১. এই যে পাঁচ

রহস্য যখন রক্তে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

০১.

এই–এই যে পাঁচ। আর এই দ্যাখো, শেষ সাপটা টপকালাম। এবার দুই পড়লেই উঠে যাব।

–দেখো, তবু আমিই জিতব। আমি আগে ওখানে পৌঁছে যাব।

–আচ্ছা সোনা, ঠিক আছে, তুমি-ই জিতবে। তুমি সবসময় জিতবে। পিকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় জয়ন্ত।–এবার তোমার দান।

পিকু মিনিট খানেক ধরে বেশ নেড়েচেড়ে দান ফেলে। ছক্কাটা টালমাটাল করে দুই এ এসে দাঁড়ায়।

যাঃ, এক্কেবারে সাপের মুখে সাপটা আবার খেয়ে নিল।

না–আমি আর খেলব না। ছক্কাটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে উঠে পড়ে পিকু। ছুটে শোওয়ার ঘরে গিয়ে ঢোকে। খাটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর জোরে কেঁদে ওঠে। পিকু যখন কাঁদে তখন কান পাতা দায়। এত জোরে কাঁদে যে আগে আশপাশের বাড়ি থেকে সবাই খোঁজ নেয় কী হল?

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি খেলা ছেড়ে পিছু নেয়। ঘরে ঢুকে খাটের ওপর পিকুর পাশে শুয়ে পড়ে, ভোলানোর চেষ্টা করে।

–সোনা, এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়তে নেই। হয়তো ওই সাপটা পেরিয়ে তুই আমার আগেই উঠে যেতিস! আমার তো দুই পড়েই না!

পাঁচ বছরের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জয়ন্ত আদর করতে থাকে। কিন্তু অত সহজে পিকু ভোলার নয়। আশা করেছিল অন্তত এবার জিতবে। আর বাবাটাও দুষ্টু। কেমন করে অত বড় সাপগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল! পিকুর লাকটাই খারাপ। বারবার ওই পঞ্চাশের আর বিরাশির বিচ্ছিরি সাপগুলো গিলে খায়। এর পরেরবার ও তবেই সাপলুডো খেলবে যদি তাতে ওই বিচ্ছিরি সাপগুলো না থাকে।

–সোনা, সব খেলাতেই হারজিত হয়। তাতে এত কাঁদে না। পরেরবার হয়তো তুমি জিতবে। জয়ন্ত বলতে থাকে–তুমি আইনস্টাইনের কথা শুনেছ?

দূর থেকে বিতানের গলা আসে,–আচ্ছা ও আইনস্টাইনের কথা কী করে জানবে? কাকে যে কী বলো!

–বাহ্, আইনস্টাইনের কথা জানবে না?

–ঠিক আছে বাবা, তুমি আইনস্টাইনের কথা বলো। পিকু বাবার পক্ষ নেয়।

–উনি ছিলেন খুব বড় বিজ্ঞানী। এই যে তুমি রিমোট দিয়ে টিভি চালাচ্ছ, ফ্যান ঘুরছে, মা মাইক্রোওয়েভে রান্না করছে, তুমি ছোট ছোট খেলনার গাড়ি নিয়ে খেলছ, আমি কম্পিউটারে কাজ করছি–সবই কিন্তু বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। আর আইনস্টাইন ছিলেন একজন খুব বড় বিজ্ঞানী।

–বাবাই, আমাদের যে গাড়িটা আছে সেটাও কি আইনস্টাইনের বানানো?

হেসে ওঠে জয়ন্ত,না তা নয়, বিজ্ঞানীরা যে সবসময় নিজে বানান তা নয়, কীভাবে করা যায় তা বলেন। আর সবাই তো সবকিছু আবিষ্কার করেন না।

–আচ্ছা তোমার চশমাটাও কি বিজ্ঞানীদের তৈরি?

 –হ্যাঁ।

–আচ্ছা বাবাই, আমাদেরও কি বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন?

না, তা নয়। বলে খানিকক্ষণ থেমে থাকে জয়ন্ত। হয়তো পরে তাও হবে। বিজ্ঞানীরাই তৈরি করবে।

–বাবাই, ঠাকুররা তাহলে কী করেন? ঠাম্মা যে বলে সব ঠাকুররা করেন।

জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,–আমরা ঠিক করছি না ভুল করছি তা ঠাকুররা বলে দেন। জানো তো, আইনস্টাইন মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন, আমি জীবনে একটাই ভুল করেছি আর সেটা হল অ্যাটম বোম নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে। একটা চিঠি লেখা। ওই একটা চিঠির জন্যই বিশাল একটা অ্যাটম বোমা তৈরি হয়। জাপান এর দুটো আস্ত শহর তার জন্য ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়।

–বাবাই, ওই বোমাটা কি আইনস্টাইন তৈরি করেছিলেন?

না রে, আইনস্টাইন খুব ভালো লোক ছিলেন। উনি কখনও ভাবেননি যে ওনার আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ওরকম একটা মারাত্মক বোমা তৈরি করা হবে।

জানো তো, আমারও এরকম একটা সমস্যা হয়েছে।

কীরকম? তোর আবার কী সমস্যা?

–দীপুকে চেনো? ও খুব দুষ্টু। আমি মাটি আর ইটের টুকরো দিয়ে একটা বল তৈরি করেছিলাম। ও সেটাকে ছুঁড়ে রুজুদের কাচের জানলা ভেঙে দিয়েছে কাল।

–সে কী? মাকে বলেছিস?

–নাহ, আমরা পালিয়ে এসেছি। ওরা দেখতে পায়নি। আর রুজু আমাকে কাল খেলতেও নেয়নি। ভালোই হয়েছে।

বিতান, ও বিতান, শুনেছ? জয়ন্ত ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে যায়, কাল পিকুরা রুজুদের কাচের জানলা নাকি বল দিয়ে ভেঙে দিয়েছে!

.

০২.

হ্যালো–বিতান বলছি–হ্যালো…

রিং হতে বিতান এসে ফোন ধরেছিল। উলটোদিকের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। কীরকম একটা ঘ্যাসঘেসে আওয়াজ।

আরো খানিকক্ষণ উত্তর না পেয়ে বিতান ফোনটা রেখে আবার রান্নাঘরে এসে ঢোকে। জয়ন্ত অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আসবে আরও দশদিন পরে। এ কদিন রান্নার বিশেষ ঝামেলা নেই। তবু একটা কিছু তো তৈরি করতে হবে। আজও রান্নার লোক আসেনি।

ফোনটা আবার বাজছে।

–দেখতো সোনা, কার ফোন। রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠে বিতান।

টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি ছেড়ে ছুটে এসে ফোন ধরে পিকু। হ্যালো, আমি পিকু বলছি।

ওদিক থেকে কারও কথা শুনতে পায় না।

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে পিকু। বলে,–মা, কেউ কিছু বলছে না।

–অ্যাই, কে না জেনে ফোনে ওরকমভাবে কথা বলে না। দাঁড়া, আমি ধরছি।

বেরিয়ে এসে বিতান ফোনটা ধরে, হ্যালো, কে? শোনা যাচ্ছে না। কান্ট হিয়ার ইউ।

ফোনের উলটোদিকে তবু নীরবতা। পুরো নীরবতা নয়, পিছন থেকে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেন অনেক দূরে কেউ ফোনে কথা বলছে।

হ্যালো? বিরক্ত হয়ে আরও মিনিট দুয়েক ধরে থেকে ফোন ছেড়ে দেয় বিতান। ছেড়েই মনে হয় ফোনটা জয়ন্তর নয় তো?

জয়ন্ত আমেরিকায় পৌঁছে একটা নতুন ফোন নাম্বার দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই নাম্বারে ফোন করে বিতান। ফোনটা সুইচড অফ। অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক সময়েই জয়ন্ত সেলফোন চার্জ করতে ভুলে যায়। আর তা ছাড়া এখন ভারতে বিকেল চারটে, অর্থাৎ নিউইয়র্কে সকাল সাড়ে ছটা। এসময় হয়তো ফোনটা ইচ্ছে করেই অফ করে রেখেছে, যাতে কেউ বিরক্ত না করে, আচ্ছা, আজকেই তো ওর নিউইয়র্ক থেকে ডেট্রয়েট যাওয়ার কথা। মর্নিং ফ্লাইটে। ও তাহলে এখন ফ্লাইটেই আছে। আর তাই ফোন সুইচড অফ।

আজকে পিকুর ছুটি ছিল। অত্যধিক গরম পড়ায় স্কুলে ছুটি দিয়েছে। এবারে কলকাতায় গরমটা খুব বেশি মাত্রায় পড়েছে। পিকু একটা ছবি আঁকতে বসেছে।

–মা, বাবাই কবে আসবে?

–আচ্ছা, তুই রোজ একই প্রশ্ন করিস কেন বলতো? কালকেই তো বললাম, দশদিন

–তার মানে আজকের পরে ঠিক নদিন?

–হ্যাঁ, তুই একটা কাজ কর। ক্যালেন্ডারে লিখে রাখ। বাবাইকেও তো রোজ এক প্রশ্ন করিস।

জানো তো বাবাই সেদিন বলল যে বাবাই নাকি সায়েন্টিস্ট। সত্যি বাবাই সায়েন্টিস্ট? আইনস্টাইনের মতো?

হেসে উঠল বিতান,বাবাই হল ইঞ্জিনিয়ারসফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সায়েন্টিস্ট ঠিক নয়। তোর সঙ্গে মজা করেছে। তা আজ সকালে অত কী কথা হচ্ছিল বাবাই-এর সঙ্গে ফোনে? রাতেও বাবাইকে ঘুমোতে দিসনি!

বাবাই আমাকে অনেক গল্প বলছিল। বলছিল একটা যুদ্ধের কথা। অৰ্জুন বলে একটা রাজা যুদ্ধ করতে চাইছিল না। তা কৃষ্ণ ঠাকুর নাকি ওকে বলেছিল যে সবই তো আগে থেকে ঠিক করা আছে। ও যুদ্ধ করুক না করুক তাতে কিছু আসে যায় না।…মা, এটা কি সত্যি?

–হ্যাঁ, মহাভারতের কথা। আমি একদিন গল্পটা পড়ে শোনাব।

–না, তুমি গল্প বলতেই পারো না। তুমি বললে দু-মিনিটেই গল্প শেষ হয়ে যায়। বাবাই কী সুন্দর গল্প বলে। আমি বাবাই-এর কাছে শুনব।

জয়ন্তর সত্যি ধৈর্য আছে। আর ছেলেকে এত ভালোবাসে আর সময় দেয়! যত ব্যস্তই থাকুক, ঠিক সময় বার করে ওর সঙ্গে খেলবে, ওর সঙ্গে গল্প করবে। এই তো আমেরিকায় গিয়েও রোজ ছেলের সঙ্গে ফোনে গল্প করে। কোনওদিনও বাদ যায় না।

বাইরে কলিংবেল বেজে উঠল। ঘর পরিষ্কারের মেয়েটা এসেছে নিশ্চয়ই। দরজা খুলতে যাবে, আবার ফোনে রিং। দরজা খোলে বিতান। কাজের মেয়ে মিনতি এসেছে। ফোনে রিং হয়েই চলেছে। ফোনটা দৌড়ে এসে ধরে বিতান।

উলটো দিকের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার আমেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে বলে ওঠে,–আপনি কি জয়ন্তর স্ত্রী?

–হ্যাঁ বলুন।

–আমি জয়ন্তর অফিস থেকে বলছি। ওর আমেরিকার অফিসের কোলিগ আমি। আমার নাম মাইক।

কি–কিছু অসুবিধে হয়েছে জয়ন্তর?

কণ্ঠস্বর খানিকক্ষণ থেমে থাকে। দ্বিধাজড়ানো গলায় বলে ওঠে,দশমিনিট আগে আমরা খবর পেয়েছি জয়ন্ত যে ফ্লাইটে ডেট্রয়েট যাচ্ছিল সেটা ক্র্যাশ করেছে। ফ্লাইটে কেউ বেঁচে আছে। কিনা আমরা সে খবর এখনও পাইনি।

খানিক থেমে মাইক ফের বলে,–দুঃখ জানানোর কোনও ভাষাই নেই আমার কাছে। এত মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা এখান থেকে সবরকম সাহায্যের ব্যবস্থা করছি।

মাইক থেমে যায়। অন্যপ্রান্তে যে বিতান আর নেই তা টের পেয়েছে।

ফোনটা হাতে নিয়ে বিতান মাটিতে বসে পড়েছে। জয়ন্ত নেই! খানিক দূরে পিকু চেঁচিয়ে ওঠে, মা, বাবাই-এর ফোন? কবে আসছে?

.

০৩.

–ম্যাডাম, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা রজতের সম্বন্ধে এত কমপ্লেন পাচ্ছি যে ওকে আর এই স্কুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। হি ইজ নট নর্মাল। হি নিক্স ট্রিটমেন্ট।

–আপনি তো জানেনই, ওর বাবা একবছর আগে মারা যায়। এয়ার ক্র্যাশে। তারপর থেকেই ও মাঝেমধ্যে এরকম বিহেভ করে। কিন্তু আমি চেষ্টা করছি। কথা দিচ্ছি–

আচ্ছা, আপনিই বলুন আমরা অন্যান্য পেরেন্টসদের কী বলব। এই নিয়ে তিনবার হল। হঠাৎ করে ও প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন হাতের কাছে যা পায় তাই ছোঁড়ে। ও এখনও বিশ্বাস করে যে ওর বাবা জীবিত। কেউ সেটা মানতে না চাইলে, ও তার সঙ্গে মারপিট শুরু করে দেয়।

আমি ওকে বোঝাব। প্লিজ ম্যাম, আমাকে আর একবার চান্স দিন।

–আর অ্যাটেন্ড্যাস! অর্ধেকের বেশিদিন ও স্কুলে আসেনি। হাউ ডু ইউ এক্সপ্লেন দ্যাট?

–ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। আমি কথা দিচ্ছি ও আসবে–রেগুলার ক্লাস করবে এখন থেকে।

অসহায় দৃষ্টিতে বিতান প্রিন্সিপ্যালের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী করে বোঝাবে যে স্কুল থেকেও যদি ওকে বার করে দেওয়া হয়, তাহলে কোনওভাবেই পিকুকে আর স্বাভাবিক করে তোলা যাবে না। সব ডাক্তারের একই পরামর্শ পিকুকে যতটা সম্ভব ব্যস্ত রাখতে হবে। তবেই আস্তে আস্তে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। শেষে কোনওমতে প্রিন্সিপ্যাল রাজি হন। আর জানিয়ে দেন যে এবারই লাস্ট চান্স।

পিকু আজকাল আগের মতো গল্পের বই পড়ে না, খেলাধুলো করে না। কারুর সঙ্গে মেশে না। এমনকী বাবার পড়ার ঘরে পর্যন্ত ঢোকে না। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে খেপে ওঠে। তখন ওকে ধরে রাখাই দায় হয়। হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে ফেলে। চিৎকার করে বলতে থাকে–তোমরা সবাই বিচ্ছিরি, মিথ্যেবাদী। কেউ খেলতে জানো না। গল্প বলতে জানোনা।

বিতান জানে না ওর ছেলে আর কোনওদিন স্বাভাবিক হবে কিনা। যাকে একসময় সারাক্ষণ ঘরে ছোটাছুটি করতে দেখত, সবসময় হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল দেখত,–সেই এখন চুপচাপ অন্ধকার। ঘরে বসে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাঝে মাঝে মনে হয় যে একদম অন্য কোনও জগতে হারিয়ে গেছে।

এরমধ্যে দুদিন বাড়ি থেকে একা বেরিয়ে গেছে। বিপদ হতে পারত। নেহাতই বিতান খুব সতর্ক ছিল, তাই দুবারই কয়েকমিনিটের মধ্যে টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে লোকজন লাগিয়ে খোঁজাখুঁজি করে পেয়েছে। বাড়িতে এখন সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে, কখন কী বিপদ হয়!

.

০৪.

কাকু, আমার কোনও চিঠি আছে? আমেরিকার থেকে?

মনোহরবাবু সাইকেল থেকে নেমে ছেলেটার দিকে তাকালেন। সেই ছেলেটাই। রোজ একই প্রশ্ন করে। দোতলা বাড়ির একতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

অন্যদিন কোনওরকমে না বলে চলে যান। এমনিতেই আজকাল চিঠিপত্র আদানপ্রদান। খুব কমে গেছে। দু-একটা আসে বিদেশ থেকে। তা সেটা আগে থেকেই খেয়াল থাকে। তা আজ শুধু না বলে থেমে থাকলেন না মনোহরবাবু। ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন। রোগা– বছর আটেক বয়েস হবে। চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল–গভীর দৃষ্টি। রং রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেলেও ফরসার দিকে।

–কেন তোমার কি কারো চিঠি আসার কথা আছে?

চুপ করে থাকল ছেলেটা।

কী নাম তোমার?

–পিকু। আমার জন্য কোন আমেরিকার চিঠি নেই না?

–না বাবু। কার চিঠি?

না–এমনিই–বলে ছেলেটা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

মনোহরবাবুর অজ একটু সময় আছে। দোনামনা করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। কলিংবেলটা টিপলেন। দু-তিনবার টেপার পরে দরজা খুলল এক মাঝবয়েসি মহিলা। মাঝারি গড়ন-সুন্দরী। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সারা পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ এসে দানা বেধেছে।

একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন মনোহরবাবু। আমি এখানকার নতুন পিওন। মাসদুয়েক এসেছি। বারান্দায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিলনাম বলল পিকু-ওকি আপনার ছেলে?

অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে গেল মহিলার। মুহূর্তে সজাগ হয়ে বলে উঠল–কেন কিছু গন্ডগোল করেছে?

না–তা নয়। আসলে মাঝেমধ্যেই জিগ্যেস করে ওর আমেরিকা থেকে কোনও চিঠি এসেছে কিনা! কিছু আর্জেন্ট চিঠি আসার কথা আছে?

বিতান একটু দ্বিধা করে বলে উঠল,–আসলে ওর বাবা একসময় আমেরিকায় ছিলেন। তাই।

–তা এখনও উনি ওখানেই?

না কয়েকবছর হল–খানিকক্ষণ থেমে বিতান ফের বলে উঠল–ওখানে মারা গেছেন।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মনোহরবাবু। কি বলবেন জানেন না। মৃত্যু তো আসেই। কারোর সময়ে আসে কারোর অসময়ে। কিন্তু বাড়ির রং চটা দেওয়াল–আগাছা ভরা বাড়িতে ঢোকার রাস্তা–আর সর্বোপরি ওই মহিলার মুখ দেখে একটা কথাই মনে হল মনোহরবাবুর। কারো কারো মৃত্যু অনেকসময় এত গভীর দাগ ফেলে যায়, যে সে দাগ আর মোছে না। এখানে যেন তাই জীবনটা শামুকের গতিতে এগোচ্ছে।

মনোহরবাবু আর কথা বাড়ালেন না। বেরিয়ে এলেন। ছেলেটা আবার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রিলের রডে নাক ঠেকিয়ে ওনারই দিকে তাকিয়ে আছে।

.

০৫.

–আচ্ছা মা, রাতুল বলছিল এয়ারক্র্যাশ হলেও অনেকে নাকি বেঁচে যায়। ও বলছিল যে যারা প্লেনে বেল্ট বেঁধে বসে থাকে, তাদের নাকি কিছু হয় না। সত্যি মা? ওরা প্লেনে করে ভুটানে বেড়াতে গিয়েছিল। তখন এয়ার হোস্টেস ওকে বলেছে।

হতেও পারে সোনা।

তা হলে মা-বাবাই বলে থেমে যায় পিকু। বিতান কথা বলে না। শুধু পিকুর চুলে আঁকিবুকি কাটতে থাকে। মাথার ওপরে খোলা আকাশ। কিন্তু আজ তারা নেই। সবকটা মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। তবু এই মুখ গোমড়া আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জলটাকে সামলে নিল বিতান। আজ ওর মন একদম ভালো নেই। আর মন ভালো না থাকলেই ওরা বাড়ির ছাদে চলে আসে। চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশার ছোট্টজীবন ওই বিশাল আকাশের কাছে সমর্পণ করে খানিকক্ষণের জন্য শান্তি পাওয়া যায়।

নতুন বছর সবে শুরু হয়েছে। আজ ৩ জানুয়ারি। পরশুদিন সারা শহর যখন নতুন বছরকে বরণের নেশায় উন্মত্ত ছিল, তখন বিতানের একাকীত্ব যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসা হাসির আওয়াজ-গান-জোরে কথাবার্তা সবকিছুই যেন অসহ্য লাগছিল। মনে হচ্ছিল সবাই যেন ওদেরকে নিয়েই ঠাট্টা করছে। সবাই যেন ওদেরকে আরও একঘরে করে দিয়েছে। পিকুর উদাস মুখ–মাঝেমধ্যে উদ্দেশ্যহীন ছটফটানি যেন ওই অনুভূতিটাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সত্যিই এ-বাড়িতে কিসের যেন বড় অভাব।

আজকে পিকুর স্কুলে অ্যানুয়াল স্পোর্টস ছিল। ওর এখন ক্লাস ফোর হয়েছে। রিলে রেসে সিলেক্টেডও হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পিকু স্কুলে গিয়ে যে কি ক্ষেপে গেল! কিছুতেই দৌড়বে না। অথচ ও না নামলে ওদের পুরো টিমই দৌড়তে পারবে না। কোনওভাবেই রাজি করানো গেল না পিকুকে। শেষে স্কুল থেকে ওকে শাস্তি দিয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ ক্লাসরুমে নিলডাউন করে রেখেছিল। বিতানকেও ক্লাস টিচার ডেকেছিলেন। মাথা হেঁট করে পিকুর সম্পর্কে হাজারো নালিশ শুনতে হয়েছে। ক্লাসে মনোযোগ নেই। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কোনও বন্ধু নেই। এমনকী মিস ওর সম্বন্ধে অস্বাভাবিক কথাটা বলতেও ছাড়েননি।

অথচ বিতান জানে যে এসবের পিছনেই আছে ওর বাবার হঠাৎ মৃত্যু। এই তীব্র অভাববোধ সময় সময় ওকে পাগল করে দেয়। আজকেও নিশ্চয়ই খেলার মাঠে প্রায় সবারই বাবাকে সঙ্গে দেখে ওর এই পাগলামি। বিতান জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে চায় বারবার। যে চলে গেছে সে তো আর কখনই আসবে না। কিন্তু পিকুর এই ব্যবহারই ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দেয় না। আরও বেশি করে জয়ন্তর কথা মনে করায়। তাই রাগটা পিকুর ওপরেই প্রকাশ করে বিতান। আজও মাথা এত গরম হয়ে গিয়েছিল যে বাড়িতে এসে বেশ কয়েক ঘা পিকুকে দিয়ে তবেই ঠান্ডা হয়েছে বিতান। তারপরে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। তারপরে ছাদে উঠে এসেছে। এতসব ঘটনা যেদিন ঘটে যায় সেদিন কি আর খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় না নিয়ে ওরা পারে! মনে হয় ওই মেঘের আড়ালেই কোথাও যেন জয়ন্ত আছে। একটা অজানা উষ্ণতা শীতের সন্ধেতেও ছুঁয়ে যায় ওদের। বিতান ছেলের হাতটাকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *