০০১.
আস্সালাতো খয়রুম মিনন্ নওম্–
শব্দ, সুর একই সঙ্গে ভোর রাতের বাতাস কেটে কেটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এখন রাতের শেষ দিকে আর সেই শীত নেই। ফাগুন মাস শুরু হয় হয়। আজানের সুরের ভেতর শেরগির হাতিদের কেউ কেউ দিন শুরুর আগেই প্রথম গরম নাদ ফেলতে শুরু করেছে। তারই মৃদু চেনা শব্দ কানে আসছিল কাছেরই পিলখানা থেকে।
আবার—
আস্সালাতো খয়রুম্…
ঘুমিয়ে থাকার চেয়ে নামাজ অনেক ভালো–
একথাই ভাবতে ভাবতে আবছা অন্ধকারের ভেতর একজন মানুষ ভাঁজ হয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ততক্ষণে আজানীর পরিষ্কার গলার স্বর শেষ রাতের পাখিদের গলায় মিশে গেল।
লা এলাহা ইল্লালাহ,
মহম্মদুর রসুলুল্লা
হাই আলে আসসালা
হাই আল্লেল ফলা
উঠে বসা মানুষটিও স্পষ্টই যেন টের পেল—
আল্লার কোনো শরিক নেই।
একথা ভাবতে ভাবতে ছায়া মানুষটির মনের ভেতরটা এই ভাবনাতেই ভরে উঠলো : মহম্মদকে আল্লাই পাঠিয়েছেন
হাই আলে আসসালা
নামাজের জন্যে এসো
হাই আলে ফলা
তাড়াতাড়ি এসো
আল্লাহু আকবর
আল্লাই সর্বশ্রেষ্ঠ
আবার–
আস্সালাততো খয়রুম মিনন, নওম্–
এবার দোতলা ডুরাসানা-মঞ্জেল তাঁবুর সামনেকার আকাশে অন্ধকার ফিকে হয়ে আলোর রং একেবারে ডিমের কুসুম। সেখানে আজমির পাহাড়ের মুণ্ডু একটু একটু করে জেগে উঠছিল। মানুষটি লম্বা চওড়া। ওদিকে তাকিয়ে সে মাথা নোয়ালো। ওপরেই মৈনুদ্দিন চিসতির সমাধি। ওদিক থেকেই উড়ে এসে এক ঝাঁক হীরামন পাখি নফরখানা, ফরাসখানার ওপর দিয়ে আবদারখানার দিকে চলে গেল। লালগলা এই সবুজ পাখিদের মানুষটি চেনে।
ডুরাসানা-মঞ্জেল তাঁবুর দোতলায় দাঁড়ানো মানুষটিকে এবার কিছু স্পষ্ট দেখা গেল। তার গায়ে রেশমের জাম্বাদকর। কোমরে কওতল তলোয়ার। মানুষটি ওপরের দিকে তাকালো। আকাশপ্রদীপ তখনো নেভেনি। বহু উঁচুতে অভ্রের লণ্ঠন তখনো জ্বলছিল। অথচ দিন আর খানিক বাদেই শুরু হয়ে যাবে।
আজানের সুরের সঙ্গে সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, আমি সেলিম জাহাঙ্গীর–আমার আব্বা হুজুর শাহেনশা হিন্দস্থানের বাদ্শা জালালুদ্দিন আকবর। তিনি গান বুঝতেন। সুর বুঝতেন। তাঁর জুলালশাহি সুর এই আজানের কথাই মনে করিয়ে দেয়–
ঠিক এইসময় আজমির পাহাড় টপকে একটা লাল বল সামনের বিরাট অন্ধকারে পড়তেই দশদিগন্ত যেন আলোয় জ্বলে উঠলো। আসলে আজমির থেকে পুষ্কর যাবার পথে আন্নাসাগরের জলে সূর্যের আলো পড়ে চারদিক ঝিকমিক করে উঠতেই এক চমকে দিন শুরু হয়ে গেল। ওই আঁধারই রাতের সঙ্গে মিশে থাকা–ঢেউ তোলা আন্নাসাগর। লম্বায় এক মঞ্জিল। চওড়াও না হোক কম করেও দুই মঞ্জিল। কতটা গভীর কেউ জানে না। মাঝে মাঝে কুমির ভেসে ওঠে। তীরে দাঁড়িয়ে আজমির দেখা যায়।
এখন বাদশা জাহাঙ্গীরের সারাটা গুলালবার দেখা যাচ্ছে। তাঁবুর পর তাঁবু। দশ খুঁটির ওপর খাড়া চৌবীন তাঁবু। শাহেনশা বাদশার নিজের ডুরাসানা-মঞ্জেল তাঁবুই দোতলা। নয় খুঁটির ওপর এই তাঁবুর দোতলায় শাহেনশা জাহাঙ্গীর নামাজ আদায় করেন। সূর্য উঠলে সেদিকে মাথা নুইয়ে জমিন বোস্ করেন। নিচের তলায় থাকেন বেগমরা। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে। নানান তাঁবু–খাট গা, সরাপর্দা, সামিয়ানা। কোনোটায় ফরাসখানা। কোনোটায় নফরখানা। কোনোটায় আবার কাশ্মীরী শরাব খাওয়ার আবদারখানা।
সূর্যের দিকে মাথা নুইয়ে বাদশা জাহাঙ্গীর জমিন বোস্ করলেন। তখনো তাঁর ঘরের ভেতর আগেনগারে গুগ্গুল পুড়ছিল নিভু আঁচে। সেই সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সুগন্ধী গোকুলা ফুলের সুবাস। বেলে পাথরের থালায় গত রাতের সেঁউতি, চামেলী, কেতকীরা শুকিয়ে এলেও গন্ধের কোনো অভাব নেই।
জাহাঙ্গীরের মনে পড়ে গেল–হিন্দুস্থান এক আজীব দেশ। এখানে এত রকমের ফুল! সব ফুলগাছের একটি করে পাতা নিয়ে ওজন করলে মোট ছয় মণে গিয়ে দাঁড়াবে। তাজ্জব!
এইবার বাদশার ছাউনি পুরোটা দেখা যাচ্ছে। যেন বা একটি চলন্ত জনপদ এইমাত্র জেগে উঠেছে। তা মনে হবেই বা না কেন?
এখন ১০২৪ হিজরির মহরম মাস। বাদশার তোপখানার মীর আতিশ-ফিরঙ্গি রডরিগোর কাছে এটা ১৬১৫ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি। শাহী দরবারে পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ ‘ভামিনী-বিলাস’ শেষ করতে চান বৈশাখী পূর্ণিমার আগে। মাঝে হাতে মোটে চৈত্র মাসটা। তার মানে এখন ফাগুন। কাল রাতে চাঁদের আলোয় চন্দ্রকান্ত পাথর বসানো ছিল। তাতে শুষে নেওয়া রাতের শিশির জমা হচ্ছিল লাল পাথুরে বাটিতে। শাহী শরবত হবে।
আন্নাসাগরের তীর জুড়ে যতদূর দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। দুই সারি তাঁবুর মাঝখানের গলির মাথায় এক বন্দে চারজন করে ঘোড়সওয়ারের উদ্ধত মাথা। আর সেই সঙ্গে টগবগাবগ। এর চেয়ে হাতির চলাচলে শব্দটা অনেক কম। কিন্তু দাপট অনেক বেশি। মঞ্জোলা হাতির দল সার বেধে আন্নাসাগরে চান করতে চলেছে। সঙ্গে মাহুত। মেঠ আর ভৈ। হাতির সামনের পায়ের সঙ্গে আড়াআড়ি করে পেছনের পা শেকলে বাঁধা। মাথায় ঝালর। উটের কাতার সামলাতে ব্যস্ত সারবানের দল।
বাদশার তাঁবুর পর তাঁবু দিয়ে গড়ে ওঠা এই চলন্ত শহর হুকুমের ইশারায় যারা খাটায়–যারা গোটায়–সেই সব তুর্কী আর তাতার মজুর, ফরাস, মুটে মিলেই প্রায় হাজার তিনেক। শ’খানেক ভিস্তি সবসময় জল তুলছে আন্নাসাগর থেকে–আর তা টেনে এনে ঢেলে দিচ্ছে নর্দমা, নালায়। সে সব সাফসুতরো রাখতেই শ’ দুই মেথরের হিমসিম দশা। এর ওপর রয়েছে গুচ্ছের দর্জি। চামার। কামারও বাদ নেই।
আলা হজরত জাহাঙ্গীর বাদশার নজর টাঙ্গন ঘোড়ার ওপর। সুবে বাংলার উত্তরের দিকে কোচবিহারে পাহাড়ী ভুটানি ঘোড়ার সঙ্গে তুর্কী ঘোড়ার মাখামাখিতে এই টাঙ্গন ঘোড়ার জন্ম। এরা খাঁটিয়ে–চেহারাটাও দেখার মতো। ইরাকি, ইরানি, তাজি, বাদাকশান, তুর্কী, জংলা ঘোড়ার দঙ্গলে এদের দেখলেই চেনা যাবে। বাদশার হুকুমে ওদের নাল-রেকাব সবই আলাদা। যে পুরুষ মানুষ ঘোড়ায় চড়তে জানে না–সে পুরুষমানুষই নয়। এই হলো গিয়ে আগ্রা-দিল্লি-আজমির, লাহোরের চাল। কেননা, অশ্ব যস্য জয়স্তস্য!
কোনো মানী মনসবদার হয়তো চলেছেন। তার আগে আগে ঘোড়সওয়াররা। লাঠি ঘুরিয়ে ‘দূর পাশ’ বলতে বলতে রাস্তা খালি করে দিয়ে এগোচ্ছে। নহবতখানা থেকে এইমাত্র আলক-দুন্দুভি, ভেরী-পণব-বিষাণ দিগন্ত কাঁপিয়ে বেজে উঠলো। দামামা, নাগরা, ঢোল, সানাই, শিঙ্গাও থেমে নেই। মাঝে মাঝে ছোট দামামা বাংলা দুগরের আওয়াজ। সেই সঙ্গে বাঁশি।
বর্ম আঁটা যোদ্ধা দেখতে উৎসুক মানুষের জোয়ার। এখন আগ্রার অর্ধেকেরও সমান নয় বাগদাদ বা ইস্পাহান। সেই আগ্রার মাথার মণি খোদ জাহাঙ্গীর যে এদানী আন্নাসাগরের তীরে তাবু ফেলে আছেন, তা এখানেই তো এখন জগৎ। দিনের শুরুতেই যে মেলা জমে উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কি?
তুর্কী, পাঠান, রাজপুতে, ইরাকিদের নিয়েই মনসবদারদের বাহিনী। শাহী ফৌজেরও বড় ভাগ রাজপুত, মানে রাঠোর, শিশোদিয়া, কচ্ছিদের নিয়েই গড়ে উঠেছে। কিন্তু শাহেনশা আকবরের সময় থেকেই সিংহাসনের সবচেয়ে বড় তাগদ–জমিনদারি ফৌজ। হিন্দুস্থানে ছড়ানো হাজার হাজার জমিনদারের তাঁবে গড়ে ওঠা এই ফৌজে লস্করের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় চল্লিশ লাখের মতো। মফস্বলের গেরস্থ বাড়ির ছেলেদের নিয়েই এই ফৌজ। সেরকম কিছু লস্করও গাঁ থেকে এসে আন্নাসাগরের তীরে খোদ বাদশার তাবিনে মোতায়েন হয়েছে।
ওরা অনেকেই মোগলাই ঠাঁই দেখেনি। তাই গায়ের দেহাতী সেপাইয়ের জংলী বে-তমিজি, বেকুব চাহুনি, সব জায়গায় বেপরোয়া নাক গলিয়ে ধমক খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা দশা আমুদে নাগরিকদের হাসির খোরাক জুগিয়ে চলেছে।
ধড়িবাজরা দাঁও মরার মতলবে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তার দু’ধারে গাছতলায়, মোটা ময়লা চাঁদিনার ছায়ায় ঠক জোচ্চররা বসে গেছে। যেখানে মানুষ সেখানেই হৈ-হুল্লোড়। তামাশা, ঠকবাজি, বাজিকরের বাঁশ পেটানো হাপু খেলার ডুগডুগি। বেদে ঝাঁপি খুলে বাঁশিতে ফুঁ দিলো। দড়ি-বাঁধা মোগলাই পোশাকে মিঁয়া-বিবির নকলে বাঁদরের আশনাই। তরমুজ খরমুজার ফালি– গরম গরম বাসি শিককাবাব, রুপোলি তবকমোড়া হালুয়াইর পচা মিঠাই, দহি-বড়ার কাঠের থালায় মানুষে-মাছিতে লড়াই, হজমি সোউ-কা-পানির মটকা, তেলেভাজা কচুরির ঝড়ি, পান, শরবত আর বারোয়ারি হুকা চিলমচির কড়া ধোঁয়ায় সকালটাই জমজমাট।
কাছেই তালপাতার বড় ছাতা নয়তো টাটের নিচে তিলক কাটা যোশীর পঞ্জিকা, রাশিচক্র, পাশা। তারই পাশে সাদা পাগড়িওয়ালা নজুমীরের দাড়ি, দোয়া, তাবিজ, আর ইউনানি ছক। ঠিক উল্টোদিকে ফাগুনের চড়া কিন্তু আরামী রোদে অথর্ব এক ফিরঙ্গি বসে। তার সামনে সামদ্রিক মানচিত্র আর কম্পাস। তারই দৌলতে মানুষজনের ভাগ্য গুণে বলার ফিকির। যা আসে! দুই দাম কিংবা একটি টাকা।
কোথাও বা ভণ্ড ফকির-দরবেশের বত্রিশ তালি ময়লা খিরকা জোব্বা গায়ে আল্লার নামে খয়রাতের চিৎকার জুড়েছে। রাস্তার আসরে বুড়ি নাচওয়ালির নীল সবুজ ঘাগরার পেখম সোনালি আঙ্গিয়া কুর্তি বাসন্তী রঙের ওড়নায় জরির ঝলমল বাহার, চোখে সুরমা দীতে মিশি, গায়ে গিল্টির গয়না, হাবভাবের মিছে চেষ্টা, ফাটা গলা, পা-জেব-ঘুংঘ্রুর আওয়াজ–তবু খদ্দের সমঝদারের খামতি নেই।
পরকাল ভেবে ভেবে একাকার হিন্দু সেপাই চড়া রোদে মেলার ভিড়ে পথের শেষ সম্বল খুঁজতে খুঁজতে কুমোরের মাটির পুতুলের ঝাঁকার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। কিষণজি সীতারামজি হনুমানজির ওপর দাম কষাকষি চলছে। হরেক রকমের মালার দোকানে ভিড়। মালা ছাড়া মুক্তি নেই। কেউ গলায় কেউ হাতে মালা ঝুলিয়ে ভাবনাশূন্য মনে আনন্দসাগরে ভাসতে ভাসতে বাদশা দর্শনে চলেছে।
ভোরের নামাজ আদায় করে শাহেনশা জাহাঙ্গীর উঠে দাঁড়ালেন। এখন তিনি দর্শন ঝরোকার সামনে যাবেন। হিন্দুস্থানের বাদশাকে নিত্যদিন যেখানেই থাকুন–দিনের শুরুতে একবার তাঁকে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াতেই হবে–যেখানে তাঁকে সবাই দেখতে পাবে। দেখে নিশ্চিত হবে। স্বস্তি পাবে। বুঝতে পারবে–হিন্দুস্থান থেমে নেই। না–বাদশা আছেন। শুধু তাই নয়–দেশের মানুষ তাঁকে দেখে মানত করে। কারও ছেলের খুব অসুখ। সে এসে খানিকটা জল বাদশার নামে ধরবে। যত কাজই থাকুক–সব ফেলে বাদশা সেই জলের দিকে ওপর থেকে একবার তাকাবেন। জলের ওপর নিজের নিঃশ্বাস ফেলবেন। সে জল ঘরে নিয়ে গিয়ে রগীকে খাওয়ানো হবে। আজ অবশ্য তেমন কেউ আসেনি। আন্নাসাগরের তীর ঘেষে ধুলোর ছটা আকাশ ধরে অনেকটা উঠেছে। এক ঝাঁক ঘোড়সওয়ারের টগবগানো ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষরে এই ধুলোর জাল। তাতে পরিষ্কার রোদ পড়ে এক রঙ্গিলা ছবি। বাদশা সবই পরিষ্কার দেখতে পান। তাঁর শরীর ভোগে লালচে–হাত দুখানি শক্তসমর্থ। বয়স এই ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ। দূরের আকাশে তাকিয়ে সেলিম জাহাঙ্গীরের কপালে ভাঁজ পড়লো। মেবার থেকে এখনো তো কোনো খবর এলো না। বাবা খুর্রমের কাছ থেকে তো কোনো কাসীদ এসে পৌঁছলো না।
ঠিক এইসময় ডুরাসানা-মঞ্জেলের সামনের মাটিতে একজন কাসীদ ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালো। এরা হিন্দুস্থানের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে। সবার আগে ছুটতে ছুটতে এসে খবরাখবর দেয়। নজর রাখে। আগাম এসে সব জানায়। কাসীদরা বাদশার খাস তাবিনের গোয়েন্দাও বটে। ডান হাত এগিয়ে দিয়ে তার ওপর মাথা রেখে কাসীদ কোমর থেকে মাথা অব্দি তার শরীর নোয়ালো। এভাবে শাহী কুর্নিশ করে লোকটি তসলিম জানালো। শেষে বললো, মথুরার তিন মঞ্জিল দক্ষিণে মাঠ-চাষীরা কর দেবে না বলে একজোট হয়েছে। ফৌজদার রজব খাঁর তিনজন ঘোড়সওয়ারকে কোতল করেছে। ফৌজদারের ধানুকী পায়দল সেপাইরা এঁটে উঠতে পারছে না।
কথা শেষ হলে কাসীদ আবার কুর্নিশ করে চলে গেল। খবরটা দরবারি আখবরাতের জন্যে জমা হলো। সারাদিন ধরে এভাবে সারা হিন্দুস্থানের খবর এসে জমা হয়। সন্ধেবেলা বাদশা উজিরদের সঙ্গে দরবারে বসে সব শোনেন। কিন্তু মেবার থেকে তো কোনো খবর এলো না এখনো। বছর বারো আগে তখনকার শাহজাদা সেলিম জাহাঙ্গীরকে বাদশা আকবরের হুকুমে মেবারের মাথা তুলে ওঠা রাণা অমর সিংহকে ঠাণ্ডা করতে যেতে হয়েছিল। সে স্মৃতি খুব সুখের নয় বাদশা জাহাঙ্গীরের। আরাবল্লির পাহাড়ী ইদর রাণা অমর সিংহ তাকে কাবু করে ফেলেছিল। কোনোরকমে মান বাঁচিয়ে সেলিম পালিয়ে এসেছিলেন। তখন তিনি দশ হাজারী মনসবদার। এলাহাবাদের সুবেদার। হিন্দুস্থানের ভাবী বাদশা। তখন তার ওয়ালিদ-ই খোদ আকবর বাদশাই বিছানা নিয়েছেন। হিন্দুস্থানের আকাশে মেঘ। উজিরদের অনেকেই সেলিমকে সিংহাসনে চান না। মানসিংহ তো পরিষ্কার জানিয়েই দিয়েছেন–সিংহাসনে তিনি সেলিমের জায়গায় তাঁর বড় ছেলে খসরুকেই দেখতে চান।
সেসব দিনের মেঘ কবেই কেটে গেছে। জাহাঙ্গীরের বাদশাহী দশ বছরে পা দিয়েছে। ঢাকা থেকে কাবুল অব্দি তাঁর ফরমান চলে এখন। কিন্তু হায়! রাজপুতানার সামান্য রাজ্য মেবার সেই কবে আকবার বাদশার আমলে বাগী হয়েছিল–মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল রাণা উদয় সিংহ–তার ছেলে রাণা প্রতাপ জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েও যুদ্ধ চালাতে লাগলো–এখন তার ছেলে অমর সিংহও সেই একই পথে চলেছে। ওদের ঠাণ্ডা না করে বাদশা জাহাঙ্গীরের শান্তি নেই–স্বস্তি নেই! মনে হয় বাদশাহী মকুটে কোত্থেকে একটা বাদুলে পোকা এসে বসে আছে। এ জন্যেই তিনি আজ তিন বছর হলো আন্নাসাগরের তীরে এই ছাউনি ফেলে বসে আছেন। শাহজাদা বাবা খুর্রমের হাতে বিরাট মোগল লস্করের দল পাঠিয়েছেন উদয়পুরে। হুকুম আছে–চিতোর দুর্গ গুড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু এখনো কোনো খবর আসছে না কেন? এবারও কি মেবারের রাণাদের কাছে মোগল সূর্যের আলো পৌঁছতে পারবে না?
পুবে ঢাকা–পশ্চিমে কাবুল, উত্তরে কাশ্মীর, দক্ষিণে বিজাপর গোলকুণ্ডা–কোথাও ফরগনার চাঘতাই বংশের সমসের কেউ আটকাতে পারেনি। আমার রক্তে যেমন আছেন তৈমুর-তেমনই আছেন চেঙ্গিস। আমি রাণা অমর সিংহকে কাবু করতে না পেরে এলাহাবাদে ফিরে গিয়েছিলাম। বাবা খুর্রমও কি ফিরে আসবে? বাদশার কপাল আবার কুঁচকে উঠলো।
জীবনটা এমনিতে আনন্দেরই লাগে বাদশা জাহাঙ্গীরের। বিরাট এই হিন্দুস্থানে তারই ইচ্ছা শেষ ইচ্ছা। আব্বা হুজুর বাদশা আকবর বেঁচে থাকতেই আমি সিংহাসনের দিকে তাকাই। সেজন্যে আমাকে তিনি চরম শাস্তি দিতে পারতেন। দেননি। বরং তাঁরই ইচ্ছাতে আমি আজ দশ বছর হলো হিন্দুস্থানের বাদশা। আমার বাতাসে কস্তুরী জাফরানের গন্ধ। আমার আকাশে সব সময় নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ে।
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস গরম হয়ে উঠেছে। রাঠোরি আর কচ্ছি, রাজপুতদের দেশ এই আজমির। এখানকার মাঠে মাঠে এখন পেকে ওঠা বাজরার শিষ কেটে তোলার অপেক্ষায়। তাই বাদশা জাহাঙ্গীর এখান থেকেই শাহজাদা খুর্রমকে সাবধান করে দিয়েছেন–মেবার অভিযান করতে গিয়ে শাহজাদা যেন ফসলের মাঠে ছাউনি না ফেলেন। যদি একান্তই ফেলতে হয় তেসে মাঠের চাষীকে যেন সরকারি খাজাঞ্চীখানা থেকে আশিরফি আর রুপেয়ায় তার লোকসান পুষিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ম বেধে দিয়ে গেছেন আলা হজরত বাদশা জালাউদ্দিন আকবর। সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন জাহাঙ্গীর। এই আন্নাসাগরের তীরে বসেই বাদশা জাহাঙ্গীর শাহজাদা খুর্রমকে মেবার অভিযানে পাঠিয়ে খুঁটিনাটি হুকুম থেকে পরামর্শ–সবই দিয়ে চলেছেন।
ছেলের যাতে জয় হয় সে জন্যে তিনি আজমিরে খাজা সাহেবের বরকতে দোয়া করেছেন। দোয়া করতে বসে কী খেয়াল হওয়ায় নিজের দুই কানও ফুঁড়িয়েছেন। খাজা সাহেবের সাক্ষাৎ চেলা এখন হিন্দুস্থানের বাদশা সেলিম জাহাঙ্গীর। তার ফোঁড়ানো কানে শাহী কুণ্ডল। বাদশার মন পাওয়ার জন্যে নিত্যদিন যেসব আমীর ওমরাহ দরবারে আসেন–তাঁরাও কেউ কেউ কান ফুঁড়িয়েছেন। বাদশার দেখাদেখি তাঁদেরও কানে কানে এখন কুণ্ডল উঠেছে।
ওয়াকেনবীশ এসে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাদশাকে কুর্নিশ করলো। তসলিম জানালো। বাদশা তার চোখে তাকালেন। তার মানে–কাল রাতে শুয়ে পড়ার পর থেকে এই সকাল অব্দি হিন্দুস্থানের নানান জায়গা থেকে যেসব খবর নিয়ে এসেছেন কাসীদ গোয়েন্দা আর কবুতরের দল–তা এখনি বাদশাকে ওয়াকিফহাল করা হোক। আব্বা হুজুর যে কত কি জানতেন! এ ব্যবস্থারও চল হয়েছে আকবর বাদশার সময় থেকে। খবর আসে। জমা হয়। দরবারি আখবরাতে সারাদিনের খবর সাজিয়ে সন্ধেবেলা বাদশাকে শোনানোই ওয়াকেনবীশী কানুন।
ওয়াকেনবীশ যে দুটো খবর জানালো–তা খুবই চিন্তায় ফেলার মতো–জরুরিও বটে। খবর শুনে তখন তখনই বাদশাকে হুকুমও জারি করতে হয়। এমনই খবর যে জন্যে বাদশা দরবারি হুকুমনামা বের করানোর জন্যে সময় দিতে পারেন না। দিতে গেলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিহার ছাড়িয়ে মোগল পতাকা এখন বাংলায় এগোচ্ছে। কোচ এলাকা পেরিয়ে কামরূপেও মোগলবাহিনী ঢুকে পড়েছে।
পয়লা খবর : ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণে চাষী পাইকরা খাজনা দিচ্ছে না। খুন্তাঘাট থেকে পাইকরা কামরূপ অব্দি ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি ইজারাদাররা গিয়ে কোন থৈ পাচ্ছে না। রায়তরা বিষ খাইয়ে কয়েকজন ডিহিদারকে মেরে ফেলেছে।
খতে কবুলাৎ গেরেফতে অন পরগনাৎ রা ব মুসতাজিরন সোপরদ।–বলতে বলতে বাদশা জানতে চাইলেন, মুস্তাজির ইজারাদারদের কথা বলো–
আলা হজরত কয়েকজন মুস্তাজিরও খুন হয়েছে।
বাদশার কপালে আবার কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। হিন্দুস্থান এত বড়–তার সব জায়গায় তিনি একই সঙ্গে হাজির থাকতে পারেন না। সে-কাজ পারেন শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহ। আর পারতো আমার আওলাদরা। শাহজাদা খুর্রমের মতো অন্যদেরও যদি অভিযানে পাঠাতে পারতাম! তারা যেন আমারই হয়ে আমাকে ফতেজং করাতো। যেমন কিনা আব্বা হুজুর তাঁর হয়ে আমাকে পাঠিয়েছিলেন মেবারে। যদিও সেখানে সেবারে আমি জং ফতে না করেই ইলাহাবাদে ফিরে গিয়েছিলাম। আব্বা হুজুরে আমাদের ওপর খুব আশা রাখতেন। আমরা তিন শাহজাদা–আমি, মুরাদ, দানিয়েল-তাঁর আশা মেটাতে পারিনি। তিনি থাকতেই মুরাদ চলে গেল। চলে গেল দানিয়েল। আল্লায় মেহেরবান-–থেকে গেছি আমি। আজ আমি হিন্দুস্থানের বাদশা।
বাদশার চোখ এখন আন্নাসাগরের জলের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়াকেনবীশ তার মুখে তাকিয়ে। বাদশার মুখের কথাই হুকুম। বাদশার মুখের কথাই ইতিহাস। বাদশা বলবেন–আর সঙ্গে সঙ্গে তা লেখা হয়ে যাবে। তাই নিয়ম।
জাহাঙ্গীর নিজেকে এখন আকবরের জায়গায় বসিয়ে ভাবছিলেন–আমার তো চার আওলাদ–চার শাহজাদা। খসরু, পরভেজ, খুর্রম, শারিয়ার। খুর্রমকে পাঠিয়েছি মেবারে। খসরুকে পাঠাতে পারতাম বাংলা মুলুকে–খুন্তাঘাটে পাইক রায়তদের বেয়াদপি গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু তা হবার নয় ইনসাআল্লার ইচ্ছায়।
সে জন্যে আমিই দায়ী। আমিই দায়ী।
ওয়াকেনবীশ দেখলো, বাদশা ডান হাত মুঠো করে নিজেরই কপালে দু’দুবার ঠেকালেন। চোখ কুঁচকে এসেছে। ডান গালে চোখের জলের ফোঁটা।
ওয়াকেনবীশ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। সে কখনো বাদশার চোখে জল দেখেনি। বাদশার চোখে জলের কথা কখনো শোনেওনি সে। সে নিজে হিন্দস্থানের নিত্যদিনের নিত্যসাক্ষী। রোজকার হাজারো সন্দেশের দরবারি আখবরাৎ লিখে লিখে সে নিজেও কখন খানিকটা ইতিহাস হয়ে পড়েছে। আসলে সব মানুষই বোধহয় ইতিহাস। সে ইতিহাস যখন মজিয়ে ফেলার মতো করে লেখা হয়–তখন তা হয়ে দাঁড়ায় কহানী।
যদি খসরু সিংহাসনের দিকে না তাকাতো। সে-জন্যে অন্ধ করে দিতে যদি তার চোখে আকন্দর আঠা লাগানোর হুকুম না দিতাম। যদি খসরু, অন্ধ হয়ে না যেতো। হায় আল্লা! আমার বড় আওলাদ খসরু–তাগড়া, আলিশান জোয়ান–শাহজাদা খসরু আমারই হুকুমে আজ অন্ধ, বন্দী। আমিই দায়ী। হেকিম আবদুল হাজি সিরাজী তো বলেছে, দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছে শাহজাদা। খসরু যদি দৃষ্টি ফিরে পায় তো ওকেও অভিযানে পাঠানো যাবে। একটু একটু করে ও আবার দুনিয়ার আলো দেখুক। এই খুন্তাঘাটেই ওকে পাঠাতে পারতাম। বিসমিল্লাহ রহমানে রহিম। খসরু ফের এই দুনিয়া দেখতে পাচ্ছে। যদি সবটা দেখতে পায় একদিন–তাহলে হেকিম আবদুল হাজি সিরাজীকে দিল্লির কাছে বিলোচপুর জায়গীর ইনাম দেবো।
পরভেজ অপদার্থ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। আর শারিয়ার! সে তো এখন বালক মাত্র। যে-বছর আমি বাদশা হলাম সে বছর শারিয়ার দুনিয়ার নূর দেখতে পেল। তাই ভরসা একমাত্র খুর্রম। কিন্তু সেই খুর্রমের চোখে তাকাতেই আজকাল ভরসা হয় না বাদশা জাহাঙ্গীরের। সবসময় সে চোখে যেন কিসের খেলা চলছে।
অথচ এই খুর্রমকে মেবারে পাঠিয়ে তারই ফতে জং দোয়া করে কয়েক মাস আগে ওই আজমিরে খাজা সাহেবের বরকতে খিচড়ি চড়ানো হলো। কিসসা-কাহানীর গপসপের মতোই এক জোড়া ডেগ্ এলো আগ্রা থেকে। এক একটা ডেগে চাপানো হলো সওয়া শো মণ করে সেরা দেওয়ান প্রসাদ চাল আর নাখদ ডাল। খাজা সাহেবের মকবারার উঠোনে উনুন ধরালেন হিন্দুস্থানের বাদশা বেগম খোদ নুরজাহান। সে ছবি শুধু আমি দেখেছি। রান্না হয়ে গেলে মইয়ে চড়ে প্রথম থালা খিচড়ি আমি নামাই। সেদিন খুর্রমের ফতেজং দোয়া করে হাজার পাঁচেক কাঙালকে খাওয়ানো হয়েছিল।
অথচ সেই খুর্রম? হাত নাড়লেন বাদশা।
ওয়াকেনবীশ গড়গড় করে বলতে লাগলো, এইসব পাইক জমিনদার সেনাদলে ভালো ধনুকবাজ শেখ ইব্রাহিম ভালো করে খেয়াল রাখেননি। মনসবদার আলমাবেগ খুন হয়েছেন। রাঙামাটি অব্দি এখন পাইকদের কব্জায়। পাণ্ডা হলে পাইক সর্দার সনাতন। সে ধমধমা দুর্গা থেকে লড়াই চালাচ্ছে। যাতে দুর্গে খাবার না যেতে পারে–সে জন্যে মির্জা নাথন আশপাশের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন–আলা হজরত।
দম নেবার জন্যে ওয়াকেনবীশ থামলো।
দুসরা খবর : আসামের জঙ্গলে মোগল তোপখানার ভারি ভারি কামান বয়ে নিয়ে যেতে হাতির খুব দরকার। খুস্তাঘাটের কাছাকাছি বকির খান পাইকদের নিয়ে হাতি ধরছিলেন। কয়েকটা হাতি বন্দীও হয়। পাইকদের গাফিলতিতে কিছু হাতি পালিয়ে যায়। কিছু হাতিখেদা সর্দারকে বকির খান ফাঁসি দিলেন। বাকি লোকদের কোড়া মারা হলো। বকির খান হুকুম দিলেন–হয় পালিয়ে যাওয়া হাতিদের ধরে নিয়ে এসো–হর খিলি হাজার রুপয়ে–নয়তো হাতি পিছু হাজার রুপেয়া করে দাও।
পাইকরা গোটা এলাকার আম জনতাকে খেপিয়ে তুললো। রাতে হামলা হলো। বকির খানকে জ্যান্ত ধরা হলো–বকির রা জিনদে গেরেফতে–দু’টুকরো করে কাটা হলো। পাইক হামলায় মোগল সেপাইদের মেরে ফেলা হলো। বাকিরা হলো বন্দী। বাদশার হাতিগুলো বাজেয়াপ্ত করা হলো। হাতিখেদা এক পাইক সর্দার নিজেকে রাজা বলে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলো–ইয়েকি আজ সরদারনে খিলগির রা ব রাজগি বরদাশতে–
ওয়াকেনবীশের আর পড়া হলো না। দোতলা এই তাঁর ঘরের পদার পেছন থেকে দু’জন খিদমতগার ছুটে এলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাদশা গদিতে বসে পড়েছেন। এই দুই খিদমতগারের ভেতর এক গোলাম ওয়াকেনবীশের খুবই চেনা। লোকটা তার বাড়িতে চুরি করতে এসে বমাল ধরা পড়ে। কানুন মোতাবেক লোকটাকে ওয়াকেনবীশ গোলাম হিসাবে পায়। ইচ্ছে করলে ওকে বাজারে বেচে কয়েক মোহর পেতেও পারতো ওয়াকেনবীশ। মোহরের দর পড়ে গেছে আকবর বাদশা চলে যাওয়ার পর। এখন নয় রুপেয়ায় এক মোহর। গোলামটা খুব বাধুক। ওয়াকেনবীশ ওকে বাদশার খিদমতগারে ভর্তি করে দেয়। ফতেজং-এর বন্দীরা, চোর, খুনীরাই হিন্দুস্থানে গোলাম হয়। গোলাম হয় ওদের ছেলেরা। আর অভাবে পড়ে অনেকে গোলাম হয়। তা লোকটা এখন বাদশার সামনে সোনার কৌটো খুলে দুই গুলি আফিম বের করে দিলো। দিলো রাতের শিশির জমানো শরবত। খেয়ে বাদশা সুস্থির হতে না হতে অন্য গোলাম রেকাবি ভর্তি খোবানী এগিয়ে ধরলো। একখানা মুখে দিয়ে বাদশা এবার চোখ খুললেন। স্থির দৃষ্টি।
ওয়াকেনবীশ বাদশার হাল হকিকতের খবর রাখে। সে এবার সোজা হয়ে বসলো। গোলাম দুজন বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরাই রাজধানীর বাইরে বাদশার সুবা সফরের সময় পাহারাদারি করে। জিনিসপত্তর জায়গারটা জায়গায় গুছিয়ে রাখে। বাদশার কখন কি দরকার তা জানে। একটা আঙুর পড়ে গেলেও তুলে রাখে। ফেলবার হলে ফেলবেন বাদশা।
আহেদী কোন লেফাফা?
বাদশার এ কথায় ওয়াকেনবীশ একখানা চিঠি মেলে ধরলো। যেসব জানবাজ লড়াকু বয়স কম বলে মনসব পাওয়ার উপযুক্ত হয়নি–তারাই আহেদী। মোগল বাহিনীর এরাই মাখন। সেরকম এক আহেদী–বকির খানের ডান হাত—লিখছে–
কুতে আন্দিশে–সমাজবিরোধীদের শায়েস্তা করতে আমি ওদের গাঁয়ে হামলা করলাম। ওরা খাজনা দেয়নি। মোগল রক্তপাত করেছে। ওরা আমার আসার কথা শুনেই জমায়েত হয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। আমাদের জন্যে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকলো। এই খবর পেয়ে দীন দুনিয়ার মালিক শাহেনশা আপনার এই সামান্য গোলাম সব জায়গা থেকে জঙ্গল কাটানোর লোক আনিয়ে জঙ্গল কাটাতে শুরু করলো। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা এইসব কুতে আন্দিশে বীর সেপাইদের ঘেরাওয়ে আটকে পড়ে—তোফানগ্ আন্দাজিওয়া তীরবাজি—বন্দুক তীর দুইই চালাতে লাগলো। তবু শেষ অব্দি ওরা হতাশ হয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো। জঙ্গে আজিম–প্রচণ্ড লড়াই শুরু হলো। আমাদের দেড়শো জন শহিদ হয়েছে। ওরা প্রায় হাজার জন নিহত হয়ে জাহান্নমে গেল। ঘোড়সওয়ারদের নিয়ে এবার গাঁয়ে ঢুকলাম। ওরা বাচ্চা কাচ্চা সমেত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে জঙ্গলে পালিয়েছিল। ঘোড়সওয়াররা গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। মেয়ে ও শিশুদের কয়েদ করা হলো।
বাস কর।
ওয়াকেনবীশ থামলো। দেখলো বাদশা চোখ বুজে ফেলেছেন।
জাহাঙ্গীর তখন ভাবছিলেন–মানুষ বিদ্রোহ করে কেন? কি জন্যে? একশো বছর হয়ে গেল–লোদীরা আগ্রা দুর্গ বানিয়েছিল। এই এলাকায় বিদ্রোহ শায়েস্তা করতেই আগ্রা দুর্গা বানানো হয়। আব্বা হুজুর আকবর বাদশা একদিন কথায় কথায় একথা বলেছিলেন।
তাহলে কি সারা হিন্দুস্থানে জায়গায় জায়গায় আগ্রা দুর্গের মতো একটা করে দুর্গ বানাতে হবে। কেননা, রায়তীদের হামলা, খাজনাব তো সেই কবে থেকেই লেগে আছে। তা করতে হলে তো শাহী আশরফিখানা ফতুর হয়ে যাবে। শাহী খরচের জন্যে হিন্দুস্থানের সব জমিনের বিঘা পিছু দশ সের করে ধান, গম পাওয়া যায়। তাতে কি ওই দুর্গ-বিলাস চলতে পারে! এতকাল মুঘল শাসনের কড়াকড়ি তো ছিল মোটে চার সুবায়–দিল্লি, আগ্রা, লাহোর আর মুলতানে।
মানুষ বিদ্রোহ করে কেন? কামরান, আসকারি–দুই ভাইই তাঁদের ভাই বাদশা হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। আমি নিজেই আব্বা হজুরের রাজধানীর দিকে সেপাই লস্কর নিয়ে এগিয়েছিলাম। খসরু আমার সিংহাসনের দিকে ফিরে চেয়েছিল। খুর্রমের চোখে কী আছে জানি না।
আবার চোখ খুলে গেল বাদশার। লেখো–
ওয়াকৈনবীশ কুমনামা লিখতে বসলো। এক্ষুনি এ-হুকুম আন্নাসাগরের তীর থেকে ব্রহ্মপুত্রের তীরে চলে যাবে।
বাদশা জাহাঙ্গীরের চোখে পলক পড়ছে না। তিনি তাঁর মুখ দিয়ে কালের শিলালিপি বলে যাচ্ছেন–
সেরা কিছু আহেদী নিয়ে চড়াও হও। উচিত শাস্তি দাও। কোতল ওয়া বনদ্ ওয়া তরাজ–খতম কর, কয়েদ কর, লুঠ কর। দুর্গ গুঁড়িয়ে দাও। মেয়ে ও শিশুদের গোলাম বানাও। জয়ী সেপাইরা লুঠের মাল যেন আগ্রায় নিয়ে আসে।
বাদশা উঠে দাঁড়ালেন। এবার তাঁর দৌলতখানায় যাবার সময় হয়েছে। হুকুম জারি করে তবিয়ৎ যেন এতক্ষণে ধাতে এলো।
এলাহাবাদের সুবেদার থাকতে থাকতেই শাহজাদা সেলিম জাহাঙ্গীর মদে মেতে ওঠেন। মেবারের রাণা প্রতাপ সিংহের ছেলে অমর সিংহের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে সেই যে এলাহাবাদের ডেরায় তিনি ঢুকলেন–হিন্দুস্থানের বাদশা হবার জন্যে আকবর বাদশার ডাক না পাওয়া অব্দি তিনি মদে চুরচুর হয়ে থাকতেন। সেই সঙ্গে আহেলা নাচনেওয়ালীর দল লেগেই থাকতো। এই সময়েই তিনি তার মনসবীর ভাঁড়ার খান-ই-সামান রুকাবট খাঁয়ের হাতে তুলে দেন। এই খান-ই-সামনি রুকাবট আসলে বল্ক-এর মানুষ। চীন থেকে আনা আফিমের কারবার ছিল তার বল্কে। মোগল সেনাদলের জন্যে বদকশান থেকে ঘোড়া আমদানির সময় রুকাবট ঘোড়ার দলের সঙ্গে চোরাই পথে সেই আফিম হিন্দুস্থানে আমদানি করতো। ওপর ওপর রুকাবট সুবেদার সেলিমের খান-ই-সামান। ভেতরে ভেতরে তার ফেঁপে ওঠা আফিমের কারবার। সে-ই শাহজাদা সেলিমকে এলাহাবাদে থাকতে আফিম ধরিয়েছিল। মদ, মেয়েমানুষ, আফিম আর ফুর্তিতে আর কিছুদিন মেতে থাকলে সেলিমের দশা তার দুই ভাই মুরাদ আর দানিয়েলের মতোই হতো। ভাগ্যিস আলা হজরত আকবর বাদশা তাকে বাদশাহীতে বসানোর জন্যে আগ্রায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নয়তো……
রুকাবট খাঁয়ের হাতের গুণে শাহজাদা সেলিমের সকাল বেলাতেই আফিমের অভ্যেস হয়ে যায়। নাস্তা করার আগেই। বলা যায় খালি পেটে। পিত্তরক্ষার জন্যে সঙ্গে কিছু, আঙর নয়তো খোবানী। ব্যস। এতেই আরাম। এতেই মৌতাত। শাহী শরীরের ভেতরটা তখন যেন কী কুরে কুরে খায়। এরই নাম আরাম।
সেই মৌতাতের ঝোঁকেই হিন্দুস্থানের বাদশা দৌলতখানায় এসে ঢুকলেন। তখনো তার মাথার ভেতর শাহী হাতিকে চাঙ্গা করার মতো কীলক ধাঁচে একটা জিজ্ঞাসাই খোঁচা দিচ্ছিল–মানুষ বিদ্রোহ করে কেন? মানুষ হামলা করে কেন? চড়াও হয় কেন? বাধ্য থাকে না কেন? কেন জানবাজ, তীরবাজ, তোফানগবাজ হয়ে ওঠে? কুতে অন্দিশে হয়ে ওঠে কেন? বাধিয়ে বসে জঙ্গে আজিম!
অথচ দীন দুনিয়ার মালিক রহমানে রহিম এই দুনিয়ার বাতাসে কস্তুরী জাফরানের গন্ধ মিশিয়ে রেখেছেন। মিশিয়ে রেখেছেন অগুরু চন্দনের সুবাস। ছাতি ভরে বাতাস টানো। ছিনা সাফা হোক। এক পেয়ালা সিরাজী আর শাদা ফল ময়দায় এক টুকরো রুটি। আর কি চাই? সেলিম জাহাঙ্গীরের মাথার ভেতর আফিমের অদৃশ্য ঘোড়াটার ক্ষুরে ক্ষুরে এমন অনেক জিজ্ঞাসা, ছিঁড়ে যাওয়া টুকরো টুকরো ভাবনা ছড়িয়ে দিয়ে খোদ বাদশাকে বাস্তব আর অলীকের মিশে যাওয়া এক সীমানায় নিয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক এই সময় ‘জাঁহাপনা সলামৎ’! বলে কুর্নিশ করতে করতে মহাবত খাঁ এসে হাজির। ঠিক এই সময়ে আগ্রা ছেড়ে মহাবত খাঁর মতো বিশ্বাসী, দিলখোলা জাঁহাবাজ জংদার মানুষের একেবারে আন্নাসাগরে ছুটে আসা ভালো লাগলো না জাহাঙ্গীরের। তিনি উসখুস করে উঠলেও সে ভাব যতটা পারা যায় চেপে রেখে চোখ তুলে তাকালেন। তার মানে কী ব্যাপার?
মহাবত হুকুম পেলে ইবলিশকেও এক হাত না দেখিয়ে ছাড়বার পাত্র নন। আব্বা হুজুর তখন বাদশা। সুবেদার সেলিম দিল্লির সিংহাসনের দিকে এগিয়েছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন এই মহাবত খাঁ। উচিত কথা বলার বেপরোয়া হিম্মত রাখেন। গোঁয়ার, দুর্মুখ হলেও কাজের লোক। নিমকহারামী ধাতে নেই। বাদশার সামনে জমিন বোস্ করে উঠে দাঁড়ালো মহাবত খাঁ।
আলা হজরত। একটা দাগমুণ্ডী ভেড়ার দাম সাড়ে ছে রুপেয়া। এক মণ সুখদোষ চাল একশো দাম। বারো দামে এক মণ গম মিলেছে। সেপাইদের কী খাওয়াবো? ঘোড়াই বা কী খাবে! মোহরের দর যে পড়ে যাচ্ছে–
জাহাঙ্গীর বাদশা, ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
মহাবত খাঁ ভয় জানেন না। বললেন, আকবর বাদশা সব মোহরই গোল করে কাটাই করার হুকুম জারি করেন। সেই মতোই আগ্রায় কাবুলে এতদিন মোহর কাটাই হচ্ছিল। আপনি ফের চৌকো করে কাটাই করতে হুকুম দিলেন। আর মোহরের দর চড়চড় করে পড়ে গেল!
বাদশার মৌতাত একথায় কেটে গেল। ইঙ্গিতটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। চাঘতাই মুঘল বাদশা বংশে এই প্রথম কোনো জেনানার নামে মোহর কাটাই হয়ে হিন্দুস্থানের বাজারে এসেছে। সেই জেনানার নাম নূরজাহান। বাদশাহের বেগম। সেলিম জাহাঙ্গীর আর নূরজাহানের নাম একত্রে নতুন মোহরে খোদাই হয়ে বাজারে এসেছে। আগের মোহরের থেকে ফারাক রাখতেই এসব মোহর আবার চৌকো করে কাটাই করতে হুকুম দিয়েছেন খোদ জাহাঙ্গীর।
মহাবত খাঁ বললেন, বাংলা মুলুকে হাওড়ার ঘুসুড়ি থেকে আরমানি ব্যাপারীরা লাসা গিয়েছিল কাপড় নিয়ে। দর পায়নি বিশেষ। ওখান থেকে ওরা সিংকিয়াং–পাঁচশো মঞ্জিল, রাস্তা উজিয়ে গিয়ে দেখে–হিন্দুস্থানের মোহরের দর আরও পড়ে গেছে।
কেন? আমি তো দর বেঁধে দিয়েছি। নয় রুপেয়ায় এক মোহর।
আপনার হুকুম জাঁহাপনা হিন্দুস্থানে চলে। কিন্তু বাইরের ব্যাপারীরা শুনবে কেন? তারা তো বাজার দেখে দর দেবে! মনসবীতে ফি পূর্ণিমায় আপনি যে তঙ্কা দিচ্ছেন তাতে মাহুত, মেঠ, সহিস, ভিস্তি, সরবানদের মাইনে মিটিয়ে দিয়ে এই চড়া বাজারে তুর্কী ঘোড়ার চিরুনি, নাল, গামছা কী দিয়ে কিনবো! কী দিয়ে কিনবো এক কাতার উটের জন্যে যব গম–কী দিয়ে কিনবো মঞ্জেলা হাতিদের ঘি, চিনি!
বাদশা বুঝলেন, মহাবত খাঁর ইঙ্গিতটা কোথায়। আব্বা হুজুর আকবর বাদশার মুরুব্বি, সেনাপতি–দুই-ই ছিলেন বইরাম খাঁ। বিশ্বাসী। আব্বা হুজুরের ভালো চাইতেন। তাকে সামলাতে আব্বা হুজুর শেষমেষ বিধান দেন–আপনার শেষ জীবনটা মক্কায় গিয়ে কাটান। মহাবতের মক্কা যাবার বয়স হয়নি। ওকে কাজেও লাগে। কোথায় পাঠানো যায় তাই ভেবে পেলেন না জাহাঙ্গীর।
ঠিক এই সময়টায় দুর্মুখ মহাবত খাঁ বলে বসলো, আলা হজরত! জেনানার আঁচলে দিন রাত ঝুলে থাকলে বাদশাহী ছারেখার হওয়া কিছু, তাজ্জব ব্যাপার নয়।
একসঙ্গে অনেক কথা এসে গিয়েছিল জাহাঙ্গীরের মুখে। মহাবত মহা চটিতং। কারণও আছে। মসনদে বসার তিন বছরের মাথায় জাহাঙ্গীরের জীবনে নূরজাহান আসেন। তারও চার বছর বাদে নুরজাহান হয়ে দাঁড়ালেন হিন্দুস্থানের বাদশার পয়লা বেগম। এক পেয়ালা সিরাজী আর এক টুকরো রুটি–প্রায় এই হলেই বাদশার জীবনে আর কিছু চাই না। হ্যাঁচাই নুরজাহান বেগমের ভালোবাসা।
কানাঘুষো, সেই নুরজাহানই এখন হিন্দুস্থান চালান। তাঁর নামে মোহর এসেছে বাজারে। মোহর চৌকো? না, গোল? এই নিয়ে কথা পেড়ে মহাবত খাঁ আসলে কোথায় ঘা দিতে চান তা বুঝতে পেরেছেন বাদশা। হিন্দুস্থানের মানুষ–আগ্রা আজমিরের বাজারে হাটুরে লোকজন এখন তাকে নয়া আসিফ বলে থাকে–একথা শুনেছেন জাহাঙ্গীর।
ষাট হাজারি মনসবদার নুরজাহান বেগম এখন বাদশাহের আতালিক–বাদশার মুরুব্বি। তাঁর কথায় বাদশা ওঠেন বসেন। এমন মানুষের নামে মোহর কাটাই হওয়া আশ্চর্যের কি!
নুরজাহানের বাবা ইতিমাদ-উদ্দৌলা এখন উজির। নরজাহানের ভাই আসফ খাঁ এখন উজিরে আজম। নুরজাহান বেগম খোদ বাদশার আতালিক। সেখানে মহাবত খাঁ মাত্র সাত হাজারি মনসবদার। মাস মাইনে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। ফি পূর্ণিমায় সাড়ে বাইশ হাজার টাকা পেয়েও হাতির ঘি, উটের যব, ঘোড়ার দানা, বন্ধুকচীর পট্টি, ধানুকীর তীর যোগানো–মাইনে তো আছেই–কঠিন হয়ে পড়েছিল। কেননা, বাইরে থেকে আমদানি করা ফল, বারুদ, কস্তুরীর দাম দিন দিন যে বেড়েই চলেছে।
তারও ওপর–বাদশা জাহাঙ্গীরের অজানা নয়–দুটো কারণে, বাদশার সুবেদারি জীবনের জিগরি সাগরিদ মহাবত খাঁ বেদম রেগে আছেন।
মহাবত খাঁ শাহজাদা পরভেজের আতালিক। বাদশার বড় ছেলে শাহজাদা খসরু যখন অন্ধ–তখন মসনদের সবচেয়ে বড় হকদার শাহজাদা পরভেজ। কিন্তু একথা কিছুতেই আমল দেয় না–শাহজাদা খুর্রম। আর সেই খুর্রমের সঙ্গেই নূরজাহান বেগম তার ভাই আসফ খাঁর মেয়ে আরজমন্দ বেগমের বিয়ে দিলেন মহা ধুমধামে। সেই শাহজাদা খুর্রমকেই বাদশা মেবার অভিযানে পাঠালেন। পই পই করে নিষেধ করেছিলেন মহাবত খাঁ–
শাহজাদাকে মোগল সেনাদলের সুলুক সন্ধান জানতে দেওয়া ঠিক হবে না জাঁহাপনা–
জাহাঙ্গীর কানে তোলেননি সে কথা।
এত বড় খোঁচা দেবার পরেও নিশ্চুপ বাদশার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না দেখে মহাবত খাঁ বেশ অনুযোগের সুরেই বললেন, দার-উল-সুলতানত আগ্রা আজকাল দার-উল-বরকত আজমিরের সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরছে আলা হজরত।
কেন? আমি প্রায় তিন বছর হলো আজমিরের কাছেই ছাউনি ফেলে আছি বলে–
হ্যাঁ জাঁহাপনা। আপনিই হিন্দুস্থান–
হা হা করে হেসে উঠলেন জাহাঙ্গীর। তা কি করে হয় মহাবত! আগ্রায় ছ’লাখ মানুষের বাস। সেখানে দুশো তুর্কী হামাম। গাছের ছায়ায় ঢাকা চওড়া চওড়া বাদশাহী সড়ক। সত্তরটা মকবরা। আম জনতার জন্যে প্রায় বিশটা বাগ। আর আজমির! কী আছে তার? জওয়ার ভুট্টার মাঠ। আমলকি বন। উড়ন্ত ময়ূর। পুষ্কর যাওয়ার পথে ওই আন্নাসাগর–
বলতে বলতে জাহাঙ্গীর আন্নাসাগরের জলে তাকালেন। সেখানে ঢেউ উঠছিল। সেই ঢেউয়ের মাথায় রোদ্দুর। সেদিকে তাকিয়ে জাহাঙ্গীর বললেন, মোগলদের কথা একটাই–তখৎ ইয়া তাবুৎ–
জানি জাঁহাপনা। হয় তখৎ–না হয় ফাঁসিকাঠের তক্তা।
চাঘতাই বংশের আমরা জানি তাগদ কাকে বলে। যাকে বলে জং-হামলা–লড়াই–একথা বলতে বলতে বাদশা জাহাঙ্গীর মহাবত খাঁর চোখে সরাসরি তাকালেন, আওরত মানে কী জানেন?
মহাবতের চোখ কেঁপে গেল। কোনো কথা বলতে পারলো না।
বাদশা ফের বলে উঠলেন, আপনি তো বড় যোদ্ধা। ইশক্ কাকে বলে বলুন তো? এবারও মহাবত খাঁ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
শাহজাদা দারাশুকো বইটার সম্পূর্ণ কপিটা কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে? বইটার মাত্র দুইটা অংশের কপি দেয়া আছে।