মানবজনম – উপন্যাস – সাদাত হোসাইন
একটা টু ব্যান্ডের রেডিও ছিল আমাদের। অজ-পাড়াগাঁয়ে আমার মা সেই রেডিওর এন্টেনা উঁচু করে ফ্রিকোয়েন্সি খুঁজতেন। তারপরও অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দ হতো। সেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দের ভেতরও আম্মা উত্তর্ণ হয়ে রইতেন একটি অপার্থিব কণ্ঠের জন্য। সেই কণ্ঠের নাম কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী।
আমি ভাবতাম এই মানুষটি বোধহয় বাস্তব জগতের কোনো মানুষ নন। তিনি বাস করেন এই রেডিওর ভেতর। তাঁকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কেবল তাঁর ওই অপার্থিব কণ্ঠ রেডিওতে কান পেতে শোনা যায়। এই বিশ্বাস আমার এই সেদিন অবধি ছিল। কিন্তু সৈয়দ আব্দুল হাদীকে নিয়ে তার বায়োগ্রাফিক্যাল ভিডিও ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে সেই বিশ্বাস ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি তিনি আমার সামনে বসে আছেন, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের একজন মানুষ। আমার যেন বিশ্বাস হলো না। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখলাম, তাকিয়ে দেখলাম, গল্প করলাম। তার সাথে ঘুরে বেড়ালাম কত কত জায়গায়। এই যাত্রায় আরও সঙ্গী ছিলেন সত্তর কিংবা আশি বছর বয়সী তার বন্ধুরাও।
আমি ক্রমশ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হতে থাকলাম, শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর চেয়েও মানুষ সৈয়দ আব্দুল হাদী-তে। আর তার সাথের অসাধারণ সব বন্ধুদের উপস্থিতিতে কলরোল, উচ্ছ্বাসে, ব্যক্তিত্বে। মনে হলো, আমার সামনে অদ্ভুত কলকাকলিতে মুখর কিছু পাখি, উচ্ছ্বসিত কিছু শিশু কিংবা ঝলমলে কিছু তরুণ। যেন বার্ধক্যকে-বয়সকে-জরাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তুমুল উচ্ছ্বাসে তারা শুষে নিচ্ছেন জীবন। জীবনের যৌবন। আমায় ভীষণভাবে চমকে দেয়া সেই সত্তরোর্ধ মানুষগুলো যেন নিমেষেই হয়ে উঠলেন আমার বন্ধু। সত্যি সত্যি বন্ধু।
সময়কে থমকে দেয়ার মতন অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়া চিরতরুণ সেই হৃদয়গুলোর জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা…
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী ও তাঁর বন্ধুদের—
মো. হাবীবউলাহ, সি.এম. সফি সামি, সি.এম. তোফায়েল সামি, সাদিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, খলিলুর রহমান, জিয়াউল হদা এবং সেই অসাধারণ যাত্রার কারিগর এনামুল হক
.
ভূমিকা
আমি বিস্তৃত পরিসরে গল্প বলতে পছন্দ করি। এ কারণেই আমার উপন্যাসগুলোর দৈর্ঘ্যও বড় হয়। মজার বিষয়, এই উপন্যাস লেখার সময় প্রায়ই নানাজন বিভিন্নভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা আপনার এবারের উপন্যাসের ঘটনা কী? কী কাহিনি নিয়ে লিখছেন? বিষয়বস্তু কী?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি খানিকটা থমকে যাই। আসলেই তো, আমার উপন্যাসের কাহিনি কী? বিষয়বস্তু কী?
আমি প্রশ্নকর্তাকে বিনয়ের সাথে বলি, আমি এখনও জানি না, আমার উপন্যাসের কাহিনি কী?
তিনি সরু চোখে আমার দিকে তাকান। তারপর বলেন, আপনি একটা উপন্যাস লিখছেন, আর আপনিই জানেন না উপন্যাসের কাহিনি কী? কেমন লেখক আপনি?
তার এই কথায় আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাই। আসলেই তো! কেমন লেখক আমি? যে লেখক উপন্যাস শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত জানেন না, উপন্যাসের কাহিনি কী? ঘটনা কোনদিকে মোড় নিবে? কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনটি? এ কেমন লেখক?
এ এক রহস্যময় ব্যাপার। এই নিয়ে আমি অনেক ভেবেছিও। ভেবে ভেবে এই রহস্যের কূল-কিনারা করতে পেরেছি। আমার মনে হয়, আমি আসলে আগেভাগে, ভেবেচিন্তে, বড় কোনো প্লট মাথায় নিয়ে, উপন্যাসের শেষ হবে কীভাবে তা সুনির্দিষ্টভাবে ভেবে, গভীর চিন্তাভাবনা করে, প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে পারি না। আমি লিখি একদম হুটহাট। হয়তো হঠাৎ করেই একটা নাম চলে এলো আমার মাথায়, কিংবা কোনো একটা শব্দ গেঁথে গেল মনে, কিংবা কোনো একটা ছোট্ট পক্তি। আমি সেই সামান্য শব্দ, নাম, বা ছোট্ট পঙক্তি থেকেই শত শত পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখে ফেলি। বিষয়টা অনেকটা সামান্য বীজ থেকে ডালপালা ছড়ানো বিশাল বৃক্ষের জন্মের মতো। ছোট্ট এক দানা থেকে যেমন মহীরুহ হয়, ঠিক তেমন। তবে পার্থক্য একটাই, শিমুল তুলোর বীজ থেকে যেমন শিমুল গাছ হয়, তাল গাছ হয় না, আমার উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব খাটে না। আমার উপন্যাস যে শব্দ বা লাইনের ভাবনা থেকে শুরু হয়, সেই শব্দ, নাম বা লাইনকে অনুষঙ্গ করে সে না-ও বেড়ে উঠতে পারে। আদতে বেশিরভাগ সময়ই সে রকম করে বেড়ে ওঠে না। বরং সে বিস্তৃত হতে থাকে তার আপন গতিতে, আপন বাকে। তার সেই গতি, তার সেই বাঁক বোঝার সাধ্য আমার নিজেরই নেই।
এর কারণ কী? এর কারণ, লিখতে বসার পর একটা সময় গিয়ে আমি হঠাৎ আবিষ্কার করি, সেই লেখা, ঘটনা কিংবা চরিত্রে আমার আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং তারাই আমাকে তখন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। লিখতে লিখতে আমি আবিষ্কার করি, খানিক আগে ভেবে রাখা আমার গল্প পাল্টে যাচ্ছে, চরিত্ররা পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে আগে থেকে ভেবে রাখা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা প্রধান চরিত্র। তার জায়গায় হয়তো প্রধান হয়ে উঠছে দীর্ঘ সময় অবহেলায় ফেলে রাখা অন্য কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ চরিত্র।
লেখালেখির এই বিষয়টি আমি উপভোগ করি। লেখক হয়েও লেখার চরিত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া।
মানবজনম তেমনই চরিত্র কর্তৃক লেখকের নিয়ন্ত্রিত হওয়া একটি উপন্যাস। উপন্যাস যদি জীবনাখ্যান হয়, মানবজনম তবে অনেক গল্পের, অনেক চরিত্রের, অনেক ঘটনার এক জীবনাখ্যান।
আমি বারবারই বলি, জীবন জুড়ে যেমন গল্প থাকে, গল্প জুড়েও তেমনি থাকে জীবন। মানবজনম সেইসব জীবনের গল্প। বা সেইসব গল্পের জীবন।
কিন্তু এই মানবজনম আসলে কি?
কে জানে, মানবজনম আসলে কি? হয়তো বিভ্রম আর অপেক্ষার নামই মানবজনম!
সাদাত হোসাইন
৫ জানুয়ারি ২০১৭
*
আষাঢ় মাসের রাত।
খানিক থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি যতক্ষণ পড়ছে ততক্ষণ জোরেশোরেই পড়ছে। চারপাশ জুড়ে একটানা ঝমঝম শব্দ। কিন্তু থেমে গেলেই চারধার একদম চুপ। হঠাৎ করেই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। তবে এখন হাওয়া বইছে। মৃদু শীতল হাওয়া। সেই হাওয়া সামান্য জোরালো হলেই গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ ঝরে পড়ছে। গায়ের নাম হোসনাবাদ। হোসনাবাদে গভীর রাত। এই রাতে মানুষ ঘরে কাঁথা-মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। টিনের চালে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ে। সেই শব্দে ঘুম হয় গভীর। এই গভীর ঘুমের রাতে গাঁয়ের বাড়িতে বাড়িতে চুরি হয়। চোর নিশ্চিন্তে সিঁধ কেটে চুরি করে। তাকে অতি সতর্কতার সাথে দুরু দুরু বুকে নিঃশব্দে চুরি করতে হয় না। সে চুরি করে আয়েশ করে। কারণ সে জানে, এই বর্ষণে গৃহস্থের ঘুম সহজে ভাঙে না।
আব্দুল ফকিরের অবশ্য সে সুযোগ নেই। তিনি কাঁধে ঝোলা নিয়ে হাঁটু সমান ল্যাদল্যাদে কাদার মধ্যে হাঁটছেন। এই কাদা-পানিতে হাঁটা তার জন্য ভয়াবহ যন্ত্রণার। তার বাঁ পায়ে বড় ধরনের সমস্যা। পায়ের সামনের দিকের পাঁচটা আঙুলই নেই। বীভৎসভাবে পাঁচ আঙুলই গোড়া থেকে কাটা। ফলে এই জল কাদায় হাঁটার সময় বা পায়ে ভারসাম্য রাখা তার জন্য খুবই কঠিন। আব্দুল ফকিরের বাঁ পায়ের এই আঙুল কাটার কাহিনি সকলের কাছেই এক বিরাট রহস্য। যদিও আব্দুল ফকির সেভাবে স্পষ্ট করে কারো কাছেই এই আঙুল কাটার ঘটনা খোলাসা করেন না। তবে লোকমুখে এই নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। সেসব কথার বেশিরভাগই নানান অতিপ্রাকৃত ঘটনা ও রহস্যে আবৃত।
আব্দুল ফকির দেখতে জীর্ণ শীর্ণ, অতি সাদাসিধে মানুষ। থুতনির নিচে সামান্য দাড়ি রয়েছে। গাল ভাঙা। তিনি পেশাদার ওঝা। সাপের বিষ নামান। সাথে জ্বিন-পরীর আছরও ছাড়ান। নানান অসুখ-বিসুখে লতাপাতার ওষুধ, পানিপড়া দেন। দশগ্রামের লোক তাকে চেনে। আব্দুল ফকিরের সাথে হারিকেন হাতে হাঁটছে জুলফিকার। জুলফিকার খানিক পাগল কিসিমের মানুষ। সে কথায় কথায় হাসে। আবার কখনো কখনো থাকে ভয়ানক গভীর। সময়ভেদে তার মধ্যে বিপরীতধর্মী আচরণ দেখা যায়। তবে এই মুহূর্তে সে আছে হাসিঠাট্টার মেজাজে। খানিক আগে চতুর্থবারের মতো আছাড় খেয়ে পড়েছে সে। অবশ্য নিজে পড়লেও কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে হাতের হারিকেনটা প্রতিবারই অক্ষত রাখতে পেরেছে জুলফিকার। কাদাপানিতে গড়াগড়ি খেয়ে উঠতে উঠতে সে হাসিমুখে বলেছে, ও কাকু, এই বাইস্যাকালে (বর্ষাকালে) দেহি হগলই ভাইস্যা যাইব গো কাকু।
আব্দুল ফকির কথা বলেননি। এই মাঝরাতে তাকে আরামের ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে, এই নিয়ে তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত। ফতেহপুরের চেয়ারম্যান খবির খাঁ তাকে জরুরি তলব করেছেন। খাঁ-বাড়ির ডাক এড়ানো সহজ কথা নয়। অবশ্য খবির খাঁর জরুরি তলব করার সঙ্গত কারণও রয়েছে। খবির খাঁর একমাত্র ভাগ্নে এসেছে শহর থেকে। ভাগ্নের নাম নয়ন। নয়ন সদ্য এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার। এখন তার আরো উচ্চতর শিক্ষার সময়। সামনে অবিরাম ব্যস্ততা। ডাক্তার জীবনের সেই অবিরাম ব্যস্ততায় ডুবে যাবার আগে সম্ভবত খানিক অবসর কাটাতেই সে গ্রামে এসেছে।
অতীতের নানান ঘটনায় বহুকাল নানাবাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই তাদের। সম্পর্কটাও যেন কেমন ধূসর আর বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত সেই সম্পর্কহীনতায় খানিক সম্পর্কের ঢেউ তুলতেই সে এসেছিল নানাবাড়ি। এসেছিল বৃদ্ধ নানা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সঙ্গে দেখা করতেও। কিন্তু এসেই সে পড়েছে বিপদে। রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে সাপের ছোবল খেয়েছে। নয়ন। কুণ্ডুলি পাকানো সাপ ছিল মশারির ওপরে। মশারি তুলতে গিয়ে সে সাপটাকে যতক্ষণে দেখেছে, ততক্ষণে সাপ তার ডানহাতের আঙুলে ছোবল মেরেছে। নয়ন তীব্র আতঙ্কে পাগলের মতো চিৎকার করেছে। তার শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। খ-বাড়ি ভর্তি নানান লোকজন। মুহূর্তেই তারা চারপাশ থেকে ছুটে এসেছে। নয়নের মামা ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খবির খাঁ। তিনি দু’হাতে নয়নের কাঁধ চেপে ধরে বললেন, কী হইছেরে নয়ন? কী হইছে?
নয়ন অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেনি। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার সামনেই ঘরের বেড়ার চৌকাঠের নিচের ফাঁকা অংশে। তার দৃষ্টি জুড়ে তীব্র ভয়। সে সেই তীব্র ভয় জড়ানো গলায় ফ্যাসফ্যাস করে বলল, সাপ, সাপ। আমাকে সাপে কেটেছে। সাপ…।
চারদিকে বর্ষার থৈ থৈ পানি। এই পানিতে গৃহস্থের বসতবাড়িতে সাপ খোপ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। বরং এই সময়ে এটিই নিয়মিত ঘটনা। গৃহস্থের উঠোনে, ঘরে, খাটের তলায় এমনকি কখনো কখনো বিছানায়ও কুণ্ডুলি পাকানো সাপ দেখা যায়। সাপে কাটা মানুষের সংখ্যাও এই সময়ে বেড়ে যায়।
খবির খাঁ লোকজন দিয়ে সাপের খোঁজে সারা ঘরে তল্লাশি চালালেন। তল্লাশি চালানো হলো বাইরে উঠানেও। কিন্তু সাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সাপটিকে আর কোথাও পাওয়া গেল না। অবশ্য গ্রাম গঞ্জের টিনের ঘরের বেড়ার চৌকাঠের নিচে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকে। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে সাপ-খোপ ঢোকা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। বরং অতি স্বাভাবিক ঘটনা। স্বাভাবিক ঘটনা বের হয়ে যাওয়াও। খবির খাঁ ধরে নিয়েছেন, সাপ সম্ভবত সেই পথেই বেরিয়ে গেছে।
টানা বর্ষায় বাড়ির চারধারের ঘাস, লতাগুল্ম তরতর করে বেড়ে উঠেছে। সবুজ ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে চারপাশ। তার ওপর বাড়ির উঁচু ভিটে ছুঁইছুঁই হয়ে উঠে এসেছে বিলের পানি। এই মেঘলা রাতে সাপটা যদি টুপ করে ওই পানিতে নেমে যায় কিংবা ঘন আগাছা বা জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, তবে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। খবির খাঁ অবশ্য সেই আশা ছেড়েও দিয়েছেন। তিনি সাপ খোঁজা বাদ দিয়ে শক্ত করে নয়নের হাতের কব্জি বেঁধে দিলেন, যাতে সাপে কাটা বিষাক্ত রক্ত নয়নের হাত থেকে শরীরের বাকি অংশের রক্তের সাথে মিশে যেতে না পারে।
নয়নকে সাপে কেটেছে রাত দশটার দিকে। আব্দুল ফকিরের কাছে খবর এসেছে রাত একটায়। ফতেহপুর থেকে নৌকায় হোসনাবাদ ঘণ্টাতিনেকের পথ। তার মানে এখন আবার ফতেহপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। তিনি খানিক চিন্তিত। এই ভরা বর্ষায় বসতভিটায় যে সাপ থাকে, সেই সাপ হয়। অতি বিষধর সাপ। খবির খাঁর ভাগ্নেকে কী সাপ কেটেছে কে জানে! দ্রুত পৌঁছাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই বর্ষায় নৌকা ছাড়া হোসনাবাদ থেকে ফতেহপুর যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। খানিক হেঁটে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে আব্দুল ফকিরকে। তাকে খবর দিয়ে আবার নৌকার ফিরে গেছে মাঝি সোহরাব। আব্দুল ফকির কাঁচা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়েছেন। জিনিসপত্রের যোগাড়-যন্তর করে রওনা হয়েছেন।
আব্দুল ফকির নৌকায় উঠলেন আরো কিছুক্ষণ বাদে। ভালো নৌকা পাঠিয়েছে খবির খাঁ। ছইঅলা বড় নৌকা। নৌকার ভেতর পরিপাটি করে বিছানা পাতা। ছইয়ের একপাশে মাটির চুলা রয়েছে। সেই চুলায় রান্না-বান্নাও করা। যায়। নৌকায় দুইজন মাঝি। খাঁ-বাড়ির বাঁধা মাঝি সোহরাব আর মাজেদ। তারা দুই ভাই। মাজেদ বড়, সোহরাব ছোট। সোহরাবের নাম নিয়ে অবশ্য খানিক জটিলতা আছে। তার নাম সোহরাব হলেও গায়ের লোকজন তাকে ডাকে ছোরাব। এই নিয়ে সোহরাবের আক্ষেপের অন্ত নেই। আব্দুল ফকিরকে দেখে সে বলল, ফইর সাব, নাও কি ছাড়ব?
আব্দুল ফকির বললেন, আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়া নাও ছাড়ো। পথে কোথাও থামবা না। বাকি রাইত একটানা নাও বাইবা। দেখছ কী শো শো শব্দে বাতাস বইতাছে! আইজ ঝড়-তুফান অইবো। সেই ঝড় তুফানেও নাও তীরে ভিড়াইবা না। কোনোদিক না চাইয়া একটানা নাও বাইবা। কথা পরিষ্কার?
মাঝি-ভাইদের মধ্যে সোহরাবের বয়স কম। সে গায়ে-গতরে শক্তিশালী। কিন্তু আব্দুল ফকিরের কথা শুনে সে খানিক ভড়কে গেল। ভীত গলায় বলল, কিছু ইশারা পাইছেননি ফইর সাব?
আব্দুল ফকির সোহরাবের কথার জবাব দিলেন না। তিনি নাওয়ের গলুইয়ের কাছে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে যত্ন করে পা ধুলেন। পা দেওয়া শেষে গম্ভীর মুখে নৌকার ছইয়ের ভেতর পাতা বিছানায় গিয়ে বসলেন। তারপর কাপড়ের পুঁটলি থেকে খানিক ধূপ আর নারকেলের ছোবড়া বের করে জ্বালালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে নৌকার চারপাশে ফুঁ দিয়ে বললেন, কই মিয়ারা, নাও এহনো ছাড়ো নাই? নাও ছাড়ো, নাও ছাড়ো।
সোহরাব লগিতে ধাক্কা দিয়ে নৌকা ছাড়ল। হাওয়ার দমক বাড়ছে। কেমন একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে নৌকার সামনে বিশেষ পদ্ধতিতে হারিকেন বাধা হয়েছে। তবে দেখে মনে হচ্ছে না সেই পদ্ধতি কোনো কাজে আসবে। হারিকেন নিভে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে।
হারিকেনের আলোয় আব্দুল ফকিরকে কেমন অদ্ভুত লাগছে। তিনি বসে আছেন ছইয়ের ভেতর বেড়ায় হেলান দিয়ে। তার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে সোহরাবের শরীর অবধি। প্রবল হাওয়ায় হারিকেনের চিমনির ভেতরের আলো দপদপ করে কাঁপছে। সাথে কাঁপছে আব্দুল ফকিরের দীর্ঘ ছায়াও। দেখে মনে হচ্ছে আব্দুল ফকিরের ওই লম্বা ভয়ালদর্শন ছায়াখানা যেন কোনো ছায়া নয়, জীবন্ত অশরীরি কোনো অস্তিত্ব! সেই ছায়ার ভেতর বসে সোহরাবের গা কেমন ছমছম করতে থাকল। তার হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তে হারিকেনের আলোটা যদি নিভে যেত, যদি সব অন্ধকার হয়ে যেত, তাহলে বেশ হতো! এমন গা ছমছমে ভয়াল আলো-আঁধারির চেয়ে অন্ধকার ঢের ভালো। এইপথে সে অন্ধকারেও নাও বেয়ে যেতে পারবে।
সোহরাবের ভাবনা শেষ হলো না, প্রবল হাওয়া বইতে শুরু করল। ঝড়ের মতো বিক্ষুব্ধ হাওয়া। সেই হাওয়ায় নাওয়ের গলুইয়ে বাঁধা হারিকেন হঠাৎ ছিটকে পড়ল বিলের পানিতে। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল নৌকা। সোহরাব কোনো কথা বলল না। মাজেদও না। সকল কিছুই কেমন যেন স্থির হয়ে রইল। সেই স্তব্ধ স্থিরতায়ও সোহরাব আর মাজেদ ঘোরের ভেতর নৌকা বেয়ে চলল।
নৌকা ফতেহপুর চেয়ারম্যান খবির খাঁর বাড়ির ঘাটে পৌঁছাল ফজরের আজানের সময়। তখন সামান্য আলো ফুটেছে। সেই আলোয় আব্দুল ফকির খাঁ-বাড়ির ঘাটে নামলেন। ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন এলাকার গণ্যমান্য লোকজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন খবির খাঁ স্বয়ং। বোঝা যাচ্ছে, ভাগ্নের চিন্তায় সারারাত ঘুমাননি তিনি। সকলেই আব্দুল ফকিরের অপেক্ষায় ছিল। আব্দুল ফকির লাঠিতে ভর দিয়ে নৌকা থেকে পা নামিয়েছেন তীরে। কিন্তু সোহরাব যেন তখনও রাতের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে ঘোরগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আব্দুল ফকিরের দিকে। যেন জগৎ সংসারে আব্দুল ফকিরকে দেখা ছাড়া সোহরাবের আর কিছু করার নেই। আর কোনো কিছুর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নৌকা থেকে আব্দুল ফকিরের নেমে যাওয়া দেখছে। আব্দুল ফকির তার পেছনের পা নামিয়ে শানবাঁধানো ঘাটে রাখলেন। খবির খাঁ দু’পা এগিয়ে এসে আব্দুল ফকিরকে কিছু বলতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আব্দুল ফকির বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলেন, খবরদার! নড়িস না, ছোরাব। নড়িস না। যুইত মতো বইস্যা থাক!
সোহরাব আব্দুল ফকিরের কথার কিছুই বুঝল না। সে হতভম্বের মতো আব্দুল ফকিরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বুকের ভেতর ধকধক করে কাঁপছে। সেই কাঁপুনি থামছে না। বরং রুদ্ধশ্বাস এক তীব্র আতঙ্ক নিয়ে সে বসে আছে। আব্দুল ফকির সামান্য সামনে এগিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে থাকা সোহরাবের পায়ের নিচে, নাওয়ের গলুইয়ের ভেতরের অংশে বিদ্যুৎবেগে হাত চালালেন। তার হাতের গতি অবিশ্বাস্য! উপস্থিত সকলে মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলেন! সোহরাব যেখানে বসে আছে, ঠিক সেখানেই, নৌকার কাঠের গলুইয়ের নিচ থেকে আব্দুল ফকির তার হাত বের করলেন। তার সেই হাতের মুঠোয় ভয়ালদর্শন এক সাপ! এক গোখরা সাপ!
বিস্ময়ে, আতঙ্কে উপস্থিত সকলেই যেন পাথরের মূর্তির মতো জমে গেলেন।
আব্দুল ফকির কারো দিকে তাকালেন না। তিনি হাতের মুঠোয় চেপে ধরা গোখরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, কীরে কালনাগিন, নাওয়ে চইড়া অত দূর পথ যাওন লাগল? আমি নিজেই তো আইতে আছিলাম!
উপস্থিত সব কয় জোড়া চোখ প্রবল আতঙ্কে যেন চোখের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে! আব্দুল ফকির জনতার দিকে তাকিয়ে সাপের গলা আরো শক্ত করে চেপে ধরে অদ্ভুত গলায় বললেন, খা রে খা, বক্ষিলারে খা।
*
ফতেহপুরের চেয়ারম্যান খবির খাঁর বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অশীতিপর বৃদ্ধ। তার ছোট ভাই আইয়ুব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘ রোগ-শোকে ভুগে বছর পনেরো আগেই মারা গেছেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার, এই বয়সেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ। মানুষ। শুধু যে শারীরিকভাবে শক্ত সমর্থ তা-ই নয়, মানসিকভাবেও যথেষ্ট দৃঢ় তিনি। কঠিন নিয়ম-কানুন মেনে চলা মানুষ তিনি। রোজ রাতে ঠিক নটায় ঘুমাতে যান, ওঠেন ফজরের খানিক আগে। কিন্তু আজ তার ঘুম ভেঙেছে আরো আগে। সম্ভবত বাইরের নানান শব্দ শুনেই তিনি আজ আগে-ভাগে জেগে উঠেছেন। উঠেই নাতি নয়নের খবর শুনেছেন। খবর শুনে দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। নিজেকে সামলে নিতে এই সময়টুকু তার দরকার ছিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে দীর্ঘ উঠান পাড়ি দিয়ে নয়নের ঘরে গিয়েছিলেন তিনি। উঠানের পশ্চিম দিকের ঘরে শুয়েছিল সে। মরার মতো পড়ে রয়েছে ছেলেটা। তবে মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সাহসী মানুষ। কিন্তু নয়নকে দেখে বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে তীব্র একধরনের ব্যথা অনুভব করলেন। শরীর জুড়ে অবশ এক অনুভূতি। নয়নের ডান হাতের আঙুলে ছোবল মেরেছে সাপ। সেই হাত দড়ি টানা দিয়ে ঘরের উঁচু আড়ার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতের কব্জি ও বাহুতেও শক্ত করে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এতে বিষাক্ত রক্ত শরীরের বাকি অংশে প্রবেশ করতে পারবে না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নাতির সামনে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। এবার যেন আগেরবারের চেয়েও দীর্ঘতর। উঠান পাড়ি দিয়ে তিনি তার ঘরে ফিরলেন।
তারপর থেকে নিজের ঘরেই বসে আছেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। জড়মূর্তির মতো চুপচাপ বসে আছেন তিনি। তার মাথা জুড়ে অসংখ্য এলোমেলো ভাবনা। সেই ভাবনাগুলো একের পর এক আসছে, আবার সম্পূর্ণ না হয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্য একটি অসম্পূর্ণ ভাবনা এসে আগের ভাবনাটিকে গ্রাস করে নিচ্ছে। কেমন একটা ঘোরের মতো অনুভূতি। বসে থাকতে থাকতে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর খানিক তন্দ্রামতো লেগে এলো। সেই তন্দ্রা কতক্ষণের তা তিনি জানেন না। তবে সেই তন্দ্রার ভেতর তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছেন। ঠিক স্বপ্নও না, আসলে অতীতের নানান ঘটনা তার চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠেছে। সেইসব ঘটনায় তিনি অবাক হয়েছেন। খানিক বেদনার্তও। তার চোখের সামনে তার একমাত্র কন্যার একমাত্র সন্তান সাপের দংশনে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, অথচ তিনি কিনা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন!
কী ভয়ঙ্কর কথা!
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজেই নিজের কাছে ভীষণ লজ্জিত এবং বিব্রত হলেন। তিনি রাশভারি মানুষ। কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন তিনি কাটিয়েছেন। প্রথম যৌবনে অল্প বয়সেই বিয়ে করেছিলেন। অল্প বয়সের সেই স্ত্রী পরপর দুই পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে গত হয়েছেন। দুই সন্তানের বড়জন ফতেহপুরের চেয়ারম্যান খবির খাঁ, আর ছোটজন বেশিরভাগ সময়েই ঘর-সংসার ত্যাগ করে বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ানো দবির খা।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন আর বিয়ে-শাদি করেননি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। পুত্রদের কথা বিবেচনা করেই তিনি আর বিয়ে করতে চাননি। নতুন মা ঘরে এলে ছোট ছোট সন্তানদের কতটা ভালোবাসবে, সে বিষয় নিয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এ কারণেই তিনি আর বিয়ে-শাদি করেননি। বছরের পর বছর কেটেছে। পুত্ররাও বড় হয়েছে। বড় পুত্র খবির খাঁর বয়স যখন কুড়ি, তখন হঠাৎ দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। এই দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আমোদি বেগম। আমোদি বেগম দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী। তবে বংশ মর্যাদায় তিনি ছোট এবং অতি দরিদ্র ঘরের মেয়ে। তার বয়স তৈয়ব উদ্দিন খাঁর প্রথম পুত্র খবির খাঁর চেয়ে বছর দুয়েক বেশি।
দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। সেই কন্যা সন্তানকে দেখে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ রীতিমত চমকে গেলেন। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। লম্বা বাঁশির মতো নাক। বড় বড় চোখ। অনিন্দ্য রূপবতী এক কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন তিনি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সেই কন্যার নাম রেখেছেন কোহিনূর। জগৎবিখ্যাত হীরার নামে নাম। কোহিনূর শব্দের অর্থ আলোর পর্বত। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোহিনূর হীরার কথা জানলেও কোহিনূর শব্দের অর্থ তিনি জানেন না। তবে নূর শব্দের অর্থ জানেন। নূর শব্দের অর্থ আলো। আর এ সকল কারণেই কিনা কে জানে, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার অপূর্ব রূপবতী কন্যার নাম রাখলেন কোহিনূর।
মানুষ হুট করে তীব্র কোনো কিছু নিতে পারে না। সেটি ভালো হোক কিংবা মন্দ। বরং অতি মন্দ মেনে নেয়ার চেয়ে অতি ভালো মেনে নিতে মানুষের সমস্যা হয় বেশি। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্য। মানুষ তীব্র সৌন্দর্য নিতে পারে না। সে তীব্র অসুন্দর যতটা ভয় পায়, তীব্র সৌন্দর্যকে ভয় পায় তার চেয়েও বেশি। তার ভেতর একধরনের চাপা আতঙ্ক কাজ করে। তার সন্দেহ হতে থাকে, এই নিখুঁত সৌন্দর্যের আড়ালে ভয়াবহ কোনো অনাবিষ্কৃত কদর্যতা লুকিয়ে নেই তো! হয়তো এজন্যই তীব্র সৌন্দর্যকে মানুষ ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বলে অভিহিত করে। তীব্র সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর’কে সে অস্বীকার করতে পারে না। কোহিনূরের সৌন্দর্য সেই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের মতো। যা দেখে চারপাশের মানুষের ভেতর অস্বস্তি হতে থাকে। বুকের ভেতর কেমন একধরনের শিরশির কাঁপন তৈরি হতে থাকে। কোহিনূরকে দেখেও তার আশেপাশের মানুষের তেমন হয়। তারাও তাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তবে এতে তারও ভূমিকাও রয়েছে। সেই ভূমিকা কেবল তার রূপেরই নয়, ভূমিকা আছে। তার আচরণেরও।
কোহিনূরের আচার-আচরণও অদ্ভুতরকম! সে বাবা ছাড়া আর কারো কাছে। যায় না। কারো সাথে মেশে না, কথা বলে না। সারাক্ষণ একা একা থাকে। বাড়ির উঠোনে, আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে-মধ্যে কথা বললেও তা বেশিরভাগ সময়ই কেবল নিজের সঙ্গে। শান্ত-শিষ্ট, ধীর-স্থির স্বাভাবিক এক শিশু। কিন্তু তার সেই স্বাভাবিকত্বেই কোথায় যেন খুব সামান্য অথচ তীক্ষ্ণ এক অস্বাভাবিকত্ব!
এই অস্বাভাবিকত্ব বহুদিন বাদে হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়। তারপর আবার মিলিয়ে যায়। মুহূর্তেই আবার সবকিছু হয়ে যায় আগের মতো চুপচাপ, শান্ত, স্বাভাবিক। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিজে এমন এক ঘটনার সাক্ষী।
তখন বছর তিনেক বয়স কোহিনূরের। সে বসেছিল উঠানের পাশে কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। তার সামনে খেজুর পাতায় বানানো অনেকগুলো চরকি। চরকিগুলো বানিয়ে দিয়েছে খাঁ-বাড়ির অতি পুরাতন কাজের মানুষ মমিনের মা।
কোহিনূর চরকিগুলোকে খেজুর কাঁটার মাথায় আলতো করে বিধিয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই কাঁটার তীক্ষ্ণ মাথা চরকির ঠিক কেন্দ্রস্থল ফুটো করে পুরোপুরি ঢুকে যাচ্ছে। ফলে চরকি আটকে থাকছে সেই কাঁটায়।
মমিনের মা প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। বার দুয়েক সে কোহিনূরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। কিন্তু প্রতিবারই গম্ভীর মুখে তাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে কোহিনূর। তারপর আবারো মনোযোগী হয়েছে। চরকিতে। কিন্তু তাতেও ফলাফলের কোনো হেরফের হলো না। বরং তার সুন্দর মুখটি ক্রমশই মলিন হয়েছে। চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়েছে। তবে চোখের সেই কঠিন দৃষ্টিতেও ছলছল করে উছলে উঠেছে পানি।
মমিনের মা আরো একবার এগিয়ে এলো। কোহিনূর আগের দুইবারের মতো এবারও সরে গেল। কিন্তু মমিনের মা এবার যেন নাছোড়বান্দা। সে কোহিনূরের সামনে গিয়ে তার মুখোমুখি বসল। তারপর খানিক ঝুঁকে কোহিনূরের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আদুরে কণ্ঠে বলল, আমার কাছে দেও গো মা। দ্যাহো, আমি কী সোন্দর কইরা গাইখা দেই। দেও, দেও।
কোহিনূর মমিনের মায়ের দিকে তাকাল না। সে এবার পিছু সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মমিনের মা এবার আর ছাড়ল না। সে এক হাতে। কোহিনূরকে জাপটে ধরে আরেক হাতে তার হাত থেকে চরকি আর কাঁটাখানা নেয়ার চেষ্টা করল। একবার, দুইবার, তিনবার। প্রতিবারই কোহিনূর তার হাত সরিয়ে নিল। কিন্তু চতুর্থবার ঘটল ভয়াবহ ঘটনা! মমিনের মা হাত বাড়াতেই কোহিনূরের হাতটি হঠাৎ সাপের মতো ছোবল মারল মমিনের মার চোখে। তীব্র চিৎকারে মমিনের মা তার ডান চোখটি বাঁ হাতে চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তার চেপে ধরা হাতের ফাঁক গলে দরদর করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বসে ছিলেন ঘরের দাওয়ায়। তিনি ঘটনার কিছুই বুঝতে পারলেন না। খানিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর দৌড়ে ছুটে এলেন। মমিনের মায়ের কাছে। মমিনের মা তখন জবাই করা মুরগির মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। তার কান-ফাটানো চিৎকারে চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এলো।
রক্তে মাখামাখি উঠান থেকে ধরাধরি করে মমিনের মাকে নিয়ে যাওয়া হলো ঘরে। ভাগ্য ভালো কোহিনূরের কাঁটার আঘাত তার চোখে লাগেনি। লেগেছে চোখের সামান্য নিচে। প্রায় অর্ধেকটা বিদ্ধ হয়েছিল কাঁটাটি। ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু সেই ভয়াবহ ব্যাপারে আতঙ্কিত হননি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। তিনি আতঙ্কিত হয়েছেন অন্য কারণে। কোহিনূর যেমন বসেছিল, ঘটনার পরও সে তেমনই বসে রয়েছে। এই যে এত কিছু হয়ে গেল, তবুও একবারের জন্যও সে ফিরেও তাকায়নি। নিজের জায়গা থেকে একচুল নড়েনি। একমনে বসে খেজুর কাঁটায় গেঁথে হাতের চরকি ঘোরানোর চেষ্টা করছে সে। সেই কাঁটায় লেগে রয়েছে রক্ত! রক্ত মেখে যাচ্ছে চরকিতেও। কিন্তু তাতে যেন কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই কোহিনূরের।
এই ঘটনার পর থেকে চারপাশের লোকজন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। সকলেই কেমন আড়চোখে তাকাতে লাগল কোহিনূরের দিকে। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ তার কাছে আসে না। অবশ্য কোহিনূর যেন এতে বরং খুশিই হলো। সে থাকে তার মতো। একা একা। বয়স যত বাড়ছে, ততই সে আরো অন্তর্মুখী হয়ে উঠছে। সাথে সাথে হয়ে উঠছে আরো রূপবতী! যেন চোখ ঝলসে যাওয়া রূপ তার। এ নিয়েই চারপাশে নানা ফিসফিসানি। নানা ঘটনায় অঘটনে সেইসব ফিসফিসানি ক্রমাগত ডালপালা ছড়ায়।
এরমধ্যে ঘটল আরেক কাণ্ড! মাঝরাতে খাঁ-বাড়ির সকলেই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক তখন একা একা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কোহিনূর। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর শোবার ঘরে সারারাত অল্প আলোতে হারিকেন জ্বলে। সেই আলোয় ঘরের কোণে রাখা জলচৌকি টেনে তার ওপরে দাঁড়িয়ে দরজার খিল খুলল সে। তারপর গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে গেল অন্ধকারে। গভীর ঘুমে অচেতন খাঁ-বাড়ির কেউ কিছু টের পেল না। ঘটনা জানাজানি হলো ফজরের আজানের পরপর। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেলেন। দিশেহারার মতো লোক পাঠালেন বাড়ির চারপাশে। পুকুরে জাল ফেলা হলো। খোঁজ লেগে গেল গ্রামের চারদিকেও। কোহিনূরকে অবশ্য পাওয়া গেল আরো খানিকটা বেলা বাড়ার পর। খাঁ-বাড়ির জামে মসজিদের সামনে স্তূপ করে রাখা শুকনো খড়ের গাদার ভেতর ঢুকে বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়েছিল সে।
এই ঘটনার পর থেকে কোহিনূরকে নিয়ে ফিসফিসানি আরো বাড়তে লাগল। লোকজন আড়ালে-আবডালে তাকে নিয়ে নানান কথা বলাবলি করতে লাগল। সেই বলাবলির বেশিরভাগ জুড়েই থাকে কোহিনূরের আগুনে রূপ আর উদ্ভট আচার-আচরণের গল্প। সেইসব গল্পে হাজার বছর ধরে চলে আসা গ্রামীণ নানা সংস্কারে রূপবতী মেয়েদের দুর্ভাগ্যের কথা যেমন টেনে আনা হয়, টেনে আনা হয় নানান অতিপ্রাকৃত অশুভ শক্তির কথাও। থাকে বদ জ্বীনের আছর, খারাপ পুরুষের নজরের কথাও। চাঁদের গায়ে যেমন সামান্য দাগ পড়লেই সেটি কলঙ্ক হয়ে যায়, তেমনি রূপবতী মেয়েদেরও সামান্যতেই কলঙ্কের অভাব হয় না।
সুন্দরী মেয়েদের পদে পদে ওঁৎ পেতে থাকে নানান বিপদ। সেই বিপদে জীবন কাটে প্রবল দুঃখ কষ্টে- এইসব ফিসফিসানি অবশ্য তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কান অবধি পৌঁছানোর কথা নয়। তার সামনে এ সকল কথা উচ্চারণ করার সাহস কারো নেই। কিন্তু সেবার এই কথা তার কান অবধি পৌঁছাল। পৌঁছালেন তার স্ত্রী আমোদি বেগম। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ধারণা, আমোদি বেগমের বুদ্ধিশুদ্ধি যথেষ্ট কম। সে সারাক্ষণ হাসে। সম্ভবত নামের সাথে মিল রেখেই কথায় কথায় আমোদ-ফূর্তি, হাসিঠাট্টা তার স্বভাব।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ জানালার কাছে বসে গভীর মনোযোগে বাড়ির পুরনো দলিলপত্র ঘাঁটছিলেন। এইসময়ে আমোদি বেগম এসে বললেন, ঘটনা শুনছেন?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঘটনা শুনতে চাইলেন না। আমোদি বেগমের বেশিরভাগ কথাই তিনি শুনতে চান না। কোনো আগ্রহ বা অর্থ খুঁজে পান না। আমোদি বেগম নিজ থেকেই বললেন, আপনার মাইয়ারে নাকি বজলু ব্যাপারীর বাড়ির আমড়া গাছে দেখা গেছে!
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ঝট করে মুখ তুলে তাকালেন। আমোদি বেগম দাঁত বের করে হাসছেন। হাসতে হাসতেই তিনি বললেন, মিছা কথা বললাম। মিছা কথায়, ইছা বল, সাথে সাথে দিছে ফল।
আমোদি বেগম হাসছেন। হাসির দমকে তার শরীর কাঁপছে। তিনি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন, আপনে তো আর আমার কথা শোনার জন্য মুখ তুইলা তাকাইবেন না। এইজন্য মাইয়ার নামে মিছা কথা বললাম। দেখলেন, মিছা কথায় সাথে সাথে ফল দিছে। আপনে মুখ তুইলা তাকাইছেন।
আমোদি বেগম আবারও হাসছেন। হাসিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে। কিন্তু সেই হাসি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ লক্ষ করলেন না। তার মুখ গম্ভীর, থমথমে। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, যা বলতে আসছ বলো। বইলা বিদায় হও।
আমোদি বেগম বললেন, বজলু ব্যাপারীর ছোট পোলা ফজু আসছিল। এইটুক পোলা। বছর পাঁচ বয়স। কী পাকনা পাকনা কথাই না জানে গো আল্লাহ! সেই পোলা বলে, তার বাপে নাকি গত রাইতে তাদের আমড়া গাছের ডালে আমাগো কোহিনূররে বসা দেখছে। সে চিৎকার করতেই তার বউ পোলা মাইয়াও ছুঁইটা গেছে। তারাও দেখছে। তারপর ভয়ের চোটে সে কী অবস্থা! তার বাড়ি ঘর জুইড়া লঙ্কাকাণ্ড ঘইটা গেছে।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমোদি বেগমের দিকে তাকিয়ে স্থির গলায় বললেন, কি বলো?
আমোদি বেগম বললেন, আপনের মাইয়া নাকি রাইত-বিরাইতে মাইনষের বাড়ির জংলা ভিটায়, গাছের ডালে ঘুইরা বেড়ায়।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোনো কথা বললেন না। একদৃষ্টিতে আমোদি বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘ সময়। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সেই শীতল, নিষ্কম্প দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আমোদি বেগম হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এই মানুষটাকে তিনি ভয় পান। বাঘের মতো ভয়। কিন্তু প্রায়ই সেই ভয়ের কথা যেন ভুলে গিয়ে হয়ে ওঠেন আদি ও অকৃত্রিম আমোদি বেগম। তবে তার পরিণতি যে খুব একটা সুখকর হয় না, তা আমোদি বেগমের চেয়ে ভালো আর কে জানে!
পরদিন ভোরে বজলু ব্যাপারীর বাড়ির পেছনের জঙ্গল কাটা শুরু হলো। শুরু হলো আশেপাশের সকল গাছপালা কাটাও। বজলু ব্যাপারীর বাড়ির ভিটায় যে বিশাল আমড়া গাছ ছিল, সেই আমড়া গাছও কাটা হলো। আমড়া গাছের সাথে বসতভিটার আম-জাম-কাঁঠাল-নারকেলসহ আর সকল বৃক্ষও কেটে ফেলা হলো। দুইদিনের মাথায় বজলু ব্যাপারীর বাড়িটি দেখে মনে হলো সদ্য কামানো চকচকে একখানা ন্যাড়া মাথা। যেই মাথার মাঝখানে একগোছা চুলের মতো কেবল বিসদৃশ একখানা ঘর।
বজলু ব্যাপারী অবশ্য গাছ কাটার আগেই খবর পেয়ে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কাছে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নির্বিকার মুখে বলেছিলেন, তোর তো উপকারই করলামরে বজু। আমার মাইয়া রাইত বিরাইতে তোর বাড়ির গাছের ডালে পাও ঝুলাইয়া বইসা থাকে। সেই জিনিস দেইখা তোর বউ-পোলা-মাইয়া ডরায়। এইটা কোনো কথা! আমি থাকতে এই গ্রামে আমার মাইয়ার জন্য এমন সাংঘাতিক অসুবিধা কারো হইতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত নিছি, তোর বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনো গাছপালা থাকব না। গাছপালা না থাকলে গাছপালার ডালও থাকব না। আর ডাল না থাকলে আমার মাইয়াও রাইত বিরাইত গিয়া সেই ডালে পাও ঝুলাইয়া বইসা থাকতে পারব না। ঝামেলা এড়ানো সহজ। সহজ বিষয় কঠিন করার লোক আমি না।
বজলু ব্যাপারী কান্নাকাটি করল, হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হলো না। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এক কথার মানুষ। যা ভাবেন, তাই করেন। তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ায়- এমন লোক এ অঞ্চলে নেই।
বজলু ব্যাপারীর বাড়ির আমড়া গাছের ডালের ঘটনা যে পুরোপুরি মিথ্যে, তা কিন্তু নয়। বজলু ব্যাপারীর ঘরের উপরের বিশাল আমড়া গাছের ডাল কাটতে গিয়ে দেখা গেল সেই ডালে আজদাহা এক ঘুড়ি আটকে আছে। ঘুড়ির রং কটকটা হলুদ। আবছা অন্ধকারে সেই ঘুড়ি দেখেই হয়তো কেউ একজন ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিল। তার দেখাদেখি চিৎকার করেছিল অন্যরাও। ভয় সংক্রামক ব্যাধির মতো, যা একজনের কাছ থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের ভেতর।
বজলু ব্যাপারীর বসতবাড়ির গাছপালা কেটে ফেলার ঘটনার পর থেকে কোহিনূরকে নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে গেল। ভালো হোক, মন্দ হোক, কোহিনূরের বিষয়ে কেউ আর কোনো কথা বলে না। এই গায়ে কোহিনূর যেন নিষিদ্ধ এক নাম। কিন্তু এতে সমস্যা বরং আরো বাড়ল। কোহিনূরকে নিয়ে সকলের ভেতরই অপ্রকাশ্য এক চাপা আতঙ্ক কাজ করা শুরু করল। সেই আতঙ্ক যেন দিনদিন বাড়তেই থাকল। তার কাছে সহজে কেউ ভেড়ে না। অন্য বাচ্চা-কাচ্চারাও না। কোহিনূরও যেন এই-ই চাইছিল। সকলের কাছ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একাকী এক মানুষ হয়ে গেল সে। মাঝে-মধ্যে নানান অদ্ভুত আচার আচরণ সে করে। কিংবা এমনও হতে পারে সেই আচরণগুলো কোহিনূর করে বলেই সেগুলো হয়তো তখন অন্যদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। সে ছাড়া অন্য কেউ করলে হয়তো তা অদ্ভুত মনে হতো না। মনে হতো স্বাভাবিক ছেলেমানুষি।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে হলো যেন গভীর কোনো স্বপ্ন থেকে তিনি এইমাত্র জেগে উঠলেন। চোখের সামনে ছবির মতো স্পষ্ট হয়ে একের পর এক ভেসে বেড়াল বহু বহু বছর আগের সেই ঘটনাগুলো। কত বছর আগের? ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ, নাকি আরো বেশি? কী জানি! তৈয়ব উদ্দীন খা সময়টা মনে করতে পারছেন না। তার কাছে হঠাৎ সকলকিছু কেমন এলোমেলো লাগতে লাগল। এলোমেলো, আবছা, অস্পষ্ট! অথচ খানিক আগেই কল্পনায় বা স্বপ্নে সেইসব দিন, সেইসব স্মৃতি, কী অদ্ভুত ঔজ্বল্যে, কী অদ্ভুত সজীবতায়ই না ধরা দিয়ে গেল!
পূবাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। খানিকবাদেই ফজরের আজান হবে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নামাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হবেন। কিন্তু শরীরটা যেন আজ সায় দিচ্ছে না। রোজ তিনি ঘুম থেকে ওঠেন ঠিক ফজরের আজানের আগে। তারপর ওজু করে মসজিদে যান। নামাজ শেষে খানিক হাঁটাহাঁটি করেন। হাঁটাহাঁটির সময় তার সাথে থাকে এস্কান্দার। এস্কান্দার ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতেই মানুষ। বিশাল দেহের বলশালী লোক সে। তার বাবা হায়দার আলী। ছিলেন খাঁ-বাড়ির বান্ধা লাঠিয়াল। সে কালে চর দখলের ভয়াবহ লড়াই হতো। সেই লড়াইয়ে খাঁ-বাড়ির আসল শক্তি ছিল হায়দার আলী। একাই একশ মানুষের সামনে পর্বত হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারত সে। এস্কান্দারও বিশাল শরীরের মানুষ। দশ গ্রামের লোক তাকে ভয় পায়। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ প্রায়ই বলেন, বাপের স্বাস্থ্য শরীলের কিছুই পাইলি না এস্কান্দার। কী পাহাড়ের মতো শরীল আছিল মানুষটার। আফসোস, অল্পবয়সে ঘাট-বমিতে মারা গেল। বাপ বাইচ্যা থাকলে বুঝতি, কী বাপ আছিল তোর! কিন্তু তুই তো তোর বাপের কিছুই পাইলি নারে ছ্যামড়া। বাপের মতো অমন বলশালীও হইলি না। না হইলি শরীলে, না হইলি সাহসে।
তবে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য জানেন, এস্কান্দার এক কথায় তার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। বাপ হায়দার আলীর মৃত্যুর পর তিনিই এস্কান্দারকে পেলে-পুষে মানুষ করেছেন। ফলে তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সে পিতাজ্ঞান করে। সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে রাখে বৃদ্ধ মানুষটাকে। ভোরের আলোর আভাস দেখা দিতেই এস্কান্দার এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দরজার পাশে দাঁড়াল। খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে, শেষে বার দুই মৃদু কাশির শব্দে সে তার উপস্থিতি জানান দিলো। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ এস্কান্দারের দিকে ফিরেও তাকালেন না। এস্কান্দার রোজ ভোরে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে মসজিদে যায়, নামাজ পড়ে। আজও সেইজন্যই সে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আজ আর মসজিদে গেলেন না। তিনি ওযু করে জায়নামাজ হাতে গেলেন নয়নের ঘরে। হারিকেনের মৃদু আলোয় তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার সামনে মৃতের মতো পড়ে থাকা নয়নের দিকে তাকালেন। নয়নের মাথাভর্তি বড় বড় কোঁকড়ানো চুল। ধবধবা ফর্সা গায়ের রং। ছিপছিপে লম্বা শরীর। এ যেন অবিকল কোহিনূরের প্রতিরূপ!
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। স্থির, অবিচল, অপলক। তার হঠাৎ কেমন অবাক লাগতে লাগল। মনে হতে লাগল, তার সামনে শুয়ে থাকা এই রাজপুত্রের মতো ছেলেটিই কি তার সেই গম্ভীর, ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা কোহিনূরের সন্তান! কী অদ্ভুত! সেই গম্ভীর মুখে একা একা ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট পরীর মতো এইটুকু এক মেয়ে কোহিনূর! তার সন্তান এই ছেলেটি, ভাবতেই কেমন অবাক লাগে! কোহিনূরকে কতবছর দেখেন না তিনি? তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।
বয়স মানুষের সামনে নানান সীমারেখা টেনে দেয়, তার মধ্যে প্রবলতম। হলো বিস্মৃতি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে সেই বিস্মৃতি এখনো পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। তবে আজকাল মাঝে-মধ্যেই বিস্মৃতি তার প্রবল উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ উঠে জানালার কাছে গেলেন। পূবাকাশে স্পষ্ট আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। ফজরের আজান হচ্ছে। নয়নের পাশে বসেই নামাজ সেরে নিলেন তিনি। নামাজ শেষে নয়নের জন্য আল্লাহর কাছে দীর্ঘ মোনাজাত করলেন।
আব্দুল ফকির ঘরে ঢুকলেন তার আরও খানিক পর। তার সাথে ঢুকলেন খবির খাঁ। আব্দুল ফকিরকে দেখে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মাথা উঁচু করে তাকালেন। তার সাথে সামান্য সময়ের জন্য চোখাচোখি হলো আব্দুল ফকিরের। তবে দুজনের কেউ কোনো কথা বললেন না। আব্দুল ফকিরের পিছু পিছু ঘরে ঢুকল আরো অনেকেই। বড় ভোলা ঘর। ঘরের মাঝখানে পুরনো আমলের উঁচু খাট। খাটের পেছনের দিকের রেলিং ঘেঁষে খ-বাড়ির বউ-ঝিয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা চুপচাপ। তবে সকলেই ভয়মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল আব্দুল ফকিরের দিকে।
আব্দুল ফকির ঘরে ঢুকতেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খুব ধীর পায়ে নড়লেন। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। খবির খাঁ ছুটে এসে বাবার পেছন থেকে চেয়ারখানা সরিয়ে নিলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোনো কথা বললেন না। তিনি ধীরে সময় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আব্দুল ফকির নয়নকে দেখলেন। নয়নের ডান হাতের আঙুলে সাপে কাটার চিহ্ন। আবছা আলোয় নয়নের হাতের সাপে কাটার দাগ স্পষ্ট না হলেও সাপের দাঁতের আঁচড়গুলো দেখলেন আব্দুল ফকির। তাকে মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত দেখালেও সাথে সাথেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন তিনি। খানিক থম মেরে বসে থেকে আচমকা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপর মৃগী রোগীর মতো তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি বিড়বিড় করে এক নাগাড়ে কী সব মন্ত্র পড়তে লাগলেন। জুলফিকার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে আব্দুল ফকিরের মাথা চেপে ধরে আছে। আব্দুল ফকির হঠাৎ তীব্র চিৎকারে বললেন, কালনাগিনী দংশন করেছে গো। কালনাগিনী দংশন করেছে। এই বিষ কালনাগিনীর বিষ। রুগী ঘর থেইকা বাইর কইরা উঠানো নামাও। ক্যালা গাছ পৌঁতো উঠানের মধ্যিখানে। অক্ষুণি, অক্ষুণি।
.
খাঁ-বাড়ির উঠানে হুলস্থুল লেগে গেল। আশেপাশের গ্রাম থেকে আব্দুল ফকিরের আরো দুই তিনজন সাগরেদও চলে এসেছে। তারা নানান জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে সাথে করে। উঠানের মাঝখানে ছোট্ট পুকুর কাটা হলো। কোথা থেকে তিনটি কলাগাছ সমূলে উপড়ে এনে সেই পুকুরের চারপাশে পুঁতে দেয়া হলো। বড় বড় ঢোল-বাদ্যের ব্যবস্থা হলো। এ সকলই আব্দুল ফকিরের বিষ নামানোর বন্দোবস্ত। তিনি এমন কায়দা-কসরত করেই বিষ নামান। বিষ নামানোর সময় বিকট শব্দে ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে মন্ত্র পড়েন। মন্ত্র পড়ার সময় উচ্চ শব্দে বাদ্য বাজানোর সঙ্গত কারণ রয়েছে। আব্দুল ফকিরের মতে, মন্ত্রের কথা সকলে শুনতে পেলে সেই মন্ত্রের আর কার্যকারিতা থাকে না। এইজন্য ঢোল-বাদ্যে বিকট শব্দের ব্যবস্থা। শব্দে ঢাকা পড়ে যায় মন্ত্রের কথা।
সকল আয়োজন শেষ। এবার বিষ নামানোর পালা। ঢোলের তালে তালে মন্ত্র পড়বেন আব্দুল ফকির আর জুলফিকার। সেই মন্ত্রের জোরে রোগীর শরীর থেকে বিষ নেমে যাবে। শরীর থেকে নেমে যাওয়া বিষ শুষে নেবে কলাগাছ। আর বিষের প্রভাবে ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়বে লকলকে লাউয়ের ডগার মতো সজীব সতেজ কলাপাতা। তারপর একসময় মরে যাবে। এ যেন জীবনের বিনিময়ে জীবন।
.
বৃক্ষজনমের বিনিময়ে মানবজনম।
আব্দুল ফকির আয়েশ করে তীব্র আঘাতে ঢোলের ওপর প্রথম শব্দটা করলেন। সেই শব্দ তরঙ্গে ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে-বাতাসে। চারপাশে মানুষ জমে বিশাল ভিড় হয়েছে। তাদের মধ্যে নানান উৎকণ্ঠা, ছেলেটা কি বাঁচবে? এই যে মরার মতো পড়ে থাকা ছেলেটা? খাঁ-বাড়ির নাতি নয়ন? সে কি এখনও বেঁচে আছে, নাকি মৃত? মৃত হলে কি তাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন আব্দুল ফকির? অবশ্য আব্দুল ফকিরকে নিয়ে এমন নানান গুঞ্জন নানান সময়ে ভেসে বেরিয়েছে। তিনি নাকি সাপে কাটা মৃত রোগীকেও জ্যান্ত করে তুলেছেন। উপস্থিত জনতার কেউ অবশ্য তা সরাসরি দেখেনি। এই নিয়ে তাদের কারো কারো আক্ষেপও রয়েছে। আজ কি তবে তাদের সেই আক্ষেপ ঘুচবে! এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারবেন আব্দুল ফকির!
রুদ্ধশ্বাস শত শত চোখের সামনে আব্দুল ফকির ঢোলের ওপরে তার দ্বিতীয় আঘাতটি করলেন। তারপর খানিক অপেক্ষায় রইলেন বাদ্যের শব্দটি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার। বাতাসে ভেসে ভেসে শব্দটি মিলিয়ে গেল দূরে। আব্দুল ফকির এবার তৃতীয় আঘাতটি করবেন। আঘাত করার সাথে সাথে। উচ্চস্বরে মন্ত্র জপতে শুরু করবেন। সাথে শুরু হবে দ্রুতলয়ে ঢোলের শব্দ। প্রথম তিনবার ঢোলে বাড়ি দিতে হয় ধীরে, বিরতি নিয়ে। তারপর মন্ত্র পড়া শুরু করামাত্র বাদ্য বাজাতে হয় দ্রুতলয়ে। আব্দুল ফকির তৃতীয় আঘাতের জন্য হাত উচ্চে তুলেছেন। আর মুহূর্ত খানেকের মধ্যে হাতখানা তীব্রগতিতে নেমে আসবে ঢোলের উপর। মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে। কিন্তু আব্দুল ফকিরের হাতটি আর নামল না। স্থির হয়ে ভেসে রইল শূন্যে, বাতাসে। যেন প্রস্তরের এক স্তব্ধ মূর্তি। তার চোখে আটকে রয়েছে উঠানের মাঝখানের খাঁটিয়ায়। চোখ আটকে গেছে উপস্থিত আর সকলেরও। নয়ন কি মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠেছে! মৃতের মতো অচেতন পড়ে থাকা মানুষটা কি আঙ্গুল ফকিরের এই দু’টিমাত্র ঢাকের। শব্দেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে!
সকলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল উঠানে। নয়ন যে শুধু নড়ে উঠল তা-ই নয়, কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরোপুরি জেগে উঠল। তারপর কুঞ্চিত কপালে আধখোলা চোখে চারপাশে তাকাতে লাগল। তার চোখ, মুখ জুড়ে রাজ্যের বিরক্তি, হতভম্ব ভাব। যেন কোনো গভীর কিন্তু অপরিপূর্ণ এক নিদ্রা থেকে সে জেগে উঠেছে। আব্দুল ফকিরের এই ঢোলের তীব্র শব্দ যেন তার সেই গভীর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবার কথা আব্দুল ফকিরের। আজকাল আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আসার পর থেকে গাঁও-গ্রামের ফকির, কবিরাজ, ওঝাদের উপর থেকে মানুষজনের বিশ্বাস উঠে গেছে। আগে যে আদর-সম্মান তারা পেতেন, আজকাল তার সিকিভাগও তাদের জোটে না। বরং কিছু হলেই পাশ করা ডাক্তার খোঁজে মানুষ।
অবশ্য ফতেহপুর-হোসনাবাদের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ফকির, কবিরাজ, ওঝাই ভরসা। এই অঞ্চলের আশেপাশে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে পাশ। করা ডাক্তার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। ভরা বর্ষায় সেটি আরো অসম্ভব। আজকের ঘটনা আব্দুল ফকিরের জন্য বিরাট সাফল্যের। শত শত লোক স্বচক্ষে ঘটনা দেখেছে, মৃতপ্রায় একজন সাপে কাটা রোগীকে তিনি মন্ত্র পড়ে ঢেলে বাড়ি দেওয়ামাত্র সুস্থ করে তুলেছেন। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা!
আব্দুল ফকিরের নানা কীর্তিকলাপের কথা লোকমুখে বছরের পর বছর ধরে ছড়িয়েছে। মানুষ তাকে ভয় করে, সমীহও করে। তবে আগের সেই রমরমা ভাবটা যেন কোথায় একটু একটু করে কমছে। লোকজন যেন আজকাল আর তেমন একটা ডাকে না তাকে। কিন্তু এই ঘটনা নিঃসন্দেহে আবার তার প্রসার বাড়াবে। নিজ চোখে দেখা এই ঘটনা লোকজন রঙচঙ মাখিয়ে দশদিকে ছড়িয়ে দিবে। ফকির ওঝাদের এই ঘোরতর দুঃসময়ে আব্দুল ফকিরের জন্য এর চেয়ে ভালো ঘটনা আর কিছু হতে পারে না!
কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে আব্দুল ফকিরের চোখে-মুখে কোথাও সেই উচ্ছ্বাস বা প্রাপ্তির ছটা নেই। যা আছে তা হলো রাজ্যের দ্বিধা, বিস্ময়। তিনি দ্বিধামিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন নয়নের দিকে। যেন তার এই দীর্ঘ জীবনে এর চেয়ে খারাপ ঘটনা আর ঘটেনি।
*
নয়নের ফতেহপুর থাকার কথা ছিল সাকুল্যে তিন দিন। কিন্তু সে থেকে গেল দীর্ঘ সময়। এই সময়ে সে নানান আদিখ্যেতা করে বেড়ালো। গায়ের বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে কাদাজলে হুটোপুটি খাওয়া, কলাগাছের ভেলা বানিয়ে বিলের পানিতে হইচই করা- সময়গুলো আনন্দের সাথেই কাটাচ্ছলি। এরমধ্যে একদিন দূরের গঞ্জে গিয়ে সে মোবাইল ফোনে তার মার সাথে কথাও বলল। মাকে সে জানাল, তার আসতে আরো কিছুদিন দেরি হবে। ফতেহপুরে এখনও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সুবিধাজনক নয়। ফলে নয়নের সাথে থাকা মোবাইল ফোনটিও এখানে একরকমের মৃত। তাছাড়া ফতেহপুরে এখনও ইলেক্ট্রিসিটিও আসেনি। ইলেক্ট্রিকের পিলার অবশ্য বসেছে বছরখানেক আগেই। কিন্তু কী এক জটিলতায় তাতে আর তার বসেনি।
.
রাতদুপুরে রঘু বয়াতিকে এনে খাঁ-বাড়ির উঠানে গানের জলসা বসাল নয়ন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁর অবশ্য গান-বাজনা ভীষণ অপছন্দ। কেবল গান বাজনাই নয়, তিনি গল্প-উপন্যাস-কবিতা কোনো কিছুই পছন্দ করেন না। তার কন্যা কোহিনূর ছেলেবেলা থেকেই মুখচোরা গম্ভীর স্বভাবের হলেও লেখালেখির প্রতি তার কিছু আগ্রহ ছিল। এই ঘটনা আবিষ্কার হয়েছিল কোহিনূরের বয়স যখন বারো বা তেরো তখন।
মেয়েকে নিয়ে সব সময়ই একটা চাপা আতঙ্কে থাকতেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। মেয়ের অস্বাভাবিক গম্ভীর আচরণ কাটানোর জন্যই কিনা কে জানে, খ-বাড়ির ইতিহাসে প্রথম মেয়ে হিসেবে কোহিনূরকে তিনি স্কুলে পাঠালেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ হয়তো ভেবেছিলেন, স্কুলে আর সকল ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশে কোহিনূরের গাম্ভীর্য এবং আচরণের অস্বাভাবিকত্ব হয়তো কিছু কমবে। কিন্তু কমল না, বরং বাড়ল। সে স্কুলে কারো সাথে মেশে না, কথা বলে না। একা একা বই-খাতা নিয়ে বসে থাকে। আর নিজের মনে আঁকিবুকি করে।
কোহিনূরকে অবশ্য স্কুলে ভর্তি করাতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল আমোদি বেগমের বাপের দেশে। ফতেহপুরে তখনও স্কুল-মাদ্রাসা কিছু নেই। যা-ও আছে সে বেশ দূরে। তার চেয়ে বরং নানাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করুক। তাছাড়া নানান কারণে ফতেহপুরে কোহিনূরকে তখন রাখতেও চাননি তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। চারপাশে মানুষের ভেতর কোহিনূরকে নিয়ে চাপা তীব্র এক আতঙ্ক। প্রবল অস্বস্তি। সুতরাং সকল দিক বিবেচনা করেই তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কোহিনূরকে পাঠিয়ে দিলেন আমোদি বেগমের বাপের দেশে। সেখানে ক্লাস এইট অবধি পড়ালেন মেয়েকে। কিন্তু সেই পড়ালেখা তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন ছোট্ট এক কারণে। মেয়ে তার স্কুলে ছড়া-কবিতা লিখে বেড়াত। সেই সকল ছড়া-কবিতা পড়ে আশেপাশের লোকজন মুগ্ধ হয়। বিশেষ করে স্কুলের হেড মাস্টার অমল বাবু ভীষণ খুশি হলেন। তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে দীর্ঘ পত্র লিখলেন। পত্রের প্রথমাংশে তিনি লিখলেন,
শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আপনার কন্যা কোহিনূর বানু কেবল রূপেই নয়, গুণেও সমান গুণান্বিতা। তাহার হস্তাক্ষর মুক্তোর ন্যায় জ্বলজ্বলে। তাহার ছন্দ ও মাত্রা জ্ঞান প্রকৃতি প্রদত্ত। ছড়া ও কবিতায় তাহার পারঙ্গমতাও বিস্ময়কর। এর মধ্যেই সে এক আচানক কাণ্ড ঘটাইয়াছে। আমি নিজ উদ্যোগে তাহার একখানা কবিতা ফরিদপুর জেলার এক স্বনামধন্য সংবাদপত্রে পাঠাইয়াছিলাম। সেই কবিতা তাহার ছবিসমেত পত্রিকায় ছাপা হইয়াছে। আমি নিজ খরচে কুড়িখানা পত্রিকা খরিদ করিয়াছি। ফরিদপুর শহরে নানা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়, নানান আলোচনা সভা হয়। আমার পরিকল্পনা রহিয়াছে আমি তাহাকে উপযুক্ত সাহিত্য সভাগুলোতেও লইয়া যাইব…।
এরপর সেই পত্রে আরো দীর্ঘ বিবরণ ছিল। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ সময় নিয়ে সেই পত্র পাঠ করলেন। পত্রের শেষে এসে তিনি বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলেন। সেখানে অমল বাবু ফুটনোট দিয়ে লিখেছেন,
পুনশ্চ : ভাবিয়াছিলাম আপনার নিকট প্রকাশ করিব না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন খচখচ করিতেছিল। তাই না বলিয়া পারিতেছি না। আমি ইতোমধ্যে দুইবার কোহিনূরকে লইয়া ফরিদপুর গিয়াছিলাম। তাহাকে সাহিত্য সভায় অনেকের সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়ছিলাম। যদিও সে কাহারো সহিত কোনোরূপ বাক্যালাপ করে নাই। অদ্ভুত ব্যাপার হইল সে স্কুলেও কাহারো সহিত কোনোরূপ কথাবার্তা বলে না। শিক্ষকদের সহিতও না। তবে সে আমাকে খুবই পছন্দ করে। আমিও তাহাকে অত্যন্ত স্নেহ করি। কন্যারূপ স্নেহ। আপনি জানিয়া ব্যথিত হইবেন যে তাহার বয়সী আমার একমাত্র কন্যা জলে ডুবিয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছে। তাহাকে দেখিলেই আমার সেই মৃত কন্যার কথা মনে পড়িয়া যায়। মনে হয়, সে-ই আমার সেই হারানো কন্যা। কোহিনূর আমাকে লইয়া একখানা কবিতাও লিখিয়াছে। সেই কবিতায় সে আমাকে পিতা বলে সম্বোধন করিয়াছে। লেখাটি দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমার চোখ জলে সিক্ত হইয়া গিয়াছিল। কী আচানক কাণ্ড দেখুন তো! এই যে এখন সেই কবিতার কথা আপনাকে লিখিতে গিয়াও আমার চক্ষু আবারো জলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে!
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কেন যেন অমলবাবুর এই ঘটনা নিতে পারলেন না। তার ভেতরে প্রবল রাগ আর অস্বস্তি তৈরি হলো। এই রাগ আর অস্বস্তির কারণ হতে পারে দুটো। এক. কোহিনূরকে তার অনুমতি ছাড়াই দুই-দুইবার ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর দুই, অমলবাবুর প্রতি কোহিনূরের এই যে প্রবল আসক্তি, সেই আসক্তি।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার রাগের কারণটি স্পষ্ট ধরতে পারলেন না। তবে সেই দিনই তিনি তোক পাঠিয়ে কোহিনূরকে ফতেহপুর নিয়ে আসলেন এবং তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেন। কোহিনূর অবশ্য সেভাবে কোনো প্রতিবাদ করেনি। সে তার মতো আবার একা একা তার জগতে ঢুকে গেল। তবে দিন যত যেতে লাগল, তৈয়ব উদ্দিন খাঁ ততই আবিষ্কার করতে লাগলেন যে এই কোহিনুর কোথায় যেন আর আগের সেই কোহিনূর নেই। জগতে যে একজন মাত্র মানুষের সাথে কোহিনূরের সখ্য ছিল, সেই মানুষটি ছিলেন তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কিন্তু এই নতুন কোহিনূরের কাছে তৈয়ব উদ্দিন খাঁও হয়ে রইলেন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই দূরের মানুষ।
কন্যাতেষ্টায় ব্যাকুল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পিতৃহৃদয় ভেতরে ভেতরে এই দূরত্ব মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু এই ব্যাকুলতার কথা, এই অসহায়ত্বের কথাও তিনি কারো কাছেই প্রকাশ করতে পারছিলেন না। তিনি জানেন না, এই কথা তিনি কার কাছে বলবেন? কীভাবে বলবেন? তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মতো রাশভারি প্রবল ব্যক্তিত্ববান মানুষটা তাই ক্রমশই যেন ভেতরে ভেতরে দংশিত হচ্ছিলেন, ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন, সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিলেন। আর সেই সঙ্কুচিত। মানুষটিই নানান সময়ে নানানরকম অসংলগ্ন আচরণ করতে লাগলেন।
খাঁ-বাড়িতে একসময় ফসল ওঠার মৌসুমে বয়াতি ডেকে রাতভর গান বাজনার আয়োজন করা হতো। জমি থেকে তোলা নতুন ধান স্তূপ করে রাখা হতো বাড়ির বিশাল উঠান জুড়ে। হারিকেনের আলোয় রাতভর সেই ধান মাড়াই করত কামলারা। মহিলারা সার বেঁধে প্রকাণ্ড কুলায় সেই ধান ঝাড়তো। আর বয়াতিরা দল বেঁধে একের পর এক গান গাইত। চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব। কাজও চলছে সমানতালে। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ একদিন হঠাৎ সেই গানের দলকে বারণ করে দিলেন। সকলে হতভম্ব চোখে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তারা ভেবেছিল এটি দুয়েকদিনের ব্যাপার। হয়তো কোনো কারণে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর মন-মেজাজ ভালো নেই। ভালো হলেই আবার সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না। খাঁ-বাড়ির বহু বছরের পুরনো একটি প্রথা তিনি সেইদিনই চিরতরে বন্ধ করে দিলেন।
.
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতদিন ধরে মনে হচ্ছিল খাঁ-বাড়িতে গান-বাজনা চিরতরেই বন্ধ। আর কখনো এই বাড়িতে গান-বাজনা হবে না। কিন্তু নয়ন যেন সেই নিষিদ্ধ প্রথা আবার চালু করল। সে রঘু বয়াতিকে নিয়ে এলো। রাতভর গানের আয়োজন করল। বড় মামা খবির খাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম। সে বিকেল বেলা নাজমা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, মামী, আজ ভরা পূর্ণিমা। বহুদিন পরে বৃষ্টিবাদলাও নেই। আজ রাতভর গান হবে। রঘু বয়াতিকে খবর দিয়েছি। বয়াতিদের দলে লোক মোট আটজন। দশ-বারোজনের খাবার ব্যবস্থা করতে হবে, পারবেন না?
নাজমা বেগম কোনো কথা বললেন না। তিনি কাঁচুমাচু মুখে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন। নাজমা বেগমের ছোট ছেলে মনির তখন গাঙপাড় থেকে মাছ ধরে ফিরেছে। বছর বাইশ-তেইশ বয়স মনিরের। তার কাঁধে ঝাঁকি জাল। সে উঠানে ঢুকতেই নাজমা বেগম বললেন, অ মনির। তোর বাপ কই গেছে। দ্যাখ তো? এ কী যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে ফেলছে দেখ দেখি তো! এই বাড়িতে বুড়োর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। আর এ এসেছে রঘু বয়াতিরে নিয়ে। অ মনির, আমি এসবের কিছু জানি নারে। তুই তোর বাপরে খবর দে। সে এসে যা একটা ব্যবস্থা করুক।
খবির খাঁ খবর শুনলেন আরো কিছু পর। খবর দিয়েছে মনির। খবির খাঁর দুই পুত্র। বড় পুত্র কুয়েত থাকে। সে আসে না বহু বছর। ছোট ছেলে মনির খানিক সহজ-সরল প্রকৃতির নির্বিবাদী মানুষ। সে বলল, আব্বা, দাদাজান শুনলে তো পিঠের ছাল তুলে ফেলাবেন।
খবির খাঁ কোনো জবাব দিলেন না। তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। খাঁ-বাড়ির ঘটনা তো নিজ ঘরের ব্যাপার, গোটা ফতেহপুরেই এখনো তৈয়ব উদ্দিন খাঁর হুকুম ছাড়া কিছু হয় না। আর সেখানে কিনা প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে নিষিদ্ধ থাকা গান-বাজনার আসর আবার শুরু হবে খাঁ-বাড়িতে! এ অসম্ভব! লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। কিন্তু কী করবেন তিনি? খবির খাঁ দীর্ঘ সময় বসে থেকেও কোনো সমাধান পেলেন না। তিনি গাঁয়ের চেয়ারম্যান সে কথা যেমন সত্য, আবার এ কথাও সত্য, তিনি তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সন্তান। এই ষাট ছুঁইছুঁই বয়সেও তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে দাঁড়াতে গেলে তার হাঁটু কাঁপে। কথা বলতে গেলে মুখ শুকিয়ে যায়। খবির খাঁ বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন! তবে যে করেই হোক নয়নকে থামাতে হবে। পথ এই একটিই। তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে কিছু বলার সাহস তার নেই। কারোরই নেই।
আছরের নামাজের পরপর তিনি হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। বাড়ির দহলিজ ঘরের সামনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁ বসা। তার পাশে বসে আছে এস্কান্দার। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ কবুতরদের খানা খাওয়াচ্ছেন। খবির খাঁ বাবার পাশ ঘেঁষে সন্তর্পণে মৃদু পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন। দহলিজ ঘরের ডান পাশ দিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে যাওয়া প্রবেশের পথে আর দুই কদম বাড়ালেই ঘরের আড়ালে চলে যেতে পারবেন তিনি। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ নিবিষ্ট মনে কবুতরদের খাবার দিচ্ছেন। মুহূর্তের জন্যও তিনি খবির খাঁর দিকে তাকাননি। হয়তো খেয়ালই করেননি। তারপরও খবির খাঁ যতদ্রুত সম্ভব তৈয়ব উদ্দিন খাঁর দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যেতে চাইছেন। প্রায় চলেও গিয়েছিলেন, কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ খুব স্বাভাবিক কিন্তু রাশভারি গলায় খবির খাঁকে ডাকলেন। বললেন, গান-বাজনা হউক। এত অস্থির হওনের কিছু নাই।
খবির খাঁ মৃদু গলায় বললেন, জ্বে আব্বা।
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আর কোনো কথা বললেন না। বাকিটা সময় খবির খাঁ তৈয়ব উদ্দিন খাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ মাগরিবের আযান অবধি কবুতরকে খাওয়ালেন। এই পুরোটা সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন তার বড় পুত্র, প্রায় ষাট বছর বয়স ছুঁইছুঁই খবির খাঁ। মুহূর্তের জন্যও তিনি তার বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁকে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারলেন না, তিনি কি দাঁড়িয়ে থাকবেন, নাকি চলে যাবেন!
দহলিজ ঘরের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে তখন বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখছে। এক তরুণী। তরুণীকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এই গাঁয়ের কেউ।
*
রাতভর গানের আসর হলো। আসরে আলো ছড়াল ঢাকা থেকে আসা অপরিচিত এক তরুণী। তরুণীর নাম হেমা। ঠিক হেমাও নয়, তার নাম হিমাদ্রি। কিন্তু বাবা আহমেদ আসলাম চেয়েছিলেন মেয়ের নাম হবে হেমা। যৌবনে অভিনেত্রী হেমা মালিনীর প্রতি দারুণ অনুরক্ত ছিলেন বলেই কিনা, এই নামের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা ছিল। কিন্তু স্ত্রী রেণু বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, তিনি তার কন্যার নাম রাখলেন হিমাদ্রি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে স্ত্রীর সাথে আসলাম সাহেবের সম্পর্কটা অসম্ভব রকমের শীতল। এই সুদীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে রেণু পারতপক্ষে অপ্রয়োজনে স্বামীর সাথে কথাবার্তা বলেননি। ঘটনাটি খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাটিই বছরের পর বছর ধরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আসলাম সাহেব ঝলমলে আনন্দের অধিকারী এক মানুষ। কিন্তু তার এই এক জীবনে সম্ভবত এটিই তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা যে, তিনি তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা কখনোই স্বাভাবিক করতে পারেননি। চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। বরং সাধ্যের সবটুকু দিয়েই তিনি চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই চেষ্টা কখনোই সফলতার মুখ দেখেনি। হেমার কাছেও তার বাবা-মায়ের এই সম্পর্ক এক রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। যদিও এ নিয়ে সে কখনোই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া আর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন বসবাস তাদের। ফলে এর পেছনে অতীতের কোনো গল্প থাকলেও, সেটি তার কখনোই জানা হয়ে ওঠেনি।
আসলাম সাহেব স্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে কখনোই কিছু করেন না। হিমাদ্রি নামটি তার পছন্দ নয়। বহু পুরুষকেই এই নামটি তিনি ব্যবহার করতে দেখেছেন। ফলে নামটি তার অপছন্দ হলেও তিনি স্ত্রীকে সরাসরি কিছু বললেন না। তবে আসল খেলাটা তিনি খেললেন হিমাদ্রির জন্মের পর। যেখানেই যান, যার সাথেই মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেন, তিনি আনন্দ ঝলমলে গলায় বলেন,
মেয়ের ভালো নাম হিমাদ্রি। এই নাম রেখেছে তার মা। কিন্তু ডাক নাম হেমা। হেমা হলো হিমাদ্রির সংক্ষেপ।
হিমাদ্রির সংক্ষেপ হেমা নয়, হওয়ার কথা হিমা। কিন্তু এই যুক্তি কেউ আর। তুলল না। বরং হিমাদ্রির মতো কঠিন উচচারণের একটি খটমট নামের পরিবর্তে অতি সহজ দুই অক্ষরের হেমা বলতে পেরেই যেন সকলে খুশি। এই সহজতার কারণেই হিমাদ্রি হয়ে রইল কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক নাম। আর আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত-অর্ধপরিচিত সকলের কাছেই হিমাদ্রি হয়ে গেল হেমা।
হেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। একটা ফিল্ড ওয়ার্কের অংশ হিসেবে সে কাজ করছে গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে। বিষয়টি জটিল এবং নিরস হবার কথা। কিন্তু নিরস এবং জটিল বিষয়কেও প্রাণবন্ত করে তোলার এক অসম্ভব ক্ষমতা এই তরুণীর রয়েছে। তরুণীকে এই বাড়ির কেউ চেনে না। কিন্তু তাতে যেন তরুণীর কিছু আসে যায় না। সে সন্ধ্যায় সরাসরি দহলিজ ঘরের সামনে এসে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, নয়নের কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। গল্প শুনে শুনে অবস্থা এমন হয়েছে যে আপনাকে প্রথম দেখায়ই চিনে ফেলেছি। মনে হচ্ছিল আপনাকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। আপনি ফতেহপুরের বিখ্যাত তৈয়ব উদ্দিন খাঁ, তাই না?
তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবাক হলেন না। তবে সরু চোখে তরুণীর দিকে তাকালেন। তরুণী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তাকে সে সুযোগ দিলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, অনেকদূর পথ জার্নি কইরা আসছ, ভেতরে যাও।
অপরিচিত তরুণীর এমন কিম্ভুত আচরণ দেখে বিস্মিত এস্কান্দার খানিক সামনে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁর কথা শুনে সে আবার ফিরে গেল। খবির খাঁও ভীষণ অবাক হলেন। ঘটনার কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন। এই তরুণীকে তিনি চেনেন না, দেখেননি কখনো। ভাব দেখে মনে হচ্ছে না যে তৈয়ব উদ্দিন খাঁও চেনেন। তবে তরুণী যেহেতু এসেই নয়নের প্রসঙ্গ তুলেছে, সেহেতু এটি সহজেই অনুমেয়, তরুণী নয়নের পূর্ব পরিচিত। কিন্তু এই সময়ে সে এখানে কী করে এলো! খবির খাঁ নানান কিছু ভাবছেন, হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার হিসেব মিলছে না। তবে হিসেব যা-ই হোক, তার বাবা তৈয়ব উদ্দিন খাঁ যেহেতু তরুণীকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে বলেছেন, সেহেতু এখানে আর কথা চলে না। তিনি কথা বললেনও না। মাগরিবের আজান হচ্ছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ উঠে দাঁড়ালেন। হাতের অবশিষ্ট খাবারের পাত্রখানা এস্কান্দারের হাতে তুলে দিয়ে খবির খাঁকে বললেন, এরে ভেতর বাড়িতে নিয়া যা। নয়ন কই? নয়নরে খবর দে!
.
নয়নকে খবর দেয়া হলো। হেমা উঠানের বাঁ পাশে লিচু গাছ তলায় চেয়ারে বসেছিল। নয়নকে দেখে সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসল। যেন বিকেল বেলা তারা একসাথে পার্কে ঘুরতে বেরিয়েছিল। আশেপাশে কোনো চা ওয়ালাকে না দেখে নয়ন গিয়েছিল চা ওয়ালাকে খুঁজতে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ঘুরেও সে চা ওয়ালাকে খুঁজে না পেয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে ফিরে আসছে। তার সেই বিব্রত ভঙ্গি দেখে হেমা যেমন করে হাসত, সে এখনও তেমন করেই হাসল। তার চোখভর্তি দুষ্টুমি। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এই ক’দিনেই তো দেখি কালাবাবা হয়ে গেছ। তবে কালাবাবা হলেও সমস্যা নেই। তোমাকে ম্যানলি লাগছে!
নয়ন সাথে সাথে জবাব দিলো না। সে চুপচাপ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। গত চার বছর ধরে সে হেমাকে চেনে। হেমার এমন বহু পাগলামির সাথে তার পরিচয় রয়েছে। হেমার ফিল্ড ওয়ার্কের কাজ পড়েছে ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে মাদারীপুর খুব দূরের পথ নয়। তবে মাদারীপুর জেলা শহর থেকেও ফতেহপুর গ্রামটি বেশ দূরের পথ। যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন ভালো কিছু নয় বলে দূরত্ব আরো বেশিই মনে হয়। ভরা বর্ষার মৌসুমে সেই পথ হয় আরো দুর্গম। হেমা এই এতখানি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কী করে এলো, তা এক বিস্ময়!
চার বছর আগে পরিচয়ের পর থেকে তাদের বন্ধুত্ব। তারপর প্রেম! তবে সেই প্রেম অদ্ভুত। সময়ে-অসময়ে, কারণে-অকারণে হুটহাট দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বোঝা যায় না। কেবল কখনো যদি মৃদু হাওয়া বয়, তবেই টের পাওয়া যায়। না হলে নিস্তরঙ্গ জলের মতো তাদের এই যুগল জীবন। সেখানে কতটা দূরত্ব বাড়ল কি কমল, সেই ভাবনা কারো মনে আসে না।
নয়ন বলল, চমকে দিয়েছ আমাকে।
হেমা বলল, আমার তো ধারণা ছিল তুমি সহজে চমকাও না। বরং সব সময় অন্যদের চমকে দাও।
নয়ন বলল, সহজে তো চমকাইনি। কঠিনে চমকেছি।
হেমা হাসল। বলল, কী কঠিন?
নয়ন বলল, এই এতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তুমি এখানে! তোমাকে হয়তো এ বাড়ির কথা, গাঁয়ের কথা কখনো কখনো বলেছি। কিন্তু তারপরও এভাবে আসাটা কঠিন। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
হেমা তরল গলায় বলল, এই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ কবিশ্রেষ্ঠ। তিনি সেই কবে বলে গেছেন, সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। আমিও কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।
এবার নয়ন হাসল। বলল, নানাজানের সাথে দেখা হয়েছে?
হেমা বলল, হ্যাঁ, হয়েছে।
নয়ন খানিকটা চিন্তিত। সে এখনো জানে না এ বাড়ির আর সকলে বিষয়টিকে কীভাবে নেবে! সে এতকাল পরে ফতেহপুর এসেছে। আর আসার পর থেকেই একের পর এক ঘটনা। তার মা কোহিনূর এ বাড়িতে আসেন না কত কত বছর! তাদের সাথে খাঁ-বাড়ির সম্পর্কও এক প্রকার আড়ালই হয়ে গিয়েছিল। সেই আড়াল হওয়া সম্পর্ক আবার খানিক জোড়া লেগে গেল তার কারণে। কিন্তু হেমা এমন দুম করে এখানে চলে আসবে, এ কথা ঘুণাক্ষরেও। ভাবেনি নয়ন। বিষয়টি কারোরই সহজভাবে নেয়ার কথা নয়। কিন্তু নানা তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে হেমার দেখা হয়েছে জেনে নয়ন বেশ কৌতূহলী হলো। সে বলল, নানাজান কিছু বলেছেন?
হেমা বলল, হু, বলেছেন।
নয়ন বলল, কী বলেছেন?
দহলিজ ঘরের সামনে তৈয়ব উদ্দিন খাঁর সাথে তার দেখা হবার ঘটনা হেমা খুলে বলল। নয়ন খানিক অবাক হলেও কিছু বলল না।
রাতে রঘু বয়াতির গানের আসর বসেছে। বহুকাল পর খাঁ-বাড়িতে গানের আসর। সেই আসর সকলের জন্য উন্মুক্ত। খাঁ-বাড়ির উঠান বিশাল মাঠের মতো। এই বিরাট উঠান লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। তবে দর্শকরা খানিক গুটিয়ে আছে। প্রতিটি গানের শেষে রঘু বয়াতির দলকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অভিনন্দিত করতে সাহস পাচ্ছে না তারা। উঠানের পূর্বপাশেই তৈয়ব উদ্দিন। খার ঘর। অতিরিক্ত কোলাহলে না আবার তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন! যদিও তৈয়ব উদ্দিন খাঁর আজকের ভূমিকায় সকলেই যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত! তবে সেই আনন্দের আবডালে অজানা চাপা কী এক আশঙ্কাও রয়েছে। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ অবশ্য আসেননি। খবির খাঁ শেষ মুহূর্তে একবার তার ঘরেও গিয়েছিলেন। এটা-সেটা নানান কথা শেষে ইনিয়ে-বিনিয়ে গানের প্রসঙ্গও তিনি তুলেছিলেন। কিন্তু তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলেছেন, একবার তো বললাম, গান হোক। এই ছোট্ট বিষয় নিয়া এত কথা বলনের তো কিছু দেখি নাই।
সেই থেকে গানের আসর চলছে। বহুকাল পর খাঁ-বাড়িতে গান করতে পেরে রঘু বয়াতি ভারি খুশি। সে বিরামহীন গান করে চলেছে। যেন নিজেই ভুলে গিয়েছে, তার সেই আগের বয়স আর নেই। একনাগাড়ে সাত-আটটি গান গাইতেই রঘু বয়াতি খানিক দমে গেল। গান শুরু করল তার দোহার আমজাদ মিয়া। কিন্তু আমজাদ মিয়ার গানে শ্রোতারা তেমন খুশি নয়। আসর কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল। শ্রোতরা যেন ক্রমশই মিয়মান হয়ে পড়ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে হেমা উঠে দাঁড়াল। অনেকগুলো হারিকেনের জ্বলজ্বলে আলোর মাঝখানে তাকে দেখে মনে হচ্ছে অপূর্ব রূপবতী এক কিশোরী। সে তার গাঢ় হলুদ ওড়না কোমড়ে গুঁজে দিতে দিতে আমজাদ মিয়াকে বলল, আমি লোকগান খুব বেশি শুনিনি, তবে আমার খুব প্রিয় একটি গান আছে, আনন্দ আইল গো বালির বিনন্দিত মন, বালির ঘরে উদয় অইছে পূর্ণিমায়া চান। আপনি এই গানটিতে বাজাতে পারবেন?
আমজাদ মিয়া একইসাথে আড়ষ্ট এবং বিস্মিত গলায় বলল, পারব না ক্যান? পারব।
আমজাদ মিয়া বাজনা শুরু করল। সেই বাজনার তালে তালে সুর তুলল হেমা। নয়ন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। হেমার গানের গলা ভালো, তা সে জানে। কিন্তু এই অচেনা-অজানা অজপাড়া গাঁয়ে হেমার মতো আপাদমস্তক। শহুরে এক তরুণী অপ্রচলিত এক লোকগানের সুরে নিজেকে এমন পুরোপুরি মিশিয়ে দিবে- এ যেন অন্য কিছু! সে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। আজকের এই হেমা যেন অন্য কেউ। অনাবিষ্কৃত কোনো এক নতুন মানুষ।
হেমার গান শেষ হলো। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। হেমাও না। রঘু বয়াতি কেবল পাশ থেকে উঠে এসে কাঁপা গলায় বলল, মা জননীরে তো চিনলাম না। কী নাম? কী গো মা জননী?
হেমা মৃদু হাসল। বলল, হেমা।
রঘু বয়াতি বলল, আগে তো আপনেরে কোনোদিন দেখি নাই? খ-বাড়ির কুটুম নাকি গো মা?
হেমা মাথা নাড়ালো। রঘু বয়াতি বলল, আরেকখান গান ধরবেননি মা?
হেমা সলজ্জ গলায় বলল, আমি তো এই গান আর পারি না। একবার ট্রেন। স্টেশনে এক ভবঘুরে বাউল দলের কাছে গানটা শুনেছিলাম। কথা আর সুরটা এমন অদ্ভুত ছিল যে মাথায় গেঁথে গেল। তারপর বহু খুঁজে বের করলাম। আর তো জানি না!
রঘু বয়াতি বলল, আপনি অন্য যেই গান পারেন, তা-ই গান। আপনের গানের গলা ভালো।
হেমা খানিক কী ভাবল। তারপর বলল, রবীন্দ্র সংগীত গাই? কিন্তু…
হেমা কথা শেষ করতে পারল না। রঘু বয়াতি বলল, গান মা, আপনের যেইটা ভালো লাগে সেইটাই গান।
হেমা চুপ করে কী ভাবল! তারপর চোখ বন্ধ করে বসে রইল। আকাশের চাঁদ আর চারপাশের হারিকেনের নরম আলোয় তার ফর্সা মুখটি কী যে অপরূপ এক মায়াময় বিভায় ছেয়ে রইল!
হেমা খুব ধীরে, দু’হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকের কাছে জড় করে গাইল, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে…।
এই গ্রামের শতশত মানুষ, তারা গান-বাজনা বলতে যা বোঝে, তা হলো রঘু বয়াতির গ্রামীণ লোকগান। সেই গানের কিছু কিছু রঘু বয়াতির নিজের লেখা। আর কিছু কিছু মানুষের মুখে মুখে বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত গান। সেই সকল গানের প্রকৃত স্রষ্টার নাম পরিচয় বিস্মৃত হয়ে সকলের গান হয়ে উঠেছে। তাতে তাদের রোজকার দুঃখ-বেদনা, প্রেম-বিচ্ছেদ, ভালোবাসার কথা থাকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের এমন অচেনা কথা আর সুরের গান তাদের কাছে স্বাভাবিক হিসেবেই দূরের কোনো দুর্বোধ্য সংগীত। তার ওপর এই গানের সাথে রঘু বয়াতির দলের ঢোলবাদ্যও বাজল না। দোহারেরা সকলে হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছে। যেন এই গানের তাল লয়টা তারা ঠিক ধরতে পারছে না। কিন্তু হেমার গলায় কিছু একটা ছিল। চাঁদের আবছা আলোয় তার খালি গলায় গাওয়া গান বিষণ্ণ সুর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের বুকের ভেতর যেন কোনো এক অচিনপুরের গভীর বিষাদ ছড়িয়ে দিলো।
গান শেষ হতেই হেমা উঠে এলো। রঘু বয়াতি আবার গান ধরল। হেমা কিছু সময় এসে তার আগের জায়গায় চুপচাপ বসে রইল। তারপর সকলের অগোচরে বেরিয়ে এলো গানের আসর ছেড়ে। বাইরে কী অপার্থিব মায়াময় জোছনা! গাছের পাতার ফাঁকে সেই জোছনা গলে গলে পড়ছে। মাটিতে এঁকে দিচ্ছে নানান রকম নকশা। সে সেই জোছনার নকশার ভেতর দিয়ে হেঁটে এসে ঢুকে গেল বাড়ির দক্ষিণ দিকের বাগানের ভেতর। গত ক’দিনে বৃষ্টি না হওয়ায় মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ভাবটা এখন আর নেই। বরং অনেকটাই খটখটে শুকনো হয়ে এসেছে চারপাশ। সে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখানে দীর্ঘাকায় এক চামুল গাছ। চামুল গাছখানা সটান দাঁড়িয়ে আছে খাঁ-বাড়ির বিশাল সীমানার শেষ প্রান্তে। তারপরেই দিগন্ত প্রসারিত ফসলের মাঠ। কিন্তু সেই বিস্তৃত ফসলের মাঠ জুড়ে ভরা বর্ষার থইথই জল। ফুরফুরে হাওয়ার মৃদু কম্পনে সেই জল তিরতির করে কাঁপছে। ছোটছোট ঢেউগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন কারো কল্পনার তুলিতে আঁকা অবাক নকশা!
হেমা সেই জলের ঢেউয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। বিস্তৃত জলরাশির সেই অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঢেউয়ের মাথায় চিকচিক করে জ্বলছে জোছনা। সেই জল আর জোছনায় ডুবে গিয়ে হেমা চামুল গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। স্থির, অবিচল। কতক্ষণ সে এমন দাঁড়িয়ে রইল তা সে জানে না। তবে দীর্ঘ সময় বাদে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার গাল বেয়ে নেমে আসছে উষ্ণ জলের ধারা। সে কাঁদছে।
কেন কাঁদছে সে?
কী এমন গোপন গভীরতম দুঃখ তার? যে দুঃখের কথা সে কাউকে বলতে পারছে না? কাউকে না! একা এই অচেনা-অজানা এক গাঁয়ের বিস্তৃত জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত অপার্থিব জল আর জোছনার কাছে এসে তাকে কেন এমন করে কাঁদতে হচ্ছে! কী এমন দুঃখ সে পুষে রেখেছে বুকের গহীন ভেতর?
অপার্থিব কোনো দুঃখ?
মানুষের দুঃখগুলো কী অদ্ভুত! সে তার পুরোটা জীবন জুড়েও জানে না, কার কাছে সে তার দুঃখের কথা বলবে! কার কাছে সঁপে দিবে তার বুকের গভীরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা একান্ত অনন্ত দুঃখগাথা!
নয়ন এসে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ। হেমা টের পায়নি। অবশ্য নয়ন তাকে ডাকেনি। তবে কাছেই কোথাও ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল নাম না জানা নিশাচর কোনো পাখি। পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দে হেমা ঘুরে তাকাল। তারপর নয়নকে দেখে কেমন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তাকাল। তবে মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে উঠল সে। মৃদু হেসে বলল, তুমি এখানে? গান শেষ?
নয়ন জবাব দিলো না। সে হেমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। হেমা খানিকটা সামনে এসে নয়নের মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর বলল, চলো ভেতরে যাই। সবাই কী ভাববে!
নয়ন সাথে সাথে জবাব দিলো না। খানিক সময় নিয়ে কী ভাবল। তারপর বলল, নানাজান আমার মাকে অসম্ভব পছন্দ করেন। পৃথিবীতে আর কোনো বাবা তার মেয়েকে এত ভালোবাসেন কিনা আমার জানা নেই। তবে নানাজান হলেন জগতের সেই সকল অসহায় মানুষদের একজন, যারা অহরহ তাদের রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ প্রকাশ করেন। কিন্তু কখনোই তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন না। এই সকল মানুষের বাইরের দিকটা হয় শুকনো, খটখটে কঠিন। সবাই কেবল তাই তাদের সেই খটখটে কঠিন রূপটাই দেখে। বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গভীর ভালোবাসাটা আর কেউ দেখে না।
হেমা কোনো কথা বলল না। নয়নই আবার বলল, মা তো বহু বছর আসে না। নানাজানের সাথে দেখাও নেই কত বছর। এতকাল পর তাই আমায় পেয়ে নানাজান কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না! না হলে এই এতকাল পরে এ বাড়িতে গান-বাজনা হলো, তুমি এলে, অচেনা-অজানা এক তরুণী মেয়ে, অন্য সময় বা অন্য কেউ হলে কী হতো জানি না। কিন্তু এ সকল আমার কারণে হচ্ছে বলেই হয়তো নানাজান কিছু বলেননি। বরং সকল কিছুতেই মৌন সম্মতি দিয়েছেন।
নয়ন সামান্য হাসল, তারপর বলল, সুতরাং এখানে রাত পার করে দিলেও কেউ কিছু বলবে না।
হেমা বলল, বলার কথা তো বলিনি। বলেছি ভাবার কথা। বলা না হয় আটকানো যায়, কিন্তু ভাবনা? ভাবনা আটকানোর কি কোনো উপায় আছে?
নয়ন হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, কী হয়েছে তোমার?
হেমা বলল, কেন? কী হবে?
নয়ন বলল, সেটাই তো জানতে চাইছি।
হেমা বলল, এই যে এমন হুট করে গ্রামে চলে এলাম, তাই?
নয়ন বলল, ঠিক তা নয়। এমন করে আসাটা তোমার জন্য অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু কোথাও যেন কিছু একটা গড়মিল…
হেমা হাসল, গড়মিল? তুমি গড়মিল টের পাও?
নয়ন বলল, হুঁ, পাই। না পেলে গানের আসর ছেড়ে তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসব কেন?
হেমা বলল, এটা তো খুব স্বাভাবিক, সহজ। আমাকে ওখানে হঠাৎ না দেখতে পেয়ে তুমি তো খুঁজবেই। এই সহজ গড়মিল খুব সহজেই সকলে টের পায়। কেবল জটিল আর অদৃশ্য গড়মিলগুলো সকলে টের পায় না।
নয়ন বলল, তুমি পাও?
হেমা সাথে সাথেই এই প্রশ্নের কোনো উত্তর করল না। সে দীর্ঘ সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নিঃশব্দ সময়। হঠাৎ কাছে কোথাও গাছের পাতায় সরসর শব্দ তুলে নেমে গেল কোনো পাখি বা প্রাণী। জলের ভেতর টুপ করে শব্দ তুলল কোনো মাছ। সেই শব্দের উৎস হতে অজস্র ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আবার ক্রমশই মিলিয়ে গেল জলে। হেমা সেই মিলিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে খুব নরম কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, পাই।
নয়ন বলল কী পাও?
হেমা বলল, জটিল অদৃশ্য গড়মিল।
নয়ন বলল, সেই জটিল অদৃশ্য গড়মিলটা কী?
হেমা আবারো চুপ করে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কী আর আপাতত ঢাকায় ফিরে যাবে না?
নয়ন খানিক চমকে উঠল! সে বলল, কেন? ঢাকায় ফিরে যাব না কেন?
হেমা বলল, জানি না। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে যে তুমি দীর্ঘ সময় এখানে থেকে যাবে।
নয়ন বলল, এমন কেন মনে হচ্ছে?
হেমা বলল, অনেক বিষয় আছে, যেগুলো মনে হবার পেছনের কারণটা মানুষ ধরতে পারে না। কিন্তু মনে হয়। আবার সেই মনে হওয়াটা সত্যিও হয়ে যায়। যায় না? এটা ধরো তেমন কারণ ধরতে না পারা কোনো মনে হওয়া।
নয়ন বলল, তুমি আজকাল কেমন দার্শনিকদের মতো কথা বলো।
হেমা হাসল। বলল, আমি আগে এমন ছিলাম না, তাই না?
নয়ন বলল, এখনও বুঝতে পারছি না। তবে কোথাও একটা বদল তো হয়েছেই।
হেমা বলল, মানুষ তো বদলায়ই। ওই যে মনে নেই, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়।
নয়ন বলল, কারণে বদলায়, কিন্তু অকারণেও কি বদলায়?
হেমা আবারও হাসল। বলল, তুমি কেন বদলেছ? কারণে, না অকারণে?
নয়ন এবার আর জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। হেমাই আবার বলল, আমরা কখনোই তো তেমন গলাগলি করে জড়িয়ে থাকা কেউ ছিলাম না। এবং এই নিয়ে তোমার আমার কারোই কোনো অভিযোগও ছিল না। আমরা জানতাম, আমরা আছি। আর সেই থাকাটা কোনোভাবেই অপ্রয়োজনীয় বা হালকা কিছু নয়। এই বোঝাবুঝিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব জরুরি। কিন্তু কী হয় জানো, দীর্ঘ সময় যখন কেউ কারো সাথে থাকে, মেশে, তখন পরস্পরের নানান কিছু তাদের চেনা-জানা হয়ে যায়। ফলে সামান্য বদলও হুট করে ধরা পড়ে যায়।
হেমা খানিক থামল। তারপর আবার বলল, আমি তোমাকে বলিনি, ভেবেছি, হয়তো আমারই বুঝতে ভুল। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে টের পাচ্ছিলাম, ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলছিল তোমার। আমি ভাবতাম, তুমি আমাকে বলবে। বারকয়েক জানতেও চেয়েছি, কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছি, তুমি বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাও না, তখন আর ঘাটাতে চাইনি।
ফুরফুরে হাওয়ায় কাঁধের ওপরের চুলগুলো এসে বারবার মুখ ঢেকে দিচ্ছিল হেমার। সে খানিক থেমে আলগোছে মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরালো। তারপর আবার বলল, প্রতিটি মানুষের নিজের খুব একার আলাদা একটা জগৎ থাকে। সেই জগতে সে ছাড়া আর কারোই কোনো প্রবেশাধিকার থাকে না। কারোরই না। আমি তাই তোমার সেই জগতে অনধিকার প্রবেশ করতে চাইনি। কিন্তু তোমার সেই পরীক্ষার আগ থেকেই তুমি ক্রমশই কেমন অস্থির হয়ে যাচ্ছিলে। তোমাকে আমি আগে কখনো রাগতে দেখিনি। কিন্তু সেই তুমি হঠাৎ করেই কেমন হয়ে যেতে থাকলে। হুটহাট যার-তার সাথে যখন-তখন অকারণে রেগে যেতে থাকলে। সব সময় কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে থাকতে। ফোনে কথা বলার সময়ও কেবল একা আমিই বলে যেতাম। প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না যে, তুমি আমার কথা শুনছ না। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আসলে কেবল ফোন কানে চেপে ধরে বসে থাকো। আমার কথা শুনছ না। তুমি আসলে ভাবতে অন্য কিছু এবং সেই অন্যকিছু ভাবনায় তুমি গভীরভাবে ডুবে আছ। দিনের পর দিন। যখন থেকে বুঝতে পারছিলাম, তারপর থেকে তোমার জন্য খুব অস্থির লাগত আমার। কিন্তু দিনে দিনে আমরা আমাদের সম্পর্কটাই যেন কেমন করে ফেলেছিলাম। সেখানে জায়গাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল।
হেমার কাঁধের উপর দিয়ে নয়ন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পেছনের বিস্তৃত জলরাশিতে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এই পৃথিবীর কোথাও আছে! বরং মনে হচ্ছে সে যেন ডুবে রয়েছে অন্যকোনো জগতে।
হেমা বলল, আসলে কী জানো, আমরা শুধু আমাদের পাশাপাশি ছিলাম, কিন্তু কাছাকাছি কখনোই ছিলাম না। ওই কাছাকাছি থাকাটাই আসল। কিন্তু পাশাপাশি থাকা আমাদের ভেতর ভেতর এক বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়ে ছিল। এই দূরত্বটা সম্পর্কের জন্য খুব ভয়ঙ্কর। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হতো, কী হয়েছে তোমার, কী হচ্ছে? কিন্তু আমরা আমাদের মাঝখানে একটা শক্তিশালী অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলেছিলাম। সেই দেয়াল টপকানোর সাধ্য আমার একার ছিল না। আমি ভাবছিলাম ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আসলে ঘটেছে উল্টোটা। সবকিছু বরং রোজ রোজ আরো বেঠিক হয়েছে। আমাদের যোগাযযাগটাও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছিল। কিন্তু সেসব খেয়াল করার মতো অবস্থাও তোমার ছিল না। আমি ঠিক জানি না কী, তবে তোমার বুকের ভেতর, তোমার ভাবনার ভেতর কোনো এক ঘূণপোকা তোমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল, সে আমি টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু কী করব বলো! কিছুই করার সুযোগ আমার ছিল না। হয়তো এখনও নেই।
হেমা নয়নের কাঁধ ছুঁয়ে বলল, তুমি আমাকে শুনছ নয়ন?
নয়ন ধীরে মাথা নাড়াল। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, শুনছি।
হেমা বলল, আমি তোমায় বিরক্ত করছি না তো?
নয়ন আবারো মাথা নাড়ল, না।
হেমা এক পা এগিয়ে এসে নয়নের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর ফিসফিস করে বলল, জগতের প্রতিটি মানুষই তার বুকের ভেতর একান্ত নিজস্ব কিছু কষ্ট বয়ে বেড়ায়। ভয়াবহ কষ্ট। সেই কষ্ট সে আর কারো কাছে বলতে পারে না। প্রকাশ করতে পারে না। কারো কাছেই না। কারণ সে জানে তার এই কষ্ট বুঝবার ক্ষমতা এই জগতে সে নিজে ছাড়া আর কারোরই নেই। কারোরই না। কেবল সে একা, কেবল সে নিজে একা ছাড়া আর কেউই সেই কষ্ট ছুঁতে পারবে না। স্পর্শ করতে পারবে না।
হেমা সামান্য থামল। তারপর আবার বলল, এই জন্যই বুঝি সবাই বলে, দিন শেষে আমরা সকলেই আসলে একা। ভীষণরকম একা, তাই না?
নয়নের হঠাৎ কী হলো! সে হেমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হেমা মুহূর্তকাল স্থবির দাঁড়িয়ে রইল। তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদা এই মানুষটাকে সে আগে কখনো দেখেনি। এই দীর্ঘ ছয় বছরেও না। সে দু’হাতে শক্ত করে নয়নকে তার বুকের সাথে জাপ্টে ধরে রাখল।
হেমা নিজেও কি কাঁদছে? কে জানে!
হেমা কাঁদলেও তার সেই কান্না শব্দহীন। হেমা আর নয়ন, দুটো মানুষ, তারা পরস্পরের চেনা কিংবা অচেনা, তারা পরস্পরকে জানে কিংবা জানে না, কিন্তু সেই মানুষ দু’টো এক গভীর নিস্তব্ধতায় দীর্ঘ সময় ধরে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অব্যক্ত কত কিছুই না বলে গেল! কত কিছুই না শুনে গেল! সে সকল হয়তো ভাষায় বলা যায় না। জগৎ তো এমনই, এখানে গভীরতম অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, প্রকাশ করতে হয় স্পর্শে, অনুভূতিতে। নয়ন আর হেমা, পরস্পরকে সেই গভীরতম অনুভূতির কথা বলে যেতে লাগল শব্দহীন এক গভীরতম নৈঃশব্দ্যে।
*
হেমা চলে গেল পরদিন ভোরেই। তারপরের কয়েকটা দিন কেটে গেল নিস্তরঙ্গ। সেই নিস্তরঙ্গ সময় কেটে গিয়ে আবার খানিক তরঙ্গায়িত হলো নয়নের সময়। তার সাথে আব্দুল ফকিরের দেখা হলো এক মঙ্গলবার। মঙ্গলবার বিলকুড়ানির হাট। বিলকুড়ানি ফতেহপুর থেকে যন্ত্রচালিত নৌকায় ঘণ্টাদুয়েকের পথ। এই এলাকার নাম বিলকুড়ানি হওয়া নিয়ে নানান গল্প রয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত গল্প যেটি রয়েছে, সেটি হলো এই অঞ্চল জলাবদ্ধতার অঞ্চল, ফলে বর্ষা মৌসুমের ফসল ছাড়া আর কোনো মৌসুমের ফসল এখানে হয় না। এই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষজন তাই অন্যান্য মৌসুমে আশেপাশের এলাকায় কাজ-কর্মের খোঁজে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হেমন্তে যে ধান ওঠে সেই ধান কাটতে তারা দলবল বেঁধে নেমে পড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে। ধান কেটে তারা গৃহস্থের কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে ধানের একটা ভাগ তো পায়ই। তার ওপর আরো খানিক অধিক আয়ের জন্য ফসল তুলে ফেলা শূন্য মাঠে, মাঠের আইল বা ইঁদুরের গর্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উচ্ছিষ্ট ধান সংগ্রহে তারা দিনের পর দিন কাজ করে। এই ধান সংগ্রহকে বলে ধান কুড়ানো। তারা যেহেতু প্রতি মৌসুমেই শুকনো ফসলের মাঠ-বিলে দলবল বেঁধে এমন ধান কুড়ায়, সে কারণেই দিনে। দিনে তাদের গায়ের নাম হয়ে যায় বিলকুড়ানির গাও। তবে আজকাল আর সেই বিলকুড়ানির গাঁওয়ের আগের সেই অবস্থা নেই। বরং আর সকল এলাকা থেকে এই এলাকা এখন ঢের এগিয়ে গেছে। এখানে সকলের আগে ইলেক্ট্রিসিটি চলে এসেছে। বাজারের দোকানপাট বেড়েছে। ইলেক্ট্রিসিটি আসার কারণে জমির দাম বেড়েছে। ব্যবসাপাতিও বেড়েছে মানুষের। হরেক রকমের লোকজন আসায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনেও বৈচিত্র্য এসেছে। দোকানে দোকানে ছোট্ট সাদা কালো, কালেভদ্রে দুয়েকখানা রঙিন টেলিভিশনও দেখা যাচ্ছে। নয়ন। এসেছে তার বড় মামা খবির খাঁর ছেলে মনিরের সাথে। আসার পুরো পথে মনির তাকে বিলকুড়ানির নানান গল্প বলেছে। নয়ন সেসব মন দিয়ে শুনেছেও।
মনিরের সকল গল্প এসে ঠেকে মাছে। কোন বছর কোন বিলে কত বড় মাছ ধরা পড়েছিল, এই হলো তার গল্পের নির্যাস। আর গল্প শেষ হবে দীর্ঘশ্বাসে, বুঝলেন ম্যাভাই (মিয়া ভাই), সেই আগিলা (আগের) দিন আর নাই। মাছ নাই পানিতে। থাকব ক্যামনে? পানিই তো নাই। আগে নাকি বাইস্যাকালে চাইরদিকে থাকত খালি পানি আর পানি। মাইনষের ঘর যাইতো। ডুইব্যা, সবারই বাড়ির চালে গিয়া ঘর বানান লাগত। আর এখন? দেখছেন, এই যে বাইস্যাকালটা আইল, আছে? কোনোদিক কোনো পানি দেহেন? এই কোমড় পর্যন্ত পানি না হইলে কি আর বাইস্যাকাল হয় কন? তার উপরে পানিতে এহন নানান বিষ। মাইনষে ক্ষেত-খামারে সার দেয়, কিটনাশক দেয়, এইগুলান তো সব বিষ। এই বিষ যায় কই? যায় পানিতে। মাছ কেমনে থাকব কন?
নয়নের শুনতে যে খারাপ লাগে তা না। তবে তার ভাবনা জুড়ে অন্য কিছু। সে প্রায়ই সেই অন্যকিছুতে আনমনা হয়ে থাকে। মনিরের বেশিরভাগ কথাই তাই তার শোনা হয় না।
নয়নের অবশ্য বিলকুড়ানির হাঁটে আসার মূল উদ্দেশ্য তার মোবাইল ফোনে চার্জের ব্যবস্থা করা। সে শুনেছে এখান থেকে ফোনের নেটওয়ার্কও অল্প-বিস্তর পাওয়া যায়। তা চার্জ হলোও। মায়ের সাথে ঢাকায় কথাও হলো। তার মা কোহিনূর বানু ফোন ধরেই বললেন, তুই কবে আসবি?
নয়ন উদাস গলায় জবাব দিলো, জানি না মা।
এইটুকু মাত্র কথা, তারপর কোহিনূর বানু চুপ করে রইলেন। তিনি পারতপক্ষে কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। তবে ব্যাতিক্রম বলতে কেবল এই নয়ন। তার এই একজীবনে তিনি যত কথা বলেছেন, সম্ভবত তার বেশিরভাগই নয়নের সাথে। তিনি খানিক চুপ করে থেকে আবার বললেন, তুই আমাকে বল তো, তুই কী চাইছিস?
নয়ন বলল, আমি তো কিছু চাইছি না মা।
কোহিনূর বানু বললেন, না চাইলে তুই আমাকে না বলেই ফতেহপুর গেলি। আর গিয়ে জানালি দুয়েক দিনের মধ্যে ফিরে আসবি কিন্তু তারপর থেকে তোর সাথে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। কয়েকদিন পরপর এখান সেখান থেকে ফোন দিয়েই আবার উধাও!
নয়ন বলল, ফতেহপুরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ফোনের নেটওয়ার্কও নেই, তা তো তুমি জানোই। কী করে কথা বলব!
কোহিনূর বানু বললেন, তুই আসছিস না কেন? কবে আসবি?
নয়ন বলল, গ্রাম আমার খুব ভালো লেগে গেছে মা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি খারাপ না লাগা অবধি আমি এই গ্রামেই থেকে যাব।
কোহিনূর বানু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে নয়নের চোখ আটকে গেল বাজারের সাথেই স্কুলের মাঠে। সেখানে খানিক আগেও ছোটখাট এক জটলা ছিল। সেই জটলা এইটুকু সময়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। মানুষের ভিড় ক্রমশই বাড়ছে। তবে মাঠ খানিক নিচু হওয়ায় ভিড়ের মানুষের মাথার উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, জটলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন আব্দুল ফকির। আব্দুল ফকিরের হাতে ফণা তোলা এক গোখরা সাপ। জটলার কারণে এতদূর থেকে আব্দুল ফকিরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। খানিক পরপর মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছে দৃষ্টিপথে। নয়ন তড়িঘড়ি করে মাকে বলল, মা, রাখি। পরে কথা বলব।
কোহিনূর বানু আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। নয়ন ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত পায়ে জটলার কাছে গেল। আব্দুল ফকির এখন জটলার মাঝখানে বসে আছেন। গোখরা সাপটা এখনো তার গলায় ঝুলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের মতো সে আর ফণা তুলে ফোঁসফোঁস শব্দ করছে না। বরং অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে দড়ির মতো গলা পেঁচিয়ে ঝুলে আছে। আব্দুল ফকিরের সামনে অনেকগুলো কাঁচের বয়াম। বয়ামগুলোভর্তি নানান রকমের ভেষজ ওষুধ। ওষুধের পাশে কয়েকটি কাঠের বাক্স। বাক্সগুলোতে সম্ভবত আরো কয়েকটি সাপ রয়েছে। কিন্তু আব্দুল ফকির সেই সাপগুলো বের করছেন না। তার সাথে রয়েছে জুলফিকার।
জুলফিকার সুর করে কথা বলছে, মুসলমান ভাইদের আমার সালাম, হিন্দু ভাইদের আমার নমস্কার। আপনেগো সামনে আইজ যিনি উপস্থিত হইয়েছেন, তারে আপনেরা সকলে এক নামে চেনেন। তিনি হইলেন কালনাগিনীর জম, নাগ নাগিনীর ভ্রম, স্বীয় পায়ে সর্প অর্পণ, সাত’শ সর্প মন্ত্রে কর্তন, নাগিনীর চোখ তাহার দর্পণ, তিনি মানব বীর, বলেন, কে তিনি? বলেন, বলেন, বলেন… তিনি…?
উপস্থিত জনতা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, তিনি আব্দুল ফইর, তিনি আব্দুল ফইর।
জনতা আব্দুল ফকিরের নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে জুলফিকার হাততালি দিলো। নয়ন এতক্ষণ খেয়াল করেনি, আব্দুল ফকিরের পাশেই তের চৌদ্দ বছরের শীর্ণকায় এক কিশোর জড়সড় হয়ে বসে আছে। জনতা আব্দুল ফকিরের নাম বলার সাথে সাথেই সেই কিশোর লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার পায়ে নর্তকীদের মতো ঘুঙুর। সে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়তেই জুলফিকার আবারো হাততালি দিলো। জুলফিকারের দেখাদেখি হাততালি দিলো উপস্থিত জনতাও। কিশোর ছেলেটি মুহূর্তেই তার কোমড় থেকে একটি বাঁশি বের করল। এই বাঁশিকে বলে বীণ। বীণ বাজাতে শুরু করলেই সাপ বীণের তালে তালে নাচতে শুরু করে।
আব্দুল ফকির হাতের ইশারা করতেই কিশোরটি বীণ বাজাতে শুরু করল। বীণ বাজাতে গিয়ে তার গলার সরু শিরাগুলো বীভৎস রকম টানটান হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। দম রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। তবে দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় দম বন্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে ছেলেটি। কিন্তু ছেলেটি পড়ল না। বিস্ময়কর রকম দম তার। আব্দুল ফকির নিস্তেজ গোখরা সাপটিকে তার গলা থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। তারপর তার বাম হাতটি মুঠি করে সাপটার মুখের কাছে নিয়ে গেলেন। আব্দুল ফকিরের দুই হাতের দশ আঙুল জুড়েই নানান রকমের বড় বড় আংটি। তিনি সেই আংটি দিয়ে বার দুয়েক মুহূর্তের জন্য সাপটার মুখে মৃদু আঘাত করলেন। সেই আঘাতেই সাপটা যেন আবার ফুঁসে উঠল। বাঁশি বাজাতে থাকা কিশোর ছেলেটি এবার অর্ধনমিত হয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে সাপটার সামনে শরীর বাঁকিয়ে নাচতে লাগল। নৃত্যের সাথে সাথে তার মুখের বাঁশি ধরা হাতেও সে চমৎকার ভঙ্গিতে নানাভাবে দোলাতে থাকল। তার এই বাঁশির সুর এবং বাঁশিসহ দেহ দোলানোয় এক অদ্ভুত সুন্দর ছন্দ রয়েছে। উপস্থিত জনতা যেন সেই সুর আর ছন্দে বুঁদ হয়ে আছে। সাথে বুঁদ হয়ে আছে সাপটির অসাধারণ নৃত্যেও।
উপস্থিত জনতার সাথে নয়ন আর মনির অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, নিস্তেজ সাপটি এবার ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুধু যে দাঁড়িয়েছে, তা-ই নয়, সে যেন বাঁশির সুরে সুরে ক্রমশই আরো উঁচুতে উঠছে। কিশোর ছেলেটির বাঁশির সুর আর ছন্দের সাথে সাথে সেও সারা শরীর বাঁকিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে নাচছে।
নয়নের কানের কাছে মুখ এনে মনির ফিসফিস করে বলল, দেখছেন ম্যাভাই, এই হইল আব্দুল ফইর! সাপখোপ তারে আজরাইলের মতো ভয় পায়। সে যা কয়, তা-ই শোনে। সে যদি আন্ধার রাইতেও রাস্তা দিয়া হাইটা যায়, আশেপাশে কোনখানে সাপখোপ থাকলে যে যেদিকে পারে পলাই যায়। দেখছেন, কেমনে মাজা দুলাইয়া নাচতে আছে। কী আচানক কাণ্ড, দেখছেন ম্যাভাই!
নয়ন কোনো কথা বলল না। মনিরই আবার বলল, দেখলেন না, আপনেরে কেমনে বাঁচাই তুলল! আপনে মরা মানুষটা, কেমনে ঢেলে দুইটা বাড়ি দিয়া আপনেরে জ্যাতা (জীবন্ত) বানাই দিলো। কী আচানক কাণ্ড!
নয়ন এবারো কোনো কথা বলল না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আব্দুল ফকিরের দিকে। আব্দুল ফকির উঠে দাঁড়ালেন আরো খানিক পর। তিনি উঠেই গম্ভীর গলায় বললেন, আপনেরা এইখানে আসছেন সাপের খেলা দেখতে। ভালো কথা। এই যে বাক্সগুলান দেখতেছেন, এইগুলানের সবকয়টা ভর্তি সাপ। নানান জাতের, নানা রঙের বিষধর সব সাপ। আইজ সবই আপনাগো দেখাব। কিন্তু তার আগে একখান কথা। এই যে বাইস্যাকাল, সকলের বাড়ি ঘরে পানি উঠতেছে। খাল বিল, নদী নালা, মাঠ, ঘাট সবই যে ডুইবা গেছে, এতে যে মহা বিপদ আইতেছে ঘরে ঘরে, সেই খেয়াল আছে?
আব্দুল ফকিরের কথা বলার ভঙ্গিতে বিশেষ কিছু একটা রয়েছে। শরীর জুড়ে কেমন শিরশিরে অস্বস্তিকর এক অনুভূতি হয়। কিন্তু সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি সত্ত্বেও তার সামনে থেকে চলে যাওয়া যায় না। কথা শেষ না হওয়া। অবধি সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নয়ন আর মনিরও দাঁড়িয়ে রইল।
আব্দুল ফকির বললেন, ঘরে ঘরে এহন সাপের বাসা। সাপ এহন যাইব কই? এই পানিতে যাইব? এই পানিতে থাকব? না। সাপের এহন যাওনের জায়গা একটাই। সেই জায়গা হইল গৃহস্তবাড়ির ঘর। গৃহস্তবাড়ির লোকজনের ঘুমানোর চৌকির তলা। ধান-চাউলের গোলা। ওইদিন হুনলাম কেরামতগঞ্জের ইনুচ মুন্সির পোলারে সাপে কামড়াইছে। সে ঘুমাই আছিল বিছানায়, আচুক্কা (আচমকা) দেখে পিঠের নিচে ঠান্ডা ঠান্ডা কী যেন লাগে। হাত দিয়া ধরতে গেছে, সাথে সাথে কামড়। আমারে খবর দিছে দুপুর বেলা। যাইতে যাইতে সন্ধ্যা। বাঁচান বড় মুশকিল আছিল। তয় শ্বাস যতক্ষণ থাকে, আল্লাহ-রসুলের দোয়ায় আব্দুল ফইর ততক্ষণ পর্যন্ত সাপে কাটা রুগীরে জমের হাতে ছাড়ে না।
আব্দুল ফকির দম নেয়ার জন্য খানিক থামলেন। পাশ থেকে জুলফিকার বলল, খালি দম থাকলেই বাঁচাইতে পারেন কাকু? দম না থাকলে বাঁচাইতে পারেন না?
জুলফিকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও কেউ কোনো জবাব দিলো না। উপস্থিত জনতা কোনো কথা বলছে না। এই এতবড় জটলা, এত এত মানুষ, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। ভয়ে বা উত্তেজনায় তারা সকলেই নিশ্ৰুপ হয়ে আছে। আব্দুল ফকিরের সম্পর্কে নানান কথা তারা নানান সময়ে শুনেছে। সে সকল কথা শুনতে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, ভয় লাগে, কিন্তু আবার ভালোও লাগে। কেমন এক ধরনের রোমাঞ্চ হয়। মনে হয় এ বাস্তবে ঘটা কোনো ঘটনা নয়। অথচ ঘটনাগুলো বাস্তব, আর সেই অবাস্তবকে বাস্তব করে তোলা মানুষটা তাদের সামনেই! সকলেই পরের ঘটনা শোনার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
জুলফিকার বলল, শোনেন মেয়ারা। আব্দুল কাকু তার নিজের ঘটনা নিজে বলতে চান না। শরমিন্দা হন। তয় আমার মুখে শোনেন। আপনেরা তো সকলে ফতেহপুরের খ-বাড়ি চেনেন। সেই বাড়ির তৈয়ব উদ্দিন খাঁরে চেনে না এমন মানুষ এই দ্যাশে নাই। সেই দিন গভীর রাইতে খবর আইল তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নাতি সাপের কামড়ে মারা গ্যাছে। নাতি বিরাট ডাক্তার। থাকে ঢাকার শহর। গ্রামে আইছে বুড়া নানারে দ্যাখতে। আইসা সাপের কামড় খাইছে। খাইছে। দিনের বেলা। কী করব, কী করব, কোন ডাক্তারের কাছে নিব, এইসব ভাবতে ভাবতেই হইছে রাইত। ততক্ষণে রুগী তো শ্যাষ। শ্বাস-নিঃশ্বাসও বন্ধ। মরা লাশ আর কি! সবাই কান্নাকাটি করতেছে। সেই সময় তৈয়ব উদ্দিন খাঁ তার বড় পোলা খবির খাঁরে ডাইকা বলল, ডাক্তার-ফাক্তার বাদ। আমার নাতিরে যদি কেউ বাঁচাইতে পারে, তয় পারব একমাত্র আব্দুল ফইর, যা এক্ষুণি তারে আনতে লোক পাঠা, এক্ষুণি। লোক আসলো ভোর রাইতে। আমরা গেলাম পরদিন বেয়ান বেলা। সাপে কাটা রোগী এতক্ষণ বাঁচে? আপনেরাই কন, বাঁচে?
তুমুল উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস তাকিয়ে থাকা মানুষগুলো এবার জবাব দিলো। তারা সমস্বরে বলল, না, বাঁচনের কথা না।
জুলফিকার স্নান গলায় বলল, বাঁচেও নাই। আহারে লাল টুকটুক্কা গায়ের রঙ পোলাটার। সাপের বিষে নীল হইয়া গেছে। মরা মানুষটা পইড়া আছে বিছানায়। সবাই চিকুর দিয়া কানতেছে। কেউ কেউ কোরআন শরিফ পড়তেছে, দোয়া-দরুদ পড়তেছে। কিন্তু উপরে আল্লাহ, আর নিচে ইল্লাহ আব্দুল ফইর। আব্দুল ফইর গিয়া রুগীরে একপলক দেখলেন। দেইখা বললেন, রুগীরে উঠানে নামাও। উঠানের মাঝখানে ক্যালাগাছ পোঁত। ক্যালাগাছের শরীলে যাবে রুগীর শরীলের বিষ, সেই বিষে ক্যালাগাছ মরব, রুগী মরব না। এই রুগীরে আমি ছাড়ব না, যতবড় সাপের বিষ হউক, এই রুগীরে আমি ছাড়ব না।
জুলফিকার একটু থামল। তারপর গলা পরিস্কার করে গম্ভীর স্বরে বলল, আব্দুল ফইর সেই রুগীরেও জমের হাতে ছাড়েন নাই। ঢোলে দুইটা বাড়ি দিয়া মন্তর পড়ছেন, সাথে সাথে রুগী লাফ দিয়া উইঠ্যা খাড়াইছে! কী মিয়ারা, সেইদিনের ঘটনা দেখছেন এমুন কেউ নাই এইহানে? কথা কন না কেন মিয়ারা? নাই কেউ এইহানে?
ভীড়ের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। সেইদিন খাঁ-বাড়িতে ছিল, নিজের চোখে সেই দিনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এমন দুজন লোকও বেরিয়ে এলো ভিড় থেকে। তারা নিজের চোখে কী দেখেছে তাও বর্ণনা করল। উপস্থিত শ্রোতারা বিস্ময়াভিভূত চোখে আঙ্গুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে একই সাথে শ্রদ্ধা, ভয় এবং বিস্ময়!
হইচই খানিক কমলে আব্দুল ফকির মৃদু কাশির শব্দ করলেন, তারপর বললেন, যাই হউক। এইসব কথা এত বলনের কিছু নাই। আসল কথায় আসি। আমার বয়স হইয়া গেছে, আগের মতো এহন আর যহন তহন হাঁটা চলা, দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না। যেইহানে সেইহানে সাপের বিষ নামাইতেও যাইতে পারি না। আপনেরা শোনছেন কিনা জানি না, এইবার এহন পর্যন্ত এই অঞ্চলে উনপঞ্চাশ জনরে সাপে কাটছে। সবখানে তো আমি যাইতে পারি নাই, তাই মারাই গেছে বেশিরভাগ। এহন আল্লায় আমারে একটা ক্ষমতা দিছে, মানুষের উপকার করার, জান বাঁচানোতে সাহাইয্য করার ক্ষমতা। এহন সেই দায়িত্ব যদি আমি ঠিকঠাক পালন করতে না পারি, তাইলে আমি হইমু পাপী। মহাপাপী। এই পাপের ভাগিদার আমি হইতে চাই না। আল্লাহর নামে আপনেগো কিছু সাহাইয্য করতে চাই।
আব্দুল ফকির থামলেন। থেমে দু’কদম বাঁ পাশে সরে গেলেন। তারপর মাটি থেকে একখানা কাঁচের বয়াম হাতে নিয়ে চোখের কাছে ধরলেন। সেই কাঁচের বয়াম দীর্ঘ সময় ধরে দেখে বয়ামখানা হাতের তালুতে নিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, এই বয়াম আপনেগো জইন্য। এই বয়ামের ভিতর যে গাছগাছরার ছালবাকল দেখতেছেন, এই ছালবাকল সাধারণ কোনো ছালবাকল না। এইগুলান সাপের জম। তার ওপর আমার মন্ত্র পড়া। বাড়ির চাইরপাশে এই ছালবাকল ছিটাইয়া দিবেন। বিছানার নিচে, চৌকির নিচে, ধানের গোলার ভিতর, টিনের চালে এই ছালবাকল যত্ন কইরা রাইখা দিবেন। এক টুকরা ছাল যেইহানে থাকব, সেইহানে সাপ তো দূরের কথা, সাপের গন্ধও আইব না।
আব্দুল ফকির বয়ামখানা মাটিতে রাখলেন। দর্শকদের মধ্যে আবার শোরগোল শুরু হয়েছে। আব্দুল ফকির শান্ত গলায় বললেন, তাড়াহুড়ার কিছু নাই। আপনেরা সবাই-ই পাইবেন। আপনেদের জইন্য ওই বস্তা ভইরা ছাল বাকল আনা হইছে। জুলফিকার আর রতন, দুইজন মিল্যা আপনেগো সবাইরেই দিব। আপনেরা যে যা পারেন কিছু হাদিয়া দিয়া যাবেন।
আব্দুল ফকির জটলা থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার থামলেন। তারপর বললেন, আরেকখান কথা। অনেক সময়ই কোনো ফইরের ফিহিরে কাজ না হইলে, সেই ফইরের দোষ হয়। সবাই বলে ফইরসাবে কোনো কামের না। কিন্তু কেউ হিসাব কইরা দেহে না, ফইরে যা কইছিল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হইছিল না কিনা? শোনেন মেয়ারা, এই ছালবাকলা ছিটাইবেন। ফজরের নামাজে খাড়ানের আগে। ওযু কইরা পাক পবিত্র হইয়া, খালি প্যাডে, এক গ্লাস পানিও খাওন যাইব না। একদম খালি প্যাডে। পাক পবিত্র থাকনটা খুব জরুরি। মনে রাইখেন।
আব্দুল ফকির কথা শেষ করে ধীর পায়ে জটলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তারপরের কয়েক মিনিটে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। তারা আব্দুল ফকিরের সেই আশ্চর্য ক্ষমতাধর বৃক্ষের ছালবাকল সংগ্রহের জন্য উঠে পড়ে লাগল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, সারি সারি সাজিয়ে রাখা কাঁচের বয়ামগুলো খালি হয়ে গেল। খালি হয়ে গেল বস্তাও। তবে সেই বৃক্ষের বাকল বিক্রির হাদিয়ায় ক্রমশই পূর্ণ হয়ে উঠল জুলফিকারের হাতের টাকার থলেটি।
নয়ন আর মনির গুটিগুটি পায়ে জটলা ছেড়ে আড়াআড়ি মাঠ পেরিয়ে স্কুলের কাছাকাছি চলে এলো। এখান থেকে সামান্য বায়ে হেঁটে গেলেই বড় খাঁল। এইসময়ে খালের দুই পাড়ে নানান রকমের সারি সারি নৌকা বাধা থাকে। নৌকাগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য নিয়ে আসে সওদা করতে। এই থইথই বর্ষায় খাল অবশ্য আর খাল নেই, দিগন্ত বিস্তৃত বিলের জলের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
খালপারের উঁচু মাটির ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে মনির বলল, ম্যাভাই, দেখলেন কারবার খান? একদম জাদুর লাহান কাণ্ড-কারখানা! আপনের ঘটনার কথাই চিন্তা কইরা দেহেন, মরা মানুষটারে ফইর সাবে জ্যাতা বানাই দিলো। কী আচানক কাণ্ড!
নয়ন তাকিয়ে আছে বিস্তৃত জলের ওপরে ভেসে থাকা ধানডগার দিকে। মৃদু ঢেউয়ে ধানের ডগাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের এই কম্পনেরও বুঝি কোনো নির্দিষ্ট ছন্দ রয়েছে। তারা একসাথে তাদের ডগা নুইয়ে প্রায় জল ছুঁইছুঁই হয়ে আবার মুহূর্তেই সাই করে দল বেঁধে উঠে যাচ্ছে। কী যে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! নয়ন সেদিক তাকিয়ে আনমনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। পাখির পালকের মতো ছুঁয়ে যাওয়া মোলায়েম হাওয়ায় তার মনটা কেমন উদাস হয়ে উঠল।
মনিরের অবশ্য সে বালাই নেই। সে নয়নের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে পানি দেখছেন ম্যাভাই, এই পানিতে কিন্তু মাছ নাই। পানির রঙ দেখলেই বলন যায়, সেই পানিতে মাছ আছে, না নাই। আপনে তো দাদাজানের সাথে কথাই বলেন না। দাদাজান আপনেরে যেই পছন্দ করেন, তার অর্ধেকও যদি আমারে করত, তাইলে দেখতেন, মাছ ধরনের কায়দা-কানুন সব আমি শিখ্যা ফালাইতাম। দাদাজান যে বয়সকালে কত মাছ ধরছে! শুনছি দাও বটি দিয়া। কোপাইয়া আইড় বোয়াল ধরত! কিন্তু তারে তো আমি বাঘের লাহান ভয় পাই। ম্যাভাই, এইবার কিন্তু দাদাজানের কাছেরতন মাছ ধরনের কিছু কায়দা-কানুন। জাইনা আমারে শিখাইবেন।
নয়ন কথা বলল না। সে খালপাড়ের উঁচু ঢিবি ধরে হাঁটা ধরল। দু’চারটি নৌকা পার হয়ে যেতেই সে দেখল একটি ছইওয়ালা নৌকার গলুইয়ে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন আব্দুল ফকির। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত সমর্থ দুই যুবক। নয়ন মুহূর্তের জন্য যেন থমকে দাঁড়াল। তারপর পা বাড়িয়ে আবার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে চাইল। কিন্তু পেছন থেকে তার বাহু চেপে ধরল মনির। তারপর ফিসফিস করে বলল, ফইর সাব ভারে বইছে।
নয়ন বলল, ভারে বসা মানে কী?
মনির দ্বিরুক্তি করল, ধ্যান ধ্যান। ফইর সাব ধ্যানে বইছে। ধ্যানে বসলে উনার সাথে জিন-পরীদের কন্টাক হয়। আগাম অনেক খবর জানতে পারেন।
নয়ন আব্দুল ফকিরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তিনি মুদ্রিত চোখে স্থির বসে আছেন। তার গলায় এখনও ঝুলে আছে সেই গোখরা সাপ। ধীরে ধীরে তার নৌকার সামনে মানুষ জমছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক দু’জন নৌকা থেকে নেমে এসে দুই পাশে হাত প্রসারিত করে খানিকটা জায়গা। নিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে স্কুল মাঠের জটলায় ওষুধ বিক্রি করে জুলফিকার আর তার সাথের সেই বীণ বাজানো কিশোর ছেলেটিও চলে এসেছে। তাদের সাথে দুজন মাল বহনকারী মুটে। মুটে দুজনের মাথায় বাদবাকি সাপের বাক্স আর নানা জিনিসপত্র। তারা সে সকল নৌকায় তুলে দিয়ে ফিরে গেল।
ততক্ষণে অবশ্য আব্দুল ফকিরের নাও ঘিরে ভিড় বেড়েছে। সন্ধ্যা নামতে খুব একটা বাকি নেই। পশ্চিমাকাশে অস্তগামী সূর্যের লাল টুকটুকে আভায় রঙিন হয়ে ওঠা মেঘ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে নয়ন বলল, উনি এখন কী করবেন রে মনির?
মনির বলল, উনি এখন কিছুই করব না। তয় লোকজন উনার কাছে এখন। নানান অসুখ-বিসুখের দাওয়াই চাইব। ভবিষ্যতের বিপদ আপদ জানতে চাইব। কারো মাইয়ার বিয়া হয় না, কারো পোলা ঘুমের মইধ্যে বিছানায় মোতে, কারো ছেলে সন্তান হয় না, এইসব দাওয়াই চাইব।
নয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে ধ্যানমগ্ন আব্দুল ফকিরের দিকে তাকাল। তারপাশে দাঁড়িয়ে আছে জুলফিকার। জুলফিকার আব্দুল ফকিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আব্দুল ফকির চোখ মেলে তাকালেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই এত এত মানুষের মধ্যেও আব্দুল ফকির চোখ মেলে সোজা তাকালেন অনেকটাই দূরে খালপাড়ের উঁচু ঢিবির উপরে দাঁড়ানো নয়নের দিকে। তারপর চমৎকার ভঙ্গিতে হেসে হাত ইশারায় নয়নকে ডাকলেন। নয়ন কিছু সময়ের জন্য বুঝতে পারল না, তিনি কি আসলেই তাকে ডাকছেন কিনা, নাকি সে ভুল বুঝছে! কিন্তু সে লক্ষ করে দেখল উপস্থিত সকলেই তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। নয়ন অবশ্য তারপরও দাঁড়িয়ে রইল। সে আসলে খানিক বিভ্রান্তি বোধ করছে। কিন্তু মনির চাপা উচ্ছ্বাস আর কিছুটা ভয়মিশ্রিত গলায় বলল, ম্যাভাই, ফইরসাবে আপনেরে ডাকে।
নয়ন মৃদুকণ্ঠে বলল, আমাকে কেন ডাকবে?
মনির বলল, চলেন গিয়া শুনি। সেই দিন তো আর আপনের সাথে ফইর সাবের কথাবার্তা হইল না। এত বড় একটা উপকার করল আপনের। আপনের
জান বাঁচাইল, তার সাথে আপনে একটা কথাও বললেন না।
নয়ন বিড়বিড় করে বলল, তা অবশ্য ঠিক।
মনির নয়নের হাত ধরে বার দুই টানল। কিন্তু নয়ন কী ভেবে তখন অনড় দাঁড়িয়ে রইল। মনির বলল, ম্যাভাই লন, লন। গিয়া দেখি ফইরসাবে কী কয়? আরেকখান কথা ম্যাভাই, ফইরসাবেও কিন্তু জানে, কোন বিলে মাছ বেশি, গাঙেও কোন কোন জায়গায় মাছ থাকে বেশি, এইটা ফইর সাব পানির মধ্যে চাইলেই এক্কেবারে পষ্ট দেখতে পায়। আপনে কিন্তু এই সুযোগে একটু জিগাইবেন ম্যাভাই।
নয়ন কোনো কথা বলল না। সে তাকিয়ে আছে উঁচু ঢিবি থেকে নিচে খালের দিকে নেমে যাওয়া ঢালের দিকে। জুলফিকার ঢাল ধরে উঠে আসছে। সে তাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তারপর গলার স্বর যতটা সম্ভব নরম করে বলল, আসোলামু আলাইকুম। আপনে ফতেহপুরের খায়গো বাড়ির তৈয়ব উদ্দিন খাঁর নাতি না?
নয়ন মাথা ঝাঁকাল, হ্যাঁ।
জুলফিকার এবার বিগলিত গলায় বলল, কী ভাগ্য দেখেন, আপনের সাথে আপনের নানাজানের বাড়িত বইসা কথা বলনের সুযোগ হইল না, আর এই এত দূরের পথে আইসা কথা বলনের সুযোগ হইল। এরেই কয়, ভাগ্যে থাকলে জুইট্যা যায়, না থাকলে খুইট্যা খায়।
নয়ন কোনো জবাব দিলো না। জুলফিকারই বলল, ফইর সাব আপনের সাথে একটু আলাপ করতে চান। তার বাও পায়ে সমস্যা, পাও কাটা পড়ছিল। এইজন্য ঢাল বাইয়া উঠতে পারে না। না হইলে সে নিজে নিজেই হাইট্যা আসত আপনের কাছে।
নয়ন যেন এবার কিছুটা বিব্রত হলো। সে বলল, না না, ঠিক আছে। আমিই আসছি।
মনিরের হাত ধরে সতর্কভঙ্গিতে ঢাল বেয়ে নিচে নামল নয়ন। মানুষের শোরগোল, ভিড় আরো বেড়েছে। সকলেই আব্দুল ফকিরের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু আব্দুল ফকির ততক্ষণে নৌকার ছইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছেন। নয়ন। আর মুনিরকে নিয়ে নৌকায় উঠল জুলফিকার। বড় নৌকা। নৌকার ভেতর সাপের বিষ নামানোর, খেলা দেখানোর, সাপ রাখার নানান জিনিসপত্র। নয়নকে নৌকার ভেতর নিয়ে গিয়ে আব্দুল ফকিরের কাছে বসিয়ে দিলো জুলফিকার। আব্দুল ফকির নয়নকে দেখে পরিস্কার গলায় সালাম দিয়ে বললেন, আপনে এখন কেমন আছেন বাজান?
নয়ন মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জ্বি ভালো।
আব্দুল ফকির বললেন, আপনের কথা বহু শুনছি। আপনে খাঁ-বাড়ির নাতি। বিরাট ডাক্তার। এই অঞ্চলে এখন দূর-দূরান্ত থেইকা অনেক ডাক্তারই আসে। কিন্তু আমাগো নিজেগো কোনো ডাক্তার নাই। আপনের কথা শুইনা পরান জুড়াই গেছিল বাজান। আপনেরে দেখনের বহু শখ আছিল। সেই শখও মিটল। কিন্তু তহন তো আপনে আর আপনে আছিলেন না। জমে মানুষে টানাটানি। আপনের সাথে কথাবার্তা তো আর হইল না। আল্লাহর কি কুদরত, আইজ, এইহানে আপনের সাথে কথা বলনের সুযোগ আল্লাহতালা কইরা দিলেন।
আব্দুল ফকির হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার হাতের মুঠোয় নয়নের হাত চেপে ধরলেন। আব্দুল ফকিরের শক্ত খসখসে হাতের স্পর্শে নয়নের সারা শরীর কেমন শিরশির করে উঠল! শরীর জুড়ে অচেনা, অদ্ভুত এক অব্যাখ্যেয় অনুভূতি! সে আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিল। আব্দুল ফকির বললেন, তা বাজান, আপনেরা কি এইখানে ফতেহপুর থেইক্যা নিজেগো নাও লইয়া আইছেন? না খ্যাপের নাওয়ে আইছেন?
ছইয়ের বাইরে নাওয়ের গলুইয়ের পাটাতনে দাঁড়ানো মনির জবাব দিলো, না ফইর সাব। আমরা বাড়িতে কাউরে বইলা আসি নাই। হাটবার তো ফতেহপুরতন অনেক মানুষ মিল্যা ট্রলার ভাড়া কইর্যা আসে। আমরা সেই ভাড়ার ট্রলারেই আসছি।
মনিরের কথা শুনে আব্দুল ফকির যেন স্বস্তি পেলেন। তিনি নয়নের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তাইলে আর কি! আমাগো নাওখানও তো হোসনাবাদ যাইব। ফতেহপুরের উপর দিয়াই হোসনাবাদ যাইতে হয়। আমাগো নাওয়েই চলেন, আপনাগো ফতেহপুর নামাই দিয়া যাব।
নয়ন কিছু বলার আগেই মনির উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, খুবই ভালো হয় ফইর সাব। খুবই ভালো হয়।
জুলফিকার মাথা নিচু করে ছইয়ের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, নাও তো ছাইড়াই দিছি কাকু, লোকজনের যে ভিড় বাড়ছিল, সামলানোই দায় হইয়া গেছিল।
আব্দুল ফকির মৃদু হাসলেন। তারপর নয়নকে বললেন, বাজান, নাও তো ছাইড়াই দিছে, আপনের অসুবিধা নাই তো?
নয়ন কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার একধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু সে মাথা নাড়িয়ে বলল, না, অসুবিধার কী আছে!
নাও বিলকুড়ানির হাট ছাড়িয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। ফুরফুরে হাওয়ায় বড় পাল তুলে দেওয়া হয়েছে। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। নৌকার দুইপাশে ধবধবে সাদা কবুতরের মতো শাপলা ফুল ফুটে আছে। নয়নের পাশেই ছইয়ের গায়ে খোপ কেটে একখানা ছোট জানালাও বসানো হয়েছে। সেই জানালায় তাকিয়ে নয়ন বলল, আমি কি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারি?
আব্দুল ফকির আবারো বিগলিত গলায় বললেন, জ্বে বাজান, জ্বে। মনে করেন এইটা আপনের নিজের নাও। আপনের যা মন চায় করতে পারেন।
নয়ন আর কিছু বলল না। সে উঠে নৌকার গলুইয়ে এসে দাঁড়াল। ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে, তবে এখনো তেমন গাঢ় হয়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ছেয়ে যাবে রাতের আকাশ। আজ কি অমাবশ্যা? নয়ন এইসব চাঁদ-তারার হিসেব জানে না। কিন্তু তার কেন যেন মনে হলো আজ অমাবশ্যা। নৌকার ছাদে সেই দুইজন যুবক আর জুলফিকারের সাথে বসে রয়েছে মনির। তাদের মধ্যে কোনো এক বিষয়ে আড্ডা জমে উঠেছে। নয়ন কান পেতে খানিক শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পারল না। তবে অস্পষ্টভাবে হলেও যে দুয়েকটি কথা কানে ভেসে এসেছে, তা শুনেই নয়ন বুঝতে পারল মনির এখানেও তার মাছ-সংক্রান্ত কোনো গল্প নিয়ে দারুণ উত্তেজিত।
কতক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল নয়ন জানে না। এই এতক্ষণ ধরে কী ভেবেছে, তাও জানে না। তবে তার ভাবনাগুলো আজকাল যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে, দেখতে শুনতে বেশ বড়সড় রঙিন, কিন্তু ধরতে গেলেই কেমন মিইয়ে যায়। নয়ন খানিকটা ঝুঁকে বাঁ পাশে তাকাল, কিন্তু বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না এখন আর। এরমধ্যেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। সে মাথা নিচু করে গলুইয়ের ভেতর ঢুকতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে সে ধাক্কা খেল কিছু একটার সাথে। তার শরীরের ধাক্কায় অন্ধকারে কিছু একটা সশব্দে ছিটকে পড়ল নৌকার মেঝেতে।
নয়ন প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মোবাইল ফোন বের করে আলো জ্বালল সে। তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল আব্দুল ফকির। ফলে নয়ন আচমকা ঘুরতেই তার শরীরের ধাক্কায় পেছনে দাঁড়ানো আব্দুল ফকির তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়েছেন নৌকার পাটাতনে। নয়ন তটস্ত ভঙ্গিতে আব্দুল ফকিরকে গিয়ে ধরল। আব্দুল ফকির অবশ্য তেমন অস্থির হলেন না। তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসলেন। তারপর বললেন, বাম পাওখানে তেমন বল পাই না। হাত-পায়ের বল থাকে হাত-পায়ের আঙুলে। হাত-পায়ে যদি আঙুল না থাকে, তাইলে বলও থাকে না। তার ওপর বয়সও হইছে। সারাজীবন দৌড়-ঝাঁপ কইরা বুড়া বয়সে আইসা শরীর হইছে। পলকা কাঠির লাহান। হালকা হাওয়া বইলেও লড়েচড়ে।
নয়ন বলল, আপনার পায়ে আঙুল নেই?
আব্দুল ফকির বললেন, ডাইন পায়ে আছে, বাম পায়ে নাই।
নয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আব্দুল ফকির মাথার ওপরে মৃদু আলোতে জ্বলতে থাকা হারিকেনটির আলো আরো খানিক বাড়ালেন। তারপর হারিকেনের লালচে আলোয় তার বাম পায়ের নাগড়া মতো জুতোখানা খুলে ফেললেন। নয়ন এতক্ষণ খেয়াল করেনি, আব্দুল ফকিরের বাঁ পায়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশই নেই। পায়ের সামনের দিকটা বীভৎসরকম আকার নিয়ে যেন ওঁৎ পেতে আছে। সে ডাক্তার, কিন্তু তারপরও আব্দুল ফকিরের পায়ের এই বহু আগের পুরনো শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতখানা দেখেও তার কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল। সেই অস্বস্তির ভেতর কি কিছুটা ভয়ও রয়েছে? নয়ন মুহূর্তের জন্য ভাবল।
হতে পারে এই বিশেষ মুহূর্তের এমন গা ছমছমে পরিবেশ এর জন্য দায়ী। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, জনমানবহীন এক বিলের জলে অমাবশ্যার ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে হারিকেনের আলোয় সে নৌকায় বসে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর সাপুড়ের সাথে। যার নৌকা ভর্তি জ্যান্ত সব সাপ। এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়াটা দোষের কিছু নয়।
নয়ন যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, কী হয়েছিল আপনার পায়ে? দেখে মনে হচ্ছে কেটে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু চেষ্টা সফল হয়নি। তবে মারাত্মক জখম অবস্থায় পায়ে পচন ধরেছিল। শেষে চিকিৎসায় ভালো হলেও এই বীভৎস অবস্থা আর এড়ানো যায়নি!
আব্দুল ফকির জবাব দিলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসলেন। নয়ন এই প্রথম আবিষ্কার করল, আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ সহজ এই মানুষটির ভেতরে যেন পুরোপুরি ধরতে না পারা ভয়ঙ্কর কিছু একটা লুকিয়ে রয়েছে! সেই পুরোপুরি ধরতে না পারা ভয়ঙ্কর কিছু একটা তার আশেপাশের মানুষদের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে প্রবল অস্বস্তি তৈরি করে। তৈরি করে আতঙ্কও। হয়তো সে কারণেই আব্দুল ফকিরের এই খুব সহজ সাধারণ নিরীহ দর্শন হাসিতেও নয়নের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে আব্দুল ফকিরের হাস্যময় চিমসানো মুখ আর জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল। তার বুকের ভেতরটা কেমন হিম হয়ে এলো।
আব্দুল ফকির আপাতদৃষ্টিতে দেখতে ভীতিকর কেউ নন। খুবই সাদাসিধে চেহারার গ্রামীণ মানুষ। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। থুতনিতে সামান্য দাড়ি। পান খাওয়া মুখে লালচে কালো ক্ষয়িষ্ণু দাঁত। শরীরটিও তেমন হৃষ্টপুষ্ট নয়। অতি সাধারণ চেহারার স্বাভাবিক এক মানুষ। কিন্তু এই অতি সাধারণ চেহারার আড়ালেই কোথায় যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা রয়েছে। সেই অস্বাভাবিক কিছু একটা অন্যদের কাছে তাকে আলাদা করে তোলে।
আব্দুল ফকির তখনও হাসছিলেন। নয়ন একদৃষ্টিতে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, আব্দুল ফকিরের হাসির সাথে সাথেই বা শেষ হতে না হতেই বুঝি ভয়ঙ্কর কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটবে। গা ছমছমে এক অনুভূতি নিয়ে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আব্দুল ফকির হঠাৎ নয়নের কাছে সরে এসে বসলেন, তারপর বললেন, ঠিক ধরছেন বাজান, একদম ঠিক। এই পাওখান একজন কোপ দিয়া কাইট্টা ফালাইছিল। সে চাইছিল রাইতের আন্ধারে আব্দুল ফইরের কল্লাখান কাইট্টা ফেলতে। একবার পারে নাই। আবার চেষ্টা করছে। আবারও পারে নাই। নাকি পারছিলও? লোকে অবশ্য বলে যে পারছিল। আব্দুল ফইরের কল্লা কাইট্যাও ফালাইছিল। কিন্তু রাইতের আন্ধারে যে আব্দুল ফইরের কল্লা সে কাটছে, দিনের বেলায় লোকজন দেখল সেই আব্দুল ফইরের শইলের ওপর কল্লাও আছে, কার ওপরে মাথাও আছে। কল্লা মাথা লইয়া আব্দুল ফইর ঠিকঠিক ঘুইর্যা বেরাইতেছে।
আব্দুল ফকির আবারও ফাঁসফেঁসে গলায় সেই লোমহর্ষক শব্দ তুলে হাসলেন। নয়নের প্রবল অস্বস্তি হচ্ছে। তার শরীর ক্রমশই আরো হিম হয়ে আসছে। অদ্ভুত অবর্ণনীয় এক অনুভূতি তাকে ক্রমাগত আরো প্রবলভাবে গ্রাস করে ফেলছে। তার মনে হচ্ছে, এই অন্ধকারে তার চারপাশের অচেনা-অজানা অসংখ্য ভয়ঙ্কর প্রাণী ওঁৎ পেতে আছে। মুহূর্তের মধ্যে তারা দল বেঁধে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সে নড়তে পারবে না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার শরীর ভার হয়ে আসছে। নিজের শরীরটাকে মনে হচ্ছে কোনো বিশাল পর্বতের নিথর শরীর। এই শরীর নিয়ে সামান্য নড়াচড়ার ক্ষমতাও তার নেই। আব্দুল ফকির নয়নের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলেন। তার মুখের বোটকা গন্ধে নয়নের পেট গুলিয়ে উঠল। সে ঝট করে বাঁ দিকে তার মুখ সরিয়ে নিল।
আব্দুল ফকির আবারো ফাঁসাস করে হাসলেন। তারপর গায়ে কাঁটা দেয়া হিম কণ্ঠে বললেন, রাইতে ঘুমের ঘোরে আব্দুল ফইরের কল্লা রাম দাওয়ের এক কোপে আলাদা কইরা ফালানো হইল। শুধু যে আলাদা কইরাই ফালানো হইছিল, তা-ই না। সেই কল্লা রাইতের আন্ধারে লইয়াও যাওয়া হইছিল। কিন্তু বেয়ান বেলা সকলে দেখল আব্দুল ফইর শইলের উপর কল্লা আর মাথা লইয়া ঘুরতাছে। হা হা হা। হা হা হা। কী বাজান, ঘটনা শুইনা কি বুঝতাছেন? ঘটনায় কোনো প্যাঁচগোছ আছে? আছে কোনো প্যাঁচগোছ?
নয়ন পিছলে তার শরীর খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিয়ে গেল। একদম নৌকার ছইয়ের বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে নিলো তার পিঠ। আব্দুল ফকির যেন আগুনের গোলার মতো ধকধকে চোখ মেলে তাকালেন। তারপর বললেন, ভয় পাইলেননি বাজান? ভয় পাইলেন? কী ভাবতেছেন, আমার কল্লার ওপরে এই মাথাটা আসল কিনা? কল্লায় রাম দাওয়ের দাগ আছে কিনা? নাকি ভাবতেছেন সকলই চৌক্ষের ভুল। ভুল দেখতেছেন? নেন নেন, হাত দিয়া দেখেন, এই কল্লা। আর এই মাথা আসল। একদম আসল।
আব্দুল ফকির আবার থামলেন। তারপর বললেন, ভয়ের কিছু নাই বাজান। আসল ঘটনা অন্য। এই ঘটনা সকলেই জানে, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস। করতে চায় না। তারা ভাবে এই ঘটনায় আব্দুল ফইরের কোনো জাদু টোনা আছে। হে হে হে। আব্দুল ফইর তো নিজের জাদু টোনার ক্ষমতার কথা নিজে বলে না, বলে মাইনষে। মাইনষেই ছড়ায় বেশি। মাইনষের মুখে জয়, মাইনষের মুখেই ক্ষয়।
আব্দুল ফকির কথার ফাঁকে ফাঁকে থামছেন। থেমে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকছেন নয়নের দিকে। সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছেন তার কথা নয়নের ওপর কেমন প্রভাব বিস্তার করছে। নয়ন একধরনের তীব্র আতঙ্ক বোধ করছে। কিন্তু সেই আতঙ্কের ভেতর থেকেও তার মনে হচ্ছে সে আব্দুল ফকিরের বাকি গল্পগুলোও শুনুক। কথাগুলো শুনুক।
আব্দুল ফকির কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, সেইদিন ঘটনা কী হইছিল আপনারে বলি শোনেন। সেইদিন আসলে ঘটনাচক্রে মাঝরাইতে আমার বাড়িতে গিয়া হাজির হইছিল আপনেগো ফতেহপুরেরই বজলু ব্যাপারী। গরমকাল। আমি আবার গরম সইতে পারি না। ঘরের সামনেই একখান ছোট দোচালা ঘর আছিল। চাইরদিকে খোলা। হুড়মুড় কইরা বাতাস আইতো। সেই ঘরেই আমি ঘুমাইতাম। সেই দিন বজলু ব্যাপারী আইল অনেক রাইতে। তার সাথেই ঘুমাইলাম। কিন্তু শেষ রাইতে আইল বিষ্টি। বিষ্টির ছাটে ভিজ্যা যাওনের দশা। আমার আবার ঠান্ডার ধাত। বজলু ব্যাপারীরে কয়েকবার ডাকলাম। সে শুনল না। ঠান্ডা আর বিষ্টি পাইয়া আরামের ঘুম। তাই বিষ্টিতে যেন না ভেজে, তাই পাটির এক পাশ উঠাইয়া তার গায়ে দিয়া আমি ঘরে চইলা গেলাম।
আব্দুল ফকির একজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বলছেন। মানুষটিকে কীভাবে খুন করা হয়েছিল সেই ঘটনা বলছেন। যেই খুনটি তিনি নিজেও হতে পারতেন। অথচ সেই বীভৎস খুনের ঘটনা বলতে গিয়ে তার চোখে মুখে চাপা আনন্দ! তিনি সামান্য থেমে চাপা গলায় বললেন, খুনি শেষরাইতের আন্ধারে আর তাড়াহুড়ায়, আমারে ভাইবা তারে জাইত্যা ধইরা খুন করছে। তার কল্লা কাইট্যা লইয়া গেছে। খুনি তো আর জানে নাই, ওই বিছনায় আমি নাই, আছে বজলু ব্যাপারী। হে হে হে। সবাই ভাবল আব্দুল ফইরের কেরামতি! আপনের কী মনে হয় বাজান, ঘটনায় আব্দুল ফইরের কেরামতি কি কিছু আছিল, না আছিল না?
নয়ন ভয় পাচ্ছে। প্রবল ভয়। সে যুক্তিবাদী আধুনিক মানুষ। আব্দুল ফকিরের এইসব ঘটনায় তার ভয় পাওয়ার কথা না। বরং এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার কথা। কিন্তু সে কিছুই পারছে না। তার সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আব্দুল ফকির বলল, কি ডাক্তার বাজান, পাইলেননি কিছু খুঁইজা? সেই রাইতে বজলু ব্যাপারীই কেন আমার বাড়িত যাইব? সে তো আগে আর কোনোদিন আমার বাড়িত যায় নাই। তাইলে ওইদিনই কেন গেল? বুঝলেন কিছু বাজান? কিছু বুঝলেন?
নয়ন ধাতস্ত হবার চেষ্টা করছে। সে একটা বিষয় আবিষ্কার করেছে, সেটি হচ্ছে আব্দুল ফকিরের কথা বলার ধরনটিই আসলে ভীতিকর। তিনি যেই ঘটনা বলছেন, তা অন্য কেউ বললে হয়তো এমন ভীতিকর মনে হতো না। একই কথা নানানভাবে বলা যায়। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার এক সহজাত ক্ষমতা আব্দুল ফকিরের রয়েছে। সেই ক্ষমতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে তার কথা, তার কণ্ঠ, তার হাসি আর তার কথা বলার ধরন। তার চেয়েও বড় কথা সেই কথা বলার জন্য তিনি সব সময় উপযুক্ত পরিবেশ খোঁজেন। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে তিনি তার এই ভয়ের খেলা খেলেন না। নয়ন এখন নিশ্চিত, তাকে বাজারের সেই জটলার ভেতরই আব্দুল ফকির দেখেছিলেন, এবং তিনি আন্দাজ করে নিয়েছিলেন যে সন্ধ্যার আগেই নয়নকে বাড়ির ফেরার জন্য নৌকার ঘাটে যেতে হবে। আর সে কারণেই আব্দুল ফকির আগেভাগেই সেখানে চলে গিয়েছিলেন। এবং তার পরিকল্পনামাফিকই তিনি নয়নকে নৌকায় তুলেছেন। কিন্তু কেন? আব্দুল ফকিরের উদ্দেশ্য কী?
নয়ন হঠাৎ বলল, আপনি মানুষকে ভয় দেখাতে খুব পছন্দ করেন, না?
আব্দুল ফকির হা হা হা করে হাসলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন, ভয়? মানুষরে কি চাইলেই ভয় দেখান যায়? আপনে পারবেন? পারবেন মানুষরে ইচ্ছা মতো ভয় দেখাইতে? আর আমি মানুষরে ভয় দেখামু কেন বাজান? ভয় দেখাইয়া আমার লাভ কী?
নয়ন বলল, ভয় দেখানোর অনেক লাভ আছে। মানুষ যা কিছু ভয় পায়, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘাটায় না। মানুষ যেই বিষয়কে ভয় পায়, সে সেই বিষয়কে সহজে মেনে নেয় বা এড়িয়ে চলে। আপনিও চান, মানুষ আপনাকে খুব সহজে মেনে নিক। আর যারা না মানবে তারা আপনাকে না ঘাটাক। আপনার কাজকর্মে বাধা না দিক। আবার সবাই আপনাকে সম্মান করুক, সমীহ করুক। আপনার প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা তৈরি হোক। মানুষের ওপর আপনার খুব প্রভাব থাকুক। এতে আপনার অনেক লাভ। আপনি এতে অনেক বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন।
নয়ন থামল। সে আবিষ্কার করল, তার ভয় কাটছে। সে সময় নিয়ে বলল, এই জগতে মানুষ এই যে এত অর্থের পেছনে ছুটছে, যুদ্ধ করছে, আবিষ্কার করছে, এই যে এত কিছু করছে, এর পেছনে কারণ কি জানেন?
আব্দুল ফকির জবাব দিলেন না। তবে নয়নের হঠাৎ বদলে যাওয়া আচরণে তিনি খানিক বিস্মিত হয়েছেন। নয়ন বলল, এই সবকিছুর পেছনে কারণ একটাই, আর সেটি হলো, ক্ষমতা, প্রভাব, কর্তৃত্ব। পৃথিবীতে সবাই ক্ষমতা চায়। কারণ মানুষ জানে ক্ষমতা পেলে সে আর সব কিছুই পাবে। পৃথিবীতে ক্ষমতার চেয়ে অধিক আনন্দের কিছু নাই।
আব্দুল ফকির হাসলেন। মৃদু হাসি। তারপর বললেন, আপনে বলতেছেন সেই দিন সেই রাইতে বজলু ব্যাপারী এমনে এমনেই আমার বাড়িতে গেছিল? আমার কোনো ক্ষমতা সেইখানে আছিল না?
নয়ন মৃদু গলায় বলল, হয়তো ছিল। কিন্তু সেটা জাদু টোনা বা ভূত প্রেতের কিছু না। হয়তো কোনো কারণে আপনি তাকে খবর দিয়ে বা অন্য কোনো কারণে তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আপনার ক্ষমতা বলতে ওইটুকুই। এমনও হতে পারে, সে নিজেই কোনো কারণে গিয়েছিল।
আব্দুল ফকির বললেন, দুনিয়াতে আল্লাহতালা দুই ধরনের মানুষ তৈয়ার করছেন। এক ধরনের মানুষ দেখে চামড়ার চোউক্ষে। আরেক ধরনের মানুষ চামড়ার চক্ষু ছাড়াও আরেক চৌক্ষে দেখে। সেই চৌক্ষের নাম গায়েবী চৌখ। অন্তরচক্ষু। এই চৌক্ষু সকলের থাকে না। অল্প কয়েকজনের থাকে। এইজইন্য বেশিরভাগ মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু এই চৌখটাই আসল বাজান। ওইটাই আসল। দুম কইরা অবিশ্বাস কইরা বইসেন না। অবিশ্বাসে বিপদ ঘটে। মহাবিপদ।
আব্দুল ফকির শেষের শব্দ ক’টি বলার সময় ঠিক সাপের মতো হিসহিস করে শব্দ করলেন। সেই শব্দে যে কারো রক্ত জল হয়ে যেতে বাধ্য। নয়নেরও হলো। সে আবারো গুটিয়ে গেল। আব্দুল ফকির বললেন, শুনছি, ডাক্তাররা নাকি বিশ্বাস করে না যে, গাঁও-গ্রামের ওঝারা সাপের বিষ নামাইতে পারে? আপনে তো ডাক্তার বাজান, আপনের কী মনে হয়, পারে?
নয়ন জবাব দিলো না। যেমন বসে ছিল তেমনই বসে রইল চুপ করে। আব্দুল ফকিরই আবার বললেন, হাজার হাজার বচ্ছর ধইরা এই দ্যাশে সাপের বিষ নামায় ওঝারা। সাপ বশ করে, এই যে আমার বাক্সের মইধ্যে এত্তগুলান সাপ, এইগুলান বশ না করলে এইভাবে রাখন সম্ভব? ধরা সম্ভব? সম্ভব না। তার উপর এই যে বীণের সুরে সুরে সাপ নাচে, এই বীণও কি যেই সেই বীণ? সব বীণেই কি সাপ নাচে? নাচে না। দুইপাতা ডাক্তারি পইড়াই আইজকাল সবাই বিদ্বান হইয়া যায়, সব জাইন্যা ফালায়। দুইন্যাতে মানুষ এক চিমটি নুনের থেইকাও কম জানে। আর না জানার পরিমাণ আসমানের তারার পরিমাণের চাইতেও বেশি। তারপরও মানুষ দুইপাতা বই পইড়াই হাজার হাজার বচ্ছরের নিয়ম-কানুনরে বলে ভুয়া, বুজরুকি! কী বেক্কেলই না এই মানুষ, কন তো বাজান?
নয়ন এবারও কোনো কথা বলল না। সে আব্দুল ফকিরকে বোঝার চেষ্টা করছে। আব্দুল ফকির আবার বললেন, কী বাজান, কথা বলেন না কেন? এই যে বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টি ধইরা এই সাপ ধইর্যা খাই, সবই কি তাইলে হারাম? মাইনষের চৌক্ষে ধুলা দিয়া খাই? মাইনষের জীবন বেইচ্যা খাই?
নয়ন এবার কথা বলল। সে বলল, না না, তা কেন? কিছু না কিছু তো আছেই।
আব্দুল ফকির এবার যেন দপ করে জ্বলে উঠলেন। বললেন, কিছু না কিছু মানে কী? কিছু না কিছু মানে কী?
নয়ন বলল, আসলে মন্ত্রটন্ত্রের বিষয়টা কিছুই না। কিছু যা আছে, তা হলো ট্রিকস, কৌশল।
আব্দুল ফকির হিসহিসে গলায় বললেন, টিরিকস? কৌশল? এখন এই বাক্সের মধ্যেরতন দুইটা গোক্ষুর সাপ ছাইড়া দেই? ছাইড়া দিয়া তখন দেখতে চাই, কী টিরিকসে আপনে সামলান!
নয়নের ভয় পাবার কথা ছিল, কিন্তু সে কেন যেন এবার আর ভয় পেল না। বরং বলল, আসলেই ট্রিক্স। এই যে আপনি বললেন সাপ বাঁশির শব্দের তালে তালে নাচে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, সাপ তো কানেই শোনে না। সে বাঁশির শব্দের তালে তালে নাচবে কী করে?
আব্দুল ফকির খপ করে নয়নের হাত ধরলেন। তার শক্ত মুঠোর মধ্যে নয়নের ডান হাতের কব্জি। নয়ন বারকয়েক সেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার হঠাৎ মনে হলো, এই পলকা বৃদ্ধ শরীরের আড়ালেও আসলে অন্য একটা মানুষ রয়েছে। অন্য একটা আঙ্গুল ফকির। সেই মানুষটা শক্ত, কঠিন, শক্তিশালী। কিন্তু মানুষ সেই মানুষটাকে দেখতে পায় না, তারা দেখে দুর্বল, বৃদ্ধ, ন্যুজ এক আব্দুল ফকিরকে।
আব্দুল ফকির বললেন, তাইলে স্কুলের মাঠে গোক্ষুর সাপখান এমনে এমনেই নাচল? এমনে এমনেই?
নয়ন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তারপরও সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, নাহ্, এমনি এমনিই নাচে নাই। এইটা সাপুড়েদের খুব পুরনো ট্রিকস। সাপ কানে শোনে না। সে বাঁশির শব্দ শুনবে কী করে? আসলে যেটি হয়, সেটি হচ্ছে সাপুড়েরা বাঁশি বাজানোর আগে সাপের মুখে নানানভাবে আঘাত করে। মাটিতে আঘাত করে। এতে সাপের শরীরে এবং মাটিতে যে কাঁপুনি তৈরি হয়, সাপ তাতে সতর্ক হয়ে যায়, সাপের অনুভূতি তাতে সজাগ হয়ে যায়। তখন যিনি বীণ বাজান, তিনি সাপের চোখের কাছে বীণ নিয়ে গিয়ে নানাভাবে দুলে দুলে বীণ নাড়াতে থাকেন। এই বীণ নাড়ানোর কারণে সাপও নড়তে থাকে। সে বীণ নাড়ানোর তালে তালে নিজের মাথা নাড়াতে থাকে। চোখের সামনে দুলুনি দেখেই সাপ মূলত তখন নিজের মাথা দোলায়। সাপুড়েরা এটাকেই বীণ শুনে সাপ নাচছে বলে প্রচার করে। আর বিষয়টি গল্প, উপন্যাস, সিনেমার জন্য খুবই আকর্ষণীয়। এই কারণেই এইসবেও বিষয়টা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আর দিনে দিনে মানুষের বিশ্বাসকে আরো পাকাঁপোক্ত করে তোলে।
আব্দুল ফকির হাসলেন, তারপর খুব সতর্ক চোখে নয়নের দিকে তাকালেন। তাকিয়েই থাকলেন। তারপর বললেন, একখান কথা শোনেন বাজান, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। বিশ্বাস না করলে এই জগতের সকলই মিছা, আর বিশ্বাস করলে সকলই হাছা। এই যে আপনেরে সাপে কাটল। আপনে তো আর টের পান নাই। টের পাইছে খাঁ-বাড়ির লোকজন। তারা জানে আপনের অবস্থা কী হইছিল। আপনে তো একপ্রকার মারাই গেছিলেন। কিন্তু মাত্র দুইখান ঢোলের বাড়িতে আব্দুল ফইর আপনেরে সুস্থ কইরা তুলছে। শত শত মানুষে দেখছে, সেইটারে আপনে কী বলবেন? আপনেরে সেই মৃত্যু থেইক্যা যেই মানুষটা বাঁচাই তুলল, তারে আপনে অবিশ্বাস করেন? তার ক্ষমতারে আপনে অবিশ্বাস করেন? বলেন টিরিকস?
নয়ন এবার খুব দৃঢ় কিন্তু ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো, ফকিরসাব, আপনার কী মনে হয়, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন?
নয়নের এই ছোট্ট প্রশ্ন এবং প্রশ্ন করার ধরনে আব্দুল ফকির যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। সেদিন খাঁ-বাড়ির উঠানে নয়ন যখন ঢোলের বাড়ি শুনে জেগে উঠেছিল, সেইদিন সেই মুহূর্তে নয়নকে দেখে আব্দুল ফকিরের চোখে যে বিভ্রান্তি, দ্বিধা এবং বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, আজ এই মুহূর্তেও সেই একই বিভ্রান্তি আর দ্বিধা ফুটে উঠল। তবে সেটি তিনি তার গলায় উঠে আসতে দিলেন না। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমি বাঁচানোর কেউ না বাজান। জান বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। আমি আব্দুল ফইর উছিলা মাত্র।
নয়ন এবার হাসল। বলল, আমার সেইদিন কী হয়েছিল ফকির সাব? আপনি আমাকে কী থেকে বাঁচিয়েছিলেন?
আব্দুল ফকির এবার যেন পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আপনে কি সুস্থ বাজান? নাকি অসুস্থ? আপনেরে যে কালনাগিনে কাটছিল, আপনের নানাজান যে সেই রাইতে আমারে আনতে পাঠাইছিল। আমি আসলাম বেয়ানবেলা। আপনে কিছুই জানেন না বাজান? নাকি সব ভুইলা গেছেন?
নয়ন এবার স্থির দৃঢ় গলায় বলল, আমি সবই জানি ফকির সাব। আমার ধারণা আপনিও সবই জানেন। কিন্তু না জানার ভান ধরে বসে আছেন। আপনি শুনতে চাচ্ছেন আমার মুখ থেকে। তাই না?
আব্দুল ফকিরের চোখে-মুখে মুহূর্তের জন্য যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, তিনি বললেন, বলেন বাজান, আপনে কী জানেন, বলেন।
নয়ন এবার মৃদু হাসল। সে ধীরে ধীরে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। সে খানকিটা সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, আমাকে তো সেদিন সাপে কাটে নাই ফকিরসাব। আপনি এতদিন ধরে সাপের বিষ নামান, সাপে কাঁটা রোগী নিয়ে কাজ করেন, এই ঘটনা তো আপনার না বোঝার কথা না!
আব্দুল ফকির সাথে সাথে জবাব দিলেন না। এ যেন মুখোমুখি যুদ্ধরত সাপ আর বেজী। মুহূর্তের অসতর্কতার মরণকামড় বসে যেতে পারে যে কারো শরীরে। আব্দুল ফকির খানিক সময় নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তাইলে, আপনের কী হইছিল সেইদিন বাজান?
নয়ন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে জুলফিকার হারিকেন নিয়ে ছইয়ের মুখে উঁকি দিলো। তারপর উঁচু গলায় বলল, ও কাকু, নাও তো ফতেহপুর ঘাটে চইল্যা আসছে। তারে তো নামাই দিতে হইব।
আব্দুল ফকির জুলফিকারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, নাও ভিড়া। নাও ভিড়াইয়া সাবধানে নামাই দে। আন্ধারে রাস্তাঘাটে আইজকাল সাপখোপের অভাব নাই। খুব সাবধান।
জুলফিকার আবার চলে গেল নৌকার গলুইয়ে। সে নামার জন্য সুবিধাজনক জায়গা দেখে নৌকা ভিড়ানোর ব্যবস্থা করছে। আব্দুল ফকির নয়নের চোখে চোখ রেখে বলল, বলেন বাজান, সেইদিন আপনের কী হইছিল?
নয়ন বলল, কেন? আপনি বোঝেননি?
আব্দুল ফকির এবার খানিক রুষ্ট হলেন। তিনি শক্ত গলায় বললেন, আমি যেইটা বুঝছি, সেইটা তো আর আপনের কাছে জানতে চাইতেছি না। আপনের কথা আপনে বলেন বাজান।
নয়ন হাসল। তারপর বলল, আপনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন ফকিরসাব। উত্তেজনা ব্যাপারটা আপনার সাথে মানায় না। আপনার মতো মানুষেরা সাধারণত উত্তেজিত হন না। কিন্তু যখন হন, তখন বুঝতে হবে, তারা হেরে যাচ্ছেন। আপনি হেরে যেতে পছন্দ করেন না, তাই না ফকিরসাব?
আব্দুল ফকির এবার আর জবাব দিলেন না। হারিকেনের তেল সম্ভবত শেষ হয়ে এসেছে বা জ্বলতে থাকা সলতে পুড়ে প্রায় নিঃশেষ হওয়ার পথে। যে কোনো কারণেই হোক, হারিকেনের আলো নিভে এসেছে। নৌকার ভেতরে ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। হয়তো স্পষ্ট আলো থাকলে নয়ন দেখতে পেত, আব্দুল ফকিরের কপালের শিরাগুলো দপদপ করে কাঁপছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।
নয়ন সেসব দেখল না, কিন্তু তারপরও সে স্পষ্ট গলায় বলল, আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার ফকির সাব। আপনাকে নিয়ে যে কত কিংবদন্তী গল্প আমি শুনেছি। আমার খুব জানার ইচ্ছা ছিল, সেইসব গল্পের কতটুকু সত্য, আর কতটুকু মিথ্যা। আপনি কতটুকু আসল, আর কতটুকু ভান? আপনার সাথে হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা হতে পারত, কিন্তু তাহলে তো আর আসল আব্দুল ফকিরকে আমি দেখতে পারতাম না। পারতাম বলেন?
আব্দুল ফকির এবারও কোনো কথা বললেন না। তবে তিনি সেই সাপের মতো ঠান্ডা চোখ মেলে নয়নের দিকে তাকিয়েই রইলেন। নয়নই আবার কথা বলল, আপনি তো জানেন, আমি ডাক্তার। সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে আমি সাড়ে সাত মিলিগ্রামের তিনখানা মিডাজোলাম ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। এগুলো উচ্চমাত্রার সিডাটিভ, মানে ঘুমের ওষুধ। এগুলো খেলে মানুষ টানা আট থেকে দশ ঘণ্টা মরার মতো ঘুমায়। আমিও ঘুমিয়েছিলাম। তার আগে খুব সাবধানে ব্লেড দিয়ে আমার হাতের আঙুলে সাপে কাটা আঘাতের মতো কতগুলো সরু আঁচড় কেটেছিলাম। তারপর চিৎকার করে সবাইকে বলেছিলাম আমাকে সাপে কেটেছে! সবাই ছুটেও এলো। তারা সারা বাড়িতে তন্নতন্ন করে সাপ খুঁজে বেড়ালো। আর ততক্ষণে আমি ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়েও পড়েছি। গভীর ঘুমে। অচেতন, যেন মৃত মানুষ। কিন্তু মৃদু শ্বাস বইছে। হাতে সাপে কাটার আঘাত। ওইসব মুহূর্তে অন্য কিছু আর কী-ই বা ভাবতে পারে মানুষ বলুন? তাছাড়া আপনি তো জানেনই, এইসময়ে এ অঞ্চলে সাপের কি উপদ্রুব!
নয়ন মুহূর্তের জন্য থামল। তার গলা শুকিয়ে এসেছিল। সে খানিক ঢোক গিলে আবার বলল, বিষয়টা খুব ছেলেমানুষি আমি জানি ফকির সাব। কিন্তু ছেলেমানুষি কে না করে? আপনি করেন না? আপনিও করেন। আমরা সকলেই করি। আমার হাতের আঁচড়ের চিহ্ন দেখে তো আপনার না বোঝার কথা না যে, ওগুলো সাপে কাটার দাগ নয়।
নৌকা খানিকটা দুলে উঠেছে। সম্ভবত ঘাটে ভিড়েছে। নয়ন বলল, ধরে। নিলাম সেই আবছা অন্ধকারে আপনি কেবল দাগ দেখেই ভেবে নিয়েছিলেন আমাকে সাপে কেটেছে। কিন্তু আপনি তো খুব ভালো করেই জানেন, বিষাক্ত সাপের দুটো দাঁতে বিষ থাকে। সে কাউকে আঘাত করলে তার সেই বিষদাঁত দুটো দিয়েই আঘাত করে। ফলে রোগীর শরীরে কেবল তার সেই বিষদাঁত দুটোর ছোবলের চিহ্নই থাকে। আর যেসব সাপ বিষাক্ত না, তারা কাউকে কাটলে, তারা রোগীর শরীরে একসারি দাঁত বসায়। পাশাপাশি এক সারি দাঁত। যারা সাপ সম্পর্কে সামান্য কিছুও জানেন, তারাও তাই এই সাপে কাটা দাগ দেখলেই বুঝতে পারেন, কোনটি বিষাক্ত সাপের ছোবল, আর কোনটি নির্বিষ সাপের ছোবল। আবছা অন্ধকারে না হয় আমার হাতের আঘাতের চিহ্ন দেখে আপনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আমাকে সাপেই কামড়েছে। কিন্তু আমার আঙুলে একসারি আঁচড়ের চিহ্ন ছিল। সেই চিহ্ন দেখে আপনার তো সহজেই বুঝে ফেলার কথা, সাপটা বিষাক্ত ছিল না।
নয়ন থামল। থেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, তাহলে? তাহলে তারপরও আমাকে বিষধর নাগিন কেটেছে বলে হৈচৈ শুরু করে দিলেন কেন? বিষ নামানোর অতসব আয়োজন কেন করলেন?
নয়ন ভেবেছিল তার কথা শুনে আব্দুল ফকির ক্ষেপে যাবেন, বা নিদেনপক্ষে অপ্রতিভ হবেন, কিন্তু আব্দুল ফকিরের চেহারায় তেমন কিছুই দেখা গেল না। তিনি বরং খুব সহজ-স্বাভাবিক গলায় বললেন, বাজান, আপনে বুদ্ধিমান মানুষ, লেখাপড়া জানা বড় ডাক্তার। আপনের বুদ্ধির সাথে কি আমাগো গাঁও-গ্রামের মানুষের বুদ্ধি কুলায়? কুলায় না। তয় একখান কথা, আপনেরে যে সাপে কাটে নাই, এই জিনিস আব্দুল ফইরের না বোঝনের কথা না। কিন্তু তাইলে ঘটনা কী?
নয়ন আব্দুল ফকিরের চোখে চোখ রেখে বলল, কী ঘটনা ফকির সাহেব?
আব্দুল ফকির গলা খাকাড়ি দিয়ে জমে থাকা শ্লেষ্ম পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন, সেই রাইতে আপনেরে কীভাবে সাপে কাটছে সেই ঘটনা পুরাটাই তো আমি নিজ কানে আপনের মামা খবির খাঁর মুখেই শুনছি। তাইলে? তাইলে আপনেরে যদি সাপে নাই কাটে, আপনে তাইলে অমন সাপ সাপ বইলা চিক্কর দিয়া ফিট হইয়া গেলেন কেন? রহস্য কী? আর ওই ঝড় বৃষ্টির রাইতে অতদূর থেইকা ওইরকম জরুরি খবর দিয়া আমারে আনানোর কারণটাই বা কী? এই রহস্যটা আমার খুব জাননের দরকার আছিল বাজান।
আব্দুল ফকির থামলেন। নয়ন কোনো কথা বলল না। সে প্রবল মনোযোগে আব্দুল ফকিরের কথা শুনছে। এ যেন কোনো রহস্যময় গল্পের শেষ পৃষ্ঠা। এক মুহূর্তের জন্যও মনোযোগ হারানো যাবে না। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আব্দুল ফকিরের চোখে। আব্দুল ফকির খানিক দম নিয়ে বললেন, আমি জানতাম, আপনের আর যাই হউক, সাপে আপনেরে কাটে নাই। কিন্তু আব্দুল ফইর তো এই অঞ্চলে একটা নাম। সে সাপে কাটা রুগীরে এমনি এমনি ছাইড়া দিয়া আসব, তাও আবার ফতেহপুরের খায়গো বাড়ির রুগী, এইটা কোনো কথা! এইটা কোনো কথা না। আর আপনের আসল ঘটনা কী? সেইটা না দেইখাই চইলা আসনের মানুষ আব্দুল ফইর না! এই দুই কারণেই আপনেরে উঠানে নামাইছিলাম। আমার ঘটনা বোঝা খুব জরুরি আছিল। আর লোকজনের সাপের বিষ নামানির বন্দোবস্ত দেখনের দরকার আছিল।
আব্দুল ফকির কেমন চাপা শব্দে হাসলেন। তারপর বললেন, নাও ঘাটে আইছে, আপনের নামনের সময় হইছে, আপনে নামেন বাজান। তয় তার আগে একখান কথা, আপনে সেইদিন যহন ঢোলের বারিতে জাইগা উঠলেন, সেইদিন সেই কাণ্ড দেইখা আমি নিজেও থম খাইয়া গেছিলাম। কিন্তু একটা রহস্য এহনও পরিষ্কার না। আপনে এত কিছু করলেন শুধু আমার সাথে দেখা করনের লাইগা? শুধু আমি কতটুক আসল, কতটুক নকল, এইটা বোঝনের লাইগা? এই কথা আমারে বিশ্বাস করতে বলেন?
নয়ন এবার চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ। জুলফিকার ঘাটে নাও ভিড়িয়েছে। সে বারকয়েক নয়নকে ডেকেও গিয়েছে। মনিরকে সাথে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে নৌকার গলুইয়ের পাটাতনে। আব্দুল ফকির বললেন, বলেন বাজান, আসল ঘটনা বলেন।
নয়ন এবার তার মুখখানা আব্দুল ফকিরের মুখের কাছে নিয়ে আসল। তারপর খুব অনুচ্চ কিন্তু সুস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, আপনি আমাকে চেনেন, আসমা?
আব্দুল ফকির কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে নয়নের দিকে তাকালেন। তারপর সামান্য দ্বিধামিশ্রিত গলায় বললেন, আসমা? কোন আসমা বাজান?
নয়ন বলল, আসমাকে সাপে কেটেছিল। আপনি গিয়েছিলেন তার বিষ নামাতে।
আব্দুল ফকির এবার যেন খানিক উদাস হয়ে গেলেন। তিনি মাথা তুলে আবছা অন্ধকারে নাওয়ের ছইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর উদাস গলায় বললেন, কত মানুষের লগেই তো দেখা সাক্ষাৎ হয় বাজান, কত রুগীর বাড়িতেই তো যাই। কত মানুষের বিষ নামাই, সবই কি মনে থাকে?
নয়ন বলল, আসমার কথা আপনার মনে থাকার কথা।
আব্দুল ফকির বললেন, বয়স তো আর কম হয় নাই। বয়স বাড়লে মানুষের ইয়াদ শক্তি কইম্যা যায়। আপনে ডাক্তার মানুষ, আপনের ভালো জাননের কথা।
নয়ন আব্দুল ফকিরের কথার জবাব দিলো না। সে মৃদু হাসল। কিন্তু তার সেই হাসিতে আব্দুল ফকির কী যেন খুঁজলেন। তিনি বললেন, ঘটনা খুইলা। বলেন বাজান।
নয়ন বলল, ঘটনা খুলে বলার তো তেমন কিছু নেই ফকির সাহেব। আপনি সবই জানেন। ঘটনার সবই আপনার মনে আছে। আপনি কিছুই ভোলেননি। আসমাকেও না।
নয়ন থামল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আব্দুল ফকিরের দিকে কিন্তু আব্দুল ফকির কোনো কথা বললেন না। নয়নই আবার বলল, আসমা থাকত শহরে। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ঢাকায় সে মানুষের বাসায় কাজ করত। কিন্তু সেই মেয়েটা শহর থেকে ফিরল লাশ হয়ে। আপনার ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আসমার জানাজার নামাজ পড়তেও আপনি গিয়েছিলেন ফকির সাব।
আব্দুল ফকির এবার যেন খানিক সতর্ক হলেন। তবে তার ভাবভঙ্গি সহজ স্বাভাবিকই। তিনি খানিক নরম গলায় বললেন, ওহ্, গহর মাঝির মাইয়া আসমা? আহারে সোনার বরণ মাইয়াডা। অভাবের সংসার বইলা বাপ মায়ে সেয়ানা মাইয়াডারে ঢাকার শহর কামে দিছিল। মাইয়া ফিরা আসলো লাশ হইয়া।
নয়নের চোখ যেন এবার ধক করে জ্বলে উঠল। সে বলল, এই তো আপনার ইয়াদ আসছে ফকির সাব। একদম ইয়াদ আসছে।
আব্দুল ফকির বললেন, কিন্তু বাজান, আসমার সাথে এইসবের সম্পর্ক কী?
নয়ন সাথে সাথেই জবাব দিলো না। খানিক থেমে কী যেন ভাবল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, সম্পর্ক আছে ফকির সাব।
আব্দুল ফকির বললেন, কী সম্পর্ক?
নয়ন ঠান্ডা, স্থির, স্পষ্ট গলায় বলল, খুন আর খুনির সম্পর্ক।
নয়ন বাক্যটা শেষ করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল আব্দুল ফকিরের চোখে। সে ভেবেছিল তার এই কথা শুনে আব্দুল ফকির মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে যাবেন। ভয় পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটল না। আব্দুল ফকির বরং নয়নকে বিস্মিত করে দিয়ে খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নয়নের আরো খানিকটা কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর চিন্তিত গলায় বললেন, আপনি কি অসুস্থ বাজান? সেইরাতের সেই ঘুমের ঔষুধের নেশা কি এখনও কাটে নাই? আপনাগো এই ঔষুধের গুনতো দেখি মাশাল্লাহ ভালোই।
নয়ন আব্দুল ফকিরের আচরণে যথেষ্টই অবাক হলো। কিন্তু সে তার ভাবে তা প্রকাশ করল না। বরং সামান্য হাসল। সেই সামান্য হাসিটুকু ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখেই সে বলল, আপনি কি জানেন, আপনি ভয়াবহ বিকৃত মানসিকতার একজন মানুষ? এই অজপাড়াগাঁয়ে আপনার মতো এমন ভয়াবহ বিকৃত মানসিকতার একজন মানুষ থাকতে পারে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কখনো না। বরং আমি কাউকে বললে, তারা আপনার মতই আমাকে পাগল বলবে। অসুস্থ বলবে। কিন্তু আপনার এই সহজ সাধারণ চেহারা আর সাদাসিধে পোশাকের আড়ালে যে এমন এক ভয়ানক অসুস্থ একজন মানুষ রয়েছে, এটি কেউ জানে না, এটি কেউ বিশ্বাসও করবে না, তাই না ফকির সাব?
আব্দুল ফকির সাথে সাথে কথা বললেন না। তিনিও হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন নয়নের দিকে। নয়ন কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই আব্দুল ফকির ধীরে সুস্থে তার বাঁ হাতখানা তুলে নয়নকে থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, কদম গাছ চেনেন? কদম গাছের পাতা?
নয়ন এতক্ষণ নানাভাবে চেষ্টা করছিল আব্দুল ফকিরের সামনে নিজেকে উন্মোচিত না করতে। নিজের ভেতরে কী চলছে সেটি আব্দুল ফকিরকে ধরতে
দিতে। কিন্তু এবার যেন আর পারল না। আব্দুল ফকিরের হঠাৎ এমন উদ্ভট প্রশ্নে নয়ন বিস্মিত হলো! তার নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগতে লাগল। সে স্থির বসে রইল। কোনো জবাব দিলো না। আব্দুল ফকির অবশ্য নয়নের জবাবের অপেক্ষাও করলেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, গ্রাম-গঞ্জে একটা গাছ আছে। গাছের পুস্তকি নাম আমি জানি না। আমরা গাঁও-গ্রামের মানুষেরা বলি লোট পিপিল গাছ। কিছুটা কদম গাছের পাতার মতো দেখতে। সাইজে আরেকটু ছোট আর রঙটাও ঘন কালচে সবুজ। সেই পাতা পানিতে ভিজাই রাখলে পানি হইয়া যায় আঠার মতো ঘন। খাইতে কোনো টেস্ট নাই। তয় কাজে পাক্কা। খাঁটি সরতিক। দিনে দুই বেলা সেই পাতা পানিতে ভিজাইয়া রাইখা সেই পানি খাইবেন। মাথায় বায়ু চড়লে, উদবাগ হইলে, ঘুম না হইলে, পেশাবের ঝামেলা হইলে, আবোল-তাবোল চিন্তা মাথায় আইলে এই পাতা পানিতে ভিজাইয়া রেগুলার খাইবেন। খুব কাজে লাগব। দেখবেন এইসব বায়ু চড়ার লক্ষণ দূর হইব। আবোল-তাবোল কথা বার্তাও।
আব্দুল ফকির থামলেন। কিন্তু নয়ন কোনো কথা বলল না। সে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছে। আব্দুল ফকির নির্বিকার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন তার সামনে সাত-আট বছরের নাবালক শিশু নয়ন বসে আছে। শিশু নয়নের নানান শিশুসুলভ কর্মকাণ্ড দেখে তার অভিভাবক সামান্য চিন্তিত। আব্দুল ফকির নয়নের সেই চিন্তিত অভিভাবক।
নয়নের হঠাৎ কী হলো! সে চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আচমকা তার মাথা ঠুকে গেল নাওয়ের ছইয়ের সাথে। নয়ন অবশ্য আঘাতটাকে পাত্তা দিলো না। সে ঘুরে আব্দুল ফকিরের দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে বলল, আপনার সম্পর্কে একদম কিছু না জেনে শুনে আমি গ্রামে আসিনি ফকির সাহেব। আর শুধু আমি একা না, আপনার অনেক ঘটনা আরো অনেকেই জানেন, কিন্তু কেউ কেউ লজ্জায়, কেউ কেউ ভয়ে আপনাকে কিছু বলে না। আমার নানাজানও আপনাকে চেনেন। হাড়ে হাড়ে চেনেন। কিন্তু আবার ভয়ও করেন।
আব্দুল ফকির এবার শব্দ করে হাসলেন। তারপর বললেন, আপনার নানাজান তৈয়ব উদ্দিন খাঁ আমারে ভয় পান? আপনের মাথাডা আসলেই গেছে বাজান। এই তল্লাটের সকল মানুষ এখনও তৈয়ব উদ্দিন খাঁর ভয়ে কাঁপে। আর আপনে বলতেছেন, সে আমারে ভয় পায়। আপনে তো এহনও নিজের নানাভানরেই চেনলেন না। আব্দুল ফকিররে কী চেনবেন বাজান?
আব্দুল ফকিরও নাওয়ের ছইয়ের বেড়ায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই নাওয়ের ছই যথেষ্ট উঁচু হলেও পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। দাঁড়াতে হয় কুঁজো হয়ে। আব্দুল ফকিরের তুলনায় নয়নের উচ্চতা বেশি হওয়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে কুঁজো হয়েই। আব্দুল ফকির নয়নের গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন, তারপর নিজের পায়ের দিকে চোখ রেখে বললেন আপনে জানেন, আমার পায়ের এই অবস্থা কে করছে? কে আমারে খুন করতে গিয়া বজলু ব্যাপারীরে খুন করছে? জানেন?
নয়ন বলল, জানি।
আব্দুল ফকির যেন কিছুটা চমকিত হলেন। তিনি বললেন, কী জানেন?
নয়ন বলল, আপনাকে সেই রাতে খুন করতে গিয়েছিলেন আমার নানাজান। তৈয়ব উদ্দিন খাঁ। কিন্তু তার ভুলে খুন হয়ে গেলেন আরেকজন, বজলু ব্যাপারী। বহু বছর আগের ঘটনা। এইসব গাঁও-গ্রামে তখন আইন কানুনের বালাই নাই। চর দখলের কারণে মানুষ খুন নিত্যদিনের ঘটনা। নানাজানের বয়সও তখন কম। শরীরে শক্তি আছে, দাপট আছে। তার কথাই তখন আইন। ফতেহপুরে তখন পুলিশ, আইন, আদালত সবই তিনি। এইজন্যই তিনি গিয়েছিলেন আপনাকে আপনার অপকর্মের শাস্তি দিতে। আপনার ভাগ্য ভালো যে আপনি অন্য গ্রামের মানুষ। না হলে দিনের আলোতেই আপনাকে তিনি প্রকাশ্যে খুন করতেন।
আব্দুল ফকির বললেন, এই তো। আপনে তো সবই জানেন। তাইলে যে আবার বললেন, আপনার নানাজানে আমারে ভয় পায়?
নয়ন বলল, এইখানেই তো আপনার আসল খেলা। নানাজানের মতো মানুষও আপনাকে ভয় পান। স্বীকার না করলেও পান। নানাজান একবার আপনাকে খুন করতে গিয়ে ভুল করে ফেললেন। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতেই আবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেবারও ব্যর্থ হলেন, তখন থেকেই তিনি মনে মনে আপনাকে ভয় পেতে শুরু করেন। কিন্তু সেই দ্বিতীয়বারের চেষ্টার আঘাতের চিহ্নই আপনি আপনার বাম পায়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য এই বারবারের ব্যর্থতা থেকে নানাজান নিজেও মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে আপনার অতিপ্রাকৃত কোনো ক্ষমতা রয়েছে। তিনি আপনাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন, কিন্তু ভয়ও করেন। তার ভেতরে ভেতরে এই ভাবনাও ধীরে ধীরে গেড়ে বসেছে যে আপনার সত্যি সত্যি অন্য কোনো ক্ষমতা রয়েছে। হয়তো এই জন্যই আমাকে সাপে কাটার কথা শুনে তিনি আপনাকেই নিয়ে আসার জন্য বলেছিলেন। কারণ তিনি যে-কোনো মূল্যে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আর, ঘটনা যা-ই হোক, যেভাবেই হোক, আমাকে সুস্থ করে দিয়ে তার সেই বিশ্বাস আপনি আরো পাকাঁপোক্তই করেছেন।
আব্দুল ফকির এবারও কোনো কথা বললেন না। বসে রইলেন স্থির। নয়ন হেঁটে ছইয়ের বাইরে এসে দাঁড়াল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘাটে নেমে হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুলফিকার আর মনির। নয়নকে দেখে মনির চকচকে চোখে তাকাল। তারপর দাঁত বের করে হেসে বলল, ম্যাভাই, ফইরসাবের কাছেরতন মাছের বিষয়টা পরিষ্কার কইরা শোনছেন তো?
নয়ন মনিরের কথার জবাব দিলো না। সেই তাকিয়ে আছে মনিরের পেছনে। জুলফিকারের হাতের হারিকেনে সামান্য জায়গা আলোকিত হয়ে আছে। বাদবাকি সকল জায়গা ঢেকে আছে গাঢ় অন্ধকারে। নয়নের হঠাৎ মনে হতে থাকল, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এই মানবজনম, এই সকল কিছুরই আসলে ওই হারিকেনের আলোর মতো খুব সামান্যটুকুই আমরা কেবল জানি, দেখতে পাই। খুব সামান্যটুকুই। আর বাদবাকি বিশাল অংশটুকু ঢেকে থাকে এই অন্ধকারের মতো ঘুটঘুঁটে গাঢ় অন্ধকারে, রহস্যে। সেই অন্ধকার, রহস্যের কিছুই আমরা দেখতে পাই না। কখনো কখনো হয়তো সেই গাঢ় অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যের বাকি অংশটুকু না দেখাই ভালো।