অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল
১. অধিবিদ্যা
যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিককে পাঠ করতে গেলে, বিশেষ করে অ্যারিস্টটল পাঠ করার সময়, দুই উপায়ে তা করা আবশ্যক-তার পূর্বসূরিদের কথা উল্লেখ করে এবং তার উত্তরসূরিদের কথা উল্লেখ করে। পূর্বসূরিদের প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের কৃতিত্ব সীমাহীন; উত্তরসূরিদের ব্যাপারে তার দোষও একই রকম সীমাহীন। তবে দোষের জন্য আ্যারিস্টটলের চেয়ে তার উত্তরসূরিগণই বেশি দায়ী। তার আবির্ভাব গ্রিক চিন্তায় সৃজনশীল যুগের শেষ পর্বে এবং তার মৃত্যুর পর দুই হাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেনি যিনি মোটামুটি তার সমতুল্য বিবেচিত হতে পারেন। এই দীর্ঘকালের শেষের দিকে তার কর্তৃত্ব প্রায় চার্চের কর্তৃত্বের মতো প্রশ্নাতীত হয়ে উঠেছিল এবং বিজ্ঞানে ও দর্শনে তা প্রগতির পথে একটি গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর পর থেকে প্রায় প্রত্যেকটি গুরুতর বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির সূচনা হয়েছে কোনো না কোনো অ্যারিস্টটলীয় মতবাদকে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে; যুক্তির বেলা এই কথা আজকের দিনেও সত্য। কিন্তু তার পূর্বসূরিদের মধ্যে (সম্ভবত ডেমোক্রিটাস ছাড়া) যদি কেউ একই রকম কর্তৃত্ব অর্জন করতেন তাহলে তা আরো ক্ষতিকর ব্যাপার হতে পারত। তার প্রতি সুবিচার করতে হলে শুরুতেই আমাদের ভুলে যেতে হবে তার মরণোত্তর অত্যধিক খ্যাতির কথা এবং সেই খ্যাতির দরুন, তার যে মাত্রাতিরিক্ত মরণোত্তর নিন্দা হয়েছে, তাও ভুলে যেতে হবে একইভাবে।
অ্যারিস্টটলের জন্ম থ্রেস-এর স্ট্যাগিরায়; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ সালে। তার পিতা উত্তরাধিকারসূত্রে মেসিডোনিয়ার রাজার পারিবারিক চিকিৎসকের পদটি পেয়েছিলেন। আঠার বছর বয়সে অ্যারিস্টটল এথেন্স যান এবং প্লেটোর শিষ্য হন। প্লেটোর একাডেমিতে তিনি অতিবাহিত করেন ২০ বছর, ৩৪৮-৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটোর মৃত্যু পর্যন্ত। তারপর তিনি কিছু সময় ভ্রমণ করেন এবং হারমিয়াস নামক এক স্বৈরশাসকের বোন বা ভাগনীকে বিয়ে করেন (গুজব আছে, মহিলা হারমিয়াসের কন্যা বা রক্ষিতা ছিলেন, কিন্তু উভয় কাহিনিই মিথ্যা প্রমাণিত হয় এই জন্য যে হারমিয়াস খোঁজা ছিলেন)। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ সালে অ্যারিস্টটল ১৩ বছর বয়সী আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক হন এবং এই পদে নিয়োজিত থাকেন তখন পর্যন্ত, যখন ১৬ বছর বয়সী আলেকজান্ডারকে তার পিতা সাবালক ঘোষণা করেন এবং ফিলিপের অনুপস্থিতিকালের জন্য তাকে রাজপ্রতিভূ হিসেবে নিয়োগ করেন। অ্যারিস্টটল ও আলেকজান্ডারের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে যা কিছু প্রশ্ন, এখন তার কোনো কিছুই আর নিরূপণযোগ্য নয়। নয় আরো এ জন্য যে অচিরেই এ বিষয়ে নানা রকম কেচ্ছা-কাহিনি পাখা মেলেছে মন্দ নয়। তাদের কিছু চিঠিপত্র আছে, তবে সেগুলোকে সাধারণভাবে জাল বা নকল মনে করা হয়। যারা উভয় ব্যক্তিরই ভক্ত তারা মনে করেন, গুরু তার শিষ্যকে প্রভাবিত করেছেন। হেগেল মনে করতেন আলেকজান্ডারের চরিত্রে দর্শনের প্রায়োগিক উপযোগিতার দেখা পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে এ. ডব্লিউ. বেন (A.w. Benn) বলছেন : আলেকজান্ডারের চরিত্র ছাড়া দর্শনের যদি আরো ভালো কোনো প্রশংসাপত্র না থাকে তবে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক…। উদ্ধত, মদ্যপ, নিষ্ঠুর, প্রতিহিংসাপরায়ণ, এবং অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই লোকটির মধ্যে হাইল্যান্ডের সর্দারদের সব অধর্ম আর প্রাচ্য দেশীয় স্বৈরশাসকদের উন্মত্ততার মিলন ঘটেছে। (The Greek Philosophers. Vol 1, P. 285).
আমি ব্যক্তিগতভাবে যদিও আলেকজান্ডারের চরিত্রের ব্যাপারে বেনের সঙ্গে একমত, তবু মনে করি যে, আলেকজান্ডারের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই উপকারী ছিল, কারণ তিনি ছাড়া হেলেনিক সভ্যতার সমগ্র ঐতিহ্যই বিলক্ষণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। তার ওপর অ্যারিস্টটলের প্রভাবের ব্যাপারে যার যার মতো করে আমরা অনুমান করে নিতে পারি, যা আমাদের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, আলেকজান্ডারের ওপর অ্যারিস্টটলের প্রভাব ছিল শূন্য। আলেকজান্ডার ছিলেন একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আবেগপ্রবণ বালক; পিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খারাপ এবং সম্ভবত লেখাপড়ায় তার অনাগ্রহ ছিল। অ্যারিস্টটল মনে করতেন কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনের মতবাদ প্রচার করতেন। তার এই শিষ্যটি তাকে নীরস এক বৃদ্ধ পণ্ডিত ছাড়া আর কিছু ভাবতেন বলে আমি কল্পনা করতে পারি না, যে পণ্ডিতকে পিতা তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন তাকে দুষ্টুমি থেকে বিরত রাখার জন্য। একথা সত্য যে, এথেনীয় সভ্যতার প্রতি আলেকজান্ডারের একটি বিশেষ উচ্চ ধারণা ছিল, কিন্তু এটা ছিল তার গোটা রাজবংশের মধ্যেই একটি সাধারণ ব্যাপার। তারা প্রমাণ করতে চাইতেন তারা বর্বর নন। উনিশ শতকে রুশ অভিজাতরা প্যারিসের জন্য যে অনুভূতি পোষণ করতেন, আলেকজান্ডারদের ব্যাপারটাও ছিল সে রকম। সুতরাং এটা যে আলেকজান্ডারের ওপর অ্যারিস্টটলের প্রভাবের ফল তা নয়। আমি আলেকজান্ডারের মধ্যে আর কিছু দেখতে পাই না, যা এই উৎস থেকে তিনি পেয়ে থাকবেন। আর এটা আরো বিস্ময়কর যে, অ্যারিস্টটলের ওপর আলেকজান্ডারের প্রভাব খুবই সামান্য ছিল। অ্যারিস্টটল তার রাজনীতিবিষয়ক চিন্তাভাবনায় এতটাই অজ্ঞ ছিলেন যে, নগররাষ্ট্রের যুগের জায়গা যে সাম্রাজ্যের যুগ দখল করেছে সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। আমার মনে হয়, শেষের দিকে অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে সেই অলস ও গবেট বালক মনে করতেন, যে দর্শনের কিছুই কোনোকালে বুঝতে পারেনি। মোট কথা, এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক এমনই নিল মনে হয়, যেনবা তারা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন দুই জগতের বাসিন্দা।
অ্যারিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল পর্যন্ত (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার মারা যান) এথেন্সে বাস করেন। এই ১২ বছর সময়কালে অ্যারিস্টটল তার দার্শনিক ধারা প্রবর্তন করেন এবং তার অধিকাংশ গ্রন্থই এই সময়ে রচিত হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুতে এথেন্সবাসী বিদ্রোহ করে এবং অ্যারিস্টটলসহ আলেকজান্ডারের মিত্রদের বিরুদ্ধে চলে যায়। অ্যারিস্টটল অধর্মাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তবে তিনি সক্রেটিসের পথ অনুসরণ না করে শাস্তি এড়াবার জন্য এথেন্স ছেড়ে পালিয়ে যান। পরের বছর ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) তিনি মারা যান।
অ্যারিস্টটল একজন দার্শনিক হিসেবে অনেক দিক থেকে তার পূর্বসূরিদের চেয়ে খুবই অন্য রকম ছিলেন। তিনিই প্রথম একজন অধ্যাপকের মতো করে লিখেছেন : তার গবেষণামূলক রচনাগুলো যেমন সুশৃঙ্খল ও প্রণালিবদ্ধ, প্রবন্ধগুলোও তেমনি বিভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত। তিনি একজন পেশাদার শিক্ষক, অনুপ্রাণিত ভবিষ্যদ্রষ্টা নন। তার কাজগুলো সমালোচনামূলক, সযত্নকৃত এবং গদ্যময়, সেখানে ব্যাকাসীয় (Bacehic) কোনো উদ্দীপনা নেই। প্লেটোর মধ্যেকার অর্ষিক উপাদানগুলো অ্যারিস্টটলের মধ্যে বাহিত হয়েছিল, এবং শক্তিশালী সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে সে উপাদানগুলোর মিশ্রণ ঘটেছিল। যেদিকটাতে তিনি প্লেটোনিক, সেখানে মনে হবে যে তার স্বভাবগত মেজাজের মধ্যে সেই শিক্ষার মাত্রাধিক্য ঘটেছে, তিনি যে শিক্ষার শিকার হয়েছিলেন। তিনি আবেগপ্রবণ নন এবং গভীর কোনো অর্থে ধার্মিকও নন। তার পূর্বসূরিদের ভুলগুলো ছিল যৌবনের চমৎকার ভুল, যে যৌবন অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়; আর তার নিজের ভুলগুলো ছিল তার যুগের ভুল, যে যুগ অভ্যাসগত সংস্কারগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। বিশদ বিবরণ ও সমালোচনার কাজে তিনি অনবদ্য; তবে বড় ব্যাখ্যার বেলায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন মৌলিক স্বচ্ছতা ও নিবিড় অনুভূতিশক্তির অভাবে।
অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যার আলোচনা যে কোত্থেকে শুরু করা যায় তা স্থির করা কঠিন, তবে সম্ভবত সর্বোত্তম জায়গাটি হবে ভাবতত্ত্ব (theory of ideas) সম্পর্কে তার সমালোচনা এবং সার্বিকগুলোর ব্যাপারে তার নিজস্ব বিকল্প মতবাদ। ভাবতত্ত্বের বিরুদ্ধে তিনি বেশ কিছু ভালো যুক্তি দিয়েছেন, সেগুলোর অধিকাংশই ইতিমধ্যে প্লেটোর পারমিনাইডিস-এ পাওয়া যাবে। সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিটি হলো সেই তৃতীয় মানুষ-এর যুক্তি : যদি একজন মানুষ এই জন্য মানুষ হয় যে সে আদর্শ মানুষটির মতো, তাহলে অবশ্যই আরো একজন আদর্শ মানুষ থাকতে হয়, সাধারণ মানুষেরা এবং ওই আদর্শ মানুষ-উভয়েই যার অনুরূপ। আবার, সক্রেটিস একই সঙ্গে একজন মানুষ এবং একটি প্রাণী, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আদর্শ মানুষটি একটি আদর্শ প্রাণী কি না; যদি তাই হয় তাহলে তো প্রাণীকুলের মধ্যে যতগুলো প্রজাতি আছে ততগুলোই আদর্শ প্রাণী থাকতে হয়। এই বিষয়ের আর এগোবার প্রয়োজন নেই; অ্যারিস্টটল এটা পরিষ্কার করেছেন যে, যখন কিছুসংখ্যক পৃথক পৃথক বস্তু বা প্রাণী একটি বিধেয় (predicate)-তে অংশ নেয়, তখন তাদের নিজেদের মতো একই রকম কিছু একটির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে বলে তা ঘটে এমনটা হতে পারে না, বরং আরো বেশি আদর্শ একটি কিছুর সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই তা ঘটে। এটা প্রমাণিত বলে ধরে নেওয়া যায়, কিন্তু অ্যারিস্টটলের নিজের মতবাদটি মোটেই পরিষ্কার নয়। স্বচ্ছতার এই অভাবের ফলেই নামবাদী ও বাস্তববাদীদের মধ্যকার মধ্যযুগের বিতর্কটা সম্ভব হয়েছিল।
মোটা দাগে বললে, অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যাকে প্লেটোর সঙ্গে সাধারণ জ্ঞানের মিশেল হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তিনি কঠিন, কারণ প্লেটো আর সাধারণ জ্ঞান সহজে মিশ খায় না। যখন কেউ তাকে (অ্যারিস্টটলকে) বুঝতে চেষ্টা করে, তখন সে একবার ভাবে যে, তিনি দর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ কোনো ব্যক্তির সাধারণ দৃষ্টিকোণগুলো প্রকাশ করছেন : আর একবার মনে করে যে, তিনি একটি নতুন শব্দভাণ্ডারসহ প্লেটোনিজমকেই উপস্থাপন করছেন। কোনো একটি অনুচ্ছেদের ওপর অতিরিক্ত জবরদস্তি করে কাজ নেই, কারণ পরবর্তী কোনো অনুচ্ছেদেই হয়তো সংশোধন বা পরিবর্তনের বিষয় থাকতে পারে। মোট কথা, তার সার্বিকগুলোর তত্ত্ব এবং বস্তু ও রূপের তত্ত্ব বোঝার সহজতম পথ হচ্ছে প্রথম সাধারণ জ্ঞানের মতবাদটি দিয়ে শুরু করা, যা তার দৃষ্টিভঙ্গির অর্ধেক এবং তারপর প্লেটোনিক সংশোধনীগুলো বিবেচনা করা, যেগুলোর অধীন করেছেন তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে।
একটি ধাপ পর্যন্ত সার্বিকগুলোর তত্ত্বটি বেশ সরল। ভাষার মধ্যে স্বকীয় নাম আছে। এবং আছে বিশেষণ। স্বকীয় নামগুলো বস্তু বা ব্যক্তির জন্য প্রয়োগ করা হয়, এই বস্তুগুলো বা ব্যক্তিদের প্রত্যেকটা শুধুই একটি বস্তু বা একজন ব্যক্তি, যার জন্য প্রাসঙ্গিক নামটি ব্যবহৃত হয়। সূর্য, চাঁদ, ফ্রান্স, নেপোলিয়ান-এগুলো অনন্য, এই নামগুলো একাধিক বস্তুর জন্য ব্যবহৃত হয় না। অন্যদিকে, বিড়াল, কুকুর, মানুষ-এই ধরনের শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের ক্ষেত্রে। সার্বিকগুলোর সমস্যাটি এই ধরনের শব্দাবলির অর্থ নিয়ে এবং সাদা, শক্ত, গোলাকার ইত্যাদি বিশেষণের অর্থাবলি নিয়ে। তিনি বলছেন সার্বিক শব্দটি দ্বারা আমি এমন ধরনের একটি কিছু বুঝি, যা অনেকগুলো উদ্দেশ্যের বিধেয় হতে পারে এবং পৃথক শব্দটি দ্বারা এমন একটি কিছু বুঝি, যা সেভাবে অনেকগুলো উদ্দেশ্যের বিধেয় হয় না।
একটি স্বকীয় নাম দ্বারা যা বোঝানো হয় তা হচ্ছে একটি বস্তুসার, আর একটি বিশেষণ বা মানবজাতি বা মানুষ এই ধরনের শ্রেণি-নাম দ্বারা যা বোঝানো হয় তা হচ্ছে একটি সার্বিক। একটি বস্তুসার হচ্ছে এইটি, কিন্তু একটি সার্বিক হচ্ছে এ রকম একটি বস্তু-সার্বিক নির্দেশ করে বস্তুটির ধরন, বাস্তব নির্দিষ্ট বস্তুটি নয়। একটি সার্বিক একটি বস্তুসার নয়, কারণ তা এই নয় [প্লেটোর ঐশ্বরিক শয্যাটি যারা কল্পনা করতে পারে তাদের কাছে শয্যাটি এই হবে; এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটল প্লেটোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।)। অ্যারিস্টটল বলছেন, এটা অসম্ভব মনে হয় যে কোনো সার্বিক শব্দ একটি বস্তুসারের নাম হবে। কারণ…প্রত্যেক জিনিসের বস্তুসার হচ্ছে তাই, যা কেবল ওই জিনিসটারই রয়েছে, যা অন্য কোনো কিছুর মধ্যে নেই; কিন্তু সার্বিক হচ্ছে সাধারণ, কেননা সার্বিক বলা হয় তাকেই যা একাধিক জিনিসের মধ্যে থাকে। বিষয়টির সারকথা এ পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছে এই যে, একটি সার্বিক নিজের অস্তিত্বে অস্তিত্বমান হতে পারে না, বরং তা বিশেষ বস্তুগুলোর মধ্যে থাকে।
বাহ্যত অ্যারিস্টটলের তত্ত্বটি বেশ সরল। ধরা যাক আমি বললাম, ফুটবল খেলা বলে একটি ব্যাপার আছে, অধিকাংশ লোক এই মন্তব্যটিকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে মনে করবে। কিন্তু আমি যদি বলতে চাই যে ফুটবল খেলোয়াড়রা না থাকলেও ফুটবল খেলা থাকতে পারে, তাহলে বিলক্ষণ মনে করা হবে যে আমি বাজে বকছি। একই রকমভাবে মনে করা হবে যে, পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব বলে একটি জিনিস আছে, কিন্তু পিতামাতারা আছে বলেই শুধু পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব বলে ব্যাপারটা আছে। মিষ্টতা বলে একটি ব্যাপার আছে, কিন্তু তা আছে শুধুই এই কারণে যে মিষ্টি জিনিস আছে এবং লালিমা বলে একটি জিনিস আছে, কারণ লাল রঙের জিনিসপত্র আছে এবং এই নির্ভরশীলতা পারস্পরিক নয় বলে মনে করা হয়; যেসব লোক ফুটবল খেলে তারা কখনো ফুটবল না খেললেও মানুষই থাকবে। যেসব জিনিস সাধারণত মিষ্টি সেগুলো টক হয়ে যেতে পারে, এবং আমার মুখমণ্ডল-যা সাধারণত লাল-ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে আমার মুখমণ্ডল হিসেবে বিলুপ্ত না হয়েই। এইভাবে আমরা এই উপসংহারের দিকে চালিত হই। যে, একটি বিশেষণ দ্বারা যা বোঝানো হয় তা তার অস্তিত্বের জন্য নির্ভরশীল তারই ওপরে, যা একটি সংজ্ঞাবাচক নাম দ্বারা বোঝানো হয়। উল্টোটা কিন্তু নয়। আমার মনে হয় অ্যারিস্টটল এই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এই বিষয়েও তার তত্ত্বটি হচ্ছে পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে প্রকাশিত একটি সাধারণ জ্ঞান সংস্কার। কিন্তু তত্ত্বটি এত সহজে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা সহজ নয়। ফুটবল খেলোয়াড় না থাকলে ফুটবল খেলা থাকতে পারে না ঠিক, কিন্তু অমুক বা তমুক ফুটবলার না থাকলেও ফুটবল খেলা বিলক্ষণ থাকতে পারে। আবার একজন মানুষ ফুটবল না খেলেও থাকতে পারে একথা ঠিক হলেও সে কিছু একটি না করে থাকতে পারে না। কোনো দ্রব্য ছাড়া লালিমা ধর্মটি থাকতে পারে না, কিন্তু এই বা ওই দ্রব্য ছাড়া থাকতে পারে। একইভাবে একটি বিষয় বা বস্তু কিছু গুণ বা ধর্ম ছাড়া থাকতে পারে না কিন্তু এই বা ওই ধর্ম ছাড়া থাকতে পারে। বস্তু ও বস্তুর ধর্মের মধ্যকার পার্থক্যের যে ভিত্তি ধরে নেওয়া হয় তা এইভাবে ভ্রমাত্মক বলে মনে হয়। আসলে এই পার্থক্যের প্রকৃত ভিত্তিটি ভাষাগত। তা এসেছে বাক্য থেকে। ভাষার মধ্যে আছে স্বকীয় নাম, বিশেষণ এবং সম্পর্কবাচক শব্দাবলি। আমরা বলতে পারি জন জ্ঞানী, জেমস নির্বোধ, জন জেমসের চেয়ে লম্বা। এখানে জন ও জেমস স্বকীয় নাম, জ্ঞানী ও নির্বোধ বিশেষণ আর লম্বা একটি সম্পর্কবাচক শব্দ। অ্যারিস্টটলের পর থেকে অধিবিদ্যকগণ এই বাক্যপ্রকরণগত পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করে এসেছেন অধিবিদ্যাগতভাবে : জন ও জেমস হচ্ছে বস্তুসার, জ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতা হচ্ছে সার্বিক। (সম্পৰ্কবাচক শব্দগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, নয়তো ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে) হতে পারে যে, যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হলে এইসব বাক্যপ্রকরণগত পার্থক্যের সঙ্গে কিছু সম্পর্ক আছে এমন অধিবিদ্যক পার্থক্য পাওয়া যাবে, কিন্তু তা যদি হয় তবে তা হবে শুধু একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যে প্রক্রিয়ায় একটি কৃত্রিম দার্শনিক ভাষা গড়ে উঠবে। এই ভাষায় জন বা জেমস-এই ধরনের কোনো নাম এবং জ্ঞানী বা নির্বোধ-এই ধরনের কোনো বিশেষণ থাকবে না। সাধারণ ভাষার সব শব্দ হবে বিশ্লেষণের অধীন এবং তাদের জায়গা নেবে এমন সব শব্দ যেগুলোর অর্থ অপেক্ষাকৃত কম জটিল। এই কাজটি যত দিন সম্পন্ন না হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত বিশেষ ও সার্বিকের সমস্যাগুলো পর্যাপ্তভাবে আলোচনা করা যাবে না। আর যখন আমরা এমন একটি স্থানে পৌঁছাতে পারব, যেখানে শেষ পর্যন্ত আলোচনা সম্ভব হবে, তখন আমরা দেখতে দেখতে পাব যে, শুরুতে প্রশ্নটি যে রকম হবে বলে আমাদের ধারণা হয়েছিল আসলে সেটি মোটেই সে রকম নয়, খুবই আলাদা।
সুতরাং অ্যারিস্টটলের সার্বিকগুলোর তত্ত্বটি পরিষ্কার করতে আমি যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি, তাহলে (আমি মনে করি) তত্ত্বটাই পরিষ্কার নয়। কিন্তু তা অবশ্যই ভাবতত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি এবং অবশ্যই একটি মৌলিক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত।
অ্যারিস্টটল এবং তার অনুসারী পণ্ডিতদের মধ্যে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে, সেটি হলো সারসত্তা। সারসত্তা কোনোভাবে সার্বিক-এর সমার্থক নয়। আপনার সারসত্তা হচ্ছে আপনি প্রকৃতিগতভাবে যা তাই। বলা যেতে পারে সারসত্তা হচ্ছে আপনার সেই সব বৈশিষ্ট্য, যেগুলো আপনি নিজে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত হারাতে পারেন না। শুধু যে একটি পৃথক বস্তুরই সারসত্তা থাকে তা নয়, একটি প্রজাতিরও তা থাকে। একটি প্রজাতির সারসত্তার মধ্যে থাকে ওই প্রজাতিটির সংজ্ঞা। সারসত্তার ধারণা প্রসঙ্গে আমি আবার ফিরে যাব অ্যারিস্টটলের লজিক আলোচনার সময়। এখনকার মতো আমি শুধু লক্ষ করছি যে এটি একটি জটপাকানো ভাবনা, সুস্পষ্টতার নামগন্ধহীন।
অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যায় পরবর্তী বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে রূপ (form) ও দ্রব্য (matter)-এর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে হবে যে রূপের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত দ্রব্য মনের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত দ্রব্যের বা বস্তুর চেয়ে আলাদা।)
এখানে আবারও অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের জন্য একটি সাধারণ-জ্ঞান ভিত্তি আছে। কিন্তু সার্বিকগুলোর প্রসঙ্গে প্লেটোর সংশোধনীগুলো যতটা গুরুত্বপূর্ণ এখানে তা তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি মার্বেল মূর্তি দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি; এখানে মার্বেল হচ্ছে দ্রব্য আর স্থপতির গড়া আকৃতিটি হচ্ছে রূপ। অথবা, অ্যারিস্টটলের দৃষ্টান্ত নিলে, যদি একজন লোক একটি ব্রঞ্জের গোলক তৈরি করে, তাহলে ব্রঞ্জ হচ্ছে দ্রব্য আর গোলাকৃতি হচ্ছে রূপ; আর শান্ত সমুদ্রের বেলায় পানি হচ্ছে দ্রব্য আর তরঙ্গহীনতা বা মসৃণতা হচ্ছে রূপ। এ পর্যন্ত সবই সরল। তিনি আরো বলছেন, একটি দ্রব্য যে একটি নির্দিষ্ট জিনিস হয়, তা তার রূপের গুণে এবং এটাই হচ্ছে জিনিসটির বসার। অ্যারিস্টটল যা বোঝাতে চাইছেন তা একটি সরল সাধারণ জ্ঞান বলে মনে হয় : একটি জিনিসের অবশ্যই একটি সীমা থাকবে এবং সেই সীমাই তার রূপ গঠন করে। কিছু পরিমাণ পানির কথা ধরা যাক : ওই পানির যেকোনো অংশ অবশিষ্ট অংশ থেকে আলাদাভাবে করা যায় একটি পাত্রে নিয়ে। অন্য একটি পাত্রে ওই পানির একটি অংশকে আলাদাভাবে ধারণ করা হলে তা হয় একটি জিনিস, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা ওই পানির মূল আয়তন থেকে আলাদা করা না হয় ততক্ষণ তা একটি জিনিস হয় না। একটি মূর্তি হচ্ছে একটি জিনিস আর যে মার্বেল দ্বারা গঠিত তার থেকে এক অর্থে আলাদা নয়; কারণ যে মার্বেলের পিণ্ড বা স্তূপ থেকে মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে তা তার একটি অংশ। স্বাভাবিকভাবে আমাদের বলা উচিত হবে না, রূপই কোনো জিনিসকে সারসত্তা দান করে, বরং এটা হয় এই কারণে যে, পারমাণবিক প্রকল্পটি আমাদের কল্পনায় রয়েছে। প্রত্যেক পরমাণু যদি একটি করে জিনিস হয়, তবে তা এই জন্যে যে তা অন্যান্য পরমাণু থেকে আলাদা এবং একটি নিজস্ব সীমানার মধ্যে বিরাজ করতে পারে এবং সেভাবে, কিছু বিবেচনায় তা একটি রূপও বটে।
এবার আমরা আসছি একটি নতুন বক্তব্যে, যা প্রথম দর্শনে কঠিন মনে হয়। বলা হয়, আত্মা দেহের রূপ। এখানে এ কথা পরিষ্কার যে রূপ মানে আকৃতি নয়। কোন বিবেচনায় আত্মা দেহের রূপ এ বিষয়ে পরে আসব; এখনকার মতো আমি খেয়াল করব যে, অ্যারিস্টটলের ব্যবস্থায় আত্মা হচ্ছে তা-ই যা দেহকে একটি জিনিসরূপে সৃষ্টি করে। আত্মার রয়েছে উদ্দেশ্যের ঐক্য এবং রয়েছে সেইসব বৈশিষ্ট্য, যেগুলো আমরা ইংরেজি organism শব্দটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করি। একটি চোখের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেখা, কিন্তু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে চোখটি দেখতে পায় না। প্রকৃতপক্ষে, যে দেখে সে হচ্ছে আত্মা।
তাহলে মনে হতে পারে যে, রূপ হচ্ছে তাই, যা দ্রব্যের একটি অংশকে ঐক্য দান করে এবং এই ঐক্য সর্বদা না হলেও প্রায়ই উদ্দেশ্যবাদী। কিন্তু রূপ আসলে এর চেয়েও আরো অনেক বেশি কিছু এবং এই বেশিটা অত্যন্ত দুর্বোধ্য।
বলা হয়, একটি জিনিসের রূপ হচ্ছে তার সারসত্তা এবং আদিবস্তু। রূপগুলো সারবস্তুময়, যদিও সার্বিকগুলো সারবস্তুময় নয়। একজন লোক যখন একটি পিতলের গোলক তৈরি করে, গোলকটি তৈরি করার আগে থেকেই তার দ্রব্য এবং রূপ উভয়ই আছে, সে যা করে তা হচ্ছে দ্রব্য ও রূপকে সে একত্রিত করে; লোকটি রূপ তৈরি করে না, পিতলও তৈরি করে না। আর সব জিনিসেরই যে দ্রব্য আছে তা নয়, শাশ্বত জিনিসও আছে, শাশ্বত জিনিসগুলোর মধ্যে যেগুলো দেশে সঞ্চরণশীল সেগুলো ছাড়া অন্যগুলোর দ্রব্য নেই। বস্তুজগতে বস্তুনিচয় সংখ্যায় ও পরিমাণে বৃদ্ধি পায় রূপ অর্জনের দ্বারা, রূপহীন দ্রব্য শুধুই একটি সম্ভাবনা মাত্র। দ্রব্য ছাড়াই সারবস্তু থাকতে পারে, আর সারবস্তু ও রূপ একই জিনিস-এই দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটোনিক ভাবগুলোর বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটলের যুক্তিগুলোই প্রদর্শন করেছে বলে মনে হয়। অ্যারিস্টটল বোঝাতে চেয়েছেন রূপ সার্বিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি কিছু। কিন্তু একটি সার্বিকের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে একটি রূপের বৈশিষ্ট্যগুলো সেসবের অনেকগুলোর মতো। বলা হচ্ছে, রূপ দ্রব্যের চেয়ে বেশি বাস্তব; এই উক্তি থেকে ভাবগুলোর অদ্বিতীয় বাস্তবতার কথা আমাদের স্মরণে আসে। মনে হবে, অ্যারিস্টটল প্লেটোর অধিবিদ্যাকে যতটা উপস্থাপন করেছেন পরিবর্তন ততটা করেননি। জেলার (Zeller) এই দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করেছেন; দ্রব্য ও রূপ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন : এই বিষয়ে অ্যারিস্টটলের স্বচ্ছতার অভাবের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এই ঘটনার মধ্যে, তিনি যেমনটি আমরা দেখতে পাব, প্লেটোর ভাবগুলোকে বন্ধুত্ব দান করার প্রবণতা থেকে নিজেকে শুধু অর্ধেক মুক্ত করেছেন। প্লেটোর কাছে ভাবগুলো যা, অ্যারিস্টটালের কাছে রূপগুলো তাই। প্লেটো তার ভাবগুলোকে সব আলাদা আলাদা বস্তুর ক্ষেত্রে একটি নিজস্ব অধিবিদ্যক অস্তি তৃরূপে দেখেছেন। এবং অ্যারিস্টটল যত তীক্ষ্ণভাবেই অভিজ্ঞতা থেকে ভাবের বিকাশ খেয়াল করুন না কেন, তথাপি এ কথা সত্য যে, বিশেষত যেখানে সেগুলো অভিজ্ঞতা ও সরাসরি প্রত্যক্ষণ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী, সেখানেও শেষ পর্যন্ত এইসব ভাব মানুষের চিন্তার যৌক্তিক ফসল থেকে রূপান্তরিত হয় একটি অতীন্দ্রিয় জগতের প্রত্যক্ষ উপস্থাপনায় এবং সে অর্থে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংজ্ঞার বিষয়বস্তুতে।
এই সমালোচনার কোনো উত্তর অ্যারিস্টটল কীভাবে খুঁজে পেতেন তা আমি দেখতে পাচ্ছি না। একমাত্র যে উত্তরটি আমি কল্পনা করতে পারছি তা হচ্ছে এই, কোনো দুটি বস্তুর একই রূপ থাকতে পারে না। একজন মানুষ যদি দুটি পিতলের গোলক তৈরি করে, (আমাদের বলতে হবে) তাহলে ওই দুটি গোলকের প্রত্যেকটির নিজস্ব গোলাকৃতি থাকবে, যা সারবস্তুময় এবং বিশেষ, যা সার্বিক গোলাকৃতির দৃষ্টান্ত, কিন্তু তার সমরূপ নয়, বা তা থেকে অভিন্ন নয়। আমার মনে হয় না আমার উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটির ভাষা এই ব্যাখ্যা ভালোভাবে সমর্থন করবে। এবং এমন প্রতিবাদের সুযোগ থেকে যাবে যে অ্যারিস্টটলের মতে, বিশেষ গোলাকৃতিটি হবে অজেয় কিন্তু তার অধিবিদ্যার সারকথাই হচ্ছে এই যে, রূপ যত বেশি হবে এবং দ্রব্য যত কম হবে, বস্তু ক্রমশই তত বেশি জ্ঞেয় বা জানার যোগ্য হবে। অনেকগুলো বিশেষ বস্তুতে রূপ যদি মূর্ত না হয়, তাহলে অ্যারিস্টটলের এই মতটি তার অবশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। যদি তিনি বলতেন যে, যতগুলো গোলাকার বস্তু আছে গোলাকৃতির দৃষ্টান্ত হিসেবে ঠিক ততগুলোই রূপ আছে-তাহলে তাকে তার দর্শনে অত্যন্ত মৌলিক কতকগুলো পরিবর্তন সাধন করতে হতো। যেমন-একটি রূপ তার সারসত্তার সমরূপ-এই দৃষ্টিকোণটি উপরে প্রস্তাবিত উত্তরটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অ্যারিস্টটলের দ্রব্য ও রূপের মতবাদটি সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। নিরেট দ্রব্যকে ধরা হয়েছে রূপের একটি সম্ভাব্যতা হিসেবে; সব পরিবর্তনকে বলতে হবে বিকাশ। এই অর্থে বিকাশ যে, পরিবর্তনের পর আলোচ্য বস্তুটি আগের চেয়ে বেশি রূপ পেয়েছে। যার অধিক রূপ আছে তা বিবেচিত হবে অধিকতর বাস্তব হিসেবে। ঈশ্বর হলেন বিশুদ্ধ রূপ এবং বিশুদ্ধ বাস্তবতা; সুতরাং তার কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। দেখা যাবে যে, এই মতবাদটি শুভবাদী এবং উদ্দেশ্যবাদী : বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং তার সব কিছু অবিরামভাবে এমন কিছুর দিকে বিকশিত হচ্ছে যা আগের চেয়ে ভালো। কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতার ধারণাটি সুবিধাজনক, তবে শর্ত এই যে তা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন আমরা আমাদের বিবৃতিগুলো এমন একটি রূপে রূপান্তরিত করতে পারি যেরূপে ধারণাটি অনুপস্থিত থাকবে। এক খণ্ড মার্বেল একটি সম্ভাব্য মূর্তি-এই কথার অর্থ হলো এক খণ্ড মার্বেল থেকে যথাযথ কর্ম দ্বারা একটি মূর্তি তৈরি হয়। কিন্তু সম্ভাব্যতা যখন একটি মৌলিক ও ন্যূনতম ধারণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন তাতে সর্বদাই চিন্তার বিভ্রান্তি লুকানো থাকে। সম্ভাব্যতার ধারণাটির অ্যারিস্টটলীয় ব্যবহার তার পদ্ধতির খারাপ পয়েন্টগুলোর একটি। অ্যারিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব আকর্ষণীয় এবং তার অধিবিদ্যার বাকি অংশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত-অবশ্য আমরা যাকে অধিবিদ্যা বলি অ্যারিস্টটল তারই একটি নাম হিসেবে ধর্মতত্ত্ব ব্যবহার করতেন। (থিওলজি নামে তার যে বইটির কথা আমরা জানি, সেটির সে রকম নাম তিনি দেননি)।
অ্যারিস্টটল বলেন, তিন রকমের বস্তুসার আছে। এক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও ধ্বংসযোগ্য। দুই. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিন্তু ধ্বংসযোগ্য নয় এবং তিনইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়, ধ্বংসযোগ্যও নয়। প্রথম শ্রেণির মধ্যে পড়ে গাছপালা ও পশুপাখি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে জ্যোতিষ্কগুলো (heavenly bodies) (অ্যারিস্টটল মনে করতেন গতির পরিবর্তন ছাড়া এদের আর কোনো পরিবর্তন নেই); তৃতীয় শ্রেণিতে হলো মানুষের যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন। আত্মা এবং ঈশ্বর।
ঈশ্বরের পক্ষে প্রধান যুক্তিটি হলো আদি কারণ : গতির মূলে অবশ্যই একটি কিছু আছে এবং এই একটি কিছু নিজে অবশ্যই অনড়, গতিহীন এবং তা অবশ্যই শাশ্বত, বস্তুসার এবং বাস্তবতা। অ্যারিস্টটল বলছেন, আকাঙ্ক্ষার বিষয়বস্তু এবং চিন্তার বিষয়বস্তু এই উপায়ে নিজেরা গতিশীল না হয়ে হয় গতির কারণ। এভাবে ঈশ্বর পূজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গতির সঞ্চার করেন, আর গতির অন্য সকল প্রকার কারণ কার্যকর হয় নিজেরা গতিশীল হবার দ্বারা (বিলিয়ার্ড বলের মতো)। ঈশ্বর হলেন বিশুদ্ধ চিন্তা; কারণ চিন্তা হলো তাই যা সর্বোত্তম। প্রাণও ঈশ্বরের অন্তর্গত, কারণ চিন্তার বাস্তবতা হলো প্রাণ ও ঈশ্বর হলেন সেই বাস্তবতা এবং ঈশ্বরের স্বনির্ভর বাস্তবতাই হলো সর্বোত্তম ও সবচেয়ে শাশ্বত প্রাণ। তাই আমরা বলে থাকি যে ঈশ্বর একটি জীবন্ত সত্তা, শাশ্বত ও সর্বোত্তম; তাই জীবন ও স্থায়িত্ব অব্যাহত থাকে এবং শাশ্বত ঈশ্বরের অন্তর্গত হয়, কারণ এই-ই হলেন ঈশ্বর। তাহলে যা বলা হলো, তা থেকে এটা পরিষ্কার, একটি বস্তুসার আছে যা শাশ্বত, অনড় এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন, আলাদা। দেখানো হয়েছে যে এই বস্তুসারের কোনো বিস্তার থাকতে পারে না, তার অংশ নেই এবং অংশে অংশে তা বিভাজ্য নয়…কিন্তু আবার এও দেখানো হয়েছে, তা নির্বিকার এবং অপরিবর্তনীয়; কেননা অন্য সব রকম পরিবর্তন স্থান পরিবর্তনের পশ্চাত্বর্তী।
ক্রিস্টধর্মের বিধাতার গুণাবলি ঈশ্বরের নেই : কারণ ঈশ্বর উৎকৃষ্টতম, তার উৎকর্ষ ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবা হলে তার উৎকর্ষের হানি হয়। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে ঐশ্বরিক চিন্তন চিন্তা করে (কেননা তা বস্তুগুলোর মধ্যে উৎকৃষ্টতম) এবং তার চিন্তা হলো একটি চিন্তনের চিন্তা। আমাদের অনুমান করতে হবে, ঈশ্বর আমাদের ইহলৌকিক জগতের অস্তিত্বের কথা জানেন না। স্পিনোজার মতো অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, মানুষ যখন ঈশ্বরকে ভালোবাসে তখন এটা অসম্ভব যে ঈশ্বর মানুষকে ভালোবাসবেন।
অনড় চালকশক্তি হিসেবে ঈশ্বর সংজ্ঞাযোগ্য বা নির্ণয়যোগ্য নন। উল্টো, জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিবেচনাগুলো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ৪৭টি বা ৫৫টি অনড় চালকশক্তি আছে। ঈশ্বরের সঙ্গে এদের সম্পর্কটা পরিষ্কার করা হয়নি; অবশ্য স্বাভাবিক ব্যাখ্যাটি হবে এ রকম যে, ৪৭ বা ৫৫ জন দেবতা আছেন। কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে উপরের উদ্ধতিগুলোর কোনো একটির পর অ্যারিস্টটল বলেন : এ রকম বস্তুসার একটিই নয় একাধিক রয়েছে, এই প্রশ্নটি আমাদের উপেক্ষা করা চলবে না। সেই সঙ্গে সেই তর্ক শুরু করেছেন যা ৪৭ বা ৫৫টি অনড় চালকশক্তিতে গিয়ে ঠেকেছে।
অনড় চালকশক্তির ধারণাটি জটিল ও কঠিন। একজন আধুনিক মনের মানুষের কাছে মনে হবে যে একটি পরিবর্তনের কারণ নিশ্চয়ই পূর্ববর্তী একটি পরিবর্তন এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যদি কখনো সম্পূর্ণ স্থির হতো, তবে তা অনন্তকাল ধরে স্থিরই থাকত। অ্যারিস্টটল যা বোঝাতে চেয়েছেন তা বুঝতে হলে আমাদের বিবেচনা করতে হবে তিনি কারণগুলো সম্পর্কে কী বলেছেন। তার মতে, কারণ চার ধরনের। যথা-বস্তুগত কারণ, রূপগত কারণ, কার্যকর কারণ এবং চূড়ান্ত কারণ। দৃষ্টান্ত হিসেবে মূর্তি বানাচ্ছে এমন একজন মানুষকে নেওয়া যাক। মূর্তিটির বস্তুগত কারণ হলো মার্বেল, রূপগত কারণ হলো মূর্তিটির সারসত্তা, কার্যকর কারণটি হলো মার্বেলের সঙ্গে ওই লোকের বাটালির সম্পর্ক এবং চূড়ান্ত কারণটি হলো ভাস্করের মনে যে লক্ষ্যটি আছে তাই। আধুনিক পরিভাষায় কারণ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে কার্যকর কারণের মধ্যে। অনড় চালকশক্তি একটি চূড়ান্ত কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে : সে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যের যোগান দেয়, যে পরিবর্তন ঈশ্বরের সমধর্মিতার দিকে অনিবার্যভাবেই একটি বিকাশ।
আমি বলেছি যে অ্যারিস্টটল মেজাজের দিক থেকে গভীরভাবে ধার্মিক ছিলেন না, কিন্তু আমার এ কথা শুধু আংশিকভাবে সত্য। হয়তো কেউ তার ধর্মের একটি দিক কিছুটা স্বাধীনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, যেমন-ঈশ্বর অনন্তকাল ধরে আছেন এবং থাকবেন : বিশুদ্ধ চিন্তারূপে বিশুদ্ধ সুখরূপে, পরিপূর্ণ আত্মসম্পূর্ণরূপে; তার কোনো উদ্দেশ্য অবাস্তবায়িত নয়। অন্যদিকে ইন্দ্রিয়জগৎ অপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু তার প্রাণ আছে, অভিলাষ আছে, অসম্পূর্ণ ধরনের চিন্তা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে। সকল জীবন্ত বস্তু কমবেশি ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন এবং ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা থেকে তারা ক্রিয়াশীল হয়। এভাবে, ঈশ্বর সব কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত কারণ। পরিবর্তন হচ্ছে দ্রব্যকে রূপ দেওয়ার মধ্যে, কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর বেলায় দ্রব্যের একটি অধঃস্তর সব সময়ই থেকে যায়। শুধু ঈশ্বরই দ্রব্য ছাড়া রূপ লাভ করেন। ব্রহ্মাণ্ড অবিরত রূপের একটি উন্নততর মাত্রার দিকে বিকশিত হচ্ছে এবং এইভাবে ক্রমশ ঈশ্বরের মতো হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে পারে না, কারণ দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বিনাশ হতে পারে না। এটি অগ্রগতি ও বিকাশের একটি ধর্ম, কারণ ঈশ্বরের অটল ও স্থির উৎকর্ষ জগৎকে গতিশীল করে শুধু তার প্রতি সসীম সত্তাগুলোর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। প্লেটো ছিলেন গাণিতিক, অ্যারিস্টটল জীববৈজ্ঞানিক; এখানেই তাদের ধর্মের মধ্যকার পার্থক্য। অ্যারিস্টটলের ধর্ম সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি হবে একপেশে। স্থির উৎকর্ষের প্রতি গ্রিকদের যে আকর্ষণ, অ্যারিস্টটালের তাও ছিল এবং তিনি কর্মের চেয়ে ধ্যান বেশি পছন্দ করতেন। আত্মা সম্পর্কে তার মতবাদে তার দর্শনের এই দিকটি ফুটে ওঠে।
অ্যারিস্টটল কোনো রকমের অমরত্বের শিক্ষা দিয়েছিলেন কি না-এটা আলোচকদের মধ্যে একটি দুরূহ সমস্যা ছিল। আভেরস (Averros, ইবনে রুশদ) মনে করতেন অ্যারিস্টটল তা করেননি। খ্রিস্টান দেশগুলোতে অ্যাভেরসের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে চরমপন্থীদের বলা হতো এপিকুরিয়ান, দান্তে যাদের নরকে দেখতে পান। আসলে অ্যারিস্টটলের মতবাদ জটিল এবং সহজেই ভুল ব্যাখ্যার শিকার হতে পারে। অ্যারিস্টটল তার আত্মা সম্পর্কে গ্রন্থে আত্মাকে দেখেছেন দেহের সঙ্গে একত্রে বাঁধা এবং তিনি পিথাগোরীয় দেহান্তরের তত্ত্বকে তিরস্কার করেছেন। তার কথা থেকে মনে হয়, দেহের সঙ্গে আত্মারও বিনাশ ঘটে। তিনি বলছেন : নিঃসংশয়ে বলা যায় যে আত্মা দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য। আবার তাৎক্ষণিকভাবে যোগ করছেন : বা, যাই হোক না কেন, আত্মার কিছু অংশ (দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য)।
দেহ ও আত্মার সম্পর্ক দ্রব্য ও রূপের সম্পর্কের মতো। অ্যারিস্টটল বলছেন : সুপ্তভাবে প্রাণসম্পন্ন একটি দেহের রূপ অর্থে আত্মা অবশ্যই একটি বস্তুসার। কিন্তু বস্তুসার হলো বাস্তবতা, এভাবে আত্মা একটি দেহের বাস্তবতা (যে রকম দেহের বৈশিষ্ট্যের কথা উপরে বলা হয়েছে)। আত্মা হলো বস্তুসার। এই অর্থে যে, তা একটি বস্তুর সারসত্তার সূত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থাৎ আত্মা হলো প্রাণসম্পন্ন দেহের সার প্রশ্ন। যে প্রাকৃতিক দেহের ভেতরে প্রাণ নিহিত আছে তার বাস্তবতার প্রথম ধাপ হলো আত্মা। এভাবে বর্ণিত দেহ হলো এক সংগঠিত দেহ। আত্মা ও দেহ এক কি না এই প্রশ্ন এমন প্রশ্ন করার মতোই অর্থহীন হবে যে ছাঁচে ঢালা একটি মোমমূর্তি আর ওই ছাঁচ থেকে গঠিত আকৃতিটি এক কি না। উদ্ভিদের রয়েছে শুধু একটি আত্মিক ক্ষমতা, তা হলো আত্মপুষ্টিসাধন। আত্মা দেহের চূড়ান্ত হেতু। এ বইতে তিনি আত্মা ও মন পৃথক করে দেখেছেন। মনকে স্থান দিয়েছেন আত্মার উপরে এবং বলছেন যে, মন দেহের সঙ্গে আত্মার মতো ততটা বাধা নয়। আত্মা ও দেহের মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে বলার পর তিনি বলেছেন : মনের ব্যাপারটা আলাদা; মনে হয় মন আত্মার ভেতরে প্রোথিত একটি স্বাধীন বস্তুসার, মন ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হবার বৈশিষ্ট্য তার নেই। আবার তিনি বলছেন : মন সম্পর্কে বা চিন্তা করার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ নেই। মনে হয়, মন আত্মা থেকে খুবই ভিন্ন রকমের একটি কিছু-শাশ্বত ও ধ্বংসযোগ্য দুটি জিনিসের মধ্যকার পার্থক্যের মতো; সব ধরনের আত্মিক শক্তি থেকে আলাদাভাবে বিরাজ করার ক্ষমতা রয়েছে শুধু মনেরই। যা কিছু বলা হয়েছে তা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, বিপক্ষে যত কিছুই বলা হোক না কেন, সব সত্ত্বেও মন ছাড়া আত্মার অন্য কোনো অংশেরই বিচ্ছিন্নভাবে অস্তিত্বমান থাকার ক্ষমতা নেই। মন হলো আমাদের সেই অংশ যা গণিত ও দর্শন বুঝতে পারে, মনের লক্ষ্যগুলো সময়হীন এবং সে কারণেই মন নিজেও সময়হীন বলে বিবেচিত। আত্মা হলো তা-ই যা দেহকে চালিত করে এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলো প্রত্যক্ষণ করে। আত্মার বৈশিষ্ট্য হলো আত্মপুষ্টি, ইন্দ্রিয়বোধ, অনুভূতি ও অভিপ্রায়; কিন্তু মনের রয়েছে চিন্ত শীলতার উচ্চতর কাজ, যার কোনো সম্পর্ক নেই দেহ বা ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে। এখান থেকেই মন হতে পারে অবিনশ্বর, যদিও আত্মার অবশিষ্ট অংশ তা হতে পারে না।
আত্মা সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মতবাদ বুঝতে হলে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আত্মা হলো দেহের রূপ এবং মনে রাখতে হবে যে, স্থানিক আকৃতি হলো এক ধরনের রূপ। আত্মা ও আকৃতির মধ্যে সাধারণ কী রয়েছে? আমার মনে হয় এই দুয়ের মধ্যে যা সাধারণ তা হলো দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিছু পরিমাণ মার্বেল থেকে একটি খণ্ড আলাদা করে নিয়ে একটি মূর্তি তৈরি না করা পর্যন্ত সমগ্র মার্বেলের ওই অংশটুকু কোনো জিনিস হয়ে ওঠে না এবং সে কারণেই তখন পর্যন্ত তার কোনো ঐক্য হয় না। ভাস্কর যখন মার্বেল খণ্ডটিকে একটি মূর্তির রূপ দেন শুধু তারপরই তার একটি ঐক্য তৈরি হয়, যা মূর্তিটি পায় তার আকৃতি থেকে। এখন আত্মার সারগত চেহারা-যার গুণে তার দেহের রূপ-হলো এই যে, তা দেহকে একটি আঙ্গিক সমগ্রতা দান করে, যার লক্ষ্যগুলো একেকটা একক। একটি একক অঙ্গের লক্ষ্য থাকে তার নিজের বাইরে; যেমন, চোখ বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে পায় না। এভাবে অনেক কথা বলা যায়, যার মধ্যে একটি প্রাণী বা একটি উদ্ভিদ সামগ্রিক বিষয়, ওই প্রাণী বা ওই উদ্ভিদের কোনো দেহাংশ সম্পর্কে ওই কথাগুলো বলা যায় না। এটা এই অর্থে যে, সংগঠন বা রূপ বস্তুসারত্ব দান করে। একটি উদ্ভিদ বা একটি প্রাণীর উপরে যা বস্তুসারত্ব আরোপ করে সেটাকেই অ্যারিস্টটল আত্মা বলছেন। কিন্তু মন ভিন্ন। ধরনের একটি কিছু দেহের সঙ্গে যা অপেক্ষাকৃত কম নিবিড়ভাবে যুক্ত। হতে পারে যে মন আত্মার একটি অংশ, কিন্তু জীবজগতের শুধু একটি সামান্য অংশই মনের অধিকারী। চিন্তন হিসেবে মন গতির কারণ হতে পারে না, কারণ তা কখনো প্রয়োগযোগ্য কিছু সম্পর্কে চিন্তা করে না এবং মন কখনো বলে না কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়।
একই ধরনের একটি মতবাদ পরিভাষায় সামান্য রদবদলসহ উপস্থাপিত হয়েছে অ্যারিস্টটলের নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স গ্রন্থে। আত্মার একটি উপাদান আছে, যা যৌক্তিক এবং আরেকটি উপাদান আছে, যা অযৌক্তিক। অযৌক্তিক অংশটি দ্বিমুখী : একটি হলো বোধশক্তিহীন, যা প্রাণসম্পন্ন সব বস্তু, এমনকি উদ্ভিদের মধ্যেও থাকে। আরেকটা হলো জৈব আকাঙ্ক্ষামূলক, যা সব প্রাণীতে থাকে। যৌক্তিক আত্মার প্রাণ চিন্তা ও ধ্যানের মধ্যে, চিন্তা বা ধ্যান হলো মানুষের পরিপূর্ণ সুখ, যদিও এই সুখ পরিপূর্ণরূপে অর্জন করা যায় না। এ রকম জীবন মানুষের পক্ষে হবে অতি উচ্চ একটি ব্যাপার; কারণ এ রকম জীবনযাপন করে বলেই সে মানুষ, এমনটি নয়। বরং ঐশ্বরিক কিছু তার মধ্যে আছে বলে সে মানুষ এবং আমাদের যৌগিক প্রকৃতির চেয়ে তা যতটা বড় হবে, অন্যান্য সদগুণের (ব্যবহারিক ধরনের) চর্চার চেয়ে সে-জীবনের কর্মও তত বড় হবে। মানুষের সঙ্গে তুলনায় বুদ্ধি যদি হয় ঐশ্বরিক, তাহলে বুদ্ধি বা যুক্তি দ্বারা পরিচালিত জীবন হবে মানবজীবনের তুলনায় ঐশ্বরিক। কিন্তু যারা নিজেরা মানুষ হয়ে মানুষের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে বলে এবং নশ্বর হয়ে নশ্বর জিনিসপত্রের কথা ভাবতে বলে, তাদের কথা আমাদের শোনা উচিত নয়। বরং আমাদের উচিত, যতটা পারি নিজেদের অবিনশ্বর করা এবং আমাদের ভেতরে সর্বোত্তম গুণাবলি অনুযায়ী জীবনযাপন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা; কেননা জীবন আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও প্রচুর শক্তিধর এবং তা সবকিছুকে অতিক্রম করার সামর্থ্য রাখে।
উপরের পরিচ্ছেদ কটি থেকে মনে হয়, এক মানুষ অন্য মানুষ থেকে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র দ্বারা আলাদাভাবে চিহ্নিত হয় তা দেহ ও অযৌক্তিক আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত; আর যৌক্তিক আত্মা বা মন হলো ঐশ্বরিক এবং নৈর্ব্যক্তিক। একজন লোক পছন্দ করে ঝিনুক, আরেকজন পছন্দ করে আনারস; এতে দুজনের মধ্যে পার্থক্য ফুটে ওঠে। কিন্তু যদি তারা গুণের নামতা সম্পর্কে চিন্তা করে এবং সঠিকভাবে চিন্তা করে, তাহলে তাদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অযৌক্তিক আত্মা আমাদের আলাদা করে, যৌক্তিক আত্মা আমাদের একত্রিত করে। এভাবে মনের বা বুদ্ধির অমরতা আলাদা আলাদা অমরতা নয়, বরং তা ঈশ্বরের অমরতার একটি অংশ। যে অর্থে প্লেটো এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্ম ব্যক্তির অমরতার কথা বলে সে অর্থে অ্যারিস্টটল ব্যক্তির অমরতায় বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। অ্যারিস্টটল শুধু মনে করতেন যে যুক্তিবুদ্ধিবাদী মানুষ ঐশ্বরিকতার অংশ, আর ঈশ্বর অমর। মানুষ তার স্বভাবের ঐশ্বরিক উপাদানগুলো বাড়াতে পারে এবং সেটা করাই হলো সর্বোচ্চ সদগুণ। কিন্তু যদি সে তা করতে সম্পূর্ণভাবে সফল হয় তাহলে সে আর আলাদা ব্যক্তি থাকবে না। বোধ করি অ্যারিস্টটলের কথাগুলোর সম্ভবপর একমাত্র ব্যাখ্যা এটাই নয়, কিন্তু আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাখ্যা।