দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
হুমায়ূন আহমেদ
আমার নাম লিপি। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সায়েন্স গ্রুপ। স্কুলের নাম লালমাটিয়া গার্লস হাই স্কুল। আমি ঠিক করেছি গরমের ছুটিতে একটা উপন্যাস লিখব। উপন্যাসের নাম মাঝে মাঝে তব দেখা পাই। নামটা সুন্দর না? তবে এই নাম আমার দেওয়া না। নাম দিয়েছেন আহসান সাহেব। আহসান সাহেব আমাদের বাড়িওয়ালা। তিনতলায় থাকেন। তাঁর অনেক বুদ্ধি। উপন্যাস লেখার আইডিয়াও তিনি দিয়েছেন। আমার ধারণা তিনি সিরিয়াসলি এই আইডিয়া দেন নি। ফাজলামি করে দিয়েছেন। তিনি অনেক ফাজলামি করেন। মুখ গম্ভীর করে ফাজলামি করেন বলে বোঝা যায় না। তিনি অনেক রসিকতাও করেন। সর্দারজিদের নিয়ে তার একটা গল্প আছে। যতবার এই গল্পের কথা আমার মনে হয় ততবারই আমি একা একা হাসি। তাঁর সম্পর্কে আমি পরে লিখব। এখন উপন্যাসটা সম্পর্কে বলি।
আচ্ছা সর্দারজির জোকটা বলে নেই, পরে ভুলে যাব। যে-কোনো মানুষকে একটা পাতা ফটোকপি করতে দিলে পাঁচ মিনিটে ফটোকপি করে নিয়ে আসে, শুধু সর্দারজিরা এক ঘণ্টা সময় নেন। কারণ তারা মূল পাতার সঙ্গে ফটোকপি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখেন–সব বানান ঠিক আছে কি না।
আহসান সাহেব বলেছেন, উপন্যাসের শুরুর কয়েকটা লাইনে কোনো-না কোনো চমক থাকতে হবে। যেন পাঠক প্রথম কয়েকটা লাইন পড়েই হুকড হয়ে যায়। অর্থাৎ বরশিতে আটকে যায়। মনে মনে বলে, ঘটনাটা কী? উপন্যাসের ওপেনিং আর দাবার ওপেনিং এক না। দাবার ওপেনিং নির্দিষ্ট হয় PK4 কিংবা PQ3। উপন্যাসের ওপেনিং নির্দিষ্ট না। তুমি যে-কোনো জায়গা থেকে শুরু করতে পারো। তবে শুরুতেই থাকবে চমক।
আমি বললাম, চমক একটা সস্তা বিষয় না?
উনি বললেন, সেটা নির্ভর করে চমকটা কে দিচ্ছে তার ওপর। দস্তয়েভস্কির চমক আর চাঁদপুরের ঔপন্যাসিক মোঃ শাহজাহান মিয়া বাবলুর চমক এক হবে না।
আমি বললাম, মোঃ শাহজাহান মিয়া বাবলুটা কে?
সে কেউ না, সে exist করে না। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ঔপন্যাসিকের উদাহরণ হিসেবে তাকে এনেছি। বুঝেছ My friend?
আমি বললাম, Yes friend.
আহসান সাহেবের মেজাজ যেদিন খুব ফুরফুরে থাকে সেদিন আমাকে My friend ডাকেন।
সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগ সময় তার মেজাজ থাকে খারাপ। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কুৎসিত ব্যবহার করেন। একবার আমাকে বললেন, তোমার মধ্যে বাঁদর ভাব আছে, এই তথ্য কি জানো?
আমি বললাম, না।
তিনি বললেন, বাঁদর প্রজাতির আছে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অসীম কৌতূহল। এবং অস্থির স্বভাব। তোমারও তাই।
আচ্ছা এই প্রসঙ্গ এখন থাক। আমি আমার উপন্যাসের শুরুটা দুইভাবে ভেবে রেখেছি। কোনটা রাখব এখনো ঠিক করি নি। দুটোতেই চমক আছে। যেমন–
(ক) আমার পাশের ঘরে কে যেন গোঁ গোঁ শব্দ করছে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে কাউকে ছুরি দিয়ে গলা কাটা হচ্ছে।
(খ) ঠিক দুপুরে একটা দাঁড়কাক এসে বসল আমাদের রেলিংয়ে। বসেই সে মানুষের গলায় ডাকল, কে আছ? কে?
দুটা শুরুতেই চমক আছে, তবে শেষেরটায় চমক একটু বেশি। প্রথমটায় ডিটেকটিভ উপন্যাস ভাব আছে। আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখব না, প্রেমের উপন্যাস লিখব। মনে হয় আমি কাকের মানুষের মতো কথা বলাটা রাখব। কাক তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। কাজেই তার একটা ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এমন হতে পারে যে, কাক কা কা করছে, সবাই ভুল শুনছে।
আহসান সাহেব বলেছেন, তোমাকে চরিত্র বর্ণনা করতে হবে। পুরোটা না হলেও কিছুটা। মনে করো, তুমি তোমার বাবার সম্পর্কে লিখছ। তোমার বাবা দেখতে কেমন এটা লিখতে হবে। যেন পাঠক তোমার বাবা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পায়। তারা উনার একটা ছবি কল্পনা করতে পারে। তোমার বাবা কত ফুট কত ইঞ্চি লম্বা এটা বলার দরকার নেই। তবে তিনি লম্বা না খাটো–এটা বলতে হবে। তার ওজন কত পাউন্ড কত আউন্স বলতে হবে না। তিনি রোগা না মোটা এটা বলা দরকার। তিনি কী ধরনের কাপড় পরেন তা লিখতে পারো। সাধারণত যে সব বর্ণনা লেখকরা এড়িয়ে যান তা দিতে পারো। যেমন, কী জুতা পরেন এবং জুতার ফিতা কীভাবে বাঁধেন।
আমি বললাম, জুতার ফিতা বাঁধাও লিখতে হবে?
তিনি বললেন, লিখতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে তুমি যদি লেখো তাহলে পাঠক ভাববে, এই লেখকের Power of observation তো ভালো। তারা আগ্রহ নিয়ে তোমার লেখা পড়বে। বুঝেছ?
আমি বললাম, Yes sir. : তিনি, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এখন তোমার Power of observation-এর . পরীক্ষা। বলো দেখি, আমি যখন বাইরে যাই তখন কোন ধরনের জুতা পরি?
আমি বললাম, আপনি বাইরে যাওয়ার সময় কখনো জুতা পরেন না। স্যান্ডেল সু পরেন। আপনার ছয় থেকে সাত জোড়া জুতা আছে। আমি আপনাকে কখনো জুতা পরতে দেখি নি।
তিনি বললেন, ভেরি গুড!
আহসান সাহেবের কথা মেনে লিখতে হলে দাঁড়কাকটার বিষয়ে আরও কিছু লেখা দরকার। আমি লিখতে পারছি না। কারণ দাঁড়কাক আমি কখনো ভালোমতো দেখি নি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা দাঁড়কাক সত্যি সত্যি। আমাদের বাসার রেলিংয়ে বসে কা কা করে ডাকত। মা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, কাক ডাকতেই আমরা যেন তাড়াবার ব্যবস্থা করি। কাকের ডাক খুবই অলক্ষণ। মার কথা সত্যি হতেও পারে। কাক ডাকাডাকির কিছুদিনের মধ্যেই আমার দাদি মারা গেলেন। কাক ডাকাও বন্ধ। অনেক দিন কাক ডাকছে না। মনে হয় খুব শিগগিরই আমাদের বাসায় কেউ মারা যাচ্ছে না। : আমার দাদির নাম মর্জিনা বিবি। যৌবনকালে তিনি কেমন ছিলেন, আমি জানি না। তখন তো তাঁকে দেখি নি। মৃত্যুর সময় তার চেহারা ডাইনি বুড়ির মতো হয়ে গিয়েছিল। গর্ত গর্ত চোখ। চামড়া শুকিয়ে প্লাস্টিকের মতো হয়ে বিকট। দেখাত। মাথায় চুল ছিল না। শুধু ডানদিকের কানের কাছে এক গোছা পাটের মতো চুল। চুলের এই গোছা তিনি খুবই যত্ন করতেন। নিজের হাতে তেল দিতেন। কাঠের চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতেন। একদিন দেখি বেণিও করেছেন।
আমি বললাম, দাদিমা চুলে বেণি করেছ? দাদিমা বললেন, বেণি করলে তোর কী? তুই … দিয়া বেণি কর।
আমি ডট ডট দিয়ে যে শব্দটা লিখেছি সেই শব্দটার মানে খুব খারাপ। হিন্দিতে চুল বললে যা বোঝায় তা। দাদিমা সারাক্ষণ কোনো-না-কোনো খারাপ কথা বলতেন। একবার আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন…। না থাক, এটা বলা। যাবে না। আহসান সাহেব যদিও বলেছেন উপন্যাসে মিথ্যা থাকবে না। মিথ্যায় খারাপ কোনো প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। তারপরেও আমার মনে হয়, সব সত্যি লেখা উচিত না। উনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে, নোংরা কথা থাকবে কি না। আমরা তো প্রায়ই নোংরা কথা বলি।
আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে, নাম প্রতিমা। প্রতিমার মতোই সুন্দর। কী সরল চেহারা! কী স্নিগ্ধ ছলছলা চোখ! দেখতে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খাওয়া দূরে থাকুক, সে ভাজা মাছই খেতে পারে না। অথচ এই মেয়ে কী যে অসভ্য! তার মুখে সারাক্ষণ নোংরা কথা। একদিন আমাকে বলে কী–লিপি! বিয়ে করার সময় খেয়াল রাখবি ছেলে যেন বেঁটে হয়।
আমি বললাম, কেন?
প্রতিমা গলা নামিয়ে বলল, বেঁটে ছেলেদের ওই জিনিস হয় লম্বা। তাদের সঙ্গে Sex করে খুব আরাম।
তুই করেছিস?
প্রতিমা গম্ভীর গলায় বলল, না করলেও জানি।
আমার উপন্যাসে আমি অল্প কয়েকটা চরিত্র নিয়ে আসব। যেমন, আমার পরিবারের লোকজন। বাইরের মানুষ হিসেবে থাকবেন শুধু আহসান সাহেব এবং আমার বান্ধবী প্রতিমা। আহসান সাহেব আমার বাবার বন্ধু। বাবা আরমানিটোলা স্কুলে তাঁর সঙ্গে পড়তেন। স্কুলে কিছু কিছু ছেলেদের বিশেষ বিশেষ নামে ডাকা হয়। আহসান সাহেবকে ডাকা হতো মার্বেল নামে। কারণ তিনি স্কুলে যেতেন পকেটভর্তি মার্বেল নিয়ে।
আপনারা নিশ্চয়ই একটু অবাক হচ্ছেন, কারণ আমি বাবার বন্ধুকে চাচা না বলে আহসান সাহেব, আহসান সাহেব বলছি। এর কারণ হচ্ছে, আমি ওনাকে বিয়ে করব। চমকে গেলেন না? আমার উপন্যাসের এইটাই সবচেয়ে বড় চমক। এই চমকটা শেষের দিকে আসবে। আমি যে তাঁকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি এই বিষয়টা আহসান সাহেব নিজেও জানেন না। যেদিন জানবেন সেদিন তিনিও চমক খাবেন। যাই হোক, আহসান সাহেব সম্পর্কে বলি।
চৌধুরী আহসান উদ্দিন।
বয়স : ৫৫
রাশি : বৃশ্চিক।
উচ্চতা : পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি
ওজন : জানি না।
গাত্রবর্ণ : শ্যামলা
পেশা : ইঞ্জিনিয়ার।
(একসময় ছিলেন, এখন ঘরে
বসে সময় কাটান। বই পড়েন।)।
বিশেষ চিহ্ন : বাঁ চোখের ভুরুর ওপর কাটা দাগ।
চুলের বর্ণ : কালো।
চোখের বর্ণ : কালো
বৈবাহিক অবস্থা : (সমস্যা আছে)….
ধর্ম : ইসলাম।
বৈবাহিক অবস্থার জায়গায় আমি লিখেছি, সমস্যা আছে। আসলে কোনো সমস্যা নেই। ভদ্রলোকের স্ত্রী রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। ভদ্রলোক নিজেই। গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হুড়মুড় করে গাড়ির ওপর একটা ট্রাক উঠে গেল। তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। অনেকদিন হাসপাতালে ছিলেন। এখনো সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি যে খুব দুঃখিত হয়েছেন তা আমি মনে করি না। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কখনো। গল্প করেন না। স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ পড়ান না বা ফকির খাওয়ান না। বেচারির একটা ছবি অবশ্যি তাদের শোবার ঘরে আছে। সেখানে এই মহিলা স্বামীর হাত ধরে সমুদ্র দেখছেন। ভদ্রমহিলার মুখ খুশি খুশি, কিন্তু তার স্বামী অর্থাৎ আহসান সাহেব মুখ বেজার করে আছেন। ছবিতে তাকে দেখে মনে হয় তাঁর প্রচণ্ড বাথরুম পেয়েছে। এই মুহূর্তে বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। নয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
আহসান সাহেবের বৈবাহিক বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই, তারপরেও আমি কেন লিখলাম, সমস্যা আছে? এর একটা কারণ আছে। একদিন আমি ছাদে গিয়েছি আচারের বৈয়াম আনার জন্যে। আমার মার আচার বানানোর ব্যাপার। আছে। তিনি হেন বস্তু নেই যার আচার বানান না। আমাদের বাসার ছাদে সব সময় ত্রিশ থেকে চল্লিশটা, আচারের বৈয়াম থাকে। এর মধ্যে তিতা করলার আচারও আছে। মার আচারের বিষয়ে পরে গুছিয়ে বলব। এখন আহসান সাহেবের বৈবাহিক সমস্যাটা বলে শেষ করি।
উনার স্ত্রী মারা যাওয়ার আগের কথা।
আমি ছাদে গিয়ে দেখি আহসান সাহেব মোবাইল টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বেশ জোরে জোরেই কথা বলছেন। আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।.উনি আস্তে বললেও শুনতে পেতাম। আমার কান খুব পরিষ্কার। কেউ। ফিসফিস করে কথা বললেও আমি শুনতে পাই। আহসান সাহেবের টেলিফোনের কথাবার্তা এ রকম—
আহসান সাহেব : আপনাকে তো একবার বলেছি। একই কথা রিপিট করে কী হবে?
ওপাশ থেকে : (শোনা যাচ্ছে না। তবে অনেকক্ষণ ধরে কথা)।
আহসান সাহেব : আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ না করে কিছু বলব না।
ওপাশ : (অল্প সময় কথা)
আহসান সাহেব : আমাকে অবশ্যই রেনুকার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ওপাশে : (কান্নার মতো শব্দ)
আহসান সাহেব : স্টপ ক্রায়িং প্লিজ। তোমাকে মনে রাখতে হবে, রেনুকাকে আমি ভালোবাসি বা না বাসি, তার সঙ্গে দীর্ঘদিন বাস করছি।
ওপাশ : (কী বলল বোঝা গেল না। আহসান সাহেবের বিরক্ত মুখ থেকে ধারণা করি–কথাগুলো তার পছন্দ হচ্ছে না।
আহসান সাহেব : তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। পেশেন্স।
ওপাশ : (মনে হচ্ছে টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। কারণ আহসান সাহেব কান থেকে টেলিফোন নামিয়ে বিরক্তমুখে টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন।)
এই সময় আমি স্টেজে ঢুকে পড়লাম। অর্থাৎ উনার কাছে গেলাম। আমি মাঝে মাঝে এই ধরনের বাক্য লিখব। শুরুতে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে।
আহসান সাহেব আমাকে দেখে বললেন, হ্যালো!
আমি জবাব না দিয়ে হাসলাম। হাসার সময় মাথা সামান্য কাত করে চিন. ডাউন করে রাখলাম। মেয়েদের এই অবস্থায় সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আমি নিজে নিজে এই তথ্য বের করি নি। ইন্ডিয়ান একটা ম্যাগাজিনে পড়েছি। ম্যাগাজিনের নাম সানন্দা। সেখানে ছবি তোলার সময় কী করতে হবে তাও লেখা আছে। ছবি তোলার সময় চীজ বলা যাবে না। জিভের আগা দিয়ে তালু ছুঁয়ে রাখতে হয়। জিভের আগা দিয়ে তালু ছুঁয়ে রাখলে মুখের চামড়া রিলাক্সড হয়। ছবি ভালো আসে। আমি দুভাবেই ছবি তুলে দেখেছি, কোনো বেশকম হয় না। তবে একটায় গালের চামড়া সামান্য ফুলে থাকে। অন্যটায় থাকে না।
আহসান সাহেব বললেন, তারপরে লিপি কী সমস্যা?
না, আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই।
আমার কাছে এসেছ? হ্যাঁ। বলো কী করতে পারি? আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে পারেন।
এখন সম্ভব না। আমি একটি জরুরি টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করছি। কাজেই গেট লস্ট, অর্থাৎ হারিয়ে যাও।
উনার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। চোখে পানি এলে চট করে মুখ সরিয়ে নিতে হয় না। তাতে চোখে আরও বেশি করে পানি জমে। আমি একটা টেকনিক বের করেছি, এই টেকনিকে চোখে জমে থাকা পানি সঙ্গে
সঙ্গে শুকিয়ে যায়। কেউ বুঝতেই পারে না যে চোখে পানি এসেছিল। এই টেকনিক ব্যবহার করে আমি চোখের পানি শুকিয়ে ফেলে বললাম, আমি এসেছি :
জবা ফুলের ইংরেজি কী জানতে। ইংরেজিটা বললেই চলে যাব।
জবা ফুলের ইংরেজি তো তোমাকে একবার বলেছি। ভুলে গেছি। বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারি দেখে নাও। তাহলে আর ভুলবে না।
এই সময় তার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল। মনে হয় জরুরি টেলিফোন, চলে এসেছে। আমি মুখ ভোঁতা করে চলে এলাম। তিনি টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত। ছিলেন বলে আমার ভোতা মুখ দেখতে পেলেন না।
আমি বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারি নিয়ে বসেছি। জবা ফুলের ইংরেজি নাম খুঁজছি। জবা ফুলের ইংরেজি আমি জানি–চায়না রোজ।
তারপরেও ডিকশনারি ঘাটছি, কারণ আহসান সাহেব আমাকে ডিকশনারি দেখতে বলেছেন। তিনি আমার গুরু। তিনি যা বলবেন তা-ই আমি করব। তিনি যদি বলেন, লিপি, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ো তো।
আমি বলব, জি আচ্ছা স্যার। এক্ষুনি লাফ দিচ্ছি। আপনি শুধু বলবেন ওয়ান টু থ্রি। থ্রি বললেই ঝপ দেব।
আমাকে ডিকশনারি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে দেখে বাবা বললেন, কী করছিস? আমি বললাম, ডিকশনারি দেখছি। জবা ফুলের ইংরেজি কী দেখছি।
বাবা আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। এর অর্থ জবা ফুলের ইংরেজি তিনি জানেন না। বাবাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। জবা.. ফুলের ইংরেজি তিনি যদি জানতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, জবা বাংলাদেশের অতি কমন এক ফুল। এর ইংরেজি হলো, চায়না রোজ। তুমি এটা। জানো না, আশ্চর্য! স্কুলে তোমাদের কী শেখায়? ক্লাস ফাঁইভ-সিক্সের একটা মেয়ে যা জানে, তুমি তো তাও জানো না।
আমার ডিকশনারি দেখা শেষ হলো।
বাবা বললেন, পেয়েছ?
আমি বললাম, হুঁ, চায়না রোজ।
বাবা বললেন, জবা বাংলাদেশের অতি সাধারণ একটা ফুল। তুমি এর . ইংরেজি জানো না শুনে দুঃখ পেলাম। চায়না রোজ অর্থাৎ নাক চ্যাপা চিনাদের গোলাপ। একটা খাতায় দশবার লেখো চায়না রোজ। যাতে আর ভুলে না যাও।
আমি খাতা নিয়ে দশবার চায়না রোজ না লিখে লিখলাম–বাবা নিজেকে যতটা চালাক ভাবেন তিনি তত চালাক না। জবা ফুলের ইংরেজি তিনি জানতেন না। ভাব করেছেন যেন জানেন।
বাবা বললেন, লিখেছ?
আমি বললাম, হুঁ।
বাবা বললেন, এক মিনিটে লেখা হয়ে গেল? কী লিখেছ দেখাও। যদি দেখি দশবারের কম তাহলে খবর আছে।
আমি গম্ভীর মুখে বাবাকে খাতা দেখালাম। তিনি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকালেন। চিৎকার চেঁচামেচি করলেন না। তিনি খাতার পাতা উল্টাতে : থাকলেন। আমি ছাদে চলে গেলাম। জবা ফুলের ইংরেজি শিখেছি, এটা আহসান সাহেবকে জানানো দরকার।
আহসান সাহেব বললেন, ডিকশনারি দেখেছ?
আমি বললাম, হুঁ। চায়না রোজ।
আহসান সাহেব বললেন, জবার আরেকটা নাম আছে। Shoe flower. অর্থাৎ জুতা ফুল। জবা ফুল জুতা কালো করার কালিতে ব্যবহার হয় বলে এই নাম। মনে থাকবে?
থাকবে।
জবার বোটানিকেল নাম হলো Hibiscus rosa. পৃথিবীর পাঁচটি দেশের জাতীয় ফুল জবা। এই মুহূর্তে আমার দুটা দেশের নাম মনে পড়ছে। একটা হলো মালয়েশিয়া, আরেকটা উত্তর কোরিয়া।
এই হলো আহসান সাহেব। হেন জিনিস নাই যে ইনি জানেন না। তাঁর বিপরীত মেরুতে বাবার অবস্থান। তিনি কিছুই জানেন না। কোনো কিছু জানার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। বাবার সঙ্গে আহসান সাহেবের বন্ধুত্ব কীভাবে। হয়েছে কে জানে! আহসান সাহেব দিনরাত বই পড়েন। বাবা সব মিলিয়ে দুটা বই পড়েছেন—শরৎচন্দ্রের দেবদাস আর যাযাবরের দৃষ্টিপাত। তিনি কথায় কথায় এই দুটা বইয়ের কথা বলেন। দৃষ্টিপাত থেকে কোটেশান দেন। যেমন, বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
বাবা তার বন্ধু আহসান সাহেব সম্পর্কে বলেন, বিস্তর পড়াশোনা করেছে। তাতে লাভ কী? যা হয়েছে এর নাম বুকিশ নলেজ। বুকিশ নলেজ কোনো কাজে আসে না।
আমার মাঝে মাঝে বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে, তোমার নলেজ কোন লাইনে? তোমার নলেজ, কীভাবে কাজে এসেছে?
মেয়ে হয়ে বাবাকে এইসব কথা বলা যায় না। সন্তান ও পিতার সম্পর্ক নিয়ে বাবা মাঝে মাঝে হাদিস থেকে উদাহরণও দেন। সেদিন বললেন, আল্লাহ যদি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করার অনুমতি দিতেন সেটা হতো, সন্তান। পিতাকে সেজদা করবে। এখন বুঝে দেখো পিতার মর্যাদা। মাতার চেয়ে পিতা টেন টাইমস ওপরে।
হাদিস জানা ভালো কোনো আলেম পাওয়া গেলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম– এই হাদিস সঠিক কি না। বাবা প্রায়ই হাদিস আওড়ান। আমার ধারণা, বেশিরভাগই বানানো। তাকে আমি কখনো হাদিস-কোরান পড়তে দেখি নি। বাবার বলা হাদিসগুলি আসলেই যাচাই করা দরকার।
আমাদের স্কুলের যে হুজুর আপা আছেন তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো না। সম্পর্ক ভালো থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম। হুজুর আপার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে কীভাবে সেটা বলি। গত রোজার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
আপা! জ্বিনরা কি খাবার খায়?
আপা বললেন, খায়। তারা মানুষের মতোই এক ধরনের প্রাণী। তাদেরও . . খাদ্যের প্রয়োজন আছে।
আমি বললাম, তারা কী খাবার খায়?
আপা বললেন, মৃত পশুর হাড়, কয়লা, এইসব তাদের খাদ্য।
আমি বললাম, আপা, জ্বিনদের মধ্যে মুসলমান আছে?
আপা বললেন, আছে। আমাদের নবিজি (সঃ)-এর কাছে অনেক জ্বিন ইসলাম গ্রহণ করেছে।
আমি বললাম, তাহলে তারা রোজা নিশ্চয় রাখে?
আপা বিরক্ত হয়ে বললেন, এইসব জানতে চাচ্ছ কেন?
আমি মুখ শুকনা করে বললাম, আপা, আমি একটা উপন্যাস লিখছি। সেখানে ধার্মিক জ্বিনের একটি চরিত্র আছে। এইজন্য জানতে চাচ্ছি।
হুজুর আপা হেড মিসট্রেসের কাছে আমার নামে নালিশ করলেন। হেড মিসট্রেস আমাকে ডেকে পাঠালেন। কঠিন গলায় বললেন, লিপি, তোমার সমস্যা কী?
আমি বললাম, আপা, আমার কোনো সমস্যা নেই।
তুমি নাকি জ্বিনদের নিয়ে উপন্যাস লিখছ?
জ্বিনদের নিয়ে কিছু লিখছি না। তাদের বিষয়ে কিছু জানি না। আমার উপন্যাসে একজন ধার্মিক জ্বিনের চরিত্র আছে। এইজন্য জানতে চাচ্ছিলাম।
হেড মিসট্রেস বললেন, তোমার নামে অনেক কমপ্লেন আছে। তোমার বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে। আগামী সোমবার চারটার পর আসতে বলবে।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
খারাপ মেয়ে আমি স্কুলে রাখব না। টিসি দিয়ে বের করে দেব। বুঝেছ? জি আপা।
আপা বললেন, বাথরুমে অতি নোংরা কিছু ছবি আঁকা হয়েছে। সেগুলি কি তোমার আঁকা?
আমি বললাম, জি-না। তবে কে এঁকেছে আমি জানি। (আসলেই জানি। ছবিগুলি এঁকেছে প্রতিমা।)
আপা চোখ মুখ সরু করে বললেন, বলো কে এঁকেছে?
আমি বললাম, কোনো এক দুষ্ট জ্বিন এঁকেছে। দুষ্ট জ্বিনরা এই ধরনের কাজ করে।
আপা বললেন, সোমবার অবশ্যই তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে।
.
সোমবারে বাবা হেড মিসট্রেসের সঙ্গে দেখা করলেন। বেশ অনেকক্ষণ থাকলেন। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। যদি আমার ডাক পড়ে! ডাক পড়ল না। বাবা মুখ শুকনা করে বের হলেন। আমরা দুজন রিকশা নিয়ে ফিরছি। বাবা _ বললেন, তুমি নাকি জ্বিন নিয়ে বই লিখছ?
আমি বললাম, জ্বিন নিয়ে বই কি লিখব? ওদের বিষয়ে কি জানি?
বাবা বললেন, সেটাও তো কথা। মা শোনো, শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের মর্যাদা। এই বিষয়েও নবিজির একটা হাদিস আছে।
আমি বললাম, হাদিস শুনতে ইচ্ছে করছে না। আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে, আইসক্রিম কিনে দাও। দুটা ললি আইসক্রিম কিনে আনো। দশ টাকা দাম।
রাস্তার মাঝখানে আইসক্রিম কোথায় পাব?
ওই যে আইসক্রিমের গাড়ি। দুটা কিনবে। আমি দুই হাতে দুটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে যাব।
বাবা বললেন, হেড মিসট্রেস ঠিকই বলেছেন, তোমার মাথায় সমস্যা আছে।
বাবা আইসক্রিম কিনে আনলেন। আমি একটা তার হাতে দিয়ে বললাম, একটা তুমি খাবে আরেকটা আমি খাব। বাবা মেয়ে দুজন আইসক্রিম খেতে খেতে যাব।
আমি যা ভেবেছিলাম তা-ই হয়েছে। বাবা আইসক্রিম খেতে খেতে যাচ্ছেন। তার চোখে পানি এসে গেছে। আমার উপন্যাসে এরকম একটা দৃশ্য থাকবে। একটা না, অনেকগুলি দৃশ্যই থাকবে।
বাবা শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। আমি বললাম, কাঁদছ কেন?
বাবা বললেন, কাঁদব কী জন্যে? চোখ উঠবে। চোখ ওঠার আগে আগে চোখ, দিয়ে পানি পড়ে।
ও আচ্ছা।
বাবা বললেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সবার চোখ উঠেছিল। এই রোগের তখন নামই হয়ে গেল, জয় বাংলা রোগ।
আমি বললাম, বাবা! তুমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছ। রিকশায় যেতে যেতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব না।
বাবা কিছু বললেন না। আমি লিখতে ভুলে গেছি–বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। সিলেট এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তাদের কমান্ডার ছিলেন সালেহ চৌধুরী। বাবার প্রধান আনন্দ মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা। এই আনন্দ তিনি তেমন পান না। কারণ আমরা তাঁকে গল্প শুরু করতে দেই না। শুরুতেই থামিয়ে দেই।
বারার আইসক্রিম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তার হাতে কাঠি রয়ে গেছে। বাচ্চাদের মতো হাতে কাঠি নিয়ে বসে আছেন।
বাবা!
হুঁ।
তোমাদের টেকেরঘাট অপারেশনের গল্পটা বলো তো।
সত্যি শুনতে চাও?
হুঁ। চাই।
গল্প তো শুনতে চাও না?
এখন চাই।
অপারেশন আসলে টেকেরঘাটে হয় নি। হয়েছে, জলকলসে।
ও আচ্ছা।
আমি কোন সেক্টরে ছিলাম তা তো জানো?
জানি। পাঁচ নম্বর সেক্টরে।
ঘটনা হলো কী, ভোরবেলায় সালেহ চৌধুরী সাহেব হঠাৎ বললেন, সবাই তৈরি হও। লঞ্চে ওঠো। লঞ্চের নামটা কি আগে বলেছি?
বলেছ। লঞ্চের নাম পাখি।
বাবা গল্প শুরু করলেন। আমি এখন আর তার কথা শুনছি না। অন্যকিছু ভাবছি। এই কাজটা আমি খুব ভালো পারি।
ক্লাসে আপারা যখন বক্তৃতা শুরু করেন, আমি অন্য কথা ভাবি।
এখন রিকশায় একই ব্যাপার ঘটছে। বাবা আইসক্রিমের কাঠি হাতে নিয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলে যাচ্ছেন, আর আমি ভাবছি প্রতিমার কথা।
প্রতিমা নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এই প্রজেক্টে আমাদের অংক আপাকে মাসে দুটা করে উড়ো চিঠি ছাড়া হচ্ছে। আমাদের অংক আপার চেহারা রাক্ষসীদের মতো। মুখভর্তি হলুদ চোখা চোখা দাঁত। বয়স চল্লিশের ওপরে। এখনো বিয়ে হয় নি। এই রাক্ষসীকে কে বিয়ে করবে!
অংক আপা স্কুলে সেজেগুজে আসেন। ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক দেন। গ্রামের মেয়েদের মতো গালে রুজ মেখে গাল লাল করেন। কী কুৎসিত যে তাঁকে দেখায়! আমার ধারণা সাজগোজের পর তিনি আয়নায় নিজেকে দেখেন না। দেখলে কখনোই সাজতেন না।
অংক আপাকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তার নমুনা (হুবহু হবে না। একবার মাত্র পড়েছি। প্রতিমা চিঠি পাঠিয়েছে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে।)–
ওগো আমার ময়না সোনা। লুতু লুতু পুতু পুতু।
তুমি যে কমলা আর বেগুনি ফুলের ছাপের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছ, দূর থেকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি। কী সুন্দর যে তোমাকে লাগছে চাঁদ সোনা! লুতু লুতুপুতু পুতু।.. .
আচ্ছা ভালো কথা, তোমার ডান স্তনটা কি বাঁয়ের চেয়ে বড়? আমার সে রকমই মনে হয়। তুমি ডান দিকে সামান্য ঝুঁকে হাঁট। ডান স্তনের অতিরিক্ত ভারেই কি এই অবস্থা?
চিঠির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। বাবা অবাক হয়ে বললেন, হাসছ কেন? আমি তো হাসির কোনো কথা বলি নাই। আমাদের একজন সহযোদ্ধা পেটে গুলি খেয়েছে। এখন মরে তখন মরে অবস্থা। এই কথা শুনে হাসির কী আছে বুঝলাম না।
আমি বললাম, বাবা সরি।
বাবা বললেন, সরি পরে, আগে বলো তুমি হেসেছ কেন? চুপ করে থাকলে হবে না। জবাব দিতে হবে। এমন কি হতে পারে যে, আমি কী বলছি তা তুমি শুনছ না। অন্য কিছু ভাবছ?
হতে পারে, তবে তোমার প্রতিটি কথা আমি শুনেছি।
বলো দেখি, টেকেরঘাট সাব সেক্টরে আমাদের উপদেষ্টার নাম কী?
আমি বললাম, মেজর জগজিৎ সিং বাথ।
বাবার চেহারা কোমল হয়ে গেল। তিনি বললেন, গুড গার্ল।
বাবার কথা সত্যি না। আমি গুড গার্ল না। আমি ব্যাড গার্ল। কেমন ব্যাড গার্ল উদাহরণ দেব? আচ্ছা দেই।
একজন ব্যাড গার্লের লক্ষণ হচ্ছে, সে তার খুব কাছের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। এই যে বাবার সঙ্গে করলাম। মার সঙ্গে তো সব সময় করছি। সবচেয়ে বেশি আহসান সাহেবের সঙ্গে। দাবা খেলা নিয়ে প্রতারণা। আহসান। সাহেবের ধারণা তিনি খুব ভালো দাবা খেলেন। আসলে তা না। আমার সঙ্গে জেতার তার কোনোই সম্ভাবনা নেই, অথচ আমি ইচ্ছা করে হেরে গিয়ে তাঁকে আনন্দ দেই। খেলায় জিতে তিনি জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বলেন। এইসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। তার জ্ঞানী কথার নমুনা—
লিপি, তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি খুব মন খারাপ করেছ। ফুটবল খেলায় হেরে যাওয়ার অর্থ শক্তির কাছে হার। দাবায় হার মানে বুদ্ধির কাছে হার। মন খারাপ হবেই। এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
আমি প্রতিবারই বলি, আপনার কাছে তো আমি হারবই।
তিনি বলেন, আগেই হার স্বীকার করে থাকবে না। চেষ্টা করবে। তোমার Opening খারাপ না। End game খারাপ। দাবার মূল খেলা হচ্ছে end game. কিছু কৌশল আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। ঠিক আছে?
জি। ঠিক আছে।
ববি ফিসারের নাম শুনেছ?
জি-না।
আমেরিকান দাবা খেলোয়াড়। Legand. দাবার জগতে হুলুস্থুল করে গেছেন। End game এর ওপর লেখা তার একটা বই আছে। আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়বে।
আচ্ছা।
এখন তোমাকে শেখাব Fools Mate। কী করে বোকা খেলোয়াড়কে তিন দানে হারানো যায়।
তিনি আমাকে Fools Mate শেখালেন। আমি মনে মনে হাসলাম। আমি জানি, তিন দানে তাকে হারানো যাবে না, কিন্তু কুড়ি দানে অবশ্যই যাবে।
দাবার গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে আমি এই পর্যন্ত তিনবার খেলেছি। প্রথম খেলায় তিনি জিতেছেন, বাকি দুটায় ড্র হয়েছে। প্রথমটায় উনি জিততে পারতেন না। একজন গ্র্যান্ড মাস্টারের সঙ্গে খেলছি, এই মানসিক উত্তেজনাই আমার কাল হয়েছে।
দাবা খেলা থেকে আমার শিক্ষা হচ্ছে, মানসিক উত্তেজনা একপাশে সরিয়ে খেলতে হবে। দৃষ্টি থাকবে বোর্ডের সেন্টারের দিকে। সেন্টারের দখল যেন কখনো হাতছাড়া না হয়। ক্যাসলিং করে রাজা লুকানো যাবে না। যুদ্ধের মাঠে। লুকানোর প্রশ্ন ওঠে না।
আমার উপন্যাসের নায়িকা হবে একজন দাবাড়ু। দাবার প্রতিভা সে কখনোই প্রকাশ করবে না। সব প্রতিভা প্রকাশ করতে নেই।
আমার উপন্যাসে নায়ক একজন, তবে নায়িকা থাকবে দুজন। একজন। আমি, অন্যজন প্রতিমা। আমি নায়ককে আকর্ষণ করব বুদ্ধি দিয়ে, প্রতিমা করবে শরীর দিয়ে।
উপন্যাস লেখার বিষয়ে আমি প্রতিমার সঙ্গে আলাপ করেছি। সে খুব উৎসাহী। আমাকে বলল, শুরুতে একটা সেক্স সিন দিয়ে দে। তাহলে পাবলিক খাবে।
আমি বললাম, সেক্স সিন আমি লিখতে পারব না।
প্রতিমা বলল, আমি লিখে দেব। যে পড়বে সে-ই ট্যারা হয়ে যাবে।
আহসান সাহেবের সঙ্গে আমি প্রতিমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। এক ছুটির দিনে প্রতিমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
প্রতিমা তাকে দেখে ভক্তি-শ্রদ্ধায় গলে যাওয়ার মতো ভাব করল। একেবারে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম।
আমি বললাম, এর নাম প্রতিমা। আমার প্রিয় বন্ধু। আপনার কথা অনেক। বলেছি তো, সে আপনাকে দেখতে এসেছে।
আহসান সাহেব প্রতিমার মাথায় হাত রেখে বললেন, কেমন আছ গো মা?
আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, আহসান সাহেব কখনো আমাকে মা ডাকেন না! কোনো পুরুষ যদি কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, তাকে সে কখনো মা ডাকবে না। ইহা সত্য, ইহা সত্য, ইহা সত্য।