১
আমি বিশ্বাস করি যে আপনারা বাঙালি, এই বাংলাদেশ আপনাদের স্বদেশ এবং এই দেশটি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা আছে। না, আমি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ এখন ভাবছি না। অতএব, আমার এ উপন্যাস পড়তে বসে— আহ্ এ আবার কেমন শুরু?— বলে বই বন্ধ করবেন না, এই অনুরোধ। আমি আপনাদের মনে করতে বলি, যে, আমরা সকলেই পল্লীর মানুষ; রাজধানী ঢাকা নগরীতে যারা বাস করছি কিম্বা নগরীতে আমাদের যাদের জন্ম, আমরাও আসলে পল্লীরই; ঢাকা নগরীও এক বৃহৎ পল্লী ভিন্ন আর কিছুই নয়। আমি আপনাদের বাংলাদেশের পল্লীগুলোর একটি বিশেষ দিকের প্রতি এখন মনোযোগ প্রার্থনা করছি।
এই বাংলাদেশের যে-কোনো পল্লীতেই আপনি লক্ষ করে দেখবেন, যে, অন্তত একজন দয়াহীন ধনবান ব্যক্তি আছেন, একজন অভিশপ্ত কৃপণ আছেন, একজন সুকণ্ঠ গায়ক ভিক্ষুক আছেন, একজন হতভাগ্য ইস্কুল শিক্ষক আছেন এবং ঘোর উন্মাদ অথচ নিরীহ একটি ব্যক্তি আছেন; এই পাঁচ ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া কোনো পল্লীই সম্পূর্ণ নয়।
কেউ একদা বলেছিলেন, ‘বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি’; আমি জানি না এই বাংলাদেশে সুদূর কোনো অতীতকালে প্লেটোর মতো কোনো দার্শনিক জন্ম নিয়েছিলেন কি না এবং তিনি বাংলার আদর্শ পল্লীর রূপরেখা বর্ণনা করেছিলেন কি না, কিন্তু এই পাঁচ চরিত্র বাংলাদেশের যে পল্লীতে, নেই, সে পল্লী বড় অসম্পূর্ণ বলে আমরা নিজেরাই অনুভব করি। আমরা শিশুকালে, আমি এখনো মনে করতে পারি, আমাদের শহর জলেশ্বরীর উঠতি দাদা মনসুর ভাই পাশের নবগ্রামের প্রশান্ত তলাপাত্রকে খাটো করবার জন্যে প্রায়ই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকে বলতেন— যা যা, তোদের ওখানে একটা পাড়ার পাগলা পর্যন্ত নেই; কী আছে তোদের? সেই তাচ্ছিল্য দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে একদিন প্রশান্ত তলাপাত্র নিজেই উন্মাদ হয়ে নবগ্রামের সুনাম রক্ষা করে কি না বলতে পারব না; প্রশান্তদা এখনো নবগ্রামে আছেন এবং রেল ইস্টিশানের প্ল্যাটফরমে তাকে আজ গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে যাত্রীদের ফেলে দেয়া ঠোঙ্গার কাগজ, বিভিন্ন মোড়ক ও সিগারেটের বাক্স সংগ্রহ করতে দেখা যায়। কাগজগুলো তিনি পরিষ্কার করে, ভাঁজ মসৃণ করে সরকারি নোটের মতো কেতাবন্দি করে রাখেন। কিন্তু এ কাহিনী প্রশান্ত তলাপাত্রের নয়; অতএব, তাকে আমরা এখানেই ছেড়ে দিয়ে যাই।
আমি একটি সমাবন্ধের খেলা, আপনাদের দিই। বাংলা শব্দটি দুর্বোধ্য যদি মনে হয়, ইংরেজিতে বললে নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে প্রাঞ্জল হয়ে যাবে— গেম অব কমবিনেশন। যেমন, পাঁচটি জিনিস হাতে আছে— এর কত রকম জোড়া হতে পারে? আচ্ছা, আমাদের সেই পল্লীর পাঁচটি চরিত্রের কথাই মনে করা যাক।
একই সঙ্গে কেউ দয়াহীন ধনবান এবং অভিশপ্ত কৃপণ হতে পারেন? আপনারা হেসে বলবেন, অবশ্যই হতে পারেন। আমি পাল্টা বলব, না, সম্ভব নয়। আমার যুক্তি এই যে, কৃপণের ধন থাকতেই হবে, এমন কোনো কথাই নেই। নির্ধনও কৃপণ হতে পারে; কৃপণতা মূলত একটি মানসিকতা বিশেষ। তাছাড়া, কৃপণ ধনী হলেও ধনকে সে গোপন করতেই ব্যস্ত, আর ধনবান যিনি, তিনি হৃদয়হীন হলেও নিজের চাকচিক্য তথা ধনের গৌরব অপরের দৃষ্টিগোচর করাতে খুব আগ্রহী।
তবে, দেখাই যাক না, অভিশপ্ত কৃপণ ব্যক্তিটি, যার নাম করলে ভাতের হাঁড়ি ফেটে যায় বলে শোনা আছে, তিনি কি সুকণ্ঠ একজন গায়কও হতে পারেন? সম্ভাবনাটি নিয়ে আপনারা ইতস্তত করেছেন, আমি অনুভব করছি; আমি বলব, অসম্ভব। আমি কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ দেখাতে পারব না। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, কৃপণের স্বরযন্ত্র গানের যোগ্য হয় না, যে গান করে সে বিতরণ করে এবং কৃপণ বিতরণকে সর্বাংশে এড়িয়ে চলে। সমাবন্ধের খেলা আমরা আরো অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি; তা সংক্ষেপেই এখন করি। সবশেষে, একজন ইস্কুল শিক্ষক কি ঘোর উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন?
অবশ্যই হতে পারেন; উন্মাদ যে কেউ হতে পারে; চিকিৎসা শাস্ত্রে বলে, পাগলের কোনো সংজ্ঞা নেই, কে যে পাগল আর কে যে সুস্থ স্বাভাবিক? – আজ পর্যন্ত কেউ ছক কেটে দেখাতে পারে নি; কাজেই আমরা যাকে সুস্থ বলে ধরে নিচ্ছি, সে আসলে হয়ত আস্ত একটি পাগল, এবং যাকে পাগল বলে সনাক্ত করেছি, সে হয়ত আমাদের চেয়েও অনেক বেশি সুস্থ ও স্বাভাবিক। চিকিৎসকেরা তো বৈজ্ঞানিক এবং বিজ্ঞানের প্রধান একটি কাজ হচ্ছে- সংজ্ঞা নির্ধারণ করা; অতএব চিকিৎসকেরা একেবারে হাল ছেড়ে না দিয়ে উন্মাদ ব্যক্তির একটি সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। সেটি হচ্ছে— সামাজিক বিশ্বাস, আচরণ ও ধ্যান ধারণার বিপরীতে যে যায় এবং সম্মিলিত কোনো মানব গোষ্ঠির অর্জিত জ্ঞানের বিরোধী উক্তি যে করে, সেই উন্মাদ।
এবং এই সংজ্ঞা শীতকালে শীত নিবারণের জন্যে গরম কাপড়ের মতো কাজ দিলেও, যে- কোনো শৈত্য বোধেই জামা কাপড় কিছু কাজে দেয় না, আপনারা নিজেরাই অবগত আছেন।
আমি এখন জলেশ্বরী উচ্চ প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আনসার আলী যিনি পরান মাস্টার নামেই গত পঁচিশ বছর থেকে পরিচিত, তার কথা ভাবছি।
বাংলাদেশের যে-কোনো পল্লীর অবশ্য উপস্থিত একটি চরিত্র হচ্ছেন একজন হতভাগ্য ইস্কুল শিক্ষক, পরান মাস্টার শিক্ষক এবং হতভাগ্য; বিদ্যালয়ে একশ সাতষট্টি জন বালক বালিকার শিক্ষক, এবং গৃহে বাইশ থেকে এগার বছর বয়সের পাঁচটি সন্তানের মধ্যে দুটি আশু বিবাহযোগ্য কন্যা ও একটি বেকার পড়াশোনায় ইস্তফা দেয়া পুত্রসহ মোসাম্মৎ চাঁন বড়ুর হতভাগ্য স্বামী পরান মাস্টার।