ছুটি একটা চিঠি লিখেছিল কোলকাতা থেকে।
ও কবে কোলকাতা গেছিল জানি না, তবে চিঠিটা পড়ে মনে হল, ও কোলকাতা যাবার আগে আমার এখান থেকে লেখা শেষ চিঠিটা পায় নি।
ছুটি লিখেছিল, আগামী শুক্রবার আমি কোলকাতা থেকে সোজা আপনার ওখানে যাব। বৃহস্পতিবার রাতে ডুন-এক্সপ্রেসে রওয়ানা হব–গোমো-বাড়কাকানা হয়ে আপনার ওখানে পৌঁছব। আমাকে নিতে স্টেশনে আসবেন। ট্রেন যতই লেট থাকুক, আপনি আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। দুজনে বাড়ি ফিরে একসঙ্গে খাব।
আপনাকে অনেক দিন দেখি না। খুব ইচ্ছা করে আপনার মুখোমুখি বসে গল্প করতে অনেক অনেকক্ষণ।
আপনি কেমন আছেন? আমি চমৎকার আছি। আপনি ত জানেন যে, আমি সব সময়ই চমৎকার থাকি। জীবন সম্বন্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই–আমি জীবনে যা-যা চেয়েছি তেমন করে, সবই পেয়েছি। না-পাওয়ার জ্বালা বা ব্যর্থতা কি তা আমি কখনও জানিনি; জানতে চাইও না।
দেখা হলে কথা হবে। আপনাকে বলার জন্যে অনেক গল্প জমা করে রেখেছি। আমার প্রণাম জানবেন। ইতি আপনার ছুটি।
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই শৈলেন এসেছিল।
এ শৈলেনের সঙ্গে আগের শৈলেনের কোনো মিল ছিল না।
শৈলেন যা বলল তাতে আমার মেয়েদের সম্বন্ধে ধারণাটা নতুন করে বিবেচনা করার ইচ্ছা হয়েছিল। মনে হয়েছিল, প্যাটই বোধ হয় আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। যেহেতু প্যাট মেয়েদের ঘৃণা করে।
নয়নতারা এখানে এসেছে আবার। ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে একজন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে। সেই পোস্টমাস্টারের নতুন চাকরী হয়েছে বাড়কাকানা এবং ডালটনগঞ্জের মধ্যবর্তী কোনো স্থানে। চাকরী হয়েছে তবে এখনও পোস্টিং পায় নি।
নয়নতারা এখানে আবার এসেছে শুধু শৈলেনের অবস্থাটা কি তা রসিয়ে দেখবার জন্যে। নয়নতারা যেসব চিঠি শৈলেনকে লিখেছিল, সেগুলো নাকি নয়নতারার নিজের লেখা নয়। অন্য কাউকে দিয়ে নেহাৎ শৈলেনের সঙ্গে মজা করবার জন্যেই ও চিঠিগুলো লিখিয়েছিল। এখানে এসে ওর আত্মীয়স্বজন এবং বিশেষ করে ওর সমবয়সী একজন আত্মীয়ার সঙ্গে এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছে।
শৈলেনের ব্যাপারটা এখন এখানেই সকলেরই জানা হয়ে গেছে। সকলেই শৈলেনকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করছে।
শৈলেনকে দেখে আমার খুব কষ্ট হল।
যে কাউকে জীবনে তেমন করে ভালোবেসেছে এবং ভালোবেসে ভালোবাসার জনকে পায় নি, একমাত্র সেই-ই জানে সেই ব্যর্থতার গ্লানি ও কষ্ট কি এবং কতখানি। শৈলেনকে কেউ বোঝে নি বরং না বুঝে অত্যন্ত স্থূলতার সঙ্গে তার পরম ব্যথার জায়গায় সকলেই নির্দয়ের মত হাত ছুঁইয়েছে এবং ওকে ব্যথা দিয়ে এক মোটা প্রাকৃত আনন্দ পেয়েছে।
শৈলেন বলল, দাদা, আমি ত ওর কোনো ক্ষতি করিনি, তবু কেন ও এমন করল আমার সঙ্গে? কারুর কাউকে ভালোলাগা কি অন্যায়? ভালোলাগা কি দোষের? ওর যদি আমাকে এমন অপছন্দই ছিল, ও ত প্রথমেই বলতে পারত আমাকে। যে কোনো মেয়েই ত বিয়ের আগে অথবা পরে এমন অনেকের স্তুতি কুড়োয়, কুড়োতে পারে–এই স্তুতি পাওয়া এবং গ্রহণ করা ত মেয়েদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু ও আমার সঙ্গে এই খেলা কেন খেলল, আমাকে ওর কাছে এবং সকলের কাছে এমন হেয় করল কেন বলতে পারেন? আমার মধ্যে কি ভালোবাসা পাবার মত কিছুই নেই?
আমি ওকে চা-টা খাইয়ে বুঝিয়ে বলেছিলাম, পাগলামি কোরো না। এরকম একজন বাজে মেয়েকে তুমি সত্যিকারের ভালোবাসনি এবং বিয়ে করে ফেল নি, এ তোমার সৌভাগ্য।
এসব মেয়ে সাংঘাতিক। এদের সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখাই তোমার উচিত নয়। বুঝলে শৈলেন, এরকম নয়নতারা তোমার জীবনে অনেক আসবে। তোমার উচিত, নয়নতারাকে দেখিয়ে তার সামনে তার চেয়ে অনেক ভালো মেয়েকে বিয়ে করা। কোনো দিক দিয়েই যে তুমি তার অযোগ্য নও, ও তোমাকে পরিহাস করে যে ওর নিজের সমস্ত জীবন একটা শূন্য প্রচণ্ড পরিহাসে নিজেকেই ডুবিয়ে দিয়েছে ও তা জানুক। এমনি করেই এ-সব সস্তা মেয়ের উপর প্রতিশোধ নিতে হয়। ও বাজে বলে তুমি নিজেকে বাজে ভাববে কেন?
শৈলেন বলেছিল, না, দাদা। আমি অনেক ভেবেছি, আমি তা পরব না। আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি দাদা, আমি ত ওর সঙ্গে খেলা করিনি। আমার মনে যতটুকু ভালোত্ব ও ভালোবাসা ছিল তার সবই যে আমি ওকেই, একমাত্র ওকেই দিয়ে দিয়েছি। দাদা, কি মনে হয় জানেন, ভালোবাসা হচ্ছে তীরের মত। তৃণ থেকে বেরিয়ে চলে গেলে সে চলেই যায়, তার লক্ষ্যকে বিধতে পারে কি না পারে তা সেই তীরন্দাজের কপাল। কিন্তু ভালোবাসা ত পোষা কুকুর নয়, যে তাকে তুতু করে ডাকতেই আবার সে ফিরে আসবে।
আমি একেবারে গরীব হয়ে গেছি দাদা, আমার মনের মধ্যে দামী যা কিছু ছিল সব যে আমি ওকে দিয়ে ফেলেছি।
আমি বললাম, তোমার উচিত ওর সঙ্গে দেখা করা, দেখা করে সব খুলে বলা, ওকে বলা যে, তুমি মনে মনে কতখানি এগিয়ে গেছ ওর দিকে। বলে দেখ, ও কি বলে।
শৈলেন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর মুখ নীচু করে বলল, দেখা করেছিলাম।
ও ত প্রথমে দেখাই করতে চাইল না। তারপর অনেকক্ষণ পর বাইরে এল। ও দারুণ সেজেছিল। চুলে ফুল গুঁজেছিল। ওকে দারুণ দেখাচ্ছিল। ও এসে বলল, বলুন আপনার বলার কি আছে।
ওকে দেখে কি মনে হল জানেন? মনে হল আমি ওদের বাড়িতে পাড়ার বকা-ছোকরাদের হয়ে সরস্বতী পূজোর চাঁদা চাইতে গেছি। আর ও হাত নেড়ে হবে না হবে না বলছে।
আমি বললাম, আমি কিছু বলতে আসিনি। আমার যা বলার আপনি ত তা জানেন, আপনার কিছু বলার আছে কিনা তাই শুনতে এসেছি।
নয়ন বলল, আমার কিছু বলার নেই। তবে এইটুকুই বলব যে, আপনার লজ্জা বা মান-সম্মান থাকলে আপনি আমাকে বাড়ি অবধি ধাওয়া করতেন না।
বলেই, ও উঠে চলে গেছিল।
আমি কিছু বলিনি জবাবে।
ওর আত্মীয়–যাঁর বাড়িতে ও এসেছে, তিনি নীচু গলায় বললেন, শৈলেন, কিছু মনে কোরো না। আমি ব্যাপারটার জন্যে খুব লজ্জিত এবং দুঃখিতও। তোমাকে আমি জানি, চিনি। তোমার সঙ্গে এই নোংরা খেলা খেলবার ওর কোনো দরকার ছিলো না। যার সঙ্গে ওর বিয়ে হচ্ছে তাকে আমি চিনি–সে বিয়েও পিরীতের বিয়ে-তবে ছেলেটি একটি বাঁদর। নয়নতারা তাকে কি দেখে ভালোবাসল জানি না। আমাকে যদি জিজ্ঞেস কর ত বলব, তোমার সঙ্গে ওর বিয়ে হলে ও অনেক বেশি সুখী হত এবং আমি নিজেও খুব খুশি হতাম। কিন্তু অল্পবয়সী মেয়েরা, বিশেষ করে তারা যদি সুন্দরী হয়, তারা মনে করে তারা যা বুঝছে তা আর কেউই বোঝে না। তুমি কিছু মনে কোরো না। আমার এখানে নয়নতারা না এলে ত এ ব্যাপারটা ঘটত না, তাই আমার নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। তোমার কাছে নয়নতারার হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমি চলে এসেছিলাম। এরপর আর ত কোনো কথা বলার নেই দাদা, আর কিছু বলার কোনো মানে নেই।
আমি শৈলেনকে বললাম, তাহলে আর কি করবে? মানিয়ে নাও। নিজেকে বোঝাও। এ নিয়ে মন খারাপ কোরো না।
শৈলেন অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল, তারপর চকিতে বলল, আপনার কাছে অন্য কিছু শুনব বলে আশা করে এসেছিলাম।
আমিও অনেকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে বললাম, আমার যে এ ছাড়া অন্য কিছু বলার নেই শৈলেন।
ও বলল, তাহলে আপনি আমাকে এখন কি করতে বলেন?
আমি বললাম, যা তোমাকে এক্ষুনি বললাম।
শৈলেন হঠাৎ দু হাত মুখের সামনে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
আমি ওর ঐ কান্নায় কোনো বাধা দিলাম না। কোনো কথা বললাম না। চুপ করে থেকে ওকে কাঁদতে দিলাম।
শৈলেন অনেকক্ষণ বাচ্চা ছেলের মত কাঁদল। তারপর লজ্জা পেয়ে জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছল, জল-ভেজা চোখে বলল, আপনি আমাকে দেখে হাসছেন, না?
বললাম, হাসব কেন শৈলেন? হয়ত সঙ্গে আমিও কাঁদছি–তবে সে কান্না তুমি দেখতে পাচ্ছ না, এই যা। কথাটা কি জান শৈলেন, জীবনে অনেককেই এমন কতগুলো সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় যে-সব সঙ্কটে অন্য কেউই তোমাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারে না। তোমার কষ্ট দেখতে পারে, মনে মনে তোমার প্রতি সমবেদনা জানাতে পারে, কিন্তু সাহায্য করতে পারে না। এই সঙ্কট থেকে পেরুতে যা করবার তা তোমাকেই করতে হবে। একা একা তোমাকে। আমরা কেউই কোনো কাজে লাগব না।
শৈলেন মুখ তুলে বলল, আমাকেই করতে হবে? একা একা?
আমি বললাম, হ্যাঁ। একা একা।
হঠাৎ শৈলেন উঠে পড়ল, বলল, ঠিক আছে। তাই কর। আপনি দেখবেন আমি যা করার করব।
বলেই শৈলেন সোজা খোলা-দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরের ঝিঁঝি-ডাকা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। কে কোথায় হারিয়ে যায় তা বোঝা যায় না।
আমি অনেকক্ষণ যেমন বসেছিলাম, তেমনই বসে রইলাম।
মনে মনে অন্ধকারকে উদ্দেশ করে বললাম, শৈলেন, তোমার এই কান্নায় কোনো লজ্জা নেই। কাউকে ভালোবেসেছ তাতে লজ্জার কি আছে? ভালোবাসার সরল অপাপবিদ্ধ কান্নায় যারা পরিহাসের রসদ খোঁজে তারা মানুষ নয়। এ কান্নায় তোমারই আত্মশুদ্ধি হল। তুমি জানো না শৈলেন, মনে মনে তোমাকে এই মুহূর্তে আমি কতখানি ঈর্ষা করি, ঈর্ষা করি তোমার সরলতাকে, তোমার সুস্থ সাবলীল সহজ ভালোবাসার প্রকাশকে। যদি আমি তোমার মত কখনও ডাক-ছেড়ে কাঁদতে পারতাম ত নিজের বুকের মধ্যে একটা মস্ত ভার হাল্কা হয়ে যেত।
মনে মনে বললাম, তুমি জানো না শৈলেন, আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যেই তোমার চেয়েও বড় কান্না আছে, থাকে; কিন্তু তা চাপা থাকে। সে কান্না নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রতিমুহূর্ত গুমরে মরে, কারণ আমরা তা প্রকাশ করার মত সুস্থ ও সহজ নই। তাই তুমি সে বাবদে আমাদের চোখে অনেক বড়।
নয়নতারা আছে; তারা বরাবরই ছিল এবং হয়ত থাকবেও। কিন্তু নয়নতারাকে তোমার চোখের জলে আজ তুমি যে নৈবেদ্য দিলে সে নৈবেদ্য জীবনে আর কারো কাছ থেকে কখনও সে এমন করে পাবে বলে আমার মনে হয় না।
প্রতিটি মেয়েই জীবনে ভালোবাসার নামে বহুবার যে সহজ পাওয়া পায়, তা ভালোবাসা নয়; সেই জ্বলন্ত ক্ষণিক সস্তা পাওয়ার নাম নিছক কাম। তেমন ভালোবাসা নয়নতারাও এ-জীবনে অনেক পুরুষের কাছে পাবে কিন্তু নয়নতারা যেখানেই থাকুক, যার ঘরেই থাকুক, যার বুকেই থাকুক, সে যদি মানুষী হয়, তবে সে তার হৃদয়ে নিশ্চয় করে একদিন জানবেই যে, শৈলেন তাকে যা দিয়েছিল, দিতে পেরেছিল, অন্য কেউই তাকে তা দিতে পারে নি, দিতে চায় নি। এমন পাওয়া সকলের কাছ থেকে পাওয়া যায় না–জীবনে একবার কি দুবার এমন পাওয়া কারো কপালে জোটে।
যেমন নয়নতারার বয়স বাড়বে, তার অল্প বয়সের ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবনাগুলো মিলিয়ে গিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতার পরশ লেগে তার দৃষ্টি স্বচ্ছ হবে, সে তেমনই এবং তখনই নিশ্চয়ই বুঝবে যে, তার জীবনে শৈলেন ঘোষ একজনই এবং একমাত্র শৈলেন ঘোষই। ছিল। অন্য যারা আসবে যাবে সে সব রাম, শ্যাম, যদু, মধুদের ও কখনও তেমন করে মনে রাখবে না। মনে রাখবে একমাত্র শৈলেনকে। যারা ভালোবেসে ভালোবাসার জনকে পায় না, তাদের সবচেয়ে বড় জিত বুঝি এইখানে। এই না-পাওয়াও একটা দারুণ পাওয়া।
ব্যর্থ প্রেম বা ব্যর্থ প্রেমিক বলে কোনো কথা কখনও আছে বা ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না। প্রেম, সে যার প্রেমই হোক, সে যদি সত্যিকারের প্রেম হয় তা কখনই ব্যর্থ হয় না। প্রেমের সমস্ত সার্থকতা প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। তাকে পাওয়া যেতে পারে; নাও যেতে পারে। প্রেমের সবচেয়ে বড় গৌরব প্রেমই। মানুষের জীবনে আর কোনো অনুভূতিই তাকে এমন এক আত্মিক উন্নতির চৌকাঠে এনে দাঁড় করায় না। যে ভালোবাসে সে নিজের অজানিতে কখন যে নিজের মনের আঁটসাঁট গরীব কাঠামোর চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়, সে নিজেও তা বুঝতে পারে না। অন্য কোনো অনুভূতিই তাকে এমন করে মহৎ, উদার ও উন্নত করে না। ভালো যে বাসে, সে ভালোবেসেই কৃতার্থ হয়; যাকে ভালোবাসে তার কৃপণতা বা উদারতার উপর তার ভালোবাসার সার্থকতা কখনও নির্ভরশীল হয় না।
এত কথা বলার মত অবকাশ আমার ছিল না, শোনার মত মনের অবস্থাও ছিল না শৈলেনের। তাছাড়া মনের মধ্যে যা আনাগোনা করে, বুড়বুড়ি তোলে অনুক্ষণ, সে সমস্ত কথা কাউকে মুখে বলাও যায় না। কারণ তা বললে যাত্রার ডায়ালগের মত শোনায়। যদিও মনে মনে আমরা সকলেই এক অশেষ-যাত্রার এক-একটি রং-মাখা চরিত্র কিন্তু যাত্রার পোশাকে মনের বাইরে আসতে আমরা কেউই চাই না।
তাই শৈলেনকে যা বলব ভেবেছিলাম, যা বলা উচিত ছিল, তার কোনো কিছুই সেদিন বলা হল না।
শৈলেন চলে যাবার পরও আমি অনেকক্ষণ একা একা বসে রইলাম। কতক্ষণ বসেছিলাম, খেয়াল ছিল না, হাঠাৎ দেখি লাবুর ভাই ডাবু এসে উপস্থিত।
বললাম, কি খবর?
ডাবু বলল, লাবু আজ ফিরেছে। আপনাকে কাল যেতে বলেছে।
কেমন আছে ও?
ভালো আছে। কাল-পরশু থেকে বাইরে যেতে পারবে বলেছেন ডাক্তার। তবে কিছু দিন ত দুর্বল থাকবেই।
আমার খাওয়ার সময় হয়ে গেছিল। ডাবুকেও বললাম খেয়ে যেতে। গল্পসল্প করে খাওয়া-দাওয়ার পর ডাবু চলে গেল।
পরদিন ভোরেই উঠে লাবুদের বাড়িতে গেলাম।
মাসীমা মুড়ি মেখে চা দিয়ে খেতে দিলেন।
লাবু হাসপাতালে এ কদিন নিয়মে থেকে ও ভালো খেয়ে-দেয়ে চেহারাটা বেশ ভালো করে ফিরেছে। লাবু যেন এ কদিনে অনেক বড়ও হয়ে গেছে। ও যেন আর সেই ছোট ছেলেটি নেই। কৈশোর শেষের সেই টিয়া-রঙা দিনগুলো তাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে যেন উন্মুখ হয়ে আছে। ও শীগগিরই যেন অসময়ে যৌবনের রুক্ষ সুন্দর পুরুষালি উপত্যকায় পা দেবে বলে ছটফট করছে।
ঘর ফাঁকা হলেই লাবু এবং আমি স্বচ্ছন্দ হয়ে কথা বলতে পারলাম।
লাবু বলল, ফিসফিস করে, ঐ রুটি ও তিতির আপনি কোথায় পেলেন?
বললাম, তোমার গুহায় বসেছিলাম, নুড়ানী তোমার জন্যে নিয়ে এসেছিল। আমাকে দেখেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল সাদা ঘোড়ায় চেপে। তোমার জিনিস, তাই তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছিলাম।
লাবু বলল, সুকুদা, আপনি একটা কাজ করবেন?
বললাম, কি?
আপনি একবার ইটিটিকারীর জঙ্গলে যাবেন? নুড়ানীর জন্যে অমি সেই পাখিটাকে রেখে দিয়েছিলাম।
কোন্ পাখি?
সেই ঝড়ে-পড়া পাখিটা। সেই হলুদ-বসন্ত পাখিটা।
তুমি না বলেছিলে–ওটাকে সারিয়ে তুলে, বাঁচিয়ে তুলে, বনে উড়িয়ে দেবে।
বলেছিলাম, কিন্তু নুড়ানী যে পাখিটাকে চাইল; বলল ও পুষবে।
তুমি না বলেছিলে, উড়িয়ে না দিলে পাখিকে বাঁচিয়ে লাভ কি?
বলেছিলাম, কিন্তু নুড়ানী যে চাইল। ঐ পাখিটাকে ছাড়া ওকে দেবার মত ত আমার কিছুই নেই। ও যে আমাকে অনেক জিনিস দেয়।
আমি বললাম, নুড়ানীর কাছে আমি হেরে গেছি–নুড়ানীর উপর আমার খুব রাগ আছে। তুমি আমার নাম কেটে ওর নাম লিখেছ কেন?
লাবু ভাঙ্গা দাঁত বের করে দেবশিশুর মত হাসল। বলল, আপনি ভীষণ হিংসুটে। আপনিও ভাল, নুড়ানীও ভালো। নুড়ানী আপনার চাইতে ভালো। কেন ভালো তা আমি বলতে পারব না। মানে, বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আমি একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, দেখলাম ওর চোখ দুটো কি এক দারুণ চিকন উজ্জ্বলতায় জ্বলছে। কোনো স্ট্রেপটোমাইসীন বা কোনো দিগ্বিজয়ী ডাক্তারের ধন্বন্তরী দাওয়াই এমন উজ্জ্বলতা আনতে পারে না কারো চোখে। এ উজ্জ্বলতা বন্ধুত্বের দান, সখ্যতার দান।
ওকে শুধোলাম, ইটিটিকারী কোন্ দিকে আমাকে বলে দাও, আর পাখিটাও দাও। এখুনি না রওয়ানা হলে রোদ চড়া হয়ে যাবে।
ও আমাকে ইটিটিকারী যাবার রাস্তা বিশদভাবে বুঝিয়ে দিল।
আমি বললাম, আমাকে দেখে যদি নুড়ানী পালিয়ে যায়?
লাবু বলল, পাখিটা দেখলেই ও আপনার কাছে আসবে। পালাবে না, দেখবেন।
এমন সময় মাসীমা ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকতেই লাবু বলল, মা, সুকুকে পাখিটা দিয়ে দাও না। সুকুন্দা পুষবে বলেছে।
লাবু খুব সপ্রতিভভাবে মিথ্যা কথাটা বলল।
মাসীমা ছোট্ট একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে বানানো লাবুর তৈরী খাঁচায় করে পাখিটাকে এনে আমার হাতে দিলেন, বললেন, বাঁচালে বাবা। আকাশ সুষ্ঠু পাখি থাকতে খাঁচার মধ্যে পাখি তোমরা কেন পুষতে চাও জানি না। তবে তুমি নিয়ে যাও। আমার চোখের সামনে ও ডানা ঝাপটাবে না যে খাঁচার দেওয়ালে, এইটুকুই সান্ত্বনা।
আমি পাখিটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দরজা অবধি যেতেই লাবু বলল, সুকুদা কিছুক্ষণ পরে আসবেন ঘুরে।
লাবুর দিকে তাকিয়ে ওর কথার মানে বুঝলাম। বললাম, আসব।
মাসীমা বললেন, হ্যাঁ বাবা, এসো আবার।
এখান থেকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে প্রায় মাইল দুয়েক রাস্তা। আঁকাবাঁকা লাল মাটির পথ পাহাড়, উপত্যকা, খোয়াই ও ঝর্ণা পেরিয়ে চলে গেছে। আলোছায়া কাটাকুটি খেলছে পথময়। নানান পাখি ডাকছে চতুর্দিকে। একটা সাদা আর কালো প্রজাপতি আমার সামনে সামনে উড়ে চলেছে–যেন পাইলটিং করছে আমাকে।
কিছুদূর যেতেই বাঁয়ে একটা ন্যাড়া টিলা চোখে পড়ল। টিলাটার নীচে একটা দোলা মত। তাতে পাঁচটা বুনো শুয়োর ঘোঁত-ঘোঁত, ফোঁৎ-ফোঁৎ আওয়াজ করে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কি যেন খাচ্ছে।
আর একটু এগোতেই একটা বিরাট বেজী পথের ডানদিক থেকে বাঁদিকে দৌড়ে গেল। দূরে ডানদিকে একটা ন্যাড়া শিমূল গাছের ডালে অতিকায় কালো ফলের মত অনেকগুলো শকুন ঝুলে আছে। গাছটার কিছু দূরে একটা লাল-রঙা গরু মাটিতে পড়ে আছে। বোধহয় সাপের কামড়ে মারা গেছে।
বেশ অনেকক্ষণ হাঁটার পর দূর থেকে একটা চওড়া নদীর ফিকে-গেরুয়া আঁচল দেখা গেল। নদীটার কোল থেকে ধুয়োর কুণ্ডলী উঠছিল।
আরো একটু এগোতেই কোলাহল কানে এল নারী ও পুরুষ কণ্ঠের মিশ্র ভাষায়। সে ভাষা আমি বুঝি না। ছাগলের ব্যা ব্যাঁ রব, ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, সব মিলিয়ে নদীর দিকটা গমগম করছে।
দূর থেকে পুরো ছবিটা আমার চোখে ফুটে উঠল।
ছেলেরা ধুতি ও কামিজ পরা। মেয়েদের পরনে রঙীন ঘাঘরা চোলি। তারা সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত। কতগুলো সাদা ধবধবে ছাগল–তাদের গলায় ঘন্টা বাঁধা–তারা মাথা নাড়লেই টুং-টাং করে ঘণ্টা বাজছে। দুটো বেশ বড় ভালুক, গাছের সঙ্গে বাঁধা। একটা অন্যটার পেটে টু মারছে। কতগুলো ঘোড়া। ক্যারাভানের মত অথচ খুব সরু ও হালকা তিনটে পদা-দেওয়া গাড়ি। এতে বোধ হয় মেয়েরা ও বাচ্চারা রাতে শোয় এবং দূরের পথে পাড়ি দেয়।
একজন বেদেনী সেগুন গাছতলায় বসে আত্মবিস্মৃত হয়ে তার সুন্দর সুডৌল বুক বের করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। একজন বুড়ো রোদে একটা বড় কালো পাথরে বসে লম্বা বাঁশের তৈরী পাইপ খাচ্ছে। কতগুলো বাচ্চা এদিক-ওদিকে মায়েদের পায়ে পায়ে ঘুর ঘুর করছে। একজন তার মায়ের পায়ের মধ্যে ঢুকে পড়ায় অসাবধানী মা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মাটি থেকে উঠেই সে ধাঁই-ধাই লাগাল বাচ্চাটার পিঠে।
আমি আস্তে আস্তে বুড়োটার কাছে গিয়ে পৌঁছতেই–ওদের প্রত্যেকে হঠাৎ যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত যে যেমন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে বা বসেছিল ঠিক সেই সেই ভঙ্গিমায় ফ্রিজ করে গেল। তার পরই আবার তারা নড়ে-চড়ে উঠল।
আমি বুড়োকে গিয়ে বললাম, নুড়ানী, নুড়ানী হ্যায়?
আমি পাখিটাকে তুলে ধরলাম। পাখিটাই আমার এই সাম্রাজ্যে আসার ছাড়পত্র। বললাম, লাবুনে ভেজা।
কওন?
আমি আবার বললাম, লাবু।
বুড়ো মুখ থেকে পাইপ বের করে উঠে দাঁড়াল। বুড়োর মুখে হাসি ফুটল; বলল, ও লাব্বু বাবু? ক্যা হো গীয়া লাব্বু বাবুকো? আতে নেহি হ্যায় বিলকুল।
আমি বললাম, বিমার থা। অব আয়েগা।
বুড়ো আমার সঙ্গে বৃথা বাক্যব্যয় না করে ডাকল, নুড়ানী নুড়ানী। কাছেই জঙ্গলের আড়ালে ছিল নুড়ানী। সেখানে কি করছিল জানি না, হয়ত কোন মূল খুঁড়ছিল বা ফল পাড়ছিল। নুড়ানী একটা আওয়াজ দিল। আওয়াজটা আমার কানে মনে হল হাতুম বলে।
একটু পরে নুড়ানী এসে আমার সামনে দাঁড়াল।
এবারে সেই চকিত ঝলক নয়। আমার লাবুবাবুর সমস্ত নুড়ানী তার সমস্ত বাদামী আর্যাবর্তের শরীর ও সোনালী চুল নিয়ে আমার সামনে রোদের মধ্যে মুখ নীচু করে এসে দাঁড়াল।
মনে মনে ভাবলাম, লাবুর রুচি আছে; কপালও আছে।
বললাম, লাব্বুনে ভেজা, বলে পাখিটা উঁচু করে ধরলাম। খাঁচাসুদ্ধ।
মুহূর্তের মধ্যে নুড়ানীর চোখমুখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। পাঁচ বছরের মেয়ের মত ও আগলখোলা সংস্কারহীন হাসি হেসে উঠল ঝকঝক করে হেসে উঠেই পাখিটাকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওকে দেখে আমার তখন মনে হল যে, ও হয়ত লাবুর সমবয়সীই হবে। ওর গড়নটা হয়ত বাড়ন্ত; সে জন্য বড় দেখায়। নইলে নিছক একটা পাখি দেখে, সে হলুদ-বসন্ত পাখিই হোক আর যে পাখিই হোক, একটা নিছক পাখি দেখে বা পেয়ে এমন উল্লসিত হওয়া যায় না যৌবনে পা দিয়ে।
কোন বেদেনী মেয়ের পক্ষে ত নয়ই।
ওকে হাসির ঝরনা ঝরিয়ে বেণী দুলিয়ে ঘাঘরা উড়িয়ে অন্য এক ঝরনার মত চলে যেতে দেখতে আমার দারুণ লাগল।
সেই সকালটা এক শান্ত স্বার্থহীন সুন্দর সুস্থ ভালো লাগায় ভরে গেল।
ওরা আমাকে বসতে বলল না, আপ্যায়ন করল না, এক আশ্চর্য রাজ্যের রাজকুমারীর কাছে জঙ্গলের রাজা লাবুর দূত হয়ে আমি এসেছিলাম, আবার সেই রাজকুমারীর নীরব বাণী বয়ে রাজা লাবুর রাজত্বের দিকে ফিরে যাব।
যাবার জন্যে পিছন ফিরেছি এমন সময় চৌকিদারের সঙ্গে দুজন লাল-পাগড়ি খাকি-পোশাকের ছড়ি-হাতে পুলিশকে আসতে দেখলাম।
পুলিশ আসতে দেখে বেদেদের দলে একটা চমক লাগল। হাঙ্গরে তাড়া করা মাছের ঝাঁকের মত ওরা দল ভেঙ্গে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল।
শুধু বুড়ো সর্দার যেমন বসেছিল, তেমনই বসে বসে পাইপ খেতে লাগল। তার পাইপ থেকে হুঁকোর মত একটা গুড়গুড় আওয়াজ বেরোতে লাগল।
সর্দার আমার দিকে একবার ঘৃণার চোখে তাকাল। বুঝলাম, সর্দার ভেবেছে, আমিই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছি।
চৌকিদারকে কি ব্যাপার শুধোতেই ও বলল, এরা আসার পর অনেকের অনেক কিছু চুরি গেছে। গরু, ছাগল, ক্ষেতের ফসল। দূরের থানায় রিপোর্ট করেছেন ম্যাকলাস্কির সাহেবরা। আমাদের উপর অর্ডার হয়েছে এদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষুনি।
বুড়ো সর্দার সব শুনল। তার মুখ দেখে মনে হল চুরি করেছে বলে কোনো অনুশোচনা তার নেই। তারা জন্মে অবধি চুরি করতে শিখেছে, তবে চুরি করে ধরা পড়ে গেছে শুধু এই জন্যে যা একটু অস্বস্তি।
সর্দার বলল, খুঁজে দেখো, যা চুরি গেছে তা আমাদের এখানে আছে কিনা।
চৌকিদার বলল, তাহলে তোমাদের পেট চিরে দেখতে হয়–সব ত পেটে ঢুকেছে এতক্ষণে- তা কি আর বাইরে আছে?
সর্দার বলল, ঠিক আছে। আমাদের চার পাঁচ ঘণ্টা সময় দাও। মেয়েরা অনেকে জঙ্গলে গেছে তারা ফিরে আসুক, আমরা খেয়ে-দেয়েই অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছি।
পুলিশরা বলল, আমরা সার্চ করব।
সর্দার বলল, করো।
তারপর পুলিশরা তাদের সেই ক্যারাভানের মত গাড়িগুলোতে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়ে সবকিছু তছনছ করে সার্চ করতে লাগল।
ওরা যখন চলে যাবেই বলেছিল, তখন এর কোনো দরকার ছিল বলে আমার মনে হলো না। তবু কি যেমন স্বর্গে গিয়ে ধান ভানে, পুলিশরা তেমনই সার্চ করতে আরম্ভ করল। কোনোরকম হেনস্থা বা উত্ত্যক্ত না করে চলে গেলে পুলিশের পুলিশত্ব থাকে না এদেশে। বিশেষ করে এই বেদেরা যখন চাঁদির জুতো মেরে এদের জুলুম বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে না।
একজন পুলিশ একটি অল্পবয়সী সুন্দরী বেদেনীর হাত ধরে ফেলল। হাত ধরে তার বুকের মধ্যে খুঁজে-রাখা একটা লাল সিল্কের স্কার্ফ টেনে বের করল। বের করেই বলল, কাঁহাসে মিলা? মেয়েটা জবাব দেওয়ার আগেই পুলিশটা আবার তার জামার মধ্যে দিয়ে বুকে হাত দিল।
কোথা থেকে কি করে ব্যাপারটা ঘটল জানি না, মুহূর্তের মধ্যে সর্দার তার পায়ের কাছ থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সাঁ করে ছুঁড়ে মারল। অদ্ভুত নিশানা সর্দারের। মেয়েটা এবং পুলিশটা একই রেখায় দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু পাথরটা গিয়ে সজোরে পুলিশের মাথার পেছনে লাগতেই সে পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা একটা খণ্ডযুদ্ধের রূপ নিল। বেদে এবং বেদেনীরা দেখতে দেখতে চৌকিদার এবং পুলিশ দুজনকে ধরে গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। কোথা থেকে এল জানি না, মুহূর্তের মধ্যে নুড়ানী তার সাদা টাট্টুতে চড়ে ফিরে এল–এসে একটা হালকা বেত নিয়ে সপাং সপাং করে ওদের মুখে ও ভুড়িতে চাবুক মারতে লাগল–ঘোড়ায় চেপে ঘুরে ঘুরে।
অন্যরা তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে লাগল।
সর্দার আমাকে নীচু গলায় বলল, তুম ভাগো বাবু। তুম লাব্বুকা আদমী হ্যায়, উসীসে আজ বাঁচ গ্যয়া।
আমি যত জোরে পারি ফিরে এলাম। মেয়েটাকে অসম্মান করার যোগ্য শান্তি ওরা দিয়েছে বলে মনে মনে ওদের উপর আমি খুশিই হলাম।
লাবুদের বাড়ি পৌঁছে দেখি লাবু খেতে বসেছে। লাবুকে একলা পেতেই ঘটনাটা লাবুকে বললাম। বললাম, নুড়ানীরা এক্ষুনি চলে যাচ্ছে।
লাবু খাওয়া থামিয়ে রেখে বলল, কোথায়?
তা জানি না। কোথাও জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে যাবে।
লাবু শুধু বলল, অ।
ও আর কোন কথা বলল না।
আমি বাড়ি ফিরে মালুকে দিয়ে থানায় একটা খবর পাঠালাম।
আমার সাক্ষাতেই পুলিশদের দুর্গতি হয়েছিল। তা জানার পরও থানায় একটা খবর না দিলে পরে বেদেদের সঙ্গে আমার সাঁট ছিল এমন দুর্নাম রটা অস্বাভাবিক নয়।
তবে মালু খাওয়াদাওয়া করে পায়ে হেঁটে সেখানে যেতে যেতে অনেকক্ষণের ব্যাপার। চার মাইল পথ। সেখানে খবর পেয়ে অন্য পুলিশরা সেখান থেকে দু মাইল ইটিটিকারী পৌঁছতেও অনেকক্ষণ। ততক্ষণে লাবুর নুড়ানী এবং তার দলবল গভীর জঙ্গলে উধাও হয়ে যাবে।
সেখান থেকে তাদের খুঁজে বের করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা লাঠিহাতে ভুড়িওয়ালা পুলিশদের হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। মনে মনে আমি নুড়ানীদের মঙ্গল কামনা করছিলাম। ওরা যেন সভ্যতার সমাজের নোংরা সৃষ্টি পুলিশদের নাগালের অনেক বাইরে চলে যায়, সেখানে ওদের কেউ খুঁজে পাবে না। জঙ্গলের মধ্যেই জংলী বেদেদের মানায়, সেখানেই তাদের সত্যিকারের জায়গা, ওরা যে কেন লোকালয়ের কাছে আসে জানি না। মনে মনে কামনা করছিলাম যে ওরা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাক যেখান থেকে কেউ যেন ওদের খুঁজে না বের করতে পারে।
আগামীকাল শুক্রবার। কিন্তু হাট বিকেলে। তাই যখন রহমান সবজিওয়ালা এল তখন কিছু আনাজ রাখলাম। মুরগীর ডিম আনতে পাঠালাম সুরজ শর্মার দোকান থেকে এক ডজন। কাল দুপুরে ছুটির জন্যে রান্না করিয়ে রাখতে হবে।
মালুকে বলে দিয়েছিলাম যেন ফেরার সময় হাসানকে খবর দিয়ে রাখে যাতে হাসান কাল সকালেই চলে আসে।
ছুটির চিঠি পড়ার পর থেকে যখনি কথাটা মনে হয়েছে, তখনি নিজেকে অপরাধী লাগছে। ছুটি জানে না এখনও যে আমার মনে এক দারুণ সন্দেহের আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে। তা ও আমার চিঠি পড়ার পরই জানতে পাবে। অথচ ও তা না-জেনে কেমন সরল খুশি মনে আমার কাছে আসছে।
যে চিঠি লেখা হয়ে গেছে তাকে ফেরানো যায় না–উপায় থাকলে সে চিঠি ফিরিয়ে আনতাম কিন্তু এখন সে চিঠি রাঁচী পৌঁছে ছুটির লেটার বক্সে একটা বিষের বিছের মত কুঁকড়ে পড়ে আছে। লেটারবক্স খুলে তাতে হাত ছোঁওয়াতেই ছুটি হয়ত কেঁদে উঠবে যন্ত্রণায়।
এখন আমার অন্য কিছু করণীয় নেই।
গতকাল রমা একটা চিঠি লিখেছিল। লাইব্রেরী পরিষ্কার করিয়ে রাখছে–যাতে আমি এলে অসুবিধা না হয়। লিখেছে কবে ফিরছি জানাতে, যাতে আমার স্টেনোগ্রাফারদের ও জুনিয়ারদের জানিয়ে রাখতে পারে। লিখেছে, স্টেশানে গাড়ি পাঠাবে এবং পারলে ও নিজেও আসবে।
আরও লিখেছে যে, আশা করি এতদিনে তোমার মাথা থেকে ছুটির পেত্নী নেমেছে। আমি ভাবতে পারি না, তুমি কি করে এমন জাত-বংশ-এ্যারিস্ট্রোক্রাসীহীন অতি সাধারণ একজন মেয়ের খপ্পরে পড়লে। কেন পড়লে?
সন্ধে হয়ে গেছে একঘণ্টা, এমন সময় ডাবু এল। ডাবু বলল, লাবু কি এখানে আছে?
কেন? লাবু বাড়িতে নেই? আমি শুধোলাম।
না। আপনি চলে আসার পরই ও মাকে বলে বেরিয়েছিল, বলেছিল, মা একটু রোদ পুইয়ে আসি। ঘরে বড় ঠাণ্ডা লাগছে। তারপর এখনও ফেরেনি।
হঠাৎ আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। বললাম, ওর একটা লুকিয়ে থাকার জায়গা আছে, তুমি চেন সে জায়গা?
না ত। ডাবু বলল।
আমি বললাম, চল ত আমার সঙ্গে একবার সেখানে দেখে আসি। শরীর ভালো না, হয়ত ঘুমিয়ে-টুমিয়ে পড়েছে।
টর্চ নিয়ে ডাবুর সঙ্গে যখন লাবুর সেই গুহায় পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় আটটা বাজে।
গুহার পাথর সরাতে গিয়ে দেখি পাথরটা সরানোই আছে। ভিতরে ঢুকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম লাবুর চিহ্ন নেই। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার গুহার মধ্যে যা যা ছিল সবই আছে–শুধু নুড়ানীর সেই চুল বাঁধা ফিতে এবং কাঁকইটা নেই–আর নেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সেই মলাট-ছেঁড়া চাঁদের পাহাড় বইটা।
আমি বললাম, না। এখানে নেই!
ডাবু উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, তবে কোথায় গেল?
আমি বললাম, কি করে জানব বল? সাপে-টাপে কামড়ায়নি ত?
ডাবু বলল, শীতকালে সাপের ভয় ত তেমন নেই।
তবে?
ডাবু বলল, নিশ্চয়ই বেদেরা ওকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমি চুপ করে থাকলাম। বললাম, তোমার তাই মনে হয়?
নিশ্চয়ই তাই। ডাবু বলল, ওর শরীর এখনও যথেষ্ট খারাপ। ও নিজে ভালো করে হাঁটতেও পারে না। ও কোথাও যেতে পারবে না এই অবস্থায় একা একা। এখন কি হবে সুকুদা!
আমি বললাম, পুলিশে খবর দাও এক্ষুনি!
পুলিশে গরীব লোকের অভিযোগ শুনবে না সুকুদা। তাছাড়া পুলিশই বা ওদের ধরবে কি করে? ওদের ত কোনো ঠিকানা নেই; বাড়ি নেই। ঠিকানাওয়ালা লোকদেরই পুলিশ ধরতে পারে না, তায় ঠিকানা-ছাড়া বেদেদের ধরবে কি করে?
আমি বললাম, তবুও পুলিশে খবর দাও এক্ষুনি। চারদিক সকলের বাড়ি আবার খুঁজে দেখো।
গুহা থেকে বেরোবার সময় আমার টর্চের আলো পড়ল দেওয়ালে। হঠাৎ চোখ পড়ল, লাবু কাঠকয়লার টুকরোটা দিয়ে আবার সেই লিস্টে কাটাকুটি করছে।
এতদিন মা একনম্বর ছিল। এখন মার নামও কাটা গেছে। সবচেয়ে উপরে লেখা আছে–১। নুড়ানী।
তারপর মার নাম, নুড়ানীর আগের নামের পাশে লিখেছে দু নম্বর দিয়ে। আমার নাম এখন তিন নম্বর হয়ে গেছে।
পুলিশে খবর দিতে যেতে হয়নি।
চৌকিদার ও সেই দুজন পুলিশকে উদ্ধার করে অন্যরা সোরগোল করতে করতে ফিরছিল বড় রাস্তা দিয়ে।
ডাবু গিয়ে দৌড়ে ওদের মধ্যে পড়ে লাবু যে হারিয়ে গেছে সে খবর ওদের দিল। হাত জোড় করে বলল, আপলোগ কুছ কিজিয়ে মেহেরবানী করকে।
কনস্টেবল সব কথা শুনে এবং লাবুর চেহারার বর্ণনা শুনে হঠাৎ রেগে উঠে বলল, উ লোগ উসকো লে গ্যয়া থোরী, উ ডাকু লেড়কা আপসে উলোগ কা সাথ মে গ্যয়া।
পরক্ষণেই সেই কনস্টেবল গোঁফ নাচিয়ে হাতের পাতা উল্টিয়ে বলল, এক ডাকুকা লেড়কীসে মহব্বৎ হ্যায়। মহব্বৎ। সমঝা, জী?
ডাবু বলল, এ্যাঁ? আপলোগ দেখা সাহী? ঠিক দেখা?
ডাবু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না কথাটা।
ডাবু সেই কনস্টেবলকেই বলল, অব কা হোগা?
সে বলল, কাহোগা? আগড় পাকড় যানেসে সব ডাকু লোগোঁকা সাথ পিটা যায়গা। ঔর কা?
পুলিশরা চলে গেল।
ডাবুর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল লাবুকে সাপে কামড়ালে বা শুয়োরে চিড়লে বা লাবু মেনেনজাইটীসে মরে গেলে ও এর চেয়ে অনেক সুখী হত।
ডাবু বলল, সুকুদা, আপনি একবার আমাদের বাড়ি চলুন। মাকে বোঝানো যাবে না। আমি যে কি করব বুঝতে পাচ্ছি না।
আমি বললাম, পুলিশদের সব কথা বিশ্বাস কোরো না। ওদের কথার কোনো দাম নেই। ওরা যা বলছে তা ভুলও হতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, লাবু স্বেচ্ছায় যাক, অনিচ্ছায় যাক, লাবু ওদের সঙ্গেই গেছে। গেছে ত কি? আবার ফিরে আসবে। গেছে বলে কি চিরদিন বেদেদের দলেই থেকে যাবে তোমাদের ফেলে? দেখো, দিন কয় পরে নিজেই একদিন ফিরে আসবে। এতে এত চিন্তার কি আছে? এখানে জঙ্গল ওর অচেনা?
তারপর বললাম, আমি এখন আর যাব না ডাবু। মাসীমাকে বুঝিয়ে বোলো–বোলা যে লাবু ভালো আছে, বেঁচে আছে, ও যে-কোনো দিন হঠাৎ ফিরে আসবে। ও অসুখে কি সাপের কামড়ে মারা গেলে কি মাসীমা সুখী হতেন? তবে?
ডাবু যেন বুঝল কথাটা। এমনিভাবে বলল, আচ্ছা। আপনাকে কষ্ট দিলাম। আমি আসি তাহলে, কেমন?
বললাম, এসো।
.
২০.
কোলকাতা থেকে গোমো জংশন, বাড়কাকানা হয়ে যে ট্রেনটা আসে সেটার সময় এগারোটা। কিন্তু বারোটার মধ্যে এলেই এখানের সকলে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করে।
রান্না-বান্না করার ফরমাস দিয়ে আমি সাড়ে দশটা নাগাদ স্টেশানের দিকে রওয়ানা হলাম। ছুটির জন্যে একটা ছাতা নিলাম সঙ্গে। মালুকেও সঙ্গে নিলাম, মাল বয়ে আনবার জন্যে।
স্টেশনে পৌঁছে মিসেস কার্ণির দোকানের সামনে বসে চা ও সিঙ্গাড়া খাচ্ছিলাম। প্লাটফর্মে আতা বিক্রী হচ্ছিল বড় বড়। পেয়ারাও বিক্রী হচ্ছিল। চীনাবাদাম ও কুড়মুড় ভাজাও। পানিপাঁড়ে জল নিয়ে বসেছিল।
একটা উদাস হায়া বইছিল প্ল্যাটফর্মের উপর শুকনো পাতা উড়িয়ে।
লাবুর পালিয়ে-যাওয়াটা অথবা হারিয়ে যাওয়াটা এখানের সকালে সকলের মুখে মুখে ফিরছিল।
শৈলেন বলল, লাবুর কথা শুনেছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বেদেরা যে কী খারাপ চরিত্রের লোক সে সম্বন্ধে কারোই কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিলো না। স্টেশনঘরের সামনের বারান্দায় বেঞ্চ পেতে বসে নিজের নিজের জীবনে বেদেদের সম্বন্ধে যার যা ঘটনা জানা ছিল ও কল্পনা করা ছিল সকলেই তা চায়ের কাপ হাতে করে বসে বসে বলছিলেন। যাঁদের এ বিষয়ে কিছুই জানা ছিলো না এবং যাঁদের কল্পনাশক্তিও অপেক্ষাকৃত কম তাঁরা সবিস্ময়ে ও সভয়ে চোখ গোল-গোল করে অন্যদের অভিজ্ঞতা শুনছিলেন।
একটা জিনিস মনে হয় আমার ভালো লাগল যে, এই ছোট জায়গায় লাবুর অন্তর্ধানের ঘটনাটা শৈলেনের প্রেমের ব্যর্থতাকে আপাতত চাপা দিয়েছিল। শৈলেন বোধ হয় অন্তত এ জন্যেই লাবুর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল মনে মনে।
শৈলেনের সেদিন স্টেশনে ডিউটি ছিল। ও ধড়াচূড়া পরে একা একা এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছিল।
দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে শৈলেন বলল, কেউ আসবে বুঝি?
আমি বললাম, হ্যাঁ। আমার একজন আত্মীয়া আসবেন কোলকাতা থেকে। তারপরই বললাম, চা খাবে শৈলেন?
ও উদাসীনতার সঙ্গে বলল, না। পরক্ষণেই বলল, আচ্ছা খাই।
মিসেস কার্ণি চা এবং আলুর চপ এগিয়ে দিলেন। ততক্ষণে সিঙ্গাড়া শেষ হয়ে গেছিল। ওরা ভিতরে নতুন করে গড়ছিল সিঙ্গাড়া।
শৈলেন যখন চা খাচ্ছিল, তখন আমি হেসে বললাম, কি? মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে ছেলের?
শৈলেন অভিব্যক্তিহীন গলায় বলল, মাথা ত গরম হয়নি কখনও দাদা।
আমি বলেছিলাম, যা বললাম মনে আছে?
ও হঠাৎ মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, বলল, মনে আছে। যা করবার একা-একা করতে হবে।
ও এমন বিষাদ-ঝরানো গলায় কথাটা বলল যে, আমার খারাপ লাগল।
তাছাড়া, মনে হলো কথাটার মধ্যে আমার প্রতি একটা চাপা বিদ্রূপও ছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, লাবুর অন্তর্ধানে আমি খুব দুঃখিত হইনি।
লাবু যে-জীবনে অভ্যস্ত হয়েছিল সকালে উঠে গরু চরাতে যাওয়া এবং বাড়ি ফিরে গেরস্থালী কাজ করা, তাতে কোনো ভবিষ্যৎ ছিলো না লাবুর। মার প্রতি কর্তব্যবোধ তার থাকা উচিত ছিল। কিন্তু ওর যা বয়স তাতে কারো প্রতি কর্তব্যবোধ জাগবার কথা নয়।
আমি বুঝতে পারলাম, জঙ্গল পাহাড়ের আশ্চর্য যাদু ওকে পাগল করেছিল। চাঁদের পাহাড় পড়ে ওর মধ্যেও একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের সখ দানা বেঁধেছিল। ঠিক সেই সময়ে ওর সঙ্গে নুড়ানীর দেখা।
উদাস আকাশের নীচে সেই বাদামী বেদেনী তাকে কিসের লোভ দেখিয়েছিল তা আমার জানা নেই, তবে শরীরের লোভ নিশ্চয়ই নয়। কারণ, লাবুর বয়সে মেয়েদের শরীর সম্বন্ধে একটা মোহময় ধারণা থাকে এই পর্যন্ত–সে শরীর ওর বয়সী কোনো ছেলেকেই আকর্ষণ করে না।
আমার মনে হয়, ও আর নুড়ানী দুজনে কোনো অদেখা চাঁদের পাহাড়ে অভিযান করার স্বপ্ন দেখেছিল। নূড়ানীদের বাধা-বন্ধনহীন উন্মুক্ত অবারিত জীবন লাবুকে নিশ্চয়ই ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল–সে আকর্ষণ লাবু প্রতিরোধ করতে পারেনি।
লাবু যদি কখনও আর নাও ফেরে, তবুও জানব, লাবু একটা কিছু করল। মার বাধ্য হয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে অসহায় যুদ্ধ করার থেকে ও অবাধ্য হয়ে এক অনিশ্চিত চ্যালেঞ্জ করা জীবনের দিকে যে আকর্ষিত হয়েছিল, এটাই আশ্চর্যের কথা।
বাঙালির ঘরে এমন বড় একটা ঘটে না।
শৈলেন চা-খাওয়া শেষ করে পয়সা দিতে গেল।
আমি বললাম, ও কি? আমিই ত তোমাকে ডাকলাম।
ও পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর বলল, কারো কাছে কোনো ঋণ রাখতে ইচ্ছে করে না।
আমি বললাম, ও আবার কি কথা। এদিকে দাদা বলল মুখে, আর এক কাপ চা খেলে ঋণ হয়ে গেল!
ও ম্লান মুখে হাসল একবার।
তারপর বলল, না, কারো কাছেই ঋণ রাখা উচিত নয়।
আমি ওর কথার মানে বুঝলাম না।
শৈলেন প্লাটফর্মের অন্যপ্রান্তে চলে গেল। প্যান্টের দু পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একা একা।
বসে থাকতে বিরক্তি লাগছিল। তাই লাইন পেরিয়ে ওদিকের প্লাটফর্মে গিয়ে আমিও রোদে পাইচারী করতে লাগলাম।
এখানে লাইন পেরুনোতে কোনো অসুবিধা নেই কারণ প্ল্যাটফর্ম উঁচু নয়। মাটি থেকে বড় জোর ছইঞ্চি কি এক ফুট উঁচু। সমান বললেই চলে। লাল কাঁকরের প্লাটফর্ম। বাঁধানো নয়। হাঁটলে পায়ের নীচের কাঁকর কচরমচর করে বেশ লাগে আস্তে আস্তে, ভাবতে ভাবতে, হাঁটতে।
কিছুক্ষণ পর আবার লাইন পেরিয়ে এদিকে আসব, হঠাৎ আমার চোখ পড়ল মিসেস কার্ণির দোকানের সামনে দুটি মেয়ের দিকে। ওদের মধ্যে একজনকে আমার দারুণ চেনা মনে হল। বাঙালি মেয়ে।
লাইনটা পেরুবার সময় হঠাৎ চিনতে পারলাম নয়নতারাকে।
ওর ছবি আমি শৈলেনের কাছে দেখেছিলাম। শৈলেন যেমন বলেছিল, আজও ও তেমনি খুব সেজেছে। মেয়েটি সাজতে জানে। খোঁপায় একটি লাল গোলাপ। সঙ্গের মেয়েটির সঙ্গে আলুর চপ খাচ্ছিল। আর খুব হেসে হেসে গল্প করছিল।
চকিতে আমি প্লাটফর্মের অন্য প্রান্তে যেদিকে শৈলেন গেছিল সেদিকে তাকালাম।
দেখি, শৈলেন অপলকে নয়নতারার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মিসেস কার্ণির দোকানের সামনে পৌঁছতেই শুনলাম, অন্য মেয়েটি নয়নতারাকে বলছে, ঐ দ্যাখ তোর প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে।
নয়নতারা আড়চোখে একবার দেখেই বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে চুলের ফুলটা ঠিক করে নিল, বলল, এমন নির্লজ্জ লোক আমি দেখিনি। ইডিয়েট, একটা ইডিয়েট। ভালোবাসা যেন সস্তা, দ্যাখ না।
ওদের কথা চাপা পড়ে গেল। একটা ডিজেল-টানা কয়লা বোঝাই মালগাড়ি আসছিল।
ডিজেল ইঞ্জিনটা একটানা গম্ভীর গোঙানি তুলে ধীরে ধীরে আমাদের পেরিয়ে গেল তারপর ওয়াগনগুলো ঘটাঘট, ঘটাং ঘটাং একখানা আওয়াজ তুলে আমাদের পেরোতে লাগল।
ওয়াগনগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে নয়নতারা আর তার সঙ্গিনী আলুর চপ খেতে খেতে অনর্গল কথা বলছিল দেখছিলাম, ওরা হাসছিল–ট্রেনের শব্দে সে কথাগুলো শোনা যাচ্ছিল না, শুধু হাসি দেখা যাচ্ছিল।
আমার কানে শুধু ওর শেষ কথাটা বাজছিল, ভালোবাসা যেন সস্তা, দ্যাখ না।
ওয়াগনগুলোর শেষে গার্ডসাহেবের গাড়ি ছিল। রেলিং-এ গার্ডসাহেবের আণ্ডারওয়ার বাঁধা ছিল রোদে শুকোবার জন্যে।
আমাদের পেরিয়ে গিয়েই হঠাৎ ট্রেনটা জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
পাজামা আর নীল শার্ট গায়ে-দেওয়া, হাতে একটা সিনেমা ম্যাগাজিন ধরা গার্ডসাহেব দৌড়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সামনে ঝুঁকে পড়েই বললেন, ইয়া আল্লা!
আমি গার্ডসাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে, যেদিকে ট্রেনের এঞ্জিন, সেদিকে তাকালাম।
কে যেন প্লাটফর্মের ওদিক থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কাট গ্যয়া, কাট গ্যয়া, ঘোষবাবু কাট গ্যয়া।
সমস্ত প্লাটফর্মময় একটা দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল–মাস্টারমশায় এবং অন্যান্য সকলে দৌড়ে গেলেন সেদিকে।
ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে আমি শুধু দেখলাম, শৈলেন তার সাদা পাটভাঙ্গা উনিফর্ম পরে চাকার কাছে মাটিতে শুয়ে আছে।
আমি বসেই রইলাম। উঠবার মত কোনো উৎসাহ বা জোর আমার অবশিষ্ট আছে বলে মনে হল না। ইতিমধ্যে কোলকাতার গাড়ি আসার ঘণ্টা পড়ল। এক্ষুনি এসে যাবে গাড়ি। আগের স্টেশন থেকে এ স্টেশনের দূরত্ব সামান্যই।
আমার উঠতে ইচ্ছা করছিল না, আমার পা দুটো মাটিতে আটকে ছিল, তবুও উঠতে হল।
ওখানে গিয়ে দেখলাম, শৈলেনের দুটো পা-ই ধবধবে প্যান্ট আর একপাটি জুতো-সুদ্ধু কোমর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। একপাটি জুতো আলাদা পড়ে আছে। আর শৈলেনের শরীরের উর্ধ্বাশ লাইনের অন্যদিকে।
স্টেশন স্টাফের মধ্যে কে যেন শৈলেনের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে ঐখানে বসে আছে, অন্যজন ঘটি থেকে জল ঢালছে মুখে।
ততক্ষণে শৈলেন তার সমস্ত তৃষ্ণার ওপারে চলে গেছে।
আমার কানের মধ্যে নয়নতারার কথাগুলো ঝমঝম্ করতে লাগল–দ্যাখ না, ভালোবাসা যেন সস্তা।
জানি না, সে কথা শৈলেন শুনতে পেয়েছিল কিনা, নইলে ভালোবাসা যে সস্তা নয়, তা তার নিজের জীবনের মূল্যে কেন ও প্রমাণ করতে যাবে?
পাশ থেকে একজন অল্পবয়সী গাট্টা-গোট্টা ছেলে, তাকে আমি চিনি না, বলল, হারামজাদীর রকম দ্যাখো, এখনও প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছেনালি করছে শালীকে আমি আজ সকলের সামনে বেইজ্জত করব। আমার জেল হয় ত হবে। এমন মাগীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
অন্যরা সকলেই নয়নতারাকে তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে ঢং করতে দেখে অবাক ও দুঃখিত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা সকলেই ছেলেটিকে ধরে রাখলেন, বললেন, পাগলামি করিস না।
মাস্টারমশাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, উনি যেন কোমরে আর জোর পাচ্ছিলেন না। মাস্টারমশাই বললেন, শৈলেনটা বোকা জানতাম, ও যে এতবড় বোকা তা ত কখনও ভাবি নাই।
ইতিমধ্যে বাড়কাকানা থেকে কোলকাতার ট্রেনটা এসে গেল।
ফার্স্টক্লাস বগিটা যেখানে এসে দাঁড়াল, সেটা শৈলেন যেখানে পড়েছিল, তার একেবারে সামনে।
কিমার হত হাড় ও মাংস লাইনের গায়ে লেগেছিল। এ যে মানুষেরই হাড় এবং মাংস, এবং তা শৈলেনের, তা মনে হতেই গা-বমিবমি করতে লাগল।
ছুটি একটা কমলা রঙা সিল্কের শাড়ির উপরে ফুলস্লীভস কমলারঙা সোয়েটার পরে দরজার হাতল ধরে এসে দাঁড়াল।
দাঁড়িয়েই আঁতকে উঠল।
আমি দৌড়ে গিয়ে ওর দিকে হাত বাড়ালাম, বললাম, হাত ধরো, ওদিকে তাকিও না।
ছুটি অভিভূতের মতো সিঁড়ি বেয়ে নেমে প্লাটফর্মে লাফিয়ে নামল।
আমি বললোম, তুমি ঐ দিকে যাও। ঐ চায়ের দোকানের দিকে, আমি আসছি।
ওখানে গিয়ে সকলকে বললাম, আমার কাছে একজন অতিথি এসেছেন। ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই আমি ফিরে আসছি।
ওঁরা বললেন, এখান থেকে বডি সরাতে সময় লাগবে। পুলিশ আসবে, পোস্টমর্টেম হবে। তাড়া নেই। আপনি খেয়ে-দেয়ে বিকেলের দিকে আসুন।
আমি জবাব দিলাম না কোনো, বললাম, আমি আসছি।
নয়নতারা ও তার আত্মীয়রা তখন স্টেশনের গেট পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিছু যে ঘটেছে তা নয়নতারাকে দেখে বোঝার উপায় ছিলো না। বরং ওকে যেন এই ঘটনার জন্যে গর্বিতাই দেখাচ্ছিল।
মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ছুটিকে সংক্ষেপে সব বললাম। সব শুনেই ছুটি নয়নতারা যেখানে পথের বাঁকে মিলিয়ে গেছে, সেদিকে তাকালো, বলল, একটু আগে বললেন না, আমি দৌড়ে গিয়ে ঠাস্ করে এক চড় লাগাতাম গালে, তারপর আরো চড়।
আমি বললাম, তুমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেছ। ব্যাপারটা এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
দীপচাঁদের দোকানের কাছে আসতেই দীপচাঁদের অল্পবয়সী ছেলে, পায়জামা পরে একটা ঘি-রঙা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে হাতে ঘড়ি পরে বেরিয়ে এল, শুধোল, যা শুনলাম সত্যি বাবু?
বললাম, সত্যি!
ছেলেটার বয়স ষোল-সতেরো হবে, মুখে বিজ্ঞভাব এনে বলল, আতমহতমা ত মেয়েরা করে, আওরত-এর কাজ। কোনো মরদ কখনও সুইসাইড করে? বেঁচে থাকলে পুরুষমানুষকে রোজ কত মুসীব্বতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তা বলে কোনো মরদ আতমহতমা করে?
আমি জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
ওকে বললাম না যে, তোমার পাটোয়ারী বুদ্ধিতে রোজ ডিফারেন্স-ইন-ট্রায়াল ব্যালান্স নিয়ে তুমি ব্যালান্স-শীট মেলাচ্ছে–অথবা যত গোঁজামিল সব সাসপেন্স এ্যাকাউন্টে ফেলে। কিন্তু এমন কেউ কেউ থাকে, যারা কোনোরকম ফিডারেন্স নিয়েই জীবনের ব্যালান্স শীট মেলাতে রাজী নয়।
ছুটি বলল, ছেলেটা ভীষণ পাকা ত। সবই জেনে গেছে।
আমি বললাম, ওর কি দোষ? সকলে যা বলে, ও-ও তাই-ই বলছে। সকলে বলে না যে, পুরুষমানুষ আত্মহত্যা করে না। আত্মহত্যা মেয়েমানুষদেরই মানায়?
ছুটি বলল, সব ব্যাপারে এই মেয়েদের হেনস্থা করা আমার মোটেই বরদাস্ত হয় না। মেয়েদের কি যে মনে করে পুরুষজাতটা তারাই জানে। এ সব কথা শুনলে রাগে গা রি-রি করে।
মনের ঐ অবস্থাতেও ওর কথা শুনে আমার হাসি পেল।
বললাম, মেয়েদের লিবারেশনের আরো অনেক ভালো ভালো প্লাটফর্ম আছে। প্লাটফর্মে সুইসাইড নিয়েও তোমরা ঝগড়া না করলেও চলবে।
ছুটি বললে, বিকেলে রাঁচী যাবার বাস নেই? না?
আমি বললাম, নেই।
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে সত্যি, এতদিন পর আপনার কাছে এলাম কত আশা করে এসেছিলাম, কত গল্প করব, মজা করব, তা না, স্টেশনেই যা দৃশ্য দেখালেন। উঃ ভাবতে পারছি না। ঈস, বেচারী–কাউকে ভালোবাসার দাম এমন করেও দিতে হয়? ভাবা যায় না।
বাড়ি পৌঁছেই আমি বললাম, ছুটি, তুমি আরাম করে চান করো, তারপর খাও, খেয়ে রেস্ট করো। আমার এক্ষুনি যেতে হবে। কখন ফিরব বলতে পারছি না। সত্যিই তুমি খুব খারাপ দিনে এসেছ।
তারপর বললাম, তোমাকে কি বলব, শৈলেনের মৃত্যুর জন্যে শুধু নয়নতারাই নয়, হয়ত আমিও দায়ী।
কেন? আপনি কেন?
হাতের ব্যাগটা টেবলে নামিয়ে রাখতে রাখতে ছুটি বলল।
আমি বললাম, ও সেদিন রাতে আমার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছিল, ভেবেছিল আমি বুঝি অসাধারণ কেউ। আমিও যখন ওকে বললাম, যা করবার তোমাকে একাই করতে হবে, একা একা। আমাদের কারোরই এ ব্যাপারে সাহায্য করার নেই, তখন ও হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, বেশ তাই-ই করব–যা করার একা একাই করব।
ছুটি বলল, ঈসস–স। আর শুনতে চাই না। আর বলবেন না।
আমি উঠলাম, বললাম, ভালো করে খেও কিন্তু তুমি।
ও বলল, আপনি কি পাগল? এর পর কেউ খেতে পারে? আমি একটু চা খাব শুধু। তারপর চান করে শুয়ে থাকব। আপনি কখন আসবেন?
জানি না ছুটি। আমার জন্যে জল গরম করে রাখতে বোলো। এসে চান করব।
ছুটি বলল, বলে রাখব। তারপর বলল, তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু। আমার এখনই ভয় করছে। তারপর বলল, সব খাবার তোলা থাকবে। রাতে যদি খাবার ইচ্ছা থাকে তখন খাব, আপনি ফিরে এলে।
আমি হাসান ও লালিকে সব বুঝিয়ে বলে, ছুটিকে ভালো করে দেখাশোনা করতে বলে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।
স্টেশনে পৌঁছে আমার কিছু করার ছিলো না। সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয়ও না। আমি ঐ শৈলেনের কাছে বসতেও পারছিলাম না। কে যেন ওর মাথার ও উধ্বাংশের উপর একটা কম্বল চাপা দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওর পা দুটো হাত দুয়েক দূরে পড়ে ছিল। রক্তে রক্তে তখন সমস্ত জায়গাটা ভরে গেছিল।
একজন বয়স্ক গোলগাল টাক-মাথা ভদ্রলোক শৈলেনের ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শরীরের পাশে বসে খুব কাঁদছিলেন। শুনলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে শৈলেনের ঝগড়া ছিল, কথাবার্তাও নাকি বন্ধ ছিল গত দুবছর। কিন্তু তার আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে শৈলেনের খুবই বন্ধুত্ব ছিল।
মৃত্যু বোধহয় আমাদের একে অন্যের কাছে টেনে আনে। সমস্ত জীবন নিজেদের আত্মম্ভরিতা, নিজেদের ঠুনকো মান, সম্মান, অভিমান নিয়ে আমরা সহজে অন্যের থেকে দূরে থাকতে পারি, কিন্তু মৃত্যু এসে এই সমস্ত মনগড়া ব্যবধান সরিয়ে দেয়–তখন প্রত্যেকেই মনে করি, কি হত কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে? কি হত নিজেকে অন্যের কাছে একটু ছোট করলে?
দুঃখের কথা এই যে, অন্যজন তার বা তাদের জীবদ্দশায় আমাদের এই সহজ কান্না দেখে যেতে পারে না। মরবার সময়ও বুকভরা ব্যথা নিয়ে মরতে হয়।
দেখতে দেখতে খিলাড়ি থেকে পুলিশ, পত্রাতু থেকে রেলের বড়সাহেব সব এসে গেলেন। তদন্ত-টদন্তর পর ময়না-তদন্ত থেকে ওকে মাপ করা হল।
নতুন ধুতি চাদরে মুড়ে নতুন খাটিয়ায় শৈলেনকে শুইয়ে আমরা হেসালঙের দিকে দেওনাথ নদীর পথে নিয়ে চললাম।
আমাদের পথ গেছে নয়নতারার বাড়ির পাশ দিয়ে। নয়নতারার বাড়ির সকলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। নয়নতারার সেই আত্মীয় প্রথম থেকেই অন্যদের সঙ্গে স্টেশনে ছিলেন।
ভীড়ের মধ্যে নয়নতারাকে দেখব বলে আশা করেছিলাম, কিন্তু নয়নতারাকে দেখা গেল না।
কেউ বলছিল বল হরি, হরি–বোল।
স্টেশনের লাইন্সম্যান গ্যাংম্যানেরা সকলেই বিহারী–তারা মাঝে মাঝে বলছিল, রাম নাম সত্ হ্যায়, রাম নাম সত্ ব্যায়। যারা খাটিয়া কাঁধে করেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই শৈলেনের সহকর্মী, থিয়েটারে শৈলেনের সহ-অভিনেতা।
শৈলেনের চেহারা খুব সুন্দর বলতে যা বোঝায় তা ছিলো না বলে, ও কখনও নায়ক হতে পারত না, বরাবরই ওকে হয় সহ-নায়ক কি ভিলেইন সাজতে হত।
আজকের বিকেলের এই শেষ দৃশ্যে শৈলেনই একমাত্র নায়ক–অন্য সকলেই দর্শক।
জবা, বোগেনভেলিয়া, গোলাপ, যে যা ফুল পেয়েছিল এনেছিল। সেই বিচিত্র রঙা ফুলের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে শৈলেন দুলতে দুলতে সকলের মাথায় চড়ে চলেছিল।
মরবার দিনে আমরা এমন করে মৃতকে মাথায় চড়াই যে জীবনে তার সামান্যতম অংশ করলেই যথেষ্ট হয়। একটু ন্যায্য প্রশংসা, একটু প্রাপ্য ভালোবাসা; একটু ভালো ব্যবহার।
আজ ওকে নিয়ে আমরা সকলে যা করছি, বেঁচে থাকতে তার কণামাত্র করলে ওকে হয়ত এমন করে আজ মরতে হত না।
নয়নতারাদের বাড়িটা আমরা প্রায় পেরিয়ে এসেছি এমন সময় এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল।
বাড়ির ভিতর থেকে পাগলিনীর মত দৌড়ে এল নয়নতারা। তার চুলের ফুল শুকিয়ে গেছে, শাড়ি খসে পড়েছে, রুক্ষ উপবাসী মুখ, আলুথালু চুল। সে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির সকলকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
তার আঁচল উড়ছিল, চুল উড়ছিল হাওয়ায়, সে এসে যারা খাটিয়া কাঁধে করে ছিল তাদের আকৃতি করে বলল, আমাকে একটু দেখতে দিন।
কেউ কোনো কথা বলল না।
শৈলেনকে নামানো হল।
শৈলেন একপাশে মুখ ফিরিয়ে ছিল, কপালে চুলগুলো শোয়ান ছিল। ভুরভুর করে অগুরুর গন্ধ বেরোচ্ছিল। নয়নতারা দৌড়ে গিয়ে শৈলেনের উপর পড়ল। নয়নতারার বুক থেকে এমন একটা চিলের কান্নার মত চীৎকার উঠে সেই শেষ বিকেলের আকাশ-বাতাস মথিত করল যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।
যে গাট্টাগোট্টা ছেলেটা শৈলেন কাটা-পড়ার পরেই বলেছিল সকলের সামনে নয়নতারাকে বেইজ্জত করবে–সেই ছেলেটির দিকে তাকালাম। সে নরম মুখে দাঁড়িয়েছিল। তার দু চোখ বেয়ে নীরবে ঝরঝর করে জল বইছিল।
এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কারো চোখই শুকনো নেই।
আমি হঠাৎ বুঝে উঠতে পারলাম না যে, এই চোখের জল কার জন্যে? শৈলেনের জন্যে? না নয়নতারার জন্যে? ওরা সকলেই কি তাহলে ইতিমধ্যে নয়নতারাকে ক্ষমা করে দিয়েছে?
নয়নতারাকে জোর করে ছাড়ানো হল। তারপর আবার হরিধ্বনি দিয়ে সকলে এগিয়ে চলল।
ভালোবাসা যে সস্তা নয়, হেয় করার জিনিস নয়, ভালোবাসা যে এক অমূল্য ধন, তা এই মুহূর্তে বেচারী বিবসা নয়নতারার মত আর কেউই জানলো না।
একবার পিছনে ফিরে তাকালাম, দৃ–রে শৈলেনের কোয়াটার দেখা যাচ্ছে, যেখানে নয়নতারাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে ও বোগেনভেলিয়া ও পেঁপেগাছ লাগিয়েছিল।
আরো দূরে নয়নতারাকে দেখা যাচ্ছে।
ধুলোর মধ্যে সে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ সমস্ত গর্ব, সমস্ত ভুল বিসর্জন দিয়ে লজ্জাহীনতায় গড়াগড়ি যাচ্ছে।
দেওনাথের পাশে যখন শৈলেনকে নামানো হল তখন বেলা পড়ে এসেছিল। জঙ্গলের গায়ে শেষ বিকেলের ম্লান লাল লেগেছিল।
শৈলেনের আত্মীয়স্বজনদের খবর পাঠানো হয়েছে, কেউই আসতে পারেননি। কালকের আগে কারো পক্ষেই এখানে এসে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
নয়নতারার পিসতুতো দাদা শৈলেনের মুখে আগুন দিলেন।
হু হু করে ধরে উঠল চিতা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একজন যাত্রার নায়ক তার যাত্রা শেষ করে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
বললাম, শৈলেন, তোমাকে এই দেওনাথ নদীর ধারে, হেসালঙের জঙ্গলে চিরদিনের মত নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেলাম। মনে মনে।
একদিন আমি, তোমার নয়নতারা, এবং আমরা সকলে এবং প্রত্যেকেই এমনি নিঃসংশয় এক অস্তিত্বহীন অসহায়তায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। অথচ কী আশ্চর্য! যতদিন অস্তিত্ব আছে এবং থাকে ততদিন এই অমোঘ অস্তিত্বহীনতার কথা আমাদের কারোই একবারও মনে হবে না।
তুমি তোমার নয়নতারাকে ক্ষমা করে দিও শৈলেন। নয়নতারা যতদিন বাঁচবে, ততদিন তোমার এই শূন্য আসনে আর কাউকেই বসাবে না। এও হয়ত একরকমের প্রাপ্তি। তুমি হয়ত এ প্রাপ্তিতে বিশ্বাস করোনি, আমিও করি না; তবু অনেকে আছে, যারা করে।
সব শেষ করে আমরা যখন লাপলার দিকে ফিরে চললাম দেওনাথের কোল ছেড়ে ঘন অন্ধকারের মধ্যে এক ভুতুড়ে সারিতে, তখন রাত আটটা বেজে গেছে।
রেলওয়ে শিং-এর কাছে এসে সকলে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। স্টেশনের দল লাপরার কোয়াটারের দিকে গেলেন। আমিও ওদের সঙ্গে গিয়ে পোস্ট-অফিসের পাশ দিয়ে মাঠের পথ ধরলাম।
পিছনের গেট দিয়ে যখন বাড়িতে এসে উঠলাম, তখন রাত সাড়ে নটা। বসবার ঘরে আলো জ্বলছিল। অন্য সব আলো নেবানো ছিল। মালু আর লালি বাবুর্চি-খানায় উনুনের পাশে গরমে বসে ছিল। হাসান উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা নাড়াচাড়া করছিল উনুনে-চাপানো হাঁড়িতে। মালুর কালো কুকুরটা গুটিশুটি মেরে বাবুর্চিখানা আর খাওয়ার ঘরের মধ্যের বারান্দায় শুয়েছিল।
আমি ডাকলাম, ছুটি ও ছুটি।
আমার গলা শুনে মালু, লালি এবং হাসান সব দৌড়ে এল। ভিতর থেকে ছুটিও দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বলল, উঠবেন না, উঠবেন না; ঐখানে দাঁড়ান।
তারপরই লালিকে কি যেন বলল।
বুঝলাম, আমি আসার আগে একাধিকবার মহড়া দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটার।
লালি একটা টাঙ্গি এবং একটা জ্বলন্ত কাঠ উনুন থেকে বের করে আনল।
ছুটি আমাকে আদেশ করল, আগে আগুনটা ছোঁন, ওই লোহাটা ছোঁন। তারপর বলল, ছুঁয়েছেন? এবার পিছনের দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকুন। তোয়ালে, আপনার জামা কাপড় সব দেওয়া আছে।
পরক্ষণেই লালিকে বলল, লালি, জলদি গরম পানি দে দো।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। ওর দিকে। ভাবখানা যেন এখানে ওই থাকে, আমিই বেড়াতে এসেছি একরাতের জন্যে।
ওরা জল দিতে যতটুকু দেরী হল সে সময়ে আমি শুধোলাম, তুমি এত সব জানলে কি করে?
ছুটি বলল, এসব জানতে আর বাহাদুরীর কি আছে? নিজের মাকে পোড়াই নি আমি নিজের হাতে? আমার মত মেয়ের সব কিছুই শিখতে হয়েছে।
আমি বললাম, তুমি এসব জানো? এ সবে বিশ্বাস করো?
ও বলল, কখনও এ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবিনি। যখন এগুলো মানতে হয়েছিল তখন মনের অবস্থা এমন ছিল না যে যুক্তিতর্ক দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করি। আমার মনে হয়, এ সময়ে কেউ তা করতে পারে না। তাইই বোধহয় এই সমস্ত নিয়ম এখনও অটুট আছে।
বাথরুম থেকে চান করে জামাকাপড় পরে বেরিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ছুটিকে বললাম, তুমি খেয়েছিলে?
না।
খাওনি কেন?
ভালো লাগছিল না।
এতক্ষণ কি করছিলে?
সোয়েটার বুনছিলাম।
কার জন্যে?
দারোয়ানের জন্যে।
কোন দারোয়ান? যার খাটিয়ায় আমি শুয়েছিলাম?
ছুটি হাসল, বলল হ্যাঁ, বুড়ো বড় ভালো লোক। আমাকে খুব স্নেহ করে।
তোমাকে কে না স্নেহ করে? আমি বললাম।
ছুটি মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। বলল খাবেন না? খুব ক্ষিদে পেয়েছে না?
বললাম, তা পেয়েছে।
ছুটিই খাবার লাগাতে বলে এল। ফিরে এসে বলল, কি হল? বলুন না।
আমি বললাম, তোমরা এক একটি আশ্চর্য চরিত্র, সাধে কি লোকে বলে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুততা মনুষ্যা?
কেন? আমরা আবার নতুন করে কি করলাম?
আমি বললাম, তুমি না; নয়নতারা।
চোখ বড় বড় করে ছুটি নয়নতারার কথা শুনল।
সব শুনে বলল, কত ঢংই জানে এসব মেয়ে। আপনারা পাঁজাকোলা করে দিলেন না কেন মালগাড়ীর চাকার নীচে ফেলে?
ছুটি আমার সামনে বসেছিল। বিকেলে ও চান করেছিল। বোধ হয় চুলে শ্যাম্পু করেছিল। বড় করে টিপ পরেছিল। ও জানে বড় করে টিপ পরলে আমি ওকে ভালো দেখি। একটা হাল্কা নীলরঙ্গা ব্লাউজের সঙ্গে একটা অফ-হোয়াইট খোলের নীল পাড়ের তাঁতের শাড়ি পরেছিল। চোখে কাজল পরেছিল, ঠোঁটে ভেজলীন।
খাওয়া বন্ধ করে আমি ছুটির দিকে তাকিয়েছিলাম।
ছুটি বলল, কি দেখছেন?
আমি বললাম, তোমাকে।
তোমাকে দেখে আমার আশ মেটে না কেন বল ত?
ও হাসল। বলল, ভাগ্যিস মেটে না। আমাকে দিয়ে যেদিন আপনার আশ মিটবে সেদিন আমার বড়ই দুর্দিন। আপনি দেখবেন, চিরদিন আপনার কাছে আমি নতুনই থাকব, ঠিক আপনি যখন যেমন চান। আমি জানি, কি করে নিজেকে নতুন রাখতে হয়।
খাওয়াদাওয়ার পর ছুটি বলল, কত সাধ করে আপনার কাছে এসেছিলাম কত গল্প করব ভাবলাম- তা না, এমন দৃশ্য দেখালেন যে আমার রাতে ঘুম হবে না।
আমি বললাম, শুয়ে পড়লেই ঘুম আসবে। তোমার ভোরে উঠে বাস ধরতে হবে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো।
ও বলল, হুঁ।
ছুটি আমার পাশের ঘরেই শুল। দরজা খোলা রেখে।
কঙ্কা বস্তীতে ঔরাওরা মাদল বাজিয়ে একটা দোলানী সুরের গান গাইছিল। ঝিঁঝি ডাকছিল একটানা বাইরে। পেয়ারা গাছের পাতা থেকে ফিসফিস করে শিশির পড়ার শব্দ হচ্ছিল।
বাথরুমের আলো জ্বালিয়ে রাখার কথা বলেছিলাম আমি। বোধ হয় শোবার সময় ও জ্বালাতে ভুলে গেছে। অন্ধকার ঘরে একটা জোনাকি আলো জ্বেলে জ্বেলে কি জানি খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
বোধ হয় ও নিজেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
আজ সারাদিনে আমার অনেক হাঁটা হয়েছে। মনটাও বড় অবসন্ন ছিল। কখন ঘুম এসেছিল মনে নেই।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বেড়ালছানার মত নরম কিছু গায়ের সঙ্গে লাগাতে–তার সঙ্গে একটা মিষ্টি সুগন্ধ।
ছুটি ফিসফিস করে বলল, আমার ভয় করছে ভীষণ; ঘুম আসছে না। তারপর অনুমতি চাইবার গলায় বলল, আপনার কাছে শোব?
আমি কথা না বলে এক পাশে সরে গিয়ে বললাম, আমার হাতে মাথা দিয়ে শোও, এসো আমার পাশে চলে এসো।
বুকের কাছে গুঁড়িসুড়ি মারা ছুটির সুস্নাতা সুগন্ধি শরীরকে জড়িয়ে ধরে দারুণ ভালো লাগছিল আমার।
ছুটি বলল, আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরুন। আমার শীত করছে।
তারপর ও হঠাৎ বলল, আমাকে চিরদিন এমন করে জড়িয়ে রাখবেন? কখনও ছেড়ে দেবেন না ত? ছেড়ে দিলে আমি কিন্তু কাচের বাসনের মত পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাব। আমার যা-কিছু জোর সব আপনারই জন্যে। আপনি অবহেলা করলে কিন্তু আমার সব জোর ফুরিয়ে যাবে। আমি একজন অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে হয়ে যাব, বাজে মেয়ে; নয়নতারাদের মত।
আমি জবাব দিলাম না। ছুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে ওর গালে গাল ছুঁইয়ে শুয়ে থাকলাম।
ছুটি বলল, ভগবানের বোধ হয় ইচ্ছা নয় যে আপনাকে আমি পুরোপুরি করে পাই। বিশ্বাস করুন, আজ আমি আপনাকে আমার যা-কিছু আছে সব দেব বলে এসেছিলাম, আমার যা কিছু গোপন এবং দামী, যা-কিছু এত বছর এত সযতনে আমি আমার নিজের বলে লালন করেছি। আপনাকে দিয়ে যে ভারমুক্ত হব, এ বোধ হয় কারোই ইচ্ছা নয়।
আমি চুপ করে রইলাম। এক দারুণ সুগন্ধি ভালোলাগা আমাকে এক আনন্দময় আশ্লেষে ছুটির শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে দিল।
ছুটি বলল, কি, জবাব দিচ্ছেন না যে?
আমি বললাম, তোমাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম, পেয়েছিলে?
হঠাৎ ছুটি আমার হাতের মধ্যে ছটফট করে উঠল।
বলল, কবে?
কিছুদিন আগে।
কই? না ত? কোলকাতা যাবার আগে ত কোনো চিঠি আমি পাইনি। কেন? চিঠিতে কি লিখেছিলেন?
আমি চুপ করে রইলাম।
ও বলল, বলবেন না?
আমি বললাম, চিঠিতে ত বলেইছি– গিয়েই পাবে–এখন মুখে আবার বলে লাভ কি? তাছাড়া চিঠিতে যা বলা যায়, মুখে কি তাই বলা যায়?
ছুটি বলল, ও। বলা যায় না বুঝি?
আমি জবাব দিলাম না।
ছুটি বলল, আপনাকে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনাকে কি আমি খুব বিরক্ত করি? বিরক্ত করি আপনাকে? আমার সম্বন্ধে আপনার এত দ্বিধা কেন?
আমি বললাম, কথা বোলো না।
এখন না বললে, কখন বলব? কেন জানি না আমার মন ভালো লাগে না। আপনি এমন অস্পষ্ট কেন? আপনাকে এখনও যদি স্পষ্টভাবে না বুঝি, ত কবে বুঝব?
আমি চুপ করে রইলাম। পরক্ষণেই ছুটি বলল, আমি যাই, এতটুকু খাটে দুজনে শুলে আপনার কষ্ট হবে।
আমি ওকে বাধা দিলাম না। আমার মনে হল ছুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে শোবার অধিকারটুকুও আমি নিজের হাতে নষ্ট করেছি। ঐ চিঠি পড়ে ছুটি মনস্থির না করা পর্যন্ত ওর কাছে কিছু পেলে আমার মনে হবে ওকে আমি ঠকাচ্ছি।
ছুটি বলল, ঘুমোন, কেমন? আমার ভোরবেলা উঠতে হবে।
এই বলে ছুটি উঠে কম্বলটা আমার গায়ে ভালো করে টেনে দিয়ে মশারি গুঁজে দিয়ে লঘুপায়ে ও ঘরে চলে গেল।
আমি বললাম, কোনো দরকার হলে আমাকে ডেকো ছুটি, সংকোচ করো না।
ও বলল, ডাকব। সংকোচ কিসের? সংকোচ ত দেখছি সব আপনার?