পাঁচ মহানায়কের গোপন জীবন – রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কালীপ্রসন্ন, বঙ্কিমচন্দ্র / রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: পয়লা বৈশাখ ১৪২৫
সেইসব পাঠক—পাঠিকার হাতে যাঁরা আমার সঙ্গে আছেন এতদিন। যাঁরা ভালোবেসে পড়েন আমার লেখা। যাঁদের সমালোচনাতেও মিশে থাকে বৈদগ্ধ্য, শীলন, সহিষ্ণুতা, সংবেদ। আর যাঁরা আমারই মতন আগ্রহী চাঁদের উল্টো পিঠের প্রতি।
প্রাককথা
উনিশ শতকের বঙ্গ—নবজাগরণের পাঁচ বাঙালি মহানায়ক এই বইটির বিষয়। এঁদের জীবনের অনেকটাই জানি। আবার কিছুটা জানি না। জানতে চাই না। বা জেনেও চেপে যাই। পাঁচ মহাপুরুষই আমার এই নতুন আঙ্গিকে লেখা উপন্যাসটির নায়ক। তাঁদের সমস্ত মানুষী দুর্বলতা নিয়েই তাঁরা জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। কোথাও বা তাঁরা পরস্পরের পরিপূরক। সামান্য তির্যক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছি তাঁদের। এই উপন্যাসের কিছুটা প্রবন্ধভঙ্গিতে লেখা। আধুনিক উপন্যাসে ক্রমশ লুপ্ত হচ্ছে গল্প আর প্রবন্ধের বিভেদরেখা। গল্পের মধ্যে প্রবিষ্ট হচ্ছে প্রবন্ধের বুনন। প্রবন্ধ আবার কখনও—কখনও আরাম পাচ্ছে গল্পের শরীরে। বাড়ছে তাদের সহবাসের প্রবণতা। মন্দ নয় হয়তো এই অনিবার্য অন্বয়!
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
২৮ মার্চ ২০১৮
কলকাতা
.
১. অবাধ্য রাজা – রামমোহন
—তোকে না বলেছি, না—বলে কোথাও যাবি না? সেই দুপুর থেকে তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। সন্ধে পেরিয়ে রাত। এখন তোর বাড়ি ফেরার সময় হল? কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
—মিথ্যে বলতে পারব না, আর সত্যিটা বলব না।
—বলবি না?
—তোমাকে সব কথা বলতেই হবে কেন?
—কারণ, আমি তোর মা।
—মা তো কী? তোমার সব বারণ শুনতে আমি বাধ্য নই।
—মা’র নিষেধ শুনবি না? সে কী রে?
—শুনব না, কারণ, তুমি বারণ করো তোমার সংস্কার থেকে। তুমি যুক্তি দিয়ে ভাবো না, চলো না।
—যুক্তি—যুক্তি—যুক্তি। তোর ওই যুক্তি—তক্কের ধার ধারি নে আমি। আমরা গোঁড়া হিন্দু। হিন্দুদের সংস্কার তোকে মানতেই হবে। আবার তুই মৌলবির বাড়িতে গিয়েছিলি? বলেছি না, যাবি না। তুই শুধু ম্লেচ্ছ—সংসর্গই করছিস না, সেই কাপড়ে আমার ঘরে এসে ঢুকছিস। আর বারণ করলেই বলবি, কোনও দেবদেবীতে বিশ্বাস নেই তোর। কোনও সংস্কারেও বিশ্বাস করিস না।
—বিশ্বাস নেই, নেই, নেই। তোমাদের বিশ্বাস অন্ধকারের বিশ্বাস। অন্ধকার যুগ। অন্ধকার বিশ্বাস। যদি সত্যি কোনও দিন আলো ফোটে, তোমাদের ওই সব যুক্তি হালে পানি পাবে না মা।
—আমার বাবা ঠিক কথাই বলেছিলেন। তুই—ই আমাদের দুঃখের কারণ হবি।
—আমি তোমার সব কথা শুনে চলতে পারব না মা। তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝে দুঃখ পাও, আমার কিছু করার নেই। আমি চলব নিজের বিচার—বুদ্ধি অনুসারে। ধর্মের আবেগ নয়। কুসংস্কারের বশ্যতা নয়। যুক্তি। শুধু যুক্তি।
—হয়তো তুই—ই ঠিক। কিন্তু আমি তো তোর মা…।
—আমি কি অস্বীকার করেছি সে—কথা? কিন্তু তুমি মা বলেই তোমার যুক্তিহীন বিচার আমি মেনে নেব না। আমি আরবি ভাষা শিখতে মৌলবির কাছে যাই। তাতে কোনও অন্যায় নেই।
—তাতে হয়তো অন্যায় নেই। কিন্তু ওই মৌলবি তোকে ‘হিন্দুবিরোধী’ করে তুলেছে। তুই নারায়ণশিলা পর্যন্ত মানছিস না! আমার ছেলে হয়ে তুই এত বড় পাপ কী করে করলি!
—মা, আমি হিন্দু ধর্মে অবিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি হিন্দু সংস্কারে বিশ্বাস করি না। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মূর্তিপুজোর কোনও সম্পর্ক নেই।
—কী বলছিস তুই?
—একদিন তুমি মানবে, আমিই ঠিক বলছি মা।
—তুই চুপ কর।
ছেলেটির মা তারিণীদেবীর মন ভেসে যায় অনেক পিছনে ফেলে আসা একটি দিনের স্মৃতিতে।
প্রবল তান্ত্রিক—বাবার মেয়ে তারিণী। এহেন শ্যাম ভট্টাচার্যের মেয়ের কিনা বিয়ে হল বিষ্ণুর পূজারি পরম বৈষ্ণব রামকান্তর সঙ্গে!
এ—বিয়ে হওয়ার নয়, তবু ঘটে গেল এই অসম্ভব ব্যাপার। সবই অদৃষ্ট। জন্ম—মৃত্যু— বিবাহ—মানুষের কোনও হাত নেই এই তিনের উপর।
শ্যাম ভট্টাচার্য তারিণীর এই বৈষ্ণবঘরে বিয়েটা মেনে নিল বটে। কিন্তু মানতে পারল না মেয়ের রাতারাতি ঘোর বৈষ্ণব হয়ে যাওয়া। তারিণী যে বাপের সঙ্গে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে, কে জানত?
তার সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসেছে তারিণী। বিয়ের পরে এই প্রথম সে এসেছে! ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠাকুরঘরের পাশে। বাপ শ্যাম ভটচায পুজোয় বসেছে। তান্ত্রিক দাদামশাই, প্রথম দেখবে নাতিকে।
পুজো সেরে শ্যাম ভটচায বাইরে এল। তন্ত্রসাধনার সমস্ত চিহ্ন তার শরীরে ও বসনে। ছেলেকে কোলে করে হাসিমুখে এগিয়ে এল তারিণী।
তান্ত্রিক দাদামশাই নাতিকে আশীর্বাদ করে তার হাতে দিল একটি বিল্বপত্র।
শিশুটি সঙ্গে—সঙ্গে সেটি মুখে পুরে চিবোতে লাগল।
আঁতকে উঠল তারিণী। বাবা এ কী করল! তার ধর্মে সরাসরি আঘাত!
—বাবা, তুমি জানো, আমি এক নিষ্ঠ বৈষ্ণবের স্ত্রী। আমার স্বামীর সংস্কারই এখন আমার সংস্কার। তাঁর ধর্মই আমার ধর্ম। কৃষ্ণই এখন আমাদের একমাত্র আরাধ্য ভগবান। আর তুমি কালীর সাধনা করো। সেই সাধনায় আমার এখন আর বিশ্বাস নেই। সব জেনেশুনেও কেন তুমি আমার ছেলের হাতে তোমার তন্ত্রসাধনার বিল্বপত্র তুলে দিলে? তুমি ইচ্ছে করেই আমার স্বামীকে ও আমাকে অপমান করেছ।
মেয়ের এই কথায় ক্রোধে জ্বলে উঠল শ্যাম ভট্টাচার্য। ধমক দিয়ে বলল, তোর জন্ম তান্ত্রিক বংশে। সে—কথা ভুলে গেলি?
—বাবা, একটা কথা মনে রেখো, আমি তান্ত্রিকের ঘরে জন্মালেও আমার বিয়ে হয়েছে বৈষ্ণব পরিবারে। আমার ছেলের মুখে তোমার দেওয়া বিল্বপত্র থাকতে পারে না।
তারিণী এ—কথা বলে ছেলের মুখ থেকে বিল্বপত্রটি বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
শ্যাম তান্ত্রিক মেয়ের আস্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত! তার শরীর রাগে কাঁপছে। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারল না কালীর সাধক। অভিশাপ দিল মেয়েকে।
মনে রাখিস তারিণী, তোর এই ছেলেই তোকে সবচেয়ে বড় আঘাত করবে। তোর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবে। তোর সংস্কারে আঘাত করবে। তোর জীবনের সব সুখ—শান্তি এই ছেলে একাই হরণ করবে। আমার অভিশাপ মিথ্যা হওয়ার নয়। তারিণী, আর—একটা কথা জেনে রাখ, শেষ পর্যন্ত তুই তোর সন্তানকে ত্যাগ করতেও বাধ্য হবি।
তারিণী প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ধীরে—ধীরে যেন তার সম্বিত ফিলে এল। সে বুঝতে পারল, এই পিতৃ—অভিশাপ তার জীবনে আকস্মিক বজ্রপাতের মতো।
সে প্রথমে ভয় পেল। তারপর বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে—কাঁদতে বলল, আমাকে ক্ষমা করো। অভিশাপ ফিরিয়ে নাও বাবা।
কিছুক্ষণ পরে কিছুটা ঠাণ্ডা হল তান্ত্রিক। গম্ভীরভাবে বলল, তারিণী, অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আমি যা বলেছি, তা ফলবেই।
তবে আরও একটা কথা জেনে রাখ, এই ছেলের কাছ থেকে দুঃখ পেলেও, এই ছেলে তোর মুখ উজ্জ্বল করবে, তোর বংশের আলো হবে—এই ছেলেই। সারা দেশ জুড়ে এই ছেলেই ঘটাবে নবচেতনার জাগরণ। পুরনো বিশ্বাসকে ধ্বংস না—করে সেই কাজ ও করতে পারবে না তারিণী।
ছেলেটা দিনে—দিনে চোখের সামনে কেন যে এমন বিগড়ে যাচ্ছে! কেন হয়ে উঠছে এমন অহংকারী, উদ্ধত, অবিশ্বাসী, নাস্তিক, শ্রদ্ধাহীন? মাঝে—মাঝে তারিণীর অসহ্য লাগে বালকপুত্রের এই বেয়াদবি।
কিন্তু ওইটুকু ছেলের মনের উজ্জ্বলতা, তার নিজের ভাবনা—চিন্তা, নিজস্ব বিশ্বাস—অবিশ্বাসের জোর তারিণী—কে অবাকও করে। ছেলেটা যে বংশছাড়া, পরিবারে থেকেও যেন বাইরের কেউ, একেবারে ভিন্ন পথের পথিক—এইটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না তারিণীর।
তার নিজের লেখাপড়া সামান্যই। ইচ্ছে থাকলেও মেয়েদের লেখাপড়া শেখার সুযোগ কোথায়? মেয়েদের কাজ বলতে তো সংসারধর্ম পালন করা। ছেলে—মেয়ের জন্ম দেওয়া। তাদের বড় করা। আর, পুরুষের কথা মেনে চলা। আর কম বয়েসে বিধবা হলে সতীসাধ্বী হয়ে স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় পুড়ে মরা।
কথাটা ভাবলেই সমস্ত শরীর ভয়ে শিউরে ওঠে তারিণীর। সে জানে, বেশি লেখাপড়া করলেই মেয়েদের ভাগ্যে স্বামী সয় না। কম বয়েসে বিধবা হতে হয়। শাস্ত্রে নাকি এমন কথাই লেখা আছে। শাস্ত্রপাঠে মেয়েদের অধিকার নেই। পুরুষের মুখে যেটুকু শাস্ত্রকথা সে শুনেছে, তার মধ্যে এই কথাটা বিশেষ জরুরি— মেয়েদের লেখাপড়া শেখা শাস্ত্রে নিষেধ।
কাজ কী শিখে? তাই চোখ বুজে স্বামী রামকান্তকে অনুসরণ করল তারিণী। কোনও প্রশ্ন নয়। কোনও সংশয় নয়। কোনও তর্ক নয়। অন্ধ অনুসরণ।
এইভাবে তো বেশ শান্তিতেই কাটছিল জীবন। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটাই ‘শত্রু’ হয়ে দাঁড়াল। একরত্তি বয়েস। কোথা থেকে আসছে সব কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই শক্তি? অবাধ্যতার এই আস্পর্ধা?
আমি ঘোর তান্ত্রিক পরিবারের মেয়ে, বিয়ে করতে বাধ্য হলাম হঠাৎই, এক ঘোর বৈষ্ণব পরিবারের ছেলেকে—তারপর বাবার ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে গ্রহণ করলাম স্বামীর ধর্মবিশ্বাস, এই কাজ কি অন্যায় নয়? নয় কি পাপ? আর এই পাপের এই অন্যায়ের ফসল কি নয় আমাদের ছেলে? এর জন্যই কি তার মতিভ্রষ্টতা? তার এই অদ্ভুত আচরণ? ঈশ্বরে তার এই অবিশ্বাস? সে মা কালীতে না বিশ্বাস করে, না বিশ্বাস করে কৃষ্ণে! তা হলে কীসে, কাকে বিশ্বাস করে সে?
ভাবতে—ভাবতে কোনও কূল পায় না তারিণী। কিন্তু কোন অপরাধে এমন শাস্তি পেতে হল আমাকে? আমার বিয়ের উপর তো কোনও হাত ছিল না আমার! আমার বাবারও তেমন কিছু করার ছিল না। সবটাই ভাগ্য। সবটাই ভগবানের ইচ্ছে!
কার? মা কালীর, না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণর? কে জানে আমার এই প্রশ্নের উত্তর? ভাবে তারিণী।
তারিণীর বিয়েটা সত্যিই ঘটল অদ্ভুতভাবে। সে এক গল্পই বটে। গল্পের শুরুতে এক ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। কৃষ্ণকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তারিণীর ছেলের প্রপিতামহ। অর্থাৎ ঠাকুরদার বাবা। কৃষ্ণকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সুবেদারের আমিন। সেই বাদশাহি আমলে এক একটি প্রদেশের নাম ‘সুবা’। ‘সুবা’—র দায়িত্বে যে, সেই সুবেদার। কৃষ্ণকান্ত কাজ করে এক মুসলিম শাসনকর্তার তত্ত্বাবধানে। এবং নানা চাতুর্যে সে জমি জরিপের কাজ করতে—করতে নিজেই বেশ কিছু জমি—জায়গার মালিক হয়ে বসল।
আমিন কৃষ্ণকান্তের বুদ্ধিমত্তা ও জমি—সংক্রান্ত প্যাঁচপয়জার দেখে মুগ্ধ মুসলমান সুবেদার তাকে ‘রায়’ উপাধি দিল।
‘রায়’ উপাধি পেয়ে কৃষ্ণকান্ত রাতারাতি কেউকেটা। ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পদবিটা সে উপড়ে ফেলে দিয়ে আরও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল।
বংশ বিচারে কৃষ্ণকান্ত কনৌজের ব্রাহ্মণ। খাঁটি শাণ্ডিল্য গোত্র। কিন্তু মুসলমানের চাকরি করে বড়লোক হয়ে সেসব ভুলে ‘রায় পরিবার’ হয়ে জাঁকিয়ে বসল মুর্শিদাবাদে।
কৃষ্ণকান্তর তিন ছেলে। ছোট ছেলে ব্রজবিনোদটি বাপের মতোই বিষয়—সম্পত্তির ব্যাপারে তুখড়। পড়ে গেল নবাব সিরাজ—উদ—দৌলার নেকনজরে। কিন্তু রক্তে কনৌজের শাণ্ডিল্য ব্রাহ্মণ। অহংকার যাবে কোথায়?
সিরাজের দাসত্ব স্বভাবে সইল না। শেষ পর্যন্ত, চাকরিবাকরি ছেড়ে হুগলির ছোট্ট গ্রাম রাধানগরে ব্রজবিনোদ পাঁচ ছেলে—বউ নিয়ে ঘর বাঁধল।
এহেন ব্রজবিনোদের পাঁচ নম্বর ছেলেটিই তারিণীর স্বামী।
এবার আসি বিয়ের গল্পে। পরম বৈষ্ণব ব্রজবিনোদ মৃত্যুশয্যায়। তার গঙ্গাযাত্রা হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘অন্তর্জলি’। গঙ্গার ঘাটেই মারা যাবে সে। তারপর সোজা স্বর্গে। এমন সময়ে এক সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ তার সামনে।
—ব্রজবিনোদ, আপনি পরম বৈষ্ণব। আমি জানি, আপনার পাঁচ ছেলে। আপনার একটি ছেলের সঙ্গে আমার কন্যার বিয়ের অনুমতি দিন, জোড়হাতে সেই সম্পূর্ণ অচেনা ব্যক্তির প্রার্থনা।
—আপনার পরিচয়? জানতে চাইল মুমূর্ষু ব্রজবিনোদ।
—আমার নাম শ্যাম ভট্টাচার্য।
—নিবাস?
—শ্রীরামপুর।
—আমি বৈষ্ণব। কৃষ্ণই আমার একমাত্র আরাধ্য ঈশ্বর।
—আমি পরম শাক্ত।
—এ বিয়ে তা হলে সম্ভব নয়।
—কেন সম্ভব নয়? আমরা তো উভয়েই হিন্দু বাঙালি ব্রাহ্মণ।
—আমি মধুর রসে বিশ্বাসী। আর আপনি তন্ত্রসাধনা করেন। বৈষ্ণব ও শাক্তর মিলনে ফল ভাল হয় না।
ফিরে গেল শ্যাম ভট্টাচার্য। ব্রজবিনোদের মনে জীবনের শেষ মুহূর্তে দেখা দিল অশান্তি। ডেকে পাঠালেন শ্যাম ভটচার্যকে। ছেলেদেরও ডাকলেন গঙ্গার ধারে। সবাই এসে দাঁড়াল।
—ইনি শ্রীরামপুরের শাক্ত ব্রাহ্মণ। এর মেয়েকে আমি আমার ঘরে বউ করে আনতে চাই। তোমাদের মধ্যে কে এঁর মেয়েকে বিয়ে করবেই বলে আমাকে কথা দিতে পারো? ছেলেদের প্রশ্ন করল ব্রজবিনোদ।
—বৈষ্ণব হয়ে শাক্ত পরিবারে বিয়ে! অসম্ভব।
—কেন অসম্ভব? আমি এই বিয়েতে রাজি। আপনি কথা দিন। বলল ছোট ছেলে রামকান্ত।
ব্রজবিনোদ মৃত্যুর আগে কথা দিল। বাবার কথা রাখল রামকান্ত তারিণীকে বিয়ে করে।
বৈষ্ণব ও শাক্তর সেই মিলনের ফসল রামমোহন। তাই তো এমন বিগড়ে গেল ছেলেটা, নিশ্চিত তারিণী। তার বিয়েটাই তা হলে এই অমঙ্গলের কারণ!
রামমোহনের বয়েস নয় পেরল। ইতিমধ্যে সে একটা কাজের কাজ করেছে। সেরে ফেলেছে তিনটি বিয়ে। ন’বছর বয়েসে রামমোহন তিন—তিনটে স্ত্রীর—স্বামী! কম কথা?
তাকে দেখলে মনে হয়, বছর আঠেরোর তাগড়াই যুবক। তার শরীরের বাড়বাড়ন্ত অসাধারণ। সে অচিরেই ছ’ফুট ছাড়াবে। এ—বিষয়ে সকলে নিশ্চিত।
তারিণীদেবী বুঝেছে, এই সারসত্য—এহেন ছেলেকে সংসারে বেঁধে রাখতে একটা বউ ‘যথেষ্ট’ নয়। একটি মেয়ে তার সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েও এমন ছেলেকে সুখী করতে পারবে না। বাপ রামকান্তও স্ত্রীর সঙ্গে একমত। তবে প্রথম বউটা টিকল না। বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই মারা গেল।
বাপ—মা—দু’জনেই চায় কামিনীকাঞ্চনে আসক্ত হয়ে সংসারী হোক রামমোহন।
ধনীর পুত্র বলতে যা বোঝায়, রামমোহন যেন তা—ই হয়। বিষয়—সম্পত্তি দেখুক। দুই বউ, উমা আর শ্রীমতি—কে নিয়ে, যদি মন না—ভরে, আরও বিয়ে করুক।
তা ছাড়া, জমিদার বা ধনীপুত্ররা হামেশাই রক্ষিতা রাখে। রক্ষিতা রাখা তো সামাজিক সম্মানের ব্যাপার। বাগানবাড়িতে আমোদ—আহ্লাদ, বাইনাচ, উপস্ত্রী সংসর্গ না—করলে কেমন বড়লোকের সুপুত্তুর? অনেক ধনী পুরুষের তো বারবাড়িও স্বৈরিণীস্বর্গ। ভিতরবাড়িতে বিভিন্ন বয়েসের চার—পাঁচটি বউ নিয়ে সুখের সংসারে বারবাড়ির বারনারীচর্চা তেমন কিছু বিঘ্ন ঘটায় বলে তো মনে হয় না।
মা ছেলের দিকে তাকিয়ে মানের কথা বুঝতে পারবে না তো, বুঝবে কে? অমন শরীর যে—ছেলের, তার মনে ভোগ—ভালোবাসার বাইরে এত সব সন্দেহ, তর্ক, প্রশ্ন আর ছটফটানি কেন?
রামমোহনের চোখের দিকে তাকায় তারিণী। চোখই মনের আয়না। শরীরের আরশি। সেখানে তারিণী স্পষ্ট দেখে কামিনীকাঞ্চনের লোভ।
কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। তারিণী অবাক হয়। বুঝতে পারে না ছেলের চোখে অলীক উজ্জ্বলতার উৎস।
শোয়ার ঘরে রামকান্ত আর তারিণী একান্তে আলোচনা করছে। বেশ রাত। নিভু—নিভু সেজের আলোয় পালঙ্কে হেলান দিয়ে শুয়ে রামকান্ত। পাশে উপবিষ্ট তারিণী। এত দিন ঘর করেও তারিণীর প্রতি ঝোঁক যায়নি রামকান্তর। তার ভাল লাগে তারিণীর দাপট।
হতে পারে সে স্বল্পশিক্ষিত। হতে পারে তার মন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। কিন্তু তার বিশ্বাসে খুঁটির জোর আছে। সংশয়হীন সংস্কারের এই দৃঢ়তা ছড়িয়ে আছে তারিণীর সমস্ত শরীরজুড়ে, রেখায়—রেখায়, এখনও।
সেজের মৃদু আলোয় ফুটে থাকা তারিণীর শরীররেখার দিকে তাকায় রামকান্ত। তার লোভ হয়। তারিণীর চোখ শুষে নেয় সেই বার্তা।
তার খালি গায়ে শুধু মাত্র পাতলা শাড়ির অপলকা আঁচল। আঁচলটি কোনওভাবে ঘন করার চেষ্টা করে না তারিণী।
ঠিক এই সময়ে রামমোহন ঘরে ঢোকে। একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রবেশ।
কোনও দিন রামমোহন এইভাবে আসে না। এখন তো তার ব্যস্ত থাকা উচিত দুই বউকে নিয়ে।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে বিছানাতেও যায় না। তারিণী জানে, রামমোহন তার পড়ার ঘরে, মগ্ন হয়ে ডুবে আছে পড়ায় কিংবা লেখায়।
—তুই! কী হল? গায়ের আঁচল চকিতে গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে তারিণী।
ঈষৎ অপ্রস্তুত, কিছুটা বিরক্ত রামকান্ত উঠে বসে তাকায় ছেলের দিকে।
—তোমাদের দু’জনকেই একসঙ্গে পাব, তাই এলুম, বলে ন’বছরের রামমোহন।
—হঠাৎ এই সময়ে তোর কীসের প্রয়োজন? রামমোহনের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে রামকান্ত।
—আমি ঠিক করেছি, আমাকে পাটনা যেতেই হবে।
—পাটনা! কেন? প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে তারিণী।
—মা, আমি তোমার এই প্রশ্নর সঠিক উত্তর দিতে পারি, কিন্তু তুমি বা বাবা কেউই বুঝবে না, কেন আমি এত জায়গা থাকতেও পাটনাতেই যেতে চাইছি।
—আমি শুনতে চাই তোর উত্তর, বলে রামকান্ত।
—এটা ১৭৮০ সাল। সাত বছর আগে, রাজা সীতাব রায় এখানেই দেহ রেখেছেন।
—কিন্তু তিনি কে? জানতে চায় রামকান্ত।
—তিনি এক বিখ্যাত নায়েব—দেওয়ান। কিন্তু সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি এক বিখ্যাত ভাবুক। দার্শনিক। যিনি হিন্দু—মুসলমানকে মেলাতে চেয়েছেন। তাঁর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত আমি। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত হতে চাই। তাই পাটনা আমাকে যেতেই হবে।
—অসম্ভব রামমোহন, অসম্ভব! তোকে কিছুতেই আমি পাটনা যাওয়ার অনুমতি দেব না। যা লেখাপড়া করার এখানেই কর। তারিণী চিৎকার করে ওঠে।
—তোর মা ঠিকই বলছে। আমাদের কাছেই পালপাড়া গ্রামে আছেন নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার। আছেন হরিহরানন্দ তীর্থস্বামীর মতো মহাপণ্ডিত। তাঁদের ছেড়ে তুই কেন যাবি পাটনা? ঠান্ডা কন্ঠে প্রশ্ন করে রামকান্ত।
—বাবা, আরবি ভাষায় যেভাবে ইউক্লিড ও অ্যারিস্টটল চর্চা হয়েছে, সংস্কৃতে তা তো হয়নি! মুসলমান সংস্কৃতির কেন্দ্র তো এখন পাটনা। সেখানে ক’বছর লেখাপড়া না করলে সেখানকার মৌলবিদের কাছে অ্যারাবিক ও পার্শিয়ান না—শিখলে আমার লেখাপড়াটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হয়ে থাকবে। এখানে আমি ইউক্লিড পড়েছি। কিন্তু আমি যত দূর ইউক্লিড ও অ্যারিস্টটলের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইছি তা কিছুতেই সম্ভব নয় এই গ্রামের পরিবেশে। আমি পাটনার মৌলবিদের কাছে আরবি ভাষায় গ্রিক গণিত ও দর্শনের পাঠ নিতে চাই, জানতে চাই কী আছে ইউক্লিডের থিওরি অফ নাম্বার্সে, তাঁর জিওমেট্রিতে, আর কীই—বা বলেছেন অ্যারিস্টটল তাঁর এথিকসে, তাঁর মেটাফিজিক্সে, তাঁর পলিটিক্সে, তাঁর তর্কশাস্ত্রে।
—তুই কবে যেতে চাস? রামকান্তর এই প্রশ্নে ঘরে বাজ পড়ল!
—না—না—না। রামমোহনকে আমি বিধর্মী হতে দেব না। ও মোচোরমানের জল খেলে আমি ওকে ত্যাগ করব, আর্ত চিৎকার তারিণীর।
—ছেলেকে ত্যাগ করবে? কেন তারিণী? ও তো অন্যায় কিছু চায়নি! ও তো শুধু জানতে চাইছে।
—ওইটুকু ছেলের এত জেনে কাজ নেই।
—জানার কোনও বয়েস নেই তারিণী…
—তা বলে…?
—জানি, পৃথিবীর কোনও ন’বছরের ছেলে ঘর—বাড়ি, মা—বাবা—সংসার ছেড়ে বিদেশ—বিভূঁইয়ে গিয়ে গ্রিক গণিত ও দর্শন পড়তে চায়নি। চাইবেও না কখনও। কিন্তু রামমোহন সাধারণ বালক নয় তারিণী। তোমাকে এই কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে।
—আমি বুঝতে পারছি আমার বাবার অভিশাপ ফলছে। এত বড় তান্ত্রিক—সাধক তিনি। তাঁর অভিশাপ মিথ্যা হতে পারে না। রামমোহন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ম্লেচ্ছ ধর্ম গ্রহণ করবে। ওই যে ‘গ্রিক’ না কীসব বলল, তাও তো সায়েবদের ধর্ম। হিন্দু শাস্ত্র ছেড়ে ওই সব? তা ছাড়া, ওর দু’টো বউ, সংসার। সেসব ছেড়ে ও চলে যাবে! ওদের কী হবে?
—মা মেজ বউ শ্রীমতি তো বর্ধমানের মেয়ে। কুড়মন গ্রামের ওই মেয়েকে নিয়ে আমি আজীবন কী করব? ওকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আর সেজ উমাকে পাঠাও কলকাতার পাশেই ভবানীপুর গ্রামে ওর বাপের কাছে। ওদের আঁচলে সারাজীবন বাঁধা থাকব না কি?
—কী বলছিস মোহন? তুই ওদের বিয়ে করেছিস। তোর সংসার!
—মা, সংসার একটা সংস্কার। আর জ্ঞান আমার সন্ধান। সকল সংস্কারের বাইরে পা ফেলে আমি অন্ধকার থেকে আলোয় যেতে চাই।
—তুই কবে পাটনায় যেতে চাস বললি না তো? রামকান্ত আবার প্রশ্ন করে।
—কাল। ভোরবেলায় রওনা দেব।
—না, কিছুতেই না। তারিণী ছুটে গিয়ে রামমোহনকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
—মা, আমাকে যেতেই হবে। এই আমার অটল সিদ্ধান্ত।
রামমোহন মা’কে চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করে। তারপর এগিয়ে যায় বাবার দিকে।
—আমি জানি মোহন, তোকে আমি একদিন ত্যাগ করতে বাধ্য হব। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে দুঃখের আঘাতটা আসবে তোরই কাছ থেকে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে তারিণী। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
—মা শোনো, শোনো, আমাকে ভুল বুঝো না। পিছন—পিছন দৌড়ে যায় রামমোহন।
রামকান্ত ধীরে উঠে দাঁড়ায় জানলার ধারে। আজ পূর্ণিমার রাত। তার বাড়ির বাগান জ্যোৎস্নায় ভাসছে।
চাঁদের আলোয় এত কান্না কেন? না। রামকান্ত কিছুতেই কাঁদবে না।
কী গো ফুলঠাকরুন, ছেলের কোনও খবর এল? পরিবার আর পাড়ার অনেকেই তারিণীকে ‘ফুলঠাকরুন’ বলে ডাকে।
—দেড় বছর হয়ে গেল। অ্যাদ্দিনে মাত্র তিনটে চিঠি দিয়েছে। তাও লিখেছে বাপকে। মুখ্যু মা—কে সে ভুলেই গিয়েছে।
—দুখখু করে কী লাভ বল ফুল? ছেলে তো তোর লেখাপড়া শিখতেই গিয়েছে। তা, সে যখন মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন তো তোর মুখই উজ্জ্বল হবে।
—মুখ ‘উজ্জ্বল’ হবে, না ‘কালো’ হবে বুঝতে পারছিনে, বলে তারিণী।
—তা যা বলেছিস ফুল। শুনেছি পাটনায় মোচরমানদের রমরমা। তোর ছেলে আবার না…। পাড়ার আর—এক বউ যেন একটু চিমটি কেটেই কথাটা বলে।
—আমারও তো সেই ভয়! এখানে তবু চোখে—চোখে রাখতুম। কিন্তু মোহন এইটুকু বয়েসে এত দূরের দেশে চলে যাবে, কে জানত? কী করে সারা দিন, কীভাবে থাকে, কী খায়, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, কিছুই জানিনে।
—পাটনা কত দূরের দেশ গো ফুলঠাকরুন, প্রশ্ন করে পরিবারেরই আর—এক মেয়ে।
—কত দূর কী করে বলব গো? গিয়েছি কি কখনও? আর যাবই—বা কেন ওই ম্লেচ্ছদের দেশে? তবে শুনেছি অনেক জঙ্গল, নদী, অনেক পায়ে হাঁটা, আর গরুর গাড়ির পথ পেরিয়ে তবে পাটনা। মাসের—পর—মাস ধরে যেতে হয়। পথেই নাকি কত লোক মরে রোগে, কত প্রাণ দেয় ডাকাতের হাতে, আর কত লোককে বাঘে খায়। যারা পৌঁছয়, তাদের মধ্যে ক’জনই—বা ফিরে আসে? তারিণীর গলা ধরে আসে কান্নায়।
—তোমার মোহন ঠিক ফিরে আসবে, দেখো তুমি, তারিণীকে আশ্বাস দেন এক বৃদ্ধা।
—ফিরে এলেই তো হল না পিসিমা! মোহন যদি বেধর্মী হয়ে ফেরে, তার থেকে না—ফেরাই ভাল। আমি অমন ছেলের মুখ দেখতে চাইনে।
—কী বলছিস ফুল! মোহন নিজের ধম্ম চেড়ে কোন ধম্ম নেবে রে? খিস্টান হবে না কি? খিস্টান হওয়ার যা হিড়িক পড়েছে।
—অচ্ছুতদের মধ্যেই খিস্টান হচ্ছে বেশি। সে অন্য কথা। কিন্তু পিসিমা, রামমোহন ওর দাদা জগন্মোহনের মতো বাপ—মা’র বাধ্য ছেলে নয়। আমাদের কোনও কথাই শোনে না। বোঝালেও বোঝে না।
—কী বোঝালে বোঝে না রে?
—মোহন হিঁদুদের তেত্তিরিশ কোটি দেব—দেবীর একটিকেও মানে না। নারায়ণশিলাকে প্রণাম করে না।
—সে কী রে! তা হলে ‘মানে’ কাকে?
—মোহন বলে ভগবান একটাই। আর সেই ভগবান নিরাকার। তার কোনও মূর্তি নেই।
—বলছিস কী ফুল!
—এসব কথা ও বাপকে চিঠি লিখে জানিয়েছে। মোহন কোরান আর বাইবেল পড়ছে। ম্লেচ্ছদের ধর্মে নাকি একটাই ভগবান। এসব পড়ে মোহন এই বয়েসেই ঠিক করে ফেলেছে, সে হিঁদুদের মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস করবে না।
—তোর বর কী বলল ছেলের এই মতিগতি দেখে?
—রেগে আগুন। বলেছে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না যদি না প্রায়শ্চিত্তির করে। তবে ওঁর নিজেরই মতিগতির ঠিক নেই।
—কেন, ঠিক নেই কেন?
তারিণীর কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে আরেক আত্মীয়া। রায়বাড়ির পুজোর দালানে বসেছে মেয়েদের মজলিশ। তারিণীই আলোচনার মধ্যমণি। আর কারও ছেলে তো আর আরবি—ফারসি পড়তে পাটনা যায়নি ন’বছর বয়েসে।
—তোর মেয়েটা বেঁচে থাকলে তোর দুঃখ বুঝত। অমন ফুটফুটে মেয়ে, অকালে চলে গেল। কেনই—বা এল? কেনই—বা গেল! ভগবানের এই লীলাখেলার কতটুকুই—বা বুঝি আমরা! দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসিমা।
—কেন যে তুমি বারবার আমার মরা মেয়েটার কথা বলো। আমি কষ্ট পাই। বোঝো না তুমি? তারিণীর কণ্ঠে একই সঙ্গে রাগ ও কাতরতা।
—তা হলেই বোঝ ফুল, আমার তিন—তিনটে ছেলেমেয়ে হারানোর কষ্টটা কতখানি। তোর তো তবু জগন্মোহন, রামমোহন আছে। আমার?
মেয়েদের মধ্যে কে একজন পিসিমার পিঠে হাত বোলাতে থাকে। পিসিমা আঁচলে বারবার চোখ মোছে।
—ফুল, বললি না তো কেন তোর মনে হয় তোর বরের মতিগতির ঠিক নেই? চোখ মোছা শেষ করে জিগ্যেস করে পিসিমা। তারিণীর বরের মতিগতির ব্যাপারে উপস্থিত সব মেয়েরই আগ্রহ প্রকাশ পায় চোখে—মুখে।
—ওই আর কী! কখনও তিনি মোহনের উপর রেগে অগ্নিশর্মা, আবার কখনও বলেন, জানো তারিণী, মোহন এই বয়েসেই আরবি ভাষায় দর্শন পড়ছে।
—সেটা কী রে তারিণী? প্রশ্ন করে সমবয়সি পাড়ার বউ। তারিণী কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই রায় পরিবারের এক দাসী এসে বলে, মা, বাবু ডাকছেন, ভিতরে আসুন, আপনার ছেলের নাকি চিঠি এসেছে।
—মোহন চিঠি লিখেছে! চকিতে উঠে দাঁড়ায় তারিণী। সিঁড়ি ভাঙে এক দৌড়ে। হুড়মুড় করে হাঁপাতে—হাঁপাতে পৌঁছয় ঘরে।
—কী লিখেছে মোহন?
—সুখবর তারিণী, বলে রামকান্ত।
—কেমন আছে সে?
—সে পাঠ শেষ করে বাড়ি ফিরবে। খুব তাড়াতাড়ি।
—কবে? কবে গো?
আর মাত্র একবছরের মধ্যেই।
—এখনও একবছর? কেন, মিছিমিছি ওখানে থেকে কী লাভ?
—পাঠ শেষ করতে এখনও সাত—আট মাস। সুতরাং বাড়ি ফেরা কি আর বছরখানেকের আগে হবে তারিণী?
—আর কী লিখেছে মোহন?
—অত সব জেনে তোমার কী লাভ?
—আমি তার মা। মোহনের সব কিছু আমাকে জানতেই হবে।
—সে লিখেছে, সে মৌলবি ও পাদ্রিদের কাছে প্রতিদিন শাস্ত্রপাঠ করছে। পড়ছে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন। যতই সে পাঠ নিচ্ছে ততই সে স্থির হচ্ছে এই সিদ্ধান্তে যে, আমাদের সব দেব—দেবী মিথ্যে। ঈশ্বর অদ্বিতীয়। এবং নিরাকার।
তারিণী পাথরের মূর্তি। ঘরের মাঝখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। রামকান্ত অবাক হয়ে তাকায় তারিণীর দিকে। তারিণীর চোখ থেকে নামছে কান্নাধারা। কোনও কথা নেই। শরীরে কোনও প্রাণস্পন্দনও চোখে পড়ল না রামকান্তর।
—তারিণী! ডাকে রামকান্ত।
সাড়া দেয় না তারিণী। রামকান্ত পালঙ্ক থেকে উঠে গিয়ে তাড়াতাড়ি তারিণীকে ধরে। রামকান্তর প্রশস্ত বুকের উপর এলিয়ে পড়ে তারিণী। তার জ্ঞান আছে কি না, রামকান্ত ঠিক ঠাওর করতে পারে না।
পাটনায় প্রায় তিন বছর কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে রামমোহন। রামমোহনকে এত দিন পরে ফিরে পাওয়ার আনন্দে রামকান্ত—তারিণী দু’জনেই কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেল।
—তুই কত বড় হয়ে গিয়েছিস মোহন! বছর বারোর ‘যুবক’ ছেলেকে আদরে জড়িয়ে ধরে তারিণী।
দেখি—দেখি কত বড় হয়েছিস তুই! ছেলের মুখটি হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিরীক্ষণ করে রামকান্ত।
কিন্তু ঝড় উঠল অচিরে।
—তোকে কিন্তু সংসারে ফিরে আসতে প্রায়শ্চিত্তির করতে হবে মোহন। ঘরদোর পবিত্র করতে আমি সত্যনারায়ণ পুজোর সব আয়োজনও করে ফেলেছি।
—প্রায়শ্চিত্ত? কেন? রাগে ফেটে পড়ে রামমোহন।
—ম্লেচ্ছদের দেশ থেকে এলি তো, তাই। এবার তুই হিঁদুর ঘরে ফিরে এলি বাবা। নারায়ণ প্রণাম করে পাপ কাটিয়ে পরিবারের মাঝে নিজের জায়গায় ফিরে আয়।
—অসম্ভব, মা। আমি কোনওরকম পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করি না। ঈশ্বর আছেন কি না, আমি সে—বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নই। যদি থাকেনও, তিনি নিরাকার। তোমাদের মূর্ত ভগবানকে, তোমাদের অসংখ্য দেব—দেবীর কোনওটিতেই আমার বিশ্বাস নেই।
—তুই কি বেধর্মী হয়েছিস মোহন? সত্যিকথা বল আমাকে আর তোর বাবাকে।
—মা, আমি বিধর্মী নই। আমি হিন্দু। কিন্তু হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ভগবানের মূর্তি তৈরি করে পুজো করার কোনও সম্পর্ক নেই। হিন্দু দর্শন সকল বিষয়ে বিতর্কে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঈশ্বরও তর্কাতীত নয়, মা ‘প্রকৃত’ হিন্দু বির্তকে বিশ্বাসী।
—মোহন, তোর কথা আমরা বুঝতে পারছি না। তোর বাবা না, আমিও না। তুই পাটনা থেকে কাদের কাছে কীসব শিখে এলি মোহন? তোকে কেমন করে ঘরে ফেরাব?
—আমি তো ঘর করার জন্য ঘরে ফিরিনি মা। শুধু তোমাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছি।
—মানে! কী বলছিস মোহন? আর্ত চিৎকার করে ওঠে রামকান্ত।
—হ্যাঁ বাবা, তা—ই। আমি কাশী চলে যাব কিছু দিনের মধ্যেই। কবে ফিরব, তা জানি না।
—কাশী! হঠাৎ আবার কাশী কেন? প্রশ্ন করে তারিণী।
—মা, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু শাস্ত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, ভাষা ও সাহিত্য পাঠের জন্য কাশী ছাড়া আর কোথায় যাব তোমরাই বলো। হিন্দু ধর্মের হিন্দু শাস্ত্রের হিন্দু ভাবনার একেবারে মূলে পৌঁছতে চাই আমি। যদি হিন্দু ধর্ম আমি কোনও দিন ত্যাগ করি, সবটুকু জানার পরেই সেই সিদ্ধান্ত নেব।
রামকান্ত ও তারিণীকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রামমোহন।
রামকান্ত ও তারিণী পরস্পরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
রামমোহনের পিতৃদেব রামকান্তর ঘরে এইমাত্র বজ্রপাত হল। রামকান্ত যেন পাথরের মূর্তি! নিঃসাড়। রামমোহন ইতিমধ্যে তিন বছরের বেশি কাশীবাসী।
রামকান্ত আর তারিণী উভয়েই কিছুটা নিশ্চিন্ত, হিন্দুতীর্থ বারাণসীতে বেদ—উপনিষদ পড়ে, হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে মৌলবিদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছে মোহন। হয়তো, নারায়ণশিলাতে তার বিশ্বাস ক্রমে—ক্রমে ফিরে আসছে। এই আস্থা ও আশাকে চূর্ণ করে ঘটল এই অকস্মাৎ বজ্রপাত, সকাল শুরু হতে—না— হতেই।
দুর্গাপুজো এল বলে। বাড়ির নাটমন্দিরে মূর্তি তৈরি হচ্ছে। এমন সময় রামমোহনের একটি চিঠি জানাল:
কেহ—কেহ বলিয়া থাকেন বিষ্ণুপাদলাভেই মোক্ষ, কেহ—বা বিশ্বাস করেন শিবপাদপদ্মে লীন হওয়া মুক্তি, কেহ বলেন কালিকাচরণরেণুপ্রসাদ পরম—পুরুষার্থলাভ। এই গূঢ়তত্ত্বও লাভ করিয়াছি যে, বৃন্দাবনে শৃগালত্বলাভই মুক্তি। এমনকী, কোনও—কোনও পরম হিন্দু গঙ্গায় কচ্ছপা— দিযোনিপ্রাপ্তি পরম শ্রেয় মনে করেন। এই মুক্তিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই।
লিখেছে পনেরো বছরের রামমোহন!
সে আরও জানিয়েছে : ঈশ, কেন, কঠ, মণ্ডুক ও মাণ্ডূক্য—এই পাঁচখানি উপনিষদ আমি গভীরভাবে অধ্যয়ন করিয়াছি। আমি এইটুকু বুঝিয়াছি যে, এই ক’খানি উপনিষদ বিশ্বের পরমতত্ত্ব ব্রহ্মবস্তুকে সাধারণ মানবের, সাধারণ অনুভবের উপরে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। আমি বেদ—বেদান্ত পাঠ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, যাহার দ্বারা ‘ব্রহ্ম’—কে জানা যায়, তাহাই ‘শ্রেষ্ঠ’ বিদ্যা। ব্রহ্মকে জানা যায় দুই উপায়ে। এক, জগৎকার্য দেখিয়া। দুই, সমাধি—যোগে। জন্মাদস্য যতঃ—জগতের জন্ম, স্থিতি এবং লয় যাহা হইতে উৎসারিত তাহাই ব্রহ্ম।
উপনিষদের দীক্ষানুসারে ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি ব্রহ্মসাধনের পথ। একটি কথা ক্রমশ বুঝিতে পারিতেছি, আরবি ভাষায় পাশ্চাত্য দর্শন ও সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু দর্শন পাঠ করিয়া, উপনিষদ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের যে প্রশস্ত পথ নির্দেশ করিয়াছে, সে—পথে ভারতের প্রাচীন ব্রহ্মতত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় সাধনার জড়বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের আশ্চর্য মিল রহিয়াছে।
এইটুকু পড়ে রামকান্ত কেমন যেন অসুস্থ বোধ করছে। তার গা—হাত—পা কাঁপছে কেন! হিন্দু শাস্ত্র পাঠ করে রামমোহনের এ কী পরিণতি!
সে চিৎকার করে ওঠে—ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছ! এই বাড়িতে তোর আর কোনও স্থান নেই।
কিন্তু বাকি চিঠিটুকু না—পড়েও থাকতে পারে না রামকান্ত। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, তবু সে পড়ে।
রামমোহন স্পষ্ট দ্বিধাহীন ভাষায় এই কথা লিখেছে: জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা—এই তিনই মায়ার দ্বারা প্রকাশিত। এই তিনকে বিচার করিলে আত্মাই অবশিষ্ট থাকে।
এইটুকু পড়ে রামকান্ত থামে। ভাবে। মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারে না। পরের বাক্যগুলিতে তার চোখ যায়, চিৎস্বরূপ আত্মাই জ্ঞান। চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই জ্ঞেয় এবং স্বয়ং আত্মাই জ্ঞাতা।
রামকান্তর মনে হয়, এ তো পাগলের প্রলাপ। হিন্দু ধর্মে এসব কথা আছে না কি? রামমোহন যাকে ‘ব্রহ্ম’ বলছে, যার উপাসনাই নাকি একমাত্র ধর্ম, সে কেমন? কেমন দেখতে তাকে? কেমন তার গুণাবলি?
রামমোহন জানিয়েছে সে—কথা। মন দিয়ে পড়ে রামকান্ত: ব্রহ্ম শব্দহীন, স্পর্শহীন, রূপহীন, রসহীন, গন্ধহীন এক অব্যয় নিত্য সত্তা। ব্রহ্ম নিজে অদৃষ্ট। কিন্তু তিনি নিরন্তর দ্রষ্টা। তিনি শ্রবণের বিষয়ীভূত নন। কিন্তু নিজে শ্রোতা। তিনি স্থূল নন। আবার সূক্ষ্মও নন। তিনি নির্বিকার নিরাধার, নির্বিশেষ, সর্বদর্শী, সর্বব্যাপী, তিনিই সকলের আত্মা। সবশেষে মধ্বাচার্যের একটি উক্তি : নির্গুণ অলীক ব্রহ্ম প্রমাণের অবিষয়। ওঁ তৎ সৎ।
চিঠি হাতে খাটের একপাশে বসে পড়ল রামকান্ত। তার ঘরের মধ্যে যে—বজ্রাঘাত হল, তাতে এইমাত্র চূর্ণ হয়েছে নারায়ণশিলা। লুটোপুটি খাচ্ছে শিবলিঙ্গ। হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেব—দেবী লোপাট। হিন্দুর সমস্ত আচার, সব ব্রত, কত হাজার বছরের বিশ্বাস ও সংস্কার, সব ধূলিসাৎ?
কী নিয়ে বাঁচব আমি? কী নিয়ে বাঁচবে তারিণী? দুর্গাপুজোর সুবাস আকাশে—বাতাসে। রামকান্ত জানলা দিয়ে ঠাকুরদালানের দিকে দেখে। তৈরি হচ্ছে দুর্গামূর্তি। আহা, কী সুন্দর! এক বছর পরে প্রতিটি হিন্দুর মা আসছেন ঘরে। এর কোনও মূল্য নেই তার ছেলের কাছে!
রামকান্ত বুক চাপড়ে—চাপড়ে বারবার হুঙ্কার দিতে থাকে, কুলাঙ্গার, কুলাঙ্গার। তারপর সারা বাড়ি কাঁপিয়ে ডাক দেয়, তারিণী, তারিণী, কোথায় তুমি?
—তুমিই তো লাই দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছ।
—আমি আবার লাই দিলুম কবে? বাবা—বাছা তুমি করো না?
—আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। বাপের শাসন না—পেয়ে মোহন নষ্ট হয়েছে।
—আমি তো দিয়েছিলুম দূর করে। করিনি?
—ওকে ‘দূর’ করা বলে? মোহন যে তিন বছর ধরে কাশীতে আছে, তার খরচ জোগাচ্ছে কে? তুমি ভাবো আমি কিছুই জানি না?
—তারিণী, প্রথম—প্রথম আমি কোনও অর্থই পাঠাইনি। মোহন কীভাবে খাওয়া—পড়ার খরচ চালিয়েছে জানো?
—জানতে চাইনে। অমন ছেলে না—খেয়ে মরল না কেন?
—মোহন সারাদিন অধ্যয়ন করার পর সারা রাত জেগে প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিগুলি হাতে লিখে নকল করে তাদের রক্ষা করছে। তার জন্য সে সামান্য পারিশ্রমিকও পেয়ে থাকে। এইভাবেই তার চলে।
—আর তুমি টাকা পাঠাও না? তারিণী কান্না চাপার চেষ্টা করে।
—পাঠাই তারিণী। মোহন কখনও চায় না। তবে আমি পাঠালে সেই অর্থ সে গ্রহণ করে।
—ফিরবে কবে?
—জানি না তারিণী। ফেরার কথা তো কিছু জানায় না। তবে…
—তবে কী?
—তবে লোকমুখে খবর এসেছে ক’দিন আগেই…।
—কী খবর? তারিণী উদ্বিগ্ন।
—খবর হল, সে বাড়ি ফিরেই একটা বই লিখবে।
—মোহনের বয়েস এখনও ষোলো হয়নি। এরই মধ্যে সে বই লিখবে? বই তো বুড়ো পণ্ডিতরা লেখে।
—হ্যাঁ, তারিণী, সেটাই আমার চিন্তার বিষয়। বড় ভয় করছে।
—ভয় করছে!
—হ্যাঁ, রীতিমতো ভীত আমি, কারণ তার বইটির বিষয়ও আমি জানতে পেরেছি।
—কী বিষয় গো?
—হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী।
—তাতে ভয় পাওয়ার কী হল?
—এই যে আমরা দূগ্গাপুজো করছি, নারায়ণশিলা সাক্ষী করে জমিদারি চালাচ্ছি, মোহন লিখবে—সব কিছুই নাকি মাটির ঢেলা আর পাথরের মূর্তি! বুঝলে তারিণী?
—মোহন যদি সেই বেয়াদপি করে, তাহলে ওকে শেয়াল—কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেব। পথেঘাটে না—খেয়ে মরুক।
—মোহন ফিরুক। এ—বই ওকে লিখতেই দেব না।
—একটা কথা, তুমি শুনেছ কি না জানি না, আমি দু—চারজনের মুখে শুনেছি।
—আমিও শুনেছি। মোহন কাশীর এক অসতী বিধবার পাল্লায় পড়েছে।
—তোমার বিশ্বাস হয়?
—না। মোহন হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করছে। হিন্দুরাও ওর নামে অপপ্রচার শুরু করেছে।
—তোমার কথাই সত্যি হোক।
—সত্যি—মিথ্যে বুঝি না তারিণী। মোহন যদি সত্যিই কোনও অসতী বিধবার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, কিংবা কাশীতে বেশ্যাসঙ্গ করে থাকে, তাতে আমাদের কী? পুরুষের জীবনে একাধিক মেয়েমানুষে কোনও দোষ নেই। কিন্তু মোহন যদি সত্যিই হিন্দুর পৌত্তলিকতাকে অপমান করে, তার চেয়ে বড় সর্বনাশ আমি কল্পনাও করতে পারি না তারিণী। মোহন আগে ফিরে আসুক। তারপর হেস্তনেস্ত করব। ওর মনে কী আছে জানা দরকার।
—আমি জানি ও ফিরলে কী হবে।
—কী হবে?
—কী আবার? তুমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাড়িতে এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করবে। পল্লির সব্বাইকে নেমন্তন্ন করবে।
—তা তো করবোই। এই বয়েসে রামমোহনের বিদ্যাচর্চাটা ভাবতে পারো? আমি স্বীকার করছি, ওর সঙ্গে তর্কে এঁটে ওঠা দায়। যখনই যাই বলি, ও চুপ করে শোনে। তারপর একটা ‘কিন্তু’ নিয়ে আসে। এমন একটা প্রশ্ন তোলে যাতে এত দিনের বিশ্বাস টলে যায়। তারিণী, মোহনের ওই ‘কিন্তু’—টাকে আমি ভয় পাই।
শোনো রামমোহন, তোমাকে শেষবারের মতো বলছি, এ—বই তুমি প্রকাশ করতে পারবে না। এই আমার আদেশ।
কাশী থেকে রামমোহন ফিরে আসার পর থেকে রামকান্ত আর তারিণীর জীবনে দেখা দিয়েছে অপ্রত্যাশিত ঝঞ্ঝাবর্ত। বাত্যাপীড়িত তাদের প্রাত্যহিক সংসার। পিতা—পুত্রের কলহ তো লেগেই আছে। তারিণীর ক্ষোভও ফেটে পড়ছে অহরহ।
হিন্দু ধর্মের পীঠস্থান পুণ্যময় বারাণসী থেকে ফিরে এল এ কোন ঈশ্বরহীন, ভক্তিশ্রদ্ধাহীন, হিন্দুধর্মবিরোধী রামমোহন? মাত্র ষোলো বছর বয়েসে কে তাকে লিখতে বলল হিন্দুর পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সর্বনেশে গ্রন্থ? সে তো এখনও নিতান্ত নাবালক। কতটুকু সে বোঝে প্রগাঢ় হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিতরের শাঁস?
—বাবা তুমি আমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলো, কেন এই বই প্রকাশ করতে তুমি বাধা দিচ্ছ?
—মোহন, তোর পাণ্ডুলিপি পড়ার পর থেকে তোর মা’র আর আমার মনে এতটুকু শান্তি নেই। আমাদের রাতের নিদ্রা গিয়েছে। এ—বই বের হলে আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। রাধানগরের ভিটে ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে।
—তোমরা বৃথাই ভয় পাচ্ছ। এবং বৃথাই রাগ দেখাচ্ছ। ভয় এবং রাগ কোনও যুক্তি নয়। আমাকে আবেগবর্জিত যুক্তি দিয়ে বোঝাও এই বইটির বিষয়ে কেন তোমাদের আপত্তি।
রামকান্ত পুত্রের মুখে ছুড়ে মারে গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি। রাগে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। তারিণী বুঝতে পেরেছে বাপ—ছেলের আবার শুরু হয়েছে তক্কাতক্কি, কলহ। সে ছুটে এসে দাঁড়ায় রামকান্তর পাশে।
—মোহন, আমি যুক্তি—তক্কের ধার ধারিনে। আমি তোর বাপ। আমি বলছি। সেটাই যথেষ্ট। এ—বই বের হবে না।
—এ—বই বের হবে।
—মোহন তুই বাবার আদেশ মানবিনি? এত বড় আস্পর্ধা?
—যুক্তিবিহীন আদেশের আমি বাধ্য নই মা, সে আদেশ যারই হোক।
—মোহন তুই যুক্তি চাইছিস! হিন্দু ধর্মের হাজার—হাজার বছরের পৌত্তলিকতাকে আঘাত করে, নারায়ণশিলাকে চুরমার করে, কৃষ্ণ—কালীকে বর্জন করে তুই আমার কাছে যুক্তি চাইছিস—কেন এই বই আমি প্রকাশ হতে দেব না? এই গ্রন্থ প্রকাশিত হলে কী হবে, তুই জানিস?
—জানতে চাইনে। আমি যা ‘সত্য’ বলে জেনেছি, তাই লিখেছি।
—মোহন, শোন বাবা, তোর জন্ম পরম বৈষ্ণব পরিবারে। তোর বাবা, আমি, আমাদের বাড়ির সকলে, তোর দাদা, তোর বউঠাকরুন, সবাই আমরা কৃষ্ণকেই ‘ভগবান’ বলে পুজো করি। তোর দুই স্ত্রী কৃষ্ণপুজো করে রোজ সকালে। শ্রীকৃষ্ণই আমাদের গৃহদেবতা। তুই সেই গৃহদেবতার মূর্তি ভেঙে ফেলবি? উঠিয়ে দিবি রাধাকৃষ্ণের পুজো, মন্দির? আর্তনাদ করে ওঠে তারিণী।
—মা, তুমি তো মহাতান্ত্রিকের কন্যা। এক সময়ে কালীকেই প্রণাম করতে। কালী থেকে কৃষ্ণে সরে গেলে কেন? কে ‘সত্য’? কালী না কৃষ্ণ?
—মোহন, তুই হিন্দু ধর্মের কিছুই বুঝিস না। স্বামীর ধর্মই সতীর ধর্ম। বিয়ের আগে বাবার আরাধ্য দেবীকেই মেনে নিয়েছি। বিয়ের পর দেখলুম, আমি এক পরম বৈষ্ণবের স্ত্রী। তার বিশ্বাসই আমার বিশ্বাস। এখন কালীর চেয়ে অনেক বেশি সত্যি কৃষ্ণ।
তারিণীর কথায় হা—হা করে হেসে ওঠে রামমোহন। হাসতে—হাসতেই বলে, তোমার নিজের কোনও মন নেই মা? বিচার—বুদ্ধি নেই? তুমি নিজে ভাবতে পারো না?
—মেয়েরা আবার নিজে—নিজে ভাববে কী রে? হিন্দু শাস্ত্রে মেয়েদের ভাবতে মানা, জানিসনে সে—কথা?
রামমোহনের চোখ দুটি হঠাৎ যেন অশেষ করুণায় ছলছল করে ওঠে। সে মা—র দিকে তাকিয়ে বলে, মা গো, কে তোমাদের পথ দেখাবে এই অন্ধকার থেকে? কে নিয়ে যাবে আলোয়?
—কেন, ব্রাহ্মণ পুরুতমশাইরা। এঁরা মহাপণ্ডিত। এঁরাই তো সমাজের মাথায়। ওঁরাই পথ দেখাচ্ছেন হিন্দু সমাজকে। ওঁদের আদেশ মেনে চলতেই হবে বাবা।
—ব্রাহ্মণ! কাশীধামেও আমি কোনও ব্রাহ্মণের দেখা পাইনি মা! কোথায় পাবে তুমি ‘প্রকৃত’ ব্রাহ্মণ?
—তোর এ—কথার অর্থ কী? গর্জে ওঠে রামকান্ত। তেড়ে মারতে যায় রামমোহনকে। বাধা দেয় তারিণী।
—বাবা, ব্রাহ্মণ সেই জন, যার ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ হয়েছে। ব্রহ্মকে যে জেনেছে।
—যদি কোনও শূদ্রের ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়?
—তা হলে সে অবশ্যই ‘ব্রাহ্মণ’। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ ব্রাহ্মণ নয় বাবা।
কিন্তু শূদ্রের ব্রহ্মজ্ঞান হবে কী করে? শাস্ত্র পড়ে এটুকু জানিস না?
—কেন, কোনও শূদ্র ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারে না?
—না, কারণ সে ‘শূদ্র’। তার শাস্ত্রচর্চার অধিকার কোথায় মোহন? আমরা ‘রায়’ হয়েও বন্দ্যোপাধ্যায়। এ—কথাটা মনে রাখিস। দ্বিজশ্রেষ্ঠ। বর্ণশ্রেষ্ঠ। আমাদের যে—অধিকার আছে, শূদ্রের সে—অধিকার নেই মোহন। শাস্ত্রের নিষেধ।
—আমি বর্ণহীন সমাজে বিশ্বাসী বাবা। আমি শাস্ত্র পাঠ করে ব্রাহ্মণের উদার ব্যাখ্যা পেয়েছি। তোমার বামুন পুরুতরা, যারা সমাজ চালাচ্ছে—তারা কেউই ব্রাহ্মণ নয়।
—তুই জাত—ধর্ম কিচ্ছু মানিস না মোহন? তুই কাশী থেকে ম্লেচ্ছ হয়ে ফিরলি! বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা, দূর হয়ে যা আমাদের সামনে থেকে। তোর মরণ হয় না কেন? কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে অভিশাপ দেয় তারিণী।
—বেরিয়ে যাচ্ছি মা। বিতাড়িত হব, সে—কথা আমি জানতুম। কিন্তু তোমাদের একটি কথা বলে যাই, আমার বইটি খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে।
এ—কথা বলে পাণ্ডুলিপিটি ঘরের মেঝে থেকে তুলে নেয় মোহন। ধুলো ঝেড়ে সেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। রামকান্ত—তারিণী, দুজনেই বুঝতে পারে, রামমোহন তার বিশ্বাসে অটল। এ—বই যে প্রকাশিত হবেই, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। এবং অবাধ্য পুত্রের জন্য আর ভেবেও লাভ নেই। যা অনিবার্য, তবে তাই ঘটুক।
—তা হলে এ কথাও জেনে যা মোহন, তোর এই পৈতৃক ভিটেতে এই মুহূর্ত থেকে তোর আর কোনো জায়গা নেই। আমার বিষয়—সম্পত্তি থেকেও তুই বঞ্চিত হলি। তুই ‘বিধর্মী’। আমাদের আর মুখ দেখাসনি। চিৎকার করে বলে রামকান্ত। বাড়ির সবাই শুনুক, এটা সে চায়।
—তুমি মোহনকে তেজ্যপুত্তুর করলে? স্বামীকে প্রশ্ন করে তারিণী।
—হ্যাঁ তারিণী। সমাজে থাকতে গেলে এ ছাড়া উপায় নেই।
—মা গো! বলে চিৎকার করে ওঠে তারিণী। রামমোহন এগিয়ে আসে মা’কে প্রণাম করতে। চরণ সরিয়ে নেয় তারিণী। বাবার দিকে এগিয়ে যায় রামমোহন।
—আমাকে স্পর্শ করার অধিকার তুমি হারিয়েছ। আমাকে অশুচি কোরো না, বলে রামকান্ত।
রামমোহন নীরবে তার প্রণাম রাখে মেঝের উপর।
তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
রামমোহন নিজের ঘরে যায়। সেখানে তার দুই স্ত্রী অপেক্ষা করছে। তারা এত দিন বাপের বাড়িতেই ছিল। রামমোহন কাশী থেকে ফিরতেই তাদেরও ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
—বাবার সঙ্গে আবার নতুন করে গণ্ডগোল হল? অ্যাতো চেঁচামেচি কীসের গো?
—বিশেষ কিছু নয়। যা ভেবেছিলুম, তাই হয়েছে।
—কী হয়েছে? প্রশ্ন করে রামমোহনের এক স্ত্রী শ্রীমতি।
—বাবা আমাকে ‘ত্যাজ্যপুত্র’ করল।
—তার মানে? প্রশ্ন করে আর—এক স্ত্রী, উমা।
—তার মানে এই বাড়িতে আমার একদণ্ডও আর বসবাসের অধিকার নেই।
—সে কী! আমরা যে দু’জনে তোমার সঙ্গেই ঘর করতে এসেছি গো। যেখানে যাবে আমাদেরও নিয়ে যেতে হবে।
—তা হয় না বউ।
—কেন হয় না? কোথায় তুমি যাবে শুনি?
—তিব্বত!
—সেটা আবার কোথায়?
—হিমালয় পেরিয়ে।
—হিমালয় পেরিয়ে? হিমালয় তো পৃথিবীর শেষ। তারপর গেলে তো পড়ে যাবে গো। একেবারে অন্ধকার। কোথায় পড়ে মরবে কেউ জানবে না।
রামমোহন অবাক হয়ে তাকায় তার দুই স্ত্রী’র দিকে। তার বিস্ময়ের মধ্যে জেগে ওঠে কান্না। এ—কান্না তার দেশের সব মেয়ের কথা ভেবেই। তারপর বলে, শোনো বউ, আমি তোমাদের ঘর করার জন্য ফিরে আসিনি। আমি শুধু দেখা করে গেলুম তিব্বত যাওয়ার পথে।
—কেন যাচ্ছ পৃথিবীর বাইরে সেই দেশে? প্রশ্ন করে শ্রীমতি।
—যাচ্ছি, খুব প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্র আর লিপি পড়তে।
—কী আছে তাতে? কী এমন নতুন কথা যা আমাদের শাস্ত্রে নেই?
—সেই শাস্ত্র, সে—বিশ্বাস এমন এক ধর্মের কথা জানিয়েছে, যে—ধর্মে ভগবান ‘নেই’।
১৭৮৯। রামমোহন সবে পনেরো পেরিয়েছে। পায়ে হেঁটে তিব্বত যাবে, এই অর্বাচীন অভিপ্রায়ে সে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে। কী এমন ডাক এল তিব্বত থেকে, যে ডাকে সে সাড়া না দিয়ে পারল না?
ধর্মের ডাক। তা ধর্ম কি ছিল না এদেশে? এ—ধর্ম সে—ধর্ম নয়। সে শুনেছে প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্র আর লিপি লুকনো আছে তিব্বতে। তাকে জানতেই হবে কী কথা আছে বৌদ্ধ ধর্মে। সে এইটুকু জানে যে, এই ধর্মে জ্বলছে এক নতুন আলো। কেমন আলো? ঈশ্বরহীন ধর্মের আলো।
কিন্তু যাবে কী করে তিব্বত?
বেশির ভাগ মানুষ, যারা তার চারপাশে খাচ্ছেদাচ্ছে, বিয়ে করছে, সংসার করছে, দু’পয়সা কামানোর জন্য রাতদিন সুলুকসন্ধান করছে, ছেলেপিলের জন্ম দিচ্ছে, দেবদ্বিজে ভক্তি করছে, চুরি—জোচ্চচুরি করে গঙ্গাস্নান করছে, অসুখে ভুগছে, মরছে—তারা যে বিশ্বাস করে হিমালয়ই পৃথিবীর শেষ। তারপর সব অন্ধকার।
কিন্তু রামমোহন জেনেছে তিব্বতে যাওয়া যায়। সেখানে যাওয়ার দুটি পথ। হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে দুর্গম পথ। একটি পথ গিয়েছে আলমোড়া হয়ে। অন্য পথটি নেপালে পৌঁছনোর পর, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত।
রামমোহন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছেছে পাটনা। সে দিশাহারা। কিন্তু ক্লান্ত নয়। সে জানে, তিব্বত পৌঁছনো ছাড়া তার অন্তত বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই। কিন্তু সে এই সত্যটিও উপলব্ধি করেছে, এই প্রায় ‘অসম্ভব’ অভিযান একা একা সম্ভব নয়। তিব্বতযাত্রী কোনও দলে ভিড়তে হবে তাকে। কিন্তু কোথায় পাবে সে এমন একটি দল?
রূপকথায় যা ঘটে, ঘটল তার জীবনে। সন্ধেবেলা। সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে একটি গাছের তলায় বসে আছে রামমোহন। ঠিক করেছে ঝুপ করে রাত নামলেই সে গাছের তলাতেই শুয়ে পড়বে। ভোরবেলা আবার শুরু হবে চলা।
—তুমি তিব্বত যেতে চাও কেন? এক পুরুষের কণ্ঠ। চমকে ওঠে রামমোহন। তার মনের কথা জানল কী করে এই সম্পূর্ণ অচেনা দেশের অজানা মানুষ?
রামমোহন দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ় বলিষ্ঠ সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর মুখে হাসি।
—আপনি জানলেন কী করে আমি তিব্বত যেতে চাই?
—এসো আমার সঙ্গে, ডাক দেয় সন্ন্যাসী। গাছতলা থেকে উঠে পড়ে রামমোহন। দীর্ঘাঙ্গ বলিষ্ঠ সন্ন্যাসীর পিছন পিছন হাঁটতে থাকে সে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর, পথ এসে শেষ হয় এক জঙ্গলের ধারে। সেখানে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে রান্না হচ্ছে গরম রুটি আর ডাল।
—তোমার নাম কী? জিগ্যেস করে প্রৌঢ় সন্ন্যাসী।
—রামমোহন।
—রামমোহন, আমাদের সঙ্গে তুমিও ডাল—রুটি খেয়ে নাও। কাল ভোরবেলা নদীতে স্নান করে আমরা বেরিয়ে পড়ব।
—কোথায় যাব আমরা?
—প্রথমে নেপাল। তারপর তিব্বত। কেউ কেউ রাস্তায় মরব। কেউ কেউ পৌঁছব।
রামমোহন অবাক হয়ে তাকায় সন্ন্যাসীর দিকে। বাকি সন্ন্যাসীরা কেউ কথা বলে না তার সঙ্গে। নীরবে গরম রুটি আর ডাল এগিয়ে দেয়।
রামমোহনকে নিয়ে দলে হল আঠারো জন। রক্সৌলে পৌঁছে দেখা গেল দলটি এখন এগারো জনের। কেউ ভেগেছে। কেউ মরেছে। কেউ বলে—কয়েই ফিরে গিয়েছে। প্রৌঢ় সন্ন্যাসী কারও উপর কোনও জোর খাটান না। বছর ষোলোর লম্বা—চওড়া রামমোহন লোটা—কম্বল নিয়ে এখন সন্ন্যাসীদেরই একজন। অন্তত আপাতভাবে তাকে আলাদা করার উপায় নেই। কিন্তু তাকে তবু আলাদা করে দেয় তার চোখ। সে ওই সন্ন্যাসীদের কেউ নয়। তার চোখে অন্য অন্বেষ।
এরপর পথ আরও দুর্গম, নেপালের সীমান্তে দাঁড়িয়ে বলে প্রৌঢ় সন্ন্যাসী, এরপর আমরা ভারতের বাইরে পা রাখব।
—পথ আরও দুর্গম কেন? প্রশ্ন করে রামমোহন।
—এর পর শুধু পাহাড় আর চড়াই। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে হাঁটতে হবে। পেরতে হবে চুরিয়াঘাট, চন্দা, চিমাপানি।
—রাস্তার নাম? না কি নদী?
রামমোহনের প্রশ্নে হা হা করে হেসে ওঠে সন্ন্যাসী। বলে, আরে না—না। এসব হল ভয়ংকর চড়াই। বুকের জোর আছে তো? নাহলে দম ফেটে মরে যাবে। যারা মরবে তাদের খাদে ফেলে দিয়ে বাকিরা উঠে যাবে, আবার চড়া কণ্ঠে হাসে সন্ন্যাসী।
—আপনি এ পথ এত ভালো করে জানলেন কী করে? প্রশ্ন না করে পারে না রামমোহন।
—আগে এসেছি, তাই।
—আপনি তিব্বত গিয়েছেন।
—হ্যাঁ। এই নিয়ে তিনবার হবে, যদি পৌঁছতে পারি।
—তিনবার! ঝলমল করে ওঠে রামমোহনের চোখ। আপনি তাহলে সন্ধান পেয়েছেন ভগবানহীন ধর্মের?
সন্ন্যাসী অবাক রামমোহনের প্রশ্নে।
চতুর মানুষ সে। ধীরে ধীরে তার বিস্ময় কাটে। সে বলে, রামমোহন, ওই পথ মাড়িও না। ওটা লামাদের রাজত্ব। ও—পথের দরজা বন্ধ। চাবি শুধু জীবন্ত ঈশ্বরের হাতে।
—জীবন্ত ঈশ্বর!
—দালাই লামা। অন্যান্য লামাও ঈশ্বরের প্রতিভূ। তিব্বত ঈশ্বরের দেশ।
—কিন্তু প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্র ও লিপিতে গৌতম বুদ্ধ যে ধর্মের কথা বলেছেন, সেই ধর্মে তো ঈশ্বরের কথা তিনি বলেননি বলেই জানি।
—কিন্তু কোথায় পাবে তুমি বালক সেই সব প্রাচীন পুঁথি ও লিপি?
—কেন? লামাদের কাছে। হয়তো প্রাচীন মন্দিরে। বৃদ্ধ পণ্ডিতদের কাছে। আপনিও নিশ্চয় জানেন সেই সব প্রাচীন পুঁথির গোপন ঠিকানা।
—জানি বালক, জানি। কিন্তু সেখানে পৌঁছনো যায় না। চেষ্টাও কোরো না। মৃত্যু তাহলে অনিবার্য।
—কে মারবে আমাকে? পুঁথি পড়তে গেলে মরতে হবে কেন?
—তুমি নিজেই জানতে পারবে, যদি চেষ্টা করো। সেই বোধি বলো, প্রজ্ঞা বলো, জ্ঞান বলো, তা শুধু কয়েক জন লামার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটাই ঈশ্বরের অভিপ্রায়।
—কী করে জানলেন ঈশ্বরের অভিপ্রায়?
—তিব্বতে পৌঁছলে তুমিও জানবে, বুঝবে, উপলব্ধি করবে তোমার অন্বেষ কত দূর বিপজ্জনক। ঈশ্বরের অভিপ্রায় লঙ্ঘন করার চেষ্টা কোরো না।
—দালাই লামা—ই তাহলে ঈশ্বর?
—হ্যাঁ, তাই। তাঁর ইচ্ছায় তিব্বত চলে। সেখানকার গাছের পাতা নড়ে তাঁর ইচ্ছায়। বাতাস বয়, ফুল ফোটে, মানুষ মরে, জন্মায়, লুপ্ত হয়। সব তাঁর ইচ্ছায়।
—লুপ্ত হয়! রামমোহন বিস্মিত।
—রামমোহন, এই কথাটুকু শুধু মনে রেখো, তিব্বতে পৌঁছনোর চেয়ে সেখান থেকে ফিরে যাওয়া আরও কঠিন, আরও অনিশ্চিত। কোথায় কোন অন্ধকার খাদে, কোন কুয়াশার ভিতরে তোমাকে কে যে অতর্কিতে লুপ্ত করে দিতে পারে তার কোনও হদিশ, কোনও নিশ্চয়তা নেই রামমোহন। তাছাড়া…
—তাছাড়া কী?
—তিব্বত পৃথিবীর হারিদ্রশাস্ত্রচর্চায় অদ্বিতীয়।
—হারিদ্রশাস্ত্র, সেটা আবার কী?
—বলতে পার গরলশাস্ত্র। সোজাকথায় সাপের বিষ। তোমার রক্তের মধ্যে কখন যে মিশে গিয়েছে বিষ, বোঝার আগেই তুমি শেষ রামমোহন।
—তবু যাচ্ছেন সেই দেশে, তিন তিনবার?
—হ্যাঁ, রামমোহন, যাচ্ছি, না গিয়ে পারি না।
—কেন?
—আমার ঈশ্বরীর কাছে ফিরে ফিরে যাই।
—ঈশ্বরী!
—তার নাম লাসি। আট বছর আগে তাকে প্রথম দেখি। তার সঙ্গে কিছুদিন ঘর করি। গ্রহণ করি তার সর্বপ্রকার সেবা। তিন বছর পর আবার ফিরে যাই। খুঁজেও পাই তাকে। জানি না এবার আর লাসিকে পাব কি না। এও এক বিপজ্জনক খেলা। তবে তোমার সন্ধানের মতো অত বিপদ নেই এই খেলাটায়।
যদি লসিকে না পান?
—তিব্বতের মেয়েরা খুব সুন্দরী রামমোহন। আর তারা স্বাধীন। তাদের নিজেদের মন আছে। হাসি আছে। আমোদ—আহ্লাদ আছে। আর নিজের নিজের শরীর আছে। সে শরীরের অধিকার তাদের। আমাদের দেশে এমন নারী নেই।
—নিজের নিজের শরীর আছে মানে?
রামমোহনের প্রশ্নে হো হো করে হাসে সন্ন্যাসী। তারপর বলে, তিব্বতের মেয়েদের মন যেমন নিজের কথা বলে, তাদের শরীরও তেমনই নিজের কথা বলে। স্বাধীনভাবে। আমি ভালোবাসার এই স্বাদ সারা ভারতে কোথাও পাইনি বালক। রামমোহন চুপ করে শোনে সন্ন্যাসীর কথা। তার হঠাৎ মনে হয়, সে তো সন্ন্যাসী নয়। তার তো ঘরে দু’টো বউ আছে। তাতে কী? শিউরে ওঠে তার সারা শরীর—মন।
ভালোবাসার অন্য স্বাদ! কোথাও অন্যায় নেই। কোথাও পাপ নেই। সে তো পুরুষ।
বেশ কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। রামমোহন এখন তিব্বতের রাজধানী লাসায়।
সে অসুস্থ হয়ে পড়ে অস্মোতে পৌঁছে। ভেবেছিল, সে মরেই যাবে বুঝি! চোখে সে ঝাপসা দেখছে। যা খাচ্ছে বমি হয়ে যাচ্ছে। এত কাছে লাসা, তবু সেখানে পৌঁছতে পারা সম্ভব হল না, এটাই সে জেনে গিয়েছিল নিশ্চিতভাবে।
—কী নাম তোমার? রামমোহন অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে তিব্বতি ভাষায়। তিব্বতে আসার আগে সে শিখে নিয়েছে চলনসই তিব্বতি ভাষা। ভাষা শিখতে তার তাৎপরতা ও মেধা অবিশ্বাস্য।
—লা, উত্তর দেয় মেয়েটি।
—আমি তোমার নাম জানতে চেয়েছি।
—তাই তো বললাম আমি, আমার নাম লা।
—পাহাড়ের খাদকে তো ‘লা’ বলে, বলল রামমোহন।
—আমিও খাদ, বিপজ্জনক, বলল মেয়েটি।
—কোথায় আমি?
—তুমি আমার বিছানায়, হেসে বলে লা।
—তোমার বিছানায়!
—হ্যাঁ! জঙ্গলের পথে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। ওটা লাসার পথ। আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি।
—কী করে আনলে?
—আমরা চারজন মেয়ে তোমাকে ঠ্যালাগাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছি।
—তোমার বাড়ি কি লাসায়?
—না, না। লাসা এখনও অনেক দূরের পথ। এই জায়গাটার নাম অম্মো। বলতে পারো—একটা পাহাড়, দু’টো চড়াই, আর একটা নদী পেরলেই লাসা।
—তাহলে তো লাসায় পৌঁছেই গিয়েছি। অন্তত লা পর্যন্ত তো পৌঁছেছি।
রামমোহনের কথায় খিলখিল করে হেসে ওঠে লা। তারপর অসংকোচে এসে বসে শায়িত রামমোহনের পাশে।
—তোমার নাম কী?
—রা, বলে রামমোহন।
—তোমার নাম ‘রা’!
—তোমার নাম যদি ‘লা’ হতে পারে, আমার নাম ‘রা’ হতে পারে না কেন?
—মানে কী?
—শব্দ।
—তুমি কেন এসেছ তিব্বতে?
—খোঁজ করতে।
—কীসের খোঁজ?
—দু’টি শব্দের।
—দু’টি শব্দের খোঁজে! কোন দু’টি, কেমন দু’টি শব্দ! লার কণ্ঠে বিস্ময়।
—ঈশ্বর নেই।
লা হঠাৎ যেন শিউরে ওঠে। তার চোখে—মুখে ফুটে ওঠে ভয়। সে রামমোহনের আরও কাছে সরে আসে।
রামমোহনের মনে হয়, এই প্রথম সে কোনও নারীকে দেখছে, পাচ্ছে তার সান্নিধ্যের উত্তাপ। অনুভব করছে তার টান। সে বিবাহিত। ঘরে তার দুই বউ। তারাও তো কম সুন্দরী নয়। তবু কেন এমন মনে হচ্ছে তার?
লা—র গায়ের রং তামাটে। ঠোঁট দু’টি ঈষৎ পুরু, কিন্তু চোখ দু’টি হরিণের চোখের মতো চঞ্চল। লা—র মধ্যে কিছু একটা আছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে সেই মেয়ের সর্বাঙ্গে। কী সেই ‘কিছু একটা’? রামমোহন নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর পায় না।
লা হঠাৎ রামমোহনের বুকের উপর উপুড় হয়ে পড়ে। বলে, লাসায় যাবে না তুমি। কিছুতেই যেতে দেব না আমি তোমাকে। রামমোহন বুঝতে পারে, সেই ‘কিছু একটা’—টা ঠিক কী!
সেটি হল লা—র মন। এই প্রথম রামমোহন দেখল, বুঝল, অনুভব করল একটি মেয়ের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে থাকতে পারে তার মন।
সেই মনের উপর হাত রাখল রামমোহন। মন হাত সরিয়ে দিল না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না। রামমোহন সেই মনকে আরও নিবিড় করে নিল নিজের বুকের মধ্যে।
—রা, এই প্রথম রামমোহনকে এমন গভীরভাবে ভিতর থেকে কেউ ডাকল।
—কী?
—রা, আমাকে কথা দাও, তুমি লাসায় যাবে না।
—লা, কথা দিচ্ছি, আমি লাসায় যাবই।
—না, না, না!
—কেন নিষেধ করছ?
—সেখানে দালাই লামা—ই ঈশ্বর। কোনওভাবে তাঁর সন্দেহের চোখে পড়লে তোমাকে মরতে হবেই।
—আমি বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন পুঁথি পড়তে চাই। দেখতে চাই লুকনো সত্যের মুখ।
—সত্যের একমাত্র মুখ তো দালাই লামা। তিনি ভিন্ন আর কোনও সত্য নেই।
—সত্যের সন্ধানে আমি মৃত্যুবরণ করতে রাজি। লা, বাধা দিও না আমাকে।
—রা, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে তুলেছি। তোমাকে মরতে দেব না।
—লা, ছেলেমানুষি কোরো না। সত্যকে না জেনে বেঁচে থেকে কী লাভ?
—আমার সঙ্গে বাঁচতে চলো রা। জীবনের শেষ সত্য, বেঁচে থাকার চরম আনন্দ আমি তোমাকে বোঝাব। কোশি নদীর ধারে কতরকমের বনফুলের অরণ্য আছে রা। সেখানে তোমার সঙ্গে বাসা বাঁধব। ঈশ্বর আছে কি নেই ওসব নিয়ে তখন তোমার ভাবতে ইচ্ছেই করবে না।
—লা, এখন বুঝছি, তুমি সত্যিই পাহাড়ের খাদ। পড়লেই মরব।
—রা, আমাকে বিশ্বাস করো। দু’দিন আগে যখন তোমার জ্ঞানহীন শরীরটাকে আমার খাটে শুইয়ে দিয়ে আমার বন্ধুরা ফিরে গেল, ভাবতে পারিনি, আমার সেবা তোমার প্রাণ ফিরিয়ে দেবে। তোমার দেহে প্রাণ ছিল বলে মনেই হচ্ছিল না। তোমাকে দিন—রাত সেবা করে ফিরে পেয়েছি। তুমি কোন দেশের মানুষ জানি না। আমার দেশে এমন সুন্দর পুরুষ কখনও দেখিনি। তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। রা, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।
কোনও মেয়ে ভালোবাসার কথা এমন অকপটে বলতে পারে! বিস্মিত রামমোহন। লা কি অম্মোর নিষিদ্ধপল্লির মেয়ে? সে কি তিব্বতি বারাঙ্গনাদের একজন? তার শরীর কি কামসূত্রের প্রাচীন পুঁথি?
রামমোহন লা—র মুখটি তার বুকের উপর থেকে চোখের সামনে তুলে ধরে। লা—র চোখে চিকচিক করছে কান্না। রামমোহনের হঠাৎ মনে হয় এই কান্নার পিছনে কোথাও লুকিয়ে আছে হাসি।
সে মনে মনে বলে, লা, তোমার মোহ পাশ আমাকে ছিঁড়ে বেরতেই হবে। আমাকে অযোগ্য, অকৃতজ্ঞ— সে তুমি যা খুশি ভেবে নিও। পৃথিবীতে কোথাও জড়িয়ে পড়তে, আটকে যেতে যে আসিনি আমি! আমি অনেক দূরের যাত্রী, লা।
গভীর রাত। নিঝুম আকাশে জ্বলছে চাঁদ—তারা। রামমোহন এত কাছ থেকে চাঁদ—তারা, আকাশভর্তি এত বড় বড় আলো, আগে কোথাও কখনও দেখেনি। সে জানলা থেকে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায় বিছানার পাশে।
ঘুমিয়ে আছে লা। চাঁদের আলোয় যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের স্বপ্ন। রামমোহন ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আলতো চুমু খায় সেই ঘুমন্ত স্বপ্নের কপালে। তারপর নিঃশব্দে ঘরের বাইরে পা ফেলে। মৃত্যুর মতো ঠান্ডা রাত তাকে গ্রাস করে। না, আর কোথাও নেই লা—র উত্তাপ।
লাসায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল পাহাড়—চড়াই— অরণ্যক্লান্ত রামমোহন। সে খুঁজে পেয়েছে তার অনিকেত আশ্রয় এক বৌদ্ধ মঠে, ভিক্ষুদের মধ্যে। ইতিমধ্যে সে উইপোকার মতো নিঃশব্দে প্রবেশ করতে শুরু করেছে প্রাচীন গোপন পুঁথির অন্তরে। জীর্ণ পুঁথিগুলিকে সে দিন—রাত তার হাতে লেখায় কপি করছে। পুঁথিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার আর তো কোনও উপায় নেই।
মঠের অধ্যক্ষ বা ‘খাম্পো’ রামমোহনের উপর খুশি। সামান্য খেতে পেলেই এই ভালোমানুষ ছোকরাটি দিন—রাত পরিশ্রম করতে পারে। রাতেও তার চোখে ঘুম নেই। সে নিরলসভাবে ‘নকল’ করে চলেছে পুরনো ছিঁড়ে যাওয়া পুঁথির লেখা!
খাম্পো বা লামার দল কেউই যা বুঝতে পারে না, যা তাদের কল্পনার অতীত, তা হল রামমোহন যা ‘নকল’ করছে তার কিছুই ভুলে যাচ্ছে না। অলৌকিক তার স্মরণশক্তি। অবিশ্বাস্য তার মেধা। বিস্ময়কর তার জ্ঞানতৃষ্ণা। অক্লান্ত তার অন্বেষ।
ষোলো বছরের রামমোহনের মধ্যে যেন আরও একবার তিব্বতে ফিরে এসেছেন তীক্ষ্নধী মতিমান আচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান!
অনেক রাত পর্যন্ত রামমোহন পুরনো পুঁথি নকল করার কাজ করে। অথচ সূর্য ওঠার আগে তার ঘুম ভাঙে। হিমঠান্ডার মধ্যে, ছায়া ছায়া অন্ধকারে, সে রোজ পায়ে হেঁটে বেড়াতে বেরয়।
কুয়াশা। তার মধ্যে একটু একটু করে আলো ফোটার ইশারা। অরণ্যের গন্ধ। আকাশের তারা এখনও সব মিলিয়ে যায়নি। রাত ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। অথচ দিন শুরু হতে এখনও দেরি।
রামমোহনের মনে হয় প্রতিদিন এই পরম লগ্নে সে মৃত্যু ও জীবনের মিলন দেখতে পায়। একই সত্যের যেন এপিঠ—ওপিঠ। নিরাকার নিরন্তর ঈশ্বরের নিভৃত নীরব প্রকাশ এই জীবন মৃত্যুর মিলনের মধ্যেই!
সে প্রতিদিন আসে পোতালা প্রাসাদের পথে। ভোরের আলো ফুটল বলে। রহস্যময় প্রাসাদ এখনও ঘুমিয়ে। ব্যস্ততার কোনও চিহ্ন নেই। অথচ এই প্রাসাদের অমোঘ আদেশেই চলছে তিব্বত। এখানে বাস করেন দালাই লামা। তিব্বতিদের ‘স্বয়ং ঈশ্বর’।
একটা খটকা ক্রমে রাগে পরিণত হচ্ছে রামমোহনের মধ্যে। কী করে একজন মানুষ ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরের প্রতিভূ’ হতে পারেন?
রামমোহন বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার অনেক পুরনো পুঁথি ‘কপি’ করেছে। সে পড়েছে এবং মুখস্থ করে ফেলেছে টীকা—টিপ্পনিগুলিও। সব ভাষ্য, ব্যাখ্যান, দুরূহ শব্দের মধ্যে সে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছে। একত্রে এগুলিই হল ‘কঞ্জুর’।
সে মনের মধ্যে প্রায় গত দু’—বছর ধরে গেঁথে নিয়েছে বৌদ্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের সব অলিগলি। সে ক্রমে উপলব্ধি করেছে যে লামাদের প্রভাবে তিব্বত ক্রমে সরে গিয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের ‘মহাযান’ শাখা থেকে ‘বজ্রযান’ শাখায়।
‘মহাযান’ সেই বৌদ্ধ দর্শন—যার প্রবর্তন করেন বৌদ্ধ শ্রমণ নাগার্জুন। ‘বজ্রযান’ শাখার সঙ্গে ‘মহাযান’—এর অনেক পার্থক্য! ‘বজ্রযান’ তো তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম! পালি ত্রিপিটকে বর্ণিত ‘হীনযান’—এর কথাও জেনে নিয়েছে রামমোহন। ‘হীনযান’ বৌদ্ধ ধর্মের এক প্রাচীন শাখা, যার কথা প্রাচীন ত্রিপিটক ‘কপি’ করতে করতে জেনেছে রামমোহন।
সুত্ত (সূত্র), অভিধম্ম (অভিধর্ম) আর বিনয়— এই তিনভাগে বিভক্ত বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ আঠেরো বছরের রামমোহনের নখদর্পণে। সে যে বৌদ্ধ ধর্মে মহাপণ্ডিত হয়ে উঠছে, সে খবর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে লামাদের মধ্যে। তারা ভেবেছিল, রামমোহন এক বোকাসোকা, নিরীহ, গরিব, বিদেশি কিশোর, যাকে খেতে—পরতে দিলে সে পুরনো পুঁথিগুলি দিন—রাত পরিশ্রমে নকল করে দেবে। কিন্তু এ কী কাণ্ড! সে যে সব মুখস্থ করে ফেলেছে! এবং প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে ‘বজ্রযান’ শাখার তান্ত্রিক বিশ্বাস নিয়ে।
বেশ কয়েকজন লামার বদ্ধমূল ধারণা, রামমোহনের প্রভাব ছড়াচ্ছে। লামাদের পক্ষে সেটা মোটেই ভাল কথা নয়। লামারা অসামান্য তান্ত্রিক শক্তির অধিকারী— বজ্রযান শাখার এটাই তো ‘মূল’ প্রচার।
রামমোহন যদি সেই শাখার মূল প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে? ছেলেটা অসাধারণ মেধাবী।
সে যুক্তি সাজিয়ে দিনকে রাত করতে পারে।
এটাই ভয়ের মূল কারণ।
ভোরের আলো ফুটতে আরও কিছু দেরি।
আজ যেন কুয়াশা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘন। রামমোহন চিনতে পারে তার পরিচিত মেয়ের ছায়া। ডুংলির ছায়াটাও কম সুন্দর নয়। রামমোহনের বুকে চাপ ধরে। একইসঙ্গে উদ্বেগ ও আনন্দের চাপ। রামমোহন বাকি পথটুকু দৌড়ে যায়। তার ধৈর্য ধরে না।
এ কী! কোথায় মিলিয়ে গেল ডুংলি!
পাশেই তো গভীর খাদ।
পা পিছলে…!
—এখানে, এই তো আমি।
এ তো ডুংলির কণ্ঠ, চিনতে ভুল হয় না। রামমোহন তাকায়। সামনে আঁধারমাখা গাছপালার জঙ্গল।
—রাম, চলে এসো, এখানে কেউ দেখতে পাবে না।
রামমোহন ঢুকে পড়ে অন্ধকার লতাপাতার আড়ালে।
ডুংলি এখানকার মেয়ে। কাজ করে দালাই লামার প্রাসাদে। অন্দরমহলের অনেক খবর ডুংলির কাছে জেনেছে রামমোহন। তবে ডুংলিও ভিতরের খাসখবর তেমন জানে না। দালাই লামাকে সে কদাচিৎ দেখেছে মাত্র।
রামমোহন ডুংলির পাশে গিয়ে বসে। গাছের নিচে একটা বড় পাথর। কবে কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমে এখানেই শেষ করেছিল অধঃপতন। সেই পাথরের উপর পাশাপাশি রামমোহন আর ডুংলি।
ডুংলির মতো সুন্দর মেয়ে রামমোহন কি জীবনে দেখেছে? না বোধহয়।
—ডুংলি, ডাকে রামমোহন
—কী? অস্পষ্ট হাসে ডুংলি।
—কিছু না। তোমার নাম ধরে ডাকতে ভালো লাগে।
—আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না?
—করে তো।
—তাহলে? এখনও অন্ধকার। এখনও আড়াল। সবাই ঘুমিয়ে।
—দাঁড়াও দাঁড়াও।
লাফিয়ে উঠে পড়ে রামমোহন। ছুটে চলে যায় জঙ্গলের মধ্যে। ডুংলি অবাক। সে ভয় পায়। অস্থির এই ভিনদেশি যুবককে কতটুকু বুঝতে পেরেছে সে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে রামমোহন। হাতে তার একগুচ্ছ বনফুল। ভোররাতের ঠান্ডা বাতাসে বনফুলের ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়ে। ফুলগুলি সে ডুংলির পায়ের কাছে রাখে। তারপর তার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে যেন নিজেকে সমর্পণ করে। এই সমর্পণ শুধু প্রেমের নয়। বেদনারও।
ডুংলি অবাক হয়। আগে রামমোহনের মধ্যে এই অসহায় বেদনার ভাবটি কখনও দেখেনি!
সে রামমোহনের মাথায় হাতে রাখে। তারপর তার মুখটি নিজের নরম, স্নিগ্ধ বুকের মধ্যে তুলে নেয়। অনুভব করে, তার বুক ভিজে যাচ্ছে রামমোহনের কান্নায়।
—তুমি কাঁদছ কেন?
—তোমাকে লুকিয়েছি। আমি অন্যায় করেছি ডুংলি।
—কী লুকিয়েছ?
—আমার ঘরে দু’টো বউ আছে। তাদের ছেড়ে আমি এত দূর দেশে।
—তোমার ঘরে বউ আছে কি না, তা জিগ্যেস করে তো আমি তোমাকে ভালোবাসিনি রাম। আর তুমি আমাকে ভালোবেসেছ তারা তোমার জীবনে থাকা সত্ত্বেও। এতে অন্যায় কোথায়?
রামমোহন ডুংলির বুক থেকে মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকায়। চোখ দু’টি হাসছে। কোথাও নেই এতটুকু বেদনা। এতটুকু অভিমান। শুধু অম্লান আনন্দ!
—গল্পটা বলবে না?
—গল্প! কোন গল্প?
—দীপংকরের গল্প। তোমাকে মাঝপথে যেদিন থামিয়ে দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি ফিরে গেলুম, পাছে অন্ধকারে আলো ফুটে ওঠে, সেই ভয়ে।
—কোনও দিন যদি ধরা পড়ে যাও?
—তাহলে আর কী, আমাকে বিয়ে করতেই হবে। তোমার আর পালানোর পথ থাকবে না।
—কিন্তু আমি যে হিন্দু।
—ধর্ম বদলে নেবে আমার জন্য, বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না?
—ডুংলি একটা খুব জরুরি কথা তোমাকে বলা হয়নি।
—যখন এতদিন বলোনি, খুব একটা জরুরি কথা বলে মনে হচ্ছে না।
—জরুরি ডুংলি, খুব জরুরি। শুনলেই বুঝবে। হয়তো আমাকে ছেড়েই যাবে তুমি।
—রাম, তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে মরা ভাল।
—তাহলে বরং না—ই বললুম। তবে কথাটা না জানলে আমাকে জানাটা তোমার সম্পূর্ণ হবে না।
—কেউ কি কাউকে কোনও দিন সম্পূর্ণ জানতে পারে? তোমার দুই বউ তোমাকে কতটা বোঝে?
—ওরা না বুঝলেও চলবে। আমি চাই ডুংলি, তুমি আমার সবটা জানো, বোঝো।
কুয়াশার মধ্যে রামমোহন ডুংলির চোখ দু’টি দেখতে পায়। কী গভীর মায়া, মমতা, ভালোবাসার দৃষ্টি!
—ডুংলি, জরুরি কথাটা হল আমি হিন্দু, কিন্তু হিন্দুর কোনও দেব—দেবীতে আমার বিশ্বাস নেই, বলল রামমোহন।
—তা কি সম্ভব? তুমি হিন্দু, অথচ বিশ্বাস করো না হিন্দুদের ভগবানে! ডুংলি লুকোতে পারে না বিস্ময়।
—ডুংলি, হিন্দু ধর্ম ভারি উদার। নাস্তিকতাকেও গ্রহণ করেছে।
—ভগবান নেই, অথচ ধর্ম আছে?
—হ্যাঁ ডুংলি, হিন্দু ধর্ম দেখিয়ে দিয়েছে ‘ঈশ্বরহীন ধর্ম’—ও সম্ভব।
—না, না, তা অসম্ভব, আঁতকে ওঠে ডুংলি।
রামমোহনের মনে হল, ডুংলি ভয় পেয়েছে।
—কিন্তু বুদ্ধও তো সে—কথা বলেছেন, ঈশ্বরহীন ধর্মের কথা। তুমি যার গল্প এইমাত্র শুনতে চাইলে, দীপংকরও তো, বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করলেও, কোনও ঈশ্বরের কথা বলেননি।
—তুমি সব জানো? দীপংকরের গল্পের সবটা? প্রশ্ন করে ডুংলি। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবার পর।
—অনেক অনেক বছর আগের কথা ডুংলি। অনেক তথ্যই হারিয়ে গিয়েছে। তবে এখানে এসে তিব্বতি এবং সংস্কৃত ভাষায় লেখা তাঁর বেশ কিছু পুঁথির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি আমি। এসব পুঁথি ভারতে পাওয়া যায় না।
—কী জেনেছ তুমি?
—দীপংকর কিশোর বয়সে ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য মেধাবী ছাত্র। তারপর বিশেষভাবে জ্ঞানচর্চা করলেন আচার্য বোধিভদ্রের কাছে। শেষ পর্যন্ত তিনি সুমাত্রায় যান আচার্য ধর্মপালের কাছে পাঠ নিতে। তিব্বতে আসেন তিনি রাজ—আমন্ত্রণে। তখন তিনি বৃদ্ধ।
—তারপর? ডুংলির কণ্ঠে উদ্বেগ।
—তারপর এক অস্থির জীবন। কোনও স্থানেই বেশিদিন থাকতে পারেননি দীপংকর। এক মন্দির গহ্বরে তাঁর দেহ পাওয়া যায়।
—কেন এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারলেন না অত বড় পণ্ডিত? কী তাকে তাঁড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে?
—তা জানি না ডুংলি, বলে রামমোহন।
—আমি জানি রাম।
—তুমি জানো!
—হ্যাঁ, আমার অনুমান, দীপংকর বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে।
—দীপংকরকে হত্যা? কেন?
—ওই যে, তুমি বললে, ঈশ্বরহীন ধর্ম। তিব্বতের ঈশ্বর দালাই লামা। তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ, ক্ষমতায় তাঁর পরেই পাঞ্চেন লামা। লামারাই তিব্বত চালান। তাঁরা হয়তো দীপংকরকে বিপজ্জনক ভেবেছিলেন।
ডুংলির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রামমোহন।
ডুংলি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রামমোহন স্থির হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে। কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ক্ষীণালোক। তবু চারিদিক যেন শীতে জমে আছে।
—আমি এবার যাচ্ছি, বলে ডুংলি।
রামমোহন তাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় নিবিড় আলিঙ্গনে।
—রাম, ডাকে ডুংলি।
—কী?
—লামারা তোমার উপর ক্রমে ক্ষিপ্ত হচ্ছে। তোমার গুপ্তজ্ঞান প্রচার কোরো না কোনওভাবে। অন্তত একথা উচ্চচারণ কোরো না কোনও দিন, ধর্ম ‘ঈশ্বরহীন’ হতে পারে।
কাল সন্ধেবেলা ঝড় বয়ে গিয়েছে। ওলটপালট হয়ে গিয়েছে লামাদের সুরক্ষিত পৃথিবী। পুরনো প্রত্যয় ছত্রাকার। উড়েছে মাথার চাল। উপড়েছে সনাতন শিকড়। অকস্মাৎ দাপটে হেলে পড়েছে সংস্কার ও পাপবোধের মহীরুহ। ছেলেটার এত বড় আস্পর্ধা, বলল কিনা বুদ্ধের ধারণায় সারা মহাবিশ্বে ‘চিরস্থায়ী’ বলে কিছু নেই!
—কেন? আত্মা? প্রতিবাদী লামারা।
—আত্মা! বুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন বলে তো মনে হয় না। পুরনো পুঁথি নকল করতে করতে উঠে দাঁড়ায় রামমোহন। তার চোখে বিদ্রোহের আগুন।
—ভগবান বুদ্ধের জীবনবোধ, দর্শনের কতটুকু বোঝ ছোকরা? এই ধরনের বেয়াদপি আমরা সহ্য করব না। কয়েকজন লামা ঘিরে ফেলে তাকে।
—আমাকে ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। আপনারা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করা, রক্ষা করার জন্য আসল ব্যাপারটাই চেপে গিয়েছেন।
—কোন আসল ব্যাপার আমরা চেপে গিয়েছি?
—প্রতীত্য—সম্যুৎপাদ তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে বুদ্ধের দর্শন। সেই দর্শনের শেষকথাটি আমি জানি।
—কী জানিস তুই? বল আমাদের।
—বিশ্ব হল জ্ঞান, অনুভূতি, চিন্তার প্রকাশ। এই প্রকাশ ফুল দিয়ে গাঁথা মালার মতো।
—এর মধ্যে আত্মার কোনও জায়গা নেই বলতে চাস? সাধারণ মানুষ কতটুকু বোঝে? তারা সারাক্ষণ অন্যায় করছে। পাপ করছে। সঠিক পথ দেখাই আমরা। সেই পথেই তাঁরা আত্মার উন্নতি ঘটাতে পারে।
—আপনাদের ক্ষমতা, রাজ্যপাট, ঐশ্বর্য বজায় রাখতে আপনারা ভুল পথে চালাচ্ছেন সাধারণ মানুষকে।
এই কথায় দু’—তিনজন লামা তেড়ে মারতে যায় রামমোহনকে। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে দু’—একজন। তারা বলে, কাউকে আঘাত করা বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী। রক্তপাত ঘটানো মহাপাপ।
—তাহলে ঠিক পথ কী? প্রশ্ন করে রামমোহনকে ঘিরে থাকা লামারা।
—ঠিক পথের সন্ধান তথাগত দিয়েছেন মহাবগ্গ সূত্রপিটকে। আপনারা জেনেও না জানার ভান করছেন হয়তো। যাই হোক, আপনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাত্রির প্রথম প্রহরে গৌতম বুদ্ধ বলছেন, ‘অবিদ্যা’ অর্থাৎ ভ্রান্ত ধারণা থেকে জন্মায় সংস্কার। অর্থাৎ প্রবৃত্তি। জীবনের প্রতি আকর্ষণ। এই আকর্ষণ জন্ম দেয় নামরূপের। ‘নামরূপ’ হল সেই মন যে সর্বদা ধেয়ে চলছে দৃশ্যমান শরীরী পদার্থের দিকে। জন্মায় স্পর্শ। আর স্পর্শ জন্ম দেয় বেদনার। বেদনা মানে ব্যথা নয়। বুদ্ধ ‘বেদনা’ শব্দটিকে ‘অনুভূতি’ অর্থে ব্যবহার করছেন। এই অনুভূতি নিয়ে আসে ভ্রান্ত তৃষ্ণা। জীবনের প্রতি তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা থেকে উৎসারিত হয় ‘ভব’। অর্থাৎ জন্মের প্রস্তুতি। আর জন্ম মানেই শোক, দুঃখ, ভোগ। সেই ভোগ যা আনন্দ আনে না। আনে অবসাদ, নিরাশা। জন্মের ভয়ংকর পরিণতি জরা ও মরণে। আপনারাই বলুন, এই অবস্থা থেকে বেরনোর সঠিক পথ কি সত্যিই আপনারা দেখাতে চান?
রামমোহনের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না লামারা। তারা স্তম্ভিত। তাদের বিস্ময়ের মধ্যে জ্বলে উঠছে যুক্তিহীন ক্রোধ।
—বুদ্ধের মতে বিশ্ব হল চেতনা—পরম্পরার ধারা। এই চেতনাধারার সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটাতে হবে। মানুষ দেহ—মন—বিজ্ঞান অর্থাৎ অহংবোধ—এই তিন উপাদানের সমষ্টি। এদের আশ্রয় করে যা পাওয়া যায়, তা চেতনা—পরম্পরার ধারা। সুতরাং ‘আত্মা’ বলে কিছু নেই।
—এ কথা বুদ্ধের? তুই বললেই হল? ক্রোধে চিৎকার করে ওঠে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।
—হ্যাঁ, এ কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটি কথাও তিনি সংকেতে বুঝিয়েছেন।
—কী কথা? ফেটে পড়ে লামারা।
—সেই ছোট্ট শব্দটি হল ‘বর্তনা’। মানে, ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতাই মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্মবোধ। ‘একাত্মবোধ’ শব্দটির মধ্যেই কিন্তু ধরা গিয়েছে ‘আত্মা’ শব্দটি। বুদ্ধ বলছেন, এই ‘বোধ’ প্রতিটি মানুষের মধ্যে দীপশিখার মতো দীপ্যমান। অন্তরে নিহিত এই দীপ্যমানতার অন্বেষই জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির পথ। তবে জীবন নামক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য বুদ্ধ খুব সুস্পষ্টভাবে একটি আচরণমার্গ স্থাপন করেছেন। ‘আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ’। জীবন একটি অসুখের নাম। সেই অসুখে আপনারাও আক্রান্ত। সেই অসুখ সারানোর ওষুধ হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
একতোড়ে কথা শেষ করে থামল রামমোহন। একটি কথাও বলল না লামারা। রামমোহন ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পথ ছেড়ে দিল নিস্তব্ধ লামারা। রামমোহন বেরিয়ে যেতেই তারা ঠিক করে নিল কী করতে হবে অবিলম্বে। এই বিদেশি ছোকরাকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। নিজেদের তো বাঁচতে হবে।
সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছে ডুংলি। বারবার ঘুম ভেঙে গিয়েছে তার। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ফিরে এসেছে দুঃস্বপ্ন। বাকি রাত সে ঘুমতে পারেনি। তার মনে একটিই প্রশ্ন: কেন দেখা হল রামের সঙ্গে? যদি না দেখা হত, তাহলে তো এত কষ্ট পেতে হত না।
কখন ভোর হবে? কখন দেখা হবে রামের সঙ্গে ভোররাতের কুয়াশার মধ্যে? সে কেন বুঝছে না পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধার কথা? আজ তাকে বোঝাবই আমি, মনে মনে বলে ডুংলি।
লামাদের সঙ্গে রামের নাকি ভয়ংকর বাগবিতণ্ডা হয়েছে। এ কথা ভেসে এসেছে দালাই লামার প্রাসাদ পর্যন্ত। ডুংলির কানে পৌঁছেছে সেই কলহের কথা। সে জানে তার পরিণতি কী হতে পারে।
রাতের শেষপ্রহরে তার আর ধৈর্য ধরেনি। সে চলে এসেছে তাদের পরিচিত জায়গাটিতে। ঝোপের আড়ালে সেই পাথরের উপরেই বসে আছে সে।
কেন আসছে না রামমোহন? এত দেরি করছে কেন? এই তো পালানোর উপযুক্ত সময়। ডুংলি চেনে জঙ্গলের পথ। ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌঁছে যাবে নদীর ধারে। তারপর…।
ওই বুঝি রাম! ঝোপটা কেমন যেন নড়ে উঠল। ডুংলি তীব্র দৃষ্টিতে তাকায়। না, কেউ নেই তো! বাতাসে নড়ল? হতেও পারে কিন্তু বাতাসে শুধু এই একটা ঝোপই বা নড়বে কেন?
—ডুংলি!
—রাম! চকিতে পিছন ফিরে তাকায় ডুংলি। তারপর একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রামমোহনকে।
রামমোহন ডুংলির মুখটি তুলে ধরে। তার চোখে চোখ রাখে। ডুংলি চোখ বোজে। রামমোহন চুমু খায় ডুংলির দু—চোখে। দু’—গালে। ঠোঁটে।
ডুংলি রামমোহনের কোমর জড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে যায় ঝোপের ধারে পাথরটার কাছে।
—রাম, আজই পালাতে হবে আমাদের। আজ। এখুনি। আমি জঙ্গলের পথ জানি। তুমি একা পালাতে পারবে না।
—আজই এখুনি কেন?
—তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে রাম।
—এত সহজ! রামমোহনের কণ্ঠে ঈষৎ ব্যঙ্গ।
আর তখুনি ডুংলি দেখতে পায় ফাঁক হয়ে গেল সেই ঝোপ। আর সেখান থেকে উড়ে আসছে একটা লিকলিকে দড়ি। অব্যর্থ নিশানা। রামের বাঁচার কোনও উপায় নেই।
ডুংলি প্রবল ধাক্কায় ছিটকে দেয় রামমোহনকে। হতবাক রামমোহন আছড়ে পড়ে বেশ খানিকটা দূরে।
ডুংলি মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে ধরে ফেলে সেই উড়ন্ত দড়ির মাথার তলাটা। তারপর সেটাকে ছুড়ে ফিরিয়ে দেয় ওই ঝোপের মধ্যেই।
তারপর ডুংলি আর রামমোহন দু’জনেই শুনতে পায় এক আর্ত চিৎকার। অস্পষ্ট গোঙানির শব্দও। কারা যেন দৌড়ে পালাল।
—ডুংলি, ওটা কী? ওই লিকলিকে দড়ির মতো জিনিসটা?
—ভয়ংকর বিষধর তিব্বতি হলুদ সাপ। ওই হল অব্যর্থ নাগপাশ রাম! তোমাকে লক্ষ্য করে ছুড়েছিল।
—কী সর্বনাশ! রামমোহন বুকের মধ্যে টেনে নেয় ডুংলিকে।
—তোমার গলায় জড়িয়ে যেত ওই লিকলিকে হলুদ সাপ। তারপর কপালের মাঝখানে ছোবল। দু’টো ছোট্ট রক্তের বিন্দু। ব্যস!
‘পালাও রাম, পালাও। আমার হাত ধরো। আমি পথ চিনি।’ কথাটা জোরে বলে না ডুংলি। তবু আর্তনাদের মতো শোনায়।
রামমোহন ডুংলির কোমর জড়িয়ে বলে, পালাব কেন ডুংলি?
—না পালালে যে মরবে রাম, মরবেই মরবে। ওরা তোমাকে বেঁচে ফিরতে দেবে না। তোমার ডুংলি তোমাকে সবসময়ে রক্ষে করতে পারবে না রাম।
‘তোমার ডুংলি!’ কথাটা রামমোহনের বুকের মধ্যে তখুনি যেন বাসা বেঁধে ফেলে। ছোট্ট নরম একটা পাখির বাসা।
—ডুংলি, পালাব কোথায়?
—আমি জানি। ছোটো আমার হাত ধরে। ওরা ঢুকে পড়ে জঙ্গলে।
জঙ্গল গভীর হয় ক্রমশ। আঁধার নিবিড় হয়। এই অন্ধকারে কীভাবে পথ চিনছে ডুংলি?
রামমোহন দাঁড়িয়ে পড়ে। সামনে পথটা দু’দিকে চিরে গিয়েছে।
—এবার কোন দিকে ডুংলি?
—বাঁদিকে।
—কী করে বুঝলে?
—আগেও পালিয়েছি। তা—ই।
—আগেও পালিয়েছ? কার সঙ্গে ডুংলি?
—আমার সঙ্গে।
—মানে?
—ওরা আমাকে তাড়া করেছিল।
—কারা ডুংলি?
—দেবতারা।
—দেবতারা তোমাকে তাড়া করেছিল?
—ছোটো রামমোহন। বাঁদিকের পথ ধরে ছুটতে থাকো। সরু পথ। হাত ধরে আর নয়। আমার পিছন পিছন এসো। এখন কথা বলার সময় নেই।
—না ডুংলি। আমাকে সবটা জানতে হবে। কারা এই দেবতার দল? কেন তোমাকে তাড়া করেছিল?
ডুংলি উত্তর দেয় না। সে প্রাণপণে ছোটে। রামমোহন এক দৌড়ে ধরে ফেলে তাকে। জায়গাটা একেবারে অন্ধকার। গাছপালার প্রাচীন ভূমি। পচা পাতার পুরনো গন্ধ। যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে আসছে।
—ডুংলি, তোমাকে বলতেই হবে, কে ওরা, কী চায়, কেন পালাচ্ছিলে? ডুংলিকে নিবিড় প্রাবল্যে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রামমোহন।
—ওরা এক এক দেবতা। ওরা আমাকে চেয়েছিল। আমি পালাচ্ছিলুম।
—পালাতে পেরেছিলে?
—না, আরও আগে, একটা ভাঙা মন্দির আছে এই জঙ্গলে, সাপের বাসা এখন, সেই মন্দিরে লুকিয়ে পড়েছিলুম।
—তারপর? রামমোহন তাকায় ডুংলির চোখের দিকে। অন্ধকারেও ডুংলির চোখ দু’টি জ্বলছে।
—তারপর ধরা পড়ে গেলুম।
—তারপর? ডুংলি তারপর কী?
—তারপর ওই ভাঙা মন্দিরের মধ্যে দেবতারা একে একে আমাকে…
রামমোহন ডুংলির ঠোঁট চেপে ধরে। আর শুনতে চায় না সে। তারপর চুমু খায় তার ঠোঁটে, চোখে, বুকে, সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয় তার অন্ধকার আদর।
—পালাও, পালাও। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ডুংলি।
ছুটতে ছুটতে ওরা পেরিয়ে যায় ওই ভাঙা মন্দির।
—দাঁড়াও রাম। বলে ডুংলি।
রামমোহন দাঁড়িয়ে পড়ে।
—শোনো রাম, বাকি পথ আমি জানি না। আমি এই পর্যন্তই এসেছিলুম। এই জঙ্গলে মানুষের যাতায়াত নেই। তাই পায়ে চলার পথও তৈরি হয়নি। এই যে দেখা যাচ্ছে চিকচিক করছে একচিলতে আলো, আমার মনে হচ্ছে, ওটাই তোমার পথ। বাকি পথ তোমাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি আমি।
—তুমি যাবে না আমার সঙ্গে? প্রায় ডুকরে ওঠে রামমোহন।
—এই পর্যন্ত। এবার আমাকে ফিরে যেতে হবে।
—বলেছিলে যে নদীর ধারে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে।
—তুমি এখন সব জানো রাম। আমার এই দেহ প্রতি রাতে দেবতারা ভোগ করেন। আমি এঁটো হয়ে গিয়েছি।
—আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে নতুন করে নেব।
—পারবে না রাম! তুমি এখন সব জেনে গিয়েছ। আর হয় না।
—হয় ডুংলি। হয়।
—না, হয় না। নষ্ট নারীর সঙ্গে কোনও পুরুষ ঘর করতে পারে না। কোনও দিন পারেনি।
—আমি তোমাকে ছাড়ব না ডুংলি।
ডুংলির শরীরটা সাপের মতো পালিয়ে যায় রামমোহনের বন্ধন থেকে। রামমোহন অবাক হয়ে তাকায় ডুংলির দিকে। এ অন্য ডুংলি!
—আমার সঙ্গে যাবে না তুমি?
—না রাম, যাব না। জানি না, তুমি বাকি পথ পার হতে পারবে কি না। জানি না, শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারবে কি না। কিন্তু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে…
—কী কথা?
—ভগবান তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন অনেক বড় কাজ করার জন্য। তুমি সংসার করার জন্য জন্মাওনি রাম।
রামমোহন নীরবে তাকিয়ে থাকে।
—এরকম অনেক ডুংলি আসবে তোমার জীবনে। কেউ পাবে না তোমার নাগাল। কোথাও কোনও নারীর কাছে নোঙর ফেলার মতো মানুষ তুমি নও। তোমার স্ত্রীরাও তোমাকে ঘরে পাবে না কোনও দিন।
সাপ যেমন হঠাৎ মিলিয়ে যায় আড়ালে, কোনও চিহ্ন থাকে না আর, ডুংলিও রামমোহনের চোখের সামনে মিলিয়ে গেল। সে কী সত্যি ছিল!
এক মুহূর্ত আগে!
কত পাহাড় পেরিয়ে! কত নদী সাঁতরে এপার—ওপার হয়ে! কত অরণ্যে রাতের পর রাত কাটিয়ে! কত খাদের পথে টালমাটাল হতে হতে! কত অসুখ আর অনাহারে ভুগতে ভুগতে! রামমোহন শেষ পর্যন্ত করে ফেলল এক অসম্ভব অবিশ্বাস্য কাজ!
সে মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে ফিরে এল তিব্বত থেকে বাবা—মা’র কাছে! তার বয়েস কুড়ির কাছাকাছি।
রামমোহন কত বদলে গিয়েছে! রামকান্ত আর তারিণীর বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ এক সম্পূর্ণ অন্য রামমোহন। তাদের বোধবুদ্ধি নাগাল পায় না এই ‘নতুন’ পুত্রের। তবু সন্তানকে ফিরে পেয়ে তারা খুশি।
রামকান্ত বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। সবাই আসে রামমোহন সম্বন্ধে কৌতূহল চরিতার্থ করতে। এই ছেলে গিয়েছিল পৃথিবীর অচেনা—অজানা প্রান্ত পর্যন্ত! প্রায় ভূত দেখার মতোই তারা দেখে রামমোহনকে। যেন মৃত্যুর পর প্রেতলোক থেকে ফিরে এসেছে সে।
—কেমন দেখতে গো পৃথিবীর শেষটা? খুব অন্ধকার, না? যাক বাবা, পড়ে যে যাওনি, তোমার বাপ—মায়ের ওপর ভগবানের কত দয়া!
রামমোহন কোনও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।
তার দুই বউ তাকে ফিরে পেয়ে ভারি খুশি। তারা রাতের অন্ধকারে বিছানায় জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, বলো, আমাদের সব বলো, কী খেতে, কে রান্না করে দিত, কী করতে সারাদিন, কে তোমার দেখাশোনা করত? আমাদের মনে পড়ত না?
রামমোহন ডুংলির কথা বলতে চায়। বলতে পারে না। কিন্তু বিছানায় সে অদৃশ্য ডুংলিকে টের পায়। ডুংলি এখন কোথায়? এখন তো দেবতাদের উপভোগের সময়। ডুংলিকে একে একে তারা…
রামমোহনের ভিতরটা ডুকরে ওঠে।
রামমোহন ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে নানক, কবির এবং বৈষ্ণব ভক্ত—কবিদের রস সে অনর্গল পান করেছে। তার সবচেয়ে ভালোলাগে চণ্ডীদাস আর জয়দেব।
শৃঙ্গাররসই শ্রেষ্ঠ রস, মনে হয় যুবক রামমোহনের। বৈষ্ণব পদাবলিতে সে পায় না ভক্তিরস। পেতেও চায় না। বৈষ্ণব পদাবলির রতি সে যেন চুমুক দিয়ে পান করে, তলানি পর্যন্ত!
তার দুই বউয়ের মধ্যে তো রতির এই খেলা, এই চুঁইয়ে পড়া স্বাদ নেই! এত আড়ষ্টতা আর কুণ্ঠা আর লজ্জা কেন ওদের! দুই বউকে দু’পাশে নিয়ে তার মনে পড়ে ডুংলিকে। রাধার শরীর যেমন তরল, ডুংলিরও।
শৃঙ্গার সম্ভব নয় নারীর তারল্য ছাড়া, জেনেছে রামমোহন। ডুংলির শরীরে মনে মনে চুমুক দেয় সে।
ডুংলিই তাকে শিখিয়েছে আর এক চুমুক। আসবপান। ডুংলির নিজের হাতে চোয়ানো মদ। মদ আর রতি। কী সহজে গড়িয়ে যায় পরস্পরের মধ্যে। কী প্রাচীন এই আশ্লেষ। কী অনন্য এই স্পৃহা ও সঙ্গম।
—কী খাচ্ছিস রে ওটা? কী বিচ্ছিরি গন্ধ! তারিণী ঝাঁজিয়ে ওঠে ঘরে ঢুকে।
রামমোহনের পড়ার ঘর তারিণীর দু’চোখের বিষ। এ ঘরে বিশেষ আসে না সে। হয়তো গন্ধটা পেয়েই ঢুকে পড়েছে।
গ্রিক আর ল্যাটিন ভাষার চর্চায় মগ্ন রামমোহন। ইংরেজি গ্রিক লাতিন—তিনটি ভাষা সে একসঙ্গে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। ডুবে আছে সাধনায়। মা—র চিৎকারে সে মুখ তুলে তাকায়। সংক্ষেপে বলে, ওটা মদ।
—তুই মদ খাচ্ছিস? তুই বৈষ্ণববাড়িতে বসে মদ খাচ্ছিস? এতদূর নেমেছিস তুই?
—বৈষ্ণব দর্শন থেকে একটি ভাবই আমি গ্রহণ করতে পেরেছি। সেই ভাবটি শৃঙ্গার। শৃঙ্গারের সঙ্গে সুরার কোনও কলহ নেই। বরং ভারি ভাব—মৃদু হেসে বলে রামমোহন।
—তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না মোহন? আমি তোর মা। তুই আমার মুখের উপর নির্লজ্জভাবে এসব বলছিস? পাশের ঘরে তোর বউরা আছে। তারা তোকে মদ খেতে দেখলে কী বলবে ভেবেছিস?
—তারা জানে। আমি কিছুই লুকিয়ে করি না। তাছাড়া, ইচ্ছে করলে তারাও খেতে পারে। আমাদের শাস্ত্রে নারীর মদ্যপান নিষিদ্ধ নয় মা। পুরাকালে ভারতীয় নারী তো সোমরস পান করত।
—ম্লেচ্ছ। ম্লেচ্ছ। ম্লেচ্ছ। তুই আর কত নীচে নামবি মোহন? দু’—চারখানা বই পড়ে নিজেকে পণ্ডিত ভাবছিস? তোর বাবা জানলে কী সর্বনাশ হবে জানিস?
—আন্দাজ করতে পারি মা। আমি সকল সর্বনাশের জন্য পুরোপুরি তৈরি। তুমি আর সময় নষ্ট কোরো না। বাবাকে এখনই গিয়ে জানাও, আমি বৈষ্ণববাড়িতে বসে মদ খাচ্ছি।
তারিণী নিমেষে বেরিয়ে যায় রামমোহনের পড়ার ঘরের চৌকাঠ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে রামকান্তর সঙ্গে। আজ তারিণীর মাথায় খুন চেপেছে। হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
রামকান্ত যা দেখছে, বিশ্বাস করতে পারে না। রামমোহন তার সামনেই মদের গেলাস তুলে চুমুক দেয়। কোনও দ্বিধা বা লজ্জার চিহ্ন নেই বেয়াদপ ছেলেটার মুখে। এ—ছেলে বেঁচে ফিরে এল কেন?
রামকান্ত ছুটে যায় রামমোহনের কাছে। এক ঝটকায় তার হাত থেকে ফেলে দেয় পানপাত্র। কাট গ্লাসের বিলিতি পানপাত্রটি পাথরের মেঝের উপর চুরমার। মদের গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করে।
—এসব কী দেখছি, কী শুনছি? এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই রামমোহন, চিৎকার করে ওঠে রামকান্ত। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। চক্ষু অগ্নিবর্ণ।
—বাবা, শ্রুতি, স্মৃতি ও তন্ত্রবচন, কোথাও মদ্যপান নিষিদ্ধ এ—কথা বলা নেই। তবে একটি হাস্যকর কথা বলা আছে, কুলবধূর পক্ষে মদ্যপানের পরিবর্তে মদ্যের আঘ্রাণমাত্র বিহিত।
এ—কথা বলে হা হা করে হাসতে থাকে রামমোহন।
রামকান্ত আর সহ্য করতে পারে না। বলে, তোকে এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছি। বেরিয়ে যা কুলাঙ্গার। পরম বৈষ্ণববাড়িতে মদ্যপানের কদাচার আমি হতে দেব না।
—বাবা, আমি আজই বেরিয়ে যাব। আর কোনও দিন ফিরেও আসব না। তবে যাওয়ার আগে একটি কথা বলে যাই, বিশুদ্ধ হিন্দু মদ্যপান বিরোধী নয়। শাস্ত্রে নিষেধ নেই। স্বয়ং সীতাদেবী মদ্যপান করতেন বাবা।
—পাপ! পাপ! তারিণী, এই পাপকে তাড়াও।
—বাবা, শোনো তবে: সীতামাদায় হস্তেন মধু মৈরেয়কং শুচি/পায়য়ামাস কাকুৎস্থঃ শচীমেব পুরন্দরঃ। বাবা, স্বয়ং বাল্মীকি লিখছেন, রামচন্দ্র সীতাকে বাম বাহুর দ্বারা জড়িয়ে ধরে আদর করে মৈরেয় মদ তুলে দিচ্ছেন সীতার হাতে। ঠিক যেমন করে দেবরাজ ইন্দ্র ইন্দ্রাণীকে মদ পরিবেশন করেন।
তাছাড়া, রামরাজত্বে তো মদের অভাব ছিল না। রাম অযোধ্যা থেকে চলে যাওয়ার পর একটি জিনিসের বড় অভাব হল: অযোধ্যার রাস্তায় কোথায় উবে গেল বারুণী মদের গন্ধ—বারুণী মদ গন্ধশ্চ না প্রবাতি সমন্ততঃ।
‘পাপ পাপ, তারিণী, এ পাপকে বাড়ি থেকে তাড়াও’। রামমোহনের কান থেকে তার পিতৃদেবের এই দুর্বচন কোনও দিন মুছে যাবে না।
—শুধু বাড়ি থেকে নয়, গ্রাম থেকেও তাড়াব, এ গ্রাম শুধু হিঁদুর। মোহনের জাত—ধম্ম দু’টোই গিয়েছে, বলল তারিণী।
নিশুতি রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রামমোহন এককথার মানুষ। বাপকে বলেছে, আজই চলে যাব। এ বাড়িতে সে আর সূর্যোদয় দেখবে না।
রাতের অন্ধকারে বাড়ির খিড়কি দিয়ে পথে পা বাড়াতে যাবে রামমোহন, এমন সময়—
—দাঁড়াও। যেও না। অন্তত আমার জন্যে থেকে যাও।
—বউঠান!
বড়ভাই জগমোহনের স্ত্রী সরস্বতীর দিকে তাকায় বিস্মিত রামমোহন।
অন্ধকারে সরস্বতী ছায়ারেখা। লবঙ্গলতার মতো সে দাঁড়িয়ে আছে খিড়কির পাশে।
—তুমি বারবার চলে যাও। তুমি ছাড়া এ—সংসারে আমার আপন বলতে কে আছে বলো?
—বউঠান, কেউ দেখতে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
—হোক সর্বনাশ। এ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারছি না। যেখানে যাবে, আমাকে তাহলে নিয়ে যাও। এককাপড়ে বেরিয়ে যাব। বলো, নিয়ে যাবে না আমাকে?
—সমাজ বউঠান, সমাজ। সমাজ প্রেম বোঝে না। শুধু নিয়ম আর নিয়ম।
—তাহলে তোমার বিশ্বাসে কেন দীক্ষিত করলে আমাকে? আমি মুখ্যু। কিছু বুঝি না। শুধু তুমি যা বলো, তাতেই বিশ্বাস করি।
রামমোহনের কাছে সরে যায় সরস্বতী। তার বুকের উপর হাত রাখে।
—কী বিশ্বাস করো বউঠান? ঈষৎ কাঁপা কাঁপা উচ্চচারণে জানতে চায় রামমোহন।
—বিশ্বাস করি, যা তুমি বিশ্বাস করতে বলেছ। হিন্দুর দেবদেবী সব মিথ্যে।
—আর?
—বিশ্বাস করি, ঈশ্বর যদি থাকেন, তিনি নিরাকার। তাঁর মূর্তি গড়ে পুজো করা অন্যায়।
—তুমি ঠাকুরঘরে যাও না?
—যাই তো।
—কার পুজো করো? নারায়ণশিলার? শ্রীকৃষ্ণের?
—তোমার পুজো করি। চোখ বুজলে তুমিই ফুটে ওঠো অন্ধকারে আলোর মতো।
সরস্বতী আলতোভাবে তার মাথাটি রাখে রামমোহনের বুকে। রামমোহন বুঝতে পারে, সরস্বতী কাঁদছে। মুছিয়ে দেয় চোখের জল।
—শোনো বউঠান। ছেলেমানুষি কোরো না। ঘরে ফিরে যাও। এইভাবে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না।
—কোথায় যাবে তুমি?
—এই গ্রামেরই জঙ্গলের ধারে গরিবদের সঙ্গে কোনও চালাঘরে আপাতত থাকব।
—পারবে না।
—কেন?
—মা আজ সকালেই খবর পাঠিয়েছেন রামজয় বটব্যালের কাছে। তোমাকে অপমান করে গ্রাম থেকে ভাগিয়ে দেওয়ার জন্য।
—ভেবো না বউঠান। আমার জন্য ভাবনা ছাড়ো। আমার ভিতরে আগুন জ্বলছে। সহজে নিভবে না।
রামমোহন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সরস্বতীর বন্ধন থেকে। তারপর পা বাড়ায় অনিশ্চিত অন্ধকারে।
—শোনো, আর একবার শুনে যাও। আর্ত অথচ মৃদু স্বরে বলে সরস্বতী।
রামমোহন থেমে যায়। কিন্তু ফিরে আসে না। সরস্বতী ছুটে বেরিয়ে আসে পথে।
নিজের হাত থেকে সোনার বালাটি খুলে সে দেয় রামমোহনের হাতে।
—রেখে দাও।
—আমি সোনা নিয়ে কী করব বউঠান? তোমার বালা বেচে অন্নের জোগাড় করব? সেভাবে বেঁচে থাকবে রামমোহন রায়!
—না গো। সেজন্য নয়। আমাকে মনে রেখো তুমি। আর…
—আর কী বউঠান?
—আর এদেশের মেয়েদের জন্যে কিছু কোরো ঠাকুরপো! তারা বড্ড অসহায়।
রামমোহন কিছু বলে না। সে বালাটি তার পুঁটলির মধ্যে রেখে দেয়। তারপর সরস্বতীর হাতটি বুকের উপর ধরে বলে, আর হয়তো কোন দিন দেখা হবে না। তোমার এই স্পর্শটুকু সঙ্গে নিয়ে গেলুম।
রামকান্ত মৃত্যুশযায়। রামমোহনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেই শয্যা নিল রামকান্ত। তারপর ঘনিয়ে এল অবসানের মুহূর্ত। খবর পেয়ে রামমোহন ফিরেছে। রামমোহনের সামনেই শেষ নিশ্বাস ফেলল রামকান্ত। আর সেই মুহূর্ত থেকে স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি নিজের দখলে নিয়ে নিল তারিণী। বড়ছেলে জগমোহন মা—র হাতের পুতুল। পরম হিন্দু। তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।
রামমোহন চেষ্টা করল পৈতৃক সম্পদের কিছুটার উপর অন্তত তার অধিকার রাখতে। সুপ্রিম কোর্টে ছেলের নামে মামলা ঠুকল তারিণী। তার বক্তব্য খুব স্পষ্ট, এই সম্পত্তি পরম বৈষ্ণব ও হিন্দুর। তার পুত্র রামমোহন হিন্দু ধর্ম—বিরোধী। তাকে তাই আমি ‘ত্যাজ্যপুত্র’ করলুম। পৈতৃক সম্পত্তিতে কোনও অধিকার নেই তার।
তরুণ রামমোহন যেন এই প্রথম প্রকাশ করল তার নিহিত শক্তি। সুপ্রিম কোর্টে আচমকা বিস্ফোরণ : The ground taken by me in all my controversies are not that of opposition to Brahminism, but to a perversion of it.
এইখানে থামল না রামমোহন। অপূর্ব দুঃসাহসে বলল, I endeavour to show that the idolatry of the Brahmins is contrary to the practice of their ancestors, and to the principles of the ancient books and authorities which they profess to revere and obey.
সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরল। হেরে গেল তারিণী। জয় হল রামমোহনের।
রামমোহন কিন্তু বাপের সম্পত্তিতে হাত দিল না। পাছে মা দুঃখ পায়, অপমানিত বোধ করে। শ্মশানের ধারে ঘর বাঁধল রামমোহন। সে একা থাকে সেখানে।
অনেক রাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে রামমোহনকে একটিবার দেখতে শ্মশানে এল সরস্বতী।
সরস্বতী কি স্বপ্ন দেখছে?
রামমোহন ধ্যানমগ্ন একটি ছোট্ট বেদিকার উপর। সামনে কোনও প্রতিমা নেই। নেই ঈশ্বরের কোনও চিহ্ন বা প্রতীক।
বেদিকাটির দু’ধারে লেখা ‘ওম তৎসৎ’। আর লেখা, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। আর রামমোহনের পিছনে লেখা একটি মাত্র শব্দ, ‘ওঁ’।
—আদিশব্দ এটাই। রামমোহনের কণ্ঠস্বর লেগে আছে সরস্বতীর কানে।
সে নীরবে চোখের জল মোছে।
তার ভিতরে আদর মিশে যায় অর্ঘে!
১৮১১ সাল। রামমোহন সাঁইতিরিশ। আট বছর হয়ে গিয়েছে মাথার উপর বাবার শাসন নেই। মা—ও যেন পরাজয় মেনে নিয়েছে। কিছুদিন আগে ফারসি ভাষায় বেরিয়েছে তার অতি সাহসী বই ‘তুহসাৎ—উল—মুয়াহহিদীন’। এই বইয়ে সে পরিষ্কার উড়িয়ে দিয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের। গেল গেল রব উঠেছে চারিদিকে।
তেত্তিরিশ কোটি দেবদেবী এবং নারায়ণশিলা নস্যাৎ। তাহলে হিন্দুদের আর থাকল কী! হিন্দু পুরোহিত কি বসে বসে আঙুল চুষে পেট ভরাবে?
হিন্দুসমাজ তেড়েফুঁড়ে লাগল রামমোহনের বিরুদ্ধে। রটে গেল, রামমোহন রায় একটা আস্ত শয়তান। হেন অন্যায় ও পাপ নেই যে লোকটা করেনি।
আগুনে ঘি ঢালল রামমোহনের বৈষয়িক শ্রীবৃদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি, ও সাহেবদের সঙ্গে তার পিরিতের সম্পর্ক।
—এই যে ভায়া, শুনেছেন রামমোহন রায়ের হাঁড়ির খবর?
মানিকতলার মোড়ে বাজার করতে করতে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে বলে আর এক পণ্ডিত। দু’জনেই মানিকতলার হিন্দুদের পাপ—পুণ্য, আচার—অনাচারের প্রাত্যহিক হিসেব রাখে।
—নতুন কিছু পেলে না কি? যা জানি তাতেই তো ঢি ঢি পড়ে গিয়েছে।
—আরে এবার তো আরও বড় কেচ্ছা।
—বলো কী? ব্যাটার পেটে অ্যাতো?
—রামমোহন রায় আর হিঁদু মেয়েতে তৃপ্ত নয় হে! সারাক্ষণ তো মদে—মেয়েমানুষে আছে। তার উপর এখন আবার মোচরমান রক্ষিতা রেখেছে।
—বলছ! তা খবরটা সত্যি বটে তো?
—ভায়া, নিজের চোখে দেখে এলুম।
—নিজের চোখে? তা দেখলেটা কী?
—মানিকতলার বাগানবাড়িতে তো ঘরে ঘরে মেয়েছেলে। তাতেও চলছে না। নিজের চোখে দেখলুম রামমোহন দিব্য ঢুকে গেল কোচোয়ানের ঘরে।
—ইশ! আর কত নিচে নামবে ভায়া!
—শুনেছি মেয়েটা পোয়াতি!
—আরে রটিয়ে দাও ভায়া, আর দেরি কেন? হিন্দু ধর্মের সর্বনাশ করেছে লোকটা। নরকেও স্থান হবে না।
—ভায়া, ওর নরকবাস এখানেই হবে। সেই সুখের দিন এল বলে।
রামমোহন ইতিমধ্যে কলকাতায়। প্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়েছে মানিকতলায়। ভোগবিলাসের শেষ নেই!
—তা, অ্যাতো টাকা আসছে কোথা থেকে?
—ঘুষ, ঘুষ, সব ঘুষের টাকা। মেয়েছেলের পিছনে খরচ করছে।
—লিখছ না কেন রামমোহনের ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারটা? জেলে পচবে ব্যাটা।
পত্রপত্রিকায় বেরল খবর— রামমোহন নানা জায়গা থেকে দেদার ঘুষ নিচ্ছে। নাহলে কলকাতায় এসে এমন রাজার হালে থাকে! সবাই ‘রাজা’ বলে যে ডাকছেও লোকটাকে। কী আশ্চর্য! ঘুষ নিয়ে নিয়ে ‘রাজা’ হয়ে গেল?
‘ক্যালকাটা রিভিউ’—তে উত্তর দিলেন কিশোরীচাঁদ মিত্র। রাজা রামমোহন ঘুষ নিয়ে ধনী! এ কথা শুধু বাঙালিই ভাবতে পারে। তিনি যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সরকারি চাকরি করেছেন। ইংরেজরা তাঁর যোগ্যতাকে সম্মান দিয়েছে। কোনও ইংরেজ কখনও তাঁকে ‘অসাধু’ বলেনি।
কিন্তু ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। রামমোহনকে তারা নরকদর্শন করাবেই। রামমোহনের একটি পুত্র হল। রামমোহন নাম রাখল রাজারাম।
—রাজারামের ব্যাপারটা শুনেছ? বলা নেই, কওয়া নেই, অমনি একটা ছেলে এল কোথা থেকে? ওর বউরা কোথায়? কার ছেলে রাজারাম?
পাড়ায় পাড়ায় রটে গেল, রাজারাম আসলে রামমোহনের ঔরসে মুসলমান উপপত্নীর ছেলে। এই অনাচার হিন্দু সহ্য করতে পারে না। রামমোহনকে ‘একঘরে’ করো। কিন্তু রামমোহন তো হিন্দু সমাজের কেউ নয়। তাকে একঘরে করার উপায় কোথায়?
যেরকম করে হোক, রাজারামকে ‘মুসলমান’ প্রমাণ করতে পারলে রামমোহনের পতন অনিবার্য—এরকম ধারণা হিন্দুদের মধ্যে।
চলতে লাগল রামমোহন—বিরোধী প্রচার। রাজারাম ‘হিন্দু নয়’, এটা বিশ্বাস্য হলে— রামমোহনের মুসলমান রক্ষিতার রসালো গল্পটাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সহজে। ফলে, রামমোহন অন্তত আর কোনওভাবে সামাজিক মর্যাদার জায়গায় থাকবে না।
কিন্তু রাজারামের ব্যাপারে যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ। রাজারাম রামমোহনের ঔরসজাত সন্তানই নয়। সে পালিত সন্তান! খাস ইংরেজ ল্যান্ট কার্পেন্টার একটি চিঠিতে লিখে গিয়েছেন রাজারামের ‘আসল’ পরিচয় : রাজারাম ডিক সাহেবের পালিত বালক। তাকে পোষ্য নিয়েছে রামমোহন। কিন্তু তাতে রামমোহনের ‘মুসলমান’ হওয়ার পথে বাধা কোথায়?
রামমোহনের ঔরসেই মুসলমান রক্ষিতার সন্তান সে। তারপর ডিক সাহেব তাকে কিছুদিন পালন করে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে রামমোহনের কাছে। হিন্দু সমাজের চোখে অত সহজে ধুলো দেওয়া যাবে না। এমন গল্পও রটল রামমোহনের নামে।
প্রকাশিত হল ‘পাষণ্ডপীড়ন’—’কোনো ধর্মসংস্থাপনা— কাঙ্ক্ষি কর্তৃক, কোনো পণ্ডিতের সহায়তায় স্বদেশীয় লোক হিতার্থে।’
‘পাষণ্ডপীড়ন’—এ বলা হল রামমোহন রায় ‘নগরান্তবাসী’ অর্থাৎ ‘অন্ত্যজ চণ্ডাল’। আর লেখা হল, ‘নগরান্তবাসীর অদ্যাপি যবনী গমনের চিহ্ন প্রকাশ হইতেছে যেহেতু নিজ বাসস্থানের প্রান্তেই যবনী গমনের ধ্বজপতাকা রোপণ করিয়াছে।’
১৮১১—তেই হঠাৎ অসুস্থ রামমোহনের দাদা জগমোহন। সংবাদটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমস্রোত বয়ে গেল রামমোহনের শিরদাঁড়ায়। যদি দাদার কিছু হয়, ওরা জোর করে চিতায় তুলবে সরস্বতীকে! অসম্ভব। কিছুতেই সেই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব নয় রামমোহনের পক্ষে।
কিছু কিছু পণ্ডিতের কাছে এ তো সুবর্ণ সুযোগ। সরস্বতীকে রামমোহন ভালোবাসে, এ কথা কারও জানতে বাকি নেই। মেয়েটার ঢলাঢলিও সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। সুন্দরীকে পুড়িয়ে মারো। সংসারে, সমাজে শান্তি আসবে। আর চুরমার হবে রামমোহন।
ওকে নিজের হাতে দাদার চিতায় আগুন দিতে বাধ্য করব আমরা। নিজে পুড়িয়ে মারবে প্রাণের সরস্বতীকে। হিন্দু ধর্মের এই হল বিধান!
জগমোহন সত্যিই মারা গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে শ’য়ে শ’য়ে খাঁটি হিন্দুর দল জমজমাট করে তৈরি করে ফেলল সতীদাহর পরিবেশ ও আয়োজন।
—রামমোহন, তোমাকে লাগাতে হবে সরস্বতীর গায়ে আগুন।
—সতীদাহ পাপ। এ—পাপ ধর্মের অঙ্গ হতে পারে না।
হা হা করে হেসে ওঠে হিন্দুরা।
ততক্ষণে সরস্বতীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে পুরোহিত—পণ্ডিতের দল। উচ্চচারিত হচ্ছে সরস্বতীকে স্বর্গে পাঠানোর মন্ত্র।
—বাঁচাও, বাঁচাও, আমি মরতে চাই না। রামমোহনের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে সরস্বতী।
প্রবল উদ্যমে বাজছে বাজনা। ঢাক। ঢোল। কাঁসর। ডুবে যায় সহগামিনীর আর্তনাদ।
রামমোহনকে কারা যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে চিতার দিকে। সরস্বতী প্রায় অজ্ঞান। রামমোহনকে লাগাতে হবে আগুন। আর দেরি করা যায় না।
রামমোহনের শরীরে দৈত্যের শক্তি। তাকে একচুলও নড়ানো গেল না। তার চোখের সামনে জ্বলে উঠল চিতা। এখন শুধু উদ্দাম বাদ্যের শব্দ। কোথাও নেই সরস্বতীর আর্তনাদ। মাথায় কে সজোরে আঘাত করল রামমোহনকে। সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
ভোরবেলা। সূর্য উঠছে।
রামমোহন ধীরে ধীরে মাথা তোলে। তার মনে পড়ে যায় সবকিছু। সে টলতে টলতে এগিয়ে যায় চিতাটার দিকে। শুধু ভিজে ছাইয়ের স্তূপ। পোড়া মাংসের গন্ধ।
সে সূর্যের দিকে তাকায়।
তারপর ঋজু হয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে, বউঠান, তুমি যেখানেই থাকো, শোনো আমার প্রতিশ্রুতি, সতীদাহপ্রথা আমি দেশ থেকে বিলুপ্ত করবই—এই আমার সূর্যপ্রণাম। তুমি যেখানেই থাকো বউঠান, দেখতে পাবে, অন্ধকার দেশে নতুন সূর্য উঠল।