১. কানাই সামন্ত সরু গলি

ঝুমরা – তিলোত্তমা মজুমদার / প্রথম সংস্করণ: অক্টোবর ২০১৮
গোপা, চুমকি, নিবেদিতা, বোজন, মিতালি, দেবযানী, মধুপর্ণা, স্রগ্ধরা, রাখী ও শাশ্বতী প্রিয় বন্ধুগণেষু…

কানাই সামন্ত সরু গলি

ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঝুমু। নীচে সরু গলির কলে জল এসেছে। মুন্নার মায়ের সঙ্গে ঝাড়ু নমিতার ঝগড়া শুরু হল বলে। ঝুমু দেখতে পাচ্ছে, ঝাড়ু নমিতা মুন্নার মায়ের অ্যালুমিনিয়ামের গামলা সরিয়ে নিজের লাল প্লাস্টিকের বালতি গুঁজে দিল। মুন্নার মা শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে। শিবুর বউ চোখ মুছল। তার দুঃখও ফুরোয় না, কথাও নয়। তার ঘরের কাছেই টাইমকল। সরু গলির মেয়েরা নিত্য দু’বেলা জল ধরতে আসে। প্রত্যেকেই অন্তত একবার শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা বলে যায়। ঝুমু সেসব শুনতে পায় না। কিন্তু ঝগড়া লাগলেই সব কথা তার ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন, খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত না থাকলে সে এই ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আর টোপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়। হবেই। টোপর মুচকি হসে, সে-ও হাসে। দু’জনেই নিবিষ্ট মনে ঝগড়া শোনে কিছুক্ষণ। দারুণ ভাল লাগে! বিনি পয়সায় অতুলনীয় উপভোগ্য জীবন্ত ধারাবাহিক। শুধু টেলিভিশনের কুশলিবের মতো এদের রংচঙে দামি শাড়ি-গয়না, কারুকাজের ঝলমলানো পাঞ্জাবি আর চড়া রূপটান নেই! অভিনয়ে তো তুলনাই হয় না। টেলিভিশনের ধারাবাহিক হল কথা-বলা পুতুলের সংলাপ, এখানে জলজ্যান্ত অভিনয়, বেঁচে থাকতে গেলে যা না করে উপায় থাকে না মানুষের! ঝুমুর গোটা ব্যাপারটাই উপভোগ্য মনে হয়। হাসি, কান্না, বিবাদ, ঈর্ষা, চক্রান্ত-সুন্দর ও অসুন্দর পাশাপাশি কিন্তু অবিচ্ছেদ্য এবং প্রাণস্পন্দনে ভরপুর। হাতে সময় থাকলে, মনমেজাজ ফুরফুরে থাকলে, দিব্যি পুরোটাই দেখা যায়। টোপর বলে, ‘আমার তো হতাশা, দুঃখ, বিরক্তি সমস্তই চলে যায় ওই কলহপুরাণ শুনলে। কী ভাষাবোধ বলো ঝুমুদি! আর কী স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপ! অনর্গল মুখে এসে যাচ্ছে!’

সবাই পারে না এমন। অনেকেই শান্ত, ভীরু। বিবাদের উপক্রম হলেই হার স্বীকার করে নেয়। তারা সব ঝুমুর দলে।

ঝাড়ু নমিতার সঙ্গে ঝুমু-র ভারী অন্তরঙ্গতা! এই সরু গলিতে কত যে নমিতা, কত যে লক্ষ্মী, কত সাবিত্রী তার ঠিক নেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জটা নমিতা। ঈশ্বরের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক জটাজূট হয়ে দেখা দিয়েছে।

শিবের স্বপ্নাদেশ পাবার পর থেকেই জটা নমিতা আর চুলে চিরুণি দেয়নি। মাথায় জটার বোঝা নিয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিল। স্বপ্নের বোঝা বললেও হয়। দেবাদিদেব মহেশ্বর ত্রিভুবনে আর লোক পেলেন না ভর করার মতো। ওই এক বয়ঃসন্ধির বালিকা নমিতা, শিবের ভার বইবার ক্ষমতা কি তার ছিল? তিনমাস সে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। তার মা নিজ অদৃষ্টকে গালি পাড়ত, শিবের ভর না হয়ে বর পেত যদি, নাবালিকা হলেও নমিতার একটা গতি হত, অর্থাৎ শিব পাওয়া ইস্তক মেয়ের দশায় মেয়ের মা একেবারেই প্রীত ছিল না। তার স্বামী, নমিতার জন্মদাতা পিতা, দশাসই চেহারার এক মোদোমাতাল, পুরসভার আবর্জনা বহনের ট্রাকচালক, মেয়ের শিবপ্রাপ্তির মাসখানেক পরেই, বমি করতে করতে পট করে মরে গেল। এই ছিল, এই নেই। মরণের হরণ করার এই বিপুল ক্ষমতা, এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ, প্রত্যক্ষ করে, ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঝুমু। যদি ভূত হয়ে গলা টিপতে আসে!

‘ধুর!’ ঝিরি ঝিরঝির করে হেসে তার ভয় উড়িয়ে দেয়। বলে, ‘কী বোকা রে তুই! আমাদের যে মা মরে গেল! ভূত হয়েও তো ফিরে এল না।’

‘যদি আসত, একই মা থাকত কি আমাদের?’

‘মা তো মা-ই। ভূত মা কি বদলে যায়?’

‘আমার তো মনে হয় আমরা প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাই।’

‘যে শিশু ছিল সে বড় হয়। যে বড়, সে বুড়ো হয়, এইরকম?’

‘সেটা তো বাইরে। আমি মনের পরিবর্তনের কথা বলছি। কাল তুই যে ঝিরি ছিলি, আজ কি একই? তা হলে ধর, যে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে, সে কি ঠিক একই মানুষ হয়ে ফিরে আসতে পারে?’

‘সে তো মানুষই নয়, ভূত।’

‘মা ভূত হয়ে এলেই বা কী হত!’

‘মা-কে দেখতাম। ইচ্ছে করে।’

এরকম কথা প্রায়ই হয়। অকারণ। মা ব্যতীত বেড়ে ওঠার মধ্যে মা কেবল স্বপ্ন আর কল্পনা। কেবল কথা আর ছবি।

ঝিরি পঞ্চম শ্রেণি, ঝুমু দশম। তখন থেকেই ঝিরি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সপ্রতিভ, সচেতন। তখন থেকে ঝুমু শুনছে তার বাবা বলে, ‘আমার বড় মেয়েটা বড্ড সরল। বোকা। ওকে নিয়েই চিন্তা।’

এখন ঝুমু জানে, সে শুধু বোকা ও সরল নয়, সে সাধারণ। তার সাধারণ চেহারা, সাধারণ ক্ষমতা, সাধারণ চিন্তা। সারল্য আর সাধারণ্য একত্রিত হয়ে জ্যোতির্ময়ের বড় মেয়ে ঝুমু সংসারে এক দায় বটে। ইদানীং, ঝুমুর বিয়ে দিয়ে তিনি দায়মুক্ত হতে চান, কিন্তু পাত্র মিলছে না। তার বয়স সাতাশ হল। জটা নমিতার বয়সও তবে সাতাশ। এই ক’বছরে একফালি গৃহের বাইরের দেওয়ালে সাদা সেরামিক টালি বসিয়ে শিবের ছোট্ট মন্দির গড়েছে নমিতা। তার ত্রিকোণ চূড়ার শীর্ষে লোহার ত্রিশূল, অন্দরে শিবলিঙ্গের পাশে সিমেন্টের ষাঁড়, সাপ। ভাস্কর্য হিসেবে অতি নিকৃষ্ট। কিন্তু তার জন্য ভক্তি আটকায় না। ভক্তিরস বিষয়টি যতই টাকাকড়ি নিরপেক্ষ বলে প্রচারিত হোক, কানাই সামন্ত সরু গলির জটা নমি ও তার মা ভক্তিরসসাগরের রেজগি কুড়িয়েই গ্রাসাচ্ছাদন চালিয়ে যায়। শিবরাত্রির দিন ঝুমু নিজেও জটা নমিতার শিবলিঙ্গে ভক্তি ভরে দুধজল ঢালে। টোপর দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘শিবের মাথায় দুধ ঢালবে?’

‘জানিসই তো।’

‘কতবার বলেছি ওটা মাথা নয়।’

‘জানি। চুপ কর।’

‘লিঙ্গে দুগ্ধসিঞ্চন, পত্রসমেত বেলফল আতঞ্চন? আহা! দেবতার ব্যথার কথা কে বোঝে!’

‘বাজে বকিস না। শিব নমিতাকে ছেড়ে তোকে ধরবে।’

নমিতার ভর বিস্ময়ের বস্তু। একদিন কৌতূহলে ভর দেখতে গিয়েছিল। শিউরে উঠেছিল সে। নমিতার চোখ দুটি টকটকে লাল। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। এই উঠছে, এই পড়ছে, এই হাত-পা ছুড়ে গোঁ গোঁ করছে। কী এক অকথ্য যন্ত্রণায় যেন আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে মেয়েটা। ঢোলা ম্যাক্সি ঊরু পর্যন্ত উঠে এসেছে। বন্ধনহীন স্তন দুটি ভয়ানক চোখ টানছে। মুন্নার মা ম্যাক্সি টেনে নামাতে গেল। তার বুকে এক লাথি মারল নমিতা। তাকেই মহাদেবের পদাঘাতরূপী আশীর্বাদ মনে করে মাটিতে গড় করল মুন্নার মা। বাবা মহেশ্বর, ভোলানাথ, দয়া করো প্রভু।

লাজলজ্জার বালাই থাকে না বলে এসময় মেয়েরাই নমিতাকে ঘিরে থাকে। বেহায়া পুরুষদের ধারেকাছে আসতে দেয় না। এসময় কলহপ্রিয়া রমণীরা একাত্ম। সরু গলির জীবনযৌবন সকলই অরক্ষিত। লোলুপ পুরুষ উঁকি মারে ভরাস্তনী ডাগর শরীরে। প্রহারও করে। গালি-খিস্তি দেয়। নারীত্ব বড় সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জটা-নমি যতই শিবের কৃপাধন্য হোক, তার অববাহিকার রক্ষা-ভার বর্তায় দেবী দুর্গতিনাশিনীদের দুই হাতে। তারা অপেক্ষা করে কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে সে। এ সময় শিবাঙ্গী, শিবলিঙ্গশক্তিপীড়িত নমিতার কাছে কায়মনোবাক্যে যাঞ্চা নিবেদন করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।কিন্তু নীলকণ্ঠ শিবের তাণ্ডব শরীরে ধারণ করে, বিপুল ক্ষমতাশালিনী হয়ে বিবিধ ভবিষ্যদ্বাণী করে, ওষুধ-বিষুধ দিয়ে ভারী ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটা!

বিষহরির অংশ হওয়া চাট্টিখানি কথা তো নয়। লোকে তার সাহায্য পায়। তার জন্য মায়া বোধ করে! সেইসব সহায়তার অস্তি ও নাস্তির অর্থ নিজেকেই করে নিতে হয়। ‘মা গো, আমার মেয়ের প্রসব ঠিকমতো হবে তো?’ জটা-নমি খিঁচুনি দিল, লালা গড়াল কষ বেয়ে। ‘হবে মা? হবে! প্রাণটা শান্ত হল গো মা।’ আর ওষুধ বিষুধ? শিবলিঙ্গে মাখানো চন্দন, তুলসী বা বেলপাতায় মেখে প্রার্থীর হাতে তুলে দেয় নমিতার মা! ‘ভক্তিভ’রে খাও, ভাল হবে।’ ভাল না হলে ভক্তিতে খাদ, ওষুধে নয়!

ঝুমু-র বিশ্বাসের জগৎ বিপুল। তবু নমিতার অতিপ্রাকৃত শক্তিতে তার বিশ্বাস নেই। কারণ সে সত্য জানে। জটা নমিতার জন্য কষ্ট পায়। চিকিৎসা করালে হয়তো সে সেরে উঠত। বিকার ব্যতিরেকে ঈশ্বরপ্রাপ্তি কি সম্ভব নয়? ঈশ্বরের সঙ্গে সৌন্দর্য একাকার মনে হয় ঝুমু-র। ঈশ্বর নিখুঁত, অবিকার, পূর্ণ, সুন্দর! সেখানে গ্যাঁজলা, হাত-পা ছোড়া, অভব্য আচরণের কোনও জায়গা নেই। ঈশ্বর বর্ষপঞ্জীতে ছাপা দেবদেবী। সালঙ্কার, সদাপ্রসন্ন, আশীর্বাদক।

ঈশ্বরই ঐশ্বর্য। ঈশ্বরই সৌন্দর্য। বাকি যত অসুন্দর, তা মানুষের করণ। এই যে জটা-নমির শিবাশিস— সে-ও তাই। সে গোপালীমাসির কাছে মূল তথ্য প্রাপ্ত হয়েছিল।

‘বাপটা মানুষ ছিল নাকি? মরেছে বেশ হয়েছে। লোকে যেমন পিটিয়ে ছুঁচো মারে, তেমনি করে মারা উচিত ছিল। তা ওই ইঁদুর মারার বিষ-টিসই দিয়েছিল বোধহয়।’ গোপালীমাসির মুখ রাগে, ঘৃণায় গনগনে, তপতপে। শান্ত মানুষ, কর্তব্যপরায়ণ, মা মরে যাবার পর ঝিরি হয়তো মরেই যেত মাসিকে তত্ত্বাবধায়ক না পেলে। তাকে এমন উগ্র হয়ে উঠতে দেখে ভয়ে ঝুমু-র গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কোনওক্রমে সে বলতে পেরেছিল, ‘বি-বিষ! মাসি! স-সত্যি?’

‘নিজের মেয়ের পেট করে দিয়েছিল মিন্সেটা। আমার সোয়ামি যদি এমন হত, জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ দিয়ে আগে ধন গালতাম, তারপর আর সব।’

‘এসব কী বলছ মাসি?’

‘সত্যি বলছি। এর এক বর্ণ মিথ্যে হলে আমার জিভ খসে যাবে। পেট খসাতে গিয়ে কম কাণ্ড? বেঁচেও মরে রইল মেয়েটা।’

‘কোনও বাবা এমন করতে পারে?’

‘দ্যাখ মা, দশবাড়ি ঘুরে কাজ করি, জীবনে কম দেখলাম না। ওই নমি-র বাপ মেয়ের জন্য এটা আনে, সেটা আনে। আর সব বাপের মতোই। কিন্তু একলা ঘরে পেলে হল। প্রথমে গায়ে হাত দিত আর ভয় দেখাত, মা-কে এসব বললে মা সঙ্গে সঙ্গে ফটাস মাথা ফেটে মরে যাবে! সরল মেয়ে ভয়ে কিছু বলেনি। শেষে ওই পশুবৃত্তি! ওইর’ম ধুমসো বিপুল পুরুষ মানুষ। জন্মদাতা বাপ। মেয়েটা দেহে-মনে কত যন্ত্রণা পেয়েছে বলো দি’নি! মিন্সেরা হল গিয়ে আপদ। ধনে রস জমলে পাগলা কুত্তা আর পুরুষমানুষে কোনও তফাত নেই। ভাদুরে কুকুরের মতো শুধু মেয়েমানুষ দেখে, সম্পক্ক, ভালমন্দ, সময়-অসময় কিছু বোঝে না। ওই এক অঙ্গতুষ্টির জন্য ওরা সর্বস্ব দিতে পারে, আবার নিতেও পারে।’

‘ইঃ! আমার গা গুলোচ্ছে! মা গো! উঃ ভগবান।’

‘তাই বলে কি সব পুরুষই এই? না। তা কক্ষনো না। বাজারে একশো কাঁচালঙ্কা কিনলে একটা দুটো পচা বেরোয় না? এ-ও সেইরকম। জানিয়ে রাখলাম। সচেতন থাকবে। বাসে, ট্রামে, পথে, ঘাটে নোংরা লোক থাকে, সতর্ক হয়ে চলবে। পোড়াকপালি রে। আজ তোদের মা বেঁচে থাকলে আরও অনেক ভাল শিক্ষে দিত। আমি কি তেমন পারি? তবু আমার জ্ঞানবুদ্ধি মতো বলি। তবে কী, ওই এক কষ্টিপাথরে সব যাচাই করে নিতে হবে। সে হল তোমার মন।’

‘তার মানে কী মাসি?’

‘মানে হল এই যে মনকে সদাজাগ্রত রাখবে। আমার গুরুদেব প্রসন্নানন্দজি মহারাজ বলে দিয়েছেন মনকে কখনও ঘুম পাড়াতে নেই, চিন্তা শিথিল করতে নেই, চেতনা আচ্ছন্ন করতে নেই। বুদ্ধির কলেবরে এই তিন অঙ্গ। মন, চিন্তা, চেতনা। তিনি বলেছেন, আমি বোঝার চেষ্টা করে চলেছি। তোমাদের মতো লেখাপড়া তো করিনি বাপু। তোমরা আরও বেশি করে বুঝবে।’

‘তা তো বুঝলাম। পুরুষমানুষেরাই কি শুধু খারাপ মাসি? মেয়েরাও তো খারাপ হয়। সিনেমায় দেখোনি?

‘দেখিনি আবার? সিনেমায় কেন মা? এ জীবনেই ঢলানি পুরুষখাকি মাগি কম দেখিনি। তবু বলব, তোলায় যদি ওজন করতে পারা যেত, ভালর বিচারে মেয়েরা হত ভারী। মেয়েমানুষ বড় অসহায় রে মা। তাদের হল মার খাবার কপাল। পুরুষেরা ভোগ করবে আর মেয়েরা তার সামগ্রী হয়ে থাকবে।’

ঝুমু ও নমিতা ও গলির গল্প

মেয়েদের ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে দেখার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে মস্ত আন্দোলন চলছে। ঝুমু-র মনে হয়, তারও কিছু করার আছে। কিন্তু কী করবে ভেবে পায়নি। তাদের এই দোতলা ঝুলবারান্দা থেকে সরু গলির অভাবী জীবনসংগ্রাম দেখলে মনে হয় খেয়ে-পরে বাঁচাই হল প্রথম শর্ত। তারপর অন্য কিছু। জটা নমিতার শিবপ্রাপ্তির উৎসে যে করুণ মর্মঘাতী অত্যাচারের কাহিনি, তার ওপরই গড়ে উঠেছে মা-মেয়ের রুজিরোজগারের উপায় ওই শিবমন্দির। এটা যদি সত্যি হয় যে নমিতার মা মনের জ্বালায় স্বামীর আহার্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, তা হলে সে স্বাধীনভাবেই তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে পেরেছে, মেয়েকে আরও বহুবার ধর্ষিতা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেও পেরেছে। সামাজিক নিয়ম হল, আইন নিজের হাতে নেওয়া চলে না। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ আছে, আদালত আছে, অপরাধীর বিচার করে সমাজ। ব্যক্তি নয়। কারণ, ঝুমুর মনে হয়, ব্যক্তি বলে কিছু হয় না। সবটাই সমাজ। লোকে কী খাবে, কী পরবে, কোথায় বেড়াবে, এমনকী ঘরবাড়ি কেমন হবে-এই সবই অদৃশ্য বা দৃশ্যমান সমষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে। ছোটবেলায় সে এক গাধা ও ধোপার গল্প পড়েছিল। গাধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে, নিজেও চেপে যাচ্ছে ধোপা। লোকে বলল, আরে দেখো, লোকটা কী নিষ্ঠুর! এত ভার বয়ে গাধাটা চলতেই পারছে না। শুনে লোকটা নেমে পড়ল। সে যত যায় তত নতুনতর মন্তব্য শোনে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলায়। জীবনে সবই এই ধোপার গল্প। সমাজ কোনও না কোনওভাবে ব্যক্তিজীবনকে সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সমাজকে সংকুচিত ও প্রসারিত করা যায়, বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। নমিতার মা কি তবে আইনের চোখে অপরাধী নয়? সে কি সমাজের অংশ হিসেবে স্বামীকে শাস্তি দিল, নাকি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে? সে কি নারী বলে শাস্তি দিল? মা বলে প্রতিশোধ নিল? নাকি শুদ্ধ মানবিকতাবোধে? জটা নমিতা ও তার মাকে কি নারীমুক্তি আন্দোলনের শরিক বলা যায়? নারীমুক্তি মানে ঠিক কী!

শিবুর বউয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে মুন্নার মা এবার জলের দিকে আসছে। পুরী গেলে যেমন করে সমুদ্রর কাছে যায় ঝুমু, দূরের ঢেউয়ে চোখ রেখে, সাদা ফেণশীর্ষের পটভূমিকায়, পায়ে পায়ে।

ঝাড়ু নমিতা খুব অবহেলায় মুন্নার মাকে দেখল। যেন কিছুই জানে না। ঝর ঝর করে জল পড়ছে। দ্রুত ভরে উঠছে বালতি-গামলা। মুন্নার মা ক্রম গুনছে। এক, দুই, তিন… কোমরে আঁচল প্যাঁচাচ্ছে এবার।

‘অ্যাই! অই লাল বালতিটা কার র‍্যা!’

নমিতার মুখে চাপা হাসি। ইচ্ছে করে মুন্নার মায়ের পেছনে লাগে মেয়েটা। তাতিয়ে দিয়ে মজা পায়। পুরসভার স্থায়ী পথঝাড়ুনে নমিতা। সপ্তম শ্রেণি পাশ। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। ঝুমু-র কাছ থেকে পত্রিকা চেয়ে নেয় পড়ার জন্য। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীসংগঠনের দাবিদাওয়া ঘোষণা করতে করতে দলের নিশান হাতে সদর্পে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় যখন নমিতা—ঝুমু-র মনে হয়, রাস্তা, ঝাড়ু নমিতার পদস্পর্শে ধন্য হওয়ার জন্য বুক পেতে দিয়েছে। তার স্বপ্ন, সে সংগঠনের নেত্রী হবে। বাসন্তীদেবী কলেজের ঠিক উলটোদিকে, রোলের দোকানি কমলকে ভালবাসে নমিতা।

‘আমিই ওকে ‘আই লাভ ইউ’ বললাম জানো ঝুমুদি। মুখে না। মেসেজ করলাম। ও আমাকে ডাকল। ডাকবে জানতাম।’

‘তারপর? মারল এক চড়?’

‘ধুৎ! সে হলে তো সমস্যাই ছিল না। নাটক করার প্রচুর চান্স পেতাম। কিন্তু লোকটা ঘুঘু, বুঝলে?’

‘ছি ছি নমি, যাকে ভালবাসিস তাকে বলছিস ঘুঘু!’

‘বলব না তো কী? এক্কেবারে হারামজাদা! বলে কী, ‘হঠাৎ আমাকে ভালবাস! কেস কী?’ বললাম, ‘যা সত্যি, তাই বলেছি। আমি কি কাউকে ভয় পাই?’ বলে, ‘কী চাও কী? প্রেম করে দু’ দিনেই ফুড়ুৎ? নাকি সংসার-টংসার করবে? আমার পক্ষে রোলের কাউন্টার বন্ধ দিয়ে মাঠ-ময়দান ঘোরা সম্ভব না। দামি সেন্টও কিনে দিতে পারব না।’ বললাম, ‘বুঝলাম, এর আগে প্রেম করে আপনার দোকানে হেভি লস গিয়েছে।’ রেগে গিয়ে বলে, ‘বাজে বোকো না। কোনও দিন কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখেছ?’ হি হি হি! বললাম, ‘রোজই দেখি। বাসন্তীদেবীর মেয়েরা তো আপনার রোল চেটে খায়।’

‘কী বদমাইশ রে তুই! বলে দিলি এরকম?’

ঝাড়ু নমিতা হাসছিল। হেসেই যাচ্ছিল। তার উচ্ছল তরুণ শরীর সেই হাসির সঙ্গে জলকল্লোল হয়ে যাচ্ছিল। একরাশ চুলের খোঁপা ভেঙে সহস্র সর্পিণী ফণা।

‘রোল চেটে খাওয়া মানে বুঝলে তো ঝুমুদি? ইঃ হি হি হি! মালটা বোধহয় বোঝেনি! দুদু-ভাতু টাইপ গো! আমি খুব নজর করেছি, মেয়েদের যখন রোল বেচে, বুকের দিকে তাকায় না। আমাকে বলে…ওঃ হো হো… আমাকে বলে, ‘রোল কি আইসক্রিম যে চেটে খাবে?’ আমি তো হাসি চেপে বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি আমার দিকটা বলি, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর টাইম আমারও নেই। আমিও জব করি। ইউনিয়নের কাজ করি। ঘরেও পায়ে পা দিয়ে বসে থাকি না। মাকে সাধ্যমতো সাহায্য করি। গরিব হতে পারি, হ্যাংলা নই যে কবে আপনি সেন্ট দেবেন তারপর গায়ে মাখার জন্য হাঁ করে থাকব।’ আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো কী শান্ত! এক মুহূর্ত কাজ থামাচ্ছে না কিন্তু। বোধহয় জিমে যায়। কী সুন্দর শরীরটা! বাড়িটা কোথায় জানো?’

‘আমি কী করে জানব?’

‘চেতলা রোডে। ঠিক রোডের ওপর না। চেতলা রোডে ‘উৎসব’ বিয়ে বাড়িটা আছে না? ভাড়া দেয়? তার ঠিক পাশের গলি। ওখানে একটা জিম আছে। দেখেছি।’

‘বাব্বা! তুই কি ওর সব খোঁজখবর নিয়েছিস নাকি? পাকা গোয়েন্দা!’

‘বাঃ! যাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই, তার খোঁজ নেব না? যদি অন্য কাউকে গলায় লটকে থাকে? আমার সঙ্গে দুগ্গিবাজি করে? যদি নেশাভাঙের অভ্যাস থাকে?’

‘হুঁ। তারপর?’

‘আমার কথা শুনে বলল, ‘দেখো নমিতা, তোমার প্রস্তাবে হ্যাঁ-না বলার আগে পস্টাপস্টি বলে নেওয়া ভাল যে আমাদের ঘরের বউ যদি হতে চাও চাকরিটা তোমাকে ছাড়তে হবে।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল কী জানো ঝুমুদি? ‘আমার বাড়ির লোক মানতেই পারবে না ঘরের বউ রাস্তা ঝাঁট দেয়।’ বললাম, ‘তো? ঝাঁট দেওয়া খারাপ কীসে? এলাকা পরিষ্কার রাখি বলেই না আপনারা ফুটপাথে দোকানদারি করে খাচ্ছেন। এলাকায় কলেরা, ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে না। আমরা শুধু চাকরিই করি না। পরিষেবা দিই মানুষকে। সাফাই না করলে কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ায় দেশ ভরে যাবে। আমাদের গুরুত্ব বোঝেন? তা ছাড়া করপোরেশনের স্থায়ী চাকরি, রিটায়ার করলে কত পাব জানেন?’ বলল, ‘আমার যা বলার বললাম। এবার তুমি ভাবো।’’

‘ভাবলি?’

‘হুঁ তো।’

‘চাকরি ছেড়ে দিবি?’

‘না। কক্ষনো না। কেন ছাড়ব? ঝাড়ুদারনি বলে কি আমি মানুষ না? বইতেই লেখা আছে আমরা সমাজবন্ধু। এটা আমার কাজ ঝুমুদি। আমি গরিব মায়ের মেয়ে, সে কি আমার দোষ? নাকি গরিবিয়ানা আমার মায়ের দোষ? সমাজে কেউ ঘি খায়, কেউ পাত কুড়োয়, এ তো সমাজেরই সৃষ্টি! ঝাড়ু দিই বলে আমার এতটুকু লজ্জা-ঘৃণা নেই। সিস্টার নিবেদিতা নিজের হাতে ঝাড়ু তুলে মানুষকে পরিচ্ছন্ন হতে শিখিয়েছিলেন। আমি তো সামান্য মেয়ে। যা পারি, তাই করি। এর জন্য আমাদের সংসারটা খেয়ে-পরে আছে। ভাই কলেজে যেতে পারছে, আমি মাথা উঁচু করে চলতে পারছি। আমি তো খারাপ পথে যাইনি, চুরি করিনি, লোভ করিনি! ও আমার আত্মসম্মানের জায়গাটা বুঝতে পারল না? আমিও তো হিসেব কষতে পারতাম। আমার তো মনে হয়নি, ফুটপাথে রোল বেচে— সে আবার যোগ্য পাত্র!’

‘কী আর করবি। ভুলে যা।’

‘হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু ভাবলেই বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে গো ঝুমুদি। এইরকমই যদি চলতে থাকে, আর কাউকে বিয়ে করেও কি আমি শান্তি পাব? তাই আর ভাবছি না। কোনও দিন যদি ওকে ছাড়া আর কাউকে ভাল্লাগে, তখন ভাবব। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাধ্যমিকটা যদি পাশ করে নিতে পারতাম। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজের অনেক সুযোগ, জানো। প্রেস্টিজও দেয় লোকে।’

‘আবার শুরু কর না। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়া যায়। পড়তে তো ভালবাসিস তুই।’

‘সে গল্প-টল্প পড়তে ভাল লাগে। সিনেমার খবর, খেলার খবর, পলিটিক্স। তাই বলে অঙ্ক, ইংরিজি, ইতিহাস, জীবনবিজ্ঞান?’

টোপর ও পলাশ ও দৃঢ় বসবাস

ঝাড়ু নমিতা দিব্যি আছে। এখন ঠিক করেছে, কমল বিয়ে করেছে জানলেই সে বিয়ের জন্য ভাবনা-চিন্তা শুরু করবে। তার ভাই পলাশের কলেজে তৃতীয় বর্ষ চলছে। একবারও অকৃতকার্য না হওয়া সাধারণ ছাত্র। ঝুমুর মতোই। সপ্তাহে তিনদিন টোপরের কাছে কম্পিউটার শেখে পলাশ। বিনিময়ে টোপরকে সে ওঠা-নামায় সাহায্য করে।

টোপর আর পলাশের মধ্যে কখনও বিচিত্র বিষয়ে কথা হয়। কখনও কথাই হয় না। দু’জনেই চুপ করে থাকে। তখন পলাশকে ছায়ার মতো লাগে। বড় বাড়ি ও সরু গলির অধিবাসীদের মধ্যে মানসিকতার নানাবিধ ফারাক। আত্মবিশ্বাসী ও আত্মকরুণাবাদীর মতো।

টোপরের সঙ্গে থাকাকালীন পলাশ যেন বৃত্যবৃত। কিছুতেই ওই ভেলভেটের মতো সবুজ আবরণ খুলে আগুনের রঙে প্রস্ফুটিত হয় না। ঝুমু-র দেখতে ইচ্ছে করে, কলেজেও পলাশ এইরকম ম্রিয়মান কিনা!

ঝুমু-র জগতের সবকিছুই তার চিন্তায় এমনি করে জায়গা পেয়ে যায়। ঘরের কাজ আর ভাবনা, এ নিয়েই সে আছে। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে টোপর থেকে শুরু করে মুন্নার মা অবধি সরস পরিক্রমা করতে লাগল।

ঝুমু ও ঝিরি ও শৈশবের ঋণ

‘অ্যাই! অই লাল বালতিটা কার র‌্যা!’

ঝুমুর সঙ্গে চোখাচোখি করল ঝাড়ু নমিতা। তারপর সরু গলায় যুদ্ধাহ্বান তুলে বলল, ‘আমার। কিছু বলবে?’

‘হারামজাদি নেকির ঢেঁকি! আবার বলে, কিছু বলবে!! রগা ঢিলে লুল্লু মাগি! বলি, আমার গামলি পাঁচ লম্বরে ছিল, ছয়ে এল কী করে র্যা!’

‘তোমার গামলির পাঁচ পা হয়েছে গো মাসি।’

‘দ্যাখ নমি, রোজকার এই রপোট আমার ভাল লাগে না বলে দিচ্ছি।’

মুন্নার মা নমিতার লাল বালতি তুলে নিজের গামলা স্থাপন করার উদ্যোগ নিতেই নমিতা লাফিয়ে উঠল, ‘রাখো! রাখো বলছি! লাইন রেখে গপ্পো মারবে, আর পরে লপচপানি, ও চলবে না। লাইন দিলে চোখ রাখতে হবে।’

‘ঢলানি মাগি! যমের অরুচি! তোর মরণ হয় না! হাটে হাঁড়ি ভাঙব। কিছু জানি না ভেবেছিস? সব লদগালদগির কুষ্ঠি যদি না খুলেছি…’

কণ্ঠ ছিঁড়ে চিৎকার করছে মুন্নার মা, কিন্তু নমিতার বালতি সরানোর সাহস করছে না। এই সম্ভ্রম দারুণ উপভোগ করছে নমিতা। মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ঝুমু নিশ্চিত, মেয়েটা একদিন নেত্রী হবেই।

উলটো দিকের জানালায় টোপর এল। হাসছে। ঝুমুকে ডাকছে ইশারায়। দুই বাড়ির মাঝে এই সরু গলি যেন নদীর মতো। এপার থেকে ওপারের সব দেখা যায়, শব্দ আসে, ডাক পৌঁছয়, এপারে বৃষ্টি নামলে ওপারের রোদ্দুর চেয়ে থাকে মেঘের তৃষায়, বৃষ্টি তখন নদী পারাপার করে। এপার থেকে গিয়ে ভিজিয়ে আসে ওপারের কাতরতা। মাঝখানে একটা সাঁকো থাকলে বেশ হত। কিন্তু সাঁকো নেই। পণ্ডিতিয়া রোড থেকে বেরিয়ে এসে বিজন ভট্টাচার্য লেন নামের ছোট রাস্তাটি পুবে-পশ্চিমে প্রলম্বিত দুটি ছোট গলিকে দাঁড়িয়াবান্ধা ছকের মতো উত্তর-দক্ষিণে কেটে উল্লাসকর দত্ত সরণি পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। সেই দুই ছোট গলির একটি, যেটি সরুতর, কানাই সামন্ত বাইলেন নাম নিয়ে টোপরদের বাড়িটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ঝুমুরদের বাড়ি থেকে। মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে কানাই সামন্ত সরু গলি পেরোলেই টোপরদের ফটক।

ঝুমু পায়ে চটি গলিয়ে নিল। ঝিরি তার অভ্যাসমতো সারা বাড়ি ঘুরে পায়চারি করতে করতে পড়ছিল। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘টোপর ডাকছে।’

‘ওমনি তুই চললি?’

‘যাব না? ও মা! কেন?’

‘আমি কি বলেছি, যাবি না? তোর খুশি তুই যাবি। লেংড়ুটার জন্য তো তোর দরদের অন্ত নেই।’

‘ওভাবে বলিস না। কী কষ্ট বলতো! প্রবীরকাকা শুনলেই বা কী বলবেন?’

‘আমার যেন বুদ্ধি নেই। আমি যেন প্রবীর কাকার সামনেই এসব বলব!’

‘উনি যখন-তখন এ বাড়িতে আসছেন, শুনতেই পারেন।’

‘যা যা! গিয়ে শার্ট বেছে দে!’

‘অত খিটখিট করছিস কেন? মন দিয়ে পড় না।’

‘মন দিয়ে পড়ব? বাড়ির চারদিকটা তো তপোবন। মুনিঋষিরা সামগান গাইছেন। উফ্! সকাল থেকে ঝগড়া আর খিস্তি! নমিটা মহা বদমাইশ! পায়ে-পা লাগিয়ে ঝগড়া করে মজা পায়। বাবা আর বাড়ি করার জায়গা পেল না! হাড়কিপটে! শস্তায় পেয়েছে, নিয়ে নিয়েছে! অসহ্য! আমি হস্টেলে চলে যাব! শহরের বাইরে চলে যাব চাকরি নিয়ে।’

‘যাস। ছোটবেলা থেকে শুনেও তোর অভ্যাস হল না! আমি আর টোপর তো খুব মজা পাই। ওই ঝগড়া মারামারি আছে বলে দিনগুলোয় যেন আর একঘেয়েমি থাকে না! আর বাবাকে দোষ দিয়ে কী করবি! বাড়িটা তো বাবা করেনি। বাবার বাবা জমি কিনে একতলা করেছিল, বাবা শুধু দোতলা তুলেছে। সবই তো জানিস।’

ঝুমু সিঁড়ি দিয়ে নামছে। বাণিজ্যবিদ্যায় স্নাতক সে। ভেবেছিল ব্যাঙ্কের চাকরির পরীক্ষা দেবে আর পেয়ে যাবে। সেরকম আদৌ হল না। কেন হল না? ঝুমু তার জন্য নিজেকেই দায়ী করে। বারো-তেরো বছর বয়স হতে না হতেই সে কেমন সংসারে ঢুকে পড়ল। কলেজের পরীক্ষায় পাশ করার মতো লেখাপড়াই সে করেছে। ব্যাঙ্কের পরীক্ষার পড়া সে কিছুই করেনি। প্রথমবার যখন বসল, মনে হয়েছিল, এক অদ্ভুত জগতে ঢুকে পড়েছে। সাধারণ জ্ঞান বা অঙ্কের উত্তর যা-ও বা কিছু পারল, যুক্তিবোধের পরীক্ষার ধাঁধায় তারই যুক্তিবুদ্ধি সব গুলিয়ে গেল। এরপর সে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় গিয়ে ব্যাঙ্ক ও আরও অন্যান্য সরকারি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বইপত্র কিনে এনেছিল। কিন্তু সেসব আয়ত্ত করার চেয়ে তার অনেক বেশি উৎসাহ ছিল বাবার চা লাগবে কিনা, যাই ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলে আনি, ইশশ্ পাখাগুলোয় ঝুল পড়েছে, আলমারির মাথায় দেখো—সাত পরত ধুলো, বিকেলে আজ নতুন জলখাবার কী বানানো যায়? টোপর পছন্দ করবে, ঝিরিও। যেহেতু ঝিরি ও টোপরের অভিরুচি সম্পূর্ণ আলাদা সেহেতু দুই ভিন্নরুচিকে এক পদে বাঁধতে যথেষ্ট বুদ্ধি প্রয়োগ করে ঝুমু। ব্যাঙ্কপরীক্ষার বইয়ের পাশে লীলা মজুমদারের রান্নার বই কিংবা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর আমিষ-নিরামিষ। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সে উতরোয়নি বটে, অন্য এক চাকরি জুটেছিল, সে-ও সংসারের টানে ছেড়ে এল। বোকা আর সাধারণ বলেই না সে এমন সুযোগ ছেড়ে এসেছে! যা গেছে তা যাক! টোপরের জন্য রাঁধতে সে আনন্দ পায়। ঝিরি ভাল খেলে ভারী খুশি বোধ করে। বাবা-প্রবীরকাকা রান্নার প্রশংসা করলে সে হেসে হেসে ঘোরে এদিক-ওদিক। তার মনে হয়, আনন্দ নুড়িপাথরের মতো ছড়ানো, তার উপরে টুপটাপ খসে পড়ে খুশির শিউলি। যখন খুশি আঁচলে তুলে নিলেই হল! সে এখন একজন পাকা রাঁধুনি। ঘর গুছোয় চমৎকার। দুই বাড়ির কোথায় কোন জিনিসটি, তার মতো আর কেউ জানে না।

ঝুমু ও গোপালীমাসি

গোপালীমাসি ঝিরিকে দুধ খাওয়াচ্ছে, তেলমালিশ করছে, কিংবা ঘুম পাড়াচ্ছে। রাতটুকুর জন্য আয়া আসে। জয়মাতা আয়া সেন্টার। এই কলকাতা শহরে টাকা ফেললেই সব পাওয়া যায়। এ বাড়িতে ঝিরির জন্য আয়া, ও বাড়িতে টোপরের জন্য। জয়মাতার সব আয়া ঝুমু-র চেনা হয়ে গেল। কোনও কোনও আয়া ভারী হিংস্র। একজন টোপারকে এমন ঘুম পাড়াল থাবড়ে-থুবড়ে যে টোপরের পিঠে লালশিটে পড়ে গেল। ঝিরি বা টোপর কাঁথায় হাগু করলে এক-একজন এমন মুখ করত যে ভয়ে চিল-চিৎকার জুড়ত তারা! আর গোপালীমাসি সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় ভারী দুঃখের সঙ্গে বলত, ‘ঘরের বউ ঘরে না ফিরলে সংসার ভেসে যায়। নইলে কি এই মেয়ে ফেলে যেতে মন চায় আমার?’

বানিয়ে বলে না মাসি। সত্যি বলে। শুধু সংসার কী করে ভেসে যায় ঝুমু বুঝতেই পারত না। খুব বৃষ্টি হলেও এ পাড়ায় জল জমে না। সংসার ভাসবে কেন?

সময় পেলেই চলে আসত বড়পিসি। তার মুখেও এক কথা। ‘তোর মা সংসারটা ভাসিয়ে দিয়ে গেল। ভাগ্যিস গোপালী হাল ধরল! মাইনেটা অবশ্য খুব বেশি নেয় এই সুযোগে।’

মাইনে? সে তো আজও নিচ্ছে মাসি। কিন্তু ঝুমু জানে, কলকাতা শহরে টাকা ফেললে সব পাওয়া যায়, গোপালীমাসির স্নেহযত্ন পাওয়া যায় না। অনেকদিন, অনেকদিন ঝুমু দেখেছে, ঝিরি চিৎকার করে কাঁদছে, লাল হয়ে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে, দম আটকে আসছে। চিৎকারের বেগে ছোট্ট লাল জিভ থিরথির কাঁপছে। গোপালীমাসি তাকে দোলাচ্ছে, থাবড়া মারছে। ভোলাচ্ছে! ব্যর্থ! সব ব্যর্থ করে দিয়ে ঝিরির খ্যাপাটে কান্না সারা বাড়িতে আর্ত কাঁপন লাগিয়ে দিচ্ছে। গোপালীমাসি ব্লাউজের হুক খুলল। ‘খ্যাপ উঠেছে। মাই না পেলে ছাড়বে না। আচ্ছা, বলো দেখি, আমার বুকে তো দুধ নেই। শুধু চুষবে।’ গুঁজে দিল ঝিরির মুখে। ঝিরি শান্ত। চক্ চক্ শব্দ তুলছে। ছোট্ট পা ছুড়ছে। ‘তুই তবু মায়ের দুধ পেয়েছিস ঝুমু, ঝিরিটা তাও পেল না। যা তো মা, বাবাকে একটু মুড়ি মেখে দিয়ে আয়। আপিস থেকে ফিরেছেন। পেটে খিদে। এই মেয়ে এখন সহজে ছাড়বে না।’

পঞ্চম বর্ষীয়া বালিকা ঝুমু, তৈল-লবণ-ঊষণ-গন্ধপত্র দ্বারা ভৃষ্টান্ন ম্রক্ষণ করতঃ উহা সুস্বাদু জ্ঞানে পিতার সম্মুখে ধরিয়া কহিল, ‘বাবা, খাও।’

জ্যোতির্ময় মেয়ের দিকে তাকালেন। বাতি নিভিয়ে বসলেন বাইরের বারান্দায়। ঝুমু কোলে। মুড়ি খাচ্ছেন। ঝুমুও খাচ্ছে। কী নুন! উঃ! কী ঝাল! জ্যোতির্ময় বলছেন, ‘তুই ভারী শান্ত মেয়ে। ভাল মেয়ে তুই। তোর মায়ের মতো।’

আর ঝুমু সত্যিই মায়ের মতো হয়ে গেল। কী মায়া! সকলের সুবিধার দিকে কী নজর! পাছে বাবা দুঃখ পায়, তাই জ্যোতির্ময় যা বলেন, ঝুমু তাতেই মাথা নাড়ে। বাবা দুঃখী মানুষ। অকালবিপত্নীক। ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা বলব কারে সে জন কোথা।’ এখনও এ বাড়িতে কেসেট রেকর্ডে গান শোনা হয়। ঝুমুই শোনে বেশি। জ্যোতির্ময় শোনেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গান। জগন্ময় মিত্রর সুরেলা নাকী সুরে ‘তুমি আজ কত দূরে’ অথবা চিররমণীয় কণ্ঠ মান্না দে পরিবেশিত ‘কতদিন দেখিনি তোমায়, মনে পড়ে তব মুখখানি।’ বিচ্ছেদবেদনার উৎস মায়ের মৃত্যু। তখন থেকেই বাবা আর প্রবীরকাকার দাবা খেলার নেশা।

ঝুমু ও দিব্য টোপর

ঝুমু চটি খুলে ঘরে এল। প্রবীর সহাস্যে বললেন, ‘আয় তো মা। আমার ভাত-ডাল একটু গরম করে দে। প্রতিমা আজ দশটায় আসবে বলল। সময়মতো অফিস না পৌঁছলেই নয়। আর এই তাড়া ভাল লাগে না। একটা বছর পার করতে পারলে বাঁচি। আঃ! খুব বিশ্রাম করব। ছাতে বাগান করব। আর জ্যোতির সঙ্গে দাবা খেলব।’

ঝুমু হিমযন্ত্র থেকে ভাত, ডাল, সবজি বার করল। মাইক্রোচুল্লিবান্ধব উষ্ণায়ণ পাত্রে সব তুলে নিচ্ছে। সরকারি হিসাব নিরীক্ষণ দপ্তরে উচ্চপদস্থ প্রবীর, দেরি করে গেলে তাঁর চলে না। সেদিক থেকে জ্যোতির্ময়ের কিছু সুবিধা আছে। দশটা নাগাদ বেরোলেই তাঁর চলে যায়। তাঁর হল বিক্রয়কর দপ্তর।

সংসারে যাতে সুবিধা হয়, কাজ হতে পারে দ্রুত এবং অনায়াস, তার ব্যবস্থায় প্রবীর সদা উদ্যোগী। খরচে তাঁর পরোয়া নেই। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় কথা-টোপরের পক্ষে ব্যবস্থা অনুকূল কিনা। মাইক্রোচুল্লি সদ্য বাজারে আসতেই প্রবীর তা কিনে এনেছেন। এ বিষয়ে দুই বাড়িতে বড়ই বৈপরীত্য! প্রবীর ও জ্যোতির্ময় যতই বন্ধু হোন, স্বভাবে তাঁদের মিল কম। প্রবীর গাছ পরিচর্যা করেন, হাহা হেসে, টোপরের সঙ্গে যুক্তি-তক্কো করে, দাবা খেলে দরাজ উড়িয়ে দিতে চান দুঃখ-বিষাদ! জ্যোতির্ময় চাপা, কৃপণ, সন্ত্রস্ত। তাঁর যে দুই কন্যা, এ যেন দুটি বিষম বোঝা হয়ে তাঁকে নিরানন্দ রাখে। স্ত্রী হারানোর বিষাদ মিশে তাঁর দুঃখ পথে ঢালা, রোদে জ্বলা, ঘন আঠালো পিচের মতো চটচটে, থকথকে। তিনি বড়ই কৃপণ! ঝুমুদের কেসেট রেকর্ড বাজানোর যন্ত্রখানা যেদিন মেরামত করেও আর বাজবে না, সেদিন হয়তো নতুন কিছু আসবে। কোনও স্বল্পমূল্য ব্যবস্থা! মাইক্রোচুল্লির কথা ঝুমু ভাবতেও পারে না!

চাকা লাগানো চেয়ারে বসে ঘরে এল টোপর। বলল, ‘তোমরা বড্ড তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ বাবা।’

‘কেন তোমার একথা মনে হল?’

‘অবসরের জন্য ব্যগ্র হয় তো বুড়োরাই।’

‘না। বুদ্ধিমানেরাও ব্যগ্র থাকে। চাকরি হল বন্ধন। তোমার ইচ্ছে না করলেও ভার বইতে হবে। ধোপার গাধা। অবসর হল স্বাধীনতা। দীর্ঘ সময় চাকরি করলাম, উপার্জন, ভবিষ্যতের সংস্থান, বাড়ি— সব হল। এখন আমার যেমন ইচ্ছে তেমন দিন কাটাব। মাঝেমধ্যে ভ্রমণে যাব। শান্তি শান্তি! এর মধ্যে ছেলে মানুষ করার একটা দায়িত্ব ছিল। তা তোমাকে দেখতে তো মানুষের মতোই লাগছে। এবারে রোজগেরে হও দেখি বাপ।’

‘আজ সন্ধ্যেয় ফিরে শুনবে আমি রোজগেরে।’

‘হুঁ? ব্যাপার কী?’

‘যাব এক জায়গায়। সাক্ষাৎ করতে।’

‘ইন্টারভ্যু?’

‘ইনফরমাল। বন্ধুর মতো কথা হবে।’

‘কোথায়? চাকুরিদাতারা আজকাল বন্ধুবৎসল হয় বুঝি?’

‘আমাদের কাজে হতে হয় বাবা। এ জগতে আত্মাভিমানের চেয়ে বাজার দখলের সাফল্য গুরুত্ব পায় বেশি। বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা তাই একান্তই প্রয়োজন। যেতে হবে ক্যামাক স্ট্রিট। বিকেল চারটে। কী সংস্থা, কোন তলে অবস্থিত, বেতনক্রম কী, আশা করি এসব প্রশ্ন করতঃ আপনি বিব্রত করিতে প্রবৃত্ত হইবেন না।’

‘পলাশ সঙ্গে থাকছে কিনা জানতে পারি?’

‘থাকছে।’

‘আশ্বস্ত হলাম। ধন্যবাদ।’

ঝুমু হাসিমুখ করে কথা শুনে যাচ্ছে। প্রবীর খাচ্ছেন। সে সামনে বসে জল-নুন সব এগিয়ে দিচ্ছে। আজ কাকার মেজাজ ভাল আছে। খোশমেজাজে থাকতে সচেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু কখনও গভীর অবসাদগ্রস্ত। অবসাদকালীন তাঁর চোখের তলায় গাঢ় কালি পড়ে। মূক নির্জীব এক মানুষ। জ্যোতির্ময় ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে একটি কথাও বলেন না। সেই সময় ঝুমুর গা ছমছম করে। এবাড়িতে এলে মনে হয় ঘরগুলো কেমন অন্ধকার। তখন সে সব জানালা হাট খুলে দেয়। সব পরদা সরিয়ে দেয়। আলো আসুক, আলো আসুক। আরও আরও আলো। মেঝে স্যাঁতসেঁতে, দেওয়াল স্যাঁতসেঁতে; মসৃণ, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর রঙের দেওয়ালে অতীতের অসহ বেদনার অভিঘাত ঝুলকালি হয়ে নেমে আসে হে আলোকময়, ধুইয়ে দাও সব। মুছে দাও দাগ। যে দাগ কেবল কিছু স্মৃতি। মূল্যহীন।

প্রবীর বেরিয়ে গেলেন। ঝুমু সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা গোছাচ্ছে। মশারি ভাঁজ করল। বিছানা পরিপাটি করল। এঁটো বাসনে জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখল। প্রবীর ভিজে তোয়ালেখানা কোনও ভাবে দায়সারা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, সেটি টানটান করে মেলে দিল।

‘এইজন্য তোমায় ডাকলাম নাকি?’

‘তবে কী জন্য?’

‘এসব কাজ তো প্রতিমাদিও পারে।’

‘আমি আরও ভাল পারি।’

‘রাগ করেছ কেন? এসো না এদিকে, আমার কাছে বোসো।’

‘হুঁ! আমার আর কাজ নেই। বাবা ডাকল বলে।’

‘না। তোমার আর কোনও কাজ নেই। তুমি এসো। এসো আমার সঙ্গে।’

টোপর শক্ত করে ঝুমুর হাত ধরল। টানছে। খুব জোর হাতে। পা দুর্বল বলে অনেক কাজ তাকে হাতের ভরে করে নিতে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম ও প্রাণায়াম করে। শরীরের অর্ধেক নিষ্ক্রিয় বলে বাকি অর্ধেক সতেজ সবল রাখতে চায়। টোপরের কাছে এলে সৌরভের আঘ্রাণ পায় সে। জীবনীশক্তির গন্ধ। সে জানে পৃথিবীতে আর কারও অস্তিত্বে এ গন্ধ নেই।

‘লাগছে টোপর।’

‘ওঃ! বুঝতে পারিনি। তুমি রাগ করলে আমার ভাল্লাগে না।’

ঝুমু হেসে ফেলল। ‘বল কী বলবি।’

‘আজ আমার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ।’

‘তো? আমি কী করব? বললি, তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

‘আচ্ছা। রাগ করেই থাকো তুমি।’

‘রাগ করবই তো। আমাকে বলিসনি তো? এত বড় একটা ব্যাপার, আমাকে বলবি না! আমিও কিছু বলব না, যা।’

‘কী?’

‘রবিবার আমার পঞ্চম প্রদর্শনী।’

‘অ! সেকথায় পরে আসছি। আগে আমাকে শুভেচ্ছা জানাও।’

ঝুমু হেসে টোপরের চুল ঘেঁটে দিল। ‘আশীর্বাদ করি। উপার্জনক্ষম হও। আমার আর ভাবনা নেই। দামি দামি শাড়ি-টারি পছন্দ করব আর তোর টাকা ওড়াব।’

‘শুধু শাড়ি?’

‘আর কী?’

‘তুমি তোমার ওড়না পেতে দাঁড়াবে, আমি সমস্ত উপার্জিত ধনসম্পদ দেব তোমার আঁচলে। তুমি তোমার লাল বাঁধানো খাতাখানি নিয়ে বসবে হিসেব কষতে। আমাদের সমস্ত জমাখরচের ভার যে তোমারই ’পরে। প্রতিমাদি কৃষ্ণপত্র ভেজানো চিনেমাটির কাতলিখানা রাখবে এনে তোমার-আমার মাঝখানে, সঙ্গে দুটি ধবধবে সাদা চিনেমাটির পেয়ালা। চায়ের সুগন্ধে তোমার আনমনা মুখে একচিলতে হাসির রেখা, তারই ’পরে বিজলি বাতির আলোছায়ার খেলা। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখব তোমার অপার্থিব লাবণ্য। দেখব আমার সুখ। আমার শান্তি।’

‘তুই সাহিত্যিক হয়ে যা টোপর। রবিঠাকুরের ভাষা চমৎকার টুকেছিস। কী ভাল মিথ্যে বুনতে পারিস! চালটা যে রাবীন্দ্রিক, সে বোধহয় তোর স্বেচ্ছানির্বাচন।’

‘হা হা! কেমন দিলাম!’

‘খুব ভাল। চমৎকার। এবারে আমাকে তোর শুভেচ্ছা জানাবার পালা। বিফল প্রদর্শনী আর ভাল লাগে না যে।’

‘বসো কেন?’

‘কী করব? এটাই যে নিয়ম।’

‘সব নিয়ম মানতে হবে?’

‘প্রেমও যে হল না একটা।’

‘ঠিক জানো? হয়নি?’

‘বা রে! আমার প্রেম হলে তুই জানতি না?’

‘কিংবা আমিই জানি, তুমি জানো না। উস্ মন্তর ফুস্ মন্তর হ্রিং ক্রিং ফট্! নাও, মন্তর পড়ে দিলাম। আর পাত্রপক্ষ তোমায় পছন্দ করবেই না। প্রত্যেকবার আমি এই মন্ত্র পড়ে দিই, আর ওরা সব মিষ্টি খেয়ে তোমার মিষ্টি লাজুক মুখখানা দেখে বিদেয় হয়।’

‘এরকম করিস না। তুই আমার শত্রু নাকি? জানিস বড়পিসি কী বলেছে? গোয়ালভরা বাঁজা গাই/আইবুড়ি ঘরে/ধন খায় মান খায়/অন্ন ধ্বংস করে।’

‘বড়পিসির ভীমরতি হয়েছে। একটা অচেনা অজানা লোক, টোপর পরে ক’টা মন্ত্র বলে তোমায় নিয়ে যাবে! টোপর পরে! ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ! আঃ হাঃ হাঃ হাঃ! টোপর পরে!’

হাসতে হাসতে লাল হয়ে যাচ্ছে টোপর। বেদম হয়ে যাচ্ছে। এলিয়ে পড়ছে তার চাকাওয়ালা চেয়ারের হাতলে। তার এই বাহনটিকে সে বলে গড়গড়ি। ঝুমু টোপরের হাসি দেখছে। নিজেও হাসছে আর বলছে থাম্, থাম্ টোপর। বিষম লাগবে।

হালকা ঢেউয়ের মতো চুল, ফর্সা গালে প্রস্ফুটিতে লাল কয়েকটি ব্রণ, ভাসা-ভাসা চোখ দু’টি, পাতলা ঠোঁট, চিবুকের কাছে দাড়ি রাখছে আজকাল। সে যখন উপবিষ্ট, অপরিচিত যে কেউ তার প্রশংসা করবে, ফিরে দেখবে তাকে, ঈশ্বর যে কতখানি অবিচার করেছেন, কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। তার উপর আরোপিত নামগুলি বিষম ভার। শতরূপ। শতরূপ। শতরূপ। সে নিজেই নিজের অবস্থাকে পরিহাস করে বলে অর্ধশতরূপ। এখন সে হাসতে হাসতে বলছে, ‘ভাবো ঝুমুদি, ভেবে দেখো, একখানা ভঙ্গুর চোঙা, দু’পাশে ল্যাতপ্যাত করছে দুটি কদমফুল, ঠিক আমার পায়ের মতো না? একদম! বলো একদম! টোপর! হা হা হা! একজন পুরুষ ও একজন নারী মিলনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে কদমফুল লাগানো চোঙা পরে! হাঃ হাঃ হাঃ! আমার নামটা! হোঃ হোঃ! নামটা! একদম সার্থক!’

হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। মুখের পেশি ভেঙেচুরে যাচ্ছে। হাসছিল। কাঁদছে। হাসতে হাসতে কাঁদছে কেন? ও কাঁদছে কেন? সরলসোজা ঝুমুর ভাবছেই না এই হাসিকান্নার তীব্র বিপরীতমুখি আবেগের উৎস অন্য কিছু, অন্য কোথাও হলেও হতে পারে। নিজের অশক্ত অকেজো পা দুটি নিয়ে টোপরের অভিযোগ বিন্দুমাত্র, কৌতুকপূর্ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপই বেশি। প্রতিবন্ধকতা ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার মতো আত্মবিশ্বাসীই কেবল এমনটি করতে পারে। স্বভাবত, আপন দুঃখ-কষ্ট অন্তরে ধারণের শক্তি তার আছে! তাই, তার আবেগ বড়ই গভীর।

‘এই! এই টোপর! কী পাগল তুই! কাঁদছিস কেন? তাকা। আমার দিকে তাকা। তোকে এভাবে কাঁদতে দেখতে আমার ভাল লাগে?’

‘বিশ্বাস করো ঝুমুদি, যতদিন, যতবার আমি ভেবেছি, তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তুমি চলে যাচ্ছ, আমার অসম্ভব কষ্ট হয়। ভীষণ কান্না পায়। কেন এরকম হয় ঝুমুদি? তুমি কে আমার? তুমি কি আমার মা? আমার দিদি? আমার বন্ধু? আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু? নাকি তারও বেশি? তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না কেন?’

ঝুমু নেমে এসেছে। এতক্ষণ যে বিছানায় কোমর ঠেকিয়ে না-দণ্ডায়মান না-উপবিষ্ট ভঙ্গিতে ছিল, সেখান থেকে নেমে এসেছে। একপাশে চওড়া আয়না লাগানো সাজের আয়ত টেবিল, শূন্য, রুপুকাকিমা ব্যবহার করতেন। ওই আয়নায় গড়গড়িসহ টোপরের পার্শ্বপ্রতিবিম্ব। সাজটেবিলের পাশে একটি দারুকোলাঙ্গ। আধাকুলুঙ্গি, আধাদেরাজ, রুপুকাকিমার শাড়িতে ভরা। প্রত্যেক বছর বর্ষা কেটে গেলে সোনার টোপর পরা শরতের রোদ যখন ঝিলিমিলি জলের মতো ছাতে বিছিয়ে যায়, যাবতীয় লেপ-তোষক-কম্বলের সঙ্গে ঝুমু রুপুকাকিমার শাড়িগুলিও রৌদ্রস্নানে দেয়। আর একবার দেয় বিষাদের হেমন্তে, যখন রোদ আসে ক্ষণিকের অতিথির মতো, জলের তলায় জলপোকা আর আলোকপিয়াসী মৎস্যকুমারদের কৃপণ আলোর পর ছায়া দিয়ে দিগন্তে পালায়। ঝুমু তখন লোক ডাকে ষাণ্মাসিক ঝাড়পোছের জন্য! তার জ্ঞাতসারে অথচ অন্তরালে থাকা সমস্ত দারুকোলাঙ্গের, সিন্দুকের, স্টিল আলমারির, দেরাজসমূহের লেপতোষক, কম্বল, শাল গরম জামাশাড়ি সে পুনরায় হেমন্তের আতপতাপে সিদ্ধ করে। এক নারীর ফেলে যাওয়া সংসার, অপর নারীর ছেড়ে যাওয়া সংসার সে রক্ষা করে চলে ইঁদুর, আরশোলা, উইপোকা, টিকটিকি, ছুঁচো, ছত্রাক, ব্যাকটিরিয়ার নিষ্ঠুর আক্রমণের থেকে।

ঝিরি যতই বলুক, এই এলাকা খারাপ, তপোবন নয়, অভিজাত পল্লি হতে হতেও হয়নি কারণ সরু গলি দিয়ে ঢুকে পড়েছে অশিক্ষা, অপরিশীলন, নির্ধন, শ্রমসম্বল মানুষের দল— নিত্য বিবদমান, মদ্যপ, লম্পট, নারীপীড়ক ও ধর্ষকে ঠাসা, তবু, ঝুমুর মনে হয়, ভাল তো। পারস্য গালিচায় চেপে সে দ্বিতীয় তলে অবস্থান করে, চাইলেই দেখতে পায় অন্য ভুবন মাটির সঙ্গে গাঁথা। এক বালতি জলের জন্য চুলোচুলি, বিকেলবেলায় পানদোক্তা মুখে পুরে এক চুলো অপর চুলির উকুন বাছতে বসে। আহা, ঝুমু বড় ভালবাসে এই কানাই সামন্ত গলিখান, বড় ভালবাসে বর্ষায় লেপ-কম্বল-কাপড়-জামায় ঢুকে পড়ে যে সোঁদা ভ্যাপসা গন্ধ, বড় ভালবাসে রান্নার বই, ঝিরির মুখঝামটা, টোপরের সর্বস্ব উজাড় করা দাবিগুলি। তুমি এসো। তুমি এখন যাবে না। এই রান্নাটা বিচ্ছিরি। চিঁড়ে ভেজে দাও সেদিনের মতো। ফালি ফালি কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ। ভালবাসে প্রবীরকাকার শার্ট থেকে খসে পড়া বোতাম পুনর্বহাল করার কাজ, বাবার জন্য প্রতি রাত্রে ইশবগুলের ভুষি গুলে দেওয়া। টোপরের কম্পিউটার, গানের রেকর্ড, বইবিনিময়, গড়গড়ি, তালবেতাল, দুঃখসুখের কথা, কথা, কথা— ‘ফুরায় না তো ফুরায় না। তোমায় পাওয়া।’ ঝুমুর চোখ ভিজে যাচ্ছে, কান্না কেমন সংক্রমক! পাগলটা কাঁদছেও দেখো, যেন কেউ মরে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে চিরবিদায় বলে। হাতের পরিবর্তে পা দিয়ে টা টা করতে করতে যাচ্ছে। আর ঝুমুকেও কাঁদতে হচ্ছে। এদিকে, যেন একেবারে ছায়াছবির দুঃখের দৃশ্য রচনার জন্য গেয়ে চলেছেন দেবব্রত বিশ্বাস-‘তোমার সুধারসের ধারা গহনপথে এসে/ ব্যথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে।’

‘পাগল, ও পাগল। চুপ কর সোনা। দ্যাখ আমার দিকে। তাকা। এই।’

গড়গড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে ঝুমু। টোপরের চুল ঘাঁটছে, প্রায়নিষ্ক্রিয় পা দুটির ওপর হাত রেখেছে। টোপর খুব জেদ করলে ঝুমু এমনই নেমে আসে ভূমিতে। চিরকাল।

তাদের প্রতিবিম্বিত দৃশ্যে অবিরাম জলধারা।

‘তুমি চলে যাবে না, বলো।’

‘কোথায় যাব না?’ নাক টানছে, চোখ মুছছে ঝুমু। কান্না কেন? কেন কান্না?

‘আমাকে ছেড়ে।’

‘তোকে ছেড়ে? আমি কী করব? বিয়ে না হলে আমার বয়েই গেল। কিন্তু বাবা চাইছে যে। বড়পিসি চাইছে। ছোটপিসি এমনিতে খোঁজ করে না, আজকাল মাঝেমধ্যেই ফোন করে জানতে চায় আমার বিয়ে ঠিক হল কিনা। দিদার সঙ্গে দেখা হলেই এক কথা। কবে নাতজামাইয়ের মুখ দেখব।’

‘সত্যি বলো, বিয়ে হচ্ছে না বলে তোমার কষ্ট নেই?’

‘তোকে ছুঁয়ে মিথ্যে বলব আমি?’

টোপর হাসল। কী প্রশান্তি মুখটায়। ঝুমু উঠল, তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে দিল। টোপর মুখ মুছে নিল। বলল, ‘আমাকে এত আদরযত্ন করা কীসের জন্য? অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছ। এবার দায় এড়াবে কী করে?’

‘আমি দায় এড়াচ্ছি কোথায়? তা ছাড়া দায়টা কী? তোর আদরযত্ন করব না? ঝিরির জন্য করি না?’

‘সবার জন্য করো। সেইটাই তো তোমার দোষ ঝুমুদি। একটা নতুন শতাব্দী যে গড়িয়ে গেল ক’ বছর, তুমি যেন সেই শরত্চন্দ্রের বড়দিদি, মেজদিদি।’

‘না রে বাবা না, আমায় অত পাওনি। আজ সব কিছু ছেড়ে তুই আমাকে নিয়ে পড়লি কেন বলতো।’

‘আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, আমরা সবাই তোমাকে ব্যবহার করছি।’

‘যাঃ! তোর মাথাটা পুরো গোলমাল হয়ে গেছে রে! নিজের লোক আবার ব্যবহার করবে কী!’

‘ওই তো। নিজের লোক। তার মায়া, স্নেহ, ভালবাসা! মানুষ খুব চমৎকার উপায়ে তার সুযোগ নেয়।’

‘খুব চমৎকার উপায়ে নয়, বলতে পারিস নানা উপায়ে, অভিনব পন্থায়, বিবিধ রকমে।’

‘হুঁ! আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই যা মনে আসে বলে দিই। আমার দেখা আর বলা দুটোই আলাদা জানো তো, কারণ আমার জগৎটাই আলাদা আর পাঁচজনের চেয়ে। আমার মাটিতে পা পড়ে না। আমি লক্ষ করে দেখেছি, আমরা সবাই নিজের শর্তে জীবনযাপন করি। আমাদের মেজাজ-মর্জি, খিদে, মনখারাপ, উদ্বেগ, ইচ্ছা-তুমি প্রত্যেককে সাহায্য করতে থাকো। কেবল তোমার কোনও শর্ত নেই। সবার জন্য তোমার চিন্তা। তোমার জন্য কেউ ভাবছে না তা নয়, ভাবছে তার নিজের শর্তে।’

‘দুর, আমি ওভাবে ভাবি না। আমার তো কোনও অভাববোধ নেই! গোপালীমাসির হয়তো স্কুল-কলেজের শিক্ষা-দীক্ষা নেই, কিন্তু মানুষটা তো ভাল, মায়ের মতোই আগলায়। মা নেই বলে আমার আর দুঃখ হয় না। আমি, তুই, ঝিরি— আমরা সবাই মাকে ছাড়া বড় হয়ে গিয়েছি। নিজেদের অভাব মেটাতে পারল না বাবা আর প্রবীরকাকা। দু’জনেই বেচারা। আমাদের মুখ চেয়ে আর একটা বিয়েটিয়েও করতে পারল না।’

‘করলেও আমরা বড় হয়েই যেতাম। তবে আমার বাবা যে আমার জন্য বিয়ে করেনি তা নয়। এ নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। আমি যাতে কোনও ভাবেই নিজেকে বাবার দায় মনে না করি, তার জন্য বাবা খুব সচেতন।’

‘তা জানি। তবে কাকা আর বিয়ে করল না কেন?’

‘কারণ বাবা মনে করে, বিবাহিত জীবনের জন্য প্রেম অত্যন্ত জরুরি। আমি বাবা-মায়ের যৌনাভ্যাসজাত সন্তান। কিংবা আপাত মুগ্ধতাজাত। যেটা ওরা ভালবাসা বলে ভুল করেছিল। পরে দু’জনেই বুঝেছিল, ওদের মধ্যে প্রেম জন্মায়নি কখনও।’

‘আমাদের দেশে এভাবেই কোটি কোটি মানুষ জন্মায়। টোপর। এটা একটা, কী বলব, বংশরক্ষার প্রথা। আরও বড় করে দেখলে নতুন প্রজন্ম বহমান রাখার পদ্ধতি। এর জন্য জৈবচাহিদাই প্রথমত প্রয়োজন। দুটো অচেনা মানুষ বিয়ে করল, তাদের মধ্যে প্রেম হল কী হল না, এটা একটা বাজি। আবার প্রেমের বিয়েও বিবাহিতর শর্তসাপেক্ষে অচল হতে পারে, ফুরিয়ে যেতে পারে। আমার দু’জন বন্ধু, কলেজে পড়ত আমার সঙ্গে, প্রেম করে বিয়ে করেছিল, এখন পস্তাচ্ছে। বাপের বাড়িতে ফিরে আসার মুখ নেই, বরকে ছেড়ে একলা বাচ্চা নিয়ে থাকার সাহস বা ক্ষমতা নেই। অতৃপ্ত, অসুখী, তবু ওই জীবনের সঙ্গে চিরকালের শেকলে বাঁধা। বিয়ে ব্যাপারটা আসলে একটা জুয়াখেলা।’

‘বাবা সেটাই আর খেলতে চায়নি। দু’রকম সংকল্প নিয়েছিল। এক, নারীবিবর্জিত পরিবার, আর আমাকে আমার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। দুই, মন থেকে যৌনতার আকাঙ্ক্ষা উপড়ে ফেলা। বাবা আমাকে বুঝিয়েছিল, যৌনতা একটি স্বাভাবিক শারীর প্রক্রিয়া যা সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

‘তুই কী ভাবছিস রে টোপর? আমি যে বিয়ে করতে রাজি, তা ওইসব করতে চাই বলে?’

‘না গো! সেজন্য এত কথা বলছি না। আজ আমার আর বাবার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাপেক্ষেও।’

‘কী যে বলিস পাগল! তোর অর্ধেক কথা আমি বুঝতেই পারি না।’

‘বুঝতে চাও না, তাই। ঝুমুদি, তুমি যেন ব্রত নিয়েছ, তোমাকে সাধারণ হয়ে থাকতে হবে। অর্ধেক বুঝবে না, অর্ধেক চাইবে না। নিজের জন্য শূন্য। অন্য কারও ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে। যেন, ঈশ্বর বলেছিলেন, ঝুমু, কী বর চাও বলো। ঝুমু বলল, ‘সাধারণের চেয়েও সাধারণ থাকি যেন প্রভু। তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুণা…!’ নীচে বসে থেকো না। তুমি বেশিক্ষণ আমার পায়ের কাছে বসলে আমার পায়ের সাড় ফিরে আসতে চায়।’

‘তাই যদি আসে, আমি সারাজীবন তোর পায়ের কাছে বসে থাকতে রাজি আছি রে টোপর।’

‘মুশকিল ঝুমুদি। একটাই মুশকিল।’

‘কী?’

‘আমার পায়ের সাড় এলে গড়গড়ির কী হবে?’

‘পাজি! আমি ভাবলাম তুই বলবি— ঝুমুদি, তোমার স্থান যে আমার মাথায়।’

‘দুত্তোর! তোমার বাহান্ন কেজি ওজন মাথায় নিয়ে মেরুদণ্ডের বারোটা বাজাব নাকি? আপাতত আমার লাঠি দুটো দাও। আমার তালবেতাল। আর তুমি ওই সোফায় বসো। আমি তোমার কোলে মাথা রাখব।’

‘প্রতিমা এলে বা অন্য কেউ এলে উঠে বসবি কিন্তু। তা ছাড়া বাবা ডাকল বলে।’

‘ডাকলে বলব তুমি নেই। এখন আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। তোমার কোলে শুয়ে। তোমাকে ছুঁয়ে।’

‘আমি এখানে নেই তো এই সাতসকালে আমি কোথায়? ঝিরি জানে আমি তোর কাছে এসেছি।’

‘ওই সবজান্তা পাকাটাকে সব কথা বলো কেন?’

‘বাঃ! বলব না?’

‘না। বলবে না। আজ থেকে, এখন থেকে, আমি তোমাকে যা যা বলব, তোমার সঙ্গে যা যা করব, তুমি কিছু ঝিরিকে বলবে না। শুধু তোমার আর আমার একটা জগৎ হতে পারে না কেন ঝুমুদি?’

‘তোকে কি এমনি আমি পাগল বলি? তুই উন্মাদ।’

ঝুমুর পায়ে ঝঝি ধরে গিয়েছে। সে উঃ আঃ করতে করতে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে, টোপরের লাঠি এনে দিল। বাহুতে ধাতব বন্ধনী, শক্ত ধাতুর নির্ভরযষ্টি। টোপর এদের বলে সে তালবেতাল। গড়গড়ি ছেড়ে উঠতে-বসতে তালবেতাল প্রয়োজন তার। জানুসন্ধি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসাড়। ডাক্তারি ব্যাখ্যায় হাফ-প্যারালিটিক। জানু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আংশিক সক্ষমতা। দাঁড় করিয়ে দিলে পড়ে যায়। পায়ের উপর পা তুলতে পারে না। কিন্তু তুলে দিলে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ছেঁচড়ে নামিয়ে নিতে পারে। ঊরু অবধি টানা একটি খাঁচায় পা গলিয়ে সে গাড়ি চালায়। মূলত ঊরুপেশির সঞ্চালনেই তা সম্ভব করতে হয়। খাঁচার মধ্যে যে শক্ত স্টিলের দণ্ড, প্রবল পরাক্রমে ঊরুপেশি তাকেই সঞ্চালিত করে, চাপ দেয়, পা উপলক্ষ মাত্র। প্রথম প্রথম অভ্যাস করতে গিয়ে সে ল্যাগব্যাগান্ডিসের মতো হয়ে যেত। ঊরু সঞ্চালন প্রয়াসে ঘর্মাক্ত শরীর ক্রমশ নেমে পড়তে চাইত আসন থেকে। সে তখন জ্যামিতিক নকশা তৈরি করতে লাগল। ঠিক কোথায় কীভাবে বলপ্রয়োগ করলে তা পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হবে। জহর তাকে সাহায্য করতেন। সাহস জুগিয়েছেন কত!

‘ধরো, একটা পুতুল গাড়ি চালাচ্ছে। একটা রোবটই ধরো।’ সে বলত ঝুমুরকে। ঝুমু সাগ্রহে দেখত সেই নকশা। জটিল অঙ্কের মতো। হয়তো অঙ্কই। সে বলত, ‘পারবি, তুই ঠিক পারবি টোপর।’

ঝিরি বলত, ‘দরকার কী! একটা ড্রাইভার হলেই তো মিটে যায়।’

ঝিরি বোঝে না, প্রতিবন্ধকতা জয় করার অন্য নাম আনন্দ!

প্রবীর, টোপরের ব্যবহার্য গাড়ি কেনার আগে কয়েকটি অংশ বিশেষভাবে নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রযুক্তি প্রতিবন্ধীকে সেই সুযোগটুকু দেয়। কিন্তু প্রযুক্তি আয়ত্ত করা এক যুদ্ধ বটে।

প্রথম যেদিন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গাড়ি চালাতে পারল টোপর, তারা রীতিমতো উৎসব করেছিল। ঝুমু জটা-নমির শিব, লেক কালীবাড়ি, কালীঘাট, ২৩ পল্লির দুর্গাবাড়ি, পাড়ার শনিমন্দির সর্বত্র পুজো দিয়েছিল টোপরের জন্য।

অপরিসীম মনের জোরে টোপর এই সক্ষমতা আয়ত্ত করেছে। টোপর নিরন্তর সংগ্রামী। যতখানি সম্ভব, প্রতিবন্ধকতা জয় করার প্রয়াসী। ঘরের মধ্যে যাবতীয় কাজ সে একাকী পারে। বাইরে বেরুলে সঙ্গী ছাড়া চলে না। এখানেই সে চিরকালের জন্য হেরে বসে আছে। শৈশবে মা ছিল তার চলনদার। মা যখন ফেলে চলে গেল, সরু গলির মোহন বা জহর বা সুভাষ, তাকে ইস্কুলে দেওয়া-নেওয়ার ভার গ্রহণ করেছিল। টোপর মজা করে বলত— আমার রোজকার বাঁচায় ওরা রোজগার বাজায়। এখন পলাশ তার চলনদার। আগামী সময়ে আর কেউ তার সহায় হবে। সে বলে— বাবা ভাল রোজগার করে, আমাকে তেইশ বছর পর্যন্ত সহায়তা জুগিয়েছে। এবার আমিই আমার স্লেজগাড়ির বাহক। প্রচুর টাকা করতে হবে, বুঝলে ঝুমুদি। তুমি হবে আমার ধনলক্ষ্মী।

টোপর ও ঝুমু ও সোনার নূপুর

ঝুমুর কোলে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকল টোপর। চোখ বন্ধ। ঝুমু চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। নরম ঘন চুলে ঝুমুর নরম সরু আঙুল। তার বুকের ভিতর স্নেহসুধা-ধারার ঝরঝর ক্ষরণ! কী সুন্দর ছেলেটা! সে নিজের অজান্তেই টোপরের নাকে আঙুল রাখল। চোখে, গালে। তার বুক শিরশির করছে। কী করে রুপুকাকিমা টোপরকে ফেলে গেলেন? ঝুমু কি পারত?

না। অসম্ভব। সে মুখ নামিয়ে টোপরের কপালে চুমু খেল। গলার কাছটায় টনটন করে উঠছে। শ্বশুরবাড়ি তো যেতেই হবে। এই ছেলেটাকে রোজ আর দেখতে পাবে না তখন। কিছুই করতে পাবে না তার জন্য। এত কথা তখন কাকে বলবে টোপর? তার কথার নক্ষত্রকণা খেয়ালখুশিমতো সাজিয়ে তোলার জন্য, সাজসজ্জাবিহীনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ঝুমুই ছিল এক আকাশি আঁচল! মা যাকে ফেলে চেলে যায়, তার কাছে অন্য কোনও বান্ধব সহজে কি আসে? অন্য নারী কোনও? টোপরের স্কুলে, কলেজে, কম্পিউটারের ব্যয়বহুল সাবলীল প্রতিষ্ঠানে কোনও মেয়ে তাকে বলেনি ভালবাসি। টোপরও বলেনি কাউকে। অথচ সে এক আদর-কাড়া ছেলে। যারা তাকে কাছ থেকে চেনেন, তার গৃহশিক্ষকগণ, তার শরীরচর্চার প্রশিক্ষক সুপ্রিয়, কানাই সামন্ত সরু গলির বাসিন্দা গাড়িচালক শিক্ষক জহর, কম্পিউটার শিক্ষাসংস্থার দক্ষ, বুদ্ধিমান প্রযুক্তিবিদ— প্রত্যেকে টোপরকে গভীর ভালবাসেন। সকলেই টোপরকে উপলব্ধি করিয়ে দিয়েছেন, সে পারে। আর পাঁচটা লোকের মতোই তার সক্ষমতা।

নিয়মিত ইস্কুলে যেতে পারত না, তাই টোপরের কৈশোরের বন্ধু ঝিরি আর ঝুমু। মাঠে খেলা করতে পারত না, তাই তার শৈশবের সাথী ঝিরি ও ঝুমু। আজও, তেইশের যৌবরাজ্যে, টোপরের অন্য বন্ধু নেই। ঘনিষ্ঠ। প্রিয়। আজ কেবল ঝুমু। ঝিরি নয়। কেন ঝিরি টোপরের প্রিয় বন্ধু হল না? বন্ধু তারা ঠিকই। কিন্তু আলগা-আলগা। বন্ধুত্বের নানা স্তর থাকে! মাঝে মাঝে ঝুমু-র মনে হয়, সে যে টোপরকে এত ভালবাসে, এত, যে কোন পরিমাপ সম্ভব নয়, এতে ঝিরি একটু একটু ঈর্ষাকাতর! ছোট তো! অবুঝ! পরে ঠিক হয়ে যাবে! টোপরও তো ছোট! ঝুমু জানে। তাই এত মায়া। এত টান। তাই তো আদরে আদরে টোপরের কপাল ভিজিয়ে দিতে চায়।

‘আর একটা দাও।’

‘কী?’

‘চুমু দাও। ঠিক ওইখানটায়। যেখানে দিলে।’

‘উম্‌ম!’

‘আবার দাও।’

‘ম্‌ম্‌!’

‘আরও আরও! দিয়ে যাও ঝুমুদি যতক্ষণ না তোমার ঠোঁট থেঁৎলে রক্ত পড়ে।’

‘ধুৎ! বয়েই গেছে! ওমনি, না?’

‘আজ, এখন, আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে ঝুমুদি। মনে হচ্ছে, বিকেল থেকে আমার অন্য একটা জীবন আসছে, তার আগে এই জীবনে যা মনে আসে বলে ফেলি।’

‘বল। শুনি। খেয়েছিস সকালে কিছু?’

‘কেন? মুখে খিদে-গন্ধ?’

‘না। ভাল গন্ধ। তোর গন্ধ টোপর।’

‘হুঁ। অনেক কিছু খেয়েছি। প্রথমে দুধ আর ভুট্টার মুড়ি। সঙ্গে কলা। তারপর চুমু।’

‘আমার চুমু খেয়ে কী হবে!’

‘ওঃ! নিজে যেহেতু অন্য একজনের চুমু খাবে, তাই আমাকেও প্ররোচিত করতে চায়! তুমি তো খুব সহজ নও। পেটে পেটে বুদ্ধি ধরো, মাথা রাখো ফাঁকা, সেই লাজে সূর্যমুখী চাঁদ আজ বাঁকা!’

‘আমি আবার কার চুমু খাব। বরের? তা যদি খেতে হয়, খাব। কাবাব তো নয় যে ভাবতে ভাল লাগবে।’

‘চুমু খাবার কথা ভাব না ঝুমুদি?’

‘এ মাঃ! যাঃ!’

‘এ ব্যাপারে ঝিরি এগিয়ে আছে। বিবস্বানের সঙ্গে চুমু পর্যন্ত ভালই গড়িয়েছে। তুমিই সেকেলে হয়ে থাকলে।’

‘তুই ভাবিস?’

‘নিশ্চয়।’

‘কাকে ভাবিস?’

‘বলব?’

‘জানতেই তো চাইছি।’

‘রাগ করবে না কথা দাও।’

‘ও মা! রাগ করব কেন?’

‘না বাবা! যদি রাগ করো!’

‘করব না। বলছি তো।’

‘প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।’

‘ইঃ! কী বিচ্ছিরি ঠোঁট!’

‘দারুণ ইয়ে! উত্তেজক! আকর্ষক! মোহময়ী!’

‘আমার কোনও নায়ককে এরকম চুমু খেতে ইচ্ছে করে না কেন?’

‘ভাগ্যিস করে না। সাধারণব্রতা শুদ্ধকুমারী, বিনম্রলতিকা বিনীতা, তুমি যে স্বপ্নে কল্পনায় চুমু খাবার জন্যও জ্যোতিকাকার অনুমতি চাইবে।’

‘মোটেই না!’

‘মোটেই না? চাকরিটা ছাড়লে কেন তবে? বললাম না, তোমাকে আমরা সবাই ব্যবহার করি। ভালবাসার ছলে, কিংবা ভালবাসার আড়ালে।’

‘না না। ওভাবে বলিস না। আমি তো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পারিনি। বড্ড কঠিন রে। আমার দ্বারা হতও না। আমি তো তেমন ভাল না লেখাপড়ায়। হয়তো সরকারি চাকরি করলে বাবা আপত্তি করত না। বড়পিসিরও একদম মত ছিল না। মা নেই তো। আমরা দুইবোন বাবার কাঁধে। ভয় পায় আসলে।’

‘ফক্স অ্যান্ড গুপ্তা কোনও সাধারণ কোম্পানি নয় কিন্তু। তোমার কমার্স ডিগ্রি, শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ পেয়েছিলে। নিজেকে তৈরি করার কত সুযোগ ছিল তোমার।’

‘বাবা বলল, প্রাইভেট কোম্পানি, কোনও নিরাপত্তা নেই। মেয়েদের নিরাপত্তাই সবার আগে।’

‘হুঁ! নিরাপত্তা! জিনিসটা আমার পায়ের মতো, বুঝলে। থেকেও নেই। পৃথিবীতে কেউ, কোথাও, সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। নামকরা হাসপাতাল— সেখানে আগুন লেগে লোক মরছে না? স্কুলে, কলেজে, রাস্তায়, মাঠে মেয়েদের অপমান হচ্ছে না? সরকারি আপিসে, খবরের কাগজের দপ্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হেনস্থা নেই? আসল কথা, তুমি সকাল-সকাল কাজে বেরিয়ে যাচ্ছ, সন্ধ্যায় ফিরছ, সক্কলের তাইতে ভারী অসুবিধা হচ্ছিল। আমারও। তুমি তিনমাস কাজ করেছিলে। তিন মাসে আমরা গড়ে ত্রিশবার বলেছি, ওঃ, ঝুমুর যে চাকরি করার কী দরকার! অর্থাৎ আমরা সবাই নিজের আখের গুছোব, আর ঝুমু আমাদের হাতের কাছে সব জুগিয়ে যাবে। বেতন চায় না, ঝগড়া প্রতিবাদ করে না, কোনও কিছুর দাবি নেই, সর্বদা হাসিমুখ, সবার সুবিধার দিকে নজর। জাপানি রোবোটের চেয়েও উৎকৃষ্ট গুণে-মানে। কারণ ঝুমুর আবার ভারী মায়াদয়া, স্নেহভালবাসা।’

‘এই, তুই আমার কান ভাঙাচ্ছিস কেন রে? আমি কি কলেজে যাইনি? বাবা কি আমার বিয়ের চেষ্টা করছে না? নিজের লোকদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেখব না? তুই কি চাস আমি স্বার্থপর হয়ে যাই?’

‘না। আমি চাই ভারসাম্য। প্রত্যেকেই যতখানি সম্ভব আত্মনির্ভরশীল হোক। আর তুমি তোমার স্নেহদাক্ষিণ্য নিজের জন্যও একটু বিলোও। নিজেকে ভালবাসাও যে দরকার ঝুমুদি।’

‘ধুৎ! ওসব আমার আসে না। মা নেই। কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। কলেজ পর্যন্ত গেছি তো!’

‘কলেজ? বাড়ি থেকে তো চার পা। ভাত বসিয়ে একটা ক্লাস করে আসা যায়। বিয়ে দিতেও কোনও সমস্যা নেই এখন। বাবা, জ্যোতিকাকা চাকরি ফুরোলে করবে কী। ঘরে থাকবে, সামান্য যা করার নিজেরাই পারবে।— বাদাবাকি তো গোপালীমাসি বা প্রতিমা আছেই। তোমাকে তখন আর দরকার নেই— বুঝলে? ঝিরির যা মতিগতি, হয় চাকরি জুটিয়ে সটকে পড়বে, নয় বিবস্বানের গলায় ঝুলে নিজের রাস্তা দেখবে। ওর তোমার মতো এত মায়ের দয়া নেই। অন্যদিকে বাবা আর জ্যোতিকাকা তাদের তো আবার ‘লোকে কী বলবে’ ভেবে ঘুম আসে না। ওই জায়গাটা জয় করতে পারলে তোমার বিয়ের চেষ্টাই করত না। তাতে অবশ্য আমারই লাভ হত।’

‘হুঁ!’

‘হুঁ আবার কী! তোমার ওপর মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় আমার। মনে হয় আঁচড়ে কামড়ে ছড়ে ফেলি।’

‘ফ্যাল দেখি! কেমন পারিস! একটু আগেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলে কাঁদছিলি, তুই মারবি আমাকে!’

‘মারব তো বলিনি। বলেছি ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছে কি পূর্ণ করা সম্ভব, নাকি করা যায়?’

‘আমার কাছে যায়। আমার কাছে তোর কোনও ইচ্ছে লুকোবি না টোপর।’

‘যা বলছ, ভেবে বলছ তো ঝুমুদি? আমি কিন্তু আর ছোট্ট টোপর নেই। বড় হয়ে গিয়েছি। যদিও তুমি এমন করো যেন এই দুই বাড়িতে জ্যোতিকাকা, বাবা, আমি, ঝিরি সবাই বাচ্চা— কেবল তুমিই বড়! সব্বাইকে আগলাচ্ছ, অথচ তোমার বুক অবধি কেউ পৌঁছয় না। এভাবে, এমন করে স্বাধীনতা দিয়ে দিচ্ছ আমায় ঝুমুদি! অনেকটা জায়গা দিয়ে দিচ্ছ কিন্তু আমাকে। পরে কৃপণ হয়ে যেও না। সহ্য করতে পারব না। মা আমাকে ফেলে গেছে, সহ্য করেছি, তুমি কষ্ট দিলে আর পারব না ঝুমুদি।’

‘এ মা! তোকে আমি কখনও কষ্ট দিয়েছি? আমি যখন ছাতে যাই, রোজ না, যখন আকাশ পরিষ্কার থাকে, মনে হয়, আমাদের ওইরকম দরকার। একটা আকাশ। যেদিকে তাকালে আমার ভেতরটা অবিরল প্রকাশ হয়ে যাবে, কোনও বাধা, কোনও দ্বিধা থাকবে না। শুধু একটা আকাশ আর আমি। তোর আকাশ আর তুই। একটু আগে বলছিলি না, আমাদের নিজস্ব জগৎ, সেখানে আর কেউ নেই,ঝিরি নেই, বাবা, প্রবীরকাকা— কেউ থাকবে না— শুধু তোর আর আমার, তখন আমি তোর আকাশ। না হলে হয় না। ওরকম হয় না।’

‘ঝুমুদি…!’

‘হুঁ?’

‘তোমার আকাশ কে?’

‘আমার? ভেবে দেখিনি রে।’

‘ভাবো। আমি ততক্ষণ বিশ্বাস করতে থাকি, বুক ভরে, মন ভরে, আমার সমস্ত চেতনার মধ্যে পুরে দিতে থাকি, আমার পরমায়ুর মধ্যে।’

‘কী?’

‘তোমার কথা। কথা দেওয়া। তুমি আমার আকাশ। ঝুমুদি, তুমি ভাবো। আমি আর একটাও কথা বলব না যতক্ষণ না তুমি নামটা খুঁজে পাবে।’

‘এ আর এমন কী কঠিন? টোপর, আমার আকাশও বোধহয় তুই-ই রে।’

‘আকাশের কোলে আজ আকাশ শয়ান। কে কাকে দেবে এক থলে ভর্তি জ্যোতিষ্কবলয়, মেঘমল্লার। কে কার কপালে দেবে চাঁদটিপ। নক্ষত্র পরাবে মাথায়। ঝুমুদি, আজকের দিনটা খুব সুন্দর। আমি পারব। তোমার আকাশ হতে পারব। তোমার সব আমাকে দেবে তো? সব কথা? সব ইচ্ছা? সব স্বপ্ন?’

‘তুই আমাকে বলিস তো, সাধারণ, বলিস তো? সত্যি বলব? টোপর? আমার না ‘আমি’ হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না। আমার ‘আমি’টা শ্রমিক মৌমাছির মতো, একটা মরলেও আরও একশোটা থাকে।’

‘তোমার কেমন ‘তুমি’ পছন্দ ঝুমুদি?’

‘তা ঠিক জানি না। আমার কখনও ঝিরি হতে ইচ্ছে করে, কখনও ঝাড়ু নমিতা। ছোটপিসি হতেও।’

‘ঝিরি কেন?’

‘কী ডাঁট না ওর? কাউকে পরোয়া করে না। বাবা তো জানিস, একটু মিতব্যয়ী, ও মানবেই না। একটা কিছু চাই তো চাই। কেঁদেকেটে, ঝগড়া করে, অভিমান করে আদায় করবেই। দারি করতে পারাও একটা গুণ রে টোপর।’

‘ঝাড়ু নমিতা কেন?’

‘কী সাহস! চাকরিটা ছাড়ল না তো! প্রেমে পড়লে লোকে কত কিছুই মেনে নেয়। পরে হয়তো আফশোস করে। কিন্তু মেনে নেয় তো! ও কিন্তু নেয়নি। কী আত্মবিশ্বাস! ও একদিন নেত্রী হবেই। হয়তো ও এই এলাকার কাউন্সিলার হয়ে যাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে এখন শিক্ষিত, অভিজাতর একচেটিয়া অধিকারে ভাগ বসিয়েছে অন্যরাও। সরু গলির মেয়ে বলে ওর কিছু আটকাবে না। ইস্কুল ডিঙোয়নি বলেও। কমলটা বোকা। নমিতার ভেতরের আগুনটা বুঝল না।’

‘কিংবা উলটোটা। বুঝেছে। তাই এড়াতে চায়। সাহসী মেয়েকে দূর থেকে দেখতে ভাল, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই লোকে দুটো উপায় খোঁজে। প্রথমেই জোরের জায়গাটা মেরে দিতে চায়। না হলে, বর্জন করে। কমল ব্যতিক্রম নয়।’

‘কমলকে সত্যিই ভালবাসে ও।’

‘তাতে কী? সেবিকা ধরনের তো নয়।’

‘তাই বা বলি কী করে? চাকরি করে, পার্টি করে, সংসারের কাজ করে, সংসারটাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।’

‘বুক দুটো বেশ বড় তো।’

‘মারব এক চড়! অসভ্যতা হচ্ছে!’

‘অসভ্যতার কী আছে? সম্পর্কবহির্ভূতভাবে একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে দেখে তখন মেয়েটাকেই দেখে, তার অবয়ব, বুঝলে খুকুমণি?’

‘বুঝলাম।’

‘শোনো, মানুষ দাস্যভাব পছন্দ করে। সেটা ছদ্মবেশ হলেও আপত্তি নেই। দাস পোষার বর্বর মনোবৃত্তি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যে আছে। কুকুর আমাদের দেখে লাঙ্গুল নর্তন করলে আমাদের মনে বেশ স্ফূর্তি হয় না? গাঁটের কড়ি খচ্চা করে লেড়ে বিস্কুট কিনে দিই না? কেন? জীবে দয়া? কচুপোড়া! প্রাণীপ্রেম যার আছে সে সাপেও প্রেম দেয়, ব্যাঙেও। আসলে কুকুরের ওই লেজ নাড়া, উঁ উঁ, সামান্য প্রশ্রয়েই আজীবন বশ্যতা, আমাদের ভেতরকার প্রভুত্ববোধকে তৃপ্ত করে। পুরুষের মধ্যে লোকে চায় দাস্যভাব। নারীর মধ্যে চায় দাস্য আর লাস্য। একইসঙ্গে সেবাময়ী ও মোহময়ী। সেবিকা ও গণিকা। দিনে লজ্জাশীলা, রাতে লজ্জাহীনা।’

‘না না। সবাই এমন প্রভুত্বপরায়ণ নয়।’

‘সবাই। এ যুগে নিন্দনীয়, তাই নিরন্তর নিজেকে সময়োপযোগী রাখার গোপন যুদ্ধ নিজেরই সঙ্গে জারি রাখতে হয়। যে যত বেশি সফল, সে তত মহৎ। এবার বলো তোমার ছোটপিসি হতে ইচ্ছা হয় কেন?’

‘ছোটপিসি কেমন দূরের মানুষ। কোনও বিপদে-আপদে আসে না। কিন্তু কোনও বিষয়ে যখন মন্তব্য করে, মতামত দেয়, সাতকাহন করে তা বলা হয়— ছোট তো অমুকটা বলছিল— যেন, সে সাতে-পাঁচে নেই বলে একেবারে দশ হয়ে বসে আছে। দূরত্বের গুরুত্ব। সে কিছুই করে না বলে ছিঁটেফোঁটাই বড় করুণা।’

‘তুমি ছোটপিসি হয়ো না ঝুমুদি, ঝিরিও না। তুমি যা, তা-ই ভারী সুন্দর। একটু একটু ঝাড়ু নমিতা হলেও হতে পারো।’

‘তার জন্য একজন কমল চাই।’

‘নিজের দাবি বুঝতে শেখো, দেখবে প্রায় সবাই এক একজন কমল।’

‘এই, অনেক বাজল। আমি যাই।’

‘তোমার তো ডাক পড়েনি। থাকো আর একটু।’

‘আচ্ছা।’

‘পায়ে ঝঝি ধরেনি তো? এতক্ষণ ধরে আমার হেঁড়ে মাথার ভার বইছ।’

‘ধরেছে।’

‘দেখছ, তুমি কেমন! বলছ না!’

‘বলতাম।’

‘কবে? নাও। সরে বসো। আমার ঘাড়ে একটা ছোট বালিশ দাও।’

‘চাকরি পেলে তোকে রোজ কাজে যেতে হবে?’

‘চাকরি! চাকরি! আজ যে দিনটা কতরকমভাবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ! বাবার কাছেও। মা যেদিন চলে যায় সেই দিনটা আমরা কোনও দিন ভুলব না, তাই না ঝুমুদি?’

‘ভোলা যাবে না। ওটা নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার কী?’

‘শোনো না। মনে আছে তো, বাবা আর জ্যোতিকাকা সারা রাত্রি দাবা খেলল তোমাদের বাড়িতে। আর তোমাদের দোতলার ঘরের বড় বিছানায় তুমি আর ঝিরি আমার দু’পাশে শুয়ে ছিলে। সেদিন জ্যোতিকাকা আমাকে কোলে তুলে দোতলায় পৌঁছে দিয়েছিল। বাবা আমার সামনে আসতে চাইছিল না। ওই রাত্রে আমরা কেন তোমাদের বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাম? মাকে ছাড়া আমাদের অভ্যস্ত হতেই হত। এ যেন লম্বা দৌড়ের আগে গা গরম করা। আমার মনে হচ্ছিল, বাড়িতে গেলেই দেখব মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। ঝিরি ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাকে বলল, আমারও মা চলে গেছে, তোরও। মা-রা শুধু চলেই যায়।’

‘আমি ঘুমোইনি। ঘুম আসছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল আচ্ছা, আমি যদি বলতাম, রুপুকাকিমা যেয়ো না, থাকো, কাকিমা থেকে যেত। কাকিমা আমার চুল বেঁধে দিত, আর কী বলত জানিস? ঝুমু, তোমার পা দু’টো খুব সুন্দর। তোমার বিয়েতে আমি সোনার নূপুর গড়িয়ে দেব। পরে ছুমছুম হাঁটবে। আজও যখন কাকিমার শাড়িগুলো রোদ্দুরে দিই, মনে হয়, ফিরতেও তো পারে কোনও দিন, কত খুশি হবে শাড়িগুলো দেখে! আমাকে চিনতে পারবে? আমি তো কাকিমাকে আগের মতোই জড়িয়ে ধরব রে টোপর! বলব, কেন চলে গিয়েছিলে? তোমার টোপর কারও থেকে কম নয়। দেখো! সেদিন, কাকিমার চলে যাওয়ার সেই রাতটা, দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা-ভয় সব মিলে আমাকে এক ধাক্কায় গড়ে দিয়েছিল বোধহয়! অতটুকু বয়সে অনুভূতি চিন্তার রূপ নেবার ভাষা পায় না। আমার বোধহয় মনে হচ্ছিল, কাকিমা বিশ্বাস ভাঙল। আমি এমন করব না। কাকিমা কষ্ট দিল, আমি দেব না। আমি ভালবাসব। সারা রাত জেগে আমি কত কী ভেবেছিলাম! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে মনে মনে ঠাকুরকে বলছিলাম, কাল সকালেই টোপরের পা দুটো ঠিক করে দাও ভগবান!’

‘আমি জানি তুমি ঘুমোওনি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে। একটানা আমাকে ভালবাসছিলে। একটুও না থেমে ভালবাসছিলে। আজও আমি ওই ভালবাসাটা ছুঁতে পারি।’

‘তুই খুব কাঁদছিলি। কান্নার শব্দ ছিল না। শুধু নাক টানা। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরলি। কী গরম ছিল! পাখা চলছিল! তবু পুড়ে যাচ্ছিলাম যেন।’

‘তুমি আমাকে সরিয়ে দিলে না কিন্তু। একটা পা, আমার সাড়হীন বাঁ পা, তুমি টেনে নিলে তোমার গায়ে। ঝুমুদি, আমার খুব ইচ্ছে করছিল তখন। কাউকে বলিনি। ওইসময় তোমার গায়ে পা তুলে দিতে ইচ্ছে করছিল। বোধহয় মাকে পেতে চাইছিলাম। মা ওইভাবে আমার পা গায়ে টেনে নিত। মা বুঝতে পারত আমি আষ্টেপৃষ্ঠে মাকে জড়িয়ে থাকতে ভালবাসি। তুমি কী করে মায়ের মতো সব বুঝে গেলে? মাত্র বারো তোমার তখন। ঝিরির জন্যই বোধহয় তুমি খুব তাড়াতাড়ি মা হয়ে গিয়েছ ঝুমুদি। সেইদিন আমিও তোমাকে ভালবাসছিলাম, ক্রমাগত, অনর্গল। বেঁচে থাকার জন্য আমার জীবনে আর নতুন কাউকে দরকার নেই।’

‘আমি আছি তো রে সোনা। আছি তো।’

‘পরদিন সকালে বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। চোখ দুটো লাল। চুল এলোমেলো। বলল, ‘টোপর, তোমার মায়ের হয়ে এবং আমার তরফ থেকে তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি পালাব না। আমি তোমাকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসব। …আমাকে সিঁড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল, তোমাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সিঁড়ির পাশে একটা ঢালু পথ করে দেব আমি। তুমি চাকাচেয়ার নিয়ে ওঠা অভ্যাস করবে। কাল সারা রাত ভেবে এই সমাধান পেয়েছি।…’ ভাবতে পারো, কী গভীর ভালবাসা, কী অসামান্য দায়িত্ববোধ! সেই রাতে আমরা সবাই নিজের মতো করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজেছিলাম। এটাকেই জীবন বলে। ধরো ঝঞ্ঝা, বন্যা, ভূমিকম্প, ধরো বোমায় বিধ্বস্ত ইরাক, সিরিয়া বা প্যালেস্টাইন-যারা থাকে, তারা শোক দিয়ে বুনতে থাকে জীবনের নকশিকাঁথা। কী রঙিন বিচিত্র কারুকাজ। রাজা পরে ভিক্ষুকের সাজ। জটিলের গলি বেয়ে রক্ত বয়ে যায়। এ ওকে আঁকড়ে ধরে যাতে না পালায়। মা আমার দায় বইতে পারছিল না। বাবা সেই দায় নিয়েছিল। বাবার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছিল। প্রিয় কেউ ছেড়ে গেলে যন্ত্রণা হবেই তো। তারই মধ্যে বাবা আমার প্রতিবন্ধকতার সমাধান খুঁজেছিল। একটা মানুষ—যে অসবর্ণ বিয়ে করেছিল বলে আজন্ম চেনা প্রিয়জনেরা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল, যার জন্য ব্রাত্য হল, সে ছেড়ে গেল প্রতিবন্ধী সন্তানের ভার বইতে পারবে না বলে। মানুষটার একক যুদ্ধ চলতেই লাগল। তাকে রোজগার করতেই হবে, সংসার-সন্তান সামলাতে হবে, নিজেকেও। আজ বাড়ির মধ্যে আমি কারও কোলে চেপে ঘোরাফেরা করি না, স্নান-টান নিজে করতে পারি, আমি অক্ষম নই, এই আত্মবিশ্বাস বাবা আমার মধ্যে গড়ে দিয়েছিল। আজ, পনেরো বছর পর, আমি চাকরির জন্য কথা বলতে চলেছি। তোমাকে বলছিলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়। দেখো, আমার এই জুতো, লাঠি, আমার গাড়ি, গড়গড়ি আমাকে সচল রাখে। ওই কম্পিউটার, নেট দুনিয়ার মধ্যে দিয়ে লেখাপড়ার দিগন্ত উন্মোচন—আমাকে কত স্বাবলম্বী করেছে। খুব ছোটবেলায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম প্রথাগত পেশার দিকে যাওয়া চলবে না আমার। এখন কিছু আমাকে জানতে হবে, শিখতে হবে, যার ওপর আমি নির্ভর করতে পারব কিন্তু নিয়মিত রোজ বাইরে গিয়ে ক্লাস করতে হবে না। এমনকী পেশাগত জীবনেও রোজ বেরোতে হবে না। ঘরের বাইরে বেরোলেই আমার এক সমান্তরাল সংগ্রাম শুরু হয়। নির্ভরশীলতা বাড়ে। আমার ভাল লাগত না কোনও দিন। শুধু ভাবতাম—কী করব আমি, কোন পথ, এমন কিছু যার মধ্যে কোনও করুণা থাকবে না, দয়া থাকবে না, প্রতিবন্ধী সংরক্ষণ থাকবে না। এত ‘আহা’ শুনেছি যে আমার আহা শুনলে বমনোদ্রেক হয়। একাদশ শ্রেণিতে আমাকে অংক, ফিজিক্স পড়াতে আসত তমোনাশদা, বলেছিল, তোর প্রার্থিত পথ খুঁজে পাবি কম্পিউটারে। যন্তরটার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করে নে। সেই হবে বন্ধু, সেই গুরু, সেই পথপ্রদর্শক।’

‘সেদিক থেকে তোর নির্বাচন একেবারে ঠিকঠাক। তমোনাশের পরামর্শও। কম্পিউটারের খেলায় কীরকম নেশা হয়ে গিয়েছিল তোর!’

‘নেশা নয়। আমি খেলা তৈরির পেছনের লজিক বোঝার চেষ্টা করতাম। তার বিজ্ঞানটা।’

‘তোর কাছে কম্পিউটারটাই ছিল খেলার মাঠ। আমি জানি।’

‘জানো, আজ যেখানে যাব, সেখানে আমার কাজটা পাকা, আজ শুধু মুখোমুখি কথা বলা। প্রথম তোমায় বললাম। বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারব। সপ্তাহে দু’দিন যেতে হবে।’

‘পাকা? মানে চাকরি পেয়ে গিয়েছিস? কিন্তু এতক্ষণ যে বলছিলি ইন্টারভিউ?’

‘আন্তর্জালিক সংযোগে কথোপকথন আগেই হয়ে গিয়েছিল। বাংলায় বললে কিম্ভূত শোনায় না? স্কাইপে ইন্টারভিউ দিয়েছি ঝুমুদি। কাজের নমুনা পাঠিয়েছি। ওরা কয়েকটা প্রোজেক্ট দিয়েছিল, তাতে পাশ করেছি। ঘাটে ছিল নৌকার এ বাঁধা চঞ্চলতা। জোয়ারের টানে রশি ছড়ে চলে যাচ্ছে স্রোতে। তাকে ছুঁয়ে আরও এক নৌকার মাঝিনী। দেখে মনে হয় হলুদ হলুদ ফুলে ভরা শান্তিলতা। আসলে সে আগুন আগুন ভালবাসে তাই পুড়ে যায় নিজের তরাসে। বুঝলে? আজ শুধু সইসাবুদ। যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে, চুক্তিপত্রের স্বাক্ষরিত দলিল হাতে না পাচ্ছি, ততক্ষণ আর কাউকে বলার কী প্রয়োজন! জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা।’

‘আমায় বললি যে!’

‘আজ থেকে তুমি আমার আকাশ ঘোষণা দিলে যে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি তোমার আকাশ হতে পারি ই ই ই!’

‘হতে পারিস মানে কী রে!’

‘ওঃ! পারি, মানে সক্ষম, তোমার সব কথা আমাকে বলবে তো ঝুমুদি? আর কাউকে না। শুধু আমাকে। ও ঝুমুদি, ও ঝুমুদি, ঝুমুদিইইই!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *