১. এবড়োখেবড়ো রুক্ষ প্রান্তর

সুখের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

কল্যাণীয়েষু
সুবোধ ভট্টাচার্য—কে

চাঁদের আলোয় দু’পাশের এবড়োখেবড়ো রুক্ষ প্রান্তর, দূরের ধুঁয়ো ধুঁয়ো পাহাড়, কাছের জঙ্গল সমস্ত মিলিয়ে একটা রাত্রিকালীন অপরিচিতিজনিত গা—ছম—ছম অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে।

মহুয়ার ঘুম পেয়ে গেছে। সেই সকালে কলকাতা থেকে বেরুনোর পর তিনশো মাইলেরও বেশি গাড়িতে এসেছে ওরা।

দিনে বেশ গরম ছিল। মার্চের শেষ। ক’টার সময় যে পৌঁছোবে সে কুমারই জানে। মনে মনে কুমারের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে মহুয়া।

বহুক্ষণ হয়ে গেছে—কোনো লোকালয়, জনমানব চোখে পড়েনি। রাস্তাটাও কাঁচা। কোথায় চলেছে ওরা কিছুই বোঝার উপায় নেই এখন।

একটু আগেই দুটো শেয়ালকে দেখেছে রাস্তা পেরুতে। জানালার নামানো কাচ দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে এক এক ঝলক মিষ্টি গন্ধ আসছে। কীসের গন্ধ মহুয়া জানে না। জানতে ইচ্ছা করছে।

সামনেই একটা হেয়ারপিন বেন্ড। কুমার গাড়ি চালাচ্ছিল। কুমারের পাশে সান্যাল সাহেব। পিছনের সিটে মহুয়া। মহুয়ার পাশে টুকিটাকি—জলের বোতল, সন্দেশের বাক্স, ডালমুট এই—ই সব।

মোড়টা ঘুরেই, গাড়িটা হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ থেকেই ইঞ্জিনটা ধাক্কা দিচ্ছিল—কিন্তু এ শব্দটা বনেটের নীচ থেকে এল না। মনে হল, গাড়ির চেসিসের নীচ থেকে এল। বন্ধ হতে হতেও, গতিতে ছিল বলেই অনেকটা এগিয়ে যাবার পর গাড়িটা থামল।

কুমার স্টিয়ারিং বাঁদিকে কাটিয়ে একটা গাছের নীচে রাস্তার পাশে দাঁড় করাল গাড়িটাকে।

মহুয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল, কী হল? সাংঘাতিক কিছু নিশ্চয়ই!

সান্যাল সাহেব পাইপ মুখে ভুরু তুলে কুমারের দিকে তাকালেন।

কথা বললেন না কোনো।

কুমারের প্রোফাইল দেখা যাচ্ছিল পেছন থেকে। একটা উঁচু কলারের কালো—সাদা খোপ—খোপ টেরিকটের জামার আড়ালে বৃষ্টিতে ভেজা কাকের মতো রোগা গ্রীবা, একমাথা হিপিদের মতো চুল—ছ’ইঞ্চি সাইড—বার্ন—তীক্ষ্ন নাক।

কুমার কথা না বলে, দরজা খুলে নেমে, বনেট তুলে, টর্চ জ্বেলে এটা—ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।

সান্যাল সাহেবও নামলেন।

সামনে বনেটটা তুলে দেওয়াতে এখন কাচটা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেল। সামনে আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

মহুয়া পথের দু’দিকে তাকাল।

এতক্ষণ গাড়ি চলছিল বলে গাড়ির আওয়াজে, গতির মত্ততায় এবং গন্তব্য পৌঁছোনোর একাগ্রতায় শুধু সামনের দিকেই চেয়ে বসেছিল ও। গাড়ির চলার শব্দে নিজেদের মধ্যের টুকিটাকি কথার মধ্যেই ডুবে ছিল। বাইরে যে একটা চন্দ্রালোকিত এবং অত্যন্ত সুখপ্রদ রাত জেগে ছিল, সেই রাতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না ওর কাছে।

গাড়িটা থেমে যাওয়াতে এবং হেডলাইট নিবিয়ে দেওয়ার পর চাঁদের আলোয় এই জংলি পাহাড়ি পরিবেশের আসল রূপ স্পষ্ট হল।

কতরকম রাত—চরা পাখি চমকে চমকে আবছায়া প্রান্তরে ডেকে ফিরছে। আলতোভাবে ঝিঁঝির আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। আরও কতরকম ফিসফিসানি উঠছে হাওয়ায় হাওয়ায়। শুকনো পাতা গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের বুকে—একটা অপার্থিব সড়—সড় শব্দ উঠছে। আরও কতরকম শব্দ ও গন্ধ। মহুয়া অবাক হয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

কুমার তার বাবার সহকর্মী। একই সাহেবি কোম্পানিতে কাজ করেন দুজনে। মহুয়া নিজেও একটা সাহেবি কোম্পানির রিসেপশনিস্ট। কলকাতায় তাদের ফ্ল্যাটে কুমার এসেছে, ও—ও গেছে কুমারের ফ্ল্যাটে বাবার সঙ্গে। ও যেখানে—যেখানে গেছে সেইসব জায়গায়—এ—পার্টিতে ও পার্টিতে, ক্লাবে গেট—টুগেদারে কুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

কুমারের সঙ্গে আলাপ সান্যাল সাহেব অথবা মহুয়ার কারোই বেশিদিনের নয়। বলতে গেলে কুমারের পীড়াপীড়িতেই দোলের আগে সান্যাল সাহেবরা দিনকয়েকের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন—পালামৌর বনজঙ্গল দেখতে।

এ—এ—ই—আই থেকে ইটিনিরারি নেওয়ার কথা বাবা তুলেছিলেন কিন্তু কুমার বলেছিল যে, এসব অঞ্চল তার হাতের রেখার মতো মুখস্থ। কিন্তু কী করে যে ওরা এতখানি পথ সুন্দর মসৃণ পাকা রাস্তায় আসার পর হঠাৎ এমন কাঁচা রাস্তায় এসে পড়ল মহুয়া বুঝতে পারছে না। ওর মন বলছে, ওরা নিশ্চয়ই রাস্তা ভুল করেছে। রাস্তা যে ভুল করেছে এ—বিষয়ে মহুয়ার কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ কুমার বেশ কিছুক্ষণ হল মোটেই কথাবার্তা বলছে না। অথচ সারা রাস্তা কথার ফুলঝুরি ফোটাতে ফোটাতে আসছে ও।

এই সাহেবি কোম্পানিতে ঢোকার আগে কুমার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে ছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা, মুসৌরী পাহাড়ে তাদের ট্রেনিং সেন্টারে পোলো খেলার কথা, ইত্যাদি—ইত্যাদি নানারকম গল্প। সত্যি কথা বলতে কি, ওর এই বকবকানি শুনতে শুনতে মহুয়া এই দশ—বারো ঘণ্টায় বেশ বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। হয়তো সান্যাল সাহেবও হয়েছেন। কারণ তিনিও বেশ অনেকক্ষণ হল কোনো কথাই বলছেন না।

মহুয়ার ভেবে আশ্চর্য লাগছে যে, শহরে কারও সঙ্গে বহু বছরের আলাপ থাকলেও তার সম্বন্ধে বা তাকে যতখানি না জানা যায়, তার সঙ্গে বাইরে বেরোলে তাকে আট—দশ ঘণ্টার মধ্যেই অনেক বেশি জানা হয়ে যায়।

সান্যাল সাহেব একবার মহুয়ার জানলার কাছে এলেন।

বললেন, কী রে মৌ, ভয় করছে নাকি?

মহুয়ার একটু গা ছমছম করলেও বলল, না বাবা! ভয়ের কী? তারপর বলল, কিন্তু গাড়ি কি ঠিক হল?

সান্যাল সাহেব পাইপ ভরতে—ভরতে বললেন, চেষ্টা করছে কুমার।

মহুয়া বলল, গাড়ি খারাপ হওয়ার কথা ছেড়ে দাও। কিন্তু আমরা কি ঠিক রাস্তায় এসেছি?

সান্যাল সাহেব চারদিকের লোকালয়শূন্য রাতের চন্দ্রালোকিত বনপ্রান্তরের দিকে চেয়ে বললেন, বোধহয় না।

ক’টা বেজেছে বাবা?

‘সাতটা।’

মহুয়া আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে এল। কুমার ওর বাইরে আসার শব্দ শুনে এগিয়ে এল। এসেই স্মাগলড বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সরি! আ—অ্যাম রিয়্যালি সরি।

মহুয়া সোজাসুজি বলল, কী ব্যাপার? আমরা কোথায় এসেছি? বেতলা থেকে কত দূরে? গাড়ির কী করবেন কিছু কি ভেবেছেন?

কুমার বলল, উই হ্যাভ বিন ডিসকাসিং বাউট দ্যাট। কিছু একটা করব নিশ্চয়ই। প্লিজ, ডোন্ট গেট আপসেট। এভরিথিং উইল বি ওল রাইট।

মহুয়া কথা না বলে দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল। ওর ভয় করতে লাগল খুব। সন্ধের আগে আগে যেখানে ওরা চা খেয়েছিল, ভুলে গেছে জায়গাটার নাম—সেখানে শুনেছিল যে, গতরাতে নাকি আঠারোটি রাইফেল নিয়ে গয়া জেলা থেকে ডাকাতরা এসে এই রাস্তাতেই ডাকাতি করে গেছে। অবশ্য এই রাস্তাই সেই রাস্তা কিনা একমাত্র কুমারই তা বলতে পারে। এও বলেছিল যে, মেয়েদের নিয়ে রাতে এসব পথে যাওয়া ঠিক নয়।

আসলে এই মুহূর্তে ভয়ের চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছে মহুয়ার। কুমারের প্রকৃত স্বরূপ এত তাড়াতাড়ি মহুয়া না বুঝলেই ভালো হত। মানুষটাকে বড় কৃত্রিম বলে মনে হয়েছে মহুয়ার এরই মধ্যে। বাঙালিদের সঙ্গেও সবসময় দাঁত টিপে টেঁশো—ইংরিজি বলে কী যে আনন্দ পায়, কী যে এরা প্রমাণিত করতে চায়, তা মহুয়া বোঝে না। এ বোধহয় একরকম হীনমন্যতা। মনে হয়, সঠিক জানে না মহুয়া।

সান্যাল সাহেব মুখে একবারও না বললেও মহুয়ার বুঝতে ভুল হয়নি যে, এইবারে বেড়াতে আসার আসল কারণ মহুয়া আর কুমারকে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ দেওয়া। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে সান্যাল সাহেব স্বাভাবিক কারণেই উদ্বিগ্ন। বছর পাঁচেকের মধ্যেই রিটায়ার করবেন উনি।

ছেলে হিসেবে কুমার ভালো। পাত্র হিসেবেও ভালো। সত্যি কথা বলতে কি, আজ ভোরে মহুয়া যখন ওদের হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বসন্তের মিষ্টি হিমেল আমেজ—ভরা সকালে একটা অফ—হোয়াইটের মধ্যে কালো কাজ করা ছাপা শাড়ি পরে কুমারের গাড়িতে ওঠে, তখন ওর ভারী ভালো লাগছিল। ও ভেবেছিল যে কুমারকে ও কিছুদিন হল জেনেছে; সেই সপ্রতিভ, যোগ্য ছেলেটিকে তার আরও অনেক বেশি ভালো লাগবে এবং তার সঙ্গে ঘর করতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে ওর বেশি দেরি হবে না।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে ওর খারাপ লাগতে শুরু করবে ও তা বুঝতে পারেনি।

ডাকাতির ভয়ের কথাটা সান্যাল সাহেব এবং কুমারের মনেও এসেছিল। কিন্তু মহুয়া ভয় পাবে বলে তা নিয়ে আর আলোচনা করবেন না ওঁরা।

বনেটটা বন্ধ করে দিতেই ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দেখা গেল সামনেই একটা পাহাড় এবং পথটা সেই পাহাড়ের মধ্যে মিশে গেছে ঘুরে ঘুরে।

কুমার ঐদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকাতে সান্যাল সাহেব বললেন, কী দেখছ?

না। মানে দিস ওয়াজ নট সাপোজড টু বি হিয়ার, কুমার বলল।

হায়াট ডু উ্য মিন? রাগত গলায় সান্যাল সাহেব শুধোলেন কুমারকে। বললেন, ভৌতিক ব্যাপার নাকি? এতক্ষণও পাহাড়টা নিশ্চয়ই ছিল। যখন আলো জ্বলছিল ও টর্চ জ্বালিয়েছিলে তখন কাছটাই নজরে আসছিল। দূরে আমরা কেউই তাকাইনি।

কুমার বলল, তা নয়। পথের এই ল্যাপে কোনো পাহাড় থাকার কথাই ছিল না।

সান্যাল সাহেব রাগ চেপে, ধরা গলায় বললেন, রাস্তা ভুল করলে রাস্তায় আনচার্টেড পাহাড় নদী অনেক কিছুই পড়বে। যে—রাস্তায় তোমার আসার কথা, সে—রাস্তা নিশ্চয়ই কোথাও ফেলে এসেছ।

তারপর একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর হয়ে বললেন, গাড়িটাও গেল বন্ধ হয়ে। তোমাকে এতবার করে বললাম রামবিলাসকে নিই, আমার গাড়ি নিয়ে আসি—তা তুমি জেদ ধরলে যে তোমার গাড়িতেই যেতে হবে—গাড়ি নিজে না চালালে রাফিং হয় না। এখন করো রাফিং।

মহুয়া ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্যে মধ্যে পড়ে হেসে বলল, কুমার, আপনি তো গাড়ির সবকিছু বোঝেন বলেছিলেন, বলুন তো দেখি কী হয়েছে?

কুমার ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে বলল, বুঝতে পারছি না। এখন হোয়াট টু ডু?

কুমার কিন্তু তখনও সপ্রতিভ। পুরো ব্যাপারটা যে তার জন্যেই ঘটেছে সে—কথা সে তখন স্বীকার করলেও, পুরোপুরি মেনে নিতে রাজি নয়।

সে বলল, আসুন গাড়িতে বসে ভাবা যাক কী করা যায়!

সান্যাল সাহেব দরজা খুলেই সামনের সিটে বসলেন। তাঁকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। পায়ের কাছে রাখা ছোট্ট ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতল বের করে ওয়াটার বটল থেকে গেলাসে জল ঢেলে মেশালেন। তারপর চুমুক দিলেন।

কুমারকে বললেন, খাবে নাকি?

কুমার নিস্পৃহ গলায় বলল, আ—স্মল ওয়ান।

বলেই আবার বলল, কাছাকাছি নিশ্চয়ই গ্রাম—টাম থাকবে। আপনারা বসুন। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসি।

সান্যাল সাহেব বললেন, তা কী হয়? এই জংলি জায়গায়, অচেনা অজানা পরিবেশ—একা যাবে কেন?

কুমার বলল, এইরকম জায়গা বলেই তো বলছি। মহুয়াকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে এমন জায়গায় কি ঘুরে বেড়ানো সেফ? তারপর ডাকাতির কথা তো শুনলেন।

সান্যাল সাহেবের গলার স্বরে কেমন এক শুষ্ক বিরক্তি ও রাগ ঝরে পড়ল। বললেন, কী করা উচিত তুমিই বলো—কী করাটা সেফ?

ইতিমধ্যে পিছন থেকে একটি আগন্তুক জীবের শব্দ শোনা গেল। অসমান প্রস্তরাকীর্ণ লাল ধূলি—ধূসরিত পথে জিপের উঁচু হেডলাইটের আলোটা লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসছিল।

হঠাৎ কুমার বলল, মহুয়া, তুমি নীচু করে বসে পড়ো। তোমাকে যেন দেখা না যায়।

মহুয়া বলল, আপনারা থাকতে আমার ভয় কী?

কুমারের গলায় ভয়। বলল, যা বলছি করো। তর্ক করো না। লিসন টু মি।

মহুয়া ভয় এবং বিরক্তিসূচক একটা সংক্ষিপ্ত চ—কারান্ত শব্দ করে সিটের নীচে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে পড়ল।

সান্যাল সাহেব পাইপ কড়মড় করে বললেন, বন্দুকটা আনার কথা বললাম; তাও আনতে দিলে না তুমি। তুমি,……………রিয়্যালি……….।

জিপটা যত কাছে আসছিল ততই যেন গতি কমে আসছিল—এবং মহুয়ার গলার কাছে কী একটা অননুভূত অনুভূতি দলা পাকিয়ে উঠছিল। ওর প্যারিসে—থাকা মায়ের কথা মনে পড়ল ওর—আরও অনেক কথা। হঠাৎ।

কুমার তাড়াতাড়ি জানালার কাচটা তুলে দিল। একটা সিগারেট ধরাতে গেল। কিন্তু পারল না। ওর কাঁপা—হাতে দেশলাইটা জ্বালাতে পারল না। একবার যদিও—বা জ্বলল, পরক্ষণেই জ্বলন্ত কাঠিটা গাড়ির মধ্যেই হাত থেকে পড়ে গেল।

মহুয়া ফিসফিস করে বলল, কী করছেন! আগুন লাগাবেন নাকি?

সান্যাল সাহেব কুমারের দিকে এবার ঘৃণার চোখে তাকালেন। তারপর হঠাৎ বাঁদিকের দরজা খুলে নেমে পড়ে রাস্তার পাশে এসে সাহসের সঙ্গে গাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

চলন্ত জিপটার মধ্যে হিন্দিতে অনেক লোক কথা বলছিল। কারা যেন হাসছিল। এমন সহজ শিকার পেয়েছে দেখে বুঝি ওদের আনন্দের সীমা ছিল না।

সান্যাল সাহেব হাত তুললেন।

জিপের ইঞ্জিনটা ওদের গাড়ির ঠিক পিছনে এসেই যেন বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমে মনে হল বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই মহুয়া বুঝল বন্ধ হয়নি—গাড়িটা থেমে গেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের ধক ধক শব্দ শোনা যাচ্ছে।

দু’পাশ থেকে একসঙ্গে চার—পাঁচজন লোকের লাফিয়ে নামার শব্দ শুনল মহুয়া। কুমারের সাড়াশব্দ পেল না। মনে হল ভয়ে ও গাড়ির মধ্যে জমে গেছে। মরেই গেল বুঝি—বা।

বাবার গলা শুনতে পেল মহুয়া। বাবা পাইপটা ধরিয়ে, শুধু হাতে, বিপদের মুখে শুধুমাত্র গলার স্বরে যতখানি ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করা যায় তা করে বললেন, হিঁয়া কোই মেকানিক মিলেগা? গাড়ি জাদ্দা খারাপ হো গ্যয়া।

ডাকাতদের মধ্যে একজন অডাকাতসুলভ অত্যন্ত ভদ্র গলায় বাংলায় বলল, আপনারা বাঙালি—কলকাতার নম্বর দেখেই বুঝেছিলাম। কী, হয়েছে কী?

গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। এখানে মিস্ত্রি—টিস্ত্রি পাওয়া যাবে?

ওঁদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, এই পাহাড়টা পেরিয়েই ওপাশে ফুলটুলিয়া গ্রাম। সুখন মিস্ত্রির একটা কারখানা মতো আছে।

ওঁদেরই মধ্যে আরেকজন বললেন, সুখন মিস্ত্রি কে রে?

প্রথম ভদ্রলোক বললেন, আরে দুখন মিস্ত্রির ভাই। দুখন মারা গেছে তো মাসখানেক হল। ওর ভাই সুখন এসে কারখানার জিম্মা নিয়েছে।

সান্যাল সাহেব বললেন, আমাদের মধ্যে কেউ কি একটু যেতে পারি আপনাদের সঙ্গে কারখানা অবধি?

ওঁরা সমস্বরে বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

ইতিমধ্যে মহুয়া সিটের তলা থেকে শরীর বের করে সিটের উপরে বসেছে আস্তে আস্তে। যারা ডাকাত নয়, তাদের কাছে অমন লুকিয়ে থাকা অবস্থায় ধরা পড়তে চায়নি ও।

মহুয়া ভিতর থেকে ডাকল, বাবা!

নারীকণ্ঠ শুনে জিপের আরোহীরা অবাক গলায় বললেন, সঙ্গে মেয়েছেলে আছে নাকি? তাহলে তো মুশকিল করলেন। তাহলে আপনারা সকলেই থাকুন এখানে—আমরা গিয়েই সুখনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা কাজ করা যায়। আমরা টো করে নিয়ে যেতে পারি আপনাদের গাড়ি। কিন্তু আমাদের কাছে দড়ি নেই। আপনাদের কাছে কি আছে?

কুমার এতক্ষণে নেমেছে গাড়ি থেকে। নেমে বলল, নেই।

সান্যাল সাহেব বললেন, কী আছে কী তোমার সঙ্গে? কিছুই না নিয়ে এত লম্বা পথে বেরিয়েছ?

মহুয়া মনে মনে বলল, গলায় দড়ি দেওয়ার জন্যেও তো কিছুটা আনা উচিত ছিল।

কী করা হবে এই নিয়ে সান্যাল সাহেব ও কুমার ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় পাহাড়ের উপরের রাস্তা থেকে একটা আশ্চর্য উদ্ভট আওয়াজ কানে এল। চোখে পড়ল একটা স্তিমিত এবং কম্পমান ঘূর্ণায়মান আলো।

ওঁরা সকলেই ওদিকে তাকালেন।

হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে বললেন অন্যজনকে, আরে এ তো সুখনের গাড়ি।

তারপর সান্যাল সাহেবের দিকে ঘুরে আশ্বস্ত করার জন্যে বললেন, পর্বতই চলে আসছে মহম্মদের কাছে। বলেই কুমারের দিকে ঘুরে বললেন, যান মশাই, আর ভয় নেই। সুখনকে ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছেন ঠিক সময়মতো।

যে যন্ত্রটা পাহাড় বেয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে, সেটাকে গাড়ি বলে ভুল করার কোনো কারণ নেই। একটা নড়বড়ে ধাতব ব্যাপার টুং—টাং—ঠিন—ঠিন—টকা—টক—ঝকা—ঝং আওয়াজ করতে করতে লাফাতে—থাকা ঘুরন্ত মিটমিটে একটা—মাত্র হেডলাইট নিয়ে পাহাড় বেয়ে অন্য কোনো গ্রহের এক কিম্ভূতকিমাকার অদৃশ্যপূর্ব জন্তু যেন হামাগুড়ি দিয়ে নামছে পাহাড় থেকে।

সকলেই সেদিকে নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। এমনকি জিপের আরোহীরাও। এঁরা বোধহয় সুখন মিস্ত্রির এই গাড়িটাকে দিনমানে দণ্ডায়মান অবস্থাতেই দেখে থাকবেন এতদিন। রাতের অন্ধকারে তার চলন্ত রূপটি দেখে তাঁরা সকলেই বিস্ময়বিমূঢ় এবং চলচ্ছক্তিহীন হয়ে গেছেন।

গাড়িটা যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই তার আওয়াজ বাড়তে লাগল। এতক্ষণ অর্কেস্ট্রার দূরাগত ঐকতান শোনা যাচ্ছিল। এখন কাছে আসায় বিভিন্ন যন্ত্রবিশেষের বিভিন্ন আওয়াজ আলাদা আলাদা হয়ে কানে লাগছে।

পথের মধ্যে দু—দুটো গাড়ি ও এত লোকজন দেখে বোধহয় সুখন মিস্ত্রি হর্ন বাজাল।

সেই চন্দ্রালোকিত হলুদ বাসন্তী রাতে তাবৎ জীবন্ত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ মায় সমবেত জনমণ্ডলীর হৃৎপিণ্ড চমকিয়ে দিয়ে সেই যন্ত্রযান একটি প্রাগৈতিহাসিক মোরগের মতো ডেকে উঠল—কঁরর—র—র—র। আবার ডাকল, কঁ—কঁর—কঁ—র—র—র—র।

এরা সকলে হইচই করে উঠল। প্রায় চিৎকার করেই থামাল যন্ত্রটাকে।

ইঞ্জিনটার সঙ্গে একচোখা আলোটাও মাথা দোলাতে দোলাতে এসে ওদের সামনে থেমে গেল। ঘটাং শব্দ করে ব্রেক কষে দাঁড় করাল ড্রাইভার গাড়িটাকে।

সুখন, এ সুখন—বলে জিপের আরোহীদের মধ্যে কে যেন ডাকল।

সিটের উপরে একটা তাকিয়া রেখে তার উপর বসে গাড়ি চালাচ্ছিল কালো হাফ—প্যান্ট ও লাল—গেঞ্জি পরা একটা বছর বারো—তেরোর বেঁটেখাটো কালো—কালো ছেলে। সে গুড়গুড়িয়ে নেমে এসে বলল, হুয়া কা?

জানা গেল ও সুখন নয়, সুখনের খিদমদগার। গাড়ি নিয়ে সুখনের জন্যে গুঞ্জা বস্তিতে যাচ্ছিল মহুয়ার মদ আনতে। সুখন কারখানা—সংলগ্ন তার বাড়িতেই আছে।

মহুয়ার মদের কথা শুনে সান্যাল সাহেব চিন্তিত হলেন ও কুমার আঁতকে উঠল।

জিপের আরোহীদের দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন ওঁরা দুজনেই। বোধহয় সুখন মিস্ত্রির চরিত্র সম্বন্ধে নীরব প্রশ্ন করলেন।

তাঁদের মধ্যে যিনি নেতা—গোছের, তিনি বললেন, আরে নে—হী। মহুয়া তো হিঁয়া সব কোই—ই পীতা। সুখন বড়া আচ্ছা আদমী। আপলোগ বে—ফিক্কর রহিয়ে। এ্যায়সা কুছ দুগগী—তিগগী আদমী নহী হ্যায়। উও বড়ে—খানদানকে পড়ে—লিখে আদমী—আভি পেটকা লিয়ে গাড়ি মেরামতীকা কামমে লাগা হুয়া হ্যায়।

তারপর বললেন, কইভী ডর নেহী। আপলোগ ইতমিনানসে যানে শকতা।

কখন ওরা সুখন মিস্ত্রির কারখানায় পৌঁছেছিল—কখনই—বা কারখানার লাগোয়া সুখনের বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল খিচুড়ি খাওয়ার পর, আর কখনই—বা রাত পেরিয়েছিল, মনে নেই মহুয়ার।

এদিকে কাছাকাছি কোনো ডাকবাংলো—টাকবাংলো নেই। একটা ছিল; সেটা নাকি দশ মাইল দূরে। এতখানি আসার পর আর কোথাও যাবার মতো অবস্থা ছিল না কারোই। তাই বাবা এবং কুমার ডিসাইড করেছিলেন যে এখানেই রাত কাটাবেন।

টালির ছাদ উপরে। সিলিং—টিলিং নেই। টালির ফাঁক—ফোক দিয়ে আলো চুঁইয়ে এসে ঘরে পড়েছে।

দেওয়ালের দিকের চৌপাইয়ে মহুয়া শুয়ে ছিল। মধ্যের চৌপাইতে বাবা, ওপাশে কুমার। শেষ রাতে বেশ শীত—শীত করছিল। চাদর মুড়ে শুয়ে মহুয়া আলস্যে পড়ে থাকল অনেকক্ষণ। আড়মোড়া ভাঙল।

কুমারের শোয়াটা বিচ্ছিরি। তাছাড়া অমন ছিপছিপে চেহারার লোক যে অমন নাক ডাকাতে পারে এ—কথা মহুয়ার জানা ছিল না। কুমারের দিকে তাকিয়ে এক বিষণ্ণ হতাশায় ওর মন ভরে এল।

মহুয়া উঠল। শাড়িটা ঠিক করল। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় এল। বারান্দায় আসতেই দেখল, কাল রাতের সেই যন্ত্রযান—চালক—কাম—তাড়াতাড়ি খিচুড়ি রেঁধে—দেওয়া মংলু যেন তারই অপেক্ষায় বসে আছে।

মংলু বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল। মহুয়াকে দেখেই বলল, চা করব দিদিমণি?

মহুয়া বলল, করো; কিন্তু এক কাপ। ওঁরা এখনও ওঠেননি।

তারপর বলল, তোমার বাবু কোথায়?

মংলু বলল, কে? ওস্তাদ? ওস্তাদ তো কারখানায়। গাড়ি নিয়ে পড়েছেন। আপনাদেরই গাড়ি।

বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বারান্দার মোড়ায় বসে চা খেল মহুয়া।

শেষ রাত থেকেই কী একটা চাপা অনামা খুশিতে ওর মন ভরে রয়েছে। ভিতরে একটা ছটফটে কষ্ট। কষ্ট মানে : আনন্দ।

বাবা এবং কুমার যে এখানে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেজন্যে ওঁদের দুজনের কাছেই মহুয়া খুব কৃতজ্ঞ।

বারান্দা ঘেঁষে থামের গায়ে পর—পর নানারঙা বোগেনভোলিয়া লতা। মেরি পামার ও আরও অনেকরকম ফুলে—ফুলে ছেয়ে আছে। তার মধ্যে একটা নিমগাছ। কোণায় একটা কুয়ো—লাটাখাম্বা লাগানো আছে। এপাশে—ওপাশে ছড়ানো—ছিটানো মবিলের টিন, টায়ার—টিউব, নানারকম গাড়ির মরচে পড়া রিম। একটা ম্যাটমেটে লালরঙা পুরোনো ভাঙাচোরা চাকাহীন গাড়ি মাটিতে বুক দিয়ে বসে আছে।

বারান্দায় বসে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে তাকিয়ে এই সকালে একা—একা চা খেতে ভারী ভালো লাগছিল মহুয়ার। অনতিদূরে শালবন থেকে কোকিল ডাকছে শিহরন তুলে। অন্য দিক থেকে সাড়া দিচ্ছে অন্য কোকিল। তখনও হিম—হিম ভাব। পলাশে শিমুলে দূরের লাল এবড়োখেবড়ো প্রান্তর ভরে আছে। এই ভোরের সমস্ত সত্তা ভরে রয়েছে কী—যেন—কী ফুলের উগ্র গন্ধে। চতুর্দিক ম’ ম’ করছে।

নাক দিয়ে জোরে হাওয়া টানল মহুয়া।

মংলুকে শুধোল, কীসের গন্ধ এ? কোন ফুলের?

মংলু অবাক চোখে তাকাল মহুয়ার দিকে।

মহুয়া বুঝতে পারছিল মংলুর মুখ—চোখ দেখে যে, জীবনে মহুয়ার মতো কখনো কারও খিদমদগারি করতে পারার এত সৌভাগ্য যে আসবে, তা বোধহয় ও কখনও ভাবেনি। তাই মহুয়াকে কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে ভেবেই পাচ্ছে না মংলু।

মহুয়ার প্রশ্নে অবাক চোখে তাকাল ও। এই অপার অজ্ঞানতায় আশ্চর্য হয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, এ তো মহুয়ার গন্ধ!

মহুয়ার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল না। তবু ও লজ্জা পেল; ওর ভালোও লাগল। ওর নামের ফুলে—ফলে যে এমন মাতাল—করা গন্ধ তা বুঝি ও নিজে এখানে না এলে জানতে পেত না। নিজেকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করল।

বারান্দার ওপাশে আর একটা ঘর। দরজা খোলা রয়েছে হাঁ করে।

মহুয়া শুধোল, এটা কার ঘর?

ওস্তাদের। মংলু বলল।

তুমিই ওস্তাদের রান্না করে দাও?

মংলু হাসল।

বলল, ওস্তাদ কিছুই খেতে চায় না। রাঁধব আর কী? কার জন্যে? সারাদিন কাজ করে, তারপর সন্ধ্যার পর যা—হয় দুজনে কিছু ফুটিয়ে নিই।

মহুয়া শুধোল, কেন? দুপুরে কিছু খাও না তোমরা?

আমি খাই। পাঁড়েজির দোকানে গিয়ে পুরি, আলুর তরকারি এসব খেয়ে আসি। রান্না করি না কিছু। একার জন্যে কে ঝামেলা করে? ওস্তাদ তো কিছুই খায় না। চা আর পান আর একশো বিশ জর্দা—ব্যাস। সারাদিনে ওই।

কাল রাতেই বিহারি—নামের এই বাঙালি লোকটাকে দেখা অবধি মহুয়ার যেন কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে ভেতরে। এমন প্রচণ্ড গোলমাল ওর অন্তর্জগতে এবং হয়তো শরীর—জগতেও আগে কখনও ও অনুভব করেনি। লম্বা, রোদে—পোড়া সবল চেহারা। জুলপির চুলে একটু পাক ধরেছে। শক্ত চোয়াল। কথা কম বলে—চোখ দুটোতে এক স্তব্ধ ঔজ্জ্বল্য—কিন্তু সব মিলিয়ে এই সুখন মিস্ত্রিকে প্রথম দেখার পরই এমন কিছু ঘটে গেছে মহুয়ার ভিতরে যে, তাদের গাড়ির মতো তার মনেরও বুঝি মেরামতির বড় দরকার হয়ে পড়েছে এখুনি।

এ—কথা ও কাউকে বলতে পারেনি। পারবেও না। মহুয়া এই মিস্ত্রিকে স্বপ্ন দেখেছে রাত্রে। একঝলক দেখেছে। ঘুমের মধ্যে এক দারুণ ভালোলাগায় ও ভরে গেছে। কেন ও জানে না। আজ এই স্পষ্ট ভোরেও অস্পষ্টতায়—ভরা রাতে—দেখা এবং স্বপ্নে—দেখা সুখন মিস্ত্রি তার সমস্ত সত্তায় একটা অদ্ভুত সুখময় আভাস রেখে গেছে। আভাসটা কোন সত্যের, মহুয়া এখনও বুঝে উঠতে পারছে না।

শেষে কিনা পালামৌর একটা অখ্যাত গ্রামের এক মোটর—মিস্ত্রি! কিন্তু তাই কি?

নাঃ। নিজেই নিজেকে বকল মহুয়া। বলল—ওর রুচি বড় খারাপ হয়ে গেছে। বলল, নিজেকে সংযত করো। এ—সব ভালো নয়।

মংলু বলল, দিদিমণি, আর একটু চা খাবেন?

মহুয়া বলল, করো।

বলতেই মংলু ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে গেল। যেতে যেতে বলল, নাস্তার বন্দোবস্ত করে রেখেছি। ওস্তাদ সূর্য ওঠার আগেই নিজে গুঞ্জা বস্তিতে গিয়ে আপনাদের জন্য আনাজ, ডিম, মুরগি সব নিয়ে এসেছে। এখানে তো মাছ পাওয়া যায় না। যখনি বলবেন পরোটা, আলুভাজা, ডিমের তরকারি বানিয়ে দেব। ওস্তাদ বলেছেন, আপনাদের কোনোরকম কষ্ট হলে আমার চাকরি যাবে। দুপুরে মুরগির ঝোল, বাইগনকা ভাত্তা, পুদিনার চাটনি, কাঁচা আম আর লংকা বাটা; আর সবশেষে গুঞ্জার প্যাড়া। আপনি শুধু বলবেন, কখন কী খাবেন!

মহুয়া বলল, কেন? গাড়ি সারাতে কি খুব দেরি হবে? গাড়ির কী হয়েছে আগে সেটাই জানা যাক।

বিকেলের আগে নিশ্চয়ই হবে না। চিন্তা করবেন না দিদিমণি। ওস্তাদ সময়মতো ঠিকই জানাবে।—মংলু বলল।

মহুয়া একবার ঘরের মধ্যে তাকাল। দেখল বাবা ও কুমার এখনও ঘুমিয়ে কাদা। রাতে হুইস্কিটা বেশি খেয়েছেন দুজনেই। তার উপর বিপদ থেকে ত্রাণের আরাম বোধহয় ঘুমের ওষুধের কাজ করেছে ওদের স্নায়ুতে।

চা—টা খেয়ে মহুয়া একবার ঘরে গেল। ঘরের দেওয়ালে একটা আয়না ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু দেখে নিল। চুলটা ঠিক করে নিল। বাথরুমে গিয়ে কালকের সারাদিনে পরা শাড়িটা ছেড়ে একটা কালো আর লাল ডুরে পাছাপেড়ে শান্তিপুরি শাড়ি পরল। একটু আলতো করে কাজল লাগাল চোখে। মহুয়া জানে যে, মহুয়ার চোখ দুটো ভারী সুন্দর। ও—যে সুন্দর, ওকে দেখে যে অনেক পুরুষ আত্মহারা হয়, এ—জানাটা ও ফ্রক পরা বয়স থেকেই জেনেছে। কিন্তু কাল রাতের লন্ঠনের আলোয় হঠাৎ যে—লোকটিকে দেখেছিল—সেই লোকটির মতো কাউকে নিজে এর আগে ও দেখেনি। ও—যে নিজেও কাউকে দেখে আত্মহারা হতে পারে—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে একটা সুতীব্র বেদনাময় অনুভূতি যে তার জীবনেও সত্যি হবে এই এতদিন পরে, ও কখনোই তা ভাবেনি। ওর ভিতরে যে একটা ভীষণ দামি আসল—আমি ছিল, সেই আমিটাকে,—সেই মুখটি, সেই ব্যক্তিত্বটি বড় চমক তুলে ডাক দিয়েছে। ওর হৃদয়ের গভীরে কেউই আর এমন করে পথ কাটেনি আগে।

অথচ আশ্চর্য! কেমন করে কী হয়ে গেল, হয়ে গেছে, ও জানে না। ওর শরীরে জোর পাচ্ছে না। ওই বাসন্তী সকালের কোকিলের ডাকে, মহুয়া আর শালফুলের গন্ধে, এই অলস হাওয়ায়, অনতিদূরের জঙ্গলের মধ্যে চরেবেড়ানো মোষের গলার কাঠের ঘণ্টার গম্ভীর ডুং ডুং শব্দে ও নিজেকে সম্পূর্ণ খুইয়ে ফেলেছে। ওর সব গর্ব, সব অহংকার, সব কিছুই বুঝি এই ফুলটুলিয়ায় ধুলোয় ফেলা গেল।

মহুয়া বাইরে এল। তারপর ওঁরা ওঠার পর ওঁদের চা দেওয়ার জন্যে মংলুকে বলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কারখানার দিকে পা বাড়াল।

পাশেই কারখানা। মধ্যে সরু সরু বাঁশ পুঁতে একটা বেড়ার মতো দেওয়া। বেড়ার উপর ওদেরই গাড়ির কার্পেট, পাপোশ, সব রোদে দেওয়া হয়েছে।

কারখানায় ঢুকে মহুয়া দেখল, ওদের গাড়ির বনেটটা তোলা। ভদ্রলোক মাথা নামিয়ে কী যেন ঠুক—ঠাক করছেন। কাল রাতে—পরা খয়েরি—রাঙা জিনের প্যান্ট—পায়ে টায়ার—সোলের চটি। ঝুঁকে—পড়া সবল সুগঠিত পা ও পেছনের আভাস, সুন্দর বলিষ্ঠ হাতের কনুই অবধি দেখা যাচ্ছে। মুখ নামিয়ে ইঞ্জিনের গভীরে কী যেন দেখছেন, যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করছেন। আর পায়ের কাছে মাটিতে লেজ—গুটিয়ে বসে আছে একটা কালো নেড়ি কুকুর। এই পরিবেশে কুকুরটি অদ্ভুত মানিয়ে গেছে।

লক্ষ করে দেখল মহুয়া যে, কুকুরটার পিছনের একটা পা ভাঙা।

মহুয়া কথা না বলে একটা খালি মবিলের ড্রামে হেলান দিয়ে মানুষটিকে দেখতে লাগল নিমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। নামটা বাজে; সুখন।

ওর অস্তিত্ব টের পায়নি সুখন।

এত সকালে কারখানায় অবশ্য কেউই আসেনি। নিমগাছে কাক ডাকছে, দূরের বনে কোকিল। ঝিরঝির হাওয়ায় কারখানার তেল—মবিলের গন্ধ ছাপিয়ে শালফুলের, মহুয়া ফুলের ও আরও কত কিছুর বনজ গন্ধ ভাসছে।

কুকুরটা একদৃষ্টে দেখছিল মহুয়াকে। ঈর্ষাকাতর চোখে চেয়ে ছিল। কুকুরটা বোধহয় মেয়ে। মহুয়ার প্রতি মনোভাবটা ঠিক কীরকম হওয়া উচিত তা ঠিক করে উঠতে পারছিল না বুঝি।

কিছুক্ষণ পর কুকুরটা হঠাৎ ভু—উক—ভুক—ভুক—ভুঃ করে ডেকে তিনপায়ে নড়বড়ে তে—পায়ার মতো দাঁড়িয়ে উঠল। উঠেই ছুঁচলো মুখে কান খাড়া করে মহুয়ার দিকে চেয়ে ক্রমান্বয়ে ডাকতে লাগল।

সুখন মুখ না তুলেই বলল, ‘আঃ কালুয়া, চুপ কর।’

তাতেও যখন কালুয়া চুপ করল না তখন সুখন মুখ তুলল। মুখ তুলেই মহুয়াকে দেখে অবাক হল। একটা অপ্রতিরোধ্য ভালো—লাগা এসে তার মুখের রং বদলে দিল। পরক্ষণেই সামলে নিল সুখন নিজেকে। সুখন মিস্ত্রি—নিজের কারখানার পটভূমিতে ফিরিয়ে আনল নিজেকে। নিজেকে মনে মনে চাবকাল।

কালিমাখা দু’ হাত তুলে নমস্কার করল। বলল, নমস্কার।

সুখনের বাঁ গালে অনেকখানি কালি লেগেছিল। ওর চওড়া চোয়াল, ছোট ছোট করে ছাঁটা খেলোয়াড়দের মতো চুল, উদ্ধত চিবুক, বুক—খোলা গেঞ্জির মধ্যে দিয়ে দেখা—যাওয়া চওড়া বুকের একরাশ কোঁকড়া চুল—এ—সব মহুয়া একনিমেষে দেখে নিল। দেখে ভালো লাগল। শুধু ভালোই নয়, কেমন যেন গা শিরশির করে উঠল ওর। সে অনুভূতিটা যে কেমন তা শুধু মেয়েরাই জানে; বোঝে। এই শিরশিরানি—তোলা একান্ত মেয়েলি অনুভূতি কোনো পুরুষের পক্ষে কখনও বোঝা সম্ভব নয়।

অনেকক্ষণ পরে যেন ঘোর কাটার পর মহুয়া বলল, নমস্কার। তারপর একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, আমার নাম মহুয়া।

সুখন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। কী বলবে ভেবে পেল না। সুখন জীবনে এই প্রথমবার অপ্রতিভ বোধ করল। ও যে এমন ক্যাবলা হয়ে যেতে পারে তা কখনও জানেনি আগে; বিশ্বাস করেনি।

সুখন নীচু গলায় প্রায় স্বগতোক্তির মতোই বলল, এখন তো বসন্তের দিন। এই—ই তো সময় মহুয়ার। গন্ধ পাচ্ছেন না বাতাসে?

আপনি?

মহুয়া জবাব না দিয়ে উলটে প্রশ্ন করে দু’চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে সুখনের দিকে তাকাল।

সুখন বলল, পাচ্ছি। সবসময়ই পাই। মহুয়ার আমি ভীষণ ভক্ত—মহুয়া ফুলের।

আর মহুয়ার মদের না?—বলেই মহুয়া হেসে উঠল।

সুখনও হাসল।

সুখনের হাসি মিলানোর আগেই মহুয়া বলল, আমি কিন্তু মদও নই, ফুলও নই। শুধুই মহুয়া।

সুখন পাশ ফিরে একটা রেঞ্জ হাতে নিয়ে বলল, মদ খাই না তা নয়; আমরা মিস্ত্রি মজুর লোক। তবে মদের চেয়ে ফুলই ভালো লাগে আমার।

পরক্ষণেই রক্ষীহীন একজন অপরিচিতা সুন্দরী ভদ্রমহিলার সঙ্গে মোটর মেকানিকের এতখানি অন্তরঙ্গতা ঠিক হচ্ছে কী না ভেবে নিয়েই সুখন গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, আপনি রাগ করলেন তো? আমি—কোথায় কী কথা বলতে হয় ঠিক জানি না। দোষ করে থাকলে মাফ করে দেবেন।

মহুয়া কথার জবাব না দিয়ে বারান্দায় একটা কাঠের বাক্সে অনেকগুলো গোল গোল চকচকে বল—বেয়ারিং পড়েছিল, সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমি একটা নিতে পারি’?

নিন না। কিন্তু কী করবেন? অবাক হয়ে শুধোল সুখন।

কিছু না। এমনিই। স্টিলের তৈরি না? দেখতে একেবারে মার্বেলের মতো। আচ্ছা, আমি কি দুটো নিতে পারি?

নিন না, আপনার যতগুলো ইচ্ছে নিন। বলেই হেসে ফেলল সুখন।

মহুয়া দুটো গোলাকৃতি বল তুলতে তুলতে বলল, আপনি খুব দিলদরাজ লোক তো!

কথার জবাব দিল না সুখন।

সুখন মনে মনে একটু ভয় পেতে আরম্ভ করেছে।

কুমার ভদ্রলোককে ওর মোটেই ভালো লাগেনি। টিপিক্যাল শহুরে, চালিয়াৎ। ক্লাশ—কনশাস। এ—লোকগুলোই দেশের অন্য ভালো লোকগুলোরও সর্বনাশ করে দিল। কুমার কতখানি উদার সে সম্বন্ধে সুখনের সন্দেহ ছিল। মহুয়াকে সুখনের সঙ্গে একা দেখে যদি সুখনকে কিছু বলে সে আকার—ইঙ্গিতেও, তাহলে সুখন কিন্তু ঘুষি—টুষি মেরে দেবে। যেদিন ভদ্রলোক ছিল, ছিল। আজ আর সে ভদ্রলোক নেই। ভদ্রলোকদের কারও কাছেই সে ভদ্রলোকি পায় না; হয়তো আজ চায়ও না। তাই ছোটলোকি কায়দায় কথায় কথায় ঘুষি চালাতেও ওর আজকাল একটুও দেরি হয় না। সহ্যশক্তি পরিণামজ্ঞান, সভ্যতা—জ্ঞান ওর আর নেই বললেই চলে। ও নিজেকে আর ভদ্রলোক ভাবে না। ভদ্রলোক হবার ইচ্ছাও আর ওর নেই।

সুখন এড়িয়ে গিয়ে বলল, আমি হলাম একজন সামান্য মিস্ত্রি। দরাজ দিল থাকলেও বা তা দেখাবার সামর্থ্য কোথায়?

তারপর কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, আপনি চা—টা খেয়েছেন?

খেয়েছি।—মহুয়া বলল।

তারপর বলল, আপনি চা খাবেন না? সকালে কি চা খেয়েছেন? আমি নিয়ে আসব? শুনলাম, চা আর জর্দা—পানই নাকি আপনার প্রধান খাদ্য—পানীয়?

সুখন অবাক হল; বলল, কে বলল? মংলু বুঝি?

বললেন না তো চা খাবেন কিনা? মহুয়া বলল।

না, না, থাক আপনি মাথা ঘামাবেন না। একটু পরে মংলুই নিয়ে আসবে। ও জানে। একবার তো খেয়েছি।

আহা, আজ না হয় আমিই আনলাম? আমাদের গাড়ি সারাচ্ছেন এত কষ্ট করে গালে কালি লাগিয়ে—আমি…।

ওকে থামিয়ে গিয়ে সুখন বলল, কষ্ট কী! এ তো আমার কাজ। এই তো রুজি। কাজ হয়ে গেলে টাকা দেবেন না বুঝি? টাকাও দেবেন—আবার এত ভালো ব্যবহারও করবেন, এটা ঠিক নিয়ম হচ্ছে না।

মহুয়া বলল, ওসব কথা আমার সঙ্গে নয়। এটা কুমারবাবুর গাড়ি। এ ব্যাপারটা তাঁর। আমি জাস্ট প্যাসেঞ্জার।

একটু থেমে মহুয়া আবার বলল, কি? খাবেন কিনা বলুন? নাকি আমার হাতে খাবেন না? আমি কিন্তু ব্রাহ্মণের মেয়ে। বাবার পদবি যখন সান্ন্যাল! বোঝা উচিত ছিল!

সর্বনাশ করেছে। আপনারা বারেন্দ্র নাকি? আমার তো খেয়ালই হয়নি! বলেই হেসে ফেলল সুখন।

মহুয়াও হেসে উঠল হোঃ হোঃ হোঃ করে। বলল, ‘আমাদের এত গুণ যে পুরো বাংলাদেশের লোক আমাদের এঁটে উঠতে পারল না বলেই মেনেও নিতে পারল না—তাই—ই তো সকলে পিছনে লাগে।’

শুধু গুণ কেন? রূপও আছে।—সুখন বলল।

কথাটা বলেই সুখন মুখ নামিয়ে নিল। নিজেই লজ্জা পেল বলে ফেলে।

মহুয়াও উচ্ছলতার মধ্যে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর চটির মধ্যে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল, আহা! কী রূপ!

নিমগাছের মগডালে হঠাৎই কাকেদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। ওরা উড়ে—উড়ে ঘুরে—ঘুরে, কা—খবা—কা—খবা—খবা—কা করে ভোরের সমস্ত শান্তি, নির্লিপ্তি, সমস্ত আমেজটুকু নষ্ট করে দিল।

মহুয়া আর সুখন দুজনেই একই সঙ্গে নিমগাছের দিকে তাকাল। দেখল একটা ছিপছিপে মেয়ে—কাককে নিয়ে দুটো কর্কশ পুরুষ কাকের মধ্যে ভীষণ লড়াই বেঁধেছে। আর সমবেত কাকমণ্ডলী দু’ দলে ভাগ হয়ে গিয়ে দুই লড়িয়েকে চিৎকার করে মদত দিচ্ছে।

সুখন একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল উপরে। মুহূর্তের মধ্যে সব কাক নিমগাছ ছেড়ে উড়ে চলে গেল। কিন্তু রয়ে গেল শুধু সেই মেয়ে—কাকটা। ও নড়ল না। ডালে বসে মসৃণ ছাই—ছাই গ্রীবা বেঁকিয়ে লাল পুঁতির মতো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার এ—কোটরে আরেকবার ও—কোটরে এসে কত কী ভাবতে লাগল।

কিছুক্ষণ উপরে তাকিয়ে থেকে সুখন স্বগতোক্তির মতো বলল, এবার আপনি বাড়ি যান। মিস্ত্রি—টিস্ত্রিরা এক্ষুনি এসে পড়বে। চিৎকার, চেঁচামেচি, আওয়াজ, গালিগালাজ—এর মধ্যে থাকতে নেই। গিয়ে ভালো করে চান—টান করে নাস্তা করুন। বেলা হলে কুয়োর জল গরম হয়ে যাবে। মংলুকে বলবেন আরও জল লাগলে কুয়ো থেকে বাথরুমে এনে দেবে।

মহুয়া কপট রাগের গলায় বলল, আপনি তাহলে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?

সুখন বলল, আপনি আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করলে গাড়ি সারাতেই আমার দেরি হবে। কারিগরিটা এখনও রপ্ত হয়নি যে।

তারপর একটু থেমে বলল, আপনারা তো বেতলা যাবেন; তাই না? বেতলা যাবার জন্যেই তো কলকাতা থেকে বেরিয়েছেন। এইখানে দেরি ও কষ্ট করবার জন্যে তো আসেননি। প্লিজ যান। আরাম করুন গিয়ে।

ফিরে আসতে আসতে ও মনে মনে বলছিল যে, এত তাড়া কেন তোমার আমাকে তাড়াবার? চলে তো আমরা যাবই। থাকার জন্যে ত’ আসিনি। তবু, গাড়িটা এক্ষুনি না—সারালেই কী নয়? গাড়ি সারাতে সময়ও তো লাগতে পারত।

মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট, একটা প্রচ্ছন্ন অভিমান, অস্বস্তিকর এক অপমানবোধ নিয়ে মহুয়া ধীর পায়ে ফিরে এল ডেরায়। ওরা তখনও ঘুমোচ্ছিলেন।

ডেরাটা চুপচাপ। মংলু বারান্দায় বসে তরকারি কাটছিল।

বারান্দায় একটা ঠান্ডা ভাব। ঝিরঝির করে প্রভাতি হাওয়া বইছে।

মহুয়াকে আসতে দেখে হঠাৎ মংলু বলল, দিদিমণি, ওস্তাদের ঘর দেখবে?

কী হবে?

উদাসীনতার গলায় বলল মহুয়া। মনে মনে বলল, লাভ কী অপরিচিত লোকের ঘর দেখে? পরক্ষণেই পরম অনিচ্ছা—সহকারে বলল, আচ্ছা চলো দেখি।

কিন্তু সুখন মিস্ত্রির ঘরে মংলুর সঙ্গে ঢুকেই মহুয়া অবাক হয়ে গেল।

বইয়ে—বইয়ে ভরা ঘরটা। সব জায়গায় বই। ইংরিজি বাংলা মেশানো। থ্রিলার—টিলার নয়, রীতিমতো সাহিত্যের বই। বিছানার মাথার কাছে বই, পায়ের কাছে বই, কোল—বালিশ করে রাখার মতো করে রাখা, দু’ পাশেই বই—জানালার তাক, মেঝে, কিছুই প্রায় বাকি নেই।

চৌপাই—এর মাথার কাছে একটা টুল। টুলের উপর একটা দিশি মদের খালি বোতলে খাবার জল—আধা ভর্তি। তার পাশে একটা ডট পেন এবং একটা মোটা খাতা।

ঘরে আর কিছুই নেই। আয়না নেই, ড্রেসিং টেবল নেই, আলমারি নেই। কাঠের খুঁটিতে পেরেক মেরে তাতে ঝোলানো আছে একটা নীলরঙা তালি—মারা কিন্তু পরিষ্কার জিনের প্যান্ট, হাতাওয়ালা টেনিস খেলার গেঞ্জির মতো গেঞ্জি। পায়জামা, দেহাতি খদ্দরের মোটা পাঞ্জাবি, একজোড়া কাবলি জুতো ঘরের কোণায়। ব্যস—স, আর কিছুই না।

মংলু ঘর ছেড়ে চলে যেতেই মহুয়া টুলটার দিকে এগিয়ে গেল। লন্ঠনটা তখনও জ্বলছিল। পলতেটা কমিয়ে, নিবিয়ে দিল সেটাকে। তারপর অন্যমনস্কভাবে টুলের উপর রাখা খাতাটা তুলে নিল।

সেই লেখার খাতার প্রথম পাতাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা আছে সুখরঞ্জন বসু, ফুলটুলিয়া, গুঞ্জা, জেলা—পালামৌ। তারপর লেখা আছে, ”রোজকার কথা—হিজিবিজি”।

প্রথম পাতা খুলতেই অবাক হয়ে গেল মহুয়া। ও নিজে সাহিত্য ব্যাপারটা ভালোবেসেই পড়েছে। কিছু যা—হয় একটা পড়তে হয় বলে পড়েনি। তাই ডাইরিগোছের খাতাটা দেখে ওর ঔৎসুক্যটা স্বাভাবিক ছিল। এই ঘরে, এমন হাতের লেখায় এমন ডাইরি দেখবে, ও আশা করেনি। ও ভাবল যে, তাহলে ও ভুল করেনি। কাল রাতের মুখটি, সেই গভীর গলার স্বরের মানুষটি, যে তার সমস্ত সত্তাকে শুধু চোখ—চাওয়াতেই, শুধু কণ্ঠস্বরেই অমন করে নাড়া দিয়েছে—তার মধ্যে কিছু একটা অসাধারণত্ব নিশ্চয়ই আছে। মিস্ত্রির পরিচয়টা যেন তাকে মানায় না।

২৯শে জুন, ‘৭৪

ফুলটুলিয়া

আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন হয় বড়—লোকদের, যাদের পয়সা আছে। আর সেই সব বড়—লোকদের, যাদের যশ আছে। আমি দুখন মিস্ত্রির ভাই সুখন মিস্ত্রি—আমার আবার জন্মদিন!

যখন ছোট ছিলাম, মনে আছে, ছোট পিসিমা আসতেন কোডারমা থেকে ওই সময়। আমার জন্মদিন উপলক্ষে নয়—আসতেন ঠাকুরমাকে দেখতে। প্রতি বছর দু’টাকা করে হাতে ধরে দিতেন। বকশিবাজারে গিয়ে মাধুবাবুর বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা বই কিনতাম—নিজের ছেলেমানুষি কাঁচা হাতের লেখায় লিখতাম—”আমার জন্মদিনে আমাকে দিলাম।”—

ইতি সুখরঞ্জন।

কত কী ভেবেছিলাম। ছোটবেলায় কত কী স্বপ্ন দেখেছিলাম। এই করব, সেই করব; এই হবো সেই হবো।

আর কী হলাম! কী হলাম; মানে মোটর মেকানিক হয়েছি বলে কোনো দুঃখ নেই। আমি কারও কাছে হাত পেতে খাই না, ভিক্ষা করি না। কারও দয়ার অন্ন নিই না—ভালো খাই, মন্দ খাই—খেটে খাই। ঘামের ভাত খাই এতে লজ্জা নেই। কে কী করে সেটা অবান্তর। কোনো কিছু করার মধ্যেই কোনো গ্লানি নেই—গ্লানিটা বরং কিছুই না—করার মধ্যে। ছোটলোকির কাজ না করে যারা ভদ্রলোকি কেতায় হাত পাতে, পরের ঘাড়ে স্বর্ণলতার মতো ঝুলে থাকে—তারা মানুষ নয়। সে বাবদে আমি মানুষ। এ জীবনে কারও বোঝা হইনি আমি। কারও বোঝাও নিইনি অবশ্য।—এক বউদি আর শান্তুর দায়িত্ব ছাড়া। সে দায়িত্বকে আমি বোঝা বলে মনে করি না। দাদা মারা গেলেন। এই মিস্ত্রিগিরি করেই আমাকে কোনোভাবে ঋণ শোধের সুযোগ না দিয়েই নিজের জীবনটা প্রায় অবহেলায় নষ্ট করেই তো দাদা মারা গেলেন!

আজ আমার একটাই আনন্দ। দাদা হয়তো বুঝতে পারেন, জানতে পারেন যে, ভাইটা তার অমানুষ হয়নি। বাংলায় এম—এ পাস করার পর একটুও দ্বিধা না করে দাদার হঠাৎ—মৃত্যুর পর দাদার কারখানার ভার সহজে গ্রহণ করেছিলাম। মনে হয় যে, দাদার আত্মা এ কথা জেনে শান্তি পান।

দুঃখটা এই কারণে যে, চিরদিন এই কারখানা আঁকড়েই পড়ে থাকতে হবে—শান্তুটা যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়ায়। সে তো অনেক বছর। বউদিকে যতদিন না তাঁর স্বাবলম্বনের মতো কিছু করে দিতে পারি—ততদিন আমার ছুটি নেই। পড়াশুনা করতে পারি না, লিখতে পারি না এক লাইন। গাড়ির মিস্ত্রি হয়ে কী কখনও লেখা যায়? দুঃখ এইটুকুই রয়ে গেল এ—জীবনে। এ জীবনে আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে কখনও ভাবিনি।

সুখন মিস্ত্রির জীবনে জন্মদিনের কোনো দাম নেই। তার জন্মদিন কেউ মনে রাখেনি কখনও; সে নিজেও না। যার জন্ম একটা জৈবিক বা যৌন দুর্ঘটনা—তার জন্মদিন আবার পালন করার কি? তাছাড়া পালন করেই বা কে? নিমগাছের ঝরা পাতার মতো প্রতি বছর এই উত্তর—তিরিশের গাছ থেকে অনেক পাতা ঝরে যায়। এখানে শুধুই লাল—টাগরা দেখানো ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত কাকেদের বাস—ঝরা পাতার দীর্ঘশ্বাস। ঘুমভাঙা—কাজ করা—ঘুম পাওয়া—ঘুম ভাঙা। এ—জীবনে কখনও কোনো কোকিল আসেনি, আসবেও না। যতদিন না সব পাতা ঝরে, সব সাধ বাসি ফুলের মালার মতো না শুকোয়, ততদিন শুধুই প্রশ্বাস নেওয়া ও নিশ্বাস ফেলা! সুখন মিস্ত্রির সব জন্মদিনের গন্তব্যই এক। তারা একই দিকে গড়িয়ে যাবে—তার মৃত্যুদিনে।

মহুয়া অনেকক্ষণ চুপ করে সেই ঘরে দাঁড়িয়ে রইল ডাইরিটা হাতে করে। এই ফাটা—ফুটো গ্যারেজ—বাড়িতে যে তার জন্যে এতবড় একটা বিস্ময় লুকোনো ছিল, তা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

সেই স্বল্প—পরিচিত পুরুষের শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে তার বুকের মধ্যে ধড়াস—ধড়াস করতে লাগল। সে কী আনন্দে, বিস্ময়ে, ভয়ে না বেদনায় তা বোঝার মতো ক্ষমতা মহুয়ার ছিল না।

তাড়াতাড়ি কাঁপা—কাঁপা হাতে ও পাতা উলটে যেতে লাগল—ওর মন যেন কী বলতে লাগল ওকে—ওকে যেন কী এক নীরব ইঙ্গিত দিতে থাকল।

দ্রুত মহুয়ার সুন্দর আঙুলগুলি এসে থেমে গেল ডাইরির একেবারে শেষে।

মহুয়া উত্তেজনায় স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর হৃৎপিণ্ড যেন বন্ধ হয়ে গেল।

২৪।৩।৭৫

এত সৌভাগ্যও কী সুখন মিস্ত্রির ছিল?

যাকে সে জীবনে চোখে দেখেনি অথচ আকৈশোর স্বপ্নে দেখেছিল, যার সঙ্গে আলাপ হয়নি অথচ মনে মনে যে ভীষণ আপন ছিল, যে পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের সংজ্ঞা, যে সুরুচির শান্ত স্নিগ্ধ প্রতিমূর্তি, যে নারী—সুলভতার সেই চিরন্তন সান্ত্বনাদাত্রী গাছের নিবিড় নরম নিভৃত ছায়া—সে কিনা এমন করে ঝড়ের ফুলের মতো উড়ে এল! উড়ে এল সুখেন মিস্ত্রির ভাঙা ঘরে!

এল যদিও, কিন্তু ক্ষণতরে এল; চলেও যাবে ক্ষণপরে।

হায় রে সুখন! তোর সাধ্যি কী একে আদর করিস; একে যত্ন করিস। এ কোকিল সুখন মিস্ত্রির দাঁড়ে বসার জন্যে জন্মায়নি। দু’ দণ্ডের জন্যেও না। তোর জন্যে নিমগাছভরা দাঁড়কাক। দিনভর, জীবনভর কা—খব—খবা—কা।

আমি জানি, তুমি ক্ষণিকের অতিথি। তুমি তোমার বড়লোক প্লে—বয় বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে, বয়স্ক বাবার সঙ্গে, ক’দিনের জন্যে মজা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। গাড়ি খারাপ হওয়াতে, এই মোটর মেকানিকের ডেরায় এসে রাত কাটালে—কত কষ্ট হল তোমার। গাড়ি সারা হলে কতকগুলো টাকা মিস্ত্রির মুখে ছুঁড়ে দিয়ে তোমরা চলে যাবে।

জানি, সব জানি। তবু সুখন, বড় কষ্ট পেলি রে সুখন, বড় কষ্ট পাবি। পৃথিবীটা এ—রকমই। বাঘবন্দির ঘর। সে ঘরে সুখন শুধুই মোটর মিস্ত্রি। সুখনের মনের ঘরে, কী টালির ঘরে—কোনো ঘরেই জায়গা নেই মহুয়ার।

তোমাকে জানাবার সুযোগও আসবে না কখনও যে, তোমাকে আমি কী চোখে দেখেছি। তাছাড়া, জানিয়ে লাভই বা কী? নিজেকে ছোট করা, অপমানিত করা ছাড়া আর তো কিছুই পাওনা নেই আমার তোমার কাছে!

তুমি যে মহুয়া! আর আমি যে হতভাগা সুখন।

তবু, বাঃ মহুয়া! তুমি কী সুন্দর মহুয়া। তুমি কী সুন্দর! তোমার মতো এত সুন্দর আর কিছুই আমি এ—জীবনে দেখিনি। কখনও বুঝি দেখবও না। দুঃখ এইটুকুই যে, তোমাকে কখনও আপন করে পাওয়া হবে না।

আরাম করে পাশের ঘরে ঘুমোও। তোমার একটু কষ্ট হবে। একটা রাত, একটা বেলা। বিশ্বাস করো—এ কথাটা—আজ আমার বড় আনন্দ। কত যে আনন্দ, তা তুমি কখনও জানতে পাবে না। ঘুমিয়ে থাকো। সোনা—মেয়ে।

ডাইরিটা এবার নামিয়ে রাখতে পারলে বাঁচে মহুয়া।

ওর সারা শরীর যেন অবশ হয়ে এল। বুকটা উঠতে—নামতে লাগল। বারান্দায় বেরিয়ে এসে মহুয়া ডাকল, মংলু, আমাকে একটু জল খাওয়াও না। শিগগিরি।

বড় পিপাসা পেয়েছে মহুয়ার। এত পিপাসার্ত ওর সাতাশ বছরের জীবনে আর কখনোই বোধ করেনি ও আগে।

মংলু জল এনে দিল। জল খেয়ে মহুয়া আবারও বাইরে গিয়ে কারখানার পাশের গাছগাছালিভরা মাঠে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল।

মাঠটা থেকে কাজে—ডুবে—থাকা সুখনকে দেখতে পাচ্ছিল মহুয়া। পুরুষ মানুষদের কর্মরত অবস্থায় যতখানি সুন্দর দেখায়, তত সুন্দর বোধহয় আর কখনোই দেখায় না—মনে হল মহুয়ার।

পায়চারি করতে করতে মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে থাকা সুখনের দিকে আড় চোখে চেয়ে মহুয়ার হঠাৎ মনে হল, কাউকেই এমন চুরি করে দেখেনি ও এর আগে। কাউকে শুধু চোখের দেখা দেখেও যে এত সুখ, তা ও কোনোদিনও জানত না।

আশ্চর্য! মহুয়া ভাবল, এখনও ও কতকিছুই জানে না; বোঝে না। কতরকম অননুভূত অনুভূতিই না আছে! অথচ কাল এখানে আসার আগে অবধিও ও দুর্মরভাবে বিশ্বাস করত যে ও নিজে মোটামুটি সর্বজ্ঞ।

সান্যাল সাহেব জেগেছিলেন একটু আগে। কুমার তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

বালিশের তলা থেকে বের করে হাতঘড়িটা দেখলেন, সাড়ে আটটা বেজে গেছে। লজ্জিত হলেন তিনি। পরের বাড়িতে এরকম যখন—খুশি ওঠা, যখন—খুশি খাওয়া যায় না। ধড়মড়িয়ে চৌপায়াতে উঠে বসলেন।

ডাকলেন, কুমার, ও কুমার!

অনেকক্ষণ ডাকার পর কুমার সাড়া দিল।

কুমার উঠলে বাইরে এলেন দুজনে। এসে মুখ—হাত ধুয়ে বারান্দায় বসলেন মংলুর দেওয়া চা নিয়ে।

দূরে মেঘ—মেঘ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের পর পাহাড়। কাছেপিঠেই টিলা আছে অনেক। ঝাটি জঙ্গল;পিটিসের ঝোপ। মাঝে মাঝেই ভরর—র আওয়াজ করে ছাতারে আর দু’একটা তিতির ওড়াউড়ি করছে। দূর থেকে কালি—তিতির ডাকছে তুররর—তিতি—তিতি—তুররর। সান্যাল সাহেব সকালের আলোয় চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন যে, বড় বড় গাছের মধ্যে বেশিই শাল। সাদা সাদা ফুল ধরেছে তাতে থোকা—থোকা। বারান্দায় বসে সামনে প্রায় আধ মাইল খোয়াইয়ে—ভরা লালমাটি, লালফুলে—ছাওয়া টাঁড় দেখা যাচ্ছে। তারপর পাহাড়।

কুমার বলল, বি—উটিফুল কান্ট্রি। কিন্তু ওই লাল লাল ফুলগুলো কী সান্যাল সাহেব? চতুর্দিকে কার্ল মার্কস—এর বাণী ছড়াচ্ছে?

সান্যাল সাহেবের মুখে মৃদু হাসি ফুটল। বললেন, তোমরা সব শহুরে ছেলে। মাটির সঙ্গে তো যোগ নেই। এসব জানবে কী করে? আমার ছোটবেলা কেটেছে দেওঘরে, বুঝলে? তখন দেওঘর একটা ছোট্ট শান্ত জায়গা ছিল। ছোটবেলার কথা বড় মনে পড়ে।

লাল ফুলগুলো কী?—অসহিষ্ণু গলায় বলল কুমার।

মনে মনে বলল, বুড়োগুলোর এই দোষ। কথায় কথায় এমন রেমিনিসেন্ট মুডে চলে যান যে, কথা বলাই মুশকিল। শুধোলাম লাল ফুল, এনে ফেললেন ছোটবেলা; দেওঘর। সময়ের যেন মা—বাবা নেই।

সান্যাল সাহেব বললেন, পলাশ, শিমুল, অশোক সবের রঙই লাল। তবে যেগুলো দেখছ, এগুলোর বেশিরভাগই পলাশ। পলাশ জংলি গাছ—বিনা যত্নে বিনা আড়ম্বরে জঙ্গলে পথে—ঘাটে সব জায়গায় ওরা বেড়ে ওঠে।

এমন সময় মহুয়াকে আসতে দেখা গেল।

কুমার লক্ষ করল মহুয়ার চোখে—মুখে একটা খুশি উপছে পড়ছে। অথচ ও উলটোটাই হলে আনন্দিত হত। কোথায় ওরা এতক্ষণে বেতলাতে ডানলোপিলো সাজানো গিজার—লাগানো ওয়েল—ফার্নিশড ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে ছিমছাম ট্রে—তে বসানো টি—পট থেকে ঢেলে চা খেতে—খেতে হরিণ দেখত, তা নয়—এই টালির ছাদের নীচে, ছারপোকা—ভরা মোড়ায় বসে, কেলে—কুৎসিত কাচের গেলাসে বিচ্ছিরি চা খাচ্ছে। মহুয়া যে রকম ফাসসী মেয়ে,—ফাসসী বলেই তো জানে কুমার; তাতে এইরকম পরিবেশে তার খুশি হবার তো কোনোই কারণ নেই।

কুমার মনে মনে বলল, ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করতে হচ্ছে। মহুয়ার এত খুশি, খুশবু; হঠাৎ! কোত্থেকে?

মহুয়া সিঁড়ি অবধি আসতেই সান্যাল সাহেব শুধোলেন, কোথায় গেছিলি মা?

কারখানা ঘুরে এলাম। গাড়ির কাজ হচ্ছে। উনি বললেন, বিকেলের আগে হবে না।

অ্যাই মরেছে! কোথায় ভাবলাম বেতলায় বসে চান—টান করে একটু বিয়ার খাব। দুসস।—কুমার বলল।

মহুয়া কথা ঘুরিয়ে সান্যাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার জলখাবার খাবে তো? মংলু একা পারবে না। আমি গিয়ে একটু সাহায্য করি।

কুমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আরে বোসো বোসো। কী আমার ইংলিশ ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে যে পারবে না ছোকরা? যা পিণ্ডি বানিয়ে দেবে তাই—ই খাব।

তারপরই বলল, বুঝলেন সান্যাল সাহেব, যেবার কন্টিনেন্টে যাই—কী কেলেঙ্কারি! ব্রেকফাস্ট মানে কী জানেন? ব্রেড—রোলস আর কফি অথবা চা। টেবিলের উপর মাখন আর জ্যাম বা মার্মালেড রাখা আছে। লাগিয়ে খাও। আর চা বা কফি সঙ্গে। সত্যি! ব্রেকফাস্ট খেতে জানে ইংরেজরা।

স্কচরা আরও ভালো জানে, সান্যাল সাহেব বললেন।

আপনি কী ছিলেন নাকি ওদিকে?

খুব অবাক হয়ে গলা নামিয়ে কুমার শুধোল। ভাবল, অফিসে তো কখনও শোনেনি যে এই বৃদ্ধ ভাম বাইরে ছিলেন কখনও।

সান্যাল সাহেব হাসলেন। বললেন, পাঁচ বছর ছিলাম ইংল্যান্ডে, ছ’বছর সুইটজারল্যান্ডে। তুমি তখন পাড়ার গলিতে গুলি অথবা ড্যাংগুলি খেলছ।

কুমার মোড়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, ওঃ বয়! আপনি এত বছর বিদেশে থেকে এসেও এখনও লুঙি পরেন?

সান্যাল সাহেব হেসে উঠলেন। বললেন, তাতে কী হয়েছে? লুঙি পরতে ভালো লাগে, তাই—ই পরি। এটা তো ইন্ডিভিজুয়াল রুচির ব্যাপার। আমি লুঙি পরতে ভালোবাসি তাই পরি, তুমি পায়জামা পরতে ভালোবাসো তাই পরো, কেউ—কেউ তো বাড়িতে ধুতিও পরেন। লুঙি পরার সঙ্গে বিদেশে থাকার কী সম্পর্ক?

না, মানে কেমন প্রিমিটিভ—প্রিমিটিভ লাগে—কুমার বলল।

সান্যাল সাহেব পাইপের পোড়া তামাক ঝেড়ে ফেলে বললেন, আমরা কী সত্যিই প্রিমিটিভ নই? আমি তুমি এ দেশের ক’জন? ক’ পার্সেন্ট? আমরা দেশের কেউই নই, কিছুই নই। শহর ছেড়ে গ্রামে এসেছ, চোখ—কান খুলে দেখো, শোনো,—অনেক কিছু জানবে, শুনবে।

কুমার চুপ করে থাকল। ওর চোখে অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ল। মনে মনে বলল, বুড়োগুলোকে নিয়ে এই বিপদ। কথায়—কথায় এত জ্ঞান দেয় না! ভাবখানা যেন, জ্ঞান দেওয়ার টাইম চলে যাচ্ছে—এইবেলা না দিলে কখন কে ফুটে যায় কে জানে!

সান্যাল সাহেব হঠাৎই শুধোলেন, তুমি কতদিন বিদেশে ছিলে?

কুমার অপ্রতিভ হল। বলল, সবসুদ্ধ বারো দিন।

তারপর সুবোধ্য কারণে কুমার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

একটু পরে মংলুকে সঙ্গে করে মহুয়া জলখাবার নিয়ে এল। মেটে—চচ্চড়ি, ওমলেট, আলু—কুমড়ো—পেঁয়াজ—কাঁচা লংকা দিয়ে একটা গা—মাখা তরকারি আর গরম—গরম পরোটা। সঙ্গে প্যাঁড়া।

সান্যাল সাহেব মংলুর দিকে সপ্রশংস চোখে বললেন, করেছ কী মংলু? এ যে বেজায় আয়োজন?

মংলু খুশি—খুশি গলায় বলল, ওস্তাদ বলেছে আপনাদের কোনো কষ্ট হলে আমার চাকরি থাকবে না। তারপরই এক নিশ্বাসে বলল, মেটে—চচ্চড়ি দিদিমণির করা।

কুমার বলল, একজন মোটর মেকানিকের ঘাড়ে এত অত্যাচার করাটা ঠিক হচ্ছে না। দিস ইজ আনফেয়ার। যাকগে, যাওয়ার সময় মেরামতের বিল ছাড়াও ভালো মতো টিপস দিয়ে যাব। নাথিং ইজ অ্যাজ এলোকোয়েন্ট অ্যাজ মানি। টিপস দিয়ে খুশি করে দেব সুখন মিস্ত্রিকে।

কুমারের কথাটা শেষ হতে না হতেই সুখন এসে দাঁড়াল সিঁড়ির কাছে, প্রায় নিঃশব্দ পায়ে।

মহুয়া পিছন ফিরে ছিল—দেখেনি।

হঠাৎ সুখনের গলা পেয়ে ফিরে দাঁড়াল।

সুখন বলল, গাড়ির একটা কাটিং শ্যাফট লাগবে। আর যা যা দরকার তার সবই আমার কাছে আছে। ফুয়েল ইনজেকশান পাম্পে গোলমাল আছে। কারবোরেটারে ভীষণ ময়লা জমেছে। এই—ই সব, আমার কাছে নেই। গুঞ্জা বস্তিতে যে দোকান আছে, তাতেও পাওয়া যাবে না। পাওয়া যেতে পারে একমাত্র রাঁচীতে। লোক পাঠিয়ে রাঁচী কিংবা ডালটনগঞ্জ থেকে আনাতে হবে। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেছে যে, আজ সকাল থেকে বাস—স্ট্রাইক। কাল মান্দারের কাছে এক বাসের ড্রাইভারকে খুব মারধোর করে লোকেরা—তাই আজ এ—রুটে সকাল থেকে বাস বন্ধ। অথচ ওটা না হলে ও গাড়ির কিছুই করা যাবে না। কলকাতা থেকে বেরুনোর আগে গাড়িটা দেখিয়ে বেরুনো উচিত ছিল। পথের যে—কোনো জায়গাতেই ভেঙে যেতে পারত। গাড়ি হাই—স্পিডে থাকলে সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্টও হতে পারত। এ—রকম অবস্থায় এ—গাড়ি নিয়ে বেরুনোটাই আপনাদের অন্যায় হয়েছে।

কুমারের মুখে পরোটা ছিল। গবগবে গলায় বলল, থামো মিস্ত্রি, থামো। তোমার কাছ থেকে দায়িত্বজ্ঞান শিখতে হবে না আমার। এ—রকম কারখানা রাখো কেন? আমরা এসেছি কাল রাতে, এখন বাজে সকাল ন’টা—এখন বলছ যে, গাড়ি সারানো যাবে না। এতক্ষণ কী ঘাস কাটছিলে? না, নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলে?

সান্যাল সাহেব ও মহুয়া একই সঙ্গে কুমারের দিকে চাইলেন।

কুমার কেয়ার না করে বলল, বলো, তোমার কী বক্তব্য আছে? বলো, মিস্ত্রি।

সুখন অবাক চোখে কুমারের দিকে তাকিয়েছিল। ভুরু দুটো কুঁচকে উঠেছিল। অনেকক্ষণ কুমারের দিকে তাকিয়ে থেকে সুখন ধীর গলায় বলল, আমার কিছু বলার নেই।

কুমার বলল, তোমার পঙ্খিরাজ গাড়ি নিয়েও তো যেতে পারতে রাঁচী—এতক্ষণে তো পার্টস নিয়ে আসা যেত।

মংলু মধ্যে পড়ে রাগ রাগ গলায় বলল, ও গাড়ি গুঞ্জা বস্তি অবধি যায়—তাও অতি কষ্টে।

সুখন এক ধমক দিয়ে মংলুকে চুপ করিয়ে দিল।

কুমার বলল, গুঞ্জায় তো যাবেই। মদ আনবার জন্য যেতে পারে, আর আমাদের গাড়ির পার্টস আনার জন্যে রাঁচী যাওয়া যায় না?

কুমার আবার বলল, বাস স্ট্রাইক তো ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে মাল আনালে না কেন? আমরা কী ফালতু লোক? কত টাকা চাই তোমার? টাকা নিয়ে যাও যত চাও, কিন্তু গাড়ি তাড়াতাড়ি ঠিক করে দাও।

সুখন শান্ত গলায় বলল, আমি কিন্তু আপনাকে বরাবর আপনি করেই কথা বলছি সম্মানের সঙ্গে।

কুমার বলল, বলবে বইকি। সম্মানের জনকে সম্মান দেবে না! তুমিও কী আমাকে তুমি বলতে চাও নাকি?

সান্যাল সাহেব সুখনের চোখে প্রলয়ের পূর্বাভাস দেখে থাকবেন। তিনি তাড়াতাড়ি করে কুমারকে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরের দিকে।

কুমার ঘরে না গিয়ে, বাইরে বেরিয়ে চলে গেল। বলল, আমি জায়গাটা সার্ভে করে আসছি।

কুমার চলে যেতে সান্যাল সাহেব কুমারের অভদ্র ব্যবহারের পাপক্ষালন করে নরম গলায় বললেন, তার মানে, কাল সকালে লোক পাঠিয়ে বিকেলে নিয়ে আসতে পারবেন তো? এই তো বলতে চাইছেন আপনি? নিয়ে আসার পর কতক্ষণের মধ্যে গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে?

মনে হয়, দু—তিন ঘণ্টায়। সুখন বলল।

সুখন মুখ নীচু করে ছিল।

বেশ! বেশ! তাই—ই হবে। আমরা তো আর জলে পড়ে নেই। এমন সুন্দর পরিবেশ, এমন আদরযত্ন: ভালোই তো হল। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে।

তারপর সুখনের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবার জন্যে বললেন, আপনি কী বলেন?

সুখন প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ঠান্ডা, ভাবাবেগহীন গলায় বলল, তাহলে রাতেই আমার লোককে টাকাটা দিয়ে দেবেন, যাতে সকালের প্রথম বাসেই চলে যেতে পারে।

সান্যাল সাহেব বললেন, রাতে কেন? এক্ষুনি নিয়ে যান। কত টাকা?

সুখন বলল, এখন দেবেন না। নেশাভাঙ করে উড়িয়ে দিতে পারি। আমরা সব ছোটলোক; ভরসা কী? রাতেই দেবেন। তিনশো টাকা।

কথা ক’টি বলেই সুখন ফিরে, কারখানার দিকে পা বাড়াল।

মহুয়া ডাকল। বলল, শুনুন সুখনবাবু।

সুখন থেমে তাকাল।

মহুয়া বলল, আপনি খেয়ে যান। একটা তরকারি আমি নিজে রেঁধেছি।

সুখন হাত তুলে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বলল, ধন্যবাদ। অনেকদিন হল আমার সকালে খাওয়ার অভ্যেস চলে গেছে। আপনারা খান। আপনারা খেলেই আমার খাওয়া হবে।

তারপরই বলল, মংলু, এঁদের ভালো করে যত্ন করছিস তো? সকালের খাওয়া—দাওয়া হয়ে গেলে আমাকে একটু চা দিয়ে যাস কারখানায়।

সুখন চলে যেতে, মহুয়াও ওর নিজের খাবার নিয়ে মংলুর সঙ্গে রান্নাঘরে চলে গেল।

যাবার সময় মুখ নীচু করে সান্যাল সাহেবকে বলে গেল, বাবা তোমার কিছু লাগলে আমাকে ডেকো।

একটু পরই কুমার ফিরে এল। এসেই বলল, একটা ট্র্যাশ জায়গা। এমন ব্যাড লাক এবারে—যেমন জায়গা, তেমন মোটর মিস্ত্রি। কাল রাতে এলাম—এখন সকাল ন’টায় বলছেন যে গাড়ির কাটিং শ্যাফট ভেঙে গেছে।

সান্যাল সাহেব বললেন, আমরাও ন’টা অবধি ঘুমোচ্ছিলাম। দোষ তো আমাদেরও। তাছাড়া, তাড়া কীসের অত? এই—ই তো বেশ, আস্তে আস্তে যাওয়া—তোমার তো আর কনফারেন্স নেই বেতলার হাতি কী বাইসনদের সঙ্গে!

পরিবেশটাকে লঘু করবার জন্যে বললেন সান্যাল সাহেব।

কুমার বলল, না, আমার এইরকম পয়েন্টলেস ভাবে টাইম ওয়েস্ট করা একেবারেই বরদাস্ত নয়।

সান্যাল সাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, কুমার, তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। ভদ্রলোকের সঙ্গে এ—রকম ব্যবহার করলে কেন? মনে হয় উনি লেখাপড়াও জানেন—লেখাপড়া জানুন আর নাই জানুন, নিজে হাতে খেটে খান—সেটাই তো যথেষ্ট সম্মানের বিষয়—তোমার এই ব্যবহারের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না আমি।

কুমার বলল, আই অ্যাম সরি! কিন্তু প্রথম দেখা—থেকেই লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারিনি। জিনের প্যান্ট, ফ্রেডপেরি গেঞ্জি, মুখ—চোখের ভাব, তাকাবার কায়দা—লোকটার মধ্যে মডেস্টি বলতে কিছু নেই। এমন একটা ভাব যেন আমাদের সঙ্গে সমান—সমান ও। আই ওয়ান্টেড টু কাট হিম ডাউন টু হিজ ও—ওন সাইজ।

সান্যাল সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কুমারের দিকে।

বললেন, স্ট্রেঞ্জ!

তারপর বললেন, যাই—ই হোক, তোমার ব্যবহারের দায়িত্ব আমাদের উপরও বর্তেছে। কারণ তুমি আমাদের সঙ্গী। আমি তোমাকে প্লেইনলি বলব, তোমার এই নিষ্প্রয়োজনীয় অভদ্রতা আমি পুরোপুরি ডিস—অ্যাপ্রুভ করি। তুমি তাতে যাই—ই মনে করো না কেন।

কুমার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধত গলায় বলল, আমি একাই আমার দোষ—গুণের দায়িত্ব নিতে রাজি। কারও অ্যাপ্রুভাল বা ডিস—অ্যাপ্রুভালের তোয়াক্কা করি না আমি।

সান্যাল সাহেব বললেন, ভালো কথা। জানা রইল আমার।

এর পরেই পরিবেশে একটা ভারী নীরবতা ছড়িয়ে গেল, জেঁকে বসল।

সবার খাওয়া—দাওয়া হয়ে গেলে, মহুয়া নিজে হাতে বেশি করে ময়াম দিয়ে চারটে পরোটা ভাজল। তারপর প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে, চা করে মংলুর হাতে প্লেটের উপর চা বসিয়ে নিয়ে কারখানার দিকে চলল।

কুমার বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সান্যাল সাহেব বাথরুমে গেছিলেন চান করতে।

কুমার বলল, কোথায় চললে?

কারখানায়।

‘কেন?’—বলেই কুমার উঠে দাঁড়াল রাগতভাবে।

মহুয়া বলল, আমাদের হোস্টকে খাওয়াতে।

তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এতে আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

কুমার বলল, ঘরে এসো, একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে।

এক মিনিট কী ভাবল মহুয়া। তারপরে বলল, আপত্তি আছে তাহলে। কিন্তু কেন? আপত্তি করার কে আপনি? আমার যা খুশি আমি তাই—ই করব। আমি কী আপনার পোষা পুডল?

কিন্তু তারপরই বারান্দায় উঠে এসে ঘরে গেল।

কুমার আগেই ঘরে গেছিল। ঘরের এদিকে জানালা ছিল না। দরজার অন্য পাশে মহুয়া গিয়ে পৌঁছতেই কুমার তাকে জোর করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করল। আবেগের সঙ্গে বলল, তুমি এরকম করবে নাকি? একটা মিস্ত্রির জন্যে এত দরদ উথলে উঠল কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি মহুয়া—আই মিন ইট….।

মহুয়া ছটফট করে উঠল। চোখে আগুন ঝরিয়ে বলল, সো হোয়াট?

কুমার জোর করে কামড়াবার মতো করে মহুয়ার ঠোঁটে চুমু খেল।

মহুয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে চৌপায়ার ওপরে ফেলে দিয়ে গরম নিশ্বাস ফেলে বলল, শুনুন আপনি, ভালোবাসা ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না, ভালোবাসার যোগ্য করতে হয় নিজেকে। আই হেট দিস। আই হেট য়্যু।

তারপর বলল, আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। আপনি এরকম জোর করেছিলেন আমাকে, একবার আমাদের ফ্ল্যাটে। সেদিন আপনাকে কিছু বলিনি। কারণ আপনার সম্বন্ধে আমার তখনও দ্বিধা ছিল। ভেবেছিলাম, আপনাকে কোনোদিন ভালোবাসতেও বা পারি। কিন্তু আজ দ্বিধা নেই আর। আপনার নামের পিছনে অনেক ডিগ্রি, ভালো চাকরি; যাকে তাকে—আপনি অনেক মেয়েকেই পেতে পারেন—যারা আপনার যোগ্য। আমি আপনার যোগ্য নই। আমার পথ ছাড়ুন।

কুমারের উত্তরের প্রত্যাশা না করেই মহুয়া ঝড়ের বেগে বাইরে চলে গেল।

গিয়েই, অত্যন্ত সহজ গলায় হেসে বলল মংলুকে, চলো মংলু। তোমাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম। দাদাবাবু গেঞ্জি খুঁজে পাচ্ছিলেন না; খুঁজে দিয়ে এলাম।

কুমার চৌপাইতে আধ—শোয়া অবস্থায় বসে মহুয়ার কথা শুনল। মহুয়ার অভিনয় করার ক্ষমতা, সহজ হবার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেল। কুমারের পেট তখনও ওঠানামা করছিল উত্তেজনায়। ও মনে মনে বলল, এই মেয়েরা এক অদ্ভুত জাত। এদের কিছুতেই বুঝতে পারল না সে।

সান্যাল সাহেব তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে এলেন চান সেরে। বললেন, কী হল তোমার?

কুমার বলল, বুকে ব্যথা করছে—বড় বেশি সিগারেট খাচ্ছি আজকাল।

সান্যাল সাহেব ওর দিকে তাকালেন। অন্য সময় হলে হয়তো কিছু বলতেন, কুমারের ভাষায় ‘জ্ঞানও’ দিতেন। কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এখন শুধু বললেন, বেশি সিগারেট খেয়ো না। বলেই, জামাকাপড় পরতে লাগলেন।

কারখানার মধ্যে মংলুকে নিয়ে ঢুকতেই একটা সোরগোল উঠল। নানারকম ধাতব ও উচ্চগ্রামে বাজতে—থাকা আওয়াজগুলো মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল। মিস্ত্রির কাজ থামিয়ে সকলেই মহুয়ার দিকে চেয়ে রইল।

মহুয়াকে চেহারায় সহজেই ফিলম আর্টিস্ট বলে ভুল করা যায়। লম্বা, ছিপছিপে। ভারী ভালো ফিগার। অত্যন্ত সুন্দর চোখ, নাক ও মুখ। মাথা ভরা চুল। সরু কপালে মস্ত একটা টিপ। সবচেয়ে বড় কথা, ওর হাঁটা—চলা—কথা বলার মধ্যে এমন এক আড়ম্বরহীন আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্ব আছে যে, ওর দিকে চাইলে যে—কোনো উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিবান পুরুষেরই চোখ আটকে যায়। আর এই গণ্ডগ্রামের মিস্ত্রিদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

সুখন মিস্ত্রি নেই। কোথায় গেছে কাউকে বলে যায়নি। মংলুর সঙ্গে মিস্ত্রিদের যে হিন্দীতে কথাবার্তা হল, তাতে মহুয়া বুঝতে পারল যে, সুখন মিস্ত্রি হলেও সুখনকে অন্য মিস্ত্রিরা অত্যন্ত সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। হয়তো বা ভয়ও করে।

ওরা ফিরে এল। পিছন ফিরতেই কারখানার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহুয়ার রূপ সম্বন্ধে নানা অশ্লীল মন্তব্য কানে এল মহুয়ার।

মংলু পিছন ফিরেই ওদের ধমক দিল। বলল, ওস্তাদকে বলে দিলে জিভ ছিঁড়ে নেবে ওস্তাদ; তখন মজা বুঝবে।

ওরা সমস্বরে দেহাতি হিন্দিতে বলল, ওস্তাদকে বলিস না। আমরা তো বেয়াদবি করিনি। সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছি শুধু।

প্রথমে মিস্ত্রিদের এই অশালীনতা মহুয়ার খুব খারাপ লাগল। তারপরই এক অদ্ভুত ভালোলাগা ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কুমারের কাছে যে সুখন অপমানিত হয়েছে—সেই অপমানের দুঃখ, মিস্ত্রিদের মুখের বুলিতে নিজে অপমানিত হয়ে ও যেন কিছু পরিমাণে শুধতে পারল। এই শোধের বোধটা বড় সুখের বোধ বলে মনে হল মহুয়ার।

ফেরার পথে মংলুর সঙ্গে ফিসফিস করে কীসব কথা হল মহুয়ার। ওর দুজনে যেন কীসব বুদ্ধি—পরামর্শ করল। ওরা ছাড়া আর কেউই তা জানতে পারল না।

মহুয়া ফিরে এসে চান করতে গেল।

ও ফিরে আসতেই কুমার কারখানায় গিয়ে পৌঁছল। মিস্ত্রিদের দামি সিগারেট খাইয়ে তার গাড়ির অবস্থা ও সুখন মিস্ত্রির স্বভাব—চরিত্র সম্বন্ধে যা জানা যায়, জানার চেষ্টা করল। যা জানল কুমার, তা ওর পক্ষে মোটেই সুখকর নয়। তার গাড়ির সম্বন্ধে যা জানল, তা অত্যন্ত খারাপ এবং সুখন সম্বন্ধে যা জানল, তা অত্যন্ত বিরক্তিজনকভাবে ভালো। এ—বাজারে এতগুলো মিস্ত্রি—হেল্পার লোকেদের হৃদয়ের একচ্ছত্রাধিপতি হওয়ার মতো এমন কী গুণ থাকতে পারে সুখনের তা কুমার ভেবে পেল না।

কারখানার একপাশে নিমগাছের ছায়ায় বসে সিগারেটের পর সিগারেট পুড়িয়ে কুমার অনেক কিছু ভাবতে লাগল।

ওর একটা গুণ আছে—সেটা এই যে, ওর দোষ—গুণ সম্বন্ধে ও সম্পূর্ণ সচেতন। ও যে সুখন মিস্ত্রির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে সেটা ও জেনেশুনেই করেছে। সুখনকে অপমান করে ওর দারুণ ভালো লেগেছে। ও জানে যে, অন্যায় করেছে ও—কিন্তু করেছে।

ও কাল রাতেই বুঝতে পেরেছিল যে, মহুয়া ও সুখন দুজন দুজনকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেছে। ও ঘাস খায় না। ওর বুঝতে ভুল হয়নি যে, এই বিহ্বলতার মানে কী। ও কপালে কোনোদিনও বিশ্বাস করেনি—পুরুষকারে বিশ্বাস করেছে—পুরুষালি জেদে বিশ্বাস করেছে—কিন্তু কপাল বলে যে কিছু আছে, এ—কথা অস্বীকার করার মতো জোর পায় না আজকে, এই মুহূর্তে। কপাল না থাকলে—যে গাড়ি তাকে একদিনও ডোবায়নি গত চার বছরে—সে—গাড়ি এমনভাবে ডোবাবে কেন? আর ডোবাবেই বা যদিও, তাও সুখন মিস্ত্রির গ্যারেজের কাছে? এইসব ঘটনাবলির পিছনে কোনো শালা অদৃশ্য ভগবানের হাত অবশ্যই আছে।

মহুয়ার সঙ্গে এই বাইরে আসার পিছনে সবিশেষ ও গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল কুমারের। পৃথিবীতে সব কাজের পিছনেই একটা ‘মোটিভ’ থাকে। এত এত পরীক্ষা পাস করে এসে, এত এত বাঘা—বাঘা ইন্টারভ্যু বোর্ডের মেম্বারদের ঘোল খাইয়ে শেষে কিনা একটা মোটর মেকানিকের কাছে হেরে যেতে হবে ওকে! যে কমপিটিটরের হিট—এ ওঠারই কোনো সম্ভাবনা ছিল না, সে কিনা ফাইন্যালে জবরদস্তি করে ঢুকে পড়ে ওকে হারিয়ে দেবে?

অত সহজ নয়।—দাঁতে দাঁত চেপে কুমার বলল।

ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট ধরে কুমার মনে মনে বলল, ভগবান বা আর যারই হাত থাক—মহুয়াকে ও চায়। ওর এই চাওয়াটা হয়তো ভালোবাসার আদালতের জুরিস প্রুডেন্স জানে না। কিন্তু তবু ওর চাওয়াতে কোনো মেকি নেই। মহুয়াকে ও চেয়েছে এ জীবনে; ও জানে মহুয়াকে ও পাবে। জীবনে যা কিছু চেয়েছে—জেদ ধরে চেয়েছে; অথচ পায়নি এমন দুর্ঘটনা ওর জীবনে কখনও ঘটেনি। যদি ভগবান থেকে থাকে—তবে সেই শালা ভগবানের নামেই ও শপথ করছে যে, মহুয়াকে সে পাবেই—মহুয়াকে জীবনসঙ্গিনী করবে ও। মহুয়াকে সত্যিই কুমার ভালোবাসে। ভালোবাসার সঠিক মানে হয়তো জানে না ও। শুধু জানে, মহুয়াকে দেখলেই কেমন একটা সেনসেশান হয়। মাথার মধ্যে, তলপেটে কী যেন একটা পোকা ওকে কুড়ে কুড়ে নিঃশব্দে খেতে থাকে।

না, না, মহুয়াকে না পেলে ওর চলবে না। সিরিয়াসলি বলছে: হি মাস্ট হ্যাভ হার। বাই হুক ওর বাই ক্রুক।

দুপুরের খাওয়া—দাওয়ার পর একটা ইরিটেটিং আলস্য। কিছুই করার নেই। গড়িয়ে, বসে, সিগারেট খেয়ে, ধু—ধু গরম ধোঁয়া ওঠা উদোম টিডিয়াস—টাঁড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্লান্তি লাগছিল কুমারের। খেয়ে—দেয়ে পায়জামার দড়ি ঢিলে করে দিয়ে চৌপায়াতে শুয়ে পড়েছিল কুমার, এবং কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছিল।

সান্যাল সাহেবের বয়স হলেও দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যাস কোনোদিনই নেই। ছুটির দিনে, খাওয়ার পর মিনিট পনেরো ইজিচেয়ারে শুয়েই উঠে পড়েন। ম্যাগাজিন পড়েন, ক্রসওয়ার্ড নিয়ে বসেন, তারপর বেলা পড়লে বাড়িসংলগ্ন একফালি জায়গাটুকুতে ফুল, লতাগাছগুলোতে জল—টল দেন নিজে হাতে, দেখাশোনা করেন।

সান্যাল সাহেব লুঙি পরে, হাতাকাটা গেঞ্জি গায়ে, সুখনের দরজা—খোলা ঘর থেকে খুঁজেপেতে একটা এস্কিমোদের উপর লেখা বই বের করলেন—ফারলি মোয়াটের লেখা—’দ্যা পিপল অব দ্যা ডিয়ার’। তারপর বারান্দায় এসে ইজিচেয়ারে আধোশুয়ে, পাইপটাতে অন্যমনস্কতা ও তামাক ভরে ধরিয়ে নিয়ে বইটা নিয়ে পড়লেন। ভাবলেন, সুখন ছোকরা এরকম জায়গায় বসে এমন এমন সব বই জোগাড় করল কোথা থেকে?

সান্যাল সাহেবের বারান্দায় এসে বসার আরও একটা কারণ ছিল। উনি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, সুখনকে নিয়ে কুমার আর মহুয়ার মধ্যে একটা চাপা মনোমালিন্য ঘটেছে। এ—ব্যাপারটার জন্যে সান্যাল সাহেব খুশি ছিলেন না। চাইছিলেন যে, ওরা একটু নিরিবিলি পেলে এই ব্যাপারটা মিটিয়ে নিক নিজেরাই।

সান্যাল সাহেব ভাবছিলেন যে, কুমারের আর যাই—ই দোষ থাক, কুমারের মতো ভবিষ্যৎসম্পন্ন জামাই এ—যুগে পাওয়া দুষ্কর। ছেলেটা মেধাবী—চিরকাল স্কলারশিপ নিয়ে পড়েছে—ন্যাশনাল স্কলারশিপও পেয়েছে। কাজ খুবই ভালো জানে। কিন্তু অত্যন্ত অসচ্ছল অবস্থা ও সাদামাটা জীবন থেকে এসে যারা নিজগুণে জীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখে এবং আশাতীত ইম্পর্ট্যান্স পেয়ে যায়, তাদেরই মাথা খারাপ হতে দেখা যায় বেশি। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সাইকেলের পেছনে গুড়ের বস্তা নিয়ে যে বাড়ি—বাড়ি গুড় বিক্রি করত, সে—ই ফেঁপে—ফুলে উঠে গাড়ি চড়ে বেড়াবার সময় সাইকেল আরোহীকে ধাওয়া করে নর্দমায় ঠেলে ফেলে আনন্দ পায়। এ তিনি নিজের জীবনেই বহু দেখেছেন। আসলে প্রত্যেক মানুষই তার বুকের মধ্যের অন্য একটা পুরনো চাপা—পড়ে যাওয়া মানুষকে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু ভুলতে না—পেরে সেই মানুষের প্রতিভূ অন্য মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। একজন মানুষ, তার মধ্যের একখণ্ড মানুষকে যতখানি ঘৃণা করে, কোনো জানোয়ার তার নিজের কোনো অঙ্গকে অন্ধক্রোধে কামড়ালেও সেই ঘৃণার সমকক্ষ হয় না। সমস্ত মানুষকেই জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে জানোয়ারের কাছেও হার মানতে হয়। সান্যাল সাহেবকেও হয়েছে, সান্যাল সাহেব জানেন, কুমারেরও হার মানতে হবে।

জীবনের দুই—তৃতীয়াংশ অতিক্রম করে এসে, আজ সান্যাল সাহেব বুঝতে পারেন, শুধু বুঝতে পারেন যে তাই—ই নয়, উনি বিশ্বাস করেন যে, জীবনে ভারসাম্য না রাখলে, না থাকলে, কোনো একটি ক্ষেত্রে দারুণ গুণী হয়েও কিছুমাত্রই লাভ নেই। বড় ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা বড় জার্নালিস্ট খুব সহজেই হওয়া যায়—কিন্তু সুস্থ, সীমা—জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হওয়া যায় না। সেটা বড় কঠিন কাজ।

কুমারের মেধা ও বাল্যকালের অসাচ্ছল্য ও অপ্রতীয়মানতার পরিপ্রেক্ষিতে যৌবনের সাচ্ছল্যই ওর সবচেয়ে বড় শত্রু হয়েছে। ওর সাফল্যই ওর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

সান্যাল সাহেব ভাবছিলেন যে, এ—দেশে সবচেয়ে গরিবের ঘরের ছেলেরাই অবস্থার পরিবর্তন হলে সবচেয়ে বেশি ক্রুর—দুর্মর ও নিষ্ঠুর বুর্জোয়া হয়। অথচ উলটোটাই হওয়া উচিত ছিল; হলে ভালো হত। তারা যদি অন্যের দুঃখ না বোঝে তো কারা বুঝবে?

এরা না অ্যারিস্টোক্র্যাট—না প্রলেতারিয়েত। এরা ডুডুও খায়, তামাকও খায়।

যাই—ই হোক, এ—সবই দোষ। কিন্তু এমন কোনো দোষ নয় যে, কুমারকে জামাই হিসাবে ভাবা যায় না। আর বড়জোর বছর পাঁচেকের মধ্যে ও এতবড় কোম্পানির একটা পুরো ডিভিশনের নাম্বার ওয়ান হয়ে যাবে। অর্থাৎ মাইনে ও পার্কস মিলিয়ে যা পাবে, তারপর সাপ্লায়ার কনট্রাকটরদের ভেট—টেট তো আছেই—সারা জীবন রাজার হালে হেলে—দুলে চলে যাবে।

বর্তমান সমাজে এই কুমারের মতো জামাইরা সুদুর্লভ। ‘পাত্র—পাত্রী’ শিরোনামা এদেরই আড়ম্বরপূর্ণ ও নির্লজ্জ ঢাকের শব্দে ভরে থাকে। সান্যাল সাহেব সব জানেন, সব বোঝেন; তিনি বোকা নন। জেনেশুনে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্যে এমন জামাই হাতে পেয়েও হাতছাড়া করতে দিতে পারেন না। এর একটা আশু—বিহিত দরকার।

কিন্তু মহুয়া বড় জেদি মেয়ে। কলকাতায় বেশ ছিল—উইক—এন্ডে ক্লাবে যেত, সিনেমায় যেত দুজনে, কুমারের যখন আসবার কথা, তখন ইচ্ছে করে সান্যাল সাহেব ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেন—অন্য কারও ফ্ল্যাটে অথবা ক্লাবে অসময়ে গিয়ে বসে ম্যাগাজিন উলটোতে উলটোতে বিয়ার সিপ করতেন।

কুমার আর মহুয়ার সম্পর্কটা রীতিমতো ঘন হয়ে এসেছিল, চিকেন অ্যাসপারাগাস স্যুপের মতন। উনি তাতে বড় খুশি ছিলেন। কুমার ছেলেটার এমনিতে কোনো দোষ নেই—পেডিগ্রি নেই এই—ই যা, ব্যাড—ব্রিডিং, সে কারণে বস্তি বস্তি ভাবটা রয়ে গেছে ওর মধ্যে পুরোমাত্রায়। কিন্তু সান্যাল সাহেব জীবনে অনেক দেখলেন, আজ এটা তিনি বিশ্বাস করেন যে, একটা মিনিমাম অ্যামাউন্ট অব ঔদ্ধত্য ও গর্ব ছাড়া এবং এমনকি ক্রুডনেস ছাড়াও জীবনে ম্যাটেরিয়ালি বড় হওয়া যায় না।

এই মিস্ত্রি ছোকরা ভালো ছেলে সন্দেহ নেই—কিন্তু মহুয়া যদি তাকে কুমারের সঙ্গে তুলনীয় বলে ভেবে থাকে, তাহলে শুধু কুমারের প্রতিই নয়, তার নিজের প্রতিও অত্যন্ত অন্যায় করবে।

বইটা কোলেই পড়ে থাকল সান্যাল সাহেবের। উনি ভাবতে লাগলেন। বাইরে ধুলো উড়তে লাগল। লাল ধুলো। গরম হাওয়ার সঙ্গে লু চলছে। শুকনো শাল পাতা পাথরে জড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি উঠছে। হলুদ, লাল, পাটকিলে শুকনো পাতা, খড়কুটো, সব কুড়িয়ে জড়িয়ে হাওয়ার স্তম্ভ উঠছে উপরে—ঘুরপাক খাচ্ছে—নাচছে; তারপর সেই স্তম্ভটা শালবনের কাঁধ ছুঁই ছুঁই হলেই হাওয়াটা ওদের বিকেন্দ্রীকরণ করে রাশ আলগা করে ছেড়ে দিচ্ছে। একরাশ খুদে ভারহীন ছত্রীবাহিনীর সৈন্যদের মতো ওরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে—মাধ্যাকর্ষণে নেমে আসছে যেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকের আশায় রওয়ানা হয়েছিল—সেই অধঃলোকে।

সান্যাল সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে দেওঘরের দিনগুলোয় ফিরে গেছিলেন। ডিগারীয়া পাহাড়—পাহাড়ের মাথায় রোজ সাঁঝের বেলায় দেখা শান্ত সন্ধ্যাতারা। একটি মিষ্টি সাধারণ শ্যামলা মেয়ের মুখ—শালবনের ভিতরে। বিবাহিতা অল্পবয়সি একটি মেয়ে। সান্যাল সাহেব তাকে ঘর থেকে বাইরে এনে নিজের ঘরে তুলেছিলেন। সান্যাল সাহেব কখনও সংস্কার মানেননি, সমাজ মানেননি। লুঙি পরলে কী হয়, মনে—প্রাণে জানেন যে, পুরোদস্তুর সাহেব তিনি। কিন্তু সেই শ্যামলী মেয়েটি মহুয়াকে উপহার দেওয়ার পরই তাঁকে সেই ঘরে মেয়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে একা রেখে এক দুর্মর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আরও বিলাসী জীবনের মোহে পড়ে ওদেরই কোম্পানির এর ফরাসি ডিরেকটরের সঙ্গে পালিয়ে গেছিল। শ্যাম্পেনের দেশের লোকের নাকে বাংলার শ্যামলা মেয়ের গায়ের বনতুলসী গন্ধ ভারী ভালো লেগে গেছিল বুঝি। ঘর ভাঙতে ঘর বাঁধতে এবং আবার ঘর ভাঙতে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল শ্যামলী। এর পরে তার কোনো খবর সান্যাল সাহেব আর রাখেননি। রাখার প্রয়োজনও বোধ করেননি। লোকমুখে শুনেছেন যে, ভালোই আছে শ্যামলী স—পুত্র। সেদিন থেকে নারীচরিত্র সম্বন্ধে তাঁর মনে এক অসীম দুর্জ্ঞেয়তা ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই। পুরো মেয়ে জাতটা সম্বন্ধে—একমাত্র নিজের রক্তজাত মেয়ে ছাড়া—তিনি একেবারেই নিস্পৃহ হয়ে গেছেন। প্রত্যেকটি মেয়েকে তিনি মনে মনে ঘৃণা করেন সেদিন থেকে। ঘৃণা বললেও ঠিক বলা হয় না; একটা ঘৃণাজনিত ও অনুশোচনাজনিত উদাসীনতার শিকার হয়েছেন তিনি।

আশ্চর্য! শ্যামলীকে আর মনেও পড়েনি কখনও। কিন্তু দেওঘরে যে সাধারণ অল্পে—সন্তুষ্ট বিনয়ী ও বেসিক্যালি ভালো স্কুল—মাস্টারের স্ত্রী ছিল শ্যামলী, যার ঘর ভেঙে সান্যাল সাহেব কোকিলের মতো উজ্জ্বল কালো শ্যামলীকে নিয়ে এসেছিলেন, সেই লোকটার কথা বারবার মনে পড়ে তাঁর। লোকটার অনুযোগহীন, উদার, উদাস চোখ দুটির কথা মনে পড়ে। পালিয়ে আসার পর ভদ্রলোক শ্যামলীকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন—একটিই—তাতে লিখেছিলেন যে, তুমি যদি খুশি হয়ে থাকো, সুখে থাকো, তাহলেই ভালো। তুমি যা চেয়েছিলে, যা আমি দিতে পারিনি ও কখনও পারতাম না, তা সুধীর সান্যালের কাছে পাবে শুধু এই কামনা করি।

সান্যাল সাহেব জানেন যে, একমাত্র এই লোকটার কাছেই উনি হেরে গেলেন, হেরে রইলেন; হেরে থাকবেন সারা জীবন।

এখন দুপুর খাঁ—খাঁ।

একমাত্র শীতকাল ছাড়া অন্য সব ঋতুতেই দুপুর আড়াইটে থেকে চারটে অবধি একটা ভারী, ক্লান্ত ও মন্থর নিস্তব্ধতা যেন প্রকৃতিকে পেয়ে বসে।

সান্যাল সাহেব বই পড়তে পড়তে কখনও যা করেন না, সেই কর্ম করলেন আজ। একটু গড়িয়ে নেওয়ার জন্যে ঘরে গেলেন। ঘরের জানালা সব বন্ধ। দরজা ভেজানো। মধ্যেটা অন্ধকার, ঠান্ডা। উপরের টালির ফাঁক—ফোঁকর দিয়ে ও জানালা—দরজার ফাটা—ফুটো দিয়ে আলো এসে এক লালচে উদ্ভাসনায় ঘরটাকে চাপাভাবে উদ্ভাসিত করে রেখেছে। বাইরে লু বইছে তখনও। পাতা ওড়ানোর, পাতা খসানোর আর পাতায়—পাতায় হাওয়ার ঝরনা ঝরানো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূরের নির্জন নির‍্যান সড়ক বেয়ে গোঁ গোঁ করে, ক্বচিৎ ট্রাক যাচ্ছে গরম হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কুয়োয় লাটাখাম্বা উঠছে নামছে। কোনো মিস্ত্রি—টিস্ত্রি চান করছে বোধহয়। লাটাখাম্বার ক্যাঁচোর—ক্যাঁচোর, একঘেয়ে যন্ত্রণা—কাতর একটা আওয়াজ সমস্ত খাঁ—খাঁ পরিবেশকে আরও বেশি উদাস ও বেদনাবিধুর করে তুলেছে।

সান্যাল সাহেব ঘরে যাওয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কুমারেরও নাক ডাকছিল। মহুয়া দেওয়ালের দিকে মুখ করে, পাশ ফিরে বাঁ—হাতটা দু’ চোখের উপরে রেখে শুয়েছিল।

একটুক্ষণ পরেই সান্যাল সাহেবের গভীর নিশ্বাস—প্রশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। ভিতরে ঘর—ভরা ঘুম; বাইরে দুপুর নিঝুম।

মহুয়া আস্তে উঠে, নিঃশব্দে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

ঘরের এই সামান্য আলোয় নিজের মুখ ভালো দেখতে পেল না মহুয়া। তবু, যতটুকু আলো ছিল, সেই আলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে তার দুটি গভীর চোখে পড়ল এবং পড়েই দ্বিতীয়বার প্রতিফলিত হল আয়নায়। হাতব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে নিয়ে ও চুলটা একটু আঁচড়ে নিল; মুখে একটু ভেসলিন লাগাল, ঠোঁটেও। হাওয়াটা বড় শুকনো, সারা—গা, মুখ চোখ সব জ্বালা—জ্বালা করছে। তারপর দরজায় একটুও শব্দ না করে বেরিয়ে পড়ল। বেরোবার সময় ঝোলানো থার্মোফ্লাস্কটা তুলে নিল দেওয়ালের পেরেক থেকে।

রান্নাঘরের দরজা—জানালা বন্ধ করে মংলু মেঝেতেই শুয়ে ছিল।

দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলল। শালপাতার দোনায় পুরি, তরকারি, প্যাঁড়া সব সাজিয়ে রেখেছিল ও। উনুনে তখনও আঁচ ছিল। ওগুলো একটু গরম করে নিয়ে শালপাতার দোনায় আবার বেঁধে—ছেঁদে নিল। তাড়াতাড়ি নিজে—হাতে চা বানাল মহুয়া—দারচিনি এলাচ এ—সব দিয়ে। যাতে বেশিক্ষণ ফ্লাক্সে থাকলেও গন্ধ না হয়ে যায় চায়ে। তারপর চা—টা ফ্লাক্সে ঢেলে মংলুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল মহুয়া।

ডান হাতের হাতঘড়িতে সময় দেখল একবার—চারটে বাজতে দশ। বাড়ির পেছন দিকে বেড়ার মধ্যে একটা বাঁশের দরজা ছিল। তা দিয়ে গলে বাইরে বেরুলেই একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। ঝরনার মতো শব্দ হচ্ছিল হাওয়ায় এই গাছের পাতার।

তারপরই একটু খোয়াই; খোয়াইটুকু পেরিয়ে একটা উঁচু বাঁধের মতো—বাঁধের উপরে সামান্য জল; একটা দহ। গোটা চারেক দুধ—সাদা গো—বক ঠা—ঠা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে। কালো—কালো ছোট্ট দুটো হাঁসের মতো পাখি জলে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটছে, আবার পরক্ষণেই জলে ঢেউয়ের বৃত্ত তুলে ডুব দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে ওদিকে তাকিয়ে মহুয়া শুধোল, ওগুলো কী পাখি?

মংলু বলল, ডুবডুবা।

মহুয়া অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে। ও বাবার সঙ্গে কাশ্মীরে গেছে, নৈনিতালে গেছে, উটীতে গেছে, যায়নি এমন ভালো জায়গা নেই ভারতবর্ষে, অথচ এই অখ্যাত অজানা ছোট্ট জায়গা—এই ফুলটুলিয়ার বিবাগী রুক্ষ দুপুরে যে চোখ ভরে এত কিছু দেখার ছিল, কান ভরে শোনার ছিল, ও কখনও তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

দুটো শুয়োর কাদায় প্যাচ—প্যাচ আওয়াজ তুলে হাঁটু অবধি কাদা—মেখে দৌড়ে গেল অন্যদিকে।

মহুয়া চমকে উঠে মংলুর বাহু ধরে ওকে দাঁড় করাল। বড় বড় চোখ করে ভয়—পাওয়া গলায় ওকে শুধোল, জংলি?

মংলু হাসল। বলল, না না। এসব কাহারটোলার শুয়োর।

একটু পরই পথটা শালবনের মধ্যে ঢুকে গেছে। এখানে গরম অনেক কম—ছায়া আছে বলে। আঁকাবাঁকা লাল মাটির পথ চলে গেছে নালা পেরিয়ে, টিলা এড়িয়ে বনের অভ্যন্তরে। জঙ্গলের মধ্যে পাতার শব্দে হাওয়াটাকে ঝড় বলে মনে হচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে ঝড়ের চেয়েও দ্রুতগামী টিয়ার ঝাঁক, ঘন সবুজের মধ্যে কচি—কলাপাতা সবুজের ঝিলিক তুলে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে চমক হেনে, উধাও হয়ে যাচ্ছে নীল—নির্জন ঝকঝকে আকাশে।

কী একটা পাখি ডাকছিল দূর থেকে। চিঁহা…চিঁহা…চিঁহা…চিঁহা….চিঁহা….চিঁহা ….চিঁউ…চিঁউ….চিঁউ….।

মহুয়া অবাক হয়ে শুধোল, এটা কী পাখি?

মংলু বিজ্ঞের মতো বলল, তিত্তর। আগে ডাক শোনেননি?

মহুয়া বাচ্চা মেয়ের মতো সরল হাসি হাসল। বলল, ‘কখনও না।’

মহুয়ার মন এক দারুণ ভালো—লাগায় ভরে গেছিল। এই পরিবেশ, অত্যন্ত স্বল্প—পরিচিত একটা মানুষ, কিন্তু যার প্রথম পরিচয়ের শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে মহুয়ার ভিতরে—সেই সুখনের জন্যে এই নিজে—হাতে খাবার বয়ে—নিয়ে যাওয়া, অপরিষ্কার জীর্ণ রান্নাঘরে চা—বানানো উবু হয়ে বসে—এ সবের মধ্যেও একটা ভীষণ আনন্দ পেয়েছিল। নিজেকে কষ্ট দিয়ে অন্যকে আনন্দিত করতে যে এমন অভিভূত হতে হয় তা ও আগে কখনও জানেনি।

আনন্দ আর সুখ এ দুই অনুভূতি একই পাড়ার বাসিন্দা ছিল আগে ওর মনে। এরা যে সম্পূর্ণ বে—পাড়ার লোক মহুয়া জানত না। প্রথম জানল।

কুমার তাকে অপমানসূচক কথা বলার পরেই কারখানায় গিয়ে, মিস্ত্রিদের কাজটাজ বুঝিয়ে সুখন উধাও হয়ে গেছিল। একমাত্র মংলু জানত ও কোথায় যায়; যেতে পারে। কালুয়াকেও আর দেখা যায়নি তারপর। মানে, সুখন চলে যাওয়ার পর থেকে।

মংলু বলছিল, কালুয়া ওস্তাদকে এত ভালোবাসে যে, ওস্তাদ বলেছে, ওস্তাদ মরে গেলে তাকে শাকুয়া—টুঙে কবর দিয়ে কালুয়ার জন্যে তার পাশেই যেন একটা ঘর বানিয়ে দেয় মিস্ত্রিরা।

মহুয়া মংলুকে শুধোল, এই শাকুয়া—টুঙ ব্যাপারটা কী?

উত্তরে মংলু উৎসাহের সঙ্গে বলল, শাকুয়া—টুঙ শালবনের মধ্যের একটা টিলার চুড়ো। সেখানে বসে পুরো পালামৌ জেলার এবং হাজারীবাগ জেলারও কিছু জঙ্গল চোখে পড়ে। ওস্তাদ ওখানে একটা ছোট্ট ঘর বানিয়েছে। মাটির দেওয়াল, মাটির মেঝে, উপরে ঘাস। বেশিরভাগ ছুটির দিনে, অথবা মনে দুঃখ—টুঃখ হলে ওস্তাদ ওখানে গিয়ে কাটায়। কোনো—কোনো দিন সারা রাতও থাকে।

মহুয়া অবাক হয়ে বলল, বাবু সেখানে করেন কী?

মংলু তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, কী—সব লেখাপড়ি করে, চুপ করে বসে থাকে।

আর খান কী? মহুয়া আবার শুধোল।

কিছুই না। মহুয়ার দিনে মহুয়ার ফল চিবোয়। পিপাসা পেলে নীচের ঝরনায় গিয়ে জল খায়। ওস্তাদ বলে—’বুঝলি মংলু, আমি হচ্ছি ময়াল সাপের জাত। একবার খেলে বহুদিন আমার খেতে হয় না।’

মংলুর সঙ্গে কথা ছিল মহুয়াকে সুখনের কাছে পৌঁছে দিয়ে ও দৌড়ে ফিরে যাবে। কুমার আর বাবাকে বিকেলে চা—জলখাবার করে দেবে। আর ঘূণাক্ষরেও জানাবে না কাউকে যে, মহুয়া কোথায় গেছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে যে, বড় রাস্তার দিকে যেতে দেখেছে ও দিদিমণিকে। যাওয়ার সময় দিদিমণি ওকে বলে গেছেন—একটু বেরিয়ে আসছি, সন্ধ্যার আগেই ফিরব।

আর একটু এগোতেই টিলাটার কাছাকাছি এল ওরা। এমন সময় দূরে কোথা থেকে মাদলের আওয়াজ ও একটানা ঝিম—ধরা গানের সুর শোনা গেল। কিছু অসংলগ্ন দূরাগত কথাবার্তা। পুরুষকণ্ঠই বেশি—স্ত্রীকণ্ঠও ছিল মাদল মাঝে মাঝে থামছে—টুকরো টুকরো কথার পরই আবার বেজে উঠছে।

মংলুকে শুধোতে সে বলল যে, কোনো শাদি—টাদি আছে বোধ হয়। নীচে ছোট্ট একটা বস্তি আছে গঞ্জুদের।

ওরা ছোট্ট টিলাটা চড়তে শুরু করেছে পাকদণ্ডী পথ দিয়ে, এমন সময় একটা মোড় ঘুরতেই মহুয়া হঠাৎই সুখনের একেবারে মুখোমুখি এসে পড়ল। সুখন হনহনিয়ে কোথায় চলেছিল, বোধহয় কারখানার দিকেই। ধাক্কা লাগছিল আর একটু হলে।

সুখন হঠাৎ মহুয়াকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।

বলল, এ কী? কী ব্যাপার? আপনি এখানে কেন?

তারপরই আবার বলল, এটা কী একটু বাড়াবাড়ি হল না?

মহুয়ার আনন্দ, উৎসাহ সবই একমুহূর্তে নিভে গেল। রোদে হেঁটে ওর সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছিল।

কিন্তু সুখন মহুয়ার অমন সুন্দর, ভালো—লাগা আর ভালোবাসায় মোহিত, অমন অনুতাপ—কাতর মুখটির দিকে একবার তাকালও না।

অন্যদিকে চেয়ে বলল, ‘কী রে মংলু? তোকে কে আনতে বলেছিল দিদিমণিকে এখানে? মেরে শালা তোর দাঁত ভেঙে দেব!’

মংলু ভয়ে সিঁটিয়ে গেল।

কালুয়া সুখনের পায়ে—পায়ে এসেছিল—সে—ও সুখনের রাগ দেখে কেঁউ কেঁউ করে উঠল।

সুখন ধমক দিয়ে বলল, ‘বল, কে আনতে বলেছিল?’

মংলুকে আড়াল করে হতভম্ব মহুয়া মুখ তুলে বলল, ‘এটা অন্যায়। কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন। ওর কী দোষ?’

তখনও সুখন অন্যদিকেই মুখ ঘুরিয়ে ছিল।

বলল, ‘দেখুন, ন্যায়—অন্যায় আমাকে শেখাবেন না। এখন ভালোয় ভালোয় এখান থেকে চলে যান। বলছি তো, আপনাদের গাড়ি পার্টস এলেই ঠিক করে দেব। ভাঙা হোক, যাই—ই হোক, আমারই বাড়ি থেকে তো অন্যায়ভাবে অপমান করে আপনারা আমাকে তাড়ালেন—তবু সুখন মিস্ত্রির কী একটু নিরিবিলি থাকারও উপায় নেই—নাকি গাড়ির মালিকদের কাছে তামাম জিন্দগী বিকিয়েই বসে আছে সে?’

পরক্ষণেই, সোজা মহুয়ার চোখে তাকিয়ে ধমকের গলায় সুখন বলল, ‘কী চান কী আপনারা সবাই, আপনি; আমার কাছে? বলতে পারেন, কী চান?’

মহুয়া মুখ নামিয়েই ছিল।

মংলু সুখনের এই ব্যবহারের কারণ বুঝতে না পেরে অত্যন্ত ব্যথিত মুখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়েছিল, কাঁধে থার্মোফ্লাক্স ঝুলিয়ে আর হাতে খাবার নিয়ে।

মহুয়া মুখ তুলে সুখনের দিকে তাকাল।

হঠাৎ, বিদ্যুৎ—চমকের মতো সুখন মুখ তুলে আবিষ্কার করল; আবিষ্কার করল মহুয়াকে। আবিষ্কার বলল না, বলা উচিত পুনরাবিষ্কার করল। আবিষ্কার তো কাল রাতের লুণ্ঠনের আলোতেই সে করেছিল।

সুখন তার অন্তরের অন্তরতম তলে অনুভব করল যে, ওর দিকে আজ পর্যন্ত কখনও কোনো নারী এমন চোখে তাকায়নি।

সুখন দেখল দু’ ফোঁটা জল মহুয়ার চোখের পাতার চিকন—কালো গভীরে টলটল করছে—শীতের সকালের গোলাপের পাপড়ির গায়ের শিশিরের মতো—উজ্জ্বল, নির্মল। তার মুখ, কপাল, গাল যেন এতখানি রোদে হেঁটে এসে লাল হয়ে উঠেছে পদ্মকলির গোড়ার দিকের কোমল লালে। সুখনের খুব একটা ইচ্ছে করেছিল। মংলু সামনে না থাকলে, সে ইচ্ছেকে ও সফল করত—করতই—। ইচ্ছে করছিল, দু’টি চকিত চুমুর উত্তাপের বাষ্পে মহুয়ার সেই দু’ চোখের জল ও শুষে নেয়; মুছে দেয়।

সুখন মহুয়ার চোখে চোখ রেখেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

দু’ ফোঁটা জল চোখ ছাড়িয়ে, গাল গড়িয়ে, বুক টপকে এসে লাল মাটিতে পড়ল। রুক্ষ মাটি মুহূর্তে তা শুষে নিল।

সুখন অপ্রস্তুত অপ্রতিভ গলায় বলল, ‘যাঃ বাবা! এ আবার কী? মহা ঝামেলা দেখছি।’

‘বিশ্বাস করুন’—বলেই ওর দু’হাত মহুয়ার দু’ বাহুতে রাখবে বলে হাত উঠিয়েই পরক্ষণেই অবাক মংলুর দু’কাঁধে রাখল। রাখল তো না, যেন থাপ্পড় মারল।

এবার বলল, ‘কী রে মংলু, সেই সকাল থেকে কিছু খাইনি। কিছু খেতে দিবি, না হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবি?’

বলেই মহুয়াকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আসুন, আসুন এতদূর যখন আমারই জন্যে, এ—হতভাগাকেই খাওয়াবেন বলে এলেন, তখন চলুন আমার ডেরাটা দেখে যাবেন।’

সুখন আগে আগে চলতে লাগল। একটু উঠেই ঘরটা চোখে পড়ল। জায়গাটার তুলনা নেই। ঘরটারও না। লাল ও হলুদ মাটির দেওয়াল, তাতে নানারকম আদিবাসী মোটিফ আঁকা। পরিষ্কার করে গোবর—নিকোনো বারান্দা।

সামনেটাতে কী এক মন্ত্রবলে যেন পৃথিবী হঠাৎ বেঁটে হয়ে গিয়ে এই মালভূমির পদপ্রান্তে নেমে গেছে—প্রায় পাঁচশ’ ফিট—নেমে গিয়েই যেন গড়িয়ে গেছে শ’য়ে শ’য়ে মাইল সবুজ, ঘন—সবুজ, হলদেটে—সবুজ, লালচে—সবুজ এবং পত্রশূন্যতার পাটকিলে রাঙা জমাট—বুনুন গালচে হয়ে গড়াতে—গড়াতে চতুর্দিকে যতদূর চোখ যায়, বিস্তৃত হয়ে গিয়ে দিগন্তরেখার তিন সীমানায় পৌঁচেছে।

ঘরটা ছোট। একদিকে একটা চৌপাই—বারান্দায় একটা দড়ির ইজিচেয়ার। শালকাঠের বুক—র‍্যাক। তার উপর কিছু বইপত্র। কোণায় মেটে কলসি; জল রাখার।

ঘরে পৌঁছে সুখনের মেজাজটা একটু শান্ত হল মনে হল। শামুক যেমন অভ্যন্তরে তুলতুলে থাকে, তেমন তার স্বাভাবিক নম্রতার স্বভাবে ফিরে গিয়ে, বাইরের শক্ত খোলস ভুলে গিয়ে সুখন বারান্দার কোণায় বসে বলল, ‘দে, মংলু, খেতে দে।’

মহুয়া মুখ নামিয়েই বলল, ‘এবার মংলুকে ছুটি দিলে ভালো হত। মংলুর ওখানে কাজ আছে। মংলুর মতো অত ভালো না পারলেও, আপনাকে খাবারটুকু দিতে পারব আশা করি।’

সুখন চকিতে মুখ তুলে মহুয়ার দিকে তাকাল। মহুয়া যে সুখনকে একা চায় এ—কথা বুঝল—ও। অনভ্যস্ত ভালো—লাগায় সুখনের বুকটা মুচড়ে উঠল।

মুখে বলল, ‘আপনার বাবাকে, কুমারবাবুকে খাবার—টাবার দিতে হবে—তাই না!’ তারপর বলল, ‘যারে মংলু, তুই যা।’

মংলু মহুয়ার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ পর ওর মুখে হাসি ফুটল। বলল, ‘চললাম দিদিমণি।’

কেন জানে না, মংলু এই দিদিমণির প্রেমে পড়ে গেছে—একজন বারো—তোরো বছরের দেহাতি সরল ছেলের দাবিহীন মিষ্টি প্রেম।

‘যেতে নেই; এসো।’—মহুয়া বলল মংলুকে।

নড়বড়ে দড়ির ইজি—চেয়ারটা এনে পেতে দিল সুখন। বলল, ‘বসুন। কিন্তু হেলান দিয়ে বসবেন না; ছারপোকা আছে।’

মহুয়া হাসল। বলল, ‘আপনি কোথায় বসবেন?’

‘এই যে’—বলেই সুখন জিন—পরা অবস্থাতেই মাটির বারান্দার উপর আসন করে বসে পড়ল।

মহুয়া বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে, না? পায়নি খিদে?’

‘খিদে? না না। আমার খিদে—টিদে সব মরে গেছে। মেরে ফেলেছি।’

তারপর একটু থেমে উদাস গলায় বলল, ‘সব খিদেই।’

সুখনের সামনে মাটিতে বসে পড়ে, শালের দোনার বাঁধনটা ঢিলে করতে করতে মহুয়া বলল, ‘কার উপর এত অভিমান? খালি পেটে চা আর জর্দা—পান খেয়ে কী প্রমাণ করতে চান আপনি?’

সুখন হাসল।

দারুণ দেখাল হাসিটা—অন্তত মহুয়ার চোখে।

সুখন বলল, ‘প্রমাণ কিছুই করার নেই। জ্যামিতিক অঙ্ক মেলানোর দিন চলে গেছে। বলতে পারেন, এখন যা—কিছুই করি তার সবটাই কিছু অপ্রমাণ করার জন্যে।’

মহুয়া চুপ করে থাকল একটু। সুখন মিস্ত্রির হঠাৎ—উত্তরের অভাবনীয়তায় অবাক হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।

তারপর বলল, ‘পুরিগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। যে ঠান্ডা খাবার দেয়, তার খারাপ লাগে। তাছাড়া, ঠান্ডা কী কেউ খেতে পারে?’

‘আমি পারি’।—সুখন বলল।

তারপর খেতে খেতে বলল, ‘আমাকে খাওয়াতে আপনার খারাপ লাগছে হয়তো, আমার কিন্তু আপনার হাতে খেতে ভারী ভালো লাগছে। এমন আদর করে কেউ আমাকে কখনও খাওয়ায়নি। মা’র কথা মনে নেই। তারপর তো স্কুল—কলেজের হস্টেলে হস্টেলেই কেটেছে।’

মহুয়ার চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে এসেছে। বাইরে রোদের তাপও নরম হয়েছে। হাওয়ার তোড় কমে আসছে। লম্বা হয়ে শাল—সেগুনের ছায়া নামছে জঙ্গলে। নীচ থেকে নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে মাদলের আওয়াজের সঙ্গে মিশে।

মহুয়া বলল, ‘খান তো; ভালো করে খান। বাড়িতে একটু আচার—টাচার রাখেন না কেন?’

‘আচার?’—বলেই একটু হাসল সুখন।—বলল, ‘আচার—টাচার তাদেরই মানায়, খাওয়াটা যাদের কাছে একটা বিরাট ব্যাপার, মানে, সুখের ব্যাপার। আমরা খাই তো খেতে হয় বলে। গরমের দিনে মাসের পর মাস বিউলির ডাল আর একটা তরকারিতে চলে। শীতের দিনে প্রায় রোজই খিচুড়ি, সঙ্গে আলু কী বেগুনভাজা। খাওয়া ব্যাপারটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনোই মানে দেখি না আমি।’ তারপর একটু থেমেই বলল, ‘খুবই সুখের বিষয়, মংলুও দেখে না।’

‘বেশ! এবার খান। খাওয়ার সময় অত কথা বলতে নেই। হজম হবে না’। বলেই, মহুয়া উঠে ঘরে গিয়ে কুঁজো থেকে গড়িয়ে চটে—যাওয়া কলাই—করা একটা গেলাসে করে জল নিয়ে এল।

সুখন বলল, ‘খাওয়ার সময় জল খাই না’। তারপরেই বারান্দার কোণে নামিয়ে রাখা ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে বলল, ‘ফ্লাস্কে কী? চা? তাহলে খেয়ে উঠে চা খাব।’

মহুয়া বলল, ‘আমি তাহলে জলটা খাই? ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।’

খাওয়া থামিয়ে সুখন বলল, ‘পাবেই তো! অতখানি পথ, রোদে। তার উপর আপনাদের তো অভ্যেস নেই। কেন যে এত কষ্ট করলেন, বুঝলাম না। কুমারবাবু খারাপ ব্যবহার করেছেন আমারই সঙ্গে। তাতে আপনার অপরাধবোধ কেন? আপনি না থাকলে ও—ইঁদুরটাকে মেরে দু’পা ধরে তুলে পুরোনো মবিলের টিনে মুখ চুবিয়ে দিতাম। সুখন মিস্ত্রিকে চেনে না! শুধু আপনার জন্যে, আপনারই জন্যে সহ্য করতে হল; করলাম।’

মহুয়া জল খেয়ে গেলাসটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘কেন? আমার জন্যেই বা কেন? আমি আপনার কে?’

সুখন খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কী বলবে, ভেবে পেল না। তারপর বলল, ‘কেউ নন। কেউ নন বলেই তো।’

একটু ভেবে বলল, ‘হঠাৎ এসে পড়লেন, একদিনের মেহমান।’

খেতে খেতে সুখন মনে মনে বলল—কেন জানি না, আপনাকে দেখার পর থেকেই কেমন হয়ে গেলাম। আমার মধ্যে যে এতসব নরম ব্যাপার—ট্যাপার ছিল আমি জানতাম না। গাড়ির অ্যাবজরবারের মতো আমার মনটাও একটা যন্ত্র হয়ে গেছিল। কোনোরকম আনন্দ বা দুঃখই আর সাড়া জাগাত না তাতে। একদিনের জন্যে এসে আমার সব গোলমাল করে দিলেন।

তারপরই চোখ তুলে মহুয়ার দিকে অনেকক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, ‘কেন এলেন বলুন তো?’

মহুয়া মুখ নামিয়ে চুপ করে রইল। কথা বলল না কোনো। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

মনে মনে ও নিজেকে বলল—আমিই কী জানতাম যে আমি এমন? আমি তো নিজে আসিনি। পুরো ব্যাপারটাই বুঝি প্রি—কন্ডিশানড।

তারপর বলল, ‘আপনার নাম তো সুখ। এখানে স্থানীয় লোকেরা আপনাকে সুখন বলে ডাকলে ডাকুক, আপনি নিজেও নিজেকে সুখন বলেন কেন? বিচ্ছিরি শোনায়।’

‘কী জানি? কখনও ভেবে দেখিনি। সুখ নামটা হয়তো আমাকে মানায় না বলে।’

মহুয়া কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘সুখরঞ্জন তো একেবারেই মানায় না। আমি কিন্তু আপনাকে সুখ বলে ডাকব।’

সুখন বিদ্রুপের হাসি হাসল। বলল, ‘ক’ ঘণ্টা! আর ক’ ঘণ্টা থাকছেন এখানে? সুখ বা অসুখ যা আপনার ইচ্ছে, তাই বলেই ডাকতে পারেন। যে নামেই ডাকুন না কেন, এখান থেকে চলে গেলেই লোকটাকে ভুলে যাবেন। মানুষটাকেই যখন মনে থাকবে না, তখন একটা নাম নিয়ে এত তর্ক কীসের?’

‘আপনি জানেন, আপনি সবই জানেন, না?’

‘কী জানি!’—সুখন শুধোল।

তারপর আবার বলল, ‘বোধহয় জানি। কিন্তু যা জানি, সেটা ঠিক কিনা জানি না।’

তারপর গেঞ্জির হাতায় জংলির মতো মুখ মুছে বলল, চা দিন।

মহুয়া এতক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল মানুষটার ছটফটে, ছেলেমানুষি স্বভাব। বয়স হয়েছে, কিন্তু বড় হয়নি একটুও।

কালুয়া দূরে তিন—ঠাঙে বসে একদৃষ্টে সুখনের খাওয়া দেখছিল। সুখন শালপাতা মুড়ে একটা পরোটা ও মেটের তরকারি দিয়ে এল তাকে পলাশ গাছের গোড়ায়। খাবারটা দিতে গিয়ে সামনে তাকিয়েই থমকে দাঁড়াল। মহুয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘দেখেছেন? বেলা পড়ে যাওয়াতে কেমন দেখাচ্ছে সামনেটা এখান থেকে?’

মহুয়া তাকাল ওদিকে। ধুলোর ঝড়ের মধ্যে, প্রখর উষ্ণ ঝাঁজের মধ্যে পলাশের লাল বুঝি এতক্ষণ ঝাপসা ছিল। সারা দুপুর আগুনে পুড়ে সব খাদ ঝরে গেছে সোনার—এখন লালে একটা নরম স্নিগ্ধতা লেগেছে। লালের ছোপে—ছোপে সবুজের মহিমা আরও খুলেছে যেন।

ও বলল, ‘সত্যি! আপনার এই শাকুয়া—টুঙ দারুণ।’

ফ্লাস্ক খুলতে—খুলতে একদৃষ্টে ওদিকে চেয়ে মহুয়া জীবনে এই প্রথমবার জানল, ওর সাতাশ বছর বয়সে যে, প্রকৃতির কী দারুণ প্রভাব মানুষের মনের উপর! এই উদার উন্মুক্ত জঙ্গলে যার যা—কিছু দাবি আছে সবই বুঝি দিতে পারা যায় কাউকে, কিছুই বাকি না রেখে।

সুখন ফ্লাস্কের ঢাকনিতে চা নিল। পরক্ষণেই মহুয়ার কথা মনে হওয়াতে ও বলল, ‘আপনি এটা নিন, আমাকে গেলাসেই চা ঢেলে দিন।’

‘না, না। ঠিক আছে।’ মহুয়া বলল।

সুখন কঠিন গলায় বলল, ‘কথা শুনতে হয়। আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট।’

‘ঈ—শ—! কত্তই যেন ছোট।’ ঠোঁট উলটে মহুয়া বলল।

হাসতে হাসতে সুখন বলল, ‘অনেক ছোট। দশ—বারো বছরের ছোট তো বটেই।’

‘আহা, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচিওরড হয়। এই ডিফারেন্স ডিফারেন্সই নয়।’

‘হুমম’—বলল সুখন।

পরক্ষণেই চায়ে চুমুক দিয়েই চমকে উঠে বলল, ‘চা কে বানিয়েছে? এ তো মংলুর হাতের চা নয়? আপনি’?

মহুয়া মুখ নামিয়ে বলল ‘কেন? খারাপ হয়েছে?’

সুখন পুলকভরে বলল, ‘খারাপ কী? দারুণ হয়েছে। একেবারে টাটী—ঝারীয়ার পণ্ডিতজির দোকানের চায়ের মতো ফারস্ট ক্লাস।’

চা খাওয়া হলে, মহুয়া ব্যাগ হাতড়ে কাগজের মোড়ক বের করল একটা। বলল, ‘এই নিন।’

সুখন হাত বাড়িয়ে নিল।

মহুয়া ঠোঁট টিপে হাসছিল।

আবার বলল, ‘এই নিন, এটাও; আমি আপনাকে দিলাম, আমার প্রেজেন্ট।’ বলেই, ছোট টিনটা এগিয়ে দিল সুখনের দিকে।

হাসছিল সুখনও। প্যাকেটের মধ্যে পান এবং একশোবিশ জর্দার আস্ত একটা টিন পেয়েই, খুশিতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল ‘একি? কোত্থেকে পেলেন?’

মহুয়া বলল, ‘কী কিম্ভূতকিমাকার নাম রে বাবা। একশো বিশ!’

সুখন হাসল। বলল, ‘চারশো বিশ হলে খুশি হতেন?’

দুজনেই হেসে উঠল। তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ।

বেলা পড়ে এসেছিল। রোদের তেজ নেই আর। পশ্চিমাকাশে ম্লান একটা গোলাপি আভা ঝুলে রয়েছে। শাকুয়া—টুঙে বসে অস্তগামী সূর্যকে তখনও দেখা যাচ্ছে। আর তারই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে উলটোদিকে উদীয়মান চাঁদ। দোলের আর তিনদিন বাকি। সূর্য আর চাঁদে মিলে পৃথিবীকে চব্বিশ ঘণ্টাই উজালা করে রাখবে বলে স্থির করেছে যেন।

এখানের এই এক মজা। দিনে যত গরমই থাক না কেন, আলোটা কমে আসতেই কেমন শীত—শীত করতে থাকে। অন্ধকার হয়ে গেলে তো কথাই নেই। তখন পাতলা সোয়েটার বা চাদর থাকলে, বাইরে বসতে ভালো লাগে।

চা খেয়ে, পান খেয়ে, একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখন চুপ করে পিছনে একপাশে বসে মহুয়াকে দেখছিল।

মহুয়া বারান্দাটার সামনের দিকে বসে নীচের উপত্যকার দিকে চেয়েছিল।

মহুয়ার মদের নেশা যেমন সুখনকে এখানে বহু রাতে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তেমন মহুয়া নামে এই মেয়েটির আশ্চর্য সান্নিধ্যর আমেজ ওকে যেন আরও কোনো তীব্রতর নেশায় আবিষ্ট, আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মহুয়াকে অবশ করেছে এই প্রকৃতি, এই হঠাৎ—দেখা, হঠাৎ কাছে—আসা, রুক্ষ, ছেলেমানুষ ও বর্বর পুরুষটি। মহুয়ার সাতাশ বছরের জীবনের পরমপুরুষ।

অনেকক্ষণ এমনি করেই দুজনে চুপ করে বসেছিল। দুজনে বারান্দার দু’দিকে, আগে পিছনে। মধ্যে অনেকখানি ব্যবধান। ব্যবধান শুধু ভূমির নয়, অনেক কিছুর।

বাইরে দিনের নিভন্ত রং, সন্ধের আসন্ন তরল অন্ধকার, চাঁদের ফুটন্ত আলো, ঘর—ছাড়া টি—টি পাখির বুক—চমকানো ডাক ও ঘরে—ফেরা টিয়ার দলের তীক্ষ্ন ছুরির ফলার মতো স্বগতোক্তি, সব মিলে—মিশে ভেঙে—চুরে যখন দারুণ কোনো একটা মিশ্র ও অলৌকিক আবেশের সৃষ্টি হচ্ছে ধীরে ধীরে—চুপিসারে—প্রকৃতির আধো—খোলা বুকের মধ্যে, তখন সুখন আর মহুয়ার বুকের মধ্যেও অনেককিছু বোধ—সংস্কার, আনন্দ—দুঃখ, পাহাড়ি নদীর স্রোতের মধ্যের তাণ্ডবে গড়াতে—থাকা ক্ষয়িষ্ণু নুড়িগুলোরই মতো ক্রমান্বয়ে ভাঙচুর হচ্ছিল। ওরা কেউই চেতনে ছিল না। অবচেতনের আশ্চর্য কুঠুরিতে এক পরিপূর্ণতার স্বপ্নে ওরা দুজনেই ডুবে গেছিল। ওরা দুজনে ভাঙচুর হচ্ছিল যে—যার মনের মধ্যে। একের ভাবনা অন্যে জানছিল না। ভাবনা তো দেখানো যায় না। দুজনের অজানিতে, এই ফিসফিসে গুমরানো বনজ বাতাসে ওরা একে—অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠছিল।

নীচের নদীর অন্ধকার খোলে—খোলে পেঁচা ডেকে ফিরছিল—কিঁচর—কিঁর, কিঁ—চিঁ—কিঁ—চিঁ—কিচর—। ওদের কানে আসছিল, অথচ সে ডাক কানে আসছিলও না। এক নিষিদ্ধ অথচ নির্মল আত্ম—অবলুপ্তির মধ্যে ওরা দুজনেই দুজনের সান্নিধ্যর নরম নেশায় যেন বেদম বুঁদ হয়ে ছিল।

কতক্ষণ যে ওরা ওইভাবে বসেছিল, ওরা কেউই জানে না।

যখন হুঁশ হল তখন একেবারে বেলা পড়ে গেছে। নীচু থেকে নানারকম রাত—চরা পাহাড়ি পাখি ডাকছে। চারদিকে, বারান্দায়, উপত্যকায় তরল সুগন্ধি ক্ষণিক অন্ধকার তখন।

আলোর মধ্যে ওরা নিরুচ্চার ছিল। অন্ধকারে ওদের দুজনেরই মন কিছু বলার জন্যে উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

হঠাৎ নীচের পাহাড়ি নদীর খোল থেকে হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে একটা ভয়—পাওয়ানো বুক—চমকানো ডাক ভেসে এল।

মহুয়া ভীষণ ভয় পেয়ে, কী করবে ভেবে না পেয়ে এক দৌড়ে সুখনের একেবারে কাছে চলে এল।

দেওয়ালে হেলান দিয়ে, দু’পা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল সুখন। কাকে এই সমর্পণ জানে না সুখন, কিন্তু এমন সমর্পণী অবস্থায় কখনো ও নিজেকে আবিষ্কার করেনি।

সুখন ওর সবল ডান হাতে মহুয়াকে অভয় দিয়ে ওকে কাছে টেনে বসাল।

মহুয়ার বুক ওঠানামা করছিল—সত্যি সত্যি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও।

সুখন মহুয়ার রেশমি—চুলের মাথাটি ওর বুকের কাছে নিয়ে এসে ডান হাত দিয়ে ওকে আশ্বাসে, অভয়ে, বড় যতনভরে জড়িয়ে রইল।

ফিসফিস করে বলল, ভয় পেয়েছেন?

লজ্জা, ভয়, এই হঠাৎ অভাবনীয়ভাবে সুখনের বুকে আসার আনন্দ, সব মিলিয়ে মহুয়া অস্ফুটে বলল, হুঁ।

সুখন কথা বলল না কোনো। ওর থুতনিটা মহুয়ার সিঁথির উপর ছুঁইয়ে বসে রইল। বসে রইল অনেকক্ষণ।

মহুয়া মুখ তুলে এক সময় বলল, ‘ওটা কীসের ডাক?’

‘হায়নার।’ সহজ গলায় বলল সুখন।

‘আপনি এখানে একদম একা—একা থাকেন, ভয় করে না আপনার?’

‘কীসের ভয়?’ কোনোরকম বাহাদুরি না দেখিয়েই বলল সুখন।

তারপর বলল, ‘আপনি একা থাকলেও ভয় করত না। থাকলেই অভ্যেস হয়ে যেত।’

তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনি আশ্চর্য মেয়ে। এই রাতে বনের হায়নাকে ভয় পেলেন, আর এই অশিক্ষিত লোকটাকে, যে লোকটার সঙ্গে আপনার কোনো ব্যাপারেই কোনো দিকেই মিল নেই, সেই মিস্ত্রিটার সঙ্গে রাতের বেলায় এখানে থাকতে ভয় পেলেন না? আপনাকে সত্যিই বুঝতে পারলাম না। আপনি ভীষণ অন্যরকম।’

আপনিও—মহুয়া ভয় কাটিয়ে উঠে বলল।

সুখন বলল, ‘আমি যদি আপনাকে নিয়ে ওই সামনের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যাই, তখন কী করবেন?’

‘কিছুই করব না’। স্পষ্ট গলায় মহুয়া বলল।

তারপরই বলল, ‘পারবেন? আমাকে নিয়ে সত্যিই পালাতে পারবেন? তাহলে বুঝব আপনার সাহস কত? আমি কিন্তু পালাতে পারি! এমন সুন্দর জায়গা—আহা!’

‘আশ্চর্য!’ বলেই সুখন উঠে দাঁড়াল।

উঠে প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। সুখনকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ওর মনে হল, এমন চিন্তায় ও জীবনে আগে পড়েনি। ওর সমস্ত বুদ্ধি দিয়েও মহুয়াকে ও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারল না। এই মুহূর্তে নিজেকেও না।

ও পায়চারি করতে লাগল বারান্দায়—সিগারেট টানতে টানতে।

মহুয়া আড়চোখে দেখছিল সায়ান্ধকারে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা একবার বাড়ছে আর একবার কমছে।

সিগারেট খাওয়া শেষ করে, হঠাৎ আগুনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সুখন।

কালুয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘরের সামনে শুয়ে ছিল—ও হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল—যেমন অদ্ভুত দীর্ঘশ্বাস একমাত্র কুকুররাই ফেলতে পারে।

কালুয়ার দিকে একঝলক তাকিয়েই সুখন সহজ গলায় বলল, ‘চলুন এবার যাওয়া যাক। আপনার বাবা ও কুমারবাবু চিন্তা করবেন। ইতিমধ্যে ওঁরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই।’

মহুয়া বলল, ‘এখন না। এখুনি আমি যাব না। আমি এখানে থাকব।’

তারপর হঠাৎ ধরা—গলায় আবার বলল, ‘আমি এখানেই থাকব।’

সুখনের মনে হল, ‘এখানেই’ এবং ‘থাকব’ কথা দুটির উপর অস্বাভাবিক জোর দিল যেন মহুয়া।

সুখন দৌড়ে এল মহুয়ার কাছে। এসে মহুয়ার চোখে খুব কাছ থেকে তাকাল।

মহুয়া ওর চোখে চাইল। অস্ফুটে বলল, ‘আমি কিন্তু সত্যি—সত্যিই থাকব—সত্যি।’

সুখন হেসে ফেলল। বলল, ‘পাগলি। আপনি একেবারে পাগলি। কী যে বলেন, তার ঠিক নেই।’

মহুয়া রাগ করে, জেদ ধরে বলল, ‘আমি যা বলছি, অনেক ভেবে বলছি।’

তারপরই বলল, ‘আমাকে বুঝি আপনার অপছন্দ?’

সুখন ওর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিল। বলল, ‘এবারেই ঠিক বলেছেন।’

তারপর বলল, ‘আপনাকে অপছন্দ করবার মতো লোক কি কেউ আছে? কিন্তু আপনি কী বলছেন, আপনি জানেন না। আমি কী, কেমন লোক, কী পরিবেশে থাকি, কীরকম মিস্ত্রিগিরি করি সবই তো নিজের চোখে দেখলেন—তারপরও কী করে বলি যে, আপনি সুস্থ? আপনার সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

সুখন অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাকে কষ্ট দিয়ে আপনার কী লাভ? কালই তো গাড়ি সারানো হয়ে গেলে চলে যাবেন—আমি যা, যেমন আছি, তাই—ই থাকব। আমি থেমে—থাকা গাড়ি সারাই—এই—ই আমার কাজ।’

তারপরই একেবারে চুপ করে গেল সুখন।

মহুয়া তেমনই দাঁড়িয়ে রইল ওর সামনে নিথর হয়ে।

দীর্ঘ নীরবতার পর সুখন বলল, ‘সব গাড়িই সারানো হয়ে গেলে এক সময় ধুলো উড়িয়ে, হর্ন বাজিয়ে চলে যায়। আমি যেখানে থাকার সেখানেই থাকি, থাকবও। আমার সঙ্গে এতবড় রসিকতা করবেন না। প্লিজ, আপনাকে বারণ করছি, এমন করবেন না।’

মহুয়া সুখনের কাছ থেকে সরে গিয়ে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, ‘কী? আমি রসিকতা করছি?’

মহুয়ার ছোট্ট কপালের মস্ত টিপটার অর্ধেক মুছে গেছিল, এক কোমর চুলের খোঁপাটা ভেঙে গেছিল—কপালের চুল লেপটে ছিল কানের পাশে। ওর নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল, চোখে আগুন জ্বলছিল।

মহুয়া বলল, ‘ভীতু, ভীষণ ভীতু আপনি।’

সুখন কী করবে ভেবে পেল না। কী করবে, কেমন করে ওর অন্তরের তীব্র আনন্দ এবং অসহায়তা ও মহুয়াকে বোঝাবে তা বুঝতে পারল না।

সুখনের ইচ্ছে হল অনেক কিছু বলে, কিন্তু কিছুই না বলে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মহুয়া ঝাঁপিয়ে এসে সুখনের বুকে ওর নরম হাতের ছোট্ট ছোট্ট মুঠি দিয়ে বারবার আঘাত করতে লাগল। বলতে লাগল, ‘ভীতু, কাপুরুষ!’

সুখন কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

চাঁদটা আরও উপরে উঠেছে একটা হলুদ থালার মতো। হলুদ চাঁদের আলোয় বিশ্বচরাচর ভরে গেছে। সন্ধের পর থেকেই যে ঠান্ডা হিম—হিম ভাবটা বনে—পাহাড়ে ভরে যায়, তাতে মহুয়া, করৌঞ্জ আর শালফুলের গন্ধ মিশে গেছে। পাশ থেকে একটা কোকিল নাভি থেকে স্বর তুলে ডাকছে—কুহু—কুহু—কুহু—কুহু—দূর থেকে তার সঙ্গিনী সাড়া দিচ্ছে শিহর তুলে কুহু—কুহু—কুহু।

সুখনের মাথার মধ্যে একজন মিস্ত্রি হাতুড়ি পিটিয়ে কোনো গাড়ির বাঁকা মাডগার্ড সিধে করছিল ক্রমান্বয়ে—হাতুড়ির পর হাতুড়ি মেরে।

সুখন সেই সুন্দরী হাওয়া—লাগা আমলকী বনের মতো থরথর করে ভালোবাসায় কাঁপতে—থাকা সুগন্ধি মহুয়ার দিকে একবার ভালো করে চাইল। তারপরই তার হাত ধরে বলল, ‘চলুন।’

সুখনের মনে হল, সে তার জন্মস্থানের গ্রহ—নক্ষত্রের নির্ভুল নির্বন্ধ—র দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এই গন্তব্য যেন বহুদিন আগে থেকেই নির্দিষ্ট ছিল।

সুখন নিজেকে বুঝতে পারল না। সুখনের মনে হল, এই বড়লোকের বেড়াতে—আসা মেয়েটি—সুখনের অনেকানেক জমিয়ে—রাখা অপমানের গ্লানি, অসম—ব্যবহারের ক্রোধ—এই সবকিছুকে নিবিয়ে ফেলার সুযোগ দিতে এসেছে।

সুখনের চোখ জ্বলে উঠল মুহূর্তের জন্যে। ও আর মানুষ নেই, ও হায়নার মতো কোনো অশ্লীল জানোয়ার হয়ে গেছে বলে ওর মনে হল।

মহুয়া একটু ভয় পেল। বলল, ‘কোথায়?’ বলেই ঘরের দিকে পা বাড়াল।

সুখন বলল, ‘এখানে নয়, আপনি ঘরের মধ্যের নন, আপনি যে মহুয়া—প্রকৃতির; জঙ্গলের। জঙ্গলে চলুন।’

মহুয়ার হাত ধরে পাহাড়ি ঘুরালের মতো নেমে চলল সুখন পাকদণ্ডী দিয়ে নীচের ঝরনার দিকে।

মহুয়া হাঁপাচ্ছিল, অমন খাড়াপথে নামা ওর অভ্যেস ছিল না। ওর হাঁটু, দু’ ঊরু উত্তেজনায়, নিষিদ্ধ ভালো—লাগায় এবং একটু ভয়েও থরথর করে কাঁপছিল। সুখন ওকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল; তারপরই কাঁধে।

তারপর তরতর করে নেমে এল নদীর খোলে। সেখানে পৌঁছেই মহুয়াকে নামিয়ে দিয়ে ওর দুই সবল হাতে মহুয়ার নরম মহুল ফুলের মতো ছিপছিপে শরীর জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চুমু খেতে লাগল সুখন যে, মহুয়ার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। ছটফট করতে লাগল মহুয়া।

সুখন ওকে ছেড়ে দিতেই মহুয়া এতক্ষণের, হয়তো এত বছরের রুদ্ধ আবেগ ও মেয়েলি কামের তীব্র অথচ চাপা উচ্ছ্বাসে সুখনকে চুমুতে চুমুতে ভরে দিল।

মহুয়া থামলে, সুখন বলল, ‘আসুন, সব কিছু খুলে আসুন।’

মহুয়া মুখ নামিয়ে অন্যদিকে চেয়ে লাজুক গলায় বলল, ‘সব?’

‘হ্যাঁ, সব’,—কঠিন গলায় বলল সুখন।

সুখনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল।

চাঁদের আলোয় সুখনের দিকে চেয়ে মহুয়ার মনে হল যে, এ লোকটাকে জানে না ও। একেবারেই চেনে না।

মহুয়ার মনে হল, একটা নিরীহ, ঘুমন্ত বাঘকে গুহা থেকে বের করে এনেছে ও খুঁচিয়ে—খুঁচিয়ে। বাঘটা এবার বদলা নেবে। বাঘটার শরীরের পেশী ফুলে উঠেছে, গলায় ঘড়ঘড়ানি শব্দ উঠেছে। বাঘটা বুঝি ওকে আঁচড়ে—কামড়ে রক্তাক্ত করে দেবে।

পাথরের মধ্যে কী যেন একটা পড়ার শব্দ হল। জিনিসটা পড়েই পাথরে গড়িয়ে বালিতে থামল। সুখন তুলে নিল জিনিসটা। চাঁদের আলোয় গোলাকার পদার্থটা চকচক করছিল।—বল বেয়ারিং।

সুখন হেসে ফেলল। বলল, ‘এ কী?’

মহুয়াও লাজুক হাসি হাসল। বলল, ‘বুকের মধ্যে রেখেছিলাম।’

‘এত ভালোবাসেন আপনি এগুলো? আপনি এখনও ছোটই আছেন। সত্যিই ছোট আছেন। আপনি মিছেই ভাবেন যে আপনি বড় হয়ে গেছেন।’

তখন জঙ্গলের ভিতর থেকে, নদীর অববাহিকায় ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে একটা পিউ—কাঁহা পাখি ডাকছিল। ক্রমান্বয়ে ডেকেই চলেছিল, পিউ—কাঁহা, পিউ—কাঁহা বলে। অন্য পাশ থেকে ঢাব পাখি ডাকছিল, গম্ভীর ভূতুড়ে গলায় ঢাব—ঢাব—ঢাব—ঢাব। পিউ—কাঁহার গলায় মহুয়া আর সুখনের আসন্ন মিলনের আনন্দ উড়ছিল, আর ঢাব পাখির স্বরে ওদের অসামাজিক নিষিদ্ধ সম্পর্কের গোপনীয়তা।

কালো পাথরের পাশে পিছন ফিরে দাঁড়ানো বিবসনা, চুল—খোলা মহুয়াকে চাঁদের আকাশের পটভূমিতে দেখে সুখনের মনে হচ্ছিল যে, মহুয়াই পৃথিবীর প্রথম ও শেষ নারী। এই শালফুল, করৌঞ্জ আর মহুয়ার গন্ধের মধ্যেই ও জন্মেছিল, এরই মধ্যে ওর পরম পেলব পরিণতি।

সুখন নিজের বশে ছিল না। উচিত—অনুচিত বোধ, ভবিষ্যতের সব কথা, ওর মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেছিল।

সে—মুহূর্তে সুখনের মনে হচ্ছিল যে, নারীমাত্রই বুঝি মহুয়ার মতো। তারা জন্মায়, হাসে, খেলে, তারা খেলায়; নিজেরা পূর্ণ হয়, পরিপ্লুত করে পুরুষকে। করেই, আবার চাঁদের আলোয়, ফুলের গন্ধে ভাসতে ভাসতে অন্য পরিপ্লুতির দেশে, নতুন আবেশের, আবেগের দেশে ভেসে যায়। নারীরা কাছে থাকে, বাঁচে ও বাঁচায়। পুরুষকে উজ্জীবিত করে, পুরুষের জীবনে নরম সুগন্ধি সব ফুল ফোটায়; কিন্তু তারা নিজেরা কখনও ফুরোয় না; ঝরে যায় না।

সাদা বালির মধ্যে হোলির চাঁদকে সাক্ষী রেখে, ফুলের গন্ধে মন্থর বাতাসকে সাক্ষী রেখে, মহুয়া সুখনের সঙ্গে এক দারুণ সুগন্ধি খেলায় মাতল।

খেলে, খেলিয়ে, আনন্দ দিয়ে, আনন্দ পেয়ে, ফুরিয়ে দিয়েই নতুন করে ভরিয়ে দিয়ে ওরা দুজনেই এক তীব্র ভালোবাসায় বিভোর হয়ে যেতে লাগল। করৌঞ্জের গন্ধের মতো, চাঁদের আলোর মতো ওরা একে অন্যের মধ্যে এবং দুজনে প্রসন্ন প্রকৃতির মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে গেল।

পাখিটা ডেকেই চলল, পিউ—কাঁহা, পিউ—কাঁহা, পিউ—কাঁহা।

মহুয়া অস্ফুটে বলল, ‘সুখ, আপনি কোথায়? আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

সুখন মহুয়ার চোখে চুমু খেল। ফিসফিস করে বলল, ‘এই তো আমি, আমি এই যে!’

তারপর ওর ঠোঁটে ঠোঁট নামিয়ে এনে বলল, ‘সুখকে দেখা যায় না শুধু অনুভব করতে হয়।’

ক্ষণকালের জন্যে মহুয়ার মন একেবারে অসাড় হয়ে গেছিল। সমস্ত সাড় তখন তার শরীরেই শুধু দাপাদাপি করে ফিরছিল। এমনটি ওর জীবনে আর কখনও হয়নি।

উপরে তারা—ভরা, চাঁদ—ওরা আকাশ, ঝুঁকে—পড়া শালবন; ঝিঁঝিদের ঝিনঝিনি।

তখন চতুর্দিকে রাত ঝরছিল, চাঁদ ঝরছিল; মহুয়ার শরীরের ভিতরে মহুয়া ঝরছিল ধীরে—ধীরে। ফিস—ফিস—ফিস—ফিস—ফিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *