১. উন্নয়নের ইতিহাস ও কৃষি: একটি প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা

প্রথম অধ্যায়

উন্নয়নের ইতিহাস ও কৃষি
একটি প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা

এই বইটির প্রধান উদ্দেশ্য, ভারতের কৃষি-অর্থনীতিকে নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করা এবং তার বর্তমান সংকটের কারণগুলি নির্দেশ করা। ভারতের কৃষির দীর্ঘমেয়াদি গতিহীনতা বা স্থবিরত্বের কিছু গভীর ও আশু কারণ অবশ্যই আছে। সেগুলি ছাড়াও এর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অর্জিত এমন কিছু চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, আজকের এই স্থবিরতার পিছনে যেগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে উদ্ভূত এক বিশেষ পরিস্থিতির সূত্রে ভারতের কৃষিতে যে-সংকট উদ্ভূত হয়েছে তার পিছনে রয়েছে এই উভয় কারণ।

ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতির বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেই ষোড়শ শতক থেকে আজ অবধি, বিশ্ব-পুঁজিবাদ গঠনের নানা স্তরে, এর গতিপ্রকৃতি কম-বেশি প্রভাবিত হয়েছে পুঁজিবাদের সঙ্গে নানা প্রকার সংযোগের ফলে। বিশ্বের প্রথম পুঁজিতান্ত্রিক দেশ ব্রিটেনের উন্নয়নের নানা স্তরে ব্রিটিশ পুঁজির সঙ্গে ভারতীয় কৃষির সংযোগ ঘটেছিল, তার ফলে ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতির চরিত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য জন্ম নেয়। ব্রিটেনে শিল্প-পুঁজি বিকাশের আদি পর্বে যখন বাণিজ্যিক পুঁজির প্রাধান্য ছিল, তখন ভারতে চলেছিল বৈদেশিক বাণিজ্যিক পুঁজির কর্তৃত্ব। পরে ব্রিটেনে বাণিজ্যিক পুঁজির জায়গায় শিল্প-পুঁজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সংযোগ মূলত নির্ধারিত হচ্ছিল ব্রিটেনে ‘পুঁজির বর্ধিত পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া’ বিকাশের স্বার্থে শিল্প-কাঁচামাল হিসেবে এদেশের কৃষিজাত পণ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে এবং প্রস্তুত পণ্য এদেশের বাজারে রফতানি করার মাধ্যমে। এর ফলে শুধু যে আমাদের সনাতন হস্তশিল্পগুলিরই ক্ষতি হল তা নয়, সাধারণভাবে শিল্পের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি হল। যেমন, বয়নশিল্পের ক্ষেত্রে হস্তচালিত তাঁতশিল্প সস্তায় কাঁচামাল পাওয়ার অবাধ সুযোগ হারাল, তার বাজারের ক্ষতি হল, উপরন্তু আমাদের সদ্যবিকশিত মিল-এ প্রস্তুত সুতি ও সুতি বস্ত্র অসম প্রতিযোগিতার সামনে পড়ল। ফলে সুতি বস্ত্রশিল্পের স্বাধীন বিকাশ বাধা পায়। ১৯৪৭ সালের পর ব্রিটিশ পুঁজির সরাসরি নিয়ন্ত্রণের যুগ শেষ হলে, বা বলা চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর, বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিন্যাসে পরিবর্তন আসে। বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নেতৃত্বে ব্রিটেনের জায়গায় আমেরিকার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, বাজার ও কাঁচামালের জন্য বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে নিজ নিজ প্রভাবে আনার রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তখন পুঁজিবাদের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বিকল্প সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছে, ফলে আপাত শান্তির পরিস্থিতিতে বিশ্বের জনগণের সমর্থন ধরে রাখাটাও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। একই সঙ্গে ‘পুঁজিবাদ বর্ধিত পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া’র সমস্যার জায়গায় জন্ম নেয় অতিরিক্ত পুঁজি-সঞ্চয়নের সমস্যা, ফলে তারা লাভজনক বিনিয়োগ-ক্ষেত্রের সন্ধানে নামে। এই লক্ষ্যে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে তারা একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির পুনর্গঠন, অন্যদিকে অনুন্নত দুনিয়ার উন্নয়ন— এ দু’টিকে বেছে নেয়। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং ‘শুল্ক ও বাণিজ্য বিষয়ক সাধারণ সম্মতি’ বা সংক্ষেপে ‘গ্যাট’— এই তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এই সময় থেকে আশির দশকের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ভারতের মতো দেশগুলির সঙ্গে বিশ্ব-পুঁজিবাদের সম্পর্কে প্রাধান্য পেত পরামর্শ, আর্থিক সাহায্য ও পুঁজি বিনিয়োগের কর্মসূচি। স্বাধীনতার পর আমেরিকার পরামর্শে ও নানাপ্রকার আর্থিক সমর্থন পেয়ে, ভারত সরকার গ্রামীণ উন্নয়ন ও পরে ভূমিসংস্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়। এরও অনেক পরে দেশে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিলে আমেরিকার পি এল ৪৮০-র গম এদেশে সাহায্য হিসেবে আসতে থাকে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের পরামর্শে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি নেওয়া হয়। পরে যখন বিশ্ব-পুঁজিবাদের সংকট নতুন চেহারা নিতে থাকে তখন ভারতের মতো দেশগুলির উন্নয়ন-প্রক্রিয়াকে আরও সরাসরি বিশ্ব-অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে বিশ্বায়নের নীতির অধীনে আনা হয় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের নির্দেশ মেনে। ভারতের কৃষি-অর্থনীতি ও তার উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের পিছনে একযোগে কাজ করেছিল বিশ্বায়ন নীতির সঙ্গে ‘শুল্ক-বাণিজ্য সম্পর্কিত সাধারণ সম্মতি সংস্থা’র পরিবর্তিত রূপ ও বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থার জারি করা একগুচ্ছ নিয়ম।

আগেই বলেছি, ভারতীয় কৃষির স্থবিরতার ও তার বর্তমান সংকটের মূল ঐতিহাসিক কারণগুলো অনুসন্ধান করতে গেলে এর বিবর্তনের সানুপুঙ্খ আলোচনা দরকার। সমাজ-বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে নেমে পণ্ডিতেরা এই বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সাধারণভাবে যেসব নিয়ম অনুসরণ করে সেগুলোকে খুঁজে দেখেছেন এবং সেগুলিকে সূত্রবদ্ধ করেছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার ঠিক কোন স্তরে বর্তমান ভারত অবস্থান করছে সেটা জানা বিশেষ জরুরি। সেটা না বুঝলে সমস্যার প্রকৃতি ও তার সমাধানের উপায় সংক্রান্ত কোনও ধারণায় আসা সম্ভব নয়। ভারতীয় অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষি-অর্থনীতি নিয়ে নানা আলোচনার অনেকটা অংশই দখল করে আছে এসব বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে চালু অজস্র বিতর্ক। আলোচনায় প্রায়শ যাঁর নাম উঠে আসে তিনি হচ্ছেন দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক কার্ল মার্কস। ভারতীয় কৃষির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যার সময় অনেক ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ মার্কসীয় বিচারপদ্ধতি ও সিদ্ধান্তের সাহায্য নেন এবং সেগুলির প্রয়োগযোগ্যতা তাঁদের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে উঠে আসে। পণ্ডিতরা অবশ্যই সব বিষয়ে একমত নন। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতীয় কৃষিসমাজের বিবর্তন এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ স্তরটিতে, অর্থাৎ পুঁজিবাদের স্তরে, পৌঁছে গেছে। যদিও এই পুঁজিবাদ হল পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদ, ভারতের মূল সমস্যা এর উৎপাদিকা শক্তির ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলের যথাযথ বিকাশে পিছিয়ে থাকা। সেই সমস্যাগুলো আবার, কারও কারও মতে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ভারতের উৎপাদন-কাঠামোয় ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে থেকে যাওয়া কয়েকটি প্রাক-পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং বলা চলে, আজকের ভারতীয় কৃষি-সংকটের মূল রয়েছে তার উৎপাদন-কাঠামো ও উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে ভারতীয় কৃষিকে মুক্ত করতে না পারলে তাকে একটি গতিশীল উৎপাদন-ব্যবস্থায় উন্নীত করা যাবে না। সচরাচর ভারতীয় কৃষি সংক্রান্ত আলোচনাগুলো কেবল যেসব প্রতিষ্ঠান ভারতীয় কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন-কাঠামোর অঙ্গ হিসেবে এই কাঠামোকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে, সেগুলির তাত্ত্বিক ও তথ্যগত বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। কিন্তু উন্নত পুঁজিবাদী দেশের কৃষির সাপেক্ষে এই প্রতিষ্ঠানগুলির বৈশিষ্ট্য কী ও সেগুলো কেন ভিন্ন তা আলোচনায় আসে না। আবার কেউ কেউ এইসব প্রতিষ্ঠানের কোনও কোনও বৈশিষ্ট্যকে দাসব্যবস্থা ও সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এইসব বিভিন্ন বিচারপদ্ধতির সহাবস্থান ঘটায় ভারতীয় কৃষির আলোচনা বেশ জটিল ও বিতর্কপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের আলোচনাগুলোর কথা মাথায় রেখেই আমরা ভারতীয় কৃষির উৎপাদন-কাঠামোর বিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াগুলিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। সমাজ ও অর্থনীতির বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা প্রগতিশীল ও প্রগতিবিরোধী উপাদানগুলিকেও চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার, এই উপাদানগুলির প্রভাবে কীভাবে ভারতীয় কৃষির অগ্রগতির পথ প্রভাবিত হয়েছে ও ভারতীয় কৃষি কীভাবে তার আজকের সমস্ত বৈশিষ্ট্য সমেত বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে সেটা বুঝতে গেলে বহুচর্চিত কিছু বিষয়ের পুনরালোচনাও প্রয়োজন। কারণ এসব বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো নানা বিভ্রান্তিতে ভরা। যেমন একটি প্রশ্ন, ভারতে কৃষির অবস্থান কি পুঁজিবাদী, নাকি সামন্ত্রতান্ত্রিক? নাকি সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উভয় উৎপাদন-সম্পর্কের বিবিধ লক্ষণ নিয়েই এদেশের কৃষি-অর্থনীতি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে? এই আলোচনাগুলো জরুরি। এটি বাদ দিয়ে কৃষি-সমস্যার মূল অনুসন্ধান করতে নামলে সাধারণ দিকনির্দেশ পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে, সঠিক দিশা স্থির করার ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ভারতের কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থাকে অনেকেই মনে করেছেন পুঁজিতান্ত্রিক, কিন্তু ভারতীয় কৃষির এই পুঁজিতান্ত্রিকতা পশ্চিমের দেশগুলির তুলনায় এখনও অনেকটাই পিছিয়ে পড়া বা কম উন্নত। কিন্তু ভারতের কৃষি-অর্থনীতির যথাযথ তথ্য বিচার করলে দেখা যায় এখানে এখনও অনেক বেশি করে প্রাক্-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে এবং সেগুলোই প্রভাবিত করছে এই অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে। তাই বিশেষ করে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-সম্পর্ক, সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ উন্নতির স্তরে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থা, নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের মতো পিছিয়ে-পড়া দেশের কৃষির অবস্থান – এই সমস্ত কিছুর পর্যালোচনাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজটি গড়ে উঠেছিল ইউরোপে, তার ভিত্তি ছিল দাসব্যবস্থা। দাসব্যবস্থায় যারা সরাসরি উৎপাদনে অংশ নিত তাদের সঙ্গে উৎপাদনের উপকরণের কোনও সংযোগ ছিল না। উৎপাদনের উপকরণ থেকে, উৎপাদিত সামগ্রী থেকে, তারা ছিল সার্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন। উপরন্তু তারা নিজেরাই ছিল উৎপাদন-উপকরণের মালিকের কর্তৃত্বাধীন, বাজারে বিক্রয়যোগ্য বা ক্রয়যোগ্য সম্পত্তি। উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকত উৎপাদনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী প্রকৃত উৎপাদকদের। তারা, বাজার-বহির্ভূত বা অর্থনীতি-বহির্ভূত ব্যক্তিগত ক্ষমতার জোরে এবং উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের স্বার্থে, এইসব দাস শ্রমিকদের বাধ্য করত উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে। এই দাস সমাজব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে বিকশিত হয়েছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ রোমান, স্পার্টান ও গ্রিক সভ্যতা। এই ব্যবস্থায় আপামর সাধারণ মানুষ তাদের শ্রমশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারত না। তার শরীর ও কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে মালিক-শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিনোদনের স্বার্থে ব্যবহৃত হত। সমাজের যা-কিছু সম্পদ, তা এর মাধ্যমেই তৈরি হত। সামাজিক জীবনযাত্রায় শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে দাসব্যবস্থার পতনের পর নবম-দশম বা একাদশ শতাব্দী থেকেই ম্যানর-সামন্ততন্ত্র বা সিনিওর সামন্ততন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। এই ব্যবস্থায়, সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা বহুক্ষেত্রেই ছিলেন প্রাক্তন দাস-মালিক। সামন্তযুগে তাঁরাই হলেন সমাজের সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের মালিক এবং ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পূর্বতন দাসদের উদ্বৃত্ত শ্রমের শোষক। সামন্তযুগে মালিক তার অধিকারে থাকা জমির কিছুটা অংশ প্রকৃত উৎপাদক চাষি বা শ্রমিকের ভরণ-পোষণের জন্য তাদের হাতে ছেড়ে দেয়। বাকি অংশ নিজের হেফাজতে রাখে। পরিণামে প্রকৃত উৎপাদক চাষি বা শ্রমিক, পূর্বতন দাসদের তুলনায় কিছুটা বেশি স্বাধীনতার বিনিময়ে বিনা পারিশ্রমিকে মালিকের জমিতে বেগার খাটতে বাধ্য থাকে। এছাড়াও মালিকের চাপানো নানা প্রকার শ্রম ও ফসলের অংশ সে মালিককে দিতে বাধ্য ছিল। এইভাবে তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সামগ্রী তৈরিতে যেটুকু শ্রম লাগত তা বাদে তার সমস্ত উদ্বৃত্ত শ্রম সরাসরি, অথবা ফসল আদায় করে, বা কখনও কখনও মূল্য ধরে দেওয়া খাজনার মাধ্যমে, মালিক পুরোপুরি শোষণ করত। এই ব্যবস্থায় প্রকৃত উৎপাদকরা তাদের জমি চাষ না করে ফেলে রাখতে পারত না কিংবা জমি বা মালিককে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার অধিকারও থাকত না। অর্থাৎ এই নতুন ভূমিদাস প্রথায় মালিকের অধীনে উৎপাদনের যেটা প্রধান উপকরণ, অর্থাৎ জমি, তার দু’টি ভাগ–একটি ভাগ থাকত সরাসরি মালিকের তত্ত্বাবধানে এবং অন্য ভাগটি যেত পূর্বতন দাস শ্রমিকের হাতে, যারা সদ্য স্বাধীন হয়েছে এবং নিজের ভরণপোষণের জন্য স্বাধীনভাবে একখণ্ড জমি চাষের অধিকার পেয়েছে। কিন্তু এর বিনিময়ে এই দ্বিতীয় শ্রেণিটি মালিকের জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটতে বাধ্য থাকত, বাধ্য থাকত মালিকের স্বার্থে অন্যবিধ শ্রম দিতেও। রাষ্ট্রের চাপানো নিয়ম অনুযায়ী সে এই জমি ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না। পূর্বতন দাসব্যবস্থার তুলনায় এই প্রথাটা ভূমিদাসদের, অর্থাৎ প্রকৃত উৎপাদকদের, কিছুটা বেশি স্বাধীনতা দিত, কারণ নিজের হেফাজতে থাকা জমিতে চাষের পদ্ধতি, শস্য বাছাই ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার ছিল। পূর্বতন দাসব্যবস্থায় শ্রমিকের সঙ্গে উৎপাদনের উপকরণ বা উৎপাদিত দ্রব্যের কোনও সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু এই নতুন ভূমিদাস ব্যবস্থায় প্রকৃত উৎপাদকের সঙ্গে উৎপাদন-উপকরণের একটি অংশের সরাসরি ও অবিচ্ছিন্ন যোগ ঘটল, যার ফলে চাষের উন্নতি ও অধিক ফলনের জন্য তার উদ্যোগ নেওয়ার অবস্থাও তৈরি হতে পারল। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের দিক থেকে এই ব্যবস্থা পূর্বতন দাস ব্যবস্থার তুলনায় নিশ্চিত একটি উন্নততর ব্যবস্থা। কিন্তু ভূমিদাস প্রথার উৎপাদন-সম্পর্কে দাস উৎপাদন-সম্পর্কের একটি বৈশিষ্ট্যও ধরা থাকল। সেটা হল, শ্রম দানকারী দাস ও ভূমিদাস উভয়ের সঙ্গেই মালিকের সম্পর্কটা বাঁধা থাকত অর্থনীতি-বহির্ভূত ও বাজার-বহির্ভূত চাপের দ্বারা। এই দুই ব্যবস্থাতেই মালিক অর্থনীতি-বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগ করে, শুধু মালিকানার জোরেই নানাভাবে প্রকৃত উৎপাদকের উদ্বৃত্ত সরাসরি আহরণ করতে পারত। এই প্রাক্পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থায় তখনও শ্রম, জমি ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের মুক্ত বাজার চালু হয়নি, ফলে শ্রম ও অন্যান্য উপকরণ সর্বোচ্চ দক্ষ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়োজিত হতে পারত না। উৎপাদনের উপকরণের মালিকের মধ্যেও তার নিজের আহরিত উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে উৎপাদনকে আরও বিস্তৃত করার— এবং এইভাবে পর্যায়ক্রমে মুনাফা বৃদ্ধি ও মুনাফার পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রমাগত একটি দীর্ঘায়ত লাভজনক উৎপাদন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে যাওয়ারও, কোনও তাগিদ থাকত না। মালিকের দিক থেকে উৎপাদনের ও তার মালিকানায় থাকা প্রকৃত শ্রমদায়ী শ্রেণির উদ্বৃত্ত আহরণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজের ভোগবিলাসিতাকে সর্বাধিক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া এবং এর মধ্য দিয়ে সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখা। দাস সমাজে মালিকের অধীনে থাকা দাসের সংখ্যা যেমন তার প্রভাব-প্রতিপত্তির নির্ণায়ক বলে গণ্য হত, সামন্ততন্ত্রে তেমনই সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা ও পরাক্রম নির্ধারণ করত তার মালিকানায় থাকা জমির পরিমাণ ও ভূমিদাসের সংখ্যা। এখানে মালিকের উৎপাদনকে দক্ষ করে তোলার ও এই উদ্দেশ্যে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় উন্নতি ঘটানোর কোনও লক্ষ্য থাকে না। ফলে এ ধরনের উৎপাদন-ব্যবস্থা পুরাতন জড়ত্বের মধ্যে পড়ে থাকে।

দাস সমাজের মতো ধনতন্ত্রেও প্রকৃত উৎপাদকরা উৎপাদনের উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। জমি ও যে-উপকরণ দিয়ে তারা চাষ করে, বা যে-শিল্পদ্রব্য তারা উৎপাদন করে, সেসবের সঙ্গে বা উৎপাদিত দ্রব্যের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক থাকে না। এর সবকিছুই থাকে মালিকের হাতে, এবং এসবের ব্যবহার সম্পূর্ণত মালিকের নিয়ন্ত্রণাধীন। তারা মালিকের কাছে বাজার-নির্ধারিত মজুরির বিনিময়ে নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করে। বাজার-ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে মালিক শ্রমিকদের মজুরি বেঁধে রাখে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন, সেই স্তরে। ফলে এই তথাকথিত মুক্ত শ্রমিকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্যের সবটাই তারা শোষণ করে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতা এবং এই প্রক্রিয়ার ওপর মালিকের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দাস ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয় করে তুলেছে। কিন্তু দাস ব্যবস্থা বা ভূমিদাস ব্যবস্থার সঙ্গে এই পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমিলটি রয়ে গেছে মালিক ও শ্রমদায়ী শ্রেণির পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সম্পর্কের ভেতর বাজার-বহির্ভূত চাপের কোনও ভূমিকা থাকে না। বরং এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বাজারের নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। স্বাধীন শ্রমের বাজারে শ্রমের চাহিদা ও জোগানের ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যে-মজুরি নির্ধারিত হয়, সেই মূল্যেই শ্রমিক মালিকের কাছে তার শ্রমশক্তি বিক্রি করে। বাজারের নিয়মে এই মজুরি শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য যা ন্যূনতম প্রয়োজন, তার বেশি হয় না। এর পরেও শ্রমিক যতটা উৎপাদন করে সেই অংশটির বাজার-মূল্য উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে মালিকের হাতে আসে। এই প্রক্রিয়ার পরবর্তী স্তরে এই উদ্বৃত্ত মূল্য মালিকের হাতে পুঁজির রূপ নেয় এবং তা উৎপাদন-ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে মালিক আরও বেশি করে শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে ও আরও বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করতে পারে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজির ক্রমসঞ্চয়ন প্রক্রিয়া এইভাবে অতি দ্রুত উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ায়। যে-শ্রেণিটি উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকে, তারা শ্রমিকের উৎপাদন-ক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন উৎপাদনশীল যন্ত্রপাতি ও কৃৎকৌশলের উদ্ভাবন ঘটায়। এর মাধ্যমে তারা উদ্বৃত্ত উৎপাদনকারী শ্রমিককে শোষণ করার মাত্রা যেমন বাড়াতে পারে, তেমনই পুঁজি সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকেও আরও গতিশীল করে তোলে। অশেষ মুনাফা আহরণ এবং সেইসঙ্গে পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার অগ্রগতিকে সীমাহীন করে তোলার জন্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা দরকার। সেই প্রয়োজন মেটানোর উপায় হিসেবে নিয়ন্ত্রক বুর্জোয়া শ্রেণি এই সমাজের পরিচালক রূপে অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে আসে। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, বিচারব্যবস্থা, অস্ত্রধারী সৈনিক এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সংস্কৃতি ও দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার যেসব মাধ্যম রয়েছে, সেগুলিকে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচালনা করে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকেই এ পর্যন্ত টিকে থাকা সমস্ত উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বলে মনে করা হয়। এই উৎপাদন-সম্পর্কের অগ্রগতির সূচক হল উৎপাদিকা শক্তির বাধাহীন বিকাশ, আর তার উৎস হল ক্রমাগত পুঁজি পুনর্বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার বাধাহীন বৃদ্ধি। মনে করা হয়, ধনতন্ত্রই এতাবৎ টিকে থাকা সমস্ত ধরনের সমাজের মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল।

দাসব্যবস্থা থেকে ধনতন্ত্র পর্যন্ত যেসব শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উদ্ভব ঘটেছে তার সবক’টিতেই সামাজিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী মালিক শ্রেণিটি তাদের শোষণ প্রক্রিয়াকে বাধামুক্ত রাখতে চেয়েছে এবং সেই প্রয়োজনে তারা গড়ে তুলেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা— তার আইন, বিচারব্যবস্থা ও আইন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনার জন্য জরুরি অস্ত্রধারী পুলিস সমেত। এই ব্যবস্থা মানুষ যাতে সহজে মেনে নেয় তার জন্য তারা উপযুক্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করে, এবং সেটা টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়। উৎপাদনের পরবর্তী উন্নততর স্তর হিসেবে ধরা হয় সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজকে। ধনতন্ত্রে যেখানে কোনও প্রকৃত উৎপাদক শ্রমিকের সঙ্গে তার নিজের সৃষ্ট উৎপাদনের উপকরণের সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতাকেই স্বাভাবিক ধরা হয়, সমাজতন্ত্রে তার অবসান ঘটে। সেখানে এই উপকরণগুলির ব্যবহার-প্রক্রিয়ার ওপর শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতন্ত্র হল এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সাম্যবাদ হল এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরের অবস্থা। সেখানে সমাজ শ্রেণিহীন। ফলে একশ্রেণির মানুষের দ্বারা অন্য শ্রেণির মানুষের শ্রমশক্তি শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে যে-সমাজব্যবস্থা, কিংবা সেই শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য জন্ম নেয় যে-রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার অবসান ঘটে সেখানে। এখানে বিষয়টি নিয়ে আর বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের পূর্বশর্ত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা কিন্তু অপরিহার্য।

সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট দীর্ঘ। পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত হল শ্রমের বাজার গঠন এবং সেই বাজারে জমি, উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ ও শ্রমশক্তির বিক্রেতা হিসেবে স্বাধীন শ্রমিকের উপস্থিতি। এর জন্য প্রকৃত উৎপাদক চাষি কিংবা ছোট কারিগর-হস্তশিল্পীকে তাদের পূর্বতন জীবিকাক্ষেত্র থেকে প্রথমে উচ্ছিন্ন হতে হবে এবং স্বাধীন শ্রমের বাজারে তাদের হাজির হতে হবে শ্রমশক্তির জোগানদার হিসেবে। যে-প্রক্রিয়ায় ছোট উৎপাদককে তার উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ করা হয় সেটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। গোটা পশ্চিম ইউরোপে সুদীর্ঘ কয়েক শতক ধরে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলেছিল। পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটার আবশ্যিক পূর্বশর্ত যে-আদিম পুঁজিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়া, ইংল্যান্ডে তা চলেছিল দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে। তার ইতিহাস আমাদের দেখায় কীভাবে এই আদিম পুঁজি সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার উল্টো পিঠে ছোট উৎপাদকরা উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে স্বাধীন শ্রম ও অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে জমির বাজার গঠনের প্রক্রিয়া। এইরকম উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদিম পুঁজিসঞ্চয়ন ও সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের একটি প্রকৃষ্টতম উদাহরণ ইংল্যান্ড। এইভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে ওঠার দু’টি পূর্বশর্তকে অত্যন্ত জরুরি গণ্য করা যেতে পারে। এক, আগেই বলেছি, জমি ও অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত ছোট উৎপাদকরা জমি ও নিজস্ব ছোট উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন শ্রমের বাজারে শ্রমের বিক্রেতা হিসেবে উপস্থিত হবে এবং উৎপাদনের উপকরণ কেনাবেচার স্বাধীন ব্যবস্থায় এই ছোট উৎপাদকরা জমি ও সমস্ত উপকরণ সহ অবাধে ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য পণ্যে পরিণত হবে। দুই, বিনিয়োগযোগ্য স্বাধীন পুঁজির সঞ্চয়ন। এটা প্রথমে বিনিয়োগে ইচ্ছুক মানুষের হাতে বাণিজ্য-মুনাফা, মহাজনি সুদ ইত্যাদির সূত্রে আর্থিক পুঁজি হিসেবে জমা হয়। পরবর্তী স্তরে তাকে মুক্ত বাজারে বিনিময় করা হয় শ্রম ও অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে, এবং এইভাবে উৎপাদনশীল পুঁজি হিসেবে এর উত্তরণ ঘটে। পূর্বসঞ্চিত এই পুঁজির বিনিয়োগ মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকভিত্তিক এক নতুন পুঁজিবাদী উৎপাদন-কাঠামো গড়ে তোলে।

তবে, ছোট উৎপাদকদের যদি পূর্বতন উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ করে স্বাধীন শ্রমের বাজার গঠন করার অবস্থায় আনতে হয়, তাহলে প্রথম প্রয়োজন বড় বড় সামন্ততান্ত্রিক খামারগুলি ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট উৎপাদন-ক্ষেত্রের প্রাধান্য বাড়ানো। এই উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলি সরল পণ্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিয়মে চলে। অর্থাৎ উৎপাদক তার নিজের বা তার পরিবারের শ্রমের মাধ্যমে যে-পণ্য উৎপাদন করে, তার উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয়। বাজারে শ্রম কেনাবেচার মাধ্যমে উৎপাদক তার নিজের ভোগের জন্য নানা পণ্য সংগ্রহ করে। এই ছোট উৎপাদককে উচ্ছেদ করেই স্বাধীন উপকরণের বাজার গঠিত হয়-যা, আগেই বলেছি, পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার একটি পূর্বশর্ত। কিন্তু এর পাশাপাশি সামন্ততান্ত্রিক প্রভুর অধীন বড় কৃষি-খামারের মালিকও প্রথমে বাণিজ্য-মহাজনি কাজে যুক্ত হতে পারে এবং পরে বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ বাজার নির্মিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফার উদ্দেশ্যে উৎপাদন শুরু করতে পারে। অর্থাৎ এভাবেও পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটি প্রাশিয়ান পদ্ধতি নামে পরিচিত, প্রথমটি পরিচিত তুলনামূলক প্রগতিশীল আমেরিকান পদ্ধতি নামে। অবশ্য কোনও পদ্ধতিতেই পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জন্য শুধু মুক্ত উপকরণ ও শ্রমের মুক্ত বাজার-ব্যবস্থা গঠন যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় একটি শর্ত হল বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির সংস্থান। আগেই বলেছি, উন্নত দেশে এই পুঁজি প্রথমে ব্যবসা ও মহাজনি কারবার থেকে ব্যবসায়ী/মহাজনদের হাতে জমা হয় আর্থিক পুঁজি রূপে। পরে, উৎপাদন ক্ষেত্রে, বাজার থেকে কেনা শ্রমশক্তি ও উপকরণ সহযোগে তা উৎপাদনশীল পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরটি দু’ভাবে ঘটতে পারে। হয় ব্যবসায়ী মহাজন নিজে উদ্যোগী হয়ে উৎপাদন ক্রিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ করে, অথবা ছোট-বড় স্বাধীন উৎপাদকরা তাদের নিজ নিজ উৎপাদন-ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বাধীন শ্রমশক্তি ও বাজারে কেনা উপকরণ সহযোগে পুঁজিবাদী উৎপাদন-ক্ষেত্র গড়ে তোলে। দু’টি ক্ষেত্রেই স্বাধীন শ্রমের বাজারে শ্রমশক্তি কেনাবেচার ব্যবস্থা থেকে এই পুঁজিবাদী উৎপাদন-ক্ষেত্র একটি লাভজনক উৎপাদন-ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, এবং তার পক্ষে পুঁজি পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব হয়। আবার, ভিন্ন পরিবেশে, শ্রম ও উপকরণের একটি বড় অংশ যখন প্রাক্-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আবদ্ধ, তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও মহাজনি পুঁজি যথেষ্ট অপ্রগতিশীল ভূমিকাও নিতে পারে। সমগ্র অর্থনীতির নিরিখে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের স্তরটির অবস্থান অত্যন্ত নীচে। তাই সদ্য সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া ছোট উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলি স্বাধীন উৎপাদন-ক্ষেত্র হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও ব্যবসায়ী ও মহাজনি পুঁজি এদের প্রতিদিন তীব্র শোষণ করে দুঃস্থ, ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় নিয়ে যায়। উৎপাদনের বদলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও মহাজনি কাজকর্মই অর্থনীতিতে প্রাধান্য পায়। এই অবস্থা বিশেষ করে দেখা যায় বিদেশি বাণিজ্যিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণে থাকা উপনিবেশগুলিতে। বাইরে থেকে আসা বাণিজ্যিক পুঁজি উপনিবেশের ছোট উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলি থেকে পণ্য নিয়ে যায় বিদেশের বাজারে। এবং বাণিজ্যের এই প্রক্রিয়া উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলির উপর অসম বাণিজ্যের বোঝা চাপায়, ফলে উৎপাদন-ক্ষেত্রগুলির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রগতিশীল রূপান্তরের রাস্তা বন্ধ হয়। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতি, এই পরিণতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ইউরোপে আদিম পুঁজি সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার ইতিহাসটি আমরা আরও স্পষ্ট ও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি পরবর্তী অধ্যায়ে। সামগ্রিক উন্নয়নের ইতিহাসে কৃষির ভূমিকা সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করেছি আজকের কয়েকটি উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়ে। আমাদের উদ্দেশ্য এটাই দেখানো যে, ভারতে কৃষির ঐতিহাসিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও এখানকার সামগ্রিক উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা উন্নত দেশের অনুরূপ পরিস্থিতিগুলি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। শুধু আজকের পশ্চিম ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলিই নয়, এমনকী জাপানের মতো এশিয়ার দেশেও এই প্রক্রিয়া পৃথক। জাপানে কৃষি-অর্থনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাসও আমাদের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আমরা জাপান ও ইউরোপের উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছি, আজকের এই উন্নত দেশগুলিতে উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরুর পূর্বশর্ত পূরণের জন্য ভূমিসম্পর্কে আমূল পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। দ্বিতীয় অধ্যায়টি ভূমিসংস্কার সংক্রান্ত। আমরা দেখিয়েছি, সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ১৯৫০–৬০-এর দশকে ব্যাপক ভূমিসংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ভূমিসংস্কার আইনগুলির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সংশ্লিষ্ট আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা ত্রুটি ছিল। যার ফলে এই ভূমিসংস্কার কৃষি-জমি ও কৃষি-আয়ের যথাযথ পুনর্বণ্টন করে প্রকৃত উৎপাদক ছোট চাষিদের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির উপস্থিতি ভারতের কৃষি অর্থনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।

তবে, সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে পর পর যেসব ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে থাকে সেগুলি পৃথিবীর সব অঞ্চলে একই পরম্পরায় ঘটেনি। ইউরোপীয় দেশগুলিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরবর্তী প্রথম শ্রেণি-বিভক্ত সমাজ হিসেবে এসেছে দাস সমাজ। তার পর পর্যায়ক্রমে এসেছে ভূমিদাস প্রথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সামন্ত সমাজব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে, প্রাচ্যে সমাজবিকাশের এই পরম্পরা পাশ্চাত্য পরম্পরা থেকে আলাদা। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজের রূপটি কেমন ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। মার্কস এবং বিভিন্ন মার্কসিস্ট পণ্ডিতদের পর্যবেক্ষণ থেকে যে-মতটি বেরিয়ে আসে তা হল, আদিম সাম্যবাদী গোষ্ঠী-ব্যবস্থার অবসানের পর পৃথিবীর সর্বত্র একইরকম সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়নি। এশিয়ার মতো প্রাচ্য মহাদেশে আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাত্রার অবসান এবং পরে তা থেকে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে উত্তরণ, এই দু’টি অবস্থার মধ্যবর্তী আরও একটি সমাজব্যবস্থার কথা মার্কস বলেছেন, তিনি এটিকে এশিয়াটিক সমাজব্যবস্থা নামে চিহ্নিত করেছেন। ইতিহাসবিদদের বিবরণ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অনুমান করা যায়, ভারতের মতো প্রাচ্যের অনেক দেশেই এই এশিয়াটিক সমাজব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। অনুমান করা যেতে পারে, খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার শতকে, প্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতা সিন্ধুসভ্যতার অন্যতম দু’টি নগরী মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা ও তৎলগ্ন গ্রামাঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাটি ছিল মার্কস-বর্ণিত এশিয়াটিক সমাজেরই প্রতিরূপ। জোড়া নগরীর চারপাশের কৃষি ও তার সঙ্গে সংযুক্ত হস্তশিল্পের ওপর গড়ে ওঠা স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজগুলিতে ব্যক্তিগত মালিকানা অনুপস্থিত ছিল। কাজেই এ থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, পাশ্চাত্যে আদিম সাম্যবাদী গোষ্ঠী-সমাজের পরবর্তী ধাপে যে-শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থা ছিল তা থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সমাজের বৈশিষ্ট্য এর গতিহীনতা। এ ছাড়াও শ্রেণিদ্বন্দ্ব এখানে অনুপস্থিত, জমি ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানাও অনুপস্থিত। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ সরল পণ্য উৎপাদন-ব্যবস্থায় প্রকৃত উৎপাদকদের মধ্যে উদ্বৃত্তের উৎপাদনশীল ব্যবহারের উদ্যোগও সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। এই কারণে এই ব্যবস্থা সবচেয়ে স্থবির অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিস ও রোমের মতো পাশ্চাত্য দেশের প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজটি দাসব্যবস্থার ওপর গড়ে উঠেছিল। তবে প্রাচ্যের গ্রামীণ গোষ্ঠী-সমাজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এশিয়াটিক সমাজ এর পরবর্তী স্তরে দাসসমাজে উন্নীত হয়েছিল কি না, এবং যদি তা দাস সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য অর্জন করে থাকে তবে সেখানে কৃষি-অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলি সেই সমাজের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে কতটা সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল, তা আলোচনার দাবি রাখে। পাশ্চাত্যের দেশগুলির ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, পুরনো সমাজের তুলনায় দাসসমাজ উন্নত ছিল, এই সমাজে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটেছিল। এবং এই বিকাশকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার তাগিদে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড সমেত গোটা ইউরোপে পুরনো সমাজকাঠামোকে অপসারিত করে এক নতুন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পত্তন অবধারিত হয়ে উঠেছিল। সেই একই প্রক্রিয়ায় ও একই কারণে, গোটা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে উৎখাত করে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অবধারিত হয়ে ওঠে। এই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-কাঠামো সর্বাধুনিক। এবং এর আগে অবধি মানবজাতি যত ধরনের সমাজব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এখানে অভূতপূর্ব ও চমকপ্রদ। পাশ্চাত্য সমাজের এই ক্রমান্বিত উত্তরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা এই উত্তরণ প্রক্রিয়ায় প্রগতিশীল ও প্রগতিবিরোধী উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করব।

ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা দেখব, ভারতীয় কৃষিতে উৎপাদন-সম্পর্কের বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে পুরনো সমাজের প্রগতিবিরোধী উপাদানগুলি কতটা ক্রিয়াশীল ছিল এবং সেসব থেকে কোন কোন প্রগতিশীল বা প্রগতিবিরোধী বৈশিষ্ট্যের সূচনা ঘটেছে।

আমাদের আলোচনায় সমাজবিকাশ সংক্রান্ত সর্বজনবিদিত ও বহুচর্চিত তাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্তের বিশ্লেষণকে স্থান দেওয়ার কারণ হল, ভারতীয় কৃষির অন্তর্নিহিত চরিত্রের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা ও তাকে যথাযথ বিশ্লেষণ করা। ভারতীয় কৃষির বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে প্রগতিবিরোধী ও প্রগতিশীল উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য একটি মানদণ্ড সামনে রাখা প্রয়োজন। এই মানদণ্ড কাজে লাগিয়ে আমরা এই দুই উপাদানের ক্রিয়ায় ভারতীয় কৃষি নতুন যে-বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, তার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারব। আমাদের বিচার্য হবে এইগুলি: ভারতীয় কৃষিতে প্রাক্-ধনতান্ত্রিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের কোনও বিশেষ স্তরে ভারতীয় কৃষি ধ্রুপদী ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়মগুলি কতটা আত্মীকরণ করতে পেরেছে এবং কতটা ধনতান্ত্রিক প্রগতিশীলতা অর্জন করতে পেরেছে। এই বিশ্লেষণ ভারতীয় কৃষির সামাজিক গঠনের মধ্যে থাকা দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে আমাদের সাহায্য করবে। এর ভিত্তিতেই আমরা ভারতীয় কৃষির দীর্ঘকালীন স্থবিরতাকে বুঝব এবং বিগত শতাব্দীর নয়ের দশকে উদ্ভূত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলার চেষ্টায় ভারতীয় কৃষির ভূমিকা বিশ্লেষণ করব। সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে যে-সংকটজনক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার প্রকৃতি ও কারণগুলি আমরা জানতে চেষ্টা করব। পরিশেষে আমরা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোয় ভারতীয় কৃষির অবস্থান নির্ণয় করতে চেষ্টা করব।

আগেই বলেছি, আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উন্নত দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিত থেকে ভারতীয় কৃষি-বিবর্তনের ইতিহাসকে বিচার করা দরকার। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দু’-একটি উন্নত দেশে কৃষি-অর্থনীতির বিবর্তন-ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হবে।

তথ্যসূত্র

১. Lenin, V. I., (1964). The Development of Capitalism in Russia, Collected Works, vol-3, 4th Edition. Moscow: Progress Publishers.

২. Marx, K. Grundrisse. 1973. Foundation of the Critique of Political Economy. Penguin.

৩. Chakraborty, A. 1983. “The Social Formation of the Indus Society.” Economic and Political Weekly. vol 18, no. 50. (Dec 10, 1983).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *