১. কাঠের ছোট ফটক

সহভূমিকা – উপন্যাস – বিমল কর

০১.

কাঠের ছোট ফটকের সামনে নীলেন্দু দাঁড়িয়ে থাকল।

পৌষের রোদ এখনও কাঁচা, সারা রাতের হিম জমে আছে ঘাসের ওপর পুরু হয়ে, মাঠ-ঘাট শিশিরে ভেজা; শীতের খর বাতাসে এই রোদ যেন গায়ে লাগছিল না।

ট্রেন থেকে যখন নেমেছিল নীলেন্দু তখন সবে রোদ উঠছে। স্টেশন থেকে আসতে খানিকটা সময় গিয়েছে তার। মাইল খানেক পথ। সামান্য কমবেশিও হতে পারে। স্টেশনের বাইরে এসে খাপরার ছাউনি দেওয়া দেহাতি চায়ের দোকানে চা খাবার সময় মহীতোষের বাড়ির খবরটা জেনে নিয়েছিল নীলেন্দু। মহীতোষ–এই নামটার এখানে কোনও বিশেষ পরিচয় নেই। মহীতোষের শারীরিক বর্ণনাও যথেষ্ট হত না যদি না নীলেন্দু দেবযানীর কথা তুলত, আরও কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক বিবরণ দিত। বাড়ির খবরটা মোটামুটি জেনে নিয়ে নীলেন্দু চলল রেল ফটকের দিকে। গায়ে লাল রঙের মোটা পুলওভার, গলায় মাফলার, কাঁধে কিট ব্যাগ। পায়ে পুরু ক্যানভাস শ্য! তবু শীত করছিল।

রেলফটকের লোকটা ডান হাতি মাঠ ভেঙে সরাসরি চলে যেতে বলল; কাছাকাছি হবে। মাঠ ভেঙেই এসেছে নীলেন্দু। রাস্তা আর মাঠের মধ্যে এমন কোনও তফাত অবশ্য চোখে পড়ার কথা নয়। দুইই প্রায় সমান এদিকটায়। মাঠ দিয়ে আসতে আসতে নীলেন্দু জায়গাটার জল মাটি বাতাসের মোটামুটি ধারণা করতে পারছিল। মাটি শক্ত, রংটাও ঠিক লাল নয়, খয়েরি, নুড়িপাথর আর কাঁকর যেন মাটির সঙ্গে মেশানো। নেড়া রুক্ষ মাঠের কোথাও কোথাও শীতের মরা ঘাস, কোথাও বা ছোট ছোট বুনো ঝোপ।

জায়গাটা ভাল। জল বাতাস যে স্বাস্থ্যকর বোঝাই যায়। নীলেন্দু স্বীকার করল, মহীতোষদা জায়গাটা পছন্দ করেছে ভালই। চোখ এড়িয়ে থাকার পক্ষে খুবই উপযুক্ত। কলকাতা থেকে অন্তত পৌনে দুশো মাইল।

মাঠ পেরিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই সেই বিশাল শিরীষ। তার সামান্য তফাতে মহীতোষদের বাড়ি।

বাড়ির সামনে এসে নীলেন্দু দাঁড়িয়ে ছিল। কাঁটালতার বেড়া চারপাশে। কাঠের ছোট ফটক। বাড়িটা বাংলো ধরনের, প্রায় চৌকোনো, ছোটখাটো, মাথায় খাপরার চাল, চারদিকে ঢালু করে নামানো, উঁচু বারান্দা, খড়খড়ি করা দরজা। আশেপাশে খানিকটা জায়গা পড়ে, সামনের দিকে কিছু গাঁদাফুল ফুটে আছে, আরও কিছু মুরসুমি গাছ।

নীলেন্দু কাঠের ছোট ফটক খুলে ভেতরে ঢুকল।

কুয়াতলায় কেউ জল তুলছিল। মৃদু শব্দ আসছে। বাড়ির আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। মনে হয় বাড়ির লোকজন এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। কিংবা বাইরের দিকে কেউ নেই। অথচ ঘরের দরজা খোলা।

নীলেন্দু বারান্দার সামনে সিঁড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ডান দিকে কুয়াতলা। বাঁধানো কুয়া। কুয়াতলার গায়ে কয়েকটা পেঁপেগাছ। দেহাতি, মাঝবয়েসি একটি মেয়ে কুয়াতলার একপাশে বসে বাসনপত্র মাজছিল। জোয়ান মতন একজন জল তুলে বালতি ভরছে।

নীলেন্দু ভাবছিল লোকটাকে ডাকবে কি ডাকবে না। তার আগেই ঘরের দিকে সাড়া পাওয়া গেল। নীলেন্দু মুখ ফিরিয়ে বারান্দার দিকে তাকাল।

ততক্ষণে মধ্যের ঘর থেকে কে যেন বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। নীলেন্দু ডাকার মতন শব্দ করল। পরনে পাজামা, গায়ে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না, গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মোটা চাদর জড়ানো, চাদর না কম্বল বোঝা মুশকিল।

খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা বা কৌতূহল নিয়ে ছেলেটি বারান্দার ধারে এসে দাঁড়াল। নীলেন্দু বলল, মহীতোষদা আছেন? বলে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকল। নীলেন্দুর চেয়ে বয়েস কমই হবে। চোখে মুখে এখনও ঘুম জড়ানো। মাথার চুল উসকো-খুসকো।

আছেন। …আপনি? ছেলেটিও নীলেন্দুকে দেখছিল।

 আমি কলকাতা থেকে আসছি।

ছেলেটি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই দেবাযানী বাইরে এসেছিল ছেলেটিকে কোনও কথা বলতে। বাইরে এসেই নীলেন্দুকে দেখতে পেল। দেখে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। থমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

নীলেন্দু সিঁড়িতে পা রেখে এমন মুখ করে হাসল যেন দেবযানীকে চমকে দিয়ে মজা দেখছে।

দেবযানী যতটা চমকে উঠেছিল ততটা যেন শঙ্কিত। চমক সামলে মুখের ভাব সামান্য স্বাভাবিক করল। চোখের কোণে তখনও কেমন যেন এক দুশ্চিন্তা।

এগিয়ে এসে দেবযানী বলল, তুমি।

নীলেন্দু বলল, খুব অবাক হয়ে গিয়েছ।

দেবযানী বলল, তা হয়েছি। বলে ছেলেটির দিকে তাকাল। তোর জিনিসপত্তর পরে গুছিয়ে নিস। দশটায় গাড়ি। এখনও অনেক সময় আছে।

ছেলেটি চলে গেল।

নীলেন্দু বলল, কে?

 ভাই।

কার? তোমার না মহীদার?

 আমার।

কই, আগে কখনও দেখিনি তো! নীলেন্দু হাসল, তোমার এরকম ভাই এখানে আর কজন আছে। বলতে বলতে কাঁধ থেকে কিট ব্যাগের স্ট্র্যাপটা খুলে ফেলল নীলেন্দু।

দেবযানী কথার কোনও জবাব দিল না।

 মাটিতে ব্যাগ রেখে নীলেন্দু গলার মাফলার আলগা করে নিল। হেসে বলল, রাগ করলে?

 দেবযানী চোখে চোখে তাকাল না নীলেন্দুর, বলল, যা ভাবো।

ওর নাম কী?

 আশিস।

 এখানেই থাকে?

 না; মাঝে মাঝে আসে। এলে দু একদিন থেকে যায়।

নীলেন্দু বারান্দার কোথাও কোনও বসার ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছিল না। একেবারে ফাঁকা। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই বার করতে করতে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হল, তোমার আশিস আজ চলে যাচ্ছে।

দেবযানী আড়চোখে নীলেন্দুকে দেখল। বলল,তোমারও কথা শুনে মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে দেখে তোমার স্বস্তি হচ্ছে না। গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ।

নীলেন্দু এবার সামান্য জোরে হাসল। বলল, কিছু মনে কোরো না, আমি একটু জেলাস; তোমার ভাইয়ের সংখ্যা বাড়লে আমার বুক কাঁপে, বলে নীলে বাঁ হাতে তার বুক দেখাল। তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে একমুখ ধোঁয়া গিলে বলল, যাক গে, এসে পর্যন্ত তোমার সঙ্গে ঝগড়া করছি। …মহীদা কোথায়?

কাছাকাছি কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

 প্রাতঃভ্রমণ! …তা তোমরা কেমন আছ?

ভালই।

নীলেন্দু সামনের দিকে তাকাল। রোদ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। সামান্য ঝকঝক করছিল। মহীদা আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে, হয়তো এখুনি এসে পড়বে। কেমন যেন প্রত্যাশার চোখ নিয়ে নীলেন্দু ফটকটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

দেবযানী বলল, তোমরা কেমন আছ?

নীলেন্দু সেকথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, তুমি যে আজকাল অতিথিকে এই ভাবে অভ্যর্থনা করো জানতাম না, দেবীদি! দু পায়ে একটানা দাঁড় করিয়ে রেখেছ?

দেবযানী সামান্য অপ্রতিভ হল, বলল, না, না, আমি ঠিক খেয়াল করিনি। এমন আচমকা এলে যে অবাক হয়ে গিয়েছি। এসো, ভেতরে এসো৷ বলে দেবযানী নীলেন্দুর ব্যাগ নিজেই উঠিয়ে নিতে যাচ্ছিল। নীলেন্দু বাধা দিল, দিয়ে ব্যাগটা উঠিয়ে নিল।

ভেতরে এসে দেবযানী নীলেন্দুকে যে ঘরে বসতে বলল, সেই ঘরে আশিসের বিছানা,–চারটে জামাকাপড় ছড়ানো। আশিস হাতমুখ ধুয়ে আসতে কুয়াতলায় গিয়েছে।

শীতের রোদ এখনও এ-ঘরে ঢোকেনি, জানলার বাইরে পড়ে আছে। বড় বড় একটা জানলা। খড়খড়ি দেওয়া। সবুজ রং। জানলার কাঠ মাঝে মাঝে ফেটে যাচ্ছে। দরজা একটাই। বেশ উঁচু। ঘরের মাথায় চটের সিলিং, চুনকাম করা। ঘরের একপাশে একটা বিছানা, তক্তপোশের পায়াগুলো দেখা যাচ্ছিল। কাঠের সাধারণ চেয়ার একপাশে। দেওয়াল-আলনায় আশিসের জামা ঝুলছে।

নীলেন্দু ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, কটা ঘর?

তিনটে।

এটা বোধ হয় তোমাদের অতিথিশালা?

দেবযানী বিছানাটা পরিষ্কার করতে লাগল। চাদরটা উঠিয়ে নিল, কাঁচতে দেবে। বাড়তি চাদর আছে দেবযানীর ঘরে। কম্বলটা পাট না করে আপাতত বিছানার ওপর ছড়িয়ে দিল। আশিসের খুচরো জিনিসগুলো একপাশে জড়ো করে রাখল।

তুমি একটু বোসো; চায়ের জল বসিয়ে আসি।

নীলেন্দু গলার মাফলার খুলে রেখে বিছানার ওপর বসল।

দেবযানী চলে গেল।

সামান্য বসে থেকে নীলেন্দু বিছানার ওপর আড় হয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ে জুতো মোজা, পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল। কাল গাড়িতে ঘুম প্রায় হয়নি। ভিড় খুব। শীতও মন্দ ছিল না। মনের মধ্যে উদ্বেগও ছিল। উদ্বেগ আর চিন্তা। মহীতোষদাকে সত্যিই পাওয়া যাবে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ ছিল। খবরটা তার কাছে কেমন উড়ো উড়ো লেগেছিল। গিরিজা কার কাছে কোথা থেকে মহীতোষদের খবর পেয়েছে স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। একবার শুভঙ্করদার কথা বলল, একবার বলল মহীতোষদার ভাইয়ের মুখে শুনেছে। আবার বলল, মহীতোষদার একটা চিঠি সে দেখেছে বাসুদেবের কাছে। এলোমেলো উলটোপালটা খবর শুনে কাউকে খুঁজতে আসা নিশ্চয় বোকামি। নীলেন্দু অনেক ভেবেচিন্তে সেই বোকামিটুকু করার ঝুঁকি নিল। অবশ্য তার মন বলছিল: এই রকম হতে পারে। মহীতোষদাকে পাওয়া যেতে পারে। দেবযানীদিকেও।

বিছানার ওপর গা ভেঙে শুয়ে থাকতে থাকতে নীলেন্দু এপাশ ওপাশ করল, হাই তুলল।

এমন সময় আশিস ঘরে এল। এসে বিছানায় নীলেন্দুকে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল।

বিছানায় উঠে বসল নীলেন্দু। বসে আশিসের দিকে হাসি-হাসি মুখ করে তাকাল। বলল, আমার নাম নীলেন্দু। কলকাতা থেকে এসেছি। মহীদাদের অনেকদিনের চেনাজানা, বন্ধুর মতন। আপনি দেবীদির ভাই শুনলাম।

আশিস প্রথমটায় যেন কী বলবে বুঝতে পারল না; পরে বলল, ওঁকে আমি দিদি বলি।

 কোনও রকম আত্মীয়?

 না।

দেবীদিকে আমি অন্তত আট-দশ বছর ধরে চিনি। বাড়ির সকলকেই। আপনাকে কখনও দেখিনি তাই বললাম। …আপনি কি আজই ফিরে যাচ্ছেন?

আশিস মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।

কোথায় থাকেন ভাই আপনি?

ঝাড়গ্রাম।

ঝাড়গ্রাম! তা হলে তো কাছেই।

আশিস মাথা নাড়ল।

নীলেন্দু আরও ভালভাবে লক্ষ করছিল আশিসকে। কলকাতার চেহারা যে নয় বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না। মফস্বল শহরের ছাপ রয়েছে চোখে মুখে, খানিকটা কুণ্ঠিত আড়ষ্ট, সামান্য যেন গ্রাম্যতা রয়েছে। চেহারায়। আশিসকে কেমন লাজুক, সরল, শান্ত-টান্তই দেখায়। নীলেন্দুর মনে হল, ছেলেটির বয়েস তার চেয়েও অনেকটা কম, অন্তত পাঁচ-সাত বছরের। চালাক চতুর বা বিশেষ বুদ্ধিমান বলেও মনে হয় না। মহীদা আর দেবীদি এই ছেলেটাকে ভিড়িয়ে ফেলেছে নাকি?

আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নীলেন্দু দেবযানী ঘরে এসে পড়ল। বলল, চল, চা খাবে চল। তোমার মহীদাও আসছে।

নীলেন্দু উঠে দাঁড়াল।

দেবযানী আশিসকে বলল, তুই দুটো ভাত খেয়ে যাবি না?

না, আশিস মাথা নাড়ল।

খেয়ে গেলে পারতিস। কোর্ট হয়ে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।

বিকেল হবে না, আশিস বলল, আগে আগে চলে যাব।

 যাবার আগে জলখাবার খেয়ে যাবি! চা খাবি আয়।

 যাচ্ছি।

দেবাযানী চোখের ইশারায় নীলেন্দুকে ডেকে নিয়ে চলে গেল।

বাড়ির পেছন দিকে ঢাকা বারান্দায় এনে দেবযানী নীলেন্দুকে বসতে বলল।

 বারান্দার পুব দিক ঘেঁষে রোদ পড়েছে। সাধারণ একটা টেবিল একপাশে, দু তিনটে মামুলি চেয়ার। বারান্দার অন্যদিকে বুঝি রান্নাঘর। ছোট। গায়ে গায়ে আরও একটা চিলতে মতন ঘর, ভাঁড়ার হতে পারে।

নীলেন্দু রোদে দাঁড়িয়ে থাকল। আরাম লাগছে। এখানে দাঁড়িয়ে কুয়াতলা দেখা যায়, কাছেই, পঁচিশ ত্রিশ গজ দূর হবে হয়তো। পেছনের দিকটায় ভাঙা পাঁচিল। কুয়াতলার ওপাশে নিমগাছ, বেশ শীর্ণ।

দেবযানী চা এনে টেবিলের ওপর রাখল।

মহীদা কই?

 আসছে। এখুনি এসে পড়বে। তুমি চা খাও।

তুমি খাবে না?

খাব।

 নীলেন্দু চেয়ারে বসল। তোমাদের এখানে প্রচণ্ড শীত।

আরও পড়বে শুনেছি।

কষ্ট হয় না তোমাদের? কলকাতার লোক।

আস্তে মাথা নাড়ল দেবযানী। না, সহ্য হয়ে যাচ্ছে। বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল আবার।

নীলেন্দু চা খেতে খেতে আবার একটা সিগারেট ধরাল। মহীদা তাকে দেখলে কতটা চমকে যাবে বলা যাচ্ছে না। বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারবেনা, নীলেন্দু স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে। অন্য রকম ভাবতে পারে মহীদা। ভাবাই স্বাভাবিক। ভেবে সন্ত্রস্ত হবে, নীলেন্দুকে মোটেই পছন্দ করবে না, বিশ্বাস করবে না।

নীলেন্দু মহীতোষের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কোন দিক দিয়ে মহীতোষ আসবে বুঝতে না পেরে সে একবার ঘরের দিকে আর একবার ভেতর বারান্দার জাফরির দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। ভেতর বারান্দার সবটাই জাফরি আর জাল দিয়ে ঘেরা, বাইরে চৌকো জাল, কাঠের ফ্রেম আটকানো; ভেতর দিকে পাতলা গোেল জাল।

ঘরের ভেতর দিয়েই মহীতোষ এল। নীলেন্দুকে দেখে থমকে দাঁড়াল। দেখল দু পলক। এগিয়ে এল। নীলু! তুই?

নীলেন্দু মহীতোষকে দেখতে লাগল। প্রায় ছ সাত মাস পরে দেখা। মনে মনে নীলেন্দু অন্য রকম ভেবেছিল। ভেবেছিল, মহীদার মুখে ঘন দাড়ি, পরনে গেরুয়া, মাথায় লম্বা লম্বা বাবাজি মার্কা চুল দেখতে পাবে। সেসব কিছুই দেখা গেল না। মাথার চুল অবশ্য বড় বড়, কিন্তু তাকে বাবাজি মার্কা বলা যায় না।

কাছে এসে মহীতোষ নীলেন্দুর কাঁধের কাছটায় হাত রেখে চাপ দিল। তুই কী করে এলি? আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ!

কোন দিকে ছিলে তুমি? আমি তো দেখতে পাইনি।

মহীতোষ বাড়ির পেছন দিকটা দেখাল। বলল, তুই সামনে দিয়ে এসেছিস, আমি পেছনের দিকে মাঠে বেড়াচ্ছিলাম। খানিকটা দূরে একটা ছোট নদী আছে। হাঁটতে হাঁটতে নদী পর্যন্ত চলে যাই। ফেরার মুখে শুনলাম কোন এক বাবু এসেছে।

তাই বলো! তোমায় খবর পাঠিয়েছিল দেবীদি।

কেমন আছিস তুই?

কেমন দেখছ। তুমি কেমন আছ? …তোমরা? নীলেন্দু যেন একটু হাসল।

মহীতোষ চেয়ারে বসল। দেবযানী চা এনেছে। দু কাপ। মহীতোষের সামনে একটা কাপ নামিয়ে রেখে বলল, তোমরা বোসো, আশিসকে চা দিয়ে আসি।

নীলেন্দু চা খেতে খেতে মহীতোষকে লক্ষ করতে লাগল।

 মহীতোষ চায়ের পেয়ালা টেনে নিয়ে চুমুক দিল। মুখ তুলে বলল, কী দেখছিস।

 দেখছি তোমার কতটা পরিবর্তন হল?

 মহীতোষ শান্ত চোখে হাসল। কিছু দেখতে পাচ্ছিস?

 সিগারেটের ধোঁয়া গিলে ফেলল নীলেন্দু। তেমন আর কোথায়! গায়ের রং প্রায় আমার মতনই হয়ে এসেছে, চোখেমুখেও তো কোনও দিব্য জ্যোতি দেখছি না, বরং তোমার শরীর খানিকটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে। নীলেন্দু এমনভাবে বলল যেন সে যা বলছে তার সম্পর্কে নিজেও তেমন নিশ্চিত নয়। তার মুখে সামান্য হাসি-হাসি ভাব ছিল।

মহীতোষ হাসছিল। বলল, শীতে শরীর শুকোয় তুই জানিস না?

নীলেন্দু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না ওসব জানি না। …কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি অবাক হচ্ছি, মহীদা; আমি ভেবেছিলাম তুমি এতদিনে দিব্যি দাড়িকাড়ি গজিয়ে ফেলবে, মাথার চুল হাতখানেক লম্বা হবে। সেসব কোথায়?

মহীতোষ সামান্য জোরে হেসে উঠল।

দেবযানী ফিরে এসে রান্নাঘরে গিয়েছিল, তার চা নিয়ে নীলেন্দুদের কাছে এসে বসল।

মহীতোষ বলল, দেবী, আমার এই মুখ নীলুর পছন্দ হচ্ছে না।

দেবযানী নীলেন্দুর দিকে তাকাল।

নীলেন্দু বলল, মিথ্যে বলব না দেবীদি, যেখানে যা মানায় তা না থাকলে চোখে লাগে। তোমাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, এখানকার কারবারটা তোমরা গুছিয়ে উঠতে পারোনি।

নীলেন্দুর গলার শ্লেষ দেবযানীর কানে লাগল। মহীতোষও হয়তো লেগেছিল। কিন্তু তার মুখ সহাস্যই থাকল। দেবযানী যেন ক্ষুণ্ণ হল। বলল, তুমি কি আমাদের কারবারের লাভক্ষতি দেখতে এসেছ?

মহীতোষ দেবযানীর মুখের দিকে তাকাল। মনে হল এই বিরক্তি তার পছন্দ হল না।

নীলেন্দু সিগারেটের শেষ ধোঁয়াটুকু গিলে ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি তো জান দেবীদি, আমি জাত ব্যবসাদারের ছেলে, লাভের কারবার দেখলে আমার লোভ বেড়ে যায়, ইচ্ছে করে দু পয়সা খাঁটিয়ে নি। বলে নীলেন্দু হাসতে লাগল।

মহীতোষ প্রসঙ্গটা পালটে নেবার জন্যে বলল, তোদের দু জনের সেই সাপে-নেউলের সম্পর্কটা আর শোধরাল না। …ওসব কথা থাক, এবার আমায় বল তো নীলু, তুই কী করে জানলি আমরা এখানে আছি?

সিগারেটের টুকরোটা কাপের মধ্যে ফেলে দিল নীলেন্দু। সামান্য চুপ করে থেকে বলল, কানে এসেছিল।

কী করে কানে এল?

 গিরিজা বলছিল। সে নাকি শুভঙ্করের কাছে শুনেছে। বাসুদেবের কাছেও শুনে থাকতে পারে। তুমি কি তোমার ভাইকে কোনও চিঠি লিখেছিলে?

লিখেছি এক-আধ বার।

তার মুখ থেকেও শুনতে পারে।

 তুই কি আমার বাড়িতে খোঁজ করেছিলি?

না। …খোঁজ করলে লাভ হত বলে আমার মনে হয়নি। আমি উড়ো খবর শুনেই এসেছি। তোমাদের এখানে সত্যিসত্যি দেখতে পাব ভাবিনি। ভেবেছিলাম, নাও পেতে পারি। না পেলে ফিরে যেতাম।

দেবযানী মুখ নিচু করে চা খাচ্ছিল। মুখ গম্ভীর। অন্যমনস্ক।

মহীতোষ বলল, তুই ভুল করেছিস। আমার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করলে এখানকার কথা তুই জানতে পারতিস। পরিতোষ তোকে অন্তত বলত।

দেবীদির বাড়িতে বলেনি, বলে নীলেন্দু দেবযানীর দিকে তাকাল।

 মহীতোষ বলল, দেবীর বাড়ির লোক জানে না। জানলেও বলত না! কেন বলত না তুই জানিস। তা ছাড়া তারা বোধ হয় জানতেও চায় না।

দেবযানী বলল, তারা কিছু জানে না।

নীলেন্দু বলল, তোমার নাম ও বাড়িতে অচল এটা তুমি জান? তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ এটাও ওরা জানতে চায় না।

দেবযানী উদাসীন ভাবে বলল, জানি। আমি ওদের কেউ নয়।

নীলেন্দু আচমকা বলল, তুমি কত টাকার গয়না নিয়ে পালিয়ে এসেছ দেবীদি? শুনেছি মোটা টাকার। আজকালকার বাজারে পনেরো বিশ হাজার হতে পারে। পাথর-টাথরও ছিল।

দেবযানী প্রথমটায় কথা বলল না, নীলেন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আস্তে করে বলল, আমি যা এনেছি সব আমার। আমার মা দিদিমা আমার জন্যে যা রেখেছিল। বাড়ির কারও কোনও জিনিস আমি নিইনি। বরং আমারই খুচরো কিছু আমি ফেলে এসেছি।

মহীতোষ দেবযানীকে দেখছিল। অসন্তুষ্ট হয়েছে দেবযানী। চোখের তলায় রাগের ভাব। কপাল সামান্য কুঁচকে উঠেছে।

মহীতোষ নীলেন্দুকে বলল, নীলু, তুই দেবীকে রাগিয়ে দিচ্ছিস।

নীলেন্দু দেবযানীকে দেখতে দেখতে হাসল, বলল, আমার ওপর রাগ করার কোনও কারণ নেই, মহীদা। আমি যা শুনেছি তাই বললাম। দেবীদি আমায় দেখে রাগ করছে না। করছ নাকি দেবীদি? নীলেন্দু ঠাট্টা করে বলল।

কথার জবাব দিল না দেবযানী।

নীলেন্দু বলল, আমায় দেখে দেবীদির যা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি। ভয় পেয়েছে। বলে একটু থামল, আবার বলল, একটা কথা আমি সত্যি করেই বলছি মহীদা, দেবীদি যা ভাবছে তা নয়। আমায় কেউ তোমাদের কাছে পাঠায়নি। আমি নিজেই এসেছি। কেউ জানে না, আমি তোমাদের কাছে আসব। কাউকে আমি বলিনি।

দেবযানী স্থির চোখে নীলেন্দুকে দেখছিল।

চুপচাপ। মহীতোষ গায়ের চাদরের আলগা অংশটা মাটি থেকে গুটিয়ে নিতে নিতে বলল, বাইরে গিয়ে বসি চল নীলু, বাইরের বারান্দায় রোদ এসে গেছে।

.

০২.

বারান্দার গায়ে গায়ে পেয়ারাগাছ, গাছতলাতেই বসল মহীতোষ ছোট ছোট মোড়া বয়ে এনে। পুরোপুরি রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ বসা যাবে না ভেবেই মাথা বাঁচিয়ে গাছতলায় বসা।

নীলেন্দু প্রথমটায় কোনও কথা বলল না, আলস্যের ভঙ্গিতে বসে চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আকাশ পরিষ্কার, ফিকে নীল, সাদা রেখার মতন মেঘের দাগ রয়েছে কোথাও কোথাও; অফুরন্ত বোদ। রোদ যে অনেক গাঢ় ও তপ্ত হয়ে গেছে বোঝা যায়। মাটি ঘাস শুকিয়ে এসেছে, ভেজা ভেজা ভাবটা আর তেমন চোখে পড়ছিল না।

মহীতোষই কথা বলল। জায়গাটা কেমন লাগছে রে?

নীলেন্দু মহীতোষের দিকে তাকাল। হাসি মাখানো নিশ্চিন্ত মুখ। নীলেন্দু আশা করছিল, তাকে দেখে মহীদার মুখ গম্ভীর হয়ে যাবে, দেবীদির যেমন হয়েছে; মহীদা বিরক্ত হবে, উদ্বেগ বোধ করবে। আশ্চর্য, এখন পর্যন্ত তেমন কিছু হল না। মহীদা যদি উদ্বেগ বোধ করেও থাকে তার কোনও চিহ্ন মুখে ফুটে ওঠেনি। শুধু কৌতূহলের কিছুটা আভাস রয়েছে চোখে।

নীলেন্দু বলল, জায়গাটা ভালই বেছে নিয়েছ। কী করে বাছলে? এদিকে আগে এসেছ কখনও?

 মহীতোষ বলল, একবার এসেছিলাম। বছর চারেক আগে।

 তখন থেকেই কি তোমার মাথায় এই আখড়া খোলার প্ল্যান ছিল?

হাসল মহীতোষ। মাথা নাড়ল। নারে, তখন কিছুই ছিল না।

এই বাড়িটার মালিক কে?

 দেবী।

নীলেন্দু অবাক হয়ে মহীতোষকে দেখতে লাগল। এক-আধবার এই ধরনের একটা সন্দেহ তার হয়েছে, তবে সে-সন্দেহ এমনই যে নীলেন্দু তা নিয়ে মোটেই ভাবেনি। তার মনে হয়েছিল, বাড়িটা মহীদারা ভাড়া নিয়েছে।

মহীতোষ নিজেই বলল, দেবী বাড়িটা কিনেছে। বেশিদিন নয়, মাস-দুই হল। এখানে জমি জায়গা সস্তা, বাড়িটাও ফাঁকা পড়েছিল, খুবই অল্প পয়সায় কিনে নিয়েছে।

নীলেন্দু অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞেস করল, বাড়িটা কার?

বাড়িটা ছিল এদিককারই এক অবাঙালি ভদ্রলোকের। কাঠের ব্যবসা করতেন। এদিকে ওদিকে আরও দু একটা বাড়ি তাঁর আছে। ভদ্রলোকের স্ত্রীর বাড়াবাড়ি ধরনের টিবি হয়; হাসপাতালে অনেকদিন ছিলেন। সেরে ওঠার পর স্ত্রীকে শুকনো ভাল জায়গায় রাখার জন্যে বাড়িটা করেন। বছর-দুই পরে মহিলা অন্য রোগে মারা যান, হার্টের রোগে। তারপর থেকে বাড়িটা ফাঁকা পড়ে ছিল। ওই যে আশিস, ওরই এক বন্ধু ভদ্রলোকের ভাগ্নে। ঝাড়গ্রামে ভদ্রলোকের অন্য সব ব্যবসা আছে। আশিসই খবরাখবর করেছিল। এই বাড়িটা রাখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের কোনও গরজ ছিল না। হাজার আষ্টেক টাকায় বেচে দিলেন।

নীলেন্দু মন দিয়ে শুনছিল। মহীদারা কি তাহলে কলকাতা থেকে চলে আসার পর ঝাড়গ্রামে ছিল।

 নীলেন্দু বলল, তোমরা কি আগে ঝাড়গ্রামে ছিলে?

ছিলাম কিছুদিন। তারপর এখানে চলে আসি। এই বাড়িতেই। ভাড়াটে ছিলাম।

নীলেন্দু গলার মাফলারটা খুলে ফেলল। শরীর তেতে উঠেছে রোদে। মাথাটা আরও একটু ছায়ার দিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আরাম করে বসল। বসে পায়ের জুতো মোজা খুলতে লাগল।

মহীতোষ গায়ের গরম চাদর কোলের কাছে গুটিয়ে নিয়ে বসেছিল। শান্ত ভাবেই। এখন বাতাস নেই। পেয়ারাগাছের পাতা যেন স্থির হয়ে আছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস বইতে শুরু করবে; আজ কদিন দুপুর থেকে শীতের হাওয়ার দমকা বাড়ছে, বিকেলের পর প্রবল হয়ে ওঠে। শীতও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

নীলেন্দু আয়াস করে বসে সিগারেট ধরাল। তারপর কী মনে করে মহীতোষের দিকে তাকিয়ে হেসে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল।

মহীতোষও হাসল। মাথা নাড়ল।

 সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ? নীলেন্দু ঠাট্টার গলায় বলল।

হ্যাঁ। অনেক দিন।

 কেন? সাধু সন্ন্যাসীদের অনেকেই তো বিড়ি সিগারেট গাঁজা আফিং খায়।

আমি তো সাধু সন্ন্যাসী নই।

 বাঃ, নীলেন্দু মজার গলায় শব্দ করল। তুমি তো ওই লাইনে এসেছ। …একটা সিগারেট খেতে দোষ কী! একসময়ে পর পর খেতে।

দোষ কিছুই নেই; আমি ছেড়ে দিয়েছি।

 কেন? ক্যানসারের ভয়ে?

 না মহীতোষ ঘাড় নাড়ল। নিজের জন্যে খরচ কমিয়েছি।

আচ্ছা, তা হলে খরচের কথা ভাবছ– নীলেন্দু পরিহাস করেই বলল।

মহীতোষ একটু চুপ করে থেকে বলল, না ভাবলে চলবে কেন? এখানে আমার আয় কী বল? খাওয়া পরা চালাবার মতন ব্যবস্থাটুকু আগে করতে হবে, বাকিতে আমার কী প্রয়োজন?

নীলেন্দু বড় বড় টান দিল সিগারেটে, মহীতোষের চোখ ভাল করে লক্ষ করতে করতে বলল, মহীদা, তুমি আমার কাছে খোলাখুলি কটা কথা বলবে?

কেন বলব না?

বেশ, তা হলে সত্যি সত্যি বলল, এই বাড়ি কি দেবীদি নিজের টাকায় কিনেছে?

 হ্যাঁ।

 টাকা পেল কোথায়? গয়নাগাটি বেচেছে?

মহীতোষ স্বীকার করল, দেবাযানী গয়নাগাটি বেচেছে। আমি দেবীকে বারণ করেছিলাম; আমার ততটা ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম পরে কিনলেই হবে। দেবী জিদ করে কিনে ফেলল। লাভের মধ্যে এই হল, ওর অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল।

নীলেন্দু যেন মনে মনে হিসেব কষে বলল, দেবীদির বাড়ির হিসেব মতন যত গয়নাগাটি পাথর-টাথর নিয়ে চলে এসেছে দেবীদি তাতে আমার মনে হয় বাড়ি কেনার পরও বেশ কিছু থাকার কথা। তাই না?

কিছু আছে, মহীতোষ অস্বীকার করল না, বলল, আমি সব খবর রাখি না, তবে দেবী কিছু সঞ্চয় রেখেছে। এখানকার ছোট পোস্ট অফিসে রাখতে হয় পেটের জন্যে, বাকিটা ঝাড়গ্রামে ব্যাঙ্কে। রেখেছে।

নীলেন্দু সামান্য অবাক হচ্ছিল। এত খোলাখুলি কথা মহীদা বলবে সে ভাবেনি। একটা সময় মহীতোষের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক ছিল যে ধরনের ঘনিষ্ঠতা তাতে মহীদা তার কাছে কোনও কিছুই গোপন রাখত না। সে সম্পর্ক এখনও থাকবে এমন কথা নয়। এবং না থাকারই কথা। মহীদার কাছে গোপনতাই এখন প্রত্যাশা করা যায়। বিশেষ করে এই টাকা পয়সার কথায়–যে টাকাপয়সা তার নিজের নয়, দেবীদির। দেবীদির অনুগ্রহে মহীদার দিন কাটছে–এই কথাই স্বীকার করতে তার সঙ্কোচ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। মহীদা কিন্তু অসঙ্কোচ।

নীলেন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট শেষ করতে লাগল। তারপর আচমকা বলল, তোমারও তো কিছু থাকার কথা।

মহীতোষ পেয়ারাগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, বলল,আমি বাড়িতে ভাইকে লিখেছি। বাবার সম্পত্তির কোনও কিছুই আমি চাইনি, শুধু পুরনো বাড়ির আমার দিকের অংশটা বেচে দিতে বলেছি। ইচ্ছে করলে পরিতোষ নিজেই কিনে নিতে পারে। না হলে বেচে দিক। বেচে দেবার কোনও অসুবিধাই নেই। …আমার কিছু টাকা দরকার, নীলু; এখানে আমি একটা কাজ করব ভেবে রেখেছি।

নীলেন্দু চুপ করে থাকল। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল ছুঁড়ে। আশিস একবার বারান্দায় এসেছিল। এখন তাকে কুয়াতলার দিকে দেখা যাচ্ছে। কোমরে গামছা জড়ানো, হাতে একটা সাদা লুঙ্গি, বোধ হয় স্নান করতে এসেছে। দশটার গাড়ি ধরবে।

রোদে বসে থাকতে থাকতে সামান্য রুক্ষ লাগছিল। ধুলোর কোনও গন্ধ নেই। অন্য ধরনের টাটকা গন্ধ লাগছিল নাকে। গাঁদা ফুলের ঝোপ রোদে বেশ উজ্জ্বল। আকাশের অনেক উঁচুতে চিল-টিল উড়ছে।

হাই তুলল নীলেন্দু শব্দ করে, দু হাত মাথার ওপর তুলে, দুপাশে ছড়িয়ে আলস্য ভাঙল। তারপর বলল, আমায় হঠাৎ এখানে দেখে তুমি কী ভাবছ, মহীদা?

মহীতোষ কোনও জবাব না দিয়ে শান্ত চোখে নীলেন্দুকে দেখতে লাগল। তার চোখ দেখে বোঝা যায় না, কী ভাবছে মহীতোষ।

আমার প্রায়ই মনে হত, তুই একদিন আসবি, মহীতোষ বলল। দেবীকে আমি বলতাম।

তোমার কেন মনে হত?

 মহীতোষ সরলভাবে বলল, কেন মনে হত তুই নিজেই জানিস।

 দেবীদি আমায় দেখে খুশি হয়নি। ভয় পেয়েছে।

 ঠিক তোকে দেখে দেবীর অসুখী হবার কথা নয়। তুই দেবীর ঘনিষ্ঠ, অন্তরঙ্গ। ও অন্যদের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে হয়তো। মহীতোষ নীলেন্দুর চোখের দিকে এমন করে তাকাল যেন এই সহজ ব্যাপারটা নীলেন্দুর না বোঝার কথা নয়।

নীলেন্দু চুপচাপ থাকল। মহীদার কথায় আপত্তি করার বিশেষ কিছু নেই। তবু তার মনে হচ্ছিল, দেবীদি পুরোপুরি নীলেন্দুকে বিশ্বাস করেনি। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস করাও কঠিন। নীলেন্দুও আশা করেনি দেবীদি তাকে দেখে দু হাত বাড়িয়ে টেনে নেবে।

খানিকটা অপেক্ষা করার পর নীলেন্দু বলল, মহীদা, তোমার কী মনে হচ্ছে?

কীসের?

 এই যে আমি হঠাৎ ধূমকেতুর মতন তোমাদের কাছে হাজির হলাম…

মহীতোষ দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি তো আগেই বলেছি, আমার মন বলছিল–তুই একদিন এসে পড়বি।

তোমার মন কী বলছিল সে কথা পরে হবে; আমি এভাবে এসে পড়ায় সন্দেহ হচ্ছে না?

 নীলেন্দুর চোখে চোখে তাকিয়ে মহীতোষ বলল, খানিকটা হচ্ছে।

কিন্তু তুমি তো বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে রয়েছ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, একেবারেই ঘাবড়াওনি?

মহীতোষ হাসির মুখ করল। বলল, তোকে দেখে অন্তত ঘাবড়াইনি?

নীলেন্দু আচমকা বলল, আমি কেন এসেছি জান?

না।

আন্দাজ করতে পারছ না?

তুই তো বলেছিস নিজের ইচ্ছেয় এসেছিস।

 মাথা নেড়ে নীলেন্দু বলল, হ্যাঁ, আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি। আমায় কেউ পাঠায়নি। কেউ জানে না আমি তোমাদের কাছে আসছি।

তা হলে আমার ভাববার…

দাঁড়াও, আমার কথা শেষ করতে দাও। আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি মানে এই নয় যে তুমি এতটা নিশ্চিন্ত থাকতে পার। এমনও তো হতে পারে, তোমার সঙ্গে আমি একটা বোঝাপড়া করতে এসেছি। নীলেন্দু স্পষ্ট ও সামান্য জেদি চোখে মহীতোষের দিকে তাকিয়ে থাকল।

মহীতোষ একটু যেন ভাবল। তারপর বলল, তোর একার সঙ্গে যদি বোঝাপড়া করার কিছু থাকে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অন্য কারও সঙ্গে বোঝাপড়ার কিছু নেই আমার। তুই ভুলে যাস না, আমি শুভঙ্করদের সকলের সামনেই আমার যা বলার বলে এসেছি। কলকাতা থেকে আমি পালিয়ে আসিনি; চলে এসেছি। আমার খবরাখবর তোদের জানানোর কোনও দরকার ছিল না বলে জানাইনি। তা ছাড়া দেবী চাইত না আমাদের খবর কাউকে দি। শুভঙ্করদের কাছে আমার কৈফিয়ত দেবার কিছু ছিল না, আজও নেই। ওদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার কথা ওঠে না।

নীলেন্দু মহীতোষকে দেখতে থাকল। এই প্রথম মহীতোষকে সামান্য বিরক্ত দেখাল। বিরক্ত এবং কিছুটা কঠিনও। নীলেন্দু আরও বেশি দেখেছে: সে জানে মহীদা প্রয়োজনে কত বেশি রূঢ়, জেদি, তিক্ত, নিষ্ঠুর হতে পারে। মানুষের চরিত্রের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানা সম্ভব নয়, কিন্তু দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গতায় নীলেন্দু মহীতোষের চরিত্রের অনেকটাই জানে, তার দুঃসাহস এবং দুর্বলতাও। যে-কোনও কারণেই হোক মহীতোষের এই ঈষৎ রূঢ়তা নীলের ভাল লাগল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীলেন্দু বলল, বেশ, বোঝাপড়াটা তোমার আমার মধ্যেই হবে।

মহীতোষ এমন করে মাথা হেলাল যাতে মনে হল তার কোনও আপত্তি নেই।

অনেকক্ষণ একই ভাবে রোদে বসে থাকতে থাকতে গরম লাগছিল নীলেন্দুর। পুলওভারটা খুলে ফেলল। কুয়াতলায় আশিসের স্নান হয়ে গেছে। সকালের দিকে বারান্দার পুব ঘেঁষে রোদ নেমেছিল অল্প, এখন অর্ধেক বারান্দাই রোদে ভরা। মাটি ক্রমশই উষ্ণ হয়ে উঠছে। বাতাসে বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই। সবই কেমন স্বচ্ছ, উজ্জ্বল।

দেবযানী বারান্দায় এল। দেখল।

পেয়ারাতলার কাছাকাছি বারান্দার ধারে এসে নীলেন্দুকে বলল, তুমি হাত মুখ ধবে না? এসো। মুখচোখ ধুয়ে একটু কিছু খেয়ে নাও।

মহীতোষেরও যেন হঠাৎ খেয়াল হল, বলল, তাই তো নীলু, তোর তো সকালে মুখ ধোওয়াই হয়নি। ওঠ। জামাটামা ছাড়। হাতমুখ ধুয়ে নে। কুয়োর জলে খুব ফ্রেশ লাগবে।

নীলেন্দু তার পুলওভারটা কাঁধের ওপর ফেলল; পিঠ নুইয়ে জুতো মোজা তুলে নিল বাঁ হাতে, ঠাট্টা করে বলল, দেখি কতটা লাগে?

.

হাতমুখ ধুয়ে নীলেন্দু ভেতর বারান্দায় এসে বসল। প্যান্ট ছেড়ে পাজামা পরেছে। গায়ে হাফ হাতা সোয়েটার।

দেবযানী সকালের জলখাবার এনে দিল। লাল আটার রুটি উনুন থেকে সদ্য তোলা; বেগুন আর কড়াইশুটির তরকারি।

নীলেন্দু খেতে খেতে বলল, বাঃ, তোমাদের এখানে রান্নার তো বেশ স্বাদ আছে।

দেবযানী দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, শাকসবজিরও খুব স্বাদ।

মাথা নেড়ে স্বীকার করে নীলেন্দু বলল, তা তো হবেই; মাটির গুণ। আমি একবার রাঁচির দিকে শীতকালে মাসখানেক ছিলাম। শীতের শাকসবজি যে খেতে কত সুস্বাদু হয় তখনই বুঝেছি।

দেবযানী বলল, এসব আমাদের বাগানের।

চোখ তুলল নীলেন্দু। তোমাদের বাগানের?

দেবযানী বলল, কুয়োতলার ওপাশটা তুমি দেখোনি, তোমার মহীদা ছোটখাটো সবজি ক্ষেত করেছে।

বাড়ির চারপাশ নীলেন্দুর এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি, পরে সবই সে দেখে নেবে। কিন্তু মহীদা সমস্ত কিছু ছেড়েছুঁড়ে এসে এখানে এক টুকরো সবজি ক্ষেত নিয়ে বসে আছে ভাবতেই তার হাসি পাচ্ছিল।

দেবযানী বলল, তুমি খাও, আমি চা নিয়ে আসি।

 রান্নার দিকে যাবার আগে দেবযানী ভেতর ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আশিসকে ডাকল। আশিসের সময় হয়ে আসছে গাড়ির, জলখাবার খেয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হবে।

আশিস এল! প্রথমে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, তারপর নিচু গলায় কীসের কথাবার্তা সেরে নীলেন্দুর দিকে টেবিলের সামনে এগিয়ে এল।

.

নীলেন্দু সহাস্য চোখে আশিসকে দেখল। কোনও কোনও মানুষকে প্রথম নজরেই মোটামুটি আঁচ করা যায়। নীলেন্দু যেন আশিসকে আগেই আঁচ করে ফেলেছিল। বেশি রকম লাজুক, বয়েসে সাবালক হলেও মনে এখনও ঠিক সাবালক হয়ে ওঠেনি; নরম চেহারা, স্বভাবও নরম গোছের; চোখের দিকে তাকালে বেশ বোঝা যায় সংসারের অনেক কিছুর সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ নয়।

আশিস বসল।

নীলেন্দু আলাপ করার ভঙ্গিতে বলল, দশটায় গাড়ি?

আশিস মাথা নাড়ল আস্তে করে।

কতক্ষণ লাগে ঝাড়গ্রাম যেতে?

মিনিট চল্লিশ।

ঝাড়গ্রাম শুনেছি ভাল জায়গা। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ট্রেনিং কলেজ অনেক কিছু আছে।

আশিস যেন একটু খুশি হল।

আপনি কী করেন, ভাই? নীলেন্দু জিজ্ঞেস করল।

কোর্টে চাকরি করি। ক্লার্ক।

 ও! ..বাড়ি ওখানেই?

 মাথা হেলিয়ে আশিস বলল, হ্যাঁ ঝাড়গ্রামেই তাদের বাড়ি।

ততক্ষণে দেবযানী এসেছে। এক হাতে আশিসের জলখাবার, অন্য হাতে নীলেন্দুর জন্যে চা। টেবিলের ওপর খাবার চা নামিয়ে দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, ফিরে এল জলের গ্লাস নিয়ে। আশিসের জন্যে চা নিয়েও এসেছে।

খেতে খেতে সাধারণ কথাবার্তা হচ্ছিল: এদিককার শীতের কথা, শাকসবজির কথা, জঙ্গলের কথা, কোথায় কোন পাহাড় আছে তার গল্প, আরও এলোমেলো কিছু কথাবার্তা।

শেষে আশিস উঠল।

দেবযানীও উঠে পড়ল। বোধ হয় আশিসকে কিছু বলবে।

নীলেন্দু কিছুক্ষণ বসে থাকল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। প্যাকেট দেশলাই ঘরে পড়ে আছে। এ সময় ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। দেবীদি আশিসের সঙ্গে হয়তো ব্যক্তিগত কথা বলছে, নীলেন্দুকে দেখলে কিছু মনে করতে পারে। নীলেন্দুর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, দেবীদি এখন পর্যন্ত তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। দেবীদির চোখ, তার ব্যবহার, ভাবভঙ্গি স্পষ্টই বলে দিচ্ছে–সে বেশ সন্দিগ্ধ, খানিকটা যেন উতলা, বিভ্রান্ত। এই উতলা ভাবটা দেবীদি চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না।

নীলেন্দুর কেমন যেন মজা লাগছিল। কে বলবে, কিছুদিন আগে এই দেবীদির সঙ্গে তার যে ধরনের সম্পর্ক ছিল তাতে এ রকম কোনও আকস্মিক সাক্ষাৎ ঘটে গেলে দেবীদি আহ্লাদে গলে যেত। গলা জড়িয়ে ধরত দু হাতে, মুঠো করে মাথার চুল ধরে টানত, কথা বলত অনর্গল, হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, হুকুম করত, জ্বালাতন করত–অর্থাৎ যে সহজ আন্তরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষকে উৎফুল্ল ও আতিশয্যময় করে তোলে দেবীদির আচরণে সেটা দেখা যেত। এই ধরনের ছেলেমানুষি অজস্রবার করেছে দেবীদি, সামান্য কারণেই। কিন্তু এখন তার কোনও লক্ষণই নেই।

টেবিল থেকে উঠে পড়ল নীলেন্দু। ভেতর বারান্দার জাফরির দরজা ভেজানো ছিল। খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। কুয়াতলায় কেউ নেই। দুটো কাক আর কয়েকটা শালিক ওড়াউড়ি করছে। রোদ কড়া হয়ে উঠছিল। পায়ের তলায় কাঁকর মেশানো মাটি, সামান্য ঘাস দুপাশে,শীতে মরে আসছে। একদিকে একটা বড়সড় আতাগাছ।

নীলেন্দু কুয়াতলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট করে বাঁধানো কুয়াতলা। কুয়া দেখল ঝুঁকে। মনে হল, গভীরতা কম নয়; জলে কিছু পাতা পড়ে আছে, বাতাসে উড়ে আসা পাতা। আশিস বোধ হয়ে চলে গেল, দেবীদি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যেন বলল।

কুয়াতলার পাশ দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে আসতেই, ছোটখাটো সবজি ক্ষেত চোখে পড়ল নীলেন্দুর। বাড়ির মধ্যে বাগান, তবু শুকনো কাঠকুটো, কোথাও কোথাও বা কাঁটাগাছের বেড়া। বাড়ির জোয়ান লোকটা বাগানে কাজ করছিল। নীলের বাগান সম্পর্কে কোনও বিশেষ উৎসাহ না থাকলেও বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে শাকসবজি দেখতে লাগল। কিছুই প্রায় বাদ নেই। একপাশে পালং শাক, অন্য দিকে বেগুন, ছোট ছোট কপি হয়ে রয়েছে, সারারাতের ঠাণ্ডা আর হিমে কপির পাতা কেমন সতেজ সাদাটে সবুজ দেখাচ্ছিল। কড়াইশুটির গাছগুলো আশ্চর্য মোলায়েম নরম। সবজি ক্ষেতের গন্ধ উঠছিল।

নীলেন্দু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেবযানীকে দেখতে পেল।

 আশিস চলে গেল? নীলেন্দু জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। …তুমি এখানে?

তোমাদের সবজি বাগান দেখছি।

দেখো। এই বাগান তোমার মহীদার।

 মহীদার এই বিদ্যেও জানা ছিল জানতাম না, নীলেন্দু হাসল।

বিদ্যের আর কী– দেবযানী বলল, ও তো সব জানে–ওই লাটু; ক্ষেতখামারের কাজ জানে। ওই সব করে। বলে একটু থামল, তারপর বলল, আমাদের একরকম এতেই চলে যায়।

নীলেন্দু চোখ তুলে দেবযানীকে দেখল। হাটবাজার করতে হয় না?

হয়, কিছু কিছু করতে হয়–; হাট থেকে আলু-টালু আনতে হয়, সামান্য শাকসবজিও। তবু বেশির ভাগটা এখান থেকেই কুলিয়ে যায়।

নীলেন্দু কী মনে করে হেসে বলল, তোমরা দেখছি কৃচ্ছতা সাধনের ব্রত নিয়েছ। দেবযানী যেন প্রথমে কথাটা বোঝেনি; পরে বুঝে বলল, তা বলতে পারো। আমাদের হাতে তো অঢেল পয়সা নেই। যতটা পারি খরচপত্র কমিয়ে চলবার চেষ্টা করি।

নীলেন্দু দেবযানীকে লক্ষ করছিল। আন্তরিকভাবে বলল, তোমার এমন অভ্যেস ছিল না। হাত টেনে কবে চলেছ আমি মনে করতেও পারি না। অভাব, দুঃখ, কায়ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা তোমার আছে–একথা ভেবে অবাক হচ্ছি।

দেবযানী সামান্য চুপ করে থেকে বলল, অবাক হবার কিছু নেই; আমায় তুমি উড়োনচণ্ডে স্বভাবের কবে দেখলে! ..যাকগে, ধরে নাও অবস্থা আমার স্বভাব বদলেছে।

তাই দেখছি। যাকে কোনওদিন রান্নাঘরের চৌকাটে দাঁড়াতে দেখিনি, তাকে দেখছি পিড়ি পেতে রুটি বেলছে।

দেবাযানী হেসে ফেলল। বলল, এ তোমার বাড়াবাড়ি; মেয়েরা রান্নাঘরের চৌকাট মাড়ায় না– এমন মেয়ে আমাদের দেশে দেখবে না। আগে আমার পিড়ি পেতে বসার দরকার করত না, এখন করে। তা ছাড়া এমন তো কিছু নয়, দুটো ডালভাত সামান্য তরকারি, ওটা না পারলে মেয়েদের লজ্জা রাখার জায়গা থাকে না।

নীলেন্দু কী মনে করে কৌতূহলের সঙ্গে বলল, তোমরা কি মাছ মাংস ছেড়ে দিয়েছ?

খাওয়া হয়ে ওঠে না।

এটা ঠিক জবাব হল না, এড়িয়ে যাওয়া উত্তর হল।

দেবযানী বাগানের লাটুকে কিছু শাকসবজি তুলতে বলে নীলেন্দুর দিকে তাকাল। বলল, এখানে মাংস পাওয়া যায় না; মাছ বলতে নদীর ঘোট ঘোট মাছ; ডিম অবশ্য গাঁয়ে পাওয়া যায়। আমি কোনও কোনওদিন পেলে খাই। ও খায় না।

মহীদা খায় না, তুমি খাও–মানে? সধবার আচার নাকি?

 দেবযানী কেমন বিব্রত বোধ করল। তুমি যদি তাই ভাব, তবে তাই। কিন্তু এমন আচার কেউ আমায় পালন করতে বলেনি।

নীলেন্দু খুব আচমকা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করেছিলে দেবীদি? কালীঘাটে?

না, দেবযানী বলল।

তবে?

আচার করে আমাদের বিয়ে হয়নি। …ও কথা এখন থাক–তোমার মহীদা তোমার জন্যে বসে আছে।

.

০৩.

ঘুম ভেঙে জেগে উঠে নীলেন্দু কয়েক মুহূর্ত কিছুই স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারল না। প্রথমে মনে হল, সে কলকাতায় নিজের বাড়িতে তার তেতলার ঘরে শুয়ে আছে। প্রায় শেষরাতের মতন আবছা লাগছিল চারপাশ। পরের মুহূর্তে সে সচেতন হয়ে উঠল; চোখ খুলে জানলার দিকে তাকাল। না, কলকাতা নয়; তার নিজের তেতলার ঘরও নয়; সময়টাও মোটেই শেষরাত বলে মনে হচ্ছে না। বড় বড় হাই তুলল নীলেন্দু চোখ ছলছল করে উঠল ঘুমের আলসে। কাল সারারাত ট্রেনে ঘুম-টুম প্রায় ছিল না; মনও শান্ত থাকার কথা নয়। রাত্রের অনিদ্রা, রেলে চাপার ক্লান্তি, মানসিক অস্থিরতা স্বভাবতই শরীরটাকে ভারী, অলস করে তুলেছিল। তার ওপর মহীদাদের এখানকার কুয়ার জলে দীর্ঘ সময় ধরে স্নান, মাঝারি মোটা চালের ভাত, প্রচুর শাকসবজি এক পেট খেয়ে আলস্য এবং ঘুম যেন সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছিল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে নীলেন্দু, তা ঘণ্টা তিনেক হবে, একেবারে অসাড়ে।

বিছানায় উঠে বসে নীলেন্দু হাই তুলতে তুলতে একটা সিগারেট ধরাল। শীতের দুপুর অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে, বিকেলও বোধ হয় শেষ হয়ে এল। জানলার বাইরে রোদ নেই, ময়লা আলো, ঘরের মধ্যে ছায়া কালচে হয়ে এসেছে। কান পেতেও নীলেন্দু কোথাও কোনও সাড়া শুনতে পেল না; মহীদা কিংবা দেবীদির গলা নেই, নড়াচড়ার শব্দ নেই। এত নিস্তব্ধতায় কেমন যেন মনে হয়। মনে হয়, মহীদারা এ বাড়িতে নেই, ছিল না, নীলেন্দু এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে কোনও স্বপ্ন দেখছে।

আরও একটু বসে থেকে নীলেন্দু উঠল। শীত করছে। তেষ্টাও পাচ্ছিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে এল নীলেন্দু। ভেতরের ঢাকা বারান্দা ফাঁকা। রান্নাঘরের দিকের দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি তোলা, জাফরির দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ। ডান দিকে মহীদার ঘর। মহীদার ঘরের গা লাগানো ঘরটা দেবীদির। এ বাড়ির তিনটে ঘরের ছক যেন কিছুটা খেয়াল মতন তৈরি করা। পুবের দিকের একটা বড় ঘর দু ভাগে ভাগ করলে যেমন হয়–অনেকটা তেমনই। বাইরের বারান্দা ঘেঁষে অপেক্ষাকৃত বড় ঘরটা মহীদার, তার গালাগানো পেছনের ঘরটা দেবীদির। নীলেন্দুর ঘরের গায়ে গায়ে ভেতর বারান্দার দিক ঘেঁষে স্নানের ঘর। রাত্রের ব্যবহারের জন্য কলঘর। বাড়ির বাইরের দিক থেকে স্নানের জল-টল বয়ে আনার জন্যে দরজা আছে, আলো বাতাস ঢোকার অঢেল ব্যবস্থা। স্নান এবং ছোট কলঘরের গায়ে অল্প ফাঁকা জায়গা, তারপর রান্না আর ভাঁড়ার। অর্থাৎ মহীদাদের ঘরের দিকে যতটা জায়গা গিয়েছে, প্রায় ততটা জায়গায় এপাশের এত ব্যবস্থা।

রান্নাঘরের দিকে ছোট কাঠের চৌকিতে জল ছিল খাবার। ছোট কলসি। পাশে মিটসিফের ওপর দু-চারটে খুচরো বাসন। গ্লাস ছিল কাচের। নীলেন্দু নিজেই জল গড়িয়ে খেল। ভীষণ ঠাণ্ডা জল, দাঁত কনকন করে ওঠে।

দেবযানীর ঘরের দিকে এগিয়ে নীলেন্দু ডাকল, দেবীদি।

 সাড়া দিল দেবযানী, দিয়ে বাইরে এল।

 নীলেন্দু বলল, কী ব্যাপার। তোমাদের কোনও সাড়া শব্দ নেই?

 তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে দেবযানী বলল, খুব ঘুমোলে।

 অলস, ভারী গলায় নীলেন্দু বলল, সাংঘাতিক। রাত্রে আর ঘুমোতে হবে না। …মহীদা কোথায়?

 ঘরেই ছিল। একজন দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে কথা বলতে বাইরে গিয়েছে। আসবে এখুনি।

ভেতর বারান্দার বন্ধ দরজার দিকে তাকাল নীলেন্দু। তাকে একবার বাইরে যেতে হবে। বলল, বিকেলে তোমাদের চা খাওয়া হয় না?

দেবযানী যেন কৌতুকের মুখ করল। কেন?

কী জানি, তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে–ওটাই বোধ হয় বাদ দিয়েছ,নীলেন্দু হাসল। আত্মসংযম করছ হয়তো।

দেবযানী বলল, এখনও অতটা পারিনি। তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ দেখে চা বসাইনি। এবার বসাব।

 নীলেন্দু ইশারায় চা বসাতে বলে বারান্দার দরজার দিকে চলে গেল।

রান্নাঘরের দরজা খুলে দেবযানী স্টোভ ধরাতে বসল।

.

হাত মুখ ধুয়ে কাপড় জামা বদলে নীলেন্দু আবার যখন রান্নাঘরের চৌকাঠের সামনে এসে দাঁড়াল তখন স্টোভ নিভে গিয়েছে। দেবযানী চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে বসেছিল। নীলেন্দুকে দেখে চা ঢালতে লাগল।

মহীদা ফিরেছে?

কই দেখছি না তো?

কোথায় গেল?

কথা বলছে বোধ হয়।

সেই তখন থেকে? …দাও, আমায় দাও নীলেন্দু হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল। বসাবার জায়গা খুঁজল চারপাশ তাকিয়ে। টেবিলের দিক থেকে চেয়ার টেনে আনার ইচ্ছে তার হচ্ছিল না। কাছাকাছি কিছু নেই। রান্নাঘরের মধ্যে উঁচু মতন একটা চৌকি ছিল ছোট। হাত বাড়িয়ে সেটা চাইল। দেবযানী নিজের চা ঢালতে লাগল।

চৌকিতে বসে নীলেন্দু বলল, তুমি আমায় অবাক করে দিয়েছ। যতই দেখছি ততই যেন বোকা হয়ে যাচ্ছি।

তোমরা অল্পতেই অবাক হও।

আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, তোমায় এই ভাবে দেখব, নীলেন্দু হাসিমুখে অথচ সামান্য উচ্ছ্বাসের গলায় বলল, এরকম একটা দৃশ্য ভাবাই যায় না। চারপাশে শীতের সারা বিকেল আলো নেই, ঝাপসা অন্ধকার কালচে হয়ে এসেছে, জাফরি দেওয়া বারান্দার এক অন্ধকার কোণে রান্নাঘরে তুমি বসে আছ। আর চৌকাটের পাশে আমি। কোথাও কোনও মানুষজন নেই, একেবারে চুপচাপ। ব্যাপারটা কেমন বাংলা উপন্যাস বলে মনে হচ্ছে।

দেবযানী হাসল, বলল, তুমি না একসময়ে কবিতা লিখতে।

কোথায় আর লিখতুম! চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন। হল না। …আমার সেই কাব্যচর্চার সঙ্গে আজকের এই ঝাপসা দৃশ্যের কোনও যোগাযোগ নেই, দেবীদি। বরং বলতে পারো, যদি কখনও নিজের অজান্তে এরকম কিছু মনে এসেও থাকে আমি নিশ্চয় মহীদাকে বাদ দিয়ে ভেবেছি।

দেবযানী তাকাল। নীলেন্দু হাসছে। তার গলার স্বরে পরিহাস। বারান্দা বেশ কালো হয়ে এসেছে। অন্ধকার হয়ে এল। হাত কয়েক তফাত থাকলে দেবযানী নীলেন্দুর মুখ স্পষ্ট করে দেখতে পেত না।

চা খেতে খেতে দেবযানী বলল, তোমার মহীদাকে তুমি বাদ দিয়ে ভেবেছ, এ আমি বিশ্বাস করি না।

নীলেন্দু পরিহাস করেই বলল, কেন বিশ্বাস করো না। প্রেমে আর যুদ্ধে সবই সম্ভব।

দেবযানী হেসে ফেলে বলল, তোমার প্রেম আমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল।

ঠিক বলেছ দেবীদি, সহ্যশীলা প্রেমিকার বড় অভাব। দুর্লভও বলতে পারো।

 কেন, তোমার সেই বিজয়ানা কে যেন? ঠাট্টা করে দেবযানী জিজ্ঞেস করল।

 চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নীলেন্দু বলল, আমার দুর্ভাগ্য দেবীদি, সেই বিজয়া এখন দিল্লি-নিবাসী। গত জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণ-ট্রাবণ হবে বোধ হয়, বিজয়া যে ভদ্রলোকের করকমল গ্রহণ করল তিনি ভারত সরকারের খাজাঞ্চিখানার বড় পেয়াদা। শুনেছি, লন্ডনের কোনও অর্থশাস্ত্রের তকমা আছে ভদ্রলোকের। বিজয়ার বাবা, বিজয়া নিজেও সাদরে এঁকে গ্রহণ করেছেন। দেখো দেবীদি, মেয়েরা হিসেবনিকেশেই বলল আর ফাটকা বাজারে কোন শেয়ার ধরবে না ছাড়বে এ বিষয়ে বেশ পটু। দু এক জায়গায় অবশ্য বেসামাল হয়ে যায়। যেমন তুমি। তুমি যা করেছ সেটা মেয়েদের সাধারণ ধর্ম নয়, এমন বোকামি চট করে কেউ করে না।

দেবযানী হাসছিল। নীলেন্দু এই রকমই। তার মন খুশি থাকলে কথা বলার ধরনটাই পালটে যায়, রসরসিকতার অভাব ঘটে না। কেন যেন, দেবযানী নিজেকে অনেকটা হালকা অনুভব করল। বোধ হয় সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম কিছুটা স্বস্তি পাবার মতন লাগল।

মহীতোষ আসছে। তার গলা শোনা যাচ্ছিল।

নীলেন্দু বলল, দেবীদি, তোমাদের এখানে কাছাকাছি কোনও দোকানপত্তর বোধ হয় নেই?

 মাথা নাড়ল দেবযানী, বলল, রেলফটকের কাছে দিনের দিকে একটা ছোট্ট মুদির দোকান বসে।

মুদিতে হবে না। স্টেশনের দিকে যেতে হবে, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে। বলে নীলেন্দু তার প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে নিল।

মহীতোষ এসে পড়েছিল।

নীলেন্দু বলল, কোথায় গিয়েছিলে?

 কোথাও নয়, কাছেই; কথা বলছিলাম একজনের সঙ্গে, মহীতোষ বলল। তুই একেবারে সেজেগুজে বসে আছিস?

স্টেশনের দিকে যাব একবার, সিগারেট কিনে আনতে হবে, সেই সঙ্গে বেড়ানোও হয়ে যাবে। তা হলে বেরিয়ে পড়। খুব শীত পড়বে আজ। বাইরে যেরকম হাওয়া..।

দেবযানী কেরোসিনের স্টোভ জ্বেলে মহীতোষের চা গরম করে দিচ্ছিল। নীলেন্দু লক্ষ করল। এসব আগে কোনওদিন ভাবা যায়নিঃকত তুচ্ছ ব্যাপারে আগে দেবীদির প্রবল আপত্তি উঠত, ফুটোনো চায়ের রাসায়নিক পরিবর্তন যে মানবশরীরের কত ক্ষতিকর মহীদা তার সম্পর্কে লম্বা বক্তৃতা দিত। এখন কোনও পক্ষের আপত্তি নেই, নীলেন্দু লক্ষ করেও কিছু বলল না।

মহীতোষের চা পেয়ালায় ঢেলে দেবযানী দুধ চিনি মেশাল। বাস্তবিকপক্ষে এখন রান্নাঘরের মধ্যেটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। দেবযানীকে দেখা যায়, কিন্তু চোখমুখ চেনা যায় না, অন্ধকার তার মুখের গড়ন এবং রেখা একেবারেই অস্পষ্ট করে ফেলেছে।

হাত বাড়িয়ে চা নিল মহীতোষ।

নীলেন্দু বলল, মহীদা, আমি দেবীদিকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি।

মহীতোষ কিছু বলার আগেই দেবযানী বলল, আমায় আবার কোথায় টেনে নিয়ে যাবে?

 স্টেশন। চলো বেড়িয়ে আসবে।

আমায় কেন অযথা টানছ?

 তোমার এখন কোন কাজ? সন্ধে জ্বালাবে না শাঁখ বাজাবে? ঠাট্টা করে বলল নীলেন্দু।

দেবযানী পিড়ি থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, সন্ধে না জ্বালালেও বাতি জ্বালাতে হবে, অন্ধকার হয়ে গেছে।

বাতি জ্বালিয়ে নাও, তারপর যাব।

 মহীতোষ দেবযানীর দিকে তাকাল, বলল, যাও, ঘুরে এসো৷

.

শীতের হাওয়া এমন করে শিউরে দেবেনীলেন্দু বোঝেনি। ঝড় নয়, কিন্তু প্রায় ঝড়ের মতনই শনশন করে হাওয়া দিচ্ছিল শীতের। শুকনো, কনকনে হাওয়া। আজ কী তিথি বোঝা মুশকিল, আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না, অজস্র তারা আকাশের কোণে জড়ো করা। সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছিল। ছেলেবেলায় নীলেন্দুর বড়মামা তাকে সপ্তর্ষি, কালপুরুষ চিনতে শিখিয়েছিলেন, সে সব আর মনে নেই নীলেন্দুর। এখন অবশ্য নক্ষত্র অনুসন্ধানেও কোনও উৎসাহ ছিল না তার। শীতের বাতাস এবং চারপাশের কনকনে ঠাণ্ডা সহ্য করতেই শরীরের সমস্ত উদ্যম ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল।

পাশে দেবযানী। দেবযানী অতটা কাতর নয়। মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই পথ হাঁটছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় টর্চ নিয়েছে দেবযানী, হাতে টর্চ।

নীলেন্দু বলল, দেবীদি, এই যদি তোমাদের সন্ধেবেলার ঠাণ্ডা হয়, রাত্রে নিশ্চয় বরফ পড়বে।

দেবযানী হেসে বলল, তোমার ঘরে কাঠকয়লার আগুন দিয়ে দেব।

চিতা সাজিয়ে আমায় ঢুকিয়ে দিলেও আপত্তি নেই, নীলেন্দু হাসল।

দেবযানী বলল, এরপর তো আরও শীত পড়বে।

বলেছিলে তখন…। কী জানি তখন কী হবে?

মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠল নীলেন্দুরা; দুজনেই চুপচাপ। রাস্তার পাশে ঢালু মাঠ, কোথাও কোথাও গরিব গেরস্তির ছোট ছোট ক্ষেত, সবজি ফলানো হয়েছে। কিছুই এখন চোখে পড়ার উপায় নেই, কুয়াশার পুঞ্জ যেন অন্ধকারের সঙ্গে মেশান।

নীলেন্দুই শেষে কথা বলল। দেবীদি, তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলো কথা আছে। যদি বলো এইবেলা সেরে নিতে পারি।

দেবযানী দু মুহূর্ত নীরব থাকল, তারপর লঘু গলায় বলল, তোমার কথা কি এত অল্পে সারা হবে?

হবার কথা নয়, নীলেন্দু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, তবু শুরু করা যাক; গোড়ার কথাটা হয়ে যাক।

বলো।

নীলেন্দু গলার করকরে মাফলারটা আরও ঘন করে জড়িয়ে নিল। বলল, তুমি কলকাতা থেকে পালিয়ে আসার আগে আমায় ঘুণাক্ষরেও কিছু জানালে না কেন? ভয়ে?

দেবযানী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল। রাস্তার দিকে টর্চের আলো ফেলল একবার, নিভিয়ে দিল। শেষে বলল, তুমি যাকে পালিয়ে আসা বলছ আমি তাকে পালানো বলি না। আমরা চলে এসেছি। আমাদের কি নিজের খুশিমতন চলে আসার অধিকার নেই? তুমি আমায় নাবালিকা ভাবছ নাকি?

নীলেন্দু বলল, না, তোমায় আমি সেসব কিছু ভাবিনি। তুমি সাবালিকা; তোমার বয়েস বোধ হয় বছর বত্রিশ হল; আমার মাথায় মাথায় ছুটছ। খুকিপনার বয়েস তোমার নেই, যে অবস্থা ঘটলে মেয়েরা সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে পুরুষমানুষের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে সে অবস্থাও তোমার হয়নি। তুমি বয়সের দোষে বা টানে যে ঘর ছাড়নি তা আমি জানি, দেবীদি। তুমি মহীদাকে তোমার আঁচলের আড়ালে ঢেকে রাখার জন্যে পালিয়ে এসেছ।

দেবযানী বিরক্ত হল না, রাগ করল না, বলল, তোমার মহীদা কি আমার আঁচলের তলায় থাকার মানুষ! যদি তেমন স্বভাবের মানুষ হত ওতবে অনেক আগেই আমি ওকে ঢেকে নিতুম।

নীলেন্দু ঘাড় ফিরিয়ে দেবাযানীর দিকে তাকাল। বলল, মানুষ যখন হেরে যায় তখন নিজের লজ্জা বাঁচাবার জন্যে সে সুবিধেমতন কৈফিয়ত খাড়া করে। মহীদা যে তোমার প্রেমের টানে, তোমার খাতিরে পালিয়ে এসেছে–এই কথাটা বোধ হয় মহীদা আজ মনে মনে স্বীকার করবে। দোষ নিও না দেবীদি, আমি তোমার ভালবাসাকে তুচ্ছ করতে চাইছি না, ছোট করতেও নয়, আমি তোমার সব জানি। কিন্তু, একথা কি তোমার একবারও মনে হয় না, তোমার ভালবাসার দিকে মন একটু বেশিরকম ঝুঁকে না পড়লে মহীদা এরকম করত না?

দেবযানী বোধ হয় খুশি হল না। বলল, একটা লোক যদি মনে করে তোমাদের মধ্যে সে থাকতে পারছে না, তার কি তোমাদের ছেড়ে আসার অধিকার নেই?

একটু চুপ করে থেকে নীলেন্দু বলল, যদি নীতির দিক থেকে ধরো তা হলে আমরা বলব, নেই। এখানে আমরা বলতে আমাদের সমষ্টিগত নীতি বুঝবে। ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য আমি অধিকার মানি। না মানলে, বন্ধুর মতন তোমাদের কাছে আসতাম না।

অনেকক্ষণ আর কোনও কথা হল না। পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে লাগল। নীলেন্দুর পায়ে শব্দ হচ্ছিল না, ক্যানভাসের মোটা বুট রাস্তার শব্দ ঢেকে দিচ্ছিল। দেবযানীর পায়ে খুব মৃদু শব্দ হচ্ছিল। দুজনের দীর্ঘতায় কিছুটা তফাত রয়েছে, ছায়ার মতন পাশাপাশি চলে যাচ্ছে তারা। দেবযানী সাধারণ মেয়ের তুলনায় সামান্য দীর্ঘ, গায়ের শাল মাথায় তুলে জড়িয়েছেফলে নীলেন্দুর মাথা ছুঁয়ে ফেলার মতন দেখাচ্ছিল। সামান্য দুরে রেলফটক। একটা লাল বাতি জ্বলছিল জ্বলজ্বল করে।

নীলেন্দুই আবার বলল, তুমি যে আমাদের বিশ্বাস করোনি, পছন্দ করোনি–এটা তো নতুন কথা নয়, দেবীদি। সকলেই সেটা জানে। তোমার অপছন্দ অবিশ্বাস সত্ত্বেও মহীদা আমাদের মধ্যে ছিল। যতদিন ছিল ততদিন তোমায় নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি। যখন আর মহীদা থাকল না–তখন বেশ বুঝতে পারলাম, তুমি তাকে আস্তে আস্তে দুর্বল করে দিয়েছ। এই দুর্বলতা মুখ ফুটে স্বীকার করা লজ্জার। কিংবা স্বীকার করলেও সেটা মুখের কথা হবে তার বেশি কিছু নয়। মোদ্দা কথাটা এই, মহীদা তোমার টানে আমাদের ছেড়েছে; তুমি তোমার ভালবাসার মানুষটিকে নিরাপদে এবং নির্ঞ্ঝাট রাখার জন্যে আমাদের সংস্রব ছেড়ে পালিয়ে এসেছ। ভয়ে। এটা পালানো ছাড়া আর কী।

দেবযানী হাতের টর্চটা জ্বেলে ফেলল। বোধ হয় অস্থিরতার জন্যে রাস্তায় আলো ফেলল, পাশের মাঠে ফেলল, শূন্যের চারিদিকে ঘোরাল, তারপর নিবিয়ে দিল।

যদি তাই হয়, তাতে ক্ষতি কী? দেবাযানী এবার শক্ত গলায় বলল।

ক্ষতি কী, তা তোমায় চট করে বোঝাতে পারব না। আগেও অনেকবার এ নিয়ে তোমার-আমার মধ্যে বচসা হয়েছে। ও কথাটা এখন থাক; আপাতত ধরে নাও, যেজন্যে তুমি পালিয়ে এসেছ, যদি সেটা না হয়।

দেবযানী যেন ভাল বুঝল না, নীলেন্দুর দিকে তাকাল। মানে?

 মানে–মহীদাকে তুমি এখানে টেনে এনে যতটা নিরাপদ করতে চেয়েছ ততটা নিরাপদ সে নয়।

তুমি যে আমায় এই কথাটা বোঝাতে এসেছ, এ আমি আগেই সন্দেহ করেছি।

কী যেন ভাবল নীলেন্দু, তারপর আচমকা বলল, ঠিকই করেছ… তুমি কি আমার ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়েছিল?

না। কেন? দেবযানী অবাক হয়ে গেল।

আমার প্যান্টের, যেটা গাড়িতে পরে এসেছিলাম, তার ভেতর দিকে চোরা পকেটে হাত দিয়েছ?

 না, দেবযানী কেমন ভয়ের গলায় বলল।

নীলেন্দু বলল, যদি দিয়ে থাকো তবে আগেই জেনেছ। যদি না দিয়ে থাকো তবে তোমার কাছে বলতে আপত্তি নেই, বিশ্রী, একটা জিনিস আমি কলকাতা থেকে বয়ে এনেছি। সেটা তোমার মহীতোষকে মোটেই নিরাপদে রাখার উপযুক্ত নয়।

দেবযানী ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখবার চেষ্টা করল নীলেন্দুকে। ভয় এবং বিমূঢ়তা তার দৃষ্টিকে যতটা আচ্ছন্ন করেছে প্রায় ততটাই অস্পষ্ট করেছে এই অন্ধকার নীলেন্দুর চোখ-মুখ। কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, নীলেন্দু হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি এই অবস্থায় দেবযানীর মুখ কতটা ভয়ার্ত, রক্তশূন্য হয়েছে দেখবার চেষ্টা করছে।

নিজের শিউরে ওঠার ভাবটা অনুভব করতে পারল দেবযানী। বুক কাঁপছে কি কাঁপছে না খেয়াল হল না। নীলেন্দুর নীচের ঠোঁট পুরু, ওপর এবংনীচের ঠোঁট খোলা রয়েছে, সামনের দাঁতের সাদা অংশ সামান্য যেন দেখা যাচ্ছিল। দেবযানীর মনে হল, এই ভয় এই আতঙ্ক তাকে সারাদিন অস্থির করে রেখেছিল, স্বস্তি দিচ্ছিল না যদিও তবু শেষ পর্যন্ত সে নীলেন্দুকে বিশ্বাস করতে চাইছিল। মহীতোষ তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেছিল: তুমি ভাবছ কেন, নীলু নিজের ইচ্ছেয় এসেছে, নিজের মরজিতে। কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নেবার মতন মনের অবস্থা দেবযানীর নয়, তবু সারাদিন নানারকম ভাবতে ভাবতে, নীলেন্দুকে লক্ষ করে তার ধারণা হচ্ছিল, হতেও পারে কোনও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নিয়ে নীলেন্দু আসেনি।

এখন দেবযানীর আর কোনও সন্দেহ রইল না, নীলেন্দু পাকাপাকি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। তার প্রবল ভয় হচ্ছিল।

নীলেন্দু দেবযানীর আতঙ্ক অনুভব করতে করতে বলল, তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছ দেবীদি।

দেবযানী কিছু বলল না। আর সহসা অনুভব করল, তার বুক ধকধক করছে, দ্রুত ঘা পড়ছে হৃৎপিণ্ডে। কেমন এক ধরনের রাগ, আক্রোশ, ঘৃণা তাকে জ্ঞানহীন করে তুলেছে।

তুমি তোমার মহীদাকে মিথ্যে কথা বলেছ? রুক্ষ কর্কশ গলায় দেবাযানী বলল।

নীলেন্দু বেশ শান্ত ভাবে বলল, তা বলে থাকতে পারি। বলার পর নীলেন্দু নিজেরই মনে হল, এ একেবারে থিয়েটারের ব্যাপার হচ্ছে। বড় নাটকীয়। এবং ছেলেমানুষি। হঠাৎ সে হেসে উঠল। হাসিটা তেমন জোর নয়, কিন্তু সহজ।

দেবযানীর পিঠে হাত রাখল নীলেন্দু, দু-চারবার আলতো করে চাপ দিল। তারপর পিঠের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দেবযানীর হাত ধরে ফেলল আচমকা।

দেবযানীর হাত ঠাণ্ডা কনকন করছিল। নীলেন্দুরও হাত গরম নয়।

নীলেন্দু বলল, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম, দেবীদি। দেখছিলাম, আমার সম্পর্কে তোমার মনোভাবের কোনও অদলবদল হল কিনা। পুরো একটা বেলা তো কাটল। …যাকগে, তোমায় সত্যি কথাটা বলি। আমি তোমার মন দেখছিলাম। আমার কাছে ভয় পাবার মতন কিছু নেই। তুমি আমার সমস্ত কিছু তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কিছু পাবে না।

দেবযানী কথা বলল না, বড় নাগরদোলার চূড়ায় উঠেনীচে নেমে আসার মতন তার উত্তেজনা ক্রমশ কমে আসছিল।

নীলেন্দু দেবযানীর দু হাত আরও চেপে ধরে বলল, দেবীদি, তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারছ না?

দেবযানী নীলের হাতের চাপ অনুভব করতে করতে বড় করে নিশ্বাস ফেলল।

.

০৪.

বাড়ি ফিরে দেবযানী দেখল, মহীতোষ নিজের ঘরে বসে কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে। ঘরের জানলা বন্ধ। এত ঠাণ্ডার মধ্যে কোনও কিছু খুলে রাখার উপায় নেই। শীতের এই সময়টায় মশাও হয় বেশ। ঘরের বাতাসে মশামারা সেই ধূপের গন্ধও রয়েছে। কাঠের ছোট টেবিলের সামনে ঝুঁকে বসে কেরাসিনের টেবিল বাতির আলোয় মহীতোষ মন দিয়ে কাজ করছিল।

দেবযানী মহীতোষের পিঠের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। কিছু বলবে মহীতোষ, কোনও রকম সাড়া দেবে যেন এই অপেক্ষায় দেবযানী দাঁড়িয়ে থাকল।

কিছু বলছিল না মহীতোষ, হাতের কাজ শেষ করে নিচ্ছিল।

দেবযানী কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। সামান্য সরে গিয়ে উঁচু টুলটার ওপর বসল। বসে অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারিদিকে তাকাতে লাগল।

মহীতোষের এই ঘরে নতুন করে দেখার কিছু নেই, অন্তত দেবযানী লক্ষ করতে পারে এমন কিছুই নয়। সাধারণ ছোট তক্তপোশ একপাশে, বিছানা পাতা, মোটা একটা সুজনি দিয়ে ঢাকা; সস্তা আলনা, দেওয়াল তাকের ওপর দু-চারটে খুচরো জিনিস, ছোট আয়না চিরুনি, এক শিশি মলম, শুকনো হরীতকী কয়েকটা, দু-চারটে বই, কিছু পুরনো কাগজপত্র। একটা বাক্স একপাশে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে রাখা।

দেবযানী হঠাৎ যেন কেমন বিরক্তি বোধ করল। কেন করল সে জানে না। হয়তো এই বাড়াবাড়ি ধরনের অনাড়ম্বর গৃহসজ্জাই তাকে বিরক্ত করল; বা মহীতোষ কোনও কথাবার্তা বলছে না বলেই সে বিরক্ত হচ্ছিল।

দেবযানী নিজেই কথা বলল। তোমার ঘরে আগুন লাগবে?

 মহীতোষ মুখ না তুলেই বলল, কটা বাজল বলো তো?

সাড়ে সাতটাত হবে, দেবযানী মোটামুটি অনুমান করে বলল। বাড়ি ফেরার সময় কলকাতা থেকে আসা এক্সপ্রেস গাড়িটা চলে যেতে দেখেছে সে; ট্রেনের সময় হিসেব করে দেখলে এখন ওই রকম সোয়া সাত কি সাড়ে সাত হবে।

মহীতোষ বলল, নীলুকে দাও। এখানকার এই ঠাণ্ডা ওকে জমিয়ে ফেলবে।

দেবযানী অসন্তুষ্ট গলায় বলল, নীলুর জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। বাইরে খুব ঠাণ্ডা। ঘরের ভেতরও কনকন করছে। আগুন লাগবে কিনা বলো?

মহীতোষ ঘাড় উঠিয়ে দেবযানীর দিকে তাকাল। টুলের ওপর কাছাকাছি দেবযানী বসে। তবু এই টেবিল বাতির মিটমিটে আলোর অত উজ্জ্বলতা নেই যে দেবযানীর মুখ স্পষ্ট করে দেখা যাবে। লক্ষ করতে করতে মহীতোষ বলল, এখন লাগবে না; পরে যদি দরকার হয় বলব।

দেবযানী কথা বলল না। আজ কিছুদিন ধরে বাড়াবাড়ি ধরনের ঠাণ্ডা পড়ে যাওয়ায় রাত্রের দিকটায় মাটির মালসায় কাঠকয়লার আগুন এনে ঘরে রাখতে হচ্ছে প্রায়ই। দেবাযানী এসব জানত না; তার জানার কথাও নয়; লাটু শিখিয়ে দিয়েছে, জামকাঠের ডালপালা পুড়িয়ে কাঠকয়লাও করে দিয়েছে এক ঝুড়ি।

মহীতোষ বলল, নীলু কোথায়?

ঘরে।

তোমরা স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলে, না আর কোথাও বেড়ালে?

স্টেশন থেকে ফিরে এসেছি।

ভালই করেছ, মহীতোষ আবার টেবিলের ওপর মাথা নোয়ালোলা। এখানে ঠাণ্ডায় বেশি ঘোরাঘুরি নীলুর সহ্য হবে না; ও তো আবার প্লুরিসিতে ভুগেছে।

দেবযানী চুপ করে থাকল। নীলেন্দুর প্লুরিসিতে ভোগার ইতিহাস ওর অজানা নয়। বছর দুয়েক আগে বর্ষার শেষ দিকে, পুজোর পর পর নীলেন্দু অসুখটা বাধিয়ে তুলেছিল, ভুগেছিল বেশ কিছুদিন, শরীর ভেঙে গিয়েছিল, মাস দুই ঘরের বিছানায় পড়েছিল। সেই ভাঙা শরীর সারাতে কম সময় যায়নি। এখন নীলেন্দুকে দেখলে তার অসুখের কথা মনে পড়ে না। দেবযানীরও মনে হয়নি। মহীতোষের কথায় মনে পড়ল।

ওকে বরং আগুন দিয়ে এসো, মহীতোষ বলল, সাবধানে থাকতে বলল, বাহাদুরি করলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। …কী করছে নীলু?

ঘরে।

কিছু দিয়েছ ওকে? গরম কিছু দাও খেতে।

দেবযানী বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি আমায় মেয়েলি ব্যাপার শিখিও না। তোমার নীলুকে যা দেবার আমি দেব। তোমার নিজের আগুন লাগবে কিনা বলো? চা খাবে, না খাবে না?

আগুন লাগবে না। নীলুর জন্যে চা করলে একটু দিতে পারো।

দেবযানী আর কিছু বলল না। সামান্যক্ষণ বসে থাকল। বসে বসে মহীতোষকে দেখতে লাগল। মহীতোষ কোনওকালেই তেমন সুপুরুষ ছিল না যে চোখ তুলে দেখলে আর পলক পড়বে না। তার গায়ের রং উজ্জ্বল হলেও তেমন কিছু গৌরকান্তি নয়, মাঝারি রকমের ফরসা বড় জোর। মাথায় সাধারণত লম্বা, পুরুষমানুষের পক্ষে যতটা না হলেই নয়, দেবযানীর চেয়ে কয়েক আঙুল মাত্র দীর্ঘ মাথায়। প্রচণ্ড স্বাস্থ্য নয় মহীতোষের, বরং ছিপছিপে গড়ন। মুখ খানিকটা তেকোনা ধরনের–অর্থাৎ গালের চোয়াল পাতলা, থুতনি সরু; মোটামুটি লম্বাটে কপালের তলায় গাল এবং থুতনির এই গড়ন খানিকটা তেকোনা দেখাবারই কথা। মহীতোষের ঘন, জোড়া ভুরুর তলায় মোলায়েম শান্ত চোখ তার স্বভাবের নরম দিকটা যেন প্রকাশ করে ফেলে। এই চোখ নরম, শান্ত, কিন্তু কেমন যেন দ্বিধাপূর্ণ। কখনও কখনও উদাসীন মনে হয়। আবার এই চোখে দেবাযানী একসময়ে যে উত্তেজনা ও আবেগ দেখেছে তাও যেন ভুলে যাবার কথা নয়। মহীতোষের শক্ত সরু নাক, তার ঝকঝকে দাঁত, পাতলা বাঁকানো ঠেটি–মানুষটার কোনও শক্তি এবং জেদের আভাসও যেন দেয়।

টুল থেকে উঠে পড়ল দেবযানী। হাতে কাজ রয়েছে।

নিজের ঘরে এসে দেবযানী লণ্ঠনের আলো বাড়িয়ে নিল। তার ঘরের সঙ্গে মহীতোষের ঘরের তেমন কোনও প্রভেদ নেই। আকারের দিক থেকে সামান্য ইতরবিশেষ হলেও সেই বড় বড় জানলা গোটা দুই, মাথার ওপর চটের সিলিং, দেওয়ালের কোথাও কোথাও পাতলা ছোপ ধরেছে। আসবাবপত্র হয়তো এ ঘরে সামান্য বেশি। খাটটা সামান্য সুদৃশ্য, ছোট মাপের একটা আলমারি আছে কাঠের, দেওয়ালের একদিকে বড় আয়না ঝোলানো, তার তলায় সরু ব্র্যাকেট; গদিমোড়া একটা ইজিচেয়ারও রয়েছে কোণ ঘেঁষে। আরও কিছু খুচরো, ছোটখাটো আসবাবপত্র। বাড়িটা কেনার সময় এই আসবাবপত্রও কিনে নিতে হয়েছিল। প্রয়োজন তো ছিলই। আর কিছু কিছু আশিস জোগাড় করে এনেছে।

গায়ের শাল খুলে রেখে দেবযানী শাড়িটা পালটে নিল। এক সময়ে তার নানা ধরনের শখের মধ্যে ছিল শাড়ির শখ। সিল্ক সে পছন্দ করত বরাবর, ভালবাসত, বিশেষ করে একরঙা বা হালকা করে ছাপা সিল্কের শাড়ি। তাঁতের মধ্যে ধনেখালি তার ভাল লাগত।

এখনও কলকাতার বাড়িতে দেবযানীর ঘরের আলমারি খুললে একরাশ আলমারি ভরতি শাড়ি পাওয়া যাবে। দু-এক বছরের জমানো নয়, আরও বেশিদিনের। কত রকম জায়গা থেকে কিনেছিল, কোনওটা কলেজ স্ট্রিট থেকে, কোনওটা মার্কেট থেকে, কোনওটা বা গড়িয়াহাট থেকে। সেসব আজও আছে! থাকা উচিত। অবশ্য দেবযানী জানেনা, তার ঘর আজও ফাঁকা পড়ে আছে কিনা কিংবা অন্য কারও দখলে চলে গেছে। দখল করলে ছোটবউদিই করতে পারে। ছোটবউদি বরাবরই, বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে পর্যন্ত তার ঘরের দিকে চোখ দিত। দিত–কেননা ছোড়দার বিয়ের পর তেতলার যেদিকটা তাকে ছেড়ে দেওয়া হল–সেদিকে পুব-দক্ষিণ বন্ধ; উত্তর দিকে একটা বার্লির কারখানা। পশ্চিম দিকে চোখ মেলে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। আর পশ্চিমে সেই খাল, দু-চারটে গাছ, একটানা বস্তি ছাড়া কিছু নেই। দেবযানীর ঘরটা পেলে ছোটবউদি সকালের দিকে পুবের রোদ পাবে, বারান্দায় বসলে অন্তত বার্লি কালখানার দিকে না তাকিয়ে থাকা যাবে। তা ছাড়া, কোনও কোনও মানুষ, নতুন হলেও, কোথাও আসা মাত্র তার দাবিটা জানাতে লজ্জা পায় না। ছোটবউদি সেই রকম। শ্বশুরবাড়িতে এসেই জানিয়ে রেখেছে দেবযানীর বিয়ে হয়ে গেলে ঘরটা তারই প্রাপ্য।

শাড়ি বদলে দেবযানী বাড়িতে পরার ছোট, করকরে শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল। শাড়িটা সাধারণ। সাদা খোলের। পাড়ও মামুলি। কলকাতার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় দেবযানী কিছুই নেয়নি, তার সুটকেসে গয়না ছাড়া দু-চারখানা শাড়ি জামা ছিল যা নিতান্ত সব সময়ে প্রয়োজন হবে বলে সে নিয়েছিল। আজকাল যা পরেটরে তার কোনওটাই সেই শাড়ি-টাড়ি নয়। বাড়ি থেকে কিছু আনতে দেবযানীর ইচ্ছে হয়নি, সুযোগও ছিল না। গয়না আর নেহাত যা দরকারে লাগবে, দু-চারটে শাড়ি জামা ছাড়া বাবার একটা ছোট ফটো এনেছিল ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটা তার ঘরের দেওয়ালে সে ঝুলিয়ে রেখেছে।

অন্যমনস্কভাবে দেবযানী বাইরে এল। ভেতর বারান্দা অন্ধকার। অন্ধকার দিয়েই কলঘরের দিকে চলে গেল। যাবার সময় দেখল, রান্নাঘরের দরজা আধাআধি খোেলা! লাটু উনুন ধরিয়ে রেখে গেছে যাবার সময়।

হাতে পায়ে জল দিয়ে মুখের ঠাণ্ডা ভাবটা মুছতে মুছতে দেবযানী রান্নাঘরে এল। কুয়ার তোলা জল হাতে পায়ে দেবার পর শীত ধরে গেছে। সামান্য কাঁপুনি লাগছিল। ছোট লণ্ঠন জ্বেলে নিল দেবযানী। লাটু ভোলা উনুন ধরিয়ে কাঠকয়লা ছড়িয়ে রেখেছে। কয়লাগুলো প্রায় সবই জ্বলে উঠেছে।

হাত দুটো সামান্য সেঁকে নিল দেবযানী। লাটুর গুণের শেষ নেই। সে যেন জানে কোন কাজটা তার সেরে রাখা দরকার। লাটুকে এই বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিল দেবযানী; লাটু রাজি হয়নি, বাড়িতে তার বুড়ো বাপ আর হাবাগোবা এক ভাই। লাটু সাত-সকালে এ বাড়িতে আসে, সন্ধে নাগাদ চলে যায়। বাসন-কোসন মাজা আর ঘরদোর পরিষ্কার ছাড়া বাকি সবটাই লাটুর হাতে, লাটু বাজারহাট করে, বাগান দেখে, জল তোলে, দেবযানীকে খুঁটিনাটি কাজে সাহায্য করে। সকালে এ বাড়িতে খায়, রাতে নিজের বাড়িতে।

মালসা টেনে নিয়ে দেবযানী কাঠকয়লার আগুন সাজাল চিমটে দিয়ে, কয়েক টুকরো নতুন কয়লাও। দিয়ে দিল।

মালসা দুটো চৌকাঠের বাইরে সরিয়ে রেখে দেবযানী চায়ের জল বসাল। একটু পরে দিয়ে আসবে, সামান্য আঁচ উঠে যাক।

নীলেন্দুর জন্যে আজ উনুন ধরানো। রাত্রের দিকে উনুন ধরানোর প্রয়োজন বড় একটা করে না। শীতের দিন, সকালে করা রান্নাবান্না রাত্রে স্টোভ ধরিয়ে গরম করে নিলেই চলে, এমনকী গরম তাওয়ায় সকালের রুটি সামান্য ঘি মাখিয়ে নেড়েচেড়ে নিলেও নরম হয়ে যায়।

হাতের কাছে তরকারির ঝুড়িতে কড়াইশুটি ছিল। টাটকা কড়াই। দেবযানী একটা কাচের বাটিতে কড়াইশুটি ছাড়িয়ে রাখতে লাগল। নীলেন্দুকে এখন খেতে দেবার মতন কিছু নেই, কড়াইশুটি সেদ্ধ বসিয়ে তাতে দু টুকরো আলু আর টমাটো দিয়ে দেবে। খেতে ঘুগনির মতন, অথচ কতটুকুই বা সময় লাগবে।

তার এই গৃহিণীপনা দেখলে নীলেন্দু হেসে বলবে, দেবীদি, তুমি তো কিছুই বাকি রাখলে না, আদর্শ বঙ্গবন্ধু।

কোনও সন্দেহ নেই, দেবযানী আজ ছ-সাত মাসে অনেক কিছু শিখেছে। তার মানে এই নয় যে, আগে তার কিছু জানা ছিল না। যে ধরনের পরিবারে জন্মালে–এমন বাঙালি পরিবার আছে কিনা দেবযানীর অবশ্য জানা নেই–মেয়েদের কুটো কাটবারও দরকার হয় না, বা সে শিক্ষা তারা পায় না– দেবযানী তেমন পরিবারে জন্মায়নি। তাদের বড় পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা ছিল গৃহস্থ ধরনের। মা যতদিন বেঁচে ছিল, ঠাকুর-চাকরের হাতে সংসার ছেড়ে দেয়নি। ঠাকুর-চাকর ছিল, তাদের মাথার ওপর ছিল মা। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নজরে রাখত। নিজের হাতে সকাল বিকেল তদারক করত সব। বড়দার বিয়ের পর বড়বউদিকেও মা সংসারের এই সাধারণ ব্যাপারটার বাইরে থাকতে দেয়নি। হেঁশেলে জুতে দিয়ে বড়বউদিকে যে মা জব্দ করেছিল তাও নয়। ঘরের বউ-মেয়ে কোনও কিছু জানবে না, শিখবে না, পাঁচভূতের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পা তুলে শুয়ে থাকবেমা মোটেই তা বরদাস্ত করত না। অর্থাৎ মার পুরো শিক্ষাটাই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বউদের যেমন হওয়া উচিত সেই রকম। ঘরের মধ্যে ছন্নছাড়া ভাব দু চোখের বিষ ছিল মার। মেজবউদিকেও মা একই ছাঁচে তৈরি করেছিল। অবশ্য বউবউদি কিংবা মেজবউদি–কেউই এমন পরিবার থেকে আসেনি যাতে মেয়েলি এই সব শিক্ষা তাদের থাকবার কথা নয়। বউদিরা মার সাংসারিক শিক্ষায় নতুন কিছু দেখেনি, অখুশিও হয়নি। মা মারা গেল মেজদার বিয়ের পরের বছর। তখন ঠিক শীতকাল নয়, কার্তিকের শেষ, একটু একটু ঠাণ্ডা পড়ছে; মা সকালের বাসি কাপড় ছেড়ে ঠাকুরঘর থেকে ফিরে সবে শ্বেতপাথরের কাপে রাখা চায়ে মুখ দিয়েছে, শরীরটা কেমন আনচান করে উঠল। বার কয়েক কাশল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বাকি চাটুকু খেয়ে, সবজির ঝুড়ি টেনে বসল; বড়দা মেজদার অফিস, তরকারি কুটে দেবে। বড়বউদি মার পান সেজে আনল। আর সেই সময়, সবে বঁটির গলায় আলু ছুঁইয়েছে, মা কেমন ছটফট করে উঠেই বউদিকে কিছু বলতে গেল, পারল না, মেঝের ওপর টলে পড়ে গেল। মার ভারী শরীর দুহাতে জড়িয়ে বউদি চেঁচাতে লাগল; বাড়িতে হইচই ছুটোছুটি, ডাক্তার এল পাড়ার, হাসপাতালে নিয়ে চলো এখনি। হাসপাতালে বিকেলের দিকে মা মারা গেল। সেরিব্রাল হেমারেজ।

বাবা মারা গিয়েছিল তারও আগে। দেবযানীর বয়েস যখন বছর তেরো। মা মারা গেল–তার একুশ বছর বয়েসে। বাবাকে দেবযানী যত বেশি করে পেয়েছিল, মাকে বোধহয় ততটা নয়। মার স্বভাবে শৃঙ্খলা ছিল বেশি রকম, শাসন ছিল চাপা, বাস্তব বোধ ছিল প্রখর। বাবার স্বভাবে এসব ছিল না বড়, বরং চরিত্রের দিক থেকে বাবা বোধ হয় মার উলটো প্রকৃতির ছিল। সংসারে যারা পুরোপুরি ডুবে থাকতে পারে না, ভালও বাসে না বাবার স্বভাব ছিল তাদের মতন। বাবা স্বভাবে এলোমেলো ছিল, অনেক ব্যাপারে উদাসীন, সরলহৃদয় মানুষ। মার সাংসারিক দূরদৃষ্টি, বাস্তব জ্ঞানের পাশে বাবাকে মানাবার কথা নয়। কিন্তু মার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে বাবা নিঝঞ্ঝাটে এবং শান্তিতে জীবন কাটিয়ে গিয়েছে। তাদের কলকাতার বাড়ি–সেও মার সম্পত্তি। দাদামশাই-দিদিমার জীবিত সন্তান বলতে মা ছাড়া কেউ ছিল না, কাজেই মা বাবার যা-কিছু মেয়ে পেয়েছিল। এ ব্যাপারে বাবার যদি বা মনে একটা অস্বস্তির ভাব থেকেও থাকে তা স্পষ্ট বোঝা যেত না। মাঝে মাঝে মা বাবার হাসি-তামাশার মধ্যে বাবার সঙ্কোচটা বোঝা যেত। কিন্তু তাও এমন কিছু নয় যে মনে করে রাখা যায়।

ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেবযানী সবচেয়ে ছোট বলে এবং একটি মাত্র মেয়ে বলে বাবার প্রশ্রয় সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। মার প্রশ্রয়ও কম নয়। কে জানে, মেয়েকে এতটা আদর-সোহাগ দেবার জন্যেই দেবযানী সংসারের অন্যদের চেয়ে খানিকটা আলাদা রকম হয়ে উঠল কি না!

চায়ের জল গরম হয়ে গিয়েছিল। কেটলি নামিয়ে রাখল দেবযানী। চায়ের জল আগে ফুটিয়ে নিয়ে ভুলই করল সে, আবার হয়তো জল গরম করতে হবে। হাতের কাছেই সসপ্যান ছিল–কী মনে করে দেবযানী চায়ের জল সসপ্যানে ঢেলে দিয়ে কড়াইশুটির দানাগুলো ঢেলে দিল; দিয়ে উনুনের ওপর সসপ্যান চাপিয়ে দিল। কটা আলুর টুকরো আর টমাটো দেবে গোটা দুই। পরে দিলেই চলবে।

মালসাগুলো ঘরে দিয়ে আসার জন্যে দেবযানী উঠে পড়ল।

.

রান্নাঘরে ফিরে এল দেবাযানী একটু পরেই।

নিজের কথা ভাবতে বসলে দেবযানী নিজেই অবাক হয়ে যায়, কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল সে নিজেও ভাল বুঝল না। ছেলেবেলায় যে মেয়ে মার বুক না খুঁটে ঘুমোতে পারত না, বাবার হাতে জুতো মোজা পরত, দিদিমার চোখের মণি ছিল–সে কি এই দেবযানী? লোকে জীবনের সঙ্গে নদীর তুলনা দেয়। এটা সহজ তুলনা। কিন্তু একেবারে যে বেমানান তাও নয়। নদীর কোনও সোজাসুজি সরাসরি পথ থাকে না, তার কোনও ধরাবাঁধা নেই, কোন পথ দিয়ে কোন বাঁক খেয়ে, কোথায় বাধা পেয়ে কেমন করে সে তার প্রবাহ বয়ে নিয়ে চলে আসে–বোঝা যায় না।

দেবযানী যে সংসারে জন্মেছিল তাতে তার জীবনের মোটামুটি একটা ধরাবাঁধা পথ থাকা উচিত ছিল; কিন্তু তাই কি থাকল? মনে তো হয় না। যদি থাকত তবে এই বয়েসে দেবযানীর কলকাতার কোনও বড় পরিবারের বউ হয়ে গোটা দুই ছেলেমেয়ে মানুষ করার কিংবা, বরের পাশে শুয়ে শুয়ে ঘরসংসারের গল্প করারই কথা ছিল। সেটা মানাত। কিন্তু এখন যা করছে দেবযানী এটা তাকে মানাচ্ছে না।

বাবা যখন মারা গেল তখন দেবযানী কিশোরী, বছর তেরো-চোদ্দ বয়েস। তার শরীর তখন বয়েস হিসেবে অতটা বাড়ন্ত হয়নি, একটু রোগা রোগা ছিল, মাথায় লম্বা দেখাত। বাবা তাকে শাড়ি ধরাতে দেয়নি। মা বাড়িতে মাঝে মাঝে শাড়ি পরাত। সাদা স্কার্ট ফ্রকের ওপর নীল রঙের হাতকাটা জোব্বা চাপিয়ে স্কুলে যেত দেবযানী, তার হাঁটা-চলার মধ্যে নাকি অহমিকা থাকত। লোকে বলত, তার চোখ নাকি রাস্তার কোনও দিকে পড়ত নানাকের সিধে সে তাকিয়ে থাকত। কেন বলত দেবযানী জানে না।

বাবা মারা যাবার পর সংসারে একটা ধাক্কা লেগেছিল। তবে সে ধাক্কা সামলে নিতে অন্যদের তেমন দেরি হয়নি, শুধু মা আর দেবাযানীর অনেকটা সময় লাগল। বিশেষ করে দেবযানীর। বাবার বুকের তলায় তার যে আশ্রয় ছিল তেমন আর কোথায় পাবে। আসলে বাবা বেঁচে থাকতে দেবযানী যা যা করার স্বাধীনতা পেত বাবা মারা যাওয়ার পর সেই স্বাধীনতা যেন খর্ব হতে লাগল। মা মেয়েকে অতটা মাথায় চড়তে দিতে চাইত না।

বড়দার বিয়ের বছর দেবযানী স্কুলের পড়া শেষ করে। বড়বউদি মানুষ খারাপ ছিল না কিন্তু এমন এক বাড়ি থেকে এসেছিল যেখানে মেয়েরা স্বামী, সত্যনারায়ণ আর সন্তান ছাড়া আর কিছু বোঝে না। দেবযানীকে খুব কিছু ভাল চোখে দেখত না বড়বউদি। তার চালচলনকে অপছন্দ করত।

মেজদা আর বড়দার মধ্যে বয়সের তফাত বছর তিনেকের। মেজদার চেহারা রাজপুত্রের মতন প্রায়, যেমন লম্বাচওড়া তেমনই মুখ হাত-পার গড়ন। কথায়বার্তায় ঝকঝকে। চেহারা আর গুণের জন্যে তার অফিসে টপাটপ প্রমোশন পেয়ে অফিসার হয়ে গেল। মা মেজদার বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মার মনে মনে ইচ্ছে ছিল, যদি সম্ভব হয় মেজ ছেলে আর মেয়ের বিয়ে একই সাথে মিটিয়ে দেবে। দেবাযানী তখন কলেজে পড়ছে। মেয়ের সম্বন্ধ যা আসত মার তা পছন্দ হত না। একটা ভাল সম্বন্ধ পেয়েছিল, কিন্তু ছেলেরা এলাহাবাদে থাকে, ছেলের বাবা নাকি জজ; মা সে সম্বন্ধ বাতিল করে দিল, কেননা দুরে মেয়ে পাঠাবে না মা। মেজদার পাত্রীই বরং আগেভাগে পছন্দ হয়ে গেল মার। কলকাতার বনেদি বাড়ির মেয়ে, লেখাপড়া জানা, দেখতে সুন্দর। মেজদার বিয়ে হয়ে গেল।

মেজবউদি শ্বশুরবাড়িতে এসে কিছুদিন সব নজর করল। ভীষণ চালাক। ওপর থেকে তার মতন মিষ্টি মানুষ আর হয় না, শাশুড়িকে গলিয়ে ফেলল। বড়বউদি বোকা, মায়ের সঙ্গে যে তার বনিবনা হচ্ছে না–এটা প্রকাশ করে ফেলতে লাগল প্রকাশ্যে। মা যেন তাতে অসন্তুষ্টই হল।

এই সময়ে মা মারা গেল। সংসারে যখন ওপর ওপর সব ঠিক থাকলেও ভেতরে ভাঙন শুরু হয়েছে–ঠিক তখন।

মা মারা যাবার পর সংসারের চেহারা দেখতে দেখতে পালটে গেল। বোধ হয় বড় বড় পরিবারের এই রকমই হয়; যতক্ষণ মাথার ওপর কেউ থাকে যে রাশ টেনে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে ততক্ষণ সকলেই কাছাকাছি পাশাপাশি যেন একই রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে; যে-মুহূর্তে সেই লোক সরে গেল ঘোড়ারা যে যার মতন ছিটকে চলে গেল। মা যে বাঁধন দিয়ে রেখেছিল তাতে সংসার ছিল বাঁধা, মা মারা যাবার পর ছড়িয়ে পড়ল, ছত্রাকার হয়ে গেল।

বড়দার হয়তো ধারণা ছিল, মা মারা যাবার পর সে হবে বাড়ির মাথা। বড়বউদি সংসারের একটা উঁচু আসনের আশা করত। সে সব আর হল না। বড়দা আর মেজদা, বড়বউদি আর মেজবউদিতে লেগে গেল। দুই ভাই আর তাদের বউয়ের রেষারেষি ইতরামি এমন জায়গায় নেমে গেল যে বাড়ির বাচ্চাকাচ্চারা পর্যন্ত কাকা জ্যেঠার ঘর মাড়াতে ভয় পেত। বড়দাকে কোনও ব্যাপারেই স্বাধীন ভাবে সংসারের কিছু করতে দেওয়া হত না। এমনকী কর্পোরেশনের চিঠির জবাব পর্যন্ত তার একার দেবার অধিকার ছিল না।

সংসারটা একটা হোটেলখানা হয়ে উঠল, যে যার মতন থাকে। যার যা খুশি করে, এজমালি রান্নাঘর থেকে দু বেলার খাবার আসে মোটামুটি, বাকিটা যে যার নিজের ঘরে কিংবা বাইরে সেরে আসে। অসুখ-বিসুখে নিজের পছন্দমতন ডাক্তার আসে ঘরে। ওষুধ চলে। কেউ কারও খবর নেয় না, বা নিলেও সেটা মুখের খবর।

দাদাদের মধ্যে দেবযানীর সবচেয়ে কাছের লোক ছিল ছোড়দা। ছোড়দার স্বভাবটা ছিল অস্থির গোছের, কোনও দিকেই মন বসাতে পারত না; লেখাপড়ায় তার মাথা ছিল মোটামুটি কিন্তু গোড়ার কটা বছর শুধু চেখে চেখে বেড়াল, একবার পড়ল সায়েন্স, তারপর গেল ডাক্তারি পড়তে, ছেড়ে দিয়ে আবার এল কমার্স পড়তে। কোনও রকমে সেটা শেষ করলেও চাকরি বাকরিতে গা করল না। কিছুদিন ব্যবসা ব্যবসা করে মেতে থাকল, হরেক রকম কোম্পানির নাম ছাপানো লেটার প্যাড তৈরি করে ঘুরে বেড়াল; তারপর.ব্যবসা ছেড়ে কোথাকার কোন বিস্কুট কারখানায় কাজ নিল। সেটাও ছেড়ে দিল মাস দুয়েকের মধ্যে। ছোড়দা যে বছরে কতবার একটা ছেড়ে অন্য একটা ধরেছে তা দেবযানীরও জানা নেই। শেষে তার বিয়ে করার শখ চাপল।

ছোড়দার বিয়েটা পুরোপুরি তার পছন্দের এমন কথা বলা চলে। বহরমপুরে কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল বেড়াতে, সেখানে একটি মেয়েকে দেখে খুব মনে ধরে যায়। কলকাতায় ফিরে এসে বাড়িতে বউদিদের কাছে সরাসরি তার বিয়ের ইচ্ছেটা জানিয়ে দেয়।

ছোটবউদি সাধারণ পরিবার থেকে এসেছে তার কোনও অহঙ্কার নেই, গালভরা কথা নেই। বরং তার মধ্যে সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দোষগুণ আছে। দেখতে যে প্রতিমা তা নয়, পুতুলও নয়, তবে ছিপছিপে চেহারার মধ্যে ভীষণ টান আছে, চোখে ধরে যায়। ছোড়দারও বোধ হয় সেজন্যে চোখে ধরেছিল।

বিয়ের পর ছোড়দা কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে গেল। তার খেয়াল-খুশির পালা চুকিয়ে সে কাজের লোক হয়ে পড়ল। এখন আর সে-ছোড়দা নেই, বন্ধুর সঙ্গে মিলেমিশে কাশীপুরে কারখানা খুলেছে ছোট ছোট যন্ত্রপাতির, লোহার টুকটাক জিনিস তৈরি করে। ভালই আছে ছোড়দা।

সংসারের এই অবস্থার মধ্যে–মানে মা মারা যাবার পর থেকে যে ঘোলা জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল–সেই স্রোতের মধ্যে দেবযানীর দিকে কেউ নজর দেয়নি। হঠাৎ হঠাৎ কিংবা মুখে দু-চার বার দাদাদের টনক নড়ে ওঠার ভাব দেখা দিলেও সত্যি সত্যি কেউ তার জন্যে ব্যস্ত বা উদ্বিগ্ন হয়নি। মেজদা চাইত বড়দা বোনের দায়িত্ব নিক, বড়দা চাইত মেজদা নিক, আর ছোড়দা, যে নিজের দায়িত্বই নিতে জানত না সে আর বোনের দায়িত্ব কী নেবে? তবে সব দোষ দাদাদের ঘাড়ে চাপানো উচিত নয়। দেবযানী নিজেই এমন একটা জীবন কাটাত যাতে তার ওপর খবরদারি করার সাহস দাদাদের হত না। কোনও দিনই সেটা হয়নি। বাবার আমলে নয়, মার আমলেও নয়। পরে আর কেমন করে হবে! দেবযানী নিজের মতন থাকত, সংসারের কোনও ব্যাপারেই তার ঔৎসুক্য ছিল না, গরজও ছিল না, সম্পর্কও ছিল ছাড়া ছাড়া। দাদাদের ব্যাপার স্যাপার সে পছন্দ করত না, তার ব্যাপারেও কারও কৌতূহল সে বরদাস্ত করতে রাজি ছিল না।

দেবযানীর যখন পড়াশোনা শেষ হয়ে আসছে তারও কিছু আগে থেকে নীলের সঙ্গে তার পরিচয়। নীলেন্দু ছোছাড়দার উদয়ন ক্লাবের খেলোয়াড় ছিল; খুব পেটোয়া ছিল ছোড়দার। কলেজে পড়ত নীলেন্দু, থাকত উল্টোডিঙির দিকে; ছোড়দা তাকে কোথায় ফুটবল খেলতে দেখে নিজের দলে টেনে এনেছিল। নীলেন্দু ভাবত, ছোড়দা তাকে কলকাতার কোনও বড় ক্লাবে নিশ্চয় ঢুকিয়ে দেবে। ছেলেমানুষ, খেলার নেশায় পেয়ে বসেছে, তার এসব ভাবনা কোনওটাই অযৌক্তিক নয়। ছোড়দাও নীলেন্দুকে খুব ভালবাসত।

বাড়িতে হরদম নীলেন্দুর আসা-যাওয়া থেকে দেবযানীর সঙ্গে আলাপ। সেই আলাপ জমেও উঠল বেশ। বয়েসের দিক থেকে দুজনের মধ্যে এমন একটা তফাতও ছিল না, বছর দুই-তিন বড় জোর। দুজনে বন্ধুর মতন হয়ে উঠেছিল। একসঙ্গে কত যে ঘোরাঘুরি, হুড়োহুড়ি করেছে। নীলেন্দুর ছেলেমানুষি স্বভাব, তার সজীবতা, উদাত্ত স্বর, অফুরন্ত জীবনীশক্তি দেবযানীকে মুগ্ধ করে রাখত। অথচ, সমস্ত চাপল্যের মধ্যে নীলেন্দুর একটা জায়গায় সীমানা বাঁধা ছিল, সে দেবযানীকে বন্ধুত্ব ও প্রীতির বাইরে অন্য কোথাও বসাতে চায়নি। দেবযানীও নয়।

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে দেবযানী তার হাত ফাঁকা দেখে কী করব কী করব ভাবতে গিয়ে মেয়ে-স্কুলে একটা চাকরি নিয়ে নিল। মাস আষ্টেক পরে তার ফিলজফির মাঝারি ফলাফল দেখিয়ে কলকাতা শহরের গায়ে মেয়ে কলেজে একটা চাকরি পেয়ে গেল। সকালের কলেজ। বাড়ি থেকে ভোের ভোর ছুটত, ফিরত বেলায়; দুপুরটা বাড়িতে কাটিয়ে বিকেলে নীলের সঙ্গে এখান-ওখান করে বেড়াত।

নীলেন্দু চেয়েছিল খেলোয়াড় হতে; যত দিন যেতে লাগল–সে খেলাটাকে আর আমলে আনতে চাইল না! দেবযানী দেখল, নীলেন্দু বড় তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। এম. এ. পড়তে ঢুকে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিল, তার বিকেলের ঘোরাফেরা কমে যেতে যেতে বন্ধ হয়ে এল, দেবযানীদের বাড়িতেও আর আসত না।

দেবযানীর বড় ফাঁক ফাঁকা লাগল, মন উশখুশ করত, রাগও হত কখনও কখনও।

একদিন নীলেন্দু বলল, চলো, তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাই।

কোথায়?

চলো না; দেখতেই পাবে।

নীলের সঙ্গে দেশবন্ধু পার্কের দিকে একটা বাড়িতে এসে মহীতোষকে দেখল। সন্ধের মুখে স্নান সেরে আদুল গায়ে মহীতোষ বসে ছিল। বৈশাখ মাসের গরমে কলকাতা তেতে পুড়ে ঘেমে মরছে।

দেবযানীকে দেখে মহীতোষ যেন সামান্য অপ্রস্তুত বোধ করে গায়ে একটা গেঞ্জি চাপিয়ে নিল।

প্রথম পরিচয়। সাধারণ কিছু কথাবার্তা। মেটে রঙের কানাভাঙা কাপে তিন কাপ চা। সস্তা সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ আর ধোঁয়া। দেবযানীর মোটেই ভাল লাগছিল না।

 বাইরে এসে দেবযানী বলল, তোর ওই মহীদাদা কী করে রে?

নীলেন্দু বলল, তোমার মতন মাস্টারি করে।

কোথায়?

বাইরে করত। বর্ধমানের দিকে। ….এখন আর করে না।

কেন?

কী হবে করে? কীসের জন্যে মাস্টারি? কার জন্যে মাস্টারি? …তোমাদের এই বইয়ের বিদ্যে প্রেসার কুকারে গলিয়ে যাদের পেটে দিচ্ছ তারা ওই বিদ্যে নিয়ে কী করবে, দেবীদি? এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে গিয়ে লাইন মারবে আর দু বেলা মা বাপের চোখের কাঁকর হয়ে থাকবে। এই তো?

দেবযানী অবাক চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে নীলেন্দুকে দেখতে লাগল। আজকাল নীলেন্দু যে তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে এটা দেবযানী লক্ষ করেছিল। অনেকবার জিজ্ঞেসও করেছে, তোর কী হয়েছে রে? নীলেন্দু স্পষ্ট করে কিছু বলত না, অস্পষ্ট করেও তার এই পরিবর্তনের আভাস দিতে চাইত না। শুধু বলত, আমার কিছু ভাল লাগে না, দেবীদি। চারদিকের ব্যাপার-স্যাপার অসহ্য লাগে। এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।

নীলেন্দু যে বেশ কিছু ছেলের মতন হতাশ, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে দেবযানী বুঝতে পারছিল। বুঝতে পারছিল, কোনও টান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকের মতন, কোনও আবেগ তাকে সাধারণ জীবনযাপনের একঘেয়েমি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে ছেলের জীবনের উদ্দেশ্য কিংবা শখ ছিল কলকাতার ফুটবল মরসুমে বড় ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমে হাততালি কুড়োবে–সেই ছেলে খেলাধুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে জীবন সম্পর্কে কেমন সচেতন হয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। দেবযানীর খারাপ লাগত না; বরং ভালই লাগত। অনেক সময় দেবযানী নীলেন্দুকে আদর করে বলত তুই যে একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলছিস আজকাল। বিপ্লববহ্নি নাকি রে? নীলেন্দু হাসত।

বলতে নেই, এই নীলেন্দুর জন্যেই মহীতোষের সঙ্গে দেবযানীর পরিচয় এবং যোগাযোগ, নীলেন্দুর জন্যেই মহীতোষের সঙ্গে প্রথম প্রথম কিছু রুক্ষ বাক্যবিনিময়। অথচ, জীবনে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে–যেখানে আদি আর মধ্যর মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেবযানী মহীতোষকে প্রথম দিকে বিশেষ পছন্দ করেনি; প্রথম দর্শনে তার প্রেমোদ্রেকও হয়নি; মহীতোষের কোনও কিছুই তাকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেনি। কিন্তু ক্রমশ কেমন করে যেন দেবযানী মহীতোষের আকর্ষণে পড়ে গেল। তাকে ভালবেসে ফেলল। এই ভালবাসার দুটো পর্ব। প্রথম পর্বে দেবযানী ছিল মহীতোষের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রের দ্বারা আচ্ছন্ন। দ্বিতীয় পর্বে সে মহীতোষকে, মনে হয়, অনেকটা নিজের মনোমতো পথে আনতে পেরেছে।

এসব অবশ্য সহজ সরল ব্যাপার নয়, রাতারাতি কিছু ঘটেনি। অনেক সময় গিয়েছে, অনেক ভয়-ভাবনা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার দিন কাটিয়ে তবে মহীতোষকে দেবযানী এই অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে।

বাড়িতে দেবযানী আর মহীতোষের ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কারও অজানা ছিল না। দাদা বউদিরা এসব পছন্দও করেনি। কিন্তু দেবযানী কারও পছন্দের মুখ চেয়ে থাকত না, সে অভেস্য তার ছিল না। ছন্নছাড়া সংসারে কে কার অভিভাকত্ব করবে, কারই বা সে উৎসাহ আছে। যাই হোক, বাড়ির অবস্থাটা এমন ছিল না যে, দেবযানী দাদাদের দিয়ে বিয়ের মেরাপ বেঁধে ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে মহীতোষের গলায় বরমাল্য দেবে। দাদারা রাজি হত না, সে মনোভাব তাদের ছিল না। মহীতোষও বরবেশে এ বাড়িতে আসত না। কাজে কাজেই দেবযানী একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে এল। আসার আগে সে তার নিজের গয়নাগাটি নিয়ে এসেছে। একে ঠিক পালানো বলে না। বাড়ি ছেড়ে চলে আসা বলে। দেবযানী সেই ভাবেই এসেছে। দাদারা যে খুশি হবে না–এটা তার জানা ছিল। সে গ্রাহ্যও করেনি। এখনও করে না।

.

বারান্দায় শব্দ হল। দেবযানী অন্যমনস্ক থাকায় একটু বোধ হয় চমকে উঠেছিল শব্দে। তাকাল। বারান্দায় আলো নেই। রান্নাঘরের খুব ম্লান আলোয় মনে হল মহীতোষ বারান্দা দিয়ে কোথাও যাচ্ছে। পায়ের কাছে কিছু ছিল, ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে।

দেবযানী চায়ের কাপ গুছিয়ে নিল। কড়াইশুটির রান্নাটা শেষ হয়ে এসেছে। গন্ধ আসছিল। উনুনের তাতে হাত-পা বেশ গরম হয়ে এসেছে দেবযানীর। কপালের ওপর চুল এসে পড়েছে। চুল সরিয়ে নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সামান্য পরে দেবযানী নীলেন্দুর ঘরে এল। এসে দেখল, নীলেন্দু কোলের ওপর কম্বল চাপিয়ে বিছানায় বসে আছে, মহীতোষ তার মুখোমুখি, বিছানার ধার ঘেঁষে বসে। গল্প করছে দুজনে।

দেবযানী হাত বাড়াল। কড়াইশুটি সেদ্ধ; খাও। খুব গরম। সাবধানে ধরো, গায়ে ফেলো না। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিটা এগিয়ে দিল দেবযানী, খুব গরম বলে বাটির তলায় কাচের প্লেট বসিয়ে এনেছে।

নীলেন্দু খাবার নিয়ে চামচ দিয়ে বাটির মধ্যে ঘাঁটতে লাগল। সত্যিই খুব গরম, ধোঁয়া দেখা না গেলেও গরম ভাপ অনুভব করা যাচ্ছিল। নাকের কাছাকাছি বাটিটা এনে টমাটো, কড়াইশুটি, কাঁচা লঙ্কার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে নীলেন্দু মোহিত হবার ভঙ্গি করে বলল, বাঃ, এ যে খাসা ব্যাপার!

দেবযানী আর দাঁড়াল না। চা আনতে হবে।

রান্নাঘরে এসে চা ঢালল দেবযানী, চিনি মেশাল। মহীতোষ নামমাত্র চিনি খায়। তার খাওয়া-দাওয়া যেন হিসেব করা। এসব আগে ছিল না, মহীতোষ কোনও দিনই এমন কিছু ভোজনরসিক মানুষ নয়, তবু সাধারণ ক্ষুধাতৃষ্ণায় তার অরুচি ছিল না। ইদানীং নানা ব্যাপারেই তার আপত্তি; বিকেলের দিকে সামান্য কিছুও মুখে দিতে চায় না, এক-আধ পেয়ালা চা যেন যথেষ্ট, সেই রাত্রে দু-চারখানা রুটি, সামান্য সবজি, একটু দুধ। এতে শরীরস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে কি হচ্ছে না এ নিয়ে দেবযানী প্রথম দিকে রাগারাগি করেছে, কোনও লাভ হয়নি। এখন আর কিছু বলে না।

চা নিয়ে দেযবানী নীলেন্দুর ঘরে ফিরে এল। মহীতোষকে দিল। নীলেন্দু বেশ তৃপ্তির সঙ্গে কড়াইশুটি সেদ্ধ খাচ্ছে। বিছানার পাশে কাঠের চেয়ারে আগুনের মালসা রাখা, তলায় এক টুকরো কাঠ। নীলেন্দুর চায়ের কাপ চেয়ারের একপাশে নামিয়ে রাখল দেবযানী।

তোমার এই বস্তুটি সাংঘাতিক উপাদেয় হয়েছে দেবীদি, আমি তোমায় সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে যাব। নীলেন্দু ছেলেমানুষের মতন হাসল। বোসো–!

দেবযানী বসল না। বলল, রান্নাঘরে আমার কাজ রয়েছে।

তুমি চা খাবে না?

খাব।

কই, নিয়ে এসো। …কাজ তো আছেই, থাকবে। একটু বোসো। অন্তত চা-টুকু খাও।

যেন বাধ্য হয়েই দেবযানী নিজের চা আনতে রান্নাঘরে গেল; ফিরে এল একটু পরেই। ফিরে এসে বিছানার একপাশে পায়ের কাছে বসল।

দু-চারটে কথার পর নীলেন্দু হঠাৎ বললে, দেবীদি, এখন মেজাজটা কী রকম তাস-খেলার মতন হয়েছে। এক জোড়া তাস পেলে ফার্স্ট ক্লাস হত। জমে যেত। বলে হাসতে হাসতে মহীতোষের দিকে তাকাল। তুমি জানো না মহীদা, দেবীদি আর আমি একসময়ে তাসের পার্টনার ছিলাম। দেবীদি দারুণ খেলে।

মহীতোষ হাসিমুখে দেবযানীকে দেখতে দেখতে বলল, দেবীর সঙ্গে আমি দাবা খেলেছি। ওকে হারানো মুশকিল।

তুমি আরও বড় খেলোয়াড় মহীদা, খেলাও বড় খেলেছ। আমি ছোট খেলোয়াড়–! বলে নীলেন্দু হোহো করে হেসে উঠল।

দেবযানী নীলেন্দুর মুখ দেখতে লাগল, হাসি দেখল। তার আচমকা মনে হল, নীলেন্দু ইচ্ছে করে, তার মনের জ্বালা মেটাবার জন্যে মহীতোষকে এই খোঁচাটা দিল। এর কি কোনও দরকার ছিল? মহীতোষ কি একলাই বড় খেলোয়াড়? তুমি কি কিছু কম নীলেন্দু?

যেন কিছুই নয়, সহজ গলায় দেবযানী নীলেন্দুকে বলল, তুমি এখনও সেই তোমাদের কী যেন নাম ছিল ক্লাবটার–সেই ছোট ক্লাবের খেলোয়াড়ই থেকে গেলে? তাই না?

নীলেন্দু প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। পরে বুঝল। বুঝে কেমন অপ্রস্তুতভাবে হাসল।

.

০৫.

জানলা খোলার শব্দে নীলেন্দু সাড়া দিয়ে বলল, দেবীদি?

দেবযানী জানলা খুলে দিল। বাইরে রোদ। আলো ছড়িয়ে গেল ঘরে। বেলা হয়েছে বোঝা যায়।

আর না, এবার ওঠো– দেবযানী বলল। শান্ত, মিষ্টি গলা; সকালের সঙ্গে যেন চমৎকার মানানসই শোনাল।

নীলেন্দু আলস্যের গলায় বলল, কটা বাজল?

দেবযানী বিছানার মশারি খুলতে খুলতে বলল, অনেক বেলা হয়েছে। এত ঘুম তুমি ঘুমোও কী করে?

নীলেন্দু জবাব দিল না। শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগল, দেবীদি পায়ের দিকের মশারি খুলে মাথার দিকে চলে গেল। মশারির আড়াল থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেবীদিকে। সাধারণ শাড়ি, কাঁধের ওপর ভেঙে পড়া খোঁপা, লম্বা লম্বা ফরসা হাত, দুগাছা করে সোনার চুড়ি। দেবীদির পিঠের সেই সামান্য বাঁকানো ভঙ্গি, কোমরের ভাঁজ–কিছুই নষ্ট হয়নি।

মশারি খুলে ফেলে দেবাযানী বলল, তুমি আজকাল খুব কুঁড়ে হয়ে পড়েছ। বলতে বলতে নীলের গায়ের ওপর থেকে মশারি টেনে নিল দেবযানী।

গলা পর্যন্ত মোটা কম্বলে ঢাকা নীলেন্দুর; বাসি মুখে দেবযানীর দিকে তাকিয়ে হাসল যেন। বলল, দেবীদি, কতকাল পরে আজ আবার এই শুভ ঘটনাটি ঘটল বলতে পারো?

দেবযানী বুঝতে পারল না। বলল, কোন শুভ ঘটনা?

হাসিমুখে নীলেন্দু দেবযানীকে দেখতে দেখতে হালকা অথচ আন্তরিক গলায় বলল, সকাল বেলায় তোমার মুখ দেখলাম, প্রথম মুখ। তুমি আমার ঘুম ভাঙিয়ে বিছানা তুলে দিচ্ছ। …আহা, এমন মধুর স্বপ্ন সেই কবে যেন দেখেছিলুম, তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম।

দেবযানী হেসে ফেলল। এমন করে কথা বলে নীলেন্দু, না হেসে পারা যায় না। বলল, থাকো না এখানে, রোজই নিজের হাতে বিছানা তুলে দেব।

লোভ দেখিয়ো না, তুমি লোভ দেখালে এখনও আমার কী বলে যেন রক্তের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

দেবযানী আর দাঁড়াল না, চলে গেল।

নীলেন্দু উঠল। সমস্ত মন প্রফুল্ল। শরীরও বেশ ঝরঝরে লাগছিল। কালকের ক্লান্তি যেন কোথাও আর নেই। জানলার বাইরে রোদ ঝকঝক করছে। বেলা হয়েছে মন্দ নয়। হাই তুলে, মাথার ওপরকার সিলিংটা একবার দেখল নীলেন্দু। এখনও সামান্য ঝাপসা হয়ে রয়েছে। হাতকাটা সোয়েটারটা গায়ে পরে চাদর জড়িয়ে নীলেন্দু মুখ ধুতে চলে গেল।

কুয়াতলায় মুখ ধোয়ার সময় নীলেন্দু মহীতোষকে দেখতে পেল। বাগানে লাটুর সঙ্গে কথা বলছে।

 নীলেন্দু শব্দ করে মুখ ধুতে লাগল। মহীতোষ দেখল।

 কী রে, ঘুম ভাঙল? মহীতোষ সামান্য তফাত থেকেই বলল।

খুব ঘুমিয়েছি। …তোমার মর্নিং ওয়াক হয়ে গেছে?

কেন, তুই সঙ্গে যাবি নাকি? মহীতোষ হেসে জবাব দিল।

আজ আর হল না। কাল–। নীলেন্দুও পরিহাস করে বলল।

মুখ-টুখ ধুয়ে মুছে এসে নীলেন্দু রান্নাঘরের কাছে ঢাকা বারান্দায় রোদে বসল। চা এনে দিল দেবযানী।

চা খেতে খেতে নীলেন্দু বলল, দেবীদি, আজ আমার ফাইন লাগছে। কেন লাগছে বলল তো?

দেবযানী পাশের দিকে চেয়ে চেয়ারে বসে ছিল। বলল, কী করে বলব। তোমার মন তুমিই জানো।

নীলেন্দু বিস্ময়ের ভান করল। আমার মন শুধু আমিই জানি। তুমি কিছু জানো না দেবীদি?

সহাস্য মুখে দেবযানী বলল, আমার কি জানার কথা!

নীলেন্দু অভিমানের মতন মুখ করল। তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। তারপর বলল, এই চমৎকার সকালে বড় দুঃখ দিলে। মেয়েরা এই রকমই হয়। এক হাতে সুধাপাত্র, অন্য হাতে বিষভাণ্ড। একটু আগে সকালে তুমি আমায় পরম সুখ দিয়েছিলে, আর এখন চরম দুঃখ দিলে।

দেবযানী জোরে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার বুক কাঁপছিল, গলার নালি ফুলে ফুলে উঠছিল। হাসতে হাসতে টেবিলের ওপর যেন একটু নুয়ে পড়ল।

নীলেন্দু টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল। দেবীদির এই হাসি তার বড় বেশি চেনা, হাসির ওই মুক্ত ধ্বনি, ওই ভঙ্গি তার কানে লেগে আছে কতকাল ধরে। এই হাসি দেবীদির চরিত্রকে বোধ হয় খানিকটা প্রকাশ করে, তার চরিত্রের নিশ্চিন্ত, উচ্ছল দিকটাই সম্ভবত। নীলেন্দু আশঙ্কা করেছিল, দেবীদির পুরনো হাসি আর শোনা যাবে না। জীবনের যে অবস্থায় ওই হাসি স্বাভাবিক ছিল এখন সে অবস্থা নেই।

নীলেন্দু গম্ভীর মুখ করে বলল, মহীদা, আমার কত বড় ক্ষতি করেছে আমিই বুঝতে পারছি।

 হাসিমুখে দেবাযানী বলল, যাক গে–তোমার মনের কথাটা শুনি।

শুনবে?

ওমা, শুনব না?

 তা হলে বলি। ..কাল আমি একটা বিরাট স্বপ্ন দেখেছি।

স্বপ্ন! …খুব ভাল স্বপ্ন?

খুব ভাল। অন্তত আমার পক্ষে। যদি স্বপ্নটা না ভাঙত–আমি আরও দেখতে রাজি ছিলাম। বলতে বলতে নীলেন্দু চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিল। আর এক পেয়ালা দাওনা, দেবীদি। আছে? এই ঠাণ্ডায় তোমার ওই মিনি সাইজের কাপে আমার পোয় না।

দেবযানী আরও চা রেখেছিল। কাপটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

নীলেন্দু আরাম করে সিগারেট খেতে লাগল। সকালের প্রথম দু-এক কাপ চা, দু-চারটে সিগারেট তার ভালই লাগে, শরীর মন যেন চাঙ্গা করে দেয়। পরে আর তা হয় না। অথচ অভ্যেস। ভাল না লাগলেও খেয়ে যেতে হয়। সে মাঝে মাঝে বেশ গম্ভীর হয়ে ভেবেছে, জীবনের প্রথম দিকে কোনও কোনও ব্যাপার গোড়ায় যতটা ভাল লাগে পরে কি আর তা অত ভাল লাগে? বোধ হয় নয়। অভ্যেসই মানুষকে চালায়। ভাল লাগা হয়তো চালায় না।

চা এনে দিয়ে দেবযানী বলল, তোমার স্বপ্নটা শুনি।

চায়ে চুমুক দিল নীলেন্দু হাতের সিগারেটের টুকরোটার আগুনে নতুন একটা ধরিয়ে নিন। বলল, স্বপ্নের দোষ হল, দেখার সময় যত বড় মনে হয়, মনে করার সময় সেটা তত ছোট হয়ে যায়। এ যেন ইলাস্টিক, দেখার সময় টেনে বাড়িয়ে তোমায় দেখাল, তারপর আবার গুটিয়ে গেল। নীলেন্দু হাসল, তার ঝকঝকে চোখ কী যেন ইঙ্গিত করতে চাইল দেবযানীকে। শেষে বলল, স্বপ্ন দেখছিলাম, কলকাতায় একটা বাড়ির দোতলা কিংবা তেতলার ঘরে আমি শুয়ে আছি, মাথার দিকের জানলা খোলা, ট্রামের শব্দ ভেসে আসছে অনবরত, তখন বিকেল না সন্ধে মনে করতে পারছি না, হঠাৎ দেখি দরজা খুলে কে একজন এল। প্রথমে মনে হয়েছিল কঙ্কর, তারপর দেখলাম কঙ্কর নয়, সিদ্ধার্থ। সিধুর বেসামাল অবস্থা। প্রচুর মদ খেয়েছে। সমস্ত মুখে দরদর করে ঘাম ঝরছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। হাতে একটা রিভলভার। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বিছানা ছেড়ে উঠতে যাব দেখি উঠতে পারছি না। কেন পারছিলাম না জানি না। সিধু তার হাতের রিভলবারটা আমার বালিশের পাশে রেখে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার কোনও দোষ নেই, তোর কাছে পৌঁছে দিয়ে গেলাম। …তারপর দেখি, আমি অন্য জায়গায়। আমার সঙ্গে তুমি। সেই যে একবার আমরা ডায়মণ্ড হারবার গিয়েছিলাম দেবীদি, তোমার মনে আছে? কোন গ্রামে বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে আর বাস পেলাম না, এক চাষির বাড়িতে রাত কাটাতে হল। তারা ভেবেছিল, আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমাদের একটা ঘরে রাত কাটাতে দিল। তোমায় আমার বউ ভেবে নেবার কারণ ছিল না, তোমার সিঁথিতে সিঁদুর ছিল না। তবু। ঠিক সেই রকম এক একচালা ঘরে তুমি আর আমি। তুমি আমার বুকে ওপর শুয়ে আদর করছ। মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছ। দিতে দিতে হঠাৎ তুমি আমার চোখে তোমার মাথার কাঁটা ফুটিয়ে দিলে। আমি বিশ্বমঙ্গল হয়ে গেলাম। তুমি তখন কাঁদছ…। নীলেন্দু চুপ করল, দেখল দেবযানীকে, চোখে যেন কৌতুক, চায়ে চুমুক দিল আবার।

দেবাযানী কথা বলল না।

নীলেন্দু ঠাট্টার গলায় বলল, সত্যি বলছি দেবীদি, তোমার বুকের চাপ যেন আমি সারাক্ষণ অনুভব করেছি।

দেবযানী বলল, আর চোখের মধ্যে যখন মাথার কাঁটা ফুটিয়ে দিলাম–তার যন্ত্রণা?

 সে-যন্ত্রণা তো নতুন নয়…। যাক গে, স্বপ্নটা তোমার কেমন লাগল?

 খুব খারাপ।

 কেন?

আমায় তুমি এখন থেকে বউদি বলবে।

 নীলেন্দু হেসে উঠল। জোরে। দেবাযানীও হেসে ফেলল।

চা শেষ করে নীলেন্দু বলল, এই স্বপ্ন হয়তো কিছু না, দেবীদি; তবু তোমার কাছে মিথ্যে বলব না, সিধু আমি আমরা একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। কী স্বপ্ন তুমি জানো। মহীদা আমাদের মধ্যে ছিল। তুমি জানো আমরা সত্যি সত্যি সকলে রিভলবার পকেটে গুঁজে ঘুরে বেড়াইনি। ওই জিনিসটা কেউ কেউ হাতে নিয়েছিল। আমরা নয়। যারা নিয়েছিল তারা আলাদা হয়ে গেল। সিধু নেব কি নেব না করতে গিয়ে মারা গেল।

সিধু মারা গেছে? দেবযানী যেন চমকে উঠল। কই বলোনি তো?

তোমায় বলিনি। মহীদাকে বলেছি কাল।

আমি শুনিনি।

সিধুকে তুমি পছন্দ করতে না। বলতে, ওকে দেখলে তোমার ভয় করে।

আমার পছন্দ অপছন্দর ওপর একটা লোকের মরাবাঁচা নির্ভর করে না, দেবযানী কেমন অন্যমনস্ক উদাস গলায় বলল। একটু থেমে আবার বলল, সিধুকে আমার ভাল লাগত না; কিন্তু সে মারা যাক এ তো আমি চাইনি। …কবে মারা গেছে?

মাস দুয়েক আগে।

কলকাতাতেই?

 না, নৈহাটির দিকে। পুলিস মেরেছে না অন্য কেউ জানি না।

 দেবযানী চুপ করে থাকল। কেমন একটা স্তব্ধতা এসেছে হঠাৎ। মহীতোষ বাগানের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। কটা চড়ুই পাখি পাক খেয়ে কুয়োতলা থেকে উড়ে গেল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। বারান্দায় রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। রান্নাঘরের একটা দরজা বাতাসে সামান্য বেঁকে গেল।

নীলেন্দু বলল, আমি তোমার সঙ্গে অনেক ঝগড়া করেছি দেবীদি, অনেক জ্বালিয়েছি। মহীদাকে আমি যতটা পছন্দ করি তোমাকে তার চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। তুমি ভেবো না–শুধু মহীদার সঙ্গে আমার লড়াই সেরে আমি ফিরে যাব। তোমার সঙ্গেও আমার ঝগড়া আছে।

দেবযানী যেন হঠাৎ কেমন বিষণ্ণ চোখে নীলেন্দুর দিকে তাকাল। তার মনে হল, নিজেরও যেন অনেক কিছু বলার রয়েছে নীলেন্দুকে মহীতোষকে যা বলা যাবে না।

বেশ তো, ঝগড়া করো, দেবযানী মৃদু গলায় বলল।

কিন্তু ছেলেমানুষের ঝগড়া নয় দেবীদি। সে আগে অনেক করেছি।

না না, বড় মানুষের ঝগড়াই করো।

তুমি আমার স্বভাব জানো। আমায় তুমি গলাধাক্কা দিয়েও তাড়াতে পারবে না যতক্ষণ না আমি বিদায় নিচ্ছি। কাজেই সাবধান।

.

রোদের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মহীতোষ বলল, নীলু, তুই সাইকেল চালাতে জানিস?

এ-রকম ছেলেমানুষি প্রশ্নের জন্যে নীলেন্দু তৈরি ছিল না, খানিকটা অবাক কিছুটা বা মজার মুখ করে মহীতোষকে দেখতে দেখতে বলল, জানি। কেন?

আমি জানি না।

 হেসে ফেলল নীলেন্দু। হঠাৎ তোমার সাইকেল চড়তে শেখার কথা মনে হল কেন?

 মহীতোষ হাসিমুখে বলল, একটা সাইকেল আমার দরকার। নতুন সাইকেলের দাম কত রে?

 জানি না।

বেশি হলে পুরনো একটা কিনব।

নীলেন্দু কিছুই বুঝতে পারছিল না। মহীতোষের সঙ্গে সে বাইরে ঘুরে বেড়াতে বেরিয়েছে। মহীতোষই নিয়ে এসেছে। রোদের মধ্যে হাঁটতে এখন পর্যন্ত ভালই লাগছে তার। শীতের পরিষ্কার আকাশে সূর্য জ্বলজ্বল করছিল। মাঠ-ঘাটের কোথাও বিন্দুমাত্র আর্দ্রতা নেই, গাঢ় তপ্ত রোদ সব কিছু শুকনো খসখসে করে ফেলেছে। শীতে ঘাস মরে যাচ্ছে মাঠের, কোনও কোনও গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরতে শুরু করেছে। কাছাকাছি কোনও বনজঙ্গল নেই, উঁচু নিচু মাঠ, দু-পাঁচটা গাছ, ঝোপঝাড়, এক-আধ টুকরো ক্ষেত চোখে পড়ে। অল্প দূরে বালিয়াড়ির মতন মাটির স্তূপ দেখা যাচ্ছিল খানিকটা।

নীলেন্দু হেসে বলল, তোমার এই বুড়ো বয়েসে সাইকেল শেখার শখ হল কেন?

মহীতোষও হাসিমুখে জবাব দিল, শখ নয় রে, দরকার। আমার প্রায় সারাদিন অনেকটা ঘোরাঘুরি করতে হবে। হেঁটে পারব না, সময় নষ্ট হবে।

নীলেন্দু কিছু না বলে হাঁটতে লাগল। নানা রকম অনুমান করছিল, কোনওটাই যেন পছন্দ হচ্ছিল না।

আরও খানিকটা এগিয়ে এসে মহীতোষ বাঁ দিকে সামান্য খাড়াই মতন জায়গার দিকে পা বাড়াল। নীলেন্দুও।

খাড়াই পেরিয়ে এসে মহীতোষ সামনের দিকটা দেখাল। বলল, ওই দেখ–।

নীলেন্দু প্রথমটায় বুঝতে পারল না কী দেখবে; শেষে কাঠের ঘোট ঘোট খুঁটি দেখল, হাত দুই-আড়াইয়ের মতন রোগা রোগা খুঁটি মাটির সঙ্গে পোঁতা।

নীলেন্দু বলল, কী ওটা? কী দেখব?

 মহীতোষ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, আয়, বসি। তোকে বলছি।

 কাছাকাছি গাছ খুঁজে ছায়ায় বসল মহীতোষ। নীলেন্দু মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে সিগারেট ধরাল।

 মহীতোষ অল্প সময় চুপচাপ থেকে শেষ বলল, ওই জমিটা কিনেছি আমরা।

 নীলেন্দু মহীতোষের চোখের দিকে তাকাল। তার মাথায় কিছু ঢুকছিল না।

খুব বেশি জমি নয়। বিঘে দশেক। বিঘে দশও কম নয়– মহীতোষ বলল, এখানকার মাটি জঙ্গলের, মানে কিছুদিন আগেও ঝোপঝাড় ছিল, কেটেকুটে সাফ করে ফসল ফলাবার চেষ্টা হয়েছিল। জঙ্গলের মাটিতে চাষ আবাদ করা শক্ত। তবু মানুষ চেষ্টা করে। ওই যে জমি-ওখানে আমরা ফসল ফলাব।

ফার্মিং?

ফার্মিং, মানে ধান চাষ নয়– মহীতোষ বলল, আমি ভেবেছি অনেকটা জমি থাকবে শুধু তিসি কলাই এই সব চাষের জন্যে, বাকিটাতে শাকসবজি, এখানে অনেক রকম শাকসবজি হতে পারে।

নীলেন্দুর খুব জোরে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছিল। মহীদা পাগল। একেবারে নির্বোধ। কোথাকার কোন রুক্ষ জমিতে চাষ আবাদের স্বপ্ন দেখছে! কী হবে শাকসবজি ফলিয়ে? ব্যবসা করবে? কলকাতার সবজিবাজারের ফড়েদের আলু পটল বেচবে?

হাত জোড় করে নীলেন্দু বলল, দোহাই মহীদা, তুমি আমায় আর হাসিয়ো না। তোমার বুদ্ধির ওপর আমার যেটুকু ভরসা ছিল, তাও গেল।

মহীতোষ বলল, তুই হাসতে পারিস কিন্তু একটা কথা বল তো? আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ কী করে বেঁচে আছে?

নীলেন্দু মুখ ভরতি ধোঁয়া গিলে দু মুহূর্ত চুপ করে থাকল। পরে বলল, বেঁচে আছে না নেই– সেটাই তো প্রথম প্রশ্ন। এ প্রশ্ন তুমি নিজেই করেছ একদিন।

এখন আমি সে তর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। ওটা পরে হবে। আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি আমাদের দেশের শতকরা আশি নব্বই ভাগ মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন কী? চাষবাস না কলকারখানা?

বিন্দুমাত্র উৎসাহ প্রকাশ করল নানীলেন্দু, তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ছেলেবেলা থেকেই তো বইয়ে পড়ানো হয়েছে, ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ।

তুই অত তুচ্ছ করে ব্যাপারটা দেখিস না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই এখনও চাষ আবাদ করে পেটের অন্ন জোগায়। …ধানচাল গমের কথা বাদ দেধর, আজ তোদের কলকাতা শহরের বাজারে বাজারে লক্ষ লক্ষ মানুষের আলু পটল কুমড়ো তরিতরকারি এসব কারা জোগাচ্ছে? কাদের পরিশ্রমে তোরা খেতে পাচ্ছিস আমি সে কথাও বলছি না। বলছি যারা খেতখামারে আলু, কচু, পটল, শাকসবজি ফলাচ্ছে, তারা সেগুলো বাজারে বেচে নিজেদের ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করছে। এটা তাদের জীবিকা, তাই কি নয়?

বেশ তো, তাতে কী!

তাতে কথাটা দাঁড়াচ্ছে, ওই দশ বিঘে জমির ফসল যারা ফলাবে, সেই ফলনের বিনিময়ে খুব কম করেও দশ-বিশ জন মানুষের গ্রাসাচ্ছাদন হবে।

নীলেন্দু এবার হেসে ফেলল। বলল, ও!

 মহীতোষ যেন সামান্য অপ্রতিভ হল। নীলেন্দুর দিকে তাকাল না, চোখ ফিরিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল।

নীলেন্দু কেমন বিরক্ত বোধ করল, বলল, তোমার মাথা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গিয়েছে মহীদা; এসব ছেলেমানুষির কোনও মানে হয় না। আমি অন্তত বুঝতে পারছি না।

মহীতোষ রাগ করল না, বিরক্তও হল না; বলল, তোরা যে জিনিসগুলোকে তুচ্ছ ভাবিস, সেগুলো অত তুচ্ছ নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি সমাজনীতি সব নীতির কাজ হল গোড়ার ব্যাপারটা অবজ্ঞা করা।

ঠাট্টা করে নীলেন্দু বলল, তুমি কি তা হলে গোড়ায় জল ঢালছ?

কথাটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে মহীতোষ বলল, আমার সব কথা তো শুনলি না–আগে থেকেই চেঁচাতে শুরু করলি। নীলু, তোর স্বভাবটা পালটে যাচ্ছে, তুই একেবারে ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসেম্বলির এম-এল-এ হয়ে যাচ্ছিস! বলে মহীতোষ হেসে ফেলল, জোরেই।

নীলেন্দুও হাসল। কেমন এক বিরক্তির মধ্যে এই হাসি যেন অবস্থাটাকে সহনীয় করে তুলল। নীলেন্দু বলল, বলো, তোমার কথা শুনি।

মহীতোষ তার উদ্দেশ্যের কথা বলতে লাগল।

ওই যে দশ বিঘে মতন জমি–যাতে এক-আধ বছর চাষবাসের চেষ্টা করে কোনও সুফল পাওয়া যায়নি, ওই জমিটাকে মহীতোষ কাজে লাগাবে। কাজে লাগাবে ধান চাষ করে নয়, অন্য রকম ফসল ফলিয়ে। জমির মাটি যেরকম তাতে তরিতরকারির ফসল হতে পারে। জল কাছাকাছি পাওয়া যাবে। সামান্য দূরে একটা ঝিলের মতন আছে, প্রচণ্ড গ্রীষ্মে শুকিয়ে আসার মতন হলেও সারা বছরই তাতে অল্পস্বল্প জল থাকে। সেই জল বয়ে আনার জন্যে ছোট করে নালা কাটা শুরু করেছে মহীতোষ, ওই যে মাটির স্তূপ ওর গায়েই সেই ঝিল।

মহীতোষ বলল, ধানের জমি স্টেশনের পুব দিকে। ধানের জমি এখনও হাতে আসেনি। কথাবার্তা চলছে। শীঘ্রি হয়তো হাতে আসবে।

এ ছাড়া, মহীতোষ একটা তাঁতঘর বসাবার ব্যবস্থা করছে। মোটামুটি কাজও এগিয়েছে খানিকটা। মাস দেড়েকের মধ্যে কাজ শুরু করতে পারবে বলে মনে হয়।

নীলেন্দু ব্যঙ্গ করে বলল, একটা কুমোরপাড়া বসাবে না?

মহীতোষ বলল, বসাতাম যদি এখানে কুমোর থাকত। তবে ইটের ভাটিখানা বসাতে পারি। শুনেছি এখানে ইট করার সুযোগ রয়েছে।

রোদ আরও গাঢ় তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সামনের প্রান্তর যেন রং ধরার মতন দেখাচ্ছিল উজ্জ্বল হলুদ। এক জোড়া পাখি উড়ে যাচ্ছিল। বাতাস রয়েছে। দিগন্তে কালচে রেখার মতন গাছপালার মাথায় আকাশ লুটিয়ে পড়েছে।

নীলেন্দুর ভাল লাগছিল না। মহীদা এতটা নির্বোধ হতে পারে তার জানা ছিল না আগে। এমনকী তার বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করছিল না, কোনও মানুষ এই বয়েসে এমন একটা ছেলেখেলায় নামতে পারে।

যেন ক্লান্ত বিরক্ত হয়েই নীলেন্দু আবার একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল,  তুমি তা হলে এই সব করবে ঠিক করেছ?

হ্যাঁ।

এতে কী হবে?

 কিছু লোক খেতে পারবে।

 তাই কী?

তোর সন্দেহ হচ্ছে? তা হলে জিজ্ঞেস করি, এখানকার লোকগুলো খায় কী? কী খেয়ে তারা বেঁচে আছে? এটা তোমাদের কলকাতা শহর নয় যে গভর্নমেন্ট রেশন দিয়ে এদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এখানে কোনও কারখানা নেই, কাজেই চাকরিবাকরির কথা ওঠে না। জমি কুপিয়ে আর বাইরে গিয়ে দিনমজুরি করে এদের জীবন কাটে। ..আমি হিসেব করে দেখেছি, যদি আমার কাজকর্ম ঠিকঠিক মতন চালাতে পারি তাহলে এখানকার পঁচিশ-ত্রিশটা পরিবার মোটামুটি খেতে পরতে পারবে।

তুমি কি পঁচিশ ত্রিশটা পরিবারকে মোটামুটি খাওয়ানো যথেষ্ট মনে করো?

 যথেষ্ট মনে করি না,নীলু। কিন্তু সমস্ত মানুষেরই সাধ্য আছে। আমার সাধ্যে এইটুকুকুলোতে পারে আপাতত। যদি বলিস আমি কি আরও বড় কিছুর কথা ভাবি না, তা হলে বলি, ভাবি। কিন্তু সে দিবাস্বপ্ন দেখে লাভ কী? আমি যেটুকু করতে চাইছি তাতেই আমার অনেক টাকার দরকার। সেই টাকার জন্যেই মরছি। এর বেশি এখন আর কিছু করার উপায় আমার নেই।

নীলেন্দু সিগারেটের কোনও স্বাদ পেল না। মুখ থেকে ধোঁয়াটা ঠেলে বের করে দিল। পরে বলল, তোমার এই সব কাজ কোনও কাজ নয়। বাস্তবিকপক্ষে তুমি কিছুই করছ না। করতেও পারবে না। মাসকয়েক আলু-বেগুনের চাষ নিয়ে থাকবে তারপর ছেড়ে দেবে।

মহীতোষ এবার যেন ক্ষুব্ধ হল। বলল, কেন?

 কেন, সেকথা আমায় জিজ্ঞেস করছ! আশ্চর্য!

তবু শুনি ।

এ তোমার কাজ নয়, মহীদা। তুমি ভদ্র পরিবারের শিক্ষিত ছেলে, হয়তো তত বড়লোক নও, কিন্তু গরিব ঘরের ছেলেও নও। শহুরে মানুষ তুমি। চাষ আবাদ ফসলের তুমি কিছু জানো না, মাটিতে সোনা ফলানো তোমার কর্ম নয়। যদি তুমি চাষি পরিবারের ছেলে হতে আমি তোমায় বাহবা দিতাম। এটা তোমার খেয়াল।

মহীতোষ বলল আমি তো বলিনি আমি নিজের হাতে চাষ করছি। যারা এসব কাজ করত তারাই করবে।

তুমি তা হলে ফাইনান্স করছ?

 করছি। শুধু তাই নয়, ওদের সঙ্গেও থাকছি।

বাঃ! জমি তোমার, আশা করছি–জমি চাষের গরু, লাঙ্গল এসবও তোমার হবে। তাঁতঘরের তুমি মালিক হবে, যন্ত্রপাতির মালিকানাও তোমার থাকবে। তার মানে তুমি এখানে জমি জায়গা তাঁতঘরের মালিকানা ভোগ করবে, আর কিছু লোক তোমার লাভের জন্যে খাটবে। এই তো?

মহীতোষ কিছুক্ষণ নীলেন্দুকে দেখল। যেন তার কোথায় ঘা লেগেছে। সামান্য গম্ভীর গলায় বলল, না, আমি মালিকানা ভোগ করব না।

নীলেন্দু তাকাল।

দেবীর ওই বাড়ি, আর তার কিছু গচ্ছিত টাকার মালিকানাও আমার নয়, নীলু। আমার কোথাও কোনও মালিকানা নেই। …আমি যা করছি তার মালিকানা আমার সঙ্গে যারা থাকবে তাদের সকলের। এটা আমার মুখের কথা নয়। আইনসঙ্গতভাবে সেই ব্যবস্থাই করা হচ্ছে।

টাকাটা তো তোমাদের?

দেবীর কিছুটা, আমার যৎসামান্য। …আমাদের কলকাতার পুরনো বাড়ির আমার অংশটা পরিতোষ বেচে দিতে পারলে সেই টাকাটা আমি এই বাবদ ঢালব। টাকার আমার বড় দরকার। মহীতোষ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

নীলেন্দু বলল, তুমি বলতে চাইছ, মহীতোষ অ্যান্ড কোম্পানির ফার্মিং-এর ব্যাপারটা তুমি এখানকার গরিবগুরবোদের দান করছ?

অসন্তুষ্ট হল মহীতোষ, বলল, দান নয়, দায়। এই দায় ওদের সকলের। যেখানে নিজের বলে কিছু থাকে না সেখানে মানুষ মনের টান পায় না। মায়ায় জড়ায় না। যদি ওই জমি, ফসল, ওই তাঁত–সবই তার নিজের বলে মনে করে তা হলে সে নিজেকে কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলবে। আমাদের দেশের মানুষের বিশেষ করে যারা জমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের শ্রমশক্তির কতটা ব্যয় হয় আর কতটা হয় না তুই জানিস?

নীলেন্দু অ-মনোযোগের গলায় বলল, শুনেছি যেন কোথায়!

একটা মোটামুটি হিসেব, বছরের মধ্যে ছ-সাত মাস…। এই ছ-সাত মাস আমাদের দেশের গ্রামের মানুষ তার শ্রম-ক্ষমতার অপব্যয় করে। এই ক্ষতির পরিমাণ কত জানিস।

নীলেন্দু মাথা নাড়ল। বলল, মহীদা, তুমি আমায় কাগজের হিসেবের ফাঁদে ফেলো না। ওটা আমি বুঝি না। বুঝতেও চাই না। …আমি শুধু বুঝি, এই কাঠামোয় কিছু হবে না–হবার নয়। …তোমার এই চেষ্টা আমার কাছে ছেলেখেলা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। আমাকে তুমি মাপ করো।

মহীতোষ আর কিছু বলল না।

আরও সামান্য বসে থেকে গাছের ছায়া থেকে উঠে পড়ল দুজনে। বাড়ির দিকে ফিরতে লাগল।

খানিকটা হেঁটে এসে নীলেন্দু যেন আপনমনে বলল, মানুষ কেমন বদলে যায়। আমি স্বীকার করি, জীবনটা ছাঁচে ঢালা ধাতব পদার্থনয়, তার নিজের একটা গতি আছে, আস্তে আস্তে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তার অদলবদল ঘটে যায়। কিন্তু এরকম নাটকীয় বদল আমি দেখিনি। অন্তত তোমার বেলায় ভাবিনি, মহীদা।

মহীতোষ কোনও জবাব দিল না।

তুমি, নীলেন্দু মহীতোষকে আঙুল দেখিয়ে বলল, সেদিনও বড় বড় কথা বলতে। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে তোমার মাথাব্যথার অন্ত ছিল না। গলায় তখন তোমার কী ঝাঁঝ, রক্তে যেন আগুন ছিল, বিপ্লব, রেভলুশন, এই অথরিটি, করাটেড সিস্টেম এর মধ্যে থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যায় তার কথা বলতে। আর আজ তুমি জমিতে আলু বেগুন ঝিঙে ফলাবার কথা বলছ! আশ্চর্য! বলতে বলতে নীলেন্দু কেমন ঘৃণার চোখে মহীতোষের দিকে তাকাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *