১. খাদ্যসংগ্রহ পর্যায় : পুরাপ্রস্তর যুগ

খাদ্যসংগ্রহ পর্যায়: পুরাপ্রস্তর যুগ

১ শারীরিক অবশেষ

মানব নিদর্শনের এখন পর্যন্ত যা আদিমতম সাক্ষ্য তা পাওয়া গেছে মধ্যপ্রদেশে হোসংগাবাদ শহরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার (কি.মি.) উত্তর-পূর্বে, নর্মদা নদীর উত্তরকূলে হাথনোরা গ্রামের কাছে। ১৯৮২ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার একজন সদস্য এই আবিষ্কারটি করেন। ধূসর রঙের এই নিদর্শনটি বহুলাংশে প্রস্তরীভূত এবং এটি একটি মানুষের মাথার খুলির ডানদিকের সম্পূর্ণ অংশ। আনুমানিক ২৭ থেকে ৩২ বৎসর বয়স্কা কোনও নারীর অবশেষ বলে এটিকে মনে করা হয়েছে। মস্তিকের আয়তন ১১৫৫ থেকে ২৪২১ কিউবিক সেন্টিমিটারের ভেতর। প্রত্যক্ষভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন কোনও সমসাময়িক নিদর্শন পাওয়া যায়নি, তবে মাটির যে স্তরটি থেকে এটি পাওয়া গেছে নর্মদাতটের সেই স্তর থেকে মানবেতর প্রাণীর অশ্মীভূত নিদর্শন ও পুরাপ্রস্তর যুগের মানব-নির্মিত প্রস্তরায়ুধ পাওয়া গেছে। এর তারিখ এখনও প্রত্যক্ষভাবে নির্ণীত হয়নি, তবে ভূতাত্ত্বিক যুগাবলীর ‘প্লাইসটোসিন’ যুগের শেষ পর্যায়ের প্রথম দিকের, এই পর্যন্ত বলা যায়। আমরা যে ভূতাত্ত্বিক যুগে বাস করি তাকে ‘সাম্প্রতিক’ বা ‘রিসেন্ট’ যুগ বলা হয়। এর সূত্রপাত বর্তমান থেকে আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে। এর ঠিক আগে ‘প্লাইসটোসিন যুগ’ যা প্রায় ২ মিলিয়ন বা ২০ লক্ষ বছর আগে শুরু হয়েছিল। মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের মাপকাঠিতে এই নিদর্শনটিকে ফেলা হয়েছে বর্তমান মানবের প্রাচীন স্তরে—‘আর্কেয়িক হোমোসাপিয়েনস’ পর্যায়ে। সেদিক থেকে এটি খুব প্রাচীন নিদর্শন নয়। তবে এশিয়া ভূখণ্ডের অন্যত্র—যথা চীন ও ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে পাওয়া প্রস্তরীভূত মানব-নিদর্শনের তুলনায় আমাদের হাথনোরা নিদর্শনটি কতটা প্রাচীন বা আদৌ প্রাচীন নয় কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। চীন ও জাভার প্রাচীনতম মানব-অবশেষের বয়স, যথাক্রমে, ৪২০,০০০ ও ৭০০,০০০ বছর।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাভার ভৌগোলিক অবস্থানের কথা আমরা যখন ভাবি তখন দক্ষিণ এশিয়া অর্থাৎ মূলত ভারতবর্ষে সমপরিমাণ প্রাচীন মানব-অবশেষ না পাওয়ার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষে অনুসন্ধানের স্বল্পতাই এর কারণ বলে মনে হয়। অন্যদিকে যখন আমরা শারীরিক নিদর্শনের বাইরে সাংস্কৃতিক নিদর্শন অর্থাৎ পাথরের অস্ত্রশস্ত্রগুলির তারিখ দেখি, তখন বুঝতে পারি যে ভারতবর্যে মানুষের আবির্ভাবকাল প্রাচীন যুগে; অথবা, প্রাচীন না হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে হাথনোরা থেকে পাওয়া শারীরিক চিহ্নটিই এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তরযুগীয় একমাত্র শারীরিক চিহ্ন। এ থেকেই এ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের স্বল্পতা বোঝা যায়। খুব সম্প্রতি হাথনোরা থেকেই মানুষের ‘কলার বোন’ বা কণ্ঠার হাড় পাওয়ার খবর আছে।

২ ভারতবর্ষে প্রস্তর-নির্মিত আয়ুধের আদি তারিখ

পশ্চিমে সিন্ধুনদ ও পূর্বে পাকিস্তানি পঞ্জাবের ‘সলট রেঞ্জ’ পাহাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে পটওয়ার অধিত্যকা বলা হয়। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ এই ভৌগোলিক অঞ্চলে অবস্থিত। ‘সোহান’ বা ‘সোয়ান’ নামে একটি নদী এই অঞ্চলে সিন্ধুনদের উপনদী। ১৯৮০-র দশক থেকে এই সোয়ান উপত্যকায় অনুসন্ধান চালানো হয় এবং এই নতুন অনুসন্ধানে, এখানে ১৯৩০-এর দশকে যে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল তার মূল সিদ্ধান্তগুলি অগ্রহণীয় বলে প্রমাণ হয়েছে। ১৯৮০-র দশকের মূল আবিষ্কারটি হয় রাওয়ালপিণ্ডি শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ‘রিওয়াত’ অঞ্চলে। এখানে এমন একটি স্তরে প্রস্তরায়ুধ পাওয়া গেছে যার তারিখ নির্ণীত হয়েছে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে। যেখানে সময়কাল এত প্রাচীন ও যেখানে প্রস্তরায়ুধের সংখ্যা এখনও সীমিত সেখানে আবিষ্কার নিয়ে কিছু বিতণ্ডা স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরে ধীরে এর প্রামাণ্যতা মেনে নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। সত্যি বলতে, এই আবিষ্কার এই সময় অস্বীকার করার কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। এ ছাড়া, প্রায় এই অঞ্চলেই, ঝিলাম নদীর পূর্বদিকে পাব্বি পাহাড় অঞ্চলে ১.৯-২ মিলিয়ন বছর আগে থেকে ০.৯-১.২ মিলিয়ন বছর আগের স্তরে প্রস্তরায়ুধ পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। রিওয়াতের আরও কাছে, দিনা ও জালালপুর অঞ্চলে প্রাপ্ত হস্তকুঠার নামক প্রস্তরায়ুধের কাল ৫ থেকে ৭ লক্ষ বছর আগে বলে নির্ণীত হয়েছে।

অন্যদিকে ১৯৭৫ থেকে কিছু ভূতাত্ত্বিক দাবি করছেন যে হিমাচল প্রদেশে শিবালিক পাহাড় অঞ্চলে ‘নিম্ন প্লাইসটোসিন’ অর্থাৎ প্লাইসটোসিন যুগের গোড়ার দিকের প্রস্তরায়ুধ পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে হিমাচল প্রদেশের সিরমুর জেলার নাহান শহরের কাছে সাকেতি ‘শিবালিক ফসিল পার্ক’ অঞ্চলে মারকন্‌ডা নদী উপত্যকায় প্রাপ্ত বহু প্রস্তরায়ুধের ভূতাত্ত্বিক স্তর সংস্থান বিশ্লেষণ করে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার দুজন সদস্য জোরালোভাবে এই দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৮৮-তে লাখে সিন্ধুনদ উপত্যকায় প্রাপ্ত পুরাপ্রস্তর যুগের কিছু আয়ুধও ‘নিম্ন প্লাইসটোসিন’ পর্যায়ের বলে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা থেকে নির্ণীত হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তর যুগের সূত্রপাত ২ মিলিয়ন বছর বা তার কাছাকাছি সময় হওয়ার সম্ভাবনা এবং দাবি দুই-ই জোরদার হয়ে উঠেছে। এই সব আবিষ্কার থেকে বোঝা যায় যে, দক্ষিণ এশীয় ভূখণ্ডের কোন অঞ্চল মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রসঙ্গে আর একটি আবিষ্কারের কথা উল্লেখযোগ্য। মহারাষ্ট্রের পুনের উত্তর-পূর্বে কুক্‌ডি নামে একটি ছোট নদী আছে। এটি ভীমা নদীর শাখাপ্রশাখার অংশ। এই উপত্যকায় একটি স্তরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের চিহ্ন হিসেবে ছাই পাওয়া যায়। যে স্তরে এই ছাই পাওয়া যায় সেই স্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, পাথরের টুকরো মেশানো, একটি স্তর থেকে পুরাপ্রস্তর যুগের আয়ুধও পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হচ্ছে যে এই ধরনের ছাই তারিখ নির্ণয়ের পক্ষে খুব উপযোগী। প্রথমে একটি প্রক্রিয়ায় যে বয়স পাওয়া যায় তা ১.৩ বা ১.৪ মিলিয়ন বছর। অবশ্যই সংশ্লিষ্ট স্তরের প্রস্তরায়ুধেরও এই বয়স হওয়া উচিত। তবে ছাইয়ের বয়স নিয়েই গোলযোগ দেখা যাচ্ছে। একই পদ্ধতিতে দুবার তারিখ নিরূপণ করে বয়স পাওয়া যাচ্ছে একবার ৬,৭০,০০০ বছর ও আর একবার ৫,৩৮,০০০ বছর। ব্যাপারটা এখানেই মেটেনি। এখন মনে করা হচ্ছে যে, ছাইটির সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের টোবা নামক এক আগ্নেয়গিরির ৭৪,০০০/৭৫,০০০ বছর আগে হওয়া অগ্ন্যুৎপাতের ছাইয়ের নিদর্শন ব্যাপকভাবে মিলছে। অতএব, মহারাষ্ট্রের এই ছাইও ৭৪,০০০/৭৫,০০০ বছরের কাছাকাছি হওয়া সম্ভব। যদিও প্রাচীনত্ব বিচারে মহারাষ্ট্রের এই সাক্ষ্য সংশয়-ঊর্ধ্বে নয়; বরং মনে করা যেতে পারে যে, ভূতাত্ত্বিক বিচারে অর্বাচীন কালের, তবু এই ধরনের সাক্ষ্য আমাদের সচেতন করে যে, ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তর যুগের সূত্রপাতের ইতিহাস আমরা এখনও কত কম জানি।

৩ পুরাপ্রস্তর যুগের মূল সাক্ষ্য

৩.১ বিস্তৃতি

আমাদের উপমহাদেশের সমস্ত উত্তর ও পূর্ব অঞ্চল জুড়ে একটি পর্বত-ভূমির বলয় আছে। উত্তরভাগে, পশ্চিমে বালুচিস্তান থেকে পূর্বে সদিয়া সীমান্ত ও পূর্বভাগে, পাতকই পর্বতমালা থেকে মিজোরাম ও পরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলবর্তী আরাকান য়োমা নামে খ্যাত পর্বতশ্রেণী। এই অতি বিস্তৃত পার্বত্য ভূভাগে একেবারে উচ্চভাগ বাদ দিয়ে অন্যত্র প্রক্ষিপ্তভাবে পুরাপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। বালুচিস্তানে এখনও কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এই অঞ্চলের পাহাড় যেখানে নীচে নেমে এসেছে—অর্থাৎ সিন্ধুপ্রদেশের পশ্চিমভাগে—সেখানে এই যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। সিন্ধুপ্রদেশে ‘মাইলস্টোন ১০১’ ও ‘সুক্কুর-রোর্‌হি’ অঞ্চল দুটি পুরাপ্রস্তর যুগের কেন্দ্র। ‘উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত’ প্রদেশে পেশোয়ারের উত্তর-পূর্বে কিছু পাহাড়ি গুহা আছে। ‘সাংঘাও’ নামে এরকম একটি গুহাতে উৎখনন করে পুরাপ্রস্তর যুগের মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর পূর্ব দিকে পশ্চিম পঞ্জাবের ‘পটওয়ার অধিত্যকাতে’ গুরুত্বপূর্ণ প্রাগৈতিহাসিক সাক্ষ্য আবিষ্কারের কথা আগেই বলা হয়েছে। এর অদূরবর্তী অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরে এই ধরনের সাক্ষ্য আবিষ্কৃত হয়েছে ও লাডাখ অঞ্চল থেকেও পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শনের কথা জানা গেছে। পূর্ব পঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশের পার্বত্য নদী উপত্যকায় এই সাক্ষ্য বিদ্যমান। আরও পূর্বে সাক্ষ্য আসে নেপালের অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলের ‘দুন’ উপত্যকাবলী থেকে। আরও পূর্বে সাক্ষ্য এখনও অস্পষ্ট। অরুণাচল প্রদেশ থেকে এই ধরনের নিদর্শনপ্রাপ্তির বিবরণ আছে, কিন্তু তা কতটা গ্রহণযোগ্য জোর করে বলা যায় না। আমাদের সন্নিকটবর্তী মেঘালয়ের গারো পাহাড় অঞ্চলে প্রাপ্ত সাক্ষ্য এবং মণিপুরে প্রাপ্ত নিদর্শন সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তবে এই পার্বত্যভূমির অংশ—ত্রিপুরা পাহাড় ও বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলের লালমাই পাহাড়ে প্রাপ্ত নিদর্শন তর্কাতীত। পশ্চিম ত্রিপুরা ও লালমাই অঞ্চলে পাওয়া পুরাপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার ফসিল হয়ে যাওয়া বৃক্ষাবশেষ বা কাঠ দিয়ে বানানো এবং বোধহয় পুরাপ্রস্তর যুগের উচ্চ পর্যায়ের। এই প্রস্তরীভূত কাঠ দিয়ে বানানো অবিকল একই রকমের সাক্ষ্য পুরাতন বর্মা বা আধুনিক ‘মায়ানমার’-এর মান্দালয়ের পার্শ্ববর্তী ইরাবতী উপত্যকা থেকেও পাওয়া গেছে। সেই কারণে অনুমান করা হয় যে, আরাকান রোমা পর্বতভূমির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই ধরনের সাক্ষ্য আরও পাওয়া যাবে।

তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, উত্তরের ও পূর্বের পর্বতভূমি থেকে পাওয়া পুরাপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য যে সর্বত্র সমানভাবে ছড়ানো তা নয়। হিমাচল প্রদেশের পূর্বদিকে নেপাল ও তারও পূর্বদিকে পশ্চিম ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের লালমাই অঞ্চল থেকেই শুধু অবিসংবাদী সাক্ষ্য এসেছে। এর কোনও বিশেষ কারণ আছে কিনা অথবা এ শুধুই পর্যাপ্ত অনুসন্ধানের অভাবের জন্য—এখনও ঠিক করে বলা সম্ভব নয়।

উত্তরের ও পুর্বের পর্বতময় অঞ্চলের নীচে ছড়ানো সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের পাললিকভূমি। এই সুবিস্তৃত অঞ্চলে কোনও পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও কম, কারণ এই ভূমি গড়ে উঠেছে পাললিক উপাদানে। এখানে পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন যদি কিছু থেকেও থাকে, তা পাললিকভূমির বহু নীচে চাপা পড়ে গেছে, কাজেই তার আবিষ্কারের সম্ভাবনা খুব কম। সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের পাললিক ভূমির নীচে বিস্তৃত একটি উচ্চতর ও প্রাচীনতর ভূমির অধিষ্ঠান। যাকে ভূতাত্ত্বিক ভাবে ভারতীয় ‘অন্তরীপ’ (‘পেনিনসুলা’) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অন্তরীপ অঞ্চল প্রস্তরময় ও ভূতাত্ত্বিক ভাবে অতি প্রাচীন। অন্তরীপ অঞ্চলের বদ্বীপ অঞ্চলগুলি যদি আমরা বাদ দিই—যেমন মহানদী-বৈতরণী বদ্বীপ, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরীর উপকূলভূমি ইত্যাদি—তবে অন্তরীপের সর্বত্রই— এমনকী কেরলেও পুরাপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদাহরণ দিয়ে আমরা অন্তরীপ অঞ্চলের সাক্ষ্যের কথা শুরু করতে পারি। পশ্চিমবঙ্গেরও তিনটি মূল ভূপ্রাকৃতিক বিভাগ—উত্তরের পর্বতময় ও পর্বতসংলগ্ন ভূমি, তার দক্ষিণে গঙ্গা-ভাগীরথীর পাললিক ভুমি ও এই ভূমির পশ্চিমে, উপকূল অঞ্চল বাদ দিলে, উচ্চতর ও প্রাচীন অংশ, যা ভারতীয় অন্তরীপের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গে উত্তরের পর্বতময় ও পর্বত-সংলগ্ন ভূমিতে পুরাপ্রস্তর যুগের কোনও সাক্ষ্য আবিষ্কৃত হয়নি। সাক্ষ্য পাওয়া যেতে পারে না, না অনুসন্ধানের স্বল্পতার জন্য পাওয়া যায়নি, তা আদৌ পরিষ্কার নয়। গঙ্গা-ভাগীরথীর পাললিক ভূমিতে সাক্ষ্য আবিষ্কারের কোনও কথা আসে না—এর একটি বড় কারণ হচ্ছে যে এই পাললিক ভূমিতে কোনও পাথর বা পাথর জাতীয় কিছুর সংস্থান নেই। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরের কিছু জেলায় লাল ও কাঁকুরে মাটি লক্ষ করা যায়। এই মাটি ‘প্লাইসটোসিন’ যুগের এবং সেদিক থেকে এই অঞ্চলে পুরাপ্রস্তর যুগের বসতি থাকাটা যুক্তিগ্রাহ্য, কিন্তু এই পুরো অঞ্চলে হাতিয়ার বানানোর মতো কোনও কিছু উপাদান নেই। যদি আয়ুধ তৈরির উপাদানই না থাকে তবে পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষ এই অঞ্চলে আসবে কেন? বাংলাদেশের মধুপুর গড় অঞ্চল—যা ঢাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে এবং সাভার, শহিদমিনার, ভাওয়ালের গড় ইত্যাদি অঞ্চলে যা পরিষ্কার দেখা যায়—সেই সম্পর্কেও একই কথা খাটে।

১৯৬০-এর দশকে ডায়মন্ডহারবারের কাছে দেউলপোতা অঞ্চলে পাললিক ভূমি থেকে কিছু পুরাপ্রস্তর যুগের মধ্য বা উচ্চ পর্যায়ের পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই হাতিয়ারগুলির সঙ্গে রাজমহল পাহাড়ে আবিষ্কৃত হাতিয়ারের সাদৃশ্য অতি স্পষ্ট—একই পাথরে একই ধরনের হাতিয়ার বানানো। রাজমহল পাহাড়ের নীচ দিয়ে প্রবাহিত গলায় এই হাতিয়ারগুলি কোনও ভাবে—সম্ভবত জলধারাতে সন্নিবিষ্ট হয় ও পরে নদীবাহিত হয়ে বদ্বীপ অঞ্চলে পলির অংশ হয়ে জমা পড়ে। পরে, এই পলির অংশ হিসেবেই এদের আবিষ্কার করা হয়।

পাললিকভূমির পশ্চিম দিকে ভারতীয় অন্তরীপ অঞ্চলের সংস্থান পশ্চিমবঙ্গে খুবই স্পষ্ট। বর্ধমান শহরের প্রান্তে দামোদরের পুল পেরিয়ে আমরা যদি আরামবাগের দিকে সোজা আসি তবে ডানদিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে উচ্চ, অপেক্ষাকৃত লাল বা গৈরিক ছোট প্রস্তর ও কঙ্কর মিশ্রিত ভূমি দেখা যায়। গড় মান্দারনের পশ্চিমে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত ‘জয়পুর’ অরণ্য ও বর্ধমান-আরামবাগের মাঝামাঝি কুশদ্বীপ অঞ্চল—এই পুরো উচ্চ অঞ্চল, বাঁকুড়া জেলার ভেতর ও পশ্চিমে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ হয়ে, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ও বিহারের সিংভূমে মিশেছে। বর্ধমান জেলার পশ্চিমাংশেও এই উচ্চভূমি পানাগড়, দুর্গাপুর থেকে শুরু করে বিহার সীমান্ত পর্যন্ত অতি স্পষ্ট। কাঁকসার জঙ্গল ও অজয় নদী পেরিয়ে এই ভুমি বীরভূমে ঢুকে ইলামবাজার-শান্তিনিকেতন-মুলুকের ডাঙা হয়ে নলহাটি পেরিয়ে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত গেছে। সমস্ত অঞ্চলটাতে—অর্থাৎ বীরভূম থেকে মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ পর্যন্ত পুরাপ্রস্তর যুগের বিভিন্ন পর্যায়ের চিহ্ন ছড়ানো। বীরভূমের তারাপীঠের অদূরে একটি নদী উপত্যকা থেকে, সিউড়ির কাছে জীবধরপুরের কাঁকুরে ডাঙা, বর্ধমান-বীরভূম সীমান্তে ‘এগারো মাইল’, বনকাঠি-অযযাধ্যার কঙ্করমিশ্রিত ল্যাটেরাইট ভূমি, বাঁকুড়ার বিহারীনাথ, শুশুনিয়া, খাতরা-মুকুটমণিপুরের কংসাবতী অঞ্চল, মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে নাকবিধি, পাতিনার বনভূমি, শিলদা-বেলপাহাড়ির তারাফেণী-ভৈরববাঁকি উপত্যকা, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় এবং অন্যান্য বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিখ্যাত পুরাপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নস্থল।

বিহার ছোটনাগপুর অধিত্যকা জুড়ে সর্বত্রই এই ধরনের নিদর্শন বিস্তৃত। সিংভূমে, পশ্চিমবঙ্গের ‘লোধাশূলী’ পেরিয়ে, বহরাগোড়া হয়ে ঘাটশিলা, জামসেদপুর, চাণ্ডিল হয়ে যে রাস্তাটি বেরিয়েছে সেই রাস্তার দুপাশে, বিশেষ করে বহরাগোড়া ও ঘাটশিলার মাঝের কাঁকুরে ডাঙা জমিতে, পুরাপ্রস্তর যুগের বিভিন্ন পর্যায়ের বহু নিদর্শন বিদ্যমান। অন্যদিকে চক্রধরপুর পেরিয়ে রাঁচির রাস্তায় উচ্চভূমিতে টেবো, হেসাড়ি অঞ্চলে এই নিদর্শন আছে। চক্রধরপুর-চাইবাসার মাঝের অঞ্চলটিতে, চাইবাসার দক্ষিণে হাট গামারিয়া হয়ে নোয়ামুন্ডি পর্যন্ত বিস্তৃত ‘কোলহান’ ভূমিতে এবং সারেঙ্গার জঙ্গলেও নিদর্শন ছড়ানো। রাঁচি অধিত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকী রাঁচি শহরের মোরাবাদী পাহাড় থেকেও পুরাপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, যেমন পালামৌ-এর পাহাড় ঘেরা বহু জায়গা থেকে পাওয়া গেছে। পালামৌ-এর লেসলিগঞ্জের কাছে পুরাপ্রস্তর যুগের উচ্চ পর্যায়ের নিদর্শন প্রচুর। এই সব অঞ্চলে সর্বত্র অনুসন্ধান চালানো হয়নি। হাজারিবাগ-গিরিডিতেও যথেষ্ট এই ধরনের নিদর্শন আছে। হাজারিবাগে রাজরাপ্‌পার ছিন্নমস্তার মন্দিরের কাছে গোলা-রামগড় অঞ্চলে, বরকাগাও অঞ্চলে ও হাজারিবাগ-বার্‌হির মাঝামাঝি এই নিদর্শন সহজেই পাওয়া যায়। সাঁওতাল পরগনার রাজমহল পাহাড়ের ভেতর ‘দামিন’ অঞ্চলে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের চিহ্ন বহু বিস্তৃত। এত বিস্তৃতভাবে এই যুগের অবশেষ পূর্ব ভারতের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। রামপুরহাট থেকে শিকারিপাড়ার দিকে যেতে পথে একসময় রাজমহল পাহাড়শ্রেণী সমতল থেকে দেওয়ালের মতো খাড়া উঠে গেছে দেখা যায়; তার কিছু পরে ডানদিকে কেঁদপাহাড়িতে একটি অনুচ্চ পাথর ছড়ানো জায়গায় এই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র আছে।

ছোটনাগপুর অধিত্যকার বাইরে, বিহারের অন্যত্রও নিদর্শন আছে। মুঙ্গেরের কাছে খড়গপুর পাহাড়ের ভীমবাঁধ-পৈসরা অঞ্চলে অবশেষ পাওয়া গেছে। রাজগির পাহাড়ের দক্ষিণে জেঠিয়ান অঞ্চলে, নওয়াদা অধিত্যকাতে, গয়ার পাহাড়ে কিছু আবিষ্কার হয়েছে এবং আরও হতে পারে। বিহারের একেবারে উত্তরে বেতিয়া অঞ্চলে কিছু পাহাড় আছে—নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে আসা ‘শিবালিক’ পর্বতমালার অংশ। নিদর্শন প্রাপ্তির দিক থেকে এই অঞ্চলটা এখনও দেখা হয়নি।

উত্তরপ্রদেশে হিমালয় বা তন্নিম্ন অঞ্চলে এই পর্যায়ের কিছু পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে তা ‘অন্তরীপ’ ভাগ থেকে। বারাণসীর কাছে মির্জাপুর জেলার পাহাড়ি অংশে, চুনার-এর কাছে শোনভদ্র অঞ্চলে, বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে এলাহাবাদের কাছাকাছি মেজার কাছে বেলান নদী উপত্যকায় নিদর্শন বহু বিস্তৃত। দিল্লি ও হরিয়ানার আরাবল্লী পাহাড় অঞ্চলে, হরিয়ানায় যমুনানগর পেরিয়ে শিবালিক শ্রেণীর মধ্যে নিদর্শন আছে। পূর্ব পঞ্জাব এবং হিমাচলে শিবালিক শ্রেণীর ভেতর আবিষ্কারের দিকে পূর্বেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

রাজস্থানের মাঝামাঝি উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আড়াআড়ি ভাবে আরাবল্লী পর্বত বিস্তৃত। এর পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশেই পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন আছে। চিতোর দুর্গের নীচ দিয়ে প্রবাহিত গাম্ভীরি নদীর উপত্যকায়, যোধপুরের কাছে লুনি নদীর অববাহিকায়, পুস্করের কাছে বালিয়াড়ি অঞ্চলে, মরু অঞ্চলে, নাগৌর অঞ্চলে, জয়াল, দিদওয়ানা ইত্যাদি অঞ্চলে, আরাবল্লী পাহাড়ের ভেতর ও সংলগ্ন বহু অঞ্চলে এই নিদর্শন পাওয়া যায়। গুজরাটের তিনটি মূল অঞ্চলেই—যথা, সবরমতী, নর্মদা-তাপ্তি অববাহিকার মূল ভূভাগ, কচ্ছ অন্তরীপ ও কাথিয়াবাড়ে, সৌরাষ্ট্র অন্তরীপে—পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন বিস্তৃত রয়েছে। মধ্যপ্রদেশে প্রায় সর্বত্র— বিশেষ করে নর্মদা ও শোন উপত্যকাতে—এই নিদর্শন পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাংশে মহানদী অঞ্চল থেকেও নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের সর্বত্র— গোদাবরী উপত্যকা, উপকূলবর্তী কোন (গোয়া নিয়ে) ও পূর্ব বিদর্ভ বা বেরারে (বানগঙ্গা উপত্যকা) নিদর্শন ছড়ানো। এমনকী পুনে ও মুম্বাই শহর থেকেও এককালে এই নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। মহীশূর, অন্ধ্র ও তামিলনাডুতেও নিদর্শন ছড়ানো প্রায় সর্বত্র। এই সব রাজ্যের বিভিন্ন নদী উপত্যকাতে ও পাহাড়ি অঞ্চলে (যেমন অন্ধ্রে ‘পূর্বঘাট’ পর্বতমালার সন্নিহিত প্রদেশে) যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেছে। অন্ধ্রে কুর্নুল অঞ্চলে কিছু গুহাতে আবিষ্কৃত উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ। চেন্নাই-এর কাছে অত্তির্‌মপক্‌কম নালা ধরে একসময় অগণিত পুরাপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। উড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাইরে সর্বত্রই এই যুগের নিদর্শন আছে। ময়ূরভঞ্জে বারিপদার কাছে কুলিয়ানা অঞ্চলে, কেনঝাড়, সুন্দরগড়, সম্বলপুর, ফুলবনি, সর্বত্র এই নিদর্শন ছড়ানো।

আমাদের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে একটি কথা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন আমাদের খুব অচেনা ব্যাপার নয়। একটু চোখ তুলে তাকালেই পাললিক ভূমির বাইরে এই নিদর্শন সর্বত্র কমবেশি পাওয়া যায়, বিশেষ করে ‘অন্তরীপ’ ভাগে। এই নিদর্শনের মধ্যে মানুষের শারীরিক অবশেষ যা পাওয়া যায় সেই মানুষেরা নিশ্চয় সবাই নির্বংশ হয়ে লোপ পেয়ে যাননি। বর্তমান ভারতবর্ষে আমাদের মধ্যেই হয়তো অল্পবিস্তর পরিমাণ তাঁদের রক্ত বইছে। যখন তাঁদের শারীরক অবশেষ বেশি সংখ্যায় পাওয়া যাবে এবং যখন সেই অবশেষ যথোপযুক্তভাবে বিশ্লেষিত হবে তখন প্রত্যক্ষভাবে বোঝা যাবে যে তাঁদের কতটা রক্ত আমাদের ভেতর এখনও আছে। এটা দুঃখের কথা যে, এঁদের কথা ইতিহাসের পাতায় প্রায় আসেইনি, আর যতটুকু এসেছে তা খুব উল্লেখযোগ্য নয়।

৩.২ প্রাকৃতিক পরিবেশ

প্রাচীন কালের প্রাকৃতিক পরিবেশ অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, উষ্ণতা ও আর্দ্রতার তারতম্য, সমগ্র উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া যায়। যেমন, প্রাচীন উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ নিয়ে ধারণা সম্ভব ‘প্রাচীন উদ্ভিদ তত্ত্ব’ (প্যালিওবোটানি) ও ‘প্রাচীন জীবতত্ত্ব’ (প্যালিওনটলজি) নামক দুই বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। শুধু আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যও তাদের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর রেখে যায় বিভিন্ন জৈবিক ও অজৈবিক বস্তুতে। অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের চিহ্ন—কয়েক শতক থেকে কয়েক হাজার বছর—থাকে গাছে, জমে থাকা প্রাচীন তুষারের স্তরের ধারাবাহিকতায়, হ্রদের নীচের মৃত্তিকায় এবং উপকূল ও সামুদ্রিক স্তরে। বহু লক্ষ বছরের নিদর্শন পেতে গেলে আশ্রয় নিতে হয় গভীর সমুদ্রস্তরে এবং শিলাস্তরে। এখানে শুধু আমাদের একটু মনে রাখা দরকার যে প্রাচীন আবহাওয়া বিশ্লেষণের পেছনে একটি বড় বৈজ্ঞানিক জগৎ আছে। আরও দুটি জিনিস মনে রাখা দরকার এই প্রসঙ্গে। প্রথমত, ভারতবর্ষে প্রাচীন প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে গবেষণা এখনও বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। দ্বিতীয়ত, পুরাপ্রস্তর যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এই গবেষণা সংঘবদ্ধ বা ব্যাপ্ত কোনওটাই নয়। যে সীমিত কিছু কাজ হয়েছে আমরা তা নিয়েই আলোচনা করব।

কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যে চিত্রটি দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ।

১. ৩৮ লক্ষ বছর থেকে শুরু করে আরও আগে—উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ (ওয়ার্ম টেম্পারেট)।

২. ৩৭ থেকে ২৬ লক্ষ বছর পর্যন্ত—উপ-উষ্ণ (সাব ট্রপিকাল) থেকে শীতল নাতিশীতোষ্ণ (কুল টেম্পারেট) পর্যায়ে উত্তরণ।

৩. ৬ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ বছর—৩টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ শীতল পর্যায়।

৪. গত ২ লক্ষ বছর—‘লোয়েস’ (loess) জমা স্তর। এই স্তরে ১০টি ‘ফসিল সয়েল’ বা প্রাচীন মৃত্তিকাস্তর দেখা যায়, যার ভেতর তিনটি স্তর সূচনা করে যে সেই তিনটি সময় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ/আর্দ্র ছিল।

৫. গত ১৭ হাজার বছর—কিছু উদ্ভিদ রেণুর পরম্পরা (pollen profile) থেকে মনে করা হয়েছে যে, ১৭ হাজার বছর আগে কাশ্মীর উপত্যকায় আবহাওয়া উষ্ণ অথবা বর্তমানের তুলনায় উষ্ণতর ছিল। ১০ হাজার বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত ‘শীতল নাতিশীতোষ্ণ’ থেকে ‘উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ’ ও তা থেকে আগের ‘শীতল নাতিশীতোষ্ণ’ পর্যায় দেখা যাচ্ছে।

প্রায় ১৮,০০০ বছর আগে কাশ্মীরে উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া যায়। মনে করা যেতে পারে যে, এই পাওয়ার সঙ্গে প্রায় সেই সময়ে হওয়া উষ্ণতর আবহাওয়ার যোগ থাকতে পারে। অর্থাৎ, আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার জন্যই তখন মানুষ এই উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, কাশ্মীরে নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগেরও নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে, আবহাওয়া নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা তা নিয়ে নীরব।

কাশ্মীর উপত্যকা দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পীরপাঞ্জাল পর্বত দিয়ে বিচ্ছিন্ন। প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে এই পর্বতমালা সৃষ্টি হয় এবং তারপর, আগে হিমালয় থেকে যে জলস্রোত এদিক দিয়ে নীচে নামত, তা আটকে একটি বিরাট হ্রদের সৃষ্টি করে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ার পর এখানে জমা হওয়া পলি দৃষ্টিগোচর হয় এবং এই পলিস্তরের নাম কাশ্মীরের স্থানীয় ভাষায় ‘কারেওয়া’ (Karewa)। ৩০ লক্ষ বছর আগে পীরপাঞ্জাল আরও উঁচু হয়ে ওঠে ও ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু আর উপত্যকায় ঢুকতে পারে না। তখন থেকে এই উপত্যকা উপ-উষ্ণ থেকে নাতিশীতোষ্ণ হয়ে পড়ে এবং ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার বৃত্তে চলে যায় —অর্থাৎ শীতেই মূল বৃষ্টি হয়। আনুমানিক ২ লক্ষ বছর আগে হ্রদটির অনেকটাই শুকিয়ে যায় এবং বাকি হিমালয়ের দিকের ভাগটুকু থাকে। হিমালয় কাশ্মীরের ‘কারেওয়া’র উত্তর-উত্তরপূর্ব জুড়ে। পলি উপত্যকা হিমালয়ের দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিম ভাগে সূপ্রকাশিত হয় এবং তার ওপর বায়ু-সঞ্চালিত ‘লোয়েস’ জমা হতে থাকে। আবার, আনুমানিক ৮৫ হাজার বছর আগে ঝিলাম নদী হ্রদ থেকে বেরিয়ে আসে ও ফলে সুপ্রাচীন হ্রদটি শুকিয়ে যায়। এই কারণে হিমালয়ের দিকে জমে থাকা ‘কারেওয়া’ পলির ওপরও ‘লোয়েস’ জমা হয়।

কাশ্মীরের এই উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ভূপ্রকৃতিরও একটি দায়বদ্ধ নিজস্ব ইতিহাস আছে, এবং যেখানে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে তা মেলানো যায় অর্থাৎ এই ভূপ্রকৃতির ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ইতিহাসকে দেখা যায় সেখানে মানুষের ইতিহাস চর্চা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। গভীর দুঃখের বিষয় যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতে এটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

আর একটি অঞ্চল যেখানে প্রাচীন আবহাওয়া ও স্থানীয় মানব ইতিহাস নিয়ে কিছু ধারণা আছে তা রাজস্থানের পশ্চিম অঞ্চল।

১. অতি শুক (major dry)—মধ্য পুরাপ্রস্তর যুগের আগে কিছু নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন বালিয়াড়ির ঢালে পাওয়া যায়।

২. অতি আর্দ্র (major wet)—৪০ হাজার বছর বা তার আগে ও পরে— বালিয়াড়িগুলিতে এই প্রাচীন আর্দ্রতার চিহ্ন ও বহু স্থানে এই পর্যায়ের প্রত্নাবশেষ। লুনি নদী যথেষ্ট সজীব।

৩, অতি শুষ্ক (major dry)—১০ হাজার বছর এবং তার আগে—উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন—বালিয়াড়িগুলির আবার সজীব হয়ে ওঠা। অর্থাৎ নতুন করে বালি জমা—সাংস্কৃতিক নিদর্শন কম।

৪. আর্দ্র—১০ হাজার থেকে ৯৫০০ বছর আগে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগের হাতিয়ারের প্রাচুর্য—কিছু হ্রদের সৃষ্টি।

এই আবহাওয়া পরম্পরাটি অনুমান করা হয়েছে রাজস্থানের মরু অঞ্চলে। এই মরু অঞ্চলেরই পৃথক একটি অঞ্চল নাগৌর জেলা থেকে নীচের ছবিটি তুলে ধরা হয়েছে।

১. জয়াল স্তর—চুনমিশ্রিত কাঁকর জমা বড় বড় পাথরের টুকরো ও পাথর মেশানো একটি স্তর। আগে এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী যে পাথর বইত তাই জমা পড়ে এই স্তরটি হয়। স্তরটির বয়সকাল ভূতাত্ত্বিক ‘প্লাইসটোসিন’ যুগের প্রথম এবং তার আগের। এই স্তরে মানুষের কোনও চিহ্ন নেই।

একটি বিভাজন রেখা ও তার পর—

২. অমরপুর স্তর—এই স্তরের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে যে স্তরটি যখন জমা হয় তখন চারদিকে নিচু, কোথাও কোথাও জলে ভরা, জমি ছিল। এই স্তরে পুরাপ্রস্তর যুগের নিম্ন থেকে মধ্য পর্যায়ের শেষ পর্যন্ত হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে। এই স্তর মিশে যাচ্ছে তার ওপরের ‘দিদওয়ানা’ স্তরে।

৩. দিদওয়ানা স্তর—এই দিওয়ানা স্তর যখন জমা হয় তখন বালিয়াড়ি তৈরি হতে আরম্ভ হয়েছে—বায়ু সঞ্চালনে জমা হওয়া স্তরের চিহ্ন স্পষ্ট। উচ্চ পূর্বপ্রস্তর যুগের নিদর্শন এই স্তরে পাওয়া যাচ্ছে।

রাজস্থানের নাগেীর অঞ্চলটিতে মাটি কেটে একটি পরিষ্কার স্তর-পরম্পরা বের হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিবরণীতে এই স্তর-পরম্পরার জায়গাটির নাম দেওয়া হয় ‘১৬ আর’ (16 R).

ওপরের জমি থেকে ৫ থেকে ৬ মিটার নিচুতে পুরাপ্রস্তর যুগের উচ্চ পর্যায়ের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। এর তারিখ ২৬২১০ ± ২২০০/১৭০০ বছর আগে। ৯ থেকে ১৩ মিটারের ভেতর পুরাপ্রস্তর যুগের মধ্য পর্যায়ের নিদর্শন রয়েছে। ১২.৬৫ মিটার গভীরতার তারিখ ১,৪৪,০০০ ± ১২০০০ বছর। ১৭.২০ থেকে ১৮.৪০ মিটার গভীরতায় পূর্বপ্রস্তর যুগের নিম্ন পর্যায়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ১৮.৬ মি গভীরতার একটি তারিখ ৩,৯০,০০০ ± ৫০,০০০ বছর।

মনে করা হয়েছে বালিয়াড়ি তৈরি—অর্থাৎ, শুষ্ক আবহাওয়া শুরু হয়ে যায় প্রায় ২,০০,০০০ বছর আগে এবং মাঝে মাঝে একটু বিরতি দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি চলে প্লাইসটোসিন যুগের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ের ভেতর আবহাওয়া শুষ্ক এবং উপ-শুষ্ক পর্যায়ের ভেতর আবর্তিত হয়েছে।১০

পশ্চিম রাজস্থানে কয়েকটি ‘লবণ হ্রদ’ আছে, যেমন সম্বর, লুণকারাণসর ইত্যাদি। এই রকম হ্রদ থেকে আহৃত বৃক্ষরেণু (Pollen) বিশ্লেষণ করে যে চিত্রটি দেওয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ।

১. ১০ হাজার বছর এবং তার আগে আবহাওয়া অতীব শুষ্ক।

২. ১০ হাজার বছর থেকে ৯,৫০০ বছরের মাঝে উচ্চ বৃষ্টিপাত।

৩. ৯,৫০০ বছর থেকে ৫,০০০ বছরের মাঝে—কম বৃষ্টিপাত।

৪. ৫,০০০ থেকে ৩,০০০ বছরের মাঝে—এই পর্যন্ত সব চাইতে বেশি আর্দ্র— বর্তমানে যে বৃষ্টিপাত হয় এই অঞ্চলে, তার চাইতে বছরে অন্তত ৫০ সেন্টিমিটার বেশি বৃষ্টিপাত।

৫. এর পর থেকে, আবহাওয়া এই অঞ্চলে বর্তমানের মতো, অর্থাৎ শুষ্ক এবং উপ-শুষ্ক।১১

গুজরাটের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রতটের উচ্চতার মাত্রার তারতম্য ঘটেছে। যেমন, সৌরাষ্ট্র অন্তরীপে সমুদ্র আরও ৫ থেকে ৩ মিটার উঁচু ছিল। এই উচ্চতা পর্যন্ত সমুদ্র বিস্তারের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, যথা প্রাচীন তটরেখা, প্রবালপুঞ্জ (coral reef) ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। সৌরাষ্ট্র অঞ্চলেই দেখা যাচ্ছে যে, ‘মিলিওলাইট’ দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ স্তরের আগে ও পরে দুভাগেই পুরাপ্রস্তর যুগের অবশেষ পাওয়া যাচ্ছে। এই স্তরের উৎপত্তি সামুদ্রিক। ৩০ হাজার থেকে ২৩০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই স্তরটি তৈরি হয় ও এর একটি বৃহৎ ভাগ ৫০ হাজার থেকে ১২০ হাজার বছর আগের সময়ে পড়ে। এ ছাড়া, আরব সাগরের নীচ থেকে সংগৃহীত স্তর-পরম্পরার নমুনা থেকে মনে করা হয় যে ১৮ হাজার, ৭ হাজার, আর ২ হাজার বছর আগে ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ার একটি পর্যায় ছিল।১২

ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে কাশ্মীরে, রাজস্থানে, গুজরাটে প্রাচীন আবহাওয়া নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। কাশ্মীরের গবেষণাটি ব্যাপক ও বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে করা। তবে, এখানে লক্ষ করা দরকার যে, উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের আগে কোনও পুরপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের সঙ্গে এই আবহাওয়া পরম্পরার সাক্ষ্য মেলানো যায়নি। রাজস্থানে যেটুকু কাজ হয়েছে তা সম্পূর্ণটাই পশ্চিম রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চলের। এখানে শুষ্কতা ও আর্দ্রতার প্রসঙ্গে আলোচনা সীমিত। গুজরাটে মূল প্রসঙ্গ সমুদ্রের উচ্চতার পরিমাপ ও তারিখ।

অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে বিশদ বিশ্লেষণ হয়েছে বললে ভুল করা হবে, যদিও প্লাইসটোসিন যুগের শেষের দিকে আবহাওয়া শুষ্ক হচ্ছিল এমন একটি ধারণা মোটামুটি মেনে নেওয়া হচ্ছে।১৩

মানবেতর প্রাণীর জীবাশ্ম প্রাপ্তি থেকেও আবহাওয়া সম্পর্কে কিছু ধারণা কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিশ্চয় করা যায়। আবহাওয়ার চাইতেও এই ধারণা প্রযোজ্য সমসাময়িক উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে।

জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চল থেকেই, তবে আমাদের এখানে জানা প্রয়োজন, পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন যে সব স্তর থেকে এসেছে সে সব স্তরে কী ধরনের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। নর্মদা উপত্যকা থেকে আমরা এর প্রথম উদাহরণ দিতে পারি। বহু ধরনের প্রাণীর জীবাশ্মই পাওয়া গেছে—গরু, মহিষ, হাতি, ঘোড়া, শূকর, হরিণ ইত্যাদির পূর্বরূপ—তাদের ল্যাটিন নাম, যথাক্রমে, বস নামাডিকাস, বিউবালাস প্যালিনডিকাস, এলিফাস নামাডিকাস, ইকুয়াস নামাডিকাস, সুস ও কাভার্স। কোথাও হিপোপটেমাস, কোথাও কুমিরও পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হয় বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ছিল, কোথাও কোথাও জলা জায়গা—জন্তুর পালের বিচরণের পক্ষে প্রশস্ত। পুরাপ্রস্তর যুগের উচ্চ পর্যায়ের মহারাষ্ট্র ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে উটপাখির ডিমের খোলা পাওয়া যাচ্ছে—এতেও মুক্ত তৃণভূমির কথা মনে আসে। মনে হয় পুরাপ্রস্তর যুগের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী, অর্থাৎ নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ে সমসাময়িক উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হলেও, তার পরিচয় আমাদের কাছে বিশেষ ধরা পড়ছে না। মহারাষ্ট্রে পৈঠানের কাছে গোদাবরী উপত্যকায় মধ্য পর্যায়ের আয়ুধের সঙ্গে বস নামাডিকাস ও এলিফাস -এর দাঁত, অর্থাৎ সেই সময়ের হাতির দাঁত পাওয়া গেছে।

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই, তবে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের নীচে গন্ধেশ্বরী ও অন্যান্য ছোট নদী উপত্যকায় প্রাপ্ত জীবাশ্মের তালিকা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। সময় আনুমানিক ৪০ হাজার বছর আগের; বস, বিউবালাস, ইকুয়াস, সুস প্রজাতিগুলি আছে; তা ছাড়া বহু ধরণের হরিণ ও বাঘ, সিংহের অস্তিত্ব জানা গেছে।১৪

ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তরযুগের আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক জগৎ কি এখন যা দেখি তার চাইতে মূলত পৃথক ছিল? এই প্রশ্নের কোনও পরিষ্কার উত্তর দেওয়া যায় না। তবু, প্রাণী ও উদ্ভিদ দুইই বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি ছিল তা মনে করা যেতে পারে। মাত্র গত পঞ্চাশ বছরে উদ্ভিদ ও মানবেতর প্রাণী এত লোপ পেয়েছে যে, উদ্ভিদ ও প্রাণী লোপ পাওয়ার জন্য আবহাওয়ার মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন তা মনে করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। বিভিন্ন স্থানের ভূপ্রকৃতি, অন্তত ভূপৃষ্ঠের ওপর আমরা যা দেখি, তা উপরের স্তরে নিশ্চয় কিছু পালটেছে, আবার যে সমস্ত স্তরে আমরা পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন নিহিত দেখি, তারও তো একটা ইতিহাস আছে। পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার অভাবে কীভাবে এই স্তরগুলি গড়ে উঠেছিল তা আমরা সব সময় বুঝি না। তবে এটুকু বলা যায় যে, এই স্তরগুলি আমরা চিনি। ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তর যুগের কাঠামো ও ব্যাপ্তি দুটোই আমরা এখন জানি।

৩.৩ কালনির্ণয়

নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের নির্ণীত তারিখের সংখ্যা এখনও কম। পশ্চিম পঞ্জাবে পটওয়ার অধিত্যকার রিওয়াত, সলট রেঞ্জের পাব্বি পাহাড়, দিনা ও জালালপুর থেকে যে তারিখগুলি আমরা জানি তাদের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। মহারাষ্ট্রে বোরি থেকে ১.৪ মিলিয়ন বছর আগের যে তারিখ পাওয়া গিয়েছিল তা এখন আর গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না—একথাও আমরা বলেছি। বর্তমান ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের যে তারিখগুলি পাওয়া গেছে তা কম সংখ্যক হলেও যথেষ্ট প্রাচীন।

পশ্চিম রাজস্থানের দিওয়ানা অঞ্চল—৩,৯০,০০০ বছর এবং বেশি; ১,৫০,০০০ বছর পর্যন্ত।

সৌরাষ্ট্রে জুনাগড় ও উমরেথি থেকে পাওয়া তারিখ— ১,৯০,০০০ বছর, ৬৯,০০০ বছর।

মহারাষ্ট্রে গোদাবরী উপত্যকায় নেভাসা—৪,০০,০০০ বছর বা কম বেশি।

কর্ণাটকে কৃষ্ণা উপত্যকায় য়েদুরওয়াড়ি থেকে—৪,০০,০০০ বছর বা কম বেশি।

কর্ণাটকে হুনস্‌গি ও বৈচাবল উপত্যকা—২,৯০,০০০ বছর, ৩,৫০,০০০ বছর ও ১৭,৪,০০০ বছর।

পূর্ব মধ্যপ্রদেশে শোন উপত্যকা—১,০৩,৮০০ ± ১৯,৮০০ বছর—নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের একেবারে শেষ পর্যায়।

নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের তারিখগুলি বোঝাই যাচ্ছে বিক্ষিপ্ত। তবু, এই পর্যায়ের প্রাচীনতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

মধ্য পুরাপ্রস্তর যুগের নিরূপিত তারিখগুলি সংখ্যায় বেশি। রেডিওকার্বন সমীক্ষা পদ্ধতিতে যে তারিখগুলি করা হয়েছে তা ৪০,০০০ থেকে ১০,০০০ বছরের ভেতর সীমাবদ্ধ এবং প্রায় সবকটিই মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত হয়েছে। অন্য পদ্ধতি দিয়ে নির্ণীত কয়েকটি তারিখ থেকে মনে হচ্ছে যে এই পর্যায়ের সূত্রপাত ৪০,০০০ বছরের অনেক আগেই হয়েছে। যথা, পশ্চিম রাজস্থানে দিদওয়ানায় এই পর্যায় ১,৬৩,০০০ ± ২১,০০০ বছর। সৌরাষ্ট্রে জেতপুরে ৫৬,০০০ বছরের বেশি। মধ্যপ্রদেশে শোন উপত্যকায় মনে হচ্ছে এই পর্যায়ের তারিখ ১,০০,০০০ থেকে ২৬,০০০ বছর। পুরাপ্রস্তর যুগের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রাচীন তারিখ ৪৫,০০০-৪০,০০০ বছর (পটওয়ার অধিত্যকার ‘সাইট ৫৫’ বা site 55)। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পেশোয়ারের উত্তর-পূর্বে সাংঘাও গুহা থেকে এই পর্যায়ের একটি তারিখ ৪২,৫০০ (৪০০০ বছর। অন্য দিকে মধ্যপ্রদেশে উজ্জয়িনী ও মান্দাদোর জেলার দুটি অঞ্চল থেকে পাওয়া তারিখ ৩১,০০০ বছর। কিছু তারিখ অবশ্য ২০,০০০ বছরের কম। শোন উপত্যকায়, উত্তরপ্রদেশে বেলান উপত্যকায় এই তারিখ ২৬,০০০ বছর হতে পারে। অন্ধ্রের কুর্নুল অঞ্চলে তারিখ ২০,০০০ বছরের কম বেশি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সামগ্রিক ভাবে, বাংলাদেশ সহ এই বিস্তৃত অঞ্চলে পুরাপ্রস্তর যুগের একটি তারিখও নেই।১৫

৩.৪ পাথরের হাতিয়ারগুলির ধরন

যে ধরনের পাথরের হাতিয়ার আমাদের উপমহাদেশে পাওয়া গেছে, সাধারণভাবে দু-একটি কথা সেই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। প্রথমত পুরাপ্রস্তর যুগের নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের হাতিয়ারগুলির মধ্যে পর্যায় অনুযায়ী একটা প্রভেদ নিশ্চয় আছে—যেমন, নিম্ন পর্যায়ে হস্তকুঠার (hand axe), ছেদক (cleaver); মধ্য পর্যায়ে চাঁছার জিনিস (scraper), ছোট ছিদ্র করার জিনিস (borer) ও ছুঁচোলো অগ্র বিশিষ্ট জিনিস (point); উচ্চ পর্যায়ে লম্বা চিলকা (blade) ও খোদাই করা জাতীয় কাজে প্রয়োজনীয় জিনিস (burin) সংখ্যায় বেশি। তবে, এক পর্যায়ের জিনিস অন্য পর্যায়ে (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে) পাওয়া যায় না এমন নয়। হস্তকুঠার নামক আয়ুধটি নিম্ন পর্যায়ে সংখ্যায় বেশি, কিন্তু মধ্য ও উচ্চ পর্যায়েও কিছু পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয়ত, আয়ুধগুলি বানানোর পদ্ধতিরও পর্যায় অনুযায়ী কিছু তারতম্য আছে। নিম্ন পর্যায়ের জিনিসগুলি সোজাসুজি একটি পাথর বা তার টুকরো থেকে বানানো হয়েছে। মধ্য পর্যায় থেকে দেখি যে প্রথমে মূল বড় পাথর বা পাথরের টুকরোটির ওপর, যে জিনিসটি বানানো হবে, চিলকা তুলে তুলে তার একটি প্রাথমিক আকৃতি দেওয়া হচ্ছে। পরে একটি আঘাত দিয়ে আকার দেওয়া চিলকাটি মূল পাথর বা পাথরের টুকরো থেকে আলাদা করে নেওয়া হচ্ছে। ‘ব্লেড’ নামধারী লম্বা, অপেক্ষাকৃত কম চওড়া, চিলকা ছাড়ানোর জন্য একটি পাথরকে প্রথমে বর্তুল আকারে নিয়ে আসা হচ্ছে ও তার চারদিক থেকে লম্বা চিলকা ছাড়ানোর উপায় করা হচ্ছে।

তৃতীয়ত, হাতিয়ারগুলি ভিন্ন ধরনের পাথর থেকে তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে আমরা দেখি যে নিম্ন পর্যায়ে ‘কোয়ার্টজ’ এবং ‘ব্যাসালট’ জাতীয় পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে হাতিয়ার বানানোর জন্য। পরবর্তী দুটি পর্যায়ে সহজে চিলকা ছাড়ানো যায় এমন সূক্ষ্মদানা বিশিষ্ট ‘কোয়ার্টজ’, ‘চার্ট’ ইত্যাদি জাতীয় পাথর ব্যবহার করা হয়েছে এবং আনুপাতিক ভাবে এদের ব্যবহার অনেক বেশি।

পরিশেষে অনুমান করা যেতে পারে যে হাতিয়ার শুধুমাত্র পাথরেরই হত না, যদিও পাথরের হাতিয়ারই বেশি পাওয়া গেছে। হাড়ের জিনিস উচ্চ পর্যায়ে কুর্নুল থেকে পাওয়া গেছে; আর, কাঠের ব্যবহারও যে থাকা খুব অস্বাভাবিক নয় এতে সন্দেহের কোনও কারণ নেই।১৬

৩.৫ সাংস্কৃতিক অবশেষ

ভারতবর্ষে যাঁরা পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শনের চর্চা করেন তাঁদের কাছে একটি খুব সাধারণ কথা হচ্ছে—‘লোকগুলি কোথায় গেল?’ এই লোকগুলির তৈরি করা পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে অজস্র—পাললিক অঞ্চলের বাইরে, বলতে গেলে, যত্রতত্র—অথচ, এই লোকগুলির দেহাস্থি বিরল (এই পর্যন্ত শুধু হাথনোরা থেকে পাওয়া নিদর্শনে সীমাবদ্ধ)। হাতিয়ার তৈরির বাইরে এদের বসবাসের সাধারণ চিহ্নও প্রায় পাওয়া যায় না কারণ একটিই— সুসংবদ্ধ গবেষণার অভাব। পাথরের হাতিয়ার এবং তার পর্যায়ক্রম বা স্তরনির্ণয় সাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিকরা করতে পারেন কিন্তু কী ধরনের স্তরে বসতির চিহ্ন পাওয়া যাবে তা নির্ণয় করতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সাহায্য দরকার। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে এই সাহায্য খুব কমই পাওয়া যায়। তাই এই নিয়ে আমাদের জ্ঞানও খুব কম। তবু, টুকরো টুকরো কিছু ছবি আছে। ছবিগুলি সত্য অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, এবং পুরাপ্রস্তর যুগের ব্যাপ্তি ও গুরুত্বের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

এই যুগের আদি বা নিম্ন পর্যায়ের কথা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।

পশ্চিম রাজস্থানে মরু অঞ্চলে জেলা-শহর নাগৌর থেকে ৫০ কি. মি. পূর্বে জয়াল—এখানে একটি কঙ্কর এবং পাথর দিয়ে গড়া উচ্চ ভূমির ওপর সহস্র সহস্র নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে। কাঠোলি-জয়াল অঞ্চলে এই উচ্চভূমি ১৬ কি. মি. লম্বা ও ৭ কি. মি. চওড়া। ইতিহাসটা এরকম: প্লাইসটোসিন যুগের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চল দিয়ে একটি বড় নদীর প্রবাহ ছিল। উপগ্রহ থেকে তোলা চিত্রাবলী বিশ্লেষণে এই নদীর প্রবাহ স্পষ্ট। প্লাইসটোসিন-এর প্রথম দিকে বা তার একটু আগে এই নদী দিয়ে বয়ে আসা কঙ্কর আর পাথরের স্তর ভূতাত্ত্বিক কোনও আন্দোলনের ফলে উঁচু হয়ে ওঠে এবং ফলত উচ্চভূমির আকার নেয়। প্লাইসটোসিন-এর মধ্য পর্যায় থেকে এখানে লোকবসতি শুরু হয় বলে মনে করা হয়েছে। আবহাওয়া তখন শুক অথবা উপ-শুষ্ক হয়ে উঠেছে, এবং পুরনো নদী মৃতপ্রায় হলেও ওই অঞ্চলে ইতস্তত ছড়ানো জলা জায়গা ছিল। এখানে নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষেরা শিকার করে বেড়াত। এই অঞ্চলের মূল স্তর-পরম্পরা, আবহাওয়া বিন্যাস এবং তারিখ আমরা ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ’ শীর্ষক অংশে আলোচনা করেছি। শিকারের অবশেষ বা রাত্রি কাটানোর কোনও জায়গা এখনও বের করা যায়নি। কিন্তু পশ্চিম রাজস্থানের এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শুকিয়ে আসা নদী উপত্যকায় কিছু মানুষ শিকার করে বেড়াচ্ছে—এই ছবিটা অন্তত স্পষ্ট।১৭

কর্ণাটকে গুলবর্গা জেলায় হুনস্‌গি বৈচবাল উপত্যকা। হুন্‌স্‌গি নালা কৃষ্ণার উপনদী। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জায়গায় নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে ও কোথাও খননকার্যও করা হয়েছে। ‘হুনস্‌গি ৫নং অঞ্চল’ নাম দেওয়া একটি অঞ্চলে খননকার্যের ফলে, এর ৩নং খাদে মোটামুটি অটুট বসতি স্তর পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্যবশত এই বসতি স্তরে পাথরের হাতিয়ার বানানোর চিহ্ন ছাড়া হাড়গোড়, আগুনের ব্যবহার ইত্যাদির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। স্তরটি ৬৩ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে বের করা হয়েছে। এই স্তরের সঙ্গে যে সমস্ত পাথর পাওয়া গেছে তাদের ভেতর গ্রানাইট পাথর একেবারে স্থানীয়, কিন্তু আর কয়েকটি ধরনের পাথর স্থানীয় নয়, যথা চুনাপাথর (লাইমস্টোন), বালিপাথর (স্যান্ডস্টোন), ‘কোয়ার্টজাইট’, ‘ডলোরাইট’ এবং ‘চার্ট’ কিছু দূর থেকে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, এই স্তরে এই সব পাথর উপস্থিতির কারণ মানবিক প্রচেষ্টা। তা ছাড়া, গেরুমাটির উপস্থিতি এই স্তরে বিশেষ লক্ষণীয়। কোনও অলংকরণের কাজে হয়তো এর ব্যবহার হত।

এই ৩ নং খাদটির বসতি স্তরের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ২ মিটার পর্যন্ত চওড়া গ্রানাইটের টুকরো পাওয়া গেছে। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাওয়া টুকরোগুলি যে মানুষ সাজিয়ে রাখেনি তা সহজেই বোঝা গেছে। এই দিকটায় মাটির স্তরই গ্রানাইট। নীচের গ্রানাইট এই দিকটায় মাটির স্তরের ওপরে উঠে এসেছে। সমস্যা উত্তর দিকের খণ্ডগুলি নিয়ে। এগুলি আলগা ভাবে সাজানো; এখানে নীচে গ্রানাইট নেই। তাই অনুমান করা যায় যে, উত্তরের টুকরোগুলি মানুষই কোনও কারণে সাজিয়ে রেখেছিল। কেন রেখেছিল আমরা জানি না। হয়তো ঘাসপাতা দিয়ে কোনও আশ্রয় বানাতে এগুলি কাজে লেগেছিল। হয়তো প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগেনি, কিন্তু এখনও অস্থায়ী আশ্রয়ের সীমারেখা হিসেবে টুকরো পাথরের ব্যবহার দেখা যায়।

হুনস্‌গি বৈচবাল উপত্যকার বন্য জন্তু ও খাওয়ার উপযোগী উদ্ভিদ ও উদ্ভিজ্জ পদার্থের তালিকা থেকে বোঝা যায় যে খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষের পক্ষে এই অঞ্চলে বাস করা সম্ভব ছিল। সারা বছর ধরেই প্রকৃতিতে খাদ্যের সম্ভার থাকত। অবশ্যই বর্ষার সময় এই খাদ্য সম্ভার বেড়ে যেত এবং অনেক বেশি জায়গায় পাওয়া যেত। তাই, এমন হতে পারে যে, পুরাপ্রস্তর যুগের যে হাতিয়ার সন্নিবেশগুলি এই উপত্যকায় দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে সেগুলি বর্ষার সময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়া মানুষের চিহ্ন। খরার সময়ে চারপাশের জলস্রোত শুকিয়ে যাওয়ায় মানুষকে নালাগুলির চারপাশে যেখানে জল জমা হয়ে থাকত সেখানে বা তার কাছেই আশ্রয় নিতে হত এমন সম্ভাবনা বেশি ছিল। সেদিক থেকে মনে করা হয়েছে যে, মূল নদী-নালার পাশে যে সমস্ত হাতিয়ার পাওয়া গেছে তা শুকনো সময়ের চিহ্ন। এও মনে করা হয়েছে যে এই ক্ষুদ্র অঞ্চলের নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষের বিচরণক্ষেত্র ১২-১৫ কি. মি. পর্যন্ত ছিল। হয়তো এদের গোষ্ঠীতে এক একটি কেন্দ্রে ২০/২৫ জনের বেশি ছিল না এবং হয়তো এরা চার পাঁচটি পরিবারে বিভক্ত ছিল। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা ছিল ০.৫, যেখানে বর্তমান সময়ে তা ৭০। পুরোটাই অনুমান, তবু প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ একটা ছবি মেলে।১৮

মুঙ্গের জেলায় খড়গপুর বলে একটি পাহাড়ি অঞ্চল আছে। এই পাহাড়কে মনে করা হয় বিন্ধ্য পর্বত থেকে বেরিয়ে আসা একটি পাহাড় শ্রেণী। এই পাহাড়ে ভীমবান্‌ধ নামক একটি জায়গায় উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। ভীমবান্‌ধের ১৮ কি. মি. উত্তরে পৈসরা। একটি ছোট জংলি উপত্যকার ভেতর একটি ছোট গ্রাম। এই গ্রামের উপকণ্ঠে অনুসন্ধান করে প্রচুর নিম্ন প্রস্তরযুগীয় হস্তকুঠার, ছেদক ইত্যাদি পাওয়া যায়। পরে এখানে খনন করা হয়। খনন করে যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে মনে করা যায় যে এটি নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের একেবারে শেষ পর্যায়ের নিদর্শন।

তিনটে জঙ্গলের গ্রাম—পৈসরা, তার পুব দিকে প্রায় ৫ কি. মি. দূরে কান্দিনী, আর পশ্চিমে ২ কি. মি.-র ভেতর বারিয়ারা গ্রাম। সমগ্র উপত্যকাটি ২৫ বর্গ কি মি. থেকে বেশি নয়। তিনটি গ্রামই উপত্যকার উপরার্ধে। উপত্যকাটির মাঝখান দিয়ে দুধপানি নালা। পাথরের হাতিয়ার সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বর্তমান পৈসরা গ্রামের আশপাশে প্রায় ২ কি. মি. জুড়ে। বারিয়ারা আর কান্দিনীর মাঝখানে ১৮ বর্গ কি. মি. জায়গা জুড়ে, অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যায় কিন্তু নিয়মিত ভাবে, হাতিয়ার পাওয়া গেছে। মনে করা হয় যে, লোকেরা থাকত পৈসরার আশপাশে কিন্তু উপত্যকার অনেকটা জায়গায় তারা খাদ্য সংগ্রহ করে বেড়াত। পৈসরা গ্রামের উপকণ্ঠে কয়েকটি জায়গায় খননকার্য করা হয় এবং যে স্তর বা যে জমির ওপর নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষেরা থাকত তার চিহ্ন পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে উপত্যকার সঙ্গে পাহাড়ের ওপর বা ঢালে কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি। গরমের দিনে পাহাড়ের ওপর বা ঢালে জল পাওয়া যায় না।

যে জমির ওপর বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে তা পাথরের ওপর জমা হওয়া ছোট ছোট কাঁকর বা মোরাম বিছানো। এই সময়ে আবহাওয়া কী রকম ছিল বোঝা যায়নি, তবে এর পরবর্তী পর্যায়ে আবহাওয়া বিশেষ শুষ্ক হয়ে ওঠে এবং হয়তো এই বিশেষ শুষ্ক পর্যায়ের পর অপেক্ষাকৃত আর্দ্র একটি আবহাওয়া পর্যায় ছিল। পাথরের তৈরি হাতিয়ারের নিদর্শনাবলী বাদ দিলে বসতির চিহ্ন যা পাওয়া গেছে তা বেশি নয়। কিছু ১৫-৩০ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত—সম্ভবত কাঠের খুঁটি পোতার জন্য— আর তেরছা বা সোজা করে ছড়ানো কিছু পাথরের চাঁই। কাঠের খুঁটি লতাপাতা দিয়ে আশ্রয় বানানো অসম্ভব ছিল না, আর পাথরের চাঁই হয়তো তার চারপাশের ঘেরকে চেপে রাখার জন্য।

পৈসরা গ্রামে এখন যাঁদের বাস তাঁরা ‘কোডা’ নামক আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। এখন জঙ্গল ফুরিয়ে আসায় তাঁদের চাষবাস করতে হচ্ছে। কিন্তু তবু জঙ্গল থেকে, পশুপাখি বাদ দিলেও, অনেকখানি দৈনন্দিন খাদ্য আসে—যেমন, বসন্তের শেষে ও গরমের কিছুটা সময় মহুয়ার ফুল ও কেঁদ, পিয়াল, বেল ইত্যাদি ফল। অপ্রতুলতার দিনে মহুয়া ফুল মূল খাবার হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। বর্ষার দিনে জঙ্গলে খাওয়ার মতো শাকসবজি থাকে; কন্দমূল তো থাকেই। শীতে আবার ফল পাওয়া যায়, সব চাইতে বেশি বুনো কুল। এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে বর্তমান ‘কোডা’রা পৈসরা অঞ্চলে নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় মানুষদের প্রত্যক্ষ বংশধর; কিন্তু জঙ্গল থেকে তাঁরা যেভাবে খাদ্য আহরণ করেন তা থেকে ওই অঞ্চলে নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগের অধিবাসীরা কিভাবে খাদ্য সংগ্রহ করত তার সম্পর্কে একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।১৯

এই পর্যন্ত আমরা যতগুলি জায়গার কথা বলেছি তার কোথাও আগুনের চিহ্ন, শিকার করা জন্তুর হাড়গোড় কিছুই পাওয়া যায়নি। কেন পাওয়া যায়নি তার কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে ওরা যেখানে বসে হাতিয়ার বানাত সেখানে রাত্রে থাকত না। এমনও হতে পারে লতাপাতা দিয়ে বানানো অস্থায়ী আবাসের চিহ্ন বহুদিন ধরে মাটির ক্ষয়, বৃষ্টির জল, সব কিছুতে নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও কেন কোথাও অন্তত আগুনের চিহ্নটুকুও পাওয়া গেল না—এটা বোঝা মুশকিল।

যেখানে এই ধরনের সাক্ষ্য পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল তা হচ্ছে ভীমবেঠকা। হোসংগাবাদের ৩১ কি. মি. উত্তরে ভূপালের ৪৫ কি. মি. দক্ষিণে ইতারসি-ভূপাল রাস্তার অদূরে একটি পাহাড়শ্রেণীতে ১০০০-এর বেশি গুহাশয় (rock shelter) পাওয়া গেছে। এই গুহাশ্রয়গুলিকে প্রথমে ৮টি অঞ্চলে ভাগ করে, প্রত্যেকটি অঞ্চলকে কয়েকটি উপ-অঞ্চলে (যথা ‘এ’ ‘বি’ ইত্যাদি) ভাগ করা হয়। উপ-অঞ্চলগুলিতে যতগুলি গুহাশয় আছে তাদের প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা নম্বর দেওয়া হয়।

ভীমবেঠকা ৩-এফ-২৩ (III. F-23) এমন একটি গুহাশয়। এখানে নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় স্তর ২.৫০ মি. পুরু। যেখানে লোকজন বসে হাতিয়ার বানাত সেরকম স্তর পরপর পাওয়া গেছে। এই বসার স্তরগুলিতে পাথরের টুকরো বা চাঁই ছড়িয়ে আছে এবং এই স্তরের ওপর হাতিয়ার তৈরির নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। যে হাতিয়ারগুলি পাওয়া যাচ্ছে তারা মূলত হস্তকুঠার ও ছেদক। এগুলি বিশ্লেষণের পর মনে করা হয়েছে, ভীমবেঠকায় এই গুহাশ্রয়ে প্রাপ্ত নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন এই পর্যায়ের একেবারে শেষের দিকের।২০

মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন বহু জায়গায় পাওয়া গেলেও এখনও এদের সম্পর্কে হাতিয়ার বাদ দিয়ে অন্য কোনও কিছু সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এই দিক থেকে ছবিটা এখনও পরিষ্কার নয়। এই সময়, নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় সাধারণ ‘কোয়ার্টজাইট’ জাতীয় পাথর ব্যবহারের পরিবর্তে সূক্ষ্মদানা বিশিষ্ট (fine grained) কোয়ার্টজাইট বা অন্য পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। পাথরের চিলকার ওপর করা হাতিয়ারের সংখ্যা বিশেষ ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আগের পর্যায়ে, অর্থাৎ নিম্ন পুরাপ্রস্তর যুগে, যার প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল—জলা ও জঙ্গল মেশানো বিস্তীর্ণ তৃণভূমি—এই পর্যায়েও তাই ছিল বলে অনুমান করা হয়। প্রাণীদের নিদর্শনও পূর্ব পর্যায় থেকে পালটায়নি।

উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের সাক্ষ্য অপেক্ষাকৃত বিশদ। এর একটা কারণ হতে পারে যে, এই পর্যায়টি প্লাইসটোসিন যুগের একেবারে শেষে। এই সময়কার আবহাওয়া সম্পর্কে মোটামুটি সবাই একমত যে এই সময় বিশেষ শুষ্কতা আসে। মনে করা হয় বায়ুসঞ্চালনের ফলে ধূলিস্তর জমা হয়। এমনকী উদ্ভিদ আবরণও এই সময় অনেক কম হয়ে যায়। তবে, জলা, তৃণভূমি—এগুলিও ছিল মাঝে মাঝে। উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের একটি বড় বৈশিষ্ট্য বর্তুলাকার একটি মূল টুকরো থেকে চারপাশে লম্বা চিলকা ছাড়ানো এবং এই চিলকাগুলি দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করা।

উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য এসেছে অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুল জেলার কিছু গুহা থেকে। এই একমাত্র অঞ্চল যেখান থেকে হাড় দিয়ে বানানো বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পাওয়া গেছে আগুনের চিহ্ন। তারিখ ২০০০০ বছরের কম বেশি। জন্তু জানোয়ারের নিদর্শনের ভেতর নাম করা যায় গণ্ডার, নীলগাই, চিংকারা হরিণ, কৃষ্ণ হরিণ, চারটি শিং বিশিষ্ট হরিণ, সম্বর, চিতল ও মূষিক হরিণ। সব মিলিয়ে অনুমান করে নেওয়া যায় যে, বর্তমানের তুলনায় অঞ্চলটিতে উদ্ভিজ্জ আবরণ অনেক বেশি ছিল।২১

অন্ধ্রপ্রদেশেরই কাছাপা অঞ্চল থেকে আরও সাক্ষ্য এসেছে। বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় গুঞ্জনা নামে একটি ছোট নদী উপত্যকা থেকে। এখনও এই অঞ্চলে অন্তত ৩০ রকম শিকার করে খাওয়ার উপযুক্ত জন্তু, ৪৫ রকম ‘নদীর মাছ’, ৬৮ জাতের পাখি, ১০ রকমের কন্দমূল, রান্না করে খাওয়া যায় এমন পাতা ১০ রকম ও ২৫ রকম বুনো ফল পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে এখনও অন্ত্রের ইয়াণাডি ইত্যাদি উপজাতির বাস, যাঁদের ভেতর খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার প্রথা একেবারে লোপ পায়নি।

গুঞ্জনা উপত্যকায় যে উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্রগুলি পাওয়া যাচ্ছে তাদের কয়েকটি বিশেষ বিস্তীর্ণ। ২ বর্গ কি. মি. জুড়ে উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার ছড়িয়ে আছে, এমনও পাওয়া গেছে। এক বর্গ মিটার জায়গায় ৫ থেকে ৬৭টি হাতিয়ার পাওয়া যাচ্ছে—যা হাতিয়ার পাওয়ার হিসেবে বিশেষ প্রাচুর্যের নিদর্শন বলে মনে করা যেতে পারে।

কেন্দ্রগুলির স্থিতি-বিন্যাস নিম্নরূপ: নদীর কাছে কিন্তু এরকম জায়গায় নয় যে বর্ষাতেও নদীর জলস্রোতে ক্ষতি হবে; হাতিয়ার তৈরির জন্যে পাথর নদীর খাতে এবং কাছের পাহাড়ে পাওয়া যাবে; জায়গাটি এরকম নয় যে, চারপাশে খাদ্যসংগ্রহ করতে অসুবিধা হবে; এ ছাড়া, পাহাড়ের পাদদেশে বা একেবারে জঙ্গলের গভীরে কোনও কেন্দ্র পাওয়া যায়নি। এখন এই অঞ্চলে যে ‘ইয়াণাডি’ উপজাতির মানুষেরা আছেন তাঁরাও মোটামুটি এরকম জায়গায় থাকা পছন্দ করেন। গুঞ্জনার কাছেই, এবং পূর্বঘাট পর্বতমালা অঞ্চলেই আর একটি ছোট নদী উপত্যকায় যে কেন্দ্রগুলি পাওয়া যাচ্ছে তাতেও অতি বিস্তীর্ণ কয়েকটি কেন্দ্র পাওয়া গেছে। ১০,০০০ বর্গ মিটার, ২০,০০০ বর্গ মিটার আয়তন জুড়ে পাথরের হাতিয়ার ছড়ানো থাকলে তাকে বিশেষ বড় ধরনের কেন্দ্রই বলতে হয়।

গুঞ্জনা উপত্যকার ‘ভোডিকালু’ কেন্দ্রটিতে প্রায় ৪ কি. মি. জুড়ে বিক্ষিপ্ত পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যায়। চাষের জন্য এর অনেক অংশ নষ্ট হয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় যে হাতিয়ারগুলি যে স্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেই স্তরটি মূলত অটুট, অর্থাৎ এখানে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির সাক্ষ্য সঠিক, এটা মনে করা যেতে পারে। হাতিয়ার বানানোর উপাদান হিসেবে এখানে সুক্ষ্মদানা কোয়ার্টজাইট এবং কালো লিডিয়ানাইট পাথর পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য কিছু কিছু কোয়ার্টজের ব্যবহারও আছে। হাতিয়ারগুলি দেখলে মনে হয় সবে তৈরি, বানাবার জায়গা থেকে জলস্রোতে ভেসে বা অন্যভাবে গড়িয়ে চলে আসেনি। মনে হচ্ছে যে, জায়গাটি এমন একটি জায়গার পাশে ছিল যেখানে সব সময় জল থাকত। মূল হাতিয়ারগুলি বাদ দিলেও, এখানে খননকার্যে ৮৪টি শিলা পট্ট, (যার ওপরে পেষা যায় এমন পাথর) ১৯টি নোড়া জাতীয় পাথর (যা দিয়ে পেষা যায়) এবং ১১৩টি ইচ্ছে করে ভাঙা হয়েছে এমন ছোট গোল পাথর পাওয়া যায়। শিকার বাদ দিয়েও উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগে উদ্ভিজ্জ খাবার খাওয়া হত তার প্রমাণ এই জাতীয় পাথর। তা ছাড়া, এই অঞ্চলে বুনো ‘নীবার’ ধান যথেষ্ট। এমনও অনুমান করা হয়েছে যে, উচ্চ প্রস্তরযুগেই এই ধান তোলা হত। ভোডিকালুতে পাথরের হাতিয়ারগুলি ইতস্তত ভাবে ৫ থেকে ১০ মিটার দূর দূর ছড়ানো, এবং পুরো অঞ্চলটিতেও বিভিন্ন জায়গায় হাতিয়ারের ধরনে কিছু প্রভেদ নজরে পড়ে। এই প্রভেদ থেকে মনে করা হচ্ছে যে, এক এক জায়গায় এক এক ধরনের কাজ হত— কোথাও শুধু হাতিয়ার বানানো, কোথাও শুধু মাংস কাটা, কোথাও কাঠ নিয়ে কাজ, কোথাও সংগৃহীত জিনিসপত্র খাওয়ার উপযুক্ত করে তৈরি করা। দূরে দূরে ছড়ানো হাতিয়ারের বিন্যাস থেকে অনুমান করা হয়েছে যে, এক একটি পরিবার এক এক জায়গায় বসে হাতিয়ার বানাত। সমস্তটিই অনুমান, কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়, আর এভাবে, পাথরের হাতিয়ারের বাইরে জীবনধারণের একটু ইঙ্গিত মেলে। ভোভিকালুর উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন সম্পর্কে এও অনুমান করা হয়েছে যে এখানে হয়তো ১৯০ জন মানুষের বসতি ছিল—অন্তত ৬টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। আর প্রতিটি গোষ্ঠীতে ৫-৬টি পরিবার, প্রতিটি পরিবারে ৫/৬ জন করে সদস্য। এসব অনুমান সাধারণত নৃতাত্ত্বিক উদাহরণাবলী থেকে করা হয়। যেমন, এই অঞ্চলে খাদ্য সংগ্রহকারী জীবনের সুগমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ১৯৫০-৫৭-র নিরবচ্ছিন্ন এবং সুদীর্ঘ ৭/৮ বছরের খরার কালে এখানকার ‘ইয়াণাডি’ উপজাতির লোকেরা মূলত জঙ্গলের কন্দমূল খেয়ে কাটিয়েছিলেন। ভোডিকালু এবং অন্ধ্রের অন্যত্র উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়ের ছিদ্র করা গোল পাথরও পাওয়া গেছে, যে ধরনের পাথর এখনও ওই অঞ্চলে নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার হয়।২২

মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে শোন উপত্যকায় সিধি জেলার বাঘোর গ্রাম থেকে উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। বাঘোর গ্রামের চারপাশে কয়েকটি জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হয় এবং তার একটিকে নাম দেওয়া হয় বাঘোর-১। উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শনটি এই বাঘোর-১-এ পাওয়া যায়। তারিখ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০-১২ হাজার বছর। এখানে ২৮৬ বর্গ মিটার জায়গা জুড়ে খোঁড়া হয় যাতে প্রাচীন কেন্দ্রটি প্রায় সবটুকুই বেরিয়ে আসে। হাতিয়ার বানানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের কাজ পৃথক পৃথক জায়গায় করা হত—কোথাও শুধু চিলকা ছাড়ানো হয়েছে, তারই কাছে চিলকাগুলো দিয়ে হাতিয়ার বানানো হয়েছে, আর কোথাও হাতিয়ারের এবং হাতিয়ার বানানোর সময় ভাঙা টুকরোগুলি জড়ো করে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পাথর মেশানো এমন একটি জায়গা ও খুব সম্ভবত একটি চুলা জাতীয় জায়গাও পাওয়া গেছে। যে হাতিয়ারগুলি বাঘোর-১ থেকে পাওয়া গেছে তা বেশির ভাগ লম্বা বা ছোট চিলকা থেকে গড়া; তা ছাড়া একটি অংশত ছিদ্র করা গোল পাথরের টুকরো, হাতুড়ির কাজ করেছে এমন অনেক পাথর ও পেষাই-এর কাজে লাগে এমন কিছু চ্যাপটা পাথর পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া ১৯৮২ সালে খননকার্যের সময় এখানে ৮৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের বিভিন্ন ধরনের পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো একটি গোল চত্বর পাওয়া যায়। এই চত্বরটির মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের পাথরের ১০টি টুকরো পাওয়া যায়। এই ১০টি টুকরো জোড়া লাগানো গেছে এবং স্পষ্টতই এরা একটা বড় পাথরের টুকরো ছিল। গোড়ায় এটি ছিল ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু, ৬.৫ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৬.৫ সেন্টিমিটার মোটা একটি ত্রিভুজাকার পাথর। এই পাথরটির মাঝে, নীচের দিক ঘেঁষে, একটির ভেতর আর একটি, ত্রিভুজাকার অল্প হলুদ-লাল থেকে কালো-লাল খয়েরি কয়েকটি দাগ—যাকে স্ত্রী চিহ্ন বলে সহজেই মনে করা যায়। গোল চত্বর বা বেদিটির ওপর মাঝখানে এই পাথরের টুকরোটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

এবার, এটি নিয়ে দুটি জিনিস লক্ষ করার আছে। প্রথমত, ঠিক এই জাতীয় পাথরের টুকরো এখনও বাঘের গ্রামের পাশে পাহাড়ে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, এখনও ভগ্ন পাথরের গোল চত্বরের ওপর মাঝখানে এই জাতীয় স্ত্রীচিহ্নযুক্ত পাথর রেখে মাতৃকা দেবীর পুজো করা হয়। গ্রামের লোকেরা সাধারণত একে মাই (মা) বলেই বলেন। তবে ‘কেরাই কি দেবী’, ‘অঙ্গারী দেবী’, ‘কালিকা মাই’ নামও শোনা যায়। এই ধরনের মাতৃস্থানে পূজা অঞ্চলের সবাই করেন—কোল ও বৈগা উপজাতির লোকেরা, বর্ণহিন্দুরা এবং স্থানীয় মুসলমানরা পর্যন্ত। উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় এই নিদর্শনটি আর বর্তমানের দৃষ্টান্তগুলি এত অভিন্ন যে, সময়ের তফাতের কথা মনে থাকে না। নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের মাতৃকাপূজা, পাথর পূজার ধারা প্রস্তর যুগেই শুরু হয়েছে। বাঘোরের এই আবিষ্কার আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের প্রস্তরযুগের ধারা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন নই।২৩

পরিশেষে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় সাক্ষ্য এসেছে পটওয়ার অধিত্যকা থেকে। এখানে একটি জায়গার নাম ‘কেন্দ্র ৫৫’; তারিখ আনুমানিক ৪৫,০০০ বছর আগে। পাথরের হাতিয়ার ছাড়াও, এই ২০০ বর্গ মিটার খোঁড়া জায়গায় পাওয়া গেছে পাথরের তৈরি একটি দেয়ালের নীচের অংশের ভাগ, একটি ইচ্ছে করে খোঁড়া গর্ত, একটি গোলাকার কুলুঙ্গি মতো জায়গা এবং সম্ভবত কয়েকটা খুঁটির গর্ত।২৪

পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু আলোচনার সুযোগ নেই এই অধ্যায়ে। খুব বিস্তৃত কাজ এই পুরো অঞ্চলে এখনও হয়নি। তবে, মূল জায়গাগুলি সম্পর্কে ধারণা হয়েছে। বীরভূম থেকে মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম, বাঁকুড়া-বর্ধমান থেকে পুরুলিয়া—এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন পর্যাপ্ত এবং বাংলাদেশের লালমাই পাহাড়ের কথা আমরা আগে বলেছি। তবু, বিশেষ কিছু অঞ্চলের কথা মনে পড়ে— যেমন, অযোধ্যা পাহাড়, পুরুলিয়া। পাহাড়টি দেখতে একটি উলটো করে বসানো বাটির মতো। তার চারপাশে বিস্তীর্ণ লাল কঙ্করময় অঞ্চল, যার পুরোটাই জঙ্গলাকীর্ণ বা এক সময় বনাকীর্ণ ছিল। বাঘমুণ্ডি পেরিয়ে মাঠার বিস্তৃত জঙ্গল। তার আগে, বলরামপুরের দিকে ডাভা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গল—সবটাই অযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করে। বলরামপুরের কাছে কানা পাহাড় অঞ্চলও তাই। অযোধ্যা পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সিরকাবাদ ‘বন’ কার্যালয়ের কাছ থেকে এক অতি বিস্তৃত ঊষর ভূমি। অজস্র উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন এই প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে—অন্তত ১৯৮১-৮২ সাল পর্যন্ত তাই ছিল। বাঁকুড়ার খাতরা-মুকুটমণিপুর অঞ্চল, বেলপাহাড়ি-শিলদা অঞ্চল, গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ময়ূরভঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জঙ্গল— সর্বত্রই পুরাপ্রস্তরযুগীয় মানুষরা ছিলেন।

বহু জায়গায় এখনও ভাল অনুসন্ধান হয়নি। শুধু প্রাথমিক ভাবে দেখা হয়েছে। মাঠা থেকে ঝালদার দিকে পাহাড়ের বা উচ্চভূমির সারি গেছে। ইলামবাজার থেকে পানাগড়ের দিকে আসতে অজয়ের ওপর পুল পেরোবার সময় দেখা যায় (অথবা যেত) অজয়ের পুরনো পাড়ের খাড়াই—তারপরই বিস্তৃত শাল জঙ্গল (অন্তত ছিল)—এই ভুমিতে পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন প্রচুর ছিল। হয়তো এখনও আছে, যদি জমি কেটে আবাদ না হয়ে গিয়ে থাকে। শ্যামারূপার গড়ের কাছে যে জঙ্গল, সেই বিস্তৃত জঙ্গলে এক সময় উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় পাথরের লম্বা চিলকা (ব্লেড) বহু ছড়িয়ে থাকত। আজকাল পশ্চিমবঙ্গের এসব অঞ্চলে মোরামের খাদ হওয়ায় লরিতে করে মোরাম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফলে পুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার পাওয়া যায়, এমন অনেক ডাঙা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের যে সব অঞ্চলের কথা আমরা বললাম তা থেকে কেউ যেন এই সিদ্ধান্তে না আসে যে, ওই অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী মানুষরা সব প্রত্যক্ষভাবে পুরাপ্রস্তরযুগীয় মানুষদের বংশধর। সময়ের এত ব্যবধানে বংশাবলীর খোঁজ পাওয়া সহজ নয়—প্রথমত পুরাপ্রস্তরযুগীয় শারীরিক অবশেষ পেতে হবে আর তারপর তাদের ‘ডি এন এ’ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে আজ ওই অঞ্চলে যে মানুষরা আছেন তাঁদের ভেতর সেই ‘ডি এন এ’ কতটা মেলানো যায়। পশ্চিমবঙ্গের নদীমাতৃক অঞ্চলে যে সমস্ত মানুষেরা বাস করেন তাঁরা একসময় নিশ্চয় প্রদেশের পশ্চিমপ্রান্তের উচ্চভূমি থেকেই নীচে পাললিক ভূমিতে নেমে এসেছিলেন। কোন পর্যায়ে এটা সম্ভব হয়েছিল পরের কোনও অধ্যায়ে আমরা তা দেখব।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে বেশি নিদর্শনের আশা করা যায় না। তবে, পাথরের অভাব দূর করতে ওখানে ব্যবহার করা হয়েছে ফসিল হয়ে যাওয়া বিশেষ ধরনের কাঠ। এই ফসিল কাঠের ওপরের বল্কল বা খোসা ছাড়ালেই ফ্লিন্ট পাথরের মতো দেখতে আর তা থেকে সুন্দর চাকলা বা চিলকে ছাড়ানো যায়। এই ফসিল কাঠ দিয়েই লালমাই পাহাড়ের উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনগুলি তৈরি হয়েছিল। কুমিল্লার কাছে ময়নামতী পাহাড়ের দক্ষিণ অংশকে লালমাই পাহাড় বলে। লালমাই-এই শুধু এই ফসিল কাঠের হাতিয়ার পাওয়া গেছে তা নয়। যেখানে যেখানে বিশেষ ধরনের শক্ত কাঠটি পাওয়া গেছে একমাত্র সেখানেই হাতিয়ার পাওয়া গেছে। বেশির ভাগই পাওয়া গেছে পাহাড়টির দক্ষিণ সীমায়—লালমাই কলেজ ও রেডিও স্টেশনের পেছনের জমিতে ও চন্ডীমুড়া এলাকায়। চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট অঞ্চলে যেখানে এই ধরনের ফসিল কাঠ পাওয়া যায় সেসব জায়গায় অনুসন্ধান চালালে এই সময়ের নিদর্শন আবিষ্কৃত হবে। মান্দালয়ের দক্ষিণ অঞ্চল (প্রাক্তন বর্মা, বর্তমান মায়ানমার) পর্যন্ত এই জাতীয় নিদর্শন বিস্তৃত ছিল।২৫

৩.৬ শিল্প?

উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের ইউরোপীয় শিল্পকলার কথা বহুবিদিত; উত্তর-পূর্ব আলতামিরার গুহাচিত্রের কথা বা দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের ল্যাসকো ইত্যাদি স্থানের গুহাচিত্রের কথা শিল্পের ইতিহাসে সুপরিচিত। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল যে, ভারতবর্ষে পুরাপ্রস্তরযুগীয় কোনও শিল্প নিদর্শন নেই। এই ধারণা এখন একটু পালটানো প্রয়োজন।

প্রাথমিক ভাবে সবচেয়ে পুরনো যে নিদর্শন তা ভীমবেঠকার একটি গুহাশ্রয়ে ৩-এফ-২৪-এ। এর মাঝখানে একটি স্বাভাবিক পাথরের দেওয়াল এবং তার গায়ে ১৬.৮ মিলিমিটার গভীর ৭টি বাটির মতো গর্ত আছে। অনুমান করা হয়েছে যে, এই গর্তগুলি পাথরের গায়ে আঘাত করে করে করা হয়েছিল। আরও অনুমান করা হয়েছে যে, এই গর্তগুলি পুরাপ্রস্তর যুগের নিম্ন থেকে মধ্য পর্যায়ে উত্তরণের সময় করা হয়েছিল। যদি এই অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়, তবে এই নিদর্শনটি সুপ্রাচীন মানতেই হয়। এই গুহাশয়টিতেই ‘চ্যালসিডোনি’ নামক চিকন এক পাথরের একটি ছোট ছিদ্রযুক্ত চাকতি পাওয়া গেছে। মধ্যপ্রদেশে মাইহারেও নাকি পুরাপ্রস্তরযুগীয় স্তরে এ জাতীয় একটি চাকতি পাওয়া গেছে। রাজস্থানে দিদওয়ানার কাছে সিংঘি তালাও-এ নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় স্তরে নাকি ৬টি স্ফটিকের টুকরো পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, কর্নাটকের হুনস্‌গিতে পুরাপ্রস্তরযুগীয় স্তরে গেরুমাটির টুকরো পাওয়ার কথা মনে করা যেতে পারে।

বিক্ষিপ্ত সব উদাহরণ নিশ্চয়ই, তবে সব মিলিয়ে পুরাপ্রস্তর যুগের নিম্ন পর্যায়েও যে একটা মনোজগৎ ছিল তার প্রমাণ অথবা ইঙ্গিত মেলে।

উচ্চ পুরাপ্রস্তর যুগের নিদর্শন অল্প হলেও সন্দেহাতীত। তবে লক্ষ করা দরকার যে, গুহাচিত্রের কোনও নিশ্চিত নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্রে পাটনে বলে একটা জায়গা খননে এই পর্যায়ে উটপাখির ডিমের খোলার ওপর করা একটি নকশা পাওয়া যায়, যা নিঃসন্দেহে মানুষের করা। ভারতবর্ষে উটপাখির ডিমের খোলার বয়স নির্ধারিত হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে। এ ছাড়া পাটনে ও ভীমবেঠকায় এই ডিমের খোলার তৈরি কয়েকটি পুঁতি পাওয়া গেছে।

উত্তরপ্রদেশে বেলান উপত্যকায় লোহান্‌ডা নালাতে উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় একটি কঙ্কর-স্তর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৫ সেন্টিমিটারের একটু বেশি লম্বা হাড়ের একটি জিনিস। এটিকে ‘হারপুন’ও মনে করা যেতে পারে। আবার এটি একটি মাতৃকা মূর্তিও হতে পারে। এটিও ২০-২৫ হাজার বছরের পুরনো জিনিস।

ভারতীয় শিল্পের সাধারণ ইতিহাসে এই নিদর্শনগুলি এখনও স্থান পায়নি। আশা করি ভবিষ্যতে স্থান পাবে।২৬

৪ পরিশেষের মন্তব্য

প্রাগিতিহাস চর্চা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায় ১৮৫৯ সালে; ওই সালে ব্রিটেনের ‘রয়াল সোসাইটি’ পুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের প্রাচীনত্বকে স্বীকৃতি দেন। ১৮৬৩ সালে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার একজন সদস্য মাদ্রাজের উপকণ্ঠে ‘পল্লভরম’ বলে একটি জায়গায় ভারতে প্রথম নিম্ন পুরাপ্রস্তরযুগীয় হস্তকুঠার আবিষ্কার করেন। এই থেকে মূল কাজ শুরু হয় এবং বিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার আগেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক গুরুত্ব বোঝা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গবেষণা তুলনামূলকভাবে কম হয়, তবে স্বাধীনতার পর থেকে এই গবেষণার ব্যাপ্তি বাড়ে।

বর্তমানে এর বড় ত্রুটি হল যে, এই গবেষণা এ পর্যন্ত যাঁরা করেছেন তাঁদের অতি বৃহৎ একটি অংশই বর্তমান লেখকের মতো ইতিহাস পড়ে আসা প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র। অথচ, ভূবিজ্ঞানের বহু পদ্ধতিই এই পুরাপ্রস্তরযুগীয় গবেষণার সঙ্গে জড়িত। যে সম্পর্কে কোনও বৈজ্ঞানিক দক্ষতা এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিকদের নেই। এঁরা প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে কী ধরনের নিদর্শন কী স্তরে পাওয়া যাচ্ছে তার সুষ্ঠু ধারণা দিতে পারেন। কিন্তু জমি, প্রকৃতি, তারিখ ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণা করার পেশাগত যোগ্যতা এঁদের নেই। আর একটি গোষ্ঠী এই ধরনেরই চর্চা কখনও কখনও করেন—তাঁরা নৃতাত্ত্বিক। এঁরা সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে কিছু অনুমান দিলেও এঁদের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ক্ষমতা খুব সীমিত। ভারতবর্ষে প্রস্তরযুগ চর্চা এবং অন্যান্য প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসে এঁদের কোনও বিশেষ স্থান নেই। অন্যদিকে, মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী এই চর্চাটি করেন তাঁদের আবার ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্বের প্রশ্নগুলি সম্পর্কে ধারণা নেই। সব মিলিয়ে, এই গবেষণায় ভারতবর্ষে কিছু নির্বেদ অবস্থা। পাথরের হাতিয়ারের মাপজোক, তা নিয়ে অঙ্ক, কমপিউটার, বড় বড় ভূতাত্ত্বিক কথা, আবহাওয়া, পরিবেশ নিয়ে চমকপ্রদ অথচ শিথিল কথা—অনেক কিছুই আজকাল বলা হচ্ছে। অথচ, আমরা যা সত্যি জানতে চাই তার সম্পর্কে তা হল—প্রাচীন নিদর্শনের কাল নির্ণয়, যে ভূমিতে মানুষ খাদ্যসংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াত তার সঠিক প্রকৃতি, বসবাসের ধরন, ইত্যাদি। ঐতিহাসিক সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান খুব ধীরে এগোচ্ছে। আশা করা যায় যে, সাধারণ শিক্ষিত সমাজে পুরাপ্রস্তরযুগীয় ইতিহাসের সম্পর্কে ঔৎসুক্য আরও বাড়লে সঠিক গবেষণাও হয়তো বাড়বে।

আমাদের মূল বক্তব্য হল যে, আমরা এই পুরাপ্রস্তরযুগীয় ইতিহাস বা সংস্কৃতির ধারা থেকে অবিচ্ছিন্ন। এই অধ্যায়ে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনের ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও প্রাচীনত্বের সম্বন্ধে যে আলোচনা আমরা করেছি তা থেকে এ বক্তব্য মেনে নিতে কোনও অসুবিধে হওয়া উচিত নয়। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে যতটুকু বলা যায় আমরা ততটুকুই শুধু বলেছি। এত দীর্ঘকালের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের মতো বৃহৎ ভূখণ্ড সম্বন্ধে এত অল্প কথা বলা গেল এটা আমাদের গর্বের বিষয় নয়।

.

প্রথম অধ্যায়

। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনা, কে এ আর কেনেডি, ‘দি ফসিল হোমিনিড স্কাল ফ্রম দি নর্মদা ভ্যালি: হোমো ইরেকটাস অব হোমো স্যাপিয়েনস?’, সি জ্যারিজ (স.), সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি ১৯৮৯, ম্যাডিসন (১৯৯২), পৃ. ১৪৫-৫২। আবিষ্কারকের লেখার নমুনা হিসেবে, এ সোনাকিয়া, ‘স্কাল ক্যাপ অভ অ্যান আর্লি ম্যান ফ্রম দ্য নর্মদা ভ্যালি অ্যালুভিয়াম (প্লাইসটোসিন) অভ সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া’, আমেরিকান অ্যানথ্রোপলজিস্ট ৮৭ (১৯৮৫) পৃ. ৬১২-১৬

। এই তারিখগুলি ও মানববিকাশের ধারা সম্পর্কে সাম্প্রতিক জ্ঞানের একটি সহজ ধারণার জন্য, রিক গোর , ‘দ্য ফার্স্ট স্টেপস’, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃ. ৭২-৯৭, বিশেষ করে ‘ডাবল ম্যাপ সাপ্লিমেন্ট’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন সম্পর্কে তারিখে দ্বিমত আছে। কারও কারও ব্যাখ্যায় এদের কয়েকটির বয়স ১ মিলিয়ন বছর।

। এর আগেও দু-একটি স্থান থেকে এরকম আবিষ্কারের দাবি আছে, তবে এই দাবিগুলি অনেক আগের ও নিদর্শনগুলি হারিয়ে গেছে। এই সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য, কে এ আর কেনেডি, ‘প্রিহিস্টোরিক স্কেলিটাল রেকর্ড অভ ম্যান ইন সাউথ এশিয়া’, অ্যানুয়াল রিভিউ অভ অ্যানথ্রোপলজি ৯ (১৯৮০) পৃ. ৩৯১-৪৩২।

। আর ডেনেল, এইচ এম রেনডেল এবং ই হেইলউড, ‘আর্লি টুল মেকিং ইন এশিয়া: টু মিলিয়ন ইয়ার ওলড আর্টিফ্যাকটস ইন পাকিস্তান’, অ্যানটিকুইটি ৬২ (১৯৮৮) পৃ, ৯৮-১০৬। এইচ এম রেনডেল ও আর ডেনেল, ‘ডেটেড লোয়ার প্যালিওলিথিক আর্টিফ্যাকটস ফ্রম নর্দার্ন পাকিস্তান’, কারেনট অ্যানথ্রোপলজি ২৬ (১৯৮৫), পৃ. ২৯৩। এইচ এম রেনডেল, আর ডেনেল ও এম এ হালিম, প্লাইসটোসিন অ্যান্ড প্যালিওলিথিক ইনভেসটিগেশনস ইন দ্য সোয়ান ভ্যালি, নর্দার্ন পাকিস্তান, অকসফোর্ড, ১৯৮৯। সম্প্রতিকালের একটি আলোচনা, আর ডেনেল ও অন্যরা, ‘দ্য নাইনটিন-নাইনটি ফিল্ডসিজন অভ দ্য ব্রিটিশ আর্কিওলজিকাল মিশন টু পাকিস্তান ইন দ্য বারোথ এরিয়া অভ দ্য পাব্বি হিলস, নর্দার্ন পাকিস্তান’, এ জে গেইল এবং জি জে আর মেভিসেন (স.), সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি, ১৯৯১, স্টুটগার্ট, ১৯৯৩, পৃ. ৪৯-৬৩।

। বি সি ভার্মা এবং জে পি শ্রীবাস্তব, ‘আর্লি প্যালিওলিথিক সাইটস অভ দ্য আউটার শিবালিক বেল্ট ইন সিরমুর ডিস্ট্রিক্ট, হিমাচল প্রদেশ—দেয়ার এজ অ্যান্ড স্ট্রাটিগ্রাফিক পজিশন’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ৮ (১৯৮৪), পৃ. ১৩-১৯। লাদাখের জন্য, জি ত্রিপাঠী, বি সি ভার্মা অ্যান্ড আর কে অরোরা, ‘লোয়ার অ্যান্ড মিডল প্যালিওলিথিক আরটিফ্যাকটস ফ্রম দ্য কোয়াটেরনারি সেডিমেন্টস অভ আপার ইনডাস ভ্যালি,’ বুলেটিন অভ দ্য ইন্ডিয়ান জিওলজিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশন ২১ (১৯৮৮), পৃ. ৮১-৮৮।

। মহারাষ্ট্রের এই ছাই-এর চিহ্ন নিয়ে সম্প্রতি একটি মতের জন্য, ফিল শেন ও অন্যরা, ‘এ নিউ জিওকেমিকাল এভিডেনস ফর দ্য ইয়ংগেস্ট টোবা টাফ ইন ইন্ডিয়া’, কোয়াটেরনারি রিসার্চ, ৪৪ (১৯৯৫), পৃ. ২০০-২০৪। গোলমাল যে মেটেনি তা বুঝতে, শীলা মিশ্র, ‘ক্রোনোলজি অভ দ্য ইন্ডিয়ান স্টোন এজ: দ্য ইমপ্যাকট অভ রিসেন্ট অ্যাবসলিউট অ্যান্ড রিলেটিভ ডেটিং অ্যাটেমপটস’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ২০ (১৯৯৫), পৃ. ১১-১৬।

। পুরাপ্রস্তর যুগের বিস্তৃতি সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে হলে (বিশদ গ্রন্থপঞ্জি-সহ), ভি এন মিশ্র, ‘স্টোন এজ ইন্ডিয়া: অ্যান ইকলজিকাল পারস্পেকটিভ’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ১৪, ১৯৮৯, পৃ. ১৭-৬৪; পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের ছোটনাগপুর অধিত্যকায় নিদর্শনের কথা পাওয়া যাবে, দিলীপ কে চক্রবর্তী, আর্কিওলজি অভ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া: ছোটনাগপুর প্ল্যাটো অ্যান্ড ওয়েস্ট বেঙ্গল, (দিল্লি, ১৯৯৩), ও বাসুদেব নারায়ণ, দ্য হিস্টরি অভ বিহার, (পাটনা, ১৯৯৫)।

। ডি পি অগ্রওয়াল, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইন ইন্ডিয়া থ্রু এজেস, দিল্লি, ১৯৯২।

। বি অলচিন এবং অন্যরা, প্রিহিস্টরি অ্যান্ড প্যালিওজিওগ্রাফি অভ দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট, লন্ডন, ১৯৭৮।

১০। তারিখ নিয়ে একটি আলোচনার জন্য, এইচ রাঘবন এবং অন্যরা, ‘রেডিওমেট্রিক ডেটিং অভ এ কোয়াটেরনারি ডিউন সেকশন, দিদওয়ানা, রাজস্থান’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ১৩ (১৯৮৯), পৃ. ১৯-২২।

১১। জি সিং এবং অন্যরা, ‘লেট কোয়াটেরনারি হিস্টরি অভ ভেজিটেশন অ্যান্ড ক্লাইমেট অভ দ্য রাজস্থান ডেজার্ট, ইন্ডিয়া’, ফিলসফিকাল ট্রানসাকসনস অভ দ্য রয়াল সোসাইটি অভ লন্ডন (বি. বায়োলজিকাল সায়েন্সেস, ২৬৭ (১৯৭৪),) পৃ. ৪৬৭-৫০১।

১২। সমস্ত পশ্চিম উপকুল নিয়ে একটি আলোচনা, ভি এস কালে ও এস এন রাজগুরু, ‘নিওজিন অ্যান্ড কোয়াটেরনারি ট্রানসগেশনাল অ্যান্ড রিগ্রেশনাল হিস্টরি অভ দ্য ওয়েস্ট কোস্ট অভ ইন্ডিয়া: অ্যান ওভারভিউ’, বুলেটিন অভ দ্য ডেকান কলেজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ৪৪ (১৯৮৫)। পৃ. ১৫৩-৬৩; এ ছাড়া, অগ্রওয়াল, টীকা ৮ দ্রষ্টব্য।

১৩। এস এন রাজগুরু, ‘প্রবলেম অভ লেট প্লাইস্টোসিন এরিডিটি ইন ইন্ডিয়া’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ৭ (১৯৮৩)। পৃ. ১২৭-৯।

১৪। জি এল বাদাম, প্লাইস্টোসিন ফনা অভ ইন্ডিয়া উইথ স্পেশাল রেফারেনস টু দ্য শিবালিকস, পুনে, ১৯৭৯। শুশুনিয়া পাহাড়ের জন্য বিশেষ করে, এম ভি এ শাস্ত্রী, ‘প্লাইস্টোসিন ভারটিব্রেটস ফ্রম শুশুনিয়া, বাঁকুড়া ডিষ্ট্রিকট, ওয়েস্ট বেঙ্গল’, ইন্ডিয়ান মিনারেলস, ২০ (১৯৬৮); অরুণ কে দত্ত, ‘অকারেনস অভ ফসিলস অভ লায়ন অ্যান্ড স্পটেড হায়েনা ফ্রম প্লাইস্টোসিন ডিপোজিটস অভ শুশুনিয়া, বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট’, জার্নাল অভ দ্য জিওলজিকাল সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া, ১৭ (১৯৭৬), পৃ. ৩৮৬-৯১।

১৫। ৬ নং টীকায় শীলা মিশ্র এবং ৭ নং টীকায় ভি এন মিশ্র দ্রষ্টব্য।

১৬। এইচ ডি সাঙ্কালিয়া, স্টোন এজ টুলস: দেয়ার টেকনিকস, নেমস অ্যান্ড প্রোবাল ফাংশানস, পুনে, ১৯৬৪। এই প্রসঙ্গে আর একটি সুবিধাজনক বই, জ্যাক বোরদাজ, টুলস অভ দ্য ওলড অ্যান্ড নিউ স্টোন এজ, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৯ সংস্করণ।

১৭। ভি এন মিশ্র এবং অন্যান্য, ‘অ্যাশুলিয়ান অকুপেশন অ্যান্ড ইভলভিং ল্যান্ডস্কেপ অ্যারাউন্ড দিদওয়ানা ইন দ্য থর ডেজার্ট, ইন্ডিয়া’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট. ৬ (১৯৮২)। পৃ. ৭২-৮৬; ভি এন মিশ্র এবং অন্যান্য, ‘লেট প্লাইস্টোসিন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড অ্যাশুলিয়ান কালচার অ্যারাউন্ড দিওয়ানা, রাজস্থান’, প্রসিডিংস অভ দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি ১৯৮৮, ৫৪, (এ), পৃ. ৪২৫-৩৮।

১৮। কে পাদায়া, দ্য আশুলিয়ান কালচার অভ হুনস্‌গি ভ্যালি (পেনিনসুলার ইন্ডিয়া): এ সেটলমেন্ট সিসটেম পারস্পেকটিভ, পুনে, ১৯৮২।

১৯। পি সি পন্‌থ অ্যান্ড বিদুলা জয়সোয়াল, পৈসরা, দ্য স্টোন এজ সেটলমেন্ট অভ বিহার, দিল্লি, ১৯৯১।

২০। ভি এন মিশ্র, ‘দ্য অ্যাশুলিয়ান ইন্ডাষ্ট্রি অভ রক শেলটার থ্রি-এফ-টোয়েন্টি থ্রি’, অস্ট্রেলিয়ান আর্কিওলজি ৮, ১৯৭৮, পৃ. ৬৩-১০৬ ; ভি এন মিশ্র, ‘দ্য অ্যাশুলিয়ান সাকসেশন অ্যাট ভীমবেঠকা’, রিসেন্ট অ্যাডভান্সেস ইন্‌ ইন্দো প্যাসিফিক প্রিহিস্টরি, ভি এন মিশ্র এবং পি বেলউড (স.) দিল্লি, ১৯৮৫, পৃ. ৩৫-৪৮।

২১। এম এল কে মূর্তি, ‘এথনোআর্কিওলজি অভ দ্য কুর্নুল কেভ এরিয়াস’, ওয়ার্ল্ড আর্কিওলজি ১৭, ১৯৮৫, পৃ. ১৯২-২০৫।

২২। ডি আর রাজু, স্টোন এজ হানটার-গ্যাদারারস: অ্যান এথনআর্কিওলজি অভ কাডাপা রিজিয়ন, সাউথ ইস্ট ইন্ডিয়া, পুনে, ১৯৮৮।

২৩। জে এম কোনায়ের এবং অন্যান্য, ‘অ্যান আপার প্যালিওলিথিক শ্রাইন ইন ইন্ডিয়া?’ অ্যানটিকুইটি ৫৭, ১৯৮৩, পৃ. ৮৮-৯৪।

২৪। ৪ নং টীকায় রেনডেল, ডেনেল ও হালিম দ্রষ্টব্য।

২৫। পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৭ নং টীকায় দিলীপ কে চক্রবর্তী দ্রষ্টব্য। এ ছাড়া, আর কে চট্টোপাধ্যায়, ‘প্যালিওলিথিক ওয়েস্ট বেঙ্গল’, প্রত্নসমীক্ষা, ১ (১৯৯২), পৃ. ২৭-৬০; বাংলাদেশের জন্য, দিলীপ কে চক্রবর্তী, এনশেন্ট বাংলাদেশ, এ স্টাডি অভ দ্য আর্কিওলজিকাল সোর্সেস (দিল্লি ও ঢাকা ১৯৯২)।

২৬। একটি সুসংহত আলোচনার জন্য, আর জি বেডনারিক, ‘প্যালিওলিথিক আর্ট ইন ইন্ডিয়া’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট. ১৮ (১৯৯৩), পৃ. ৩৩-৪০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *