সর্বনাশিনী – সায়ন্তনী পূততুন্ড / Sorbonashini – Sayantani Putatunda
প্রকাশকাল – মার্চ ২০২২
.
উৎসর্গ – আমার জেঠিমাকে
***
কিছু কিছু রাত অত্যন্ত অভিজাত। শান্ত, সুগন্ধি। নিস্তরঙ্গ নৈঃশব্দ্যের চাদর গায়ে দিয়ে নীরবে ঘুমিয়ে থাকে। কখনো কখনো অবশ্য মুখচোরা বৃষ্টি রিমঝিম করে ভিজিয়ে দেয় তার অন্ধকার বুক। তখন সেই নির্লিপ্ত বুকে অনেকরকম শব্দ ও গন্ধের আস্বাদ পাওয়া যায়। কখনো দ্বিমিদ্রিমি মাদল বাজে, কখনো জলতরঙ্গের মিষ্টি ঝংকার বেজে ওঠে। অন্ধকারের ভেতরেই মাটির সোঁদা গন্ধ আর ভেজা ঘাসের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। এক অব্যক্ত আঁধার প্রেমিকের মতো পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টিকে। চারদিকে শুধু টুপটাপ, রিমঝিমের মূৰ্ছনা চলতে থাকে।
আবার কিছু রাত স্বভাবতই বন্য প্রকৃতির। সেখানে আলো-আঁধারির বিপজ্জনক খেলা চলতে থাকে। কিছুটা প্রকাশ্য, কিছু অপ্রকাশ্য। বৃষ্টিপাত হলেও তা অত্যন্ত দুর্দম, দুর্দান্ত। সেখানে প্রেমিকের আদরের মতো রোমান্টিসিজম নেই। বরং রিরংসার আদিম আগুন উদ্ধত লেলিহান শিখায় দাউদাউ করে জ্বলছে। সেখানেও শব্দ আছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী! সে শব্দ প্রাণে আরাম দেয় না, চূড়ান্ত দহনে জ্বালিয়ে মারে।
ঠিক তেমনই কিছু শব্দ এখন এই ঘর থেকে ভেসে আসছে। নরম সাদা ধবধবে বিছানাটা থেকে থেকে যেন শিউরে শিউরে উঠছে। মাঝেমধ্যেই একটা প্রবল শীকার বিপজ্জনকভাবে কর্ণেন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে তুলছে। ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ এতটাই আক্রমণাত্মক যে মনে হয়, দুটো কালান্তক প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ বুঝি পরস্পরকে আক্রমণ করেছে। পারলে গিলেই খাবে! দুটো নগ্ন শরীর নীল আলোর আভায় মিলেমিশে যাচ্ছে প্রেমে কিংবা যুদ্ধে!
ঘরের একপাশে একটা টেবিলের ওপরে পাতা আছে দাবার ছক। নরম নীলাভ আলোর মোহময়ী রেখা চেসবোর্ডের সাদা-কালো-মসৃণ খোপের ওপর পড়েই পিছলে যাচ্ছে। সাদা-কালো যুঁটিগুলো স্বল্প অথচ মোলায়েম আলো পেয়ে চিকচিকিয়ে উঠছে! খেলা এখনও শেষ হয়নি। খুঁটিগুলো অমীমাংসিত, অবিন্যস্তভাবেই পড়ে রয়েছে।
কিন্তু দৃশ্যটা ভারি অদ্ভুত! একটা অত্যন্ত বিপজ্জনক মুহূর্তে এসে স্থগিত হয়েছে খেলাটা! বিপদটা অবশ্য খুব সহজে চোখে পড়ে না। তবে একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে সাদা রঙের রাজার অজান্তেই বিপজ্জনকভাবে তার দিকে এগিয়ে আসছে কালো রঙের রানি! সাদা ঘোড়া, হাতি অন্যান্য দিকে আক্রমণ করতে ও ঠেকাতে এতটাই ব্যস্ত যে তাদের নজরেই পড়েনি যে রাজা অরক্ষিত ও বিপন্ন!
ওদিকে বিছানায় রাজা প্রায় রানিকে আদরে আদরে বিধ্বস্ত করে তুলছে। রানিও হার মানবে না। একের পর এক লাভ বাইটে অস্থির পুরুষ। দাবার মতো এই খেলাটাও এখনও অমীমাংসিত। কে জিতবে বোঝা মুশকিল! পুরুষটি যতই নারীর ওপরে কবজা করতে চাইছে, নারীটি মোহিনী অথচ কামাতুর হাসি হেসে অধরা রহস্যের মতো পিছলে যাচ্ছে। তার শীকারের শব্দ, খিলখিল হাসি ঘনিয়ে আসা সর্বনাশের অশনি সংকেত দেয়। পুরুষটি সবলে তাকে দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ নারী অবদমিত হতে জানে না! সে সপাটে একটা মোচড় দিয়ে উঠে বসেছে পুরুষের ওপর! রাজা নয়, রানিই এ খেলার চালিকাশক্তি! সেটা এই বুভুক্ষু পুরুষটাকে বোঝানো দরকার।
নারীটি শানিত দৃষ্টিতে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পুরুষটির দিকে। এই মুহূর্তে কী অসহায় লাগছে লোকটাকে! একটা বেঢপ ভুড়িওয়ালা থলথলে মাংসপিণ্ড ছাড়া ওকে আর কিছু বলা যায় না। বিবস্ত্র পুরুষ এত কুৎসিতও হতে পারে! এখন কুতকুতে চোখে ভীষণ কামনার আর্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দেখলেই ঘেন্না করে! জঘণ্য চেহারার মতো লোকটার স্বভাবটাও অত্যন্ত কুৎসিত! মেয়ে দেখলেই কামড়াতে আসে। মেয়ে মানেই যেন মাংস! ভোগ্যবস্তু! এরা এমনই হয়! এরা চিরকালই এমন!
প্লিজ বে-বি!
লোকটা কাতরে উঠল। মেয়েটি জানে ও আর বেশিক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। ওর সে ক্ষমতাই নেই। চাইলে এখনই পরিতৃপ্ত করতে পারে পুরুষটিকে। বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে মিটিয়ে দিতে পারে সব তৃষ্ণা। কিন্তু করবে না। ওকে বুঝতে হবে যে দাবার ছকে কালো রানি চিরদিনই সাদা রাজার চেয়ে শক্তিশালী! গায়ে অসুরের মতো জোর থাকলেই সব যুদ্ধ জেতা যায় না।
মেয়েটি হেসে উঠে তার নরম ঠোঁট লোকটির পুরু ঠোঁটের ওপরে নামিয়ে আনল। একটা সুদীর্ঘ চুম্বন! তার সাপের মতো বিস্ত সুগন্ধি চুল কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে দিল লোকটার মুখ। রোমশ হাত দুটো খেলে বেড়াচ্ছে পেলব, মসৃণ দেহের বিপজ্জনক ভাঁজগুলোয়। কোমল পিঠের ওপরে প্রবল চাপ অনুভব করল মেয়েটি। সে একটুও বিচলিত না হয়ে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে লাগল কঠিন পৌরুষকে। অদ্ভুত একটা দুলুনি! যেন একটা বেসামাল জাহাজ সমুদ্রের দুরন্ত ধাক্কায় থেকে থেকে দুলে উঠছে। একটা জ্বালা শরীর থেকে ক্রমাগত মনের দিকে যাচ্ছে। নারী অগ্নিগর্ভা! পুরুষ অধৈর্য! এখন তার রিক্ত হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ক্রমাগতই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে সে!
অথচ মেয়েটি তাকে কিছুতেই সম্পূর্ণ গ্রহণ করছে না। অজগর যেমন শিকারকে সযত্নে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে একটু একটু করে তার জীবনীশক্তি
ও সমস্ত লড়াই শেষ করতে থাকে এবং অবশেষে শিকার যখন চরম যন্ত্রণায় মৃত্যু প্রার্থনা করছে, তখন অল্প অল্প করে গিলতে শুরু করে, অবিকল ঠিক তেমনই করছে সে! রমণের সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রতিটা পদক্ষেপের যন্ত্রণাও বুঝিয়ে দিচ্ছে।
কাম্ অহ্ হানি! অধৈর্য মানুষটা খলিত স্বরে বলে–এবার তো এসো।
মেয়েটা ফের হেসে উঠল। মেঝের ওপর ঝনঝনিয়ে বুঝি আছড়ে পড়ল বেলোয়ারি ঝাড়। হাসির মধ্যে সুর আর মাদকতার মাত্রা প্রবল।
আবার দুলুনিটা ফিরে এলো। আরও প্রবলভাবে। আবেগে, অসহায়তায় চোখ বুজল পুরুষ। দুলছে সে! সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের মতো কাঁপছে। আস্তে আস্তে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে একটু একটু করে। চেতনা প্রায় শেষ বিন্দুতে গিয়ে ঠেকেছে। আর নিয়ন্ত্রণে নেই সে। বেসামাল ঘোড়ার মতো হৃৎপিণ্ডটা দামাল হয়ে উঠেছে! সমস্ত সংসার সুপ্ত হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে…!
পুরুষটি লক্ষও করেনি মেয়েটির ঠোঁটে একটা তীক্ষ্ণ হাসি ভেসে উঠল। কী ভীষণ নিষ্ঠুর সে হাসি! যে কথাটা অসমাপ্ত খেলার শেষে বলা উচিত ছিল, এই মুহূর্তে সেটাই বলল সে। আস্তে আস্তে নাগিনির মতো হিসহিসিয়ে উচ্চারণ করল–
চেকমেট!
মেয়েটার চোখে হিংস্র উল্লাস নেচে ওঠে। সে জানে চেসবোর্ডের খেলা শেষ হোক না হোক, এবার এই খেলাটা শেষ হবে! গত তিন মাস ধরে এই খেলা চলছিল। এবার তার অন্তিমপর্ব। বোকা পুরুষটা জানে না দাবায় সবচেয়ে শক্তিশালী খুঁটিটি রাজা নয়-রানি! আর একটু পরেই নিজের চোখের সামনে নিজেরই প্রেমিককে তিলে তিলে মরতে দেখবে সে…!
এই নিয়ে তৃতীয়বার!
*
অন্ধকার চৌখুপি ঘরে মাথা নিচু করে বসেছিল লোকটা।
ওর একেবারে মাথার ওপরে টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। তাতে মানুষটার শীর্ণকায় চেহারাটা আলো-ছায়ায় মাখামাখি হয়ে আরও পাঁশুটে হয়ে গিয়েছে। একেবারে টিপিক্যাল শুকনো ছুঁচো মার্কা চেহারা। ছোটখাটো নুয়ে পড়া দেহ! দুই পাশে ঝোলা গোফ এখন আরও বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ঝুলে পড়েছে। হাত-পা কাঠি কাঠি! সবচেয়ে ভয়ংকর তার গাত্রবর্ণ! দুনিয়ায় অনেক কালো মানুষ আছে, কিন্তু এরকম বিতিকিচ্ছিরি রকমের কালো খুব কমই দেখা যায়। চামড়া নয়, প্রাচীন বাড়ির ছ্যালা পড়া, নোনাধরা দেওয়াল! মানুষ নয়, মানুষের প্রেতাত্মা! এই মুহূর্তে ওকে দেখলে কেউ বলবে যে, এই লোকটাই গত কয়েকমাস ধরে তিলোত্তমার বুকে হ্রাস হয়ে ঘুরছিল!
এই অতি সাধারণ দর্শন, লো প্রোফাইলের মানুষটি এখনও পর্যন্ত প্রায় হাফ-ডজন রেপ-মার্ডার করেছে। এবং কাজ সারার পর প্রত্যেকবার ভিকটিমের মুখ অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিত সে। পুলিশ রীতিমতো ল্যাজে গোবরে হয়ে শেষমেশ কেসটা সিআইডিকে দিয়ে দিয়েছিল। অনেক হাঙ্গামার পর শেষ পর্যন্ত এই সাইকোটিকে বাগে এনেছে সিআইডি, হোমিসাইড। কিন্তু কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না তার স্বীকারোক্তি! এই হাড়-পাঁজরা সর্বস্ব ক্রিমিনালের মধ্যে যে এত শক্তি আছে তা কে জানত! একেবারে বজ্রকঠিন শক্তিতে মুখ এঁটে বসে আছে সে। প্রচুর কচুয়া ধোলাইয়ের পরও মুখ খোলার নাম নেই!
বাইরে হঠাৎই পুলিশ বুটের ভারি শব্দ! একাধিক ভারি জুতো দ্রুত এবং সাবলীল ছন্দে এদিকেই হেঁটে আসছে। লোহার দরজাটা আচমকা খুলে যাওয়ার সজোর আওয়াজে সচকিত হয়ে মুখ তুলে তাকাল সে। এতক্ষণ ধরে এই শব্দটা শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তবু কৌতূহলবশতই চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল অতিথিদের। এখন তার ওপর হাত সাফ করতে আবার নতুন কে এলো!
স্যার, ভীষণ মোটা চামড়া এটার। একটা কণ্ঠস্বর সজোরে বলে ওঠে–পিটিয়ে পিটিয়ে পেটাই পরোটা বানিয়ে দিয়েছি। তবু মুখ খুলছে না! অসম্ভব নির্লজ্জ পাবলিক!
এইবার আগন্তুকরা আলোর তলায় এসে দাঁড়াল। এদের মধ্যে দুজনকে সে আক্ষরিক অর্থেই হাড়ে হাড়ে চেনে। কারণ এতক্ষণ ধরে এরাই তার হাড় ভাঙার তাল করছিল। বাকি দুজনের মধ্যেও একজনের মুখ চেনা। লম্বা চেহারার ফরসা সুদর্শন যুবকটিই তাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু পাশের জন…!
ও কী মানুষ!… না অপূর্ব সুন্দর একটা মূর্তি!
একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ তাকে ভালোভাবে মেপে নিল। কানে এলো মোলায়েম অথচ উষ্ণ, গম্ভীর কণ্ঠস্বর–এ কী! পুরো বেগুনপোড়া বানিয়ে ফেললে যে! মারের চোটে ওর সারা গায়ে কালশিটে পড়ে গেছে নাকি!
কালশিটে নয়। ফরসা চেহারার সুদর্শন অফিসার হেসে ফেলেছে। হাসতে হাসতেই বলল–অরিজিনাল কমপ্লেকশন স্যার। একদম হলমার্ক।
অরিজিনাল বলছ? গম্ভীর কণ্ঠ অবিচলিত ভাবেই বলে–একটু অ্যাসিড টেস্ট করে দেখা যাক।
ইঙ্গিতটা বুঝে নিয়ে বলল অফিসারটি–নিয়ে আসব?
একদম। ল্যাব থেকে একদম নির্ভেজাল জিনিস নিয়ে এসো অর্ণব। ড. চ্যাটার্জীকে বলাই আছে! জাস্ট বললেই ক্রেটটা দিয়ে দেবেন। ওর অ্যাসিডটা তেমন জোরালো ছিল না! ভিকটিমের শুধু মুখই পুড়েছে। আর বিশেষ কিছু হয়নি। আসল অ্যাসিড কাকে বলে সেটাও ওর দেখা উচিত।
ও কে স্যার।
ফরসা অফিসার, তথা অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। সম্ভবত হুকুম তামিল করতেই গেল। বাকিদের তথাকথিত স্যার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন তার সামনে। অন্য দুজন তার পেছনে সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে আছে। আসামির দিকে কিছুক্ষণ একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বুকপকেট থেকে বের করে আনলেন সিগারেটের প্যাকেট। নিজে একটা স্টিক তুলে নিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন ওর দিকে। ফের সেই শান্ত, সান্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে–
নিবি?
কোনোমতে মাথা নেড়ে না বলল লোকটা। অ্যাসিড শব্দটা শুনেই ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে। এরা কি তার ওপরে অ্যাসিড ঢালবে নাকি! এতদিন সে সুন্দরী মেয়েদের মুখের ওপর অ্যাসিড ঢেলে চরম আনন্দ পেয়েছে। মনে মনে বলেছে–পোড়, মাগি পোড়! সুন্দর মুখের জন্য এত নখরা! এবার পোড়া মুখ নিয়ে নরকে যা!
কিন্তু এবার কি তবে তারই পোড়ার পালা! সে অবশ্য মেয়েগুলোকে মারার পর অ্যাসিড ঢেলেছিল। এরা তাকে জীবন্তই পোড়াবে না তো!…
বুকের মধ্যে ভয় আঁচড় কাটছে। রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে একসা হচ্ছে সে! তবু সামনে বসে থাকা মানুষটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না! চোখ ফেরানো যায় না! এই হচ্ছে পুরুষ! এই হচ্ছে যৌবন! যৌবনের ঔদ্ধত্য, উল্লাস যেন ফেটে পড়ছে। যখন ও সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন মনে হচ্ছিল আর্ট গ্যালারিতে যে মূর্তিগুলোকে দেখে সাহেব-মেমরা আহ্লাদে গলে যায়, সেই মূর্তিই বুঝি জ্যান্ত হয়ে এসে দাঁড়াল! লোকে বলে ভগবানের হাতে নাকি বিশেষ সময় নেই। নিজের চেহারা বারবার আয়নায় দেখে তারও ধারণা তেমনই হয়েছিল। কিন্তু এখন সে ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো। যদি ওপরওয়ালা এতই ব্যস্ত, তবে এই জিনিস তার হাত থেকে বেরোয় কী করে!
ঈষৎ বাদামি মসৃণ তুক, দীর্ঘ ঋজু উদ্ধত দেই, অসম্ভব ধারালো মুখের আদল বোধ হয় একেবারে মেপে মেপে তৈরি করা হয়েছে! কোথাও একটু বেশি বা একটু কম নেই! চওড়া কাঁধ, সুগঠিত গ্রীবা, বুক আর চওড়া কবজি কী প্রচণ্ড পুরুষালি! কোমর নিখুঁত সরু! চোখ দুটো শান্ত, অথচ প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ! লোকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল তাকে। কী পুরুষ! শার্টের ওপর থেকেই এমন! না জানি শার্টের তলায় কত কারুকার্য আছে! সে নিজে যদি এমন সিংহের মতো পুরুষ হতে পারত তবে জীবনটাই হয়তো অন্যরকম হতো। বউ তার কথায় ওঠবস কত, বিছানা গরম করে দিত! মেয়েরা পেছন পেছন ঘুরঘুর করত। তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য পাগল হতো অনেক সুন্দরী! এতগুলো খুন করতে হতো না…!
সে ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করে–স্যার, আপনাদের কিছু ভুল হচ্ছে…আমি কিছু করিনি!
ফস্ করে জ্বলে উঠল লাইটার। সামনের মানুষটি ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে বেশ কয়েকবার ধোয়া ছাড়লেন। তারপর খুব ঠান্ডাভাবেই বললেন–দ্যাখ তোতারাম–এই ডায়লগ শুনিয়ে লাভ নেই। এখনও সময় আছে, সব খুলে বল্। নয়তো আমাদের আরও একটা ভুল হবে। সেটা তোর পক্ষে খুব ভালো হবে না।
সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে। সুগঠিত লম্বাটে মুখ, চোখ দুটোয় সামান্য রাগী রাগী দৃষ্টি। চোয়ালের দৃঢ়তায় স্পষ্ট, এ খুব সহজ মানুষ নয়। একদম ঠান্ডা মাথার মক্কেল! যা বলছে, করেও ফেলতে পারে। বুকের ভেতরে ভয়টা ফের গুড়গুড় করে ওঠে! সত্যিই কি অ্যাসিড মারবে নাকি! ….
ছয় ছয়টা রেপ এবং মার্ডার! স্যার একটু ঝুঁকে বসলেন। নিচু স্বরে কেটে কেটে বললেন–আমার জুনিয়রের ধারণা এটা সেফ সাইকো কিলিং! খুন আর রেপের নেশায় করা। কিন্তু আমার থিয়োরি একটু আলাদা! ঐ মেয়েগুলো তোর মতো একটা রোড়-রোমিওকে পাত্তা দেয়নি বলেই ওদের ওপর মর্দানগি ফলিয়েছিস তুই! তোর মেল-ইগো হার্ট হয়েছে বলে সেফ মেরে ফেললি! তাই না?
লোকটা কেঁপে ওঠে! যে সত্যটা একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে, সেটা এই মানুষটা এমন অবলীলায় বুঝে ফেলল কী করে! সে বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে! হা! আজ পর্যন্ত সবাই তার পৌরুষকে অবমাননা করেছে। তার বৌও রাতের বেলা ধামসে ধুমসে শেষ পর্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে যায়! উঠতে-বসতে খিস্তি মারে-ল্যাওড়া বোকাচোদা কোথাকার! ঐ মেয়েগুলোও তার পৌরুষকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউ কদর করেনি তার! সেজন্যই…!
ওর মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই স্যার বুঝলেন ঢিলটা মোক্ষম জায়গায় লেগেছে। তার তরুণ, সুন্দর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বললেন–মর্দানগি! মেল ইগো! আচ্ছা!
কথাটা বলেই দীর্ঘ টানটান দেহটা ফের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পিছনে তখনও দুই অফিসার দাঁড়িয়ে। তাদের দিকে বজ্রকণ্ঠে নির্দেশ গেল–দুজন লেডি অফিসারকে ডেকে নিয়ে আসুন তো। বলবেন, যেন অবশ্যই ওঁরা গ্লাভস পরে আসেন। এ ব্যাটা জবানবন্দি দিক আর না দিক, ওর মেল ইগো বরবাদ করেই ছাড়ব। পৌরুষ মাড়াচ্ছে শালা!
ইয়েস স্যার! দুজনের মধ্যে একজন দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল বাইরে।
ইতোমধ্যেই অর্ণব নামক অফিসারটি একটা বড়সড়ো ক্রেট নিয়ে এসে ঢুকল। লোকটা সভয়ে লক্ষ করে অফিসাররা ওর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন গোটা কয়েক বড় বড় বালবের মতো কী যেন! তার ভেতরে যে তরল কিছু একটা আছে সেটা স্পষ্ট! অ্যাসিড বালব নয় তো! কী সর্বনাশ! এই অফিসারটি কি নিজেও উন্মাদ!
তার মনের কথা বোধ হয় উলটোদিকের মানুষটিও বুঝলেন। একটা দুষ্টু হাসি তার মুখে ভেসে ওঠে। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন তিনি–ঠিকই ধরেছিস! তুই আর কত বড় সাইকো! আজ আরও বড় সাইকো দেখে নে!
স্যার!
ততক্ষণে দুজন লেডি অফিসারও এসে হাজির। সশব্দে দীর্ঘ মানুষটিকে স্যালুট ঠুকল তারা। তাদের দেখেই স্যার বললেন–এই তো। মিস বোস আর মিস ঘোষ! আপনাদের মধ্যে কার একটা চমৎকার গন্ডারের চামড়ার লেডিজ ব্যাগ দরকার? এখানে ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে।
লেডি অফিসার দুজন পরম বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকায়। লোকটা অবশ্য সে বিস্ময়ের কারণ বুঝল না। কিন্তু অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসি চাপার চেষ্টা করে। স্যার লেডি অফিসারদের নাম ফের গুলিয়ে ফেলেছেন! এই দুজনের কারোরই পদবি বোস বা ঘোষ নয়! স্বাভাবিকভাবেই ওরা অবাক হয়ে ভাবছে, এই মিস বোস আর মিস ঘোষটা কে?
স্যারের অবশ্য সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি ইশারায় লেডি অফিসারদের কাছে ডাকলেন। খুব নিস্পৃহস্বরে বললেন–এই লোকটার চামড়া গন্ডারের চামড়ার থেকেও মোটা! আপনারা দায়িত্ব নিয়ে ওর চামড়াটা গা থেকে খুলে নিন। তারপর সেটা থেকে চমৎকার ব্যাগ হবে। গ্লাভস পরে। এসেছেন তো?
প্রশ্নটা করার কোনো দরকার ছিল না। দুই মহিলা অফিসারই নির্দেশমতো গ্লাভস পরে এসেছে।
ফ্যান্টাস্টিক! তার চোখের তারায় কৌতুক নেচে ওঠে–দাঁড়ান একটা টেস্ট করে দেখি।
বলতে বলতেই তিনি বিদ্যুৎ গতিতে তুলে নিলেন একটা বাল্ব। পরক্ষণেই লোকটার দিকে ধা করে অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছুঁড়ে দিলেন। যে লোকটা এতক্ষণ এত মারেও টু শব্দটি করেনি সে এবার ভয়ের চোটে লাফিয়ে উঠে প্রাণান্তকর চিৎকার করে উঠেছে! বালবটা সঁই করে তার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সোজা পেছনের দেওয়ালে ধাক্কা খেল! একটা সজোর শব্দ! তার সঙ্গে একরাশ উত্তপ্ত ধোঁয়া! চোখ-মুখ যেন জ্বলে গেল লোকটার। অ্যাসিড! নিঃসন্দেহে এটা অ্যাসিডই! অন্য কিছু নয়।
সে অজান্তেই দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল। পা দুটো থরথর করে। কাঁপছে! শুধু পা নয়, গোটা দেহটাই বাঁশপাতার মতো হিহি করে কাঁপছে তার। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে! সে যদি আরও কয়েক ইঞ্চি লম্বা হতো তবে এতক্ষণে মুখ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত!
ধু–স! স্যার ব্যাজার মুখে বললেন–ফস্কে গেল! এত বেঁটে হতে তোকে কে বলেছিল বে!
জিনিসটা কিন্তু সলিড! পিছন থেকে অর্ণব ভয়ে ভয়ে বলে–আরেকটা ট্রাই করবেন স্যার?
নাঃ, ফাস্ট বোলারের কাজ নয়! মুরলীধরন স্টাইল লাগবে! বলতে বলতেই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন লেডি অফিসারদের দিকে চলে আসুন। টিপ করার জন্য এর থেকে ভালো জিনিস আর পাবেন না! দেখেছেন তো কেমন সুন্দর কালো চামড়া। পুরোটাই তুলে নিতে পারেন। বেশি হয়ে গেলে আমাদের জন্যও একটু রাখবেন। আজকাল টেকসই লেদার বুটের খুব অভাব!
কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই স্মার্ট ভঙ্গিতে বুটের খটখট শব্দ তুলে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। লেডি অফিসাররা ততক্ষণে অ্যাসিড বাল্ব তুলে নিয়েছে। লোকটা কিছু বোঝার বা বলার আগেই তার দিকে ফের রে রে করে ধেয়ে এলো কয়েকটা। গায়ে না লাগলেও আশপাশ ঘেঁষে চলে গেল। সে ততক্ষণে প্রায় শুয়ে পড়েছে। দুহাতে মুখ চেপে প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল–যাবেন না স্যার! বলছি! স-ব বলছি! প্লিজ, বাঁ-চা-ন!
চলে যেতে গিয়েও একটু থমকে দাঁড়ালেন স্যার। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে মনোরম গ্রীবা ভঙ্গি করে তার দিকে তাকালেন। ঠোঁটে ভেসে উঠল সেই পেটেন্ট দুষ্ট হাসি। গম্ভীর স্বরে বললেন–বাঃ অর্ণব! অ্যাসিড টেস্ট তবে কাজে এলো দেখছি! তোতারাম এতক্ষণে কথা সরিৎসাগর হয়েছে!
এক পাশে নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছিল অন্য দুই পুরুষ অফিসার। তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি–আর কী! লিখে নাও স্টেটমেন্ট। আপাতত এ কে এখানেই ক্লোজড। এমন চার্জশিট ফাইল করবে যেন হারামজাদার ফাঁসি ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা না থাকে। আর যদি একটাও মিথ্যে কথা বলে, তবে মিস ঘোষ আর মিস বোস এখানেই আছেন। ওঁরা ওর চামড়া ছাড়িয়ে আমড়া গাছে শুকাতে দেবেন। ভালো লেদারের জিনিস আজকাল দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে।
লোকটার মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে আমসি! সে ঢোক গিলল। স্যার দুই লেডি অফিসারের দিকে তাকিয়ে ভারি মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললেন–হি ইজ অল ইওরস! গোলমাল করলেই বেগুন পোড়াকে সোজা মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দেবেন। গট ইট?
ইয়েস স্যার।
মহিলা অফিসার দুজন মুখ টিপে হাসছে। তাদের দিকে হাত নেড়েই গটগট করে দ্রুত ছন্দে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পেছন পেছন অর্ণবও। অনেকক্ষণ ধরেই সে কী যেন বলার জন্য উশখুশ করছে। বলব বলব করেও বোধ হয় বলতে পারছে না। একবার মুখ খুলছে, পরক্ষণেই চুপ করে যাচ্ছে।
তার স্যার, তথা অফিসার অধিরাজ ব্যানার্জী সম্ভবত ব্যাপারটা আন্দাজ করে হাঁটতে হাঁটতেই বলল–পেটে কিছু থাকলে বলেই ফেল অর্ণব। নয়তো বদহজম হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা!
এবার একটু সাহস করে বলেই বসল অর্ণব- ইয়ে…মানে, আপনি মিস গুপ্ত আর মিস হাজরাকে একেবারে ঘোষ-বোস বানিয়ে দিলেন স্যার!
ফিক করে হেসে ফেলল অধিরাজ–তাতে কী হলো? এখানে থোড়াই কৌন বনেগা ক্রোড়পতি খেলা হচ্ছে যে ঠিক বললেই সাত কোটি মিলবে!
কিন্তু অতগুলো অ্যাসিড বাল্ব! সে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলে ড. চ্যাটার্জী এককথায় দিয়ে দিলেন! আমি তো ভাবতেই পারিনি যে আপনি
সত্যিই লোকটাকে বাল্ব ছুঁড়ে মারবেন! যদি গায়ে লেগে যেত?
আমি চাইলে নিশ্চয়ই লাগত। অধিরাজ স্মিত হাসল–আমার এত খারাপ দিনও আসেনি যে একটা আস্ত লোকের মাথা মিস করব। টিপটা যেখানে করেছিলাম, সেখানেই লেগেছে।
কিন্তু লেডি অফিসাররা তো আপনার মতো জেনে-বুঝে মিস করবে না। স্যার। তার ওপর আপনি আবার হাওয়া দিয়ে এলেন! রাগের মাথায় যদি সত্যি সত্যিই গায়ে মেরে দেয়?
সে নির্বিকারভাবে বলল–মারলে মারবে। সমস্যাটা কী?
এ যে খাঁটি অ্যাসিড! লোকটা তো…!
তুমিও সত্যি অর্ণব! অধিরাজ এবার সজোরে হেসে ওঠে–টাকলুকে চেনো না তুমি? কিপ্টে নম্বর ওয়ান! অত দামি জিনিস এমনিই দিয়ে দেবে। স্রেফ একটাই অ্যাসিড বালব ছিল ওখানে! ওটায় মার্ক করা ছিল। আর ওটাই আমি ভেঙেছি।
তবে! অগাধ বিস্ময়ে অর্ণবের মুখ দিয়ে যেন শব্দ বেরোয় না।–বাকিগুলো…!
বাকিগুলোও খাঁটি জিনিস! ড. চ্যাটার্জীর ল্যাব থেকে কখনো নকল। জিনিস বেরোয় না! সে হাসতে হাসতে জানায়-একদম আসল, বিশুদ্ধ ও চমৎকার এইচ টু ও! অর্থাৎ জল!
অর্ণব হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছিল না। ভয় দেখানোর কী অভিনব পদ্ধতি। শুধু ঐ শুটকো ক্রিমিনালই নয়, সে নিজেও রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিল। আর ড. চ্যাটার্জীই বা কী! একবারের জন্যও বুড়ো বলেনি যে এগুলো সব জল! উলটে বলল–সাবধানে নিয়ে যাও কীর্তিমান! কোনোভাবে একটা যদি বাই এনিচান্স পায়ের ওপর পড়ে, জুতুয়া শুদ্ধ ছিচরণখানাই কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যাবে!
সেই থেকে ভয়ে কাঁটা হয়েছিল সে! কিন্তু এবার তার বেজায় রাগ হয়। ছেলেমানুষ পেয়ে এরকম ভুলভাল জুজুর ভয় দেখানোর মানে কী! এ কী জাতীয় ভূতুড়ি!
আপনমনেই হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে ভেতরে গরগর করছিল অর্ণব। রিভেঞ্জ…রিভেঞ্জ! টাকলু বুড়োর আবার মেপে মেপে জল খাওয়ার অভ্যাস। পাছে অন্য কেউ জল খেয়ে নেয়, তাই ল্যাবের তাকে রাখা জলের শিশিতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের নকল লেবেল সাঁটিয়ে সবাইকে ধাপ্পা দেয়। এরপর কোনোদিন আসল হাইড্রোক্লোরিকের সঙ্গে জলের শিশি পালটাপালটি করে না রেখেছে…!
অত্যন্ত ভয়ংকর প্রতিশোধস্পৃহায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে। সংবিৎ ফিরল অধিরাজের মোবাইলের রিংটোনে। সেতারের ঝংকারে দেশ রাগ বাজছে।
এ ডি জি শিশির সেন!
অধিরাজ ডিসপ্লেতে চোখ রেখেই একটু উত্তেজিত স্বরে বলল। এডিজি, অর্থাৎ অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, শিশির সেন ফোন করছেন। তাঁর ফোন মানেই ফের কিছু গুরুতর ঘটেছে! নতুন কোনো কেস…?
অর্ণবের সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে যায়। শিশির সেনের ফোন মানেই বিপদ! চ্যালেঞ্জিং কেস! এবার আবার কী মারাত্মক অপরাধ ঘটল শহরের বুকে!
অধিরাজ তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো এডিজি সেনের ইস্পাত কঠিন শীতল কণ্ঠস্বর।
ব্যানার্জী! ইমিডিয়েটলি চলে এসো। সর্বনাশিনী স্ট্রাইকস এগেইন! কেসটা এবার আমাদের হেফাজতে!
*
অ্যানাদার ডেথ ফোরকাস্ট! এই নিয়ে তিন নম্বর! খুন কে হবে জানা গেছে। কিন্তু ভগবানই জানেন লাশটা কবে বা কোথায় পাওয়া যাবে! এভাবে একটা খুনিকে ট্র্যাক করা যায়!
এডিজি শিশির সেনের কপালে সুস্পষ্ট চিন্তার ভাঁজ। ঘরে চিল্ এসির শীতল আমেজ সত্ত্বেও তিনি রীতিমতো ঘামছেন। রুমালে বারবার মুখ মোছার ফলে ফরসা মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। মুখ দেখেই বোঝা যায়, প্রবল চাপে আছেন। একটু অসহিষ্ণু ভঙ্গিতেই বললেন–-
এরকম খুনি আমি নিজের ক্যারিয়ারে বাপের জন্মেও দেখিনি! প্রত্যেকবার খুন করার আগে ফেসবুকে ফোরকাস্ট করছে মেয়েটা! বলতে বলতেই মাথা নাড়লেন তিনি–সরি, সরি! মেয়ে কি না স্পষ্ট জানি না। পুরুষও হতে পারে। কিন্তু ফেসবুক প্রোফাইলে একটা মেয়ের ছবিই দেওয়া আছে! পুলিশও সন্দেহ করছে যে, কোনো মেয়ে এর সঙ্গে ডেফিনিটলি যুক্ত আছে। আর সে কি না একটা লোকের মরার আগেই মৃত্যুর ফোরকাস্ট করে বসে থাকে! অথচ কেউ কিছু করতেই পারছে না! এ তো ওপেন চ্যালেঞ্জ! ব্যানার্জী, মিডিয়া এরপর সেফ পুলিশ আর প্রশাসনের মুখে কালি মাখাবে।
অধিরাজ নির্বাক অথচ শান্ত দৃষ্টিতে এডিজি সেনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে অবশ্য কোনো উত্তেজনার চিহ্ন নেই। সে বেশ কিছুদিন ধরেই সর্বনাশিনীর কেসটা ফলো করছে। টেলিভিশনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এই নাম বহুচর্চিত! এরকম ঘটনার সাক্ষী আগে কখনো হয়নি এ শহরে। পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, কিন্তু এ রহস্যের তল পায়নি। শেষ পর্যন্ত তারা হাত তুলে নিয়ে সিআইডি, হোমিসাইডকে কেস ফাইল দিয়ে দিতে বাধ্য হলো।
লোকটা বা মেয়েটা কে তা কেউ জানে না! তার নাম, ধাম, ঠিকানা কিছুই জানা নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু অপূর্ব এক কৃষ্ণাঙ্গীর ছবি দেওয়া একটি প্রোফাইল! ফেসবুক প্রোফাইলটির নাম সর্বনাশিনী! কালো হলে কী হবে! এমন অপূর্ব সুন্দরী নারী খুব কমই চোখে পড়ে। আর কী চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো দেহসৌষ্ঠব তার! প্রথমে সকলেই ভেবেছিল এটা একটা ফেক প্রোফাইল! কিন্তু মেয়েটির অ্যালবামে তার এমন একাধিক ব্যক্তিগত ফটো আছে যেগুলো সচরাচর ফেক প্রোফাইলে থাকে না। অনেক পুরুষই সে সৌন্দর্য দেখে কুপোকাত হয়েছিল।
তখন কে জানত যে এই সৌন্দর্যের পেছনে সত্যি সত্যিই সর্বনাশ লুকিয়ে রয়েছে!
আজ থেকে প্রায় বছরখানেক আগে কলকাতা পুলিশ বাইপাসের সুনসান এলাকায় একটা মৃতদেহ উদ্ধার করে। মৃতদেহটিকে দেখলেই বোঝা যায় যে মৃত ব্যক্তি খুব সাধারণ মানুষ নয়। লাশের পরনের দামি পরিচ্ছদ, হাতের লাখখানেকের বিদেশি ঘড়ি, দামি রত্নখচিত আংটি, দামি মোবাইল এবং সর্বোপরি মানুষটির অভিজাত চেহারা স্পষ্ট বলে দেয় যে লোকটি রীতিমতো অর্থবান! অথচ সেই লোকটির লাশ এরকম বেওয়ারিশ অবস্থায় ঝোঁপের মধ্যে পড়ে আছে!
পুলিশ মোবাইলের সাহায্যেই মৃত ব্যক্তির পরিচয় খুঁজে বের করে। ভদ্রলোকের নাম সঞ্জীব রায়চৌধুরী। সাংঘাতিক নামকরা বিজনেস আইকন না হলেও যথেষ্টই বিত্তবান। এককথায় টাকার কুমির বলা যায়। তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে জানা গেল, যতটা গুণবান ব্যবসায়ী তিনি ছিলেন, ঠিক ততটাই সর্বগুণসম্পন্ন চরিত্রহীন! মদ, মাংস আর মেয়ের একনিষ্ঠ সাধক! তাঁর জীবনে একের পর এক নারী এসেছে। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি উদারহস্ত। তবে সম্প্রতি কোনো এক সুন্দরীর খপ্পরে পড়ে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার আগেই তাঁর জীবনের সঙ্গেই বিচ্ছেদ হয়ে গেল! অবশ্য তাতে যে স্ত্রী বিশেষ দুঃখিত নন তা বুঝতে পুলিশের অসুবিধে হয়নি। ভদ্রমহিলা স্পষ্টাস্পষ্ট জানিয়েই দিলেন, কোন সুন্দরীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক ছিল, তা তিনি জানেন না। সবাই জানে যে মি. রায়চৌধুরী কিছুদিনের জন্য বিজনেস ট্রিপে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর স্ত্রীর সন্দেহ, বিজনেস ট্রিপ নয়, মৃত্যুর সময়ে সঞ্জীব তার সেই গোপন প্রেমিকার সঙ্গেই ছিলেন। এবং সেই সুন্দরীই তাঁকে যমালয়ে পাঠিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ ভিকটিমের স্ত্রীয়ের ওপরেই সন্দেহের তীর বহাল রেখেছিল। বলাইবাহুল্য, যে অবিশ্বাসী স্বামী পরনারীতে আসক্ত, তাঁকে কোনো স্ত্রী-ই ধুপ-ধুনো দিয়ে পুজো করবে না! তার ওপর ডিভোর্স হলে মিসেস রায়চৌধুরীকে পথে বসতে হতো। সুতরাং বিরাট দুটো মোটিভ তাঁর কাছে ছিল। প্রতিশোধ আর অগাধ অর্থ!
এই অবধি পুলিশের তদন্ত কোনোরকম বাধা পায়নি। তারা খুনের থিয়োরি নিয়েই এগোচ্ছিল। যদিও লাশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো চিহ্ন ছিল না। তবু একটা খটকা তো ছিলই! সঞ্জীব রায়চৌধুরীর মতো লোকের যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হতো তবে দেহটা অমন বেওয়ারিশ পড়ে থাকত না! তাঁর সঙ্গে গাড়ি ছিল। সেটা কোথায় গেল! লুটপাটের কেস হলে তাঁর দেহে দামি দামি জিনিস থাকার কথাও নয়। তাছাড়া ট্যুরের নাম করে তিনি ছিলেনই বা কোথায়! সত্যিই কি বাইরে কোথাও ছিলেন? না গল্পটা তাঁর স্ত্রীর স্বকপোলকল্পিত?
পুলিশ যখন এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই ফরেনসিক রিপোর্ট তাদের মাথায় দাম করে এক হাতুড়ির বাড়ি বসিয়ে দিল! ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ স্পষ্ট জানালেন, সঞ্জীব রায়চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতাই নেই! তাঁর মৃত্যুর কারণ ম্যাসিভ লিভার ড্যামেজ, অ্যাকিউট হেপাটিক ও রেনাল ফেইলিওর। তাঁর পাকস্থলীতে কোনোরকম খাদ্য ছিল না। দেহের কোথাও কোনোরকম বিষের অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। সঞ্জীবের যে অতিরিক্ত পরিমাণে মদ্যপানের নেশা ছিল, তা প্রায় সর্বজনবিদিত। তাই একজন ক্রনিক মাতালের ক্ষেত্রে এই ধরনের মৃত্যু মোটেই অস্বাভাবিক নয়! পুলিশ যখন লাশ পায়, তার প্রায় ছিয়ানব্বই ঘণ্টা আগেই তিনি মারা গিয়েছেন।
এইরকম রিপোর্টের পরে পুলিশের আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। ভিকটিমের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে কারোর ওপর কেস করা যায় না। সঞ্জীবের স্ত্রীও খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। ফলস্বরূপ কেসটা চাপা পড়ে যায়।
কিন্তু ঘটনা আদৌ এখানেই থেমে থাকল না।
এর ঠিক তিন মাস পরে ফের সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে! এবার দেহটা একটা আবর্জনার স্তূপে পাওয়া গেল। ভিকটিম মাঝারি মানের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী অর্জুন শিকদার। তিনিও সঞ্জীব রায়চৌধুরীর মতোই নারীপ্রেমিক ও অতিরিক্ত মদ্যপানে অভ্যস্ত। ওঁর স্ত্রীর বিবৃতির সঙ্গে সঞ্জীববাবুর স্ত্রীর বক্তব্যের অদ্ভুত মিল! অর্জুনও নাকি কোনো অজ্ঞাত ব্যুরে ছিলেন! এবং কোনো দিলতোড় সুন্দরী তাঁকেও কবজা করে ফেলেছিল। মৃত্যুর কারণ এবারও এক! ম্যাসিভ লিভার ড্যামেজ, অ্যাকিউট হেপাটিক ও রেনাল ফেইলিওর! মৃত্যু হয়েছে যথারীতি মৃতদেহ আবিষ্কারের আনুমানিক পাঁচদিন আগে।
ফরেনসিক অবশ্য এবার একটি নতুন তথ্য জুড়ল। সঞ্জীবের ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টা তেমন খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। এবার মৃতের দেহে বেশ কিছু লাভ-বাইটের দাগ পাওয়া গেল। বিশেষজ্ঞ জানালেন-ভোগ-চিহ্নগুলো খুব পুরোনো নয়। অর্জুন সেক্সয়ালি অ্যাকটিভ ছিলেন। এবং সম্ভবত মৃত্যুর আগে কোনো নারীর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছিলেন।
এবার পুলিশের বেশ সন্দেহ হলো। হুবহু একই ঘটনা দুজনের সঙ্গে কী করে ঘটে? এটা কি নেহাতই কাকতালীয়? পুলিশের তদন্তকারী অফিসারের ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না। ভিসেরা টেস্ট হলো ভিকটিমের। কিন্তু এমনই কপাল যে এবারও কোনো বিষের অস্তিত্ব নেই! লোকটার মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে হলো! ফরেনসিক এবারও ফেল মারল।
তবুও পুলিশ অফিসার হাল ছাড়লেন না। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল। বিষের অস্তিত্ব নেই ঠিকই, কিন্তু দুজনের মৃত্যুই অদ্ভুতভাবে একরকম! দুজনেই রীতিমতো ধনবান। দুজনের বাড়িতেই বিক্ষুব্ধ স্ত্রী উপস্থিত! দুজনেই মৃত্যুর আগে ট্যুরে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। এখানে কোনো রহস্যময়ী নারীর উপস্থিতির। অন্তত অর্জুনের ক্ষেত্রে ফরেনসিক রিপোর্ট তেমনই বলছে। কে সেই সুন্দরী! দুজন কি আলাদা, নাকি একই মহিলা? কিংবা দুই ব্যবসায়ীর মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? কিংবা দুই ক্ষুব্ধ স্ত্রীর মধ্যে কোনো যোগসাজশ?
প্রত্যেকটা সম্ভাবনা যাচাই করে দেখলেন তদন্তকারী অফিসার। কিন্তু অন্ধকার কমার বদলে গাঢ় হলো আরও বেশি। ভিকটিম দুজনের মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। কেউ কাউকে চিনতেনই না! দুই স্ত্রীর মধ্যে কোনো লিঙ্ক নেই! ফরেনসিকও নতুন কোনো তথ্য দিতে পারছে না! সুপারি র্যাকেট সম্পূর্ণ নীরব। দুই ব্যবসায়ীর গত কয়েকমাসের ব্যাংক স্টেটমেন্টে কোনো সন্দেহজনক লেন-দেন নেই! তার আগে অবশ্য কিছু মহিলাদের নামে ট্রানজাকশান পাওয়া গেল। কিন্তু সে নেহাতই সামান্য। উক্ত মহিলাদের খুঁজে বের করাও হলো। তারা সবাই পেশায় কলগার্ল। একদম প্রফেশনাল! এদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করার জন্য ঐ দুই ব্যবসায়ী উঠে পড়ে লাগবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া প্রত্যেকেই জানাল, কারোর সঙ্গেই স্টেডি অ্যাফেয়ারে যাননি ওঁরা। গত ছয় মাসে ব্যবসাক্ষেত্র আর সংসারের বাইরে কোনো মোটা টাকা খরচও হয়নি। খবরি নেটওয়ার্ককে অ্যাক্টিভ করে দেওয়া হলো। কিন্তু তারাও অনেক চেষ্টা করে কিছুই বের করতে পারল না।
পুলিশ অফিসারটি মহা ধন্দে পড়লেন। স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে এর পেছনে কোনো গোলমাল আছে। কিন্তু সেই ধাঁধাটিও সম্পূর্ণ পর্দানশিন। যদি এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের অ্যাঙ্গেলেও ভাবা যায়, তবুও কোনো মোটিভ নেই! সচরাচর সুন্দরী মহিলারা অর্থবান পুরুষদের টার্গেট করে থাকে তাদের টাকা হাতানোর জন্য। কিন্তু এখানে তেমন কোনো ব্যাপারই দেখা যাচ্ছে না! বরং দুই ক্ষেত্রেই পুরুষ দুজন ক্ষেপে উঠেছিলেন প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীটি বিরাট সম্পত্তির অধিকারিনী প্রায় হতেই যাচ্ছিল। তার আগেই লোক দুটোকে সে মারবে কেন! সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের পেট কেউ কাটে না। তাছাড়া মারলই বা কী দিয়ে? ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব!
ভাবতে ভাবতেই যখন তিনি গলদঘর্ম হয়ে উঠেছেন, এবং তদন্ত প্রায় ডেড-এন্ডে পৌঁছেছে, তখনই এক খবরি অদ্ভুত একটা খবর দিল। অফিসারকে বলল– খবরটা কতখানি কাজে লাগবে জানি না স্যার। কিন্তু বোধ হয় দুই ভিকটিমের মধ্যে কিছু কানেকশন আছে। আপনাকে হোয়াটস-আপে একটা ফেসবুক লিঙ্ক পাঠাচ্ছি। একটু দেখুন তো।
কিছুক্ষণ পরেই এসে পৌঁছল সেই ফেসবুক লিঙ্ক। অফিসার খুলে দেখলেন সেটা সর্বনাশিনী নামের এক অদ্ভুত সুন্দরীর ফেসবুক প্রোফাইল। টাইমলাইনে পোস্ট করা আছে মাত্র কয়েকটা শব্দ–আরআইপি অর্জুন শিকদার!
প্রথমেই অবশ্য আসল ব্যাপারটা বোঝেননি তিনি। তবে অবাক হয়েছিলেন। অর্জুন শিকদারের যা চরিত্র, তাতে কোনো মহিলাই তাঁর মৃত্যুতে দুঃখিত হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য ইনিই যদি সেই রহস্যময়ী প্রেমিকা হয়ে থাকেন তবে আলাদা কথা। তিনি উত্তেজিত হয়ে খবরিকে পালটা ফোন করে বললেন–গ্রেট জব! এই মেয়েটার সঙ্গে অর্জুন শিকদারের অ্যাফেয়ার ছিল কি না খোঁজ নিতে পারবি?
খবরি জবাবে বলল–সে খোঁজ তো নিয়ে নেব। কিন্তু স্যার, পোস্টটা ঠিকমতো দেখেছেন কি?
মানে? ভদ্রলোক বিস্মিত–আরআইপি মার্কা পোস্টটার কথা বলছিস তো? দেখেছি। কেউ খুব দুঃখ পেয়েছে।
ভালো করে দেখুন স্যার! ওটা সাধারণ আরআইপি মার্কা পোস্ট নয়। যেদিন পোস্টটা পড়েছে সেই ডেটটা দেখুন। খবরি জানায়–ডেটটা অর্জুন শিকদারের মৃত্যুর অন্তত সাত দিন আগের! ওটা দুঃখের পোস্ট নয়। ডেথ ফোরকাস্ট!
কী!
শব্দটা এত জোরে বলেছিলেন অফিসার যে গোটা থানাই প্রায় কেঁপে উঠেছিল। রুদ্ধশ্বাসে বললেন তিনি–কী বলছিস? অর্জুন শিকদারের মৃত্যুর সাত দিন আগের পোস্ট! সে কী!
হ্যাঁ স্যার। ও প্রান্ত থেকে খবরির অপেক্ষাকৃত নিচু স্বর ভেসে এলো–শুধু তাই নয়। স্ক্রল করে একটু নিচে নামুন। সঞ্জীব রায়চৌধুরীর আরআইপি মার্কা পোস্টও আছে। সেটাও ভদ্রলোকের মৃত্যুর ঠিক আট দিন আগে পোস্ট করা। মানে ওটাও ডেথ ফোরকাস্ট!
অফিসারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিতের মতো বসে রইলেন। তারপর পাগলের মতো তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখলেন সর্বনাশিনীর প্রোফাইল! হ্যাঁ, খবরির প্রত্যেকটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি! সঞ্জীব রায়চৌধুরীর আরআইপি পোস্টও আছে! এবং সেটা সত্যিই তাঁর মৃত্যুর প্রায় আটদিন আগে পোস্ট করা হয়েছে। এ প্রোফাইলটা এই দুজনের মৃত্যুতে আদৌ শোক প্রকাশ করেনি। বরং তাদের মৃত্যুর আগাম ঘোষণা করেছে। ডেথ ফোরকাস্ট! কী সাংঘাতিক!
পুলিশ এতদিন সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল। এবার একটা লিড পেয়ে উঠে পড়ে সবেগে তদন্ত করতে শুরু করল। তাদের সাইবার সেল সর্বনাশিনীর আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করার জন্য আদা নুন খেয়ে লেগে পড়ে। প্রোফাইলে মেয়েটির যত ছবি ছিল সব প্রত্যেকটি পুলিশ স্টেশনে পাঠানো হলো। খবরিদের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল তার ছবি।
কিন্তু শেষমেশ কিছুই হলো না। ছবির মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও! সাইবার সেল তার আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেল। কারণ বেশিরভাগ পোস্টই হয় কোনো অখ্যাত সাইবার কাফে থেকে হয়েছে, নয়তো মোবাইল থেকে! পুলিশ সেই সাইবার কাফেগুলোতেও টু মারল, কিন্তু যথারীতি কোনো লিড পেল না। আর যে যে মোবাইল থেকে স্টেটাস আপডেট বা পোস্ট হয়েছে, আইপি অ্যাড্রেসের মাধ্যমে সেগুলোকে ট্র্যাক করতে গিয়ে সাইবার সেলের পুরো সসেমিরা অবস্থা। কোনোটারই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সাইবার সেল সঞ্জীব ও অর্জুনের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখল। তাদের ফ্রেন্ডলিস্টে কিন্তু আদৌ সর্বনাশিনীর প্রোফাইল নেই। চ্যাট হিস্ট্রি ঘেঁটেঘুঁটেও সন্দেহজনক অন্য কোনো প্রোফাইল পাওয়া গেল না।
এই কেসটা নিয়ে মিডিয়া প্রচুর হল্লা করেছিল। এখনও করছে। অনেকেই এটাকে পারফেক্ট ক্রাইম বলছে। অনেকে পুলিশের চৌদ্দ গুষ্টির তুষ্টি করেছে। কিন্তু অধিরাজ জানে যে পারফেক্ট ক্রাইম বলে কিছু হয় না। ওটা ক্রিমিনালের ভ্রান্ত একটা ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুলিশকেও দোষ দেওয়া যায় না। তাদের হাতে তদন্ত করার মতো পর্যাপ্ত কোনো এভিডেন্সই ছিল না। এরকম অবস্থায় তাদের ফ্রাস্ট্রেটেড হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু হাল ছাড়েনি তারা। নিয়মিতভাবে প্রোফাইলটার ওপর নজর রেখে বসেছিল। আর আজ হয়তো…!
এই দেখো। শিশির সেন তাঁর ল্যাপটপটা অধিরাজের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন–নেক্সট আপডেট দিয়েছে সর্বনাশিনী। সেই একই স্টাইল! আরআইপি পোস্ট!
অর্ণবের শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। কী সর্বনেশে খেলায় মেতেছে এই প্রোফাইল! সর্বনাশিনীর আর আইপি পোেস্ট মানে আরেকটা মানুষের আগাম মৃত্যুর সংকেত! এখনও লোকটা মরেনি ঠিকই, তবে খুব শিগগিরিই মরবে! আর কী করে যে মরছে তা ঈশ্বরই জানেন!
সে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল পোস্টটায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে। আর.আই.পি বিজয় জয়সওয়াল!
বিজয় জয়সওয়াল! অর্ণব স্খলিত স্বরে বলল–নিশান জুয়েলার্সের মালিক নয় তো?
নিঃসন্দেহে তিনিই। শিশির সেন জানালেন–পোস্টটা ঘণ্টাখানেক আগে, অর্থাৎ বিকেল পাঁচটায় পড়েছে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ বিজয় জয়সওয়ালের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। জানা গেল, যথারীতি তিনিও ট্যুরের নাম করে হাওয়া হয়ে গেছেন। তার জীবনেও কোনো অজ্ঞাত প্রেমিকা ছিল। এবং অ্যাজ ইউজুয়াল–তাকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না!
অর্ণব চিলড এসির ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে নেয়ে একসা হতে থাকে। এবারের শিকার হাই প্রোফাইল। বিপদ বুঝেই পুলিশ কেসটা সিআইডিকে ট্রান্সফার করেছে। অর্থাৎ সেফ ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়েছে।
ব্যানার্জী! এডিজি বিপন্ন চোখ দুটো তুলে অধিরাজের দিকে তাকিয়েছেন–যে করেই হোক, এবারের খুনটা আটকাও। আমি জানি না কোন্ অজ্ঞাত উপায়ে সে ফরেনসিককে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এগুলো সব খুন। ওপরমহল থেকে ট্রিমেন্ডাস প্রেশার আসছে। এই লোকটা যথেষ্ট প্রভাবশালী। ওর লাশ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না আমরা।
অধিরাজ খুব শান্ত ভাবেই বলল–আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট স্যার। তবে হয়তো এখনই ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। পোস্টটা মাত্র এক ঘণ্টা আগে পড়েছে। যতদূর আমি কেসটা সম্বন্ধে জানি, এই ফোরকাস্টটা মৃত্যুর অন্তত সাত-আট দিন আগে হয়। সুতরাং আশা করতে বাধা নেই যে বিজয় জয়সওয়াল এখনও জীবিতই আছেন। আর তাঁকে খোঁজার জন্য বেশ কিছুটা সময় হয়তো আমরা পাব।
তাহলে খোজো! টেবিলের ওপর একটা চাপড় মেরে বললেন এডিজি সেন–যে করেই হোক্ জ্যান্ত বের করো লোকটাকে। তার সঙ্গে খুনিকেও। আকাশ চিরে বের করবে না পাতাল খুঁড়ে তা আমি জানতে চাই না। বাই হুক অর ক্রুক লোকটাকে বাঁচাও। তোমার হাতে খুব বেশি সময় নেই ব্যানার্জী। যত তাড়াতাড়ি পারো, কাজ শুরু করে দাও।
ও কে স্যার।
অধিরাজ আর অর্ণব এডিজি সেনের ঘর থেকে নীরবেই বেরিয়ে এলো। সর্বনাশিনীর প্রোফাইলের সবকয়টা ছবির প্রিন্ট আউট দিয়ে দিয়েছেন শিশির সেন। অধিরাজ সেগুলোই খুব মন দিয়ে দেখছে। অর্ণব লক্ষ করে তার চোখ দুটো অন্যমনস্ক। কপালে সামান্য ভাঁজ। ছবিগুলো দেখতে দেখতেই হাঁটছে। কিন্তু ভঙ্গিটা চিন্তান্বিত।
স্যার?
উঁ? অধিরাজ যেন সংবিৎ ফিরে পায়। এবার অর্ণবের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু আত্মমগ্নভাবেই বলল-এই একটা ছবি ছাড়া খুনির ব্যাপারে কোনো ক্ল, কোনো এভিডেন্সই নেই! পুলিশ অলরেডি ছবিটাকে সাকুলেট করেছে। তবু আমরাও চেষ্টা করব। পুলিশের থেকে আমরা আরও বিপজ্জনক অবস্থায় অর্ণব। আগের দুটো কেসে ভিকটিম মৃত ছিল। কিন্তু আমার ধারণা এবার ভিকটিম এখনও বেঁচে আছে। আর এই স্কোপটা পেয়েও যদি আমরা তাকে বাঁচাতে না পারি, তবে প্রেস্টিজে পুরো গ্যামাক্সিন!
অর্ণবের কপালে চিন্তার ভাঁজ–কিন্তু শুরু কোথা থেকে করব স্যার? পুলিশ যেখানে দাঁড়িয়েছিল, আমরাও ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে। ||||||||||
উঁহু! সে মাথা নাড়ে–এবার আরও একটা ক্ল আমাদের হাতে আছে। বিজয় জয়সওয়ালের বাড়িতে যাও। ওঁর একটা ফটো নিয়ে এসো। এই মেয়েটার সঙ্গে এবার জয়সওয়ালের ফটোও সাকুলেট করাব। প্রত্যেকটা পুলিশ স্টেশনে ফ্যাক্স করে দুটো ছবিই পাঠিয়ে দাও। মেয়েটাকে যদি না-ও পাই, জয়সওয়ালকে পাওয়ার চান্স আছে। আমাদের ইনফর্মার নেটওয়ার্ককে অ্যাক্টিভ করে দাও। সবার হাতে যেন দুটো ছবিই থাকে। আর…!
বলতে বলতেই অধিরাজ হঠাই দুম করে বেমক্কা একটা প্রশ্ন করে বসে–আচ্ছা অর্ণব, যদি তোমায় এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার করতে হয়, তবে প্রেমিকাকে নিয়ে কোথায় যাবে?
অ্যাঁ! অর্ণব প্রায় আকাশ থেকে পড়ে–এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার!
কেন? ঠোঁটের কোণে মৃদু দুষ্টু হাসিটা ফের ঝিলিক দিয়ে উঠেছে–তুমি পরকীয়া করতে পারো না? সমস্যা কোথায়? এখন তো বৈধ হয়ে গিয়েছে!
স্যার! আ–মি!
সে আর কী বলবে বুঝে পায় না! রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত বেচারি একটা স্বকীয়তাই করে উঠতে পারল না, তো পরকীয়া কীভাবে করবে!
কেন? তোমার লাইফে কেউ নেই? অধিরাজ চোখ কুঁচকে তাকিয়েছে তার দিকে। দুচোখে স্পষ্ট কৌতুক–স্পেশ্যাল কেউ? স্পেশ্যাল বন্ধু-টন্ধু?।
এবারে পুরো বাউন্সার! অর্ণব থতমত খেয়ে কী বলবে বুঝে পায় না। বোকার মতো বলে বসল–আমার তো শুধু আপনিই আছেন স্যার।
আমি! কিছুক্ষণ হাঁ করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষমেশ হেসেই ফেলল সে–জিনিয়াস! রিয়েলি জিনিয়াস অর্ণব! তবে ঠিকই আছে। এখন ওটাও বৈধ।
অর্ণব বুঝল কী চরম বোকামি করে বসেছে। লজ্জায় লাল হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল–স্যার, আমি তা বলিনি…মানে…তা বলতে চাইনি…!
অধিরাজ হাসতে হাসতেই বলে–রিল্যাক্স। টেনশন না করে ছবি দুটোকে কলকাতার যত হোটেল বা রিসোর্ট আছে, ছোট-মাঝারি-বড় সব জায়গায় ঘোরাও। দীঘা বিশেষ করে মন্দারমণি পুলিশকে অ্যালার্ট করো। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি জানতে চাই যে উক্ত দুই ব্যক্তির মধ্যে কাউকে সেখানে দেখা গিয়েছে কি না।
কিন্তু জয়সওয়াল তো বাইরে কোথাও যেতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বা বিদেশে। লোকটার প্রচুর টাকা। হয়তো সুইজারল্যান্ডে বা মরিশাসে বসে হাওয়া খাচ্ছেন!
না অর্ণব। তাতে দুটো টেকনিক্যাল প্রবলেম আছে। অধিরাজ একটু আত্মবিস্মৃত স্বরে বলল-প্রথমত, সুইজারল্যান্ড বা মরিশাসে যেতে হলে পাসপোর্ট-ভিসা লাগে। আগের দুটো কেসে দুজন ভিকটিমের পাসপোর্টই বাড়িতে পেয়েছে পুলিশ। আর ভিসা করালে তার একটা রিপোর্ট লাগে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট থেকে শুরু করে অনেকরকম ডিটেলস্ লাগে। তেমন কিছু করলে পুলিশ ঠিকই জানতে পারত।
নকল পাসপোর্ট বা নকল নামে ভিসাও তো হতে পারে। অর্ণব আমতা আমতা করে বলে–যে পাবলিক এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার করছে, আর প্রেমিকাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে-সে থোড়াই ঢাক পিটিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বেড়াবে!
গুড থিঙ্কিং। সে মাথা কঁকালো–কারেক্ট। হতে পারে। সেক্ষেত্রেও টাকা তো লাগবে। অথচ দুটো লোকের ব্যাংক স্টেটমেন্টে তেমন কোনো সন্দেহজনক ট্রানজাকশান নেই। পুলিশ লোক দুটোর নামে-বেনামে যত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, ক্রেডিট, ডেবিট কার্ডের ডিটেলস সব তন্নতন্ন করে ঘেঁটেছে। কিস্যু নেই! পাসপোর্ট-ভিসা না হয় বাদ দিলাম, অন্তত প্যাসেজমানি এবং অন্যান্য খরচের টাকাটা বের করল কোথা থেকে?
টাকা হয়তো মেয়েটি দিয়েছে। প্রেমিকের জন্য এইটুকু তো করতেই পারে।
বাপ রে! অধিরাজ তার কাঁধ চাপড়ে দেয়– তুমি তো রীতিমতো এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের এক্সপার্ট হয়ে গেলে গুরু! সত্যিই কি কোনো পরকীয়া করোনি? নাকি চুপচাপ ফুলে ছাপ মারছ?।
এর উত্তরে বিব্রত হয়ে হেঁহেঁ করে দন্তকান্তি দেখানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বলাই বাহুল্য, অর্ণব ও তাই করল। অধিরাজ মৃদু হেসে বলল–তোমার থিওরি ধরো মেনেই নিলাম। পাসপোর্ট, ভিসা–টাকাপয়সার ব্যাপার গোল্লায় যাক! ধরো, সমস্ত কিছু ম্যানেজ করে দুজন লোকই বিদেশে প্রেম করতে গিয়েছিলেন। এবং যখন তারা প্রেমিকার সঙ্গে ইন্টু পিন্টু করছিলেন তখনই চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন। অথবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফরেনসিক। রিপোর্ট অনুযায়ী যা তা অসুখ নয়–একেবারে লিভার ড্যামেজ! অ্যাকিউট হেপাটিক ও রেনাল ফেইলিওর। এইরকম মারাত্মক অসুখ হলে প্রথমেই ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে স্মরণ করতে হবে! শুধু তাই নয়–যে লোকের পটল তোলার চান্স আছে তেমন সিরিয়াস মেডিক্যাল সিচ্যুয়েশনে প্রথমেই এমব্যাসি বা কনসুলেটকে খবর দিতে হবে। সেখানে আর নকল পাসপোর্ট-ভিসা চলবে না। এমব্যাসি রোগীর দায়িত্ব নেবে, এবং ফ্যামিলিকে খবর দেবে। আর যদি পটল তোলে তাহলে তো আরও বিপদ! এমব্যাসির পারমিশন, একটা অবশ্যম্ভাবী অটোন্সি, সাত ঘাটের জল খেতে খেতে বডি নিয়ে আসার প্রসিডিওর- এত কাণ্ড হবে আর তার কোনো ট্রেসই থাকবে না! এটা কি আদৌ সম্ভব? আর লোক দুটোর বডিতে কোনো অটোন্সির চিহ্ন ছিল না।
তার মানে ওরা দেশের বাইরে যায়নি। অর্ণব একটু চিন্তা করে বলল–কিন্তু দেশের ভেতরে শিমলা, মুসৌরি, দিল্লি, গোয়া–যেকোনো জায়গাতেই থাকা অসম্ভব নয়।
যদি কলকাতার বাইরেই থাকবে তবে মৃতদেহটাকে কলকাতায় ডাম্প করার মানে কী! যেখানে মরেছে, সেখানেই ফেলে দিলে তো ল্যাটা চুকে যায়। তা না করে কিলার ঘাড়ে করে ডেডবডিটাকে কলকাতায় এনে ফেলল! আর যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই দুই মক্কেল যখন কলকাতায় ফিরলেন, তখনও মরেননি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, সেক্ষেত্রেও তারা কোনো নার্সিংহোমে ভর্তি না হয়ে চুপচাপ বসে মরাই ঠিক করলেন! এ কি দেবদাস পেয়েছ নাকি, যে প্রেমের জন্য লিভার পচিয়ে গাছতলায় মরবে! অধিরাজ মাথা নাড়ছে–কোনো লজিক নেই! তাছাড়া দুজনেই গাড়িতে বেরিয়েছিলেন। সেই দুটো গাড়ি গেল কোথায়?
অর্ণব এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝল। সত্যিই ব্যাপারটা রীতিমতো গোলমেলে! এবং এই মুহূর্তে তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়জোর দীঘা বা মন্দারমণিতে যাওয়া সম্ভব। পুলিশ একটু অ্যালার্ট থাকুক, কিন্তু আমার মনে হয় ওঁরা ওখানেও নেই। অধিরাজ আপনমনেই বিড়বিড় করে–সম্ভবত জয়সওয়াল এই সর্বনাশিনীর সঙ্গে সর্বনেশে সওয়াল জবাবটা কলকাতাতেই করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোথায়! কোথায় হতে পারে…! কোথায় হওয়া সম্ভব…!
বলতে বলতেই হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে। কী ভেবে সচকিত হয়ে ডাকল–অর্ণব!
স্যার?
এখনই বিজয় জয়সওয়ালের বাড়ি যাও। মিসেস জয়সওয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। আই থিঙ্ক, ইনিও গাড়িতেই বেরিয়েছিলেন। ওঁর গাড়ির নম্বরটা নিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে অ্যালার্ট করো। ওদের সমস্ত সিগন্যালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বলো। কোনো না কোনো ফুটেজে নিশ্চয়ই গাড়িটাকে দেখতে পাবে। ভদ্রলোকের ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজো। আমার ধারণা ওঁর পাসপোর্টটা ওখানেই আছে। মিসেস জয়সওয়ালকে জিজ্ঞেস করবে। যে মি. জয়সওয়ালের কলকাতায় কয়টা ফ্ল্যাট, বা বাড়ি, ফার্মহাউস আছে। সেগুলোতেও সার্চ অপারেশন চালাও। দরকার পড়লে শোরুমে ভদ্রলোকের কেবিনটাও সার্চ করো। কোথাও কিছু বাদ দেবে না! কাগজের টুকরো, পলিথিন–যা দেখবে, এভিডেন্স ব্যাগে তুলে আনবে। সাইবার সেলকে ওঁর ফোনের লাস্ট লোকেশন, আর সর্বনাশিনীর লেটেস্ট আইপি অ্যাড্রেসটা ট্র্যাক করতে বলল। আমিও একবার দেখি, পুলিশ কেন এই প্রোফাইলের আইপি অ্যাড্রেস পাওয়া সত্ত্বেও কিছু করতে পারেনি!
ও কে স্যার।
আর এই সব ইনফর্মেশন আমার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চাই অর্ণব। অধিরাজের দুই চোখে দুশ্চিন্তা–আপাতত সর্বনাশিনীকে চেজ করছি না। মনে রেখো, আমাদের এখন একটাই উদ্দেশ্য। বিজয় জয়সওয়ালকে যে করেই হোক, জীবিত অবস্থায় পাওয়া। যে লোক অলরেডি দু-দুটো খুন করে। ফেলেছে-যা প্রায় পারফেক্ট ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে, সে ও কাঁচা কাজ করার লোক নয়! এবং যখন ডেসপারেটলি ডেথ ফোরকাস্ট করছে, তার মানে একদম ফুল টাইট প্রস্তুতি নিয়েছে। এ কেস সাধারণ নয়। এটা আমাদের অ্যাসিড টেস্ট!
অর্ণব বিনা বাক্যব্যয়ে দ্রুত পদে নিজের কাজগুলো বুঝে নিতে চলে যায়। অধিরাজ সর্বনাশিনীর ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত সুন্দরী! যদিও একটু নিগ্রোবটু ধরনের চেহারা। একরাশ কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিচের দিকে। ঈষৎ তীর্যক চাউনি। এককথায় মদিরাক্ষী। মুখের আদল চমৎকার। হাসিটা ভারি আলো ঝলমলে সরল! এককথায় কালো বিদ্যুৎ!
ছবিটা দেখতে দেখতেই তার মনে হলো, ছবির মেয়েটাকে চেনা চেনা ঠেকছে। এই মুখ সে আগেও কোথাও দেখেছে। এই হাসি, এই চোখ, এই কোঁকড়া কোঁকড়া চুল! অত্যন্ত পরিচিত।
দেখেছে তো বটেই! অধিরাজের চোখ কুঁচকে যায়। প্রশ্ন হলো–কোথায়?
*
বাইরে তখন প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। একটু আগেই ঝড় রীতিমতো তাণ্ডব করে গিয়েছে। ফলস্বরূপ হয়তো কোথাও ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে পড়েছে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে গোটা চত্তর। তার মধ্যেই বৃষ্টির মুখরতা। একটানা বৃষ্টিপাতের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুড়গুঁড়িয়ে উঠছে মেঘ। ঝলসে ঝলসে ওঠে বিদ্যুতের প্রখর ভ্রুকুটি। তার তীব্র আলো জানলার কাঁচের ওপর পড়ে চমকে চমকে উঠছে।
অন্ধকারের মধ্যেই নিজের ঘরের বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসেছিল মেয়েটি। অন্ধকারকে সে এখনও ভয় পায়। ছোটবেলায় তার ধারণা ছিল, অন্ধকার বুঝি এক জাতীয় রাক্ষস। সুযোগ পেলেই ধরে গিলে নেবে। যে মূর্তিমান তমিস্রা ছোটবেলা থেকেই তাকে তাড়া করে আসছে, প্রত্যেকবার ভয় দেখিয়ে এসেছে–আজও তার খেলা শেষ হয়নি! আজও সে প্রতি পলে পলে তার অন্ধ চোখ নিয়ে সামনে আসে।
অথচ এখন তার অন্ধকারে বসে থাকার কথা নয়। ওদের হাউজিং কমপ্লেক্সে যে পাওয়ার ব্যাক-আপ আছে, তা পাশের ঘরের বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ভেসে আসা এক চিলতে বৈদ্যুতিক আলোর উপস্থিতিতেই বোঝা যায়। অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে, তবুও এক অদ্ভুত জেদে ঘরে আলো জ্বালেনি সে। অ্যালিস বলে, ভয়কে সবসময় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হয়। তার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। নয়তো ভয় তাকে হারিয়ে দেবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে অন্ধকারের মুখোমুখি বসিয়েছে।
আমি পারব…আমি পারব…পারতেই হবে…!
আপন মনেই বিড়বিড় করতে করতে মেয়েটি ভয়ে ভয়ে আড়চোখে পাশের ঘরের দিকে তাকায়। ঐ তো, ঐ বন্ধ ঘরে আজও বসে আছেন মি. বাজাজ। আজও নিশ্চয়ই তার সামনে পাতা আছে দাবার ছক! রোজই এই সময়ে তিনি দাবা খেলেন। সাদা রানি প্রতিদিনই খেয়ে ফেলে কালো রানির ভাগ্যকে! আকণ্ঠ মদ্যপান করেন, আর তারপর…!
আকাশে সঘন মেঘ সশব্দে গুড়গুঁড়িয়ে ওঠে। একঝলক বিদ্যুতের নীলাভ আলো যেন ছিটকে এসে পড়ল মেয়েটির মুখে। সেই সামান্য আলোতেই দেখা গেল তাকে। কৃষ্ণাভ অথচ পেলব মসৃণ মুখ ঘিরে ঘন মেঘের মতো ছড়িয়ে আছে কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের রাশ। সামান্য উঁচু কপালের নিচে একজোড়া ঝকঝকে অথচ ভীরু চোখ। ঠোঁট দুটো এক অব্যক্ত ভয়ে অল্প অল্প কাঁপছে। মুখের ভাঁজে ভাঁজে প্রকট আশঙ্কা!
মেয়েটি এবার আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে আসে। কী যেন একটা প্রচণ্ড সংকল্পে এখন তার চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠেছে। পা টিপে টিপে হাঁটার ভঙ্গিতে গোপনীয়তা স্পষ্ট। এখনও মন্ত্র পড়ার মতোই বলে চলেছে–পারতেই হবে! …পারতেই হবে…পারব…! কিন্তু কী যে পারতে হবে, কিংবা কী যে পারবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বাইরে বৃষ্টির বেগটা আরও বাড়ল। বৃষ্টি পতনের প্রবল শব্দে প্রায় আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না! মেয়েটির কানে অবশ্য তখন জাগতিক কোনো শব্দের আভাস নেই। সে শুধু নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা এখন উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছে। নিজের দেহের প্রতিটা ধমনি, শিরা-উপশিরায় রক্তের দ্রুত চলাচলটুকুও টের পাওয়া যায়। সমস্ত রক্তনালি কাঁপিয়ে, ঝনঝনিয়ে চলেছে রক্তপ্রবাহ। প্রচণ্ড উত্তেজনায় নিঃশ্বাসের তাল দ্রুত! মনে হচ্ছে, হৃৎপিণ্ডটা বুঝি ফেটে যাবে! সমস্ত দেহ উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
চলতে চলতেই সে বন্ধ দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। এরপরের কাজটা খুব সহজ নয়। মেয়েটা ঠোঁট কামড়াল। অন্ধকার ভয়ের এক নাম। কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয়ের নাম মি. বাজাজ! তিনি এই মুহূর্তে ঐ ঘরে বসে আছেন। এই বন্ধ দরজা খুললেই দেখা যাবে তাঁকে। আরামকেদারায় ঠেস দিয়ে নিমগ্ন চিত্তে তাকিয়ে আছেন চেসবোর্ডের দিকে! তার পছন্দের সাদা রানি, কালো রানিকে মাত দেওয়ার জন্য গুটিগুটি এগোচ্ছে। কিন্তু কিস্তিমাতের আগেই থামানো দরকার ওঁকে। থামাতেই হবে…! পারতেই হবে…!
আবার একটা কড়কড় শব্দ! পরক্ষণেই বজ্রপাত! এক ঝলক আগুন বুকে নিয়ে কোথাও বুঝি বাজ পড়ল। মুহূর্তের প্রকাশে আবার দেখা গেল মেয়েটির মুখ। ভয় পেলে অনেকসময় মানুষের মুখ মুখোশের মতো হয়ে যায়। তার মুখও এখন অবিকল ভয়াল জাপানি মুখোশের মতো দেখাচ্ছে! রক্তশূন্য, ভীত!
সে অতি সন্তর্পণে দরজাটা খুলল। এমন নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল, যেন মেয়েটি নয়–নিয়তি এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ও-প্রান্তে। সামান্য ফাঁক করে দুটো সতর্ক চোখ ভেতরের দিকে উঁকি মারল। ভেতরের দৃশ্যটা দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এখন ঠিক কী করছেন মি. বাজাজ? টের পেয়েছেন কি কিছু?
সামনের দৃশ্যে অবশ্য তেমন কোনো বিপদসংকেত পাওয়া গেল না। এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আরামকেদারায় কেউ একজন বসে আছেন। তার মাথার ওপরে কোহিনুর হীরের দ্যুতি নিয়ে ঝলমল করছে দামি অ্যান্টিক ঝাড়বাতি। সামনে শৌখিন কাঁচের টেবিল। টেবিলের ওপর হুইস্কির বোতল আর গ্লাস। তার পাশে চেসবোর্ড। খেলাটা এখনও অমীমাংসিত। মানুষটিকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার একটা হাত এলিয়ে পড়ে আছে আরামকেদারায়।
অতি সন্তর্পণে নীরবে, সরীসৃপের মতো ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা। মি, বাজাজের রুচি ভারি উদ্ভট ধরনের। এই ঘরটাকে দেখলে ঘর কম, মিউজিয়াম বেশি মনে হয়! কী নেই এ ঘরে! একদিকের দেওয়ালে সারি সারি পুরানো অ্যান্টিক ঘড়ি। যখন সবকটা একসঙ্গে বাজতে থাকে তখন কান পাতা দায়। অন্যদিকে টাঙানো আছে অনেক মুখোশ! মুখোশগুলোর মধ্যে কোনটা যে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ সঠিকভাবে বলা মুশকিল! সবকটাই এমন ভয়ংকর যে দেখামাত্রই আঁতকে উঠতে হয়। অথচ প্রত্যেকটাই নাকি অত্যন্ত দামি! মি. বাজাজ দেশ-বিদেশ থেকে কিনে এনেছেন। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে এইরকম বীভৎস মুখোশ কেনার মানে যে কী, তা তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস আজ পর্যন্ত কারোর হয়নি। মি. বাজাজ কারোর কথা শোনেন না। তার কোনো কাজের কৈফিয়ত দেওয়াও পছন্দ করেন না।
মেয়েটির দৃষ্টি এবার দেওয়াল ছেড়ে দেওয়াল সংলগ্ন প্রকাণ্ড মেহগনির টেবিলের দিকে গেল। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে নানারকমের দামি অ্যাশট্রে। কোনোটা আইভরির, কোনোটা রুপোর। ধূমপায়ীদের জন্য একটা। অ্যাশট্রেই যথেষ্ট। কিন্তু যেহেতু লোকটির নাম মি, বাজাজ, সেহেতু একগাদা অ্যাশট্রে থাকবেই। রয়েছে একটি রত্নখচিত কলমদানি। বেশ কয়েকটা বহুমূল্য বিদেশি পেন সুন্দরভাবে সাজানো আছে তার গর্ভে। তারপাশেই ফুলদানি, কয়েকটা রুপোর কয়েন ইতস্তত ছড়ানো, সিল্কের রুমাল, বেশ কয়েকটি পুরানো বই যার মলাট নেই, একটা শৌখিন কফি মগ, সিগারেটের প্যাকেট, ছোট ছোট কিছু জাপানি পুতুল, একটি সোনালি রঙের লাফিং বুদ্ধ, পোর্সেলিনের একটি নগ্ন নারী মূর্তি, খাঁটি ফরাসি আতরের খালি শিশি, ভিন্টেজ ওয়াইনের কয়েকটা বোতল, একটা সুন্দর কারুকার্য করা বাঁটওয়ালা বিপজ্জনক ভোজালি এবং আরও অনেক কিছু!
মেয়েটির ভুরু কুঁচকে যায়। এসব টেবিলের ওপরে জড়ো করে রাখার মানেটা কী! যেখান থেকে যা পেয়েছেন মি. বাজাজ সব সাগ্রহে নিয়ে এসেছেন। এবং যথারীতি দুদিন পরেই সেই মূল্যবান জিনিসটার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলস্বরূপ সেগুলো এখন অযত্নে টেবিলের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। মি. বাজাজ এরকমই! যেকোনো জিনিস, তা বস্তু হোক–কী মানুষ, একবার হাসিল করে ফেলার পরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন তার এই অবস্থাই হয়! অনাদৃত হয়ে পড়ে থাকে।
মেয়েটির লোভাতুর দৃষ্টি সোনালি বাঁটের কারুকার্য করা ভোজালিটার ওপরে পড়ল। তার চোখ চকচক করে ওঠে। এই সেই তুরস্কের ভোজালি, যেটা একসময়ে এক কুখ্যাত খুনির সম্পত্তি ছিল। এই ভোজালি অনেক মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে। আজও তার তীক্ষ্ণ ফলা চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতায় চিকচিকিয়ে উঠছে। হয়তো রক্তপিপাসু অস্ত্রটা নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছে যে আজ আবার তেমনই একটা মুহূর্ত আসতে চলেছে, যা একসময় অতীতে এসেছিল!
সে শিকারি বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে ছুরিটার দিকে এগোতে থাকে। মি. বাজাজ এখনও তার উপস্থিতি টের পাননি। তিনি আপনমনে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে দাবা খেলতেই ব্যস্ত। নিজের খেলায় এতটাই মগ্ন যে এই মুহূর্তে কানের কাছে অ্যাটমবোমা ফাটলেও বোধ হয় টের পাবেন না। এই সুযোগ…!
ভীষণ উত্তেজনায় মেয়েটা আরও একটু এগোতে গিয়েই আচমকা একটি স্ট্যান্ডের ওপরে রাখা ফুলদানির সঙ্গে ধাক্কা খেল! নীল স্বচ্ছ কাঁচের ফুলদানি সপাটে মেঝেতে পড়ে গিয়ে প্রবল ঝনঝন আওয়াজ তোলে! সে ভয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল ফুলদানিটা পুরো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে!
ওঃ!
ভয়ের চোটে মেয়েটা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। সর্বনাশ! মি, বাজাজের শখের ফুলদানি ভেঙে গিয়েছে! এবার কী করবে সে?তার থেকেও ভয়ের কথা যে মি. বাজাজ ঠিক কী করবেন? কোমরের বেল্ট দিয়ে পেটাবেন? না পিঠে গরম ইস্ত্রির ছ্যাকা! অথবা আরও কঠিন কোনো শাস্তি! কী হবে এবার!
মি. বাজাজ, আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি! ওটা জাস্ট ভেঙে গেল। প্লিজ বিলিভ মি!
কান্নামাখা কাতর স্বরে বলল সে। যেন এক অবোধ শিশু ভুল করে ফেলে মাফ চাইছে। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। শব্দগুলো আটকে আটকে যাচ্ছে। তবু কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বলে-ফরগিভ মি! আই অ্যাম সরি! আমায় মেরো না মেরে না! প্লিজ!
মি. বাজাজ কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি এখনও দাবা খেলাতেই মগ্ন। শুধু মেয়েটি যেন শুনতে পেল ভদ্রলোক সেই আগের মতো চাপা হিসহিসে কণ্ঠে বললেন–ই ফোর টু ই ফাইভ!
আই অ্যাম সরি!
মেয়েটা অসহায়ের মতো কাঁদছে এবং থরথর করে কাঁপছে। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার চোখের এক ফোঁটা জল নাক বেয়ে টুপ করে খসে পড়ল চিবুকের ওপরে। তীব্র বৈদ্যুতিক আলোয় ঝিকিয়ে উঠল অশ্রুবিন্দু। যেন চকচকে কালো গ্র্যানাইটের বুকে ঝলমল করছে এক কুচি হীরে!
ই ফোর টু ই ফাইভ!
মি. বাজাজ আবার চাপা অথচ ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন। সে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মি. বাজাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকাল তার দিকে। মি. বাজাজও এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। লোকটার চোখ দুটো কী শীতল! অভিব্যক্তিহীন! যার শুভবুদ্ধি মরে গিয়েছে সে বোধ হয় এমনভাবেই তাকায়। ঠিক যেন একটা সাপ…!
এন সি থ্রি টু এন সি সিক্স।
মি. বাজাজ এখনও নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। কোনো হেলদোল নেই। অদ্ভুত শানিত দৃষ্টিতে যেন মাপছেন তাকে। ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর হাসি। এ হাসি তার অতি পরিচিত। এ হাসি ভয়ংকর! …
আমায় মেরো না…প্লিজ…! মেয়েটি কান্নামাখা অনুনয় করে–আ…আমি কিছু করিনি… আমি ঐ লোকটাকেও কিছু করিনি… ও কী করে মরে গেল জানি না! আমি ওদের কাউকে মারতে চাইনি…!
মি. বাজাজ কোনো উত্তর দিলেন না। এখনও নির্বাক অথচ রহস্যময় হাসিটা ঝুলছে তার ঠোঁটের কোণে। ভীষণ ঠান্ডা দুটো চোখ ছুরির মতো বিধছে!
ছুরির কথা মনে পড়তেই হঠাৎ যেন একটু সাহস ফিরে পেল সে। আড়চোখে একঝলক দেখে নিল ছুরিটাকে। শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে কোনো মতে বলল–
তুমি আমাকে মারবে না! নয়তো আমি তোমাকে মারব…! হা…হ্যা! তোমাকেই মারব। তুমি আমাকে হারাতে পারো না। তুমি…।
কুইন টু এইচ ফাইভ! চেক অ্যান্ড মেট!
শান্ত অথচ ক্রুর স্বরে উত্তর এলো। মেয়েটি শিউরে ওঠে! চেক মেট! এটা কিছুতেই হতে দেওয়া চলবে না! ওঁকে থামানো দরকার! এই মুহূর্তেই থামানো দরকার! কিন্তু কীভাবে…!
সে বিদ্যুৎ গতিতে চোখের পলকে সামনের টেবিল থেকে তুলে নিল তুরস্কের সেই কুখ্যাত ছুরি! মি, বাজাজ কিছু বোঝার আগেই তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেয়েটা। পাগলের মতো কোপের পর কোপ মারতে মারতে বলল–শ-য়-তা-ন! স্কাউড্রেল! আমাদের সবার লাইফ নষ্ট করেছ তুমি…। কী ভেবেছ? তুমি ডিক্টেটর? যা বলবে, যা করবে–সব চুপচাপ সহ্য করতে হবে? ইউ বাস্টার্ড! …নে! নে! …এই নে!
মি. বাজাজের মুখ দিয়ে একটা কাতরোক্তিও বেরোল না! সামান্য শব্দটুকু করার সুযোগও পাননি। ছুরির আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর দেহ! তিনি টু শব্দটিও না করে কাত হয়ে পড়লেন আরামকেদারার চেয়ারের ওপরে! …
বে–বি!
মেয়েটি পাগলের মতো একের পর এক কোপ বসিয়েই যাচ্ছিল। একটা তীব্র স্বরে সচকিত হয়ে তাকাল। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যালিস। সম্ভবত সে এতক্ষণ কিচেনে ছিল। পরনে কুকের অ্যাপ্রন! তার চিল্কারের শব্দ শুনে ছুটে এসেছে। এমনিতেই অ্যালিস ভীষণ পৃথুলা। অতবড় চেহারাটা নিয়ে দৌড়ে আসতে ঘেমে গিয়েছে। তার ওপর চোখের সামনে এই দৃশ্য! সে দেখল, অ্যালিসের দৃষ্টিতে ভীষণ ভয়! জোরে জোরে শ্বাস টানছে আর দরদর করে ঘামছে মহিলা! কোনোমতে বলল-ওঃ ডিয়ার! হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান!।
এতক্ষণে তার চেতনা ফিরল! একটা অস্ফুট শব্দ করে সে মি, বাজাজকে ছেড়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। কিছুক্ষণ বোধহীনের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। কী করে ফেলেছে, সেটা বুঝতে হয়তো কয়েক মুহূর্ত লাগল তার। পরক্ষণেই সে পাগলের মতো ছুটে যায় অ্যালিসের দিকে। যন্ত্রণাকাতর মানুষটা একটু আশ্রয়ের আশায় ছুটে গেল সেই অনন্ত স্নেহময়ীর দিকে, যে ছোটবেলা থেকে তাকে বুকে করে মানুষ করেছে। তার স্থূল দেহকে আঁকড়ে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল সে–আমি ওকে খুন করেছি…অ্যালিস, আমি ওঁকে মেরে ফেলেছি! আমি মারতে চাইনি, বিলিভ মি! …
অ্যালিস তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে–আই নো! কুল ডাউন বেবি।
তার বুকে মুখ গুঁজে কান্নাবিকৃত স্বরে বলল মেয়েটা–আমি কাউকে মারতে চাইনি! কাউকে নয়! কিন্তু ওরা সবাই একে একে মরে গেল! …ওরা মরে গেল!
অ্যালিস নীরবে মেয়েটির মাথায় হাত বোলাতে থাকে। তার স্পর্শে পরম মমতা আর সান্ত্বনা। অজান্তেই বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস পরে।
আরামকেদারার ওপরে তখনও পড়ে রয়েছে মি. বাজাজের ছুরি বিদ্ধ দেহ। সামনে দাবার ছকে খেলা অমীমাংসিত। তাঁর চোখ দুটো খোলা! দুই চোখে সেই ভয়ানক শীতল দৃষ্টি!…
যেন মানুষটা কোনোদিন বেঁচেই ছিল না!
*
ফু-লে ফু-লে ঢ-লে ঢ-লে, ব-হে কী-ই-বা মৃ-দু বা-য়…!
এতক্ষণ ফরেনসিক ল্যাব চুপচাপই ছিল। সচরাচর এমন নিস্তব্ধই থাকে। ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. অসীম চ্যাটার্জী ল্যাবে যন্ত্রপাতির স্বাভাবিক হালকা টুং টাং-ঠুং ঠাং ছাড়া কোনোরকম উঁচু শব্দ বরদাস্ত করেন না। এমনকি সামান্য গল্পগুজব করলেও ল্যাবের কঙ্কালগুলোর মতোই দাঁত ছরকুটে হই হই করে তেড়ে মারতে আসেন। তাই তার অধস্তন কর্মীরা তাঁর সামনে ভয়ের চোটে প্রায় মগ্ন মৈনাক হয়ে থাকে।
আজও সকলেই ঘাড় গুঁজে চুপচাপ নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আচমকা রবিঠাকুরের গান কানে আসতেই অবাক হয়ে তাকাল। ড. চ্যাটার্জীর ল্যাবে এরকম তারস্বরে বেসুরো গান কে গাইছে! কার এত স্পর্ধা যে স্বয়ং মা মনসাকে ধুনোর ধোয়া দেয়!
অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ একসঙ্গে গানের উৎসের দিকে তাকায়। কিন্তু তাকিয়ে যা দেখল তাতে তাদেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম! গায়কটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ড. চ্যাটার্জী! বুড়োর প্রাণে হঠাৎ কী ফুর্তি হয়েছে কে জানে, কথা নেই বার্তা নেই গলা ছেড়ে গান ধরেছেন! শুধু একা গানে রক্ষা নেই, সঙ্গে পা ঠুকে ঠুকে ভুলভাল তালও দিচ্ছেন! উপস্থিত সকলেই প্রায় কনফিউজড ৎ এর মতো পরস্পরের মুখ দেখছে! সকলের চোখে একটাই অনুচ্চারিত প্রশ্ন–বুড়ো পেগলে গেল নাকি?
ড. চ্যাটার্জীর সবচেয়ে একনিষ্ঠ ও দক্ষ কর্মী, তথাকথিত ডান হাত আহেলি মুখার্জী লাঞ্চ পর্ব শেষ করে গুটিগুটি ল্যাবে ঢুকছিল। এমনই কপাল যে গান শুনে সেও ঘাবড়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে! আর পড়বি তো পড় একেবারে বুড়োর সুমুখে! তাকে দেখেই ড. চ্যাটার্জী গান থামিয়েছেন। আহেলি সভয়ে দেখল তার ভুরুযুগল ফের হুঁয়োপোকা মূর্তি ধারণ করেছে। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে থামিয়েই পেটেন্ট খ্যানখ্যানে স্বরে বলে উঠলেন– মাস রেপ-মার্ডার-অ্যাসিড কেসের মক্কেলের রিপোর্ট তৈরি করেছ? ফাইল রেডি তো?
বেচারি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে–আরেকটু বাকি আছে স্যার। সিমেনের ডিএনএ রিপোর্টটা পেতে একটু দেরি হয়েছে…তাই…!
দেরি করছ তো তুমি! রীতিমতো খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন ভদ্রলোক– এরকম অ্যানিমিক পেশেন্টের মতো কুঁইকুই করে কথা বলছ কেন? লাঞ্চে কী খেয়ে এলে? সাবু?
কপালদোষে আহেলি প্রশ্নের পেছনের ব্যঙ্গটা ধরতে পারেনি। মিউমিউ করে বলল–আজ্ঞে না। রুটি আর কাঁচকলার কোপ্তা!
কাঁচকলা! ড. চ্যাটার্জী এমন মুখভঙ্গি করেছেন, যেন সে কাঁচকলা নয়, পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ফেলেছে! কড়া করে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তুলনামূলক ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন–কাঁচকলার কোপ্তার রেসিপিটা কী?
আহেলি প্রমাদ গোণে। এটা সম্পূর্ণ সিলেবাসের বাইরে! সে বেচারা চিরকালই বীকার, বার্নার, টেস্টটিউব, কেমিক্যাল-অ্যাসিড বা সল্ট, বিষ, সলিউশন প্রভৃতি ঘেঁটে অভ্যস্ত। জীবনেও হাতা-খুন্তি নাড়েনি। কাঁচকলা আর এঁচোড়ের মধ্যে পার্থক্য কী–সেটাও সে বোঝে না! এবার এই ভয়ংকর গুগলির উত্তর কী দেবে!
ড. চ্যাটার্জী তার মুখ দেখে বুঝে গেলেন যে এই মেয়ে রান্নার কিছুই জানে না। তাকে আরও একটু খোঁচানোর জন্য বললেন–কাঁচা লঙ্কা আর কুমড়োর খোলা দিয়ে শুক্তো বানাতে পারো?
সর্বনাশ! আহেলি কাঁচকলার কোপ্তার ধাক্কায় ইতি মধ্যেই হাফ কুপোকাত! তার ওপরে আবার কাঁচা লঙ্কা আর কুমড়োর খোলা দিয়ে শুক্তো এসে পড়েছে! সে কী করবে ভাবছিল তার আগেই একটা গম্ভীর অথচ মোলায়েম কণ্ঠস্বর ঠিক পেছন থেকেই বলে উঠল–ড.! ইউ আর জাস্ট ন্যান্ডিক্যালি গৰ্ম্যান্ডেড বাই দ্য ডোমফ্যাক্টি অফ ইওর ক্যারেক্টার!
ক্ষীঃ! ড. চ্যাটার্জী আহেলির পেছনে এসে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে প্রায় চিড়বিড়িয়ে উঠলেন–রাজা, কীসব ভুলভাল বকছ! নর্ম্যান্ডিক্যালি গৰ্যান্ডেড আবার কী জিনিস? ডোমফ্যাক্টি খায় না মাথায় মাখে? মঙ্গলগ্রহের ভাষা বলছ নাকি? মার্সিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ?
কী করব! অধিরাজ ওরফে রাজা ঠোঁট টিপে হেসে নিরীহভাবেই বলে–আপনার কাঁচা লঙ্কা আর কুমড়োর খোলার শুক্তোও তো পৃথিবীর রেসিপি বলে মনে হচ্ছে না! সেটাও ঠিক ততটাই ন্যান্ডিক্যালি গৰ্ম্যান্ডেড!
ড. চ্যাটার্জী একটা গলার গভীরে অস্ফুট গরগর ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ শব্দ করে ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেলেন। আহেলির দিকে তাকিয়ে ফের খ্যাকখেঁকিয়ে উঠেছেন–তুমি এখানে স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলছ নাকি! থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? লিভ! আমার বিকেলের মধ্যেই ফাইল রেডি চাই। নাউ… শুঃ… শুঃ…!
শু মানে জুতো নয়। যারা ড. চ্যাটার্জীকে চেনে, তারা প্রত্যেকেই জানে। এই শুঃ… শুঃ এর অর্থ কেটে পড়ো। আহেলি তার রক্ষাকর্তার দিকে একটা সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিপাত করে সুড়সুড় করে কেটে পড়ল। অধিরাজ কোমরে হাত রেখে টানটান হয়ে ভারি সুন্দর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল। সে মাথাটা নম্রভাবে সামান্য ঝাঁকিয়ে আহেলির কৃতজ্ঞতার সম্মান রাখল। আহেলি চলে যেতেই ড. চ্যাটার্জী তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তুমি এমন অসময়ে এসে টপকে পড়লে কেন? এখনও কোনো লাশ আসেনি যে যখন-তখন এসে আমায় জ্বালাতে শুরু করবে। স্রেফ পুলিশের ফরেনসিক রিপোর্ট আর কিছু স্যাম্পল এসেছে।
না ঠিক লাশের জন্য নয়! অধিরাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে জানায়–শুনলাম ফরেনসিক ল্যাবে নাকি হাঁড়িচাচা ঢুকে পড়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে! তার অত্যাচারে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট অতিষ্ঠ! এমনকি বিশ্বস্ত সূত্রে জানলাম স্বর্গে রবিঠাকুর পর্যন্ত কানে আঙুল দিচ্ছেন! সিরিয়াস কেস। অগত্যা আমাকেই আসতে হলো।
ড. চ্যাটার্জী প্রায় লাফ মেরে উঠলেন! চিৎকার করে বললেন–কুৎসিত, কদাকার, পাষণ্ড, পাজি কোথাকার! একটাও কু দেব না তোমায় হতভাগা বাঁদর ছেলে…!
অধিরাজ ব্লেজারের পকেট থেকে একখানা ডিভিডি বের করে ড. চ্যাটার্জীর নাকের সামনে নাড়তে নাড়তে বলল–শিওর ড.? সত্যিই দেবেন না?
ড. অসীম চ্যাটার্জী দেখলেন সেটা পদ্মাবত ফিল্মের অরিজিনাল ডিভিডি। টাকলু বুড়ো পৃথিবীতে লাশ ছাড়া যদি আর কিছুর দিকে তাকায় তবে সে হলো দীপিকা পাডুকোন! ড. চ্যাটার্জীর একমাত্র ক্রাশ! অনেকদিন ধরেই তিনি ফিল্মটা দেখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার দরুণ আর পেরে ওঠেননি। অধিরাজ তাঁকে ইউটিউব থেকে দেখে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। অথচ বুড়ো এমনই টেক-এক্সপার্ট যে রেগেমেগে বলল-ফাজলামি হচ্ছে! আমার বাড়িতে অনেক টিউব আর বাল্ব আছে। খামোখা নতুন টিউব কিনে কী করব!
বলাইবাহুল্য, এবার ডিভিডিটা দেখেই বুড়োর মুখ একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে–পদ্মাবত! আমার জন্য?
না না! সে আড়চোখে ড. চ্যাটার্জীর দিকে তাকিয়ে অপরূপ ভঙ্গি করে–আপনার জন্য নয়। এডিজি শিশির সেন বেশ কিছুদিন ধরেই পদ্মাবত দেখার বায়না করছিলেন। তাঁর জন্যই এনেছি। আপনি তো আবার দীপিকাকে পছন্দ করেন না! বাই দ্য ওয়ে, সকলেই বলছে দীপিকাকে নাকি পদ্মাবতীর মেক-আপে দারুণ দেখাচ্ছে!
ড. চ্যাটার্জী কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকলেন। তারপরই ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বললেন–ফাইন, যেটুকু আন্দাজ করতে পারছি, বলছি। কিন্তু আগে ডিভিডিটা দাও। তোমায় বিশ্বাস নেই বাপু।
অধিরাজ ফের শিশুসুলভ হেসে ডিভিডিটা তাঁকে দিয়ে বলল–প্লিজ, প্রসিড।
ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টরা এতক্ষণ গোটা ঘটনাটাই হাঁ করে দেখছিল। ড. চ্যাটার্জী তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন–এখানে কি মেগাসিরিয়াল চলছে নাকি?
সঙ্গে সঙ্গেই ফরেনসিক ল্যাব ফাঁকা। সকলেই হঠাৎ খুব দ্রুততার সঙ্গে কোথায় পাতলা হয়ে গেল কে জানে! এখানে ড. চ্যাটার্জী আর অফিসার ব্যানার্জীর কেমিস্ট্রি সর্বজনবিদিত। দুজনের সম্পর্ক অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মতো। লাভ অ্যান্ড হেট রিলেশন। নাকে নাক লাগিয়ে ঝগড়াও করা চাই, আবার একজনের আরেকজনকে ছাড়া চলে না। অতএব দুজনের নাটকের মাঝখানেনা থাকাই ভালো।
দ্যাখো ছোঁড়া, পুলিশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যা বলেছেন তার থেকে। বেশি কিছু এক্সপেক্ট কোরো না। আমি সুপারম্যান নই। তবু কিছু জিনিস আমার মনে হয়েছে যা ফরেনসিক রিপোর্টে নেই।
বলতে বলতেই ড. চ্যাটার্জী কিছুটা স্কিন স্যাম্পল, কিছুটা ব্লাড, ভিকটিমের জামা-কাপড় আর বেশ কিছু ছবি এনে টেবিলে রাখলেন–এগুলো আজ সকালেই এখানে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমবার পুলিশ ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেয়নি বলে সব এভিডেন্স লাশের সঙ্গেই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার ওদের বুদ্ধি খুলেছে। তাই এবার পোশাক শুদ্ধ ব্লাড স্যাম্পল, টিস্যু স্যাম্পল, স্কিন-হেয়ার স্যাম্পল প্রিজার্ভ করে রেখেছিল। আমি সেগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি।
অধিরাজ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল। এখন সে মুখ খুলবে না। তাঁর এইটুকু বিশ্বাস আছে বুড়ো যখন বলতে শুরু করেছে, তখন কিছু একটা ক্ল দেবেই। ড. চ্যাটার্জী বলতে থাকেন–আমি ওদের রিপোর্ট পড়েছি। ওরা ভুল করেনি। প্রথমজনের কেসটা ওদের কাছে নর্মালই ঠেকেছে। সেটার ব্যাপারে বলার কিছু নেই। তবে দ্বিতীয় লোকটার ব্লাডে, টিস্যুতে, বা স্কিনে সত্যিই কোনো বিষের অস্তিত্ব নেই। ফরেনসিক এক্সপার্ট ভিসেরা করেছিলেন। বেচারি তন্নতন্ন করে প্রত্যেকটা বডি পার্টস ঘেঁটে দেখেছেন। পাকস্থলীতে কোনো বিষ নেই! বিষ তো দূর, এমনকি ভিকটিমের পাকস্থলীতে ফুড ট্রেসও নেই। অনেক বিষ আছে বা বিষাক্ত গ্যাস আছে যা ইনহেল করলে মৃত্যু হতে পারে। সেজন্য তিনি ফুসফুসও দেখেছেন। বাট লাংস নর্মাল। লাশের গায়ে সামান্য উঁচ ফোঁটানোর চিহ্নও নেই! বাধ্য হয়েই তিনি নর্মাল ডেথের সার্টিফিকেট দিয়েছেন। উপায়ই বা কী ছিল! কিন্তু আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা আর গাট ফিলিংস বলছে কোথাও কোনো বিষ প্রয়োগ হয়েছেই। তবে বিষটা লোকটার শরীরে ঢুকল কী করে? খাবারের মাধ্যমে তো নয়ই। অন্য কিছু সম্ভাবনাও অবশ্য আছে। প্রথমত, ভদ্রলোক হয়তো পুরো বিশ্বামিত্র হয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে ধ্যান করছিলেন। কোনো মেনকা এসে তার ধ্যান ভঙ্গ করে বলেছে–মুখটা খোল তো বাবু, একটু বিষ ঢেলে দিই। তিনিও লক্ষ্মী ছেলের মতো হাঁ করেছেন। মেনকাও এমন বিষ ঢেলেছে যেটা হয় পাকস্থলীতে ট্রেস ছাড়ে না, নয়তো এতটাই স্বাভাবিক তার অস্তিত্ব যে চোখে পড়লেও স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
এরকম হতে পারে?
নিশ্চয়ই। হয়তো সেই বিষটা এমনই সাধারণ যে বিষ বলে চেনা দায়। যেমন, ফর এগজাম্পল–অ্যাকোনাইট।
অধিরাজের মাথায় যেন বাজ পড়ে–অ্যাকোনাইট! সে তো ওষুধ!
ওষুধ ঠিকই, তবে দুধারি তরোয়াল! তিনি জানান–হোমিওপ্যাথিতে যে অ্যাকোনাইট ব্যবহৃত হয় সেটা জ্বর, রেস্টলেসনেস, সর্দি, কাশি সারাতে ওস্তাদ। আ গুড অ্যানালজেসিক। কিন্তু সেসব অ্যাকোনিটাম প্ল্যান্ট ছাড়াও কিছু এমন প্ল্যান্ট আছে যেগুলো অ্যাকোনিটাম স্পেশিজের মধ্যেই পড়ে। যেমন ডেভিলস হেলমেট বা মক্কশুড! এই অ্যাকোনিটাম প্ল্যান্টগুলো থেকে অ্যাকোনিটিন নামের একটা অ্যালকালয়েড টক্সিন বের করা যায়। মোস্ট নটোরিয়াস পয়জন। পাকস্থলীতে থাকবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্লাডে, বডি ফ্লুইডে অ্যাকোনিটামের ট্রেস পাওয়া যায়। এখানে তাও নেই। ভালো করে দেখেছি। সুতরাং অ্যাকোনাইট বাদ। আমি অবশ্য অন্য কাউকে সন্দেহ করছি। এমন কেউ যে দেখতে শুনতে ভীষণ নিরীহ, অত্যন্ত স্বাভাবিক তার অস্তিত্ব। কিন্তু বদমায়েশ দি গ্রেট! অনেকটা তোমার মতোই তেঁটে!
কে? এমন কিছু আছে কি?
অবশ্যই। তিনি মাথা ঝাঁকালেন–তুমি কি জানো যে পটাশিয়াম ক্লোরাইড একটি ভয়ংকর মার্ডার ওয়েপন?
অধিরাজ হাঁ–পটাশিয়াম ক্লোরাইড! মানে সল্ট?
সল্টেও ফল্ট আছে। ড. চ্যাটার্জী হাসলেন–অতিরিক্ত মাত্রায় আই মিন, ওভারডোজ দিলে বা ইঞ্জেক্ট করলে কিডনি ফেইলিওর বা সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে পটল তোলা কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্তু পরীক্ষা করলে সেফ রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা একটু বেশি পাওয়া যাবে। কারণ পটাশিয়াম ক্লোরাইড সিস্টেমে ঢুকে পটাশিয়াম আর ক্লোরাইড আয়নে মেটাবলাইজড় হয়ে যায়। ও দুটোই মানবশরীরে অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং অবশ্যই প্রয়োজনীয় বস্তু! ফরেনসিক বুঝতেই পারবে না যে লোকটা মরল কী করে! আমি ভাবছিলাম, তেমনই কিছু নয় তো! লিভার ড্যামেজ যদিও হয় না, তবে রেনাল ফেইলিওর সম্ভব। পুরোপুরি চান্স আছে যে দুই ক্রনিক মাতালের লিভার আগে থেকেই কেরে পড়েছিল। ওটা নেহাতই কো-ইনসিডেন্স। তাই প্রাথমিক ভাবে রেনাল ফেইলিওরকেই আসামি ভাবলাম। ব্লাডটা আরেকবার টেস্ট করে দেখলাম পটাশিয়াম বেশি আছে কি না। মজার কথা এই ভিকটিমের ব্লাডে পটাশিয়াম একটু বেশিই আছে! সুতরাং পটাশিয়াম ক্লোরাইডকে ক্লিনচিট দেওয়া যাচ্ছে না বস!
তাহলে কালপ্রিট পটাশিয়াম ক্লোরাইড? অধিরাজ কৌতূহলী।
প্রাথমিকভাবে তেমনই মনে হচ্ছে। কিন্তু এখনই শিওর শট বলতে পারছি না। কী করে মালটা দিল সেটাই আমার কাছে এখনও রহস্য। পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইঞ্জেক্ট বোধ হয় করেনি। তাহলে অন্তত সিরিঞ্জের দাগ পাওয়া যেত। তবে আরও একটা তথ্য তোমায় দিতে পারি, যেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। হয়তো কাজে লাগতে পারে।
ড. চ্যাটার্জী একটু থেমে এবার নিজের টাকটাকে আদর করতে শুরু করেছেন। যখনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বলেন তার আগেই মস্তিষ্ককে একটু আদর করে নেওয়া তাঁর স্বভাব। অধিরাজ নিচু স্বরে বলল–নার্সিসাস!
কী!
এই রে! বুড়ো শুনে ফেলেছে। সে সামলে নেয়–না…না। বলছিলাম জিনিয়াস!
হুম্। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তার কথাকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে বললেন–আমি এমনি এমনি ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে গাইছিলাম না। ভিকটিমের স্কিন স্যাম্পলের মধ্যে আমি অয়েল মলিকিউলের ট্রেস পেয়েছি। এবং সেটা যা তা অয়েল নয়। অ্যারোমা অয়েল। স্পেশ্যালি ল্যাভেন্ডার!
অ্যারোমা অয়েল!
ইয়েস। এটা তখনই সম্ভব যখন কেউ রেগুলার অ্যারোমা থেরাপি ম্যাসাজ নেয়। ইনি নিতেন।
এক্সেলেন্ট। অধিরাজ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে–আপনিও কি তাই ভাবছেন, যা আমি ভাবছি?
তুমি কী ভাবছ না জেনে বলব কী করে? বুড়ো ফের বেঁকিয়ে ওঠে–আমি অন্তর্যামী নাকি?
কোনোভাবে অ্যারোমা অয়েল ম্যাসাজের মাধ্যমেই বিষটা আসেনি তো? ভায়া স্কিন?
ছেলের বুদ্ধি আছে! ড. হাসলেন–আমিও তাই ভেবেছিলাম। যদিও প্রমাণ নেই। স্কিনে পয়জনের কোনো ট্রেসই নেই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে। অ্যারোমা অয়েলটা খুব ভালো জাতের। এককথায় ইউনিক। আই মিন পাতি তেল, যা বাজারে পাওয়া যায় ঠিক তা নয়। মার্কেটের তেলে ফ্লাওয়ার এক্সট্রাক্টের চেয়ে ভেজালই বেশি মেশানো হয়। কিন্তু এই তেলটা একেবারেই তা নয়। একদম খাঁটি চিজ! সম্ভবত এটা নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে সযত্নে বানানো। আর যারা এসব অ্যারোমা, হার্বাল প্রোডাক্ট বা আয়ুর্বেদ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে তেল বানাতে পারে তারা গাছ-গাছড়ার বিষয়ে ওস্তাদ হয়! এমনকি রীতিমতো স্কলার বটানিস্টও এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। বিদেশ থেকে প্রয়োজনে নানারকম প্ল্যান্টস নিয়ে এসে রিসার্চ করতেই পারে। প্রাণদায়ী হার্বসের খবর যে রাখে, সে প্রাণঘাতী হার্বসের খবরও রাখতে বাধ্য। সুতরাং এমন কোনো দেশি বা বিদেশি ফ্লাওয়ার, রুট, প্ল্যান্ট থাকতেই পারে যা সর্বনেশে বিষ। মে বি, সে বিষটা এখনও ফরেনসিকের নজরে পড়েনি। হয়তো ল্যাভেন্ডারের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তেমনই কিছু। অথবা কোনো মারাত্মক কোনো নার্ভ এজেন্ট। সোমান, সারিন বা তাঁবুনের মতো কিছু। যেটা স্কিনের মাধ্যমে অ্যাবসর্বড় হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে। যদিও সেক্ষেত্রেও বোঝা যেত যদি না জিনিসটা সম্পূর্ণ আনোন হয়…!
তাহলে আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন? অধিরাজ এবার একটু অধৈর্য-পটাশিয়াম ক্লোরাইড না আনোন অ্যারোমা অয়েল?
এবার ড. চ্যাটার্জীও একটু সংশয়ান্বিত–সেটাই তো বুঝতে পারছি না। পটাশিয়াম ক্লোরাইডের সম্ভাবনাটা থাকছেই। কিন্তু পাশাপাশি অ্যারোমা অয়েলের চান্সও কিছু কম নয়। অন্তত সম্ভাবনাটা মাথায় রেখো।
হুঁ! ল্যাভেন্ডার অয়েল!
অন্যমনস্কভাবে বলল অধিরাজ। সে এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে। কেসটা ক্রমাগত ছড়িয়ে ছিয়াত্তর হচ্ছে! কী যে লিড় দিলেন ড. চ্যাটার্জী! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এবার তিনিও শিওর নন! কোথায় অন্ধকার একটু হালকা হবে, উলটে আরও বেড়ে গেল! কলকাতায় অ্যারোমা ক্লিনিক আর স্পা-স্যালোনের সংখ্যা কিছু কম নয়। এবার সন্দেহের তীর সেদিকেও গেল! এমন দিনও এলো যেদিন ল্যাভেন্ডারকেও সন্দেহের চোখে দেখতে হচ্ছে! ভগবান জানেন আরও কী কী দেখতে বা শুনতে হবে!
অ্যারোমা থেরাপি কি আদৌ লিড়? না সেটাও ডেড-এন্ড! সঞ্জীব রায়চৌধুরীও কি কোনো অ্যারোমা ক্লিনিকে যেতেন? অনেক বিজনেসম্যানই স্ট্রেস এবং টেনশন কমানোর জন্য অ্যারোমা থেরাপি নিয়ে থাকেন। দুশ্চরিত্রদের কাছে তো এই জাতীয় ম্যাসাজ পার্লার আর স্যালুনের আকর্ষণ আরও বেশি। অনেক ম্যাসাজ পার্লারের পেছনে সেক্স র্যাকেটও থাকে। তেমনই কিছু নয় তো! হানি ট্র্যাপেই কি ফেঁসে গিয়েছিলেন ওঁরা? কিন্তু তাহলে খুন হতে হলো কেন? ক্লায়েন্টদের মারা এই জাতীয় সেক্স র্যাকেটের স্বভাববিরুদ্ধ। তবে?
মাথায় এরকম অনেক চিন্তা নিয়েই সে অন্যমনস্ক হয়ে ফরেনসিক ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎই মোবাইল বেজে ওঠায় সচকিত হয়ে ফোন রিসিভ করল।
অন্য প্রান্তে তার কর্মী কাম বন্ধু পবিত্র আচার্যর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়–রাজা, সর্বনাশিনীর কেসটায় অদ্ভুত একটা আপডেট হয়েছে। বুঝতে পারছি না ভালো কী মন্দ!
কী হয়েছে? নানাবিধ আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে ওঠে–ফের লাশ…! এত তাড়াতাড়ি!
না! চার পায়ে নয়, বিজয় জয়সওয়াল দুপায়ে হেঁটেই আজ বাড়ি ফিরেছেন। সম্পূর্ণ অক্ষত ও সুস্থ!
হো-য়া-ট!
এর বেশি কিছুই বলতে পারল না অধিরাজ! বিজয় জয়সওয়াল বাড়িতে ফিরে এসেছেন! এটা কী করে হলো!