নিকট কথা – উপন্যাস – সমরেশ মজুমদার
আজকাল এটা খুব হচ্ছে। আর কারও হচ্ছে কি না জানি না, আমার হচ্ছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই গা গুলিয়ে ওঠে, বমি পায়। নিজের পাছায় লাথি মারা যায় না বলে সেই বমিটা গিলে ফেলি। আমি তাই চেষ্টা করি কম কথা বলতে, একদম যদি না বলতে পারতাম তাহলে মন্দ হত না।
আমি যে বাড়িটায় থাকি সেটা তৈরি হয়েছিল আমার জন্মানোর বহুবছর আগে। একতলার কোণের ঘরটা আমার জন্যে বরাদ্দ। ঘরটায় সুবিধে হল রাস্তা দিয়ে ঢোকা যায় আবার ভেতরে যাওয়ার দরজাও আছে। ওই ঘরেই আমি থাকি আর আমি কথা বলতে ভালবাসি না। সেটা বাড়ির সবাই জেনে গেছে বলে আমায় কেউ বিরক্ত করে না। আমার বয়স এখন আঠাশ।
আমার বার্থ সার্টিফিকেটে যে জন্ম-তারিখ লেখা রয়েছে সেটা ধরলে আমার বয়স এখন সাতাশও হয়নি। স্কুলে ভর্তি করার সময় কর্পোরেশনকে ম্যানেজ করে বাবা একটা বার্থ সার্টিফিকেট জোগাড় করে ভেবেছিল, ছেলের আয়ু এক-দেড় বছর বাড়িয়ে দিলাম। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, আমার সঙ্গে পড়ত এমন অনেক ছেলের দেখেছি দু’নম্বরি বয়স করে দিয়েছে বাপ মা। জিজ্ঞাসা করলে তেনারা বলবেন, যা চাকরির বাজার, হাতে দেড় এক বছর থাকলে খোঁজাখুজির সুবিধে হবে। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয়েছিল আমরা চাকরি পাব না ঠিক সময়ে, দরজায় দরজায় খুব ঘুরতে হবে এবং সেই ফাঁকে সময়সীমা ফুরিয়ে যেতে পারে, তাই ওই বাড়তি সময়টুকু দিলে আমাদেরই উপকার হবে। বার্থ সার্টিফিকেটের কথা কিন্তু মা-বাবার মনে নেই। আমার পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত এ বাড়িতে পায়েস হত ঠিকঠাক জন্মদিনে। পনেরো বছর বয়সে মা মারা যান।
আমার একটা এম. এ. ডিগ্রি আছে। বঙ্গসন্তান স্কুল থেকে বেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে। কেন ভর্তি হচ্ছে, যেটা পড়ছে সেটা পড়ে পরে কী উপকারে লাগবে। এ নিয়ে কেউ ভাবে না। তুমি এম.এ. পাশ করেছ, টাকাপয়সা খরচ করে পড়িয়েছি এতদিন, এবার চাকরি করে সংসারের উপকারে এসো। কিন্তু ইতিহাস, বাংলা অথবা ফিলজফি নিয়ে পঞ্চাশ বাহান্ন পেয়ে পাশ করে হাত পাতলে যে চাকরি পাওয়া যায় না, এ কথাটা ওঁরা যখন বিশ্বাস করবেন তখন ওঁদের কাছে আমরা ঘি শুকিয়ে যাওয়া ছাই-এর গাদা ছাড়া আর কিছু নই।
এই এক গ্যাঁড়াকল। পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কলেজে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনবছর ধরে হিউমানিটিজ গ্রুপের বিষয়গুলো পড়ানোর অভিনয় করা হয়। ছেলেমেয়েগুলো সেই বৈতরণী পার হবার পর দ্যাখে অর্জিত বিদ্যা কোনো কাজে লাগছে না। স্কুলে মাস্টারি করতে গেলেও এম.এ. ক্লাশে ভর্তি হতে হবে। আবার দু’বছর। তারপর সমস্ত রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা স্কুলগুলোর একজন বাংলা বা ফিলজফির মাস্টার মশাই কবে অবসর নেবে আর তার সেই চেয়ারটির দিকে শকুনের মতো তাকিয়ে থাকবে হাজার হাজার বাংলা অথবা ফিলজফির এম.এ. প্রতিবছর যাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দু-চারজনের কপালে শিকে ছিঁড়তে পারে, বাকিরা ঢুকে যায় কেরানির চাকরিতে তাও ভাগ্য সহায় থাকলে। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর অথবা ভাষার ইতিবৃত্ত পড়ে কী লাভ হল ছেলেটির? প্রশ্ন করলে উত্তর একটাই, জ্ঞানার্জনের জন্যে পড়াশুনা। নিজেকে শিক্ষিত করতে, ঐতিহ্য বহন করতে এই শিক্ষানবিশি। পেটে যার ভাত নেই তাকে দিনরাত রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বলার মতো ব্যাপার। আসলে স্কুলের পর পাঁচবছর এত হাজার হাজার ছেলেকে ভুলিয়ে রাখা গেল, এটাকে যারা লাভ বলে মনে করেন তাঁদের কাছে মুরগি আর কুকুরের মাংসের কোনো পার্থক্য নেই। বিকেলবেলায় চমৎকার চপ কাটলেট ভেজে হাসিমুখে খদ্দেরের প্লেটে ধরে দিতে অসুবিধে হয় না।
দেখে শুনে মনে হয় আমরা শালা কুত্তার থেকেও অধম। রাস্তার ঘেয়ো কুত্তার কথা বলছি না। বাড়িতে বাড়িতে যেসব কুত্তা আদরে মানুষ হয় তারা আমাদের থেকে ঢের ভাল আছে। আমার এক মাসতুতো বোন তার কুকুরকে কাঁটামাছ খেতে দেয় না, গলায় কাঁটা ফুটে যাবে বলে। বমি বা পায়খানা করলে আদুরে গলায় ধমক দেয়, নো কিটি নো। তোমাকে কতবার বলেছি এসব পেলে টয়লেটে যাবে। লোকে দেখলে বলবে তোমাকে আমি কিছুই শেখাইনি। এইসব বলতে বলতে সে যখন বস্তুগুলো পরিষ্কার করছে তখন তার কিটি পাশে বসে লেজ নাড়ছে কান ঝুলিয়ে প্রসন্ন মুখে।
এই যে আমি কুত্তার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করলাম, এটা আমার ভাল লাগল না। মুশকিল হল, কারও সঙ্গে যে কথা বলে না তার মনে সবসময় কথার খই ফোটে। আমি কেন বেঁচে আছি এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু উত্তরটা আমি সবসময় খোঁজার চেষ্টা করি। আর এই চেষ্টার জন্যে মনে হরেক রকম ভাবনা চুলকে ওঠে। কুত্তা-ভাবনাটা সেই কারণেই।
আমি এম.এ. পাশ করেছিলাম বাংলা নিয়ে। বাংলাদশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তাদের চেষ্টায় বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর অন্যতম স্বীকৃত ভাষা। ওরা যে ভাষার জন্যে জীবন দিয়ে হাততালি পায় আমি সেই ভাষায় এম.এ. পাশ করে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়েছি এতদিন। এটাকে কী বলব? কলকাতায় যখন কেউ কেউ একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে তখন তাদের ভণ্ডামি দেখে পিত্তি জ্বলে যায়!
হ্যাঁ, শব্দটা এতক্ষণে মাথায় এল। আমি আমার চারপাশে শুধু একের পর এক ভণ্ড দেখে। যাচ্ছি। এত ভণ্ড একসঙ্গে বাস করে কী করে? এখন মনে হয় এই প্রশ্নটা করাও বোকামি। অন্ধদের দেশে তাঁরা তাঁদের মতো করে বেঁচে ছিলেন। একজন চক্ষুষ্মান সেখানে হাজির হয়ে নানা অসঙ্গতি দেখে মানিয়ে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সে চোখ বন্ধ করে ফেলতেই সব কিছু সহজ হয়ে গেল তার কাছে।
এদেশে বাস করতে হলে সবাইকে ভণ্ড হয়ে থাকতে হবে। মুখে এক কথা, মনে আর এক, কাজ করব যা ভাবব অন্য। এ না হলে তোমার টায়ার পাংচার। আমার বাবা রাজনীতি করেন। গত কুড়ি বছর শাসকদলের হয়ে কাজ করছেন। নিচের দিকের কমিটি ডিঙিয়ে পার্টির ওপর দিকের কমিটিতে পৌঁছে গিয়েছেন। এখন তাঁর হাতে দলের অনেক কিছু দায়িত্ব। কিন্তু তিনি কখনও নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। একটা ভেজা কাককেও দলের নমিনেশন পেলে তিনি নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে পারেন তবু নিজে দাঁড়াতে চাইছেন না। এই ব্যাপারটাকে লোকে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে দ্যাখে। পার্টির জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে ক’জন পারে?
এই ভদ্রলোক চাকরি করতেন কর্পোরেশনে। কুড়িবছর আগে যখন দল ক্ষমতায় আসেনি তখন উনি এগারোটার মধ্যে অফিসে যেতেন। দল ক্ষমতায় এলেন তার উপর এত চাপ পড়ল যে তিনি একটার আগে সেখানে পৌঁছতে পারতেন না। কোন কোনোদিন সেটাও সম্ভব হত না। অথচ মাইনেপত্তর ঠিকঠাকই পেতেন। সেসময় বাড়িতে আর একধরনের লোক আসত। তাদের কেউ কেউ কর্পোরেশনের কর্মচারী, বাকিরা কর্পোরেশনের অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী। আড়াল থেকে কথাবার্তা শুনে মনে হত, বাবার হাতে একটা বিশেষ চাবি আছে যা দিয়ে তিনি যে কোনো ইচ্ছার দরজা খুলে দিতে পারেন। তা এই করতে করতে বাবা যখন আরও ওপরতলায় উঠে এলেন তখন নিজের যা প্রাপ্য বুঝে নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। অবশ্য আমার একভাই একবোন কর্পোরেশনে চাকরি করছে। সল্টলেকে দু-দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া খাটছে। হ্যান্ডলুমের পাজামাপাঞ্জাবি বাবা শরীর থেকে নামাননি, আমাদের সংসারের খরচ যেমন চলছিল তেমনই চলছে। এখন শুধু সকাল হলেই বাইরের ঘরে ভিড়। এলাকার ভাড়াটে বাড়িওয়ালা, কারখানার মালিক শ্রমিক থেকে রাজ্যের গোলমাল ঢেউ-এর মতো বাবার পায়ে এসে আছড়ে পড়ছে এবং তিনি সেগুলোর সুরাহা করে দিচ্ছেন।
বছর তিনেক আগে কাগজে খবর পড়ে কৌতূহল হয়েছিল। বিখ্যাত এক গুরুদেব এসেছিলেন কলকাতার উপকণ্ঠে। দেখতে গিয়েছিলাম। তখন বিকেলবেলা। বাস থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করতেই লোকে উৎসাহ নিয়ে দেখিয়ে দিল। বাড়ির সামনে খুব ভিড়। পাগলের মতো লোকে ঢুকতে চাইছে। স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ সেই ভিড় সামলাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লাইন করে দেওয়া হলো। অতবড় লাইন আমি ইডেন গার্ডেনেও দেখিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত শুনে গেলাম বাবার অযৌক্তিক কাহিনিগুলো। ক্যানসার তো বটেই এখন নাকি উনি এইডসও সারিয়ে দিচ্ছেন স্পর্শ করে। বুঝতে পারলাম লাইনের বেশিরভাগ মানুষ কঠিন অসুখে ভুগছেন অথবা অসুস্থদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। তিনঘণ্টার অপেক্ষা আমাকে পৌঁছে দিল যে ঘরে সেখানে ষণ্ডামার্কা স্বেচ্ছাসেবকরা রয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে একটা দড়ি দরজা গলে ওঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রয়েছে। আমার আগের মানুষটি সেই দড়ি ধরে তার প্রার্থনা নিবেদন করছে করুণ গলায়। তিরিশ সেকেন্ড হওয়া মাত্র জোর করে তাকে বের করে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বলল, তিরিশ সেকেন্ড! তিরিশ সেকেন্ডে যা বলার বাবাকে বলে দিন।
তিনি কোথায়? আমি অবাক!
আরে! ওই দড়িটা দেখছেন না?
কিন্তু এটা তো বাবা নন?
যাচ্ছলে। কোথায় থাকো তুমি। দ্বিতীয়জন বলল, ওই দড়ির প্রান্ত বাবা দোতলার ঘরে বসে বাঁ পায়ে ছুঁয়ে আছেন। ওটা ধরলেই বাবা তোমাকে টের পেয়ে যাবেন।
টেলিফোনের লাইনের মতো কথা বলা যাবে?
আরে, বলবে তো বলো নইলে কেটে পড়।
আমি দড়িটা ধরে জোরে টান মারলাম কিন্তু ওটা বেশ শক্ত আর নাড়ানো গেল না। মনে হল ওই দড়ির প্রান্ত ওপাশে, চোখের আড়ালে কোনো শক্ত খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে। ততক্ষণে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হলো। আমার পরের লোকটি হামলে পড়ল দড়ির ওপর।
গুরুদেব সে-সময় কী করছেন কেউ জানে না, শুধু ওই দড়ি ধরে বৈতরণী পার হবার জন্যে যে আকুলতা ভক্তদের মধ্যে দেখেছি তাতে নিজেকে জুতোতে ইচ্ছে করছিল। এঁরাই আমাদের বাবা কাকা দাদা জেঠা। এঁদের সঙ্গেই আমরা বাড়িতে বাড়িতে বাস করি শ্রদ্ধা নিয়ে। চমৎকার।
ইদানীং আমার বাবা সেইরকম গুরুদেবের ভূমিকা নিয়ে ফেলেছেন। ওপরতলায় উঠলেই ক্ষমতা আসে হাতে, আর ক্ষমতা এলেই চামচে জুটে যায়। বাবারও জুটেছে। তারা পার্টিরই কর্মী। ওপরে ওঠার ইচ্ছে যতটা গুছিয়ে নেবার সাধ তার চেয়ে ঢের বেশি। লোকজন জেনে গেছে বাবা প্রসন্ন হলে এম.এল.এ. হতে বাধ্য, রাইটার্স থেকে ফাইল নড়বে দূরের কথা, যাকে বলে ছুটবে, ঠিক তাই। কিন্তু ইদানীং তাঁরা আমার বাবার দর্শন পাচ্ছেন না। এত লোকের সঙ্গে জনে জনে কথা বলার মতো সময় তাঁর নেই। অতএব চামচেরা স্ক্রুটিনি করে। স্তোক দেয় অথবা কাটায়। যাঁর ভাগ্য খুব ভাল তিনি বাবার দর্শন পান। আগে বাবা বসতেন আমাদের বাইরের ঘরে। এখন আর একটি ভেতরের ঘরের দরকার হয়েছে আশীর্বাদধন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্যে। কিন্তু এসব চলে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত। তারপরেই বাবা বেরিয়ে যান গণতান্ত্রিক কর্মধারা রূপায়ণের জন্যে।
এম.এ. পাশ করার পর বাবা আমাকে ডেকে কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক এত ব্যস্ত যে আমার সঙ্গে আলাদা কথা বলার সময় তাঁর ছিল না। ভাই-বোনের সঙ্গেও একই অবস্থা। ডাক পড়েছিল মধ্যরাত্রে। বাড়ি ফিরে স্নান করে উনি আহ্নিকে বসেন। শব্দটা বাবাই ব্যবহার করেন। রাত এগারোটার পরে কেউ ডাকতে এলে চাকরকে বলে দেন, এখন আমি ব্যস্ত, আহ্নিকে বসেছি, কাল আসতে বল। বাবা আহ্নিক সারেন দু পেগ শীভাস রিগ্যাল আর আটটা কাজুবাদামে। সেই কর্পোরেশনে চাকরি করার সময় থেকেই এই পরিমিতিবোধ বাবার ছিল। তখন দু’পেগ ডি.এস. খেতেন। একটু একটু করে ডি.এস. থেকে প্রিমিয়ামে উঠলেন। এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়াম হুইস্কি বাতিল করে স্কটল্যান্ডের প্রিমিয়ামে অবস্থান করছেন। তবে কখনই দু’পেগের বেশি নয়। সারাদিন খাটাখাটনি, টেনসনের পর দু’পেগ হুইস্কি খেলে নার্ভ ভাল থাকে। হার্টও সক্রিয় হয়। এবং তাদের মহান নেতারও নাকি ওই অভ্যেস আছে। সত্যি কথা, তিরাশিচুরাশিতেও ভদ্রলোকের ছবি দেখলে মনে হয় সত্তর পার হননি। ওই বয়সে ভদ্রলোক যেরকম পরিশ্রম করেন তা একটা তিরিশ বছরের ছেলে করলে ক’দিনেই হাঁপিয়ে উঠবে। বাবা তার এই মহান নেতাকে অনুসরণ করছেন অন্ধভাবে। ইদানীং বাবার কথাবার্তাও ওই ভদ্রলোকের মতো হয়ে গিয়েছে।
আমার তখন ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম বলে দিই এখন যেতে পারব না। তারপরই মনে হল অনেককাল বাবার সঙ্গে কথা বলিনি, উনিও ডাকেননি। তাছাড়া এরকম একটা ডাকের জন্যে দর্শনপ্রার্থী জনগণ যখন হাঁ করে বসে থাকে তখন আমি কি এমন হরিদাস যে ফিরিয়ে দেব?
গেলাম। বালিশে হেলান দিয়ে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বাবা বসেছিলেন। অনেককাল পরে বাবাকে খালি গায়ে দেখলাম। একটু রোগা রোগা মনে হল। লোকটাকে খুব খাটতে হচ্ছে।
এসো। বসো, উঠে বসো। হ্যাঁ, বিছানাতেই বসো। বাবা সামান্য সরলেন।
না। ঠিক আছে। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
তুমি তো এম.এ. পাস করলে। এবার কী করবে ঠিক করেছ?
কিছুই ঠিক করিনি।
কেন?
আমি ঠিক করলেই সেটা করা যাবে কি না তা তো জানি না।
আঃ, বড্ড পেঁচিয়ে কথা বল। তোমার মায়ের স্বভাব ছিল এইরকম।
আমি তো মায়েরই ছেলে।
মায়ের ছেলেরা কখনও বড় হয় না। হ্যাঁ। কলেজ সার্ভিস কমিশনে নাম লিখিয়েছ?
এখনও ওরা নাম চায়নি।
তোমার কলেজে পড়ানোর ইচ্ছে আছে তো?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
স্ট্রেঞ্জ! তাহলে বাংলা নিয়ে এম.এ. পাস করলে কেন?
চাকরি করব বলে পড়িনি।
বাঃ। তা যখন পড়েই ফেলেছ তখন বিদ্যেটাকে কাজে লাগাও। ছেলেমেয়েদের শেখাও।
এই বিদ্যে শেখাবার জন্যে এম.এ. পড়ার দরকার হয় না। বাড়িতেই পড়া যায়।
বাবা আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি গ্লাস শেষ করে তাঁর কোটা অনুযায়ী দ্বিতীয়বার ঢাললেন। জল মেশাবার সময় লক্ষ্য করলাম তাঁর চোখ খুব সতর্ক। ঠিক পরিমাণ মতো জল ঢেলে জগটা ট্রের ওপর রেখে একটা কাজু মুখে পুরলেন, তোমার কথা শুনে আমি একটুও রাগ করিনি। এসো, এখানে বসো। কাম।
অগত্যা বসতে হলো। মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। ছেলেবেলায় দেখেছি মা বাবার জন্যে রাত জেগে বসে থাকতেন। তখন বোধহয় সংসারে খুব টানাটানি ছিল। দেশ-উদ্ধার করে এসে বাবা খেতে বসতেন চোরের মতো। প্রায়ই দেখেছি মায়ের খাবার কিছুই থাকত না। আর তখন মনে হত ওই লোকটা মায়ের খাবার খেয়ে নিয়েছে বলে মা খেতে পেল না। তখনও বাবার নিয়মিত রাতের আহ্নিক শুরু হয়নি। কর্পোরেশনের অ্যাসেসমেন্ট সেলে বদলি হবার পর থেকেই বাড়ির হালচাল পাল্টাল। দু’বেলা আমিষ পড়তে লাগল পাতে। এবং বাবা তার আহ্নিক শুরু করলেন। কিন্তু মা হয়ে গেলেন আরও চুপচাপ।
বিছানায় বসার পর বাবা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, কাল থেকে তুমি পার্টি অফিসে যাবে। তোমাকে সবাই চেনে, তুমি এবার চেনাজানা করে নাও।
কেন?
আমার ছেলে হয়ে তোমার সঙ্গে পার্টির কোনো সংযোগ নেই এটা ভাল দেখায় না, তাই।
সেটা কি অন্যায়?
ন্যায়-অন্যায় জানি না। আমি যখন সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে আমাদের পতাকার নিচে শামিল হতে উদ্বুদ্ধ করছি তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নিজের ছেলের ক্ষেত্রে কেন পারিনি?
এর উত্তর তো আপনার জানা আছে।
জানা আছে? নাঃ, আমি জানি না!
যিনি আপনার আদর্শ বলে শুনি তিনি তো তার ছেলেকে পার্টিতে নিয়ে যেতে পারেননি। নিশ্চয়ই তাকেও এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। সেই কৈফিয়তই কোট করবেন।
মাই গড! বাবা চমকে উঠলেন।
আমি ভুল বললে বলুন সংশোধন করে নেব।
তুমি কার সঙ্গে নিজের তুলনা করছ জানো? ওঁর মতো কর্মক্ষমতা থাকলে তুমি এম.এ. পাশ করে বেকার বসে থাকতে না। বাবা হঠাৎ রেগে গেলেন।
আমি কারও সঙ্গে নিজের তুলনা করছি না। কৈফিয়ত দেবার কথা উঠল বলে বললাম।
কয়েক সেকেন্ড লাগল বাবার, নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। বললেন, তোমাকে নিয়ে আমার অনেক পরিকল্পনা আছে। দ্যাখো, এতকাল রাজনীতি করছি। রাজনীতির জন্য চাকরি ছাড়লাম। এখন পার্টির কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। তুমি হয়তো জানো আমাকে অনেকবার ইলেকশনে দাঁড়াতে বলা হয়েছে কিন্তু আমি আড়ালেই থাকতে চাই। তবে সততার তো একটা মূল্য আছেই। সেই কারণেই পার্টিসূত্রে কিছু ক্ষমতা আমি পেয়েছি। এখন দেখছি মাঝারি শ্রেণির নেতাদের ছেলেরা ঝটপট মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। তুমি বেলগাছিয়ায় যাও অথবা টালিগঞ্জে, শুনবে অমুক নেতা বা মন্ত্রীর ছেলে যা বলবে তাই হবে। এইসব ছেলের সঙ্গে পার্টির যোগ কিন্তু খুব কম। যেদিন বাবা থাকবে না সেদিন তাদেরও দিন শেষ। এই ভুলটা আমি তোমার ক্ষেত্রে করতে চাই না। তাছাড়া আমি তোমাকে একেবারে তৃণমূল থেকে উঠতে বলছি না। তার প্রয়োজনও নেই। তোমার ভূমি তৈরি আছে। এম.এ. ডিগ্রিটা কাজে লাগবে। ওটা তুমি চাকরি করার জন্যে অর্জন করোনি। পার্টিতে তোমার স্ট্যাটাস বাড়াবার জন্যে ব্যবহার করো। আমাদের বেশিরভাগই তো অশিক্ষিত। কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ তাই লাঠি ঘোরাতে পারে সহজেই।
আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
খুব সহজে। পার্টির সঙ্গে সংযোগ রাখলে তোমাকে ওপরের দিকের কোনো সেলে প্লেস করতে আমার অসুবিধা হবে না। অধ্যাপনা করতে চাইলে কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্যানেলের প্রথম দিকে তোমার নাম থাকবে।
আর না চাইলে?
হ্যাঁ। এটাই আমি চাইছি। অধ্যাপনা করলে জীবন একটা জায়গায় আটকে থাকবে। অর্থ, বল, সম্মান সব একই জায়গায় পাক খাবে। আমি সেটা চাই না। দ্যাখো, আমাকে কেউ কখনও সাহায্য করেনি। আমি যা করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। কিন্তু এই করাটা এত সামান্য যে, যাক গে, আমি চাই, তুমি আমার থেকে শুরু করো।
কী রকম?
দু’জন নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাপ্রোচ করেছেন। তারা ইনভেস্টমেন্ট করতে চান। একজন মাছের বিভিন্ন আইটেম টিনে প্যাক করে বিদেশে পাঠাবেন আর একজন টেক্সটাইলের কারখানা করবেন। কিন্তু ওঁদের কোনো এস্টাব্লিশমেন্ট এদেশে নেই। তুমি ওয়ার্কিং পার্টনার হয়ে এঁদের সঙ্গে যোগ দেবে। প্ল্যান, প্রোগ্রাম যা কিছু ইঞ্জিনিয়াররাই করবে, তুমি শুধু সেটা এক্সিকিউট করবে। ব্যাপারটা রপ্ত করতে তোমার বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তার আগে তোমাকে পার্টির লোক হতে হবে। কয়েক মাস যাওয়া আসা, মিছিল করা, স্লোগান দেওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে তোমাকে পুশ করতে আমার অসুবিধে হবে না। এদেশে ব্যবসা করতে গেলে প্রথম সমস্যা হল শ্রমিক সমস্যা। তুমি যদি শ্রমিকদের একজন বলে নিজেকে আগেই চিহ্নিত করতে পারো, তাহলে ওই সমস্যা মাথা চাড়া দেবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারি লালফিতের ব্যাপার। ওর জন্যে আমি আছি। তাই তোমাকে নিলে যারা টাকা ঢালবে তারা বিস্তর উপকৃত যেমন হবে, তেমনি তোমারও ওপরে ওঠার দরজা একটার পর একটা খুলে যাবে।
আমি উঠে পড়লাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় চললে?
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। ইশারায় ওঁকে অপেক্ষা করতে বলে প্রায় দৌড়ে পাশের টয়লেটে ঢুকে পড়লাম। আলো জ্বেলে বেসিনের ওপর ঝুঁকে পড়তেই হড়হড় করে বমি বেরিয়ে এল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাক খাচ্ছিল এগুলো, এখন মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে হাঁপাতে লাগলাম। কল খুলে জল মুখে নিয়ে স্বস্তি ফিরছিল না। আজকাল এটা হচ্ছে। কেন হচ্ছে বুঝতে পারি না। যখন হয় তখন আচম্বিতেই হয়। মুখ মুছে ঘরে ফিরে আসতেই প্রশ্ন হল, কী হয়েছে?
বমি।
সেকি। কী খেয়েছিলে? বদহজম হয়েছে নাকি?
না। তার জন্যে নয়।
তাহলে?
আজকাল এমন হয়।
তাই নাকি। কালই হরেন ডাক্তারের কাছে যেও, লিভারে কিছু হল নাকি।
শরীর ঠিক আছে।
আজকাল এমন হয় বলছ আবার শরীর ঠিক আছে, সম্ভব নাকি?
বেশি কথা বললে বা শুনলে এমন হয়।
কথা বললে বা শুনলে বমি হয় আমি বাপের জন্মে শুনিনি।
কেমন ঘেন্না লাগে, গা গুলিয়ে ওঠে আর তারপরই বমি বেরিয়ে আসে। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারিনি।
বাবার মুখ এবার শক্ত হয়ে গেল, আমার কোন্ কথা শুনে তোমার ঘেন্না হল? গা গুলিয়ে উঠল? উত্তর দাও?
আমি লোকটার দিকে তাকালাম। এই লোকটা আমার বাবা। সেই পুরনো গপ্পোটা তুলে যদি প্রশ্ন করি, উত্তরটা দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে প্রমাণ করুন আপনি আমার বাবা! তাহলে কি জবাব দেবেন?
তাকিয়ে আছ কেন? কী জিজ্ঞাসা করলাম শুনতে পাওনি?
পেয়েছি। কিন্তু আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না? তুমি এত বড় উদ্ধত?
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি এ বিষয়ে কথা বললে আবার বমি করে ফেলব।
স্ট্রেঞ্জ। বাবার চোখমুখ দেখবার মত। হাতের গ্লাসের দিকে তাকালেন, এর গন্ধ সহ্য হচ্ছে না, এমন তো হতে পারে। তোমার মায়ের হতো না।
মায়ের সব অভ্যেস আমি পাইনি।
সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।
আসলে, আপনার আলমারির সব বই আমি পড়েছি।
বই? কোন্ বই?
আমি আলমারিটা দেখালাম। ওটা বই-এ ঠাসা। মার্কস সাহেব থেকে আরম্ভ করে অশোক মিত্র, বাবার সংগ্রহ চমৎকার। কোনো কোনো বই পড়ার সময় বুঝেছি আমার আগে কেউ তার পাতা উল্টে দ্যাখেনি। বাবা চোখ ছোট করলেন, তো?
ওগুলো পড়লে যে ধারণা তৈরি হয় তার সঙ্গে আপনাদের কাজের কোনো মিল নেই। অথচ ওগুলো থেকে কিছু শব্দ নিয়ে বাক্য তৈরি করে আপনারা এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করেছেন যে–আমার আর কথা বলতে ভাল লাগছে না।
না। পালিয়ে যেতে দেব না তোমাকে। বলো, কী বলতে চাও?
আপনি আমাকে পার্টি করতে বলছেন সুবিধে আদায় করার জন্য। আপনাদের দলের বেশিরভাগ নেতার ছেলে বেআইনি পথে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়েছে। বাবার ইনফ্লুয়েন্স আর সেই সুবাদে সঙ্গে মাস্তান রেখে চললে টাকা আপনি আসে। আর আপনার নেতার ছেলে পার্টি থেকে বহু দূরে থেকেও এদেশে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। এমন কি তার কোম্পানিতে কেন লকআউট ক্লোজার হয়, তা নিয়ে আপনাদের শ্রমিকদরদী নেতারা কোনো প্রশ্নও করে না। আপনি সেই ভুলটা করতে চান না বলে আমার ওপর পার্টির সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে রাখতে চান? আপনারা পার্টি করেন টাকা রোজগারের ধান্দায়। ওপরের তলার নব্বইভাগ নেতার বেআইনি সম্পত্তি আছে। এই, আপনি দু-দুটো বেআইনি ফ্ল্যাটের মালিক। ওইসব বই-এর লাইন আপনাদের দেখে এখন লজ্জা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। আপনার উপদেশ শুনলে তাই আমার বমি আসে।
যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। এক পয়সার মুরোদ নেই অথচ জ্ঞান দিচ্ছ আমাকে। শুয়োরের বাচ্চা! চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
কয়েকজন, খুব অল্প কয়েকটা মানুষ দলে আছে যারা আদর্শে বিশ্বাস করে। মানুষের জন্যে কাজ করতে চায়। দলের অবস্থা দেখে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীত্ব থেকে বেরিয়ে এসেও শেষপর্যন্ত সামান্য কিছু করতে পারবে বলে আপোস করে। এরা আছে বলে এখনও আপনারা সর্বহারা গণতান্ত্রিক ইত্যাদির সাইনবোর্ডটা বহন করতে পারছেন। নইলে আপনাদের সঙ্গে আপনাদের বিরোধীদের কোনো পার্থক্য নেই। বলতে বলতে আবার বমি পেয়ে গেল। আমি টয়লেটে ছুটলাম। শরীর হালকা হতেই মুখে জল দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলাম। এই আমি, আমার নাম মা রেখেছিলেন বিপ্লব। মা যে কি বোকা ছিলেন!
এই পরিবারের কর্তা যখন বাবা তখন তার ছেলের নাম বিপ্লব? কানাছেলের নাম পদ্মলোচন এর চেয়ে কম হাস্যকর। মায়ের কেন এমন মতিভ্রম হয়েছিল তা তিনিই জানেন।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, এইসময় হুঙ্কার উঠল, যাচ্ছ কোথায়? আগে কথা কমপ্লিট কর।
আমার কোনো কথা নেই।
নেই?
হ্যাঁ। কারণ আপনি আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলেছেন।
তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছ?
একদম নয়। বলে ভাল করেছেন।
ভাল করেছি?
হ্যাঁ প্রশ্নটা আমার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম আমি কেন শুয়োরের বাচ্চা হতে পারছি না। কেন আমার এসব দেখলে শুনলে বমি আসে। শুয়োরের বাচ্চাদের তো বমি পায় না। তারা ঘোঁত ঘোঁত করে কাদায় খাবার খোঁজে, কোনো প্রতিবাদ করে না। মানুষের অবস্থা তো একই রকম। বাসে-ট্রামে ওঠার জায়গা নেই তবু ওঠে। আগে এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোয় যারা আগুন জ্বেলেছিল প্রতিবাদে, তারাই এখন বিভিন্ন নাম দিয়ে সরকারি বাস বের করে তিনগুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছে বেসরকারি বাসের চেয়ে, অথচ কেউ প্রতিবাদ করে না। আলুর দাম মন্ত্রীর কৃপায় হু হু করে বেড়ে গেলেও মুখ বুজে লোকে কেনে। পাঁঠার মাংসের দাম একশ’ টাকা ছাড়িয়ে গেলে ভাবে তার নিজের মাংস কি ওই দামে বিক্রি হবে? নিউ মার্কেটে শুয়োরের বাচ্চার মাংস বেশ দামি। অথচ মানুষের মাংস কলকাতায় বিক্রি হয় না। হলে তবু! যাকগে। আপনি আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলে কিছুটা সম্মান দিলেন।
সম্মান দিলাম? তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না ভেবেছ? যেহেতু তোমাকে শুয়োরের বাচ্চা রাগের মাথায় বলে ফেলেছি তাই বার বার বলে বোঝাতে চাইছ আমি শুয়োর। স্কাউন্ডেল।
উনি সত্যি সত্যি খেপে গেলেন।
আমি শুয়োরের বাচ্চা হলে আপনাকে শুয়োর ভাবব কেন?
যেহেতু আমি তোমার বাবা!
এইটে গোলমেলে ব্যাপার।
তার মানে? ওনার চোয়াল আবার ঝুলে গেল।
আচ্ছা, আপনাকে যদি বলা হয় প্রমাণ করুন, আপনি আমার বাবা তাহলে সেটা প্রমাণ করতে পারবেন? গোলমেলে ব্যাপার নয়?
আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমি তোমার বাবা?
যদি বলা হয়! না, পারবেন না। দেখুন, আপনার চেহারার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। মা বলত আমি মামারবাড়ির ধাত পেয়েছি। আপনার স্বভাবের সঙ্গে আমার কোনো সাদৃশ্য নেই। আপনি যা ভাবেন আমি তার উল্টো। আমাদের দেখলে পাবলিক কখনই বলবে না আমরা বাপ ছেলে। মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে এসেছি। সেটা মা তো বটেই, ডাক্তার নার্স সাক্ষী হিসেবে আছে। অতএব আমি মায়ের ছেলে। এ নিয়ে কোনো ডিসপুট নেই। কিন্তু কে বাবা তা মা বলে দেয় বলেই তিনি বাবা হন।
বাঃ। তোমার বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম আছে বাবা হিসেবে।
ওখানে আপনার বদলে মায়ের কোনো বয়ফ্রেন্ডের নাম বললে ওরা সেটাই লিখত।
মায়ের বয় ফ্রেন্ড? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব হতভাগা।
আপনি একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন আমি সত্যি বলছি বলে আর দাঁড়ালাম না আমি। একটু ভাল লাগছিল গা গুলানো ভাবটা কমে যাচ্ছিল বলে। নিজের ঘরে চলে এলাম। নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়াতেই ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগল। রাত বাড়লে বাতাসের চরিত্র খারাপ হয়? ওই ভদ্রলোক আমাকে ব্যবহার করতে চাইছেন। নিজে দু’হাতে কামিয়ে চলছে না, আমাকে এন. আর, আইয়ের সঙ্গে ভিড়িয়ে মাল খিঁচতে চান। ওই ওঁর নেতার সম্পর্কে পাবলিক একই কথা বলে। ছেলেকে হরেক রকম কোম্পানি করে দিচ্ছেন ভদ্রলোক বিদেশিদের সঙ্গে কোলাবরেশনে, তার এক একটার নাভিশ্বাস অল্প কয়েক বছরেই উঠে যাচ্ছে। কিন্তু, লোকে বলে, ছেলে তার অর্জিত কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে রেখে আসছে। আর উনি বছরে দু’বার এন. আর. আই. খোঁজার নাম করে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট চেক করে আসেন।
আজ আমার ঘুম আসছিল না। হঠাৎ চোখে পড়ল মহিলাটিকে। ঠিক উল্টোদিকের ফ্ল্যাট। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি দেখতে পেয়েছি বুঝে হাত নেড়ে বললেন, ঘুম আসছে না?
আমি না বুঝে মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ। তিনি গলা তুললেন, আমারও।
আমি ঝটপট সরে এলাম। এরকম কেস জীবনে শুনিনি। ওই বাড়িটা নতুন হয়েছে। সবকটা ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে তৈরি হবার আগেই। ওই মহিলাকে কখনও দেখিনি। ভদ্রমহিলা কারো দিকে তাকিয়ে কি হাত নাড়ছেন? নাকি এদিকে অন্য কেউ আছে। আমি একতলায় আর উনি দোতলায়। তাকিয়ে আছেন এদিকেই। অতএব আমিই ওঁর লক্ষ্য। আমার ঘুম আসছে কি আসছে না জেনে উনি কী করবেন? কী লাভ?
সরে এলাম জানলা থেকে।
আজ আমার খুব ভাল লাগছে। যাঁকে বাবা বলি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলে এসেছি বলেই বলি, তাঁকে কথাগুলো বলতে পেরে আনন্দ লাগছে। আচ্ছা, মানুষ কত সহজে আনন্দিত হয়, না? অথচ ওই ভদ্রলোকের আহ্নিকের আরাম আজ ঘুচল। এখন উনি কি করতে পারেন? আমাকে, বড়জোর এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। আমার মাসিক আয় এখন আটশো টাকা। দিব্যি চলে যায়। কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশকের নতুন বই-এর প্রুফ দেখি আমি। এই হল বিপ্লবকুমারের বিপ্লব। আটশো টাকায় থাকা-খাওয়া যায়?
আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। অনেকেই ঘর অন্ধকার হলে চমৎকার ঘুমিয়ে পড়েন। আমার আবার উল্টো। অন্ধকার আমার মনে হাজারটা সমস্যা স্প্রে করে। সেগুলো মুছতে রীতিমত লড়াই করতে হয়।
আজকাল কিছুতেই ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙে না। ওদিকে রাত হয় বলেই হয়তো আজও সাড়ে আটটায় বিছানা ছাড়লাম। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে কেন জানি না জানলার সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ পড়ল সামনের দোতলায়। কেউ নেই সেখানে। কিন্তু এদিকে বাড়ির সামনে ভিড় জমেছে। বাবার দর্শন পেতে আগ্রহীরা ইতিমধ্যেই জড়ো হয়ে গেছে। আচ্ছা, ভদ্রলোক কি গতরাত্রে ঘুমিয়েছিল? ওঁর মনে কি একবারও মায়ের চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ এসেছিল? আমার মায়ের চরিত্র কিরকম ছিল? মায়ের মুখ মনে পড়ল। সাধারণ আটপৌরে সহজ সরল বাঙালি মেয়ের মুখ। যাদের জীবনে স্বামীপুত্রকন্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা নেই, পরপুরুষের সঙ্গে দূরকথা, নিজের স্বামীর সঙ্গেই যাঁদের প্রেম করা হয়ে ওঠে না। হয়তো শারীরিক আনন্দও একটা অভ্যেসের মধ্যে সীমিত। আমার মায়ের চরিত্র এতই আটপৌরে যে ওই ভদ্রলোকের সন্দেহ লবণের লাড্ডু হয়ে যাবে এবং সেটা তাকেই গিলতে হবে। আচ্ছা, কেন বেঁচেছিলেন? যদি জন্ডিসে মারা না যেতেন তাহলে এতকাল কি কারণে বেঁচে থাকতেন? শুধু স্বামীর সঙ্গে সহবাসে পাওয়া সন্তানগুলোকে বড় করার জন্যে? দু’বেলা রান্নাঘরে কাটিয়ে প্রত্যেকের মুখে আহার তুলে দেবার জন্যে? একে তো একধরনের মানুষ সেবা বলে থাকেন। তা সেই সেবা করে জীবন ফুরিয়ে দিতে যারা উৎসাহ যোগান, মহীয়সী আখ্যা দেন, তাদের মতো ক্রিমিনালদের গুলি করে মারা যায় না? আর এই সব নির্বোধ রমণীদের যাদের জ্ঞানচক্ষু ফোটালেও ফুটবে না, জন্মমাত্র কেন জন্ডিস হয় না? ম্যালিগন্যান্ট জন্ডিস!
পিতৃদেবের ঘরের গায়ে তাঁর নিজস্ব টয়লেট বাথরুম রয়েছে। কিন্তু আমাদের সবার জন্যে বাথরুম কমন। টয়লেট তার মধ্যেই। বাড়িটা যেহেতু পুরনো ধরনের তাই এই ব্যবস্থা। এখনও এ বাড়ির কলঘরে চৌবাচ্চা আছে। চৌবাচ্চার বিলাসিতা দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে আজকাল ভাবা যায় না।
কলঘরের সামনে পৌঁছে দেখলাম ওটার দরজা বন্ধ। এই এক জ্বালা, একটু অপেক্ষা করে গলা তুললাম, ভেতরে কে? তাড়াতাড়ি কর।
দেরি হবে। মেজভাই-এর গলা।
কেন?
এইমাত্র ঢুকেছি। অফিস যেতে হবে।
অতএব অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নেই কেন? মনে পড়তেই দোতলায় উঠে এলাম। ভদ্রলোক ঘরে নেই। এখন তিনি নিচের দরবারে আসীন। ওর বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার হলাম। এখানে আসা আমাদের অভ্যেস নেই, বোধহয় এক্তিয়ারেও। কিন্তু আজ মনে হলো, কেন আসব না? এই বাথরুম টয়লেট তো বাড়ির বাইরে নয়।
সকালে এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট আমার বরাদ্দ। সকালে এর চেয়ে বেশি খেতেও ইচ্ছে করে না। এখন আমাদের রান্নাঘর ঠাকুর সামলায়। লোকটা রোজ ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কেন জানি না, ঠাকুর আমাকে একটু সমীহ করে চলে। চলুক।
সেজেগুজে পথে নামলাম। সাজগোজ বলতে জিনস আর টি শার্ট। পায়ে চপ্পল। দরজায় তালা দিয়ে দেখলাম তখনও দুতিনজন পাবলিক বাবার চামচাদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। মানুষের কতরকমের ধান্দা থাকে তা মানুষই জানে না।
রাস্তায় নামবার আগে দোতলায় নজর চলে গেল কোনো কারণ ছাড়াই। তখন তাঁকে দেখতে পেলাম। কাল রাত্রের সেই মহিলা। বয়স কত হবে? আমারই বয়সী। কিন্তু কি আশ্চর্য, চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিল। যেন আমাকে কখনও দ্যাখেনি। উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল দূরের বাড়ির দিকে। অথচ গতরাত্রে ইনিই আমাকে হাত নেড়ে প্রশ্ন করেছিলেন। একেই হয়তো নকশা করা বলে। মেয়েদের পক্ষে এমনটা করাই সম্ভব। নিকুচি করেছে।
আমার হাসি পেল। হাঁটতে-হাঁটতেই হাসলাম। আমাদের বাংলা ভাষায় চমৎকার কিছু শব্দ আছে। যেমন এই নিকুচি। আহা। কী শব্দ। যেমন, ন্যাকামি। করো অনুবাদ। পারবে না। কিন্তু ওই শব্দদুটো কত শত মানে কী স্বচ্ছন্দে বুঝিয়ে দেয়। মোড়ের মাথায় আসতেই হঠাৎ কানে শব্দগুলো ঢুকল। দুটো বছর বাইশের ছেলে কথা বলছে। ভারতীয় ক্রিকেট টিম কেন একের পর এক ম্যাচ হেরে যাচ্ছে তাই নিয়ে আলোচনা। কিন্তু প্রতি তিনটি শব্দের পর দু অক্ষরের পুরুষাঙ্গ অথবা চার অক্ষরের শব্দ অকাতরে ব্যবহার করে চলেছে জোর গলায়। রাস্তা দিয়ে ছেলেমেয়ে, মহিলা, বৃদ্ধরা যাচ্ছেন কিন্তু ওরা অসাড়। আর যাঁরা যাচ্ছেন তারা ওসব শুনেও যেন শুনতে পাননি এমন ভান করছেন।
আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এই যে ভাই, কাজটা কি ঠিক করছেন?
ওরা হকচকিয়ে গেল। একজন জিজ্ঞাসা করল, কেন? অন্যায় কিছু করেছি?
আপনারা এতক্ষণ কী বলেছিলেন?
ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করছি।
করছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অশ্লীল শব্দ বলেছিলেন কেন?
অশ্লীল শব্দ? যাঃ বাঁআ। অশ্লীল শব্দ কখন বললাম?
এইমাত্র কী বললেন? আপনার লজ্জা করছে না, নিজেই জানেন না কি বললেন। আপনার মা-বোনেদের সামনে বসে ওই কথা যদি কেউ বলত আপনার ভাল লাগত?
আমি চিৎকার করে উঠতেই ভিড় জমে গেল। কয়েকজন আমাকে টানতে লাগল। একজন বলল, ছেড়ে দিন দাদা। এদের বলে কিছু লাভ হবে না।
আমি অসহায় চোখে লোকটির দিকে তাকালাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম কানে এল, প্রথম ছেলেটি তখনও বিস্মিত গলায় বলে চলেছে, কী মাল মাইরি। আমাকে কেন টকরালো তাই বুঝতে পারছি না এখনও। আফসোস হচ্ছিল। আমি কাদের বোঝাতে যাচ্ছিলাম। জননীদেবী যত ভালবাসা নিয়ে আমার নাম বিপ্লব রাখুন না কেন, আমার ক্ষমতা একটা মাথা নাড়া পুতুলের চেয়ে বেশি নয়। শরীর গুলিয়ে উঠছিল। ট্রাম রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যদি কোন অলৌকিক উপায়ে ক্ষমতা পেতাম তাহলে এইসব বঙ্গ যুবকদের জিভ কেটে ফেলতাম। হয়তো আশি শতাংশ যুবক বোবা হয়ে যেত কিন্তু তাতে কানের আরাম হত।
তারপরেই মনে হল, আমি অকারণে রেগে যাচ্ছি। এককালে শালা বলাটাও অশ্লীল ছিল, এখন তো নেই। তাহলে?
ট্রামে চেপে কলেজ স্ট্রিট যেতে কতক্ষণ। তারমধ্যেই চোখে পড়ল দুটো মধ্যবয়সী লোক টিকিট না নিয়ে এক টাকা কন্ডাক্টরের হাতে গুঁজে নেমে পড়ল। দু’টাকা কুড়ির বদলে এক টাকা। কন্ডাক্টরের মুখের দিকের তাকালাম। একেবারে বুদ্ধদেবের মুখ। দাড়ি কদিন না কামানো সত্ত্বেও ওই মুখে পৃথিবীর কোনো পাপ স্পর্শ করেনি।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম ভেতরের দিকে। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলাম, এই যে দাদা, আপনাকে আট আনা দিলে বিনা টিকিটে যাওয়া যায় বুঝি!
লোকটি আমার দিকে তাকাল না। নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
এক বৃদ্ধ বললেন, এই তো চলে আসছে ভাই। আজ তো নতুন দেখছি না। পঞ্চাশ সালেও এই কাণ্ড হত। এই করে করে বাস-ট্রাম লোকসানে চলছে। যাও প্রাইভেট বাসে। অনেক কম ভাড়া, কই তাদের তো তবু লোকসান হয় না!
আর একজন প্রৌঢ় খিঁচিয়ে উঠলেন, লোকসান কোথায় নেই বলুন তো? বড় বড় মন্ত্রীরা ঘুষ নিচ্ছে, হাওলা কেস, বোফর্স কেস-এ কত ট্রানজেকশন হয়েছে জানেন? তা এমনি এমনি ও হয়েছে নাকি? পাবলিককে ঠকিয়ে হয়েছে। দেশের এক নম্বর যদি ঘুষ নেয় তো এই বেচারারা কী দোষ করল!
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে আপনি ওকে সমর্থন করছেন?
আলবাত করছি। ক’টাকা মাইনে পায়? ভাড়া বাড়িতে থেকে বাজার করে খেতে গেলে ওর মাইনেতে কদিন চলবে? অ্যাঁ! এই যে বাজারে দ্যাখেন, একশ’ টাকা মাংস, দেড়শো টাকা ইলিশ হু হু করে পাবলিকের ব্যাগে ঢুকে যাচ্ছে কোন রোজগারে? নিশ্চয়ই মাইনের টাকায় নয়। দেখছেন না, চারপাশের সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে অথচ লোকে প্রতিবাদ না করে দিব্যি ম্যানেজ করে যাচ্ছে। ও বেচারাকে একটাকা আট আনার জন্যে দোষ দিয়ে কী লাভ?
কথাগুলো শোনামাত্র আমার গা-গুলানি ভাবটা উধাও হয়ে গেল। মনে হল ভদ্রলোকের প্রত্যেকটা কথাই সত্যি। বাড়তি রোজগার তো খেটেখুটে হয় না আর বাড়তি রোজগার না করলে মানুষ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাঁচবে কী করে? এদেশে শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমবন্টন, ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো চালু করা আর সোনার পাথরবাটি কিনে আনা যে একই ব্যাপার। তা গণতান্ত্রিক দলের নেতারা বুঝে গিয়েছেন বলেই তারা আর ও পথে এগোচ্ছেন না। যে যা পারো লুটেপুটে খাও, বেঁচে থাকো কিন্তু খবরদার দলের শৃঙ্খলা ভেঙো না। ওটা ভাঙলেই তোমাকে দলবিরোধী কাজের জন্যে বহিষ্কার করা হবে।
কলেজ স্ট্রিটে নেমে বাবার কথা মনে এল। ওই লোকটির উপদেশ বাবার কাছে নিশ্চয়ই কথামৃত। শুনলে খুশি হতেন। আচ্ছা, এসব সত্য জানা সত্ত্বেও আমি মেনে নিতে পারি না কেন? কেন মনের ভেতর খচখচ্ করে? আহা, এই খচখচ্ শব্দটাও তো দারুণ।
প্রকাশনা সংস্থাটি বেশ বড়। এদেশে তো বটেই, বাংলাদেশেও এদের বিশাল কারবার। আমি এখানে চাকরি করি না। চাকরি এঁরা আমাকে অফার করেননি। কিন্তু একটা টেবিল চেয়ার দিয়েছেন। প্রুফ এলে টেবিলে পাঠিয়ে দেন। দু’ঘণ্টা অন্তর চা খাওয়ান এবং দুপুরে রুটি এবং আলুরদমের ব্যবস্থা থাকে। এতেই আমার চলে যায়।
টেবিলে বসামাত্র বেয়ারা প্রুফ দিয়ে গেল। আমার একপাশে চলন্তিকা এবং সংসদ। বাংলাভাষার প্রহরী। খুব জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিকের উপন্যাস। বছরে চার-পাঁচটা সংস্করণ চোখ বন্ধ করে বিক্রি হয়। অবশ্য এঁর জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেই বেশি। তিনলাইন পড়তেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। ভুল বানান যদি দীর্ঘ-উ কেউ লেখে তাহলে তার লেখা ভুলে যাওয়া উচিত। উপন্যাসের শুরু হয়েছে এইভাবে। তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। দয়া করে তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্রিয়া। উনিশশো ছিয়ানব্বইতে এই রকম লেখা যাঁরা লেখেন তাঁরা কী তা আমি জানি, কিন্তু যাঁরা পড়েন, পয়সা দিয়ে বই কিনে পড়েন তারা কোন গ্রহের মানুষ? এছাড়া নায়ক ধুতি পরে বাড়ি থেকে বের হলো এবং একটু বাদেই রাস্তায় জল জমা থাকায় প্যান্টের পা গোটাল। নায়িকার নাম প্রিয়া, পিয়া, তিয়া এক এক পাতায় এক এক রকম। বাক্য মাঝে মাঝেই অসম্পূর্ণ! আমি টেবিল থেকে উঠলাম।
অফিস ঘরের ভেতর একটা কাচের ঘর। প্রকাশক মশাই সেখানে বসেন। রোগা ফর্সা প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি শিক্ষিত এবং সুদর্শন। মাস কয়েক আগে ওঁর ঘরে ঢুকে বলেছিলাম, ভাল বাংলা বানান জানি, কাজ দেবেন? তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, লেখার নেশা আছে নাকি?
না।
তাহলে বসো। কী নাম?
কাজটা হয়ে গিয়েছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। উনি কিছু হিসেব করেছিলেন। বিরক্ত হয়ে তাকালেন। বললাম, কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা বলব।
বল।
আপনি বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি করছেন।
আমি? চমকে উঠলেন ভদ্রলোক, কী রকম?
স্বজন মুখোপাধ্যায়ের যে উপন্যাসটা ছাপা হচ্ছে সেটা আপনি পড়েছেন?
না।
সেকি? আপনি না পড়ে বই ছাপছেন?
উনি সোজা হয়ে বসলেন। কলম বন্ধ করলেন, পড়া উচিত বলে মনে করিনি। স্বজনবাবুর বই-এর স্টেডি সেল আছে।
ও। তাহলে কিছু বলার নেই। আপনার তো আরও অনেক প্রুফ রিডার আছে তাদের কাউকে ওর প্রুফ দিলে আমার ভাল লাগবে।
কেন?
উনি লিখতে জানেন না। বাক্য অসংলগ্ন, অজস্র বানান ভুল। ভেতরে তথ্যের অসংলগ্নতা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।
নিয়ে এসো।
বেরিয়ে এসে প্রুফ নিয়ে গেলাম। তিনি দেখলেন। তারপর বললেন, মানুষ করে দাও।
মানে?
রিরাইট করে দাও।
অসম্ভব।
বাজে কথা বোলো না। এ বই ছাপা হলে যখন বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হবে তখন তোমার উচিত সেই ক্ষতিটা যাতে না হয় তা দেখা।
আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন। রিরাইট হলে সমস্ত লেখাটাই নতুন করে লিখতে হবে। অথচ সেটা ওঁর নামে ছাপা হবে, টাকা উনিই পাবেন।
ও ব্যাপারে কথা বলছি। টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন প্রকাশক, হ্যালো, স্বজনবাবু ভাল আছেন? হ্যাঁ, আগেরটা আবার এডিশন হয়েছে। কিন্তু স্বজনবাবু আমি যে মুশকিলে পড়েছি। কী করি বলুন তো? হ্যাঁ। একজন সাংবাদিক এসেছেন আপনার পাণ্ডুলিপি দেখতে। উনি ফটোকপি ছাপবেন কাগজে, মানে আপনার ওপর কভারেজ করবেন। হ্যাঁ, ভাল কথা, কিন্তু মুশকিলটা এখানেই। কেন? আপনার হয়তো সময় কম ছিল তাই প্রতি পাতায় অন্তত কুড়িটা বানান ভুল, সেন্টেন্সে গোলমাল। এগুলোর ছবি ছাপা হলে কী হবে ভেবেছেন? আমি বলি কি আপনি যদি নতুন করে! হ্যাঁ, সময় কম, তা আমি জানি। আচ্ছা, এককাজ করলে হয়। আমার পরিচিত একটি ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিই? হ্যাঁ, খুব ভাল বানান জানে। না না কেউ জানবে na। তবে বিনা পয়সায় তো করবে না। ধরুন আপনার প্রাপ্য থেকে তিন-চার পার্সেন্ট ওকে দিয়ে দিলে সম্মানটাও থাকে আপনার নামও বেড়ে যাবে। না দু-চারশো দিলে ও রাজি হবে না, তাছাড়া খবরটা তো চেপে রাখার ব্যাপার আছে, এটা বুঝছেন না কেন? ঠিক আছে তো? ও কে!
রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, যাও।
উনি রাজি হলেন?
হয়েছেন। তুমি প্রুফেই কারকেশন করতে করতে যাও।
আমি অন্যের হয়ে লিখব?
আপত্তি কেন? তুমি সন্তোষকুমার ঘোষের নাম শুনেছ?
হ্যাঁ। শ্রীচরণেষু মাকে-র লেখক।
উনি একজন বিখ্যাত সাংবাদিক নামে রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখেছিলেন। সেই বইতে কোথাও ওঁর নাম ছাপা ছিল না। তুমি ভেবে নাও, বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে দিচ্ছ। আরে, আমি না ছাপি আর একজন কৃতার্থ হয়ে ওই বই ছাপবে। বুঝেছ?
টেবিলে ফিরে এসে নিজের সঙ্গে লড়াই করতে আরম্ভ করলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। একটা মন বলছিল, এটা অন্যায়, খুব অন্যায়। আর এক মন বলছিল, এটা শ্রাদ্ধের মতো কাজ। করা উচিত। এই বই ছাপা হলে অন্তত ষাট টাকা দাম হবে। যারা খেয়ে না খেয়ে বই কেনে তাদের উপকার করা হবে।
প্রথমে পুরো উপন্যাসটি পড়ে ফেললাম। সেই ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। কোন সময়ের গল্প, নায়ক নায়িকা কী করে এসব নিয়ে লেখক মাথা ঘামাননি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। এই লেখক গপ্পো বলতে জানেন। যত খারাপ লাগুক আমাকে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে তো ছাড়ল। প্রচণ্ড গতি। বাবার আলমারিতে একটা উটকো বই পেয়েছিলাম। ওই রাজনৈতিক মতবাদ বোঝাই বইগুলোর পেছনে সেটা পড়েছিল। মোহন সিরিজের বই। মোহন সিরিজের নাম আমি কলেজে পড়তে শুনেছি। বাংলা ডিটেকটিভ উপন্যাসের ইতিহাস বলতে হলে ওই মোহন সিরিজের কথা সমালোচকরা একটু আধটু বলে থাকেন। তা আগ্রহী হয়ে বইটি পড়লাম। ওই সিরিজ নাকি একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। ওই লেখকের লেখায় গতি ছিল। যখনই কোনো সমস্যার সামনে নায়ক দিশেহারা তখন লেখক সমাধান করলে এই বলে, কোথা হইতে কি করিয়া কি হইয়া গেল মোহন জানে না কিন্তু বাঙালি পাঠককুল পড়ার সময় এই গোঁজামিল মেনে নিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে স্বজনবাবু বাজারে করে খাচ্ছেন।
একবার মনে হল অত ঝামেলার দরকার কী? আমার কাজ প্রুফ দেখা। বানান ঠিক করে দেওয়া প্যারাগ্রাফ সাজিয়ে দেওয়া আর কোনো বাক্যে গোলমাল থাকলে সেটা ঠিক করা। তাই করি। আমি শুরু করলাম। দুপুরে আলুরদম দিয়ে রুটি সবে শেষ করেছি এমন সময় স্বজনবাবু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা প্রকাশকের কাচের ঘরে চলে গেলেন তিনি। ভদ্রলোকের পরনে শু, ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি। এই রকম পোশাকে লেখক আজকাল বড় একটা দেখা যায় না।
আমি আবার কাজ শুরু করতেই উনি বেরিয়ে এসে আমাদের ম্যানেজারকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। ম্যানেজার আমাকে দেখিয়ে দিতে একটা চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন, কী নাম ভাই?
নিজের নাম বলতে খারাপ লাগল। বললাম, বলুন।
ইয়ে, হয়েছে কি, এই লেখাটা খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখেছি। যদি ভুলভাল কিছু হয়ে থাকে তাহলে ঠিকঠাক করে দেবেন ভাই, স্বজনবাবু বললেন।
আপনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভুল কোট করেছেন।
অ! ওটা অবশ্য অনেকেই করে। মানে, দেখবেন, কিছু লোক আবৃত্তি করার সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলল কিন্তু সব শব্দ ঠিক বলল না। আমি ওই বাস্তবচিত্রটা ধরতে চেয়েছি। ঠিকঠাক করে দিন। কিন্তু ভাই কথাটা পাঁচ কান করবেন না।
লোকটার গলার স্বর এমন যে আমার মজা করতে ইচ্ছে করল। প্রকাশকের ঘর দেখিয়ে বললাম, কিন্তু উনি আমাকে বলেছেন পুরো উপন্যাসটাকে রিরাইট করতে।
বলেছেন?
হ্যাঁ।
বেশ করুন। গল্পটা ঠিক রাখবেন। আর স্পিড। স্পিডটা নষ্ট করবেন না। আমার অ্যাসেট হল ওটা। ওটা যেন নষ্ট না নয়।
দেখছি।
আপনি গপ্পো লেখেন?
না।
বাঁচা গেল। যারা গপ্পো লেখে তারা তাদের মতো লিখবে। তাদের নিজেদের লেখা যখন পাবলিক পড়ে না তখন আমার হয়ে লিখলে তার হালও ওই একই রকম হবে। তা আপনি যখন লেখালেখি করেন না তখন ভরসা পাওয়া গেল। আজ সন্ধেবেলায় কী করছেন?
কেন?
আসুন না। একটু খাওয়াদাওয়া করা যাবে।
কোথায় যেতে হবে?
একটা কাগজ টেনে ফসফস করে ঠিকানা লিখলেন স্বজনবাবু। সেটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলে আসুন। ওখানে গল্প পাব। আপনি আমাকে সাহায্য করলে আর দেখতে হবে না। একটা চোখ কুঁচকে উঠে গেলেন ভদ্রলোক।
আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। সাহিত্য কি সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে করা যায়? বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ অথবা শরৎচন্দ্র মাথায় থাকুন, বিভূতিভূষণ তারাশংকর এমন প্রস্তাব শুনলে কি আত্মহত্যা করতেন না? নাকি যুগ পাল্টেছে, অ্যাপ্রোচও। এখন কম্পুটারের যুগ। পাঠক চান তাই লেখক উগরে যদি না দেন তাহলে বাজার শেষ হয়ে যাবে। এমন কত লেখক তো লেখেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা দূরে থাক, দেশ পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় কত নতুন লেখকের গল্প, সদ্য পরিচিত লেখকের ধারাবাহিক উপন্যাস। অথচ সেগুলো সম্পর্কে পাঠক মোটেই উৎসাহী নয়। অথচ স্বজনবাবুদের উপন্যাস বাজারে বেরুলেই এডিসন হয়ে যায়। বইমেলায় লোকে অটোগ্রাফ নেবে বলে কেনে। এইসব লোক তো বুদ্ধু নয়। স্বজনবাবুর উপন্যাস না কিনে ছয়শো গ্রাম মাংস কিনলে রবিবারের দুপুরে ভাতের স্বাদ আরও চমৎকার হত। কিন্তু তা তো করছে না। আমার কাছে ধন্দ এখানেই।
কয়েকদিন আগে একটি ছেলে ভুল করে অফিসে ঢুকে পড়েছিল। আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা স্বজন মুখোপাধ্যায়ের দুপুর ঠাকুরপো বইটা আছে? আমি কিনতে চাই। অবাক হয়ে তাকালাম। বড়জোর কুড়ি বছর বয়স। দুপুর ঠাকুরপো, যে কোনো উপন্যাসের নাম হয় তা আমি ভাবতে পারি না।
ম্যানেজার শুনছিলেন, বললেন, আমাদের সেলস কাউন্টারে যান ভাই।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত দাম?
আশি টাকা। ম্যানেজার বলার আগেই ছেলেটি জানাল।
আপনি বুঝি খুব উপন্যাস পড়েন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
শ্রীমতী কাফে পড়েছেন?
স্বজন মুখার্জির লেখা?
না। সমরেশ বসুর উপন্যাস।
নাঃ। ওসব পুরনো লেখা পড়া হয়নি। আচ্ছা চলি।
কথাটা মনে পড়তেই আমার খুব রাগ হল। যে লোকটা সমরেশ বসুর পায়ের যোগ্য নয় তার বই আমাকে রিরাইট করতে হবে কেন? শুধু টাকার জন্যে? কোনো দরকার নেই। ঠিক করলাম, প্রুফ দেখে দায় শেষ করব। রিরাইট করা আমার দ্বারা হবে না। প্রকাশক যাই মনে করুন, আমি নাচার।
পাঁচটা নাগাদ আমি বের হলাম। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এখন কোথায় যাওয়া যায়? কফি হাউসে অবশ্য যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কী লাভ? সেই টেবিলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা পরনিন্দা পরচর্চা করা কাঁহাতক ভাল লগে। কফি হাউসে এক আজব জায়গা। যদি কেউ বলে গত দশ কি কুড়ি বছরে ধরে নিয়মিত কফি হাউসে আসছে তাহলে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় লোকটির জীবন চোরাবালিতে আটকে গিয়েছে। সাফল্য পেলে কেউ আর অনর্থক সময় নষ্ট করার জন্যে কফি হাউসে আসে না।
তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ?
পেছনে ফিরে তাকালাম। প্রকাশক বেরিয়ে এসেছেন।
ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়!
যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বুঝি?
তা না!
আমার সঙ্গে চলো।
কোথায়?
রবীন্দ্রসদনে। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রোগ্রাম আছে।
রবীন্দ্রনাথের গান?
ওহো, জানো না। আমরা যাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতাম এখনকার ছেলেমেয়েরা তাকেই রবীন্দ্রনাথের গান বলে। চলো।
ভদ্রলোক হঠাৎ আমার ওপর এমন সদয় হচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না। এই কয় মাসে তিনি প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলেননি। মাঝে মাঝে মনে হত উনি আমাকে চেনেনই না।
রবীন্দ্রসদনের পেছনে গাড়ি পার্ক করতেই কানে এল কেউ গান গাইছে। সুন্দর, উদাত্ত গলা। মাইকে ভেসে আসছে না। উদাসী হাওয়ায় পথে পথে–। গাড়ি থেকে নামতেই লোকটিকে দেখতে পেলাম। মুখে দাড়ি, হাতে ব্যাগ। গান গাইতে গাইতে হনহন করে হাঁটছে। একবার গেটের কাছে চলে যাচ্ছে, আর একবার পার্কিং লটের কাছে ফিরে আসছে। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। গানটা শেষ হতেই আর একটা ধরল। প্রকাশক বললেন, বাঃ গাইছে বেশ ভাল কিন্তু পাগল নাকি?
সদনের সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি আমাকে আচ্ছন্ন করল। যে ভঙ্গিতে ও গাইছে তা একমাত্র নিজের জন্যেই গাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্য কেউ সেটা শুনছে কিনা তা নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে ও নিজেই নিজের রাজা। এমন সুখ কজন মানুষ পেতে পারে। নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে ওর কোনো দায় নেই।
রবীন্দ্রসদনের চাতালে মোটামুটি ভিড়। মেয়েরা সব সেজেগুজে এসেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, রবীন্দ্রনাথ হলেই কলকাতার কিছু মহিলা অফ হোয়াইট শাড়ি পরেন, চুলে সাদা ফুল। তখন তাদের তাকানো হাঁটাচলা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ঠিক আশ্রমবালিকা যাকে বলে তা নয় কিন্তু নিজেকে শুদ্ধ দেখাবার চেষ্টা প্রকট থাকে। প্রকাশকের আসন প্রথম সারিতে। তার পাশে আমাকে বসালেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, বুঝলে হে, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আসছি সায়গলের আমল থেকে। হ্যাঁ।
সায়গল? যদ্দুর জানি পঞ্চাশ সালের অনেক আগেই ভদ্রলোক গত হয়েছেন। আমার এই প্রকাশকের বয়স কিছুতেই পঞ্চান্নর বেশি নয়। পঞ্চাশ সালে ওঁর বয়স ছিল বড় জোর উনিশ। ওই বয়সে কেউ–। তাই বা বলি কেন? শুনেছি উনি ওপার বাংলার লোক। কুড়ি বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসেছিলেন। তাহলে সায়গলের গান শুনলেন কখন? আমি চাপা গলায় বললাম, আপনি গুল মারছেন!
কী? কী বললে?
আপনি শুনতে পেয়েছেন। গুল যারা মারে তাদের কান খুব শার্প হয়।
অ। আমি গুল মারছি?
এই তো শুনেছেন!
তুমি তোমার বস-এর সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলবে?
দেখুন, আমি যদি বলতাম আপনি মিথ্যে কথা বলছেন তাহলে আপনি খুব রাগ করতেন। কিন্তু গুল মারছেন বললে আপনার একটু কাটল কিন্তু রক্ত পড়ল না।
বাঃ তুমি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। গুড।
আমার বাবা এটা মনে করেন না, আপনি করলেন।
উনি তাহলে তোমার সঙ্গে মেশেননি। যাকগে, স্বজনের উপন্যাসটায় হাত দিয়েছ?
হাত! ওটা ঠিক করতে গেলে দশটা হাত লাগবে। মা দুর্গাকে ডেকে আনুন।
ওসব বললে তো চলবে না। পাবলিক যা খায় তাই লিখছে স্বজন।
আমি বানান আর সেনটেন্স দেখে দিচ্ছি।
কী? রিরাইট করছ না? প্রকাশক হতভম্ব।
না। বিবেকে লাগছে।
এই কথা বলার জন্যে আমি তোমাকে স্যাক করতে পারি, তা জানো?
করে দিন। আমি তাহলে বেঁচে যাই।
অ্যাঁ। তার মানে?
একটা কুৎসিত পরিশ্রম করতে হয় না তাহলে।
প্রেক্ষাগৃহ তখন প্রায় ভরে গেছে। অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে মিনিট দশেক দেরি আছে। আমি ভাবছিলাম, এখনই আমাকে ওখান থেকে উঠে যেতে হবে। কিন্তু প্রকাশক মুখ খোলার আগেই একজন সুন্দরী মহিলা এগিয়ে এলেন। অফ হোয়াইট সিল্কের শাড়ি, মিলিয়ে ব্লাউজ, কপালে চন্দনের টিপ। মহিলা প্রকাশককে বললেন, ও মা, কখন এসেছ! আমি ভাবতে পারছি না। কি ভাল লাগছে!
প্রকাশক জোর করেই বোধহয় হাসলেন, তোরা কেমন আছিস?
আমি ভাল। শুধু মায়ের বাতের ব্যথা আবার বেড়েছে। শোনো মামা, আমি তোমার অফিসে যাব। আমার কয়েকটা রেফারেন্স বই-এর দরকার আছে। তোমাকে হেল্প করতে হবে।
এম. এ. করেছিস অনেকদিন! এখন ওসব বই-এর কী দরকার।
ওটা তুমি বুঝবে না।
হঠাৎ মহিলা আমার দিকে তাকালেন, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি কি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন?
হ্যাঁ।
কী সাবজেক্ট ছিল?
বাংলা।
এই, তুমি বিপ্লব। না?
হ্যাঁ।
আমায় চিনতে পারছ না? আমি সুভদ্রা।
সুভদ্রা? আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন বিশ্বাসঘাতকতা করল। সুভদ্রা নামের কোনো মেয়ের কথা মনে পড়ল না।
কি, মনে পড়ছে না?
না। আমি কিছু মনে করতে পারছি না।
আমরা তিনবন্ধু সবসময় একসঙ্গে ঘুরতাম, একই শাড়ি পরে ক্লাসে যেতাম। তাই ছেলেরা আমাদের নাম দিয়েছিল ত্রিধারা। মনে পড়ছে?
এবার আবছা মনে এল। তিন বন্ধু, খুব হাসত। অন্য মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারলে ওই তিনজন কখনই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু তিনজনকে একসঙ্গে মনে পড়ছে, আলাদা করে একে নয়। আমি মাথা নাড়ালাম, হ্যাঁ, বাকি দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তো?
চিঠিতে। মঞ্জুলা এখন আমেরিকায়। ওর স্বামী ওখানে ডাক্তারি করে। রত্ন দিল্লিতে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কী করছ তুমি? সুভদ্রা জিজ্ঞাসা করল।
আপাতত তোমার মামার পাবলিকেশনে গিয়ে প্রুফ দেখি।
সেকি? অন্য কিছু–!
প্রকাশক এবার কথা বললেন, তোরা এবার মুখ বন্ধ করবি? এখনই পর্দা উঠবে। এই, তুই তোর সিটে চলে যা। ইনটারভ্যালে আসিস।
সুভদ্রা গম্ভীর মুখে চলে গেল। আমার অত সামান্য কাজ করা বোধহয় ওকে খুব বিভ্রান্ত করেছে। হ্যাঁ, এম. এ. পাশ করে একজন মাত্র আটশো টাকার বিনিময়ে বানান ঠিক করে দেয়, কোনো অ্যাম্বিশন নেই, এটা কারও ভাল লাগার কথা নয়।
পর্দা ওঠার আগে প্রকাশক বললেন, তুমি এম এ পাশ করে পড়ানোর দিকে গেলে না কেন?
আমরা জন্যে চাকরি নিয়ে কেউ বসে নেই, তাই।
তুমি বড্ড বাঁকা বাঁকা কথা বলো তো হে!
আপনার কান এসব শুনতে অভ্যস্ত নয়, তাই বাঁকা বলে মনে হচ্ছে।