১৯. সুরতুন পথের ধুলোয় বসে

সুরতুন পথের ধুলোয় বসে মুঠি মুঠি ধুলো তুলে মাথায় দেয়নি, শাড়ির পাড় ছিঁড়ে ফেলে তাকে যোগিনী সাজতেও হয়নি। মাধাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে আসার একমাস কালের মধ্যে স্নানের অভাবে, বস্ত্রের অভাবে, মাটির আরও কাছাকাছি সুরতুন আর-দশজন ভূমিজার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে।

এমন একসময় ছিলো যখন বর্তমানের ক্ষুধার দংশন এত সন্নিকট ও প্রবল ছিলো যে, ভবিষ্যতের চিন্তা করা একরকমের অর্থহীন কল্পনাবিলাস বলে বোধ হতো। তার সেসব দিনের তুলনায় তার চালের কারবারের দিনকে সুদিনই বলতে হবে। এখন সে ভাবতে শিখেছে। কাজেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাধাই-ত্রাসটা কমে গেলে তার মনে প্রশ্ন উঠলো, এরপরে সে কী করবে। আউস উঠেছে। ধানভানার কাজে সে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু চিকন্দির চাষীরা আগের তুলনায় হিসেবী বেশি হয়েছে, তাদের আহ্বাদী বউ-ঝিরাও এবার নিজেরাই ধান ভানছে। এর জন্য চৈতন্য সাহার ঋণের বোঝা কতখানি দায়ী তা অবশ্য সুরতুনের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

তার ফলে তার সঞ্চিত টাকায় হাত পড়েছে, এবং এ ব্যাপারটাই তাকে অস্থির করে তুলো আবার। দু’একদিন গাঁইগুই করে একদিন সে ফতেমাকে স্পষ্ট করে বলে ফেলো, ভাবি, তুমি যেন, গাছের মতো শিকড় ছাড়ে দিছে; মোকাম কাক কয় জানো? গাড়িতে আবার কোনোদিন চড়বা কি চড়বা না?

ফতেমা প্রস্তাবটির সব দিকে চিন্তা করলো কিছু সময়। কথাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে সে বললো, ভাবে দেখি একটুক।

ভাবনার কী আছে? এই ভাবতে বসে সুরতুনের মনে পড়লো প্রাচীন দিনের কথা। এবং একথাও অস্বীকার করা যায় না ফতেমার মনেও অনুরূপ চিত্ৰই ভেসে উঠেছিলো। দুজনে দু জায়গায় বসে চিন্তা করছে কিন্তু ঠিক যেন কথোপকথনের সাহায্যে একে অন্যের বর্ণনাকে পরিস্ফুট করে দিচ্ছে।

ফতেমা ভাবলো, দুর্ভিক্ষ হওয়ার বছরেই ধান কুড়োনোর কাজ শেষ হলে একদিন ফতেমা শ্বশুরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রজব আলি বলে কী কও আম্মা? না, আমার ধনটু বেচে দেন।-তোমার ধান! সে কয়টুক?–সোয়া মন হবি।–ই-রে আম্মা, কস কী? মাপলি। কিবা করে? ধামায় কাঠায়।–উ রে আম্মা, এ যে আধ মনে সোয়া মন ফলাইছি।

সুরতুনও যেন ঘটনাটা চোখের সম্মুখে দেখতে পেলো।

মজুরিতে পাওয়া ধান, আর নিজের জমির ধানে রজব আলির আঙিনার অনেকাংশ ভরে গেছে। বলদ দুটির মুখে ঠুলি পরিয়ে ইয়াকুব আঙিনায় বিছানো ধানের আটিগুলির উপরে টালিয়ে নয়ে বেড়াচ্ছে। পাঁচু আর বেল্লাল দুজনে এসেছে। রজব আলি তাদের সঙ্গে বসে তামাক খাচ্ছে।

পাঁচু সান্দার বললো–তাইলে আমাক কাল দিতেছো বলদ?

–তা দিবো, কিন্তু বলদেক খাওয়াবো কি?

–কেন, খৈল দিবো, মাড় দিবো ভাতের।

–তাতে হবি নে। গুড়ে জ্বাল দিয়ে সরাপিঠা খাওয়াবা নাকি কও।

–আচ্ছা, আচ্ছা, তাও খাওয়াবো। রজবভাই যেন্‌ চ্যাঙড়া হতিছে দিন দিন। পাঁচু হাসলো।

–আসো না, চালা-ডুগডুগ খেলি, দেখি কে পারে।

তার পরে বেল্লালের পালা। সেও বলদ চায়। সে বললো–তোমার বলদেক চান করায়ে শিঙে তেল মাখায়ে দিয়ে যাবঅনে, সকালে নিয়ে বেলা ডোবার সাথে সাথে

–হবি নে, হবি নে।

–কী করতি হবি কও?

–বলদের বদলা বিবিসাহেবাক যদি একবেলার জন্যি ধার দেও চিড়া কোটার কামে, তবে।

পাঁচু বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলো-ইনসাল্লা!

বেল্লাল হঠবার পাত্র নয়, সে বললো–কিন্তুক সে অখুশি হয়ে যদি বাড়ি যায় খেসারত দিবের হবি কৈল।

–কেন্? তোমরাই কও রজব আলি চ্যাঙ্‌ড়া হতিছে।

তিনজনে ডাক ছেড়ে হেসে উঠলো।

ফতেমার মনে পড়লো–সে তার শোবার ঘরের জানলায় মেহেদিরাঙানো আঙুলগুলো রেখেছিলো ইয়াকুবের নজরের আওতায়। বলদজোড়া থামিয়ে ইয়াকুব বাড়ির ভিতরে গিয়েছিলো পান খেতে। যখন সে পান নিচ্ছে তখন সে এবং ফতেমা দুজনেই দেখতে পেয়েছিলো খড়ের নিচে নিচে ধানের যে স্তর জমেছে রজব আলি হাতে তুলে তা দেখছে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে, যেন এক এক জায়গায় এক এক রকম ধান পাওয়া যাবে। কুক্‌-কু—কুক্‌-কুরা-কুর-কু-কু–এরকম একটা শব্দও আসছে কোথা থেকে। অবাক লাগলো ইয়াকুবের। শব্দটাকে লক্ষ্য করতে গিয়ে ফতেমাও দেখতে পেয়েছিলো–রজব আলির ঘোরাটা যেন শুধুমাত্র ঘোরা নয়, নিচু হয়ে ধানটা রেখে যখন সে দাঁড়াচ্ছে দ্বিতীয় মুঠি তুলে নেওয়ার আগে তখন বাঁ পাটি ডান পায়ের আড়াআড়ি পড়ছে। কুকুরা-কুর শব্দটাও উঠছে তখন। নাচে নাকি বাজান? এখন। ফতেমার মনে হলো–হায়, হায়, এ কী হলো? কান্নাও আসে না, দম ফেলাতেও যে পারি না।

সুরতুন তার চিন্তার জঞ্জাল থেকে মুক্ত হওয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে বললো–ওই দ্যাখো, রজব আলি বুড়া হইছে কিনা দ্যাখো! এক ডালা শাদা চুল মাথায় যে নিষ্কর্মার মতো মাটিতে আঁকিবুকি কাটছে কাঠি দিয়ে সে-ই যদি রজব আলি হয় তবে ধানে তোমার কি বিশ্বাস?

অবশ্য অতীতের স্মৃতিই শুধু সব সময়ে দিনির্ণয়ে সাহায্য করে না। যদি বর্তমানে গ্রহণযোগ্য সম্পদ থাকে অতীতের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু এখানে এমন কিছুই চোখে পড়ছে না যার উপরে নির্ভর করা যায়। খুব খোঁজ-খবর করলে, একবারের জায়গায় বিশবার হাঁটলে চাল তৈরি করে দিয়ে খুদে-চালে মিশিয়ে একজনের পেট চলে, কিন্তু এই ধানেও দু মাস পরে টান ধরবে। তখনকার ভাবনাও এখনই ভাবতে হয়। তাছাড়া এখন বোধ হয় সে একদিনও আর উপবাস করতে পারবে না, যদিও এর আগে বহু দিনরাত্রি উপবাসে কেটেছে যখন সে মোকামের পথ চেনেনি।

চিকন্দির পথ ধরে চলতে চলতে আর একদিন সে চিন্তা করলো–এমন কষ্টের যার জীবন তার মাধাই এমন করে কেন?

রৌদ্রে ও ক্ষুধায় ভিন্ন হয়ে সে মনস্থির করার চেষ্টা করতে লাগলো, প্রথম যখন এবার দেখা হবে, মাধাইয়ের কাছে কেঁদে-কেটে তার পা জড়িয়ে ধরে সে বলবে–তুমি অমন করো কেন্ আগে যেমন ছিলে আবার তেমন হও।

কিন্তু সাহস জিনিসটার স্বরূপ এই, চিন্তাভাবনা করতে গেলে যুক্তিগুলির মূল্যহীনতাই বেশি করে চোখে পড়ে।

সে যা-ই হোক, চিকন্দির মহোৎসবে অন্য অনেকের মতো সুরতুনও গিয়েছিলো। বাগিচার একান্তে সান্দাররা বসেছিলো। মালপোয়র জিম্মাদার রামচন্দ্র তাদের দিকে এসে রজব আলিকে দেখতে পেয়ে বললো, কে, আন্ধারে ও কে? রজবভাই যে? রজব আলি কী একট বলেছিলো, ততক্ষণে রামচন্দ্র হাঁকাহাকি শুরু করেছে, গরম ভাত দেও, ভাজি আন, ওরে ছিদাম ডাল আনিস বেশি করে।

সান্দারদের আকণ্ঠর উপরে আকণ্ঠ খাওয়া হলো। রামচন্দ্র মালপোয়ার তল্পিবাহকদের হুকুম দিলো, এখন দিন ফুরায়ে আসতেছে, ডবল ডবল চালাও মালপুয়া আর পায়েস।

আহার শেষ হলে সুরতুন পুষ্করিণীতে হাতমুখ ধুতে গিয়ে সান্দারপাড়ার অন্যান্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিলো। একা একা ফিরছিলো সে। কেষ্টদাসের বাড়ির কাছে এসে সে সম্মুখের দলটির মধ্যে একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, কাছের লোক চেনা যায় না, আর তাছাড়া অন্ধকারে যেটুকু ঠাহর হলো তার সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের মিল নেই।

পরদিন চিকন্দিতে কাজ ছিলো বলেও বটে, পরিচিত কণ্ঠস্বরটির অনুসন্ধানের জন্যও বটে, সুরতুন অত্যন্ত সকালে চিকন্দির পথ ধরেছিলো।

সুরতুন ঠিকই আন্দাজ করেছিলো, লোকটি টেপির মা-ই বটে। কিন্তু দিনের আলোয় এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তার খটকা লাগছে। টেপির মা ঠোঁট টিপে না হাসলে বোধ হয় সে সাহস করে ডাকতেও পারতো না। টেপির মায়ের পরনে গেরুয়া রঙের ধুতি, তার সেই কদম ফুলের মতো করে ছাঁটা চুলগুলি যাতে সে পুরুষদের মতো করে গামছা জড়াতে সেগুলি বেড়ে বেড়ে কাঁধের উপরে থলোথলো হয়ে লুটোচ্ছে। নাকের উপরে রসকলি। সুরতুন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। শুধু বেশভূষায় নয়, টেপির মা দেহের দিকেও যেন নারীত্বের পানে কয়েক পা ফিরে এসেছে।

টেপির মা বললো, এই গাঁয়ে থাকিস? দিঘায় আসছিলাম, সেখানে শুনলাম মচ্ছোবের কথা।

একাই আলে?

না। গোঁসাইও আইছে।

গোঁসাই?

টেপির ধম্মবাপ।

এবার মনে পড়লো সুরতুনের, কথায় কথায় টেপি এমনি একটা সংবাদ দিয়েছিলো বটে। ওরা কথা বলতে বলতে টেপির ধর্মপিতা বেরিয়ে এলো। পিঠের উপরে মাঝারি গোছের কন্থা ঝোলা, হাতে গোপীযন্ত্র, পায়ে পিতলের ঘুঙুর। অত্যন্ত কৌতূহলে যেটুকু সাহস হয় তারই সাহায্যে সুরতুন গোঁসাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে দেখলো। একমুখ কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ি, সেগুলি চিবুকের নিচে একটা গ্রন্থিতে আবদ্ধ হয়ে দুলছে। মাথার চুলগুলি চূড়া করে বাঁধা। মুখের দৃশ্যমান অংশ বসন্তের চিহ্নলাঞ্ছিত। সে যখন কথা বললো, দেখা গেলো তার মুখের সম্মুখে একটা দাঁত নেই।

গোঁসাই এলে টেপির মা বললো, ভালোই হলো দেখা হলো। আমরা এখন আবার হাঁটতে লাগবো। সানিকদিয়ার যাবো।

দিঘায় ফিরবা না?

কাল এমন বেলায়।

বুধেভাঙা হয়ে যাবা? তাইলে তাই যায়গা, ফতেমার সঙ্গেও দেখা হবি।

সেদিনটার প্রায় সমস্তক্ষণই সুরতুন চিন্তা করলো। সন্ধ্যার পর ফতেমার সঙ্গে টেপিকে নিয়ে আলোচনা করলো। ফতেমাও বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে শুনলো। তারপর তারা দুজনে মিলে টেপির মায়ের প্রকৃত বয়স কত হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করলো।

রাত্রিতে বিছানায় শুয়ে অবশেষে সুরতুন বললো, কে ভাবি–

কী কস?

চলো না কে, টেপির মায়ের সঙ্গে আবার দিঘায় যাই।

দিঘার পথ কি তোমার অজানা?

গাঁয়ে থাকেই বা কী করি?

যাও তাইলে।

পরদিন সকালে টেপির মা তার গোঁসাইকে নিয়ে বুধেভাঙার পথ দিয়ে যাচ্ছিলো, সুরতুন দেখতে পেয়ে তাদের ডেকে আনলো ফতেমার বাড়িতে। সেখানে পারস্পরিক কুশল প্রশ্নের ছলে কিছুটা কথাবার্তা হলো। একসময়ে ফতেমা হেসে হেসে গোঁসাইয়ের কাছে গান শুনতে চাইলো। একতারা বাজিয়ে নাচের ভঙ্গিতে উর্ধ্বাঙ্গ গতিশীল করে গোঁসাই গান শোনালো। দেহতত্ত্বের গান। অর্থ সবটুকু বোঝা যায় না, কিন্তু শুনলে লজ্জার মতো বোধ হয়।

ফতেমার কাছেবিদায় নিয়ে টেপির মা যখন দিঘায় যাবার জন্য প্রস্তুত হলো সুরতুন বললো, দাঁড়াও, আমি আসি।

গোঁসাই আগে আগে, পিছনে পাশাপাশি টেপির মা আর সুরতুন। মাধাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে প্রথম ধাক্কাটায় টেপির মায়ের পিছনে আত্মগোপন করা যাবে এ সময়ে এই কি ভেবেছিলো সুরতুন?

খানিকটা চলার পর টেপির মা জিজ্ঞাসা করলো, সুরো, আমার গোঁসাইয়েক দেখলা, পছন্দ হয়?

ভালোই হইছে, তুমি কি আগেই চিনতা ওনাক?

না। ও তো মোকামের লোক। চালের মোকামে এক আখড়ায় থাকতো। একদিন পথে আলাপ হইছিলো। তারপর মোকামে একদিন জ্বর হইছিলো আমার। জ্বর নিয়ে গাছতলায় শুয়ে আছি, দেখি ও যায় পথ দিয়ে। কলাম বাবাজি, শোনেন একটু, দিঘার গাড়িতে বসায়ে দিবেন?

তারপরই তোমার হলো? তাতে কি হয়। তারপর যখন দেখা হলো, দেখা কবেহবি ঠিকঠাক করে রাখছিলাম। ততদিনে নিজেও ঠিক হলাম। গিরিমাটি কিনছিলাম, কাপড় রাঙালাম। চুল কাটলাম না, তেল দিয়ে জল দিয়ে আট পয়সার এক কাকই কিনে পাট পাট করলাম। তারপর দেখা হলো।

দিঘার কাছাকাছি এসে সুরতুন ভাবলো মাধাইয়ের সঙ্গে দেখা না হয় এমনি একটা পথ দিয়ে চলা উচিত, কিন্তু কীভাবে প্রস্তাবটা উত্থাপন করা যায় ভেবে পেলো না। টেপির মা বললো, চলো, সুরো, টেপিক দেখে যাই।

এটা এমন এক পল্লী যেখানে অন্য শ্রেণীর মেয়েরা আসে না। গেরুয়াপরা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী দেখে মেয়েরা বেরিয়ে এসে ভিক্ষাও দিতে চাইলো। তখন টেপির মা টেপির কথা জিজ্ঞাসা করলো। টেপির কথা শুনে টেপির পরিচিত দু’একজন আগ্রহ করে কাছে এসেদাঁড়ালো। একজন বলেই ফেলো, তাইলে তোমরা টেপির খোঁজে আসছো?

সে কনে গেছে, এখানেই তো থাকতো।

পালাইছে।

সে কী! কনে গেলো?

কোথায় গেলো পালিয়ে এ যদি বলাই যাবে তবে আর পালানো হলো কী।

মেয়ের খবর না পেয়ে টেপির মায়ের মনটা ভার হয়েছিলো, সে আবার হাঁটতে লাগলো। কিন্তু পল্লীর একটা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়ে দোকানে যাওয়ার ছল করে এদের পিছন পিছন

আসছিলো। মোড়ের দোকানটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মেয়েটি টেপির মাকে ডাকলো।

শোনো!

কিছু বলবা?

মেয়েটি চারিদিকে চেয়ে দেখে ফিসফিস করে বললো, সেই চেকারবাবুই টেপিক গাড়িতে উঠায়ে নিছে।

সেই চেকারবাবুর সঙ্গেই গিছে তাইলে?

মনে কয়। সেই চেকারবাবুর বউ নাকি মরছে। এক ছাওয়াল আছে, তাক মানুষ করতে হবি।

এত জানো তবে আগে কও নাই কেন?

টেপি কয়ে গেছে, মাকে কয়য়া, আর কাউকে কয়োনা। তাই দেখলাম তোমারা তার আপন লোক কিনা।

টেপিদের পল্লী থেকে বেরিয়ে টেপির মা বললো, সুরো, তুমি কোথাও যাবা?

কনে যাই? মাধাই-পূর্ণ দিঘায় নিঃসঙ্গ হবার ভয়ে সুরতুনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেলো।

আজই মোকামে না যায়ে চলে না কেন আমাদের গাঁয়ে। একসাথে খাওয়াদাওয়া করবঅনে। রাত কাটায়ে তারপর যা করবের হয় কোরো।

নিমন্ত্রণ পেয়ে সুরতুন বেঁচে গেলো।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উঁচুনিচু পথে অনেকটা সময় হেঁটে গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন টেপির মায়ের বাড়িতে অবশেষে পৌঁছনো যায়। একটা ছোটো শোবার ঘর, ততোধিক ছোটো একটা রান্নাঘর নিয়ে বাড়ি। তার বেশিকিছু অন্ধকারে ঠাহর হলো না।

ঘরে ঢুকে গোঁসাই দেশলাই জ্বাললো, একটা কুপি ধরিয়ে নিলো। এমন হয় যে, দিনের পর দিন দুজনের একজনও থাকে না বাড়িতে। কাছেই ছ্যাচড়া চোরের চোখে পড়তে পারে এমন কোনো সংসার করার উপাদান ঘরে নেই। শোবার ঘরের দুপাশে দুটি বাঁশের মাচা। বাঁশের খুঁটির গায়ে ঝোলা টাঙিয়ে রাখার আড়। সেই আড়ের উপরে দুখানা চট ঝুলছে। ঘরে ঢুকে টেপির মা চট টেনে নিয়ে দুটি মাচাতেই পেতে দিলো। সুরতুনকে বসতে বলে সে গোঁসাইকে বললো, তুমি ঝোলা থিকে কথা কাপড় সব বার করে বিছানা পাতো দুইখান, আমি জল নিয়ে আসি।

গোঁসাই এতক্ষণ কথা বলেনি, জল আনার প্রস্তাবে বললো, আমি থাকতি তুমি এই আন্ধারে জল আনতে যাবা, লক্ষ্মী?

যাবো আর আসবো। এই আন্ধারে তোমাকে একলা ছাড়ে দিবের পারি?

গোঁসাই আর পীড়াপীড়ি করলো না। ঝোলা থেকে দু-একখানা কথা বার করে সে মাচার উপরে বিছানো চট দুখানা যতদূর সম্ভব ঢেকে দিলো।

জল নিয়ে ফিরে এসে টেপির মা বললো, আমার দুইবার রাঁধা লাগবি, ততক্ষণ তোমরা গান করো, গল্প করো।

গোঁসাইয়ের ঝোলা থেকে বেরুলো দুটি মালসা, একটা ছোটো হাতা, চাল, ডালের একটি মোড়ক, কয়েকটি আলু-বেগুন, একটা তেলের শিশি, তরকারি কোটার ছুরি–অর্থাৎ সংসার বলতে যত কিছু সব।

সুরতুন হেসে বললো, দুনিয়া নিয়ে বেড়ান দেখি।

এরকম সংসার করায় টেপির মা যে অত্যন্ত পটু তত বোঝা গেলো। রান্নাঘরে প্রদীপের মৃদু আলোয় রান্নার জোগাড় করে নিয়ে সে ফিরে এলো। বললো, গোঁসাই, একটু কষ্ট দিবো যে। কয়খানা কলাপাতা কাটতে হবি। চলো যাই।

তুমি যাবা? সেই জঙ্গলে তোমাকে আমি যাতে দিতে পারবো না। এবার সে একটু দৃঢ়স্বরে বললো।

লোকটি ঘোর অন্ধকারে বেরিয়ে গেলো। সেই নিঃশব্দ গভীর অন্ধকারে পৃথিবীর সবই প্রায় অবলুপ্ত, তার অন্যান্য অধিবাসীরা এখানে স্মৃতিমাত্র। জোনাকির আঁকগুলি কোনো অজ্ঞাত কারণে মাটির দিকে নামছে, আবার উপরে উঠে যাচ্ছে।

গোঁসাই পাতা নিয়ে ফিরে এলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সুরতুন বললো, সাপখোপের ভয় নাই আপনার?

সব সাপ কামড়ায় না; আর কালসাপের কথা–সে লোহার বাসরেও কামড়ায়। এরই মধ্যে একসময়ে টেপির মা এসে বললো, একটুক দেরি আছে পাকের, ততক্ষণে গোঁসাই একটা গান ধরো। গান শুনতে শুনতে কাম করি।

কিন্তু সুরতুনের অন্যরকম ইচ্ছা ছিলো, সে বললো, গোঁসাই, আপনেরা যখন দুইজনেই চলে যান তখন এ বাড়িঘর দেখে কে?

ভগোমান। কিন্তু দেখার কী বা থাকে?

তা ঠিক। যা আছে দুনিয়ায় তা আছে ঝোলায়। আপনেও কি চালের মোকামে যান?

ও কারবার আমি করি না।

টেপির মা বুঝি একা যায়?

না তো। তাক যাতে দিবের পারি কই? মনে হয় হারায়ে যাবি।

কুপির স্নান আলোয় গোঁসাইয়ের মুখের চেহারা বোঝা গেলো না।

সুরতুন বললো, সংসার তো চালাতে হয়?

পথে পথে হাঁটি। লোকে চাল দেয়, দু-একটা পয়সাও দেয়। দুজনে ভিক্ষাশিক্ষা করি। গাছতলায় চাল ফুটায়ে নিই।

তাতে কি সুখ হয়?

ছার সুখ! গোঁসাই একটা পদ সুরেলা করে আবৃত্তি করলো :

দু-দিকে দুই পাহাড়। যশোমতী পাহাড়ে শীতল বরফ, ডানদিকে ধনোবতী পাহাড়ে বাঘ ভাকোর বাস। মাঝে উপত্যকা। চাষী, জমি চাষ করতে করতে পাহাড়ে চায়ো না। কত পণ্ডিত যশোমতী পাহাড়ে বরফ-পাথর হলো, কত চাঁদবেনে ধনোবতী পাহাড়ে সাপের বিষে মরেছে। বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করো, সে যুগল পাহাড়ের সন্ধান দিবি, যুগল স্বর্ণপাহাড়। সেই পাহাড়ের মাঝে সুখ বাস করে। . সুরতুন বললো, আপনের কথা আমি বুঝবের পারি না, শুনবের ভালো লাগে। টেপির মা আহারের আয়োজন শেষ করে এদের ডাকতে এসেছিলো, সে হাসিমুখে বললো, এই দ্যাখো, তোমারও ভালো লাগতি লাগলো!

খুব সকালে উঠেও সুরতুন দেখলো টেপির মায়ের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেছে। রান্নাঘরের সামান্য দু-একখানি বাসন মেজে-ঘষে শুকোতে দিয়ে সে তখন রান্নাঘর ও উঠোন নিকোচ্ছে। টেপির মা বললো, চান করবা? পুকুরে চলো যাই।

দুজনে একসঙ্গে স্নান করে এসে সুরতুন দেখতে পেলো গোঁসাইয়ের আলখাল্লা পরা হয়ে গেছে। ভিজে চুলগুলো চূড়া করে বেঁধে তখন সে দাড়িতে গ্রন্থি দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।

ঘরের মধ্যে তার দ্বিতীয় কাপড়টি ও একটা চটের থলি ছিলো, সেগুলির অনুসন্ধানে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে সুরতুন দেখলো মাচা দুটি ছাড়া ঘরের মধ্যে আর কিছু নেই।

গোঁসাই বললো, এই যে বুনডি, তোমার থলে এখানে।

সুরতুন দেখলো বৈষ্ণবীর কথা ঝোলা ও গোপীযন্ত্রের পাশে তার থলিটাও গুছিয়ে রেখেছে গোঁসাই।

টেপির মাও সাজসজ্জা করে নিলো। গোঁসাইয়ের ঝোলা থেকে ছোটো একটা আয়না বের করে উঠোনের মাটিতে জল দিয়ে সামান্য একটু কাদা করে রসকলি আঁকলো সে। সুনিদ্রিত, সদ্যস্নাত প্রসন্ন টেপির মায়ের দিকে চেয়ে সুরতুনের আবার মনে হলো, এ যেন টেপিই অন্য এক সজ্জায় এখানে বসে আছে, শুধু গায়ের রংটা টেপির চাইতে মলিন আর ত্বকের এখানে সেখানে দু-একটা আঁচিল চোখে পড়ে, টেপির যা নেই।

তারপর যাত্রা শুরু হলো। যাত্রার শুরুতে গোঁসাইয়ের হাতের গুপীযন্ত্র বুং বুং করে উঠলো দু-একবার। জয় শিবোদুর্গা রাধে।

তাদের পিছনে সকালের রোদ্দুরে ঝাঁপ টেনে খড়ের ঘর দুটি যেন প্রতীক্ষায় বসে রইলো।

কিছুদূর গিয়ে টেপির মা প্রশ্ন করলো, কও সুরো, আমাক কি ভালো দেখলা না?

সে যেন পিতৃকুলের কারো কাছে প্রশ্ন করে জানতে চায় নিজের শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে মতামতটা।

রাত্রিতে যা চোখে পড়েনি এখন সুরতুন সেগুলি লক্ষ্য করলো। দুইটি শাখা রেলপথ সংযুক্ত হয়ে দিঘার কিছু দূরে যে কোণটি সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে অবস্থিত সরকার থেকে খাস করা এবং পরে পরিত্যক্ত একটা গ্রাম এটা। গ্রামের যে অঞ্চলে বসতি ছিলো সেখানে এখন অগম্য জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কিছু কিছু আম কাঁঠালের গাছ, কখনো দু-একটি নারকেল গাছ চোখে পড়ে। কেউ হয়তো কোনো কালে সখ করে লাগিয়েছিলো, এখন জঙ্গুলে হয়ে গেছে এমন কয়েক ঝাড় কলাগাছও দেখতে পাওয়া যায়। কলাগাছে মোচা হয়েছে, নারকেল গাছে ফল আছে। সেকালে এটা বোধ হয় গ্রামের একটা সড়ক ছিলো, এখন অনেকাংশই লতাগুল্মে আচ্ছন্ন। গ্রামের যে অংশে চাষের জমি ছিলো সেদিকে ভাটের আর বিছুটির জঙ্গল, এখানে-সেখানে ছড়ানো কয়েকটা বাবলা গাছ। এই বিস্তীর্ণ জায়গাটায় জনমানবের সাড়া নেই। দিনমানে পথটি ধরে হয়তো দু একজন লোক চলে, বিকেলের দিক থেকে নির্জন হয়ে যায়। এই নির্জনতায় টেপির মায়ের দুখানা নিচু কুঁড়ের বাড়ি।

যেতে যেতে সুরতুনের মনে হলো, কিন্তু ঘরে ছেলেপুলে থাকলে কি এরা এমন করে দুজনে বেরিয়ে পড়তে পারবে যন্ত্র হাতে করে? সে ভাবলো, যে বয়সে মেয়েরা প্রথম সন্তানবতী হয়, টেপির মায়ের সে বয়স নয় কিন্তু সন্তান ধারণের পক্ষে টেপির মাকে এখন অপটু বলেও মনে হচ্ছে না।

টেপির মা সঙ্গীকে নিয়ে অন্য গ্রামের পথ ধরলো। সুরতুন মোকামের ট্রেনের খোঁজ নেওয়ার জন্য স্টেশনের দিকে গেলো।

যে কথাটা সর্বক্ষণ মনে থাকে সেটা কিছুকালের জন্য আদৌ মনে ছিলো না কেন, ভাবলো সুরতুন। স্টেশনে যেতে তাকে কেউ বাধা দেবে না একথা ঠিক, তেমনি ঠিক যে, স্টেশনটি সরকারের, কিন্তু একথা ভুললে চলে কি করে সুরতুনের কাছে সমগ্র দিঘাটাই মাধাইয়ের। বুদ্ধি স্থির করতে তার সময় লাগলো। ওভারব্রিজটা অনেকটা উঁচু, তার রেলিংটাও মানুষকে আড়াল করে রাখে। সুরতুন স্থির করলো ওভারব্রিজ দিয়ে সে স্টেশনে ঢুকবে। তাহলে দূর থেকে মাধাইকে দেখতে পেয়ে সাবধান হওয়া যাবে।

ওভারব্রিজের তিনটে সিঁড়ি স্টেশনে নেমেছে। প্রথম সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে মাধাইকে দেখতে না পেয়ে সে যখন উৎসাহিত হয়ে নামতে যাচ্ছে স্টেশনে, ঠিক তখনই সে দেখতে পেলো রোদে পিঠ দিয়ে একটি প্যাকিং বাক্সর উপরে বসে আছে মাধাই। যেন বেড়াতে এসেছে স্টেশনের কাজকর্ম দেখতে, এমনি তার ভঙ্গি। দু-তিন ধাপ নেমেছিলো সুরতুন, মাধাইকে দেখতে পাওয়ামাত্র ফিরে দাঁড়িয়ে ওভারব্রিজের রেলিং-এর আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।

ঠিক এই সময়ে সুরতুনের মনে হলো–একে তো রেগে আছে মাধাই, তার উপরে এই ময়লা কাপড় আর ঝাকড়-মাকড় ময়লা চুল নিয়ে সামনে গেলে আর রক্ষা থাকবে না।

পরে ভেবেচিন্তে সে ঠিক করলো এই স্টেশন-ভর্তি লোকজনের মধ্যে মাধাই তাকে না বকতেও পারে এবং যদি গোপনে চলতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় তার চাইতে বরং মাধাইয়ের চোখের সম্মুখে চলাফেরা করাই ভালো। অন্তত সে ক্ষেত্রে সে বলতে পারবে–তোমার কাছেই তো যাচ্ছিলাম।

সুরতুন নিজের পরনের শাড়িটার আঁচল ঘুরিয়ে দু-ফেরতা করে গা ঢেকে নিলো। তারপর পা মেপে মেপে অগ্রসর হলো। মাধাইয়ের কাছাকাছি এসে সে এমন করে মাটির দিকে চাইলে যেন তার দৃষ্টি ফেরাতে হলে দু হাত দিয়ে তার মুখ তুলে ধরতে হবে। এ তো তার দৈহিক ভঙ্গি। তার মনে কিন্তু অপূর্ব একটা ব্যাপার ঘটলো। দূর থেকে যত কাছে সে যাচ্ছিলো ভয়ের ভাবটা তত বেশি পরিবর্তিত হচ্ছিলো। ব্যবধান যখন খুব বেশি নয় তখন হঠাৎ তার সেই রাত্রিটার কথা মনে পড়ে গেলো। তার সমস্ত গা রি-রি করে কেঁপে উঠলো। এবং অদ্ভুত একটা অনুভূতি এই হলো যে, মাধাইয়ে ডুবে যেতে পারলেই যেন সব ভয় এড়ানো যায়।

এই মেয়ে, তুমি কী চাও?

সুরতুন দেখলো টিকিটবাবু জানলার ওপার থেকে কথা বলছে। নিজেকেও সে লক্ষ্য করলো। টিকিট ঘরের লোহার রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। একখান টিকিট দেন বিরামপুরের।

কাঁপা কাঁপা আঙুলে টাকা-পয়সা গুনে মোকামের টিকিট নিয়ে সে কোনদিকে যাবে তা ভাবলো।

এবার যা সে করলো সেটা তার পূর্বতন চিন্তাধারার সমান্তরাল নয়, সমভূমিস্থ তো নয়ই। তার মনে হলো, মাধাই তাকে চিনতে পারেনি। তখন হঠাৎ তার একরকমের কষ্ট বোধ হলো। সে যা-ই হোক, ভাবলো সুরতুন, অনেকদিন পরে সে মোকামে যাচ্ছে, যাওয়ার আগে মাধাইয়ের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ানো তার কর্তব্য।

কিন্তু মাধাই সেই প্যাকিং বাক্সের উপর ছিলো না।

ট্রেন এলো। মোকামে যাওয়ার পরিচিত ট্রেন। সুরতুন একটা কামরায় উঠে যাত্রীদের পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো। ট্রেন ছাড়লো।

ট্রেনটা যেখানে দিঘার দীর্ঘ প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যায় সেখানে একজন লোক ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো এই কাজটিতে মাধাইকে দেখা গেছে। সুরতুন জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে ছিলো। ট্রেন তখনো পুরো দমে ছুটতে শুরু করেনি। মাধাই-মাধাই। মাধাই গাড়ির দিকে চেয়ে ছিলো, তার মুখের উপরে সোজাসুজি সুরতুনের চোখ দুটি গিয়ে পড়লো। মুহূর্তের জন্য হলেও দৃষ্টি দুটি পরস্পরকে ধরার চেষ্টা করলো।

রোগা দেখালো মাধাইকে। চুলগুলো তেমন পাট করা নয়। পোশাক-পরিচ্ছদ যেন কেমন ঝুলঝুলে। রোগা দেখালো মাধাইকে!

সুরতুনের বসবার জায়গাটা ঠিক হয়নি। নিকটতম যাত্রীটি অনবরত পা দোলাচ্ছিলো, আর যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে কখনো তার হাত কখনো তার হাঁটুটা সুরতুনের গায়ে লাগছিলো। সুরতুন উঠে গিয়ে একটা জানলার কাছে দাঁড়ালো। সেই জানলাটায় মলিন চেহারা ও ময়লা কাপড়পরা চার-পাঁচটি মেয়ে নিশ্বাস নিচ্ছিলো।

ট্রেনের ভদ্ৰব্যক্তিরা সুরতুন এবং তার কাছে দাঁড়িয়ে-থাকা স্ত্রীলোককটিকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। তারা সকলেই এই এক বিষয়ে একমত যে এরা টিকিট কাটেনা, চালের চোরাচালান করে এবং এদের জন্য গাড়িতে চড়া আজকাল অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চালের এমনি চালান উচিত কিংবা অন্যায়, এ নিয়েও তারা আলোচনা করলো। তারপর তারা আলোচনা শুরু করলো, একজন মেয়েছেলের পক্ষে কতটা চাল লুকিয়ে নেওয়া সম্ভব। এরপরে আলোচনাটা স্বাভাবিকভাবেই এদের অন্তর্বাসের গবেষণায় পরিণত হলো। এমন আলাপ প্রতিবারই যাত্রীরা করে, তবে এবার কল্পনার আতিশয্য দেখা দিয়েছে। বিব্রত হয়ে স্ত্রীলোক কটি যাত্রীদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালোলা।

মনটা একটু থিতুলে সুরতুন ভাবলো : টিকিট কেটে এ ব্যবসা চলে না। ভদ্রলোকরা ঠিকই বলেছে, টিকিটের টাকা চালের লাভ থেকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। গ্রামে বসে যখন মোকামে যাওয়ার কথা ভাবতো তখনই সে স্থির করেছিলো টিকিট কেটে যদি সে যাওয়া-আসা করে তবে বোধ হয় মাধাইয়ের সাহায্য ছাড়াও চলতে পারে। এই চিন্তাটাই প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে টিকিট কিনিয়েছিলো। টিকিট কেটে গাড়িতে উঠে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধও হচ্ছিলো। হিসাবের কথাটা উঠতে এখন সে বুঝতে পারলো টিকিট কেনাটা চলবে না।

সুরতুন তার পাশের মেয়েটিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, মোকামে চাল কত?

উনিশ।

এখানে কতকে?

পঁচিশ।

সুরতুন আঙুলে গুনে গুনে হিসাব করলো–উনিশে পঁচিশে ছয়। ছয় আধে তিন। পনেরো সেরে দুই টাকার কিছু উপরে। ভাড়ার টাকা ওঠে, খাবে কী?

পরের দিন সকালে, মোকাম থেকে চাল নিয়ে ফিরে সুরতুন তার পুরনো মহাজনের কাছে গেলো। চাল নিবা গো?

কতকে?

পঁচিশ।

দূর বিটি। মোকামে উনিশ, এখানে না হয় বাইশ হবি।

তাইলে খুচরা বেচবো।

সুরতুন দিঘার বাজারের একান্তে গামছা বিছিয়ে চাল বিক্রি করতে বসলো। কিন্তু আগেকার মতো লোকের যেন চালের উপরে টান নেই। সুরতুন খোঁজ করতে গিয়ে দেখলো গ্রামের দিক থেকেও চাল আসছে। লোকে সেই মোটা চালই সস্তায় নিচ্ছে।

চাল বিক্রি করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো, কিন্তু জেদ করে পঁচিশের এক পয়সা নিচে সে নামলো না। বাজারের কলে মাথাটা ধুয়ে আহারের চেষ্টায় এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো সে। মাধাই আর তার নেই যে সেখানে গিয়ে রান্না চাপাবে। কাল সারাদিন, আজ এখন পর্যন্ত ভাত খায়নি সে। ভাতের খোঁজে সে হোটেলে ঘুরলো, কিন্তু প্রায় সকলেই এমন দামের কথা বললো যে শুনে সে হাসবে কি কাদবে বুঝতে পারলো না। একটা বিহারি চা-ওয়ালার দোকান থেকে সেঁকা রুটি আর টকো ডাল খেয়ে আঁজলা পুরে পুরে জল পান করে সুরতুন স্টেশনের বাইরের মালগুদামের কাছে বসে পড়লো। এখন সে কী করবে? আশ্রয়?

স্টেশনে থাকা যায় সারাদিন সারারাত, কিন্তু তা শুধু জেগে থাকা, বসে থাকা, সতর্ক হয়ে। স্টেশনের উপরেই অনেকের অনেক বিপদ ঘটেছে। গত রাত্রিতে ঘুমনো হয়নি বলে ঘুমনোর জন্য আজ গ্রামে ফেরা যায় না। তাহলে ব্যবসা হয় না। আজও কি সে টেপির মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে নির্লজ্জের মতো বলবে–আজও এলাম। তার চাইতে মাধাইয়ের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করা ভালো নয়? তুমি আমাকে আবার ঘরে থাকতে দাও, হয় হোক, যা হয় হোক–এই বলে মাধাইয়ের দুখানা পা জড়িয়ে ধরবে? গ্রামে থাকতে আর একদিন এমনি সাহসী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা সে করেছিলো। এই সময়ে তার মনে হলো কত সস্নেহ ব্যবহারই না ছিলো মাধাইয়ের।

নিরুপায়ের মতো অন্ধকারে পথ ঠাহর করতে করতে টেপির মায়ের বাড়ির কাছাকাছি এসে সে লক্ষ্য করলো একটা আলো যেন জ্বলছে কিন্তু সেটা যে জোনাকি নয় তা নিশ্চিত বলা যায় না। সে দাঁড়িয়ে পড়লো, তাহলে সে কি ফিরে যাবে? পিছনের দিকে চাইলো সে। বিপদ যত পেছন থেকেই আসে। মুহূর্তে সেই নির্জনতা অসংখ্য অদৃশ্য অস্তিত্বে কিলবিল করে উঠলো। মহাবিপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য একদিন এক নির্জন কুটিরে রাত কাটিয়েছিলো সে; সে সময়ে তার মোহাবস্থা ছিলো। ভয়ে এখন তার গা ঘামতে শুরু করলো। একদা সে পতিত গোরস্তানের পথে যাওয়া-আসা করেছে, মনের সে অবস্থাও তার আর নেই। মাধাইয়ের ভয় যেন তার অর্জিত সাহসের মূল-দেশটাকেই শিথিল করে শৈশবের ভয়শীলতায় পৌঁছে দিয়েছে।

এখানে তবু একটা কুটির আছে এই মনে করে একদৌড়ে সে টেপির মায়ের আঙিনায় গিয়ে দাঁড়ালো।

শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ হতেই গোঁসাই বললো, কে ভাই? মানুষ যদি তাহলি আসো। গোঁসাই যেন তারই প্রতীক্ষা করছিলো সুরতুকে দেখতে পেয়ে এমন ভঙ্গিতে সে স্বাগত করলো।

সুরতুন ঘরে ঢুকে দেখলো, এদিকে মাচায় বসে গোঁসাই তামাক খাওয়ার ব্যবস্থা করছে, ওদিকের মাচায় টেপির মা ঘুমুচ্ছে গুটিসুটি হয়ে। তার শোওয়ার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে সে যেন অত্যন্ত ছেলেমানুষ কেউ।

খাওয়া-দাওয়া হইছে, বুনডি?

তাইলে এক কাজ করো। তোমার দিদির পাশে যায়ে শোও।

আপনেদের খাওয়া-দাওয়া?

আজ আর কেউ খাবো না। পোরস্কার জলের এক পুকুর পায়ে তার বাউরিতে এক আমগাছের তলায় তোমার দিদি রান্না করলো ও বেলায়।

এর আগের দিন রাত্রিতে গোঁসাই ঘুমিয়ে পড়লে তবে টেপির মা আর সুরতুন শুয়েছিলো। গোঁসাই জেগে বসে থাকবে আর সে শুয়ে পড়বে এতে যেন কোথায় সংকোচ বোধ হলো সুরতুনের।

কিন্তু গোঁসাই বোধ হয় মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে, সে বললো, আচ্ছা, তামাক না হয় না খালাম। তুমি শোও, আমি আলো নিভায়ে দি।

গোঁসাই ফুঙ্কারে কুপিটি নিভিয়ে দিলো। সমস্ত পৃথিবী যেন চোখ বুজলো।

সুরতুন একটি অনুভবগ্রাহ্য নির্ভরতায় টেপির মায়ের পাশে শুয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়লো।

সকালে উঠে টেপির মা সুরতুনকে দেখতে পেয়ে বললো, ওমা, তুই কখন আলি?কী খালি? কী অন্যাই, আমাক ডাকলি না কেন্‌?

সুরতুন বললো, বড়ো মুশকিলে পড়ছি; করি কী কও?

সুরতুন তখন থেকে শুরু করে পুকুর থেকে স্নান করে আসতে আসতেও তার অসুবিধার কথাগুলো ব্যক্ত করলো। শুধু মাধাইয়ের কাছে যেতে কেন ভয়, সেটার সবটুকু প্রকাশ করলো না।

সব শুনে টেপির মা রসিকতার লোভ সংবরণ করতে পারলো না, কিন্তু সুরতুনের মুখে বিরসতা দেখে সে বললো, তা ধরা দেওয়া না-দেওয়া তোর ইচ্ছে। ব্যবসা করবের চাস, কর। যেদিন মোকামে যাবি না, নিজের গায়েও যাতে ইচ্ছে হবি নে, আমার গাঁয়ে আসিস। রোজ আমাদের পাবি না, দূরে চলে গেলে আর ফিরি না, ঘরের আগাড় ঠেললিই খুলবি। আর তা ও যদি তোর মনে কয়, আমার ঘরের পাশে ঘর তুলে নিস। গোঁসাইকে কবরী। পড়শী হবি।

নিজের সমস্যার সমাধান হিসাবে প্রস্তাবটা লোভনীয় বোধ হলো সুরতুনের; সে বললো, জমি কার?

তা কি জানি। যদি উঠায়ে দেয় দিবি। গোঁসাই কয় কি জানিস? কয় যে, সারা দেশে র‍্যালগাড়ি গিছে। তার দুইপাশে বিশ-পঁচিশ হাত জায়গা কোনো জমিদারের দখলে নাই। এখান থিকে উঠায়ে দেয় র‍্যালের ধারে যায়ে বসবো কোথাও। সেখান থিকে তুলে দেয় আবার অন্য কোথাও। এমনি পাঁচবার ঘর তুলতি তুলতি পরমাই ফুরাবি। নিষ্পত্তি।

ঘর তোলা হোক আর না হোক সুরতুন মোকাম থেকে ফিরে দু’বার এদের ঘরে বাস করেছে।

এবার সে প্রশ্ন করলো, টেপির মা লো, এ তোমার কী ব্যবসা? এতে কি চালের ব্যবসার চায়ে লাভ?

চালের ব্যবসায় চুরি আছে। এতে ধরো যে তা নাই।

গোঁসাই কী কয়?

সে কয়–ভিক্ষে কও তা-ও আচ্ছা। কিন্তু লক্ষ্মী, আমি গান না করলি কি ভিক্ষে হয়?

শুনতে শুনতে সুরতুনের পছন্দ হয় এমন জীবনটাকে। যেটা সে অনুভব করে সেটা এই : পিছন থেকে ধরার কেউ নেই, কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ফেরার তাগিদ নেই। যেখানে রাত্রি সেখানেই আশ্রম। মাথার উপরে গাছ থাকে ভালো, না থাকে সেও মন্দ নয়।

কিন্তু সমস্যার সমাধান অত সহজ নয়।

টেপির মা রোজ ঘরে ফেরে না এটা শুনেছিলো সুরতুন। এক সন্ধ্যায় সুরতুন এদের ঘরে এসে দেখলো তখনো এরা ফেরেনি। প্রতীক্ষায় কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত করলে সে; রাত্রিই শুধু গম্ভীর হলো। সুরতুন দরজার কাছে বসে ছিলো, বাইরে অন্ধকার-ঢাকা প্রান্তর। দূরে দূরে জোনাকির তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে, আজ যেন ঝিঁঝির ডাকও কানে আসছে। কয়েকদিনের যাওয়া আসায় এ জায়গাটার সঙ্গে পুরোপুরি পরিচয় হয়েছে। তার ফলে এই গভীর অন্ধকারে আধ ক্রোশের মধ্যে দ্বিতীয় প্রাণী নেই, এ বোধটাই তীব্রতর হলো।

মনের অনুভব করার একটা সীমা আছে। সেই সীমায় পৌঁছনোর পরে সুখদুঃখ ভয়-ভাবনা সব এক হয়ে গিয়ে মন পাথর হয়ে যায়। তেমনি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকতে থাকতে সুরতুন দুঃস্বপ্ন ও ঘুমের মধ্যে রাত্রিটা অতিক্রান্ত করলো। দিনের আলো ফোঁটামাত্র সে বাড়িটাকে দূরে রাখবার জন্যই বেরিয়ে পড়লো, যেন সেটাই বিভীষিকা। কিন্তু কী উপায়? কে বলে দেবে, পথটা? গ্রামে ফিরে যাবে? অনেক চিন্তা করে সে স্থির করলো দিনের বেলায় বাজারে কাটাবে, রাত্রিতে ট্রেনে চলবে। যদি তখনো শরীর বিশ্রাম চায়, স্টেশনে বসে থাকবে। যদি মাধাই তাকে দেখতে পায় তোত দেখুক, যদি সে ধরে নিয়ে গিয়ে শাসন করে, করুক। সে নিজের বুদ্ধিতে আর এগোতে পারছে না এটাই আসল কথা। মানুষ তো ট্রেনে কাটা পড়ে।

.

স্টেশনে একদিন বসে থাকতে থাকতে জীবনের এক অদ্ভুত রূপের সঙ্গে সাক্ষাৎহয়ে গেলো সুরতুনের। ক্লান্তি, অনিদ্রার অবসাদ ও আত্মকেন্দ্রিক আবর্তপ্রায় চিন্তায় তখন সে নিমজ্জমান। কে তার গায়ে হাত দিলো। দিশেহারা হয়ে সে উঠে দাঁড়াতেই লোকটি বললো, তুমি সুরো না? কেন সুরা, আম্মা কনে? এবার সুরতুন লোকটির মুখের দিকে চাইলো। সোভানরাতারাতি বেড়ে উঠেছে এই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে যেন, আর তার মুখে যেন রাতারাতি কিছু দাড়ি গজিয়েছে; কোলে জয়নুল।

বিস্মিত সুরতুন বললো, কার কথা জিজ্ঞেসা করো, তুমি কেডা?

আমি ইয়াজ। আম্মা কনে-ফতেমা?

‘সে গাঁয়ে।

হায়, হায়, কী করি কও?

কী হইছে?

সেই খাঁ লাগাইছিলো গোল। মারলাম এক তামেচা উয়েরই এক কুকুরমারা লাঠি দিয়ে। রক্ত কত! জমিন ভিজে গেলো।

কী করছো? কাক মারছো? আমার কাছে আসছো কেন? পুলিস আসবি তা বোবো?

বুঝি। পালাতেই তো হবি। যাবো কনে তাই কও। আর তাছাড়াও, সোভানেক ওরা ঘিরে ফেলাইছে বাজারের মধ্যি। তাক তো ছাড়ায়ে আনা লাগবি। করি কী তাই কও?

তুমি এখান থিকে যাও, যাও। আমাক বিপদে ফেলাবা।

সুরো, এক কাম করো। জয়নুল, কোলের মধ্যে লাফালি চড় খাবি কৈল। সুরো, তুমি এক কাম করো, তুমি জয়নুলেক একটুক রাখো, আমি সোভানেক নিয়ে আসি। সে আটকা পড়ছে।

কথাটা বলতে বলতে সম্ভবত সোভানের করুণ মুখখানা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো তার কাছে, জয়নুলকে সুরতুনের কোলে ঠেলে দিয়ে সে দৌড়ে চলে গেলো।

ইয়াজ চলে গেলে সুরতুন ভাবলো, সে তো ফতেমা নয়, সে কী করতে পারে। মোকামে যাওয়ার গাড়ির সময় হয়েছে, যদি এখনই ইয়াজ না আসে তার মোকামে যাওয়া হবে না। কিন্তু তার চাইতেও বড়ো কথা–পুলিস। এ সবের সন্ধানে পুলিস নিশ্চয়ই আসবে, এবং যদি তারা আসে তাকেও রেহাই দেবে না। সুরতুনের মনে হলো ইয়াজের তাকে চেনার কথা নয়। জয়নুলই নিশ্চয় তাকে চিনিয়ে দিয়েছে, তেমনি জয়নুলের উপস্থিতিই পুলিসকে নিশানা দিয়ে সাহায্য করবে।

সুরতুনের মোকামে যাওয়া হলো না। সে মনস্থির করার আগেই মোকামের গাড়ি চলে গেলো। অবশেষে টেপির মায়ের খোঁজে যাওয়াই উচিত বলে বোধ হলো তার। পুলিসের সঙ্গে কথা বলতে পারে এমন একজন পুরুষ অন্তত সেখানে আছে। জয়নুল ঠিক সেই মুহূর্তে যাত্রীদের কাছে ঘুরে ঘুরে পয়সা চেয়ে বেড়াচ্ছিলো। সুরতুন স্থির করলো এই সুযোগেই পালাতে হবে। ওভারব্রিজের উপরে কিছু দূরে উঠেই কিন্তু সে দেখতে পেলো জয়নুল তার পিছন পিছন ছুটে আসছে।

সে সন্ধ্যাতেও টেপির মা ফিরলোনা।বরং জয়নুলের খোঁজে ইয়াজ এলো সোভানকে নিয়ে।

সুরতুন বললো, এখানে আসছি জানলা কী করে?

ইয়াজ বললো, সে অনেকক্ষণ থেকেই সোভানকে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সুরতুনের দিকে লক্ষ্য রাখছিলো, সকলে একসঙ্গে ধরা পড়ার চাইতে যে কোনো একজন ধরা পড়া কম দুঃখের হবে বলেই সে কাছাকাছি আসেনি।

সুরতুন বললো, আমাক পুলিশে ধরবে কেন্‌?

তোমার সঙ্গে জয়নুল ছিলো। আর তা ছাড়া সেহারামি পুলিসেক কইছে, আমি তুমি জয়নুল সোভান সবই একদলের। ফতেমার নাকি দল।

উচ্ছ্রিত জানুর উপরে চিবুক রেখে নিঃশব্দে মুখোমুখি বসে রইলো ইয়াজ এবং সুরতুন। জয়নুল-সোভানের মুখেও কথা নেই।

সুরতুন একসময়ে প্রশ্ন করলো, যাক মারলা সে কে?

ইসমাইল কসাই। জয়নুলদের বাপ।

তাক মারলা কেন্‌? মারলাই যদি তবে তারই ছাওয়ালদের টানে বেড়াও কেন্? এরা তোমার কে?

এটাই ইয়াজেরও সব চাইতে গোলমাল লাগছে। ব্যাপারটা এই রকম : ফুলটুসির ছেলে সোভান-জয়নুল ইদানীং স্বাবলম্বী হয়েছিলো। প্ল্যাটফর্মে ঢুকবার পথের পাশে বসে তারা যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চায়। ভিক্ষালব্ধ পয়সায় তারা একটা হোটেলে খায়। এ সবের পরামর্শ ইয়াজই দিয়েছিলো। হোটেলের বাসি ভাত-তরকারি ফেলে দেওয়ার বদলে সস্তা দামে এই শিশু দুটির কাছে বিক্রি করা লাভজনক বলে হোটেলওয়ালা নজর মিঞা আপত্তি করে না। মদ চোলাই করার গোপন এক কন্ট্রাক্ট নিয়ে ইসমাইলের অবস্থা হলে একটু ভালো হয়েছে। পশ্চিমী রইসদের রক্ত তার শরীরে আছে এটা প্রমাণিত করা কঠিন নয় তার পক্ষে, এই হয়েছে তার বর্তমান মনোভাব। নজর মিঞার হোটেলে বসে কাল সন্ধ্যায় এরকম কথাই হচ্ছিলো। যদি আত্মগরিমার প্রচারমাত্র হতে ক্ষতি ছিলো না, কিন্তু গোলাপি নেশার আমেজে ইসমাইলের মনে হয়েছিলো উপস্থিত সকলকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে তারা তার তুলনায়। নীচস্তরের লোক।

নজর হাসতে হাসতে বলেছিলো, তা আর বলতে! ছাওয়ালরা যখন ভিক্ষে করে খায় তখন অযুধ্যার লওয়াব ছাড়া আর কী বলা যায়।

কী, আমার ছেলে ভিক্ষে করে খায়! দিশি ভাষায় এইটুকু বলে লাফিয়ে উঠলো খাঁ সাহেব। বাড়ি ফিরে সে জয়নুল-সোভানকে ধমকে দিলো, খবরদার, ভিমাবেনা।ব্যাপারটা জয়নুল সোভানের কাছে শুনে ইয়াজ বলেছিলো, কেন, খাতে দিবি বুঝি?

আজ সকালে জয়নুলরা ভিক্ষার কৌটা নিয়ে বেরুতে গিয়ে খাঁসাহেবের সম্মুখে পড়ে গিয়েছিলো। খাঁ সাহেব হেঁকে বললো, কাহা যাতা?

সোভান-জয়নুল হক শুনে উঠোনে থেমে গিয়েছিলো। শাসনের প্রথম কিস্তি হিসাবে দুজনের দু গালে দুটি চাটি মেরে ইসমাইল খাঁ খানদানি উর্দু ঝাড়লো, ইলিস কা বাচ্চা, কালি কুত্তিকি বেটা।

হাঁকাহাঁকিতে ইয়াজের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এসে সে। বললো কৌতুক করে, খুব যে চুত্তপুস্ত। ব্যাপার কি?

চপ শালে বেতমিজ। তু শিখলায়া।

দ্যাখো, গাল দিয়ো না কয়ে দিলাম। ভিক্ষা করবি নে তো তুমি কি খাতে দিবা?

বেশখ।

সখ করে ও কাম কেউ করে না। ইয়াজ বললো।

চপ্‌ বেওকুফ।

ইয়াজ হাসবার চেষ্টা করলো কিন্তু তার আগে খসাহেব জয়নুল আর সোভানকে দ্বিতীয় কিস্তি শাসনে ভূমিসাৎ করো দিলো।

হঠাৎ কী হলো ইয়াজের, সেও লাফিয়ে পড়লো উঠোনে। ইসমাইল খাঁ তৃতীয় কিস্তি শাসনের জন্য একটা চেলাকাঠ হাতে করতেই ইয়াজও একটা লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়ালো। বহু দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিলো ইয়াজের। আবাল্য নির্দয়ভাবে প্রহৃত হয়েছে সে। তার গরঠিকানা জন্ম নিয়ে চাঁচামেচি করেও যখন ইসমাইল থামলো না বরং চেলাকাঠটাকে ব্যবহার করার জন্য জয়নুলের দিকে এগিয়ে এলো, তখন ইয়াজ লাঠিটা দিয়ে খাসাহেবকে এক ঘা বসিয়ে দিলো।

সুরতুনের প্রশ্নে এটুকু বলে ইয়াজ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো। জয়নুল, সোভান, ফুলটুসি, ইসমাইল আর সে নিজে কী একটা গুঢ়সূত্রে একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। জয়নুল ও সোভান ফুলটুসি-ইসমাইলের সন্তান এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য বাল্যকালে ফুলটুসি ও ইয়াজ যাকে আম্মা বলতো সেই বৃদ্ধা ইসমাইলকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করেছিলো।

ইয়াজ বললো, ইসমাইল বাপ হোক, কিন্তুক ও ওদের মারবি কেন্‌?

আগে ওরা বাপের ছাওয়াল, তোমার কিন্তুক ওরা কে?

কেউ না হলিও ওরা ফুলটুসির ছাওয়াল।

সে তোমার কে?

কেউ যদি নাও হয়, সে বড়ো ভালো ছিলো। ছোটোকালে একসঙ্গে আমরা খেলা করছি।  গাঢ় অন্ধকারে সমাধান খুঁজবার ভঙ্গিতে ওরা বসে রইলো। জয়নুল ইয়াজের গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সোভান ইয়াজের ভঙ্গি অনুকরণ করে বসেছিলো বর্টে, ঘুমেও চুলছিলো।

সোভান বললো, বড়োভাই, আব্বা কি আমাদের সঙ্গে দৌড়ায়ে পারবি?

না পারবের পারে। কেন্?

তবে আর ভয় কি? ধরবের পারবি নে। আমরা মনে কয় ভিক্ষে করেই খাবো। আঁধারে পালায়ে থাকলি খাতে দেয় কেন্‌?

সোভানদের ক্ষুধা পেয়েছিলো। সে তার বর্তমানের অনুভব দিয়ে যা স্থির করলো যুক্তির : দিক দিয়েও তার মূল্য আছে। তিনজনে আত্মগোপন করে থেকেও গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে এমন সংগতি নেই ইয়াজের।

ইয়াজের মনে অনুশোচনা এসেছিলো। সে ভাবছিলো মারামারি না করে এখন যেমন পালিয়ে এসেছে তখনো তেমনটা করলেই হত। সে রাগ করে বললো, সেই ভালো, তোরা ভিক্ষে কর। কীসের মায়া, কও, সুরো; আপনি বাঁচলি চাচার নাম। যার বাপ তারে মারছে আমার কী মাথার দরদ। ঠিক। পালানই লাগবি।

সোভান বললো, তাই যাও। সে যদি মারধোর করে আবার তোমাক কয়ে দেবো। আর ফতেমাক না পাই, সুরোক পাবো।

যে গা ঢাকা দিয়ে থাকে তাকে যে প্রয়োজন হলেই পাওয়া সম্ভবনয় সোভানের পরিকল্পনার মধ্যে এমন দুশ্চিন্তা প্রবেশ করলো না।

ইয়াজ বললো, তোক কিন্তু এক কথা কই, সুরো; যদি এমন-তেমন দেখো এ দুডেক নিয়ে ফতেমার কাছে পৌঁছায়ে দিয়ো।

ইয়াজের স্বরে এমন আকূতি ছিলো যে সুরতুনকে রাজী হতে হলো।

সারা রাত উৎকণ্ঠায় দরজার পাশে বসে থেকে ভোরের আলো ফোঁটার আগেকার জ্যোৎস্না আকাশে দেখে সুরতুন খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছিলো বাঁ দিকের মাচাটায়। ডান দিকের মাচাটার উপরে ইয়াজকে জড়িয়ে ধরে তার দুই ভাই ঘুমে অচেতন।

সুরতুন ধড়মড় করে উঠে বসলো। সে দেখতে পেলো টেপির মা ও গোঁসাই এসেছে। এদিকে ইয়াজরাও রাত্রির স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেছে।

সুরতুনকে গোঁসাই প্রথমে দেখতে পেয়েছিলো, সে বললো, বুনডি আছে? ভালোই হয়েছে। দ্যাখো দেখি আমরা কী বিপদ নিয়ে ফিরে আলাম।

কী হইছে?

তোমার বুনের পা মচকায়ে গেলো। তা ঠিক করলাম পা ফুলে অচল হওয়ার আগেই ঘরে চলো। যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো হলো না।

টেপির মা বললো, তুমি আজ রাঁধে খাওয়াবা আমাক সেই আসল কথাটা কও।

গোঁসাই একথার উত্তর না দিয়ে বললো, বুনডি, আজ কৈল তোমার ধানের মোকামে যাওয়া হবি নে। আজ সারাদিন আমরা এখানে থাকবো। সকলে মিলে রাঁধেবাড়ে খাওয়া-দাওয়া করবো। গানবাজনা করবো।

গোঁসাই রান্নার জোগাড় করে নিলো। উনুনে আগুন দিলো যেন তামাকে আগুন রাখবার জন্য। ভাত নামতে নামতে তার বিশবার তামাক খাওয়া হয়ে গেলো।

স্নান-আহারের পর্ব খুশি খুশি হাল্কা আবহাওয়ার মধ্যে শেষ হলে টেপির মা একটা বড়ো কথা পায়ের উপরে মেলে নিয়ে সেলাই করতে বসলো। গোঁসাই তামাকের ককে নিয়ে সুরতুনের সঙ্গে গল্প শুরু করলো। তখন সুরতুন ইয়াজদের ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করলো।

গোঁসাই বললো, তারা গেলো কোথায়?

গা ঢাকা দিছে।

তবে তোমার কোনো ভয় নাই, বুনডি। এতে পুলিস তোমাক কিছু কবি নে। কিছুক্ষণ বিরতির পর টেপির মা সেলাই থেকে মুখ তুলে বললো, আমার কী মনে হয়, সুরো, তা তোমাক কই। মনে কয়, ফুলটুসি নিজে সাধে মরণ আনছিলো।

গোঁসাই তামাকে মন ডুবিয়েছিলো। সে বললো, জীবনটা বড়ো মজেদার দেখি। কও, ইয়াজের কে ঐ সোভানরা। তার জন্যি তোর অত কেন্‌? বুঝলা না, লক্ষ্মী, তুমি একদিন জিজ্ঞাসা করছিলে, উত্তর দিবের পারি নাই। দুইজনে দেখা হওয়ার আগে তুমি নিজের ভাত-কাপড় রোজগার করতা, আমিও করতাম। তবে দুইজনে এই দোকান সাজালাম কেন্? কেন্ যে সেদিন বুঝি নাই, বুঝলেও কবের পারি নাই; এই দ্যাখো জীবনে ভাতের চায়েও মজা আছে।

কয়েকটা দিন সুরতুনের নির্বিঘ্ন শান্তিতে কাটলো। টেপির মা ও গোঁসাই ঘরে ছিলো। পুলিসের ভয়ে দু’তিন দিন সে মোকামে গেলো না। তারপর গোঁসাই তার মনের অবস্থা বুঝে আবার তাকে বোঝালো পুলিসের ভয় নেই। তারপর মোকামে যেতেও অসুবিধা হয়নি, ফিরে এসে নিশ্চিন্ত বিশ্রামের আশ্রয়ও পাওয়া গেছে। একদিন কথায় কথায় টেপির মা বলেছিলো, যদি একা ঘরের মধ্যি থাকতি ভয় করে ঘরের বাইরে থাকিস। আলো জ্বালালে মানুষের চোখে পড়ার ভয় যদি থাকে আন্ধারে থাকিস। ভয় নাই। পৃথিমিতে ভয় কীসের।

ভয়ের কথা ভাবতে ভাবতে একদিন সুরতুনের অনুভব হলো, ভয় আছে কিন্তু তাকে অত মান্য না করলেও চলে। বিকেলের পর সে টেপির মায়ের ঘরের দিকে আসছিলো। আজ যদি টেপির মায়েরা চলে গিয়ে থাকে–এই আশঙ্কা থেকেই চিন্তার সূত্রপাত। দ্যাখে কৌতুক-ভয় পেয়ে এ-ঘর থেকে পালিয়ে স্টেশনে অনিদ্রার রাত কাটাতে আরম্ভ করেছিলো সে। তারপর ঝড়ের মতো এলো পুলিসের ভয়, সেই ভয়ে যেন সাপের গর্তে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো সে। মাধাইয়ের উপরে নির্ভর না করে চালের ব্যবসা অসম্ভব, এ আশঙ্কাও কেটে গেছে। নিজের হয়ে সে ব্যবসা করছে। টিকিট ফাঁকি দেওয়ার একটা ফিকির সে ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে। পুলিসের ভয় আছে; সে কি একেবারেই যায়? তবে সেটা অসহ্য কিছুনয়। এই ভাবতে ভাবতে টেপির মায়ের ঘরের কাছে পৌঁছলো সে। টেপির মায়েরা সেদিন সত্যিই অনুপস্থিত। সুরতুনের সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে উঠলো। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললো না সে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে মৃতের মতো নিঃশব্দে শুয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো।

সহজে ঘুম এলো না। একফালি চাঁদ উঠলো। ছ্যাঁচার বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলো এসে পড়লো। তখন সুরতুন একটা বেপরোয়া মনোভাব অবলম্বনের চেষ্টা করতে লাগলো। নিজের মুখে সে যে কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলো সেটা তার দেখতে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিলো না, কিন্তু নিজের সুগঠিত পেশল বাহু দুটিকে লক্ষ্য করলো, হাতের আঙুলগুলির শক্তি যাচাই করার জন্য দুহাত কয়েকবার মুষ্টিবদ্ধ করলো।

মনটা একটু জুড়োলে একদিন সেভাবলোইয়াজের কথা। তার কথায় একটি বিচিত্র অনুভূতি হলো তার। গোঁসাইয়ের কথা পুনরাবৃত্তি করে সে বললো, জীবন কী মজাদার দ্যাখো। ফতেমা নজের অর্থ ব্যয় করে জয়নুলদের খাওয়াতো। তখন সুরো এজন্য ফতেমাকে সমালোচনা করেছে। পাছে তাদের সঙ্গে আলাপ হলে সে নিজের তহবিলে খরচ করে বসে এই আশঙ্কা থেকে সে জয়নুল-সোভানদের দেখলে অনির্দিষ্টভাবে বিরক্ত হয়েই উঠতো। অথচ ইয়াজ এলো তারই চাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে।

ইতিমধ্যে একদিন সুরতুনের মনে পড়লো মাধাইকে শেষ যেদিন সে দেখে ছিলো ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, রোগা-রোগা দেখিয়েছিলো তাকে।

আর-একদিন সুরতুন টেপির মাকে বললো যে সে মোকামে যাবে। কিন্তু গেলোনা। স্টেশনে পৗঁছে এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে মাধাইয়ের খোঁজ করে বেড়াতে লাগলো সে। সারা স্টেশনে খুঁজে এমনকী ওভারব্রিজে দাঁড়িয়েও মাধাইয়ের সন্ধান না পেয়ে স্থির করলো, সে ফিরে যাবে। ওভারব্রিজের সিঁড়িটা যেখানে প্রধান প্ল্যাটফর্মে নেমেছে তার কাছেই রেলের একটা অফিস এবং তার বিপরীত দিকে মিলিটারিদের স্থাপিত ক্যান্টিনের গুদামঘর। এই দুয়ের মাঝখানে দু হাত চওড়া একটা সরু গলিপথ। এ-পথে লোক চলাচল প্রায়ই নেই। সুরতুন এই পথ ধরে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। ঠিক এমন সময়ে দেখা হয়ে গেলো সেই গলিটার মধ্যে মাধাইয়ের সঙ্গে। সুরতুনের সাহসটার কিছু আর অবশিষ্ট ছিলো না তখন। তার মনে হতে লাগলো সারাটা সকাল সে শুধু মাধাইকেই খুঁজেছে। সে একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো। মাধাই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার হাতে ছোট একটা পুঁটুলি, সম্ভবত সে বাজার করে ফিরছিলো। সুরতুনের সামনে এসে সেদাঁড়িয়ে পড়লো। দেয়ালে নিজের দেহভার ছেড়ে দিয়ে মাধাইয়ের চোখের দিকে চোখ তুলে দাঁড়ালো সুরতুন। দেয়ালে দেহভার ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা তার। পা কাপছিলো, চোখের সম্মুখে দৃশ্য জগৎবর্ণহীন হয়ে আসছিলো। তার মনে হলো মাধাই হাত বাড়িয়ে না ধরলে সে পড়ে যাবে।

মাধাইয়ের ঠোঁট নড়লো; অবশেষে সে কথা বললো, সুরতুন্নেছা? ভালো আছো?

ভালো আছি। আপনে কেমন আছো, বায়েন?

তা ভালোই।

মাধাই চট করে চলে যেতে পারলো না। সুরতুনেরও সরে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো না। সে যেন মাধাইয়ের কালি-পড়া চোখের দৃষ্টিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে। সে লক্ষ্য করলো মাধাইয়ের গালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে, তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। পাট-পাট করা বড়ো বড়ো চুল ছিলো মাথায়, কানের পাশে বাবরির মতো দেখাতো। এখন চুলগুলি যেন ছোটো ছোটো করে ছাঁটা, ঘাড়ের কাছে অনেক দূর তুলে কামানো। রুক্ষ দেখাচ্ছে তাকে।

কিন্তু কথা আর এগোলো না। মাধাই চলে গেলো।

চলতে শুরু করে সুরতুন স্থির করলো আজ আর সে মোকামে যাবে না। একবার তার মনে হলো হোটেল থেকে সে খেয়ে যাবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে স্থির করলো–তাহলে তো চলবে না। রান্না যখন করতেই হবে আজ থেকে করলেই বা দোষ কী? ভয় ও অভিমানের আড়ালে একদিন কোথায় একটা প্রতীক্ষাও লুকিয়ে ছিলো। সেটা যেন আজ মুছে গেলো। পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নেওয়াই ভালো, এই স্থির করলো সে। টেপির মা বা গোঁসাই আপত্তি করুক কিংবা না-ই করুক, তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের হেঁসেলে ঢুকতে সংকোচ বোধ হলো। সুরতুনের। একটা হাঁড়ি, একটা ছোটো কড়া, লোহার একটা হাতা কিনে নিয়ে সে আস্তানায় ফিরবে। চাল আছে। টেপির মায়ের বাড়ির পিছনে জঙ্গলে ধুদুল দেখে এসেছে সে।

রান্না চড়িয়ে সুরতুন তার ব্যবসায়ের হিসেব নিতে বসলো। এবার ব্যবসা করতে আসার সময়ে সে আট টাকা কয়েক আনা মূলধন নিয়ে বেরিয়েছিলো। কোমরের গেঁজে খুলে বার করে খুচরো পয়সা রেজগিতে গুনে দেখলো পাঁচটা জমেছে। আঁচল খুলে নোট বার করে গুনে দেখলো সেখানেও চারটে টাকা আছে। এ কয়েকদিনের ব্যবসায় তার মূলধন তাহলে কমেনি।

ধুঁদুল তেমন তেতো ছিলো না। অনেকদিন পরে নিজের রান্না নিজে করে খেতে ভালোই লাগছিলো। টাকার হিসেবেও সে ঠকেনি। সুরতুন একটা দিবানিদ্রার ব্যবস্থা করে নিলো।

কিন্তু ঘুমোতে গিয়ে তার মনে হলো, তখন মাধাই যদি তার হাতের পুঁটুলিটা তার হাতে দিয়ে বলতে চল, তাহলে সে কি না-গিয়ে পারতো? মাধাই কি তার নিজের প্রয়োজন বোঝে না? সে তো পড়ে যাচ্ছিলো, কেন মাধাই তবে তাকে তুলে নিলো না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *