১. অধ্যাপক মৈত্র

গাছের পাতা নীল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন অধ্যাপক মৈত্র। যেমন মাথা নিচু করে চলে যায় সাহায্যপ্রার্থী গরিব তার ধনী আত্মীয়ের দরজা থেকে অবহেলার দান কুড়িয়ে নিয়ে।

অবহেলাই। অবহেলা করেই ছেড়ে দিল ওরা শেষটায় ওদের আসামিকে। বোধ করি বা একটু করুণাও হয়েছিল ওদের কারও কারও, অধ্যাপকের গম্ভীর হতাশা-আঁকা অসহায় মুখ দেখে। বলল,  যাক গে, চলে যান।

অবিশ্যি গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যে থেকে দু-একটা শেয়াল ডাক উঠল বইকী, ওদের এতদিনকার প্রিয় আর সম্মাননীয় অধ্যাপকের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা লক্ষ করে। উঠল দু-একটা তীব্র অসভ্য সিটি। কিন্তু সে তো হবেই। ওইটুকুর ওপর দিয়েই যে গেছে, প্রৌঢ় লোকটাকে যে হাসপাতালে পাঠায়নি ওরা এই ঢের। ইচ্ছে করলেই নাকি ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে পারত, অথবা মুখে ঘুসি মেরে দাঁত খসিয়ে নিতে পারত। তা করেনি ওরা।

অতএব বলতেই হবে রীতিমত ভদ্রই ওরা। ওরা শুধু সিটি মেরে দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, আর পিছনে হুক্কা হুয়া ডেকেছে।

হুক্কা হুক্কা, হুক্কা হুয়া।

 শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলেন অধ্যাপক।

না, কানে হাত চাপা দিলেন না, অথবা ওদের সম্পর্কে কোনও অভিশাপবাণীও উচ্চারণ করলেন না। অনুভূতির যন্ত্রটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে, শুধু বুকের মধ্যে কীসের যেন একটা পাষাণভার। এ কি হৃদ্যন্ত্রে কোনও কঠিন ব্যাধি আক্রমণের পূর্বলক্ষণ? না শুধু ভয়ংকর একটা উত্তেজনার ভার?

এই ভারটা প্রথম অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক যখন তাঁর ক্লাসে লেকচারের সময় ছেলেরা রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক তুলেছিল এবং বেশ কয়েকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তর্ক তো থামায়ইনি, বরং বলে উঠেছিল, এই আছেন এক পেঁতি বুর্জোয়া, সত্যিকথা শোনবার সাহসটুকুও নেই।

তখন। হঠাৎ ওই ভারটা অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক মৈত্র। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।

চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, গেট আউট। যারা গোলমাল করছ, বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে।

অধ্যাপক মৈত্রের দীর্ঘ অধ্যাপনার ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধ করি এই প্রথম। তাঁর স্বরনালী থেকে এমন রূঢ়স্বর বেরোনো সম্ভব একথা আর কেউ দূরে থাক, তিনি নিজেও বুঝি কখনও জানতেন না।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও–এমন কথা জীবনে কখনও মনে মনেও বলেছেন কি মৈত্র? বোধ করি বলেননি। কারণ অতীতে এমন পরিস্থিতি আসেওনি। পড়ানোর গুণে তিনি সকলের প্রিয়, চরিত্রের গুণে সকলের শ্রদ্ধেয়।

তবে তিরস্কার কি আর করতে হয় না কখনও? কলেজের কিছু ছাত্র তো সর্বদাই থাকে যারা ছাত্র নামের অযোগ্য, যারা অসভ্য অভব্য দুর্বিনীত।

করতে হয় তিরস্কার, কিন্তু অধ্যাপক মৈত্র বরাবরই সেটা করেছেন তাঁর নিজস্ব মৃদু অথচ দৃঢ়ভঙ্গিতে। যেটা অনেক সময় ধমকের চেয়ে কার্যকরী। যার সামনে অবিনয় অভব্যতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।

কিন্তু আজ অন্য ঘটনা ঘটে গেল। যার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অধ্যাপক মৈত্রেরই মাথা হেঁট করে প্রস্থান।

মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সুদীর্ঘ সাধনা-অর্জিত সম্মানের আসনটি হারালেন অধ্যাপক মৈত্র।

মুহূর্তের মধ্যে যেন কী হয়ে গেল।

রূপান্তর ঘটে গেল অধ্যাপক মৈত্রের সামনের ওই ভদ্র চেহারার আর সভ্য পোশাকের ছেলেগুলোর। হঠাৎ দেখতে পেলেন অধ্যাপক, তিনি একদল গুণ্ডার দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, তাই দেখলেন অধ্যাপক সরোজাক্ষ মৈত্র। মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার এমনি এক অবস্থার কথা– কোনও এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বেশি রাত্রে ফিরছিলেন। ট্রাম রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় সে বাড়ি থেকে। রাস্তার লোকসমাগম কমে গেছে। কিন্তু সরোজাক্ষ সেটাকে বিপজ্জনক মনে না করে বরং শান্তির কারণ মনে করে নানা কথা ভাবতে ভাবতে আসছিলেন। ভাবছিলেন নসুমামা এমন কিছু বড়লোক নন, অথচ মেয়ের বিয়েতে যা দানসামগ্রী দিয়েছেন, তা বড়লোকের মতো। কষ্ট করেই দিয়েছেন। তবে না দিলে নাকি বিয়েটা ঘটত না। এমন ভাল জামাইটি হাতছাড়া হয়ে যেত। তাই বহু টাকা ঋণ করে নসুমামা ভাল জামাইয়ের উপযুক্ত দক্ষিণা সংগ্রহ করেছেন।

ভাল জামাই!

ভালর সংজ্ঞাটা কী?

ভাবতে ভাবতে আসছিলেন সরোজাক্ষ, হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে পাঁচ-সাতটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে ঘিরে ধরল সরোজাক্ষকে। আর কবলিত শত্রুকে ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল, সঙ্গে যা আছে চটপট বার করে দাও তো জাদু!

ঠিক যে ভঙ্গিতে একটু আগেই সরোজাক্ষর ছাত্ররা বলে উঠেছিল, তাঅ্যাপলজিটা একবার চেয়েই নিন না স্যার চটপট।

হ্যাঁ, ওটাই দাবি ছিল ওদের। এই দাবিতেই ঘেরাও করেছিল তাঁকে। ক্ষমা চাইতে হবে অধ্যাপককে তাঁর উদ্ধত বচনের জন্যে।

.

 সেদিনের সেই গুণ্ডাগুলোর দাবি এক কথাতেই মিটিয়ে দিয়েছিলেন সরোজাক্ষ। টাকা-পয়সা বেশি ছিল না সঙ্গে, কিন্তু দামি ঘড়িটা হাতে ছিল, ছিল সোনার আংটি সোনার বোতাম। নিজের বিয়েটা তখনও খুব পুরনো হয়ে যায়নি তাই বিবাহলব্ধ ওই জিনিসগুলো ছিল। সরোজাক্ষর শ্বশুর অবস্থাপন্ন ছিলেন, জামাইকে দামি দামি জিনিসই দিয়েছিলেন।

কিন্তু পরিস্থিতির চেহারা দেখে দামি জিনিসগুলি সামলাবার চেষ্টা করেননি সরোজাক্ষ, বিনা বাক্যে খুলে দিয়েছিলেন ঘড়ি আংটি বোতাম, গায়ের শাল। পকেট থেকে পার্স। মাত্র সাতটি পয়সা চেয়ে নিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে মৃদু হেসে, বলেছিলেন, এত রাত্রে পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে যেতে বড় বেশি কষ্ট হবে।

কিন্তু আজ বিনা বাক্যে এককথায় ওদের দাবি মেনে নিতে পারেননি। ঘড়ি আংটির থেকে অনেক বেশি দামি একটা জিনিস রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন প্রথমটায়। ওরা যখন ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল ক্ষমা চাইতে হবে স্যার, মাপ চেয়ে কথা ফিরিয়ে নিতে হবে–তখন তিনিও ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলেন, অন্যায় কিছু বলে থাকলে নিজেই ফেরত নিতাম, নিজেই ক্ষমা চাইতাম।

একটা ছেলে, হয়তো অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল, সে এসে গলা নামিয়ে বলেছিল– তা শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ছেলে যে একেবারেই ছিল না তা নয়, ছিল। অনেক ছিল। হয়তো তারাই সংখ্যায় বেশি, কিন্তু তাদের সাহস ছিল না সহপাঠীদের এই অসভ্যতার প্রতিবাদ করবার। কারণ তারা দলের শিকার। তারা জানে তারা যে মুহূর্তে প্রতিবাদ করবে, সেই মুহূর্তে বন্দুকের মুখ ঘুরে যাবে। তাই তারা বিপন্নমুখে একে ওকে মৃদু অনুযোগ করছিল, না না, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতটা করার কোনও মানে হয় না।

কিন্তু তাদের আবেদন ধোপে টেকেনি, কারণ তারা সংখ্যাগুরু হলেও দলের কাছে তাদের হার। স্বাধীন চিন্তার স্বাধীন মত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করবার সাহস বা শক্তি তাদের নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতার রাংতায় মোড়া একটা অমোঘ দাসত্বের যূপকাষ্ঠের বলি তারা।

তাই তাদের একজন গলা নামিয়ে পরামর্শের সুরে বলেছিল, যা হোক করে দুটো কথা বলে ওদের শান্ত করে ফেলুন স্যার, বড় ভয়ংকর ছেলে ওরা। ছুরি বার করতেও পিছপা হয় না।

তবু তখনও সরোজাক্ষ হিসেব করতে পেরে উঠছিলেন না কোনটাকে বেশি দামি বলে ধরবেন, নিরাপত্তা না আত্মসম্মান?

তাই তখন বলেছিলেন, দেখা যাক কতদূর করতে পারে।

বলেছিলেন। কারণ তখনও ভেবেছিলেন কদিন ঘেরাও করে রাখতে পারে রাখুক। দেখি কদিন চলে এই নাটক। আমাকে আমি সে নাটকের দর্শক ছাড়া আর কিছু ভাবব না।

ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছেলেটি বলেছিল, সামান্যর জন্যে ভয়ানক মুশকিলে পড়ে যাবেন স্যার।

সরোজাক্ষ যেমন ছিলেন সেই ভাবেই বলেছিলেন, সামান্য কিনা তাই হিসেব করছি।

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা কষা হল না।

সংখ্যাগুলো যেন ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর ক্লাস-রুমের ধারের হল-এর ফোনটা বেজে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেলে সেটাকে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করল,ওঃ, স্যারের বাড়ি থেকে বলছেন? দেখুন ফিরতে তাঁর একটু দেরি হবে, বিশেষ একটা ব্যাপারে আটকা পড়ে গেছেন।…কখন মিটবে? তা বলতে পারছি না, সেটা ওঁর নিজের হাতে।…না, মাপ করবেন, ওঁকে এখন ডেকে দেওয়া যাবে না

টেলিফোনটাকেও ঘেরাও করে রেখেছিল ওরা, কাজেই কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না সেটা ব্যবহার করা। না অন্য প্রফেসরদের, না শুভবুদ্ধি চাকর দারোয়ান কেরানিদের। অথচ সবাই একবার করে পুলিশের কথা ভেবেছে।

অধ্যাপক মৈত্র যেন এতক্ষণ কোনও একটা ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে বসে ছিলেন। ওদের ঠাণ্ডা গলা ক্রমশই উত্তপ্ত হচ্ছিল, নিজেদের মধ্যেই তর্কাতর্কির মাধ্যমে চেঁচিয়ে উঠছিল–কিছুতেই না। অ্যাপলজি না চাইলে একটি পা নড়তে দেওয়া হবে না। জাদু ঘুঘুই দেখেছেন, এবার ফাঁদ দেখুন।…পুলিশ? কে ডাকবে? প্রিন্সিপাল? ডাকুক। দেখি কত মুরোদ..

সরোজাক্ষ যেন অবাক হয়ে শুনছিলেন কথাগুলো।

এরা পড়ত তাঁর কাছে?

বসে থাকত সভ্য চেহারা নিয়ে?

ক্রমশই যেন সেই আচ্ছন্নতা বাড়ছিল।

এই ফোন-এর ব্যাপারটার পর হঠাৎ যেন চমক ভাঙল। চিন্তার পরদায় আস্তে আস্তে ভেসে উঠল, বাড়ির লোকের ব্যস্ততা…লোক জানাজানি কাণ্ড, পুলিশের সাহায্য ভিক্ষা নিয়ে উদ্ধার…নিরাপত্তার আশ্বাসবাহী সুরক্ষিত ভ্যান-এ চড়ে পলায়ন…পরদিনের সংবাদপত্রের হেডলাইন, বন্ধু আত্মীয় হিতৈষিবর্গের বিস্ময় প্রশ্ন ও দার্শনিক মন্তব্য, তার সঙ্গে সহানুভূতি বারি।…কী লজ্জা কী লজ্জা!

তারপরে খেয়ালে এল দরজায় কিছু কিছু চেনা মুখ দেখেছিলেন যেন, হতাশ বিপন্ন উদ্বিগ্ন নিরুপায়।

হয়তো সেই মুখেরা কিছু বলতেও চেষ্টা করেছিল এই উন্মত্তগুলোকে লক্ষ্য করে, তারপর আস্তে সরে গিয়েছিল। তার মধ্যে কি অধ্যক্ষের মুখও ছিল? মনে করতে পারছেন না। হয়তো ছিল। হয়তো ঈষৎ বিরক্তিও ছিল তাতে।

যেন সে বিরক্তিতে অভিযোগের ছায়া, কী আবার ঘটালে বাপু? নাও এখন বোঝে। জানো তো বিষধর সর্প নিয়ে বাস আমাদের, কেন আবার তাদের ল্যাজে পা দিতে যাওয়া।

অর্থাৎ ওঁরা দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবেন না।

সংকল্পে ভাঙন ধরল।

কেলেঙ্কারির দৃশ্যগুলো মাথা তুলে দাঁড়াল। আপস করতে হল। ওদের সঙ্গে নয়। নিজেরই সঙ্গে। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ভবিষ্যতে স্থির হবে, এখন এই অবস্থার অবসান দরকার। নচেৎ আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো তাঁর বড় ছেলে সরেজমিনে তদন্ত করতে আসবে কোন জটিল কর্মর্জালে আটকা পড়ে আছে তার বাবা। গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে, হয়তো থানা-পুলিশ কাণ্ড করে পরিস্থিতি নরক করে তুলবে।

সংকল্পচ্যুত হলেন।

ক্ষমা চাইলেন।

উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা চাইতে বলেছ, এতক্ষণ ধরে আমি বিচার করে দেখছিলাম সেটা চাইবার মতো কাজ আমি করেছি কিনা।

ভিড়ের মধ্যে বেশ একটু গুঞ্জন উঠল।

অর্থাৎ হুঁ বাবা, পথে এসো।

অধ্যাপক মৈত্র কথা শেষ করলেন, দেখলাম ক্ষমা চাওয়াই উচিত। একা আমি নয়,সমস্ত প্রতিষ্ঠানটারই ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ দিনের পর দিন তোমাদের আমরা ঠকিয়েছি। তোমাদের আমরা শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতা শোভনতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশি রাশি টাকা নিয়ে চলেছি, কিন্তু দিতে পারিনি সে জিনিস। দিতে পারছি কি না তাকিয়েও দেখিনি। এই প্রতারণার জন্যে ক্ষমা চাইছি ।

 আরও কিছু বলতেন হয়তো, ঘেরাও দলের পিছন থেকে মোরগ ডাক উঠল। তারপর অনেকগুলো গলার ছ্যাবলা হাসি-সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কথা বলছে রে! ওসবে আর কিছু হবে না চাঁদ, সে দিন চলে গেছে।

সরোজাক্ষর যেন মনে হল কাছে কোথায় ফার্নেস জ্বলছে, তার হলকা আসছে কানে মাথায় মুখে। তবু কষ্টে বললেন, তা বটে। তবে এটা সাজানো কথা নয়। এই মুহূর্তে সত্যিই অনুভব করছি, তোমাদের আমরা ঠকিয়ে চলেছি। তোমাদের গার্জেনদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থের সুযোগ নিচ্ছি, অথচ তাঁদের বিশ্বাসের মূল্য রাখছি না। বিবেকের কাছেই জবাব দেবার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, তোমাদের আর কী বলব। তবে মনে হচ্ছে হঠাৎ একদিন শাসন করতে বসাটা অন্যায় হয়েছে আমার। তার জন্যে ক্ষমা চাওয়া দরকার।

গুঞ্জনটা প্রবল হল।

অধ্যাপকের ক্ষমা চাওয়ার সুরের মধ্যে যেন অন্য অর্থ নিহিত রয়েছে। তথাপি অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াটাও রয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। কী তবে করা যায়? ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে। বলল একটা অশ্লীল গলা।

তারপর কারা যেন কাদের মিনতি করল, অনুরোধ উপরোধ শোনা গেল কিছু কিছু ধরে নে বাবা প্রথম অপরাধ–এই নিয়ে আর গণ্ডগোলে কাজ নেই। ক্ষমা চাওয়াটা তো পষ্ট প্রত্যক্ষ, সেই–সেইটাই রেকর্ড থাকবে–

অতঃপর ওরা ঘেরাওয়ের প্রাচীর ভেঙে ঈষৎ সরে গিয়ে যেন করুণার গলায় বলে উঠল,ঠিক আছে, চলে যান।

সরোজাক্ষ কোনওদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে যেন কোনও অপরাধের নাটকের ধরা পড়া নায়কের মতো আস্তে আস্তে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

প্রাচীরের ভাঙা ইটের এক একটা খণ্ড বলে উঠল, এইটুকু তো আগে করলেই হত জাদু! মিথ্যে ভোগালেন।

তারপর শব্দ উঠল হুক্কা হুয়া। শব্দটা যেন অধ্যাপক মৈত্রকে তাড়া করে পিছু পিছু ছুটে আসতে লাগল।

আমি হার মানলাম।

মনের গভীরে নিঃশব্দ নিশ্বাসে উচ্চারণ করলেন সরোজা-ভাবিনি এরকমটা কখনও হবে। হয়তো আমারই ভুল হয়েছিল। ওরা ছাত্র, ওরা রাজনীতি নিয়ে উত্তেজিত হবে এটা স্বাভাবিক। আমরাও হয়েছি

সরোজাক্ষ একবার চিন্তাকে থামালেন–আমরাও হয়েছি কিন্তু সে কি এইরকম অসভ্য নির্লজ্জতায়? আমরাও উত্তেজিত হয়েছি, কিন্তু তার জন্যে কি ভাষার শালীনতা হারিয়েছি? তার জন্যে কি..না, কোনও একটা অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হয়ে ইচ্ছে করে মতলব করে কখনও উত্তেজিত হইনি আমরা। পরাধীনতার অপমানে উত্তেজিত হয়েছি। উত্তেজিত হয়েছি শাসকদের অনাচার দেখে, অত্যাচার দেখে, দেশের জনগণের নিশ্চেষ্ট ঔদাসীন্য দেখে। উত্তেজিত হয়েছি, বিচলিত হয়েছি।

কিন্তু এদের রাজনীতি আলাদা।

এদের উত্তেজনা উন্মাদনার উৎস অন্য। এরা মূঢ় অন্ধ, এরা একটা মতলবের শিকার মাত্র। তাই এরা

উত্তেজিত হয়ে ওঠে না, ইচ্ছে করে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এরা ছাত্র সেজে এসেছে, সত্যি ছাত্রদের ঘর পোড়াতে। তাই এই অগ্নিনাটকের সৃষ্টি।

সরোজাক্ষ এদের কথা জানেন না তা নয়। তবু সরোজাক্ষ কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি, তাঁরই দুগজ দুরে বসে এরা এমন করে বারুদ তৈরি করছিল, আর সে বারুদের প্রথম বলি হবেন সরোজাক্ষ নিজেই। অবশ্যই এর পর অধ্যয়ন অধ্যাপনার শান্তছন্দে ঝড় উঠবে, কল্যাণের বুলি আওড়াতে আওড়াতে অকল্যাণ এসে ঢুকবে চোরা দরজা দিয়ে। শান্তির ছদ্মবেশে আসবে অশান্তি। সর্বনাশা অশুভ বুদ্ধির মদে মাতাল একটা শক্তি তছনছ করতে থাকবে চিরায়ত মূল্যবোধগুলি। তছনছ করতে থাকবে শ্রদ্ধা সম্মান আশ্বাস বিশ্বাস ভালবাসা।

সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?

পদত্যাগ? না আবার মাথা হেঁট করে ফিরে গিয়ে বিনম্র দাসত্ব?

 হ্যাঁ, পদত্যাগের প্রশ্নও আসছে।

এ শুধু কয়েকটা বাজে ছেলের ঔদ্ধত্যই নয়, এর পিছনে যেন রয়েছে সরোজাক্ষদের অসহায়তার ছবি। এ যেন দিন ফুরোনোর নোটিশ। যেন অদৃশ্য দেয়ালে দেয়াল-লিপি লেখা হচ্ছে, নীতি রত্নমালার মালা পরিয়ে পরিয়ে আমাদের সাজিয়ে রেখে এযাবৎকাল অনেক সুবিধে নিয়েছ তোমরা, বিনা দাবিতে দখল করে বসে আছ শ্রদ্ধা সম্মানের আসন, আর চলবে না ওসব কৌশল। আমরা শুধু পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে কিছুদিন পরে এসেছি বলেই তোমাদের চরণ পুজো করে চলব, এমন বোকামির দিন শেষ হয়েছে। তোমাদের গড়া ওই মিথ্যে ভব্যতার খোলস খুলে ফেলে আমরা বন্য হব, বর্বর হব, আদিম মানবের সন্তানের রূপে ফিরে যাব। যেটা নির্ভেজাল, যেটা সত্য।

ওদের এই শেয়াল ডাকের মধ্যে, মোরগ ডাকের মধ্যে, সিটি দিয়ে ওঠার মধ্যে যেন সেই সংকল্পের আভাস রয়েছে। আর সে সংকল্পের পিছনে রয়েছে একটা প্রবল যুথশক্তি।

.

ঠিক এইভাবেই হয়তো ভাবছিলেন না সরোজাক্ষ, ভাবতে পারছিলেন না, শুধু যেন এক একটা ঢেউ উঠছিল চিন্তার সমুদ্রে।

এ যুগের এই সংকল্পের আভাস কি শুধু আজই দেখতে পেলেন সরোজাক্ষ তাঁর ক্লাসের কতকগুলো ছেলের চোখে? আপন সংসারের গণ্ডিতে দেখেননি? মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনও একটি ঘটনার স্ফুলিঙ্গ দেখেননি তাঁর পরিচিত জগতের পরিধিতে?

তবে আজই হঠাৎ এমন বিচলিত হয়ে পড়লেন কেন? কেন তখন হঠাৎ করে মনে হল কোনও লুকোনো কার্নিসের খাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে একঝাঁক চামচিকে তাঁর মুখের উপর দিয়ে উড়ে গেল? কেন মনে হল একটা কালো বাদুড় ডানা ঝাঁপটে চলে গেল তাঁর চোখের সামনে দিয়ে?

সরোজাক্ষ ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষর ক্ষমা চাওয়াই উচিত হয়েছে। এত অল্পে বিচলিত হবেন কেন তিনি? তিনি কি আগামীকালের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন না? তিনি কি তার জন্যে নিজেকে একবিন্দুও প্রস্তুত করেননি? যদি না করে থাকেন সেটাই ভুল।

.

আস্তে আস্তে গাড়িটা চালাচ্ছিলেন সরোজাক্ষ, আস্তে আস্তে চিন্তার ভাঁজ খুলে খুলে যাচ্ছিল। আমি কি শুধু আজকেই হার মেনেছি? আমরা কি হঠাৎই কোনও একদিন পরাজিত হই? জন্মের শুরু থেকেই কি আমরা হার মানতে চলছি না?

জীবনের যে স্ফুলিঙ্গকণাটুকু নিয়ে আমাদের এত আস্ফালন, সেটা আমাদের সম্পূর্ণ হাতের বাইরের জিনিস। অনন্তকাল ধরে এই একটা আক্ষেপে মাথা খুঁড়ছে মানুষ

কোথায় ছিলাম কেনই বা এলাম
 এই কথাটা জানতে চাই,
আসার কালে ইচ্ছাটা মোর।
কেউ তো কেমন শুধায় নাই।

 তা হলে? তা হলে হচ্ছে এই–

আমার জন্ম আমার ইচ্ছাধীন নয়, আমার জীবনের পরিবেশ আমার ইচ্ছাধীন নয়। তবে এই পৃথিবীর লীলাটা আমার ইচ্ছাধীন হবে এমন বায়না করি কেন? আর বায়না করলেও যে কোনও লাভ নেই– সেও তো প্রতিপদে অনুভব করতে করতে এই প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছি, তবু হঠাৎ বিচলিত হলাম, তবু সেই বায়নাটা করে মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম।

গ্লানি জমে উঠছে মনে।

যে রকম মৃদু গতিতে গাড়ি চালান, গতি তার চাইতেও মৃদু হয়ে যাচ্ছে, যেন ভুলে ভুলে যাচ্ছেন কোথায় যাবেন।

হ্যাঁ, গাড়িটা চালান সরোজা হাস্যকর রকমেরই মৃদুগতিতে।

 সরোজাক্ষর বড় ছেলে বলে, বাবার মোচার খোলা গাড়ি, গোরুর গাড়ির স্পিড।

.

কিন্তু গাড়িটা কি সরোজাক্ষ নিজে কিনেছেন?

নাঃ, অধ্যাপক মানুষ, আর শান্ত স্তিমিত মানুষ, গাড়ি কিনবার সাধ তাঁর কোনওদিনই হয়নি, সাধ্যও না। বরং গাড়ি চড়ে কলেজ যেতে লজ্জাই পান, অনেকটা দূরে রেখে, পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢোকেন। তবু এই গাড়িটা তাঁকে চড়তে হয়, চড়ে কলেজে যাওয়া-আসা করতেও হয়। সেও তো এক হার মানারই ব্যাপার।

স্নেহের আবদারের কাছে হার মানা।

নিঃসন্তান ছোট কাকার ভারী প্রিয়পাত্র ছিলেন সরোজা, কাকিরও। তাঁদের মনের জগতে ছেলের জায়গাটুকুতেই যেন সরোজাক্ষর স্থান ছিল।

বছর দুই আগে কাকা মারা গেলেন আর তখনই এল এই হার মানার পরিস্থিতি। কাকিমা বললেন, উনি বলে গেছেন গাড়িটা তোমায় দিতে।

সরোজাক্ষ বিচলিত গলায় বললেন,আমায় দিতে মানে? আমি গাড়ি নিয়ে কী করব?

চড়বে। কলেজ যাওয়া-আসা করবে। বড় শখের জিনিস ছিল ওঁর এটি, তাই যখন তখন বলতেন, আমি মরে গেলে তুমি যেন কে চালাবে ভেবে গাড়িখানা বেচে দিও না, গাড়িটা সরোজকে দিও।

সরোজাক্ষ অবশ্য এইটুকুতেই রাজি হননি, এ প্রস্তাবের প্রতিবাদের দিকে অনেক যুক্তি খাড়া করেছিলেন–লোকে হাসবে, ড্রাইভার রাখার পয়সা কোথা? নিজের অভ্যাস নেই।

কাকি উড়িয়ে দিয়েছেন সেকথা।

বলেছেন, চালাতে তো তুমি জানো একটু একটু, তা ছাড়া শিখে নেবে। তোমার কাকাও তো যখন গাড়ি কিনলেন, কিছুই জানতেন না, শিখে নিলেন। বলতেন, ব্যাপারটা কিছুই শক্ত নয়, একটু চোখ কান খোলা রেখে ঠাণ্ডা মাথা নিয়ে চাকাটা ধরতে পারলেই হল। কাকি একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিলেন,তুমি ওটা ভোগ করলে তিনি পরলোকে থেকেও তৃপ্তি পাবেন। তুমি ওতে চড়ে কলেজ যাবে আসবে।

আর কি করবেন সরোজাক্ষ?

কাকির চোখে জল!

 কাকার পরলোকগত আত্মার পরিতৃপ্তির দায়িত্ব।

অতএব গাঢ় মেরুন রঙের ছোট ছিমছাম ওই গাড়িটি গ্রহণ করতে হল সরোজাক্ষকে নিশ্চয় ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কাকি বারবার সেই কথাই বললেন, কাউকে কিন্তু দিয়েটিয়ে দিও না বাপু, তুমি ব্যবহার করলেই তিনি পরিতৃপ্ত হবেন।

বিগত আত্মার পরিতৃপ্তি লাভের ক্ষমতা আছে কি না, অথবা প্রয়োজন আছে কি না, আর সত্যিই এই তুচ্ছ পার্থিব বস্তুর উপরে সে পরিতৃপ্তি নির্ভরশীল কি না, এ সব কুট প্রশ্ন তোলবার মতো প্রকৃতি নয় সরোজাক্ষর, তিনি তাঁর এই প্রায়-সমবয়সী অথচ স্নেহে শ্রদ্ধায় মাতৃস্থানীয়া মহিলার অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না।

তদবধি ব্যবহার করছেন ওটা।

আস্তে আস্তে চালান, সযত্নে রক্ষা করেন। যেন কার গচ্ছিত ধন, যেন সে ফিরে এসে আবার ফেরত নেবে।

তা এই গাড়ি লাভের পর থেকেই যেন সহকর্মীদের আর ওঁর প্রতি তেমন সহানুভূতি নেই। যেন সরোজাক্ষ ওদের টেক্কা দিয়ে কোনও উচ্চস্তরে ওঠার চেষ্টায় হাত লাগিয়েছেন।

হয়তো সরোজাক্ষর আজকের দুর্দশায় তাই কেউ তেমন কাতর হয়নি। হয়তো ভেবেছে-কমুক, অহংকারটা একটু কমুক।

গাড়িটার জন্যে বাড়িতেও কি কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে থাকতে হয় না সরোজাক্ষকে? সরোজাক্ষর স্ত্রী বিজয়া কি বলেন না, অমন গাড়ির গলায় দড়ি! দুটো বই তিনটে মানুষের বসবার জায়গা হয় না, তাকে আবার গাড়ি বলে! ও গাড়ি ওই বাঁজা মানুষদেরই ভাল। ছেলেপুলের ঘরে গেরস্তপোষা গাড়ি নইলে মানায়? ছিঃ।

যেন মানানোর প্রশ্ন বিস্মরণ হয়ে নিজেই গাড়িটা আহরণ করেছেন সরোজাক্ষ। তবু মন্তব্যের ভঙ্গি এমনি তীব্র আর নিরাবরণ বিজয়ার।

হয়তো বিজয়ার গাড়িটার প্রতি এই সপত্নীর ঈর্ষা হত না, যদি সরোজাক্ষ তাঁকে ওই গাড়ি চড়িয়ে কালীঘাট গঙ্গার ঘাট করিয়ে বেড়াতেন, কিন্তু আশ্চর্য, কোনওদিন সে প্রস্তাব করেন না সরোজা। একদিনও করেননি।

বিজয়া কি নিজে মান খুইয়ে বলতে যাবেন?

তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কানে কি আর তোলেন না কথাটা? কোনও কাউকে মাধ্যম করে সরোজাক্ষর কানের কাছে কি উচ্চারণ করেন না, কালী গঙ্গা? ঠাকুর মন্দির? হুঁ, পারতাম ছোটখুড়ির মতো বুড়ো বয়েস অবধি পিঠে আঁচল ফেলে শাড়ি আর টাইট ব্লাউজ পরে সন্ধ্যাবেলা গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতে, তা হলে হয়তো ভাগ্যি ফিরত। দেখেছি তো খুড়িকে এ-যাবৎ। কে বলবে আমার থেকে আটন বছরের বড়। ছুকরিটি সেজে বরের পাশে বসে সিনেমা যাচ্ছেন, নিউ মার্কেটে যাচ্ছেন। বলি, শেষরক্ষা কি হল?

সরোজাক্ষ শুনতে পান।

কিন্তু সরোজাক্ষর চিরকালের পরম সাধনা, কানে তুলো দেওয়ার সাধনা। তাই বিজয়ার সব কথাই শূন্যে গদা ছোঁড়া। হয়তো এই ব্যর্থতার জ্বালা থেকেই বিজয়ার ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, জিভ আরও শাণিত হয়, কিন্তু সমোজাক্ষ আপন সাধনায় অবিচল থাকেন। সরোজাক্ষ কোনওদিনই বলে ওঠেন না, তোমার তা হলে শেষরক্ষার গ্যারান্টি আছে তো? শাড়ির বদলে গামছা সার করে, আর গোবর গঙ্গাজলের পারানি সঞ্চয় করে?

না, বলেন না, নীরবই থাকেন।

 শুধু আজই হঠাৎ সরোজাক্ষ চিরদিনের সাধনা বিস্মৃত হয়েছিলেন।

সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন, পদত্যাগের প্রতিক্রিয়াটা কী হতে পারে? ঘরেবাইরে? অবশ্যই বাইরে সহস্র প্রশ্ন, আর বাড়িতে সহস্র শরাঘাত। পুরুষমানুষ রাগ করে উপার্জন ত্যাগ করতে চাইলে সংসার কবে তাকে ক্ষমা করে? কবে বলে থাকে–ঠিক করেছ। সত্যিই তো এমন অপমানের মধ্যে কখনও টেকা যায়? এ তো একদিনের ব্যাপার নয়, আবার হেঁট মাথায় ফিরে গেলে, রোজই করবে। তার চেয়ে এই ভাল।

বলে না।

বলতে পারে না। সমস্ত সম্পর্কই স্বার্থের শৃঙ্খলে বাঁধা। সেখানে এতটুকু টান পড়লেই কর্কশ শব্দ বেজে উঠবে।

অতএব ধরেই নিতে হবে, এ সংকল্প প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই খুব একটা অশান্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সরোজাক্ষকে।

কলেজেও হয়তো সহজে গৃহীত হবে না সেই পদত্যাগপত্র। কর্তৃপক্ষ সম্ভ্রম-সম্মানের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিতে না পারলেও অনুরোধ-উপরোধ আসবে সেখান থেকে। কারণ সেটা স্বার্থের ব্যাপার। প্রফেসর মৈত্রর পড়ানোর সুনাম আছে। কথাটা ভেবে পরক্ষণেই লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। শুধুই কি স্বার্থ? সরোজাক্ষকে সকলেই কি ভালবাসেন না? অন্যান্য অধ্যাপকেরা, স্বয়ং অধ্যক্ষ? দায়িত্ব তাঁদের নেবার ক্ষমতা নেই তাই। যে-কোনও মুহূর্তে তাঁরাও এইভাবেই লাঞ্ছিত অপমানিত হতে পারেন। এ আশঙ্কা আছে তাঁদের।

হঠাৎ একটু কৌতুক বোধ করলেন সরোজাক্ষ–আমরা কি তবে সেই দেশে বাস করছি, যে দেশের ব্যবহার বিধিতে বেড়ালরা পালায় নেংটি ইঁদুরদের দেখে!

তাই, তা ছাড়া আর কি।

 ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে-মর্মক্ষেত্রে ওই মজার দেশেরই লীলা আজ।

.

পদত্যাগপত্রের বিষয়ে পরামর্শের কেউ নেই। নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।

 বিজয়া কোনওদিনই তাঁর মর্মভাগিনী নয়, বিজয়ার সঙ্গে তাঁর দুর গ্রহের ব্যবধান। বিজয়া কোনওদিনই সরোজাক্ষর রুচিকে, চিন্তাকে, ভাবধারাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। বিজয়া আপন স্থূলবস্তুর জগতে বিচরণশীল। যদিও বিজয়া ওই ব্যবধানটা অনুভব করতে পারেন। সরোজাক্ষর সৌজন্য ভদ্রতা আর শান্ত ব্যবহারের আবরণ তাঁকে সশ্রদ্ধ করতে পারে না। সেই অনুভূতিটা অতএব আক্রোশপরায়ণ করে বিজয়াকে।

বিজয়া তাই যেন ইচ্ছে করেই অধিকতর স্কুল হন, অধিকতর কর্কশ।

 কিন্তু শুধুই কি ইচ্ছে করে?

বিজয়ার উপাদানে আর কী-ই বা আছে? আর কী-ই বা ছিল?

অথচ সরোজাক্ষর সমস্ত কল্পনার সমস্ত ভাবনার একটি শরীরিণী মূর্তি একদা চোখে পড়েছিল সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষর মনে হয়েছিল মানসী শব্দটার প্রকৃত অর্থ জানতে পারলাম আজ।

কিন্তু সেটা এ যুগের ব্যাপার নয়।

সরোজাক্ষ তখন তরুণ যুবক, সদ্য এম-এসসি পাশ করে বেরিয়েছেন। মেয়েটি বি-এ পাশ করে এম-এ পড়বার জন্যে বায়না ধরেছে তার অধ্যাপক পিতার কাছে।

সরোজাক্ষরই অধ্যাপক তিনি।

সরোজাক্ষ তখনও রুজি-রোজগারে স্থিতিশীল হননি, তবু লজ্জার মাথা খেয়ে করে বসেছিলেন প্রস্তাব।

হয়তো সেই সঞ্চারিণী পল্লবিনী শ্যামাঙ্গীর কৃষ্ণকালো চোখ দুটির মধ্যে সে প্রস্তাবের প্রশ্রয় ছিল।

 কিন্তু সরোজাক্ষর লজ্জার মাথাটা খাওয়াই সার হল। সরোজাক্ষর বাবা নলিনাক্ষ বলে উঠলেন, ওরা তো গাঙ্গুলি। তার মানে রাঢ়ী? তা হলে?

তা হলে যে কি, তার অজস্র উত্তর ছিল সরোজাক্ষর মনের মধ্যে, তবু সরোজাক্ষ সেই কুঞ্চিত জ্বর নীচে মাথা তুলতে পারলেন না।

সরোজাক্ষর মা বললেন, বি-এ এমএ পাশ মেয়ে, বউ হয়ে আসবে? তার মানে তুই বিয়ে করেই আলাদা হতে চাস?

মার সামনে একটু কথা বলেছিলেন সরোজা। বলেছিলেন,কেন, আলাদা হবার কথাই বা আসছে কেন? পাশকরা মেয়েরা কি বাঘ না ভালুক?

মা সতেজে বলেছিলেন,আমাদের কাছে তাই।

 কেন? আমিও তো এম-এ পাশ।

 সেকথা রাখ। ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?

হ্যাঁ, তখনও একথা বীরদর্পে চলত।

 ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?

 মার কাছে যুক্তি ছিল না। শুধু রায় ছিল। কারণ রায় মানবার লোক ছিল।

তাই সরোজাক্ষ মানসীকে অপ্রাপ্য বস্তু বলে আশার জগৎ থেকে বিদায় দিলেন। আর যখন বউদি তার ঘোট বোন উত্ত্যক্ত করতে লাগল বাবাঃ, এক কেলে শুঁটকির বিরহে যে তুমি নিজে কালিবর্ণ হয়ে গেলে,তখন কিছুদিনের জন্যে এলাহাবাদে পিসির বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।

ওইখানেই ইতি। আবার ফিরলেন ম্লান গম্ভীর মুখ নিয়ে। যদিও

সরোজাক্ষ জানতেন প্রেমও নয় বিরহও নয়, এ শুধু একটা আশাভঙ্গের বেদনা। অধ্যাপকের মেয়ের সঙ্গে তাঁর হয়তো আঙুল গোনা কয়েকটি দিনের দেখা। তবুও–বেজেছিল বেদনা। তার কী হয়েছিল তার খবর পাননি কোনওদিন।

কিন্তু সরোজাক্ষ পাগলও নয়, বুন্ধুও নয় যে, সেই বেদনাকে সম্বল করে জীবন কাটিয়ে দেবার পণ করবেন।

সরোজা শুধু দৃঢ়স্বরে জানিয়েছিলেন, রোজগার না করে বিয়ে করব না।

নলিনাক্ষ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছিলেন, আমার একমাত্র পুত্রবধূকে একমুঠো ভাত জোগানোর ক্ষমতা আমার নেই?

সরোজাক্ষ বলেছিলেন, তা নয়, ওটা আমার একটা খেয়ালই ধরুন।

হয়তো খেয়াল, হয়তো নীতি, হয়তো বা কিছুটা সময়ক্ষেপ। তবে বাপ-মা আর বেশি ব্যস্ত করেননি। তাঁরাও হয়তো ভেবেছিলেন বড় মাছকে টেনে তুলতে হলে প্রথমে সুতো কিছুটা ছাড়াই দরকার, হঠাৎ টান মারলে ছিঁড়ে যাবে।

তাঁরা শুধু তলে তলে পরমাসুন্দরী খুঁজছিলেন, বিত্তবানের কন্যা হওয়াও আবশ্যক। হাঘরের মেয়ে তাঁদের পছন্দ নয়। তা সরোজাক্ষর মা বাবা তাঁদের মানসকন্যাকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পিতা বিত্তবান, কন্যা অ-বিদুষী। আর রূপ? হ্যাঁ, এখন শুনলে অবিশ্বাস্য হলেও একদা বিজয়া রূপসী ছিলেন। রূপসী, স্বাস্থ্যবতী, নবযৌবনা সেই কন্যাকে ছেলের কাছে ধরে এনে দিয়ে মা বাপ আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিলেন।

এক সময় পথ শেষ হয়।

গোরুর গাড়িও পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়।

নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়ে চললেও অভ্যস্ত হাত যথাপথেই চালিয়ে নিয়ে যায়।

পকেট থেকে চাবি বার করে বাড়ির পাশের ছাড়া জমিটুকুতে চালা তুলে নেওয়া গ্যারেজটা খুলে ফেলে গাড়িটা ঢুকিয়ে দেন সরোজা, আবার তালাবন্ধ করেন, ধীরে ধীরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসেন।

সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষ যে গাড়িটাকে মোচার খোলা বলে ব্যঙ্গ করে, হয়তো এটাও তার একটা কারণ। সরোজাক্ষর ওই স্বার্থপরের মতো কেবলমাত্র নিজের ব্যবহারের শেষে গাড়িটা তুলে ফেলা। কাউকে অফার না করা। নীলাক্ষর কি হাত নিসপিস করে না? ওই গাড়িটার ওপর হাত পাকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু মান খোয়াতে কে চায়?

অথচ এই এক অদ্ভুত মনোভাব সরোজাক্ষর। তোমরা যখন আমার সেন্টিমেন্টের মূল্য বোঝো না, গাড়িটাকে যে আমি ছোটকাকার ভালবাসার মূর্তি হিসেবে দেখি তা বোঝো না, ছোট বলে ব্যঙ্গ করো, দাতব্যের মাল বলে কৌতুক করো, তখন ঠিক আছে–চড়ো না কেউ।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন সরোজা।

বাপের আমলের বাড়ি, সেকেলে ধরনের গড়ন। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে ঘর। চারের একদিকে দুখানা বৈঠকখানা, একদিকে রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর খাবারঘর, একদিকে বাজে বাড়তি ঘর আর স্নানের ঘর, আর বাকি দিকটায় সিঁড়ি উঠে গেছে দালানের মধ্য থেকে।

কোথাও কারও সাড়া নেই, কারণ বিজয়ার এখনও ঠাকুরঘর থেকে নামার সময় হয়নি। নামলেই কুরুক্ষেত্র বাধবে। ঠাকুর-চাকরের এতক্ষণকার গাফিলি, বউমার অনুপস্থিতি, ছেলের বে-আক্কেল, আর সরোজাক্ষর ঔদাসীন্য, সব নিয়ে চেঁচাতে শুরু করবেন। স-পুরী একগাড়ে করে ছাড়বেন।

কিন্তু এখন বাড়িটা যেন থমথম করছে। সরোজা অনুমান করতে পারলেন, নীলাক্ষ সেই একবার টেলিফোন করে নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। বিজয়ার নিশ্চিন্ত অনিশ্চিন্ততার প্রশ্ন নেই। তিনি যদি সত্যিই চিন্তিত হয়ে থাকেন সরোজাক্ষর দেরি দেখে, হয়তো কিছু হরির লুট মেনে বসেছেন।

আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন সরোজাক্ষ।

সিঁড়িটা নীচের তলার দালান থেকে উঠতে উঠতে একবার দোতলার দালানের মুখে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েই আবার একটা মোচড় খেয়ে বাঁক নিয়ে উঠে গেছে তিনতলার ইশারা বহন করে। কিন্তু ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলে দেখা যাবে ইশারাটা মিথ্যা, তিনতলার ভরাটি দেহ কোথাও নেই। সিঁড়ির শেষটা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদের মাঝখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

ছাদটায় বর্ষায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে শ্যাওলা জমে, আবার বর্ষার শেষে রোদের দাপটে সে শ্যাওলা শুকিয়ে উঠে কলাই ডালের খোসার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কোণে কোণে জমা হয়। তার খাঁজে খাঁজে খুদে খুদে আগাছার চারা জন্মায়। আবার দৈবাৎ কোনও একদিন সম্মার্জনীর মার খেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা।

কারণ ছাদের সীমানায় সিঁড়ির ঘরটা বিজয়ার ঠাকুরঘর। কাজে কাজেই বিজয়া আদৌ পছন্দ করেন না ঝি-চাকররা যখন তখন হুট করে ঝাঁটা নিয়ে উঠে এসে আশ্রমপীড়া ঘটায়। তা ছাড়া দরকারই বা কি? ছাদে আসছেই বা কে? দেখছেই বা কে?

নিতান্তই যখন দেখা যায় জঞ্জালের ছিপিতে ছাদের রে ওয়াটার পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে উঠেছে, তখনই বিজয়ার আদেশপত্র গিয়ে পৌঁছয় নীচের তলায়। কোনও একজন ঝাঁটাধারী সাবধানে এসে সাফ করে দিয়ে যায় বিজয়ার কড়া পাহারার শাসনতলে।

নচেৎ বারো মাসই বিজয়া ওই ধুলো জঞ্জাল ভরা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদটাকে সামনে নিয়ে নিজের সেই ছোট্ট এল শেপ কুঠুরিটিতে বসে থাকেন, কে জানে ধ্যানমগ্ন হয়ে কিংবা জপের মালার হিসেব নিয়ে।

দোতলাটা ভরা ভর্তি।

দোতলায় অনেক ঘর।

সিঁড়িতে উঠেই বড় দালান, দালানের দুপাশে ঘরের সারি। দক্ষিণের সারিতে প্রথমেই সরোজাক্ষর নিজের ঘর, তার পাশে অবিবাহিত পুত্র কমলাক্ষর ঘর, আপাতত সে এখন খঙ্গপুরে পড়তে গেছে, তাই ঘরটা ফাঁকা। কমলাক্ষর ঘরের পাশে সরোজাক্ষর দুই মেয়ের ঘর, যার মধ্যে একজন বিবাহসূত্রে ঘরের দখল ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, অপরজনও যাই-যাই করছে। তবে এখনও সে এ ঘরে সবলে প্রতিষ্ঠিত। নিজের জিনিসপত্র ব্যতীত কারও একখানা রুমালকেও প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ সে। হয়তো ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই তার দাবির ভাষা এত জোরালো। জোরের যেখানে ভিত নেই, সেখানেই তো মুখের আস্ফালন।

শুধু দিদি এলে মীনাক্ষী ঘরের দখল ছেড়ে মায়ের ঘরে শুতে যায়। কারণ দিদি অর্থেই তো জামাইবাবু।

কমলাক্ষর ঘরটায় কেউ শুতে রাজি হয় না। ঘরটার একটা বিরাট দোষ সরোজাক্ষর ঘরের সঙ্গে তার যে ব্যবধান প্রাচীর, সেটা একটা কাঠের পার্টিশন মাত্র। কথা বললে শোনা যায়। গুনগুনিয়ে গান গাইলে শোনা যায়, রাত জেগে গল্পের বই পড়লে আলো দেখা যায়।

সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা ইচ্ছাসাপেক্ষে বাবার জ্ঞানগোচরে আসতে রাজি নয়।

মীনাক্ষীর ঘরের পরে, সামনে খোলা বারান্দাওলা সবচেয়ে বড় ঘরখানা সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষর। সস্ত্রীক সপুত্র তার সেখানে বসতি। মীনাক্ষীর ঘরের মধ্যে দিয়ে মাঝখানে যে দরজাটা আছে, সে-দরজার ওপর একটা আলমারি চাপিয়ে রেখে নীলাক্ষ নিজের জন্যে একটা অন্য ভুবন গড়ে নিয়েছে। ওর ঘরে কেউ কদাচিৎ ঢোকে।

উত্তরধারে খানিকটা অংশ বারান্দা বাবদ খরচ হয়ে যাওয়ায়, ঘর দক্ষিণের মতো চারখানা না হয়ে তিনখানা। এই তিনখানা ঘরের দুখানা ঘর গৃহিণীর অধিকৃত। একখানায় তিনি মাত্র রাত্রিটুকুতে দেহরক্ষা করেন (আর সময় কোথা তাঁর?), বাকিখানায় সুরক্ষিত রাখেন তাঁর সাংসারিক মালপত্রের বোঝা। সে ঘরে নেই এমন জিনিস নেই। বাসনের সিন্দুক থেকে শুরু করে ভাঙা লোহা পর্যন্ত, বাড়তি বিছানা থেকে শুরু করে তোশক ঘেঁড়া টিকিন পর্যন্ত, সব জমানো আছে বিজয়ার সেই ঘরে। আছে ঘি-তেলের খালি টিন, কাঠি ফুরনো দেশলাই বাক্স, মশলা বাঁধা দড়ি, বাসি খবরের কাগজ, পরিত্যক্ত ঠোঙা। আরও কত কীই আছে। স্রেফ হরেকরকমবার ব্যাপার।

এগুলিতে সংসারের কারও হাত দেবার অধিকার নেই, কারণ এ ঘরের প্রত্যেকটি জিনিসই নাকি বিজয়ার একান্ত প্রয়োজনীয় এবং নিতান্ত বিশুদ্ধ। পাছে কেউ কোনও প্রয়োজনে বিজয়ার ধ্যানমগ্নতার অবকাশে ওগুলির বিশুদ্ধতা কলঙ্কিত করে বসে, তাই ঘরটাকে বিজয়া চাবিবন্ধ করে রাখেন।

আগে আগে সরোজাক্ষ বলতেন, বসবাস করা বাড়িতে চোখের সামনে একটা দরজায় তালা ঝুলছে এটা দেখতে বিশ্রি–এখন আর বলেন না।

কারণ বিজয়া তার জবাবে বলেছেন, তোমার সংসারে আমিও তো একটা বেমানান বিশি, তবু তো আছি চোখের সামনে দৃষ্টিশূল হয়ে।

বিজয়ার কথা বলার ধরনই এইরকম।

তা বিজয়ার ছেলেমেয়েদেরও কথায় কিছু ধরনআছে। ঘরটাকে কমলাক্ষ বলে মার মিউজিয়াম। ময়ূরাক্ষী বলে, মার বৈরাগ্যের নিদর্শন; আর মীনাক্ষী বলে সাড়ে বত্রিশ ভাজার খিলি।

নীলাক্ষ ঠিক এ ধরনের কথা বলে না, সে চাপা রাগের গলায় বলে, এটা হচ্ছে স্রেফ নির্লজ্জ দখলের নমুনা। আমি কেবলমাত্র একটা ঘরে কত অসুবিধেয় পড়ে আছি, অথচ উনি আস্ত একটা ঘরে শুধু জঞ্জাল ভরে রেখে

আরও একটা বরবাদি ঘর নিয়েও চাপা সমালোচনার ঝড় বয়, কিন্তু সরোজাক্ষর মুখোমুখি এসে পৌঁছয় না ঝড়টা। ওই জায়গাটায় যে সরোজাক্ষর মনোভাব অনমনীয়, সেটা সকলেরই জানা। সে ঘরটা ঠিক সিঁড়িতে উঠেই বাঁ হাতি, অর্থাৎ সরোজাক্ষর ঘরের সামনাসামনি। ঘরটার দরজায় একটা ছিটের পরদা আছে বটে, কিন্তু সেটা ঝোলানো থাকে কদাচিৎ, ওলটানোই থাকে সব সময়, কাজেই ঘরের অধিকর্তাকে সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়।

নীলাক্ষর মতে সেটাও একটা কুদৃশ্য, কিন্তু ওর আর প্রতিকার নেই। লোকটা নীলাক্ষর ঠাকুর্দার জামাই, আর এ-সংসারে আছে সেই ঠাকুর্দার আমল থেকেই। মগজে ছিটওয়ালা বেকার জামাইটিকে ভদ্রলোক দিব্যি জামাই আদরেই প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন। সরোজাক্ষও সেই আসন থেকে টেনে নামাননি তাকে। বোন কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, ভগ্নীপতি রয়ে গেছে। এখনও তার জন্য যখন তখন রাবড়ি আসে, রাজভোগ আসে, বড় গলদা চিংড়ি, রুইমাছের মুড়ো আসে। তার বাসনা হলেই আসে। এই বিরাট দৃষ্টিশূল জিনিসটাও সয়ে যেতে হয় সরোজাক্ষর সংসারকে।

কারণ ওটা সরোজাক্ষর স্পেশ্যাল খরচ।

ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই আতিশয্যে এই অপচয়ে বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক, অপর আত্মীয়রা অথবা অনাত্মীয়রাও শুনে বলে অনাসৃষ্টি। কিন্তু সইতে হচ্ছেই।

ছেলেবেলায় অবশ্য পিসিবর্জিত পিসেমশাই ছেলেমেয়েদের কাছে রীতিমত আকর্ষণের বস্তু ছিল। কারণ ছেলে ভোলানোর বহুবিধ কৌশল ছিল তার আয়ত্ত। বলতে কি, নিজেই সে শিশু বনে যেতে পারত, সমবয়সী হয়ে যেতে পারত ওদের।

কিন্তু ওরা তো আর কেউ চিরশিশু নয়। ওদের শৈশব যথাসময়েই গত হল এবং সেই অতিক্রান্ত শৈশববিজ্ঞেরা তাদের সদ্যলব্ধ জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা বুঝে ফেলল কী ঘোরতর একটা অপচয়ের ধারা অনাহত স্রোতে বয়ে চলেছে সংসারে।

অথচ–

হ্যাঁ, অথচ সরোজাক্ষ কর্মক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি উঠে এসে প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর ওই দীর্ঘকালের বিপত্নীক ভগ্নীপতিটিকেই। উঠেই বাঁ দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, কী সারদা, কী হচ্ছে? নতুন কোনও আবিষ্কার হল নাকি আজ?

সারদাপ্রসাদ সামনে পিছনে পাশে কোলে নতুন পুরনো ছেঁড়া ময়লা বই কাগজের বস্তা নিয়ে বসে থাকে চৌকিতে, সাড়া পেয়ে চোখ তোলে, অথবা চোখ না তুলেই বলে, আবিষ্কার কি দাদা, এ তো পড়েই আছে। চন্দ্ৰসূর্যের মতো সত্যি। আমরাই কেবল চোখ থাকতে অন্ধ। আমি শুধু সেই দৃষ্টিটা খুলে দিতে চাইছি–

লোকের জ্ঞানদৃষ্টি খুলে দিতে চাইছে সারদাপ্রসাদ; অর্থাৎ বিরাট এক গবেষণা পুস্তক লিখছে সে।

সারদাপ্রসাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হল–আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রাচীন যোগশক্তি। আধুনিক বিজ্ঞান যা দিয়েছে, অথবা নিত্য নতুন চেহারায় দিয়ে চলেছে, সেসব যে প্রাচীনকালের যোগী-ঋষিদের কাছে ছেলেখেলা মাত্র ছিল, হাজার হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষই যে বিজ্ঞানের শেষ কথা বলে গেছে, এই সত্যটি প্রমাণ করবার জন্যে জীবন পাত করে চলেছে সারদাপ্রসাদ। সারাজীবন ধরে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সে, তত্ত্ব অনুধাবন করছে এবং তুলনা ও উদাহরণ লিপিবদ্ধ করছে। সব গোছানো হয়ে গেলেই থিসিসটি লিখে ফেলার কাজে হাত দেবে।

সরোজাক্ষ মাঝে মাঝে খোঁজ নেন, কী সারদা, তোমার থিসিসের কতদূর?

সারদাপ্রসাদ মহোৎসাহে বলে, এই তো দাদা, এইবার আরম্ভ করব। এদিক ওদিক আর সামান্য একটু গোছানো বাকি।

সরোজাক্ষ হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে চলে যান, হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে বলেন, আরম্ভটা করেই ফেলল। হাত না দিলে এগোবে না।

না দাদা, সারদাপ্রসাদ আত্মস্থের গলায় বলে, সবদিক থেকে গুছিয়ে না নিয়ে হাত দেওয়াটা ঠিক নয়। গোছটা হয়ে গেলেই হেসে ওঠে সারদাপ্রসাদ, ধরব, আর মারব।

সারদাপ্রসাদের পৈতৃক সম্পত্তির নিজ অংশ থেকে মাসে মাসে কিছু ভাড়া পায়, জ্ঞাতি ভাইপোরা করুণাপরবশ হয়েই হোক, বা চক্ষুলজ্জার বশেই হোক, পাঠিয়েই দেয়, মেরে নেয় না। সেই টাকায় সারদাপ্রসাদ রাজ্যের পুরনো পুরনো বই কেনে, আর দিস্তে দিস্তে কাগজ কেনে। সে সব কাগজের পারিপাট্য কম নয়, আলাদা আলাদা অধ্যায় হিসেবে পাঞ্চকরে, দড়ি বেঁধে, মলাট লাগিয়ে, দস্তুরমতো ব্যবস্থা করে রাখে সে। এমনকী পর পর পৃষ্ঠাসংখ্যা পর্যন্ত লিখে রাখে, যাতে পরে না এলোমেলো হয়ে যায়। এখন শুধু ধরা আর মারাটাই বাকি।

বিজয়া এক-আধ সময় তীক্ষ্ণ হুল ফোঁটানো গলায় বলেন, সময়কালে ওই ধরা আর মারার অভাবেই আমরা আজ পড়ে মার খাচ্ছি।

কমলাক্ষ যখন ছুটিতে আসে, মাঝে মাঝেই বলে, পিসেমশাইয়ের ওই ধরা আর মারাটা যদি আমাদের জীবকালে হত, তা হলে দেখে যেতে পারতাম।

ময়ূরাক্ষী কদাচ আসে।

তবু কড়া হুল বিঁধিয়ে বলে,আরে বাবা, আমি যা বলছি সারকথা, ওই থিসিসটি একটি আবরণমাত্র। বউ নেই, অথচ শ্বশুরবাড়িতে শেকড় গেড়ে বসে আছি–এই লজ্জাটি ঢাকবার ছল। মনে হচ্ছে থিসিস উনি কোনওকালেই লিখবেন না। দেখে নিও তোমরা। আমি বলছি–পাগলও নয় ছাগলও নয়, স্রেফ ফন্দিবাজ ধূর্ত।

আগে ময়ূরাক্ষী এত আক্রোশের গলা তুলত না, এখন তোলে। ওর বর ওর বাপ-ভাইকে বোকা বুদ্ধ বলে বড় ঠাট্টা করে বলে লজ্জায় অপমানে আক্রোশ জন্মে গেছে। নইলে পিসেমশাই যে ওদের সংসারে বাড়তি মাল, অনাবশ্যক জঞ্জাল, পরগাছা, এসব কথা ওর মাথায় আসত না। এখন আসে। বরের ভাবেই ভাবিত ময়ুরাক্ষী, বরের চোখেই জগৎ দেখে।

মীনাক্ষীর অবশ্য সে প্রশ্ন নেই, কারণ মীনাক্ষীর এখনও বর হয়নি। কিন্তু নিজেই সে দুনিয়া দেখতে শিখে ফেলেছে; তাই তার চোখেও পিসেমশাইয়ের এই নিশ্চিন্ত জীবনটি অসহ্য। তাই মীনাক্ষী বলে, মরে মনিষ্যি হব, ঘরজামাই হয়ে জন্ম নেব! বাবাঃ কার জামাই কে পুষছে।

বলে, তবে সরোজাক্ষর সামনে নয়।

সরোজাক্ষ যে বকেন তা নয়, সরোজাক্ষ কেমন অদ্ভুত একটা ধিক্কার দেন। এ ধরনের কথার আভাসমাত্র শুনলেই একবার চোখ তুলে বলেন, এসব ছোট কথা তোমাদের মাথায় আসছে কী করে। বলো তো?

অতএব বাবার সামনে নয়।

অতএব সরোজাক্ষ সিঁড়িতে উঠেই প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর বাড়ির সেই অবান্তর লোকটাকেই। কী সারদা, কাগজপত্র আছে তো? কী সারদা, বিকেলে একবার বেরোও না? শরীর ভাল থাকবে কী করে?–সারদা, একটা বাংলা টাইপরাইটার থাকলে তোমার বেশ সুবিধে হত, তাই না?

ওরা শুনতে পেলে ঘরে বসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, তা দাও না, তুমিই একটা কিনে দাও। এত যখন ভালবাসা!বলে, শরীর ভাল থাকার সুরও তো কিছু দেখি না। আহারটি যা দেখা যায়… বলে, ওঃ কাগজের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, তার মানে এসে যাবে দু-চার দিস্তে।

তবে যাকে প্রশ্ন করা হয়, সে বোঝে এগুলো প্রশ্নের জন্যে নয় কথার জন্যে। কথা বলবার একটা উপলক্ষ। তাই সে আত্মস্থর গলায় বলে, আপনিও যেমন দাদা, আবার টাইপ মেশিন! ভগবান পাঁচ-পাঁচটা আঙুল তবে দিয়েছে কেন?..বলে, শরীর? এ শরীর হচ্ছে দধীচির হাড়ে তৈরি বুঝলেন? বজ্র, বজ্র!.বলে, কাগজ থাকবে না? ফুরুতে দিই নাকি? কমতে নামতেই এনে মজুত করি না?

ব্যস ওই পর্যন্তই।

 সরোজাক্ষ হয়তো ততক্ষণে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

আজ কিন্তু সরোজাক্ষ কথা বলতে ভুলে গেলেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ভয়ানক একটা ক্লান্তি অনুভব করছেন, তাই কখনও যা না করেছেন তাই করলেন। হাতমুখ না ধুয়ে পোশাক না ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। সরোজাক্ষর পক্ষে এটা একটা লক্ষণীয় অনিয়ম।

শুয়ে থাকতে থাকতে সরোজাক্ষ শুনতে পেলেন তিনতলায় সিঁড়ি থেকে বিজয়া সশব্দে স্বগতোক্তি করছেন, পোড়ারমুখো কলেজে কি রোজই মিটিং? এই এতখানি রাত হল, এখনও মিটিং চলছে? ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!

ধন্যবাদটা কাকে দিচ্ছেন বিজয়া তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। সরোজাক্ষকে, না কলেজ কর্তৃপক্ষকে, কে জানে!

সরোজাক্ষ তবু উঠে পড়ে সাড়া দিলেন না, যেমন পড়ে ছিলেন, পড়ে রইলেন। কিন্তু একটু পরেই ঘরের মধ্যে পদশব্দ। তার সঙ্গে একটা উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, দাদা, এসে শুয়ে পড়লেন যে? শরীর খারাপ হয়নি তো?

বন্ধ চোখটা খুললেন সরোজাক্ষ, আর কেন কে জানে হঠাৎ চোখ দুটো তাঁর জ্বালা করে উঠল।

উঠে বসলেন।

 সহজ গলায় বললেন, না না, শরীর ঠিক আছে।

অনেক দেরি হল। মিটিং ছিল বুঝি?

সরোজাক্ষ একবার ওর দিকে তাকালেন, কেমন একটু হেসে বললেন, না, ওরা আমায় আটক করেছিল।

আটক! ওরা! কারা?

সারদাপ্রসাদ অবাক গলায় তাকায়।

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ছেলেরা! আমার ছাত্ররা। ঘেরাও করেছিল, ক্ষমা চাইয়ে তবে ছেড়ে দিল।

সারদাও হেসে বলে, ধ্যাৎ কী যে বলেন! ঠাট্টা করছেন।

ঠাট্টা নয় হে, সত্যিই!

 সারদা বলে, সত্যি! আপনি ক্ষমা চাইলেন, এই কথা বিশ্বাস করব আমি?

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, আধুনিক জগতে অবিশ্বাস্য বলে কোনও কথা নেই সারদা! ওটা সেকেলে হয়ে গেছে।

সারদা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, ওটা সেকেলে হয়ে গেছে? ভারী বড়াই আধুনিক যুগের। বলি কীসের বড়াই? চাঁদে গুতো দিতে যাচ্ছে বলে? বলি প্রাচীনকালের পুরাণ, উপপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, এসব খুলে দেখেছে আধুনিক যুগ? দেখেনি, দেখে না। দেখলে বুঝতে পারত চাঁদ তো তুচ্ছ কথা, ইন্দ্রলোক বরুণলোক বায়ুলোক,–এমনকী গোলোক পর্যন্ত ফটফটিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। অবশ্য হরে নরে যদু মধুরা কি আর? তারা একাল সেকাল চারকালেই এক। বেড়াতেন যোগসিদ্ধরা। যোগসিদ্ধ বলতে কী বোঝায়? বিজ্ঞানসিদ্ধ। স্রেফ নামের পার্থক্য। একাল বলে বিজ্ঞান, সেকাল বলত যোগ। যোগটাই উপযুক্ত নাম। যোগঅর্থাৎ মনঃসংযোগ। তাই মনঃসংযোগের ফলেই বস্তুতে বস্তুতে রাসায়নিক যোগ, দুরের সঙ্গে নিকটের যোগ।

এসব কথা অবশ্য সরোজাক্ষর শতবার শোনা, তবু ওই উৎসাহ-প্রদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, তাই তো, এটা তো সত্যি ।

বলতেই হবে সত্যি– উদ্দীপ্ত মুখ আরও উদ্দীপ্ত হয়, তবেই বলুন, বড়াইটা তোরা করছিস কী নিয়ে? বিজ্ঞান দেখাচ্ছে। আরে বাবা, এ যুগ তো বিজ্ঞানের অ আ ক খ শিখছে, আর সেকালের যোগীঋষিরা? তার অনুস্বর বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু সব শেষ করে ফেলেছিল। নারদ ঋষি ঢেঁকি চড়ে ত্রিভুবন পয়লট্ট করে বেড়াত। সেই চেঁকিটি কী?

সারদাপ্রসাদ রহস্যব্যঞ্জক হাসি হেসে বলে, লিখব সেকথা! ঢেঁকিটি আর কিছুই নয়, একটি পাওয়ারফুল হেলিকপ্টার। সেইটিতে চেপে শূন্যে ঘুরত, নীচে থেকে চাষা-ভুষোরা বলাবলি করত ঠিক যেন ভেঁকি। সেই থেকে ওইটাই চলিত হয়ে গেছে।-মনোরথ মানে কী? ওই বস্তু।–উঃ ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় দাদা–সারদা যেন ছটফটিয়ে ওঠে,আধুনিক বিজ্ঞান এক একটা রকেট ছুঁড়ে মনে করছে কী বাহাদুরিই করলাম! আর সেকালে? গ্রহে গ্রহে যাতায়াত, আদানপ্রদান, এসব কিছুই নয়। ধরুন, বৃহস্পতি গ্রহের একটা ছেলে শুক্র গ্রহে এসে লেখাপড়া করল, প্রেম করল, কত কীর্তিই দেখাল। বিজ্ঞানের কতখানি উন্নতি হলে তবে এসব সম্ভব বলুন? এ যুগের তোরা তো বড় বড় মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে মনে করছিস কী কাণ্ডই করলাম, আর সেকালে? মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী অমর হওয়ার মন্ত্র!

সারদা পায়চারি করে বেড়ায়, মাথার চুলটা মুঠো করে চেপে ধরে, ভাবলে জ্ঞান থাকে? বলুন?

সরোজাক্ষ খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলেন, তবু মৃদু হাসলেন, না না, জ্ঞানটা রাখা দরকার। ওটা হারানো ঠিক নয়।

দরকার তো বুঝলাম, কিন্তু থাকে কই? যখনই চিন্তা করি, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। এই আমরা ভারতবর্ষের লোক আজ যেন ভিখিরি। আমাদের কিছু ছিল না, কিছু নেই। আমরা মূর্খ, অজ্ঞ, হা-দেখলে! অথচ আমাদের সবই ছিল।

সরোজাক্ষ বিষণ্ণ গলায় বলেন, কী ছিল তা জানি না সারদা, তবে এখন যে কিছু নেই তা জানছি।

 সারদা দৃঢ় গলায় বলে,শুধু সেটা জানলেই তো চলবে না, তার প্রতিকার করতে হবে। জগৎ সমক্ষে এইসব প্রমাণপত্র নিয়ে গিয়ে গিয়ে দাখিল করে তাদের তাজ্জব করে দিতে হবে। কী করে রাষ্ট্রদূতেরা? দেশের পয়সা খরচ করে বিদেশে বসে থেকে? শুধু বিলাসিতা, শুধু দেশের নাম ডোবানো, এই তো? কেন, দেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে নিয়ে যেতে পারে না এইসবনজির? বলতে পারে না ভারী তোরা আজ বিমান যুদ্ধের বড়াই দেখাস, মেঘনাদের নাম শুনেছিস? জানিস রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল কীসে চেপে? পুষ্পকরথ শব্দটার অর্থ কী? না, তা বলবে না, শুধু বিদেশে গিয়ে এই গরিব দেশের পয়সায় লঞ্চপানি করবে, মদ খেয়ে বেহেড হবে।

সরোজাক্ষর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, সরোজাক্ষর আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু বললেন, এক কাজ করো সারদা, এই নিয়ে নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলল।

আপনি বলবেন তবে লিখব? সারদা হাসে, এ সবই তো তৈরি! নেহাত কাটাকুটি তাই আপনাকে পড়তে দিতে পারছি না, নচেৎ দেখিয়ে দিতাম কীভাবে হেনস্থা করেছি ওদের। মানে ওই আমাদের দেশের কেষ্ট-বিষ্ণুদের। কালোবাজারিদের দুষি আমরা। কিন্তু আমি বলব ওই আমাদের দেশের মাথারা, রাষ্ট্রদূতেরা, তার থেকে অনেক বেশি অনিষ্টকারী! কালোবাজারিরা যা করছে, তার পিছনে তবু একটা যুক্তি আছে। ব্যবসা করতে নেমেছে, দু পয়সা লুঠতে চেষ্টা করছে। আর তোরা? শিক্ষিত সভ্য নামধারী অসভ্য অশিক্ষিতরা? একহাতে ভিক্ষের ঝুলি বয়ে বেড়াচ্ছিস, আর অন্য হাতে পয়সার হরির লুঠ দিচ্ছিস। ওদের দেশের ছেঁড়া কাঁথা কুড়িয়ে এনে গায়ে জড়িয়ে বলছিস–দেখ দেখ, আমরা কেমন সেজেছি। আর বলছিস কাকে?না, ওদের কাছেই। বুঝিসনা কত হাস্যাস্পদ হচ্ছিস। অথচ নিজের ঘরে লক্ষ্মীর ঝাঁপি, নিজের ঘরে শাল দোশালা।

শুনে শুনে সরোজাক্ষর এসব মুখস্থ হয়ে গেছে, কারণ সারদাপ্রদাদের যখনই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, তখনই সারদার মুখ থেকে এইসব জ্বালাময়ী বাণী বেরোতে থাকে। এ-জ্বালা নিরোধের একমাত্র ওষুধ নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলার অনুরোধ।

সরোজা আবার সে অনুরোধ করেন।

সারদা গম্ভীরভাবে বলে, এই চললাম দাদা, টাকা-টাটকি লিখে ফেলাই ভাল।

সেই ভাল।

 বলে আবার শুয়ে পড়েন সরোজা।

সারদা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বই আমাকে দুটো লিখতে হবে দাদা! একটা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন যোগশাস্ত্রের তুলনামূলক ব্যাখ্যা, আরআর একটা হচ্ছে আজকের এই অধঃপতিত ভারতবর্ষের

সারদার আবেগে বাধা পড়ল, ওপর সিঁড়ি থেকে বিজয়ার গলা শোনা গেল, এত আড্ডা হচ্ছে কার সঙ্গে ঠাকুরজামাই? শালাবাবু বুঝি এসেছেন?

সেরেছে! বউদি!বলে সারদা ছেলেমানুষের মতো দৌড় দেয়।

বিজয়া দরজায় এসে দাঁড়ান।

সশব্দ স্বগতোক্তি করেন, ছুটে পালানো দেখো। যেন চোর-ছ্যাঁচোড়। তারপর কণ্ঠস্বর ঈষৎ তোলেন, আমার এখনও পুজোপাঠ শেষ হয়নি।

সরোজাক্ষ ইঙ্গিতটা বোঝেন, নিঃশব্দে উঠে দরজার পরদাটা সরিয়ে দিয়ে এসে বসেন। না, শুয়ে পড়েন না আর, বসে থাকেন ঋজু হয়ে।

বিজয়া এক পা রথে, এক পা পথের ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে তিক্ত গলায় বলে ওঠেন, রোজ রোজ কীসের এত মিটিং?

সরোজাক্ষ ওই তিক্ত কণ্ঠের উৎসের দিকে একবার তাকান। দেখেন শরীরটা এত অকথ্য অযত্নেও অমলিন। হলুদরঙা কপালটার উপর মস্ত বড় সিঁদুর টিপটা নিত্য দিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে। নিত্যদিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে গরদ শাড়ির চওড়া লালপাড়টা। গায়ে জামা শেমিজের বালাই না থাকায় ডানদিকের অনাবৃত কাঁধটা দেখা যাচ্ছে, সেই অংশটুকুও সমান জ্বলজ্বলে। শুধু মাংসভারহীন।

ওই জ্বলজ্বলে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ একটা হিংস্র কল্পনা মনে এল শান্তস্বভাব সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন বিধবা হলে ওকে কেমন দেখাবে।

মনে মনে ওঁর সর্বাঙ্গ থেকে লাল রং মুছে নিলেন সরোজা, শাড়ির পাড়ের লাল, সিঁদুরের লাল, হাতের শাঁখার লাল। তারপর মনে মনে বললেন, একটা হলদে কাঠের পুতুল দেখাবে, স্রেফ একটা হলদে কাঠের পুতুল। মনে মনে ওঁর রংটা মুছে ফেলতে থাকেন সরোজা।

বিজয়া এই অবকাশে অসহিষ্ণু হলেন, আবার বললেন, ইস্কুল কলেজের মিটিং রাতদুপুর অবধি চলে?

সরোজাক্ষ নির্লিপ্ত গলায় বললেন, মিটিং ছিল না।

মিটিং ছিল না? বিজয়ার তেতো গলা সন্দেহে তীক্ষ্ণ শোনায়, তবে যে নীলু বলল, টেলিফোনে বলেছে মিটিং হচ্ছে।

তা হবে।

তা হবে? চমৎকার! কী নিশ্চিন্দি! বাড়ির লোকের যে দুশ্চিন্তা বলে কিছু থাকতে পারে সেটা বোধ হয় স্মরণে থাকে না?

দুশ্চিন্তা!

সরোজাক্ষ আর একবার ওই লাল প্রহরীদের দিকে তাকালেন। ভাবলেন যমের কি সাধ্য হবে তোমার ওই প্রহরীদের অতিক্রম করে বৈধব্য ঘটাতে পারবে তোমার?

মুখে বললেন, দুশ্চিন্তার কী আছে?

তা তো বটে। বিজয়ার সর্বপ্রকার বাহুল্য মাংসবর্জিত মুখের নিখুঁত কাঠামোখানা আরও কাঠ দেখাল। বিজয়ার কটুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বলাই ভুল হয়েছিল আমার।

সরোজাক্ষ এতক্ষণে উঠে গায়ের জামাটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে রাখতে রাখতে বলেন, নীলু বাড়ি আছে?

নীলু? বিজয়া উলটোনো ঠোঁটে অবজ্ঞার ভঙ্গি ফোঁটান, কেন? বাপের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে? দুশ্চিন্তায়?

সরোজাক্ষ একটু ব্যঙ্গের গলায় বলেন, আশ্চর্য কি! এই তো শুনেছিলাম বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় কাতর।

হুঃ! তা হলে তো তরেই যেতাম! ছেলে টেলিফোনে একবার বাপের খবর নিয়ে কর্তব্য সেরে বেরিয়ে গেলেন, বউও তার সঙ্গে নাচতে নাচতে চলে গেলেন, ব্যস আর কি চাই? সাজের কী ঘটা। পেটকাটা পিঠকাটা একবিঘৎ জামা, হাওয়ার শাড়ি, ঠোঁটে নখে রং, দেখলে মাথা কাটা যায়। ছিলেন তো একখানা ঘরের ভাড়াটের মেয়ে, নম্রতা ভব্যতা সভ্যতার ভেকও ছিল, এখন নিজ মূর্তি ধরেছেন!

বিজয়া মুখ বাঁকালেন।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, অন্যায় কথা বলব না, শুধু এই নীতিই কি সভ্য মানুষের শেষ নীতি? অন্যায় কথার প্রতিবাদ না করাটাও কি অন্যায় করারই নামান্তর নয়? অথচ সরোজাক্ষ ওই না বলার নীতিতেই প্রতিষ্ঠিত থেকে নিজেকে সভ্য শিক্ষিত ভেবে স্বস্তিতে থাকেন।

এই দুর্বল নীতিই কি তাঁকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে? প্রথম থেকে কঠোর শাসনের নীতিতে বিশ্বাসী হলে আজকের ইতিহাস অন্য হত? ঘরে এবং বাইরে?–

কিন্তু সরোজাক্ষ কোনওদিন শাসনের পথ ধরেননি, প্রতিবাদেরও নয়। নির্লিপ্ত থাকবার সাধনাটাই অভ্যাস করেছেন।

ভুল করেছেন কি ঠিক করেছেন, সে হিসেব করতে না বসে হঠাৎ অভ্যস্ত সাধনা থেকে চ্যুত হয়ে বলে ওঠেন, মূর্তিটা তিনি নিজে ধরেননি, তাঁর গুণবান স্বামীই তাঁকে নতুন মূর্তিতে গড়ে তুলেছেন।

কথাটা সত্যি।

নীলাক্ষর স্ত্রী সুনন্দা ছিল নেহাতই গেরস্থালি ঘরের মেয়ে। সুনন্দা বাল্যে তার গরিব বাবার সেই একখানা ঘরের সংসারেরও একটি কোণে বসে শিবপুজো করেছে, পুণ্যিপুকুর করেছে। সুনন্দা তরুণী হয়ে উঠেও বারব্রত করতে ভালবাসত। সুনন্দা গুরুজন দেখলে মাথায় কাপড় দিত, আর মাথা হেঁট করত। সুনন্দা পায়ে আলতা পরত, সুনন্দা স্নান করে উঠে সিঁদুর না পরে জল খেত না। সেই সুনন্দাকে ভেঙে গড়েছে নীলাক্ষ।

কিন্তু ভাঙাটা কি খুব সহজে হয়েছিল? নীলাক্ষকে কি তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিষ্ঠুর হতে হয়নি? যথেষ্ট পরিমাণে কৌশলী? একদিনে তো ভাঙেনি, তিলে তিলে দিনে দিনে। অনেক অনিচ্ছা, অশ্রুপাত, প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে সেই সাধারণীকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করল নীলাক্ষ। তারপর?

তারপর এই নতুন মূর্তি।

যা দেখে নীলাক্ষও এখন মাঝে মাঝে ভয় পায়, বিস্মিত হয়।

এখন আর সুনন্দা শুধু নীলাক্ষর প্রয়োজনেই পেটকাটা বুককাটা ব্লাউজ পরে অতি আধুনিকার মার্কা মেরে পার্টিতে যায় না। এখন সে নিজের সংগৃহীত নিমন্ত্রণপত্রে পার্টিতে পার্টিতে ঘুরে বেড়ায়, হি-হি করে হাসে, মিহি করে কথা বলে, আর এমন ভাব দেখায় যেন চিরকালই সে এই জীবনে অভ্যস্ত।

নীলাক্ষ যেখানে বউকে ওর ডিলারদের সঙ্গে শুধু হেসে কথা বলতে বলে, সুনন্দা সেখানে তাদের গা ঘেঁষে বসে উদ্দাম হাসিতে নিজেকে ছেড়ে দেয় তাদের গায়ে।

নীলাক্ষ তার বউকে টোপ করে গভীর জলের রুই কাতলাকে খেলিয়ে তুলতে চেয়েছিল,নীলাক্ষর বউ তার স্বামীকে সে রকম দু-দশটা রুই কাতলা ধরে দিয়ে নিজেই কোন ফাঁকে গভীর জলের মাছ হয়ে গেছে।

ওদের একটা ছেলে আছে, যার ভাল নাম উজ্জ্বলাক্ষ, আর ডাকনাম বিচ্ছু। ছেলেটা আগে প্রাণ ছিল সুনন্দার, এখন যেন অসুবিধের বোঝ। অন্তত তার কথাবার্তায় আর ব্যবহারে তাই যেন মনে হয়। যখন তখনই বলে আর একটা বছর গেলেই বোর্ডিঙে দিয়ে দেব ওটাকে।আর বলে বেশ সরবেই।

সরোজাক্ষ শুনতে পান, কিন্তু ডেকে হেঁকে কোনওদিন সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেন না। সমর্থনে কি অসমর্থনে কোনওদিকেইনা। তবু তাঁর যেন মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি সেটাও ভাল। অন্তত ছেলেটা তার বোধের দরজা খোলার পর যেন টের না পায় সে তার মা-বাপের একটা অসুবিধে! সে তার মা বাপের স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পথে বাধা-স্বরূপ।

কিন্তু কথাটা বিজয়ার কানে পৌঁছলেই তিনি মন্তব্য করে বসেন। বলেন, তা দেবে বইকী বোর্ডিঙে। নইলে বাবা-মার সাহেব হওয়াটা হবে কী করে? একটা মাত্তর ছেলে, সে ছেলেটাকে পাঁচ বছর পার হতে না হতে বাড়িছাড়া করে দেবার কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না? মায়া-দয়া বলে বস্তুটা কি ভগবান তোমাদের শরীরে দেননি?

সুনন্দা, যে সুনন্দা নাকি বিয়ের পর বেশ কয়েকটা বছর শাশুড়ির সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে পারত, সে এখন তার খাটো চুলের গুচ্ছ নাচিয়ে অমায়িক গলায় বলে, তা বোধ হয় দেনই নি। তা আপনার যদি মন কেমন করে, আপনিই নিন না ভার। আমার সময় কম, দেখাশোনা করতে পারি না বলেই

বিজয়ার রাগ আছে, তেজ নেই। অহংকার আছে, আত্মসম্মানবোধ নেই। তাই বিজয়া বলেন, হ্যাঁ, আমার তো আর অন্য কাজ নেই। আমি আমার পুজোপাঠ শিকেয় তুলে ওই বিচ্ছু বদমাইশের ভার ঘাড়ে নেব।

তবে আর কী করা! সুনন্দা চোখ নাচিয়ে বলে, তবে ওর কপালে বোর্ডিংই। মা বাপ নিষ্ঠুর। ঠাকুমা বিজি, পিসি উদাসীন, অতএব?

বলে যেন কেটে কেটে, যেন টুকরো বসিয়ে বসিয়ে।

আর বোধ করি দিন গোনে কবে ছেলেটাকে বাড়িছাড়া করবার বয়সে পৌঁছতে পারবে। সুনন্দাকে তার স্বামী নিজে হাতে ধরে যে জীবনে পৌঁছে দিয়েছে, সে জীবনে ওই দুরন্ত শিশুটা নিতান্তই অবান্তর।

আপাতত এখনও বাড়িছাড়া করতে পারেনি, তাই নিজেরা যখন বেরোয়, ছেলেটাকে তার মামার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর ফেরার সময় ঘুমে অচৈতন্য ছেলেটাকে উঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসে।

 দিদিমা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে–নাতিরমতো করে নয়, গচ্ছিত রাজপুত্রের মতো করে। কারণ জামাইয়ের ভঙ্গিটা স্রেফ রাজোচিত। এই দীনের কুটিরে নিতান্ত দীন শয্যায় যে তার ছেলেকে রেখে যায় সে, সেটা যেন কুটিরবাসীদের প্রতি বিশেষ কৃপা।

তবুও ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে বলেন, আহা, ঘুমিয়ে পড়েছে, থাকুক না হয়, সকালে ওর দাদু দিয়ে আসবেন। 

কিন্তু এ অনুরোধের মূল্য দেয় না ওরা। মহিলার নিজের মেয়েই ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, না বাবা, একদিন ওই আহ্লাদেপনার স্বাদটি পেলে আর রক্ষে আছে? রোজ বলবে–মামার বাড়িতেই ঘুমিয়ে থাকি। তার মানেই স্কুলের বারোটা বেজে যাওয়া।

কথাটা অবশ্য সত্যি।

চার বছরের বিচ্ছু আজ প্রায় বছর দুই হল স্কুলে যাচ্ছে। ভোরের স্কুল, তাকে পিটিয়ে পাটিয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্যে শেষ রাত থেকে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে যায় বাড়িতে, ঘুম-ঘুম চোখ ছেলেটাও ওই যাওয়াটাকে পণ্ড করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। অতএব লড়াই চলে এক পর্ব।

প্রথমে দু-একদিন বলেছিলেন সরোজাক্ষ, এত অল্প বয়স থেকে স্কুলে যাবে? অতটুকু বাচ্চা সবটা ঘুমুতে না পেলে, সকালের খেলাটা খেলতে না পেলে, স্বাস্থ্যটা ঠিক থাকবে? মেজাজও বিগড়ে যায় ওতে।

নীলাক্ষ বলেছিল,নিয়মে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

আর কিছু বলেননি সরোজা।

ওইটুকুতেই তাঁর মনে হয়েছিল নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে ফেলেছেন। ওদের ছেলে, ওরা অবশ্যই তার ভাল-মন্দ বুঝবে। তিনি কি আর বোঝতে বসবেন, নিয়মটা শুধু কোনও একটা সময়ে করলেই হয় না, চব্বিশটা ঘণ্টাকেই তা হলে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধতে হয়।

একটা দুবছরের শিশুকে ভোরবেলা স্কুলে পাঠাতে হলে, তাকে অন্তত রাত আটটার মধ্যে বিছানায় পাঠাতে হয়। কিন্তু সেদিকে তোমরা চোখ বুজে থাকবে। তোমাদের স্বেচ্ছাবিহারের তালে ওর জীবনটা নিয়ন্ত্রিত। ও সারা সন্ধ্যা ওর দিদিমার কাছে যথেচ্ছ উপদ্রব করবে, যথেচ্ছ আবদার করবে আর যথেচ্ছ সময়ে খেয়ে হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে যখন নিতান্তই ঘুমে ঢুলে পড়বে, তখন তোমরা ওকে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় নিয়ে আসবে টানতে টানতে, আর ঘণ্টা কয়েক পরেই ওকে নিয়মের শিক্ষা দেখাতে বসবে। ওতে নিয়মও হয় না, স্বাস্থ্যও গড়ে না।

না, ছেলেকে এসব বোঝতে বসেন না সরোজা। তিনি অন্যমনস্ক বটে, তবে অবোধ নন। এ ধরনের কথা বললে ওরা যদি বলে বসে, বেশ তো, মা রাখুন ওকে। ঠিক সময় খাওয়া শোয়া হবে।

বলতেই পারে। বলবেই নিশ্চয়। সুযোগ পেলেই ছোবল বসাবে। এই মনোভাব নিয়েই থাকে ওরা। কেন থাকে, তা জানেন না। তবে থাকে এটা জানেন। আর এও জানেন, বিজয়া কোনওদিনই স্বামীর কথার মান রাখতে বসবেন না।

বিজয়ার সময় কোথায় নাতি দেখবার?

বিজয়ার নিজের ঘরে ডজনখানেক পোষ্য নেই? বিজয়াকে তাদের খাওয়াতে হয় না? শোয়াতে হয় না? চামর ব্যজন করতে হয় না? তাদের সেই সেবাপর্বের জন্যে সর্বদা বিশুদ্ধবাসা হয়ে থাকতে হয় না? সরোজাক্ষ তো জানেন পৃথিবীর কোনও মহাশক্তিই ওঁকে ওঁর আসন থেকে টলাতে পারবে না। অন্য সর্ববিধ শোভনতা অশোভনতা ওঁর কাছে তুচ্ছ। সরোজাক্ষ অবশ্য বোঝাতে যাবেন না, তবু যদি বোঝাতে চেষ্টা করেন নিশ্চয়ই জানেন বিজয়া পরিষ্কার প্রাঞ্জল ভাষায় বলবেন, রোজ দিদিমার ঘাড়ে চাপানোটা দৃষ্টিকটু তা বুঝি। তবে তারও চেয়ে দৃষ্টিকটু ওই বাচ্চা ছেলেটাকে ভাসিয়ে দিয়ে নিত্য সন্ধেয় মা বাপের ধেই ধেই করে বেড়াতে যাওয়া। তবে? ওরা ওদের ছাগল ল্যাজে কাটবে, আমার কি!

হ্যাঁ, এইরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হক কথা অধ্যাপক গৃহিণীর।

আগে আগে সরোজাক্ষ স্ত্রীর এই নিরাবরণ হক কথার নিরাবরণতায় মরমে মরে যেতেন। মরমে মরে যেতেন ওঁর গ্রাম্যতায়। ক্রমশ সয়ে গেছে, অথবা সয়ে যায়নি। সয়ে যাবার নয়। শুধু চুপ করে গেছেন।

আগে চেষ্টা করতেন। বিয়ের পর প্রথম প্রথম, সেই অতীতকালে। নববধূর আচার-আচরণ, ভাষা-ভঙ্গি সবকিছুর ওপরই সংস্কারের মার্জনা চালাতে ব্ৰতী হয়েছিলেন। বিজয়া ওঁর সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। পঞ্চদশী বিজয়া স্বচ্ছন্দে তার অতি মার্জিত অতি সুকুমার রুচি নতুন বিয়ের বরের সামনে খসখস করে গা চুলকোতে চুলকোতে বলেছে, নমস্কার করি বাবা তোমাদের বালিগঞ্জের পায়ে। মশার কামড়ে একেবারে ডুমো ডুমো করে ছাড়ল। এমন ডাঁশ ডাঁশ মশা নিয়ে ঘর করো কী করে তোমরা? গায়ে গণ্ডারের চামড়া নাকি?

সরোজ মরমে মরেছেন।

 সরোজাক্ষ বলেছেন, ওভাবে কথা বলছ কেন? ভালভাবে কথা বলতে পারো না?

 বিজয়া তার সুন্দর মুখে খিলখিল করে হেসে বলেছে, কথায় আবার ভালমন্দ কি? আমি তো মশাদের গালমন্দ করছি না? রক্তগুলো সব চুষে নিল, বলব না সেটা?

কিন্তু খারাপ গালমন্দই কি মুখে আটকায় বিজয়ার? না আটকাত? তবু তখন মাঝে মাঝেই সব বিরক্তি ছাপিয়ে সুন্দর মুখেরই জয় হত।

হত। কারণ তখন সরোজক্ষর বয়েস পঁচিশের নীচে। সেই বয়েসটার কাছে হার মানতেই হত মাঝে মাঝে। হার মানতে হত বিজয়ার নিখুঁত মুখ আর অনবদ্য গঠনভঙ্গির কাছে। হার মানতে হত তার চাঁপা রঙের দেহবল্লীর কাছে। আর হার মানার পরমুহূর্তেই আসত ধিক্কার। নিজেকে মারতে ইচ্ছে করত। আরও করত, যখন দেখতেন বিজয়া সেই অসহায় আত্মসমর্পণটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।

ষোড়শী বিজয়া সরোজাক্ষকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সমবয়সী ননদকে বলত, বেটাছেলে জাতটা হচ্ছে একটা নচ্ছার জাত বুঝলি? বিয়ে হলে টের পাবি। মুখে দেখায় যেন কতই উদাসীন সাধুপুরুষ, বুঝি মেয়েমানুষ জাতটাকেই ঘেন্না…হি হি হি, রাত্তিরের অন্ধকারে বুঝলি? বুঝবি, বিয়ে হলে টের পাবি।

সরোজাক্ষর কান বাঁচিয়ে তো নয়ই, বরং কান লক্ষ্য করেই এ আলোচনা চলত। খেয়াল করত না আলোচনার সঙ্গিনী সরোজাক্ষরই ছোট বোন। দাদা বলে যার সমীহর শেষ নেই। মুখ তুলে কথা বলতে পারে না।

শুনে অপমানে ধিক্কারে কান গরম হয়ে উঠত সরোজাক্ষর, প্রতিজ্ঞা করতেন ইহজীবনে আর নয়। কিন্তু রক্ষা হত না সে প্রতিজ্ঞা। ওই বেহায়া মেয়েটাই আবার গায়ে পড়ে কাছে এসে, অথবা কেঁদেকেটে ফিট করে–

কিন্তু যাক, সে কথা।

সে-জীবনে ইতি পড়ে গেছে।

 বিজয়া এই মর্ত্যলোকের মালিন্য থেকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। সরোজাক্ষ নীচের তলায় নিজের কাজে। সরোজাক্ষ ওই ঊর্ধ্বগতির কারণ নির্ণয় করতে অক্ষম নন, কিন্তু সরোজাক্ষর তার প্রতিকারের ক্ষমতা নেই।

সরোজাক্ষ তাই ওই পট্টবস্ত্র পরিহিতার সংস্রব থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতেই চেষ্টা করেন। যতটা সম্ভব কম কথা কইতে।

তবু আজ একটু কথা কইলেন।

 কিন্তু বিজয়া কি চুপ করে যাবেন?

বিজয়া কি জীবনে কখনও চুপ করে যেতে রাজি হন? হন না। এখনও তা হলেন না। বললেন, হু। স্বামী! মেয়েমানুষ নিজে শক্ত হলে স্বামীর সাধ্যি আছে তাকে বদলাবার?

সরোজাক্ষ ভাবলেন, তা নেই বটে।

 কিন্তু সরোজাক্ষ আর কথা বললেন না। সরোজা তোয়ালেটা পেড়ে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন। আর ভাবতে লাগলেন, কাল সকালে কোনও খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় সরোজাক্ষর লাঞ্ছনার কাহিনী ঘোষিত হবে না তো?

সরোজাক্ষ দেখতে পেলেন না একজোড়া জ্বলন্ত চোখ নিষ্ফল আক্রোশে তাকিয়ে থেকে থেকে আগুন ছড়িয়ে আবার চলে গেল তার সেই নাসেরে আসা পুজোপাঠের উদ্দেশ্যে।

.

রাস্তার মোড়ে ছাড়াছাড়ি হতে হয়, বাড়ির সামনে পর্যন্ত একসঙ্গে আসার সাহস হয় না। কী জানি কে দেখে ফেলে। এই নিয়ে দিবাকর ব্যঙ্গ হাসি হাসে। বলে, বাস্তবিক কী অদ্ভুত তোমাদের বাড়িটি! বিশ্বাস হয় না তোমরা একটা উচ্চশিক্ষিত পরিবার, তোমার বাবা একজন অধ্যাপক, মেয়েদের কলেজে পড়বার পারমিশান দিয়েছেন, আর এই কলকাতা শহরের আধুনিক সমাজে বাস করছ তোমরা!

এ ব্যঙ্গে মীনাক্ষী ক্ষুব্ধ নিশ্বাসে তপ্ত হয়। বলে, কেন বিশ্বাস হবে না? আমার শ্রীযুক্ত দাদার আচার-আচরণ দেখলে খুব বিশ্বাস হবে। রাত দুপুরে বউ নিয়ে পার্টি থেকে ফিরবেন। চোখ লালচে, পা বেঠিক, ইংরেজি ছাড়া বোলচাল নেই মুখে, মার সামনে বউদির কাঁধ ধরছেন পিঠ ঠুকছেন, কে বলবে তবে আমরা অনগ্রসর।

দিবাকর দাসের বাড়ি গণ্ডগ্রামে, ওর বউদিরা এখনও একগলা ঘোমটা দেয়, আর ওর ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে এখনও দিনের বেলায় বর বউয়ের দেখাসাক্ষাৎটা গর্হিত কর্মের মধ্যে পড়ে, তাই বোধহয় দিবাকরের সমাজচিন্তা এত প্রগতিশীল। তাই সে কথায় কথায় মীনাক্ষীকে সেকেলে বলে নিন্দে করে, ভীরু কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ব্যঙ্গ করে। বলে,শুধু তোমার গার্জেনদের দোষ দিলে কী হবে, তুমি নিজেও কম কনজারভেটিভ নও। নইলে এতদিনেও একবারের জন্যে একটু সুযোগ জোগাড়ে রাজি করাতে পারলাম না।

মীনাক্ষী আরক্তিম হয়, মীনাক্ষী ঝংকার দেয়,আঃ যতসব অসভ্যতা।

দিবাকর দাস বলে, ওই ওইটিই হচ্ছে বদ্ধমূল কুসংস্কার। যা চিরন্তন সত্য, যা অপরিহার্য অনস্বীকার্য তাকে অস্বীকার করা, তাকে চোখ বুজে এড়িয়ে যাওয়া, তার ওপর অকারণ একটা পাপ মার্কা দেওয়া, এর কোনও মানে হয়?

দিবাকরের ঈষৎ বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন আগুনের ঢেলার মতো জ্বলে।

মীনাক্ষীর বুক কাঁপে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটিটা যেন সরে যেতে চায়, মীনাক্ষী তাই কথা পালটায়। বলে,উঃ বাংলা ভাষায় কী দখল! তুমি ইকনমিকসে অনার্স নিতে গেলে কেন, বাংলায় নেওয়া উচিত ছিল।

কথা পালটাচ্ছ? তার মানে ভয় পাচ্ছ!

দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ব্যঙ্গে ঝুলে পড়ে, আশ্চর্য! আশ্চর্য এই মিথ্যে ভয় পাওয়া আর তার জন্যে অনর্থক লোকসান খাওয়া। জীবনের সবচেয়ে দামি দিনগুলো তুমি লোকসান দিচ্ছ।

মীনাক্ষী তবু কথা হালকা করতে চায়, মীনাক্ষী দিবাকর দাসের ধধ করে জ্বলে ওঠা চোখের দিকে তাকায় না, অন্যদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, যতসব বাজে কথা! লোকসান আবার কি? তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আবার লাভ লোকসানের হিসেব!

দিবাকর উত্তেজিত হয়, দিবাকর রূঢ় গলায় বলে,তুচ্ছ? তুচ্ছ যে মোটেই নয় তা কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে। লোকান মনে হচ্ছে কিনা তার উত্তর নিজের মধ্যেই পাবে, যদি নিজের দিকে স্পষ্ট করে তাকাবার সাহস থাকে। নেই, সে সাহস নেই! তোমরা মেয়েরা হচ্ছ উটপাখির দল! বালিতে মাথা গুঁজে বসে আছ।

দিবাকর দাসের গায়ের রং কালো, গড়ন বেঁটে আর বলিষ্ঠ ধরনের, ঠোঁট পুরু, নাক মোটা, চওড়া কাঁধ। দিবাকরের মাথার চুল কুচি কুচি করে ছাঁটা, পরনে একটা সাদা ট্রাউজার আর কোমরে চওড়া ইলাস্টিক দেওয়া হাতপুরো ঢিলে ব্লাউজ ধরনের গাঢ় খাকি রঙের কোট। এককথায় সবটা মিলিয়ে কেমন একটা কর্কশ বন্য বন্য ভাব। অন্তত মীনাক্ষীর বাবা, সরোজাক্ষ দেখলে দিবাকর দাসকে একটা বর্বর ছাড়া আর কিছু বলতেন না। কিন্তু মীনাক্ষীর দুরন্ত আকর্ষণ ওই বন্যতার উপর, ওই বর্বরতার প্রতি। পুরুষের কোমল স্নিগ্ধ সৌম্য চেহারা তার পছন্দ নয়। তাই দিদির বরকে দেখলে তার হাসি পায়। অবজ্ঞা আসে। এবং দিদিকে সে কথা বলতেও ছাড়ে না। ঠোঁট উলটে হেসে হেসে বলে, যাই বলিস দিদি, পুরুষ মানুষকে অমন মোলায়েম ভদ্র চেহারা মোটেই মানায় না। একটু বুনো বুনো গোঁয়ার গোঁয়ার না হলে পুরুষ মানুষ অচল।

দিদির ভিতরে কী আছে কে জানে, তবে তর্কে হারতে রাজি হয় না সে। তাই বলে,ঠিক আছে, তোকে একটি নিগ্রো যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে।

মীনাক্ষী হেসে ওঠে।

মীনাক্ষী ঠিক দিবাকরের মতো কাঁধ ঝাঁকায় আর ঠোঁট ওলটায়, বিয়ে দেওয়া হবে? সেই অপেক্ষায় বসে থাকব নাকি তোর মতো?

নিজেই করবি?

নিশ্চয়।

মীনাক্ষীর দিদি যেন ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায় তার অবিবাহিতা ছোট বোনের দিকে। ওর দৃষ্টি দেখলে মনে হয় যেন ওকে ওর প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মীনাক্ষী সেটা ভোগ করতে চাইছে। তাই হঠাৎ কৌতুকের গলা ছেড়ে কড়া গলায় বলে, তলে তলে চালানো হচ্ছে বুঝি কিছু?

মীনাক্ষী সামলে নেয়, হেসে দিদির গলা ধরে। বলে, রাগলে তোকে কী সাংঘাতিক সুন্দরী দেখায় দিদি।

দিদিকে ওর ভাল লাগে না, সর্বদাই ওর মনে হয়, ছেলেবেলা থেকেই মনে হত, দিদি যেন ওকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছে। তবু যখন তখন দিদির বাসায় বেড়াতে যেতে হয় মীনাক্ষীকে, না হলে কলেজ শেষে এবং বাড়ি ফেরার সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানটাকে মাঝে মাঝে ম্যানেজ করে নেওয়া শক্ত হয়ে ওঠে।

মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, মীনাক্ষী এ ভয়টুকু করে চলে। ভয় করে বাবার সামনে পড়ে যাবার, তাই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি করতে হয় দিবাকরের সঙ্গে।…আর দিবাকর দাস চওড়া কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে চলে যায়। দিবাকর দাসেদের পরিবারে সেই প্রথম ছেলে যে বি-এ পড়ছে, তাই দিবাকর দাসের মধ্যে যেন একটা বিশ্ব নস্যাৎ ভাব জন্ম নিয়েছে। দিবাকর দাস মনেপ্রাণে আচারে আচরণে অতি প্রগতিশীল হতে চায়, তাই দিবাকর মীনাক্ষীকে চমকে দেবার মতো কথা বলে। বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে।

দিবাকর তার বন্য বর্বর চেহারাটার জন্যে লজ্জিত তো হয়ই না, বরং সাজসজ্জায় সে চেহারাকে আরও কর্কশ করে তুলতে পছন্দ করে। আর মীনাক্ষীর আকর্ষণও সেই বস্তুটার উপরই। মীনাক্ষী ওই কর্কশ কুৎসিত লোকটার আকর্ষণেই সম্মোহিত।

দিবাকর যদি ওকে লুঠ করে নিয়ে যেতে পারত, হয়তো মীনাক্ষী লুঠ হয়ে যেতে দ্বিধা করত না। কিন্তু দিবাকরের চোখেই শুধু আগুন জ্বলে, দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটোতেই শুধু একটা সর্বগ্রাসী। ক্ষুধা জেগে ওঠে, কার্যক্ষেত্রে দিবাকর সেই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি হয়। আর অন্তত একদিন একটা সুযোগ আহরণ করাবার জন্যে মীনাক্ষীকেই পীড়াপীড়ি করে।

মীনাক্ষীর বুক ধকধক করে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটি সরে সরে যায়, মীনাক্ষী শুধু বলে, সবুর করো না বাপু, আর কিছুদিন সবুর করো।

সেই সবুর করাটাকে মীনাক্ষী ভবিষ্যতের কোনও একটা শুভলগ্নের তারিখ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে চায়।

যে নাকি পিছিয়ে পড়ে থাকবার ভয়ে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে গলা বাড়ায়, ধর্মসতীত্ব সততা সভ্যতা সবকিছুকেই কুসংস্কার আর প্রথামাত্র বলে অবজ্ঞার চোখে দেখার ভান করে, তার কথা মীনাক্ষী জানে না। মীনাক্ষী লজ্জিত হয়।

লজ্জিত হয় নিজের সভ্যতা সততা ধর্মবোধ আর সতীত্ববোধের জন্যে। কিন্তু ওগুলো যে তার মজ্জায় মজ্জায়, তাই ত্যাগ করে উঠতে পারে না। মীনাক্ষী অতএব পতঙ্গের ভূমিকা নিয়ে আগুনের পাশে পাশে ঘুরে মরে।

সরোজাক্ষ তাঁর আত্মহারা কন্যার এই বিহ্বলতার সংবাদ জানেন না, তিনি তাঁর মেধাবিনী কন্যার পরীক্ষার রেজাল্টটাই জানেন। সেখানে মীনাক্ষী কোনওদিন বাবাকে হতাশ করেনি। অতএব মেয়ে সম্পর্কে আর কোনও কিছু জানবার চেষ্টা করেন না সরোজাক্ষ।

তবে ইদানীং বিনা চেষ্টায় আরও কিছু কিছু জানতে পেরে যাচ্ছেন, যেমন মীনাক্ষীর নাকি ক্রমশই বন্ধুসংখ্যা খুব বাড়ছে, আর মীনাক্ষী প্রায় প্রত্যেকদিনই কারও না কারও বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে।

সরোজাক্ষ অবশ্য তাঁর মেয়ের এই দেরি করাটা মোটেই পছন্দ করেন না, কিন্তু অপছন্দর প্রকাশ তো তাঁর শুধু মুখটা একটু কোঁচকানো, এ ছাড়া আর কি? আর কি করবার ক্ষমতা তাঁর আছে?

তথাপি ওইটুকুতেই ভয়।

ওইটুকুতেই মীনাক্ষী সন্ত্রস্ত হয়, ওইটুকুর জন্যেই তার বন্ধুর সঙ্গে রাস্তার মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি, ওইটুকুর জন্যেই বন্ধুকে একবারও বাড়িতে আমন্ত্রণ না করা, ওইটুকুর জন্যেই সহস্র মিথ্যার জাল ফেলা।

এর প্রভাব কাটিয়ে উঠবার শক্তি অর্জন করতে পারে না মীনাক্ষী।

 মোড়ের কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত পায়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে এল মীনাক্ষী। একটু থমকে তার ঠাকুর্দার আমলের এই পুরনো ধরনের বাড়িখানার দিকে চোখ তুলে তাকাল।

দেখল দোতলায় বাবার ঘরে আলো জ্বলছে, খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে আলো। ঠোঁটটা একটা কামড়াল। এটা দিবাকরের কাছ থেকে শেখা নয়, এটা মীনাক্ষীর নিজস্ব। ছেলেবেলা থেকেই কোনও কিছু অপছন্দ হলে ঠোঁটটা কামড়াত। এখনও রয়ে গেছে অভ্যাসটা।

ঠোঁট কামড়ে ভাবল, আশ্চর্য, একজন পুরুষ মানুষ সারাদিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় একটু খেলাধুলো আমোদ-প্রমোদের ধার ধারে না। একটু বেড়াতে যায় না। স্রেফ বাড়ি বসে থাকে! অথচ দিবাকর

উঠতে বসতে যে কোনও ব্যাপারে দিবাকরের সঙ্গে তুলনা করাই যেন নেশা হয়ে গিয়েছে মীনাক্ষীর। বোধ করি অতুলনীয় দিবাকরকেই তার পুরুষের আদর্শ বলে মনে হয়। তাই দিবাকরের বেপরোয়া রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর গল্প মনে পড়ে যায় তার বাবাকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি বসে থাকা দেখে।

নিজের বেপরোয়াপনার অনেক গল্পই করে দিবাকর। বলতে গেলে ওইটিই তার গল্পের উপজীব্য। আমি!আমিকে কেন্দ্র করেই তার যত কথা।

থাকে দিবাকর তার এক বিজনেসম্যান বিরাট বড়লোক মামার বাড়িতে, কারণ নিজেদের বাড়ি তো তাদের দেশের জমিদারিতে। তা মামা নাকি দিবাকরকে শাসন করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। শাসন করতে এলে দিবাকর মামাকে হাসির তোড়ে উড়িয়ে দেয়। যুগটা যে আর তার মামার আমলে আটকে নেই, সেই পরম সত্য তথ্যটি শুনিয়ে দিয়ে মামাকে ঠাণ্ডা করে দেয়।

বেড়িয়ে বাড়ি ফেরবার সময় একটু রাত হয়ে গেলে যখন ভয়ে বুকটা ছমছম করে, তখন মীনাক্ষীর দিবাকরের সেই নির্ভীক উক্তিগুলো মনে পড়ে গিয়ে নিশ্বাস পড়ে।

যুগটা পালটেছে সে কথা কি মীনাক্ষীই সগর্বে ঘোষণা করে না তার মায়ের কাছে? করে, মায়ের কাছে করে। যথেষ্টই করে। বলে, তুমি তোমার ওই মান্ধাতার আমলের ঠাকুর ঘরেই আবদ্ধ থেকো গে মা, আমাদের চালচলনের মানে আর তোমার বুঝে কাজ নেই।বলে, পৃথিবী গিয়ে চাঁদে উঠছে, আর তোমরা তোমাদের সেই পুরনো খোঁটায় বাঁধা পড়ে থেকে পুরনো কালের জাবর কাটছ।

এমন আরও অনেক কিছুই বলে মীনাক্ষী।

কিন্তু মাকে বলে আর লাভ কি? বাবাকে দেখলেই তো অস্বস্তিতে মন ভরে ওঠে, সিঁড়ির নীচে চটি খুলে রেখে পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতে হয়।

এতে যেন নিজের কাছেই নিজে হেয় হয়ে যায় মীনাক্ষী। যেন বাপের মুখের উপর সশব্দ প্রতিবাদে ফেটে পড়তে পারলেই তার অহমিকা পরিতৃপ্ত হতে পারে।

কিন্তু সরোজাক্ষ তাকে সে সুযোগ দেন কই?

সরোজাক্ষ কি কোনওদিন ধমকে উঠে বলেন, এত রাত করে ফিরলে কেন?

বলেন না।

শুধু সরোজাক্ষ, মেয়ে যখন তাঁর দরজার সামনে দিয়ে পার হয়, একবার তাকিয়ে দেখেন। মীনাক্ষী অবশ্য সেই তাকানোর দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিন্তু মীনাক্ষী অনুভব করে সেই তাকানোর চোখ দুটোয় অসন্তোষের গভীর কালো ছাপ, সেই চোখ দুটোর উপরকার হৃ দুটো কুঁচকে গিয়ে কাছাকাছি সরে এসেছে।

ওই অনুভবটাই মনের মধ্যে অপমানের জ্বালা ধরায় মীনাক্ষীর। তাই নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে অকারণের যেন কী এক আক্রোশে ফুলতে থাকে সে, আর একা-একাই নিজের স্বপক্ষে বহুবিধ যুক্তি খাড়া করে বাবাকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

নীলাক্ষর আচরণটা তখন তার যুক্তির মালমশলা হয়। ছেলের বেলায় যে দিব্যি অম্লান বদনে মেনে নেন সরোজাক্ষ, আর মেয়ের বেলায় ভুরু কোঁচকান, এইটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনে করে জবাব তৈরি করতে থাকে সে।

যাক, সেসব জবাব তৈরি তো পরের ব্যাপার। এখন সিঁড়ির তলায় চটি খুলে রেখে খালি পায়ে নিঃশব্দে ওঠার কৌশলে চলে যাবে সোজা তিনতলার মার ঠাকুরঘরের সামনে। ফিরেছে, সেটা যত তাড়াতাড়ি মাকে জানানো যায়।

বিজয়া যেই বলেন, এই এখন ফিরলি তুই? সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠতে পারে মীনাক্ষী, কেন, খুব রাত হয়ে গেছে? খাওয়া-দাওয়ার সময় হয়ে গেছে তোমাদের?না কি ঘুমের? তোমার ছেলে বউ ফিরেছে তো?

দিবাকরের কাছে হেয় হয়ে আসার শোধটা তোলে মায়ের ওপর।

বিজয়া হয়তো বলেন, দাদার দৃষ্টান্তটাই খুব ভাল কেমন? হয়তো বা বলেন, আমাকে শুনিয়ে কী হবে, আমি তোমাদের সংসারের কে? আমি তো এ সংসারের একটা আবর্জনা জঞ্জাল! আমার কাছে আসাই বা কেন? ফিরেছ বেশ করেছ, আমার বাবার মাথা কিনেছ, যাও এখন খাটে শুয়ে পা নাচাও গো

এইরকমই কথা বিজয়ার।

কিন্তু আজ বিজয়া অন্য সুরে কথা বললেন। মেয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজায় দাঁড়াতেই চাপা গলায় বললেন, সোজা উঠে আসছিস, না বাপের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

সোজাই উঠে এসেছি।

ঠিক আছে। দেরি দেখে কিছু বললে, বলবি অনেকক্ষণ এসেছি, মার কাছে ছিলাম।

মীনাক্ষী এখন সাহসীর ভূমিকা নেয়। বলে কেন, খামোকা বাজে কথা বলতে যাব কেন?

বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবেনা।বিজয়া মুখভঙ্গি করেন, বাজে কথা তো বলোনা একটুও!

সেটা আবার তুমি কখন শুনলে?

 বিজয়া মেয়ের চোখে চোখে তাকান। চাপা কঠোর গলায় বলেন,দেখ মীনা, তুই আমার পেটে জন্মেছিস বই আমি তোর পেটে জন্মাইনি। কোনটা সত্যি কথা আর কোনটা বাজে কথা, তা আমি চোখের চাউনিতেই টের পাই। এই আটটা সাড়ে আটটা রাত পর্যন্ত তুমি যে তোমার কোন বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে যাও, আর কোন লাইব্রেরিতে পড়তে যাও, তা আর আমার বুঝতে বাকি নেই। যা বলছি তোমার ভালর জন্যেই বলছি।

মীনাক্ষী মার চোখের থেকে চোখ নামিয়ে নেয়, তবু গলার স্বর সতেজ রাখে। বলে, আমার সবচেয়ে ভাল করা হয় মা, যদি একটা লোহার খাঁচা বানিয়ে তাতে ভরে রাখতে পারো আমায়।

খাঁচা? তোমরা খাঁচায় আছ? এ যুগের মেয়েরা? বিজয়া উত্তেজিত গলায় বলেন, উঃ কী বেইমান তোরা, কী বেইমান! হয়তো এরপর তোর বউদিও বলবে, আমি খাঁচায় বন্দিনী হয়ে আছি।

বউদির সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না, মীনাক্ষী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, দেখো তোমার ওই বউও একদিন মদ খেয়ে টলমল করতে করতে ফিরবে।

সেকথা কি তুই আমায় বোঝাতে আসবি? আমি তো চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি সে দৃশ্য।

হু! যত দোষ মেয়ের বেলায়।

মেয়েকে যে পরের বাড়িতে চালান করতে হবে।

দরকার নেই। মীনাক্ষী ভারী গলায় বলে, আমার জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না তোমাদের।

তা জানি! বিজয়া কটুগলায় বলেন,তোমার ভাবনায় যে তুমিই মাথা ঘামাচ্ছ তা আমি খুব টের পাচ্ছি। এখন যাও কিছু খাওগে। রাতদুপুর অবধি যেখানে আড্ডা দাও তারা তো আর খিদের সময় খেতে দেয় না।

আমার খিদে পায়নি– মীনাক্ষী সর্বশরীরে একটা মোচড় দিয়ে বলে, আমি যাচ্ছি বাবার কাছে। জিজ্ঞেস করব বাবার পিসিদের কালটা এখনও আছে কি না। জিজ্ঞেস করছি, কলকাতা শহরের রাস্তাটা এখনই এই সন্ধেবেলাতেই মহিলাশূন্য হয়ে গেছে কি না।

কেন, ইচ্ছে করে কেঁচো খোঁড়বার কী দরকার?

অকারণ ভয়ে কাঁটা হওয়ার দরকারটা কী, তাও জানি না। মীনাক্ষী ভাবে, হঠাৎ উদ্ধতের ভূমিকা নিয়ে বলেই ফেলি আজ আমার কথা দিবাকরের কথা। হয়ে যাক–একটা হেস্তনেস্ত।

কিন্তু হঠাৎ যেন সাহসটা ফুরিয়ে যায়। তাই মীনাক্ষী আর না এগিয়ে বলে ওঠে, যাক, আমার কথা আর তোমাদের শুনে কাজ নেই। তুমি থাকো তোমার স্বর্গলোকে। বাবা থাকুন তাঁর উচ্চচিন্তার গজদন্ত মিনারে। দাদার স্বর্গ তো দাদা নিজেই রচনা করছে। আমার ভাবনা আমি ভাবব।

বলে পাক খেয়ে তরতর করে নেমে এসে বাবার ঘরের দিকে একটা কটাক্ষপাত করে ঢুকে পড়ে বাঁ দিকে সারদাপ্রসাদের ঘরে। আর আশ্চর্য কৌশলে মুখে একটা হালকা হাসির প্রলেপ মাখিয়ে নিয়ে সহাস্যে বলে, কী পিসেমশাই! নতুন কী আবিষ্কার করলেন?

.

পিসেমশাইকে নিয়ে মজা করবার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই এ-ঘরে এসে ঢোকে মীনাক্ষী। প্রশ্ন তোলে, নতুন কী আবিষ্কার করলেন পিসেমশাই?

মজা করা ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্যও অন্তর্নিহিত আছে। কোথায় কোন অদৃশ্য কালির লেখায় যেন পড়ে নিয়েছে মীনাক্ষী, পিসেমশাইকে আত্মীয়ের পদমর্যাদা দিলে বাবাকে কিঞ্চিৎ সন্তুষ্ট করা যায়। আর–ডেকে কথা কওয়া মানেই তো আত্মীয়ের মর্যাদা দেওয়া।

কই, দিদি কি দেয় সেটুকু মর্যাদা?

বেড়াতে আসে, দু-চার ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। একবার পিসেমশাইবলে উঁকিও মারে না। মীনাক্ষী উঁকি মারে। বিশেষ করে যেদিন দিবাকরের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আসতে একটু বেশি দেরি হয়ে যায়, যেদিন সেই মুক্ত হয়ে চলে আসবার সময় অনবরতই ভয় ভয় করে, মনে হয় পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে সরে যাচ্ছে একটা অতল গহ্বরের সংকেত জানিয়ে জানিয়ে।

সেদিন মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে অস্বস্তি হয়। মনে হয় মায়ের চোখ দুটো সার্চলাইট হয়ে মীনাক্ষীর ভিতরটা সমস্ত দেখে ফেলছে। দেখে ফেলছে ওই গহ্বরের সংকেতটাও। হয়তো মা হঠাৎ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে উঠবে, কী গো তোমরা একালিনীরা, আমাদের সন্দেহ বাতিক নিয়ে বড় যে ধিক্কার দাও, এখন কী হচ্ছে? ঘি আর আগুনের প্রবাদটা খেটে যাচ্ছে না?

কিন্তু কে আগুন, কে ঘি?

মীনাক্ষীই তো গলে গলে যাচ্ছে, মীনাক্ষীই তো আগুনের আঁচে পাখা পোড়াতে ছুটছে।

কী তীব্র আকর্ষণ সেই বন্য বর্বরতার, কী সৌন্দর্য সেই পুরু পুরু ঠোঁটজোড়ার, সেই জ্বলন্ত আগুনের ঢেলার মতো দুটো চোখের!

কিন্তু আকর্ষণের অন্তরালেই তো ভয়ের বাসা।

অতএব বাবার সামনে এসে দাঁড়াতেই পারা যায় না দিবাকরের সান্নিধ্য থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে কেমন যেন অশুচি অশুচি লাগে, মনে হয় বাবার দৃষ্টিতে দেখতে পাবে ঘৃণা আর হতাশা। যেন সে দৃষ্টি অনুক্ত হলেও তীব্র প্রশ্ন করে উঠবে,ছি ছি মীনাক্ষী, তুমি এই! এই তোমার রুচি!

অতএব প্রথম নম্বর এই পাগলের ঘরটায় ঢুকে পড়া শ্রেয়।

এই আত্মনিমগ্ন খ্যাপা লোকটা তাকিয়ে দেখবে না। দেখবে না মীনাক্ষীর কোথায় কোথায় লেগে রয়েছে একটা বন্যসুখের স্বাদ।

সারদার আবিষ্কার সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই সারদা উল্লসিত হয়, উত্তেজিত হয়। আজও হল। বলে উঠল, আবিষ্কার কিছুই নয়, সবই রয়েছে জাজ্বল্যমান, শুধু তাকিয়ে দেখার ওয়াস্তা। শুধু পূর্বপুরুষের বুদ্ধির প্রতি একটু শ্রদ্ধা রেখে বিচারটা করা। তা নয়–গোড়া থেকেই তোমরা ধরে বসে আছ, তোমাদের জেনারেশনের আগে পর্যন্ত সবাই বুদ্ধ ছিল। হচ্ছিল সেই কথা দাদার সঙ্গে। একটা তুচ্ছ কথাই ধরো না–এই যে খাদ্যাখাদ্য বিচার, এই যে বার তারিখ তিথিনক্ষত্র ধরে ধরে খাদ্যগুণের হিসেব কষা, যা নাকি করে গিয়েছেন আগেকার পণ্ডিতরা, তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিয়ে চিন্তা করে দেখেছ কোনওদিন তোমরা? দেখোনি। স্রেফ উপহাসের হাসি হেসে রায় দিয়ে রেখেছ সেকালের লোকগুলোর কোনও কাজকর্ম ছিল না, তাই বসে বসে লিখে রেখেছে তেরোদশীতে বেগুন খেলে মহাপাতক, প্রতিপদে কুম্মাণ্ড খেলে জাতিপাত।

আরে বাবা, ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ হাইজিনিক তা তলিয়ে দেখেছ? তা দেখবে কেন? সেটা যে তোমাদের মতে বুন্ধুরা করে গেছে। এখন তোমাদের স্বর্গভূমি ওদেশ থেকে ফতোয়া আসুক ফেব্রুয়ারিতে মুলো খেলে ক্যানসার হয়, আর নভেম্বরে ওল খেলে কুষ্ঠ, তা হলে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে–উঃ বিজ্ঞানের কী উন্নতিই করেছে ওরা! এইসব বুঝে ফেলেছে।

সারদা একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলে, অথচ এদেশ? কোন জন্মে উদ্ভিদ জগতের সব রহস্য জেনে বুঝে ফাঁস করে বসে আছে।

মীনাক্ষীর কাছে এসব কথা নতুন নয়, তবে উত্তেজিত সারদাপ্রসাদ সব সময় নতুনের মতো করেই বলে, কাজেই মীনাক্ষীও নতুন শোনার সুরেই বলে, তা বেশ তো পিসেমশাই, না হয় তাঁরা সব জেনে ফেলে বলে-টলে গেছেন, কিন্তু ওইসব ধর্মের ভয় দেখিয়ে কেন?

কেন? সারদাপ্রসাদের মুখে একটি অলৌকিক হাসি ফুটে ওঠে, কেন, বুঝতে পারছ না? মানুষ জাতটা যে আত্মঘাতী জাত! হিতাহিত জ্ঞানের বালাই মাত্র নেই। বিশেষ করে জনসাধারণ, মানে তোমাদের ওই গণদেবতারা। যাতে ক্ষতি, যাতে সর্বনাশ, সেইদিকেই ঝোঁক। অন্য প্রাণিজগতে কোনও বেনিয়ম আছে? কদাচ না। নিজেদের অনিষ্টকর কিছু করছে তারা? মোটেই না। কিন্তু মানুষ? নিজের অনিষ্ট নিজে ডেকে আনাই তার পেশা।

মীনাক্ষী সহসা কেঁপে ওঠে।

মীনাক্ষীর মনে হয় সারদাপ্রসাদ বুঝি তাকে উদ্দেশ করেই বলছে কথাটা। ৩৪

কিন্তু সারদার অভিযোগ কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, নিতান্তই সমষ্টিগত ব্যাপার। তাই সে দুই হাত উলটে বলে–কাজে কাজেই তাদের হিত করতে, পাপ, পুণ্য, ধর্ম, অধর্ম, ভাল হওয়া, মন্দ হওয়া, অনেক কিছুর কোটিং মাখিয়ে ওষুধের বড়ি দিতে হয়। যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা সমাজকল্যাণকামী, তাঁরা তাই সেই বুদ্ধির বশেই সবকিছুতেই ওই করতে নেই আর করতে হয়-এর ছাপ দিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু মানুষ তো আর চিরদিন অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না।

কথা কয়ে নিজেকে হালকা করে নিচ্ছে মীনাক্ষী, করে নিচ্ছে সহজ।

তবে মীনাক্ষীর এ প্রশ্নে সারদা কৌতুক হাসি হেসে ওঠে, অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না? বলি ওহে একালের বিজ্ঞ মেয়ে, ডাক্তার যখন প্রেসক্রিপশন দেয়, তুমি তার সব উপাদান জেনে, তার উপকারিতা বুঝে তবে খাও? তা তো খাও না? জানো লোকটা একটা বিদ্যে শিখেছে, সেই বিদ্যেটা প্রয়োগ করছে, তুমি তা থেকে লাভবান হচ্ছ। এও তাই। ডাক্তার যদি বোঝতে বসে কীসের মধ্যে কী আছে, তুমি তখন আর গ্রাহ্য করে খাবেনা,বুঝলে? সেকালের ডাক্তাররাও তাই ওই ধর্ম দেখিয়ে হিত করত লোকের। ওই পাপপুণ্য দেখিয়েই দিত স্বাস্থ্যশিক্ষা, সমাজশিক্ষা, শৃঙ্খলারক্ষার শিক্ষা। বলতে পারা যায় শাস্ত্র মানে লবুক!…কিন্তু তোমরা সেই লকে অবজ্ঞা করে স্বেচ্ছাচারিতাটি বেছে নিয়েছ। তাতে কী হচ্ছে? বলল কতটা লাভবান হচ্ছ তাতে? কচু। কচুপোড়া! সমস্ত সমাজটাই ফ্রাস্টেশানে ভুগছে।

মীনাক্ষী এই পাগলের কথা উড়িয়ে দিতে পারত। দেয়ও তাই, কিন্তু আজ যেন মীনাক্ষী এই হাস্যকর তর্কের মধ্যে থেকেই আপন যুক্তির শক্তি সংগ্রহ করতে চাইছে। তাই সে দৃঢ়গলায় বলে, অবোধের শান্তির চাইতে এই ফ্রাস্টেশানও ভাল পিসেমশাই।

ভাল? সারদাপ্রসাদ বিরক্ত গলায় বলে, তারপর? পরিণামটা? হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, পরিণামটা কী জানো? ওই ফ্রাস্টেশান ব্যাধিগ্রস্ত জগৎ কাজ ছেড়ে দেবে, চেষ্টা ছেড়ে দেবে, বেঁচে থাকবার জন্যে যেসব আয়োজন, তাতে পরাত্মখ হবে। হয়ে ক্রমশ কাপড় পরা ছেড়ে, কাঁচা মাংস ধরে, কোটি কোটি বছরের সাধনা মুছে ফেলে সাবেককালের গুহ্য-জীবনে ফিরে যাবে।

উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সারদাপ্রসাদ।

এই উত্তেজিত মূর্তির দিকে তাকিয়ে হাসিটা আর চেপে রাখতে পারে না মীনাক্ষী। হেসে উঠে বলে, সেটা আপনার আমার জীবদ্দশায় হবে না আশা করছি

সারদাপ্রসাদ এই ব্যঙ্গে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। তারপর কড়াগলায় বলে, তোমাদের মতো ফাজিল ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। যাও, নিজের কাজে যাও।

অর্থাৎ ঘর থেকে বিদায় হও। অপমানে মীনাক্ষীর মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সেও পাথুরে গলায় বলে, যাচ্ছি।

সারদাপ্রসাদ আপন অধিকারের সীমা সম্পর্কে চিন্তা করে না। বলে, হ্যাঁ যাও। আমার কাজ আছে। প্রায় ওকে ঠেলে ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সারদাপ্রসাদ।

হ্যাঁ, এরকম রেগে ওঠে সে।

 কিন্তু সে রাগ শরতের মেঘ। ভুলে যায়। হয়তো কালই আবার মীনাক্ষীকে ডেকে বলবে,ওহে আধুনিকা, শোনো শোনো–আজকের এই হতভাগ্য ভারতবর্ষের প্রাচীনকালে কী ছিল শোনন–

মীনাক্ষীও পাগল ছাগল বলে ক্ষ্যামা ঘেন্না করে থাকে পিসেমশাইকে, দাদা বা দিদির মতো তীব্র একটা আক্রোশ নেই লোকটার উপর। কিন্তু আজ সে বড় ক্রুদ্ধ হয়েছে। আর এই ক্রোধটা হয়তো নানা কারণ সঞ্জাত।

হয়তো বিজয়া যা বলেছেন সেটাও একটা কারণ, আড্ডায় আড়াই হয়, খাওয়াটা হয় না।একেবারে হয় না তা নয় অবশ্য, হয়। হয়তো বা এক পেয়ালা কফি, হয়তো বা চা আর অমলেট। বেশি খাওয়ার রেস্ত কোথায়? দুজনেই তো পড়ুয়া। দিবাকর অবশ্য তাদের দেশের জমিদারি আর বিজনেসম্যান বিরাট মামার গল্প অনেক করে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই দেখা যায় ও পার্সটা ভুলে এসেছে, কিংবা পার্সটা ভরে আনতে খেয়াল করেনি। তাছাড়া আর এক ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত দিবাকর তুচ্ছ ক্ষুধাতৃষ্ণার ধারই ধরতে চায় না যেন। সেই প্রথম পরিচয়কালের মতো কফি হাউসে এক ঘণ্টা অথবা গঙ্গার ধারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট-এর মনোরম স্বাদ প্রায় ভুলেই গেছে মীনাক্ষী। এখন ভূমিকাটা অনেকটা অভিযুক্ত ও অভিযোক্তার। মীনাক্ষী আছে কাঠগড়ায় যেন অন্ধ কুসংস্কারের জ্বলন্ত নিদর্শন হয়ে, আর দিবাকর। প্রতিপক্ষের উকিলের ভূমিকায়। দিবাকরের প্রত্যেকটি অভিব্যক্তিতেই তাই শাণিত বিদ্রূপ আর তীক্ষ্ণ সমালোচনা। দিবাকর তাই সর্বদাই উগ্ৰ অসহিষ্ণু।

ভালবাসার মধুর স্বাদটা যে কী, তা জানে না মীনাক্ষী। জানে না তার স্নিগ্ধতা, সরসতা, পূর্ণতার স্বাদ। মীনাক্ষীর প্রেমাস্পদ ওকে দেয় শুধু একটা তীব্র জ্বালার অনুভূতি। প্রতিক্ষণই তাই মনে হয় মীনাক্ষীর, আপন জীবনে সে নিরুপায়, সে বন্দিনী, সে একটা কঠোর শাসনের তলায় নিষ্পেষিত। যে শাসনটা অন্যায়।

সব কিছু মিলিয়ে মীনাক্ষীও যেন ভারসাম্য হারাচ্ছে।

তাই আজ মীনাক্ষী, যা হয়তো সে ঘণ্টাখানেক পূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি, তাই করে বসে। সারদাপ্রসাদের ঘর থেকে বেরিয়ে তীব্র বেগে বাবার ঘরের পরদাটা সরিয়ে ঢুকে পড়ে বিনা ভূমিকায়। বলে ওঠে, বাবা, আপনার কি মনে হয়, পৃথিবীতে কিছুদিন আগে এসে পড়ার অধিকারে যাকে যা খুশি অপমান করা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *