্সি।

এতক্ষণ যে প্রশ্নটা বুকের ভেতর খচখচ করছিল এবার সেটাকে ভাষায় রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেলডন।

গ্যালাক্টিক এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এ কথা আপনি কেন বললেন?

সেলডনের দিকে মুখ ঘুরালো হামিন। সাংবাদিক হিসেবে চারদিক থেকেই আমার কাছে প্রচুর তথ্য উপাত্ত আসে। খবর শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যায় কিন্তু খুব অল্প পরিমাণই আমি প্রচার করতে পারি। ট্র্যান্টরের জনসংখ্যা কমছে। পঁচিশ বছর পূর্বে জনসংখ্যা ছিল কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন।

জনসংখ্যা কমে যাওয়ার আংশিক কারণ হচ্ছে জন্মহার হ্রাস। অবশ্য ট্র্যান্টরে জন্মহার কখনোই বেশি ছিল না। এই যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি খুব বেশি শিশু দেখেছেন? মনে হচ্ছে না যা দেখেছেন তা বিশাল জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। আরেকটা কারণ হচ্ছে অভিবাসন। ট্র্যান্টরে যে পরিমাণ লোক আসছে চলে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি।

বিশাল জনসংখ্যার কথা চিন্তা করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেলডন। বললেন।

কিন্তু এটা অস্বাভাবিক। কারণ এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। তাছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যেও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। কারণ এই মুহূর্তে কোথাও কোনো বিদ্রোহ নেই, অরাজকতা নেই, গত কয়েক শতাব্দীর অস্থির সময়ের কোনো ছোঁয়া নেই। যত যাইহোক রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ, অশান্তি বিশৃঙ্খলা একদিক দিয়ে গতিশীলতা, বহমান জীবনের নিদর্শন। এখন চারদিকে কেমন যেন ক্লান্তি। সবকিছুই শান্ত, সুস্থির। তার কারণ কিন্তু এই না যে মানুষ আসলে সন্তুষ্ট, তারা আসলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

আমি কিছুই বলতে পারব না।

আমি পারি। এ্যান্টিগ্র্যাভিটি হলো একটা প্রমাণ। অল্প কয়েকটা গ্র্যাভিটিক লিফট বসানো হয়েছে, নতুন করে আরো বসানোর কোনো পদক্ষেপ নেই। পুরো প্রজেক্টটাই অলাভজনক পর্যায়ে চলে গেছে, অথচ মনে হচ্ছে লাভজনক করে তোলার আগ্রহ কারো নেই। কারিগরি অগ্রগতির হার গত এক শতাব্দী থেকে। কমতে কমতে এখন হামাগুড়ি দিয়ে চলার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই থেমে গেছে। এগুলো আপনি লক্ষ্য করেননি? আপনি তো একজন গণিতজ্ঞ।

লক্ষ্য করলেও কখনো কারণ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি তা বলা যাবে না।

কেউই মাথা ঘামায়না। সবাই মেনে নিয়েছে। বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা একটা কথা বলতে খুব ভালোবাসেন–এটা করা অসম্ভব, অব্যবহারিক, অকার্যকর। তারা চিন্তা ভাবনা না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। যেমন আপনি সাইকোহিস্টোরী। নিয়ে আপনি কী ভেবেছেন? কাগজে কলমে জিনিসটা মজাদার কিন্তু বাস্তবে পুরোপুরি অকার্যকর। ঠিক বলেছি?

হ্যাঁ এবং না। বিরক্ত সুরে বললেন সেলডন। বাস্তবে ব্যবহারের অনুপযোগী। তার কারণ এই না যে আমার ভেতরে আগ্রহের অভাব আছে বা আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। আসলেই এটা অকাজের জিনিস।

এটাও যে ক্ষয়িষ্ণু সময়ের আবর্তে এম্পায়ার হাবুডুবু খাচ্ছে তারই প্রভাব। হামিনের কণ্ঠে তিরস্কার।

যে ক্ষয়িষ্ণু সময়ের কথা বলছেন, রাগের সাথে বললেন সেলডন, সেটা আপনার ধারণা। আপনার ভুলও তো হতে পারে?

এক মুহূর্ত চিন্তা করল হামিন। হতে পারে। সবটাই আমার অভিজ্ঞতা আর অনুমান। আসলে আমার দরকার সাইকোহিস্টোরীর একটা কার্যকরী কৌশল।

কাঁধ নাড়লেন সেলডন। আপনাকে দেওয়ার মতো এমন কোনো কৌশল আমার কাছে নেই। কিন্তু ধরা যাক আপনার অনুমান নির্ভুল, ভেঙ্গে যাচ্ছে এম্পায়ার। মানবজাতির অস্তিত্ব তারপরেও থাকবে।

কোন নিয়ম বা কাঠামোর অধীনে? প্রায় বারো হাজার বছর ধরে ট্রাক্টর শক্তিশালী শাসকদের অধীনে থেকে শান্তি বজায় রেখেছে। মাঝখানে অনেক বাধা এসেছে–বিদ্রোহ, স্থানীয় গৃহযুদ্ধ, আরো অনেক ঝড় ঝাপ্টা–কিন্তু সামগ্রিকভাবে এবং বিশাল এলাকা জুড়ে শান্তি বজায় রাখতে পেরেছিল। হ্যালিকন কেন এত বেশি প্রো-ইম্পেরিয়াম? আপনার নিজের গ্রহের কথা বলছি। কারণ এটা ছোট গ্রহ এবং প্রতিবেশীরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত যদি না এম্পায়ার তাকে নিরাপত্তা দিত।

আপনি বলতে চাইছেন এম্পায়ারের পতনের পর পুরো মহাবিশ্বে যুদ্ধ আর অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে?

অবশ্যই। সম্রাট বা ইম্পেরিয়াল ইনস্টিটিউশন আমি পছন্দ করি না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার হাতে কোনো বিকল্প নেই। আমি জানি না কীভাবে শান্তি বজায় রাখা যাবে। তাই আমার হাতে বিকল্প কোনো উপায় না আসা পর্যন্ত আমি এটাকে ছেড়ে দিতে পারি না।

এমনভাবে কথা বলছেন যেন গ্যালাক্সির নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে। ছেড়ে দিতে পারি না। বিকল্প উপায় পেতে হবে। এভাবে কথা বলার আপনি কে?।

আমি যা বলছি কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই বলছি। সবার কথা বলছি। ব্যক্তি চ্যাটার হামিন-এর জন্য আমার কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই। আমার জীবদ্দশাতে এম্পায়ার শেষ হবে না; বরং বেঁচে থাকতে থাকতেই হয়তো অগ্রগতির কিছু লক্ষণ ফুটে উঠবে। অবক্ষয় কখনো সরল পথে চলে না। হয়তো বা আরো এক হাজার বছর পরে এম্পায়ারের পতন চূড়ান্ত হবে। তখন আমি বেঁচে থাকবো না। আমার কোনো বংশধর বা উত্তরাধিকার থাকবে না। দুএকজন মেয়ের সাথে সাময়িক কিছু সম্পর্ক হয়েছিল। কোনো সন্তান নেই, হবেও না কোনোদিন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনারও কোনো সন্তান নেই, সেলডন।

বাবা মা এবং দুটো ভাই আছে। কোনো সন্তান নেই। খানিকটা দুর্বলভাবে হাসলেন তিনি। একটা মেয়ের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটা মনে করত যে তার চেয়ে অঙ্ক শাস্ত্রকেই আমি বেশি পছন্দ করি।

তাই?

আমি সেরকম মনে করতাম না। মেয়েটা মনে করত আর তাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়।

তারপর আর কারো সাথে সম্পর্ক হয়নি?

না। সেই দুঃখ আমি আজো ভুলতে পারিনি।

বেশ আমরা তাহলে ঝাড়া হাত-পা, কোনো বন্ধন নেই। এই মুহূর্তে আমার একটা হাতিয়ার আছে; যার পুরো নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে।

কী সেই হাতিয়ার। জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। যদিও উত্তরটা তিনি জানেন।

আপনি। জবাব দিল হামিন।

জবাবটা প্রত্যাশিত ছিল বলেই সেলডন অবাক বা বিস্মিত হয়ে সময় নষ্ট করলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ভুল করছেন। আমি আপনার কোনো কাজেই আসব না।

কেন?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেলডন। একই কথা কতবার বলতে হবে? সাইকোহিস্টোরীর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এতে অনেক মৌলিক সমস্যা আছে। ফলাফল বের করার জন্য অসীম সময় আর মহাবিশ্ব পুরোটা পেলেও কোনো লাভ হবে না।

আপনি নিশ্চিত?

আমার দুর্ভাগ্য, হ্যাঁ।

গ্যালাক্টিক এম্পায়ার-এর পুরো ভবিষ্যত বের করার কোনো প্রয়োজন নেই। দরকার নেই প্রতিটা মানুষ বা প্রতিটি গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করার। শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর বের করলেই চলবে; গ্যালাকিক এম্পায়ার কী ভেঙ্গে যাচ্ছে, যদি তাই হয় তবে কখন? তারপরে মানবজাতির অবস্থা কী হবে? এই ভাঙ্গন বা ধ্বংস ঠেকানোর জন্য বা পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কি কিছু করা যায়? আমার তো মনে হয় এই প্রশ্নগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ।

মাথা নেড়ে বিষণ্ণ হাসলেন সেলডন। গণিত শাস্ত্রের ইতিহাসে দেখা যায় যে তার অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল খুব সহজ কিন্তু উত্তরগুলো ছিল সবচেয়ে জটিল বা আদৌ কোনো উত্তর ছিল না।

কোনো উপায় নেই? আমি জানি গ্যালাক্টিক এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারছি না। পুরো বিশ্লেষণ এবং তার উপসংহার আমার মনের ভেতরে রয়েছে অথচ কাউকে বোঝাতে পারছি না যে আমার কোনো ভুল হয়নি। কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না আমার কথা যার কারণে এই পতন ঠেকানো বা কোনো সাবধানতা অবলম্বন করা যাবে না। আপনি আমার এই কথাগুলো প্রমাণ করে দিতে পারবেন।

এই কাজটাও আমি আপনাকে করে দিতে পারব না। আমি আপনাকে এমন কোনো প্রমাণ বের করে দিতে পারব না কারণ আসলে কোনো প্রমাণ নেই। আমি আপনাকে কোনো প্রয়োগযোগ্য গাণিতিক সিস্টেম তৈরি করে দিতে পারব না তার কারণ সেটা অসম্ভব। আমি এমন দুটো জোড় সংখ্যা তৈরি করে দিতে পারব না যার যোগফল সবসময়ই বেজোড় সংখ্যা হবে, সেই সংখ্যাটা আপনার বা গ্যালাক্সির জন্য যত জরুরি প্রয়োজনই হোক না কেন আমি নিরূপায়।

আপনিও তাহলে অবক্ষয়ের শিকার। হাল ছেড়ে দেওয়াদের দলে।

আর কী করার আছে আমার?

চেষ্টা করেও দেখবেন না? আপনার কাছে যতই অর্থহীন মনে হোক, জীবনে এর চেয়ে ভালো কিছু কী করার আছে? আপনার কী আরো কোনো মূল্যবান উদ্দেশ্য আছে? আরো বৃহৎ এবং মহৎ কোনো উদ্দেশ্য?

দ্রুত কয়েকবার চোখ পিটপিট করলেন সেলডন। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রহ, বিলিয়ন বিলিয়ন সংস্কৃতি। কোয়াড্রিলিয়ন মানুষ। আর এই সবগুলোর সম্মিলিত যোগফল যা হয় তার চেয়েও অধিক সংখ্যক আন্তঃসম্পর্ক। আর আপনি বলছেন এগুলোকে একটা নিয়মের ভেতর বেঁধে ফেলতে।

না, আমি আপনাকে চেষ্টা করতে বলছি। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রহ, বিলিয়ন বিলিয়ন সংস্কৃতি, কোয়াড্রিলিয়ন মানুষের জন্য। সম্রাটের জন্য না। ডেমারজেলের জন্য না। মানব জাতির জন্য।

আমি ব্যর্থ হব।

কী আসে যায়। পরিস্থিতি তো পাল্টাবে না। চেষ্টা করে দেখবেন?

এবং নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠিক বলতে পারবেন না কেন, সেলডন নিজেকে বলতে শুনলেন, আমি চেষ্টা করব। আর এভাবেই নির্ধারিত হয়ে গেল তার জীবনের গতিপথ।

.

১৪.

পথ চলা শেষ হলো। ট্যাক্সি নিয়ে হামিন যেখানে থেমেছে সেই জায়গাটা আগে যেখানে খাওয়া-দাওয়া করেছিল তার চেয়েও ছোট (বিস্বাদ খাবারের কথা মনে হতেই মুখ কুঁচকালেন সেলডন)।

নির্ধারিত স্থানে ট্যাক্সি জমা দিয়ে ফিরে আসছে হামিন। হাঁটতে হাঁটতেই ক্রেডিট স্লিপ শার্টের ভিতরে ছোট পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। এখানে আপনার কোনো ভয় নেই। বলল সে। ঘরে বাইরে সবখানেই নিরাপদ। এটা স্ট্রিলিং সেক্টর।

স্ট্রিলিং?

 আমার ধারণা নামটা রাখা হয়েছে সেই ব্যক্তির নামে যে সর্বপ্রথম এখানে বসতি শুরু করে। বেশির ভাগ সেক্টরের নামই কোনো না কোনো ব্যক্তির নামে রাখা হয়, তার সবই বিদঘুঁটে আর কঠিন উচ্চারণ। অথচ যদি বলার চেষ্টা করেন যে এই নাম পাল্টে সুরভিত উদ্যান রাখা উচিত তখন আপনার সাথে কোমর বেঁধে মারামারি শুরু করবে।

স্বাভাবিক, নাক সিটকে বললেন সেলডন। গন্ধটাকে কোনোভাবেই সুরভিত বলা যাবে না।

ট্র্যান্টরের কোথাও সুগন্ধ নেই, তবে আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

এখানে আসতে পেরে আমি খুশি। জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে তা কিন্তু বলছি না, তবে ট্যাক্সিতে বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে। ট্র্যান্টরে ঘুরে বেড়ানো নিশ্চয় সবার কাছেই আতঙ্কের। হ্যালিকনে আমরা বাই এয়ারে যাতায়াত করি। এখানে দুহাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আসতে যে সময় লেগেছে, ওখানে সময় লাগত আরো কম।

আমাদের এখানেও জেট আছে।

তাহলে-

এয়ার-ট্যাক্সির ব্যবস্থা করা আমার জন্য সহজ, কারণ নিজেকে গোপন রাখতে পেরেছি। এয়ার জেট-এর বেলায় সেটা সম্ভব হতো না। সমস্যা দেখা দিত। আপনি এখানে নিরাপদ। তারপরেও আমি চেয়েছি ডেমারজেল যেন জানতে না পারে আপনি কোথায় আছেন। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। আসল গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের এক্সপ্রেস ওয়ে ধরতে হবে।

শব্দটা সেলডনের পরিচিত। মনোরেইল। ইলেকন্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড-এর সাহায্যে চালানো হয়, তাই না?

হ্যাঁ।

আমাদের হ্যালিকনে অবশ্য এই জিনিস নেই। সত্যি কথা বলতে কী প্রয়োজনও নেই। ট্র্যান্টরে প্রথম দিনেই একটা এক্সপ্রেসওয়েতে চড়েছিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আসার জন্য। চমৎকার অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমার মনে হয়েছে ভিড় এবং কোলাহল অত্যধিক বেশি।

আপনি কী হারিয়ে গিয়েছিলেন? আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করল হামিন।

না, নির্দেশনামূলক যে সাইনগুলো আছে সেগুলো যথেষ্ট সাহায্য করেছে। উঠা-নামায় একটু অসুবিধা হচ্ছিল, তবে আমি অনেক সাহায্য পেয়েছি। এখন বুঝতে পারছি যে আমার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে সবাই বুঝতে পেরেছিল আমি আউটওয়ার্ল্ডার। সবাই সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল; বোধহয় আমার হতচকিত ভাব এবং পদে পদে হোঁচট খাওয়া দেখে ওরা বেশ আনন্দ পাচ্ছিল।

বেশ, একবার যখন অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তাহলে আর অসুবিধা হবে না। যথেষ্ট ভদ্রভাবে বলল হামিন তবে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বাঁকা হাসি চোখ এড়ালো না। চলুন তাহলে।

অলস ভঙ্গিতে ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করল দুজন। আলো দেখে সবারই মনে হবে বেশ চমৎকার একটা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। হঠাৎ হঠাৎ আলোর পরিমাণ কমছে। বাড়ছে। যেন সূর্যটা মেঘে ঢেকে গিয়েই আবার বেরিয়ে আসছে। ঘটনাটা আসলেই সত্যি কী না দেখার জন্য নিজের অজান্তেই উপরে তাকালেন সেলডন। কিন্তু মাথার উপরে আকাশ শুধুই উজ্জ্বল।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হামিন বলল, আলোর এই কম বেশির ব্যবস্থা বোধহয় মানুষের মনের কথা চিন্তা করেই তৈরি করা হয়েছে। কখনো আপনি দেখবেন যে রাস্তায় চমৎকার দিনের আলো। আবার কখনো দেখবেন আজকের চেয়েও কম।

কিন্তু কখনো বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না।

না। শিলাবৃষ্টি বা বৃষ্টিসহ তুষারপাত কিছুই হয় না। না প্রচণ্ড গরম না প্রচণ্ড শীত। ট্র্যান্টরে এখনো অনেক কিছু টিকে আছে, সেলডন।

প্রচুর মানুষ রাস্তায়। অধিকাংশই বয়সে তরুণ। হামিন জন্মহার সম্বন্ধে যাই বলুক না কেন বয়স্কদের সাথে বেশ কিছু শিশুও দেখা যাচ্ছে। সবাইকে মনে হলো বেশ সুখী। নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। পোশাকআশাকে রঙের ব্যবহার ইম্পেরিয়াল সেক্টরের তুলনায় অনেক কম। হামিন তাকে যেগুলো এনে দিয়েছে চমৎকার মানিয়ে গেছে পরিবেশের সাথে। দুএকজন টুপি পড়েছে, বাকি সবার মাথা খালি। কৃতজ্ঞ চিত্তে সেলডন নিজের টুপি খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখলেন।

দুটো ফুটপাথ আলাদা করার জন্য মাঝখানে কোনো গভীর খাদ নেই। বোধহয়। হামিনের বক্তব্য অনুযায়ী তারা এখন রয়েছেন গ্রাউন্ড লেভেলে। কোনো যানবাহনও দেখা গেল না। কারণটা জিজ্ঞেস করলেন হামিনকে।

ইম্পেরিয়াল সেক্টরে প্রচুর যানবাহন চোখে পড়ে কারণ সম্রাটের অফিসাররা সেগুলো ব্যবহার করে। অন্যান্য জায়গায় ব্যক্তিগত যানবাহন দুর্লভ। যারা ব্যবহার করে তাদের জন্য রয়েছে আলাদা টানেল। ব্যক্তিগত যানবাহন থাকার কোনো। আবশ্যিকতা নেই যেহেতু এক্সপ্রেস ওয়ে আছে। স্বল্প দূরত্বের জন্য আছে চলমান করিডর। তারচেয়েও কম দূরত্বের জন্য আছে ফুটপাথ, সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের পা দুটোকে ব্যবহার করতে পারি।

হুশ হাশ আর ঘ্যাস ঘোস শব্দ শুনে সেদিকে তাকালেন সেলডন। সামান্য দূরেই দেখতে পেলেন অনেকগুলো এক্সপ্রেস ওয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটে চলেছে।

ঐ যে। আঙ্গুল তুলে দেখালেন তিনি।

দেখেছি। কিন্তু আমরা বোর্ডিং স্টেশনে যাব। ওখানে গাড়ির সংখ্যা বেশি এবং চড়াও সহজ হবে।

নিরাপদে একটি এক্সপ্রেসওয়ে কার-এ চড়ে বসার পর হামিনের দিকে ঘুরে সেলডন বললেন, আমাকে যা সবচেয়ে বেশি অবাক করে তা হলো এগুলো কত শান্ত নীরব। একেবারেই শব্দহীন। অথচ আমার ধারণা ইলেকক্টোম্যাগনেটিক প্রপালশন এর কারণে কান ঝালাপালা করার মতো শব্দ হওয়ার কথা। কান পেতে তিনি ম্যাগনেটিক ফিল্ড-এর অতি মৃদু শব্দ শোনার চেষ্টা করলেন।

হ্যাঁ, চমঙ্কার নেটওয়ার্ক, হামিন বলল। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েগুলো একসময় ছিল আরো চমৎকার। তখন তো আপনি দেখেননি। আমার যখন তরুণ বয়স তখন শব্দ হতো আরো কম। বয়স্কদের কাছে শুনেছি তারও আগে নাকি ফিসফিসানির মতো শব্দও ছিল না–যদিও আমার মনে হয়

এখন আগের মতো নেই কেন?

কারণ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। আমি আপনাকে অবক্ষয়ের কথা বলেছি।

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। মানুষ নিশ্চয়ই বসে বসে ভাবে না, আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। কাজেই এক্সপ্রেসওয়ে গোল্লায় যাক।

না, তা করে না। আসলে কিছু করার নেই। হয়ে গেছে। বগিগুলোর রঙ চটে গেছে। নষ্ট বগিগুলো পাল্টানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ম্যাগনেটগুলো রিপ্লেস করা হয়েছে, কিন্তু সবই করা হয় যেনতেন প্রকারে এবং অনেক দিন পরপর। আসলে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিটের যোগান দেওয়া যাচ্ছে না।

ক্রেডিট গেল কোথায় তাহলে?

অন্য খাতে। গত শতাব্দীগুলো ছিল যুদ্ধবিগ্রহে পরিপূর্ণ। এখন নেভী অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আকারে অনেক বড়ো এবং তার পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রচুর। ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বা বিদ্রোহ দেখা দিলেও ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় শতগুণ।

কিন্তু ক্লীয়ন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তো সেরকম অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা নেই। গত পঞ্চাশ বছর থেকেই আমরা বেশ শান্তিতে বসবাস করছি।

কিন্তু শান্তি আছে বলেই সৈনিকরা তাদের বেতন কমাতে দেবে না। অ্যাডমিরালরা চায় না পুরনো আমলের যুদ্ধযানের নেতৃত্ব দিতে বা তাদের পদবী। নিচে নেমে যাক। আর তা করতে গিয়ে সমাজের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড অবহেলিত হচ্ছে। এটাকেই আমি বলছি অবক্ষয়। নিশ্চয়ই আপনিও একমত হবেন? আপনার কী মনে হয় না এইধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্লেষণ সাইকোহিস্টোরীতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে?

অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সেলডন। তারপর বললেন, ভালো কথা, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়।

হাহহা, তাইতো এই সেক্টরের নামটা চেনা চেনা লাগছে। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আমি শুনেছি।

অবাক হইনি। ট্র্যান্টরে একশোর বেশি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে এবং স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটা।

আমি কী ওখানেই থাকব?

কিছুদিনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পবিত্র ধর্মশালার মতো। ওখানে কেউ আপনাকে ছুতে পারবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।

তা না হয় হলো, কিন্তু যারা আগে থেকেই আছে তারা কি আমাকে খুশী মনে মেনে নেবে?

নেবে না কেন? আজকাল ভালো একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। ওরা আপনাকে কাজে লাগাতে পারবে। আপনিও ওদেরকে কাজে লাগাতে পারবেন।

তার মানে, বলতে চাইছেন আমি যেন ওখান থেকেই সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপম্যান্টের কাজ শুরু করি।

আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন। গম্ভীর গলায় বলল হামিন।

আমি শুধু চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। বললেন সেলডন এবং মনে মনে। ভাবলেন এটা হচ্ছে বালি দিয়ে রশি তৈরি করার প্রতিশ্রুতির মতো।

.

১৫.

আলোচনা খুব বেশি হলো না। সেলডন বাইরে তাকিয়ে স্ট্রিলিং সেক্টরের ঘরবাড়ি দেখতে লাগলেন। ভবনগুলোর কিছু কিছু একেবারেই নিচু আবার কয়েকটা এত উঁচু যেন আকাশ ছুঁড়ে উঠে গেছে। দালানকোঠার মিছিলে হঠাৎ হঠাৎ ছেদ টেনেছে। প্রশস্ত সড়ক। এছাড়াও নিয়মিত দূরত্বে অনেকগুলো সরু গলি চোখে পড়ল।

সেলডন ধারণা করলেন ভবনগুলো যেমন উপরে উঠেছে তেমনি মাটির নিচেও নেমেছে। সম্ভবত উপরে যত উঁচুতে উঠেছে মাটির নিচে নেমেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ধারণাটা মাথায় আসার সাথে সাথে তিনি সেটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করলেন।

অনেকক্ষণ থেকেই দৃশ্যাবলী দেখছেন সেলডন। হঠাৎ সচেতন হলেন। কারণ বাইরে দিনের আলো কেমন যেন ম্লান হয়ে আসছে। ঝট করে হামিনের দিকে ঘুরলেন। মুখে কিছু না বললেও সেলডনের প্রশ্নটা ধরতে পারল হামিন।

বিকেল গড়িয়ে রাত নামছে।

সেলডনের ভুরু উঁচু হলো সেই সাথে ঠোঁটের কোণাগুলো বেঁকে গেল নিচের দিকে। চমৎকার। আমি কল্পনার চোখে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি পুরো গ্রহটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, আবার এখন থেকে ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর আলোকিত হচ্ছে।

হামিন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ছোট করে হাসল। কল্পনাটা সঠিক হয়নি, সেলডন। পুরো গ্রহে কখনোই একসাথে রাত নামে না–বা দিন হয় না। পুরো গ্রহেই আলোর হ্রাস বৃদ্ধির মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। আসল দিন রাতের মতো। গম্বুজের উপরে ঠিক যেভাবে রাত শেষে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটে আর দিন হয় ঠিক সেইরকম। যেন ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে দিনরাতের পার্থক্যের মিল থাকে।

মাথা নাড়লেন সেলডন। তাহলে নিজেদেরকে চারপাশে আবদ্ধ করে রেখে আসল প্রকৃতির নকল করার দরকারটা কী?।

আমার ধারণা মানুষ এইভাবেই চায়। ট্র্যান্টরিয়ানরা নিজেদের এইভাবে ঢেকে রাখতে চায় কিন্তু সেটা মনে রাখতে চায় না। আসলে ট্র্যান্টরিয়ান সাইকোলজির ব্যাপারে আপনার ধারণা কম।

লজ্জা পেলেন সেলডন। তিনি একজন হ্যাঁলিকনিয়ান। এবং হ্যালিকনের বাইরে শুধু ট্র্যান্টর কেন লক্ষ লক্ষ বাসযোগ্য গ্রহের কোনোটার ব্যাপারেই কিছু জানেন না। তিনি কীভাবে সাইকোহিস্টোরি বিজ্ঞানকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য করে তুলবেন।

মানুষের সংখ্যা যাইহোক না কেন–প্রয়োজনীয় সবটুকু জ্ঞানার্জন কী সম্ভব?

একটা ধাঁধার কথা মনে পড়ল সেলডনের। ধাঁধাটা এইরকম : তুমি কী অত্যন্ত ছোট এক টুকরা প্লাটিনাম তুলতে পারবে। তার জন্য যতজন মানুষ লাগে লাগুক। শর্ত একটাই তুলতে হবে খালি হাতে কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করা যাবে না।

উত্তর, হ্যাঁ, তোলা যাবে। স্বাভাবিক মধ্যাকর্ষণে এক কিউবিক মিটার প্লাটিনামের ওজন ২২, ৪২০ কিলোগ্রাম। ধরা যাক প্রত্যেক ব্যক্তি ১২০ কিলোগ্রাম ওজন তুলতে পারবে। তাহলে সর্বমোট ১৮৮ জন লোকের প্রয়োজন হবে। কিন্তু ১৮৮ জন লোক এক সাথে এক কিউবিক মিটারের এক টুকরা প্লাটিনাম ধরতে পারবে না। খুব বেশি হলে নয় জন সেটাকে হাত দিয়ে ধরতে পারবে। অথচ আগেই বলা হয়েছে কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করা যাবে না। খালি হাতে তুলতে হবে।

ঠিক একইভাবে সাইকোহিস্টোরির জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন সেটা অর্জনের জন্য যথেষ্ট লোকজন পাওয়া যাবে না। খুব অল্প কয়েকজনই সেটার কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে এবং প্রয়োগ করতে পারবে।

হামিনের কথায় ধ্যান ভাঙল তার। আপনি বোধহয় এখনই চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন, সেলডন।

আমি আসলে ভাবছিলাম নিজের অজ্ঞতার কথা।

অত্যন্ত উপযোগী একটা কাজ। সবারই আপনার পথ অনুসরণ করা উচিত। যাইহোক, এবার নামতে হবে।

চারপাশে তাকালেন সেলডন। কীভাবে বুঝলেন?

প্রথমবার এক্সপ্রেসওয়েতে চড়ার সময় আপনি যেভাবে বুঝেছিলেন। নির্দেশনা দেখে।

এবার সেলডনও নির্দেশনাটা দেখতে পেলেন। তাতে লেখা : স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়–তিন মিনিট।

পরের বোর্ডিং স্টেশনে নামব। দেখে শুনে পা ফেলবেন।

হামিনকে অনুসরণ করে গাড়ি থেকে নামলেন সেলডন। দেখলেন আকাশ গাঢ় রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ফুটপাথ, করিডর, দালানকোঠাগুলো আলোকিত। একটা হলুদাভ আভা ফুটে বেরুচ্ছে সেগুলো থেকে।

তার কাছে মনে হলো তিনি বোধহয় হ্যালিকনেই আছেন। চোখ বন্ধ করে এখানে নিয়ে আসার পর বাঁধন খুলে দিলে সত্যি সত্যি বিশ্বাসও করে ফেলতেন যে আসলেই হ্যালিকনের কোনো আধুনিক নগরীর জনবহুল অংশে দাঁড়িয়ে আছেন।

হামিন, স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে কতদিন থাকতে হবে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

বরাবরের মতোই স্বভাবসুলভ শান্ত গলায় জবাব দিল হামিন। বলা মুশকিল, সেলডন। হয়তো সারাজীবন।

কীহ!

হয়তো নয়। তবে সাইকোহিস্টোরির গবেষণাপত্রগুলো প্রচার করার মুহূর্ত থেকেই আপনার জীবনের লাগাম আপনার হাত থেকে ছুটে গেছে। সম্রাট এবং ডেমারজেল সাথে সাথেই আপনার মূল্য বুঝতে পারে। আমি পারি। নিঃসন্দেহে আরো অনেকেই পেরেছে। তো বুঝতেই পারছেন আপনি আর আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণকারী নন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *