১. আজিব রাজীব

১. আজিব রাজীব

ছোটাচ্চুর ঘরে মিটিং, সব বাচ্চারাই এসেছে। ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে বসেছে, বাচ্চাদের কেউ বিছানায় কেউ মেঝেতে। এক দুইজন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ছোটাচ্চু তার গালের বিন্দি বিন্দি দাড়ি দুই একবার ঘষে বলল, “তোদেরকে আমি কেন ডেকেছি আমি নিজেই জানি না, কারণ আমি যেটা তোদেরকে বলব সেটা মোটেও বাচ্চাদের সাথে আলোচনা করার বিষয় না।”

একজন রিনরিনে গলায় বলল, “বুঝেছি! বুঝেছি তুমি কী নিয়ে কথা বলবে!”

ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “কী নিয়ে?”

“ইয়ে এবং বিবাহ!”

সবাই মাথা নেড়ে আনন্দে চিৎকার করল, বলল, “ইয়েস! ইয়েস! ইয়ে এবং বিবাহ!”

ছোটাচ্চু কেমন যেন একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর গাল ঘষে বলল, “তোদের সব কিছু নিয়ে ইয়ারকি!”

একজন বলল, “এটা মোটেও ইয়ারকি না।”

ছোটাচ্চু বলল, “যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস না!”

আরেকজন বলল, “কে বলেছে আমরা বুঝি না? মনে নাই তোমাদের দুইজনের যখন প্যাঁচ লেগে গিয়েছিল তখন আমরা–

ছোটাচ্চু একটা ধমক দিল, বলল, “চুপ কর!”

**

বাচ্চারা চুপ করল কিন্তু মুখ টিপে খিকখিক করে হাসতে লাগল। ছোটাচ্চু বলল, “আমি তোদেরকে ডেকেছি আমি এখন কী করব সেটা বলতে।”

বাচ্চারা চিৎকার করল, “বল! বল ছোটাচ্চু, বল!”

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা সবাই জানিস আমি এই দেশের প্রথম একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছিলাম। একদিন যখন এই দেশে ডিকেটটিভ এজেন্সির ইতিহাস লেখা হবে আমার নাম সেখানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।”

টুম্পা বলল, “এবং টুনি আপুর।”

শান্ত বলল, “আমার নামটাও লিখতে হবে। আমি আর আমার বন্ধুরা মিলে গাবড়া বাবারে ধরেছিলাম মনে আছে? যা একটা ল্যাং মেরেছিলাম–”

প্রমি বলল, “মারামারি করার জন্য কারো নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে না।”

টুম্পা বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমার নামটা লেখা হবে পিতলের

অক্ষরে।

মুনিয়া বলল, “না হলে প্লাস্টিকের অক্ষরে।” তখন সবাই হি হি করে

হাসতে শুরু করল।

টুনি বলল, “তোমরা সবাই একটু চুপ করবে? ছোটাচ্চু কী বলতে চায় একটু শুনি।”

প্রমি বলল, “হ্যাঁ, সেটা শুনি। সবাই চুপ।

সবাই শেষ পর্যন্ত চুপ করল তখন ছোটাচ্চু তার গলা পরিষ্কার করে আবার শুরু করল। বলল, “তোরা জানিস আমি রেকর্ড সময়ের ভিতরে দা আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেসন্সি দাঁড়া করিয়েছিলাম। ক্রাইম সলভ করার জন্য একটা টিম তৈরি করেছিলাম। সেই টিমটি ছিল আধুনিক, প্রশিক্ষিত, দক্ষ, সাহসী এবং অ্যাঁ অ্যা–”

ছোটাচ্চু বলার মতো আরেকটা শব্দের জন্য মাথা চুলকাতে লাগল। শান্ত তখন সাহায্য করার চেষ্টা করল, বলল, “রাজপথের লড়াকু সৈনিক।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “রাজপথের লড়াকু সৈনিক?”

“হ্যাঁ।”

“এখানে রাজপথের লড়াকু সৈনিকের কী আছে?”

“জানি না। কিন্তু দেখেছি সবসময় বলে।”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “পলিটিক্স করার সময় এগুলো বলে গাধা কোথাকার। আমি কি পলিটিক্স করতে গেছি?”

একজন বলল, “উল্টোটা হয়েছে। সরফরাজ কাফি পলিটিক্স করে ছোটাচ্চুকে বের করে দিয়েছে। তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল।

টুনি বলল, “তোমরা ছোটাচ্চুকে কথাই বলতে দিচ্ছ না। তোমরা কি কয়েক মিনিটের জন্য কথা বন্ধ করবে?”

সবাই আবার কথা বন্ধ করল, তখন ছোটাচ্চু বলল, “আমি জাতির সামনে প্রমাণ করেছি যে আমি জিরো থেকে শুরু করে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি। আমি শুধু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন রহস্যভেদী ডিটেকটিভ নই–আমি একই সাথে একজন অসাধারণ সংগঠক!”

কেউ একজন হাসি চাপতে গিয়ে নাক দিয়ে শব্দ করে ফেলল এবং সেটা শুনে আরো কয়েকজন খুকখুক করে হেসে ফেলল। ছোটাচ্চু সেটা না শোনার ভান করে বলল, “আমি দেখিয়ে দিয়েছি যে আমি চাইলেই পারি। আমি অসাধ্য সাধন করতে পারি। আমি কর্মঠ, উৎসাহী, উদ্ভাবক–”

শান্ত ছোটাচ্চুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু নিজের প্রশংসা নিজের করা ঠিক না।”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “কী বললি?”

“বলেছি যে নিজের প্রশংসা নিজে করা ঠিক না। আমি যখন করি তখন সবাই মিলে আমাকে গালাগাল করে প্রমি বলল, “মোটেই না শান্ত। তোকে কেউ গালাগাল করে না। তোকে নিয়ে হাসাহাসি করে। হাসাহাসি আর গালাগালি করা এক জিনিস না।”

শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, “হাসাহাসি করা গালাগালি করা থেকে অনেক বেশি খারাপ করা– “

“মোটেও না। হাসাহাসি হচ্ছে আনন্দ করা, গালাগালি হচ্ছে ঝগড়া টুনি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “তোমাদের জন্য আমরা ছোটাচ্চুর আসল কথাটাই শুনতে পাচ্ছি না। ছোটাচ্চু আমাদেরকে ডেকেছে একটা কথা বলার জন্য, সেটা আগে শুনি।”

তখন আবার সবাই চুপ করল। ছোটাচ্চু কটমট করে সবার দিকে তাকাল তারপর বলল, “কথা বলার সময় তার মাঝে একটা ফ্লো থাকে। সেই ফ্লো থাকলে কথা বলা যায়। তোরা বার বার সেই ফ্লো নষ্ট করে দিচ্ছিস কেউ একজন বলল, “আর করব না।”

“মনে থাকে যেন।”

“মনে থাকবে।”

ছোটাচ্চু আবার শুরু করল, কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “কী যেন বলছিলাম?”

একজন বলল, “তুমি কতো পরিশ্রমী আর উৎসাহী–’

আরেকজন যোগ করল, “আর বুদ্ধিমান–”

আরেকজন যোগ করল, “আর উৎপাদক — “

আরেকজন ধমক দিল, “উৎপাদক না গাধা, উদ্ভাবক –”

“আমি স্পষ্ট শুনেছি ছোটাচ্চু বলেছে উৎপাদক।”

“মোটেই না। ছোটাচ্চু বলেছে উদ্ভাবক। তাই না ছোটাচ্চু?”

টুনি আবার বাধা দিল, “প্লিজ তোমরা চুপ করো। ছোটাচ্চুকে বলতে দাও।”

সবাই চুপ করল, ছোটাচ্চু সবার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে মানুষের জীবন হচ্ছে বহমান নদীর মতো ৷ চলতে চলতে সেটি গতি পাল্টায়। আইনস্টাইন এতো বড় বৈজ্ঞানিক তিনি পর্যন্ত শেষ জীবনে বেহালা বাজিয়ে কাটিয়েছেন।”

শাহানা আপত্তি করতে গিয়ে থেমে গেল। ছোটাচ্চু বলতে লাগল, “নিউটন কী করলেন? পলিটিক্স? এমন কী আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত জমিদারি শুরু করেছিলেন।”

এবারে শাহানা একটু আপত্তি না করে পারল না, বলল, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি শুরু করেছিলেন সেটা মনে হয় ঠিক না। আগে থেকে ফেমিলির জমিদারি ছিল–”

ছোটাচ্চু থামিয়ে দিল, “একই কথা। আমি যেটা বলি সেটা শোন।” ছোটাচ্চু তার মুখে একটা দার্শনিকের মতো ভাব ফুটিয়ে বলল, “আমি বলতে চাচ্ছি যে সবার জীবনই এরকম, একটা কিছু করতে করতে অন্য কিছু করা। যার ভেতরে যত বেশি মালপানি সে তত বেশি ধরনের কাজ করতে পারে।”

একজন বলেই ফেলল, “কখনো বেহালা, কখনো পলিটিক্স কখনো জমিদারি–“

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে তাকাল কিন্তু কোনো জবাব দিল না। আগের সুরে বলতে লাগল, কাজেই আমিও মনে মনে ভাবছি একই জীবনে শুধু একটা কাজ করে কেন খুশি থাকব? কেন নানা ধরনের কাজ করব না?”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “নানা ধরনের কী কাজ ছোটাচ্চু?”

শান্ত বলল, “বলেছেনই তো, বেহালা বাজাতে বাজাতে পলিটিক্স আর অফ টাইমে জমিদারি।”

প্রমি বলল, “চুপ কর গাধা। জমিদারি কবে উঠে গেছে।”

টুনি আবার জিজ্ঞেস কলল, “নানা ধরনের কী কাজ?”

ছোটাচ্চু বলল, “এইতো।”

“এইতো মানে কী?”

“এইতো মানে–” ঠিক তখন ছোটাচ্চুর টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছোটাচ্চু নম্বরটা দেখে ভুরু কুঁচকালো। তারপর কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যালো।”

অন্য পাশ থেকে একজন মহিলার গলার স্বর শোনা গেল, বলল, “এইটা কি ডিটেকটিভ শাহরিয়ার সাহেবের নাম্বার?”

“জী, কথা বলছি।”

“ও আচ্ছা। হাউ নাইস! আমার কী সৌভাগ্য আমি এতো বড় একজন ডিটেকটিভের সাথে সরাসরি কথা বলছি।

বাচ্চারা টেলিফোনের কথা শুনতে পাচ্ছিল না কিন্তু দেখল ছোটাচ্চুর মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠেছে। তারা অপেক্ষা করতে থাকে কখন টেলিফোনের আলাপ শেষ হয় কিন্তু সেটা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, হাত দিয়ে মুখের নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে ছোটাচ্চুকে টেলিফোনটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়ার জন্য ইঙ্গিত দিতে লাগল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ছোটাচ্চু মুখের মাঝে একটা মোলায়েম হাসি ফুটিয়ে কথা শুনেই যেতে লাগল, মাঝে মাঝে শুধু বলতে লাগল, “ও আচ্ছা!”

“তাই নাকি?”

“বাহ্!”

“কী চমৎকার”

“সত্যি?”

“অসাধারণ।”

“ভেরি গুড।”

“নো প্রবলেম!”

“অবশ্যই অবশ্যই।”

“কী যে বলেন!”

ছোটাচ্চু ঠিক নতুন কী কাজ করবে সেটা জানার জন্য সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল কিন্তু ছোটাচ্চুর টেলিফোন আলাপ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ না দেখে শেষ পর্যন্ত একজন একজন করে উঠে যেতে লাগল। তারা গিয়ে দাদি (কিংবা নানির) ঘরে একত্র হলো এবং ছোটাচ্চু কী ধরনের কাজ করতে পারে সেটা নিয়ে নিজেরাই জল্পনা কল্পনা করতে লাগল। তাদের

আলোচনাগুলো হলো এরকম :

“আমার মনে হয় ছোটাচ্চু কুমিরের ব্যবসা করবে।”

“কুমির? কুমিরের ব্যবসা কীভাবে করে?”

“ও মা! সেটাও জানিস না। অনেক বড় পুকুর কেটে সেখানে কুমির এনে ছেড়ে দেয়। যেভাবে গরুর ফার্ম হয়, মুরগির ফার্ম হয়, সেরকম কুমিরের ফার্ম হয়। কুমির অনেক দামে বিক্রি হয়।”

“আমার মনে হয় না ছোটাচ্চু কুমিরের ফার্ম করবে।”

“কেন?”

“কুমিরের ফার্ম করতে অনেক টাকা লাগে। অনেক বড় জায়গা কিনতে হয়। বিদেশ থেকে কুমির আনতে হয়। ছোটাচ্চুর এতো টাকা নাই।”

“ঠিকই বলেছিস। ছোটাচ্চু এমন বিজনেস করবে যেখানে টাকা লাগে না।”

“সেটা কিসের বিজনেস?”

“আমার মনে হয় ছোটাচ্চু তেলাপোকার বিজনেস করবে!”

“তেলাপোকা? ছিঃ! ইয়াক থুঃ!”

“ছিঃ ইয়াক থু করছিস কেন? জানিস না চাইনিজরা তেলাপোকা খায়?”

“সত্যি? ইয়াক থু!”

“সত্যি। শুধু তেলাপোকা না–সব রকম পোকা, পোকার ডিম সব কিছু খায়।”

“কীভাবে খায়? তেলাপোকা পালিয়ে যায় না?”

“ধুর বোকা। জ্যান্ত খায় নাকি? ভেজে খায়!”

আচ্ছা! আমি ভেবেছিলাম জ্যান্ত খায়। প্লেটের উপরে জ্যান্ত

তেলাপোকা রাখে, তারপর সেগুলো ধরে ধরে খায়।”

“না, না। জ্যন্ত তেলাপোকা খায় না। ভেজে মুচমুচে করে খায়। চানাচুরের মতন। খুব টেস্টি!”

“খুব টেস্টি? তুই কী খেয়ে দেখেছিস নাকি?”

“না, আমি খাই নাই, গুগলে দেখেছি।”

“তাহলে ছোটাচ্চু তেলাপোকার ব্যবসা করবে? এই ব্যবসায় টাকা-পয়সা লাগে না। সব বাসাতেই ফ্রি তেলাপোকা পাওয়া যায়।”

“কিন্তু একটা সমস্যা আছে।

“কী সমস্যা?’

“ছোটাচ্চু মনে হয় তেলাপোকাকে ভয় পায়।”

“উঁহু, ছোটাচ্চু মাকড়সাকে ভয় পায়।”

“শুধু মাকড়সাকে না। তেলাপোকাকেও ভয় পায়। মনে নাই সেইদিন একটা তেলাপোকা উড়তে শুরু করেছিল তখন ছোটাচ্চু কী ভয় পেয়েছিল?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিকই বলেছিস।”

“আমার কী মনে হয় জানিস?”

“কী?”

“সবচেয়ে সহজে টাকা বানানোর উপায় হচ্ছে কোচিং সেন্টার দেওয়া “কোচিং সেন্টার?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু কোচিং সেন্টার দিতে হলে ছাত্রদের পড়াতে হয় না?”

“ধুর! পড়াতে হয় না। খালি মডেল টেস্ট নিতে হয়।”

“মডেল টেস্ট?”

“হ্যাঁ। একটার পর একটা। যত মডেল টেস্ট তত টাকা।”

“ঠিকই বলেছিস। বলতে হয় জিপিএ ফাইভ গ্যারান্টি। বিফলে মূল্য ফেরত।”

“তাহলে লাভ কী?”

“কেউ কেউ তো নিজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যাবে, সেটাই লাভ।”

“হুম! তাহলে ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টার দিবে?”

“মনে হয়।”

“আমার অন্য একটা জিনিস মনে হচ্ছে।”

“কী মনে হচ্ছে?”

“ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টারই দিবে কিন্তু অন্য রকম কোচিং সেন্টার।

“অন্য কী রকম কোচিং সেন্টার?”

“ডিটেকটিভ কোচিং সেন্টার।”

“ডিটেকটিভ?”

“হ্যাঁ বড় করে বিজ্ঞাপন দিবে। লেখা থাকবে, বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ারের কাছ থেকে হাতে-কলমে ডিটেকটিভের কাজ শিখুন।

“মানুষেরা আসবে?”

‘একশো বার আসবে। পাশে ছোটাচ্চুর একটা ছবি থাকবে চোখে কালো গগলস, মাথায় হ্যাট আর হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস।”

“আর অন্য হাতে পিস্তল-”

“হ্যাঁ, পিস্তল। একেবারে ফাটাফাটি বিজ্ঞাপন, ছোটাচ্চু ছাত্রদের জায়গা দিতে পারবে না।”

দাদির ঘরে বাচ্চারা যখন এরকম আলোচনা করছে তখন ছোটাচ্চুকে একজন মহিলা তার ছেলের কথা বলছিলেন। সব মা-বাবাই মনে করে তার ছেলে বা মেয়ে ছোটখাট আইনস্টাইন না হয় মাদাম কুরী। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা আসলেই অন্যরকম। এই মহিলার ছেলেটা আসলেই বিস্ময়কর। ছোটাচ্চুর সাথে ভদ্র মহিলার কথাবার্তা এভাবে শুরু হয়েছিল — মহিলা বলছিলেন, “আমি আপনার কাছে একটা বিশেষ কারণে ফোন করেছি। আপনাকে আমার ছেলের কথা বলতে চাই। তার একটা কারণও আছে, যদি কিছুক্ষণ সময় দেন তাহলে বলি।”

“কোনো সমস্যা নেই, বলেন।

“আমার ছেলের নাম রাজীব, তার বয়স আট। কিন্তু সে মোটেও আট বছরের একটা বাচ্চার মতো না। জানি না আপনি বিশ্বাস করবেন কি না সে হায়ার এলজেবরা আর ট্রিগোনোমেট্রি শেষ করেছে, এখন ক্যালকুলাস শিখছে।”

ছোটাচ্চু খাবি খেল, বলল, “অবিশ্বাস্য! কী বলছেন আপনি?”

“বিশ্বাস না করলে আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।”

“না, না অবিশ্বাস করছি না।”

“সে এর মাঝে চারটা ভাষা জানে। বাংলা, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ আর কোরিয়ান। বাংলা ইংরেজিটা আমরা তার সাথে নিজেরাই কথা বলতে পারি, অন্য দুটো করার জন্য এম্বেসি আর হাই কমিশন থেকে লোক খোঁজ করতে হয় ৷”

“কী অসাধারণ!”

“হ্যাঁ নিজের ছেলে বলে বলছি না, আসলেই অসাধারণ। সে এর মাঝে দুইটা কম্পিউটার ল্যাংগুয়েজে প্রোগ্রামিং করতে পারে, সি প্লাস প্লাস আর পাইথন, আমি তার কিছু বুঝি না! সেদিন দেখেছি একটা প্রোগ্রাম লিখেছে সেটা দাবা খেলতে পারে!”

“দাবা? দাবা খেলার প্রোগ্রাম?” ছোটাচ্চু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

“জী। দাবা। আমি খুব ভালো দাবা খেলতে পারি না, আমাকে খুব সহজে হারিয়ে দেয়। রাজীবের বাবাকে অবশ্য পারে না! শুধু দাবা খেলার প্রোগ্রাম না, আরো অনেকগুলো গেম বানিয়েছে

ছোটাচ্চু বলল, “কী আশ্চর্য! মাত্র আট বছরের একটা ছেলে?”

“জী। আট বছর তিন মাস। এর মাঝে দুনিয়ার সব বই পড়ে ফেলেছে। গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান, ইতিহাস। এখন কলেজ লেভেলের ফিজিক্স বই পড়ছে। বুঝেছেন?”

“জী। দেশের মানুষের তো আপনার ছেলের কথা জানা উচিত মহিলা বললেন, “একজাক্টলি! আমি ঠিক এই জন্যে আপনাকে ফোন করেছি।”

“আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“একটা টেলিভিশন চ্যানেল আমার ছেলের ওপর একটা প্রোগ্রাম করতে চেয়েছিল। ঠিক যেদিন টেলিভিশনের ক্রু আসবে আমার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর তার সাথে পেটে ব্যথা আর বমি। প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে হলো। আরেকবার আমরা ছেলেকে নিয়ে যাব টেলিভিশন স্টুডিওতে, রাস্তায় গাড়ি ভেঙে গেল। আরেকবার সাংবাদিক আসবে বাসায় রাজীবের দাঁতে ব্যথা! মুখ ফুলে একাকার : সাথে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর। “

“কী আনফরচুনেট।” ছোটাচ্চু জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, “যাই হোক সবসময় তো আর এরকম ঘটবে না। তা ছাড়া সময়ও চলে যায় নাই।”

“আমি আসলে এ জন্যই আপনাকে ফোন করেছি। আমাদের কী সন্দেহ হয় জানেন?”

“কী?”

“এই ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃত। কেউ একজন ইচ্ছা করে এটা আমার ছেলের বিরুদ্ধে করছে।

“ইচ্ছা করে?”

”হ্যাঁ। ইচ্ছা করে করছে। শত্রুতা করে করছে। কেউ একজন চায় না আমার ছেলের কথা দেশের মানুষ জানুক। “

“কেন?” ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কেন চাইবে না?”

“হিংসা করে।”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?”

মহিলা গলার স্বর নিচু করে বললেন, “জী। করি। সেই জন্য আপনাকে ফোন করেছি। আমি সামনাসামনি আপনাকে সেটা বলতে চাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “আমার তো নিজের অফিস নাই, আপনাকে তাহলে আমার বাসায় আসতে হবে

“আসব। আমি চলে আসব। আপনি আমার ছেলেটাকে রক্ষা করেন, কেন জানি মনে হয় তার ওপর অনেক বিপদ। মনে হয় এরকম প্রতিভাবান না হয়ে সাধারণ ছেলে হলেই ভালো হতো। তাহলে তার ওপর কারো এত নজর থাকতো না।”

ছোটাচ্চু সাহস দিয়ে বলল, “আপনি ভয় পাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ রাজীবের মায়ের সাথে কথা বলে টেলিফোন রেখে দিল। বাচ্চাদের সাথে কথা বলার জন্য সে তাদের ডেকে এনেছিল, তারা শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। ছোটাচ্চু তাদের খুঁজে বের করার জন্য দাদির ঘরে গিয়ে দেখে তারা কোনো একটা বিচিত্র কারণে পা দিয়ে কান চুলকানোর চেষ্টা করছে। কেন পা দিয়ে কান চুলকাতে হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যায় কিন্তু ছোটাচ্চু সাহস করল না। বাচ্চারা তাকে দেখে কান চুলকানো বন্ধ করল, একজন বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার কাজটা মোটেও ঠিক হয় নাই।”

অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক হয় নাই। ঠিক হয় নাই।”

“আমাদেরকে ডেকে নিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলে।”

“কথা আর শেষ হয় না! বলতেই থাকলে বলতেই থাকলে। ছোটাচ্চু বলল, “জরুরি একটা ফোন চলে এসেছে, আমি কী করব?” একজন বলল, “আমরা অবশ্য চিন্তা ভাবনা করে বের করে ফেলেছি “কী বের করে ফেলেছিস?”

“তুমি এখন কী করবে?”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কী করব?”

মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “তেলাপোকা ভাজা বিক্রি করবে!”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আরেকজন বলল, “না, না। তুমি কোচিং সেন্টার দিবে। কোচিং সেন্টার সবচেয়ে বেশি টাকা!”

ছোটাচ্চু মুখ কালো করে বলল, “তোদের এই ধারণা? আমি টাকার জন্য কোচিং সেন্টার দিব?”

আরেকজন বলল, “এটা অন্যরকম কোচিং সেন্টার। ডিটেকটিভ হওয়ার কোচিং সেন্টার!”

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “তোদের ব্রেন ড্যাম্প হয়ে গেছে, তোদের চিন্তার দৌড় কোচিং সেন্টার পর্যন্ত!”

“তাহলে তুমি কী করবে?”

ছোটাচ্চু উঠে দাঁড়াল, বলল, “দেখি তোরা চিন্তা করে বের করতে পারিস কিনা। যেটা করব সেটার প্রথম অক্ষর ‘উ’।”

“উ?”

“হ্যাঁ।”

“উ’তে উট!” মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি তুমি উট কিনে এনে কোরবানির ঈদের সময় বিক্রি করবে!”

“তোদের বুদ্ধি ঐ পর্যন্তই। ‘উ’ ছাড়াও এটাকে “কা’ও বলা যায়। প্ৰথম শব্দটা শুরু হচ্ছে ‘কা’ দিয়ে, পরের শব্দ ‘উ’ দিয়ে।”

“কা আর উ কাউ? মানে গরু? তাহলে গরুর ব্যবসা?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়তে নাড়তে বের হয়ে গেল। অন্যরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার পা দিয়ে কান চুলকানোর খেলায় ফিরে গেল। শুধু টুনি ছোটাচ্চুর পিছে পিছে বের হয়ে এল। ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে কে ফোন করেছিল ছোটাচ্চু?”

“একটা আট বছরের ছেলের মা।”

“কেন?”

“কেন আবার, একটা সমস্যা সমাধান করার জন্য।”

“কী সমস্যা?”

“ছেলেটা অসম্ভব ব্রাইট–এখনই তিন চারটা ল্যাঙ্গুয়েজ জানে, এলজেবরা, ট্রিগোনোমেট্রি, ক্যালকুলাস জানে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে পারে, কলেজের ফিজিক্স পড়ে–”

টুনি জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, “আহা বেচারা!” ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “আহা বেচারা? আহা বেচারা হবে কেন?”

‘একজন প্রডিজি–আহা বেচারা হবে না তো কী?”

“প্রডিজি?”

“হ্যাঁ।”

“সেটা আবার কী? কোনো অসুখ নাকি?”

টুনি বলল, “অসুখের মতোই বলতে পার। এতো ছোট থাকতে যদি এতো কিছু করতে পারে সেটা তো অসুখের মতোই!”

ছোটাচ্চু বলল, “কী বলছিস তুই? এতো জিনিয়াস একটা ছেলে আর তুই বলছিস অসুখের মতো?”

“আসলে আমি নিজে তো কখনো প্রডিজি দেখি নাই, শুধু তাদের কথা শুনেছি। আম্মু এই মোটা একটা সাইকোলজির বই এনেছিল সেখানে প্রডিজিদের কথা লেখা ছিল। ইংরেজি বই–ঠিক করে পড়তে পারি নাই। সেইখানে লেখা ছিল।

“কী লেখা ছিল?”

“প্রডিজি হওয়া যতটুকু ভালো তার থেকে বেশি যন্ত্রণা।”

“কেন যন্ত্রণা কেন?”

“জানি না।”

ছোটাচ্চু রেগে গিয়ে বলল, “তুই জানিস না আর বলে দিলি ছোটবেলা জিনিয়াস হওয়া খারাপ?”

“বললাম তো ছোটাচ্চু, বইটা ইংরেজিতে লেখা ছিল, বাংলায় হলে পড়ে ফেলতাম। যেটুকু পড়েছি মনে হয়েছে-

“কী মনে হয়েছে?”

টুনি মাথা চুলকে বলল, “মনে হয়েছে বাবা-মা বাচ্চাটাকে নানা রকম চাপের মাঝে রাখে তখন বাচ্চাটার জীবনে কোনো মজা থাকে না। অন্য বাচ্চাদের মতো আনন্দ করতে পারে না।”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “এটা মনে হয় তুই ঠিকই বলেছিস! এই মহিলাও মনে হয় তার বাচ্চাকে নিয়ে টেলিভিশন প্রোগ্রামিং করতে চায়–”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “করে না কেন?”

“প্রত্যেকবার যখন করতে যায় তখন বাচ্চাটার জ্বর উঠে যায়–না হয় বমি, পেট ব্যথা, শরীর খারাপ। দাঁত ব্যথা সেই জন্যই–”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “সেই জন্য কী?”

“সেই জন্য বাচ্চাটার মা আমার কাছে আলাপ করার জন্য আসছে। সন্দেহ করছে কেউ বাচ্চাটার উপর শত্রুতা করছে–কিছু একটা খাইয়ে দিচ্ছে।”

টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “বাচ্চাটার মা আমাদের বাসায় আসবে?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যি?” টুনির চোখ চকচক করতে থাকে।

“সত্যি।”

“তাহলে তুমি তাকে বল বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে। প্লিজ ছোটাচ্চু প্লিজ।”

ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“আমি বাচ্চাটাকে দেখতে চাই। প্রডিজি কেমন হয় আমি কখনো দেখি নাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “আমিও দেখি নাই। মনে হয় হাত-পাগুলো হবে কাঠি কাঠি আর মাথাটা হবে ইয়া বড় গোল একটা ফুটবলের মতো।” বলে ছোটাচ্চু

হা হা করে হাসতে লাগল।

টুনি একটু অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল।

পরের দিন বিকাল বেলা রাজীব নামের আট বছরের প্রডিজি ছেলেটাকে নিয়ে তার মা ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে এলেন। টুনি আগে থেকেই সময়টা জেনে রেখেছিল। সে নিজেই দরজা খুলে তাদেরকে বসার ঘরের ভেতরে নিয়ে এলো। ছেলেটার মা ঠিক যেরকম হওয়ার কথা সেরকম, একটু নাদুস নুদুস, ফর্সা এবং গোলগাল। ছেলেটার চোখে চশমা, মাথার চুল এলোমেলো,

মুখটা বড় মানুষের মতো গম্ভীর। সেটা একটা কালো টি-শার্ট আর নীল হাফপ্যান্ট পরে আছে। ছেলেটা বসল না, ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। দেওয়ালে টানানো ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।

টুনি ভিতরে গিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনল, ছোটাচ্চু ছেলেটাকে দেখেই বলল, “এই তাহলে আমাদের ইয়াং জিনিয়াস!”

ছেলেটা নিশ্চয়ই এই কথাটা অনেকবার শুনেছে তাই সেটা শুনে তার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া হলো না, ছোটাচ্চুর দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে রইল ৷

সোফায় বসে থাকা গোলগাল নাদুসনুদুস মহিলা ছেলেটাকে বললেন, “রাজীব, তুমি শাহরিয়ার সাহেবকে সালাম দাও।”

ছেলেটা মেশিনের মতো হাত তুলে সালাম দেওয়ার ভঙ্গী করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। ছোটাচ্চু বলল, “আরে না, না। আমাকে সালাম দিতে হবে না। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।’

টুনি কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “ও তোমাদের সাথে বসে থেকে কী করবে? আমাদের সাথে খেলবে। চল, ভেতরে চল।”

মহিলা শুনে মনে হলো খুবই অবাক হলেন, বললেন, “ও খেলবে?” তার কথা শুনে মনে হলো খেলা জিনিসটা খুবই ভয়ংকর কিছু–খেললে কিছু একটা সর্বনাশ হয়ে যায়। মহিলা বললেন, “ও কখনো খেলে না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কী করে?”

মহিলা বললেন, “রাজীব পড়াশোনা করে, অঙ্ক করে, প্রোগ্রামিং করে।” টুনি মাথা নেড়ে বলল, “সবসময় এসব করলে মাথা আউলে যাবে।

আস আমার সাথে, খেলবে –“

বলে টুনি কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে রাজীবের হাতটা খপ করে ধরে টেনে তাকে নিয়ে গেল। মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে হা হা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই টুনি ছেলেটাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

ছোটাচ্চু মহিলাটাকে বলল, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমাদের টুনি খুবই রেসপন্সিবল মেয়ে। রাজীবকে সে দেখে শুনে রাখবে।”

মহিলা বললেন, “কিন্তু রাজীব খুবই অমিশুক। কারো সাথে মিশতে চায় না, বন্ধু-বান্ধব নেই, নিজে নিজে থাকে। সে তো বড় মানুষের মতো তাই

বাচ্চাদের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না।

“না পারলে পারবে না, আবার চলে আসবে এখানে। আপনি কী বলতে এসেছেন সেটা বলেন, আমি শুনি।”

মহিলা নার্ভাসভাবে একটু পরে পরে দরজার দিকে তাকাতে লাগলেন। তিনি আশা করছেন তার ছেলে এক্ষুণি টুনির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু সে এলো না।

টুনি ছেলেটাকে টেনে ভিতরে নিয়ে তার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে চুপ করে থাকতে বলল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “তুমি যদি চলে যেতে চাও তাহলে চলে যেও, শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।”

ছেলেটা এখনো হকচকিয়ে আছে। বলল, “কী প্রশ্ন?”

“তুমি জ্বর তোলো কেমন করে?”

অন্য যে কোনো বাচ্চা হলে জিজ্ঞেস করতো, “জ্বর? কিসের জ্বর?” রাজীবের সেটা করতে হলো না, মুচকি হেসে বলল, “তুমি বুঝে গিয়েছ আমি নিজে করি?”

“না বোঝার কী আছে? পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, দাঁত ব্যথা এগুলো তো সোজা। কিন্তু জ্বর তোলা কঠিন। কীভাবে কর?”

“করি না। একটু গরম পানি রাখি, থার্মোমিটারটা সেখানে একবার চুবিয়ে নেই, কাউকে না দেখিয়ে।”

টুনি নিঃশব্দে হাসল, বলল,

“জিনিয়াস!”

ছেলেটা বলল, “কাউকে বলে দেবে না তো?”

“মাথা খারাপ? বাচ্চাদের কত সমস্যা–বড়রা সেগুলো কোনোদিন বুঝবে না। কোনোদিন বলব না।

ছেলেটা বলল, “থ্যাংকু।”

টুনি বলল, “এর জন্য থ্যাংকু দিতে হবে না। তুমি কী চলে যাবে নাকি আমাদের সাথে খেলবে?”

“আমি চলে যাব না। কিন্তু আমি তো কোনো কিছু খেলতে পারি না। “

“ধুর বোকা! খেলতে না পারার কী আছে!”

ছেলেটা চমকে উঠল, জীবনে কখনো কেউ তাকে বোকা বলেনি। এই প্ৰথম!

টুনি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আস আমার সাথে।”

ছেলেটা পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তোমরা কী খেলবে?”

“আজকের খেলাটা জানি না। প্রত্যেক দিন নতুন খেলা আবিষ্কার হয়।” টুনি হাঁটতে হাঁটতে টুম্পাকে পেয়ে গেল, টুম্পা একটু অবাক হয়ে রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ভাইয়াটা কে?”

“এর নাম রাজীব। তার আম্মু ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলতে এসেছে। রাজীব তাই আমাদের সাথে খেলবে।”

টুম্পার মুখে হাসি ফুটে উঠল, যে কোনো খেলা খেলতে টুম্পা সব সময় রেডি। টুনি বলল, “আগে ঝুমু খালাকে একটু নাস্তা দিতে বলে আসি।

“চল টুনি আপু।”

তিনজন মিলে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ঝুমু খালা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একটা চামুচ ঘুরাচ্ছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ঝুমু খালা, তুমি গান গাইছ কেন?”

“কেতলিতে পানি গরম করছি সেইজন্য

টুনি একটু অবাক হয়ে বলল, “কেতলিতে পানি গরম করার সময় গান গাইতে হয়?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“কেতলিতে পানি গরম করানোর সময় যদি তুমি কেতলির দিকে চায়া থাকো তাহলে হে টের পায় তখন দেরি করে। অন্যদিকে চায়া থাকলে তাড়াতাড়ি করে, সেই জন্য অন্যদিকে চায়া থাইকা গান গাইতে হয়।”

টুনি আর টুম্পা ঝুমু খালার এই রকম অনেক যুক্তি অনেকবার শুনেছে তাই তারা বেশি অবাক হলো না কিন্তু রাজীব প্রথমবার শুনেছে তাই সে ফিক করে হেসে ফেলল। ঝুমু খালা তখন রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কেডা?“

রাজীব কিছু বলার আগেই টুনি বলল, “এর নাম রাজীব। রাজীবের আম্মু ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে এসেছেন।”

“টিকটকির কাম?”

টুম্পা বলল, “টিকটকি না ঝুমু খালা, ডিকেটকটিভ।

“একই কথা।” ঝুমু খালা আবার রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বয়সে তোমার চোখে এতো বড় চশমা কেন? দিন-রাত টেলিভিশনে কার্টুন দেখ?”

রাজীব মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি কার্টুন দেখি না।”

“তাহলে?”

টুনি বলল, “মনে হয় দিন-রাত বই পড়ে, না হলে কম্পিউটারে কাজ করে সেইজন্য। তাই না রাজীব?’

রাজীব একটুখানি মাথা নাড়ল, তখন ঝুমু খালা বলল, “তার মানে তোমার মাথার ভিতরেও টুনির মতো খালি মগজ আর মগজ?”

টুনি বলল, “ঝুমু খালা, রাজীবের মাথার মগজ আমার মগজ থেকেও অনেক বেশি তেজী

“কী কও তুমি?”

“সত্যি কথা বলি।”

“তাহলে হে কি আমার ঘাসের বিচির অঙ্কটা পারব?

“জিজ্ঞেস করে দেখ।”

ঝুমু খালার সন্দেহ তবু যায় না। তারপরেও শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে কও দেখি, একটা কলাগাছের নয়টা পাতা। প্রত্যেকটা পাতায় নয়টা কানী বক। প্রত্যেকটা বকের মুখে নয়টা করে খইলসা মাছ, প্রত্যেকটা মাছের মুখে নয়টা করে ঘাসের বিচি। সব মিলিয়ে কয়টা বিচি? দেখি তুমি পার কি না–”

ঝুমু খালা কথা শেষ করার আগেই রাজীব বলল, “ছয় হাজার পাঁচশ একষট্টিটা।”

ঝুমু ঝালা প্রথমে হা করে তাকিয়ে রইল, তারপর হেসে ফেলল বলল, “তুমি এই অঙ্কটা আগে শুনছ।”

রাজীব বলল, “না। শুনি নাই।”

“তাহলে এতো তাড়াতাড়ি কেমন করে কইলা?”

রাজীব ইতঃস্তত করে চুপ করে রইল, টুনি বলল, “আমি তোমাকে বলেছি না ঝুমু খালা রাজীবের মাথার মগজ তোমার আমার মগজ থেকে অনেক বেশি তেজী! রাজীব আরো কঠিন অঙ্ক করতে পারে।

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, খাইলশা মাছের বদলে মাগুর মাছ দিয়ে দাও মুখে আরো বেশি করে ঘাসের বিচি দাও, সেইটাও মনে হয় পারবে।

ঝুমু খালা বলল, “তুমি একটা দুধের বাচ্চা আরো কঠিন অঙ্ক করতে পারবা?”

রাজীব মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা বলল, “কতো কঠিন পারবা?”

রাজীব বলল, “যেমন মনে করেন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, একটা ইউনিভার্সে নয়টা গ্যালাক্সি, প্রত্যেকটা গ্যালাক্সিতে নয়টা প্লেনেটারি সিস্টেম, প্রত্যেক প্লেনেটারি সিস্টেমে নয়টা গ্রহ, প্রত্যেকটা গ্রহে নয়টা মহাদেশ, প্রত্যেকটা মহাদেশে নয়টা দেশ, প্রত্যেকটা দেশে নয়টা বিভাগ, প্রত্যেক বিভাগে নয়টা জেলা, প্রত্যেকটা জেলায় নয়টা উপজেলা, প্ৰত্যেকটা উপজেলায় নয়টা গ্রাম, প্রত্যেকটা গ্রামে নয়টা মাঠ, প্রত্যেকটা মাঠে নয়টা বাগান, প্রত্যেকটা বাগানে নয়টা কলাগাছ, প্রত্যেকটা কলাগাছে নয়টা পাতা, প্রত্যেকটা পাতায় নয়টা বক, প্রত্যেকটা বকের মুখে নয়টা মাছ, প্রত্যেকটা মাছের মুখে নয়টা ঘাসের বিচি তাহলে আমি চেষ্টা করলে মনে হয় সেইটাও বলতে পারব।“

ঝুমু খালা হাত দিয়ে ঠাস ঠাস করে তার কপালে মেরে বলল, “বলে কী এই ছেলে? এই রাজীব তো দেখি আজিব। আজিব রাজীব!”

টুনি হাসিমুখে বলল, “আমি বলেছি না এই ছেলের মগজ তোমার আমার মগজ থেকে অনেক বেশি তেজি, হাজার গুণ পাওয়ারফুল!”

ঝুমু খালা বলল, “তাহলে বল দেখি কয়টা ঘাসের বিচি হয়?”

রাজীব চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে তাকালো, নাক মুখ কুঁচকে চিন্তা করতে লাগল, দেখে মনে হলো তার পেট ব্যথা করছে। তারপর চোখ খুলে বলল, “আঠারো কোটি তেপান্ন লক্ষ দুই হাজার আঠারো কোটি আটাশি লক্ষ একান্ন হাজার আটশ একচল্লিশটা ঘাসের বিচি।”

ঝুমু খালা আবার তার কপালে ঠাস ঠাস করে মারল, বলল, “তুমি একটা কাগজে লেইখা দিয়া যাও, আমি মুখস্ত করে ফেলব!”

রাজীব হাসি চেপে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এটা কেন মুখস্ত করবেন?”

“সবাইরে জিজ্ঞেস করব! দেখি আর কেউ পারে কিনা।”

“ঠিক আছে, আমি লিখে দেব।“

“অঙ্কটাও লেইখা দিও, সেইটাও মুখস্ত করে ফেলব।”

“ঠিক আছে।”

টুনি বলল, “বুঝেছ ঝুমু খালা, ও আমাদের গেস্ট, অনেক বিখ্যাত গেস্ট, সেজন্যে তোমার কাছে এসেছিলাম বলার জন্য, তুমি আজকে খুব ভালো করে নাস্তা দিও!”

“ঠিক আছে।” তারপর রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজিব রাজীব! তোমার কী খেতে ভালো লাগে বল। কী খেতে চাও?”

রাজীব বলল, “আমাকে বাসায় মিষ্টি খেতে দেয় না। আমার মিষ্টি খেতে অনেক ভালো লাগে!”

ঝুমু খালা বলল, “গুড! রসমালাই কামিং। সাথে সিংগাড়া আর কাবাব।“

টুম্পা স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, “আমার খালা তোমার খালা ঝুমু খালা ঝুমু খালা!”

রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় টুনি বলল, “তোমার কেতলির পানি মনে হয় ফুটে গেছে!”

ঝুমু খালা দাঁত বের করে হেসে বলল, “এইজন্য কেতলির দিকে নজর দিতে হয় না, তাহলে তাড়াতাড়ি ফুটে!”

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে টুনি টুম্পাকে বলল, “টুম্পা তুই যা দেখি যাদেরকে পাস খুঁজে নিয়ে আয়, আমরা এখন রাজীবকে নিয়ে খেলব!”

“কী খেলব টুনি আপু?”

“কোনো মজার খেলা–রাজীব মনে হয় কোনো খেলাই জানে না!” রাজীব মাথা নেড়ে জানাল, কথাটা সত্যি। টুনি বলল, “তুই যা, আমি শাহানা আপুর সাথে একটু দেখা করে আসছি।”

“ঠিক আছে।“

টুনি রাজীবকে নিয়ে শাহানার রুমে গেল। শাহানা একটা পেন্সিল চিবাতে চিবাতে একটা খাতার উপর ঝুঁকে কিছু একটা দেখছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী করছ শাহানা আপু?”

“একটা ক্যালকুলাস প্রবলেম।” রাজীবের দিকে তাকিয়ে কলল, “এই বাচ্চা কে? আগে দেখিনি।“

“ঝুমু খালা নাম দিয়েছে আজিব রাজীব।”

“আজিব রাজীব? কেন? এই আজিব নাম কেন?”

টুনি বলল, “সেটা তুমি ঝুমু খালাকেই জিজ্ঞেস কর।”

রাজীব একটু এগিয়ে শাহানা আপুর খাতার দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা দেখে শাহানা আপুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। শাহানা আপু জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?”

“না, না।”

টুনি বলল, “কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল।

রাজীব ইতঃস্তত করে বলল, “আপনি ভেরিয়েবল ট্রান্সফর্মেশন করে চেষ্টা করেন, হয়ে যাবে। এক্স স্কয়ার প্লাস ফাইভ সমান জেড ধরতে পারেন।”

শাহানা আপুর চোয়াল ঝুলে পড়ল। বলল, “তোমার বয়স কত?”

“আট। আট বছর তিন মাস।”

“তোমার বয়স আট বছর আর তুমি ক্যালকুলাসের এই প্রবলেমটা এক নজর দেখেই বলে দিলে কীভাবে করতে হবে?”

রাজীব নিচু গলায় বলল, “আই এম সরি।

“সরি? সরি কেন?”

“না, এইতো সবার ব্যাপারে আমি নাক গলাই, কিছু একটা বলে ফেলি, এটা ঠিক না।”

শাহানা আপু অবাক হয়ে বলল, “কেন? ঠিক না কেন?”

“এর মাঝে নিজেকে দেখানোর একটা ভাব চলে আসে। এটা খুব খারাপ অভ্যাস। বিশেষ করে আমি যেহেতু ছোট–”

শাহানা আপু কী বলবে বুঝতে পারল না। একটু পরে বলল, “তুমি কী জান যে তুমি একটা প্রডিজি?”

রাজীব মাথা নাড়ল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“তুমি নিশ্চয়ই আরো অনেক কিছু করতে পার যেটা তোমার বয়সী বাচ্চারা পারে না।

রাজীব আবার মাথা নাড়ল, বলল, “আমি সেটা কাউকে জানতে দিতে চাই না। আমার আব্বু আম্মু ঠিক উল্টা, সবাইকে সব সময় বলে বেড়ায় টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করতে চায়, পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতে চায়। আমার অনেক যন্ত্রণা।’

শাহানা বলল, “কেন তুমি কাউকে জানতে দিতে চাও না? সবাই তো বিখ্যাত হতে চায়। তুমি তো বিখ্যাত হয়ে বসে আছ!”

“আমি কম্পিউটার প্রডিজির উপরে যত লেখা পাওয়া যায় সব পড়ে ফেলেছি। আমি দেখেছি ছোট থাকতে যারা প্রডিজি থাকে বড় হতে হতে তারা অন্যদের মতো সাধারণ হয়ে যায়। তাহলে ছোট থাকতে জিনিয়াস হয়ে লাভ কী?”

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “এখন আমার মনে পড়েছে। আম্মু সাইকোলজির উপর যে বই এনেছিল সেখানেও এটা লেখা ছিল।”

রাজীব বলল, “আরো অনেক সমস্যা আছে।”

“কী সমস্যা?’

“ছোট থাকতে সব কিছু সহজ মনে হয়, শিখতে কোনো পরিশ্রম হয় না, তাই তারা কষ্ট করতে শিখে না। বড় হলে উল্টো ঝামেলায় পড়ে। অনেক সময় লেখাপড়াই হয় না। সেজন্য বাবা-মায়ের খুব কেয়ারফুল থাকতে হয়। আমার মা-বাবা এগুলো জানে না, বুঝে না, শুধু আমাকে সার্কাসের জন্তুর মতো দেখিয়ে বেড়াতে চায়, বাচ্চাদের সাথে মিশতেও দেয় না। “

টুনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আট বছরের বাচ্চা কিন্তু কতো সুন্দর করে বড় মানুষের মতো কথা বলছে! বাচ্চার গলার স্বর তা না হলে বোঝাই যেতো না যে একটা ছোট বাচ্চা কথা বলছে, মনে হতো বড় মানুষ কথা বলছে।

টুনি বলল, “আমি একটা কথা বলি?”

রাজীব বলল, “বল।”

“তোমার বয়স মাত্র আট হলেও তুমি আসলে একটা বড় মানুষের মতো। তোমার জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ তুমি খুব ভালো করে জান। তাই তুমি ঠিক ঠিক জিনিসগুলো করার চেষ্টা কর”

“আমি তো তাই করতে চাই কিন্তু আমার আব্বু আম্মু সেগুলো করতে দেয় না।”

“চেষ্টা করতে থাকো। তুমি পারবে।”

শাহানা আপু বলল, “আমাদের টুনির কিন্তু অনেক বুদ্ধি। সে কিন্তু তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।“

রাজীব মাথা নাড়ল, বলল, “আমি টের পেয়েছি!”

“কীভাবে টের পেলে?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “বলা যাবে না। এইটা আমাদের দুইজনের সিক্রেট।”

ঠিক তখন হুড়মুড় করে অনেকগুলো বাচ্চা একসাথে ঘরে ঢুকলো একজন বলল, “আমাদের বাসায় নাকি একজন বাচ্চা আইনস্টাইন এসেছে! ঝুমু খালা তার নাম দিয়েছে, আজিব রাজীব।”

টুম্পা রাজীবের হাত ধরে বলল, “এই যে আজিব রাজীব!”

সবাই রাজীবের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। মুনিয়া কাছে এসে একবার ছুঁয়ে দেখল!

টুনি বলল, “চল ছাদে, খেলি গিয়ে!”

“কী খেলব?”

“বুদ্ধির খেলা খেলা যাবে না, তাহলে কেউ রাজীবের সাথে পারবে না! খেলতে হবে হুটোপুটি খেলা, কাড়াকাড়ি ঝাঁপাঝাঁপি খেলা।”

শান্ত বলল, “আমার ওপর ছেড়ে দাও! এমন খেলা খেলব যে কেউ আস্ত ফিরে আসবে না–শরীরের কোনো না কোনো টুকরা রেখে আসতে হবে।”

সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, “ইয়েস! ইয়েস!”

যখন সবাই মিলে ছাদে উঠছে তখন মুনিয়াকে দেখা গেল বিড়বিড় করে

কী যেন বলছে। টুনি বলল, “কী বলিস মুনিয়া?”

মুনিয়া বলল, “উ-উ-উ-”

“উ-উ-উ-? মানে কী?“

“মনে নাই ছোটাচ্চু কী করবে সেটা উ দিয়ে শুরু? শব্দটা কী চিন্তা করে পাচ্ছি না।”

রাজীব মুনিয়ার কথা শুনে বলল, “উ দিয়ে তো খুব বেশি শব্দ নেই ৷ আর কিছু একটা করা জাতীয় শব্দ তো আরো কম। এক হতে পারে উকিল না হয় উপন্যাস।”

টুনি বলল, “উকিল হবে না, ছোটাচ্চু তো উকিলের পড়া পড়ে নাই। পড়লেও ফেইল করবে।”

মুনিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, “তার মানে উপন্যাস! ছোটাচ্চু নিশ্চয়ই উপন্যাস লিখবে। তাই না টুনি আপু?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই বলে যে একটা উপন্যাস লিখবে।

মুনিয়া বলল, “তাহলে আগের শব্দটা কী হবে? ‘কা’ দিয়ে শব্দ?”

রাজীব বলল, “পরের শব্দটা উপন্যাস হলে তো সোজা। তাহলে কা দিয়ে আগের শব্দটা হচ্ছে কালজয়ী! তোমার ছোটাচ্চু একটা “কালজয়ী উপন্যাস’ লিখবে!”

মুনিয়া আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “ঠিক বলেছ! কালজয়ী উপন্যাস! কালজয়ী উপন্যাস!”

সবাই ঘুরে তাকালো, কিন্তু কেউ বেশি অবাক হলো না। এই বাসায় বেশির ভাগ কথাবার্তাই হয় চিৎকার আর চেঁচামেচি করে!

.

ছাদে চামুচ কাড়াকাড়ির একটা ভয়ংকর খেলা যখন মাঝামাঝি পর্যায়ে, সবারই হাত-পা কিংবা কনুইয়ের ছাল অল্প বিস্তর উঠে গেছে তখন ঝুমু খালা এসে খবর দিল নিচে নাস্তা দেওয়া হয়েছে এবং সবাইকে নাস্তা খাওয়ার জন্য নিচে ডাকা হচ্ছে। রাজীবের মা নাস্তা খেয়েই রাজীবকে নিয়ে চলে যাবেন।

শান্ত প্রায় হুংকার দিয়ে বলল, “এখনই চলে যাবেন মানে? আমাদের খেলা মাত্র জমে উঠেছে!”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ, রাজীব ভাইয়া এখনই যেও না।”

টুম্পা বলল, “এতো তাড়াতাড়ি গিয়ে কী করবে?”

তবে নাস্তার কথা শুনে সবাই হুড়মুড় করে নিচে রওনা দিল।

নিচে বাইরের ঘরে রাজীবের মা রাজীবের চকচকে ঘামে ভেজা মুখ দেখে বেশ অবাক হলেন। বললেন, “কী হলো রাজীব? তোমার কী হয়েছে?”

“খেলছিলাম।”

“কী খেলছিলে?”

“চামুচ ছিনতাই। খুবই ইন্টারেস্টিং খেলা। কিন্তু একটু ডেঞ্জারাস।

টুম্পা বলল, “শান্ত ভাইয়া আউট না হওয়া পর্যন্ত একটু না, অনেক ডেঞ্জারাস।”

মুনিয়া বলল, “শান্ত ভাইয়া চোট্টামি করে সেই জন্যে তাকে আউট করা যায় না।

শান্ত চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি? আমি চোট্টামি করি? দিব একটা চাটকানি — “

ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “ব্যাস অনেক হয়েছে। কাউকে কারো চাটকানি দিতে হবে না। সবাই চুপচাপ বসে নাস্তা খা।

শান্ত আস্ত একটা কাবাব মুখে ঢুকিয়ে চিবুতে চিবুতে অস্পষ্টভাবে বলল, “ঝুমু খালা কতো নাস্তা এনেছে দেখেছ?”

ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “মুখে খাবার নিয়ে কথা বলছিস কেন? এটা কী রকম অভ্যাস?”

প্রমি বলল, “তুমি এতো অবাক হচ্ছ কেন? এটাই তো শান্তর স্টাইল।”

শান্ত কাবাবটা গিলে ফেলে বলল, “তোমাদের যন্ত্রণায় আমি শান্তি মতো খেতেও পারি না।”

প্রমি বলল, “থ্যাংকু ঝুমু খালা এতো রকম নাস্তা বানানোর জন্য। এতো খিদে পেয়েছিল মনে হচ্ছে আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব!”

ঝুমু খালা বলল, “ঘোড়া খেতে চাইলে অন্য জায়গায় যাও! আমি তোমাগো জন্য ঘোড়া রানতে পারমু না।

ঝুমু খালার কথা শুনে সবাই অকারণে হি হি করে হাসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হাসে রাজীব!

রাজীবের আম্মু অবাক হয়ে রাজীবের দিকে তাকিয়েছিলেন। তার গম্ভীর টাইপের শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ করে কেমন জানি হাসি খুশি এবং চঞ্চল হয়ে গেছে। অন্য বাচ্চাদের মতো হইচই করছে, কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে, ধাক্কা ধাক্কি করছে, একটুতেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। এতো অল্প সময়ে এই ছোট বাচ্চার মাঝে এতো বড় পরিবর্তন? রাজীবের আম্মু তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “রাজীব, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। বাসায় যেতে হবে।”

রাজীব রস মালাইয়ের রসটা সশব্দে চুষতে চুষতে বলল, “আরো কিছুক্ষণ থাকি আম্মু? আমাদের খেলাটা শেষ করে যাব।”

রাজীবের আম্মু বললেন, “আমি কতোক্ষণ বসে থাকব? আমার কাজ শেষ।”

“তুমি চলে যাও আম্মু। গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দাও।”

একসাথে সব বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, গাড়িটা পাঠিয়ে দেন, রাজীব খেলবে আমাদের সাথে।”

কেউ যেন শুনতে না পারে সেইভাবে শান্ত ফিসফিস করে বলল, “আমিও এই পিচ্চিরে দিয়ে আমার সব হোমওয়ার্ক করিয়ে নিব!”

রাজীবের আম্মু বললেন, “ভুলে গেছ রাজীব, প্রফেসর কামরুল আজকে সন্ধেবেলা আসবেন? তোমার সাথে ফিজিক্স নিয়ে কথা বলবেন, দেখবেন তোমাকে ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের সাথে ক্লাশ করতে দেওয়া যায় কিনা?”

রাজীব বলল, “ফোন করে না করে দাও আম্মু। আমার ইচ্ছা করছে না।”

রাজীবের আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “ইচ্ছা করছে না?”

রাজীব মাথা নাড়ল, “নাহ্! এতো তাড়াহুড়ার কী আছে আম্মু? ধীরে সুস্থে অন্য সবার মতো লেখাপড়া করি। তাছাড়া–’

“তাছাড়া কী?”

“তাছাড়া আমার বেশি লেখাপড়া করার দরকার নাই। আমি ঠিক করেছি বড় হয়ে ক্রিকেট প্লেয়ার হবো।”

রাজীবের আম্মু চা খেতে খেতে বিষম খেলেন। বললেন, “ক্রিকেট পেয়ার?”

“হ্যাঁ। শান্ত ভাইয়া বলেছে আমাকে শিখিয়ে দেবে।”

শান্ত রসমালাই মাখামাখি করে খেতে খেতে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “শিখিয়ে দেব। আসল ক্রিকেট বল দিয়ে খেলা হবে- “

রাজীব বলল, “আর যদি ক্রিকেট প্লেয়ার না হতে পারি তাহলে বাওয়ালি হয়ে যাব ৷“

রাজীবের আম্মু আরো একবার বিষম খেলেন, “বাওয়ালি?”

“হ্যাঁ। সুন্দরবনে মধু আনতে যায়।”

মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “আমিও যাব! আমিও যাব! রাজীব ভাইয়া আমাকে নিয়ে যেও। প্লিজ। প্লিজ।”

“ঠিক আছে।” রাজীব মাথা নাড়ল, “তোমাকে নিয়ে যাব।”

.

রাজীবের আম্মু যখন রাজীবকে রেখে একা একা ফিরে যাচ্ছিলেন তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তার মহা প্রতিভাবান ছেলেটা কেমন করে হঠাৎ খুবই সাধারণ ছোট একটা বাচ্চা হয়ে গেছে। যে বাচ্চাটিকে কোনোদিন হাসতে দেখেনি সে হি হি করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে, যার কখনো কোনো বন্ধু হয়নি সে অন্য বাচ্চার সাথে হুটোপুটি করছে, ধাক্কাধাক্কি করছে। যে এতদিন একটা বড় বিজ্ঞানী হবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলেছে বড় নৌকা করে সবাইকে নিয়ে বাওয়ালি হয়ে মধু আনতে যাবে। কী আশ্চর্য! রাজীবের আম্মু বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এতো অল্প সময়ের মধ্যে তার ছেলের এতো বড় একটা পরিবর্তন হবে যে তাকে একা একটা অপরিচিত বাসায় কিছু বিচিত্র ছেলেমেয়ের কাছে রেখে যেতে হবে।

.

রাজীব বেশ রাতে ফিরে গেল। যাওয়ার আগে তাকে ঝুমু খালার অনেকগুলো আজব আজব অঙ্কের সমাধান করে যেতে হলো। যখনই সময় পাবে তখনই চলে আসবে সবাইকে এই কথা দিয়ে রাজীব তাদের গাড়িতে উঠল। রাজীবের পকেটে কড়কড়ে একটা নতুন দশ টাকার নোট, তার জীবনের প্রথম উপার্জন। শান্তর হোমওয়ার্ক করে দেওয়ার জন্য শান্ত গোপনে রাজীবকে এটা বখশিস হিসেবে দিয়েছে।

রাজীবকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য বাসার প্রায় সবাই নিচে নেমে এসেছিল। তার গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার পর ছোটাচ্চু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই টুকুন ছোট একটা বাচ্চা অথচ তাকে কত বিপদের মাঝে থাকতে হয়!”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী বিপদ ছোটাচ্চু?”

“পিছনে অনেক শত্রু। কখন কী করে ফেলে! এদেরকে বের করার জন্যই তো তার মা আমার কাছে এসেছিলেন।”

টুনি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “তোমাকে একটা কথা বলি ছোটাচ্চু?”

“বল।”

“তুমি রাজীবের আম্মুকে বল যেন তাকে টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করার জন্য না হয় পত্রিকার ইন্টারভিউয়ের জন্য নেওয়ার চেষ্টা না করেন। তাহলেই দেখবে সব শত্রু নাই হয়ে গেছে!”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”

টুনি বলল, “ভুলে গেছ আমি তোমার এসিস্টেন্ট? তুমি যেরকম ডিটেকটিভ, আমিও সেই রকম ডিটেকটিভ!”

ছোটাচ্চু আরেকটু কী বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মুনিয়া এসে চিৎকার করে বলল, “ছোটাচ্চু তুমি কী করবে আমরা বের করে ফেলেছি!”

“বের করে ফেলেছিস

“হ্যাঁ।”

“কী করব?”

“তুমি একটা উপন্যাস লিখবে। কালজয়ী উপন্যাস! ঠিক বলেছি কী না?”

ছোটাচ্চু কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “মানে, মানে, ইয়ে-কেমন করে বের করলি?”

“আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স!”

“আ-আ-আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স?” ছোটাচ্চু মুখ হা করে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল!

.

রাজীব যাওয়ার আগে এই বাসার বাচ্চাদের অনেক নতুন শব্দ শিখিয়ে গেছে। সময় মতো সেগুলো ব্যবহার হবে–ছোটাচ্চু সেটা তখনো জানে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *