১. অ্যাক্সিয়াল জাতিসমূহ (সি. ১৬০০ থেকে ৯০০ বিসিই)
নিজেদের আর্য আখ্যা দেওয়া দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপের বাসিন্দা পশুপালক জনগোষ্ঠী প্রথম অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতার প্রয়াস পেয়েছিল। আর্যরা সুস্পষ্ট কোনও জাতিগত গোষ্ঠী ছিল না বলে কোনওরকম বর্ণবাদী পরিভাষার বদলে এটা বরং অহঙ্কারের প্রকাশ ছিল, যার মানে ‘অভিজাত’ বা ‘সম্মানিত’ ধরনের কিছু। আর্যরা সাধারণ সংস্কৃতির অংশীদার শিথিল সংগঠিত গোত্র ছিল। বেশ কয়েকটি এশিয়া ও ইউরোপিয় ভাষা গড়ে তুলবে, এমন একটি ভাষায় কথা বলায় ইন্দো-ইউরোপিয়ও বলা হতো তাদের। আনুমানিক ৪,৫০০ অব্দ থেকেই ককেসিয় স্তেপে বাস করে আসছিল তারা, কিন্তু তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি একটা সময়ে কিছু কিছু গোত্র প্রান্তরের উপর দিয়ে আরও দূরে সরে যেতে শুরু করে এক সময় বর্তমানের গ্রিস, ইতালি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং জার্মানি নামে পরিচিত এলাকায় এসে পড়ে। একই সময়ে স্তেপে রয়ে যাওয়া আর্যরা ক্রমশঃ পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে দুটো ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়, ইন্দো- ইউরোপিয়দের আদি ভাষা রূপ থেকে ভিন্ন রূপে কথা বলতে শুরু করে তারা। একটি আভেস্তা উপভাষা ব্যবহার করে, অন্যটি সংস্কৃতের একটি আদি রূপ। অবশ্য, এই পর্যায়ে তাদের ভাষা প্রায় কাছাকাছি ধরনের ছিল বলে তারা যোগাযোগ বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এবং একই সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে ১,৫০০ শতাব্দী নাগাদ এক সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে পেরেছিল।
শান্তিপূর্ণ, অলস অবস্থান ছিল এটা। তখনও ঘোড়াকে পোষ মানানো হয়ে ওঠেনি বলে আর্যরা বেশি দূরে যেতে পারত না, তো স্তেপেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের দিগন্ত। তারা জমি চাষ করত, ভেড়া, ছাগল আর শুয়োর পালত এবং স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতাকে মূল্য দিত। যোদ্ধা ধরনের জাতি ছিল না ওরা, পরস্পরের সঙ্গে বা প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সঙ্গে এক আধটা বিচ্ছিন্ন সংঘাত বাদে কোনও শত্রু ছিল না তাদের, ছিল না নতুন নতুন এলাকা দখলের কোনও ইচ্ছা। অন্যান্য প্রাচীন জাতির মতো আর্যরা নিজেদের মাঝে আর চারপাশে দেখা, স্পর্শ করা এবং শোনা সকল বস্তুর ভেতর এক ধরনের অদৃশ্য শক্তি অনুভব করত। ঝড়, বাতাস, গাছপালা ও নদী নৈর্ব্যক্তিক নিশ্চল বিষয় ছিল না। এগুলোর সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা বোধ করত আর্যরা এবং স্বর্গীয় হিসাবে তাদের শ্রদ্ধা করত। মানুষ, দেবদেবী, গাছপালা ও প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি ছিল একই স্বৰ্গীয় ‘শক্তির’ প্রকাশ, আভেস্তারা যাঁকে বলত মাইন্যু আর সংস্কৃতভাষীরা বলত মান্য। এটা তাদের সবাইকে প্রাণশক্তি যোগাত, বাঁচিয়ে রাখত এবং একসঙ্গে রাখত।
সময়ের পরিক্রমায় আরও আনুষ্ঠানিক দেবনিচয় গড়ে তোলে আর্যরা। একেবারে আদিম স্তরে বিশ্বের স্রষ্টা দাইউস পিতর নামে এক আকাশ দেবতার উপাসনা করত তারা। কিন্তু পরমেশ্বরের (হাই গড) মতো দাইউস এতটাই দূরবর্তী ছিলেন যে শেষপর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক ও স্বর্গীয় বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে শনাক্ত অন্যান্য বোধগম্য দেবতাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হন। বরুণ মহাবিশ্বের নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখেন; মিথ্রা ছিলেন ঝড়, বজ্র এবং জীবনদায়ী বৃষ্টির দেবতা; ন্যায় বিচার ও প্রজ্ঞার দেবতা মাযদা সূর্য ও তারামণ্ডলীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন; এবং স্বর্গীয় যোদ্ধা ইন্দ্র ভিত্রা নামের তিনমাথাঅলা ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে শৃঙ্খলা এনেছেন। সভ্য সমাজের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আগুনও দেবতা ছিলেন, আর্যরা তাকে বলত অগ্নি। অগ্নি স্রেফ আগুনের স্বর্গীয় পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমস্ত অগ্নিকুণ্ডে জ্বলন্ত আগুন। এমনকি বিভ্রম সৃষ্টিকারী যেসব গাছপালা আর্য কবিদের অনুপ্রাণিত করত তাদেরও দেবতা বলা হতো, আভেস্তা ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছিল হোমা আর সংস্কৃত ভাষায় সোম: দুর্ভিক্ষ থেকে জাতিকে রক্ষা করা এবং তাদের পশুপালের প্রতি লক্ষ রাখা স্বর্গীয় পুরোহিত ছিলেন তিনি।
আভেস্তান আর্যরা তাদের দেবতাদের বলত দেবা (‘উজ্জ্বল জন’) এবং আমেশা (‘অমর’)। সংস্কৃত ভাষায় এই দুটি শব্দ দেবা আর অমৃতে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য, এইসব স্বর্গীয় সত্তার কোনওটিই আজকাল আমরা যাকে দেবতা বলি তেমন কিছু ছিলেন না। সর্বশক্তিমান ছিলেন না তাঁরা এবং মহাবিশ্বের উপর তাঁদের কোনও পরম নিয়ন্ত্রণও ছিল না। মানুষ ও অন্য সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির মতো মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রাখা পবিত্র নিয়মকানুনের প্রতি নিজেদের সমর্পণ করতে হতো। এই বিধিবিধানের কল্যাণেই একের পর এক ঋতুচক্রের আগমন ঘটে, যথাসময়ে বৃষ্টিপাত হয়, নির্ধারিত মাসেই প্রতিবছর ফসল উৎপাদিত হয়। আভেস্তানরা এই নিয়মকে বলত আশা, আর সংস্কৃত ভাষীরা বলত ঋতা। এটা সবকিছুকে যথাস্থানে ধরে রেখে এবং কোনটা সঠিক ও সত্যি চিহ্নিত করে জীবনযাপন সম্ভব করে তুলেছিল।
মানুষের সমাজও এই বিধানের উপর নির্ভরশীল ছিল। লোকজনকে পশু চারণ অধিকার সম্পর্কিত মজবুত, পালনীয় চুক্তি সম্পাদন, গবাদিপশুর পালন, বিয়ে ও খাদ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে হতো। সামাজিক পরিভাষায় তরজমা করা হলে আশা| ঋতার মানে ছিল নিয়মের অভিভাবক বরুণ ও তাঁর সহকারী মিথ্রার মাঝে মূর্ত আদর্শ বিশ্বস্ততা, সত্য ও সম্মান। এই দেবতারা ভাবগম্ভীর শপথের ভেতর দিয়ে প্রণীত সব কভেন্যান্ট সমঝোতার তত্ত্বাবধান করতেন। মুখের কথাকে আর্যরা দারুণ গুরুত্বের সঙ্গে নিত। অন্য সমস্ত ঘটনার মতো ভাষা ছিল দেবতা, দেবা। আর্য ধর্ম দৃশ্যমান ছিল না। আমরা যতদূর জানি, আর্যরা তাদের দেবতাদের কোনও প্রতিমা তৈরি করত না, বরং তার বদলে শ্রবণের ক্রিয়াটি পবিত্রের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে দিত তাদের। অর্থের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্তবের শব্দই পবিত্র; এমনকি একটি শব্দাংশও ঐশীকে ধারণ করতে পারে। একইভাবে উচ্চারিত হয়ে যাওয়ার পর কোনও শপথ আবিশ্যিকভাবে অবশ্যপালনীয় হয়ে দাঁড়াত, আর কথ্য জগতের স্বাভাবিক পবিত্র শক্তিকে বিকৃত করায় মিথ্যা ছিল সম্পূর্ণ অশুভ ও পরম সত্যবাদিতার প্রতি এই দুর্বলতা আর্যরা কখনওই হারায়নি।
প্রতিদিন বিশ্ব ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেবতারা যে শক্তি ক্ষয় করছেন সেটাকে পূরণ করতে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করত আর্যরা। অগ্নিকে পুষ্টি যোগানোর জন্যে উৎসর্গকারী একমুঠ শস্য, দই বা তেল আগুনে নিক্ষেপ করত, কিংবা এক গোছা সোমের কাঠি গুঁড়ো করে মণ্ডটুকু জল দেবতার নামে উৎসর্গ করত এবং পবিত্র পানীয় তৈরি করত। প্রয়োজন মেটানোর মতো যথেষ্ট ফসল ফলাতে পারত না, কিন্তু আর্যরা কেবল আচরিক ও মানবিকভাবে হত্যা করা পশুই খেত। কোনও পশুকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতার নামে উৎসর্গ করার পর সেটার আত্মার বিনাশ ঘটত না, বরং তা গৃহপালিত পশুর আদিআদর্শ রূপ গিউশ আরবানের (‘ষাঁড়ের আত্মা’) কাছে ফিরে যেত। আর্যরা তাদের পশুপালের সঙ্গে একাত্ম বোধ করত। এভাবে, পবিত্র করা হয়নি এমন কোনও পশুর মাংস খাওয়া ছিল পাপাচার, কারণ অশ্লীল হত্যা একে চিরকালের জন্যে ধ্বংস করে দিয়েছে, এবং এভাবে সকল প্রাণীকে একসূত্রে গাঁথা পবিত্র জীবনকে লঙ্ঘন করেছে। আবার, আর্যরা কখনওই অন্যের সঙ্গে ‘আত্মার’ প্রতি অনুভব করা এই গভীর শ্রদ্ধা হারায়নি এবং এটা তাদের অ্যাক্সিয়াল যুগের গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে পরিণত হবে।
যেকোনও প্রাণীর প্রাণ নেওয়াই ভীতিকর কাজ, একে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না, উৎসর্গের আচার আর্যদের অস্তিত্বের এই কঠিন বিধানের মোকাবিলায় বাধ্য করেছিল। উৎসর্গ তাদের সংস্কৃতির সংগঠনকারী প্রতীকে পরিণত হয়ে সেভাবেই থেকে যাবে, যার মাধ্যমে বিশ্ব জগৎ ও তাদের সমাজকে ব্যাখ্যা করত তারা। খোদ মহাবিশ্বই উৎসর্গের ভেতর দিয়ে অস্তিত্ব পেয়েছে বলে বিশ্বাস করত আর্যরা। বলা হয়ে থাকে, সূচনায় স্বর্গীয় বিধান অনুযায়ী কাজ করার সময় দেবতারা সাতটি পর্যায়ে বিশ্ব জগৎকে অস্তিত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমে বিশাল গোলাকার ঝিনুক আকৃতির আকাশ সৃষ্টি করেন তাঁরা, তারপর ঝিনুকের খোলে জমানো জলের উপর চ্যাপ্টা থালার মতো রাখা পৃথিবী। পৃথিবীর কেন্দ্রে তিনটি জীবন্ত প্রাণী স্থাপন করেন দেবতারা: একটি গাছ, একটি ষাঁড় এবং একজন পুরুষ। সবশেষে অগ্নি সৃষ্টি করেন তাঁরা। কিন্তু গোড়াতে সবই ছিল প্রাণহীন। দেবতারা ত্রি-বলী সম্পাদন না করা পর্যন্ত-গাছকে দোমড়ানো, ষাঁড় ও মানুষ হত্যা-বিশ্ব সজীব হয়ে ওঠেনি। সূর্য আকাশে চলাচল করতে শুরু করে; ঋতু চক্রের পরিবর্তন প্রতিষ্ঠিত হয় ও উৎসর্গের বস্তুগুলো তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করে। পেষা গাছ থেকে উঠে আসে ফুল, ফসল ও গাছপালা; ষাঁড়ের মৃতদেহ থেকে জন্ম নেয় পশুপাল এবং পুরুষের মৃতদেহ জন্ম দেয় মানবজাতির। আর্যরা উৎসর্গকে সবসময়ই সৃজনশীল মনে করে আসবে। এই আচার নিয়ে ভাবতে গিয়ে তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের জীবন অন্য প্রাণীর মৃত্যুর উপর নির্ভরশীল। তিনটি আদি-আদর্শ প্রাণী আত্মত্যাগ করেছিল যাতে অন্যরা বেঁচে থাকতে পারে। আত্ম-ত্যাগ ছাড়া বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক প্রগতি সম্ভব হতে পারে না। এটাও অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম নীতিতে পরিণত হবে।
আর্যদের তেমন জাঁকাল উপাসনালয় ও মন্দির ছিল না। খোলা প্রাঙ্গণে লাঙ্গলের ফলার গভীর দাগ দিয়ে বাকি বসতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছোট সমতল একখণ্ড জমিনের উপর উৎসর্গ করা হতো। সাতটি আদি সৃষ্টির সবগুলোকেই প্রতীকীভাবে এই গণ্ডীতে উপস্থাপন করা হতো: মাটির মাধ্যমে পৃথিবী, পাত্রে জল, অগ্নিকুণ্ডে আগুন; ছুরির ফলায় তুলে ধরা হতো পাথরের আকাশ, দোমড়ানো সোমের গোছায় গাছ, বলীর পশুতে ষাঁড়, আর পুরোহিতের মাঝে প্রথম পুরুষ। দেবতারাও উপস্থিত রয়েছেন বলে মনে করা হতো। শাস্ত্রাচারের স্তবে বিশেষজ্ঞ হোতর পুরোহিত দেবতাদের ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে শ্লোক গাইতেন। পবিত্র চৌহদ্দীতে ঢোকার পর স্তুতিবাক্য শুনতে বেদীর চারপাশে ছিটিয়ে দেওয়া সদ্য-কাটা ঘাসের উপর আসন পেতে বসে পড়তেন দেবতারা। এইসব অনুপ্রাণিত স্তুতির শব্দই যেহেতু দেবতা ছিল, চারপাশের পরিবেশ ভরিয়ে তুলে গান তাদের চেতনায় প্রবেশ করার পর গোটা সমাবেশ স্বর্গীয় সত্তায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করত। শেষপর্যন্ত আদিম উৎসর্গের পুনরাবৃত্তি করা হতো। পশু বলী দেওয়া হতো, হাত বদল হতো সোমা, আর শিকারের সবচয়ে পছন্দের অংশটি আগুনে নিক্ষেপ করতেন পুরোহিত, যাতে অগ্নি সেটাকে দেবতাদের আবাসে নিয়ে যেতে পারেন। পুরোহিত ও অংশগ্রহণকারীরা দেবতাদের উৎসবের ভোজে অংশ নিয়ে পবিত্র মাংস খাওয়া এবং তাদের সত্তার ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে উন্নীত করছে বলে ভাবা নেশা সৃষ্টিকারী সোম পান করার সময় পবিত্র সমাবেশের ভেতর দিয়ে শেষ হতো অনুষ্ঠান।
এই বিসর্জন বস্তুগত লাভও বয়ে আনত। গোত্রের একজন সদস্য এর সূচনা করেছে, যার আশা ছিল তার নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উৎসর্গে যোগ দেওয়া এইসব দেবা ভবিষ্যতে তাকে সাহায্য করবেন। যে কোনও আপ্যায়নের মতো আচার স্বর্গীয় সত্তার উপর দয়াময় সাড়া দেওয়ার দায়িত্ব তুলে দিত; এবং হোতর প্রায়শঃই তাঁদের পৃষ্ঠপোষকের পরিবার, ফসল এবং গবাদিপশু রক্ষা করার কথা মনে করিয়ে দিতেন। উৎসর্গ সমাজে পৃষ্ঠপোষকের মর্যাদাও বাড়িয়ে দিত দেবতাদের মতো তার মানুষ অতিথিরা এখন তার কাছে ঋণী, ভোজের জন্যে পশু সরবরাহ করে এবং অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী পুরোহিতকে মোটা উপহার দিয়ে নিজেকে বিত্তাশালী লোক হিসাবে প্রমাণ করেছে সে। ধর্মের সুবিধা ছিল নেহাতই বস্তুগত এবং ইহজাগতিক। লোকে চাইত দেবতারা তাদের গবাদিপশু, সম্পদ এবং নিরাপত্তা দেবেন। প্রথম দিকে পরকালের কোনও আশাকে প্রশ্রয় দেয়নি আর্যরা, কিন্তু দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ নাগাদ কেউ কেউ অনেক উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়েছে, এমন সম্পদশালী ব্যক্তিরা মৃত্যুর পর স্বর্গে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।
আর্যরা মেসোপটেমিয়া ও আর্মেনিয়ার ককেসাসে আরও অগ্রসর সমাজ আবিষ্কার করার পর এই ধীর, ঘটনাবিহীন জীবনের অবসান ঘটেছিল। আর্মেনিয়দের কাছে ব্রোঞ্জের অস্ত্র সম্পর্কে জানতে পারে তারা এবং পরিবহনের নতুন কায়দাও প্রত্যক্ষ করে: প্রথমে ষাঁড়ে টানা কাঠের ঠেলাগাড়ি এবং তারপর যুদ্ধ রথ আয়ত্ত করে তারা। স্তেপের বুনো ঘোড়া বশ মানানোর কৌশল রপ্ত ও সেগুলোকে রথে জুতে দেওয়ার কৌশল শেখার পর চলিষ্ণুতার সুখ জানতে পারে। জীবন আর আগের মতো হবে না। আর্যরা পরিণত হয় যোদ্ধায়। এখন দ্রুত গতিতে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে পারছিল তারা। উন্নত অস্ত্রের কল্যাণে প্রতিবেশী বসতির উপর চকিত হামলা চালিয়ে তাদের গবাদিপশু আর ফসল লুটে আনতে পারছিল। পশুপালনের চেয়ে ঢের বেশি রোমাঞ্চকর এবং আকর্ষণীয় ছিল এটা। তরুণদের কেউ কেউ দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের সেনাবাহিনীতে মার্সেনারি হিসাবে কাজ করে দক্ষ রথ-যোদ্ধায় পরিণত হয়। স্তেপে ফেরার পর নতুন পাওয়া নৈপুণ্য কাজে লাগিয়ে পড়শীদের গবাদিপশু চুরি করতে শুরু করে তারা। হত্যালীলা চালিয়ে, লুটপাট করে, চুরি করে জীবন একেবারে ওলটপালট হয়ে গেছে ভেবে বিহ্বল, শঙ্কিত এবং সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে পড়া অধিকতর রক্ষণশীল আর্যদের সন্ত্রস্ত করে তোলে।
আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বহুগুন বেড়ে উঠেছিল স্তেপের সহিংসতা। এমনকি নিরিবিলি থাকতে ইচ্ছুক অধিকতর প্রথাগত গোত্রগুলোও নিজেদের রক্ষার স্বার্থে এই নতুন সামরিক কৌশল রপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এক বীরের যুগের সূচনা হয়েছিল। শক্তিই ছিল অধিকার; সর্দাররা লাভ ও দাপটের খোঁজ করেছেন; কবিরা আগ্রাসন, বেপরোয়া সাহস আর সামরিক শক্তির গুণ গেয়েছেন। প্রাচীন আর্য ধর্ম প্রতিদান, আত্ম-উৎসর্গ আর জীবের প্রতি দয়ার প্রচার করেছিল। এখন আর সেটা পশু ছিনতাইকারীদের কাছে আবেদন রাখতে পারছিল না, স্বর্গের মেঘে রথ হাঁকিয়ে বেড়ানো গতিশীল ড্রাগন ঘাতক ইন্দ্ৰ ছিলেন তাদের নায়ক। ইন্দ্র পরিণত হয়েছিলেন স্বর্গীয় আদর্শে, হানাদাররা তাঁর কাছে আকাঙ্ক্ষার কথা জানাত। উন্নত ঘোড়ার মালিক বীরেরা যুদ্ধের কামনা করে, নির্বাচিত যোদ্ধারা যুদ্ধে আমার সাক্ষাৎ করে,’ জোর গলায় বলেছেন তিনি। ‘আমি দয়াময় ইন্দ্র, বিবাদ সৃষ্টি করি, ধুলি ওড়াই, অতুল্য প্রাণশক্তির প্রভু!১১ লড়াই করে, হত্যা করে লুটপাট চালানোর সময় আর্য রাখালরা ইন্দ্র ও বাহুবলে বিশ্ব বিধান প্রতিষ্ঠাকারী আগ্রাসী দেবাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করত।
কিন্তু আরও প্রথাগত আভেস্তা-ভাষী আর্যরা ইন্দ্রের নগ্ন আগ্রাসনে ভীত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, দেবাদের সন্দেহ করতে শুরু করেছিল তারা। তাঁরা কি সবাই সহিংস ও নীতিহীন? পৃথিবীর বুকের ঘটনাপ্রবাহ সবসময়ই স্বর্গের ঘটনাবলীর প্রতিফলন ঘটায়, তো, যুক্তি তৈরি করল তারা, এমনি ভীষণ হামলাগুলোর অবশ্যই একটি স্বর্গীয় প্রতিরূপ রয়েছে। ইন্দ্রের পতাকা তলে লড়াইতে লিপ্ত পশু ছিনতাইকারীরা নিশ্চয়ই তাঁর পার্থিব প্রতিপক্ষ। কিন্তু স্বর্গে দেবারা কাদের হামলা করছেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদেরকে-যেমন শৃঙ্খলার অভিভাবক বরুণ, মাযদা এবং মিথ্রাকে সম্মানজনক উপাধী ‘প্ৰভু’ (আহুরা) দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত ন্যায়বিচার, সত্যি ও জীবন ও সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধার পক্ষে দাঁড়ানো শান্তিপূর্ণ আহুরাগণই ইন্দ্র ও অধিকতর আগ্রাসী দেবাদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন? যেভাবেই হোক, এক দূরদর্শী পুরোহিতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটা, আনুমানিক ১২০০ সালে আহুরা মাযদাই তাঁকে স্তেপে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন তিনি।১২ তাঁর নাম ছিল জরাথুস্ট।
স্বর্গীয় বৃত্তি অর্জন করার সময় এই নতুন পয়গম্বরের বয়স ছিল আনুমানিক তিরিশ বছর, আর্য ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিলেন তিনি। সম্ভবত সাত বছর বয়স থেকেই পৌরহিত্য পেশার জন্যে পড়াশোনা করেছিলেন, ঐতিহ্য সম্পর্কে এত ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, উৎসর্গের মুহূর্তেই দেবতাদের উদ্দেশে পবিত্র স্তব রচনা করতে পারতেন। কিন্তু গবাদিপশু ছিনতাই নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন জরাথুস্ট, শিক্ষা শেষে অন্য পুরোহিতদের সঙ্গে পরামর্শের পেছনে বেশ কিছু সময় পার করেন এবং সমস্যার একটা সমাধান বের করার লক্ষ্যে আচার অনুষ্ঠান দিয়ে ধ্যান করেছেন। একদিন সকালে বসন্ত উৎসব উদযাপনের সময় ভোরে ঘুম থেকে উঠে দৈনন্দিন উৎসর্গের জল আনতে নদীর দিকে যাচ্ছিলেন জরাথ্রুস্ট। জল ভেঙে আগে বেড়ে খাঁটি উপাদানে নিজেকে নিমজ্জিত করেন তিনি, উঠে আসার পর নদী তীরে এক উজ্জ্বল সত্তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। জরাথ্রুস্টকে তিনি নিজের নাম বলেন বহু মানাহ (‘শুভ উদ্দেশ্য”)। জরাথ্রুস্টের সৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সবচেয়ে মহান আহুরা ঔজ্জ্বল্যে ভরা সাত দেবতার ঘিরে রাখা প্রজ্ঞা ও ন্যায় বিচারের প্রভু মাযদার কাছে নিয়ে যান তাঁকে।১৩ সূচনার প্রতিশ্রুতিতে উজ্জ্বল এক কাহিনী। এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছিল: দেবতা ও মানুষ, প্রত্যেককেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়: তারা কি শৃঙ্খলার পক্ষে নাকি অশুভের?
জরাথ্রুস্টের দিব্যদৃষ্টি প্রভু মাযদা কেবল মহান আহুরাদের একজন নন বরং পরম ঈশ্বর বলে নিশ্চিত করে তাঁকে। জরাথ্রুস্ট ও তাঁর অনুসারীদের কাছে মাযদা আর প্রাকৃতিক জগতে অস্তিত্ববান রইলেন না, বরং দুয়ে, ভিন্ন ধরনের উপাস্যে পরিণত হলেন তিনি।১৪ একক অনন্য উপাস্যে বিশ্বাস পরিপূর্ণ একেশ্বরবাদ ছিল না এটা। মাযদার সাত সঙ্গীর উজ্জ্বল সঙ্গীও – পবিত্র অমরগণ-স্বর্গীয় ছিলেন: প্রত্যেকে মাযদার একটি করে গুণ প্রকাশ করেন এবং প্রথাগতভাবে সাতটি আদিম সৃষ্টির একটির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কিত। জরাথ্রুস্টের দর্শনে একেশ্বরবাদী প্রবণতা ছিল। প্রভু মাযদা পবিত্র অমরদের সৃষ্টি করেছিলেন; তাঁরা তাঁর সঙ্গে ‘এক মন, এক কণ্ঠ, এবং একই কর্মের’১৫ ছিলেন। মাযদা একমাত্র উপাস্য ছিলেন না, তবে তিনি ছিলেন প্রথম অস্তিত্ববান। সম্ভবত সূচনায় একটিমাত্র বৃক্ষ, একটি পশু আর একজন মানুষ থাকার দাবি করা সৃষ্টিকাহিনী নিয়ে ধ্যান করে এই অবস্থানে পৌঁছেছিলেন জরাথ্রুস্ট। আদিতে ঈশ্বর মাত্র একজন ছিলেন ধরে নেওয়াই যুক্তিপূর্ণ।১৬
কিন্তু কেবল তর্কের খাতিরে ধর্মতাত্ত্বিক আঁচ-অনুমানে আগ্রহী ছিলেন না জরাথ্রুস্ট। স্তেপের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তছনছ করে দেওয়া সহিংসতা নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলেন তিনি। মরিয়া হয়ে এর অবসান ঘটানোর উপায়ের খোঁজ করছিলেন। জরাথ্রুস্টের নামে প্রচলিত সাতটি অনুপ্রাণিত স্তোত্রগীত-গাথা-বিক্ষিপ্তচিত্ত আক্রম্যতা, অক্ষমতা আর ভীতিতে ভরপুর। ‘জানি কেন আমি ক্ষমতাহীন, মাযদা,’ আর্তনাদ করেছেন পয়গম্বর, “আমার সামান্য কটি পশু আর লোক আছে।’ ‘জীবনকে ধ্বংস করার জন্যে অশুভ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত’ হানাদারদের কারণে তাঁর সম্প্রদায় সন্ত্রস্ত ছিল। অশুভ ইন্দ্রের নির্দেশে যুদ্ধরত নিষ্ঠুর যোদ্ধারা শান্তিপ্রিয়, আইননিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপর চড়াও হয়েছে। একের পর এক বসতিতে সন্ত্রাস চালিয়ে লুটতরাজ চালিয়েছে তারা, গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে, তাদের ষাঁড় আর গাভী নিয়ে গেছে।” হানাদাররা ইন্দ্রের পাশাপাশি লড়ই করার কারণে নিজেদের বীর বলে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু গাথাগুলো ভুক্তভোগীরা কিভাবে তাদের বীরত্বপূর্ণ কালকে দেখেছিল সেটাই দেখায় আমাদের। এমনকি গবাদিপশু পর্যন্ত প্রভু মাযদার কাছে আবেদন জানিয়েছে: ‘আমাকে কার জন্যে আকৃতি দিয়েছো? কে আমাকে সৃষ্টি করেছে? ভীতি ও হামলা, নিষ্ঠুরতা আর শক্তি আমাকে বন্দি করে রেখেছে।’ প্ৰভু মাযদা যখন জবাব দিলেন যে তাঁর শিক্ষার কথা শুনতে পেয়েছেন এমন একমাত্র আর্য জরাথুস্টই তার রক্ষক, গাভী সন্তুষ্ট হতে পারেনি। জরাথ্রুস্ট কি করতে পারবেন? আরও কার্যকর সাহায্যকারী কামনা করেছে সে। গাথাগুলো ন্যায়বিচারের জন্যে কেঁদে মরে। পবিত্র অমরগণ, আশার অভিভাবকরা কোথায়? প্রভু মাযদা কবে শান্তি বয়ে আনবেন? ১৮
মানুষের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব জরাথ্রুস্টকে এক ছিন্নভিন্ন, বিরোধময় দর্শনে আলোড়িত করেছে। সমন্বয়ের অতীত শিবিরে বিভক্ত দুটো বিশ্বকে স্থবির মনে হয়েছে। প্রভু মাযদার সঙ্গে ইন্দ্র ও তাঁর হানাদার বাহিনীর কোনও মিল ছিল না, তার মানে নিশ্চয়ই ভিন্ন কোনও আহুরার আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন তাঁরা। যা কিছু ভালো ও দয়াময়, তার একটিমাত্র স্বর্গীয় উৎস থাকলে, উপসংহারে পৌঁছান জরাথুস্ট, নিশ্চয়ই হানাদারদের নিষ্ঠুরতা অনুপ্রাণিতকারী একজন দুষ্ট উপাস্যও আছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই বৈরী আত্মা (আংরা মাইন্যু), ক্ষমতার দিক থেকে প্রভু মাযদার সমকক্ষ, তবে তাঁর বিপরীত। সূচনায় পরস্পরের সঙ্গে ‘অনিবার্য বিরোধের নিয়তি সম্পন্ন যমজ’ দুইজন আদিম আত্মা ছিলেন তাঁরা। দুজনই যার যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মিথ্যা, অশুভের প্রতিভু দ্রুজের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বৈরী আত্মা। যা কিছু ঠিক ও সত্যি সেই আশার চিরন্তন প্রতিপক্ষ তিনি। কিন্তু শুভের পক্ষ বেছে নিয়েছেন প্রভু মাযদা এবং পবিত্র অমর ও মানুষকে তাঁর মিত্র হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। এখন প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুকে আশা ও দ্রুজের ভেতর যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।১৯
প্রজন্মান্তরে আর্যরা ইন্দ্র ও অন্য দেবাদের উপাসনা করে আসছিল, কিন্তু এখন জরাথ্রুস্ট উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, দেবারা নিশ্চয়ই বৈরী আত্মার পাশাপাশি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।২০ পশু ছিনতাইকারীরা তাঁদের পার্থিব প্রতিরূপ। স্তেপের নজীরবিহীন সহিংসতা জরাথ্রুস্টের প্রাচীন দেবনিচয়কে দুটি যুদ্ধমান দলে ভাগ করার কারণে পরিণত হয়েছিল। ভালো নারী-পুরুষ অবশ্যই আর ইন্দ্র ও দেবাদের কাছে উৎসর্গ করতে হবে না; তারা আর পবিত্র গণ্ডীতে আমন্ত্রণ করতে পারবে না তাঁদের। তার বদলে তাদের অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে প্রভু মাযদা, তাঁর পবিত্র অমর এবং অন্য আহুরাদের প্রতি অঙ্গিকারাবদ্ধ হতে হবে, একমাত্র তাঁরাই শান্তি, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা আনতে পারেন। দেবারা ও তাঁদের অশুভ অনুগত পশু ছিনতাইকারীদের অবশ্যই পরাস্ত ও ধ্বংস করতে হবে। ২১
এখন গোটা জীবনই পরিণত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে সবারই একটা ভুমিকা ছিল। এমনকি নারী ও দাসরাও মূল্যবান অবদান রাখতে পারত। আচার আয়োজন নিয়ন্ত্রণকারী প্রাচীন শুদ্ধতার বিধানগুলোকে এবার নতুন তাৎপর্য দেওয়া হয়েছিল। অনুসারীদের জন্যে একটি খাঁটি ও পরিচ্ছন্ন জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন প্রভু মাযদা, কিন্তু বৈরী আত্মা পৃথিবীতে হামলা চালিয়ে পাপ, সহিংসতা, মিথ্যাচার, ধূলি, আবর্জনা, মৃত্যু আর পচনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন একে। সুতরাং সৎ নারী-পুরুষকে অবশ্যই তাদের চারপাশের পরিবেশকে ধূলি ও দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। খাঁটিকে ভেজাল থেকে, ভালোকে খারাপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রভু মাযদার জন্যে পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারবে তারা।২২ অবশ্যই দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করতে হবে তাদের। শীত ঋতুতেই দেবারা শক্তিমান হয়ে ওঠেন, সুতরাং এই সময় গুণবান সব নারী-পুরুষকে অবশ্যই দ্রুজের বিভীষিকার উপর ধ্যান করে তাঁদের প্রভাব ঠেকাতে হবে। রাতে যখন দুষ্ট পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ায় তখন অবশ্যই ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে তাদের এবং অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইতে অগ্নিকে শক্তিশালী করে তুলতে আগুনে সুগন্ধি ফেলতে হবে। ২৩
কিন্তু কোনও যুদ্ধই চিরকাল চলতে পারে না। প্রাচীন, শান্তিপূর্ণ বিশ্বে জীবনকে আবর্তনমূলক মনে করা হতো: ঋতুগুলো একটা অন্যটিকে অনুসরণ করত, দিনের পর রাত আসত আর রোপনের পর আসত ফসল তোলার সময়। কিন্তু জরাথ্রুস্ট এইসব প্রাকৃতিক ছন্দে আর বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না। এক প্রলয়ের দিকে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে পৃথিবী। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা ভয়াল স্বর্গীয় বিরোধের এক ‘সীমিত সময়ে’ বাস করছিলেন, কিন্তু অচিরেই শুভের চূড়ান্ত বিজয় ও অন্ধকারের শক্তির বিনাশ প্রত্যক্ষ করবেন তারা। এক ভয়াল যুদ্ধের পর প্রভু মাযদা এবং অমরগণ নারী-পুরুষের পৃথিবীতে নেমে আসবেন, উৎসর্গ করবেন। এক বিশাল বিচারানুষ্ঠান হবে। পৃথিবীর বুক থেকে দুষ্টদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে, নরকে বয়ে যাবে উন্মত্ত নদী এবং বৈরী আত্মাকে জ্বালিয়ে দেবে। মহাবিশ্ব আবার আদি নিখুঁত অবস্থায় ফিরে যাবে। পাহাড় ও উপত্যকা এক বিশাল সমতলে মিশে যাবে, যেখানে মানুষ ও দেবতা প্রভু মাযদার উপাসনা করে চিরদিন পাশাপাশি বাস করতে পারবেন। আর কোনও মৃত্যু আসবে না। মানুষ হয়ে যাবে অসুস্থতা, জ্বরা আর মরণশীলতা থেকে মুক্ত দেবতার মতো।২৪
আমরা এখন এই ধরনের প্রলয়বাদী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু জরাথ্রুস্টের আগে প্রাচীন বিশ্বে এমন কিছু ছিল না। আপন জাতির দুর্ভোগ লক্ষ করে ক্ষোভ ও ন্যায়বিচারে জন্যে আকাঙ্ক্ষা থেকে থেকেই এর উদ্ভব ঘটেছিল। ভালো, নিরীহ মানুষদের উপর যন্ত্রণা চাপিয়ে দেওয়া দুষ্ট লোকদের শাস্তি হোক এটাই চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন যে, অন্তিমকাল দেখার জন্যে তিনি বেঁচে থাকবেন না। তাঁর পরে আরেকজন আসবেন, “একজন ভালো মানুষের চেয়েও ভালো”২৫ এক অতিমানব। গাথাসমূহ তাঁকে সওশ্যান্ত (‘যিনি ফল বয়ে আনবেন’) বলে আখ্যায়িত করেছে। জরাথ্রুস্ট নন, চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনিই প্রভু মাযদার বাহিনীকে নেতৃত্ব দেবেন।
অনেক শতাব্দী পরে, অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু হলে দার্শনিক, পয়গম্বর এবং অতীন্দ্রিয়বাদীদের সবাই অহিংসতার উপর ভিত্তি করে তাঁদের সময়ের নিষ্ঠুরতা ও আগ্রাসনকে ঠেকানোর প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু জরাথ্রুস্টের জ্বালাও পোড়াও, সন্ত্রাস আর নিশ্চিহ্নকরণের চিত্রকল্প নিয়ে হতবিহ্বল দর্শন ছিল প্রতিশোধ পরায়ণ। তাঁর ব্রত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিবেশ, নিষ্ঠুরতা এবং ভোগান্তি অনিবার্যভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগ ধরনের ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে না, বরং জটিল বাস্তবতাকে অতিসরলীকৃত শুভ ও অশুভে শ্রেণীবদ্ধকরণে উদ্বুদ্ধ করার মতো এক ধরনের উগ্র ধার্মিকতার জন্ম দিতে পারে। জরাথ্রুস্টের দর্শন গভীরভাবে সংশয়বাদী। আমরা দেখব, আগন (‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা) প্রাচীন ধর্মের ক্ষেত্রে সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। শুভ ও অশুভের ভেতর মহাজাগতিক আগনকে তাঁর বাণীর মূল বিষয়ে পরিণত করে জরাথ্রুস্ট প্রাচীন আধ্যাত্মিক জগতের অংশ ছিলেন। আপন সময়ের সহিংসতাকে স্বর্গীয় বলয়ে নিক্ষেপ করে একে পরমে পরিণত করেছেন তিনি।
কিন্তু প্রবল রকম নৈতিক দর্শনে জরাথ্রুস্ট অ্যাক্সিয়াল যুগের অপেক্ষায় ছিলেন বটে। নতুন যোদ্ধা রীতিতে কিছু পরিমাণ নৈতিকতা আনতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রকৃত বীররা কখনওই সতীর্থ প্রাণীজগতকে সন্ত্রস্ত করেন না, বরং আগ্রাসন ঠেকানোর চেষ্টা করেন। পবিত্র যোদ্ধা শান্তির প্রতি নিবেদিত; প্ৰভু মাযদার পক্ষে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা, তারা ধৈর্যশীল, শৃঙ্খলাবদ্ধ, সাহসী এবং দুষ্টের হামলা থেকে সকল ভালো প্রাণকে রক্ষার বেলায় ক্ষিপ্ৰ ২৬ শৃঙ্খলার (আশা) সহচর আশাবানদের অবশ্যই তাদের পরিবেশে পবিত্র অমরদের অনুকরণ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, নদী তীরে জরাথ্রুস্টের কাছে দেখা দেওয়া ‘সৎ উদ্দেশ্য’ ছিলেন গাভীর অভিভাবক এবং আশাবানকে অবশ্যই তাঁর নজীর অনুসরণ করতে হবে, যারা গবাদি পশুকে চারণভূমি থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, তাদের ঠেলা গাড়ির সঙ্গে জোতে, হত্যা করে এবং যথাযথ আচার ছাড়াই খায়, সেই হানাদারদের নয়।২৭ স্বর্গীয় ন্যায়বিচারের মানব অবতার ‘সৎ অধিপতি’ ছিলেন প্রস্তর আকাশের রক্ষক, সুতরাং আশাবানরা অবশ্যই কেবল দরিদ্র ও দুর্বলকে রক্ষার জন্যেই তাদের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন। জরাথ্রুস্টবাদীরা দুর্বল লোকদের রক্ষা, যত্নের সঙ্গে গবাদিপশু পালন আর প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুদ্ধ করার সময় অমরদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন এবং বৈরী আত্মার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
প্রাচীন আর্য ঐতিহ্যে প্রোথিত হলেও জরাথ্রুস্টের বাণী প্রবল বৈরিতাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। লোকে একে দারুণ চাহিদা সম্পন্ন আবিষ্কার করেছে; কেউ কেউ নারী ও কৃষকদের কাছে তাঁকে প্রচারণা চালাতে দেখে এবং সবাই- কেবল অভিজাতরা নয়-স্বর্গে যেতে পারবে-তাঁর এই বিশ্বাসে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছে। দেবাদের প্রত্যাখানে অনেকেই অস্বস্তিতে ভুগতে পারে: ইন্দ্র প্রতিশোধ নেবেন না?২৯ অনেক বছর নিজের জাতির কাছে প্রচারণা চালানোর পর মাত্র একজন দীক্ষিত পেয়েছিলেন জরাথ্রুস্ট, তো নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যান তিনি এবং আরেক গোষ্ঠীর প্রধান বিসতাস্পার মাঝে একজন পৃষ্ঠপোষকের খোঁজ পান, জরাথুস্টিয় ধর্মবিশ্বাসকে নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। বিসতাস্পার দরবারে অনেক বছর ছিলেন জরাথ্রুস্ট, বীরের মতো অশুভের বিরুদ্ধে তিক্ত, সহিংস লড়াই চালিয়ে গেছেন। এক ট্র্যাডিশন মোতাবেক প্রাচীন ধর্ম প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষুব্ধ পুরোহিতদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর জরাথ্রুস্টিয় মতবাদ সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারি না আমরা। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ নাগাদ আভেস্তান আর্যরা দক্ষিণে অভিবাসন করে পূর্ব ইরানে বসতি করে, যেখানে জরাথুস্টিয়বাদ জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়। প্রধানত ইরানি ধর্ম হিসাবে টিকে আছে এটা। বিস্ময়করভাবে জরাথুস্ট যাদের নিন্দা করেছেন সেই আর্য পশু ছিনতাইকারীরাই শেষপর্যন্ত অহিংসা, সহিংসতাহীন নীতির উপর ভিত্তি করে অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রথম স্থিতিশীল ধর্ম সৃষ্টি করবে।
সংস্কৃত-ভাষী কিছু আর্য যখন স্তেপে প্রলয় কাণ্ড ঘটিয়ে চলছিল, সেই সময় কিছু আর্য আফগানিস্তান হয়ে ছোট ছোট দলে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণে অভিবাসন শুরু করেছিল, শেষপর্যন্ত পাঞ্জাবের সিন্ধু নদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মাঝে উর্বর ভূমিতে বসতি গড়ে তোলে তারা। নিজেদের আবাসের নাম দিয়েছিল তারা সপ্ত- সিন্ধু বা ‘সাত নদীর দেশ’। ভারতে আর্য বসতি নিয়ে অনেক বিতর্ক চলে আসছে। কোনও কোনও পণ্ডিত এমনকি তেমন কোনও ঘটনা ঘটার কথাই অস্বীকার করেন, ভারতের স্বদেশী লোকজনই এই সময়ে পাঞ্জাবে গড়ে ওঠা সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল বলে যুক্তি দেখান তাঁরা। আর্যরা ভারতে এই প্রাথমিক যুগের কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রেখে যায়নি। যাযাবর সমাজ ছিল তাদের, লোকজন খোলামেলা বা সাময়িক শিবিরে বাস করত। আমাদের তথ্যের একমাত্র উৎস হচ্ছে সংস্কৃতে রচিত সম্মিলিতভাবে বেদ (‘জ্ঞান’) নামে পরিচিত আচরিক টেক্সট। বেদের ভাষা আভেস্তানের এত কাছাকাছি এবং গাথা’র সঙ্গে এত নিবিড় যে, নিশ্চিতভাবেই তা আর্যদের ধর্মশাস্ত্র। বর্তমানে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই দ্বিতীয় সহস্রাব্দে স্তেপের আর্য গোত্রগুলোর প্রকৃতই সিন্ধু উপত্যকায় উপনিবেশ গড়ে তোলার কথা মেনে নিয়েছেন। তবে ব্যাপক অভিবাসন বা সামরিক আগ্রসন ছিল না এটা। যুদ্ধ, প্রতিরোধ বা ব্যাপক বিস্তৃত ধ্বংস-লীলার কোনও আলামত নেই। তার বদলে দীর্ঘ সময় জুড়ে এই অঞ্চলে সম্ভবত বিভিন্ন আর্য গোত্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
আর্যদের প্রথম দলটি এসে পৌঁছানোর পর তারা হয়তো সিন্ধু উপত্যকায় এর আগের কোনও সভ্যতার অবশেষ প্রত্যক্ষ করে থাকবে।৩১ ক্ষমতা ও সাফল্যের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় (সি. ২৩০০-২০০০) এই প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য মিশর বা মেসোপটেমিয়া থেকেও বড় ছিল। এর দুটো দর্শনীয় রাজধানী ছিল: আধুনিক সিন্ধের মোহেনজো-দারো এবং আনুমানিক ২৫০ মাইল পুবে হরপ্পা। কিন্তু সিন্ধু নদের তীর বরাবর ৮০০ মাইল এবং আরবীয় উপকূলের আরও ৮০০ মাইল বরাবর হুবহু একই গ্রিড প্যাটার্নে নির্মিত আরও শত শত অনুরূপ ছোট ছোট শহরও খনন করা হয়েছে। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা ছিল অত্যাধুনিক এবং ক্ষমতাশালী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক, মেসোপটেমিয়ায় সোনা, তামা, কাঠ, আইভরি আর তুলা রপ্তানি করত এবং ব্রোঞ্জ, টিন, রূপা, নীলকান্তমনি আর সোপস্টোন আমদানি করত।
দুঃখজনকভাবে হরপ্পান ও তাদের ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা, যদিও কিছু কিছু প্রলুব্ধকারী সূত্র রয়েছে যা থেকে মনে হয় অ্যাক্সিয়াল যুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু ধর্মীয় প্রথা সম্ভবত সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা থেকে নেওয়া হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি মাতৃ-দেবীর প্রতিমা, পাথরের লিংগাম এবং পশুপাখীতে ঘেরাও হয়ে যৌগিক আসনের মতো ভঙ্গিতে বসে থাকা অবয়বসহ তিনটি সীলমোহর আবিষ্কার করেছেন। এটাই কি দেবতা শিব ছিলেন? ধ্রুপদী হিন্দুধর্মমতে শিব হলেন পশুজগতের প্রভু, এক মহান যোগী, কিন্তু আর্য উপাস্য নন তিনি, সংস্কৃত বেদে কখনওই তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। জোরাল কোনও প্রমাণের অভাবে আমরা ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে পারব না। আর্যরা প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলে পৌঁছানোর পর হরপ্পান সাম্রাজ্য কার্যত হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোয় বসতিকারীরা থেকে থাকতে পারে। এখানে অধিগমন এবং বিনিময়ের ঘটনা ঘটে থাকে পারে, এবং আর্যদের কেউ কেউ হয়তো স্থানীয় ধর্মবিশ্বাস মেনে নিয়ে তাকে আপন করে নিয়েছিল।
ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন শহরগুলো নতুন করে নির্মাণ ও সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনও ইচ্ছা আর্য অভিবাসীদের ছিল না। সবসময় চলার উপর ছিল বলে জনবসতির নিরাপত্তাকে ছোট করে দেখত তারা এবং হামলা চালানোর আগে ঘোড়াকে রথের সঙ্গে ‘জুতে দেওয়া’র যোগ বেছে নিয়েছিল। জরাথ্রুস্টিয়দের বিপরীতে নিরিবিলি, শান্তিপূর্ণ অবস্থানের প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না তাদের। যুদ্ধ রথ এবং ক্ষমতাশালী ব্রোঞ্জের তলোয়ার ভালোবাসত ওরা; ওরা ছিল পশুপালক, পড়শীদের গবাদিপশু ছিনতাই করেই জীবীকা অর্জন করত। গবাদিপশু ছিনতাইয়ের উপর জীবন নির্ভরশীল থাকায় ক্রীড়ার চেয়েও বেশি কিছু ছিল তা; স্বর্গীয় ক্ষমতার এক ধরনের মিলন ঘটানো আচার-অনুষ্ঠানসহ এটা ছিল পবিত্র কর্মকাণ্ড। ভারতীয় আর্যরা একটি গতিশীল ধর্মের আকাঙ্ক্ষা করেছে; ওদের ঘোড়াগুলোই ছিল ভ্রাম্যমাণ যোদ্ধা ও রথযোদ্ধা। ক্রমবর্ধমানহারে জরাথ্রুস্টের উপাসিত আসুরাদের* একঘেয়ে ও নিষ্ক্রিয় আবিষ্কার করতে থাকে তারা। স্রেফ স্বর্গীয় প্রসাদে বসে নিরাপদ দূরত্ব থেকে জগৎকে নির্দেশ দিয়ে চলা বরুণের মতো একজন আসায় কিভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারে কেউ? রোমাঞ্চপ্রিয় দেবাদের বেশী পছন্দ করতে থাকে তারা, ‘আসুরা’রা যেখানে দরবারে নিজেদের বাড়িতে বসে থাকেন সেখানে তাঁরা চাকায় ভর করে চলেন।৩২
[* সংস্কৃতে আভেস্তান আহুরা পরিণত হয়েছে আসুরায়।]
নিজেদের পাঞ্জাবে থিতু করার পর প্রধান আসুরা বরুণের প্রথা ইতিমধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছিল আর তাঁর জায়গায় পরম ঈশ্বরে পরিণত হচ্ছিলেন ইন্দ্ৰ।৩৩ বুনো, উড়ন্ত দাড়ি, সোমে পূর্ণ পেট আর যুদ্ধের জন্যে প্রবল উন্মাদনা নিয়ে ইন্দ্র ছিলেন আদিআদর্শ আর্য যার কাছে সব যোদ্ধা যাচনা করত। সময়ের সূচনায় তিনমাথা ড্রাগন প্রিত্রা জীবনাদায়ী জলের প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়ায় খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল পৃথিবী; তো তার উদ্দেশ্যে চকচকে ভয়ঙ্কর বজ্র নিক্ষেপ করেছিলেন ইন্দ্র। এভাবে, বরুণের মতো অলসভাবে ঘরে বসে থেকে নয়, কঠিন প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধ করে পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে তুলেছিলেন তিনি। বৈদিক টেক্সটে বরুণের সকল গুণ-আইনের প্রয়োগ, সত্যির অভিভাবকত্ব এবং মিথ্যার শাস্তিদান-ইন্দ্রকে দেওয়া হয়। কিন্তু সব রকম জাঁক সত্ত্বেও ইন্দ্র একজন ঘাতক, মিথ্যাচার ও প্রতারণার ভেতর দিয়েই কেবল প্রিত্রাকে পরাস্ত করতে পেরেছিলেন তিনি, এই অস্বস্তিকর সত্যি অখণ্ড রয়ে যায়। লাগাতার বেপরোয়া যুদ্ধে লেগে থাকা একটি সমাজের সহিংস ও ঝামেলাপূর্ণ দর্শন ছিল এটা। বৈদিক শ্লোকগুলো গোটা সৃষ্টিকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয়াল বিরোধে আলোড়িত হতে দেখেছে। দেবা এবং আসুরারা স্বর্গে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, আর আর্যরা পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার জন্যে যুদ্ধ করেছে। এটা ছিল অভাবের কাল; সিন্ধু উপত্যকায় কেবল স্থানীয় বসতিগুলোর লোকজনের-বাড়িতে অবস্থানকারী আসুরাদের পার্থিব প্রতিরূপ-পশু ছিনতাই করেই আর্যরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারত।
আর্যরা কঠিন জীবন যাপনকারী, কড়া পানীয় পানকারী জাতি ছিল, সঙ্গীত, জুয়া আর মদ ভালোবাসত।
কিন্তু এমনকি এই প্রাথমিক কালেও আধ্যাত্মিক প্রতিভার পরিচয় রেখেছিল তারা। পাঞ্জাবে পৌঁছানোর অল্প পরে একটি শিক্ষিত অভিজাত গোষ্ঠী বৈদিক ধর্মশাস্ত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক অংশ রিগ বেদের (‘পঙক্তিতে জ্ঞান’) আদি স্তোত্রগীতগুলো সংকলিত করতে শুরু করে। শেষ হওয়ার পর এটা দশটি গ্রন্থে বিভক্ত ১,০২৮টি স্তোত্রগীত ধারণ করবে। এটা ছিল গীত, মন্ত্ৰ (আচারে ব্যবহৃত সংক্ষিপ্ত গদ্য সূত্র), ও সেগুলোর আবৃত্তি সংক্রান্ত নির্দেশনা সংবলিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের একটা অংশমাত্র। সম্পূর্ণই অনুপ্রাণিত ছিল এই টেক্সট ও কাব্য; এগুলো ছিল শ্রুতি, ‘যা শোনা হয়েছে।’ প্রাচীন কালের মহান গণকদের (ঋষি) কাছে প্রত্যাদিষ্ট হওয়ায় এগুলো ছিল সম্পূর্ণ কর্তৃত্বব্যাঞ্জক, মানবীয় ত্রুটির অতীত, স্বর্গীয় ও চিরন্তন।
আর্য গোত্রগুলো ভারতে আগমনের সময় নাগাদ এর ভাষা ইতিমধ্যে প্রাচীন হয়ে যাওয়ায় রিগ বেদের কিছু কিছু স্তোত্রগীত সত্যিই অনেক প্রাচীন কালের হতে পারে। কাব্যগুলো সাতটি পুরোহিতসুলভ পরিবারের ছোট একটি দলের সম্পত্তি ছিল। প্রত্যেকরই নিজস্ব স্বত্ত্বাধীন সংগ্রহ ছিল, উৎসর্গের আচার- অনুষ্ঠানে এসব আবৃত্তি করত তারা। পরিবারের সদস্যরা এইসব স্তোত্রগীত অন্তর দিয়ে মুখস্থ করে রাখত এবং পরের প্রজন্মের কাছে কেবল মৌখিকভাবেই হস্তান্তরিত হতো; সাধারণ শতক দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আগপর্যন্ত ঋগ বেদ লিখিত রূপ লাভ করেনি। সাক্ষরতার আবির্ভাবের পর থেকে আমাদের স্মৃতি শক্তি হ্রাস পেয়েছে, লোকে এমন বিরাট সব টেক্সট মুখস্থ করতে পারত বলে বিশ্বাস করা কঠিন মনে করি আমরা। কিন্তু এমনকি প্রাচীন সংস্কৃত প্রায় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার পরেও বৈদিক ধর্মশাস্ত্র অবিশ্বাস্য নির্ভুলতায় হস্তান্তরিত হতো এবং আজও দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে যাওয়া মূলের সুর ও আনতি হুবহু হাত ও আঙুলের আচরিক নির্দেশিত ভঙ্গিমাসহ টিকে আছে। আর্যদের কাছে শব্দ সবসময়ই পবিত্ৰ ছিল, এইসব পবিত্র টেক্সট শোনার সময় লোকে ঐশী শক্তিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে ভাবত। স্মৃতিতে ধারণ করার পর এক পবিত্র সত্তার উপস্থিতিতে পূর্ণ হয়ে যেত তারা। বৈদিক ‘জ্ঞান’ বাস্তব ভিত্তিক তথ্য অর্জনের কোনও ব্যাপার ছিল না, বরং তা ঐশী অধিকার হিসাবে অনুভূত হতো।
ঋগ বেদের কবিতাগুলো দেবতাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ কাহিনী জানায় না বা উৎসর্গের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে পরিষ্কার বর্ণনা দেয় না, বরং সম্প্রদায়ের কাছে আগে থেকে পরিচিত মিথ ও কিংবদন্তীর মতো হেঁয়ালি ও ধাঁধায় আবৃত করে আভাস দেওয়া হয়। এগুলো যে সত্য প্রকাশ করতে চেয়েছিল তাকে স্পষ্ট, যৌক্তিক আলোচনায় তুলে আনা সম্ভব ছিল না। কবি একজন ঋষি, গণক ছিলেন। তিনি নিজে এইসব শ্লোক আবিষ্কার করেননি। অন্য জগৎ থেকে আগত মনে হওয়া বিভিন্ন দিব্যদৃষ্টিতে নিজেদের তাঁর কাছে প্রকাশ করেছে এগুলো।৩৬ ঋষি সত্যি দর্শন করতে পারতেন এবং সাধারণ লোকের কাছে স্পষ্ট নয় এমন সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু শুনতে জানে এমন কারও কাছে তাকে শেখানোর স্বর্গীয়ভাবে প্রদত্ত মেধা ছিল তাঁর। বেদের পবিত্র জ্ঞান স্রেফ শব্দের বৈজ্ঞানিক অর্থ থেকে নয়, বরং তাদের ধ্বনি স্বয়ং যা দেবা থেকে এসেছে।
মনোযোগের সঙ্গে রিগ বেদের দূরদর্শী সত্যি স্তোত্রগীত শোনার সময় সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন মনে হওয়া বিভিন্ন বস্তুকে একসূত্রে গেঁথেছে বলে মনে হওয়া বিভিন্ন বৈপরীত্য আর অদ্ভুত, নিবিড় হেঁয়ালির গোপন তাৎপর্য দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে পেয়েছে বলে ভাবত তারা।৩৭ এই শক্তি ছিল স্বর্গীয় শৃঙ্খলাকে মানবীয় ভাষায় তরজমা করা রিতা। ঋষি পবিত্র শব্দাংশগুলো বাস্তবে উচ্চারণ করার সময় রিতা রক্তমাংসে পরিণত হতো এবং পাঞ্জাবের এক ছিন্নভিন্ন, বিরোধময় জগতে সক্রিয় হয়ে উঠত। শ্রোতারা একের পর ঋতু প্রবাহ ঘটানো, নক্ষত্রমণ্ডলী তাদের কক্ষপথে বিরাজকারী, ফসল ফলে আর মানব সমাজের বিক্ষিপ্ত উপাদানসমূহকে সামঞ্জস্য দানকারী সেই শক্তির সংস্পর্শে এসে পড়েছে বলে মনে করত। সুতরাং ধর্মশাস্ত্র মতবাদগতভাবে ধারণযোগ্য জ্ঞান বিতরণ করত না, বরং মানুষকে জীবনের দৃশ্যমানের সঙ্গে অদৃশ্য মাত্রার যোগসূত্র স্থাপনকারী সেতু অধিকতর স্বজ্ঞাপ্রসূত অন্তর্দৃষ্টি যোগাত।
বাইরে থেকে আগত বলে মনে হওয়া কিন্তু আবার অন্তস্থঃ কণ্ঠস্বর হিসাবেও অনুভূত অনুপ্রাণিত বাণী গ্রহণের জন্যে ঋষিরা সবসময় নিজেদের তৈরি অবস্থায় রাখতে শিখেছিলেন। হয়তো ইতিমধ্যে তাদের অবচেতনে প্রবেশে সক্ষম করে তোলা মনোসংযোগের কৌশল সৃষ্টি শিখতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। সাধারণ বিচ্যুতকারী চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারলে মনের দরজাগুলো খুলে যেতে পারে, এবং বাঙ্ময় ভাষার আবিষ্কর্তা, বিশ্বের আলো অগ্নি তাঁদের দেবতার মতো একইভাবে দেখায় সক্ষম করে তুলবে বলে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। ঋষিরাই ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের ভিত্তি তৈরি করে গিয়েছিলেন। একেবারে গোড়ার দিকে প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে যাওয়ার সচেতন প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁরা এবং একটি গভীর অধিকতর মৌলিক সত্যি অনুভব করতে চেয়েছেন।
কিন্তু তাসত্ত্বেও ঋষিরা আর্য সম্প্রদায়ের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যোদ্ধা ও হানাদাররা সম্পূর্ণ ভিন্ন আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা ছিল। তাদের জীবন পর্যায়ক্রমে গ্রাম (গ্রামা) এবং জঙ্গলে (অরণ্য) যাপিত হতো। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের সময় তাদের কোনওমতে নির্মিত অস্থায়ী আসুরাদের মতো শিবিরে বাস করতে হতো। কিন্তু দক্ষিণায়নের পর সম্প্রদায়ের সম্পদ পূরণ করার জন্যে ষাঁড় ও ঘোড়ায় জোয়াল দিয়ে হানা চালানোর এক নতুন চক্র শুরু করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত তারা। গ্রাম ও বনের বিরোধিতা ভারতে একটি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ নজীরে পরিণত হয়। একটি অপরটির সম্পূরক ছিল। বসতি স্থাপনকারীরা ফসল ফলাত এবং যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় গবাদিপশুর জন্ম দান করত। কিন্তু তারপরেও সমাজের বহিস্থঃ বলয়ে ঘুরে বেড়ানো পশু ছিনতাইকারীদের তরফ থেকে অব্যাহত আক্রমণের শঙ্কায় থাকত তারা। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলেই যোদ্ধা বীরত্ব দেখাত আর অজানাকে জানার চেষ্টা করত। পরে অ্যাক্সিয়াল যুগে সাধুরা আধ্যাত্মিক বলয়ে অগ্রযাত্রার লক্ষ্যে বনে চলে যাবেন। সুতরাং আর্যরা অরণ্যে একাধারে সহিংসতা ও ধর্মীয় আলোকনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে; এবং একেবারে গোড়ার দিকেই এদুটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ঋষির মতো ধৈর্য ধরে অপেক্ষা ও মনপ্রাণ ফাঁকা করে তোলার বদলে একজন যোদ্ধা জানত দর্শন ও অন্তর্দৃষ্টির জন্যে তাকে যুদ্ধ করতে হবে।
স্তেপে হানা দেওয়া শুরু করার পর থেকে আর্যরা দৈনন্দিন অস্তিত্বের সংশয়বাদী ধারা ফুটিয়ে তোলার জন্যে তাদের আচারের ধরন পাল্টে ফেলেছিল। বিস্তারিত বিবরণ না দিলেও গবাদি পশু ছিনতাইকারীদের নতুন উৎসর্গের আচারে দারুণ অস্বস্তিতে ভুগছিলেন জরাথ্রুস্ট। পরবর্তীকালে একটি ভারতীয় আচরিক টেক্টটে বলা হয়েছে, ‘আমাদের অবশ্যই দেবতারা গোড়াতে যা করেছেন তাই করতে হবে। ‘দেবতারা এভাবে করেছেন, মানুষকেও এভাবে করতে হবে, বলেছে আরেকটি ১ আক্রমণ ও যুদ্ধে আর্য যোদ্ধারা দেবা ও আসুরাদের যুদ্ধের পুনরাভিনয় করত। যুদ্ধের সময় নিজেদের চেয়ে ভিন্ন কিছুতে পরিণত হতো তারা, ইন্দ্রের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম মনে করত; এইসব আচার তাদের যুদ্ধবিগ্রহকে ‘আত্মা’ যোগাত এবং পার্থিব যুদ্ধকে স্বর্গীয় আদিআদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এগুলোকে পবিত্রে পরিণত করত।
সুতরাং ভারতের আর্য সমাজের আধ্যাত্মিক প্রাণ ছিল বিসর্জন, কিন্তু অর্থনীতিরও মূল ছিল তা। স্তেপের প্রাচীন শান্তিপূর্ণ আচার আরও আগ্রাসী ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং পশু ছিনতাইকারীদের বিপজ্জনক জীবনকে প্রতিফলিত করেছে। আর্য উৎসর্গগুলো এখন সগর্বে লুটের মাল প্রদর্শন ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসর্গের ভোজের জন্যে বিপুল সংখ্যক পশু হত্যাকারী উত্তর পশ্চিমের পটল্যাচ উৎসব পালনকারী আদি আমেরিকান গোত্রগুলোর মতো ছিল। কোনও সম্প্রদায় তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ পশু ও ফসল পুঞ্জীভূত করলে উদ্বৃত্তটুকুকে অবশ্যই ‘পুড়িয়ে ফেলতে হতো’। চিরন্তনভাবে চলার উপর থাকা কোনও যাযাবর গোষ্ঠীর পক্ষে এইসব রসদ জমিয়ে রাখা ছিল অসম্ভব, এবং সমাজের সম্পদ বণ্টনের একটি কঠিন প্রস্তুত উপায় ছিল পটল্যাচ। আচার সর্দার কিভাবে সফল হয়েছে ও তার সম্মান বাড়িয়েছে তাও দেখাত।
ভারতে রাজা (‘সর্দার’) একইরকম চেতনায় উৎসর্গের আয়োজন করতেন। ৪২ একটি বিশেষ উৎসর্গের চৌহদ্দীতে নিজের গোত্রের প্রবীণ ও অন্যান্য প্রতিবেশী গোত্র প্রধানদের আমন্ত্রণ জানাতেন তিনি, যেখানে তাঁর উদ্বৃত্ত লুটের মাল-গবাদি পশু, ঘোড়া, সোম এবং শস্য-প্রদর্শন করতেন। এইসব পণ্যের কিছু অংশ দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো এবং শোরগোলময় ও জাঁকাল ভোজ সভায় খাওয়া হতো; অবশিষ্টাংশ উপহার হিসাবে অন্য রাজাদের বণ্টন করা হতো। পৃষ্ঠপোষকের অতিথিদের উপর এইসব উপহারের প্রতিদান দেওয়ার একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করত এটা এবং রাজারা পরস্পরের সঙ্গে আরও দর্শনীয় উৎসর্গ প্রদানের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তববাক্য উচ্চারণকারী
হোতর্ পুরোহিত পৃষ্ঠপোষকের ঔদার্য তাঁর পক্ষে আরও সমৃদ্ধি বয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর তারিফ করেও গীত গাইতেন। এভাবে পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের আনুকূল্য অর্জন এবং খোদ বহুল্যময় মেজবান ও উৎসর্গকারী ইন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রয়াস পাওয়ার সময় একাধারে প্রশংসা ও সম্মানও পেতে চাইতেন। জাগতিক জীবন ত্যাগ করে যখন তাঁর স্বর্গীয় প্রতিকৃতির অনুরূপ হওয়ার কথা ঠিক তখন এক আগ্রাসী আত্ম- প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তিনি। প্রাচীন আচারের এই বৈপরীত্য অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু সংস্কারকের উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হবে।
উৎসর্গ ইতিমধ্যে অঞ্চলে মহামারীতে পরিণত হওয়া সহিংসতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে পৃষ্ঠপোষকের হাতে আর কোনও পশু থাকত না বলে সম্পদ পূরণ করার জন্যে হামলার নতুন ধারা শুরু করতে হতো তাকে। আমাদের হাতে এইসব উৎসর্গের কোনও সমসাময়িক বিবরণ নেই, তবে পরবর্তী কালের টেক্সটসমূহে ধারণ করা বিক্ষিপ্ত উল্লেখ থেকে কি ঘটেছিল তার একটা ধারণা পাই আমরা। উৎসর্গ একটা ভাবগম্ভীর আয়োজন ছিল, তবে আবার বিশাল উচ্ছৃঙ্খল কার্নিভালও ছিল। বিপুল পরিমাণ মদ ও সোম পান করা হতো বলে লোকে হয় মাতাল হয়ে পড়ত বা প্রীতিকরভাবে প্রফল্ল থাকত। আয়োজক রাজার বরাদ্দ করা দাসীদের সঙ্গে সাধারণ যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হতো, অনুষ্ঠিত হতো প্রাণবন্ত আগ্রাসী প্রতিযোগিতা : রথ প্রতিযোগিতা, তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা এবং দড়ি টানাটানি। নাচিয়ে, গায়ক ও বাঁশি বাদকদের বিভিন্ন দল পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করত। চড়া বাজিতে পাশা খেলা চলত। যোদ্ধাদের বিভিন্ন দল মেকি লড়াইতে লিপ্ত হতো। উপভোগ্য ব্যাপার ছিল, তবে আবার বিপজ্জনকও। এই দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশে খ্যাতি ও সম্মানের জন্যে ক্ষুধার্ত পেশাদার যোদ্ধাদের ভেতর প্রহসনমূলক লড়াই অনায়াসে মারাত্মক যুদ্ধে পরিণত হতে পারত। একজন রাজা পাশা খেলায় গাভী বাজি ধরে গোটা পশুর পাল খুইয়ে বসতে পারতেন। অনুষ্ঠানের উত্তেজনায় ভেসে গিয়ে ‘প্রতিপক্ষের’ উপর হামলা চালানোরও সিদ্ধান্তও নিয়ে বসতে পারতেন তিনি-প্রতিবেশি কোনও রাজা যার সঙ্গে তার খারাপ সম্পর্ক চলছিল বা যিনি নিজস্ব প্রতিদ্বন্দ্বী উৎসর্গের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। টেক্সট দেবা ও আসুরাদের প্রায়ই পরস্পরের উৎসর্গে হস্তক্ষেপ করে লুটের মাল ও জিম্মি নিয়ে সটকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়, এতে বোঝা যায় যে এই ধরনের সহিংস হস্তক্ষেপ পৃথিবীর বুকে সাধারণ ঘটনা ছিল। আচরিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ না পেলে রাজা অপমানিত হতেন; শত্রুশিবিরে আক্রমণ চালিয়ে লুটের মাল নিয়ে আসাটা তাঁর পক্ষে মর্যাদার প্রশ্নে পরিণত হতো। এইসব শাস্ত্র-অনুপ্রাণিত হামলায় লোকে হত্যা করতে ও নিহত হতে পারত।
এক উচ্চকিত আনুষ্ঠানিক পটভূমিতে উৎসর্গের অনুষ্ঠান আর্য বীরত্বের মহিমা ও ত্রাসের আচরণ বিধিকে পুনঃমঞ্চায়ন করত।৪৪ একজন যোদ্ধার গোটা জীবনই ছিল আগন, তার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অবসান ঘটার মতো খাবার ও সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে এমন এক মারাত্মক ও বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা। স্তেপে বাস করার সময় থেকেই আর্যরা তাদের ভেতর সেরা ও সম্পদশালীরাই স্বর্গে দেবতাদের মিলিত হবে বলে বিশ্বাস করে এসেছে। এখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, যুদ্ধে মর্যাদার সঙ্গে নিহত একজন যোদ্ধা অবিলম্বে দেবতাদের জগতে উত্থিত হয়। সুতরাং বীরত্বের বিধিতে সহিংস মৃত্যু ও আলোকন ছিল অবিচ্ছেদ্য। একটি প্রাচীন কাহিনী এই বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলেছে। একদল যোদ্ধা একটি দীর্ঘমেয়াদী জাঁকাল উৎসর্গের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বলে মিলিত হয়েছে। কিন্তু যেমনটা প্রায়শঃ ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বী একদল যোদ্ধা তাদের ঘেরাও করে ফেললে মারাত্মক যুদ্ধ হয়। দুঃখজনকভাবে তাদের নেতা সুরা নিহত হয়। সবকিছু চুকে যাওয়ার পর তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্যে স্বগোত্রীয়রা বৃত্তাকারে মিলিত হয়, কিন্তু তাদের একজন দিব্যদর্শন লাভ করে। সে দেখতে পায় উৎসর্গের জমিনের উপর দিয়ে হেঁটে পরিত্র আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সুরা, এবং তারপর স্বর্গে আরোহণ শুরু করেছে। ‘শোক করো না, ‘ সতীর্থদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেছে সে, ‘কারণ তোমরা যার জন্যে শোক করছ সে উৎসর্গের অগ্নি থেকে ঊর্দ্ধে আরোহণ করেছে এবং স্বর্গে প্রবেশ করেছে। কেবল এক বিপজ্জনক আচারের সময় নিহত হওয়াতেই দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছে সুরা। নেতা অকালে যুক্তিহীনভাবে খুন হয়েছে, এই একটিমাত্র কারণেই তার সহচর এই মহৎ দর্শন লাভ করেছে।
যোদ্ধাদের কেউ কেউ তাদের বীরত্বসূচক রীতির অসারতা বুঝতে পেরেছিল। রিগ বেদের পরবর্তী কালের স্বল্প সংখ্যক কবি এক নতুন ধরনের ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবাদ তুলে ধরেছেন। লোকে ক্লান্ত বোধ করছিল। ‘দারিদ্র্য, নগ্নতা এবং ক্লান্তি অনেক বেশি চাপ দিচ্ছে আমার মনে,’ অভিযোগ করেছেন ঋষি, ‘আমার মনটা পাখির মতো ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। ইঁদুর যেভাবে জেলের জাল কাটে, উদ্বেগ তেমনি কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে।৪৬ আক্রম্যতা শেষ বৈদিক কালকে চিহ্নিত করেছে, অস্বস্তিকর সামাজিক পরিবর্তনের একটা সময় ছিল সেটা।৪৭ দশম শতাব্দীতে প্রাচীন সাম্যবাদী গোত্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল এবং ক্ষত্রিয় (‘ক্ষমতাবান’) নামে পরিচিত যোদ্ধা পরিবারের অভিজাত গোষ্ঠী প্রাধান্য বিস্তার করে। অপেক্ষাকৃত নিম্ন অভিজাত বংশের ছিল যারা, বৈশ্য, গোত্রীয় লোক, হানাদারী ছেড়ে কৃষকে পরিণত হতে শুরু করেছিল। ক্ষত্রিয়রা আক্রমণের নতুন মৌসুমের শুরুতে তাদের ঘোড়ায় লাগাম জোতার মুহূর্তে বৈশ্যরা গ্রামে রয়ে যেত। অনার্য জাতি শুদ্রদের মতো এখন দরবারে ঘরে বাস করা আসুরাদের মতো হয়ে গিয়েছিল তারা এবং পরিণত হয়েছিল লুটের সহজ শিকারে।৪৮
অল্প কয়েকজন সর্দার প্রাথমিক রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। সারা জীবন রাজা থাকার জন্যে নির্বাচিত হতেন না কেউ। প্রতি বছর পবিত্রকরণের আচার রাজাসুয়ো বিপদের মোকাবিলা করতে হতো তাঁকে। কেউ না কেউ সব সময় তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে তৈরি থাকত। এবং আচারের সময় সফল আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়ে ও পাশা খেলায় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ক্ষমতা ফিরে পেতে হতো। পরাস্ত হলে জঙ্গলে নির্বাসনে যেতে হতো তাঁকে, কিন্তু সাধারণত ফিরে এসে আবার রাজাসুয়োতে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতেন। ভারতীয় রাজ্যের অস্থিতিশীলতা এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে রাষ্ট্র পরিচালনার এক আদিম সারগ্রন্থে রাজার শত্রুকে রাষ্ট্রের গঠনকারী অংশে পরিণত করেছে।
অন্তিম বৈদিক আমলে অভিবাসনের একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। দশম শতাব্দীতে আর্যদের কেউ কেউ ক্রমেই পুবে সরে যেতে শুরু করে যমুনা ও গঙ্গা নদীর মাঝামাঝি দাওবে বসতি করতে থাকে। এই অঞ্চল আর্য ভারত, অর্থাৎ ‘আর্যদের দেশ’ পরিণত হয়। দুটি ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে এখানে। কুরু-পাঞ্চলার রাজারা গাঙ্গেয় সমতলের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বসতি করেন, হস্তিনাপুরে রাজধানী স্থাপিত হয়। অন্যদিকে দক্ষিণে মাথুরা এলাকায় বসতি করে যাদব গোষ্ঠী। এখানকার পরিবেশ পাঞ্জাব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বিচিত্ৰ গাছপালার আরামপ্রদ জঙ্গল ছিল সবুজ স্বর্গের মতো, কিন্তু ছোট শহর ও শিবির গড়ে তুলতে জমি বের করতে আগ্রগামীদের গাছপালা পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছিল। ফলে আগুনের দেবতা অগ্নি উপনিবেশিকরণের নতুন পর্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিলেন। বসতি ছিল ধীর ও পর্যায়ক্রমিক। প্রতি বছর কুরু-পাঞ্চলা যোদ্ধাদের দল পাঠাত, তারা নিবিড় বনের আরও গভীরে প্রবেশ করে স্থানীয় জনগণকে অধিকার করে নিত ও আগের বছরের চেয়ে কিছুটা পুবে নতুন চৌকি স্থাপন করত।° শুদ্রদের খামারে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ফসল ছিনতাই করত তারা এবং নিজেদের মাঠে চাষ করার জন্যে মৌসুমি বৃষ্টির আগেই ফিরে আসত। ধীরে ধীরে আর্য সীমান্ত সামনে অগ্রসর হতে থাকে-অ্যাক্সিয়াল যুগের আর্যদের অভ্যন্তরীণ এলাকার পদ্ধতিগত অধিকারের পূর্বাভাস শৃঙ্খলা পরায়ণ, সধৈর্য একটি প্রক্রিয়া। পুবে এই ক্রম-বর্ধিত যাত্রাকে পবিত্র করে তোলার লক্ষ্যে নতুন নতুন আচারের বিকাশ ঘটানো হয়েছিল।
চলিষ্ণুতা তখনও পবিত্র মূল্য বহন করছিল: উৎসর্গের জমিন মাত্র একবার কাজে লাগানো হতো, আচারের শেষে তা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হতো। উৎসর্গের এলাকার পশ্চিম প্রান্তে একটি কুঁড়েঘর বসতিকারী গৃহস্থের দরবার তুলে ধরত। আচারের সময় যোদ্ধারা গম্ভীরভাবে কুঁড়ে থেকে আগুন বহন করে চৌহদ্দীর পুব প্রান্তে নিয়ে যেত, এখানে খোলা বাতাসে একটি নতুন অগ্নিকুণ্ড বানানো হতো। পরের দিন আরেকটু পুবে একটি নতুন উৎসর্গ স্থান স্থির করা হতো; এবং আচারের পুনরাবৃত্তি হতো। এই অনুষ্ঠান নতুন এলাকায় অগ্নির বিজয়ী অগ্রযাত্রাকে নতুন করে নির্মাণ করত। পরবর্তী কালের একজন আচার বিশেষজ্ঞ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন: ‘এই আগুনের আমাদের জন্যে স্থান তৈরি করা কথা, এই আগুন সামনে এগিয়ে যাবে, আমাদের শত্রুকে জয় করবে, প্রবল বেগে আমাদের শত্রুকে জয় করবে; প্রতিযোগিতায় এই আগুনের পুরস্কার লাভ করতে হবে।৫২
অগ্নি বসতিস্থাপনকারীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের উপনিবেশ ছিল নতুন সূচনা, এবং প্রথম সৃষ্টির মতো বিশৃঙ্খলা থেকে একে উদ্ধার করে আনতে হয়েছে। আগুন যোদ্ধাদের চারপাশের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রতীকায়িত করত। নিজেদের আগুনের সঙ্গে নিবিড় একাত্ম বোধ করত তারা। কোনও বৈশ্যের অগ্নিকুণ্ড থেকে আগুন চুরি করতে পারলে একজন যোদ্ধা তার গবাদিপশুকেও প্রলুব্ধ করে সরিয়ে নিতে পারবে, কারণ তারা সবসময় আগুনকে অনুসরণ করবে। ‘প্রতিপক্ষের বাড়ি থেকে দাউদাউ করে জ্বলন্ত আগুন নিতে হবে তাকে,’ বলেছে পরবর্তী কালের একটি টেক্সট; ‘এভাবে সে তার সম্পদ, তার সম্পত্তি নিয়ে যায়।৫৩ আগুন যোদ্ধার ক্ষমতা ও সাফল্যকে প্রতীকায়িত করত; এটা ছিল-বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ-তার অল্টার ইগো। নতুন আগুন তৈরি করতে পারত সে, একে নিয়ন্ত্রণ ও পোষ মানাতে পারত। আগুন ছিল তার পুত্রের মতো; মৃত্যুর পর তাকে দাহ করার পর উৎসর্গের শিকারে পরিণত হতো সে এবং তাকে দেবতাদের আবাসে নিয়ে যেতেন অগ্নি। আগুন তার সেরা ও গভীরতম সত্তাকে (আত্মা) তুলে ধরত, আর আগুনই যেহেতু অগ্নি, এই সত্তা ছিল পবিত্র ও ঐশী।
সর্বত্র উপস্থিত ছিলেন অগ্নি, কিন্তু তিনি গোপন। সূর্যে, বজ্রে, ঝড়ো বৃষ্টিতে এবং পৃথিবীর বুকে আগুন বয়ে আনা বিদ্যুৎ চমকে ছিলেন তিনি। পুকুর আর ঝর্নায় উপস্থিত ছিলেন তিনি, উপস্থিত ছিলেন নদীর তীরের কাদায়, আগুন জ্বালানো যাবে এমন গাছপালায়।” অগ্নিকে এইসব গোপন স্থান থেকে সমীহের সঙ্গে উদ্ধার করতে হতো ও মানবজাতির সেবায় ব্যবহার করতে হতো। একটি নতুন বসতি স্থাপন করার পর যোদ্ধারা অগ্নিকায়না আচার পালন করত, এই সময় অগ্নির জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি নতুন বেদী নির্মাণ করত তারা। প্রথমে অগ্নির সুপ্ত অবস্থায় থাকা কাদা সংগ্রহের জন্যে আচরিকভাবে নতুন অঞ্চলের অধিকার গ্রহণ করে নদী তীরের দিকে এগিয়ে যেত তারা। দখলদারির এই কাজে বাধা দিতে এগিয়ে আসায় তাদের হয়তো স্থানীয় বাসিন্দাদের হত্যা করতে হয়েছে।
জমিনে ফেরার পর বিজয়ী যোদ্ধারা অগ্নির অন্যতম প্রতীক পাখির আকারে তাদের বেদী নির্মাণ করত এবং নতুন আগুন জ্বালানোর পর অগ্নি আত্মপ্রকাশ করতেন।৫৬ কেবল তারপরই নতুন উপনিবেশ বাস্তবতায় পরিণত হতো: ‘অগ্নি বেদী নির্মাণ করার পরেই একজন বসতিস্থাপনকারীতে পরিণত হয়, ‘ বলেছে পরবর্তী কালের টেক্সট, ‘এবং অগ্নি বেদী নির্মাণকারীরাই বসতিস্থাপনকারী। ১৫৭
আর্য আচারের ধাঁচে আক্রমণ নির্মাণ করা হয়েছিল। সোম আচারে পবিত্র পানীয় যোদ্ধাকে দেবতাদের জগতে তুলে নিয়ে গেছে বলে মনে হতো। দেবতাদের ঐশী শক্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠার পর ‘স্বর্গ এবং এই বিশাল পৃথিবীর পুরোটাই অতিক্রম করে গেছে’ বলে মনে হতো তাদের। কিন্তু এই স্তোত্রগীত শুরু হয়েছে: ‘এটা, এমনকি এটাই আমার সংকল্প, একট গাভী জয় করা, এট ঘোড়া জয় করা: আমি কি সোমরস পান করিনি?১৫৮ সোম আচারের সময় পৃষ্ঠপোষক এবং তাঁর অতিথিদের উৎসর্গের এলাকা ত্যাগ করে উৎসর্গের জন্যে গবাদিপশু ও সোম সংগ্রহ করার জন্যে আশপাশের বসতিতে আক্রমণ চালাতে হতো। রাজাসুয়োতে নতুন রাজা সোমরস পান করার পর নুতন আক্রমণে পাঠানো হতো তাঁকে। তিনি লুটের মালসহ ফিরে এলে আয়োজক পুরোহিত তাঁর রাজঅধিকতার স্বীকার করে নিতেন: ‘হে রাজা, আপনিই ব্রাহ্মণ!৫৯
বৈদিক আমলে আর্যরা পরম বাস্তবতা ব্রাহ্মণের ধারণা গড়ে তোলে। ব্রাহ্মণ দেবা ছিলেন না, কিন্তু দেবতাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি উন্নত, গভীর এবং মৌলিক এক শক্তি যা, মহাবিশ্বের বিচ্ছিন্ন উপাদানসমূহকে একসঙ্গে ধরে রাখে এবং ছিন্নভিন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষাকারী এক শক্তি।। ব্রাহ্মণ ছিলেন সমস্ত বস্তুকে শক্তিশালী ও প্রসারিত হতে সক্ষম করে তোলা মৌলিক নীতি। এটাই জীবন ৬১ সর্বব্যাপী হওয়ায় ব্রাহ্মণকে কখনওই সংজ্ঞায়িত বা বর্ণনা করা যাবে না: মানবজাতি এর বাইরে গিয়ে এঁকে বস্তুগতভাবে দেখতে পারবে না। কিন্তু আচারের ভেতর দিয়ে তাঁকে অনুভব করা সম্ভব। রাজা আক্রমণ শেষে করে যুদ্ধের লুটের মালসহ নিরাপদে ফিরে আসার পর বাহ্মণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। এখন তাঁর রাজ্যকে একত্রিত রাখার এবং একে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত হতে সক্ষম করে তোলার চাকার মুল বিন্দু, চক্রনাভিতে পরিণত হয়েছেন তিনি। নীরবতার ভেতরও ব্রাহ্মণকে অনুভব করা হতো। অনেক সময় কোনও একটি আচার ব্রহ্মার রহস্য প্রকাশকারী মৌখিক সূত্রের প্রতিযোগিতা ব্রাহ্মদ্য দিয়ে শেষ হতো। চ্যালেঞ্জকারী কঠিন ও হেঁয়ালিময় প্রশ্ন করত আর প্রতিপক্ষ সমান হেঁয়ালীময় ভাষায় তার উত্তর দিত। একজন প্রতিযোগি উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়া পর্যন্ত চলত এই প্রতিযোগিতা: নীরবতায় পর্যবসিত হতো সে, প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হতো।৬২ ভাষার অক্ষমতার বিস্ময়কর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া উত্তরের অগম্য প্রশ্নের রহস্যময় বিরোধে ব্রাহ্মণের দুর্জ্ঞেয়তা অনুভূত হতো। অল্প কিছু পবিত্রক্ষণের জন্যে গোটা জীবনকে ধরে রাখা রহস্যময় শক্তির সঙ্গে একাত্ম বোধ করত প্রতিযোগিরা, এবং বিজয়ী বলতে পারত যে সেই ব্রাহ্মণ।
দশম শতাব্দী নাগাদ কোনও কোনও ঋষি এক নতুন ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান সৃষ্টি করতে শুরু করেছিলেন। প্রথাগত দেবাদের আনাড়ী ও অসন্তোষজনক মনে হচ্ছিল; তাদের ছাড়িয়ে কোনও কিছুর দিকে লক্ষ করার প্রয়োজন ছিল। রিগ বেদের শেষদিকের কোনও কোনও স্তোত্রগীত উপাসনার অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন দেবতার খোঁজ করেছে। ‘আমাদের অঞ্জলি দিয়ে আমরা কোনও দেবতাকে শ্রদ্ধা জানাব?’ ঋগ বেদের দশম পুস্তকের স্তোত্রগীত ১২১-এ প্রশ্ন করেছেন ঋষিদের একজন। মানুষ আর পশুর প্রকৃত প্রভু কে? তুষার ঢাকা পাহাড় আর মহাশক্তিশালী সাগরের অধিকারী কে? কোন দেবতা আকাশকে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখেন? এই শ্লোকে কবি এমন এক উত্তরের খোঁজ পেয়েছেন যা ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম আদি মিথে পরিণত হবে। আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে ব্রাহ্মণের ব্যক্তিরূপ ভাষ্য এক স্রষ্টা ঈশ্বরের আবির্ভাবের দর্শন লাভ করেছিলেন তিনি। তাঁর নাম ছিল প্রজাপতি: ‘সর্বস্ব’। প্রজাপতি মহাবিশ্বের অনুরূপ ছিলেন; তিনিই ছিলেন একে টিকিয়ে রাখা প্রাণশক্তি, চেতনার বীজ এবং অচেতন বস্তুর জল থেকে আবির্ভূত আলো। কিন্তু প্রজাপতি আবার মহাবিশ্বের বাইরের আত্মাও ছিলেন, যিনি প্রকৃতির বিধিবিধানকে শৃঙ্খলা দিতে পারেন। সর্বব্যাপী ও দুর্জ্ঞেয়, তিনি একাই ছিলেন ঈশ্বর, তাঁর পাশে আর কেউ ছিল না।’
কিন্তু অন্য এক ঋষির কাছে একে অনেক বেশি নির্দিষ্ট মনে হয়েছিল। ৬৩ সূচনায়, তিনি বলেছেন, কিছুই ছিল না। অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব ছিল না, ছিল না মৃত্যু বা অমরত্ব, বরং ছিল কেবল ‘বাছবিচারহীন বিশৃঙ্খলা।’ কেমন করে এই বিশৃঙ্খলা শৃঙ্খলিত ও টেকসই হতে পারে? কবি বর্ণনা করেছেন যে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর থাকতে পারে না:
নিশ্চিতভাবে কে জানে, আর কেই বা এখানে ঘোষণা করতে পারে
কখন এর জন্ম হয়েছে, কখন এই সৃষ্টি হয়েছে?
এই বিশ্বের সৃষ্টির অনেক পরের সৃষ্টি দেবতাগণ। তাহলে কে বলতে
পারবে কখন এটা অস্তিত্ব পেয়েছে?
তিনি, সৃষ্টির প্রথম মূল, সবই তিনি আকৃতি দিয়েছেন নাকি দেননি,
মহাস্বর্গের চোখ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিশ্চিতভাবেই
জানেন তিনি-কিংবা হয়তো জানেন না
কবিতাটি একটি ব্রাহ্মদ্য। তিনি ও শ্রোতা উভয়ই অজানার নীরবতায় পর্যবসিত না হওয়া পর্যন্ত একের পর তলহীন প্রশ্ন করে গেছেন ঋষি।
অবশেষে বিখ্যাত পুরুষা স্রোত্যে একজন ঋষি আর্যদের প্রাচীন সৃষ্টি কাহিনী নিয়ে ধ্যান করে ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। প্রথম মানবের আত্মত্যাগই মানবজাতিকে অস্তিত্ব দিয়েছিল বলে স্মরণ করেছেন তিনি। এবার আদিম সেই ব্যক্তিটির (পুরুষা) বর্ণনা দিয়েছেন, স্বেচ্ছায় উৎসর্গের আঙিনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি, সদ্য-কাটা ঘাসের উপর শুয়ে পড়ছেন এবং দেবতাদের তাকে হত্যা করতে দিচ্ছেন। আত্ম-উৎসর্গের এই ব্যাপারটি সৃষ্টি জগৎকে সক্রিয় করে তোলে। স্বয়ং পুরুষা মহাবিশ্ব ছিলেন। সমস্ত কিছু তাঁর শবদেহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে: পাখি, পশু, ঘোড়া, গবাদিপশু, মানবজাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়, স্বর্গ এবং পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ। এমনকি মহান দেবা অগ্নি এবং ইন্দ্রও তাঁর দেহ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু প্রজাপতির মতো তিনিও ছিলেন দুয়ে: তাঁর সত্তার ৭৫ ভাগ ছিল অমর, সময় আর জরায় আক্রান্ত হওয়ার নয়। যোদ্ধাদের সংশয়বাদী আচারের বিপরীতে এই উৎসর্গে কোনও লড়াই ছিল না। কোনওরকম সংগ্রাম ছাড়াই নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলেন পুরুষা।
পুরুষা এবং প্রজাপতি ছিলেন উন্নত পুরাণ বিহীন ছায়াটে, দূরবর্তী অবয়ব। তাঁদের সম্পর্কে বলার মতো তেমন কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষেই, বলা হয়ে থাকে যে, প্রজাপতির আসল নাম ছিল একটা প্রশ্নঃ ‘কে?’ (কা?)। অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচানলগ্নে ভারতের স্বাপ্নিকরা ধারণা ও কথা অতিক্রম করে দুয়ের নীরব উপলব্ধির দিকে সরে যেতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পুরুষা স্তোত্রগীত যেমন দেখায় যে, তখনও প্রাচীন আচারে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন তাঁরা। আচার- অনুষ্ঠানগুলো বিপজ্জনক ও সহিংস হলেও ভারতে মহাপরিবর্তনের অনুপ্রেরণা হয়েছিল সেগুলো। দশম শতাব্দীর শেষদিকে ঋষিরা প্রথম মহান অ্যাক্সিয়াল যুগ আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি কারী প্রতীকের জটিল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
.
ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইয়েলো রিভার উপত্যকা শাসন করে আসা চীনের শ্যাং রাজবংশ নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান বলে বিশ্বাস করত। বলা হয়ে থাকে যে, সাধারণভাবে মানবজাতির সঙ্গে যোগযোগহীন এক পরম শক্তিশালী উপাস্য দি চীনের বিস্তৃর্ণ সমভূমিতে একটি কৃষ্ণ পাখি পাঠিয়েছিলেন। সেই পাখি একটা ডিম পাড়ে, এক নারী সেই ডিম খেয়ে নেয়। সময়ের পরিক্রমায় শ্যাং রাজবংশের প্রথম আদিপুরুষের জন্ম দেয় সেই নারী। দি-এর সঙ্গে এই অনন্য সম্পর্কের কারণে রাজাই ছিলেন পরম ঈশ্বরের সঙ্গে যার সরাসরি দেখা করার অনুমতি পাওয়া পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি। একমাত্র তিনিই দি-এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ সম্পাদন করে প্রজাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতেন। গণকদের সহায়তায় কোনও সামরিক অভিযান শুরু করার উপযুক্ততা বা একটি নতুন বসতি স্থাপনের সম্ভাব্যতা নিয়ে দি-এর সঙ্গে পরামর্শ করতেন তিনি। ফসল তোলার কাজটি সফল হবে কিনা জিজ্ঞেস করতে পারতেন দি-কে। ভবিষ্যদ্বক্তা ও স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে মধ্যস্ততা করার ক্ষমতা থেকে রাজা বৈধতা অর্জন করতেন, কিন্তু অধিকতর জাগতিক স্তরে আবার তাঁর উন্নত মানের ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্রের উপরও নির্ভর করতেন তিনি। উৎসর্গে শ্যাংদের ব্যবহার করা ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ রথ আর চকমকে জাহাজ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী গোষ্ঠীগুলোর প্রধনাদের হাতেরই সম্ভবত প্রথম শ্যাং নগরীগুলোর পত্তন ঘটে থাকবে। নতুন প্রযুক্তির ক্ষমতার মানে ছিল যে রাজারা বাধ্যতামূলক শ্রম বা যুদ্ধ বিগ্রহের জন্যে হাজার হাজার কৃষককে সমবেত করতে পারতেন।
শ্যাংদের জানা ছিল যে, তাঁরাই চীনের প্রথম রাজা ছিলেন না। জিয়া রাজবংশের শেষ অধিপতির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার দাবি ছিল তাঁদের (সি. ২২০০-১৬০০)। জিয়াদের পক্ষে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক বা দালিলিক সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলেও তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষ নাগাদ সমতলে কোনও ধরনের রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।৬৭ চীনে ধীরে ও বেদনাদায়কভাবে সভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছিল। চারপাশের পাহাড়পর্বত ও জলাভূমি সদৃশ বসতি স্থাপনের অতীত ভূমিতে মহাপ্রান্তর ঘেরাও ছিল। জলবায়ু ছিল কর্কশ, গা-পোড়ানো গ্রীষ্ম আর বরফ শীতল শীত কাল, এই সময় বসতিগুলোতে বালুময় হাওয়ায় আক্রান্ত হতো। ইয়েলো রিভারে নৌ চলাচল কঠিন ছিল, ক্রমাগত বন্যা হতো। আদি বসতি স্থাপনকারীদের জলাভূমি থেকে জল অপসারণ করতে খাল খনন এবং ফসল ভাসিয়ে নেওয়া ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ করতে হয়েছিল। এইসব প্রাচীন নির্মাণ কর্মের স্রষ্টাদের সম্পর্কে চীনাদের কোনও ঐতিহাসিক স্মৃতি ছিল না, কিন্তু তারা জিয়া বংশের আগে চীনা সাম্রাজ্য শাসনকারী সামন্ত রাজাদের কাহিনী বলে থাকে যারা পল্লী এলাকা বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। হলুদ সম্রাট হুয়াং-দি দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করে সূর্য, চাঁদ ও তারামণ্ডলীর কক্ষপথ স্থির করেছিলেন। শেন নঙ কৃষির উদ্ভাবন করেছেন এবং ত্রয়োবিংশ শতাব্দীতে প্রাজ্ঞ সম্রাটদ্বয় ইয়ায়ো এবং শান শান্তি ও প্রগতির এক স্বর্ণ যুগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শানের আমলে গোটা দেশ ভয়নাক প্লাবনে ভেসে গেলে প্রধান পূর্ত কর্মকর্তা ইউকে এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন শান। তের বছর ধরে খাল খনন করেন ইউ, জলাভূমি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং নদীগুলোক সাগরমুখী করেন, যাতে এগুলো যেন জমিদারদের মহাসম্বর্ধনায় যাওয়ার মতো নিয়মমতো প্রবাহিত হয়। ইউ’র প্রবল প্রয়াসের সুবাদে লোকে ধান ও জাওয়ার উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিল। সম্রাট শান এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ইউকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনেীত করেন এবং এভাবে জিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকারীতে পরিণত হন ইউ। এইসব কিংবদন্তীর সাধু রাজন্যরা চীনা অ্যাক্সিয়াল যুগের দার্শনিকদের পক্ষে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
এইসব কাহিনীর কোনও কোনওটার সঙ্গে শ্যাং অভিজাতরা নিশ্চিতভাবেই পরিচিত ছিলেন। তাঁরা জানতেন, সভ্যতা একটি নাজুক ও কষ্টার্জিত সাফল্য, এবং বিশ্বাস করতেন যে, বেঁচে থাকার নিয়তি অনিস্তার্যভাবে তাঁদের আগে বিদায় নেওয়া সমস্ত আত্মার সঙ্গে গ্রন্থিত। শ্যাং-রা ইয়ায়ো, শান বা ইউ’র মতো ক্ষমতাশালী না হতে পারেন, কিন্তু বিশাল প্রান্তরের বিপুল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন ৬৯ দক্ষিণ পশ্চিমে হুয়াই উপত্যকা এবং পুরে শানতাং পর্যন্ত প্রসারিত ছিল তাঁদের রাজত্ব। দূরবর্তী পশ্চিমের ওয়েই উপত্যকতায়ও তাদের প্রভাব টের পাওয়া যেত। কোনও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র শাসন করেননি তাঁরা, তবে রাজ দরবারের একজন প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত ছোট ছোট প্রাসাদ নগরীর নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শহরগুলো ছিল ছোট, বন্যা বা আক্রমণের বিরুদ্ধে যাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় সেজন্যে রাজা ও তাঁর প্রজার জন্যে জমাট মাটির তৈরি একটিমাত্র উঁচু দেওয়াল-ঘেরা আবাসিক কমপ্লেক্স থাকত। শাং-দের শেষ রাজধানী ইন-এ দেয়ালগুলোর পরিসীমা ছিল আটশো গজ। একটা সাধারণ নকশা অনুসরণ করত শাং শহরগুলো: আকারে সাধারণত আয়তকার হতো সেগুলো, প্রতিটি দেয়াল কম্পাসের একেকটি কাঁটার দিক নির্দেশ করত। প্রতিটি বাসস্থান হতো দক্ষিণমুখী। রাজকীয় প্রাসাদের তিনটি উঠোন এবং আচার পরিচালনা ও রাজনৈতিক আলোচনার জন্যে একটি দরবার মহল থাকত; প্রাসাদের পুবে ছিল পূর্ব পুরুষের মন্দির। বাজার থাকত রাজার বাড়ির উত্তরে, এবং কারুশিল্পী, রথনির্মাতা, তীর-ধনুক প্রস্তুতকারী, কামার এবং কুমাররা রাজকীয় লিপিকার, গণক এবং আচরিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শহরের দক্ষিণ এলাকায় বাস করত।
এটা সাম্যভিত্তিক সমাজ ছিল না। শ্যাং-রা চৈনিক সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া ক্ষমতা স্তরক্রম ও পদবীর প্রতি প্রবল দুর্বলতা দেখিয়েছেন। দি-এর পুত্র হিসাবে রাজা নিজের শ্রেণীর সামন্ত পিরামিডের সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকতেন। এই সারিতে পরে ছিল রাজ দরবারের যুবরাজরা, বিভিন্ন শ্যাং নগরীর শাসক; তাঁদের নিচে স্থান পেতেন দরবারে বিভিন্ন পদের অধিকারী মহান পরিবারের কর্তা ও নগর প্রাচীরের বাইরের গ্রাম্য এলাকার আয়ে জীবীকা নির্বাহ করা ব্যারনরা। সবশেষে সামন্ত পিরামিডের একেবারে ভিত্তিতে ছিল সাধারণ ভদ্রলোক, যোদ্ধা শ্রেণী।
নগর ছিল ক্ষুদ্র অভিজাত ছিটমহল, খোদ ভিন্ন এক জগৎ। শ্যাং অভিজাত গোষ্ঠী ধর্ম, যুদ্ধবিদ্যা এবং শিকারে তাদের সমস্ত সময় ব্যয় করতেন। সামরিক প্রতিরক্ষার বিনিময়ে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপন্ন আদায় করতেন তাঁরা। তবে এলাকার খুব সামান্য অংশই এই সময় কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল। ইয়েলো রিভার উপত্যকার বেশির ভাগ এলাকা তখনও নিবিড় বন আর জলাভূমিতে ভরে ছিল। শ্যাং আমলে হাতি, গণ্ডার, মোষ, প্যান্থার আর লেপার্ড হরিণ, বাঘ, বুনো ষাঁড়, ভালুক, বাঁদর এবং অন্যান্য শিকারের সঙ্গে বনে ঘুরে বেড়াত। এইসব জন্তুজানোয়ার আপদে পরিণত হতে পারত বলে শিকার একাধারে দায়িত্ব ও বিনোদন ছিল। রাজার বিজয়ী বেশে শহরে ফিরে আসার সময় শিকারগুলোকে উৎসর্গ করা হতো ও বিশাল, শোরগোলময় উন্মত্ত ভোজসভায় খাওয়া হতো।
যুদ্ধ ও শিকারের ভেতর তেমন একটা পার্থক্য ছিল না। যুদ্ধবিগ্রহ ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের ভেতর সীমাবদ্ধ কর্মকাণ্ড কেবল তাদেরই অস্ত্র ও রথের মালিকানার অনুমতি দেওয়া হতো। কোনও নৈমিত্তিক সামরিক অভিযান ছিল শ’খানেক রথসহ একটা মাঝারি মাপের ঘটনা; পায়ে হেঁটে এগোনো কৃষকরা যুদ্ধে অংশ নিত না, তবে পরিচারক, ভৃত্য ও বাহকের ভূমিকা পালন করত তারা আর ঘোড়ার দেখভাল করত। শ্যাং-দের আঞ্চলিক কোনও উচ্চাভিলাষ ছিল না; স্রেফ মূল্যবান পণ্য-ফসল, গবাদিপশু, দাস ও কারুশিল্পী-ছিনিয়ে নিয়ে বিদ্রোহী নগরীগুলোকে শাস্তি দিতেই যুদ্ধ করতেন তাঁরা। অনেক সময় তখনও চৈনিক সংস্কৃতিতে নিজেদের না মেশানো শ্যাং বসতির ভেতরে-বাইরে ঘিরে থাকা জাতি ‘বর্বরদের’ বিরুদ্ধে অভিযান সূচিত হতো। জাতিগতভাবে শ্যাং-দের থেকে ভিন্ন ছিল না তারা, পরে শেষপর্যন্ত সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়ার পর চৈনিক সভ্যতায় নিজস্ব অবদান রাখবে। নিজস্ব এলাকায় বর্বরদের সঙ্গে শ্যাংদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, তাদের সঙ্গে স্ত্রী ও পণ্য বিনিময় করত। রাজ্য লাগোয়া অঞ্চলে বাসকারী বর্বররা সাধারণত শ্যাংদের মিত্র ছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বসবাসকারী বর্বরদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না।
শ্যাং অভিজাত গোষ্ঠীর শহুরে জীবনের সঙ্গে জমি চাষে নিয়োজিত কৃষক সম্প্রদায়ের কোনও মিলই ছিল না। অভিজাত গোষ্ঠী তাদের মানুষই মনে করত না, কিন্তু বর্বরদের মতো কৃষকদেরও চৈনিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে। কৃষক সম্প্রদায় মাটির সঙ্গে একাত্ম বোধ করত, প্রকৃতির আবর্তনমূলক আনন্দকে ঘিরে সংগঠিত হতো তাদের সমাজ। শীত ও গ্রীষ্মের পার্থক্য দিয়ে কৃষক জীবন প্রভাবিত হতো। বসন্তে শুরু হতো কাজের মৌসুম। পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যেত, মাঠে কুঁড়ে ঘরে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করত; কাজের মৌসুমে কেবল স্ত্রীরা যখন তাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসত সেই সময়টুকু ছাড়া স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকত না। ফসল তোলার পর জমিনকে বিশ্রাম দেওয়া হতো, পুরুষরা আবার ঘরে ফিরে আসত। বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে গোটা শীতকাল ঘরে অবস্থান করত তারা। এটা ছিল তাদের শীতনিদ্রার কাল, বিশ্রাম ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের সময়; কিন্তু গ্রীষ্মে যাদের তেমন কিছু করার ছিল না, সেই নারীরা এবার তাদের শ্রমের মৌসুম শুরু করত: কাপড় বোনা, চরকা কাটা আর মদ বানানো। এই পরিবর্তন হয়তো চীনা ধারণা ইনও ইয়াং-এ অবদান রেখে থাকতে পারে। ইন ছিল বাস্তবতার নারী বৈশিষ্ট্য। কৃষক নারীর মতো এর ঋতু ছিল শীতকাল; অভ্যন্তরীণ, অন্ধকার, রুদ্ধ জায়গায় সারা হতো এর কর্মকাণ্ড। পুরুষ বৈশিষ্ট্য ইয়াং গ্রীষ্ম ও দিনের আলোয় সক্রিয় ছিল; এটা ছিল বাহ্যিক, বহির্মুখী শক্তি এবং এর ফল ছিল সীমাহীন।৭০
কৃষিতে শ্যাং অভিজাত গোষ্ঠীর কোনও আগ্রহ ছিল না, তবে স্পষ্টতই আধ্যাত্মিক অর্থে ল্যান্ডস্কেপকে সমৃদ্ধ হিসাবে অনুভব করেছিলেন তারা। ঠিক চারটি প্রধান দিকের প্রভুর মতো পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, এবং বাতাস ছিল গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। এইসব প্রকৃতি-দেবতা আকাশ দেবতা দি-এর স্বর্গীয় প্রতিরূপ পৃথিবীর অধিকারে ছিলেন। ফসল-এর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন বলে উৎসর্গের মাধ্যমে তাঁদের তোয়াজ ও তোষামোদ করা হতো। অবশ্য রাজপ্রসাদের পূর্বপুরুষরা আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, যাদের কাল্ট শ্যাং রাজবংশের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ইনে (আধুনিক আনিয়াং) প্রত্নতাত্ত্বিক খননে নয়জন রাজার সমাধি উন্মোচিত হয়েছে; চারপাশে তাঁদের শেষকৃত্যে আত্মউৎসর্গ করা সৈনিকদের দেহাবশেষ নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় বেদীর উপর কফিনে শুয়ে আছেন তাঁরা। মৃত্যুর পর রাজা স্বর্গীয় মর্যাদা লাভ করতেন; দি- এর সঙ্গে স্বর্গে বাস করতেন তিনি এবং পৃথিবীতে তাঁর জীবিত আত্মীয়দের সাহায্য করার আবেদন জানাতে পারতেন।
বংশের নিয়তি মৃত রাজাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল বলে বিশ্বাস করতেন শ্যাং-রা। দি-এর নিজস্ব বিশেষ কোনও প্রথা এবং প্রকৃতি-দেবতাদের নিয়মিত আচার না থাকলেও জাঁকজমকের সঙ্গে পূর্বপুরুষদের পূজা করা হতো; আচরিক পঞ্জিকায় প্রত্যেকেরই উৎসব তারিখ নির্ধারিত ছিল। রাজারা পূর্বপুরুষদের ‘আপ্যায়ন’(বিন) করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। রাজ পরিবারের সদস্যরা মৃত আত্মীয়দের মতো পোশাক পরতেন, নিজেদের তাঁদের অনুকৃত পূর্বপুরুষদের অধিকারে চলে গেছেন বলে মনে করতেন এবং তাঁরা দরবারে প্রবেশ করলে রাজা তাঁদের সামনে প্রণত হতেন। প্রকৃতি-দেবতাদের রাজ প্রাসাদের উঠোনে ভোজে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হতো। যেখানে অসংখ্য পশু বলী দিয়ে রান্না করা হতো। তারপর দেবতা, পূর্বপুরুষ এবং মানুষ একসঙ্গে ভোজে অংশ নিতেন।
কিন্তু এই ব্যাপক আচারের পেছনে এক গভীর উদ্বেগ উঁকি দিয়ে চলত।৭২ শহর ও নগরের অভিভাবক ছিলেন দি। বৃষ্টি ও বাতাসের পরিচালক ছিলেন তিনি, শ্যাং রাজারা যেভাবে সভাসদ আর সৈনিকদের নির্দেশ দিতেন সেভাবেই প্রকৃতি-দেবতাদের নির্দেশ দিতেন। কিন্তু দি ছিলেন অবোধ্য। প্রায়ই খরা, বন্যা এবং বিপর্যয় প্রেরণ করতেন তিনি। এমনকি পূর্বপুরুষরাও অবিশ্বস্ত ছিলেন। মৃতদের আত্মা বিপজ্জনক হতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন শ্যাং-রা, তাই আত্মীয়রা মৃতদের পুরু কাঠের কফিনে করে কবর দিত, জেড দিয়ে তাদের মৃতদেহের সৎকার করত এবং আত্মা যাতে পালিয়ে গিয়ে জীবিতদের উপর চড়াও হতে না পারে সেজন্যে তাদের বিভিন্ন গহ্বর ভরে দিত। সম্ভাব্য ঝামেলাবাজ প্রেতাত্মাকে সহায়ক উদার সত্তায় পরিণত করার জন্যে আচার- অনুষ্ঠান তৈরি করা হয়েছিল। মৃতকে একটি নতুন নাম দেওয়া হতো এবং তিনি এখন সম্প্রদায়ের প্রতি দয়াময় আচরণ করবেন, এই আশায় তাঁর পূজার জন্যে একটি নতুন দিন স্থির করা হতো। সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন পূর্বপুরুষ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতেন বলে সদ্য মৃতকে অপেক্ষাকৃত মহান পূর্বপুরুষদের তাদের পক্ষে আবেদন জানাতে রাজি করাতে আচার-অনুষ্ঠানও নকশা করা হতো, যারা হয়তো পালা এল দি-এর সঙ্গে মধ্যস্ততা করতে পারবেন।
দি, প্রকৃতি দেবতা ও পূর্বপুরুষদের কাছে হাড় ও কচ্ছপের হাড়ে রাজকীয় গণকদের খোদাই করা লিপি থেকেই এসেছে শ্যাংদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য। প্রত্নতাত্ত্বিকরা খনন করে এমনি খোদাই করা ১৫০,০০০ ভবিষ্যদ্বাণীর হাড় বের করেছেন। এগুলো দেখায় যে, রাজারা শিকার, ফসল তোলা কিংবা এমনকি দাঁত ব্যথা সম্পর্কে পরামর্শ চেয়ে তাঁদের সমস্ত কর্মকাণ্ড এইসব শক্তির পরীক্ষার জন্যে নিবেদন করেছিলেন। প্রক্রিয়াটি ছিল সরল। রাজা কিংবা তাঁর গণক একটা উত্তপ্ত দণ্ড ব্যবহার করে বিশেষভাবে প্রস্তুত কচ্ছপের খোলস বা গরু-মোষের হাড়কে বিশেষ দায়িত্ব দিতেন। ‘আমরা মিলেট ফসল ঘরে তুলতে যাচ্ছি,’ বলতে পারতেন তিনি, কিংবা, “পিতা জিয়ার [সপ্তম শ্যাং রাজা] উদ্দেশ্যে, আমরা ভালো ফসলের জন্যে প্রার্থনা করছি।” এরপর খোলসে সৃষ্টি হওয়া ফাটলগুলো পরখ করে ভবিষ্যদ্বাণী মহৎ কিনা সেই ঘোষণা দিতেন তিনি। পরে রাজকীয় খোদাইকারীরা নির্দেশ খোদাই করত। অনেক সময় দেবতা বা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীও উল্লেখ করত তারা এবং খুবই বিরল ক্ষেত্রে-ফলাফল অন্তর্ভুক্ত করত। অবশ্যই এটা যৌক্তিক প্রক্রিয়া ছিল না, কিন্তু গণকরা স্পষ্টই নির্ভুল তথ্য রক্ষার চেষ্টা করছিল। উদাহরণ স্বরূপ, তাদের কেউ কেউ উল্লেখ রাজা তাঁর স্ত্রীর সন্তান ধারণ ‘ভালো’ হবে (অর্থাৎ তিনি ছেলে জন্ম দেবেন) বলে ভবিষ্যদ্বাণী করার কথা করেছে, যদিও তিনি মেয়ে জন্ম দিয়েছিলেন এবং রাজার দিনটা মাটি হয়েছিল।৭৫
অনেক সময় আধ্যাত্মিকতাকে নিয়ন্ত্রণে শ্যাং রাজাদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। পূর্বপুরুষরা ঘনঘন বাজে ফসল ও দুর্ভাগ্য পাঠাতেন। দি অনেক সময় সম্ভাবনাময় বৃষ্টি প্রেরণ করতেন, কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী আরও উল্লেখ করেছে যে, ‘খোদ দি আমাদের ফসলের ক্ষতি করছেন।৭৬ দি ছিলেন অনির্ভরযোগ্য সামরিক মিত্র। তিনি শ্যাং-দের প্রতি ‘সহায়তা যোগাতে’ কিংবা শত্রুপক্ষকে অনুপ্রাণিত করতে পারতেন। ‘ফ্যাং-রা আমাদের আক্রমণ ও ক্ষতি করছে,’ বিলাপ করেছে আরেকটি ভবিদ্বাণী। ‘স্বয়ং দি আমাদের উপর বিপর্যয় নামাতে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।’৭৭ অকার্যকর ও অনির্ভরযোগ্য দি আকাশ দেবতার স্বাভাবিক পরিণতির শিকার হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করেন। শ্যাং-রা কখনওই তাঁর সাহায্য চাইতে রুটিন শাস্ত্র নির্মাণ করেননি, এবং দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ প্রত্যক্ষভাবে তাঁকে আহবান জানানো পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে কেবল পূর্বপুরুষ ও প্রকৃতি-দেবতাদের কাছে আবেদন রাখছিলেন।
শ্যাং সমাজ সূক্ষ্মতা, আভিজাত্য এবং বর্বরতার অদ্ভুত মিশেল ছিল। শ্যাং- রা তাদের পরিবেশের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতেন। তাঁদের শিল্পকলা ছিল আধুনিক ও উদ্ভাবনী, তাঁদের ব্রোঞ্জ আচরিক পাত্রগুলো বুনো পশু এবং তাদের গবাদিপশু, ষাঁড় এবং ঘোড়ার নিবিড় পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। ভেড়া, গণ্ডার বা প্যাঁচার আকৃতিতে অসাধারণ সুন্দর মূর্তি নির্মাণ করেছেন তাঁরা। কিন্তু এত কোমলভাবে পর্যবেক্ষণ করা পশু হত্যার বেলায় কোনও সংকোচ ছিল না তাঁদের, অনেক সময় এক উৎসর্গ অনুষ্ঠানেই শ’খানেক পশু হত্যা করতেন। রাজকীয় শিকারের সময় বেপরোয়া সংখ্যায় বুনো পশু হত্যা করতেন শ্যাং, এবং বিন ভোজসভা বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গৃহপালিত পশুর হেকাটুম ভোগ করতেন। রাজা এবং অভিজাতরা বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন, গবাদিপশু, ধাতু, ফসল এবং শিকারের মাধ্যমে এর পরিমাপ করতেন তাঁরা। জন্তু-জানোয়ারে ভরা ছিল তাঁদের পরিবেশ, কৃষকরা শস্য ও ধানের অন্তহীন প্রবাহের যোগান দিত বলে তাঁদের সম্পদ অন্তহীন মনে হতো। ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয়ের কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না।
পরে অন্যতম অ্যাক্সিয়াল পয়গম্বর মোজি শ্যাং-রাজাদের জাঁকাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা স্মরণ করেছেন, ‘স্বর্গের পুত্রগণ’ স্পষ্টতই অপব্যয়, অশ্লীল জাঁকজমক আর অসহায় ভৃত্য ও প্রজাদের আচরিক হত্যাকাণ্ডে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন:
একজন রাজকুমারের মৃত্যুতে ঘোড়া ও সম্পদের ভাণ্ডার শেষ করা ফেলা হতো। স্বর্ণ, জেডে এবং মুক্তো বসানো হতো মৃতদেহের উপর। থানে থানে সিল্কের কাপড় আর ঘোড়া জোতা রথ কবরস্থ করা হতো তাঁর সঙ্গে। কিন্তু প্রচুর পর্দা আর তেপায়া ফুলদানী, ঢোল, টেবিল, পাত্র, বরফাধার, মোমের কুড়োল, তলোয়ার, পালক বসানো পতাকা, হাতির দাঁত আর পশমি চামড়াও প্রয়োজন হতো শবাধারের জন্যে। সমস্ত ধনসম্পত্তি মৃতের সঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতো না কেউ। তাঁকে অনুসরণ করার জন্যে যেসব লোককে উৎসর্গ করা হতো, সে স্বর্গের সন্তান হলে, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে গোণা হতো তাদের। কিন্তু বড় কর্মকর্তা বা জমিদার হলে তখন তাদের দশ বা একক হিসাবে গোণা হতো।৮০
শ্যাং ধর্মে নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতা ছিল। শেষপর্যন্ত চীনাদের মনে হয়েছিল যে, এমনকি দি-ও, যাঁর নৈতিক দায়িত্ববোধ বলে কিছু নেই, শাসক রাজবংশের উপর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
১০৪৫ সালে ওয়েই উপত্যকার ক্ষুদে রাজ্যের শাসক জাতি ঝোউ-এর রাজা ওয়েন রাজা রাজধানী থেকে দূরে থাকার সময় শ্যাং রাজ্যে হামলা চালান। দুঃখজনকভাবে রাজা ওয়েন যুদ্ধে নিহত হন, কিন্তু তাঁর ছেলে রাজা উ শ্যাং অঞ্চলের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং ইয়েলো রিভারের উত্তরে মু-ইয়ে’র যুদ্ধে শ্যাং সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। শ্যাং রাজার মাথা কাটা যায় এবং ঝোউ ইন দখল করে নেয়। লুটের মাল বণ্টন করেন রাজা উ। তিনি ওয়েই উপত্যকার পুরোনো ঝোউ রাজধানীতেই অবস্থান করবেন বলে স্থির করেন, তাই ছেলে চেঙ-কে ইনের দায়িত্ব দেন, এবং শেষ ম্যাং সম্রাট উ-কেঙ-এর হাতে অন্যান্য শ্যাং শহরের প্রশাসনের দায়িত্ব তুলে দেন। তারপর ওয়েই উপত্যকায় ফিরে যান রাজা উ। এর অল্পে পরেই সেখানেই মারা যান তিনি।
তাঁর মৃত্যুর পর শ্যাং রাজকুমার ঝোউ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ লুফে নেন। কিন্তু রাজা ওয়েনের ভাই সাধারণভাবে ঝোউ-এর ডিউক হিসাবে পরিচিত দান বিদ্রোহ দমন করেন এবং শ্যাং-রা কেন্দ্রীয় সমতলের নিয়ন্ত্রণ হারান। রাজকুমার চেঙ হন নতুন রাজা, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ঝোউ-এর ডিউক রিজেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং একটি আধা- সামন্তবাদী ব্যবস্থার পত্তন করেন। ঝোউ-এর রাজকুমার ও মিত্রদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত জমিদারি হিসাবে একটি করে নগর দেওয়া হয়, এবং ঝোউ তাঁদের রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যে একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করে। নতুন রাজার সম্মানে এর নাম রাখা হয়েছিল চেঙঝোউ।
নানাভাবে ঝোউ সরাসরি শ্যাংদের অবস্থান অধিকার করে নেয়। শ্যাংদের মতো শিকার, তীরছোঁড়া, রথ চালানো, এবং জাঁকাল ভোজসভা পছন্দ করত তারা। প্রাচীন শ্যাং কায়দাতেই নিজেদের শহরগুলো গড়ে তুলেছিল, প্রকৃতি- দেবতা পূর্বপুরুষদের উপাসনা করত এবং ভবিষ্যদ্বাণী করত। দি-র উপাসনাও অব্যাহত রাখে তারা, কিন্তু একদিক থেকে সেটা প্রাচীন ধর্মের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল-দি-কে তারা তিয়ান (‘স্বর্গ’) বলে আখ্যায়িত করা তাদের নিজস্ব আকাশ-দেবতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিল। তবে এখানে একটা সমস্যায় পড়েছিল তারা। শ্যাং-রা শত শত বছর দৃশ্যতঃ দি-র আশীর্বাদেরই শাসন করে গিয়েছিলেন। তখনও মহান প্রান্তরে বাস করে চলা শ্যাং অভিজাত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জয় লাভ করতে হলে ধারাবাহিকতা জরুরি ছিল। ঝোউরা পূর্বপুরুষের পাশাপাশি মৃত শ্যাং রাজাদেরও পূজা করতে চেয়েছিল। কিন্তু যেখানে তারা তাঁদের বংশ ধ্বংস করেছে সেখানে কেমন করে শ্যাং আত্মার উপাসনা করতে পারে?
ডিউক অভ ঝোউ একটা সমাধান বের করেন। দি অনেক সময় শ্যাংদের সাজা দিতে শত্রু গোত্রগুলোকে ব্যবহার করেছেন। এখন, মনে হচ্ছে, তিনি ঝোউদের তাঁর অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। নতুন পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী পবিত্রকরণ উপলক্ষ্যে ডিউক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। অন্যতম মহান চীনা টেক্সট শুজিং-এ তা লিপিবদ্ধ আছে।
৮১ শ্যাং রাজারা, বলেছেন তিনি, স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়েছিলেন। স্বর্গ সাধারণ লোকের দুর্ভোগে করুণায় ভরে উঠেছিলেন। তাই শ্যাংদের দেওয়া অধিকার তুলে নিয়েছেন তিনি এবং নতুন শাসকের খোঁজ করেছেন। অবশেষে ঝোউ রাজাদের উপর এসে পড়েছে তাঁর দৃষ্টি, যাঁরা অবশেষে, সর্বোচ্চ স্বৰ্গীয় সত্তা তিয়ান শ্যাং দির নতুন পুত্রে পরিণত হয়েছেন।
এভাবে দারুণ অনভিজ্ঞ হলেও স্বর্গের নতুন সন্তানে পরিণত হয়েছিলেন রাজা চেঙ, ব্যাখ্যা করেছেন ডিউক। তরুণের পক্ষে গুরুদায়িত্ব ছিল এটা। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তাঁকে অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে সতর্ক’ থাকতে হবে। অবশ্যই ‘তাঁকে ক্ষুদ্র জাতির সঙ্গে সমন্বয়’ বজায় রাখতে হবে…জনগণের বক্তব্য সম্পর্কে প্রাজ্ঞভাবে শঙ্কিত থাকতে হবে। ঈশ্বর প্রজাদের উপর অত্যাচার চালানো শাসকের কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা তুলে নিয়ে আরও যোগ্য বংশের হাতে তুলে দেন। একারণেই শ্যাং ও জিয়া রাজবংশ ব্যর্থ হয়েছিল। শ্যাং রাজাদের অনেকেই বিজয়ী শাসক ছিলেন, কিন্তু বংশের শেষদিকের বছরগুলোয় জনগণের অবস্থা করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যন্ত্রণায় আকাশের দিকে ফিরে আর্তনাদ করেছে তারা আর স্বর্গও ‘সারা দুনিয়ার মানুষের জন্যে কষ্টে শোক করে’ ঝোউদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ তাঁরা ন্যায় বিচারের প্রতি গভীরভাবে অঙ্গিকারাবদ্ধ। কিন্তু ঝোউদের আত্মতুষ্টিতে ভোগা চলবে না।
নতুন নগরে বাস করার সময় রাজাকে তাঁর নিজের গুণাবলীর জন্যে শ্রদ্ধা মেশানো উদ্বেগ দিন। রাজা যদি গুণেরই কদর করেন, তিনি যেন ঈশ্বরের কাছে দীর্ঘমেয়াদী ম্যান্ডেটের জন্যে প্রার্থনা করেন। রাজার দায়িত্বের ক্ষেত্রে, তিনি যেন সাধারণ মানুষের পালিয়ে যাওয়ার কারণ না হন, ভুল না করেন, কঠোর শাস্তির মাধ্যমে শাসন করার কথা না ভাবেন। এভাবে তিনি অনেক বেশি সফল হতে পারবেন। রাজা হতে হলে তাঁকে গুণের প্রাধান্যে অবস্থান গ্রহণ করতে দিন। তখন ক্ষুদ্র জাতি তাঁকে আদর্শ করে সারা বিশ্বে নিজেদের গড়ে তুলবে। রাজা তখন আদর্শে পরিণত হবেন। ৮২
গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এটা। ঝোউরা আগপর্যন্ত নৈতিকতা সম্পর্কে মাথাব্যথাহীন ধর্মে একটি নৈতিক আদর্শ যোগ করেছিল। ঈশ্বর স্রেফ শুয়োর আর ষাঁড়ের বলীতেই প্রভাবিত হন না, বরং সহানুভূতি আর ন্যায়বিচার প্রয়োজন। চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগে ঈশ্বরের ম্যান্ডেট গুরুত্বপূর্ণ আদর্শে পরিণত হবে। শাসক স্বার্থপর, নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী হলে ঈশ্বর তাঁকে সমর্থন করবেন না, তাঁর পতন ঘটবে। কোনও একটি রাষ্ট্রকে দুর্বল ও তাৎপর্যহীন মনে হতে পারে-বিজয়ের আগের ঝোউ-এর মতো-কিন্তু এর শাসক প্রাজ্ঞ, মানবিক এবং প্রজাদের কল্যাণের ব্যাপারে সত্যিকার অর্থে সচেতন থাকলে গোটা বিশ্বের লোক তাঁর পেছনে সমবেত হবে, এবং স্বর্গ তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করবেন।
অবশ্য গোড়ার দিকে ম্যান্ডেটের ব্যাখ্যা নিয়ে কিছু ভুলবোঝাবুঝি হয়েছিল।৮৩ ঝোউ-এর ডিউক এবং তাঁর ভাই শাও-এর ডিউক গোঙ-এর ভেতর মারাত্মক মতদ্বৈততা ছিল। ঝোউ-এর ডিউকের বিশ্বাস ছিল যে স্বর্গ ঝোউ-এর সকল লোককে ম্যান্ডেট দিয়েছেন; সুতরাং নতুন রাজাকে তাঁর মন্ত্রীদের পরামর্শের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু শাও গোঙ কেবল রাজাই ম্যান্ডেট পেয়েছেন বলে যুক্তি দেখান। একমাত্র রাজাই সরাসরি স্বর্গের প্রতি অগ্রসর হতে সক্ষম ঈশ্বরের সন্তান হওয়ার প্রাচীন ধারণায় ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। নিশ্চিতভাবেই, রাজা উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন, কিন্তু তিনি শাসন করার ম্যান্ডেট দেওয়া এক অনন্য, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা লাভ করেছেন।
সঙ্গত কারণেই রাজা চেঙ-এর কাছে চাচা গোঙ-এর যুক্তিটিই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। একসঙ্গে মিলে তাঁরা দুজন ঝেউ-এর ডিউককে অবসরে যেতে বাধ্য করেন। কেন্দ্রীয় সমতলের পুবে ব্যক্তিগত জমিদারী হিসাবে তাঁকে দেওয়া লু শহরে আবাস গড়ে তোলেন তিনি। লুর জনগণের নায়কে পরিণত হন। সম্মানিত পূর্বপুরষ হিসাবে তাঁকে সম্মান করত তারা। জাদুকরী কারিশমার চেয়ে গুণাবলী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ডিউকের বিশ্বাস অ্যাক্সিয়াল যুগের উপযুক্ত অন্তর্দৃষ্টি ছিল। স্রেফ পূর্বপুরুষ ছিলেন বলেই অনৈতিক জীবন যাপনকারী কাউকে সম্মান করার বদলে প্রথার উচিত উপযুক্ত ও মেধাবী মানুষকে সম্মান জানানো।৮৪ কিন্তু চীনারা এই নৈতিক দর্শনের জন্যে তৈরি ছিল না, তারা অতীতের অপ্রাকৃত আচারে ফিরে গিয়েছিল।
রাজা চেঙ-এর পরে যেসব রাজা শাসন করেছেন তাঁদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। কিন্তু স্বর্গীয় ক্ষমতা পাওয়া সত্ত্বেও ঝোউ-এর বিজয়ের একশো বছর পরে ঝোউ রাজবংশের পতন শুরু হওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার ছিল। সামন্তবাদী ব্যবস্থার অন্তস্থঃ দুর্বলতা ছিল। বছর পরিক্রমায় বিভিন্ন নগরের শাসকদের রাজ দরবারের সঙ্গে আবদ্ধ রাখা রক্তের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এসেছিল, ফলে বিভিন্ন নগরে রাজকুমাররা স্রেফ রাজার দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই বা দুই বা তিন গুন দূরবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। পশ্চিম রাজধানী থেকে রাজারা শাসন অব্যাহত রেখেছিলেন এবং দশম শতাব্দী নাগাদ অধিকতর পূর্বাঞ্চলীয় নগরীগুলো অস্থির হয়ে ওঠার বিষয়টি পরিষ্কার ছিল। ঝোউ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব হারানোর অনেক বছর পরেও ঝোউ রাজারা ধর্মীয় ও প্রতীকী আভা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। চীনারা কোনওদিনই ঝোউ রাজবংশের প্রাথমিক যুগের কথা ভুলতে পারবে না; তাদের অ্যাক্সিয়াল যুগ স্বর্গীয় ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্য ন্যায়বিচারক শাসকের সন্ধানে অনুপ্রাণিত হবে।
.
দ্বাদশ শতাব্দীতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল সংকটে গ্রস্ত হয় এবং গ্রিক, হিট্টাইট ও মিশরিয় রাজ্যগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, গোটা অঞ্চল নিক্ষিপ্ত হয় অন্ধকারে। ঠিক কি ঘটেছিল আমরা জানি না। পণ্ডিতরা সাধারণত মিশরিয় নথিতে উল্লেখ করা ক্রিট ও আনাতোলিয়া থেকে আগত উন্মুল নাবিক ও লাভান্তে যুগে ধ্বংসলীলা চালিয়ে শহর ও গ্রাম তছনছ করে দেওয়া কৃষকদের প্রাচীন দস্যুদল ‘সাগর-জাতি’কে দায়ী করে থাকেন। তবে এটা মনে হয় যে, সাগর-জাতি সম্ভবত বিপর্যয়ের কারণের চেয়ে বরং একটা লক্ষণ ছিল। জলবায়ু বা পরিবেশগত পরিবর্তন বিপর্যয়ের প্রতি সৃজনশীলভাবে সাড়া দেওয়ার স্থিতিশীলতার ঘাটতি বিশিষ্ট স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে প্রবল খরা ও দুর্ভিক্ষের দিকে চালিত করে থাকতে পারে। হিট্টাইট ও মিশরিয়রা শত শত বছর ধরে নিজেদের ভেতর মিশর ও নিকট প্রাচ্যকে ভাগ করে রেখেছিল। মিশরিয়রা গোটা দক্ষিণ সিরিয়া, ফোনেশিয়া ও কানান নিয়ন্ত্রণ করেছে, অন্যদিকে হিট্টাইটরা এশিয়া মাইনর ও আনাতোলিয়া শাসন করেছে। ১১৩০ সাল নাগাদ মিশর তার বেশির ভাগ বিদেশী প্রদেশ খোয়ায়; ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় হিট্টাইট রাজধানী; বিশাল কানানীয় বন্দর উগরিত, মেগিদ্দো এবং হাজোর ধ্বংস হয়ে যায়; ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ভূমধ্যসাগরীয় রাজ্য গ্রিস। মরিয়া সহায়-সম্বলহীন লোকজন চাকুরি ও নিরাপত্তার খোঁজে গোটা এলাকায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিল।
সঙ্কটের ভয়ানক পরিণতি প্রত্যক্ষকারীদের উপর অনেপনীয় প্রভাব রেখে গিয়েছে। আসন্ন অন্ধকার যুগে দুটি অ্যাক্সিয়াল জাতির উদ্ভব ঘটে। মাইসিনার ধ্বংসাবশেষ থেকে জেগে ওঠে একটি নতুন সভ্যতা; আর কানানের উচ্চভূমিতে ইসরায়েল নামে পরিচিত বিভিন্ন গোত্রের একটি কনফেডারেশন আবির্ভূত হয়। সত্যিকার অর্থে অন্ধকার যুগ ছিল বলে সামান্য ঐতিহাসিক নথিপত্র নিয়ে এই সময়কালের গ্রিস বা ইসরায়েল সম্পর্কে খুবই কম জানি আমরা। নবম শতাব্দী পর্যন্ত গ্রিকদের সম্পর্কে কার্যত আমাদের কাছে কোনও বিশ্বস্ত তথ্য নেই; আদি ইসরায়েল সম্পর্কে আছে সামান্য চকিত ঝলকমাত্র।
খুবই ধীরে ধীরে কানানের পতন ঘটছিল।৮৫ মিশর প্রত্যাহার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে মিশরিয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে থাকা উপকূলীয় সমতলে বিশাল নগর-রাষ্ট্রগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করে—এমন একটি প্রক্রিয়ার জন্যে এক শো বছর সময় লাগতে পারে। আবার, মিশরিয়রা বিদায় হওয়ার পর শহরগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কেন আমরা জানি না। শহুরে অভিজাত গোষ্ঠী ও অর্থনীতি যার উপর নির্ভরশীল ছিল সেই জমি চাষকারী কৃষক সম্প্রদায়ের ভেতর বিরোধ দেখা দিয়ে থাকতে পারে। শহরগুলোর অভ্যন্তরে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা মিশরিয় ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের বিরোধ বৈরিতা দেখা দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এইসব নগরের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ১২০০ সালের অল্প আগে উচ্চভূমিতে উত্তরের নিম্ন গালিলি থেকে দক্ষিণের বীরশেবা পর্যন্ত একটি নতুন বসতির নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।৮৬
এই গ্রামগুলো তেমন দৃষ্টি নন্দন ছিল না: এগুলোর কোনও নগরপ্রাচীর ছিল না; সুরক্ষিত ছিল না; জাঁকাল কোনও সরকারি ভবন, প্রাসাদ বা মন্দির ছিল না; কোনও আর্কাইভও ছিল না। মাঝারি, সমরূপ বাড়িগুলো সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন করা হতো এমন একটা সাম্যবাদী সমাজ থাকার ইঙ্গিত করে। পাথুরে, কঠিন জমিনে বাসিন্দাদের সংগ্রাম করতে হতো। সেরিয়াল শস্য ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল ছিল তাদের অর্থনীতি, তবুও প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে বসতিগুলো সমৃদ্ধি লাভ করেছিল বলে মনে হয়। একাদশ শতাব্দীতে উচ্চভূমিতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে, লোকসংখ্যা গিয়ে পৌছায় আশি হাজারের কাছাকাছি। পণ্ডিতরা একমত যে, গ্রামগুলোর বাসিন্দারাই ফারাও মার্নেপতেহ (সি. ১২১০) এর বিজয় স্তম্ভে উল্লেখিত ‘ইসরায়েল’ জাতি ছিল। এটাই ইসরায়েলের প্রথম অ-বাইবেলিয় উল্লেখ; এ থেকে মনে হয় এই সময় নাগাদ উচ্চভূমির বাসিন্দারা এই অঞ্চলেরই অধিবাসী তাদের শত্রুদের কানানীয়, হুরিয় এবং বেদুঈনদের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখত।৮৭
আদি ইসরায়েলের বিকাশ সম্পর্কিত সমসাময়িক কোনও বিবরণ নেই। বাইবেল আমাদের বিস্তারিত কাহিনী জানালেও আদিতে মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত এইসব বিবরণ লিপিবদ্ধ করার অনেক কাল আগের কথা। অ্যাক্সিয়াল যুগের অবদান বাইবেলের সৃষ্টি বেশ কয়েক শতাব্দীর প্রয়োজন হওয়া একটি দীর্ঘ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে আদি বাইবেল টেক্সটসমূহ লিখিত হয় এবং পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর কোনও এক সময় বাইবেলিয় অনুশাসন চূড়ান্ত হয়েছিল। অ্যাক্সিয়াল যুগে ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ, কবি, বিশ্লেষক, পয়গম্বর, পুরোহিত এবং আইনবিদরা তাদের ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতাগণ-আব্রাহাম, মোজেস, জোশুয়া, ডেভিড-ইসরায়েলের কাছে চীনাদের ইয়াও, শান ও ঝোউ-এর ডিউকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। ভারতের সাধুরা তাঁদের উৎসর্গের আচার নিয়ে যেভাবে ভেবেছিলেন ঠিক সেভাবে ইসরায়েলিরা তাদের সূচনার কাহিনী নিরন্তর ভেবে গেছে। ইসরায়েলের সূচনার কাহিনী অ্যাক্সিয়াল সাফল্য আবর্তিত হওয়ার একটি সংগঠনকারী প্রতীকে পরিণত হবে। আমরা যেমন দেখব, ইসায়েলিরা তাদের গাথা গড়ে তুলেছে, একে পরিবর্তন করেছে, এর উপর অলঙ্কার চাপিয়েছে, সংযোজন করেছে, নতুন করে ব্যাখ্যা করেছে এবং একে সময়ের বিশেষ অবস্থার প্রতি সাড়া দানে সক্ষম করে তুলেছে। প্রত্যেক কবি, পয়গম্বর এবং স্বাপ্নিক বিকাশমান বর্ণনায় তাৎপর্যের দিক থেকে প্রসারিত ও গভীরতা লাভ করা নতুন স্তর যোগ করেছেন।
চূড়ান্ত বিবরণ ইসরায়েল জাতি কানানের আদিবাসী ছিল না বলে দাবি করেছে। ১৭৫০ সালে তাদের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম মেসোপটেমিয়ার উর থেকে তাঁর ঈশ্বরের নির্দেশে কানানে এসে বসতি করেছিলেন। গোষ্ঠীপিতাগণ পাহাড়ী এলাকার বিভিন্ন স্থানে বাস করেছেন: হেব্রনে আব্রাহাম, তাঁর ছেলে ইসাক বীরশেবায়; এবং আব্রাহামের প্রপৌত্র জাকব (ইসরায়েল নামেও পরিচিত) শেচেম অঞ্চলে। ইয়াওয়েহ ইসরায়েলকে একটি শক্তিমান জাতিতে পরিণত করবেন এবং তাঁদের আপন দেশ হিসাবে কানান দান করবেন বলে গোষ্ঠীপিতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এক দুর্ভিক্ষ-কালে জাকব/ইসরায়েল এবং তাঁর বার ছেলে (ইসরায়েলি গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা) মিশরে অভিবাসন করেন। প্রথমে এখানে সমৃদ্ধি লাভ করেন তাঁরা, কিন্তু শেষপর্যন্ত মিশরিয়রা তাঁদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করে; চার শো বছর ধরে বন্দিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করে ইসরায়েলিরা। অবশেষে, ১২৫০ সালের দিকে তাদের ঈশ্বর ইয়াওয়েহ করুণা করেন এবং ক্ষমতার প্রবল প্রকাশের ভেতর দিয়ে মোসেজের নেতৃত্বে তাদের মুক্তি দেন। ইসরায়েলিরা মিশর ছেড়ে পালানোর সময় যাতে নিরাপদে সাগর অতিক্রম করতে পারে সেজন্যে ইয়াহওয়েহ অলৌকিকভাবে সী অভ রীডসের জল দ্বিখণ্ডিত করেন, কিন্তু তারপর তাদের তাড়া করে আসা ফারাও ও মিশরিয় সেনাবাহিনীকে ডুবিয়ে হত্যা করেন। কানানের দক্ষিণ মরু এলাকায় সিনাই পাহাড়ের উপর ইসরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন ইয়াওয়েহ এবং তাদের পবিত্র জাতিতে পরিণত করবে এমন একটি এক নতুন আইন দান করেন। কিন্তু ইয়াহওয়েহ শেষপর্যন্ত তাদের কানানের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার আগে ইসরায়েলিদের চল্লিশ বছর বিজন প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। প্রতিশ্রুত ভূমিতে ঢোকার আগেই পরলোকগমন করেন মোজেস, কিন্তু আনুমানিক ১২০০ সালের দিকে জোশুয়া ইসরায়েল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে ইসরায়েলকে বিজয়ী করেন। জোওয়ার অধীনে ইসরায়েলিরা সবগুলো কানানীয় শহর ও নগর ধ্বংস করে, সেগুলোর বাসিন্দাদের হত্যা করে এবং তাদের জমিন অধিকার করে নেয়।
১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলি প্রত্নতাত্ত্বিকদের খনন কাজ অবশ্য এই কাহিনী নিশ্চিত করেনি। বুক অভ জোশুয়ায় বর্ণিত পাইকারী ধ্বংসলীলার কোনও আলামত খুঁজে পাননি তারা, বিদেশী আগ্রসনের কোনও লক্ষণও না, মিশরিয় কোনও আর্টিফ্যাক্টস নয়, জনসংখ্যায় পরিবর্তনের কোনও আভাসও নয়। পণ্ডিত মহলে বিতর্ক ছিল প্রবল, এবং প্রায়শঃই ভারতে বৈদিক সংস্কৃতির উৎস নিয়ে আলোচনার মতোই বিদ্বেষপূর্ণ। সাধারণ পণ্ডিতমহলের মতে মিশর থেকে অভিবাসনের কাহিনী ঐতিহাসিক নয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নয়, বাইবেলিয় বিবরণ সপ্তম বা ষষ্ঠ শতাব্দীর পরিস্থিতি তুলে ধরেছে, যখন বেশির ভাগ টেক্সট লেখা হয়ে গিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পণ্ডিত উচ্চভূমিতে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের অনেকেই সম্ভবত উপকূলের পতনশীল নগর-রাষ্ট্রগুলো থেকে এসেছিল বলে বিশ্বাস করেন। সুতরাং আদি ইসরায়েলিদের অনেকেই সম্ভবত বিদেশী নয়, বরং কানানবাসীই ছিল। বাইবেলের আদি অংশ আদিতে ইয়াহওয়েহর দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্বতমালার দেবতা থাকার ইঙ্গিত দেয়, এবং দক্ষিণ থেকে উচ্চভূমিতে অভিবাসনকারী অন্য গোত্রগুলো ইয়াহওয়েহকে তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল বলে মনে হয়। ইসরায়েলিদের কেউ কেউ—উল্লেখযোগ্যভাবে জোসেফের গোত্রও-এমনকি মিশর থেকেই এসে থাকতে পারে। উপকূলীয় নগর-রাষ্ট্রসমূহে মিশরিয় শাসনাধীন ইসরায়েলিরা হয়তো প্রকৃতই মিশর থেকে মুক্তি অর্জন করেছে বলে ভেবে থাকতে পারে তবে সেটা তাদের আপন দেশেই। বাইবেলের লেখকরা আধুনিক ইতিহাসবিদকে সন্তুষ্ট করার মতো বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভুল কোনও বিবরণ লিপিবদ্ধ করছিলেন না। অস্তিত্বের খোঁজ করছিলেন তাঁরা। এগুলো ছিল জনগণকে একটি নতুন ভিন্ন পরিচয় গড়ে তোলার সহায়ক মহাকাব্যিক কাহিনী, জাতীয় গাথা।৮৮
আদতেই ইসরায়েলি হয়ে থাকলে কেন তারা নিজেদের বিদেশী দাবি করতে যাবে? প্রত্নতাত্ত্বিকরা উচ্চভূমিতে উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক অবক্ষয়, বড় ধরনের জনসংখ্যার পরিবর্তন ও বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের ভেতর দুই শতাব্দীব্যাপী জীবন-মরণ সংগ্রামের প্রমাণ পেয়েছেন।৮৯ এমনকি বাইবেলিয় বিবরণ ইসরায়েল কোনও একক পূর্বপুরুষ থেকে আবির্ভূত হয়নি, বরং ‘ইসরায়েলে’র অংশ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর-হেফার ও তিরযাহ শহরের জিবোমীয়, জেরেমিয়, কেনীয় এবং কানানীয় সমন্বয়-বলে ইঙ্গিত দেয়। এইসব গ্রুপ ও ক্ল্যান একটি কোভেন্যান্ট চুক্তিতে নিজেদের আবদ্ধ করেছিল বলে মনে হয়। প্রত্যেকেই প্রাচীন কানানীয় শহুরে সংস্কৃতির দিকে পিঠ ফিরিয়ে নেওয়ার সাহসী, সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই অর্থে প্রকৃতই বাইরের লোক ছিল তারা এবং প্রান্তে অবস্থানের অভিজ্ঞতা হয়তো যুগপৎ তাদের ইসরায়েলের বিদেশী উৎসে বিশ্বাস এবং বাইবেলের কানানীয় বিরোধী যুক্তিকে অনুপ্রাণিত করে থাকতে পারে। জাতিসমূহের পরিবারে ঘোর ও উত্তাল পরিবেশে জন্ম নেওয়া প্রান্তিকে পরিণত হওয়ার লাগাতার হুমকিতে থাকা নবাগত ছিল ইসরায়েল। ইসরায়েলিরা একটি প্রতিপরিচয় ও প্রতিবয়ান গড়ে তুলেছিল: দেবতা ইয়াহওয়েহর সঙ্গে তাদের এক অনন্য সম্পর্ক থাকায় তারা অঞ্চলের অন্যান্য জাতি থেকে ভিন্ন।৯২
সদস্যরা স্বগোত্রীয়দের মৃত্যুর বদলা নেবে, এটাই গোত্রীয় রীতিনীতির দাবি ছিল। স্বগোত্রীয়রা রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত; গোত্রীয় লোকেরা একই জীবনের অংশীদার।৯৩ সুতরাং তাদের নিজেদের মতো করেই স্বতীর্থ গোত্রীয় সদস্যদের ভালোবাসতে হতো। প্রায়শঃই ‘ভালোবাসা’ হিসাবে অনূদিত হেসেদ মূলতঃ কারও পারিবারিক গোষ্ঠীর প্রতি উদার ও কল্যাণময় আচরণ দাবিকারী আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী গোত্রীয় পরিভাষা ছিল।৯৪ রক্তের সম্পর্ক নেই এমন লোকদের বিয়ে বা ভাইয়ের মর্যাদা দেওয়া কোভেন্যান্ট চুক্তির মাধ্যমে গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারত। গোত্রীয় লোকদের দলের নতুন সদস্যদের ভালোবাসতে হতো, কারণ এখন তারা তাদের রক্তমাংসে পরিণত হয়েছে, হাড়ের মতো হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু আদি কোভেন্যান্ট এই আত্মীয়তার পরিভাষাটি ব্যবহার করেছে। এমন হতে পারে যে, নতুন ইসরায়েলের বিভিন্ন জাতিগত গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধকারী কেভেন্যান্টকে এই রীতিটি প্রভাবিত করেছিল।৯৫ পশ্চিমা সেমিটিক বিশ্বে সামাজিক এককসমূহ বৃহৎ হয়ে ওঠায় বৃহৎ কনফেডারেশনকে একসূত্রে বেঁধে রাখা বন্ধনের পবিত্রতা বোঝাতে আত্মীয়তার পরিভাষা আগের চেয়ে আরও ঘনঘন প্রয়োগ হতে শুরু করে। এভাবে আদি ইসরায়েলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আইন গোত্রীয় আদর্শে প্রভাবিত ছিল। এলাকার অন্যান্য জাতির মতো ইসরায়েলিরা জাতীয় দেবতার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কিত মনে করেছে, নিজেদের তারা অ্যাম ইয়াহওয়েহ, ইয়াহওয়েহ’র ‘আত্মীয়’ বা ‘জাতি’ বলত।৯৬
প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল দেখায় যে পাহাড়ী এলাকায় জীবন ছিল কঠিন। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এক উত্তাল সময় ছিল সেটা। আদি বসতিস্থাপনকারীদের প্রায় নিশ্চিতভাবেই উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াসে সেই দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। বাইবেল জর্দান নদীতে এক মহান বিজয়ের স্মৃতি ধরে রেখেছে: মোয়াব অঞ্চল দিয়ে দক্ষিণ থেকে অভিবাসন করা গোত্রগুলোকে তাদের নদী পারাপারে বাধা দানকারী স্থানীয় বিভিন্ন দলের মোকাবিলা করতে হয়ে থাকতে পারে। কোনও গ্রমে থিতু হওয়ার পর বসতিস্থাপনকারীদের পড়শীদের সঙ্গে সহাবস্থান শিখতে হয়েছে তাদের এবং তাদের অনভিজ্ঞ সমাজকে হুমকি দানকারী লোকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়েছে। জাজেস ও ১ সামুয়েলে বর্ণিত বিক্ষিপ্ত যুদ্ধগুলো একাদশ ও দশম শতাব্দীর পরিস্থিতির নিখুঁত বিবরণ বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন। ১২০০ সালের দিকে ইসরায়েল কানানের দক্ষিণ উপকূলে বসতি স্থাপন করা ফিলিস্তিনদের মতো গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল, মোটামুটি একই সময়ে যখন উচ্চভূমিতে প্রথম গ্রামের পত্তন ঘটেছিল। একজন গোত্রীয় নেতাকে (সোপেত: বিচারক) গোত্র আক্রান্ত হলে প্রতিবেশী বসতিগুলোর সমর্থন আদায়ে সক্ষম হতে হতো। এই কারণে ইসরায়েলি সমাজের কাছে হেরেম (‘পবিত্র যুদ্ধ’)-এর প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গোত্র আক্রান্ত হলে বিচারক অন্য গোত্রগুলোকে ইয়াহওয়েহর মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহবান জানাতেন। ইসরায়েলের মূল কাল্ট বস্তুটি ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া অ্যাম ইয়াহওয়েহকে একত্রিতকারী চুক্তির প্রতীক আর্ক অভ দ্য কোভেন্যান্ট নামে পরিচিত একটা প্যালাডিয়াম। বাহিনী যাত্রা শুরু করলে আর্কের সহযাত্রী হতে ইয়াহওয়েহকে আহ্বান জানাতেন বিচারক :
হে সদাপ্রভু উঠ, তোমার শত্রুগণ ছিন্নভিন্ন হউক
তোমার বিদ্বেষীগণ তোমার সম্মুখ হইতে পলায়ন করুক।৯৭
আক্রমণের বিরুদ্ধে সবসময় তৈরি অবস্থায় বাস করে দিশাহারা জাতি একটি যুদ্ধংদেহী প্রথা গড়ে তুলেছিল।
ইসরায়েলি জাতি প্রতিবেশীদের থেকে নিজেদের ভিন্ন মনে করলেও বাইবেলিয় দলিল ষষ্ঠ শতাব্দীর আগপর্যন্ত ইসরায়েলের ধর্ম আসলে অন্যান্য স্থানীয় লোকদের ধর্ম থেকে খুব বেশি ভিন্ন না থাকার ইঙ্গিত দেয়। আব্রাহাম, ইসাক এবং জাকব কানানের পরম প্রভু এল-এর উপাসনা করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মগুলো এল-এর কাল্টকে ইয়াহওয়ের কাল্টের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ৯৮ মোজেসের কাছে ইসরায়েলের ইতিহাসের গোড়ার দিকে গোত্রপিতারা তাঁকে এল নামে ডাকতেন এবং কেবল এখন নিজের নাম ইয়াহওয়েহ প্রকাশ করছেন বলে প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করার সময় খোদ ইয়াহওয়েহ এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন।৯৯ কিন্তু ইসরায়েলিরা কোনওদিনই এল-কে ভোলেনি। দীর্ঘ সময়ের জন্যে দেবতাদের স্বর্গীয় মহাসভায় কানানীয় ঈশ্বর এল-এর সভাপতিত্ব করার ট্যাবারনাকলের মতো একটি তাঁবুই ছিল ইয়াহওয়েহর মন্দির।
কানানে এল শেষপর্যন্ত বেশির ভাগ আকাশ দেবতার পরিণতি লাভ করেন, চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ তাঁর ধর্মীয় প্রথার পতন শুরু হয় রথে চেপে মেঘের উপর ঘুরে বেড়ানো, অন্য দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং জীবনদায়ী বৃষ্টিপাত ঘটানো গতিশীল ঝড়ের দেবতা স্বৰ্গীয় যোদ্ধা বা’ল তাঁর স্থান দখল করেন। প্রথমদিকে ইয়াহওয়েহর ধর্মীয় প্রথা বা’লের প্রথার মতো ছিল, জেরুসালেমে ইয়াহওয়েহর মন্দিরে ব্যবহারের লক্ষ্যে বা’লের কিছু কিছু স্তুতিবাক্য গ্রহণ করা হয়েছিল। যুদ্ধ, হাতাহাতি মারপিট ও দেবতাদের ভেতর ভীতিকর লড়াইয়ের গল্পে ভরপুর মধ্য প্রাচ্যীয় ধর্ম জোরালভাবে কষ্টকর ছিল। বাবিলনে যোদ্ধা দেবতা মারদুক আদিম সাগর তিয়ামাতকে হত্যা করেছি তাঁর মৃতদেহকে দানবীয় সেলফিশের মতো টুকরোটুকরো করে স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিবছর নববর্ষের অনুষ্ঠানে আরও এক বছর বিশ্বের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে ইসাগিলার মন্দিরে এই যুদ্ধের পুনরাভিনয় হতো। সিরিয়ায় বা’ল সাত-মাথা ড্রাগন লোতানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, বাইবেলে যার নাম বলা হয়েছে লেভিয়াথান। বিশৃঙ্খলার প্রতীক আদিম সাগর ইয়াম ও খরা, মৃত্যু এবং বন্ধ্যাত্বের দেবতা মোতের সাথেও লড়েছেন তিনি। তাঁর বিজয় উদযাপনের জন্যে বা’ল স্বয়ং তাঁর পবিত্র পাহাড় সাপান পর্বতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ষষ্ঠ শতাব্দী অবধি ইসরায়েলিরাও ইয়াহওয়েহ নতুন বিশ্ব সৃষ্টি ও তাঁর জাতিকে বাঁচাতে লেভিয়াথানের মতো সাগর ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বলে মনে করত।১০০
উগারিতের স্তোত্রগীতসমূহ দেখায় যে, স্বর্গীয় যোদ্ধা বা’ল গোটা মহাবিশ্বকে ওলটপালট করে দিয়েছেন: তিনি ‘পবিত্রজনদের’ দল নিয়ে বজ্র হাঁকিয়ে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে অগ্রসর হওয়ার সময়,
আকাশমণ্ডলী কাগজের মতো দুমড়ে যায়,
আর আরুরের পাতা শুকিয়ে যাওয়ার মতো
ডুমুর ঝরে পড়ার মতো
তাদের সব আশ্রয় নিপীড়িত হয়।১০১
বা’ল-এর পবিত্র কণ্ঠস্বর জমিনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়, তাঁর গর্জনে পাহাড়পর্বত কাঁপতে থাকে। ১০২ তিনি বিজয়ীর বেশে সাপান পাহাড়ে ফেরার পর প্রাসাদ থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর গমগম করতে থাকে, বয়ে আনে বৃষ্টি ১০৩ উগারিতের ধর্মীয় আচারে পুনরাভিনয় করে উপাসকরা খরা আর মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ তাঁর সাথে নিত। মোতের বিরুদ্ধে জীবন-মরণ লড়াইয়ের পর বোন-স্ত্রী আনাতের সঙ্গে মহাআনন্দে মিলিত হন বা’ল। তাঁর উপাসকরা মাটির পবিত্র শক্তিকে সক্রিয় করে তোলার জন্যে এবং ভালো ফসল ঘরে তুলতে আচরিক যৌন মিলনেও অংশ নিত। আমরা জানি, পয়গম্বরদের বিরক্তি উদ্রেক করে ইসরায়েলিরা অষ্টম শতাব্দী এবং তারপরেও দীর্ঘ দিন এইসব উন্মত্ত যৌনলীলায় অংশ নিয়েছিল।
বাইবেলের আদিমতম টেক্সটে-আনুমানিক দশম শতাব্দীতে লিখিত বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন পঙক্তি এবং পরবর্তী বিবরণে অন্তর্ভুক্ত করা-ইয়াহওয়েহকে হুবহু বা’লের মতো স্বর্গীয় দেবতা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এই সময় গোত্রগুলো এক সহিংস বিপজ্জনক জীবন যাপন করছিল বলে দেবতাদের সমর্থন তাদের প্রয়োজন ছিল। কবিতাগুলো সাধারণভাবে ইয়াহওয়েহর দক্ষিণাঞ্চলীয় পাহাড়ে কুচকাওয়াজ করে ফেরার ও উচ্চভূমির বাসিন্দাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এভাবে সং অভ ডেবোরা:
হে সদাপ্রভু, তুমি যখন সেয়ীর হইতে নির্গমন করিলে,
ইদোম ক্ষেত্র হইতে অগ্রসর হইলে,
ভূমি কাঁপিল, আকাশও বর্ষিল,
মেঘমালা জল বরিষণ করিল।
সদাপ্রভুর সাক্ষাতে পৰ্ব্বতগণ কম্পমান হইল
ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভুর সাক্ষাতে ঐ সীনয় কম্পমান হইল।১০৪
এমনি আরেকটি আদি কবিতায় ইয়াহওয়েহ পারান পাহাড় থেকে আসার সময় ‘তিনি পৃথিবীকে কাঁপিয়েছেন’, এবং তিনি অগ্রসর হওয়ায় প্রাচীন পর্বতমালা ধ্বংস হয়ে গেছে; চিরস্থায়ী পাহাড়গুলো জমিনে মিলিয়ে গেছে। তাঁর প্রতাপ আদিম সাগরে ধেয়ে বেরিয়েছে এবং ইসরায়েলের বিরোধিতাকারী জাতিগুলো সত্রাসে কম্পিত হয়েছে।১০৫
আদি ইসরায়েলে কেন্দ্রীয় কোনও স্যাংচুয়ারি ছিল না, তবে শেচেম, গিলগাল, শিলোহ, বেথেল ও ব্রেনে বেশ কয়েকটি মন্দির ছিল। পরবর্তীকালের বাইবেলিয় বিবরণের বিক্ষিপ্ত টেক্সট থেকে আমরা যতদূর বলতে পারি, কোভেন্যান্টের আর্ক এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো। ইসরায়েলিরা স্থানীয় মন্দিরে ইয়াহওয়েহর উপস্থিতিতে তাদের কোভেন্যান্ট নবায়ন করত। মন্দিরগুলোকে প্রায়শঃই ইসরায়েলের অতীতের মহান চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম করা হতো: হেব্রনের আশপাশে দক্ষিণাঞ্চলীয় গোত্রগুলোর নায়ক ছিলেন আব্রাহাম; জাকব বেথেলের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; জাকবের অন্যতম প্রিয় পুত্র জোসেফ বিশেষভাবে উত্তরে পাহাড়ী এলাকায় দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। উত্তরে বিশেষ করে শিলোহয়ও মোজেস বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ১০৬ কোভেন্যান্ট উৎসবের সময় ভৃত্য, পুরোহিত এবং বিচারকগণ এইসব মহান ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করতেন। তাঁরা আব্রাহামের একবার ব্রেনের কাছে মেমরেতে তাঁর তাঁবুতে কয়েকজন আগন্তুককে আপ্যায়ন করার স্মৃতিচারণ করতেন; আর অগন্তুকদের একজন ছিলেন খোদ ইয়াহওয়েহ; জাকব বেথেলে ইয়াহওয়েহর স্বর্গীয় দর্শন লাভ করেছিলেন, যেখানে জমিন থেকে স্বর্গের দিকে উঠে যাওয়া এক বিশাল মই দেখেছিলেন তিনি; ভূমির অধিকারের পর জোশুয়া বিভিন্ন গোত্রকে শেচেমের এক কোভেন্যান্টের মাধ্যমে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। প্রতিটি উপাসনালয়ের সম্ভবত নিজস্ব কাহিনী ছিল, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মৌখিকভাবে তা হস্তান্তরিত হয়েছে, সতীর্থদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে ভাবগম্ভীর আনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হয়েছে।
ইসরায়েলিরা সম্ভবত তাদের অনুষ্ঠানে এইসব মহান কৃতিত্বের পুনরাভিনয় করত। উদারহরণ স্বরূপ, কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে, বুক অভ জোশুয়া গোত্রের বিজয়ীর মতো জর্দান নদী অতিক্রম উদযাপন করা গিলগালের বসন্ত উৎসবের কথা ধারণ করেছে।১০৭ বাইবেলিয় ইতিহাসবিদরা ফসল তোলার মৌসুমে বসন্ত কালে ‘জর্দান নদী দুকূল ছাপিয়ে যেত ১৮ বলে আচরিক বিবরণকে বাধা দিয়েছেন। মনে হয়, বিশেষভাবে এক মহান অলৌকিক ঘটনার স্মৃতিবাহী উৎসব উপলক্ষ্যে বাঁধ দিয়ে জল প্রবাহকে রুদ্ধ করা হতো। জোশুয়া তাঁর জাতিকে নিয়ে বন্যার পানির কিনারে আসার পর তাদের স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কি ঘটে দেখতে বলেন। জল আর্ক বহনকারী পুরোহিতদের পা স্পর্শ করামাত্র অলৌকিকভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলে সবাই নিরাপদে শুকনো পায়ে নদী পেরিয়ে গিলগালের প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করে। স্থানীয় জনগণ-’ইমোরিয়দের সকল রাজা ও সমুদ্রের নিকটস্থ কানানীয়দের সকল রাজা’-ঘটনার কথা জানার পর ‘তাহাদের হৃদয় গলিয়া গেল ও ইস্রায়েল-সন্তানগণের হেতু তাঁহাদের আর সাহস রহিল না।’১০৯ প্রতি বছর অতিক্রমের বসন্ত উৎসবে (পিস্যাচ) গোত্রগুলো আচরিকভাবে এই মহান মুহূর্তটাকে নতুন করে গড়ে তুলত। জর্দানের পুর তীরে মিলিত হতো তারা, তারপর বাঁধ দিয়ে আটকানো জল পেরিয়ে পশ্চিম তীরে আসত, প্রবেশ করত গিলগালের মন্দিরে, যেখানে বারটি গোত্রের প্রতিটির জন্যে একটি করে খাড়া প্রস্তরের বৃত্ত (গিলগাল) ঘটনার স্মৃতি তুলে ধরত। ইসরায়েলিরা এখানে তাঁবু খাটাত, কোভেন্যান্ট নবায়ন করত এবং অখণ্ড রুটি (মাযযোথ) ও ভূট্টা পোড়া খেয়ে বিজয়ীর মতো ভূমিতে প্রবেশের পর ‘প্রথমবারের মতো দেশের উৎপন্নের স্বাদ নিয়েছিলেন’ যারা সেই পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে পিস্যাচ উদযাপন করত। ১১০
সবশেষে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গিলগাল থেকে রওয়ানা দেওয়ার পর সম্ভবত জোশুয়ার লাভ করা দিব্যদর্শনেরও পুনরাভিনয় হতো।
যিরীহোর নিকটে অবস্থিতি-কালে যিহোশূয়ো চক্ষু তুলিয়া চাহিলেন, আর দেখ, এক পুরুষ তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান, তাঁহার হস্তে একখানা নিঙ্কোষ খড়গ; যিহোশূয়ো তাঁহার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কি আমাদের পক্ষ?’ তিনি কহিলেন, ‘না; কিন্তু আমি সদাপ্রভুর সৈন্যের অধ্যক্ষ, এখনই আসিলাম।’ তখন যিহোশূয়ো ভূমিতে উবুড় হইয়া পড়িয়া প্রণিপাত করিলেন, ও তাঁহাকে কহিলেন, “হে আমার প্রভু, আপনার এ দাসকে কি আজ্ঞা করেন?’ সদাপ্রভুর সৈন্যের অধ্যক্ষ যিহোশূয়োকে কহিলেন, ‘তোমার পদ হইতে পাদুকা খুলিয়া ফেল, কেননা যে স্থানে তুমি দাঁড়াইয়া আছ, ঐ স্থান পবিত্র। তখন যিহোশূয়ো সেই রূপ করিলেন।১১১
পিস্যাচের উৎসব ছিল জেরিকোয় আক্রমণের ভেতর দিয়ে শুরু হওয়া প্রতিশ্রুত ভূমি অধিকারের পবিত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি। দেয়ালগুলো অলৌকিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল এবং ইসরায়েলিরা ঝড়ের বেগে শহরে প্রবেশ করেছে। ‘পরে লোকেরা প্রত্যেক জন সম্মুখপথে নগরে উঠিয়া গিয়া নগর হস্তগত করিল। আর তাহারা খড়গধারে নগরের স্ত্রী, পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ এবং গো, মেষ, গৰ্দ্দভ সকলই নিঃশেষে বিনষ্ট করিল’ ১১২
ইয়াহওয়েহ ভালো যোদ্ধা ছিলেন। বসন্তকালীন ফসল তোলার মৌসুমের একটা সময়ে গিলগালের উৎসব অনুষ্ঠিত হতো, কিন্তু ভালো ফসলে জন্যে কোনও প্রার্থনা নয় বরং স্রেফ এক সামরিক অভিযানের স্মৃতিচারণ ছিল। ইসরায়েলি উপাস্যকে ইয়াহওয়েহ সাবাওথ অর্থাৎ ‘সেনাবাহিনীর’ দেবতা বলা হতো; স্বর্গীয় বাহিনী তাঁর সঙ্গী ছিলেন এবং তাঁর অধিনায়ক ইসরায়েলিদের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যুদ্ধ ছিল পবিত্র কর্মকাণ্ড। লোকে যুদ্ধের আগে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্যে নিজেদের পবিত্র করে নিত, আর জোশুয়া যেখানে দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন সেই যুদ্ধক্ষেত্র ছিল পবিত্র স্থান। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই স্বৰ্গীয় লড়াইয়ের পুনরাভিনয় করেছে, কিন্তু ইসরায়েল সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করতে যাচ্ছিল। মিথের পবিত্র আদিম জগতে অর্জিত একটি যুদ্ধ বিজয়ের স্মৃতিচারণ করার বদলে ইসরায়েলিরা এমন বিজয় উদযাপন করত যেটা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মানবীয় কালেই, খুব বেশি দূরবর্তী নয় এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছে।
বাইবেলের বেশ গোড়ার দিকের একটি কবিতায় মিথ থেকে ইতিহাসে সরণ স্পষ্ট। সম্ভবত গিলগালের উৎসবে এটা গীত হতো এবং দশম শতাব্দী কালের সময়ের মতো প্রাচীন হতে পারে।১১৩ চূড়ান্ত বাইবেলিয় টেক্সটে দ্য সং অভ সী১১৪ ঠিক সী অভ রীডস পেরুনোর পরেই মোজেসের বোন মিরিয়ামের জবানীতে যাত্রা কাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু সং অভ সী স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আদিতে ইসরায়েলের শত্রুরা সী অভ রীডসে নয় বরং জর্দান নদীতেই ডুবে মরেছিল। এই অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষকারী লোকজন মিশর নয়, সিনাইয়ের অধিবাসী ছিল, কিন্তু কানান ও জর্দানের পূর্ব তীরের রাজ্যগুলোর বাসিন্দারা:
পলেস্তিয়াবাসীগণ ব্যথাগ্রস্ত হইয়া পড়িল।
তখন ইদোমের দলপতিগণ বিহ্বল হইল;
মোয়াবের মেড়ারা কম্পগ্রস্ত হইল;
কানান-নিবাসী সকলে গলিয়া গেল।
ত্রাস ও আশঙ্কা তাহাদের উপরে পড়িতেছে;
তোমার বাহুবলে তাহারা প্রস্তরবৎ স্তব্ধ হইয়া আছে।১১৫
গানে ইয়াহওয়েহ তাঁর জাতিকে সিনাই পেনিনসুলার ভেতর দিয়ে নয় বরং প্রতিশ্রুত ভূমির উপর দিয়ে বিজয় যাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে দেখানো হয়েছে। পরে এক্সোডাসের কাহিনীর সঙ্গে মেলাতে একে অভিযোজন করা হয়েছে, তবে মনে হয় আদিতে জর্দান পেরুনোর ঘটনা উদযাপনের আচার সী অভ রীডস অতিক্রমের বিবরণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজে এসেছে।১১৬
সী অভ রীডসের বিজয়কে জর্দান নদীর অলৌকিক ঘটনা দিয়ে মেলানো খুবই সহজ ছিল। কানানীয় পুরাণে মধ্যপ্রাচ্যে সবসময়ই বিশৃঙ্খলার বিধ্বংসী শক্তির প্রতীক আদিম মহাসাগর ইয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাকে হত্যার মাধ্যমে মহাবিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন বা’ল। কিন্তু ইয়ামকে আবার প্রিন্স রিভার বলে ডাকা হতো। সাগর আর নদীর পরস্পর পরিবর্তনযোগ্য। সং অভ দ্য সী বালের প্রথা ও পুরাণের জোরাল প্রভাব তুলে ধরে।১১৭ বা’লের মতো ইয়াহওয়েহকেও স্বর্গীয় ঐশী যোদ্ধা হিসাবে তারিফ করা হয়েছে।
হে সাদপ্রভু, তোমার দক্ষিণ হস্ত বলে গৌরবান্বিত;
হে সদাপ্রভু, তোমার দক্ষিণ হস্ত শত্রু চূর্ণকারী;
তুমি নিজ মহিমার মহত্ত্বে, যাহারা তোমার বিরুদ্ধে উঠে,
তাহাদিগকে নিপাত করিয়া থাক;
তোমার প্রেরিত কোপাগ্নি নাড়ার ন্যায় তাহাদিগকে ভক্ষণ করে।১১৮
বালের মতো ইয়াহওয়েহ জোরের সঙ্গে সাগর/নদী নিয়ন্ত্রণ করেছেন: তাঁর নাসিকার সামান্য গর্জনে স্রোত সকল ‘স্তূপের ন্যায় দণ্ডায়মান হইল,’১১৯ আর বিজয়ের পর ইয়াহওয়েহ তাঁর পবিত্র পাহাড়ে কুচকাওয়াজ করে যান, যেখানে তিনি চিরকালের জন্যে রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত, ঠিক ইয়ামের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সাপান পাহাড়ে যেভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বা’ল। তবে চমকপ্রদ পার্থক্য ছিল। বা’ল যেখানে সামনে বেড়েছেন পর্বতমালা, বনজঙ্গল আর মুরভূমি কুঁকড়ে গেছে; সং অভ সী-তে ইয়াহওয়েহ অতিক্রম করে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনগণই ত্রাসে স্থবির হয়ে গেছে। প্রাচীন পৌরাণিক দ্যোতনা ইসরায়েলের ঐতিহাসিক লড়াইগুলোকে দুয়ে অর্থ দিয়েছে।
পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, ইসায়েলিরা পরে বা’লের প্রতি দারুণ বৈরী হয়ে উঠবে, কিন্তু এই পর্যায়ে তাঁর ধর্মীয় প্রথা তাদের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী মনে হয়েছে। তখনও তারা একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেনি। ইয়াহওয়েহ তাদের বিশেষ দেবতা ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য দেবতার অস্তিত্ব স্বীকার করত তারা এবং তাঁদের উপাসনা করত। ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে ইয়াহওয়েহ একমাত্র দেবতায় পরিণত হবেন না। একেবারে গোড়ার দিকে ইয়াহওয়েহ ছিলেন ‘পবিত্রজনদের’ একজন বা ‘এল-এর পুত্র, যিনি স্বর্গীয় সভায় উপস্থিত থাকতেন। সময়ের সূচনায়, বলা হয়ে থাকে, এল প্রতিটি জাতির একজন পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, এবং ইয়াহওয়েহ ‘ইসরায়েলের পবিত্র জন’ হিসাবে মনোনীত হন। দ্বিতীয় বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত অন্য একটি আদি কবিতা প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব প্রকাশ করেছে:
পরাৎপর যখন জাতিগণকে অধিকার প্রদান করিলেন,
যখন মনুষ্য-সন্তানগণকে পৃথক করিলেন
তখন ইস্রায়েল-সন্তানগণের সংখ্যানুসারেই
সেই লোকবৃন্দের সীমা নিরুপণ করিলেন।
কেননা সদাপ্রভুর প্রজাই তাঁহার দয়াংশ;
যাকোবই তাঁহার রিক্ত অধিকার।১২০
পবিত্রতার আক্কাদিয় প্রতিশব্দ হচ্ছে এলু, ‘পরিচ্ছন্নতা, ঔজ্জ্বল্য, আলোকময়’। প্রায়শঃই ‘দেবতা’ হিসাবে অনূদিত হওয়া হিব্রু এলোহিম-এর সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু আদিতে মানুষের কাছে যা কিছু দেবতা বোঝাতে পারে তাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ‘পবিত্রজন’রা ভারতের দেবা, ‘উজ্জ্বল- জন’দের মতো ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে পবিত্রতা ছিল বাহ্মণের মতো দেবতাদের অতীতে অবস্থান করা শক্তি। মেসোপটেমিয়ার ইলাম (‘ঐশ্বরিকতা’) বিশেষ কোনও উপাস্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া উজ্জ্বল ক্ষমতাকে বোঝাত। এটা ছিল মৌলিক বাস্তবতা, কোনও একক ভিন্ন আকারের সঙ্গে মেলানো যেত না। দেবতারা ইলামের উৎস ছিলেন না, কিন্তু মানুষ, পর্বতমালা, গাছপালা আর তারামণ্ডলীর মতো তাঁরাও এই পবিত্রতার অংশীদার ছিলেন। কাল্টের কোনও কিছু ইলামের সংস্পর্শে এলে পবিত্র হয়ে যেত: রাজা, পুরোহিত, মন্দির এবং এমনকি সংযোগের কারণে আচারের পাত্রগুলোও পবিত্র হয়ে উঠত। একক স্বর্গীয় সত্তায় পবিত্রতাকে সীমিত করার ব্যাপারটা আদি ইসরায়েলিদের কাছে বিচিত্র ঠেকতে পারত। ১২১
প্রথম সহস্রাব্দের সূচনা নাগাদ ইসায়েলি সমাজ বিকশিত হয়েছিল এবং আরও জটিল হয়ে উঠেছিল; প্রাচীন গোত্রীয় সংগঠন আর পর্যাপ্ত ছিল না। অনেকেই এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেও ইসরায়েলের একটি রাজতন্ত্র প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আদিতে বাইবেল মোতাবেক রাজা ডেভিড (সি. ১০০০-৯৭০) এবং রাজা সোলোমন (সি. ৯৭০-৯৩০) রাজধানী জেরুসালেম থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্য শাসন করেছিলেন। দশম শতাব্দী নাগাদ তা দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ নিয়ে ইসরায়েল রাজ্য অপেক্ষাকৃত বড় ও সমৃদ্ধ ছিল। জমি ছিল উর্বর, উৎপাদনশীল, যোগাযোগ ও পরিবহন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ এবং জেজরিল উপত্যকা দীর্ঘদিন ধরেই মিশর ও মেসোপটেমিয়ার ভেতর প্রধান বাণিজ্য পথ ছিল। দক্ষিণের অনেক ছোট ও বিচ্ছিন্ন ক্ষুদে রাজ্য জুদাহ রাজা ডেভিডের বংশধররা শাসন করতেন; এর এবড়োখেবড়ো জমিন খামারের পক্ষে রুক্ষ ছিল। ১২২
অবশ্য বাইবেলি লেখকরা দক্ষিণের রাজ্যের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন বলে জুদাহর ধর্ম সম্পর্কে অনেক বেশি জানি আমরা। এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কানানীয় রাজতন্ত্র ছিল। স্বর্গীয় যোদ্ধার পার্থিব প্রতিরূপ এবং ইয়াহওয়েহর সঙ্গে কান্টিক সম্পর্কের কারণে পবিত্র সত্তা ডেভিডিয় রাজার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে আবর্তিত হতো কাল্ট। তাঁর অভিষেকের সময় পবিত্রজনদের একজনে, ঈশ্বরের পুত্রে পরিণত হয়েছেন তিনি। ইয়াহওয়েহ দত্তক হিসাবে গ্রহণ করেছেন তাঁকে, তিনি ঘোষণা করেছেন: ‘সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, তুমি আমার পুত্র।’১২৩ ইয়াহওয়েহর বিশেষ দাস হিসাবে ঈশ্বরের অন্য পুত্রদের সঙ্গে স্বর্গীয় অধিবেশনে আসন গ্রহণ করেছেন তিনি। ইয়াহওয়েহর প্রতিনিধি হিসাবে তিনি তাঁর পার্থিব প্রতিপক্ষদের ধ্বংস করবেন, ঠিক যেভাবে ইয়াহওয়েহ সাগর আর নদীর স্বর্গীয় শক্তিকে পরাস্ত করেছিলেন।
কোভেন্যান্ট আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে পটভূমিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং ইয়াহওয়েহ ও বিভিন্ন গোত্রকে মিত্রে পরিণতকারী কোভেন্যান্ট জুদাহয় রাজা ডেভিডকে তাঁর বংশ চিরকাল টিকে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পাদিত কোভেন্যান্টের কাছে গ্রস্ত হয়েছে। প্রাচীন কোভেন্যান্ট উৎসবগুলো ইসরায়েলি ইতিহাসের প্রতি জোর দিয়েছে, কিন্তু রাজকীয় কাল্ট আবার প্রাচীন পুরাণে ফিরে গেছে। দশম শতাব্দীর মন্দিরের স্তোত্রগীতসমূহ জেরুসালেমকে সাহায্য করার জন্যে তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসার সময় ইয়াহওয়েহকে সাগরের বুকে দাঁড়ানো অবস্থায় বর্ণনা করেছে, বালের মতো তাঁর বজ্র আর বিদ্যুৎ পৃথিবীর মাথার উপর ঝলসাচ্ছিল।১২৪ সম্ভবত নববর্ষের উৎসবে এক বিরাট মিছিলে ইয়াহওয়েহর পবিত্র পাহাড় যায়নে বিজয় কুচকাওয়াজের পুনরাভিনয় হতো, এবং রাজা সলোমন কর্তৃক নির্মিত মন্দিরে আর্ক নিয়ে যাওয়া হতো। কয়ার সুরেলা কণ্ঠে গান গাইত: ‘ইয়াহওয়েহ, সবল ও সাহসী, ইয়াহওয়েহ, যুদ্ধে সাহসী!’ এল-এর অন্য পুত্র, প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিসমূহের পৃষ্ঠপোষকদের অবশ্যই পবিত্র দরবারে প্রবেশ করার সময় লেবাননের সিডার গাছ বিচ্ছিন্নকারী এবং বজ্রের ফলাকে তীক্ষ্ণ করে তোলা ইয়াহওয়েহকে সম্মান দেখাতে হবে।১২৫ ইয়াহওয়েহর কণ্ঠস্বর মরুভূমি কাঁপিয়ে দিয়েছে, পত্রহীন করে দিয়েছে বনজঙ্গল। ‘সদাপ্রভু জলপ্লাবনে সমাসীন ছিলেন; সদাপ্রভু চিরকালতরে সমাসীন রাজা!’
ইয়াহওয়েহ তখনও যোদ্ধা দেবতা ছিলেন, কিন্তু ইসরায়েলে উপাসিত একমাত্র দেবতা ছিলেন না। অন্য দেব-দেবীরা আরও কোমল ছিলেন, ছন্দ ও সমন্বয় প্রতীকায়িত করেছেন তাঁরা এবং ভূমিকে উর্বর করে তুলেছেন। মোতকে হত্যা করে আনাতের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর এমনকি ভয়ঙ্কর বা’ল তাঁর বিজয় স্বর্গ ও পৃথিবীর গভীরতর স্তরে একই গভীর ছন্দ এনে দিয়েছে বলে ঘোষণা করেছিলেন: ‘গাছের কথা আর পাথরের গুঞ্জণ, পৃথিবীর গভীরে, তারামণ্ডলীর গভীরে কথোপকথন করে। ১২৭ ইসরায়েলিদের স্বর্গীয় যোদ্ধাদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বেশির ভাগই পবিত্রতার অন্য ধরনগুলোও চাইত। এটা শেষপর্যন্ত কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনায় ইচ্ছুক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করবে। অ্যাক্সিয়াল যুগ তখনও শুরু হয়নি। এই সমস্ত ঐতিহ্য প্রবল মাত্রার উদ্বেগে বৈশিষ্ট্যায়িত ছিল। পশু ছিনতাইকারীদের সহিংসতায় স্তেপের জীবনযাত্রা বদলে যাওয়ার আগে আর্য ধর্ম শান্তিপূর্ণ ও দয়াময় ছিল। কিন্তু নজীরবিহীন আগ্রাসনের ধাক্কা জরাথুস্টকে একটি মেরুকৃত বিরোধপূর্ণ দর্শন গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল। ইসরায়েল ও ভারতেও নিরাপত্তাহীনতা ও নতুন বৈরী এলাকায় একটি সমাজ পরিচালনার সমস্যাগুলো কাল্টে সহিংসতা ও আগ্রাসী কল্পচিত্র এনে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ অনির্দিষ্ট কালের জন্যে টেনশনের এমনি মাত্রার সঙ্গে বাস করতে পারে না। আচার তাদের মহাগহ্বরের দিকে তাকিয়ে অসম্ভবকে মোকাবিলা করে টিকে থাকা সম্ভব বলে শিখিয়েছিল। নবম শতাব্দীতে আমাদের অ্যাক্সিয়াল জাতিসমূহের চতুর্থটি, গ্রিকরা তাদের অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল; তাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, আচারের নাটকীয়তা কিভাবে প্রাচীন বিশ্বের জনগণকে ঐতিহাসিক বিপর্যয় ও হতাশার বিরুদ্ধে সৃজনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলায় সাহায্য করেছে।