ওঙ্কার – উপন্যাস – আহমদ ছফা
বইটি সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত
এ গ্রন্থটি পাঠ করলে যে কোনো সহৃদয় পাঠকই মোহিত হবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচণ্ড আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে এর চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু কোথাও লিখিত হয়েছে এমন আমার জানা নেই।
-আবুল ফজল
শেষে জানাই তাঁর (আহমদ ছফার) লেখা পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছি এবং সকল পাঠক আমারই মত তাঁর গ্রন্থ পাঠে সে আনন্দের শরীক হতে পারবেন বলে আমার ধারণা।
-দৈনিক পূর্বদেশ
হিন্দু পুরাণ মতে ‘ওঙ্কার’ হচ্ছে আদি ধ্বনি, সকল ধ্বনির মূল। লেখক বলতে চেয়েছেন, বাহ্য কান দিয়ে আমরা ধরতে পারি না পারি, সকল চেতনে, সকল হৃদয়ে সেই আদ্য ধ্বনি বিরাজিত। এই ধ্বনি, এই হৃদয় এই চেতনা যে বোবা মেয়েতে ছিল, সে তার প্রাণ দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। একটি সমুচ্চ বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ ও তীব্রভাবে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন লেখক। তার এই প্রচেষ্টা কিছুটা অভিনব। আহমদ ছফার ছোট গল্প পড়তে গিয়ে দেখেছি তিনি দুঃসাহসী পুরুষ।
-দৈনিক ইত্তেফাক
আহমদ ছফার বর্ণনা কৌশল চরিত্র চিত্রণ রীতি এবং অনুভুতি স্নিগ্ধ ও হৃদয়গ্রাহ্য ভাষাই মনকে গ্রাস করে। এই রচনার অন্তর্গত সংবেদনশীলতাই বক্তব্যের গভীরে টেনে নেয়। … মনে হয়, একটি মহাকাব্যের বিষয়কে যেন সনেটে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থে।
-দৈনিক বাংলা
সত্যি বলতে কি আজকাল গল্পের বাজার বড় মন্দা। প্রথম পাঠে আন্দোলিত বা বিহ্বল হবার মত গ্রুপ অধুনা তেমন চোখে পড়ে না। আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ সেদিক থেকে এক বিরল ব্যতিক্রম।
-সাপ্তাহিক বিচিত্রা
একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেই আহমদ ছফাঁকে জানতাম। কিন্তু সম্প্রতি ‘বিচিত্রায় প্রকাশিত তাঁর গল্প ‘ওঙ্কার’ পড়ে তার মধ্যে একজন নিপুণ গল্পকারকে দেখতে পেয়েছি। সত্যিই ভাষায় সাবলীল সৌন্দর্যে বিদগ্ধ বর্ণনায়, তাঁর গল্পটি হয়ে উঠেছে সজীব প্রাণময়। গল্পের বিষয়বস্তুটিও নতুনতর।
-বিচিত্রায় জনৈক পাঠকের পত্রাংশ
সমগ্র উপন্যাসটি বড় গল্প না গদ্য কবিতা? আমাকে একটি বিদেশী উপন্যাসের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, যদিও তার সঙ্গে বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনই মিল নেই। শ্রী বিষ্ণুদে অনূদিত ভের করস (ফরাসী) সমুদ্রের মৌন’ উপন্যাসটি আপনি পড়েছেন? ফ্রান্সে নাজি অবরোধের সময় লেখা।…
ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিনিধি বোবা বাংলা মার মুখে ভাষা ফোঁটাতে পারবে না, যে কাজ একমাত্র শক্তিমান সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব। এই কথা কটি যে কতখানি সত্য তা আমরা এখানে (পশ্চিম বাংলায়) সবচেয়ে ভাল এখন বুঝতে পারছি।
-সিদ্ধার্থ ঘোষ
সাহিত্য ধারা। ৪ / ২, মহেন্দ্র রোড, কোলকাতা, ২৫ (জনৈক কোলকাতার পাঠকের পত্রাংশ)।
.
০১.
আমাদের কিছু জমিজমা ছিল। আমার বাবা নিজে করেননি। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সম্পত্তির সঙ্গে একখানা মেজাজও তাঁকে পূর্বপুরুষেরা দিয়ে গিয়েছিল। তাঁর তেজ বিশেষ ছিল না, তবে ঝাঁঝটা ছিল খুব কড়া রকমের।
সময়টা বাবার জন্য যথেষ্ট ভালো ছিল না। শহর বন্দর অফিস আদালত কলেকারখানায় ব্যক্তির আত্মসত্তা গরিমায় নিজের শোণিত উষ্ণ রাখতে চেষ্টা করতেন। ঈষদুষ্ণ নয়, কিছুদিন রীতিমতো উষ্ণই রাখতে পেরেছিলেন। তার কারণ, বাবা পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে রক্তের মতো বিত্তও উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন। সেজন্য পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত বিত্তে আত্মশোণিতের হিমোগ্লোবিন কণা উজ্জ্বল রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু, হায়রে! কবে কেটে গেছে সে কালিদাসের কাল!
আমার বাবা যেভাবে দিনাতিপাত করতেন, তাকে কিছুতেই একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণ বলা যাবে না। তাঁর স্বপ্ন কল্পনা চিন্তা বাসনার বাগানে পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মারা দলে দলে হানা দিত। এই প্রেতাত্মাই তাঁকে জাগরণে নেশাগ্রস্ত করত। তিনি একজন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতোই জীবনযাপন করতেন।
বলতে ভুলে গেছি। আচারে ব্যবহারে তিনি উগ্র রকমের পরহেজগার মানুষ ছিলেন। তাঁর বিশেষ সংস্কার নিয়ে ঠাট্টা করব অন্তত তেমন কুসন্তান আমি নই। বাবা ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন। শরীয়তের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। চূড়ান্ত দুঃখের দিনেও আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্বিকার থাকতে পারতেন।
অতি ছোট বয়সে তাঁকে হাতীর দাঁতে খোদাই করা ব্যক্তিত্বের অনুপম স্তম্ভ মনে করতাম। এখন বুদ্ধি বিচেনা পেকেছে। দুনিয়াদারীর যাবতীয় বস্তু বিবসনা করে ভেতরের ব্যাপার জানার মতো দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে চেতনা। জনকের কাঠিন্যমণ্ডিত বয়েসী ছবিটি স্মরণে এলেই কেন বলতে পারব না, শরীরের আঁকে বাঁকে ঢেউ খেলে একটা ধ্বনি চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রাণময় হয়ে ওঠে। পশু-পবিত্র পশু। হাঁ তিনি পবিত্র পশুই ছিলেন। আর তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন যথার্থ পশু। এক সময়ে মদে মেয়েমানুষে আমাদের সে তল্লাট উজাগর রেখেছিলেন। তার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি অতীত যুগের পরিধি পেরিয়ে আমার কানে বহু দূরাগত বাদ্যের আওয়াজের মতো রণিত হয়নি গুঞ্জন। ক্ষুধার্ত মানুষের কর্কশ আর্তচিৎকার শুনেছি। অতীতরূপী মুজিয়মে সঞ্চিত চিত্রমালার আভা, ধ্বনিপুঞ্জের লাবণী, রক্তের খরতেজ আমাকে স্পর্শই করতে পারে নি।
এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি এর সব কটিই বাবার চিন্তাচেতনার পরতে পরতে অপরূপ কুহক রচনা করেছিল। বাবাকে তাই পবিত্র পশু বলেছি। আবার এই সময়ের মধ্যেই জগতের আমাদের অংশে নতুন ছাদের পশুদের উদ্ভব হতে শুরু করেছে।
কখনো কখনো ভারি বিব্রত লক্ষ্য করতাম তাঁকে। বার্ধক্যজীর্ণ মুখাবয়বে একটা অসহায় ভঙ্গি বড় করুণভাবে ঝুলে থাকত। তখন বুঝিনি। বয়সে বুদ্ধি ছিল না। এখন উপলব্ধির স্তরে স্তরে জনকের অদৃশ্য অশ্রুপাত জোয়ারের জলের মতো ফুলে ফুলে সারা মনপ্রাণ ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
অনেক বার বাবাকে আমাদের পিশাচের দাঁতের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লাল ইট বের হওয়া দালানের নামাজের বিছানায় বসে হতাশভঙ্গিতে রেলের লাইন, ট্রাক বাসের গতায়ত, এক চোখ কানা আবুনসর মোক্তার সাহেবের ধবধবে সাদা নতুন বাড়ির পানে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। চিড়িয়াখানার খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন সম্পূর্ণ অনাত্মীয় দৃষ্টিতে লোহার খাঁচা নিরিখ করে, তেমনি দৃষ্টি দিয়ে আমার বাবা আমার কালের পৃথিবীর দিকে তাকাতেন। গাছপালা দেখলে অন্তরীণ সিংহশিশুর চোখে যেমন গহন বন, নিবিড় অরণ্যানী আর নিষ্ঠুরতার স্বপ্ন নামে, তেমনি আবেশে ঘনিয়ে আসত দৃষ্টি, যখন তিনি ফার্সি হরফে লেখা তুলোট কাগজের ‘সজরা অথবা বংশপঞ্জির বুকে সস্নেহে আঙ্গুল বুলোতেন। যুগ-যুগান্তরের পুরনো কীটদষ্ট পাংশুটে তুলোট কাগজ। ডানদিক থেকে জের জবর সম্বলিত বাঁকা-বাঁকা টানা হাতের লেখা খয়েরী রঙের হরফগুলো অখণ্ড প্রতাপ অফুরন্ত মহিমার প্রতাঁকের মতো তাঁর চোখে অদৃশ্য শিখায় জ্বলজ্বল করত। নামোক্ত এসব মহাপুরুষদের স্মৃতিতে জীয়ন্ত করে বাবা তাঁদের সঙ্গে হৃদয়ের ভাব বিনিময় করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন একটানা। সেই সময় বাবার চারপাশে চেতনে নিশ্চেতনে মিশে একটা নিশ্চল তন্ময় পরিবেশের সৃষ্টি হতো। তন্ময়তা কেটে গেলে তাঁর দু-চোখে একটা অচেনা আলো ফুটে বের হতো। তার অর্থ করলে এরকম দাঁড়াতো- এই দুনিয়াদারী, ঘরবাড়ি, মানুষজন এসবের কিছুই আমি চিনিনে, কিছুই বুঝিনে। তাঁর দৃষ্টিতে বন্দী বিহঙ্গের কাতরতা ফুটে থাকত। সামনে যে যুগ থাবা প্রসারিত করে এগিয়ে আসছিল তার নখরাঘাত তিনি অনুভব করতেন। এই যুগে তিনি যে একজন ফালতুর বেশি নন তা নিজেই ভালো করে উপলব্ধি করতেন।
তাঁর চিন্তা কল্পনা সবই অতীতের মাপে তৈরী। কিছু বর্তমানের সঙ্গে খাপ খায় না। সেজন্যেই বোধহয়, সৃষ্টিকর্তার ওপর তার আস্থাটাও নোঙরের মতো অমন স্থির অনড় ছিল । সহায়হীন মাতাল রাতের অন্ধকারে ঘরের বৌয়ের গঞ্জনা সইতে না পেরে যেমন শুড়িখানায় সান্ত্বনার সন্ধানে যায়, তেমনি চারপাশের পরাক্রান্ত পৃথিবী প্রবল তিরস্কারে বাবাকে তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে পাঠাতো। হয়তো তিনি জানতেন, হয়তো জানতেন না। তাঁর চোখেমুখে কি রকম বিষণ্ণ যন্ত্রণার ফুল ফুটে থাকত। তার যন্ত্রণার মধ্যে সমস্ত বিশ্বেসী মানুষের যন্ত্রণা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
যেহেতু আমি বাবাকে পবিত্র পশু বলেছি সেজন্য কেউ যেন আমাকে পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাহীন মনে না করেন। পশুদেরও তো রক্তধারা বংশপরম্পরা সামনের দিকে ধাবিত হয়। আমি নিজে যে মমতাহীন নই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নিজের মুখে সে কাহিনী চূড়ান্ত বিশ্বস্ততাসহকারে আপনাদের কাছে বলে যাচ্ছি।
পুরনো মডেলের গাড়ি যেমন শহরের নতুন রাস্তায় ঠিকমতো চলতে পারে না, ঝাট লাগায়, দুর্ঘটনা বাঁধায়, ধোঁয়া ছড়ায়, তেমনি আমার বাবা আমার কালের পৃথিবীতে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি কেবল দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েই যাচ্ছিলেন। সৃষ্টির বোঁটা ধরে নাড়া দিয়ে একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাঁধাবার মতো শক্তি কিংবা শিক্ষা কোনোটিই তার ছিল না। তিনি আঘাত করতে গিয়ে আহতই হচ্ছিলেন।
বলেছি, সামান্য কিছু জমিজিরেত তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাই নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে বিক্রম প্রকাশ করতেন। তাই করে রক্তের হিংস্রতার দংশন কিছুটা লাঘব করতেন। আমাদের মানুষজন বিশেষ ছিল না। খুনজখম বাঁধিয়ে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো তাও সাধ্যের বাইরে ছিল। বাবা মামলা মোকদ্দমা করেই মনের ঝাল মেটাতেন। তখন দুনিয়ার আমাদের অংশ আবুনসর মোক্তার সাহেবদের দখলে চলে যেতে বসেছে।