কলকাতা – শ্রীপান্থ (নিখল সরকার)
শিল্পী গণেশ হালুই
প্রিয়বরেষু
.
প্রসঙ্গত
এ বই কলকাতার ইতিহাস নয়। না ধারাবাহিকতায়, না বিস্তারে। তার সহজ কৈফিয়ত, আমি পেশাদার ঐতিহাসিক নই। এ বইয়ের তবু একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। এক সময় কলকাতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। নেশার ঘোরে তখন এক গ্রন্থাগার থেকে আর এক গ্রন্থাগার, এক বই থেকে আর এক বইয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই পরিক্রমায় প্রথম জানার উত্তেজনায়, পাঠককেও কিছু জানাবার তাগিদ বোধ করি। হয়তো মনে মনে তাঁদের চমকে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন একটা বাসনাও ছিল। সেই সূত্রে দৈনিক কাগজের পৃষ্ঠায় সীমিত পরিসরে এই লেখালেখি। পাঠকের আগ্রহে কয়েক দশক আগে তা নিয়ে দুটি সংকলনও বের হয়েছিল। অবাক কাণ্ড, অকিঞ্চিৎকর সেই রচনা সংগ্রহ দুটির ভাগ্যে কিছু সমাদরও জুটেছিল। অনেক বছর পরে আবার এক সংকলনের পিছনেও রয়েছে পাঠকের তাগিদ। অনুমান করি তাঁদের একাংশ নতুন প্রজন্মের পাঠক। ভাবতে ভাল লাগে, তাঁরাও আমার কলকাতা সম্পর্কে এলোমেলো উপাখ্যানে আগ্রহী। সম্ভবত তার এক কারণ, এ বইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, যা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত, এবং সম্ভবত সর্বক্ষেত্রে ইতিহাসসম্মতও নয়। বস্তুত, এ বইয়ে এমন অনেক রচনা আছে যার মূল উপজীব্য ইতিহাসের পাদটীকায়ই লভ্য।
এই সংকলনে একটি ‘নির্দেশিকা’ও যুক্ত হল। সেটি যাঁরা পড়তে পড়তে আরও পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবেন তাঁদের জন্য। ‘নির্দেশিকা’ রচনায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন: পি. থানকাপ্পন নায়ার, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, বিজিতকুমার দত্ত, রমাকান্ত চক্রবর্তী, অমিত রায়, সুনীল দাস, ভাস্কর ভট্টাচার্য ও অর্ক সরকার। তাঁদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পুরানো দিনের ছবি অবলম্বন করে আশ্চর্য সুন্দর নতুন ছবিতে মমতা নিয়ে বইটিকে সাজিয়েছেন নবীন শিল্পী কৃষ্ণেন্দু চাকী। তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ত্রুটিপূর্ণ কপি সংশোধন করে বইটিকে যথাসম্ভব নির্ভুল করার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছেন পার্থপ্রতিম দাশ। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আন্তরিক ধন্যবাদ প্রাপ্য আনন্দ পাবলিশার্স-এর বাদল বসুরও। বস্তুত, তাঁর সধৈর্য ও নিয়মিত চাপ না থাকলে এই সব রচনা হয়তো এখনও ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে থাকত।
শ্রীপান্থ
কলকাতা
শ্রাবণ, ১৪০৬
.
কলকাতার নাম
কলকাতার নাম কলকাতা না হয়ে বোম্বাই, ডোভার বা হংকং হল না কেন? মিসেস হোয়াই যদি একান্তই তা জিজ্ঞেস করে বসেন তবে মিস্টার বিকজ-এর পক্ষে চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় কী!
এই অদ্ভুত নামটি নিয়ে অনেক ভেবেছেন মিস্টার বিকজ। ভাবতে ভাবতে এক সময় কলকাতাকে ঠেলে দিয়েছিলেন সোজা কালীঠাকুরের কোলে। হ্যাঁ, কালী থেকেই কলকাতা। কলকাতা কালীর শহর। সিদ্ধান্তটা মোটামুটি ভালই লাগল মিস্টার বিকজ-এর। তিনি তক্ষুনি ছুটলেন মিসেস হোয়াইকে খবরটা জানাতে। কিন্তু সহসা তাঁর মনে পড়ে গেল স্বয়ং কালীর উৎপত্তির কথা। ‘ক্রোধের ঔরসে তাহার ভগ্নী হিংসার গর্ভে কালীর জন্ম। কালী স্বীয় ভগ্নী দুরুক্তির পাণিগ্রহণ করেন। ভয় উহার পুত্র, মৃত্যু কন্যা।’ কলকাতা মিসেস হোয়াই-এর ভালবাসার শহর। এ শহরের এমন বীভৎস আদি ইতিহাস শুনলে নিশ্চয় শকড হবেন তিনি। তাঁর মনে দাগা লাগবে। সুতরাং গবেষণার ফলটাকে মনে মনে হজম করে ফেললেন মিস্টার বিকজ। কলকাতার সঙ্গে কালীর যোগাযোগের কথাটি অতঃপর আর জানতে পেল না কেউ।
কিন্তু মিসেস হোয়াইকে খুশি না করলেও নয়। বাধ্য হয়েই মিস্টার বিকজ প্রত্নতাত্ত্বিক সাজলেন। তিনি জানেন, কলকাতা ব্যাবিলন বা হরপ্পার মতো প্রাচীন শহর নয়। এমনকী তার প্রতিবেশী শহরগুলোর মতোও প্রবীণ নয়। ঢাকা রোমান আমলের শহর। রাজমহলে রাজত্ব করেছেন পর পর একশজন রাজা। নদিয়া ছিল পাঁচ শ’ বছর ধরে বাংলার অক্সফোর্ড। আর মুর্শিদাবাদ? কলকাতা যখন সামান্য একটা মফস্বল গঞ্জও নয়, মুর্শিদাবাদ তখন লন্ডনের চেয়েও জমকালো শহর। ক্লাইভ নিজে বলেছেন সে কথা।
তা হলেও শাবল নিয়ে নামতে দোষ কী! মিস্টার বিকজ কলকাতার পুরানো পুকুরগুলোর তল হাতড়ালেন, এখানে ওখানে মাটি খুঁড়লেন, তারপর সগর্বে এসে হাজির হলেন মিসেস হোয়াই-এর বৈঠকখানায়। মিসেস হোয়াই তখনও চোখ বুজে একমনে ‘হোয়াই, হোয়াই’ জপে চলেছেন। ‘হোয়াই ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা? হোয়াই?’
‘বিকজ’—সর্বাঙ্গে মাটিমাখা মিস্টার বিকজ এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। ‘বিকজ, ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা’। মিস্টার বিকজ কৈফিয়ত দিলেন—‘কিন্তু মাদাম, কলকাতা প্রাচীন সিটি। আমি তা প্রমাণ করতে পারি। আমার হাতে তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।’
মিসেস হোয়াই বললেন—‘দেখি।’
মিস্টার বিকজ পকেটে হাত দিলেন। তারপর কীসের যেন ছোট ছোট বীজ বের করলেন। মিসেস হোয়াই-এর হাতে সেগুলি তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই আমার প্রমাণ।’
মিসেস হোয়াই দেখলেন। তাঁর চোখে আবার জিজ্ঞাসা দেখতে পেলেন মিস্টার বিকজ। তিনি বললেন—মাদাম, বোধহয় জানতে চাইছেন এগুলো কীসের বীজ? এগুলো খাপড়া ফলের বীজ। যে-কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক জানেন এর কী মূল্য। যেখানে এই বীজ পাওয়া যায়—’
মিসেস হোয়াই ছুড়ে ফেলে দিলেন বীজগুলো। ‘আই অ্যাম নো বোটানিস্ট। আমি বোটানিস্ট নই। তবুও আমি অনুমান করছি, আপনি বলতে চান—যেখানে এই বীজ পাওয়া যায়, সেখানে অনেক কাল আগে গাছ ছিল। গাছ কেন, বন ছিল হয়তো এখানে। কিন্তু আমি চাই, এখানে যে শহর ছিল তার প্রমাণ।’
মিস্টার বিকজ দমলেন না। তিনি অন্য পকেটে হাত দিলেন। এবার বের হল দুটো লোটা (সঙ্গে কম্বল ছিল না কিন্তু) ওরফে দুখানা ঘটি। একখানা মাটির, অন্যখানা পিতলের।
কিন্তু তাতেও মন ভরানো গেল না মিসেস হোয়াই-এর। তিনি বললেন, এবার না হয় প্রমাণ হল, এখানে মানুষ ছিল। (মিসেস হোয়াই আধুনিক সমাজতত্ত্বে, নৃতত্ত্বে যথেষ্ট পারদর্শিনী হলে হয়তো বলতেন—সেই মানুষগুলোর মধ্যে বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত দুটি শ্রেণীও ছিল)। কিন্তু নিশ্চয় এ কথা প্রমাণ হল না যে, এখানে শহর ছিল।
মিস্টার বিকজ এবার ঐতিহাসিকের শেষ নজরানাটি বের করলেন। তিনি কিছু মুদ্রা টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন—‘কালীঘাটের কাছে মাটি খুঁড়ে এগুলো পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলো কবেকার জানেন মাদাম? গুপ্তযুগের। এই তিনটে হচ্ছে তৃতীয় চন্দ্রগুপ্তের, যাঁর উপাধি ছিল দ্বাদশাদিত্য, তাঁর। আর এই পনেরোটি হচ্ছে বিষ্ণু গুপ্তের।
মোটেই বিস্ময়ের লক্ষণ দেখা গেল না মিসেস হোয়াই-এর চোখে মুখে। তিনি হাসলেন।—‘আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, কোনও পতুর্গিজ বা ডাচ বা আমাদেরই কোনও পিন্সটন বা লৌরি কনৌজের কাছ থেকে জোগাড় করে এগুলো কলকাতায় এনেছিল। কালীঘাটে বেড়াতে গিয়ে সেগুলো খোয়া যায়। শেষে এশিয়াটিক সোসাইটির এক দরোয়ান একদিন কুড়িয়ে পেল। এবং বাজারে চালাতে না পেরে শেষে দান করে দিল সোসাইটিকে। সোসাইটি দেবে হয়তো ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে (এখন লাইব্রেরি)। ‘সো, ইউ সি, ডিয়ার বিকজ, দিস ইজ নট কনভিনসিং। আমার বিশ্বাস হয় না এসব প্রমাণ।’ ঠোঁট উলটে ঘোষণা করলেন মিসেস হোয়াই।
মিস্টার বিকজ প্রমাদ গুনলেন। কী-ই বা করতে পারেন তিনি। সত্য বটে, বিপ্রদাস পিপলাই পঞ্চম শতকের লোক। এবং তাঁর ‘মনসামঙ্গল’-এ কলকাতার কথা আছে। মুকুন্দরামের চণ্ডীতেও তা আছে বলে তিনি শুনেছেন। আর ‘আইন-ই-আকবরি’তে যে আছে সে তো তিনি নিজেই পড়েছেন। কিন্তু কলকাতার নাম আর তার উৎপত্তি তো এক কথা নয়। নাম তো কতই থাকতে পারে। কিন্তু তার উৎপত্তির কারণ কোথায় পাবেন তিনি। তা ছাড়া স্থানীয় বিজ্ঞজনেরাও বলেন, ‘মনসামঙ্গল’ আর ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলকাতা প্রসঙ্গ প্রক্ষিপ্ত।
তা ছাড়া নেটিভদের ওপর নির্ভর করতে যাওয়ার অনেক বিপত্তি। কে জানে, ওঁরা প্রত্যেকেই হয়তো দাবি তুলবেন—আমিই কলকাতার উৎপত্তি। গোবিন্দপুর নিয়ে সেবার যা হল। বিশেষজ্ঞরা বললেন—এই গাঁ-খানার আদি গোবিন্দ দত্ত। প্রতাপাদিত্যের কাকা রাজা বসন্ত রায়ের কর্মচারী ছিলেন ভদ্রলোক। ভগবান গোবিন্দজি একদিন তাঁকে স্বপ্নে বললেন—মাটি খোঁড়, টাকা পাবি। গোবিন্দবাবু কালীঘাটের কাছে একটা পছন্দসই জায়গা খুঁড়লেন। অনেক টাকা পাওয়া গেল সেখানে। সুতরাং গোবিন্দজির নামে তিনি গ্রাম পত্তন করলেন একখানা। নাম তার গোবিন্দপুর। গোবিন্দপুর এখন কলকাতার ভুবনবিখ্যাত ময়দান। কিন্তু আশ্চর্য এই, শেঠরা এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধরেরা বলেন—তাঁদের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউ থেকেই গোবিন্দপুর। হাটখোলার দত্তরা এবং কুমারটুলির মিত্রদের মতে গোবিন্দপুরের আদি তাঁদের পূর্বপুরুষ জনৈক গোবিন্দবাবু।
সুতানটি নিয়েও অনেক তর্ক। কেউ কেউ বলেন—দুটো খুব ডেলিকেট জিনিস নিয়ে সুতানটি। সুতা এবং নটীর ব্যবসা থেকেই তাদের মতে সুতানটি। আবার কেউ কেউ বলেন, দূর, এসব বাজে কথা। আসলে সুতানটির উৎপত্তি অন্য জিনিস থেকে। জাহাঙ্গিরের সময়ে মানসিংহ বড়িশার জনৈক লক্ষ্মীকান্তকে কলকাতা জায়গির হিসেবে দান করেন। তিনিই বিখ্যাত সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি। এই চৌধুরীদের ঠাকুর ছিলেন শ্যামরায়। শ্যামরায় ঠাকুরের মন্দিরের সামনে ছিল বিরাট এক চন্দ্রাতপ বা ছত্র! পুজোর শেষে এই ছত্রের নীচে প্রতিদিন প্রসাদ বিতরণ বা লুঠ হত। সেই থেকেই ছত্রলুট। ছত্রলুট থেকে সুতালুটী। ক্রমে লুটী থেকে নুটী। অবশেষে—নটী/নটি। আবার কারও কারও মতে নটি নয়,—সুতানুটি। সুতা মানে তাঁতির তাঁতের জন্য দরকারি সুতো, তার গুটোনো ছোট ছোট বান্ডিলগুলো হচ্ছে নুটি। কে না জানেন, সাবেক কলকাতায় তাঁতই ছিল প্রধান শিল্প,—ইন্ডাস্ট্রি।
মিস্টার বিকজ জানেন মিসেস হোয়াইকে এসব কথা বললে তিনি হেসেই খুন হয়ে যাবেন। কিন্তু জোব চার্নকের ওপর তো দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না! চার্নক কলকাতার আদি এ কথা যে ঐতিহাসিক ভুল। তিনি আজকের কলকাতাকে সুতানটি বলেই জেনে গেছেন। ১৭০০ সনের ২৭ মার্চ অবধি কোম্পানির সাকুল্য ডেসপাচ-এ কলকাতা বলতে সুতানটিই। এপ্রিল থেকে কলকাতা।
সুতরাং ইংরেজদের আশা ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়ে মিস্টার বিকজ এবার হিন্দুস্থানি হলেন। কোম্পানির সিপাইদের মতো তিনি গান ধরলেন—
‘কাল গৈয়ে কলকাত্তাকি, যিনকে পূজা ফিরিঙ্গি কিন
বাঙ্গালি কো মুলুক ধন দৌলত দখল করলিন।’
মিসেস হোয়াই ভুরু কোঁচকালেন।—‘মানে?’
‘মানে, কালী থেকে কলকাতা’—জবাব দিলেন মিস্টার বিকজ। ‘কালী + থা = কলকাত্তা।’ একসময়ে এখানে কালী ছিলেন। তিনি উঠে গিয়ে যেই কালীঘাটে বসলেন, তক্ষুনি এই জায়গার নাম হয়ে গেল কলকাতা।
মিসেস হোয়াই প্রশ্ন তুললেন—‘কেন উঠে গেলেন তিনি?’
মিস্টার বিকজ বললেন সে অনেক কথা। আপনাকে তা হলে শৈব আর শাক্তের পার্থক্য জানতে হবে, বৌদ্ধ মহাযান আর কাপালিকদের সাধনভজন পদ্ধতি বুঝতে হবে। তার চেয়ে শুধু এইটুকু জেনে রাখুন—তখন বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর ছিল কালীক্ষেত্র, আর তার অধীশ্বরী কালী বাস করতেন কলকাতায়। কাপালিকরা একদিন তাকে নিয়ে পালিয়ে গেল কালীঘাটের ব্রনে। ঘটনাটাকে একটু ঐতিহাসিক রং দেওয়ার জন্য একজন ইংরেজ ঐতিহাসিককে কোট করলেন মিস্টার বিকজ। ‘জানেন তো, তিনি বলেছেন দক্ষিণেশ্বরও এককালে ছিল বাংলার রাজধানী।’
মিসেস হোয়াই গম্ভীর হয়ে উঠলেন। তা না হয় ছিল। কিন্তু কালী থেকে কলকাতা হবে কী করে? তা হলে তো মিস্টার বিকজ থেকেও বসরা হতে পারে, মিসেস হোয়াই থেকে হতে পারে সাংহাই।
‘আচ্ছা, তা হলে কালী দেবীকে না হয় বাদই দিচ্ছি’, মিস্টার বিকজ আবার মাথা চুলকোতে আরম্ভ করলেন। তারপর মিসেস হোয়াই-এর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলে উঠলেন—‘যদি বলি কলকাতা হয়েছে ‘কিল কিলা’ থেকে তা হলে আপনি মানবেন তো? রাধাকান্ত দেব কিন্তু তাই বলেছেন। তিনি বলেছেন—কবি রামের বইতেও নাকি তাই আছে।’
‘কিলা বা কেল্লা থেকে কলকাতা’, মিসেস হোয়াই এবার হেসেই অস্থির।
মিস্টার বিকজ বললেন—‘হাসছেনই যখন, তখন শেষ থিওরিটি শুনেই হাসুন। কলকাতার নামকরণের শেষ গবেষণার ফলটি কী জানেন? কলি মানে চুন, আর কাতা মানে ভাটি—অর্থাৎ, কলকাতা বা কলিকাতা হচ্ছে চুনের ভাটি। এখানে জেলেদের বাস ছিল আপনারা শুনেছেন। কিন্তু, এটা নিশ্চয় জানেন না যে—মাছের চেয়ে তাদের বেশি নজর ছিল ঝিনুক আর শামুকের ওপর। ওসব পুড়িয়ে চুন তৈরি হত তখন এখানে। সেই চুন বা কলি থেকেই কলিকাতা। মোটামুটি সবাই (কলকাতা করপোরেশন সহ) এই যুক্তিটা মেনে নিয়েছেন, সুতরাং আশা করি আপনিও মানবেন।’ একজন গবেষক খোঁজ নিয়ে দেখেছেন বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় এবং নদীর ওপারে হাওড়ায়ও কলকাতা আছে। আর ওই ঠিকানাগুলোর সঙ্গেও ছিল চুনের সম্পর্ক।
মিসেস হোয়াই নির্বাক। বোঝা গেল, এমন সর্বসম্মত সিদ্ধান্তটিকে তিনি প্রকাশ্যে বাতিল করতে যেমন সাহস পাচ্ছেন না, মনে মনে তেমনি মেনে নিতেও পারছেন না। আবার সমস্যায় পড়লেন মিস্টার বিকজ। তিনি জানেন মিসেস হোয়াই দুনিয়ার অনেক সিদ্ধান্তের জননী। তাঁর কাছে যেমন-তেমন যুক্তি ওরফে গোঁজামিল সম্পূর্ণ অচল। যদিও কলকাতা নামের আদি হিসাবে চুন এবং কালী দুটোই তাঁর মনঃপূত হয়েছিল, তবুও মিসেস হোয়াই-এর মুখ চেয়ে আবার তাঁকে সন্ধানে বের হতে হল।
মিস্টার বিকজ এবার ফিরে এলেন ডাচ হয়ে। মিসেস হোয়াই তখনও অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছেন আর বলছেন—‘হোয়াই, হোয়াই? হোয়াই ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা?’
মিস্টার বিকজ এসে বললেন—‘বিকজ, ক্যালকাটা ওয়াজ গলগাথা।’
‘গলগাথা? মানে?’ থমকে দাঁড়ালেন মিসেস হোয়াই।
মিস্টার বিকজ উত্তর দিলেন—‘মাদাম, ডাচ ভাষায় “গল” মানে মড়ার খুলি। “গলগাথা” মানে মরা মানুষের খুলিতে বোঝাই দেশ। কলকাতা তাই ছিল কি না প্রথম দিকে।’
‘প্রথম দিকে কেন, এখনও আছে। কলকাতা এখনও অবশ্যই নরককুণ্ড। কিন্তু তা হলেও এ শহরের আদি হিসাবে ডাচ পর্যটকদের মানতে পারি না আমি। আই অ্যাম সরি মিস্টার বিকজ। মিসেস হোয়াই মিস্টার বিকজের মতোই খাঁটি ইংরেজ। অসত্যকে সত্য বলে ঘোষণা করা যদিও এঁদের দুজনের কারও স্বভাব নয়, তবু প্রায়-সত্যকে সেধে এনে সত্যের আসনে বসিয়ে দেওয়াও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। বিশেষ, তাতে যদি ইংরেজদের গৌরবহানি হয়। সুতরাং ডাচরা বাতিল হয়ে গেল। ‘গলগাথা’ থেকে কলকাতা? অসম্ভব বলে রায় দিলেন মিসেস হোয়াই।
আবার মাথা চুলকোতে আরম্ভ করলেন মিস্টার বিকজ। সহসা দেবী অ্যাকসিডেন্টেশ্বরীকে মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি ধীরে ধীরে বললেন-‘কলকাতার কলকাতা নামটা নেহাতই অ্যাকসিডেন্ট মাদাম।’
মিসেস হোয়াই বললেন-‘কেমন?’
মিস্টার বিকজ বললেন—‘আমার মনে হয়, “খাল কাটা” থেকে আমাদের এই ক্যালকাটা হয়েছে মিসেস হোয়াই।’
‘খাল কাটা?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মারাঠা ডিচের নাম শুনেছেন তো মাদাম। কলকাতার লোকেরা বর্গীদের ঠেকাবার জন্যে তখন খাল কেটেছিল একটা। সেটাই মারাঠা ডিচ। কলকাতার লোকের নাম হয়ে গিয়েছিল তখন ডিচার। সুতরাং খাল কাটা থেকে ক্যালকাটা খুব অসম্ভব কি?’
মিসেস হোয়াই বললেন—‘অসম্ভব হয়তো ছিল না, কিন্তু এখন এই যুক্তি সম্পূর্ণ অবাস্তব। কেননা, আগেই আপনি বলে ফেলেছেন, ১৭০০ সনের এপ্রিল থেকে কলকাতা ক্যালকাটা। অথচ বর্গীদের টাইম-টেবিল দেখছি তার বেয়াল্লিশ বছর পরে…’।
লজ্জায় জিভ কাটলেন মিস্টার বিকজ। তা, আমারই ভুল হয়ে গেছে মিসেস হোয়াই। খাল কাটা নয়, আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম ঘাস কাটার কথা। সাহেব জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন জায়গা। ঘেসুড়ে ভাবল—সাহেব বুঝি জানতে চায় এ ঘাস কবেকার কাটা? সে বলল—কাল কাটা। সাহেব তক্ষুনি তার নোট বইতে টুকে ফেললেন—ক্যালকাটা।
‘হাসছেন কেন? হতেই পারে। সিরাজউদ্দৌলাকে আমরা “সার রজার ডাউলার” করতে পেরেছি, জুম্মামারীকে জেমস অ্যান্ড মমারি, আর এটুকু পারব না?’ মিস্টার বিকজ সিরিয়াস হয়ে উঠলেন—‘শ্রীরামপুর কোথা থেকে হয়েছে জানেন তো? গরিবেরা সেখানে ডাচদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করত আর বলত—“সার, আই অ্যাম পুওর, অ্যাম পুওর—তাই থেকে হল সি-রাম পোর।” এবার নিজেও আর না হেসে পারলেন না মিস্টার বিকজ।
তাঁদের এই হাসির মধ্যেই বোমা পড়ল একখানা। হাতবোমা। এক অখ্যাত ঐতিহাসিক নিক্ষেপ করলেন সেটি। তিনি বললেন—ক্যালকাটার আদি কালীও নয়, কলিও নয়। ক্যালকাটার আদি তোমরা—ইংরেজরা। ক্যালকাটা তোমাদেরই সৃষ্টি, বন্ধু!
মিসেস হোয়াই এবং মিস্টার বিকজ দুজনেই সাগ্রহে শুনতে বসলেন সে কাহিনী।
ঐতিহাসিক মুচকি হেসে বললেন—কালিকটকে মনে পড়ে তোমাদের? দক্ষিণোপকূলের সেই কালিকট?
‘আলবত, ওখানেই তো প্রথম ঠেকেছিল পশ্চিমের জাহাজ। নোঙর ফেলেছিল পতুর্গিজরা। কালিকটের তখন কী ঐশ্বর্য!’ মিস্টার বিকজ এগিয়ে এসে জানিয়ে দিলেন—কালিকট অপরিচিত নয় তাঁদের কাছে।
ঐতিহাসিক আবার হাসলেন। কালিকটের ওই ঐশ্বর্যই হল কলকাতার আদি। ইউরোপে তখন কালিকটের ভীষণ খ্যাতি। ওখানকার জিনিসপত্তরের ভীষণ কদর। ইন্ডিয়ান জিনিস বলতেই লোকে জানে কালিকটের জিনিস। আলবত এই জিনিস ‘মেড ইন কালিকট’। সুতরাং কালিকটকে নিয়ে বিপত্তিতে পড়লেন ইংরেজরা। ওখানে কোনওমতেই স্থান করতে পারলেন না তারা। ভাসতে ভাসতে অবশেষে ঠেকলেন এসে সুতানটীর তটে। ফ্যাকটরি একটা হল বটে, কিন্তু ‘মেড ইন হুগলি’ বা ‘মেড ইন সুতানটি’ বললে কে কিনবে তাদের জিনিস। ইউরোপে পতুর্গিজদের কালিকট যে তখন বাজারের রাজা।
সুতরাং—ঐতিহাসিক এবার উকিল হলেন। ‘সুতরাং, ইংরেজ ব্যবসায়ীরা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন। কী উপায়?’
একজন বুদ্ধিমান ছিলেন তাঁদের মধ্যে। তিনি বললেন—‘উপায় অতি সহজ। নামাও সব প্যাকিং বাক্স আর বস্তা। উপায় আমি এক্ষুনি বাতলে দিচ্ছি।’
তাই করা হল। তিনি কালির ডিবেতে ব্রাশ ডুবিয়ে বস্তার গায়ে বড় হরফে লিখে গেলেন ‘KALKATA’। কালিকটও তখন ‘কে’ দিয়ে শুরু। বানানটাও অনেকটা এরকম। সুতরাং, এ ফাঁকি আর ধরে কে? খদ্দেররা যদি একখানা ‘এ’র উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি নিয়ে ভাবিত হয়েই ওঠে, তবে আর তারা কীসের খদ্দের? কেমন করে বলা যাবে তারা ‘ফরেন গুডস’-এর সমজদার! সুতরাং ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ‘হুররা’ দিয়ে উঠলেন। সাবাস বন্ধু, সাবাস। সুতানটি সেদিন থেকেই কলকাতা।
মিসেস হোয়াই এবার নির্বাক। মিস্টার বিকজ বাকরুদ্ধ। তাঁদের মুখ খোলার আগেই ঐতিহাসিক বলে চললেন, তাই যদি না হবে তবে আলিনগরে রাজি হলে না কেন তোমরা? কেন তবে মিরজাফরকে দিয়ে লিখিয়ে নিলে যে আলিনগরকে ‘ক্যালকাটা’ করতে অমত নেই তাঁর? পলাশীর যুদ্ধের চেয়েও এ খবরটা দেশে পাঠানোর জন্যে কেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে তোমরা? কেন? তা মন খারাপের কিছু নেই, ভাই আমরাও তা করি। বড়বাজারে জিনিস বানিয়ে ছাপ লাগাই ‘মেড ইন ইংল্যান্ড’। নয়তো, ‘মেড অ্যাজ জার্মানি’। এ তো আর মিথ্যে নয়। এটুকু অনৃতভাষণ আমাদের মহাভারতেও চলে। বলেই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
মিসেস হোয়াই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন—অ্যান্ড সো, ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা!
মিস্টার বিকজ মাথা চুলকে উত্তর দিলেন—‘আই ডু নট নো।’
কলকাতার দাম
কলকাতা শহরটাকে কোনওমতে একবার বেচে দিতে পারলে এক্ষুনি গিয়ে গঙ্গাস্নান করে আসেন—এ নগরীর এমন ওয়ারিস যে একেবারে একজনও নেই সেকথা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। তেমনি, থেকে থেকেই যাদের মনে হয় ‘সবসে বড়িয়া হত যদি কলকেত্তাটা হামার হত’ তাদের সংখ্যাও যে কেবলমাত্র কবি এবং উন্মাদের মধ্যেই নির্দিষ্ট, তাও বলা যায় না।
যদি এদেরই কেউ কোনও দিন এগিয়ে এসে জানতে চায়—‘কেতন লেগা’, তবে কী দাম চাইবে কলকাতা?
কলকাতার নগর-সভা কানে পেন্সিল গুঁজে খাতা খুলে বলবে—চারশ কোটি টাকা। তাদের অ্যাসেসমেন্টের মতে কলকাতার নাকি তাই দাম।
অপজিশনের সাবধানী সদস্য টেবিল চাপড় দিয়ে ঘোষণা করবেন—মিথ্যে কথা। ওসব হিসেব মিথ্যে, বোগাস।
একজন খপ করে নগর-সভার কান থেকে পেন্সিলটি তুলে নিয়ে হিসেব কষতে বসে যাবেন। দৈর্ঘ প্রস্থ গুণ করলে কলকাতার ক্ষেত্রফল সাঁইত্রিশ বর্গ মাইল। এর মধ্যে ছাব্বিশ বর্গ মাইল ফসলী। অর্থাৎ ঘরবাড়িতে বোঝাই। বাকিটুকু উপস্থিত পতিত। অর্থাৎ, আপাতত সেখানে পথ, ঘাট, পার্ক ইত্যাদি। পথ বা পার্ক বিনা খরচে তৈরি হয় না সত্য, তা হলেও এত বড় শহরটাকে যে কিনবে তাকে ফাউ হিসেবে এগুলো ছেড়ে দেওয়া যায়। নয় কি?
তা হলেও দেখা যাচ্ছে, আমরা যদি কাঠা প্রতি জমির দাম ধরি গড়ে তিন হাজার টাকা এবং বাড়ির দাম ধরি গড়ে তার দ্বিগুণ তা হলে কলকাতার দাম দাঁড়ায় একুনে বারো’শ কোটি টাকা।
কলকাতা যদি কথা বলতে পারত তা হলে সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে থামতে বলত লোকটিকে। তারপর একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বুড়ো শহর বলত—‘হিসেবটা তোমার অঙ্ক হিসেবে নির্ভুল বন্ধু। হয়তো এই বুড়োর হাড়পাঁজরের দাম হিসেবে একটু বেশিই ধরে ফেলেছ তোমরা। ইটের দাম আর কত ছিল তখন! বেশি হলে হাজার তিন টাকা। এক’শ মণ জ্বালানির দাম ছিল দশ টাকা। আর মানুষের মজুরি দশ পয়সা।’
তা-ও লোকের জন্যে বিশেষ টাকা লাগত না, আমাদের টাকা যা লাগত সে লোক ধরে আনতে। এই ধরো আমাদের কেল্লাটা। এটা যখন তৈরি হয় তখন কালেক্টরকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিলেন ক্লাইভ: দেখো বাপু, লোক না থাকে, তোমাকে আমি মফস্বল থেকে চার হাজার মানুষ জোর করে ধরে আনবার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু কাজ আমার সময়মত শেষ হওয়া চাই।
সময় একটু লাগত বটে, কিন্তু খরচ বিশেষ হত না। তোমরা এখন এক কাঠা ইটের বাড়ির দাম ধরছ ছ’হাজার টাকা। কিন্তু ভাবতে পার কি, লাটভবনটা তৈরি করতে আমাদের লেগেছিল মোটে ১৩ লক্ষ টাকা। তা-ও, এ বলতে গেলে সেদিনের কথা। লর্ড ওয়েলেসলি তখন গভর্নর জেনারেল। নবাবি মেজাজ ছিল তার। তিনি বললেন: ভারতবর্ষকে যদি আমাদের শাসন করতেই হয়, তবে তা কুঁড়েঘরে থেকে করলে চলবে না। আমি প্রাসাদ চাই। শাসনও করব আমি বাদশাহের মতো, নীল আর মসলার খুচরা দোকানির মতো নয়। সুতরাং জমি কেনা হল। জমি যে সেকালে বিনা পয়সায়ও না পাওয়া যেত, তা নয়। খাজনাও সবাইকে দিতে হত না। কালেক্টার আপিসের নথিপত্র খুললেই দেখবে অনেক দলিলের নীচে লেখা আছে—’The rent is excused, being cutcherry servant.’ শেখ মানুল্লা কালেক্টার সাহেবের জমাদার। কোম্পানি বিনা পয়সায় চিরদিনের জন্য কয়েক বিঘা জমি দিয়ে দিল তাকে—’for pious uses,’ অর্থাৎ দেবসেবার জন্যে। ১৭৬৮ সনে জর্জ ভোসিটার্ট নামে একজন ৬৩১ বিঘা ১১ কাঠা ৮ ছটাক জমি পেয়ে গেলেন মাত্র বার্ষিক ৭৮৯ টাকা খাজনার বিনিময়ে। কেননা, ভদ্রলোক কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। প্রায়ই বিনেপয়সার জমি জুটত এই পর্তুগিজ ভদ্রোলোকটির ভাগ্যে। কখনও পুকুর কাটিয়ে জনসেবার জন্যে, কখনও অন্য কোনও ‘সাধু’ কারণে।
অথচ, জমি যে তখন অনেক ছিল এমন নয়। বাস করা যায় কলকাতায় এমন জমি ছিল মোটে ৮৪০ বিঘা। এর মধ্যে বাড়ি ঘর ছিল মোটে ২০৪ বিঘায়। আর ৪০০ বিঘা জুড়ে ছিল একখানা ‘গ্রেট বাজার’। আজ যার নাম বড়বাজার। জমির দাম ছিল তখন ইটের দামের চেয়েও অনেক কম। দেবোত্তরী, ব্রহ্মোত্তরী, কোম্পানিত্তরী যদি না করাতে পারো, তবে কড়ি ফেলে কিনে নাও না। দাম মোটে আট আনা বিঘা। সাহেবপাড়ার গা ঘেঁষে হলে অবশ্য একটু বেশি দিতে হবে। তখন দাম বারো আনা।
১৭১০ সন বা কাছাকাছি সময়ের কথা বলি। শহর তখন ধীরে ধীরে শহরের চেহারা নিচ্ছে। লম্বায় তার দেহ তখন প্রায় তিন মাইল। চওড়ায় এক মাইল। কোলে, পিঠে জমিও বিস্তর। প্রায় দু’হাজার বিঘার কাছাকাছি। কিন্তু জমি তখনও জলের দামে পাওয়া যায়। ১৭৫২ সনে হলওয়েল সাহেবের বিবরণমত কলকাতায় তখন মোট জমি ৫৪৭২ বিঘা। তার মধ্যে কোম্পানি নিজে ব্যবহার করে ৩১০ বিঘা। ৭৩৩ বিঘা খাজনাহীন। বাদ বাকি সব ঈশ্বরের খাস এলাকা। গির্জা, মসজিদ, মন্দির এবং ব্রাহ্মণে বোঝাই।
জমি বিলি হত তখন বিঘা প্রতি বার্ষিক তিন টাকা খাজনায়। তা-ও যে অতি কম জনই দিতে চাইত, সে কথা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, লাট ভবনের জন্যে বেশি ভাবতে হল না ওয়েলেসলিকে। জমি কিনতে তাঁর লাগল মোটে ৮০ হাজার টাকা। বাড়ি করতে তেরো লক্ষ, আর আসবাবপত্র সাজসজ্জায় পঞ্চাশ হাজার। ব্যস, হয়ে গেল ভারতে কোম্পানির রাজপ্রাসাদ, গভর্নমেন্ট হৌস।
কলকাতার বিস্ময়কর দ্রষ্টব্যগুলোর জন্যে কত খরচ হয়েছে জানো? মনুমেন্টের কথাই ধরো না। এক’শ বাহান্ন ফুট উঁচু চুনার পাথরে তৈরি এই বিজয়স্তম্ভটি বানাতে খরচ লেগেছে মোটে পঁয়ত্রিশ হাজার। দমদম-বারাসত রাস্তাটা ভাল করে সারাই করতে লেগেছিল কুড়ি টাকা। সুতরাং বুড়ো কলকাতা মাথা নেড়ে বলবে, আজকের নগরের ইটপাথরের দাম হিসেবে বারোশ কোটি টাকা—একেবারে মন্দ বলোনি তোমরা। কিন্তু বন্ধু, বিক্রির দামটা বলার আগে কেনা-দামটা ভেবে দেখেছ কি? তোমরা ক’জন জানো এ শহরের ‘কস্ট প্রাইস’?
আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম উস-সান বললেন—‘হ্যাঁ, উচিত দাম দিয়ে ইচ্ছে করলে কলকাতার জমিদারি তোমরা কিনতে পারো। আমার কোনও আপত্তি নেই। ইতিপূর্বে অনুমতি ছিল ব্যবসা করবার। বছরে দিল্লীশ্বরকে থোক তিন হাজার টাকা নজরানা দিলেই চলবে। এবার (১৬৯৮ সন) অনুমতি পাওয়া গেল, সুতানটী, গোবিন্দপুর আর কলকাতা গাঁ তিনখানার জমিদারি স্বত্ব কিনবার।
সাবর্ণ চোধুরীরা কিছুদিন ইতস্তত করলেন—তারপর কবালা করলেন ইংরেজদের সঙ্গে। সেই দলিল আজও আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। অবশ্য দিল্লীশ্বরের সেই উদার অনুমতিপত্রটি হারিয়ে গেছে। তাতে লেখা আছে, চৌধুরীরা তিনখানা গাঁয়ের দাম বাবত পেয়েছিলেন মোটে তেরো হাজার টাকা।
কথাটা সত্য। কিন্তু ইংরেজরা বলেন—তাঁদের আসলে খরিদ দাম পড়েছে তিরিশ হাজার। কারণ আজিম-উস-সান-এর সম্মতিটা কিনতে তাঁদের নগদ উপঢৌকন তথা উৎকোচই দিতে হয়েছে ষোল হাজার টাকা। তারপর পথ খরচ, পান-খরচ ইত্যাদি আছে।
১৭১৫ সনের সরমান-দৌত্যের ফলে যখন ফারুখশিয়ার-এর হাত থেকে মাত্র আট হাজার আট’শ ছত্রিশ টাকায় হুগলির দুই তীরে দশ মাইল জুড়ে বিস্তীর্ণ আটত্রিশখানা গাঁয়ের অধিকার হাতে এল, তখন অনেকে হয়তো ভাবলেন—জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল দেশটা।
কিন্তু কোম্পানির অ্যাকাউন্টস বই খোলো, দেখবে, এর অনেক অনেক গুণ বেশি পড়েছে তার আসল দাম। ১৭০৯ সনে ভবিষ্যৎ না জেনেই বাদশাহকে ছেচল্লিশ হাজার টাকা ভেট পাঠিয়েছে তারা। আর দূতবাহিনীর সঙ্গে গেছে তিরিশ হাজার পাউন্ডের উপহার। ক’দিন ধরে মিটিং-এর পর মিটিং চালাতে হয়েছে। শুধু কি টাকা দিলে বাদশার মন খুশি হতে পারে? তার উপর আর্মেনিয়ান শারহেদকে দিনের পর দিন বাদশাজাদার সঙ্গে বসে পুতুল খেলা খেলতে হয়েছে, হ্যামিলটনকে ডাক্তারি করতে হয়েছে। এবং আরও কত কী। সেসব বলতেও এখন লজ্জা পাবে কলকাতা।
মোট কথা, কলকাতায় খাজনার চেয়ে বাজনায়ই সেকালে কাজ হত বেশি। হুগলির ফৌজদার কত আর খাজনা পেতেন ইংরেজদের থেকে। সুতানটী বাবত তাঁরা দিতেন ৩০৫ টাকা, গোবিন্দপুর বাবত ৭০ টাকা আর কলকাতা বাবত ৩৩ টাকা। কিন্তু ‘বাজনা’ দিতেন। হাতে তুলে দিতেন উপহারের ডালি। কখনও মোমবাতি, কখনও আয়না, কখনও অন্দরের জন্যে হিরের মালা। বছরে বছরে প্রায় তিন হাজার টাকা চলে যেত তাঁদের এই উপহারের ডালিটি সাজাতে। শুধু মোমবাতিতেই তো লাগে এগারো’শ টাকা। এক জোড়া যেমন তেমন আয়নার দাম সাড়ে পাঁচশ টাকা। একখানা ঘড়ি দিলে প্রায় নয়’শ টাকার ধাক্কা।
এই হচ্ছে এক দিকের দাম। কোনও দলিলে এর উল্লেখ নেই, কিন্তু কলকাতার পকেটে তার চিহ্ন আছে। কোম্পানিকে কি কম কিপ্টেমি করে চালাতে হয়েছে এসব ভেটের টাকা তুলতে। ১৭৫৯ সনের কথা বলছি। ইংরেজরা যখন ফাঁকার উপর ছিল তখন দুমদাম কত তোপ দেখেছে কলকাতা তার ইয়ত্তা নেই। অথচ, পলাশীর যুদ্ধের দু’ বছর পরে কিনা তারা ঘোষণা করলেন— ‘তোপের বদলে এবার থেকে জয়ধ্বনি চালাও। কামানের বদলে গলা বাজাও। ‘কেননা বারুদ বাঁচাতে হবে’ (“to prevent needless expense of Powder.”) বলা বাহুল্য, এই হুঁশিয়ারিটা পরের কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়, বিগত যুদ্ধটির জন্যে এখানে সেখানে যা দাম দিতে হয়েছে তারই কিঞ্চিৎ তুলবার চেষ্টা মাত্র।
কিন্তু আসল দাম কি আর এতে ওঠে? সেই খরচের বহর যদি জানতে চাও তো চলে যাও পার্ক স্ট্রিটের কবরখানাগুলো কিংবা সেন্ট জন চার্চের প্রাঙ্গণে। দেখবে ইটে ইটে লেখা আছে সেই ত্যাগের কাহিনী। জাহাজ থেকে উনিশ বছরের ছেলেটা নামল। একটা রাতও কাটল না, পরের দিনই কবরখানায় শয্যা নিতে হল বেচারাকে।
মাসে মাইনে মোটে কুড়ি টাকা। জ্বালানি আর খাওয়া-দাওয়া অবশ্য ফ্রি। কিন্তু, তা হলেও কে রাজি হবে কলকাতার মতো জায়গায় আসতে? জীবনের দৈর্ঘ্য যে সেখানে ঘোড়ার গ্যালপ-এর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে শেষ হয়ে যায়। এমনকী, নেটিভদের পর্যন্ত সয় না এই শহরের জলহাওয়া। হিজলির পানি খেলে যেমন ‘যমে মানুষে টানাটানি’ তেমনি তখন নেটিভদের কাছে কলকাতার পানিও। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় নিজে লিখে গেছেন—কলকাতায় নাকি ‘মৃৎপাত্রে অধিক দিন লবণ রাখিলে যা হয় মানুষেরও তাই হত। অত্যল্প আঘাতে গায়ের ত্বক উড়িয়া যাইতে লাগিল। শরীরের বর্ণ শ্বেত হইয়া যাইতে লাগিল’ ইত্যাদি। লোকে একে বলত ‘লোনা লাগা’। কার্তিকবাবু অবশ্য গাঁয়ের হাওয়াতেই সেরে উঠেছিলেন, কিন্তু অন্যদের রীতিমতো ওষুধ খেতে হত। কঠিন ওষুধ। কাঁচা থোড়, ঘোল ও কলমির ঝোল খেতে হবে। তার ওপর গাঁয়ে কাঁচা হলুদ মাখতে হবে। সুতরাং দুটো বর্ষাও লাগে না, দেখতে দেখতে অ্যাংলো-স্যাকসন জোয়ানেরা গলে কাদা হয়ে যায়। মৃত্যুহার তখন কত জানো? ১৭০০ সনে কলকাতায় ইংরেজ ছিল মোট বারো’শ। বৎসরান্তে দেখা গেল চার’শ ষাট জন কমে গেছে সমাজ থেকে। দেশে তখন তুলোর গুদাম বা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীলোকদের মতো কলকাতাবাসী ইংরেজেরও ইনস্যুওরেন্স প্রিমিয়ামের রেট বেশি।
তবুও এরা এসেছে। মরেছে, আবার এসেছে। কেন? লাভের জন্যে? তবে সে কাহিনীটুকুও শোনো। বুড়ো শহর আবার শুরু করল—রাতারাতি লাভের শহর হয়নি কলকাতা। ১৭০০ সনের খবর শোনো। বছরে তিন হাজার টাকা কোম্পানিকে দিতে হয় তখন। অথচ কলকাতা থেকে তখন রাজস্ব আদায় হয় মোটে বারো’শ টাকা। চার বছর চলে গেল। কোনও লাভ নেই। পাঁচ বছরের মাথায় ঘরে এল মোটে চার’শ টাকা। এত কাঠখড় পুড়িয়ে এই জমিদারি নেওয়া অথচ বার্ষিক তিন হাজার টাকা লাভের জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হল দশ-দশটি বছর। দশ বছর পরেও যে খুব একটা কিছু হল তা নয়। ১৭৪২ সনের জমা খরচের খাতাটি দেখো। এপ্রিল মাসের হিসেব। রাজস্ব আদায় হয়েছে এই মাসে মোট ৯৭২৯ টাকা। আদায় বাবদ খরচ ২৪৮১ টাকা। অথচ এদিকে কোম্পানির এস্টাব্লিশমেন্ট কস্টই তখন মাসে কুড়ি হাজার টাকা। গ্র্যাচুয়িটি নিয়ে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের মাসিক মাইনে ২৫৪ টাকা। পাদরি আছেন একজন। তাঁর মাইনে মাসে ৮৪ টাকা। চিকিৎসক আছেন একজন, তাঁকেও দিতে হয় মাসে মাসে তিরিশ টাকা।
সুতরাং কলকাতা শুধু মুনাফার জন্যেই বড় হয়েছে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা ভুল ভাবেন। লাভ যদি এ শহরের অস্থিমজ্জা হয়, তবে মমতা কলকাতার প্রাণ।
শুধু সাহেবদের নয়, কলকাতা নেটিভদেরও ভালবাসার শহর। কখনও ব্যবসায়ী সেজে সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে কলকাতায় এসে বসত করেছে তারা, কখনও এসেছে সিরাজউদ্দোলার ফৌজে নাম লিখিয়ে, কখনও বা আবার তল্পিতল্পা নিয়ে ছুটে পালিয়েছেও ইংরেজদের পিছু পিছু। কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার ফিরে এসেছে সেই কলকাতারই কোলে। কারণ কলকাতা ইংরেজদের রাজধানী হলেও বাংলার মৃত্তিকাজাত শহর।
সেদিক থেকে কলকাতা তাই বাঙালির মনের মুকুর। বাঙালি চরিত্রের যত কিছু দোষত্রুটি, হীনতা, দুর্বলতা, কলকাতা তার একটি অবিনশ্বর স্মৃতিস্তম্ভ। কিংবা, এও বলা যায়, কলকাতা বাঙালি-দর্শনে সর্বোৎকৃষ্ট ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। আবার তেমনি হাল আমলের বাঙালি চরিত্রের যত কিছু মহত্ত্ব, যা কিছু গৌরব, কলকাতা তার জাদুখানা। এখানে এখনও পথে বের হলে আদি ব্রাহ্মসমাজের বাড়িটি দেখা যাবে, দেখা যাবে সুকিয়া স্ট্রিটের সেই বাড়িটি যেখানে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়েছিল। তা ছাড়া কলকাতা ভারতবর্ষের কাছে দুনিয়ার জানলাও বটে। এখানে হিন্দু কলেজের ডিরোজিও-শিষ্যরা একদিন নতুন যুগের বার্তা নিয়ে পথে বেরিয়েছিল, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটের একটা পুরানো বাড়িতে দ্বারকানাথেরা ভারতচিন্তায় বসেছিলেন, এবং ইত্যাদি। কলকাতা হিন্দু কলেজের শহর, ডিরোজিওর শহর, কলকাতা দ্বারকানাথ, রামমোহন, সুরেন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রের শহর।
আসল বিক্রিওয়ালা হলে তাদের খাতায় এঁরা এত দিনে তিলে তিলে যা যোগ করেছেন তা-ও যোগ হত। কারণ, ব্যবসায়ীরা একে বলেন—‘গুডউইল’। আমরা যাকে সুনাম বলি—কলকাতার গুডউইল যে তার চেয়েও অনেক বেশি। হিন্দুস্থানিরা এখনও বলে—‘ব্যোম কালী কলকেত্তাওয়ালি, তেরা নাম না যায় খালি।’ শুধুমাত্র কলকাতার নাম নিলেও যে কিছু না কিছু এসে যায়। তা পকেটেই আসুক, আর মনেই আসুক। ইট, কাঠ, পাথরের কলকাতাকে হয়তো পকেটের কড়ির বলে কেনা যায়, কিন্তু মনে গর্ব জাগায় যে ‘গুডউইল’ তার দাম দেওয়ার লোক কোথায়?
কলকাতায় কত মানুষ
কলকাতায় কত মানুষের বাস?
চোখ মেলে তাকালে মনে হয় কোটি কোটি। হয়তো বা পুরাণকথিত অর্বুদ-খর্বুদের কথাও মনে পড়তে পারে। যেদিকেই তাকাই মানুষ আর মানুষ। যাকে বলে—লোকের মাথা লোকে খায়। ট্রাম বাস মিনিবাসে খাঁচায় বন্দি মুরগির মতো গাদাগাদি করে চলেছে মানুষ। শহরতলির ট্রেনেও একই চেহারা। ফুটপাতে কিলবিল করছে মানুষ আর মানুষ! পথে ঘাটে, হাটে মাঠে সর্বত্র মানুষ। এখন দিন আর রাত্তিরে, সকাল আর দুপুরে কোনও তারতম্য নেই। যে-কোনও দিন যে-কোনও সময়ে চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়ালে মনে হয় এই মাত্র বুঝি কোনও মস্ত সভা ভাঙল, কিংবা কোনও বড় খেলা। শহরের বুকে অষ্টপ্রহর চলেছে মানুষের মিছিল। একজন পরদেশি দর্শক লিখেছিলেন—কাকভোরে পৃথিবীর কোনও বড় শহরের জনপথে কখনও এত মানুষ দেখিনি। কোনও মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের ঘরে মাঝরাত্তিরে উঁকি দিলে ঘুমন্ত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়েও একই কথা বলতে হত তাঁকে।—ইস, এক ঘরে এত মানুষ।
তবু যদি প্রশ্ন করা যায়—এত মানে কত? কলকাতায় ঠিক কত মানুষের বাস? মুশকিল তখনই। শহরে কোনও রাজনৈতিক দলের জমায়েত হলে পরদিন দেখা যায় এক এক খবরের কাগজে এক এক রকম সংখ্যা। কোনওটিতে ছয় হাজার, কোনওটিতে ষাট হাজার। কেউ যদি ফেনিয়ে, ফাঁপিয়ে তাকে ছয় লাখ বানিয়ে ফেলেন তা হলেও বলার কিছু নেই।
কলকাতার জনসংখ্যা নিয়ে সে ধরনের কোনও বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। কারণ, প্রতি দশ বছর অন্তর এখানে মাথা গুনতির একটা বন্দোবস্ত আছে। ১৯৮১-তেও ঘটা করে গোনা হল একবার। ’৯১-এ আর একবার। মজার ব্যাপার এই, তবু কিছু কিছু মানুষের মনে খটকা থেকেই যায়। গণনা শেষে প্রাথমিক ফলাফল শুনে সন্দেহবাদীরা মাথা ঝেঁকে বলতে শুরু করলেন—কী, মাত্র ৩২ লক্ষ ৯১ হাজার মানুষের বাস এ শহরে? হতেই পারে না। কলকাতার জনসংখ্যা তো ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে সেই কবে। তাঁরা যখন শুনলেন এক দশক আগে, ১৯৭১ সনে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ৩১ লক্ষ ৫০ হাজার, এবং পরের দশ বছরে বৃদ্ধির হার শতকরা ৪.৫ ভাগেরও কম, তখন তাঁরা আরও অবিশ্বাসী। কেউ কেউ রায় দিলেন—এসব মনগড়া হিসাব। বুঝতেই পারছেন, সরকারি হিসাব তো! কাগজে কাগজে বের হতে লাগল নালিশ—আমাদের গোনা হয়নি। কই, লোকগণনার কোনও কর্মী তো আমাদের বাড়ি আসেননি! ইত্যাদি।
কলকাতার ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, এ তর্ক কলকাতার মতোই পুরানো। সত্যি বলতে কী, কেউ কোনও দিন জানতেন না এ শহরে সঠিক কত মানুষের বাস। এক দল যদি বা একটা হিসাব দাঁড় করালেন, অন্য দল সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিলেন সে হিসাব। এভাবেই চলেছে আদ্যিকাল থেকে। এখনও চলেছে। নগরের শৈশবে কলকাতার জনসংখ্যা যদি প্রহেলিকা, তবে অন্তত কিছু মানুষের কাছে আজও তা-ই। হাতে কলমে অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলেও তারা মানতে চান না অঙ্কে কোনও ভুল নেই।
১৯০১ সনের লোকগণনার পর শহরের জনসংখ্যা নিয়ে আলোচনা করতে বসে এ. কে. রায় (সেন্সাস অব ইন্ডিয়া ভল্যুম-৭, ক্যালকাটা, টাউন অ্যান্ড সাবার্বাস, পার্ট ১, এ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা, ১৯০২) লিখেছেন—সত্যি, আদি কলকাতার জনসংখ্যা প্রহেলিকার মতো। আসলে গোলমাল তখন দুটি শব্দের অর্থ নিয়ে। এক ‘টাউন’, দ্বিতীয় ‘পপুলেশন’। সাহেবরা দিল্লির বাদশাদের কাছে কলকাতার লাগোয়া ৩৮টি গ্রামের জমিদারি চেয়েছিলেন। অথচ গ্রাম সুতানটির মতো সাহেবদের কাগজপত্রে সেসব গ্রামও টাউন। সুতরাং আদি পর্বে মাথা গুনতির সময় কোন এলাকার লোকজনদের গোনা হয়েছে বলা শক্ত। আরও শক্ত কাদের মাথা গোনা হয়েছে সেটা স্থির করা। কেউ স্থায়ী বাসিন্দাদের গোনার চেষ্টা করেছেন। কেউ আবার গোনার সময় যাকে সামনে পেয়েছেন তাকেই হিসাবে ধরেছেন। কেউ, ‘পপুলেশন’ বলতে যদি শহর এলাকার সমুদয় নারী পুরুষ শিশুকে ধরে থাকেন, তবে কেউ কেউ আবার ইচ্ছা করেই নারী এবং শিশুকে বাদ দিয়েছেন। ভাবখানা এই, ওদের গুনতি করে কী লাভ? কেউ কেউ অতি উৎসাহে ঢুঁ মেরেছেন শহরের বাইরে। এমনকী নদীর ওপারেও। ফলে বিভ্রাট ঠেকায় কে!
জোব চার্নক সুতানটিতে স্থায়িভাবে আড্ডা গাড়েন ১৬৯০ সালে। সি. আর. উইলসন হিসাব করে দেখিয়েছেন (‘আর্লি অ্যানালস অব দি ইংলিশ ইন বেঙ্গল’) ১৭০৪ সালে কোম্পানির খাস এলাকায় জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। আর মারাঠা-খাদের চৌহদ্দির মধ্যে স্থানীয় জমিদারদের এলাকা ধরলে ৩০ হাজার। তাঁর হিসাব মতো ১৭০৬ সনে সংখ্যা দুটি ছিল যথাক্রমে ২২ হাজার এবং ৪৪ হাজার, ১৭০৮ সনে ৩১ হাজার এবং ৬২ হাজার। ১৭১০ সনে যথাক্রমে ৪১ হাজার এবং ৮২ হাজার। অথচ হ্যামিলটন লিখেছেন: ১৭১০ সালে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ১২ হাজার। উইলসন সাহেবের মতে ১৭৫১ সালে ব্রিটিশ প্রভাবাধীন স্থানীয় জমিদারদের এলাকাসহ কলকাতার জনসংখ্যা ছিল, ২০৯৭২০ জন। অথচ হলওয়েল বলছেন ১৭৫২ সনে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ৪০৯০০০। অর্থাৎ, উইলসনের যোগফলের প্রায় দ্বিগুণ। কাকে বিশ্বাস করব আমরা? উইলসন খ্যাতনামা গবেষক। এদিকে হ্যামিলটন এবং হলওয়েল যাকে বলে ‘প্রত্যক্ষদর্শী’। প্রথমজন ১৭১০ থেকে ১৭২৯ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। দ্বিতীয়জন, হলওয়েল ১৭৫২ সনে ছিলেন কলকাতার ‘কালেক্টর’। সুতরাং এককথায় তাঁদেরই বা নাকচ করে দেওয়া যায় কেমন করে। আরও বিপত্তি ঘটিয়েছেন পরবর্তী গণনাকারীরা। গ্রাঁপ্রি লিখেছেন ১৭৮৯-৯০ সালে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল পাক্কা ৬ লক্ষ। ১৭৯৬ সালে মার্টিন সাহেব হিসাব কষে বললেন, ওসব বাজে কথা, কলকাতার জনসংখ্যা এখন মোটে ৫ লক্ষ। এই সব বিতর্কের যুগে ১৭৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঝড়ে যে কলকাতায় তিরিশ হাজার মানুষ মারা পড়বেন তাতে আর বিস্ময় কী! বিলাতের ‘জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিন’ ডুবে যাওয়া ছোট বড় নৌকো এবং জাহাজের সংখ্যা ধার্য করেছিল কুড়ি হাজার।
এ ভাবেই গড়িয়ে গেল অষ্টাদশ শতক। উনিশ শতকেও কিন্তু বিতর্কের অন্ত নেই কলকাতার জনসংখ্যা নিয়ে। ১৮০০ সালে নগর কতোয়ালরা একটি কমিটি বসালেন। পুলিশের সেই কমিটি গুনে বললেন, কলকাতার জনসংখ্যা একুনে ৫ লক্ষ। অথচ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হলওয়েল জানিয়েছিলেন তখনই শহরের জনসংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ১৮০২ সালে আবার গুনতে আরম্ভ করলেন শহরের ম্যাজিস্ট্রেটরা। তারা ঘোষণা করলেন—শহরের লোকসংখ্যা ৬ লক্ষ। দু’ বছরের মধ্যে এক লাখ বেড়ে গেল। ১৮১৪ সালে আবার নতুন খবর—শহরের জনসংখ্যা এখন ৭ লক্ষ। পরের বছর ‘ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেট’ নামে শহরের একটি খবরের কাগজ জানাল—তাঁদের মতে শহরের জনসংখ্যা বড় জোর ৫ লক্ষ। কলমের এক খোঁচায় দু’ লাখ ছেটে ফেলে দিলেন তাঁরা। ১৮২১ সালে অ্যাসেসারদের লাগানো হল ঘরবাড়ি, জমিজমার সঙ্গে বাসিন্দাদেরও গুনে দেখতে। তাঁরা বললেন—আমরা পাচ্ছি ১৭৯৯১৭ জন। কোথায় সাত লাখ, আর কোথায় পৌনে দু’ লাখ। ‘জন বুল’ তৎকালে শহরের নামী কাগজ। ওঁরা আপত্তি তুললেন। কাগজে তর্ক জুড়লেন। বললেন—আমাদের হিসাবে কলকাতার বর্তমান (১৮২২) জনসংখ্যা ৩ লক্ষ। কাকে বিশ্বাস করব।
১৯৩৩ সালে ক্যাপ্টেন স্টিল আবার গুনতে নামলেন। এবার যোগফল দাঁড়াল ১৮৭০৮১ জন। ১৮৩৭ সালে ক্যাপ্টেন বার্চ গুনে বললেন ২২৯৭১৪ জন। ১৮৫০ সালে সাইমন নামে আর এক সাহেব আসরে নামলেন। তাঁর অঙ্কে ফল মিলল ৩৬১৩৬৯ জন। সে বছরই প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে শুরু হল আবার গোনার কাজ। ওঁরা জানালেন, সাইমন সাহেব অঙ্কে ভুল করেছেন। কলকাতার জনসংখ্যা আসলে ৪১৩১৮২ জন। ১৮৬৬ সালে ডাউলিনস সাহেব জানালেন জনসংখ্যা তখনও চার লাখে পৌঁছায়নি। বন্দর এবং কেল্লা বাদ দিলে কলকাতায় মোটে ৩৫৮৬৬২ জনের বাস। ১৮৭২ সালে চিক্ সাহেবও তা-ই করলেন। পোর্ট এবং ফোর্টকে বাদ দিয়ে তিনি কলকাতার বাসিন্দাদের গুনলেন। এবার পাওয়া গেল ৪২৮৪৫৮ জন। একের সঙ্গে অন্যের ফারাক অষ্টাদশ শতকের তুলনায় কিছুটা কমে আসছে বটে, কিন্তু লক্ষণীয়, তর্কের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
এত তারতম্য কেন, তা নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি। এ. কে. রায় ছাড়াও এস. ডব্লিউ. গুড (‘মিউনিসিপাল ক্যালকাটা ইটস ইনস্টিটিউশনস ইন দেয়ার ওরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ,’ ১৯১৬), ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার (‘এ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল’, ভল্যুম -১, ১৮৭৫) এবং আরও কেউ কেউ কলকাতার জনসংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গোলমাল কেন এবং কোথায় তার অনেকটাই ধরা পড়েছে তাঁদের গবেষণার ফলে। এ. কে. রায় রাজস্বের হিসাবের সঙ্গে সম্ভাব্য জনসংখ্যার হিসাব কষে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, যদিও প্রত্যক্ষদর্শী তবু হ্যামিলটন এবং হলওয়েল দু’জনেই ভ্রান্ত। রাজস্ব এবং নাগরিকদের সম্ভাব্য অনুপাত দেখিয়ে তিনি আদি যুগের কলকাতার জনসংখ্যা ধার্য করেছেন—১৬৯৬-এ ৮০৭৩ জন, ১৭০৪-এ ৫১৬০০ জন, ১৭০৮-এ ১০৮৭০০ জন ১৭১০-এ ১৪৭৪০০ জন। অথচ হ্যামিলটন ১৭১০ সনে শহরের জনসংখ্যা ধরেছিলেন মোটে দশ থেকে বারো হাজার।
হলওয়েল ছিলেন শহরের জমিদার এবং কালেক্টর। নয়া নগরের জমি, পুকুর, বাগান, ঘরবাড়ি সবকিছুর বিস্তারিত এক খতিয়ান তৈরি করেছিলেন তিনি ১৭৫২ সনে। বিভিন্ন এলাকা মেপে তিনি জানিয়েছিলেন শহরে মোট জমির পরিমাণ ৯২৫৫ বিঘা। মোট ঘরবাড়ির সংখ্যা ১৪৭১৮টি। তাঁর মতে প্রতি বাড়িতে গড়ে ৮ জন করে লোক বাস করে এবং প্রতি পাট্টাদারের অধীনে আছে গড়ে ৫ জন করে প্রজা (টেন্যান্ট)। এ. কে. রায় মনে করেন হলওয়েল সাহেবের হিসাবে গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে। তিনি ভুল করেছেন এই ভেবে যে ‘টেন্যান্ট’ বা প্রজা/বা ভাড়াটেদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র বাড়ি আছে এবং সেসব বাড়ির প্রত্যেকটিতে গড়ে ৮ জন করে লোক বাস করে। হলওয়েল সাহেবের হিসাবের সূত্র: মোট জমি ৮৫২২ বিঘা x প্রতি বিঘায় বাড়িওয়ালা এবং প্রজাসমেত বাড়ির সংখ্যা ৬ x প্রতি বাড়িতে ৮ জন বাসিন্দা = ৪০৯০৬৫ জন। এ. কে. রায় লিখছেন, তখনকার মানচিত্র প্রতি হোল্ডিং-এ এমনকী ৮টি কুঁড়ে ঘরও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর মতে, ১৭৫২ সালে শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৪৭১৮ বাড়ি + প্রতি বাড়িতে ৮ জন বাসিন্দা = ১১৭৭৪৪ জন।
গ্রাঁপ্রি, মার্টিন, পুলিশ কমিটি, ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়গণ, ইস্ট ইন্ডিয়া গেজিটিয়ার, প্রভৃতি পরবর্তী গণনাকারীরা যে হিসাব দাখিল করেছেন, এ. কে. রায় মনে করেন, সেগুলি আনুমানিক হিসাবমাত্র। শহরের সীমানা নিয়ে ওঁরা বিশেষ চিন্তাভাবনা করেননি। ১৭৯৪ সালে শহরের সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল মারাঠা-পরিখা। ফলে বানিয়াপুকুর কিংবা ট্যাংরা শহরের চৌহদ্দির বাইরে। হলওয়েল সেগুলিকে শহরের ভিতরে ধরেছিলেন। অন্যরাও সীমানা ছাড়িয়ে অন্যত্র উঁকি দিয়েছেন। মার্টিন সাহেব সম্ভবত বন্দরের বাসিন্দাদেরও গুনেছিলেন। এমনকী হাওড়া-সালকিয়ায় টুঁ মেরে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া শহরের স্থায়ী বাসিন্দা এবং দিনের বেলায় যাঁরা আসা যাওয়া করেন তাঁদের মধ্যে কোনও ফারাক করা হয়নি। ওঁদের কাছে সবাই গোনার মতো। সবচেয়ে বড় কথা সকলেরই মাথায় তখন চেপে আছে, হলওয়েলের ভূত।
হলওয়েল কেমন করে অন্যদের প্রভাবিত করেছেন তার নানা চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়েছেন পরবর্তী গবেষকরা। ১৮১৯ সালে চারজন সার্ভেয়ার নিয়োগ করা হয়েছিল শহর জরিপ করার জন্য। তাঁরা সরেজমিনে সব দেখে বললেন—শহরে ঘরবাড়ির সংখ্যা ৬৭৫১৯, বাসিন্দা সংখ্যা ১৭৯৯১৭ জন। সম্ভবত সংখ্যাটা সত্যের কাছাকাছিই ছিল। কিন্তু কর্তাদের মাথায় তখনও হলওয়েলের হিসাবের খাতা ঘুরছে। মোটে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার? হতেই পারে না। সার্ভেয়াররা নিজেদের অফিসেই কর্তাদের সমালোচনার মুখে পড়লেন। ম্যাজিস্ট্রেটরা নিজেরাই কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। দোতলা পাকা বাড়িতে গড় বাসিন্দা সংখ্যা ১৬ জন, একতলা বাড়িতে ৮ জন, কুঁড়েঘরে ১১ জন (সার্ভেয়াররা বলেছিলেন ৮ জন) এভাবে হিসাব করে তাঁরা নতুন যোগফল পেলেন ২৩০৫৫২ জন। তাতেও মন ভরে না। কী করে ভরবে? হলওয়েল সেই কবে বলে গেছেন জনসংখ্যা চার লাখের কোঠায়। তবু সার্ভেয়ারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ম্যাজিস্ট্রেটরা অঙ্কটাকে কিছু ফাঁপালেন। আরও বাড়ানো দরকার। সুতরাং, অফিসের সরকার এবং পিওনদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল শহরের প্রবেশ পথগুলোর মুখে। তারা ফিরে এসে বলল—হ্যাঁ, প্রতিদিন গড়ে লাখখানেক লোক শহরে আসে বটে! তাও যোগ করা হল ফাঁপানো সংখ্যার সঙ্গে। ‘পাবলিক’ তবু সন্দেহবাদী। ‘জন বুল’ লিখল—এত কম কিছুতেই হতে পারে না!
