যুবক–যুবতীরা – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
অবিনাশ
আমি লম্বা ভাঙা আরাম কেদারায় এবং পরীক্ষিৎ খাটে শুয়ে ছিল। পাশের ঘরে অনিমেষের স্ত্রী। এক-এক সময় শীতের শুকনো হাওয়ায় জামাকাপড়ের নিচে আমার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। দূরের বাঁধ থেকে মাটিকাটা কামিনদের অল্প ভেসে-আসা গোলমাল, এ ছাড়া কোনও শব্দ ছিল না। শুধু শীতের দুপুরে যখন ধপধপে ফর্সা নির্জন রোদ, তখন যেহেতু কাকের ডাক ছাড়া মানায় না, বড় বড় মিশমিশে দাঁড়কাকগুলো যা মফঃস্বলেই সাধারণত দেখা যায়, তাদের ডাকাডাকি মাঝে মাঝে আমাকে একাগ্র করেছিল। এবং টিনের চালে তাদের কুৎসিত পায়ের শব্দে আমি কখনও কখনও অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলাম।
মনে পড়ে সেই দুপুরবেলায় বসে থাকা। খাটে ঘুমন্ত পরীক্ষিৎ, পাশের ঘরে অনিমেষের স্ত্রী গায়ত্রী, এবং আমার চুপচাপ বসে থাকা। সেই দৃশ্যটার কথা ভাবলেই কেমন যেন ঝন ঝন করা শব্দ শুনতে পাই, জামার মধ্যে হঠাৎ কোনও পোকা ঢুকে যাওয়ার মতো অস্বস্তি বোধ করি। আমি জীবনে কোনও পাপ করিনি। আমার শাস্তি পাবার ভয় নেই। মাথার ওপর সব সময় দণ্ডাজ্ঞার ছায়া রয়েছে এমন মনে হয় না। তবু সেদিনের সেই দুপুরের কথা মনে পড়লে কেমন যেন ভয় করে। জীবনে কারুর ক্ষতি করিনি সজ্ঞানে, চোখ মেলে পৃথিবীকে যে-রকম দেখা যায়, আমার কাছে পৃথিবী ঠিক সেই রকমই, আর কিছু না, না স্বপ্ন, না আয়না। আমি কোনও রকম বাসনাকে বন্দি করতে চাইনি কখনও, মৃত্যুর চেয়ে জঘন্য মানুষের অতৃপ্ত বাসনা, ভেবেছি। জব্বলপুরে আমি কী করেছিলাম, সে কি পাপ? গত বছর শেষ শীতে, সেই জব্বলপুরের দুপুরে?
পরীক্ষিৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। অদ্ভুত ঘুম ওর, যেন জন্মের সময়েই প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ও ঘুমিয়ে কাটিয়ে যাবে। ও যখন জেগে থাকে, তখন ভয়ানক ভাবে জেগে থাকে, যখন ঘুমোয়, প্রবল ভাবে ঘুমোয়। দুপুরে খেয়ে ওঠার পর হঠাৎ আমার মনে পড়েছিল যে সিগারেট নেই। ডুবে গেছি মাইরি, সম্পূর্ণ ভাবে ডুবে গেছি।
পরীক্ষিৎ চেঁচিয়ে উঠেছিল, ভাত খাবার পর এই টক মুখ নিয়ে কী করব? গায়ত্রী বলেছিল, মশলা খান না, আমার কাছে ভাজা মশলা আছে। মশলা আর সিগারেট এক হল? পরীক্ষিৎ ধমকে উঠেছিল, তারপর সেই বিখ্যাত জার্মান উপন্যাসের নায়কের মতো বলেছিল, সিগারেট নেই তো ভাত খেলাম কেন? ভাত খাবার প্রধান কারণই তো এই — তারপর সিগারেট টানতে বেশি ভাল লাগবে। ঘুরঘুরে ইঁদুরের মতো ও তখন বাডির সমস্ত কোণ খুঁজে দেখল– যাবতীয় প্যান্টের পকেট থেকে তরকারির ঝুড়ি পর্যন্ত সিগারেটের দোকান প্রায় মাইল খানেক দূরে, চাকর চলে গেছে তার বাড়িতে, দরকার হলে পরীক্ষিৎ নিজেই ভরা পেটে এক মাইল ছুটত, কিন্তু হঠাৎ বাথরুমে পৌনে এক প্যাকেট পেয়ে গেল এবং পরম উল্লাসে আমাকে একটি এবং নিজে ধরিয়ে শুয়ে পড়ল।
কিন্তু যে-সিগারেটের জন্য ওর এত ব্যস্ততা, সেটা শেষ হবার আগেই এমন ভাবেও ঘুমোল যে, যাতে ওর আঙুল কিংবা বিছানা পুড়ে না যায়, তাই আমি ওর ঘুমন্ত হাত থেকে সিগারেটটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলাম। ঘুমন্ত হাত’ কথাটা ঠিক ব্যবহার করেছি। ও যখন ঘুমোয় তখন ওর সমস্ত শরীর ঘুমোয়। ওর শরীরের প্রত্যেকটি অংশে আলাদা ঘুম আছে। যখন যেমন শোয়, ঠিক সেই রকমই শুয়ে থাকে আগাগোড়া, একটুও নড়ে না। কখনও ঘুমের মধ্যে ওকে জোর করে ডাকলে ও চোখ মেলে তাকায়, শরীরে সামান্যতম স্পন্দনও দেখা যায় না। আস্তে আস্তে ওর মুখ, ঘাড়, গলা, হাতের ঘুম ভাঙে। বিখ্যাত ঘুম পরীক্ষিতের। গায়ত্রী তখনও জেগে ছিল পাশের ঘরে, মাঝে মাঝে ওর শরীরের, কাপড়জামার এবং হার-চুড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। একবার তবু ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গায়ত্রী, ঘুমিয়েছ?
না, সেলাই করছি। আপনি কী করছেন?
কিছুনা, কী করব তাই ভাবছি।
চা খাবেন?
না, একটু পরে, এখন এক গ্লাস জল খাব।
শব্দ করে খাট থেকে নেমে অল্পক্ষণ ও কী জন্য যেন দেরি করল। তারপর জল নিয়ে এল ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে। গেলাসটা বোধহয় ওদের নতুন বিয়েতে পাওয়া, নয়তো এত ঝকঝকে গেলাস কারুর বাড়িতে দেখিনি। এই গেলাস এবং তার মধ্যেকার জলের শীতলতা যেন আমি বুক দিয়ে অনুভব করলাম। তখনই সেই জল থেকে আমার ভয় করল। বললাম, টেবিলের ওপর রাখো।
নিচু হয়ে যখন ইজিচেয়ারের হাতলে গেলাসটা রাখল, আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ব্লাউজের নিচটা শাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে, শোবার সময় সব মেয়েই এ-রকম বের করে দেয়, নিচের বোতাম খোলা, ওর পেটের কাছে একটা ফর্সা ত্রিকোণ আমার চোখে পড়ল। এবং যে-হাত দিয়ে ও গেলাসটা রাখল, সেই হাতের নিচে ভিজে দাগ। শীতকালেও অনেক মেয়ের বগল ঘামে ভিজে থাকে এবং সাধারণত তারা কী-রকমের মেয়ে, আমি জানি।
আপনি ঘুমোবেন না? গায়ত্রী জিজ্ঞেস করে।
না, দুপুরে আমার ঘুম আসে না।
আমারও। ইয়ে কী রকম ঘুমোচ্ছে। খানিকটা হাসল, তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, রুমালে একটা ফুল তুলছি, যাই। যাবার সময় আমি ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকব জেনেও ও বেশ সপ্রতিভ ভাবে চলে গেল।
না, আমার কিছুই ভাল লাগছিল না, আমি দুপুরবেলা ঘুমোতে চাই না, কখনও ঘুমোইনি। অথচ এখন কী করব? বই পড়তে গেলে বমি আসে। গায়ত্রীকে আবার ডাকব কিংবা ওর ঘরে গিয়ে গল্প করব? কেন জানি না, আমার সমস্ত শরীরে যেন শিকল নাড়াচাড়ার মতো ঝন ঝন করে শব্দ হচ্ছিল। আমি উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালাম। এদিকে আর বাড়ি নেই, অনেক দূর পর্যন্ত মাঠ ঢালু হয়ে নেমে গেছে, মাঝে মাঝে সবুজ নীল খেত, বেশ দূরে একটা নৈবেদ্য’র মতো পাহাড়। এসব কিছুই বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখবার নয়, মাঠের ডান দিকের কোণে একটা অতিকায় শিশুগাছ, ওখানে শ্মশান। অনিমেষের অফিস এখান থেকে দেখা যায় না, ও অবশ্য আজ গেছে তেঘড়িয়ায়, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে, সেখানে হাজিরা দিতে। মফঃস্বলের সরকারি চাকরি এই জন্যই জঘন্য। ছুটিতে থাকলেও নিষ্কৃতি নেই, ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা মন্ত্রী এলেই ছুটতে হবে। সকালে বেশ তাস জমে উঠেছিল, এমন সময় আর্দালি এসে ম্যাজিস্ট্রেটের শুভাগমনের কথা জানাতেই অনিমেষের মুখ শুকিয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজিরা দেবার জন্য ওকে ছুটির দিনেও দাড়ি কামাতে ও জুতো পালিশ করতে হল।
আমি চুপ করে বসে ছিলাম। পৃথিবীতে কোথাও কোনও শব্দ নেই। মাটিকাটা কামিনরা এখন বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে। খবরের কাগজটা আমার হাত থেকে খসে যেতেই আমি তাতে একটা লাথি মারলাম। আমার চোখ খর খর করছে, আমার কিছুই করার নেই।
কাল সন্ধেবেলা আমরা যখন বাইরে টেবিল পেতে বসে চা খাচ্ছিলাম, সেসময় দু’জন ভদ্রলোক অনিমেষকে ডাকতে এসেছিল। ওদের দেখে যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়ল অনিমেষ, তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, আপনারাই যান, আমার অসুবিধে আছে, আমরা আর যাব না।
একটুক্ষণ কথাবার্তায় বোঝা গেল, আজ ওদের নেমন্তন্ন ছিল, কোনও কলিগের ছেলের অন্নপ্রাশন, আমরা এসেছি বলে অনিমেষ বিব্রত বোধ করছে। অথচ খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুঝতে পারলাম। আমার মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে, লোকের সঙ্গে ফর্মালি পরিচিত না হলে বা কোনও কিছু জিজ্ঞাসিত না হলে কোনও কথা বলতে পারিনা। পরীক্ষিৎ ও-সব মানে না, চেঁচিয়ে উঠল, যা না, ঘুরে আয়, আমরা ততক্ষণ খানিকটা বেড়িয়ে আসি। একটু ওষুধ খেতে হবে, মাথা ধরে যাচ্ছে।
যাঃ, তোরা একা একা থাকবি!
একাই একশো, পরীক্ষিৎ বলে, ওষুধ কোথায় পাওয়া যায় রে? একটু চোখ নিচু করে ইঙ্গিত করল।
স্টেশনের কাছে, এগিয়ে এসে বলল অনিমেষ, এ-দিকে পাওয়া যায়, দিশি। কথাবার্তার মধ্যে গায়ত্রী উঠে ঘরে চলে গিয়েছিল। অনিমেষও ভেতরে গেল। একটু বাদে গায়ত্রীর তীক্ষ্ণ, অশোভন গলা শুনতে পেলাম, না, আমি যাব না, তুমি একা যাও। লোক দুটি আমাদের সামনে বসে ছিল। আলাপ করার চেষ্টায় মফঃস্বলের লোকদের একমাত্র প্রশ্ন, দাদারা কোথা থেকে, ব্যগ্রভাবে নিক্ষেপ করেছিল।
ফরাক্কাবাদ! বলে পরীক্ষিৎ এমন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে বসল যে, আর ওরা উৎসাহ পায়নি। গায়ত্রীর গলা শুনে ওরা হা-হা করে খানিকটা হেসে উঠল, বউদি ক্ষেপেছে মাইরি, চল দেখি। ওরা দু’জনে উঠে ঘরে গেল এবং খানিকক্ষণ চাষাড়ে রসিকতা, হি হি হে, মাইরি যা মশা পড়েছে এবার, ফাসক্লাস পর্দার রঙটা তো, কবে আপনার বাড়িতে অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খাব বউদি, হ্যা-হা-হা, চলুন দাদা রাত হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদির খানিকটা পর গায়ত্রী এবং অনিমেষ সেজে বেরিয়ে আসে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরব, অনিমেষ বলল; গায়ত্রীর মুখ নিচু করা, দাদাদের ফেলে রেখে গেলাম, হ্যা হ্যা। লোক দুটির এক জন বা সমস্বরে বলে চলে গেল। আমি এতক্ষণ কোনও কথা না বলে চুপ করে ওদের দেখছিলাম। বেশ সবল লোক দুটি, ওদের আমার ভাল লাগাই উচিত, ওই রকম সরল, শুয়োরের মতো নির্ভীক জীবনই তো আমি এত কাল চেয়ে আসছি।
ওরা চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষিৎ বেরিয়ে গিয়ে ঘুরে এল আধ ঘণ্টার মধ্যে। চুপচাপ দু’জনে আধবোতল শেষ করার পর ও প্রথম কথা বলল, কেমন লাগছে রে এদের দু’জনকে?
ভালই। বেশ তো সুখেই আছে অনিমেষ বউকে নিয়ে।
হুঁ, সুখে আছে, পরীক্ষিৎ বিড় বিড় করল। কী করে বুঝলি তুই সুখে আছে?
কেন, দেখাই তো যাচ্ছে, ছোট্ট সুখের সংসার।
সত্যি, অনিমেষটাকে আর চেনাই যায় না। যেন বাঘের গায়ে কেউ সাদা চুনকাম করেছে। বুঝলি, বাঘের গায়ে! হালুম করার বদলে এখন মিউ মিউ করে।
আমি পরীক্ষিতের এই খেলো উপমাটাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, দেখা যাচ্ছে বিয়ে করার পর অনিমেষই বেশ সুখে আছে।
হঠাৎ পরীক্ষিৎ চটে গেল, কেন সুখে থাকবে? কী অধিকার আছে ওর সুখে থাকার?
আমি
বললাম, বাঃ, পৃথিবীসুষ্ঠু লোককে তুই অসুখী থাকতে বলবি নাকি?
আমরা ঘেন্না করে, পরীক্ষিৎ বলল, রাত্তিরবেলা যখন দড়াম করে দরজা বন্ধ করে, কী-রকম তেল-তেল মুখ হয় দেখেছিস? এত যে বন্ধুত্ব ছিল, বিয়ের আগে যে নদীর পাড়ে বসে এত কথা হল, সব হাওয়া? কাল বললাম, চার জনে এক সঙ্গে এক ঘরে শোব, হেসে উড়িয়ে দিল। কী হাসি দু’জনের। আমি কি ভাঁড় নাকি যে, হাসির কথা বলে মজা দেব? মজা তো বউ যথেষ্ট দিচ্ছে। রাত্তিরবেলা বউগুলোর স্বভাব দেখেছিস, যেন ঘুরঘুরে নেউল। বাথরুমে গা ধোয়, মুখে আরাম করে স্নো, বিছানা পেতে (অশ্লীল), কথাবার্তা বলছে অথচ…(ছাপার অযোগ্য)
ও-কথা থাক পরীক্ষিৎ, অন্য কথা বল।
না, এ-সব দেখলে আমার বমি আসে। অনিমেষটা আউট হয়ে গেল। আচ্ছা, এখানে ইলেকট্রিক নেই কেন? টিমটিমে টেমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। আই ওয়ান্ট গ্লোরিয়াস সানসাইন অলসো অ্যাট নাইট। আয়, ওই খড়ের গাদাটায় হ্যারিকেনটা ভেঙে উলটে দিই। খানিকক্ষণ বেশ আলো হবে। বলার সঙ্গে সঙ্গে ও হ্যারিকেনটা তুলে নিল।
তোর কি আধবোতলে নেশা হল, ছিঃ! আমি বললাম।
পরীক্ষিৎ ওর ছোট ছোট করমচার মতো চোখ দুটো সোজা তুলে যেন ছুঁড়ে দিল আমার দিকে, তুই কী বলছিস অবিনাশ, আমার দোষ হল? তোর খারাপ লাগছে না? এত কথা হল, এত প্রতিজ্ঞা, আর এক জন বিয়ে করে বলবে, আমাকে ছেড়ে দাও ভাই।
তুই-ও এক দিন ছেড়ে দিবি।
বিয়ে করে? পরীক্ষিৎ ব্যগ্রভাবে নিক্ষেপ করে।
অথবা ক্লান্ত করে। সকলেই তাই দেয়। বয়স ঊনত্রিশ হল, খেয়াল আছে?
পরীক্ষিৎ নেশার ঝোঁকে আরও মুখ খারাপ করতে থাকে। আমার একটু একটু হাসি পায়, আমি চুপ করে থাকি। পরীক্ষিতের কি বয়স বাড়ে না? এক সময় কী সব ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা, কেউ বিয়ে করব না, সারা দিনে মেয়েদের জন্য আধ ঘণ্টার বেশি ব্যয় করব না, শিল্পের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে- এই সব। এ-সব কেউ বেশি দিন মনে রাখে? এ-সব নিয়ে কেউ পরে সিরিয়াসলি অভিযোগ জানায়? পরীক্ষিৎটা পাগল, অনিমেষ বিয়ে করে সুখে আছে, তাতে দোষেব কী? বেশ তো ভালই আছে। আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, ও-পাশে কি ঝাউবন আছে নাকি রে? অমন শোঁ শোঁ শব্দ কীসেব?
পৃথিবীর ঝাউ কি সুপুরি কি জামরুল, ও-সব আমি চিনি না। সবই পৃথিবী। আর পৃথিবী ঠিকঠাক আছে। গায়ত্রী মেয়েটা কেমন?
ভালই তো, বেশ ছিমছাম। হাসির সময় ঠোঁট অল্প ফাঁক করে, সুতরাং অভিমানী।
কী করে জানলি? মেয়েদের অভিমান কি হাসিতে বোঝা যায়? ও জন্য তো ওদের শরীর জানতে হয়।
এই কথায় আমি একটু কেঁপে উঠেছিলাম। আমার আঁতে ঘা লাগে, পরীক্ষিৎ আমার কথাটাই ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে এই প্রসঙ্গে। গায়ত্রীর সঙ্গে পরীক্ষিৎ বেশ সহজ ভাবেই কথাবার্তা বলে। আমি পারি না।
কোনও রকম শারীরিক বন্ধুত্ব না হলে অথবা করার চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত না হলে আমার সঙ্গে কোনও মেয়ের অন্তরঙ্গতা হয় না। বেশির ভাগ মেয়ের কাছেই আমি এ-জন্য একটু অভদ্র বা লাজুক বলে পরিচিত। পরীক্ষিৎ আমার ব্যাপারটা জানে বলেই খোঁচা দিয়েছে। আমি ওকে চিনি। ওর হাড়ে হাড়ে গণ্ডগোল। ও আমাকে কী বলতে চায় তা আমি অনেকক্ষণ বুঝতে পেরেছি।
.
তারও আগের দিন রাত্রে খাওয়ার পর আমরা তিন জন বসে গল্প করছিলাম, গায়ত্রী আমাঙ্গের সঙ্গে বসেনি, খুটখাট করে সংসারের কাজ সারল, দু ঘরের বিছানা পাতল পরিপাটি করে, তারপর সব কাজ শেষ করেও ও আমাদের সঙ্গে গল্প করতে এল না। নিজের শোবার ঘরে চুপ করে বসে রুমালে ফুল তুলতে লাগল। ওর সেই একা বসে থাকা এক প্রবল প্রতিবাদের মতে, যেন প্রতি মিনিট ও আশা করছে আমরা কতক্ষণ আড্ডা শেষ করব এবং অনিমেষ শুতে যাবে, আমার তাই মনে হয়েছিল। সুতরাং আমি বলেছিলাম, চল এবার উঠে পড়ি, আমার ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম পাচ্ছে? সে কী, তোর? পরীক্ষিৎ চেঁচিয়ে উঠল, মাঝে মাঝে সত্যি অবাক করে দিস তুই। ঘুম পাচ্ছে অবিনাশ মিত্তিরের? রাত এগারোটায়, যে আসলে একটা রাতের ঘুঘু! তোর কি ফর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? বউ কোথায় গেল। পরীক্ষিৎ বিরক্তি মিশিয়ে উঁচু গলায় বলল, যে-গলায় পরীক্ষিৎ গান গায়, রাগ প্রকাশের সময়ও ওর গলা সেইরকম দীর্ঘ সুরেলা থাকে। অনিমেষ, বউকে বল, এক ঘরে বিছানা করতে, চার জনে এক ঘরে শুয়ে সারা রাত গল্প করব!
এ-কথা বলার সময় পরীক্ষিতের গলায় কোনও দ্বিধা ছিল না। বন্ধুত্বের চূড়ান্ত সঙ্ঘে ওর বিশ্বাস, বন্ধুদের সঙ্গে মারাত্মক সব পরীক্ষায় জীবন কাটাতে হবে এবং কখনও কোনও ক্লান্ত মুহূর্তে যার-যার ব্যক্তিগত শিল্প সৃষ্টি। পরীক্ষিৎ একথা জোর করে বলে। শিল্প-শিল্প করে ও গেল, শিল্প ওর মাথার ভূত। অনিমেষ ওর প্রস্তাবে বিষম উৎসাহিত হয়ে গায়ত্রীকে ডেকেছিল। গায়ত্রী এল বারান্দায়। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।
.
পরীক্ষিৎ শেষ গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে বলেছিল, আমি অনিমেষকে বড় ভালবাসি। ও-রকম কবি হয় না। ওকে ডুবিয়ে দিতে চাই। ও-রকম সুখী সেজে থাকলে ওর দ্বারা আর কিছু হবে না জীবনে, আমাকে একটু তোর গ্লাস থেকে ঢেলে দে।
আমি ওকে একটু দিয়ে আমার গ্লাস শেষ করে দিয়েছিলাম।
অনিমেষের সুখের তুই বারোটা বাজিয়ে দে, অবিনাশ। তুই কী করছিস, যাঃ তুই একটা নিরেট –ও একটা মেয়েমানুষ পেয়ে সব ভুলে যাবে? আমি বললাম, সব ভুলে গেছে কোথায়? অনিমেষ তো আগের মতোই আমাদের সঙ্গে মিশে আড্ডা দিচ্ছে।
কোনও কারণ নেই, তবু পরীক্ষিৎ আমার একথা শুনে একটু মুচকি হাসি হাসল। রহস্যময় হাসি। বলল, তুই কি ভাবছিস, আমি বিয়ে করার বিরুদ্ধে কিছু বলেছি? করুক না বিয়ে যার ইচ্ছে। কিন্তু অনিমেষ ওর বউয়ের সঙ্গে যখন কথা বলে তখন দেখলে মনে হয় যেন ও আলাদা একটা জগতে আছে। এই জগৎটা ভেঙে দিতে হবে। একটা মেয়েমানুষ মানেই কি আলাদা জগৎ? কী ভয়ানক মেয়েগুলো, অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে আপত্তি করল কেন? যেহেতু এক বছরেই গোটা দুয়েক ডিম পাড়েনি। তুই ওর বিষ দাঁত ভেঙে দে না। আমি বললাম, আমি কেন ভাঙতে যাব? তাছাড়া, আমার কী-ই বা ক্ষমতা আছে? পরীক্ষিৎ আমার কথা শুনল না, নিজের মনেই বলে চলল, কী হচ্ছে কাল থেকে, খালি খাওয়া আর গল্প, কী সব গল্প, ওমুক লোকটা, ওর মেজ শালি, সে-দিন হাটে পুলিশ এসে…এ-সব কী? মনে আছে গতবার আমরা সকলে মিলে কী নিয়ে যেন মারামারি করেছিলাম? এই দ্যাখ, আমার থুতনিতে একটা কাটা দাগ আছে, তুই ঘুষি মেরেছিলি। সে-সব দিন– ।
আমি বললাম, পরীক্ষিৎ, তুই তোর বিশ্বাস বা ইচ্ছে আমার ঘাড়ে চাপাতে চাস কেন? এটা তোর একটা রোগ। আমার আর অতটা ভাল লাগে না। কোনও মানুষকেই আঘাত করার ইচ্ছে নেই আমার। সকলে সকলের ইচ্ছেমতো বাঁচুক। আমিও সরল, স্বাভাবিক জীবন চাই, অনেক দিন বাঁচতে চাই। অনিমেষের সংসার দেখে আমার সেই দিক দিয়ে লোভ হচ্ছে।
সে কী রে? এ যে দেখছি বাংলা সাহিত্যে যাকে বলে ‘জীবন-প্রেমিক’। যাঃ, আর হাসির কথা বলিসনি। তোর একটা অকারণে হিউমার করার স্বভাব আছে। অনিমেষের মধ্যে একটা গণ্ডগোল ঢুকিয়ে দে। ও ভয় পেয়ে যাক, সন্দেহ করুক নিজেকে। না হলে ও আর কোনও দিন লিখতে পারবে না। ও না লিখলে আমারও আর ইচ্ছে করে না। বাংলা সাহিত্যে আমার আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
কেন, বিমলেন্দু?
ওই মোটা হুঁৎকোটা? ও তো পাবলিকে হাততালি চায়। তাই পাবে। ওর কথা ছাড়।
তাহলে বিশ্বদেব?
মনীষী বিশ্বদেব বল, এরপর তুই বুঝি শেখরের নাম বলবি? তুই আমাকে এত ছোট ভাবিস?
তুই কিন্তু বিমলেন্দুর সামনে মুখ নিচু করে থাকিস। ওকে বলিস গ্রেট। আড়ালে নিন্দে করা তোর স্বভাব। চল, বাইরে ঘুরে আসি। মাথায় ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে ভাল লাগবে। তুই ঘোলাটে জল খেতে বড় ভালোবাসিস, পরিষ্কার জল দেখলে তোর বমি আসে, না রে?
একটু হেসে পরীক্ষিৎ চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল, ওর পা একটু টলে যায়। আমি ওর হাতটা ধরে বাইরে এলাম। আঃ, ভারি সুন্দর চাঁদের আলো দিয়েছে। পরীক্ষিৎ বলল, এই আলো খেলে নেশা হবে?
আগেকার কালের লোকদের হত, যাদের মাথার মধ্যে ভালবাসা ছিল। নেশার ঘোরে উন্মাদ হয়ে যেত শেষ পর্যন্ত। ওই জন্য পাগলের ইংরেজি লুনাটিক। তোর ও-সব কিছু হবে না। তুই বড্ড সেয়ানা।
আমি চুপ করে বসে আছি। সেই দুপুরবেলা। আমার কিছুই করার নেই। পরীক্ষিতের বেশ নাক ডাকে দেখছি। অমন কায়দাবাজ নাক দিয়ে এ কী ভালগার আওয়াজ! এ-কথা মনে করিয়ে দিলে ওর মুখের চেহারা কী-রকম হয় বিকেলবেলা দেখতে হবে। চুপ করে বসে আমি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। ও-ঘরে গায়ত্রী বসে আছে, ওর সঙ্গে অনায়াসে গিয়ে গল্প করা যায়। যায়, যদি স্বাভাবিক ভাবে গিয়ে বসতে পারি। তা পারব না, কৃত্রিমতা একেবারে ঢুকে গেছে। কোনও যুবতী মেয়ের সঙ্গে যে একা ঘরে দুপুরবেলা বসে শুধু গল্প করা যায় এই বিশ্বাসটাই যে নেই। প্রিমিটিভ, একেবারে প্রিমিটিভ। দু-একটা হালকা গল্প-গুজব রসিকতায় কি গায়ত্রীর সঙ্গে এখন সময় কাটানো যায় না? কেন আমি শুধু শুধু একা বিরক্ত হয়ে বসে আছি? কাল আমি পরীক্ষিৎকে বলেছিলাম, গায়ত্রীকে নিয়ে তুই এমন ভাবে ভাবছিস কেন? বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি, স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট চমৎকার সংসার এখানে। আয়, ঠাট্টা-ইয়ার্কি ফষ্টি-নষ্টি করি, লুকিয়ে প্রেম করার চেষ্টাও চলতে পারে। ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ লড়াই হোক-কেউ ব্যর্থ হয়ে দুঃখ পাক, কেউ সফল হয়ে নিরাশ হয়ে পড়ুক, কেউ জ্বলে-পুড়ে মরুক মনে মনে সেইটাই তো স্বাভাবিক। জীবন এই রকম। তার বদলে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে তুই আমাকে বলছিস ওর সঙ্গে সম্পর্ক করতে যাতে অনিমেষ দুঃখ পায়, ওর সুখ ভেঙে যায়, আর তুই থাকবি আড়ালে। আমার ব্যক্তিগত লোভ থাক বা না থাক, অনিমেষকে কষ্ট দেবার জন্য আমি একটি মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ব–এ কী! পরীক্ষিৎ যথারীতি নিজের ভাষায় আমাকে কিছু গালাগালি দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, না, অনিমেষ-গায়ত্রীর সুখের সংসার ভাঙতে আমার একটুও লোভ নেই। ওরা সুখে থাক।
আমি উঠে গিয়ে গায়ত্রীর ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ালাম।
গায়ত্রী বলল, আসুন।
খাটে পা মুড়ে বসে দু’হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ও সেলাই করছিল, আমাকে দেখে একটুও ভঙ্গি বদলাল না। লাল শাড়ির নিচে সাদা শায়ার লেস বেরিয়ে পড়েছে, তার নিচে পদ্মপাতার মতো গায়ত্রীর পায়ের রঙ, সে-দিক থেকে আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। গায়ত্রীর রঙ একটু কালো, গোল ধরনের মুখ। তেমন সুন্দর নয়, ছায়া কিংবা মায়ার পাশে দাঁড়ালে গায়ত্রীকে মেটেই রূপসী বলা যাবে না। কিন্তু জলের মাছের মতো গায়ত্রীর চকচকে স্বাস্থ্য, সেই স্বাস্থ্যের অহঙ্কার ওর চোখে-মুখে। দু-এক ফোঁটা ঘাম জমে গড়িয়ে এসেছে থুতনি বেয়ে। ব্লাউজের একটা বোম খোলা, আমি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। ডিজাইনকরা ব্লাউজের হাতা টাইট হয়ে চেপে বসেছে ওর বাম বাহুতে, আমার মনে হল একটা কুমির যেন ওর হাত কামড়ে ধরেছে। আমি সেদিক থেকেও চোখ ফিরিয়ে নিলাম। জানলা দিয়ে রোদ্র এসে ওর তৃণভূমির মতো ঘাড়ের ওপর দিয়ে গিয়ে পড়েছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়, সেখান থেকে ঠিকরে এসে লাগছে ওর চোখে, অথচ ও সরে বসেনি। ও কি জানত, আমি এক সময় এসে ওর উদ্ভাসিত মুখ দেখব?
আসুন, দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসবেন না?
কারাগারের দরজায় যখন জল্লাদ এসে দাঁড়ায়, তখন তাকে কী-রকম দেখায়? আমার নিজেকে মনে হল সেই জল্লাদের মতো। আমার হাতে মারাত্মক অস্ত্র। আমি নিজেকে বুঝতে পারিনি, আমার শরীর অন্য রকম লাগছিল। যেন কোথায় টঙ ঢঙ করে পাগলা ঘন্টি বাজছিল। আমি তো এ ভেবে এ-ঘরে আসিনি, সরল পদক্ষেপে এসেছিলাম দরজা পর্যন্ত। এখন আমার বলতে ইচ্ছে হল, গায়ত্রী, শেষবারের মতো ঈশ্বরের নাম করে নাও।
দেখুন তো ডিজাইনটা কেমন হচ্ছে? ওর কণ্ঠস্বর ময়ূরের মতো কর্কশ।
আমি কাছে এসে চেয়ারে কিংবা খাটে বসব ভাবছিলাম –গায়ত্রী একটু সরে হাত দিয়ে জায়গা দেখিয়ে বলল, বসুন না।
আমি বললাম, গায়ত্রী, কেমন আছ?
ও এক ঝলক হেসে বলল, হঠাৎ একথা?
সত্যিই হঠাৎ ও-কথা জিজ্ঞেস করার মানে হয় না। পরশু দিন এসেছি, আজ কি আর ও কথা জিজ্ঞেস কবা যায়! কিন্তু মেয়েদের কোনও সময় চোখের দিকে তাকালেই আমার মুখ দিয়ে এই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে। এর কী উত্তর চাই, তা আমি জানি না। হয়ত ওদের ভিতরের কোনও গুপ্ত খবর ওদের মুখ থেকে বিষম ভাবে শুনতে চাই। এর পরেই আমার বলতে ইচ্ছে হয়, কত দিন তোমাকে দেখিনি। কিন্তু এ-কথাও বলা চলে না, কারণ গায়ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপই ছিল না, অনিমেষের বিয়ের সময়ও আমি আসিনি, পা ভেঙে বিছানায় শুয়ে ছিলাম। তবু কত দিন তোমাকে দেখিনি এ কথা বলার ইচ্ছে আমার মধ্যে ছটফট করে।
গায়ত্রীর সঙ্গে মিনিট দশেক কী কী বিষয়ে যেন কথা বললাম। তারপর ও উঠে বলল, দাঁড়ান, চায়ের জল চাপিয়ে আসি। খাট থেকে নামতেই আমি ওর হাত ধরলাম। খাটের পাশে পা ঝুলিয়ে আমি বসে ছিলাম, ওকে হাত ধরে পাশে নিয়ে এলাম। ও বলল, দেখেছেন, আমি কতটা লম্বা, প্রায় আপনার সমান।
আমি ওর বুকে মুখটা গুঁজে দিলাম। গায়ত্রী বলল, এ কী এ কী! কিন্তু সরে গেল না। আমি দুই হাতে ওর কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ওর দুই বুকের মাঝখানের সমতলভূমিতে গরম নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম, একটু একটু করে বুঝতে পারলাম, ওর বুকে তাপ আসছে, ওর শরীর আকন্দ ফুলের আঠার মতো আমার চোখে-মুখে লেগে যাচ্ছে, ও সরে দাঁড়াচ্ছে না। আমি মনে মনে কাতর অনুরোধ করলাম, গায়ত্রী সরে যাও, মনে মনে বলেছিলাম, গায়ত্রী আমাকে একটা থাপ্পড় মারো, ডেকে জাগাও পরীক্ষিৎকে। আমাকে বলো, নরকের কুকুর। গায়ত্রী, প্রতিবেশী দিয়ে আমাকে মার খাওয়াও, আমি তোমার প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব, তোমাকে খুব ভালবাসব, সরে যাও গায়ত্রী।
খাটের ওপর জায়গা হচ্ছিল না বলে আমি লাথি মেরে পাশবালিশটা ফেলে দিলাম মাটিতে। গায়ত্রী সারা শরীর দিয়ে হাসছে। একবার বলল, ও, আপনার মনে এই ছিল। থুতনির একবিঘৎ নিচে কামড়ে গভীর লাল করে দিতে ও নিঃশব্দে আর্তনাদ করল। আমি অশ্লীল ভাবে হেসে বললাম, তোমার শরীরে তো জোর কম নয়। ও বলল, আপনিও বুঝি কবিতা লেখেন?
না, তোমার মুখের ভেতরটা দেখি!
তবে বুঝি গল্প?
দু-একটা। তোমার লাগছে?
না-আ, কী-রকম গল্প, পড়লে বোঝা যায়? নাকি ওদের মতো? মাথা খারাপ!
কী মাথা খারাপ? বোঝা যায় না!
তুমি ওসব পড়তে যাবে কেন? ও-সব পড়ার কী দরকার। মুখটা ফেরাও।
সবাই বলে, অনিমেষ এক জন বড় কবি। আমি পড়ে কিছুই বুঝতে পারি না। আমাকে কপি করতে দেয় মাঝে মাঝে। আমি এক বর্ণ বুঝি না। অবশ্য বলি, খুব চমৎকার হয়েছে, বিশেষ করে শেষের লাইনটা। ও খুশি হয়। গায়ত্রী গোপন আনন্দে হাসল। তারপর বলল, বুঝতে পারি না কেন? লেখার দোষ না আমার মাথার দোষ?
সব তোমার দোষ। তুমি কেন এত সুন্দরী হয়েছ?
আমি আবার সুন্দরী! আমার তো নাক ছোট, চোখের রঙ কটা।
সৌন্দর্য বুঝি নাকে-চোখে থাকে? সৌন্দর্য তো এই জায়গায়। আমি হাত দিয়ে ওর সৌন্দর্য স্থানগুলি দেখিয়ে দিলাম ও চুমু খেলাম। ও বলল, আপনি একটি আস্ত রাক্ষস। আঃ, সত্যি লাগছে, দাগ হয়ে যাবে যে!
আমি বললাম, গায়ত্রী, আমার আর বাঁচার পথ রইল না।
কেন?
এই যে আমি তোমার মধ্যে ডুবে গেলাম। আমি এর আগে কোনও মেয়েকে ছুঁইনি, কিন্তু পরশু দিন থেকেই তোমাকে দেখে– ।
গায়ত্রী পোশাক ঠিক করে উঠে বসল। তাকাল আমার দিকে এক দৃষ্টে। আমার মুখে সম্পূর্ণ সরলতা ছিল, মঞ্চে যে সরলতা দেখা যায়, যা ভয়ংকর বিশ্বাসজনক।
ও, আমারই বুঝি দোষ হল! গায়ত্রীর গলায় একটু ঝাঁঝ।
সব তোমার দোষ, কেন দুপুরে এ-ঘরে একা বসে ছিলে? একথা বলার সময় গোপনে পিছনে হাত দিয়ে ওর ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে দিলাম। ও এঁকে-বেঁকে হেসে উঠে আমার বুকে কিল মারতে লাগল। ওর তীব্র ঘনিষ্ঠতা দেখে হঠাৎ আমার সন্দেহ হল, আমার নাম কি অবিনাশ না অনিমেষ? এক বছর আগে আমিই কি ওকে বিয়ে করেছিলাম?
আমরা দুজনে কিছুক্ষণ পাশাপাশি শুয়ে রইলাম। আমি ওর একটা হাত তুলে ঘামের গন্ধ নিতে লাগলাম। এই গন্ধে বেশ নেশা আসে আমার। পরে ঘুম পায়। এই ঘামের গন্ধই মেয়েদের শরীরের গন্ধ। অনিমেষ তোমাকে খুব ভালবাসে, না?
হ্যাঁ, সত্যিই খুব ভালবাসে। ওর জন্য আমার মায়া হয়। জানেন, আমি খুব সুখী হয়েছি। আমি তো সব পেয়েছি। এমন সুন্দর স্বামী, সংসারের কোনও ঝঞ্জাট নেই, ইচ্ছেমতো দিন কাটাতে পারি। অথচ মাঝে মাঝে তবু আমার বুকের মধ্যে হু-হু করে কেন বলুন তো?
আমি মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বললাম, ও-সব গণ্ডগোলের প্রশ্ন আমাকে কোরো না।
এই সময় হঠাৎ আমার তাপসের কথা মনে পড়ে। তাপসের স্বভাবই হল পরে আসা। পরীক্ষিৎ নয়, তাপসই আমার সব চেয়ে সর্বনাশ করেছে। আমার কানের কাছে মন্ত্র দিয়েছে, স্ত্রীলোক মাত্রই সুলভ, ওরা ভালবাসা চায় না, ওরা গোপনতা চায়। ওদের জন্য ভালবাসা খরচ করার দরকার নেই। ওরা চায় গোপনে অত্যাচারিত হতে। আমার মনে পড়ল, গায়ত্রীকে একবারও আমি বলিনি, ভালবাসি, এমনকী অভিনয় করেও না, গায়ত্রীও শুনতে চাইল না। আমি প্রথম ওর ব্লাউজ খুলে স্তনের কুঁড়িতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলেছিলাম, কী সুন্দর তোমার বুক! তাতেও ও খুশি-চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু আমি তো বলিনি, কী সুন্দর তুমি! আমি ওর সম্পূর্ণ বসন সরিয়ে বলেছিলাম, কী সুন্দর তোমার ঊরু। বলিনি, কী সুন্দর তুমি। সে-কথাও শুনতে ও চায়নি। অর্থাৎ ভালবাসা কথাটা শুনতে চায়নি। মাত্র তিন দিনের চেনা এর মধ্যে আবার ভালোবাসা! ধ্যুৎ!
কী দুঃসাহস গায়ত্রীর, ও-ঘরে পরীক্ষিৎ শুয়ে, মাঝখানের দরজাটা ভেজানো, এমনকী বন্ধ না পর্যন্ত। প্রথম যখন ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম, তখনও ও রেগে উঠলে, অনায়াসে আমি ঠাট্টা বলে চালিয়ে দিতে পারতুম। বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে এ-সব ঠাট্টা কি আর চলে না! কিন্তু ওর সমস্ত সত্তা যেন একটা বিশাল তালাভাঙা দরজার মতো ছিল, একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আসলে এর মধ্যে আমার কোনও লোভ, কোনও পরীক্ষা করার ইচ্ছে, অনিমেষকে যন্ত্রণা দেবার চেষ্টা, কিছুই ছিল না। শুধু দুপুরবেলার ঘুমহীনতা, শুধু এইটুকুই, এই জন্যই এসেছিলাম এ-ঘরে। কিছুদিন ধরে সব সময়ে আমি ছটফট করছি, কোনও রকম ভোগে আসক্তি নেই, মেয়েদের দেখলে তেমন একটা ইচ্ছে সত্যই জাগত না, গায়ত্রীও তেমন কিছু রূপসী নয়। হঠাৎ আনমনে চলে এসেছি এ-ঘরে, কথা বলতে বলতে প্রায় অজান্তেই ধরেছি ওর হাত, স্বাভাবিক ভাবেই একটা হাত চলে গেছে ওর কোমরে, এবং তারপর বুকে মুখ না গোঁজার কোনওই মানে হয় না। আর বুকে মুখ গোঁজার পর কে না চায় পাশে টেনে শোয়াতে! অথচ যেন কী বিরাট কাণ্ড ঘটে গেল, লোকে শুনলে তাই ভাববে। এরই জন্য খুনোখুনি হয়, আত্মহত্যা। না, শুধু এইটুকুই না বোধহয়, যারা খুনোখুনি বা আত্মহত্যা করে তারা মাত্র এর জন্যই করে না, আর একটা কিছু জড়িত থাকে ভালবাসা। সে-সম্পর্কে আমার তো কোনওই দাবি নেই, বোধ নেই, বোধ নেই বলা ঠিক হল না, আগে ছিল, আজ আর মনে পড়ে না। অনিমেষ, তোমার ভালবাসায় আমি কোনও ভাগ বসাইনি, তোমার স্ত্রীর ওপর কোনও লোভ করিনি, সম্পূর্ণ নির্লোভ আমার এই আজকের দুপুরের একটা ডুব, কোথাও কোনও মলিনতা নেই, একনদীতে কেউ দু’বার ডুব দেয় না। কী ক্ষতি হয় এতে?
হঠাৎ বিষম ভয় পেয়ে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে মারাত্মক অজগরের মতো একটা নীল রঙের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ক্রমশ স্ফীত হতে হতে এগিয়ে আসছে। ধোঁয়ার রেখাটা এসে আমাকে ছুঁয়ে কেটে গেল। এর মানে পরীক্ষিৎ জেগে আছে, আর শেষ পর্যন্ত আমি পরীক্ষিতের প্যাঁচে পড়লাম। ও যখন আমাকে আর অনিমেষকে নিয়ে ভয়ঙ্কর খেলা খেলবে, আমাকে সুস্থ হতে দেবে না, আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে দেবে না। ওর এই নেশা আমি জানি। তাড়াতাড়ি আমি গায়ত্রীর মুখ এ-দিকে ফিরিয়ে দিলাম যাতে নীল ধোঁয়া ও দেখতে না পায়।
এখন চা খাবেন? ফিসফিস করে গায়ত্রী জিজ্ঞেস করল। চলুন না, আমি রান্নাঘরে গিয়ে তৈরি করব, আপনি পাশে বসবেন।
অনিমেষ বুঝি রোজ বসে?
না, ও তখন কবিতা লেখে। এই বলে গায়ত্রী নিয়ন আলোর মতো কুৎসিত ঢঙে হাসল। তারপর বলল, কলকাতায় আপনাদের বাড়ি যাব।
আমি তো মেসে থাকি, সেখানে মেয়েরা থাকতে পারে না।
তবে কোথায় থাকব? যাবনা কলকাতায়? আর দেখা হবে না?
বিমলেন্দুদের বাড়িতে থাকবে। ওদের বাড়িতে অনেক জায়গা আছে। বিমলেন্দু ছেলেও খুবই ভাল।
আমি তো চিনি। বিয়ের সময় এসেছিল। বড্ড গম্ভীর।
ওর চোখে-মুখে আমি লোভ দেখতে পাচ্ছি। আহা, অনিমেষের জন্য সত্যিই আমার দুঃখ হল। এই সব মেয়ে স্ত্রী কাঁকড়াবিছের মতো, তাদের স্বামীদের সম্পূর্ণ গ্রাস করে। আমার বুকের মধ্যে তবু হু হু করে কেন বলুন তো? গায়ত্রী একটু আগে আমাকে যে জিজ্ঞেস করেছিল, তার উত্তর আমি জানি। পরীক্ষিৎ কিংবা শেখর হলে অনেক বড় বড় কথা বলত, নিঃসঙ্গতা, উদাসীনতা এই সব। আসলে মেয়েটা একটু বেশি চায়। অল্পে খুশি হতে চায় না। অনিমেষের মতো সূক্ষ্ম ধরনের ছেলেকে বিয়ে করে ওর আশ মিটছে না, চায় একটা ধারাবাহিক নির্লজ্জ অনুষ্ঠান। অনিমেষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশি দিনের নয়, ও যে ঠিক কী-রকম ছেলে আমি জানি না। বিমলেন্দু আর তাপসের বন্ধু হিসেবেই পরিচয় হয়েছিল। তবে ওকে বড় ভাল লাগে আমার, যেন সব সময় তারের ওপর দিয়ে হাঁটছে, এমন নিখুঁত। অনিমেষের কোনও ক্ষতি করতে চাই না আমি, আমি সত্যিই অনিমেষকে কোনও দুঃখ দিতে চাইনি। এতে কী আসে যায় অনিমেষের? এ তো হঠাৎ একটা দুপুরের দুর্ঘটনা। দুপুরবেলা কোনও কাজ ছিল না, ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল। যাই হোক, অনিমেষ, আমি মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, হল তো?
আমার তো কিছুরই অভাব নেই, তবু মাঝে মাঝে বিষম মনখারাপ লাগে কেন বলুন তো?
তোমার মন বলে যে কিছু আছে এই প্রথম জানলাম। কথাটা বলেই বুঝলাম, খুবই বেফাঁস হয়ে গেছে, তবুও গায়ত্রীর ওপর আমার বিষম ঘৃণা এসে গেল। আমি আদর করার ভঙ্গিতে ওকে কামড়ে দিলাম। গায়ত্রী আমার কথায় ধড়মড় করে উঠে বসেছিল, কিন্তু আমার মুখে সেই মঞ্চাভিনেতার সরল হাসি দেখে তৎক্ষণাৎ ভুলে গিয়ে নিজেও হাসল। আমাকে বুঝি খুব খারাপ ভাবছেন?
তোমাকে খারাপ ভাবতাম যদি না আজ দুপুরে তোমার কাছে আসতাম। তোমাকে মনে হত নিছক মফঃস্বলের বউ। তুমি একটি রত্ন। তুমি বিয়ের আগে ক’টা প্রেম করেছ?
যাঃ! ও হাসল আবার। আমি মানুষ হয়েছি কাশীতে, ওখানে মেয়েই বেশি, ছেলে কোথায়?
তবু?
সে কিছু না। বলার মতো কিছুনা।
আমি চোখ বুজলাম। একটু একটু ঘুম পাচ্ছে যেন।
খানিকটা পর চায়ের কাপ নিয়ে এসে আমার থুতনিতে একটা টোকা মেরে বলল, উঠুন, এবার পাশের ঘরে গিয়ে বসুন, লজ্জা নেই আপনার? বন্ধু দেখলে কী ভাববে এ-ঘরে এসে খাটে ঘুমোচ্ছেন?
পরীক্ষিৎ? আমি বললাম, কে ওকে গ্রাহ্য করে, ও আবার মানুষ নাকি?
এরই মধ্যে গায়ত্রী কখন স্নান করে নিয়েছে এবং আবার শুদ্ধ পবিত্র লাগছে ওকে। আমার মধ্যে আবার আলোড়ন হল, রূপ দেখেই তাকে নষ্ট করার পুরনো ইচ্ছে জেগে উঠল, হাতও বাড়িয়ে ছিলাম কিন্তু হাওয়া থেকে ফিরিয়ে আনলাম হাত তুড়ি মারার ভঙ্গিতে। ধীরে-সুস্থে উঠে পাশের ঘরের ইজিচেয়ারে বসলাম। গায়ত্রী বোধহয় আশা করেছিল আমি যাবার সময় ওকে একবার চুমু খাব।
গায়ত্রী পরীক্ষিৎকে ডাকতে লাগল। পরীক্ষিৎ ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। বিষম ডাকাডাকিতে ওঠে না। আমি ওকে একটা লাথি মারতেই আস্তে আস্তে চোখ তুলল, তারপর ঠোঁট ফাঁক করল, তারপর জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে?
চা। নিন, উঠে মুখ ধুয়ে নিন। গায়ত্রী খুব মিষ্টি করে বলল ওকে।
.
অনিমেষ এল সন্ধের পর। খুব লজ্জিত মুখ। গলার টাই খুলতে খুলতে বলল, ইস, তোদের খুব কষ্ট দিয়েছি। এমন চাকরি, ছুটি নিলেও নিষ্কৃতি নেই! কী করলি সারা দুপুর? পরীক্ষিৎ বিরক্ত মুখে বলল, সারা দুপুর আমি পড়ে পড়ে ঘুমোলাম শুধু। বিশ্রী ঘুম। অবিনাশ বোধহয় লিখছিল নাকি?
না, আমি লিখি-টিখিনি।
আসবার সময় একটা জিনিস দেখে মনটা বড় ভাল লাগছে। অনিমেষ বলল অন্য মনস্ক গলায়, শ্মশানের পাশ দিয়ে আসবার সময় দেখি শ্মশান ধুচ্ছে। সব চিতা নেভানো, পরিষ্কার, কোনও লোকজন নেই। ডোমগুলো একটা সদ্য শেষ হওয়া চিতা জল ঢেলে ঢেলে ধুচ্ছে। আমি খানিকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। মনে হল, পৃথিবী থেকে সব চিতা ওরা ধুয়ে ফেলছে। কোথাও আর কোনও মৃত্যু নেই।
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, অনিমেষের মন এখন কবিত্বে ডুবে আছে। আমাদের দুপুর কাটানো নিয়ে ও আর বিশেষ মাথা ঘামাবে না।
বাইরে বসে চা খেতে খেতে খানিকক্ষণ আড়ার পর পরীক্ষিৎ হঠাৎ অনিমেষকে একটু আড়ালে ডেকে বলল, শোন— ।
আমি সাধারণত কেউ আড়ালে গিয়ে কথা বললে সেখানে যাই না, কান পাতি না, কিন্তু এখন আমি কিছুতে অনিমেষ আর পরীক্ষিৎকে এক সঙ্গে থাকতে দিতে চাই না। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে নিবীহ মুখে বললাম, কী বলছিস রে?
রাত্তিরের দিকে একটু খেলে হত না? পরীক্ষিৎ জিজ্ঞেস করল।
কিন্তু গায়ত্রীর সামনে, অনিমেষ বিব্রত মুখে বলল, কোনও দিন তো খাইনি। তুই যদি বলিস–
কোনও দিন খাসনি, আজ থেকে শুরু কর! পরীক্ষিৎ ওকে খোঁচা মারে। আমি বুঝতে পারলাম অনিমেষ সত্যিই চায় না। বললাম, তার চেয়ে বেরিয়ে গিয়ে মাঠে বসে।
নদীর ধারে চমৎকার ঘাট বাঁধানো। দূরে মার্বেল পাহাড় দেখা যায়। বাকি অন্ধকার। একেবারে শেষ সিঁড়িতে এক জন সাধু বসে আছে অনেকক্ষণ। দূরে শ্মশান। অনিমেষের ধারণা সত্যি নয়। তিনটে চিতা এক সঙ্গে জ্বলছে হু-হু করে। শীতকালের এই শেষ দিকটাতেই বেশি লোক মরে, পুরনো রোগীরা টেকে না। তিন জনে চুপচাপ বসে, ওয়াটার বটলের গ্লাসে জল মিশিয়ে খাচ্ছি। পরীক্ষিৎ অস্বাভাবিক চুপ। সাধারণত ও একটু নেশা হলেই বিষম বক বক করে। আজ এমন চুপ কেন? ওর যে-কোনও ব্যবহারই আমার কাছে সন্দেহজনক লাগছে। অনিমেষ বলল, কাল সন্ধ্যাবেলা রূপগিরি ঝরনায় বেড়াতে যাব, ভারি সুন্দর জায়গাটা।
এই সময় অন্ধকারে সাইকেল রিকশার আওয়াজ হল। আমরা সচকিত হয়ে দেখলাম তাপস। আরে বাবা, বহু দিন বাঁচবি তুই, পরীক্ষিৎ চেঁচিয়ে বলল, সোজা এখানে এলি কী করে, গন্ধ শুঁকে?
না, বাড়িতে গিয়ে শুনলাম তোরা নদীর পাড়ে এসেছিস। বাড়িতে বসতে পারতাম, কিন্তু গায়ত্রী রান্নায় ব্যস্ত, মাংস চাপিয়েছে, তাই সোজা চলে এলাম।
আমরা তিন জনে তিনটি বাতিস্তম্ভের মতো স্তব্ধ হয়েও মুখোমুখি বসে ছিলাম এতক্ষণ, তাপস এসেই প্রথমে একচুমুকে বোতলের বাকিটুকু শেষ করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা পুরো বোতল বার করল। তারপর বলল, খবরের কাগজ পড়িস? এখানে বাংলা কাগজ আসে?
না! কেন রে? আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম।
সুধীন দত্ত মারা গেছেন।
সে কী? এই সেদিনও তো দেখে এলাম সবিতাব্ৰতর বাড়িতে। রীতিমতো শক্ত চেহারা। কী হয়েছিল?
ঠিক জানি না বিমলেন্দু, শেখর, অম্লান, ছায়া ওরা গিয়েছিল ওঁর বাড়িতে। ওরা শ্মশানে যাবার সময় খাটে কাঁধও দিয়েছিল। আমি যাইনি। মৃত্যুর পর মানিকবাবুকে দেখে এমন অসম্ভব ভয় পেয়েছিলাম যে, আর কারুর মৃত্যুতে যাই না। শুনলাম, হার্ট ফেলিওর। রাত্তিরবেলা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছেন, মাঝরাত্তিরে উঠে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে একবার কাশি, সঙ্গে সঙ্গে শেষ।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইলাম। খুবই আশ্চর্যের কথা, চুপ করে থাকার সময় আমার মন সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে ভুলে বার বার চলে যাচ্ছিল গায়ত্রীর সঙ্গে দুপুরের দিকে সেখান থেকে আমার সুটকেসের চাবিহারিয়ে যাওয়ায়, তারপর পকেটের দেশলাইয়ে, হঠাৎ জলের শব্দে, শ্মশানের আগুনে, তারপর আবার সুধীন্দ্রনাথ দত্তেফিরে এসে খুব আন্তরিকভাবে তার জন্য দুঃখ বোধ করলাম। সবিতাব্রতর বাড়িতে তিনি আমাকে কী কী যেন বলেছিলেন, আমার মনে পড়ল না। আহা, ভারি সুন্দর দেখতে ছিল তাকে, মার গেলেন! যাকগে কী আর হবে। ওয়াটার বটলে একটুও জল নেই। এখন কোথায় জল পাব?
একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছিস, সুধীন দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশ, এদের কারুরই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। অনিমেষ বলল, অসুখে ভুগে ভুগে মরলে এদের যেন মানাত না।
আয়, সুধীনবাবুর নাম করে আমরা বাকি বোতলটা খাই। পরীক্ষিৎ বলল। শেষের দিকে আমাদের চার জনেরই বেশ নেশা লেগে গেল। আমি কতবার মনে করার চেষ্টা করলাম, স্যুটকেসের চাবিটা আমি কলকাতাতেই ফেলে এসেছি, না এখানে এসেহারাল? কিছুতেই মনে পড়ে না।
পরীক্ষিৎ ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচে। সাধুবাবার সঙ্গে কী নিয়ে কিছুক্ষণ বচসা করে ফিরে এসে বলল, না, নেই!
কী?
গাঁজা।
তাপস বলল, রাত্তিরটা কী করবি?
ঘুমোব, আমি বললাম।
ইয়ার্কি আর কী! এত দূরে এলাম ঘুমোবার জন্য? অনিমেষ ওর বউকে নিয়ে এক ঘরে ঘুমোবে, আর আমরা তিন-তিনটে মদ্দা এক ঘরে? ধৎ, এর কোনও মানে হয়?
অনিমেষ তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা, গায়ত্রী পাশের ঘরে একা থাক, আর আমরা চার জনে এক সঙ্গে সোব।
কেন বাবা। তাপস ধমকে উঠল, আমি না হয় তোমার বউয়ের সঙ্গে আজ শুই, আর তুমি ওদের সঙ্গে শোও। একটা রাত্তিরে কিছু হবে না। আমি বিয়ে করলে তুমি এক দিন শুয়ে নিও। শোধ হয়ে যাবে।
তাই নাকি! হা-হাকরে পরীক্ষিৎ অট্টহাসিকরে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে হাসল, হাসি থামতেই চায় না। চমৎকার বলেছিস, ওফ। আবার হাসি। শেষে একটা থাপ্পড় মেরে ওকে থামাতে হল।
অনিমেষ মুচকি হেসে বলল, এ-সব কি আর এত সহজে হয়! অন্য জনেরও তো একটা মতামত আছে।
তাপস বলল, ঠিক আছে, আমি ওর মত যাচাই করে দেখছি। তোর কোনও আপত্তি নেই তো?
এ-সব আলোচনা যত হয়, ততই আমার ভাল। ব্যাপারটা হালকা দিকে থাকে। আমার ঘটনা পরীক্ষিৎ বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এরা তিন জনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু! কত স্বপ্ন, পরিকল্পনা করেছি এক সঙ্গে। কিন্তু আজ আমার কেমন খাপছাড়া লাগছে। মনে হচ্ছে আমি ওদের দলের বাইরে, আমার সঙ্গে আর মিলছে না। এই খেপে ওঠানো সময়, সব রকম নিয়মহীনতা। এখনও তো পৃথিবীতে আছে কত মানুষ, আত্মবিস্মৃত, হেমন্তের অবিরল পাতার মতো। ঘুমোত যায় ও জেগে ওঠে, দশটায় অফিস যাবে বলে সারা সকালটাই যায় সেই প্রস্তুতিতে, এবং সত্যি সত্যিই অফিস যায় রোজ। তারা সিনেমা দেখে আনন্দ পায়, বউকে নিয়ে রিকশায় চাপতে পারে, তাস খেলায় দু’বাজি জিতে স্বর্গসুখ পায়। আমিও তাদের মতোই বাঁচতে চাই, দু-চারটে গল্প কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যকে উদ্ধার করার ভার আমাকে কে দিয়েছে? কী এমন বিষম দরকারি এই বন্ধুসঙ্গ, এই অসামাজিকতা, এই বিবেকহীন, বাসনাহীন, রমণীসম্ভোগ! না, আমি এ-সব আর চাই না। এখান থেকে কলকাতা গিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ব, বহু দিনের ঘুম, সারাটা জীবন ঘুমন্ত মানুষের মতো ঘুরব-ফিরবঅজ্ঞানে। আমার শিরা-উপশিরায় সমস্ত রক্ত ভীত এবং ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ-সব বখাটে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আমি মোটেই মিশতে চাই না আর।
কিন্তু তার আগে যদি এবারের মতো বেঁচে যাই, পরীক্ষিৎকে সামলাতে পারি, যদি দ্বিধাহীন রেখে যেতে পারি অনিমেষের মন। হঠাৎ কেন আজ দুপুরবেলা! খুব অন্যায় কি? আমি কিন্তু সত্যিই অনিমেষকে কোনও কষ্ট দিতে চাই না।
পরীক্ষিৎ হাই তুলে বলল, অসম্ভব ঘুমিয়েছি দুপুরে। এখনও ঘুম গায়ে লেগে আছে। তুই কী করলি রে?
অদ্ভুত ক্ষমতা আছে পরীক্ষিতের। যে যেটা চিন্তা করে গোপনে, ও ঠিক সেই প্রসঙ্গে কথা বলবে। অন্তত আমার সঙ্গে তো অসম্ভব মেলে। বললাম, দূরের বাঁধের কাছটায় গিয়েছিলাম আদিবাসীদের দেখতে। কিন্তু আজকাল আর আদিবাসী-মেয়েরা তেমন সুন্দরী নেই। পাঁচ-ছ’বছর আগেও ছত্তিশগঢ়ি মেয়েদের যা দেখেছি! এখন ব্লাউজ-শায়া পরে, কাচের চুড়ি পরে না, স্নান করার সময়ও সব কিছু খোলে না।
অনিমেষ বলল, আপনি বুঝি ভেবেছিলেন সব কিছু রেডি থাকবে খুটে-টুলে, আর আপনি গিয়ে চোখ ভরে দেখে আসবেন। আদিবাসীরাও সভ্য আর সজাগ হয়ে যাচ্ছে।
আমি অন্য মনস্ক গলায় বললাম, হয়তো আগেই ওরা বরং সভ্য ছিল, এখন আমাদের মতো অসভ্য হচ্ছে। বলেই মনে হল, একথাটা বেশ বোকাবোকা হয়ে গেল, কারণ অনিমেষের কথায় বোধহয় ঠাট্টার সুর ছিল। কিন্তু আমার দুপুর-কাটানোর প্রসঙ্গের চেয়ে ছত্তিশগঢ়ি মেয়েদের নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা ভাল। তাছাড়া, আমি আরও বললাম, সাঁওতালরা…আমার মনে হয় না, তাঁ, আমি..কী কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে আদিবাসী প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা হয়েছিল। কিন্তু মোক্ষম কথা বলল পরীক্ষিৎ, অবিনাশটা মেয়েছেলে ছাড়া কিছু জানে না। এই তিন দিন তুই কাটাচ্ছিস কী করে? নাকি চালাচ্ছিস কিছু গোপনে?
আমার চোখ দুটো হঠাৎ ঝিমিয়ে এল। ইচ্ছে হল ওকে খুন করি সেই মুহূর্তে। একবার ওর দিকে তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত উদাসীন হেসে আমি অনিমেষের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, আপনি আজকাল কী লিখছেন?
অনিমেষ বলল, না, কবিতার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বোধহয়। কলম হাতে নিয়ে বসি, সব ঠিকঠাক আছে কিন্তু ভাষা নেই।
আমার বড় খিদে পেয়েছে, তোদের পায়নি? তাপস জিজ্ঞেস করে। গায়ত্রীকে দেখে এলাম মাংস চাপিয়েছে। চল যাই।
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল। পরীক্ষিতের পা টলছে। তাপস আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, মুখটা গম্ভীর করলে তোকে একদম মানায় না, অবিনাশ।
.
চার জনে আমরা এক ঘরে শুয়েছি। পাশের ঘরে গায়ত্রী। আজ খাবার পর সকলে এক সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম, গায়ত্রীও। তাপস খুব জমিয়ে দিয়েছিল। তাপস এসে পড়ায় খুব ভাল হয়েছে, পরীক্ষিতের পাগলামি আমাকে সহ্য করতে হচ্ছে না। তারপর বেশ রাত হলে অনিমেষ গায়ত্রীকে বলল, আজ এ-ঘরেই থাকি। তোমার একা থাকতে ভয় করবে?
না, ভয় কেন! না না। গায়ত্রী মিষ্টি হেসে বলল।
ভয় করলে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারি। তাপস সরল মুখে জানাল।
তাহলেই আমার বেশি ভয় করবে। সমস্বরে হাসি। গায়ত্রীর চোখের দিকে তাকাইনি।
গায়ত্রী ও ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে দেবার পর আমরা চার জনে খানিকক্ষণ তাস খেলোম। আমার ভাল লাগছিল না। একবার খুব ভাল হাত পেতেই আমি তাসগুলো ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, নাঃ, এবার তোল।
প্রত্যেকেরই অল্প নেশা ছিল তখনও, সুতরাং শুয়ে শুয়ে গল্প করার নাম করে আলো নিভিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হল না।
মাঝ রাতে বুকের ওপর প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে জেগে উঠলাম। অসম্ভব লেগেছিল, স্পষ্ট আর্তনাদ করেআমি উঠেবসলাম। আমার পাশে তাপস, তারপরঅনিমেষ, তারপর পরীক্ষিৎ। আমার চোখে তখনও ঘুমঘোর কিন্তু বুকে যন্ত্রণা। মনে হচ্ছে এরা তিন জনেই বহুক্ষণ ঘুমন্ত। ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতেই পরীক্ষিতের সুরেলা গলা শুনতে পেলাম, অবিনাশ কোথায় গিয়েছিলি রে?
প্রথমটায় বুঝতে পারিনি ওর মতলব। বললাম, কোথাও যাইনি তো, হঠাৎ..।
এই যে দেখলাম, তুই বাইরে থেকে এলি, মিটিমিটি হাসল পরীক্ষিৎ, আলো নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সাপখোপ আছে।
এবার বুঝলাম, ও কী চায়। ও সাজাতে চায়, আমি চুপি চুপি গিয়েছিলাম। অর্থাৎ গায়ত্রীর ঘরে হয়তো। পরীক্ষিতের খাড়া নাকটার দিকে একবার তাকালাম। তারপর পাজামার দড়িটা ভাল করে বেঁধে ওর দিকে এগুতে যাবার আগেই অনিমেষ বলল, না, না, আমি দেখেছি পরীক্ষিৎ আপনাকে ঘুষি মেরে জাগিয়েছে।
রাগ ভুলে সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরনো হুল্লোড়ের ভাবটা এসে গেল। সে কী মশাই, আপনি জেগে আছেন? কেন? ওঃ হো– বলে এমন জোরে হেসে উঠলাম যে তাপসও ঘুম ভেঙে তাকাল। আমার মধ্যে একটা অসভ্য, বিকৃত, মজার ইচ্ছে আগেকার দিনগুলোর মতো হঠাৎ ছটফট করে উঠল। উঠুন, উঠুন, অনিমেষকে হাত ধরে টেনে তুললাম, তারপর গায়ত্রীর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম বেশ শব্দ করে। এক শরীর ঘুম নিয়ে গায়ত্রী উঠে আসতেই আমি অনিমেষকে হিড়হিড় করে টেনে আনলাম। অমন ডেলিকেট ধরনের ছেলে অনিমেষ, আমার এ-রকম বর্বরতায় খুব বিব্রত বোধ করছিল, কিন্তু ওর চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি, ওকে উঁচু করে তুলে গায়ত্রীর ঘরে ঠেলে দিয়ে বললাম, এই নাও তোমার জিনিস। তারপর দরজা টেনে দিলাম।
আমার ব্যবহারটা বোধহয় জমল না, বোধহয় খানিকটা অতি-নাটকীয় হয়েছিল, তাই পরীক্ষিৎবা তাপস যোগ দেয়নি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শোনার পর তাপস জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার রে?
কিছু না, ঘুমের ঘোরে ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তাই বেচারাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। পরীক্ষিৎ বলল, শোন অবিনাশ…। আমি বললাম, আজ নয়, আজ আমার ঘুম পেয়েছে, কোনও কথা শুনবনা।
সেদিন রাত্রে আমি একটা ছোট স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নটা হয়তো ছোট নয়, কিংবা অনেকগুলো স্বপ্ন। কিন্তু আমার অল্প একটু মনে আছে।
স্বপ্নটা এই রকম :
প্রশ্ন: তোমার জিভটার বদলে কী দেবে?
আমি: আর যাই হোক, দু’চোখের মণি নয়।
প্রশ্ন: তবে?
আমি: আমার একটা পা –।
তা কি সমান হল? জিভের সমান একটা পা?
তবে, আমার হাতের আঙুলগুলো নিন, ডান হাতের আঙুল, যে-হাত দিয়ে আমি লিখি।
না, জিভ থাকলে তুমি অন্য লোক দিয়েও লেখাতে পারবে।
তবে কী দেব? বুকের একটা পাঁজরা নিন।
না, জিভের বদলে আর কিছু হয় না। আমি তোমার জিভটাই চাই।
কেন? কেন?
তুমি এক ধরনের সুখ চাও, তাই-ই পাবে। সে-সুখের জন্য মানুষের জিভটা অবান্তর।
না না।
কেন, পৃথিবীতে বোবা মানুষেরা যৌনসুখ পায় না?
কী জানি। পায় হয়তো। অন্তত পাওয়া উচিত। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, পাবনা। আমাকে দয়া করুন!
কাজ সেরে যখন চলে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, আপনি কোন দেবতা তা তো জানা হল না! কিন্তু তখন আমার জিভ নেই। সুতরাং আমার কথা বোঝা গেল না, দেবতাটি অস্পষ্ট ঘড় ঘড় শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। আমি দরজার পাশে পরীক্ষিৎকে পুরো ব্যাপারটার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম।
পরদিন সকালে আমার ঘুম একটু দেরিতে ভেঙেছিল। স্বপ্নের কথাটা সকালে মনে পড়েনি। মনে পড়ল অনেক দিন পর, আজ লেখার সময়। আমি মুখ ধুতে বাথরুমে পেস্ট আনতে গেছি, গায়ত্রী বেসিনে কাপ-ডিশ ধুচ্ছিল, আমাকে দেখে চাপা গলায় বলল, আপনি একটি অসভ্য ও ইতর। কাল রাত্তিরে কী করলেন?
উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসার পর মনে পড়ল জিভ-ছোলাটা আনা হয়নি, মুখ ধোবার সময় ওইটা চাই-ই, নইলে বড় নোংরা লাগে। আমি আবার বাথরুমে ঢুকতেই গায়ত্রী সামান্য একটুও কি–ছি ছি। আমি বললাম, খুব কি খারাপ করেছি? অনিমেষের জন্য আমার মায়া হচ্ছিল।
লজ্জা করে না আপনার?
আমি ওর নিচু থাকা ঘাড়ে আলতো দাঁত বসিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ও বনবিড়ালির মতো ঘুরে দাঁড়াতেই আমি বেরিয়ে গেলাম।
.
আমলকি গাছের ছায়ায় বসে রোদ পোয়াচ্ছে পরীক্ষিৎ, তাপস খবরের কাগজের একটা শিটের উপর শুয়ে আর একটা শিট সম্পূর্ণ খুলে ধরে পড়ছে। অনিমেষ নেই। বেশ ঝকঝকে সকালটি, এক ছিটে মেঘ নেই আকাশে, ফটফট করছে নীল রঙ। তাপস চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, ওর চোখের মণি দুটোও খানিকটা নীলচে। ঘড় ঘড় করে একটা তিন চাকার কিম্ভুতকিমাকার গাড়ি চালিয়ে একটা লোক এসে উপস্থিত হল। আওয়াজটায় বিরক্ত হয়েছিলাম। আমি চোখ গরম করে জিজ্ঞেস করলাম, কী চাই? লোকটার বেশ তেল-চকচকে গোল মুখখানি, কিন্তু গলা কিংবা ঘাড় বলে কিছু নেই, থুতনির নিচেই বুক। বলল, আমি আজ্ঞে, মনোহারি জিনিসপত্তর এনেছি।
কী আছে তোমার?
পাঁউরুটি, বিস্কুট, গরমমশলা, বাঁধাকপি, তেজপাতা, ঘি, তিলকুটো, চন্দ্রপুলি, শোনপাপড়ি, আসল বাঙালির তৈরি –। লোকটা অনেক কিছু বলত এমন ওর মুখের ভাব, থামিয়ে বললাম, চাইনা।
আজ্ঞে?
চাইনা।
আজ্ঞে?
বিরাট চিৎকার করে বললুম, চাইনা। লোকটা বুঝতে পেরে গাড়ি ঘোরাল। তাপস মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়ছিল, শেষ না হওয়া পর্যন্ত চোখ তুলতে পারছিল না। এবার হঠাৎ বলল, ডাক, ডাক লোকটাকে। ভারি চমৎকার ওর মুখখানা, ওকে আমার কাজে লাগবে। বিষম হল্লা করে লোকটাকে অনেকক্ষণ ডাকার পর ঘাড় ফেরাল, ঠিক ঘাড় না, বুক ফেরাল বলা যায়। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে এল।
দোকান খোল, দেখি কী আছে?
খাবাব-টাবার নেবেন, না তরকারি, স্টেশনারি?
কী খাবার, দেখাও।
চন্দ্রপুলি, তিলকুটো, শোনপাপড়ি।
দাম বলো, কত করে?
দু’আনা পিস। ডজন। দেড় টাকা। খাঁটি এক টাকা ছ’আনা পাবেন, স্যার।
বারো আনা দিতে পারি, এর চেয়ে বেশি হয় না ভাই।
না, পারব না স্যার, কেনা দাম পড়ে না।
ও, তোমার কেনা জিনিস নাকি? আমরা ভেবেছিলাম ঘরে তৈরি। তবে কে কিনবে?
না, মানে মালপত্তর স্যার, কিনতেই হয় স্যার, খরচ পোষায় না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার ক্ষতি করতে চাই না। তুমি আদ্দেক-আদ্দেক দিয়ে যাও।
আধ ডজন করে নেবেন?
না, সব জিনিসের আদ্দেক। বারো আনায় চন্দ্রপুলির চন্দ্রটা দিয়ে যাও, পুলিটা তোমার থাক।
চন্দ্র? শুধুচন্দ্র?
হ্যাঁ। যেমন ধরো তিলকুটো। তিলগুলোই দাও (না হয় শালা তর্পণ করব এক মাস), তাপস আমার দিকে তাকিয়ে বলল। তুমি কুটোগুলো স্বচ্ছন্দে নিয়ে যেতে পারো।
পারব না স্যার। লোকটা খানিকক্ষণ কী ভাবল, তারপর বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তুমি হয়তো ভাবছ, পরীক্ষিৎ বলল, আমরা প্রথম দিকটা মানে ভাল দিকটা নিয়ে নিচ্ছি বলে তোমার ক্ষতি হচ্ছে। বেশ তো, শোনপাপড়ির প্রথমটুকুই তুমি নাও, আমাদের পাপড়িগুলোই দাও! কী হে?
না, হয় না, তা হয় না।
পাঁউরুটির কোন ভাগটা নিবি? তাপস জিজ্ঞেস করল, পাঁউ না রুটি?
আমি রুটি খাই না। পরীক্ষিৎ জানাল।
তবে বুঝি পাঁউ খাস? দাও, ওকে পাউটা দিয়ে দাও। পাঁউ দিতে পারবে তো?
লোকটা চুপ। ওর চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
আর কী আছে দেখি? পরীক্ষিৎ এগিয়ে ওর দোকানগাড়ির ঢাকনা খুলে দেখল।
দারচিনি মানে দারুচিনি, শুধু দারু হ্যায় তুমারা পাশ? মহুল কিংবা পচাই?
না।
অ! দারচিনিকে আবার গরম মশলাও বলে। গরম মশলাটার পুরোটাই নেব। আমি মশলাটুকু খাব আর অবিনাশবাবুকে গরমটুকু দিয়ে দাও। তেজপাতারও পাতা চাই না। তেজ দাও অবিনাশবাবুকেই, ওর দরকার। আমি হাসলাম। লোকটা পকেট থেকে একটা সবুজ রুমাল বার করে মুখ মুছল। এটা কী ও পরীক্ষিৎ হাত ঢুকিয়ে একটুকরো আদা তুলল। আচ্ছা, ভাল জিনিস পাওয়া গেছে। পরীক্ষিৎ অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল।
পুরোটা নিসনি, পুরোটা নিসনি, ওর ক্ষতি হয়ে যাবে। শোনো, আমি বললুম, এরও তুমি আদ্দেক বেচে দাও, তোমার লাভই হবে ভাই। আদার আ-টুকু দাও পরীক্ষিৎবাবুকে, তুমি দা-টা নিয়ে যাও। এরপব তুমি চাই দা, চাই দা বলে ফেরি করবে। লোকে কিনতে এলে তুমি দায়ের বদলে আদা বেচে দেবে! আর পরীক্ষিৎবাবুআ নিয়ে যা করবার করবেন।
দুর শালা! যত সব বাজে ঠাট্টা এই নিরীহ লোকটাকে নিয়ে। তাপস বলল, আসল জিনিসটার খোঁজ নে!
পরীক্ষিৎ বলল, দাঁড়া, আমি বার করছি। খুব মনোযোগ দিয়ে বাক্সের ভেতরের জিনিসগুলো দেখল। তারপর একটা পাউরুটি কাটা ছুরি হাত দিয়ে তুলল। হ্যাঁ, এতেই অনেকটা হবে। শোনো ভাই, সিরিয়াসলি, তোমার কাছে মেরামত করার জিনিস আছে? এই ছুরিটা মেরামত করতে হবে। লোকটা কিছু একটা উত্তব দিল, বোঝা গেল না।
এই ছুরিটা মেরামত করা দরকার বুঝতে পারছ না? চন্দ্রপুলি তো দেখালে, চন্দ্রবিন্দু আছে?
লোকটা বিকট ঘড় ঘড় শব্দ করল।
আঃ, বুঝতে পারছ না? ছুরির ছ’য়ের মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসাতে হবে, আর একটা অনর্থড় লাগবে মানে ড-এ শূন্য-র। এইটুকু বদলাতে পারলেই অবিনাশবাবু যত ইচ্ছে দাম দেবে। জিনিসটা তাহলে কী হল? হুঁড়ি। তোমার হাতে চুড়ি-টুড়ি আছে?
আসল কথায় এসো তো ভাই, তাপস বলল নিচু গলায়, তোমার সন্ধানে মেয়েছেলে-টেলে আছে?
আজ্ঞে?
দেখো না ভেবে। তোমাদের এখানে এসেছি, দাও দু’একটা জোগাড় করে। সন্ধের দিকে নিয়ে আসবে।
পারব না স্যার।
পারবে না একথা বলতে নেই! ছিঃ! চেষ্টার অসাধ্য কিছুই নেই। চেষ্টা করো আগে, চেষ্টা করার আগেই কী করে বুঝলে যে পারবে না?
লোকটা একটা অপ্রত্যাশিত কথা বলল এবার। প্রায় ফোঁপানো গলায়, বাবু, আমি লেখাপড়া শিখিনি আপনাদের মতে, আমি গরিব মানুষ, আমি গরিব, ওই —
একটুক্ষণ আমরা তিন জনেই চুপ করে রইলাম। তাপস লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, তুমি গরিব মানুষ। হায় হায়, আগে বলোনি কেন, আমরাও বিষম গরিব, হায় হায়। তাপস লোকটার গলা জড়িয়ে ধরতে গেল, ওঃ, বুক জ্বলে যায়, আমরা কত গরিব জানো না, আমাদের কিছু নেই, আমরা তোমার আধখানা করেও কিনতে পারব না, চলে যাও, আমরা ভিখিরি, লেখাপড়া-জানা ভিখিরি ওঃ। তাপস হঠাৎ এমন মড়াকান্না জুড়ে দিল যে গায়ত্রী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে, আর লোকটাও গাড়ি ঘুরিয়ে হাঁটতে লাগল মন্থর পায়ে।
গায়ত্ৰী লোকটাকে বলল, ও মুকুন্দ, আধ সের পিঁয়াজ দিয়ে যাও।
লোকটা কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধরা গলায় বলল, পুরোটাই নেবেন তো মা, আদ্দেক দিতে পারব না আমি।
তাপস সমেত আমাদের তিন জনের হাসির চিৎকার অনিমেষ গেটের কাছ থেকে শুনতে পেল।
.
দুপুরে কী কী করেছিলাম মনে নেই। খুব বৃষ্টি হয়েছিল মনে আছে। আর খাবার সময় গায়ত্রী ভেবেছিল আমি শক্ত করে ধরেছি, সুতরাং গায়ত্রী ছেড়ে দিল এবং আমি ধরিনি, বাটিটা পড়ে ছিটকে ভেঙে গেল। আমি ব্যতীত সকলে হাসাহাসি করার সময় পরীক্ষিৎ টেবিলের তলা থেকে আমার পায়ে লাথি মেরেছিল।
বিকেলবেলা আমরা একটা সাপ মারলাম। দলবল মিলে বেরুতে যাচ্ছি, বাড়ির গেটে হাত দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাপস বলল, সাপ! সাপ! গায়ত্রী! প্রত্যেকেই এক সেকেন্ডে তিন পা পিছিয়ে দেখলাম, গায়ত্রীর খুব কাছে একটা সাপ –বেশ বড়, কালো বেল্টের মতো, এতগুলো তোক দেখে চট করে ফুলবাগানে ঢুকে পড়ল। সর্বনাশ, বাড়িতে সাপ পুষে রেখেছিস? লাঠি নিয়ে আয়, তাপস বলল, যা যা। পরীক্ষিৎ গম্ভীরমুখে জানাল, ওটা সাপ নয়, এই শীতে সাপ আসবে কোথা থেকে? ওটা আসলে শয়তান। গায়ত্রীকে কোনও একটা গোপন কথা বলতে এসেছিল।
যাঃ, ঠাট্টা নয়, আমার বুক কাঁপছে এখনও, উঃ! গায়ত্রী সরে এসে অনিমেষ ও আমার মাঝখানে দাঁড়াল। পরীক্ষিৎ কথাটা এমন সুন্দর ভাবে বলেছে যে, আমি ছবিটা যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সাপটা গায়ত্রীর সায়ার ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে এল, এই রসমণীর দুই উরুর মাঝখানে কোন গুপ্ত কথা বলে। যেন কোনও পৌরাণিক কাহিনির সত্য এই মুহূর্তে এখানে ঘোষিত হয়ে গেল। শয়তান শুধু নারীর কাছেই সে-সত্য ঘোষণা করে যেতে পারে। এই মুহূর্তের জন্য দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, চাক্ষুষ ভাবে দৃশ্যটা সত্যই ভয়ঙ্কর, আমি তাই অনিমেষকে বললাম, যান লাঠি নিয়ে আসুন, ওটাকে কি এখানে পুষে রাখবেন নাকি?
আমি আসছি, তাপস দৌড়ে ভিতরে চলে গেল সুরকির পথ পেরিয়ে। ও এমন ভিতু স্বভাবের, যাবার সময় এমনভাবে গেল পা ফেলে, যেন ওর কাছে সমস্ত পৃথিবীটাই এখন সাপে ভর্তি।
কী দরকার ওটাকে মারার, অনিমেষ বলল, এর আগেও ওটাকে কয়েক বার দেখেছি, কোনও ক্ষতি করে না কিন্তু।
কী যা-তা বলছেন! সাপ রোজ ক্ষতি করেনা, একদিনই করে। অন্ধকারে গায়ে পা দিলে চৈতন্যদেবের বাণী শোনাবে না। এখন ওদের হাইবারনেশন পিরিয়ড শেষ হচ্ছে, খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে নতুন জীবনে। এখন ওদের তেজও যেমন, বিষও সেই রকম মারাত্মক।
পরীক্ষিৎ বলল, যাই বল, জিনিসটা দেখতে ভারি সুন্দর। কীরকম উদাসীন ভঙ্গিতে চলে গেল, অকারণে মারিসনি।
তাছাড়া, ওটার তো বিষ না-ও থাকতে পারে। অনিমেষ বলল, অত বড় সাপ-বোধহয় দাঁড়াস, অর্থাৎ যাকে ঢ্যামনা বলে।
মোটই ঢ্যামনা নয়, ঢ্যামনা হয় ছাই-ছাই হলুদ, এটা একদম কালো।
বিষ নিশ্চয়ই আছে, পরীক্ষিৎ বলল, সম্পূর্ণ বিষহীন কোনও জিনিস কোনও মহিলার কাছে আসবেই-বা কেন?
ধ্যাত, আপনি সব সময় অসভ্য কথা বলেন।
অনিমেষ আর আমি হাসলাম। পরীক্ষিৎ আমার চোখে চোখ ফেলেছে।
তাপস দুটো দরজার খিল এনে এগিয়ে দিয়ে বলল, কে মারবে মারো, আমি ওর মধ্যে নেই। তবে মারা দরকার। এই হুস, বেরিয়ে আয়। বলে একটা খবরের কাগজে আগুন জ্বালিয়ে ঝোপটায় ছুঁড়ে দিল।
সাপটা ওখানেই আছে, কোথাও যায়নি, আমি লক্ষ্য রেখেছি, গায়ত্রী বলল।
কিন্তু ফুলগাছগুলো নষ্ট হবে। পরীক্ষিৎ নিচু গলায় বলল।
অনিমেষ লাঠিটা তুলে এগুতে গিয়েও যেন এই কথা শুনেই পিছিয়ে এল। ওদের অস্বাভাবিক কবিত্ব দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটু বিরক্ত বোধ হল। ঝাঝালো গলায় বললাম, ওগুলো তো দোপাটির ঝোপ, বিনা যত্নেই হয়, আবার হবে। তাছাড়া শোন, সাপ হচ্ছে মানুষের শত্রু। শত্রুকে কখনও আক্রমণের সুযোগ দিতে নেই, তার আগেই মারতে হয়।
ওঃ! পরীক্ষিৎ হঠাৎ চুপ করে গেল, যেন আমি এক অমোঘ যুক্তি দিয়েছি যার উত্তর হয় না। তারপর বলল, যদি মারতেই হয় সর আমি মারছি। পরীক্ষিৎ ঝোপটার অনেকটা কাছে এগিয়ে গেল খিল হাতে, তারপর খুব সহজেই কাজ হয়ে গেল। লাল-সাদা ফুলের ঝাকের ওপর আন্দাজে একটা বাড়ি মারতেই স্প্রিঙের খেলনার সাপের মতো সাপটা তড়াক করে ফনা তুলে উঁচু হল। আঁকরে গায়ত্রী একটা সরু আওয়াজ তুলে পিছিয়ে গেল দৌড়ে। পরীক্ষিৎ সাপটার দিকে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল, একটুও ভয় নেই, যেন ও কোনও এক গুণিনের মতো মন্ত্র দিয়ে বশ করতে চায় সাপটাকে। আমি ওর ডান পাশে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দুজনের হাতেই খিলের ডাণ্ডা, একটু দূরে সাপটা অল্প অল্প দুলছে। পরীক্ষিৎ আমার দিকে তাকাল, ওকে একেবারে মারতে হবে বুঝলি, পালাবার চেষ্টা করলে মুশকিল হবে। তারপর যেমন ভাবে গালে থাপ্পড় মারে, সেই রকম পরীক্ষিৎ ওর লাঠিটা দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সাপটার ফনায় মারল, আমিও সেই সময় লাঠি চালিয়েছিলাম, ঠক। করে শব্দ হল দু’জনেরটা লেগে। সাপটা মাটিতে পড়তেই আমরা দুজনে ধুপধুপ করে পেটালাম। অল্প সময়েই সাপটা নিস্তেজ হয়ে গেল।
সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকেই একটা সিগারেট ধরিয়ে পরীক্ষিৎ বলল, এখন এটাকে কী করবি? সাপকে ফেলে রাখলে আবার বেঁচে যায়। বৃষ্টি পড়লেই বেঁচে উঠবে। পুড়িয়ে ফেলা উচিত। কী করবি? সাপটা কিন্তু জাতের, খাঁটি চন্দ্ৰবোড়া।
কিন্তু কে এখন ওটাকে পোড়াবে বসে বসে?
এক কাজ করা যাক, আমি বললাম, ওটাকে নিয়ে চল বড় রাস্তায় ফেলে দিই। কয়েকখানা বড় বড় ট্রাক ওটার ওপর দিয়ে চলে গেলেই হবে।
সেটা মন্দ না। পরীক্ষিৎ ওর লাঠিটার মাথায় মরা থ্যাৎলানো সাপটাকে তুলল। তারপর সৈন্যবাহিনীর শোক-শোভাযাত্রার আগে নিচু পতাকা হাতে যে-লোকটা হাঁটে তার মতো ভঙ্গিতে পরীক্ষিৎ এগিয়ে চলল। যেন ওর সত্যিই খুব দুঃখ হয়েছে। পরীক্ষিৎকে আমি জ্যান্ত মুরগির ছাল ছাড়াতে দেখেছি। জীবজন্তুর ওপর ওর দয়ামায়া বোধ যে খুব প্রবল, তার তো কখনও পরিচয় পাইনি। কিন্তু বোধহয় সাপ, টিকটিকি এই জাতীয় ঠাণ্ডা রক্তের জীবের প্রতি ওর সত্যিকারের কোনও টান আছে।
তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। লাল আকাশটার কোনও এক দিকে সূর্য। এই সময় সূর্যের রশ্মিগুলো আলাদা ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। এখন একটু চেষ্টা করলেই কল্পনা করা যায় যে, সন্ধেবেলার সূর্য থেকে অসংখ্য লাল রঙের সাপ পৃথিবীতে ঝরে পড়েছে। পরীক্ষিৎ লাঠিটা বাগানের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেবার আগে একবার সূর্যের দিকে তাকাল।
অনেক দিন আগে আমরা এখানে একবার বেড়াতে এসেছিলাম। বছর সাতেক আগে। তখনও জায়গাটা অন্য রকম ছিল। একটা ঝিরঝিবে ঝরনা। পাশে ছোট মন্দির। এখন দেখছি রীতিমতো একটা নদী। বেশ গভীর জল মনে হয়, প্রবল স্রোত। ও-পারে ব্রিজ বানিয়েছে, এসব ব্রিজ-ট্রিজ কিছুই আগে ছিল না। বেশ ঝকমকে চওড়া কংক্রিটের, নদীর চেয়ে ব্রিজটাও কিছু কম সুন্দর দেখতে নয়। প্রশস্ত চাঁদের আলোয় ফট ফট করছে সাদা রঙ। গায়ত্রী একটা হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছে, সুতরাং প্রায়শই ও মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার সঙ্গে। আশেপাশে লোকজন নেই। মন্দিরের কাছে কয়েকটা দোকান। অনিমেষ কী যেন আলোচনা করছে তাপসের সঙ্গে। আমি রেলিঙের ওপর ঝুঁকে কী যেন খুঁজছিলাম নিচে। কী খুঁজছিলাম মনে পড়ছিল না, গভীর মনোযোগ দিয়ে চোখ ঘোরাচ্ছি অথচ কেন, ঠিক কী দেখতে চাই যেন মনে আসছেনা। কী খুঁজছি অনেকক্ষণ পর মনে পড়ল, একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছেলেকে। স্পষ্ট মনে আছে, আগের বার যখন এসেছিলাম, আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম ঝরনাটার পাশে। আমার বার বার মনে হল, ঝুঁকে তাকালে এখনও সেই ছেলেটাকে দেখতে পাব। ঝরনার (এখন নদী) পাশে একটি মুগ্ধ যুবা বসে আছে। না, কিছু দেখা যায় না অন্ধকারে। তখন কী সুন্দর চোখ ছিল আমার, ঝরনার চাঁদের আলো দেখলে কী ভালই লাগত। আমি হু-হু করে ভেসে আসা হাওয়ায় বার বার নিশ্বাস নিয়েছিলাম। আজ কিছুই ভাল লাগছে না, অথচ আজও এ জায়গাটা কম সুন্দর নয়। বন্ধুরা, গায়ত্রী, চমৎকার ঠাণ্ডা জ্যোৎস্না, এমনকী যথেষ্ট সিগারেট আছে পকেটে। কিন্তু আমার খালি মনে হচ্ছে, এখান থেকে চলে যাই। বন্ধুদের কারুকে না বলে পালাই। যেন ভুল জায়গায় এসেছি। এই যুগপৎ জ্যোৎস্না ও হাওয়ার রাত আমার জন্য নয়। বুকের মধ্যে ব্যথা ও ভয় হচ্ছে। বিষম পালিয়ে যাবার ইচ্ছে। তবু নিচে জলের কাছে পাথরের ওপর সেই ছেলেটাকে যদিবসে থাকতে দেখি, তবে হয়তো এবারের মতো বেঁচে যাব।
তাপস বলল, আই নীড এ উওম্যান, না হলে আমি ঠিক জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়াতে পারি না।
এবার একটা চটপট বিয়ে করে ফ্যাল, অনিমেষ বলল।
ভাগ শালা। চল অবিনাশ, ওই চায়ের দোকানটায় যাই, যদি ফোক টোক জোগাড় করা যায়।
না রে, আমার ইচ্ছে নেই।
বিয়ে করাটাকে অত ঠাট্টা করিস না, অনিমেষ বলল।
কেন, কী এমন পরমার্থ পেয়েছিস?
অনেক সুবিধে আছে। আমি তো ভাই বেশ সুখে আছি।
কে চার হাত-পায়ে সুখ চায়! তাছাড়া সুখটাই-বা কী? কানের দুল, শাড়ি, মেনস্টুরেশান, ডাক্তার, নেমন্তন্ন;-সব চেয়ে মুশকিল, কখনও একা থাকা যায় না। কিন্তু এ-সব বাদ দিয়েও তো মেয়েছেলে পাওয়া যায় বিয়ে না করে!
যাঃ, শুধু শুধু থিওরিটিক্যাল কথা বলিস না। যে-সম্বন্ধে তোর অভিজ্ঞতা নেই, সে-সম্বন্ধে কথা বলা উচিত না।
তাপস চকিতে অনিমেষের দিকে সোজাসুজি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমার অভিজ্ঞতার কথা আমি মুখে বলি না কখনও, লিখে জানাই। তাছাড়া বিয়ে সম্বন্ধে তোরই-বা কী নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে? তুই কি পৃথিবীতে নতুন বিয়ে করেছিস? পৃথিবীতে মানুষ বিয়ে করছে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে, তাদের সকলের অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানি।
তাদের সকলেরই অভিজ্ঞতা খারাপ?
কী গাড়োলামি করছিস? বিয়ে করা উচিত কি না তাই নিয়ে সিম্পোসিয়াম চালাবি নাকি? যার ইচ্ছে করবে। কিন্তু একটা মেয়েছেলে চাই, এ-কথায় বিয়ের প্রসঙ্গ আসে কী করে?
আমার বিয়ের কথাই মনে হল। কারণ বিয়ে করে আমি স্ত্রীলোক এবং শান্তি দুটোই পেয়েছি।
পরীক্ষিৎ গান গাইছিল। হঠাৎ গান থামিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, কিন্তু অনিমেষের মতো সুন্দরী বউ থাকলে ভাই শান্তি বেশি দিন রাখা যায় না।
অনিমেষ কথাটা শুনল, কিন্তু কান দিল না। বলল, তাপস, তুই আর এ-রকম পাগলামি কত দিন করবি? তোর তো লেখার জন্য সময়ের দরকার।
আমিও সুযোগ পেলে একটা ছোটখাটো বিয়ে করে ফেলব। আমি নিরীহ ভাল মানুষ হয়েই বাঁচতে চাই। আমি বললাম।
তাপস একাই চলে গেল চায়ের দোকানের দিকে।
পরীক্ষিৎ ব্রিজের রেলিঙের ওপর উঠে বসেছে। প্রথমে গুন গুন করে গান করছিল, তারপর বেশ গলা ছেড়ে দিল। পর পর তিনখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত না থেমে শেষ করার পর বলল, বিনা নেশায় চেঁচালে বড় গলা ব্যথা করে। গতবার আমরা সবাই মিলে কী গান গাইতাম রে?
কী জানি, আমার মনে নেই। আমি একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিতে না-দিতেই সেটা হাত ফসকে জলে পড়ে গেল।
তাপস জানে। তাপস ওটা খুব গাইত। গেল কোথায় ছোকরা? একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে পরীক্ষিৎ বলল, কাণ্ডটা দ্যাখ! সাধে কি আমি রাগি।
গায়ত্রী গিয়েছিল মন্দিরে। ফিরে এসে ব্রিজের ও-পাশে অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়েছে। অনিমেষ চলে গেছে ওর কাছে, দু’জনে নিবিষ্ট হয়ে কী যেন বলছে।
দেখেছিস, একটু চান্স পেয়েই জোড়া মেরে গেছে। এই জন্যই (অশ্লীল) আমি (ছাপার অযোগ্য, ছাপার অযোগ্য) একটু অন্ধকার পেলেই (অশ্লীল, ছাপার অযোগ্য)।
যাক গে, ছেড়ে দে। নতুন বিয়ে করেছে, একেবারে একা থাকতে পারছে না আমাদের উপদ্রবে।
শুনেছিস, কাল অনিমেষ কা বলল। একদম লিখতে পারছে না, ভাষা নেই ফাসা নেই, যত (অশ্লীল, ছাপার অযোগ্য)। বিয়ে করে মজে গেছে। ওই বলল না, শান্তি পেয়েছে। আমি ওর শান্তির বারোটা বাজাতে চাই। আজই।
তোর নতুন বইটা কবে বেরুচ্ছে, নাটকটা শেষ করলি না?
কার জন্য লিখব? তুই লিখিস না আজকাল। তাপসটা লেখে ব্লডি রোজ। এক অনিমেষ— তা-ও বিয়ে করে শান্তি পেয়েছে। দাঁড়া ওর শান্তি ভেঙে দিচ্ছি। ওকে বলে দিই, যাকে নিয়ে অত সোহাগ করছ, সেই তোমার বউয়ের (ছাপার অযোগ্য, ছাপার অযোগ্য)।
ও-সব চালাকি ছাড় অবিনাশ মিত্তির! আমি সোজা কথা বলব। পরীক্ষিৎ হাতের সিগারেটে জোর টান দিয়ে এক মুখ ধোয়া ছেড়ে ভর দিয়ে পাঁচিলের উপর দোল খেল।
পড়ে যাবি, পরীক্ষিৎ, ঠিকহয়ে বোস। আমি দেখতে পেলুম সেই অজগরের মতো নীল ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওর মাথার চারপাশে। লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ মনে হল ওর মাথা দিয়ে দুটো শিং বেরুচ্ছে। গায়ত্রী মেয়েটা খুব ভাল, আমি বললাম, ওরা দুজনেই দু’জনকে খুব ভালবাসে।
আমার মুখের দিকে গভীরভাবে তাকাল পরীক্ষিৎ। বলল, আর তুই?
আমি হোপলেস, আমার দ্বারা কিছু হবে না।
আমার নাটকটার জন্য কাঁচা মাল দরকার। আমার অনিমেষকে চাই।
এ খুব ছেঁদো কথা হল। তোর কি মডেল লাগে লেখার জন্য?
ওকে নিয়ে লিখব কে বলেছে। ওর গণ্ডগোল নিয়ে লিখব। গল্প তো বানাতে পারি না রে, তাহলে তো এত দিনে উপন্যাস-ফুপন্যাস লিখে কেলেঙ্কারি করতাম। অনিমেষকে ঈর্ষা করে লিখতে ইচ্ছে হয়।
শেক্সপিয়ার কিংবা ইয়োনেস্কোকে ঈর্ষা করনা!
যাঃ, বাজে বকিস না। তুই আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করছিস। কিন্তু এরই-বা কী মানে হয়। বন্ধুরা বইল এক দিকে, আর বউয়ের সঙ্গে গুজুর গুজুর। শোন অবিনাশ, আমিও ওর সত্যিকারের বন্ধু। আমি ওর উপকারই করতে চাই। একটা মেয়ের কাছে ডুবে যেতে দিতে পারি না।
পরীক্ষিৎ, কাল ক’টার ট্রেনে ফিরব রে আমরা?
জানি না। অনিমেষকে ডাকি!
কলকাতায় ফিরে তোর নাটকটা স্টেজে করব। হল ভাড়া নিয়ে।
তুই আমাকে ভোলাতে চাইছিস? না, আমি অনিমেষকে ডেকে বলতে চাই, আজই এখনই, অনিমেষ –
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তুই অনিমেষকে কী বলনি? যত সব পাগলামি!
পরীক্ষিৎ গাঢ় চোখে আমার দিকে তাকাল, একটাও কথা না বলে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। কী বিশ্রি ওর সেই হাসি। সেই হাসির মধ্যেও নীল ধোঁয়া। আমি অস্বস্তিকর ভাবেওর হাসির সঙ্গে যোগ দিতে চাইলাম। আমার তখন হাসি পেল না।
হঠাৎ পরীক্ষিৎ বিষম জোরে অনিমেষের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠল। আমি থতমত খেয়ে বললাম, পরীক্ষিৎ, আগুনটা দে তো। বলে, ওর মুখের সিগারেট থেকে আমার সিগারেট ধরিয়ে নেবার জন্য এগিয়ে গিয়ে ওর ওপর ঝুঁকে পড়লাম। তারপর ডান হাত দিয়ে ওর পেটে একটা আলতো ধাক্কা দিতেই হাত দুটো ওপরে তুলে বাতাস ধরার চেষ্টা করে পরীক্ষিৎ উলটে পড়ে গেল। নিচের নদীর জলে ঝুপ করে একটা শব্দ হল। আর শোনা গেল, পরীক্ষিতের আর্তনাদ নয়, জারুল গাছের একটা রাত-পাখির কর্কশ ডাক। গায়ত্ৰী আর অনিমেষ ছুটে এল চিৎকার করে। পরমুহূর্তেই বিষম অনুশোচনায় আমার মন ভরে গেল। ছিঃ, কেন পরীক্ষিৎকে আমি জলে ফেলে দিলাম। খুবই বোকার মতো কাজ হল এটা। কোনও মানে হয় না। ও খুবই ভাল সাঁতার জানে, নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে। এর বদলে ওকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেই একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।