১৮৩১ সালে ক্যাপ্টেন স্টিল আর এক কাণ্ড করলেন। খুব যত্ন সহকারে গুনে তিনি ঘোষণা করলেন, কলকাতা শহরে ঘরবাড়ির সংখ্যা ৭০০৭৬টি এবং বাসিন্দা সংখ্যা ১৮৭০৮১ জন। বলেই মাথা চুলকোতে লাগলেন। কেননা সিন্ধ্বাদের ঘাড়ের সেই নাছোড়বান্দা বুড়োর মতো হলওয়েল তখনও কর্তাদের ঘাড় থেকে নামেননি। নিজেকেই নিজে সংশোধন করতে বসলেন স্টিল। বললেন—আমি নারী আর শিশুদের গুনিনি। (কেন, ‘মুরগি পাখি নয়, মেয়েরা নয় মানুষ’ সেই সূত্র মেনে কি? শিশুদের গুনতেই বা মানা করেছিল কারা?) গুনিনি ভৃত্যকুলকেও। যদিও তাঁর হিসাবের খাতায় তাদের জন্য স্বতন্ত্র ঘর ছিল এবং সে ঘরগুলো শূন্য ছিল না। তবু তিনি হলওয়েলকে গুরু মেনে নতুন করে আঁক কষতে বসলেন। নতুন ফল লাভ হল—৪১০৯৩০। হাঁফ ছাড়লেন স্টিল। তাঁর মুখে হাসি ফুটল। খুশি মনে লিখলেন—এবার নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন সংখ্যাটা ‘মাচ নিয়ারার দি ওল্ড ক্যালকুলেশন’।
হলওয়েলকে প্রথম অস্বীকার করার ধৃষ্টতা বা সাহস দেখান পুলিশ সুপার বার্চ সাহেব। ১৮৩৭ সালে তিনি হিসাবপত্র করে বললেন—শহরের জনসংখ্যা ২২৯৭১৪ জন। এই হিসাবটা অনেকে মেনে নিয়েছিলেন। এমনকী দৈনিক গড়ে এক লাখ লোক এই শহরে আসা-যাওয়া করে, অনেকে নাকি তার দেওয়া এই অবিশ্বাস্য তথ্যটাও দিব্যি হজম করেছিলেন।
সাইমনের হিসাব নিতান্তই নমুনা সমীক্ষা। তিনি শহরের নানা এলাকায় ৩৫৭টি পাকা বাড়ি আর ১০৩৬টি ‘নেটিভ’ বাড়ির লোকসংখ্যার ভিত্তিতে বিরাট অঙ্ক ফেঁদেছিলেন। সুতরাং, ভুল তার হতেই পারে। ১৮৫০ সালে ম্যাজিস্ট্রেটরা বলেছিলেন শহরের জনসংখ্যা চার লাখের ওপর। কেউ কেউ মেনে নিয়েছিলেন এই ভেবে যে হয়তো ওঁরা বন্দর এবং নদীতে ভাসমান নৌকোর বাসিন্দাদেরও গুনেছিলেন। কিন্তু অন্যরা মনে করেন ঝুটা। সব ঝুটা হ্যায়।
এ ভাবেই চলেছে দশকের পর দশক। গোঁজামিল আর গোঁজামিল। শহরে প্রথম লোকগণনার তাগিদ অনুভূত হয় সাতান্নর মহাবিদ্রোহের পরে। কর্পোরেশনের বোর্ড অব কমিশনাররা ঘোষণা করেন—আমাদের ধারণা, সভ্য দুনিয়ায় সম্ভবত ভারতের এই ব্রিটিশ মেট্রেপলিস-এর মতো এমন কোনও শহর নেই যেখানে পরিসংখ্যান এমন ত্রুটিপূর্ণ। অন্যত্র যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত, ভারত যেন সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। যেন এইসব পরিসংখ্যানের কোনও ব্যবহারিক মূল্যই নেই। ১৮৫৯ সালেও তাঁদের স্বীকার করতে হল—‘দি এক্জাকট পপুলেশন অব ক্যালকাটা রিমেইনস অ্যাট দি মোমেন্ট আ মিসট্রি।’
১৮৬৩ সালে আইন রচিত হল রহস্যভেদের জন্য। সেই আইনমাফিক শহরে প্রথম লোকগণনা করা হয় ১৮৬৬ সালের ৮ জানুয়ারি। দেখা গেল—ফোর্ট, পোর্ট এবং হেস্টিংস এলাকা নিয়ে কলকাতার মোট জনসংখ্যা ৩৭৮০৬৬ জন। সেই লোকগণনার ভারপ্রাপ্ত কর্তা ছিলেন কর্পোরেশনের তদানীন্তন ভাইস-চেয়ারম্যান ডাউলিনস সাহেব। ২২০ জন মাইনেকরা গণনাকারী নিয়োগ করা হয়েছিল। খরচ পড়েছিল ২১৫৪৮ টাকা। গণনা শুরু করার আগে ঢেঁড়া পিটিয়ে শহরবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল—ভয়ের কিছু নেই। মাথা গুনলে কারও কোনও অনিষ্ট হবে না। কারও ধর্মে হাত দেওয়া হবে না, এর জন্য নতুন কোনও করও বসবে না। তবু নাকি ৯৮ জন নাগরিক পালিয়ে গিয়েছিলেন শহর ছেড়ে। তা ছাড়া মাইনেকরা গণনাকারীরা ফর্ম লিখতে অনেক ভুলচুকও করে বসেছিলেন। ফলে ফের নতুন করে গোনা হয় আর এক দিন। চূড়ান্ত ফল বের হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি।
আনুষ্ঠানিকভাবে শহরে এর পর লোক গণনা করা হয় ১৮৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি। ১৮৭১ সালে সারা ভারতে গৃহীত হয় আদমসুমারির সিদ্ধান্ত। সেই সূত্রেই সেবার (১৮৭২) শহরে লোকগণনার উদ্যোগ। পুলিশ কমিশনারের অধীনে সেবার আদমসুমারির দায়িত্ব নিয়েছিলেন চিক সাহেব। তিনি কর্পোরেশনের মস্ত অফিসার। ঘোড়ার গাড়ি এবং নৌকোর লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র অধিকার তাঁরই। পোর্ট এবং ফোর্ট মিলিয়ে সেবার শহরের জনসংখ্যা ধার্য হয় ৪৪৭৬০১ জন। শহরতলি ধরলে ৬৩৩০০৯। লক্ষণীয়, এত দিনে শহর কলকাতা সবে হলওয়েলের অঙ্ক ছুঁতে পারল। চিক কার কী পেশা, তারও একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গণনাকারীরা সেটি পত্রপাঠ নাকচ করে দেন। একজনের মন্তব্য: ‘টোটালি বেস্লেস।’
সারা ভারতের আদমসুমারির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৮৭২-এর কলকাতায় লোকগণনা। শহরের কর্মকর্তারা বললেন—আমাদের প্রয়োজন এতে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। সুতরাং আমরা একবার নিজেদের মতো করে কলকাতার জনসংখ্যা যাচাই করে দেখতে চাই। তাঁদের তরফে নগরের অভিভাবকদের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে ১৮৭৬ সালে আসরে নামলেন আই. সি. এস. বেভার্লি সাহেব। দিন ধার্য হল ৬ এপ্রিল। বেভার্লি জানালেন, শহরের জনসংখ্যা ৪২৯৫৩৫। চার বছর আগেকার যোগফলের সঙ্গে খুব একটা হেরফের নেই। মাথা গুনতে সেবার কর্পোরেশনের খরচ পড়েছিল ২০৫৮২ টাকা।
১৮৮১ সনে আবার আদমসুমারি। শহরে এবারও সে কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন এইচ বেভার্লি। এবার শোনা গেল কলকাতার জনসংখ্যা ৪৩৩২১৯ জন। শহরতলি ধরলে ৬১২৩০৭ জন। (শহরতলি ওইসব এলাকা যথা ভবানীপুর, কী এন্টালি, পুরসভার অঙ্গীভূত হয় ১৮৮৯ সনে।) প্রসঙ্গত বেভার্লি জানালেন, শহরে পাকাবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, কাঁচাবাড়ি কমছে।
ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট, দোকানপাট, কিংবা জনবিন্যাসের কথা থাক। আমরা এখানে স্রেফ মাথা গুনতির যোগফল নিয়েই আলোচনা করছি। কেননা, ফলাফল সত্যই এক এক সময় চাঞ্চল্যকর। ১৮৮১ সনে শহরতলিসমেত জনসংখ্যা স্থির হয়েছিল ৬১২৩০৭ জন। অথচ এক দশক পরে ১৮৯১ সালে শহরতলিতে (যা ইতিমধ্যেই পুর এলাকায় পরিণত) ধার্য হল ৬৮১৭১১ জন। দশ বছরে কলকাতার জনসংখ্যা কিন্তু বিশেষ বাড়ল না। শহর যেন পেঁচোয় পাওয়া শিশু। তবে একটা পুরানো খবরকে নতুন করে জানালেন গণনাকারীরা। কলকাতা বরাবরই ‘ভিনদেশিদের’ শহর। ওঁরাও স্বীকার করলেন সে কথা। বললেন—‘ক্যালকাটা ইজ নট হোম-বর্ন, বাট ইমপোর্টেড’। ১৯০১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট প্রকারান্তরে জানাল—আগেকার বৃত্তান্তগুলো সম্ভবত সঠিক নয়। কেননা, কলকাতার জনসংখ্যা একুনে ৮৪৭৭৯৬ জন। ১৯১১ সনে জানা গেল সংখ্যাটি ৮৯৬০৬৭ জন। অর্থাৎ, এক দশক কেটে গেলেও শহর কিন্তু বিয়ের পর নতুন কনের মতো গায়েগতরে ফেঁপে উঠছে না।
নিয়মমাফিক ঘটা করে আদমসুমারি শুরু হওয়ার পরও অতএব বিতর্ক কিন্তু থামল না। ১৮৭২ সালের আদমসুমারি সম্পর্কে হান্টার লিখেছেন—যোগফল মেনে নেওয়া শক্ত। খাস কলকাতার এলাকা ধরা হয়েছে ৭.৮০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৪৪৭৬০১ জন। শহরতলি ধরলে শহরের এলাকা তখন ২৩.১৭ বর্গমাইল, জনসংখ্যা ৬৩৩০০৯ জন। কিন্তু হান্টার মনে করেন এসব তথ্য মোটে নির্ভরযোগ্য নয়। অন্যরাও অনেকে নাকি এইসব সংখ্যা হজম করতে রাজি হননি। তাঁর মতে এর কারণ—সারা দেশে মাথা গোনা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। কিন্তু কলকাতায় গোনার দায়িত্ব ছিল পুর-কর্তৃপক্ষের ওপর। সুতরাং বিভ্রাট ঠেকায় কে। পুরকর্তাদের সম্পর্কে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল হান্টারের ইঙ্গিত থেকেই তা বোঝা যায়। নগরপিতারা শুনে হয়তো অবাক হবেন, নিন্দুক শুধু একালে নয়, সেকালেও ছিলেন।
১৮৮১ সালের আদমসুমারি সম্পর্কে বেভার্লি লিখেছেন: লোকগণনার নির্দিষ্ট দিনে আমি মিঃ বুরদিলনকে নিয়ে গোড়ার গাড়ি চড়ে শহরের নানা মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়েছি। সর্বত্র অভাবিত দৃশ্য। দেখলে চমৎকৃত হতে হয়। সাধারণত যে সময়ে শহরে হই হল্লা কিংবা কলগুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়, তার অনেক আগেই সেদিন শহর নিঝুম। সর্বত্র নিস্তব্ধতা। যেসব জনপথে সব সময়ে ভিড় সেগুলি পর্যন্ত জনমানবহীন। রাত আটটায় শহরে যেন মধ্যরাত্রি। যেন একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে, চারদিকে রটে গেছে শহরের পথের আলো নিভে যাবে। তখন কেউ রাস্তায় থাকলে তার কপালে ঝামেলা আছে। সে বিপাকে পড়বে। আরও নানা ধরনের গুজব। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেকে যেন ঘরে একটা আলো জ্বালিয়ে রাখে। অন্তত গণনাকারীরা হাজির না হওয়া পর্যন্ত, সেসব শুনে কল্পনাপ্রবণ প্রাচ্যদেশীয়দের মনে নানা জল্পনা। তবে সবাই নির্দেশ মান্য করছে, আমরা গাড়ি হাঁকিয়ে যেতে যেতে দেখলাম প্রত্যেকের ঘরে আলো জ্বলছে। বোঝা যায়, সবাই জেগে বসে আছে, গণনাকারীদের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। পথে মাঝে মধ্যে গণনাকারীদের সঙ্গেও আমাদের দেখা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছে একজন কনস্টেবল এবং একজন কী দু’জন সহকারী।
বেভার্লি লিখছেন: আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই সে রাত্তিরে ঠিকঠাক কাজ হয়েছে। সম্পূর্ণ এবং সফল। এই বিবরণ পড়ে, একালের একজন ঐতিহাসিকের মন্তব্য: বেভার্লি নিজেই কি আমাদের জানিয়ে দেননি, এরকম আবহাওয়ায় আর যাই হোক, নির্ভুল জনগণনা সম্ভব নয়!
অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনা এই কলকাতার আদমসুমারি নিয়ে বিতর্ক কিন্তু একালেও একেবারে থেমে যায়নি। যদিও বিতর্ক এখনও অনুচ্চ, তবু গত ১৯৮১-র আদমসুমারির প্রাথমিক ফলাফল নিয়ে মৃদু গুঞ্জনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সত্যিই তো, ১৯৭১ সালে শহরের লোকসংখ্যা ছিল যেখানে ৩১ লক্ষ ৫০ হাজার, দশ বছর পরে ১৯৮১ সালে সেখানে মোটে ৩২ লক্ষ ৯১ হাজার। এক দশকে কলকাতার জনসংখ্যার বৃদ্ধিহার শতকরা ৪.৫ ভাগ। অর্থাৎ বছরে শতকরা আধভাগেরও কম! অথচ এই সময়ে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে শতকরা ২৬ ভাগ, পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ২৩ ভাগ। কলকাতায় তবে এত কম কেন? বিশেষত ১৯৬১-৭১ সালের মধ্যে নগরীর জনসংখ্যা বেড়েছিল যেখানে শতকরা ৭.৫ ভাগ এবং তার আগের দশকে (১৯৫১-৬১) শতকরা ৮.৫ ভাগ। গণনাকারীরা, বলাই বাহুল্য, এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে পারেন। জন্ম, মৃত্যু, আগমন, নির্গমন, শহরতলির বা বৃহত্তর কলকাতার বাড়বাড়ন্ত চেহারা—অনেক তথ্য দিয়েই প্রমাণ করা সম্ভব সংখ্যাটা ঠিক, তা যতই কেন সন্দেহপরায়ণ নাগরিক খবরের কাগজে চিঠি লিখুন না!
মুশকিল এই, শুধু সাধারণ নাগরিক নন, একালেও অনেক সময় সেন্সাস রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বসেন সেন্সাস-এর কর্মকর্তারা নিজেরাই। ১৯৫১ সালের আদমসুমারির কথা মনে পড়ছে। ১৯৫১ সালে কলকাতার আয়তন ছিল ৩২.৩২ বর্গমাইল (খাস কর্পোরেশনের এলাকা ২৮.৩৪ বর্গমাইল।) ১ মার্চ, ১৯৫১ সালে শহরের লোকসংখ্যা স্থির হয়েছিল ২৫৪৮৬৭৭ জন। প্রায় সমপরিমাণ এলাকায় ১৯৩১ সালে লোকসংখ্যা ছিল ১১৬৩৭৭১ জন। অর্থাৎ কুড়ি বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। তবু লোকের মনে সন্দেহ। কলকাতার মাত্র এই কটি লোক? এদিকে যে ঝাঁকে ঝাঁকে বাস্তুহারারা আসছেন। শহরে নিশ্বাস নেওয়া শক্ত। তবু, মোটে এত কম লোক! সেবার আদমসুমারির কর্তা অশোক মিত্র। কলকাতা খণ্ডের ভূমিকা লিখতে বসে তিনি উল্লেখ করেছেন সেসব তর্ক-বিতর্কের কথা। লোকগণনার প্রাথমিক ফলাফল শুনে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছেন। অনেকেই বিস্মিত। অনেকের মনেই সন্দেহ। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন শহরের জনসংখ্যা নিশ্চয় চল্লিশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে অনেকেই হতাশ। খবরের কাগজে প্রকাশ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলেই যে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে এমন নয়। তবু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। ভেবে দেখা দরকার আমাদের যোগফলের সঙ্গে আরও দশ লক্ষ চুয়ান্ন হাজার মানুষ জুড়লে শহরের কী চেহারা দাঁড়ায়।
শ্রীমিত্র তাঁর যোগফলের সমর্থনে যেসব যুক্তি এবং তর্ক উত্থাপন করেছেন তা বলতে গেলে নিশ্ছিদ্র। তাঁকে খারিজ করে দেওয়া তীক্ষ ছিদ্রান্বেষীর পক্ষেও কঠিন কর্ম। অথচ মজার ব্যাপার এই, তিনি কিন্তু অবলীলায় খণ্ডন করে দিয়েছেন ১৯৪১সালের আদমসুমারির ফলাফল। যুদ্ধের জন্য সেবার রিপোর্ট ছাপা হয়নি। তিনি সরকারের তাক থেকে পান্ডুলিপি নামিয়ে এনে শুধু যোগফল নয়, তছনছ করে দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরির পেশ করা যাবতীয় তথ্য। বলেছেন—ভুল, সব ভুল। (সেন্সাস অব ইন্ডিয়া ১৯৫১, ভল্যুম ৬, পার্ট ৩, ক্যালকাটা সিটি। এ মিত্র।)
তাই বলছিলাম—তর্কে দোষ কী! দোষ কী, যদি কেউ বলেন কলকাতায় কত মানুষ কেউ তা এখনও সঠিক জানেন না! আমি আপনি তো বটেই, এমনকী আদমসুমারির কর্তারাও না!
জোব চার্নকের মুখোমুখি
আমরা ওঁর নাম জানি। জানি বললে সামান্যই বলা হয়। মুখস্থ। রোমের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে রোমুলাস আর রোমাস-এর নাম, কলকাতার সঙ্গে তেমনই জোব চার্নকের। গৌড়, রাজমহল, ঢাকা, নদিয়া আর মুর্শিদাবাদের পর ভাগীরথী-তীরে বাংলার এই যে ষষ্ঠ রাজধানী কলকাতা, সে নাকি তাঁরই কীর্তি। রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি। কলকাতাও না। চার্নকের আগেও ছিল কলকাতা, পরেও আছে। মাঝখানে ১৬৯০ সালের এক বাদলা দিনে সুতানটির ঘাটে এই পরদেশি সওদাগরের নোঙর করার ঘটনাটা তাৎপর্যে ঐতিহাসিক। কেননা, এই বিন্দু থেকেই ক্রমে সিন্ধু। ধীরে ধীরে মানচিত্রে রক্তবর্ণের ছটা—তিন গণ্ডগ্রাম মিলে বন্দর-নগরী কলকাতা। কলির শহর এই কলকাতাই অনেকদিন ধরে পরদেশিদের রাজধানী। কিপলিং-এর ‘চান্স-ডাইরেকটেড, চান্স-ইরেকটেড’ তত্ত্ব অতি সরলীকরণ। একদিকে সরস্বতী নদীর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর ধারা, পর্তুগিজদের ‘খুদে স্বর্গ’ সপ্তগ্রামের মৃত্যু, হুগলি থেকে মোহনার দূরত্ব। অন্যদিকে বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষায় কলকাতা এলাকার বিশেষ কিছু কিছু সুবিধা—সব মিলিয়ে পালা সেদিন কলকাতার দিকেই ভারী। তা ছাড়া কলকাতার সপক্ষে সেদিন আরও দুটি জোরালো যুক্তি নিশ্চয় মনে মনে ওজন করেছেন ভাগ্যান্বেষী বণিকের দল। এক—হুগলি, মানে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুটি এখান থেকে কিঞ্চিৎ দূরে। সেটাই ভাল। অন্য দিকে গোবিন্দপুরে রয়েছেন শেঠ বসাকরা, সহযোগী স্বদেশি কমপ্রাডোর-র দল। তাঁদের হাতে সুতানটির জমজমাট হাট। এককথায় ভূগোল, ইতিহাস এবং কাল—সবই সেদিন কলকাতার অনুকূলে। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই, জোব চার্নক নিমিত্ত। ইংরেজের শহর কলকাতার ভিত্তিপ্রস্তরটি তাঁর হাতেই স্থাপিত।
আমরা ওঁর ইতিহাস জানি। জানি মানে, পুনর্নির্মাণ করতে পারি। ভারতের এই তল্লাটেও যথারীতি সকলের আগে পৌঁছেছিল পর্তুগিজরা। তারপর ডাচরা। ইংরেজরা সকলের শেষে। এই মুলুকে ইংরেজের প্রথম ‘ফ্যাক্টরি’ ওড়িশায় মহানদীর বদ্বীপে একটি তুচ্ছ বিন্দুতে, ১৬৩৩ সালে। তারপর সেখান থেকে বালাসোর-এ। এক পা এক পা করে ১৬৫১ সালে হুগলিতে, ‘৫৮ সালে কাশিমবাজারে। ক্রমে পাটনা, সিংগিরা, এবং ১৬৬৮ সালে ঢাকা। এসব কেন্দ্রের ওপর খবরদারির দায়িত্ব ছিল মাদ্রাজ কাউন্সিলের। ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে ব্যবসা পরিচালনা করতেন তাঁরা। তারই মধ্যে কোম্পানির খাতায় একসময় উঁকি দিয়েছে জনৈক চার্নকের নাম। প্রথম তাঁর দেখা মেলে ১৬৫৮ সালের ১২-১৩ জানুয়ারি। স্পষ্ট লেখা ‘জোব চার্নক, ফোর্থ, স্যালারি টুয়েনটি পাউন্ডস।’ খাতার ওই পাতাটা কাশিমবাজার কুঠির। তার অর্থ চার্নক তখন কাশিমবাজারে একজন জুনিয়র মেম্বার, সামান্য কর্মী; বছরে মাইনে তাঁর একুনে কুড়ি পাউন্ড। তার বছর দুই আগে, ১৬৫৫-৫৬ সনে এদেশে এসে নেমেছেন তিনি। সুতরাং বোঝা যায় তখনও বিশেষ কোনও পদোন্নতি হয়নি তাঁর। কাশিমবাজার থেকে পাটনায়। সেখানে ভাগ্য কিঞ্চিৎ প্রসন্ন। সকলের ওপরে তাঁর ঠাঁই। ১৬৭১ সালে দেখি মাইনে তাঁর দ্বিগুণ হয়েছে, কুড়ির জায়গায় চল্লিশ পাউন্ড। ১৬৭৫ সালে বছরে আরও কুড়ি পাউন্ড বাড়তি দেওয়া হচ্ছে তাঁকে ‘গ্রাচুইটি’ হিসাবে। ১৬৮০ সালে আবার তিনি কাশিমবাজারে। সেখানেও কুঠির প্রধান তিনি। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য সংবাদ ‘বে কাউন্সিল’ ওরফে এই অঞ্চলের সব কুঠির তত্ত্বাবধায়ক যে আঞ্চলিক পরিচালক সমিতি তাতে দ্বিতীয় স্থানটি নির্দিষ্ট হয়েছে তাঁর জন্য। দুই দুইবার সুযোগ আসা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ আসনটি ফসকে গেছে কেন কে জানে, চার্নক প্রথমের মর্যাদা পাননি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত। চার্নক সে বছর বদলি হয়েছেন হুগলিতে। এখানে কাউন্সিলে প্রথম তিনি। এবার থেকে সরাসরি মাদ্রাজের ওপরওয়ালাদের কাছে জবাবদিহির দায় তাঁর। আর এমনই ভাগ্য, সে বছরই স্থানীয় রাজকর্মচারীদের সঙ্গে হুগলিতে ইংরেজ কুঠিয়ালদের তুমুল গোলমাল। হুগলি তছনছ করে কুঠিয়াল চার্নক পালালেন সেখান থেকে। কোম্পানি যুদ্ধ ঘোষণা করল প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে। সার জোসিয়ার-এর সেই ঘোষণাপত্র পড়ে পরবর্তী কালের ইংরেজরা তাঁর ধৃষ্টতা আর দুঃসাহসিকতা দেখে হেসে খুন। ছয় কোম্পানি সৈন্য আর দশটি নড়বড়ে জাহাজ পাঠালেন তিনি মোগলদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। চার্নককে হুকুম দেওয়া হল—দরকার হলে গঙ্গার মুখে চট্টগ্রামে চলে যাও, সেখানে নতুন করে কুঠি বসাও। কোথায় গঙ্গা, কোথায় হুগলি, আর কোথায় চট্টগ্রাম। চার্নক জলে ভাসতে লাগলেন। সে বছর (১৬৮৬) ডিসেম্বরে সুতানটিতে এসে হাজির হলেন তিনি। কিন্তু সুতানটি তখনও তাঁর পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়। আবার জলে। পরের বছর সেপ্টেম্বরে ঘুরে-ফিরে আবার সুতানটিতে। মতলব কিছু রসদ সংগ্রহ, আর কোনও মতে বর্ষাটা পার করে দেওয়া। তারপর ভাসতে ভাসতে কিছুকালের জন্য মাদ্রাজে বিশ্রাম। তারই মধ্যে হুগলিতে এসেছেন নতুন শাসনকর্তা—ইব্রাহিম খাঁ। ইংরেজের ভাষায় ‘দি মোস্ট ফেমাসলি জাস্ট অ্যান্ড গুড নওয়াব অব বেঙ্গল।’ তিনি ওঁদের ষাট হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হলেন। চার্নক আবার ফিরে এলেন বাংলায়। কিন্তু হুগলিতে নয়, সেই সুতানটিতে। সেদিন ২৪ আগস্ট, ১৬৯০। ইতিমধ্যে ওঁরা মনে মনে লোফালুফি করেছেন আরও ক’টি জায়গা নিয়ে। চট্টগ্রামের কথা ছেড়েই দিচ্ছি। কথা উঠেছিল হিজলি এবং উলুবেড়িয়া সম্পর্কেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহাল রইল সুতানটির প্রস্তাব। এই তাঁর তৃতীয় এবং শেষবারের মতো পদার্পণ। দু’ বছর পরে ১৬১২ সনের ১০ জানুয়ারিতে এখানেই শেষ নিশ্বাস ফেলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স নাকি বাষট্টি বছর। সেন্ট জন চার্চ প্রাঙ্গণে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে তাঁর সমাধি। এটি অবশ্য পরবর্তিকালে (১৮৯২) সংস্কার করা হয়েছে। তবু অনেকে মনে করেন কলকাতা
আমরা ওঁর সম্পর্কে আরও কিছু কিছু খবর জানি। কিছু ইতিহাস। কিছু খোশ গল্প। জানি ওঁর কালের খবরও। এ-কালের হাতে রয়েছে সেকালের চোখে দেখা একাধিক বিবরণ। স্যার উইলিয়াম হেজেস-এর দিনলিপি, মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জের কর্তা স্ট্রেনসহাম মাস্টার-এর দিনলিপি আঠারো শতকের সিন্ধুবাদ ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী এবং ইন্ডিয়া অফিসে সংরক্ষিত এগারো খণ্ড তথ্যপঞ্জি। স্বাধীন সওদাগরবেশে হ্যামিলটন কেপ থেকে জাপান পর্যন্ত দরিয়া তোলপাড় ফিরেছেন ১৬৮৮ থেকে ১৭২৩ সাল। কলকাতার শৈশব তাঁর নিজের চোখে দেখা। ইন্ডিয়া অফিসের খাতা শেষ হয়েছে ১৭০৬ সালে। বাল্যলীলার খবর অতএব সেখানেও কিছু কিছু পাওয়া যায়। প্রথম খণ্ডটির শিরোনাম ‘ডায়রি অ্যান্ড কনসালটেশন বুক ফর অ্যাফেয়ার্স অব দ্য রাইট অনারেবল ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেপট বাই রাইট ওয়রশিপফুল দ্য এজেন্ট অ্যান্ড কাউন্সিল বিগিনিং জুলাই সিক্সটিন্থ, ১৬৯০। সংক্ষিপ্ত রুক্ষ শুষ্ক গদ্য। সবই প্রায় কাজের কথা। সেখানে ‘ওয়রশিপফুল এজেন্ট’ সাহেবকে খুঁজে পাওয়া শক্ত। তবু খুচরো খবর অফুরন্ত।
আগস্টে নোঙর করার চারদিন পরে প্রথম কাউন্সিল মিটিং। তাতে জানা যাচ্ছে সুতানটিতে ওঁদের যা ছিল সবই গেছে। আবার বাড়ি তৈরি করা হোক—বা না হলে নয় এমন সস্তা বাড়ি। দেওয়াল হবে মাটির, ছাদ খড়ের। ফ্যাক্টরির জন্য জমি না পাওয়া পর্যন্ত তা-ই দিয়েই চালিয়ে যেতে হবে। তার বেশ কিছুকাল পরে কাঁচা বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর যে পাকাবাড়ি গড়া হয় নিলামে তা বিক্রি হয়েছিল ৫৭৫ টাকায়। সুতরাং, বোঝা যায়, কী তখন অবস্থা! চার্নককে বাস করতে হয়েছে প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন নৌকোয়। সদলবল। সপরিবার।
বাস জলে। সওদাগরি গাছতলায়। ১৮২০ সালে মার্কিজ অব হেস্টিংস-এর হুকুমে কেটে ফেলার আগে পর্যন্ত বৈঠকখানায় একটি বটগাছকে ঘিরে কত না উপকথা! সে গাছতলায় বসেই নাকি আড্ডা দিতেন চার্নক। কেনাবেচা করতেন। তাঁর পরনে থাকত মসলিনের ঢিলে জামা আর পা-জামা। মুখে থাকত গড়গড়ার নল। পরবর্তী কালে গবেষকরা অবশ্য গাছটির ঠিকানা বদল করেছেন। তাঁরা মনে করেন শিয়ালদহে নয়, সে গাছ ছিল নিমতলার কাছাকাছি। বৈঠকখানার পর সতী-উদ্ধার পর্ব। ‘ক্রাইজ চার্নক’—স্ক্যাটার দ্য ফ্যাক্টর্স। ডাবল দ্য ব্রাহ্মিন ইন টু! দ্য টল পেল উইডো ইজ মাইন, জো—দ্য লিটল ব্রাউন গার্ল ইজ ফর ইউ!’—জোসেফ টাউনসেন্ড-এর এই নাটকীয় পদ্যের উৎসও হ্যামিলটন। তিনি লিখেছেন—এক সুন্দরী সতীকে চিতার আগুন থেকে কেড়ে এনে ঘরে তুলেছিলেন চার্নক। ঘটনাটি হয়তো মিথ্যা নয়। কিন্তু নাট্যমঞ্চ কলকাতার গঙ্গাতীর নয়, চার্নক তাঁর জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছিলেন পাটনায়। সম্ভবত ১৬৬৩ সালে। সেদিন কি তিনি মধ্যযুগীয় নাইটের ভূমিকায়? স্রেফ মানবিকতাবোধ থেকেই কি হিন্দু রমণীর দিকে ত্রাতার মতো হাত বাড়িয়েছিলেন? নাকি চোখে ছিল তাঁর লালসার আগুন? চার্নক রোমান্টিক প্রেমিক না লুঠেরা দস্যু? মেয়েটিকে খ্রিস্টান নাম দিয়েছিলেন তিনি—মারিয়া। ‘জোব চার্নকের সঙ্গে দীর্ঘ কুড়ি বছর ঘরকন্না করেছেন মারিয়া। কেউ কেউ বলেন—চোদ্দ বছর। অন্তত চারটি কন্যা-সন্তানের জননী তিনি। এই চার কন্যা পাত্রস্থ করেছেন চার্নক এদেশে। অবশ্য স্বমেলে। বড় মেয়ে মারির বিয়ে হয়েছিল কলকাতার কোম্পানিরই আর এক কর্মী চার্লস আয়ার-এর সঙ্গে। পরে যিনি স্বনামধন্য স্যার চার্লস আয়ার। কনিষ্ঠতমা বোধ হয় এলিজাবেথ। এলিজাবেথ বাউরিজ। তিনি অন্তত ১৭৪০ সাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন কলকাতায়। কেননা, দেখা যাচ্ছে সে বছর কোম্পানির পরিচালকদের কাছে কিছু মাসোহারার জন্য আবেদন করছেন তিনি। আবেদনপত্রে প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছেন অন্য ভগ্নীপতিদের কথাও। সবাই ছিলেন কোম্পানির বিশিষ্ট কর্মীর সহধর্মিণী। জন কোম্পানির কর্তারা মাসিক পঞ্চাশ টাকা মঞ্জুর করেছিলেন তাঁকে। সেই দানের অর্থেই দিন চলত তাঁর।
শোনা যায়, কলকাতাতেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল ওঁদের মা মারিয়াকে। চার্নক প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কবরে মুরগি জবাই করতেন একটি করে। মারা যাওয়ার পর তাঁকেও সমাহিত করা হয় নাকি একই কবরে। লালদিঘির অদূরে গির্জার উঠোনে মাটির তলায় পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছেন বিদেশি অভিযাত্রী আর তাঁর দিশি বিবি। অন্তত কলকাতার আদিবাসীদের অনেকের ধারণা তা-ই। রেভারেন্ড হাইড উনিশ শতকে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন চার্নকের সমাধি নিয়ে। তাঁর অনুমান, কবরে লেখালেখিগুলো ১৬৯৫ সালের। সমাধি জামাতা আয়ার-এর কীর্তি। তাতে দুই মেয়ের কথা আছে, কিন্তু তাদের মায়ের কথা নেই। হাইড নিশ্চিত বলতে পারেননি মারিয়াও এখানেই শায়িত। মুরগি জবাইয়ের ব্যাখ্যা হিসাবে বলা হয়, মারিয়া হয়তো পঞ্চপিরের ভক্ত ছিলেন। তাঁর বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই এই উৎসর্গ। সত্য হোক, মিথ্যে হোক, এসব কারণেই চার্নক বেঁচে আছেন এখনও। এখনও তিনি জীবন্ত, এখনও সমান বর্ণাঢ্য।
চার্নক প্রেমিক ছিলেন। পত্নী-প্রেমিক। সেটা কিন্তু তৎকালে খুব স্বাভাবিক চরিত্রলক্ষণ নয়। কেননা, ভারত ব্রিটেন নয়, দূরবর্তী দেশ এবং বিদেশে স্বদেশি রীতিনীতি অতিশয় শিথিল। অসবর্ণে তখন বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই ওঁদের। লজ্জাবোধ নেই পদস্খলনে। স্ট্রেনসহাম মাস্টার-এর বিবরণে আমরা শুনি হুগলি কুঠিতে এক টমাসের কথা। সে সন্দেহবাইগ্রস্ত। তাঁর স্ত্রী নাকি কাউন্সিলের প্রধান ভিনসেন্টের সঙ্গে নষ্ট। শহর পত্তনের ক’বছরের মধ্যেই কলকাতায় আর এক কাণ্ড। ওয়েলডান নামক এক সাহেবের অনুপস্থিতিতে মেমসাহেব নাকি দু’জন নাবিককে নিয়ে আমোদে মত্ত। ওয়েলডেন ফিরে এসে একজনের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা আদায় করে বউকে তুলে দিলেন তার হাতে। এমনই সব কেচ্ছা। তারই মধ্যে চার্নক আর মারিয়ার সুখের সংসার একটু অন্যরকম দেখায় বই কি! বিশেষত, চার্নক যখন অন্য মেজাজের মানুষ। তিনি লোভী সওদাগর, বেপরোয়া অস্ত্রধারী। হ্যামিলটন লিখেছেন—তিনি ‘রেইনড মোর অ্যাবসলিউট দ্যান এ রাজা, অনলি হি ওয়ানটেড ম্যাচ অব দেয়ার হিউম্যানিটি।’ এদেশের রাজাদের চেয়েও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল তাঁর, ছিল না শুধু মানবিকতাবোধ। তাঁর এক নেশা ছিল নাকি পান থেকে চুন খসলেই স্থানীয় লোকদের ধরে এনে সাজা দেওয়া। ওরা যখন আর্তনাদ করত, চার্নক তখন বসতেন ভোজের আসরে। নেটিভদের কান্নাই ছিল নাকি তাঁর কাছে গান।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, সমসাময়িক গোরাদের মধ্যে চার্নক এক অস্থির উদ্ধত, গোঁয়ার-গোবিন্দ। স্ট্রেনসহাম মাস্টার লিখেছেন—হুগলির কুঠিতে বিবাদ বিড়ম্বনা লেগেই আছে। চার্নক কিছুতেই হিসাবের খাতা লিখবে না। সে ‘দ্বিতীয়’, সুতরাং বলে—খাতা লেখা আমার কাজই নয়। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে যেভাবে হুগলি লণ্ডভণ্ড করেছেন তিনি তাতেও হঠকারিতার প্রমাণ মেলে। স্থানীয় দর্শকরা নাকি তাজ্জব। ফিলিফ উড্রাফ নবাব মহাব্বত খানের বিবরণ পেশ করেছেন। তিনি বলেন, সাহেবের জাহাজে আতস কাচ ছিল। তাই দিয়ে রোদ প্রতিফলিত করে চন্দননগর পর্যন্ত সব সে জ্বালিয়ে ছাই করে দিল। নবাবের ফৌজের ওপর হুকুম হল—নদীতে শেকল ফেলে ফিরিঙ্গির জাহাজ আটকাও। ইউরোপিয়ান তলোয়ার দিয়ে সে শেকল কেটে বেরিয়ে গেল সাহেব। নবাব স্পষ্টতই বিস্মিত, মুগ্ধ। চার্নক বুঝি তাঁর মনের মতো নায়ক।
চার্নক যাঁদের কাছে সত্যই নায়কের ভূমিকায় তাঁরাও কিন্তু কদাচিৎ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একালের এক ঐতিহাসিক মনে করেন কোম্পানির তৎকালের কর্মচারীদের মধ্যে তিনি বিশেষ অসংস্কৃত। স্থূল প্রকৃতির। সেটাই স্বাভাবিক। চার্নক উচ্চ কুলোদ্ভব নয়। বস্তুত, কাদের ছেলে তিনি, স্বদেশে কোন অঞ্চলে ছিল তাঁদের ভদ্রাসন, কিছুই এখনও জানা যায়নি। তাঁর বিশেষ শিক্ষাদীক্ষাও ছিল না নাকি। কোম্পানির খাতায় যেসব লেখালেখি তা থেকে তাঁর বিদ্যার পরিচয় কিছু মেলে না। জোরালো সই-তে অবশ্য অদম্য এক ব্যক্তিত্বের ছাপ। হান্টার-এর কথা —‘’Charnock now stand fourth in the manuscript records as a block of rough-hewn British manhood.’’
আমরা একেই বলি গোঁয়ার গোবিন্দ। কেমন দেখতে ছিলেন এই প্রবাদ-পুরুষ? হান্টার মনে করেন—সুশ্রী নন সম্ভবত। কেননা, তার অঙ্গে ছিল না নরম পোশাক, তাঁর বাস ছিল না প্রাসাদে। সাম্রাজ্য গড়ার কারিগর এঁরা, চেহারা নিয়ে ভাববার সময় কোথায়?
জানি না, বাষট্টি বছর বয়সে এদেশের তপ্ত জল-হাওয়া আর অস্থির পরিবেশে কেমন চেহারা দাঁড়িয়েছিল তাঁর। চরিত্রের মতো চেহারায় নাকি ছায়া ফেলে বিশেষ অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমা। চার্নক অতএব মনোহর না হয়ে ভয়াবহ কোনও পুরুষের মূর্তি ধারণ করলেও সেটা বিস্ময়ের হত না। কিন্তু ১৯৭৪-এ প্রকাশিত চার্নকের একমাত্র প্রতিকৃতিটি বলছে একসময় সত্যই সুবেশ এবং সুশ্রী ছিলেন জোব চার্নক। কে বলবে সওদাগর, যেন কোনও কবির চিত্র। এতকাল তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছি আমরা। ইতিহাস। উপকথা। প্রবাদ। এই প্রথম রূপকথার নায়কের মুখোমুখি। কত বয়স তখন তার? জানি না। হিসাব করলে মনে হয় জন্ম তার ১৬৪০ নাগাত। এদেশে যখন এসেছেন বয়স তখন পনেরো কি ষোল। এই ছবি কি ঠিক তার আগের? নাকি পরে কখনও আঁকানো? জানি না। হুগলি কুঠির বিবরণে দেখছি কাজ হত সকাল নটা দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। বিকেলে আবার চারটে পর্যন্ত। তারপর সামাজিকতা। আড্ডা। খানাপিনা। আরক, পাঞ্চ, সিরাজ। কুঠির প্রধান এবং দ্বিতীয় যিনি, তাঁরা চলাফেরা করতেন পালকিতে। অন্যরা বাইরে বের হলে মাথার ওপর থাকত মস্ত মস্ত ছাতা। ১৬৫৮ সালে পোশাক ছিল কাপড়ের কোট, তাতে লেস। বস্তুত এই লেসই ছিল নাকি ইংলিশম্যানের ব্যাজ, মানে প্রতীকের মতো। উচ্চপদে অধিষ্ঠিত যাঁরা, তাঁরা পরচুলা পরতেন। মাথায় পরচুলা, গায়ে লেসওয়ালা বাহারি কোট—তবে কি এই তরুণ হুগলির কুঠিয়াল? এখনও জানি না। কেন না, জোব চার্নকের মুখোমুখি আমরা হঠাৎই। এতকাল প্রতীক্ষার পরে এই প্রথম দেখা গেল তাঁর মুখ একটি পুঁথির পাতায়। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দেওয়ালে। পুঁথিটি বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। এই সংস্করণটি কয়েক বছর আগে (১৯৭৪) প্রকাশিত। (মাইক্রোপডিয়া অংশ ভল্যুম ২৷১৫ সংস্করণ)। বইটি এদেশে পৌঁছেছে তখনই। তার পাতায় অনেক নতুন খবর আছে। কলকাতার পক্ষে বিশেষ দ্রষ্টব্য জোব চার্নকের এই ছবি। ওঁরা জানিয়েছেন ছবিটি টি, ট্রটার (T. Trotter, 1750-1803) নামে একজন শিল্পীর এচিং। মূল প্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন হোয়াইট (White) নামে আর এক শিল্পী। উপস্থিত এ ছবি আছে ম্যানসেল কালেকশনে (Mansell Collection)। হোয়াইট কবেকার লোক? তিনি কি দেখেছিলেন চার্নককে? মূল প্রতিকৃতিটিই বা এখন কোথায়?
আমরা এখনও বিস্তারিত কিছুই জানি না। অথচ না-জানা অবধি অপেক্ষা করে থাকব তা হয় না। কেননা ছবিটি জোব চার্নকের। আর আমরা দর্শকরা কলকাতার মানুষ। পণ্ডিতেরা বিবাদ করুন লয়ে তারিখ সাল, আমরা ইতিমধ্যে দু’ চোখ ভরে দেখে রাখি সেই বিদেশি অভিযাত্রীকে। যাঁর সোনার কাঠির স্পর্শে (নাকি স্থূল শীতল লৌহদণ্ডের নির্মম আঘাতে?) একদিন ঘুম ভেঙেছিল ভাগীরথীর এই তীরে, চোখ মেলেছিল ভবিষ্যতের কলকাতা।
কলকাতার পিতামহ
আরমেনিয়ান স্ট্রিট আর আরমানি গির্জা। আরমানি ঘাট, আরমানি কলেজ। কলকাতার ভূবৃত্তান্তে এদের উল্লেখ আছে। মিথ্যে বলব না, রাস্তাটির না হলেও ঘাট ও গির্জাটির জন্যে কিঞ্চিৎ স্থানও বরাদ্দ আছে কলকাতার ইতিহাসে। বিশেষ করে গির্জাটির জন্য। কারণ, আরমানি গির্জা কলকাতার প্রবীণতম গির্জা। প্রথমত গির্জা, দ্বিতীয়ত বয়ঃপ্রবীণ। সুতরাং এই সৌজন্যটুকু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু ব্যস, এখানেই ইতি। অতঃপর কলকাতার সব আজব কাহিনীর নায়ক ইংরেজ। কলকাতার ইতিহাস ইংরেজের ইতিকথা। তাদের শৌর্য, বীর্য, বুদ্ধি, মেধা ইত্যাদির কাহিনী। সে কাহিনীতে মুরদের মতো ফিরিঙ্গিদের মতো আরমেনিয়ানরাও অপাঙক্তেয়। অথচ কলকাতা-কারিগরদের সারি করে বসালে আরমেনিয়ানরা এসে পড়ে একেবারে প্রথম সারিতে।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি চার্নক সাহেব কলকাতার জনক। এমনকী, গতকাল অবধিও তাই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু আজ এই আরমানি গির্জার আঙিনায় দাঁড়িয়ে মনে হল চার্নক কিংবা ইংরেজরা যদি পিতা হন কলকাতার, তবে আরমেনিয়ানরা পিতামহ। আমার গাইড আমাকে এনে দাঁড় করালেন একটা কবরের সামনে। আরমানি ভাষায় তার উপরে লেখা কতকগুলো হিজিবিজি কথা। ইংরেজি করে বলে গেলেন তিনি: দানশীল সুকিয়া সাহেবের স্ত্রী এখানে কবরস্থ হয়েছেন ১৬৩০ সালের ২১ জুলাই।
অর্থাৎ জোব চার্নকের কলকাতার মাটিতে পা দেওয়ার ত্রিশ বছর আগে এখানকার মাটিতে দেহরক্ষা করেছেন জনৈকা আরমানি গিন্নি। তথ্যটা বড় নতুন ঠেকল আমার কাছে। সুতানটিতে এর আগেও মানুষ ছিল আমি জানি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর ‘বেনিয়ার বালা’ চিৎপুর কলিকাতা কালীঘাট হয়ে তবে গিয়েছিলেন পুবমুখো, এ সংবাদ গুজব হলেও শুনতে মন্দ লাগে না, কিন্তু তাই বলে সুদূর আরমেনিয়ার মানুষ? অবশ্য সবাই জানেন ইউরোপিয়ানদের বহু আগে থেকে সেই মুঘল-যুগে আরমেনিয়ানদের গতায়াত ছিল এদেশে। স্থলপথে আফগানিস্থান, পারস্য হয়ে তাঁরা এদেশে এসে ব্যবসা করেছেন সেই সেকাল থেকে। সুরাট, আগ্রা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, সয়দাবাজ—অনেক নগরে বন্দরেই ওঁদের ঠিকানা। কিন্তু কলকাতায়? সুতানটির মতো গণ্ডগ্রামে?
উইলসন সাহেব লিখেছেন: কলকাতার ইতিহাসকে আরও পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে চেষ্টা সম্প্রতি নানা জন নানা ভাবে করে চলেছেন তা একেবারে বিফল হয়নি। সেই প্রচেষ্টার প্রথম ফল: এই কবরটি। জনৈক আরমেনিয়ান ঐতিহাসিক আরমানি গির্জার কবরখানায় আবিষ্কার করলেন এটি। সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে গেল ইংরেজের পিতৃ-গৌরব। এখানেই শেষ হল না। একটা বা তিনটে কবরের মূলধনে পিতামহর দাবি উপস্থিত করলেন না আরমেনিয়ানরা। তা হলে হয়তো, কিঞ্চিৎ চিতাভস্মের জোরে আমরাও চেষ্টা করতে পারতাম তা। দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে তাঁরা প্রমাণ করলেন, আরমেনিয়ানরা শুধু কলকাতার প্রথম বিদেশাগত বাসিন্দা নয়, তারাই কলকাতার আসল সৃষ্টিকর্তা। ইংরেজের হাত দিয়ে তারাই পত্তন করেছে এ শহর। তারাই রক্ষা করেছে এ শহরের ইংরেজকে। তারা না থাকলে কলকাতা হয় না, তাদের বাদ দিলে কলকাতার ইংরেজদের চলে না। অথচ ইংরেজরা ইতিহাসে বেমালুম বাদ দিয়ে বসে আছে তাদের। কথাটা ঠিক বুঝতে হলে ইতিহাস নেড়েচেড়ে দেখতে হয় একটু।
১৬৯০ সন। চার্নক কলকাতায় নেমেছেন। গাছতলায় বসে হুঁকো খাওয়া চলে, কিন্তু ব্যবসা করতে হলে ফ্যাক্টরি চাই, গুদাম চাই। আবার এসব বাঁচাতে হলে চাই দুর্গ। কিন্তু দেবে কে? তার জন্য মোগল বাদশাহদের অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু তাঁরা বর্তমানে ইংরেজদের উপর যারপরনাই খাপ্পা। শুল্ক দিয়ে ব্যবসায়ের অনুমতি দিলেও ফ্যাক্টরি বা দুর্গ করার অনুমতি দেবেন কি না কে জানে! দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে বেচারা চার্নককে তাই জীবন কাটিয়ে যেতে হল তাঁবু, কুঁড়েঘর আর নৌকাতেই। তারপরেও বেশ কিছু দিন চলে গেছে। কোনওমতেই গোছগাছ করে বসতে পারছে না ইংরেজরা। মনে তাদের ভয়ানক দুশ্চিন্তা। এমন সময় (১৬৯৬ সালে) বিদ্রোহী হল শোভা সিং। ওরা ভাবলে বুঝি শাপে বর হল। জবরদস্ত খাঁ এলেন তাকে দমন করতে। ইংরেজরা স্থির করল তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে দেখা যাক। জবরদস্ত খাঁর কাছে যেতে হলে জবরদস্ত লোক চাই। খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। কিন্তু উপযুক্ত লোক পাওয়া গেল না। অবশেষে ইংরেজরা শরণাপন্ন হল একজন আরমেনিয়ানের কাছে। তাঁর পুরো নাম খোজা ইসরায়েল সারহেদ। সারহেদ ছিলেন হুগলির একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং সুরাটের বিখ্যাত ফানুস কালান্দরের ভ্রাতুস্পুত্র। কাকার সঙ্গে একবার বিলেত ভ্রমণেরও সুযোগ হয়েছিল তাঁর। যা হোক, ইংরেজরা সারহেদকে ধরে বসল। সুতানটি ডায়েরিতে ১৬৯৭ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসের বিবরণীতে এই ধরাধরির বিস্তারিত খবর আছে।
ইতিমধ্যে অওরঙ্গজেবের নাতি আজিম উস-সান এলেন বাংলার সুবেদার হয়ে। আবার ইংরেজরা বসে বসে দরখাস্ত লিখলে। উস-সান সমীপে সে দরখাস্ত বয়ে নিয়ে গেলেন এবারও সারহেদ। আকবরের কাল থেকে দরবারে আরমেনিয়ানদের খাতির। সারহেদও খাতির পেলেন তাঁর কাছে। বরং অতিরিক্ত হৃদ্যতা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে আজিম উস-সানের। তার কারণ সম্পর্কে শোনা যায় আজিম উস-সানের আগেই তাঁর পুত্রের মনোজয় করে ফেলেছিলেন বিচক্ষণ সারহেদ। সারহেদ বিলাসী আজিম উস-সানের জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন নানা উপহার, সঙ্গে নিয়েছিলেন তাঁর পুত্রের জন্য কিছু খেলনা। আজিম উস-সানের পুত্র ফারুখ শিয়ার তখন চোদ্দ বছরের কিশোর। খেলনা পেয়ে সে মহাখুশি। পিতাও তাই। সারহেদ দিনরাত্রি কিশোরের সঙ্গে খেলনা নিয়ে মত্ত। সে খেলায় যোগ দিলেন আজিম উস-সানও নিজেও। খেলতে খেলতে তিনি একসময় মঞ্জুর করে দিলেন তাঁর আর্জি। সেই আর্জিবলে ইংরেজরা পেল তিনখানা গাঁয়ের জমিদারি স্বত্ব। সুতানটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা। এ গাঁ তিনখানা অতঃপর তাঁরা দরকার হলে কিনে নিতে পারেন দেশি জমিদারদের থেকে। ১৬৯৮, ১০ নভেম্বর ১,৩০০ টাকায় কেনা হয়ে গেল জমিদারি। ইংরেজরা জমিদার হয়ে গেল কলকাতা সুতানটি গোবিন্দপুরের। বার্ষিক খাজনা ১১৯৫ টাকা। পত্তন হল কলকাতা মহানগরীর। শুরু হল ইংরেজের অভিযাত্রা। সারহেদ না থাকলে তা হত কি?
দিন এগিয়ে চলল। কিন্তু বিপদেরও যেন আর শেষ নাই। দিল্লির বাদশার খাতির পেলেও ইংরেজরা এদিকে ক্রমেই চক্ষুশূল হয়ে উঠল বাংলার নবাব জাফর খাঁর কাছে। জাফর খাঁ তাদের আগেকার যাবতীয় অধিকার নাকচ করে দিতে চান। এর একটা বিহিত বিধান আবশ্যক। স্থির হল আবার দরবারে লোক পাঠাতে হবে। লোকজনও ঠিক হল। জন সারমন, খোজা সারহেদ, জন প্রেট এবং এডওয়ার্ড স্টিফেন—এ চারজন যাবেন দিল্লিতে দূত হিসাবে। যেতে যেতে সময় লাগবে, ব্যবস্থাদিও করতে হবে। ইতিমধ্যে যদি কোনও নতুন বিপদ এসে যায়!
—‘কোনও বিপদ আসবে না,’ দিল্লি থেকে কোম্পানি বাহাদুরকে জানালেন আর এক আরমেনিয়ান। তিনি খোজা মানুর। মানুর ছিলেন অওরঙ্গজেবের দুহিতা বাদিশাহা বেগমের অনুচর। তিনি সম্রাটকে বলেকয়ে এক হুকুমনামা জারি করালেন। তাতে তাঁর দেওয়া ফরমানকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হল সমস্ত সুবাদার এবং বাদশাহের অন্যান্য কর্মচারীদের। তাদের এও বলে দেওয়া হল, কলকাতা থেকে সারহেদ এবং অন্যান্য ইংরেজ দূতরা যেন উপহারসমেত নিরাপদে দিল্লি পৌঁছাতে পারেন।
দূতবাহিনী চলল দিল্লি। সারহেদ তাঁদের একজন। পদমর্যাদায় তিনি দ্বিতীয়। ইংরেজ না হওয়া সত্ত্বেও কেন নেওয়া হল তাঁকে এ দলে, তার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে: দরবারে সারহেদদের প্রভাবের ফলেই ইতিপূর্বে আমরা নানা খাতিরলাভে সমর্থ হয়েছি। সুতরাং তাঁকে দূতবাহিনীর একজন পুরো সদস্য হিসেবেই নেওয়া স্থির হল।
কাউন্সিলের মতে খোজার সমর্থনে অন্যান্য কারণগুলো হল: ১। সারহেদ সম্রাট ফারুখ শিয়ারের বাল্যবন্ধু, ২। তিনি উত্তমরূপে এতদ্দেশীয় ভাষা জানেন এবং ৩। তাঁকে যদি দূত-বাহিনীর সদস্য না করে উকিল হিসেবে পাঠানো যায় তা হলে ইংরেজের মর্যাদা সম্রাটের চোখে কমে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কারণ, তখন সারহেদকেই বেশি সম্মান দেবেন সম্রাট। সুতরাং সারহেদও কোম্পানির দূত হয়েই চললেন দিল্লি।
সেই দৌত্যকাহিনী সর্বজনবিদিত। ইংরেজের উদ্দেশ্য বিফল হল না। ১৭১৭ সালে মহামান্য ফারুখশিয়ারের কাছ থেকে ইংরেজরা লাভ করল বহু অভিপ্রেত ফরমান। এতে ফারুখ শিয়ার ইংরেজদের পূর্বেকার সমস্ত অধিকার তো স্বীকার করে নিলেনই, সেই সঙ্গে কোম্পানিকে নতুন করে অধিকার দিলেন হুগলি নদীর দু’পাশে দশ মাইল পর্যন্ত আটত্রিশখানা গ্রাম কিনে নেবার। অর্থাৎ, প্রায় গোটা ২৪ পরগনার জমিদারি পেয়ে গেল ইংরেজরা। গড়ে উঠল বাংলায় ভবিষ্যৎ ইংরেজ রাজত্বের চিরস্থায়ী ভিত। হু হু করে বেড়ে চলল ইংরেজ-অধীন কলকাতা। স্টুয়ার্ট লিখেছেন: দূতবাহিনী ফিরে আসার পর কলকাতাবাসীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মোগল রাজত্বের কোনও সময়ে যা ছিল না সেই স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা দুই-ই পেলেন তাঁরা। ফলে ক্রমে ক্রমেই ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল কলকাতা।
কলকাতা তথা বাংলার ইতিহাসে এই ফরমান যারপরনাই মূল্যবান জিনিস। সারমন-দৌত্যের এই সাফল্যের জয়মাল্য চিরকাল ঐতিহাসিকেরা দিয়ে আসছেন ডাঃ হ্যামিলটনের গলায়। হ্যামিলটন ছিলেন ডাক্তার। দূতদের সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবেই তিনি গিয়েছিলেন দিল্লি। কথিত হয়ে থাকে সেখানে তিনিই নাকি বাদশার ব্যাধি নিরাময় করে পারিতোষিক হিসেবে লাভ করেছিলেন ফরমানটি। সেন্ট জন চার্চের অঙ্গনে হ্যামিলটনের সমাধিতেও দেখেছি ক্ল্যাসিক্যাল ইংরেজিতে লেখা হয়েছে সেকথা। কোথায়ও দেখা যায়নি সারহেদকে। এটা বলা অনাবশ্যক যে, তাতে গৌণ হয়ে যায় না এই দৌত্যে সারহেদের ভূমিকা।
প্রথম ছিল নিরাপত্তার প্রশ্ন। সে প্রশ্ন মিটিয়ে দিয়ে গেলেন সারহেদ জবরদস্ত খাঁর সঙ্গে দরবার করে। তাঁর খাতিরেই কলকাতার জমিদারি। ফ্যাকটরি। তারপর শোয়া-বসার জায়গা। সারহেদের খাতিরে আজিম উস-সান ইংরেজদের সামনে মেলে ধরেন বরাভয় মুদ্রা। আর এবার বলতে গেলে রাজত্বই এসে গেল হাতে। সারহেদের আগেকার ভূমিকা এবং দূতবাহিনীতে তাঁর নিয়োগ থেকে অনুমান করা যায় এ ব্যাপারেও তাঁর হাত ছিল। জোব চার্নক যদি এ শহরের পিতা হন তবে খোজা সারহেদকে কলকাতার পিতামহ বলতে অসুবিধা কোথায়?
যা হোক কলকাতার আরমেনিয়ানদের কথা এখানেই শেষ নয়। কারণ কলকাতার আসল কাহিনীর এখানে শুরু মাত্র। কলকাতার তখনও কৈশোর চলছে। ১৭৫৭ সালের কথা। সহসা এল ঝড়। মহা বিপর্যয়। সিরাজউদ্দৌলা আক্রমণ করলেন কলকাতা। ইংরেজের নবনগরী ভেঙে পড়ল খান খান হয়ে। খড়ের মতো এক ঝটকায় উড়ে গেল দুর্গ। ড্রেকের নেতৃত্বে প্রাণরক্ষার্থে শহরের ইংরেজ নর-নারী আশ্রয় নিলেন ফলতায়। কলকাতা হল আলিনগর। ফলতা ইংরেজ-রিফিউজি ক্যাম্প। নবাবের আদেশে বন্ধ হয়ে গেল সেখানকার খাদ্য সরবরাহ। ফলতার বাজারে কেউ পথ মাড়ায় না। না খেয়ে খেয়ে মৃত্যুর মুখের দিকে এগিয়ে চলল সাহেবরা। তাদের কোনও বান্ধব নেই এ বিপদে। তাদের সাহায্য করবার জন্য তখন বেঁচে নেই খোজা সারহেদ। কিন্তু ছিল অন্য আরমেনিয়ানরা। রাত্রির অন্ধকারে চুপিচুপি তাদেরই একজন এগিয়ে গেল কলকাতা থেকে ফলতার দিকে। টোকা পড়ল ইংরেজ কর্তৃপক্ষের দরজায়।—‘এই নাও খাদ্য।’ আনন্দে জড়িয়ে ধরল তারা এই অপরিচিত বান্ধবকে। শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেবের মতো দু’একজন অনুগত বাঙালিকে বাদ দিলে সেই দুর্দিনে আরমেনিয়ানরাই ইংরেজের ত্রাতার ভূমিকায়।
কে তুমি?
‘আমি খোজা পেট্রাস আরাটন। কলকাতার আরমানি ব্যবসায়ী।’ মুখে মুখে রটে গেল পেট্রাসের কথা। পেট্রাস উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করলেন। চিঠি লিখলেন মানিক চাঁদের কাছে। যোগাযোগ করলেন জগৎ শেঠের সঙ্গে। আরব্য উপন্যাসের নায়কের মতো অসমসাহসে তিনি ক্লাইভ আর ওয়াটসন এসে পৌঁছানো অবধি ফলতার উদ্বাস্তুদের বাঁচিয়ে রাখলেন।
এ জন্যে যেসব অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজ জীবন বিপন্ন করে চলতে হয়েছে তাঁকে, তা রীতিমতো রোমাঞ্চকর। পড়তে পড়তে মনে হয় এ উপকারের মূল্য ইতিহাসের দু’চার ছত্রে শোধবার নয়। দুঃখের বিষয়, ইংরেজরা সেটুকু চেষ্টাও করেনি।
ক্লাইভ, ওয়াটসন এলেন। কলকাতার পুনরুদ্ধার হল। কিন্তু পেট্রাসের ছুটি হল না। অন্তরঙ্গ মিত্র হিসাবে ক্লাইভ ধরে রাখলেন তাকে। পেট্রাসের মাধ্যমে গোপনে মিরজাফরের সঙ্গে শলা-পরামর্শ শুরু হল, সিরাজউদ্দৌলাকে সরাবার। পেট্রাস হলেন ক্লাইভের গুপ্তচর। এই যড়যন্ত্রের পরিণতি সকলের জানা। তারপর যখন ইংরেজদের দরকার হল মিরজাফরকে সরাবার, পেট্রাস তখনও বন্ধু। অবশেষে মিরকাশেমকে ঘায়েল করার ব্যাপারেও নিযুক্ত হলেন পেট্রাস। তা-ও সম্পন্ন হল। সমাধা হল বঙ্গে ‘বিপ্লব’। ব্যস, এখানে এসেই শেষ হয়ে গেল পেট্রাসের খাতির।
এবার শুরু হল পেট্রাসকে নিয়ে দরবার। দু’চারজন ছাড়া সকলেই একবাক্যে রায় দিয়ে বসলেন—লোকটি কখনও ইংরেজের মিত্র নয়, আসলে নবাবের গুপ্তচর। ওকে ফাঁসি দেওয়া হোক, কয়েদ করা হোক, তাড়িয়ে দেওয়া হোক, ইত্যাদি ইত্যাদি। অতি দুঃখে পেট্রাস চিঠি লিখলেন কোম্পানির ইংলন্ডস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে। দীর্ঘ চিঠি। কোম্পানির জন্য তিনি শুরু থেকে কী কী করেছেন, এবং এজন্য কত বিপদের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে তা বিস্তারিত লিখে তিনি উপসংহারে লিখলেন:
যদিও আপনাদের চরমতম বিপর্যয়ের মুহূর্তে আমি নিজের জীবন বিপন্ন করে এমনভাবে দেশদেশান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি, এবং যদিও বলতে গেলে বর্তমানের এই সুখকর পরিণতির জন্য আমিই প্রধানত দায়ী, তবুও আমার এমনই কপাল যে আপনারা একবার উল্লেখও করলেন না এই হতভাগার কথা!
এ চিঠির উত্তর আজও মেলেনি। এবং এ চিঠিখানাও নেই কোনও ইংরেজের ইতিহাসে। এটি সেই আরমানি গবেষকই বহু কষ্টে আবিষ্কার করেছিলেন!
মারাঠা ডিচ
‘সমস্ত গ্রামবাসী পালাইয়া গেল। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁহাদের পুঁথিপত্র লইয়া পালাইলেন, সুবৰ্ণবণিকেরা তাঁহাদের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে। গন্ধবণিকেরা তাঁহাদের মালপত্র, ব্যাপারিরা তাঁহাদের পণ্য নিয়া পালাইলেন। কামার হাতুড়ি নিয়া পালাইল, কুমার তাহার চাক নিয়া পালাইল। জেলেরা জাল নিয়া পালাইল। বানিয়ারা পলায়ন করিল। চারিদিকে কত লোক পালাইয়া গেল তাহার কোনও ইয়ত্তা নাই। গ্রামে গ্রামে যত কায়স্থ এবং বৈদ্য ছিল তাহারা বর্গীর নাম শুনিবামাত্র পলায়ন করিল। ভদ্র রমণীগণ যাঁহারা কদাপি ঘরের বাহিরে গমন করেন নাই তাঁহারাও মাথায় মালপত্র নিয়া পালাইলেন। যেসব রাজপুত্র কৃষিকাজ করিত, বর্গীর নামোল্লেখমাত্র তাহারা তরবারি ফেলিয়া রাখিয়া ছুটিয়া পালাইল। গোঁসাই মোহন্তগণ পাল্কি চড়িয়া পালাইলেন। কৈবর্ত, শেখ, সৈয়দ, মুঘল, পাঠান সকলে পালাইল। গর্ভবতী রমণীগণও ছুটিয়া পালাইলেন। দশ-বিশজন লোক হয়তো রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে তাহারা বর্গীদের দেখিয়াছে কি না—তাহা হইলে সকলেই সমস্বরে উত্তর করিবে—‘না।’ সকলে পালাইতেছে তাই তাহারাও পালাইতেছে।” গদ্যে ভাঙাইলে ‘মাহারাষ্ট্রা পুরাণ’-এর বয়ান অনেকটা এই রকম।
নবাব আলিবর্দির ভূমিকা যত ভাল অভিনীতই হোক, তরুণ সিরাজ ভাবাপ্লুত কণ্ঠে যত বীরত্বই প্রকাশ করুক না কেন, অপেরা পার্টির ‘বঙ্গে বর্গী’ দেখে বাংলার মানুষের মনে সেদিন যে আতঙ্কের অন্ধকার নেমে এসেছিল, তাকে বোঝা যাবে না। পরিমাপ করা যাবে না মঞ্চের ভাস্কর পণ্ডিতকে দেখে বর্গীর অত্যাচারের পরিমাণকে। বাংলার, সারা পশ্চিমখণ্ডে সেদিন মৃত্যুর মহোৎসব। হত্যা, লুণ্ঠন, আগুন আর উন্মাদ উদ্দাম প্রবৃত্তির খেলা।
বলা বাহুল্য, ভাগীরথী পেরিয়ে এসে কান্না পৌঁছাল কিশোর নগরী কলকাতার কানেও। কিন্তু সে কান তখন বধির। নেটিভরা অক্ষম বাঙালি। কোম্পানি দায়িত্বহীন বিদেশি। বর্গীর অত্যাচার থেকে বাংলাকে বাঁচানোর দায়িত্ব তাদের নয়, দায় বাংলার নবাবের। কিন্তু নিজেদের? নিজেদের রক্ষা করবে কে? বর্গীরা যে কলকাতায় আসবে না—এমন তো কোনও হলফ করেনি তারা। বরং ‘লুঠব তো ভাণ্ডার’ বলে এদিকেই এগিয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি। অতএব কোম্পানির মনেও ঘনিয়ে এল আতঙ্কের ছায়া। কোম্পানি আতঙ্কিত। নেটিভরাও ভয়ে কাঁপছে। সুতরাং কলকাতায়ও সাজ সাজ রব উঠল।
তখনকার কলকাতা। তখনকার কালের যুদ্ধ। আমার মতো গত মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি যাঁরা দেখেছেন কাগজ-আঁটা জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে তাঁদের পক্ষে কষ্টকর সেদিনের প্রস্তুতিকে অনুমান করা।
‘কী আর হবে, গোবিন্দপিসেকে চিঠি দিয়ে দিচ্ছি বাড়িটাকে একটু পয়-পরিষ্কার করাতে। আসছে মাসের মাইনে পেয়েই বিদায়। ততদিন “দুর্গা দুর্গা” জপ।’
অফিস আদালত খালি করে, বাড়িঘর ছেড়েছুড়ে কেরানি বাঙালির মতো সেদিন পালাননি সুতানটি গোবিন্দপুরের মানুষ। হাওড়া স্টেশনে রেল নেই, সবচেয়ে বড় কথা, নেই নিরাপদ আশ্রয়। পালাবেন কোথায়? সুতরাং কলকাতার মাটি আঁকড়েই পড়ে রইলেন—বেনিয়ান, সরকার, মুৎসুদ্দি, আড়তদার আর হাটুরের দল। পড়ে রইলেন শেঠ বসাক ধনপতিরাও। ভরসা মা গঙ্গা, আর এই কোম্পানি।
এদিকে কোম্পানির গবেষণার আর শেষ হয় না। সত্যিই তো আত্মরক্ষার ব্যবস্থাটুকু তো অন্তত চাই। অবশ্য গড় একখানা গড়েছে তাঁরা তাঁদের পাড়ার উঠোনেই। লালদিঘির কোণে। কিন্তু সেটি নিতান্ত অপ্রতুল। কোম্পানির কর্তারা মিটিংয়ে বসলেন। কমিটি গঠিত হল একটি। চারজন সাহেবের কমিটি। তাঁরা সারা শহর ঘুরে এসে বললেন—রাস্তাঘাট, গলি-ঘিঞ্জি যা দেখে এলাম তাতে আর যাই হোক, এটুকু বলতে পারি আমাদের বর্তমানে যা সৈন্য আছে তা তো কোন ছার, যদি আজ থেকেই শুরু হয় সৈন্যসংগ্রহ তা হলেও এ শহরকে রক্ষা করার মতো ব্যবস্থা করে তোলা সম্ভব হয়ে উঠবে না। সুতরাং বিশেষজ্ঞরা এলেন, পরিকল্পনা দাখিল হল, বাতিল হল। আবার নয়া পরিকল্পনা নতুন করে দাখিল হল। প্রথমে এখানে, তারপর বিলাতে। বিলাতের কর্তৃপক্ষ বলে পাঠালেন—ভাল কথা। আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করবে বই কি! তবে দেখো খরচপত্র যেন কম হয়। আর দেখো, মাননীয় নবাব বাহাদুর যেন বিরক্ত না হন। তিনি যেন মনে না করেন তোমরা বেশি বেশি শুরু করে দিয়েছ। তা ছাড়া যাই করো না-করো, বুঝে শুনে করো। গৃহস্থবুদ্ধি থাকা চাই, দু’দিন পরেই যেন আবার নতুন খরচের দায় না পোয়াতে হয়। ওহো, আর একটা কথা, নেটিভদেরও দেখো। মনে রে
নেটিভরা কান পেতে রইলেন। গড়ের সামনে দু’ বেলা ঘোরাঘুরি করেন শেঠরা, বণিকেরা। কী হয়, কী হয়। খবর এল। কত মঞ্জুর হল, তাই শোনার জন্য অধীর আগ্রহ তাদের। কোম্পানি বলল—এত ব্যস্ত কেন? আমরা তো সব ব্যবস্থাই করছি। তাঁরা বাগবাজারের ঘাটে দাঁড় করিয়ে দিলেন একখানা জাহাজ। নাম ‘টাইগ্রেস’। পেরিনস্ পয়েন্টে জাহাজ দাঁড়াল আর একখানা, আর জায়গায় জায়গায় বসানো হল গুটিকয় কামান। সাত জায়গায়।
—আর?
আর কী করা যায় তাই তো ভাবছি। কোম্পানি আবার ভাবিত হল।
এবার নেটিভ-রাগ চড়ে গেল গোবিন্দপুর সুতানটির মানুষের মাথায়। তারাও মিটিং বসাল। স্থির হল—‘আমরাই রক্ষা করব আমাদের।’ ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, কামান বন্দুক নেই, না থাক। খাদ কাটব শহর ঘিরে। খাদ বলতে ডিচ। ৪২ গজ চওড়া ৭ মাইল লম্বা। বাগবাজার থেকে শুরু করে প্রায় বৃত্তের মতো উত্তর থেকে পুব দিকে ঘুরে দক্ষিণ দিকে যাবে। খরচাপত্র যা লাগে নিজেরাই দেব। নিজেদের খরচের পরিখা হবে নিজেদের রক্ষার জন্য।
সে মিটিংয়ে সভাপতি বা প্রধান অতিথি কে ছিলেন জানি না, সেই সভার শ্রোতা হওয়ার দুর্লভ ভাগ্যও হয়নি আমার—তা হলে দেখতে পেতাম দৃঢ়সংকল্প কতকগুলো মানুষের উজ্জ্বল মুখ। অন্যের হাতে নিজের জীবনরক্ষার দায়িত্বটুকু তুলে দিয়ে তাঁরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ইষ্টনাম জপছেন না, কোদাল হাতে নেমেছেন। পরিখা কাটতে। বর্গীর লম্ফ সুতানটির মাটি স্পর্শ করার আগেই ঘোড়াসমেত তলিয়ে যাবে সেই খাদের গভীরে। দস্যুতার সমাধি হবে এখানেই। এই কলকাতায়।
কোম্পানি থেকে আগাম নেওয়া হল কিছু টাকা। পঁচিশ হাজার টাকা। ১৭৪৩ সালের ২৩ মার্চ। ধার নেওয়া হল টাকাটা। কথা রইল জনসাধারণ পরিশোধ করবে। দায়ী রইলেন শেঠেদের বাড়ির বৈষ্ণবচরণ, রামকৃষ্ণ, রাসবিহারী আর উমিচাঁদ।
অবিরাম কোদাল চলল। নিঃশব্দে মাটি কেটে গেল কলকাতার মানুষ। ছ’ মাস কেটে গেল। তিন মাইল খাদ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ইতিমধ্যে সংবাদ এল। মারাঠিদের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেছে নবাবের। তা হলে আর কী দরকার মিছিমিছি মেহনত করে। কোম্পানির ইংলন্ডস্থ কর্তৃপক্ষের মতো সাংসারিক পরামর্শ দেবে এমন অভিভাবক তো আর ছিল না কলকাতার সাধারণ মানুষের। তাই সেখানেই বিরতি দিল তারা। তাতেও বাগবাজার থেকে জানবাজার স্ট্রিট, অর্থাৎ প্রায় বেগবাগান অবধি তৈরি হয়ে গেল খাদ। কেউ কেউ বলেন, টালির নালাটাও ওরই অপভ্রংশ। বাগবাজার থেকে সোজা পুবদিকে চলে যায়নি সেটা। গোবিন্দ মিত্তির আর উমিচাঁদের বাগানবাড়ি তখন হালসিবাগানে। সেখানে অবধি গিয়ে একটু বাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওটা। আজ সেখানটায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বাড়ি।
তারপর? তারপর বর্গীও আর এল না, খাদ কাটাও হল না। তেমনিই পড়ে রইল ষাট বছর। মাঝখান থেকে কলকাতার লোকেদের সারা বিশ্বে নাম হয়ে গেল ‘ডিচার’। এবং অবশেষে এই মরা খাদের উপর দিয়ে তৈরি হল রাস্তা। বাগবাজারের মারাঠা ডিচ লেন আর আপার এবং লোয়ার সার্কুলার রোড।
চমকে উঠলেন মারাঠা ডিচ লেনের বৃদ্ধ অধিবাসী। ‘আমাদের এই লেনটার সঙ্গে বর্গী আক্রমণের যোগ আছে জানতাম, কিন্তু সার্কুলার রোডগুলো খাল ছিল তা তো জানি না।’
অনেকেই জানেন না। মারাঠা ডিচ লেনের মুদি বউ, কেরানি-গিন্নিও হয়তো জানেন না সারা দিনের খাটুনির পর গভীর রাতে দুরন্ত ছেলেটাকে যে বর্গীর ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে হয় সে বর্গী সত্যিই একদিন এসেছিল। ওই সামান্য দূরে গঙ্গার ওপারে। জানেন না হয়তো এই গলি তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা নিজেদের হাতে খুঁড়ে গিয়েছিলেন তাঁদের শিশু-সন্তানদের মন থেকে বর্গীর ভয় ভাঙানোর জন্যে।
সার্কুলার রোড তৈরি হয়েছে ১৭৯৯ সনে। অবশ্য এর বহু পরেও এই সেদিন অবধিও বেঁচে ছিল একটুখানি খাদ। পাল লেন আর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মাঝামাঝি। আজ সেটুকও বুজে গেছে।
আবার মাটি দিয়েই ভরাট করতে হল তা হলে?
—না, কিছুই করতে হল না। পুরুষানুক্রমে জঞ্জাল ফেলে অতি সহজেই কলকাতা বুজিয়ে দিয়েছে পূর্বপুরুষের স্মৃতিকে।
এত জঞ্জাল? তা হবে। ভদ্রলোক হাসলেন। কলকাতার জঞ্জাল তো, বঙ্গোপসাগরও যে ভরে যায় তাতে!
একটি পিতলের পাত
সকালে মস্ত মস্ত বাড়ির দরোয়ানেরা এখানে বসে দাঁত মাজে আর দেহাতি গান গায়। দশটা বাজতে না-বাজতেই এসে দাঁড়ায় সারি সারি গাড়ি। ফুটপাত দিয়ে চলেন সারি সারি পদাতিক। গা বাঁচিয়ে দেওয়ালটা ঘেঁষে পান সাজতে বসেন একটি মেয়ে। একদল লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছে তাবিজওয়ালার। ছাড়া-পাওয়া ড্রাইভারেরা পান চিবুচ্ছে রোদে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু ইস্টার্ন রেলওয়ের রেন-পাইপে বারো মাস বান। দরদর করে জল চলেছে ফুটপাত ভাসিয়ে।
আরও একটু সরে দাঁড়াতে হল ড্রাইভারদের। শতরঞ্চটি আরও একটু সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাবিজওয়ালা, বাক্সটাকে একটু কোলের দিকে টেনে নিলেন পানওয়ালি। হয়তো জুতো বাঁচাতে আপনিও একটু বেঁকে গেলেন বাঁ দিকে।
কিন্তু কোথায় গেলেন জানলেন কি? জানলেন কি ইস্টার্ন রেলওয়ের এই বিরাট বাড়িটার এই ছায়াপুষ্ট ফুটপাতটি ছেড়ে যাওয়া মানে ফোর্ট উইলিয়ম থেকে কয় কদম হটে যাওয়া।
হ্যাঁ, হটে যাওয়া ছাড়া কী? লক্ষ করলেই দেখতে পেতেন ওই পানওয়ালিটির সামনে ওই নোংরা জলাধারটির নীচে, ধূলিমলিন ফুটপাতের বুকে আজও জ্বলজ্বল করছে একফালি পিতলের পাত, জ্যামিতির খাতায় মোটা লাইনে আঁকা একটি কোণ।
প্রতিদিন বহু জনের পদধূলি পড়ে এর ওপর। কিন্তু চোখে পড়ে বোধ হয় অতি অল্পজনের। পড়লেই বা ক’জন ভাবতে পারেন একদিন এখানেই ছিল ইংরেজের আদি কেল্লা, কলকাতার প্রথম ফোর্ট উইলিয়ম। এইখানেই দাঁড়িয়ে একদিন লড়াই করেছিলেন আমাদের তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা, এবং এখানেই দাঁড়িয়ে একদিন আত্মসমর্পণের নিশান দেখিয়েছিলেন ড্রেক আর হলওয়েল?
কলকাতার ইতিহাসে সে এক কাহিনী।
১৬ জুন, ১৭৫৬ সাল।
হই-হই করতে করতে নবাব-সৈন্যরা এসে হাজির হল কলকাতায়। মারহাটা ডিচ-এর পাহারাওয়ালারা ভয়েই পথ ছেড়ে দিল তাদের। ‘পেরিনস পয়েন্ট’-এ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কোম্পানির নাবিকেরা, কিন্তু সেও বানের মুখে বালির বাঁধ।
পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে দেখতে দেখতে সিরাজউদ্দৌল্লা এসে দাঁড়ালেন ডালহৌসি স্কোয়ার-এ। সামনে তাঁর ইংরেজের উদ্বাস্তু কেল্লা ফোর্ট উইলিয়ম। দখল করা মানেই ইংরেজের কেল্লা চিরকালের মতো ফতে করে দেওয়া।
সিরাজউদ্দৌল্লা জানতেন এই কেল্লাখানাই ইংরেজের সর্বস্ব। ওদের ধন দৌলত, বাণিজ্য সওদা যা আছে তা এই কেল্লার ভিতরেই। এমনকী, এটাও তাঁর অজানা নয় যে কলকাতার যত ইংরেজ আছে তাদের সবাই আজ এখানে।
সুরতাং রাজবল্লভের ওপর হুকুম হল—চলো কিল্লা।
কেল্লার ভিতরে তখন জড়াজড়ি করে পড়ে আছে রাশি রাশি ভয়। গত কাল কোম্পানির হিসেবের খাতাপত্তর সব জাহাজে চড়েছে। আজ ১১ জুন। দশটার সময় পালিয়ে গেছেন ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট ড্রেক এবং বড় বড় সামরিক কর্তাব্যক্তিরা। এখন কেল্লায় আছে বলতে কয়েক হাজার অ্যাংগ্ল ইন্ডিয়ান, পর্তুগিজ, আরমেনিয়ান মেয়েপুরুষ, কাচ্চা-বাচ্চা, আর সাকুল্যে সব মিলিয়ে পাঁচ’শ পনেরো জন সৈনিক। এর মধ্যে আড়াইশো মাত্র পাকা লড়িয়ে। বাদবাকিরা সব অ্যামেচার।
উপায়ান্তরহীন হলওয়েল বললেন, তিন-তিনটে সিন্দুক ভরতি সোনাদানা গিনি-মোহর রয়েছে কেল্লায়। এগুলো তোমাদের সমানভাবে ভাগ করে দেব আমি। তোমরা লড়াই করো।
দুপুরের আগেই তিন-তিনবার কেল্লার গায়ে আছড়ে পড়ল নবাব সৈন্যরা। বিকেলে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠল কেল্লা থেকে। লকলক করে আগুনের শিখা উঠল অন্ধকার আকাশে। রাজবল্লভ আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিলেন ইংরেজদের। একশো ছেচল্লিশজন নরনারীকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন হলওয়েল।
যুদ্ধ থেমে গেল। উত্তরের প্রবেশপথ দিয়ে বিজয়গর্বে সিরাজউদ্দৌল্লা ঢুকলেন বিধ্বস্ত ফোর্ট উইলিয়মে।
ফোর্ট উইলিয়ম তখন একটা ধ্বংসস্তুপ মাত্র। ইংরেজের গর্ব যেন ইচ্ছে করে গুঁড়িয়ে পড়ে আছে বাংলার নবাবের পায়ে।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল ডালহৌসি স্কোয়ারে কিন্তু তার কোনও সংবাদই রাখে না আজকের ডালহৌসি। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার মতো কলকাতার লড়াই, ফোর্ট উইলিয়মের পতন স
নয় বলেই ফেয়ারলি প্লেস দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডালহৌসির পথিকদের কদাচিৎ আজ নজরে পড়ে ফুটপাতের গায়ে মিশে থাকা আড়াআড়ি এই পিতলের পাতটিকে। পায়ে পায়ে কত লোক মাড়িয়ে যাচ্ছে এটি, কিন্তু কই, কারও তো মনে পড়ে না একবার সিরাজউদ্দৌল্লার কথা, কিংবা ডালহৌসির সেই ঐতিহাসিক লড়াইয়ের কথা। এর ক’পা দূরে উত্তরের সেই প্রবেশপথটি নিয়েই তো একদিন বাংলার নবাব ঢুকেছিলেন ইংরেজের কেল্লায়।
তাকিয়ে দেখুন উলটো দিকের দেওয়ালটিতে একবার। ইস্টার্ন রেলওয়ের বাড়ির দেওয়াল। মার্বেল পাথরে পরিষ্কার হরফে লেখা আছে, ‘এইখানে এই পিতলের পাতটি বরাবর ছিল ফোর্ট উইলিয়মের উত্তর-পশ্চিম কোণ।’ কেল্লার উত্তরসীমার গায়েই ছিল কেল্লার বিরাট ঘাট। জোয়ারের দাগ পড়ত এর দেওয়ালের গায়ে। পায়ে পড়ে থাকত ভাটার জলরাশি। নদী তখন স্ক্র্যান্ড রোডের ওপারে নয়, এখানে। ফেয়ারলি প্লেসের মাঝামাঝি।
কেল্লার পূর্ব সীমা ছিল নেতাজি সুভাষ রোড, দক্ষিণ সীমা জেনারেল পোস্ট অফিস। জেনারেল পোস্ট অফিসের ভিতরে ঢুকলে আজও দেখতে পাবেন গুটিকয়েক খিলান। ফোর্ট উইলিয়মের অবশেষ। এখানেও যথারীতি লেখা আছে পাথরের গায়ে সেই পরিচয়লিপি। কলকাতার স্মৃতিশক্তি কম। কার্জন সাহেব তাই লিখিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সে ১৯০০ সালের কথা। আজ তিনিও ইতিহাস।
কিন্তু আজও আছে পিতলের এই স্মারকগুলো। এই ফেয়ারলি প্লেসের বুকে পর পর দু’ জায়গায় চোখ মেলে তাকালে আজও দেখতে পাবেন জ্বলজ্বল করছে ফোর্ট উইলিয়মের উত্তরসীমা। ক্ষয়ে-যাওয়া পাথরের নীচে থেকে এখনও উঁকি দিচ্ছে ইতিহাসের একটি আস্ত অধ্যায়। এইখানে ফেয়ারলি প্লেসের এই জায়গাটিতেই একদিন উদ্ধত হয়ে উঠেছিল একটি সাম্রাজ্য-সাধনা এবং এইখানে এই পিতলের রেখাটি থেকে সামান্য কিছু দূরেই প্রথমবারের মতো ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন। এদিকেই ছিল ফোর্টের উত্তরের গেট। এবং এই প্রবেশদ্বার দিয়েই বাংলার নবাব ঢুকেছিলেন একদিন ইংরেজের কেল্লায়।
ফেয়ারলি প্লেসের বেগম
আজ থেকে দেড়’শ বছর আগে এমনই কোনও গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় যদি কেউ সাহস করে এই ট্যাংক স্কোয়ার বা লাল দিঘিপাড়ায় একবার পা দিতেন এবং যার নাম আজ ফেয়ারলি প্লেস সেই খানদানি রাস্তাটির উত্তর দিকের ফুটপাতে একবার উঁকি দিতে পারতেন তা হলে এমন একটি দৃশ্য তিনি দেখতে পারতেন—যার কাছাকাছি কোনও নমুনা আজ একমাত্র চৌরঙ্গি পল্লির বিখ্যাত ক্লাব বা হোটেল বাড়িগুলোর সামনেই সম্ভব।
রাস্তার দু’ ধারে কলকাতার সেরা ঘোড়া, সেরা গাড়ির সারি। কখনও বা শুধু একটা ঘোড়া, কিংবা একখানা পালকি। তবে নগরের সেরা বলেই দর্শনীয় প্রত্যেকটিই। মায় কোচবাক্সে ছায়ার মতো যে মানুষগুলো বসে আছে তারা পর্যন্ত। যেন ছবির মানুষ। তা হলেও সত্যিকারের দর্শক যে, কিছুতেই তার চোখ বেশিক্ষণ পথে পড়ে থাকতে রাজি হবে না। মুহূর্তে আগন্তুকের নজর গিয়ে পড়বে উত্তরের ছোট বাগিচাটির পরে যে বিরাট বাড়িখানা, ভেলভেটে আড়াল করা তার জানালাগুলোর দিকে। পর্দার নিয়মে সম্পূর্ণ পর্দানশিন নয় বলেই সেখানে চোখে পড়বে ঝাড়লণ্ঠনের সারি। মোমের আলোয় মাঝে মাঝে ঝিলিক দেবে মন্থর টানা পাখার ঝালর, হয়তো বা একসময় সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার পথে কোনও খানসামার শিরোভূষণ।
তার পরও যদি আরও দু’ পা এগিয়ে যেতেন কেউ তা হলে তাঁর কানে আসত ঠুংঠাং কাচের আর খিলখিল হাসির আওয়াজ, নাকে ঠেকত গোলাপজল আর অম্বুরি তামাকের গন্ধ এবং হয়তো বা কোনও ইংরেজি বাদ্যের ছন্দও। সন্দেহ নেই, ফেয়ারলি প্লেসের সেই প্রাসাদটিতে ‘বড়া খানা’ চলেছে।
পরের দিন কিংবা তার পরের দিন আবার যদি কোনও পথচারী এখানটায় আসতেন, তা হলে নিশ্চয়ই মত বদলাতে হত তাঁকে। কেন না, সেদিনও একই দৃশ্য, একই সুগন্ধ, একই কাচ-হাসি-বাদ্যের জলতরঙ্গ। এমনকী ক্যালেন্ডারের উলটো দিক ধরে যদি এগিয়ে যেতেন তিনি তা হলে দেখা যেত একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এমনকী পঁচিশ বছর আগেও ফেয়ারলি প্লেসের এই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যার এক চরিত্র, এক বক্তব্য। সুতরাং মনে হতে পারে লাল দিঘির ঘরে ঘরে নিত্য যেখানে যুগান্তর সেখানে নন্দনকাননের মতো এই আনন্দ-নিকেতনটি হয়তো কোনও ক্লাব-ঘর।
কিন্তু তা নয়। সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা দখলের আগে পুরানো কেল্লার উত্তর-পশ্চিমে এই মস্ত বাড়িটায় যিনি থাকতেন, সবাই জানে, তিনি মস্ত লোক ছিলেন। নাম তাঁর ক্রুটেনডেন। পরিচয়—কলকাতার গভর্নর। উৎসাহীরা জানেন এখন যিনি সেখানে আছেন, তিনি কেল্লাধিপ জনৈক ক্রুটেনডেনের চেয়ে কোনও অংশে কম নন। বরং বলা চলে কলকাতায় তিনিই এখন যথার্থ কেল্লাদার, কেন না, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁরই দরবারে গোটা শহরের আনাগোনা, নজরানা। কে না জানে, ‘বেগম’ স্বয়ং গভর্নর জেনারেলদের পর্যন্ত নিজের বৈঠকখানায় ধরেন!
কথাটা একটু বিশদ করা দরকার। কলকাতা নায়িকা-বর্জিত পাষাণপুরী কোনও কালেই ছিল না। এখানে এক সময়ে মাদাম গ্রান্ডের মতো জীবন্ত চাঞ্চল্য বাস করে গেছেন যাঁর ‘প্রীতির’ মূল্য হিসেবে গভর্নর জেনারেলের দোসর স্বয়ং ফিলিপ ফ্রান্সিস আদালতে দাঁড়িয়ে সানন্দে নগদ পঞ্চাশ হাজার সিক্কা টাকা গুনে দিয়ে গিয়েছেন। কলকাতা এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা বিশ্বের তিন খণ্ডের নায়িকা লোলা মনটেজের শহর। এখনকার ‘প্যাগোডা বৃক্ষের’ ছায়ায় এ শহরের দরবারি আবহাওয়াতেই লোলার পরবর্তী বিচিত্র জীবনের মহলা। এখানকার পার্ক স্ট্রিটের ‘সাঁ-সুসি’ থিয়েটারেই আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী এস্থার লীচ, এবং এখানেই লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানায় পাথরের ক্রুশ বুকে নিয়ে পড়ে আছেন নবাগতা অভিনেত্রী-নর্তকী মারিয়া মেডেলিন টেলার ওরফে মাদাম দারমেনভিল। ৯৭ তালতলা নিবাসী এই সাতাশ বছরের সুন্দরীটি সত্যিই কলেরায় মারা গিয়েছিলেন কি না, মিথ্যে বলব না, সে বিষয়ে কলকাতা এখনও মনে মনে ঘোরতর সন্দেহ পোষণ করে।
ফেয়ারলি প্লেসের ‘বেগম’ তাঁদের কেউ ছিলেন না। দর্শক হিসেবে কখনও সখনও সামনের সারিতে আসন পরিগ্রহ করা ছাড়া স্থানীয় রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না তাঁর। আবার মিস্ স্যান্ডারসন, মিসেস হেস্টিংস বা মিস এমা র্যাংহামের মতো নিজেই সর্ব-মঞ্চ-সার রঙ্গিনী ছিলেন না তিনি।
মিসেস হেস্টিংসের কাহিনী আজ সকলের জানা। এই দ্বিতীয় পত্নীটিকে উপলক্ষ করে দুরন্ত দুর্দান্ত পুরুষ হেস্টিংস কবিতে পরিণত হয়েছিলেন। সাউথ পার্ক স্ট্রিটে মিসেস বারওয়ের অবশেষের ওপর স্থাপিত পিরামিডখানার দিকে তাকালে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না যে, মিস্ স্যান্ডারসন সত্যিই পূর্বদেশীয় কোনও সম্রাজ্ঞীবিশেষ ছিলেন এবং কোটিপতি ‘নবাব বারওয়েল’ ছাড়াও তাঁর স্নেহে ক্রীত অনেক দাস ছিলেন। শোনা যায়, কুমারী কালে গভর্নর হৌসের কোনও এক ‘বল’ উপলক্ষে তিনি একজনের কানে কানে তাঁর পছন্দের পুরুষোচিত পোশাকটি কী তার ইঙ্গিত করেছিলেন, এবং তার ফলে নির্দিষ্ট দিনে দেখা গিয়েছিল সাকুল্যে ষোল জন তরুণ সেই পোশাকে হাজির হয়ে তাঁকে কুর্নিশ করছেন। তাঁদেরই একজন, কলকাতার বিখ্যাত সামাজিক মানুষ অ্যাটর্নি হিকি লিখছেন, নাচ শেষে আমরা দু’ জন দু’ জন করে সারি সাজিয়ে ওঁর পালকির পাশে শোভাযাত্রা করে ওঁকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। ‘চিনপুরা-বেলি’, ‘হুঁকা টার্বান’ বা ‘টার্বান কনকুয়েস্ট’ নামে সাংবাদিক হিকির আর এক প্রাত্যহিক প্রতিপাদ্য মিস্ র্যাংহাম যেন তাঁকেও পিছনে ফেলে কলকাতাকে নিয়ে দু’ হাতে লোফালুফি করে গেছেন। ফ্রান্সিস তাঁর জনৈক বন্ধু লিভিসকে লিখছেন ‘যদি তুমি এমাকে বিয়ে করে থাকো, অথবা যদি ম্যাকেঞ্জি ওঁকে বিয়ে করে থেকে থাকে কিংবা কলিংস বা আর্কডেকিন…।’ এমার যে কোন দিকে মন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো ‘বিচক্ষণ’ ব্যক্তিও তা সঠিক জানেন না। ১৭৮১ সালে এমার জন্মদিনে নগরবাসীকে ভোজসভায় আপ্যায়িত করেছেন নেটিভ কুলচূড়ামণি রাজা নবকিষণ। কিপলিং তাঁকে দেখে প্রশংসা করেছেন, হিকি তাঁর দুরন্তপনার বিবরণ দিয়েছেন: এমা মেয়েদের মতো ঘোড়ায় চড়ে না, সে পুরুষের মতো ঘোড়ার পিঠে বসে…প্রথম শ্রেণীর ‘জকি’দের সে বাজিতে হারিয়ে দেয়, সে চমৎকার বন্দুক চালায়। ‘বেঙ্গল গেজেটে’র সাংবাদিক হিকি তাঁর কাগজের পাতায় আবহাওয়া বার্তার মতো প্রতি দিন নিয়মিতভাবে তাঁর মতিগতির খবর ছাপেন: ‘সিট ক্রসড-লেগড অন দাই বোর্ড অব ট্রেড…ড্রাইভ এমা…ফ্রম মাই হেড…।’ বোর্ড অব ট্রেডের সেই এমায় পাওয়া মানুষটির নাম দিয়েছেন হিকি ‘পিপদানি দরজি’। ‘দরজি’ মানে টেলার, সুতরাং কারও আর বুঝতে বাকি রইল না মানুষটি আসলে জন টেলার।
আমাদের ফেয়ারলি প্লেসের ‘বেগম’ও মাঝে মাঝে কাগজে উঁকি দিতেন বটে, কিন্তু তা ঠিক এই অর্থে নয়। কেন না, বেগমের খ্যাতির কারণ ছিল অন্য।
ফেয়ারলি প্লেস থেকে মিনিট কয়েকের পথ। লালদিঘি পিছনে ফেলে হেস্টিংস স্ট্রিটের মোড়ে সেন্ট জন চার্চের উঠোনে যদি কেউ একবার পা দেন, তা হলে অতি সহজেই তিনি বেগমের প্রথম পরিচয়টি পেতে পারেন। চার্নকের সমাধি থেকে পশ্চিমে কবরখানার উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রাচীন গ্রীক মন্দিরের অনুকরণে সুন্দর একটি সমাধি দেখবেন। তার গায়ে লেখা আছে:
‘Beneath are the deposited of the remains of Mrs. Frances Johnson, second daughter of Edward Crook then Governor of Fort St. David on the coast of Coromondal, and was born on the 10th of April, 1725. In 1738 intermarried with Parry Purple Tempire, nephew of Bradyll then Governor of Calcutta, her second husband was James Altham of Cal. Next inter-marriage with William Watts after inter-married Rv. William Johnson…!’ ইত্যাদি।
পড়তে গেলে মনে হয় মিসেস জনসন ওরফে ফেয়ারলি প্লেসের বিখ্যাত ‘বেগম’ বোধ হয় তাঁর চার চারজন স্বামীর গৌরবেই গরবিনী। কিন্তু তা নয়। কেন না, সেদিনের কলকাতায় কোনও ইংরেজ মহিলার স্বামী সংখ্যাকে কোনও আড্ডা বা আলোচনাসভাতেই একমাত্র এজেন্ডা করা চলত না, যেমন উৎসাহী খুঁজে পাওয়া যেত না কোন বাদশাহদের হারেমে ক’জনা আছেন তার হিসাবনিকাশে। দুই-ই তখন চলতি রেওয়াজ, স্বাভাবিক ঘটনা।
এই সেন্ট জন চার্চেরই বিয়ের রেজিষ্ট্রি বইখানা একবার খুললে প্রমাণ পাওয়া যাবে তার। ১৭৭২ সালের বাঁধানো খাতাটার প্রথম পাতায় আছে ন’টি নিয়তি-নির্বন্ধের খবর। তার মধ্যে দুটি পাত্রী পর্তুগিজ কিংবা এতদ্দেশীয়, বামুন-কায়েত বা শেখ-সৈয়দের কন্যা। বাকি সাতজনের পাঁচজন বিধবা। তাঁদের মধ্যে একজন জনৈকা মেরী গ্রান্ট-এর, সেটা এঁর পঞ্চম পরিণয়। ভদ্রমহিলা প্রথম বিয়ে করেছিলেন এক ফরাসি ভাগ্যান্বেষী সৈনিককে। দ্বিতীয়বার একজন নৌচালককে, তৃতীয় জনৈক মেজরকে, চতুর্থ এক ক্যাপ্টেনকে এবং পঞ্চম একজন প্রতিষ্ঠিত সিভিলিয়ানকে। সুতরাং ফেয়ারলি প্লেসের ‘বেগমে’র চেয়েও স্বীকার করতে হবে, পদোন্নতির ধাপগুলো তাঁর আরও নয়ন-মনোহর ছিল। তিনি অবশ্যই এক চারুচিত্তহারা নারী
পরের পাতায় বিয়ে আছে সাকুল্যে উনিশটি। তার মধ্যে বিধবা চারজন। একজনের সেটা তৃতীয় পক্ষ। তার পরের পাতাটিতে ঘণ্টাধ্বনির সংবাদ আছে পনেরোটি। তার মধ্যে মাত্র ছ’জন পাত্রী কুমারী। তার পরের পাতায় তেইশটি বিয়েতে কুমারী কনে মাত্র পাঁচজন। বিধবাদের একজন, মেরী শেফার্ডের দেহে ‘ব্রাইডাল-গাউন’ চাপল এই নিয়ে ছ’বার। সুতরাং, ‘বেগম’ কিছুতেই সে কারণে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। বিয়ে নয়, যতদূর মনে হয়, বিয়ের চেয়েও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠার মূলে। নয়তো একজন সম্ভ্রান্ত সামাজিক মহিলার কবরের গায়ে তাঁর শেষ পরিচয়টাই থাকত, বোধহয় জীবনের সম্পূর্ণ কাহিনীটি নয়।
ফলকটায় কিছু কিছু ভুল আছে। প্রথমত, কলকাতায় যিনি ‘বেগম জনসন’ নামে বছরের পর বছর দিঘিপাড়ায় রাজত্ব করে গিয়েছেন তাঁর পিতা কখনও করমণ্ডল উপকূলে সেন্ট ডেভিড দুর্গে গভর্নর ছিলেন না। স্বদেশ যাত্রার আগে এডওয়ার্ড ক্রুক-কে পদটা দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি তা গ্রহণ করেননি। অন্তত কোম্পানি এবং মাদ্রাজের কাগজপত্র তাই বলে। দ্বিতীয়ত, আমাদের এই ‘বেগমে’র সঙ্গে, কলকাতার গভর্নর টমাস ব্রাডিল-এর ভাগিনা অথবা ভ্রাতুস্পুত্র পার্পল টেম্পলারের বিয়ে হয়েছিল ১৭৪৪ সালে, কবরে লেখা ১৭৩৮ সালে নয়। বেগমের বয়স তখন উনিশ বছর। তৃতীয়ত, সেটি বোধহয় ইচ্ছে করেই লেখা হয়নি যে মিসেস জনসন নামে এই ইংরেজ ললনাটি যাকে বলে খাঁটি অ্যাংগ্লো-স্যাকসন, তা ছিলেন না। তাঁর মা এবং ঠাকুমা দু’ জনেই ছিলেন এতদ্দেশীয়। যা হোক টেম্পলার গভর্নরের নিকটাত্মীয়, সুতরাং সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। গায়ের রং কিঞ্চিৎ তামাটে হলেও ‘বেগম’ হলে-হতে-পারতেন গভর্নরের কন্যা, সুতরাং অভিজাত ছিলেন। এবং স্বভাবতই তিন বছরের দুটি সন্তান এবং স্বামীকে কবরস্থ করে বছরের শেষে রূপসী দুঃখী বিধবা যখন আবার চার্চে এসে উপস্থিত হলেন তখন সমাজের সাধ্য কী তাঁকে এড়িয়ে চলে? কিঞ্চিৎ ভয়, কথঞ্চিৎ কৌতূহল—দুইয়ে মিলে মাদ্রাজের কন্যা কলকাতায় রাতারাতি পরিচিত হয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় বর কলকাতার জনৈক সিভিলিয়ান জেমস এলথাম বিয়ের দ্বাদশ রাত্রিতে গুটি বসন্তে বিদায় নিলেন। অবিচলিত বেগম পরের বছর (১৭৪৯) নভেম্বরে বিয়ে করলেন বিখ্যাত উইলিয়াম ওয়াটস সাহেবকে। সিরাজউদ্দৌলার দরবারে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটস আজ ক্লাইভের মতোই সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি। বেগমের প্রসিদ্ধিরও অন্যতম কারণ বিশেষ করে এই তৃতীয় পরিণয়টিই।
সিরাজের ফৌজ যখন কাশিমবাজার দখল করে কলকাতার পথিক—ওয়াটস, মিসেস ওয়াটস এবং তাঁদের তিনটি পুত্র কন্যা এমেলিয়া, এডোয়ার্ড এবং সোফিয়া তখন মুর্শিদাবাদের কেল্লার অতিথি। এমেলিয়ার বয়স তখন মোটে ছ’ বছর, এডোয়ার্ডের চার বছর এবং সোফিয়ার এক বছর। ‘বেগম’ একত্রিশ বছরের রূপসী ওয়াটস-পত্নী। সিরাজ সপরিবার আটক করলেন ওঁদের। এবং তারই ফলে দু’ দিনের মধ্যেই আলোচনার উপলক্ষ হয়ে গেলেন ওয়াটসের সঙ্গে তাঁর বিবিও।
সে খ্যাতি আরও পল্লবিত হয়ে উঠল যখন সাঁইত্রিশ দিন পরে পুত্রকন্যা সহ হঠাৎ মিসেস ওয়াটস এসে হাজির হলেন চন্দননগরে, ফরাসিদের আশ্রয়ে। সিরাজ তখন কলকাতাকে ‘আলিনগরে’ রূপান্তরিত করতে মনোযোগী। পরে বেগমের মুখেই শোনা তাঁর সেই বিস্ময়কর পরিত্রাণ কাহিনী। সিরাজ তাঁকেও আটক করেছেন শুনে সিরাজের দিদিমার মনে বিশেষ করুণা সঞ্চারিত হয়। পরবর্তিকালে ইংরেজদের প্রতি তাঁর স্নেহের জন্যে নাম হয় তাঁর ‘কোম্পানির মা’। তিনি নবাবকে অনুরোধ করলেন বন্দিনী সাহেবজাদিটিকে অন্তত তাঁর জেনানায় রাখতে। হাজার হোক, একটি অসহায়া নারী তো!
সিরাজ আপত্তি করলেন না। মিসেস ওয়াটস ছেলেমেয়ে নিয়ে মুর্শিদাবাদে নবাবের অন্দরে আশ্রয় নিলেন। ক্রমে দু’ জনে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এবং অবশেষে তারই চরম স্বীকৃতি হিসেবে নবাবের অগোচরে প্রবীণা বেগম নবীনা ইংরেজ ললনাকে চিরকালের মতো ‘বেগম’ বিশেষণে ভূষিতা করে রাতের অন্ধকারে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। সঙ্গীদের হাতে গুঁজে দিলেন ফরাসিদের ঠিকানা। বলা নিষ্প্রয়োজন, মিসেস ওয়াটস সেই থেকেই কলকাতায় স্বনামধন্যা ‘বেগম’। কেন না, যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন সিরাজের হারেমের সেই সাঁইত্রিশটি দিন তিনি তাঁর কথাবার্তায়, চালচলনে, আচারে-আচরণে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ফেয়ারলি প্লেসে এমন কোনও সন্ধ্যা ছিল না কলকাতার ‘বেগমের’ মুখে যেদিন মুর্শিদাবাদের সেই বেগম সম্পর্কে কিছু না কিছু সংবাদ শোনা যেত। লোকেরা তাই বৈঠকের কেন্দ্রমণিটিরও নাম দিয়েছিলেন ‘বেগম’,—বেগম জনসন।
মিসেস ওয়াটস ‘বেগম’ হলেন কী করে সে কাহিনী এখানেই শেষ বটে, কিন্তু তিনি মিসেস জনসন হলেন কীভাবে সে কথাটাও শোনা আবশ্যক। কেন না, ফেয়ারলি প্লেসে যে বাড়িটা দশকের পর দশক কলকাতার অভিজাতদের আসল রাজধানীবিশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটি ছিল বেগম জনসনেরই মহল।
‘বঙ্গের বিপ্লব’ সমাধা করে সপরিবার ওয়াটস স্বদেশযাত্রা করলেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মিসেস ওয়াটসও সহযাত্রিণী সাজলেন। সে ১৭৬০ সালের কথা। সেখানেই কিছুদিন পরে বিগত হলেন কোম্পানির অন্যতম করিতকর্মা কূটনীতিক ওয়াটস।
ছেলেমেয়েরা দেশেই রয়ে গেল। স্বামীর ভূসম্পত্তির তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্যে মিসেস ওয়াটস ন’ বছর পরে (১৭৬৯) জাহাজে চাপলেন আবার। এবং তার ক’ বছর পরে ১৭৭৪ সালের ১ জুন এই সেন্ট জন চার্চের বিশপ রেভারেন্ড উইলিয়াম জনসনকে বিয়ে করে ঘর পাতলেন তিনি। বেঙ্গল গেজেটের মতে রেঃ জনসন বা ‘রেঃ টালি-হো’ যখন ষোল বছর কলকাতায় কাটিয়ে, কলকাতার জন্যে এই চার্চটির ব্যবস্থা করে এবং নিজের জন্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা পকেটে পুরে ১৭৮৮ সালে গির্জার কাজে ইস্তফা দিয়ে একা একাই জাহাজে চাপেন, মিসেস জনসন তখন খুব দুঃখিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে তাঁর অনুরাগীরা তো নয়ই। (‘…an event for which no friend of Mrs. Johnson can be sorry’).
তিনি সানন্দে বিগত চার স্বামীর সম্পত্তিকে ভিত্তি করে ফেয়ারলি প্লেসে তাঁর দরবার খুলে বসলেন। ‘বেগম জনসন’ পরবর্তী পঁচিশ বছর জুড়ে কলকাতার সম্রাজ্ঞী। তাঁর ঘরে গোটা শহরের মান্যদের মজলিশ। ঘোড়া, পালকি, জুড়ি, কাচ-হাসি-গড়গড়ায় ফেয়ারলি প্লেস তখন সন্ধ্যার পরে অলৌকিক। বেগমের অফুরন্ত আকর্ষণ, অঢেল পয়সা, অভাবিত অভিজ্ঞতা। তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে দেখেছেন, তাঁর অন্দরমহলে সাঁইত্রিশটি রজনী অতিবাহিত করেছেন, তিনি ক্লাইভের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং যে বর্গীদের ভয়ে কলকাতা একদিন থরথর করে তাঁর চোখের সামনে কেঁপেছে, সেই মারাঠাদের এখন কোম্পানি ইচ্ছেমতো ডাইনে বাঁয়ে চালাচ্ছে, তা-ও দেখছেন। এমন সন্ধ্যা কলকাতার আর ক’জন জমাতে পারেন।
সুতরাং, অনুরাগীদের মুখে প্রস্তাবটা শুনে অত নিয়মনিষ্ঠ অভিজাত গভর্নর জেনারেল যে লর্ড ওয়েলেসলি, তিনিও আপত্তি করতে পারলেন না। চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, সেন্ট জন চার্চের কবরখানার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়েলেসলি শুনলেন, বেগম সেখানেই শেষ শয্যা নিতে বাসনা প্রকাশ করেছেন। তাই হবে, গভর্নর জেনারেল কথা দিলেন।
সম্ভবত না দিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। কেন না, বেগম সে খবরটাও গোপন রাখেননি যে তাঁর বড় মেয়ে এমেলিয়ার বিয়ে হয়েছে রাইট অনারেবল চার্লস জেনকিনসের সঙ্গে। তিনি আর্ল অব লিভারপুল। তস্য পুত্র রবার্ট ব্যাংকস তথা লিভারপুলের দ্বিতীয় আর্ল, সম্পর্কে তাঁর নিজের নাতি। তদুপরি ছেলে এডোয়ার্ড হানস্লোপ পার্কে বিশিষ্ট ইংরেজ নাগরিক, এবং তৃতীয় সন্তান সোফিয়ার স্বামী বারবাদোসের গভর্নর।
১৭১২ সালে সত্যি সত্যিই ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন ফেয়ারলি প্লেসের বেগমের নিজের দৌহিত্র আর্ল অব লিভারপুল। সে খবরটা শোনার জন্যেই যেন অষ্টাশি বছরেও বেঁচে ছিলেন বৃদ্ধা বেগম। কেন না, খবরটা কলকাতা পৌঁছবার ক’দিন পরেই ১৭১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রিয় কলকাতার মাটিতে নিজের ঘরে, পরিপূর্ণ দরবারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন দেশে-বিদেশে সেকালের অন্যতম প্রবাদ—‘বেগম জনসন’।
কবরের গায়েই লেখা আছে সেদিন তাঁর শবযাত্রায় ছ’ ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে, দেহরক্ষী বাহিনী নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ওয়েলেসলির পরবর্তী গভর্নর লর্ড মিন্টো। অন্য যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হেনরি রাসেল, কাউন্সিল সদস্য অনারেবল চার্লস লামসডেন এবং রাজধানীর অন্য গণ্যমান্যগণ।
‘বেঙ্গল অবিচ্যুয়ারি’ দীর্ঘ পরিচয় দিয়ে সদ্য বিগত কলকাতার সম্রাজ্ঞী সম্পর্কে লিখছে—তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন, অত্যন্ত প্রফুল্ল এবং তৃপ্তিকর। অফুরন্ত কাহিনী ছিল তাঁর ভাণ্ডারে এবং তিনি জানতেন কেমন করে সে সব কথা অন্যদের শোনাতে হয়। তাঁর মুখে গল্প শুনতে কেউ কোনও দিন ক্লান্তি বোধ করেছেন বলে শোনা যায়নি।
উপসংহারে কলকাতা তাঁর বেগমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছে: ‘হার ডিউজ অব লাইফ ওয়্যার কারেক্ট অ্যান্ড দি বেনেভোলেন্স অব হার হার্ট…কনটিনিউড আনইম্পেয়ারড টু দি লেটার পিরিয়ড অব হার লাইফ।’
তার প্রমাণ এই সমাধি ফলকখানা। নয়তো চার-চারজন স্বামীর কাহিনী কি কোনও সম্ভ্রান্ত মহিলা এমন করে শ্বেতপাথরের গায়ে খোদাই করে রাখেন?
শোনা যায় ‘বেগম’ তাঁর উইলে জীবন সম্পর্কে তাঁর এই ‘যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি’র আরও চমৎকার একটি নমুনা রেখে গেছেন। তাতে জনসন যে তাঁর স্বামী ছিলেন সে কথাটা সগৌরবে তিনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাঁর বিপুল সম্পত্তির সব বিলিয়ে দিয়ে গেছে নাকি, যাঁরা তাঁর কেউ ছিলেন না, ফেয়ারলি প্লেসের সান্ধ্য দরবারে সমবেত সেই অমাত্যগণের নামে।
শহরের নৌকোডুবি
শহরের বুকে নৌকোডুবি। ট্রাম-বাস চলে না এ রাস্তা দিয়ে। সুতরাং ট্রাম-বাস অ্যাকসিডেন্ট নয়। স্বভাবতই রিকশা ঠেলারও নয়। সুতরাং নৌকোডুবিই হয়েছিল এখানে। আজব নগরীতে সে এক তাজ্জব ব্যাপার!
‘এমন আতঙ্কের দৃশ্য আর কোনও দিন দেখিনি আমি। এমনকী শুনিনি পর্যন্ত। যে বাড়িটায় আমি আছি, আমার বিশ্বাস, সেটা কলকাতার সব চেয়ে মজবুত বাড়ি। কিন্তু বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ এমন তীব্র হয়েছিল সেদিন যে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যেন ছাদটা ভেঙে পড়বে আমাদের মাথায়। এমন ভয়ানক শব্দ হচ্ছিল উপরে যে, পরিবারের লোকজনকে নিয়ে অবশেষে আমাকে নেমে আসতে হল নীচে। সেখানে আবার আশ্রয় নিয়েছেন বেচারা মিসেস ওয়াস্টেল তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে। ঝড়ের তোড়ে তাঁর বাড়ির জানালা-দরজা সব ছিটকে বেরিয়ে গেছে দেওয়ালের গা থেকে। সকাল অবধি আমাদেরও কাটাতে হল তাঁর সঙ্গে নীচে।
অবশেষে সকাল হল। শহরটার দিকে তাকালে মনে হয় শত্রুপক্ষ এসে যেন বেপরোয়া বোমা বর্ষণ করে গেছে এর উপর।…আমাদের সুন্দর ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাগুলোর দু’ ধারে একটিও গাছ নেই। সব ছিন্নভিন্ন। গতকাল যা ছিল, আগামী কুড়ি বছরেও তেমনটি হবে না আর। নদীটি রূপ নিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের। সারা নদী ধ্বংসস্তূপে বোঝাই।’
অনুমান করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই এ বিবরণ একালের কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর নয়। প্রায় আড়াই শ’ বছরেরও আগে এই কলকাতা থেকে লেখা একখানা চিঠি এটি। লিখেছিলেন সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য স্যার ফ্রান্সিস রাসেল। যে রাত্রির বর্ণনা দিয়েছেন স্যার ফ্রান্সিস তা কলকাতার ইতিহাসে ভীষণতম দুর্যোগের রাত্রি। ১৭৩৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রবল ঝড় বৃষ্টি এবং (মতান্তরে) তৎসহ ভূমিকম্পে কোম্পানির নয়াপত্তন সেদিন ফিরে এসেছিল আবার শৈশবের দশায়, চার্নকের কলকাতায়। সেন্ট অ্যানের গির্জা নেই। চিৎপুরে গোবিন্দ মিত্তিরের নবরত্ন গুঁড়িয়ে গেছে। কাঁচা কি পাকা বাড়ি সব মাঠ। বিলেতের ‘জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজিন’-এর রিপোর্টমতে কলকাতা এবং আশেপাশে মিলে নিহত মানুষের সংখ্যা ত্রিশ হাজার, পশু-পাখি (বাঘ-গণ্ডারসহ) অসংখ্য এবং ছোট বড় জাহাজ নৌকো ইত্যাদি কুড়ি হাজার। পাঁচ টনের দু’খানা ইংরেজি জাহাজ নাকি ছিটকে পড়েছিল নদীর বুক থেকে দু’শ ফ্যাদম দূরে এক গ্রামের ভিতরে। চল্লিশ ফুট বেড়ে গিয়েছিল সেদিন হুগলি নদীর জল।
সেদিন নিশ্চয়ই বন্যা হয়েছিল এই অঞ্চলে। চারিদিকে থই-থই জল। ধানখেত ডুবে গেছে। বিরাট বিরাট গাছগুলো সব বুকজলে দাঁড়িয়ে। আরও কুড়ি হাজার নৌকো-জাহাজের অন্তত দু’ চারখানা নিশ্চয়ই ডুবেছিল সেদিন এখানে। হ্যাঁ, এই আজকের ক্রিক রো অথবা তার কাছাকাছি কোনও জায়গায়। প্রাচীন কলকাতার ম্যাপ, অষ্টাদশ শতকের অধিকাংশ মানচিত্রেই জায়গাটার নাম দেওয়া আছে ‘ডিঙ্গা-ভাঙা’। মৌলালি আর তালতলার কাছাকাছি জায়গাটাকে তাই বলা হত তখন।
সত্যিই হয়তো সেদিন মধ্যরাত্রির অন্ধকারে এই প্রায়-নির্জন মাঠ আর বনভূমির মাঝে ঝড়ের ক্রুদ্ধ গর্জনে হারিয়ে গিয়েছিল একদল ভয়ার্ত মাঝি-মাল্লার চিৎকার। কেউ শোনেনি, কেউ সাড়া দেয়নি। কারণ, আজকের মতো ঘন জনবসতি ছিল না সেদিন এখানে। ভাঙা মাস্তুল আর ছেঁড়া পালের চিহ্ন রেখে ডুবে গিয়েছিল সেই ডিঙাটি এখানে—এই ক্রিক রো-তে। ক্রিক রো তখন জনপথ হয়নি, ক্রিক-ই। রাস্তা নয়, নদীই। ছোট নদী।
দূর, কী যে বলেন! শীতের দুপুরে প্রায় দু’শ ষাট বছর পরে ক্রিক রো-তে ক্রিকেট খেলছিল কয়টি ছেলে। তাদেরই একজন মন্তব্য করলে আমার কথা শুনে।
হ্যাঁ, ডিঙা-ভাঙা অবশ্য শুনেছি আমাদের ছেলে বয়সেও। এ নামে তখন একটা গলিও বোধহয় ছিল ওদিকে। তবে এত বৃত্তান্ত তো শুনিনি কো। ক্রিক রো-র এক প্রবীণ বাসিন্দা মোটামুটি বিস্মিত হয়েই বললেন।
আজকের ক্রিক রো এত বৃত্তান্ত জানে না। এমনকী, জানেন না ক্রিক রো-র অদ্ভুত গড়ন বাড়িগুলোর বর্তমান বাসিন্দারাও।
‘এত উঁচু কেন আপনাদের বাড়ির ভিত, সিঁড়ি?’
কী জানি বাবা, বাড়িওয়ালার মর্জি। সিঁড়ি বেয়ে বারোটার কলের জল নিয়ে উপরে উঠছিলেন এক ভদ্রমহিলা। উত্তর দিলেন তিনি। দু’শ বছর আগেও এমনই উঠতেন মেয়েরা সিঁড়ি বেয়ে, কলসী কাঁখে। তবে সে কলসীতে থাকত কলের নয়, নদীর জল।
কলকাতার সে এক আশ্চর্য ভূগোল। কোথায় তখন এই ক্রিক রো? চাঁদপাল ঘাট যেখানে, ঠিক তার উত্তর দিকটায় ছিল তখন একটা মাঝারিগোছের নদী। ছোটও নয়, বড়ও নয়, মাঝারি। ঠিক রিভারও নয়, স্ট্রিমও নয়। সাহেবরা তাই বলত ক্রিক—ভাগীরথী থেকে উঠে হেস্টিংস স্ট্রিটের মাঝ দিয়ে এসে এঁকেবেঁকে পড়েছিল সেটি ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। তারপর ক্রিক রো-র মাঝ দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল ধাপার মাঠে, তখনকার লবণ হ্রদে। চার্চ লেন আর কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের কাছে এপার ওপার করার জন্যে এর উপর সেতু ছিল দুটো। আজকের মতো ট্রাম-বাস লরি তখন ছিল না। এই নদীটিই ছিল তখন শহরে মালপত্তর আমদানি রফতানির পথ। অনেকদিন চালু ছিল এই জলপথটি। এমনকী সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণকালেও। তবে তখন আধা-আধি মজে গেছে। এই মজা নদীর বুক ভরে তৈরি হয়েছে রাস্তা। সেই স্মৃতির অবশিষ্ট এই ক্রিক রো আর ওয়েলিংটন স্কোয়ার।
দুপুরের ক্রিক রো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে ঠেকলাম সার্কুলার রোডে। আবার ক্লান্ত পায়ে এ রাস্তা দিয়েই উজান বেয়ে পৌঁছলাম এসে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। বসে পড়লাম একটা বেঞ্চিতে। আমার সামনে এলিয়ে পড়ে রয়েছে ক্রিক রো। প্রথম বাঁক অবধিই চোখে পড়ে এখানে বসে। মন-পবনের নাও তখন নিয়ে গেছে আমায় অনেক দূরে—সেই অতীতে। সেখানে কোথায় এই ওয়েলিংটন স্কোয়ার, এই ক্রিক রো!
পার্কের কোণে বসে বাদাম ভাজছিল একটি হিন্দুস্থানি মেয়ে। কে বলবে এ সেই জেলে-বউ নয়? মাছ ভাজছে নৌকোর গলুইয়ে বসে। মরদেরা লগি ঠেলছে। হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে এল শীতের অলস দুপুরকে কাঁপিয়ে একটা গানের গলি। রেডিওতে মধ্যাহ্নের প্রোগ্রাম। আহা, ভাটিয়ালি হত যদি একখানা! কলকল-ছলছল-ছলাৎ দাঁড় টেনে চলেছে সওদাগর বজরা। হাঁ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা দোতলার বারান্দায়। কী বলছে?
হ্যাঁগা, কোথা যাবে মাঝি?
কোনও নিস্তব্ধ দুপুরে কিংবা ঝড়ের রাতে ক্রিক রো-র দোতলা একতলা যেখানেই থাকুন, আপনি কান পাতবেন—শুনতে পাবেন তখন এমনই আরও কত প্রশ্ন!
ফাঁসির ফ্যান্সি
রাস্তাঘাটের নাম বদল কলকাতার ইতিহাসে বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। রানি মুদি লেন নাম নিয়েছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট, রসপাগল রোগ—রসা রোড, প্রিয় খানসামা লেন—টারবুলস লেন, ক্লাইভ স্ট্রিট—নেতাজি সুভাষ রোড। এমনই আরও কত!
বলা বাহুল্য, এই নাম-বদলে রাস্তার নাম-কৌলীন্য হয়তো কোথায়ও কোথায়ও বৃদ্ধি পায় কিছু, কিন্তু বেচারা রাস্তার ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ কিছুই হয় না তাতে। রাস্তা রাস্তাই থেকে যায়, নতুন নামটিও নাম মাত্র।
কিন্তু আমার আজকের পথটি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বেচারা আজ নিজেও ভুলে গেছে তার নামের অর্থ। অথচ একদিন শোনবার মতোই অর্থ ছিল তার।
আচ্ছা, যদি বলি ‘ফ্যান্সি’, অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাববেন চিনি, বেশ চিনি, কোথায় যেন দেখেছি। দেখেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি বলছি ‘ফ্যান্সি’ (Fancy) মানে কী জানেন? সবাই জানে। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রও জানে। সাহেব মেমের নাম যদি না হয় তবে ফ্যান্সি কথাটার মানে সবাই জানে। যদি বলি ফ্যান্সি লেন সবাই হয়তো বলবেন, ‘আহা, কী সুন্দর নাম! এ নাম লন্ডন, প্যারিতে মানায়, কলকাতার গলিপথের এ নাম শোভা পায় না, তাই না?’
কিন্তু যদি বলি ফ্যান্সি মানে ফাঁসি। অর্থাৎ গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া, তারপর ক্রমে শ্বাসরোধ এবং অবশেষে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি? তা হলে নিশ্চয়ই শিউরে উঠবেন আপনি। এবং নিশ্চয়ই তখন এই শ্রুতিমধুর নামটির প্রতি আর বিন্দুমাত্র ফ্যান্সি থাকবে না আপনার। হয়তো বা তাড়াতাড়ি অফিস ফেরার ট্রাম ধরতে গিয়ে কোনাকুনি পথের সন্ধানে আর কোনও দিন পা বাড়াবেন না এই গলিতে।
অবশ্য স্বেচ্ছায় কেউ বাড়াতেন না। কারণ এখানে পা বাড়ানো মানেই ছিল মৃত্যু। অথচ আমার, আপনার মতো অন্য পথও ছিল না বেচারাদের সামনে যে, এ পথ এড়িয়ে চলবে তারা। ফলে তাদের স্ত্রী পুত্র পরিজনের গলা-ফাটানো বিলাপ শেষ পর্যন্ত এসে থেমে যেত এখানে। জল্লাদের হাতের দড়িটি ধীরে ধীরে বাক্রোধ করে দিত তাদের চিরদিনের জন্য। হ্যাঁ, এখানেই। ডালহৌসির এই ফ্যান্সি লেনেই। ফ্যান্সি লেন তখন রাস্তা নয়, ফা-ন্-সি’র জায়গা, ফাঁসিমঞ্চ। কিংবা—ফাঁসির পর প্রাণহীন দেহ ঝুলিয়ে রাখবার ঠাঁই।
সে অন্য যুগ। অন্য জগৎ। ফাঁসি তখন ফ্যান্সি। সাহেব সুবার ফ্যান্সি তখন গরিব লোকের ফাঁসি।
অপরাধ? অপরাধ তখন কী, আর কী নয় বলা কঠিন কাজ। বিশেষ করে কলকাতার ব্যাপার জন্ম থেকেই আজব। ১৮০০ সালের কথা। ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে কোম্পানির লোক। কী, না ব্রজমোহনের ফাঁসি হবে। ‘ব্রজমোহনের ফান্সি হবে’। অপরাধ শ্রীব্রজমোহন একটা ঘড়ি চুরি করেছেন। মূল্যবান ঘড়ি। দাম ২৫ টাকা। সেই অপরাধে ফাঁসি হবে। হরি পাল, প্রসাদ পাল, রাজময় এবং চৈতনেরও ফাঁসি হবে। তাদের অপরাধ রাহাজানি। আর নন্দকুমারের ফাঁসি তো সর্বজনবিদিত।
কোম্পানির তখন নয়া রাজত্ব। স্বভাবতই কড়া মেজাজ। কথায় কথায় ফাঁসি আর তুড়ুম ঠোকা, নয় তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া।
ফাঁসি হবে। ব্ল্যাক টাউনের বাসিন্দারা ভয়ে তটস্থ। কোথায় হবে ফাঁসি? যা নিয়ম। অর্থাৎ প্রকাশ্য স্থানে কোনও চৌমাথায়। বহু লোকের সামনে। চারিদিক থেকে পিল পিল করে তোক আসছে। ফাঁসি দেখবে। আজকের ফ্যান্সি লেনে এবং পরের রাস্তা ওয়েলেসলি প্লেসে অনেক বড় বড় গাছ ছিল তখন। জনতা এসে জমায়েত হত তার তলায়। ফাঁসি হত সেখানেই। সেইসব গাছের তলায়। লোকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখত এবং কেউ কেঁদে, কেউ সাহেবদের ন্যায়পরায়ণতা দেখে ধন্যি ধন্যি করে ফিরে যেত যে যার ঘরে। কিন্তু নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সোজা ঘরে ফেরেনি কেউ। ব্রহ্মহত্যার পাপ দেখে তো এমনি ফেরা যায় না। গঙ্গা স্নান করে ফিরেছিল কলকাতার বাসিন্দারা কুলিবাজার থেকে। ফ্যান্সি লেনে ফাঁসি হয়নি তাঁর, হয়েছিল ওখানে।
যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন কী কানুনে হত এসব? উত্তরে বলতে হয় আজব কানুনে। ইদানীংকাল অবধি যত রকমের আদালতি ব্যাপার শুনেছেন আপনি, সেই প্রাচীন এবং অর্বাচীন—সব রকমের বিচারই চলত তখন কলকাতা শহরে। তবে কলকাতার মতো করে কোম্পানির কায়দায়। শুনলে তাজ্জব মনে হবে বটে কিন্তু তখনকার কলকাতা শহরে বিচারের কোনও ত্রুটি ছিল না। পিপলস কোর্ট, মেয়রস কোর্ট, সদর দেওয়ানি আদালত, নিজামত আদালত, সুপ্রিম কোর্ট—এসব তো ছিলই, তা ছাড়া আগে পিছে ছিল আরও রকমারি বিচারশালা। কোর্ট অফ রিকোয়েস্ট বলে ছিল এক আদালত যার নাম দিয়েছি আমি পিপলস কোর্ট। তবে ‘পিপলস’-এর মানে এই বিংশ শতকের ভাষায় ভাববেন না। জনসাধারণ নয় তারা। জনসাধারণই যদি বিচারক হবে তবে কোম্পানির রাজত্ব হয় কী করে! পিপলস মানে সরকার নয়, সরকারের মনোনীত চব্বিশজন ব্যক্তি। স্বভাবতই বিত্তবান ব্যক্তি। এঁরা কোর্ট বসাতেন প্রকাশ্য স্থানে। আজকে যেখানে লালবাজার সেখানে ছিল তাঁদের ধর্মাধিকরণ।
চব্বিশ ব্যক্তি ছাড়া এক ব্যক্তির বিচারও চলত তখন। কান্ত মুদি ছিলেন এমনই একজন খ্যাতনামা বিচারক। বিবেচনাশীল ব্যক্তি হিসাবে সাহেবমহলেও খ্যাতি ছিল তাঁর। সুতরাং দেশীয় লোকদের মধ্যে জাতিগত কিংবা বিবাহঘটিত বিবাদ নিষ্পত্তির ভার তাঁর উপর অর্পিত হল। সে দায়িত্ব এক সময় পালন করেন মহারাজা নবকৃষ্ণ। জাতের নামে বজ্জাতির সেই বিচারালয়কে বলা হত জাতিমালা কাছারি।
এসব ছিল নিম্ন আদালত। সাহেবদের প্রথম নিজস্ব আদালত হচ্ছে মেয়রস কোর্ট। তার বিচারকদের মধ্যে থাকতেন স্বয়ং মেয়র, সাতজন খাঁটি ইংরেজ এবং বত্রিশজন দেশীয় খ্রিস্টান। তাঁদের আবার প্রটেস্ট্যান্ট হওয়া চাই। তার নীচে ছিল জমিদারের বিচার। জমিদার মানে ইংরেজ সিভিলিয়ান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তো অনেক পরের ঘটনা। তাঁকে বিচারকার্যে সাহায্য করতেন ব্ল্যাক-জমিদার। অর্থাৎ দেশি বড়লোকেরা। এসবের উপরে ছিল কোর্ট অব আপিল বা গভর্নরের বিচার, তারও উপরে কোর্ট অব কোয়ার্টার সেসন।
কোম্পানির দেওয়ানি লাভের আগে পর্যন্ত এই ছিল কলকাতার বিচারধারা। তারপর সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হল ১৭৭৪ সনে। কিন্তু সেটিও যে কেমন মহাধর্মাধিকরণ ছিল, নন্দকুমারের ফাঁসিই তার প্রমাণ।
যা হোক, নন্দকুমার তবুও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিলেন। তিনি রাজা লোক। কিন্তু সাধারণ লোকের সে ক্ষমতা কোথায়? তারা ব্ল্যাক জমিদারের নতুন শেখা ল অ্যান্ড অর্ডারেই ঘায়েল হয়ে বসে পড়ত। আর উঠত একেবারে ফাঁসির গাছে। আপিল আদালত, লাটের আদালত ভাবতেও পারত না তারা। আজকের মতো উকিল মোক্তার ছিল না। সুতরাং একবার হুকুম হয়ে গেলেই হল। ওকালতি আরম্ভ হয় বলতে গেলে প্রায় উনিশ শতকে। কিন্তু তখনও কলকাতার আদালতে মকদ্দমা করার মতো ভাগ্যবান ছিলেন অতি অল্প কজন। মাত্র পনেরোজন অ্যাটর্নি আর ছ’জন ব্যারিস্টার ছিলেন তখন। তাঁদের সবাই সাহেব। সুতরাং গরিবের নজরানা জোগানো কত কঠিন তখন। যদি জিজ্ঞেস করে কেউ ‘সাহেব এটা কী হবে?’ অমনি ফেলতে হত এক মোহর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন তো ফেলো আরও এক মোহর। তৃতীয় তো আরও এক। যত প্রশ্ন তত মোহর।
সুতরাং সুতানটি গোবিন্দপুর কলকাতার আসামিরা কোনও প্রশ্ন করত না। এসব প্রশ্নের খরচ জোগানোর চেয়ে তাদের পক্ষে ঢের সহজ ফাঁসি যাওয়া। অতএব মুখ বুজে বোবা হয়ে ঝুলে পড়ত তারা। কতজন ঝুলেছে আমরা জানি না। নন্দকুমার অনেক পরবর্তী কালের, তা ছাড়া তিনি রাজকুমার সুতরাং তার খবরটা পেয়েছি আমরা। কিন্তু পাইনি অগণিত জেলেকুমার, তাঁতিকুমার, চাষিসন্তানের খবর।
আজকের ফ্যান্সি লেনে তা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ডালহৌসি অঞ্চলে পরিচ্ছন্ন একটি গলি। রাজভবনের অতি কাছাকাছি। কিন্তু নির্জন। এ অঞ্চলে এমন জনহীন পথ কম। কর্মবহুল ওয়েলেসলি প্লেসের সঙ্গে কেমন যেন বেমানান। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের সঙ্গে তো তুলনাই হয় না। না হওয়াই স্বাভাবিক। অফিস-বাড়ির সব পিছন পড়েছে এর দিকে, সুতরাং নির্জন হবে বইকি।
কিন্তু এ নির্জনতা যেন একটু ভিন্ন ধরনের। ফ্যান্সি লেনে আর সেসব গাছ নেই আজ। দু’একটা যা আছে তা নিতান্ত অর্বাচীন। তবে হ্যাঁ, একটি গাছ আজও আছে। গভর্নর হাউসের রাস্তার দিকে ঢুকতে পতিত জায়গাটার পরের বাড়িটায়। কী একটা গাছ যেন, জোর করে ভাঙা পুরানো বাড়িটার মাথায় চড়ে বসেছে। একটা চড়ুইয়ের ভারে নুয়ে পড়ে এর ডাল, সুতানটির জোয়ান মরদদের ভার সইবে কী করে? কিন্তু এর পূর্বপুরুষ হয়তো ছিল মহীরুহ। সে বৃক্ষ হয়তো একসঙ্গে একাধিক দেহ ধারণে সমর্থ ছিল।
তাদের লোপ করতে গিয়ে হয়তো থেকে গেছে এই শিকড়, বংশধর।
দিনে আর না-যান না-যাবেন ফ্যান্সি লেনে। কিন্তু রাতে বাড়ি ফেরার পথে একবার উঁকি দিয়ে যাবেন অন্তত এখানে। দেখবেন কিছু নেই। শুধু মিটিমিটি করে জ্বলছে একটি ঝাপসা আলো। একটা গ্যাস ল্যাম্প নয়। তবু গ্যাসের বাতির মতো ঝাপসা,—রহস্যময়।
কোন দিকে তাকিয়ে আছে মনে হয়? হাইকোর্টের চূড়া দেখা যায় ওদিকে। আপিল করতে চায় গোবিন্দপুর সুতানটির ব্রজমোহন, হরি পালেরা? নাকি তাকিয়ে আছে এদিকে গভর্নর হাউসের গেটের দিকে কালো কোট করা প্রহরীটির মাথার উপরে যেখানে জ্বলজ্বল করছে সোনালি রঙের এক লাইন—‘সত্যমেব জয়তে’!
ইন্দের স্মরণে
ইন্দেকে দেখেছেন কেউ? রোগা-পটকা চেহারা, কাঁদো-কাঁদো মুখ। বারো বছরের ছেলে। গেল বৃহস্পতিবার না বলে-কয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এইটুকুন একরত্তি ছেলে, কোথায় কোন বেঘেরো পড়েছে কে জানে! তবু দোহাই আপনার, ওকে দেখতে পেলেও কাউকে বলবেন না। না, কাউকে না। ওর জন্য কোনও মা অনাহারে থেকে শয্যা নেয়নি, কোনও দাদা ওর ফিরে আসার খরচ ধার করে বসে নেই। কেউ ওর জন্যে কাঁদছে না। ওর কেউ নেই। শুধু বারো বছরের এক হাড্ডিসার শরীর, আর একটি কিশোর মন।
তবে হ্যাঁ, আছে একজন। তিনি ইন্দের প্রভু, মালিক। তিনি চিনেবাজারের রবার্ট ডানকান। ইন্দে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। বারো বছরের ছেলে, তবু সাহস দেখেছেন। সাবাস! সাবাস ছেলে! বারো বছরের দু’টি কিশোর চোখ মেলে চিনেবাজারের কোনও বাংলোর জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ইন্দে হয়তো স্বপ্ন দেখত, মুক্তির স্বপ্ন, খোলা আকাশের স্বপ্ন। সাহেবের জিঞ্জির তাই আর বেঁধে রাখতে পারল না। ইন্দে স্বাধীন হয়ে গেল। আমাদেরও বহু বহু আগে, এই আজব নগরীর কোনও দাস-দুর্গ ভেঙে বারো বছরের ইন্দে স্বাধীন হয়ে গেল।
আজব নগরীর সবই আজব। জীবন, মানুষ, জনতা, সব। খবরের কাগজে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ বার্তা তখনও বের হত। তাতে একদিন বের হল ক্রুদ্ধ ডানকান সাহেবের দু’ ছত্র বিজ্ঞাপন: ‘গত বৃহস্পতিবার চিনাবাজারের মি. রবার্ট ডানকানের বাড়ি হইতে ইন্দে নামক বারো বৎসর বয়স্ক একটি ক্রীতদাস নিরুদ্দিষ্ট হইয়াছে। কেহ তাহার সন্ধান দিতে পারিলে ১টি স্বর্ণ-মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে।’ ১৭৮০ সালে কলকাতার ইংরেজি কাগজে বেরুল এই বিজ্ঞাপন। প্রতিদিন বের হত এমনই মানুষ কেনাবেচার বিজ্ঞাপন। কিন্তু পলায়ন কদাচিৎ। কে জানে, আমাদের ইন্দেই হয়তো এ ব্যাপারে প্রথম। ইন্দে কলকাতার দাস-সমাজের প্রথম মুক্তপুরুষ। জানি না, স্বর্ণলোভ সংবরণ করার মতো মানুষ ছিল কি না সেদিনকার কলকাতায়। আহা, যদি একজন লোকও বুঝতে পারত ওর কিশোর চোখের স্বপ্নকে। ইন্দের উত্তরপুরুষ আজ হয়তো এই মহানগরীর কোনও কেরানি, ব্যবসায়ী বা শিক্ষক কিংবা হয়তো বাংলার কোনও অঞ্চলে আজ তারা কৃষক, গৃহস্থ। চিরকালের মতো তার বংশধরদের দাস-কলঙ্ক মোচন করে দিয়ে গেছে ইন্দে। আর যদি এক মোহরের বদলে কেউ তাকে ধরে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে ডানকান সাহেবের কুঠিতে? যদি তুলে দিয়ে থাকে অপেক্ষমান রক্তচক্ষু সাহেবের হাতে? তবে? তবে কী হয়েছে ওর ভাগ্যে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। একে নগদ কড়ি দিয়ে কেনা গোলাম, তার ওপর পলায়নের মতো অপরাধ। প্রোটেস্ট্যান্ট ক্যাথলিক যা-ই হোন, চিনাবাজারের ডানকান কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবেন না তাকে। আহা, ইন্দে যেন সত্যিই ধরা না পড়ে থাকে।
আর যেন ধরা না পড়ে থাকে সেই যুবকটিও—মেমসাহেবের খিদমত করার চেয়ে পালিয়ে গিয়ে লাঙল ঠেলাও যার কাছে ছিল অধিকতর সম্মানজনক, পরম গৌরবের জীবন। ডানকানের মতো তার মালিকও বিজ্ঞাপন দিয়েছেন কাগজে। অষ্টাদশ শতকের কলকাতার ইংরেজি সাপ্তাহিকে “হারাইয়াছে। মেমসাহেবের সেবাযত্নে নিযুক্ত ২০/২১ বা তার কাছাকাছি বয়সের একটি ক্রীতদাস নিখোঁজ হইয়াছে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, ছিপছিপে লম্বা গড়ন, চোয়াল চওড়া, মুখে বসন্তের দাগ। সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হইতেছে, এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর কেহ তাহাকে কেরানি কিংবা অন্য কোনও পদে বহাল করিবেন না। আর যদি কোনও ভদ্রলোক তাহার সন্ধান পান এবং ক্লেশ স্বীকার করিয়া এই বিজ্ঞাপনদাতার নিকট তাহা জ্ঞাপন করেন, তবে তাঁহাকে যথোপযুক্তরূপে পুরস্কৃত করা হইবে।” দেখছেন বোধহয়, ছেলেটির কেরানি হওয়ার পর্যন্ত সম্ভাবনা ছিল। হয়তো লেখাপড়া জানত, হয়তো শুধুমাত্র গৌরবর্ণের কারণেই সে সম্ভাবনা ছিল তার। কে জানে, কেরানি হওয়ার সাধই ওকে টেনে এনেছিল কি না এমন দুঃসাহসিক পথে। হয়তো আত্মগোপন করে এ সাধ মিটিয়েছিল বেচারা! হয়তো এমনও হতে পারে, ‘কোনও ভদ্রসন্তানের ক্লেশ স্বীকারের ফলে’ চিরকালের মতো মিটে গিয়েছিল তার সব সাধ, সব স্বপ্ন। সমসাময়িক কালের বিবরণ শুনলে তা-ও যে খুবই সম্ভব, এ কথা আপনিও মানবেন। সামান্য অপরাধের জন্যে দাসদের তখন, তখনকার কলকাতায়, যেসব শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল শুনলে বুঝতে পারবেন, কেন ইন্দের জন্যে, এই যুবকটির জন্যে আমার এত আশঙ্কা। একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন: সোমত্ত মেয়েদের পর্যন্ত দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে ঝুলিয়ে অন্য দাসদের সামনে পোড়া লোহা দিয়ে গায়ে দাগ কেটে দেওয়া হত। আর মালিক যদি একটু সদাশয় কিংবা ধর্মভীরু হন তবে ডিসেম্বরের ভোরে কুয়ো থেকে বিরতি না দিয়ে বালতি বালতি জল ঢালা হত তার গায়ে। ১৮২৭ সালে মারিয়া ডেভিস নামে এক ইংরেজ মহিলা তার ‘নাসিবুন’ নামে এক বাঁদিকে এমনই অমানুষিক অত্যাচার করে প্রভু সোসাইটিতে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
বলতে পারেন, কলকাতার লোকের মনে কি বিন্দুমাত্র ধর্মবোধ ছিল না, ছিল না কি একটুখানি হৃদয়বত্তা? আজ বিংশ শতকের কলকাতায় বসে এসব কথা বলা বা উত্তর দেওয়া দুই-ই অবান্তর। সারা সুবা বাংলায়, শুধু বাংলায় কেন, সারা ভারতে দাসপ্রথা তখন রীতিমতো চালু প্রথা। আলু-পটলের মতো মানুষ কেনা-বেচা তখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। হিন্দুরা তা করেছেন, মুসলমানেরা করেছেন। ইংরেজরা ‘ট্রাডিশন’ রক্ষার নামে শুধু মাত্র চালু রেখেছেন প্রথাটি। কার্যসিদ্ধির জন্য এটা তাঁরা ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের সর্বত্র করেছেন। তবে এ দেশে এ ব্যাপারে ইউরোপিয়ানদের মধ্যে পথিকৃৎ হচ্ছে পর্তুগিজরা। ওদিকে আরাকান, চট্টগ্রাম, ঢাকা এদিকে সন্দ্বীপ, হুগলি, বজবজ—সর্বত্র পর্তুগিজ হারমাদ আর বোম্বেটেরা বছরের পর বছর মায়ের কোল, গৃহস্থের সংসার শ্মশান করে বেড়িয়েছে। ১৭৬০ সালে বজবজের কাছাকাছি আক্রাতে তাদের রীতিমত একটা ‘দাস-গুদাম’ গড়ে ওঠে। পাছে তারা কলকাতা বন্দর আক্রমণ করে বসে কোনও দিন এ ভয়ে আজকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে নদীর ওপর এক শিকড় বেড় দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রতিরোধ করার জন্য। মগেরাও ছিল তাদেরই মতো। এরা একবার দক্ষিণ বাংলা থেকে ১৮০০ ছেলে, মেয়ে, পুরুষ ধরে নিয়ে চলে যায় আরাকানে। দেখে আরাকান-রাজ মহা খুশি। তিনি বেছে বেছে শিল্পী কারিগর এমন কিছু লোক কিনে রেখে বাদ-বাকিদের ফিরিয়ে দিলেন মালিকদের কাছে। বাংলার সন্তানেরা বিক্রি হল সেখানে প্রকাশ্য বাজারে। দাম ২০ টাকা থেকে ৭০ টাকা। কেউ কিনে নিয়ে লাগাল গৃহস্থালির কাজে, কেউ খেতের কাজে। ১৫ সের চাল তাদের মজুরি, খাওয়া, পরা, হাতখরচা—সব।
ফরাসিরাও তাই। ১৭৯১ সালে এই চন্দননগরে বসে ক’জন ফরাসি ভদ্রলোক প্ল্যান করলেন ভাল করে এই ব্যবসায়ে নামবার জন্যে। তাঁদের সংকল্প—বাংলা থেকে মেয়ে পুরুষ ধরবেন, আর সোজা চালান দেবেন পণ্ডিচেরিতে। একবার এই ব্যাপারে খিদিরপুরের কাছে জাহাজডুবি হয়ে মারা গেল ত্রিশজন দাস। পরবর্তিকালে এই লোকসান নিশ্চয়ই পুষিয়ে নিয়েছিলেন ফরাসি দাস ব্যবসায়ীরা। ক্লোরিকস নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক এক বিবরণ রেখে গেছেন তাঁর দাস-শিকারের। বেচারার মন্দভাগ্য। বহু সাধ্যসাধনা করে তিনি ধরতে পেরেছিলেন মাত্র একজন স্ত্রীলোক আর দুটি শিশুকে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। আশা প্রকাশ করেছেন: ভবিষ্যতে যদি কোনও দিন একটা বড় জাহাজ আর কিছু বেশি লোকজন জোগাড় করতে পারেন তবে এই সংখ্যা তিনি ছাড়িয়ে উঠতে পারবেনই।
কলকাতার ইন্দের প্রসঙ্গে এসব কাহিনী আনতে হল নয়তো আধুনিক শিশু-নগরীর বুকে এই পুরনো ব্যবসার প্রচলন কাহিনীকে বোঝা যাবে না। ইংরেজরা এল। ফরাসিরা তখনও ব্যবসা গুটোয়নি। পর্তুগিজদের কাজকর্মও চালু। তারা দেখল, বাঃ, এ তো বেশ মজার ব্যবসা। হাঙ্গামা-হুজ্জত নেই, মূলধন চাই না, বুদ্ধিবৃত্তিরও বিশেষ দরকার নেই। বেওয়ারিশ দেশ। কোনও মতে ধরে চালান দেওয়া, অথবা অসুবিধে থাকে তো কাছাকাছি বাজারে এনে হাজির করা। নয়া নয়া সিভিলিয়ানরা আসছে। মুঠো মুঠো টাকা, দেশি ব্যবসায়ীদের মেঝের নীচে ঘড়া ঘড়া টাকা। ক্রেতার অভাব কী? মশলাপাতি, লবণ, কাপড়-চোপড় ছেড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরু করে দিল দাস-ব্যবসা। পাপপুণ্য মান-অপমানের কথাই ওঠে না। এ দেশের হিন্দু-মুসলমান নীতিশাস্ত্রে এ ব্যবসা সিদ্ধ। আর কুলীন ফরাসিরা যেখানে নেমেছে, সেখানে ইংরেজের মান অপমান আবার কী? কর্নওয়ালিশ সাহেব কোর্ট অব ডিরেকটারদের কাছে তাঁর লিপিতে অক্লেশে লিখে গেলেন: ‘দাসত্বপ্রথা তুলে দেওয়া সহজ নয়। একে দাসেরা সংখ্যায় অধিক তদুপরি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের আইনমতো এ ব্যবসার অধিকার স্বীকৃত…সুতরাং অধীনের নিবেদন এই—’ ইত্যাদি। তিনি এক ফরাসিকে ধরে ৫০০ টাকা জরিমানা করে দিলেন। হেস্টিংস সাহেব আরও করিৎকর্মা। তাঁর ব্যবসা-বুদ্ধি আরও পরিপক্ক। তিনি আইন করলেন ডাকাতদের বিচার হবে স্বগ্রামে। আর শাস্তি হবে এই, তার পুত্র-পৌত্রাদি বংশানুক্রমে দাস হয়ে থাকবে রাষ্ট্রের, অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। কোম্পানির আদেশমতো দেশের ‘জনসাধারণ’-এর সুখ-সুবিধের কথা বিবেচনা করে কাজে লাগানো হবে তাদের। তা ছাড়া তিনি আরও একটা ব্যবস্থা করলেন। তিনি আইন করে দিলেন, অপরাধীদের কয়েদ-বদ্ধ করে বসিয়ে বসিয়ে না খাইয়ে তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হবে। তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হবে দূর-দূরান্তে কোম্পানির অন্যান্য অধিকৃত অঞ্চলে। খরচপত্তরের সুবিধে হবে, তার ওপর লাভও হবে কোম্পানির। হেস্টিংস আরও লাভের সন্ধান দিলেন কোম্পানিকে। তিনি ঘোষণা করলেন, দাসদের রেজিষ্ট্রি করে নিতে হবে কোর্ট হাউসে, ৪ টাকা ৪ আনা লাগবে জনপ্রতি। জমি, বাড়ি, মোটর, রেডিওর মতো দাসদেরও রেজিস্ট্রেশন হবে। তারাও তো সম্পত্তি, কেনা মাল। সাধু! সাধু! বললেন বোর্ড অব ডিরেকটার তাঁর বৈষয়িক বুদ্ধি দেখে।
ফলে বিধিসম্মত উপায়েই কলকাতার ঘরে ঘরে উঠে এল দাসেরা। তারা সাহেবদের সেলাম করে, খিদমত করে, মিসি-বাবাদের ফরমাশ খাটে। অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় শুরু হল নয়া বিলাস, যার যত দাস তার তত খাতির, তার তত নাম-ডাক। স্যার উইলিয়ম জোন্স তখনকার কলকাতার এই দাসদের সম্পর্কে লিখেছেন: ‘এই নগরের অনেকের ঘরেই ক্রীতদাস আছে, যাদের অতি অল্প মূল্যে কেনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন: ‘সম্ভবত আপনাদের অনেকেই দেখেছেন কলকাতার খোলা বাজারে বিক্রির জন্যে এমনই ছেলে-মেয়েতে ভরতি কত বিরাট বিরাট নৌকো ভেড়ে নদীতে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এদের অধিকাংশকেই তাদের মা-বাবার কাছ থেকে অপহরণ করে অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে এক মুঠো চালের পরিবর্তে সংগ্রহ করা হয়েছে।’
আমাদের ইন্দেও হয়তো একদিন এমনই একমুঠো চালের বদলে অথবা কারও বিয়ের যৌতুক-স্বরূপ বা পিতা-মাতার ঋণের পরিবর্তে কিংবা অপরাধের জরিমানা হিসেবে মায়ের কোল ছেড়ে উঠে এসেছিল কোনও ব্যবসায়ীর নৌকোয়। তারপর একদিন সেই নৌকোখানা ঠেকেছিল এই আজব নগরীর ঘাটে। আর সেদিনই হয়তো চিনেবাজারের মি. রবার্ট ডানকান পালকি চড়ে হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন স্ট্রান্ডে, সেই ঘাটের ধারে। তারপর আজকালকার শৌখিন বাবুদের মতো দেখে-শুনে তাজা ইলিশ কেনার মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছিলেন নৌকোর খোল ভরতি নর-সন্তানগুলোকে। হঠাৎ হয়তো তাঁর চোখ পড়েছিল একজোড়া ডাগর ডাগর ভয়ার্ত চোখে। গলায় বাঁধা দড়িটা ধরে টানতেই একটা কম্পমান ক্ষুধার্ত শীর্ণদেহ কিশোর উঠে এসেছিল পাড়ে। অবশেষে চিনেবাজারের কুঠিতে। ‘হ্যাল্লো ডিয়ার, দেখো এসে কী এনেছি তোমার জন্যে।’ ছুটে এসেছিলেন মিসেস ডানকান। তারপর হয়তো আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠেছিলেন ‘হাউ নাইস আ গিফট’। ডানকান দড়িটা তুলে দিয়েছিলেন গিন্নির হাতে।
১৭৮০ সনের এক বৃহস্পতিবার ইন্দে সেই দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ল। অপেক্ষা করে রইল না কবে ডানকানদের আত্মায় করুণা জাগবে, কবে দাস-মুক্তির আন্দোলন হবে, আইন হবে। তা হলে কমপক্ষে আরও প্রায় একশ বছর অপেক্ষা করতে হত ওকে। আরও দুই পুরুষ দাস হয়েই থাকতে হত ওর সন্তানদের। ইন্দে তা হতে দেয়নি। দাস-মুক্তির আইনের পথ চেয়ে না থেকে ইন্দে নিজের পায়ে মুক্তির পথ মাড়িয়েছে। ইন্দে কি কলকাতার প্রথম মুক্ত দাস? প্রথম কেনা গোলাম?
লটারির শহর
রাডিয়ার্ড কিপলিং কলকাতাকে বলেছিলেন ভূঁইফোঁড় শহর। যেমনি বলা, আর যায় কোথা। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা হই-হই করে তেড়ে এলেন এ কী বলেন স্যার, এ কী বলেন? ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ইত্যাদি যাবতীয় যুক্তি সহ তাঁরা কলকাতার মর্যাদা রক্ষায় প্রবৃত্ত হলেন। পাশে এসে দাঁড়ালেন ইংরেজ রাজপুরুষেরা। তাঁরা সাক্ষ্য দিলেন। বললেন, ম্যালেরিয়া আর রক্ত আমাশয়ে আমরা কি হাজারে হাজারে মারা যাইনি এখানে? আমরা কি লড়াই করিনি? আমরা কি—এ কথার বোধ হয় জবাব নেই।
তবুও আলিপুরের মিলিটারি কবরখানা থেকে শুরু করে ইংরেজদের প্রতিটি কবরখানা ঘুরে আসার পরও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কিপলিং সাহেব ভারতবর্ষ এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে যাই বলে থাকুন কলকাতার কথাটা যথার্থই বলেছেন। এ শহর সত্যিই লটারির শহর। জানি, একটু পরে আপনিও স্বীকার করবেন এ কথা। কিন্তু তার আগে বলুন দেখি, আপনি বিশ্বাস করেন কি না লটারিতে অথবা ভাগ্যে। অন্তত খবরের কাগজের রাশিফলে।
যদি ‘না’ বলেন তা হলেও আমি মানব না। কারণ ‘না’-এ বিশ্বাস নেই আমার। কেন নেই, শুনবেন? কলকাতার সেন্সাস রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই শহরে কিছু কিছু লোক আছেন, যাঁরা কোনও ধর্মে আস্থাবান নন (Person who did not return a religion)। কথাটা চোখে পড়া অবধি আমি সেইসব ধর্মহীনদের (অ-ধার্মিক নয় কিন্তু) সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু গত তিন মাসে সম্ভাব্য এলাকা এবং আস্তানায় ঘুরে ঘুরে কী পেয়েছি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। দুটি কথা মাত্র বলছি। প্রথম জনের নিবাস ব্রেবোর্ন রোডের ফুটপাত। অবলম্বন পতিত জমি-ঘেরা একটি দেওয়াল। উপজীবিকা বোধ হয় ভিক্ষা (যে দু’দিন তাকে আমি দেখেছি, সে-দুদিনেই সে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। সে-দৃষ্টিতে ঔদাসীন্য ছিল, প্রার্থনা ছিল না)। পরিবার-কর্ত্রী পোড়াকাঠের মতো কোনও বয়সের এক মেয়ে। তার সংসার বলতে তিনখানা ইট, একখানা মাটির হাঁড়ি আর তিনটি হাড্ডিসার সন্তান। কিন্তু এ কী, মাথার ওপরে সেই আঁস্তাকুড়ের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে একখানা সিন্দুরচৰ্চিত রং-চটা দেবীমূর্তি। বোধ হয় কালী। দ্বিতীয় জনের নিবাস চিৎপুর রোড। তারও আশ্রয় ফুটপাত। তবে এত নিঃসঙ্গ নয় সে বেচারা। স্থানটি আবর্জনা-স্তূপ সংলগ্ন। তাই অনেক কুকুর তার নিত্য প্রতিবেশী। তার দেওয়ালটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় বিলক্ষণ কলাপ্রীতি আছে লোকটির। একগাদা ছবি আঠা দিয়ে সাঁটা দেওয়ালে। প্রধানত কাপড়ের ট্রেডমার্কের সংগ্রহ। যতখানি দেখেছি তার বেশির ভাগ ছবিই রাধাকৃষ্ণের যুগল-মূর্তি, খাদ্যভাণ্ড হাতে অন্নপূর্ণা, সিংহারূঢ়া জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি। সুতরাং বুঝতে পারছেন, এরা দুজনেই হিন্দু। প্রথমটি শাক্ত, দ্বিতীয়টি শৈব। আর উদাহরণের দরকার নেই। তা হলে সেন্সাসের মতো এক ভল্যুম রিপোর্ট লিখতে হবে আমাকে।
এর পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন আমি ভাগ্য-ভূত-ভগবান এবং লটারিতে আস্থাহীন লোক আছে বলে বিশ্বাস করি না। ‘মদায়ত্তং পৌরুষং’ বলার মতো জোর নিরীহ বঙ্গ-সন্তানের কলজেয় নেই। কারণ আপনাদের শৈশব কেটেছে হাঁচি-টিকটিকি কুষ্ঠি-ঠিকুজি এবং গুপ্তপ্রেস ডাইরেকটরি পঞ্জিকা অনুযায়ী। যৌবনেও তাই প্রায়শ আমরা বারবেলা কালবেলা গুনে পথে নামি। রাশিফলের জন্য কেউ কেউ রোববারে তিনখানা বাংলা কাগজ রাখেন। রীতিমতো স্টাডি করে বিশেষ কোনওটির সপক্ষে পরের মাসে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করেন। স্বভাবতই প্রতি মাসে সমর্থন পত্রান্তরিত হয়। পাখি, কুলো, ষাঁড়, জ্যোতিষী কোনওটাতেই অবিশ্বাস নেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাঙালির। টিকিট কেনার পয়সা থাকলে লটারিতে তো নয়ই। সুতরাং বুঝতে পারছেন তো কেন আমি কিপলিং সাহেবের সঙ্গে একমত। বস্তুত কিপলিংয়ের সমর্থনে কষ্ট করে তথ্যাদি সংগ্রহ করেছি আমি শুধুমাত্র এই একটি কারণেই। আহা, এত বড় শহরখানা যদি সত্যি-সত্যিই ভাগ্যের দান হত।
ইতিহাস বলে ‘হত’ নয়, তাই হয়ে আছে। এ লটারির শহর। কোথায় থাকেন আপনি? কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট? মানিকতলা-বউবাজার-আমহার্স্ট স্ট্রিট—কোথায়? আরও এদিকে? ওয়েলিংটন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি? কোথায়, সাহেব পাড়ায়? লাউডন স্ট্রিট, হাঙ্গার ফোর্ড স্ট্রিট—জানবেন, এর যেখানেই থাকেন আপনি, আপনার ওখানে বাস নেহাত ভাগ্যের লীলা। কারণ, আর অনেক পথের মতো ওগুলো পুরোপুরি লটারির দান। ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, হেস্টিংস স্ট্রিট, ক্রিক রো, ম্যাঙ্গো লেন, বেন্টিংক স্ট্রিট এগুলোও অংশত তাই। অর্থাৎ লটারির বরে এগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া হয়েছে, পুষ্ট হয়েছে কিংবা মসৃণতা লাভ করেছে। আচ্ছা, ধরে নিচ্ছি আপনি আমার মতোই বাস্তুহারা। বেলেঘাটা কিংবা পার্ক সার্কাসের কোনও বস্তি-বাসিন্দা। কোথায় স্নান করেন আপনি? বেলেঘাটা খালে? ওয়েলেসলি স্কোয়ারে? এগুলোও কাটা হয়েছে আগের পথেই, ভাগ্যের বলে।
বাবুঘাটের উদ্বাস্তুরাও জানতে পারেন, বাবুঘাটও লটারির দান। তারপর, জনসভায় অরুচি নেই নিশ্চয়ই। এমন দল-মত-নিরপেক্ষ প্রিয় সভাস্থল ওয়েলিংটন স্কোয়ারও তাই। এবং সদ্য উদ্ধার করা ‘টোন হাল’ তো বটেই! সুতরাং বুঝতে পারছেন ব্যাপারটি তা হলে।
আচ্ছা, আরও খুলেই বলি কথাটা। যে যুগের কথা বলছি তখন পৌরসভাও নেই, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টও নেই কলকাতায়। অষ্টাদশ শতকের কথা। সে যুগে রাস্তা-ঘাট তৈরি, মেরামত তথা পরিচ্ছন্ন করা হত লটারিতে, লটারির টাকায়। ১৭৯১ সাল থেকে চলে আসছে এই প্রথা। অনেককাল পর্যন্ত, সম্ভবত ১৮৩৬ সাল অবধি এটাই ছিল প্রথা, অন্য সব ব্যতিক্রম। বেসরকারিভাবেই শুরু হয়েছিল বটে কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সরকারও পা বাড়ালেন এ পথে। সরকারি লটারি হত। সরকারি কমিটি। ১৮০৯ সালে স্বয়ং গভর্নর-জেনারেল বসালেন এক লটারি কমিটি। ওয়েলেসলি সাহেবের ইমপ্রুভমেন্ট কমিটি আরও প্রসার ঘটালেন তার। যেমন টিকিট তেমনই টাকা, তেমনই পুরস্কার। গরিব লোক শুনত, কিনতে পারত না। একখানা টিকিটের দাম হয়তো ৫০ সিক্কা টাকা। আর একজন মশালচির মাসিক মাইনে দু টাকা। তবে পুরস্কারও ছিল তেমনি। চার্লস ওয়েস্টন (১৭৯১) শেষ টিকিটের মালিক হিসেবে পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলেন গোটা টেরিটিবাজারটি। তখনকার দিনেও তার দাম কমপক্ষে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা। ১৮০৯-১৭ সালের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে বারো লাখ টাকা দিয়েছে মানুষ পুরস্কারের আশায়। ’১৭ সালে উঠে গেল ওয়েলেসলির কমিটি। আবার নতুন করে বসল আর এক লটারি কমিটি। পুরনো সারাই তাদের কাজ নয়, সে দায়িত্ব তখন চলে গেছে অন্য হাতে, ম্যাজিস্ট্রেটদের ঘাড়ে। এদের কাজ হল নয়া পুকুর তৈরি, নতুন ড্রেন কাটা, গাছপালা কেটে নতুন রাস্তাঘাট তৈরি ইত্যাদি। অনেক কাজ হয়েছে তখন। সম্ভবত আপনার বাড়ির সামনে পিছনের রাস্তা দুটো সে-কালেরই তৈরি। অবশেষে ১৮৩৬ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে গেল সরকারি লটারি। কেন হল সে একটা প্রশ্ন বটে! কেউ কেউ বলেন জনসাধারণ নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছিল। মানুষের লোভের প্রবৃত্তিকে এমনভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলাতে তারা গররাজি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শুধু সে কারণে বন্ধ হয়েছে বলে মনে করেন না অন্যরা। কারণ নেটিভদের মর্যাল নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের ভাবনার কোনও কারণ থাকতে পারে এটা বিশ্বাস করার মতো কথা নয়। বিশেষত ইংল্যান্ডে তখন এই লটারি সর্বজনপ্রিয় খেলা। তবে মনে হয়, উঠে গেল লোকসান খেয়ে। বহু টাকা ঋণ হয়ে গিয়েছিল নাকি কমিটির। তবুও কত লাভ করেছিলেন তাঁরা দশ বছরে জানেন? ১০,১৯,৩৪৯ টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে ৪৮,৯৪৫ টাকা।
আমরা শুনেছি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল টাউন হলের লটারি। পাঁচজন মিলেমিশে একটু খানাপিনা নাচ-গান আলাপ আলোচনা করব, অথচ এমন একখানা হল নেই শহরে, এ কেমন কথা? কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাই লা গ্যালারিজ ট্যাভার্নে সমবেত হলেন। প্রস্তাব গৃহীত হল। যুগপৎ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন আরও এক দল। তখনকার দিনে দল থাকলেও, এসব ব্যাপারে দলাদলি ছিল কম। দুই দল এক হয়ে গেলেন। তারপর শুরু হল কাজ। কাজ মানে লটারি। শহরময় রটে গেল টাউন হল হবে, লটারি হবে। হুহু করে বিক্রি হয়ে গেল টিকিট। ৬,৫০০ টিকিট। এক একখানা ৬০ সিক্কা টাকা। ১,৩৩১ খানা ছাড়া আর সব ফাঁকা। গরিবেরা শুনল। বড়মানুষেরা হইহই করলেন কিছুদিন। লটারি হয়ে গেল। কিন্তু খানাপিনা হবে বলেই তো আর রেস্টুরেন্ট গড়া নয়—টাউন হল। টাকা চাই কত! সুতরাং আবার হল, আবার হল। পর পর চারবার হল টাউন হলের লটারি। তারপর তৈরি হল আজকের বাড়িটি। ২২ মার্চ, ১৮১৪। সময় লাগল পনেরো বছর আর টাকা গেল ৭ লক্ষ, তাজমহলের খরচের প্রায় কাছাকাছি।
টাউন হল দেখে এসেছি। পুনঃসংস্কার হচ্ছে বলে নয়, লটারির ধন বলে। ভাগ্য-বিশ্বাসে কত বড় কাজ করে ফেলতে পারে মানুষ তার সাক্ষী এই বাড়িটি। তন্ন তন্ন করে ঘুরে বেড়ালাম কিন্তু কোথাও পেলাম না সেইসব ভাগ্যহীনদের নাম। স্ত্রীর গয়না অথবা জমি বন্ধক রেখে যারা কিনেছেন ষাট সিক্কা টাকায় ফাঁকা টিকিটগুলি। দেশি বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ছবি আছে, মূর্তি আছে, স্মারকচিহ্ন আছে। আছে, মানে ছিল। কিন্তু নেই ভাগ্য-বিশ্বাসী সেই সব ভাগ্যহীনদের একজনও। তাঁদের উত্তরপুরুষেরা কোনও দিন টাউন হলে নাচগান করেনি, খানাপিনা করেনি খাদ্য দফতরের লোয়ার ডিভিশন কেরানি হিসেবে, শুধু কলম পিষে গেছে এর বিরাট বিরাট স্তম্ভের আড়ালে, অথবা নিম্ন আদালতের মুহুরিগিরি। এখনও টাউন হলের নীচে রাস্তার রেলিংয়ের পাশে, রাজভবনের দরজায়, এখানে ওখানে তারা দোকান সাজিয়ে বসে। রঙ-বেরঙের টিকিটের দোকান। রাজ্যপাল যক্ষ্মাভাণ্ডার, রেডক্রস—কত কী নাম জানা না-জানা টিকিট। লাইন টানা ফর্ম, দোয়াত কলম, একখানা টুল। ভাগ্যের টিকিট বিক্রি করে সংসার চালায় এরা দুর্ভাগ্যের প্রহর গুনে গুনে। আজব ভাগ্য বইকি! এর পরও কি বলতে পারেন আপনি, কিপলিং সাহেব মিথ্যা বলেছেন? এ শহর কি সত্যই ‘চান্স ইরেকটেড, চান্স ডাইরেকটেড’ নয়?
কলকাতার পথ
রাজভবনের প্রধান ফটকের উলটো দিকে একটা গলি আছে। নাম ফ্যান্সি লেন। ফ্যান্সি কোনও আমুদে পশ্চিমী সুন্দরীর নাম নয়। এ রাস্তা কোনও ফ্যান্সি বল কিংবা ফ্যান্সি মার্কেটেরও স্মারক নয়। বিশপ হিবারের মতে, ফ্যান্সি শব্দটা এসেছে ফাঁসি থেকে। হ্যাঁ, ফাঁসি। ফাঁসি বিকৃত হয়ে হয়েছে ফ্যান্সি এক সময়, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এবং উনিশ শতকের প্রথম প্রহরে। কলকাতায় যখন ইংরাজি আইনের আদিপর্ব চলছে তখন অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া হত এখানে। ফ্যান্সি লেন তখন জনপথ নয়, বনাঞ্চল। তার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট নদী। সে নদীর নাম আজ কিরণশঙ্কর রায় রোড। কিছুকাল আগেও নাম ছিল হেস্টিংস স্ট্রিট। নদীর ধারে এই বিন্দুটিতে নাকি ছিল কয়টি বড় বড় গাছ। তারই ডালে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ঝুলত অপরাধীর দল। ১৮০০ সনে ফাঁসি হয়েছিল জনৈক ব্রজকিশোরের। তার কথা আগে বলা হয়েছে। তার অপরাধ—সে একটি ঘড়ি চুরি করেছিল। ঘড়ির দাম, আদালতের কাগজপত্র বলছে পঁচিশ টাকা।
কলকাতার রাস্তাঘাটের নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে নানা রোমাঞ্চকর ইতিহাস। শুধু ইতিহাস কেন, ভূগোল, সমাজ, সংস্কৃতি—এককথায় প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় জুড়ে বিস্তৃত নগর জীবনের বিবর্তনের নানা কাহিনী। স্ট্রিট ডিরেকটরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক এক সময় মনে হয় যেন উপন্যাস পড়ছি। রহস্য-উপন্যাস।
সবাই জানেন ভাগীরথীর পূর্ব তীরে কলকাতার মাটিতে পাকাপাকিভাবে ইংরাজ বণিকদের পদসঞ্চার ১৬৯০ সালে আগস্টের এক বর্ষণমুখর দিনে। কলকাতা তখন জনহীন নয়। সুতানটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা কাছাকাছি তিনটি গ্রাম নিয়ে নদীতীরে সেদিন যে মহানগরের স্বপ্ন তার একদিকে নদী আর তিনদিকে জলা এবং বনভূমি। ফাঁকে ফাঁকে উঁচু ডাঙায় ছোট ছোট বসতি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু গ্রাম। সে কলকাতা কিন্তু এখনও পুরোপুরি লুপ্ত নয়। পূবের লবণহ্রদ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে এক উপনগর। কিন্তু হ্রদের অনেকখানিই এখনও রয়ে গেছে। রয়ে গেছে অতীতের আরও নানা স্মৃতি। যথা: শিয়ালদহ। এই মস্ত রেল স্টেশনটি ছিল একসময় লবণহদের এক প্রান্তে একটি দ্বীপ। সে দ্বীপে শেয়ালরাজা বাস করত, কিংবা শেয়ালকাঁটার বনে ঘুরে বেড়াত ডোরাকাটা রয়াল বেঙ্গল টাইগার, কে জানে! (কলকাতায় বাঘের দৌরাত্ম্যের কাহিনীও রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।) বেলেঘাটা বলে যে অঞ্চলটি সেটি তেমনই ছিল চর-তুল্য, আর উত্তর কলকাতায় হেদুয়া নামে যে পুকুরটি সেটি ছিল হ্রদ। ঠনঠনে ছিল শক্ত মাটির ডাঙা, ঝামাপুকুরের মাটি বুঝি বা আরও শক্ত, ঠুকলে আওয়াজ হয় ঝন্ ঝন্। শুধু তা-ই নয়, স্ট্রিট ডিরেকটরিতে এখনও রয়েছে ক্রিক রো। এককালে নাম ছিল ডিঙাভাঙা লেন। কোনও এক ঝড়ের রাতে একদা সেখানে ডুবে গিয়েছিল কারও নৌকো। উলটাডিঙিও, বলা নিষ্প্রয়োজন, দুর্ঘটনার স্মারক।
জলার মতো জঙ্গলের খবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহরে। বটতলা, নিমতলা, নেবুতলা, বেলতলা, বাঁশতলা, তালতলা ইত্যাদি হরেক নামের মধ্যে এখনও বেঁচে আছে কলকাতার আদি মানচিত্র। এন্টালি নাকি হিন্তল গাছ থেকে। এমনকী মির্জাপুরও বলা হয়, কোনও মির্জা সাহেবের নামে নয়, মাটি থেকে। যোগ তার মৃৎ বা মাটির সঙ্গে।
এই প্রাকৃতিক পরিবেশে, বলাই বাহুল্য, গাঁয়ের মানুষ তাঁদের জীবন এবং জীবিকা চালিয়ে যেতেন। আজকের দক্ষিণ বঙ্গের সাধারণ মানুষেরই মতো নানা লৌকিক দেব-দেবী তখন এই এলাকায়। এখন শহরে বিদ্যুতের আলো জ্বলে, মোটর চলে। জল আসে কলের নল বেয়ে, কিন্তু ঠাকুর দেবতারা এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান। কালীঘাটের কথা বাদই দিচ্ছি। কলির শহর কলকাতা কালীর শহর। চৌরঙ্গি, ধর্মতলা, পঞ্চাননতলা, শীতলাতলা, ষষ্ঠীতলা, ওলাইচণ্ডীতলা, রাধাবাজার, চড়কডাঙা, রথতলা—সবই ঠাকুর দেবতার নামে। শীতলার দায়িত্ব ছিল এই সেদিন অবধিও শহরের মানুষকে বসন্ত রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা। বেলগাছিয়ার ওলাইচণ্ডী এখনও নাকি রক্ষা করেন আমাদের কলেরা থেকে। এমনকী, বড়বাজার নামটি কলকাতার সবচেয়ে বড় বাজার বলে নয়, আসলে নাকি বুড়োর বা বৃদ্ধের বাজার বলে। বৃদ্ধ বা ‘ওল্ড’ অর্থ প্রাচীন নয়, এই ওল্ডম্যান নাকি আমাদের বুড়ো শিব।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর কলকাতার জমিদার হলওয়ে সাহেব স্থির করেন শহরকে তিনি অন্যভাবে সাজাবেন। স্থির হল এক এক জেলার লোকেরা এক এক পল্লিতে থাকবে। কুমারটুলিতে কুমোরেরা, কলুটোলায় কলুরা, জেলেটোলায় জেলেরা, কম্বুলিটোলায় কম্বল বিক্রেতারা, দরজিপাড়ায় দরজিরা, যোগীপাড়ায় তাঁতিরা, আহিরিটোলায় বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা গোয়ালারা, খালাসিটোলায়—খালাসিরা ইত্যাদি। আজ অবশ্য সেই কড়াকড়ি বিন্যাস আর নেই, কিন্তু অনেক এলাকায়ই নামগুলো টিকে আছে। খালাসিটোলায় এখন খালাসি ক’জন থাকেন জানি না। শোনা যায় সেখানকার একটি পানশালায় একদা জাহাজিদের পাশাপাশি একসঙ্গে সাঁতার কেটেছেন শহরের অনেক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। ইদানীং নাকি নিছক সদ্য শিক্ষার্থীদের ভিড়।
কে কোন এলাকায় থাকবে সেটা যেমন মোটামুটি চিহ্নিত ছিল, তেমনই কোথায় কোন জিনিস কিনতে পাওয়া যাবে তাও বোঝা যেত বাজারের নাম থেকেই। যেমন দরমাহাটা, সবজিহাটা, আমহাটি, সুটাহাটা, কাপুড়েপট্টি, দইহাটা, পগেয়াপট্টি, চাউলপট্টি। পগেয়াপট্টি, কেউ বলেন পাগড়ি হাট, মেগের কাছে পেগের বড়াই করতে হলে একদা ছুটতে হত নাকি সেখানে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন পগেয়াপট্টি আসলে ছিল জুতোর বাজার। সেখানে এখন ঠিক কী মেলে জানি না। জানি না, চাউলপট্টিতেই বা আজ কীসের পসরা। চাল এখন রেশনের দোকানে পাওয়া যায়। নয়তো ফুটপাতের প্রকাশ্য বে-আইনি বাজারে। সে বাজার অবশ্য অতি সম্প্রতি আইনসম্মত করা হয়েছে। আর কাপড়-চোপড়? গোটা শহরই তো মনে হয় সুতানটি। বোনা সুতোর বর্ণাঢ্য উপবন। সেখানে পরিরা ঘুরে বেড়ায়। বস্ত্রহীন ভিখারি অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
বনের মতো বাগও আছে কলকাতায়। অবশ্য মাটিতে তত নয়, যে পরিমাণ স্মৃতিতে। কলকাতা জন্ম থেকেই কসমোপলিটান শহর। এখানে ইংরেজের আগে থেকেই নাকি ছিলেন আর্মেনিয়ানরা। ইংরেজের পায়ে পায়ে এসেছে অন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরা। স্বনামধন্য খোজা ওয়াজিদ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, হুজরিমল—কেউ বাঙালি নন। কলকাতায় আদি পর্বে ওঁরা ইতিহাসের ভাগ্যনিয়ন্তা। বাঙালিদের বরাত খুলে যায় বিশেষ করে পলাশির যুদ্ধের পরে। লুটের পয়সায় শহর এবং শহরতলিতে তখন ইংরেজের অনুকরণে হঠাৎ-ধনীরা গড়ে তোলেন অসংখ্য বাগানবাড়ি। পেরিনস গার্ডেন (বাগবাজারে সিরাজকে ঠেকাবার জন্য এখানে কামান বসানো হয়েছিল), সারমনস গার্ডেন (ইনি দূত হয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন), আরও কত কী! ক্লাইভের বাগানবাড়ি ছিল দমদমে, হেস্টিংসের আলিপুরে, বেলগাছিয়ায় ছিল লর্ড অকল্যান্ডের। পরবর্তী কালে সেটিকে কিনে নেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তারপর পাইকপাড়ার রাজারা। উমিচাঁদ আর হলওয়েল সাহেবের শাগরেদ ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের পাশাপাশি দুটি বাগানবাড়ি ছিল পূর্ব কলকাতায়। তার নাম এখন জোড়াবাগান। জোড়াবাগান একটি থানা, একটি নির্বাচনী এলাকা। আর এক ব্ল্যাক জমিদার নন্দরামের ছিল নন্দনবাগান। রাজাবাগানে ছিল রাজা রাজবল্লভের বাগানবাড়ি। মোহনবাগান যে নামে বিখ্যাত একটি ক্লাব, যে সবুজ-মেরুন পতাকার জন্য ফুটবল-পাগল ছেলে-বুড়ো উত্তেজনায় কাঁপে, সেখানে নাকি ছিল রাজা গোপীমোহন দেবের বাগানবাড়ি। হাতিবাগানে ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতিশালা।
অবশ্য শুধু গণ্যমান্যদের নামাঙ্কিত নয়, অন্য বাগানও ছিল। যথা: বাবুবাগান, বিবিবাগান, কেরানিবাগান, বামুনবাগান, চোরবাগান, সুর্তিবাগান। শেষোক্তটি সুর্তি বা লটারিতে পুরস্কার হিসাবে পাওয়া। তার চেয়েও শোনার মতো বোধহয় রতন সরকার গার্ডেন লেন নামক সরু গলিপথটি একদা দর্শকদের যে বাহারি বাগানটিতে নিয়ে ছেড়ে দিত তার অধিপতির ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী। ১৬৯৭ সালের কথা। ক্যাপ্টেন স্ট্যাফোর্ড ‘ফেলকন’ নামে একটি জাহাজ নিয়ে পৌঁছালেন কলকাতার ঘাটে। স্থানীয় গণ্যমান্য বাঙালিদের কাছে তিনি একজন দোভাষী বা দোভাষ চাইলেন। বাবুরা ভাবলেন সাহেব বুঝি একজন ধোপা চাইছেন। তাঁরা ঘরে ফিরে রতুকে পাঠিয়ে দিলেন। চালাক চতুর রতু দোভাষী হয়ে গেল। তারপর সাহেব-সংসর্গের অনিবার্য ফল, দেখতে দেখতে আঙুল ফুলে কলাগাছ।
তাই বলছিলাম, কলকাতার রাস্তাঘাটের নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে নানা রোমাঞ্চকর ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে আঁকা শহরের মানচিত্রগুলোতে দেখা যায় কিছু বাজার, নদীর ঘাট কিংবা পুকুর বা বাগান বিশিষ্ট বাসিন্দাদের নামের সঙ্গে জড়িত বটে, কিন্তু রাস্তাগুলি তখনও ‘ব্যক্তিগত’ হয়ে ওঠেনি। কোন রাস্তা কোথায় গেছে, কোন দিকে—এই তখন তার প্রথম এবং শেষ পরিচয়। অবশ্য রাস্তাও তখন বেশ কম। যা ছিল তারও অধিকাংশই এলোপাথাড়ি, গাঁয়ের রাস্তার মতো আঁকাবাঁকা। কোনওমতে বড় সড়কে পড়তে পারলেই হল। এখনও কোনও কোনও গলি বাঁচিয়ে রেখেছে সেদিনের স্মৃতি। যথা: ক্রুকেড লেন, সারপেনটাইন লেন, জিগজ্যাগ লেন, কর্কস্ক্রু লেন ইত্যাদি। দু’একটি অবশ্য পরবর্তী কালে নাম পালটেছে, কিন্তু চেহারা-চরিত্র এখনও অপরিবর্তিত। রাস্তাঘাট তৈরি এবং সংস্কারের চেষ্টা পলাশির পর শুরু হলেও সুসংগঠিত উদ্যোগ অনেক পরবর্তী কালের কাহিনী। এক সময় রাস্তাঘাটের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল পুরোপুরি ‘ভাগ্যের’ হাতে। অর্থাৎ লটারি-কমিটি নামক গোষ্ঠীর ওপর। তাঁরা টাকা তুলতেন লটারি করে। প্রথম এই উদ্যোগের কথা শোনা যায় ১৭৯১ সালে। উদ্যোগটি ছিল বেসরকারি। ১৮০৯ সালে লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যমে গঠিত হয় প্রথম সরকারি লটারি কমিটি। ১৮১৭ সালে নগর উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করেছে এই কমিটি। ১৮১৭ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত সে কাজ চালিয়ে যায় নতুন এক কমিটি। তবু আমরা দেখি, ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বে পৌঁছাবার পরও কলকাতায় পাকা জনপথ মাত্র দু’খানা। অবশ্য শহরে তখনও সত্যিকারের কোনও মিউনিসিপ্যালিটি বা পুরসভা গড়ে ওঠেনি। নগরশাসনের জন্য অষ্টাদশ শতকেই নানা পরীক্ষ-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রতিনিধিমূলক সংগঠনের সূত্রপাত ১৮৪৭ সালে। তারপর ধাপে ধাপে তার গণতান্ত্রিক চেহারা। যা হোক, উনিশ শতকের সাতের দশকের পর শহরের পথের পরিমাপ বেড়ে চলে। কলকাতা পরিণত হয় ক্রমে, একজন কবি যা বলেছেন, ‘স্পাইডার সিটি’ বা ‘মাকড়শা শহরে’। ব্যক্তির নামে রাস্তাঘাটের নামকরণের রেওয়াজ শুরু হয় তখন থেকেই। আর তারই জের হিসেবে ক্রমে কলকাতার অঙ্গে ওঠে বিচিত্র এক নামাবলি।
কলকাতার জনসমুদ্র হয়তো অন্তহীন, কিন্তু রাস্তা তা নয়। পৌরসভার আয়তন ৩৭ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ১৯৭১ সালের মাথা গুনতির হিসেবে ৩৩ লক্ষ। বৃহত্তর কলকাতা, মেট্রোপলিটান ডিস্ট্রিক্ট মাইল। লোকসংখ্যা ৮৩ লক্ষ। পরবর্তী জনগণনার ফলাফল আগে একটি রচনায় (‘কলকাতায় কত মানুষ’) বলা হয়েছে। বৃহত্তর কলকাতার জনসংখ্যাটি অপ্রাসঙ্গিক নয় কেননা, সেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০ লক্ষ মানুষ আসা যাওয়া করেন শহরে অথচ তুলনায় শহরে রাস্তা খুবই কম, মাত্র ৫১০ মাইল। কলকাতায় শহরের মোট জমির শতকরা মাত্র ৯ ভাগ রাস্তার দখলে। অন্য দিকে দিল্লি বা মাদ্রাজে শতকরা ২০ ভাগ। বিশ্বের কোনও কোনও শহরে আরও বেশি—শতকরা ২৫/৩০ ভাগ। কলকাতায় দীর্ঘতম জনপথটি দৈর্ঘ্যে ৪ মাইল, এবং প্রশস্ততম রাস্তাটি চওড়ায় ১৫০ ফুট। এমন শ্বাসরোধকারী শহর বুঝি আর হয় না।
রাস্তা যেটুকু আছে সেটুকুও কোনও বিচারেই আদর্শ জনপথ নয়। এক সময় একটি টায়ার কোম্পানি হোর্ডিং ঝুলিয়েছিল শহরে—বামপিটি বামপিটি বাম/ইট ইজ হাউ দি রোডস মুভ এ ক্যালকাটান।’… কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। যানবাহনের সওয়াররা যেন বোতল এবং কলকাতার পথের কর্তব্য নিয়মমাফিক সেসব শিশিবোতলকে ঝাঁকিয়ে তাজা রাখা। শহরের রাস্তাঘাটের এই হালের পিছনে অবশ্য কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। প্রথমত টাকা নেই, রোড ট্যাক্স বাবত রাজ্যের আয় বছরে গড়ে ৯ কোটি টাকা, তার অর্ধেকই আসে কলকাতা থেকে। অথচ কর্পোরেশন নিয়মিতভাবে পায় বছরে মাত্র ১০ লক্ষ টাকা। ফলে কলকাতায় রাস্তাসারাই খাতে খরচ নামমাত্র। মাদ্রাজ কর্পোরেশন প্রতি বছর রাস্তা সারাইয়ের জন্য খরচ করে ১.৫ কোটি টাকা, দিল্লি ১.৬ কোটি টাকা, মুম্বই ২.৫ কোটি টাকা, অথচ কলকাতা বছরের পর বছর প্রায় কিছুই করতে পারেনি। ওসব শহরে প্রতি মাইল রাস্তা সারাইয়ের জন্য খরচ যেখানে গড়ে ৫ হাজার টাকা, কলকাতা সেখানে হাজার দেড়েক টাকা খরচ করতে পারলেই বর্তে যায়। মাদ্রাজ, দিল্লি এবং মুম্বই নতুন রাস্তা গড়ার জন্যও বছরে অনেক টাকা খরচ করে। তার পরিমাণ যথাক্রমে গড়ে ১.১২ কোটি টাকা, ১.৫ কোটি টাকা এবং ৩.৫ কোটি টাকা। কিন্তু কলকাতা কদাচিৎ তা পারে। এই সব হিসাবপত্র অবশ্য পুরনো, সত্তরের দশকের। একটু খোঁজখবর করলে আগ্রহী পাঠক পরের দশকগুলোর সংখ্যা-তথ্য পেয়ে যাবেন। তবে মনে হয় না, আয়-ব্যয়ের অনুপাতে খুব হেরফের ঘটে গেছে।
কলকাতায় পৌরসভা নতুন রাস্তা গড়ার চেয়ে পুরনো রাস্তার নতুন নামকরণেই যেন বেশি উৎসাহী। দ্বিতীয়ত, এ শহরে পথের অনেক দেবতা। পৌরসভা বা সি এম ডি-এ তো আছেই, তা ছাড়া অনেক পথের দায়িত্ব ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, পোর্ট ট্রাস্ট, পি ডব্লিউ-ডি’র ওপর, এমনকী অন্য মিউনিসিপ্যালিটি এবং জেলা পরিষদও বাদ নেই। কথায় আছে, ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’। কলকাতার রাস্তাও বুঝি বা আর কিছুতেই রাস্তা হয়ে উঠতে পারছে না। তৃতীয়ত, খোঁড়াখুঁড়ি। যে কোনও আধুনিক শহরের মতো কলকাতার মাটির তলায় অনেক কাণ্ড, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শহরের যান্ত্রিক গোলযোগ লেগেই আছে। ফলে ছয় ঋতু বারো মাস চলেছে খোঁড়াখুঁড়ি। কখনও গাঁইতি হাতে নামছেন টেলিফোন কর্তৃপক্ষ, কখনও গ্যাসওয়ালা বিদ্যুৎওয়ালা, কখনও বা জল কিংবা নিকাশী ব্যবস্থার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা। এক একসময় মনে হয় কলকাতা যেন কোনও জীবিত শহর নয়, সদ্য আবিষ্কৃত কোনও মহেঞ্জোদরো। প্রত্নতাত্ত্বিক তার রহস্যের সন্ধানে আপন মনে খুঁড়ে চলেছেন। কবে সে রহস্যের কিনারা হবে, কে জানে!
গ্রীষ্মে এই শহরের পথ অতি তপ্ত। এখানে ওখানে দেখা যায় গলিত লাভায় আটকে আছে একপাটি চপ্পল, সেটি ছাড়িয়ে নিয়ে পরে ফের পায়ে দেবে সে সাধ্য ছিল না পদাতিকের। সে পথে চলতে চলতে মোটরের চাকা এমন আওয়াজ তোলে যে, মনে হয় কেউ যেন নতুন কাপড় ছিঁড়ছে, কিংবা নিষ্ঠুর কেউ অতিকায় কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর চামড়া ছাড়াচ্ছে। বর্ষায় আবার যত জুতো পথিকের পায়ে তার চেয়ে অনেক বেশি হাতে, শহর স্তব্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় দেখা যায় সার সার মৃত মোটর। বিশাল ডবল ডেকার বাস পর্যন্ত তখন কোমরজলে দাঁড়িয়ে নিথর। অচল ট্রামের ড্রাইভার-কনডাক্টর সিটে গা এলিয়ে ঘুমোয়। জেগে থাকে শুধু তার ইঞ্জিন। অবশ্য যদি বিদ্যুৎ থাকে। কলকাতায় ভরসা তখন পদযুগল কিংবা রিকশা। বর্ষায় এক এক সময় কলকাতা আবার ভেনিসের চেহারা নেয়, শহরের পথে তখন দেখা যায় নৌকো। আবার ফিরে আসে সেই অষ্টাদশ শতকের কলকাতা ডিঙাভাঙা কি উলটাডিঙির যুগ। শীতে অবশ্য এসব ঝক্কিঝামেলা কম। তবু কলকাতার শীতে যেন আর আগেকার সেই ফুরফুরে আমোদের ঋতু নেই, ইদানীং বড়ই বিষণ্ণ। পথঘাটে তখন ধুলোর চাদর। এক সময় দু’বেলা জল দিয়ে ধোয়া হত শহরের সব জনপথ। সে ব্যবস্থার সূচনা ১৮১৮ সালে। কিন্তু গত কয় বছর ধরে বন্ধ। ফলে, শুধু রাস্তাঘাট নয়, ঘরবাড়ি, এমনকী সামান্য যে ক’টি গাছ অবশিষ্ট আছে তাদের পাতাও শীতের ধুলোয় আচ্ছন্ন। এক দিকে ধুলো অন্য দিকে ধোঁয়া। শহরের সেই নব রসায়নের নামকরণ করা হয়েছে ধোঁয়াশা। এক সময় গ্যাসের আলোতেই উজ্জ্বল ছিল কলকাতার রাত্রি। এত উজ্জ্বল যে ১৮৫৭ সালে প্রথম যখন ইংরেজ মহল্লায় গ্যাসের প্রদীপ জ্বলে তখন অন্ধকার ব্ল্যাকটাউন থেকে একজন বাঙালি মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের অন্ধকার আরও বেড়ে গেল। ১৮৯৯ সালে বিদ্যুৎ এসেছে শহরে, ১৯১০ সাল থেকে আলো-দানের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগই গড়ে তোলা হয়েছে কর্পোরেশনে। ইদানীং মার্কারি ভেপার আলোও জ্বলছে কিন্তু অন্ধকার যেন তবুও বেড়েই চলেছে। শীতে সে অন্ধকার আরও প্রকট, লোডশেডিংবশত নয়, হেতু ওই স্মগ। কলকাতায় তখন শ্বাস টানাও কষ্টকর।
তারই মধ্যে দিয়ে ‘ছুটছে মোটর গটর গটর, ছুটছে গাড়ি, জুড়ি, ছুটছে লোকে নানান ঝোঁকে, করছে হুড়োহুড়ি।’ পৃথিবীর মধ্যে কলকাতাই বোধ হয় এমন এক শহর যেখানে সব ধরনের যানবাহনের সহাবস্থান। ভারত সম্পর্কে বলা হয়, এখানে সমাজ বিবর্তনের প্রায় সব স্তরই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। কলকাতায়ও দেখা যায়, বলতে গেলে, প্রায় সব যুগের সব রকমের বাহন। নেই বলতে একমাত্র পালকি। সে খেদ পুষিয়ে নিচ্ছেন শহরের শব বাহকরা। তাঁরা যেভাবে হেলে দুলে হাঁক ডাক পেড়ে শ্মশানের দিকে যাত্রা করেন, তাতে অনিবার্যভাবেই মনে পড়ে বিগত যুগের পালকি-বাহকদের কথা। পালকি না থাকলেও এখনও আছে কিছু কিছু পালকি-গাড়ি। ফিটনও আছে দু’চারখানা। আছে গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মানুষে টানা রিকশা—সব। একটি হিসেবে দেখছি শহরে বেসরকারি বাস আছে ১৫০০, সরকারি বাস ৭০০, মিনিবাস ৫০০, ট্যাক্সি ৭ হাজারের মতো। প্রাইভেট গাড়ি, লরি—সব মিলিয়ে মোটরের সংখ্যা ২ লক্ষের ওপর। তা ছাড়া আছে হাজার ৩৫ মোটর সাইকেল এবং স্কুটার। এই হিসাবও সত্তরের দশকের। হিসাব এখানেই শেষ নয়। ভূভারতে আর কোথাও যা নেই কলকাতায় এখনও রয়েছে সেই ট্রামগাড়ি। যার সংখ্যা ৩০০-৩২০ খানা। আছে ঠেলাগাড়ি, যার সংখ্যা ১২ হাজারের মতো, মানুষে-টানা রিকশা ৬ হাজার। শেষোক্ত দুটির সংখ্যা সঠিক বলা মুশকিল। কারণ, লাইসেন্সধারী যত না, তার চেয়ে বেশি বিনা-লাইসেন্সধারী, কেউ কেউ বলেন লাইসেন্সধারী রিকশা যদি ৬ হাজার, বিনা লাইসেন্সে চলে তবে ৬০ হাজার।
এই হট্টমালার শহরে যা অনিবার্য তাই ঘটছে। গতিশীলতা কমছে, দুর্ঘটনা বাড়ছে। কলকাতার পথে ‘জ্যাম’ আজ প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। পথ খারাপ, ফলে গাড়ি যত্রতত্র বিকল হয়ে যায়। তারা পথ অবরোধ করে। দ্বিতীয়ত, এত শ্লথগতি যান যেখানে সেখানে গতিশীলতা স্বচ্ছন্দে বইতে পারবে না, সেটা তো স্বয়ংসিদ্ধ। কিন্তু কে কাকে বোঝায়! কলকাতায় সবাই আগে যেতে চায়। পথের আইন কেউ মানতে চায় না। মানাবার মতো ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়। এই বিপুল এবং বিচিত্র যানবাহনকে সামাল দেওয়ার জন্য শহরে ট্রাফিক পুলিশ আছে ১৫ হাজারের মতো। তাদের সাহায্য করে কিছু হোমগার্ড। কিন্তু সহনশীলতায় তাদের জুড়ি নেই। দেখেও দেখে না। অথবা, কোনও রহস্যময় কারণে জেগে ঘুমোয়। সুতরাং, বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। আশ্চর্য এই, এ শহরে গাড়ির চালকেরা বোধহয় মনে মনে ভাবে হর্ন বাজালেই সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। জটিল জ্যামের উপান্তে দাঁড়িয়েও অধৈর্য চালককে দেখা যায় ক্রমাগত তারা হর্ন বাজিয়েই চলেছে। হয়তো আমাদের আওয়াজ-প্রিয়তার সেটা আর এক লক্ষণ। চতুর্দিকে যখন আওয়াজ আর আওয়াজ, তখন ঐকতানে গাড়ির চালকরাই বা বাদ থাকবে কেন!
পথ যখন অপেক্ষাকৃত ফাঁকা তখন শুরু হয় আবার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দৌড়ের প্রতিযোগিতা। এ ব্যাপারে রীতিমতো খ্যাতি অর্জন করেছে প্রাইভেট (বে-সরকারি) বাস, লরি আর মিনিবাস। শেষোক্তটি কলকাতার পথে সর্বশেষ বারোয়ারি যান। তাদের আরোহীরা মনে মনে অবিরাম দুর্গানাম জপ করেন। এদের চালকদের বেপরোয়া ভঙ্গি এক একসময় মনে করিয়ে দেয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার জাপানি স্যুইসাইড স্কোয়াড-এর বৈমানিকদের কথা।
মরো কিংবা মারো—এই যেখানে চালকদের অঘোষিত মন্ত্র, সেখানে বছরে গড়ে তিন’শর বেশি মানুষ পথে মারা পড়বেন তাতে আর বিস্ময় কী! আগেই বলেছি, কলকাতায় পথ-দুর্ঘটনা বাড়ছে। কিছুকাল পূর্বের একটি খতিয়ান: একমাত্র এপ্রিল ১৯৭৯-তেই শহরে পথ-দুর্ঘটনায় মারা যান ২৫ জন। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে পথ-দুর্ঘটনার সংখ্যা একুনে ৩৫০২। এই ক’মাসে মোট নিহতের সংখ্যা ১২০ জন। আহতের সংখ্যা ১৪১৭ জন। মনে হয়, পুলিশ ঈষৎ আত্মতুষ্ট কারণ আগের এই মাসগুলিতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১২৬ জন।
মিছিলের কথা অন্য। কলকাতা মিছিল নগরী। এই অভিধা আদিকাল থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতা। অনেক ঐতিহাসিক মিছিল দেখেছে শহরের রাজপথ। এখনও নিয়মিত দেখছে। কলকাতায় প্রতিবাদের প্রিয়তম পন্থা পথ। ‘রাস্তাই রাস্তা’—বলেছিলেন একজন জনপ্রিয় বামপন্থী কবি। নাকি, পথই পথ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘পদাতিক’। মিছিল দীর্ঘতর করার নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছে কলকাতা। মিছিল সম্পর্কে উদাসীন থাকার উপায় নেই আর আজ। এমনভাবে মিছিলের পরিকল্পনা করা হয় যাতে অল্প মানুষ নিয়েই অনায়াসে বিস্তীর্ণ এলাকায় যানবাহনের প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। কখনও কখনও পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ। কলকাতা সত্যিকারের সামরিক লড়াই দেখেনি এমন নয়। সিরাজউদ্দৌলা আক্রমণ করেছিলেন এ শহর। বিজয়ী নবাব শহরের নাম রেখেছিলেন আলিনগর। তারপর শহর পুনরুদ্ধারের পর শিয়ালদহ এলাকায় নবাব শিবিরে ক্লাইভের অতর্কিত আক্রমণ। সেসব এখন ইতিহাসের বিষয়, কলকাতায় পথের স্মৃতিতে তার চেয়ে তাজা ’৪২-এর আন্দোলন, ’৪৬-এর দাঙ্গা বা পরবর্তী কালে নানা রাজনৈতিক ঘটনা। এখন ‘যুদ্ধ’ বলতে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ। নয়তো খেলার মাঠে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে লড়াই। তবে সব কিছুরই জের পোহাতে হয় শেষ পর্যন্ত সর্বংসহ জনপথকেই। সব হাঙ্গামাই গড়িয়ে এসে পৌঁছায় পথে।
যখন মিছিল নেই, পদাতিক তখনও পথে। কারণ পথ দখল করে নিয়েছে অন্যরা। দেবতা, দোকানি, হকার, ভিখারি, কুষ্ঠরোগী, বারাঙ্গনা, কিংবা বেকার, জঞ্জাল, ষাঁড়, কুকুর, কিংবা সংসার। চৌরঙ্গির একটা ফালিকে মনে মনে একবার আমি নাম দিয়েছিলাম পঞ্চপি’র মেলা। পাঁচটি ‘পি’ (ে) মানে-পেডলার, পিম্প, প্রসটিটিউট, পিকপকেট আর পুলিশ। একটি বিদেশি কাগজে এক সময় এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল চৌরঙ্গির পথে প্রতি তিনজনের একজন ফাউন্টেনপেন ফিরি করে। তিনি নজর করলে দেখতে পেতেন আরও অনেক কিছুই ফিরি হয় সেখানে।
সত্যিই, কী নেই কলকাতার ফুটপাতে! তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে অনেকেই সশরীরে হাজির। তারপর ৩০ থেকে ৪০ হাজার কুষ্ঠরোগী, কয়েক হাজার অন্য ধরনের ভিখারি, কয়েক হাজার ফিরিওয়ালা, নানা ধরনের পাসিং-সো (যথা: বাঁদরওয়ালা, ভালুকওয়ালা), কিছু গণৎকার, কিছু কবি (হ্যাঁ, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের কাছে কোনও এক কবি নাকি রাস্তার ধারে ব্ল্যাক বোর্ড খাটিয়ে ইনস্টান্ট পদ্য শোনায় পথিকদের), কিছু চিত্রকর, কিছু উন্মাদ, কিছু এজিটেটার এবং অগণিত বেকার, অসংখ্য স্ট্রিট-ওয়াকার।
শেষোক্তদের এখন দেখা যায় শুধু চৌরঙ্গি পাড়ায় নয়, অনেক এলাকারই ফুটপাতে এবং কেবল সন্ধ্যায় বা রাতে নয়, ভরদুপুরেও। সিনেমা হলের সামনে বা রেস্তোরাঁর সামনে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে বা ঘাসে তারা সঙ্গীর জন্য বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। আরও খোলাখুলি বললে দাঁড়িয়ে থাকে পেটের ধান্দায়। এদের মধ্যে কিশোরীও অনেক। কলকাতার রেড ডিস্ট্রিক্ট-এর প্রসিদ্ধি শুনেছি ভারতজোড়া। এ শহরে রূপোপজীবিনীরা বলতে গেলে নয়া বন্দরের পত্তনদিন থেকেই আছে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কলকাতা জন্ম থেকেই সাবালক পুরুষের শহর। এখনও এ শহরে পুরুষ নারীর অনুপাত সুষম নয়, সুতরাং নগরের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লাল আলোর এলাকা যদি বেড়ে গিয়ে থাকে সেটা বিস্ময়কর ঘটনা নয়। বেদনাদায়ক, পথঘাটে এভাবে মেয়েদের ফিরি হতে দেখা। ‘পাগড়ি বাঁধা একটা লোক/গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল/ রাস্তায় টহলদার/বড়িয়া একটা মাল’, আর তা-ই দেখে নাকি ট্রামের ‘তারের গায়ে অনেকক্ষণ ধরে ঝুলে থাকল একটানা একটা ছি ছি শব্দ’, লিখেছিলেন বাঙালি কবি।
ট্রামের তারে এখন আর ছি ছি শোনা যায় না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুর্তিবাজ বণিক-তনয় কিংবা অন্য শহর থেকে আসা কাজের মানুষটি যখন হাতে পোর্টফোলিও ব্যাগ নিয়েই রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে শাড়িপরা কোনও কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে দরদাম করে তখন হয়তো মধ্যবিত্ত বাঙালির চোখে সেটা ঈষৎ দৃষ্টিকটু ঠেকে, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
ভিখারিদের অনেকেও শোনা যায় দিনে ভিখারি, রাতে দেহপসারিনী। অবশ্য দেহ বলে যদি কারও কিছু থেকে থাকে। বস্তুত নিজের রুগণ্ দেহখানিই তার ভিক্ষাপাত্র। কলকাতার একজন বিদেশি জীবনীকার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রাস্তার ধারে কলতলায় মেয়েরা যেভাবে স্নান করে, কাপড় বদলায়—তা দেখে। বিস্ময়কর আরও অনেক দৃশ্যই কিন্তু দেখা যায়। স্নানান্তে ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসে হাঁটুতে ভাঙা আয়নার টুকরো রেখে চুল বাঁধা কিংবা পলেস্তরা খসে পড়া দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা লক্ষ্মীর ছবির পায়ে মাথা ঠোকা—সেও কি দর্শনীয় নয়?
ফুটপাত নিয়ে অনেক স্মরণীয় গল্প কবিতা উপন্যাস রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। অনেক ফুলের গল্প। অনেক অশ্রুর কাহিনী। কলকাতার ফুটপাত ১৭৭০ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত অনেক দুর্ভিক্ষের স্মৃতি ধারণ করে আছে। অনেক কংকাল এবং কলঙ্ক কাহিনী। এখন আর ভয়াবহ সেইসব দুর্ভিক্ষ নেই। কিন্তু জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ—যথারীতি সবই হয় ফুটপাতে। মৃত্যু বা জন্ম অবশ্য ঈষৎ আড়ালে। কেননা, এক্ষুনি বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেউ মরবে বলে মনে হলে মাদার টেরিজার নির্মলহৃদয়ের নীল পাড় শাড়ি পরা পরিরা এসে তাদের কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে সঙ্গীরা আসন্নপ্রসবাকে কোনও মতে বয়ে নিয়ে যায় কোনও সরকারি হাসপাতালে। অথবা অন্য কোনও আশ্রমে। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধা নেই এসব নিত্যই ঘটছে। কেননা, একটা হিসাব বলছে, এই শহরের শানবাঁধানো ফুটপাতে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ নিশিযাপন করে। আর একটা হিসাব অনুযায়ী, তাদের যোগফল ৩০ নয় ৭০ হাজার।
কলকাতার আকাশে সূর্য উঠতে না-উঠতে জেগে ওঠে এই ফুটপাত। একজন বিদেশি দর্শক লিখেছেন—পৃথিবীর কোনও শহরে সকাল সাতটায় এত মানুষ দেখা যায় না। ঘুমকাতুরে না-হলে তিনি দেখতে পেতেন শহরের ফুটপাত তার অনেক আগেই জাগ্রত। বেলা যত বাড়ে, ততই বাড়ে ভিড়। ব্যস্ত মহল্লাগুলো যেন চলমান ব্যাবেল। কলকাতা কসমোপলিটান শহর। বাঙালি, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, ইংরেজি—সব ভাষায় কলরোল একসঙ্গে ঘুরপাক খায় ফুটপাতের মাথার ওপরে। তৎসহ হাঁচি, কাশি, হাঁক ডাক, হই হুল্লোড়, গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ। তারই মধ্যে রাস্তার এক কোণে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আগামী বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী, স্ট্রিট কর্নার মিটিং। লহমার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বিবিজান চলে যান লবে জান করে। দূরত্ব রেখে পিছু পিছু হাঁটে উদভ্রান্ত ভবঘুরে। মনে মনে ভাবে এরা কারা, কোথায় থাকে, কেমন বিছানায় ঘুমোয়, কাদের সঙ্গে শোয়। সে লোকগুলোর মাইনেই বা কত!
গাড়ি থেকে কারা নামল, ট্যাক্সিতে কার হাত ধরে কে উঠল—অন্যদের সেদিকে তাকাবারও সময় নেই। ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসেছে জমাটি তাসের আড্ডা। কিংবা ক্যারাম বোর্ডের। চারিদিকে দাঁড়িয়ে দর্শক। ট্রেন ফেল হবে হয়তো, তবুও গায়ে পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এও ফুটপাতেরও দৃশ্য।
ইদানীং কলকাতার ফুটপাতে আর এক সংযোজন বৃক্ষতল-ক্লাব। স্ট্রিট কর্নার গ্যাং পৃথিবীর অনেক শহরেই হয়তো আছে। কিন্তু গাছের তলা বাঁধিয়ে ‘মেম্বার অনলি’ ঝুলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলে বোধ হয় একমাত্র কলকাতা শহরেই। গলিতে আড্ডা বসে রোয়াকে। অনেকে সে আড্ডা বন্ধ করার জন্য রোয়াকে কণ্টকশয্যা বিছিয়ে দেন। তবু আড্ডার অবলুপ্তি নেই। বাস স্ট্যান্ড, সিনেমা হলের বারান্দা এবং এইসব উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান আড্ডায় সাহিত্য শিল্প, থিয়েটার, সিনেমা, ফুটবল, ক্রিকেট, রাজনীতি, ভালবাসা—সব কিছুরই চর্চা চলে। কখনও জন্ম নেয় নতুন কোনও লিটল ম্যাগাজিন, কিংবা শৌখিন কোনও নতুন নাটকের দল। কলকাতার ফুটপাত অতএব নিতান্তই শান বাঁধানো মরুভূমি নয়। কথায় আছে—কলকাতার পথের ধুলোয় সোনা। নজর করলে দেখা যাবে সত্যিই কোনও কোনও এলাকায় ফুটপাতের পাশে নর্দমায় সোনা খোঁজে একদল লোক। সেটাই তাদের জীবিকা। তেমনই ফুটপাত যে আরও অসংখ্যের আশ্রয় এবং অন্নদাতা তাই নয়, ফুটপাত যেন এই দমবন্ধ করা শহরে একমাত্র স্বর্ণগর্ভ সম্ভাবনাময়। ফুটপাতই অবশেষে মুক্তির একমাত্র প্রতিশ্রুতি। যথা নদীতীর।
কলকাতায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের বাস বস্তিতে। কলকাতা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪ লাখের ওপর। কলকাতায় কমপক্ষে প্রতি বর্গমাইলে ১০২০১০ জন মানুষের বাস। এজাতীয় কয়টি ছোটখাটো খবর যাঁদের জানা আছে তাঁরা অনায়াসে বুঝতে পারবেন শহরবাসীর জীবনে কেন ফুটপাত আজ এমন প্রিয়। সেখানে গা বাঁচিয়ে হাঁটা যায় না, ইচ্ছে করলেও হাতে জ্বলন্ত সিগারেট বা মাথায় খোলা ছাতা নিয়ে চলা যায় না, না-চেঁচিয়ে কথা বলা যায় না—তবু মানুষ ভিড় জমায় ফুটপাতেই। কেননা, অনেকের কাছে ঘর আরও দুঃসহ, নৈরাশ্য কিংবা নিঃসঙ্গতা আরও পীড়াদায়ক। এখানে হাঁউ মাঁউ কাঁউ-এর মধ্যে মানুষ অন্তত মানুষের গন্ধ পায়। সময় কাটে। দৈবাৎ হয়তো আশার আলোও ঝিলিক দিয়ে যায়।
ভারী পায়ে, ভারী মনে রাতে আবার পরাজিতের দল গুটিগুটি ফিরে আসে নিজের পল্লিতে। গাড়িবারান্দার তলে, অথবা খোলা আকাশের নীচে ফুটপাতের সংসারীরা ঘুমোবার আয়োজন করে। যারা ঘরে ফিরছে তারা কি জানে, চিরকাল এমন ছিল না। শহরের প্রতিটি রাস্তাই তা রোড, স্ট্রিট, অ্যাভিন্যু, রো, লেন, বাই লেন, স্কোয়ার, প্লেস, সরণি, গলি, বাগ, অ্যাপ্রোচ—যাই হোক না কেন, কোনও না কোনও মাপের সাফল্যের স্মারক। তা না হলে কেন গলির মোড়ে কাস্ট আয়রনে ঢালাই হয়েছিল ওইসব নাম? কেন এনামেল প্লেটে এমন করে লেখা হয়েছিল যাতে সেগুলো এক-দুই বর্ষায় মুছে যেতে না পারে, বেঁচে থাকে দশকের পর দশক?
কলকাতা ইংরেজের শহর বলে বর্ণিত হলেও এ শহরের সব জনপথ ইংরেজের নামে মোহরাংকিত নয়। শহরের পিতা বলে কথিত জোব চার্নক থেকে শুরু করে অনেক ইংরেজের নামেই রাস্তা আছে শহরে। জোব চার্নকের নামে ছিল চার্নক-প্লেস। তবে চার্নক নাকি এখন আর পথে বেঁচে নেই। সত্যমিথ্যা জানি না। সত্য হলে কলকাতার লজ্জার শেষ নেই। বিশেষত, জোব চার্নকের নামে শহর এখন ফি বছর জন্মদিন পালন করে! অবশ্য জাদুঘরে এখনও রয়েছে ‘চার্নকাইট’ নামে একটি বিরল প্রস্তর খণ্ড। ভিক্টোরিয়া-অ্যালবার্ট, ক্লাইভ, হেস্টিংস তো কলকাতার পথে। ইংরেজের বিশিষ্ট কীর্তিকথাও বন্দিত কলকাতার পথের নামে। যথা ওয়ারটারলু স্ট্রিট। কিংবা প্রিটোরিয়া স্ট্রিট। প্রথমটি ওয়াটারলুর যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক, দ্বিতীয়টি প্রিটোরিয়ায় ব্রিটিশ পতাকা ওড়াবার দিনটিকে স্মরণ করে। সহযোগী আরও অনেক বহিরাগত ঠাঁই পেয়েছেন কলকাতায়। সুকেস স্ট্রিট আর্মেনিয়ান শ্ৰেষ্ঠী পিটার সুকেস-এর নামে, এজরা স্ট্রিট, ইহুদি ব্যাপারি এজরার স্মরণে, আর বারেটো স্ট্রিট বহন করছে পর্তুগিজ জোসেফ বারেটোর স্মৃতি। এমনই আরও কত কী!
ইউরোপীয় এলাকার চেয়েও রোমাঞ্চকর কিন্তু সাহেবরা যাকে বলত ‘ব্ল্যাক টাউন’ সেই আমাদের দিশি মহল্লার নামগুলো। অবশ্য রোমান্স ও পাড়ায়ও আছে। যথা: আলিপুরের ডুয়েল অ্যাভিনু কিংবা হেস্টিংস-এর লাভ লেন। প্রথমটিতে পিস্তল নিয়ে লড়াই করেছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আর তাঁর কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস। নেপথ্যে নাকি ছিলেন সুন্দরী নারীও। লাভ লেন-এও হয়তো এককালে শোনা যেত তাঁদের মৃদু পদশব্দ। ফিসফিস। এখন অবশ্য পি জি হাসপাতালের কাছাকাছি একটি নির্জন ছায়াবীথি এ-গৌরব অর্জন করেছে লোকচক্ষে। যদিও আসল নাম তার অন্য। এরকম হয়। একসময় ডালহৌসি স্কোয়্যার এলাকার জনপথের নাম ছিল রানি মুদির গলি। ‘রানি মুদির গলি, সরাবের বোতল খালি’—এই মর্মে একটি জনপ্রিয় গান বা পদ্যও রচিত হয়েছিল তখন। কিন্তু আসলে সেটি নাকি একজন ফরাসি ভদ্রলোকের নামের বিকৃতি। এভাবেই কিল্লা ঘাট স্ট্রিট পরিণত হয়েছে কয়লা ঘাট স্ট্রিটে।
সে যাই হোক, বাঙালিটোলায় রাজা রানি নেই তা নয়। কলকাতার স্ট্রিট ডিরেক্টরিতে এখনও কমপক্ষে ৩০টি রাস্তার নামের আগে রয়েছে ‘রাজা’, ৭টির ‘রানি’। তাঁদের পাশাপাশি অথবা কাছাকাছি রয়েছেন অনেক গণ্যমান্য ভারতীয়। তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশিষ্ট, নানা কৃতিত্ববশত সম্মানিত। নিতান্তই যাঁর অন্য কোনও পরিচয় নেই তিনিও কিন্তু দাবি করতে পারেন অর্থকৌলিন্য। তবু বলব কলকাতার পথ আদিকাল থেকে জনতারই দখলে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের অধিকারে। রবীন্দ্রনাথের পদ্যে আছে গলির প্রতীক হিসাবে কিনু গোয়ালার গলি। এ নামে কলকাতার কোনও মানচিত্রে কোনও রাস্তা হয়তো নেই, কিন্তু রয়েছে গোয়ালিনী লেন। রয়েছে আরও অনেক অতি সাধারণ মানুষের স্মৃতি। যথা: বুন্ধু ওস্তাগর লেন, গুলু ওস্তাগর লেন, নিমু খানসামা লেন, ছকু খানসামা লেন, করিমবক্স খানসামা লেন, শরিফ দফতরি লেন, রফিক সারেঙ লেন, ইমাম বক্স খানাদার লেন। করিমবক্স ছিল রাজভবনে একাধিক গভর্নর জেনারেলের হেড খানসামা। এক সময় রাজভবনের দেওয়ালে তার একটা তৈলচিত্রও ঝুলত।
১৮৭৭ সালের পর কিছু রাস্তার নাম পালটেছিলেন ইংরেজরা। নাম কাটা পড়েছিল হুঁকাওয়ালা গলি, গাঁজাওয়ালা গলি, খইরু মেথর লেন, স্ক্যাভেঞ্জারস লেন-এর মতো কিছু কিছু রাস্তার। বোধ হয় পরবর্তী কালের মান্য সাহেবদের রুচিতে বেধেছিল। নাম এখনও পালটাচ্ছে। বস্তুত, স্বাধীনতার পরে কলকাতা কর্পোরেশনের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তার নাম পালটানো। এক সময় জওহরলাল নেহরু এর বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছিলেন। কিছু কিছু ঐতিহাসিকও নাম বদলের বিরুদ্ধে। তবু নাম পালটাচ্ছে। কেননা, সস্তায় কিস্তিমাতের এটাই একমাত্র উপায়। দেশের বরেণ্যদের নতুন রাস্তা গড়ে স্মরণ না করে পুরানোর নাম পালটে দিলেই তো হয়ে গেল কাজ। এভাবে সম্প্রতিকালে শহরের অনেক নামই পালটে গেছে। তবে লক্ষ করলে দেখা যায় এই পাগলামির মধ্যে একটা বিশেষ প্রবণতার লক্ষণ রয়েছে। কলকাতা রাজনৈতিক শহর। ‘রেড সিটি’ ঠিক না হলেও রাজনীতি যে এ শহরের একটি ফুসফুস তাতে সন্দেহ নেই। আর একটি ফুসফুস—সংস্কৃতি। নাম বদলের পিছনেও সক্রিয় দুই-ই।
গান্ধী বা নেহরু, গোখেল কিংবা মতিলাল তো বটেই, কলকাতার রাস্তায় এখন মার্কস, লেনিন, হো-চি-মিনও রয়েছেন। রয়েছেন খ্যাত অথবা স্বল্পখ্যাত নানা দেশপ্রেমিক। কিন্তু তাঁদের পিছনে ফেলে কলকাতার মানচিত্রে ফুটে বের হচ্ছে যে কলকাতা সে কলকাতা সাংস্কৃতিক। কলকাতাকে বলা হয় ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। সে কারণেই বোধহয় তার পথে ঘাটে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নামের ছড়াছড়ি। বাল্মীকি, কৃত্তিবাস, শেকসপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ-বঙ্কিম হেম, নবীন, ইকবাল-গালিব, এমনকী উনিশ শতকের কবিয়াল ভোলা ময়রা এবং একালের কিশোর কবি সুকান্ত—সবাই আছেন এই কলকাতায়। আছেন গিরিশ ঘোষ, দানীবাবু, শিশির ভাদুড়ি, প্রমথেশ বড়ুয়া এঁরাও। শুধু তাই নয়, ভারতের আর কোনও শহরে আছে কি না জানি না, কলকাতায় এমন কিছু রাস্তা আছে যেগুলি বইপত্রের নামে। তৎকালে অবশ্য পদ্মনাথ নামে একজন পুস্তক-বিক্রেতার নামে একটি রাস্তা ছিল কলকাতায় (এখনও আছে), কিন্তু একালে দেখা যাবে শুধু সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট বা বিশ্বকোষ লেন নয়, স্বর্ণলতা স্ট্রিটও। বিশ্বকোষ লেন থেকে প্রকাশিত হত নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত প্রখ্যাত বাংলা এনসাইক্লোপেডিয়া আর স্বর্ণলতা, সবাই জানেন, একটি উপন্যাসের নাম।
স্মৃতি যখন বেদনাদায়ক, কলকাতা কিন্তু তখনও মুছে ফেলার চেষ্টা করেনি। যথা: গুমঘর লেন (মধ্য কলকাতা)। যখনই ওই রাস্তা দিয়ে যাই, ভাবি কে কাকে গুম করে রেখেছিল এখানে, কবে? কী তার অপরাধ? ভাবতে ভাবতে মন বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে আসে।
আবার ভাল লাগে যখন শুনি বুদ্ধ ওস্তাগর লেনের ৩৫ জন বাসিন্দা পৌরসভাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল—হ্যানডস অফ। এ রাস্তার নাম বদলে তারা রাজি নয়। এই নিষ্ঠুর নির্মম শহরে এইসব নাম সাধারণের গৌরবপতাকা। বাঁচার প্রতিশ্রুতি। বুদ্ধু ওস্তাগর যদি বেঁচে থাকে আমিই বা তবে এই অরণ্যে হারিয়ে যাব কেন, ভাবতে ভাবতে গলিতে ফেরে পদাতিক। কাল প্রাতে শুরু হবে আবার রণ। জীবন-সংগ্রাম।